সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
হতে পারে সেটা ২০১৮ সাল। শোনা গেল, দেশ জুড়ে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের ‘মন্দির দখলের’ অভিযান চলছে। তা সে হতেই পারে — রাষ্ট্র যা চায়, তাই পারে। এ সব খবরে আমার খুব একটা হেলদোল ছিল না কিন্তু হল — যখন শুনলাম ‘সিমলা কালীবাড়ি’ সরকার দখল করবে।
আমি যে খুব বেশি ধার্মিক তা নয় তবে মন্দির বা বিশেষ করে সিমলা কালীবাড়ি জুড়ে — এই যে এক বাঙালিপনা বেঁচে আছে — তা বেশ উপভোগ করি। ধরা যাক, বাংলা ভাষা, তা নিয়ে বা তার শুদ্ধতা বা বিস্তার নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও, এখানকার অনুষ্ঠানে বা মন্দির চত্বরে বাংলায় কথা বলার হিড়িক বেশ উপভোগ করতাম। দুর্গাপুজোর সময় বা কালীপুজো আর সরস্বতী পুজোয় — সব কাজ বাঙালি করবে এবং পুরোহিত বাঙালিই হতে হবে, তাতে বাংলার ঐতিহ্য বজায় থাকবে — গর্ব হত শুনে।
‘কালীবাড়ি’ সরকার দখল করবে শুনেই শুধু যে এখানকার বাঙালিরা তা নয়, আগে যারা সিমলায় ছিলেন তারাও প্রতিবাদে যোগ দিলেন। একটা কথা ঘুরতে লাগলো ‘কালীবাড়ি চলে গেলে সিমলায় বাঙালিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে’। এ কথা যেন প্রথম শুনলাম এবং একটা ‘ভয়’ নিয়ে যে এরা টিঁকে আছে তা অনুভব করলাম। এরকমও কথা হল, যদি সরকার দখল করতে আসে তবে সবাই এবং বাইরে থাকা ছেলে-মেয়েরাও চলে আসবে কালীবাড়ি বাঁচাতে। তা কিছুদিন এই চর্চা চলার পর থেমে গেল কিন্তু ওই সংশয়টা যেন ছাড়বো ছাড়বো করেও কেউ ঝেড়ে ফেলতে পারলো না।
দেখতে দেখতে আমার পনেরোটা বছর পার হয়ে গেছে এই শহরে কিন্তু গাঁটছড়াটা যে বাঁধা হয়নি তা এই ‘দখলের দৌড়’ না চললে বুঝতে পারতাম না। শহরটাকে আমার বেশ ভালো লাগে তার শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্য। প্রথম যা আমাকে মুগ্ধ করে তা এর আন্তরিকতা। রাস্তায় দেখা হলেই নমস্কার করা, আমার বাড়িতে চা খেতে আসবেন বলা, দরকার হলে ডাকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসেছি নিজের পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে তাই একটু যেন বেশি আগ্রহ ছিল এই সব ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরার। কলকাতা শহর যেন দৌড়ছে, কোথাও আমার নাম নেই। এই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে মাঝে হেরে গিয়ে থেমে গিয়ে ছিটকে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যখন পালানোর পথ খুঁজছিলাম, তখন এই শহরবাসী যেন এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতে দিল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল যে।
সময় যত গড়াতে লাগলো ততই দেখলাম সাজানো বাগানের ধারে মালির ঘর যেমন কখনই গৃহস্থের বসত হয় না তেমনি এটাও আমার আশ্রয় হল না। ঠিক কেন যে হল না তা জানা নেই। ইচ্ছে কিন্তু আছে ষোলআনা। ইতিহাস কখনই আমাদের পিছু ছাড়তে চায় না। এই শহর ঘিরে বাঙালির ইতিহাসও তাই। ১৮৪৫ সালে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। শোনা কথা, জাখু মন্দিরে যাওয়ার পথে, কোন এক নালায় এই মূর্তি পড়ে ছিলো। সেই সময় কোন এক বাঙালি স্বপ্নাদেশ পান আর মূর্তি তুলে আনেন এখানে। মানে ব্যান্টনী হিলে প্রতিষ্ঠা হয় এবং এই মন্দির ঘিরেই বেড়ে ওঠে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা। এই মন্দিরের সঙ্গে নাকি এক স্কুলও ছিল। এখানকার প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তানরাও পড়তে আসতেন। আমার বন্ধু হিমাচলী, তার বাবা, জেঠারাও পড়েছেন।
বাঙালি মানেই যে বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, রাজনৈতিক, সম্ভ্রান্ত অর্থাৎ উচ্চবিত্তশালী মানুষের যা যা গুণ থাকা দরকার তা আছে। বাঙালি চতুরও বটে, ইংরেজের হাত ধরে এ শহরে এসে নিজেদের বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং শুধুই কি নিজেদের, তার জাতভাইদেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে যেন এক সামাজিক পংক্তি যা সাধারণ হিমাচলী থেকে আলাদা। তারা জমিজমা কিনলেও কেরানি হয়ে থেকেছে। পেয়েছে রায়বাহাদুর খেতাব কিন্তু লাঙলে হাত দেয়নি কখনও। বাঙালির এই চরিত্র দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে স্বতন্ত্র এক জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে সিমলা শহরে।
বাঙালির আর একরূপও ধরা পড়েছে এখানে। সাধারণ হিমাচলীর মধ্যে এরা কালাজাদুর দেশের লোক। এরা এমন এক জাতি যে নিজের ঘর ভাঙে আর অন্যের ঘরও ভাঙে। টিঁকে থাকে না কোথাও। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার। দীর্ঘ দিন ধরে বাঙালি এখানে সাধারণের সঙ্গে মেশেনি, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। বাঙালি ঘরের মেয়ে এখানকার মানুষকে বিয়ে করেনি। অল্প কিছু ঘরেই হিমাচলী বৌ এসেছে।
বাঙালি খুবই সচেতন। কোন্ বাঙালি কালীবাড়ির সদস্য পদ নেবে বা কাকে সদস্যপদ দেওয়া হবে তা তার চালচলন, সামাজিক পরিচিতি বা বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ না নমঃশূদ্র এ সবের বিচার আছে। এই যে এত পুরোহিত, প্রায় সাতজন, তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন এখানে তারা কালীবাড়ির সদস্যপদ নিতে পারে না। আমিও সদস্যপদ পাই অনেক পরে। তবে আমার চেহারা বা চালচলন হয়তো উচ্চবিত্তের মতো তাও দীর্ঘ দশ বছর পরে মন্দির চত্বরে বসতে পেলাম। দিনে দিনে যত হিমাচলবাসী শিক্ষিত হয়েছে, সরকারি চাকুরে হয়েছে, রাজনীতিবিদ হয়েছে ততই বাঙালি তার জায়গা থেকে ধীরে ধীরে সরে গেছে যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই ‘মন্দির দখল’ ঘিরে তাদের এত হাহাকার।
বর্তমানে কালিবাড়ীর সঙ্গে জড়িত পরিবারের সংখ্যা ৩০-৪০ হবে কিন্তু আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে তার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০-২০০ বা তার বেশি। পুজো-পার্বনে কালীবাড়িতে পা ফেলার জায়গা হত না। ছিল নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের লড়াই কিন্তু বাঙালি সবাই একসঙ্গেই পাত-পেড়ে খেতে পারত। এই কালীবাড়িতে, ভিন্ন রাজ্য বা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালি শ্রমিকের দল, কম পয়সায় থাকতো আর খেতে পারতো। শোনা কথা, কোন বাঙালি শ্রমিক বেআইনি কাজ করলে তা হিমাচলের যে কোন জেলায় হোক না কেন, সরকারি মহলে এই উচ্চবিত্ত বাঙালিদের তাদের জন্য কথা বলার অধিকার ছিল। কোন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আগে বা প্রয়োজন হলে এই বাঙালি একে অপরকে সাহায্য করত।
পরিবর্তন হল। পরিবর্তন দেখলেন ষাটের দশকে জন্ম নেওয়া বাঙালিরা। প্রথমেই তারা হারালেন সরকারি চাকুরী। অনেকক্ষেত্রেই একচেটিয়া সাধারণ হিমাচলী হয়ে উঠলেন অনেক বেশি জাতি সচেতন। তারা হলেন শহরমুখী আর শুরু হল এক জমি দখলের লড়াই। একসময় অর্থাৎ এই ষাটের দশকে যারা জন্ম নিয়েছেন তারা বেসরকারি স্কুলে যেমন বিশপ কটন্ স্কুলে যেখানে বাংলা ভাষা পড়ানো হতো সেখানে ছিলেন বাঙালি শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে তা বন্ধ হল। চাকরী হারালেন বা শুরু করলেন অন্য বিষয়ে শিক্ষকতা। একটা চাপা বা গুপ্ত লড়াই শুরু হল চাকরি ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক চাপান-উতোরের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সুবিধে প্রাপ্ত হিমাচলী শিক্ষিত হিমাচলী ধীরে ধীরে সরকারি চাকরির জায়গা দখল করে নিলেন। বাঙালি শ্রমিকের চাকরি করবে না তারা ব্যবসায়ীও নয় তাই প্রতিষ্ঠিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরা ধীরে ধীরে সিমলা ছাড়লেন। তারা সাধারণ চাকরি করবে না যেন এক ধনুকভাঙা পণ এবং এই ধনুকভাঙা পণের পিছনেও কিছু কথা আছে। সিমলা কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠা হল ১৮৪৫ সালে, তখনও কিন্তু এটা ব্রিটিশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে চিহ্নিত হয়নি তবে তার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী বাঙালি তার জমি চিনে নিয়েছে।
শোনা যায় ‘শ্যামলা দেবী’র পূজারী ছিলেন এক তান্ত্রিক-হিন্দু-বাঙালি সাধু। ওই সময় এবং এখনও তুক্তাক্, বশীকরণ, কালাজাদুর (যা একমাত্র বাঙালির সম্পদ) চল বরাবর এই পাহাড়ে আছে। মনে মনে হিমাচলী যেন বাঙালিদের ভয়ও পায়। এই অঞ্চল ছিল কেওন্থল্ রাজ্যের অঙ্গ, ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে নিয়ে নেয় এই অঞ্চল। কোন এক ব্রিটিশকর্মী নাকি ফেলে দিয়েছিলেন এই ‘শ্যামলা দেবী’র মূর্তি। তারপর ভয় দেখানো, স্বপ্নাদেশ যা হয়ে থাকে তার মাধ্যমে ‘শ্যামলা দেবী’ তার অবস্থান ফিরে পেলেন। দেবীর নামেই ব্রিটিশরা এই শহরের নাম রাখলেন সিমলা আর বাঙালি তার জায়গাও ফিরে পেলো।
ব্রিটিশদের সঙ্গে এলেন বাঙালি আমলার দল। এরা সবাই কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী। আর এলেন কিছু নিম্নপদস্থ বাঙালি কেরানী। ব্রিটিশের পর সবচেয়ে শিক্ষিত, আধুনিক, স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বাঙালি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৩৯ (হতে পারে) এখানে ব্রিটিশদের শীতকালীন রাজধানী ছিল। এই পর্যন্ত বাঙালিদের রমরমা অবস্থা। ব্রিটিশ শহর ছাড়লো আর বাঙালিদের এক বড় অংশ উচ্চপদস্থ আমলাবৃন্দকে ছাড়তে হল সিমলা যার সংখ্যা প্রায় ৮০। স্থায়ী বাঙালিরা এদের বিদায় দিলেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ১৯৫৫ সালে আসা বাঙালিরাও কিন্তু তখন দেখলেন এই সম্ভ্রান্ত বাঙালি জাতিকে। কালীবাড়িতে দুটি ক্লাব ছিল। রবিচক্র যা সম্ভ্রান্ত ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারিদের আর অন্য দল যারা সাধারণ কেরানি বা অন্যান্য কাজে নিযুক্ত ছিল। ছিল নিজেদের স্কুল ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হত। তাতে ছিল ল্যাবের ব্যবস্থা। শোনা যায় বাঙালিরা তাদের এক মাসের মাইনে দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি করলেন এই স্কুল আর এই মন্দির। তৈরি হল ‘বঙ্গীয় সম্মীলনী’ যা আজও আছে। বাঙালি যেন উঠে পড়ে লেগে পড়েছে তাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে আর তার ফলে তারা কোনদিনও সাধারণ হিমাচলবাসীর কাছের মানুষ হতে পারেনি — আজও নয়।
বাঙালিদের জমিজমা ছিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। তবে তারা কৃষক ছিলেন তা নয়, ছিল বাগান বাড়ি। এ সবই ছিল সিমলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বিপত্তি শুরু হল হিমাচল রাজ্য অভিষেকের সময় থেকে বা তার কিছু আগে থেকেই। বাঙালি তার জৌলুস হারাতে শুরু করে কেন্দ্রিয় সরকারের অফিস দিল্লিতে চলে গেেল। তার সঙ্গে চলে গেল সরকারি বাঙালি অধিকার। আর নতুন হিমাচল সরকার কিছু নিয়ম তৈরি করলেন। কৃষক ছাড়া কেউ জমি আদায় করতে পারবে না। সরকারি চাকরিও পাবে না। ১৫ বছরের বেশি যারা হিমাচলে আছেন তাদের বোনাফাইড সার্টিফিকেট দেওয়া হয় আর ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ ও ৪ বিগোয়া (৪৫০ স্কোয়ার ফিট - ১ বিগোয়া) পর্যন্ত জমি কিনতে পারেন। বাঙালিদের ঢালাও সরকারি চাকরির হার কমল কিন্তু তার সঙ্গে অন্য কাজের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় স্থায়ী বাঙালিরা তাদের জমিজমা বেচে দিতে শুরু করলেন।
বাঙালির ঐতিহ্য ‘মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ ছিল নিত্যানন্দ ব্যানার্জিদের। লোয়ার বাজারে যা আজও আছে তবে সেখানে চা বিক্রি হয়।
বাঙালি যেন পারলো না এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে আর পারলোও না স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিমাচলী সংস্কৃতিকে নিজের বলে স্বীকার করতে। এই দম্ভ বা নিজস্বতা বাঙালিকে এক স্বতন্ত্র জায়গায় পৌছে দিল আর আমরা যারা এলাম আজকের দিনে তারাও চিহ্নিত হলাম এক স্বতন্ত্র জাতিরূপে। আমাদেরকে সম্মান করা যায় কিন্তু নিজের বলা যায় না যেন।