সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনে ইংরেজদের Liberal Education এর ধাঁচে শাসকরা যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যার পেছনে এখানকার উঠতি মধ্যশ্রেণির সক্রিয় সমর্থন ছিল, স্বাধীনতার পর তাকে সামান্য অদলবদল করে জাতীয় শিক্ষার রূপ দেওয়া হল। এখানেও দেশের মধ্যশ্রেণির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। স্বাধীন দেশে এই মধ্যশ্রেণি বা ভদ্রলোক বর্গ তাদের নিজেদের সামাজিক গন্ডিতেই শিক্ষাকে আটকে রেখে নিজেদের উচ্চাশা চরিতার্থ করেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্বে এদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিপরীতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা তেমনভাবে করা হয়নি। ফলে এদেশীয় শিক্ষার যেমন জাতীয় চরিত্র অর্জন করা হয়নি, তেমনই ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে শিক্ষার সুযোগ না পৌঁছে দেবার জন্য, শিক্ষার আঙিনা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তা গণতান্ত্রিকও হয়ে ওঠেনি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মত দুজন শিক্ষাবিদের জন্ম এদেশেই।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৪৮-৪৯ এ তৈরি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত শিক্ষা কমিশন। ১৯৫৩-৫৪ তে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন আর ১৯৫৪-৬৬ সালে কোঠারি কমিশন নামে পরিচিত শিক্ষা কমিশন। ১৯৬৮ সালে এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ঘোষিত হয়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতি। আঠারো বছর পরে ১৯৮৬ সালে ‘চ্যালঞ্জ অফ এডুকেশন’ নামে খসড়া শিক্ষা দলিলের ভিত্তিতে আবার তৈরি হল জাতীয় শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতির দুটি মৌল বৈশিষ্ট্য, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলি হল (ক) জাতীয় সংহতির সহায়ক পাঠক্রম ও পাঠ্যবই যা সমস্ত ধরণের সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বোধ থেকে মুক্ত হবে। (খ) স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে আধুনিক কমিউনিকেশন টেকনোলজির প্রয়োগ। (গ) চাকরির সঙ্গে ডিগ্রীর সম্পর্ক না রাখা। (ঘ) মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। (ঙ) প্রতি জেলায় Centre of Excellence হিসাবে একটি করে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলা (চ) উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। কারণ হিসাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন— ‘‘আমাদের লক্ষ্য নিরবচ্ছিন্ন আধুনিকীকরণ, ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও দ্রুত সামাজিক ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাওয়া।’’ আর এই শিক্ষানীতির প্রায় সাড়ে তিনদশক পরে অাবার জাতীয় শিক্ষানীিত ঘোষিত হল দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের আমলে। ৪৮৪ পাতার এই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০১৯ তৈরি হয়েছে ইসরোর প্রাক্তণ অধিকর্তা কে কস্তুরিরঙ্গণএর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির দ্বারা। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে গঠিত টিএসআর সুব্রহ্মনিয়ম এর নেতৃত্বাধীন Committee For Evolution of the New Education Policy মে ২০১৬ তে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি হয়েছিল ৪৩ পাতার Some Inputs For Draft National Educational Policy ২০১৬। এই ধারাতেই কস্তুরিরঙ্গণ কমিটির রচিত নতুন শিক্ষানীতি, রিপোর্টগুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
সময় এগোনোর সাথে সাথে দেশের শিক্ষানীতিরও পরিবর্তন হবে এটাই প্রত্যাশিত। এখানে সে নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। পাশাপাশি গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে একুশ শতকের বিশের দশকের সময়কাল পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর সাথে সাথে আমাদের দেশেও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে বিপুল পরিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঘটে চলেছে দেশের শিক্ষার নীতি নির্ধারকেরা (ভারতবর্ষে অবশ্য তাঁরা রাজনৈতিক মাতব্বরই হয়ে থাকেন) তার সঙ্গে তাল মেলাতে সর্বদা উদগ্রীব, অতীতের মত। অতীতে গঠিত শিক্ষা কমিশন বা কমিটিগুলো যে এদেশের প্রেক্ষিতে স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় তেমন রাখেন নি, তা দেশের শিক্ষার সামগ্রিক ছবির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই সব প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০কে।
স্বাধীনতার পর ভারতরাষ্ট্র তার ফেডেরাল কাঠামোকে মোটামুটি বজায় রেখেছে এবং এদেশের বহুজাতিভিত্তিক সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে মান্যতা দেবার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি অনেক ত্রুটি দুর্বলতা সত্ত্বেও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনার উদ্যোগ দেখায়নি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী পথ প্রথম থেকে অনুসরণ করার ফলে ক্রমশ দেশে ধনী দরিদ্রর মধ্যে বৈষম্য বেড়ে গেছে। কিন্তু এদেশের সরকারি ঘোষণায় অন্ততঃ ছিল কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের লক্ষ্যে তা পরিচালিত হবে। যার কিছু কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্য করাও গিয়েছিল। তা আশির দশকের শেষাশেষি থেকে পাল্টাতে শুরু করে। অর্থনীতির উদারীকরণের খোলা হাওয়া এদেশে প্রবেশ করল তার ঝোড়ো উদ্দামতা নিয়ে। রাতারাতি বদলাতে শুরু করল বা উধাও হয়ে যেতে লাগল আমাদের পরিচিত অনেক কিছু। এসব কিছুর চিহ্ন আমরা দেখেছিলাম ’৮৬র জাতীয় শিক্ষানীতিতে। দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নতুন প্রজন্ম সেই শিক্ষানীতিতে ভর করে আধুনিক পৃথিবীতে নতুনভাবে নিজের জায়গা খুঁজে পাবে। প্রায় রাতারাতি উন্মুক্ত হয়েছিল বিদেশের হাতছানি, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা, উৎকর্ষমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য দেহমন সমর্পণ করে প্রস্তুতি নেওয়া। সেদিন অবশ্য শিক্ষার নীতি নির্ধারকরা এটাও বুঝেছিলেন পিরামিডাকৃতি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ার দিকটাকেও শক্ত করা প্রয়োজন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অক্ষরবঞ্চিত রেখে দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক প্রগতি সম্ভব নয়। সেকারণে চালু করা হয়েছিল জাতীয় সাক্ষরতা কর্মসূচী যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯১-২০০১ এই পর্বে এদেশে সাক্ষরতার হার যে পরিমাণ ঊর্দ্ধমুখী হয়েছিল তা অতীতে কোনদিন হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় এসেছিল শিক্ষার অধিকার আইন সকলের জন্য শিক্ষাগ্রহণের অধিকার সুনিশ্চিত করতে। জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬তে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল জাতীয় সংহতি রক্ষার কথা। এর জন্য সব ধরণের সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার ঘোষণাও ছিল। শিক্ষা বিষয়ে সেসময় সরকারের ঘোষণা ছিল 'as the main instrument of change, education should be considered a key input for national development' অার এই development এর তাগিদে শিক্ষা মন্ত্রককে পরিবর্তন করা হল মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে। কারণ ‘উন্নয়নে’র হাড়িকাঠে ‘মানবসম্পদ’ সর্বদা বলিপ্রদত্ত। ’৮৬র শিক্ষানীতি থেকে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধাঁচাকে পরিত্যাগ করে আমেরিকান ধাঁচাকে প্রয়োগ করতে উদ্যোগ শুরু হল।
শিক্ষার মৌলিক অধিকার, যা একটি দেশের জনগণের প্রগতির জন্য আবশ্যিক শর্ত। মানুষকে শিক্ষার আঙিনায় পৌঁছে দিতে রাষ্ট্র বা সরকারের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য্য। নতুন শিক্ষানীতিতে কার্যতঃ একে অস্বীকার করে শিক্ষাকে ‘কোয়াসি পাবলিক গুড’ বলা হয়েছে। এর আড়ালে রাষ্ট্র/সরকার শিক্ষার সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়। সাথে সাথে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত মূলমন্ত্র-এক দেশ একটাই নেতা একটাই দল— তার প্রতিফলন পড়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে। ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদিতা এখানে অনুপস্থিত। এই দলিল নিয়ে জনমত যাচাইয়ের বিষয়টি নাম কা ওয়াস্তে করা হয়েছে। শিক্ষা কেন্দ্র-রাজ্যের যুগ্ম তালিকায় থাকলেও রাজ্যের মতামত নেওয়া হয়নি। মতামত নেওয়া হয়নি সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষক বা ছাত্রদের কোনও সংগঠনের মতামতও নেওয়া হয়নি একমাত্র অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ছাড়া। বলা হয়েছে নতুন শিক্ষা দলিল আমাদের শিক্ষানীতিতে আমূল পরিবর্তন আনবে। ফলে ১৯৮৫ সালের নতুন শিক্ষানীতি এবং ১৯৯২এর রিপোর্টের সঙ্গেও এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে আগের শিক্ষানীতির পর্যালোচনা করে প্রয়োজনানুসারে তাকে সংশোধন না করে, খোলনলচে বদলে নতুন পথে যাত্রার ইঙ্গিত দেওয়া রয়েছে।
সামগ্রিক এই পরিবর্তন আনার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে যে স্বাধীনতা উত্তর পর্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘সমতা’ আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এদেশের শিক্ষানীতিগুলোয় উচ্চমানের প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার ভাবনা ছিলনা। নতুন নীতিতে সর্বস্তরে শিক্ষায় ‘সমতা’ আনার কথা বলা হলেও এখানে রয়েছে inclusion এর কথা। শিক্ষায় সকলের সমান অধিকার একথা আগের শিক্ষানীতিগুলোয় ঘোষণা করা হয়েছিল। অবশ্য রূপায়ণে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতিও ছিল। এখন সম-অধিকার আর inclusion দুটোই বলা হচ্ছে যদিও দুটো এক জিনিষ নয়। ভারতীয় সংবিধানে পিছড়ে বর্গদের (নারীসহ) সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কিছু নীতি নিয়মের উল্লেখ রয়েছে, নতুন শিক্ষানীতিতে কার্যত তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি অনেক খামতি রয়েছে যদিও শিক্ষানীতিগুলোয় তা নিয়ে প্রতিশ্রুতি অন্ততঃ থাকত। এখানে তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। মনে হতেই পারে ‘সমতা’ আর ‘উচ্চমান’ পরস্পরের প্রতিপক্ষ এবং সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষপাত ‘উচ্চমান’ অর্জনের দিকেই। উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্র দার্শনিক টি.এইচ.গ্রিন শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তাঁর মত ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ‘ভদ্রলোক’দের শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। শিক্ষাকে হতে হব— A Great Leveller' যাতে তা এক সমতাবাদী সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
একুশ শতকের নলেজ সোসাইটির প্রয়োজন এক ‘ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে শিক্ষায় ‘উচ্চমান’কে অগ্রাধিকার দেওয়ার যুক্তি হাজির করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা আয়োগ (RSA) ‘নালন্দা’ ও ‘তক্ষশীলা’-এই দুই মিশনের মাধ্যমে শিক্ষানীতির রূপায়ণ ঘটাবে। অর্থাৎ নলেজ সোসাইটির ভিত্তি যে তথ্যপ্রযুক্তি যার একমাত্র উদ্দেশ্য বিপুল পরিমাণ তথ্য সম্ভারের দখল ও তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার রাশ নিজের দখলে রাখা, তার বাহিনী তৈরি করা। আর ‘ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্য’ বলতে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার বস্তাপচা অংশের সঙ্গে যোগ স্থাপন। স্বাধীন দেশের শিক্ষাকমিশনগুলো এবং শিক্ষাদলিলগুলোয় জোর দিয়ে বলা হয়েছিল দেশ গঠনে শিক্ষার ভূমিকার কথা এবং সেগুলি সংবিধানের মুখবন্ধে ঘোষিত নীতিগুলো রূপায়ণে গুরুত্ব দিয়েছিল। নতুন শিক্ষানীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজবাদ’ বিষয় দুটি নিয়ে কোন কথা নেই এবং সেটি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমন অনুমানের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক স্পষ্ট নতুন শিক্ষানীতি রূপায়ণের পরিকল্পনায়। সেখানে দেশের যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামোকে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। শিক্ষানীতির দলিলে বলা হয়েছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে জাতীয় স্তরের সর্বোচ্চ কমিশন রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগ (RSA) গঠন করা হবে। একইভাবে প্রতিটি রাজ্যেও মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে রাজ্য শিক্ষা অায়োগ (RSA) নামে একটি কমিটি তৈরি হবে। রাজ্য শিক্ষা আয়োগের কাজ হবে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগের গৃহীত সিদ্ধান্তগুিল কার্যকরী করা। শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় রাজ্যের নিজস্ব কোন বিশেষ ক্ষমতা থাকবে না। নয়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা আয়োগ এ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিটি (RSAAC) নামে একটি কমিটি তৈরি হবে যার সদস্যরা হবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, ভারতের প্রধান বিচারপতি, লোকসভার অধ্যক্ষ, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও লোকসভার বিরোধী দলনেতা। অর্থাৎ বিরোধী দলনেতা ছাড়া সকলেই শাসক পক্ষের লোক।
শিক্ষানীতির ২৩ নম্বর অধ্যায়ে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে প্রস্তাবিত ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেশন অথরিটি, ন্যাশনাল এ্যাক্রেডিটেশন এ্যান্ড এ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল, জেনারেল এডুকেশন কাউন্সিল, হায়ার এডুকেশন গ্র্যান্টস কাউন্সিল, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ্ এডুকেশনাল রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং, ন্যাশনাল ইন্স্টিটিউট অফ্ এডুকেশনাল প্ল্যানিং এন্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠনের সময় তাদের চেয়ারপার্সন, চিফ এক্সিকিউটিভদের এবং বোর্ডের সদস্যদের নিয়োগ করবে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা আয়োগ। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যই RSA কাজ করবে।
নতুন শিক্ষানীতিতে আরও কতকগুলি নির্দিষ্ট বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতিকে পুনর্গঠন করার পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া, শিক্ষায় সর্বজনীন বিনিয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং বৃত্তিমূলক ও বয়স্ক শিক্ষার প্রসার। এই সমস্ত পরিবর্তনের সঙ্গে স্কুল শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষাকে এক আঙ্গিকে নিয়ে আসার কথাও বলা হয়েছে।
নতুন শিক্ষানীতিতে বলা অনেক কথা আগেও শুনেছি আমরা। শিক্ষায় সমতার বিষয়টি নিশ্চয় জরুরি, শিক্ষার স্বাধিকারের কথাও অতীতে শোনা গেছে। পাশাপাশি ১৯৮৬’র শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় স্তরে নন ফর্মাল শিক্ষাকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল এবং চাকরিকে ডিগ্রি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। মনে রাখা দরকার এই সময় থেকে মুক্ত বিদ্যালয়, মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, দূরশিক্ষা ইত্যাদি পদ্ধতি চালু হতে শুরু করে। একই ভাবে ১৯৯০এর দশকে পুণ্যায়া কমিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে অর্থসংগ্রহ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকারি উচ্চশিক্ষার ফি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করার কথাও সেইসময় থেকেই এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত শুরু হল এই সময় থেকে।
প্রসঙ্গতঃ আলোচনা করা যায় বিদ্যালয় শিক্ষার বেসরকারি -করণের প্রশ্নে। শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯এর মধ্যেই বহুদিক ছিল যার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার বাণিজ্যীকীকরণের গতিবেগ বেড়েছ। সেখানে যেমন সমস্ত শিশুর জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল তেমনি বৈষম্যকেও সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করা যায়নি। কার্যতঃ বৈষম্যকে এখানে টিকে থাকার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাঙ্ক ও আই এম এফ আরোপিত শর্তমাফিক ভারতীয় অর্থনীতিতে যে স্ট্রাক্চারাল এ্যাডজাস্টমেন্ট (SAP) আনার কথা বলা হয়েছিল তারই প্রত্যক্ষ পরিণতি এটি। এখন আন্তর্জাতিক পুঁজি তার থাবাকে আরও চেপে বসাতে চায়। সে কারণেই নতুন শিক্ষানীতি ২০১৯ এর মাধ্যমে স্কুলশিক্ষাকে কার্যতঃ অবাধ বেসরকারি করণের ডাক দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট পুিঁজ যা আজ তামাম ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রক ভারত সরকার তারই হাতে তুলে দিচ্ছে শিক্ষাকে অন্যান্য অনেক কিছুর মত। সেকারণে শিক্ষাক্ষেত্রেও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব, যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক না থাকা সহ বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অস্বীকার করে, সেগুলি থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর নির্দেশে ‘লার্নিং অাউটকামস’, ‘পেডাগগি’ আর ‘কারিকুলাম’ কথাগুলোর ওপর জোর দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল্যায়ন এর একটা ব্যবস্থা হল ‘লার্নিং আউটকামস’। পাশাপাশি শিক্ষাবিদ্রা এমত পোষণ করেন যে শিক্ষার্থী কি শিখলো তা লার্নিং আউটকামস দিয়ে সবসময় বিচার করা যায় না। নতুন শিক্ষানীতিতে এমন কথা বলা হেয়েছ যে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই ‘পেডাগগি’ ও ‘কারিকুলাম’ এর ওপর ভিত্তি করে বিদ্যালয় শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনা যায় এবং সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে বেসরকারি ক্ষেত্রকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষাব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে না তুলেও শুধুমাত্র ‘পেডাগগি’ ও ‘কারিকুলাম’ এর গালভরা কথা শুনিয়ে অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মত স্কুল খুলে ব্যবসা চালাতে পারবে। গত শতকের আটের দশকের শেষ দিক থেকে তৎকালীন রাজ্য সরকারের ভুল শিক্ষানীতির কারণে এ রাজ্যে ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট স্কুলগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণে আছে। শিক্ষার বেসরকারি করণের অন্যতম একটা রূপ ছিল সেটি। আরেকটি রূপ হলো প্রাইভেট ট্যুইশন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে (যারা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের পড়ুয়া) স্কুলে যাওয়ার চেয়ে টিউটরের কাছে যাওয়াটা প্রধান হয়ে দেখা দিল। পারিবারিক আয়ের একটা বড় অংশ প্রাইভেট টিউটরদের পেছনে খরচ হতে লাগল। শিক্ষা নিয়ে দেশ জুড়ে কাজ করে এমন একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রাইভেট ট্যুইশনের পেছনে গড় খরচ ছিল পরিবারের মোট আয়ের তেরো শতাংশ, বা তারও বেশি। প্রাইভেট ট্যুইশনির খরচ জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে এমন পরিবার প্রত্যন্ত গ্রামে অনেক দেখা যাবে।
বর্তমানে শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯এ ৬-১৪ বছরের শিশুদের অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের শিক্ষার অধিকার আইনের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর জন্য বিদ্যালয় শিক্ষাকে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই নীতিতে কোন কথা নেই। সাথে সাথে এটা পরিষ্কার যে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণির ছেলেমেয়েদের এক ছাদের নিচে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার দেওয়ার সরকারি দায়িত্ব এখানে অস্বীকার করতে চাওয়া হয়েছে। এটি আগে সরকারি ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তাকেই বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ‘শুভচিন্তা’র ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ অনুসারে ‘বিনাব্যয়ে’ শিক্ষা দেওয়ার জন্য (সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের) পঁচিশ শতাংশ আসন সংরক্ষণের নিয়ম বাতিল করার কথাই ঘোষণা করা হয়েছ ২০২০র শিক্ষানীতিতে। বলা হয়েছে যে বেসরকারি ফিলানথ্রিপক সংস্থাগুলোও যাতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারে তার জন্য এই ধরণের নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলো শিথিল করে দেওয়া হবে।
নতুন শিক্ষানীতিতে আগামী দশ বছরের মধ্যে ৩-১৮ বছর বয়স্ক পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগে এই বয়ঃসীমা ছিল ৬-১৪ বছর। শিক্ষানীতি ২০২০তে এই বয়ঃক্রমের সীমা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে যে ‘‘স্বাধীনতার পর থেকে দশকের পর দশক ধরে আমাদের শিক্ষাকে সমাজের প্রতিটি স্তরে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া নিয়েই শুধুমাত্র ভাবা হয়েছে, শিক্ষার গুণমান নিয়ে কিছু ভাবা হয়নি।’’ এই ঘোষণা থেকে উদ্দেশ্যটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ‘শিক্ষার গুণমান’ এর নাম করে শিক্ষাকে সমাজের সমস্ত শ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা সরকার ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলতে চলেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় স্তরে নারীশিক্ষা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হলেও উচ্চশিক্ষাস্তরে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। অথচ সমাজের অগ্রগতির প্রশ্নে নারী শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সকলের জন্য সাধারণ স্কুলের ব্যবস্থা, কোঠারি কমিশন যাকে Common Type School (CTS) বলেছিল এবং তার ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিল। অস্বীকার করা যাবে না সেদিকে তেমনভাবে নজর কোনদিন দেওয়া হয়নি। নেপ ২০২০তে বিষয়টিেক পুরো বাতিল করে শিক্ষার ক্রেতাদের ‘ক্রয়ক্ষমতার’ ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের জন্য আলাদা আলাদা মানের স্কুল তৈরির ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ফলে এই আশঙ্কা মোটেই অসঙ্গত নয় যে এই ব্যবস্থায় সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হওয়ার বদলে তা আরও বেড়ে যাবে।
বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের যে কথা এই নীতিতে বলা হয়েছে বাস্তবে তা আমাদের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি না ঘটিয়ে তার গঙ্গাযাত্রাকে যে সম্পূর্ণ করবে সেই আশঙ্কা অমূলক নয়। বলা হয়েছে পরিচালনার সুবিধার জন্য গ্রামাঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দূরে দূরে থাকা স্কুলগুলোকে একসাথে একটা স্কুল কমপ্লেক্স এর আওতায় আনা হবে। এর উদ্দেশ্য হল একটা কমপ্লেক্স এর মধ্যে থাকা এক স্কুল অন্য স্কুলের রিসোর্স ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টা এই রকম এক স্কুলের শিক্ষক অন্য স্কুলে পড়াতে যাবেন, এক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অন্য স্কুলের ল্যাবরেটরি ব্যবহার করবেন। শহরাঞ্চল যদিও বা এটা সম্ভব হয়, গ্রামাঞ্চলে দূরে দূরে থাকা স্কুলগুলির শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের এরকম যাতায়াতের ফলে যে সময় নষ্ট হয়ে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে, তা কিভাবে কাটানো যাবে সে বিষয়ে এই শিক্ষানীতির দলিলে কিছু বলা হয় নি। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছাত্রছাত্রীরা। এর সাথে রয়েছে বিভিন্ন স্কুলের সময়ের সামঞ্জস্য রাখা সহ অারও বিষয়। যেগুলি দেখবেন বা এই সমন্বয় সাধন করবেন এলাকার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অর্থাৎ তিনি শিক্ষার দিকে না তাকিয়ে বাড়তি এসব কাজ করে যাবেন। নতুন শিক্ষানীতি ২০২০র মাধ্যমে সরকার চাইছে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন স্কুল, নতুন চাকরি, নতুন পরিকাঠামো গড়ে না তুলে অর্থাৎ রিসোর্স তৈরি না করে অপর্যাপ্ত রিসোর্স দিয়েই কাজ চালানো হবে যাতে উন্নত পরিষেবা আর পরিচালনার সুবিধার নামে বিষয়টিতে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা অনুপ্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডে আগের বিজেপি সরকার এক বহুজাতিক সংস্থার পরামর্শে ছয় হাজার প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দিয়ে অন্য স্কুলে জড়ে দেওয়ায় সেখানে ড্রপ আউট বেড়ে গেছে। রাজস্থানেও ৩০ শতাংশ স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শিক্ষাদানের জন্য দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষককূল। তাদের সহযোগিতা করবেন শিক্ষাকর্মীরা। অর্থাৎ পাঠদানের গোটা বিষয়টি পরিচালিত হবে একটি সংগঠিত কর্মীবাহিনীর দ্বারা। নতুন নীতিতে এই সংগঠিত কর্মীবাহিনীর বদলে স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর শিক্ষাদানের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে বেসরকারি ব্যবস্থায় কার্যতঃ সেটি চুক্তিবদ্ধ চাকরিতে পরিণত হবে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে অল্প পয়সায় শিক্ষক নিয়োগ করে বিশেষতঃ প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ডটাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা বলেই এটিকে মনে হয়।
এতদিন কারিকুলাম, টেক্সট বই থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পঠনপাঠন, প্রশাসনিক কাজের গাইডলাইন দিত ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (NCERT)। একই ভাবে রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে স্টেটকাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ এণ্ড ট্রেণিং (SCERT)। শিক্ষার সামগ্রিক গুণমান নির্ধারণ করার জন্য পথ দেখানো তাদের কাজ। এখন থেকে SCERT নামের কেন্দ্রীয় বডি কারিকুলাম, টেক্সট বই থেকে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত সমস্ত বিষয়তত্ত্বাবধান করবে। এবং শিক্ষার ক্ষেত্র এটিকে সর্বোচ্চ বডি করা হবে। রাজ্যে রাজ্যে সরকারি আর বেসরকারি স্কুলের সাধারণ গুণমানের বিচার করবে স্টেট স্কুল রেগুলেটরি অথরিটি (SSRA) নামে একটি নতুন নিয়ন্ত্রক বডি। স্কুলের এ্যাক্রেডিশনও পরিচালনা করবে SSRA। SCERT, SSRA নামের নতুন তৈরি হওয়া বডিগুেলা সরাসরি RSAর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বর্তমানে রাজ্যস্তরে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বডি ডিপার্টমেন্ট অফ্ স্কুল এডুকেশন (DSE)। নতুন ব্যবস্থায় DSEর কোন ভূমিকা থাকবে না। টেক্সট বই তৈরি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ— সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে কেন্দ্র থেকে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য কোন কিছুরই গুরুত্ব নেই সেখানে।
স্কুল রেগুলেশন এর ক্ষেত্রে সরকারি আর বেসরকারি স্কুলে একই পদ্ধতি মানার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হবে এবং শেষে সরকারি স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। শিক্ষানীতিতে একথাও বলা হয়েছে যে কয়েকটি শর্ত মানলেই বেসরকারি স্কুল ভালো ‘এডুকেশনাল আউটকাম’এর জন্য সরকারি অর্থসাহায্য পেতে পারে। বেসরকারি স্কুলগুলোতে ফি ঠিক করার ব্যাপারেও কেন্দ্র বা রাজ্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। এখানেই শেষ নয়। প্রতি তিন বছরে একবার করে বেসরকারি স্কুলগুলো SSRA’র পর্যালোচনার ভিত্তিতে মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে নিজেদের ফিও বাড়াতে পারবে।
বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠক্রম কাঠামো গঠনের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা আমরা দেখে নেব। এতদিনের পরিচিত ১০+ ২+ ৩ মডেল, যার মধ্যে রয়েছে ১০+ ২স্কুলশিক্ষা প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিন্যস্ত, বাকিটা উচ্চশিক্ষা স্নাতক স্তরের। বিদ্যালয় স্তরে একেবারে দশম শ্রেণিতে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়া চালু ছিল। পরবর্তী কালে অবশ্য একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়। সমগ্র স্কুল শিক্ষা বিষয়টি উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বারোবছরের শিক্ষার পাঠক্রম। এর বদলে প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের স্কুল শিক্ষা চালু হবে। উচ্চ মাধ্যমিক নামের আলাদা স্তরটি লোপ পাবে। এখন কাঠামো গড়ে উঠবে ৫+ ৩+ ৩ + ৪ বছরের বিন্যাসে। বয়স অনুসারে শিক্ষার্থীদের চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পাঁচ বছরের মৌলিক স্তরে প্রাক্স্কুল (গ্রেড-১) এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি (গ্রেড-২)। তিন বছরের প্রস্তুতিমূলক স্তর— যে স্তরে থাকবে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি। মধ্যম স্তর হবে তিন বছর— ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিকে নিয়ে। চার বছরের মাধ্যমিক স্তর হবে নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণি নিয়ে। এভাবেই গোটা স্কুলশিক্ষাকে এক ছাতার নিচে আনা হবে। পাশাপাশি প্রান্তিক, অল্পসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে চলা স্কুলগুলিকে হয় অারো সক্রিয় করে তোলা হবে, কিংবা তাদের অন্য বড় স্কুলের সঙ্গে মেলানো হবে। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে এই ধরণের ছোটো স্কুলে অর্থ বিনিয়োগ এবং সম্পদ ব্যবহারের ‘সাশ্রয়’ হয় না।
স্কুল কমপ্লেক্স-এর ধারণায় বলা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে অঙ্গনওয়াড়ি ও অন্যান্য যেসব কেন্দ্র থেকে এখন প্রাক্ স্কুল শিক্ষা পাওয়ার কথা সেগুলিকে এলাকার প্রাথমিক স্কুলটির সঙ্গে এবং প্রাথমিক স্কুলগুলিকে স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়গুলির সঙ্গে যোগ করা হবে। এর ফলে এলাকা জুড়ে স্কুল পরিচালনার প্রাথমিক একক হিসাবে গড়ে উঠবে একটি বড় ‘স্কুল কমপ্লেক্স’। এখানে শিক্ষকদের নিয়োগ করা পাশাপাশি নিয়োগ করা হবে একাধিক সমাজসেবী ও কাউন্সেলর যারা শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করবেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্কুল কমপ্লেক্সের প্রধান হবেন। এই স্কুল কমপ্লেক্স এর জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি থাকবে। একইভাবে প্রতিটি স্কুলেও একটি করে ১০-১২ জনের ম্যানেজমেন্ট কমিটি থাকবে। এসবের মধ্যে দিয়ে এলাকার মানুষের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ ভূমিকাকে বাড়িয়ে স্কুলের ওপর ‘জনসমাজের মালিকানা’র বোধ সৃষ্টি করা যাবে বলে দলিলটিতে বলা হয়েছে। অবশ্য বাস্তবতার সঙ্গে এই ধারণার অনেকটা ফারাক রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায় ১৯৯২ সালের শিক্ষা দলিলেও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই দলিলে কোঠারি কমিশন প্রস্তাবিত Common Type School এর কথা বলা হয়েছিল। বর্তমান দলিলে অবশ্য তার উল্লেখমাত্র নেই।
নতুন শিক্ষানীতি ২০২০ তে বিদ্যালয় পরীক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। শিক্ষার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে রাজ্যস্তরে State Census Examination এর ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি নিরন্তর মূল্যায়ন এর কথাও বলা হয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও বদল আনা হবে। মাধ্যমিক স্তরের (অর্থাৎ অষ্টম-দ্বাদশ) প্রতিটি বছরে দুটি করে সেমেস্টার হবে অর্থাৎ চার বছরে মোট আটটি সেমেস্টার হবে। প্রতিটি ভাগে ছাত্রছাত্রীরা পাঁচ থেকে ছয়টি বিষয় নিতে পারবে। বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা থাকবে যাতে ব্যক্তিগত আগ্রহ ও মেধার পূর্ণ বিকাশ হয় বলে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে।
শিক্ষক সংখ্যায় ঘাটতি, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলি লক্ষ্য রেখে এই দলিলে বলা হয়েছে কোন শিক্ষককে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্য কাজে (যেমন মিড্-ডে মিল, ভ্যাকসিনেশান) নিযুক্ত করা যাবে না। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমান বি-এড কোর্সের পরিবর্তন করে চার বছরের ইন্টিগ্রেটেড বিএড কোর্স চালু করার কথা বলা হয়েছে। এখানে উচ্চমানের সিলেবাস ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই কোর্সে প্রতি বছর কম করে ৫০ ঘণ্টার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখার কথাও রয়েছে।
প্রাক্ স্কুল এবং বুনিয়াদি স্তরের অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন নীতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাক্ স্কুল শিক্ষায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেগুলিই এই শিক্ষালাভের একমাত্র জায়গা নয়া নতুন শিক্ষানীতিতে অঙ্গনওয়াড়ি সহ প্রাক্ স্কুলশিক্ষার সমস্ত কেন্দ্রগুলিই স্থানীয় কোন প্রাথমিক স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এভাবে তারা স্কুল কমপ্লেকসের অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের উপর এই স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও দেওয়া হবে। এর জন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হবে। প্রশ্নটা হলো অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা তাঁদের নিজ নিজ কাজে খুব দক্ষ এবং তাঁরা যোগ্যতার সঙ্গেই সে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু শিশুদের শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগের যৌক্তিকতা কতটা। আগেকার শিক্ষা সংক্রান্ত দলিলের কোন কোনটিতে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাক্ স্কুল শিক্ষার সামগ্রিক প্রয়োজন স্বীকার করে বলা হয়েছিল যে এই প্রকল্পটিকে একটি day care centre বা ক্রেশ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। শিশুকন্যারা যাতে ভাইবোন সামলানোর কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে স্কুলে আসতে পারে। শ্রমজীবী মা কাজে গিয়েও সন্তান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকবেন। অন্তঃসত্ত্বা মায়েরাও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। প্রাক্ স্কুল শিক্ষাকে এর অংশ করতে হলে শিক্ষা বিভাগ ও নারী শিশুকল্যাণ বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পারস্পরিক সমন্বয় ও সহযোগিতা দরকার। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে স্কুল কমপ্লেক্স এর মধ্যে আনার যে প্রস্তাব রয়েছে তাতে ছোটো শিশুর ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের দেখভাল কিভাবে হবে তার উল্লেখ নেই। প্রাক্ স্কুল ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য পুষ্টিকর জলখাবার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবে সেবিষয়ে কোন কথা নেই।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য নেপ ’২০তে বলা হয়েছে সমস্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষার্থীকে কম করে একটি বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিতে হবে। স্কুল কমপ্লেক্সে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক থাকবেন। এই উদ্দেশ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় সমগ্র শিক্ষার্থীদের পঞ্চাশ শতাংশ অংশগ্রহণের লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
এদেশে বয়স্ক শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম। এরাই কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে দেশের অগ্রগতির ধারাকে সচল রাখেন। এদের মধ্যে ফাংশনাল লিটারেসির বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। যে সব দেশে নিরক্ষরতার হার শূন্য সেখানেও ফাংশনাল লিটারেট পাওয়া ক্রমে শক্ত হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অসাধারণ দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে সম্পর্কে জ্ঞানার্জনও দক্ষতা অর্জন করা কঠিন হচ্ছে বলেই এই সমস্যা। আজকের বয়স্ক শিক্ষার অভিমুখ এই ফাংশনাল লিটারেসির প্রতি। নতুন শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষার জন্য একটি স্বশাসিত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দেওয়া আছে, যেটি বয়স্ক শিক্ষার জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা তৈরি করবে। প্রস্তাবিত স্কুল কমপ্লেক্সে এই শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। উপযুক্ত কোর্সের সঙ্গে মুক্ত শিক্ষার জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করার প্রস্তাবও নতুন নীতিতে রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় শিক্ষা বিষয়ক রামমূর্তি কমিটি প্রথাগত স্কুলগুলিকেই প্রথা বহির্ভুত শিক্ষার দিকে নিজেকে বিস্তৃত করা কথা বলেছিল। নতুন শিক্ষানীতিতে তার উল্টো পথে হেঁটে প্রথা বহির্ভূত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকেও স্কুল বলে চালানোর কথা বলছে। অথচ একই কমপ্লেক্স এর অাওতায় নানা ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে থাকলে কি অসুবিধা হবে বা কিভাবে সেইসব অসুবিধা মেটানো হবে সে বিষয়ে এই নীতিতে কিছু বলা নেই।
প্রতিটি শিক্ষানীতিতে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতিতে হিন্দি ও সংস্কৃতকে ভীষণ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক সামাজিক কারণে আগের অনুসৃত ত্রিভাষা শিক্ষার কথা বলেও পরে অহিন্দি ভাষা রাজ্যগুলির হিন্দি নিয়ে আপত্তিতে তা পাল্টানো হয়। নতুন শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। একই সাথে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাকেও চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুই ব্যবস্থা একসাথে চললে তার ফল সম্পর্কে আমরা অবহিত। এই নীতিতে বলা হয়েছে প্রাথমিকের পর মধ্যম স্তর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেখানে সম্ভব সেখানে একটি উপস্থাপন যোগ্য ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। কারণ শিশুর সার্বিক মানসিক বিকাশের সহায়ক হিসাবে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অন্যভাষা ধাপে ধাপে শিখবে। রামমূর্তি কমিটি এমন প্রস্তাবও করেছিল স্থানীয় ভাষা কোন শিশুর মাতৃভাষা থেকে আলাদা হলে মাতৃভাষার পরে তাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন শিক্ষানীতিতে শিশুকে ধাপে ধাপে যেভাবে ভাষা শেখানোর কথা বলা হয়েছে তা কার্যতঃ শিশুমনকে বিভ্রান্ত করবে। তার স্বাধীন বিকাশ, চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতাকে রুদ্ধ করবে। স্কুল ও উচ্চশিক্ষার সমস্ত স্তরে সংস্কৃত ভাষা শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করানোর নামে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একটা ভাষা। এখানে বলা হয়েছে যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাসঙ্গিক কিছু পঞ্চতন্ত্রের গল্প ও অন্যান্য কিছু ‘ইতিহাস-পরিবর্তনকারী সংস্কৃত লেখা’ স্কুলস্তরে বিভিন্ন বিষয়ে, সাহিত্যে এবং লেখার ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার ক্রমবিকাশের ওপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব প্রচার করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আএরাপ করার কথাও বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা-ব্যবস্থা শেখানোর ক্ষেত্রেও সংস্কৃত বা হিন্দি আরোপের একটা প্রবণতা রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ক্লাসিকাল ভাষার প্রতি ছদ্মপ্রীতি দেখিয়ে কিছুটা নিরপেক্ষতার ভাণ করা হলেও সংস্কৃত ভাষার প্রতি অতি ভালবাসাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। পলিসিতে ‘মাল্টি লিঙ্গুইসম’ এর নামে ২৩ বার সংস্কৃত, হিন্দি-১২ বার, তামিল-৫বার কন্নড়-৩বার, ওড়িয়া-২বার এবং মালয়ালম-২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের প্রাথমিক স্তর থেকেই অন্ততঃ তিনটি ভাষার মধ্যে 'immersed' করা হবে। তৃতীয় শ্রেণিতে পৌঁছনোর আগেই শিশু যাতে তিনটি ভাষায় কথা বলতে এবং প্রাথমিক স্তরের বই পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে অন্য দুটি ভাষায় সে লেখাও শুরু করবে। এখানে ওই তিনটি ভাষার মধ্যে সর্বত্র ইংরেজি থাকবে এবং তাই প্রাধান্য পাবে পরোক্ষে তাও স্বীকার করা হয়েছে। যদিও দলিলে উচ্চবর্গের মানুষদের ইংরেজি প্রীতিরও তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। কোনটা মুখ, কোনটা মুখোশ বোঝা সত্যি কঠিন।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০র প্রধান লক্ষ্য ২০৩০ সালের Agenda For Sustainable Development এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘উন্নয়ন’, যেখানে বিশ্ববাজারের স্বার্থে শিশুকে যন্ত্রে পরিণত করার জন্য যে কোনভাবে প্রাক্ স্কুল ও প্রাথমিক পর্বে অক্ষর জ্ঞান ও সংখ্যাজ্ঞান তার মাথায় ঢোকানো। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের। এমনিতে তারা শিক্ষায় পরিপূর্ণভাবে অংশ নিতে পারে না। নতুন শিক্ষানীতি যে এই গোষ্ঠির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি সম্পর্ণ দায়সারা ভাবে করতে চায় তার প্রমাণও রয়েছে। যেমন প্রস্তাব করা হয়েছে উপজাতিপ্রধান বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকের অভাব পূরণ করার জন্য প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক উত্তীর্ণদের নিয়োগ করা হবে যারা এই সব বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে পড়াবে। কিন্তু এদের বেতন কাঠামো ও চাকরির শর্ত নিয়ে এখানে কোন কথা নেই। একই ভাবে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে ‘স্বেচ্ছাসেবী’ ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তারা হবেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সেনাবাহিনীর অফিসার। ভাল ছাত্রছাত্রী এবং সামাজিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা স্বেচ্ছাসেবক হতে পারবে। এদের বলা হবে ‘টিউটর’। আর স্থানীয় যে সব মহিলা, যারা উপজাতি সম্প্রদায় ভুক্ত স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন তাঁরা স্কুলছুটদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসবেন। বিশেষ ক্লাস নেবেন। তবে কারোরই বেতন কাঠামো বা চাকরির শর্ত নিয়ে কিছু বলা হয় নি। বোঝাই যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে সস্তায় কিছু চাকুরিজীবী নিয়োগ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে গোড়াতেই তাদের দুর্বল করে ফেলা এবং এইভাবে ধীরে ধীরে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া।
এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় যখন দেখি দলিলে রেগুলেশন এর ক্ষেত্রে সরকারি আর বেসরকারি স্কুলে একই প্রক্রিয়া মানার প্রস্তাব রয়েছে যাতে এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে একটা অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় এবং পরিণতিতে সরকারি স্কুল শিক্ষা বিলুপ্ত হয়। দলিলে এটাও বলা হয়েছে যে কয়েকটি সহজ শর্ত মানলেই বেসরকারি স্কুল ‘এডুকেশনাল আউটকাম’ ভাল করার জন্য সরকারি অর্থ সাহায্যও পেতে পারে। এমনকি, বেসরকারি স্কুলগুলোতে ফি-ঠিক করার ব্যাপারেও কেন্দ্র বা রাজ্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানানো হয়েছ। শুধু তাই নয় প্রতি তিন বছরে একবার করে স্টেট স্কুল রেগুলেটরি অথরিটি (SSRA)র পর্যালোচনা সাপেক্ষে বেসরকারি স্কুলগুলো মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে নিজেদের ফিও বাড়াতে পারবে।
শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগকে ‘মানবহিতৈষী’ বলা হয়েছে এবং তাদের এই ভূমিকা(!) পালনের জন্য যথাযথ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাদের হাতে পাঠ্যবই পরিকল্পনা, মূল্যায়ন বোর্ডের কাজকর্মের দায়িত্ব থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব মূল্যায়ন নিয়ামক সংস্থা তৈরি করতে পারবে। গবেষণার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রশ্নই থাকবে না। ফান্ডিং অথরিটির দয়ার ওপর তা নির্ভরশীল হবে। আর বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঢালাও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ‘উৎকর্ষের’ দোহাই দিয়ে বেতন নির্ধারণের, অনগ্রসর অঞ্চলগুলোতে বেসরকারি পুঁজির ওপর নির্ভর করে Special Education Zone গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে সরকার তাদের অবাধ সুযোগ দেবে। CSR বা কর্পারেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির নামে শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্য করার কার্যতঃ সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এ ধরনের ‘শিক্ষা উদ্যোগপতি’দের জন্য সরকার যেমন তাদের করছাড় দেবে তেমনি গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ শতাংশ অাসন সংরক্ষিত না রাখার স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে অবাধ লুঠপাট চলবে। সরকার পরবর্তী কালে ঘোষণা করেছে (যদিও ভিন্ন ক্ষেত্রে) ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। বরং ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা তার কাজ। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা (যেহেতু শিক্ষাও সরকারের চোখে ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়) সরকারি অবাধ সাহায্য পাওয়ার গ্যারান্টিও পেয়ে গেলেন।
২০১১-১২ সালের শিক্ষার সর্বভারতীয় এক সমীক্ষায় জানা যায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার সেসময় ছিল ২০.৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫.৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার এক সমীক্ষায় রিপোর্ট জানা যায় ২০১৮ তে দেশে ৯৯৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ৩৯৯৩১িট কলেজ এবং ১০৭২৫টি একক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কলেজের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ ছিল সরকারি, ৭৮ শতাংশ বেসরকারি। গত সাত বছরে দেশে যে ৩৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৯টি বেসরকারি। এই বৃদ্ধির হারকে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এই উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনা সফল করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে ঢোকার আগে আমরা আমাদের দেশের শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের কথাটি মাথায় রাখা। এই দেশে সেই ১৯৬৮ সালে ঘোষিত প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে এখনও পর্যন্ত শিক্ষাখাতে জিডিপি বরাদ্দ ৬ শতাংশ করার কথা বলে আসা হলেও সরকারি স্বীকৃতি মতো তা ছিল জিডিপি’র ৪.৪৩ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে এই খরচ ছিল। তা ২০১৩ সালে দাঁড়ায় ৩.৮ শতাংশে, ২০১৪তে ৩.১ শতাংশ আর ২০১৭তে তা নেমে এসেছিল ২.৭ শতাংশে।
বিশ্বব্যাঙ্কের বিভিন্ন রিপোর্ট জানা গেছে শিক্ষাখাতে সে সময় কিউবার বরাদ্দ ছিল ১২.৯ শতাংশ, নরওয়ে ৮ শতাংশ, ভুটানে ৬.৬ শতাংশ উজবেকিস্থানে ৬.৩ শতাংশ, ব্রেজিলে ৬.২ শতাংশ। ইজরায়েল ৫.৮ শতাংশ ব্রিটেন ৫.৫ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট ৫ শতাংশ। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র বরাদ্দের নিরিখে পৃথিবীর ১৯৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪৩ নম্বরে। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানাচ্ছে ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের শতাংশের হিসেবে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের বিচারে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৭৭। এশিয়া মহাদেশের কথা অালোচনা করলে ভারতের শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় মোট ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। পাশাপাশি ভুটানে ব্যয় ২২.৮ শতাংশ, ইরান ২১.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ২০.৫ শতাংশ, ইজরায়েল ১৫.৫ শতাংশ, বাংলাদেশ ১৪.৫ শতাংশ। নতুন শিক্ষানীতিতে তা জাতীয় আয়ের ৪.৪ শতাংশ বলা হলেও বাস্তবের ছবিটা তা নয়। এরই মধ্যে সরকারের দাবি তা ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। কোভিড জনিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা কিভাবে সম্ভব বোধহয় সরকারও জানে না।
নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকার জন্য নানাধরণের বাধ্যবাধকতার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সেকারণে National Higher Education Regulatory Authority (NHERA) গঠন করার কথা বলা হয়েছে যেটি হবে একটি স্বাধীন সংস্থা। UGC র ক্ষমতা ছেঁটে ফেলে Higher Education Grants Council (HEGC) নামের এক নতুন বডি তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল এ্যাক্রেডিটেশন এন্ড এ্যাসেসমেন্ট (NAAC) নামের পুরনো বডির ঢালাও পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। NAAC এর কার্যাবলীও নিয়ন্ত্রণ করবে RSA। স্কুল শিক্ষার মত উচ্চশিক্ষাতেও কারিকুলাম, পেডাগগি, অ্যাসেসমেন্ট ইত্যাদি দেখা হবে। পাশাপাশি AICTE, Bar Council of India র মত সংস্থাগুলির ক্ষমতা সংঙ্কুচিত করা হবে।
বর্তমান নিয়মে পার্লামেন্ট বা রাজ্য বিধানসভা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দিয়ে থাকে। নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে নতুন এই ধরণের প্রতিষ্ঠান NHERA থেকে বাধ্যতামূলক স্বীকৃতি করিয়ে নিতে হবে। সব ধরণের উচ্চশিক্ষার জন্য বড় আকারের বহুমুখী (Multi Disciplinary) বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ তৈরি করা হবে যাদের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে পাঁচহাজার বা তারও বেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে। সমস্ত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক বিষয়, পঠন পাঠন সংক্রান্ত এবং আর্থিক বিষয়ে পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া হবে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে নতুন দলিলে। এদের রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, টিচিং ইউনিভার্সিটি এবং কলেজ তিনভােগ ভাগ করা হবে। বর্তমানের সেন্ট্রাল উইনিভার্সিটি, সেন্ট্রালি ফান্ডেড টেকনিক্যাল ইন্স্টিটিউট এবং ইন্স্টিটিউট অফ্ ন্যাশনাল ইমপরট্যান্স কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ICSSR, ICPR, ICHR, DAE, DBT র মত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের নিজের গবেষণায় অনুদানের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NRF) নামে নতুন এক কেন্দ্রীয় বডি তৈরি হবে। তারাই বিষয়টি দেখভাল করবে। বেসরকারি সংস্থাগুলিও NRF এর মধ্যমে গবেষণার কাজে লগ্নি করতে পারবে। পরিণতি সহজবোধ্য।
সমস্ত গবেষক শিক্ষার্থীদের নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি বাধ্যতামূলক ভাবে আটটি করে টিচিং এ্যান্ড পেডাগগি কোর্স পড়াতে হবে ইংরেজি ভাষার সাথে কোন একটা ভারতীয় ভাষার আরেকটা ইউনিট নিতে হবে। অবশ্য বিদেশি গবেষকদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। প্রশ্নটা উঠবে এর ফলে গবেষণার গুণমান নিয়ে। পাশাপাশি সরকারের আরেকটি উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। অধ্যাপকদের শূন্য পদে সাংবিধানিক নিয়ম মেনে নিয়োগ না করে গবেষক ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা সরকারের তরফে তা এখানে দেখা গেছে।
১৯৪৯এ রাধাকৃষ্ণণ কমিশন সহ পরবর্তী কালের বিভিন্ন শিক্ষা দলিলে সাধারণ উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি জাতীয় পুনর্গঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা ভোকেশনাল এডুকেশন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিংএর মত ব্যবহারিক দক্ষতামূলক শিক্ষা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২০র নতুন শিক্ষানীতিতে বিষয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র জ্ঞান ভাণ্ডারগুলিকে ভেঙ্গে সুসংহত ব্যবস্থার নামে সেই পরিকল্পনার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে একমুখি বিষয় শিক্ষার বদলে Liberal broad based multidisciplinary শিক্ষা চালু করাই উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য। প্রাচীন নালন্দা তক্ষশীলারও এমন আদর্শ নাকি ছিল।
বি.এ. বি.এসসি, বি.কম আগের মত চালু থাকলেও তাকে চারটি পর্যায়ে ভাঙা হবে। সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও অনার্স। কেউ যদি প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেন তাহলে তিনি যতদূর পড়েছেন সেই পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য কোন একটা সার্টিফিকেট পারেন। অাবার ইচ্ছা করলে ভবিষ্যতে বাকি পাঠক্রম শেষ করতে পারবেন। কিছু কিছু বিষয় যেমন নতুন হবে তেমনি কিছু বিষয় বাতিল হবে। বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে পড়ুয়ার স্বাধীনতা থাকবে। কলা বিভাগের সঙ্গে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের বিষয় নেওয়া যাবে। অর্থাৎ চারবছরের স্নাতক পাঠক্রমে যে একাধিক ‘এক্সিটপয়েন্ট’ ঘোষণা করা হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয়না। স্নাতক হবার পরেও শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি পায় না। সেখানে মাঝপথে পড়া থামিয়ে বিভিন্ন সার্টিফিকেট পেলে তাদের চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন কথা নেই। বরং বলা যেতে পারে এতে মাঝপথে কলেজ ছুটকেই (Dropout) প্রশ্রয় দেওয়া হবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত বিষয়ের স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষা নেওয়া হবে যেখানে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তি হতে হবে। এখানে একটা গুরুতর দিকের প্রতি আমাদের নজর দেওয়া দরকার। এই শিক্ষানীতিতে স্কুল স্তরে নারী শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হলেও, উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রায় কিছুই নেই। চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু করার কথা বলা হয়েছে।
ক্লাস ঘরে পাঠদান প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং পরিকল্পনা মতো শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। আর করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা নেওয়া, কলেজে ভর্তি হওয়া সব চালু হয়ে গেল। উচ্চশিক্ষায় অনলাইন মাধ্যমের ব্যবস্থা ২০১৭ সাল থেকেই সরকার শুরু করেছিল SWAYAM পোর্টাল আর কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে। শিক্ষানীতির খসড়ায় যদিও ছিল না তবু এই বছর জানুয়ারি মাসে সেই খসড়ার সংযোজন করে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। যদিও দেশে ডিজিটাল পরিকাঠামো ও অনলাইন শিক্ষার হাল বুঝতে সরকারি তথ্যই যথেষ্ট। অবশ্য সরকার কোনদিকেই কর্ণপাত করবে না। হিসাব মতো শহরাঞ্চলে বসবাসকারী সমাজের স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকায় পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অনুপাতের হার ২৭ শতাংশ। একই ভাবে বিদ্যুৎ ঘাটতি বা নেট সংযোগ দুর্বল হওয়ায় ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে এখনও লক্ষাধিক গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছয়নি। দেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করেন জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। আর দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে একটিমাত্র ঘরে কোন রকমে জীবন কাটায়। অনলাইন শিক্ষায় এক বিরাট সংখ্যক পড়ুয়া যে শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রমাণ, এই সময়ের মধ্যে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা নিচ্ছে। ভারতের শিল্পপতিরা ২০০০ সালে শিক্ষাসংস্কারের উদ্দেশ্যে যে রিপোর্ট পেশ করেছিল, আম্বানী বিড়লা রিপোর্ট নামে যা পরিচিত সেখানে শিক্ষার প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ও সেক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৭ সালে নীতি আয়োগের তৈরি করা এ্যাকশন প্ল্যানে অনলাইন শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছিল, তা নাকি এনরোলমেন্ট বাড়তে সহায়ক হবে।
কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ছাত্রছাত্রীরা মাথায় হাত দিক, উল্লসিত কর্পোরেট হাউসগুলো। গুগল এর CEO সুন্দর পিচাই বলেছেন ভারতে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রসারে অাগামী ৫-৭ বছরে তিনি ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন। অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে CBSE কে সাহায্য করবে গুগল ও ফেসবুক। এই প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার সঙ্গে গড়ে তোলা হবে ‘জাতীয় সংগ্রহ ভাণ্ডার’। এখানে ডিজিটাল আকারে সংরক্ষিত হবে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র যা সমস্ত ভাষাতেও পাওয়া যাবে।
দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ১৯৯৫ সালে গ্যাট্চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য। ১৯৯৫ সালের পর থেকে দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত কমিটির সুপারিশ ছিল উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানোর। ঐ বছরই প্রথম নথিভুক্ত হয় মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ভারতের মোট উচ্চশিক্ষার্থীর দুই তৃতীয়াংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে। এই শতকের প্রথম পনেরো বছরে দেশে প্রতি বছর গড়ে ২০০০ করে নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশই বাণিজ্যিক উদ্যোগে। বাণিজ্যিক উদ্যোগে কর্পোরেট কায়দায় চালানো হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোক। সেখানে একটি মনোনীত সার্বভৌম প্রশাসনিক বোর্ড কাজ পরিচালনা করবে। সেখানে দশ থেকে কুড়িজন স্বাধীন ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ থাকবেন। শিক্ষক, প্রশাসনিক আধিকারিকেরা থাকবেন। কর্পোরেট কায়দাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলা হবে CEO বা Chief Executive Officer। বোর্ড তাঁকে মনোনীত করবে এবং বোর্ডের অনুমোদিত নীতির ভিত্তিতে তিনি একাডেমিক কাউন্সিল তৈরি করবেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে থেকে যেমন আসবেন, তেমনি বাইরে থেকেও আসতে পারেন। এদের মধ্যে শিক্ষাবিদ থাকবেন দু’জন, বাকিরা আমলা।
ঝলমলে স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন শিক্ষা এসব গালভরা শব্দের আড়ালে মূল প্রশ্ন টাকা কোথা থেকে আসবে। এখানে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অর্থবরাদ্দ বাড়ানোর আশ্বাস রয়েছে। বলা হয়েছে বিগত চার বছরে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে পরোক্ষ কর আদায়ের হার ১.৫ শতাংশ বেড়েছে। জিএসটি’র আওতায় গত চার বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে বিশেষ পরোক্ষ করদাতার সংখ্যা। ১৮ লক্ষের মত ব্যক্তিগত করদাতা বেড়েছে। এই সব বাড়তি করের একাংশ শিক্ষায় আসবে বলে আশা করলেও শিক্ষা সেসের ব্যাপারটির উল্লেখ নেই। জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করা কথা বাতিল না করা হলেও জোর পড়েছে আগামী দশবছরে মোট সরকারি ব্যয় বরাদ্দের কুড়ি শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার লক্ষ্যে যাওয়ার। যা নির্ভর করে করের অনুপাত বাড়ার ওপর। অর্থাৎ বর্তমানে সর্বজনীন খরচের ১০ শতাংশ যা পরের দশ বছরে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে যার মধ্যে ৫ শতাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য, ২ শতাংশ বিদ্যালয় শিক্ষায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য এবং ১.৪ শতাংশ বিনিয়োগ হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। অথচ মোটেই জোরের সাথে শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ ব্যয় করার কথা বলা হয়নি। সরকারি অর্থঘাটতি মেটাতে বেসরকারি সংস্থার ‘মানবহিতৈষী’ অনুদানের ওপর নির্ভর করা হবে। অথচ CSR বিষয়টি আইনের ফাঁক গলে এখনও বাধ্যতামূলক নয়।
নতুন শিক্ষানীতিতে উৎকর্ষমূলক জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গঠনের স্বপ্ন ফেরি করা হয়েছে। প্রতিজ্ঞা রয়েছে শিক্ষার সর্বজনীন প্রসার ঘটানোর। যদিও ‘সকলের জন্য শিক্ষা’কে বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ নেই। ২০০১ সাল থেকে সর্বশিক্ষা অভিযান চালু হয়। ৬-১৪ বছরের শিশুদের ‘এলিমেন্টারি এডুকেশন’ দিয়ে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে এসে তাদের শিক্ষা সম্পর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বিশাল সংখ্যক শিশু এর ফলে বিদ্যালয়ে এল। তাদের পঠন পাঠন এর জন্য পার্শ্ব শিক্ষক নিয়োগ করা হল। গোটা প্রকল্পে কেন্দ্র রাজ্যের অংশীদারিত্ব স্পষ্ট হয়েছিল। এখানে পার্শ্বশিক্ষক, শিক্ষাবন্ধু ইত্যাদি ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া হবে। ফলে বিপুল সংখ্যক পার্শ্বশিক্ষক সংকটে পড়বেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও ‘অতিথি’ শিক্ষক না রেখে কাজ করবেন।
উল্লেখযোগ্য যে ৪৮৪ পাতার শিক্ষানীতির বক্তব্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজবাদ’ কথা দুটি অনুপস্থিত। রাধাকৃষ্ণণ কমিশন থেকে শুরু করে শিক্ষার যত দলিল স্বাধীন ভারতবর্ষে তৈরি হয়েছে তারা দেশের পুনর্গঠনে শিক্ষাকে বিশেষ ভূমিকা দিয়ে সংবিধানের মুখবন্ধে ঘোষিত নীতিগুলির বিশেষ উল্লেখ করেছে। অথচ বিভিন্ন ধর্মের মিশ্রণে গড়ে ওঠা নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, মুক্ত ভাবনার প্রসার বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখায় এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট অবস্থান না থাকলে ইতিহাসের বিকৃতি, বৈজ্ঞানিক ধারণার উদ্ভট ব্যাখ্যা আরও জোরালো ভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ্ অনিল সদ্গোপাল বলেছেন কোনও শিক্ষানীতিকে ভালভাবে বোঝার জন্য তার মূল পাঠের পাশাপাশি ভেতরের কথাকেও বুঝে নেওয়া দরকার। সেই কথাগুলো উল্লেখ করা হয় না। এই শিক্ষানীতির আসল উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। শিক্ষার দায় নিজেদের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা, ধাপে ধাপে শিক্ষার সমস্ত স্তরকে মুনাফা লোভী শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে কার্যতঃ দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে শিক্ষার আঙিনা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এবং ভারতবর্ষের শিক্ষার যে নিজস্বতা ছিল তা পরিকল্পিতভাবে করে দেবার আশঙ্কা রয়েছে বলে শিক্ষাবিদ্দের অনেকে মনে করছেন। আশার কথা বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে শিক্ষার ওপর নেমে আসা কর্পোরেটসহ নানা ধরণের আক্রমণের মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লড়াই করছে। এই শিক্ষানীতি চালু করার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যদিও দেশজোড়া প্রতিবাদ আপত্তিতে কর্ণপাত না করে কস্তুরীরঙ্গণ কমিটি এই রিপোর্ট পেশ করেছে। রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তেমনভাবে আলোচনা করা হয় নি এবং সংসদে পেশ না করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দিয়েছে। আর অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ছাড়া কোন গণসংগঠনের মতামত নেওয়া হয়নি। আমাদের বিরাট দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের জাগতিক ও মানসিক চাহিদা বিপুল। সেদিকে নজর দিতেই হবে শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন্য। পাশাপাশি দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু এই দলিলে তার যথাযথ প্রতিফলন পড়েনি।
দলিলের শুরুতে তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘‘জ্ঞানের ভুবনে পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ তথ্যভান্ডার (বিগ ডেটা) যন্ত্রগত শিক্ষা (মেশিন লার্নিং) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নাটকীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলির কারণে বিশ্বজুড়ে নানা অদক্ষ শ্রমের কাজ যন্ত্রই করে দেবে (মানব শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না)। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, সমাজ বিজ্ঞান ও কলাবিভাগের বিভিন্ন শাস্ত্রের বিবিধ দক্ষতার সংযোগে বিশেষতঃ গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য বিজ্ঞান (ডেটা সায়েন্স) নির্ভর দক্ষ শ্রমের চাহিদা খুবই বেড়ে উঠেছে।’’ (‘দেশ’ পৃ: ২৯ ২রা সেপ্টেম্বর ২০২০)। বোঝাই যাচ্ছে এই চাহিদা মেটানোর জন্য একদিকে যেমন বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাওয়ার জন্য ধনীর ঘরের ছেলে মেয়েরা যাবতীয় প্রস্তুতির সুযোগ পাবে, ঠিক বিপরীতে কোটি কোটি অভুক্ত অর্ধভুক্ত শিশুরা স্কুলে গিয়ে নিজেদের মাতৃভাষায় সাবলীল ভাবে লিখতে বা পড়তে পারবে না। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ছড়া ‘লেখাপড়া করে যে / গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। তাতে ‘আচ্ছেদিনের’ পরিস্থিতিতে হবে বেশি কড়ি দিয়ে লেখাপড়া করবে যে / গাড়ী ঘোড়া চড়বে একমাত্র সে।’
শিক্ষা মানুষের অধিকার। সেই অধিকারকে সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের। নতুন শিক্ষানীতি ২০২০তে ভারত রাষ্ট্রের সেই দায় পালনের কোন অঙ্গীকার নেই। নতুন দিনের আগমন বোধহয় এভাবেই হবে।
তথ্যসুত্র :—
এই বিষয়ে প্রকাশিত বহু পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইট।