সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আজকাল আর কেউ লিখতে বসে কলম কামড়ায় না। কলমের ব্যবহারই উঠে গেছে প্রায়। তাই ল্যাপটপের কীবোর্ডে আঙুল ছুঁইয়ে ভাবছিলাম কী লিখি। কীভাবে দু-চার কথায় ধারণা দিই প্রায় অর্ধ শতাব্দীর এক সম্পর্কের, অজস্র ঘটনার স্মৃতির, জীবনের বিচিত্র চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এক দীর্ঘ বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতার। এরকম স্মৃতিচারণ সাধারণ পরিচিত বা আলগা বন্ধুদের কাজ। আমার সঙ্গে সমীর ভট্টাচার্য্যের যে সম্পর্ক তাতে ওর কথা এভাবে লিখতে যাওয়া কেমন মামুলি মনে হচ্ছে।
ম’রেই গেল সমীর। বা বলা উচিৎ, মেরে ফেলল নিজেকে। যেদিন বুঝেছিল আর কোনদিন কথা বলতে পারবে না, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারবে না দেবব্রত বিশ্বাসের ঢং-এ, উচ্ছৃঙ্খলতার মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল যতটা সম্ভব। জীবনে কোনদিনই কারও কথা শোনেনি, মারণরোগের মুখোমুখিও বদ্ধপরিকর ছিল নিজের মতো চলবে। তাই বলছি, ব্যাটা মেরেই ছাড়ল নিজেকে।
সমীর ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হয় ১৯৭৮-এ। আমার এক বছর পরে, যদিও বয়সে ছিল আমার চেয়ে বছর দু-তিনের বড়। মানুষকে আকর্ষণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রাখত। কথা বলে যেত অনর্গল, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক, বাজে কথা নয়। সেই প্রাক-ইন্টারনেট যুগে আর্ট, সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে ওর জানার ব্যাপ্তি আর গভীরতা চুম্বকের মতো টেনে রাখত কলেজের অজ্ঞ ছাত্রছাত্রীদের। মনে আছে, প্রথম যেদিন আমরা কয়েকজন একটা ক্লাসরুমে বসে আড্ডা মারছিলাম, বুঝেছিলাম ও অন্যদের থেকে আলাদা। পড়াশুনা, আসর জমানো রসিকতাবোধ আর স্বশিক্ষিত গানের গলার জন্য শুরু থেকেই ও ছাত্রমহলের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। অচিরেই “ভট্চাজ “, “মজবুড়ো” প্রভৃতি ডাকনামে পরিচিত হয়ে যায়। বলা যায় ওর হাত ধরেই আমার ছাত্র রাজনীতির স্বাদ নেওয়া। ওরই প্রভাবে আমার আর্টকে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দেখার অভ্যেসটা পোক্ত হয়েছিল।
১৯৮০-তে আমি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, সমীর সহ সম্পাদক। তখন থেকেই আমাদের বন্ডিংয়ের শুরু। পরে কলেজের সরকারিকরণের দাবিতে ছাত্র স্টিয়ারিং কমিটি তৈরি হলে তাতেও ওর অবদান ছিল প্রচুর । অন্যান্য কলেজের আন্দোলনেও আমরা সামিল হতাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল, বিহারীলাল কলেজ, কোথায় না গেছি তাদের পাশে দাঁড়াতে। সমীর অক্লান্ত নেতৃত্ব দিয়েছে সে সব সংহতির প্রয়াসে। স্তম্ভিত করার মতো লেটারিং-এর দক্ষতা ছিল। যখন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে রাত কাটাতে হয়েছে তাদের আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে, সারারাত অক্লান্তভাবে পোস্টার লিখে গেছে। অবলীলায় রঙের বাটিতে তুলি ডুবিয়ে চটজলদি তৈরি করেছে রাশিরাশি লিখন আর ছবি। মাথা ছিল অসম্ভব ঠান্ডা (অর্থাৎ আমার ঠিক উল্টো)। সহ সম্পাদক হলেও ছাত্র সংসদের অপ্রীতিকর বা চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো ও-ই করত আমার বকলমে। যেমন ওকেই এগিয়ে দেওয়া হতো কর্তৃপক্ষ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনার সময়।
ধর্মতলায় লেনিনমূর্তির আশপাশটা সে সময় একেবারেই অন্যরকম ছিল। এখনকার মতো ভিড় ছিল না, মূর্তিটাও তালাবন্ধ থাকত না। ১৯৭৯ নাগাদ ঐ মূর্তির নিচে শুরু হয় আমাদের কয়েকজনের সান্ধ্য আড্ডা। সেটা এমনই প্রচার পেয়েছিল যে আমাদের কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে লোকে ওখানেই আসত। তখন নানা বিষয়ে জানার সুযোগ ছিল সীমিত, এবং আমাদের সেই জানায় অনেক গলদ ছিল। তবু সেই নরম মাটিতে ভর দিয়েই চলত আর্ট ও রাজনীতি নিয়ে তুমুল আলোচনা। সঙ্গে দফায় দফায় অদূরের ডেকার্স লেনের চা। আশির দশকের মাঝামাঝি সে আড্ডা ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮১-তে বন্দিমুক্তি আন্দোলনের রেশ ধরে তৈরি হয় উত্তর কলকাতা অঙ্গন মঞ্চ নামে এক বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংস্থা। পথেঘাটে নাটক, গণসংগীত, আবৃত্তির অনুষ্ঠান হতো। তারও আয়ু ছিল বছর দুই কি তিন। তারই পাশাপাশি পেইন্টার্স ইউনিটি নামে আমাদের কয়েকজনের একটা গ্রুপের জন্ম হয়, যার উদ্যোগে কার্জন পার্ক, শিয়ালদহ, বি বি ডি বাগ এবং মফঃস্বলের খোলা জায়গায় বেশ কিছু প্রদর্শনী হয়। ঐ গ্রুপের তরফেই প্রথম বের করা হয় “পট” নামে স্বল্প বাজেটের এক পত্রিকা, প্রথম থেকেই যার ভার ছিল সমীরেরই ওপর। প্রথম সংখ্যায় বেরিয়েছিল ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার। সমীরের সঙ্গে শিল্পীর এক গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে।
ছাত্র রাজনীতিই হোক বা গ্রুপের কাজকর্ম অথবা নিছক আড্ডা, সব কিছুতে সমীরই ছিল অলিখিতভাবে আমাদের তাত্ত্বিক ধ্বজাবাহক। Ideologue যাকে বলে। ভুল হোক বা ঠিক, তাত্ত্বিক তর্কে গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলত। আর ততদিনে ও আমার জীবনেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, ওর বাড়ির সঙ্গেও আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অমসৃণ, অনিশ্চিত মুহূর্তে আগাগোড়া ও-ই ছিল আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট।
আমার ব্যাচ পাশ করে বেরোতেই কলেজ তালতলা থেকে চলে যায় দমদমে। সমীর তখনও বেরোয়নি। তালতলায় থাকাকালীন আমরা যে কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম, দমদম অঞ্চলে সেই গোষ্ঠীর দলীয় জোর থাকায় তারা কলেজকে পুরোপুরি কব্জা করে নেয় এবং কিছু কাগুজে অসঙ্গতির অজুহাতে সমীরকে ডিপ্লোমা পরীক্ষায় বসতে বাধা দেয়। সে বাধা সরানোর ব্যাপারে তারা এমন অসম্মানজনক শর্ত দেয় যা মানতে সমীর অস্বীকার করে। তাই ডিপ্লোমা ছাড়াই ও কলেজ ছাড়ে।
আমি দেশ ছাড়ি ১৯৮৮ সালে, যদিও কলকাতায় আসাযাওয়া অব্যাহত ছিল। সে সময়ের অসম্ভব ব্যয়সাপেক্ষ আন্তর্জাতিক টেলফোন যোগাযোগ এড়াতে একমাত্র সম্বল ছিল দীর্ঘ চিঠি। একদিকে চিঠি পৌঁছতে লাগতো কমবেশি দশদিন, অর্থাৎ একটা চিঠির উত্তর পেতে তিন সপ্তাহ বা তার বেশি। সমীর কলকাতার অনুপুঙ্খ খবর দিত পনেরো-ষোল পাতার চিঠিতে, আমিও ওখানকার অভিজ্ঞতা বিশদে জানাতাম । উদগ্রীব হয়ে থাকতাম কবে ওর মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ভরা মোটা খামটা পৌঁছবে। কলকাতায় এলে ওর সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কাটত।
সমীরের ছবির দিকটা প্রথম বছর দুয়েকে তেমন আলাদা করে চোখে পড়েনি। কলেজে কাজও করত কম। কিন্তু ডিপ্লোমা থেকে বঞ্চিত হয়ে কলেজ ছাড়ার পরই প্রকাশ পেতে থাকে ওর সৃজনী ক্ষমতা । পরের এক দশকে ওর ছবিতে কারিগরী দক্ষতা ও চিন্তাভাবনা দুদিক থেকেই পেয়েছি চোখ ধাঁধানো প্রতিশ্রুতি। তখন আমাদের চোখে ঈশ্বর ছিলেন স্বদেশের নিখিল বিশ্বাস, প্রকাশ কর্মকার, রামকিঙ্কর বেইজ, মীরা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ; আর পশ্চিমের ক্যাথে কোলভিৎজ, ম্যাক্স বেকমান, জর্জ গ্রস,পল ক্লী, এবং অবশ্যই পিকাসো। সেই বছরগুলোয় সমীরের শৈল্পিক বিকাশ তুবড়ির তীব্রতায় রোশনাই ছড়িয়েছে। আমি দেশ ছাড়ার পরেই একটা গ্রুপ শো-তে ওর “মেট্রোপলিস” সিরিজ চেনামহলে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল। নব্বুয়ের দশকের প্রথম দিকে সমীর ও আরও কয়েকজন মুম্বই যায় ছবির বাজার পরখ করতে। প্রথম পর্বে সকলেরই কিছু বিক্রি হলেও বাজারের জটিল নিয়মে পরে ওদের ছবির চাহিদা পড়ে যায়। বছর তিনেক চেষ্টা করে সবাই কলকাতায় ফিরে আসে।
আমাদের মধ্যে একমাত্র সমীরই নিয়মিত কবিতা লিখত, এবং যারপরনাই ভালো লিখত। রং রেখার মতো সাহিত্যের ভাষাতেও যে ওর দখল কোনও অংশে কম নয়, ওর কবিতার বই “জললিপি”-ই তার অকাট্য প্রমাণ। শুধু তাই নয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে ছিল অগাধ পড়াশুনা। আমি নিঃসন্দেহ যে সে বিষয়ে ওর জ্ঞান যে কোনও জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞের প্রজ্ঞার সঙ্গে অনায়াসে তুলনীয়। বলেছিলাম কবিকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখতে। যতদূর জানি কোনদিনই লেখেনি।
গতানুগতিক স্মৃতিচারণে মানুষটার অপ্রশংসনীয় দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়াই দস্তুর। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। ছেচল্লিশ বছরের একটা সম্পর্ককে পেছন ফিরে দেখতে গিয়ে সে পক্ষপাতিত্ব করতে পারব না। সমীরের মুখের ওপর যেমন কখনও সঙ্গত সমালোচনা করতে ছাড়িনি, আজও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না, সে অন্যদের যতই খারাপ লাগুক।
২০০০ সাল নাগাদ প্রথম আমার নজরে আসে সমীরের ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খলতা, যার সবচেয়ে খারাপ দিকটা দেখি ঐ দশকের শেষের দিকে। লক্ষ্য করি মদ্যপানের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর চিন্তাভাবনার ধারও কমছে । ক্রমে দিশা হারায় ওর ছবির উন্নতি। আর্থিক স্থিতির জন্য বিভিন্ন সূত্রে অনেকবার কমার্শিয়াল ও অন্যান্য ধরনের কাজের সুযোগ পেয়েও প্রত্যেকবারই নানা অজুহাতে সে সব প্রত্যাখ্যান করেছে। একদিকে নিজেকে দাবি করেছে পূর্ণ সময়ের শিল্পী বলে, আবার আর্টের জগতে নিজের কাজের ক্রয়মূল্য তৈরি করতে যে সব পন্থা নিতে হয় সে ব্যাপারে বরাবরই ছিল চূড়ান্ত অনীহা (আমার ধারণা এর জন্য দায়ী বাজার সম্পর্কে বামপন্থী মতাদর্শের এক বস্তাপচা সংস্করণপ্রসূত স্থুল দৃষ্টিভঙ্গি)। অথচ একই সঙ্গে নিজের শৈল্পিক স্বীকৃতির আকাঙ্খার কোনও কমতি ছিল না। আশপাশের আরও কয়েকজনের মতোই সমীর মনে করত সাফল্যের দেবীর উচিৎ ওকে স্বেচ্ছায় দর্শন দেওয়া। বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি, ঝগড়া হয়েছে, ভূরি ভূরি পরামর্শ দিয়েছি, কিন্তু কোনওভাবেই একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারিনি ওকে। উত্তরোত্তর বেড়েছে কলা জগৎ ও বৃহত্তর সমাজ সম্পর্কে রাশি রাশি অভিযোগ আর এক ভিত্তিহীন উন্নাসিক শ্লেষ।
ঋত্বিক ঘটক ও ষাটের দশকের “হাঙরি জেনারেশন”-এর বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সমীরের একার নয়, আমাদের সকলেরই ছিল অসীম শ্রদ্ধা। সে সব মানুষদের উচ্ছৃঙ্খল, বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার প্রতিও ছিল এক রোমান্টিক আকর্ষণ, যা ঐ বয়সে অবশ্যই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বুঝিনি বোহেমিয়ান হওয়া মানেই নৈরাজ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া নয়। নজর দিইনি নিজের কাজের প্রতি সেই শিল্পীদের আপোষহীনতা এবং তাঁদের কাজের বিপুল সম্ভারের দিকে। সোজা কোথায়, প্রোডাক্টিভিটি, যা একটা উত্তরাধিকার রেখে যায়। আমরা যে আনুগত্য নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “কার্নিশে কার্নিশ, ফুটপাতে ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে” আওড়েছি মন্ত্রের মতো, তার সিকিভাগও স্বীকৃতি দিইনি তাঁর কবিতার ভাণ্ডার, আর সেই সৃষ্টির পেছনে তাঁর শৃঙ্খলাকে। যত উৎসাহ নিয়ে ঋত্বিক ঘটক অথবা পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের মাতলামির বৃত্তান্ত আলোচনা করেছি, তাঁদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সে সম্ভ্রম আমাদের ছিল না। তাই তাঁদের যাপনের প্রতি আমাদের আকর্ষণের সুযোগে কখন যেন একটা নৈরাজ্যের বার্তা সমীরসহ আমাদের কারও কারও মধ্যে গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল। আর সেই অবক্ষয়ী মূল্যবোধের প্রভাবে নতুন শতকের প্রথম পনেরো বছরে পাহাড় থেকে সমীরের দ্রুত গড়িয়ে নামার সাক্ষী আমি নিজে।
এমনটা কিন্তু একেবারেই নয় যে এ সবের মধ্যে সমীর ছবি আঁকেনি। বরং অনর্গল এঁকে গেছে, উপকরণ পেলেই কাজ করেছে কিছু না কিছু। কোনও কোনও ছবিকে স্বতন্ত্রভাবে দেখলে তার জোর ও সম্ভাবনাও কারও নজর এড়ায়নি। কিন্তু আমার কলা ইতিহাসের প্রশিক্ষিত চোখে সামগ্রিকভাবে চিন্তাভাবনার ধারবাহিকতা, বা বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে পরিবর্তনের কোনও পরিষ্কার লজিকের হদিশ মেলেনি। ওর সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছি এ নিয়ে, একজন পেশাদার শিল্পীর কাজের বহমানতায় কন্সেপচুয়াল কন্সিস্টেন্সি বলতে কী বোঝায় সেটা কোনদিনই বোঝাতে পারিনি। মনে হয়েছে চিন্তাভাবনার দিক থেকে ও আশির দশকেই থমকে গেছে।
এই টুকরো টুকরোভাবে জোরালো অথচ সামগ্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছবির ধারা শক্ত শিকড় ছড়ায় সমীর ফেসবুক নিয়ে মেতে ওঠার পর। সম্ভবত শরীরকে অত্যধিক অত্যাচার করার ফলেই ২০১৫ সালের মাঝামাঝি ওর একটা স্ট্রোক হয়, যার পর থেকে অবাধে চলাফেরা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়, আর অতীতের সেই ধারালো, বহুমুখী মানুষটা ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। একটু সুস্থ হবার পর থেকে ফেসবুকই হয়ে ওঠে ওর বিকল্প জগৎ। ক্রমশ সোশ্যাল মিডিয়ার মেকী ও শস্তা স্তাবকতার ফাঁদে জড়িয়ে যায়। প্রত্যহ একেকটা ছবি দেখে অদৃশ্য দর্শকরা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে বাহবা দিয়েছে আর সমীরের অহংবোধ সাময়িকভাবে তৃপ্ত হয়েছে। মনে হ’ত যেন ও ফেসবুকের জন্যই ছবি আঁকে। আর এভাবেই চিন্তাভাবনা ও কাজের কন্সেপচুয়াল কন্সিস্টেন্সির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা দ্রুত বাষ্পীভূত হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনও ছবিতে অনেক সময়েই উঁকি মেরেছে আগেকার শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টির আভাস, কিন্তু তার প্রগতির কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাইনি। আমি ততদিনে হাল ছেড়ে দিয়েছি।
নিজের ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমীর শেষবার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়েছে অসুখটা ধরা পড়ার সময়। নানা সূত্র থেকে সবরকম সাহায্যের ইঙ্গিত সত্ত্বেও প্রথমে বেশ কিছুদিন যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা অগ্রাহ্য করায় রোগটা অসহ্য কষ্টের মধ্যে দিয়ে অন্তিম পরিণতি অনিবার্য করে দেয়। সেই দুর্ভোগে ও নিজে শেষ হয়ে গেছে, আর ওর বাড়ির লোকেরা থেকেছে জীবন্মৃত হয়ে।
সমীর এত বছরে আমার জন্য যা যা করেছে সে ঋণ শোধ করা হয়ে ওঠেনি। আমার জীবনের এতটা জায়গা জুড়ে ওর আনাগোনা যে এই বয়সে আর সে ফাঁক ভরাট হওয়ার আশা রাখি না। তবে মনে হয় বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি আমিও যতদূর সম্ভব রেখেছি। একটা সংস্কৃত শ্লোকে বলে বন্ধুর শেষযাত্রায় সামিল হওয়ার কথা। বাঁশের মাচায় বয়ে ওকে চুল্লিতে ঢোকানো পর্যন্ত সঙ্গে ছিলাম। আরও এক বন্ধু বছর দেড়েক আগে অকালে চলে গেল, কিন্তু তার বেলায় দেশে ছিলাম না। তাই কোনও বন্ধুর শেষ মুহূর্তে আমার উপস্থিতি এই প্রথম।
সমীর ভেতরে চলে যাওয়ার পর গনগনে চুল্লির সামনের দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেলে ভেবেছি, এই তবে পুরো গল্পটা? কী রয়ে গেল? এক সজ্জন, বন্ধুবৎসল মানুষের স্মৃতি? কিন্তু স্মৃতি তো ক্ষয়িষ্ণু। যার জন্য এত জেদ, এত তর্ক, সেই ছবি আঁকা? কোথায় ছবি?? পারব না তো ওর টুকরো টুকরো কাজ জোড়া দিয়ে একটা রেট্রোস্পেক্টিভ কিউরেট করতে, যাতে একজন পেশাদার শিল্পীর পরিচয় পাওয়া যাবে। তাহলে সমীর ভট্টাচার্য্যের উত্তরাধিকারটা কী? Legacy? আমার শূন্যতাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে ওর প্রতি এক দৈত্যাকার ক্ষোভ, নিজের সম্ভাবনাকে তিলে তিলে হত্যা করার জন্য।