সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষিতা এবং খুন হওয়া এক মহিলা চিকিৎসকের খুন হওয়ার পরে, সারা বাংলা এক অভূতপূর্ব গণরোষ প্রত্যক্ষ করলো। মহিলারা লড়াইয়ের এক অসাধারণ নিদর্শন তৈরী করলেন। অদলীয় কিন্তু আদ্যন্ত রাজনৈতিক এক শ্লোগান তুলে, ভারতের আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জমায়েত হওয়ার ডাক দিলেন মূলত মহিলারাই- ‘রাতের দখল নাও’। প্রাথমিকভাবে কলকাতার মাত্র তিনটি জায়গায় জমায়েত হওয়ার ডাক, দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে গেল রাজ্যের বিভিন্ন শহরে। শিলিগুড়ি থেকে আসানসোল হয়ে কলকাতা অন্তত দেড়শটি জায়গায় জমায়েত হয়েছিলেন, লাখো লাখো মহিলা এবং পুরুষ। ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে এই আন্দোলনে শরিক হলেন। রাতারাতি স্বাধীনতা দিবসের মানে বদলে গেল। যে স্বাধীনতা দিবসে সাধারণত জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সেই সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন, সেই উচ্ছ্বাস মূহুর্তে বদলে গেল লড়াইয়ের আলোচনায়, নারী আন্দোলন, নারী স্বাধীনতা, নারীদের নির্ভয়ে বাঁচার স্বাধীনতায়। যে মহিলা চিকিৎসক টানা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করার পরে, বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে তাঁর ধর্ষণ এবং খুন হয়, সেই মৃতা চিকিৎসকই সামনে নিয়ে আসলেন সেই অমোঘ প্রশ্ন। এই যে আজকের সময়ে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা সমস্ত জায়গায় লড়াই করছেন, তাঁদের নিজেদের কাজের জায়গায় কোনও নিরাপত্তা নেই?
আরজিকরের ঘটনা ক্রমশ রোজ জটিল হচ্ছে। একদিকে যেমন সিবিআই তদন্ত করছে, অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছে, কিন্তু হাসপাতালে মৃতা চিকিৎসক কিংবা তাঁর পরিবারের মানুষজন কি কোনোদিন বিচার পাবেন? আর যাঁরা রাস্তায় নেমে উই ওয়ান্ট জাস্টিস বলছেন, তাঁরাও কি যা চাইছেন, তা পাবেন? কিংবা তাঁদের অধিকাংশ কি জানেন, কি চাইছেন? নাকি সেই প্রচলিত সমাধান ফাঁসি হয়ে গেলেই আপাতত শান্তি কল্যাণ হবে? রাস্তা ঘাটে কান পাতলে বেশ কিছু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেইগুলোকে যদি পরপর সাজিয়ে দেওয়া যায়, তা এইরকম। সিবিআই দ্রুত যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করুক। সুপ্রিম কোর্টও বিচারের নামে, সময় কাটানোর এই পন্থা ছেড়ে, যত দ্রুত সম্ভব এই রহস্যের কিনারা করার জন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে চাপ দিক। রাজ্য প্রশাসনের যে বা যাঁরা আরজিকরের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন তাঁদের শাস্তি হোক। কেন আরজিকরের ঘটনাকে ধামা চাপা দিতে চেয়েছিল, কলেজ কর্তৃপক্ষ? সেই প্রশ্নও উঠছে। শুধু আর জি কর হাসপাতাল নয়, অন্যান্য মেডিকেল কলেজগুলিতে চলতে থাকা ঘুঘুর বাসা ভাঙ্গা হোক। এই সমস্ত প্রশ্ন ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রশ্ন হয়তো উঠছে, কিন্তু মূলত এই সমস্ত প্রশ্নকে ঘিরেই বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছে। কথা উঠছে, এই সমস্ত বিষয়গুলো সমাধান হয়ে গেলেই, কি মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে? মহিলাদের নির্ভয় স্বাধীনতার যে দীর্ঘদিনের দাবী, তা পূরণ হবে? খাওয়া, পরার স্বাধীনতা পাবেন, সমাজের প্রান্তিকতম একজন মহিলা? নাকি তা আটকে থাকবে, শহুরে মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যেই?
তবে কোথাও তো একটা ক্ষোভ আছেই। দীর্ঘ তেরো বছরের সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। সিন্ডিকেট রাজ, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি, রেশন সংক্রান্ত দুর্নীতি এবং বেশ কিছু নারী নির্যাতনের ঘটনাকে আজকের রাজ্যের শাসকদলের লঘু করে দেখানোর প্রক্রিয়া আজকের এই ক্ষোভের আগুনকে আরো বেশী করে ইন্ধন যুগিয়েছে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কিছু নীচু তলার নেতাদের দাদাগিরি, সহ আগে উল্লিখিত সমস্ত কিছুই হয়তো আজকের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এখন দেখার, এই ক্ষোভকে কীভাবে সামাল দেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাথমিকভাবে আরজিকরের ঘটনার পরে, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভেবেছিলেন, বিষয়টা উনি সামলে নেবেন। আরজি করের অধ্যক্ষকে প্রাথমিকভাবে ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজে বদলি করে উনি হয়তো ভেবেছিলেন, ক্ষোভকে প্রশমিত করা যাবে, কিন্তু তা হওয়ার বদলে, চিকিৎসকদের ক্ষোভ এবং সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। রাস্তায় নেমে আসেন সাধারণ মানুষ।
এমনিতে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা আছে, একজন ধর্ষণকারীকে যদি ফাঁসি দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রীও সেই প্রচলিত ধারণাকে সম্বল করেই ধর্ষণকারীর ফাঁসির দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন, তাঁর সংগঠন নিয়ে, কিন্তু তিনি হয়তো এখনও বুঝতে পারেননি, এই সমস্যাটা শুধু একটি আরজিকরের নয়, এই সমস্যা আরো গভীরে। এতে আরো হিতে বিপরীত হয়েছে। শুধুমাত্র একজন অভিযুক্তের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নামলে কি সমস্যার সমাধান হবে? বিষয়টা যেহেতু সামাজিক এবং নারী সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই সমাধানও আসতে হবে সামাজিক স্তর থেকে। সরকারের তরফ থেকে যখন আগুপিছু না ভেবে, মহিলাদের জন্য কিছু নিদান দেওয়া হয়, তখন তার মধ্যে সামাজিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য থাকার বদলে, ঘটনাকে দ্রুত ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল লুকোনো থাকে, যার ফলে সমস্যা কমার বদলে আরো বৃদ্ধি পায়।
এবার আসা যাক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রসঙ্গে। যতই শাসকদলের পক্ষ থেকে বলা হোক না কেন, এই বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি যেন না করা হয়, বিরোধী দলেরা তো রাজনীতি করবেই। মুখ্যমন্ত্রী দিনের পর দিন, উদ্ধত আচরণ করবেন, তাঁর আশেপাশের নেতারা ভুল স্বীকার করার বদলে অন্যান্য রাজ্যে নারী নির্যাতনের উদাহরণ দেবেন, মানুষ তা মেনে নেবেন কেন? মানুষ জানে, অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে কী হয়, তাই তাঁদের আর নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই, কিন্তু মানুষ সুশাসনও দেখতে চান। একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব আরো বেশী। অনেকেই জানেন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার মহিলাদের কী চোখে দেখে, তাই তাঁদের আর নতুন করে বোঝানোর দরকার নেই, কিন্তু মহিলা সুরক্ষা দেওয়ার বদলে, তাঁদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে, তাঁদের যদি কাজের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হয়, তাহলে তা একজন মহিলা মেনে নেবেন কেন? মাথা ব্যাথা হলে কি মাথা কেটে বাদ দিতে হবে? মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে গেলে কি তাঁদের কাজের জায়গা থেকেই বাদ দিতে হবে?
সমাজের প্রচলিত ধারণা সবসময়ে ঠিক হবে, এমনটা নাও হতে পারে। তাই শুধু খুঁজে পেতে একজনকে ফাঁসি দিয়ে দিলেই এই সমস্যা রাতারাতি মিটবে না। সমস্যার গভীরে পৌঁছনো জরুরি, তার সামাজিক দিকটা দেখাও জরুরি। বামপন্থীদের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিকও বটে। মহিলাদের সমস্যা, মহিলাদের সমান অংশীদারিত্ব নিয়ে কথা বলা বামপন্থীদেরই কাজ। মহিলাদের স্বাধীনতার লড়াইটা একদিনে আসবে না। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, নানান দেশে মহিলাদের নানান দাবিদাওয়া আদায় হয়েছে, দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। সেই আন্দোলনগুলোর পাশে, বামপন্থীদেরই পাওয়া গেছে। আজকের লড়াইটাও সেইরকম আরো একটি লড়াই। শুধু আরজিকরের মৃতা মেয়েটির বিচারের লড়াই নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারী স্বাধীনতার লড়াই। কিন্তু সেই লড়াইও পথ হারাতে পারে, যদি শুধু রাজনৈতিক দলগুলো এই লড়াই থেকে ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখে, কারণ শুধু ক্ষমতার বদল হলেই এই সমস্যা মিটবে না।
আরো একটা কথা এই লেখায় আসা জরুরি। ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে যেভাবে মহিলাদের ডাকে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ হয়েছিল, আরজি করের ঘটনা নিয়ে, যেভাবে তা ছড়িয়ে গিয়েছিল, রাজ্যের নানান মফস্বল শহরে, তা নিঃসন্দেহে অভাবনীয়, কিন্তু মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই প্রতিবাদ যেন কখনোই শহর কেন্দ্রিক উচ্চবিত্তের আকাঙ্ক্ষার আন্দোলন না হয়ে যায়। এই আন্দোলন যেন পৌঁছতে পারে, প্রত্যন্ত গ্রামের শেষতম মহিলার কান অবধি। ঘরের ভিতর থেকে যেন আন্দোলন তৈরী হয়, মহিলাদের সুরক্ষার দাবীতে আন্দোলন। রান্নাঘর থেকে শুরু হয় লড়াই। তবেই মনুবাদী সংস্কৃতিকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে। তবেই মহিলাদের ঘরে আটকে রাখার, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে পারে। মহিলাদের সমানাধিকারের দাবি শুধুমাত্র কিছু বশংবদ সাংসদ বা বিধায়ক তৈরী করা নয়, তাঁদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন না ঘটলে কোনোদিনই ধর্ষণের মতো সমস্যা কমবে না। আজকে যেখানে এই বাংলাই পথিকৃত হতে পারতো, মহিলাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের, তাঁদের নির্ভয় স্বাধীনতার, সেখানে এই লড়াই আবার নতুন করে লড়তে হচ্ছে কেন, সেই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আবার আসবে। তা সত্ত্বেও যে বাংলা নারীর ক্ষমতায়নের পথিকৃৎ হতে পারতো, সেই বাংলায় আজ আরজিকরের মৃতা মেয়েটির শুধু নয়, সমস্ত মহিলা সমাজের এই লড়াই কিন্তু ইতিহাসে লেখা থাকবে।