সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সার্ধ শতবর্ষ আগে বাংলার মধুকবি লিখেছিলেন---
‘কোথায় বাল্মীকি, ব্যাস
কোথা তব কালিদাস
কোথা ডবভূতি মহোদয়
অলীক কুনাট্য বঙ্গে
মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে,
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়৷’
অনেকেই মনে করেন কবিরা ভবিষ্যদ্রষ্টা হন৷ তাঁদের সৃষ্টিতে যে ভাবনা উঠে আসে তা বহুদিন পরেও সত্য বা প্রায় সত্য বলে প্রতীয়মান হয়৷ দিন ও কাল পাল্টে গেলেও, প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়ে গেলেও, পাত্র-পাত্রীর আমূল পরিবর্তন ঘটলেও কবি-কথন প্রায় আর্ষবাক্যের মতোই ধ্রুব হয়ে থাকে৷
উপর্যুক্ত হতাশার ব্যঞ্জনা কবি প্রকাশ করেছিলেন বাঙলা তথা দেশজ নাট্য ও সাহিত্য সম্পর্কে৷ মধুকবি যখন কাব্যচর্চা করেছেন তখন বাঙলা সাহিত্যের ঊষাকাল৷ চর্যাপদ থেকে বঙ্কিমী যুগে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বিবর্তনের মধ্য যুগ৷ বিদ্যাসাগর বা মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলায় অতি ক্ষীণ তবু শিক্ষিত মহলে ধীরে পরিচিত হচ্ছেন৷ গিরীশচন্দ্র, অর্ধেন্দু মুস্তাফি, নবীন চন্দ্রের সৃষ্টি তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে৷ নাটক বলতে আড়খ্যামটা, খেউর, যৌনগন্ধী কবির লড়াই, আলকাপের ‘অশ্লীলতা’ আর অন্যদিকে দেবদেবীর লীলাকীর্তন৷ সামাজিক পালা কোথায়? মধুকবির নিজের লেখা ‘শর্মিষ্ঠা’ বেলগাছিয়া ভিলায় অনুষ্ঠিত হবে আরও কয়েক বছর পরে৷
‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হয়ে যাচ্ছে কী? তাহলে কি এই প্রবন্ধে আমরা বর্তমান বাঙলা কাব্য-সাহিত্য-নাট্যশালার অবচয়ী অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি? মেট্রোশহরের ও পল্লীসমাজের সাংস্কৃতিক সংঘাত ও কৌম সাংস্কৃতিক উৎখাতই কী আজকে আলোচ্য? তা আদৌ নয়৷ আজকের শিবের গীত হল, বাংলার বর্তমান রাজনীতি বা আরো পরিস্কার ভাবে বললে দলীয় রাজনীতি, যার কথা শুনলেই শিক্ষিত ভদ্র সমাজ ঘৃণাভরে নাসিকা কুঞ্চন করেন, নিজেদের হীরের টুকরো সন্ততিকে বারে বারে সতর্ক করেন ‘খবরদার কলেজে রাজনীতিতে গিয়ে নিজের কেরিয়্যার নষ্ট করবি না৷’ পরামর্শ দেন, এইমস্, আইটিটি, আইজার, আইআইএস আঁচল পেতে বসে আছে৷ কাদার তাল থেকে মূর্তি গড়ার পর, সেই মূর্তি রপ্তানি হবে কর্নেল, কেমব্রিজ, এম আই টি, বার্কলে, অক্সফোর্ড, মেলবোর্ন বা বার্লিনে৷ সেই সব ছেড়ে প্রাদেশিক নোংরা রাজনীতির পচা ডোবায় কূপমন্ডুক এবং ‘হঠাৎ হাসপাতালে অকারণে ফাঁকতালে মহাপ্রয়াণ’ - এর অর্থ কী!
বাংলা তথা দেশের রাজনীতিতে কুশীলবদের আকৃতি বদলে গেছে৷ মহাবাগ্মী (যদিও আই.সি.এস. ফেল) রাষ্ট্রগুরু, প্রতিথযশা ব্যারিস্টার বোনার্জি সাহেব, দিনে লক্ষ টাকা উপার্জন করা দেশবন্ধু, তুখোর ইংরাজি শিক্ষিত বিপ্লবী ও ভবিষ্যতের পণ্ডিচেরির ঋষি (যিনি যোগবলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্থগিত করেছিলেন বলে ভদ্রকুলের একাংশের দৃঢ় বিশ্বাস), ইটনে পড়া কাশ্মিরী পণ্ডিত পরে প্রধানমন্ত্রী, বাংলা মায়ের কোলজোড়া ছেলে নেতাজী সুভাষ (শব্দবন্ধটি আমার নয়, প্রখ্যাত লেখক-প্রকাশক সজনীকান্ত দাসের) - এঁদের মতো দিক বিজয়ী ব্যক্তিত্বরা ছিলেন প্রাদেশিক রাজনীতির অগ্রপথিক৷ দেশের মানুষের কাছে নমস্য, প্রণম্য৷
দেশ ‘স্বাধীন’ হওয়ার দুই দশকের মধ্যে এঁরা অন্তর্হিত হলেন বা অতি অসুস্থ অবস্থায় অবসরে গেলেন৷ জাতির পিতার চিত্র একমাত্র কারেন্সি নোটে রেখে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হল৷ তাও কংগ্রেসী বা খণ্ডজনতা পার্টির জামানায় পোরবন্দরের বিড়লা বান্ধব নেতা ও পিতা নিজেকে কোনক্রমে টিঁকিয়ে রেখেছিলেন এখানে ওখানে৷ গান্ধীঘাটে বছরে দুইবার মালা পেতেন আর বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানরা এলে দর্শন৷ পশ্চিমী রাষ্ট্র প্রধানরা জুতো খুলে ফুল দেন এবং মনে মনে মুচকি হাসেন, ভারতবর্ষে শ্রমিক-কৃষকের অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কেমন বিনষ্ট করে দিতে পেরেছিলেন এই ‘জনক’৷ একবার নয় বারবার৷
আর বিগত দশ বছর ধরে যে ‘অমৃত মহোৎসব’ চলছে তার অভিঘাতে তাঁরই দুই দেশওয়ালী ভাই-এর অশ্বমেধের ঘোড়ার সামনে কেবলমাত্র চশমাটুকু বাঁচাতে পেরেছেন, আর কিছুই নয়৷
খ
দেশসেবকদের চরিত্র পরিবর্তনঃ পূর্বানুবৃত্তি
মোটামুটি সত্তরের দশক থেকে রাজ্যের রাজনীতি পাল্টে গেল৷ চারু মজুমদার নামে উত্তরবঙ্গের এক কমিউনিস্ট নেতা ডাক দিয়েছিলেন ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার৷’ তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন (যা আজ অলীক কল্পনা মনে হয়) ‘১৯৭৫ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকায় গণফৌজ মার্চ করবে৷’ অবশ্যই তাঁর এই ঘোষণার পিছনে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন এবং বিপ্লবের জীবন্ত বিগ্রহ চেয়ারম্যান মাও-এর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল৷ কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি সে পথে এগোয় নি৷ চিনে লিন পিয়াও, চেন পো তা ও সাংহাই র্যাডিক্যালদের পতন হয়েছে৷ মাদাম চিয়াং জীবনের শেষ দিনগুলি হুয়া ও তেঙ-এর কারাগারে কাটিয়েছেন৷ চিন-এর নতুন নায়করা ঘোষণা করেছেন ‘ধনী হওয়া গৌরবজনক’ এবং ‘বিড়ালের রঙ দেখার দরকার নেই, ইঁদুর ধরতে পারলেই হল’৷ নতুন শতকের প্রথম দুই দশকের মধ্যে প্রায় ৫০ জন অর্বুদপতি সন্তানের জন্ম দিয়েছে মহাচিন৷ ঘটে গেছে তিয়ান আন মেন৷ প্রাক্তন রেডগার্ড ‘জিনপিং’-এর সুযোগ্য পরিচালনায় এবং বোল্ট পরিকল্পনায় চিনে আজ বিশ্বের প্রথম বা দ্বিতীয় শক্তিশালী পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ৷
প্রবীন বয়সের কুঅভ্যাস অনুসারে আবার বহু দূরে সরে এসেছি৷ সত্তরের দশকে নকশাল দমনের উদ্দেশ্যে এশিয়ার মুক্তিসূর্য বলেছিলেন ‘প্রতিটি নকশালকে শারীরিকভাবে খতম না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে৷’ তার তালে তাল মিলিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড দাশগুপ্ত বিগ্রেডের সভায় বলেছিলেন ‘পুলিশের বন্দুকের নলে কি নিরোধ লাগানো আছে? নকশালরা মরছে না কেন?’ তাঁরই সুযোগ্য পার্টিকর্মীরা কাশীপুর ও বরাহনগর গণহত্যায় শত ঘোষের বাহিনীকে সাহায্য করল বোরখা পরে নকশালপন্থী কর্মীদের বাড়িগুলি চিনিয়ে দিয়ে৷
যাইহোক রাজ্যে ‘নকশাল খমত’ শেষ হল। ১৯৭৫ সাল নাগাদ গণফৌজের বদলে জরুরী অবস্থায় আধাসামরিক বাহিনী মার্চ করতে লাগল৷ ১৯৭২-’৭৭-এর সেই নরবলির দিনগুলিতে, মায়ের পায়ে কত রাঙা জবার অর্ঘ্য নিবেদিত হল তা সিদ্ধার্থ শংকর থেকে, অমিয়, রঞ্জিত, বিভূতির দল হয়ত বলতে পারলেও পারত৷
সরোজ দত্তের কবন্ধ পড়ে রইল ভোরের ময়দানে, চারুবাবুর হত্যা হল লালবাজারে ওষুধের অভাবে। এই তন্ত্রসাধনার যজ্ঞকুন্ড থেকে উঠে এল রক্তলোলুপ পিশাচবাহিনী। বাহিনীর মহানায়ক প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, সুব্রত মুখার্জী, নির্বেদ রায়, সৌমেন মিত্র ইত্যাদি প্রভৃতি৷
নকশালরা খতম হলো বটে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে অনেকটাই পাল্টে দিয়ে গেল৷ ১৯৭৭-এ জরুরী অবস্থার চিতাভস্মের উপর পা ফেলে এবং জনতা পার্টির স্কন্দারূঢ় হয়ে ক্ষমতায় এলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)৷ গ্রামীণ ভূমি সংস্কার, বামফ্রন্ট রাজত্বের মুকুটের মণি, কিন্তু শুরু হয়েছিল কংগ্রেস রাজত্বের শেষ দিকেই৷ প্রাক্তন ভূমি ও ভূমি সংস্কার সচিব শ্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে বামফ্রন্ট আমলের বিপুল ঢক্কনিনাদ সত্ত্বেও পরিমাণগতভাবে গ্রামীণ ভূমি সংস্কারের অধিকাংশই ঘটেছিল ১৯৭৭ এর আগে৷ বরং ১৯৭৭ পরবর্তী মহামহিমান্বিত ‘বর্গা’র বন্টন করা কৃষিজমির সিংহভাগই নানা মামলা মোকদ্দমা মারফৎ ফিরে গিয়েছিল প্রাক্তন জোতদারদের হাতে৷ তার সঙ্গে নতুন জমির পাট্টা পাওয়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে না ছিল বীজ, সার, কীটনাশক কেনার পুঁজি, না ছিল উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা৷ ফলে ১৯৮৬-৮৭-র মধ্যে সেই আমড়াতলার মোড়৷ হু হু করে বেড়ে গেল ক্ষেতমজুর/ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা৷
গ
গ্রামের দিকে নয়া শাসকের উত্থান ও সংঘর্ষ
একথা বললে অন্যায় হবে না যে সাড়ে তিন দশকের চোখের মণির মতো বামফ্রন্ট শাসনে সবচেয়ে উপকৃত শ্রেণি হল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বামপন্থী বলে নিজেদের প্রচার করা সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষক-অধ্যাপকের দল৷ পরবর্তী দিনগুলিতে এরাই বামফ্রন্ট শাসনের প্রধান স্তম্ভ। কৃষক দরিদ্র হয়েছে, অসংখ্য কারখানা ঝাঁপ বন্ধ করেছে। Labour In West Bengal- এর পুরনো বার্ষিক সংখ্যাগুলি আর্কাইভ থেকে উল্টে দেখুন৷ দেখবেন কারখানা বন্ধ হওয়া ও শ্রমিকদের কর্মচ্যুতির মাত্র ১৫-২০ শতাংশের কারণ শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট৷ প্রায় ৮০ শতাংশই লকআউট এবং ক্লোজার, যার প্রায় পুরোটাই মালিকপক্ষের গা জোয়ারি৷ একদিকে শিল্পায়নের দুন্দুভি ও পুঁজির সন্ধানে প্রতি গ্রীষ্মে বিলাত যাত্রা আর অন্যদিকে চা বাগানগুলিতে হয়ে আসা অন্ধকার এবং ভয়াবহ মৃত্যু মিছিল, গঙ্গার দুপারে পাটশিল্পের অন্তর্জলী যাত্রা এবং দুর্গাপুর-হাওড়া শিল্পাঞ্চলে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের মৃত্যু৷ মাঝখানে ‘জেনে রাখো দিল্লীশ্বর, রক্ত দিয়ে গড়ব মোরা বক্রেশ্বর!’ সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ৷
এই দীর্ঘ ৩৪ বছরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও কম বিচিত্র নয়৷ দিল্লিতে ইন্দিরা হত্যার সহানুভূতিক ঝোড়ো বাতাসে বিপুল গরিষ্ঠতায় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর পাইলট পুত্রের ককপিটে চালকের আসন গ্রহণ এবং তাঁকে মধ্যমণি করে এক গুচ্ছ নবীন নেতার উত্থান৷ তার সঙ্গে ভারতবর্ষকে কনকর্ডে সওয়ার করে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি৷ এই সময় রাজ্যে সিংহাসনারূঢ় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সংঘর্ষ, বাঙালি অস্মিতার নামে রাজ্যের শাসক দলের শপথ এবং রাজনীতির এই শান্তি-সংঘর্ষের আবহে এক যুবনেত্রীর উত্থান৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ যাদবপুর কেন্দ্রে তাঁর চমকপ্রদ বিজয় এবং শ্রী রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভায় যুবকল্যাণ দপ্তরের উপমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে প্রবেশ৷
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি৷ সত্তরের দশক থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল অধিকার করে বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্রের বহুল ব্যবহার৷ চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ বলেছিলেন ‘বন্দুকের নল থেকেই বার হয়ে আসে রাজনৈতিক ক্ষমতা’৷ সত্তরের দশকে মাও-এর ভাবশিষ্যরা তা বিশ্বাস করতেন এবং সাধ্যমত প্রয়োগেও কসুর করেন নি৷ কিন্তু মাও এর এই মহার্ঘ্য বাণী অনেক বেশি আত্মস্থ করেছিল শত্রুশিবির৷ বন্দুকের ব্যবহারেই পুলিশ-আধাসামরিক ও সামরিক বাহিনি এবং তাদের পরিচালকরা নকশাল আন্দোলনকে দমন করে৷ রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে যথেচ্ছভাবে প্রাইভেট আর্মি, গুণ্ডাবাহিনী এবং তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মীদের (মূলত কংগ্রেস) সশস্ত্র করা হয়েছিল সরকারি উদ্যোগে৷
এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় বলতে গেলে ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’৷ আজ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনকে ঘিরে এবং নির্বাচন নিরপেক্ষ ভাবেও নরহত্যা, এলাকা দখল, দলীয় আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ অর্থাৎ ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা’৷ তার উৎস কিন্তু ৭০ দশকে৷ বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী নানা পরিসংখ্যান দিয়ে ও অন্তর্তদন্ত করে দেখিয়েছে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনে বিরোধী পক্ষের বা প্রতিবাদী মানুষকে হত্যার সংখ্যা সত্যি সত্যিই বিশাল। মরিচঝাঁপি, বিজনসেতু, চাঁদমনি চা বাগান, কলকাতা বন্দর, ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শান্তিপুর, করন্দা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ছোট আঙ্গারিয়া, নেতাই -ভারতচন্দ্রের ভাষায় ‘‘গুণিতে গেলে গুণের নাহি শেষ’’৷ আনন্দের কথা ২০১১ সালে পালাবদলের পর বহু অন্যায় এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও গণহত্যা ও সীসার বুলেটের দুঃস্বপ্ন সেইভাবে ফিরে আসেনি৷ অন্তত এখন পর্যন্ত৷
যাই যোক, প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে বাংলার রাজনীতি ক্রমশ অহিংসার নির্মোক ত্যাগ করে সহিংস হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখতে পাই যে অহিংস পথে কোনোদিনই সমাজ পরিবর্তন অথবা এক জাতি বা গোষ্ঠীর আধিপত্য থেকে অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর মুক্তি আসেনি। প্রাচীন প্রস্তর বা নব্য প্রস্তর, তাম্র বা লৌহ যুগের যে সব প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে একদিকে রয়েছে নানা ধরনের তৈজসপত্র আর অন্যদিকে রকমারী আয়ূধ – যা অবশ্যই শিকার অথবা কৌম সংঘর্ষে ব্যবহৃত হ‘ত। প্রাক ইতিহাস থেকে এগিয়ে এলেও প্রাচীন, মধ্য বা আধুনিক যুগের ইতিহাস মূলত গোষ্ঠী সংঘর্ষের ইতিহাস। এমনকি হিন্দু ধর্মের (যাকে বর্তমানে সনাতন ধর্ম বলা হচ্ছে) পূজ্য দেবদেবীরা নানা অস্ত্রে শোভিত, যুদ্ধ করতে অতি উৎসাহী। কেবল সমুদ্র মন্থনের অমিয় পানে অমর বলেই মারা পড়েছে মূলত দনুনন্দন দানব বা অসুরের দল। দেবতাদের মৃত্যুর খবর বড় একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রাচীন গ্রীক উপকথা থেকে, মহাভারত বা ইলিয়াড নহাকাব্য অস্ত্রের ঝনঝনানি, রক্তস্রোত ও হত্যাকাণ্ডে ভরপুর। মাত্র ১৮ দিনে দুই পক্ষের প্রায় ১৮ অক্ষৌহিনী সৈনিকের মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই আধুনিক যুদ্ধের চেয়ে কম ঘাতক নয়। পাঠকদের শুধু মনে করিয়ে দিই, এক অক্ষৌহিনী মানে ২১,৮৭০ টি রথ, সমসংখ্যক যুদ্ধহস্তী; ৬৫,৬১০ অশ্ব এবং ১,০৯,৩৫০ পদাতিক। আজ থেকে প্রায় দেড়-দুই-আড়াই হাজার বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা কতই বা ছিল? শুধু তির, গদা, ভল্ল ইত্যাদি দিয়ে যদি এই বিপুল পরিমাণ গণহত্যা সম্ভব হয়– তাহলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তো বলতেই পারেন কয়েকমাসে প্যালেস্তাইনে মাত্র ৩৫,০০০ ফিলিস্তিনি হত্যা, তাও আবার ভয়ঙ্কর সব ক্ষেপনাস্ত্র, অ্যাসল্ট রাইফেল ও বোমা দিয়ে – নিতান্তই শিশুক্রীড়া!
মধ্যযুগ তো রাজায় রাজায় হানাহানির ইতিহাস৷ তিন তিনটি ধর্মযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবিস্তার, অসংখ্য গণহত্যা, নাদির শাহ, তিমুর লেন (তৈমুর লঙ), কার্থেজের ইউরোপের দেশে দেশে আক্রমণ, শ্বেত হুনদের সাম্রাজ্য বিস্তার, ইউরোপে জাতি রাষ্ট্রের উত্থান ইত্যাদি প্রভৃতি৷ আধুনিক যুগ রক্তসিক্ত হয়ে আছে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক বোমানিক্ষেপ থেকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্বে৷ পদানত এবং উপনিবেশিক জাতিসমূহের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে উঠে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৪ কোটি সৈন্য ও নাগরিক৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৭ কোটি৷ ভিয়েতনামে মার্কিন ফৌজের হাতে ৬০ লক্ষ৷ বাঙলাদেশে খান সেনাদের হাতে ৩০ লক্ষ৷ ‘ফ্যাট ম্যান’ ও ‘লিটিল বয়’-এর ধাক্কায় সাথে সাথে ২ লক্ষ (তখন কিন্তু জাপান নতজানু হয়ে পড়েছে, বোমা ফেলার দরকার ছিল না)৷ তাহলে বেঞ্জামিন বাবুর আর দোষ কী? আমরা শান্তির মুখোশ পরেছি বলে?
রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর কোনোদিনই শান্তির পথে হয়নি, হতে পারে না৷ সেদিনও নয়, আজও নয়। অতএব আজকে রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল তথা নির্বাচনী সংগ্রাম যে সংঘর্ষ পূর্ণ, রক্তাক্ত, হিংস্র, আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ হয় হবে তাতে আর বিচিত্র কী? সেই প্রেক্ষিতেই আমাদের বিচার করতে হবে বর্তমান বাংলা তথা ভারতের অবস্থা।
ঘ
পালাবদলের পালা
পশ্চিমবঙ্গে পূর্বতন শাসকরা ঘোষিত গান্ধীবাদী ছিলেন না৷ নিজেদের মার্কসবাদী বলতেন৷ আসলে তাঁরা যে আদৌ কী ‘বাদী’ ছিলেন, তা সংজ্ঞায়িত করা মুসকিল৷ মার্কসবাদ মোতাবেক তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকের পক্ষে, সর্বহারার সরকার৷ কিন্তু ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হবার পর থেকে তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির এই প্রধান খণ্ডটি এমন কোনো বুনিয়াদি কাজ করেননি যাকে কমিউনিস্ট বা সমভোগতন্ত্রী বলা যায়৷ চীন ভারত যুদ্ধের সময় শোনা গিয়েছিল এঁরা নাকি চীনপন্থী৷ যদিও এঁদের দ্বিতীয় প্রধান নেতা তখন নিরাপদ মধ্যপন্থার আড়ালে আত্মগোপন করেছিলেন এবং একটি পত্রিকা বার করেছিলেন৷ পরে পুরোপুরি প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোনারদের সঙ্গে যোগ দেন৷ দুটি যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতার পর, প্রসাদজোতে কৃষক রমণীদের গুলিবিদ্ধ করার পর সিদ্ধার্থশংকরের ঘাতক বাহিনীকে নকশালদের হত্যায় সাহায্য করার পর, জনতা পার্টি ও জয়প্রকাশের আন্দোলনের ঘােড় চেপে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসীন হল৷ সেই চর্বিত চর্বনের প্রয়োজন নেই৷
১৯৯৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে রাজ্যে তৈরি হল ঘাসফুলের দল বা তৃণমূল কংগ্রেস৷ নেতৃত্বে শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৪ সালে সিপিএম এর দুঁদে নেতা শ্রী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে ইনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন৷ অচিরেই তাঁর অননুকরণীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধিতে ভূষিত হলেন; পরে সিপিএম-এর হামলায় গুরুতর আহত হওয়ায় তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব ঊর্ধ্বগামী হয় এবং রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভায় স্থান পান৷
কংগ্রেসের অাভ্যন্তরীণ রাজ্য সভাপতি নির্বাচনে শ্রী সৌমেন মিত্র কেন্দ্রীয় পার্টির মদতে তাঁকে অন্যায়ভাবে পরাজিত করেন৷ এইসময় সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেসের আঁতাত প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল৷ কংগ্রেসের নাম হয়েছিল তরমুজ - অর্থাৎ বাইরে সবুজ ভিতরে টুকটুকে লাল৷ দিল্লী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়তেন ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতি কীর্ণাহারের ব্রাহ্মণ তনয়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন এবং এখনও আছেন সার্বজনীন ‘দিদি’ হিসাবে৷ পূর্বতন শাসক ফ্রন্টের মহাসচিব শ্রী থুড়ি কমরেড অনিল বিশ্বাস ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন ‘উনি দিদি থেকে দিদিমা হয়ে যাবেন তবু মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না৷’ এই সময় থেকেই কিন্তু মার্কসবাদী পার্টি রজ্জুর মধ্যে সর্প দেখতে থাকে - মুখে অবশ্য মেকি ব্যঙ্গের হাসি ঝুলিয়ে রাখে৷ বন্যার জলের মতো মমতার প্রতি ধেয়ে আসে কটূকাটব্য, অশ্লীল শব্দবন্ধ৷ অসংসদীয় কদর্য্য ভাষা এবং শারীরিক আক্রমণ৷
জ্যোতিবাবুর নির্দেশে গুলিচালনায় ২১ জুলাই (১৯৯৩) নিহত হয় ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী (তখন মমতা কংগ্রেসের যুবনেত্রীই ছিলেন) ৷ নিজের পাতা ফাঁদে সিপিএম জড়িয়ে পড়ে৷ মুখে যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বা গালাগাল চলুক ঈশানকোণে মেঘ জমছিল৷ পলিটব্যুরোর কানে বাজছিল দৈববাণী
‘তোমারে বধিবে যে
গোকুলে বাড়িছে সে৷’
তারপর বয়োবৃদ্ধ জ্যোতিবাবুর অপসারণ৷ ভদ্রলোক সারা জীবন ভারতের শাসকশ্রেণীকে যে সেবা দিয়েছেন, তাতে অবশ্যই তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু কারাতগোষ্ঠীর কাঠিবাজিতে শেষ জীবনে এসে সেই রাজমুকুট তিনি পরতে পারলেন না৷ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে টগর বোস্টমীর কথা আছে, যিনি নীচু জাত বলে নিজের স্বামী সম্পর্কে বলেছিলেন ‘নিকে করেছি কিন্তু হেঁসেলে ঢুকতে দিই নি৷’
ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বহু দশক আগেই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কর্মসূচী ত্যাগ করেছে৷ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দেওয়াল লিখনও প্রায় ’৮০-র দশক থেকে আর দেখা যায় না৷ ক্ষমতার সিংহাসনের এক টুকরো পেতে আগ্রহী কারাতবাবুর দল কেন হঠাৎ টগর বোস্টমী সেজে জ্যোতিবাবুকে ‘ন্যায্য সম্মান’ থেকে বঞ্চিত করেছিল তা এক প্রহেলিকা৷ দেবেগৌড়া ও গুজরালের ক্ষণজীবী যৌথ মন্ত্রীসভায় অবশ্য সিপিআই প্রবেশ করলেও (ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ও চতুরানন মিশ্র) সিপিএম তাদের ‘সতীত্ব’ বজায় রেখেছিল৷ ওই টগর বোস্টমীর গল্পো৷
এরপর কেন্দ্রে ২০০৪ সালে উজ্জ্বল ভারতের ধ্বজাধারী বাজপেয়ী ও বিজেপির পরাজয়, আবার নানা কুনাট্য, সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে বিদেশিনী ইস্যুতে দিল্লি তোলপাড় এবং নরসিমহা রাও-এর অর্থমন্ত্রী ও উদার অর্থনীতির জনক মনমোহন বা মৌনমোহনজীর শিখণ্ডী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীত্ব৷ সোনিয়াজি হলেন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (UPA) এর অন্তরাত্মা, তস্য পুত্র শ্রীমান রাহুল যাত্রাদলের বিবেক এবং সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ছপ্পড় ফুঁড়ে ৬২টি আসন পেয়ে ঘোষণা করল ‘এই সরকার, আমরা দাঁড়াতে বললে দাঁড়াবে, বসতে বললে বসবে৷’ হ্যায়, কাদের যেন চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছা করে!!
২০০৪ থেকে ২০১৪ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র শাসন চলল কেন্দ্রে৷ আর পশ্চিমবঙ্গে দুইটি ধাপে হুড়মুড় করে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ল বুঁদির কেল্লা৷ ধাপ দুটির নাম সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম৷
এই ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনেকেরই জানা৷ পুনরুল্লেখ অপ্রয়োজনীয়৷ শুধু একটি বিষয় আমাকে বড় আশ্চর্য করে৷ ‘খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে, কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে৷’ দিব্যি তো একের পর এক উন্নত বামফ্রন্ট চলছিল৷ পঞ্চায়েত অস্ত্র, বিল্ডিং ও সামাজিক বয়কটের হুমকিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা, কেন্দ্রে বন্ধু সরকার, একমাত্র বিরোধী তৃণমূল তেমন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, বুদ্ধিজীবীরা জলপানি পেয়ে খাঁচায় পোরা, গ্রামে শ্বেতরক্ষী থুড়ি লালফৌজ মার্চ করছে, শহরে প্রোমোটার রাজ এবং বিপুল তোলা পার্টিফান্ডে জমা হচ্ছে, বিরোধী বা প্রতিবাদীদের জন্য খতম অভিযান, রাজারহাটে হাজার হাজার একর জমি দখল করে নিঃশব্দে নিউটাউন বানিয়ে ফেলা হয়েছে৷ তাহলে খামোখা বুদ্ধবাবু ‘শিল্পায়ন, শিল্পায়ন’ বলে হেড অফিসের বড়বাবুর মতো ক্ষেপে উঠলেন কেন? দিব্বি দিয়ে বলতে পারি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম না ঘটলে আরও একাদশ বামফ্রন্ট চলতো৷ তাহলে? রহস্যটা কী? কেন বুদ্ধবাবুর এই ‘শিল্পবিপ্লব’ এবং পতন?
ঙ
পতনের ‘প্রিলুড’
আমি আজও বহু চিন্তা করেও বুঝতে পারিনি যে কবি সুকান্তর ভ্রাতষ্পুত্র আদ্যন্ত পরিশীলিত চুল থেকে পাদুকা পর্যন্ত শ্বেতশুভ্র, মধ্যবিত্ত এবং আনন্দবাজারের নয়নের মণি কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রীত্বে আসীন হয়ে শিল্প স্থাপনার মতিভ্রম হলো কেন৷ দিব্যি তো একটি শিল্পে পিছিয়ে পড়া, দলীয় আধিপত্যবাদী, গ্রাম ও শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লায় পাইপগান, ওয়ান শর্টার এবং অগ্নিবন্দুক (মাননীয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ভাষা ধার করলাম) এর আধিপত্যে স্বতন্ত্র একটি রাজত্ব চালাচ্ছিলেন৷ বঙ্গপ্রদেশকে ভাগ করে দিয়েছিলেন মজিদ মাস্টার, পিনাকী, অনিল বসু (ওরফে মানিক রায়), অমিয় পাত্র, আবদুল রেজ্জাক মোল্লা, অশোক ভট্টাচার্য্য, বংশগোপাল চৌধুরী, লক্ষ্মণ শেঠ, সুভাষ চক্রবর্তী, শেখ শাহজাহান, সুজিত বসু, গৌতম দেব, হাতকাটা দিলীপ, কানকাটা সমীর, হুব্বা শ্যামলদের মতো ক্ষত্রপ, মহাক্ষত্রপ, সামন্ত ও মনসবদারদের মধ্যে৷ দখল হয়ে গেল নয়া উপনগরীর জন্য বিস্তির্ণ কৃষিজমি যার নাম নিউটাউন৷ দরিদ্র কৃষিজীবীদের বিঘা প্রতি ১০/১৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রায় ৯৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা কৃষিজমি, জলাভূমি, বনভূমি দখল করা হল উচ্চ মধ্যবিত্ত ও কর্পোরেট জগতের ডানা মেলবার জন্য৷ মোট মুনাফা যে কত কোটি টাকা তা ঈশ্বরই জানেন৷ সাদা ও কালো টাকায় এক বিরাট কেলেঙ্কারী৷ এই সময় শাসকদলের ইন্দ্রপতন ঘটল৷ চানক্য কমরেড অনিল বিশ্বাস নাস্তিকের স্বর্গে প্রয়াণ করলেন (উল্লেখ করি, তাঁর সুযোগ্যা বিদূষী কন্যা সম্প্রতি নাকি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন)৷ সিপিএম পার্টির গোঁড়া সমর্থকরা কেউ কেউ এখনও হা হুতাশ করেন যে কমরেড বিশ্বাসের ‘অকাল প্রয়াণ’ই সিপিএম-এর পতনের কারণ৷ নচেৎ এই শতকে সিপিএম ‘অজেয়’ হয়ে থাকত৷ নবারুণ ভট্টাচার্য্য কথা প্রসঙ্গে আমাকে একবার বলেছিলেন ‘‘অনিলবাবু যদি মার্কসবাদী পার্টির শ্রেষ্ঠ মনীষা হন, তবে পার্টির অবস্থা বোঝাই যাচ্ছে৷’’ অবশ্য এত পরিশীলিত ভাষায় বলেন নি, তাঁর অননুকরণীয় নিম্নবর্গীয় ভাষাতেই বলেছিলেন৷
সপ্তম বামফ্রন্ট ২০০৪ সালে সিংহাসনারূঢ় হল৷ চালক কমরেড ভট্টাচার্য। জ্যোতিবাবুর ট্রাম শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার, আত্মগোপনে থাকার এবং সংসদীয় বিরোধী নেতা হিসাবে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল৷ অভিজ্ঞতা ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখবারও৷ যেমন কেন্দ্রীয় পার্টিতে ই এম এস, রণদিভে, সুন্দরাইয়া, বাসবপুন্নিয়া, অচ্যুতানন্দ, গোপালন, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোনারদেরও ছিল৷ কিন্তু আজ এল কারাট, ইয়েচুরি ইত্যাদি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপের নেতৃত্ব৷ যারা কোনোদিন কোন কৃষক, শ্রমিক বা গণ আন্দোলনে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেননি৷ প্রকাশ কারাত সম্পর্কে একমাত্র বীরত্বপূর্ণ কাহিনী জানা যায় যে গ্রেপ্তারী এড়াবার জন্য জরুরী অবস্থার সময় এরিক হবসন-এর এই ছাত্রটি লরির খালাসি সেজে দিল্লি থেকে পলায়ন করেন৷
একই ভাবে কবি ও সাহিত্যিক নূতন মুখ্যমন্ত্রী কোনোদিন কোনো শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনে যোগ দেননি৷ তার সময় কেটেছে রজনী পাম দত্ত, জর্জ ব্লেক, ক্রিস্টোফার হিল, এরিক হবসনদের লেখা পড়ে৷ তার সঙ্গে মায়াকোভস্কি, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, পাবলো নেরুদা, সার্ত্র, কাফকা, মার্কেজ পড়ে৷ ইনিংসটা তিনি ভালোই শুরু করেছিলেন জ্যোতিবাবুর ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে বসেই তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাইকেল ভ্যানে চেপে কাঁচা ও কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামে, এক নির্যাতিতাকে সান্ত্বনা জোগাতে৷ চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল৷
নিকট অতীতে অনীতা দেওয়ানের যৌনাঙ্গে একটি টর্চ গুঁজে দেওয়া হয়েছিল৷ বঙ্গেশ্বর (নামটি বর্তমান পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক শ্রী বরুণ সেনগুপ্তের দেওয়া) স্থবির সুলভ নিরাসক্তিতে বলেছিলেন ‘এমন তো কতই হয়’৷ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে রাত্রে রোগী দেখতে বের হতে বামপন্থী সংগঠনের সদস্যা তরুণী সেবিকা ওই দলেরই সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত ও নিহত হন৷ শাসকদল তাঁর ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করেছিলেন তিন মাসের মাহিনা৷
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে কোনো প্রতিষ্ঠিত চা বাগানে চা গাছ উপড়ে ফেলা যাবে না৷ চাঁদমণি চা বাগানে কিন্তু উপনগরী তৈরী করার জন্য সমস্ত চা গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছিল৷ কৃষকদের উচ্ছেদ করে নিক্কোপার্ক এবং অ্যাকোয়াটিকার বিলাসের ব্যবস্থা করা নিয়ে কিছু প্রতিবাদ হলে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন ‘সব কিছু কি ভিখারির বাচ্চাদের মধ্যে করতে হবে নাকি৷’
এর মধ্যে নানা ঘটনা ঘটেছে যেসব ঠিক কমিউনিস্ট সুলভ তো নয়ই এমনকি বামপন্থী সুলভও নয়৷ দু’দুবার হাসপাতালে সুচিকিৎসার দাবিতে জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলন৷ অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী কমরেড বিনয় চৌধুরীর ভাষ্য- ‘বন্দুকের মুখে কাজ করাবো’৷ অযৌক্তিকভাবে ট্রাম বাস ভাড়া বৃদ্ধি৷ প্রতিবাদীদের (সি আই এ)-র চর বলে চিহ্ণিত করা ও মাধাই হালদারকে গুলিবিদ্ধ করা৷ হাসপাতালগুলির বেসরকারিকরণ ও বিশ্বব্যাঙ্কের নির্দেশে (Structural Adjustment Policy-র অন্তর্গত) সরকারি হাসপাতালে Usher's Fee চালু করা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং গণপরিবহণ ক্ষেত্রে ব্যাপক বেসরকারিকরণ৷
মজার বিষয় একই ঘটনা কেন্দ্রেও চলছিল এবং সে ক্ষেত্রে সি পি এম-এর জনপ্রতিনিধিরা মেকী তারস্বরে চিৎকারে গগন চূর্ণ করছিলেন৷ এর মধ্যে কিন্তু অন্ততঃ তিন বছর (দেবগৌড়া ও গুজরালের প্রধানমন্ত্রীত্বে) কেন্দ্রে ‘বন্ধু’ সরকার ছিল যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে৷
বাইপাসের দুধারে প্রায় বিনা পয়সায় বেসরকারি হাসপাতালকে জমি দান, নিরাময় পলিক্লিনিক আমরীতে রূপান্তরিত হওয়া, জে এন রায় টি বি হাসপাতালের ২৫ একর জমি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে রূপান্তরিত হওয়া, সেখানে ভর্তির মূল্য এখন ১ কোটি টাকার মত৷
’৮০-র দশকে সিটু রাস্তায় শুয়ে পড়ে সরকারি অফিসে কম্পিউটারের প্রবেশ রুখছিল৷ ফলে আইটি শিল্পের দক্ষিণে যাত্রা৷ গঙ্গার দুধারে আগরপাড়া, কামারহাটি, নৈহাটি, জগদ্দলে জুট মিলগুলিতে লাল বাতি জ্বলল৷ ছোট ছোট উৎপাদন শিল্পে সিটুর দাপটে বাঙালি শিল্পপতিরা ঝাঁপ ফেলে দিলেন৷ কিন্তু অগ্রবাল, কানোরিয়া, বাজোরিয়া, গোয়েঙ্কা-র দল ফেঁপে ফুলে উঠল৷ পি এফ, ই.এস.আই-এর কোটি টাকা অনাদায়ী, ন্যূনতম মজুরি প্রেতের অট্টহাসির মতো শোনায়; পাল্টি ও ঠিকা শ্রমিকদের কোনো অধিকার নেই৷ কারখানা আইন শিকেয় তোলা৷ ইচ্ছামত ক্লোজার আর লক আউট৷ কারখানার বন্ধ দরজায় লাল ন্যাকড়া টাঙিয়ে অভুক্ত শ্রমিকরা বিড়ি ফোঁকে দিনের পর দিন৷
উত্তরবঙ্গে চা বাগানেও একই চিত্র৷ সারা দেশের মধ্যে নিম্নতম মজুরী৷ মাঝে মাঝে গাড়ীর ধোঁয়া আর ধুলো উড়িয়ে শ্রমিক নেতার আগমন ও জ্বালাময়ী ভাষণ৷
প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে সি পি এম তথা বামফ্রন্ট জেতে৷ পঞ্চায়েত থেকে লোকসভায়৷ নন্দরানী দল - ৬ লাখ, অনিল বসু - ৫ লাখ৷ কিভাবে? প্রশ্ন করবেন না দয়া করে৷ (শেষাংশ পরবর্তী সংখ্যায়)