সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সৌজন্য প্রতিদিন।
“আসামে কোটি কোটি বাংলাদেশী অবৈধভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে”- এই মিথ্যে প্রচার একসময় সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছিল উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা এবং তাদের দোসর রাজনৈতিক দলগুলো । ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সিপিআই নেতা ও সাংসদ ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো ব্যক্তিও এই টোপ গিলে ফেলেছিলেন!
আসামে ডি ভোটার তৈরির প্রেক্ষাপট
১৯৬১ সাল
আসামে জনগণনা শুরু হলো। সেনসাস কমিশনার অব্ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ২, ২০,৬৯১ জন অনুপ্রবেশকারী পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে প্রবেশ করেছে। গোয়েন্দা বিভাগ এই তথ্য সমর্থন করে।
১৯৬৪ সাল
কেন্দ্রীয় সরকার ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল অর্ডার’ নামক আইন জারী করে। সারা দেশের জন্য এই আইন তৈরি হলেও একমাত্র আসামেই এই আইন মেনে বিদেশি নির্ধারণের লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে চারটি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল হয়। এবং ১৯৬৮ সালে সংখ্যা বেড়ে এগারোটি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় বিভিন্ন জেলায়।
১৯৭৯ সাল
১৯৭৯ সাল থেকেই শুরু হয় আসামে বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন। একই সময় ভোটার তালিকায় সংশোধনের কাজ শুরু হয়। আসাম ‘বিদেশি বিতাড়ন’ বা ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে সেই সময় উত্তাল আসাম রাজ্য!
১৯৮০ সাল:
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামে বিদেশি সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসলেন “আসু” (অল্ আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)’র সঙ্গে। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে নাগরিকপঞ্জী নবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ১৯৭১ সাল ২৪ মার্চকে ভিত্তিবর্ষ করতে হবে কেননা সেই সময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আন্দোলনকারীরা তা মেনে নেয়নি।
১৯৮৩ সাল
ইন্দিরা গান্ধী আসামে “দ্য ইললিগ্যাল মাইগ্রেন্টস্ ডিটারমিনেশন অ্যাক্ট” (IMDT) প্রণয়ন করেন। এই আইনে একজনের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়িত্ব সেই ব্যক্তির ওপর থেকে সরিয়ে রাষ্ট্র, পুলিশ ও অভিযোগকারীর ওপর অর্পণ করা হয়।
১৯৮৫ সাল ১৫ আগষ্ট:
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে ‘আসু’, ‘আসাম গণ পরিষদ’- এর মধ্যে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয় যা “আসাম চুক্তি” নামে খ্যাত।
১৯৮৫ সাল ৭ ডিসেম্বর:
আসাম চুক্তির ৫ নং দফাটিকে আইনি মর্যাদা দিয়ে ‘নাগিরকত্ব আইন, ১৯৫৫’-তে নতুন ৬(ক) ধারা হিসেবে সংযোজন করা হলো, যা শুধু আসামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আসামে আগতদের নাগরিকত্ব নির্ণয়ের বিশেষ ভিত্তিবর্ষ ও তারিখ নির্ধারিত হয়। ১৯৬৬, ১ জানুয়ারিতে মূল ভিত্তির তারিখ ধরা হয়। ওই তারিখের আগে পর্যন্ত যারা আসামে এসেছে, তারা আসামের মূল নাগরিক।
১ জানুয়ারি, ১৯৬৬-র পরে কিন্তু ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখ আসামে আসা চিহ্নিত হবেন ‘Stremlined Foreigner’ হিসেবে। এরা নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য Foreigner Regional Registration Office-(FRRO) এ আবেদন করলে আসামে থাকতে পারবেন কিন্তু দশ বছর ভোট দিতে পারবেন না। তবে Stremlined Foreigner- দের শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, ব্যবসাসহ অন্য সব নাগরিক অধিকার অটুট থাকবে।
২৪ মার্চ, ১৯৭১-এর মধ্যরাতের পর পর যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তাদের বিদেশি বলে ঘোষণা করা হবে এবং বাংলাদেশে না পাঠানো পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে।
১৯৯৭ সাল ১৭ জুলাই
ভারতের নির্বাচন কমিশন সার্কুলার জারি করে অ- নাগরিকদের সনাক্ত করে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেন।এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের তালিকাভুক্ত করবার জন্য বাড়ি বাড়ি জরিপের কাজ শুরু হয়। সেই সময় যারা নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন ভোটার তালিকায় তাদের নামের আগে “D” চিহ্ন জুড়ে দেওয়া হয়।‘D’ অর্থে ‘Doubtful voter’। এই পর্যায়ে প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ব্যক্তিকে ডি- ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই থেকে ডি -ভোটার অধ্যায়ের সূচনা হয় আসামে। ডি-ভোটারদের ভোটে দাঁড়ানোর এবং ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ডি -ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল করার নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় সরকার। এই মুহূর্তে আসামে মোট ১০০ টি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আছে।
ডি - ভোটাররা নোটিশ পাওয়ার পর যারা ভারতীয় প্রমাণ করতে পারেনি তাদের মধ্যে বহু নাগরিকদের আসামের ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল—কোকরাঝাড়, তেজপুর, যোরহাট, গোয়ালপাড়া, শিলচর ও ডিব্রুগড়। দুই - তিন বছর থেকে শুরু করে দশ- বারো বছর ধরে অনেকেই বন্দিজীবন কাটিয়েছেন এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে।
আসামে ‘ঘোষিত বিদেশিদের' এক সময় ‘পুশ ব্যাক’ করা হতো। সেই সিস্টেম ২০১৩ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। কিন্তু তারপর থেকে বাংলাদেশ সরকার সেই ‘পুশ ব্যাক’ সিস্টেমের বিরোধিতা করে এবং জানায়, আদৌ ‘ডি ভোটাররা' বাংলাদেশের নাগরিক ছিল কী না যাচাই না করে ডি ভোটারদের বাংলাদেশে স্থান হবে না।
এদিকে উগ্র অসমিয়া জা্তীয়তাবাদী দল দেখতে পাচ্ছিল ডি- ভোটারদের সংখ্যা বড়জোর তিন লক্ষ হচ্ছে! তাহলে বাকিরা (কোটি কোটি) গেল কোথায়? আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদ দল( আসু, আসাম গণ পরিষদ, অসমিয়া কংগ্রেস, অসমিয়া বিজেপি, রাইজর দল) উঠে পড়ে কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারকে দিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩ পাশ করালেন। এতে ১৯৫৫ সালের মূল নাগরিকত্ব আইনে আরো অন্য ধারার সঙ্গে ১৪(ক) ধারা যোগ হয়, যার মাধ্যমে দেশে নাগরিকপঞ্জী বা নবীকরণের আইনি বিধান পায়। এই আইন বাধ্যতামূলকভাবে সকল ভারতীয় নাগরিকদের নাম ও বিবরণ পঞ্জীকরণের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রদানের অধিকার সরকারকে দেয়। এনপিআর – এনআরসি’র রূপরেখা এই আইনের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। এই আইন পাশ হওয়ার পরেই আন্দোলনে মুখর হন অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা। ২০০৫ সালে আসু'র সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠকে আসামে নাগরিক পঞ্জী নবায়নের সম্মতি জানায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। প্রায় দু’বছর পর নবায়ন প্রক্রিয়া কীভাবে হবে, কংগ্রেসের তরুণ গগৈ সরকার ২০০৮ সালে একটি কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠায়। এরপর ২০০৯ সালে ‘ পাবলিক ওয়ার্কস কমিটি ‘ ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জী নবায়নের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায় করে। সেই মামলাকে ইন্টারভেনশন পিটিশনের মাধ্যমে বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই নাগরিক পঞ্জী নবায়নের মামলায় যুক্ত হয়ে জোর কদমে আইনি রূপদানের পথে এগিয়ে যান, যার ফলশ্রুতি ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া সার্কুলার জারি করে আসামে নাগরিক পঞ্জী নবায়নের সূচনা করেন।
এই হচ্ছে তরুণ গগৈ সহ বাকি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, বাজপেয়ী সরকার ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈর পরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান ‘আসামে কোটি কোটি বাংলাদেশী খোঁজা’ এনআরসি’র মাধ্যমে!
‘অরাজনৈতিক আসামবাসী’ বুঝতেই পারলো না কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্র তৈরি করতে যাচ্ছে এই এনআরসি'র মাধ্যমে। এবং পরবর্তীতে তাই হয়েছিল।
এনআরসি’র প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ৯০ লক্ষ মানুষের এনআরসি থেকে বাদ পড়েছিল। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ৯০ লক্ষ মানুষ নথিপত্রের সন্ধানে রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বে্রিয়েছেন, কবেকার হারিয়ে যাওয়া নথিপত্র জোগাড় করতে গিয়ে নিজেদের উপার্জিত অর্থ খরচ করতে হয়েছে! কত মানুষকে পথে বসিয়েছে! ভয়ে আতঙ্কে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা খুব খুশি। বাঙালি সহ অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর ওপর এই শারীরিক মানসিক আর্থিক নির্যাতন তারা চেয়েছিল। সেদিক থেকে তারা সফল।
এরপর ২০১৮ সালে ৩০ জুন দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর এনআরসি ছুটদের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪০ লক্ষ। সেই সময় দেখা গেল, প্রথম খসড়া তালিকায় যাদের নাম এসেছিল দ্বিতীয় খসড়ায় তাদের নাম নেই! এর মূল কারণ ছিল একই লিগ্যাসি কোড বিভিন্ন পরিবার ব্যবহার করেছিলেন ভুলবশত।
লিগ্যাসি কোড বা লিগ্যাসি ডাটা
আসামে নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত। ১৯৭০ সাল এবং তার আগের ভোটার তালিকা সরকার সমস্ত জেলা থেকে সংগ্রহ করে ডিজিটালাইজ করেছিল এবং এই কাজের দায়িত্বে ছিল WIPRO সফটওয়্যার কোম্পানি। এনআরসি ফর্ম পূরণ করার সময় আপনার পূর্বসূরীর ভোটার তালিকায় নাম বের করতে হবে এনআরসি সেন্টার বা ক্যাফের মাধ্যমে। কম্পিউটার থেকে ভোটার তালিকা বের হয়ে গেলে তালিকার নিচের দিকে একটি কোড জেনারেট হয়। সেটাই লিগ্যাসি কোড বা লিগ্যাসি ডাটা। সেই এক-ই কোড বেশকিছু মানুষ ব্যবহার করার ফলে ৪০ লক্ষ মানুষকে দাবি ও আপত্তি -র সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
ভেরিফিকেশনের নামে বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক দফায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে এনআরসি কেন্দ্রে ডাকা হয়। এতে শুধু ৪০ লক্ষ নয়, পরিবারের মধ্যে যাদের নাম ছিল তাদেরও মানসিক অবস্থা খুব খারাপের দিকে চলে যায়! এই ভেরিফিকেশনের পেছনে ছুটতে গিয়ে জনসাধারণের প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।
আসামের এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পেলো ২০১৯ সালের ৩১ আগষ্ট। এতে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম বাদ পরলো। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী পরিবার সেই সংখ্যা মেনে নিতে পারলো না! কোটি কোটি বাংলাদেশী খোঁজ করতে গিয়ে নিজেদের তৈরি করা এই কঠিন ও অসম্ভব কাগজপত্র জোগাড় করার সিস্টেম ব্যবহার করেও মাত্র ১৯ লক্ষ! চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার দু’দিন পরেই আসামের এনআরসি কোর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা গৌহাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিজেপি সহ তাদের দোসররা বললো, এই এনআরসি তালিকা ভুল। এই এনআরসি মানিনা। উগ্র অসমিয়ারা বলতে শুরু করলো, প্রচুর বিদেশিদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় এসে গেছে। প্র্তীক হাজেলা বলেছিলেন, ‘সব মিথ্যে, কোনও বিদেশির নাম নেই এনআরসিতে!’ এনআরসি নিয়ে আসাম সরকার বা বিজেপি সরকার যাই বলুক না কেন, আমাদের দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রবিশ কুমার ২০১৯ সালে এক সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এনআরসি’র এই প্রক্রিয়াকে ‘বিধিবদ্ধ’, ‘স্বচ্ছ’ ও ‘আইনি প্রক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছিল।
১৯ লক্ষ এনআরসি ছুটরা আটকে আছে কেন?
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আসামের এনআরসি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক ছিলেন রঞ্জন গগৈ, যিনি ছিলেন আসামের এনআরসির ভয়াবহতা তৈরি করার মাস্টার মাইন্ড। সেই ৪০ লক্ষ মানুষ যখন দাবি জানানোর কথা ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট, সেই দাবি - আপত্তির স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (Standard Operating Procedures বা SOP) তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আসাম সরকার ও এনআরসি অথরিটি (বকলমে রঞ্জন গগৈ)! তাদের তৈরি করা SOP সুপ্রিম কোর্ট শিলমোহর দেয়।
বিদেশি ট্রাইব্যুনালকে আরো শক্তিশালী করার জন্য ১৯৬৪ সালের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের আদেশ সংশোধন করা হয়েছে গত ৩০ মে, ২০১৯ সালে। সংশোধনের ১০ নং পয়েন্ট নিয়ে আপত্তি তুলেছে আমসু (All Assam Minority Students Union) । কী আছে এই দফাতে? “নাগরিকপঞ্জী থেকে যাদের নাম বাদ পড়বে, তারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করবেন। এবার আবেদনের কোনো ভিত্তি বা Merit আছে কী না তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। মামলার ভিত্তি থাকলেই জেলাশাসক এবং আবেদনকারীদের ডাকানো হবে। আর যদি কোন ভিত্তি নেই বলে মনে করেন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা, তাহলে কিচ্ছু করার থাকবে না আবেদনকারীদের । সোজা ফরেনার ডিক্লেয়ার করে দেবে এবং তারপর ডিটেনশন ক্যাম্পে। তারপর বাঁচতে হলে হাইকোর্টে মামলা করতে হবে।
আগেই বলেছি, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা কীভাবে ভারতীয়দের ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে। সেই ক্ষেত্রে স্বদেশী ঘোষণা করতে টাকার লেনদেন হবে কী না জানি না!!
এবার ১৭ নং পয়েন্ট কী বলছে? — “বিচার প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করতে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলিকে ‘নিজস্ব পদ্ধতি’ প্রয়োগের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। বিপজ্জনক স্বাধীনতা। ওরা নিজেদের খুশি মতো নিজস্ব পদ্ধতি চালাবে এবং হয়তো বেশিরভাগ মানুষকে বিদেশি ঘোষণা করবে। খেয়াল রাখতে হবে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের মেম্বার পদে চুক্তিবদ্ধ নিয়োগ।
এই দুই পয়েন্টের সংশোধন দরকার। দরকার বয়সের হেরফের, দু-একটি কাগজপত্র নেই বলে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে দেওয়া, সেটা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না।
আমসু ১০ নং এবং ১৭ নং পয়েন্ট – এর সংশোধন চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব, মূখ্য বিচারপতির কাছে চিঠিও দিয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টেও কেস ফাইল করেছে। কেস নং ৮৬৩/ ২০১৯। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে রঞ্জন গগৈ অবসর নেয়। অবসর নেওয়ার আগেই SOP তৈরি ও ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অর্ডার সংশোধন করেন রঞ্জন গগৈ। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক হলেন চন্দ্রচূড়। আমসু'র ১৭ নং পয়েন্ট ঠিকঠাক করলেও ১০ নং পয়েন্ট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এখনও পর্যন্ত কিছু বলেনি। আমসুর এই কেসের সাথে জামাতও শরীক হয়।
আসামের এনআরসির চূড়ান্ত তালিকাকে রাজ্য সরকার প্রচার করছে, এই তালিকা খসড়া। অথচ আসামের এনআরসির ওয়েবসাইট থেকে বলছে এটাই চূড়ান্ত তালিকা।
আসামের এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার পর সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা যায়, ১৩ লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ গেছে, ১.৫ লক্ষ গোর্খা, ১ লক্ষ অসমিয়া, প্রায় ৩ লক্ষ বিভিন্ন আদিবাসী যার মধ্যে চা জনজাতি, বড়ো,মিসিং, নাগা, রাভা, মনিপুরী, রেলওয়ে কলোনির হরিজন সহ আরও আদিবাসী যাদের সঙ্গে বাংলাদেশে আসা যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই! ১.৫ লক্ষ শিশুদের নাম বাদ পড়েছে যেখানে মা-বাবার নাম এনআরসিতে আছে, অথচ SOP তে উল্লেখ ছিল ১৪ বছরের নিচে শিশুদের নথিপত্র না থাকলেও চলবে। উপরোল্লিখিত সংখ্যার কোনো সরকারি রিপোর্ট নেই। সেই সময় সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকেই জানা। তবে, সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের নাম না আসেনি। স্বাধীন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দীন আলি আহমেদ এবং সঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাতি নাতনিদের নাম আসেনি।
বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বুঝতে পারছেন সবাইকে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হলে আগামী ১০০ বছরেও শেষ হবে না। এনআরসি তে বাদ পরার মধ্যে শুধুমাত্র নিপীড়িত জনগণ নয়, অনেক স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নামও বাদ পড়েছে। তারা প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারে সেই কারণগুলোর জন্যই হয়তো সুপ্রিম কোর্ট, রেজিস্ট্রার জেনারেল অব্ ইন্ডিয়া বা কেন্দ্রীয় সরকার কোনো রকম পদক্ষেপ নিতে অপারগ!
আসামে এনআরসি করে কেন্দ্রীয় সরকারের লাভ হয়েছে। এনআরসির মাধ্যমে আসামে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে বিজেপি সরকার। মাত্র ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে নাকানিচুবানি খাওয়ানো গেল আসামের মানুষদের। ২০১৫ থেকে ২০১৯ – এই চার বছর আসামের নাগরিক “এনআরসি সিন্ড্রোম “ রোগে আক্রান্ত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আসাম হচ্ছে ‘ টেস্টিং ল্যাবরেটরি।‘ তাই সারা দেশে এনপিআর – এনআরসি করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। মাত্র একটি ঘোষণা করার মাধ্যমে সারা দেশকে তোলপাড় করে রাখা যায়। তবে, এনআরসি করে আসামের বাঙালিদের একটি লাভ হয়েছে – “কোটি কোটি বাংলাদেশী আসামে ঘুরে বেড়াচ্ছে’’ এই অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারের সুপ্রিম কোর্টে কেসের মধ্যে বাংলাদেশে “পুশব্যাক” বিষয়টিও উঠে এসেছিল। সমস্যায় পড়ে গেছিল সেই সময় সর্বানন্দের বিজেপি সরকার। কেন?
প্রথম কারণ:
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে আট তারিখে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি দীপক গুপ্ত ও সঞ্জীব খান্না, আসাম সরকারকে হাজির হতে বলেছিল সুপ্রিম কোর্টে। মূল বিষয়: আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিদের নিয়ে আসাম সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ জানা! সরকারের প্রতিনিধি হয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা সেখানে গিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারায় চরম ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছিল তুষার মেহেতাকে। আদালতের কড়া অবস্থানে অস্বস্তিতে পড়েছিল সেই সময়ের সর্বানন্দ সরকার! আসামে বিদেশিদের শনাক্ত করে বহিষ্কারের প্রক্রিয়াটা কতটা ঠুনকো, হর্ষ মন্দারের সুপ্রিম কোর্টের কেসে সরকারের তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। আসলে দেশ থেকে কাউকে বার করে দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের, আসাম সরকারের নয়।
দ্বিতীয় কারণ
একজন বন্দিকেও বা জাতীয়তাবাদীদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘অনুপ্রবেশকারী’- দের বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব বা সাহস হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের। তার কারণ, বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, ভারতে তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে বসবাসকারী লোকদের বাংলাদেশ সরকার নেবে না।
তৃতীয় কারণ
ভবিষ্যতে ডি ভোটার মামলায় যাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নিক্ষেপ করা হবে তাদের দু’বছর পর ছেড়ে দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুযায়ী।
চতুর্থ কারণ:
আসামে গোয়ালপাড়া জেলায় মাতিয়া নামে একটি জায়গায় ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। সরকার “দোষী সাব্যস্ত বিদেশি” (convicted foreigner)- দের কিছু সময়ের জন্য নতুন ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখতে পারে, কিন্তু যেই ডি - ভোটারদের বিদেশি ঘোষণা করে সেই ডিটেনশন ক্যাম্পে গণহারে পাঠানো হবে, খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চলে আসবে অর্থাৎ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে। এমনিতেই ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যক্তিদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছিল, বিশেষ করে দুলাল পাল,রতন চন্দ্র বিশ্বাস, মোমিরান নেসা, চন্দ্র ধর দাস, মিনারা শাহনারা বেগম সহ আরো অনেকের ভিডিও ক্লিপিং, সর্বভারতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে যাওয়ায় আসাম সরকারকে প্রচুর হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল! সর্বত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করায়, আসাম সরকারের এই একটি মাত্র ইস্যুতেই ল্যাজেগোবরে অবস্থা! বিজেপি সরকারের এই বৈরি পলিসির জন্য অসমিয়াভাষী জনগোষ্ঠী সারা পৃথিবীতে নিন্দিত হচ্ছিল!
ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি ও তারপর –
সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার পর আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গেই আছে। বেশিরভাগ ব্যক্তিরা বিবাহিত হওয়ায় তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই দিনযাপন করছেন। তাদের কষ্ট একটাই, প্রতি সপ্তাহে একবার তাদের স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে হয় জামিনের শর্তানুযায়ী। তার মানে তারা আসামে তাদের পরিবারের সঙ্গেই রয়ে গেছেন। তারা তাদের মত করেই জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে নিজেদের বাসস্থানে রয়েছেন, কেউ আবার মারাও গেছেন, কেউ কেউ আবার পরিবার চালানোর জন্য অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করছেন।
অর্থাৎ দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তারা আসামেই থেকে যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী । তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি?
১) ফরেনার্স ট্রাইবুনাল থেকে ডি ভোটারদের নোটিশ
২) কোর্ট কেসে হেরে যাওয়া
৩) সেই ব্যাক্তিদের বিদেশি ঘোষণা ও ডিটেনশন ক্যাম্পে নিক্ষেপ
৪) দুই বছর পর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি ও পরিবারের সঙ্গে থাকা।
৫) সেই ঘোষিত বিদেশিদের আসামেই অর্থাৎ ভারতেই থেকে যাওয়া।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে আসামে ডি ভোটার তৈরি করার পর বিদেশি ঘোষণা করে ১৯৭১ সালের পরে আসা ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ যখন বাংলাদেশে পাঠানো যাচ্ছে না, তাহলে মিছেমিছি এই হেনস্তা এবং সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করার দরকার আছে কি? একশো’টা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের পেছনে অনর্থক অর্থব্যয় হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না? ফরেনার্স ট্রাইবুনালের একেকজন মেম্বার (বিচারক) মাসে এক লক্ষ টাকা মাইনে সহ সরকারি গাড়ির ব্যবস্থা। তার ওপর অন্য ফরেনার্স ট্রাইবুনালের কথা জানি না, কিন্তু শিলচর ফরেনার্স ট্রাইবুনালে তো নাগরিকত্ব বিক্রি হয়! পশ্চিমবঙ্গে ডি-ভোটার তৈরি হলে সেখানেও তাই হবে!
আসামে এই মূহূর্তে আছে ১০০ টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। ১০০ জনের মেম্বারদের মাসিক বেতন এক কোটি টাকা (১০০ ×এক লক্ষ) । বছরে ১২ কোটি টাকা । বাকি কর্মচারী নিয়োগ, ঘরভাড়ার খরচ তো নেহাৎ কম নয়! শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের পরে আসা বিদেশিদের খুঁজতে এতো খরচ! নিট রেজাল্ট তো জিরো!
কেউ হয়ত বলবেন, কেন্দ্রীয় সরকার সস্তাশ্রম তৈরি করার জন্য এতকিছুর সাজ সরঞ্জাম! কিন্তু এটাতো কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হতে পারে না। যেহেতু সারা দেশে নাগরিকত্ব বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্টিকরণ দিক তারা দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে কী করতে চায়। সরকার যেটা বলে, To find out illegal migrants and to deport them in their respective Countries “– সেটা তো ডাহা মিথ্যে কথা! এই বিষয় গুলো তুলে ধরতে হবে বিভিন্ন সভা সমিতিতে, জনগণের দরবারে, এরপর রাজ্যসভা ও লোকসভায়। । এবং আসামে ডি ভোটার তৈরির প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে উপরোক্ত যুক্তিগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তুলে ধরে। আসামের রাজনৈতিক দল ও নেতা লবিদের দলীয় নাড়া বাঁধা। স্বাভাবিক মানবিক বোধ সম্পন্নরা অন্যরাজ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে জনমত গড়ে তুললে আসামের অনেকেই সোচ্চার হবেন।