সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
চিন্তা রবি স্মারক বক্তৃতা
২০ জুলাই ২০১৪, কোঝিকোড়ে যোগেন্দ্র যাদবকে ‘চিন্তা রবীন্দ্রন’ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। এর আগে যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন পি. সাইনাথ এবং আকার প্যাটেল।
সুপরিচিত কার্টুনিস্ট ই পি উনির যোগেন্দ্রর হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
আজকের ভারতে ‘বাম’ বলতে আমি কী বুঝি সেই কথাটাই আজ উপস্থাপনা করব। বিশেষ কিছু কারণে এটা আমার কাছে শুধু একটা একাডেমিক জিজ্ঞাসা নয়, রাজনৈতিক প্রশ্নও। যবে থেকে আমার ‘এই চলা’র শুরু, সেই সময় এই ‘চলন’ ‘বাম’ হিসাবে গণ্য করা হত না। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ আমি জেএনইউ’র ছাত্র। যুক্ত ছিলাম একটি সমাজতান্ত্রিক দল, ‘সমতা যুবজন সভা’র সঙ্গে। রাজনৈতিক গুরু ছিলেন, কিষাণ পট্টনায়ক, যাঁকে আপনারা ‘লোহিয়াইট’ ধরনের সমাজতান্ত্রিক বলতে পারেন। এরপর ১৯৮০-র দশকেই, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন – ‘সমতা সংঘ’-এ যোগ দিয়েছিলাম। সংগঠনটি পরবর্তী সময়ে ‘সমাজবাদী জন পরিষদ’ নামে একটি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সংস্থার রূপ নেয়। প্রধান ছিলেন কিষাণ পট্টনায়কই। আমরা ‘বাম’বলে অভিহিত হতাম না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখছি আমাকে ‘বাম’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আমি পরিবর্তিত হয়েছি এমন কিন্তু নয়। পরিবর্তন ঘটে গেছে পরিবেশ আর রাজনৈতিক আবহাওয়ায়। পদ্ধতি ও চরিত্রায়নের এমন অনায়াস রূপবদল একমাত্র এই ভারতেই সম্ভব। বছর ২৫ আগে এমনটি ঘটলে ব্যাপক হাসাহাসি হ’ত।
আপনারা তো জানেনই, পুরানো মতাদর্শগত মহাবিশ্বে ‘উদার বাম’ এমন শব্দবন্ধ কোনো অর্থ বহন করত না। কেমন করে একইজন ‘বাম অথচ উদার’ হতে পারেন? হয় আপনি ‘বাম’ অথবা ‘উদার’। কিন্তু আজ আপনি এই ধরনের অভিব্যক্তি শুনতে পান। প্রথম প্রথম আমার বেশ মজা হ’ত, তারপর একসময়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। আমার মনে হ’ল, হয়ত এই শব্দবন্ধ সমসময়ের কোনো বৈশিষ্ট্য বহন করছে। এবং যতই আমি এ নিয়ে চিন্তা করি ততই অনুভব করি যে আমাদের সময়কালে ‘বাম’ শব্দটির অর্থ পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন।
দুদিন আগে চেন্নাই-এ আমি ২০২৪ সালের নির্বাচনী রায়ের প্রভাব নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানকার সব কিছু পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র মিনিট কয়েক আগে, পরিচিতি দেওয়ার সময়, মিঃ জনি আমার সেদিনকার ভাষণের একটি বাক্যাংশ উদ্ধৃত করলেন। সেদিন আমি বলেছিলাম, ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিক) শেষ হয়ে গেছে। আমি মনে করি, ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে উদ্বোধিত ভারতের প্রজাতন্ত্রটি ২০১৯ সালে শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র এখনও জন্মগ্রহণ করেনি এবং আমরা আজ একটি ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ দাঁড়িয়ে আছি। ২০২৪ সালের নির্বাচন চমৎকার কোনো দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়নি বটে, তবে ভাগ্যক্রমে আমাদের সেই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষা করেছে। আমাদের জন্যে স্বস্তির একটি ছোট্ট জানালা ওই ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ খুলে দিয়েছে। শুধু আগামী ৫ বছরের জন্য নয়, আগামী কয়েক দশকের জন্য ভারতকে রূপান্তরিত করার এটি এক সংকট মুহূর্ত।
এই মুহূর্তে ‘বাম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যদি তারা তাদের কমিউনিটির সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে এবং গোটা কমিউনিটিকে অপেক্ষমান ওই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে পুনঃসংবদ্ধ করে। তাই আমি শুধুমাত্র অর্থ আবিষ্কারে আগ্রহী নই। আমি আগ্রহী মিশন নির্ধারণে। এটা যে অত্যন্ত ব্যবহারিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্যের প্রশ্ন, সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চয়ই একমত হবেন।
শুরুতেই দুটো প্রাথমিক আপত্তির নিষ্পত্তি করা যাক। প্রথমেই যে আপত্তির মুখোমুখি হতে হবে সেটা হ’ল, এই ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন, ‘বাম’ কি ইতিমধ্যেই মৃত নয়? মূলধারার মিডিয়ায় আপনি এইরকমই শুনতে পাবেন। এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও। তারা বলে ইউএসএসআর’র পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘বাম’ মারা গেছে। আরও বলে, বাম রাজনৈতিক দলগুলিকে যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, চূড়ান্ত পতনের অবস্থায় রয়েছে। আপাতত এরা দেশের ছোট ছোট পকেটে সীমাবদ্ধ এবং আপনি জানতেও পারবেন না কখন এরা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে! এদের নিয়ে ভাবছেন কেন?
আমার দুটো উত্তর আছে। এক, আমি মনে করি আজকের ভারতে ‘বাম’ উপস্থিতি, সংগঠিত ‘বাম’ রাজনৈতিক দলগুলির দৃশ্যমান নির্বাচনী উপস্থিতির চেয়ে অনেক গভীর। ছোট সংখ্যার ওপর আমার একটা তত্ত্ব আছে। তত্ত্বটি হ’ল জনজীবনে ছোট সংখ্যা বিশাল ভূমিকা পালন করে।
আমি প্রায়শই পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কথা ভাবি। পাঞ্জাবের জনজীবন, হরিয়ানার জনজীবনের চেয়ে খুবই আলাদা এবং এটা শুধু এই কারণে নয় যে পাঞ্জাব একটি শিখ রাজ্য। না, এটি আসল কারণ নয়। পাঞ্জাবের জনজীবন হরিয়ানার জনজীবনের চেয়ে খুব আলাদা, যদিও উভয়ই এক শিকড় থেকেই উদ্ভূত। পার্থক্য জাতিগত নয়। সেই ‘গদর’ আন্দোলন থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং নকশাল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পাঞ্জাবের রূপান্তর ঘটেছে, শুধুমাত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে নয়, স্পষ্ট হয়েছে ‘বাম’ ঝোঁক। আজ আপনি পাঞ্জাবে কমিউনিস্টদের প্রায় দেখতেই পাবেন না, তবে পাঞ্জাবের সাহিত্য যদি দেখেন, যদি আপনি পাঞ্জাবের কবিতা দেখেন, যদি আপনি পাঞ্জাবের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দেখেন, যদি আপনি পাঞ্জাবের একাডেমিক কাজ দেখেন, তবে আপনি হরিয়ানার তুলনায় একটি গুণগতভাবে ভিন্ন প্রকৃতির কাজ পাবেন। ‘বাম’ উপস্থিতি খুবই কম, কিন্তু তার বিচরণ অনেক গভীরে ব্যাপ্ত। জনসংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে, বিশেষ আকৃতিও দিয়েছে। তেলেঙ্গানায়ও আমি এটা অনুভব করি। যদিও অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘বাম’ আজ প্রায় অপ্রাসঙ্গিক।
সুতরাং এক, ‘বাম’ মৃত নয় কারণ এর এক গভীর উপস্থিতি রয়েছে, দ্বিতীয় এবং সেটাই আমার আসল পয়েন্ট, ‘বাম’ উপস্থিতি বেশ ব্যাপক। ‘বাম’ এর সম্ভাব্য ব্যাপ্তি ‘স্ব-স্বীকৃত’ ‘বাম’ এর চেয়ে অনেক বেশি। এই পয়েন্টটি বিশদে ভাবা যাক। ‘বাম’ আছে, ছাপ মারা ‘বাম’ ছাড়াও। যদি আমরা এটা আবিষ্কার করতে পারি, যদি আমরা এগুলো সংযুক্ত করতে পারি, তাহলে ‘বাম’ আর যাই হোক মৃত নয়। কয়েক বছর আগে আমিই একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম ‘বাম’ মৃত, ‘বাম’ দীর্ঘজীবী হোক।
দ্বিতীয় আপত্তি উঠতে পারে, প্রথম আপত্তি থেকে। প্রথমেই বলা হয়েছে ‘বাম’ মৃত। দ্বিতীয় আপত্তি তাই আসতে পারে, এই বিষয় নিয়ে চিন্তাই বা কেন করা হবে, আমরা কি জানি না ‘বাম’ কী বস্তু? এই আপত্তি গোঁড়াদের কাছ থেকে। তারা দাবি করে ‘বাম’ কথাটার প্রকৃত অর্থ একমাত্র তারাই বোঝে। আজকের দিনে, অনেকেই এই ধরনের দাবি করে যে ‘কমিউনিস্ট বাম’ই একমাত্র ‘বাম’, সত্যিকারের ‘বাম’য়ের দাবিদার তারাই। ফলশ্রুতিতে, ধীরে ধীরে অন্যান্য সমস্ত সোশ্যালিস্ট, প্রগতিশীল ও সমতাবাদী চিন্তায় ‘বাম’ শিরোনামটি পরিত্যক্ত হ’ল। পরে এটি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
আমার মনে হয়, এই একচ্ছত্রতা রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণের মূল কারণ। যখন কোনো আন্দোলন উর্ধ্বমুখী হয়, তখন সেই আন্দোলনের সত্যিকারের দাবিদার কে হবে তা নিয়ে বিতর্ক এবং বিভাজন অস্বাভাবিক নয়। ১৯৮০’র দশকে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেসময় আমরা ‘লাল’-এর শত রকমের ‘বাম’ দেখতে পেতাম। আপনি ‘কংগ্রেস বাম’ হতে পারেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক সমাজবাদী’ হতে পারেন, ‘সিপিআই সমাজবাদী’ হতে পারেন, ‘সিপিএম সমাজবাদী’ও হতে পারেন। হতে পারেন নকশাল এবং মাওবাদীও। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আপনি ট্রটস্কাইটও হতে পারতেন। সেসময় অসংখ্য ‘লাল’, আর সেটাই স্বাভাবিক। কোনো আন্দোলন যখন সম্প্রসারিত হয়, সে হয় যেন এক নদীর সম্প্রসারণ, অসংখ্য তার শাখা উপশাখা। সেই সময় আমরা তীব্র লড়াই করেছি।
একটা উদাহরণ আমি উল্লেখ করে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়কালে আমাদের প্রথম অর্জন ছিল এসএফআইকে, জেএনইউএসইউ’র সভাপতির পদ থেকে উৎখাত করা। এবং আমরা এতে গর্বিত ছিলাম। বিশ শতকের এই যে সব ছোটখাটো লড়াই, আজ আর সেসবের তেমন কোনো গুরুত্ত্ব নেই। কিছু কিছু মনোভাব এবং সেক্টারিয়ানিজম বিপ্লবীদের পথ অন্বেষণের বড় বাধা। আজ আর আমরা অতীতের অমন সব বিরোধের মৃত ওজন বহন করতে পারি না। এখন আমি কেরালায় আছি। এখানে বেশ কিছু পুরনো বিরোধ এখনও চলমান। কিন্তু অতীত-বিরোধের মৃত-ওজন বহন করা – আমি নিশ্চিত আমাদের কোনও জায়গায় পৌঁছে দেবে না।
আমরা যা করতে পারি তা হ’ল, একেবারে আলাদা, মৌলিক কিছু বলা শুরু করা - যেমন ‘আমি জানি না’ বলা। এটা যথেষ্ট মৌলিক বক্তব্য।
আমরা শুরু করে দেখি না কেন ‘বাম’ কী হতে পারে? নতুন করে দেখা যাক। এর জন্য সর্বোত্তম উপায় হবে এই শব্দের ইতিহাসে একবার দ্রুত নজর দেওয়া। আমি আপনাদের ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিরক্ত করব না, যেহেতু আমি খুব ভালো ইতিহাসবিদ নই। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে এই 'বাম' শব্দের উৎপত্তি ফরাসি বিপ্লবের পর। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে যারা স্পিকারের বাম দিকে বসেছিলেন তারা ছিলেন মনার্কি-বিরোধী, অত্যন্ত বিপ্লবী রিপাবলিকান। তারাই সেই সময়ের ‘গণতন্ত্র প্রিয়’ মানুষ। তারা গীর্জা বিরোধী, তাই এই ব্লককে সাধারণভাবে 'বাম' বলা হ’ত। মনে রাখবেন, তারা সমাজবাদী ছিলেন না, কারণ সমাজবাদিতা তখনও মূলমঞ্চে আসেনি। তারা সেই অর্থে সমতাবাদীও ছিলেন না। এইভাবে বিশ শতকের পরিভ্রমণে 'বাম' শব্দটি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হতে থাকে। উনিশ শতকের শেষদিকে, 'বাম' শব্দটি সমাজবাদীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং বিশ শতকে এটা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এই হচ্ছে ভারতের সমাজবাদী ধারণার ইতিহাস। এর অংশবিশেষ আমি পেশাদারিত্ব নিয়ে লিখেছি এবং অন্য কোনো সময়ে বিস্তারিতভাবে লিখব বলে আশা রাখি। একটা বিশেষ কথা তুলে ধরার জন্যে প্রসঙ্গটি আনলাম। মূল কথাটা হচ্ছে , ভারতের সাম্যবাদী সমাজ ধারণার তিনটি পর্যায় রয়েছে। তার মধ্যে একটি পর্যায় বলশেভিক বিপ্লবের আগে।
সাম্যবাদ ভারতীয়দের কাছে মার্ক্সের মতো পরিচিত। ভারতে মার্ক্সের প্রথম জীবনচরিত মালয়ালম ভাষাতেই লেখা। সাম্যবাদী হওয়ার অর্থ নিয়ে মানুষের কল্পনার পরিসর ছিল খুবই খোলামেলা। সামাজিক ধারণার লিপিবদ্ধ ইতিহাসে, এ্যাকাডেমিক ইতিহাসবিদরা এই পর্বটি নিয়ে খুবই বিব্রত। কেননা তাঁরা মনে করেন, এইসব মানুষজন মুক্তমনা হলেও যেহেতু বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ জানতেন না, সুতরাং তারা প্রকৃত সাম্যবাদী হতে পারেন না। তারা তাদের যার যা নিজস্ব কল্পনা, মূল্যবোধ উজাড় করে দিতেন ‘সাম্যবাদ’ কথাটার সঙ্গে এবং মনে করতেন, এটাই সাম্যবাদ। উদার মনের অনেক মানুষেরাই ভেবেছিলেন সাম্যবাদ কোনো মহৎ কিছু ব্যাপার যা ইউরোপের কোথাও ঘটছে এবং তারপর তারা তাদের মানসিক আশা–আকাঙ্ক্ষা, সাম্যবাদের ধারণায় যোগ করে নিতেন। স্বামী বিবেকানন্দ সাম্যবাদ সম্পর্কে বলেছেন। সেখানে তিনি জাত-পাতের অসমতার বিরোধিতার সঙ্গেই সাম্যবাদকে বেশি সম্পর্কিত মনে করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'সাম্য' শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
এই প্রথম পর্বটি প্রায় ১৮৭০-এর দশক থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত। আমি অবশ্য বলব ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। বলশেভিক বিপ্লবের পরও ছিল সেই সমৃদ্ধ কল্পনার সময়কাল। তখন ইন্টারনেটের দিন নয় এবং বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়া থেকে আসা নতুন সব সাহিত্য ভারতীয়দের সহজলভ্য ছিল না। তথ্যের এই সীমাবদ্ধতা সাম্যবাদ কী এবং কী হতে পারে, এইসব কল্পনা আরও উসকে দিয়েছিল মুক্ত চিন্তার পরিসর। দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় - যদি তারিখ ধরে বলি, বলব ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের সঙ্গে নয় বরং এম.এন. রায়ের বইয়ে সাম্যবাদের ভাষ্য উপস্থিত হওয়ার পর। এম.এন. রায় একরকমভাবে মুক্ত-পরিসরের কল্পনার ইতি টানলেন। তাঁর বই 'ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন' আসলে সেই সময়কাল, যখন থেকে কল্পনার রাশ টেনে ধরা হয়। সাল ১৯২৩ ।
'ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন'-এ এম.এন.রায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ইত্যাদি সম্পর্কীয় আনুষ্ঠানিক ভাষ্য উপস্থিত করলেন। বললেন, কেমনভাবে বিষয়গুলি পর্যালোচনা করা উচিত? উল্টোপাল্টা সমালোচনা নয়, স্বপ্ন দেখা নয়, যথাযথভাবে পড়তে হবে। শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার পক্রিয়া। এই সময়কাল অনেকভাবেই ভারতীয় সাম্যবাদের শীর্ষ মুহূর্ত। কিন্তু আমি যেমন ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি, এটি একই সঙ্গে উদার কল্পনায় সাম্যবাদ নিষিক্ত হওয়ারও পরিসমাপ্তি।
সাম্যবাদ, এখন এক মূলগত ব্যাখ্যার অধীন। এই মূলগত ব্যাখ্যা আজও বিতর্কিত। সেসময় ভারতে ছিল নানান ধরনের সাম্যবাদী ভাষ্য। নেহেরু ছিলেন। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ছিল। এখন আর আমরা মনে রাখি না যে, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই একটি পার্টি। রাজনৈতিক দলেরও কংগ্রেসের ভিতরে থাকার অবকাশ ছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণ পরিচালনা করতেন কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি। অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, রাম মনোহর লোহিয়া, মিনু মাসানি এবং কিছুকালের জন্যে হলেও ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ। পার্টির পরিচিতি ছিল মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। এই পার্টিকে শুধু ১৯৫০-এর দশকের ভূদান আন্দোলনের লেন্স দিয়ে দেখলে হবে না। তখন তারা বলশেভিক, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ভারতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্রায়ন নিয়ে বিতর্ক ছিল। বিতর্ক ছিল, ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত হওয়া উচিত, তা নিয়েও।
মনকেমন করা সেই ঐতিহাসিক বিতর্কে আজ ভেসে না গিয়ে – এই বিষয় নিয়ে আমি কিছুটা লিখেওছি – আমি বলব সেই সম্পর্ক ১৯৪২ সালে ভেঙে যায়। এটি একটি গল্প এবং এটি ৮০ বছরের সম্পর্ক ভাঙার গল্প যা আমি ১৯৪২ সম্পর্কে বলেছিলাম। ভারতের সমাজবাদীরা ও ভারতের কমিউনিস্টরা তাদের মধ্যকার সম্পর্ক চিরতরে ভেঙে দেয়। তিক্ততা এত বেশি ছিল যে আর কোনোদিনই তারা কাছাকাছি আসতে পারল না অথচ এর পেছনে ছিল প্রায় ব্যক্তিগত কিছু কারণ।
ভারতের বাম চিন্তাধারার ইতিহাসে গুরুতর একটা ক্ষতি হয়ে গেল। অবশ্য আজকের আলোচনার কেল্দ্রবিন্দু এটা নয়। আর তার পরেও ভারতের মধ্যে বিভিন্নভাবে বাম থাকার পথ ছিল এবং স্বাধীনতার পরেও ধারাবাহিকভাবে চলেছিল।
বিভিন্ন ‘বাম’ শেডের আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু ১৯৭৭ সালে ‘বাম কংগ্রেস’ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের বেশিরভাগই শেষ হয়ে যায়। কংগ্রেস- সিপিআই জোটের অবসান এবং সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকার সমূহের উত্থানের মধ্যে দিয়ে ‘কমিউনিস্ট বাম’ই একমাত্র বাম হিসাবে আবির্ভূত হয় আর অর্থোডক্সি’র উত্থান ঘটে। সেই অর্থোডক্সি কী ছিল? চারটি স্তম্ভের উপর সেই অর্থোডক্সি’র নির্মাণ। প্রকৃত বাম বলতে কী বোঝায়? বলা হ’ল, তুমি যদি বাম হও, প্রকৃত বাম তোমাকে তখনই বলা হবে যখন তুমি মার্ক্সবাদকে তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করবে। শুধু তাই নয়, একটি নির্দিষ্ট প্রকারের মার্ক্সবাদ গ্রহণ করবে, যে কোনো মার্ক্সবাদ নয়। একটি নির্দিষ্ট প্রকারের মার্ক্সবাদ ও মতাদর্শ হতে হবে কমিউনিজম। এবং মার্ক্সবাদী তত্ত্ব এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শের মধ্যে একটা গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। যদি তোমার মডেল হয় USSR এবং তোমার পছন্দের বাহক হয় কমিউনিস্ট পার্টি তাহলেই তোমার মৌলিক ধ্যানধারণা ‘বাম’ হিসেবে স্বীকৃত হবে। এইভাবেই অর্থোডক্সি ‘বাম’-কে সীমাবদ্ধ করে দিল। সুতরাং অর্থোডক্সি ‘বাম’-এর সংজ্ঞা সংকীর্ণ করে দিল, সংকুচিত করে দিল। কিছু মানুষ এটিকেই প্রামাণিক এবং সঠিক বলবে, কিন্তু আমার ভাষায় এটা সংকীর্ণ এবং অর্থোডক্সি। এখন বাম হওয়ার মানে কী সেটা বুঝতে হবে। যদি এটাই বাম হয়, তাহলে সন্দেহ নেই যে বামের ভবিষ্যত শেষ হতে তেমন কিছু বাকি নেই।
কমিউনিস্ট পার্টির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। USSR ভেঙে পড়েছে। চীন অন্তত বামের জন্য কোনো অনুপ্রেরণা নয়। চীন কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুঁজিপতিদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু বামের জন্য এটি কোনো অনুপ্রেরণা নয়। সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে শুধুমাত্র তার নিজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক ছিল বলে নয় বা এর অর্থনীতি গভীরভাবে ত্রুটিযুক্ত ছিল বলে নয়, বরং কমিউনিস্ট ব্যবস্থা ছিল আধুনিকতায় মন্ত্রমুগ্ধ, আধুনিক ইউরোপীয় নগর শিল্প সমাজের একটি রূপ। এবং বড় আকারের উৎপাদন আর তার প্রযুক্তির সংযুক্তি ছিল নিবিড়। কমিউনিজমও ছিল গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ ।
যদি কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্বাধীনতার জন্য মানুষের অনুসন্ধানকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়, কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাজারের যুক্তি বুঝতে অক্ষম হয়, এবং এমনকি মার্কসবাদের মতো অর্থনৈতিক প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তা বুঝতেও ব্যর্থ হয়, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই। মার্কসবাদই ছিল বিপ্লবীদের প্রধান ভিত্তি। আমরা আজ যা বলি সমাজবিজ্ঞান।
মার্কসবাদ বিপ্লবীদের জন্য মৌলিক ছিল এবং আমরা আজ সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে যে মার্কসবাদকে বিবেচনা করি, তা সত্যি। আমি মনে করি আমরা এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করছি না। আজ যা আমরা সাধারণভাবে সমাজবিজ্ঞান বলি, তা আসলে একসময় মার্কসবাদী ভিত্তির ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সমস্ত সত্য হওয়া সত্ত্বেও, বলা উচিত মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানের অনেক ভবিষ্যদ্বাণীই অতিরঞ্জিত ছিল। বেশিরভাগ ভবিষ্যদ্বাণী ভুল ছিল এবং বস্তুনিষ্ঠ সত্যের উপর একচেটিয়া অধিকারের দাবিগুলি ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক। ভারতের মতো সমাজে এর প্রয়োগেও মার্কসবাদী তত্ত্বের আরেকটি জন্মগত ত্রুটি দেখা যায়। এটি গভীর ইউরোসেনট্রিক।
আমি আজ এই সব নিয়ে বিতর্ক শোনাতে এখানে আসিনি। আমি শুধু বলতে চাই, আমরা যে চার স্তম্ভের কথা বলেছি সেগুলির অর্থোডক্স পাঠের মধ্যে যদি আমরা বাম’কে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, সেক্ষেত্রে ‘বাম’য়ের ভবিষ্যত খুব সংকটজনক। তবে আমি শুরুতেই বলেছিলাম যে আমার মনে হয়, এই অর্থোডক্স ভাবনার চেয়ে গভীরতর বাম আছে এবং সংকটের মুহূর্তে এটি নতুন করে চিন্তা করা প্রয়োজন। আসলে যা ঘটেছে তা হ’ল, আপনি জানেন - ইতিহাসে আপনি একটি ধারণা পান এবং তারপর সেই ধারণার ওপর অনেক সাজপোশাক চাপাতেই থাকেন। এবং তারপর সেই সাজপোশাক ধারণার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি আমরা, বামেরা করেছি। এবং এখন সেইসব সাজপোশাক খুলে ফেলার সময় এবং নতুন করে এই কথাটি বলা শুরু করার সময় যে, আসলে বাম হওয়ার মানে কী।
তাহলে বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সে বামের সংজ্ঞা কী ছিল? আমি আপনাদের বলেছিলাম যে তখন মার্কসবাদ ছিল না, তখন সাম্যবাদ ছিল না বা অন্তত একটি আধিপত্যকারী ভাবনা হিসেবে তো নয়ই। তাদের ‘বাম’ বলার কারণ এইজন্যেই ছিল যে, তারা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করেছিল। মনার্কি, আরিস্টোক্রেসি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমনসব বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তাই তাদের এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব স্বাভাবিকভাবে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাদ বিরোধিতা বা প্রতিরোধের দিকে চলে যায়। কিন্তু মনে রাখবেন শুরু কিন্তু প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার চিন্তা দিয়ে। চলুন দেখি আজ কোথায় ‘বাম’ আলাদা হয়ে উঠলো।
‘বাম’ মুলত একটি ক্ষমতা বা স্থিতাবস্থার স্বপক্ষের বক্তব্যসমূহ প্রশ্ন করার ক্ষমতা। এটি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যা বামকে আলাদা করে, যা বামকে বাম করে তোলে। বিশ্ব যখন শক্তিশালীর দিকে বাঁক নেয়, বাম তখন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন, কখন? সবকিছু ছাড়া সবাই যেমন থেকে যায় এবং বিশ্বাস করে যে কিছু সহজভাবে পরিবর্তন করা যায় না, বামরা জিজ্ঞাসা করে, কেন নয়? এই অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট, নন-কনফর্মিস্ট রাডিকাল অবস্থান ‘বাম’দের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ধরনধারণ পরিবর্তিত হতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের সময়, প্রতিষ্ঠান ছিল মনার্কি, প্রাচীন শাসন। এখন এটি পুঁজিবাদ হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কলোনিয়ালিজম, সংগঠিত ধর্ম, জাতি রাষ্ট্র, জাতির অর্ডার বা প্যাট্রিয়ার্কি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, আপনারা যদি আমাকে আর একটু এগোতে উৎসাহ দেন, তাহলে বলি, প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, আনুষ্ঠানিক মার্কসবাদ বা এমনকি বিজ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বাম হচ্ছে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, আধিপত্যের বিরোধিতা এবং কেন তা জিজ্ঞাসা করা। বহিরঙ্গের সমালোচনা নয়, মার্কসবাদী অর্থে সমালোচনা, আধিপত্যের কোন বিশেষ রূপের জন্যে নির্মিত ধারণার সঙ্গে যুক্ত প্রধান প্রধান অনুমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা, সেগুলো ভেঙে ফেলা এবং বলা, "ঠিক আছে বা কেন?" এইটাই ‘বাম’কে ‘বাম’ করে তোলে। আমি যা বলছি তা যদি কোনো অর্থ বহন করে তাহলে ‘বাম’ একটি সম্পর্কমূলক ধারণা, অবস্থানমূলক কোনো ধারণা নয়। অর্থাৎ ‘বাম’ মানে কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্ট বা অবস্থান নয়। আপনি পাবলিক সেক্টরের পক্ষে। আপনি অন্যকিছুর পক্ষে বা আপনি শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে। বিষয়টা এরকম নয়। আপনি পর পর গোটা বিষয়টাই জানেন। শুধুমাত্র স্থিতিশীল অবস্থানের একটি সিরিজ নয় বরং পরিসর এবং সময় সম্পর্কিত। সময়, দেশ, কাল। দেশ কাল সাপেক্ষই ‘বাম’কে ‘বাম’ করে তোলে।
তাহলে ফরাসি বিপ্লবের ‘বাম’, বিংশ শতাব্দীর রাশিয়া বা পুতিনের সময়ের রাশিয়া থেকে খুবই ভিন্ন হবে। ইউরোপের ‘বাম’ এবং উপনিবেশ পরবর্তী দেশ-সমাজের ‘বাম’ ভিন্ন হতে হবে। ভারতীয় সমাজে ‘বাম’-এর প্রকৃত অর্থ বিংশ শতাব্দীতে আমরা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি নি। উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সময়, স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের আধিপত্যের সময় এবং মোদীর ভারতের সময় বামের প্রকৃতি খুবই ভিন্ন হতে হবে। কারণ আপনি কোনো একটা কিছুর বিরোধিতা করছেন, কোনো একটা প্রতিপক্ষের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন, কিছু একটা প্রতিরোধ করছেন এবং এই কিছু একটা বা কোনো একটা পরিবর্তিত হলে ‘বাম’ হওয়ার মানেও পরিবর্তিত হতে হবে।
তাহলে মোদীর শাসনাধীন ভারতে ‘বাম’ হওয়ার মানে কী? আজকের আধিপত্যের কাঠামো কী? ‘বাম’ যদি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিষয় হয়, তাহলে আমাদের প্রথম জিজ্ঞাসা হতে হবে, কার আধিপত্য? আমার অভিব্যক্তিতেই রয়েছে এর উত্তর, মোদী আধিপত্য করে। আপনি এক ধাপ পিছিয়ে যেতে পারেন এবং বলতে পারেন বিজেপি বা কেউ বলতে পারে আরও এক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে আরএসএস। মোদীর ব্যক্তিত্ব, বিজেপির রাজনীতি, আরএসএসের মতাদর্শ আজকের আধিপত্যকারী রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু ‘বাম’ হওয়া মানে আলাদা আরো কিছু প্রশ্ন করা। শুধুমাত্র কে আধিপত্য করে তা নয়, বরং কী আধিপত্য করে এবং কীভাবে? এই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে লুকানো কাঠামো উন্মুক্ত হতে শুরু করে। বিজেপি’র রাজনৈতিক আধিপত্যে কাঠামোর আরো গভীরে আধিপত্য বিস্তারের একটা ছক আছে। বিজেপি, মোদী, আরএসএস হল কাঠামোর গভীরে আধিপত্য বিস্তারের বাইরের মুখাবয়ব। এটাই আমরা দেখি। আমি 'মোদানি' শব্দটি খুব পছন্দ করি। এটি রাজনৈতিক বাগবিধির শব্দ হলেও কখনও কখনও রাজনৈতিক বাগবিধি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ধারণ করে। 'মোদানি' শব্দটি আসলে সব কিছু ধারণ করে। আমরা একটি বহুস্তরীয় কাঠামো দেখছি যা বহু রূপের আধিপত্য ধারণ করে। নৃশংস রাষ্ট্র শক্তির মাধ্যমে; নির্বাচনী যন্ত্র, অর্থ, মিডিয়া এবং যা কিছু আমরা দেখি তার মাধ্যমে বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হয়।
এছাড়াও রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার, একটি শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্য, যেখানে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে। তাই এটা একটা নৃশংস প্রধানতাগামী আধিপত্য। এছাড়াও আছে জাতপাতের আধিপত্য। একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য নয়, বর্ণাশ্রমের আধিপত্য, জাতপাত ব্যবস্থার আধিপত্য এবং তাই ‘সনাতন’ শব্দের পুনরাবৃত্তি একটি দুর্ঘটনা নয়। কারণ উনিশ শতকে হিন্দু ধর্মের সংস্কার এবং জাতপাত ব্যবস্থায় অসমতা দূর করার যে কোনও প্রচেষ্টার বিরোধিতা করার জন্য ‘সনাতন’ এবং ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছিল।
তাহলে ব্রাহ্মণবাদের আধিপত্য ও ক্রনি র্পুঁজিবাদের আধিপত্য রয়েছে। আজকের মতো পুঁজির অশ্লীল শাসন, ভারত অতীতে কখনও দেখেনি। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে মজা করি যে, যখন আমরা জেএনইউ-তে ছিলাম, তখন ভারতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অনেকটাই স্বতন্ত্রতা ছিল কিন্তু তখন আমরা বলতাম ভারত রাষ্ট্র আর কিছুই নয়, শুধুমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণির এজেন্সি। সে সময়ের বাস্তবতা কিন্তু এমন ছিল না। আর আজ যখন ভারত রাষ্ট্র সত্যিসত্যিই বুর্জোয়া শ্রেণির এজেন্সি হয়ে গেছে, আমরা আর সেই তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করি না। আপনি জানেন, আজ ভারতে ইতিহাসের সবচেয়ে চরম ক্রনি ক্যাপিটালিজমের শাসন এবং একই সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনও। আমাদের রাজনৈতিক শাসনে স্বৈরাচার, সামাজিক শাসনে ব্রাহ্মণবাদ, ধর্মীয় ভেদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন এবং তার সঙ্গে ক্রনি ক্যাপিটালিজম। আজ আমরা একাধিক আধিপত্য দেখতে পাচ্ছি। ‘বাম’কে সবকিছুরই বাম হতে হবে। এটি এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। ‘বাম’কে এখন উঠে দাঁড়াতে হবে।
এমন কথা বলছি না যে, যে কেউ মোদী বা বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই, তাকে ‘বাম’ বলা হবে। এটা হাস্যকর। কারণ বিভিন্ন ধরনের শক্তি আছে। মোদী বিরোধী শিবিরের মধ্যে একটা বিভাজন-রেখা আছে। মোদী বিরোধী, বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে কেউ কেউ বেশ ভালো রকমের বিরোধিতা করতে পারছে এবং এর জন্যে আমাদের তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে, সেই বিরোধী শক্তির দুটি প্রকারভেদ আছে। একটি যা ‘বাম’ নয়, ‘বাম’-এর মিত্রও নয়। তাদের ‘বাম’ ছাতার নীচে আনা উচিত নয়, আসবেও না। অন্যটি অবশ্যই ‘বাম’ ছাতার নীচে আনা উচিত। কিছু শক্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করে। তাদের অবস্থান মোদীর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে। তারা কোন মতেই ‘বাম’ নয়। কিন্তু তাদেরটাও বিরোধিতা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিরোধিতা। আমাদের উচিত এই বিরোধী শিবির শক্তিশালী করার জন্য সচেষ্ট থাকা। কিন্তু আমরা একে ‘বাম’ বলে মনে করি না।
দেশে বিজেপি বিরোধী একটি শিবির আছে যা গভীরতর ক্ষমতার কাঠামোকে বিরোধিতা করে- যা অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক এবং মতাদর্শিক। যারা শুধু ক্ষমতার স্থানান্তর নয়, বরং একটি গভীর রূপান্তরের বিশ্বাস করে। আজকের ‘বাম’-এর ঐতিহাসিক কাজ হলো পিরামিডের নীচের অংশ থেকে একটি নতুন সামাজিক ব্লক গঠন করা। ভারতের সমাজ ব্যবস্থা যদি একটি পিরামিড হয়, তবে বিজেপি পিরামিডের উপরের অংশটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে দখল করতে সক্ষম হয়েছে। শ্রেণি, জাতি এবং কিছুটা লিঙ্গের দিক দিয়ে দেখতে হলে, বিজেপি পিরামিডের উপরের অর্ধেকটি সম্পূর্ণত অধিকার করেছে এবং নীচের অর্ধেক থেকে কৌশলে কিছু অংশ নিয়েছে, এবং এইভাবে বিজেপি তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করেছে। আজকের ‘বাম’-এর ঐতিহাসিক কাজ হলো পিরামিডের নীচের অংশ থেকে একটা সামাজিক ব্লক গঠন করা। নীচের অংশ শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দিক দিয়ে গণ্য করা উচিত এবং এই নীচের অংশ ভারতের জনসংখ্যার ৫০% নয়, সম্ভবত ভারতের ৮০% জনসংখ্যারও বেশি। অ্যান্টি বিজেপি রাজনীতির ট্র্যাজেডি হলো বিজেপি ২০% থেকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করতে পারে এবং অ্যান্টি বিজেপি শক্তি ৮০% ভোট শেয়ার নিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এইটাই আসলেই ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ এবং কাজ।
সুতরাং ‘বাম’ রাজনীতি হতে হবে গণতান্ত্রিক রিপাবলিকানিজমের রাজনীতি। আজ মৌলিক গণতান্ত্রিক রিপাবলিকানিজম, মৌলিক এবং গণতান্ত্রিক। এটা বোঝার জন্যে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে 'রিপাবলিকানিজম' শব্দটির সঙ্গে আজ আর পলিটিক্যাল সায়েন্সের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞার কোনো মিল নেই। কেননা রিপাবলিক ওখানে কেবল রাজার বিরোধিতা বোঝায়। ভারতের কোন মনার্ক নেই, এমনকি কেউ মনার্ক হওয়ার ভানও করেন না। রিপাবলিকানিজম এখানে এমন কিছু যা ইউরোপীয় ঐতিহ্যে ৫-৬’শ বছর পুরনো। বরং সমান নাগরিকত্বের দাবি কিছুটা আমাদের প্রাচীন ভারতীয় গণতন্ত্রের উত্তরাধিকারও। এটা নিয়ে পরে আমি আরো লিখব, কিন্তু এখন কেবল রিপাবলিকানিজম শব্দটি উল্লেখ করতে চাই। রিপাবলিকানিজম হচ্ছে একটি সম্প্রদায় গঠন যেখানে সব নাগরিক সমান। গণতান্ত্রিক, গণতন্ত্র রক্ষা করা এবং গণতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া। যারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে না, তারা আজকের বাম ও রাডিক্যাল বোঝাপড়ার অংশ হতে পারে না। যারা এগিয়ে নিতে চায় তারা কোনো সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আটকে না রেখে যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে। সহজ সরলভাবে বললে, আমি প্রথমেই যা বলেছিলাম, যে আমরা এখন ভারতের প্রথম রিপাবলিকের শেষ পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় রিপাবলিকের শুরুতে আছি, যার রূপ আমরা জানি না।
এবং আগামী কয়েক বছরে আমরা দেখতে যাচ্ছি যে দ্বিতীয় রিপাবলিক কেমন হবে তা নিয়ে একটি তীব্র লড়াই আসন্ন । বিজেপির উদ্দেশ্যগুলি স্পষ্ট, দয়া করে ভাববেন না যে ২০২৪ সালের নির্বাচন তাদের চূড়ান্ত আঘাত দিয়েছে। আপনি মি. মোদির সম্পর্কে একটি ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তিনি তার শাসনের পতন দেখতে চাইবেন না, যেমন মি. মনমোহন সিং করেছিলেন। বিজেপি লিখিত অলিখিত যা কিছু সম্ভব সবকিছু করবে, ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্যে। বিজেপি জানে যে দ্বিতীয় রিপাবলিকের জন্য তারা কী ধরনের কাঠামো গঠন করতে চায়, তাদের রিপাবলিক আসলে একটি হিন্দু রাষ্ট্রের বাস্তব সংস্করণ। এ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, আমি এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাব না। আমরা কোন ধরনের দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠন করতে চাই, সেটা অবশ্য একটা বড় প্রশ্ন।
একদিকে কিছু মানুষ প্রথম রিপাবলিকের দিকে ফিরে যেতে চাইবেন, তাদের নস্টালজিয়া নেহরুর দিনের প্রতি, নস্টালজিয়া রয়েছে নেহরুর রিপাবলিকের প্রতি, সেই গণতন্ত্রের দিনগুলির প্রতি। আমার মতে, এটি সম্ভব নয় এবং এটি কাম্য নয়। আমরা শুধু সেই রিপাবলিকে ফিরে যেতে পারি না। দ্বিতীয় রিপাবলিক নতুন করে গঠন করতে হবে। আমরা কি শুধু পুনরুদ্ধার করতে চাই, নাকি নতুন করে গঠন করতে চাই? আমার মতে, বাম-এর আজকের কাজ হ’ল, একটি রাজনৈতিক ব্লক গঠন করা, একটি রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করা যা একটি নতুন রিপাবলিক গঠন করবে। একটি নতুন রিপাবলিক। এই নতুন রিপাবলিক গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হবে এবং এটা একটা বৃহৎ শিবির হতে চলেছে। এই শিবিরে শুধু কমিউনিস্ট থাকবে না যেমন সত্য, তেমনি সব কমিউনিস্ট এই শিবিরে যোগ্য নাও হতে পারে। এটি শুধু সমাজবাদীদের জন্য হবে না এবং আবারও বলব যে, সবাই যারা সমাজবাদী বলে পরিচিত তারা এই শিবিরের যোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু এটি অন্তর্ভুক্ত করবে সকলকে, যারা জাতপাত নির্মূলের জন্য কাজ করছে, কাজ করছে পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, রিপাবলিক রক্ষা করছেন, রক্ষা করছেন সংবিধান। আমি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই এবং এটি আমার উপলব্ধিও - যা জনি তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ২০২৪ সালে সারা দেশ পরিক্রমাকালীন আমার একটি আবিষ্কার বলে – সারা দেশে গণতন্ত্রের জন্য সমর্থন কতটা বিস্তৃত! আমাদের মধ্যে যারা গণতন্ত্রের জন্য সমর্থন মাঝে মাঝে অনুভব করি, আমি জানি না আপনি কেরালায় অনুভব করেন কিনা, কিন্তু উত্তর ভারতে অনেক সময় আমরা বিজেপি আরএসএসের আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণরূপে অসহায় বোধ করেছি। কিন্তু ২০২৪-এর ভ্রমণ থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে বিজেপি আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সম্পদ সমাজের গভীরে নিহিত রয়েছে। সমস্যা হলো, তারা আনুষ্ঠানিক বিরোধী শক্তির অংশ নয়। বিরোধী পক্ষগুলি, আনুষ্ঠানিক বাম, ঐতিহ্যগত বাম, যা কিছু ধরে রেখেছে তা শুধুমাত্র দেশের বর্তমান বাম-এর একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। বাম শক্তির প্রাচুর্য উপলব্ধি করা যায় মানুষের আন্দোলনে, কৃষকদের উত্থানে, বহুজন, আদিবাসী, দলিতদের উত্থানে। মুসলিম নারীদের সিএএ'র বিরুদ্ধে অসাধারণ প্রতিরোধেও এই শক্তির প্রকাশ। প্রতিরোধের জন্য ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত এই সম্পদ সবাই-ই পেতে পারে।
আমরা আরও অনেক কিছু যোগ করতে পারি, তবে আজকের এই সময়ে আমি এমন কিছু এড়িয়ে যাচ্ছি যা নিয়ে আমি একসময় বিস্তারিত লিখতে চাই। তবে আমি শেষ করতে চাই এই বলে যে যদি আমরা এই ‘বাম’-এর পুনর্গঠন করতে চাই, তবে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে শুরু করতে পারি এবং প্রথম ধাপগুলির একটি হবে মার্কসবাদ নিজেই। লেনিনের মার্কসবাদ নয়, কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ। এটি এখনও একটি বৌদ্ধিক ভাণ্ডার যা আমাদের বোঝার অপেক্ষায় রয়েছে, একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের সেট হিসাবে ওপর থেকে আরোপ করা কিছু নয়, একটি পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহারের অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের অভ্যাস থেকে শিখতে পারি। আমরা প্রায়শই মনে করি বামপন্থার অভ্যাসটি বামপন্থার তত্ত্বের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। এবং যদি শুধু তত্ত্বটিকে প্র্যাকটিসের আলোকে পুনর্গঠন করা যেত, আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। সুতরাং, এগুলি অভ্যন্তরীণ সম্পদ।
আর আছে, যা আমি 'প্রতিবেশী সম্পদ' বলি, যে সম্পদ বামেরা সবসময়ই পেতে পারত কিন্তু পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। আছে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, অসাধারণ চিন্তাবিদ যেমন রাম মনোহর লোহিয়া, আচার্য নরেন্দ্র দেব, যিনি নিজেকে একজন মার্কসবাদী হিসেবে পরিচয় দিতেন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত জয় প্রকাশ নারায়ণ, যে ঐতিহ্য কিষাণ পট্টনায়ক অব্দি এসে শেষ হয়ে গেছে। ফুল্লে ও আম্বেদকরের ঐতিহ্য রয়েছে, ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলন ও ভারতীয় নারীবাদী চিন্তাধারার ঐতিহ্য রয়েছে। এইগুলিই আমাদের প্রতিবেশী সম্পদ।
বাইরের সম্পদও আমাদের ব্যবহারের জন্যও উন্মুক্ত। কী সেই বাহ্যিক সম্পদ? গান্ধী। পুরাতন সেই গান্ধী এখনও আমাদের দেশে মৌলিক প্রজাতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য উপযুক্ত। শুধুমাত্র তার অহিংসা নয়, গান্ধী আমাদের আরও অনেক কিছু দিতে পারেন। আমি আরো উল্লেখ করতে চাই পরিবেশগত সংগ্রামের সম্পদ এবং ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী তত্ত্ব যা ডানপন্থী শিবিরে উপেক্ষিত কিন্তু এর মধ্যে অনেক মৌলিক সম্ভাবনা রয়েছে। এসব পুনরুদ্ধার করা এবং বাম’-এর মধ্যে আনা দরকার।
এবং অবশেষে আমি একটি সম্পদের কথা উল্লেখ করতে চাই যা আমাদের সবার জন্যই বিশেষভাবে উপযোগী এবং তা হল ভারতের সংবিধান। কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন এখানে ‘বাম’ কোথায়? আপনি মনে করুন নির্বাচনের সময় সম্পদের পুনর্বন্টন নিয়ে বিতর্কের কথা। কংগ্রেস প্রসঙ্গ তোলার সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপি লাফিয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তারা পুনর্বন্টনের কথা বলছে। বিজেপি সভাপতি শ্রী নাড্ডা একটি আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারে চোখের পলক না ফেলে বলেছিলেন 'এরা সমতার কথা বলে, এরা মাওবাদী'। স্পষ্টতই শ্রী নাড্ডা ভারতের সংবিধান পড়েননি যেখানে পুনর্বন্টনের বিষয়ে বিতর্ক ছিল। তারা রাষ্ট্রের নীতি নির্দেশক অংশগুলি পড়েননি যেখানে স্পষ্টভাবে এই দেশে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। এই সমস্তই ভারতীয় সংবিধানের অংশ, কোনও বলশেভিক মতাদর্শ নয়। তাহলে আমরা ‘বাম’ গঠনের প্রেরণার জন্য অন্য কোথায় কেন যাব? আমি কী আপনাদের ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ অনুসরণ করার পরামর্শ দিতে পারি, কেননা এটি অত্যন্ত ‘বাম’ নথি। হতে পারে একটা সময় ছিল যখন আমরা ভারতীয় সংবিধানকে কিছুই মনে করিনি। আমি স্বীকার করতে চাই যে যখন আমি জেএনইউ-তে ছাত্র ছিলাম, তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম এটি একটি খুব রুটিন, যদি না বলা হয় মূল্যহীন কাগজের টুকরো। আপনি জানেন সেখানে কিছু উচ্চাশার শব্দবন্ধ আছে, যা কেউই গুরুত্ব সহকারে নেয় না। এবং তারপর বিজেপি সংবিধান পর্যালোচনার জন্য একটি কমিশন গঠন করল। আমরা একটি সমাবেশ করলাম এবং সেই সমাবেশে আমার পুরনো জেএনইউ সহকর্মীদের সাথে দেখা করলাম। আমরা নিজেদের বলছিলাম, এটাই কি সেই নথি নয় যা নিয়ে আমরা রসিকতা করতাম? সময় পরিবর্তন হয়, তাই ‘বাম’ ধ্যানধারণারও পরিবর্তন করতে হবে এবং এর শুরু হতে পারে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে। ‘বাম’ থাকার একটি খুব গভীর ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে । ‘বাম’ কী বুঝতে ও পুনর্বিবেচনা করতে ইচ্ছুক থাকলেই একমাত্র আমাদের মহান ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব। ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।