সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ধরি ধরি ধর ধর ধরি কিন্তু ধরে কই?
কারে ধরি কেবা ধরে ধরাধরি করে কই?
ধরনে ধারণে তারে ধরণী ধরি তেনারে
আঁধার ধারণা মাঝে সে ধারা শিহরে কই?
চলচিত্তচঞ্চরি – সুকুমার রায়
এই সহস্রাব্দে এসে ঠিক রোমাঞ্চকর সিনেমার মতো আমাদের উটতি বয়েসের দুনিয়া আমাদের অজান্তেই কখন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। কম বয়েসে আমরা ভাবতাম পৃথিবীর গল্প যেদিকে এগোচ্ছে তাতে যতই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকুক, পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে, চীন, ভারত সমেত গরীব দেশগুলোতে দারিদ্র্য কমবে এবং আরো অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নতি হবে। আমাদের কাছে যে গল্পের শুরু, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’। ‘বিজ্ঞানই শেষ কথা বলে’, যে জানার শুরু, হনুমান চলিশার দাপটে সে আজ পলায়মান। তখন স্কুলে যাবার পথে নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে দেওয়াল লিখনে পড়েছিলাম ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, আর এখন দেখছি ভারতের দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী আর চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের একই পুঁজির দোলনায় দোলা। যে সংবাদমাধ্যমের গৌরকিশোর ঘোষ, রামনাথ গোয়েঙ্কারা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলে জেলে গিয়েছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরা সরকারের পোষা সারমেয়র চেহারা ধারণ করে সরকারকে পাহারা দিচ্ছে।
শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই যেন এর প্রতিচ্ছবি। যে সোভিয়েত রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার পক্ষে ছিল তাদেরই উত্তরসূরিরা ক্রিমিয়া, ইউক্রেনে সাম্রাজ্য বানাচ্ছে। একদিন আমেরিকা গণতন্ত্রের নামে ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, ইত্যাদি দেশে সৈন্য পাঠাত, গর্ব করত তাদের গণতন্ত্র নিয়ে, গণতন্ত্রের তথাকথিত পীঠস্থান সেই তাদের দেশের রাজধানীতেই, ‘কংগ্রেস’, অধিবেশন চলাকালীন আক্রান্ত হয়, বিশৃঙ্খল আমেরিকার জনগণ দ্বারা। আপাতদৃষ্টিতে বাইরের জগত এক থাকলেও নিজেদের অজান্তেই কখন কমিউনিস্ট আন্দোলন, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলন,সব কোথায় হারিয়ে গেল। আমাদের স্বপ্নের শোষিত মানুষের অধিকারের লড়াই কখন হারিয়ে গেছে হোয়াটসঅ্যাপের গালগল্পে। যে জ্ঞানচর্চা ও আদর্শের কথা শুনে বড় হয়েছিলাম, কখন যে সেসব ধনচর্চা আর দুর্নীতিতে পরিণত হল বুঝতেও পারিনি। পাড়ার জমি দখলকারী পয়সাওয়ালা পেটমোটা প্রমোটার কখন যে পাড়ায় গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে গেলেন খেয়াল করিনি। রাজনীতিতে আদর্শের জায়গা নিয়ে নিল ধর্ম আর জাতপাত। আগে নিজেকে বুদ্ধিজীবী ভাবতে পারলে মানুষের গর্ব হত, সেই বুদ্ধিজীবী শব্দ কখন গালাগালে পরিণত হয়ে গেল।
বিগত চার দশকে পৃথিবীর হ’লটা কী? সেই একই মানুষ, সমাজ আর গণতন্ত্র রয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। আগের তুলনায় অনেক মানুষের বিশেষ করে মধ্যবিত্তের জীবন ও রোজগারের উন্নতি হয়েছে। ইংরাজি স্কুল আর কর্পোরেট হাসপাতালে মধ্যবিত্ত মানুষের ভিড়। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে, বাড়ির বদলে বহুতল ফ্ল্যাট এখন মফস্বলেও। অথচ দুচারটে ছোটখাটো যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদীদের মাঝে মাঝে জেগে ওঠা আর রাজনৈতিক প্যাঁচ কষাকষি ছাড়া তেমন বড় কোন পরিবর্তন কিন্তু পৃথিবীতে আসেনি, যাতে সভ্যতা যে রাস্তা দিয়ে চলছিল, তাকে এত বদলে যেতে হবে।
এই সময়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন জগতজোড়া উবেবি-র (উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়ন) ঢেউ আর দ্বিতীয় পরিবর্তন তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ। কিন্তু বহু অঙ্ক কষে পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরাই তো এই রাস্তার কথা বলেছিলেন এবং তথাকথিত জিডিপি নির্ভর উন্নয়নও কম হয়নি। মধ্যবিত্তের রোজগারেও বেশ জোয়ার এসেছিল। কিন্তু করোনা-পূর্ব সময় থেকেই পৃথিবী জুড়ে অর্থনীতির অবস্থা যেন ঠিক নেই, ঠিক নেই। করোনা ছাড়া এই সময় বর্তমান বিশ্বজুড়ে দুটো সঙ্কটের কথা খুব বড় করে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে; এক জলবায়ু পরিবর্তন আর দুই বিশ্বজুড়ে অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক বৈষম্য। এবং এরা এমন সাঙ্ঘাতিক চেহারা ধারণ করেছে যা নাকি সভ্যতার সঙ্কট।
২
জলবায়ু পরিবর্তনকে বছর বছর গরম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইক্লোন, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যার ঘনঘন ধেয়ে আসা থেকে কিছুটা বুঝতে পারলেও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে সেরকম ভাবে বুঝতে পারি কি? বছর ত্রিশ আগে পাড়ায় রিক্সা চালাতো ক্লাশ ফোর পাশ মদনদা, তার ছেলে সঞ্জীব বি-এ-তে ফেল করে এখন পাড়ায় টোটো চালায়। কিন্তু তখনকার টাটা-বিড়লাদের থেকে এখনকার আম্বানিরা কতো বেশি বড়লোক হয়েছে সেটা নিয়ে মদনদা বা সঞ্জীব কারোরই মাথা ব্যাথা নেই, আমাদেরও নেই। আর এটাও কি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব যে, সেই সময়ে মদনদার থেকে টাটা হাজার গুণ বড়লোক ছিল, নাকি এখন সঞ্জীবের থেকে আদানি কোটি গুণ বড়লোক হয়েছে? আর তাদের থেকে টাটা আম্বানিরা কতগুণ বড়লোক বা টাটা, আদানির থেকে এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার গরীব কিনা তাতে সঞ্জীবের কি? সে তো তার বাবার থেকে ভাল অবস্থায় আছে এটাতেই সে সুখী।
অথচ এই বৈষম্যই এই সময়ের সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ যখন দেশে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি চরমে, গত বছরই ৭.৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে,১ আর এশিয়ার ধনীতম মানুষ হয়ে উঠেছে আদানি ২, একমাত্র ভারতীয় যিনি বিশ্বের ৮ জন ১০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদের অধিকারীর তালিকায় এসে গেছেন। World Inequality Report ২০২২অনুযায়ী, ভারতকে দরিদ্র ও এক অতিধনী অভিজাত গোষ্ঠী সম্পন্ন অসম দেশের শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের নীচের ৫০% মানুষ দেশের মোট আয়ের ১৩% এর মালিক, যেখানে উপরের ১০% মানুষ দেশের ৫৭% আয়ের মালিক। বিশ্ব পুঁজিপতিদের বড় সংস্থা World Economic Forum, যারা প্রতিবছর সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্বের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সম্মেলন করে থাকে তারাও এই বৈষম্য নিয়ে চিন্তিত। তারা তাদের এপ্রিল,২২ এর আলোচনাপত্রে করোনা-উত্তর বিশ্বে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়ংকর বেড়ে চলার কথা আলোচনা করেছে। ৩ বলা হয়েছে বিশ্বের উপরের দিকের ১০% মানুষ ৭৬% সম্পদের মালিক।
এই বৈষম্য কিন্তু রাতারাতি হয়নি, ভারতবর্ষে গত শতাব্দীর ন’য়ের দশকের প্রথমে যখন মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশনেই অর্থনৈতিক ঊবেবি-র (উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়ন) পথ নেওয়া হয়েছিল। অসাম্য বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও সেসময় কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু বলা হয়েছিল এটাই নাকি দেশজুড়ে উন্নয়নের একমাত্র পথ, এতে লোকে বড়লোক হবে, আর তাদের উপচে পড়া বা চুঁইয়ে পড়া পয়সায় গরীবদের অবস্থা ফিরবে। কিন্তু যারা এই নীতি প্রণয়নে ভারতের মতো বিভিন্ন দেশকে উৎসাহ দিয়েছিল সেই বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ এখন কঁকাচ্ছে কারণ এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নাকি এই সময়ের বিশ্বের সব থেকে বড় সঙ্কটের একটা।
তার কারণও খুব স্পষ্ট; জাতিসংঘের ২০২০-র রিপোর্ট বলছে বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়তে থাকা আয়ের বৈষম্য পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনকে খুব খারাপভাবে প্রভাবিত করছে। বেশির ভাগ উন্নত দেশে এবং কিছু মাঝারী আয়ের দেশগুলোতেও আয়ের বৈষম্য বেড়েছে এবং চীন সমেত, বিশ্বের দ্রুতবেগে বাড়তে থাকা অর্থনীতিতে এর পরিষ্কার প্রতিফলন রয়েছে৪।প্রশ্ন হচ্ছে এর আগে কি বৈষম্য ছিল না? যুগ যুগ ধরেই তো বৈষম্য আছে, কবে পৃথিবী জুড়ে সাম্য ছিল? তাহলে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে এতো কান্নাকাটি কেন? তার কারণ অবশ্য জাতিসংঘের ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে যে বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষের হাতে বেশির ভাগ সম্পদ জমা হচ্ছে। আগেও বড়লোক ছিল, এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯০ তে উপরের এই এক শতাংশের মানুষের হাতে সম্পদের ভাগ যত ছিল ২০১৫ তে তা অনেক বেড়ে গেছে। মানে বড়লোক আরো বড়লোক হয়েছে অন্যদিকে গরীবের সংখ্যা ও দারিদ্র্য দুই বেড়েছে ৫।
সাতের দশকের শেষে মাও-সে-তুং-এর মৃত্যুর পর, দেং-জিয়াও-পিং চীনদেশে কমিউনিজমের রাস্তা ছেড়ে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক পথে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পশ্চিমে মারগারেট থ্যাচার ও রোনাল্ড রেগান বাজার অর্থনীতিকে দৃঢ় করে পশ্চিমের সামাজিক ন্যায় ও সামাজিক নিরাপত্তার যে মডেল ছিল তাঁকে ত্যাগ করে এবং কাছাকাছি সময়ে হয় সোভিয়েত রাশিয়ার পতন। ভারত ও পিছিয়ে থাকেনি। নয়ের দশক থেকে মনমোহন সিং বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর এর হাত ধরে ঊবেবি-র পথে যাত্রা শুরু করে। যখন থেকে বাজার অর্থনীতিকে নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা প্রবল প্রতাপে ছড়িয়ে দিতে শুরু করল তখন থেকেই বড়লোকদের বড়লোক হওয়া বেড়ে গেল। আশ্চর্যের কথা দেখা গেল বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের গরীব মানুষরা তার সমর্থন করেছিল। ক্রমশ শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষদের সংগঠন ও আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ল। এরই সঙ্গে বাড়ল জলবায়ু পরিবর্তনের গতি। বিশ্বজুড়ে এই গণতান্ত্রিক পথে বাজার অর্থনীতি মেনেই তো আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি, এখন হঠাৎ রাস্তা পরিবর্তনের এতো ব্যগ্রতা কেন?
৩
এই জুলাই মাসে ঝাড়খণ্ডের দুমকায় রাজমহল পাহাড়ের নিচের গ্রাম হিরাপুরে বোধন পাহারিয়া বলেছিল যে এবারের বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে বীজতলাতেই সব বীজ শুকিয়ে গেছে, এবার বোধহয় খাবার চালটাও হবে না। ফেরার পথে দেখলাম পাকুড়, দুমকা, বীরভূম সব জায়গাতেই এক অবস্থা, বোধনের মতো অনেকেরই এবার বৃষ্টির অভাবে চাষ হবে না। এদিকে এখন প্রতি বছরই অস্বাভাবিক গরম, জলের অভাব এবং খরার প্রকোপ সাঙ্ঘাতিক বাড়ছে। এছাড়া এখন প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগর-উপকূলবর্তী মানুষজন বিশেষ করে সুন্দরবনের মানুষ এখন বছর বছর ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের শিকার। এদিকে এবছর লন্ডনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপর, গরমে স্পেনের ক্যাটালনিয়ায় দাবানল ভয়ংকর রকম ছড়িয়ে পড়ছে আর তাপপ্রবাহে ইউরোপে অনেক জনের মৃত্যুও হয়েছে, আমেরিকার ফ্লোরিডা অঞ্চলে সাইক্লোন এখন বাৎসরিক দুর্যোগে পরিণত। কানাডায় কিছুদিন আগের ভয়ানক সাইক্লোনে সাতদিন বিদ্যুৎ ছিল না। সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধাক্কা এতদিন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের অগণিত মানুষকে বিপর্যস্ত করছিল তা এখন পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষজনকেও বিপর্যস্ত করতে শুরু করেছে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গত দুই-তিন দশক ধরে নানা কথাই তো আমরা শুনে আসছি। তাহলে এইসব কথা বারবার ফিরে আসছে কেন? কারণ, কথা অনেক হলেও কাজ সেরকম কিছু এগোয়নি। তাই দেখা গেল এই বছরের গোড়ার জাতিসংঘে আই-পি-সি- সি’র বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে মানুষ এবং এই গ্রহের এক ‘বিপজ্জনক এবং ব্যাপক বিঘ্নের’ কারণ বলেছেন। এর প্রভাব সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা জানিয়ে বলেছিলেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দুই দশক ধরে বিভিন্ন ইকোসিস্টেম ধংস হবে, বহু জীব প্রজাতি বিলুপ্ত হবে, মারাত্মক তাপপ্রবাহ এবং বন্যার প্রকোপ বাড়বে। আই-পি-সি-সি’র অধিকর্তা হোই সুং-লি বলেন ‘এই রিপোর্ট নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি সম্পর্কে একটি মারাত্মক সতর্কতা’৬।এটা খুব স্পষ্ট যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনেক প্রতিশ্রুতি ও কথা হলেও কাজ কিছু এগোয় নি।
সতের জনের এক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গ্রুপ যাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পল এরলিখও আছেন, তাদের গবেষণা পত্রে ৭ বলেছেন, “এই গ্রহ স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর দুর্যোগের কারণে”ভয়াবহ এক বিশ্বব্যাপী জীববিলুপ্তির (Mass Extinction) পথে এগিয়ে চলেছে। তারা এও বলেন মানব প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হবে তার অজ্ঞতা ও নিস্ক্রিয়তা। তারা সাবধান করেছেন যে, মানুষ জীববৈচিত্র ধংসের ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের গুরুত্বকে এখনো ধরতেই পারেনি। তাদের মতে, এই সঙ্কটের মাত্রা এতো বড় যা মানুষ সমেত সমগ্র জীবমণ্ডলকে ধংস করবে, বিশালাকৃতির এই সঙ্কটকে সাধারণ মানুষ দূরে থাক বড় বড় বিশেষজ্ঞরাও অনুধাবন করতে অক্ষম ৮।এই বছরের প্রথম দিকে যখন এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তখনও বিশ্বের সব দেশ ২০১১ সালের জাতিসংঘের ঘোষিত ২০টি Aichi ৯ জীববৈচিত্র্য লক্ষ্যের একটাও পূরণ করতে ব্যর্থ। এর পরিণতিতে প্রাকৃতিক জগত সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে পড়ছে। বিগত ১০ বছরে দুবার বিশ্বের সব দেশ এই লক্ষ্য পুরণে ব্যর্থ হল। এবং ২০২২-এ গ্লাসগোর COP 26 সম্মেলনে ৫০টি দেশ পুনরায় অঙ্গীকার করেছে ২০৩০-এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বিশ্বকে বাঁচানোর।
এই বছর প্যারিসে Intergovernmental Science-Policy Platform on Biodiversity and Ecosystem Services (IPBES), তাদের নতুন রিপোর্টে দেখিয়েছে যে যদি বিশ্ব স্তরে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে ১০লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে মানুষ দুই-তৃতীয়াংশ স্থল এবং ৬৬% সামুদ্রিক পরিবেশের বড় রকম পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটিয়ে ফেলেছে।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এগোচ্ছে না কেন? জাতিসংঘের বিজ্ঞানীকূল এর নানা কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসাবে বিশ্বনেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন। এখন প্রশ্ন, বিভিন্ন দেশের নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটকে দেখেও নিজেদের দেশে এই সংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নে বারবার ব্যর্থ কেন? বিশেষ করে আমেরিকা চিনের মতো শক্তিশালী এবং বড় অর্থনীতির দেশের নেতৃবৃন্দ। এটা বুঝতে হবে, এটা তাদের খামখেয়ালীপনা নয়। বেশিরভাগ সময়েই তারা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিস্টেমে কাজ করে সেটাই তাদের কাছে বড় বাধা। আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্টই সেখানকার অসম্ভব শক্তিশালী খনিজ তেলের গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে জীবাশ্ম তেলের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আনতে পারবে না। অন্যদিকে ভারত ও চিনের মতো দেশের পক্ষে কয়লা বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে তাদের জ্বালানির প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। এখানে সাধারণ মানুষের সস্তায় যে জ্বালানির প্রয়োজনীতা, এইমুহূর্তে জীবাশ্ম জ্বালানিই তা মেটাতে পারে। দ্রুত উন্নয়নের সহজ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সব দেশই এমন এক উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছে এবং মানুষকে এমন এক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ করেছে, যে তারা এখন সহসা তার থেকে বেরোতে চাইবে না। এবং সব রাজনৈতিক দল জনগণের মতকে মেনে চলবে, ক্ষমতায় থাকার জন্য বা ক্ষমতায় আসার জন্য। অর্থাৎ এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট থেকে বেরোনোর পথে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন এই দুই বিশ্বব্যাপী সমস্যার মধ্যে কি কোন যোগাযোগ আছে? নাকি এরা একে অপরের থেকে আলাদা?
৪
বর্তমান সময়ে দ্রুত প্রযুক্তির পরিবর্তন এবং উৎপাদনে উন্নত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন কলকারখানায় কায়িক শ্রমের ও পরম্পরাগত শ্রমিকদের এক বড় অংশ তাদের কর্মসংস্থান হারাচ্ছে। অন্যদিকে কমসংখ্যক কিন্তু বেশি মাইনের আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। এর ফলে ভারতবর্ষের মতো যেসব দেশে শিক্ষার প্রসার ও মান খুব কম এবং আর্থিকভাবে দুর্বল এক বিশাল জনসংখ্যা কায়িকশ্রম ও পরম্পরাগত শ্রমের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এক বড় সংখ্যক শ্রমযোগ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে এবং সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পড়া যায় না যে অর্থনৈতিক অসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা আপাতভাবে দুটো আলাদা সমস্যা মনে হলেও এরা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটা বুঝতে হলে আমাদের এখানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে দেখা যায় জঙ্গলে ঢাকা এই মালভূমি-প্রধান অঞ্চলে আদিবাসীদের বাস এবং ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে এক সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। এখানকার জঙ্গলের কারণে জলের প্রাচুর্য ও জমির উর্বরতা অটুট ছিল, যা এখানকার আদিবাসীদের এক প্রকৃতি নির্ভর স্থায়ী, স্থিতিশীল জীবন ও জীবিকা দিয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ উপনিবেশিকতা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে, এই মালভূমি অঞ্চলের কাঠ ও খনিজ কাঁচা মালের জন্য বিগত দু’শ বছরে প্রাকৃতিক সম্পদের যে প্রাতিষ্ঠানিক লুট হয়েছে তাতে এখানকার বনভুমি ও জীববৈচিত্রের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ধংস হয়েছে তেমনই এখনকার আদিবাসীদের স্থায়ী, স্থিতিশীল জীবনযাত্রা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা যেমন দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে গেছে অন্যদিকে টাটা, জিন্দাল, গোয়েঙ্কা, আগরওয়াল, আদানি প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পরিবার এই খনিজ সম্পদ ও কাঠের ব্যাবসা করে বিগত বছরগুলিতে অসম্ভব সম্পদের মালিক হয়েছে। কিন্তু এ’ত বহুদিন ধরে চলে আসছে, আজ হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন উঠছে?
ক্রমশ এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশ্বঅর্থনীতির স্থায়িত্বকে এক গভীর সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দুই সমস্যা শুধু গরীব মানুষদের নয় বিশ্বপুঁজি ব্যবস্থাকেও এতটাই অনিশ্চয়তার সামনে এনে ফেলেছে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও চিন্তায় ফেলেছে। একদিকে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্যের প্রধান কারণ অন্যদিকে এই দুই সঙ্কট পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। এবং এর শিকার হবে বিশ্বজুড়ে অগণিত সাধারণ মানুষ ও প্রাণী।
আই-এম-এফ তাদের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে ১০ তাদের ভয়ের কারণ খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল গতিময়তায় বিশ্ব-অর্থনীতির অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন এবং এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। তারা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সঙ্কট বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট ১ শতাংশ বাড়লে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে ১.৫ শতাংশ হারে। এবং এই বৈষম্যের হার কিন্তু বিভিন্ন গ্রুপ্রের দেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হবে। ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে এর হার সাত গুণ বেশি হবে।
বর্তমান বাজার অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমারা এখন ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে এই বিপুল বৈষম্যকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, এক বিশাল অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কর্মহীন শ্রমযোগ্য কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন ভূমিকা থাকছে না, অন্যদিকে এইসব অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ এই বাজার ব্যবস্থায় উপভোক্তা হিসাবেও থাকবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এদের মুল্য যখন খুব কম তখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এদের ভূমিকা কেবল ভোট দেওয়ায়।
৫
বিগত চার দশকে বাজার অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির সাঙ্ঘাতিক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেল। প্রথম প্রথম ঘুষ নেওয়া বাড়ল, এর সাথে বাড়ল কালো টাকার রমরমা এবং এরপর বড় ব্যবসার ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার ও নানা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঠকিয়ে টাকা বানানো। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা দলের হয়ে ২০০১ সালে বাঙ্গারু লক্ষ্মণ মাত্র ১লক্ষ টাকা নিতে গিয়ে ধরা পড়েন আর এখন রাজ্যের নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় নাকি ৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে ধরা পরেছেন। এই দুটো নিশ্চয়ই সঠিক তুলনা নয় তবুও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সময়ের সাথে সাথে দুর্নীতির বিস্তার ও অঙ্ক দুটোই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভারতে দ্রুত বেড়ে চলা দুর্নীতিকে রুখতে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি আইন-ব্যবস্থাও ব্যর্থ। এরই সঙ্গে যেটা ক্রমশ কমছে সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ, সততা ও আদর্শ।
গ্লাসগোর COP 26 সম্মেলনের পর লেখক আমিতাভ ঘোষ সাম্প্রতিক এক ইন্টারভিউতে বলেছেন যে, এই সম্মেলনের ফলাফল থেকে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে, এরা এদের উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তার কথা থেকে এই জটিল সঙ্কটের সময় দুটো ভয়ের কথা একসঙ্গে বেরিয়ে আসে। এক,জাতিসংঘের মতো সকল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, যাদের কাজ এই সমস্যার সমাধান খোঁজা তাদের প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভেঙে পড়া, আর দুই; বিশ্বস্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা কোন এক দেশ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সামলানো অসম্ভব। প্রথম প্রসঙ্গে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে জাতিসংঘের অসহায় অবস্থার কথা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেন। বর্তমানে একজন সাধারণ মানুষ থেকে দুঁদে কূটনীতিক সবার কাছে স্পষ্ট যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে জাতিসংঘ বা অন্যান্য যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব ক্রমশ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। গত দুই বছরে কোভিড অতিমারির সময় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভুমিকা রাষ্ট্রনেতা থেকে সাধারণ মানুষের কাছে বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যে ভয়াবহ অবস্থা ছিল তার থেকে মানুষের বেরিয়ে আসার পথ হিসাবেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এবং গত শতাব্দীর আটের দশক পর্যন্ত এইসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের রাজনীতি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসার চেষ্টা করেছে। এদের কাজে এবং পরিচালনার মধ্যে বড় পরিবর্তন দেখা যায় আটের দশকের পর বিশ্বজোড়া বাজার অর্থনীতির প্রবল প্রতাপে।
বর্তমান বিশ্বে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থায় যে বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণ করে এবং সেখানে তারা যেসব চুক্তি করে বা কথা দেয় সেসব কথা বা চুক্তির শর্ত মানার কোন দায় তাদের নেই। যেমন রাশিয়া গত বছর নূতন দিল্লির ব্রিক্স (BRICKS) ঘোষণাপত্রে সাক্ষর করেছিল এই বলে যে ব্রিক্সদেশের সদস্যরা কোন সার্বভৌম দেশকে দখল করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তাঁর কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ইউক্রেন আক্রমণ করে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিগত ২৫বছরে নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তিতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বারবার আমেরিকা, চীন সহ পশ্চিমের উন্নত দেশ এইসব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এক বা দুই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী বা দেশের রাষ্ট্রনায়ক তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার জোরে বিভিন্ন দেশের মেনে নেওয়া চুক্তির বাস্তবায়ন আটকে দিচ্ছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অসহায়ের মতো তা দেখছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষজন এবং তৃতীয় বিশ্বের অসংখ্য গরীব দুর্বল মানুষ। অথচ মজার ব্যপার হচ্ছে বিগত চার’শ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের উপর দাঁড়ানো প্রথম বিশ্বের সমস্ত পাপের বোঝা, এই তৃতীয় বিশ্বের মানুষজন এখনো বয়ে চলেছেন। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধের ফল হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির চাপে তারা বিধ্বস্ত, তাদের অবদান বিশ্ব-উষ্ণায়নে সবথেকে কম অথচ এর সমস্ত খারাপ ফল তারা সব থেকে বেশি ভোগ করে চলেছে। এই সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকৃতি বন্ধ করার জন্যই একসময় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুচনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এইসব প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশ ও গোষ্ঠীর হাতে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্রমাগত ব্যবহৃত হচ্ছে।
করোনা সময়ে দেখা গেল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিদের দাপট ও মাত্রাহীন লাভের গল্প। ক্রমশ এইসব অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থাদের লাভের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে তাদের প্রভাব দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর পড়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল, তথ্যপ্রযুক্তি, জীবাশ্ম শক্তি ও বিনোদন সংস্থার লবি এবং সবার ওপরে এদের পুঁজির জোগানদার, আর্থিক বাজারে বিদেশের রাজনীতি বিদেশনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকেও লাভের জন্য ব্যবহার করে গেছে।
৬।
এই সময়কালের এক বড় চিন্তাবিদ ইউভাল নুহা হারারি তাঁর ‘দি সেপিয়েন্স’ বইয়ে, পৃথিবীর অন্য সব প্রাণীর মধ্যে মানুষের অভূতপূর্ব সাফল্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মানব-সভ্যতাকে প্রভুত ক্ষমতার অধিকারি করে তোলে, মানুষের সমষ্টিগত কল্পনা এবং তাকে নির্ভর করে অসংখ্য মানুষের সমবায় ও সংগঠিত কর্ম প্রয়াস। এই সমষ্টিগত কল্পনা জন্ম দেয় দেশ, সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র, ধর্ম, গণতন্ত্র, সমানাধিকার ইত্যাদি, বস্তুত যার উপর বর্তমান মানব-সভ্যতা দাঁড়িয়ে। এইসব কল্পনায় এমন একটা মহান উদ্দেশ্য থাকে যা সমষ্টি অন্তর্গত ব্যক্তিকে এক বৃহৎ উদ্দেশে উত্তীর্ণ হবার বা বড় কিছু পাবার অনুপ্রেরণা যোগায়। অগণিত মানুষ তাদের সেই সমষ্টি-কল্পনাকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একসঙ্গে কাজ করে, ঘাম ও রক্ত ঝরায়। অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস এবং তা বাস্তবায়নের যে চেষ্টা, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানব সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কাহিনী। প্রকৃতপক্ষে আজকের বিভিন্ন রাষ্ট্র বা ধর্ম তো অনেক মানুষের সমষ্টিগত কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে যে বর্তমানে আমরা মানব সভ্যতার যে সঙ্কট দেখছি তাঁর সমাধানে এইসব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ কেন? ক্রমশ কর্কট রোগের মতো যেসব সমস্যা মানব সভ্যতাকে গ্রাস করতে চলেছে তার সমাধানে মানুষের সেই সমষ্টিগত কল্পনা নির্ভর কাজের ব্যর্থতা কেন? অমিতাভ ঘোষের মতো লেখকদের কেন মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানেরা মৌলিকভাবে ভেঙে পড়েছে সভ্যতার বৃহত্তম সঙ্কটের মোকাবিলায়? মনে রাখতে হবে এই দেশ, রাষ্ট্র, ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এই সমষ্টিগত কল্পনা জন্ম দিয়েছে বৃহৎ কর্পোরেট, আইন ব্যবস্থা, মুদ্রার এক বৃহৎ কাল্পনিক কাহিনী যাদের মানুষের মন এবং তাদের তৈরি ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন জাগতিক অস্ত্বিত্ত নেই। কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত মানুষের স্বার্থ, লোভ ও বাসনা এবং এই এইসব সমষ্টিগত লোভের জীবনযাত্রার কিন্তু এক বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব আছে। অনেক মানুষের মধ্যে দিয়ে অনেক সময় ধরে চর্চিত হতে হতে এইসব লোভ ও বাসনা বাস্তবের মতো অনুভূত হতে থাকে।
গ্রীক সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায় যে গ্রীসের নগরসভ্যতার পরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্যের আক্রমণকে রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্পারটার যুদ্ধ বা ম্যরাথনের যুদ্ধের কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এক শক্তিশালী গ্রীক সাম্রাজ্য গঠনের সমষ্টিগত কাহিনীর পরিণতি। লেনিন
ও বলশেভিক নেতৃত্বের সাম্যের ও সমাজতন্ত্রের কাহিনীর সফল সমষ্টিগত পরিণতিই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম দেয়। ঠিক এইরকম শক্তিশালী জাতির কাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করেই চেঙ্গিস খান বাউন্ডুলে যাযাবর মোঙ্গলিয়ানদের এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। জার্মানদের জগতশ্রেষ্ঠ মানবজাতি বানানোর কাহিনী সফলভাবে বিক্রি করেই হিটলার থার্ডরাইখের সর্বময় কর্তা হন। অর্থাৎ এইসব সফল সমষ্টিগত কাহিনী মানব সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করে চলেছে। তাহলে এখন যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা দেখছি, তার কারণ কি?
কারণ আমরা অন্যদিকে দেখছি না আরেক শ্রেণির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সফলতা। বাজার নির্ভর বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজী অহিংস পথে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাবেন না মুসোলিনি ইটালিকে ফ্যাসিস্ট পথে চালিত করবে, সবই নির্ভর করবে বৃহত্তর জনগণের সমষ্টিগত চিন্তার উপর। ঠিক সেরকমভাবেই যেসব মানবতামুখী প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর মানবসমাজ বা সমগ্র মানব প্রজাতিকে রক্ষা করার কথা ভাবছে তাদের থেকে যখন লাভ ও লোভ-নির্ভর বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থারা প্রভুত অর্থনৈতিক ক্ষমতায় বলশালী হয়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের সুবিধামত সমষ্টিগত চিন্তার জন্ম দিচ্ছে, তখন তারা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের সকল প্রতিষ্ঠানকেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
৭
গত ১লা আগস্ট ভারতে ৫জি স্পেকট্রামের নিলামে সব থেকে বেশি মুল্য পাওয়া গেছে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১০ সালে যে ২জি স্পেকট্রামের দুর্নীতির কথা শোনা গিয়েছিল, সেখানে CAG বলেছিল ২জি’র নিলামে নাকি ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অর্থাৎ ২০১০-এর ২জি নিলামের লোকসান ২০২২এর ৫জির নিলামের সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে বেশি। এটা কি সম্ভব? মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই সময়ে ২জি নিয়ে যে দেশব্যাপী জনমত তৈরি হয়েছিল তার তুলনায় এখন সব চুপ। কেন? কারণ তখন জনমত তৈরি করতে বিরোধী দল সক্ষম হয়েছিল, এখনকার বিরোধী দল তা করতে পারছে না। কিন্তু এটা কি কেবল রাজনৈতিক বিরোধী ও সরকার পক্ষের লড়াই, নাকি অন্য কিছু? প্রশ্ন আসবে এর মোটিভ বা উদ্দেশ্য কি? কে বা কারা সব থেকে বেশি লাভবান হ’ল এইভাবে মূর্তির জনমত তৈরির খেলায়? মুঠোফোনে মাথা গুঁজে বসে থাকা জনগণ এই মুহূর্তে এই নিয়ে আলোচনায় রাজি নয়। এই যে মুঠোফোনের সমাজ মাধ্যমের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা তাই ক্রমশ জনমত তৈরির অব্যর্থ ওষুধে পরিণত হয়েছে।
শ-বারো বছর আগেও রেডিও টেলিভিশনের মতো ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের উপর রাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করত যাতে মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধ মাধ্যমের পক্ষে সব মানুষকে ব্যাক্তিস্তরে প্রভাবিত করা বেশ শক্ত। বর্তমানের ইন্টারনেট-নির্ভর ইলেক্ট্রনিক সমাজমাধ্যমের সঙ্গে কম্পুটার-নির্ভর কৃত্রিমবুদ্ধির (Artificial Intelligence) অসীম শক্তিশালী এলগোরিদম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার অসীম ক্ষমতা এনে দিয়েছে গুগুল, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো বিভিন্ন সমাজমাধ্যম চালানো কোম্পানিদের হাতে। জনমতকে নিজের দিকে আনার জন্য দরকার দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছে তাদের মতো করে বোঝানোর অস্ত্র, যা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বলে এইসব অমিতবলশালী কর্পোরেট গোষ্ঠী এখন করতে সক্ষম। এটা কোন উর্বর মস্তিস্কের যথেচ্ছ কল্পনা নয়, এটা বাস্তব। কিছুদিন আগের নীল তিমি ‘Blue Whale’ ইন্টারনেট খেলাটির কথা ভাবলে বোঝা যায়। বহুদূর থেকে এই মাধ্যমের দ্বারা একজন মানুষকে এতোটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায় যে, সে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পিছপা হয় না।
সাম্প্রতিক নেট দুনিয়ার অনেক মানুষই নেটফ্লিক্সের তথ্য-চিত্র ‘The Social Dilemma’ দেখে নড়ে চড়ে বসেছেন। এই তথ্যচিত্রে দেখান হয়েছে আজকের জগত বিখ্যাত ও বৃহৎ সমাজ মাধ্যমের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ প্রযুক্তিবিদদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার। এদের অনেকেই এইসব সমাজমাধ্যমের শুরুর সময় থেকে জড়িত ছিলেন। যেভাবে এইসব সমাজমাধ্যম আমাদের চিন্তাকে নিয়্ন্ত্রণ করছে ও নিজেরদের স্বার্থে ব্যবহার করছে তাতে এরা প্রত্যেকেই ভয়ংকর বিপদের আশঙ্কা করছেন। এই তথ্যচিত্র থেকে তিনটে জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে;
ক) আমাদের মনোযোগ এখন পণ্য। সমাজ-মাধ্যম কোম্পানিদের প্রধান উদ্দেশ্য, আমাদের মনোযোগ দখল করা এবং বাজারে যে সব থেকে বেশি পয়সা দেবে তাকে বিক্রি করা। এই প্রবাদটা এখন খুব প্রচলিত হয়েছে, তুমি যদি কোন পণ্য বিনামুল্যে পাচ্ছ তাহলে জানবে তুমিই পণ্য। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিখ্যাত বই ‘The Attention Merchants’-এর লেখক টিম ঊর মতে, এই মনোযোগ-ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মডেলই হচ্ছে মানুষের চিন্তায় প্রবেশ করার যে পথ তাকে বিক্রি করা। ‘এই মনোযোগ শিল্পের প্রধান প্রয়োজন ক্রমাগত বিক্ষিপ্ত মন যাকে সহজেই বিজ্ঞাপনের জন্য খোলা যাবে’, এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ‘বিক্ষিপ্ত মনের অসুস্থতা’ বা ‘Distraction Sickness’। যা ইতিমধ্যে হয়ত আপনাকে আমাকে ধরে ফেলেছে।
খ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব সাইটেরই পরিকল্পনা হচ্ছে আসক্তি বা নেশা ধরানো। মানব মনের দুর্বল জায়গার সুযোগ নিয়ে তাকে ব্যবহার করা। অর্থাৎ আপনি যে ধরনের জিনিস পছন্দ করেন বা ভালোবাসেন তাকে লক্ষ্য করা এবং বারবার আপনার সামনে নানা ভাবে নিয়ে আসা যাতে আপনি তার থেকে বের হতে না পারেন। এবং সে যতো আপনাকে টানতে পারবে ততো আপনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
গ) এরা কোন সাধারণ ব্যবহার করার যন্ত্র (tool) নয়। যেমন ধরুন দেওয়ালে পেরেক লাগানোর জন্য আপনার একটা হাতুড়ি আছে। আপনার প্রয়োজন হলে আপনি হাতুড়ির ব্যবহার করেন এবং তার বাক্সে রেখে দেন, হাতুড়ি কখনই বাক্সে ঠকঠক করে মাঝে মাঝে বলে না দেখুন, ওইখানেও একটা পেরেক আছে ইত্যাদি। কিন্তু সামাজমাধ্যম আপনাকে প্রতিনিয়ত জানায় আপনাকে কত লোক ভালো বলল, কত লোক আপনার বন্ধু, তারা এই মুহূর্তে কতো আনন্দ করছে ইত্যাদি। বারবার সে আপনাকে ডাকছে, আপনার দুর্বলতা অনুযায়ী প্রলুব্ধ করছে এর মধ্যে ঢোকার জন্য।
অর্থাৎ মানুষের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদও এখন এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সমষ্টির কল্পনাকেই যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে সভ্যতাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটেও সরকারের দোষ দেখতে পেলো না, অন্যদিকে কয়েক বছরের মধ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, এক বড় সংখ্যক মানুষের প্রধান শত্রুতে পরিণত হল, কোনটাই আকস্মিক ঘটনা নয়।
৮
এই অবস্থার প্রাথমিক কারণ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের প্রকৃতি থেকেই উদ্ভূত। পুঁজিবাদের অধীনে কার্যত মানুষের সমস্ত উদ্যোগ যে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তা সম্পদের ব্যবহার কম করতে গিয়ে প্রযুক্তির দ্বারা দক্ষতার যে ভয়ংকর উন্নতি করেছে তা অনিবার্যভাবে আরও শোষণের বিশালব্যবস্থা হয়ে ওঠে, যা সম্পদের ব্যবহার কম করার বদলে, তাকে বাড়ানোর দিকে নিয়ে চলেছে। এই গতিশীল অবস্থা, জেভনস প্যারাডক্স নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভন্স প্রথম এই প্যারাডক্সের কথা বলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, জেমস ওয়াটসের বাষ্প-ইঞ্জিন, কয়লা-চালিত ইঞ্জিনগুলির ক্ষমতা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে উন্নত করে, ইঞ্জিনে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যদিকে আবার কয়লার ব্যবহারের নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটায়। একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার পরিমাণ কমে গেলেও, ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে যায়। জেভন্স প্যারাডক্সে আমরা বাস্তবে দেখি মোটর গাড়ির জ্বালানীর দিকে দক্ষতা যত বেড়েছে তা মানুষকে দীর্ঘ দূরত্বে গাড়ি চালাতে উৎসাহ দিয়েছে। কয়েকজন হাতেগোণা বড়লোক উপভোক্তা নন, গণ হারে মানুষকে উপভোক্তায় পরিণত করে।
এখন এই জেভন্স প্যারাডক্সকে বিশ্বব্যাপী বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে দেখা যায় যে এটি আসলেই কোনো প্যারাডক্স নয়, বরং এটাই পুঁজিবাদের অন্তর্নির্মিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। শেয়ারহোল্ডার-মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলি, বৈশ্বিক-পুঁজিবাদের প্রাথমিক এজেন্ট হিসাবে, আইনগতভাবে গঠিত হয়, শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা বাধ্যতামূলকভাবে সর্বাধিক করার জন্য। যদিও শেয়ারহোল্ডারদের আইনত ‘মানুষ’ বলে ধরা হয় কিন্তু তারা যদি প্রকৃতপক্ষে মানুষ হয় তবে তারা সাইকোপ্যাথ হিসাবে গণ্য হবে, কারণ তারা নির্মমভাবে তাদের সব থেকে বেশি মুনাফার লক্ষ্য পূরণের জন্য যে কোন আনুসঙ্গিক ক্ষতির বিবেচনা করে না। আজকে এই মুহূর্তে বিশ্বের ১০০টা বড় অর্থনীতির মধ্যে ৬৯টাই বৃহৎ কর্পোরেশন, যেগুলি সম্মিলিতভাবে একটি ভয়ংকর শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে যার একটি মাত্র লক্ষ্য, দ্রুততম হারে অবিরাম মুনাফা বৃদ্ধির জন্য মানবতা এবং বাকি জীবকে ব্যবহার করা ১১।
সত্যিই কি মানবপ্রজাতি তারি সভ্যতার চাপে ধ্বংস হতে চলেছে, নাকি এলান মাস্কের রকেটে চড়ে মঙ্গলে গিয়ে বসতি বানাবে? কে জানে, তবে আবার আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয়নি, তিনি বলেছিলেন মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই সময়ে কিছু রাস্তার কথা বিশিষ্ট, প্রাজ্ঞ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এই জটিল অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য। উপরে উদ্ধৃত Frontiers in Conservation Science এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এই বিপুল বিশ্বব্যাপী সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সাম্যের সুদুর প্রসারী পরিবর্তন। এই রিপোর্টের গবেষকরা যে যুক্তিপূর্ণ সুপারিশ করেছেন তার মধ্যে আছে অবিরাম এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চক্রকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা, পরিবেশের বিভিন্ন বস্তু ও পরিষেবার সঠিক মুল্যায়ন, সম্পূর্ণভাবে জীবাশ্ম শক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা, কর্পোরেট গোষ্ঠীর লবিং বা সীমাহীন তদ্বিরের উপর লাগাম টানা এবং নারীদের সশক্তিকরণ।
গারডিয়েন পত্রিকায় ফিল ম্যাকডাফের এক নিবন্ধের ১২ শিরোনাম ‘Ending climate change requires the end of capitalism. Have we got the stomach for it?’ এখানে লেখক বলেছেন নীতির ছোটখাটো পরিবর্তনে এখন আর কোন কাজ হবে না, এখন রান্না ঘরের নোংরা জলের গামলাটাকেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হবে, কাজ, মালিকানা এবং পুঁজি নিয়ে।
বিভিন্ন আলোচনা থেকে একটা সত্যি বেরিয়ে আসে যে মানুষ ঘরের মধ্যে উপস্থিত বিরাট উটটাকে আর উপেক্ষা করতে পারবেনা, সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। এই উটটা এত বড় এবং এত স্পষ্ট এবং সর্বব্যাপী যে তাকে অর্থনৈতিক কচকচি দিয়ে বা রাজনৈতিক প্যাঁচ কষে আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই উট হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণ সভ্যতাকে এক ভয়ংকর সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরই প্রতিফলন আমরা দেখি ষোল বছরের কিশোরী গ্রেটা থানবারগের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে। তার সঙ্গে যখন তার বয়সী কিশোর কিশোরীরা রাস্তায় বেরিয়ে আমাদের প্রজন্মকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে তখন মনে আশা জাগে।
১.https://www.cnbc.com/2021/03/19/covid-pandemic-pushes-75-million-more-people-into-poverty-in-india-study.html
২https://www.forbes.com/sites/jemimamcevoy/2022/04/11/indias-gautam-adani-is-now-richest-asian-
৩.https://www.weforum.org/agenda/2022/04/economic-inequality-wealth-gap-pandemic/
৪. World Social Report 2020
৫. World Social Report 2020
৬. IPCC adaptation report 2022
৭. a report in Frontiers in Conservation Science
৮.https://www.theguardian.com/environment/2021/jan/13/top-scientists-warn-of-ghastly-future-of-mass-extinction-and-climate-disruption-aoe
৯. UN Convention of Biological Diversity in 2011
১০. IMF Working Paper No. WP/22/103, For whom the Bell Tolls: Climate Change and Income Inequality, May 2022
১১.https://www.resilience.org/stories/2021-10-13/solving-the-climate-crisis-requires-the-end-of-capitalism/
১২https://www.theguardian.com/commentisfree/2019/mar/18/ending-climate-change-end-capitalism