সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাংলার পথে পথে, মাঠে মাঠে সুর। সে সুরের কতই না বিভাগ, কতই না ভাব, কতই না মিষ্টতা। লোকজীবনের একটি অঙ্গ সেই গান। নদীর গান, মাঠের গান, ঘরের গান, আঙিনার গান, পথের গান, চাষের গান, পরবের গান, বিয়ের গান—সকালের গান, সন্ধ্যের গান, রাতের গান—মেয়েদের গান, পুরুষের গান—একার গান, আসরের গান, সম্মিলিত গান—কতই না বৈচিত্র। এই সুর, এই গান আজকের নয়—এর ইতিহাস বহু প্রাচীন। অথচ এর কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। এই গান আদিম, সরল এবং অবরোহক্রমিক।
‘ধারাবাহিত ঐতিহ্যানুগ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ’ই ‘লোক’। তাঁদের মুখের গান-ই লোকগান। কেউ কেউ একে সঙ্গীত আখ্যা দিতে আপত্তি জানালেও তা অবশ্যই ‘লোকসঙ্গীত’ বা ‘লোকগীতি’ বা ‘লোকগান’। লোকজীবনের সঙ্গে জড়িত এই গান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র। লোকসমাজের জীবন ছন্দের প্রতি মুহূর্তে যা প্রবণতা হয়ে ধরা দেয় সেই সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী অংশ এই গান। ফলে সেখানে ধরা পড়ে লোকজীবনের নানান কথকতা, ধরা পড়ে আধ্যাত্মিকতা। জটিল তত্ত্বের বিষয়ও সহজ হয়ে ধরা পড়ে এইসব গানে। বাউল গানের ভাষা, ছন্দ, সুর তাই সহজেই হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে যায়। আবার যখন শুনি ভাটিয়ালি, সারি, ভাওয়াইয়া, তখন জীবন, জীবনের টুকরো টুকরো আখ্যান উঠে আসে গানের ভাষায়। এই গানের পদবিন্যাস সরল, ভাষা সহজ, ভাব বোধগম্য, তাও-ছন্দ-লয় সহজ, সুরও স্বতঃস্ফূর্ত। এই গানে কোনো বাধা নেই, আছে হৃদয়-মনের স্বতঃউৎসারিত আবেগ। তাই রাস্তায় ভিখারি গান গায় এই সুরে, রাখাল বালক আপন মনে সুর ধরে, খেলতে গিয়ে শিশুরাও গান করে। কেবলই আনন্দ নয়, সুখে-দুঃখে, অসহায়তায়, যন্ত্রণায়, ক্রন্দনে, প্রেমে, ভালবাসায়, জীবনানুভূতির গভীরতায় এই গান বেরিয়ে আসে তথাকথিত লেখাপড়া না জানা খেটে খাওয়া মানুষগুলির হৃদয় থেকে। এই গান তাঁদের জীবন। তাঁদের জীবনের নির্যাস-ই এই গান।
এই গানের সঙ্গে যুক্ত থাকে আরো কত বিচিত্র বিষয়। গানের জন্য বাদ্যযন্ত্রও তাঁদের হাতেরই তৈরি। কখনো খালি গলাতেই গান, বাদ্যযন্ত্র লাগে না—ভাদু টুসু, ভাটিয়ালিতে সেই দৃশ্য দেখা যায়। তবে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সাধারণত একতারা, দুতারা, খঞ্জনি, সারেন্দা, গাবগুবি, বেণা, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ—এইসব ব্যবহৃত হয়। এগুলি ‘লোকবাদ্য’ নামে পরিচিত। অবাক করার বিষয়, সাধারণ মানুষ তার নিজস্ব ছন্দকে নিজস্ব সুরকে কীভাবে নিজের হাতে বানানো একেবারে সাধারণ যন্ত্র দিয়ে মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলে। যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু নিয়েই সে সন্তুষ্ট।
লোকসঙ্গীতের সুরবৈচিত্র যেমন লক্ষণীয়, তেমনি এর আঙ্গিক ও বিষয়বৈচিত্রও বহুধা। নৌকা চালাতে চালাতে মাঝিরা গান করে, কখনো এককভাবে, কখনোবা সম্মিলিত ভাবে। পথ চলতে চলতে একাকী বা সম্মিলিতভাবে বৈষ্ণব ভিখারিদের গান আজ আর শোনা না গেলেও তা একসময় বাংলার পথে-ঘাটে মিশে থাকত। বাউলেরাও একইভাবে গান ধরে। তবে এখন আখড়ায় কিংবা অনুষ্ঠানে সেই সুর শোনা যায়। বাসে বা ট্রেনেও মাঝে মাঝে বাউলদের দেখা পাওয়া যায়। বঙ্গে চৈত্র মাসের গাজন বিখ্যাত। সেই উপলক্ষে নীলের গানও জনপ্রিয়। নীল অর্থাৎ শিবের গান। হর-পার্বতী সেজে নৃত্যশেষে চলে শিব-দুর্গার পারিবারিক জীবনের ঘটনা সম্বলিত গীতি—‘মন দিয়ে শোন সবে, হইবে শিবের বিয়ে/ কৈলাসেতে হইবে অধিবাস’। গাজন উপলক্ষে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় চলে বোলান গান। বহু সম্প্রদায় কোন এক গ্রামের নির্দিষ্ট আটচালায় কিংবা বড় বৃক্ষের নিচে এসে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে বোলান গান ধরে। এই গানের অধিকাংশই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক। মালদহে বৈশাখ মাসে শিবের গাজন উপলক্ষে প্রচলিত শিবের গান—গম্ভীরা। গম্ভীরার মতোই শিববন্দনা ও শ্লেষাত্মক গান গাওয়া হয় মুর্শিদাবাদ, বীরভূমে, যার নাম আলকাপ। পূর্ববঙ্গে নদীতে নৌকায় পাল তুলে ভাটিয়ালি গান গায় মাঝি—‘কুচবরণ কইন্যা রে তার মেঘবরণ কেশ’। ভাটিয়ালি সুরের অনুরূপে উত্তরবঙ্গে মাঠের গান ভাওয়াইয়া প্রসিদ্ধ। মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, প্রেমের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত আহয় এই গানে। যুবকের যুবতী সেজে নদীর ঘাটে ঘাটে আসর জমিয়ে নাচের সঙ্গে গান করার রীতি প্রচলন আছে পূর্ববঙ্গে, যার নাম ঘাটু গান। এগুলি ছাড়াও আছে পিরকীর্তন, গাজির গান, জারি গান, কিচ্ছার গান, রামগান, পালাগান, কবিগান, গ্রাম্য কীর্তন, ভাসান গান, পটের গান, বিয়ের গান, ছাদ পেটানোর গান, সারি গান, ঝুমুর, টুসুর গান, ভাদু গান—আরো কত কি।
এইসব গান শুধুই কী গান! গানের সঙ্গে মিশে থাকে কত শত ইতিহাস, কত অজানা গল্প, সাধারণের জীবনপ্রবাহের কত খুঁটিনাটি বিষয়। মিশে থাকে কত পেশার মানুষের কথা, কত শিল্পীর যোগসূত্র, কত পরিবেশের বিভিন্নতা। ফলে লোকসঙ্গীত কেবল শিল্পীর বা গায়কের মনের কথা বা প্রাণের কথা-ই নয়, বরং বলা চলে জাতির কথা, ইতিহাসের কথা, জনসমাজের এক অভিব্যক্তিময় দলিল। রাঢ়বঙ্গে প্রচলিত আছে ভাদু টুসুর গান, বাউল গান, ঝুমুর গান, বিয়ের গান, পটের গান, কীর্তন গান, কবিগান, রামায়ণ গান, হাপু গান, বাঁধনার গান, ঝাপান গান ইত্যাদি।
ভাদ্র মাসে ভাদু পূজা। রাঢ় বাংলার মেয়েরা মেতে ওঠে এই পুজোয়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়িতে ভাদু পাতা হয়। একমাস ধরে গ্রামাঞ্চলের চলে মেয়েদের আসর। কোন মন্ত্র নেই, আছে কেবল গান। গান দিয়েই দেবীর আরাধনা। ভাদুর মূর্তি সামনে রেখে কিংবা প্রদীপ দেওয়া টেরাকোটার তৈরি বাটিতে সলতে দিয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে রাত জেগে ভাদুর গান করেন মেয়েরা। একসঙ্গে। এক সুরে। বাদ্যযন্ত্র লাগে না। সামনে রেকাবিতে নামানো থাকে সাধ্যমতো মিষ্টান্ন দ্রব্য। প্রায় সবই বাড়ির তৈরি হয়। কখনো দোকান থেকে কিনে আনা খাজা, জিলিপি। সংক্রান্তির রাত ভাদু উৎসবের শেষ রাত—জাগরণের রাত। এক গ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পাড়ায় ভাদুপূজা করে থাকে মেয়েরা। তাই প্রায় প্রত্যেকেই উৎসবের সাজসজ্জা বা ভাদুমূর্তি দেখতে যায়। আর ভেসে আসে গান—“ভাদু বৈল্তে আলি তোরা / বৈস লো তোরা ছাঁচকলে। /পাৎনা ভর্যের মাড় রাখ্যেছি / খা লো তোরা প্যাট ভর্যেৈ।।”
ভাদুপূজা সম্পর্কে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত রাঢ়বঙ্গে। কথিত আছে পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজার সুন্দরী কন্যা হলে ভদ্রেশ্বরী। তাঁর বয়স বাড়লেও উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় না। মনের দুঃখে তাই সে প্রাণত্যাগ করে। রাজা কন্যাশোকে পাগলপ্রায় হয়ে যান। সেই বছরই তিনি তাঁর মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি ব্রত উদ্যাপন করেন। সেই থেকে তাঁর রাজ্যে ভাদুব্রত পালন করা হয়। এই কিংবদন্তী বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায় একটু এদিক ওদিক করে। তবে কাহিনি যাই হোক না কেন, ভাদ্র মাসের শুরু থেকে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে যেভাবে গীতসহকারে দেবীর আরাধনা করা হয়, তাতে প্রতিফলিত হয়ে পড়ে সমাজের বহু বিচিত্র দিক। বিবাহিত নারীর একান্ত যাপনচিত্রের পাশাপাশি উঠে আসে তাঁর যন্ত্রণার কথাও। একটি ভাদু গানে পাওয়া যায়—“শ্বশুর বাড়ির লোক এসেছে, হেইমা কিছু বলো না/ শাশুড়িতে শুনত্যে পেলে, আমায় দেবে গঞ্জনা।”
ভাদুর গানগুলো প্রথমাবস্থায় কীরূপ ছিল তা জানা না গেলেও বর্তমানে যে তাতে নব নব বিষয় সংযোজিত হয়েছে তা বোঝা যায়। সচেতন কবিদের কলমের জোরে ভাদুর গানে গুরুত্ব পেয়েছে সমকালীন সমাজ, পুরাণ-ইতিহাসের কাহিনি, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে যুদ্ধ-মহামারির গল্প। তবে এটুকু বোঝা যায়, ভাদুর কাহিনি বর্ণনা ও রূপমুগ্ধতা, নারীর যন্ত্রণা, তার সুখ-দুঃখের নিত্যনৈমিত্তিক অনুভূতি বিষয়ক গানগুলিই প্রাচীন। যেমন—‘কি কি গয়না লিবি ভাদু বল না গো আমারে।/ পায়ে লিব নুপুর তোড়া সাজবো গো বাহারে।।/ আর কি কি গয়না লিবি ভাদু বল না গো আমারে।/ নাকে লিব নথের টানা সাজব গো বাহারে।।” এই গান শুনে কি কেবলি মনে হয় যে এ কেবল ভাদুর চাহিদা? নাকি খেটে খাওয়া চাষী-মজুর পরিবারের মেয়েদের মিষ্টি-মধুর কামনা? এই হল ভাদুর গান।
এবার আসা যাক সময়কাল ধরে ভাদু গানের বাস্তবের একটা দিকে। ভাদ্র মাস বঙ্গে বন্ধ্যা মাস। প্রায় সকল রকম শুভ কাজ বন্ধ। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধের পর ভাদুর সামনে চলে গান। চাষী-বাসী মানুষগুলোর বাড়িতে সলতে পাকানো প্রদীপ বা লণ্ঠনের আলোয় এই আসর জমে। চাষ শুরু প্রায়। জ্যৈষ্ঠ মাসে ধানের বীজ বপন করা হয় চারা তৈরির জন্য। ১৩ জ্যৈষ্ঠ রোহিনীর দিন চাষীঘরের মেয়েরা বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে ক্ষেত থেকে মাটি এবং সাহাড়া গাছের ডাল নিয়ে আসে। বীজ বপনের সময় ধানের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় রোহিন মাটি। ৭ আষাঢ় পালন করে অম্বুবাচী। এদিন চাষের কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। এরপর ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষ একাদশীতে জাওয়া পরব। শস্য ও সন্তান কামনায় এই পরব। অনেকেই জাওয়া-করমের সঙ্গে ভাদুপূজার যোগসূত্র টেনে ভাদুপূজা জাওয়ার অঙ্গ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এভাবে ভাবলেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাংলার সংস্কৃতির বেশিরভাগটাই যেহেতু কৃষির সঙ্গে যুক্ত তাই ভাদুপূজাকেও কৃষি-সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। জাওয়াতে যেভাবে শস্য কামনা করে বীজের অঙ্কুরোদ্গমকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, তেমনি ভাদুপূজার গানেও সেই আবেদন কম-বেশি লক্ষ করা যায়। সেইসঙ্গে একটি বিষয়, আদিবাসী সমাজে শিকার উৎসবের ক্ষেত্রে উৎসবে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যেরূপ আদিবাসী নারী তাঁর পতির কাছে বিনিময় স্বরূপ ফুল-পাতা চায়, সেরূপ চাষের কাজের শুরুতেই যেন ভালবাসার স্বীকৃতি পেতে চায় চাষী ঘরের মেয়েরা। মূল চাষ শুরুর ঠিক পূর্ব মুহূর্ত এই ভাদ্র মাস। পুরুষের সঙ্গে মেয়েদেরও সেই কাজে যোগ দিতে হয়। ধান চারা লাগানো থেকে শুরু করে ধান ঘরে আনা পর্যন্ত। সংসারের যাবতীয় কাজ তো আছেই, সেইসঙ্গে চাষের কাজ। ফলে এক হাতে সংসার আর অন্য হাতে চাষ—দুই-ই সামলাতে হয় বাড়ির মেয়েদের। তাই কিছু অভিমান, কিছু চাওয়া, কিছু কামনা তাঁদের থেকেই থাকে। যেন বলতে চায় এবারের চাষে উপার্জন হলে তাঁর খাটুনির স্বীকৃতি স্বরূপ যেন একতু সুখ, একটু আনন্দ দেওয়া হয়। সে হয়তো পায়ের তোড়া, নাকের গয়না কিংবা কপালের একটা টিপ পেলেই সে খুশি। এই চাওয়া তো আর অমূলক নয়, কিংবা দুর্মূল্যও নয়। ফলে ভদ্রেশ্বরীর আরাধনায় সেই কামনা-ই যেন ফুটে ওঠে। শুধু কি পার্থিব চাওয়াই?—সঙ্গে আছে প্রেম প্রত্যাশা, সন্তান কামনা।
এবারে আসা যাক বর্তমানের ভাদুগানে। সচেতন কবি বা আঞ্চলিক কবিগণ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাদু গানের বই লিখে চলেছেন। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বহু ইলেক্ট্রনিক্স ও মনোরঞ্জনের বহুধা দ্রব্য এসে যাওয়ায় মন-গড়া ভাদু গান নারী সমাজে তেমন আর প্রচলন না থাকলেও অল্প লেখা-পড়া জানা তরুণী বাজার চলতি ভাদুগানের বই কিনে গান করেন বৈকি। সেসব গানে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, পুরাণ, ইতিহাস। যেমন—“পরমাণু যদি ফাটে মা/ সোনার বিশ্ব হবে শ্মশান।/ হিরোসিমা নাগাসাকি/ থাকুক না মা গো স্মৃতি হয়ে।” পূর্বে ভাদুর গানগুলি মুখে মুখে তৈরি হত, তেমনি অনেক গান বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ঠাকুমা-দিদিমা পরম্পরায় সেই গানগুলি ক্রমপ্রবাহিত হয়েছে, ঠিক লোকছড়াগুলির মতো। কিন্তু এখন সেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা যেমন কষ্টকর, তেমনি জরুরিও। বাঁকুড়ার লক্ষ্মীসাগরে একটি বৈষ্ণব পরিবারে ৬০-৭০ বছর আগের ভাদু গানের খাতা পাওয়া গেল, যেটি সেই বাড়ির তুষ্টবালা দাসের লেখা। এই খাতায় যে গানগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত। গানগুলিতে বৈষ্ণব পদাবলির প্রভাব রয়েছে। এমনকি সুরেও বৈষ্ণব পদাবলির সুর খানিকটা গ্রহণ করা হয়েছে। অবাক করার বিষয় হল, ভাদু বা ভাদু গান কিভাবে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে তার একটা চূড়ান্ত প্রমাণ এই জাতীয় খাতাগুলি। এরূপ বহু খাতা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে পাওয়া যায়। আবার যখন গ্রামাঞ্চলে মুদ্রণ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে, সেসময়ে ভাদুগান সম্বলিত চারটা ‘লিফ’ বের করে বিক্রি করা হত হাটে, মেলায়। চারটে ‘লিফ’এর প্রথম অংশটুকু বাদ দিয়ে মোট ত্রিশ খানি ভাদুর গান থাকত। এখন অবশ্য পাড়ায় পাড়ায় গানের প্রতিযোগিতা না থাকলেও খুব জোরে রেকর্ডিং গান চালানোর প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।
ফলে লক্ষণীয়, একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে আর পাঁচটা লোকউৎসবের বৈশিষ্ট্য মেনেই লোকসমাজের প্রায় সব ধরনের মানুষ জড়িত। যেহেতু এটি নেহাত মেয়েদের উৎসব, তা সত্ত্বেও পুরুষদের ভূমিকাও লক্ষ করা যায়।
ভাদুর মতোই আর একটি পরব—টুসু পরব। ভাদ্র মাসে যেমন ভাদু পূজা, পৌষ মাসে তেমন টুসু পূজা। ভাদ্র মাস যেমন মল মাস, পৌষ মাসও তেমনি মল মাস বা অশুভ মাস। ভাদুপূজার মতো টুসুও একমাস ধরে হয় এবং সংক্রান্তির রাত জাঁকজমক সহকারে রাত জাগা বা ‘জাগরণ’ হয়। টুসুতেও একটি সরা রেখে বা মূর্তি রেখে বা চৌদল রেখে আরাধনা করার প্রচলন আছে। এখানেও বাড়ির সকল মেয়ে অংশগ্রহণ করে, সন্ধে হলেই দীপ, ধূপ জ্বালিয়ে গান করে। টুসুর গানের বিষয়বস্তুও প্রায় এক। টুসু সম্পর্কিত কিংবদন্তীও প্রায় একরূপ। এখানেও টুসুর আত্মহত্যার কথা আছে। বাঁকুড়া জেলার পরকুল, পুরুলিয়ার দেউলঘাটা বা বীরভূম, ঝাড়খণ্ডে, মেদিনীপুরে টুসুকে কেন্দ্র করে বিরাটাকারে মেলা বসে। ভাদুর ক্ষেত্রে অবশ্য সেটা দেখা যায় না। এর কারণও অবশ্য আছে।
ভাদু হল কৃষির প্রথম পর্বে, আর টুসু পরব কৃষির প্রায় শেষে। যেহেতু কুর্মি, বাউরি ইত্যাদি কৃষক সম্প্রদায়ের পরব এই দুটি, তাই উক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত রাঢ় এলাকা এই দুই পরবকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে। বিশেষত টুসু পরবে যেহেতু মেলা বসে, তাই অনেকেই টুসু পরবকে রাঢ়ের জনসাধারণের জাতীয় উৎসব বলেও আখ্যা দিতে চেয়েছেন। মোটকথা, কৃষির শেষ পর্যায়ে যখন প্রচণ্ড কায়িক শ্রম দিয়ে চাষের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে ক্লান্ত বাড়ির মেয়েরা, তখন আবার বিশ্রাম ও চাওয়া-পাওয়ার আসর নিয়ে হাজির হয় তাঁরা। ভাদুপুজোর সময় যত সুখ-দুঃখ আর কিছু কামনা বাসনা, প্রত্যাশার কথা, টুসু পুজোতেও তার প্রতিচ্ছবি থাকে। সেখানেও থাকে শ্রম, কষ্ট, যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও প্রেমের ছবি। পৌষে বছর শেষে, মাঘে আবার নতুন করে কৃষি বর্ষ শুরু। তাই নারী হৃদয়ের একান্ত অনুভূতিগুলি আবার গান হয়ে ফুটে ওঠে। একটি টুসু গানে আছে—“পই্রব বুড়া বিলাতি শাড়ি।/ ও তোর কী ধারি গো কী ধারি।।/ বিকে দিব গো ঘর বাড়ি।/ ওগো ঘর বাড়ি।।/ পই্রব বুড়া বিলাতি শাড়ি।।” কখনো প্রেমিকার প্রেমবিহ্বল রূপ ধরা পড়ে টুসুর গানে—“তোর কি আমি লই মনের মতন।/ তুই করলি কেন অযতন গো অযতন।।/ তোর কি আমি লই মনের মতন।”
প্রত্যাশার আর এক রূপ নারীর ভাবনাকে কোথায় গিয়ে পৌঁছে দেয় তা দেখতে পাই একটি গানে—“বলি চল গো টুসু যাব বিলাতে। / আমি রইব না আর ভারতে।।/ ওগো খানা পিনা খাব না গো।/ আমি খাব রুটি পরটাতে।।/ ওগো পরা কাপড় পই্রব না গো।/ সাই্জব সামিজ শায়াতে। / ওগো পায়ে লিব হিলতোলা জুতা।/ আমি চাই্পব হেলিকপ্টাতে।/ চল গো আমি যাব বিলাতে।।” টুসুর গানগুলি নিইয়ে ভাবলে দেখা যাবে, চাষী ঘরের মেয়েদের ছোট ছোট কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-প্রত্যাশা কিভাবে তাঁদের কাছে এত গুরুত্ব পেয়েছে। আসলে চাষই যাঁদের সম্বল, দিন আনা দিন খাওয়া সেই মানুষগুলো সারা বছর পরিশ্রম করে সামান্য একটু সুখলাভের প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশা নিতান্তই অমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক। তার চেয়েও বড় কথা হল, এরা অল্পেতেই সন্তুষ্ট। অত্যধিক প্রয়োজন নেই, টুসু মেলায় বা মকর মেলায় বা পরের দিন এখ্যান মেলায় এরা ‘ইলির-মিলির-ঝিলির’ কানের দুল, কাঁচের চুড়ি, টিপ কিনতে পেলেই খুশি, আর কিছু চায় না তাঁরা। জীবনে এর চেয়ে আর কী সুখ থাকতে পারে?
শুধু কি নারী-জীবন?—টুসু গানেও চিত্রিত হয় সমাজ, দেশ ও বিশ্বের চিত্র। তবে এগুলো সাম্প্রতিক। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার বহু আঞ্চলিক কবির লেখা টুসু গীতি বিক্রি হয় হাটে-বাজারে। তাতে উঠে আসে সমাজ সচেতনতার দিকটিও। বাঁকুড়ার হরিপদ মাহাতোর লেখা টুসু গানের বিষয়ে এমনিভাবেই এসেছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পণপ্রথার কুফল, সর্বশিক্ষা অভিযান, জল সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপন, নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি বিষয়। আবার টুসু কখনো মা, কখনো মেয়েরূপে গানে প্রতিভাত হয়। আদরের মেয়ে টুসুকে নিয়ে তাই গান ধরে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মায়েরা, মেয়েরা—“টুসু আমাদের কলেজ গেছে/ নিজে স্কুটি চালিয়ে/ পাড়ায় লোক ভালে সবাই/ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে।”
আবার ভাদু বা টুসুর গানে আছে অন্যের টুসুকে ছোট করার গান। বিষয়টি বহু জনের কাছে পরশ্রীকাতরতা মনে হলেও তা আদৌ ঐরূপ নয়। নিজেদের টুসু বা ভাদু সম্পর্কে প্রশংসা করতে গিয়েই চলে আসে অন্যের সঙ্গে তুলনা। তাই মেয়েরা গান ধরে—“আমাদের টুসু হাসে যখন/ মুক্তা ঝড়ে পড়ে গো/ উয়াদের টুসু হাসে যখন/ রক্ত পোকা ঝরে গো।” কিংবা “আমাদের টুসু মুড়ি ভাজে/ চুড়ি ঝলমল করে গো/ উয়াদের টুসু আঁচল পাতে/ লাল ঝরে পড়ে গো।” একইভাবে “আমাদের ভাদুর কালো চুলে তেল চুঁইয়ে পড়ে গো/ উয়াদের ভাদুর তেল জুটে নাই, উকুন লড়বড় করে গো।” এক পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে আর এক পাড়ার মেয়েদের এইভাবে নিজেদের টুসু বা ভাদু সম্পর্কে শ্রেষ্টত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে চলে গানের লড়াই। কৃষিকাজে প্রতি মুহূর্তেই যেমন প্রচুর শ্রম দরকার হয়, তেমনি প্রয়োজন হয় কাজটিকে সুন্দর করে করার। কারণ একটু অসংলগ্ন হলেই বা গুরুত্ব না দিয়ে করলেই চাষে ত্রুটি ঘটে ও সেবছর চাষ ভালো হয় না। তাই সবদিক নজর রেখে কাজের মধ্যে পারফেক্শন আনতে হয়। অন্যের ভাদু বা টুসুকে খাটো করার অর্থ এই নয় যে পরশ্রীকাতরতা, বরং নিজের কাজকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ করার মানসিকতা থেকেই এই তুলনা।নিজের শক্তি ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরে যেন আত্মশক্তিকে স্মরণ করে নেয় মেয়েরা। তবে এক্ষেত্রে কবিগানের মতো প্রতিপক্ষ কখনোই কাছে থাকে না, সবাই নিজের নিজের ভাদু বা টুসুর আসরেই থাকে এবং সেখানেই এরূপ গান ধরে ও হাসাহাসি চলে, অনেকটা বাড়ির অন্দরমহলে মেয়েদের রঙ্গ-তামাশার মতো। এই সূত্রেই লক্ষ করা যায় টুসু-ভাদুর গানে আদিরসাত্মক ভাবের ব্যবহার। তবে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে দায়ি সেই অমার্জিত কবিগোষ্ঠী যারা চটজলদি নিজেদের প্রচার চায়। এইসব গান সরাসরি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করলেও ভাবে-ভঙ্গিতে অশ্লীলতাকেই নির্দেশ করে। যেমন একটি গানে আছে—“কচি ডালিম রাখবি যতনে।/ ফিরে পাবি না আর জীবনে।।/ এদিক সেদিক ঘুরছে লোফার ডালিম পাকার সন্ধানে।/ ভালো করে রাখবি ধনি জাকিট বডির বন্ধনে।।” এরূপ গানের গীতিকারেরা নিজেদের সংক্ষেপ নাম বা ছদ্মনাম ব্যবহার করে ছোট চটি বই বের করেঙ, যেগুলি হাটে বাজারে বেশ ভালো-মতোই বিক্রি হয়। গীতিকারের অর্থলাভ হয়।
ভাদু বা টুসু গানে যেভাবে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে এইসব লোকসঙ্গীত গুরুত্ব পাচ্ছে। লেখার মধ্য দিয়ে তো আছেই, সেইসঙ্গে রেকর্ড করে ক্যাসেট বা অডিও বা ভিডিও ভার্সনেও এইসব গান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসারলাভ করেছে। সেইসূত্রেই বিভিন্নভাবে টুসু-ভাদু সংস্কৃতিও ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন স্তরে—তা সে নামকরণেই হোক বা বিজ্ঞাপনেই হোক। গানগুলিতে প্রচলিত রামায়ণ-মহাভারতের কথা, বৈষ্ণবীয় ভাব ও ভাবনার কথা এবং সেইসঙ্গে সমকালীন রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজের কথা এমনভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে, সমাজের সকল মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। টুসু কেন্দ্রিক মেলায় সকল শ্রেণির মানুষের ভিড় চোখে পড়ে। গবেষকমহলে ভাদু-টুসুর গান ও বিষয় সূত্রে আলোচনাসভাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ইদানিংকালে।
আসলে রাঢ়বঙ্গে ভাদু বা টুসু পরব নিছক কোন ব্রত বা উদ্যাপিত একদিনের অনুষ্ঠান নয়—একটা সম্পূর্ণ মাসের আয়োজন। আরো ভাববার বিষয়, ঐ দুটি মাসে অন্য কোনো শুভ কাজও করা চলে না, চলে শুধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের মাধ্যমে ভাদু বা টুসুর আরাধনা। এই পরবদুটির গানই সম্বল, গানই মুখ্য। কারণ এতে পুরোহিত থাকে না, মন্ত্র থাকে না, মূর্তি না থাকলেও চলে, থাকে শুধু সম্মিলিতভাবে বাড়ির বা পাড়ার মেয়েদের একসঙ্গে বসে জীবনের টুকরো টুকরো চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের গান গাওয়া। কৃষিকে কেন্দ্র করে কৃষির প্রারম্ভে ও কৃষির শেষ পর্যায়ে এরূপ একমাসব্যাপী অনুষ্ঠান লোকসমাজের নারীমহলটিকে বিশেষভাবে উন্মোচিত করে। নারী মনের প্রেম, বিরহ, যন্ত্রণা প্রকাশের স্বাধীন ক্ষেত্র যেন এই আসরদ্বয়। গানের মধ্য দিয়ে নারী হৃদয়ে জমে থাকা যন্ত্রণা যেমন মুক্তি পায়, তেমনি আশার আলো দেখে, স্বপ্ন দেখে।