সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
স্বীকার করতে বাধা নেই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুদিন আগেও খুব অপরিষ্কার ছিল, যদিও এখন আর নেই। অবশ্য আমার ধারণাটা ছিল দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, তা নাহলে সে লেখাপড়া সে জ্ঞানবুদ্ধি আমার কোথায়? আর কেমন অপরিষ্কার ছিল বোঝাতে গেলে আগে অন্য একটা গল্প বলতে হয়। সেটা তন্ত্রসাধনার গল্প।
পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তন্ত্রসাধনা হল জীব-শিবে একাত্মতার সাধনা। তন্ত্রমতে আমাদের দেহে আছে তিন নাড়ি – ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। ঐ তিন নাড়ির সাহায্যে ষটচক্রভেদ করে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে সহস্রাররূপ শিবে মিলিত হতে পারলেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ। পঞ্চমুণ্ডি মানে পাঁচ জাতের মানুষের মাথা মাটিতে পুঁতে তার ওপর বসে সাধনা করার আসনবিশেষ। পাঁচ জাত কেন? অনেকদিন আগে যে দাদা আমাকে গল্পটা বলেছিল সে বলেছিল, তন্ত্রে কোনো জাতভেদ নেই, ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সবরকম মাথা এই সাধনায় ব্যবহৃত হয়। জ্যান্ত না মরা? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সে দিতে পারেনি, কারণ সেও কখনো কোনো তান্ত্রিককে নিজের চোখে সাধনা করতে দেখেনি, গল্পটা তারও শোনা। তবে সে আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, মরাই হবে, জ্যান্ত মানুষকে কি আর পুঁতে ফেলে কেউ! আমি বলেছিলাম কিন্তু কাপালিকরা তো সাধনার প্রয়োজনে মানুষকে বলি দিয়ে তার শবদেহর ওপরে বসে সাধনা করে, একথা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গেছেন। দাদা আমার জ্ঞানের প্রশংসা করেছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বুঝিয়েছিল যে এক, তান্ত্রিকের সঙ্গে কাপালিকের তফাত আছে, আর দুই, জ্যান্ত মানুষকে পুঁতে ফেলার কথা তো কোথাও নেই। তাতে করেও একটা প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। মরা মানুষ হাঁ করবে কি করে? এইভাবে আমার কম বয়সে শোনা এই গল্পে দু’একটা ধাঁধা থেকে গিয়েছিল। তাই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে হতে পারে লোকগুলোকে গলা পর্যন্ত পুঁতে দেওয়া হয়েছিল, তারা তখনো পুরো মরেনি, তাই মুণ্ডুগুলো হাঁ করত। কোনো কোনো মাছের মুণ্ডু আর ধড় আলাদা করার সময় মুণ্ডুগুলো যেমন হাঁ করে এও তেমনি।
মোট কথা, পঞ্চমুণ্ডির ওপর বসে সেই তান্ত্রিক সাধনা করতেন। তান্ত্রিক মন্ত্র আওড়াতেন আর মাঝে মাঝে মুণ্ডুগুলো যখন হাঁ করত, তখন তাদের মুখে একটু একটু করে মটর ফেলে দিতেন। এই করতে করতে একটা সময় মুণ্ডুগুলো হাঁ বন্ধ করত আর তান্ত্রিকও সমাধিস্থ হয়ে যেতেন।
এই গুরুদেবের একাধিক শিষ্য ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল একেবারে অপোগণ্ড। সে কোনো কম্মের ছিল না। তাই গুরুদেব তাকে আনুষঙ্গিক নানা কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। গুরুপত্নীর ফাইফরমাশ খাটা, ধোয়াধুয়ি কাচাকুচি করা, গোরুর দুধ দোওয়া, তাল তাল গোবর এনে তার থেকে ঘুঁটে তৈরি করা এবং ইত্যাদি। হতে পারে এই সেই শিষ্য যে ইদানিং গোরুর দুধে সোনার খোঁজ পেয়েছে আর গোরুর চোনায় খোঁজ পেয়েছে করোনার ওষুধের। অবশ্য অতীতে আমাদের এক প্রধানমন্ত্রী নিজের চোনার মধ্যেও স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন, যার নাম ছিল শিবাম্বু।
তবে এই শিষ্য কিন্তু একটা কাজ খুব নিষ্ঠাভরে করত। অন্য শিষ্যরা যখন গুরুগৃহে বসে ওঁ হ্রীং ক্লীংগুলো যতটা পারে কমিট ইন ইয়োর মেমোরি করার চেষ্টা করত, সে থিয়োরিটিকালের ধার না ধেরেই প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করত। রামভক্ত হনুমানের মত দূরে বসে গুরুদেবের সাধনা দেখত। তার গোপন ইচ্ছে সেও গুরুদেবের মত তন্ত্রসাধনা করে, কিন্তু গুরুদেব তাকে মন্ত্রতন্ত্র কিছুই শেখান না। বললে বলেন, “ও তোমার কম্ম নয়।”
একদিন গুরুদেব জরুরি কাজে একটু দূরে গেলেন। যাবার সময় এই শিষ্যকে আশ্রমের ভার দিয়ে গেলেন আর পইপই করে বলে গেলেন, আর যে বসে বসুক, সে যেন কিছুতেই আসনে চেপে না বসে, তাহলে ভয়ানক বিপদ হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গুরুদেব যেতেই শিষ্য মহা উৎসাহে আসনের ওপর চেপে বসল। মন্ত্রতন্ত্র তো কিছুই জানে না। অংবংচং বলতে লাগল আর মুণ্ডুগুলো হাঁ করলেই মুখে মটর গুঁজে দিতে লাগল। কিন্তু যেহেতু মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানে না, মুণ্ডুগুলোর হাঁ করা কিছুতেই থামতে চাইল না। দেখতে দেখতে মটর ফুরিয়ে এল। আসন ভয়ানকভাবে কাঁপতে লাগল। ভয়ে শিষ্যের মুখ শুকিয়ে গেছে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কান পাতলে শোনা যায় অস্ফুটে বলছে, গু মট ফু গে অর্থাৎ গুরুদেব মটর ফুরিয়ে গেছে। ভয়ের চোটে সব আব্রিভিয়েশন হয়ে গেছে।
তখন আমার প্রায়ই মনে হত এই তন্ত্রসাধনার সঙ্গে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রসাধনার বেশ মিল আছে। তন্ত্রের জীব-শিবে একাত্মতার সাধনা হল সংসদীয় গণতন্ত্রে দলে-গদিতে একাত্মতার সাধনা। পঞ্চমুণ্ডি হচ্ছে বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহানের নামে নানা জাত, নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি আর নানা ভাবের পিণ্ডি চটকিয়ে সেই পিণ্ডিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে তারপর তাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে তার ওপর বসে সাধনা করার আসন বিশেষ। নাড়ি তিনটে হল শীর্ষ নেতৃত্ব, সংগঠন আর টাকা। ষটচক্রের বানানে একটু পরিবর্তন করে নিলেই চলবে। ষটের জায়গায় ‘ষড়’ বসিয়ে নিলেই হল। ‘ষড়’ মানে চক্রান্ত। চক্রান্তের চক্র, সংক্ষেপে ষড়চক্র। অর্থাৎ গদিতে আসীন হতে না দেওয়ার যাবতীয় বিরোধী চক্রান্ত ভেদ করে তবে এগোতে হয়। কুলকুণ্ডলিনী হল ভোটার আর সহস্রাররূপ শিব হল গদি। মটরগুলো হল অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা আর স্বাস্থ্য নিয়ে দেওয়া ঝুরি ঝুরি প্রতিশ্রুতি। যে দলের প্রতিশ্রুতি মাথাগুলো গিলতে গিলতে ধীরে ধীরে শান্ত হয়, সেই দল গদিস্থ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু দুটো জিনিস কখনো পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারিনি। একটা হল, এই সাধনার সাধকটি কে? আর একটা হল, অপোগণ্ড শিষ্যটিই বা কে? আমার খুব মনে হত এই সাধনার প্রায় সব শিষ্যই একটু একটু অপোগণ্ড। তাদের বই পড়া থিয়োরিটিকাল বিদ্যের সঙ্গে প্র্যাক্টিকাল প্রায়শই মেলে না, আসনে বসলেই মুখগুলো কোনো না কোনো সময় ঝামেলা করে। ফলে মুখগুলোর হাঁ যখন কিছুতেই বন্ধ হতে চায় না, যখন আসন ভয়ানকভাবে কাঁপতে থাকে, তখন কান পেতে শুনে দেখেছি, তারা সকলেই অস্ফুটে বলছে, গ না গুষ্ পি অর্থাৎ গণতন্ত্র না গুষ্টির পিণ্ডি।
তো আমি ঠিক করলাম এই অজ্ঞতার হাত থেকে আমাকে বেরোতে হবে। আমাকে জানতে হবে এই সাধনার সাধকটি ঠিক কে? যদিও গান্ধীজি এই সাধনার সাধক কিনা সে ব্যাপারে আমার সংশয় ছিল, তবু আমি গান্ধীজিকে দিয়ে শুরু করার কথাই ভাবলাম। তিনি জাতির জনক বলে কথা। ফলত আমি কংগ্রেসের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও ভাবলাম। কেননা যতই হোক একে তো এটা একশো পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোনো একটা দল, তার ওপর তারাই তো গান্ধীজিকে জাতির জনক বানাল, টাকায় তাঁর ছবি ছাপল, জায়গায় জায়গায় তাঁর মূর্তি বসাল। গান্ধীজির কথা তাদের থেকে ভালো আর কে বলতে পারবে? এই ভেবে আমি এক কংগ্রেসী বন্ধুর কাছে গেলাম, বললাম, “আচ্ছা, এই সাধনার সাধকটি ঠিক কে বলতো, গান্ধীজি কী?” সে শুনে বলল, “আরে দূর দূর, সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে গান্ধীজির কোনো ধারণাই ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে তিনি যেসব শব্দ ব্যবহার করে গেছেন সেসব শব্দ মুখে আনাও পাপ। বন্ধ্যা, বেশ্যা। এক ইংরেজ মহিলার অনুরোধে পরে অবশ্য ‘বেশ্যা’ শব্দটা বদলেছিলেন। সত্যি বলতে কী, নাথুরাম গডসে মেরেছে বটে, নাহলে তাঁর যা ধারণার ছিরি ছিল, গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা তাঁর অন্য আরো অনেকের দিক থেকেই ছিল।”
“বল কী? কেন, তিনি কী এমন বলেছিলেন?”
“তিনি অবশ্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু বলতে গিয়ে বলেছিলেন, বিলিতি ধরনের এই সংসদীয় গণতন্ত্র এদেশে আমদানি করলে দেশটা নাকি গোল্লায় যাবে।”
“কেন, গোল্লায় যাবে কেন?”
“তাঁর মতে, পার্লামেন্ট নিজে থেকে কোনো কাজ করতে পারে না, যেটুকু যা কাজ করে বাইরের চাপে, সেইজন্যে সে বন্ধ্যা। আর বেশ্যা এইজন্যে যে মন্ত্রীদের বদল লেগেই আছে। যখন যারা মন্ত্রী হয়, পার্লামেন্ট চলে যায় তাদের দখলে। আজ ইনি তো কাল তিনি।”
“তাই নাকি? কিন্তু পার্লামেন্ট যে বাইরের চাপে কাজ করে সে চাপ তো জনগণের। সেটা তো ভালো।”
“সেকথা তিনি মানলেন কোথায়? তাঁর বক্তব্য ছিল যে পার্লামেন্ট যদি জনগণেরই হবে, তাহলে তাকে তো চাপ দিতে লাগারই কথা নয়। সে তো জনগণের স্বার্থে আপনাআপনিই কাজ করবে। কিন্তু তাতো হয় না, পার্লামেন্ট যেটুকু যা কাজ করে, গদি চলে যাবার ভয়ে। আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে গেছেন তিনি।”
“যেমন?”
“যেমন ধর, পার্লামেন্টের সদস্যরা নাকি সব ভণ্ড আর স্বার্থপর। তারা যে যার নিজের স্বার্থ পূরণেরই চেষ্টা করে সবসময়। পার্লামেন্ট নাকি যেটুকু কাজ করে ভয়ে। আজ যে ব্যবস্থা হল কাল তা রদ করে দিতে হয়। বড় বড় বিষয়ে আলোচনার সময় কোনো কোনো সদস্য ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ বা পড়ে পড়ে ঝিমোয়। না হলে এমন শোরগোল তোলে যে যারা শুনতে চায় তাদেরও কানে তালা লেগে যায়। পার্লামেন্টে নাকি যে যে দলের সদস্য হয়, সে সেই দলের পক্ষে চোখ বুজে মত দিয়ে দেয়। অনেক সময় তাকে মত দিতে বাধ্যও করা হয়, না দিলেই বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবে। দেশের লোকের টাকা নষ্ট ছাড়া পার্লামেন্ট আর কিছু করে না।”
একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একটু উশখুশ করছিলাম। সাহস করে বলেই ফেললাম, “কিন্তু শুনেছি এম. সি. চাগলাও নাকি অনেকটা এরকম কথাই বলেছিলেন। সংসদে বেশির ভাগ সদস্যেরই নাকি সংসদের কাজেকর্মে কোনো আগ্রহ নেই। তারা শুধু তাদের দলের মেজরিটি রক্ষে করেই খালাস।”
“কে? এম. সি. চাগলা? আরে দূর, ওঁর কথা ছাড়ো তো। বম্বে হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস থাকার সময় উনিই তো হরিদাস মুন্ধ্রা কেলেঙ্কারিতে টি টি কৃষ্ণমাচারিকে ফাঁসিয়ে দিলেন। বেচারা কৃষ্ণমাচারিকে অর্থমন্ত্রীর পদটা ছেড়ে দিতে হল। কত বিশ্বাস করে নেহরু চাগলাকে ওয়ান ম্যান কমিশন বানিয়ে তদন্তের ভার দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন যে চাগলা কৃষ্ণমাচারিকে ঠিক বাঁচিয়ে নেবেন। ফল হল উলটো। কৃষ্ণমাচারি নেহরুর খুব প্রিয় ছিল, এই ঘটনায় নেহরু খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। ঐ জন্যেই তো নেহরু চাগলাকে দেখতে পারতেন না। শুধু তাই নয়, নিজে মুসলমান হয়েও চাগলা বিজেপির মহা অধিবেশনে হাজির হয়ে বিজেপিকে তোল্লা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কে বলেছে কংগ্রেসই একমাত্র বড় দল? এই তো আমার চোখের সামনে ভবিষ্যতের আর একটা বড় দল আর প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি। অটলবিহারী বাজপেয়ী।”
“তাহলে তো বলতে হবে চাগলা সাহেব দারুণ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। দেখ ভাই বিজেপি তো সত্যিই আজকে দেশের বৃহত্তম দল। অটলবিহারী বাজপেয়ীও দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা থাকতে বিজেপি এরকম মহীরুহ হয়ে উঠল কি করে?”
“ও তালেগোলে হয়ে গেছে।” আমার কংগ্রেসী বন্ধু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। তাই গান্ধীজি প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললাম, যাই হোক গান্ধীজির কথা বল।”
“হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?”
“বলছিলে যে গান্ধীজির মতে নাকি পার্লামেন্ট দেশের টাকা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু করে না।”
“শুধু কী তাই? গান্ধীজি প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেগুলো আরো খারাপ কথা।”
“কিরকম?”
“এই যেমন, তিনি পার্লামেন্টের ভালোর জন্যে যত না, তার থেকে বেশি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে মাথা ঘামান। সবসময় চেষ্টা করেন যাতে তাঁর দল জেতে। পার্লামেন্ট ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সে দিকে তাঁর বড় একটা খেয়াল থাকে না। দলীয় সুবিধের জন্যেই পার্লামেন্টকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। তিনি হয়ত সরাসরি ঘুষ নেন না, কিন্তু চালাকির আশ্রয় যথেষ্টই নেন। কাজ হাসিল করার জন্যে একে উপাধি ওকে খেতাবের ঘুষ দেন। এছাড়াও আছে।”
“এছাড়াও আছে?”
“ভোটার আর খবরের কাগজগুলোকেও তিনি তুলোধোনা করেছিলেন। ভোটারদের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে রীতিমত ব্যঙ্গ করেছিলেন। ভোটাররা কাকে ভোট দেবে সব নাকি ঐ খবরের কাগজ দেখে ঠিক করে। আর খবরের কাগজগুলো মিথ্যের বেসাতি করে। একটা কাগজ একটা ব্যাপারকে গুরুত্বই দেয় না, আর একটা কাগজ সেটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায়। একটা কাগজ যদি কোনো নেতাকে ভালো বলে, তো আর একটা কাগজ সেই নেতার বাপান্ত করে। ভাব একবার গান্ধীজির চোখে ভোটারদের আর খবরের কাগজগুলোর, যাকে আমরা চতুর্থ স্তম্ভ বলে জানি, কী মর্যাদা!”
“কিন্তু তাহলে দেশটা চলবে কী দিয়ে?”
“সেটাই তো হচ্ছে কথা। সে ব্যাপারেও গান্ধীজির অদ্ভুত ভাবনা। শহরের প্রতি তাঁর কোনো ভালোবাসাই ছিল না। তাঁর ধারণা, কোটি কোটি মানুষ কখনই শহরে আর বড় বড় বাড়িগুলোতে একসঙ্গে শান্তিতে বাস করতে পারেনা। সেখানে বাস করলে হিংসা আর অসত্যকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকবে না। তাঁর যত ভাবনা ছিল গ্রাম নিয়ে। গ্রামসমাজকে নাকি হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ব্রিটিশ আসার আগে যেমন ছিল। নিজের যা কিছু প্রয়োজন তা সে নিজেই মিটিয়ে নেবে। প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠবে এক একটি প্রজাতন্ত্র। আর এই গ্রামসমাজের তৃণমূল স্তর থেকেই গড়ে উঠবে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে নাকি গড়ে তুলতে হবে পঞ্চায়েত থেকে। সিদ্ধান্তগুলো সেখান থেকে ওপরে যাবে, সেই অনুযায়ী দেশ চলবে। ওপর থেকে নিচে নামবে না। সিদ্ধান্তগুলো কোনো পার্টি লাইন ধরে হবে না, হবে কোনো একটা বিষয় নিয়ে গ্রামবাসীদের ভাবনার ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে। সত্য অহিংসা আর নিষ্ঠার পথে সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করতে হবে। যেহেতু গ্রামের মানুষ সহজ সরল হয়, সত্য অহিংসা আর নিষ্ঠার আদর্শে তারা বিশ্বাসী হয়ে উঠবে, গ্রামসমাজটাও তাই হয়ে উঠবে। জানোই তো তিনি এমনকি কংগ্রেসকেও তুলে দিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, কংগ্রেসীরা এবার দলীয় পতাকা ছেড়ে লোকসেবক হয়ে গ্রামে যাক, সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করুক। তাঁর মতে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ঐ তৃণমূল স্তর থেকে ধাপে ধাপে উঠে যে নেতৃত্বের সৃষ্টি হবে সেখান থেকে আসবেন। তাঁর ভাষায় এটা নাকি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বা ডাইরেক্ট ডিমক্র্যাসি। সাধে কী আর আমাদের নেহরু সাহেব চিঠি লিখে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনার এইসব ধারণাগুলো যেমন প্রতিক্রিয়াশীল তেমনি আজগুবি।’ ”
ভয়ে ভয়ে বললাম, “কিন্তু শুনেছি এম. এন. রায়, জয়প্রকাশ নারায়ণ এঁরাও নাকি দলীয় রাজনীতি পছন্দ করতেন না আর নোয়াম চমস্কি নাকি গান্ধীজির এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন।”
“করেছেন, কিন্তু নোয়াম চমস্কি একজন পণ্ডিত মানুষ, বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁর সে যোগ কোথায়?”
“আর?”
“আর কী! বড় শিল্প ছিল তাঁর নাপসন্দ। তাঁর বক্তব্য ছিল যে বড় শিল্প মানুষের ব্যক্তিত্বকে তার মানবিক সত্তাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া বড় শিল্প চারপাশকেও নষ্ট করে দেয়। এই পৃথিবী আলো হাওয়া জল জঙ্গল জমি এসবই নাকি আমরা কোনো উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাইনি, সন্তানদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পেয়েছি। অতএব খেয়াল রাখতে হবে যেমনটা পেয়েছিলাম তেমনটাই যেন তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি। এসব আজগুবি কথা নয়?”
“আজগুবি কেন?”
“আরে, ধার নিলে তা সুদসমেত ফেরত দিতে হবে না?”
“কিন্তু প্রকৃতি মানে তো শক্তি। শক্তির তো বাড়াকমা নেই। আমি অবশ্য আমার ফিজিক্সের ক্লাস ফোরের বিদ্যে নিয়ে বলছি। তাকে তুমি বাড়াবে কী করে? ধর, শক্তি হল দশ, তুমি যদি তা সুদসমেত ফেরত দিতে চাও, তাহলে তোমাকে দশের সঙ্গে এক দুই যা হোক একটা কিছু যোগ করতে হবে। ধর তুমি যোগ করলে দুই, তাহলে দাঁড়াল দশ যোগ দুই বারো অর্থাৎ মোট বারো তোমাকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু শক্তিকে তুমি বারো বানাবে কী করে? সেটা করতে গেলে তোমারই উলটে বারোটা বেজে যাবে না?”
“ধ্যুস, দশকের পর দশক ধরে চেষ্টা করে গেলেও দশকে যে আমরা বারো বানাতে পারব না সেকি আর আমরা জানিনা? খুব জানি। কিন্তু ধর আমরা যদি ঐ দশকেই নয় কিংবা আট কিংবা সাতে পরিণত করে দিতে পারি আর বাকি এক কিংবা দুই কিংবা তিনকে বস্তুগত সুদে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে আমাদের ছেলেপুলেরা আসলটা যে কমে গেল সেটা আর হাতেনাতে ধরতেই পারবে না। বরঞ্চ তারা খুশি হয়ে যাবে।”
“কেন খুশি হবে তারা?”
“হবে না? তারা যখন দেখবে তাদের বাপকাকারা নানারকমের উপকরণ দিয়ে পৃথিবীটাকে এমন সুন্দর সাজিয়ে দিয়ে গেছে যে চারিদিক ঝকমক করছে, তখন তারা কি খুশি হবে না? তখন কি আর তারা আসল সুদ ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবে?”
“ঝকমক মানে?”
“ঝকমক মানে বড় বড় রাস্তা, চওড়া চওড়া ফ্লাইওভার, আকাশছোঁয়া বাড়ি, বড় বড় মল, বড় বড় গাড়ি, বড় বড় কারখানা, বড় বড় কংক্রিটের বাঁধ, আরো কত কী। তার নামই তো উন্নয়ন।”
“উন্নয়ন মানে?”
“তুমি বড় কথায় কথায় মানে মানে কর। এই একুশ শতাব্দীতে এসেও তোমাকে আবার উন্নয়নের মানে বোঝাতে হবে নাকি? উন্নয়ন মানে উন্নয়ন, তার আবার মানে কী?”
“বেশ। কিন্তু তুমি যে বললে বড় শিল্প ছিল গান্ধীজির নাপসন্দ, তাহলে যন্ত্রের কি হবে? বড় বড় শিল্প তো বড় বড় যন্ত্র ছাড়া চলে না।”
“আর বোলো না, সেও এক ঝকমারি। বড় বড় যন্ত্রকে গান্ধীজি খুব ভয় পেতেন, কারণ নাকি এইসব যন্ত্র খুব তাড়াতাড়ি জিনিস উৎপাদন করে ফেলে, হাত দিয়ে মানুষ যা পারে না।”
“তাতে কি হ’ল ? ভালোই । জাতীয় অর্থনীতির সুরাহা হবে।”
“সে তো জানি তাতে ভালোই, কিন্তু গান্ধীজির বক্তব্য তো উলটো। তিনি জাতীয় অর্থনীতি, জাতীয় সমৃদ্ধি এসব মোটেই বুঝতেন না। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হল এতে মানুষ বেকার হয়ে যাবে। যে দেশে এত লোক এবং তাদের প্রত্যেকের কাজের দরকার, সে দেশে বড় যন্ত্র সংকট বাড়াবে ছাড়া কমাবে না। তাই তিনি সরাসরি বলেছেন, আমাদের দেশে বড় যন্ত্রের প্রয়োজন নেই, কুটিরশিল্পই যথেষ্ট। দেশের মানুষ যখন অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে তখন প্রয়োজনে তারা বড় যন্ত্রকে গ্রহণ করবে।”
এইখানে এসে আমি একটু হোঁচট খেলাম। বড় যন্ত্রের সঙ্গে আবার হিংসা অহিংসার সম্পর্ক কী? কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ল চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমসে’র শ্রমিক নায়ক সারাদিন ধরে একটা বড় যন্ত্রের নাটবল্টু টাইট করতে করতে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছিল যে তাকে অ্যাসাইলামে দিতে হয়েছিল। তাই আমি ও ব্যপারে আর না ঢুকে অন্য কথা পাড়লাম। বললাম, “কিন্তু যতদূর মনে পড়ে ভারতীয় অর্থনীতির বইতে পড়েছিলাম নেহরু সাহেব দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় বলেছিলেন, বড় শিল্পের ওপর বেশি জোর দেওয়া আমাদের ভুল হয়েছে, আমাদের নজর দেওয়া উচিত ছিল কুটিরশিল্পের দিকে।”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন, তার কারণ তিনি সবসময় একটা দোটানায় ভুগতেন। কখনো তাঁর মনে হত গান্ধীজি ঠিক, কখনো মনে হত গান্ধীজি ভুল। এতেই তো দেশের ক্ষতি হয়েছে।”
“যাক গে, নেহরুর কথা থাক। কিন্তু বড় যন্ত্র বড় শিল্প এসব যদি গান্ধীজির নাপসন্দই হয়, তাহলে পুঁজিপতিদের সম্পর্কে তাঁর কী অভিমত ছিল?”
“সেটা আরো উদ্ভট। গান্ধীজির কাছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মানে হল ব্রিটিশ পুঁজিপতি ও পুঁজি এবং তাদের দোসর ভারতীয় পুঁজিপতি ও পুঁজির হাত থেকে মুক্তি। পুঁজিপতিদের তিনি গরিব মানুষের অছি হয়ে যাবার ডাক দিয়েছিলেন।”
“অছি মানে?”
“অছি মানে ট্রাস্টি। মানে গচ্ছিত সম্পত্তির জিম্মাদার।”
“কার গচ্ছিত সম্পত্তি?”
“জনগণের।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ পুঁজিপতিরা জনগণের সম্পত্তি তাদের জিম্মায় আছে এটা মনে রেখে ব্যবসাবাণিজ্য করবে?”
“আমি বলতে চাইছি না, গান্ধীজি বলতে চাইছেন।”
“কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব, পুঁজিপতিরা হচ্ছে বেড়াল, বেড়ালকে মাছ আগলাতে বলার ব্যাপার হয়ে যাবে না সেটা?” আমি বললাম।
“সম্ভব নয় তো বটেই। তবে এই ব্যাপারটায় আমরা গান্ধীজিকে তেমন দোষ দিই না। প্রণামী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ছিলেন তো, মাছের ব্যাপারটায় কোনো ধারণা ছিল না।”
“তা বটে। কিন্তু দুধের ব্যাপারে তো তাঁর ধারণা ছিল। তিনি তো দুধ খেতেন। বেড়ালকে দুধ আগলাতে দেওয়াও তো একই ব্যাপার।”
সে তো ঠিকই। আসলে বেড়ালের ব্যাপারটাতেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। তিনি তো ছাগল পুষেছিলেন।”
“বেশ, এতই যখন বললে, দেশের সুরক্ষা, সেনাবাহিনী নিয়ে গান্ধীজির ভাবনার কথাও একটু বল। এত যে অস্ত্র কেনাকেনি, এত যে আধা-সরকারি, সরকারি সেনাবাহিনীতে পুলিশে রেগুলার রিক্রুটমেন্ট এ নিয়েও তো নিশ্চয়ই গান্ধীজি কিছু নির্দেশ দিয়ে গেছেন। মানে কতটা অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দরকার পড়বে, সেনাবাহিনীতে পুলিশে কী পরিমাণ লোক লাগবে।”
“ক্ষেপেছ। অহিংসার পূজারি, তিনি কখনো ওসব কথা বলেন। তিনি তো কোনো সেনাবাহিনী রাখতেই বারণ করে গেছলেন। তাঁর মতে, আত্মরক্ষার জন্যে সশস্ত্র বাহিনীরই দরকার নেই, অস্ত্রশস্ত্র তো দূরের কথা। কিন্তু চারপাশে যখন এত শত্রু তখন গান্ধীজির কথা মানলে কি চলত? গান্ধীজির কথা শুনে তো একরকম চলা হচ্ছিল, কিন্তু চিন গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বলে দিয়ে গেল, ব্যাটা, শিগগিরি শিগগিরি অস্ত্র বানা। সেই থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারটায় কোনো অবহেলা করিনা, আর যে ব্যাপারেই করি না করি। সেনাবাহিনীতে লোক নেবার ব্যাপারেও না, আর কোনো লোক নেবার ব্যাপারে করি না করি।”
“তা বটে। বিশেষ যখন পাশেই জ্ঞাতিশত্রু।”
“তুমি পাকিস্তানের কথা বলছ তো? হ্যাঁ, তারাই তো সব থেকে বড় বিপদ। কিন্তু গান্ধীজি পাকিস্তানকে জ্ঞাতিশত্রু ভাবলেন কোথায়? সেই জন্যেই তো গুলি খেয়ে গেলেন।”
বুঝলাম যে দেশশাসন করতে গেলে গান্ধীজির কোনো কথাই শুনলে চলত না এটাই কংগ্রেসের বক্তব্য। তাই জিগ্যেস করলাম, “গান্ধীজির কোনো কথা শুনলেই দেশ চলত না যদি, তাহলে লোকটাকে এত মাথায় তুললে কেন? তাঁকে জাতির জনক বানিয়ে দিলে, টাকার ওপর তাঁর ছবি ছাপালে, জায়গায় জায়গায় মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে দিলে।”
আমার কংগ্রেসী বন্ধু বেশ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “কারণ ছিল। আমরা যদি লোকটাকে ভগবান বানিয়ে না দিতাম, তাহলে লোকটা ভূত হয়ে দেশের লোকের ঘাড়ে চাপত। আর দেশের লোককে ভূতে ধরলে যে কী কাণ্ড হয়, তুমি নিশ্চয়ই জানো। তাদের তাণ্ডবে তখন আমরা অস্থিরপঞ্চম হয়ে যেতাম, সুস্থিরভাবে দেশশাসন করতেই পারতাম না। কিন্তু আমরা লোকটাকে ভগবান বানিয়ে দিয়েছি, তাই সে ভয় আর নেই। এখন আর লোকটার কোনো কথা মেনে চলার দরকার নেই, শুধু নিয়মিত তাঁর পুজো করে গেলেই চলবে। আর কেমনভাবে পুজো করতে হবে এদেশের লোককে বুঝিয়ে দিতে হবে না, সেটা তাদের রক্তে আছে। হ্যাঁ দশচক্রে পড়লে ভগবানেরও ভূত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সেই জন্যে আমরা তাঁর ত্রিসীমানা থেকে দশচক্র সরিয়ে সে জায়গায় অশোকচক্র বসিয়ে দিয়েছি, এখন আর লোকটার ভূত হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই।”
শেষের কথাগুলো আমার মোটা মাথায় ভালো ঢুকল না। ভগবান, ভূত, দশচক্র, অশোকচক্র, সেসব আবার কী? যাক্ গে, তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি চললাম আমার বামপন্থী বন্ধুর উদ্দেশে।
২
আমার এই বামপন্থী বন্ধুর নাকের তলায় একটা মোটা গোঁফ আছে। দূর থেকে তাকে দেখলে কেমন জোসেফ স্টালিনের মত লাগে। সে আমাকে দেখেই বলল, “তুমি তোমার সেই কংগ্রেসী বন্ধুর কাছ থেকে আসছ, না?”
আমি তো অবাক। বামপন্থীদের বুদ্ধি প্রখর হয় এবং সেটা নিয়ে তাদের একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার থাকে জানতাম, কিন্তু তারা যে ফেলুদার মত ডিটেকটিভও হয়ে উঠেছে জানতাম না। বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে?”
সে বলল, “তোমার ঝোলা থেকে যে হ্যান্ডবিলটা উঁকি মারছে ওটার দিকে তাকিয়ে। তেরঙ্গা হাত চিহ্ন দেওয়া হ্যান্ডবিলটা আজই প্রেস থেকে ছেপে বেরিয়েছে, এইমাত্র আমার কাছেও এক কপি এসে পৌঁছেছে। তো কী করতে গিয়েছিলে?”
“আসলে আজ সকাল থেকেই একটা প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” বলে তাকে বললাম ব্যাপারটা।
“তোমার প্রশ্নটার অনেক ভাগ, ভাগে ভাগে উত্তর দিতে হবে।” সে বলল, “প্রথম কথা হচ্ছে সাধনা। দ্যাখো সাধনা-টাধনায় আমরা বিশ্বাস করি না, ওসব ভাববাদী কথাবার্তা, আমরা বস্তুবাদী। তবে হ্যাঁ যদি ধারণার কথা বল, এদেশে গণপরিষদের ধারণা প্রথম নিয়ে এসেছিলেন এম. এন. রায়। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি সেটা কংগ্রেসের গোচরে আনেন। কংগ্রেস তখন দেশের সবথেকে বড় দল। কংগ্রেস সেটা লুফে নেয় এবং পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে দলীয় স্তরে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে। তারপর সংবিধান তৈরি হওয়া পর্যন্ত ইতিহাস তুমিও জানো। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র গড়ে ওঠার পেছনেও কমিউনিস্ট পার্টিরই সবথেকে বড় অবদান ছিল।”
“কিন্তু যতদূর জানি এম. এন. রায় তো নিজেই আর কমিউনিস্ট থাকেন নি।”
“সেকথা ঠিক, পরবর্তীকালে তিনি রেনিগেড হয়ে গিয়েছিলেন, ভাববাদী হয়ে গিয়েছিলেন। তাতে কমিউনিস্টদের প্রাথমিক ভূমিকাটা তো আর মুছে যাচ্ছে না।”
“বেশ, তারপর?”
“তারপর ধর গান্ধীজির ব্যাপারটা। গান্ধীজি নিয়ে আমাদের বক্তব্য অনেকটা কংগ্রেসের মতই। সবথেকে বড় কথা লোকটা ছিল আফিমখোর।”
“আফিমখোর ছিল, বল কী? কোনোদিন শুনিনি তো একথা।”
“তবে আর বলছি কী? সেক্যুলার মোটেই ছিল না। সারাদিন ধর্মে বুঁদ হয়ে থাকত, আর জানোই তো ধর্মকে আমরা মনে করি মানুষের আফিম। আচ্ছা, তুমিই বল, ধর্মনৈতিক স্বাধীনতা বলে কিছু হয়?”
“সে আবার কী জিনিস?”
“কী জিনিস সেটা গান্ধীজিই জানেন। তার ওপর লোকটা বিজ্ঞানে একেবারে অজ্ঞান ছিল। আর যন্ত্রের মানে প্রযুক্তির ব্যাপারটা তো বুঝতই না। না হলে বিংশ শতাব্দীতে বসেও বলে, গ্রামে যাও, চরকা কাটো, যাঁতা পেষো, ঢেঁকিতে পাড় দাও। আমাদের কিন্তু দিন শুরু হয় বিজ্ঞান দিয়ে, শেষও হয় বিজ্ঞান দিয়ে। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আমরা মানি না।”
“তা বটে। বিজ্ঞানের তো একটা ধর্ম আছেই, যেমন ধর অক্মিজেনের ধর্ম আর হাইড্রোজেনের ধর্ম আলাদা।” আমি আমার বিজ্ঞানের জ্ঞান জাহির করতে যাই।
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা পদার্থের ধর্ম। অ-পদার্থের নয়।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ গান্ধীজির ধর্ম অপদার্থের ধর্ম।”
“ব্যাপারটা তো তাই দাঁড়ায়।”
“যাক্ গে, ধর্মের কচকচি থাক। কিন্তু শুনেছি গান্ধীজি নাকি যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন না। রামমনোহর লোহিয়াকে তিনি বলেছিলেন, রেল, বিদ্যুৎ, এসব ছাড়া যে আর চলবে না তিনিও জানেন। চরকাও তো যন্ত্রই। এমনকি এই শরীরও তো একটা যন্ত্র।”
“কিন্তু চরকা দিয়ে কি উন্নয়ন হবে?”
“উন্নয়ন মানে?”
“উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। তার আবার মানে কী?”
“এ ব্যাপারে কংগ্রেসীদের সঙ্গে তোমাদের তো বেজায় মিল দেখছি। ওরাও বলে, উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। তার আবার মানে কী?”
“তা হতে পারে, তবে উন্নয়নের ব্যাপারে কংগ্রেস আর বিজেপির সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ওরা উন্নয়ন চায় পুঁজিপতিদের পেট মোটা করার জন্যে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির তফাত শুধু এইটুকুই যে কংগ্রেসের একটু একটু চোখের চামড়া আছে, তাই ওদের কর্নিয়াটা দেখবে সামান্য হলেও ভেজা ভেজা থাকে, বিজেপির চোখের চামড়াই নেই, তাই দেখবে ওদের কর্নিয়াটা একেবারে শুকনো। আমরা উন্নয়ন চাই দেশের লোকের ভালোর জন্যে। আমাদের শ্লোগানই হচ্ছে – সবার পেটে ভাত চাই, সবার হাতে কাজ চাই। তাই দ্যাখো আমাদের কর্নিয়াটা সবসময় ভেজা ভেজা। কথায় কথায় চোখে জলও এসে পড়ে। কিন্তু আমরা জানি কেঁদে ফেলাটা দুর্বলতার পরিচয় হবে, তাই আমরা কিছুতেই বুঝতে দিই না যে আমাদের চোখ জলে ভিজে গেছে, চোখের আগুন দিয়ে সেটা আমরা ঢেকে রাখি।”
“বেশ। আচ্ছা, কংগ্রেসীদের কাছে শুনলাম যে গান্ধীজি নাকি ভারতীয় পুঁজিপতি আর পুঁজির থেকে মুক্তির খোঁজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা সব জনগণের সম্পত্তির অছি হয়ে যাক। এ ব্যাপারটা আমার খানিকটা বেড়ালকে মাছ আগলাতে বলার মত লেগেছে। আমার কংগ্রেসী বন্ধু বলছিল যে আসলে বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির কোনো ধারণা ছিল না তো তাই তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। তিনি তো ছাগলের ব্যাপারেই যেটুকু যা জানতেন। এ ব্যাপারে তোমার কি মত?”
“আমাদের মত কংগ্রেসীদের থেকে আলাদা। কংগ্রেসীরা গান্ধীজিকে আড়াল দিতে চাইছে তাই বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির অজ্ঞতার দোহাই দিয়েছে। বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির ভালোই ধারণা ছিল, তিনি যখন দুধ খেতেন, বেড়ালের হাত থেকে দুধকে যে আড়াল করতে হয় তা তিনি জানতেন না হতেই পারে না। গান্ধীজি আসলে বেড়ালকেই আড়াল দিতে চেয়েছিলেন, নিজেও বেনিয়া তো। অবশ্য সব বামপন্থী এরকম ভাবে না, আমাদের মধ্যে অনেক উপদল আছে।”
“তোমরা তো বেশ ক্যাটকেটে দেখছি।”
“তা তো হবেই। জানোই তো, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতেই আছে, the communists disdain to conceal their views and aims।”
“কিন্তু তোমাদের views and aimsটা ঠিক কী?”
“কেন, সমস্ত existing social condition এর forcible overthrow করে সর্বহারাকে ক্ষমতায় আনা, সর্বহারার শাসনের প্রতিষ্ঠা করা, এমন এক দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব মানুষই সমান।” বলতে বলতে আমার বামপন্থী বন্ধু বেশ গদগদ হয়ে উঠল।
“খুবই বড় কথা। কিন্তু সেটা কি হয়েছিল?”
“কেন, রাশিয়াতে হয়েছিল, চিনে হয়েছিল, ভিয়েতনামে হয়েছিল, কিউবায় হয়েছিল।”
“অনেকে যে বলে শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা নাকি দাঁড়িয়েছিল, সব মানুষই সমান, কিন্তু কিছু মানুষ অন্যান্যদের চাইতে বেশি সমান। শেষপর্যন্ত নাকি কিছু মানুষের ক্ষমতাই হয়ে উঠেছিল সবমানুষের শত্রু। তুমি রাশিয়ার কথা পাড়লে। কিন্তু আমি যতদূর জানি রোজা লুক্সেমবুর্গ লেনিনের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ এনেছিলেন যে তিনি রাশিয়ার কারখানাগুলোতে নানারকমের খবরদারি আর সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আর ১৯২১ সালের শুরুতে স্বয়ং লেনিন বলেছিলেন, রাশিয়া হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকভাবে বিকৃত একটি সমাজরাষ্ট্র।”
“বেশ, তোমার কথা একটু একটু মেনে নিলাম, কিন্তু চিনে?”
“চিন তো আরো সাংঘাতিক। দেং শিয়াও পিং তো সরাসরি বলেছিলেন, বড়লোক হওয়া তো খারাপ নয়।”
আমার বামপন্থী বন্ধু একটু ঢোঁক গিলে বলল, “কিন্তু দ্যাখো, বড়লোক হওয়া কি সত্যিই খুব খারাপ? মুষ্টিমেয় লোকের কাছে যে পরিমাণ ভোগের উপাদান আছে, সেই পরিমাণ ভোগের উপাদান যদি সবাইয়ের কাছে থাকে তাহলে খারাপটা কি?”
শুনে আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, বললাম, “বল কী? ভোগ আর সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে তফাত নেই?” কেমন যেন আমার মনে হল এই জন্যেই ভোক্তা সমাজটা দেখতে দেখতে পৃথিবীটাকে গ্রাস করে নিতে পেরেছে। মুখে বললাম, “তোমরা দেখছি সত্যিই ক্যাটকেটে।”
“সে তো আমরা স্বীকারই করলাম, তাতে কী হল?”
“সেই ক্যাটকেটে না, ইংরেজিতে যে সি এ টি ক্যাট সেই ক্যাটকেটে।”
“মানে?”
“মানে হল গান্ধীজি বেড়ালকে কতখানি আড়াল করেছেন জানি না, কিন্তু তোমরাও বেশ বেড়ালভক্ত। বেড়ালের সঙ্গে তোমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কখনো সেটা গালাগালির, কখনো গলাগলির। কখনো টাটা-বিড়লা দূর হটো, কখনো টাটা-বিড়লা যুগ যুগ জিও।” দেখলাম যথেষ্ট হয়েছে, আমার বিজেপি বন্ধুর কাছে যাবার সময় হয়ে গেছে, বললাম, “আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাক। উঠি।”
সে বলল, “চললে কোথায়, আসল কথাই তো বলা হয়নি। জানবে না এ দেশের এই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক কী?”
“কী?”
“আমরা মনে করি এটা হল বুর্জুয়া সংসদীয় গণতন্ত্র।”
“মানে? লেনিন যাকে বলেছিলেন, ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’?”
“ঠিক তাই।”
“তুমি কি বলতে চাও নেহরু অম্বেদকর মৌলানা এঁরা সব—”
“আহা, কথাটা তো ব্যক্তি নিয়ে নয়, সিস্টেম নিয়ে।”
“তোমরা তাহলে গোঁয়ারের মত সেই খোঁয়াড় আঁকড়ে
আছ কেন?”
“আমাদের কোনো উপায় নেই, বুঝলে। এখনো তো জনগণ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি যে এটা শুয়োরের খোঁয়াড়। যদিও তারা সন্দেহ করে। শুয়োরের গায়ের একটা গন্ধ কেউ কেউ পায়। কেউ কেউ ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজটাও শুনেছে। এর বেশি কিছু না। তাই--”
“তাই কী?”
“তাই আপাতত খোঁয়াড়টাকে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারছি না। আমরা মানি যে এই বুর্জুয়া সংসদীয় গণতন্ত্র জনগণকে স্রেফ ভোটার বানিয়ে দেয়, কিন্তু আমাদের কোনো উপায় নেই।”
“কিন্তু দ্যাখো যারা এই খোঁয়াড়টাকে পেছন থেকে চালায়, তারাও তো কম চালাক না। তারাও তো জনগণকে বছরের পর বছর ম্যানেজ করে চালিয়ে যেতে পারে। ঐসব গন্ধ ঢাকা, ঐসব আওয়াজ পালটে দেওয়া এই বিজ্ঞানের যুগে তো কোনো ব্যাপারই না। এরকম করে চললে তোমরা তো কোনোদিনই প্রমাণ করতে পারবে না ওটা আসলে শুয়োরের খোঁয়াড়।” আমি বললাম।
“তোমার কথা ঠিক। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে ভাবনার নানা ধারা উপধারা আছে। একদল মনে করে আমাদের কাজ হচ্ছে ঐ শুয়োরের খোঁয়াড়ের মধ্যে থেকেই ওটা যে আসলে শুয়োরের খোঁয়াড় সেটা যথাসাধ্য জনগণের চোখে ফুটিয়ে তোলা। আর জনগণকে পরিবর্ত ব্যবস্থার কথা ভাবতে উৎসাহিত করা। কেউ কেউ মনে করে আমাদের কাজ হচ্ছে ঐ শুয়োরের খোঁয়াড়ের মধ্যে থেকেই ওটাকে ভেতর থেকে দুর্বল করা। কেউ কেউ আবার একটু অভিনবভাবেও ভাবে। তারা চায় এটাকে বাঘের গুহা বানাতে। আবার কেউ কেউ ভাবে এটাকেই একদিন দ্রুতগামী ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে দেওয়া যাবে। এ নিয়ে আবার তাদের নিজেদের মধ্যেই বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করে তা কেন, বানানোই যায় যদি, তাহলে এটাকে পাখিরালয় বানিয়ে দিলে কেমন হয়? কেমন পাখির কলতানমুখর হয়ে উঠবে গোটা দেশটা। আছে অবুঝ আরো একদল, যারা এই শুয়োরের খোঁয়াড়ে ঢুকতেই চায় না, তারা কোনো খোঁয়াড়ি ভাঙার মধ্যেই নেই। এইভাবেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।” আমার বামপন্থী বন্ধুর দীর্ঘ বক্তৃতা এইবার থামল। আর আমিও রাস্তা মাপলাম।
৩
আমি যখন আমার বিজেপি বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলাম, সে তখনো পুজোয় ব্যস্ত। সকালের দিকে পুরো একঘণ্টা টিভি খুলে বসে সে রামদেবের দেখাদেখি যোগব্যায়াম করে। তারপর আরো একঘণ্টা তার যায় পুজোতে। অন্য অনেক দেবদেবীর মূর্তির সঙ্গে দেখলাম একটা হনুমানের মূর্তি আর একটা রণং দেহি রামের মূর্তিও রয়েছে। সে খুব মন দিয়ে আরতি করছিল। খুব মন দিয়ে হনুমান চালিসা পাঠ করল। একবার ভাবলাম তাকে জিগ্যেস করব সে কী মন্ত্র দিয়ে রামের পুজো করে। আমাদের এদিকটাতে রামের পুজোর কোনো চল নেই, তাই রামের পুজোর মন্ত্রতন্ত্রের ব্যাপারেও কিছুই জানি না। যেটুকু যা রাম আমাদের এদিকে পাওয়া যায় তাও আবার সীতার সঙ্গে। গোটা পশ্চিমবঙ্গে রামসীতার বড় মন্দির আছে তিনটে। তারপরই মনে হল রামের পুজোর মন্ত্রর আলাদা করে আর দরকার কি, বাল্মিকীর রামায়ণই তো রয়েছে।
হাতটাত ধুয়ে আরাম করে বসল সে। সে ব্রাহ্মণ হলেও তার বসার ভঙ্গিটা দেখেছি অনেকটা ব্যবসার জায়গায় মারোয়াড়িরা যেমন দুপাশে দুটো গদি নিয়ে আয়েস করে বসে তেমনি। এই প্রথম আমি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তার চোখের চামড়া আছে কি নেই, কিন্তু ভালো বুঝতে পারলাম না। হ্যাঁ, এটা ঠিক তার চোখটা যেন একটু বেশিই ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু চামড়া আছে কি নেই ভালো বোঝা গেল না। সব শুনেটুনে সে বলল, “প্রথম কথা হচ্ছে কংগ্রেসের কথা তবু চলতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্টদের কথা আর মুসলমান আর খ্রিস্টানদের কথা তুমি আমার সামনে মুখে আনবে না। কংগ্রেস তবু একটু একটু হিন্দুত্বের চর্চা করে, কিন্তু কমিউনিস্টরা হল দেশদ্রোহী, ওরা না মানে ধর্ম, না মানে জাতীয়তাবাদ। আর মুসলমান, খ্রিস্টান ওরা সব বিদেশী।”
“বেশ, আনব না, তারপর?”
দ্যাখো, তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর ঐভাবে আমি দিতে পারব না। আমাদের ভাবনার ধরণ, টেকনিক সবই আলাদা।”
বললাম, “ঠিক আছে তোমার মত করেই বল।”
সে বলল, “তোমার প্রশ্নের এককথায় উত্তর হল, ‘সবই বেদে আছে’। চকিতের জন্যে আমার মনে পড়ল মেঘনাদ সাহা কোন্ এক বন্ধু স্বামীজিকে যেন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘সবই ব্যাদে আছে’। কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা বললে আমার এই বিজেপি বন্ধু আর আমার মুখদর্শন করবে না। তাই প্রকাশ্যে বললাম, “বল কি, সবই বেদে আছে?”
“হ্যাঁ, সবই বেদে আছে। আমরা কি, না হিন্দু। সপ্ত সিন্ধু থেকে হিন্দু। সংস্কৃতের ‘স’টা ভাষার বিবর্তনে ‘হ’ হয়ে গেছে। যেমন সপ্তাহ থেকে হপ্তা। তো আমাদের পূর্বপুরুষ কারা, না আর্যরা, তাঁরাই তো বেদ লিখে গেছেন, নাকি। সেই বেদে তুমি সব পাবে।”
“কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম হিন্দুটা পারসিক শব্দ। আহুর মাজদার হপ্ত হিন্দু থেকে হিন্দু। ওরা যেহেতু ‘স’ উচ্চারণ করতে পারত না। তুমি যেসব কথা বলছ এগুলো তো যতদূর জানি দামোদর বিনায়ক সাভারকর বলেছিলেন।”
“সাভারকর তো বেদের কথাগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যে আমাদের পূর্বপুরুষ সেইসব মহান আর্যরা আমাদের জন্যে শুধু বেদ লিখে যান নি, তাঁরা আসমুদ্রহিমাচল এই গোটা দেশটাকে নেশন বানানোর স্বপ্নও দেখেছিলেন। এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি। আমরা শুধু তাঁদের সেই স্বপ্ন সার্থক করার চেষ্টা করছি।”
“কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম নেশনের ধারণা এসেছে ইয়োরোপ থেকে।”
“ওসব ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা। বরঞ্চ বলতে পারো আমাদের দেশে জন্ম নেওয়া নেশনের ধারণাই ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে। ইয়োরোপ তো অনেক কিছুই আমাদের দেশ থেকে চুরি করেছে। যেমন ধর, ওরা এরোপ্লেন আবিষ্কার করার অনেক আগেই আমাদের এরোপ্লেন ছিল।”
“অনেক আগেই আমাদের এরোপ্লেন ছিল? কিরকম?”
“কেন পুষ্পকরথ। যাতে করে রাম লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় এনেছিলেন সীতাকে।”
“কিন্তু সেতো মহাকাব্যের কল্পনা বলে জানি। আমি তো জানি ১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্স প্রথম এয়ারক্রাফট বানিয়ে আকাশে ওড়েন। আচ্ছা, সে যাইহোক, অতীতে আর কী কী ছিল আমাদের?”
“কেন হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছিল, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল, অ্যাটম বম ছিল, গাইডেড মিসাইল ছিল।”
“হেড ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট? মানে গণেশ?”
“হ্যাঁ, নয় তো কী?”
“বল কী? ইয়োরোপ-আমেরিকা তো এখনো ওদিকটায় সাহস করে ঢুকতেই পারে নি। আচ্ছা, এটা তাহলে আমরা ওদের শেখাতে পারি।”
“পারিই তো। সে ব্যবস্থা হচ্ছে তো।”
“কী বল তো?”
“সে জন্যেই তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেদিক বোর্ড খুলে দিচ্ছেন। এই বোর্ডের আন্ডারে সবার আগে অ্যাফিলিয়েশন পাবে বাবা রামদেবের গুরুকুলগুলো।” বলার সময় সে দুকানের পাশে হাত রাখল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়করা বা বাজিয়েরা যেমন রাখে তাদের গুরুদেবের কথা বলার সময়।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ আমাদের দেশে সেই বেদের দানাই ঝরে ঝরে পড়ছে যুগ যুগ ধরে। বেদের শেকড় থেকেই বেরিয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ। সেসবের থেকেই আবার বীজ পড়ে বেদানা হচ্ছে এবং এইভাবেই চলছে। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই বেশ বেদানাদায়ক।”
“হ্যাঁ, যারা মানতে চাইছে না তাদের পক্ষে বেদনাদায়ক বটে।”
“কিন্তু একটা প্রশ্ন এখনো থেকে যাচ্ছে। তোমাদের এই নেশনের ধারণার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্পর্ক কী? তোমাদের নামে তো বদনাম হচ্ছে তোমরা স্বৈরতান্ত্রিক, তোমরা ফ্যাসিস্ট। তোমরা সংবিধান মানো না, তোমরা জাতীয় পতাকা মানো না।”
“গোড়ায় মানতাম না। গোড়ায় আমরা ভেবেছিলাম এ ব্যাপারে হিটলারই ঠিক। কিন্তু এখন আমরা মনে করি হিটলারের জাতিতত্ত্বটা ঠিক আছে, কারণ আমাদের সবার শরীরে তো সেই বিশুদ্ধ আর্যরক্তই বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফ্যাসিস্ট হবার দরকার নেই। কারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সংসদীয় গণতন্ত্রের মত ভালো জিনিস আর হয় না। এই সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনোভাবে যদি তুমি একবার মেজরিটি পেয়ে যেতে পারো, ব্যস, তুমি যা খুশি করতে পারো। তুমি ইচ্ছেমত বিরোধীপক্ষকে নাকাল করতে পারো, তাদের সরকার যখন তখন ফেলে দিতে পারো, স্বশাসিত সংস্থাগুলোকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারো, যাকে যখন খুশি জেলে পুরতে পারো, যার যখন খুশি কণ্ঠরোধ করতে পারো, প্রয়োজন পড়লে হাপিশও করে দিতে পারো, আদালতকে, আইনব্যবস্থাকে পেটকোঁচরে গুঁজে নিতে পারো, মিডিয়াগুলোকে ভায়া বিজনেসমেন তোমার ঢাক পেটাতে বাধ্য করতে পারো। তাই যদি পারো, তাহলে পৃথিবীতে কোন্ বুদ্ধু আছে যে ফ্যাসিস্ট হওয়ার বদনাম কিনতে যাবে। যখন ফ্যাসিস্টরা যেসব কাজ করে, সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই সে সেগুলো করে নিতে পারছে শুধুমাত্র মেজরিটির সাহায্যে। সেই জন্যেই আমরা এখন সংবিধান মানি, কারণ মেজরিটি দিয়ে সংবিধানের যে কোনো জায়গাকে যখন খুশি বদলে দিতে পারি। সেই জন্যেই আমরা এখন জাতীয় পতাকাও মানি, কারণ মেজরিটি দিয়ে অশোকস্তম্ভের সিংহটার আগেকার নিরীহ শান্ত ভাবটা কাটিয়ে স্বয়ংসেবকদের মনোমত বানিয়ে নিতে পারি, পতাকার সবুজটা পাকিস্তানের মত বলে সেটাও পালটে দেবার চেষ্টা করতে পারি। আর এসবই আমরা পারি মেজরিটি আছে বলে।”
“এটা তুমি ঠিক বলেছ।”
“তবেই বোঝো। অনেকেই আমাদের সেন্ট্রাল ভিস্তার বিরোধিতা করছে। তারা তো জানে না কেন আমরা সেন্ট্রাল ভিস্তা শেষ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি। তুমি কি জানো গত কুড়ি বছরে বিহার উত্তরপ্রদেশে কী পরিমাণ জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটেছে। অথচ তার ভিত্তিতে লোকসভার সিট বাড়েনি। ঐ জনসংখ্যার ভিত্তিতে কোনোভাবে যদি লোকসভার সিট বাড়ে তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় তাদের বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। তাই সেন্ট্রাল ভিস্তার পরিকল্পনা। তাছাড়াও সেন্ট্রাল ভিস্তা মানে তুমি আর একটা দর্শনীয় জিনিস পেয়ে গেলে। অনেকটা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মত। যেমন আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। সেন্ট্রাল ভিস্তা এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যার মধ্যে থাকবে রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ আর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে এমন কায়দায় তৈরি করা হচ্ছে যেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ সবকিছুর ওপর নজর রাখতে পারবেন।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও, বিহার উত্তরপ্রদেশ মানে তোমাদের গোবলয়, মানে যেখানকার গোবরে তোমাদের সব থেকে বেশি পদ্মফুল ফোটে।”
“তা তুমি বলতে পারো। আপাতত আমাদের লাভ। ওখানকার সিটগুলো যদি ঠিকঠাক পাই, তাহলে আগামী একশ বছর আর আমাদের ফিরে তাকাতে হবে না। ইতিমধ্যে সমস্ত রাজ্যকেই যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারি, তাহলে আর কোনো চিন্তাই থাকে না। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই যে নেশনের স্বপ্ন আমরা সার্থক করে তুলতে পারব।”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা গণতন্ত্র রইল কি?”
“এই সংসদীয় গণতন্ত্রে তো মেজরিটিটাই মূল কথা। তাহলে কেন রইল না? আমরা তো স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছি না। তাছাড়া দেশকে যারা ভালোবাসে, তারা আমাদের বিরোধিতা করতে যাবেই বা কেন? আমরা তো যা কিছু করছি দেশের ভালোর জন্যেই করছি।”
“আচ্ছা, তোমাদের এই সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের জায়গাটা ঠিক কোথায়?”
“দ্যাখো, আমরা সাদাসাপ্টা কথা বলা পছন্দ করি, ঐ কংগ্রেসী বা অন্যান্য দলের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয়। সোজা কথায় সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ হচ্ছে স্রেফ ভোটার, তার আগেও তার কোনো অস্তিত্ব নেই, তারপরেও তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ভোটের সময় তাদের মন জয় করার জন্যে আমরা অনেক কথা বলি, তাকে বলে ‘জুমলা’। ‘জুমলা’ মানেই হচ্ছে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি যা পালন করার জন্যে নয়।”
“বেশ। আমার শেষ দুটো প্রশ্ন।”
“বলে ফ্যালো।”
“গান্ধীজির ব্যাপারে তোমাদের কী মত?”
“এইবার তুমি আমাকে মুশকিলে ফেললে। গান্ধীজি নিয়ে মুখ খোলার ব্যাপারে আমাদের ওপরমহল থেকে নিষেধ করে দেওয়া আছে। তবে তুমি বন্ধুস্থানীয়, বিশ্বাস করে বলছি, গান্ধিজির ব্যাপারে আগে আমাদের বেশ অ্যালার্জি ছিল। কিন্তু ইদানিং আমরা সেটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। তার একটা কারণ হল এখন তো দেশটা গুজরাটি বেনেদের হাতে আর যতই হোক লোকটা গুজরাটি ছিল, শুধু গুজরাটিই ছিল না, বেনেও ছিল। আর একটা কারণ হল লোকটা তালেগোলে শুধু মাস লিডারই হয়ে যায়নি, বিদেশেও বেশ নাম কুড়িয়েছিল। তো তোমাদের এই গান্ধীজিকে নিয়ে এখন ভালো ব্যবসাও হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো ঠিকই করে ফেলেছেন, সবরমতী আশ্রমটাকে পর্যটন কেন্দ্র বানাবেন, দেশবিদেশের লোক দেখতে আসবে, কিছু বিদেশি মুদ্রার আমদানি হবে।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, কিন্তু শুনেছি তার জন্যে তোমরা নাকি ওখানকার হরিজন বস্তিগুলো আর যে পাঁচটা বেসরকারি সংস্থা আশ্রমের সঙ্গে একযোগে কাজ করত তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছ।”
“এসব আমাদের নিছক বদনাম করার চেষ্টা। হরিজন বলে কিছু হয় না, ওরা সবাই হিন্দু, বরঞ্চ তোমাদের গান্ধীজিই ওদের হরিজন বলে সরিয়ে রেখেছিল।”
“বেশ, তারপর?”
“লোকটার স্টারটা ভালো ছিল। তালেগোলে মাস লিডার হয়ে গিয়েছিল। তা নাহলে লোকটা যে ভালো করে কিছু বুঝত তা নয়। খুব গ্রাম গ্রাম করত। অথচ আমাদের থেকে বেশি গ্রাম নিয়ে কি কেউ মাথা ঘামায়। গ্রামের সবথেকে বড় প্রতীক হল গোরু, সেই গোরুকে আমরা মাথায় করে রেখেছি। যে গোরুর গোবর থেকে ঘুঁটে হয়, আমাদের সময়ই তো সেই ঘুঁটে হস্তশিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। তুমি কি জানো ঘুঁটে এখন অ্যামাজনের মাধ্যমে অব্দি বিক্রি হয়। তার নাম হল ‘ওঁ’। আর দাম শুনলেই বুঝতে পারবে আমাদের সময় ঘুঁটে কত গুরুত্বপূর্ণ একটা হস্তশিল্পে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এককিলো ঘুঁটের দাম হচ্ছে একশ তিরিশ টাকা। এক কিলোতে থাকে দশটা করে ঘুঁটে, মানে এক একটা ঘুঁটের দাম দাঁড়াল তেরো টাকা। প্রাচীন ভারতে ধর্মগোলা ছিল, তারই আধুনিক রূপ হল আদানির সাইলো। আমরা সেই প্রাচীন ভারতকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছি, তবে হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তোমাদের গান্ধীজির মত না, চরকা কাটো, যাঁতা পেষো, ঢেঁকিতে পাড় দাও।”
আমার বিজেপি বন্ধু এবার একটু থেমে দম নিল। আমি দেখলাম যথেষ্ট হয়েছে, এবার আস্তে আস্তে উঠে পড়াই ভালো। বললাম, “আমার একেবারে শেষ প্রশ্ন হল উন্নয়ন নিয়ে।”
সে বলল, “উন্নয়ন নিয়ে আবার কিসের প্রশ্ন? উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। এ নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন হতে পারে না।”
আমাকে সময় দেবার জন্যে তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
৪
বেরিয়ে পাশের পানের দোকানের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার মুখচোখ এক অদ্ভুত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আমার এতদিনের সংশয় যেন সব কেটে গেছে। অনেকদিন পরে ভবতোষ শতপথীর কবিতার একটা লাইন মনে পড়ল। “বাজে ঢাকঢোল ভিতরে খোল, কঠিন কাইদা।” হুঁ হুঁ বাওয়া, এ কঠিন কাইদা যার তার পক্ষে বোঝাই সম্ভব নয়।