সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল শিবার। ঘুম ভাঙ্গার কারণ, অবচেতন মনে স্বপ্ন যখন রঙিন থেকে রঙিনতর হচ্ছিল তখনই হঠাৎ পেটে কামর। চোখ বুজে মটকা মেরে থাকল কিছুসময়। সারাদিনের গতর খাটান শরীরটা একটু বিশ্রাম চায় এই সময়ে। রাতের এই কয়েক ঘন্টাই বিশ্রাম। পরদিন সকাল হলেই সাইকেল নিয়ে ছুটতে হবে কাটাবেলে। মাটি কাটার কাজ। দু’মাস ধরে করছে। ডাকাবুকো চওড়া শরীরটা তাকে এই কাজ পাইয়ে দিয়েছে। নাহলে এই বাজারে কাজ কোথায়? বেশিরভাগই পার্টির লোক। তার মত কয়েকটা তাগড়া জোয়ানকে কন্ট্রাক্টর আলাদা বেছে নিয়েছে তাই! তা-নাহলে নেতাদের পিছনে ঘুরে মরতে হতো।
পেট চেপে শুয়েও স্বস্তি পাচ্ছেনা কিছুতেই। লুকানো মেঘের মতো গুড় গুড় করেই চলেছে পেটটা। শেষে বাধ্য হয়ে চোখ মেলে। চোখ কচলে দেখে সারাঘরে সাদা টুনি লাইটের আলো। দড়মার বেড়ার একচালা ঘরে চাঁদ যেন ফুলশয্যার আসর বসিয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এসে আরো অবাক। মাথার উপর ফোকাস মেরে আধখানা চাঁদ ফটফটে সাদা চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সিসি টিভির ক্যামেরা। কড়া নজর চারপাশে। কিন্তু শিবার ওসব দেখার সময় কোথায়? এক দৌড়ে সোজা চলে গেল মাস্টারদার সর্ষে ক্ষেতের আলে। আলের দু’ধারে কোমর সমান গাছ। হালকা বাতাসে দুলছে সর্ষে ফুল। রূপালি আলোয় সোনালি ঢেউ। শিবা কোনদিকে না তাকিয়ে লুঙ্গি তুলে পা ফাঁক করে বসে পড়ল আলের মাঝে।
শরীরের নিচ দিয়ে গরম বেরিয়ে যেতেই ফুরফুরে হালকা বোধ করে শিবা। কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নটাকে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। কোন দিনই পারেনা। রাতের সব স্বপ্নই সর্ষে ফুলের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! তারপর ঘুম চটকালেই ভোকাট্টা। কোথায় যে ভেসে যায়!
কাজ হয়ে গেলে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে শিবা। শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস শরীর ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে। এক টুকরো মেঘ চাঁদের গা ঘেঁষে চলে যেতেই জ্যোৎস্নার আলো আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ রাতকে সঙ্গে নিয়ে একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকা। ফিরতি পথে পা বাড়াতেই দূরে একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ল শিবার। হেঁটে বেড়াচ্ছে আলোর বিন্দুটা। প্রথমে ভাবল আলেয়া হবে হয়তো। কপালের উপর চার আঙ্গুল দিয়ে চাঁদকে আড়াল করে দেখে, আলোর বিন্দুটা ডানে-বাঁয়ে বাঁক নিচ্ছে বারবার। তবে কি আল পথ ধরে এগিয়ে আসছে। কীসের আলো?
মাস কয়েক আগে মায়ের দাহ কাজ সেরে শ্মশান থেকে ফেরার সময় এমনি একটা আলোর বিন্দু দূরে, ক্রমশ আরো দূরে সরে যাচ্ছিল। সেদিন পেছন ফিরে তাকায়নি। তাকাতে নেই। মাঘ-শীতের ঠান্ডায় আদুল গায়ে কাঁপতে কাঁপতে বুঝতে পারছিল, আলো থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সে। তখন মনে হল মায়ের কথাই ঠিক। প্রায় সময়ই বলত, “আমি বিদেয় নেব যেদিন, দুনিয়ার হাজার আলোও মিথ্যে হবে সেদিন, দেখবি! চোখে আলো পড়লিই দুনিয়ার সব রং সাদা। চেনা জিনিসও তখন অচেনা হবে।“
এসব বলার কারণ, শিবা তার মাকে সন্দেহের চোখে দেখত। নিজের জন্ম নিয়েই সন্দেহ। কে তার আসল বাপ? একদিন সরাসরি প্রশ্ন করে যমুনাকে,“আমার জন্মবাপ কে? কার দায় হব আমি?”
কিছু সময় অসহায় চোখে শিবার দিকে তাকিয়ে যমুনা বলে,“এমন কথা কেমন করে মুখে আনিস তুই, জানিনে। উপরে থুথু ফেললি নিজের মাথায়ই পড়ে। আমাকে অবিশ্বাস করিস করিস, নিজের বাপকে অস্বীকার করিস নে। সে বড় ভোলা ভালা মানুষ ছিল।”
“বাবাঃ দরদ যে উথলে উঠছে! তা অমন সোয়ামীর পিরিতের দু’চারখান চিহ্ন পিঠের কাপড় সরালি যে এখনো মিলবে। সে কি আমাকেও রেয়াত করেছে? করেনি। হেঁসো ছুঁড়ে মেরেছিল।”
শিবা তখন সাত কি আট। অচিন একদিন রাগে হাতের হেঁসো ছুঁড়ে মারল। সেই উড়ন্ত হেঁসোর কোপে শিবার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল উড়ে গিয়ে পড়ল যমুনার পায়ের কাছে। যমুনা তখন দাওয়ায় বসে লাউডাটা কাটছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হাউ-হাউ করে কান্নাকাটি করার কথা ভুলে গেল। রক্তাক্ত শিবা তখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে। যমুনা তাকে পাঁজাকোলা করে ছুটল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ফিরে এসে আঙ্গুল হারানো শিবাকে দাওয়ায় শুইয়ে জলভরা চোখে অচিনের উদ্দেশ্যে শুধু একটা কথাই বলল,“নিজের সন্তানের এমন একটা ক্ষেতি করতে পারলে?”
অচিন সেইদিনই প্রথম প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলল,“উ আমার ছেলি না। তোর কলঙ্ক।”
“না না…” বলে বুক ভাঙ্গা কান্নায় আছড়ে পড়ল যমুনা।
অচিন মন্ডল মানুষটা সহজ সরল হলেও যমুনাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তাদের প্রথম সন্তান জন্মানোর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়। এরপর অনেক বছর যমুনার পেটে আর সন্তান আসেনি। ওদিকে সংসারের অভাবের সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ল অঞ্চল প্রধান মাস্টারদা। ন্যায্য পাওনার থেকেও বেশি করে চাল দিত, গম দিত, ঘর ছাউনির ত্রিপল দিত। অচিনকে ডবল রোজ দিয়ে তার আম বাগানে রাত পাহারার কাজেও লাগাত। সেই সময়ই শিবার জন্ম হলে অচিন তাকে মানতে চায় নি। এত বছর বাদে পেট বাঁধল কী করে? পঞ্চায়েতির প্রধান মাস্টারদা কেন তার ঘরে আসে? যমুনা অনেক কেঁদে কেটে বোঝাতে চেয়েছে, বাপের বাড়ি থাকতে মাস্টারদা তার চার কেলাসের মাস্টার ছিল। যমুনা একদিন পঞ্চায়েত অফিসে গেলে হঠাৎ মাস্টারদার দেখা পায়। সেই থেকে মাস্টারদা মাঝে মধ্যে তাদের বাড়ি আসে। তাদের অভাবের কথা জেনে পঞ্চায়েত থেকে এটা ওটা সাহায্য করে। অভাবের কারণেই সাহায্য নেওয়াটা মেনে নেয় অচিন। কিন্তু মাস্টারের বাড়ি বয়ে আসাটা মানতে পারে না।
কাটা আঙ্গুল নিয়েও অনেক কথা শুনতে হত শিবাকে। গাঁয়ের লোক পথ আটকে তার ডান হাতটা তুলে বলত,“ বাপ তোর কীসের দক্ষিণা নিল রে?”
এই কথার অর্থ সে বুঝত না। কিন্তু তখন থেকেই মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তবে কি বাপের উড়ন্ত হেঁসোয় তার আঙ্গুল উড়ে যাবার পেছনে মাস্টারদার কোন হাত আছে? এই সব ভেবে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একদিন সুযোগ বুঝে মাস্টারদার বাড়ির উঠোন হেগে ভরিয়ে আসে। মনে মনে গালও দেয়,“ শালার মাস্টার। তোর মুখে…।”
ষোল বছর বয়স থেকেই লায়েক লায়েক ভাব, বাপকেও আর রেয়াত করত না। যমুনা বলত,“ নিজের বাপকে শ্রেদ্ধা ভক্তি করতে শেখ।”
শিবা মাটিতে থুতু ছুঁড়ে বলত, “বাপ না ছাই। নিজের কলঙ্ক ঢাকতে আমারে ঢাল বানাচ্ছ? গাঁয়ের লোক যে পাঁচ কথা বলে, পারবে তাদের মুখ বন্ধ করতে?”
“গাঁয়ের লোক সত্যিটা জানেনা, তাই…। তা-বলে তুইও! পেটের সন্তান হয়ে…” বলতে বলতে অভিমানে চোখ ছেপে জল আসত যমুনার।
এখন নিরিবিলি, মায়াময় চাঁদের আলোয় অনেক দূরের একটা আলোর বিন্দু দেখে শিবার মনে সংশয় জাগে— মা কি সত্যিই…!
মাথার উপর সাদা আকাশ আর চারপাশে আদিগন্ত বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেতে যেন খই ফোঁটা সাদা আলোর নদী বয়ে যাচ্ছে। আর সেই নদীতে পালতোলা নৌকার মত দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে একাকী নিঃসঙ্গ একটি আলোর বিন্দু। আলপথে, ডানে বামে, ঘুরে ঘুরে। শিবার ইচ্ছে করছে এই আলপথে শুয়েই বাকি রাতটা কাটিয়ে দিতে। বেড়ার ঘর কিংবা এই জ্যোৎস্না মাখা ক্ষেতের আল, চোখ বুজলে কী আর তফাৎ! ওই আলোর বিন্দুর মতো তারও যে নিঃসঙ্গ জীবন।
অচিন মন্ডল তার বাপ কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় শিবা। দক্ষিণ দিঘির পাড়ে আম বাগানে গলায় দড়ি দেওয়াটাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয় তার কাছে। আত্মহত্যার জন্য নিজের ভিটেয় গাছ থাকতে অত দূরে মাস্টারদার বাগানে কেন? গাঁয়ের লোক জানল, অচিন মন্ডল অভাবের জ্বালায় গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু গাঁয়ে কার ঘরে অভাব নাই? এসব তলিয়ে ভাবেনি এতদিন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে নিরিবিলি, নিরুপদ্রব হলেই পেছনের অশান্ত এলোমেলো জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া করে শিবা। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।
আলোর বিন্দু যখন আরও কাছে চলে এল, শিবা হঠাৎ পিছন ফাঁকা করে মাথার উপর লুঙ্গি তুলে ঘোমটা টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াল আলো। শিবা নিশ্চিত হল, আলো হাতে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোয়াল শক্ত করে মাথা থেকে লুঙ্গি নামিয়ে কষে বেঁধে নেয় কোমরে।
আগন্তুক এবার সরাসরি মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আলোটাকে মাথার উপর তুলে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলে,“মাঝরাতে আলোকিত জ্যোৎস্নায় আমার সর্ষে ক্ষেতের আলে বাহ্যত্যাগ?”
মাস্টারদাকে দেখে অবাক হলেও বিস্মিত হল না শিবা। এখন বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে পঞ্চায়েত। পাছে কেউ শত্রুতা করে ফসল নষ্ট করে, সেই ভয়ে কী নিজেই পাহারায় বেরয়! তা’বলে এই মাঝরাতে, একা!
“আপনি কেনে মাঝরাতে মাঠেঘাটে…। হুরী-ফুরী নামে। আলো ঘোরে শ্মশানে। ক্ষেত-খামারে হায়না চরে। ভয় ডর নাই? আমরা অভাবী মানুষ। সরকারি মাগনার চালে বদ হজম হয়, প্যাট গুড়্ গুড়্ করে…।”
“খাইয়ে-দাইয়ে তোদের পুষে সরকারের কী যে লাভ! যে পাতে খাস সে পাতেই হেগে রাখিস।”
শিবা মাস্টারের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না। আপনা হতে কোদালের মত সামনের দু’খানা দাঁত বেরিয়ে আসে তার। সেটা মাস্টারের নজরে পড়ার কথা নয়। এ যেন শিকার নিজেই গুটি গুটি পায়ে এসে বাঘের খাঁচায় গা চুলকাচ্ছে। এই মাস্টার তার পরিচয়কে অনিশ্চিত করেছে। এই মাস্টারের কারণেই সে হাতের আঙ্গুল হারিয়েছে। আজ তাকে বাগে পেয়েছে। বুঝে শুনে এগোতে হবে। মুখে হালকা হাসি রেখে বলল,“ তা মাস্টারদা, আমাগরে নিয়ে এত চিন্তা কীসের আপনাদের? দিনে মাস্টারি করেন, আর রাতের বেলা? দুই সময়ে দুই মানুষ। কিন্তু আমাগ কাছে এই সর্ষে ক্ষেত, তিসি ক্ষেত, ক্ষেতের আল, দিনে যা রাতেও তাই। ফুরফুরা বাতাস, চান্দের জোছনা, রোদ-বৃষ্টি, আন্ধার— এইসব আপনারা থাকলেও আছে, না থাকলেও আছে। তা মাস্টারদা, এবার ভোট নিতে আলা না?”
মাস্টার আলো থেকে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে বলে,“ভোটের খবরে তোদের এত মজা কীসের রে?”
মাঝরাতে মাস্টারকে একা পেয়ে শিবা বেশ মজাই পেয়েছে। মাস্টারের বিরুদ্ধে অনেক দিনের পুষে রাখা রাগ ঢেউ খেলছে মনে। আধখানা হেসে বলল, “আমাগ সবেতেই মজা। মাসে তিন কিলো পেলে মজা, আবার পাঁচ কিলো পেলেও মজা। আপনি ছিলেন পেইছি। এখন কেষ্টবাবু, তিনিও দেচ্ছেন। পেলেই হল!”
মাস্টার দেখছে শিবার কথার ভাঁজ তো যেমন তেমন না। খুব সাহস যে! নিজের পুরানো পঞ্চায়েতি ঝাঁজ এনে বলল,“পেয়ে পেয়ে তোদের নোলা বেড়ে গেছে।”
“সে মাস্টার, আপনাদিগের দয়া আর ভোট ঠাকুরের কৃপা। ভোট ঠাকুর আছে বলেই না আমরা পাই।” মাস্টারের দিকে দু’পা এগিয়ে বলে, “ আচ্ছা মাস্টারদা! আপনে গাঁয়ের মান্য গন্য মানুষ। তা অচিন মন্ডল আপনের আম বাগানেই মরতে গেল কেন? কায়দা করে রটালেন গলায় দড়ি দ্যাছে। পাড়া গাঁয়ের মানুষ যে অন্য কথা বলে! ”
মাস্টারের হাতের আলো বেমক্কা নেচে উঠল যেন। নিজেকে সামলে-সুমলে বলল, “জীবতকালে কোনদিন ইস্কুলে পা দিস নি, অথচ কথা শুনলে মনে হয় যেন পেটে কথার জাহাজ নিয়ে ঘুরছিস। দু’পাতার বিদ্যে পেলে তোকে আর দেখতে হত না।”
সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে শিবা বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অসংখ্য আলোর বিন্দু এদিকেই এগিয়ে আসছে। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আলোর মিছিল দেখে মাস্টার ঘাবড়ে যায়। বিস্ময় না লুকিয়ে বলে, “ এই মাঝরাতে…!”
“কারা মাস্টার?” শিবা জানতে চায়।
মাস্টার দৃষ্টি না সরিয়ে বলে,“ সেটাই তো ভাবছি!”
হাতের আলো নিভিয়ে স্থির হবার চেষ্টা করে মাস্টার। চাঁদের রুপালি আলোয় শিবা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মাস্টারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন। আলোর মিছিল ক্রমশ এগিয়ে আসছে আলপথ ধরে। মাস্টার হঠাৎ মাথা নিচু করে বসে পড়ল। শিবা নিশ্চিত হল, মাস্টার ভয় পেয়েছে।
“মাস্টার, আপনে ভয় পাচ্ছেন?”
মচকায় তবু ভাঙ্গে না মাস্টার। বলে,“ কেন, ভয় পাব কেন? তুই জানিস ওরা কারা?”
আগুয়ান আলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিবা বলল,“জানিনে। আবার জানিও বটে। ওরা রোজ রাতে বেরয়। তবে এদিকপানে কখনো আসে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনেরে দেখে…!”
“শিবা! মজা মারিসনে! ওরা দেখতে পেলে আমাকে মেরে ফেলবে।”
মাস্টারের গলায় আর্তনাদ। ভয়ে ঢুকে পড়ল সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে। শিবা দেখে এক গোছা সর্ষে গাছ খামোখা নুয়ে পড়ল মাটিতে। মাস্টার হামাগুড়ি দিচ্ছে তাতে।
“কেন, মাস্টারকে মারবে কেন?” শিবার মুখে চাপা বিদ্রুপ।
“জানিনে। তুই কিন্তু আমাকে দেখিস নি। না না, তুইও পালা এখান থেকে। ওরা তোকেও মারবে। আমার কাছে থাকিস নে, যা পালা!”
শিবা মাস্টারের কথায় আমল দেয় না। চোয়াল শক্ত করে ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে একেবারে মুখোমুখি বসে বলে,“ ওরা কী বলছে জানেন?”
মাস্টার গলা নামিয়ে বলে,“ না, আমি শুনতে চাইনে। তুই অন্যদিকে ভাগ। আমার সঙ্গে আসিস নে। দু’জনাই বিপদে পড়ব।”
মাস্টারের কথা শুনে শিবার হাসি পায়। তার বিপদের কথা ভেবে মাস্টার চিন্তিত! গলাটাকে মোলায়েম করে বলল, “ মাস্টার, আজ এই সুন্দর জোছনা রাতে চাঁদ পানে চেয়ে একটা সত্যি কথা বলেন দেখি।”
“কী, কী সত্যি কথা!” তোতলাতে থাকে মাস্টার।
শিবা মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। চারপাশের ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম কর্নসার্ট ছাপিয়ে চিৎকার করে জানতে চায়,“আমি কে?”
সেই চিৎকারে কয়েক মুহূর্ত থেমে যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। বাতাসের আচমকা ঝাপটে উড়তে থাকে ফুল, যেন সারা মাঠ জুড়ে কাঁপছে জ্যোৎস্না ফুল। অনেকটা কাছে এসেও থমকে দাঁড়ায় আগুয়ান আলোর বিন্দুগুলো।
শিবার রুদ্রমূর্তি আন্দাজ করে মাস্টার ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। সর্ষে ক্ষেতের ভেতরে বুক দিয়ে হেঁটে পালানোর চেষ্টা করে। শিবাও ছাড়ে না। পিছু নেয়।
মাস্টার বাধা দেবার চেষ্টা করে,“ হারামখোর, তুই আমার পেছু নিচ্ছিস! নিজে মরবি আমাকেও মারবি?”
“না মাস্টার, ওরা আমাকে মারার সুযোগ পাবে না। শুধু আপনাকে…”
শিবার কথায় থমকে পিছনে তাকায় মাস্টার। চোখে মুখে আতংক। ক্ষেতের ভিতর স্থির বসে থাকলেও তার শরীরের কাঁপুনিতে দোলা লাগে সর্ষে ফুলে। শিবা মাথা তুলে দেখে, আলোর মিছিল দাঁড়িয়ে আছে সেই আলের উপর যেখানে কিছুক্ষণ আগেই নিজেকে হালকা করেছে। তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হঠাৎ দু’হাতে গলা চেপে ধরলো মাস্টার।
“সব তোর চক্রান্ত। তুই ইচ্ছা করে আমাকে এখানে টেনে এনেছিস। ভাবছিস আমি কিছু বুঝিনে? জানিনে? সব জানি। আমার বাড়ির উঠোনে তুই-ই হেগেছিলি। তখন কিছু বলিনি। লোক জানাজানি হলে আমারই সম্মান হানি হবে বলে চুপচাপ ছিলুম। পঞ্চায়েতির কোন সাহায্য তোদের দিইনি? এখন আমাকে মারার চক্রান্ত? নেমকহারাম!”বলে ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয় শিবাকে।
শিবা গলায় ধারালো সুর মিশিয়ে বলে, “আপনে ভুল ভাবছেন মাস্টার। আমি মারব কেন? আপনে নিজেই মরে আছেন।”
“ইস্কুলে না যেয়েই দেখছি কথার দিগ্ -গজ হয়েছিস। এত কথা শিখলি কোথায় বলতো?”
“অচিন মন্ডল ইস্কুলে না পাঠালিও যে রক্ত শরীলে সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে, তা লেখাপড়া জানা রক্ত। সবসময় টগবগ করে ফুটছে। আমায় দেখে বুঝতে পাচ্ছেন না? আলোটা আবার জ্বালি?”
“না…আ আ” বলে শিবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাস্টার,“শালা, বেজন্মা! আমার দেয়া ধান চাল খেয়ে শেষে কিনা আমাকেই…”
সাতাশ বছরের যোয়ান ছেলে শিবা সর্বশক্তি দিয়ে মাস্টারকে উল্টে ফেলে চেপে ধরে,“ আমাকে বেজন্মা বানাল কে, বেজন্মার বাপ? আপনের জন্য আমার হাতের একখান আঙ্গুল উড়ে গেছে। এই আপনের জন্য অচিন মন্ডল আমারে নিজের ছেলি বলে মানেনি কোনদিন। আপনের জন্য আমার মায়ের সংসার ভেঙ্গিছে। অচিন মন্ডল যেমন তাকে কোনদিন সুখ দেয়নি, আমিও তেমনি কম দুঃখ দিইনি তাকে। এ সব কিছুর দায় আপনের। এখন আপনের হাতে কোন ক্ষমতা নাই। ভোট নাই যার, ক্ষমতাও নাই তার। আজ সব হিসাব চুকাতি হবে”
একগোছা সর্ষে গাছ তুলে মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। হাত পা-ও কষে বেঁধে টেনে আনল আলের উপর। ততক্ষণে আলোর বিন্দুগুলো আরও কাছাকাছি এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের।
মাস্টার গোঙাতে গোঙাতে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল,“ শিবা, বাপ আমার! আমার কথাটা শোন। আমাকে ছেড়ে দে। অকারণ এই মাস্টারকে মেরে কেন জেলের ঘানি টানবি? তুই কী চাস বল, আমি তোকে সব দেব। আমাকে এভাবে ফেলে রাখিস নে। ঐ এত আলোয় আমার বড় ভয়। আমাকে এই অবস্থায় লোকে দেখলে…”
“ভয় নাই মাস্টার! আপনেকে কেউ আর দেখতি পাবে না। যে ক’খান হাড়-গোড় পড়ি থাকবে, তাতে কেউ চিনতিই পারবেনা। ঐ যি দেখছেন একপাল আলো, জোছনার মধ্যিও কেমন জ্বলজ্বল করছে। হাতের আলোখান দেখে কাছে আসতি সাহস পাচ্ছে না। আমি সরে পড়লেই ওরা ভোজন উৎসবে মেতি উঠবে। ওদের পেটে বড় খিদা।”
শিবা খুশি মনে আলো নিয়ে ঘরের পানে হাঁটতে থাকে। আর পিছন ফিরে তাকায় না।