সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
স্বতন্ত্র ও স্পষ্ট রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসেবে হিমাচল প্রদেশ প্রকাশ পেতে থাকে স্বাধীনতার পর থেকেই। যদিও এই প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে, পৌরাণিক কাহিনী, মহাকাব্য এবং পুরাণের সূত্রে বহু পরিচিত।এখানকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা জনজাতি যেমন পুরোপুরি স্বতন্ত্রভাবে হিমাচলেরই তেমনি আবার বাইরের থেকে বহু মানুয এখানে এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন। যার ফলে যথেষ্ট মিশ্রণও ঘটেছে এবং হিমাচল প্রবেশ বর্তমানে সমতল ও অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংমিশ্রিত এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব।
তবে এই সংমিশ্রণ হিমাচলের সবুজ অঞ্চলে আটকে থেকেছে বহুদিন বা এখনও আছে এবং তা মূলত প্রাকৃতিক কারণে। প্রাকৃতিক দিক থেকে হিমাচল মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি যথেষ্ট বৃষ্টিপাতে ঘন সবুজ এবং অন্য অংশ বৃষ্টিহীন মরুভূনি। এই অঞ্চলটি লাহুল ও স্পিতি জেলা এবং কিন্নরের কিছু অংশ। আয়তনগত ধারণার জন্য এটা উল্লেখ করা যেতেই পারে যে লাহুল ও স্পিতি জেলা ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা।
পাঞ্জাব ও শিমলার ৩০টি পূর্বতন প্রিন্সলি স্টেট বা করদ রাজ্য মিলিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ই এপ্রিল হিমাচল প্রদেশের সূচনা। সেই সময় চাম্বা, মাহাসু, মাণ্ডি আর সিরমুর এই চারটি জেলায় বিভক্ত ছিল হিমাচল প্রদেশ। পরবর্তীকালে বিভিধ পরিবর্তন এবং সংযোজনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের হিমাচল প্রদেশে ১২টি জেলা। ইউনিয়ন টেরিটরি থেকে আলাদা রাজ্য হিসাবে পরিগণিত হয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে।
পাহাড়ে বিশেষত হিমাচলের পাহাড়ে জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বিশেষত ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চল অর্থাৎ লাহুল ও স্পিতিতে। পরিবারের সকলকে সার্বিকভাবে এই বেঁচে থাকার লড়াইতে সামিল হতে হয়। এখানকার শীতকাল যা প্রায় পাঁচ মাস বরফে ঢাকা, সেই সময় অসুস্থতা এবং অন্যান্য কারণে অনেকে তুলনামূলক কম ঠাণ্ডার জায়গায় চলে যান। যদিও ২০১১ সালের সেনসাসের হিসাব অনুযায়ী সম্ভবত ভারতের কষ্টকরতম বসবাসের জায়গা স্পিতি উপত্যকায় এর উল্টো ছবি পাওয়া যায়। দশক প্রতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব যে লাহুল ও স্পিতি জেলায় ২০০১ থেকে ২০১১ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (-) ৫ শতাংশ অর্থাৎ পুরো জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমেছে। অথচ এই জেলার রুক্ষতম সাবডিভিশন স্পিতি উপত্যকার জনসংখ্যা ঐ একই সময়ে শতকরা (+) ১৬.৬৫ বেড়েছে। তার কারণ মূলত পণ্যমূলক কষি উৎপাদনের অভাবনীয় বৃদ্ধি। এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা অন্যত্র পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু যারা ঐ শীতে গ্রামে রয়ে গেলেন তাদের জীবন যাত্রা প্রায় থমকে যাওয়া অবস্থায় চলে যায়। প্রচুর বরফপাতের জন্য জমি রাস্তা সবকিছু বরফে চাপা পড়ে যায়। সেইজন্য তাদের প্রধান কাজের ক্ষেত্র চাষবাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সময় কাটে মূলত প্রশস্ত বসার ঘর কাম রান্না ঘরে আগুনের পাশে। এখন অবশ্য খোলা উনুন ব্যবহার হয় না। বন্ধ উনুনে টিনের চোঙা ঘরের বাইরে বের করে দেওয়া থাকে যাতে ধোঁয়া ঘরে না জমে কিন্তু ঘরের হাওয়া গরম থাকে। সেই ঘরে বসে আড্ডা, অল্প স্বল্প গান বাজনা অথবা ভেড়ার লোম থেকে সুতো তৈরি করা। এতেই সময় কাটে। এই শীতকালেই পারিবারিক জমায়েত বেশি হয়, একেক দিন একেক জনের বাড়িতে। সেই দিনগুলোতে গান বাজনা বা আড্ডা আরও জমে ওঠে। এই জীবন যাপনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য তারা আন্তরিকভাবে অপেক্ষা করে থাকে মেলা বা উৎসবের জন্য
যখন অন্য অনেক মানুষের সাথে তাদের মেলামেশার সুযোগ হবে আর দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের বদলে কিছু নতুন খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে বা নতুন পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তোলা যাবে।
হিমাচল প্রদেশের দুর্গমতম স্থানগুলোর মত একটি হল পিন উপত্যকা। আমরা যারা বাইরের লোক তারা প্রথমত সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেনই। চারদিকে বরফের মুকুট পরা আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। সেই অনিঃশেষ বরফ চূড়া থেকে বয়ে আসা জলধারা। বহু উপর থেকে নিচু পর্যন্ত কোন গাছের চিহ্নমাত্র নেই। শীতের কয়েক মাস সেই পর্বতের সমস্তটা এমনকি নীচে নদী পর্যন্ত বরফ ঢাকা থাকে। বরফ গলে যাবার পর সেই বিরাট পর্বতের গায়ে কোথাও লাল রঙের পোচ, কোথাও সবুজ, আবার কোথাও বা কিছুই নেই, শুধুই ধূসর রুক্ষতা। সেই পর্বতের পায়ের কাছে কোথাও একটু মাটি। সেই মাটিকে ঘিরে কিছু মানুষের বেঁচে থাকা বছরের পর বছর। মাটি এখানে অত্যন্ত মহার্ঘ। একটা হিসেব থেকেই য়া বোঝা যাবে। পুরো স্পিতি উপত্যকা এবং পিন উপত্যকায় মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা চাষযোগ্য। বাকী অংশে প্রায় কিছুই জন্মায় না। কিছু ক্ষেত্রে কিছু কিছু ঝোপ বেড়ে ওঠে, তাও নদী সংলগ্ন এলাকায়। এই ঝোপের একটা বড় অংশই ‘সিবাকথর্ন’-এর ঝোপ। সিবাকথর্ন কুঁচফলের চেয়ে একটু বড়, লাল রঙের ফল। অত্যন্ত উপকারী ফল। যদিও তা প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে।
এখানে বরফ পড়া শুরু হবার আগে জমি চাষ করা শেষ করে জমির প্রান্তে পাথরের অবরোধ তৈরী করা হয় এবং সমস্ত জমি স্থানীয় ঘাস তুলে ঢেকে দেওয়া হয়। এর ওপর বরফ জমা হয়। বরফ গলে যাবার সময় যাতে মাটি ধুয়ে বেরিয়ে না যায়, তার জন্য এই ব্যবস্থা।
এই পিন উপত্যকাতেই একটি গ্রাম। গ্রামের নামটা উহ্য থাক। সেই গ্রামের একটি বাড়িতে সমীক্ষার কাজ চলছে।
গৃহকর্ত্রী প্রশ্নের জবাবে বাড়ির সবার নাম বয়স ইত্যাদি জানাচ্ছেন। উত্তর শুনে একটু খটকা লাগলেও বোঝা গেল, তিনি বহুভর্তৃক অর্থ্যাৎ ইংরেজিতে যাকে Polyandry বলে, তার পরিবারে সেটাই চালু। সেই গ্রামে প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবারে এই প্রথা চালু আছে। ওই গৃহকর্ত্রীর স্বামীরা দুই ভাই। কথা বলে জানা গেল যে এই প্রথা ক্রমশ কমে আসছে।
এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের উদ্দেশ্য এই যে হিমাচলের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনজাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভিন্নতা এখনও অটুট। হতে পারে দুর্গমতার জন্যে এই সব অঞ্চলে বাইরের প্রভাব সেভাবে এসে পৌঁছায়নি। এই অঞ্চলের মানুষেরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরম্পরা শক্তভাবে বজায় রেখেছেন। সমতল সংলগ্ন এলাকায় প্রথমত মুঘলদের প্রভাবে বাইরের সংস্কৃতির মিশ্রণের সূচনা। এখন এইসব অঞ্চলে পাঞ্জাবী সংস্কৃতি মিশ্রিত পাহাড়ী সংস্কৃতির নিজস্বতা বজায় আছে। বাইরের সংস্কৃতির প্রভাবেই সমতল সংলগ্ন হিমাচলে শুরু হয়েছিল ‘‘রীত’’ নামক কদর্য বিবাহ পদ্ধতির। সিমলা, মাণ্ডি, কুলু, কাংড়া এবং আরও কয়েকটি তৎকালীন রাজ্যে ‘‘রীত’’প্রথা চালু ছিল। এই প্রথা অনুযায়ী কোন অনুষ্ঠান ছাড়া শুধুমাত্র টাকা দিয়ে মহিলাদের ঘরে নিয়ে আসা হতো। তখনকার দিনে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বা খুব বেশি হলে ২০০০ টাকা মেয়েটির মা, বাবা বা স্বামীকে দিয়ে তাকে নিয়ে আসা যেত। এই যে টাকা দেওয়া হতো তা ‘‘রীত’’ মূল্য ধরা হতো। একজন ‘‘রীত’’ মূল্য দিয়ে কতজন মহিলাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে তার কোন সীমা ছিল না এবং তাদেরকে অন্য কারও কাছ থেকে ‘‘রীত’’ মূল্য নিয়ে দিয়ে দেবে সেটা একেবারেই তার সিদ্ধান্ত ছিল। ১৯১৭ সালে দলীপ সিং এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটান। লাহুল ও স্পিতি অঞ্চলে এই প্রথা কোনদিনই দেখা যায়নি। এই বিবাহ পদ্ধতি সমতল সংলগ্ন হিমাচল ছাড়িয়ে দুর্গমতর এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি।
তবুও সমাজে মহিলাদের স্থান বিচার করতে গেলে সমস্ত হিমাচলে পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থা চোখে পড়বেই যা ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের বা কেরালার কিছু অঞ্চলের সামাজিক ব্যবস্থার থেকে আলাদা। বরং মূল ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে তুলনীয়। তবে মূল ভারতবর্ষীয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে পাহাড়ের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা আলাদা। অতীতে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল যা এখন হিমাচলের অন্তর্ভুক্ত, সেই অংশ ছাড়া অন্য এলাকাতে মহিলারা বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। পরিবারে তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে এইসব বিষয়ে কখনো বিবাদ সৃষ্টি হয় না। ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চলের এই সামাজিক অবস্থান অবশ্যই বাকী হিমাচলের থেকে আলাদা, যেখানকার সমাজ ব্যবস্থা মাতৃকেন্দ্রিক বংশ পরম্পরা বা মাতৃকুল ভিত্তিক (Matrilineal)। বাকী হিমাচলে মহিলারা সামাজিক ভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাহীন ভাবে বাঁচতে বাধ্য হন। তার মূল কারণ পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবাধ মান্যতা তার সাথে স্থানীয় পুরাকথা এবং বিশ্বাস যা জড়িয়ে আছে মূলত পুত্রসন্তানবতী হওয়া বা না হওয়ার সাথে। এখানে মহিলারা পুত্রসন্তান ছাড়া জীবন ব্যর্থ এই বিশ্বাস নিজেরা করতে শুরু করেন। তার নিজস্ব কোন ইচ্ছা আছে, স্বতন্ত্রতা আছে তা ভুলে যেতে বাধ্য হন। সামাজিক মূল্যবোধ এতটাই শক্তিশালী হিসাবে দেখা যায় সেখানে যে শত দুঃখ হেনস্থার পরেও তারা স্থিতাবস্থার সপক্ষেই থাকেন। তারাই হয়ে ওঠেন কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম পরিশ্রমী বাহক। তাদের শ্রম নিঙড়ে বেড়ে ওঠে কৃষি অর্থনীতির স্বাস্থ্য। পরিবারের জন্য শ্রমদানে তারা অগ্রবর্তী কিন্তু তাদের স্থান পরিবারে উন্নত হয় না। আর যদি পুত্র সন্তানের মা না হতে পারেন তবে তার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করতেই পারেন, যদিও তা আইনত সিদ্ধ নয় কিন্তু সামাজিক ভাবে তা গ্রহণীয়। যারা এতকিছু সহ্য করতে পারেন না তাদের পিতৃপুরুষদের বাড়িতেও তাদের গ্রহণ করতে চায় না। তারা উপহাসের পাত্র হন।
বিভিন্ন প্রকারের অঞ্চল এবং তাদের আলাদা প্রকারের জীবন ধারার সমন্বয়ে গড়ে উঠেচে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যটি। একদিকে কিন্নর এবং লাহুল স্পিতির সম্পূর্ণ জনজাতি প্রধান জীবনধারা, অন্যদিকে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশ সংযুক্তিকরণের পর ‘পাহাড়ি’ ও ‘পাঞ্জাবী’ সংস্কৃতির মিলিত জীবনযাপনের ছবি। একদিকে হিন্দু সংস্কৃতি ও তার প্রকারভেদ, অন্যদিকে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধারা। মাঝখানের সীমারেখা এখানে বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়।
ভৌগলিক ও সংস্কৃতিগত এত বিভিন্নতা সত্ত্বেও সমাজ বা পরিবারের এখানে মহিলাদের সম্মান ও গুরুত্ব তার সন্তান ধারণের সাপেক্ষে নির্ধারিত। পুত্র সন্তানের মা, অভিযোগহীন, বাধ্য এবং কায়িক শ্রমে কোন অনীহা নেই, এমন নারীই পরিবারে ও সমাজে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। আলাদা করে তার নিজের ইচ্ছাপূরণের কোনো অধিকার থাকবে এটা কেউ আশা করে না। জন্ম থেকেই পিতৃতান্তিক সমাজধারা তার জীবন সেই ধাঁচে গড়ে দিতে চায়। কন্যাসন্তানের জন্য আলাদা যত্ন বা সাহায্য অভিভাবকেরা করেন না, কেননা তারা ‘পরায়া ধন’ (অন্যের সম্পত্তি), যাকে অন্য পরিবারে উপহার দিতে হবে। শ্বশুরবাড়িতে তারা বাইরে থেকে আসা কেউ। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সন্দেহাতীতভাবে আনুগত্যের প্রমাণ দিতে পারছে বা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারছে।
সুতরাং একদিক থেকে দেখতে গেলে এখানে নারীদের নিজের দেহের উপরে নিজের কোনো অধিকার নেই। শুধুমাত্র তাই নয়, তারা তাদের নিজের ইচ্ছেমতো কোনো দেবতার আরাধনাও করতে পারে না। মান্ডি জেলার একটি অংশে নারীরা যখন তার পিতার আশ্রয়ে থাকেন, ততদিন শুধুমাত্র তার পিতৃগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট দেবতাকেই পুজার্চনা করতে পারেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নির্দিষ্ট দেবতাকেই পুজা করতে পারবেন এবং তাও পুতির সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর। এই নারীদের শুধুমাত্র তার নিজের দেহের উপর কোনো অধিকার নেই তাই নয়, তার ঈশ্বরবিশ্বাসের অধিকারও শর্তসাপেক্ষ।
অন্যদিকে লাহুল স্পিতিতে পুত্র সন্তানের জন্মের পর যে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে হয় না।
হিমাচলের নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের বিষয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির সংবেদনশীলতা সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা পেতে আমরা একটি অনতি-অতীতের সমীক্ষার প্রাসঙ্গিক অংশটি দেখে নিতে পারি। এই সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী:
১. কীভাবে জমি ব্যবহার করতে হবে সেই বিষয়ে লাহুল ও স্পিতি জেলাতে ১৪ শতাংশ মহিলা সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে সিমলা ও কিন্নর অঞ্চলে মাত্র ৭ শতাংশ মহিলা এই সুযোগ পান।
২. লাহুল স্পিতি অঞ্চলে নারীরা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজেদের নামে পেতে কোনো সামাজিক চাপ অনুভব করেন না, অথচ কিন্নর অঞ্চলে ২৫ শতাংশ মহিলা এই চাপ অনুভব করেন। সিমলা এবং কাংড়া অঞ্চলের নারীদের ৬৩ শতাংশ উত্তরাধিকার সূত্র পাওয়া সম্পত্তি পেতে সামাজিক চাপের সম্মুখীন হন।
৩. সিমলা ও কিন্নর অঞ্চলের নারীদের ৩০ শতাংশ উল্লেখ করেছেন যে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজেদের নামে পেতে প্রচলিত স্থানীয় সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে কিন্নরে এই শতাংশ ২৬ এবং লাহুল স্পিতিতে এই শতাংশ ৩৪।
এই তথ্য থেকে নারীদের প্রতি স্থানীয় সংস্কৃতির সংবেদনশীলতার মাপকাঠিতে লাহুল স্পিতি অঞ্চল সবচেয়ে এগিয়ে আছে, এই ধারণা করা যেতেই পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি দিকে আমরা দৃষ্টি ফেরাতে পারি। ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চল অর্থাৎ মূলত লাহুল ও স্পিতি উপত্যকার প্রায় সমস্ত আদি বাসিন্দারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর বাকী হিমাচলের অন্য অঞ্চল বিবিধ আঞ্চলিক আচার আচরণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের যোগাযোগও সমতলের সাথে, বিশেষত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সাথে অনেক বেশি। স্বভাবতই তাদের প্রভাবও এই অঞ্চলে বেশ প্রকট। রোটাং পাস এবং কুঞ্জুম পাসের দুর্লঙ্ঘ বাধার জন্য লাহুল ও স্পিতি সবসময়ই একটু বিচ্ছিন্ন থেকেছে।যদিও অটল টানেলর জন্য লাহুল এখন অনেক সহজ যোগাযোগের মধ্যে চলে এসেছে কিন্তু স্পিতি এখনও প্রায় একই রকম দুর্গম। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবন যাপনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সে পারিবারিক অনুষ্ঠানই হোক বা গ্রামের সামগ্রিক কোন সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানকার প্রতিটি গ্রামের জন্য বৌদ্ধ মঠ নির্দিষ্ট করা আছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ছোট সন্তানকে সাধারণত ‘লামা’ হবার জন্য মঠে পাঠানো হয়। যে বাড়িতে পুত্র সন্তান নেই সেই বাড়ির কন্যা সন্তানকে ‘চোমো’ (মহিলা লামা) হবার জন্য পাঠাবার নিয়ম। পারিবারিক বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে নির্দিষ্ট মঠের লামাদের অংশ গ্রহণ থাকে। সব মিলিয়ে এটা মনে করা যেতেই পারে লাহুল স্পিতির বৌদ্ধ সমাজে বৌদ্ধ মঠগুলির প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই আছে। পরিবারহীন বয়স্ক মানুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমও দেখতে পাওয়া যায় স্পিতি উপত্যকার “কী” গ্রামে। এটি চালান গ্রামের মানুষেরা।
লাহুল ও স্পিতি উপত্যকায় মহিলাদের স্থান সমাজে যথেষ্ট উঁচু জায়গাতে বলে বোঝা যায়। কিন্তু বাকী হিমাচলের ছবিটা সেরকম আশাপ্রদ নয়। তবে এই ফারাক ধর্মের কারণেই হয়েছে কিনা তা সুনিশ্চিত করে বলার আগে অন্যান্য বিষয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে আগামী দিনে কোন উৎসাহী গবেষক আলোকপাত করবেন বলে আশা রাখি।
তথ্যসূত্র:
1. Census 2011 2.. Women Land Rights of Women in Himachal Pradesh: Impacts and Challenges : Submitted to National Commission for Women :Submitted by : SAHAAS (Brotherhood Uplifting CYWO), Shimla, H.P. 3. Situational Analysis of Single Women in Himacal Pradesh, 2006, Compiled by Prajakta Panshikar and Subhash Mendhapurkar. 4. Conjugality, Sexuality and Shastras: Debate on the Abolition of Reet in Colonial Himachal Pradesh by Yogesh Snehi.