সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাংলা লোকসংগীতের অন্যতম প্রাচীন চর্চাকেন্দ্র ভ্রমরা এবছর তার ৬০ বছরে পদার্পণ করেছে। কলকাতা শহরে এই ধরনের এত প্রাচীন লোকসংগীত চর্চার প্রতিষ্ঠান সম্ভবত আর নেই। নাগরিক মানুষের কাছে বাংলার নিজস্ব শিকড়ের সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়া, তাদের লোকসংগীত ও লোকশিল্পে আগ্রহী করে তোলা মোটেও সহজ কাজ নয়। তথাপি এই কঠিন কাজটিই ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে ভ্রমরা এত বছর ধরে করে এসেছে। গড়ে তুলেছে ভ্রমরার এক বৃহৎ পরিবার ও গোষ্ঠী, যারা নিয়মিত লোক সংগীত চর্চায় নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে। এদের কেউ কেউ তিন পুরুষ যাবদ এই সংস্থার সাথে যুক্ত, এরা কেউ কেউ কণ্ঠ শিল্পী; কেউবা পরম্পরাগত লোক যন্ত্রের (যেমন সারিন্দা, দোতারা, বাংলা ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি) বাদক। বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা লোকগান, তার সুর এবং লোকসংস্কৃতির ধারক বাহকের কাজ করে চলেছে ভ্রমরা ও তার পরিবারের সদস্যরা। এরই ফলশ্রুতি ১৯৯৩ সালের প্রকল্প ‘শিকড়ের সন্ধানে’ অডিও ক্যাসেটের সিরিজ যাতে ধরা আছে বাংলার প্রান্তপ্রান্তরের লোকসংগীত শিল্পী গান এবং বাজনা, রয়েছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া গানের সম্ভার।
ভ্রমরার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং লোকসংগীতের আরও প্রসারের লক্ষ্যে বর্ষব্যপী হীরকজয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় উত্তরবঙ্গের মালদহ জেলার মানিকচক ব্লকের ধরমপুর গ্রামে। এই গ্রামে এবছরের (২০২২) ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চ ভ্রমরা তার অনুষ্ঠান কর্মসূচী সফলতার সাথে সম্পন্ন করে। এযাবৎকাল ভ্রমরার কর্মসূচী ছিল মূলত কলকাতা শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাকেন্দ্রিক। যদিও গ্রামীণ শিল্পীরা ভ্রমরার অনুষ্ঠানে বহুবছর ধরেই অংশগ্রহণ করছেন। গ্রামবাংলার লোকশিল্পের সাথে যুক্ত গুণীজনের সমাবেশ ঘটত ভ্রমরার লোক উৎসবে। কিন্তু হীরকজয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। এটি স্থির করা হয় যে ভ্রমরা শহরকেন্দ্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামগ্রামান্তরের মানুষ এবং লোক শিল্পীদের কাছে পৌঁছাবে। তাদের নিজেদের ভূমিতে গিয়ে তাদের শিল্পী ও শিল্পীদের সাথে একাত্ম হবে। কাজটি আদপেও সহজ ও মসৃণ ছিল না। তথাপি এই উদ্যোগের ঝুঁকি নেওয়া হয় এবং প্রাথমিক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এধরনের অভূতপূর্ব কর্মসূচীকে সফলতার সাথে বাস্তবায়িত করতে সমর্থ হয়। ধরমপুর গ্রামের ঝা পরিবারের এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় মহা ধুমধাম করেই এই অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়; মূলত গ্রামবাংলার গ্রামগ্রামান্তরের ছড়িয়ে থাকা মণিমুক্তের মত গুণী অথবা ভীষণই অখ্যাত লোকশিল্পী ও লোকশিল্প দলের যোগদান এবং প্রদর্শন ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য, এছাড়া দোতারা, ঢোল, সারিন্দা, বাঁশীর মত পরম্পরাগত বাংলার নিজস্ব লোকবাদ্য যন্ত্রের প্রতি আরও উৎসাহবৃদ্ধি করাও ছিল অপর একটি উদ্দেশ্য।
২৫শে মার্চ সকাল ১১টায়, মঞ্চসংলগ্ন মাঠে (যেটি আসলে একটি আমবাগান) দোতারা কর্মশালা শুরু হয়। পরিচালনা করেন ভ্রমরার সদস্য এবং বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী শ্রী তীর্থদেব ভট্টাচার্য। পরপর তিনদিন (২৫, ২৬, ২৭ মার্চ) বেলা ১১টা থেকে ৩টে পর্যন্ত এই কর্মশালা চলে। প্রায় ১৫জন উৎসাহী ব্যক্তি এই কর্মশালায় যোগদান করেন। যাদের মধ্যে কলকাতা থেকে আগত অংশগ্রহণকারীরাও ছিল যাদের কেউ কেউ শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত।
এই দিন বিকেল ৫টার অনুষ্ঠানের খোলামঞ্চে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন পর্বের মধ্য দিয়ে তিনদিনের কর্মসূচীর সূচনা হয়। ভ্রমরার সম্পাদক দলের প্রশিক্ষকে প্রবীন লোকসংগীত শিল্পী শ্রী শিবব্রত কর্মকারের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠান সুমম্পন্ন হয়। ধামসা বাজিয়ে (শঙ্খ ও উলুধ্বনি সহযোগে) অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী ও স্থানীয় প্রবীন গ্রামবাসী শ্রী বাসুদেব মণ্ডল মহাশয়। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং স্থানীয় মানিকচক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী জ্যোতিভূষণ পাঠক মহাশয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কাহালা সম্প্রদায় সমেবেত বাদ্যযন্ত্রসংগীত পরিবেশন করে। এই কাহালা সম্প্রদায় প্রধানত লোহার কারিগর অর্থাৎ কর্মকার সম্প্রদায়। কাহালা সম্প্রদায় কোথাও লোহার সম্প্রদায় নামেও পরিচিত। বাংলা সানাই, ঢোল, কুড়কুড়ি সহযোগে সমবেত ‘চেরাপেটা’র ঐকতান বাদন উপস্থাপন করেন তাঁরা। উত্তরবঙ্গের যেকোন শুভ অনুষ্ঠানে বিশেষত বিবাহ অনুষ্ঠানে পরম্পরাগত ‘চেরাপেটার’ ঐকতানবাদন খুবই পরিচিত এক দৃশ্য। এই দিনের সর্বশেষ অনুষ্ঠান ছিল ‘বিষহরী’ পালা। ‘মনসা’ সমগ্র বঙ্গ দেশে (অবিভক্ত বঙ্গভূমি) বহু যুগ ধরে আরাধ্য দেবী। সাপের পুজো তথা মনসাদেবীর আরাধনার প্রচলন হওয়া থেকে আজ অবধি নানাভাবে, ভঙ্গিমায় ও আঙ্গিকে দেবীর আরাধনা করা হয়েছে। মনসাদেবী এবং বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী থেকে সৃষ্টি হওয়া মনসামঙ্গল কাব্য বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়, তৈরি হয়েছে লোক শিল্পের নানা ধারা বা আঙ্গিক। উত্তরবঙ্গে মনসামঙ্গলের বিশেষ এক আঙ্গিক হল ‘বিষহরী’ পালা। দক্ষিণ বঙ্গে কোথাও জাগগান কোথাও বা জাতগান, তেমন রাঢ়বঙ্গে ঝাপান ও বিষহরার গান আবার পূর্ববঙ্গে রয়ানি নামে পরিচিত। এই সবকটি পালারই মূল বিষয় দেবীমনসা ও সাপ। কোথাও কেবলমাত্র গানের মাধ্যমে আবার কোথাও দলগতভাবে অভিনয়, গান ও কথকথার মাধ্যমে মনসা কাহিনী বর্ণনা করা হয়। কোথাও এককভাবে চামর হাতে কথক তার গানের মাধ্যমে ঐ পালা বর্ণনা করেন এবং সাথে দোহার ও যন্ত্রীরা তাকে সঙ্গত করেন। স্থানীয় ছোট ধরমপুর গ্রামের নবজাগরণ মনসামঙ্গল নাট্যসংস্থা পরিবেশন করে মনসামঙ্গলের ‘বিষহরী’ পালা। পরিচালনা করেন শ্রী বাসুদেব মণ্ডল যিনি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধক ছিলেন। রূপসজ্জার মাধ্যমে চরিত্র নির্মাণ করে, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে ‘বিষহরী’ পালার প্রথম অংশ ঐ দিন পরিবেশন করা হয়।
পরেরদিন ২৬ মার্চ বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে বাংলার প্রসিদ্ধ একান্ত নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র ঢাকের একক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করেন মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বিশিষ্ট লোকযন্ত্র বাদক শ্রী খোকন দাস। এরপর পরিবেশিত হয় সারিন্দা এবং ঢোলের যুগলবন্দী। সারিন্দা পরিবেশন করেন উত্তর ২৪ পরগণার হাবড়ার বিশিষ্ট যন্ত্রশিল্পী শ্রী গোবিন্দ দে। ঢোলে সঙ্গত করেন খোকন দাস ও সুবীর বিশ্বাস। বাংলার যাত্রাপালা কিংবা পালাগানের ক্ষেত্রে যে বাদ্যযন্ত্র অঙ্গ তার নাম হল ক্ল্যারিওনেট বা স্থানীয় ভাষায় কালোবাঁশি। এই কালোবাঁশি ও ট্রামপেটের সমবেত যুগলবন্দী উপস্থাপন করেন স্থানীয় লোকসংগীত শিল্পী সুভাষ রুইদাস ও সম্প্রদায়।
এরপর শুরু হয় পরপর তিনটে প্রযোজনা। প্রথমে স্থানীয় লৌকিক সৃজনী পরিবেশনা করে ডোমনী। ডোমনী মালদহ জেলার স্থানীয় সংস্কৃতির অভিন্ন অংশ। বিহার থেকে বহুকাল আগে প্রব্রজন হয়ে আসা মানুষেরা মালদহ জেলায় এক উপনিবেশ গড়ে তোলেন। তাদের সাথে বয়ে আসা ভোজপুরী আর স্থানীয় বাংলাভাষার মিশ্রণে তৈরি হয় এক বিশেষ মিশ্রভাষা, যার স্থানীয় নাম ‘খোট্টা’ ভাষা। বহুগান ও পদরচিত হয়েছে এই খোট্টাভাষায়। এই পালায় পুরুষেরা মহিলা সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। এদের বলা হয় ছুকড়ি। এজন্য কখনও কখনও এদের লম্বা চুলও রাখতে হয়। পরবর্তী পালা ছিল নাটুয়া, স্থানীয় মথুরাপুর গোয়ালপাড়া নাটুয়াগান সংস্কৃতিমঞ্চ পরিবেশন করে নাটুয়া। এই নাটুয়া পালাও খোট্টাভাষাতেই হয়ে থাকে। ডোমনী ও নাটুয়া উভয়পালাতেই রূপসজ্জা করে চরিত্র নির্মাণের মাধ্যমে অভিনয় ও গানের মধ্য দিয়ে কাহিনীকে দৃশ্যায়িত করে বর্ণনা করা হয়। ডোমনীর বিষয়বস্তু প্রধান পারিবারিক বা দাম্পত্যকেন্দ্রিক। নাটুয়ার ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিষয় বা ঘটনা প্রাধান্য পায়। নাটুয়াতে অবশ্য ছুকড়ি থাকে না। ঐ দিনের শেষ পালা ছিল ঝাড়নী। স্থানীয় রসুলপুর মারসিয়া গানের দল ঝাড়নী পরিবেশন করে। কারবালার প্রান্তরের সেই দুঃখজনক ঘটনার শোকাহত বর্ণনা এই ঝাড়নী গান। এই বিশেষ শোকের ঘটনার বর্ণনার নানা ভঙ্গি সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলন আছে। বঙ্গ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের জারি গান ও জারিসুর খুবই পরিচিত একটি আঙ্গিক। মহরম মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের পার্বণ। এই পার্বণেরই এক লোকশৈল্পিক প্রকাশ ঝাড়নী পালায়, মুর্শিদাবাদে ঐ ধরনের পালাকে ঝাণ্ডিগান বলে। বাঁশ থেকে তৈরি এক ধরনের ঝাড়ু হাতে, তার থেকে সৃষ্টি শব্দ প্রক্ষেপণ ও তালের মধ্য দিয়ে এই গান গাওয়া হয়। আঙ্গিকের দিক দিয়ে গুজরাটের গরবার সাথে এই নাচের মিল পাওয়া যায়। পোষাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে স্থান বিশেষে পার্থক্য লক্ষণীয়। ঐ দিন অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে লোকসংগীত পরিবেশন করে ভ্রমরা।
শেষ দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সকাল ৭টায় সর্বস্তরের সমবেত শিল্পী সহযোগে ধরমপুর গ্রাম পরিক্রমণ করা হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান কিছু আগেই শুরু হয়। বিকেল ৪টার সময় তিন দিনের দোতারা কর্মশালা শেষে শিক্ষার্থীরা মঞ্চে প্রদর্শন করেন দোতারার সমবেত বৃন্দবাদন। এরপরে প্রথমে অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রথমদিনের মনসামঙ্গল বিষহরী পালার দ্বিতীয়ভাগ ‘জীয়নপর্ব’ অর্থাৎ লখীন্দরের জীবন ফিরে পাওয়ার গল্প পরিবেশন করে নবজাগরণ নাট্য সংস্থা। এরপর বাউলসংগীত পরিবেশন করেন বীরভূমের জয়দেবের বিশিষ্ট শিল্পী লক্ষণদাস বাউল এবং বাঁকুড়ার ধনঞ্জয় ধীবর। এরপর ঝাপান গান অর্থাৎ সাপধরার গান পরিবেশন করেন বীরভূমের বিশিষ্ট লোকশিল্পী সৃষ্টিধর বাদ্যকর এবং নারায়নবাদ্যকর ও সম্প্রদায়। ঝাপান গানে কণ্ঠ শিল্পীর হাতে থাকে ‘িবষম ঢাক’, যা এই গানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে অবশ্য কোন অভিনয় নেই কেবলমাত্র গানের মাধ্যমেই ঘটনা বর্ণিত হয়। সাথে থাকে ঢোল আর কাঁসি। অনেক সময় প্রতীক হিসেবে থাকে ‘মনসা কাঁটা গাছ’। এরপর গম্ভীরা পালা পরিবেশন করে স্থানীয় কুতুবপুর গম্ভীরার দল। গম্ভীরা মালদহের লোকসংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব ধারা। গমীরা কথার অর্থ শিব। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সমগ্র মালদহ জুড়ে গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে এই শিব স্থাপন করা হয়। যেখানে একে স্থাপন করা হয় তাকে গমীরার স্থান বলে। এই দিন থেকে এক বছরের জন্য গম্ভীরা পালা অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সূচনা পর্বে অর্থাৎ শিব (গমীরা) প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে দুদিন ধরে (ঢাক ও কাঁসি বাজিয়ে) মুখোশ নৃত্য হয়। প্রথম দিন (৩০ চৈত্র) ছোট তামাশা এবং পরের দিন (৩১ চৈত্র) বড় তামাশা হয়। এক সময় মাটির মুখোশ প্রচলন ছিল। এখন মুখোশের প্রচলনটাই নেই, মুখোশ নির্মাণে ও নৃত্য পরিবেশনে মালদহের দুজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিরা হলেন প্রয়াত রামপণ্ডিত এবং প্রয়াত বিশ্বনাথ পণ্ডিত। এখানে পণ্ডিত অর্থে মৃৎশিল্পী বর্তমানে এই প্রথা হারিয়ে যেতে বসেছে। গম্ভীরা এসেছে এই গমীরা থেকেই। এর প্রধান চরিত্র শিব, থাকে জনপ্রতিনিধির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয় এবং তার কাছে সম্বৎসরের সুবিচারের আশায় অভাব অভিযোগ পেশ করা হয়, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে। গম্ভীরার উৎপত্তি অবিভক্ত বঙ্গের নবাবগঞ্জে। তবে সেখানে এখন শিবের পরিবর্তে নানা ও নাতি— এই দুই চরিত্রের সৃষ্টি করা হয়েছে, এখানেও রূপসজ্জার মধ্য দিয়ে চরিত্র নির্মাণ ও অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনী বর্ণনা করা হয়। গম্ভীরা গান একেবারেই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত হয়। প্রায়শই এর বিষয় এবং বক্তব্যের প্রেক্ষাপট হয় রাজনৈতিক। সমাজের প্রান্তিক মানুষের সামাজিক অবস্থান ও অভাব অভিযোগ দূর্দশার কাহিনীর বর্ণনা থাকে গম্ভীরা পালায়। গম্ভীরার চারটি পর্যায়— বন্দনা, চারইয়ারি, ডুয়েট ও রিপোর্ট।
উত্তরবঙ্গের বিয়ের মত নানা শুভ অনুষ্ঠানে গম্ভীরা ও মনসা গানের দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কখন একমাস বা পনেরো দিন বা সাতদিন, কখনও বা এক দুদিন ধরে এই পালাগান বলে। বিবাহ অনুষ্ঠানে মনসার গানই অধিক প্রাধান্য পায়। এখানে প্রদর্শিত সমস্ত পালাগানেই এটা লক্ষণীয় যে যেসকল লোক শিল্পী এই পালাগানে অংশগ্রহণ করেন তারা সকলেই সমাজের প্রান্তিক অংশের কৃষির কাজে নিযুক্ত শ্রমজীবি মানুষ। এদের প্রায় সকলেই ভূমিহীন কৃষক। এরাই এই সর পালাগানের ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। এরা আবার একই সাথে একাধিক পালায় অংশগ্রহণ করেন। যেমন একজন বিষহরীদলের সদস্য গম্ভীরা দলেরও শিল্পী। বিয়ের অনুষ্ঠানে মনসা গানের আমন্ত্রণ অধিক থাকায় অন্যান্য পালা বিশেষ করে গম্ভীরার প্রদর্শন অনেক কমে এসেছে। বস্তুত গম্ভীরাপালা এখন কিছুটা অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। উত্তরবঙ্গে ব্রতগানের যথেষ্ট প্রচলন ছিল যা এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। এই পর্যায়ে ব্রতগানের অনুষ্ঠান রাখা সম্ভবপর হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ের অনুষ্ঠানে একে রাখা হবে।
ঐ দিন সবশেষে সমবেতভাবে লোক সংগীত পরিবেশন করে ভ্রমরা, এভাবেই ২৭শে মার্চ রাত ১২টায় ৬০ বছর উদযাপনের প্রথম পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। সামনে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার নিয়ে, নতুন যাত্রাপথের অনুসন্ধানের লক্ষ্য নিয়ে এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে।