সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দুই ভাই। বয়সের ফারাক প্রায় পনেরো বছরের। বাবা মাষ্টারমশাই, সেই সূত্রে বাড়িতে প্রচুর বই। বড় ভাই পড়ে আর ভাবে। সে পড়ে নানা গল্প, আর ভাবে কোনোদিন সেও তেমন গল্প লিখবে। চেষ্টা করে, কিন্তু হয় না। মন মতো হয় না। ভাই তার বড়ো আদরের। বই পড়ায় মন নেই তার, সারাদিন খাতায় হিজিবিজি দাগ কাটে। বড়ো হয়ে কী হবে জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দেয়, পৃথিবীর একজন সেরা কার্টুনিষ্ট হবে।
কার্টুন? এই এঁদো জায়গায়? এই দেশে? ক’জন জানে কার্টুন?
জানাবো। আমিই জানাবো তাঁদের। বেশ প্রত্যয়ী উত্তর দেয় ভাই।
তবুও তো ভাইয়ের এক পথ আছে। কত কম বয়েস, সে এখনই ঠিক ক’রে নিয়েছে সে কী করবে। আর, অনেকটা বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে পথ পাচ্ছে না। যা লেখে মনমতো হয় না। যাও বা মনমতো হয়, ভাই নাকচ ক’রে দেয়। ভাইয়ের কথার দাম তার কাছে অনেক। এই ‘ডুডু’ বই না পড়লে কী হবে, দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই অনেকটা আলাদা, অনেকটা পরিণত। লেখাগুলো নিয়ে ভাইয়ের কাছে যায় আর ভাই মাথা নেড়ে ব’লে, হচ্ছে না।
—কী করলে হবে?
—আরও দেখতে হবে। আরও ‘অবসার্ভ’ করতে হবে তোমায়। ভাই জানায়।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে সে চলে আসে তাঁদের গাঁয়ের পুরোনো গীর্জার মাথায়। এ জায়গা তাঁর বড়ো প্রিয়। অনেকটা নিরিবিলি আর নিজের সাথে অনেকটা সময় কাটানো যায় এখানে এসে। এখানে এসে মাঝে মাঝেই সে বসে থাকে। হঠাৎ বাইরের দিকে চলে যায় তাঁর চোখ। তাঁদের গ্রাম প্রায় পুরোটাই দেখা যায় এখান থেকে। ওই তো দূরে নদী, এপাশে রেললাইন, ওদিকে জঙ্গল, ওদিকে বাড়িঘর। কত কতবার দেখেছে। কিন্তু আজ যেন শুধু গ্রাম নয়, তাঁর কাছে ধরা দিল গল্পের ‘প্লট’ হিসেবে। এই গ্রামকে নিয়েই সে লিখবে। এখনই ডুডু’কে কিছু বলবে না সে, আগে লিখুক কিছু। গীর্জার সেই ছাদের চুড়োয়, এক দেওয়ালে ইঁটরঙে লিখে দিল সে,
‘Past is gone, Present is fleeting, future is vague.’ নীচে লিখে দিল নিজের নাম। আর পেয়ে গেল, নিজের গল্পের চরিত্রের নাম। স্বামী।
অনেকটা লেখার পর একদিন ভয়ে ভয়ে দেখালো ভাইকে। বেশ মন দিয়ে পড়ে হাল্কা হেসে ভাই জানালো, হচ্ছে। কিন্তু এর সাথে কিছু ছবি দিতে হবে – তাহলে ব্যাপারটা জমবে আরও।
—কে এঁকে দেবে আমার লেখার জন্য?
—কেন? পৃথিবীর সেরা কার্টুনিষ্ট। মুচকি হেসে জানান দিল ভাই।
জন্ম নিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক গল্প – মালগুড়ি ডে’জ (Malgudi Days).
আলাদা করে আর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। পড়তে পড়তে অনেকটা আন্দাজ ক’রে নেওয়া যায় এই দুই ভাইদের। দাদা হলেন ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা লেখক আর.কে.নারায়ন‘স্বামী’ আর ভাই হলেন অন্যতম সেরা কার্টুনিষ্ট আর.কে.লক্ষ্মণ ।
আর. কে. লক্ষ্মণের পুরো নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ তাঁর জন্ম। তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনে, সেই সময়ের মাইসোরে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন রাশভারী; কাছের এক স্কুলের হেডমাষ্টার মশাই। ছয় ভাই আর দুই বোনের মধ্যে লক্ষ্মণ ছিলেন সবচেয়ে ছোটো।
বাবার সূত্রে বাড়িতে বইয়ের আনাগোনা লেগেই ছিল। দাদা নারায়ণ স্বামীকে যেমন টানত সেই বইয়ের গল্প, লক্ষ্মণকে প্রথম থেকেই টানত বইয়ের ইলাস্ট্রেশন। বাড়িতে আনাগোনা ছিল The Strand, Punch, Wide world –এর মতো পৃথিবীবিখ্যাত ম্যাগাজিনের। অনেক পরে তাঁর (প্রায়) আত্মজীবনী TheTunnel Of Time – এ লক্ষ্মণ বলছেন, বাবা ছিলেন এক আশ্চর্য জগতের মানুষ। আপাত রাশভারী এই মানুষটিকে কাজের জায়গায় সবাই সমীহ করেই, বলা ভালো এড়িয়েই চলত। অথচ এই মানুষটিই বাড়ি এসে ডুব দিতেন অগাধ বইয়ের জগতে। প্রবল নেশা ছিল কর্ণাটকী সঙ্গীতে। শিশুর মতো আনন্দ পেতেন। লক্ষ্মণ লিখছেন, অবাক হতাম এই ভেবে, একই বাড়িতে তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ পড়াশোনায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করছে আর কেউ ডাহা ‘ফেল’ করছে, এই অসম্ভব ‘হারমোনি’ তিনি সহজেই মেনে নিতেন।
দাদাদের মতো পড়াশোনায় অতটা ‘আগ্রহ’ না থাকলেও আগ্রহ ছিল নানারকম জিনিস সংগ্রহ করার। সে হয়তো গাছের পাতা, ফেলে দেওয়া বোতল বা ভাঙাচোরা সাইকেলের চেন। ছোটোবেলায় সেগুলোই ছিল তাঁর যক্ষের ধন। লাল-নীল-সবুজ এই রঙের জিনিসে আগ্রহ ছিল তাঁর প্রবল। রঙিন কাঁচ নিয়ে খেলতে খেলতে একদিন শুনে ফেলেছিলেন জানলার পাশ দিয়ে যাওয়া এক বুড়ো আধপাগল মানুষের কণ্ঠস্বর। যে বিড়বিড় ক’রে বলছিল, ‘To be young is very heaven, my boy, very heaven…’ . লক্ষ্মণ লিখছেন এই কথাগুলো তাঁকে চালিত করেছে বহু বছর। এক অসম্ভব পরিতৃপ্তি, শুদ্ধতা দিত। যদিও পরে জানতে পেরেছিলেন এই লাইনগুলো এক বিখ্যাত ইংরাজি কবিতার, তবু এই কথাগুলো মনে পড়লেই সেই আধখ্যাপা বুড়োর মুখ মনে পড়ত। মনের মধ্যে এই শৈশবকে আজীবন বহন করেছেন লক্ষ্মণ, আমরা তাঁর কাজের মধ্যে দেখতে পাই এই সারল্যকে।
সেই সারল্য কিন্তু নমনীয়তা নয়। পবিত্র রাগ আর প্রবল রসবোধ ছিল লক্ষ্মণের। তাঁর কাজ শুরুর দিকের সময়েও এই রসবোধ দেখতে পাই আমরা। সেসব অনেক পরের কথা অবশ্য। আপাত শান্ত, মিতভাষী, মুখে পাইপ ঝোলানো লক্ষ্মণকে দেখলে আন্দাজ করা শক্ত, এই মানুষটিই ছোটোবেলায় তাঁর পাড়া ক্রিকেট টীমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। স্বপ্নের মতো সুন্দর কেটে যাওয়া টাল খেতে পারত যখন তাঁর অল্প বয়েসেই বাবা চ’লে যান; স্ট্রোকে। কিন্তু দাদাসহ বাড়ির বড়রা আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। হাইস্কুলের পড়া শেষ করে যখন সুযোগ এলো, লক্ষ্মণ বেছে নিলেন তাঁর ছোটোবেলার স্বপ্নকে। ভর্তি হতে চাইলেন J. J. Institute of Applied Arts-এ। কিন্তু সেখানকার প্রধান জানালেন, সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম ‘talent’ দরকার, তা এই শিক্ষার্থীর নেই; ফলে বাতিল হ’লেন লক্ষ্মণ। পরে লক্ষ্মণ লিখছেন, এটা আশ্চর্যের কিছু নয়; কারণ যে ধরণের ভাবনা নিয়ে আমি এগোচ্ছিলাম তা ভারতবর্ষের মাটিতে নতুন ছিল। এবং স্বাভাবিকভাবেই এখানকার ‘talent’-এর নিক্তিতে তা ‘শূন্য’ ছিল।
লক্ষ্মণ এরপর ভর্তি হন মাইসোরের মহারাজা কলেজে। এর মধ্যে তিনি ‘স্বরাজ্য’ বা Blitz-এর মতো ম্যাগাজিনে ইলাস্ট্রেট করা শুরু করেছেন। কলেজে পড়তে পড়তে তাঁর দাদার (R. K. Narayan) লেখা গল্পের ইলাস্ট্রেট করা শুরু করলেন The Hindu তে। একই সঙ্গে চলছে ‘স্বতন্ত্র’তে তাঁর আঁকা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা। তখনও তেমনভাবে হাত পাকাননি লক্ষ্মণ, সবে দু-তিন বছর হ’ল বিভিন্ন ম্যাগাজিনে আঁকছেন। এই সময়েই তিনি এঁকে ফেললেন ‘হিন্দু কোড বিল’-এর সমর্থনে এক কার্টুন, যাতাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। হিন্দু কোড বিলের প্রস্তাব ছিল, ছেলেমেয়েদের বিয়ের বয়েস যথাক্রমে ন্যূনতম ১৮ এবং ১৫ বছর ; বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ; অসবর্ণ সিদ্ধ ; পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলে এবং মেয়ের সমানাধিকার এবং আরও অনেক কিছু। পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে-র প্রবন্ধ ‘সাত দশক’ থেকে আমরা জানতে পারি, এই বিরোধিতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু মহাসভা এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রবর্তিত জনসংঘ এবং আরও কিছু দল। লক্ষ্মণ তাঁর বাইশ বছর বয়েসে এই বিলের প্রস্তাবের সমর্থনে আঁকলেন এই ব্যঙ্গচিত্রটি। যেখানে নেহেরু গদি-আঁটা তোশক (হিন্দু কোড বিল) ‘অফার’ করছেন এক সাধুবাবাকে। এবং সাধুবাবা তা অস্বীকার করছেন, বলছেন, হাল ফ্যাশানের এই সব কিছুর বদলে তাঁর পুরোনো কণ্টকশয্যাই বেশ ভালো। পাশের বাচ্চা অবশ্য চেঁচাচ্ছে, বলাই বাহুল্য।
এখান থেকেই লক্ষ্মণের যাত্রাপথের এক মোটামুটি রেখরূপ আমরা পেয়ে যাই। সারাজীবনে লক্ষ্মণ বারবার ‘প্রতিবাদ’ করেছেন অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধান্দাবাজ নেতা-নেত্রীদের চালাকিকে। এক সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে বারবার দেখেছেন তাঁর ভারতবর্ষকে। যে সাধারণ মানুষের কোনো ধর্ম নেই, প্রবল পড়াশোনা নেই, পাণ্ডিত্য নেই, আছে শুধু সাদা চোখে সময়কে দেখার ক্ষমতা। একজন খুব সাধারণ মানুষের মতোই বোকা না হ’তে চাওয়ার মন। আর আছে প্রবল সাহস। আর এভাবেইজন্ম নিয়েছে ‘The common Man’।
এই কমনম্যানের শুরু থেকেই খড়্গহস্ত হয়েছেন লক্ষ্মণ। ১৯৫১ তে The Hindu তে তাঁর যোগদান এবং সেই সময় থেকেই তাঁর ভবিষ্যতের দীর্ঘ পথ চলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৫১ তে You said It-এর মধ্যে দিয়ে তাঁর কমন ম্যান বড়ো বড়ো পালের গোদাদের শায়েস্তা করেছেন – জবাই করেছেন। কখনও তা হয়ে উঠেছে ভারত পাকিস্তান অভিসন্ধিচুক্তি আবার কখনও বা ধর্মীয় মেরুকরণের রাষ্ট্রীয় চেষ্টার দালালদের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ উঠে আসছে নেতা-মন্ত্রীদের স্বাভাবিক ‘ঘুষ’ খাওয়ার প্রবৃত্তি নিয়ে; সরকারী কর্মচারীদের কাজ করার ‘কৌশল’ নিয়ে, বিভিন্ন পেশার (ডাক্তার,পুলিশ) ওপর উঠে আসা কালো দাগ নিয়ে। এবং এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নয়। রীতিমতো ধারাবাহিকভাবে, ‘সিরিজ’ হিসেবে উঠে আসছে। Common Man-এর এই দীর্ঘপথ যাত্রায় যা পরবর্তীকালে series হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে। কখনও Bye-Lateral Relations, Democracy on Death Row, Kucch Kucch Lo chahai, Netas in the Net, Sarkari Tarkari নামে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রে, বিভিন্ন সময়ে দেশের অধিকাংশ নেতা মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষের কাছে নিতান্ত উপহাসের পাত্র-পাত্রী। এর বেশী কিছু নয়। সাধারণ মানুষের মনের গভীরে এই অশিক্ষিত, চোর, ধান্দাবাজ নেতা মন্ত্রীদের জন্য কোনো সময়েই বিন্দুমাত্র সহানুভূতি সম্মান ছিল না,এখনও নেই। তাহলে যেটুকু রয়ে যায় তা কি ভয়? কিছুটা তাই। এবং এই ভয় নেতাদের গুণ্ডাগিরির ভয়, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অসহনীয় করে তোলার ভয়। একজন সাধারণ মানুষ জানেন, সত্যি কথা বলার জন্য– একজন ঘুষখোর নেতাকে চোর বলার জন্য তাঁর বাড়িতে বোম পড়বে। আমাদের মনে পড়ে ব্রেখটের গ্যালিলেওর কথা।
Unhappy is the land that breeds no hero!
No Andrea, Unhappy is the land that needs a hero.
আমাদের এই জীবনে, অসৎ মানুষদের নিয়ে ঘিরে থাকা জীবনে লক্ষ্মণ এসেছিলেন তাঁর ক্ষুরধার হিউমার নিয়ে। যে হিউমার দিয়ে তিনি পুষ্ট করেছিলেন আমাদের ভাবনাকে, সাহস জুগিয়েছিলেন। আবার অশিক্ষিত নেতা-মন্ত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই এই বুদ্ধিদীপ্ত হিউমারের অপমান বোঝার মতো শিক্ষিত নয়, অথবা বুঝতে পারলেও বারবার সেই হিউমারের কাছে পরাজিত হয়েছে।
The Tunnel of Time লক্ষ্মণের আত্মজীবনী। কার্টুনের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন The Hotel Riviera (1988) এবং The Messenger (1993)-এর মতো উপন্যাস। লিখেছেন নানা ছোটো গল্প আর ভ্রমণকাহিনী, যা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে The Distorted Mirror শিরোনামে। তাঁর সামগ্রিক জীবনের দিকে লক্ষ রাখলে আমরা দেখতে পাই, লক্ষ্মণ সারাজীবন ধরে যে ভাবনার চর্চা করেছেন তা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর চর্চাকে, চেতনাকে। সুখের কথা, আমাদের এই হারিয়ে ফেলার দেশে,তাঁর অসংখ্য কাজ – কার্টুন সংরক্ষিত হয়েছে দু’মলাটে। A vote for laughter, A Dose of Laughter, Laugh with Laxman বা Common man-এর সাথে তাঁর বিখ্যাত কাজ An Uncommon Man নামে সংকলিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে লক্ষ্মণই একমাত্র কার্টুনিস্ট যার তৈরি Common Man এর ৮.২ ফুটের ব্রোঞ্জের মূর্তি বসেছে পুনেতে। Times of India-র ১৫০ বছর পূর্তিতে ১৯৮৮ সালে, Common Man-এর পোস্টাল স্ট্যাম্প বের করা হয় Indian Postal Department-এর তরফে। ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করা হয় আর.কে.লক্ষ্মণকে।
২০১৫ সালে, প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৩ বছর বয়সে লক্ষ্মণ চলে যান।
২০২১ সাল আর. কে. লক্ষ্মণের জন্মশতবর্ষ গেল। অনেকটাই নিস্প্রভ। অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাসে যার অবদান প্রবলভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের রাজনীতিকে এবং সমাজকে যিনি বারবার ‘আঘাত’ করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে। এক উন্নত ঋজু মানুষ, যিনি কখনও আপোষ করেননি, অথচ আপোষ করলে যে মানুষটা সব কিছু পেত, আমাদের এই হতদরিদ্র সময়ে আমরা একজন লক্ষ্মণকে পেয়েছিলাম অথচ তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। আমাদের এই সময়ে বড্ড প্রয়োজন লক্ষ্মণকে। প্রয়োজন লক্ষ্মণের প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের সময়ের এক অন্যতম কার্টুনিস্ট শুধু নন, এক অসাধারণ চিন্তাবিদের নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ।
শুধু নেতা মন্ত্রীরা নয়, লক্ষ্মণের কলমে উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের দ্বিচারিতার কথা; না-পাল্টানো অসহায় অভ্যাসের কথা। নোংরা হাসপাতাল করিডোরে দাঁড়িয়ে দু’জন সাধারণ মানুষ এই নোংরা অবস্থার জন্য দোষারোপ করছে আর তাঁর পরপরই পানের পিক ফেলছে সেই করিডোরে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের নামে যে ভণ্ডামি এবং শ্রেণিবিভাজন, একেও তাঁর হিউমারে তুলে আনছেন। ব্যক্তিগত মতে এর পিছনে The Hindu-র দায় অনেকখানি। প্রায় প্রতিদিন লক্ষ্মণকে তুলে আনতে হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। ফলে নিজের ক্ষেত্রের মধ্যে থেকেই সমাজের খুঁটিনাটি ঘটনাকেও বিষয় করে তুলছেন লক্ষ্মণ। আবার কখনও নির্মল হাস্যরস, আনন্দ হয়ে উঠছে তাঁর আঁকার বিষয়।
সঙ্গীত যেমন এক non-verbal medium, ঠিক তেমনই কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র। সেই কার্টুনের মধ্যে যেমন প্রচ্ছন্ন মজা আছে, কখনও আছে এতো তীব্র আঘাত, সেই আঘাতে নিজেরাই অসহায় হয়ে পড়েছি। সেই ছবির অভিঘাত লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তার জন্য আমাদের ফিরে ফিরে যেতে হবে লক্ষ্মণের কাছে, লক্ষ্মণের কাজের কাছে। লক্ষ্মণ তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ঘরানা তৈরি করেছিলেন। করেছিলেন দেখার এবং দেখানোর এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গী। তার প্রখরতা কেমন তা আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি একটা ঘটনায়। ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কার্টুনিস্ট স্যার ডেভিড লো সস্ত্রীক যাচ্ছিলেন হংকং-এ। প্লেনের ম্যাগাজিনে এক কার্টুন দেখে, তিনি নেমে পড়েন মুম্বাইয়ে; ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে আসেন সেই ম্যাগাজিনের দপ্তরে, কার্টুনিস্টের সাথে দেখা করার জন্য। লক্ষ্মণের বয়েস তখন ৩১। পৃথিবী বিখ্যাত এক কার্টুনিস্ট কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই একটা মাত্র কার্টুন দেখে চলে আসেন ভারতের মতো হতদরিদ্র দেশের এক অখ্যাত কার্টুনিস্টের সাথে দেখা করার জন্য !
The Tunnel of Time লক্ষ্মণের আত্মজীবনী। কার্টুনের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন The Hotel Riviera (1988) এবং The Messenger (1993)-এর মতো উপন্যাস। লিখেছেন নানা ছোটো গল্প আর ভ্রমণকাহিনী, যা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে The Distorted Mirror শিরোনামে। তাঁর সামগ্রিক জীবনের দিকে লক্ষ রাখলে আমরা দেখতে পাই, লক্ষ্মণ সারাজীবন ধরে যে ভাবনার চর্চা করেছেন তা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর চর্চাকে, চেতনাকে। সুখের কথা, আমাদের এই হারিয়ে ফেলার দেশে, তাঁর অসংখ্য কাজ – কার্টুন সংরক্ষিত হয়েছে দু’মলাটে। A vote for laughter, A Dose of Laughter, Laugh with Laxman বা Common man-এর সাথে তাঁর বিখ্যাত কাজ An Uncommon Man নামে সংকলিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে লক্ষ্মণই একমাত্র কার্টুনিস্ট যার তৈরি Common Man এর ৮.২ ফুটের ব্রোঞ্জের মূর্তি বসেছে পুনেতে। Times of India-র ১৫০ বছর পূর্তিতে ১৯৮৮ সালে, Common Man-এর পোস্টাল স্ট্যাম্প বের করা হয় Indian Postal Department-এর তরফে। ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করা হয় আর.কে.লক্ষ্মণকে।
২০১৫ সালে, প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৩ বছর বয়সে লক্ষ্মণ চলে যান।
২০২১ সাল আর. কে. লক্ষ্মণের জন্মশতবর্ষ গেল। অনেকটাই নিস্প্রভ। অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাসে যার অবদান প্রবলভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের রাজনীতিকে এবং সমাজকে যিনি বারবার ‘আঘাত’ করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে। এক উন্নত ঋজু মানুষ, যিনি কখনও আপোষ করেননি, অথচ আপোষ করলে যে মানুষটা সব কিছু পেত, আমাদের এই হতদরিদ্র সময়ে আমরা একজন লক্ষ্মণকে পেয়েছিলাম অথচ তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। আমাদের এই সময়ে বড্ড প্রয়োজন লক্ষ্মণকে। প্রয়োজন লক্ষ্মণের প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের সময়ের এক অন্যতম কার্টুনিস্ট শুধু নন, এক অসাধারণ চিন্তাবিদের নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ।