সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৪
স্বাদেশিকতা পর্ব (শেষাংশ) ও বিদ্যাসাগর
স্বাদেশিকতা পর্ব (শেষাংশ; আরো কিছু কথা)
ইতিহাসকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখলে অনেক সময় এমন অনেক সত্য উদ্ঘাটিত হয়, যেগুলো হয়ত সাদা চোখে ধরা পড়ে না। যেমন ‘স্বাদেশিকতা’ শব্দটা। আমাদের দেশে শব্দটা আধুনিক, জন্ম ব্রিটিশ আমলে, মূলে ইংরেজি ‘patriotism’। ‘patriotism’ শব্দটার ঠিক বাংলা হয় না, স্বাদেশিকতা একটা কাজ চালানো গোছের শব্দ এবং গঠনও অনেক পরে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শব্দটার বাংলা হিসেবে ‘দেশহিতৈষণা’ শব্দটা চালু ছিল, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সেটাও সঠিক প্রতিশব্দ নয়। তিনি বলেছিলেন, “Patriot শব্দের যাঁহারা অনুবাদ করেন দেশহিতৈষী, তাঁহারা নিতান্তই দায়ে পড়িয়া তাহা করেন। Patriot শব্দের ঠিক্ প্রতিশব্দ আমাদের দেশীয় ভাষাতে নাই ও কস্মিনকালে ছিলও না। ... দেশের হিতসাধনকারী philanthropist স্বতন্ত্র আর কায়মনোবাক্যে দেশের স্বকীয় মাহাত্ম্যের সমর্থনকারী patriot স্বতন্ত্র। যিনি স্বদেশের স্বাধীনতা, গৌরব, তেজোবীর্য এবং মহত্ত্ব রক্ষা করিয়া মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করেন তিনিই patriot।”
এই অর্থে patriot শব্দটার প্রথম উল্লেখ পাই রামমোহন রায়ের বিভিন্ন লেখায়। যেমন, ১৮২৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জন ডিগবিকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, “The distinction of castes, introducing innumerable divisions and sub-divisions among them [Hindus] has entirely deprived them of patriotic feeling...” (অর্থাৎ, জাতব্যবস্থায় জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ স্বাদেশিকতার অনুভূতি থেকে হিন্দুদের বঞ্চিত করেছে...) কিংবা ১৮৩২ সালে ‘ইন্ডিয়া’র প্রাচীন ও আধুনিক সীমানা নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিদানের সময় এ দেশ ইংরেজের দখলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি লিখছেন, “The army they [the English] employed chiefly consisted of the natives of India, a country into which the notion of patriotism has never made its way.” (অর্থাৎ, ইংরেজরা যে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিল তা প্রধানত এ দেশের লোক নিয়ে গঠিত, স্বাদেশিকতার ধারণা যে দেশে প্রবেশ করেনি।)। মোদ্দা তিনি বলতে চান, স্বাদেশিকতার ধারণা এ দেশে ছিল না এবং না থাকার কারণ হচ্ছে হিন্দুদের মধ্যে জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ। রামমোহনের বেলায় স্বাদেশিকতার ক্ষেত্র ছিল ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট ‘ইন্ডিয়া’ নামক রাষ্ট্র। তাঁর স্বাদেশিক চেতনা হচ্ছে জাতি হিসেবে ভারতীয়ত্বের অনুভব। তাঁর বক্তব্যের সারার্থ হচ্ছে, আমরা যদি জাতপাতে এত বিভক্ত হয়ে না থাকতাম, তাহলে জাতি হিসেবে ভারতীয় হয়ে উঠতে পারতাম।
কিন্তু সেটা কি সম্ভব ছিল? এর উত্তর পেতে গেলে আরো একবার আমাদের রামমোহনেই ফিরে যেতে হবে। খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে দেশের লোকের স্বাদেশিকতার অভাব নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন, ভূগোল-ইতিহাস মিশিয়ে তাঁর সেই দেশের প্রাচীন রূপটি তাঁর কাছে কী ছিল। যে রচনা থেকে দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে, তারই শুরুতে তিনি লিখছেন, “India, anciently called the ‘Bharat Varsa’ after the name of a monarch called ‘Bharat’...’’। তার কিছু পরে লিখছেন, এই বিশাল সাম্রাজ্যের বিশাল বিশাল সব ভূখণ্ড আগে বিভিন্ন নরপতিরা আলাদা আলাদাভাবে শাসন করতেন, রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন কিন্তু পরস্পরের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন। তাঁরা সব একই ধর্মের অনুসরণ করতেন, সংস্কৃত শাস্ত্রের অনুমোদিত শুদ্ধ-বিশুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। ভূখণ্ডগুলি নদী, পাহাড় অথবা কৃত্রিম সীমারেখা দ্বারা একটা আর একটার থেকে আলাদা হত। ব্রাহ্মণদের পবিত্র গ্রন্থাদি অনুযায়ী দুটো বড় বড় ভাগে এই ভূখণ্ডগুলি বিভক্ত ছিল। একটি ভাগ – সভ্য ও পুণ্য ভূমি (মনু পুণ্য ভূমি বলতে বুঝিয়েছেন যেখানে দেবতারা প্রায়ই গমনাগমন করতেন সেই সরস্বতী ও দৃশ্যদ্বতী এই দুই পবিত্র নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে, মুনিঋষিদের ভাষায় ব্রহ্মবর্ত)। সিন্ধু নদের তীর থেকে হিমালয়ের পাদদেশ ধরে ধরে বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত, যার মধ্যে পড়ে রাজমহল, বিহার, বারাণসী, এলাহাবাদের প্রদেশগুলি এবং নর্মদার উত্তর ধরে ধরে প্রায় ভারতের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত মালব, ভূখন্ডগুলির এই অংশটিকে বলা হত সভ্য ও পুণ্য ভূমি। পাদটীকায় লিখেছেন, মনু এই অংশটিকেই ‘আর্যাবর্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভূখন্ডগুলির দ্বিতীয় অংশটিকেও বলা হত সভ্য ভূমি, কিন্তু পুণ্য নয়। পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মাঝামাঝি ছিল তার অবস্থান এবং একটা অংশ মিশে যেত গঙ্গার মোহনায়, আর একটা অংশ মিশে যেত সিন্ধু নদের মোহনায় যার মধ্যে পড়ত গুজরাটের একটা বড় অংশ। এই দুটো সভ্যদেশের সীমানার বাইরে যেসব পাহাড়-পর্বত উপত্যকা সমতলভূমি, যদিও তারা ভারতবর্ষেরই অংশ, তাদের বলা হত ম্লেচ্ছদেশ অর্থাৎ সেখানে অসভ্যরা থাকে।
কিন্তু সত্যিই কি ইন্ডিয়া আর রামমোহন কথিত ভারতবর্ষ সমার্থক ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের স্বাদেশিকতা থাকা না থাকার প্রশ্নটি। সম্প্রতি ঐতিহাসিক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য সংক্ষেপে পেশ করা যেতে পারে।
বেদ, পুরাণ এবং কাব্য -- ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠা এই তিনরকমের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সত্তা হিসেবে ভারতবর্ষের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একেবারে গোড়ায় ছিল মানুষজন বা গোষ্ঠী অর্থে জন এবং ছিল তাদের বাসভূমি অর্থে জনপদ। ভরতও ছিল এরকমই একটা জন এবং তাদের জনপদের নামটাই সম্ভবত বিবর্তিত হতে হতে একসময় ভারতবর্ষে পরিণত হয়। কিন্তু এই ভারতবর্ষ ছিল একটা অংশবিশেষ, সমগ্র নয়। এই জন্যে নয় যে এরকম জনপদ আরো ছিল, যেমন, কুরু, কোশল, মগধ, বাৎস্য ইত্যাদি। তারা যার যার নামেই অভিহিত হত, ভারতবর্ষ নামে অভিহিত হত না। একটি মধ্যবর্তী অঞ্চল নির্ণয় করে তারই চারিপাশে ঐ জনপদগুলির অবস্থানকে নির্দেশ করা হত। ‘দিশ’ শব্দটা দিয়ে সেগুলির দিককে বোঝানো হত, এই ‘দিশ’ থেকে পরে ‘দেশ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। এই ‘দিশ’ শব্দটা দিয়ে ভারতবর্ষ কোন্দিকে সেটা বোঝানো হত। উপমহাদেশটার কোনো নিশ্চিত সীমানা ছিল না, কোনো ভৌগোলিক বন্ধনে আবদ্ধ নয়। পুরাণগুলি যতই আসমুদ্রহিমাচল বলে ভৌগোলিক সীমানা তৈরির চেষ্টা করুক না কেন, জনপদগুলি এবং জাতিগোষ্ঠীগুলি সেই ভৌগোলিক বন্ধনে কখনো বাঁধা পড়ে নি। রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য় আছে পৃথুদকের (আধুনিক হরিয়ানা) প্রান্ত থেকে শুরু উত্তরাপথের বাসিন্দারা হল শক, কেকয়, বন্যুজ, ভোক্কণ, হুন, কম্বোজ, লিম্পক, টঙ্গন, তুরুস্ক, তুশার ইত্যাদি জনেরা, যা দিশের দিক থেকে দেখলে ভৌগোলিক নয়। একইভাবে রাজশেখর ও অন্যান্য বহু সূত্রে শ্রীলংকাকে দেখানো হয়েছে দক্ষিণাপথের অংশ হিসেবে। পুরাণে বিশ্বলোকের বিবরণ দিয়ে ভারতবর্ষকে তার একটা অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাতে আছে বিশ্বলোকের সৃষ্টিবৃত্তান্ত এবং তারই একটা অংশ হিসেবে বর্ণিত আসমুদ্রহিমাচলের নিরিখে ভরত ছাড়াও অন্যান্য অনেক রাজবংশের বংশ ও তাঁদের রাজ্যের বিস্তৃতি তালিকা। কাব্যেও পুরাণের অনুরণন পাওয়া যায়। যেমন কালিদাসের ‘রঘুবংশ’। কিন্তু কালিদাসের রঘুবংশে রঘুর যে দিগ্বিজয় তার ভূগোল-ইতিহাস আবার অন্যরকম। ওদিকে মহাদেশের একটা অংশ বোঝানো হয় যে ‘বর্ষ’ শব্দটি দিয়ে, তার নিরিখে যদি ভারতবর্ষকে ধরা যায়, তাহলে সেখানে আছে জম্বুদ্বীপ, যে জম্বুদ্বীপ কর্মের আদর্শ দ্বারা চালিত হয়। অর্থাৎ শুধু ভূগোল নয়, বিবেচ্য বিষয় ছিল রাজবংশের ইতিহাস ও আদর্শও। এই জম্বুদ্বীপই হল সেই জায়গা যেখানকার বাসিন্দারা চতুর্বর্ণে বিভক্ত। এখানেও দিশের ব্যাপারটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সেই মধ্যাঞ্চল, যা ‘মধ্যদেশ’ বা ‘আর্যাবর্ত’ নামে খ্যাত। এই আর্যাবর্তই মডেল হিসেবে কাজ করত। এখানেই ছিল চতুর্বর্ণের এবং চতুরাশ্রমের অস্তিত্ব (মূলে শিষ্ট ব্যবহার)। কোনো জনপদ আর্যাবর্তের থেকে কতটা কাছে কিংবা কতটা দূরে তা নির্ণীত হত এই মডেলকে কতটা সেগুলি মেনে চলে তাই দিয়ে। এই হিসেবেই মনু আর্যাবর্তের বাইরের দেশগুলোকে ম্লেচ্ছদেশ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং তার চারিদিকের (দিক বিস্তৃত হতে হতে সাত বা নয়ও হতে পারত) জনপদগুলির বাসিন্দারা নিজেদের তাদের জনপদের পরিচয়েই চিহ্নিত করত, ভারতবর্ষের পরিচয়ে নয়। ফলে ভারতবর্ষের নিরিখে ‘স্বদেশ’ বা ‘স্বদেশী’ শব্দটা তাদের অজ্ঞাত ছিল, এবং বিপরীতভাবে যতই কেননা হানা ও বহিঃশক্তির আক্রমণে ভারতীয় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক, ‘বিদেশ’ বা ‘বিদেশী’ শব্দটাও তাদের অজ্ঞাত ছিল। এদিক থেকে তাদের মধ্যে কোনো ‘আমি’ ও ‘অন্য’ বিভাজন ছিল না। বিভাজন যেটা ছিল, সেটা ছিল বর্ণের ভিত্তিতে।
এই যে ভারতবর্ষ যার কোনো নিশ্চিত সীমা ছিল না এবং যা ছিল মূলত এমন এক ধারণা যার মধ্যে ঠাঁই হতে পারত বিচিত্র সামাজিক বৈশিষ্ট্য সহ বহু স্থানের, উপনিবেশিক পর্বে এসে তার নির্দিষ্ট সীমানা সৃষ্টি করে তাকে মানচিত্রের মধ্যে আবদ্ধ করে সুদৃঢ় প্রশাসন দিয়ে বেঁধে রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা হল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে রামমোহন যে ভারতবর্ষকে ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমার্থক করে দিয়েছিলেন, সেরকম কোনো ভারতবর্ষ অতীতে ছিল না। জনপদগুলোকে বাদ দিয়ে কোনো ভারতবর্ষ ছিল না, কিন্তু ঐসব জনপদের বাসিন্দাদের এক জাতি হিসেবে ভারতীয়ত্বের অনুভবও সম্ভব ছিল না। তাহলে রামমোহনের মধ্যে ইন্ডিয়ার সমার্থক এই ভারতবর্ষের ধারণা শেকড় গাড়ল কি করে? তিনি তো সংস্কৃতে এতটাই সুপণ্ডিত ছিলেন যে একটি লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উইলিয়ম জোন্সেরও ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তো দেখেছিলেন যে বেদ পুরাণ কাব্য মিলিয়ে আমাদের সৃষ্টিসম্ভারের বিচিত্র ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়েছে। সেটা কখনো ভূগোল-ইতিহাসগত, কখনো কল্পনাগত এবং কখনো আদর্শগত এবং একটা আর একটার সঙ্গে মেলে না। অতএব স্বীকার করতেই হয় ভারতবর্ষের ইতিহাসপাঠের ক্ষেত্রে উইলিয়ম জোন্স, জেমস মিল, জন ব্রুস, অ্যাডাম এন্ডারসন, জন ম্যালকম, স্যার টমাস রো, রবার্ট ওরমে, জেমস রেনেল, আলেক্সান্ডার ডাউ ইত্যাদি উপনিবেশিক ঐতিহাসিক রচিত ইতিহাস দ্বারা তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, নেশন বা জাতির ধারণাতেও তিনি তাঁদের অনুবর্তিতা করেছেন।
আসা যেতে পারে জনপদের কথায়। অখণ্ড ভারতবর্ষ হিসেবে না হয় না-ই হল, কিন্তু ঐসব জনপদের বাসিন্দাদের যার যার জায়গার প্রতি টানেরও কি অভাব ছিল, যাকে বলতে পারি দেশপ্রেম? এই প্রথম আমরা অপেক্ষাকৃত একটা কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়াই। Patriotism-এর কাজচালানো গোছের অর্থ যেমন স্বাদেশিকতা, কিংবা দেশহিতৈষিতা, ভাবগত অর্থ তেমনি দেশপ্রেম। পশ্চিমী মতে Patriotism কথাটার শব্দগত আভিধানিক অর্থ হল নিজের জায়গার সঙ্গে জাতিগত দিক থেকে, ভাষাগত দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে একাত্মবোধ। ওদিকে আবার বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যা, বিনয়, দয়া দাক্ষিণ্য, মহত্ত্ব ও সদাশয়তা এসব গুণকেও patriot-এর গুণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আমেরিকাতে যেখানে patriot শব্দটার সবথেকে বেশি প্রতিপত্তি, সেখানে খাঁটি patriot হচ্ছেন তিনিই, যিনি রাষ্ট্রের অন্যায় দেখলে দেশকে বাঁচাতে তার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখেন। আরো একটা অর্থ আছে যেটা কোনো দেশের অভিধানেই পাওয়া যায় না। আমি যেখানে থাকি সেখানকার আলো, হাওয়া, জল, জঙ্গল, জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ সবের সঙ্গে আমার একাত্মবোধ, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, প্রেমের সম্পর্ক। পৃথিবীর সব দেশের সব জনপদের সম্পর্কে এই দেশপ্রেম সত্যি এবং স্বাভাবিক। তবে এই দেশপ্রেম বিশ্বচেতনার অংশ, এই দেশপ্রেমের মধ্যে আত্মপর বোধ নেই। এমনকি রামমোহনের যে স্বাদেশিকতা তাও প্রকৃতপক্ষে এই দেশপ্রেমই, যে জন্যে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্ক নিকট।
অতএব জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগের কারণে এ হেন দেশপ্রেমও ছিল না রামমোহনের এই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। এখানেও তিনি ইয়োরোপীয় ধ্যানধারণার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু রামমোহনের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুলও ছিল না। এটা ঠিকই, জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ককে নষ্ট করে দিয়ে দেশপ্রেমকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছিল। কেমনভাবে দিচ্ছিল সেটা দেখানোর আগে প্রাচীন ভারতের একটা মনোহর ছবি তুলে ধরি, কারণ সেটাও বাস্তব এবং তার খেই ধরেই আমাদের এগোতে হবে।
যে বেদ থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শুরু বলে আমরা মনে করি, সেই বেদের অজস্র সূক্ত আলো, হাওয়া, জল, জঙ্গল, জমির প্রতি অকৃত্রিম প্রেমের পরিচয়ে ভরপুর। শুধু প্রকৃতি নয়, নানান ভাষার নানান ধর্মের মানুষের কথাও সেখানে সহাবস্থানের সূত্রে দিব্যি ফুটে উঠেছে।
নানান ভাষা নানান ধরম মানুষ নানান-তর্
পিত্থিমি তো পালেন সবায় যার যেখানে ঘর।
(বেদের কবিতাঃ গৌরী ধর্মপাল)
ফুটে উঠেছে সভাসমিতির কথাও। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের ব্যাখ্যায়, এই সভাই পরবর্তী কালে সমাজে পরিণত হয়।
যত গ্রাম আছে যত অরণ্য
যত সভা আছে ভূমিতে
যত মানুষের মেলা ও সমিতি
তোর গুণ গাব সবেতে।
(বেদের কবিতাঃ গৌরী ধর্মপাল)
প্রাচীন ভারতের সভাসমিতি নিয়ে বিদ্যাভূষণ দুটো গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, বর্ণব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে এইসব সভাসমিতিগুলোই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করত, সমাজ পরিচালনা করত। বিদ্যাভূষণ একটা চমৎকার কথা লিখেছিলেন, “সভা ছিল সামাজিকভাবে মেলামেশার কেন্দ্র—আর সমিতি ছিল সমগ্র জনসাধারণের সঙ্ঘবদ্ধ বাণী।”
সমিতিতে রাজাকে উপস্থিত থাকতে হত। প্রয়োজন হলে সমিতি রাজা নির্বাচনও করে দিত। প্রয়োজন হলে এরা রাজাকে পদচ্যুত অব্দি করতে পারত। রাজকার্য পরিচালনার জন্যে অমাত্যসভা ছিল। এই অমাত্যদের পরামর্শ না নিয়ে কোনো কিছু করার অধিকার রাজার ছিল না। যদিও এই সভায় রাজা নেতৃত্ব করতেন, সভায় থাকত চারজন ব্রাহ্মণ, আটজন ক্ষত্রিয়, একুশজন বৈশ্য, তিনজন শূদ্র ও একজন সুত। এই সাঁইত্রিশ জনের মধ্যে আটজন আইনকানুন গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হত।
গ্রামে বা নগরে এক এক জাতির বাড়ি শ্রেণিবদ্ধ আকারে থাকত। পঙক্তিগুলিকে বলা হত ‘সমুদায়’। সমুদায়গুলো ছিল পাড়ার অনুরূপ। পাড়াগুলো ছিল যেন এক একটা পরিবারের মতন। পাড়ার লোকে সারাদিনের কাজের শেষে এক জায়গায় মিলিত হত। তাদের সামাজিক ও ব্যবসায়িক জীবন কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হত। আর সেই নিয়মগুলি সকলেই ধর্মজ্ঞানে মেনে চলত। পাড়ায় সকলে পরস্পর বিয়ে, পানভোজন প্রভৃতি বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামাজিক নিয়মকানুন সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলত। কারো অবস্থা খারাপ হলে সাহায্য পেত। পরস্পরের সাহায্য ও স্বার্থ রক্ষের জন্যে তারা ‘বার্তিক’ নিয়ম মেনে চলত। এসবের জন্যে সমিতি বসত। মন্দির, পুণ্যশালা, ধর্মশালা, হাসপাতাল ইত্যাদি পরিচালনের জন্যে সভাসমিতিতে রীতিমত বৈঠক চলত।
তখন গ্রাম ও নগরের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মের তফাৎ ছিল না। নগরগুলোও সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা স্বীকার করত। নগরগুলি কেন্দ্রস্বরূপ এবং সেই বৃত্তকে ঘিরে চারিপাশে সরলরেখায় গ্রামগুলির অবস্থান [এখানেও সেই একই নিয়মের অনুবর্তিতা, যে নিয়মে মধ্যাঞ্চল এবং তার চারিপাশের জনপদগুলিকে বোঝানো হত]। গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নগরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত এবং সে হিসেবে অন্যান্য গ্রামগুলির সঙ্গেও।
প্রাচীন ভারতে সবাইকে বিকেলের দিকে সভাসমিতিতে যেতে হত। সেখানে অনেক কাজের কথা হত। গোরু আর চাষের উন্নতি নিয়ে আলোচনা হত। মিউনিসিপ্যাল বোর্ড ও লোকাল বোর্ডের কাজও সভাসমিতি থেকে চলত। এখান থেকে সময়ে সময়ে বিচারালয়ের কাজও চলত। রাস্তাঘাট তৈরি, খানাডোবা যাতে অস্বাস্থ্যকর না হয়, জলনিকাশের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত এসবেরও ব্যবস্থা করা হত। আর একটা যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ব্যক্তিকে কখনো সমাজের ওপরে ঠাঁই দেওয়া হত না [অর্থাৎ আমাদের দেশে ‘ইন্ডিভিজুয়ালিজ্ম্’ ব্যাপারটা ছিল না। এটাও উপনিবেশিক শাসকদের অবদান]।
যদি বলি এই লেখাটা তখনকার যখন জাতীয়তাবাদ আমাদের এখানে শেকড় গেড়ে গেছে এবং দেশের ইতিহাসকে মহত্ত্বমণ্ডিত করে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে তাহলে হয়ত ভুল বলব না, আবার পুরোপুরি ঠিকও বলব না। বিদ্যাভূষণ অবশ্যই বানিয়ে বানিয়ে এই বর্ণনা করেন নি। এই ছবিটা সম্ভবত সেই সময়কার যখন বর্ণ ছিল কর্মভিত্তিক, অর্থাৎ পেশাগত ব্যাপার। আম্বেদকরের ইতিহাসপাঠ অনুযায়ী একেবারে গোড়ায় বর্ণের কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না এবং মর্যাদার বাইরে ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু শেষ মৌর্য সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) ক্ষমতায় বসার সময় থেকে মনুর (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) হাতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র জন্ম নেয়। এই বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে সাতটা পরিবর্তন পাকাপাকি আনতে পেরেছিল। আম্বেদকর মনুস্মৃতি থেকে একে একে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, ১. ব্রাহ্মণরা শাসন করার ও রাজহত্যা করার অধিকার প্রাপ্ত হয়; ২. ব্রাহ্মণরা একটি বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়; ৩. বর্ণকে তারা জাতে রূপান্তরিত করে; ৪. বিভিন্ন জাতের ভেতর সংঘর্ষের ও অসামাজিক অনুভবের বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়; ৫. শূদ্র এবং নারীদের অধোগামী করে; ৬. সমাজে নানারকম শ্রেণিভাগ করে অসাম্যের সূচনা করে; ও ৭. সামাজিক ব্যবস্থাকে আইনানুগ ও কঠোর করে তোলে যা আগে ছিল না।
ভারতীয় ইতিহাসের প্রায় শুরু থেকেই এই জাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে ছবি আমরা পাই সেই ছবিটাই আসল ভারতবর্ষের ছবি এবং সে ছবির মূলে শ্রেণি ও বর্গ নির্বিশেষে দেশপ্রেম। ব্রাহ্মণরা ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করতে করতে যে দেশপ্রেমকে নষ্ট করে দিচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে এবং মাঝেমধ্যে ছেদ সহ মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলন পর্যন্ত বয়ে এসেছিল। আম্বেদকর একটা খুব চিত্তাকর্ষক কথা বলেছেন, মুসলিম শাসকদের হাতে আসার আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের লড়াইয়ের ইতিহাস। এমনকি মুসলিম শাসকদের আমলেও যে ভক্তি আন্দোলনের বিকাশ আমরা দেখি, তার মধ্যেও প্রচ্ছন্নভাবে বৌদ্ধধর্মের ছায়া দুর্লক্ষ্য নয়। যদিও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বারেবারেই ভারী হয়ে বুকের ওপর চেপে বসেছে যার প্রমাণ পাই বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশের ইতিহাসে, যখন গোস্বামীরা নব্য-এলিট হয়ে দেখা দিল এবং নিম্নবর্গের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরকমই এক গোস্বামীর সঙ্গে রামমোহন বিচারে বসেছিলেন।
...
সে যা হোক, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রামমোহনের হাত ধরে বাংলায় ইন্ডিয়া বা ভারতবর্ষকেন্দ্রিক patriotism বা –স্বাদেশিকতার ধারণা প্রবেশ করল (আগেই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এ স্বাদেশিকতা দেশপ্রেমের থেকে ভাবগত দিক থেকে ভিন্ন)। সমসাময়িক রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু তাঁর গানে স্বাদেশিকতার আর এক রূপ ফুটিয়ে তুললেন যার প্রকাশক্ষেত্র প্রাদেশিক। একটা আর একটার অপর পিঠ। তিনি গাইলেন, “নানান্ দেশে নানান্ ভাষা / বিনে স্বদেশীয় ভাষে পুরে কি আশা।” (কামদ খাম্বাজ; তাল জলদ্ তেতালা)।
রামমোহনের স্বাদেশিকতা শুধু যে ইন্ডিয়াকেন্দ্রিক ছিল তাই নয়, ছিল প্রধানত বুদ্ধি, যুক্তি ও বিচারবোধকেন্দ্রিকও। রামমোহন ছিলেন কী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কী সামাজিক জীবনে প্রধানত বুদ্ধি, যুক্তি ও বিচারবোধের দ্বারা চালিত এক মস্ত মানুষ, একমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্র বাদে হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দেবার প্রবণতা তাঁর মধ্যে তেমন দেখা যায়নি। সে প্রবণতা ছিল ডিরোজিওর মধ্যে। বিদ্যাসাগর এলেন তাঁদের দুজনেরই উত্তরাধিকার নিয়ে। বুদ্ধি যুক্তি বিচারবোধ তাঁর মধ্যে কিছু কম ছিল না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। রামমোহনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি যে মেয়েদের জন্যে অবিরাম অশ্রুপাত নিয়ে এলেন, সে অশ্রুপাত ছিল ডিরোজিওর উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি যে প্রবল হৃদয়বত্তা নিয়ে এলেন তারই অংশ। এখানে অবশ্যই একটা কথা যোগ করা দরকার। প্রবল হৃদয়বত্তার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর ডিরোজিওর উত্তরাধিকারী হলেও বৃহত্তর অর্থে শৈশব থেকে তাঁর ভেতরে হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দেবার প্রবণতা গড়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা ভগবতী দেবী। সত্যি বলতে কি, বিদ্যাসাগর জীবনীর থেকে ভগবতী দেবীর জীবনী কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিদ্যাসাগর নিজেই একবার বলেছিলেন, মায়ের গুণের একশ শতাংশের এক ভাগও যদি আমি পেতাম তাহলে ধন্য হয়ে যেতাম।
বিদ্যাসাগরঃ কিছু এলোমেলো ভাবনা
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে যথার্থ patriot বলেছিলেন, তবে এজন্যে নয় যে বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর ছিলেন কিংবা তাঁর প্রবল হৃদয়বত্তা ছিল। তাঁর মতে এসব গুণ থাকলে একজনকে বড় জোর philanthropist বলা যায়। তাঁর যুক্তি ছিল অন্যরকম।
“আপনারা হয়ত মনে করিতেছেন যে, তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, দীন দুঃখীদিগের মা-বাপ ছিলেন, বিধবা রমণীদিগের সন্তাপানলে নয়নজল বর্ষণ করিতেন, সেই কারণে আমি তাঁহাকে patriot বলিতেছি। এরূপ অবিচার আপনারা আমার প্রতি করিবেন না। তিনি যদি একশত বিশ্ব-বিদ্যালয় স্থাপন করিতেন, শত সহস্র দরিদ্র লোককে Rothschilde করিয়া দিতেন, দশ কোটি বিধবার মৃত সাধব্য পুনর্জীবিত করিতেন, তাহা হইলে শুদ্ধ বলিতাম তিনি মস্ত একজন philanthropist। Patriot তাঁহাকে বলিতেছি আরেক কারণে। যখন তিনি Woodrow সাহেবের অধীনতা শৃঙ্খল ছিন্ন করিয়া নিঃসম্বল হস্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন পূর্বক লেখনী যন্ত্র দ্বারা জীবিকা সংস্থানের পথ কাটিতে আরম্ভ করিলেন, তখন বুঝিলাম যে হাঁ, ইনি patriot যেহেতু ইনি খাওয়া পরা অপেক্ষা স্বাধীনতাকে প্রিয় বলিয়া জানেন। যখন দেখিলাম যে, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সারাংশ সমস্তই ক্রোড় পাতিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, অথচ সে সভ্যতার কৃত্রিম কুহকাংশে পদাঘাত করিয়া স্বদেশীয় উচ্চ অঙ্গের সভ্যতা—বিদ্যা বিনয় দয়া দাক্ষিণ্য মহত্ত্ব এবং সদাশয়তা—সমস্তই আপনাতে মূর্তিমান করিয়াছেন, তখন বুঝিলাম যে, এ ব্রাহ্মণের অন্তঃকরণ সত্যসত্যই patriot ছাঁচে গঠিত।”
কিন্তু খাওয়া পরা অপেক্ষা স্বাধীনতাকে প্রিয় বলে জানার জন্যে শুধু নয়, সাহেবের অধীনতা শৃঙ্খল ছিন্ন করার আর এক অর্থ আছে। সেটা হল রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো। ওদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাঙালির ইংরেজনবিশীর যে উন্মত্ততা তাকে প্রত্যাখান করে আমাদের উচ্চ অঙ্গের সভ্যতার মধ্যে উপ্ত যে প্রবল হৃদয়বত্তা সেগুলিও বিদ্যাসাগর শুধু যে ‘আপনাতে মূর্তিমান’ করেছিলেন তা তো নয়, তিনি চেয়েছিলেন এতদ্বারা বাঙালি সমাজেও শুষ্ক বুদ্ধি যুক্তি বিচারবোধের তলে তলে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো প্রবল হৃদয়বত্তা বইয়ে দিতে। ইতস্তত তাঁর নানারকম মন্তব্যের মধ্যে তাঁর সেই মনোভাবের আভাস পাওয়া যায়।
বিদ্যাসাগর চরিত্রের ব্যাখ্যা বুদ্ধিজীবীরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, বাঙালি সাধারণ সমাজ বিদ্যাসাগরকে যে মাথায় তুলে রেখেছিল সে শুধু তাঁর বিচিত্র কার্যকলাপের কারণে নয়, সবকিছুর মধ্যে তাঁর যে হৃদয়বত্তার প্রকাশ ঘটেছিল তাই প্রত্যক্ষ করে। সম্ভবত এটা লক্ষ করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চৈতন্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। গ্রাম-গঞ্জ–মফঃস্বল থেকে শুধুমাত্র তাঁর দর্শনলাভের আশায় ছুটে আসত, তিনি সেসব জায়গায় গেলে দূরদূরান্ত থেকে তাঁকে দেখতে আসত। কলকাতায় এলে একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য ছিলেন বিদ্যাসাগরও। বিচিত্র কার্যকলাপ আরো অনেক বড় মাপের মানুষের ছিল, কিন্তু তাঁদের দেখতে লোকে ছুটে আসত না। সাধারণ মানুষ হৃদয়টাকে সবথেকে বড় করে দেখে।
তবে প্রশ্ন হতে পারে সামগ্রিকভাবে সে হৃদয়বত্তা বাঙালি সমাজের অন্তরে প্রবেশ করল না কেন? বাঙালি সমাজকে বিমূর্ত হিসেবে ভাবলে এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ দুটি প্রধান বর্গে বিভক্ত ছিল—উচ্চ ও নিম্ন। যদিও নিম্নবর্গ সমাজটাই বিশাল কিন্তু তাদের কোনো ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল না। সংখ্যায় নগণ্য হলেও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল উচ্চবর্গ সমাজের করায়ত্ত। বর্গের এই ভাগ কোনো বর্ণের ভিত্তিতে ছিল না। উচ্চবর্গের মধ্যে নিম্নবর্ণের লোকও ছিলেন, যেমন কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন জাতে তিলি, যেমন বাবু রাজকৃষ্ণ মাঢ় ছিলেন কৈবর্ত, রামদুলাল দে সরকারও উঁচু জাত থেকে আসেন নি, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন জাতে সদগোপ। একইভাবে নিম্ন বর্গের মধ্যেও উচ্চ বর্ণের লোক ছিল, যেমন বিশেষ করে গ্রাম সমাজের অঙ্গীভূত ব্রাহ্মণরা। ব্রিটিশরা গ্রাম সমাজকে ধ্বংস করতে শুরু করে দেওয়ার পর থেকে প্রধানত তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তাঁরা ছিলেন মূলত পরাশ্রয়ী ও উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। গ্রামের যাবতীয় অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করে আর টোলে ছাত্র পড়িয়ে তাঁদের যা আয় হত তাতে সংসার চলে যেত। কিন্তু ক্রমশ তাঁদের অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাদেশের সাধারণ আর্থিক অবনতি ও গ্রাম সমাজের অতি দ্রুত ভাঙনের মধ্যে এই ব্রাহ্মণসমাজের অপরিসীম দুর্গতির শুরু হয়। বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন,
একমুঠো অন্নের জন্য তাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন, অনেক সময় অনাহার ও অপমানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সপরিবারে মৃত্যুবরণও করেছেন। খ্রীষ্টান মিশনারীদের জার্নালে, রোজনাম্চায় ও রিপোর্টে তার অনেক মর্মান্তিক কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এই অবস্থায় এইসব ব্রাহ্মণরা বেঁচে থাকার খাতিরে কৌলিন্য প্রথাকে বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। ঘুরিয়ে বললে নিম্ন বর্গের সাধারণ স্বভাব যে বিদ্রোহ তার থেকে সরে গিয়ে উচ্চবর্ণের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র অনুযায়ী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। আর একবার বিনয় ঘোষে যাই,
অনুলোমপ্রথা বা Hypergamy-র জন্য কুলীন সমাজে বহুবিবাহ আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, কিন্তু প্রথমে দু’চারজন স্ত্রীর মধ্যেই সাধারণত তা সীমাবদ্ধ থাকত। পরে যত মেলবন্ধন হয়েছে, তত সংকুচিত মেলের গণ্ডীর জন্য একস্বামীর বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। তারপর ধীরে ধীরে বিবাহটা কুলীন ব্রাহ্মণের জাত-ব্যবসায়ে পরিণত হতে দেরি হয় নি, আর্থিক কারণে। তখন শতাধিক বিবাহ পর্যন্ত হতেও বাধা রইল না।
এরই প্রতিফল হিসেবে বালবিধবার সংখ্যা বেড়েছে। কুলীনের স্ত্রী বাপের বাড়িতে থাকে, এমনিতেই আর্থিক বোঝা, তার ওপর তার আছে বৈধব্যের যন্ত্রণা। অতএব দায়মুক্তির অপকৌশল হল সহমরণ, গায়ে এঁটে দেওয়া হল সতীত্বের আদর্শ। বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে সহমরণের সংখ্যা সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কোনো শাস্ত্রীয় বা আদর্শগত যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায় না।
এই যে ব্রাহ্মণসমাজ এই সমাজই বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রোধের, বাল্যবিবাহ রোধের ও বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টার বিরোধিতা করেছিল। এ ব্যাপারে তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, তিনি ছিলেন বাংলার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অবিসংবাদী নেতা। উচ্চবর্গ সমাজের এটাই ছিল সবথেকে বড় অংশ। এই অংশের মধ্যে আর এক ভাগে ছিলেন একদল নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, যাঁরা দেশ-সমাজ নিয়ে মাথা ঘামাতেন ঠিকই, তাঁদের সেরকম কোনো স্বার্থবোধও ছিল না, কিন্তু তাঁরা ছিলেন বেজায় গোঁড়া, আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যুক্তির আলোকে দেখতে মোটেই রাজি ছিলেন না। এঁরাও ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেবের অনুগামী। আর একটা অংশ ছিল, তারা ছিল ইংরেজদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, কোনো সামাজিক ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। তৃতীয় অংশটা ছিল আকারে খুবই ছোটো, দেশ নিয়ে সমাজ নিয়ে এঁরাও মাথা ঘামাতেন। তবে তাঁদের মধ্যেও আবার তিনটি ভাগ ছিল। একদল মনে করতেন ইয়োরোপের অনুসরণ করাই শ্রেয় যেহেতু ওরাই ব্যাপারগুলো ভালো বোঝে। আর একদল সমন্বয়ে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সে সমন্বয় সবসময় সুচিন্তিত হত না। ছিলেন আরো একদল যাঁরা প্রয়োজনমত নতুন যুক্তির আলোয় নিজের দেশকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু ইয়োরোপের দ্বারা প্রভাবিত হতেন কমই। বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন এই দলে বা বলা যায় তিনিই ছিলেন এই ধারার পুরোধা অভিযাত্রী। নিজের দেশের সঙ্গে সম্যক পরিচিত বিদ্যাসাগর প্রতিটি ক্ষেত্রে ইয়োরোপীয় পদ্ধতিকে বাজিয়ে নিয়ে তবেই গ্রহণ করতেন। আর তিনি যে তাঁর কাজেকর্মে সমর্থন পেয়েছিলেন সেটা মোটামুটি এই তৃতীয় অংশের।
ওদিকে নিম্নবর্গ সমাজের অবস্থা ছিল তথৈবচ। এই বর্গের অংশ উচ্চবর্ণ যে ব্রাহ্মণরা তারা তো ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে নিয়েছিল, বাকিরা বরাবরই স্বভাব-মূক, অনুচ্চকিত, articulate নয় তারা। তাই বিদ্যাসাগরের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা কোনো ইতিহাসে লেখা নেই। কদাচিৎ জেলেপাড়ার সঙের গানে আমরা শুনতে পাব,
বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে
সদরে করেছ রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।
কবে হবে এমন দিন প্রচার হবে এ আইন,
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরোবে হুকুম
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম
সধবাদের সঙ্গে যাব বরণডালা মাথায় লয়ে।
বিদ্যাসাগরের এইসব সমাজ সংস্কার– বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ রোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন –এই নিয়ে Lucy Carroll একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হিন্দু জনসংখ্যার অন্তর্গত যে শূদ্ররা ও দলিতরা, যারা মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ ছিল না এবং বিধবাবিবাহেও কোনো বাধা ছিল না। অর্থাৎ এগুলো গোটা সমাজের সমস্যা ছিল না। এগুলো ছিল উচ্চবর্ণের সমস্যা। সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টাকে উচ্চ বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যে বিদ্যাসাগর প্রায়ই সমালোচিত হয়ে থাকেন, যদিও সেসব সমালোচনার মধ্যে সত্যতা নেই। প্রথম কথা প্রগতিশীল শূদ্র ও দলিত সমাজের মধ্যে এসব সমস্যা ছিল না বললে এটা দাঁড়ায় না যে সে সমাজে আর কোনো ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষাসংস্কারের খুবই প্রয়োজন ছিল এবং বিদ্যাসাগর তা নিয়ে প্রাণপাত করেছিলেন। দ্বিতীয় কথা গোটা সমাজের সমস্যা নয় বলে কোনো সংস্কারকে উপেক্ষা করার যুক্তিটি ঠিক যুক্তি নয়। তাহলে জ্যোতিবা ফুলে যখন দলিতদের জন্য লড়াই করেন, তখন আমরা এই বলে তাঁর লড়াইকে নস্যাৎ করে দিতে পারি যে সেটা গোটা সমাজের জন্যে নয়। বিদ্যাসাগরের সময়কার ব্রাহ্মণ নারীদের অবস্থা দলিতদের থেকে কিছু ভালো ছিল না।
আরো একটা কথা আছে। সেটা বিধবাবিবাহের ব্যাপারে। সম্ভবত বিধবাদের বিয়ে শূদ্রদের মধ্যেও চালু ছিল না। আঠেরোশো ছিয়াত্তর সালের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ (১৯ অগস্ট) লিখেছিল যে, তাঁতি নাপিত ধোপাদের মধ্যে বিধবাদের বিয়ে চালু না থাকার কারণে লোকসংখ্যা কমছে। নব্য সম্প্রদায় উচ্চ শ্রেণির মধ্যে বিধবাবিবাহের জন্যে যত পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করছেন সেইরকম পরিশ্রম ও অর্থব্যয় যদি তাঁরা শিল্প ও শ্রমজীবীদের জন্যেও করতেন তাহলে মঙ্গল হত। এর অর্থ হচ্ছে যে শুধু উচ্চবর্ণের মধ্যে নয়, নিম্নবর্ণের মধ্যেও বিধবাবিবাহের ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল। কারণটা দুর্বোধ্য নয়। রঘুনন্দন শূদ্রদের দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন—সৎ শূদ্র ও অসৎ শূদ্র। যারা তাঁর বিধান মেনে চলবে, তারা সৎ শূদ্র। যারা মেনে চলবে না, তারা অসৎ শূদ্র। তাঁতি, নাপিত, ধোপারা ছিল সৎ শূদ্র। যেহেতু তখনকার ধারণা অনুযায়ী রঘুনন্দন বিধবাবিবাহের অনুমোদন দেন নি, তাই বিধবাবিবাহের বাধা না থাকলেও পরিবারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হত না। যদিও পরে জানা যায় রঘুনন্দন বিধবাবিবাহের ব্যাপারে বাধা দেন নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন পাশের পরেও সে উদ্যোগ নেওয়া হল না কেন? উত্তরে বলা যায় বিদ্যাসাগরের একার পক্ষে এতদিকে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব ছিল না আর নব্য সম্প্রদায়ের যে ছোট্ট অংশটি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছিল, তাদের আগ্রহের দৌড় অতদূর পৌঁছয় নি।
বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় কীর্তি শিক্ষাসংস্কার। এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রসঙ্গে আসার আগে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে শুধু একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করি। বিদ্যাসাগর ব্যালান্টাইনের প্রতিবেদনের প্রত্যুত্তরে যে বলেছিলেন, “[t]hat the Vedanta and Sankhya are false systems of Philosophy is no more a matter of dispute.” এই কথাটার অর্থ অনেকেই ধরেছেন যে বিদ্যাসাগর এই দর্শন দুটোকে ভ্রান্ত দর্শন বলে অভিহিত করেছেন। এটি একটি ভুল ধারণা। ‘false’ শব্দটা আমাদের দর্শনচর্চায় ‘ভ্রান্ত’ হিসেবে নয়, ‘নেতিবাচক’ হিসেবে ব্যাখ্যাত।
এবার জেনে নেওয়া যাক বিদ্যাসাগর আসরে নামার আগে আমাদের দেশে বাংলা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কিরকম ছিল। এদেশের অগণিত সাধারণ মানুষকে তাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষা দেবার কথা উইলিয়ম কেরি প্রথম বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সে প্রস্তাবে সরকার তেমন সাড়া দেয়নি। এর অনেক পরে সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ১৮৩৫ সালে উইলিয়ম অ্যাডাম সাহেব বাংলা ও বিহার জুড়ে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটা সমীক্ষা করেছিলেন এবং ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ এই সময়কাল ধরে তিনটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। সেই প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছিলেন তখনো বাংলা ও বিহার জুড়ে বাংলা শিক্ষার জন্যে এক লক্ষের বেশি পাঠশালা রয়েছে। সেই প্রতিবেদনে তিনি একথাও বলেছিলেন যে যদিও এইসব পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থা আদিম পর্যায়ের, তবু যে পদ্ধতিতে এইসব পাঠশালায় শিক্ষা দেওয়া হয় সে শিক্ষা চাষীদের, ছোটোখাটো জমির মালিকদের এবং দোকানদারদের খুব কাজে আসে। পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্র’ বইতে এইসব পাঠশালায় কি কি পড়ানো হত তার এবং তার সঙ্গে ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। এইসব পাঠশালায় প্রধানত ব্যবহারিক এবং কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। পাঠশালার পাঠ্যক্রম মানে শুভঙ্করী। শুভঙ্করী মতে আগে অক্ষর পরিচয়, তারপর বানান শিক্ষা, তারপর আর্যা। অঙ্কের গণনা ছাড়া ধানের ওপর যেসব হিসেব পাঠশালায় শেখানো হত, তার মধ্যে ছিল ধানের মাপ, মজুত চালের হিসেব, ধান কেনাবেচার জন্যে টাকার দরে আনার দরে ধানের হিসেব। শুধু ধান নয়, ধান, চাল, গুড়, সর্ষে এসব কেনাবেচার জন্যেও উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত। শস্য ছাড়াও সোনা, রুপো, তামা, কাঁসা, রাং ইত্যাদির বাসনপত্র কেনার পদ্ধতি শেখানো হত। নিখুঁত মাপজোকের জন্যে নানারকম কালি শেখানো হত—ইট কালি, নৌকো কালি, দেওয়াল কালি, পুষ্করিণী কালি ইত্যাদি। সময় নিরূপণ এবং বার-তিথির নিয়ম জানার জন্যে অল্প অল্প জ্যোতিষও শেখানো হত। কবিরাজি চিকিৎসায় অনুপানের ঠিকঠাক মাপ জানার জন্যে ‘চিকিচ্ছায় তোলার পরিমাণ’ শেখানো হত। তাছাড়া ছিল চিঠিপত্র লেখার ধারা, নাম লেখার ধারা, গ্রাম লেখার ধারা, আরো কত কি। শেখানো হত নীতিকথাও। সতীর্থদের সঙ্গে সবসময় ভালো ব্যবহার করবে, প্রত্যেক পড়ুয়া মনে রাখবে তারা সমবেত হয়েছে কোনো গুরুমশায়ের পাঠশালায় নয়, এটি তাদের ‘গৃহ-নীড়’। প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে বাক্যে ও আচরণে যেন যত্ন ও শিষ্ট ভাব প্রকাশ পায়। শিক্ষককে বা দীক্ষাদাতা গুরুকে যেন সযত্নে এবং কায়ক্লেশে সেবা করা হয়। এইভাবে শিশুদের মানস-ক্ষেত্রে শান্ত ও ভদ্র জীবন এবং মানবিকতাবোধের বীজটি বুনে দিতেন গ্রাম্য গুরুমশায়।
পাঠশালার গুরুমশায় ও ছাত্র প্রসঙ্গে মণ্ডল জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণ দুরকমের গুরুমশায়ই ছিলেন, তবে সাধারণত ব্রাহ্মণেতর জাতির ছাত্ররাই এইসব পাঠশালায় পড়তে আসত। আসত মুসলমান ছাত্ররাও, যদিও তাদের জন্যে আলাদা শিক্ষণপদ্ধতিও চালু ছিল। পঞ্চানন মণ্ডলের লেখা থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় না, সেটা হল চাষবাস সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে অন্য সূত্র থেকে জানা যায় ফসল কাটার সময় শিশুরা বাড়ির লোককে সাহায্যে ব্যস্ত থাকার কারণে ঐ সময়টা পাঠশালা বন্ধ থাকত।
এবার দেখা যাক পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার এই ছবিটা বিদ্যাসাগরের হাতে কিভাবে কতখানি বদলে গেল। সবথেকে বড় পরিবর্তনটার কথা গোড়াতেই বলে নিই, সেটা হল মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো। শুধু উচ্চবর্ণ নয়, নিম্নবর্ণের মধ্যেও মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর চল অল্পই ছিল।
এবার আসা যাক পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার কথায়। প্রথম বদল এল বর্ণমালায়। আগেকার ষোলো স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন (চৌতিশা) মিলে পঞ্চাশ অক্ষরের যে বর্ণমালা ছিল বিদ্যাসাগর তাকে বারো স্বর আর চল্লিশ ব্যঞ্জনে দাঁড় করালেন। দীর্ঘ ‘ঋ’ আর দীর্ঘ ‘৯’র যেহেতু প্রয়োগ নেই, সে দুটোকে ছেঁটে ফেললেন। যেহেতু অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণের মধ্যে গণ্য হতে পারে না, সেগুলোকে ঠাঁই দিলেন ব্যঞ্জনবর্ণের শেষে। ড়, ঢ় ও য় যেহেতু পদের অন্তে থাকে এবং আকার ও উচ্চারণে ড, ঢ ও য-র থেকে আলাদা, সেহেতু ঐ তিনটি হয়ে দাঁড়াল স্বতন্ত্র বর্ণ এবং চন্দ্রবিন্দুও হয়ে দাঁড়াল স্বতন্ত্র বর্ণ। ক ও ষ মিলে যেহেতু ক্ষ হয় অর্থাৎ সংযুক্ত বর্ণ, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকা থেকে তাকেও বাদ দিলেন। পুরো সংস্কারটা এত বিজ্ঞানসম্মত যে প্রশংসা না করে থাকা যায় না, অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও তিনি আগেকার কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্ক হারান নি।
এরপর ‘বোধোদয়’এর কথা বলা যায়। পদার্থকে ঈশ্বরের ওপরে ঠাঁই দেবার জন্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বইটি আদরের। খেয়াল করে পড়লে দেখা যায় বিদ্যাসাগর এই বইতে একদিকে পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার যতটুকু রক্ষার উপযুক্ত সেটুকুকে রক্ষা করছেন, অপরদিকে একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। পদার্থের চেতন-অচেতন, মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদ, ভাষা, কাল, বস্তুর আকার ও পরিমাণ, বর্ণ (অর্থাৎ রং), ধাতু, কয়লা, কেরোসিন তেল, জল-নদী–সমুদ্র, কৃষিকাজ, শিল্প-বাণিজ্য-সমাজ, আরো কত কি।
বোধোদয়ের দুটো জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিদ্যাসাগরই প্রথম গ্রামবাংলার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি চালু করেছিলেন, কিন্তু সেই তিনিই ‘বাক্যকথন ভাষা’য় নিম্নলিখিত উপদেশ উচ্চারণ করেছিলেন,
“ইংলণ্ডীয় লোকে অর্থাৎ ইঙ্গরেজদিগের ভাষা ইঙ্গরেজী। ইঙ্গরেজেরা এক্ষণে আমাদের দেশের রাজা সুতরাং ইঙ্গরেজী আমাদের রাজভাষা। এ নিমিত্ত সকলে আগ্রহপূর্বক ইঙ্গরেজী শিখে। কিন্তু অগ্রে জাতিভাষা না শিখিয়া, পরের ভাষা শিক্ষা কোনও মতে উচিত নহে।”
‘কৃষিকাজ’এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন,
“ইদানিং অনেকেই কৃষিকর্মকে অশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন। কিন্তু বাস্তবিক উহা অতি সম্মানের কার্য।”
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কবি নবীনচন্দ্র সেনকে তিনি যা বলেছিলেন সেটা নবীনচন্দ্রের বয়ানে,
“এই পোড়া শিক্ষা এই দেশ হইতে উঠিয়া গেলেই ভাল হয়। আমি আমার গ্রামে একটি স্কুল খুলিয়াছি। আর তাহার ফলে আমি দেশত্যাগী হইয়াছি। চাষাভুষার ছেলেরা পর্যন্ত যেই দু পাত ইংরাজি পড়িতে আরম্ভ করিল, আর তার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িল। তাহাদের ভালো কাপড় চাহি, জুতা চাহি, মোজা চাহি, মাথায় টেরিটি পর্যন্ত চাহি। এখন আমার বাড়ী যাইবার জো নাই। গেলেই কেহ বলে—‘দাদাঠাকুর! তুমি কি করিলে? ছেলেটি একবার ক্ষেতের দিকে ফিরিয়াও চাহে না। আমার আধা জমির চাষ হইল না। খাইব কি? ইহারও বাবুয়ানার খরচই কোথা হইতে যোগাইব?’ কেহ বলে—‘আমার গরুগুলি মারা গেল। ছেলেটি তাহাদের কাছে একবারও যায় না। চরান দূরে থাকুক। আমার উপায় কি হইবে?’ আমি যেমন পাপ করিয়াছি, আমার তেমন প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে। আমি আর পাড়াগাঁয়ে স্কুলের নামমাত্র করিব না। এদেশ তেমন নহে যে, লেখাপড়া শিখিয়া আপন আপন ব্যবসা ভাল করিয়া করিবে। এ লক্ষ্মীছাড়া ছেলেগুলা দু পাত ইংরেজি পড়িলেই আপনার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িয়া দেয়; আপনার পিতামাতাকে পর্যন্ত ঘৃণা করে।”
বিদ্যাসাগরের এই বক্তব্য থেকে সমাজ নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতটি বেশ বোঝা যায়। সে মতের দিক থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির পূর্বসূরি। তাঁর মানসিকতা ছিল দেশপ্রেমের, ঠিক স্বাদেশিকতার নয়। দেশের সমস্ত কিছুর প্রতিই ছিল তাঁর আত্মার টান। গোরুর দুধ খাওয়ার জন্যে বাছুরটা মায়ের দুধ না খেয়ে থাকে বলে তিনি গোরুর দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি সমাজ-রাজনীতির দিকে যান নি। শোনা যায় কলকাতায় যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৮৮৬ সালের অধিবেশন হচ্ছিল, তাই নিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বাবুরা তাদের সম্মেলন করছে। তারা লম্বাচওড়া বুলি ঝাড়ছে, বক্তৃতা দিচ্ছে এবং এইভাবেই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করছে। হাজার হাজার লোক প্রতিদিন অনাহারে যে মারা যাচ্ছে সেটা তাদের ভাবনার বিষয় নয়। এই রাজনীতি করে কি হবে?” যখন কিছু আগ্রহী ব্যক্তি গিয়ে বিদ্যাসাগরকে কংগ্রেসে যোগ দিতে বলে, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বাধীনতার জন্যে কর্তারা কি অস্ত্র ধরতে পারবেন?”