সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
গৌতম ভদ্র
মুখপাত
অধুনা দীপেশ চক্রবর্তী বিশ্রুত ঐতিহাসিক, তাঁর আগ্রহ বহুধা বিস্তৃত, বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লেখক হিসাবে তিনি পারঙ্গম। তাঁর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ বইটির নাম The Climate of History in a Planetary Age, New Delhi: Primus Books, 2021। ঠিক এই বইটি ছাপা হবার আগে তিনি সমগোত্রীয় বিষয় ধরে আর একটি প্রবন্ধের বই ছাপান, The Crisis of Civilization Exploring Global and Planetary Histories, New Delhi: Oxford University Press, 2018। গত দেড় দশক ধরে তাঁর লেখালিখি মূলত: আবর্তিত হয়েছে একটা বিষয় ধরে - বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়। এই আলোচনার পরিসরে মানব সভ্যতার সার্বিক প্রগতির ইতিহাস ও গ্রহ-জাগতিক ও নৈসর্গিক সংকটে মানুষের আত্মচিন্তন ও পরিপার্শ্ব চিন্তন নিয়ে ভাবাভাবির আকার, প্রকার ও বিবর্তন নিয়ে দীপেশ মাথা ঘামিয়েছেন। সেই বুদ্ধিগত ভাবনার পরিণত ফসল উপর্যুক্ত বই দুটি।
ব্যক্তিগত সৌহার্দের সুবাদে আমি এই বই দুটো উপহার পাই, পড়েও ফেলি। কিছুটা বুঝি বলে মনে হয়, নিজের পড়াশোনার খামতির জন্য কিছুটা বুঝিনা। ইতি-মধ্যে বাংলাদেশে দীপেশের অনুরাগীরা দীপেশের উদ্দেশ্যে সম্মাননা গ্রন্থ বার করবে বলে ঠিক করে। দীপেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও তাঁর লেখালেখি নিয়ে একটা কিছু লেখার জন্য আমি অনুরুদ্ধ হই। তখন বেশ অসুস্থ ছিলাম, তবু সানন্দে রাজি হই, ‘সুহৃদ-সম্ভাষণ’ নামে একটা বড়-সড় প্রবন্ধও লিখে ফেলি। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ নিয়ে দীপেশের চিন্তা নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনাটিতে প্রবন্ধটি শেষ হয়।
প্রায় চার বছর কেটে যায়, দীপেশের উপর্যুক্ত বই দুটি বেরিয়ে যায়। নানা মাসিক আশ্বস্তবাণী পাওয়া সত্ত্বেও আমার ‘সুহৃদ সম্ভাষণ’ আজও বের হয়নি। বাংলাদেশ থেকে আর সাড়া-শব্দ নেই, যাকে বলে ‘All quiet on the western front’.
এহ বাহ্য। গত শতকের আশির দশকে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন-এর কর্মী হিসাবে নানা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার করা, কালাকানুন রদ করা ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে আন্দোলন করতাম। এই কাজে ‘জরুরি অবস্থার’ নানা অভিজ্ঞতা ও নকশালবাড়ি আন্দোলন-এর নানা স্মৃতি অনুঘটক হিসেবে কাজ করত। এই পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে মানবাধিকারের বৃহত্তর পরিসরে নাগরিক অধিকার প্রসারিত হল। পাশাপাশি যৌবনের কল্প-স্বর্গের সৌরভে ভরপুর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থাগুলির নিঃসীম আধিপত্যবাদের কাহিনী ও কার্যকলাপ বুঝতে আরম্ভ করি, ক্রমবর্ধমান পড়াশুনা নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছিল। দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রের জুলুমি সীমা থেকে সমাজে ক্ষমতাস্তম্ভের ভিন্নরূপ সম্পর্কেও ধারণা স্পষ্ট হতে শুরু করল।
পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, এমনকি নিবিড় মানবিক ব্যক্তি সম্পর্ক, নানা আধিপত্য-আনুগত্যের প্রশ্নে দীর্ণ ও প্রাতিষ্ঠানিক নিগড়ে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ১৯৯০-এর দশকে নানা ক্ষমতাবন্ধনের পরিসর থেকে নিছক রাষ্ট্রীয় জুলুম বিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের শরিক হতে শুরু করল নানা ধ্যানধারণার সৃজনশীল কর্মীরা, বলা যেতে পারে শত ফুল ফুটে উঠল। সেই পরিসরে নারীবাদ, দলিত জনজাতি সত্তাবাদ, ও প্রকৃতি-মানুষের সম্পর্ক-বিচার থেকে পরিবেশবাদ-এর আন্দোলন নিজ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে স্ব স্ব ক্ষেত্র খুঁজে বার করছিল।
আদর্শগতভাবে পরিবেশবাদী আলোচনা ছেলেবেলা থেকে এক গভীর লালিত বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দেয়। ইতিহাসের বইতে কেমন করে আগুন জ্বালানো শেখা থেকে শিকারি মানুষ কৃষি কাজে লিপ্ত হয়ে সভ্যতা গড়ে তুলছে সেই আখ্যান পড়তাম। অনিবার্য প্রগতির দিকে মশাল হাতে মানুষ ছুটছে, ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে ছাপা ‘বিশ্বপরিচয়’-এর মত জনপ্রিয় বইয়ের প্রচ্ছদ আজও ভুলিনি। প্রযুক্তির ক্রম-উন্নতি, নানা গোত্রের বিপ্লব, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্রম - নানা উত্থান-পতনে মানুষই তো হিরো, প্রকৃতিকে জয় করছে, স্পুটনিক আকাশে পাঠানো হচ্ছে। যখন মানুষ নিজের মর্ত্য-সীমা ভেঙে ফেলছে, তখন শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটলেই কল্প-জগৎ বাস্তব হবে, ‘each according to his ability’ থেকে ‘each according to his need’ নীতিতে উত্তরণ সম্ভব হবে বিজ্ঞানের শক্তির অতুল সম্ভাবনায় আস্থাশীল মানুষের কাছে। প্রকৃতির ভাঁড়ার অফুরন্ত, উৎপাদিকা শক্তির সীমা নেই, উৎপাদন লাফ দিয়ে বাড়বে, মানুষের চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক শক্তিগগুলি যেন হামেহাল হাজির আছে। শ্রেণি সম্পর্ক পাল্টানোই যেন আবশ্যিক শর্ত। বেশ একটু সরলরৈখিক স্কেচ করলাম। কিন্তু এই ধারণাকেই বিজ্ঞান বলে জানতাম ও মানতাম। আর কে না জানে বিজ্ঞান সত্য, আর সত্য তো সর্বজয়ী।
ভুল বুঝবেন না। উপর্যুক্ত বালখিল্য প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানবাদ তথা আধুনিক প্রগতিবাদকে যে কেউ কেউ খোঁচা মারেননি, তা কিন্তু নয়। সব প্রযুক্তির রাজনীতি আছে, কোন প্রযুক্তির উদ্দেশ্যটা কি, কার জন্য - এই সব বেমক্কা প্রশ্ন তুলে নিজেদের গবেষণার পরিসরে কপিল ভট্টাচার্য্ ও ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের মতো বিজ্ঞানীরা আমাদের বার বার সতর্ক করেছেন। বৃহত্তর অর্থে প্রযুক্তি, আধুনিকতা ও উন্নয়নের আন্ত-সম্পর্ক ধরে গোড়ায় টান দিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জোসেফ কর্নেলিয়াস কুমারাপ্পার মতো ভারতীয় চিন্তকরা। আধিপত্যবাদী উন্নতির উচ্চবর্গীয় চিন্তার বিরুদ্ধে তাদের তত্ত্বচিন্তা আমার বড় হবার দিনগুলিতে আদ্যন্ত বাতিল হয়ে যায়, চরকা কাটা বছরে একটা দিন উদযাপনের কুৎসিত রাজনৈতিক প্রতীকে রূপান্তরিত হয়।
কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পরিবেশবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগে আমূল পরিবর্তন আসে। গোলকায়িত বহুজাতিক ধনতন্ত্রবাদ ও আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপরায়ণ রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার অর্থই হল যেন তেন প্রকারে নিসর্গের সম্পদের উপর সর্বগ্রাসী ও সর্বভুক মানুষের আধিপত্য কায়েম করা। এই আধিপত্যের নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক আছে, স্থানিক মাত্রা থেকে বৈশ্বিক মাত্রায় আধিপত্যের কাঁটাগুলো নড়াচড়া করে ।
৬ ডিসেম্বর ২০২২-এ লেখাটা লিখছি। সকালে দেখলাম কেরলে তিরুবন্তপুরম-এর কাছে ভিঞ্জিগ্রাম-এর বন্দর তৈরি করার বিরুদ্ধে ১৩৮ দিন ধরে চলা মৎস্যজীবীদের আন্দোলন প্রত্যাহার হয়েছে, আদানিরা সাগর বন্দর তৈরি করার উদ্যোগ চালু করার সবুজ সংকেত পেয়েছে। মৎস্যজীবীদের মার্কসবাদী সরকার ক্ষতিপূরণ দেবেন কিন্তু বন্দরের ফলে কেরলের উপকূলভাগ চিরতরে ধ্বংস হবে কী না, তা নিয়ে কোন খতিয়ান দিতে বা হিসেবনিকেশ করতে সরকার বিন্দুমাত্র তৈরি নয়। এই অবস্থানে বামভক্ত ও রামভক্তরা সহমত হয়ে মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী ময়দানে নামতে প্রস্তুতও ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষও চাগানো হয়। আদানিদের প্রকল্প ছাড়া কেরলের উন্নয়ন কী করেই বা হবে ? আবার এও পড়ছি যে গৌতম আদানিদের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লা খাদান খোলা হবে, অজস্র কয়লার দৌলতে সস্তা বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। জনমোহিনী সরকার মমতাময়, জমি দখলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা পুনর্বাসন পাবে, ভুক্তভোগী পরিবারের একজন সরকারের কোনো বিভাগে ‘গ্রুপ ডি চাকরি পাবে। আর কি চাই। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস, তীব্র উষ্ণায়নের ও পরিবেশ দূষণের কথা বলা শহুরে নকশালদের উন্নয়নবিরোধী প্রচার, বাংলার উন্নতির পেছনে ছুরি মারা। উন্নয়ন অর্থই তো তাৎকালিক হাতে গরম মুনাফা, ভবিষ্যতের সংকটের কথা কেই বা ভাবে?
এ সবই জানা কথা। অঞ্চল বিশেষে আধিপত্যকামী উন্নয়নের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী জনগণ মরণপণ লড়াই চালায়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ সেই লড়াই। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এই লড়াই ইস্যুভিত্তিক, আঞ্চলিক সীমাতেই আবদ্ধ। গ্লোবাল উন্নয়ন চিন্তা পরিবেশের লড়াইকে আঞ্চলিক ইস্যুতে আটকে রাখতে চায়। কারণ পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ, আমলাতান্ত্রিক পুলটিস - এই সবের মাধ্যমে ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের চট-জলদি প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও মানুষের দীর্ঘমেয়াদী সুষম ও স্বাভাবিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা যায়, মুনাফাটাই তো সব। আমাজন নদীর জঙ্গল ধ্বংস থেকে সুন্দরবনের ব-দ্বীপ এই চিন্তাজাত উন্নয়নতন্ত্রের শিকার।
নিজের স্বার্থে গ্লোবাল নিয়ত লোকাল তৈরি করে চলে। এহেন খণ্ডীকরণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতি ও সভ্যতার মূল্যায়ন করতে চাইছেন, নেচার ও কালচারের সম্পর্কের সমস্যাকে পুনর্বিন্যস্ত করতে তাঁরা ইচ্ছুক। তাঁদের ভাবনার মানচিত্র অনুযায়ী সভ্যতার তথা পরিবেশের সংকটের ভুক্তভোগী সব জীব ও প্রজাতি, কেবল মানুষ নয়।
দীপেশ চক্রবর্তীর রচনা এই প্রতর্কের অংশী। নিছক দেশ, কাল বা বিশেষ কোনো জনসমাজ-শ্লিষ্ট দাবি-দাওয়ার পরিসরে দীপেশ তার অন্বীক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। প্রাণী-অপ্রাণী, পৃথিবী-সৌরজগৎ, তথা মানুষী সত্তা ও অনেক অমানুষী বস্তুপুঞ্জের মধ্যে টানাপড়েনের সূত্রে সে পরিবেশ-ভাবনাকে চিন্তা করেছে। ফলে ইতিহাস-বিদ্যার অবয়ব বদলে গেছে, প্রগতি-ক্রমের চরিত্র বিচার এক থাকেনি। দীপেশের ভাষ্যে গ্রহ-জগতের ময়দানে জীবপ্রাণ ও প্রকৃতির খেলাটার নিয়মকানুন ভিন্ন, কালের মাপকাঠিতা অন্য। এই সামগ্রিক ভাবনাই তার রচনার জোর।
অবশ্যই দীপেশ আমার সুহৃদ। বন্ধুর রচনার পাঠক আমার মতো ক্যাবলা বাঙালিও। তবে দীপেশের এই বই দুটি নিয়ে কোনো বিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ লেখা আজও আমার চোখে পড়েনি, দুই বছর হয়ে গেল। আমার অপ্রকাশিত ‘সুহৃদ-সম্ভাষণ-এর প্রাসঙ্গিক অংশটুকু কালধ্বনিতে ছাপাবার জন্য দিলাম। সামান্য রদবদল হয়েছে। বাংলায় দীপেশের রচনাটিকে নিয়ে আলোচনা হোক, পরিপ্রশ্ন উঠুক; নীরবতা সবসময়ে উন্নতিকামী বিকাশপুরুষ বা বিকাশমহিলাদের আধিপত্যবাদকে মজবুত করে।
‘সুহৃদ-সম্ভাষণ’ রচনার শেষাংশ
সাম্প্রতিক লেখাপত্রে দীপেশ চক্রবর্তী জানিয়েছে যে, সত্তর বছরব্যাপী জীবনে তার দুটি পরিচিতি আছে, গ্লোবাল ও লোকাল। দীপেশ তো ‘টানা চল্লিশ বছর সাদাদের দেশে বাস’ করছে। ঢাকার বন্ধুরা দীপেশ চক্রবর্তীকে বলেছে, ‘আপনে আর লোকাল নেই, আপনারে দেইখতে দেইখতে, এইটা আমরা বুঝতে পাইরতেছি, আপনি এক্কেরে গ্লোবাল ও সাদা হইয়া গেছেন।’১ দীপেশও স্বীকার করেছে যে পশ্চিমি মানুষদের চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে কিছুটা ভাবা, কথাবার্তা চালানো তাঁর বর্তমান জীবনে অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। এমনকি এটাও মনে হয়েছে যে, ‘আমি বাংলায় বলছি, কিন্তু ভাবছি হয়তো ইংরেজিতে।’
ঢাকার বন্ধুরা দীপেশের যাত্রাকে ‘এক্কেরে গ্লোবাল’ বলেছিলেন, কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের সূত্র ধরে দীপেশের বর্তমান চিন্তা তো ‘গ্লোবালেই থেমে নেই, তা গ্রহজাগতিক (planetary) বৃত্তে ঢুকে পড়েছে। উষ্ণায়ন তথা পরিবেশচিন্তা প্রসারিত হয়েছে গ্রহজগৎ ও অণু-পরমাণু নিয়ে গড়া বস্তুবিশ্বের অঙ্গীরূপেই মনুষ্য প্রজাতির ভাবনায়, সেই ভাবনাই দীপেশের বর্তমান রচনার মাপনি, এক বিশ্বব্যাপী বিতর্কের অংশী তার সাম্প্রতিক সন্দর্ভগুলি। দীপেশের অনুসন্ধিৎসায় লোকাল, গ্লোকাল তো আছেই, তা ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রহজগতের লোকে, প্লানেট-এর দেশ ও কালের মাত্রায়। ভাবছে কোনো না কোনো মানুষ, চৈতন্যময় মানুষের ভাবনাক্ষেত্রই আলোচনার পরিসর, এইটুকুই যা প্রারম্ভিক সাদৃশ্য।
দ্বিভাষিক দীপেশের আলোচনায় ঝোঁকে রকমফের আছে। দীপেশ জানিয়েছে যে, ‘ভাবনার গদ্যের তারতম্য আছে’।২ ভাবনাটা পৃথিবীর সব বাসিন্দার জন্য । কিন্তু যে ভাষায় ভাবছি, যে ভাষায় চিন্তাকে উপস্থাপিত করছি, তার ‘স্থানিকতা’ আছে, প্রাকরণিক ও প্রায়োগিক বিশেষত্ব আছে। ভাষান্তরে চিন্তার সুতোয় খিঁচ ধরতেই পারে। বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা গ্রহ জগতের অস্তিত্বের সংকট সংক্রান্ত বিতর্কে শরিক হতে গিয়ে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা দীপেশের নানা প্রবন্ধ ও বই আমাকে পড়তে হচ্ছে, অন্য কিছু রচনাও প্রসঙ্গ সূত্রে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। সেইসব পড়াকে ফিরে বাংলায় উপস্থাপিত করার প্রক্রিয়াতে ভাবনা ও ভাষার টানাপড়েনের হাত থেকে আমিও রেহাই পাব না।
ভাবনা ও ভাষার টানাপড়েনটা জ্ঞানাঙ্গনের নানা বর্গীয় নতুন শব্দ - পরিভাষায় আকীর্ণ, সমাজবিজ্ঞানে এতদিনের প্রচলিত ও গ্রাহ্য ধ্যানধারণা থেকে একটু পৃথক। প্রকৃতি ও জীবজগতে জ্বালানিখোর অবিমৃষ্যকারী মানুষের সর্বাতিশ্রয়ী আগ্রাসন ও সার্বভৌমিক বিকাশ এই গ্রহে মনুষ্য প্রজাতি তথা খোদ পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। পোপের আহ্বানে আর অমিতাভ ঘোষের পরিবেশ ও আবহাওয়া সংকট নিয়ে আলোচনাতে বা কবি মণীন্দ্র গুপ্তের টুকরো গদ্যরচনায় আছে মানব ধর্মী বিশ্ব সভ্যতাকে বাঁচাবার আর্তি।৩ সুনামি সংকট বা সুন্দরবনের জগৎ বিখ্যাত জল ও জীবজীবনের ক্রমধ্বংসের আখ্যান তো প্রজাতি হিসাবে আমাদের বিপন্ন হয়ে পড়বার নিদর্শন মাত্র। এইরকম প্রাকৃতিক জৈব বিপর্যয় থেকেই হয়তো বা উঠে এসেছে করোনা ভাইরাস। ভাইরাসের দাপট বিশ্বব্যাপী অতিমারীর চাপে পৃথিবীব্যাপী জনসমাজ নির্বিশেষে সবাই নাজেহাল। ইতিহাসে দ্বন্দ্বে ও অসাম্যে দীর্ণ তথা বিপন্ন মানব সমাজের কথা অজানা নয়। সমাজবিজ্ঞানে শ্রেণি-সম্প্রদায়-কৌম ইত্যাদি বর্গ নিয়ে চুলোচুলি চলেছে। একবিংশ শতক পর্যন্ত নানা সামাজিক তর্কে ওই সব বর্গগুলিকে বুড়ি ধরে লেখা হয়েছে পৃথিবীতে মানবসমাজের ইতিবৃত্ত, বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের ঈপ্সা ও কর্তৃত্বের নানা ঝোঁককে। মনুজ উদ্যমের জোর ও আধিপত্যের আধার উপর্যুক্ত বর্গগুলি, নানা আঁকাবাঁকা পথে ওইগুলোই স্বদেশ ও সভ্যতার মৌল বিকাশের নিশান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উষ্ণায়ন ও ধ্বস্ত পরিবেশের চাপে মানব সভ্যতার নির্বিশেষ প্রগতি-আখ্যানে বিশ শতকের শেষ পর্ব থেকেই চিড় ধরতে আরম্ভ করে। পাশাপাশি নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানা প্রজাতির প্রাণীর নির্মম অবলুপ্তির অন্যসব সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন খণ্ড কাহিনীতে।৪ একবিংশ শতকে সেই সব কাহিনীর তাত্ত্বিক সূত্রায়ণে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল অন্য ধরনের শব্দ, পৃথক বর্গ, যেমন, holocene, anthropocene, great acceleration, planetary ইত্যাদি। রেমন্ড উইলিয়ামস সংকলিত keywords-এ এইসব শব্দের হদিস নেই। দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর জগতের অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে গত সত্তর বৎসরে আমরা আরেক সময়পর্বজাত বিদ্যা তথা অভিজ্ঞতায় ঢুকে পড়েছি।৫
এই নূতন সময়পর্বে মানুষের ইতিহাস ভাবনা কী হবে, কোনদিকে সেই ভাবনা বাঁক নেবে. এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে দীপেশ। তার অধুনা প্রকাশিত বইটির নাম নজর কাড়ে, ‘গ্রহজাগতিক যুগে ইতিহাসের আবহাওয়া’, অর্থাৎ ইতিহাসভাবনা তথা রচনার আবহাওয়া তথা প্রেক্ষিত চেতনা। তার চিন্তায় আমরা তিনটি ধারার মিশ্রণ দেখি। প্রথম, তার নিজস্ব ইতিহাসচর্চার রূপ-রূপান্তর ও পরিবেশ-বিপর্যয় নিয়ে নিজের অনতিপূর্ব অভিজ্ঞতা দীপেশের বইয়ের উৎসর্গপত্রে জায়গা পেয়েছে। ২০১৯-২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে মৃত মানুষ আর ২০২০ সালে বাংলার আমপুন দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের স্মৃতিতর্পণ। দ্বিতীয়ত, পার্থিব প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের স্থিতি নিয়ে ইমানুয়েল কান্ট, মার্টিন হাইডেগার, হানা আরেন্ট, কার্ল ইয়াসপার্স প্রমূখ দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে দীপেশের পরিচয় গভীর, সেই পরিচয় তার তাত্ত্বিক ভাবনাকে পরিপুষ্ট করেছে। এইসব পরিচিতির নানা সাক্ষ্যের পাশে রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ ও বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে দীপেশের আলাপচারিতা লক্ষ করার মতো। তৃতীয়ত, দর্শন পাঠে জারিত চিন্তার সহযোগী হয়েছে অন্য গোত্রের বিদ্যা পরিচিতি, জড় ও জীবনপ্রক্রিয়ার অন্বয়ে স্থিত ‘ভূ-ব্যবস্থা বিজ্ঞান’ বা Earth system science, এই তিন ধরনের পরিচিতির অভিজ্ঞতার বুনটে তৈরি বিশেষ সন্দর্ভের তত্ত্বভূবন।
উপর্যুক্ত তত্ত্বভুবনের চলবিন্দু (Fulcrum) হল দুটি স্বতন্ত্র বর্গের ধারণা, গোলকায়িত (global) বিশ্ব আর গ্রহজাগতিক (planetary) বিশ্ব । দুটোতেই ‘বিশ্ব’ শব্দটি আছে। দীপেশের মতে, দুটি বিশ্বের রূপ-লক্ষণ পৃথক। গোলকায়নের বিশ্ব নির্মাণ নৃকেন্দ্রিক (a human-centric-construction)।৬ গ্রহ জাগতিকের বিশ্বচিন্তায় মানুষের ঠাঁই নড়ে যায়। তার কেন্দ্রীয় স্থিতিতে বিপর্যয় ঘটে। ইতিহাসভাবনা বা রচনায় এই দুটি বর্গ যে সবসময় বিপরীতমুখী হয়ে কাজ করবে সেরকম নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার অনুযায়ী দীপেশের অভিমত হল বিশ্বব্যাপী ধনতান্ত্রিক ইতিহাস গ্রহ-জাগতিক চিন্তা ব্যতিরেকে লেখা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সার্বিক পরিবেশে মনুষ্যজাতির স্থিতি ও ক্রিয়াকর্মের ইতিহাস গ্রহজাগতিক অভিজ্ঞতা ও চিন্তা বৃত্তের বাইরে থেকে রচনা করা সম্ভব নয়।৭ গ্রহজাগতিক ব্রহ্মাণ্ডে অণু-পরমাণু নিয়ে প্রাণ- প্রক্রিয়ার লীলা চলে, জল- মাটি -বায়ু আকাশে ব্যাপ্ত বিশ্বে অন্য বিচিত্র প্রজাতি ও নানা জড়বস্তুর সঙ্গে মানব প্রজাতিকে সম্পর্কে যেতে হয়, ভিন্ন প্রাণের ও ভিন্ন ভূ-বস্তুর অবস্থিতি নিজেদের জীবনপ্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি পায়, কোনো না কোনো বর্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষের নৈমিত্তিক চিন্তা অভ্যাসের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে। মোদ্দা কথা, গ্রহজাগতিক বিশ্বে জৈবিক মানুষের অস্তিত্ব অন্য প্রজাতি সমৃদ্ধ জীবনচিত্র ও জড় বস্তু নিচয়ের অঙ্গ, স্বতন্ত্র সার্বভৌমত্বের দাবিদার নয়।
এই বক্তব্যের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে দুই ভিন্ন বিদ্যায় নিষ্ঠ সময়চিন্তার প্রতিচ্ছেদের পরিসরে দীপেশ ইতিহাসভাবনার রূপান্তর নিয়ে বক্তব্য হাজির করেছে। নৃকেন্দ্রিক সময় ধারণা (anthropocene time) ও ভূকেন্দ্রিক সময় ধারণা (geological time)। অবশ্যই সময়ধারণা তো যে-কোনো ইতিহাস চেতনার অক্ষ, মৌলিক পরিবর্তন তো সেখানেই সাধিত হবার কথা।
আধুনিকতার প্যাঁচ-পয়জার নিয়ে চিন্তক ব্রুনো লাতুরের সঙ্গে দীপেশের কথোপকথনের সূত্রে বলা যেতে পারে যে, দুই ভিন্ন প্রকৃতির সময় চৈতন্যের মিশ্রণে দীপেশ আগ্রহী। তার মতে, আমাদের ইতিহাসবোধে ‘ভূতাত্ত্বিক চেতনার অনুপ্লবণ’ (the percolation of a geological consciousness) ঘটছে, এই অনুপ্লবণই আমাদের নিশ্চিত ইতিহাসবোধের প্রেক্ষিতে কাঠামোগত রদবদলটা সরাসরি উপমিত করেছে ‘ভূ-স্তরপাতিক সরণ’ (tactonic shift)-এর সঙ্গে। ফলে ইতিহাস চিন্তার চলনে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।৮ প্রচলিত ইতিবৃত্তে আধুনিক মানব সভ্যতার ভাবনা কয়েক দশক-শতক পেরিয়ে বেশিদূর পেছনে হটে না, সময় সারণিতে আদিম, প্রাচীন ও মধ্যযুগের অতীতচারণে দুই-তিন-হাজার বছরের মাত্রায় চলাফেরা করাটাই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে, ভূতত্ত্ব তথা গ্রহজাগতিক বিবর্তনের সময়মাত্রার নিরিখ তো লক্ষ-কোটি বছরের, সেই শাস্ত্রে কয়েক বিলিয়ন বৎসরের হিসাবে পৃথিবী নামের গ্রহটির প্রাকৃতিক বিবর্তন আলোচিত হয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানীরা আলোচনা করেছেন, সেই আলোচনায় এই ইতিবৃত্তের অনেকটাই মানবরহিত। মানবরহিত ও মানব অধ্যুষিত গ্রহে নানা প্রজাতির এসেছে, নানা কারণে ধ্বংসও হয়েছে। তবে সেই ইতিহাসের উপস্থাপনা অনেকাংশে ফসিল সুলভ প্রাণহীন অবশেষের বৃত্তান্ত, বাঁচা-মরার মানবিক ইতিবৃত্তে সেদিনের প্রাণীরা আদিমকালের চাদিম হিমমাত্র। আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ ডাইনোসর বনবাসী ও গুহাবাসী মানুষের দাপাদাপির রোমাঞ্চকর সন্দেহ নেই, কিন্তু সেরকম বর্ণনা একটি নৃকেন্দ্রিক ইতিহাসের প্রাক-কথন মাত্র, সেই আখ্যানে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের কুদরতে টেরোড্যাকটিল পাখি সশরীরে সভ্য লন্ডনের বিজ্ঞান সভায় হাজির হয়ে যায়।
প্রচলিত পাঠ্য ইতিহাসে নিরিখে তো শিল্পবিপ্লব প্রগতির যুগ, আধুনিক প্রায়োগিক বিজ্ঞানের জগৎব্যাপি জয়যাত্রার সূচনা। অন্যপক্ষে, এই সময়ের উদারনৈতিক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় সচেতন, বিচারক্ষম স্বশাসিত একক ব্যক্তি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রে জাঁকিয়ে বসেন। বিপরীতে ভূতাত্ত্বিক সময় মাপকাঠিতে শিল্প-বিপ্লব তো ক্ষণপূর্ব আগের ঘটনা। এই সময় বিন্দু ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের আরম্ভকাল। কিছু ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রকৃতির উপরে ক্ষমতার নিয়ামক রূপে মানবিক ক্রিয়া-কলাপ ও মদমত্ততার আরম্ভক্ষণ, anthropocene পর্বের সূচনাপর্ব তো শিল্পবিপ্লবের আমল। আধুনিক মানবসভ্যতার সার্বভৌম প্রগতির আরম্ভলগ্নে প্রোথিত হয়েছে প্রাকৃতিক জীবনের ভাঁড়ার নিঃশেষ করে নেবার উদ্যোগ পর্ব।৯
দুই ভিন্ন বিদ্যা, দুই ধরনের সময়দৃষ্টি, দুই পৃথক বিচারবোধ। আজকের গ্রহজাগতিক (planetary) পৃথিবীতে ভূ-পদার্থী শক্তি (geo-physical force) রূপে সামূহিক (collective) মনুষ্য প্রজাতি অন্য সব প্রজাতির অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে নিছক স্ব-শাসিত ব্যক্তি মানুষের স্বার্থ ও বুদ্ধির বর্গে মনুষ্য সমাজের ক্রিয়া কর্ম ও মানবিক সত্তার রূপ বিচার করা একপেশে হয়ে যেতে পারে।
গ্লোবাল ও প্লানেট সম্পর্কের টানাপড়েনে বারবার বিভাজিত সময়প্রেক্ষিত দীপেশের রচনায় ফিরে এসেছে। এই দ্বি-বিভাজিত কালবোধের অনুষঙ্গে দীপেশের রচনা নানা দ্বিত্ববোধের বর্গে ভরপুর। যেমন,'splitters' (বিভেদকারী) আর 'lumpers' (সংবদ্ধকারী) শব্দবন্ধের মোড়কে আলোচিত হয়েছে খণ্ডীকরণ ও একীকরণের প্রশ্ন। অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র স্বর গ্রহায়িত ইতিহাসের অ-মানবিক মাত্রায়, কিভাবেই বা সর্বাঙ্গীণ অখণ্ডতার আধারে সমাজ, কাল ও ব্যবস্থা বিশেষে ভিন্নতার মানাঙ্ক স্থির হবে সেটা জটিল প্রশ্ন। তবে এই মানবিক অভিজ্ঞতার খণ্ড পরিসরে ভূতাত্ত্বিক সময়ের ব্যাপ্তি ধরা সম্ভব নাও হতে পারে।
ইতিহাসের সময় চেতনায় ভূগোলকব্যাপী বিশ্বদৃষ্টি ও গ্রহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নানা দ্বি-ভাজের জন্ম দেয়, ইতিহাস সাধনায় বাঁক আসে। এক বিশিষ্ট ধরনের দেখায় উষ্ণায়ন তথা প্রাকৃতিক সম্পদ তথা ফসিল ব্যবহারের ইতিবৃত্ত অসাম্য ও ক্ষমতার দাপটের কথা মাত্র। দীপেশ বক্তব্যটির যাথার্থ অস্বীকার করেনি। তার মতে, ক্ষমতার দাপট ও সামাজিক অসাম্যের ইতিকথা ‘গ্রাউন্ড আপ’ দেখার বিষয়। কিন্তু সেই দেখার বৃত্তান্তটা ‘অর্ধ কথন’ মাত্র। আরেকটা বৃত্তান্তের উৎস নিহিত থাকে বাইরে থেকে দেখায়, ‘আউটসাইডার’ ইন দেখা। বাঙালি দীপেশ মনে করিয়ে দিয়েছে সুবচনী হাঁসের পরে বসে রিদয়ের উপর থেকে পৃথিবী দর্শনের সাহিত্যিক আখ্যানকে, ওই আখ্যানের সঙ্গে তুলনা টেনেছে আজকের গ্রহজাগতিক ভুবনে ‘মঙ্গলগ্রহে বসে বা স্পেসশিপে বসে পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকা সঙ্গে। এহেন আকাশবিহারী দর্শনে মানুষ প্রজাতি সমেত ‘পৃথিবীকে বাইরে থেকেই একটা টেটালিটি’ রূপে দেখা হয়, আইডেন্টিটি এন্ড ডিফারেন্স হিসেবে’ মানুষকে দেখাটা বিচার্য নয়। একটা দেখা যেন আর একটা দেখার পরিপূরক। বাংলা বক্তৃতায় এই দুই ধরনের দেখাই দীপেশের অখ্যাত ‘মানবিকতা ও ‘অ-মানবিকতা’র ভাবনা বা গল্প, এই দুটো গল্পের ‘মাঝামাঝি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।’১০
আধুনিক জীবনচর্চার পরিসরে দুই ধরনের কালবোধের প্রেক্ষিতে দীপেশ আরেকটি দ্বিত্ব-এর ধারণা উত্থাপন করেছে। পরিবেশ সংক্রান্ত বিতর্কে শব্দ দুটি পরিচিত, 'sustainability' ও 'habitability'-এর টানাপড়েন। এক কোটিতে আছে অবিরাম উন্নয়নের যাত্রায় বিশ্বে অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনুষ্য প্রজাতির টিকে থাকার বাসনা ও প্রচেষ্টা। অন্য কোটিতে দেখি নানা জীব অধ্যুষিত ধরাধামের ভারসাম্য বজায় রেখে জন্মলব্ধ পরিদৃশ্যমান জগতকে বসবাসযোগ্য করার ঈপ্সা। এই দুই কোটির মধ্যে টানাটানি হাল আমলে দৈনন্দিন জীবনভাবনাকে সমস্যায়িত করেছে। নৃকেন্দ্রিক জীবনযাপনের রাজনীতির পরিসরটি উপর্যুক্ত দ্বিত্ববোধের ক্রিয়ায় ভরপুর।১১ বলে নেওয়া ভালো যে দীপেশ বর্ণিত দ্বৈতবর্গগুলি সবসময় পরস্পরবিরোধী সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। সংযোগী, প্রতিচ্ছেদী ও সহঅবস্থানী রূপেও বর্গগুলি থাকতে পারে।
নানা দ্বিত্ববোধের বিশ্লেষণের মাধ্যমে দীপেশের আলোচনা প্রসারিত হয়েছে দ্বি-ভূমি স্থিত মানুষের সত্তার দার্শনিক তাৎপর্য নির্ণয়ে। কালচেতনা ও দেশবোধ তো জীব অস্তিত্বের ভিত্তি। ‘planetary age’ তথা গ্রহজাগতিকযুগে মানুষ বলে আখ্যাত জীবটি একই সঙ্গে দুই অক্ষে গতায়াত করছে। একপক্ষে সে স্বজ্ঞাবান অধিকার সচেতন ব্যক্তি মানুষ; অন্যপক্ষে সত্তাবিহীন ভূ-পদার্থী (geophysical) সামূহিক মনুজ শক্তি হিসাবে সে আবির্ভূত । একটি অপরটির সঙ্গে অন্বয়-ব্যতিরেক সম্পর্কে যাচ্ছে। ইতিহাস দর্শনে এহেন দ্বন্দ্ব নিরসনের কোনো আশু নিদান জানা নেই, উপর্যুক্ত বিরোধ বা মিলন ক্ষেত্রের আকার-আয়তন, সীমা-সরহদ্দ সবই অনিদের্শ্য। ‘নতুন দর্শনে ঋদ্ধ নৃতত্ত্ব চিন্তা ('a new philosophical anthropology') এই দ্বন্দ্ব ক্ষেত্রের অন্তর্গত আদান-প্রদান ও বিরোধের শর্তগুলি স্পষ্ট করে তুলবে, সেই নতুন চিন্তার সুবাদে নানা মাত্রায় স্থিত ভিন্ন ভিন্ন দ্বৈতবোধ অদ্বৈত চৈতন্যকে ছুঁতে পারবে। ভবিষ্যতে ঐ প্রত্যাশারই উচ্চারণ যেন দীপেশের সাম্প্রতিক গ্রন্থ।১২
দীপেশের সন্দর্ভটি কোনো কালানুক্রমিক ইতিহাসবৃত্তও নয়, কার্যকারণ পরম্পরার সরাসরি শৃঙ্খলে বাঁধা আখ্যানকাহিনিও নয়, বরং বিশেষ সময়ে গ্লোবাল আর প্লানেট চিন্তার পরিচ্ছেদজাত সঙ্কুল ক্ষেত্রে ইতিহাস চৈতন্যের তত্ত্বতালাশ। তত্ত্বতালাশের পরতে পরতে রয়েছে অন্য ধরনের ইতিহাস রচনায় ইঙ্গিত, জড়জগৎ ও প্রাণময় জীবনের পারস্পরিকতার সমস্যা। কেবলমাত্র উপস্থাপক বৈতণ্ডিক হবার ইচ্ছা আমার নেই। এক জিজ্ঞাসুরূপে বহসে যাচ্ছি, নিজের প্রতিক্রিয়া বা শঙ্কা প্রকাশ করার জন্য দীপেশ-উল্লিখিত আখ্যান-ইঙ্গিতকে হয়ত বা সদৃশ্য বিশেষ প্রসঙ্গের আকারে উত্থাপিত করতে হচ্ছে।
দীপেশের বইতে নানা বীজগর্ভ মন্তব্য ছড়িয়ে আছে, মন্তব্যগুলি আধুনিকতা জ্ঞানতত্ত্ব ও ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে নতুন ভাবনা উসকে দেবে। দুয়েকটি মাত্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, নিসর্গ সম্পর্কে মানুষের বোধ নিসর্গের সৌন্দর্য ও বিশালতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা তো অন্তহীন, এই অন্তহীন অভিজ্ঞতার ভাষা ও চিত্রগত সাক্ষ্যের অভাব নেই। ধর্মবোধ থেকে ধর্মরহিত চেতনায় মানুষ ও প্রকৃতির নির্ভরতাও বোধগম্যতার চিন্তা পরিবর্তিত হয়, সেই মননের মানচিত্র কয়েকটা অক্ষর বিন্দু কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা দীপেশ করেছে।১৩ আলোচনায় এক অন্য ভুবনের ইঙ্গিত আছে। বিস্ময়, ভয় ও শ্রদ্ধার সূত্রেই তো আমরা আমাদের পরিপার্শ্বে যেই অন্যভুবনকে স্বীকার করি, জড় প্রকৃতির প্রাণের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানবাদের নামে সেইসব মানবিক অনুভূতিলোককে বাতিল করা অর্থ প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক মানুষের হার্দ্য সম্বন্ধকে নাকচ করে দেওয়া। প্রকৃতি হয়ে ওঠে যেন জর্জ অরওয়েল বর্ণিত পশু খামার, কেজো চাহিদা মেটাবার বস্তু ভাণ্ডার। অথচ বিস্ময়, ভয়. শ্রদ্ধা মানুষকে গ্রহ-প্রকৃতির নানা পট-বর্ণনায় সংস্থাপিত করে, গ্রহজাগতিক পৃথিবীর প্রতি আধুনিক মানুষের শীতল ঔদাসীন্য (cold indifference) লজ্জা দেয়। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে দীপেশ-অনুসন্ধিত নতুন নৃতত্ত্ববিদ্যার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে এই গ্লোব ও প্লানেট নামে দুই ভুবনের মধ্যে অনুভূতির আখ্যান গড়ে তোলার ক্রিয়াকর্ম। বুদ্ধদেব বসু ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই ভিন্ন মেজাজের বঙ্গনিবাসী মেধাজীবী। আমি নিশ্চিত যে, দীপেশের বক্তব্যের মুদ্দায় এরা দুজনে আগ্রহী হতেন।১৪
নতুন দর্শন অভিসারী ‘নৃতত্ত্ব চিন্তার’ সূত্রে হাল আমলের বিশ্ব প্রজাতির জগতের সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা দীপেশ উল্লেখ করেছে।১৫ ২০২০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাপক হারে উট নিকেশ করা হয়। জীব হত্যার ‘তুচ্ছ’ তথ্যের পেছনে বৃহৎ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত বিধৃত আছে, পৃথিবীবাসী এক প্রজাতির প্রতি অন্য প্রজাতির কৃতঘ্নতার নিদর্শন কাহিনিটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। একটু বিশদে ইতিবৃত্তটা জেনে রাখলে ক্ষতি নেই। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় পাদ থেকে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান, রাজস্থান ও আফগানিস্তান থেকে উট অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি হত। উটদের সঙ্গে উটের চালকরাও ওই দেশে যায়। এই চালকদের অনেকেই পুশতুভাষী আফগান, তবে বালুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব নিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও উটচালকের বৃত্তি গ্রহণ ক’রে অস্ট্রেলিয়ায় আড্ডা গাড়ে। এইসব গোষ্ঠীকেই একসঙ্গে ‘গনি’ বলা হত, এদের বসতি ‘গনি টাউন’ নামে আখ্যাত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় ‘শ্বেত’ সভ্যতা বিস্তারে তন্তুতে তন্তুতে ভারতীয় উট ও গনিচালকদের কথা জড়িয়ে আছে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উষর এলাকায় শ্বেতকায় অভিযাত্রীরা উটের কারাভানে চেপে নতুন নতুন এলাকায় বসতি গড়ে চলে। এই সব এলাকাতেই উটই ছিল যানবাহন। ওই জীববাহী পরিবহনের উপর নির্ভর করেই নানা খ্রিষ্টান মিশন প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের সংগঠন স্থাপন করে। গনিরাও নিজেদের বসতিতে মসজিদ গড়ে তুলেছিল। সুফি ধর্মেরও চর্চা হত, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘মাহদি’ মতবাদও জনপ্রিয় হয়েছিল। গনিদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বৈবাহিক আদান প্রদানের নিদর্শন আছে।
১৯৩৫-৬০-এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরিবহন ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তিত হয়। পাকা রাস্তা তৈরি আর মোটর ও ট্র্যাকের প্রাদুর্ভাবে কারাভানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, গনি বসতিগুলো ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে। পোষা উটদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘তারা’ বুনো হয়ে ওঠে, সংখ্যাও খুব বেড়ে যায়। গত শতকের শেষ দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার ঊষর অঞ্চলে জল ও খাদ্যসম্পদের জন্য বুনো উটরা সভ্য মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে খরার সময় লোক বসতি বাঁচাবার জন্য বেশকিছু বুনো উটকে খতম করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষে অস্ট্রেলিয়ার ঝোপঝাড় আকীর্ণ উষর ভূমিতে উটেরা বিপন্ন বোধ করে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তারা আশেপাশের মনুষ্য বসতিতে দলে দলে ঢুকে পড়তে থাকে। জনবসতিতে খাদ্য ও বিশেষত জলের সংকট দেখা দেয়। ৮ই জানুয়ারি ২০২০-এ ‘ পশুমঙ্গলের সর্বোচ্চ নির্মাণের সঙ্গে সংগতি’ (in accordance with the highest standards of animal welfare) রেখে কল্যাণমুখী অস্ট্রেলিয়ান সরকার পাঁচদিন ধরে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে বুনো উট মেরে ফেলে। খতিয়ানের হিসাবে মতভেদ আছে, তবে রকমফেরে সর্বোচ্চ মৃত সংখ্যা দশ হাজার, আর সর্বনিম্ন মৃত সংখ্যা পাঁচ হাজার।
মনে রাখতে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে উট হেলাফেলা করা পণ্য নয়। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে অস্ট্রেলিয়ার উট সরবরাহ করে, ‘কোরবানি’তে উটের চাহিদা বাড়ে। উদ্যোগপতিরা টিনে ভরতি উটের দুধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পাঠায়, ওই দুধে দই ভালো জমে। পুঁজির আবর্তিত পথে পণ্য ব্যবহারের রীতি বদলে যাওয়া স্বাভাবিক। উট আমদানির দেশটি উট ও এই প্রাণিজাত খাদ্য রফতানির দেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।১৬
উপর্যুক্ত তথ্যবিবৃতি চমৎকার পশুকাহিনির উপজীব্য হতে পারে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মনুষ্যপ্রজাতি অন্য প্রজাতির প্রাণিকূল ঝাড়ে বংশে নিকেশ করে, এই কথা পূরণও। ২০২০-এ পূর্বাপর সম্বন্ধানুসারে মনুষ্য প্রজাতির সামূহিক ও রাষ্ট্রিক দাপটের শিকার উট বলে নির্দিষ্ট প্রজাতির বিশেষ এই কাহিনি তো কৃতঘ্নতার এক ক্লিন্ন ইতিবৃত্ত। কিন্তু সেই ইতিবৃত্তে উটেরা বিষয়, বিষয়ীর বোধ ও চৈতন্যের ঐকান্তিক বর্গে তাদের কথা বিধৃত। ভিন্ন প্রজাতিরূপে উটেদের আর্তি উচ্চারণ কী, সেটাকে সামান্য ধরতে পারার এন্টেনা কি মানুষের ভাষা চৈতন্যে আছে? আদৌ থাকা সম্ভব?১৭
রচনার মাঝে মাঝে দীপেশ ‘conjoined histories’ বা ‘সংযোগ-সম্বন্ধী ইতিহাসাবলি’ লেখার উল্লেখ করেছে।১৮ গ্লোবাল বিশ্বের মানুষের দৌড় আর গ্রহজাগতিক বিশ্বে মানুষের যাত্রাকাহিনির মাত্রা ও গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। এই দুই ভিন্ন মাত্রা ও প্রকৃতির সংযোগ কোন ভরবিন্দু নির্ভর? সমস্যাটি অনুবাদের মাধ্যমে দীপেশের জবানিতে পেশ করছি, মূলটিও পাদটীকায় আছে।
ভূ-পদার্থী শক্তি হিসাবে আমরা নিজেরা কখনোই সরাসরি অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে পারব না। অথচ আমরা জানি যে আমাদের সামূহিক অস্তিত্বের (collective existence) সাধন প্রণালিসমূহের মধ্যে অন্যতম ওইটি (ভূ-পদার্থী শক্তি স্থিতি) … এই অমানবিক শক্তিসদৃশী মানুষের সাধন স্থিতি আমাদের বলে যে আমাদের মানুষী জীবনটা আর কোনো সহজ সত্তাগুণে [কেবলমাত্র] বিভূষিত নয়। মানুষের অস্তিত্ব তো সত্তাবোধে লগ্ন। সেটা অনস্বীকার্য। ...কিন্তু এই গ্রহে ভূ-পদার্থী শক্তি হতে গিয়ে আমরা আরেক ধৰনের সামূহিক অস্তিত্বের রূপও বিকশিত করেছি. সেই রূপটার কোনো সত্তাময় মাত্রা নেই। সেই রূপটাকে বোঝার জন্য এখন নিজেদের চিন্তার সম্পর্কেও স্ব-চিন্তা আমাদের বোধব্যাখ্যার ক্ষমতাকে চূড়ান্ত সীমায় ঠেলে দিয়েছে। মানুষকে নিয়ে চিন্তার সত্তাবোধরহিত পন্থার নানা প্রয়োজন আমরা বোধ করছি।১৯
সত্তার ভাবনা তো মানুষেরই ভাবনা, সত্তাময় মানুষের পূর্ণ ভাষা আছে, ইতিহাসের জ্ঞান তো ভাষাময়, সব জ্ঞানই ভাষায় অনুবিদ্ধ। সত্তারহিত অ-মানবিক মানুষের কথা বলা হয়েছে, তার ভাষা কী? চিন্তার সাধনপ্রণালি কী? অ-মানবিক যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে বর্ধিত সামূহিক অস্তিত্বের কোটি ও সত্তাময় চিন্তক মানুষের জীবকোটির মধ্যে ছিলার গুণ টানতে গেলে ধনুকটাই ভাঙবে কিনা? রচনার মধ্যে আবহবিদ ও ঐতিহাসিকের ভাবনার ‘আদান-প্রদান’-এর কথা দীপেশ বলেছেন, আবহবিদের সমাবেশে বৈজ্ঞানিকদের প্রবন্ধাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সবের ভাষাতে সত্তাময় মানুষের উদ্বেগের কথা বলা আছে, জীব ও জীবনের সব টানাপোড়েনেই একেবারে মানুষী চিন্তনের বর্গে ধরা আছে। সত্তাময় মানুষী সামূহিক অস্তিত্ব ও সত্তারহিত অমানুষী সামূহিক অস্তিত্ব কী কী শর্তে একীকৃত হবে, বা পরিপূরক হবে, বা অনসত্তামূলক চিন্তার আকার কী? দীপেশের অনুসন্ধিত ‘সংযোগ-সম্বন্ধী ইতিহাসবলি’ বৈশ্বিক, কান্ট ও হানা আরেন্টের অর্থেই সার্বত্রিক মানুষের আস্তিত্বিক স্থিতির আধার। গ্রহজাগতিক কালে ও ভুবনে মানব এবং অ-মানবের সম্পর্ক ক্ষেত্র সগুণ বা নির্গুণ, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর দীপেশের জানা নেই, ফলে আসন্ন ইতিহাসের চারিত্রিক প্রত্যাশাও একটু ধোঁয়াশা থেকে যায়।২০ উষ্ণায়ন পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যায় জর্জরিত মানবসমাজ। এই প্রস্থানভূমির উপর দাঁড়িয়ে দীপেশের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। গ্লোবাল মানুষের অস্তিত্ব ও চৈতন্যে ঢুকে পড়েছে আরেক বস্তুসত্য, প্লানেট বা গ্রহরূপী জগৎ, তাকে পরিত্যাগ করে আধুনিক মানুষের অবস্থান ভাবা ও বাঁচিয়ে রাখা দুষ্কর। নতুন নৃতত্ত্ববিদ্যার সন্ধিৎসায় এই সমস্যাটি দীপেশের মতো ভাবুককে প্রণোদিত করেছে। এই ভাবনা উপস্থাপনের নান্দী-প্রশ্নটি ইমানুয়েল কান্টের, দীপেশ বইতে উচ্চারণ করেছে, মূল ভাষাতেও প্রশ্নটি পেশ করা হয়েছে, ‘মানুষ কী?’ (Wast ist der Mensch?)২১
এই জিজ্ঞাসা চকিতে আমার মতো পাঠকের মনে গত শতকের শেষে আরেকজন চিন্তাবিদের লেখাকে মনে করিয়ে দেয় ‘মানুষের অন্তর্ধান’ নিয়ে মিশেল ফুকোর বিবরণ স্মরণীয়। ইউরোপীয় প্রবোধনের কেন্দ্রে থাকা বিষয়ী মানুষের রূপটি ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রতার্কিক সম্বন্ধে দানা বেঁধেছিল, সম্বন্ধের কুলজিটা দেড়শ বছরের পেছেনে যায়নি। গত শতকের শেষে ফুকোর রচনাপাঠ প্রভুমন্য পাশ্চাত্যের জ্ঞানভিত্তির অবয়ব গড়ে ওঠার নিহিত প্রক্রিয়াকে আমাদের কাছে উন্মোচিত করেছিল, আধুনিকতার আদর্শায়িত মানবতাবাদকে ফর্দাফাই করতে সক্ষম হয়েছিল। সমুদ্রের বেলাভূমিতে আঁকা জ্ঞানগর্বী বিষয়ী সভ্য মানুষের ছবি আসন্ন ঢেউয়ের ধাক্কাতেই অচিরে মুছে যাবে, এই ছিল তাঁর বহুল পরিচিত ভবিষ্যৎবাণী।২২
ফুকোর বিখ্যাত জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্দর্ভ লেখার পর দেখতে দেখতে ষাট বছর চলে গেছে। নবায়িত নৃতত্ত্ববিদ্যার সন্ধানী আলোকে অন্য মানুষী সত্ত্বা বা মানুষী সত্তার ‘অতিরেক’ (‘more than human’)-এর রূপ-ছবিকে হাজির করার দাবি উঠছে, চিন্তার দিগন্তে পট-পরিবর্তন ঘটছে। দীপেশের মতে, তার লেখা বইটি মানবিক অস্তিত্বের নতুন শর্তগুলি খুঁজে বার করবার যৌথ অঙ্গবিশেষ। হিউমানিস্ট চিন্তার নবায়ন এভাবেই হতে চলেছে।২৩
বইটিতে ‘উত্তরকথন’ বলে একটি অংশ যোজিত আছে, ব্রুনো লাতুর ও দীপেশের কথোপকথনে মাঝে মাঝেই নতুন ঐতিহাসিক দিগন্ত (vista)-এর প্রত্যাশা আছে, মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক তথা মানবিক শৰ্তের সদর্থক গুণচিন্তা আছে। দুইজনের আলাপচারিতা ‘নাস্তি’তে শেষ হয়নি।
আলাপচারিতায় দুই ‘চিন্তক’ই ‘গাইয়া’ (gaia) বলে একটি ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন, ধারণাটির কোন তারে তারা টান দিচ্ছেন, সেটা আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়।২৪ ‘গাইয়া শব্দটি গ্রিক পুরাণ থেকে নেওয়া, পরিবেশবাদীদের আলোচনায় বহুল ব্যবহৃত। ওই ‘গাইয়া’র খোপে পরিদৃশ্যমান জগতের প্রতি বিস্ময়, ভয়, শ্রদ্ধা জাতীয় অনুভূতির উদ্রেকের কথা দীপেশ বলেছে। ওর মতে, ‘গাইয়া’র বোধমুহূর্ত ‘কাব্যিক’ (poetry)। দুই ভিন্ন বৈশ্বিক জগতে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক স্থিতির মেলবিন্দু পাওয়া গেলেও যেতে পারে গাইয়ার মৌহূর্তিক ‘অনন্য’ (singularity) উপস্থিতির আস্বাদিত অভিজ্ঞতায়।২৫ এই বক্তব্যই পাঠক হিসাবে আমি বুঝেছি। ভুল বুঝতে পারি, অন্য পাঠক ভিন্নভাবেও বুঝতে পারেন।
উপর্যুক্ত বোঝার সূত্রে ভারতের একজন বাংলাভাষী পাঠক হিসাবে আমি একটি চিন্তাপ্রক্ষেপ করছি, ‘ঋত’-এর বর্গ পেশ করছি। ‘গেইয়া’ আর ‘ঋত’ হুবহু সমার্থক নয়, তবে সদৃশ।২৬ নিয়ম ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থার অনুশাসনে গ্রজাগতিক বিশ্ব আবর্তিত হয়। এই তত্ত্বটি অবশ্য আধুনিক জীববিজ্ঞান ও আবহবিজ্ঞান দ্বারা আদ্যন্ত শোধিত ও হালনাগাদ নয়, কিন্তু একেবারে বাতিল হবার ঝুড়িতেও পড়েনি। ঋতবাদীদের মতে, মানবসত্তা বিশ্বপ্রকৃতির প্রাণময় সত্তার অংশ, সেই অংশ হয়ে ওঠা ও থাকার গতিপথই ঋতের পন্থা। ঋতপথের রাহি মানুষ নিসর্গনিষ্ঠ। ব্যক্তিসত্তায় ওই মানুষের জাগতিক সব অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে প্রকৃতি অনুভব করে। সেটাই তার পরম প্রাপ্তি। ঋতে আস্থা থাকলে ইহজগতে গ্রাহ্য কোনো না কোনো ভাষার মধ্যেই ব্যক্তি দেহেন্দ্রিয় সন্নিকর্ষজাত পদার্থের জ্ঞানে ‘সমষ্ঠিরূপ অভিব্যক্ত জগত’কে মান্যতা দেয়। ঋতের চিন্তা বা বোধই মানবিক চৈতন্যকে জগন্ময় করে তোলে।২৭
ভারতীয় চিন্তন ও সামাজিক অভ্যাসের রীতি-নীতিতে ইতিহাসের সামান্য ছাত্র হিসাবে ঋতবাদের স্বাক্ষর প্রকীর্ণভাবে ছড়িয়ে আছে, দেখতে পাই। ঋতবাদী ঈপ্সা উচ্চারিত হয় যজ্ঞ বা উৎসবের মন্ত্রোচ্চারণে।২৮ জাতকমালার বোধিসত্ত্ব তো পশু-পাখি তথা জীবসত্তায় ছড়িয়ে থাকেন, ঐ অসংখ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণিসত্তার উদবোধনের যাত্রাপথে বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। রামায়ণের আদিশ্লোক ও মহাভারতের নানা গল্পে জীবগতের প্রতি আনৃশংসতার আচরণকে সহনীয় মানবিক চিত্তবৃত্তি বলে তুলে ধরা হয়েছে। আনৃশংসতার নীতি বিপর্যয়েই তো যুগবিপর্যয়ের সূত্রপাত।
তথ্যবস্তুর নিরিখে জানা যায় যে মোগল আমল থেকে পারিপার্শ্বিক নিসর্গে মনুষ্যেতর প্রাণি ও জড়বস্তুদের স্থিতি অধিকার রক্ষার পক্ষে কৃষিজীবী বিশনিয়া সম্প্রদায় সদাসচেতন, তাদের কৌমসর্ব ঋতবাদী চিন্তায় প্রোথিত। এই কয়েক বছর আগে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার মামলায় বিশনিয়ারা বলিউডের নামজাদা অভিনেতাদের নাজেহাল করেছে। বিজ্ঞানের সাবুদ জানা নেই, তবে ঋতবাদী চিন্তনের পক্ষে জনসমাজের ক্রিয়াকর্মের সাক্ষ্য প্রচুর।
এই ব্যবহারিক সাক্ষ্য অনুসারে ইতিহাসবোধ ও সময়চেতনা ঋতবাদী আকারে লেখা হতে পারে। বাংলা লেখালিখির জগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঋতবাদী আকারের একজন সেরা নকশাকার। তাঁর এই গোত্রীয় নানা রচনার মধ্যে ‘খুঁটি-দেবতা’ নামে একটি স্বল্প আলোচিত রচনার উল্লেখ করছি। ঘোষ-পাড়া বলে বাংলার অজ অঞ্চলে এক তুচ্ছ লোকবিশ্বাস ও প্রবাদ কাহিনি নিয়ে বিভূতভূষণ গল্পটি ফেঁদেছিলেন। বিষয়, বাঁশের খুঁটির মতো প্রাণহীন জড়বস্তুর প্রাণে অতিশায়িত হবার কথা। হোলমত্তা-শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা নন্দলাল গরিব, তাঁর অল্পবয়সী বউটা স্বভাবে সাদাসিধে। পরিবারের দুঃসময়ের সম্বল বলতে বউয়ের কাছে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া কিছু গহনা ছিল। সবার অজান্তে নন্দলালের আশ্রয়দাতা লোভী ও প্রতাপী মামাশ্বশুর রাঘব চক্রবর্তী বউটির গহনা হাতিয়ে নেয়। তক্তাপোষের বাঁশের খুঁটির কাছে অসহায় ‘নিরক্ষরা বিকৃতমস্তিষ্কা গ্রাম্য বধূ’ অন্যায়ের বিহিত করার জন্যে আবেদন জানাত। অবস্থা বিপাকে নন্দলাল বউকে নিয়ে কারখানায় কাজ করতে যায়। ‘হাঁফ ছেড়ে’ রাঘব চক্রবর্তী বাড়ি মেরামতের কাজে লেগে পড়েন, কাশীতে তীর্থযাত্রার সংকল্পও করেন। এই সুখের সময়ে তার চোখে ঘুম আসে না, অনিদ্রায় দিনরাত ছটফঠ করেন। স্বপ্নে দেখেন সেই বাঁশের খুঁটি ‘বিকটাকার মূর্তিতে’ আঙুল তুলে রাঘবকে ব্যঙ্গ করে চলেছে। ভয়ে ও অনুশোচনায় কারখানায় গিয়ে ভাগ্নে-বৌকে তিনি গহনা ফেরত দেন। ওই খুঁটি দেবতার প্রসাদে পরিবারে পর প্রজন্মের এক ক্যান্সার আক্রান্ত পুত্রবধূ সুস্থ হয়; তখন বাঁশের খুঁটিটি শ্যামরায়ের ‘কমনীয় তরুণ দেবমূর্তি’র আকারে বউ-এর দিকে ‘মৃদুহাসিমুখে’ চেয়ে ছিল। একেবারে সহজ বিশ্বাসের গল্প, খুব একটা বস্তুবিজ্ঞান সম্মত নয়। বিভূতিভূষণ আখ্যানটি সেভাবেই লিখেছিলেন। গল্পের প্রতিটি স্তরে বিস্ময়, ভয় ও শ্রদ্ধার অনুভূতির সুর অনুরণিত, ঋতবাদী আবেদনের মন্ত্রে কাহিনিটি সিদ্ধ। ওই খুঁটি-দেবতার আবাহনে জড় ও জীব হাত ধরাধরি করে, গ্রহ-পৃথিবী’র (planetary earth) স্থিতি মানুষী লোকবিশ্বের সহগ হয়ে ওঠে।২৯
গাইয়ার একটি বীক্ষণে মানুষ উপর থেকে নীচে দেখে (top-down
approach), ‘স্পেসশিপ’ বা গ্রহযানে বসে পৃথিবীকে দেখা ‘আউটসাইড-ইন’, বীক্ষণটি সামগ্রিক, জীবন ও জড় একাকার।৩০ ভারতীয় ঋতবাদের সহজসাধনে খণ্ড দেখা ও অখণ্ড দেখার সহ-অবস্থান আছে। এমনকি একটি দেখা আরেকটির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট। অখণ্ডের বিবর্ত খণ্ড খণ্ড জীবরূপ, জৈনরা সেই তালিকায় সব প্রজাতির অণু-প্রাণকেও সসম্মানে স্থান দেন। সহজপন্থে ‘গ্রাউন্ড আপ’-এর ধারণাটি হাজির হয় ‘উজুবাট’-এর রূপে, একেবারে উজান বাওয়া। দর্শক এই যাত্রাপথে জীবজগতকে চৈতন্যের পথে আনে, দেহভাণ্ডেই তার ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান হয়। দ্বৈত বনাম অদ্বৈতের টানাপড়েনে মায়া বা লীলার খেলায় প্রাকৃত বৃন্দাবনের গোষ্ঠে স্থিত পাহাড়, গাছপালা, বিষধর সাপ, ঝড়-বৃষ্টি সবই অপ্রাকৃত সত্তায় হাজির হয়। এই লীলার খেলার দোলাতেই চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাসের কাব্য পদাবলীর রস আমরা আস্বাদন করি। মানবিক ও অমানবিক দুই স্তরেই রস আস্বাদন চলতে পারে।৩১ গাইয়ার অনন্যতা (singularity) তো কাব্যিক অনুভূতি বোধে, এমন একটা কথাই তো দীপেশ তার আলাপচারিতার শেষে জানিয়েছিল।
মানবিক ও অ-মানবিক ভুবনের মধ্যে গতায়াতের সম্ভাবনার চিন্তা দীপেশের বইতে আলোচিত হয়েছে। সম্ভাবনার চরিত্র নিয়ে বিতর্ক থাকবে। তবে ইতিহাসবিদ্যাচর্চার দিগন্তে এহেন চিন্তা কার্যকারণ পরম্পরা সিদ্ধ ইতিহাসবিজ্ঞান ও কাব্যিক-গল্পকথায় ঋদ্ধ ঐতিহ্যচেতনার সীমানা ভেঙে দিতে পারে, চৈতন্যের অতিরেকে বিবরণই হয়ে উঠবে বিশ্লেষণ। ঐতিহাসিক বাস্তবতা কাব্যিক অতিশয়িতায় ব্যঞ্জিত হবার জন্য ক্ষণে ক্ষণে দাবি জানাবে। ভারতীয় ঋতবাদের হার্দিকতায় ইতিহাসবোধের যে কোনো গোত্রান্তর যেন স্বাগত।
পাদটীকা
১। দীপেশ চক্রবর্তী, মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, সমর সেন স্মারক বক্তৃতা (কলকাতা: অনুষ্টুপ,২০১৮) পৃ. ১৮-১৯। উপর্যুক্ত রচনার পাশাপাশি দীপেশের চিন্তার অভিমুখের দিকবদলের হদিস আছে, সাম্প্রতিক ইতিহাস ভাবনাঃ আমার ইতিহাসের আলপথ ধরে (কলকাতাঃ তালপাতা, ২০১৫) নামক নিবন্ধে।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দীপেশ অনেকদিন ধরে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে লেখালেখি করছে। প্রথম লেখার খসড়া বাংলা ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। দুয়েকটি বাহবা পেলেও বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে তেমন কোন আগ্রহ সঞ্চার হয়নি। অথচ পাশ্চাত্যের একাডেমিতে দীপেশের চিন্তা বিষয়গুণে তর্কের সমৃদ্ধ পরিসর খুলে দিয়েছিল। তার অভিজ্ঞতার কথা বিধৃত আছে একটি বইতে, Dipesh Chakraborty, 'Introduction', The Crises of Civilization: Exploring Global and Planetary Histories(New Delhi, Oxford University Press,2018) [CC বলে নির্দেশিত] পৃ. xxxiii।
২। দীপেশ চক্রবর্তী, মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭, ৪৪-৪৭।
৩। Amitav Ghosh, The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable (Chicago: Chicago University Press, 2016) . মণীন্দ্র গুপ্ত, ‘পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান, গদ্যসংগ্রহ (কলকাতা, অবভাস, ২০০৭), পৃ. ৮১-১৪০। ‘ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা-এর উদ্বেগ সুন্দর ফুটে উঠেছে জয়ন্ত বসুর লেখা প্রবন্ধে, ‘ গ্যাস চেম্বারেরপথে পৃথিবী? আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯।
৪। এহেন গোত্র প্রথমেই মনে আসে Rachel Carson- এর জগদ্বিখ্যাত বইয়ের কথা, The Silent Spring(1962)। DDT- এর মতো রাসায়নিক কীটনাশক কিভাবে জীবজগৎ ও প্রাণীবৈচিত্রের ছন্দ ধ্বংস করছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ বইটিতে বিধৃত আছে। বৃহৎ শিল্পপতিরা লেখিকার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হন। অন্যপক্ষে, আমেরিকা জুড়ে রচনাটি পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন ভাবনার জন্ম দেয়, Garry Kroll- এর মতো ঐতিহাসিকের চোখে, 'RC's silent spring played a large role in articulating a subversive subject as a perspective that cuts against the gain of materialism, scientism and technologically engineered control of nature'. Wikipedia. ‘অর্ন্তঘাতমূলক বিদ্যা কিভাবে একবিংশ শতকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার প্রধান ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে, সেটি অনুসন্ধিৎসার বিষয়। জ্ঞান চর্চা ও পরিবেশবাদী আন্দোলনে রাচেল কারসনের বৈপ্লবিক অবদান চিরস্মরণীয়।
৫। মূলত ভূ-তাত্ত্বিক শাস্ত্রবিদ্যার সুবাদে পার্থিব পরিবেশ চর্চায় শব্দগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যেমন,পৃথিবী বলে গ্রহটির বিবর্তনের কালপঞ্জিতে বর্তমান সময়ে পর্বের তকমাটি হল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বোলোনায় ভূতাত্ত্বিকদের কংগ্রেসে অভিধাটি গৃহীত হয়েছে। শব্দটি গ্রীক ভাষা জাত। Holos-->whole, koiros --> new অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন। শেষ তুষার যুগের অবসানের পরে উপর্যুক্ত কালপর্বে মানুষ প্রজাতির জন্ম থেকে পারমাণবিক সভ্যতার বিকাশ ঘটে। বর্তমানে এই যুগের ছায়াতেই আমরা বাস করি।
Anthropocene শব্দের মূলও একটি গ্রিক শব্দ। Anthropos -->Anthropo--> নর বা মানুষ, koiros --> cene --> new - নতুন বা সাম্প্রতিক। নৃকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক যুগ বোঝাতে anthropocene শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোন আন্তর্জাতিক ভূ-বিদ্যা সম্মেলনে সর্ববাদী সম্মতরূপে এখন শব্দটি যুগ নাম হিসেবে গৃহীত হয়নি। তবে বৈজ্ঞানিক মহল থেকে পরিবেশবিদদের আলোচনায় শব্দটি বহুল প্রচারিত। পৃথিবীর পরিবেশ, আবহাওয়া ও জীবজগতের উপর মনুষ্য প্রজাতির সামূহিক সর্বাতিশ্রয়ী আধিপত্য এই পর্বের লক্ষণ। পৃথিবীতে অধুনা ভূ-পদার্থী শক্তি হিসেবে মানুষ প্রজাতি বিরাজ করছে। ১৯৪৫ সাল থেকে পারমাণবিক শক্তির দাপটে ও জেনেটিক্স তথা জীন তত্ত্ব ও প্রযুক্তির ব্যবহারে পার্থিবজীব ও জগতের উপর মানুষের খবরদারি দুর্মর হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিতে এই বিপুল ক্ষমতা বৃদ্ধি বা 'Great Acceleration', ‘দুরন্ত গতিময় বলে বিশেষায়িত করা হয়েছে।
প্রাগুক্ত শব্দগুলির অর্থ বিচার ও তাৎপর্য নির্ণয় নিয়ে নানা আলোচনা আছে। আগ্রহী পাঠকের জন্য একটি সহজলভ্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ, Ian Angus, Facing the Anthropocene: Fossil Capitalism and the Crisis of the Earth System (New Delhi: Aakar Books, 2016), Christophe Bonneuil and Jean-Baptiste Fressoz, The Shock of the Anthropocene: The Earth, History and US (NY: Verso, 2016)
৬। CHPA, p 18-19
৭। ‘Interview: Dipesh Chakraborty on how climate changes upends long standing ideas of modernity’, Scroll, July 11, 2021. গ্রহ জাগতিক সময় পর্বে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভূ-ব্যবস্থা বিজ্ঞান চর্চার ধারা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন, উপর্যুক্ত সাক্ষাৎকারটিতে দীপেশ এই মত ব্যক্ত করেছে। এহেন শাস্ত্রে বিজ্ঞানের একদা ছাত্র দীপেশের পড়াশোনার নিবিড় পরিচয় ধরা পড়েছে, ‘Anthropocene time’ শিরোনামাঙ্কিত অধ্যায়ে, CHPA pp 155-182।
৮। 'Global Reveals the Planetary', 'A conversation with Bruno Latour' Postscript CHPA, p.215. প্রাগুক্ত।
৯। দীপেশ চক্রবর্তী, ‘ আরেক টোয়েন্টি টোয়েন্টি: পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও মানুষের ইতিহাস’, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স,২০১০) পৃ. ২৩ পৃ.৩৮-৪০। এই রচনারই ইংরেজি রূপ দীপেশের বহুচর্চিত প্রবন্ধ, ‘Climate of History: Four Thesis, Critical Inquiry, 35:2, pp.197-222।
১০। মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, ঐ, পৃ. ৩৬-৪০
‘বুড়ো আংলা’য় আকাশবিহারী রিদয়ের দৃষ্টি তথা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টির ঝোঁক বিচারে দীপেশের মতের সঙ্গে আমার মতের বৈমত্য আছে। ‘বুড়ো আংলা’ গল্পে হাঁসের পিঠে আকাশচারী রিদয় পার্থিব ভেদকে পূর্ণ মর্যাদা দেয়, মটকা বসা কুঁকড়োরা উড়ন্ত হাঁসদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়, উত্তরগুলি সব সবিশেষ। রিদয়ের দর্শনে ও মননে একেবারে বিশেষণ মাফিক আলাহিদার নানা খুপরি তৈরি হচ্ছে,
‘কোন ঘাট?’ ‘সাঁকের ঘাট - গুগলি ভরা।’
কোন হাট? ‘উলোর হাট - খড়ের ধুম।’...
‘কোন আবাদ?’ ‘নসীরাবাদ - তামুক ভালো।’...
‘কোন দীঘি?’ ‘রায়দীঘি - পানায় ঢাকা।’
‘কোন খাল?’ ‘বালির খাল - কেবল চড়া।’...
‘কার বাড়ি?’ ‘ঠাকুর বাড়ি।’
‘কোন ঠাকুর?’ ‘অবিন ঠাকুর - ছবি লেখে।’ ‘কার কাচারি?’
‘নাম করো না, ফাটবে হাঁড়ি।’
(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ বুড়ো আংলা’, রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড
(কলকাতা: প্রকাশ ভবন, ১৯৭৬), পৃ.১৫৫
উপর থেকে নিচে দেখার এই বিবৃতিতে আকাশবিহারী দর্শনের ফ্রেমে নানা ভেদেই অঞ্চলগুলির বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল, বৈপরীত্যের টানে ভরপুর, এক বাড়িতে অবন ঠাকুর ছবি আঁকেন আর ওই সংবাদের ঠিক পরেই কাছারির নামে হাঁড়ি ফাটে, ইশারা তো কাফি হ্যায়। অবশ্যই কাল্পনিক বিহার, কিন্তু গগনচারী রিদয়ের দেখায় ভূমণ্ডলের একীকরণ উদ্দেশ্য নয়, বরং প্রকৃতি ও জীবের বহুধা সংযোগের সংস্কৃতির মধ্যে প্রাণের ইচ্ছাসত্তা ও ক্রিয়াসত্তার নানা ভিন্ন প্রকাশের নির্বাধ উদযাপনই তো বুড়ো আংলা’র মর্ম। সেই অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়াতেই তো নিষ্ঠুর অভিশপ্ত রিদয় প্রাণময় নিসর্গে তার মনুষ্যত্বটি ফিরে পায়।
CHPA-তে দীপেশ অবন ঠাকুরের উল্লেখ করেনি, ভাষাভেদ ও পাঠকভেদে উপস্থাপনার রীতিতে রকমফের হওয়া স্বাভাবিক।
১১। CHPA pp.81-85
১২। CC, pp.242-243, CHPA, pp. 19-20, 91-93।
‘নবদর্শন ঋদ্ধ নৃতত্ত্ববিদ্যা’ বা এক্ষেত্রে নিছক নৃ- কূলবিদ্যা বা ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি নিয়ে বিদ্যাচর্চা বোঝায় না। বরং ইমানুয়েল কান্টের সংজ্ঞার্থে শব্দটির তাৎপর্য বোধিত হয়েছে, ‘ মানুষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিষয়ক তত্ত্বনীতি’। 'a systematic ...doctrine containing our knowledge of man' Introduction, Anthropology from a Pragmatic point of view (1798). দ্রষ্টব্য, Howard Caygill, A Kant Dictionary (Oxford: Blackwell, 1995), pp. 73
১৩। CHPA, pp 188-190
১৪। CHPA, pp. 194-196, 198-204.
৩০-এর দশকে এক বিখ্যাত পত্রিকায় রূপকথায় পরি ও ভূতুড়ে গল্প নিয়ে মাতামাতি করার বিরুদ্ধে এক প্রাজ্ঞ চিন্তক ও সম্পাদক আপত্তি জানান; উদ্দেশ্য সৎ, জুজুর ভয় ও মিথ্যা জ্ঞান থেকে সরল শিশু মনকে মুক্ত রাখা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি নামে প্রবন্ধ সংগ্রহে (১৯৩৫) বুদ্ধদেব বসু বক্তব্যটিকে তুলোধোনা করেন। শুদ্ধির নামে, যুক্তি দোহাই দিয়ে এহেন ফতোয়াধর্মী বক্তব্য বিস্ময়, হর্ষ ও আতঙ্কের মতো অনুভূতি থেকে শিশুর মনকে বঞ্চিত করে, বিচিত্র কল্পনার জগতের স্বাদকে ভোঁতা করে দেয়।
বিভূতিভূষণের মনের দৃষ্টিপ্রদীপে তো অন্য এক ভুবন সবসময়ই হাজির থাকতো। নদীর তীরে সেই জগৎ থেকেই মধুসুন্দরী দেবী তারানাথের কাছে আসতেন, নিবিড় প্রেমে লিপ্ত হতেন, আবার ভয়ংকরী রূপ দেখাতে দ্বিধা করতেন না। মানুষী ও অমানুষিকের অণ্বয়ে দেবী সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা তারানাথের জীবনের এক সংক্ষিপ্ত পর্বকে অনন্য করে তুলেছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় গল্প’, বিভূতি রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, (কলকাতা; মিত্র ও ঘোষ, ১৮০১), পৃ. ১৮২-১৯৫।
সমাজতত্ত্বের একটি বিচার অনুযায়ী আধুনিক জগতকে অ-বিমোহিত বা disinterested বলা হয়। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোক ও উত্তাপে আমাদের দৈনন্দিনতা থেকে সব কুহক বা মায়াই উবে গেছে, অন্য ভুবনে বিশ্বাস থাকা তো কুসংস্কার। অথচ ইতরত্ব (অপরত্ব) বা ভিন্নাশ্রয়ী বোধ না থাকলে কোলো সত্তা বা জগতই তার সসীমত্ব ও অসসীমত্বের টানাপড়েনকে বিবৃত করতে পারে না। এক লোকের অবস্থানকে ধরার জন্যই অ-লোককে আহ্বান করতে হয়। দুটি নজির হাজির করছি।
Provincializing Europe -এর মতো সুপরিচিত বইতে একটা সুন্দর কথা-কণিকা দীপেশ পেশ করেছিল। গত শতকে কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস আয়ারল্যান্ডের লোককথা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলো। কার্যসূত্রে মিসেস কনোলি বলে এক বয়স্ক মহিলা ইয়েটসকে নানা লোককথা বলেন। বৈঠক শেষে ইয়েটসের প্রশ্নের উত্তরে কনোলি জানিয়ে দেন যে পরিদের অস্তিত্বে তিনি ঘোর অবিশ্বাসী। বিদায় নিয়ে ইয়েটস চলে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কনোলি ফুকরে ওঠেন, ‘কিন্তু তারা আছে, মি. ইয়েটস, তারা আছে। Dipesh Chakrabarty, Provincializing Europe (New Jersey: Princeton University Press, 2000), pp. 111-112.
আমাদের মতো বাঙালি পাঠকের কাছে অংকের নামজাদা প্রফেসর আর প্রচণ্ড নাস্তিক মহেশ মিত্তির একেবারে অপরিচিত নন। ভুতের থাকা বা না থাকা নিয়ে প্রিয় সহকর্মী হরিনাথ কুণ্ডুর সঙ্গে হাতাহাতি করে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে ভূতের অনস্তিত্ব নিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ লেখককে প্রতি বৎসর পুরস্কার দেবার জন্য ফান্ড তৈরি করে তিনি লিখে যান, অছি হরিনাথ কুণ্কুডু। গভীর রাতে মহেশের শেষযাত্রার আয়োজন ঐ হরিনাথই অতি কষ্টে করেছিলেন। শ্মশানের পথে ছুটন্ত খাটের উপরে মহেশের শব দাঁড়িয়ে উঠে লেকচারের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলতে থাকেন,‘ ও হরিনাথ - আছে আছে, সব আছে, সব সত্যি। (‘ মহেশের মহাযাত্রা’, পরশুরাম গ্রন্থাবলী, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: এম. সি. সরকার, ১৩১২)
পরশুরাম পরম যুক্তিবাদী, অপবিজ্ঞান আর বাবাজিদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আত্যন্তিক। তবু লোক ও অ-লোকের মধ্যে বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে গতায়াতের পথ, প্রশ্ন তোলার জায়গাটা তিনি বন্ধ রাখেননি, পরিসর খোলা রেখেছেন। সব অবিমোহনের মধ্যে মানুষকে চারপাশের পরিসরকে প্রাণময় করে তুলতে অমানুষিকতার হাতছানিতে সাড়া দিতে হয়, অন্য ভুবনকে খুঁজতে হয়। ভুবনটি বিজ্ঞানসম্মত না বিজ্ঞানোত্তর, সেই তর্ক ভিন্ন।
১৫। CHPA, pp. 90
১৬। আমার বলা উটকাহিনির তথ্যভিত্তি কাগজের টুকরো খবর বা অন্তর্জালে প্রাপ্ত পশুপ্রেমীদের প্রতিবাদপত্র। মহাদেশের ইতিহাসে নানা বিষয়ধর্মী আলোচনায় উটেদের অস্তিত্বগাথা প্রকীর্ণ হয়ে আছে। Ben Lerwill, ‘The strange story of Australia’s Wild Camel’, BBC Travel. 2018410, 10 April 2018, the Indian Express, 10 Jan, 2020.
সম্প্রতি এক গবেষণা গ্রন্থে সামিয়া খাতুন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অভিবাসনের ইতিবৃত্ত রচনার আদিকল্পে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে দক্ষিণ এশিয়াবাসীদের অবস্থিতি কী ভূমিকা পালন করেছিল, তার বিবৃতি দিয়েছেন । বিংশ শতকের প্রথমার্ধে উটের বাহিনী ও উটের বাহিনী-চালকদের কথা সেই কাহিনীতে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান পেয়েছে। লিপিকুশলতার জোরে স্মৃতিসাক্ষ্য, কথাকণিকা, বটতলা থেকে ছাপা ইসলামি কিস্সা, প্রত্নসাক্ষ্য - সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক বর্ণাঢ্য নকশি কাঁথা বোনা করুণ মানবিক গাথা হিসাবে বইটি গণ্য হতে পারে। Samia Khatun , Australiaramah, The South Asian Odyssey in Australia (Queensland: University of Queensland Press, 2019), pp 107-124.
১৭। ভাষার খেলা বোঝার শর্তগুলি ব্যবহারকারীদের ‘ জীবনযাপনের পটরূপে’ ('form of life’) নিহিত আছে, এই হ্বিটগেনস্টাইনীয় বক্তব্যে আমি আস্থাবান। সিংহ কথা বললেও বলতে পারে, কিন্তু সিংহের কথা আমাদের বোধগম্য হবে না, কারণ সিংহের জীবন যাপন পটরূপ আমাদের অনধিগম্য। তুলনীয়, Ludwig Wittgenstein, Philosophical Investigations, (Oxford: Basil Blackwell, 1961) pp. 223। আলোচনা, Marie Mcginn, Wittgenstein and the Philosophical Investigetions (London: Routledge 1997), pp 51-53
হ্বিটগেনস্টাইন তাঁর ভাবনাকে সুত্রাকারে বিধিবদ্ধ করতেন। ভাষা ব্যবহার ও ভাষাকে বোঝার বিশ্লেষণেও নানা প্রসঙ্গানুসারে হ্বিটগেনস্টাইন রচনায় টুকরো টুকরো ভাবে যাপন পটরূপের কথা উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক বহমান। দ্রষ্টব্য। সবিতা চক্রবর্তী, হ্বিটগেনস্টাইনের দর্শনে যাপনের প্রেক্ষাপট, হ্বিটগেনস্টাইন: জগৎ, ভাষা ও চিন্তন, সম্পাদনা: তুষার কান্তি সরকার ও অন্যান্য (কলকাতা: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি১৯৯৮), পৃ. ১৮৭-২০৬। এই বক্তব্য নিরঙ্কুশ নয়। ভাষার অন্তহীন ক্ষমতার অধিকার প্রাপ্তি ও অধিকারবোধ মানুষকে অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে স্বতন্ত্র গুণে বিভূষিত করেছে, ভাষাজ্ঞানই মানুষের অন্যতার মাপকাঠি, আধুনিক সভ্যসমাজের ধারণাটির কুলজি বিচারের অনুপম আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, David Abram, The spell of Sensuous: Perception and the Language in a More than Human World (NY: Vintage, 1997).
একজন পড়ুয়া হিসাবে বলতে পারি যে বৈমত্য থাকা সত্বেও উপর্যুক্ত বইটি পড়ার আনন্দ অপরিসীম, উপমার প্রয়োগ ঝলমলে, ভাষার স্বচ্ছ, স্বাদু ও বহমান। আব্রাম একসময় পেশায় যাদুকর ছিলেন, গবেষণার কাজে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামে ও নানা ছোট জনগোষ্ঠীতে বাস করেছেন। ফলে গোলকায়িত আধুনিকতার বাইরে জনজীবনে নিসর্গ চেতনা, সম্পর্ক ও ব্যবহার কিভাবে দৈনন্দিনতার নানা স্তরে ছড়িয়ে থাকে, সেই সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর আলোচনার তথ্যভিত্তি। অন্যপক্ষে তিনি অবভাসবাদী (phenomenologist), এডমুন্ট হুসের্ল (Edmund Husselr) ও মরিস মার্লো-পঁটি (Maurice Merlau-Ponty) অনুগামী। নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও অবভাসবাদের চর্চার সমন্বয়ে তার রচনাটির অবয়ব তৈরি হয়েছে।
আব্রামের রচনা দুটি ঝোঁক আকর্ষণীয়। প্রথমত, নিসর্গ (nature) বনাম কৃষ্টির (culture) দা-কাটা বিভাগ চিন্তা মানুষকে পঙ্গু করে তোলে, দুটো পরস্পর-নির্ভর, একটার উপস্থিতি বাদ দিয়ে অন্যটির কথা চিন্তা করা সমীচীন নয়। দ্বিতীয়ত, দেখা ও শোনার সরণিতে মানুষের সংবেদনা পরিদৃশ্যমান জগতের দিকে প্রসারিত হয় । শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শের মাধ্যমে প্রাণীজগৎ ও নৈসর্গিক জড়ভুবনের সঙ্গে মানুষ বলে প্রজাতির শরীরী অর্থেই নানা সম্পর্কে জালে জড়িয়ে পড়ে, ওই জড়াজড়ির সুবাদে আদান-প্রদানেও পারস্পরিক বোধগম্যতা ও সংবেদনশীলতার ভাষাও তৈরি হয়। নৃতাত্ত্বিক পাঠ ও গবেষণার ভাণ্ডার থেকে আব্রাম ভাষা ব্যবহারের নানা নিদর্শন পেশ করেছেন।
ভারতীয় বৈয়াকরণদের ভাবিত সবিকল্পতায় আস্থাবান পাঠক মানুষী ভাষার ব্যঞ্জনার অপরিসীম শক্তিকে মানব বিকাশের অন্যতম বিশেষ শর্তরূপে দেখতে আমি আগ্রহী। কুকুর কামড়ের তীব্র ব্যথা দংশিত মানুষ কিভাবে অদংশিত অনভিজ্ঞ মানুষের কাছে বোধগম্য করবে, হ্বিটগেনস্টাইনের এই কূটাভাস আদৌ ফেলনা নয়। তবে মনুষ্য অতিরেক জগতের ('more than human') সঙ্গে সম্পর্ককে সমস্যায়িত না করে মানবিক অস্তিত্ব বোঝা সম্ভব নয়, এই চিন্তাকে আব্রাম নতুন প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তার উপর্যুক্ত সন্দর্ভে হ্বিটগেনস্টাইন সম্পর্কে আব্রাম নীরব।
(‘More than human') বা মানুষ অতিরেক শব্দবন্ধটি দীপেশের রচনাতেও এসেছে। CHPA, pp. 48 ('the history that gestures to 'we' that may indeed be more than human') ।
আলোচনা প্রসঙ্গে ‘অতিরেক’ শব্দটিকে বেছে নেওয়া সঙ্গত বলে আমি মনে করেছি। ওই শব্দটিতে বেশি, প্রাচুর্য তথা অতিরিক্ত বা অতিশয়-এর দ্যোতনা আছে। ‘অতি এই উপসর্গটি অতিক্রমণ-এর ভাবনাকে আনে। আবার ‘ভেদ, ‘অন্তর’ বা বিশেষ’ বোঝাতেও ‘অতিরেক’ শব্দটি প্রযুক্ত হতে পারে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড, (সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৬৬) পৃ. ৪৫।
১৮। তুলনীয়, সংযোগী ইতিহাসরচনা প্রসঙ্গে দুইজন ফরাসি বুদ্ধিজীবীর বক্তব্যের সঙ্গে দীপেশের মত একেবারে পৃথক। সংযোগী ইতিহাসরচনা প্রসঙ্গে প্রাগুক্ত দুই ফরাসি বুদ্ধিজীবীর (দ্রষ্টব্য টিকা ৫) বক্তব্যের ঝোঁক ভিন্ন। এঁদের ধারণানুযায়ী, কিভাবে গোলকায়িত ভুবন ব্যবস্থা ও গ্রহ পার্থিব ব্যবস্থা নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত হল, সেই ইতিবৃত্ত ধনতন্ত্রের অবয়ব বিকাশ ও পুঁজির বিশ্বচক্রমণের কাহিনিতেই নিহিত আছে। ধনতান্ত্রিক বিকাশের সর্বভুক চাহিদাই মানুষকে সর্বাতিশায়ী আগ্রাসনের দিকে নিয়ে গেছে। ধনতন্ত্রবাদই ভূকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে চরম অর্থে নৃকেন্দ্রিক করে তুলেছে। এঁদের মতে, anthropocene-এর চেয়ে capitalocene শব্দটি বর্তমান সময়কে বোঝার পক্ষে সুপ্রযুক্ত। গ্লোবাল/ প্লানেট ঘিরে দীপেশ চক্রবর্তীর বক্তব্য একটি ‘সর্বগ্রাহী মানবিকতা’র (all inclusive view of humanity) কথা বলে। মনুষ্য সমাজের দ্বন্দ্ব, বৈষম্য ও স্তরবিন্যাস সেই বক্তব্যে স্থান পায় না। পুঁজির সর্বগ্রাসী রূপ ব্রাত্যই থাকে। 'Capitalocene: A Combined History of Earth System and World System', in Christophe Bonneuil and Jean-Baptise Fresso, 221-252। একটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন। ভারতের নিজস্ব পরিবেশ আন্দোলন ও তৎসংক্রান্ত আলোচনা ঝোঁক সম্পর্কে দীপেশ ভালোমতোই ওয়াকিবহাল। বাংলায় লেখা নানা প্রকীর্ণ অনুপ্রবন্ধই সেই সচেতনতার প্রমাণ। দ্রষ্টব্য, দীপেশ চক্রবর্তী, ‘আবহাওয়া-বিতর্কে ভারত, দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি,২০১৩, পৃ.৫৫-৭২। বিগত বছরে করোনা মহামারীতে মানুষের চিরন্তন মৃত্যু অভিজ্ঞতা ও ভিন্নতার মানচিত্র নিয়ে দীপেশের সংবেদনশীল রচনা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অবশ্য এই রচনাগুলির সঙ্গে পরিচয় থাকা উপর্যুক্ত ফরাসি লেখকদের সম্ভব নয়। Capitalocene: A Combined History of Earth System and World System', in Christophe Bonneuil and Jean-Baptise Fresso, 222-252। প্রাগুক্ত।
১৯। CC, pp. 239, পূর্বোক্ত। উদ্ধৃতিটির মূল রূপ,
'But we cannot ever experience ourselves as a geo-physical force - though we know now that this is one of the modes of our collective experiences. ... This non-human, force-like mode of existence of the human tell us that we are no longer simply a form of life that is endowed with a sense of ontology. Humans have a sense of ontic belonging. That is undeniable. ... But in becoming a geo-physical force on planet, we have also developed a form of collective existence that has no ontological dimension. Our thinking about ourselves now stretches our capacity for interpretive understanding. We need non-ontological, ways of thinking about human.'
২০। সমালোচনা ও ও সমস্যা প্রসঙ্গে দীপেশ সচেতন। তুলনীয়, CHPA, pp. 46-48।
২১। CHPA, pp. 20
২২। Michel Foucault, The Order of Things: An Archeology of the Human Sciences (NY: Vintage, 1973), pp 386-387
২৩। Dipesh Chakrabarty,' Humanity's current predicament renews for the humanist the question of the human condition. This troubled book then, joins the effects of our humanists in collective thinking our way toward a new philosophical anthropology', CHPA ..., পূর্বোক্ত।
২৪। ‘গাইয়া’ কথাটি গ্রিক পুরাণ থেকে নেওয়া, আভিধানিক অর্থ -
ভূ-মাতা। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ নিয়ে দ্যাখা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনীয় ‘গাইয়া’র ধারণা। পৃথিবী বা ধরিত্রীর আশ্রয়ে আমাদের জন্ম ও পুষ্টি, সব প্রাণের ধারক এই ধরার ‘ধৃ’ ক্ষমতা। ধরা তো ধৃতি দেবী।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে মঙ্গল ও পৃথিবীর আবহাওয়া নিয়ে তুলনাত্মক আলোচনায় বৈজ্ঞানিক জেমস লাভলক জানান যে, এই সৌরজগতের গ্রহ পরিস্থিতিতে পৃথিবী অনন্য, গ্রহটি একটি সার্বিক প্রাণময় জগৎ। এই জগতকেই তিনি ‘গাইয়া’ নামে অভিহিত করেন, নামটা সাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিং বাতলে দেন। অণু-পরমাণু নিয়ে তৈরি বিচিত্র জড় পদার্থ ও নানা ছোট-বড় জীবকোষে সমৃদ্ধ প্রাণিজগতের সমবায়ে পৃথিবী নামে গ্রহ তৈরি হয়েছে, মানুষী ইচ্ছা অনপেক্ষে এই জগতে ধ্বংস ও নির্মাণের খেলা চলে। পৃথিবী যেন ‘এক আত্মশাসিত জৈবিক ভারসাম্য স্থিত এক ব্যবস্থা’ ('a living self-regulating organism')। এই স্বনিয়ন্ত্রিত গ্রহজাগতিক সত্তার অঙ্গ, প্রাণ ও অপ্রাণ সব কিছুই। প্রথম এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে মোটেই স্বীকৃত হয়নি। ১৯৭৩ সনে মহিলা বিজ্ঞানী লীন মারগুলিস (Lyn
Margulis)-এর লেখা এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রে পৃথিবীর জীবজগতের নানা নিদর্শন নিয়ে লাভলক সেই ‘গাইয়া’ তত্ত্বকে ভূ-বিজ্ঞান ব্যবস্থার ভিত্তি বলে পেশ করেন। তখন থেকেই ‘গাইয়া’ তত্ত্ব পরিবেশ বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্ব পায়। দ্রষ্টব্য, James Lovelock হ্যাঁ, Gaia: A new Look at the Life on Earth, (1979), with a new preface and corrections(NY: Oxford University Press, 2000)
বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে লাভলকের বক্তব্যের বিরোধী অনেকেই। তবে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে চেক প্রজাতন্ত্রের সভাপতি ভাকলাভ হাভেল গেইয়া তত্ত্বের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন, সমাজশাস্ত্রীদের কাছে সেই বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। হাভেল নিজে নাট্যকার, ইউরোপে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ। তাঁর মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসারী এই গেইয়া ধারণায় মানুষের বিজ্ঞানচেতনা ও কল্পচেতনার সাক্ষাৎ হয়। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার আকস্মিক ফল হিসাবে মানুষ হাজির হয়নি। দ্বিতীয়ত, ব্রহ্মাণ্ডে স্থিত জীব ও জড়-এর অংশী মানুষ। গাইয়া ভাবনায় ক্ষুদ্র ও বৃহতের অন্বয় নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হবে, সব প্রাণীই সেই ব্যবস্থার শরিক হয়ে উঠবে। হাভেলের প্রত্যাশা একাধারে বৈশ্বিক, মানবিক ও রাজনৈতিক। Lovelock , প্রাগুক্ত, ix - x।
২৫। CHPA, pp. 207, 211, 216-217. মূল ইংরেজি উপস্থাপনা, ' May be that is reason why Lenton and you bring Gaia back in. The point about its singularity is precisely the point about its poetry. ... It's all this poetry.'
২৬। ‘ঋত’ শব্দটি প্রাচীন বৈদিক ও পরবর্তীকালে ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে নানা দ্যোতনায় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ঋ’ অর্থ চলা, গমন, গতি। এই চলাটা সোজা, আঁকাবাঁকা নয়। এই ধাতুর্থে ‘ঋজু’ শব্দটা সিদ্ধ, ঋজু পথই তো সত্য ও পবিত্র।
‘ঋত’-এর বেদবিহিত অর্থ ‘ বিশ্বব্যাপারের সুনিয়ত কার্যক্রম’, সেই ক্রমের বাঁধনে বাঁধা জড় ও জীবজগৎ। এই নিয়মক্রমের আবর্তনে সূর্য, চন্দ্র, ছয় ঋতু আবর্তিত হয়, বাগানে ফুল ফোটে ও ঝরে, মানুষের প্রাণও এই নিয়মের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রবাহিত হয়। ঋতু রক্ষা ব্যতীত মানুষের প্রজননক্রিয়া সম্ভব নয়। মানুষী কল্পনায় দেবতারা ‘ঋতজাত’, আদিবৈদিক দেবতা বরুণ ‘ঋতপতি’, অগ্নি তো ‘ঋিতের রাখাল’। ঋত বা নৈসর্গিক নিয়মের বিপর্যাস তো অনৃত, অসত্য অপবিত্র। এভাবে নৈসর্গিক ক্রম ও নৈতিক নিয়ম মিলে মিশে যায়।
বিশ্বব্যাপী নৈসর্গিক নিয়মে জারিত জীবজগতের আবর্তনে অহংকে অনুসদৃশ ও অংশী বলে মনে করার ভাবনায় আস্থা থাকাকেই ‘ঋতবাদ’ বলে আখ্যাত করা যেতে পারে। নানা কুলজিসূত্রে লোকজ, দেশজ বা মার্গ সংস্কৃতির নানা প্রকাশে ‘ঋত’-এর ভাব স্ফুতিত হয়েছে, সেই স্ফোটিত অর্থেই ‘ঋতবাদ’ শব্দটি আমি প্রয়োগ করেছি।
শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে অসংখ্য আলোচনা আছে। কয়েকটি সহজলভ্য সূত্র নির্দেশ করা হল। যথা, তারানাথ তর্ক বাচস্পতি, বাচ্যস্পত্যম, তৃতীয় খণ্ড, (দিল্লি: রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থা, ২০০২, পুনর্মুদ্রণ); হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড (নিউ দিল্লি, সাহিত্য অকাদেমি,১৯৭৮); Maurice Bloomfield, The Religion of the Veda: The Ancient Religion of India (New York: G.P. Putman, 1908) pp126-127; Sukumari Bhattacharji, Indian Theogony (Calcutta; Firma KLM, 1978) pp 27-28; রণদীপণ ৱসু, চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন (ঢাকা: রোদেলা,২০১৭), পৃ. ৩৩৫-৩৪৬।
অথর্ব বেদের ভূমি সূক্তে পৃথিবী বন্দনায় ‘ভূ-মাতার’ প্রয়োগ আছে, ‘ভূমে মা, ধেহি...ধেহি ভূত্যামা’ , ভূতি = বিশ্বপ্রকৃতি।
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল ‘ঋত’ শব্দটির মধ্যে ধৃত কল্পনাকে সুন্দর বলেছিলেন। তাঁর মতে ‘বিশ্বপ্রকৃতি বিজ্ঞান যা বিজ্ঞানজগতের অধৈতব্য বিষয় এবং মানব হৃদয়ের অথবা মানব মনের বিধান যা দর্শন, ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় তারই নাম ঋত।’ (বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, নীতি, যুক্তি ও ধর্ম, কলকাতা: আনন্দ প্রকাশন, পৃ. ৫৪। উপর্যুক্ত দুই ক্ষেত্রীয় যোজনায় ঋতের দ্যোতনা সার্বত্রিক হয়। বিজ্ঞান, ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রাদি বিদ্যার চর্চায় ঋত-এর ধারণা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।)
২৭। এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত দুয়েকটি শব্দের জন্য আমি ঋণী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাষাত্মদর্শন (কলকাতা: ধ্যানবিন্দু, ২০১৪) পৃ.৪৬
২৮। ঋত শাসিত জগতে প্রাকৃতিক স্থিতির পটে সব প্রজাতির সঙ্গে মানুষ ধরিত্রীসে সম বাসিন্দা, জীব ও জড়জগতের শরিক - এহেন ঋতবাদীদের মানবিক স্বীকৃতির কাব্যিক প্রকাশ নানা যাজ্ঞিক সূক্তে দেখা যায়। প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম সাধনায় কৌমী মন্ত্র গীতে উচ্চারিত শুদ্ধ ঋতবাদী চেতনায় (‘ঋতচ্ছন্দ ওজক্ষরা’) দুটি সূক্তের কিছু নির্বাচিত অংশ পেশ করছি।
এক বিশ্ববন্দনায় প্রার্থনার শুরু,
যা হয়েছে, হবে-- সবের ঈশানী বিপুল পৃথিবী,
দাওআমাদের সমস্ত- ছাওয়া আলোক-রাজ্য বিরাট লোক
... পৃথিবী, তোমার গিরি অরণ্য,
হিমেল পাহাড় হোক সুরম্য।
পার্থিব ভূ- জগৎ নির্বিশেষে সব জীবের পোষ্টা, সেই পোষকত্বই তো ধর্মমঙ্গল,
... তোমারই গর্ভে জনম সবার, তোমাতেই বিচরণ,
যত দ্বিপদকে চতুষ্পদকে তুমিই কর ভরণ।
তোমারই আপন, হে পৃথিবী, এই মর্ত্য পঞ্চজন-
মানুষ তো মাটির, মাটিতেই জীবন ও জীবনান্ত,
... এই মাটিতেই মানুষ বাঁচে- মাটির মানুষ
অন্নে স্বধায়
সেই মাটি দিন প্রাণ আমাদের
দিন না আয়ু সেই পৃথিবী
বুড়ো হবো সেই অবধি
জড় ও জীবের সমবায়ে এই পৃথিবী, তার প্রাণময় কায়া, মানুষের প্রণতি তাকেই,
এই পৃথিবী - নুড়ি, পাথর, ধুলোমাটি -
শক্ত করে রয়েছে ধরা আঁটিসাঁটি।
সোনায় গড়া হৃদয়খানি তার
করছি তাকে নমো নমস্কার
পৃথিবীটা ‘বহুধা’ গোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে রঙি-বিরঙি,
... নানান ভাষা নানান ধরম মানুষ নানান-তর
পিথিমি তো পালেন সবার যার যেখানে ঘর।...
পৃথিবী নানা প্রজাতির জীবে ভরপুর। ঋতুচক্র অনুযায়ী তাদেরও জীবনচক্র নির্ধারিত।
ও পৃথিবী , তোমার যে সাপ আর মা বিছে, বাপ কি হুল-
শীতে কাবু নিরিবিলি লাগায় ঘুম-
আর যা আছেন পোকামাকড়, বর্ষা এলেই নড়ন-চড়ন
কিলবিলোনি
সর্বংসহা পৃথিবীতে ভালো-মন্দ সবারই জায়গা আছে,
মলিন যা, তা পালেন-পোষেন, তা-ও যা গরীয়ান
পাপীও মরে ভালোও মরে, সহ্য করে যান।
(ঋষি অর্থবার ভূমিসূক্ত, অথর্ব বেধ, ১২/১)
জীবজগতের ঋতের শৃঙ্খলা সার্বত্রিক। ঋতুচক্রে তো প্রাণের ডাক শোনা যায়, যেন লোক উৎসবের অম্বুবাচী,
ঋতু এলে গাছপালাদের
প্রাণ যখন ডাকে
এই মাটিতে যা আছে সব
আনন্দেতে মাতে
ব্যক্ত-অব্যক্তের নধ্যে প্রাণ প্রক্রিয়া বহমান,
প্রাণ সে বিরাট, প্রাণ সে দেষ্ট্রী
উপাসনা করে প্রাণকে সকলে
প্রাণই সূর্য, প্রাণ চন্দ্রমা
প্রাণকে সকলে প্রজাপতি বলে
ভূ-নিসর্গ তো প্রাণময়, উচ্চ ও অধঃ জুড়্ প্রাণের অস্তিত্ব,
প্রাণ ও অপান
যব আর ধান
ষাঁড়কেও বলে প্রাণ।
যবের ভেতরে প্রাণ আছে ভ’রে
ধানকে বলে অপান
মনুষ্য প্রজাতি জগৎব্যাপি প্রাণপ্রবাহের অণুমাত্র,
জন্ম নিচ্ছে যা-কিছু এই যে
যা কিছু নড়ছে- চড়ছে- করছে
সবার মালিক তুমি, হে প্রাণ, তোমায় নম
... অটল অনিদ থাকুক সে -প্রাণ
নিয়ে প্রচেতনা বিপুল বিশাল
আমার সাথের সাথী।
(ঋষি বৈদর্ভী ভার্গভের প্রাণসূক্ত, অথর্ববেদ, ১১/৮)
মূল দুটি সূক্ত ও অনুবাদের জন্য দ্রষ্টব্য: গৌরী ধর্মপাল, বেদের কবিতা (কলকাতা: নবপত্র প্রকাশন, ১৯৮২) পৃ. ১১০-১৩৫, ১৬০-১৭১
লম্বা সব উদ্ধৃতি, ইচ্ছা করেই বড় একটা টীকাতে দিলাম। আগেকার holocene যুগের কবিতা, একাধারে চিন্ময় ও বাঙ্ময়। এই অভিজ্ঞতার শুদ্ধ ধ্বনন anthropocene যুগের কোনো কোনো মননে অনুরণন তুলবে, এই ভরসা রাখা যায়। কারণ সর্বাতিশ্রয়ী ক্ষমতার ফাঁক-ফোকরে আদিম মানবিকতার অস্তিত্ব আধুনিক সমালোচনার ধারণায় দুর্লক্ষ্য নয়। পুনর্গঠন চলতে থাকে, পুরাণ বারবার একালে হাজির হয়।
২৯। বিভূতিভূষণকে সুনীতিকুমার ‘ঋতানুসন্ধানী’ ও ‘ঋতজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছেন। দ্রষ্টব্য, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিভূতি রচনাবলী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ, ১৩৯৯), পৃ. ৩৭।
‘মৌরিফুল’ নামক গল্প সংকলনে আলোচ্য গল্পটি প্রাপ্তব্য। বিভূতি রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, ঐ, পৃ.৩০৬-৩১৫
গল্পটি আগাগোড়া পঠিতব্য। দুটি প্রাসঙ্গিক অংশমাত্র উদ্ধৃত করছি,
‘এই বিশাল মাঠে প্রতিদিন সকাল হয়, সূর্য মাঝ-আকাশে দুপুরে আগুন ছড়ায়, বেলা চলিয়া বিকাল নামিয়া আসে, গোধূলিতে পশ্চিম দিক কত কি রঙে রঞ্জিত হয়।... কিন্তু কখনও কোনো কালে রাঘব চক্রবর্তী বা তাহার প্রতিবেশীরা এই সুন্দর পল্লী প্রান্তরের প্রকৃতির লীলার মধ্যে কোনো দেবতার পুণ্য আবির্ভাব কল্পনা করেন নাই, প্রয়োজনবোধও করেন নাই- সেখানে আজ সর্বপ্রথম এই নিরক্ষরা বিকৃত-মস্তিকা গ্রাম্যবধূটি বৈদিক-যুগের মন্ত্রদ্রষ্টা বিদূষীর মতো মনে-প্রাণে খুঁটি-দেবতার আবাহন করিল।’ (ঐ, পৃ. ৩১০)।
বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা বিভূতিভূষণ সেইভাবে করেননি, বিশ্বাসই সব। গল্পটির শেষ তো এইভাবে,
‘বিশ্বাসী মানুষের রোগ সারে, হয়তো বধূটির তাহাই ঘটিয়াছিল। হয়তো সবটাই তার মনের কল্পনা। রাঘব চক্রবর্তী যে বিরাটাকায় পুরুষ দেখিয়াছিল সেও তার অনুতাপবিদ্ধ মনের সৃষ্টিমাত্র, হয়তো-কারণ খুঁটির মধ্যে দেবতা সেই সেই রূপেই তাহার সম্মুখে দেখা দিয়াছেন যার পক্ষে সে রূপের কল্পনা স্বাভাবিক।
সত্য মিথ্যা জানি না - কিন্তু খুঁটি-দেবতা সেই হইতে ওই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ হইয়া আছেন। (ঐ, পৃ. ৩১৫)।
৩০। Lovelock, xxi - xxvi প্রাগুক্ত।
৩১। এইখানে একটু ফুটকাটা দরকার। দীপেশের রচনায় বিমোহন (enchantment) ও অবিমোহন (disenchantment) ও পুনর্বিমোহন (reenchant)-এর কথা আছে। গ্রহজাগতিক-এর সঙ্গে কীভাবে মানুষ নানা স্তরে হার্দিকতা স্থাপন করবে, আকন্দ আর গেঁড়ি-সুসনীরা মানুষের জীবনচর্চার অংশী হবে, সেই স্বীকৃতি অবশ্যই ভাবনার। লালনের গীত, রবীন্দ্রসংগীত বা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হলেই গ্রহ-জগতের পরিমণ্ডলে সর্ব প্রাণীর বোধন ঘটবে না, ঘটা সম্ভব নয়। এমত বলাও উদ্দেশ্য নয় যে ব্রজের রাখাল বালক হতে পারলেই নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক নিভিয়ে দেওয়াটা কাজ। কিছু ঋতবাদে সব প্রাণের নিবিড় বন্ধনের কথা আছে, সেই কথার ঈপ্সাকে জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে টানাপড়েনে উঠে আসা আধুনিক নানা পরিপ্রশ্নের মধ্যে জিইয়ে রাখতে হবে।
৩২। কারণ সভ্যতায় বস্তু-প্রগতির অন্যতম প্রধান জিকির তো ‘নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র’। সেই জিকিরের মধ্যে অযান্ত্রিকের স্বর শোনানোর আবশ্যকতা ঋতবাদের চর্চার মধ্যে পাওয়া যেতে পারে, এটাই বক্তব্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
এই রচনাটি মুসাবিদা করার সময় পরিবেশ তথা উন্নয়ন সংক্রান্ত বিতর্ক থেকে উত্থাপিত নানায় ইংরেজি শব্দবন্ধকে বাংলায় লিখতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছি। বারবার ঠেকে গেছি। অবশ্যই গ্লোবাল, প্লানেট, অ্যানথ্রোপসিন, ক্যাপিটালোসিন শব্দগুলিকে প্রতিবর্ণায়ন করে স্বচ্ছন্দে বাংলায় লেখা যায়। বেঙ্গলিশও বাংলার বিশিষ্ট বাগধারা, ক্ষেত্রবিশেষে জোরদার ও বোঝনদার।
তবু সাবেকি আমলের চিন্তানুযায়ী কিছু শব্দের পারিভাষিক দ্যোতনা বাংলা ভাষার অনুসঙ্গে ভাববার চেষ্টা করেছি বা প্রয়োগ করেছি। বাংলা ভাষায় globalisation-এর চালু প্রতিশব্দ ‘ বিশ্বায়ন’। এই শব্দটির নিরঙ্কুশ ব্যবহার আমার কানে বাজে। ভারতীয় ভাষায় ‘বিশ্ব’ শব্দটির ব্যঞ্জনা ব্যাপক। ঐ শব্দে নিহিত আছে নিখিল ও অশেষের ধারণা, বেদান্ত দর্শন পৃথক পৃথক শরীরে প্রবিষ্ট অনুচৈতন্যের পারিভাষিক নাম বিশ্ব। বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি কানে ভাসে, ‘ আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান... ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে...।’ কৃত্রিম উপগ্রহ. আন্তর্জাল প্রযুক্তিনির্ভর সর্বগ্রাসী একীকৃত জগতকে নানা প্রাণবিশিষ্ট অসংখ্য জীবশরীরের স্বেচ্ছাময় সমবায় বলে স্বীকার করতে আমি কুন্ঠিত বোধ করি, বরং এহেন জগতকে প্রযুক্তির কেজো দাপটে বতুল পিণ্ড বলেই আমার মনে হয়েছে। তাই globalisation বলতে আমি গোলকায়ন প্রতিশব্দটি ব্যবহার করেছি। 'Global world' ‘গোলকায়িত পৃথিবী বা ভুবন’ পরিভাষাটিকে সঙ্গত মনে করেছি।
তার আলোচনায় দীপেশ বারবার দুটি শব্দবন্ধ এনেছে, 'global world' ও 'planetary world'। ভূ-বিদ্যার সূত্র ধরে 'planetary'-এর প্রতিশব্দ আমি ‘গ্রহজাগতিক’ করেছি। মুসাবিদা করার পর মনে হচ্ছে যে, গ্রহজগত-এর মধ্যে সৌরজগতও ব্যঞ্জিত হয়। শব্দটিও বড়। ‘ গ্রহ-পৃথিবী’তেই জড় ও জীবনময় জগৎ বোঝায়। ‘ গ্রহ-পার্থিব ব্যবস্থা’ বা 'planetary earth system' পরিভাষাটিও ব্যবহার করা যায়। 'Anthropocene’ নিয়ে বিতর্ক হবার প্রেক্ষিতে ইতিহাসচর্চার ভাষায় 'geological turn' বা ‘ভূ-তাত্ত্বিক মোচড়’ আসাটা স্বাভাবিক।
পরিভাষাকে জনগ্রাহ্য হতে হবে, কোনেরকম গোঁড়ামি থাকা কাম্য নয়। তবে প্রত্যেক ভাষার রওয়ানিতে শব্দের অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনার নিজস্বতা বিবেচ্য। নানা সমার্থক শব্দের মধ্যে ব্যঞ্জনার নিরিখে একটি বিশেষ পরিভাষা নজর কাড়তে পারে। মতান্তর শিরোধার্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
রচনাটি পরিমার্জনের জন্য সাব্বির আজম, দেবরাজ ঘটক ও দেবর্ষি তালুকদারের কাছে আমি ঋণী।
Dipesh Chakraborty
১. The Climate of History in a Planetary Age, New Delhi; Primus Books, 2021
২. The Crises of Civilisation Exploring Global and Planetary Histories; New Delhi; O.U.P; 2018