সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
অম্লান বিশ্বাস
ভারতের স্বাধীনতা এলো ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা এলো বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে কেটে দু'ভাগ করে। পঞ্জাব প্রদেশ ভাগ হওয়ার অভিজ্ঞতা আগে না থাকলেও বাংলা প্রদেশ আগেও একবার বিভক্ত হয়েছিল । ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ইচ্ছায়। প্রতিবাদের প্রাবল্যে তা প্রত্যাহৃত হয় ছ’বছর বাদে। সেই প্রতিবাদের ক্ষেত্রভূমি হিসেবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের সুনাম অর্জন করে বাংলার নেতৃত্ব। যদিও তখনও বাঙ্গালীদের একটি অংশ বাংলা ভাগের পক্ষেই ছিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের অভিঘাত এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সরকার তার সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়। নতুন কৌশল এসেছিল ভারতীয় রাজনীতিতে। আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী ধারণার সফল প্রয়োগ। অথচ তার চল্লিশ বছরের মধ্যেই, স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত আগে বাংলায় আন্দোলন সংঘঠিত হল, পরিচালিত হল - ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার জন্য। প্রথম বাংলা ভাগের সময় বাঙালির যে শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, শেষ এবং স্থায়ী বাংলা ভাগের জন্যও সেই শ্রেণীর মানুষেরাই আন্দোলন সংঘঠিত করেছিলেন। তারা সমাজে সম্মানিত এবং ভদ্রলোক হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
এই প্রেক্ষাপট স্বাধীন ভারতের বিশেষত্ব বাংলার নাগরিকদের সকলেরই জানা। তবুও স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ঢাকঢোল পেটানো সশব্দ সময়ের নিভৃত ফোকরে মূলত বাংলা ভাগের অব্যবহিত আগের ঘটনাক্রম ফিরে দেখার জন্য এই লেখার আয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ সরকার বুঝে যায় যে, তাদের পক্ষে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই । তাদের পক্ষে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব নয় । ইংল্যান্ডে নব-নির্বাচিত ‘লেবার’ গভর্মেন্ট তাদের পূর্বতন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে ১৯৪৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করে যে, জুন, ১৯৪৮-এর মধ্যে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
এই ঘোষণাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি উল্লেখ করেন যে ভারতবাসী নিজেরাই ঠিক করুক তাদের সরকার এবং সংবিধান কেমন হবে এবং ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতার উল্লেখ করে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেন। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় হিসেবে পাঠানো হয়। বিভিন্ন কারণে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য লন্ডন আগ্রহী ছিল।
ইতিমধ্যে ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনে মুসলমান জনগণ মুসলিম লীগের পক্ষে রায় দেবার ফলে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আপোষ মীমাংসায় লীগ ও জিন্নাহকে উপেক্ষা করা লন্ডন বা দিল্লির পক্ষে সম্ভব ছিল না । সুতরাং আলোচনার জন্য একটি ত্রিপাক্ষিক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলো - ব্রিটিশদের পক্ষে কথা বলার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে নিয়ে।
বাংলার জন্য এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা কংগ্রেস এবং হাই কমান্ডের টানাপোড়েনের শেষে তখন বাংলা কংগ্রেস শিখণ্ডীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাংলার মুসলমান নেতাদের কেন্দ্রের আলোচনায় কার্যকরভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয় । তাছাড়া চল্লিশের দশকের শুরু থেকে প্রাদেশিক সরকারের দুর্বল ভূমিকার জন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে এসেছিল।
আবার জিন্নার সাথে বাঙালি মুসলমান রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল সন্দেহপূর্ণ। সুতরাং জিন্নাও বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ বা দাবিকে অগ্রাধিকার দেবেন সেটা ভাবাও বাতুলতা।
কংগ্রেস হাইকমান্ড যখন দেশবিভাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাই তখন বাংলা কংগ্রেস তাদের দৃঢ সমর্থন দিয়েছিল। হিন্দু বাঙালিরা স্থায়ীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শাসনে থাকার অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল দৃঢভাবে।
১৯৩৭ সালে কংগ্রেস হাইকমান্ড নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া প্রদেশগুলোতে এককভাবে সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং কোয়ালিশন নীতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । যে সব দল নির্বাচনী ঐক্য করেছিল তাদের কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যেতে বলা হয়। যুক্তপ্রদেশে জিন্নাহর নেতৃত্বে লীগ ১৩৪ আসনের মধ্যে ২৭ টিতে জয়লাভ করে। বাকি আসন কংগ্রেস পায়। কিন্তু নির্বাচনী ঐক্য অস্বীকার করে কংগ্রেস বলে সরকারে যোগ দিতে হলে তাদের কংগ্রেসে যোগ দিতে হবে। এই নীতি বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসের শরৎ বসু, কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের অনুমতি চান । কিন্তু হাই কমান্ড তা প্রত্যাখ্যান করে ।
একটা সময় ভারতের কোন অংশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা কংগ্রেস নেতৃত্ব ভাবতেও পারতেন না। ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কোনো আশা নেই, সেই অংশগুলিকে ছেড়ে দিতে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে । সুতরাং দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
গান্ধী অনুগামী দেবচন্দ্র ঝা-এর বয়ানে - ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে তখনই গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের বিরোধের সূত্রপাত । স্বাধীনতা যতই নিকটবর্তী হতে থাকে এই বিরোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশদের সঙ্গে দেশভাগ নিয়ে কোন চুক্তিতে না আসার জন্য গান্ধীর জেদ, শুধু জিন্নার হাতে ক্ষমতা দিয়ে ব্রিটিশ চলে যাক, এমনসব কথায় কংগ্রেস নেতারা যারপরনাই ক্ষুব্দ্ধ ও মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা শ্রেয় মনে হয়েছে সেটাই করেছে।
আর গান্ধী জীবনীকার প্যারেলালের দৃষ্টিতে, ‘স্বাধীনতার কিছুদিন আগে থেকে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া এই নেতাদের চিন্তায়, আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটে গেল আমূল পরিবর্তন । তারা তখন অন্য কক্ষপথের পথিক এবং মাউন্টব্যাটেনই হলেন সেই কক্ষপথের কেন্দ্র। কংগ্রেস নেতাদের তখন মাউন্টব্যাটেন উপযুক্ত ছাত্র হিসেবে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন - গান্ধী নয়, শুধু এদের সাথে আলোচনা করেই কর্তব্য স্থির করতে হবে’।
এটা সবাই জানেন যে, এটলির লেবার পার্টি ১৯৪৫-এ ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় আসার পর ব্রিটিশদের ভারত নীতির আমূল পরিবর্তন হয় । ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের সময় চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিল ভারতকে ফলপ্রসূভাবে যুদ্ধে ব্যবহার করার। ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি তিনি কোনোভাবেই সামনে আসতে দেন নি। তিনি মনে করতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘ মুকুটের উজ্জ্বলতম রত্ন’ ভারতকে স্বাধীনতার অর্থ হলো ইংরেজ জাতির পক্ষে চরম বিপর্যয়। গ্রেট বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর চার্চিল ভারত বিষয়ক নীতি ঘোষণা করেছিলেন এই বলে যে, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানে পৌরহিত্য করবার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিনি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সময়েও তিনি তার ঘোষিত ভারত নীতিতে অটল ছিলেন। তার নিজের ডেপুটি ক্লিমেন্ট এটলি, চীনের জেনারেল চিয়াং কাইশেক এবং এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও তার মত পাল্টাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
চার্চিলের এই গোঁড়া ভারত বিদ্বেষে সমর্থন যুগিয়ে ছিলেন আরও দুই ইংরেজ রাজপুরুষ। একজন দিল্লিতে ভারতের বড়লাট লর্ড লিনলিথগো আর অন্যজন ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ স্টেট লিওপোল্ড আমেরি। লিনলিথগোর মত ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পারস্পরিক বিরোধ কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের পুরনো প্রভাব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা। লিনলিথগো এবং আমেরির এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন ক্লিমেন্ট এটলি এবং তিনি বিশ্বযুদ্ধে চীনকে পাশে পাওয়ার যুক্তি উল্লেখ করেন।
এই সময় চিয়াং কাইশেক ভারতে গিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি ভারতে গিয়ে গান্ধী এবং নেহরুর সাথে পরিচিত হয়ে এই মুহূর্তে যৌথ লড়াইয়ে ব্রিটেনকে সহযোগিতার অনুরোধ করতে চান। ব্রিটিশ রাজদূত চীন থেকে পৃথক বার্তায় এও জানান যে, আমেরিকার ফিলিপিনসকে স্বাধীনতা দেবার পর চীনারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বৃটেনের ভারতকে স্বাধীনতা না দেবার জন্য। তারা বৃটেনের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
এই খবরে চার্চিল অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে চিয়াং কাইশেককে লেখেন যে, গান্ধী ও নেহেরু ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনের বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের সংগে দেখা করতে হলে চিয়াং কাইশেককে জিন্না, দলিত প্রতিনিধি এবং রাজন্যবর্গের সাথেও কথা বলতে হবে।
ব্রিটিশরা বাধ্য করলো চিয়াং কাইশেককে জিন্নার সঙ্গে কথা বলতে। তিনি গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন চীনে ফিরে যাবার পথে কলকাতায় । চিয়াং ব্রিটিশদের এই চাল বুঝতে পারলেন। তিনি ভারত থেকে বিদায় নেবার সময় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে গেলেন যে, তিনি আশা করেন যে তার মিত্র ব্রিটিশ আর কোন কালবিলম্ব না করে ভারতকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করবে।
এই সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেঞ্জি কিং ব্রিটিশ সরকারকে এক বার্তায় জানান যে চিয়াং কাইশেক মনে করেন ভারতে হিন্দু- মুসলমান বিরোধ অত্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে এবং এখুনি ভারতকে স্বায়ত্তশাসন না দিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং তিনি এই মত আমেরিকাকেও জানিয়েছেন। কিন্তু চার্চিল এ ধরনের পরামর্শে কর্ণপাত করেননি। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে জানালেন যে, জাপানের আক্রমণের আশঙ্কার মুখে তিনি ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে অরাজকতার ভিতর ঠেলে দিতে পারেন না। রুজভেল্ট অবশ্য জানালেন যে, ‘আমার ব্যক্তিগত মত হল যে ভারতবর্ষে আপাতত একটা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হোক এবং সেই সরকারে সমস্ত জাতি, ধর্ম, দল, অঞ্চল সকলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকুক’।
নানা দিক থেকে চেষ্টা সত্বেও চার্চিল ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সফল হলেন । বেশ কয়েক বছর পর যুদ্ধপরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এটলি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন এবং বললেন যে, ‘তিনি যেন ভারতে গিয়ে এমন ব্যবস্থা করেন যাতে ব্রিটিশ স্বার্থ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকে - যেমনটি ডারহাম করেছিলেন কানাডার ব্যাপারে’।
এই বিষয়ে গান্ধী, রুজভেল্ট এবং চিয়াং কাইশেককে বিস্তারিত চিঠি দিয়েছিলেন।
মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, যদি তারা ডোমিনিয়ন হিসাবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে যোগ দিতে রাজি থাকে তবে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং কংগ্রেস নেতাদের ভারত ভাগের প্রস্তাবেও রাজি করিয়ে ফেললেন।
ভারত ভাগ রুখতে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানোর ইতিহাসে গান্ধীর বক্তব্য ছিল, ‘দেশকে অরাজকতার মধ্যে রেখেই ব্রিটিশ বরং এদেশ ছেড়ে চলে যাক। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করলে যে ভয়ংকর পরিণাম আমাদের ভোগ করতে হবে তার তুলনায় এটা বরং শ্রেয়।
কিন্তু ততদিনে কংগ্রেস তার এতদিনের ঘোষিত নীতি থেকে সরে এসে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে । এমনকি পাঞ্জাবকে হিন্দু ও মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাগ করার দাবিও জানিয়েছে এবং তা ১৯৪৭-এর মার্চে ভারতের শেষ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসবার আগেই । এ বিষয়ে প্যারেলাল বলেছিলেন, - এ ধরনের ঘটনা কিছুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে মনে হতো। গান্ধীজির সঙ্গে পরামর্শ না করে কংগ্রেস নেতৃত্ব কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে গান্ধীর প্রশ্নের উত্তরে নেহরু লিখলেন - তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে পাঞ্জাব ভাগের দাবি এখনই জানানো দরকার, কেননা বাস্তব পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে আর সম্ভব নয়। আসলেই জিন্নার পাকিস্তানের দাবির এটাই হবে সমুচিত জবাব। আর সরদার প্যাটেলের জবাব ছিল - আপনাকে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা কষ্টকর, তবে এটুকু জানিয়ে রাখি যে তাড়াহুড়ো করে কিছুই করা হয়নি।
তবু গান্ধীজী মাউন্টব্যাটেন দিল্লিতে আসার পর তাকে পরামর্শ দেন - বড়লাট যেন সাহসের সঙ্গে সত্যের মুখোমুখি হন, সত্য মেনে কাজ করেন, তার ফলে ইংরেজ চলে যাবার পর যদি শোচনীয় জীবনহানি হয় - হবে। ১৯৪৮-এর জুন মাসে ইংরেজ শাসনের অবসান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই দেশভাগ যাতে না হয় তার জন্য গান্ধীজী কয়েকটি প্রস্তাব দেন। সেগুলি হল:
—সরকার গঠনের ভার জিন্না যদি চান তাকেই দেওয়া হোক।
—ক্যাবিনেটের সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করার দায়িত্বও তাকেই দেয়া হোক।
—জিন্না যদি এতে রাজি থাকেন, তবে কংগ্রেস সবরকমভাবে তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ সমগ্র ভারতের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী না হয়।
—ভারতের সামগ্রিক স্বার্থে কাজ হচ্ছে কিনা তার বিবেচনার ভার ব্যক্তিগতভাবে মাউন্টব্যাটেনের হাতে থাকবে।
—ক্যাবিনেটে মুসলিম লীগ ও সহযোগীদের হয়ে জিন্নাকে আশ্বাস দিতে হবে যে তারা সমগ্র ভারতে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবেন।
—ন্যাশনাল গার্ড বা অন্য কোনরকম বেসরকারি সেনাদল রাখা চলবে না।
—উপরোক্ত কাঠামোর মধ্যে থেকে জিন্না যদি চান, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই তাঁর পাকিস্তান- প্রস্তাব ক্যাবিনেটের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে পারেন। অবশ্য তাকে শক্তির সাহায্যে নয়, যুক্তির সাহায্যে, কোনরকম চাপ সৃষ্টি না করে সমস্ত প্রদেশের অনুমোদন নিতে হবে ।
—প্রাদেশিক বিধানসভাগুলিতে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও লীগের প্রস্তাব বিবেচনার সময় সেই গরিষ্ঠতার সুযোগ না নিয়ে দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে খোলা মনে তা বিচার করবে । আর দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে মাউন্টব্যাটেন নেবেন ।
—আর জিন্না যদি এই দায় নিতে অস্বীকার করেন তবে উপযুক্ত রদবদল করে কংগ্রেসকে সেই দায়িত্ব দেয়া হোক।
লর্ড ওয়াভেলকে যে কথা গান্ধীজী বলেছিলেন ১৯৪৬-এ, তাই বললেন মাউন্টব্যাটেনকে - যদি অরাজকতার মধ্যে দেশটাকে ছেড়ে দিতে না চান তবে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ, যে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হাতে গোটা দেশের শাসনভার দিয়ে যান।
তবে গান্ধীজী এই শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হলো আর ব্যর্থ হলো ভারতকে অখণ্ড রাখার চেষ্টা । গান্ধীজী আস্থা রেখেছিলেন ভারতের সাংস্কৃতিক ও সহনশীলতার ঐতিহ্যের উপর । তাঁর বিশ্বাস ছিল, ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করার পর ভারতবাসী এই কাজে নিশ্চিতভাবে সফল হব । কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের সে আস্থা ছিল না । সরদার প্যাটেল বড়লাটকে এমন কথাও বললেন - অখণ্ড ভারত নিয়ে গান্ধীজী ইদানিং যা বলছেন তার প্রতি গুরুত্ব দেবার কোনও দরকার নেই।
যেভাবে দেশভাগের আয়োজনে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সূচনা হলো তাতে গান্ধীজী এই পর্যায়ে সমস্ত উৎসব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য চলে এলেন বাংলায় ।
২
এইবার বাংলার দিকে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৩৬-৩৭ সালের নির্বাচনে হিন্দু ভোট ভাগ হয়েছিল কংগ্রেস ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। কিন্তু ১৯৪৫-৪৬ সালে হিন্দুরা সুস্পষ্টভাবে ভোট দেয় কংগ্রেসকে। ১৯৩৬-৩৭ সালে যেখানে কংগ্রেস ৮০টি আসনের মধ্যেই মাত্র ৪৮টি এবং বিশেষ হিন্দু আসনের মধ্যে ৪টি আসন পেয়েছিল সেখানে ১৯৫৫-৪৬ সালে কংগ্রেস পায় ৭১টি সাধারণ আসন আর ১৫টি বিশেষ আসন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বর্ণহিন্দুদের সর্বসম্মত দল হিসাবে পরিগণিত হয়। এমনকি তপশিলি সম্প্রদায়ের আসনের মধ্যে কংগ্রেস শতকরা ৮০ ভাগ আসনে জয়ী হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ আসন থেকে ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী জয়লাভ করেন । হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এই বিপুল বিজয়কে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের জয় হিসেবে দেখলে ভুল হবে। তার প্রমাণ পরবর্তীকালে পাওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিক ফলাফলে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ক্ষমতা লাভ করে । মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ১১৩টি আসন আর অন্যান্যরা জয়লাভ করে ৫১ টি আসনে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সুরাবর্দী সরকার গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন।
এর ফলে হিন্দু বাঙালিরা অত্যন্ত হতাশ হন। ৪২-৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হিসেবে সুরাবর্দীর কথিত দুর্নীতির জন্য হিন্দু জনমনে তিনি ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন । সংবাদপত্রের লেখালেখিতে দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য সুরাবর্দীকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুরাবর্দী বাঙালি হিন্দুদের ভীতি দূর করতে প্রায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। মন্ত্রিসভায় হিন্দু-মুসলমান সমতার যে নীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সুরাবর্দী বাতিল করেন। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ১৩ থেকে কমিয়ে ১১ করেন, আর হিন্দু মন্ত্রীর সংখ্যা কমিয়ে ৩ করেন, এবং ৩ জন হিন্দু মন্ত্রীর ২ জনকে তপশিলি সম্প্রদায় থেকে গ্রহণ করেন।
এরপর মুসলিম লীগের ঘোষিত ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’, ১৬ আগস্টে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং কলকাতার রাস্তায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হন। ফলে মুসলমান সরকারের শাসন বাংলাকে পাকিস্তান বানানোর পথে নিয়ে যাবে এই বিশ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুদের মধ্যে গেঁড়ে বসে। অখণ্ড বাংলার একজন মুখ্য প্রচারক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনিও ১৯৪৬-এ তাঁর মত পাল্টান। মুসলমান শাসনের থেকে দেশ বিভাগ ভালো এই ধারণা হিন্দুদের মধ্যে ততদিনে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
১৯৪৪ সালে রাজাগোপালাচারী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সমন্বয়ে পাকিস্তানের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলে শ্যামাপ্রসাদ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু ১৯৪৬-এ তার অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে যায়। সুরাবর্দী সরকারের অপরিণত উদ্ধত কার্যকলাপ এবং ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা হিন্দু মানসিকতা ওলটপালট করে দেয়। তারা এই ঘোষণাকে নিজেদের অস্তিত্বের সংকট হিসাবে গ্রহণ করে। আর তার বিরুদ্ধে আমরণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়।
এই পরিপেক্ষিতে কুখ্যাত কলকাতা হত্যাযজ্ঞ (The Great Calcutta Killing) সংঘটিত হয়। হিন্দু মুসলমান উভয় পক্ষই যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে একে অপরের হত্যালীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্তচক্ষু হিংস্র গোষ্ঠী-চেতনায় ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো, নিঃশেষে বিলুপ্ত হলো সৌভ্রাতৃত্বের একদা ঐতিহ্য। এরপর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধারাবাহিকতায় নোয়াখালিতে ঘটে গেল পরিকল্পিত গণহত্যা। স্বদেশী আন্দোলন, স্বাধীনতার বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলনের বিপুল অর্জন যেন রাতারাতি বিনষ্ট হয়ে গেল। হারজিত-বিহীন নরমেধ যজ্ঞে বলি হয়ে গেল অসংখ্য প্রাণ। বহু দিন বাদে ব্রিটিশ আবিষ্কার করলো – এখন আর তাদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন নেই। নোয়াখালির রামগঞ্জ এলাকার এম এল এ গোলাম সারওয়ারের ক্রমাগত উস্কানি ও নেতৃত্বে ১০ অক্টোবর ১৯৪৬ শুরু হল গণহত্যা। এই আক্রমণ, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, ধর্ম পরিবর্তন, অগ্নিকান্ডের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হিংসা টানা দশ দিন চলতে থাকে।
মহাত্মা গান্ধী এই খবরে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সহায় সম্বলহীন এই মানুষদের পাশে দাঁড়াবার জন্য ৭ নভেম্বর ১৯৪৬ থেকে ২ মার্চ ১৯৪৭ পর্যন্ত নোয়াখালিতে অবস্থান করেন। মানবতার শ্মশাণভূমি নোয়াখালিতে তিনি গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন ধ্বস্ত মানুষের হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন আক্রমণকারী গোষ্ঠীর হৃদয়ে মানবতাবোধ সঞ্চার করতে। তার এই প্রচেষ্টায় নোয়াখালিতে ইতিবাচক সাড়া পড়েছিল।
এই ঘটনা প্রবাহের মাঝে কিছু মানুষ এর বিরুদ্ধে যুক্তবাংলার ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন শরৎ বসু। তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন এবং বলেন - ধর্মীয় ভিত্তিতে প্রদেশের বিভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের ভিত্তি হতে পারে না। কিন্তু অনতিবিলম্বে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রদেশ কংগ্রেসের কেউ শরৎ বসুকে সমর্থন করেননি। কিছুদিনের মধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ভারত ভাগ সমর্থন করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাশ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই Constituent Assembly’র বাংলার ১১ জন হিন্দু সদস্য মাউন্টব্যাটেন এর সঙ্গে দেখা করে ‘ ভারত ইউনিয়নের মধ্যে পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় পৃথক ও স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশের দাবি জানান’। শেষ পর্যন্ত যুক্ত-বাংলার ভাবনা আর দানা বাঁধেনি। বাংলা অবিভক্ত রাখার পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস হয়ে যায়।
রেডিও, খবরের কাগজ, সরকারি প্রচারপত্র, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ভারতবাসী জেনে গেল যে দেশ বিভক্ত হচ্ছে । প্রত্যন্ত এলাকার অসংখ্য প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ সেই খবর পেলেন অনেক পরে । দুই প্রান্তেরই অসংখ্য মানুষ দাঙ্গা, মৃত্যু আর উৎখাতের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে মাটিতে তাদের জীবনযাপন সে মাটি আর তাদের দেশ নয়। যারা রেডিওর কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলেন তারা ৩ জুন, ১৯৪৭-এর সন্ধ্যেবেলা খবর পেলেন ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত হবে অখণ্ড ভারত বর্ষ।
বাউন্ডারি কমিশন গঠিত হলো ৩০ জুন। সিরিল রাডক্লিফের নেতৃত্বে। রাডক্লিফ ভারতে পৌঁছলেন ৮ জুলাই, শেষ পর্যন্ত ৩৮০০ মাইল সীমানা নির্ধারণ করতে।
ইতিমধ্যে মাউন্টব্যাটেনের বিবৃতি মত বাংলা এবং পাঞ্জাবে প্রাদেশিক বিধানসভা দুটি আলাদা অংশ মিলিত হবেন। মুসলমান সংখ্যাধিক্যের জেলাগুলি একত্রে এবং বাকিরা আলাদা। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন প্রদেশে ভাগ হবে কিনা।
পাঞ্জাব বিধানসভার অধিবেশন মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না, কিন্তু বাংলা বিধানসভায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। বাংলা বিধানসভায় প্রথমেই মুসলমান এবং হিন্দু সংখ্যাধিক্যের জেলাগুলির যৌথসভা হয়। সেই সভা পরিচালনা করেন স্পিকার নুরুল আমিন । সেখানে ১২৬ জন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেন আর ৯০ জন তার বিরুদ্ধে ভোট দেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বর্ধমানের মহারাজার সভাপতিত্বে হিন্দু প্রধান জেলাগুলির সভায় ৫৮ - ২১ ভোটে বাংলাভাগের প্রস্তাব পাশ হয়, আর মুসলমান প্রধান জেলাগুলির সভায় ১০৬ - ৩৫ ভোটে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে প্রস্তাব পাশ হয় । কিন্তু হিন্দুপ্রধান জেলাগুলির ফলাফল জানার পর মুসলমান প্রধান জেলাগুলির সভায় ১০৭ - ৩৪ ভোটে পাকিস্তানে যোগ দেবার প্রস্তাব পাশ হয়।
ইতিমধ্যে বাউন্ডারি কমিশনের কাছে বাংলার দাবি জানাবার জন্য AICC-র পক্ষ থেকে একটি coordination committee তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কংগ্রেস ছাড়া সেই কমিটিতে হিন্দু মহাসভা, New Bengal Association (Major General A.C. Chatterjee) এবং Indian Association-কে সামিল করা হয়। এই কমিটির সম্পাদক করা হয় নির্মল কুমার বসুকে। নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর সহকারি হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য কাজকর্মের ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে। সভাপতি নিযুক্ত হন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন - অধ্যাপক বিনয় ব্যানার্জি, সমর রায়, ডাক্তার প্রমথনাথ ব্যানার্জি, বঙ্কিম মুখার্জি, অধ্যাপক এস এন বসু, রায়বাহাদুর চুনিলাল রায়, সনৎকুমার রায় চৌধুরী, অধ্যাপক হরিচরণ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, এস. এন. মোদক, রায় বাহাদুর বি. বি. মুখার্জি এবং ডাক্তার এস. পি. চ্যাটার্জী। আচার্য জেবি কৃপালনী ২৩ জুন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এই ঘোষণা করেন। এই কমিটির প্রথম সভা হয় ২৯ জুন। পরবর্তীকালে এন. সি. চ্যাটার্জী, পি. বি. মুখার্জি এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
কিন্তু এই কমিটি শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে একটি দাবিপত্র বাউন্ডারি কমিশনের কাছে জমা করতে পারেনি। নির্মল কুমার বসু বহু চেষ্টা করেও ঐক্যমত গঠনে ব্যর্থ হন বিশেষত্ব কমিটির সভাপতি বিখ্যাত আইনজীবী অতুল গুপ্তের জেদের জন্য। এ বিষয়ে সমাধানের জন্য নির্মল বসু অধ্যাপক সত্যেন বসুর সাহায্য চান, কিন্তু সত্যেন বসুও কোন সাহায্য করেননি। কমিটির মূল প্রস্তাব গৃহীত হয় ১০ - ২ ভোটে তবে তা অতুল গুপ্তের মতের বিরুদ্ধে। অথচ জে. বি. কৃপালনী কমিটি ভেঙে দিতে রাজি হননি । অতুল গুপ্ত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাবি পত্র জমা দেন আর নির্মল চ্যাটার্জী কমিটির পক্ষ থেকে বাউন্ডারি কমিশনে প্রতিনিধিত্ব করেন। হিন্দু মহাসভা, Indian Association এবং New Bengal Association-এর পক্ষ থেকে আলাদা করে দাবি পত্র জমা করেন।
আমরা ওই দুটি দাবি পত্রের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আমাদের স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া শেষ করব ।
সীমানা নির্ধারণের দাবি পত্রে কংগ্রেস বিস্তারিত তথ্য ও মানচিত্র এবং বিভিন্ন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সংযুক্ত করে । ১৯৪১-এর জনগণনা তথ্য বহুল ব্যবহার করা হয়। যদিও ১৯৪১ এর জনগণনা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয় এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংগৃহীত বলে সন্দেহ প্রকাশ করে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ সবাই। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা উভয়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলার সঙ্গে রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেনি যদিও সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২.৯৪ শতাংশ। কংগ্রেসের দাবি পত্রে দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা এবং জমির আয়তন তাদের সিদ্ধান্ত নেবার কেন্দ্রে ছিল আর অন্য দাবি পত্রে জমির সঙ্গে জল বা জলবাহী নদী, মাটির চরিত্র, প্রাকৃতিক গঠন ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
৩
বাউন্ডারি কমিশনে কংগ্রেস যে স্মারকলিপি জমা দেয়, তার সঙ্গে মুসলিম লীগের দাবির বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য জানিয়ে একটি নোট জমা দেয়। মুসলিম লীগের দাবি পত্রে ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম ডিভিশন এবং কলকাতা সহ প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রায় পুরোটা দাবি করা হয়েছিল। কলকাতা কেন পাকিস্তানে যাওয়া উচিত নয় তার জন্য কংগ্রেস ও অন্য সংগঠনগুলির দাবি পত্রে তথ্য সহ ব্যাখ্যা জমা করা হয়। কংগ্রেসের স্মারকলিপিতে পশ্চিমবঙ্গের মোট ৪০১৩৭ বর্গ মাইল এলাকা দাবি করা হয় যেখানে মোট ২,৮০,৩২,০০০ মানুষের বসবাস। তখন তার হিসেব মতো বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ।
দেশভাগ এবং বাংলাভাগ অবধারিত এটা পরিস্কার হয়ে উঠতেই মুসলিম লীগ মূলত খাজা নিজামউদ্দিনের নেতৃত্বে কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু এই বিষয়ে লীগ নেতৃত্বের মধ্যেই মতভেদ থাকায় এই আন্দোলন দানা বাঁধেনি। কেননা ইতিমধ্যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসাবে ঢাকার নাম ঘোষণা করেছিলেন ১০ জুন, ১৯৪৭-এ। তাছাড়া কলকাতার দাবি ছেড়ে দেবার জন্য ৩৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষমতায় আসেন । তিনি ওই টাকা গ্রহণ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তা দিয়ে ঢাকাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজধানী গড়ে তোলার কথা বলেন। সুতরাং কলকাতার দাবি মুসলিম লীগ তুলে নেয়।
পরে অবশ্য ৩৩ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি ভুয়ো হিসেবে প্রমাণিত হয়। Partition council-এর চেয়ারম্যান হিসাবে মাউন্টব্যাটেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, যেখানে কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে বল্লভভাই প্যাটেল ও এইচ এম প্যাটেল এবং লীগের সদস্য হিসাবে লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছিলেন। সেই ঘোষণায় কলকাতাকে লাহোরের পরিবর্তে ভারতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়। সুতরাং ক্ষতিপূরণের কোন প্রশ্ন ছিল না।
কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা ও অন্যান্যদের স্মারকলিপিতে সীমানা নির্ধারণের দাবিতে খুব একটা ফারাক দেখা যায় না। প্রধান সমস্যা দেখা দিয়েছিল ৪৬ শতাংশ জনগণের জন্য ৫৭ শতাংশ এলাকা দাবি করার প্রশ্নে। যা অতুল বাবু আইনের যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন নি। তার মনে হয়েছিল ওই দাবি আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। হিন্দু মহাসভার দাবি ছিল জমির উর্বরতা ও অনুর্বরতা বিচার করে এলাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। কিন্তু তারা আলাদা স্মারকলিপিতে সেই পরিমান এলাকা দাবি করেননি। তবুও তারা আলাদা হলেন।
স্পষ্টতই বাংলা ভাগের আন্দোলনে কংগ্রেস ছিল অগ্রণী অংশীদার। হিন্দু মহাসভার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তখন সহযোগিতার চেয়েও বেশি ছিল। মহাসভা ছাড়াই কংগ্রেস আলাদাভাবে বাংলা ভাগের আহ্বান জানিয়ে প্রচুর জনসভার আয়োজন করে । সবচেয়ে বড় জনসভা হয় বালিগঞ্জে। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন ড: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। যতদূর জানা যায় এই ধরনের ৭৬টি জনসভা আয়োজিত হয়েছিল । তার মধ্যে কংগ্রেস কমপক্ষে ৫৯ টি জনসভার আয়োজক ছিল । ১২ টি জনসভা হয়েছিল মহা সভার উদ্যোগে, আর ৫ টি জনসভা হয়েছিল যৌথ উদ্যোগে।
শেষ পর্যন্ত সীমানা ভাগ করে তার রিপোর্ট জমা দিলেন সিভিল রেডক্লিফ। তিনি জানতেন কোনো পক্ষকেই তিনি সন্তুষ্ট করতে পারবেন না । যে কাজ তিনি করছেন তার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি হবে । তবু তাকে সীমানা ভাগ করতে হলো। তিনি তার কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে গেলেন। এমনকি তার পারিশ্রমিকও তিনি গ্রহণ করেননি।
বাংলা প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়ে, বড় হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ জানল তার পায়ের তলার মাটি তার দেশ নয়। তাকে চলে যেতে হবে । চরৈবেতির আনন্দ সন্ধানে নয় - তার হৃদয়, আত্মা, চেতনা ছিন্ন করে চলে যেতে হবে সীমানার অন্যদিকে। যে নেতৃত্ব ১৯০৫ সালে মূলত কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় জীবনপণ লড়াইয়ের ময়দানে ছিল বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য, সেই নেতৃত্বই এখন নির্ধারণ করে ফেলেছে সীমানা। আর সেই রক্তমাখা সীমানার কাঁটাতার আজও প্রতি সকালে সূর্যের আলোয় তার ধারালো দাঁত পরিষ্কার করে নেয়।
কংগ্রেস দাবিপত্র
১) বর্ধমান ডিভিশন (সম্পূর্ণ)
২) প্রেসিডেন্সি ডিভিশন (বাদ যাবে- (ক) নদীয়া জেলার কুষ্ঠিয়া সাব ডিভিশনের গড়াই নদীর পূর্বের অংশ, যে অংশ সম্পূর্ণ আলফাডাঙ্গা থানা এবং মোহাম্মদপুর থানার অংশ। (খ) খুলনা জেলার দক্ষিণ পূর্বে মোরেলগঞ্জ এবং সরণখোলা থানা)
(যুক্ত হবে- (ক) রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানা (খ) বাকরগঞ্জ জেলার গৌরাণ্ডি, নাজিরপুর, স্বরূপকাটি এবং ঝালাকাটি থানা (গ) ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাব-ডিভিসন ও রাজৈর থানা)
৩) রাজশাহী ডিভিশন – (ক) দার্জিলিং জেলা (সম্পূর্ণ), (খ) জলপাইগুড়ি জেলা (সম্পূর্ণ) (গ) রংপুর জেলা - (যুক্ত হবে- শুধুমাত্র ডিমলা ও হাতীবান্ধা থানা এবং ভুরঙ্গমারী থানা; যেহেতু আসাম এবং ভারতীয় ইউনিয়নের সংযোগকারী রেললাইন, শিয়ালদা থেকে আসাম পর্যন্ত, এই থানার মধ্যে দিয়ে গেছে) (ঘ) দিনাজপুর জেলা (বাদ যাবে- খানসামা, চিরিরবান্দার, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী নবাবগঞ্জ, গোরাঘাট, পানি তোলা এবং পোর্সা থানা) (ঙ) মালদা জেলা- (বাদ যাবে- ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, নাচোল, এবং গোমস্তাপুর থানা), (চ) রাজশাহী জেলা-(যুক্ত হবে- শুধুমাত্র গঙ্গার দক্ষিণবর্তী বোয়ালিয়া থানা)
হিন্দু মহাসভা ও Indian Association, New Bengal Association এর দাবি পত্র
১) বর্ধমান ডিভিশন (সম্পূর্ণ)
২) প্রেসিডেন্সি ডিভিশন - (বাদ যাবে- (ক) খুলনা জেলার সরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ থানা (খ) খোকসা, কুমারখালির অংশ এবং নদীয়া জেলার কুষ্ঠিয়া থানা)
৩) রাজশাহী ডিভিশন- (ক) দিনাজপুর (বাদ যাবে- খানসামা, চিরিরবান্দার, ফুলবাড়ি, নবাবগঞ্জ, পার্বতিপুর, পোর্সা, পানিতোলা এবং গোরাঘাট থানা) (খ) রংপুর- (যুক্ত হবে- শুধুমাত্র ডিমলা, হাতীবান্ধা এবং ভুরঙ্গমারী থানা), (গ) রাজশাহী - (যুক্ত হবে শুধুমাত্র গোদাগাড়ি, রামপুর-বোয়ালিয়া থানা এবং পাবা থানার অংশ) , (ঘ) জলপাইগুড়ি জেলা (সম্পূর্ণ), (ঙ) দার্জিলিং জেলা (সম্পূর্ণ), (চ) মালদা জেলা (সম্পূর্ণ)
৪) ঢাকা ডিভিশন- (ক) গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশন, (খ) রাজৈর থানা এবং ফরিদপুর জেলার কালকিনি ও মাদারীপুর থানার অংশ), (গ) গৌরাণ্ডি, উজিরপুর, নাজিরপুর, স্বরূপকাটি, ঝালাকাটি, বানারিপাড়া, বাবুগঞ্জ থানা এবং বরিশাল-কোতোয়ালি, পিরোজপুর, নলচিতি এবং কাউখালি থানার অংশ)
তথ্যঋণঃ
১) সাতচল্লিশের ডায়েরি - নির্মল কুমার বসু (সম্পাদনা, অভীককুমার দে)
২) The Great Partition – The Making of India and Pakistan - Yasmin Khan
৩) The Partition of Bengal and Assam, 1932 -1947 – Contour of Freedom – Bidyut Chakrabarty
৪) বাংলা ভাগ হলো - জয়া চ্যাটার্জি
৫) মহাত্মা গান্ধী, কংগ্রেস ও ভারত ভাগ - দেবচন্দ্র ঝা।