সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
১৯৭৬ সাল। ‘জন অরণ্য’ সিনেমার প্রিমিয়ার পার্টি। আকাশবাণী কলকাতার কিছু কর্তাব্যক্তিরাও আমন্ত্রিত হয়েছেন সেই পার্টিতে। প্রখ্যাত শিল্পী জগন্নাথ বসুও আমন্ত্রিত। তাঁর মুখেই এই ঘটনা শোনা।
জগন্নাথ বসু প্রিমিয়ারে দেখেছেন ‘জন অরণ্য’। দেখার পর থেকে মুখিয়ে আছেন সত্যজিৎ রায়ের সাথে কথা বলার জন্য। দুর্দান্ত সিনেমা, সন্দেহ নেই। কিন্তু জগন্নাথ বসুর উৎসাহের ক্ষেত্র আলাদা। সিনেমায় একটা ছোট্ট ‘ভুল’ চোখে পড়েছে তাঁর। আর আমরা সবাই জানি, কাজের ক্ষেত্রে কতটা নিখুঁত সত্যজিৎ। তা সে তাঁর লেখা গল্পই হোক, কিংবা প্রচ্ছদ, গান, সিনেমা সর্বক্ষেত্রে ! আমাদের জন্য চলমান এনসাক্লোপিডিয়া। আমরা যারা অনেকেই লালমোহনবাবু তাঁদের জন্য একজন ফেলুদা আছেন, আর সেই ফেলুদা সত্যজিৎ। জগন্নাথ বসুর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা নয়। এ হেন সত্যজিৎ রায়ের ‘ভুল’ ধরা পড়লে, সেটা যতক্ষণ না তাঁর গোচরে আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ স্বস্তি নেই।
প্রিমিয়ার পার্টিতে প্রচুর লোকের ভিড়। মধ্যমণি সত্যজিৎ, স্বভাবতই তাঁকে আলাদা করে পাওয়া মুশকিল। তবুও তাঁর মাঝেই একটুখানি ফাঁকা পাওয়া গেল আর কালক্ষেপ না করে জগন্নাথ বসু উপস্থিত হলেন তাঁর সামনে। সত্যজিৎ রায় তখন প্লেট হাতে। পরবর্তী কথোপকথন অনেকটা এরকম –
জগন্নাথ বসু – নমস্কার। আমি জগন্নাথ বসু।
সত্যজিৎ রায় – নমস্কার।
—আপনার প্রতিটি সিনেমাই আমার দেখা। প্রিমিয়ারে ‘জন অরণ্য’ দেখলাম। অসাধারণ। তুলনা নেই !
—(এরকম অনেক কথাই আজকের দিনে সত্যজিৎ শুনেছেন। ফলত সৌজন্যের হাসি।)
—কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে আমার একটা কথা আছে। মানে সিনেমায় আমার একটা ‘ভুল’ চোখে পড়েছে।
—(এবারে ভ্রু কুঁচকোলেন সত্যজিৎ। ব্যারিটোন কন্ঠে ভেসে এলো) কীরকম?
—আসলে, সিনেমার এক জায়গায় দেখানো হচ্ছে, সোমনাথ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এসেছে। লোডশেডিং। একটা মোমবাতির আলোর মধ্যে দিয়ে আঙুল চলছে আর একটা গান ভেসে আসছে। ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’।
—হ্যাঁ।
—সিনেমা দেখে আমার যতটুকু মনে হ’ল, জিজ্ঞেস করছি, গানের সোর্স কি রেডিও?
—হ্যাঁ, রেডিও।
—আমি আকাশবাণীতে যুক্ত, ফলে এই জায়গাটায় আমার কানে লেগেছে। এইখানেই একটা ভুল হয়েছে।
—কী ভুল?
—গানের সাথে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট (বাজনা) নেই। খালি গলায় গান বাজছে। আকাশবাণী থেকে জাতীয় শোকদিবস ছাড়া খালি গলায় গান সম্প্রচারিত হয় না। আর সেটাও সকালবেলা। সন্ধ্যেতে নয়।
জলদগম্ভীর কন্ঠে উত্তর ভেসে এলো – কেন হয় না? হওয়া উচিত !
জগন্নাথ বসু বলছিলেন, ওই একটা মুহূর্তে আমাকে স্তব্ধ করে দিলেন সত্যজিৎ। সত্যিই তো, খালি গলায় গানের মাধুর্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমি নিজে আকাশবাণীতে যুক্ত এতোবছর ধরে, অথচ আমারও তো মনে হয়নি কেন হয় না ! কেন হবে না?
‘কেন হয় না? হওয়া উচিত’... এটা যে কোনো শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। অবশ্যই শিল্পের শর্তটুকু মেনে। কিন্তু কতজন শিল্পী প্রথাভাঙা পথে হাঁটতে সাহস পান? অন্যপথে হেঁটে এক নতুন পথ যিনি দেখাতে পারেন, তিনিই তো শিল্পী, তাই না?
সত্যজিতের শৈল্পিক জীবনে এই প্রথাভাঙা পথের খোঁজ চলেছে নিরন্তর। প্রথাগত যে পথ সেই ‘সুরক্ষিত’ পথে তিনি কখনই হাঁটেননি। শুধুমাত্র শিল্পের তাগিদে নয়, জীবনের তাগিদেও। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট হবে। সত্যজিৎ তাঁর সাক্ষাৎকারে নানা জায়গায় বলেছেন, ছোটোবেলা থেকে যেটা ভালো পারতাম তা হ’ল ছবি আঁকা। অথচ কলাভবনের এই ছাত্র তাঁর কোর্স অর্ধসমাপ্ত রেখে চলে আসেন, পরবর্তীকালে প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনের এক নতুন জগত খুলে দেওয়া এই শিল্পী প্রচ্ছদের কাজ তেমন করেননি (তাঁর নিজের বই, সন্দেশ বাদ দিলে)। সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়েন। কেন? একটা উত্তর বাল্যকাল থেকেই সিনেমার প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক। কিন্তু সে ঝোঁক তো আঁকার প্রতিও ছিল ! সত্যজিতের সৃষ্ট চরিত্র মনমোহনকে দিয়ে ‘আগন্তুক’-এ সত্যজিৎ এর উত্তর দিয়েছেন। স্পেনের আলতামিরা গুহায় আদিম মানুষের আঁকা বাইসনের ছবি দেখে মনমোহন বলেছিলেন, তোমার ক্ষুরে দণ্ডবৎ বাইসন ভায়া ! আমি আর যাই হই কোনোদিন আর্টিস্ট হ’ব না। কারণ এমন কোনো ইন্সটিটুইশন নেই যে আমাকে অমন বাইসন আঁকা শেখাবে ! সত্যজিতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। অজন্তা, ইলোরা গুহায়, আরও বলা ভালো ভারতীয় শিল্পের সাথে যখন পরিচিত হচ্ছেন সত্যজিৎ, তিনি বুঝেছিলেন, এই ক্ষেত্রে অনেক ‘experiment’ হয়ে গেছে। ছক ভাঙার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নেন ভারতীয় সিনেমার জগতকে।
সত্যজিতের এই প্রথাভাঙা পথ কিন্তু তাঁর নানা কাজের মধ্যে এক সূক্ষ্ম যোগাযোগ তৈরী করে দিয়েছে। সে সম্পর্কে বিস্তৃত আলচনায় যাওয়া এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা, অনেকটা পটকায় আগুন দেওয়া বলা যেতে পারে, হয়তো অন্য একরকমভাবে দেখার আশায়।
প্রথম জীবনে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে পাশ করে অনেকটা অনিচ্ছাতেই, মায়ের আগ্রহে, শান্তিনিকেতনে যোগ দেন সত্যজিৎ। অনিচ্ছা কারণ, ফাইন আর্ট নিয়ে কাজের উৎসাহ তাঁর কোনোদিনই ছিল না, ঠিক করে রেখেছিলেন কমার্শিয়াল আর্টেই ঝুঁকবেন, যেটা আবার কলাভবনে শেখানো হয় না। ওখানে গিয়ে ভারতবর্ষের শিল্পকলার ঐতিহ্যকে ভালোভাবে জেনে এসে পরে তা কাজে লাগানো যাবে, এই মনোভাব নিয়ে তিনি যান এবং কলাভবন তাঁকে হতাশ করেনি। পরে তিনি লিখছেন, “শিল্পকলার ক্ষেত্রে পশ্চিমী ঐতিহ্যের যে প্রভাব, এতদিন আমার চেতনাকে তা-ই পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছিল। মুগ্ধ হয়ে দেখেছি রেমব্রান্ট আর দা ভিঞ্চির শিল্পকলা। এবারে প্রাচ্য পৃথিবীর শিল্পকলার ঐশ্বর্যময় জগতের দরজাটা আমার চোখের সামনে খুলে গেল। চিনে ল্যাণ্ডস্কেপ, জাপানি কাঠখোদাই আর ভারতীয় মিনিয়েচার হঠাৎ ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিল আমার চেতনাকে। প্রাচীন শিল্পৈশ্বর্যের জন্যে ভারতবর্ষের যে সব জায়গার খুব খ্যাতি, তিনজন বন্ধুর সঙ্গে সেই সময়েই আমি সেখানে যাই। অজন্তা, ইলোরা আর খাজুরাহো দেখে আমার চোখ খুলে যায়।” (অপুর পাঁচালি, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৫, পৃ ১৭-১৮)
চার বছরের কোর্স অসমাপ্ত রেখে আড়াই বছরের মাথায় ১৯৪২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে ১৯৪৩ সালের জুন মাসে জুনিয়ার আর্টিস্ট হিসেবে তিনি যোগ দেন ডি.জে.কিমার-এ। বাজার চলতি হরেক পণ্যের প্রচারের জন্য যে বিজ্ঞাপন, সেখানে শিল্পস্বত্তার প্রয়োগ করার তেমন সুযোগ এবং সুবিধে কোনোটাই ছিল না। কিন্তু সেখানেও দুর্দান্ত কিছু কাজের মধ্যে দিয়ে কিমার-এর ম্যানেজার ডি.কে (দিলীপকুমার গুপ্ত)-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথমদিকের সেই কাজের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। ‘Art in industry’-র জন্য সত্যজিৎ যে প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, তা যদি পাওয়া যায়, তা হবে নিঃসন্দেহে জাতীয় সম্পদ।)
১৯৪৩ সালে ডি.কে যখন সিগনেট প্রেস তৈরী করেন তখন সার্থকভাবে তাঁর শিক্ষাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান সত্যজিৎ। এর আগে প্রচ্ছদই হোক অথবা ইলাস্ট্রেশন বা টাইটেল পেজ, কোনোক্ষেত্রেই তেমন শৈল্পিক যত্ন চোখে পড়ত না। অনেকটা দায়সারা ভাবেই যেন শুধুমাত্র ‘inform’ করার দায়িত্ব ছিল সেই কাজগুলোর। সত্যজিতের হাত ধরে সিগনেট বাংলা প্রকাশনার জগতে বিপ্লব আনে। অবশ্য সিগনেটের আগে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ তাঁর কাজের নান্দীমুখ করে ফেলেছেন ।
প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম প্রকাশিত ডিজাইন ছিল ‘পাগলা দাশু’র প্রচ্ছদ। তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের বইটি যখন এম.সি.সরকার এণ্ড সন্স, ১৯৪০ সালে প্রকাশ করার কথা ভাবেন, তখন প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিতকে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হয়তো সুকুমার পুত্র বলেই। কারণ ১৯৪০ সাল, সত্যজিৎ তখন সদ্য কলাভবনে ভর্তি হয়েছেন এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন সম্পর্কে হাতে কলমে তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। অথচ, প্রথম কাজ করতে এসেই প্রথা ভাঙলেন সত্যজিৎ।
এর আগে বইয়ের প্রচ্ছদে যা কাজ হয়েছে সবই দ্বিমাত্রিক। অর্থাৎ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দিয়ে দেখা তো দূরস্থান, একই তলে সব উপাদান রেখে প্রচ্ছদ তৈরি হত। সত্যজিৎ এসে প্রথমে সেই ধারণাটা পালটে দিলেন, তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতে যা আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে। তিনি ধার করলেন পাগলা দাশুর একটি গল্প, যেখানে দাশুর সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা পাই, সে যে নেহাত ‘পাগলা’ নয়, ‘ফচকেমি’ স্বভাবের, তার একটা আভাস দাশুর এই মুখ দেখলে স্পষ্ট হয়।
মজার ব্যাপার হল, সুকুমার তাঁর নানা লেখার সার্থক চিত্ররূপায়ণ করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে কখনই দাশুকে আঁকেননি। এই বইয়েও হিতেন্দ্রমোহন, দাশুকে আঁকলেও (ইলাস্ট্রেশন), সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেনি। সেদিক থেকে দাশুকে বাঙালীর কাছে হাজির করার একটা কৃতিত্ব সত্যজিতের, যা তিনি দুর্দান্তভাবে পালন করেছিলেন। দাশুরই একটা গল্প যেখানে একটু দূরে বন্ধুরা একটা খালি বাক্স পরম উৎসাহে খুলছে, আর দর্শকের/ পাঠকের অনেক কাছে এসে দাশু চোখ মটকে, ‘কী, কেমন দিলাম?’ গোছের অভিব্যক্তিতে পাঠকদেরও সঙ্গে নিয়ে নিচ্ছে। সত্যজিৎ আসার আগে, গল্পের সাথে প্রচ্ছদের মাধ্যমে পাঠকের যোগাযোগ (communication) ঘটানো বিরল ছিল। শুধু inform করাটাই মুখ্য ছিল। সত্যজিৎ নিতান্ত অ্যামেচার অবস্থাতেই কিন্তু চিন্তনে প্রথা ভাঙলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই প্রচ্ছদ বাদ দিলে ‘প্রফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা’তেই শুধুমাত্র প্রচ্ছদের এক কোণে সত্যজিতের ‘S.Ray’ সইটুকু দেখি। তাছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে সত্যজিৎ প্রচ্ছদে তাঁর সই ব্যবহার করেননি। এবং, উল্লেখ্য, এখানে সত্যজিৎ এই সইটা করেছিলেন অনেকটা বাবার সইয়েরই আদলে। প্রথম কাজের থেকেও বাবার কাজ, কতোটা যত্নে তিনি করেছিলেন, এটা দেখলে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
জীবনের দ্বিতীয় প্রচ্ছদ যখন সত্যজিৎ করছেন তখন তিনি কলাভবন থেকে আড়াই বছরের একটা কোর্স করেছেন, অনেক বেশী দেখেছেন, অনেকটা পরিণত। সত্যজিতের কিমারের সহকর্মী ও.সি.গাঙ্গুলী জানাচ্ছেন, সত্যজিৎ তখন প্রতিদিনই প্রায় অসংখ্য ম্যাগাজিন কিনছেন, বেশীরভাগই বিদেশের, সেখানকার কাজকর্ম, রঙের ব্যবহার এসব নিয়ে রীতিমতো সিরিয়াস পড়াশোনা করছেন। ১৯৪৩-এ, সংকেত ভবন থেকে প্রকাশ পায় কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছাতুবাবুর ছাতা’। সত্যজিতের জীবনের দ্বিতীয় প্রকাশিত প্রচ্ছদ। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাবো, মূলত দুটি রঙ নিয়ে তিনি কাজ করছেন, কালো এবং হলুদ। কালো রঙে তিনি ছাতুবাবুকে আঁকছেন, তাঁর জামায় বৃষ্টির ফোঁটা, এবং বাইরে বৃষ্টির আকারে ছাতাকে ব্যবহার করলেন। রঙের ব্যবহার তখনও উন্নত ছিল না তেমন। সত্যজিৎ তাঁর তৃতীয় রঙ হিসেবে ফাঁকা অংশকে (সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডকে) দারুণ বুদ্ধিমত্তায় ব্যবহার করলেন। তাঁর এই কাজ দেখে আমরা এম.সি.এশারের symmetry-র ছায়া দেখি, বিশেষত হলুদ অংশে সাদা ছাতার ব্যবহার আর তাঁর উল্টোটা।
এরপর সিগনেট থেকে বের হয় ক্ষীরের পুতুল, তাঁর প্রথম সিগনেটের প্রচ্ছদ। এখানেও রঙের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এমনকি, এর পর সিগনেটে তিনি যত প্রচ্ছদ করেছেন প্রতিটি প্রচ্ছদ আমাদের অবাক করে দেয় তার ব্যপ্তিতে। পূর্ণেন্দু পত্রী একবার বলেছিলেন, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম সিগনেটের বইগুলোর জন্য, বিশেষ করে সত্যজিতের প্রচ্ছদের জন্য। এক একটা প্রচ্ছদের মুগ্ধতায় কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা !
বইয়ের সাথে প্রচ্ছদকে দারুণভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা, নানারকম এক্সপেরিমেন্ট, পথভাঙা, চিরাচরিত প্রথা নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন পথের খোঁজ... উল্লেখ করা উচিত, শৈল্পিক খোঁজ, এটাই আলাদা করে দিয়েছিল প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিতকে। তার ফলস্বরূপ আমরা পাই, যখন ‘হাতেখড়ি’ বের হচ্ছে, পুরো বইটাকে একটা স্লেটের আদলে ভেঙে নিলেন। এমনকি বইয়ের কোণ মুড়ে গোল করে দিলেন, পাশ বরাবর কাঠের ব্লক যেন। আবার ‘খাই খাই’য়ের প্রচ্ছদে সারি বেঁধে বসে থাকা লোকজন, তাঁদের নানান অভিব্যক্তি। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এর প্রায় কুড়ি বছর পর গুপী গাইন বাঘা বাইনে, ভুতের নাচের দৃশ্যের ফ্রেম।
আবার জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর প্রচ্ছদ আঁকার সময় তিনি পুরো প্রচ্ছদ জুড়ে ডোরাকাটা বাঘের হলুদ কালো রঙ, তাতে গুলির অংশ বোঝানোর জন্য একটা সাদা অংশ, কাট আউট, যেখানে লেখকের নাম আর বই-এর নাম। পিছনেও একই ডিজাইন, শুধু সাদা অংশটা একটু বড়ো। এখান থেকে বোঝা যায় ডিটেলসের দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজরের কথা। গুলি বের হয়ে যাওয়ার সময় গর্তটা একটু বেশী বড়ো হয়। কোনো রঙের আতিশয্য নয়, শুধু চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সামান্য এক প্রচ্ছদকে অসামান্য করে দিলেন সত্যজিৎ।
সত্যজিতের প্রচ্ছদ যদি খুব খুঁটিয়ে দেখা যায়, তাহলে দেখতে পাবো সেখানে ‘সাদা’ বা ফাঁকা অংশের সুন্দর ব্যবহার। সেই সময়ে, যেখানে একাধিক রঙ ব্যবহার করার আধুনিক পথ তেমন নেই, দুটো রঙ মোটামুটি ব্যবহার করা যাত, সেখানে তৃতীয় রঙ হিসেবে ‘সাদা’ বা ‘ফাঁকা স্পেস’কে বারবার ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। প্রথম থেকেই চারপাশে যতটা সম্ভব সাদা জায়গা ছেড়ে রেখে মূল বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেওয়া, পরে সাদা অংশকে প্রচ্ছদের নানান জায়গায় ব্যবহার করা। সত্যজিতের ভাষায় যা ছিল – ‘White space is like white lettering.’
নরেশ গুহর ‘দুরন্ত দুপুর’-এর প্রচ্ছদে গনগনে হলুদ রঙের ওপর নিবের টানে আঁকলেন এক একাকিনীকে। শুধু অ্যানাটমির বেসিক থিয়োরীকে কাজে লাগিয়ে। বুকের কাছে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে সে একটা কাপড় ধরে আছে। আবেদনে পরিপূর্ণ, অথচ তা কখনই অশ্লীলতার সীমা স্পর্শ করেনি।
সত্যজিতের সারা জীবনের কাজে আমরা এই ব্যাপারটা দেখতে পাই। যাপনকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তাঁর কাজে। আধুনিকতা মানেই উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, আধুনিক ভাষায় ‘ডার্ক’ কিছু করতে হলেই যে তাকে যৌন সুড়সুড়ি দিতে হবে, এটার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর কাজে, মূলত ফিল্মের থেকে একটা উদাহরণ দিলে এ বিষয়টা সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
এই ধারণার এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই, প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমা করার সময়, যখন মূল গল্পে এক জায়গায় সুনীল লিখছেন
“সিদ্ধার্থ শিবেনকে কনুই দিয়ে একটা খোঁচা মারল। পাশ দিয়ে দুটি যুবতী চলে গেল—ওদের চেয়ে দু-এক বছরের বড়োই হবে—দু-জনেই বেশ স্বাস্থ্যবতী, এক হালকা সুগন্ধ বয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সিদ্ধার্থ বলল, সাউথ ক্যালকাটায় এলে বেশ ভালো ভালো মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। এইজন্যই আসতে ইচ্ছে করে! কী বুক দেখেছিস?
শিবেন বিজ্ঞভাবে জানাল, সব আসল নয়, নকল।
—তোকে বলেছে! তুই হাত দিয়ে দেখেছিস?
—হাত দিয়ে দেখতে হয় না, একদিন বাসে একজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল, লোহার মতন শক্ত কী যে একটা—
—ভাগ! আমারও তো প্রায়ই ধাক্কা লাগে, দু-একবার ইচ্ছে করেও একটু, বুঝলি না, চান্স পেলে, কিন্তু আমি তো সব্বারই দেখেছি নরম-নরম—তোর লাকটাই খারাপ।”
সত্যজিৎ যখন চিত্রায়ণ করছেন, তিনিও অবদমন দেখাচ্ছেন। কিন্তু কী দেখাচ্ছেন? উলটোফুট থেকে হেঁটে আসছে এক উন্নতবক্ষা নারী। তাঁর বুক দেখে সিদ্ধার্থর মনে পড়ছে মেডিক্যাল ক্লাসরুম, female breast নিয়ে স্যারের লেকচার। বাবা মারা যাওয়ায়, সংসার টানার জন্য যে সিদ্ধার্থকে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেই সিদ্ধার্থের অবদমনে আজও ওই ক্লাসরুম।
সত্যজিতের আগে টাইটেল পেজ তেমনভাবে গুরুত্বই পায়নি। সত্যজিৎ পরবর্তী যুগে, এমনকি এখনও টাইটেল পেজ তেমন গুরুত্ব পায়না। বইয়ের মূল মলাট (প্রচ্ছদ) কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে (অথবা প্রচ্ছদের অতিরিক্ত রকমারিতে বইয়ের নাম বোঝা না গেলে তখনই টাইটেল পেজের ভূমিকা। ফলত অনেকটা গুরুত্বহীন।) অথচ, সত্যজিৎ কৃত কিছু টাইটেল পেজের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কীভাবে বইয়ের জগতে একপ্রকার বিপ্লব এনেছিলেন সত্যজিৎ, সিগনেটের হাত ধরে।
সিগনেটের হয়ে সর্বশেষ প্রচ্ছদ আঁকেন বিষ্ণু দে’র ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’।
প্রচ্ছদের কাজে সত্যজিৎ টাইপোগ্রাফিতে এক বিবর্তন এনেছিলেন। শুধুমাত্র একটা অক্ষর কতোরকম ভাবে লিখে নতুনত্ব আনা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা পাই তাঁর কৃত এক্ষণের প্রচ্ছদ্গুলো দেখলেই। ‘এ’,’ক্ষ’,’ণ’ এই তিনটি অক্ষর যে কতরকমভাবে ধরা দিয়েছে সত্যজিতের কলমে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্যামল ঘোষের স্মৃতিকথা ‘স্মৃতি সত্তা নাট্য’ বইতে তিনি লিখছেন –
“জীবিকার সূত্রে কিছুকাল আমাকে মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত থাকতে হয়েছিল। তখন এক্ষণ পত্রিকা শারদ সংখ্যার জন্য দু’রঙের একটি প্রচ্ছদপটের নকশা এলো আমার হাতে। এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। রঙের নমুনাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন সঙ্গে। এইসব ছাপা তখন জিংক ব্লকে হত। ব্লকের ছবি তোলার সুবিধের জন্য আঁকতে হত লাল আর কালোতে।ছাপার সময়ে নমুনা দেওয়ার রং মিলিয়ে ছাপা হতো। এখানে যে রেখাচিত্রটি দেওয়া হয়েছে তা দেখলাম ভ্রু আঁকার পেন্সিল আর গরমে গলে আসা একটি লাল ডটপেনে আঁকা। ফলে যেখানে-সেখানে কালি জুবড়েছে, আঁকতে গিয়ে নরম পেন্সিলের শীষ ভেঙে যাওয়ার আঙুলে ঘসে সে সব অবাঞ্ছিত দাগ মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। মোটমাট বেশ অপরিচ্ছন্ন কাজ। মোটেই সত্যজিৎ রায়ের নামের উপযোগী নয়।”
শ্যামলবাবু ভেবেছিলেন, সিনেমার কাজে ব্যস্ত সত্যজিৎ রায় মনোযোগী হওয়ার সময় পাননি। বড্ড দায়সারা ভাবে এঁকে দিয়েছেন। তিনি বলছেন,
“দেখে শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল না অমন মানুষের নামে এমন একটা কাঁচা প্রচ্ছদ ছাপা হোক। কিন্তু যাদের পত্রিকা ভালো না লাগলেও নিরুপায় হয়ে ‘যদ্দৃষ্টং’ ছেপে দিতে বললেন তারা। প্রথম রঙটি ছাপা হওয়ার পরে দ্বিতীয় রংয়ের বেলাতেও তাদের পছন্দমতো অন্য কোন রঙের ব্যবহার করব কিনা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু সে বদলের সাহস তাদের ছিল না। ফলে শিল্পীর দেওয়া কালার চার্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় রংটি ব্যবহার করতে হলো আমাকে।
‘কিমাশ্চর্যম!’ দ্বিতীয় রঙটি ছাপার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখের সামনে যেন হাজার রঙিন ঝাড়বাতি জ্বলে উঠলো। আমার ধারণার ওই বীভৎস রং পাশাপাশি ব্যবহারে সেই অপরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদ নকশাটি যেন স্বর্গীয় মাধুরী পেল। এমন যে হতে পারে তা আমার সুদূর কল্পনারও অতীত। এ যেন শুঁয়োপোকা থেকে রূপান্তরিত প্রজাপতি। এ আমার নতুন শিক্ষা। প্রসঙ্গত বলা যায় সে বছরের ‘শ্রেষ্ঠ শারদ প্রচ্ছদ’ হিসেবে সেই এক্ষণ পত্রিকাটি সেবারে মনোনীত হয়েছিল।” (এক্ষণ তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা)
কাজের প্রতি কতটা আত্মবিশ্বাস, কতটা জ্ঞান তাঁর ছিল এটা বোধহয় এই ঘটনার থেকে আমরা একটা আভাস পাই।
সত্যজিৎ জানেন কতোটা দ্যাখালে ঠিক দ্যাখানো যাবে। ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতকে এই প্রসঙ্গে আনছি।
‘হত্যাপুরী’ (ফেলুদা)র ‘মেঘ পোহানো’ ভদ্রলোকের মৃত্যু বীভৎসতা দেখাচ্ছেন সত্যজিৎ। কীভাবে দেখাচ্ছেন? ফেলুদা সে অর্থে মূলত ছোটোদের জন্য লেখা। সত্যজিৎ, ইলাস্ট্রেশনে ফ্রেমের মধ্যে শুধু পা দুটিকে রাখলেন। মূল ফোকাস করলেন লালমোহনবাবু আর তোপসের মুখের এক্সপ্রেশনে। এবারে কতটা বীভৎস হতে পারে সেই মৃত্যু, তা দর্শকের জন্য রেখে দিলেন।
না দেখিয়েও যে দেখানো যায়, সত্যজিৎ শেখান।
প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিৎ অনেকেরই পরিচিত। কিন্তু কমিকস শিল্পী সত্যজিৎ? সন্দেশের জন্য কমিকস এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। এবং নির্বাক কমিকস। চরিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ আটপৌরে বাঙালী বাবুকে। সন্দেশ প্রকাশের চারটি ঋতুসংখ্যা, সেই মতো চারটে কমিকসকে আমরা পাই। প্রতিটা কমিকস ছ’টা খোপে বন্দী, এবং সম্পূর্ণ, নির্মল হাস্যরসের অধিকারী। যে হাস্যরসের অধিকারী তিনি ছিলেন তাঁর ব্যক্তিজীবনে। শুধু চারটে কমিকস প্রমাণ করে দেয়, কমিকসশিল্পী হিসেবে তাঁর দক্ষতা। টিনটিনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, তোপসের কল্যাণে আমাদের অনেকটাই জানা।
প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যে প্রথা ভেঙে এগিয়েছিলেন সত্যজিৎ, সিনেমায় এসেও তার অন্যথা হয়নি। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সিনেমা এক নতুন ভাষা পায়, এ কথা বলাটা অত্যুক্তি হবে না। প্রথম ছবি থেকেই, আরও স্পষ্ট করে বললে ছবির টাইটেল কার্ড থেকেই সত্যজিৎ চলতি পথের থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। পথের পাঁচালীর চলচ্চিত্রায়ণে সিনেমার প্রয়োজনে যেটুকু পাল্টানো, খুব সাধারণভাবে দেখলে শুধু সেই পরিবর্তনটুকুই নয়, গভীরতর অর্থেও এক পরিবর্তন এসেছে। সত্যজিতের অপু ট্রিলজিতে মূল চরিত্রের মৃত্যুদৃশ্য এসেছে মোট পাঁচবার। ইন্দির ঠাকরুন, দূর্গা, হরিহর, সর্বজয়া এবং অপর্ণা। অথচ, একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তাঁর ছবিতে মৃত্যু, জীবনের চরম বিরুদ্ধতা হিসেবে আসেনি। পথের পাঁচালী প্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটক বলছেন, “পথের পাঁচালীতে এমন কিছু নেই যা আমরা হাজারবার ভাবিনি বা কল্পনা করিনি”। ব্যক্তিগত অনুভূতিকে সার্বিক করে দেওয়ার ক্ষমতা অথবা সার্বিক অনুভূতিকে একটা স্তরে নিয়ে এসে শিল্পে রূপান্তর করা, সত্যজিৎ রায় সেই বিরল প্রতিভাদের মধ্যে অন্যতম যার মধ্যে এই দুটো ক্ষমতাই, মনন ছিল।
সত্যজিতের ছবিতে, দূর্গার মৃত্যুদৃশ্যে মৃত্যুর বাহন হিসেবে সত্যজিৎ ব্যবহার করলেন ক্ররমূর্তি গণেশকে। প্রলয়ের তাৎপর্যে। সত্যজিতের ছবির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, সত্যজিৎ ভাবান কিন্তু কখনই জোর করে দেখান না। তাঁর সিনেমায় তিনি প্রভূত উপাদান ছড়িয়ে রাখেন। সেগুলোর দেখা পেলে ভালো, না দেখা পেলেও সিনেমার মূল ‘গল্প’ প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে না। এবং একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে, এই না দ্যাখা জিনিসের অমোঘ টানেই বারবার দেখা, নিত্যনতুন আবিস্কারের আতিশয্যে আনন্দ পাওয়া।
এই ডিটেইলিং বাংলা সিনেমায় বিরল।
যেমন, ‘মিসটেক’ মুকুলের সাথে মন্দার বোস আর অমিয়নাথ বর্মনের প্রথম দ্যাখায়, ছাদের ওপর থেকে মুকুলের সমবয়েসী কোনো বন্ধুর মারফত মুকুলের সাথে সাথে আমরা জানতে পারি, ‘মুকুল, ওই গলিতে একটা ঘুড়ি বেরোলো দ্যাখ। দ্যাখ, ওই যে।’ গল্প কিছুটা এগিয়ে, মুকুলের কিডন্যাপড হওয়া ও বাড়িতে ফেরত আসা, ফেলুদা তোপসের তার সাথে দেখা করে বের হওয়ার পর আমরা দেখতে পারি, মুকুলের বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেলুদা, তোপসে আর (আসল)মুকুলের বাবা একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় এসে দাঁড়ান। যেখানে কথোপকথন হয়, ‘সাথে একটা রিগার্ডস জুড়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক।’ বলে চলে যায়। গল্প বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু একটু থেমে ওই দৃশ্যে আশপাশে দেখলে দেখতে পাবো, ওই ল্যাম্পপোস্টের থেকে একটা ঘুড়ি ঝুলছে !
সামান্য সূত্র। সত্যজিৎ রেখে যাচ্ছেন। আর আবিস্কারের অপার আনন্দে আমরা মেতে উঠছি। হয়তো এই ঘুড়ি সেই ঘুড়িও নয়, কিন্তু, কার তাতে কি? আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি !
তেমনই ট্রেন। পথের পাঁচালীতে অপুর থেকে অনেকটা দূরে ছিল ট্রেন / রেললাইন। দেখা যেত না ঘর থেকে। অপরাজিততে আমরা পাচ্ছি, এই ট্রেন কিন্তু বাড়ির অনেক কাছে চলে এসেছে। সপ্তাহান্তে মা অপেক্ষা করে আছে শহরফিরতি ট্রেনের দিকে তাকিয়ে, এই বুঝি অপু ফিরে এলো। আর নগরসভ্যতায় অভ্যস্ত অপু মা’কে ‘ম্যানেজ’ করে নিচ্ছে কিছু টাকা পাঠিয়ে। ভিক্টোরিয়ায় যখন প্রবল শব্দে ঘড়ির আওয়াজ, ঠিক সেই সময়ের jump cut-এ আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে সূর্যঘড়ি, নিস্তরঙ্গ জীবন। অপুর সংসারে অপুর ঘরের ঠিক পাশেই রেললাইন। সেখানে সারাদিন ট্রেনের কোলাহল।
শুধুমাত্র ট্রেনকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে সত্যজিৎ উল্লেখ করছেন নগরজীবনে সহজে শামিল হয়ে ওঠা অপুকে। শহুরে সভ্যতায় যত অভ্যস্ত হচ্ছে অপু, ততই গ্রাম্য অপুর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সে।
এই রূপকের ব্যবহার ‘সিরিজ’-এর ক্ষেত্রে বারবার ফিরে এসেছে সত্যজিতের ছবিতে। সত্যজিতের সম্পর্কে অনেকের অভিযোগ উনি রাজনৈতিক বিবাদ বিতর্ক এড়িয়ে গেছেন। ঠিকই। সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে সরাসরি এক টুকরো রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তকে তুলে ধরেননি। তিনি বরাবর সামগ্রিক চিত্রকে তুলে ধরায় বিশ্বাসী ছিলেন। নইলে, ‘রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল ! তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?’ – এর থেকে এতো সহজে যুদ্ধবিরোধী গান আর তৈরি হয়েছে কি? ‘হীরক রাজার দেশে’-র থেকে বড়ো রাজনৈতিক ছবি, ফ্যাসিস্ট বিরোধী ছবি আর হয়েছে কি?
সত্তরের দশক, বড্ড টালমাটাল সময়। রাজনৈতিক ঢেউ সরাসরি আছড়ে পড়ছে সমাজ জীবনে। ‘সোনার টুকরো ছেলেরা আজ অশ্বমেধের বলি’.. সেই সময় সরাসরি সেই বিষয়কে নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। অথচ, অভিযোগ, সত্যজিৎ চুপ ! সত্যিই কি তাই? সেই সময়কে, সেই দুরন্ত সময়কে নিয়ে সত্যজিৎ তৈরী করছেন ক্যালকাটা ট্রিলজি [প্রতিদ্বন্দ্বী(১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), জন অরণ্য(১৯৭৬)]। সিনেমার বিশ্লেষণে যাবো না, আমায় আশ্চর্য করেছিল এই ট্রিলজিতে টালমাটাল সময়কে সত্যজিৎ জুড়ছেন সময় দিয়েই। হ্যাঁ, সময়। রূপকে আনছেন ঘড়িকে।
প্রতিদ্বন্দ্বীতে সিদ্ধার্থর ঘড়ি ভেঙে যায় হাত থেকে পড়ে। বিপ্লবের স্বপ্ন (ভাইয়ের সাথে কথোপকথন এবং আয়নায় নিজের মধ্যে চে’কে খুঁজে নেওয়া) যখন ভেঙে যায় বাইরের বিড়ালের গোঙানিতে, সিদ্ধার্থ টেবিলের ওপর থেকে কিছু একটা ছুঁড়ে মারে ওই শব্দ লক্ষ করে। ক্যামেরায় হাতের পাশেই দেখানো হয় ঘড়িকে।
সীমাবদ্ধতে টুটুল (শ্যালিকা) এই শহরে এলে শ্যামলেন্দু তাঁকে একটি ঘড়ি দেয়। মফঃস্বল থেকে আসা টুটুলকে শহুরে সময়ের দ্যোতক এই ঘড়ি, এভাবে যদি নাও ভেবে নিই, তাহলেও একদম শেষে এসে দেখা যায় যে শ্যামলেন্দুর থেকে ঘড়ি নিয়েছিল টুটুল, সিনেমার একদম শেষে সম্পূর্ণ পালটে যাওয়া শ্যামলেন্দুকে সেই ঘড়ি ফেরত দেয় টুটুল। উপরে উঠতে গিয়ে, ক্রমশ আরও উপরে উঠতে গিয়ে সময় যে এতো দ্রুত পালটে গেছে.. !
জন অরণ্যে বরং ঘড়ি আর রূপক হিসেবে থাকে না। অনেকটা প্রকট হয়ে ওঠে। চল্লিশ পার্সেন্টের মধ্যে একজন হওয়ায়, বৌদি ঘড়ি উপহার দেয় সোমনাথকে। সেই ঘড়ির প্রসঙ্গ উঠে আসে প্রেমিকার সাথে শেষ দেখায়। ঘড়ি কিন্তু ‘ক্লাস’ রিপ্রেসেন্টেটিভ তখন। নটবর মিত্তিরের ঘড়ি সেটাই বুঝিয়ে দেয়। আর এই ঘড়ি বন্ধক রেখেই বন্ধুর বোনকে হোটেলের ঘরে রেখে আসে সোমনাথ... সময়টাকে পালটে দেওয়ার আশায়।
সত্যজিৎ ভাবান। কিন্তু জোর করে দেখান না।
সুকুমারের তথ্যচিত্র। ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ পড়তে গিয়ে তার নাট্যরূপে যে কারোরই স্বাভাবিকভাবে মনে আসবে বয়সে ছোটোদের দিয়ে চরিত্রে অভিনয় করানোর কথা। কিন্তু সত্যজিৎ তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে গিয়ে প্রতিটা চরিত্রে নিয়ে এলেন বড়দের। অপ্রত্যাশিতভাবে। যা ছোটোরা করে, তা বড়োরা করলে সে যে আরও মজাদার হবে তা বলাই বাহুল্য। এই নিয়ম পালটে নেওয়া সত্যজিৎ বারবার করেছেন। তাঁর আগে বা পরেও টাইপেজের ব্যবহার সার্থকভাবে কতজন করেছেন? অথচ সত্যজিতের প্রায় প্রতিটি ছবিতে টাইপেজের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
তেমনই রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। কালার ছবির যুগেও সত্যজিৎ কিন্তু সাদা কালোয় ছবি বানিয়ে চলেছেন। এবং রঙ সেখানেই আনছেন, যেখানে শৈল্পিক কারণে রঙের প্রয়োজন। অশনি সংকেতে রঙ আনছেন, কেন? বিভূতিভূষণ লিখছেন, এই দুর্ভিক্ষে মানুষের জীবনযাত্রা ধূসর হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃতি তার সজীবতা হারায়নি। এই প্রকৃতির সজীবতা ধরার জন্য প্রথমবার রঙের ব্যবহার করছেন সত্যজিৎ। (কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক্সপেরিমেন্ট রঙ এবং তাও multi coloured নয়। একই কথা গুপী গাইন বাঘা বাইনের শেষ কয়েকটা ফ্রেমের ক্ষেত্রে খাটে)।
একই বিষয়কে নানাভাবে পাঠ দেওয়া সম্ভব, এটা সত্যজিৎ জানেন। ঠিক এই কারণেই ‘হীরক রাজার দেশে’তে যেভাবে ঘুষ আসে, ‘জন অরণ্য’তে সেটাই আরও ‘ডার্ক’ হয়ে ওঠে।
সলিল চৌধুরীর আগে বাংলা গানে যন্ত্রের (ইন্সট্রুমেন্টের) ব্যবহার হত গানের পরিপূরক হিসেবে। ইন্টারল্যুড বা প্রিলিউডে গানেরই সুরের ধরতাই চলত। সলিল আসার পর, বাংলা গানে, ইন্সট্রুমেন্টের মধ্যে দিয়ে বলার যুগ এলো। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ গানটুকু নিলেই বোঝা যাবে এখানে আলাদাভাবে ইন্সট্রুমেন্ট একটা বক্তব্য প্রকাশ করছে।
সত্যজিতের হাত ধরে বাংলা সিনেমায় প্রথমবার শব্দ এক প্রধান ভূমিকা পেল। ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর শুধুমাত্র মিউজিক্যাল নয়, নগরজীবনের শব্দকে তিনি নিয়ে এলেন গল্প বলার পরিপূরক হিসেবে। অজস্র উদাহরণ। এই মুহূর্তে যেমন মনে পড়ছে, একই শব্দ জলসাঘরের ক্ষেত্রে আমরা পাই অনেকটা ক্ষীণভাবে আর মহানগরের ক্ষেত্রে পাচ্ছি জোরালোভাবে। অবচেতনে হলেও সত্যজিৎ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, জলসাঘরের জমিদার বাড়ির থেকে অন্যান্য বাড়িগুলো অনেকটা দূরে আর মহানগরের ক্ষেত্রে সেটাই অনেকটা কাছে চলে আসছে।
• মহানগরে বৃদ্ধ মাষ্টারমশাই বলছেন, ‘কলকাতাটা যে এতো চেনজ করে গেছে এ কথা ভাবতেও পারিনি বৌমা।’ ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ‘চণ্ডালিকা’ ভেসে আসে – ‘মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়...’
• মহানগর। সুব্রত আরতি আলোচনা করছে যে আরতি ঘরকন্না করবে, না, অফিসেই কোনো চাকরী। পাশের বাড়ি থেকে রেডিওর কর্কশ আওয়াজ। কাঁটা ঘুরিয়ে নতুন চ্যানেল ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেউ।
• আরতি যেদিন চাকরী পেল। সুব্রত বাবাকে জানাবে সে খবর। পাশের বাড়ি থেকে রেডিওয় ভেসে এলো, ‘সারা দেশে আজ প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হয়েছে’।
এইরকম উদাহরণ সত্যজিতের সিনেমায়, কাজে প্রচুর। একজন শিল্পীকে আপাতভাবে দেখা যায়। কিন্তু তাঁর কাজের সার্থকতা সেখানেই যখন ছোটো ছোটো এমন উপাদান খনন হতে থাকে তাঁর তৈরী কাজের বহু বহু বছর পরেও। সত্যজিতের সিনেমার কাছে বারবার ফিরে আসা যায় এই কারণেই। তাঁর লেখার কাছে, তাঁর আঁকার কাছে। তাঁর জীবনদর্শনের কাছে, যাপনের কাছে। সত্যজিৎ স্বাভাবিকভাবেই, অতি সহজে পথ হেঁটে চলেন। পথের পাশে কতোকিছু পড়ে থাকে। তিনি চিঠি রেখে যান অনেক। আমরা কেউ কেউ পাই, কেউ কেউ পাই না। সেই চিঠি কেউ পেয়েও পথ হারাই। আফশোসের বিষয়, সত্যজিৎ সময়ের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র আলো হিসেবে থেকে যাবেন। তাঁর সেই আলো, সেই পথভাঙা পথ ধরে হেঁটে চলার পথিক খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
গ্রন্থসাহায্যঃ
• রং তুলির সত্যজিৎ / দেবাশীষ দেব / সিগনেট প্রেস
• সাক্ষাৎকার সমগ্র – সত্যজিৎ রায় / পত্রভারতী