সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৩
স্বাদেশিকতা পর্ব ১৮০৯-১৮৭২
কিছু শব্দ কিছু কথা
সাধারণভাবে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীকে বাংলায় নবজাগরণের যুগ হিসেবে ধরা হয়। আবার সেই ঊনবিংশ শতাব্দীরই দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অর্থাৎ মার্ক্স কর্তৃক অভিহিত ১৮৫৭র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকে ধরা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয় আন্দোলনের যুগ। এই প্রবন্ধে কিন্তু সময়ের এই ভাগকে সে হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। যুগটা নবজাগরণের হলেও তার মূল শক্তি বা প্রেরণাটা কি? লেখকের মতে সেটা স্বাদেশিকতা। এই স্বাদেশিকতা দেশে সবসময়ই ছিল, কিন্তু তার ধার কমে গিয়েছিল। নতুন বিরোধের সংস্পর্শে এসে সে নিজেকে শানিয়ে নেবার অবকাশ পায়। তাই ১৮০৯ থেকে ১৯০৯ সাল এই একশ বছরকে দুটি কালপর্বে ভাগ করে বাংলায় স্বাদেশিকতার কাল হিসেবে দেখানো হল। ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ সাল একটি কালপর্ব, ১৮৭২ থেকে ১৯০৯ সাল আর একটি কালপর্ব। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ ডানা মেলতে শুরু করে এই ১৯০৯ সাল থেকেই, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে যার অন্তিম পরিণতি দেখতে পাই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায়।
এই স্বাদেশিকতার প্রথম কালপর্ব হল ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ। এই সময় জুড়ে দেখি আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষা ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। সব মিলিয়ে একে বলতে পারি সমাজসংস্কার। ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দে পৌঁছে এই প্রেক্ষাপটটা অনেকটাই বদলে গেল। এমন নয়, যে সমাজসংস্কারের চেষ্টাগুলো আর রইল না, কিন্তু ঐ বছরই বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হবার পর থেকে বাংলায় স্বাদেশিকতার পালে যে হাওয়া লাগল, তাকে আর শুধুমাত্র সমাজসংস্কার বলা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের বলিষ্ঠ লেখনীতে একদিকে যেমন প্রবল দেশপ্রেমের হাওয়া বইতে লাগল, অপরদিকে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। দেশে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল স্বাধীনতার আকাঙ্খা। সেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হল জাতীয়তাবাদে। এবং ১৯০৯ সাল থেকে এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের উপজ হিসেবেই জন্ম হল ক্ষমতার কাঙালপনার, যার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, চুরমার হয়ে গেল মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের কল্পনা, যদিও আপাতদৃষ্টে আমরা এক স্বাধীন ভারত পেলাম।
একটা শব্দ অনেক কথা বলে। যেমন, স্বাদেশিকতা। স্বাদেশিকতা এসেছে স্বদেশ থেকে, নিজের দেশ। গোড়ায় দেশ। ব্রিটিশরা যখন এ দেশটাকে রাষ্ট্রে পরিণত করে নি, তখনো দেশ ছিল। কিন্তু তখন ভারতবর্ষ ছিল একটা ধারণা, বিশেষ করে মহাকাব্যগুলির সূত্রে যে ধারণা সমাজমানসে অধিষ্ঠিত ছিল। আর দেশ বলতে যে নির্দিষ্ট জায়গায়--প্রধানত গ্রামে-- একজন মানুষ থাকত সেটা হত তার দেশ, আবার যে জনপদের সে অধিবাসী সেটাও হত তার দেশ। দেশ শব্দটার দ্বৈত অস্তিত্ব।
স্বাদেশিকতা কোনো উপনিবেশিক উপাদান নয়। স্বাদেশিকতা আধুনিক শব্দ, কিন্তু স্বাদেশিকতা দিয়ে যেটা বোঝায় সেটা আধুনিক নয়। সেটা হল দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম। নিজের দেশকে ভালোবাসাটা সর্বজনীন ও সর্বকালীন সত্য, সে যে যে দেশেরই হোক না কেন। দেশ মানে শুধু দেশের মানুষকে ভালোবাসা নয়। দেশ মানে দেশের আলো, হাওয়া, জল, মাটি, গাছপালা, পশুপাখি থেকে শুরু করে পাহাড়, অরণ্য, গ্রাম, শহর, মানুষের মন, তাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং দেশপ্রেম মানে এই সবকিছুর সঙ্গে একাত্মবোধ, যেমনটি পাই কালিদাসের মেঘদূতে রামগিরি আশ্রম থেকে অলকাপুরীতে যাবার যক্ষের দেওয়া দীর্ঘপথের বর্ণনায়। “যাও না বন্ধু, পথ বলে দিচ্ছি আমি। পথ তোমার ক্লান্তিকর হবে না। পাবে জল, পাবে ছায়া, পাবে সৌধোৎসঙ্গের উষ্ণতা। চোখ, কান দুই-ই জুড়োবে তোমার। দেখবে মধুর দৃশ্য, শুনবে কিন্নরীদের গান, শুধু একটু মন্দ্রধ্বনি যদি কর মৃদঙ্গের সঙ্গত হবে শিবসঙ্গীতে। কেকাধ্বনিতে স্বাগত জানাবে সজলনয়ন ময়ূরেরা। নদীদের ভ্রুভঙ্গী তো দেখবেই, নগরবধূদের ভ্রুলতাবিলাসও নিশ্চয় তোমার দৃষ্টি এড়াবে না। চোখ তুলে তারা তোমার দিকে যখন চাইবে, মনে হবে কৃষ্ণভ্রমরের পঙক্তি। এ সব দেখতে দেখতে তুমি কৈলাসে এসে পড়বে, আর কৈলাসের কোলেই তো অলকা।”
ভাবের কথা ছেড়ে যদি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসি, তাহলেও দেখব একজন দেশপ্রেমিক চায় যেন তার দেশের আলো, হাওয়া দূষিত না হয়, যেন জল, জঙ্গল, জমি ধ্বংস না হয়। যেন তার দেশে দারিদ্র না থাকে, শোষণ না থাকে, বঞ্চনা না থাকে, হিংসা না থাকে। যেন তার দেশটা আরো সহনশীল হয়, আরো গণতান্ত্রিক হয়, প্রকৃতিগতভাবে যেন দিন দিন আরো inclusive হয়। যেন তার দেশের ভাষাগুলোর দিন দিন সমৃদ্ধি ঘটে, যেন যার যার ধর্ম অটুট থাকে। অবশ্যই সে চায় দেশকে এবং নিজেকে সুরক্ষিত দেখতেও। নিজের দেশের সম্পর্কে সে যেমন এইসব চায়, বিশ্বের সব দেশের সম্পর্কেই সে একই কামনা করে। যেন সব দেশই শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে, আনন্দে থাকে, সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তার এসব চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষমতার গন্ধ নেই। সে নিজের জীবনযাত্রার ধরন, নিজের বিশ্বাস, নিজের মূল্যবোধ, নিজের ঐতিহ্য, নিজের ভাষা, নিজের ধর্ম যে কোনো কিছুর মূল্যে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু চায় না সেসব অন্য কারুর ওপর চাপিয়ে দিতে। তার মধ্যে কোনো আগ্রাসী ভাব নেই, স্বভাবগতভাবেই সে রক্ষণশীল। এই ধারণাতেও সে ভোগে না যে তার দেশ ভুল করলেও দেশপ্রেমিক হিসেবে তার একমাত্র পবিত্র কর্তব্য তাকে সমর্থন করা, My country right or wrong। কারণ একজন দেশপ্রেমিক নিজের দেশকেও নৈতিকতার মানদণ্ডে যাচাই করে। এবং চায় না যে তার দেশের নৈতিক অধঃপতন হোক। স্বাদেশিকতার সঙ্গে নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।
স্বাদেশিকতার কথা উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের কথাও ওঠে। অতএব দেখা যাক জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ শব্দটা আবশ্যিকভাবেই আমাদের দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি করা একটি শব্দ। জাতি শব্দটা নিয়ে গোড়া থেকেই সমস্যা। জাতির অর্থ কী? ইংরেজিতে জাতির অর্থ করা হয়েছে nation। কিন্তু ঠিক তাই কী? ইংরেজিতে জাতির অন্তত চাররকম মানে পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় জাতি অর্থে race, যেমন ককেশীয় জাতি, নিগ্রো জাতি, মঙ্গোলীয় জাতি। জাতি অর্থে nationও, যারা যৌথভাবে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস, নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের অংশীদার এবং একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণ, যেমন ব্রিটেন। আবার জাতি অর্থে ethnic groupও, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, আসলে raceএরই ক্ষুদ্রতর শ্রেণিবিভাগ, যেমন ককেশীয় জাতির একাধিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ানরা এবং জার্মানরা উভয়েই ককেশীয় জাতির অন্তর্গত, কিন্তু রাশিয়ানরা স্ল্যাভিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, জার্মানরা নরডিক। এবং চতুর্থত মোহম্মদ আদিবের মতে, জাতি অর্থে tribeও, যদিও তাদের আমরা উপজাতি হিসেবেই চিহ্নিত করি। তিনি লিখেছেন, “উপজাতির সংজ্ঞাটি বেশ গোলমেলে, কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে উপজাতি বলতে রাষ্ট্র স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষদের বোঝায় যাদের মোটামুটি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ রয়েছে।” উদাহরণস্বরূপ তিনি চাকমাদের কথা বলেছেন। চাকমারা একটি ছোট অঞ্চলের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও মারমা, ত্রিপুরা সহ অন্যান্য উপজাতিদের থেকে আলাদা, তাদের রয়েছে একই সঙ্গে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রয়েছে নিজস্ব রাজা, আবার তারা একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম গোলমেলে। জাতি বলতে একই সঙ্গে বোঝায় বর্ণ, জাতি, জাত, এমনকি কখনো কখনো সামাজিক শ্রেণিও। অহিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বর্ণ, জাতি বা জাত খাটে না বটে, কিন্তু তাদেরও রয়েছে নানারকমের ভাগ।
এই জাতি থেকে আরো কতকগুলো শব্দ এসেছে। জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) বা রাষ্ট্র-জাতি (state-nation)। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বলা হয় জাতি বা nation হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাতিসত্তা, রাষ্ট্র নয়। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে বলে রাষ্ট্র। যখন একটি জাতির নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকে, একমাত্র তখনই সে হয়ে ওঠে জাতি-রাষ্ট্র। প্রশ্ন ওঠে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে রাষ্ট্র বলে যদি মেনেও নিই, তার অন্তর্গত জাতিসত্তাটি কি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ অভিন্ন? পৃথিবীতে এমন দেশ কি খুব বেশি আছে? নেই যে তার প্রমাণ আমরা সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দিয়ে পেয়েছি। এখানেই জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। ভারত যেহেতু বিবিধের মাঝে মিলন মহানের দেশ, যোগেন্দ্র যাদবরা জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পালটা রাষ্ট্র-জাতি তত্ত্ব হাজির করেছেন। যদিও তাতে করে সমস্যা মেটে না।
যে অর্থে ভূখণ্ড হিসেবে দেশের একটা নির্দিষ্টতা আছে, nation বলে অভিহিত করে জাতিকেও সেইরকম একটা নির্দিষ্টতা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে সংকট বেড়েছে ছাড়া কমেনি। কারণ প্রাণ-অপ্রাণের নানা বৈচিত্র্য, নানারকমের মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম সবকিছুর মিশেল ঘটেছে দেশ শব্দে, চরিত্রগতভাবে সে সর্বপ্রকারে inclusive। কিন্তু জাতি শব্দটা যেহেতু একান্তভাবে মনুষ্যকেন্দ্রিক, চরিত্রগতভাবে সে এমনিতেই exclusive (অর্থাৎ মনুষ্য ব্যতীত কোনো ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়), তার ওপর nation শব্দে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করায় তার exclusivity বেড়ে গেছে। তাছাড়া, দেশে অন্য আরো অনেক কিছুর মতন মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মেরও ঠাঁই আছে, কিন্তু বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের নির্দিষ্টতার ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে যাওয়ায় nationএ মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। ডালিয়া গেব্রিয়াল, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের এক ছাত্রী, এ নিয়ে বলেছেন,nation শব্দটার সবথেকে বড় সমস্যা এই যে, nationহতে গেলে তাকে আগে নির্দিষ্ট করে নিতে হয় কারা কারা তার পরিধির বাইরে। এই বাইরের লোকজনের তালিকায় সবার আগে থাকে পরিযায়ীরা (অর্থাৎ মানুষের চলিষ্ণু ধর্মের কোনো ঠাঁইnation-এ নেই), তার পরে থাকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া লোকজন, সন্দেহজনক ব্যক্তিরা, মেয়েরা এবং অক্ষমরা। এবং যেহেতু তারা nationএর পরিধির বাইরে, তাদের অকল্পনীয় হিংসার শিকার হতে হয়। কেন এমন হয়? কারণ,nationগড়ে ওঠে যুক্তিবহির্ভূত জাতিসত্তাকে (বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায়, কল্পিত) কেন্দ্র করে এবং অন্য যারা এই পরিধির বাইরে, তাদের জীবনের কোনো মূল্য তাদের কাছে থাকে না। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। nation শব্দটাকে ঘিরে এতসব ঝামেলা এড়াতে আন্তর্জাতিক আইনে এখন আর nation অর্থে জাতি ধরা হয় না, একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে, যেখানে অনেক লোক একসাথে বাস করে, nation বলা হয়।
জাতি থেকে জাতীয়তা থেকে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেক প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে “রাষ্ট্রকৃত সমস্ত ভালো মন্দ ক্রিয়াকলাপ ছাপিয়ে নিজেকে তার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার এবং সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রের স্বার্থকে ঠাঁই দেওয়ার প্রবণতা।” তাঁর বিশ্লেষণে, ক্ষমতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা, জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপ্ত থাকে ক্ষমতার আকর্ষণ। রাষ্ট্র চায় যে কোনো কিছুর মূল্যে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে, নিজেকে সর্বাধিক সম্মানিত করে তুলতে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে আর যেহেতু জাতীয়তাবাদী মানুষ ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে, রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে অভিন্ন করে ফেলে, তার চাওয়াগুলোও রাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তখন সেই ব্যক্তিমানুষ যেহেতু সে রাষ্ট্র নামক এক বৃহৎ শক্তির পক্ষ নিয়েছে, তার উচ্চমন্যতার কারণে কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি আর শুনতে চায় না এবং সামান্যতম সমালোচনা তাকে হিংস্র করে তোলে। শুধু তাই না, তার নিজের ঘটানো হিংসামূলক ঘটনাগুলোকে অব্দি সে অস্বীকার করতে থাকে। আর তবু মানতেই হবে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আমাদের এখানে (এবং মহারাষ্ট্রে) যে স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেধেছিল, ১৯০৯ সালে তাই পরিণত হয় পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদে।
স্বাদেশিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা হচ্ছে এই—স্বাদেশিকতা মৌলিক রূপে কোনো বিদেশি জিনিস নয়, যদিও স্বাধীন দেশের স্বাদেশিকতা একরকম, পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা আর একরকম। পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত, যেমন, ইংল্যান্ড স্বাধীন দেশ, সপ্তদশ শতাব্দীর সেই ইংল্যান্ডে যেভাবে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে সার্বিক প্রতিরোধের মাধ্যমে খর্ব করে দেওয়া গিয়েছিল, আমাদের এখানে তা সম্ভব ছিল না। বিদেশী শাসনের শুরুতেই উপনিবেশিক শাসক যেভাবে আমাদের হিন্দু ও মুসলমান দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল এবং যেভাবে ক্রমাগত মুসলমানদের সর্বক্ষেত্র থেকে হটিয়ে বর্ণহিন্দুদের সেই জায়গায় তুলে এনেছিল, তারপর কোনো প্রতিরোধই আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হওয়া সম্ভব ছিল না। জাতীয়তাবাদ কিন্তু সে অর্থে সীমায়িত নয়। জাতীয়তাবাদ শব্দ এবং সে আদর্শের সারবস্তু দুটোই এদেশে খোদ ইয়োরোপের রপ্তানি। ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক নানা ধরনের যে সংগ্রাম চলেছিল, অজস্র অত্যাচার মুখ বুজে সহ্যের বিনিময়ে, অজস্র বলিদানের বিনিময়ে, অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে যা স্বাধীনতা(?) নিয়ে এল, সে সম্পর্কে এককথায় বললে বলতে হয় ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল আর সেই সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বকে তছনছ করে দিয়ে গেল। জাতীয়তাবাদ যদি এত উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল কেন এবং আমাদের অস্তিত্বকে তার শেকড় থেকে উৎপাটিতই বা করে দিয়ে গেল কেন? একথার উত্তরে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, দুর্বল ও দরিদ্র দেশগুলো যে এই আদর্শকে খুব যুক্তিপূর্ণ এবং আত্মশক্তির জাগরণের সহায়ক বলে ভেবেছিল, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কোনো বিচারশীল, উদার, সর্বংসহ, সৃজনশীল আদর্শ নয়। ইয়োরোপের বাইরে কোথাও এ জিনিস ছিলও না। এ হল দেশে দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি। শুধু রপ্তানিই নয়, রীতিমত সর্বনাশা রপ্তানি, কারণ এ কোনো যুক্তি বা মুক্তির সন্তান নয়, বরঞ্চ তার উল্টোটা, উদগ্র কল্পনাবিলাস, রাজনৈতিক ত্রাণকর্তার ভঙ্গির ফসল, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীনতার হত্যা।
ফিরে যাওয়া যাক স্বাদেশিকতায়। আগেই বলা হয়েছে আমাদের স্বাদেশিকতা এই উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত ছিল। সেই সীমায়িত স্বাদেশিকতা আমাদের মধ্যে কী ধরনের উপনিবেশিকতার জন্ম দিল তার ইঙ্গিত দেওয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। যেমন প্রথম থেকেই ভাগ হয়ে যাওয়াতে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারল না। তবু চেষ্টা হয়েছিল, ১৮৫৭ সালে, যাকে আমরা বলি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর একটা চেষ্টার কথাও বলা যায়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৬৩ সালে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল এবং যা ধিকধিকিয়ে চলেছিল ১৮০০ সাল অব্দি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে এর চেহারাটা ছিল ভাঙাচোরা। সেই ভাঙাচোরা দুর্বল আংশিক প্রতিরোধ নিয়ে আমরা যত গর্বই করি না কেন, তা আসলে উপনিবেশিকতা ছাড়া কিছু নয়। ব্রিটিশরা কেন এরকম করেছিল তার কারণ আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং শাসকের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি থেকেই ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। যদিও ভারততত্ত্ব তখনো দানা বাঁধেনি, কিন্তু ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এদেশে এসেছিল। বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি থেকে, তাদের দেশ থেকে যেসব লোক মোঘল আমলে এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের প্রদত্ত বিবরণ থেকে তারা এসব খবর সংগ্রহ করেছিল।
উপনিবেশিক ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার থেকে যে উপনিবেশিকতার জন্ম তার বোঝা আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। উপনিবেশিক ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত এই স্বাদেশিকতা আর্থ-সামাজিক স্তরেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সবথেকে বড় উদাহরণ হল জমির পণ্য হয়ে যাওয়াটা আমরা বিনাবিচারে মেনে নিলাম। জমিতে আগে কৃষকদের মালিকানাস্বত্ব ছিল এটা জেনেও রামমোহন কৃষকদের দখলিস্বত্বের কথা বললেন। আগে জমিদারদের কোনো দখলীস্বত্বই ছিল না, তারা ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। ব্রিটিশ আমলে ব্যাপারটা পুরো উল্টে গেল। এখন হয়ে দাঁড়াল কৃষকের দখলিস্বত্ব আর জমিদারদের মালিকানাস্বত্ব (যদিও আপাতদৃষ্টে, কেননা রাজস্ব ঠিকমত দিতে না পারলে জমিদারিও নিলামে উঠত এবং হস্তান্তরিত হত)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জমিদাররা জমি নিয়ে যা খুশি করতে পারত। স্বাধীনমত জমি কেনাবেচা করতে পারত, কৃষকের কাছ থেকে মোটা রকমের খাজনা আদায় করতে পারত, জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করতে পারত। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিতে সরকারি খাজনার রকমফের হত। কোনোবছর অনাবৃষ্টি হয়ে উৎপাদন কমে গেলে সেই অনুযায়ী খাজনা দিলেই হত। এখন সরকারি খাজনার পরিমাণের কমাবাড়া বলে কিছু রইল না, উৎপাদন যাই হোক না কেন। সেই খাজনার ওপর আবার জমিদাররা আবওয়াব ইত্যাকার নানারকমের অন্যায় দাবি চাপিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস তুলল। জমিদারের খাজনা এবং বাড়তি আবদার মেটাতে গিয়ে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে লাগল। সে ধার মেটাতে না পেরে হয় মহাজন নয় জমিদারদের কাছেই জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতে লাগল। দেখতে দেখতে কৃষকদের একটা বিশাল অংশ পরিণত হল ভূমিহীন খেতমজুরে। ওদিকে ইংরেজ শাসনের দৌলতে দেওয়ানি বেনিয়ানি মুচ্ছুদিগিরি করে যারা দেদার টাকা আয় করেছিল, নিলাম হওয়া পুরোনো জমিদারিগুলো তারা ক্রমান্বয়ে কিনে নিতে থাকল। কিন্তু তারা বেশির ভাগই কলকাতার বিলাসব্যসনে আসক্ত এবং শহর ছেড়ে থাকতেও চায় না, ফলে জমিদারিগুলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ সম্পর্ক হত ক্ষীণ। এইভাবে জন্ম হল একদল অনুপস্থিত জমিদারের। এইসব নতুন জমিদার না জমিদারি পরিচালনার কিছু বুঝত, না জমিদারি থেকে পাওয়া লাভ ছাড়া আর কোনোকিছুতে তাদের উৎসাহ ছিল। জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের ও তদারকির দায়িত্ব তারা যাদের ওপর ছেড়ে দিতে থাকল, তারাই জন্ম দিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির— পত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, পাঁতিদার, তালুকদার, ইজারাদার, জোতদার ইত্যাদির।
এ পর্যন্ত এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষণীয় রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষতা করলেন এই যুক্তিতে যে এর ফলে পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে আয়বৃদ্ধি হবে এবং তার জন্যে খাজনা বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তিটা যে ভুল তা আগেই দেখানো হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন)। বেশির ভাগ পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেই চাষবাস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল আমলে। অতএব কৃষকের দ্বারা জমির উন্নতি ইংরেজ আমলের ঘটনা ছিল না। অবশ্য কৃষকের দুর্দশার প্রতিবিধান করতে গিয়ে রামমোহন গবর্নমেন্টের সঙ্গে জমিদারের যেরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রজার সঙ্গেও তেমনি জমিদারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন, কেননা কৃষক জমির উন্নতি করলেই যদি জমিদার খাজনা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কৃষক আর জমির উন্নতি করার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। হতে পারে রংপুরে থাকতে যে কৃষক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, জমিদারের সঙ্গে কৃষকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবের নেপথ্যে সেই সম্পর্কের একটা ভূমিকা ছিল। রামমোহন কৃষির উন্নতির জন্যে সরকারকে একটি কৃষি দপ্তর খোলার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
এহ বাহ্য। এই ‘কৃষির উন্নতি’ ব্যাপারটা কী? যে দেশের সমাজটাই কৃষিপ্রধান, বাইরে থেকে এসে একদল শাসক তার কী উন্নতি করতে পারে? যে দেশের কৃষক দিবারাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার জমি চষে চলেছে, যে তার জমিকে হাতের তালুর মত চেনে, তাকে কৃষির উন্নতির ব্যাপারে পরামর্শ দিতে যাবার এই চেষ্টা কেন, তাও আবার পরামর্শদাতা তাঁরা যাঁরা কৃষির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। রামমোহন থেকে এই সংস্কৃতি ঊনবিংশ শতাব্দী হয়ে আজো বহমান।
এই প্রবন্ধে প্রতিটি কথা প্রমাণসহ বলা সম্ভব নয়, মোটের ওপর ব্যাপারটা হচ্ছে এই, ভারতীয় কৃষিকে আদিম পর্যায়ের ও পশ্চাৎপদ বলে দেগে দিয়ে ব্রিটিশের দিক থেকে কৃষির উন্নতির আয়োজন করার দুটো বড় কারণ ছিল। খাজনা নির্দিষ্ট করে দেবার ফলে একদিকে বিশাল পরিমাণ কৃষক প্রতিদিন খেতমজুরে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল এবং অপরদিকে ব্রিটিশ কর্তৃক কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে বিশাল পরিমাণ কারিগর সেই কৃষিকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছিল এবং এই পরস্পরবিরোধী অবস্থার মধ্যে পড়ে আমাদের কৃষিক্ষেত্র ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল এবং একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটছিল। এই অব্যবস্থাকে চাপা দিতে ব্রিটিশ একদিকে কৃষির উন্নতিতে কৃষকের অনাগ্রহের কথা চাউর করেছিল এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে কৃষির উন্নতি তত্ত্বকে সামনে এনেছিল। কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ হল, শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে এইসময় যেসব কৃষি সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ হয়েছিল, বিশেষ করে লাঙল এবং কাস্তের, ভারতে সেসবের বাজার তৈরি করা। ঐসব লাঙল এবং কাস্তে বিক্রি থেকে একটা আয় আসবে, তার ওপর ঐসব লাঙল ও কাস্তে ব্যবহারের ফলে জমি বেশি উর্বর হবে, উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন বাড়লে জমির আয় বাড়বে, জমির আয় বাড়লে রাজস্ব বাড়বে, পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি শুল্কও বাড়বে।
মাইকেল মধুসূদন যখন উত্তরপাড়ায় ছিলেন, তখন উত্তরপাড়া হিতকারী সভা কৃষিবিদ্যা নিয়ে বলতে ডাকেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্রকে। সভার বিষয় শুনে মাইকেল বলেছিলেন, “কৃষিবিদ্যা নিয়ে আবার বক্তৃতা কি? চাষারা কি জানে না কি করে ধান বুনতে হয়। খাচ্ছ কি করে? তাদের আবার কৃষিবিদ্যা কি শেখাবে?”
ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে বলতে গিয়ে জন অগুস্টাস ভোয়েলকার বলেছিলেন, “বেশির ভাগ জায়গাতেই উন্নতি করার মত প্রায় কিছুই নেই।” জন কেনি বলেছিলেন, “যেখানে একটা প্রদেশেই চার হাজারের মত ধানের প্রজাতির উৎপাদন হয় এবং প্রত্যেকটা প্রজাতিকে তার গুণাগুণ ও তার উপযুক্ত জমি অনুযায়ী ভাগ করে চাষ করা হয়, সেখান থেকে বীজ সংগ্রহের কোনো মানে হয় না। এমনকি ভারতীয় কৃষিতে আধুনিক লাঙলের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না।” আর ১৮৩২ সালের ১৩ অগস্ট কমনস কমিটির সামনে দেওয়া সাক্ষ্যে বটানিকাল গার্ডেনের তৎকালীন সুপারিন্টেডেণ্ট ড. ওয়ালিক বলেছিলেন অধিক ফসলের স্বার্থে বাংলার নরম মাটিতে ব্যবহৃত সনাতনী লাঙলের বদলে ইয়োরোপীয় লোহার লাঙল ব্যবহার করার ফলে নিচের নোনা মাটি উঠে জমির ক্ষতি হয়ে যাবার কথা।
স্বাদেশিকতার অন্য উদাহরণগুলো হল, যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষার ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। ডিরোজিওর ছাত্ররা যে এ ব্যাপারে খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলির সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে সবথেকে বেশি যাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরেরও রামমোহনের মত ক্ষুরধার বিচারশীল মন ছিল, তিনি শাস্ত্রঘেঁষাও ছিলেন না, বরঞ্চ রামমোহনের তুলনায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অনেক কম, আর তবু তাঁকে তাঁর সমাজসংস্কারের কর্মসূচিগুলোকে সফল করতে বারে বারে শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কেন? ১৭৭২ সালে দশ জন পণ্ডিতের সাহায্যে ওয়ারেন হেস্টিংস শ্রুতি, স্মৃতি, শাস্ত্র ও ব্যবহার এই চার উপাদানের ওপর নির্ভর করে হিন্দু আইন বিধিবদ্ধ করলেন। এর ফলে গোটা সমাজের বুকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য আরো চেপে বসার সাথে সাথে শাস্ত্রকে এড়িয়ে সমাজসংস্কার অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এটা রামমোহনের পক্ষেও সত্যি ছিল। ব্রিটিশ আসার আগে আমাদের দেশে শাস্ত্র ছিল, ধর্মীয় গোঁড়ামোও ছিল, কিন্তু এরকম কোনো ব্রিটিশ ধাঁচের সুসংহত হিন্দু আইনের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল না। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রাক-ব্রিটিশ সমাজেও ছিল, কিন্তু তখন কি রাষ্ট্রীয় পরিসরে কি সামাজিক পরিসরে, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় সমাজের পরিসরে, তার প্রতাপ ছিল সীমাবদ্ধ। এর পরের দফায় ১৭৮৪ সালে আমাদের এখানে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ব্রিটিশ কর্তৃক যে সুশৃঙ্খল সংস্কৃতচর্চার জোয়ার এল, যাকে বলা হতে লাগল ভারততত্ত্ব, তার জোয়ারে আমাদের দেশীয় পণ্ডিতদের সংস্কৃতচর্চা তলিয়ে গেল। প্রথমে আইন, তারপর তার খোপের মধ্যে সংস্কৃতচর্চাকে পুরে দিয়ে শাসক গোষ্ঠী এ দেশ সম্পর্কে যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তৈরি করল, তাকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ‘epistemic violence’ বা ‘জ্ঞানতত্ত্বমূলক হিংসা’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশের হাতে গড়ে উঠল এক নতুন হিন্দুসমাজ, যার কর্তৃত্ব ব্রাহ্মণদের হাতে। অনেক পরে ১৯২৫ সালে সেই হিন্দুসমাজের পক্ষ নিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বললেন, “যাবতীয় রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং বিদেশি আক্রমণের মধ্যে হিন্দুসমাজকে অখণ্ড রাখতে ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষরাই সবকিছু আইনের আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেইসব আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতম করে তুলেছিলেন।” চৈতন্য ও সূফী আন্দোলনের ফলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব থেকে যে সমাজ অনেকটাই ছিটকে গিয়েছিল, শাসনের সুবিধার্থে তাকে ব্রিটিশ আবার সংহত করে তুলে সমান এবং সহায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত করল। এক আধিপত্যের সঙ্গে আর এক আধিপত্যের সহাবস্থান ঘটল। যে হিন্দুসমাজের উত্তরাধিকার আমরা এখনো বহন করে চলেছি, সে হল এই হিন্দুসমাজ।
আসা যাক মেকলের কুখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’এর কথায়। প্রধানত যে দুটো কারণে মেকলের মিনিট কুখ্যাত, তার একটা হল মেকলের বাগাড়ম্বর, “ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান,” দ্বিতীয়টা হল তাঁর উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা, “এই মুহূর্তে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে একটি শ্রেণি গঠন করার, যারা আমাদের এবং কয়েক কোটি মানুষ যাদের শাসনভার আমাদের হাতে, তাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এমন এক শ্রেণি যারা রক্তে এবং রঙে ভারতীয় হবে, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হবে।” মেকলের বাগাড়ম্বর নিয়ে কিছু বলার নেই, সে মূর্খতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার, কিন্তু মেকলের উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা নিয়ে ঈষৎ ভাবার আছে। কেননা এর ঠিক পরেই মেকলে লিখেছিলেন, “এই শ্রেণির হাতে আমরা দেশের আঞ্চলিক মাতৃভাষাগুলোর সংস্কৃতিসাধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারি, যারা পশ্চিম থেকে বিজ্ঞানের শব্দাবলী নিয়ে ঐসব আঞ্চলিক ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে এবং ভাষাগুলোকে ধীরে ধীরে তারা ঐসব জ্ঞান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উপযুক্ত বাহন করে তুলবে।” মেকলে যদি শুধু আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা বোঝার মত করে গড়ে তোলার কথা বলতেন আর তার জন্যে আমাদের কারো কারো ইংরেজি ভাষাটা জানার ওপর জোর দিতেন, তাহলে তিনি এত নিন্দিত হতেন না। কিন্তু তাঁর বক্তব্য এই দাঁড়াল যে পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারকবাহক যে ইংরেজি ভাষা সেটা জানতে গেলে রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে। যদি ধরেও নিই ইংরেজি ভাষা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারার বাহক, তাহলেও সেটা আত্মস্থ করতে গেলে আমার রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে কেন? তাহলে কি পশ্চিমী বা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা সর্বজনীন নয়, একান্তভাবে ইংরেজ হয়ে উঠতে না পারলে সেগুলো বোঝা সম্ভব নয়? ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা স্পেনকে কি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে কোনো কিছু শিখতে তাদের নিজেদের রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হয়েছিল? মেকলের মতে, ওরকম কথা উঠবেই না, কারণ ওগুলো সবই মহান ইয়োরোপীয় সভ্যতার অংশ, বাদবাকি সব বর্বর দেশ, যেমন ভারত, যাকে সভ্যতার আলো দেখানোর দায়িত্ব তাঁদের হাতে। কোনো বর্বর দেশ যদি ইংরেজের কাছ থেকে কিছু শিখতে চায় তো তাকে সর্বপ্রকারে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে, কারণ ইংরেজের রুচি ইত্যাদি গুণ অর্জন করতে না পারলে সে সেগুলো বুঝে উঠতে পারবে না। এই দম্ভ নিয়ে কথার বিস্তার করে লাভ নেই। শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে নয়, আপাদমস্তক এক উপনিবেশিক শাসকের মতই মেকলে আসলে ইংরেজিনবিশ একটি বশংবদ শ্রেণি গঠনের লক্ষ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন, মেকলের আগে থেকেই যে ইংরেজিনবিশ বশংবদ শ্রেণির গঠন এখানে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিশীল বিচারধারাকে যাঁরা বাংলা ভাষায় আনার চেষ্টা করলেন, তাঁরা কেউই রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে ওঠেন নি। রামমোহন রায় নিজে বাংলায় একটা ভূগোলের বই লেখার চেষ্টা করছিলেন, আত্মীয় সভার সদস্য ব্রজমোহন মজুমদার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ফারগুসনের অ্যাস্ট্রোনমির একটা বাংলা অনুবাদ করছিলেন। তারপর একদিকে এলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সূত্রে অক্ষয় কুমার দত্ত, আর একদিকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এই ধারায় একের পর এক চেষ্টা হল, সেই চেষ্টার শেষ বোধহয় বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন।
আর তবু আধুনিক বিজ্ঞান মাতৃভাষায় সাধারণ মানুষের জ্ঞানতত্ত্বের অঙ্গনে সেভাবে প্রবেশ করতে পারল না। কেন? তার বদলে যেটা ঘটল, সমাজের মধ্য স্তরে ইংরেজি ভাষা নিয়ে দিন দিন বাড়তে লাগল দৃষ্টিকটু রকমের হ্যাংলাপনা, যা ক্রমশ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেল, অপরদিকে আধুনিক বিজ্ঞান শেখার মাধ্যম হয়ে রইল সেই ইংরেজি ভাষাই, যা সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে হয়ে উঠল ক্ষমতার হাতিয়ার।
১৮৩৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মামুদও তাঁর দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের বলেছিলেন, “তোমরা ফরাসিতে ওষুধপত্রের ওপর যেসব বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আছে সেগুলো পড়....আমার উদ্দেশ্য তোমাদের ফরাসি ভাষা শেখানো নয়, আমার উদ্দেশ্য ফরাসি ভাষায় যেসব বিজ্ঞানসম্মত ওষুধপত্র আছে সেগুলোর সম্পর্কে তোমরা জ্ঞানার্জন কর এবং ধীরে ধীরে সেগুলো আমাদের ভাষায় নিয়ে নাও।” আমাদের দেশে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা বিতর্কিত চিঠিটিতে রামমোহনও প্রায় একই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন লাটসাহেব যেন পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে, যেমন অঙ্ক, প্রাকৃতিক দর্শন (এখনকার ভাষায় পদার্থবিজ্ঞান), রসায়ন, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি, আমাদের পরিচয় ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। যেহেতু এসব বিষয়গুলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ছাড়া জানার উপায় নেই, ইংরেজি ভাষার জ্ঞানটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থার প্রেক্ষিত কী? সবথেকে বড় প্রেক্ষিত যে দেশজ বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে এ দেশের সমাজ গড়ে উঠেছিল তা ছিল প্রকৃতিগতভাবে কৃষিপ্রধান আর আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে যে সমাজ ইংল্যান্ডে গড়ে উঠেছিল সে সমাজ ছিল শিল্পপ্রধান। কৃষিপ্রধান সমাজের ও শিল্পপ্রধান সমাজের মনন কি একরকম হতে পারে? কৃষিপ্রধান সমাজের দর্শন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি; শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শন সেখানে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। ইয়োরোপের শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শনের সঙ্গে বেদের এই কথাটার মিল হওয়া কি সম্ভব?
ভুঁই গো, যা তোর এখানে ওখানে খুঁড়ি,
ভরে যাক পূরে যাক সব তাড়াতাড়ি।
ওগো নির্মলা বিদ্ধ না করি যেন
মর্ম তোমার, তোমার হৃদয়খানি।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরে আমাদের দেশের বাকি সাধারণ মানুষ যে এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের প্রতি আত্মিক টান সেভাবে অনুভব করল না, সম্ভবত তার একটা অন্য কারণও আছে। আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক আর এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে ছিল ক্ষমতার সম্পর্ক, আমাদের সহজাত বোধে যার অস্তিত্ব ছিল না এবং যার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন বিরূপতা ছিল? যেসব ধর্মান্দোলনগুলো সমাজসংস্কারের ধারায় হয়েছিল, চৈতন্য থেকে সূফী, তাদের তত্ত্বে কোথাও ক্ষমতার গন্ধ ছিল না।
ব্রিটিশরাও এখানে এমন কোনো শিল্পপ্রধান সমাজ গড়তে চায়নি যে সমাজ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে এবং তার বাজারের দখল ছিনিয়ে নেবে। শিল্পবিপ্লবের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে প্রধানত এদেশকে কাঁচা মালের রসদদার করে তুলতে চেয়েছিল আর এ দেশটা ছিল তাদের কাছে তৈরি জিনিস বিক্রির বিরাট বাজার। কাজেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিমী জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিচয় ঘটানোর ব্যাপারে সরকারের কোনো আন্তরিক চেষ্টা ছিল না। ড. মহেন্দ্রলাল সরকার যখন ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সাহায্য চান, তখন সরকার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় নি। অনীহার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান শিখিয়ে কী হবে, তার চেয়ে বরঞ্চ টেকনিকাল ইন্সটিটিউট বেশি কাজে লাগবে। সরকারের দরকার ছিল কারিগর। যারা বড় বড় যন্ত্র তৈরির প্রাথমিক উপাদানগুলোর যোগান দিতে পারবে। ওদিকে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর কর্মোদ্যোগীদের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথ ছিল বন্ধ।
১৮০৯ সালকে স্বাদেশিকতার প্রারম্ভিক কাল হিসেবে গ্রহণ করার একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮০৯ সালে রামমোহন যখন রংপুরে ডিগবি সাহেবের অধীনে কাজ করছিলেন, তখন দিনের শেষে সন্ধ্যের পর তিনি বাসাবাড়িতে ধর্মালোচনার জন্যে সভা ডাকতেন। প্রতিপাদ্য বিষয় হত পৌত্তলিকতার অসারত্ব ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা। রামমোহনের নিজের কথায়, তিনি চেয়েছিলেন দেশবাসীর মন থেকে যাবৎ ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে তাদের যুক্তিশীল করে তুলতে। কারণ এই ধর্মীয় গোঁড়ামোগুলো শুধু সমাজের বুনটটাকে ধ্বংস করছিল তাই নয়, পরদুঃখকাতরতাকেও তাদের মন থেকে মুছে দিচ্ছিল। এই যে দেশবাসীর কল্যাণের জন্যে চিন্তা, এটা হল স্বাদেশিকতার গোড়ার কথা। ১৮০৯ সালের ধর্মালোচনার সেই সভাগুলো থেকেই ব্রাহ্মসমাজের যাত্রা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে যদি বলি স্বাদেশিকতার যুগেরও শুরু হয়, তাহলে ভুল বলা হবে না। আর একশ বছর পরে ১৯০৯ সালকে স্বাদেশিকতার অন্তিম লগ্ন হিসেবে ধরা হল এই জন্যে যে এই বছরই স্বদেশী আন্দোলনের শেষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল্স্ অ্যাক্টের কারণে বাঙালি ঐক্য দু টুকরো হয়ে যায় অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়ে করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে বাংলাভাগ রদ হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আগেকার ঐক্য আর বজায় ছিল না।
১৯০৯ সাল থেকে জাতীয়তাবাদের যে আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হল, তার অবস্থান রামমোহন রায়ের বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার রামমোহনের কঠোর সমালোচনায় একটা কথা অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই এলিট বাঙালির ‘জাতীয় চেতনার উন্মেষ’ রামমোহন থেকে হয়নি, (তবে তা রমেশচন্দ্রের ধারণা মত ডিরোজিও থেকেও হয়নি, রামমোহনের মত ডিরোজিও-ও ছিলেন দেশপ্রেমিক) জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বঙ্কিমচন্দ্র থেকে। রামমোহন ছিলেন বিশ্বজনীন মানবতাবাদের পূজারী এবং একথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে এই বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ধারণাও তিনি পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। শুধু খ্রিস্টীয় বা ইসলামী নয়, ভারতীয় দর্শনেরও একনিষ্ঠ ছাত্র রামমোহনের এই আদর্শে স্থিত হওয়ার জন্যে পশ্চিমের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার ছিল না। বিশ্বজনীন মানবতাবাদের উদ্গাতা হিসেবে রামমোহন parallel and different narrative অর্থাৎ সমান্তরাল ও ভিন্ন আখ্যানের জনক হওয়ার দাবী করতেই পারেন। রামমোহনের এই ব্যাটনটাই অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে যায় এবং পরিপুষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক রামমোহন তাঁর বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সঙ্গে বেকনের উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদ এবং বেন্থামের হিতবাদ মিলিয়ে যে আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন, চরিত্রগতভাবেই তা ছিল উপনিবেশিক। উপনিবেশগুলো সম্পর্কে বেন্থামের ধারণার কথা আগেই বলা হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন), বেকন আরো তীব্রভাবে উপনিবেশিক শাসকদের সপক্ষতা করেছিলেন।
পশ্চিমে যেমন কোনো আলোচনার শুরু গ্রিসকে ছাড়া হয় না, গ্রিক সাহিত্য গ্রিক দর্শন গ্রিক বিজ্ঞান, আমাদের দেশেও তেমনি উপনিবেশিক শাসনের আলোচনার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণকে ছাড়া হয় না। আর নবজাগরণের শুরু মানেই রামমোহন। শুধু শুরুই নয়, তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে এমনভাবে ছেয়ে আছেন যে তাঁর আলোচনা ছাড়া এগোনো যায় না। রামমোহন একটি খনিবিশেষ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর রচনা, তাঁর চিঠিপত্র, তাঁর কর্মকাণ্ড সবকিছুর যদি ব্যবচ্ছেদ করা যায় তাহলে আমরা পরের প্রায় দুশো বছরের সংকট, দ্বন্দ্ব ও গতির নিশানা সবই পেয়ে যাই। যেমন, রামমোহনের বিধবাবিবাহ নিয়ে আপত্তি ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “বিধবার বিবাহ তাবৎ সম্প্রদায়ে অব্যবহার্য হইয়াছে, সুতরাং সদ্ব্যবহার করাইতে পারে না।” এর মানে হল, যদিও শাস্ত্রে নিষেধ নেই, কিন্তু সব সম্প্রদায়েই বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছে, অতএব সদাচার হতে পারে না (যদিও এ ধারণাও ঠিক নয়, বর্ণহিন্দুসমাজের বাইরে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না)। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন একথা লিখেছিলেন। এবার ভাবুন ১৮৫৫-৫৬ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাণপাত করছেন, তাঁকে তাঁর পূর্বসূরির তায় রামমোহনের মত ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করে এগোতে কি পরিমাণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
প্রথাগত ধারণা এই যে তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় যুগান্তকারী মাত্রা যোগ করেছিলেন এবং একটা লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন। রামমোহনকে নিয়ে ঘুরেফিরে যত আলোচনা চলে, সব ঐ মাত্রা আর লক্ষ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেহেতু সেই সমাজের ধারাবাহিকতা থেকেই আমরা এসেছি এবং আমাদের মননে আমাদের কর্মকাণ্ডে সেই ধারাবাহিকতা এখনো কোনো না কোনোভাবে বহমান। ফলত রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক থেকে যান এবং যে কোনো আলোচনায় অগ্রাধিকার পান। এর প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার থেকে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঐতিহ্য-আধুনিকতা, বিশ্বাস-যুক্তি, পৌত্তলিকতা-বেদ-উপনিষদ, স্বাদেশিকতা-জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় দর্শন-পাশ্চাত্ত্য দর্শন ইত্যাকার বাইনারি নিয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন, রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক।
তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিমত হচ্ছে তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। কেউ কেউ আবার তা মানতে রাজি নন। একদলের মতে, তিনি ছিলেন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরোধা, যাঁর কাজকর্ম উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিল। আর একদল রামমোহন উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিলেন একথা অতটা মেনে না নিলেও রামমোহনের আধুনিকতা নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন আছে। তাঁদের বিচারে রামমোহনের কর্মকাণ্ডে বুর্জোয়া আধুনিকতা স্পষ্টরূপ পায়নি। আছেন আরো একদল, যাঁরা বুর্জোয়া আধুনিকতার চরিত্র নিয়েই প্রশ্নমুখর। আর একদল যাঁরা এই আধুনিকতাকে উপনিবেশিক আধুনিকতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
যেমন, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার। তাঁর মতে, রামমোহন ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। তিনি তাঁর যুগের সৃষ্টি নন, তিনি তাঁর যুগের স্রষ্টা। সে যুগ আধুনিক ভারতের যুগ। রামমোহনকে এই আখ্যায় ভূষিত করার কারণ হিসেবে তিনি রামমোহনের জন্মের সময়কার অন্ধকারের বিবরণ দিয়েছেন, যে অন্ধকার থেকে রামমোহন দেশকে বের করে এনেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভারতের সুকুমারী শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সৃজনশীল ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল অখণ্ড নীরবতা। কোনো প্রতিভাধর পথপ্রদর্শকের দেখা মিলছিল না। সংস্কৃত সাহিত্যের মহান শিক্ষকেরা অদৃশ্য। প্রদেশের মাতৃভাষাগুলোরও কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছিল না। ভারতীয় মনন হয়ে গিয়েছিল অতীতের ব্যাপার। দর্শনের শাখাগুলি মৃত। তার জায়গায় আসর জমিয়ে বসেছিল ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে নানান কুতর্ক, সেগুলোই দর্শন হিসেবে চলে যাচ্ছিল। মহান ধর্মগুরুদের ধর্মান্দোলনগুলো যেন সেই অন্ধকার সময়কেই গাঢ়তর করে তুলছিল। তাঁদের আধ্যাত্মিক কথা কেউই বুঝতে পারছিল না এবং অনুগামীরা নানারকম সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়ে সেইসব পাপের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল, যেগুলো সমাজ থেকে দূর করার কথা তাদের ধর্মগুরুরা বলেছিলেন। চৈতন্যের প্রেমের বাণী তাঁর অযোগ্য শিষ্যদের হাতে পরিণত হয়েছিল ফাঁপা অগভীর হৃদয়াবেগে। জ্ঞান আর চৈতন্যের অধোগামিতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জাঁকিয়ে বসেছিল ভ্রষ্টাচার এবং সামাজিক অধঃপতন। অটল বিশ্বাস, পবিত্র হৃদয় আর সুস্থ আচরণের জায়গা নিয়েছিল অজস্র কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, অর্থহীন দেশাচার আর লোকাচার। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশ এই সময় একটা সন্ধিক্ষণের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমান আমল গিয়ে সবে কোম্পানি আমল এসেছে, কিন্তু কোম্পানি তখনো প্রধানত বাণিজ্য আর সম্পদ আহরণ নিয়ে ব্যস্ত। দেশে তখনো মুসলমান আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল। নতুন শাসকরা দেশের লোকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণে বাধা দিতে চায় না, কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার ভয়। সতীর অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা একের পর এক লাটসাহেবের গোচরে এসেছে, কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেন নি, কারণ তাহলে কোম্পানি শাসন বিপদে পড়তে পারে। শিক্ষা তখনো সরকারের বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি।
পশ্চিমের সংস্পর্শে ঘুম ভেঙে এ দেশ আধুনিক ভারত হয়ে উঠেছিল এবং তার সেই হয়ে ওঠায় বাংলার অবদান ছিল সবথেকে বেশি, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও সেকথা মনে করেন। তবে তিনি রামমোহনকে আধুনিক ভারতের জনক বলে স্বীকার করতে সেভাবে রাজি নন। তিনি অবশ্য প্রায় সবকিছুতেই রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকাকে নস্যাৎ করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার হল, রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন, জাতীয় চেতনার উন্নতি এবং দেশাত্মবোধের বৃদ্ধির ব্যাপারেও রমেশচন্দ্র রামমোহনকে প্রধান উৎস হিসেবে মানতে রাজি হননি। তিনি সে কৃতিত্ব দিয়েছেন ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের। আর রমেশচন্দ্র মনে করেন, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনতে সম্পূর্ণ অসফল হয়েছে। সমাজ সংস্কারক রামমোহন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, বঙ্গসমাজে বুনিয়াদি পরিবর্তন আনার ব্যাপারে একমাত্র সতীদাহ নিয়ে প্রচেষ্টা ছাড়া রামমোহনের আর কোনো ভূমিকা নেই।
যেমন সুমিত সরকার। তিনি রামমোহনকে যুগস্রষ্টা বলে মনে করেন নি, তাঁর মতে রামমোহন ছিলেন তাঁর যুগের সৃষ্টি এবং সে যুগের সীমাবদ্ধতার ফসল। তিনি সেই সন্ধিক্ষণের ফসল, যখন প্রাক-পুঁজিবাদী কাঠামো থেকে বুর্জোয়া আধুনিকতার দিকে সমাজের যাত্রা ক্ষীণভাবে আভাসিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সে যাত্রা উপনিবেশিক অধীনতার দ্বারা সীমায়িত বলে তাকে দুর্বল বিকৃত ক্যারিকেচারের মত লাগছে। আগেকার মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদদের ভাবনার ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ঐতিহ্য-আধুনিকতার দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া সমান বিপজ্জনক, কারণ তা আসলে আমাদের ঠেলে দেয় ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং এই ভাবধারার ধারকবাহক ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবক্তাদের দিকে। বুর্জোয়া আধুনিকতা ও আধুনিকতা এক জিনিস নয়। রামমোহনের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তুহফাতুল মুয়াহিদ্দিনের যুক্তিধারা যেসময় তিনি উপস্থাপিত করেন, তখনো ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভালো করে তাঁর পরিচয় হয়নি।
হেমচন্দ্র সরকারের লেখায় উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা পাই সেটা হল আধুনিকতা বলতে তিনি কিন্তু ইয়োরোপকে বোঝেন নি, তিনি বুঝেছেন নিজের দেশেরই ঐতিহ্যগত জাগরণকে। আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সুমিত সরকারও ইয়োরোপের বাইরের এক আধুনিকতার, যা ঢের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তার দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। দুই সরকারের এই রামমোহন প্রসঙ্গ আমাদের নিয়ে গেলে ফেলে ঐতিহ্য-আধুনিকতার বাইনারিতে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ত্রুটিগুলির কথা বলতে গিয়ে একদা শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন, “একটা অভিযোগের সত্যতা আমরা স্বীকার না করে পারি না যে আমাদের চোখ পূবের তুলনায় অনেক বেশি পশ্চিমে নিবদ্ধ ছিল। আমাদের হাতের কাছে অমূল্য সত্যের যে খনি আছে তাকে আবিষ্কার না করে আমরা পশ্চিমে সত্যের চর্চায় কি প্রগতি ঘটল জানতে বেশি উৎসাহী ছিলাম। আমাদের দেশের বইগুলোতে, আমাদের নিজেদের লোকাচারে এবং দেশাচারে সত্যের যে রত্নভাণ্ডার সঞ্চিত আছে, তার তুলনায় পশ্চিমী আদর্শগুলো আমাদের টানত বেশি।” এই হল সেই উপনিবেশিকতা (coloniality), যার কথা বর্তমান প্রবন্ধে বলতে চাওয়া হচ্ছে। এই উপনিবেশিকতা (coloniality) কি আমাদের জ্ঞানচর্চায় আমরা আজো বহন করে চলছি না? বিশেষ করে এই বাংলায়?
ব্রাহ্মধর্ম যে এ দেশে শেকড় গাড়তে পারে নি তার সবথেকে বড় কারণ হল একটা স্তরে যেমন ব্রাহ্মধর্মে সমন্বয়ধর্মিতা ছিল, আর একটা স্তরে ছিল না। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ফলে শাস্ত্রকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের বাইরের যে বিশাল সমাজ, যে সমাজ সমান পৌত্তলিকতায় আসক্ত, তাদের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা এবং ইয়োরোপীয় ভারততত্ত্ববিদরা সমানে প্রমাণ করতে লাগলেন যে পৌত্তলিকতা হচ্ছে উচ্চ আদর্শসম্পন্ন ভারতীয় সমাজের চূড়ান্ত নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের চিহ্ন। মনিয়ের উইলিয়ামস থেকে শুরু করে এচ. এচ. উইলসন, জেমস মিল সকলেই একবাক্যে বেদ বেদান্ত এমনকি মনু থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে শুরু করলেন যে সেসব গ্রন্থে কোথাও পৌত্তলিকতার কথা নেই। ভেতরের কথাটা এই, পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন এই বৃহত্তর সমাজ স্বশাসনের উপযুক্ত নয় এবং বাইরের থেকে তাঁদের মত যুক্তিনিষ্ঠ একেশ্বরবাদীরা এসে এই সমাজকে সুশাসন দিতে পারে। যদি এ দেশের লোককে একেশ্বরবাদীরা পথ দেখাতে সক্ষম, তাহলে ইসলামই তো যথেষ্ট ছিল। তাদের এদেশে আসার দরকার পড়ল কেন? সমাজের সর্বক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের হঠানোর দরকার পড়ল কেন? অতএব শুধু যুক্তিনিষ্ঠতা কোনো কারণ নয়। সে কারণ তাদের আধুনিকতা, যে আধুনিকতা শিল্পপ্রধান সমাজের উপজ এবং যার বিকাশ একের পর এক উপনিবেশ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীল। সে আধুনিকতার কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত লক্ষ্যণীয়, যে ইয়োরোপ রেনেসাঁয় শাস্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তির ওপর ভর করে চলতে শুরু করেছিল, সেই ইয়োরোপের প্রধান চালিকা শক্তি ব্রিটিশ এই উপনিবেশে শাসক হয়ে এসে এ দেশের শাস্ত্রকেই আইনে পরিণত করল। এর আগে এরকম কোনো লিখিত আইন হিন্দুদের বেলায় আমাদের দেশে ছিল না। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের আর এক নাম উপনিবেশিক আধুনিকতা।
অপরদিকে যে ভারততত্ত্ববিদরা আমাদের বেদ উপনিষদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাই আবার পৌত্তলিকতার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদিম উপাদানগুলি থেকে আমাদের সমাজে অজস্র দেবদেবীর জন্ম হয়েছে এবং সমসাময়িক সমাজে যার বহমানতা বিদ্যমান, এমনকি ইয়োরোপীয় সমাজের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টানরা যে খেতে বসার আগে ‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড’ বলে প্রার্থনা করেন, সে প্রার্থনার জন্ম নব্য প্রস্তর যুগে এবং ঈশ্বরকে পিতারূপে কল্পনা করে প্রার্থনা করার যে ভাবনা সে ভাবনার জন্ম চারণ যুগে। অথচ নব্য প্রস্তর যুগের বা চারণ যুগের এই প্রার্থনাগুলো এখনো বহাল আছে এবং সে ঐতিহ্য খ্রিস্টানদের গৌরবের কোনো হানি ঘটায় না। কোসাম্বির ভাষ্যে, আমাদের দেশে সমাজের নিম্নবর্গের মধ্যে যে নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের চল আছে, সেগুলো এই বৃহত্তর উৎপাদনশীল সমাজে তাদের এক একটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্তরগত অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী। জাত ও ধর্মের সঙ্গে মিশে ঐ অনুষ্ঠানগুলি গোষ্ঠীগুলিকে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক মর্যাদার পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে তাদের জাত এবং কখনো কখনো তাদের ধর্মবিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, কেন কখনো কখনো ধর্মবিশ্বাসগুলির সমন্বয় ঘটে, আবার কেন কখনো কখনো কিছুতেই সেগুলো মিলতে চায় না। স্বাভাবিকভাবে শংকর কিংবা রামানুজের দর্শন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কারণ তাদের সে উচ্চস্তরে এ সমস্যাটার অস্তিত্বই নেই।
বেদ উপনিষদে পৌত্তলিকতার উল্লেখ থাক আর না থাক, আমাদের দেশে পৌত্তলিকতার সঙ্গে দর্শনের বিরোধ ছিল এমন কথাও কোথাও নেই। বুদ্ধ পৌত্তলিকতা সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তিনি নিজে দেবদেবীর পূজায় পশুবলি দেয় এমন বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছিলেন, এই আশায় যে তিনি তাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে অহিংস করে তুলতে পারবেন। মূল সমস্যাটা ছিল পশুবলি নিয়ে। আমরা সবাই জানি বৌদ্ধধর্ম কৃষিজীবীদের বসতিগুলোকে স্থায়িত্ব দেবার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। কৃষিজীবীদের প্রধান সমস্যাই ছিল বৈদিক সমাজের পশুবলি। বুদ্ধের অহিংসা এই পশুবলি বন্ধের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল। অহিংসাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে বুদ্ধকে বেদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। সেই বিরোধিতায় জন্ম হয়েছিল এযাবৎ কালের এক শক্তিশালী দর্শনের। শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তেও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। বরঞ্চ ব্যক্তিগতভাবে শংকরাচার্য ভগবান হিসেবে বিষ্ণুর আরাধনার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। তাঁর টীকাতেও বিষ্ণুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পরিবারের কুলদেবতা।
(চলবে)
(এই পর্বের শেষে টীকা ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে)