সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ভোর ব্যাপারটা চিরকালই আমার কাছে খুব elusive ছিল, মানে ছলনাময়ী টাইপের একটা জিনিস। আদৌ আছে কি নেই সেটা খুব ভাল বুঝতাম না এক সময়ে। একদম ছোটবেলায় খুব ঘুমকাতুরে ছিলাম। ভাগ্যি ভাল যে মর্নিং স্কুল ছিল না, ধীরেসুস্থে বেলায় যেতাম। তখন ভোর বলতে মহালয়া আর বছরে যে কদিন দিদার বাড়িতে থাকতাম। মহালয়ার দিন সত্যিই ভোরে উঠে পড়তাম, পাঁচটা নাগাদ রেডিওর আওয়াজে ঘুম ভাঙত। চোখমুখ ধুয়েই বাগানে গিয়ে শিশিরমাখা শিউলি কুড়োতাম। অন্যদিন হয়ত পুজো করার আগে মা কিছুটা শিউলি কুড়োত আরো নানাবিধ ফুলের সাথে, কিন্তু মহালয়ার ভোরটা আমার জন্য তুলে রাখা থাকত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলার আওয়াজের সামনে বোধহয় চুবড়িতে করে একরাশ শিউলি রাখার দস্তুর । থাকা উচিত। তাতে বেশ একটা আলাদা আমেজ আসে, অন্তত ১৪১৯ বঙ্গাব্দ অব্দি তো এসেছে। গরমের ছুটিতে যখন দিদার বাড়ি গিয়ে কদিন থাকতাম, ভোরবেলা নানারকম আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত - জলের ভারী আসত, রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা, জমাদার, গঙ্গায় লঞ্চ ধরতে যাওয়া অফিসযাত্রী, ঢাকা বারান্দায় কাজের মাসি বাসন্তীদির টুংটাংখটখট বাসন মাজা, পুরনো আমলের ফ্ল্যাটবাড়িতে কমন পাম্প চালানো নিয়ে ভাড়াটেদের কাজিয়া, ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘুম ভেঙেও মটকা মেরে পড়ে থাকতাম যতক্ষণ না মা এসে তুলে দিত জোর করে। তারপর দিদার ভাঁড়ার থেকে লম্বা মোটা বান, তাতে রাংতায় মোড়া নরম মাখন দেওয়া, অথবা কোনোদিন পরোটা আর সাদা আলু-চচ্চড়ি, সঙ্গে বাড়ির নীচের মিষ্টির দোকান থেকে আনা সদ্য গরম জিলিপি বা রসগোল্লা। দাদুর প্রিয় নাতনি হওয়ার দরুণ ভোরবেলাই এইসব সুখাদ্য আমার জুটত। ওখানে দিনের যে সময়ে প্রাতরাশ সারা হয়ে যেত, নিজের বাড়িতে সেই সময়টা আমার জন্যে ভোরই ছিল। ১৯৬০-৭০ এর দশকের ফ্ল্যাটবাড়ি কেমন হত তা আমি একটু বড় হয়ে সিনেমায় দেখেছি। এখন স্মৃতিগুলো জাবর কাটলে বুঝতে পারি যে দিদার বাড়িটা একটা বড় উদাহরণ ছিল। তিনতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি, ডিজাইনটা আমার বেশ অদ্ভুত লাগত তখন। একতলায় সামনের দিকে দু-তিনটে দোকানঘর ছিল, তার মধ্যে একটা মিষ্টির দোকান। ঘুরে অন্যদিক দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজা ছিল। ল্যান্ডিংয়ে একটা ফ্ল্যাট, তার ওপরের তলায় আরেকটা, তার ওপরেরটাতে দিদা-দাদু-মামা থাকতেন। দিদার ফ্ল্যাটে ঢুকেই ঘরের ঘেরায় একটা U ধরনের ঢাকা বারান্দা ছিল, শুধু U-এর মাঝের খোঁদলটা ফাঁকা। তাই একটু বৃষ্টি হলেই বারান্দা জলময় হয়ে যেত। ঘর থেকে রান্নাঘর/বাথরুম যেতে গেলে ভিজে যেতে হত। আর ওই U দিয়ে নীচে তাকানোটা আমার একটা নেশার মত ছিল, নীচে তাকালেই অনেকটা দেখা যেত। ভোরবেলা আরো দুই ফ্ল্যাটের লোকেরা জেগে কলকলানিতে ভরিয়ে দিত। একজনদের বারান্দায় পাখির খাঁচা ছিল, তাদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে যেত। তিনতলার রাস্তার দিকের বারান্দা থেকে ভোরের গঙ্গার ধার দেখতে পাওয়াটাও ওখানে যাওয়ার একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল।
আরেকটু বড় বয়েসে ভোর ছিল শুধু রবিবারে ওঠা, আঁকার ক্লাসে যাওয়ার জন্যে। উঠে তৈরি হয়ে গিয়ে আঁকা শিখে আবার ফেরারও তাড়া থাকত, সকাল নটার 'চন্দ্রকান্তা' দেখার জন্যে, সাথে প্রাতরাশে রবিবার-স্পেশাল লুচি-আলু চচ্চড়ি-জিলিপি। রবিবার দিনটাকে অন্যদিনের তুলনায় বেশ দীর্ঘ মনে হত ভোরে ওঠার দরুণ। পরপর চন্দ্রকান্তা, মহাভারত/ রামায়ণ, জাঙ্গল বুক, ইত্যাদি দেখতাম সারা সকাল, রবিবার বলে পড়ার ছুটি। এরপর দিলাম জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, দিয়ে চলে এলাম কলকাতায়।
তারপর হায়ার সেকেন্ডারিতে শুরু হল সেই অত্যাচার যাকে মর্নিং স্কুল বলে। শুরুর কদিন কাকার বাড়ি থেকে মায়ের সাথে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে বাস-ট্রাম ধরে রাস্তা চেনার জন্যে যাতায়াত করলাম। পরে স্কুল বাসে ভর্তি হওয়াতে একটু সুবিধে হল, তবে সময়টা আরো এগিয়ে এল। আমার মত ঘুমকাতুরের পক্ষে সকাল ছটায় উঠে তৈরি হয়ে নাকেমুখে দুধ-কর্ণফ্লেক্স গুঁজে গলির মুখে বাসের জন্যে অপেক্ষা করা যে কী দুষ্কর ব্যাপার সে ব্যথা 'বোঝে কি আনজনে...'। তবে ওই দু'বছরে দক্ষিণ কলকাতার ভোরদের (হ্যাঁ, বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ভোর) খুব ভাল করে চিনে গেছিলাম। গ্রীষ্মকালে জলে ধোয়া রেড রোড দিয়ে হু হু করে যেতে যেতে হাওয়ায় আবার ঘুম পেয়ে যেত। ভবানীপুরের বনেদি বাড়ি থেকে হাজরার আধুনিক ফ্ল্যাটদের জেগে ওঠা দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় দিব্যি কেটে যেত। শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কচুরি-সিঙাড়া-জিলিপির নানাবিধ গন্ধে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আমাদের মনও আনচান করে উঠত। বর্ষায় জুতো-মোজা খুলে হাতে নিয়ে বাসে উঠতাম কারণ আমাদের রাস্তায় একহাঁটু জল জমেই থাকত। তবে স্কুল ছুটির পর ওই জুতো-মোজা পরেই ছপাত করে বাস থেকে গলির মুখে জলের মধ্যে লাফ মারতাম। বৃষ্টিভেজা কলকাতার একটা আলাদা রূপ আছে যেটা অন্য কোনো শহরে পাওয়া যায় না। দুর্গাপুজোর আগের ভোরগুলোতে পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়ে যেত। আর শীতকালে কুয়াশাঢাকা ভোরে একেকটা রাস্তা্র আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা দেখতাম আমাদের বাসের আলোয়। বকুলবাগানের বড় বড় গাছগুলো মাথাভর্তি কুয়াশা নিয়ে আমাদের কুর্ণিশ করত ভোর ভোর।
এরপর দেখলাম আরেক রকমের ভোর। কলেজে পড়াকালীন রসায়নের এক বিখ্যাত গৃহশিক্ষক আমাদের ব্যাচের সময় রেখেছিলেন রবিবার ভোর সাতটায়। কোনো মানে হয় বলুন? তখন আমরা ঢাকুরিয়া চলে এসেছি। নিজেকে কোনোমতে টেনে তুলে চা খেয়ে রিকশায় চেপে সেলিমপুর যেতাম। সেখানে বাসের অপেক্ষায় কয়েক মিনিট দাঁড়াতাম। ছুটির দিনের ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে বাস চলত। গোটা যাত্রাপথে আস্তে আস্তে রবিবারের বাজারটা জেগে উঠত। লোকজন অন্যদিনের চেয়ে ঢিমেতালে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরোত। কোন একটা বাস ছিল কী জানি, গোলপার্ক থেকে বাঁদিক নিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের উঁচু উঁচু গাছগুলো পেরিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটত। আমাদের এক আত্মীয় থাকতেন সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক বিল্ডিংয়ের তেরোতলায়। ওদের বিল্ডিংটা পেরোনোর সময় তাকিয়ে ভাবতাম তেরো তলার ওপর থেকে কি ওরা নীচে তাকিয়ে চিনতে পারে কোনটা কোন রুটের বাস? স্যারের বাড়ি ছিল চেতলার এক গলিতে। পুরনো দিনের শরিকি বাড়ি। বৈঠকখানায় গাদাগাদি করে আমরা কয়েকজন বসতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করত। ঠিক ফুটবল খেলার হাফটাইমে রেফারির মত স্যারের গিন্নি হুইসল দেওয়ার বদলে দরজায় খটখটাতেন। স্যার উঠে গিয়ে মিনিট দশেকে বোধহয় লুচি টুচি সাঁটিয়ে আসতেন। ফিরে এসে চা নিয়ে বসতেন ইনর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির থিওরি বোঝাতে। আমরা কেউ তখন ঢুলছি, কেউ ট্রেন ধরার চিন্তায়, কারুর পেট ডাকছে ক্ষিদেতে। শুধু ভাবতাম কখন ছাড়া পাব। বাড়ি ফেরার তাড়ায় মনে হত রিকশা কাকু পক্ষীরাজের মত চালায় না কেন। ফিরে হাত পা ধুয়েই লুচি-আলু চচ্চড়ি আর জিলিপি। যে রবিবারে বাবার বাজার যাওয়ার দরকার হত না, বা হয়ত শরীরটা একটু খারাপ, সেদিন গুলোতে আমি ফেরার সময় সেলিমপুর থেকে বড় বড় মোটা মোটা জিলিপি নিয়ে ফিরতাম।
এখন এই ১৪১৯ সালে শৈশব-কৈশোরের ভোরকে ছুটি দিয়ে তরুণী ভোর দেখি। প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে যাদবপুরের গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্য চোখে ভোরকে দেখি। ঝিলের ধারের কটি পাড়া এখনও সে অর্থে 'পশ' হয়ে যায়নি। চার-পাঁচতলা ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটের পাশাপাশি ঘরোয়া একতলা-দোতলা বাড়ি এখনও আছে, তাকে ঘিরে ছোট্ট উঠোনে ফুলের টব, রাস্তায় টিউবওয়েল। ভোরবেলা কোনো বাড়ি থেকে মুসুর ডালে সম্বার দেওয়ার গন্ধ ভেসে আসে, কোনো বাড়ি থেকে স্কুল/অফিসযাত্রীদের জন্যে মাছভাজার, কোনো বাড়িতে নতুন হন্ডা সিটি গাড়ি ধোয়া চলে, কোনো বাড়ির ধেড়ে ছেলে অফিস বেরোবার সময়ে তার মা চিৎকার করেন, 'ছোটন, হেলমেটটা নিয়া যা,' কোনো বাড়ির রকের সামনে ম্যাক্সি-পরিহিতা মাসিমা মাছউলির সাথে দরাদরি করেন, কোনো বাড়ির গ্রিলঘেরা বারান্দায় শান্ত-সৌম্য বৃদ্ধ বসে খবরের কাগজ পড়েন। এইসবের মধ্যেই কোথাও পুরনো দিনের ভোরেরা নতুনের সঙ্গে মিশেও হারিয়ে যায় না এখনও, শুধু কলকাতাতেই।
প্রবাসে বাংলার বশে
বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা বোধহয় বাঙালীর প্রিয় বিষয়। তাই দেশে-বিদেশে এমনকী হয়ত অন্তরীক্ষে গিয়েও বাঙালী আলোচনা করবে যে অমুকে বাংলাটা কী করে ভুলে গেল বা তমুকে কোন উচ্চারণে ভুল করল। ‘সোনার কেল্লা’তে মন্দার বোস বলেছিলেন, “আপনি যদি বিদেশে বাংলা ভুলবেন বলে ইচ্ছে করেন, তাহলে তিন মাসে ভুলে যেতে পারেন। আর তা যদি ইচ্ছে না করেন, তাহলে ত্রিশ বছরেও ভোলবার কোনো চান্স নেই।” কথাটা কম বয়েসেই আমার বেশ মনোগ্রাহী হয়েছিল, যখন কস্মিনকালেও ভাবিনি যে কখনও দেশের বাইরে থাকব। কাকতালীয়ভাবে এ বছরের অগাস্ট মাসেই আমার প্রবাস জীবনের পঞ্চদশ বর্ষপূর্তি।
প্রসঙ্গত বলি, পরিবারের লোকেরা আমাকে ছোটবেলা থেকেই ‘বইপোকা' বলে লেবেল সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা, ইংরাজি ও বেশ কিছু হিন্দি বইও আছে আমার সংগ্রহে। হিন্দির অনুপ্রবেশ একেবারেই স্কুলের সিলেবাস ধরে। বাবা-মা ভর্তি করেছিলেন ইংরাজি মাধ্যমে এবং বাবার বদলির চাকরি বলে চেয়েছিলেন যাতে আমি হিন্দিটা শিখি, তাই ক্লাস ওয়ান থেকেই আবশ্যিক ভাষা হিসেবে হিন্দি শুরু হয়। দশ বছরে বাবা কোথাও বদলি হননি, তবুও আমি হিন্দিটা দিব্যি শিখে গেলাম। ভালবেসেই পড়েছিলাম, তাই বোর্ডের পরীক্ষার পর বারোশ টাকার বৃত্তিও পাই। স্কুলের হিন্দি শিক্ষক আমাকে যারপরনাই স্নেহ করতেন, একবার পরীক্ষায় ওঁর ছেলের চেয়েও আমি বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। তাতে বলেছিলেন যে ওঁর বিশ্বাস ভাষাটায় আমার দখল জন্মাচ্ছে, কেননা মাতৃভাষা না হয়েও কয়েক বছর শিখে হিন্দি ব্যাকরণে ভাল নম্বর পাওয়া নাকি দুর্লভ ব্যাপার। সিলেবাস ধরে হিন্দি পড়ার পাশাপাশি বাড়িতে বাংলা শিক্ষা চলছিল। ছোটদের বাংলা বই থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণ হয়ে বছর বারো তেরো বয়েসেই বহু উপন্যাস পড়ে ফেলি। আমার মা সংস্কৃতে অনার্স ছিলেন। বড়দের উপন্যাস পড়ছি দেখে সবার আগে বঙ্কিম রচনাবলী ধরিয়ে দিলেন। ‘দারুণ নিদাঘের সন্ধ্যায়…' ইত্যাদি দেখে মায়েরই শরণাপন্ন হয়েছিলাম অর্থ বুঝতে। তারপর আর কোনো বাধা ছিল না, বইয়ের আলমারির উত্তরোত্তর বৃদ্ধি দেখে কয়েক বছর অন্তরই নতুন আলমারি বানাতে হয়।
২০০৬ সালে যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলাম, বাক্স-প্যাঁটরার ভেতরে অবশ্যই কিছু বাংলা বই ছিল। বিদেশে ইংরাজি বই পাওয়া গেলেও বাংলা যে পাব না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। নিজের ওই কটা বই পড়ে ফেলার পর বন্ধুদের কাছে যে কটা ছিল সেগুলো শেষ করলাম। ছাত্রাবস্থায় কারুর বাড়ি বা হোস্টেলে গেলে সরেজমিনে একটু দেখে নিতাম তার কাছে কোনও বাংলা বই আছে কিনা। আনকোরা কোনও বই হলে ধার নিয়ে এসে পড়ে নিতাম। প্রতি বছর বন্ধুদের কেউ ছুটিতে দেশে গেলে তাদের হাত দিয়ে বই আনিয়েছি। কলকাতায় যাদের বাড়ি, বাবা-মা বই কিনে তাদের পৌঁছে দিতেন। আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়েছিল, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলাম, সেখানে জনা পঞ্চাশ-ষাট বাঙালি ছিল এবং তার মধ্যে আমরা দশ-পনেরো জন পাশাপাশি মেস করে থাকতাম। দিবারাত্রি বাংলায় বাক্যালাপ চলত, ক্যাম্পাসের ভেতরে দিব্যি নিজেদের ভাষায় আড্ডা দিতাম, বাংলা গান শুনতাম, একসঙ্গে মহালয়া শোনা থেকে শহরের প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করা - এইভাবেই বাংলাকে ভোলার কোনো সুযোগ করে দিইনি নিজেদের। আমার কোনও বন্ধু বাংলায় অসামান্য প্রবন্ধ লিখত, কেউ গান লিখত, কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্লেষক ছিল, আবার কেউ আমারই মত বইপোকা। ফলে আলোচনার বিষয়ের কোনোদিন অভাব হয়নি।
বিয়ের পরে দেশের যে কটা শহরে থেকেছি, কোথাও বাংলাকে ভোলার কোনো অবকাশ হয়নি। টিভিতে বাংলা চ্যানেল, সিনেমা হলে বাংলা ছবি ও বাঙালী রেস্তোঁরা খুঁজে বের করা আমরা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিলাম। বাংলা বইয়ের যোগান একটু সহজ হয়ে গিয়েছিল ততদিনে অনলাইন কেনাকাটার সুযোগ এসে। এ ছাড়া পুণে বা হায়দ্রাবাদে বাংলা পূজাবার্ষিকী সংখ্যাগুলিও পাওয়া যেত প্রতি বছর। কিছু বই বাবা-মা অথবা বন্ধুরা ক্যুরিয়ার করত। ততদিনে নিজেও বাংলা ব্লগ ও ছোটগল্প লিখতে শুরু করি যার কয়েকটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে কার না ভাল লাগে। সেই তাগিদেই লেখা চালিয়ে যাই। প্রবাসে বন্ধুরা উৎসাহ দিয়েছে প্রচুর। হায়দ্রাবাদের বাঙালি পূজা সমিতির উদ্যোগে যে শারদীয়া পত্রিকা প্রকাশ হয় প্রতি বছর, তাতে একবার আমার একটি কবিতা বেরোয়। ততদিনে আমরা সে শহর ছেড়ে চলে গেলেও এক বন্ধু নিয়ে আসে পত্রিকার এক কপি। এভাবেই একে অপরের দ্বারা রিলে দৌড়ের মত বাংলা ভাষা উদ্ভাসিত হয় দেশ জুড়ে।
গত চার বছর ধরে বাংলা থেকে বহুদূরে থাকি, শুধু বাংলা কেন, দেশ থেকেই বহুদূরে, বলা যায় প্রায় হাজার যোজন দূরে। বাংলা ভাষা বলার লোক যদিও এখানে খুব একটা কম নয়। ভারতীয় বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের লোকেরা আছেন। গল্প করতে কোনো অসুবিধা হয় না। সেরকমই একজন আমাদের প্রতিবেশী। ওঁর দোকানে গেলে আমাদের পরিবার সম্পর্কে কুশলাদি জিজ্ঞ্যেস করেন, নিজেদের সুখদুঃখ ও খাবারদাবার ভাগ করে নেন। দেশটুকু যে আলাদা সেটা ক্কচিৎ কখনও কথায় উঠে আসে। বাঙালী বিদেশে আসার আগে সবার আগে খোঁজ নেয় মাছ বা পাঁঠার মাংস পাওয়া যায় কিনা। সেই খোঁজেই আমরাও গিয়েছিলাম একটি বাংলাদেশী দোকানে। গিয়ে বরঞ্চ দোকানির সঙ্গে এমন আলাপ জমে গেল যে গত তিন বছর ওঁর দোকানে যেতাম হাতে সময় নিয়ে, বাংলায় গল্প করার জন্যে। সিলেট থেকে বরিশাল, সব জেলার লোকেই আসতেন সেখানে, আমরাও কিছু গল্প ফাউ পেয়ে যেতাম। ইলিশ মাছের আমদানি-রপ্তানি থেকে বাতাবি লেবুকে ওখানে জাম্বুরা বলা হয়, তোপসে মাছকে ওঁরা বলেন তাপসী, বা ওই মাসে পুঁইশাক কেন আসেনি, এইসব গূঢ় আলোচনাও হত। বাংলা চর্চায় পোস্ত বা পুঁইশাক কুলীনের পর্যায়ে না পড়লেও গল্পে আমোদের কোনো কমতি কিন্তু ঘটায় না।
মাতৃভাষা নিয়ে ফরাসি বা জার্মানরা যতটা ভাবনাচিন্তা করেন, বাঙালীরা ততটা করেন না - এরকম একটা গুজবের গুঞ্জন কানে আসে আজকাল। এর খানিকটা অবশ্যই সত্যি, কিন্তু এর উলটোদিকেও বহু বাঙালী আছেন। আমার কয়েকজন পরিচিতের সাত-আট বছরের বাচ্চারা যখন প্রবাসে বসে ফরাসী স্কুলে পড়ে বাড়িতে ইংরাজি চর্চার পরেও পয়লা বৈশাখে বাংলায় 'বীরপুরুষ' আবৃত্তি করে, তখন মনটা ভরে যায়। এতে তাদের বাবা-মায়েদের প্রচুর কৃতিত্ব আছে নিঃসন্দেহে; এঁরা বাড়িতে একসঙ্গে দুটো ভাষা শেখান (বাংলা ও ইংরাজি) যেগুলো স্কুলে পড়ানো হয় না। এই উদ্যম না থাকলে বাচ্চাগুলি বাংলায় কথা বলতেও পারত না হয়ত, আবৃত্তি-গান তো দূরের ব্যাপার। আমার প্রতিবেশীর শিশুটি প্রশ্ন করেছিল, যে সাতাশের পরে যদি আঠাশ হয়, তাহলে তার পরেরটা নতাশ নয় কেন। তার এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা কয়েকজন চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাংলা গুণতিতে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এও কি এক ধরনের ভাষা চর্চা নয়?
বাংলায় লেখা, পড়া বা কথা বলা ছাড়াও যেটা অবচেতনে করি সেটা হল বাংলায় ভাবা। দোকানে গিয়ে আটচল্লিশ যোগ পঁচিশ করতে হলে এখনও মনে মনে ভাবি, চল্লিশ আর পঁচিশ যোগে পঁয়ষট্টি, আর আট হল তিয়াত্তর। আমার ধারণা, এটা যতদিন অবচেতনে থাকবে, আমার পক্ষে বাংলা ভুলে যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, সে যে দেশেই থাকি না কেন।