সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(শেষাংশ)
আগের সংখ্যা (এপ্রিল, ২০২১)
ভারত আর পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ১৬০০ সালে গড়ে তোলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংল্যান্ডের রানী, রানী এলিজাবেথ তাদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার দেয়। দিল্লির সুলতান তখন জাহাঙ্গির, আর বাংলায় সুলতান, আঞ্চলিক রাজা ও বারো ভূঁইয়ার দাপট। বারো ভূঁইয়াদের নেতৃত্বে ঈশা খাঁ, একজন মুসলমান রাজপুত। ১৬০৮-এ কোম্পানি সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। পরে অন্যান্য জায়গায়ও। বাংলার হুগলিতেও।
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি, জেমস হার্ট আসলেন ঢাকায়। সেই শুরু বাংলায় ইংরেজ বণিকের আসা। ১৭১৫-য় মোগল দরবার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। মোগল সাম্রাজ্যের অন্যত্রও চালু হয় সেই মুদ্রা।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদৌলা কলকাতা দখল নেওয়ার পর (২০ জুন) লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে জাহাজে করে সেনাবাহিনী এনে কলকাতা পুনরায় দখল করে (২ জানুয়ারি, ১৭৫৭)। পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদৌলা পরাজিত হলেন এবং পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। ইংরেজদের সঙ্গে আগাম চুক্তি মতো মীরজাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ উৎকোচ বাবদ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হ’ত। পরে দুর্নীতির পাহাড় প্রমাণ চাপে ১৭৬০-এ ক্লাইভকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হলে তার অনুপস্থিতিতে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্লাইভকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয় আবার ।
ক্লাইভ ফিরে আসেন প্রবল পরাক্রমে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। এবার নতুন পদ। ইংরেজ সরকারের গভর্নর। মাত্র মাস তিনেকের ব্যবধানেই ক্লাইভ দিল্লির তদানীন্তন বাদশাহ, শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি আদায় করেন (১৭৬৫, আগস্ট ১)। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন তখন ইংরেজদের করায়ত্ব। নবাবের অস্তিত্ব নামমাত্র। নবাবের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব কোম্পানির। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলে। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপন করার মধ্য দিয়ে এই দেশের স্বনির্ভর দেশীয় অর্থনীতি কার্যত ধ্বংস করে দেয়। বাংলা ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ব হয় ১৮১৩ সালে। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।
বণিকের মানদণ্ড/ পোহালে শর্বরী,/ দেখা দিল/ রাজদণ্ড রূপে…
–র ধারাবাহিকতায়
বারো
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করার লক্ষ্য নিয়ে, সঙ্গে ক্রুসেডের স্মৃতি। ক্রুসেড মূলত ধর্মীয় যুদ্ধ। পবিত্রভূমি জেরুজালেম এবং কন্সটান্টিনোপলের অধিকার মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে ইউরোপের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ১০৯৫ - ১২৯১ সাল অব্দি সম্মিলিত যুদ্ধ। ক্রুসেড। সূত্রপাত করেন পোপ দ্বিতীয় উর্বান। তিনিই ১০৯৫ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে সহায়তা চান। পরবর্তী সময়ে অ-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের যে কোন সামরিক প্রচেষ্টাই, ক্রুসেড।
ক্রুসেডারেরা মধ্যপ্রাচ্যে সামন্তবাদী রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছিল। তাই ক্রুসেড, ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদ ও উপনিবেশবাদের একটি আদি রূপ। ক্রুসেডের নামেই ইউরোপীয় খ্রিস্টানেরা তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিস্তার করতে দেশ থেকে দেশান্তরে সামরিক অভিযানে বের হত।
অর্থাৎ ক্রুসেড ছিল যুদ্ধভিত্তিক খ্রিস্টধর্ম ও খ্রিস্টান ইউরোপের সম্প্রসারণের বহিঃপ্রকাশ। এখানে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ সামরিক চিন্তাধারার মিলন ঘটেছিল। তার ফলে খ্রিস্টানেরা অন্য সংস্কৃতিতে বাস করা শেখে এবং একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে পরাজিত দেশের ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে।
ইংরেজ আসার আগে ভারতবর্ষে সম্প্রদায়গত পার্থক্য ছিল, সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ইংরেজদের ক্ষমতা বিস্তারের পথ ধরে তাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উসকানিতেই তৈরি হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। চতুর ইংরেজ শুরু থেকেই ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিয়ে ভাগ করো ও শাসন করো নীতির বাস্তবায়নের চেষ্টা করে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ইংরেজ বরাবরই ভরসা রেখেছিল সম্প্রদায়গত বিভাজনের ওপর। জাতি, অর্থ, বর্ণ, ধর্ম, আচার-বিচার-সংস্কার-পরম্পরাগত অবস্থান সম্পর্কিত বিবাদ-বিভাজন ছিল তার অন্যতম সম্বল। বিশেষত ধর্মীয় বিভাজন। কেননা ধর্মীয় উন্মাদনা, অন্য চেতনাকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে, এবং ওই উন্মাদনা পারে না এমন কাজ নেই। এ তার ক্রুসেডের স্মৃতি।
ইংরেজ শক্তি প্রথমে কংগ্রেসের এবং পরে মুসলিম লিগ গঠনের উৎসাহ জোগাল। ১৯৩১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখানোটা আগেই শুরু করেছিল, পরে আনল পৃথক নির্বাচন। হিন্দুরা ছিল প্রতিষ্ঠিত, মুসলমানরা ছিল উঠতি—এই দুইয়ের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ইংরেজ শক্তি সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছে।
মুসলিম লিগ চেয়েছিল মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র আবাসভূমি। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব ছিল একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ এবং তাকে কোনোভাবেই ভাগ করা চলবে না। এমনকি প্রদেশগুলোকেও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক – লিগ ও কংগ্রেস, দু-পক্ষই এই ব্যাপারে একমত। বিরোধ, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কীভাবে ভাগ করা যায়, তা নিয়ে। আসলে নেহরু বা জিন্না কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। রাজনীতির সার্বভৌমত্ব। Dicision making Power. Extraordinary সময়ে সেই একমাত্র Dicision প্রয়োগের অধিকারি। Extraordinary moment তৈরি করে দিল ব্রিটিশ-রাজ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেহরু-জিন্নার সার্বভৌমত্বের ধারণায় ঘৃতাহুতি পড়ল, এবং শেষ পর্যন্ত দু-জনই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ভারতবর্ষ যেন তাদের পৈতৃক ভূমি। ফলত দেশভাগ।
দেশভাগ হ’ল। বলা ভাল, রাষ্ট্র ভাগ হ’ল। ভারতবর্ষ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি, ভাষা-সংস্কৃতি-আঞ্চলিকতা।
বাংলা ছিল একক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মূল জনপদবাসী সহ বাংলা ভাষাভাষী এক জাতির দেশ। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ছিল আঞ্চলিকতায় এবং মূল নিবাসী আদি জনপদবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার সমস্যা ছিল আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষায়, শ্রেণির, বর্ণের। প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল কৃষকের সঙ্গে জমিদারের। জমির মালিকানা। ফসলের অধিকার। কৃষি ও শিল্প-শ্রমিকের মজুরি। সর্বসাধারণের শিক্ষা-অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের। সর্বোপরি ইংরেজ শাসনের অবসান। বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র যে বাঙালি মনের সন্ধান পেয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া উচিত। রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থকে পরস্পরের পরিপন্থী বলে তিনি মনে করতেন না। বরং খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য-শিক্ষার অভাব প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ অভিন্ন বলেই মনে করতেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মকাণ্ডে নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান, শিখ – জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ – নির্বিশেষ অবস্থান। এমনটাই ছিল সেই সময়ের, গত শতকের চল্লিশের দশকের বাঙালির বাংলা। বিবাদ-বিসংবাদ ছিল, বিভাজনের প্রবণতাও ছিল, ছিল ধর্মীয় বিভাজনের উর্ধে বাঙালি জাতি চেতনা।
এতদসত্ত্বেও ভাগ হ’ল বাংলা। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গার কালো ছায়া, দ্বিজাতিতত্ত্ব, চকিতে ছড়িয়ে পড়া গুজব, রাস্তার পাশে পড়ে-থাকা লাশ, ভয়ে চমকে ওঠা, অদ্ভুত আঁধারের মতো বিছিয়ে-থাকা আতঙ্ক। হাজারে হাজারে উদ্বাস্তু। ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও, ধারণা করা হয়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছেন। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৫ লাখ। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু, দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতি অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। ১৯৪৭-এ ভারত রাষ্ট্র গঠিত হ’ল। বাংলা হ’ল অঙ্গরাজ্য। সারা অঙ্গে দেশভাগের ক্ষত। মননে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দ্বেষ। অথচ মূল যে সমস্যা — ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের।
ধর্মভিত্তিক জাতিতত্ত্ব বাংলায় অপ্রধান ছিল বলেই ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজাপার্টি (কেপিপি) ক্ষমতায় আসে। মূল শ্লোগান ছিল, ডাল-ভাতের সংস্থান, ভূমিসংস্কার ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা।
মাতঙ্গিনী হাজরার দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ, মেদিনীপুর জেলার কংগ্রেসকর্মীদের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা, অজয় মুখার্জি, সুশীল কুমার ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে লালবাড়ির দখল, অজয় মুখার্জির উদ্যোগে ১৯৪২-এর ১৭ ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠনে হিন্দু-মুসলমান আপামর বাঙালি উদ্বেলিত হয়েছিল।
ধর্ম কোথাও প্রধান হয়নি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ অনুসৃত নীতি-পদ্ধতি যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ধর্মীয় সমাজ-সামাজিক বিভাজন তৈরি করতে সমর্থ হয় সেখানে বাংলা এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। এই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা — এর ভেতরেই ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ।
জাতীয়তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল, দেশটা এক জাতির, লিগ বলল, দেশ দুই জাতির। এক ও দুইয়ের হট্টগোলে সেই সময়কালের ১৭টি ভাষা-গোষ্ঠীর দাবি হারিয়ে গেল। বহু জাতিত্বের সত্যটাকে অস্বীকার করতে দুই দলই ধর্মকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। ‘বন্দে মাতরম’ রণধ্বনি মুসলমানদের কাছে টানেনি বরং ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ তুলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ধর্মকে সামনে নিয়ে আসাতে আরও একটি সুবিধা হয়েছে। হিন্দু কংগ্রেস ও মুসলমানের মুসলিম লিগ দুই দলই মেহনতিদের তাদের পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে পেরেছে। নাহলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হবে কেন?
ভারতবর্ষের মানুষের জন্য কংগ্রেস বা লিগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, আর তারা ইংরেজের দেখানো পথে দেশ শাসন করবে। আর ইংরেজ চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা সমর্পন, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকে।
শ্রেণি তো নয়ই এমনকি জাতি প্রশ্নের সমাধানও দুই পক্ষের কোনো পক্ষই চায়নি। অন্যদিকে শ্রমিক ধর্মঘট ও কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটলেও, লবণ সত্যাগ্রহ বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের প্রতি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ইংরেজ বিরোধী জাতীয় চেতনার যে ব্যাপ্তি প্রকাশ পেয়েছিল তাকে যথোচিত মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয় কমিউনিস্টরা। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের আভাস সত্ত্বেও শ্রেণি ঐক্য ও ইংরেজ বিরোধী জাতীয়তাবোধ সমন্বিত হ’ল না।
অথচ এমন এক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা ইংরেজ-শাসকেক ছিল। সিপাহি অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যোগ দেয়নি। এটা ছিল ইংরেজদের একটা বড় ভরসা। কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো অভ্যুত্থানে যদি মধ্যবিত্তের বিক্ষোভ মেহনতিদের বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তাকে দমন করা যে সম্ভব হবে না —এটা ইংরেজরা বুঝে গিয়েছিল। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে। ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরও বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। তাই ‘স্বাধীনতা’র পরে, ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লিগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লিগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।
সাম্প্রদায়িকতা শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার, এবং সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে — দেশভাগ ছাড়া গত্যন্তর নেই। শরৎ বসু প্রমুখের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধতা ব্যর্থ হ’ল। সিরিল র্যাঙডক্লিফের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে দেওয়ার। কাজটা তিনি করেছেন ম্যাপের ওপর পেনসিল দিয়ে দাগ টেনে।
এবং ১৩ আগস্ট যেনতেন ভাবে কাজটা শেষ করেই তিনি চলে গিয়েছিলেন, পারিশ্রমিকের জন্যও অপেক্ষা করেননি। গৃহস্থের রান্নাঘর চলে গেল হিন্দুস্থানে, শোয়ার ঘর পাকিস্তানে। নদীর দেশ বাংলা। নদী নেমেছে ওপর থেকে নিচে। নদীকে তো কাটা যায় না, তবু কাটা হয়েছে, এবং তাতেই বোঝা গেছে কেমন অবাস্তব ছিল ঘটনাটা। ভাটি শুকিয়ে মরে উজান না পেলে। উজান প্লাবিত হয় ভাটিতে নামতে না পারলে।
ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
তেরো
দেশভাগের আগে সুদীর্ঘ সময়কাল জুড়ে গড়ে উঠল, বলা ভাল গড়ে তোলা হ’ল দুটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সম্প্রদায়। হিন্দু মুসলমান। একে অপরের শত্রু। এই বোধের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র-চেতনা। পাশ্চাত্যের নেশন স্টেট। দেশভাগে জাতি-শ্রেণি সমস্যার সমাধান হ’ল না। হওয়ার কথা ছিলও না। পাকিস্তান তো নয়ই। কারণ পাকিস্তানি জাতি বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্বই ছিল না; ছিল বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠান। বেলুচদের সঙ্গে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর লড়াই এখনো চলছে। পাকিস্তানি জাতীয়তা গড়ে তোলার জন্য জিন্না উর্দু ভাষার সাহায্য নেবেন ভেবেছিলেন; সুবিধা হচ্ছে না দেখে ফিরে গিয়েছিলেন ধর্মের কাছেই। জাতিসমস্যা ও শ্রেণিগত শোষণের ফলেই পাকিস্তান-রাষ্ট্র থেকে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম হয়। যদিও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনও সুস্পষ্ট কর্মসূচি না থাকায়, এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বহুত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ায় সেখানেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আপস করতে হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-বর্ণ-ভাষা-সম্প্রদায়ের বহুত্বকে মর্যাদা ও সম্মান দিতে না পারলে পাকিস্তানও টিকবে না।
ভারতও একদিকে যেমন স্বাধীন হলো অপরদিকে তেমনি এই অঞ্চলে জাতি-শ্রেণিসমস্যা নতুন করে সামনে এল। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও উপমহাদেশে জাতি-শ্রেণিসমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। গুরুত্ব পায়নি হিন্দু সমাজের নির্মম বর্ণ-বিভাজন ব্যবস্থা। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে, স্বাধীনতার দশক দুয়েক আগেও, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভানেত্রী, শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বর্ণধর্ম বিভাজনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সূক্ষ্মশরীরের (আত্মার, দেহজ্যোতির ) বর্ণ খুঁজে পেলেন ভারতের এই বিশাল মানবসমাজে। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই বর্ণ ছিল ব্রাহ্মণের শুক্ল, ক্ষত্রিয়ের লোহিত, বৈশের পীত আর শূদ্রের কৃষ্ণ।
১৯২০-র দশকের প্রথম দিকে গান্ধিজীও বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন না। যদিও বিরোধিতা করেছিলেন অস্পৃশ্যতা ও জাতিগত নিপীড়নের । পরে ১৯২১ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় গান্ধিজী লিখলেন, “আমি পুনর্জন্মে আগ্রহী নই। কিন্তু যদি আমার পুনর্জন্ম হয়, তা হলে আমি যেন অস্পৃশ্য হয়েই জন্মাই।” প্রথম দিকে তিনি ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহ সমর্থন করেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৪০-এর দশকে মহাত্মা বর্ণব্যবস্থার সম্পূর্ণ মূলোচ্ছেদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন এবং নিজে তাঁর আশ্রমে এই ধরণের বিবাহের আয়োজন করেন। গান্ধিজী বলছেন, অস্পৃশ্যরা হিন্দু সমাজের থেকে আলাদা নয়। যদিও অম্বেডকরের মতে গান্ধিজী বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে যেতে চাননি, তাদের তোষণ করেই তাঁর জীবন কেটেছে। তিনি স্বরাজ বা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা যতটা বলেছেন, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে, দলিতদের বিরুদ্ধে কিছুই প্রায় করেননি।
দলিত শব্দে প্রধানত কিছু জাতি (পেশা) গত গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যারা সচরাচর নিপীড়িত এবং অনগ্রসর। দলিতরা হিন্দু ধর্মের চার বর্ণ ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন হয়ে পঞ্চম বর্ণ, যা পঞ্চমা নামেও পরিচিত। ধর্মীয় বিশ্বাসে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্ট ও বিভিন্ন লোকধর্ম। ভারতের ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে দলিতদের সংখ্যা ২০ কোটি যা ভারতের জনসংখ্যার ১৬%। অর্থনীতিবিদ এবং সংস্কারক বি আর আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত সামাজিকভাবে অবদমিত মানুষজনকে দলিত সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করেন। তার গঠন করা "লেবার পার্টি"-তে সমাজের অবদমিত শ্রেণীর সমস্ত লোককে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যাদের মধ্যে মহিলা, ক্ষুদ্র কৃষক তথা অনগ্রসর শ্রেণীর লোকরাও ছিল। ১৯৭০ দশকে ‘দলিত’ শব্দের বহুল ব্যবহার হয় যখন 'দলিত পেন্থার' সমাজকর্মী গোষ্ঠী এর ব্যবহার করেছিল। কানহাইয়া কুমার-এর মতো নতুন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে ‘দলিত’ শব্দের সংজ্ঞা আরও ব্যাপক, একজন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কৃষক যিনি অতি কষ্টে জীবন নির্বাহ করছেন তিনিও ‘দলিত’ শ্রেণিতে পড়েন। বর্তমান সরকারি ব্যবহারবিধিতে দলিত শব্দ অসাংবিধানিক, ‘অনুসূচিত’ শব্দের ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ভারতে দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ২০১৪ সালের পর নির্যাতন ও বৈষম্য আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ সালে উত্তর প্রদেশে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। হরিয়ানা ও গুজরাটেও নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্ডিয়া টুডের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রতি ১৫ মিনিটে ভারতে দলিতদের বিরুদ্ধে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয়। এবং গত ১০ বছরে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। দলিত সম্প্রদায়ের জীবনমান নিয়ে ২০১১ সালের এক আদমশুমারিতে দেখা গেছে ৬০ শতাংশ দলিত কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছে না; ৫৩.৬ শতাংশ দলিত শিশু অপুষ্টির শিকার; ২০ শতাংশ দলিত বিশুদ্ধ জল ও স্যানিটেশন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। ১৯৮৯ সালে তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের (শিডিউলড কাস্ট ও শিডিউলড ট্রাইব) বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য যে আইন করা হয়েছিল তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে বাতিল করে দেওয়া হয়।
ইন্ডিয়া টুডের ভাষ্যমতে, এই আইনটি ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে দলিতদের নিরাপত্তা ঢাল। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি। এই আইন বাতিলের পেছনে তারাই মূল ভূমিকায় ছিল বলে বিশ্লেষকদের মত। দলিতদের ওপর নির্যাতনের এই খড়গ ক্ষমতাসীনদের আচরণে আরও স্পষ্ট হয়। ২০১৬ সালে বিজেপি নেতা দয়াশংকর সিং বহুজন সমাজবাদী পার্টি প্রধান ও দলিত নেত্রী মায়াবতীকে ‘পতিতার চেয়েও খারাপ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে প্রকাশ্যে দলিতদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারত শুরু থেকেই সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে নাকি হিন্দু রাষ্ট্র হবে এ নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেই তুমুল আলোড়ন চলছিল। একদিকে ছিল গান্ধী-নেহরুপক্ষ অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ। এই বিতর্কের সমাধান হয় ১৯৭৬ সালে ভারতকে সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বহুজাতি ও রাজ্যের সমষ্টি ভারত ১৯৭৬ সালে সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতের রাজনীতি ঠিক তার উল্টো পথে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অসহ্য রকমের বেআব্রু হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সাম্প্রতিক গেজেট নোটিফিকেশনে জানানো হয়েছে, সীমান্ত অঞ্চলে, বিএসএফের এলাকা ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হ’ল। এই অংশে ‘জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে’ বিএসএফ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, দেহ তল্লাশি করতে পারে এবং তার জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারে। ভারতের পূর্বাঞ্চল বরাবর রয়েছে ৪,১৫৬ কিমি (২৫৮২ মাইল) লম্বা টানা আন্তর্জাতিক সীমানা। অসম ২৬২ কিমি (১৬৩ মাইল), ত্রিপুরা ৮৫৬ কিমি (২৭৫ মাইল), মিজোরাম ১৮০ কিমি (১১০ মাইল), মেঘালয় ৪৪৩ কিমি (২৭৫ মাইল) এবং পশ্চিমবঙ্গ ২,২১৭ কিমি (১,৩৭৮ মাইল)।
এই আইনে উত্তরের কার্শিয়াং থেকে দক্ষিণে সুন্দরবন অব্দি, পশ্চিমবঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যাবে। চলে যাবে সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গই । কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনির আওতায় পড়ছে রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান শহর শিলিগুড়ি। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র শুধু নয়, উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের পথ, পাশের রাজ্য সিকিমের প্রবেশপথ। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় শাসকদলের সাংসদ-বিধায়কেরা উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার কথা তুলতে শুরু করেছে। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কেন্দ্রীয় বাহিনির কবলে এলে সেখানে অনুপ্রবেশকারীর ধুয়ো তুলতে তাদের সুবিধা।
বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে আসতে চলেছে, রাজ্যের লোকসভা কেন্দ্রগুলির অর্ধেক আর তার একুশটি বিধানসভা কেন্দ্র। হাবরা অশোকনগর বসিরহাট সহ উত্তর ২৪ পরগনার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আর দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক-তৃতীয়াংশ। এই সমস্ত এলাকায় স্থানীয় পুলিশকে না জানিয়েই যেকোনও ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে বিএসএফ।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তরফে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনার মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কেন্দ্রীয় শক্তি, বিপুল অর্থ, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়েও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ হওয়ায় তার এই আত্মঘাতি প্রচেষ্টা।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পুলিশিব্যবস্থা স্ব স্ব রাজ্যের অধীন। পশ্চিমবঙ্গের দশটি জেলায় আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। রাজ্যের অভ্যন্তরের এতখানি অঞ্চল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিপর্যস্ত হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চার হাজার কিলোমিটার জুড়ে কাঁটাতার। বিএসএফ এখানে প্রতিদিন বন্দুক-বেয়নেটে কেড়ে নেয় মানুষের প্রাণ। চোরাকারবারি? জঙ্গিদলের সন্ত্রাসবাদী? না, তারাই যারা পেটের দায়ে বাধ্য হয় সীমানা পেরোতে। ফেলানি।
বছর দশেক আগের একটি ছবি গোটা দুনিয়ার মানুষকে ভয়ঙ্করভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থেকে ঝুলছে লাল সোয়েটার পরা হাত, তার সমান্তরালে চুলের বেণী। চোদ্দ বছরের ফেলানি খাতুন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনি বা বিএসএফের গুলিতে মারা যায়। তার মরদেহ ঝুলে থাকে দীর্ঘ সময়, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তারপর তাকে নিয়ে যায় বিএসএফ। আরও তিরিশ ঘণ্টা পর লাশ ফেরত দেয় ওপারে। ফেলানির অপরাধ? সে কি অনুপ্রবেশকারী? না, সে নিজের দেশেই ফিরছিল। এর আগের দশ বছর ভারতের নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করছিল সে তার বাবার সঙ্গে। সেদিন ফিরছিল সে তার নিজের দেশে। ফিরতে গিয়ে কাঁটাতারে তার কাপড় আটকে যায়। ভয়ে সে চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি। মৃত্যুপথযাত্রী জল চেয়েছিল। জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে সেটুকুও তাকে দেওয়া যায়নি। ঘটনায় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়ে যায়। ফেলানিকে কেউ মারেনি এই কথাটি দুনিয়াজুড়ে মানবাধিকার কর্মীরা দেওয়ালে লিখেছেন। মানবাধিকার সংগঠন মাসুম ও ফেলানির বাবার করা মামলার এখনও বিচার চলছে। ফেলানির বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ। কেন গুলি চালাতে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনিকে? আত্মরক্ষার জন্য? কাকে বিপন্ন করেছিল ফেলানি?
অনুপ্রবেশ। ঢুকে পড়ে এনআরসির প্রসঙ্গ। সীমান্ত পেরিয়ে যে আসে সে আর শুধু মানুষ থাকে না, হয়ে যায় হিন্দু অথবা মুসলমান। শরণার্থী বা অনুপ্রবেশকারী।
ওপার বাংলা এপার বাংলা
মাঝখানে কাঁটাতার
গুলি খেয়ে ঝুলে থাকলে ফেলানি
বলো তো দোষটা কার?
কবীর সুমন
চোদ্দ
এজন মানুষ নিজের দেশে সরাসরি হিংসার শিকার হয়ে বা নিপীড়িত হওয়ার আশংকায় অন্য দেশের আশ্রয়প্রার্থী হন যখন, তখন তিনি শরণার্থী বা রিফিউজি। শরণার্থীকে আশ্রয় চাইতে হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে যারা কাজের সন্ধানে বা অর্থনৈতিক কারণে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যান, আর যারা অত্যাচারের কারণে, প্রাণের দায়ে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন, তাঁদের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। আশ্রয়দাতা দেশ কখনই কোন শরণার্থীকে জোর করে নিজের দেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না।
শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের নাগরিকত্ব চাইতেও পারেন, আবার নাও চাইতে পারেন। আশ্রয়দাতা দেশ তার নীতি অনুযায়ী নাগরিকত্ব মঞ্জুর করতে পারে, আবার নাও পারে। সমস্যা মিটলে শরণার্থীরা নিজের দেশে ফিরে যেতে পারেন বা সমস্যা না মিটলে এক আশ্রয়দাতা দেশ থেকে চলে গিয়ে অন্য দেশের কাছেও আশ্রয় প্রার্থী হতে পারেন।
পূর্ব-বাংলা থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ-লাখ হিন্দু নির্যাতন থেকে বাঁচতে ও জীবনরক্ষার জন্য ভারতে পাড়ি জমায়। এদের মধ্যে দলিত-নমঃশূদ্র হিন্দুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব-বাংলা থেকে আনুমানিক ৪১ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে ৩৪ লাখ উদ্বাস্তুকে ১০টি রাজ্যে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১১.১৪ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনকে ১৭টি রাজ্যে পুনর্বাসন করা হয়েছে। দু মেয়াদে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে ১৪.৪ লাখ উদ্বাস্তু। যাদের বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। এই উদ্বাস্তুদের ৭০ শতাংশই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। অন্য এক হিসাব মতে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ উদ্বাস্তু দরিদ্র তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত নিরক্ষর ভূমিহীন কৃষক ও মজুর। এছাড়াও তাদের মধ্যে পেশাগত বৈচিত্র্যও ব্যাপক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সচেতনতাও অনেক কম। ‘হরিগুরু চাঁদভক্ত মতুয়া মহাসংঘ’-র কথায়, ভারতে মোট বাঙালি উদ্বাস্তু ৪ কোটি। পশ্চিমবঙ্গে ২.৫ কোটি, বাইরে ১.৫ কোটি। (প্রথম আলো, ২৪/১১/২০১৮)
দেশভাগের এত দশক পরেও, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নানা রাজ্যে শিকড়ের সন্ধানে মাথা খুঁড়ছেন দেড় কোটিরও বেশি বাঙালি উদ্বাস্তু মানুষ। ওডিশা, কর্নাটক, অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, উত্তরপ্রদেশ, অসম, আন্দামান, বিহারের মতো বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। ২০১৯ সাল নাগাদ প্রকাশিত নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির এক সমীক্ষা রিপোর্টে এমন পরিসংখ্যানই সামনে এসেছে। ওই খতিয়ান অনুযায়ী, আর্থিক ভাবে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা এই মানুষজন এখন ক্রমেই হারিয়ে ফেলছেন তাঁদের মাতৃভাষার অধিকারও। কারণ, ভিন রাজ্যে বহু জায়গাতেই বিদ্যালয় শিক্ষাক্রমে বাংলার ঠাঁই নেই। পাশাপাশি, জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ (এনআরসি) ঘিরে নানা আইনি ও পদ্ধতিগত জটিলতায় ভিন রাজ্যে বসবাসকারী এই উদ্বাস্তু বাঙালিদের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে অস্তিত্বের এক তীব্র সঙ্কটের শিকার দেড় কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু।
নিখিল ভারতীয় বাঙালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিন রাজ্যে বহু প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছেন এই বাঙালি উদ্বাস্তুরা। তাঁরা রয়েছেন দাক্ষিণাত্যের কর্নাটকেও। সেখানকার কোপ্পাল ও সংলগ্ন এলাকায় রয়েছেন ৩৫ হাজার বাঙালি। ছত্তিসগড়ের বস্তার এলাকায় বাঙালির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ, সরগুজায় প্রায় ৮০ হাজার, দুর্গে ২৫ হাজার। উত্তরপ্রদেশের পিলভিটে রয়েছেন প্রায় ৩ লাখ বাঙালি। বিজনোরে ৫০ হাজার, খেরিতেও ৫০ হাজার। রাজস্থানের ঝালওয়ার-বারানেও প্রায় ২০ হাজার বাঙালি উদ্বাস্তুর বাস। মধ্যপ্রদেশের সাতনায় এই সংখ্যা কম করে ৫ হাজার। ছত্তিসগড়ের কানকেরেও প্রায় ১.৫ লাখ বাঙালি উদ্বাস্তু রয়েছেন। (আজ বিকেল, জানুয়ারি ৩, ২০১৯, আজ বিকেল ডট কম) ।
সামগ্রিক ভাবে যে ছবিটা উঠে আসছে, তা বাঙালি জাতি বা ডায়াস্পোরার পক্ষে খুবই দুশ্চিন্তার। নানা স্তরে রাজনৈতিক নিগ্রহ, ভাষার সঙ্কট, বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দরুণ বহির্বঙ্গে বসবাসকারী এই বিশাল সংখ্যক বাঙালি রীতিমতো কোণঠাসা। কিছুকাল আগে অসমের তিনসুকিয়ার ধলায় পাঁচ বাঙালিকে দুষ্কৃতীরা গুলি করে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। অসম-অরুণাচল সীমান্তের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা এই বাঙালিরা প্রত্যেকেই ছিন্নমূল। পশ্চিমবঙ্গের মূল স্রোতের বাঙালি ভূমিপুত্ররা যদি এই বঙ্গভাষী উদ্বাস্তুদের বিপদে পাশে না দাঁড়ান, তবে তা সব বাঙালির পক্ষেই বিপদ।
উদ্বাস্তু বাঙালির সঙ্কট প্রসঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকেই মনে করেন, সঙ্কট অনেক গভীরে। জনজাতির সামাজিক বিবর্তনের ইতিবৃত্তে, ছিন্নমূল মানুষ সংখ্যালঘিষ্ঠ ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ার কারণে মূল স্রোতের সঙ্গে মিলেমিশে থাকারই চেষ্টা চালান। এই প্রক্রিয়া বাধা পেলে সমস্যা তৈরি হয়। বাঙালি ডায়াস্পোরাকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এদের মধ্যে এক বিশাল সংখ্যক মানুষ স্বেচ্ছায় দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরা যেখানে রয়েছেন, সেখানকার ভাষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁরা কোনও আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করেন না। কিন্তু ছিন্নমূল বাঙালিদের ক্ষেত্রে সঙ্কট ঘুরেফিরেই আসছে।
এই যে মানুষজন বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে দেশত্যাগ করলেন, তাঁরা কেউই ভাবেননি, ভারতে গিয়ে তাঁদের নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। সে প্রস্তুতি নিয়ে দেশ ছাড়েননি।
১৯৫৫ সালে তৈরি হয় ভারতের নাগরিকত্ব আইন। এই আইনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিঃশর্ত ভাবে স্বীকৃত। একটি বাচ্চা ভারতে জন্মালে সে ভারতের নাগরিক। ভারতের আকাশে উড়ন্ত এরোপ্লেনে বা ভারতের সাগরে ভাসমান জাহাজ বা স্টিমারে জন্ম নিলেও নাগরিক। এছাড়া নাগরিকত্ব পাওয়ার অন্যান্য উপায়ও স্বীকৃত। যথা আদি বসবাস সূত্রে। যথা ন্যাচারালাইজেশন সূত্রে। যথা রিফুজি রেজিস্ট্রেশন সূত্রে। যথা উত্তরাধিকার সূত্রে। বোঝাই যাচ্ছে যে এই আইন অতীতে অবিভক্ত ভারতের অধিবাসী ও বর্তমানে ভারতের অধিবাসী উদ্বাস্তুদের ও তাঁদের সন্তানদের স্বার্থ রক্ষা করে।
সিএএ ১৯৮৬, সিএএ ২০০৩ ও সিএএ ২০১৯ -এ ধাপে ধাপে কেড়ে নেওয়া হয় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার নিঃশর্ত অধিকার। শুধু জন্মালেই হবে না, বাবা ও মায়ের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। সিএএ ১৯৮৬ পর্যন্ত বলা ছিল যে যারা ভারতে জন্মেছেন তাদের মা-বাবার মধ্যে অন্তত একজন নাগরিক হলেই তিনি জন্মসূত্রে নাগরিক হবেন। কিন্তু এবার বলা হ’ল, বাবা-মা দুজনের একজনও যদি "বেআইনি অভিবাসী" না হন, একমাত্র তবেই ভারতে জন্মানো শিশুকে নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এর ফলে আরও বহু উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান, যারা এদেশের জন্মসূত্রে নাগরিক হওয়ার কথা, তাদেরও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হল।
সিএএ ২০০ –এ সারা ভারতে নাগরিকপঞ্জি কার্যকর করার কথা বলা হয়। মূল লক্ষ্য, ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী, হিন্দু দলিত সম্প্রদায় ও বিভিন্ন ধর্ম-জাতি-শ্রেণি-পেশার ১.৫ কোটি উদ্বাস্তু মানুষকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
এনআরসি, এনপিআর আর জাতীয় পরিচয়পত্রের কথা বলা হল ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার। এই ধারা যতক্ষণ না বাতিল হবে ততক্ষণ ভারত রাষ্ট্র যে কোনও সময়ে এনপিআর করতে পারে।
সিএএ ২০১৯ -এ এমন এক প্রস্তাবনা এল যাতে "জাতীয় পরিচয়পত্র" পাওয়ার তাগিদে উদ্বাস্তুরা নিজেরাই নিজেদের "বেআইনি অভিবাসী" ঘোষণা করে দেবেন। অর্থাৎ, যে উদ্বাস্তু এই দেশে ভোটার, আধার, পাসপোর্ট, প্যান ইত্যাদি সমস্ত পরিচয়পত্র নিয়েই বাস করছিলেন, তিনি সিএএ ২০১৯ এর প্রস্তাবনা পড়ে প্রথমেই লিখে দিতে পারেন, তিনি বে-আইনি। অর্থাৎ এ যাবৎ তার সমস্ত পরিচয়পত্র বেআইনি! এরপর তিনি সরকারের কাছে আইনি স্বীকৃতি ভিক্ষা করবেন। তখন তাঁদের আবেদন বিচার করবে ইনটেলিজেন্স ব্যুরো এবং র! তারা প্রমাণ চাইবে ধর্মের, প্রমাণ চাইবে কোথা থেকে এসেছেন, প্রমাণ চাইবে ধর্মীয় অত্যাচারের, প্রমাণ চাইবে এদেশে আসার কারণের! সন্তুষ্ট হলে নাগরিক। প্রমাণ দিতে না পারলে নিজের ডিক্লেরেশন অনুযায়ী "বেআইনি অভিবাসী"। এবং এ যাবতকাল জাল পরিচয়পত্র রাখার জন্য ভারতের দণ্ডবিধি অনুযায়ী জেলে বসত নিশ্চিত।
২০১৯ সালে দেশজুড়ে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সংসদীয় কমিটির রিপোর্টের ওপর গোয়েন্দা বিভাগের বয়ান অনুযায়ী সারা ভারতে নাগরিকপঞ্জি করা হলে মাত্র ৩১ হাজার ৩১৩জন উদ্বাস্তু নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে। ফলে বিজেপি দেশজুড়ে নাগরিকপঞ্জির যে এজেন্ডা নিয়েছে তাতে দলিত হিন্দুদের বড় একটা অংশ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে।
যার স্পষ্টত প্রমাণ, ২০১৭-র বর্ষশেষে আসামে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে নাগরিকপঞ্জীর যে খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে মধ্যরাতে, সেখানে ৪০ লক্ষ মানুষকে, আসামের বাঙালিদের, ভারতর নাগরিক নয় বলে তালিকা প্রকাশ করা হ’ল। ২০১৯-র ৩১ আগস্টের চূড়ান্ত তালিকায় ২০ লক্ষ মানুষের নাম নেই। হিন্দু বাঙালি শরণার্থী, মুসলমান বাঙালি অনুপ্রবেশকারী। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪–র আগে আসা শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পাবেন। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোনী আইন গৃহীত হয়। দক্ষিণ আসামের বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকার মানুষদের, সেখানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির নাম নেই। বাঙালিদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে চরম উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে। ডিটেকশন ডিলিশন ডিপোর্টেশন।
২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টে সংগৃহীত তথ্যাদি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আসামে নাগরিকপঞ্জীতে নাম নথিভুক্ত করতে চেয়ে ৩.২৯ কোটি আবেদনপত্রের মধ্যে ১৯ লক্ষের কিছু বেশি নাম ৩১ আগস্ট, ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা প্রস্তুত করতে সরকারের হ্যয় হয়েছে ১২২০ কোটি টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া ২০২১ এর ২৩ মার্চ আসাম সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, যাদের নাম বাদ গিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে অনতিবিলম্বে যেন ‘রিজেকশন স্লিপ’ ইস্যু করা হয়। ‘ডি ভোটার ও তাদের বংশধর, বিদেশী হিসাবে ইতিমধ্যে যাদের সনাক্ত করা হয়েছে ও তাদের বংশধর’ এমন ১০৩২ টি নথিভুক্ত কেসের বিষয়ে নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বাঙালিদের সামনে আরও বড় বিপদ আসছে।
২০১৯ জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকার অসম চুক্তির ৬নং ধারা বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করার ১৪ জনের কমিটি তৈরি করে দেয়।
(ছয়) ৬নং ধারায় ছিল অসমীয়াদের সাংস্কৃতিক সামাজিক ও ভাষিক আত্মপরিচয় ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও প্রসারে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কমিটিতে কোনো বাঙালি বা অসমীয়া গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ছিল না। ১৯৮৫’র ১৪ই আগস্টেও ছিল না। রাজ্য রাজনীতিতে ও সামাজিক অর্থনৈতিক অধিকারের নিয়ামক শক্তি হিসাবে ভাষিক সংখ্যালঘুরা ভূমিকাহীন।
*কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ পদেও এই সংরক্ষণ।
*বেসরকারি মডেলে বা আদলে বা রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমবেদনা থাকলে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭০-১০০% অসমিয়া।
*জমির মালিকানায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকবে অসমীয়াদের। ব্যবস্থাপত্রে সাংবিধানিক অনুমোদন থাকবে। সংখ্যাগুরুদের সংরক্ষণ দেওয়া হলে সংবিধানের ১৫(৪) এবং ১৬(৪) লঙ্ঘিত হবে।
এন আর সি কার্যকর হলে ১৯৭১’র ২৫ মার্চের আগে যারা এসেছেন তাদের সবারই নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা। ১৯৫১’র জানুয়ািরর আগে যারা এসেছেন তারা সুপার সিটিজেন। অন্যদের কোনো অধিকার থাকবে না। দুই শ্রেণির নাগরিক। নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি না।
শুধু তাই নয়। দেশভাগের দায়ভারে এখন নতুন করে জর্জরিত বাঙালি। এই ডিসেম্বরের (২০২১) ২ তারিখে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডে’র খবর অনুযায়ী, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা তার রাজ্যের অসমীয়া মানুষজনকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বহু সরকারি জমি অধিকার করে ঘর বাড়ি চাষবাস করছে, ওদের জোর করে হটিয়ে এলাকা দখল করে অসমীয়াদের নিজেদেরই কৃষিতে আসামকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলই শুধু নয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত বাঙালির বিপন্নতা ভারত-রাজধানী দিল্লি সহ সারা ভারত জু়ড়েই। অমীমাংসিত জাতি সমস্যা।
আসামের বাঙালিও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিভাজিত, হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালিতে। এবং এই বিভাজনকে ব্যবহার করছে অসমীয়া আধিপত্যবাদী সন্ত্রাস। আসামকে বাঙালিশূন্য করার প্রয়াস এখনও অব্যাহত।
পনের
বর্তমান ভারত-শাসকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হিন্দুত্বের এক নির্মিত সংজ্ঞায় বলপূর্বক জাতি-সংস্কৃতি-ধর্ম-ভাষা-বর্ণ-আঞ্চলিকতার বহুত্ব বিলুপ্ত করে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের একমাত্রিক একাধিপত্য কায়েম করে এক জাতিরাষ্ট্র গঠনের উন্মাদবৎ আচরণে। বিপন্ন ২২টি স্বীকৃত ভাষাভিত্তিক জাতি ও সাস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বহুসংখ্যক উপজাতি। ফলস্বরূপ ক্রমাগত খর্বিত বহুত্বচর্চা, সহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতা ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য। ২০১৪ সালের পর ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে নাগরিকপঞ্জি করা এবং মুসলিম ও দলিত শ্রেণির ওপর উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের নির্যাতন ও শোষণ রাষ্ট্রের এ্যাজেন্ডা।
ভাষা-সংস্কৃতি-ব্যবসায়িক সম্পর্কসূত্র সৃষ্ট গুজরাটি অস্মিতা নির্মান করেছে গুজরাটি জাতিসত্তার 'জাতীয়তাবোধ' নয় এক দর্পিত 'জাতীয়তাবাদ'। 'ব্যাক টু সয়েল', 'ব্যাক টু মাদার' মানসিকতা যেমন 'ইনক্লুসিভ জাতীয়তাবোধ' জন্ম দেয়, ঠিক তেমনই 'জাতিসত্তার এক্সক্লুসিভ অস্তিত্ব ও একক নিয়ন্ত্রণ আকাঙ্খা'রও জন্ম দেয়। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের মুসলমান শাসকের আধিপত্যকামী শাসন হয়ত গুজরাটি জাতিসত্তার 'অন্তর্গত রক্তে' ক্রিয়াশীল বর্তমান। গুজরাট নয়, বিদেশে বসবাসকারী অথচ গুজরাট একাত্মবোধ-মনস্কতা যে 'হিন্দু ধর্মীয় বোধ নির্মাণ করে তা স্থিত হয় হেগরেওয়ার-সাভারকারের 'রাম' কল্পনায়। হেগরেয়ারের 'রাম' হচ্ছেন এমন এক 'নির্মিত বলশালী অবতার', যিনি মুসলমান-রূপ রাক্ষস নিধন করেন।
গান্ধির 'রাম' ছিলেন ঈশ্বর। তাঁর জন্ম সুখে দুখে আনন্দে। ধর্ম, লোকচার, যাপন, মূল্যবোধ, নৈতিকতায়, অনুভবের দৃশ্যমানতায়, যা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক। উত্তর ভারতের 'রাম' রামচরিত মানসের 'রাম', রামায়ণের 'রাম'। অপ্রাতিষ্ঠানিকই।
মঞ্জুরেকর- হেগরেওয়ার-সাভারকারের 'রাম' জন্ম নেয় ফৈজাবাদে। 'রাম'ই হচ্ছেন আদর্শ পুরুষ। 'রাম'য়ের পতাকাই সংঘের পতাকা। মুসলমানেরা তার ওপর গড়েছে 'বাবরি মসজিদ'। 'বাবরি মসজিদ' ধ্বংস করে উদ্ধার করতে হবে 'রাম জন্মভূমি'। হিন্দুদের 'টাস্ক'! 'কর্তব্য'।
হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ধর্মোন্মাদদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য পশ্চিমকে হারাতে হবে। হারাতে হবে তাদের জাতি-রাষ্ট্রের নির্মাণ-পদ্ধতি অনুসরণ করেই। প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্রবিধির প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রেখে, উগ্র অযৌক্তিক উন্মাদনায় ভেসে বা ধর্মীয় নব জাগরণে সওয়ার হয়েই সেই চলা।
হিন্দু ধর্মমতের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য সহ অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি-মুক্ত, সাভারকার নির্মিত বৈদান্তিক বিশ্বাসের সঙ্গে পশ্চিমী প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রনীতিতে দাঁত নখ তীক্ষ্ণ করে সব বহির্শক্তি ও আভ্যন্তরীণ শক্তিকে পিষে মারা। হিন্দুধর্মের বহুত্ববাদী ধ্যানধারণাকে বিনাশ করে পশ্চিমী ভাবাদর্শকে অনুসরণ করা। ধর্মীয় ভাষ্য উদ্ধৃত করে তাকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচারে আনা।
রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক ধারণা ক্রমাগত সমাজ অভ্যন্তরে ধারণ করতে করতে ন্যাশান্যালিস্টিক রাষ্ট্র নিজেই ঔপনিবেশিকদের চরিত্র অনুসরণ করে। তাদের ধ্যানধারণায় পুষ্ট হয়। এক নির্মিত আধুনিকতা। পশ্চিমী আধিপত্যবাদী ভাষ্যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, চিরায়ত ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধুনিকতার ও উন্নয়নের যে নতুন ভাষ্য নির্মাণ করলেন সেখান থেকে জন্ম নিল ভিন্ন এক ধর্মীয় হিংসাশ্রয়ী ভাবাদর্শের। রাষ্ট্রকাঠামো, গণমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তার ভাবাদর্শ, উন্নয়ন এবং আধুনিকতার যে ভাষ্য নির্মিত হল সেখানে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় একটি নির্ধারক ভূমিকা নিল।
এই আধুনিকতা-নির্মিত ভাষ্য, আর ছোট ছোট গোষ্ঠী আর শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই নয়, বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে চারিয়ে গেছে। এরা দেখতে পাচ্ছেন, তাদের 'পরিচিতি' আক্রান্ত - নিজস্ব পরিচিতি-বিশ্বাসী মানুষজন মনে করেছেন তারা হেরে গেছেন, তাদের আর কিছু করার নেই। একেবারে কোণঠাসা এক সব মানুষজনের মধ্যে থেকে উঠে আসছে এক হিংসাশ্রয়ী অবস্থান। সমৃদ্ধ কোনো যাপন নয়, ইনক্লুশন নয় এক্সক্লুশন, রাষ্ট্রাধীন ঔপনিবেশিক ধর্মীয় এক যাপন-পদ্ধতি অনুসরণ।
অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে এই বছর ২০২২-এ জানুয়ারির প্রথম দিনেই নেট মাধ্যমে বুলি বাই নামে একটি অ্যাপে ১০০ জনেরও বেশি বিশিষ্ট সাংবাদিক, অভিনেত্রী ও সক্রিয় সমাজ কর্মী, যাঁরা সবাই-ই ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম, তাঁদের ছবি দিয়ে , দাবি করা হয় যে তারা "দাসী হিসাবে বিক্রয়ের জন্য"। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং সামাজিকভাবে বিশিষ্ট মুসলিম মহিলাদের নীরব করার জন্যই এই আপাত প্রচেষ্টা। ভারতে ইসলামোফোবিক ঘটনার নিদর্শন।
২০২১ সালের শেষ দিনে উত্তর প্রদেশ সরকারের আর্থিক অনুদানে একটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক নিম্নরুচির ইসলামোফোবিক বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে। তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, উত্তর ভারতের হরিদ্বার শহরে অনুষ্ঠিত তিনদিনের ধর্মীয় সম্মেলনে বেশ কিছু উগ্র ডানপন্থী হিন্দু নেতা প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছিলেন । ওই ডিসেম্বরেই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বক্তৃতায় ভারতের সুদূর ইতিহাসের মুসলিম ব্যক্তিত্ব এবং বর্তমান সময়ের "সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় চরমপন্থা"র মধ্যে এক সংযোগসূত্র স্থাপন করে ভারতের মুসলমানদের দায়ী করেন এবং সুদূর অতীতের তাদের "পূর্বপুরুষদের" দ্বারা সংঘটিত কথিত অপরাধের জন্য শাস্তির ন্যায্যতার কথা তোলেন।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে "৮০ বনাম ২০ শতাংশ"য়ের লড়াই হিসাবে, বর্ণনা করেছেন। এই ২০২১ সালেই মুসলিম বিরোধী প্রচার ও মুসলিম বিরোধী একাধিক আইন ও নীতি দেশের নির্লজ্জ ইসলামোফোবিক মিডিয়া যথার্থ বলে দিবারাত্র প্রচার করেই চলেছে।
২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের মুসলমানরা হুমকির মধ্যে আছেন। গত কয়েক বছরে, এই সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। আজ, উগ্র ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমর্থনে এবং মাঝে মাঝে উৎসাহ দিয়ে, মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে তাদের নিজেদের দেশে আর সমান নাগরিক হিসেবে দেখা হয় না। তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আক্রমণ করা হচ্ছে এমনকি অপরাধী করা হচ্ছে। মুসলিম নারীরা শুধুমাত্র মুসলিম বলেই অপমানিত ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। মুসলমানদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে। মুসলমানদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হচ্ছে। বিজেপির ভারতে মুসলমান হওয়া আর নিরাপদ নয়।
তবে, মুসলিমরাই একমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয় যা দেশে ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থীদের লক্ষ্যবস্তু। ভারত জুড়ে খ্রিস্টানরাও একই রকম ঘৃণা ও সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে। রাজ্যের পর রাজ্যে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং দরিদ্র হিন্দু ও উপজাতিদের জোর করে ধর্মান্তরিত করার জন্য খ্রিস্টানদের দায়ী করা হচ্ছে। চার্চে হামলা হচ্ছে, যাজকদের মারধর করা হচ্ছে। ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরামের মতে, ভারতে গত এক বছরে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অন্তত৪৬০টি হামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
বিজেপির নেতৃত্বে ভারত বিশ্বের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। তারা শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের ধর্মীয় আচার, খাদ্যাভ্যাস এমনকি ব্যবসাকে অপরাধী করার জন্য আইন পাশ করা হচ্ছে। বৈষম্যমূলক আইনের উপরে, তারা নিয়মিতভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে এবং শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মিডিয়ার পাশাপাশি টিভি ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও তাদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার করছে। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, দেশের নির্বাচিত শাসকরা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ক্রমাগত অমানবিক এবং এমনকি তাদের দানবীয়করণ করছে।
ষোল
নেশন বোধে জারিত ও তাড়িত এক রাষ্ট্র।
একদা সম্রাট ছিলেন। সম্রাট operate to hold the existing social norms, not to overrule it. Time delegated, time bound, status বজায় রাখা। Early Modernism -এ রাজা সরাসরি নয়, পারিষদ দিয়ে শাসন করেন।
Absolute রাষ্ট্র এল Sovereignty ও Democracy যুক্ত হয়ে। ফরাসী বিপ্লবের পর Sovereignty & Democracy with Dictatorship.
Rule exist in the normal time but for any (as I define) exceptional state of affairs, I/We hold the Sovereign power...আমি, আমিই ঠিক করব।
২০২০’র মার্চ মাসে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি Prime Minister’s Citizen Assistance and Relief in Emergency Situations বা PM CARES নামের তহবিলটি তৈরি করেন। ২৯ মার্চ দিল্লির রাজস্ব বিভাগে এটি নথিভুক্ত হয়। তারপর থেকে বহুবার তিনি নিজে, সরকারের নেতামন্ত্রীরা, এমনকী সেলিব্রিটিরাও এই তহবিলে অনুদানের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান করেছেন। বস্তুত, দেশের সব বড় শিল্পপতি থেকে শুরু করে, সেলিব্রিটিরা প্রত্যেকেই এই তহবিলে অর্থ দান করেছেন। করোনা মোবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৈরি PM CARES ট্রাস্টে কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন্দ্র সরকার বা কোনও রাজ্য সরকার সরাসরি এই ট্রাস্টের তৈরি তহবিলের হিসেব-নিকেশ বা খরচের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে না। খোদ কেন্দ্রের দেওয়া নথিতেই উল্লেখ আছে এই তথ্যের। মজার কথা হল, সরকারি সংস্থা না হওয়া সত্ত্বেও PM CARES-এর চেয়ারম্যান পদে আসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও, সেটা ব্যক্তি হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন। একইভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এই তহবিলের ট্রাস্টি। এবং, এই তহবিলের যাবতীয় আয়ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র এই কয়েকজনের হাতেই ন্যস্ত। পরোক্ষে বলতে গেলে এই PM CARES ট্রাস্ট, এই কয়েকজনের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন।
আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, আমি সেই ক্ষমতা যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করব।
সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড (সিইএল), বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা বিভাগের (ডিএসআইআর) অধীনে একটি কেন্দ্রীয় পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজ (সিপিএসই। কেন্দ্রীয় সরকার মেসার্স নন্দল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির কাছে CEL বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ এই কোম্পানির কোনো অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তিগত এবং ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা নেই, এবং ট্র্যাক রেকর্ডও সন্দেহজনক। ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনাল (NCLT, CP No. 290/ND/2018, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯-এ দেওয়া আদেশ) এর সামনে কোম্পানির একটি মামলা বিচারাধীন।
সিইএল বহুবার সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা বিভাগ (ডিএসআইআর) দ্বারা গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য জাতীয় পুরস্কার। ৩১ অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত, সিইএল-এর কাছে ১,৫৯২ কোটি টাকার অর্ডার বাকি ছিল। এই অর্ডার থেকেই সিইএল ভারত সরকারকে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকার মুনাফা দিতে সক্ষম। ৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত, সার্কেল রেট অনুযায়ী সিইএল -এর দখলে থাকা জমির মূল্য ৪৪০ কোটি টাকা।
সিইএল-এর জমি বিডিং প্রক্রিয়ার একটি অংশ হোক বা না হোক, সিইএল-এর সম্পদের অন্তর্নিহিত মূল্য, মূর্ত এবং অস্পষ্ট, যার মধ্যে চার দশক ধরে নির্মিত ব্র্যান্ডের মূল্য এবং এর প্রযুক্তিগত ক্ষমতাগুলিকে উপেক্ষা করার কোন মানে হয় না।
সিইএল তার নিজস্ব আর এ্যান্ড ডি প্রচেষ্টার পাশাপাশি কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ও ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ল্যাবরেটরি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে প্রথম সৌর কোষ এবং সৌর মডিউলের বিকাশ, ১৯৯২ সালে প্রথম সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ফেজ কন্ট্রোল মডিউল (পিসিএম), এলআরডিই (ইলেক্ট্রনিক্স রাডার ও ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট) রাজেন্দ্র রাডারে ব্যবহারের জন্য, ক্যাডমিয়াম জিঙ্ক টেলুরাইড। প্রতিরক্ষা অ্যাপ্লিকেশনের জন্য এবং রেলওয়ে সিগন্যালিং সিস্টেম ব্যবহারের জন্য এক্সেল কাউন্টার।
ইলেকট্রনিক্স বিভাগ যখন ২০টিরও বেশি সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন, কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ডিসপ্লে ফ্যাব্রিকেশন ইউনিট স্থাপনের জন্য ৭৬,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে সেসময় মাত্র ২১০ কোটি টাকায় কোম্পানি তুলে দেওয়া হচ্ছে নন্দল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং প্রাইভেট লিমিটেডের হাতে। কোম্পানিটি খুব কমই কোনো ব্যবসা করছে। কোম্পানির কোনো স্থায়ী সম্পদ নেই। এটির কোন জমি এবং ভবন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি নেই। এটি একটি ট্রেডিং কোম্পানি যার কোন উল্লেখযোগ্য সম্পদ নেই। মেসার্স নন্দল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং প্রাইভেট লিমিটেডের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়; এর ৯৯.৯৬% শেয়ার মেসার্স প্রিমিয়ার ফার্নিচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়ার্স প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে রয়েছে, যা ২৩ অক্টোবর, ২০০৭ এ গঠিত হয়েছিল।
Power in the name of People। Authority is established। তৈরি হ’ল Revolutionary Pattern।
Dictatorship in the name of People। Power in the name of People।
বাস্তিল ভেঙে গেল, স্থলাভিষিক্ত হ’ল PROMISE.
I promise to bearer..
Political হয়ে একটা বোধ তৈরি হ'ল। শত্রু ও মিত্র। Political community.
আমার Liberal concept বলল, সবাই ভাই ভাই। নিঃস্বার্থ ভালবাসা। না। No. Empirical sense - Group hostility. এমন লেভেলে থাকবে, ওঠাতে হবে, অপরের অস্তিত্ব আমার কাছে বিপদজনক। Political unity জন্ম দিল Sense of exterminate.
রাষ্ট্র থাকতে হলে Political হতে হবে। Political other Jews should be anhilated. রাষ্ট্রের আগে Political হতে হবে। Politics হচ্ছে সার্বভৌম। রাজনীতিরই সার্বভৌমত্ব হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট রাজনৈতিক ক্ষমতা - Private exercise of Public power ।
এই শত্রু-মিত্র বোধে জারিত ও তাড়িত সে বিশ্বাসী রাষ্ট্রনির্মিত বয়ানে। ২০১৯ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ৩০০ কেজি আরডিএক্স বোঝাই ট্রাক বিস্ফোরণে সেনাবাহিনীর ৪৪ জন জওয়ান নিহত হন। বিস্ফোরণ ঘটায় পাকিস্তানের জঙ্গীরা। তার কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্জিকাল স্ট্রাইকে ৩০০ জন পাকিস্তানি জঙ্গী মারা যায়। মিডিয়ার তুমুল জয়ধ্বনি। জাতিয়তাবাদী জিগির। নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী বিপুল ভোটে জিতে আসে। মিডিয়ার ভীতিপ্রদ উল্লাসধ্বনির মধ্যেও কয়েকজনের ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছিল সেদিন। সবটাইই নাকি সাজানো। হারিয়ে গিয়েছিল সে স্বর। কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মুম্বাই পুলিশ অর্ণব গোস্বামীর উগ্র জাতীয়তাবাদী চ্যনেলের বিরুদ্ধে চলা এক তদন্তে হদিশ পায় একটি হোয়াটসঅ্যাপ বিনিময়-বার্তা। বিনিময় হয়েছিল অর্ণব গোস্বামীর সঙ্গে তৎকালীন বার্ক (যারা প্রতিটি টিভি চ্যনেলের দর্শক সংখ্যার হিসাব রাখে)-এর চেয়ারম্যান পার্থ দাশগুপ্ত-র। সেখানে নাকি পরিষ্কার বোঝা গেছে, অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী জানতেন পুলওয়ামার ঘটনা ঘটবে। জানতেন কবে বালাকোটে সার্জিকাল স্ট্রাইক ঘটানো হবে। অর্ণব উল্লসিত, ‘উই হ্যাভ ও’ন ইট লাইক ক্রেজি’। অনুমান করা শক্ত নয়, এই ঝঙ্কিত উচ্ছ্বাস আসন্ন নির্বাচন ঘিরে, জানা ছিল পুলওয়ামার ভারতীয় জওয়ান নিধনের আগাম বার্তা। জঙ্গী জাতীয়তাবাদ। নিজের দেশের নাগরিকদের জীবন হেলায় বিপন্ন করে, ছিন্নভিন্ন হতে দিয়ে দেশপ্রেমের রব তোলা, নিজেদের, কেবলমাত্র গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থরক্ষায়।
I on behalf of the people... I or We. যখন যেরকম।
Majoritarian decision.
একজন রাজনৈতিক মানুষ সর্বোতভাবেই প্রতিপক্ষ খোঁজে। মননে তার শত্রু ও মিত্র। সেই একই মানুষ ভিন্ন তার সামাজিক সত্তায়। সামাজিক অবস্থানে পরিবারে বা পাড়াপড়শী বা পেশাগত পরিচয়ে তার স্বাভাবিক উদারমনস্কতা বিভাজিত রাজনৈতিক বোধে।
সতের
ভারতীয় সহনশীলতার ভিত্তি বিশ্বাস। বিশ্বাস তুলসীদাস, কবীর, চৈতন্যে। বিশ্বাস উদার বৌদ্ধধর্মে, বিশ্বাস উদার ইসলামে, বিশ্বাস সত্যপীরে। সহনশীলতার ভিত্তিভূমি এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় বোধ, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, সমৃদ্ধ ভক্তিগীতি আর লোকসাংস্কৃতিক অঙ্গন। এখানেই সে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক তার অবাধ বিচরণ ও ভাবাশ্রয়। ইতিহাসেও অনুসন্ধান হোক একমাত্রিক নয়, সাংস্কৃতিক বহুত্ব। হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ব, দেশপ্রেম ও সামরিক-স্বৈরতান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার গুণগত তফাৎ অস্পষ্ট করে, হিংসাশ্রয়ী ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত নির্মাণ করে, সমস্ত দেশকে সাদা-কালোয় বিভাজিত করে এই বিরাট, বিশাল, ঐতিহ্যবাহী ভারত বলদর্পে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও নির্মিতি, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত 'আত্মনির্মাণ', মধ্যবিত্ত সমাজের খুবই পছন্দ। ঔপনিবেশিক পরবর্তী মধ্যবিত্তদের ধারণা, পশ্চিম এতটা এগিয়ে গেছে কেননা ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে আরো ভালো বোঝাপড়া সে অর্জন করেছে। আধুনিক ভারত নির্মাণে মধ্যবিত্তদের অবস্থান যেখানে ধর্মকে কোনো পরিসর না দিতে চাওয়া সেখানে সাধারণ মানুষ তার যাপনে ধর্মকে আলাদাভাবে হলেও জড়িয়ে রেখেছেন।
এই যে দু'ভাবে দেখা, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখার পরিসর খুঁজে নেওয়া, দৃষ্টিভঙ্গিগত আলাদা। বিশ্বাসী যেখানে যুক্তি বুদ্ধি ক্ষমতা ও তার এ যাবৎ অধীত বিশ্বাসকে অতিক্রম বা ছাড়িয়ে যেতে পারে, নির্দিষ্ট মতাদর্শ - একাধিক নির্মিত ও সূত্রায়িত ভাষ্য সত্ত্বেও - অনমনীয় অনড় সংকুচিত আচার আচরণে সুসংবদ্ধ। আধুনিকতা নির্মাণে বহুত্বে বিশ্বাসী ধর্মে বাধা, বাধা ছোট ছোট জনপদগোষ্ঠী, মূলবাসী-আদিবাসী জনসমাজ। এমনকি বড় বড় জাতিসত্তাও। স্বকীয় ভাষাসত্তাও। স্বকীয় ভাষাসত্তা বিলুপ্ত হতে থেকে ক্রমশ। এমনভাবেই পাঞ্জাবী ভাষা হিন্দি হয়ে যায়। মুছে যায় শিখ ও হিন্দু ধর্মের পার্থক্য। নিজের বৈশিষ্ট্য বিলোপ করে নিজেকে নির্মাণ।
মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের হারামণি গ্রন্থের ভূমিকা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘...আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। সুরে হিন্দু-মুসলমানের কন্ঠ মিলেছে, কোরাণ পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামে গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কিরকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।...'
তোমার ঘরে বসত করে কারা, ও মন জানেনা তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা – লালন শাহের এই আত্মজিজ্ঞাসা সমাজতাত্তিক অন্বেষণের বাইরেই রয়ে গেল। মনুসংহিতার চতুর্বর্ণের বর্ম ভেদ করে সহ-নাগরিককে স্বজন ভাবতে পারল না বাঙলাও। যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করতে পারল না সমাজ। নবজাগরণের পর্যায় পার হয়ে আসার এতগুলো বছর পরেও পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে নিজের জাত পরিচয় জাহির করে মেলে ধরে বাংলা জাতমুক্ত! কলেজ অধ্যক্ষকে নির্দ্বিধায় অন্ত্যজ শ্রেণি বলে বিদ্রুপ করে তাঁরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক।
সে ভাবতে থাকে। চিন্তাসূত্র গ্রন্থিমুক্ত হতে থাকে। কিছুটা গোচর কিছুটা অগোচরে। গ্রন্থিমুক্ত হওয়ার কথা শুনেছিল সে, শয়নকালে, পারলৌকিক ব্রতে যোগদানে বা শোকপালনপর্বে শিখা গ্রন্থিমুক্ত রাখতে হয়। শিখা চৈতন্যস্বরূপ। উপনয়নকালে মুণ্ডিত মস্তকে তার শিখা রাখার কথা হয়েছিল দৈর্ঘে এক দেড় ইঞ্চি। সেদিন সে অস্বীকার করেছিল সেই আচার-বিচারের। স্বজন-পরিজনেরাও কেউ বিরোধিতা করেননি সেই অস্বীকারে।
রেওয়াজও ছিল না তার পরিবারে কোনও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। তবু তার মধ্যবিত্ত সমাজ পরিসরে হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-বাগদি-কৈবর্ত বিভাজন আজও অষ্পষ্ট নয়। দুর্গা পুজো উৎসব নয়, ভক্তি-আচার-জাত-পাত পুষ্ট। দোল-দুর্গোৎসব স্বাভাবিক, কিন্তু ঈদ ধর্মীয় গোঁড়ামি।
সে ভাবে তার শিক্ষা-সংস্কার-পরিবার-সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র কথা। সে তার এক প্রক্রিয়াজাত। হঠাৎ করে তার উদ্ভব নয়। চারপাশটাকে বদলাতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে। যেখান থেকে তার উদ্ভব, পরিবার, পাড়া, গ্রাম সেখান থেকেও সে বিচ্ছিন্ন। তার একদা সম্মিলন আজ আর অটুট নাই। তার নিজস্ব সৃষ্টির ইচ্ছারূপ সংঘবদ্ধ ভাবাদর্শে। শ্রেণি সম্প্রদায়ে। ‘ল্যাঙ্গোয়েজ’, ‘ইজম’, ‘রিলিজিয়ন’-এ।
প্রাণীজগতের দিকে তাকালে সে দেখে সেই জগত, তার অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে বর্তমানে বাস করছে। বাবুই পাখির বাসা এক’শ, দু’শ, পাঁচ’শ বছর আাগে যেমন ছিল, আজও তাই এবং ভবিষ্যতেও তেমনটাই থাকবে। সে মানুষ, তিন কালের জীব। তারই মধ্যে প্রতি কালসময়ে একই সঙ্গে দুই জগতের বাসিন্দা। ক্ষণিক ভিতরের, ক্ষণিক বাহিরের জগত। সৃজনে বাস্তবায়িত করে কল্পিত রূপ, সৌন্দর্য চেতনায় পাল্টে পাল্টে একদা অধরা সেই রূপ আয়ত্ত করেই আবারো নিমগ্ন সে নতুন
ভাল প্রেমের কবিতা যত না সফলতা নিয়ে, তার চেয়ে বেশি ব্যর্থতা নিয়ে, অপূর্ণতা নিয়ে। না পাওয়ার দুর্দম আকাঙ্ক্ষাজাত মনোবেদনা। সে কি প্রেমের আনন্দ অল্পক্ষণ, আর বেদনা দীর্ঘস্থায়ী এই অর্থে। অথবা এর সঙ্গে যুক্ত ভিন্ন এক বাস্তবতা। সে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে যে তাকে রচনা করেছে, সেই তাকে পাওয়ার পরিসর, প্রতিষ্ঠান তাকে ছেড়ে দেয়নি। মানুষের কল্পনার মূল্য প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। রাষ্ট্র কেয়ারই করে না। তার নিজস্ব অনুরণন ধারণ করতে পারে না রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তাকে চেনে না, তার চোখেও রাষ্ট্র দৃশ্যমান নয়। অথচ তারই সম্মতিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র, তার নামেই তারই ওপর, তারই নাকি প্রয়োজনে নানান বিধিনিষেধ জারি করে চলে। পুলিশ-মিলিটারি, আইন-আদালত, মন্ত্রীসভা-সংসদ, আমলা-সচিব, ছোট-বড়-মাঝারি সরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই কাজ করে রাষ্ট্রকে টিঁকিয়ে রাখতে। রাষ্ট্র থেকে সে বিচ্ছিন্ন, ভিন্ন এক সার্বভৌম ক্ষমতা তার পরিসর নির্দিষ্ট করে দেয়।
মানুষ তো একমাত্রিক নয়। মানুষ তো তার অস্তিত্বের অসংখ্য প্রশ্নের শুধুই ক্রীড়নক নয়, বাস্তব জীবনের অগণন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে উত্তর খোঁজে বিচক্ষণতায়। অঙ্গীভূত করে অপরাপর মতামত। পাশ কাটিয়ে যান চতুরতায়ও।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৭৮৪) কান্ট সেই সময়কালকে নির্দিষ্ট করলেন মুক্তির সময়কাল হিসাবে। জানালেন, এক আলোকায়নের কথা। অপরিপক্কতা থেকে মুক্তির কথা। বেশিরভাগ মানুষ অভিভাবক ছাড়া চলতে পারেন না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। ইমম্যাচুয়র। ইমম্যাচুইরিটি থেকে মুক্তি হল এনলাইটেন্টমেন্ট, আলোকায়ন। জানার সাহস দেখাতে হবে, ডেয়ার টু নো। জিজ্ঞাসুর সাহস দেখাতে হবে, ডেয়ার টু আস্ক। ব্যক্তি মেধাবী কি মেধাবী নয়, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আসলে সে সাহসী নয়, আলস্য বেশি। নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোর পরিশ্রম স্বীকার করায় আলস্য। ভাল হয় যদি একটা বই থাকে, কী করিতে হইবে। ডাক্তার বদ্যি, মাস্টার, মোক্তার, মোড়ল বা যাজক পুরোহিত। কেউ একজন। যে কোনো সমস্যায় সেই লোকটি জানিয়ে দেবে কেমন করে চলতে হবে।
দেকার্তে বললেন নিশ্চিতভাবে জ্ঞানকে নির্ধারণ করায় হলো আধুনিকতা। আধুনিকতার অর্থ শক্তির আধিপত্য বিস্তার করা। ষোড়শ শতাব্দী থেকেই এনলাইটেনমেন্টের অর্থ অপরিণত থেকে পরিণত হওয়ার চিন্তা। উৎপাদন পদ্ধতি বুদ্ধির ব্যবহারেই সমৃদ্ধ হয়। বুদ্ধি দ্বারাই নির্ধারিত হয় সত্য। সত্য নির্মিত হয়। বিশুদ্ধ বুদ্ধি ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য উপলব্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েই কান্টের thing-in-itself।
নানান অভিভাবক যুক্তির শৃঙ্খলার পথে হাঁটতে তৈরি করে নানান বাধা। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে এগোনোর পথে বাধা। আলোকায়নের, আধুনিকতার পথে প্রশ্ন করতে হবে, নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধিকে ব্যবহার করে যুক্তির মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ বের করতে হবে। ব্যক্তির মুক্তি ক্রিয়াশীল দুটি ধাপে, ব্যক্তিগত (Private Domain) ও সামষ্টিক (Public Domain)। ব্যক্তি পরিসরে যুক্তির পুরোটা দেখাতে নাও পারি কিন্তু পাবলিক ডোমেইনে চূড়ান্তভাবে যুক্তি তুলে ধরতে পারি।
এখান থেকেই কি শুরু তার দ্বন্দ্বের সমাধানসূত্র! রাষ্ট্রের আধিপত্যে চূড়ান্ত বিশ্বাসী থেকে সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা মেনে নেওয়া! অস্তিত্বের সঙ্গে বিচ্ছেদ! বিচ্ছেদ তার নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে, বহুমাত্রিক যাপন-বৈচিত্র্য থেকে, প্রকৃতি থেকে, মিথ থেকে। কমলকুমার জানাবেন - আলো কমে আসিতেছে।
আধুনিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা পছন্দ করে সেকুলারিসম। সেকুলারিসম জানালো ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও আধুনিকতা বিরোধী। সুতরাং সমাজ জীবনে ধর্মের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ভাবনা, বিজ্ঞান, সর্বজনীন সত্য। একই সঙ্গে পশ্চিমী ভাবাদর্শে নিজেদের সাজানো। একেবারে অনুকরণ নয়, নিজেদের সংস্কৃতিতে যেসব চিহ্ন বর্তমান, যার দ্বারা পশ্চিম আজ উন্নত সেসব অনুকরণ করা।
'সেকুলারিসম' শব্দটি ইউরোপ থেকে বাংলায় এসেছিল উনবিংশ শতাব্দী থেকে। আদৃত হল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে। ধর্ম যেমনভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসকে যুক্ত করতে পারে বা যাপনের ভিন্নতাকে গ্রহণ করতে পারে তেমন কোনো নমনীয়তা সেকুলারিসমের নেই। যদিও সেকুলারিসমের একটি ব্যাখ্যায়, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য সহ বিকাশ ভাবনা সমর্থন করে, ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে না বরং বলে শতাব্দী জুড়ে যে পরম্পরাগত যাপন চলে আসছে, সহিষ্ণুতা লক্ষিত যে যাপনে সেই ধারাকে যুক্ত করা হোক আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে কিন্তু বহুত্ববাদের বিপ্রতীপে সেকুলারিসম, নিজ-অস্তিত্বের এক একমাত্রিক 'খ্রিষ্টিয় মতাদর্শ'র ধারণা গড়ে তোলে। ১৮৫০ সালে, শব্দটির নির্মাণ-কালে, সেকুলারিজমে ধর্ম, বৈচিত্র্য এবং বিশ্বাসের সহাবস্থান আদৃত ছিল। সমসাময়িক বিচারধারায় সেকুলারিসমে ধর্ম অস্বীকৃত, এবং বিজ্ঞান, 'উপাস্য দেবতা'। অস্বীকৃত, সব ধর্মকে সমান চোখে দেখা, শ্রদ্ধা করা। এমনকি অস্বীকৃত, সমাজ জীবনে ধর্মের অনুপ্রবেশ বন্ধ না করতে পারলেও কথোপকথন চলুক সব বিশ্বাসের মধ্যে। একমাত্রিক এক বোধ।
আঠার
করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় তলানিতে। আর এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বলেছেন, ‘অ্যাক্ট অফ গড’। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যাই বলুন না কেন, ২০১৯ সালে যখন করোনার কোনও থাবাই ছিলই না, তখনও দেশের কৃষক ও দিনমজুরদের দুরাবস্থা অবর্ণনীয়।
এনসিআরবি-র তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৩৫৭ কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন। সেখানে ২০১৯-এ ১০ হাজার ২৮১ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দুবছরের মধ্যে তফাৎ সামান্যই। অপরদিকে, ২০১৮ সালে ৩০,১৩২ দিন মজুর আত্মহত্যা করেছিলেন। সেখানে ২০১৯-এ সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৩২,৫৫৯। আত্মহত্যাকারীর ৭.৪ শতাংশই কৃষক। কৃষি ক্ষেত্রে আত্মহত্যার নিরিখে শীর্ষ রয়েছে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা।
একদিকে যখন গোটা দেশে, বাড়ছে পাহাড় প্রমান বেকারত্ব সেসময় শাসক ঘনিষ্ঠ আম্বানি আদানির সম্পদ পড়ছে উপচে। আদানি, আম্বানির পরেই রয়েছেন সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সাইরাস পুনাওয়ালা। এইচসিএল টেকনোলজিসের শিব নাদার এবং উইপ্রো টেকনোলজিসের আজিম প্রেমজি।
করোনার সময় ভারতে বিলিয়ন ডলারের (অন্তত ৭৪ হাজার কোটি টাকা) সম্পদের মালিকের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪২ জন। সম্পদের নিরিখে প্রথম ১০ শতাংশ জনের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ। প্রথম ১০ জনের মোট বিত্তকে কাজে লাগাতে পারলে আগামী ২৫ বছর দেশের স্কুল শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার খরচ উঠে আসবে।
করোনা অতিমারি (?)-তে বাবা-মা’কে হারিয়ে অনাথ হয়েছে ১০ হাজার ৯৮ জন শিশু। বাবা কিংবা মা, দুজনের এক জনকে হারিয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার ৯১০ জন। এই হিসাব ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি অব্দি জাতীয় শিশু রক্ষা কমিশনের।
লকডাউনের মধ্যেই প্রান্তিক ও পরিযায়ী মানুষদের দুর্দশা সংক্রান্ত খবর করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৫ জনের বেশি সাংবাদিককে। উত্তর প্রদেশ সেদিক থেকে সব চেয়ে এগিয়ে। শুধু তাই নয় 'প্রেস ফ্রিডমের' পক্ষে সওয়াল করা স্মৃতি ইরানির নেতা মোদীর আমলে ভারতে প্রেস ফ্রিডমের অবস্থা শোচনীয় - ১৮০ দেশের মধ্যে, ১৪২!
এই অক্টোবরেও (২০২১) সোশাল মিডিয়ায় দেখা গেল একটা ছবি. তামিলনাড়ুতে একটি গ্রামের পঞ্চায়েতের সভানেত্রী সরকারি বৈঠকে চেয়ার পাননি। হতে পারেন তিনি পঞ্চায়েত প্রধান। কিন্তু তিনি দলিত। তথাকথিত ‘নিচু জাত’। মাটিতে বসেই বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন তিনি। বাকিরা ‘উঁচু’ জাতের হওয়ায় বসেন চেয়ারে।
তিনি তফশিলি তালিকাভুক্ত আদি দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের। গত বছর তিনি একটি সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হন। সরকারি বৈঠকে মাটিতে বসানোই শুধু নয়, অতীতে আরও অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তিনি। মহিলা জানিয়েছেন, তিনি তথাকথিত নিচু জাতের হওয়ায় পঞ্চায়েতের সহ-সভাপতি তাঁকে বৈঠকে সভাপতিত্বও করতে দেননি। এমনকি পতাকা তোলার অনুমতিও পাননি তিনি। তাঁর বদলে পতাকা তোলেন সহ-সভাপতির বাবা।
এই ছবি শুধু তামিলনাড়ু নয়,অন্যত্রও। এখনও জাতপাতের বৈষম্য মারাত্মক। অস্পৃশ্যতার নানা নজির দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি অনেক এলাকায় 'নিচু জাত’-এর মানুষদের শ্মশান ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয় না। কোথাও কোথাও গ্রামের মধ্যেই দলিতদের থাকার জন্য আলাদা জায়গা চিহ্নিত থাকে। উচ্চবর্ণের বাড়ির সামনে দিয়ে জুতো পায়ে হাঁটার অধিকার নেই 'নিচু জাত’-এর মানুষদের। কিছুদিন আগে পর্যন্তও বহু এলাকায় তফশিলি জাতি, জনজাতির মানুষেরা নির্বাচনে দাঁড়াতে ভয় পেতেন। এখন সেই সমস্যা কমলেও দলিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মান যে অনেক জায়গায় অধরা থেকে গিয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পঞ্চায়েত প্রধানকে মাটিতে বসানোর ছবি।
রাষ্ট্রের ক্রমবর্দ্ধমান দৌরাত্ম, মেজোরিটেরিয়ান রুল ভারতের বহু মানুষ আর মানতে চাইছেন না। ২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার। সেগুলি হল - কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন এবং কৃষি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করেন কৃষকরা। কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করেন কৃষকরা। চাপে পড়ে দেড় বছরের জন্য তিনটি কৃষি আইন স্থগিত রাখতে রাজি বলেও আশ্বাস দেয় মোদি সরকার। কিন্তু, তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। ২০২১-এর গুরু নানকের জন্মদিন গুরুপরবে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
২০২১-এর শীতকালীন অধিবেশনে পাস করতে হয়েছে কৃষি আইন প্রত্যাহার বিল (Farm Laws Repeal Bill 2021)। আলোচনা ছাড়াই সংসদের দুই কক্ষে ধ্বনি ভোটে পাস হয় এই বিল। কৃষি আইন প্রত্যাহার বিল পাস হয়ে গেলেও নিজেদের আন্দোলন প্রত্যাহার করছেন না কৃষকরা। কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে আইন না আনা পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। সরকারকে ফের কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, প্রথমে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ হবে। তার পর দেশ জুড়ে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি)। সিএএ হওয়ার দু’বছরের মাথাতেও ওই আইনের ধারা তৈরি করে উঠতে পারেনি কেন্দ্র। দেশ জুড়ে এনআরসি-র কাজ কবে শুরু হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে লিখিত প্রশ্নের মাধ্যমে তা জানতে চাওয়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে এনআরসি করার ক্ষেত্রে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। অসমের এনআরসি প্রসঙ্গে রাই বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অসমের এনআরসি হয়েছিল। যার সঙ্গে গোটা দেশে এনআরসি করার কোনও সম্পর্ক নেই।’’
অথচ, দু’বছর আগে সিএএ ও এনআরসি-কে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। সিএএ-র আওতায় প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান) নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। কেন মুসলিমদের ওই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল, তা নিয়ে সরব হয়েছিল প্রায় গোটা দেশ।
ভারতের মুসলমানরা এখন আর তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চলতে থাকা আক্রমণকে মেনে নিচ্ছেন না।মুসলিম মহিলাদের ভয় দেখাতে, অপমান করতে যে একটি তথাকথিত ‘নিলাম অ্যাপ’-এ ‘বিক্রয়যোগ্য’ বলে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মহিলারা পুলিশ-প্রশাসনকে দোষীদের খুঁজে বের করতে এবং শাস্তি দেওয়ার জন্য চাপ দিতে এফআইআর দায়ের করে। যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমস্যাটি মেনে নেবে না, নিরাপত্তা বাহিনী - যারা অতীতে একই ধরনের মুসলিম বিরোধী অপরাধগুলিকে উপেক্ষা করেছিল - দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং অ্যাপটির পিছনে রয়েছে বলে বিশ্বাস করা চারজনকে গ্রেপ্তার করে৷
‘নীরবতা আর বিকল্প না’ এমন মনে করে বেঙ্গালুরু এবং আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের ছাত্র ও শিক্ষকেরা এই জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠিতে সংখ্যালঘুদের উপর ঘৃণামূলক বক্তৃতা এবং আক্রমণের বিরোধিতা করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ঘৃণার কণ্ঠস্বরকে ‘উদ্দীপিত’ করে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পাঠানো এই চিঠিতে ১৮৩ জন স্বাক্ষরকারী রয়েছে, যার মধ্যে আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের ১৩ জন ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং আইআইএম আহমেদাবাদের তিনজন। “আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বিষয়ে আপনার নীরবতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সকলের জন্য - যারা আমাদের দেশের বহুসাংস্কৃতিক কাঠামোকে মূল্য দেয় - তাদের জন্য হতাশাজনক। আপনার নীরবতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিদ্বেষে ভরা কণ্ঠকে উৎসাহিত করে এবং আমাদের দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, এটি ‘আমাদের বিভক্ত করতে চায়’। দেশকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানায়।
আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের পাঁচজন ফ্যাকাল্টি সদস্য চিঠির খসড়া তৈরি করেছেন। তারা হলেন প্রতীক রাজ (কৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক); দীপক মালঘান (সহযোগী অধ্যাপক, পাবলিক পলিসি), ডালহিয়া মণি (সহযোগী অধ্যাপক, উদ্যোক্তা); রাজলক্ষ্মী ভি মূর্তি (সহযোগী অধ্যাপক, সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান); এবং হেমা স্বামীনাথন (সহযোগী অধ্যাপক, পাবলিক পলিসি)। মালঘান একজন বিশিষ্ট পরিবেশগত অর্থনীতিবিদ।
আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের অন্যান্য সদস্য যারা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে হলেন ঈশ্বর মূর্তি যিনি সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানের অধ্যাপক; কাঞ্চন মুখার্জি (অধ্যাপক, সাংগঠনিক আচরণ এবং মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা); রাহুল দে (অধ্যাপক, তথ্য সিস্টেম); সাই ইয়াওয়ারাম (কৌশলের অধ্যাপক); রাজলক্ষ্মী কামাথ (সহযোগী অধ্যাপক, পাবলিক পলিসি), ঋত্বিক ব্যানার্জি (সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান); এবং মনস্বিনী ভাল্লা (সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান)। আইআইএম আহমেদাবাদে যে স্বাক্ষর করেন তারা হলেন অধ্যাপক অঙ্কুর সারিন (পাবলিক সিস্টেম গ্রুপ), অধ্যাপক নবদীপ মাথুর এবং অধ্যাপক রাকেশ বসন্ত (অর্থনীতি)৷
চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, “আমাদের সংবিধান আমাদের মর্যাদার সাথে আমাদের ধর্ম পালন করার অধিকার দেয় – ভয় ছাড়া, লজ্জা ছাড়া। আমাদের দেশে এখন ভয়ের অনুভূতি রয়েছে - সাম্প্রতিক দিনগুলিতে গীর্জা সহ উপাসনালয়গুলি ভাংচুর করা হচ্ছে, এবং আমাদের মুসলিম ভাই ও বোনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। … “আমরা আপনার নেতৃত্বকে আমাদের মন ও হৃদয়কে একটি জাতি হিসাবে, আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দেওয়া থেকে দূরে রাখতে বলি। আমরা বিশ্বাস করি যে একটি সমাজ সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং বৃদ্ধিতে ফোকাস করতে পারে বা সমাজ নিজের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারে। আমরা এমন একটি ভারত গড়তে চাই যা বিশ্বে অন্তর্ভুক্তি এবং বৈচিত্র্যের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। আমরা, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট ব্যাঙ্গালোর এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট আহমেদাবাদ এর নিম্নস্বাক্ষরিত ফ্যাকাল্টি, স্টাফ এবং ছাত্ররা আশা করি এবং প্রার্থনা করি যে আপনি সঠিক পছন্দ করার ক্ষেত্রে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন”।
মুসলিম সাংবাদিক ও কর্মীদের একটি সংগঠন অক্লান্তভাবে সারা দেশে ইসলামফোবিক ঘটনা এবং হামলা নথিভুক্ত করছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি দাবি করছে। এই সাংবাদিক এবং কর্মীরা, বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় এবং অন্যান্য অনেক গণতান্ত্রিক মানসিকতার ভারতীয়দের সমর্থনে, হরিদ্বারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি করা গণহত্যার আহ্বান যাতে শাস্তির বাইরে না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।
সুপ্রিম কোর্ট সোমবার ঘোষণা করেছে যে এটি হরিদ্বারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানো এবং ঘৃণামূলক বক্তব্যে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের জন্য একটি আবেদনের দ্রুত শুনানি করবে। আদালত সম্প্রতি ত্রিপুরা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে যে ২০২১ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে রাজ্যে মুসলিম বিরোধী সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে কথা বলা বা লেখেন এমন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে।
ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ছে, কারণ এটি করতে হবে। বিজেপি কমপক্ষে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে এবং এর নেতারা শীঘ্রই যে কোনও সময় তাদের মুসলিম-বিরোধী এবং খ্রিস্টান-বিরোধী বক্তব্য পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা নেই। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কথা বলছে, কারণ তাদের জন্য নীরব থাকা আর বিকল্প নেই। তারা তাদের জন্মভূমিতে তাদের ন্যায্য স্থানের জন্য লড়াই করছে – তারা তাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে।
উনিশ
আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত - এই তিন কালের জীব। আমি 'ভিতরে' থাকি, 'বাহিরে' আসি - এই দুই জগতের বাসিন্দা। ক্ষণিক আসি, ক্ষণিক যাই, ভিতরে অথবা বাহিরে জিরোই, ক্যালেন্ডারের হিসাব মানে না।
আমার আমি এক প্রক্রিয়াজাত। শ্রমে, সম্মিলনে। প্রশ্নের ক্রীড়নক নই। চিন্তা বা দর্শন সক্রিয়তায় একটিভিজম সাপেক্ষ নয়।
মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করি আমার প্রেমিক-সত্তা, আমার অস্তিত্বের ভিতর-বাহির।
আমার ভালোবাসার মূল্য প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। রাষ্ট্র কেয়ার করে না। আমার অনুরণন রাষ্ট্র ধারণ করতে সক্ষম নয়। প্রেমের কবিতায় তাই বোধহয় এত অপূর্ণতা, ভালো লাগা।
রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রগঠনের, একাধিক তত্ত্ব। এযাবৎ সৃষ্ট কোনো তত্ত্বকে চিরন্তন সত্য মনে করে স্থির বসে থাকলে, আমি কোনদিনই সত্যে পৌঁছাতে পারব না। তাই আগের তত্ত্বগুলো ক্রমাগত বিচার বিশ্লেষণ, গ্রহণ বা খারিজ করে নতুন তত্ত্বের এষণায় থাকতে হয়, থাকতেই হয়।
ভাবনা বা অনুভূতি আমার যা কিছু প্রকৃত সম্পদ। ওটা হারিয়ে ফেললে আমার আর কিছু থাকবে না। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাব আমি। প্রসঙ্গত সরকার অন্য আরও প্রতিষ্ঠানের মতই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রনাধীন একটা সংগঠন। সরকার ও রাষ্ট্র এক নয়।
চারপাশ বদলাতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হই। কিছু সৃষ্টির স্বপ্নে ইচ্ছারূপে, চৈতন্যতরূপে ধারণ করি ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, ভাবাদর্শ। সেই Political Community. সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন। অস্তিত্বের সঙ্গে বিচ্ছেদ।
এই পথই গ্রহণ করেছি, করছি তিন কাল জুড়ে। নিরন্তন বয়ান নির্মাণ করি। আলোকায়ন। চেরাগ জ্বালানিয়া প্রকল্প।
ব্যক্তি অবস্থান! আমি আছি, সব স্বাঁসো কী স্বাঁসো মেঁ - মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, কাবা তীর্থে নয়, ক্রিয়া-কর্মে নয়, যোগ-বৈরাগ্যে নয় - আমি সকল নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তোমার পাশে আছি।
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত
আমি তোমার আঙুল ধরতে চাই
আমি আবার তোমার পাশে
হাঁটতে চাই
কুড়ি
তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
জীবনানন্দ
যেসব বই, পত্র-পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়েছেঃ
সুকুমার সেন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)
দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকা
Shashi Tharoor An Era of Darkness এর The Myth of Enlightened Despotism
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা
Madhusree Mukherjee : The British Empire and the Ravaging of India during World War II (2010)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ : প্রথম আলো ১১ আগস্ট ২০১৭
অবভাষ, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৪
http://roar.media/bangla/main/history/partition-of-bengal-the-background-story
রুবায়েত আমিন যেভাবে ইংরেজরা খুবলে খেয়েছিল উপমহাদেশ ও বাংলার অর্থনীত (https://roar.media/bangla/ main/history/how-the-british-destroyed-the-economy-of-the-subcontinent-and-bengal)
উন্নয়ন, বিভাজন ও জাতি : বাংলায় নমশূদ্র আন্দোলন, ১৮৭২-১৯৪৭ Posted by bangalnama on August 31, 2009
কাশ্মিরের মতো বাংলাতেও দুয়ারে সেনা দেখা যাবে অচিরেই : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় চার নম্বর প্লাটফর্ম।