সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
‘‘আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নখাই”- এ ভাবেই বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রবহমান বেহুলার কথা, বেহুলার মিথ। সঙ্গীতে সাহিত্যে শিল্পকলায় নাটকে যাত্রায় এখনও বেহুলার অবস্থান। এ আলোচনায় লোকসঙ্গীত ও লোকশিল্পে বেহুলার মিথটি কি ভাবে উঠে আসছে সে বিষয়ে কিছু দৃষ্টান্ত আলোচিত হল।
যে ছত্রটি প্রথমেই উদ্ধৃত হয়েছে তার সম্পূর্ণ অংশ—
ও ডিঙ্গা সাজায়ে দে ডিঙ্গা সাজায়ে দেখো
ও আমি লয়ে যাব উজুনি নগরে॥
দুধের করো নদীনালা কলার করো ভেলা॥
ও মাগো সেই ভেলাতে ভেসে যাবে লখিন্দর বেহুলা॥
আজি গে রামেশ্বরের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নাই॥
আজি গে মাধাইগঞ্জের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নখাই॥
আজি গে গুদামবরের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ধোনামোনার ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ধোনামোনার ঘাটের থেকে ও ডিঙ্গা চলিতে নাগিল॥
আজি গে ধোবানির ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দংশন॥
আজি গে ধোবানির ঘাটে বেহুলা যায় গড়াগড়ি॥
এটি বীরভূম অঞ্চলের একটি সাপনাচানি গান। গায়ক সৃষ্টির বাদ্যকর, গুরুর মুখে শুনে গান করেন ও গান রচনা করেন। নিচের গানটিও একই গায়কের।
ও কালী কি নয়নে (আরে) আমার প্রাণে চাইলি রে
আজ ঘরে রইতে দিলি না॥
ও মাগো সাঁতালি পর্বতে শ্বশুর গো ও আমায় দিলেন বাসরঘর॥
লোহার আঁচির লোহার প্রাচির লোহার বাসরঘর॥
ও মাগো কোন কামারে গড়েছিল লোহার বাসরঘর॥
সরুপারা পিঁপড়ে ফাঁকে গো কেমনে ঢুকল কালনাগ॥
উটকপালী খেরম-ঠেঙ্গী চিরুণ-চিরুণ দাঁত॥
মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত॥
মাগো সোনার বরণ স্বামীর দেহ কালি বরণ হল॥
মাগো হতভাগী বেহুলার মন ও আমার কপাল ভেঙ্গে যায়॥
বেহুলা হল সতীকন্যা ও আমার রোদনে বসিল।।
ও মাগো বেহুলা হলো সতীকন্যা ধুলোতে দেই গড়াগড়ি॥
ও মাগো এ বলিয়ে কান্দে তখন বেহুলা সুন্দরী॥
সাপখেলার সময় এই গানগুলি গাওয়া হয়, সঙ্গে থাকে ছোট বিষম ঢোল। ‘চিরুণ-চিরুণ দাঁত/ “মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত।’ এই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় ক্ষেমানন্দের (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ?) মনসামঙ্গল-এ ‘খণ্ডকপালিনী বেহুলা চিরুনী দাঁতী/ বিভা দিনে খাইলে পতি না পোহাতে বাড়ি।’ লোককবিরা নিজেরাই একটি বয়ান তৈরি করেন কখনও মঙ্গলকাব্যের ছত্র পঙ্ক্তি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে।
ও ঢোঁড়া যা যারে কালীকে আনিতে ঢোঁড়া যা॥
আজিগে কালীকে আনিবার ছলেরে আমার যায় ঢোন্ডু নাগ॥
চল চল চল কালী ও তোমায় ডেকেছেন মনসা॥
তাড়াতাড়ি আসে কালী ও তখন মায়ের নিকটে॥
মায়ের চরণে কালী ও আমার প্রণাম করিল॥
সাঁতালি পর্বতে আছে ও কালী লোহার বাসরঘর॥
তাহার ভিতরে নিদ্রা যায় বেহুলা নখিন্দর॥
আজিকে কোনোরকমে কালী তুমি পূর্ণ কর সাধ॥
তুই কালী না খাইলে ও আমার পুজো হবে না॥
এতখনে কালীনাগ তখন চলিল খেইয়া॥
ঈশানকোণে দ্যাওয়ালেতে একটা আছে চিত্রফাঁক॥
যেমন কন্যা তেমনি বর ও মাগো বিধাতার গঠন।।
ও মাগো দোষ করে নাই ঘাট করে নাই (ও আমি) কিবা বলে খাই॥
তিনকুড়িরও নােগর মাতা ও আমি কালনাগিনী॥
ও মাগো লখিন্দরকে খাইতে মোর ওগো শক্তি নাহি পারে॥
যেমন কন্যা তেমনি বর ও মাগো বিধাতার গঠন॥
তুই কালী না খাইলে ও আমার পুজো হবে না॥
এখানে ‘কালী’ কালীনাগ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কালীনাগ লখিন্দরকে দংশন করেছিল। নিরক্ষর লোকগায়ক সৃষ্টিধর বাদ্যকর যখন এই গানগুলি উদাত্ত কণ্ঠে গান তখন সর্বশ্রেণির শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনে। সাপখেলার সময় এই গানগুলি গাওয়া হয়, সঙ্গে থাকে ছোট বিষম ঢোল। ‘চিরুণ-চিরুণ দাঁত/ ‘মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত। এই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় ক্ষেমানন্দের (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ) মনসামঙ্গল-এ ‘খণ্ড-কপালিনী বেহুলা চিরুনী দাঁতী/ বিভা দিনে খাইলে পতি না পোহাতে রাতি।’ লোককবিরা নিজেরাই একটি বয়ান তৈরি করেন কখনও মঙ্গলকাব্যের ছত্র পঙ্ক্তি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে। পেশার জন্য এই শিল্পীকে বেতের কাজ করতে হয় অথবা ব্যান্ড বাজাতে হয়। গানগুলি ‘ভ্রমরা লোকসংস্কৃতি সংস্থা’র সংগৃহীত ও প্রচারিত। ‘ভ্রমরা’ কর্তৃক ‘শিকড়ের সন্ধানে’ ক্যাসেট, সিডিতে সংকলিত ও পুস্তিকায় মুদ্রিত।
বরিশাল অঞ্চলের ‘বেদিয়া’ বা ‘বেদে’ সম্প্রদায়ের গান—
‘রে বিধি কি হইল।
সোনার বরণ লখাইরে আমার
বরুণ হইল কালি
কি সর্পে দংশিল লাখাইরে
বেহুলা হইল রাঢ়ী॥
আজ হইল বেহুলার বিয়া
বাইদার সিন্দুর দিয়া
কেমন করে যাইবে গো বেহুলা
বাইদাপাড়া দিয়া বে
—ভ্রমরা সংগৃহীত। বরিশাল অঞ্চলের গান।
নিম্নবর্গের নানা চরিত্রের নানান পেশার সঙ্গে বেহুলার সম্পর্ক তৈরি করার ঘটনা মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণগুলিতে দেখা যায়—
প্রসন্ন রূপেতে যদি দেহ ত মেলানি।
ছুলিব ডুমুনি রূপে তোমার জননী॥— বিপ্রদাস
বেহুলা ডোমনী সাজিয়া অন্তঃপুরদ্বারে হাজির হইয়া হাঁক দিল, ‘কে লইবে চুপড়ি বিয়ানী। (সুকুমার সেন, ১৯৭০ : ২১৭)। বাংলার কৃষিজীবনের সঙ্গে বেহুলার সম্পর্কের কথা পাওয়া যায়—
‘‘বেহুলা কান্দিয়া বলে প্রার্থনায় লৈয়া কোলে
যাব আমি ছয়মাসের পথ।।” (কেতকাদাস)
‘এই ইঙ্গিতের মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। শ্রাবণ বা ভাদ্র মাস থেকে ছয় মাসের পথ অতিক্রম না করলে লখিন্দরকে ফিরে পেতে পারি না। এই লখিন্দর চাষীর ঘরের ফসল বা পৌষ-মাঘ মাসে চাষীর মুখে হাসি ফুটিয়ে ফিরে আসে।’ (সুজিত চৌধুরী, ২০১২: ৩৬)।
পশু-পক্ষী জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেরও নিদর্শন পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল-এর অাখ্যানগুলির মধ্যে আছে—
এক পাল শেয়ালের দল একত্রে বেহুলাকে ডাক
মড়া ফেলে ফিরে যাও ‘প্রাণ পাই তোর পাকে’।
কিন্তু শৃগালগুলিকে বেহুলা জানান এই শব তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় স্বামীর— এই শব তিনি দিতে পারেন না, হয় তিনি স্বামীকে বাঁচাবেন নয় মৃত্যুবরণ করবেন। তখন—
‘‘এত কথা শুনি যত শৃগালিনী
এ পড়ে উহার গায়ে।
অপূর্ব কাহিনী কভু নাহি শুনি
মড়া নাকি প্রাণ পায়।’’ (কেতকাদাস, সুকুমার সেন, ১৯৭০: ১৮৩)
অনুরূপ ঘটনা বাঘের সঙ্গেও ঘটে। —(বিজয়গুপ্ত)
এইভাবে নানাম ঘটনা বেহুলার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা লোকসমাজে প্রতিষ্ঠা করে।
বেহুলার প্রবাদপ্রতিম সৌন্দর্যের বর্ণনা মনসামঙ্গল-এ আছে—
‘‘চাচর মাথার কেশ চন্দন ললাটে।
পূর্ণিমা চাঁদ যেন রাহুর নিকটে॥
দশন মুকুতা পাঁতি অথরে তাম্বুল।
নাসিকা নির্মাণ দেখি যেন তিল ফুল।
নিতম্ব যুগল যেন নয়নে কাজল।
কমল উপরে যেন ভ্ৰমর যুগল॥
অর্ধোত্থিত স্তনদ্বয় শোভে হৃদপরি।
সরোবর মধ্যে যেন কমলের কড়ি॥”—(বিষয়গুপ্ত)
[ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : ১০২]
আরেকটি রূপের বর্ণনা—
‘‘পথের পথিক যত বাইয়া যায়।
বেহুলার রূপ দেখি ঘন ঘন চায়॥
ত্রিজগৎ মোহিনী কেন মড়া লইয়া কোলে॥
কলার মান্দাসে ভাসে ঢেউর হিল্লোলে।” (কেতকাদাস)
[দীনেশ চন্দ্র সেন, ১৯৮৬ ১৯০-৯১]
মঙ্গল কাব্যগুলিতে ইন্দ্রের সভার বা স্বর্গের নর্তক-নর্তকীদের শাপগ্রস্ত হয়ে বা কোনো উদ্দেশ্য সাধন করার জন্যে মর্তে জন্মগ্রহণের কাহিনী আছে। মনসামঙ্গল-এ মনসা এইরকম— অনিরুদ্ধ-ঊষা নর্তক দম্পতিকে মর্তে লখিন্দর-বেহুলা রূপে পাঠালেন। চাঁদোর স্ত্রী সনকার গর্ভে লখিন্দর ও উজানীনগরে সাধু বণিকের ঘরে বেহুলা জন্মালেন। এর পর বেহুলা-লখিন্দরের বিবাহ, লখিন্দরকে সাপে কাটার ঘটনাগুলি মনসামঙ্গল-এর আখ্যানের মধ্যে চলেছে। লখিন্দরের জীবন কামনার জন্য বেহুলা ‘দেবপুরে’ গিয়ে অন্যান্য দেবনর্তকীদের সঙ্গে—
আপনি মৃদঙ্গ বাহে গীত গাহ রঙ্গে।
সুতান সুছন্দে নৃতা করে অঙ্গভঙ্গে॥
ক্ষেণেক রহিয় রাধা করয়ে বিশ্রাম।
পুন ছন্দ-বিছন্দে নাচে অনুপাম॥
দ্বিজ বিপ্রদাস বলে বন্দি বিষহরি।
কামেতে পীড়িত হৈয়া বলে ত্রিপুরারি॥(বিপ্রদাস)
এর পর শিবের লুব্ধ দৃষ্টি কুপ্রস্তাবের পর শিব লজ্জিত হয়ে নারদকে দিয়ে মনসাকে ডাকিয়ে লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন, দেবতারাও সন্তুষ্ট হয়ে তাতে সম্মতি দিলেন। (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২১৬)
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ রচনাকালে, ’১৫-১৬ শতাব্দীতে মেয়েদের নৃত্যগীতি বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়। দুঃখের সময় হাসিমুখে বেহুলা দেবসভায় নেচে গেয়ে স্বামীর ও তাঁর ভ্রাতাগণের জীবন পুরস্কার নিয়ে ফিরে এলেন। [দীনেশ চন্দ্র সেন, ১৯৮৬ : ১৯১]
মঙ্গলকাব্যগুলির মতই ‘বিষহরি মনষাঙ্গল’ এই ধরনের পালাগুলিতেই এই ঘটনার বর্ণনা—
শিব। সুন্দরী তুমি নৃত্য করতে পারো?
বেহুলা। হ্যাঁ প্রভু
(নৃত্যগীত)
সোনারই পলংখের ময়না কুন বনে যায় রে
কুন বনে যায় ময়না
ফিরে নাহি চাই রে—
দধি দুগ্ধো মাখম ছানা,
তবু ময়নার মন পাইলাম না,
উড়ে যায় রে প্রাণের ময়না
ফিরে নাহি চায় রে।
দধি দুগ্ধো ছানা মাখোম,
উড়ে যায় রে প্রাণের ময়না
ফিরে নাহি চায় রে। —(বিষহরি বা মনষাঙ্গলা)
এর পরের ঘটনার বিবরণ— অন্যান্য মনসামঙ্গল-এর মতই আখ্যানকে আরো অন্যভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, কাহিনীটিও আরো লোকায়ত। পরের অংশটি ‘মা মনসা মঙ্গল’ বা বিষহরি পালা— গায়ক শ্রী তারিণী মোহন রায় (টোকা গিদাল), ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি।
‘বিষহরি’ পূজা মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের... নিজস্ব ভাষা, লোক বিশ্বাস, লোকাচার সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের অন্তর্গত গীতিনাট্য ও লোকনাট্য। গান, নাচ-এ সংলাপের ত্রিবেণী সংগম ঘটেছে এখানে। [রামাপ্রসাদ নাগ, ২০১২: সংগৃহীত ও সম্পাদিত পৃথি] বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের বরযাত্রীদের একটি বিবরণ ঐ পুঁথিতে আছে—
উত্তরে সাজিল হর ধনপতি সদাগর
তার সৈন্যের নাই লেখা জোকা
পশ্চিমে আইল সাজি, হাসেন হুসনো কাজি,
সাংখী করে কড়েয়া লক্ষ লক্ষ ভার।
দক্ষিণে সাজিল হর শঙ্খপতি সদাগর,
সঙ্গেতে তারা লইল তলোয়ার
উরভূষি - সরভূষি সাজে কন্যা চন্দ্রামুখী
ডাইনে তুলিয়া কান্দে খোপা।
বালার বিচার কাজ রাইগণ রৈবাতী সাজে
নানা পৈরাণে পরে শাড়ি। (ঐ, ৮৯-৯০)
কয়েকটি মনসামঙ্গল-এ হাসান-হুসেন দুই ভাই জমিদারের সঙ্গে মনসার সংঘর্ষ ও পরে মনসার মনসার ভক্ত হয়ে ওঠার কাহিনীটি আছে। (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২০২)। উত্তরবঙ্গের পালায় হাসান-হুসেনো কাজি কে বেহুলার বিবাহে বরযাত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণগুলি ও প্রচলিত লোকায়ত পালা ও সঙ্গীতে বেহুলার নৃত্যগীতের বর্ণনা গুরুত্ব পেয়েছে। অমলেন্দু ভট্টাচার্য নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে মনসামঙ্গল কাব্যগুলির সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন, ‘‘নাগপূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে নৃত্যগীত একথার উল্লেখ আছে কাশ্মীরের পৌরাণিক ইতিবৃত্ত নীলমত পুরাণে। ...নাগদের সামাজিক জীবনে গীতবাদ্যের যে একটা বড় ভূমিকা ছিল উপরোক্ত দুটি পৌরাণিক কাহিনী এর প্রমাণ। এই সূত্রেই নাগ-সংস্কৃতি থেকে উদ্ভুত মনসাপূজায় যুক্ত হয়েছে নৃত্যগীত।’’ [অমলেন্দু ভট্টাচার্য, ২০১২ : ৭৫] বেহুলার নৃত্য পারদর্শিতার সঙ্গে অনিরুদ্ধ-ঊষার পৌরাণিক কাহিনী ও নাগ সংস্কৃতির উপাদান যুক্ত হয়েছে।
অঞ্চল ভেদে লোককাহিনী, লৌকিক পালা, মনসা কীৰ্তন, পটুয়াদের পটে-পটুয়া, সঙ্গীতে বেহুলাকে নানাভাবে দেখানো হয়। মেদিনীপুরের পিংলা-নয়াগ্রামের পটুয়া দুখুশ্যাম চিত্রকর মনসার পট দেখিয়ে (তাতে বেহুলাও প্রদর্শিত হন) যে গান করেন তাতে বেহুলাকে ‘নাচনী’ বলা হয়েছে। এই পট গানের সঙ্গে পটে আঁকা দৃশ্য দেখানো হয়।
(ও তুই কেন এলি সুরপুরে বেহুলা সুন্দরী
ও তোর, পায়ের জল মোর গায়ে পড়িল
আমি বিষহরি
ও তোর বাসর ঘরে মরবে পতি কঁড়ে রাঁঢ়ী)
ছয়পুত্র খেলে ছয় বধূ হইল রাঁঢ়।
জন্মে নাহি জানবে না কড়ার পুষ্পদান॥
তিন গাই না, গীত গাই মধুর সে বাণী।
সদাই সমরে পূজা চ্যাংমুড়ি কানি॥
কোলের পুত্র আছে নাম লখিন্দর।
এর বিবাহ দিতে চলে নিছুনি নগর॥
নিছুনি নগর ঘর অমূল্য বেণানী।
তার কন্যার নাম রেখেছে বেহুলা নাচনী॥
[দুখুশ্যাম চিত্রকর, শ্যামল বেরা-২০১২: ১৪০-৪১ সংকলিত]
‘চ্যাংমুড়ি কানি’ বিশেষনটি অনেকগুলি মনসামঙ্গল-পদ্মাপুরাণ, লোকগান, ভাসান গান-এ পাওয়া যায়, এর অর্থ শববাহনে বাঁশে জড়ানো কাপড় (সুকুমার সেন)।
বেহুলার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সংকল্পে অটুট থাকা, কোনো সঙ্কটে ভেঙে না পড়া, প্রতিবাদী নারীত্ব এই বিশেষণগুলি মনসামঙ্গল-এ দেখা যায়। অনেকগুলি মনসামঙ্গল-এ বেহুলা লখিন্দরের অংশটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। একটি অংশে আছে চাঁদ লখিন্দরের জন্য মেয়ে দেখতে এসে বেহুলাকে পছন্দ করলেন। বেহুলার বাবা সাধু চাঁদো (চাঁদ বেনে) কে ভোজনের অনুরোধ করলে চাঁদো বললেন লোহার কলাই-সিদ্ধ খাবেন। অসম্ভব জেনে সকলে যখন ‘‘এমন অদ্ভুত কর্ম না শুনি কখন’’ তখন বেহুলা সাহসের সঙ্গে বললেন আমি লোহার কলাই সিদ্ধ করব। ‘‘নর হইয়া করে সিদ্ধ লোহার কলাই’’ তাতে চাঁদোর খিদে মিটল (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২১৩)। এই অবাস্তব ঘটনাকে মনসামঙ্গল-এর কবিরা তুলে ধরেছেন বেহুলার সমস্ত বাধা জয় করার চারিত্রিক উপাদানটিকে দেখানোর জন্য।
বেহুলার চিত্রও নানাভাবে আঁকা হয়েছে বিশেষ করে মনসার পটগুলিতে, দুখু শ্যাম চিত্রকরের কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এগুলিও লোকায়ত শৈলীর অঙ্কন আর এখনকার শিল্পীরা বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি এঁকেছেন। নাটকে ও কবিতায় বেহুলার উল্লেখ তুলনা বা উপাখ্যানটির প্রয়োগ চলছে। মঙ্গলকাব্য ও তৎসম্পর্কিত লোকসাহিত্যের মধ্যে মনসামঙ্গল ও বেহুলার উপাখ্যানের প্রয়োগ এ কবালের শিল্প সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। মধ্যযুগে মনসামঙ্গলগুলি কোনো রাজা বা ভূস্বামীর আদেশে লেখানো হয় নি, স্বঃপ্রবৃত্ত হয়েই কবিরা এই কাব্য রচনা করেছেন এবং এই কাব্য বা পালার চরিত্রগুলিই লোকায়ত বাংলার দৈনন্দিন জনজীবনের ছবি, অনেকটাই নিম্নবর্গের জীবনযাপন। ‘‘মনসার ভাসান নিম্ন থেকে নিম্নতম বর্গের বিনোদন চর্চায় চলে এসেছে’’ (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২২৬)। এদেরই অবলম্বনে এ কালের কিছু নাটক ও যাত্রা লোক-মন জয় করেছে।
“এই দীর্ঘ দুঃখ-কথার অবসানে কবিগণ বেহুলার যে কৌতূহলদীপ্ত সুপ্রফুল্ল চিত্রখানি আঁকিয়াছেন, তাহার মাধুর্যের মধ্যেও দুঃখমিশ্র একটু সকরুণ ভাব জড়িত আছে, সেই মলিন অথচ মধুর সৌন্দর্য আমাদের মর্ম স্পর্শ করে... বেহুলা চরিত্র আঁকিতে কোন কবিগুরু বা বাল্মীকি লেখনী ধারণ করেন নাই। আমা কবিগণ বংশদণ্ডাগ্রে, ব্লটিং কাগজের অভাব বালিকা দ্বারা পূর্ণ করিয়া তুলট-কাগজের উপর সতীর রেখাপাত করিয়াছেন; তথাপি উহা এক আদর্শ সার্ধ্বী চিত্র হইয়োছে। ...নানাবিধ সদগুণের প্রতিভা যেন আপনা আপনি সমাজ হইতে সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হইয়া বেহুলার ন্যায় আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে, ইহাতে কবিদের সাহিত্যদর্পণ পড়িতে হয় নাই।... অকৃত্রিমতাই এই সকল কবির প্রতিভা। প্রকৃতি যেন স্বয়ং ইহাদের হাতে তুলিয়া দিয়া তাহাদের নিজগৃহ দেখাইয়াছেন, তাঁহাদের নিজ বাড়ি-ঘরের ছবি আঁকিতে গিয়া অজ্ঞাতসারে বিশ্ব-চিত্র ভাণ্ডারে এক অমূল্য আলেখ্য উপহার দিয়াছেন।” (দীনেশচন্দ্র সেন, ১৯৮৬: ১৯১)।
ভাসান
সারি সারি নাও জলে ভাসে নৌ বাইচের সাজ
দুটি নৌকা জোড়া খুলে গেলেই ভাসান
তীরে বিসর্জনের সিঁদুর খেলা
গাঙরীতে ভেলা ভাসে
সেই কবে বেহুলা ভাসিয়েছিলেন
তরুণ আকাশ এই গাছ হিমালয় গলা
কাঠিন্য গলা নয়ানীর পানি
ভাসান পালার কলার মাজুষ
ভাসতে ভাসতে চন্দ্ৰমুখী মধুকর
বহুমুখী জাহাজ হয়ে যায়
কাঠিতে বোল পড়ে থাকবে কতক্ষণ
আবাহনে ভাষা উঠে আসে
আমরা যাচ্ছি ( গৌড়বচন, ১৯৮৯)
পাঠপঞ্জী :
অমলেন্দু ভট্টাচার্য, ২০১২: ‘‘মনসামঙ্গল কাব্য : নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে”, অঞ্জন সেন ও শেখ মখবুল ইসলাম সম্পাদিত সৰ্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সি, কলকাতা।
দীনেশচন্দ্র সেন, ১৯৮৬ : বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক, কলকাতা।
দুখুশ্যাম চিত্রকর, ২০১২: শ্যামল বেরার ‘মনসা : লোকায়ত প্রেক্ষিত-এ উদ্ধৃত অঞ্জন সেন ও শেখ মখবুল ইসলাম সম্পাদিত সৰ্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
রমাপ্রসাদ নাগ, ২০১২: ‘‘মনসা মঙ্গলের প্রককথন’’, সর্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত।
সুকুমার সেন, ১৯৭০: বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড-পূর্বার্ষ, ইস্টার্ন পাবলিসার্স, কলকাতা।