সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(অভিজিত পাল বিজ্ঞান ও সমাজকর্মী। নিবাস উত্তর চব্বিশ পরগণার হালিশহরে। করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’য়ের সময়ে পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশন এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে লোকাল ট্রেনে হকারদের ওঠা নিষিদ্ধ করে । তারই প্রতিবাদে অভিজিত সাইকেলে বাঁকুড়া যাওয়া মনস্থির করেন। তাঁর সেই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা তিনি ফেসবুকে লিখতে থাকেন। আমরা সেই ধারাবাহিক লেখাগুলি এখানে একত্রে সংকলিত করা হ’ল। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়া। শুধু বানান ব্যবহারে কিছু সাযুজ্য আনা হয়েছে।)
কথারম্ভ
আমাকে যারা ভীষণ ভালোবাসেন তারা কষ্ট পাবেন কিম্বা খুব রেগে যাবেন। তাই যারা ভালোবাসার সঙ্গে প্রশ্রয় দেন,তাদের জন্যই লেখা।
এত দূরে কেউ বাড়ি করে? না হলে বিকাশ এর বাড়ি পৌঁছাতে দু'দিন লেগে গেল! গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে বৃষ্টি মাথায় করে দুর্গাপুরে শোভনদার বাড়িই পোঁছোলাম রাত সাড়ে ন'টা। আর আজ সকাল দশটায় বেড়িয়ে বিকাশ এর বাড়ি পোঁছোলাম রাত দশটা। মানছি প্যাডেল সাইকেল করে যেতে ত সময় লাগবেই। যার জন্য যাওয়া চারপাশের প্রকৃতি পরিবেশের টানে ত মাঝে মধ্যে থামতেই হবে!
আর হ্যাঁ, বাড়িতে বললে আমার ইচ্ছে-পূরণ হতো না। তাই সাইকেলে যাবার কথা বলিনি। কিছুক্ষণ বাদেই বলে দিয়েছি, তোমাদের কথাই মেনে নিলাম! সাইকেলে করে বাঁকুড়া যাচ্ছি। মা খুব রেগে গেছেন। স্বাভাবিক। মায়ের জায়গায় আমি হলেও রাগ করতাম, কথা বলতাম না।
ভাবছেন মাথার স্ক্রু ঢিলা না হলে কেউ খামোকা এত কষ্ট করে। আমার সঙ্গে ছিলেন হকার ভাইরা।যাদের হাওড়া ডিভিশনে ট্রেনে হকারি বন্ধ করা হয়েছে। গতবছর ২৪শে মার্চ করোনা লকডাউন এর সময় থেকে ট্রেন প্লাটফর্ম এ হকারি বন্ধ মানে রোজগার বন্ধ। খড়-কুটো আঁকড়ে বাঁচবার মরিয়া চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে হাওড়া ডিভিশনে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল ট্রেনে হকারেরা উঠতে পারবেন না। তাই যতদিন হকারেরা ট্রেনে উঠতে পারবেন না আমিও হাওড়া ডিভিশনে ট্রেন চড়বো না। এভাবে তাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের সঙ্গে আমার সংহতি জানালাম।
হাসছেন... এভাবে কিসসু হয়!
ঈশ্বর গুপ্ত ব্রিজ পার করে জি.টি. রোড ধরে বর্ধমান... চলার পথে যা
কুড়িয়েছি তা খুবই সামান্য। সময় তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। গতকাল দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতালের সুপার ডাঃ শোভন পান্ডা দার কোয়ার্টার এ হাসপাতালের কর্মী সৌরভ আমার হাতে ফুলের তোড়া আর স্মারক উপহার দিলেন। বলা বাহুল্য এ ধরনের উপহার পেয়ে স্বভাবতই মনে পুলক জেগেছে। এই পর্বে যা সঞ্চয় করেছি তা সুযোগ বুঝে জানানোর ইচ্ছে আছে।
১
"ঘরের থেকে বাইরে গেলে
জগত আমার ঘরবাড়ি... "
রুংকু দিদিরে কথা দিয়েছি, 'তাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে দাদুর বাড়ি দিয়ে আসবো'।
আমার মধ্যে ক্ষ্যাপা মানুষটারে কথা দিয়েছি। তোকে সাইকেলে চাপিয়ে বাঁকুড়া ঘুরিয়ে আনবো। হ্যাঁ,'দামু' আমার উপর ভর করেছিল। বাড়িতে বলে বেরোতে পারতাম না? নিজেকে বোঝাতেই কালঘাম ছুটে গেছে! সে কথা আর কারে কই? আর অন্যদের বুঝিয়ে বেরোনো অসম্ভব।
তাই, একরকম প্রস্তুতি ছাড়াই বেড়িয়ে পড়লাম। সমস্যাকে ঝামেলা হিসেবে না দেখে মুখোমুখি হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজে চলা।
আপাত মনে হতে পারে একা চলেছি। আসলে একলা মানুষের দৌড় কতটুকু! মনের মধ্যে ক্ষ্যাপা মানুষটারে টানতে টানতে নিয়ে গেছি। কি টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে পথচলা! আর সাইকেল যার আপাতদৃষ্টিতে কোন প্রাণ নেই মনে হতে পারে! সাইকেল আমার সারথি, তাকে ছাড়া এ দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া একপ্রকার অসম্ভব। চাকা আবিস্কার করেছিলেন যে মানুষটি, সেই চাকাকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার উত্তরাধিকার আজ আমাদের করায়ত্ত।
পায়ে হেঁটে পথ চলার সুখস্বপ্ন লালন করলেও সে মাহেন্দ্রক্ষণ এখনো অনেক দূরে। তার আগে বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই ছাড়পত্র মিলবে। কিছুদিন আগেই হাওড়া ডিভিশনে হকারদের ট্রেনে উঠতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আমি ত ঘুরতে যাচ্ছি। আর হকার ভাইরা ত এ বিলাসিতা নিয়ে ট্রেনে চড়েন না। তাদের প্রতিদিনের দিনযাপনের সঙ্গে যার গাঁটছড়া বাধা।
"তুমি যখন বোমার মতো ফেটে পড়লে প্রকান্ড রাজপথে তোমাকে দেখছিলাম।" তোমাদের লড়াইয়ে আমাকেও সাথী করো বন্ধু। তাই, 'কঠিনেরে ভালোবাসিলাম'। আমার পথশ্রমে, ঘামে, ক্লান্তিতে তোমরাও রইলে সাথী হয়ে..
আমার ছোট ছেলের ইচ্ছে ছিল,'বাবা, তোমার সঙ্গে যাবো।' নিয়ে যাবার সাহস হয়নি কিন্তু ওরই বয়সী ১২ বছরের শ্রমিক জামলো মকদমকে সঙ্গে নিলাম। তেলেঙ্গানা থেকে ছত্তিসগড় এর বিজাপুরে হেঁটে বাড়ি ফেরার হিম্মত ওর আছে। তবে জামলো হাঁটবে আর আমি ড্যাংডেঙিয়ে সাইকেলে যাবো তা কি করে হয়! তাই গামছা দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলাম। ও দুটি হাত আর দুটি পা দিয়ে আমায় জড়িয়ে নিল। এবার আমায় পায় কে!
ঋণ- করোনা অতিমারি ও এই সময়।
রাজা সেন এর চলচ্চিত্র 'দামু'
'চেনা আধুলি' নাট্যসংস্থার নাটক'জামলো মকদম'
https://www.facebook.com/100005835725229/posts/1629791497225359/
২
এই শরীরটা কার?
কার আবার, আমার।
কার? কার? কার?
বাবার এই ধরনের কথোপকথনের বহুবার সাক্ষী বলে জানি উত্তরদাতা কিছুতেই এই কথার উত্তর দিতে পারবেন না। প্রশ্নকর্তার উপর্যুপরি প্রশ্নবানে উত্তরদাতা রীতিমতো ঘাবড়ে যান।
এবার ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন তার শরীরের মালিক তিনি নন। মা যেমন বলেন, তোর খিদে পেয়েছে, চাড্ডি খেয়ে নে। আমার বড় ছেলে বেড়ালটাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে।আমার সাধ্যি কি ওর কাছ থেকে বেড়ালটিকে ছিনিয়ে নেব। ঝিনাই ওর মাকে কাকুতি মিনতি করে, বাবা যেন ইঁদুর ধরার আঠা লাগানো বই কিনে না আনে।
ইঁদুরের খুব কষ্ট হয়!
আমার পরিবারের লোকজন যে আমার চলার পথে থাকবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! মনুষ্যজাতি মাত্রই এই স্বভাব। জগতের বাকি বাসিন্দাদের বিষয়ে বলা বা বোঝার ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই।
মিথ্যে বলে বেরোনো আর মিথ্যের পর্দা ফাঁস হলে অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায়। আবার ভরসার যে আমার কাছের মানুষেরা ত আমায় চেনেন। শুধু কি তাই যাদের কাছে যাচ্ছি তারাও শোনামাত্র উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। এ যেমন বিড়ম্বনার তেমনি সুখেরও। আর চলার পথে যারা বন্ধুত্বের উষ্ণতা দিয়ে ঘিরে থাকলেন, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে তুললেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন..সবুজের স্নিগ্ধতা দিলেন এঁকে, তাঁর বেলা!
আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যায় .. গাছ থেকে টুপ করে পাখির বিষ্ঠায় সবুজ জামায় সাদা দিয়ে চিত্র আঁকা হয়ে যায়। রোদে, বৃষ্টিতে, মাঠে, ক্ষেতে,ডোবায়, জলে, কাদায়,ফুলে,কুঁড়িতে,প্রজাপতি, পিঁপড়ে, ফড়িং এর সাথে মাখামাখি হয়ে চলার সুখ কি অন্য কিছুতে পাওয়া সম্ভব!
'খারাপ চা' এরকম একটা দোকানের নাম দেখে চেখে দেখবার ঔৎসুক্য জাগে.. আমার চলাটা নিছকই পাগলামি হিসেবে দেখেন না তা জানিয়ে দিতে ভোলেন না। কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে সিয়াচেন বর্ডার, লাদাখের পথে সাইকেল রিকশায় সত্যেন দাস এ পথ দিয়ে গেছেন। তার ছবি সাগ্রহে দেখান। সত্যেন দাস এর স্ত্রী ও সন্তানের
সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল। রিকশা ভর্তি করে খেজুরের বীজ নিয়ে রাস্তার ধারে ছড়াতে ছড়াতে গিয়েছিলেন। 'যদি দু'একটা বীজ ভিজে ওঠে ' তার আশায়! আহা!এভাবেও ভাবা যায়! আবেগে খুশিতে চোখ ভিজে ওঠে।
শোভনদার ফোন পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। 'কখন বর্ধমান আসবে? রাত হয়ে যাবে। হাইওয়ে ধরে দুর্গাপুরের রাস্তা খুব বিপদজনক।
'কোন বাসে লরিতে সাইকেল তুলে দিয়ে চলে আসো।’ সন্দীপ এর ফোন, বর্ধমানে আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।
কিন্তু আমি ত ব্রত রেখেছি, আমার সাইকেলের চাকা রাস্তায় দাগ এঁকে যাবে। তাই আমি আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকি। বন্ধুদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা, ভালোবাসায় আমার পথচলায় দ্বিগুণ শক্তি এনে দেয়। সাইকেল চালাতে চালাতে খুশিতে মন গুনগুনিয়ে ওঠে।
এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ।আইসক্রিম বিক্রেতার কাছ থেকে আইসক্রিম কিনে দু'চার কথা বলে সাহস সঞ্চয় করছিলাম।
সামান্য গেলেই বর্ধমান। প্রতিদিন শহরে যাই, আজ দুয়ারে সরকার এ লোকজন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। এখন ফিরে যাবো। এত পাকামো করতে কে বলেছিল? একথা কে বললো। কেউ ত আশেপাশে নেই। এ ত ভালো লক্ষ্মণ নয়। মাথা বিগড়ে গেলে এমন হয় শুনেছি।
ফোনে চার্জ নেই। বৃষ্টি হয়ে চলেছে। যাকে শুধোই দুর্গাপুর কত দূর? আপনি সাইকেলে যাবেন? বাসে উঠে যান। নতুবা পৌঁছাতে পারবেন না। ভোর সাড়ে পাঁচটা কিভাবে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না। এবার কি হবে?
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের অবস্থা! জামা-কাপড় ভিজে চপচপে। সড়ক পথে প্রাণ হাতে করে চলার মতো কষ্ট স্বীকার করার অভিজ্ঞতা নেই। অবশেষে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায় যখন দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতাল এ শোভনদাকে দেখতে পাই। হাসপাতালের কর্মী সৌরভ আমায় দেখতে আসেন। ফুলের তোড়া আর স্মারক আমার হাতে তুলে দেন। মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় শিং গজিয়ে ওঠে। মাথায় যতই চাটি মারি শিংটাকে মাথার ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে পারছি না।
৩
তাই বলে কোন ডাক্তারবাবু আমায় মশারী টাঙিয়ে দেবেন, এটা আমি ভাবতেই পারি না। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি ডাক্তার আমাদের বিপদের দিনে আলো জ্বেলে দেন। সমাজে তার একটা বিশেষ আসন আছে। তাই ডাক্তারবাবুদের কাছ ঘেঁষে থাকি। ডাঃ শোভন পান্ডা দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতাল এর সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেন। আবার বিভিন্ন গনসংগঠনের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের কাজও করেন। কোপাই শ্রমজীবী হাসপাতালের শুরুতে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। সেখানে মাটির চাতালে বসে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক কথোপকথন শুনছিলাম।
মানুষের যাতে হাসপাতালে যেতে না হয় সেটা শেখাবেন। এবং সেটা সম্ভব। এ ত স্বপ্নের মতো শোনালো। তাহলে শুধু হাসপাতাল বানানোটাই জরুরি নয় ? সেদিন আলাপ করার ইচ্ছে থাকলেও মনের মধ্যেই ছিল।
আমাদের বন্ধু সন্দীপ রায়ের মাধ্যমে হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদ এর বন্ধুদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ডাঃ শোভন পান্ডা আমাদের কাছে শোভনদা হয়ে ওঠেন। এত ভালো শ্রোতা খুব কমই দেখেছি।
এ হেন শোভনদাকে আমি বেশ বিপদের মধ্যে ফেলেছিলাম। আমার সাইকেল সফর কি ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে তাই নিয়ে খুব আশংকিত ছিলেন। এই পথেই শিল্পী কালিকাপ্রসাদের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। শেষমেশ অক্ষত শরীরে আমায় দেখে শান্ত হন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শোভনদা বললেন, "সন্দীপ বলেছেন, তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে নিতে,চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সাইকেলটা যেন রেখে দিই।"
বলা বাহুল্য রাত দশটা থেকে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত আপনজনের সান্নিধ্যে বেশ শক্তি সঞ্চয় করলাম। ইচ্ছে ছিল ই এস আই হাসপাতাল ঘুরে দেখবো। শোভনদাই বারণ করলেন সাইকেল নিয়ে দিনে দিনে পৌঁছাতে হলে সময় নষ্ট করা যাবে না। খাতরা যাবার পথ এঁকে বুঝিয়ে দিলেন।
দিনের শুরুতেই চোখ আটকে গেল। ভিক্ষা অন্বেষণে কাঠের চাকা ওয়ালা গাড়ি ঠেলে এগিয়ে চলেছেন পৌঢ় মানুষটি, গাড়ির মধ্যে বাটি হাতে বসে আছেন এক মহিলা। একটু আলাপ করবার ইচ্ছে হল। কিঞ্চিৎ অর্থদানের মধ্যে দিয়ে জীবনের গ্লানি দূর করার চেষ্টা করলাম।
প্রফুল্লচিত্তে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলা। চারপাশের অচেনা জনপদ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পরা - এভাবে দুর্গাপুর ব্যারেজ হয়ে বড়জোড়া, পোয়াবাগান দিয়ে খাতরার রাস্তায় উঠে পড়লাম। মাঝেমধ্যে খেজুর খাচ্ছি। জল পান করছি। আর গামছা দিয়ে ঘাম মুছে চলেছি। মৌমাছি সাইকেল না আনলেও সেই সুবিধা পাচ্ছি। সুন্দর পিচের রাস্তা ধরে একটু কষ্ট করে চালাতে পারলে ঢাল বেয়ে মূহুর্তে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া যায়। এদিকে বিকাশ চন্দ্র পতি ফোনে যোগাযোগ রেখে
চলছে। আর কতদূর? এখনও বাঁকুড়া আসতে পারেননি? বেলিয়াতোড় - ফুলবেরিয়া রাস্তায় একটা বোর্ড লেখা গোপাল লাল জিউ মন্দির, ডাকাইসিনী অস্থল তীর চিহ্ন দেখে সাইকেলের চাকা শাল বনের মাঝে লালমাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে ললো। দু'একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে এগিয়ে চলা।এ পথে হাতির দেখা মেলে, ইলেকট্রিকের মোটা তার বেঁধে দেয়া আছে। এ জায়গা ছেড়ে কি করে যাই! রাখাল একপাল গরু নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অরণ্য বনানীর মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলার সুখ এর মাঝে সময় বড় বেরসিকের মতো এগিয়ে চলেছে। এভাবেই কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। কোন পথিককে যদি বলি ধলডাঙা দিয়ে গোবিন্দপুর যাবো। উনি আঁতকে ওঠেন। জানেন কত রাস্তা। সাইকেলে যাবেন? কখন পৌঁছোবেন? সত্যিই আমি জানি না। তবে আমি এটুকু জানি আমায় যেতে হবে। দিনের আলোয় প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ মেখে চলার সুখ এখানে নেই। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ চলমান গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পথ হাতড়াতে হাতড়াতে চলা।
আমার ক্ষ্যাপা মানুষটারে জাগিয়ে রাখতে গান গাইতে লাগলাম। 'হোক বেসুরো পর্দা বদল ' এ ত আমার চলার পথের যষ্টি।
আমি মারের সাগর পারি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।।
হঠাৎই সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। পায়ে একটু লেগেছে। পেছনের চাকার ব্রেক ভেঙে গেছে। কিন্তু সাইকেল চালানো যাবে। আসেপাশে কেউ নেই যে এগিয়ে আসবে। তাই এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো ঝিঁঝি পোকা। তারস্বরে ডেকে চলেছে। চিৎকার করে জোনাকিপোকাকে বলছে, অন্ধকারে তুই পথ দেখিয়ে এগিয়ে দে। ও আমাদের অতিথি।
একজন দৃষ্টিহীন মানুষ কিভাবে পথ চলে? কোনদিন ত তার কাছ থেকে এ কথা জানতে চাই নি। সামনের চাকার ব্রেক সম্বল করে চলা।ক্রমশ ঢালু রাস্তা পেয়ে সাইকেল ছুটে চলেছে। থামাতে গেলেই ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠছে। কোনক্রমে পা দিয়ে সাইকেল থামিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা টর্চ কিনলাম। এবার যদি সাইকেলটা সারানো যায়। ফোনে চার্জ না দিলে বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
সাইকেল সারানোর দোকান পেয়ে গেলাম। ফোনে চার্জ দিতে দিলেন। নিমেষে আপনারজন হয়ে উঠলেন। দশ টাকায় সাইকেল সারিয়ে দিলেন। আমি কোথায় যাবো, রাস্তায় কোন অসুবিধে হলে কি করতে হবে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন। চা না খাইয়ে ছাড়বেন না।
"প্রথমে আপনাকে দেখে কেমন কেমন লাগছিল। পরে বুঝলাম আপনি ভালোমানুষ"। শোন তোমরা, উনি কি বলছেন, আমি শিখিয়ে দিইনি। অনেকটা মনের জোর নিয়ে আবারও চলা। টর্চের আলো ধরে এগিয়ে চলা।
মন গুনগুনিয়ে উঠলো,
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো।
যখন তুমি রাস্তা হাঁটো
সারাদিনের ক্লান্তি তোমার মুখের আবির
ভালোবাসার মানুষ
এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত-
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
তুই ছেঁড়া মাটির বুকে আছিস
পুরোনো নাম, ঘুরে ফিরে একই নাম :
ভালোবাসা।
এভাবে কখন যে সত্যি সত্যি আমার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেলাম আর 'প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে' বেশ টের পেলাম।
বি.দ্র.লেখাটি বড্ড বড় হয়ে গেল। কেটে ছোট করলাম না। ইচ্ছে হলে পড়বেন। দাঁত মাজার ব্রাশে মাজন নিতে গিয়ে বেশি টিপে ফেলেছি। তাই...
৪
কথাই ছিল মাঠে যেতে হবে। মানে আমরা যাকে আজকাল পটি বা টয়লেট যাব বলি। যদিও টয়লেট বেশ গোলমেলে ব্যাপার। সেজন্য বলা হয় বড়ো না ছোট। তবে মাঠে হাগতে যাবো কথাটা বেশ মধুর। বিকাশ ভাইয়ের মোটর সাইকেলে আর আমি প্যাডেল সাইকেলে, বেশ মজা লাগছে। সাধারণত যখনই বেগ এসেছে তখনই পায়খানায় গেছি। আর
বাইরে বেরিয়ে বহু জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পরে কোথায় মলত্যাগ করছি তা দেখার মতো বিলাস সাজে না।
চলেছি ত চলেছি,ভালোই লাগছে। প্রকৃতির আস্বাদ নিতে নিতে চড়াই উৎরাই রাস্তা পেরিয়ে চলা। প্রায় নয় কি.মি.পার করে ক্যানেলের ধারে শাল বন সেটাই বিকাশের শৌচালয়। বিকাশ বললো, আমি ডানদিকে যাচ্ছি, আপনি বামদিকে যান। পাশেই জলা আছে। আমরা এটাচড বাথরুমে অভ্যস্ত, যখন দরকার তখন যাই। নিশ্চিত নিরাপত্তা। এখানে তার উপায় নেই, সারাদিনে একবারের বেশি যাওয়া যায় না।সেই হিসাব করে সাধারণত বিকেলে দু'ভাই যায়। আমি এসেছি আর বেরোতে হবে তাই বিকাশ রাতে শাবু খেয়েছে। তাতে নাকি পায়খানা হতে সুবিধা হয়। যদিও বিকাশের বাড়িতে আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ শেষ পর্যায়ে, দরজা লাগানোর মিস্ত্রির অপেক্ষায় আটকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের টাকাতে প্রধানমন্ত্রীর 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান' চলছে। এক
আন্তর্জাতিক গবেষক দল বলছেন, শৌচালয়ের উন্নতি মানেই স্বাস্থ্যের উন্নতি নয়। ডাঃ স্বপন জানা লিখেছেন, "যে কোনও জীবের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রথম রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।তা রোগ শরীরের ভেতর বা বাইরের যে কোনও কারনেই হোক না কেন।নিজস্ব শারীরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে প্রধানত পুষ্টির মাধ্যমে। তারপর দরকার হয় বিশ্রাম, আমোদ প্রমোদ, কাজ ও সুস্থ পরিবেশের।
...দেশের মানুষের খাওয়া-পরা,থাকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার অবাধ স্বাধীনতা গড়ার মধ্য দিয়েই স্বচ্ছ ভারত গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।
মানুষের মল একটি উচ্চমানের সার। চীনদেশের কৃষিতে এর বহুল ব্যবহার স্বীকৃত। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কৃষিতে মলের প্রয়োগ দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
প্রাতকৃত্যের কাজ সমাধা করে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা, চা খাওয়া চললো। অন্য মানুষজনের সাথে পরিচিত হলাম। জায়গাটা সম্পর্কে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছি। তালডাংরা,ভাগাবাঁধ এ যে ক্যানেল সেখানে পুরুলিয়ার তিনটি নদী কাসাই,কংসাবতী আর কুমারী নদীর জল প্রবাহিত হচ্ছে। বানসা রোড দিয়ে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, মুকুটমনিপুর যাবার বাস পাওয়া যায়।
ফেরার পথে মাধুকরীর খোঁজে বারেবারে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আর বিকাশের গ্রামে ঢোকার মুখে পুকুরে ফুটেছে পদ্ম। সাদা পদ্ম। ভাবছিলাম গতকাল রাতের অন্ধকারে এরকম কত কিছুর রসাস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যদিও রাতের অন্ধকারে অচেনা অজানা জনপদে নিজেকে খুঁজে দেখার সুখই বা কম কিসে!
আমরা মুড়ি, আলুসিদ্ধ, চপ সহযোগে সকালের জলখাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এবার আমরা যাবো ঘাট রাঙামাটি। বিকাশের পরিকল্পনা মতো আমি অটোয় চাপলাম। বিকাশ ভাইয়ের মটর সাইকেলে সাথে সাথে চলেছে। টোটোয় গোবিন্দপুর থেকে বাসে বাঁকুড়া
বাসস্ট্যান্ড থেকে আবারও কাশীপুর এর বাস ধরে ঘাট রাঙামাটি নেমে বিকাশকে ফোন করলাম। মটর সাইকেল খারাপ হয়ে গেছে। আজ সারানো যাবে বলে মনে হয় না। আর
একা বিকাশের পক্ষে বাসে উঠে আসা এককথায় অসম্ভব। বিকাশ চেষ্টা করেছিল বাস দাঁড় করিয়ে যদি আসা যায়। কিন্তু বাস কন্ডাকটরের সহযোগিতা পেল না। অগত্যা বিকাশ বাড়ি ফিরে গেল। এদিকে বিকাশের সঙ্গে একসঙ্গে যাবো বলে সাইকেলটা রেখে যেতে হল। মনটা মুষড়ে গেল। কি আর করা।
রাঙামাটি থেকে হেঁটে গেলে ঊষারডি গ্রাম দু'কি.মি. পথ। পায়ে হেঁটে গেলে অর্থের সাশ্রয় আর মনের আরাম দুই-ই হয়। আর প্রকৃতির মাঝে একলা হতে মনে এক অনির্বচনীয় সুখ হয়। শহরের কোলাহলমুখর জীবনের বাইরে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সখ্যতার সুখ নিতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। প্রবল সূর্যালোকে লালমাটি
পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির সেজে ওঠা যেন আমারই অপেক্ষায়.. তাকে সময় দিয়ে বেঁধে দিলে চলে! সারি সারি তাল-খেজুর-শাল এর ফাঁক দিয়ে আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা কি মোবাইলে ধরা যায়! মনের মণিকোঠায় তাকে চিরস্থায়ী করে রাখার জায়গা আপনিই করে নেয়। জামডোবা গ্রাম হয়ে ঊষারডি গ্রাম এ আমায় অভ্যর্থনা জানালো অনির্বাণ মুখার্জি। বছর দুই-তিন হল আলাপ, এমন প্রাণশক্তিতে ভরপুর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণকে যত দেখি তত অবাক হই। শান্তিপুরের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল এ মেয়েদের সাবান তৈরি শেখাচ্ছে। গ্রামের সম্পদকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার নিবিড় চর্চা করে চলেছে। সাবান তৈরির উপকরণ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করার উপর জোর
দিচ্ছে। শাল বীজ সংগ্রহ করে তার গুড়ো ব্যবহার করা চলছে। তেল নিস্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে আরও ভালো হয়। মহুয়া তেলও এখানে সহজলভ্য।
ভাস্বতী রায় ২০১৮ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে তোলেন একটা বিশাল মাটির আর খড়ের চালার সুদৃশ্য ঘর। যেখানে পরিচিত বন্ধুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। ৫-৬ জনের উষ্ণ অভ্যর্থনার ছোঁয়া গতানুগতিক জীবন থেকে অন্য চর্চায় দীক্ষিত করে। যার সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিতে পারলে এক অনির্বচনীয় সুখ পাওয়া সম্ভব। এমন একটা জায়গা পেয়ে আমি বিকাশের কথা ভুলেই গেলাম। হাসিমুখে তেঁতুলের সরবৎ এগিয়ে দিল অনির্বাণ। ভাস্বতীদি বললেন, আমরা খেতে বসে গেছি। আপনি স্নান করে খেতে আসুন। আমি ছাড়াও পাঁচজন অতিথি এসেছেন। তাদের মধ্যে কলকাতার সুদীপবাবু আমার পূর্ব পরিচিত। দুপুরে নিজস্ব জৈব পদ্ধতিতে আঞ্চলিক দেশী ধান ঝাঁঝি আউশ চালের ভাত বিভিন্ন ব্যঞ্জনে পরিবেশিত হলো। বলা চলে আমি যেন মায়ের সান্নিধ্যেই আছি।
এলাকায় তাল খুব সহজলভ্য। অথচ মানুষের কাজে লাগে না। গাছতলায় পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। তাই অনির্বাণ একটা পরীক্ষা চালাচ্ছে। তালের জ্যাম তৈরির মধ্যে দিয়ে গ্রামের মহিলারা আর্থিক স্বনির্ভরতার দিকে এগোতে পারে।
তিন বিঘা জমির মধ্যে দুই বিঘা জমিতে জয়দার তত্ত্বাবধানে দেশী ধান
ভুতমুড়ি, ঝাঁঝি আউশ, কেরালা সুন্দরী, সাঠিজেলে, ষাটিয়া ধানের চাষ চলছে। কিচেন গার্ডেন থেকে প্রতিদিনের সব্জি আসে। সাবান তৈরির সাথে সাথে মেয়েরা সেলাই এর কাজ করছে। সেগুলো বিক্রির মধ্যে দিয়ে সহজিয়া জীবনেও হাসি খেলে যায়।
মেঘে আধার ঘনিয়ে অপরূপ সাজে ঊষারডি গ্রামে সন্ধ্যা নামে... টিপ টিপ বৃষ্টি ক্রমে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। এক অনাস্বাদিত সুখের আবেশ মনকে মাতাল করে তোলে।
‘কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।'
৫
'ঘুম থেকে উঠে এতটা খোলামেলা পরিবেশ থেকে বাড়ি গেলে প্রথমে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধে হয়। অনির্বাণ উঠোনে দাঁড়িয়ে দু'হাত ছড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে গেল। সকাল দশটায় পাঁচাল পৌঁছাতে হবে। তাই ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। অনির্বাণ
আমায় একটা সুন্দর দিন উপহার দিল।
ভোরের আলো গায়ে মেখে ঊষারডি গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছি। গ্রামের মানুষজনের সাথে আলাপ পরিচয় হলো না। তাই আবারও আসবো এই সংকল্প মনের মধ্যে লালন করতে করতে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছি। গতকাল প্রবল সূর্যালোকে প্রকৃতির যে রূপ প্রত্যক্ষ করেছি, আজ ভোরবেলা একই পথ দিয়ে চলেছি অথচ আজকের চলার পথে প্রকৃতি অনেক শান্ত। নাম না জানা পাখি আমায় এগিয়ে দিতে এসেছে। বয়স্ক তালগাছ বুঝি বা তাকে পাঠিয়েছে।
রাঙামাটি বাসস্ট্যান্ডে এসে সবে দাঁড়িয়েছি আর এক পশলা বৃষ্টি এসে রাস্তা ধুয়ে দিল। এবার বাসে চেপে বাঁকুড়া থেকে বেলিয়াতোড় সোনামুখি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। ন'টায় পাঁচালের বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বাসের দেখা নেই। অগত্যা টোটোয় চেপে পড়লাম। প্যাসেঞ্জার নেই তাই একশো টাকা লাগবে। এক
প্যাসেঞ্জার জুটে গেল। তাই পঞ্চাশ টাকা। টোটোয় চেপে যেতে যেতে প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
সবুজ পাহাড় ডাকে, আয় রে ছুটে আয়।
এই শ্যামলা পথের বাঁকে আয় রে ছুটে আয়।
মহিলারা জঙ্গল থেকে শুকনো ডালপালা মাথায় নিয়ে চলেছে। ঘুম থেকে উঠলে মরদ ছেলেপুলেদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে যে! দাঁড়ালে চলবে! অবশেষে পাঁচালে এসে পোঁছোলাম। কিছু খেয়ে নিতে দোকানে ঢুকলাম। একটা থালায় মুড়ি, চপ, বড়া সহযোগে জল দিয়ে মেখে নিলাম। এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস এর সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছে হল। ইতিমধ্যে সৌরভ মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির। শোভনদা পাঠিয়েছেন। প্রথমে ডাঃ শোভন পান্ডা এলাকার স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে কথা বলবেন। পাঁচাল গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আছে। তারা কেউ জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করছে। কেউ কেউ বিজ্ঞান সংগঠন, লোকসংগ্রহশালা, নাটক ইত্যাদি নিয়ে আছেন। শোভনদা এই সব সংগঠনের কর্মীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে বসেছেন। এই এলাকায় মূলত স্বাস্থ্য ও জৈব কৃষি নিয়ে একটা আশ্রম গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনছেন। অনুকূল পরিবেশ পেলে তা হয়তো একদিন বাস্তবায়িত হবে। বলতে গেলে এটি সলতে পাকানো পর্বে রয়েছে।
বিনোদবাটী গ্রামীণ উদ্যোগ এর সাথে যুক্ত শান্তি রায় এর পরামর্শ মতো মূলত আই সি ডি এস ও আশা কর্মীদের সাথে প্রাথমিক বসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে কি কর্মসূচি গ্রামের উপকারে লাগতে পারে সেটা ঠিক করা। যদিও বিভিন্ন কারণে দু'জন স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতিতে আলোচনা শুরু হয়। দুর্গাপুর থেকে ডাঃ শোভন পান্ডা, সৌরভ এসেছেন। চেতনা লোকসংগ্রহ শালা থেকে দেবাশীষ মুখার্জি ও সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুর থেকে হরেকৃষ্ণ সাউ,সোনামুখি থেকে রাজীব কড়ি, অর্জুনপুর গ্রাম থেকে শুভেন্দু মন্ডল ছাড়া আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
রবিবার সকাল দশটায় বেশির ভাগ মহিলারা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের নির্দিষ্ট কর্মসূচির বাইরে এই ধরনের কর্মসূচি কিভাবে মেলানো যাবে সেই বিষয়ে কথা হয়।
ডাঃ পান্ডা বাসন্তী, পাথর প্রতিমা এলাকায় দিদিদের সঙ্গে স্বাস্থ্য বিষয়ে
কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। যারা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ রেখে কাজ করে চলেছেন। এখানকার দিদিদের প্রস্তাব দিয়েছেন, আপনাদের কাছে ০-৫ বছর বয়সী যেসব বাচ্চারা আসে তাদের রোগ অসুখ বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আপনারা নিজেরাই বাচ্চাটির মা-বাবাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবেন।
যেমন সর্দি /কাশি/শ্বাসকষ্ট এর উপসর্গ নিয়ে আসা বাচ্চাটি সুস্থ, অসুস্থ
না মারাত্মক অসুস্থ সেটা আপনারা প্রশিক্ষিত হলে বলে দিতে পারবেন। আগামী দিনে এ বিষয়ে দিদিদের মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার হলে সেই মতো কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয় পর্বে জনা দশ কর্মীরা স্বাস্থ্য ও জৈব কৃষি নিয়ে কাজের সমস্যা,
সম্ভাবনা বিষয়ে কথা বলেন। এবার ফেরার পালা। আজই বিকাশের বাড়ি ফিরে গেলে আগামীকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব।
দেবাশীষদা বললেন, আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে বাড়ি ফিরতে, তাই আজ আপনি পাঁচালে আমার বাড়িতে থাকবেন। তারপর কাল সকালে আপনি যাবেন। এরকম আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে মটর সাইকেলে উঠে পড়লাম।
মাদারির খেলা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। এর আগেও পথে ঘাটে এদের দেখা মিললেও এমন গ্রামীণ পরিবেশে সম্মিলিত মানুষের ভিড়ে যে ছবি রচনা হয়েছে তা ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। অপরিচিত আমি অন্যের ঔৎসুক্যের কারণ হয়ে উঠেছি। কি আর করার আমি নিরুপায়। খেলা শেষ হইতে বাচ্চাটি বাটি হাতে ছুটে গেল। কিন্তু আস্তে আস্তে ভীড় ফাঁকা হয়ে গেল। এত আকুল হয়ে যারা বাচ্চাটার ব্যালেন্সের খেলা দেখছিল তারা তাদের সমর্থন দিয়ে গেল না! আমি দশ টাকা এগিয়ে দিলাম। মাধুকরী দিয়ে মাধুকরী নিলাম। মুহূর্তে আমার চোখে ঘোর লেগে গেল। একি দেখছি, এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে মহিলারা, বাচ্চারা বাটি ভর্তি করে চাল,আলু নিয়ে আসছে। মাটিতে পাতা কাপড়ের উপর থালা বাটি উপুড় করে ধীরে ধীরে বাঁচার রসদ জড়ো হতে থাকলো। ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে আদর আর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিই। লোভ সংবরণ করে কাছ থেকে শিশুটির ছবি তুললাম। খুশিতে বাচ্চাটার হাতে আবারও দশটা টাকা দিলাম। নিজের উপর রাগ হলো। সবটা উজাড় করে দিতে পারি না কেন!
সাপের মাথায় পা দিয়ে
সে নাচে
কান্না কেন কান্না কেন তোর
বন্যা খরা মড়ক বুকে বাঁচে,
ভাবনা কেন ভাবনা কেন তোর?
তুই কি ভাবিস
তার ঘুমে সেই স্বপ্ন নেই?
আছে
সাপের মাথায় পা দিয়ে
সে নাচে
কান্না কেন কান্না কেন তোর?
কবিতা : অমিত দাস, সুর : প্রতুল মুখোপাধ্যায়
এর আগেও আমি পাঁচালে এসেছি ভৈরব সাইনির জৈব কৃষিকাজ দেখে গেছি। ভৈরব জয় কিষাণ আন্দোলন, পশ্চিবঙ্গের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কাজে নিয়োজিত। এবার তাই দেখা হল না। কিন্তু পাঁচালেই চেতনা লোকসংগ্রহ শালার যে এত যত্ন ও মননশীলতার সাথে প্রকৃতির কোলে নীরবে নিভৃতে আমার অপেক্ষায় পথ চেয়েছিল তা ত আমি টেরই পেতাম না, যদি না দেবাশীষদা ও সনৎদার উষ্ণ সান্নিধ্যে আসতাম। আমি অভিভূত এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ গণউদ্যোগের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলার মতো দূরূহ একটা কীর্তি
যারা গড়লেন। এই ধরনের কাজ আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। যা অবশ্যই অনুকরণীয়। ভালো লাগবে যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হামলে পড়ে বলবে, ওই দেখ ঢেঁকি, আমাদের বাড়িতে একসময় ছিল। ধান,চিঁড়া, ছাতু কোটা হতো।
আর ওই দেখতে পাচ্ছিস, হ্যাচাক। ওটা জ্বালানোর একটা কায়দা আছে। সবাই পারে না। যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন রাতে কোন অনুষ্ঠান হলেই এর দরকার পরতো।
আরে এটা ত সেই প্রাচীন পুথি...
কত রকম বাদ্যযন্ত্র, হ্যারিকেন, টাইপ রাইটার... কত কত মানুষের হাতের স্পর্শ লেগে আছে! 'বিস্ময়ে তাই জাগে!
৬
বাইরে বেরিয়ে প্রতিদিন সকালে আপনাতেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। বাড়িতে যে আলসেমি তার লেশমাত্র নেই। সকাল ছ'টায় সনৎদার মোটর সাইকেল চেপে বেলিয়াতোড় যাবো। একটা দিনও পেরিয়ে যায়নি অথচ কিভাবে যেন বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। গতকাল চেতনা লোকসংগ্রহ শালায় দেবাশীষদা ও সনৎদা বইপত্র গোছাতে গোছাতে কথা বলে যাচ্ছিলেন। গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠার মেলবন্ধন টের পাচ্ছিলাম। দেবাশীষদার
স্ত্রী সকালে চা খাওয়ালেও আবারও পরিচিত চায়ের দোকানে সনৎদা চা খাওয়ালেন।
পথে যেতে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়,' যামিনী রায় ইনস্টিটিউট অফ আর্ট এন্ড কালচার' এর বহিরঙ্গের সাথে পরিচিত হলাম। রাস্তার উপর, গেটের ভিতরে বাঁকুড়া লোকশিল্পকলার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন নজরে এল।এখন গেট বন্ধ এবং হাতে সময় নেই। তাই এর স্বাদ নিতে আবারও আসবো।
প্রকৃতি এখানে দু'হাত বাড়িয়েই আছে। এত স্বল্প সময়ের সফরে দু'হাত
প্রাণপণে মুঠো করে আছি। পাছে প্রকৃতির ডাকে মন পাগলপারা হয়ে ওঠে! বেলিয়াতোড় থেকে বাঁকুড়া, গোবিন্দপুর নেমে টোটো চেপে নয়াদা বিকাশ এর গ্রামে যাবো। মুখ্যত বিকাশের আমন্ত্রণে বাঁকুড়া এলেও বিকাশের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারিনি।
খাতরা যাবার বাসে উঠে পড়লাম। ভাবছি ছোট বেলায় ইংরেজি বিষয় এ 'তোমার জীবনের লক্ষ্য' হিসেবে 'কৃষক হব' এর উপর প্রবন্ধের নোট মুখস্থ করেছিলাম। পরীক্ষার খাতায় লেখার প্রয়োজন হয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু স্বপনদা(ডাঃ স্বপন জানা) যখন ফোনে কথাবার্তার সময় বলেন, আগে ভেবেছিলাম আমায় যে করে হোক ডাক্তার হতে হবে। আর যখন ডাক্তার হলাম তখন মনে হল কৃষক হতে হবে। অ-পাসকরা চিকিৎসকদের বলেন অন্নদাতার চিকিৎসক দল। কিসের তাড়নায় তিনিকথাগুলো বলেন! সমাজে একজন চিকিৎসক ডাক্তারবাবু হিসেবে পূজিত হন। আর কৃষক এর সাথে বাবু কথা যুক্ত করা যায় কিন্তু সেটা কাকের পেছনে ময়ূর এর পেখম লাগালে যেমন দেখতে হয় তেমনি! হঠাৎই বাস এসে দাঁড়ালো শুনুকপাহাড়ি হাট এ। মন ছটফটিয়ে উঠলো ইসস এখানে যদি নেমে পড়তে পারতাম! এক গ্রামীণ হাটের সঙ্গে পরিচয় ঘটতো। ভাবতে ভাবতে বাস স্টপেজ ছেড়ে এগিয়ে চললো।
গোবিন্দপুর নেমে টোটো খোঁজ করলেও পায়ে হেঁটে যেতে ইচ্ছে হল। টোটো ভর্তি হতে সময় ও অর্থ দুই-ই ব্যয় হবে। তার বদলে হেঁটে গেলে প্রকৃতির রসাস্বাদ করতে করতে দিব্যি কেটে যাবে। ৪ কি.মি. পথ গেলেই নয়াদা, দিগার বাঈদ গ্রাম।
শরৎ এর আকাশ ক্ষণে ক্ষণে অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। কখনও কাশের ঝোপের আড়াল থেকে তাকে প্রাণভরে দেখছি, আবার পুকুরের জলে পানকৌড়ির মতো ডুব দিতেও দেখছি। রাস্তার দু'ধারের 'বনফুলে প্রজাপতি ক্লান্ত যখন' - না, প্রজাপতি নয় মৌমাছি , আর ফুল ছেড়ে কুঁড়িগুলোতে সে কি লুটোপুটি! আমি মোবাইলে ছবি তোলায় তার নাকি ভারি সুখ হয়েছে, তার উপর আমি ভীনদেশী! কালো পিঁপড়ে ফুট কেটে বললো ঢঙ! হালিশহরেও ত আমাদের আত্মীয়স্বজন আছে তাদের দেখে ত এভাবে হামলে পরতে শুনিনা। বিকাশের ফোনে সম্বিত ফিরে পেলাম। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম।
বিকাশের সঙ্গে দেখা হতেই বললো, 'আজ আপনার যাওয়া হবে না। আজ জন্মাষ্টমী আজকে বাড়ির ছেলের বাইরে থাকতে নেই। মা বলেছেন, আপনিও এ বাড়ির ছেলের মতো। বেশ,তাহলে আমার ত কিছু বলার নেই। ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছ যে মোরে!
চা-মুড়ি সহযোগে জলখাবার খেতে খেতে কত কথাই যে উঠে এলো। আমার সাইকেলে চলে আসার সিদ্ধান্ত.. গত দু'দিন আমার সঙ্গে না থাকতে পেরে মনটা বেজায় খারাপ লাগছিল। বলছিল, আমার এতদিনের পড়াশোনা যা দিতে পারেনি দু'তিন বছরের কৃষি কাজ আমায় অনেক পরিচিতি দিয়েছে। আমার জন্মসূত্রে পাওয়া কৃষি কাজই আমায় বেশি ভরসা যোগায়। আমি গুণে দেখেছি একটা ভুতমুড়ি ধান রোপণ করলে তার থেকে কমপক্ষে আড়াইশটা ধান পেয়েছি। একটা আলু থেকে ৫-৬টা চোখ বেরোয়।একটা চোখ লাগালে অন্তত ১০টা আলু পেতে পারি। আর কোন কিছু এর থেকে বেশি ফেরত দেবে? তবুও চাষির এই হাল কেন? বাজার অর্থনীতির কোন জট ছাড়ালে কৃষকের হাতে সত্যি সত্যিই ক্ষমতায়ন ঘটবে?
বিকেলে ভাগাবাধের ক্যানেলের জলে স্নান সেরে শালের জঙ্গল পেরিয়ে বাধের জলায় আলো থাকতে থাকতে বিকাশের ধানের ক্ষেত দেখে মন জুড়িয়ে গেল। বিকাশের বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, কি ধান লাগিয়েছিস এত বাড় হয়েছে?
বইলবো কেনে?
একটুকুন ইউরিয়া ছইড়ে দিলেই বুঝা যাবে!
গোধূলি বেলায় শিলাবতী নদীর ধার ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম। একটু দূরে দূরে ছেলে-বুড়োর দল বড়শি হাতে মাছরাঙা পাখির মতো ঘাপটি মেরে বসে আছেন।আর টুকটাক মাছ থলেতে ভরছেন। 'প্রকৃতিতে বিনা পয়সায় ভোজ পাও।'
আসার পথে বিকাশের বন্ধুর সাথে আলাপ জমে উঠলো। অগত্যা বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে এলাম। চাষযোগ্য জমি ছাড়াও গাই-গরু আছে। তার দেখাশোনা যিনি করেন তিনি বিকাশের বন্ধুর কাকা।কোন বিষয়ে কারোর প্রতি কাকার রাগ হলে তাকে থামায় কার সাধ্যি! 'রেগে আগুন তেলে বেগুন '...এর থেকে রেহাই পেতে মনোচিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ দিলে রাগ সাময়িকভাবে কমে যায়। যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। দু'একটা নমুনা আমাদের সামনে হাজির করলেন। দ্বৈত চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে আমাদের মুগ্ধতায় নিয়ে গেলেন। দুধপানের পরে চা-বিস্কুটও জুটলো, বিকাশের বাড়ি পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। তালের বড়া, শালপাতায় মুড়ে তালের পিঠে তৈরি হয়ে গেছে। একা একা এক থালা বড়া-পিঠে দিয়ে রাতের খাবার সেরে ফেললাম।আর বিকাশ রাতের অন্ধকারে টর্চ নিয়ে নিজের জমিতে জল যাবার ব্যবস্থা করে এলো।
৭
বেড়াল এক গাল হেসে বলল, 'তা আর জানিনে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত -সিধে রাস্তা, সওয়া ঘন্টার পথ,গেলেই হল'।
বিকাশও আমায় বাড়ি ফেরার সহজ রাস্তা বাতলে দিল। দিনে দিনে পৌঁছে যাবেন। এই বানসা রোড দিয়ে সিধে রাস্তা, বিষ্ণুপুর, কোতলপুর, আরামবাগ ,তারকেশ্বর , চুঁচুড়া.. আমি ত ব্যান্ডেল বি.এড কলেজে পড়েছি। বাসে যাতায়াত করেছি। সকাল সাতটায় বাসে চেপে দুপুর বারোটায় তারকেশ্বর থেকে আবার বাসে দু'ঘন্টা। আড়াইটে থেকে তিনটা নাগাদ পৌঁছে যেতাম।
প্রতিদিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে বিকাশ রাতের খাবার খেয়ে রাত আটটায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঠিক ভোর সাড়ে চারটে বাজলেই ঘুম ভেঙে যায়। তাই আমি ঠিক করলাম ভোরের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়বো। বিকাশের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সাড়ে চারটে নাগাদ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যত রাতই হোক আজই বাড়ি ফিরবো। এরকম একটা মনোবাসনা নিয়ে বিকাশের গ্রাম থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যাচ্ছি। সাক্ষী হয়ে থাকলো বানসা রোড, শাল মহুয়ার জঙ্গল, কাঠকুড়াতে আসা দেহাতি মহিলারা, ধানের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে আসা জনমজুর, গরু, মোষ,ছাগল চড়ানো রাখাল, দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতে থাকা সাপ, বনবিভাগের বাংলো...যতই তাড়া থাকুক চলার পথে সবার ডাকাডাকি ত আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়! প্যাডেল সাইকেলের মজা এমন যতটা শক্তি প্রয়োগ করবো ততটাই এগোবো। এ আমার আপন শক্তিকে জ্বালিয়ে পাওয়া ধন। পৌরসভার ছাড়া কলের মতো নয় যে কান মুললেই ঝরঝর করে জল পড়বে। এ টিউবওয়েল -হাতলে চাপ দিয়ে যে ডানপিটে ছেলেটা জল পেতে ঝুলে পড়ে তার ক্ষেত্রেও কলের ধাতব শরীরে মায়া জড়ায় না। সে আবারও চেষ্টা করে চলে..
ঘন্টায় ৮ কি.মি.গতিতে সাইকেল চলছিল। রোদ-বৃষ্টি এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। আরামবাগ, তারকেশ্বর এর বাস হু হু করে কানের পাশ দিয়ে ছুটে চলে। প্রলুব্ধ করে, ভালো চাস ত আমার নায়ে আয়! তোর কষ্ট ত আর দেখতে পারি না। সেই ভোরে বেরিয়ে বিকেল হতে চললো বাঁকুড়া জেলা পার হতে পারলি না। এদিকে তোর ফোনে চার্জ নেই। বাড়ির লোক, বন্ধুরা চিন্তা করছে,আবার ফেসবুকে
স্টেটাসও দিয়েছিস। সবাইকে চিন্তার মধ্যে রেখেছিস।
"পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"। তাই চারপাশের কোন কিছুরই রসাস্বাদ করতে পারছি না। শুধু পথকে পেছনে ফেলে আসার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলাটা টের পাচ্ছি। আরও প্রবল শক্তি নিয়ে ছুটে চলা।
"আমরা দেব বোবাকে ধ্বনি, খোঁড়াকে দ্রুত ছন্দ
অসম্ভবের পথে হেঁটেই আমাদের আনন্দ"।
এতে করে কি আরও শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলা যাবে! খড়-কুটোর মতো সবকিছুই আঁকড়ে নিয়ে পথ চলা। অন্ধকার ঘনিয়ে এসে পথ চলার গতি কমিয়ে দিল। আরামবাগ দিয়ে তারকেশ্বর এর পথে, চাঁপাডাঙা যাবার রাস্তা বিপদসংকুল। পা টিপে টিপে পথ চলা। বাড়ি ফেরার আশা ক্রমশ নিভে আসছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা রাত ধরে সাইকেল চালিয়েও পৌঁছাতে পারবো না। লোকজনদের মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করছি,
চুঁচুড়া যাবো। কোন রাস্তায় গেলে সহজ হবে ? এত রাতে এরকম একটা প্রশ্ন শুনে বেশির ভাগ লোকজনই ভূত দেখার মতো করে আমায় আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছেন! নিজের প্রতি একপ্রকার করুণাই হল।রাতটা কোথাও থেকে যাবো। কোথায়?
ও দাদা,কাছাকাছি কোন স্টেশন আছে?
এ দিক দিয়ে কিছুটা গেলেই লোকনাথ স্টেশন।
বেশ মজা লাগলো, "রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি, আমায় স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো"। যদিও লোকনাথকে স্মরণ না করে লোকনাথ স্টেশনে সাইকেল স্ট্যান্ডের মালিকের সাথে পরামর্শ করে সাইকেলটা রেখে দিয়ে স্টেশনের প্রতীক্ষালয়ে আশ্রয় নিলাম। কখনও হাসপাতালে বাবার শয্যার পাশে রাত কাটিয়েছি,ইমার্জেন্সির পাশে রাতে চাদর পেতে শুয়েছি, ট্রেন গন্ডগোলে স্টেশনেই কেটে গেছে রাত... আর আজ আমি স্বেচ্ছায় এসেছি অনিশ্চয়তার পথে, আমায় কেউ জোরও করেনি এ পথচলায়.. আমার কাছে এ এক অন্য অনুভবের জগতের দ্বার উন্মোচিত করে দিল। আমার সঙ্গী চালচুলোহীন উদাস বাউল। দু'চার কথা বলে কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। তথাপি সারারাতে যখন চোখ ঘুমে বুজে আসছিল সেই কি আমায় চোখে চোখে দেখে রাখলেন ? আজ তার দুয়ারে আমি এসেছি অতিথির বেশে!
৮
রাতে প্রতীক্ষালয়ের বসার জায়গায় ব্যগটাকে কোলবালিশ করে আর মাথায় প্লাস্টিকের মধ্যে বই ভরে বালিশ করে শুয়ে পড়লাম। আমায় ভীনদেশী দেখে কিনা জানিনা মশারা আমায় র্যারগিং করা শুরু করলো। বিশ্বভারতীতে একবার কলাভবনে ভর্তির পরীক্ষা দিতে আগের রাতে এসে কোথায় থাকবো তার ঠিক নেই। সদ্য পরিচিত কলাভবনের এক ছাত্রের সাথে আলাপ হল, কাজ দেখালাম। আর রাতে একটা কোনরকম
থাকার জায়গা পেলেই হবে। 'রাত ঠিক ন'টায় ক্যাম্পাসের ভেতর এই গাছটার নিচে অপেক্ষা কোরো, এক সিনিয়র দাদার স্টুডিওতে নিয়ে যাবো'।সেই মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমায় নিয়ে চললো একটা ঘরে যেখানে জনাকয়েক দাদা-দিদির সঙ্গে দেখা। চেনা দাদা বললেন, তোর কাজগুলো দেখা। এগুলো কাজ হয়েছে? এই কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হতে এসেছিস? আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিকেলে ইনিই আমার
কাজ দেখে তারিফ করেছিল আর এখন কি সব বলছে! একজন কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই আমায় চা করতে বললো, কেউ এসে কপালে তিলক এঁকে দিল। কেউ গান গাইতে বললো.. একেই তা হলে রাগিং বলে, শুনেছি, আজ তা প্রত্যক্ষ করলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। রাতের অন্ধকারে কোনক্রমে ছিটকে বাইরে চলে এলাম। আর একি সেই দাদাই আমার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, আমায় ক্ষমা করে দে! কিছুই বুঝতে পারছি না। আমায় বন্ধুর মতো বুকে জড়িয়ে ধরলো। চল, তোর একটা শোবার ব্যবস্থা করে দিই। সেই দাদাকে বলে দিল,তুমি আর কিছু কোরো না। তোমার স্টুডিওতে রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আগামীকাল কলাভবনে ভিসুয়াল আর্টস এর প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা দেবে। মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়লাম। যখনই ঘুম ভেঙে যায় চেয়ে দেখি দাদাটি হয় ছবি আঁকছে নতুবা বেহালা বাজিয়ে চলেছে। শুয়ে শুয়ে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছি।
কখন ভোর হয় সেই অপেক্ষায় পায়চারি করে চলেছি। ফোনে চার্জ নেই যে ফোন ঘেঁটে টাইম-পাস করবো। বই পড়তে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরছি। টিউবওয়েল চেপে চোখে জলের ঝাপটা দিলাম। টিকিট কাউন্টার চত্বরে ছোট ছোট টগর গাছ ফুলে ভরে গেছে। ভোর পাঁচটা নাগাদ কাউন্টারে এক ভদ্রলোক টিকিট চেয়ে সাড়া না পেয়ে গজগজ করতে করতে স্টেশনে উঠে গেল। সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন তাই এখনো কাউন্টার খোলেননি। কিছুক্ষণ বাদেই সাইকেল স্ট্যান্ড খুলে গেল। ফোনে চার্জ দিয়ে দিলাম। এক চায়ের দোকান দেখিয়ে দিলেন যেখানে ভালো চা পাওয়া যায়। দেখতে দেখতে সেই দোকানের আশেপাশে আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে থাকলো। ভদ্রলোক আজ আসতে দেরি করেছেন। তাই কিছু খদ্দের তাকে দু'একটা টিপ্পনী কাটতে ছাড়লো না। শ্রমজীবী মানুষেরা, বিশেষত মহিলারা প্লাটফর্মে উঠে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সাড়ে পাঁচটার স্টাফ স্পেশাল ট্রেন প্লাটফর্ম চেছেপুছে নিয়ে চললো।
ফোনে চার্জ দিয়ে সকাল ছ'টায় আবার সাইকেল নিয়ে নতুন উদ্যমে পথকে পেছনে ফেলে ফেলে চলা। কামারকুণ্ডু রেলগেটের পথে এগিয়ে চলেছি।এক বিশাল বটগাছ সম্ভ্রম জাগানো প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি হয়ে আমার মতো পথিককে দাঁড় করিয়ে দিল। ছবি তুলতে তুলতে চোখ চলে গেল প্রাচীন টেরাকোটার কাজ করা মন্দিরে..আমার সাধ্যি কি ওর রূপ রস গন্ধ এর সুবাস না নিয়ে যাই! কাছে যেতেই কানে এলো, তুই আমায় দেখলি,এক ছুট্টে কোথায় চলে আসবি তা না করে ভাবছিস,বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। আরে এই পথে এই জীবনে আর আসা হবে? আর আমারও বয়স হয়েছে, কিইবা আমার অবশিষ্ট আছে ! আজ যেটুকু দেখছিস কাল তা পাবি কিনা তার কি নিশ্চয়তা আছে! মহা বিশালাক্ষী মন্দির, তারকেশ্বর। হালিশহর এ তিনশো বছরের পুরনো নন্দ কিশোর জিউর মন্দিরের টেরাকোটার কাজ এর সাথে আশ্চর্য মিল পাচ্ছি। প্রতীক্ষালয়ে বসে থাকা মানুষটিকে শুধোলাম। এটা খুব জাগ্রত মন্দির। আপনি কি করেন? এই গরু-ছাগল চড়াই.. হালিশহর থাকেন, ওদিকে আমার যাওয়া আছে...
বাসুদেবপুর হয়ে হরিপাল হয়ে নালিকুল -এর পথে আমার একদা সাইকেল সফর এর চাকার দাগ আজও মুছে যায়নি। নালিকুলে বাঁধের মাঠে গভীর রাতে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে 'পালাপার্বণ' এর অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। তখনও মঞ্চে বাউল গান চলছে। তার আবেশে আয়োজকদের শরীরে মনে দোলা লেগে যাচ্ছে। সমবেতভাবে নেচে উঠে আর আরও গানের অনুরোধ আসতে থাকে।
দেখতে দেখতে নসিবপুর এসে গেলাম। চন্দননগর যাবার রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। এর আগেও এ পথ দিয়ে গেছি। গাছপালায় ঘেরা প্রকৃতি দু'দন্ড বিশ্রাম নিতে বলে।
'আরে ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছিস কোথায়? একটু আমার ছায়ায় বোস দেখিনি, তোকে সুবাতাসে ভরিয়ে তুলি, গতকাল খুব ভোরে তুই বেরিয়েছিস ত! অবাক হচ্ছিস, কি করে জানলাম! আরে বাতাস তোর খবর বয়ে এনেছে। তুই এ পথ দিয়ে গেলে তোকে একটু যত্ন করতে বলেছে, এ আবার বলার কি আছে, বাতাস না বললে কি তোকে যত্ন করবো না! সকাল থেকে ত পেট পরিষ্কার করিসনি। এর থেকে ভালো জায়গা আর পাবিনা।
চন্দননগর এ হুগলি জেলা পরিষদের উদ্যোগে নিউ দীঘা বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। কাঠের ব্রিজ পার হয়ে চূঁচুড়া যেতে জি.টি.রোড ধরে এগিয়ে চললাম। ক্রমশ বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছি। আদিসপ্তগ্রাম হয়ে সরস্বতী নদী পার হয়ে রেলগেটের লেবেল ক্রসিং এ আটকে গেলাম। এখানে কলার বিশাল বাজার। টোটোয় কলার কাঁদি তোলা হচ্ছে। যত বাড়ির কাছাকাছি আসছি ততই শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। সেই চেনা বিছানার জন্য, আমার যত্ন করবার জন্য মুখিয়ে আছে আমার পরিজনরা। তারা আদরে ভালোবাসার সঙ্গে রাগ, দুঃখ,ক্ষোভ নিয়ে আমার আসার পথ চেয়ে আছে। টি.ভি.সিরিয়ালে দেখা যায় জামাই ষষ্ঠী চলে গেলে তারপর সেটা তার মধ্যে জুড়ে দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরে গেলেও ফেসবুকে একসপ্তাহ কেটে গেল বাড়ি পৌঁছাতে... এই সময় পর্বে যারা আমার সঙ্গে রইলেন তাদের জন্য রইলো অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা!