সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদ এবং রাজ্যসভায় তিনটি কৃষি বিল পাশ করে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার কোনোভাবেই কোনো বিরোধী পক্ষ বা কোনো কৃষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার বোধ করেনি। প্রস্তাবিত বিলটি জনসমক্ষে আসার পর গত আগস্ট মাস থেকেই পঞ্জাবের কৃষকরা নানাভাবে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। একাধিক সংগঠন তথা বিরোধী দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই বিল খানিকটা অগণতান্ত্রিকভাবেই সেপ্টেম্বর মাসে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কৃষকদের প্রতিবাদ চলতেই থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পিছু না হঠাতে কৃষকরা ২৫ নভেম্বর থেকে দিল্লি চলো অভিযান শুরু করেন। মূলত হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের একাধিক কৃষক সংগঠন এই অভিযানে শামিল হতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁদের দিল্লির সীমানাতেই আটকে দেওয়া হয়। আটকে দেওয়া এরকমই তিনটি সীমানা হল সিংঘু, টিকরি এবং গাজীপুর। এগুলোর মধ্যে সিংঘুতেই সর্বাধিক কৃষক সমাবেশ ঘটতে থাকে।
সুদূর কলকাতায় বসে টিভি আর ইউটিউবই ছিল ভরসা এই চলতি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে কিছু জানার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হাতে গোনা কয়েকটি মিডিয়া ছাড়া বাকি সব মিডিয়া শাসকদলের কাছে বিকিয়ে যাওয়ায় আমরা সাধারণ মানুষরা খুব বেশি তথ্য পাচ্ছিলাম না। তাই জানুয়ারি মাসে যখন দিল্লি যাওয়ার সুযোগ এল, তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম একবার সিংঘু বর্ডারে যেতেই হবে।
২৫ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছলাম। আর ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা ‘ট্র্যাক্টর মিছিল’ আয়োজন করলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন দিল্লির বাইরে যেসব গ্রামে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে সেসব গ্রাম থেকে ট্র্যাক্টরে চেপে তাঁরা দিল্লি অভিমুখে আসবেন। উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করে যে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া পথেই কৃষকরা মিছিল করতে পারবেন। এবং সে পথ মূলত দিল্লি বর্ডারের আশেপাশেই।
দিল্লিতে আমি যেখানে থাকছিলাম সেখান থেকে গাজীপুর সীমানা কাছে হওয়ায় ওইদিন সকালে গাজীপুর সীমানার দিকে যাওয়াই ঠিক করি। দুপুর বারোটা নাগাদ মিছিল শুরু হওয়ার কথা। দূর থেকে যখন মিছিলকে এগিয়ে আসতে দেখলাম এক অদ্ভুত শিহরণ বোধ করলাম। কয়েকশো ট্র্যাক্টর পর পর আসছে গান বাজিয়ে। আবালবৃদ্ধবনিতা সবরকম সওয়ারিকেই দেখা গেল। হরিয়ানা থেকে আগত এক কৃষকও আমাদের সাথে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জানালেন সিংঘুর তুলনায় গাজীপুরের সমাগম নাকি খুবই কম। তবে সিংঘু যেহেতু খানিকটা দূরে ভাবলাম টিকরি বর্ডার যাই। কিন্তু মেট্রো স্টেশনে ঢুকে জানতে পারলাম দিল্লি মেট্রোর একাধিক মূল স্টেশন নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। এবং ফোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম কিছু কৃষক তাঁদের ট্র্যাক্টর নিয়ে দিল্লি পুলিশের নির্দিষ্ট পথের সীমা লঙ্ঘন করে লালকেল্লা, আইটিও ইত্যাদি চত্বরে ঢুকে পড়েন এবং তাণ্ডব শুরু করেন (ওঁদের সঙ্গে কদিন থাকার পর এই ঘটনার পূর্ণ সত্যতা সম্পর্কে আমি অবশ্য সন্দিহান)। অগত্যা আমি আমার দিল্লির আস্তানাতেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জনগণ আয়োজন করে সিটিজেনস মার্চ – ইন সলিডারিটি উইথ ফার্মার্স মুভমেন্ট। আমার যাদবপুর কফি হাউসের বন্ধুর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে এ সংক্রান্ত একটা মেসেজ পাই। তাতেই এই মিছিল সম্পর্কে আমি জানতে পারি। মান্ডি হাউস থেকে যন্তরমন্তর পর্যন্ত এই মিছিল হাঁটবে। এটি কেবলমাত্র একটি জনগণের মিছিল, সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক। আবার যদি মেট্রো স্টেশন বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে আমি বেলা ১২টার (মিছিল শুরু হওয়ার নির্দিষ্ট সময়) বেশ আগেই মান্ডি হাউসে পৌঁছে যাই। কিন্তু পৌঁছে হতবাক। দিল্লির এই মান্ডি হাউস চত্বর অনেকটা আমাদের কলকাতার নন্দন চত্বরের মত। আমার দীর্ঘ দিল্লিবাসী জীবনের অনেক সুখস্মৃতি আছে এই মান্ডি হাউস অঞ্চলকে জড়িয়ে। নানা ভবনে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। কিন্তু এই মান্ডি হাউস অঞ্চল একদম অচেনা। চারিদিকে দিল্লি পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। একাধিক ডিটিডিসি বাস দাঁড়িয়ে আছে। এবং প্রতিটি বাস ভর্তি পুলিশ – মহিলা এবং পুরুষ দুইই। এছাড়াও দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জলকামানের গাড়ি। বেলা বারোটা বাজার খানিক আগে থেকে সব বাস থেকে পুলিশকর্মীরা বর্ম পরে নেমে আসতে শুরু করলেন এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারলাম নেপালের দূতাবাসের সামনে যেখানে আমরা জমায়েত হয়েছি সেখান থেকে যন্তরমন্তর যাওয়ার পথ লোহার ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হল। ১০-১৫ মিটার অংশ একদিকে ব্যারিকেড দিয়ে আর অপরদিকে জলকামান আর বিশাল পুলিশ বাহিনী। অবাক লাগল দেখে যে যত না মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন এই মিছিল উপলক্ষে, তার থেকেও বেশি সংখ্যায় পুলিশ উপস্থিত। ক্রমাগত মাইক নিয়ে তাঁরা ঘোষণা করে গেলেন যে করোনা মহামারির জন্যে দিল্লিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে আর সেই কারণে এরকম জমায়েত বে-আইনি। জনগণের উদ্দেশে তাঁরা বলছিলেন যেন সকলেই শীঘ্র ঐ জায়গা খালি করে বাড়ি চলে যান, নইলে তাঁরা জনতার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন। তবে খুব অপ্রিয় কোনো ঘটনা ঘটেনি সেদিন। বেলা তিনটের পর থেকে ভিড় কমতে থাকে। আমিও একসময় বাড়ির দিকে রওনা দিই।
১৩ ফেব্রুয়ারি অবশেষে সুযোগ এল সিংঘু যাওয়ার। গুগুলের সাহায্যে কিছু তথ্য হাতে এল। প্রথমে যেতে হবে জাহাঙ্গীরপুর মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে ১৪৪ নম্বর বাস ধরে যেতে হবে সিংঘু বর্ডার। সিংঘু আসলে দিল্লির উত্তর সীমানা বরাবর হরিয়ানার একটা গ্রাম। আমাদের পরিচিতদের কেউই সিংঘু যাননি বলে এর বেশি তথ্য যোগাড় করতে পারলাম না। উত্তর দিল্লির ঘিঞ্জি অঞ্চল ছাড়িয়ে বাস একসময় এক নম্বর জাতীয় সড়ক বরাবর চলতে শুরু করল। বাসটির শেষ গন্তব্যস্থল সিংঘু স্কুল। প্রায় ৫০ মিনিট পরে হাইওয়ের ওপর বাস থেমে গেল। জানা গেল এখানেই নেমে যেতে হবে। এখান থেকেই বাস আবার দিল্লির দিকে যাত্রা করবে। এর বেশি বাস আর যাবে না কারণ সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। অতএব সব যাত্রী বাস থেকে নেমে অন্ধকার হাইওয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা বেজে গেছে। দেখলাম একাধিক বৃদ্ধা/বৃদ্ধ এবং কোলের শিশু নিয়ে মহিলাও হাঁটছেন। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পর পৌঁছোলাম সিংঘু গ্রামে। কিন্তু সামনেই কংক্রিটের ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছে এবং অসংখ্য পুলিশ টহল দিচ্ছেন। রাস্তার ধার বরাবর প্রায় ৩ ফুট চওড়া একটি উন্মুক্ত নালা। তার একজায়গায় খানিক অংশে ব্যারিকেড, যার ওপর দিয়ে স্থানীয় মানুষের যাতায়াত করার রাস্তা ছিল, যে রাস্তাটা যায় কুণ্ডলী বলে হরিয়ানার আর একটা গ্রামে। কিন্তু সে রাস্তাটাও কংক্রিটের ব্যারিকেড দিয়ে আটকানো, তাই অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ ঐ তিন ফুট খোলা নালা টপকে যাতায়াত করছেন। পেরিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটি টোটো রিক্সা এবং অটোরিক্সা দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুএকজন ঠেলাগাড়িতে করে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু কিভাবে কৃষকরা যেখানে আন্দোলন করছেন সেই সিংঘুতে যাব কেউই আমাদের বলতে পারল না। ‘যেতে চাই’ বললে একটাই প্রশ্ন ‘কোন্ গ্রামে যেতে চাও?’ অগত্যা পুলিশেরই শরণাপন্ন হতে হল। তারা জানাল যে হাইওয়ের ওধারেই সিংঘু গ্রাম। কিন্তু ব্যারিকেড টপকে কাউকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি তাদের কাছে নেই। আর এই রাতে ঘুরপথে যাওয়া নিরাপদ নয়। তাই আমার দিল্লি ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। কিন্তু আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম যে আজ সিংঘুতে পৌঁছোতেই হবে। তার দুটো কারণ। প্রথমত আবার ঐ অন্ধকারে হাইওয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে ফিরে যাওয়া নিরাপদ হবে না। দ্বিতীয়ত দিল্লি ফেরার শেষ বাসের সময় জেনে এসেছিলাম রাত সাড়ে আটটা, আর তখন বাজে নটা। কৃষকরা যেখানে আন্দোলন করছেন সেখানে পৌঁছে যাওয়াই হল আমার জন্য সবথেকে নিরাপদ। এই সময় একটি টোটোচালক বলল যে সে আমাকে আন্দোলনের জায়গায় পৌঁছে দেবে। একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিন্ত হয়ে তার টোটোতে চেপে বসলাম। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেই রাস্তার দুদিক বরাবর লোকালয়, নানাবিধ জিনিসের দোকান, সব্জির হাট ইত্যাদি এবং অগণিত লোক পায়ে হেঁটে যাতায়াত করছেন। বুঝলাম দিল্লি পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল যাতে আমি সিংঘু না যাই। টোটোর অন্তিম গন্তব্যের নাম কুণ্ডলী বর্ডার। টোটোচালক জানাল সামনে কয়েক মিটার এগিয়ে গেলেই আমি কৃষকদের আন্দোলনের জায়গায় পৌঁছে যাব। সত্যিই তাই। একটু এগোতেই চোখে পড়ল কয়েকজন সর্দারজি এবং কিছু তাঁবু। বাস থেকে নামার পর একটা চাপা ভয় মনের মধ্যে কাজ করছিল, যতই হোক জায়গাটা দিল্লি ও হরিয়ানার সীমান্ত, কিন্তু এখন নিশ্চিন্ত, আর কোনো ভয় নেই। এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। উত্তর দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক কারখানা আছে। এখানকার লোকজন মূলত সেইসব কারখানাতেই ঠিকাকর্মীর কাজ করে।
সামনে যে সর্দারজিদের দেখতে পেলাম তাঁদের জানালাম আমি কলকাতা থেকে এসেছি এবং তাঁরা যদি দয়া করে আমাকে ‘কিষাণ মঞ্চ’, যে মঞ্চে অনুষ্ঠিত হওয়া নানা অনুষ্ঠানের ঝলক আমরা ইউটিউবের নানা চ্যানেলে দেখতে পাই, সেখানে নিয়ে যান। ওঁরা পরম আনন্দে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনে কুছ নাস্তা কিয়া?’ কিন্তু আমি আগে সেই মঞ্চ দেখতে ইচ্ছুক জানালে তাঁদের মধ্যে যিনি সবথেকে বৃদ্ধ সর্দারজি, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন।
কৃষকদের অবস্থান বা ‘মহল্লা’তে ঢোকার মুখে কয়েকজন সর্দারজি দাঁড়িয়েছিলেন। পরে জানতে পারি বাইরের থেকে যারা ওখানে ঢুকছে তাদের ওপর তাঁরা নজর রাখেন। বৃদ্ধ সর্দারজি জানালেন, তাঁর ৬৫ বছর বয়স, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি, গত ৭ দিন ধরে সিংঘুতে আছেন। আমরা যখন মঞ্চের কাছে পৌঁছোলাম তখন সেখানে বিশেষ লোকজন ছিল না। মঞ্চের সামনের দর্শকাসনে কয়েকজন কম্বল বিছিয়ে শোবার জোগাড় করছেন। ওখানেই কয়েকজন পাহারারত ছিলেন, আমি বাংলা থেকে এসেছি শুনে অভ্যর্থনা জানালেন। ওদের মধ্যে একজন জানালেন তাঁর নাম রণজিৎ সিং, ডাক নাম গোল্ডি, সেই নামেই তিনি বেশি পরিচিত। তিনি শিখ সেবা ফোর্স (শিসেফো) নামক একটি সংস্থার সদস্য। গোল্ডি আমাকে প্রথমেই খাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একটি তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি লোক বসে খাওয়াদাওয়া করছিল। রুটি ডাল সহযোগে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। পাশেই তখন চলছে পরের দিন সকালের খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা ঠিক করলেন আমি শিসেফোর তাঁবুতেই থাকব। আমি সাথে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ল না। তাঁবুতে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেপ কম্বল ও তোশক মজুত আছে। আমার জন্যে একটা ছোট তাঁবু ওঁরা ছেড়ে দিলেন। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু কিছুদিন বাদেই ভোট তাই ওখানে অনেকের নানা প্রশ্ন বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে। আলাপ হল ফরিদার সঙ্গে। ফরিদা এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। প্যারামেডিক্যালের সার্টিফিকেট আছে তার। সিংঘুতেই একটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে সে রোজ রুগীদের দেখাশোনা করে। এই বাবদ প্রতি মাসে তাকে ২৪,০০০ টাকা দেওয়া হয়। আড্ডার মাঝে মাঝে ফ্লাস্ক থেকে গরম বাদামমিশ্রিত দুধ পরিবেশন করা হল বেশ কয়েকবার। শিসেফোর এবং অন্যান্য তাঁবুগুলো জাতীয় সড়ক ২ (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) বরাবর লাগানো আছে। আর এই হাইওয়ের ধারে অসংখ্য মোটরগাড়ি সারানোর কারখানা। এরা প্রত্যেকেই তাদের কলঘর শৌচাগারগুলি কৃষকদের ব্যবহারার্থে খুলে দিয়েছে। এরকমই একটি মোটরগাড়ি সারানোর কারখানার সংলগ্ন জায়গায় শিসেফোর তাঁবুগুলো ছিল, তাই স্নান করা বা শৌচাগার সংক্রান্ত কোনো অসুবিধা ভোগ করতেও হল না আমাকে। রাত্রি দশটার মধ্যে সমস্ত মেয়েদের যার যার তাঁবুতে ঢুকে যেতে হয়। আর সারারাত কয়েকজন পাহারা দেন। প্রতিমুহূর্তে তাঁরা সজাগ থাকেন, যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটিয়ে না বসেন, কারণ শাসক সদা-তৎপর এই আন্দোলনের কোনো দোষত্রুটি ধরতে। সারারাত মাঝে মাঝেই লাঠি ঠোকার আওয়াজ কানে এল, বুঝলাম সদাজাগ্রত প্রহরীরা দায়িত্বে আছেন। ঐতিহাসিক জিটি রোডের ওপরে রাত্রিবাস করছি ভেবে বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল পাশের তাঁবুগুলোর বাসিন্দাদের কথাবার্তার আওয়াজে। চারিদিকে ঘোর কুয়াশা। তাঁবুর বাইরে এসে দেখলাম রাস্তার ধার বরাবর ১০-১২ মিটার দূরত্বে রাখা আছে চা/কফির ডিস্পেন্সার, সঙ্গে ট্রে ভর্তি বিস্কুট।
সিংঘুতে শিখদের নানা সংস্থা তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছে – শিখ সেবা ফোর্স, ইউনাইটেড শিখ অর্গানাইজেশন, খালসা অর্গানাইজেশন এবং আরো অনেক সংস্থা। প্রত্যেক সংঘের নিজস্ব লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে। ঐ কুয়াশার মধ্যেই দেখলাম গোল্ডি এবং তার সহকর্মীরা শিসেফোর অফিসিয়াল ক্যাম্পের সামনে টেবিল চেয়ার সাজিয়ে রাখছেন। টেবিলের ওপরে দৈনন্দিন দরকারি সামগ্রী রাখা হয় – গায়ে মাখা ছোট সাবান, শ্যাম্পু, মাথার তেল, টুথপেস্ট, ব্রাশ, মাস্ক, ছোট স্যানিটাইজার, কাপড় কাচার সাবানগুঁড়ো, ছোট তোয়ালে। কৃষকরা বা অন্য কেউ যে থাকবেন তাঁর সারাদিনে কী কী দরকার হতে পারে সেসব ভেবেই এইসব সামগ্রী মজুত থাকে। এমনকি পুরুষদের গেঞ্জি জাঙিয়াও রাখা আছে, কেউ চাইতে এলে দেওয়া হয়। টেবিলের এক কোণায় দেখলাম একটি নেল কাটার দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা আছে। একজন বৃদ্ধ সর্দারজি নখ কাটতে এসে জানালেন একটু বড় মাপের নেল কাটারের দরকার, বুড়ো আঙুলের নখ কাটতে সুবিধা হয়। এবং এই ব্যবস্থা শুধু শিসেফো ক্যাম্পে নয়, অন্যান্য সংস্থার ক্যাম্পে এবং কিছু কিছু ব্যক্তিগত ক্যাম্পেও চোখে পড়ল। সকালবেলা স্থানীয় লোকরা কাজে যাওয়ার সময় কোনো না কোনো ক্যাম্পের সামনে থামছেন, চা বিস্কুট খেয়ে তাঁরা আবার রওনা দিচ্ছেন নিজেদের গন্তব্যের দিকে। যাঁরা খাচ্ছেন এবং যাঁরা খাওয়াচ্ছেন তাঁদের কাছে যেন এটাই নিয়ম। আন্দোলনের শুরু থেকে এরকমটাই হয়ে চলেছে। স্থানীয় মহিলা পুরুষ কাজে যাওয়ার সময় কোনো লঙ্গরে প্রাতঃরাশ করবেন আর কাজ থেকে ফেরার পথে আবার কোথাও রাতের খাওয়া খেয়ে বাড়ি ঢুকবেন।
আমাকে গোল্ডি এরকমই এক লঙ্গরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আলু পরোটা খাওয়ানো হয়। একেক লঙ্গরে এক এক রকম খাবার। কোথাও খিচুড়ি, কোথাও পোহা, কোথাও আলু টিক্কি, কোথাও পুরি সব্জি। এক জায়গায় দেখলাম স্যান্ডুইচও খাওয়াচ্ছে। সব জায়গাতেই অগণিত লোক খাচ্ছেন। এ দৃশ্য তো দেখার মতই, কিন্তু তার থেকেও বেশি দেখার মত জায়গা হল যেখানে খাবার বানানো হয়। সারাদিন ধরে এই লঙ্গর চলে আর তার জন্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে চলেন অগণিত নারীপুরুষ। এক জায়গায় দল বেঁধে কয়েকজন আটা মাখছেন, আরেক এক জায়গায় দল বেঁধে রুটি বানাচ্ছেন, আবার কয়েকজন রান্নার বাসন ধুয়ে চলেছেন। হরিয়ানা সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু এই সমগ্র অঞ্চলে পুরসভার কোনো পরিষেবা দেওয়া হয় না, তাই প্রতিদিন সকালে বাইরে থেকে জল এবং দুধের গাড়ি আসে। বড় বড় জেনারেটর সারাদিন চলতে থাকে যাতে সব তাঁবুর ভেতরে বিদ্যুৎসংযোগ থাকে। আর কৃষকদের মধ্যে থেকেই কয়েকজন নিয়ম করে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে থাকেন। খালসা অর্গানাইজেশন আর্থিকভাবে বেশি শক্তিশালী, তাই খালসার পক্ষ থেকে বড় বড় আর.ও. ফিল্টার রাখা হয়েছে, যদিও পানীয় জলের সরবরাহ শুধুমাত্র এই আর.ও. ফিল্টারগুলিই নয়। প্রত্যেক ক্যাম্প মিনারাল ওয়াটারের বোতল মজুত রেখেছে। গোল্ডির সঙ্গে এরপর বেরোলাম গোটা ব্যাপারটাকে চাক্ষুষ করতে।
ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল যেন একেকটা মহল্লায় ঘুরছি। কারণ তাঁবুগুলো সেভাবেই বানানো হয়েছে। একেক গ্রামের কৃষকরা (বা অন্য পেশায় নিযুক্ত গ্রামবাসীরা) একই মহল্লায় থাকেন, তবে নারী পুরুষ আলাদা আলাদাভাবে। কিন্তু কিছু কিছু পরিবার নিজেদের ব্যবস্থায় এসেছেন প্রতিবাদ জানাতে। তাঁরা কোনো সংস্থার তাঁবুতে না থেকে নিজেরা ট্র্যাক্ট্ররের ওপরেই বা রাস্তার ধারের কোনো জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে নিজেদের মত রান্নাবান্না করে থাকছেন। এরকমই এক পরিবারের সাথে দুপুরের খাওয়া সারলাম। গোল্ডি জানালেন যে এরকম পরিবারদের মাঝে মাঝে অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয় কারণ নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহে ঘাটতি হয়। অবশ্য একাধিক সংস্থা তখন তাঁদের সাহায্য করে।
প্রায় সব ট্র্যাক্টর বা তাঁবুর ভেতরেই টিভি আছে। গোল্ডি জানালেন যে অনেক তাঁবুতেই এসি বা কুলার লাগানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রাতের দিকে ঠাণ্ডা থাকলেও সকালে রোদের তেজ তীব্র এবং বেশ গরম। তাই কয়েক জায়গায় শরবৎ পরিবেশন করা হচ্ছে। আমরাও এক জায়গায় লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাদাম এবং খসখসের (পোস্ত) শরবৎ খেলাম, এর আগে কখনো খাইনি। গরমে নাকি পঞ্জাব-হরিয়ানা অঞ্চলের বাসিন্দারা এই শরবৎ খান, কারণ এই শরবৎ শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে।
একাধিক লঙ্গরখানা ও রান্নার জায়গা ঘুরে দেখা হল। প্রতিটি রান্নার জায়গাই দেখার মত। বিশালাকায় কড়াইতে রান্না হচ্ছে, ২/৩ মিটার চওড়া ব্যাসের চাটু/তাওয়ার চারদিকে ১২-১৫ জন মহিলা গোল হয়ে বসে রুটি বানাচ্ছেন কিংবা আটা মাখছেন। শেকল বাঁধা অবস্থায় পর পর রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার রাখা আছে। প্রতিটি লঙ্গরেই এই মুহূর্তে যা রসদ আছে তাতে আরো এক বছর চলে যাবে। গোল্ডি জানালেন, শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর নানাদিক থেকে অবিরাম রসদ আসতেই থাকে। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পঞ্জাবীরাও নানাভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, তাই এই আন্দোলনকে এখন শুধুমাত্র কৃষকদের আন্দোলন বলাটা খুব ভুল হবে। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। আন্দোলনস্থলে উপস্থিত কারোর মুখে কোনো বিষণ্ণতার ছাপ নেই। কাউকে দেখে মনে হল না যে নিজের ঘরবাড়ির আরাম ছেড়ে এই যে তাঁরা তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছেন তা নিয়ে তাদের কোনো অনুযোগ আছে। মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট দল গোল খঞ্জনি বাজিয়ে মিছিল করে চলেছে। যুবকরা কোনো একটা ট্র্যাক্টরে বড় বড় মিউজিকাল বক্সে গান বাজিয়ে এদিক ওদিক ধীরগতিতে ঘুরছে।
সিংঘু আন্দোলন কমিটির নিয়ম অনুযায়ী পঞ্জাব ও হরিয়ানার প্রতিটি গ্রাম থেকে কৃষক বা গ্রামবাসীদের আসতে হবে। আন্দোলন কমিটির গাড়ি গিয়ে গ্রাম থেকে ১০/১২ জনকে নিয়ে আসে। অন্তত ৭-১০ দিন থাকার পর আবার গাড়ি গিয়ে তাদের গ্রামে ফেরত দিয়ে আসে। কিন্তু সেই সময় ঐ ১০-১২ জনকে ফেরত পাঠানোর আগে ঐ গ্রাম থেকে অন্য ১০/১২ জনকে আসতে হবে। এর ফলে গ্রামের প্রতিটি মানুষেরই একটা দায়বদ্ধতা থাকে এবং শুধুমাত্র কয়েকজনের ওপরেই চাপ পড়ে না। যেহেতু এই সময় খেতে চাষবাসের কাজও থাকে তাই এই নিয়মে চাষের কাজেরও কোনো ক্ষতি হয় না।
আন্দোলনস্থলে যদি কোনো ব্যক্তির শরীর খারাপ করে বা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তার শুশ্রুষা এবং তার পরিবারের সব দায়িত্ব ঐ ব্যক্তি যে গ্রামের বাসিন্দা সেই গ্রামের সকলে ভাগ করে নেবেন।
আমি খুবই ভাগ্যবান যে সিংঘুতে পৌঁছে আমার গোল্ডির সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। গোল্ডি সিংঘু আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ। সমস্ত মিডিয়া, যারা কৃষক আন্দোলনের খবর নিয়মিত সৎভাবে প্রচার করে, গোল্ডির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ওঁর সাথে আলাপ না হলে আমি আন্দোলনের এত খুঁটিনাটি জানতে পারতাম না বা স্বচক্ষে দেখতে পেতাম না। ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে একটা তাঁবুর সামনে তিনজন বাঙালি ভদ্রলোককে দেখে আলাপ করলাম। তাঁরা এসেছেন ত্রিপুরা যুক্তিবাদী বিকাশ মঞ্চ থেকে। আমি সুদূর কলকাতা থেকে আসা একজন মহিলা শুনে তাঁরা আমার একটি সাক্ষাৎকার নিলেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল যখন গোদি মিডিয়ার কল্যাণে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য প্রচারিত হচ্ছে, তখন একজন মহিলা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া।
সিংঘুতে আন্দোলনস্থলে একাধিক লাইব্রেরি আছে। অন্তত তিনটে লাইব্রেরিতে গোল্ডি আমাকে নিয়ে গেলেন। ঢোকার মুখে রেজিস্টার আছে, সেখানে নিজের নাম লিখে বই নিয়ে ওখানেই বসে পড়া যায়। সবথেকে বড় যে লাইব্রেরি সেটি একটি মঞ্চও বটে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় বৈঠক বসে। আন্দোলনের মুখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসেন। আন্দোলনকারীদের নানা সংশয়, মতামত ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনার ফলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই এই আন্দোলনের সাথে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বলে ভাবতে পারেন। এই তাঁবুর মধ্যে অসংখ্য হাতে আঁকা ছবি ও পোস্টার চোখে পড়ল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা বা জায়গা থেকে যাঁরা এসে এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে গেছেন এইসব পোস্টার তাঁদেরই সমর্থনের দলিল। কৃষকরা সর্বদা চেষ্টা করে চলেছেন এই আন্দোলনকে সকলের আন্দোলন হিসেবে দেশের জনগণের কাছে তুলে ধরার। শুধুমাত্র কৃষক আন্দোলন হয়েই যেন না সীমিত থাকে এই আন্দোলন। তাই তাঁরা চান অন্যান্য রাজ্য থেকে এবং অন্য পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরাও যেন এই আন্দোলনে শামিল হন। মনে হয় সেই কারণেই এবং আমি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক বলে যেখানে অচিরেই ভোট, গোল্ডি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যদি মঞ্চে কিছু বলি। প্রথমে ইতস্তত করলেও আমি রাজি হয়ে যাই, সত্যিই তো, এটা তো আমার কর্তব্য পশ্চিমবঙ্গে বসে আমি এবং আমার অসংখ্য বন্ধু ও পরিচিতরা কৃষকদের সমর্থনে যা ভাবি সেটা ওঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এতদিন যে মঞ্চের কথা শুধু মিডিয়াতেই দেখেছি সেখানে উঠে কিছু বলতে পারার অভিজ্ঞতা এক কথায় অনন্য। এর আগে জীবনে কোনোদিন কোনো মঞ্চে কিছু বলার অভিজ্ঞতা আমার নেই, তাই খানিক ভয়ও করছিল। তবে এটাই বুঝলাম যে অন্তরে যা বিশ্বাস করি সেকথা অন্যের সামনে বলাটা মনে হয় খুব কঠিন নয়। সিংঘুতে দুটি খোলা মঞ্চ আছে। এবং দুটি মঞ্চের পরিচালন কমিটি মনে হয় আলাদা। অন্য মঞ্চটি অপর প্রান্তে, হাইওয়েতে যেখানে দিবারাত্র পুলিশ মোতায়েন আছে সেখানে। এই মঞ্চেই কিছুদিন আগে ইট পাটকেল ছোঁড়া হয়েছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে। গোল্ডি যখন আমাকে সেই মঞ্চ দেখাতে এবং সেখানকার বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে গেলেন, তখন সেখান থেকেও আমাকে অনুরোধ করা হল মঞ্চে কিছু বলার জন্যে। দুই মঞ্চেই দেখলাম পরিচালন কমিটি একটি রেজিস্টার রাখেন। সেখানে বক্তার নাম এবং অন্যান্য কিছু জরুরি তথ্য নথিবদ্ধ করা হয়। মঞ্চে বলার জন্যে যখন অপেক্ষা করছি, তখন দেখলাম একদল মহিলা (কয়েকজন বাচ্চা মেয়েও ছিল এইদলে) ছোট্ট মিছিল করে এগিয়ে আসছেন, তাঁদের মিছিলের ভাষায় বুঝলাম তাঁরা হরিয়ানার কোনো গ্রাম থেকে আসছেন। একটা লাইন স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘পঞ্জাব হরিয়ানা ভাই ভাই’। সেদিন রোববার ছিল বলে আশপাশের গ্রামের অনেকেই এসেছেন। একটি অল্পবয়সী মহিলার সঙ্গে আলাপ হল, সে তার মেয়ের সঙ্গে এসেছে। এই অঞ্চলের কাছেই তার বাড়ি। জানাল, যেদিন থেকে আন্দোলন চলছে, প্রতি রবিবার সে এখানে আসে। ২৬ জানুয়ারির পর কিছু কিছু মিডিয়াতে আমরা দেখেছিলাম যে স্থানীয় লোকরা বিদ্রোহ করছেন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি মেয়েটির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। সে জানাল, ঐদিন স্থানীয় লোকজন কেউ আন্দোলঙ্কারীদের লক্ষ করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে নি। আর সেটাই স্বাভাবিক, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের যে একটা সুস্থ সহাবস্থান আছে সেটা নিজের চোখেই দেখছিলাম।
সিংঘুতে একাধিক গণতাঁবু আছে। কিন্তু সবথেকে বড় তাঁবুগুলো খালসা ক্যাম্পের। খালসার পুরুষদের জন্যে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে ৭০০ বিছানা, এবং মহিলাদের জন্যে ২০০ বিছানা। প্রত্যেক বিছানার নির্দিষ্ট নম্বর আছে আর সেই নম্বর অনুযায়ী টোকেন দেওয়া হয়। তাঁবুতে প্রবেশ করার মুখে কয়েকজন স্বেচ্ছাকর্মী রেজিস্টারে নাম ও টোকেন নম্বর মিলিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেন।
খালসা এবং অন্যান্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক ওয়াশিং মেশিন স্থানে স্থানে বসানো আছে। সকলে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় কাচিয়ে আনছেন। পাশেই ইস্ত্রি করার বন্দোবস্তও আছে।
যে কৃষকরা এতদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, তাঁদের শরীর তো খারাপ হতেই পারে। তাই একটি আপৎকালীন হাসপাতাল আছে যেখানে ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা চালু আছে। নানা রাজ্য থেকে ডাক্তাররা এখানে আসেন স্বেচ্ছায় পরিষেবা দিতে। হাসপাতাল সংলগ্ন তাঁবুতে আছে ওষুধ বিলি করার ব্যবস্থা। বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়াও ডেন্টাল ক্যাম্প ও আই ক্যাম্পও আছে। মধ্যপ্রদেশের একটি মেডিক্যাল টিম এই মেডিক্যাল ক্যাম্প চালায়। এখানেই আলাপ হল পুষ্পার সাথে। সে এসেছে গুনা থেকে। তারাও পালা করে আসে।
সবথেকে মজার তাঁবু হল ‘জখমি জুতোকি হসপিটাল’। এখানে এক বৃদ্ধ সর্দারজি বসে থাকেন। তাঁর বয়স ৮০র ওপরে, প্রথমদিন থেকে এখানে আছেন। কর্মসূত্রে এক সময়ে তিনি ইউকে, কানাডাতে ছিলেন। কিন্তু এখন অম্লানবদনে জুতো মেরামতের কাজ করে চলেছেন। এই কাজ করতে বিন্দুমাত্র ঘৃণা বা অপমান বোধ করেন না, স্বেচ্ছায় তিনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন।
এখানেই দেখা হল এক অল্পবয়সী সর্দারজির সাথে। তাঁর সারা শরীর জুড়ে লোহার শেকল। সে জানাল, আজ আন্দোলনের ৭৮তম দিন। আন্দোলনের প্রথমদিন থেকে সে স্বেচ্ছায় নিজেকে শেকলে জড়িয়েছিল। সরকার এই নতুন নিয়ম প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই শেকল সে খুলবে না।
বেলা শেষে যখন শিসেফোর ক্যাম্প দপ্তরে বসে আছি দেখলাম একাধিক মহিলার দল ফিরে যাচ্ছেন। তাঁরা সব এসেছিলেন আশপাশের গ্রাম থেকে, পায়ে হেঁটে। একজন এসে গোল্ডির সাক্ষাৎকার চাইলেন। তাঁর সাথে একদল মহিলা—বৃদ্ধা থেকে বালিকা। পাশের কোনো এক গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন ঐ ভদ্রলোকের দায়িত্বে। তিনি জানালেন তিনি চান তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আজকের দিনের অভিজ্ঞতা ভিডিওবদ্ধ করতে। শিসেফোর কথা তাঁরা নানা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন ও শুনেছেন।
সারাদিন এরকম নানা মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে এটাই বুঝলাম এই আন্দোলনে শুধুমাত্র পঞ্জাব বা হরিয়ানার কৃষকরাই নন, কত অগণিত মানুষ শামিল হয়েছেন। তাই সরকারকে একদিন না একদিন কৃষকদের দাবি মানতেই হবে।
গোল্ডি বলছিলেন যে তাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন যাতে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকে। কিন্তু তাঁর মত বয়স্ক আন্দোলনকারীদের মনে একটাই ভয়, এভাবে সরকার আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করলে তরুণ আন্দোলনকারীরা কোনো অপ্রিয় কাণ্ড ঘটিয়ে না ফেলেন। তাই তাঁরা সারাক্ষণ কামনা করেন যে যত শীঘ্র সম্ভব সরকার যেন তাঁদের সাথে আলোচনায় বসে এবং তাঁদের দাবি মেনে নেয়। মনে মনে এই আশা নিয়ে আমিও এবারের মত বিদায় নিলাম। গোল্ডি ওরফে রণজিৎ সিংয়ের কাছে অশেষ ঋণী যে তাঁর জন্যেই এক ঐতিহাসিক আন্দোলনকে এত কাছ থেকে দেখতে পেলাম এবং খুব সামান্যভাবে হলেও এই আন্দোলনে শামিল হতে পারলাম।