সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
শহরটা এখানে এসে অাচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। অচল ফেরিঘাট। লোকজনের চলাচল, আনাগোনা,হৈ চৈ নেই। চারিদিক চুপচাপ, নীরবতা, শোকসভার নিস্তব্ধতা। শুধু কিউই, কিউই সুরে কয়েকটা নাম-না-জানা পাখির ডাক উঁচু পাড়ের ঝুঁকে পড়া গাছের পাতার আড়াল থেকে কানে আসছে। শুকনো নদী খাতের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছের সারির মাথা থেকে কুবু...কুবু...কুবু...স্বরে আর্তনাদ করতে করতে ঘুঘু জাতের পাখি নিস্তব্ধতার ওপর সপাটে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে গাছের আড়াল ছেড়ে উড়ে গেল শূন্য আকাশের টানে। পাড়ের উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো ভূমির দিকে তাকালে বহুদূর পর্যন্ত আড়ালহীন আকাশ।
পাড় থেকে ফেরি নৌকায় যাওয়ার জন্য বাঁশের মাচার যে সাঁকো ছিল, সেটা শীর্ণকায়, কঙ্কালসার হয়ে জলের ধার পর্যন্ত পৌঁছানোর বহু আগেই মাটির ওপর ঘাড়-মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে। ছবিতে দেখা বিশালাকায় ডায়ানাসোরের কঙ্কালের মতো।
লোকজন, জনপদ, হৈহৈ রবের মানুষজনের সাড়া না-পেয়ে নদীও কী মুখ ফিরিয়ে নেয়! কখন, কবে থেকে মানুষের সঙ্গে এই দূরত্ব তৈরি হয় তা’কি বুঝতে পারে মানুষ। না-হলে সরতে সরতে কোথায় হারিয়ে গেল নদীর জলরাশি। কে শুষে নিল এত বিপুল জল। একটা বিচলিত বোধ কাজ করে মৈনাকের।
হা-হোসেন, হা-হোসেন করে বুক চাপড়ানো হাওয়া বইছে এই জনমানব শূন্য অঞ্চলে। উঁচু পাড় থেকে ঢালু পথ বেয়ে নদীর মরা খাতে হাঁটতে শুরু করে মৈনাক। শুকনো নদী খাতে নিস্প্রাণ করোটির মতো সাদা বালি যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ হয়ে রয়েছে। আকাশের নীচে কাফনের সাদা কাপড় কে যেন যত্ন করে বিছিয়ে রেখেছে।
নদীর করুণ চেহারা দেখে বুকে ভার বোধ হয়। একটা অব্যক্ত বেদনা কেমন বাইরে বেরোনের পথ খুঁজে না-পেয়ে বুকে চেপে ধরে। নদীর এই মরা চেহারা দেখতে চোখ আটকে যায় মৈনাকের। মৃত এক পশু অপলক চেয়ে রয়েছে। আর তার শরীরের পেছনের দাবনা থেকে খুবলে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে কুকুরের দল। কিছুটা তফাতে অপেক্ষা করছে শকুনের দল। মৃত পশুর নিস্পলক চাউনি মৈনাকের পা-দুটোকে নিশ্চল করে দেয়। নদীর মরা খাত থেকে উঁচু পাড়ের দিকে উঠে আসে সে। দীপ্তেন এই জলটুঙ্গি’র কথা বলেছিল চিঠিতে। চিঠি পেয়ে আসার ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু দীপ্তেনের চিঠিতে যে জলটুঙ্গি’র কথা ছিল এখন নিজের চোখে দেখে কেমন অন্যরকম মনে হয় তার। অন্তত এই রকম শুকিয়ে যাওয়া, মরা একটা মলিন চেহারার কথা লিখে কাউকে আসতে বলে না। তবে কী অন্য একটা চেহারা ছিল। দীপ্তেনের চিঠির পৌঁছানো নয়, নয় করে বছর তিন হয়ে গেল। দীপ্তেনের সঙ্গে এর মধ্যে আর কোন বাক্যালাপ হয়নি। বাক্যালাপ হওয়ার জন্য কোন সংযোগের চিহ্ন দীপ্তেনের নেই। কোন মোবাইল নেই। আবার একটা অভিমান থাকতে পারে। চিঠি পাওয়ার পর পর মৈনাকের কাছ থেকে কোন জবাব না-পেয়ে দীপ্তেন হয়তো ভেবে নিয়েছে মৈনাক আসবে না। আসারও একটা সময় থাকে তারপর সেই সময়ও পেরিয়ে যায় আস্তে আস্তে। মৈনাক সেই সময়টাতে এল যখন দীপ্তেন এখানে ওর আসার ওপর সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।
শীত যাই যাই করছে। গরম নেই। হালকা চাদরের মতো একটা শীত বোধ জড়িয়ে থাকে। দিনের আলো চলে যাচ্ছে একটু একটু করে। একটা শ্রী-হীন চেহারা নিয়ে জলঢুঙ্গির ওপর আধাঁরের চাদর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে আসার কথা জানানো হয়নি দীপ্তেনকে। জলটুঙ্গি নামের মধ্যে কেমন একটা টান রয়েছে, তাই পুবের এই স্টেশনে প্রায় কোন প্রস্তুতি ছাড়াই যখন নেমে পড়লো সূর্য তখন মাথায় ওপর দিন শাসন করছে। তাকে নিয়ে আর যারা স্টেশানে নেমেছিল অল্পকয়েক জন। তারা হনহনিয়ে স্টেশন চত্বর ছেড়ে যেতেই এতক্ষণ সওয়ারিদের ভার বহন হালকা করে ট্রেনটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলতে শুরু করে। মৈনাকের কোন তাড়া নেই। ট্রেন গতি বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যেতেই প্রান্তিক স্টেশনটা মুখ বুজে ফেলল। মৈনাক ধীরপায়ে ওভার ব্রীজ পেরিয়ে স্টেশনের মূল গেট অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালো দীর্ঘ লম্বা বাতিস্তম্ভের নীচে। স্টেশনের রূপ বদলে গেছে অনেকটাই। লম্বা বাতিস্তম্ভ ঘিরে বৃত্তাকারে বাগান। অল্প কয়েকটা সওয়ারি বহন করে নেবার জন্য রিকশা, টোটো দাঁড়িেয়। মৈনাকের চোখ খুঁজছিল অনেক আগে আসার সেই ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়ি। নগরায়নের একমুখী ধাক্কায় এক্কা গাড়ীকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে এই সাজানো চত্বর থেকে।
বাঁক ঘুরে একটু হাঁটতেই মৈনাকের চোখে পড়লো হারিয়ে যাওয়া রূপটান, আভিজাত্যকে জোর করে ধরে রাখার এক প্রবল চেষ্টায় এখনও ঘোড়ায় টানা এক্কা-টাঙা দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে ওঠার রেকাবে পা দিয়ে গাড়িতে উঠে মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে এল, জলটুঙ্গি যাবো।
মাথায় ফেজ, ছুঁটলো দাড়ি, পরনে ঢিলে পা-জামা পরিহিত মাঝ বয়সী মানুষটি ভাঙা গলায় বলল, সে’তো বহুদূর। বেলা পেরিয়ে যাবে।
যাকগে, তুমি কী যাবে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় টাঙার মালিক ঘাড় নেড়ে বলল, যাবো, কিন্তু ভাড়া বেশি লাগবে। একশো টাকা।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাগাম হাতে নিয়ে মুখে একটা শব্দ করতেই টাঙা চলতে শুরু করলো। ঘোড়ার পায়ের নালের ছন্দে শব্দ তুলে টাঙা প্রায় দৌড়তে শুরু করলো। আস্তে আস্তে মুছে যেতে শুরু করলো চেনা দৃশ্যগুলো। যেগুলো প্রায় সব শহরেই রয়ে যায়।
জলটুঙ্গিকে এখনকার জামানা কেউ চেনে না। পচা খাল রাস্তার দিকে মুখ রেখে কোচোয়ান বলল।
তন্ময়তা ভাঙলো মাইক্রোফোনের তীব্র আওয়াজে। মৈনাক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর ঢেউ খেলানো পাড়ের ভূমির ওপর। একটু দূরেই একটা নৌকা শুকনো নদী খাতে পাটাতন, ভাঙা-ছৈ নিয়ে খোলা আকাশের নীচে হাড় জিরেজিরে শরীরে করুণ ভাবে পড়ে রয়েছে।
মাইকের তীব্র আওয়াজ কানের ভেতর শব্দগুলো গুলির মতো বিঁধলো। আশ্চর্য দু’মুখো মানুষ দেখুন। একটা শরীরে দু’মাথা ওলা মানুষ আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আপনার এলাকায় থাকবে। এই সুযোগ আর পাবেন না। আমাদের তাঁবুতেই দেখতে পাবেন পৃথিবীর আশ্চর্য দু’মাথাওলা মানুষ।
মৈনাক আর দাঁড়ালো না। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার ছাওয়া জলটুঙ্গিকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করলো লম্বা পা ফেলে শহরের দিকে। এলোমেলো ঝোপ-জঙ্গল থেকে ঝিঁ-ঝিঁ-র ডাক আসছে। আকাশের এক কোণে ইঁদুরে কাটা চাঁদ। মাইকের শব্দের তীব্রতা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। একটা ধোবিখানা চোখে পড়লো। সার সার সিমেন্টের পাটাতনের পাশেই জল ধরার ছোট ছোট চৌবাচ্চা। কাপড় আছাড় দেওয়ার শব্দ নেই। ধোপাহীন একটা ফাঁকা জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা-দু’টো শ্রীহীন, ছাড়া ছাড়া ঘর-বাড়ি চোখে পড়ছে মৈনাকের। এখনো অন্ধকার জমাট নয়। অচেনা পথে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে বেশ। ঘণ্টা কয়েক আগে টাঙা করে যাবার সময় যেটুকু চোখে পড়ছিল সেটুকু সমুল করেই হাঁটছে সে। এভাবেই এসে পড়লো ভাঙাচোরা রেলিং, শ্রী-হীন একটা পার্কের কাছে। দোলনার বসার বেঞ্চগুলোর কাঠের পাটাতন নেই। পড়ে অাছে দুই প্রান্তের লোহার পায়া। আচমকা চোখের ওপর ঝুপ করে অন্ধকার নামতে মৈনাক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নতুন, অচেনা জায়গায় এই আচমকা আঁধার নামা তাকে স্থবির করে দিল। ধাতস্থ হবার জন্য দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে সিগারেট লাইটার দিয়ে অগ্নি সংযোগ করলো। অন্ধকারের মধ্যে সিগারেটের লালাভ বিন্দুটুকুই মৈনাক হয়ে জ্বলতে লাগলো।
আচমকা অন্ধকারের মধ্যে মৈনাকের মনে হল কে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনুমানে ভুল নয়। তার কানের পাশে আঁধার মাখা মুখ নিয়ে কেউ একজন ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো, চলবে নাকি! পাউচ প্যাকেটে টেম্পার দেওয়া মাল।
মৈনাক ঘাড় ঘুিরয়ে দেখার চেষ্টা করলো অচেনা স্বরের মানুষটাকে। চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে এল না। এরকম অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে মৈনাকের নাকে তীব্র ঝাঁঝাঁলো, মাথা ঝিম ঝিম করা একটা গন্ধ এল। গন্ধের মধ্যে থাকা জিনিসটাকে চিনতে চাইছিল। তার মনে হল খুব চেনা গন্ধ। গন্ধের পরিচয় তাকে পৌঁছে দিল এক সচেতনতায়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ডেনড্রাইটের তীব্র গন্ধ টানা নেশুরেদের এখন নেশার নতুন সামগ্রী। জায়গাটা খুব সুবিধেজনক নয়। মুহূর্তের মধ্যে মৈনাককে চমকে দিয়ে সাদা আলোয় ভরে গেল অঞ্চলটা। রেলিং ভাঙ্গা পার্কটার মধ্যে সিমেন্টের হাতির মাথায় বসে আছে কেউ। দূরে রিকশা স্ট্যান্ডের জটলা। মৈনাক পা-বাড়ালো রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে। গান ভেসে আসছিল ঐদিক থেকে, বাবুজি ধীরে চলনা, যারা সামাহলনা।
রিকশাওলা প্যাডেলে চাপ দিয়ে রিকশায় গতি এনে বলল, গাঙহাটিতে নতুন এসেছেন?
মৈনাক বলল, না, না। আগেও এসেছিলাম একবার। কিন্তু এদিকটায় আসিনি।
এদিকটায় আসার আগে কাউকে জানপুছ করবেন তো।
আমি জলটুঙ্গি দেখতে এসেছিলাম, মৈনাকের জবাবে রিকশা চালাতে চালাতে রিকশাওলা বলল, নামেই জলটুঙ্গি। এরকম মরা নদী কেউ শখ করে দেখতে আসে। আগে শীত কালের দিকে প্রচুর বিদেশী পাখি আসতো এখন শিয়াল-কুকুর আর হাড়গিলেদের চারণভূমি। আর যত রাজ্যের পাতাখোর, মাতাল, আর নেশুরেদের আস্তানা। হ'! কী হয়ে গেল জায়গাটা!
ফেরিঘাট ছিল তো, মৈনাক বলল,
সে অন্যযুগের কথা, ছবি হয়ে গেছে। জল নেই তো! ফেরিঘাট।
নদী এরকম শুকিয়ে যায়! মৈনাকের বিস্ময়ে রিকশাওয়ালা বলল, নিজের চোখেই তো দেখলেন। তবে আপনার মতো আমারও মনে হয় নিজে থেকে নদী শুকিয়ে যায় না। শুকিয়ে দেওয়া হয়। এসব একদিনের ব্যাপার নয়। খুব পরিকল্পনা করে প্রতিদিন একটু একটু করে নদীটাকে শুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড্রিঙ্কস ফ্যাক্টরি দেখেছেন?
ড্রিঙ্কস ফ্যাক্টরি, স্ট্রেঞ্জ! মৈনাক বলল।
কত জল টানতো জানেন। গ্যালন, গ্যালন, এ খবর সবই বাতাসে এখন ঘুরে বেড়ায়। জায়গাটাই কেমন দীন দরিদ্রের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। লোকজন-ই সব ছেড়ে ছুড়ে কোথায় চলে গেল। এখন তো শ্মশানের দশা। আপন মনেই রিকশাওলা বলতে থাকে।
রিকশাওয়ালার সবটা বোঝা যায় না। মৈনাক একবার স্মরণ করিয়ে দিল, কংসবণিক পাড়ায় যাবে।
আরে, আমার খেয়াল আছে। ঐ ফেরিঘাটের সঙ্গে আমার জীবনটাই হারিয়ে গেছে।
কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় রিকশাওলা বলল, ফেরিঘাট চালু থাকলে রিকশা টেনে জীবন কাটতে হত না।
কংসবণিক পাড়ায় এসে রিকশা থেকে নেমে দাম মিটিয়ে মৈনাক বলল, নামটাই তো জানা হল না তোমার।
স্বপন ধর। স্বপন ধর বললেই হবে।
দুই
বহুদিন আগে বন্ধুবান্ধব নিয়ে দীপ্তেনের এখানে এসেছিল একবার-ই। রাত কাটিয়ে ছিল হুল্লোরের মধ্যে। আজ বহুদিন পর প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালো মৈনাক। আর্চ করা লোহার শৌখিন গেট। বহুদিন সংস্কারের অভাবে জীর্ণ, ভেঙে পড়ার উপক্রম। পুরোনো আমলের খড়খড়ি জানালাগুলো বন্ধ। দোতালার কোথাও কোন আলোর চিহ্ন নেই। আশপাশের সাজানো ঘরবাড়ির মাঝে, পুরোনো বয়স্ক চেহারা নিয়ে দীপ্তেনের বাড়িটা বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গলা ছেড়ে মৈনাক ডাকলো, দীপ্তেন, দীপ্তেন -
অন্ধকার বাড়ি, বাইরের আলোয় যেটুকু চোখে পড়ছে তাতে ধারনা হয় বাড়ির ভেতরে কেউ থাকে না। এই ভাবনা মাথায় আসতেই মৈনাকের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হল। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেই অনিশ্চিয়তায় পুনরায় গলা দিয়ে উচ্চস্বরে বেরিয়ে এল, দীপ্তেন, আমি মৈনাক।
মৈনাক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুটা তফাতে একটা ছোট দরজা খুলে একজন অপরিচিতা মহিলা বেরিয়ে মৈনাকের সামনে এসে বলল, এদিক দিয়ে আসুন। ওখান দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।
অবাক হ’ল মৈনাক। বিস্ময় নিয়ে মহিলাকে অনুসরণ করে ছোট দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। মৈনাকের মনে হল বাড়ির পেছন দিকে চলে এল। এদিকটাতে বড় বড় গাছ তাদের পাতার ছাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছে জায়গাটা। কোন কালে বাগান ছিল। এখন সবটাই ঝোপঝাড়। আম, জাম, নিম, কাঁঠাল গাছের নীচে বুনো আকন্দের ঝাড়, ক্যাসিয়ার জঙ্গল। খুব হালকা একটা আলোর রেশ তার চোখের সামনে অপরিচিত মহিলার হাতের থেকে বেরিয়ে এটুকু দৃশ্যমান।
বাগানের কাঁচা পথ পেরিয়ে পুরোনো আমলের টানা বারন্দায় ওঠার জন্য সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে কড়ি-বরগার টানা লম্বা বারান্দায় দাঁড়ালো মৈনাক। আগে মহিলা। তার ঠিক মাথার ওপর লম্বা লোহার শিকল দিয়ে ঝোলানো পুরোনো আমলের শৌখিন কাঁচের বাতিধার কড়ি-বরগার ছাদ থেকে নিষ্প্রদীপ হয়ে ঝুলে রয়েছে।
নীরবতা ভেঙে মৈনাক বলল, দীপ্তেন নেই, আমি মৈনাক, দীপ্তেনের বন্ধু। বহুদিন আগে এই বাড়িতে একবার এসেছিলাম।
কমজোরের বিজলি বাতির আলোয় অন্ধকার মাখা আগে চলা অচেনা মহিলা ঘাড় ফিরিয়ে মৈনাকের দিকে মুখ রেখে বলল, অনেক দিন এই বাড়ির দরজায় দীপ্তেনের নাম ধরে ডাকেনি কেউ। আপনি আসুন।
মৈনাক বিস্ময় চেপে রেখে অনুসরণ করলো। টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে প্রায় পুরোনো কালের সিঁড়ি ওপরে ওঠার। দু’দিকে খাড়া উঁচু দেওয়ালের মাঝ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে। যেন সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে এই আরোহন।
দোতলায় এসে অন্ধকার কিছুটা কাটে। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। মনে হয় থাকে না কেউ। একটা ঘরের সামনে মৈনাক-কে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বালতে দীপ্তেন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে মৈনাকের চোখের সামনে। দেওয়ালে দীপ্তেনের বড় ছবি, আলনায় ঝোলানো পরনের পোশাক। টেবিলে, বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দীপ্তেনের ব্যবহৃত কাগজ পত্র, পাতা ওল্টানো বই, ডায়েরি, কলম। যেন কাজ করতে করতে বাইরে কারুর ডাক পেয়ে বেরিয়ে গেছে হঠাৎ।
মৈনাক প্রশ্নচিহ্ন মুখ নিয়ে তাকালো অচেনা মহিলার দিকে। শ্যামলা রঙের, লম্বাটে গড়নের মহিলা মৈনাকের দিকে চোখ রেখে বলল, দ্বিধাহীন স্বরে, আমি মলিনা, দীপ্তেন বাবু’র মা’কে দেখাশুনো করি। কিন্তু এখন এই ঘর-দোর আমাকে আগলে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
মৈনাক মুখ তুলে বলল, কেন, দীপ্তেন?
আপনি জানেন না? মলিনার স্বরের মধ্যে বিপন্নতা টের পেল মৈনাক।
আমি! না’তো।
দীপ্তেনবাবু আজ প্রায় মাস ছয়েক উধাও। কোন খবর নেই। একদম অদৃশ্য। ওর মাকে নিয়ে আমি পড়েছি জলে। কাউকে চিনি না, কী করবো বুঝতে পারছি না। অনেক দিন পর আপনার মতো চেনা কেউ এই বাড়িতে পা রাখলো।
মলিনার কথা মৈনাককে যেন সজোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু তার পা’ দু’টো পেরেক দিয়ে গাঁথা। এ রকমের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের মাঝখানে ফাঁকামাথা আর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে। এই রকম পরিস্থিতে যে তাকে পড়তে হবে কিছুক্ষণ আগেও ওর ভাবনার মধ্যেও ছিলনা। ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি এরকম একটা কঠিন বাস্তব তার জন্য অপেক্ষা করছে। নিজেকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলো না। সামনে বিছানায় নিজের শরীরের ভারটা ছেড়ে দিল।
মাসীমাকে নিয়ে কোথাও খোঁজ-খবর করেন নি? মৈনাকে’র উদ্বিগ্ন স্বরে মলিনা বলল, করেছি, থানায় মিসিং ডায়রি করেছি। সবই আমার সাধ্যমতো।
দীপ্তেনের না-থাকা মৈনাককে গভীর জলে ফেলে দিয়েছে। ভাবার জন্য তার একটু সময় দরকার। মাথায় কোন শব্দই অর্থবোধ নিয়ে আসছে না। বাকরুদ্ধ অবস্থায় বিছানায় বসে রইল।
মৈনাকের কাছ থেকে কোন রকম সাড়া না-পেয়ে মলিনা আপন মনেই বলল, মাসিমাকে খবর দিই আর আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি।
মলিনা ঘর ছেড়ে যেতে, মৈনাক বিছানা ছেড়ে দেওয়ালে টাঙানো দীপ্তেনের হাসি মুখের ছবির দিকে এগিয়ে গভীর ভাবে দেখতে থাকলো। নিমগ্নতা গ্রাস করলো মৈনাককে।
এনিথিং রং দীপ্তেন। তুই আমাকে ভীষণ মুশকিলে ফেললি। তুই আসতে লিখেছিলি। দেরী হল কিন্তু এলাম আর তুই লুকিয়ে রয়েছিস ইডিয়েট্। বেরিয়ে আয়।
আপনার চা। মলিনার কথায় তন্ময়তা ভাঙে মৈনাকের। পায়ে পায়ে ফিরে আসে বিছানায়। চা’য়ে চুমুক দেয়। এখুনি দীপ্তেনের মা’র মুখোমুখি হতে মন চাইছিল না। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। মলিনার কথায় মৈনাক মুখ তুলে বলল, আমাকে একটু সময় দিতে হবে। তারপর না হয়...
মৈনাকের কথা শেষ করতে না দিয়ে মলিনা বলল, মাসীমা, বাড়ি-ঘর, আর টাকা পয়সা।
মাসীমা! মৈনাকের বিস্ময় বোধ।
রাতের বেলা কোন কিছুই দেখতে পায় না। এমন কি দিনের বেলায় অসুবিধে হয় দেখার। অনুমান করে বসে বসে ঘোরা ফেরা করে। আচ্ছা, দীপ্তেনবাবু কী ফিরবেন না? কী এমন হ’ল যে বাড়ির পথ ভুলে গেল।
মৈনাক জবাব দেবার মতো কোন কথা খুঁজে পেল না। শুধু শুনে গেল চুপ করে।
মলিনা দেখলো মৈনাককে। তারপর চা-য়ের কাপ নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল নীরবে।
বিছানা ছেড়ে দীপ্তেনের ছোট টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। টেবিল জুড়ে কাগজ, পেনদানি, অ্যাসট্রে’র মধ্যে ডায়রিটা পড়ে রয়েছে। কৌতূহলী মন নিয়ে বড় ডায়রিটা হাতে তুলে বিছানায় বসে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো মৈনাক। হালকা একটা ধুলোর স্তর রয়েছে ডায়রির পাতায়। ধারাবাহিকভাবে দিন ধরে কোন লেখা নেই। চোখ আটকে গেল পাতা জুড়ে বড় বড় করে লেখা ‘ডু নট ওয়েস্ট ইয়োর টাইম।’ ঠিক তার নীচে ছোট ছোট করে লেখা, টাইম ওয়েস্ট আস। মজা পেল মৈনাক। কিন্তু ও’র চোখ খুঁজছে প্রয়োজনীয় কিছু কথা। যা দিয়ে অন্তত পরবর্তী পা ফেলার মতো একটা জায়গা পাওয়া যাবে।
হঠাৎ-ই আটকে গেল মৈনাকের চোখ। গোবিন্দ সেই যে মলিনাকে রেখে উধাও হ’ল। তারপর আর কোথাও চিহ্ন নেই। একে নিয়ে কী করি। মনে হয় নিরুপায় হয়ে গোবিন্দ’র হাত ধরে ছিল। না, হলে ভবঘুরে গোবিন্দ’র হাত কোন চালাক মেয়ে ধরে। না, মেয়েটা ভালো, ঘর-বাড়ির দেখভাল করছে নিজে থেকেই। বাড়িতে মেয়েরা থাকলে বোঝা যায় বাড়িতে একটা গোছানো ব্যাপার থাকে। তা’না হলে কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব। কিন্তু গোবিন্দ গেল কোথায়!
এরপর আর কোন লেখা নেই ডায়রির পাতায়। কিছু হিসেবপত্তর। দীপ্তেন বোধহয় ব্যাঙ্কে একটা টাকা ফিক্সড করে ছিল। সেই সমস্ত সার্টিফিকেটের নম্বরগুলো পরপর রয়েছে।
মৈনাক পাতা ওল্টাতে শুরু করল। পাতা ওল্টাতে গিয়ে তার মনে হ’ল ডায়রির পাতায় হদিশ মিলতে পারে দীপ্তেনের।
অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি এখনও বৃষ্টির কোন দেখা নেই। হাওয়া অফিস বলছে এবার ‘এল নিনো’। কিন্তু মাথায় সূর্যের তাপে দেহ-মন কাহিল। জিভ বের করা কুকুরের হাল। আকাশে কোথাও এক কণা মেঘ নেই। যাও বা বিকেলের শেষে একটু কালো মেঘের চিহ্ন দেখে মনে একটু আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, এই মেঘে কোন আশা নেই। আশা করার মতো জীবনে কিছু ঘটবে না বোধহয়। গ্রামে ঘুরে ঘুরে বীজ কোম্পানীর হয়ে ক্যানভাসিং করা, সম্পন্ন চাষীদের একত্র করে বীজের গুনাগুণ ব্যাখা করা, ছোট ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই বিষয়ে আলোচনা সভা বসানো। ওদের মধ্যে কাউকে দিয়ে এই সমস্ত কিছু বলালে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয়। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি এরাও সুবিধা চাইছে। ফ্রি সার্ভিস বলে কিছু হয়না। অফিসে রাধিকা গুপ্ত’র সঙ্গে কথা বলতে হবে। ও তো ব্যাঙ্কের বিষয় দেখাশুনো করে। রাধিকা বলে ছিল, পার্স খুলতে দেরী করবেন না। এখন সব সর্ট স্প্রিন্টার। আপনি দেরী করলে দেখবেন কালকে আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের বিশাল প্রজেক্ট। এই গাঙহাটিতে আমরা গ্রীন রেভিলিউশ্যান এনে দেবো। রেভিলিউশ্যানের জন্য আর অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে না। গ্রামের সবার পকেটে টাকা আসবে। আপনার ফিল্ডওয়ার্ক যত ভালো হবে, কোম্পানীর গাড়ি তত মসৃণ ভাবে চলবে। ঘরের কোণে মাকড়সার জাল পেতে চুপ করে বসে শিকারের অপেক্ষায় থাকে অর্থোডক্সরা। শিকারের সন্ধানে আপনাকেই টার্গেট করতে হবে তবেই আপনার পেছনে কোম্পানী থাকবে। শুধু মাথায় রাখুন, এভরিথিং ফর সেল। নিজেকে বিক্রী করার কায়দা রপ্ত করতে হয়।
একটানা ডায়রির পাতায় দীপ্তেনের লেখা পড়তে গিয়ে দীপ্তেনকে অনুভব করতে পারলো মৈনাক। যেন এই ঘরের মধ্যেই রয়েছে। মলিনা কখন রাতের খাবার দিয়ে গেছে খেয়াল করেনি। সমস্ত বাড়িটায় কোন সাড়া শব্দ নেই। আশপাশ রাতের নৈঃশব্দে চুপ করে রয়েছে। উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে শেষ শীতের একটা হালকা ঠাণ্ডা ঢুকছে চুপিসারে। চোখ তুলে মৈনাক খোলা জানালা দিয়ে দেখলো গাছপালারা মাথায় একটা কুয়াশার চাদর টেনে নিদ্রা যাবার তোড়জোর করছে। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে নীচতলা থেকে। ঘরের মধ্যে আলোর রেশ থাকায় অন্ধকার যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে কালো আলখাল্লা পরে প্রহরীর মতো। দরজা খোলা পেয়ে একটা বিড়াল নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। অবাক চোখে মুখ তুলে মৈনাকের দিকে তাকালো। গলায় শব্দ করলো মিয়াউ, মিয়াউ করে। তারপর উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে লাফ মারলো অন্ধকারের মধ্যে। ক্যা, ক্যা করাত চেরা গলায় রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে কোন নিশাচর পাখি ডেকে উঠলো।
মৈনাক ঢাকা দেওয়া খাবার খেতে শুরু করলো। ডায়রিটা বিছানার ওপর রেখে দিল। যে ভাবনা মাথায় নিয়ে এখানে এসেছিল তার সবটাই উলটে গেছে। এখন ওর হাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কিছু নেই। ঘটনা যে দিকে বাঁক নেবে সে দিকে হেলতে হবে। তারই একটা ধারনা পাবার চেষ্টা করছিল ডায়রির পাতায়, এখনও সেরকম সূত্র খুঁজে পায়নি। এই বুঝতে না-পারা মৈনাকের শরীর-মনে এক ধরনের অস্বস্তি চোরা গোপ্তার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। অস্বস্তি কাটাতে মৈনাক সিগারেট ধরালো। একটা দীর্ঘটান দিয়ে উত্তরের জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
ফেরারি পাখিদের মতো হু হু করে দিনগুলো চোখের ওপর ভেসে উঠলো। দীপ্তেন সাইকেলের রডে ওর বাবাকে বসিয়ে অফিসে নিয়ে আসতো। ওর বাবা পাবলিক হেল্থ ডিপার্টমেন্টের কোন এক পদে চাকরি করতো। ওর বাবা হ্যান্ডিক্যাপড ছিল। পা ছোট-বড় ছিল। হাঁটতে অসুবিধে হতো। রোগাটে গড়নের, চাপা গায়ের রঙ, ধুতি-পরা দীপ্তেনের বাবা এলাকায় টিকে বাবু নামে পরিচিত ছিল। বরফকলের পাশ দিয়ে গাড়ি যাবার রাস্তার ধারে যে মেস বাড়ি বড় পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে শ্রীপুর অার রাজপুরের মাঝে আদ্যিকাল থেকে সীমান্তরক্ষী হয়ে পাহারা দিত, সেই মেসবাড়িতে দীপ্তেন ওর বাবাকে নিয়ে থাকতো। সেনানিবাস ছিল একসময়। পায়রার খোপের মতো ঘরগুলোতে রাজপুরে কাজের সন্ধানে আসা মানুষদের মেসবাড়ি ছিল ঐ সেনানিবাস। সেনা নিবাসের পেছনে অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ক্যাসিয়া, আকন্দ, ফনিমনসা, পার্থেনিয়াম, শিয়াল কাঁটা, কচু আরও নাম-না-জানা বুনো ঝোপ জঙ্গলে ভরা অংশের মাঝে মাথা তুলে খেঁজুর, আতা, কুল গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো। জন বসতিহীন নির্জন ঐ ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে পায়ে চলা পথ দিয়ে অনেকটা হেঁটে গেলে শ্রীপুর পৌঁছানোর ঠিক আগে একটা টাওয়ার ছিল। বুনো জঙ্গলের মধ্যে রেলের লাইন পাতা ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। কবে কী প্রয়োজনে এই রেল লাইন পাতা হয়েছিল জানা নেই। কোনদিন রেলগাড়িও বোধ হয় এই রেল লাইন দিয়ে চলেনি। আমরা বন্ধুরা দীপ্তেনের কাছে যেতাম এই জায়গাটার টানে। দীপ্তেন বলতেই সেই খাঁড়া পাঁচিলের দূর্গের মতো বাড়ির ছবিটা ফুটে উঠলো মৈনাকের চোখের সামনে।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে জ্বলন্ত অংশটুকু জানালা থেকে সরে এসে অ্যাসট্রের মধ্যে গুঁজে বিছানায় টান টান হয়ে নিজেকে ছেড়ে দিল মৈনাক। ঘরের বিজলি বাতি জ্বলতে থাকলো। সারাদিনের পেরিয়ে আসা ঘটনাগুলো ঘুম না আসা চোখে বিচ্ছিন্নভাবে আসতে লাগলো।
কোচোয়ানের মাথায় ফেজ, ছুঁচলো দাড়ি, টাঙাওয়ালার বাতাসে চাবুক হিসহিস শব্দ করে উঠলো। মৈনাক দুলে উঠলো যেন জলের ঢেউয়ের ওপর দুলতে দুলতে ভেসে চলে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারের পাড় ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। খালি জল আর জল। এক অনন্ত জলরাশি। আচমকা চোখের অদূরেই দেখতে পেল দীপ্তেন ওর দিকে বড় দু’টো চোখ নিয়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখ দু’টো স্থির। ওর শরীর ঘিরে রয়েছে বড় ডানাওয়ালা হাড়গিলে, শকুন। মৈনাকের গলা বুজে এল। কে যেন দু’হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেছে। মৈনাক গলা দিয় স্বর বার করার চেষ্টা করছিল। দীপ্তেনকে ডাকতে চাইছিল। দীপ্তেনের বড় স্থির চোখ আর ওকে ঘিরে থাকা বড় ডানাওয়ালা পাখি জলে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে...।
তিন
সকালের আলোয় মৈনাক বাড়ির ভগ্নদশা দেখছিল। মনের মধ্যে লেপ্টে থাকা উদ্বেগ ঘুমের রেশ কাটিয়ে ক্লান্তি এনেছে শরীরে। মৈনাক ঘর ছেড়ে বাইরে এল। বাইরে খোলা চত্বর। উঁচু পাঁচিলের আলসে তুলে আশপাশের বাড়ি থেকে একটা আড়াল তোলার চেষ্টা ছিল। কিন্তু এ বাড়িতে দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে একটা ক্ষয় রোগ বাসা বেঁধেছে। দীপ্তেনের তাকানোর সময় হয়নি কিংবা হয়তো উদাসীন ছিল। বাগানের অামগাছের মোটা ডাল আলসের পাঁচিলের ওপর পড়ে বেশ কিছুটা অংশ ভেঙেছে। ডালটা শুকিয়ে গেছে। মনে তো হয় এটাও অনেকদিন। কেউ খেয়াল করলেও উদ্যোগী হয়নি। মৈনাক ঐ ভাঙা অংশের দিকে এগিয়ে গেল। ভাঙা অংশ দিয়ে নীচে দীপ্তেনদের এজমালি রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে। চাল নেই কিন্তু কঙ্কালের মতো চালের নীচে বাঁশের অস্থিকাঠামোটা এখনও পর্যন্তু টিঁকে রয়েছে। রয়েছে একটা বড় উনুন। আরও টুকিটাকি কিছু গৃহস্থালীর জিনিস। দীপ্তেনের যৌথ পরিবারের চিহ্নগুলো গতবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছিল। আরও একজনকে মৈনাক এখনও পর্যন্ত দেখেনি। ঝাঁকড়া চুলের ব্যনিয়ান পরা, আলুথালু বেশের মাঝ বয়সি সেই রাঙা কাকাকে। প্রথম দেখাতেই সে বলেছিল, আমার সাজানো বাগান, শুকিয়ে গেল। দীপ্তেন বলেছিল মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। নীচের তলায় থাকতো। আর মাঝে মাঝে উদাত্ত কণ্ঠে থিয়েটারের কোন সংলাপ বেরিয়ে আসতো। মধ্য দুপুরের নির্জনতা ভেঙে বুকফাটা আর্তনাদের মতো, দীপ্তেনের রাঙা কাকার সংলাপ, জাহানারা, জাহানারা কোথা গেলি মা। দেখছিস না চারদিক কালো করে আঁধার নামছে কেমন চারিধারে। এখন-ই দীয়া জ্বালাও। অন্ধেরা, যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে। এখনই অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা...
ঘর বাড়ি দেখছেন? মলিনার সাড়া পেয়ে মৈনাক বলল, মিলিয়ে দেখছিলাম পূর্বের দেখার সঙ্গে।
মিললো কিছু? মলিনার ছোট্ট কথার জবাবে মৈনাক বলল, মেলে না’কি। সময় অনেক কিছুই ক্ষইয়ে দেয়। এই আমাকে আসতে লিখে দীপ্তেন-ই বাড়িতে নেই। এটাই তো মিলছেনা। আচ্ছা, গোবিন্দ কোথায়?
মৈনাকের জিজ্ঞাসায় মলিনা চমকে উঠলো। তারপর বলল, আপনার চা-খাবার ঘরে রেখে এসেছি।
মৈনাক ঘরের দিকে ফিরতে মলিনা বলল, গোবিন্দ দা’কে আপনি চেনেন?
ঘাড় নাড়লো মৈনাক।
তবে? মলিনা’র ছোট্ট জিজ্ঞাসায় মৈনাক বলল। আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না ওকে পেলে সুবিধে হত।
পাবেন বলে মনে হয় না। মলিনার উত্তরে মৈনাক বলল, পাবো না কেন?
ঘরের দরজা পেরিয়ে বিছানায় বসতে গিয়ে মৈনাক লক্ষ্য করলো বিছানা পরিস্কার। চা’য়ে চুমুক দিয়ে দেখলো মলিনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। মৈনাক বলল, তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে গোবিন্দর?
মলিনা মাথা নাড়লো। তারপর বলল, অনুমান করতে পারি।
মৈনাক বলল, সেই অনুমানটা শুনি।
জেলে। মলিনার জবাবে বিষম খেলো মৈনাক। এরকম উত্তর আশা করেনি। কোনরকমে সামলে অবাক স্বরে বলল, জেলে!
এরকম টানা মালের কারবার করলে দু’চারবার জেলে যেতে হয়। আমাদের পাড়ায় এটা কোন অবাক করা ঘটনা নয়। ওখানে সবাই কম বেশি জেলে যায়। মলিনা কথা থামাতে মৈনাক বলল, তোমার পাড়ার নাম কি?
মলিনা বলল, চৈতল পাড়া।
চার
অচেনা জায়গায় চলাফেরা করার সময় নিজেকে যতটা সম্ভব খোলামেলা রাখতে হয়। মনে অযথা উৎকন্ঠা থাকলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া সেটাই পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়। মৈনাক গুমটির দোকান থেকে সিগারেট কিনে আগুন ধরিয়ে মুখের ধোঁয়া ছেড়ে দোকানির উদ্দেশে বলল, চৈতল পাড়া যেতে কোন রাস্তায় গেলে সুবিধে হবে।
দোকানি খুচরো পয়সা ফেরৎ দিয়ে বলল, আপনি জেলে পাড়ায় যাবেন কেন?
জেলেপাড়া! মৈনাক বলল।
তুড়ি মারার ভঙ্গিতে দোকানি বলল, চৈতল পাড়া তো এই সেদিন হ’ল। দিন দিন কত কী দেখবো। কেওড়া পাড়া, জেলে পাড়ার গায়ে সাজ পোশাক পরিয়ে দিলেই বাবুলোক হয়ে গেলি। যাকগে ঐ সামনের মোড় থেকে যে কোন লোককে বলবেন, সেই পথ বাতলে দেবে। তবে সাবধান ওরা কিন্তু খতরনাক, মারকুটে।
দোকানির কাছ থেকে সরে মৈনাক চৈতলপাড়া যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
চৈতলপাড়ায় কার কাছে যাবেন? রিকশাওলা জিজ্ঞাসা করতে মৈনাক বলল, গোবিন্দ’র কাছে কয়েকটা জিনিস পাবার কথা ছিল।
ও, টানা মালের গোবিন্দ। রিকশাওলার কথা শুনে মৈনাক বলল, গোবিন্দ তো খুব ফেমাস।
ফেমাস আর কী আমাদের কপালে জোটে বাবু। ও সব বড়লোকদের ব্যাপার। আমরা দাগী হয়ে যাই।
প্রসঙ্গ বদল করে মৈনাক বলল, কতটা দূর হবে?
তা’, ২ কিলোমিটার হবে।
চৈতলপাড়ার কাছে আসতে একটা পচা বোঁটকা গন্ধ নাকের মধ্যে দিয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায় মৈনাকের। সবুজ জলের একটা বড় জলাশয় দেখলে শরীর গুলিয়ে ওঠে। চারদিকে তাকালে মনে হয় একটা বড় জ্যালজ্যালে নোংরা মশারি দিয়ে গোটা অঞ্চলকে ঢেকে রাখা হয়েছে। লোম ওঠা কুকুরের দল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এলাকা দখলে মত্ত। কতগুলো হোৎকা শুয়োর জলাশয়ের ধারে রাখা টিনের পাত্র থেকে খাবার খাচ্ছে শব্দ করে। তাদের মুখ থেকে তরল খাবার গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে জলাশয়ের সবুজ জলে। একটা ঘোড়া টানা গাড়ি একদিক হেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক তার পাশে কাঁধের ওপর একটা দগদগে ঘা নিয়ে শীর্ণকায় ঘোড়া দীর্ঘ সফর শেষে পরম আরামে চোখ বুজে তার ঘাড়ে ঝোলানো ঝোলা থেকে খাবার চিবোচ্ছে।
রিকশা চৈতলপাড়া ঢোকার মুখেই নামিয়ে দিয়েছিল মৈনাককে। মাথা ঝিম করা দুর্গন্ধ সয়ে সাবধানে পা ফেলে সে। ভুল পদক্ষেপে যে কোন সময় রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষ্টা লেগে যেতে পারে জুতোতে।
যতরাজ্যের বাতিল, ফেলে দেওয়া, নোংরা মাখা প্লাস্টিক বোতল, খেলনা, ক্যারিব্যাগ, গাড়ি, হাতল ভাঙা চেয়ার, ফালতু জিনিসের স্তূপ করা পাহাড়ের পেছনেই টালির চালায় মৈনাক দেখা পেল গোবিন্দর।
মৈনাকের সঙ্গে প্রথমে দেখায় কথা না বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণ মনের ভেতর যে কথাগুলো জমিয়ে নিয়ে আসছিল সেটা বলতে না পারা মৈনাককে হতভম্ব করে দিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেঁচিয়ে বলল, মলিনা আমাকে পাঠিয়েছে।
মলিনার নাম শুনে দরজার পাল্লা খুললো গোবিন্দ। বেরিয়ে বলল, মলিনা পাঠিয়েছে। কিন্তু আপনি কে?
সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে গোবিন্দ’র দিকে এগিয়ে মৈনাক বলল, চলে।
হাত দিয়ে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে গোবিন্দ বলল, নরক দর্শন করলেন। চলুন আপনাকে নদীর দিকে নিয়ে যাই। এখানে থাকা আপনার পক্ষে খুব সুখের হবেনা।
ভাঙাচোরা, সরু, সংকীর্ণ, দুটো চালা ঠেকা ঠেকি করা ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মৈনাকের নাকে পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধ এল। গোবিন্দকে অনুসরণ করে বস্তি ছেড়ে বেরিয়ে এল। সামনে সান বাঁধানো একটা ঘাট। ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে একটা সবুজ প্রান্তরের মধ্যে। বোঝা যায় বহুকাল আগে জলের প্রবাহ ছিল। জল ছেড়ে দেওয়া মাটিতে এখন গরু, ছাগল চরছে।
এতক্ষণের দমবন্ধ করা পরিবেশ ছেড়ে এসে বড় করে মুখ খুলে শ্বাস নিল মৈনাক। গোবিন্দর দিকে তাকাতে বলল, আমি জানি আপনি কী জিজ্ঞাসা করবেন। তবে আমি যতদূর জানি দীপ্তেনবাবু একটা বড় চক্করে পড়েছে। সহজে নিস্তার পাবেনা। আপনি বারপুরে ধরনীধর মিত্র, নাম করা মানুষ, ওর সঙ্গে কথা বলে কিছু আভাস পেতে পারেন। আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। অামি দীপ্তেনবাবুর নীচের তলার সঙ্গী ছিলাম। ঝড়ের সংকেতের কথা বলেছিলাম। কানে তুলেছিল কিনা কে জানে! যাক গে, আপনাকে বড় রাস্তা দেখিয়ে দিই। চলুন।
কীসের ঝড়! মৈনাকের জিজ্ঞাসায় গোবিন্দ হেসে বলল, আপনি তো দেখছি অ, আ, ক, খ না জেনেই মাঠে নেমে পড়েছেন।
আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে তো! মৈনাকের কথায় গোবিন্দ বলল, হবে। আপনি দীপ্তেনবাবুর লোক। আপনাকে সাহায্য না-করলে অর্ধম হবে। হ্যাঁ, মলিনা কিন্তু খুব ভালো, পড়ালিখা জানে, এখানে থাকলে কখন কে ছোবল মারতো।
কেন ওর বাবা-মা? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় গোবিন্দ বলল, মা’টাতো গা’য়ে আগুন দিয়েছিল বহুদিন আগে, বাপটা জেলে।
আর কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে চলমান একটা রিকশাকে দাঁড় করিয়ে গোবিন্দ বলল, কোন রকম খবর থাকলে আমি নিজেই পৌঁছে যাবো আপনাকে এখানে আসতে হবে না। এ জায়গা আপনার কাছে সুবিধের নয়।
শহরের পেটের ভেতর সে এ রকম অচেনা জায়গা থাকতে পারে মৈনাকের ধারনায় ছিল না। এখন নীল আকাশের নীচে ঝকঝকে রাস্তায় যেতে যেতে মৈনাকের মনে হ’ল দীপ্তেনের মতো একজন অ্যাভারেজ লোকের পক্ষে সম্ভব নয় কোন জটিল আর্বতে জড়িয়ে পড়া। যদি না কেউ ওকে ঠেলে ঐ ঘুর্ণিপাকের মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু কে?
পাঁচ
দুপুর মাথায় নিয়ে যখন মৈনাক দীপ্তেনের বাড়িতে ফিরলো ওর মাথা জুড়ে যন্ত্রণা। মাথার দু’পাশ দপ দপ করছে। চোখের পাতা ভারী। কোনরকমে ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দিল। এই মাইগ্রেন ওর পরিচিত। এখন ওর কী কী করণীয় ও সেগুলো জানে। কিন্তু এখুনি সেগুলো করার জন্য শরীর সায় দিচ্ছিল না। চোখের পাতা বন্ধ করে ও পড়ে রইল।
আলকাতরার মতো কালো, ঘন, ভারী একটা যন্ত্রণা ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দখল নিয়ে নিল। ক্রমশ চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে দুহাত-পা-ওলা হিংস্র পশুর মতো যন্ত্রণা ঝাঁপিয়ে পড়লো দাঁত-নখ বার করে। মৈনাকের চোখ, মুখ, মাথা জুড়ে দাপাদাপি করতে লাগলো।
ঘরে ঢুকে মলিনা দেখলো বাইরের পোশাক না ছেড়েই বিছানায় শুয়ে আছে মৈনাক। ডাকার সাহস হ’ল না তার। খাবার থালা টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে দরজার পাল্লা দু’টো টেনে ভেজিয়ে দিল বাইরে থেকে। দিনের শেষ আলো ঢুকতে না পেরে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।
একটা বরফের মতো হিমশীতল ছোঁয়া মৈনাক কপালের ওপর স্পর্শ পেল। সেই হিমশীতলতার স্পর্শে কালো, ভারী যন্ত্রণাটা সরে গিয়ে সকালবেলার আলোর মতো নির্মল লাগছিল। মৈনাক আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটোর পাতা খুলল। খুলেই বুঝতে পারলো ঘরটা অন্ধকার। এবং একটা হাত ওর গায়ের থেকে সরে গেল দ্রুত। বিছানা থেকে নেমে ঘরের সুইচ অন করতে আলোয় ভরে গেল মুহূর্তের মধ্যে। দেখলো দীপ্তেনের মা ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু চাউনিটা কেমন। হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝতে চাইছিল হয়তো দীপ্তেনকে। মৈনাক কথা বলার উদ্যোগ নিতেই হাত এবং পা দিয়ে ঘষটে ঘষটে দীপ্তেনের মা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মন্থর ভাবে।
যন্ত্রণাটা একদম নেই। জল খেল অনেকটা। শরীরটা পালকের মতো হালকা লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে উত্তরের জানালার পাল্লাটা দু’হাট করে খুলে দিল। এক ঝলক তাজা বাতাস গায়ে-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘড়ি না দেখলেও বুঝতে পারলো রাত শেষ হবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। একটা দু’টো করে পাখি ডাকছে। রাতের আকাশের রং ফিকে হতে শুরু করেছে। শুকতারাটা এখনও জ্বলজ্বল করছে। উষাকাল অনেক, অনেক দিন পর মৈনাক দেখার মতো সময় পেল। এই মুহূর্তকে অনুভব করতে ঘরের আলো নিভিয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে রইল। একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে প্রকৃতিতে।
আপনি তো মুখে কিছুই তোলেন নি দেখছি, মলিনার কথায় মৈনাক হাসলো নীরবে। কাল রাতে খাবার মতো অবস্থা ছিল না আমার। আর খেলেও বমি হয়ে যেত। আচ্ছা, মাসীমা রাতে ঘুমোয় না?
মৈনাক জিজ্ঞাসা করায় মলিনা বলল, না, চোখের দৃষ্টি কমে আসার পর থেকেই এই উপসর্গ দেখছি। রাতের বেলা না ঘুমিয়ে বাড়ির সব কিছুই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বোধহয়। মাঝখানে তো সিঁড়ির দরজা খোলা পেয়ে নীচের বাগানে হাত দিয়ে গাছগুলোর দেহ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতো রাতের বেলায়। এখন দেখুন গভীর ঘুমে মাসীমা।
তাই দিনের বেলা দেখছি না। ডাক্তার বাবুকে বলেছিলেন? মৈনাকের প্রশ্নের জবাবে মলিনা বলল, দীপ্তেনবাবু থাকতে ডাক্তারবাবু বলেছিল, একটা চোখে গ্লুকোমা। অন্যটাতে অপরেশান করা হয়েছিল। সেটাও ক্ষীণ দৃষ্টি।
আচ্ছা, আপনি জানেন বারপুর এখান থেকে কতটা দূর? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় মলিনা বলল, আপনি কী যাবেন?
ইচ্ছে আছে। ছোট করে বলল মৈনাক।
আপনি কী দীপ্তেনবাবুর খোঁজ পেয়েছেন? মলিনার প্রশ্নের জবাবে মৈনাক বলল, না, না, তবে চেষ্টা করে দেখছি কী এমন হ’ল যে, দীপ্তেন আচমকা অর্ন্তধান হ’ল। দীপ্তেনের মতো সাদামাটা ছেলের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
ছয়
রাধিকা গুপ্তের মুখ গোল। ঘাড় পর্যন্ত চুল। ঠোঁটে চড়া বাদামি রঙের লিপস্টিক। মোমপালিশ করা মুখ। প্লাক করা ভুরু ধনুকের মতো বাঁকা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। কানের নীচের গ্রীবায় ড্রাগনের ট্যাটু। ডান হাতের কবজিতে বড় ডায়ালের ঘড়ি। জাপানী মেয়ের মতো ঠোঁটে হাসি এনে বলল, বলুন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ।
মৈনাক রাধিকা গুপ্তর ব্যক্তিগত কক্ষে বসে ফালি চাঁদের মতো টেবিলের উল্টো দিকের থেকে রাধিকার প্রশ্নে বলল, আমি একজনের খোঁজ পাবার জন্য এসেছি।
রাধিকা গুপ্তের ধনুকের মত বাঁকা ভুরু একটু কুঁচকে গেল। মুখে বিরক্তি এনে বলল, এটা তো ইনভেস্টিগেশন অফিস নয়।
আই নো ইট ভেরি ওয়েল বাট্ দীপ্তেন বসু আজ ছয় মাস বাড়ি ফেরেনি। আপনাদের স্টাফ্ ছিল। মৈনাকের উত্তেজিত স্বরে রাধিকা গুপ্তের কোন ভাবান্তর হল না।
ইটস ভেরি স্যাড বাট্ আমি এরকম তিনশো স্টাফ নিয়ে কাজ করি। অফিসের কাজের বাইরে কে, কী করছে সেটা দেখা আমার কাজ নয়। ইট ইস বেটার টু গো পুলিশ স্টেশন। থ্যাঙ্ক ইউ, রাধিকা গুপ্ত দু হাত করজোর করতে মৈনাকের আর কিছু বলার রইল না। ঠাণ্ডা ঘর থেকে বের হতে বুঝতে পারলো ওর কান দুটো গরম লাগছে।
ওভাল শেপ্ড ফাইবার গ্লাসে মোড়া সুদৃশ্য অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে সামনে চা’য়ের দোকানের চেয়ারে বসলো মৈনাক। হাতের তাস সবটাই বেরিয়ে গেল। ভীষণ আশা নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু কোন লাভ হল না। দীপ্তেনের ব্যাপারে বোধ হয় কিছুই করা যাবে না। এ বোধহয় বুনো হাঁসের পালক খোঁজা।
চা-য়ের দোকানের বয় সামনে দাঁড়াতে মৈনাক চা-টোস্টের অর্ডার দিল। এখন মাঝ দুপুরে চা-য়ের দোকানের টেবিলগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন বসে আছে। বেশ কয়েকটা টেবিল ছাড়িয়ে গাঢ় হলুদ রঙের আলখাল্লা, গলায় চাপানো নানা রঙের পুঁতির মালা, কপালে লাল তিলক টানা লোকটা চা-য়ের দোকানে ঝলমল করছে।
চা-টোস্ট দিতে মৈনাক খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে মনে হল দুরের আলখাল্লা পরা লোকটা ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে। মৈনাক ওর চোখে চোখ রাখতে হলুদ বসন পরা লোকটা হাসলো। মৈনাক আবার ওর খাওয়ায় মন দিল। চা-য়ে চুমুক দিল। শেষ করে একটা সিগারেট ধরালো। ধোঁয়া ছাড়তে দেখলো হলুদ বসন পরা লোকটা একদম ওর উল্টো দিকে এসে বলল, কিছু মনে না করলে কয়েকটা কথা বলবো স্যার।
মজা লাগলো মৈনাকের। এই ধরনের লোকেরা একটু গা’য়ে পড়া হয়। অযাচিত কিছু উপদেশ বিলিয়ে অর্থ দাবী করে। মৈনাক ঘাড় নাড়লো।
লোকটা বলল, আমি ফোরটেলিং করি।
আপনার কেন মনে হল আমি আমার ভবিষ্যৎ জানতে চাইছি!
আপনার চোখ বলছে আপনি গভীর দুশ্চিন্তায় আছেন। লোকটার কথায় মৈনাক বলল, বলুন তো কীসের দুশ্চিন্তা।
অর্থের সুরাহা হওয়ার কোন রাস্তা নেই স্যার। অর্থ আপনার কপালে নেই।
মৈনাক টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোন স্কুলে পড়েছেন।
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, বলার মতো নয়। তবে আপনাকে বলছি আজ প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হবে।
গনগন করছে দুপুরের রোদ। এর মধ্যে বলে কিনা ঝড়-বৃষ্টি হবে। তবে নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে লোকে এক সপ্তাহ আগে জেনে যায়। এ হয়তো সে রকম। মৈনাক কথা না বাড়িয়ে চা-য়ের দোকানের দাম মিটিয়ে বাস টার্মিনাসের দিকে পা চালালো।
আলখাল্লা পরা লোকটা দ্রুত পা চালিয়ে ওর পিছনে এসে বলল, আর একটা কথা স্যার, আপনি দিয়ে কোন লোকের কাছ থেকে সাহায্য পাবেন।
মৈনাক দশটা টাকা লোকটার হাতে দিয়ে বলল, আর কিছু হবে না। এবার অন্য কাউকে ধরুন।
মাথার ওপর তাপ বর্ষণ হচ্ছে। ২টোর বাসটা পেতেই হবে। না হলে গাঙহাটিতে পৌঁছতে দেরী হবে। যখন বেরিয়েছিল, ভেবেছিল কিছু একটা সূত্র পাবে। কিন্তু উলটে কপালে জুটলো কিছু অপমান। দীপ্তেনের ডায়রিতে এই রাধিকা গুপ্ত সম্পর্কে লেখা ছিল। দীপ্তেনের না-থাকা এদের কোনরকম মাথাব্যাথা নেই। হাত ধুয়ে ফেলেছে। মৈনাকের রাগ হল। কিন্তু সেই রাগ বেরোতে না পেরে পা দু’টোকে জোরে জোরে ফেলতে লাগলো।
বাসে উঠে শরীর জুড়ে ঘামের স্রোত নামলো। একটা ক্লান্তি দু’চোখের পাতায় এসে ভর করলো। বাস অল্প সময় পরেই গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করলো। মৈনাকের চোখ বুজে এল।
গাঙহাটিতে যখন নামলো হাত ঘড়িতে তখন সাড়ে চার বেজে গেছে। রোদের এখন সেই প্রখরতা নেই। চারিদিক কেমন থম মেরে আছে। মৈনাক পা চালালো দ্রুত। যখন দীপ্তেনের বাড়ির দরজায় পৌঁছালো তখন আকাশ কাঁপিয়ে বাজের শব্দ আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে বড় ড্রামের গড়িয়ে চলার মতো গুম গুম করে চলে গেল। মৈনাক সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ওপর উঠতে বুঝতে পারলো মত্ত ষাড়ের মতো গোঁ-গোঁ করতে করতে প্রলয় ঝড় শুরু হল। দুমদুম করে শিল পড়তে লাগলো ছাদে। যেন রণমত্ত হিংস্র দুটো পশু মুখোমুখি হয়ে প্রবল বিক্রমে পরস্পরের ওপর সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের মুখ নিঃসৃত জান্তব শব্দ আকাশ, বাতাস বন-জঙ্গল প্রাণ ভয়ে আলোড়ন করতে করতে ওলোট পালোট শুরু করে দিল। ঘন ঘন বজ্র পাতে মনে হল পৃথিবী বোধহয় শেষ লড়াইতে নেমেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা বর্শার ফলকের মতো দরজা-জানালার ওপর পড়তে থাকলো সশব্দে। অন্ধকারের মধ্যে মৈনাক ঘরের মধ্যে বসে ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য শুনতে লাগলো।
সাত
বাস টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে মৈনাক বারপুর যাবার বাসের সময় দেখছিল। প্রথম বাস ছেড়ে গেছে ভোর বেলা। দ্বিতীয় বাস ছাড়তে এখনও একঘন্টা দেরী। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। টার্মিনাসের থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানগুলো পেরিয়ে লোকসমাগম একটু হালকা দেখে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্টের এখনই একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ। বাইরের সকাল দশটার আলো ঝলমলের বদলে কেমন একটা মায়াবি মোহময় হালকা-আলো। বাইরের থেকে পৃথক হওয়ার জন্য এই কৃত্রিমতা একটা সাময়িক ভালোলাগা তৈরি করে। কোণের একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। যতটা ফাঁকা মনে হচ্ছিল ততটা ফাঁকা নয়। তবে কলেজ পড়ুয়াদের সংখ্যাটা চোখে পড়ার মতো। নিছক সময় কাটানো এবং কৌতূহল বশে এখানে ঢুকে পড়া। কোলাহল নেই তবে মৃদু গুঞ্জন বিদেশী মিউজিকের সঙ্গে মিশে আছে। খাবারের তালিকায় চোখ বোলালো মৈনাক। খাবারগুলোর মধ্যে পরিচিত খাবার খুঁজছিল। আচমকা কাঁধে হাত পড়তেই মুখ তুলতে যেটা দেখলো সেটা মৈনাকের কাছে বিস্ময়কর বললে কম বলা হবে। পরিবেশ, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মুখ থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এল, তুই!
মাথায় বিদেশী হ্যাট পরা অত্রি বলল একদমে, তোকে এখানে দেখবো এটা ভাবনার মধ্যে ছিল না। তুই এখানে, নিশ্চয় প্লটের ব্যাপার।
মৃদু হাসি দিয়ে মৈনাক বলল, আর তুই ফিরলি কবে। অত্রি বলল, উত্তর পরে। এতদিন পর যখন দেখা হল চল তোকে একটা অসাধারণ জিনিস দেখাবো।
মৈনাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মধ্যে ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার নিল।
তোকে এখানে দেখতে পাবো একদম ভাবিনি। এতো মিরাকেল। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, তুই দীপ্তেনকে চিনতিস।
দীপ্তেন! অত্রির মধ্যে দ্বিধা দেখে মৈনাক বলল, সেই যে দুর্গবাড়ি, ওয়াচ টাওয়ার।
ওহ! দ্যাট ফানি ডেইজস। হ্যাঁ, হ্যাঁ, টিকে বাবু। মনে পড়েছে। অত্রি’র কথায় মধ্যে খাবার সার্ভ করে গেল।
ওই দীপ্তেনের বাড়িতে আমি এসেছি কিন্তু দীপ্তেন নেই। মৈনাকের কথা শেষ করতে না দিয়ে অত্রি বলল, ও নেই তো কী আছে আমি আছি। চ. আজ তোকে দেখাবো আমি কোথায় থাকি। একে বারে হাওয়া মহল।
খাওয়া শেষ করে দু’জনেই বেরিয়ে এল রেস্টুরেন্ট থেকে। মৈনাককে দাঁড় করিয়ে অত্রি গাড়ির স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে রোদ এখন বেশ চড়া। মোটর বাইকে শব্দ তুলে মৈনাকের কাছে এসে বলল, নে উঠে পড়। ওহ, কতদিন পর দু’জনে একসঙ্গে।
মোটর বাইক গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করলো। ক্রমশ শহর ছাড়িয়ে যেখানে দাঁড় করালো অত্রি সেটা একটা ফ্যাক্টারির সামনে। জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির প্রধান গেটের সামনে অত্রির মোটর বাইকটার স্টার্ট বন্ধ হতে ফ্যাক্টরির প্রধান ফটক খুলে গেল।
কিছুটা অবাক চোখ নিয়ে মৈনাক ঢুকলো অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরির মধ্যেটা দেখে মনে হচ্ছে একটা ঝড় এসে সব কিছু ওলোট পালোট করে দিয়েছে। ভাঙাচোরা, পোড়া জিনিস ছত্রখান হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা চার চাকার গাড়ি ঝলসানো, হেডলাইট দু’টো খুবলে নিয়েছে কেউ। প্রসেসিং ইউনিটের টিনের চাল তোবড়ানো, অ্যাসবেস্টসের একটাও আস্ত নেই।
অত্রি দাঁড়িয়ে থাকা মৈনাককে ধাক্কা দিয়ে বলল, ধ্বংসস্তুপ দেখছিস।
মৈনাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অত্রির দিকে মুখ ফেরাতে অত্রি বলল, ম্যানমেড ডিজাস্টার। জনরোষ ও বলতে পারিস।
কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় অত্রি বলল, সে অনেক ইতিহাস। তোকে বলবো পরে। তবে এটা একটা সময়ের সাক্ষী, এটা থাকবেনা আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। রেজারেকশান। ধ্বংসস্তুূপ থেকে মাথা তুলবে এই জলটুঙ্গির অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি। আমি সেই দায়িত্ব নিয়েই এখানে এসেছি। তোকে তার একটা নমুনা দেখাবো চল।
ফ্যাক্টরির কোম্পাউন্ডের এই অংশটা অনেকটা রানওয়ের মতো। ছোট চাটার্ড প্লেন অনায়াসে নামা-ওঠা করতে পারে। কথাটা অত্রিকে বলতে, অত্রি বলল, আগে তো এইটা রানওয়ে ছিল। তারপর রানওয়েটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফ্যাক্টরি তৈরি হয়।
তুই এত কথা জানলি কী করে? মৈনাক বলাতে অত্রি বলল, ফিল্ড ওয়ার্ক করে তবে এখানে এসেছি। বিগত দশবছর এখানে কী হয়েছিল তা সব কিছু আমার নখদর্পনে, চাইলে এক্ষুনি বলতে পারি। কিন্তু তুই বোরড হবি। তার চেয়ে তোকে যেটা দেখাতে এনেছি সেটা দেখে তোর দারুন লাগবে।
অত্রির কথা শুনে মৈনাক বলল, আমার বোরিং লাগবে না। তুই বলতে পারিস।
আমার লাগবে বস ঐ মৃতদের কথা বলতে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, এখানে মৃতদের কথা আসছে কোথায়!
ইতিহাস তো মৃতদেরই হয়। যাক এটা নিয়ে কথা পরে হবে। আপাতত তোলা থাক। তোকে ঐ লিফটে চড়িয়ে একদম আকাশের কাছে নিয়ে যাব। চাইলে পেয়েও যেতে পারিস আকাশের চাবি।
বড় বড় কনস্ট্রাকশনে হাইরাইজ ওঠার জন্য শ্রমিক-মজুরেরা সেরকম খোলা লোহার খাঁচা ব্যবহার করে। এটাও সেরকম লিফট, আস্তে আস্তে নেমে আসছিল মাটির দিকে।
দুজনে ঐ লোহার খাঁচায় উঠতে ওটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। মৈনাক দেখলো মাটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সরতে সরতে ক্রমশ চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। মাটির ওপর জিনিসগুলো এত ছোট হয়ে যাচ্ছে যেন লিলিপুটের আকার নিতে নিতে ক্রমশ বিন্দু বিন্দু হয়ে গেল। সবটা কেবল যেন অলীক বস্তু হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেও যেগুলো একটা আকৃতি নিয়ে নিজেদের জাহির করছিল। এখন সেগুলো এত ক্ষুদ্র যেন মনে হয় তুচ্ছ, নগন্য। এখন ভূমির ওপর থাকা সবই অলীক। লিফট শেষ পর্যন্ত যখন থামলো তখন মনে হল লোহার ট্যাঙ্কের ছাদের ওপর। প্রথম অভিজ্ঞতায় মৈনাকের কাছে একটা অ্যাডভেঞ্চার। ওর শরীর জুড়ে একটা রোমাঞ্চ সেতারের তারগুলোর মতো রিন রিন করে সুর তুলছিল। ওর মনে হ’ল ও দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী থেকে দূরে এক বিশালাকার লোহার স্টেডিয়ামের মধ্যে। স্টেডিয়ামের ঘাসের বদলে এখানে রয়েছে লোহার পাত। অনেক দূরে একটা ব্রীজ আকাশে আলপনার মতো আবছা একটা রেখা। বাকী শহর-গ্রাম, সবুজ-গাছ পালা সব নীচে বৃত্তকারে সাজানো রয়েছে। হাওয়া বইছে জোরে।
কী বলেছিলাম না হাওয়া মহল। এবার বিশ্বাস হচ্ছে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, সত্যিই অসাধারণ। ইউনিক, এত উঁচুতে আমি উঠিনি কোন দিন। কিন্তু এটা তো একটা বিশাল জলাধার।
২১৫টা লোহার স্তম্ভের ওপর ৮৫০০ টন এই লোহার কাঠামোর এখন মেরামতির সঙ্গে মজবুত করার কাজ চলছে। একসঙ্গে জলাধার থেকে পানীয় জল আর সেচ দুটোই হবে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, জল কোথায় জলটুঙ্গি তো এখন শুকনো নদী খাত।
মুচকি হেসে অত্রি বলল, জল আছে বলেই ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করছে সরকার আর আমার কোম্পানী। ড্রিঙ্কিং ওয়াটারটা আমাদের আর সেচ সরকারের। মৌ স্বাক্ষর হয়ে গেছে।
কিন্তু গতবারের জনরোষ যদি আবার আছড়ে পড়ে। মৈনাকের কথায় অত্রি বলল, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু এবার ট্র্যাজিক এন্ড হবে না। গতবার মূল কালপ্রিট্ ছিল বিদেশী বীজ কোম্পানী। যাদের জন্য এই তল্লাট জলশূন্য হয়ে গেছে। কোথাও ডাস্ট অব্ বোল। শুধু ধুলো। কিন্তু ওরা সেটা মানতে চায়নি। ওদের উচ্চ ফলনশীল বীজ প্রচুর জল খায়। আর ওদের সঙ্গে গ্রামের চাষীরা ছিল।
অত্রির কথা শেষ হতে মৈনাক বলল, কিন্তু তোদের ওপর আক্রমন হ’ল কেন? তোরা তো চাষ করিস না কিংবা ঐ বিদেশী কোম্পানীর প্রতিযোগী নস।
খোলা চোখে দেখলে সেটা মনে হতেই পারে। কিন্তু এই জলঢুঙ্গির জল ধারণ ক্ষমতা কমছিল কিন্তু বীজ কোম্পানী এই বেসিন এরিয়ায় শস্য চাষের জমি বাড়িয়ে যাচ্ছে। চাষীদেরও হাতে পৌঁছে যাচ্ছিল টাকার থলি। কে আর লাভের কড়ি গোনার সময় খেয়াল রাখে টাকার রং কি? কীসের বিনিময়ে এল এই অর্থ। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, তোদের জল নেওয়াটা ওদের সহ্য হ’ল না।
ঠিক তাই। ১৯৬০ সালে জলটুঙ্গি যেখানে ৫৫ বিলিয়ন ঘন মিটার জলের যোগান দিত, ২০০০ সালে সেই জলের যোগান ৫ বিলিয়নে। এখন সেটা ১-য়ের নীচে। যারা লাভের কড়ি গুনছিল তাদের শিরে সংক্রান্তি। আর এই লাভ না পাওয়া লোকগুলোকে মারমুখী করে ঘুরিয়ে দেওয়া হ’ল জলঢুঙ্গির অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি’র দিকে।
হুঁ বুঝলাম। মৈনাক বলল, কিন্তু তারপরে তোর কোম্পানী ১৫০০ কোটি টাকা ঢেলে প্রকল্প গড়ছে কেন সেটা মালুম হ’ল না।
মৈনাকের কথা শেষ হতে অত্রি হো, হো করে থাকলো। হাসি থামিয়ে বলল, সোলারিস ফিল্ম দেখেছিস তুই।
মৈনাক বলল, আন্দ্রেই তারকোভক্সি। রাশিয়ান ছবি।
ব্যাস, তা হলে তোকে আর ডিটেলস বলতে হবে না। সেই কৃত্রিম স্পেস বা স্টেশনে যখন নায়ক গেল, দেখল তার মৃত স্ত্রী রয়েছে। তার ছেড়ে যাওয়া স্ত্রী’কে পেয়ে .... অত্রিকে থামিয়ে মৈনাক বলল, তুই সিরিয়াস বিষয় থেকে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাইছিস কেন?
অত্রি বলল কিছুক্ষণ আগেও এই হাওয়া মহলকে দেখে তুই কেমন বিহ্বল হয়ে গেছিলিস। আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে বললি এ-তো পৃথিবীর বাইরে রয়েছি। সেই সমস্ত ভুলে গিয়ে নীচের তলার যাবতীয় কথা, প্রসঙ্গ এনে দেখার আনন্দটায় একদম জল ঢেলে দিলি।
না, না, সত্যিই ইউনিক অত্রি। রিয়েলি অনেক দিন স্মৃতিতে থাকবে। তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মৈনাক থামতে অত্রি বলল, চাইলে আবার আসবো। এখন চল ধরাধামে যাই।
আট
দরজায় ধাক্কা দিতে মৈনাকের ঘুম ভেঙে গেল। চোখের পাতা খুলতে বুঝতে পারলো সকাল এখন ক্রমশ দিনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে মলিনা বলল, এই নিয়ে দু’বার ডাকলাম। গোবিন্দদা এসেছে, সঙ্গে এনেছে আর একজন কে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
মৈনাক বলল, কোথায় ওরা?
নীচে দাঁড়িয়ে আছে। মলিনা বলতে মৈনাক বলল, যাও, এই ঘরে নিয়ে এসো। আর ওদের জন্য চা-আন।
গোবিন্দর পেছনে পেছন কালো রঙের, লম্বা, সাদা কাঁধ থেকে হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া ক্লোক পরা মানুষকে দেখে মৈনাক হাত জোড় করে নমস্কার করতে অচেনা মানুষ হাসলো। গোবিন্দ চেয়ার টেনে বসতে বলে, মৈনাককে বলল, ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস। আপনাকে কিছু বলতে চায়।
মৈনাক অবাক হয়ে গোবিন্দ’র দিকে তাকাতে বলল, উনি দীপ্তেনবাবু সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। কিন্তু আমাকে ঠিক বিশ্বাস করে বলতে অসুবিধে আছে। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম। ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের চোখে-মুখে-চেহারার মধ্যে এক ধরনের শান্ত, গাম্ভীর্য রয়েছে। সেই গাম্ভীর্য ভেঙে বলল, গোবিন্দ আমাকে বলেছে আপনার কথা। আমি আপনাকে বিশেষ কিছু গোপনীয় কথা বলতে চাই। এটা না বলতে পারলে আমার অধর্ম হবে। আর তাছাড়া, আমার কাছে কিছু জিনিস আছে সেগুলি আপনার হাতে তুলে দিতে পারলে শান্তি। আমি অনেকদিন ধরে এগুলি নিজের কাছে রেখেছি। এবার উপযুক্ত মানুষের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি দায়মুক্ত হব।
হ্যাঁ, আপনার গোপন কথা বলুন। মৈনাক বলতে গোবিন্দ উঠে ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
দেখুন বিষয়টা আমি পাঁচকান করতে চাইনা। দীপ্তেনবাবু আপনার বন্ধু তো প্রথমে আপনিই জানুন। মালোপাড়া চার্চের যে ছোট সিমেট্রি আছে। মাস ছয় আগে গভীর রাতে একজনকে কবরস্থ করা হয়। খ্রীস্টান আচার মেনেই। অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ। নাম ম্যাথুজ উইলিয়াম। এবং সেই মৃতের কিছু জিনিসপত্র আমার কাছে রেখে দেওয়া হয়। পরে আমি জানতে পারি কবরে যে মানুষটিকে শোয়নো হয়েছিল সে ম্যাথুজ নয়।
ম্যাথুজ নয় কেন আপনার মনে হল? মৈনাকের জিজ্ঞাসার মধ্যেই গোবিন্দ চা ও কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলো। খুব দ্রুত হাতে সেগুলো রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চা-য়ের কাপে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস বলল, ম্যাথুজ ইঞ্জিনের ড্রাইভার। ড্রাঙ্কড্। মাথার সামনে টাক। গাল পর্যন্ত চওড়া জুলপি। জিন্স আর কলারতোলা গেঞ্জি পরতো। এই পোশাক পরতোই না। বলে, জোব্বার পকেট থেকে ট্রাউজার-শার্ট বের করে মৈনাকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
মৈনাক হাত বাড়িয়ে নিল। এগুলো, বলে অবাক নয়নে তাকালো।
কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস পুনরায় বলল, ট্রাউজারের ভেতর দিকে দেখুন দর্জিঘর স্টিকার পাবেন। আর একটা কথা এখন আমি নিশ্চিত ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ নয়, মার্ডার।
কিন্তু এতদিন অাপনি মুখ বুজে ছিলেন। আর এটা যে হারিয়ে যাওয়া দীপ্তেনের এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে। মৈনাকের দ্বিধা জড়িত প্রশ্নে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস বলল, আমি মালোপাড়া চার্চের ফাদার। আমার জানার অনেকগুলো জায়গা আছে। আর একটা কথা, আপনার যদি মনে হয় তবে ঐ সিমেট্রিতে আসলে আপনাকে আমি দেখিয়ে দেবো। হ্যাঁ, আমার এই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ গোপনীয়। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি তো।
দীর্ঘ কথায় শেষে ফাদারের ইচ্ছায় মাথা নাড়ালো। প্রতি নমস্কার জানালো মৈনাক। এবং ফাদারের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া দেখলো। গোবিন্দ ফাদারকে নিয়ে নীচে নামছে। মলিনা ঘরে ঢুকলো। চা-য়ের কাপ, থালা নিয়ে যাবার সময় মৈনাকের নিশ্চল অবস্থা দেখলো। মলিনা ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর খেয়াল হ’ল মৈনাকের ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস যে জামা-প্যান্ট দিয়ে গেছে সেগুলো একবার মলিনাকে দেখালে হয়।
মৈনাক ডাকলো মলিনাকে। মৈনাক জামাটা দেখাতে মলিনা জামাটা হাতে নিল তারপর বলল, এটা আপনি পেলেন কোথায়?
মৈনাক বলল, দর্জি ঘরে গিয়েছিলাম দীপ্তেনের খোঁজ করতে ওরা এটা দিয়েছে।
মলিনা মাথা নেড়ে বলল, না, না, এটা তো দীপ্তেনবাবু পরে বেরিয়েছিল। এটা দর্জি ঘরে থাকবে কী করে।
মৈনাকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল কথাটা কিন্তু সংবরণ করলো নিজেকে। কী হবে। তার চেয়ে বরং যে রকম চলছিল সেরকম চলুক। দীপ্তেনের না থাকা এ বাড়িতে সয়ে গেছে। নতুন করে আর ইন্ধন জুগিয়ে লাভ নেই। কিন্তু চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারলো না। না’কি জানা ছিল না বেরোনোর রাস্তা। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মৈনাক বলল, তুমি যাও।
মৈনাকের কথা শুনে মলিনা চলে গেল। দেওয়ালে দীপ্তেনের টাঙানো ফটোর দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। গাল পর্যন্ত টানা জুলপি, টিকালো নাক, চোখের মনি দু’টো বিড়ালের মতো কটা, মাথার সামনে অল্প চুল, ম্যাথুজ উইলিয়াম!
নয়
বারপুরে এসে ধরনীধর মিত্র বলতে ঘুরতে হ’ল মৈনাককে। সাজানো গোছানো ছোট মফঃস্বল শহর এখনও পর্যন্ত মহানগরের আদব কায়দা রপ্ত করে উঠতে পারিনি। মহানগরগুলোতে ব্যক্তি যতই জনপ্রিয় হোকনা কেন। আসলে সে একটা সংখ্যা। তাঁর বাড়ির নম্বর ও রাস্তার নামের মধ্যেই তার পরিচয়। মফঃস্বলগুলোতে এখনও ব্যাক্তি সংখ্যার ভিড়ে হারিয়ে যায়নি। প্রথমে রিকশাওলা যে ধরনীধরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তিনি ডাক্তারবাবু। তিনি মৈনাকের কাছ থেকে শুনে বলল, হ্যাঁ সার্ভেয়ার ধরনীধর মিত্র। তারপর রিকশাওয়ালাকে বলল, তুমি সুভাষ এভিনিউ-য়ে নিয়ে যাও। ওখানেই পেয়ে যাবে।
ডাক্তার বাবুর নির্দেশ মত রিকশাওলা রিকশা ঘুরিয়ে সুভাষ এভিনিউ-য়ের দিকে যাওয়ার জন্য প্যাডেলে চাপ দিল। রাস্তার দু-ধারে গাছের সারি। এখনও কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল রয়েছে। শিমুল গাছগুলোতে ফুলের বান ডেকেছে। রোদ চড়া হচ্ছে। রিকশাওলা ধরনীধর মিত্র’র বাড়ির সামনে মৈনাককে নামিয়ে দাম নিয়ে রাস্তার বাঁকে হারিয়ে গেল। এখন অনেক দূর পর্যন্ত গাছে ঢাকা চওড়া রাস্তা লোকজনহীন। রাস্তা থেকে সরে এসে কলিং বেলে আঙ্গুল ছোঁয়ালো মৈনাক। বাইরের শ্বেতপাথরের নেমপ্লেটে ধরনীধর মিত্র। গর্ভনমেন্ট সার্ভেয়র।
ঘরের দরজা খুলে বারান্দার ছোট, গ্রীলের দরজা খুলে মাথাভর্তি সাদা চুল, সুঠাম চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক মৈনাকের সামনে এসে দাঁড়াতে মৈনাক দু’হাত জড়ো করে বলল, আমি গাঙহাটি থেকে আসছি। দীপ্তেন আমার বন্ধু। ওর ব্যাপারে কিছু খোঁজ-খবরের জন্য এসেছি।
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি ভেতরে আসুন। ধরনীধরের কথায় মৈনাক বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বসার ঘরে ঢুকে বলল, চা খান তো?
মৈনাক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে ধরনীধর বাবু বসার ঘরের জানালার দিকে গিয়ে ফ্লাক্স এনে দু’টো কাপে চা ঢেলে একটা মৈনাকের দিকে এগিয়ে দিয়ে সোফায় আরাম করে বসলেন।
মৈনাকও উল্টো দিকের সোফায় বসে বলল, আমার বন্ধু দীপ্তেন বীজ কোম্পানীর হয়ে....।
মৈনাককে কথার মাঝে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ধরনীধর মিত্র বলল, এখন সে কোথায়?
মৈনাক বলল, আমি ঠিক বলতে পারবো না।
আমার কাছে এসেছিল বহুদিন আগে। খুব জরুরী কিছু প্রশ্ন নিয়ে। ওই গ্রামগুলোতে কোম্পানীর হয়ে কাজ করতে গিয়ে ও লক্ষ্য করেছিল। যেগুলো আমার জানা ছিল না। ওর এই পয়েন্টগুলো গ্রাউন্ড লেভেলের অভিজ্ঞতা বিশেষত জলস্তর, পরিবেশ নিয়ে, আর কৃষিজমিতে পূর্বের মতো ফসল হচ্ছে না, ক্রমশ বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অ্যাফেক্টজোন হ’ল জেলেপাড়া। যারা জলঢুঙ্গিতে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করতো তারা দেখলো মাছ তো হচ্ছে না।
এসবের জন্য কী ক্ষোভ জমেছিল। যা একদিন আছড়ে পড়েছিল জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরির ওপর। মৈনাকের মুখ থেকে একথা শুনে ধরনীধর মিত্র বলল, একটা আই ওয়াশ করার চেষ্টা।
কিন্তু দীপ্তেনের এখানে ভূমিকা কী? মৈনাকের কথায় ধরনীধর বাবু বলল, দীপ্তেনরা স্কেপগোট হয় চিরকাল। কারণ ওরা ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধটা করে।
আপনার কাছে দীপ্তেন এসেছিল কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ধরনীধর বলল, একটা সার্ভে করার জন্য ওকে ডেকেছিলাম। যোগ দেবে বলেছিল পরে ও পিছিয়ে যায়। হয়তো বুঝতে পেরেই পিছিয়ে যায়। ওর কাজের বিপক্ষে ছিল আমাদের সমীক্ষা।
আর আপনাদের সার্ভে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ধরনীধর বলল, আমরা একটা নদীর মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে আর একটা বিস্ময়কর জিনিস আবিস্কার করেছি। তবে রিটায়ার্ড জিওলজিস্ট রঞ্জন দে’র জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে, ও মাটির চরিত্র বোঝে। সেই আবিস্কার যদি বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে আবার মরা গাঙে জোয়ার আসবে।
ধরনীধরের গলা কথার শেষের দিকে আবেগে থর থর করে কাঁপছিল।
বলেন কি! জলটুঙ্গি আবার জলে ভরে যাবে? মৈনাকের প্রশ্নে ধরনীধর বাবু বললেন, তা হয়ত হবে না। তবে এই নদী খাতটা পাইপ লাইনের কাজে ব্যবহার হবে। নদীর দু’ধারে সে ক্ষেতগুলো দাবানলের পরের চেহারা নিয়েছে সেটা আবার শস্য শ্যামলা হয়ে উঠবে।
এ’তো আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, না ম্যানড্রেকের সম্মোহন। মৈনাকের কথা ধরে ধরনীধরবাবু বলে ফেললেন, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। তারপর সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ বদল করে বলল, আজ অনেক বেলা হ’ল।
মৈনাক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে এল ধরনীধর মিত্রের বাড়ি থেকে। গাছের ছায়া ঢাকা, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট ধরালো। আচমকা অত্রির কথার সঙ্গে ধরনীধর বাবুর কথার মধ্যে কোথায় একটা সংযোগ রয়েছে বলে মনে হল তার। অত্রির সঙ্গে একবার এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে হ’ল কিন্তু স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল বলে যদি এড়িয়ে যায়। যা হয় হবে, একবার নিজের কৌতূহল মেটাবার জন্য মোবাইল বের করে অত্রির নম্বরে ফোন করলো। রিং হচ্ছে মোবাইলের অন্য প্রান্তে।
হ্যাঁ, বলছি। অত্রির সাড়া দেবার পর মৈনাক বলল, তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তোর সময় আছে?
তোর জন্য সময় আছে। এই সন্ধের দিকে হলে ভালো হয়। চলে আয় সেই বাস টার্মিনাসের রেস্টুরেন্টে। পানাহার আর কথা দুই-ই চলবে। ও প্রান্তে হাসির শব্দ শোনার পর মৈনাক বলল, তা’হলে ছ’টা নাগাদ তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
দশ
হাতে একটু সময় নিয়ে মৈনাক বাস টার্মিনাসের কাছে রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকলো। আজ লক্ষ্য করলো, রেস্টুরেন্টের নাম জ্বলজ্বল করছে বৈদ্যুতিন আলোয়, ‘পারিজাত-ইন’। রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে একদম কোণের দিকের নিরিবিলি টেবিলটার কাছে গিয়ে বসলো। এখান থেকে মোহময়, মায়াবি আলোর ছায়াময় অস্তিত্বের মধ্যে কাচের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলে বোঝা যায়। মৃদু লয়ে বিদেশী মিউজিক বাজছে। সাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়ালে সমুদ্রের ঢেউ তট রেখায় আছড়ে পড়লে যেমন সুরের ঐকতান তৈরি হয়। এই পারিজাত ইনে’র মধ্যে বসে মৈনাক অনুভব করলো জলোচ্ছাসের সেই সিমফনি।
কাঁধে হাতের ছোঁয়া পড়তে মৈনাক দেখলো অত্রি বসেছে ঠিক টেবিলের উল্টো দিকে।
কিউ মুঝে বুলায়া? অত্রির কথায় মৈনাক বলল, আজ দুপুরের দিকে বারপুরে ধরনীধর মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।
দ্যাট ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী, এনারজেটিক। কেন? অত্রি জিজ্ঞাসা করতে মৈনাক বলল দীপ্তেনের ডায়রিতে ওর নাম ছিল।
তুই দীপ্তেনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস, তাই না, অত্রির কথায় মৈনাক বলল, হুঁ। যাকগে, ধরনীধরবাবুকে তোর চেনা কী এখানে কর্মসূত্রে।
হ্যাঁ, শুধু উনি নন। ওনার দলের সবাইকে আমি চিনি। অত্রির জবাবে মৈনাক বলল, আজ কথায় কথায় ধরনীধর বাবু বলছিলেন এক আবিস্কার, ডিসকভারির কথা।
কথার মাঝখানে ওয়েটার বিয়ারের ছোট দু’টো ক্যান আর এক প্লেট ফিসফিঙ্গার দিয়ে গেল। মুচকি হেসে অত্রি বিয়ারের ক্যানের সিল ভেঙে মুখে ঢেলে বলল, গরমের মোস্টপ্রিভেন্টিভ মেসারড।
বলছিস, মৈনাক বলল।
শুধু বলছিনা, টেস্ট নিতে বলছি। আর হ্যাঁ, দ্যাট ওল্ড ম্যান আর কি কি বলল তোকে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, ওর এই আবিস্কার যদি সত্যি হয় তাহলে ভোল পাল্টে যাবে জলটুঙ্গির। ওহ, তাহলে তো সবটাই বলে দিয়েছে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, না, আমি আবিস্কারের কথা শুনতে চাই না। এই ভোল পাল্টাবে কী ভাবে সেটাই তোর কাছ থেকে শুনতে চাইছি। শোনাটা তোর খুব জরুরী। অত্রির এই কথায় মৈনাক কিছু না বলে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিল।
শোন তাহলে। মালোপাড়া খ্রীষ্টানদের চার্চের আরও উত্তরে গ্রামগুলো ছাড়িয়ে বন-জঙ্গলের মধ্যে যে টিলা আছে। ঐ টিলার পাঁচশো মিটার নীচে এক জলের ভাণ্ডার অাছে। এই জল ভাণ্ডারের জন্ম হয়েছিল গত তুষার যুগে। বিশাল শিলীভূত জল ভাণ্ডার ঠিক মতো যদি ব্যবহার করা যায় তবে এই অফুরন্ত জল আগামী এক হাজার বছর ধরে চলবে। পাইপ লাইনের মধ্যে দিয়ে এই জলকে দূরদূরান্তে পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করার জন্যই জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরিতে আমাদের আগমন। অত্রির মুখের থেকে এই কথা রূপকথার গল্পের মতো বেরিয়ে আসছিল।
দীর্ঘক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে মৈনাক বলল, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য!
অত্রি বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিয়ে বলল, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া তো পূর্বে মরুভূমির মতো ছিল। স্যান জোয়াকিন ভ্যালি এই রকম জলের প্রাপ্তি জোরে দুনিয়ায় খাদ্য আর তুলো উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
সত্যি ধরনীধরবাবু তো দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী, মৈনাকের কথায় অত্রি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
‘পারিজাত ইন’ এখন জমজমাট। সমস্ত টেবিলগুলো ভরে গেছে, রসিক মানুষের ভিড়ে। এক জন জোকারের মতো সেজে ম্যাজিক দেখাচ্ছে।
আর এক রাউন্ড হয়ে যাক অত্রি মৈনাকের দিকে চেয়ে বলল। মৈনাক উঠে পড়লো টেবিল ছেড়ে। আরে বাবা, বোস না। অত্রির জেদাজেদিতে বসে পড়লো। বিদেশী মিউজিকের রেশ আছড়ে পড়ছিল। মৈনাকের মনে হল একটা জাহাজের ডেকের ওপর সবাই রয়েছে। পারিজাত ইন ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে।
এগারো
গোবিন্দ এসে পড়েছিল সময়ের একটু আগেই। মৈনাক নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিচ্ছিল। এসে অবধি দীপ্তেনের মা’র সঙ্গে কথা হয়নি। আজ মলিনাকে ডেকে দীপ্তেনের মা’র ঘরে ঢুকলো কিন্তু দেখলো মাসীমা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কী ভেবে মৈনাক বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত মাসীমা’র হাতের সঙ্গে নিজের হাত স্পর্শ করলো। তারপর মলিনা’র দিকে ফিরে বলল, আজ ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।
গোবিন্দ ঘরের বাইরে থেকে বলল মৈনাকের উদ্দেশে, এখনও রওনা না হলে সাড়ে-নটা’র বাসটা বেরিয়ে যাবে। মালোপাড়ায় যেতে কিন্তু দু-আড়াই ঘন্টা লাগবে।
মৈনাক আর দেরী না-করে গোবিন্দকে সঙ্গে করে বেরিয়ে এল রাস্তায়।
বাস ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর থামতে গোবিন্দ ও মৈনাক নেমে পড়ল। বাস ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর দিয়ে যাবে না। পূর্ব দিকে যাবে। ন্যাশনাল হাইওয়ে উত্তরের থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। এবার ওদের উত্তর দিকে যেতে হবে। অন্তত দুই কিলোমিটার যেতে হবে এখনও। ভ্যান রিকশা ছাড়া গতি নেই। অগত্যা গোবিন্দ-মৈনাক তাতে চেপে বসলো। জাতীয় রাজপথের ওপর দিয়ে হা-হা করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে মালবাহী ট্রাক, দুরপাল্লার বাস, ম্যাটাডোর চলে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। দু-পাশে ক্ষেত জমি বুক চিতিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। দু-পাশের বিস্তীর্ণ জমি রুক্ষ। কোন মানুষ জন কিংবা পশু নেই। শুধু আকাশের অনেক উঁচুতে চিল তার ডানা ছড়িয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভ্যান রিকশা হাইওয়ের পাশে লোকজনের পায়ে চলা পথ ধরে বাঁ-দিকের খোয়া ওঠা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় নেমে এল নাচতে নাচতে।
এ ভাবে কতদূর আর যেতে হবে? মৈনাকের প্রশ্নে ভ্যানচালক বলল, তা হাফ কিলোমিটার হবে। মালোপাড়ার পেছন দিকে বিলের কাছে আপনাদের নামিয়ে দেবো। ওখানে থেকেই চার্চের চূড়া দেখতে পাবেন। বাকী পথটুকু আপনাদের হেঁটে যেতে হবে। ঘুর পথে গেলে আরও সময় লাগতো। হাঁটতে হত না একদম চার্চের মুখে পৌঁছে যেতেন। কিন্তু আপনারা তাড়া লাগালেন। তাই...।
ভ্যান চালক কে কথা শেষ করতে না দিয়েই মৈনাক বলল, মোক্তার বিল কেন?
আরে এই মোক্তার-ই এখানে প্রথম চার্চ তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। স্কুল করে। সেই থেকে মালোপাড়ার সবাই খেস্টান হয়ে গেল। সে বহুকাল আগের কথা। আশপাশের গাঁ-গঞ্জের মানুষজনের মধ্যে তখন না’কি খেস্টান হওয়ার ঢল নেমেছিল। এখন এসব নেই তবে মাঝে মধ্যে সাহেব-মেমরা আসে।
তুমি এতসব জানলে কী করে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ভ্যানচালক বলল, আমিও খেস্টান। সদা প্রভুর অনুগামী।
কালো আবলুস কাঠের মতো দেহের কাঠামোয় বয়েসের ভার নেমেছে ভ্যানচালকের। ফতুয়ার মতো জামার আড়ালে থাকা গলায় ঝোলা চেনের ক্রশকে বাইরে এনে একবার ঠোঁট ছোঁয়ালো ভ্যানরিকশা থামিয়ে। তারপর আঙ্গুল তুলে বলল, ঐ যে শরবনের ভেতর দিকে তাকান।
ভ্যান চালকের আঙ্গুল তোলার দিকে চোখ রাখতে মৈনাক দেখলো শরবনের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে চার্চ।
দাম মেটানোর সময় মৈনাক দেখলো ঘামে ভিজে গেছে ওর পরনের ফতুয়া। দাম নিয়ে সৌজন্য বশত হাসলো। তারপর ভ্যানরিকশা নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে গেল।
চুপ থাকা গোবিন্দ বলল, এ রাস্তা অামার চেনা। আসুন। মৈনাক গোবিন্দর পিছন পিছন চলতে লাগলো। রাস্তার দু’ধারে ঘন শরবন মাথা উঁচু করে চলার পথটুকু একদম ঢেকে দিয়েছে। নীচু জমিতে জল জমে আছে। কোথাও বকের দল মানুষের সাড়া পেয়ে ঝাঁক বেধে পাখা মেলে শরবনের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। দূরের গীর্জা ক্রমশ চোখের সামনে স্পষ্ট হতে লাগলো। কিছুটা এগিয়ে গোবিন্দ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, যাহ! গেল কোথায়?
পেছনে আসা মৈনাক গোবিন্দ’র থেকে যাওয়ায়, বলল, কী’হল?
রাস্তাটা নেই। মোক্তার বিলের জলে হারিয়ে গেছে। গোবিন্দর কথা শুনে মৈনাক অবাক হ’ল। আর চল্লিশ ফুটের যত দূরে গীর্জা। এটা বোধহয় গীর্জার পেছনদিক। হাওয়ায় শরবনে ঢেউ উঠেছে।
জল বেশি হবে না। গোবিন্দর দেখা দেখি মৈনাক হাঁটু পর্যন্ত প্যান্টের ফোল্ড গুটিয়ে নিল। জুতো হাতে নিয়ে জলাভূমিতে নেমে পড়লো। গোবিন্দর পিছনে পা ফেলল। জল হাঁটুর কিছুটা আগে পর্যন্ত উঠে স্থির হয়ে রয়েছে। পা ফেলার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হচ্ছে। অবশেষে উঁচু ভূমিতে উঠে মৈনাকের চোখ স্থির হয়ে গেল গীর্জার দেওয়ালে আঁকা চিত্রে। কাঁটার মুকুট পরা যীশুখ্রীষ্টের রক্তের ধারা নেমেছে মুখ বেয়ে। পৃথিবীর যাবতীয় যন্ত্রণা সহ্য করেও চোখ দু’টোয় ফুটে উঠেছে প্রেম, ভালোবাসা।
প্যান্টের ফোল্ড আবার পায়ের পাতা পর্যন্ত নামিয়ে গোবিন্দ বলল, এবার চলুন ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের খোঁজ করি।
মূল চার্চ খুব বড় নয়। চার্চের সামনে অনেকটা প্রান্তর। চার্চের সংলগ্ন সমাধি ক্ষেত্রের প্রবেশ পথের মুখটাতে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখা হতে মৈনাক কে ডেকে নিয়ে গেল নিজস্ব ঘরে। এখানে যে অাসবেন সেটা অামি জানতাম। এখানে এত মানুষ শুয়ে অাছে তাদের কেউ না কেউ বছরের কোন সময় অাসে। ফুল দেয়, ক্যান্ডেল জ্বালায়। কৃষ্ণ কিশোর কথা শেষ করে মৈনাকের দিকে ইঙ্গিত করলো ওকে অনুসরণ করতে।
মৈনাক কৃষ্ণকিশোর কে অনুসরণ করলো। পায়ে পায়ে কবর খানায় ঢুকলো। পেছন পেছন গোবিন্দ। গাছে গাছে সমাধিক্ষেত্র ছায়ায় ঢাকা এক শান্ত, নীরব। যেন ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়। মাটির নীচে চির ঘুমে থাকা মানুষগুলো কোন কোলাহল পছন্দ করেনা। শুধু গাছের পাতার ছাতার আড়াল থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে টিউই স্বরে, টিউই স্বরে।
নীরবতা ভেঙে কৃষ্ণকিশোর বলল, আশপাশের পাঁচ ছয় গ্রাম, মফস্বলের এটাই একমাত্র কবরখানা। বড়দিনে মেলা বসে। লোকজন আসে, প্রার্থনা হয়, প্রভু যীশুর জীবন বাণী নিয়ে প্রদর্শনী হয়। ঐ যে দেখুন ঐ সমাধি ফলকটা মোক্তার সাহেবের।
কৃষ্ণকিশোরের হাতের ইঙ্গিতে মৈনাক দেখলো চার কোণা পিরামিড অাকৃতির সিমেন্টের স্মৃতি ফলক। কয়েক পা এগিয়ে স্মৃতি ফলকে লেখা পড়লো, No more noisy I loud word from me. Such is my master's will.
হাঁটা পথের দু’ধারে ছোট ছোট সমাধিফলক মাটিতে গাঁথা। এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা ছাতিম গাছের নীচে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। কবরখানার গাছগুলো হাওয়ায় দুলে উঠলো। মুখে কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে ছাতিমগাছের নীচের দিকটাতে দেখালো।
মৈনাক বসে পড়ল ঘাসে ঢাকা শুকনো পাতার ওপর। তারপর হাত দিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করলো। গোবিন্দ এগিয়ে গেল আরও কয়েক পা। সেখানে নাম-না-জানা বুনো সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। সেই সাদা ফুল তুলে এনে মৈনাকের পরিষ্কার করা জায়গাটাতে ছড়িয়ে দিল। এই সময় মৈনাকের কী যেন হল, দীপ্তেনের টানে এখানে এসে পৌঁছালো। সেই মানুষটাই চিরকালের মতন চুপ করে গেছে। তাকে যে এখানে পাবে না, সে যে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে এই ভাবনাটা মাথায় ছিল না তার। ঘুনাক্ষরে এই চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এখন নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। সম্বলহীন মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত রকমের নিঃসঙ্গ, শূন্য, ফাঁকা লাগছিল তার। দীপ্তেনের না-থাকার বেদনা মৈনাকের ভেতরে জমাট হয়ে ছিল বরফের মত। এখন সেই জমাট হওয়া বরফ গলে জল হয়ে দু’চোখের কোল উপচে ঝরে পড়ল টপ টপ করে গোবিন্দ’র ছড়িয়ে রাখা ফুলের ওপর।
অনেকক্ষণ কেটে যাবারপর ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস মৈনাকের মাথার ওপর হাত রাখলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল, সাচ ইস লাইফ। তুমি কোথাও কিছু হারাবে আবার কোথাও কিছু পাবে।