সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বন্ধুদের এক আড্ডায় প্রস্তাবটা উঠল — দিল্লি গেলে কেমন হয়? ততদিনে দিল্লির উপকণ্ঠে তিন কৃষি বিল প্রত্যাহার ও Minimum Support Price (MSP) (নূন্যতম সহায়ক মূল্যের) দাবিতে কৃষক জমায়েতের দেড় মাস আর কৃষক আন্দোলনের ছয় মাস অতিক্রান্ত। সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতা, সরকারের সাথে হওয়া কৃষক সংগঠনগুলোর ১১ দফা নিষ্ফলা বৈঠক —দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাপঞ্জিতে ঠাহর করা যাচ্ছিল না আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। অবশেষে ২২ জানুয়ারি কৃষক সংগঠনগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ১২ থেকে ১৮ মাস বিলগুলোকে স্থগিত রাখার প্রস্তাবকেও নাকচ করল। এর পরে সবার প্রতীক্ষা ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর মিছিলের। এই আবহে আমরা তিন বন্ধু ২৩ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছালাম।
সংবাদপত্র, গণমাধ্যমগুলোর কারণে সিংঘু বর্ডারের নাম কৃষক বিক্ষোভে বহুশ্রুত। তাই প্রথম গন্তব্য সিংঘু। পশ্চিমবঙ্গে বড় হয়ে ওঠা চোখ আন্দোলন-স্থলে ইতিউতি খোঁজে লাল পতাকার উপস্থিতি। কিন্তু অবাক করে পতাকার রঙের সমাহার — হলুদ, সবুজ, সাদা, নীল, গেরুয়া, আর হ্যাঁ লাল পতাকাও। বোধকরি এও রঙের পতাকায় রাঙা বিক্ষোভস্থল দেখে আমাদের মধ্যে এক জন বলে ওঠে— এ তো দেখছি গণঅভ্যুত্থান! ঠিকই। কখন যেন গণআন্দোলন বদলে গেছে গণঅভ্যুত্থানে। কুম্ভ আর গণঅভ্যুত্থান— আপাত সম্পর্কহীন দুটো শব্দকে মিলিয়ে দিয়েছে সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর, এরকম আরও নানান প্রতিবাদস্থল। বইয়ের পাতার ইতিহাস তো কোন পুরোনো সময়ের ঘটমান বর্তমান। আর বর্তমানে দাঁড়িয়ে অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাসের পাতায় যে গণআন্দোলন স্থান করে নেবে— তার সাক্ষী থাকার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর। হৃদয় ছুঁয়ে যায় রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধার এই বিনম্র শান্তিপূর্ণ প্রকাশ। এই আন্দোলনের আবেগ মর্মস্পর্শী— কি করে ভোলা যায় গাজীপুর বর্ডারের সেই ৯৩ বছরের পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের মেরঠ অঞ্চলের কৃষককে। আন্দোলনের স্বপক্ষে তাঁর ঋজু দাঁড়িয়ে থাকাকে। অন্যদিকে আন্দোলনের যুক্তির বুনোটও তেমনই ক্ষুরধার। কেন এই আন্দোলন?— তিন কালা কানুন ওয়াপস, MSP লাগু। কতদিন চলবে?— ইয়ে লম্বা চলেগা। (আজ মার্চ ২০২১ এ ১০০ দিন অতিক্রান্ত এই আন্দোলন। কি প্রফেটিক লাগে এখন জানু: ২০২১ এ শোনা ওই উচ্চারণ! কবে বাড়ি ফিরবেন? — কানুন ওয়াপাস নহী তো ঘর ওয়াপস নহী। এতদিন পরেও সেই সব উচ্চারণ কানে বাজে। এসব তো শুধু কৃষক ইউনিয়ানের শেখানো বুলি নয়। গণআন্দোলনের আগুনে সেঁকে নেওয়া সাধারণ কৃষকের উপলব্ধি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কৃষক আজ অস্তিত্বের সংকটে ; পি. সাইনাথ যাকে আমাদের সভ্যতার সংকটও বলেন।) রুখে দাঁড়িয়েছে। উপলক্ষ তিন কৃষি বিল ও MSP। কিন্তু অন্তর্লীন আছে প্রচুর কথা— অনেক বঞ্চনা, কৃষি অলাভজনক হয়ে যাওয়া। এই সকল নিয়ে বসে আছে কৃষক দিল্লির উপকণ্ঠে।
দিল্লি শহর আকৃতিতে গোলাকার। উত্তর থেকে দক্ষিণে পশ্চিমদিক বরাবর হরিয়ানা আর পূবে উত্তর প্রদেশ। পঞ্জাব থেকে দিল্লি পৌঁছাতে গেলে হরিয়ানা বা উত্তর প্রদেশ পেরিয়ে আসতে হয়। দিল্লির উপকণ্ঠে বেশ কিছু জায়গায় কৃষক অবস্থান চলছে— ১) সিংঘু, ২) টিকরি, ৩) ধাসা, ৪) মসানী ব্যারেজ, ৫) সাহাজাহানপুর খেড়া, ৬) পালওয়াল, ৭) সুনহেড়া, ৮) চিল্লা ও ৯) গাজীপুর। অবস্থান আন্দোলনের মূল দাবি— তিন কৃষি বিল প্রত্যাহার ও MSP এর আইন। তলিয়ে ভাবা প্রয়োজন কেন তিনটি আইন একসাথে পাশ হল। আইনগুলো কি বলে?
তিন কৃষি বিল :— প্রথম বিলটি হল — Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020 : এই বিলটি APMC মান্ডি সংক্রান্ত। APMC মানে Agricultural Produce Marketing Committee। APMC মান্ডি (পরবর্তীতে শুধুই মান্ডি) হল সরকার নির্ধারিত বাজার এলাকা। কৃষিজ পণ্যের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী মান্ডিতে চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনতে পারে MSP নির্ধারিত মূল্যে। আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডি ও MSP র যোগ অঙ্গাঙ্গী। APMC মান্ডিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীকে কর দিতে হয়। এই কর বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম। এই কর বাবদ পঞ্জাব ও হরিয়ানা সরকারের রাজস্ব আয় হয় ভাল রকম। নতুন এই বিলটি কৃষক-উৎপাদিত শস্য মান্ডির বাইরেও ব্যবসায়ীকে কেনার অনুমতি দিল। কেন্দ্রীয় এই আইন রাজ্য সরকারগুলিকে মান্ডি বহির্ভূত বেচাকেনার উপর কোন রকম কর বসাতে দেবে না। সুতরাং মান্ডিতে কর বলবৎ, মান্ডির বাইরে বেচা কেনা করমুক্ত। লক্ষণীয় এই বিলে কেন্দ্রীয় সরকার কোথাও মান্ডি অবলুপ্তির কথা বলেনি। কিন্তু কৃষকদের আশঙ্কা কর কাঠামোয় এই তারতম্যের কারণে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই মান্ডিগুলো বিলুপ্ত হবে। আর যে হেতু মান্ডির সাথে MSP-র যোগ অঙ্গাঙ্গী, সেহেতু MSP ও আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হবে। যদিও সরকার বলছে MSP থাকবে। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডির গুরুত্বের কথা পি. সাইনাথ খুব সহজে বুঝিয়েছেন — ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলের যেরকম গুরুত্ব, ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডির গুরুত্ব ততোধিক। সরকারি স্কুল ধ্বসে গেলে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি, মান্ডি শেষ হয়ে গেলেও তাই হবে। অন্যদুটো বিল নিয়ে আলোচনা করার আগে MSP নিয়ে দু-চার কথা।
MSP (Minimum Support Price / ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) : ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার পর ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ MSP চালু হয়। MSP র আওতায় থাকা ২৩টি সামগ্রীর (নানা রকমের শস্য, ডাল, তৈলবীজ, ব্যাবসায়িক শস্য যেমন পাট, আখ ইত্যাদি) ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে Commission for Agricultural Costs and Prices নামক কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা। MSP মূলতঃ কৃষকদের সুনিশ্চিত আয়ের আশ্বাস — যা তাকে কৃষি কাজে উৎসাহ জোগাবে। সরকারি তথ্য বলে দেশের ৬ শতাংশের কম কৃষক MSP তে বিক্রি করতে পারে। MSP-র ঘোষণা কার্যকরী তখনই হয় যখন MSP তে সরকার অনেকটা ক্রয় করে। মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক MSP থেকে উপকৃত হলেও MSP ও সরকারি ক্রয় বাজারদর কৃষকের স্বপক্ষে রাখতে সাহায্য করে। কৃষক MSP না পেলেও বাজারদর খুব নীচে যেতে পারে না। মান্ডিতে MSP তে ব্যবসায়ীর কিনতে বাধ্য হওয়াটা চাষির পক্ষে যায়। মান্ডি ও MSP-র এই যোগটা বুঝলে আমরা বুঝতে পারব কৃষক সমাজের ভয়টা কোথায়। কৃষকদের ভয় এই নতুন APMC আইনের কারণে মান্ডিগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে অবলুপ্ত হবে। মান্ডির সাথে MSP-র যোগের কারণে মান্ডি অবলুপ্ত হলে MSPও শেষ হবে। চাষিকে তখন বৃহৎ পুঁজি গিলে খাবে। সরকারি নীতি — সে যার কথা ভেবেই হোক, বেসরকারি পুঁজি বা কৃষক — তার পরিণতি সম্পর্কে দেশের অনেক কৃষক এবং কৃষক সংগঠন সম্যক অবহিত। কোনরকম বোধ চিন্তা ছাড়াই কিছু নেতার কথায় তিন মাসের উপর দিল্লির প্রবল আবহাওয়ায় বসে থাকবে এমন মূর্খ আমাদের দেশের চাষিরা নয়।
দ্বিতীয় বিলটি হল Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Form Services Act, 2020। এক কথায় চুক্তি চাষ। চাষি খরিদ্দার বা ব্যবসায়ীর সাথে পূর্বনির্ধারিত চুক্তিপত্রের নিরিখে চাষ করবে। সেই চুক্তিতে দামও পূর্বনির্ধারিত থাকবে। এই আইনে বলা আছে যে কোন পক্ষ যদি মনে করে চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে তাহলে সে সিভিল কোর্টে যেতে পারবে না। সাব-ডিভিশানাল ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে নিষ্পত্তি হতে হবে। চাষি তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানে বৃহৎ পুঁজির সাথে চুক্তি ও তার উকিলদের সাথে লড়াই তার পক্ষে কি বিভীষিকা হতে পারে! এই চুক্তিতে কৃষিজ পণ্যের মান ও ফলনের পরিমাপ সম্পর্কেও চুক্তি থাকবে। চাষি যদি সেই মান বজায় রাখতে না পারে তাহলে খরিদ্দার কিনতে নাও পারে। বাজারে দাম যখন চড়া থাকে তখন অনেক সময়ই খরিদ্দার ফসলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফল কেনে না — চাষি পড়ে বিপাকে। আর এই চুক্তি বলে যখন কোর্টে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ, চাষি তখন প্রমাদ গোনে।
তৃতীয় আইনটি হল Essential Commodities (Amendment) Act, 2020। পুরানো আইনের বলে essential commodity (প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য) তালিকাভুক্ত শস্য একটা আয়তনের উপর মজুত করা যায় না। নতুন আইনে মজুত করার ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ায় কৃষকদের ভয় যে খাদ্যদ্রব্য মজুত করবে বড় কোম্পানি। একচেটিয়া কারবারও তৈরি হবে। খাদ্যদ্রব্যের দামও নিশ্চিতভাবে বাড়বে। পচনশীল খাদ্যদ্রব্যে দাম ৫০ শতাংশ বাড়লে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামছাড়া হবার আশঙ্কায় চাষির ভয় খাদ্যসুরক্ষা হারানোর।
Food Corporation of India (FCI) র পুর্নগঠনের জন্য শান্তাকুমার কমিটির রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০১৫ সালে। এই কমিটির সুপারিশগুলোর সম্পর্কে কৃষক সংগঠনগুলো অবহিত। তাই সরকার এই তিনটে আইন এক সাথে পাশ করানোর ফলে চাষিরা কোথাও একটা সামগ্রিক চিত্র দেখতে পাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের দুর্গতির। অস্তিত্বের সংকট তৈরি হলেই মানুষ এরকম রুখে দাঁড়ায়। আর হ্যাঁ, এই প্রতিবাদকে রূপ দেয় সংগঠন — এক্ষেত্রে কৃষক সংগঠন।
আন্দোলনের রূপরেখা ও কৃষক সংগঠন :
কৃষকদের অবস্থান স্থলে ঘুরে কথা বললে বা ভারতের কৃষি ব্যবস্থার সাথে সামান্য হলেও পরিচয় আছে এমন কেউও বলবে যে আজ যে আন্দোলন আমরা দেখছি তা শুধুই তিনটি কৃষি বিল নিয়ে নয়। এর পিছনে আছে অনেকদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনা। এই কৃষি আন্দোলনের সম্পর্কে অনেকেই বলেন এ তো শুধু পঞ্জাব ও কিছুটা হরিয়ানার চাষিদের আন্দোলন। তবে দ্রুত ঘটে যাওয়া মহাপঞ্চায়েতগুলো আমাদের জানান দিচ্ছে এই আন্দোলন আজ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থান বিক্ষোভ সারা দেশের নজর এই আন্দোলনের দিকে ফেরাতে বাধ্য করেছে। দিল্লির এই অবস্থান না চললে আমরা হয়ত এই দ্রুত ঘটে যাওয়া মহাপঞ্চায়েতগুলোর কথা জানতামই না।
এখনকার এই কৃষক আন্দোলনকে বুঝতে গেলে সবুজ বিপ্লবের কথায় ফিরতে হবে। এখন যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব তাদের অনেকেরই আমেরিকা থেকে আসা PL480 গমের কথা মনে থাকবে। PL480 গমের সরবরাহ বন্ধ ও দেশের খাদ্যসংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দেখা দিল সবুজ বিপ্লব — কৃষিতে উচ্চফলনশীল বীজ, সার, নানা প্রকার রাসায়নিক, উন্নত সেচ ও যান্ত্রিক চাষ (mechanized farming) ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিক ফলন। এই mechanized farming এর প্রচলনেই ট্র্যাক্টরের বহুল ব্যবহার আজ যা আন্দোলনের বা মিছিলের অন্যতম হাতিয়ার। লক্ষণীয় যে সবুজ বিপ্লব কিন্তু শুধু ভারতেই ঘটছে না, পৃথিবীর আরও নানান জায়গায় (যেমন মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইত্যাদি) ঘটছে সেই সময়। ভারতে সবুজ বিপ্লবের শুরু মূলতঃ পঞ্জাব ও হরিয়ানায়। এর ফলে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষি পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার বিনিয়োগ করে। তৈরি হয় মান্ডি, সংযোগকারী রাস্তা, খাদ্যশস্য মজুত করার গোডাউন, সেচ ব্যবস্থা। পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরাও খাদ্যশস্য ফলানোর রেকর্ড স্থাপন করেন। উৎপাদনশীলতায় এখানকার চাষিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোঠায়। সরকারও ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ নিয়ে আসে MSP যা চাষিকে নিশ্চিন্ত করে তার আয়ের সম্পর্কে। তবে এই কৃষিব্যবস্থায় চাষের খরচ বেশি ও ক্রমবর্দ্ধমান। ফলতঃ শস্যের দাম যদি বেঁধে রাখতে হয়, তাহলে চাষির আয় যায় কমে। ১৯৮০র দশক থেকে এই অঞ্চলে কৃষিজ আয় কমতে শুরু করল। অন্য দিকে বেড়ে চলল চাষের খরচ। ফল দাঁড়াল মারাত্মক — চাষিরা আস্তে আস্তে দেনার চক্রে ঢুকতে থাকল। পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা রিপোর্ট বলে কৃষিকাজে যুক্ত পরিবারগুলোর সামগ্রিক ঋণের বোঝা ১ লক্ষ কোটি টাকা। প্রতি পরিবারের বার্ষিক গড়ঋণের বোঝা ৪ লক্ষ টাকা। পঞ্জাবের প্রতি ৩ জন কৃষকের মধ্যে ১ জন দারিদ্রসীমার নীচে। এই দেনার দায় ও কৃষিকাজের অনিশ্চয়তার অবশ্যম্ভাবী মর্মান্তিক পরিণতি হিসেবে আসে আত্মহত্যা। পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, লুধিয়ানা; পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, পাতিয়ালা ও গুরু নানকদেব বিশ্ববিদ্যালয়, অমৃতসর — এই তিনটে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সমীক্ষা বলে ২০০০-১০১৫ এর মধ্যে গড়ে প্রত্যেক দিনে ৩ জন চাষি আত্মহত্যা করে। পঞ্জাবে কৃষিকাজে যুক্ত পরিবারগুলোর গড় আয় মাসিক ১৮,০০০ টাকা। পঞ্জাবের চাষি আজ বুঝছে এই তিনটে কৃষি আইনের ফলে সরকার কৃষিতে বিনিয়োগ কমাবে ও কর্পোরেট ঢুকে পড়বে ব্যাপক হারে কৃষিতে। দেশের মধ্যে বোধকরি চাষের ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের সাথে সবচেয়ে বেশি মোলাকাত হয়েছে পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিদের। সরকারি বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দেখেছেন তাদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়েছে। কর্পোরেটের হাতে কৃষি ব্যবস্থার রাশ গেলে কি হবে তারা বিলক্ষণ বোঝেন।
দেশের ৭০০০-এর বেশি কিছুর মান্ডির অধিকাংশই পঞ্জাব ও হরিয়ানায়। প্রতি ৫ কিমি-র মধ্যে একটা মান্ডি থাকতে গেলে প্রয়োজন আরও ৪২,০০০ এর বেশি। মান্ডি — MSP — FCI এর খাদ্যশস্য কেনা ও মজুত — তার থেকে Food Security Act, PDS ব্যবস্থা, mid day meal — গরিবমানুষের খাদ্য সরবরাহের এই শৃঙ্খলে APMC মান্ডির গুরুত্ব কোথায় তা পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক ভালই বোঝে। তাই সে বোঝে মান্ডি বন্ধ হবার পরিণতি। যেখানে মান্ডি গড়ে ওঠেনি সেখানকার চাষিরা তা হারানোর মর্মাথটাও অতটা বোঝেন না। ভারতের অন্যান্য জায়গার চাষিদের গড় অবস্থা (আয়, দেনা, জমির আয়তন, আত্মহত্যা ইত্যাদির নিরিখে) পঞ্জাবের থেকে খারাপ। কিন্তু সেই চাষিরাও অনেকে এখন স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট ও MSP র কথা জানে। C2 + ৫০% শতাংশ (C2 মানে গোদা অর্থে চাষের সবরকম input cost) জানে। তাই দেশের সব জায়গার চাষিকে যুক্ত করতে আসলো MSP-র দাবি। আন্দোলন নেতৃত্বের প্রাজ্ঞতার নমুনা।
এবার আসা যাক কৃষক সংগঠনগুলোর কথায়। আমরা দূর থেকে দেখে বা মিডিয়ায় শুনে বলি যে কৃষকরা বসে আছে। এই অবস্থান কাছে গিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে এই স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে সুচারু রূপ দিয়েছে অনেক কৃষক সংগঠন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ান (BKU) এর নানান ফ্যাকশন (faction)। BKU শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। অন্যতম স্থপতি ছিলেন চৌধুরী চরণ সিং, এম.ডি. নানজুন্দাস্বামী, নারায়ণস্বামী নায়ডু, ভূপিন্দার সিং মান, মহেন্দ্র সিং টিকায়েত। পঞ্জাব খেতিবাড়ি ইউনিয়ান, কিষান সংঘর্ষ সমিতি, (হরিয়ানা) রায়তু সংঘ, (কর্ণাটক), ভ্যাবাসাইগল সংঘম – এরকম নানান সংগঠন মিলে তৈরি হয়েছিল BKU। এখন BKU নানান ফ্যাকশনে বিভক্ত— যেমন BKU (রাজেওয়াল), BKU (লাখোয়াল), BKU (দাকাউন্ডা), BKU (টিকায়েত), BKU (দোওবা), BKU (চাদুনী), BKU (একতা – উগ্রাহান), ইত্যাদি। BKU উপদলগুলি নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে, সচরাচর নির্বাচনে অংশ নেয় না, WTO-র বিরোধিতা করে, জেনেটিকালি মডিফায়েড (GM) শস্যের বিরোধিতা করে। BKU ছাড়াও আছে নানান সংগঠন — জামহুরি কিষান সভা, ক্রান্তিকারি কিষান ইউনিয়ান, সারা ভারত কিষান সভা (AIKS), জয় কিষান আন্দোলন, ইত্যাদি। পঞ্জাব হরিয়ানার আনুমানিক ৩০টি সংগঠন ও দেশের আরও নানান প্রান্তের আনুমানিক ১০টি সংগঠন নিয়ে তৈরি হয় প্রায় ৪০টি সংগঠনের একটি মঞ্চ — সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (SKM)। SKM-এর কাজ দেখভাল করে ৭ জনের একটা কোঅর্ডিনেশন কমিটি। ভারতীয় কৃষকেরা প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে নানান রকম সংগঠনের আওতায় সংগঠিত হচ্ছেন। এক অর্থে SKM অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলির ধাত্রী সংগঠন হল All India Kisan Sangharsh Coordination Committee (AIKSCC)। AIKSCC তৈরি হয়েছিল প্রায় ২৫০টি কৃষক সংগঠন নিয়ে মধ্য প্রদেশের মান্দসৌরে গুলিচালনায় ৫জন কৃষকের মৃত্যুর পর। SKM এর বাইরে আরও দুটি - মূলত পঞ্জাবের - ইউনিয়ান এই কৃষক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছে — BKU (একতা – উগ্রাহান) ও কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ কমিটি (KMSC)। BKU (একতা - উগ্রাহান) মূলত পঞ্জাবের মালওয়া অঞ্চলে সংগঠন করে— কৃষক আত্মহত্যা ও কৃষকদের নিয়ে অারও নানান সামাজিক কাজের জন্য এরা খ্যাত। BKU (একতা - উগ্রাহান) SKM এর মঞ্চের বাইরে। কিন্তু যৌথ মিটিং করে, একসাথে অনেক পরিকল্পনাও গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের (১০ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠান পালন করে ভীমা কোরেগাঁও ও আরও নানান কেসে জেলে বন্দি বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবি তোলেন এরা। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। SKM এর আবেদন ছিল এমন কিছু না করতে যাতে আন্দোলনের অভিমুখ নষ্ট হয়। BKU (একতা – উগ্রাহানের) সভাপতি যোগিন্দার সিং উগ্রাহানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন—বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সহায়তা করেন কর্পোরেট-শোষণের জটিল প্রক্রিয়া বুঝতে। ওনারা না বোঝালে আমরা হয়ত অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। তাই ওনাদের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কি গভীর সত্য; কত সহজে বলা! অন্য সংগঠন KMSC হল পঞ্জাবের খেতমজুর ও দলিতদের সংগঠন। সিংঘু বর্ডারের জমায়েত SKM সংগঠিত। গাজিপুরও তাই — তবে এখানে BKU (টিকায়েত) ফ্যাকশনের প্রভাব বেশি। টিকরি বর্ডারের জমায়েত স্থলে SKM এর উপস্থিতি থাকলেও এই জমায়েতের মূল সংগঠন — BKU (একতা – উগ্রহান)। KMSC এর অবস্থানও সিংঘু বর্ডারে।
ঘটনাপঞ্জি : জুন ৫, ২০২০ তে অধ্যাদেশ (ordinance) জারি হয়। তিনটি কৃষি বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ঘটে যায় সেপ্টেম্বর ১৪ - ২৭ এর মধ্যে। সরকার পার্লামেন্ট এর নানান কমিটিতে এই বিল পাঠাতে রাজি হয়নি। এই বিলের সমর্থকরাও এত তাড়াহুড়ো কেন তা নিয়ে কোনো আলোকপাত করতে পারেনি। শ্রম আইনের সংস্কার বিলও উত্থাপিত ও পাশ হয় সেপ্টেম্বর ২০ – ২৪ এর মধ্যে। অনেক দিন পরে ১লা মার্চ, ২০২১এ যখন কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলি যৌথ বৈঠকে বসে সিংঘু বর্ডারে তখন তার কারণ বোঝা যায়।
জুন, ২০২০ তে ordinance পাশ হবার পর থেকেই পঞ্জাবে আন্দোলন শুরু হয়। জুনে করোনার প্রাবল্য ও লকডাউন চলেছে সীমিত হলেও। Ordinance গুলো এরকম সময় পাশ করা হল কেন, ordinance এরই বা কি প্রয়োজন ছিল — এমনতরো নানান প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কৃষকরা সন্দিহান এই বিলের ব্যাপারে। Ordinance পাশ হবার পর করোনাজনিত সামাজিক দূরত্ববিধি মানার কারণে কৃষক জমায়েত করা যাচ্ছিল না বলে চাষিরা বাড়ির ছাদে উঠে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানাতো। আস্তে আস্তে প্রতিবাদ সংগঠিত হতে শুরু করল পঞ্জাবে। লক্ষ্য করার যে ordinance পাশ হবার পর পরই জুলাই মাসে শুরু হয় খড়িফ শস্যের বীজবপন। খরিফ চাষ চলে জুলাই থেকে অক্টোবর। খরিফ চাষ শুরু হবার পর পরই আন্দোলন গতি পেল। প্রথমে পঞ্জাব, পরে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ রাজস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্জাবে আন্দোলনের কথা আমাদের মিডিয়া প্রায় আমাদের কিছুই জানায়নি। দীর্ঘ দুমাসের কাছাকাছি ট্রেন চলাচল বন্ধ থেকেছে, টোল প্লাজায় টোল দেওয়া নেওয়া বন্ধ। রিলায়েন্স কোম্পানির পেট্রোল পাম্প, রিটেল ব্যবসা ও মোবাইল টাওয়ার বন্ধ। রাস্তায় রাস্তায় স্ট্রিট কর্নার, পিকেটিং। পঞ্জাবে কিছুটা ঘুরলেই বোঝা যায় একটা গোটা সমাজ — শুধু গ্রাম নয়, শহরও — কেমন আন্দোলিত। সমাজে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে বলেই দীর্ঘ ৮ মাস পরেও ৪০০ কিমি দূরে দিল্লীর বুকে এমন অভূতপূর্ব অবস্থান বিক্ষোভ বজায় রাখা যায়।
অক্টোবরে খরিফ শস্য কাটা ও রবি চাষ শুরুর পরই নভেম্বরে দিল্লি চলো। মার্চে আবার রবি শস্য কাটার সময়। তখন আবার অবস্থানের ভিড় কমবে। জাতীয় মিডিয়ার অবস্থানস্থলগুলোতে ভিড় কমে যাওয়া এবং আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার উল্লাস আমরা দেখি TV তে। কিন্তু এই মিডিয়া একটুও তলিয়ে ভাবে না ভিড় কমে যাওয়ার কারণ। জাতীয় মিডিয়ার এই বৈরি অবস্থান কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার তো করেছেই, এনেছে এই মিডিয়ার প্রতি এক অদ্ভুত বিরক্তি যা অবস্থানস্থলগুলোতে ফুটে উঠেছে নানান বর্ণময় পোস্টারে।
জুন ১৪-এ BKU (একতা – উগ্রাহান) প্রথম ordinance বিরোধী প্রেস স্টেটমেন্ট জারি করে। জুলাই ২০ পঞ্জাবের ১১টি কৃষক সংগঠন শিরোমণি অকালি দল — বিজেপির বিরুদ্ধে কুশপুত্তলিকা দাহ করে। জুলাই ২৭ কৃষক ইউনিয়ানগুলো একটি যৌথ ট্র্যাক্টর মিছিল সংগঠিত করে। সেপ্টেম্বর ১৭ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন শিরোমণি অকালি দল নেত্রী হরসিমরাত কাউর বাদল। সেপ্টেম্বর ২৪ থেকে শুরু হয় রেল রোকো। নভেম্বর ৫ এ চাক্কা জ্যাম। নভেম্বর ২৫ দিল্লি চলো। পঞ্জাব থেকে শুরু করে হরিয়ানা হয়ে দিল্লি চলো। এই যাত্রাপথে হরিয়ানার কৃষক সংগঠনগুলো পঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলোকে প্রভূত সাহায্য করে। এই দিল্লি চলোর নাটকীয় কিছু ভিডিও ক্লিপিংস আমরা দেখেছি। এই জমায়েত বাড়তে বাড়তে ২৬ জানুয়ারির কাছাকাছি এসে জনপ্লাবনের চেহারা নেয়। তারপর ২৬ জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির অভিঘাতে আন্দোলন সাময়িক ধাক্কা খায়। কিন্তু ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাকেশ টিকায়েতের কান্না, মুজাফরনগরের সিসৌলির রাত্রের মহাপঞ্চায়েত ও কৃষক আন্দোলনের অভূতপূর্ব প্রত্যাবর্তন। এই আন্দোলনকে যারা পর্যবেক্ষণ করছেন তারা সকলেই বলবেন এই আন্দোলনের গতির লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী।
জুন, ২০২০ তে পঞ্জাবের গ্রামে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রতিনিধিরা আজ আমাদের শহরে। তারা তৈরি করতে চাইছেন সারা দেশের কৃষক সমাজের সাথে এক সংলাপ। যে সংলাপ ছুঁয়ে যাবে আমাদেরও। কানে বাজে অবস্থান স্থলের সেই কথা — ‘‘ইয়ে লড়াই সির্ফ মেরে লিয়ে নেহি হ্যায়, তুমহারে লিয়ে ভি হ্যায়’’। তার কারণ আমার চাষের সাথে তো তোমার খাদ্য সুরক্ষা জড়িত। বৃহৎ পুঁজির হাতে চাষ গেলে তোমার খাদ্যের দাম তো হবে লাগামছাড়া। কাজও হারাব আমরা, নিজের বাপ-ঠাকুর্দার জমিতে হব খেতমজুর। আন্দোলনের গর্ভে আমি – তুমি মিলে যায়। তৈরি হয় নতুন ‘‘আমরা’’। এই আন্দোলনে পঞ্জাবের ধনী চাষি, মাঝারি চাষি, আর্থিয়া (commission agent), ক্ষুদ্রকৃষক ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক — সবাই আছে যাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কে বিরোধ (contradiction) থাকাই দস্তুর। অনেকের চোখে আর্থিয়ারা দালাল, কিন্তু পঞ্জাবের কৃষি সমাজ তাকে তার নিজের অংশ মনে করে। কারণ বিপদে আপদে, চাষের কাজে, ঋণের সাহায্যে তাকে পাশে যায়।
এই মাপের আন্দোলন— যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ তার ব্যাপ্তিতে, তার দৈর্ঘ্যে — নানান প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায় আমাদের কাছে। পঞ্জাবের আন্দোলনের সাথে, BKU-র কৃষি আন্দোলনের সাথে আমাদের রাজ্যের কৃষকের যোগ কোথায়? এই যোগসূত্রগুলো অনেকভাবেই স্থাপিত হয়। বিহারে ২০০৬ সালে APMC মান্ডি Act অবলুপ্ত হয় প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে। প্রথম দু-তিন বছর চাষিরা কিছুটা বেশি দাম পেলেও অচিরেই কৃষি পণ্যের বাজার হয়ে যায় volatile। দাম পড়তে শুরু করে। বিহার থেকে ব্যবসায়ীরা চাল কিনে পঞ্জাব – হরিয়ানার মান্ডিতে বেচে। বিহারে তৈরি হয় প্রচুর ভূমিহীন কৃষক যারা পঞ্জাবে যান খেতমজুর হিসেবে। এদের কাছ থেকে পঞ্জাবের অনেক কৃষক শোনেন APMC মান্ডি লোপ পাওয়ার ফল।
এ ছাড়া থাকে কৃষক আন্দোলনের নেতা থেকে সাধারণের কাছে শোনা — ইয়ে লম্বা চলেগা। কেন? কারণ তারা বোঝেন সরকার ছাড়িয়ে এই লড়াই তাদের এনেছে বৃহৎ পুঁজির সামনে। আন্দোলনস্থলে ঘুরলে, কথা বললে তাই ফিরে ফিরে আসে আদানী অম্বানীর কথা। তারা জানেন এই লড়াই protracted।
এ ছাড়াও এই কৃষি আন্দোলন তুলে এনেছে ইতিহাসকে। অনেক পঞ্জাবী বা হরিয়ানার কৃষক তাদের আগের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেখেন এই আন্দোলনকে। দুটো উদাহরণ। ‘‘পাগড়ি সাম্ভাল জাঠ্ঠা’’ ছিল ভগৎ সিং-এর কাকা সর্দার অজিত সিং এর নেতৃত্বে বৃটিশদের করা তিন কালা কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন। আজকের আন্দোলন সেই ইতিহাস তুলে নিয়ে আসে। এছাড়া আছে স্যর ছোটুরামকে স্মরণ। পশ্চিম উত্তরঃপ্রদেশে জাঠ ও মুসলিমদের মুজ্জফরনগর দাঙ্গার পরের বিভেদকে ভোলাতে সাহায্য করছে এই আন্দোলন। অনেক সময়েই মুসলমানদের শুনতে হয় — ‘‘বাবর কা আওলাদ’’। আমরা কি জানি যে ১৫২৭ এ খানওয়া ময়দানে বাবরের সাথে লড়াই হয়েছিল হাসান খাঁ রাণা সাংঘার। মেওয়াত অঞ্চলের (হরিয়ানা – জয়পুর – দিল্লী – আগ্রা নিয়ে যে অঞ্চল) মুসলমান প্রধান অঞ্চলের কৃষকরা সুনহেড়া অবস্থানস্থলে মেওয়াতি দিবস পালন করবেন ১৫ মার্চ। হ্যাঁ ‘‘বাবরের আওলাদ’’রা বাবরের বিরুদ্ধেই মেওয়াতি দিবস পালন করবে। এই আন্দোলন এক বহমান নদী, কলেবরে বাড়ছে। নানান ধারা, উপধারা এসে এতে মিশছে। সমাজের অনেক কিছুকে ধরেই সে টান মারছে। আন্দোলনে মহিলা কৃষকদের অংশগ্রহণ নজর-কাড়া। BKU (একতা – উগ্রাহান)-র পঞ্জাবের বারনালায় করা মহাপঞ্চায়েতে দেড় লাখ লোক হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের ভাড়া করা লোকের মিছিল নয়। স্বেচ্ছায় আসা মানুষের জমায়েত। সেই ভিড়ের মধ্যে আনুমানিক ৮০ হাজার মহিলা ছিলেন।পঞ্জাবের যুবসমাজের নেশাগ্রস্ততার কথা শোনা যায়। এই আন্দোলনের প্রভাবে সেটাও কমের দিকে।
ইতিহাস ঘটছে আমাদের সামনে। সেই ইতিহাসের ক্ষণিক অংশমাত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২৩ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০২১।
সিংঘু বর্ডার
দিল্লিকে ঘিরে হরিয়ানার উপর দিয়ে দিল্লির পশ্চিম সীমান্ত বরাবর অর্ধচক্রাকারে আছে ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল বা কুন্ডলী – মানেসর – পালওয়াল এক্সপ্রেসওয়ে। তেমনই দিল্লিকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশের উপর দিয়ে দিল্লির পূর্ব সীমান্ত বরাবর অর্ধচন্দ্রাকারে আছে ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে। অর্থাৎ ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে দিল্লি শহরকে। ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে যেখানে NH-44 বা জম্মু-দিল্লি হাইওয়েকে কেটে ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে নাম নিয়েছে, সিংঘু বর্ডার (হরিয়ানা ও দিল্লির উত্তর প্রান্তের বর্ডার) সেখান থেকে প্রায় ১৫ কিমি দক্ষিণে। এই NH-44 এর সংযোগ স্থল থেকে সিংঘু বর্ডার পর্যন্ত ১৫ কিমি লম্বা রাস্তার উপর কৃষক অবস্থান ছিল ২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে। এখানে চার লেনের হাইওয়ের দুপাশে খুব ঘন জনবসতি নেই। এই ১৫ কিমি রাস্তার দুই প্রান্তে সাধারণ পুলিশ ব্যারিকেড ছিল ২৬ জানুয়ারির আগে। আন্দোলনের সংগঠনগুলির হলুদ, সবুজ, লাল, গেরুয়া পতাকা লাগানো গাড়ি থাকলে অথবা পায়ে হেঁটে আন্দোলন স্থলে ঢোকা বা বেরোনোয় কোনো সমস্যা ছিল না।
পুলিশ ব্যারিকেড ছাড়ালেই চোখে পড়বে NH-44-এর উপর বহু মানুষ তাঁদের ট্রাক্টর, ট্রলি ও তাঁবুতে অবস্থান করছেন। মাঝে এক ফালি রাস্তা ছাড়া আছে স্থানীয় মানুষ, আন্দোলনে যাঁরা আসছেন গাড়িতে বা ট্রাক্টরে করে তাঁদের জন্য। রাস্তার দুই দিকেই সারি সারি ট্রলি ত্রিপল বা প্লাস্টিকে ছাওয়া, কখনও বা অস্থায়ী তাঁবু রাস্তার উপর। ট্রলির ভিতরে খড়ের গাদার উপর তোষক ও কম্বল চাপিয়ে হয়েছে শোওয়া, থাকার ব্যবস্থা। বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। ভিতরে উঁকি দিলেই দেখা যায় কোনো বৃদ্ধ হয়ত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। নবীনেরা ব্যস্ত প্রাত্যহিক কর্মে। প্রায় সব ট্রলিতেই আছে ঝাণ্ডা কোনো না কোনো কৃষক সংগঠনের। সাথে পোস্টারও। মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধ – বৃদ্ধা, ছোট বাচ্চা দলে দলে পাঞ্জাবের মানুষ এসেছেন এখানে। তাঁরা কখনও থাকছেন সপরিবারে, কখনও অন্যান্য গ্রামবাসীর সাথে। ট্রলি এবং প্রায় সব ট্রাকটরেই রয়েছে কখনও সংযুক্ত কৃষক মোর্চা, কখনও বা তাঁদের নিজ নিজ সংগঠনের সবুজ, হলুদ, গেরুয়া, নীল, লাল বা সাদা পতাকা।
ট্রলি ও ট্রাক্টরের সারির মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে মূলত শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি (SGPC)-র লঙ্গরখানা। তাঁদের বিশালাকৃতি, প্রায় প্রমাণ মাপের মানুষ ঢুকে যাবে এমন বড় বড় কড়াই, ডেকচিতে চলছে ডাল, তরকারি, খিচুড়ি, পায়েস বা হালওয়া রান্না। মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধ, জোয়ান নির্বিশেষে হাত লাগিয়েছেন রান্নার কাজে— সবজি কাটা, ধোয়া, বাসন মাজা, কড়াইতে হাতা ঘোরানোয়। খিদে পেলে যে কোনো লঙ্গরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মিলছে রুটি ও তরকা ডাল। একটি মুসলিম লঙ্গরও চোখে পড়ল। এঁরা হলেন মুসলিম ব্রাদারহুড, এসেছেন মালের কোটলা, পাঞ্জাব থেকে। তাঁরা শুধু লঙ্গরখানাই চালাচ্ছিলেন না। ছিল লেপ, কম্বলের সংস্থানও। আন্দোলনের গোড়ার দিকে যখন মূলত পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলি এখানে জমা হতে শুরু করে, তখনও কিন্তু SGPC এখানে এসে পৌঁছান নি। পরবর্তী কালে পাঞ্জাবের বহু গুরুদ্বারা তাঁদের খানিকটা লঙ্গর এখানে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। খবরের কাগজ বা মিডিয়াতে বহু মানুষ হয়ত বা না-জেনেই মন্তব্য করেছেন ‘‘এ তো পিৎজা বার্গার খাওয়া পাঞ্জাবের ধনী কৃষকদের আন্দোলন। কিন্তু আন্দোলন স্থলে বহু ধনী মানুষকেই হয়ত দেখা গেছে, কিন্তু লঙ্গরের খাওয়াতে তাদের কোনো বাহুল্য দেখা যায় নি। পাঞ্জাবের ধনী মানুষও যখন লঙ্গরে সেবা করার জন্য যান তিনি যখন দান করেন, তিনি নিজে যা খান তাই তিনি দানের জন্য দেন। এই তাঁদের ঐতিহ্য— তাই দু এক জায়গায় বাদাম, কমলালেবুও (পাঞ্জাবে এই সময় কমলা লেবু খুবই সস্তা ছিল — ৪ কিলো ১০০ টাকায়) লঙ্গরে কেউ কেউ দিচ্ছিলেন। যদিও তা খুবই কম।
মাঝে মাঝেই দেখা গেল রেশন ও জলের ট্যাঙ্কার আসছে বাইরে থেকে। চাল, ডাল, আটা ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী লঙ্গরখানার সেবায়েতরা নিজেদের প্রয়োজন মতো নিচ্ছেন সেখান থেকে। রেশনের লরি, জলের ট্যাঙ্কার এগিয়ে চলেছে আরও দক্ষিণে দিল্লির দিকে মঞ্চ অভিমুখে।
একটু নজর করলে চোখে পড়ে সারি সারি ট্রাক্টরের পিছনে অস্থায়ী toilet। তবে তা সিংঘুতে জড়ো হওয়ার মানুষের সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষত মহিলাদের যথেষ্ট কষ্ট করেই সমাধা করতে হচ্ছে প্রাত্যহিক শৌচকর্মাদি।
আরও দক্ষিণে এগিয়ে যেতে দেখা গেল, বেশ কিছু অস্থায়ী গ্রন্থাগার youth for Swaraj এর তাঁবুতে হয়েছে বেশ কিছু বইয়ের সংগ্রহ। সেখানে দু একটি বাচ্চা ছেলেকে পড়তেও দেখা গেল। ছিল আরও দু একটি সংগঠনের বইয়ের সংগ্রহ। এই অস্থায়ী গ্রন্থাগারগুলিতে মূলত গুরুমুখীতে লেখা বই-ই সংখ্যায় বেশি ছিল। ছিল কিছু হিন্দি ও ইংরাজি বইও। বইয়েই বিভিন্নতাও তেমনই। — ছিল বামপন্থী দর্শন, সাহিত্য, শিখ ইতিহাস, ধর্মীয় ও আরও বহু প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বইয়ের সমাহার। এখানে দেখা গেল বহু মানুষই বই পড়ছেন অথবা বই ফেরত দিতে এসেছেন পড়ার পর। রয়েছে প্রচুর মেডিকেল ক্যাম্প। সামান্য সর্দি, কাশি, জ্বরের ওষুধ মিলছে নিখরচায়। আছে মানুষের কাপড় জামা কাচার ব্যবস্থাও। চোখে পড়ে স্বেচ্ছাসেবকরা আন্দোলনে যোগদানকারী মানুষের জামা কাপড় কেচে দিচ্ছেন ওয়াশিং মেশিনে।
গোটা রাস্তা জুড়ে দুধারে সারি দেওয়া ট্রলি, ট্রাক্টরের গায়ে লাগানো হয়েছে নানা রঙ্গীন পোস্টার। সেখানে আন্দোলনরত কৃষক সাধারণ জনগণ ও কৃষক ইউনিয়নগুলির ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে নিপুণভাবে। কোথাও মোদী – আদানি – আম্বানি – কঙ্গনার মাথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে গরু-ছাগল-ভেড়া-মোষের দেহের উপর। কখনও বা আজতক, zee news, নিউজ ২৪, রিপাবলিক ভারতের মতো টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিদের শেকল দিয়ে বাধা আদানি – আম্বানির হাতে। কৃষক ইউনিয়ন ও সাধারণ কৃষক সমাজ খুব সহজেই আদানি – আম্বানি মোদী ও মিডিয়া — এই ত্রয়ীকে এক আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছেন। তাই আছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভের উদ্গিরণ, জাতীয় ও অন্যান্য মিডিয়ার প্রতি প্রবল অবিশ্বাস ও সন্দেহ। তাই চোখে পড়ে গাড়ির কাঁচে আটকানো পোস্টার ‘‘Zee media গদ্দার হ্যায়’’। উল্টোদিকে কৃষক সমাজের ব্যথার কথা ফুটে ওঠে সেই সব পোষ্টারে — যখন তাঁরা লেখেন “we are farmers, not terrorist” “no farmers, no food, no future”. কৃষকের মমতা মাখা মুখ ফুটে ওঠে ফসল কোলে নিয়ে কোনো এক পোস্টারে।
২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে মানুষ, ট্রাক্টর ও ট্রলির ঢল নেমেছিল রাস্তায়। তাঁরা এসেছেন গাড়িতে মোটর সাইকেলেও। শুধু কৃষক নন, কৃষকের ভাই, বোন বৃহত্তর পরিবার, যাঁরা অন্যান্য কাজেও যুক্ত তাঁরাও এসেছেন সহমর্মী হয়ে, এক অভুতপূর্ব উৎসাহ ও একতার মন্ত্র নিয়ে কৃষকের লড়াইয়ের অংশ হতে। সিংঘু বর্ডারে অধিকাংশই ছিলেন পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম থেকে আগত শিখ সম্প্রদায়। নবীনরা আসছিলেন অতি উৎসাহে উৎসব মুখর হয়ে ট্রাক্টরের উপর বড় বড় বক্স বাজিয়ে। সেখানে যেমন ছিল পাঞ্জাবী চটুল গান, তেমনই পাঞ্জাবীতে লেখা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে রচিত বহু গান। বৃদ্ধ শিখেরা আসছিলেন তাঁদের মতো করে নীরবে। বহু ট্রলিতে ছিল নানা বয়সী মহিলাদের উপস্থিতি। ট্রাক্টরের বিভিন্নতা দেখলেও অবাক হয়ে যেতে হয়— স্বরাজ, নিউ হল্যান্ড, John Desse, Eicher, Mahindra, Powertrac, Farmtrac ও আরও কত রং ও ধরন তার হিসাব রাখা দায়।
হরিয়ানার বেশ কিছু কৃষক সংগঠন জমায়েতে এসেছেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেখানকার কৃষকেরা দেখা গেল তাঁবুর সামনে গোল হয়ে বসেছেন বিশাল বড় এক হুঁকো নিয়ে। হুঁকোর নল হাতে হাতে ফিরছে বয়স্ক ও নবীনদের মধ্যে — চলছে আলোচনা — হয়ত বা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়েই। এখানে নবীন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি ও যোগদান সত্যিই বিষ্ময়কর। এই নবীন প্রজন্ম স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন, সামলাচ্ছেন মঞ্চ ও আরও অনেক কিছু।
পায়ে পায়ে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছি সংযুক্ত কৃষক মোর্চার মঞ্চের সামনে। যেখানে চলছে পাঞ্জাবী নাটক – গান – কবিতা আবৃত্তি। লাল – নীল – সবুজ রঙ্গিন পাগড়িতে ভরে গেছে মঞ্চের সামনের মাটির উপরে পাতা সবুজ কার্পেটের দর্শকাসন। সঙ্গে আছেন তেমনই রঙ্গিন ঘোমটা দেওয়া সর্দারনীরা। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত এসে স্লোগান দিচ্ছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ— যো বলে সো নিহাল। সৎ শ্রী আকাল ওয়াহে গুরুজীকে ফতেহ’’। — দর্শকাসনে বসা মানুষ গর্জে উঠছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ’’।
মঞ্চের একপাশ দিয়ে চলছে বহু বর্ণময় গাড়ী ও ট্রাক্টরের যাতায়াত। আর তারই মাঝে চোখে পড়ে নীল জোব্বা পরিহিত, তলোয়ারধারী শিখ নিহাং সম্প্রদায়ের সৈনিকদের ঘোড়ায় চড়ে টহল দেওয়া। শিখ শৌর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন তাঁরা।
মঞ্চের আশে পাশে রয়েছে ছোট ছোট জমায়েত। সাধারণ জনগণ কথা বলছেন স্থানীয় টিভি চ্যানেল ও মিডিয়ার সাথে। অধিকাংশই পাঞ্জাবীতে। এক গেরুয়া পাগড়িধারী শিখ তাঁর দুঃখ উজাড় করে দিলেন। মিডিয়া ও সরকারের ‘খলিস্তানী’ অপবাদের বিরুদ্ধে। ‘খালসা’। যিনিই সত্যের জন্য, শুদ্ধতার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা সকলেই ‘খালসা’ এই পবিত্র শব্দটির সাথে ‘স্থান’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে, তাদের যে আতঙ্কবাদীর সাথে এক আসনে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা তাতে তাঁরা মর্মাহত, দুঃখিত।
আর এক পাশে দেখা গেল পাগড়িধারী এক বৃদ্ধ কৃষক হাতে All India Kisan Sabha (AIKS)-র লাল পতাকা নিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন কোনো এক স্থানীয় টিভি চ্যানেলে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমান্বয়ে চাপিয়ে দেওয়া নোটবন্দী, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি এবং তার পরেই এই কৃষক বিলের মতো জনস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচীর বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। তাঁর প্রশ্ন — ৩৭০ ধারা যদি প্রত্যাহার হতে পারে, তবে এই তিন কালা কানুন রদ করতেই বা সমস্যা কোথায়। তিনি মনে করিয়ে দেন এ দেশের ফৌজের অধিকাংশই পাঞ্জাবের বিভিন্ন কৃষক পরিবারের সন্তান। না কোনো মোদী আম্বানী বা আদানির সন্তান। ওরা দেশের জন্য জীবন কুরবানি দেন না! এই অমোঘ সত্যটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই তাঁদের মতো মানুষের আজ বড়ো প্রয়োজন।
ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হয় সোনিপতের এক ক্ষুদ্র চাষী ও AIKS-এর সদস্যের সাথে। তিনি সিংঘু বর্ডারে AIKS-এর তাঁবুর দায়িত্বে আছেন। তিনি কবি ও গীতিকারও বটে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়েন নি। তাই বোধহয় তিনি আন্দোলনের কথা, প্রতিবাদের কথা গান গেয়ে মোদীকে ‘তু মান যা....’ অত্যন্ত সহজ ভাবে বলতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষকে, মানবতাকে মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ক্ষমতাকে, ঈশ্বরকে নয়।
২৫ জানুয়ারির রাতে সিংঘু বর্ডারে youth for Swaraj-এর তাঁবুতে পৌঁছাতে বেগ পেতে হল বেশ। সেদিন NH-44 ও expressway মোড়ের অনেক আগে থেকেই দেখা গেল রাস্তার উপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অগুণতি ট্রাক্টরের সারি। পুলিশ সেদিন অত্যন্ত তৎপর। বহু ট্রাক্টরকেই আটকে দিয়েছে হাইওয়ের উপর। সারি সারি ট্রাক্টরের মাঝে আমাদেরও গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল — প্রায় ৬-৭ কিমি অন্ধকার রাস্তা, মাছি গলার জায়গা নেই, এমনভাবে পাশাপাশি রাখা ট্রাক্টরের মাঝখান দিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম তাঁবুতে, প্রায় রাত ১০ টা নাগাদ। চারিপাশে যেন উৎসবের আমেজ। কারণ পরের দিনই আছে সেই ট্রাক্টর মিছিল। মানুষের উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে। চারিপাশে বাজছে বক্স। হয়ত বা পিনাও একটু চলেছে। তাই রয়েছে সতর্ক পাহারাও। না পুলিশের নয়। দুই প্রান্তের দুই ব্যারিকেডে মুক্তাঞ্চলে স্বেচ্চাসেবকদের তাঁরা আমাদের মত করোনার ভয়ে ভীত, মুখে মাস্ক পরা মানুষ দেখলে বিচলিত হচ্ছিলেন। প্রসঙ্গত, সিংঘু বর্ডারে এই মাস্ক পরিহিত মানুষরা যে এখনও তাঁদের সবটুকু দিয়ে এই আন্দোলনে সামিল হতে পারে না তা সুস্পষ্ট। তিন কালা কানুন ওয়াপস ও MSP লাগু কুম্ভস্নানে যাওয়ার আগে মানুষের যে আকৃতি দেখা যায় তারই এক ঝলক দেখা গেল ওখানে সমবেত মানুষের মধ্যে। যারা, ওখানে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের কারোমুখে ‘মাস্ক’ দেখা যায় নি। ওনাদের আসলে মুখোশের আড়ালে কিছু ঢেকে রাখতে হয় না। রাত নেমে আসতেই স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাদের মত যারা আছেন তাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে। রাত্রিবাসের জন্য ছিল বেশ কিছু তাঁবু। যে কেউ এসে পরিচয়পত্র দেখিয়ে থাকতে পারবেন সেখানে।
২৫ তারিখ রাতে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মধ্যেও ছিল। ছিল কিছু চাপা উদ্বেগ। ২৬ জানুয়ারির সকাল বেলা থেকেই সাজ সাজ রব। জায়গায় জায়গায় গরমজলের ব্যবস্থা হয়েছে, দিল্লির ঠাণ্ডায় স্নানের ব্যবস্থা করতে। একে একে মানুষ আসছেন স্নান করে পবিত্র হয়ে, যেন যুদ্ধযাত্রা নাকি কুম্ভমেলার সেই শাহি স্নানের মতো পুণ্যার্জনের লক্ষে সকাল সকালই ট্রাক্টরে চেপে এগিয়ে যাচ্ছেন সকলে সিংঘু বর্ডার পার করে দিল্লির দিকে। রাস্তা ভরে গেছে নানা রঙের পাগড়িতে। কেউ কেউ ট্রাক্টরে চেপে, কেউ হেঁটে, কাঁধে পতাকা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন দিল্লির দিকে। বৃদ্ধ – বৃদ্ধা দৃপ্ত স্বরে স্লোগান দিচ্ছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ’’।
সিংঘু বর্ডার পুলিশ বর্ডার পুলিশ পোস্টের কাছে দেখা গেল, ব্যারিকেডের খুব সামান্য অংশই খোলা রয়েছে ট্রাক্টরের যাতায়াতের জন্য। মানুষ ও ট্রাক্টরের সংখ্যার তুলনায় তা সংকীর্ণ অতএব বেশ কয়েকজন শক্ত, সমর্থ স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এলেন ঠেলে, উপড়ে দিলেন রাস্তা আটকানোর বড় বড় সিমেন্টের ব্লক। ঠিক এইখানেই দিল্লির দিকে মুখ করে ছিল কিষান–মজদুর সংঘর্ষ কমিটি (KMSC)'র মঞ্চ। এখানেও জমায়েত হয়েছেন বহু মানুষ। এই মঞ্চে মূলত ভূমিহীন কৃষক ও মজদুরের সংখ্যাই বেশি। মঞ্চে চলছিল বিভিন্ন নেতার বৃক্ততা – আর কিষাণ ঐক্যের ডাক।
২৬ জানুয়ারির ট্রাক্টর মিছিলে আমরা পদচারী হিসাবেই যোগ দিতে পেরেছিলাম। কারণ মানুষের তুলনায় ট্রাক্টরের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। Youth for Swaraj-এর তাঁবুস্থলে রাতের অন্ধকারে কোনো তাঁবু থেকে ভেসে এল অল্পবয়সীদের বক্সের গান— আবার কোথাও গুরুবাণীর গম্ভীরমাখা সুর। — কোথায় যেন রব উঠল মোদী মর গ্যয়া হায়। আলাপ হল বহু মানুষের সাথে যারা কিন্তু আমাদেরই মতো সরাসরি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত নয়।
সন্দীপ আলুরি (৩৫)। ইনি একটি ক্যামেরা কাঁধে হায়দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন সিংঘু বর্ডারের উদ্দেশ্যে। Software এর চাকরি ছেড়ে তিনি documentary film বানান। হায়দ্রাবাদে স্থানীয় কোনো কৃষকের কাছে এই আন্দোলনের কথা শুনে আর থাকতে পারেন নি। চলে এসেছেন, থাকছেন এবং প্রতি পদে আশ্চর্য হচ্ছেন এই মানুষগুলির সংঘবদ্ধতা ও ঐক্য দেখে।
এসেছেন আকাশ সিং (বয়স ২৪) পাতিয়ালা থেকে। তিনি এসেছেন শুধুই কৃষকদের সমর্থন দিতে। দীর্ঘ একমাস ধরে তিনি এখানে থাকছেন – ছবি তুলছেন। দ্বাদশ শ্রেণীর পর পড়াশোনা না ভাল লাগায় কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব পড়াশোনা অগাধ। শুধু পাঞ্জাবী সাহিত্য নয়, মারাঠী এবং আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের কথা যা জানেন তা বিস্ময়কর।
মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে কানে এল তামিল শ্লোগান। জনা ১৫-র একটি দল এসেছেন তামিলনাড়ু থেকে। তাদের লাল পোস্টারে চে-গুয়েভারা ও আম্বেদকর। তামিলনাড়ুর বেশ কিছু বামপন্থী সংগঠনের তরফ থেকে তাঁরা এসেছেন কৃষক আন্দোলনে সামিল হতে।
দুপুর ১২টার পর থেকেই লালকেল্লার খবর আসতে লাগল সমাবেশে। পুলিশ প্রহরাও মনে হল যেন আস্তে আস্তে বাড়ছে। কিন্তু না, হাতে রঙ্গিন পতাকা, মুখে কিষাণ ঐক্যের বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলে শান্তিপূর্ণ ট্রাক্টর মিছিল।
সিংঘু বর্ডার পাঞ্জাবের সমস্ত জেলার মানুষ ধনী, দরিদ্র, কৃষক, পড়ুয়া, ব্যবসায়ী, শিক্ষক চাকুরিজীবী নির্বিশেষে উপস্থিত হয়েছেন ‘‘তিন কালা কানুন ওয়াপসী’’র জন্য সরব হয়ে। তাঁরা শীত-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, সমস্ত অসুবিধা অগ্রাহ্য করে বসে আছেন তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। কারও কোনো ক্লান্তি দেখা যায় নি। ওঁরা বলছেন— ভারতের সমস্ত প্রান্ত থেকে তোমরা এস। তোমরা দেখো এখানে কোথায় ‘খালিস্তানি’ আছে? আমরা চাষী – আতঙ্কবাদী নই। ওরা ওদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন এই তিন আইনের প্রভাব কি ভয়াবই হতে পারে। ওনাদের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। ওনারা বলেন— এ শুধু আমাদের রুটি, রুজির প্রশ্ন নয়। এই আন্দোলন তোমার মতো তামাম সাধারণ ভারতবাসীর খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নেও। তোমরাও আওয়াজ উঠাও। স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলন প্রাঙ্গনের বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল — দিল্লির প্রচন্ড শীত আর গরমে কতদিন এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবেন? প্রতিটি মানুষ একই দৃপ্ত স্বরে সুর মিলিয়ে বলেছেন — এই তিন কালা কানুন ওয়াপসী না হওয়া পর্যন্ত আমরা উঠছি না। এই অবস্থান চালু থাকবে — ‘‘ইয়ে লম্বা চলে গা’’।
সিংঘু বর্ডারের কৃষক অবস্থান যেন এক মুক্তাঞ্চল, আবার এক রাজনৈতিক মহাকুম্ভও — যেখানে হাজার হাজার পাঞ্জাব, হরিয়ানার মানুষ একত্রিত হয়েছেন নিজস্ব পরিচয়কে দূরে সরিয়ে একটিই উদ্দেশ্যে — ‘‘তিন কালা কানুন ওয়াপস ও MSP লাগু’’
টিকরি বর্ডার
টিকরি বর্ডার দিল্লি ও হরিয়ানার উত্তর-পশ্চিমের বর্ডার। দিল্লি থেকে যে সবুজ মেট্রো লাইন হরিয়ানার বাহাদুরগড়ের দিকে চলে গেছে সেই মেট্রোলাইনের নীচে NH-9 বা রোহতক রোডের উপর। টিকরি-কালান মেট্রো স্টেশন থেকে শুরু করে প্রায় হরিয়ানার রোহতক পর্যন্ত (প্রায় ৪০ কিমি) চলে গিয়েছিল কৃষক অবস্থান ২৬শে জানুয়ারির ঠিক আগে। এখন সেটা নেমে এসেছে আনুমানিক ১৫-২০ কিমিতে, স্বভাবতই চাষের প্রয়োজনে। এখানে রোহতক রোডের দুপাশেই ঘন জনবসতি, দোকান পাট। দুই লেনও চওড়ায় সিংঘু বর্ডারের থেকে অনেকটাই অপ্রশস্ত। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাসস্থান এখানে। অপেক্ষাকৃত ঘিঞ্জি এলাকাও।
দিল্লির দিক থেকে এখানে পৌঁছালে প্রথমেই পড়বে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (SKM) এর মঞ্চ, হরিয়ানামুখী হয়ে। টিকরি বর্ডারের চরিত্র কিছুটা হলেও সিংঘু থেকে আলাদা। এখানে মঞ্চ অনেক বেশি কৃষক মোর্চা দ্বারা পরিচালিত। অনেক সুসংবদ্ধ। অনেক বেশি রাজনৈতিক। এখানের পাঞ্জাবের মানুষ যেমন আছেন তেমনই আছেন হরিয়ানার কৃষকও। এবং সংখ্যায় হরিয়ানার কৃষক এখানে অনেক বেশি সিংঘু বর্ডারের তুলনায়। এখানে লঙ্গরের সংখ্যা কম। আন্দোলনে যোগদানকারী মানুষ যাঁরা ট্রাক্টর ও ট্রলি নিয়ে এসেছেন, ট্রলি বা তাঁবুতে থাকছেন, তাঁরা অনেকেই নিজেরা রেঁধে বেড়ে খাওয়া দাওয়া করছেন। এখানে পাঞ্জাবের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলির তাঁবু যেমন আছে তেমন হরিয়ানার বিভিন্ন কৃষক সংগঠন এমনকী খাপ পঞ্চায়েতের তাঁবুও আছে। আছে ট্রলি টাইমস নামে পাঞ্জাবী ও হিন্দিতে প্রকাশিত পত্রিকার অফিস। সেখানে সুদূর মহারাষ্ট্রের ভীড থেকেও স্বেচ্ছাসেবক এসেছেন কাজ করতে। তাঁরা আন্দোলনস্থলে বায়ো-টয়লেট বসানোর চেষ্টা করছেন, চেষ্টা করছেন আন্দোলন স্থল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে।
ছোট ছোট জমায়েতে মানুষ আন্দোলন নিয়ে তৈরি করা কবিতা-গান পাঠ করছেন। কেউ বা অমিত শাহ সেজেছেন। তাঁকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে লাঠি পেটার অভিনয় করছেন বাকিরা। চলছে সিংঘুর মতোই স্থানীয় চ্যানেলের নেওয়া সাক্ষাৎকার। এমনই এক সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া অজয় ভাল্লারার অশেষ দুর্গতির খবর পাওয়া গিয়েছিল দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর। তিনি ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষা দপ্তরের কোনো এক আধিকারিক। সাতদিনের ছুটি নিয়ে নিজস্ব তাগিদে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে। পরবর্ত্তী কালে ছুটি থেকে ফিরে গিয়ে তিনি জানতে পারেন তাঁকে suspend করা হয়েছে।
২৪ জানুয়ারির টিকরি বর্ডারও দারুন উত্তেজনায় ভরপুর। বক্সের গান, আন্দোলনের slogan এ মুখরিত সারা রাস্তা। ক্রমাগত ঢুকছে ট্রাক্টর ও মানুষ — বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এমন কী শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষও। মঞ্চ থেকে ভেসে আসা নেতৃত্বের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও উদাত্ত আহ্বান — কিষাণ একতা জিন্দাবাদ।
একটি তাঁবুতে দেখা গেল, বেশ কিছু মানুষ পোস্টার লিখছেন। বহু মানুষ আসছেন চিরকুট লেখা তাঁদের স্লোগান নিয়ে। আর স্বেচ্ছাসেবকরা তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলছেন আর্ট পেপারে, ছবিতে। এখানেই আলাপ হল পাঞ্জাবের ফরিদকোর্টের এক পাগড়িধারী ICSC স্কুল মালিকের সাথে। বয়স ৩৫। তিনি প্রায় একমাসের উপর এখানে রয়েছেন। আমরা এই আন্দোলন এতদিন ধরে কিভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে, উনি শোনালেন শিখ শৌর্য ও বীরগাথার ইতিহাস। তিনি বলেন পাঞ্জাবের লড়াইয়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন। তাঁরা আফগান – পাঠান – মোঘল সকলের সাথে লড়েছেন— রক্ষা করেছেন ভারতবর্ষকে আপামর ভারতবাসীর হয়ে। বন্দা বাহাদুরের মোঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প শোনান তিনি — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর বন্দীবীর কবিতায় লিখে গেছেন যাঁর কথা। এই কৃষক আন্দোলনকেও তাঁরা সেই ইতিহাসেরই এক ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন— তাই তাঁরা গর্জে উঠতে পারেন সদর্পে আজও - তিন কালা কানুন ওয়াপস। ইতিহাস সচেতনতার এক সুন্দর নিদর্শন দেখা গেল এখানেই একটি পোস্টারে। East India Companyর সাহেবদের পোষাকে আম্বানী-আদানী-মোদী। তেমনই রয়েছে নীলদর্পণ সম্পর্কে লেখা বইয়ের বড় করা photocopy।
এখানেই আলাপ হয় অর্চনা সিংয়ের সাথে। তিনি বলেন কৃষকের সাথে মাটির সম্পর্কের কথা। তিনি বলেন বাড়ির মেয়ে যেমন বাড়ির ইজ্জত — মাটিও কৃষকের কাছে তাই। এই তিন কালা কানুন মোদী ও আম্বানী – আদানীর মাটিকে ধর্ষিত করার পরিকল্পনা — তা তাঁদের ঘরের মেয়ের বেইজ্জতির সমান — তাই ‘বেটি’র সম্মান রক্ষার্থে তারা দৃঢ়, সংঘবদ্ধ কঠিন — তাঁরা ফিরে যাবেন না। কৃষকরা বোঝেন এই তিন কালা কানুন তাদের মাটির বেইজ্জতি — অপমান। তাঁরা পালা করে আন্দোলনে অবস্থান করবেন। প্রতি গ্রাম থেকে তাঁরা দুই তিনজন কৃষককে পাঠাবেন ট্রাক্টর ও যাবতীয় রাহাখরচ দিয়ে বর্ডারে। বাকী গ্রামবাসীরা সামলাবেন তাঁদের ফসল তাঁদের চাষ — যতদিন না তাঁরা আবার ফিরে আসেন গ্রামে। — যাবে আবারও এক নতুন দল বর্ডারে।
টিকরি বর্ডারে আরও একটি মঞ্চ ছিল কিষাণ একতা উগ্রাহান। এই মঞ্চ যদিও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ৪০টি দলের মধ্যে নেই কিন্তু আন্দোলনের শুরু থেকেই তাঁরা কিষাণ সংযুক্ত মোর্চার সাথে সংহতি রেখে আন্দোলনে থেকেছেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, বুঝিয়েছেন, কৃষকের পাশে থেকেছেন।
রাত নেমে আসে টিকরি বর্ডারে। গুরুবাণী শোনা যায়। কোনো এক তাঁবুর ভিতর থেকে। উঁকি মারতেই আসে গুরুবাণী শোনার ও পরে লঙ্গর সেবার নিমন্ত্রণ।
কিষাণ সংযুক্ত মোর্চার বিভিন্ন দল, উপদল, কিষাণ একতা উগ্রাহান, ক্রান্তিকারী কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ কমিটি খাপ পঞ্চায়েত গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি আরও কত নাম জানা না জানা সংগঠন এতগুলি ভিন্ন মত ও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ এই বিলের বিরুদ্ধে কিভাবে এককাট্টা হয়েছেন তা অবিশ্বাস্য লাগে। হিন্দু, শিখ, মুসলিম পরিচয় ভুলে এই অসাধারণ একতার সন্ধান পেতে ইচ্ছা করে।
পাঞ্জাবের মানুষের অসাধারণ সেবা, শৌর্য সংঘবদ্ধতা, দৃঢ়তা ও সহনশীলতার ইতিহাসই হয়ত এই দীর্ঘদিনব্যাপী আন্দোলনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই তারা যখন বলেন ‘ইয়ে লম্বা চলেগা’ — ভরসা হয় — বিশ্বাস জাগে।
গাজীপুর বর্ডার
দিল্লীর উত্তর পূর্ব প্রান্তে দিল্লী – উত্তরপ্রদেশের বর্ডার গাজীপুর। এখানে রয়েছে ১২ লেনের ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারের একদিকে দুটি লেন নিয়ে প্রায় তিন কিমি লম্বা কৃষক অবস্থান। ২৭ জানুয়ারির সকালে প্রায় ৮টি লেন দিয়েই চলছিল স্বাভাবিক দুমুখী গাড়ি চলাচল। পুলিশি তৎপরতা অন্য বর্ডারগুলির তুলনায় একটু বেশিই চোখে পড়েছিল। হয়ত বা ২৬ জানুয়ারির লালকেল্লার ঘটনার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন হিসাবে।
গাজীপুরের সংযুক্ত কৃষক মোর্চার মঞ্চ দিল্লিমুখী। মঞ্চের প্যান্ডেলে রয়েছে ভগত সিং, নেতাজী, মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের ছবি। উপরে তাকালে চোখে পড়ে হাইওয়ের উঁচু থাম্বায় পথনির্দেশের বোর্ডগুলিতে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কৃষকেরা। ‘‘Corporate ভাগাও দেশ বাঁচাও’’, ‘‘কিষাণ দেশ কি শান হ্যয়, ফির ঠান্ডমে সড়কোপর কিউ পরেশন হ্যায়’’
মঞ্চে আসছিলেন বিভিন্ন কৃষক ইউনিয়নের বক্তারা — হান্নান মোল্লা, রাকেশ টিকায়েত, আরও অনেক ছোট বড় নেতারা। তাঁরা কৃষক আইনগুলি সম্পর্কে বলছিলেন — উজ্জীবিত করছিলেন মানুষকে – প্রস্তুতি নিতে বলছিলেন এক লম্বা লড়াইয়ের।
দর্শকাসন ছিল ভর্তি। প্রথম দিকে মহিলা ও তারপর পুরুষেরা। পাঞ্জাবী লাল, নীল, হলুদ সবুজ পাগড়ির সাথেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশীর সাদা বা সবুজ গান্ধী টুপির সমাহার। সালোয়ার – কামিজ পরিহিতা সর্দারনীদের সাথে দেখা গেল উত্তরপ্রদেশীয় রীতিতে শাড়ী পড়া ঘোমটা দেওয়া জাঠনীদেরও। মুসলিম মহিলা ও পুরুষের সংখ্যাও ছিল ভাল। এখানেও বহু মানুষ এসেছেন তাঁদের ট্রাক্টর, ট্রলি ও তাঁবু নিয়ে, রাস্তার দুধারে অস্থায়ী বাসস্থান বানিয়েছেন তাঁরা। লঙ্গর চলছে, মুসলিম লঙ্গরখানাও চোখে পড়ল — ঐদিন চাউমিনও জুটে গেল লঙ্গরখানায়। মেডিকেল ক্যাম্প, টয়লেটের ব্যবস্থাও রয়েছে সিংঘু বা টিকরির মতো। মহিলাদের জন্য আলাদা তাঁবু, তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তাঁবুও চোখে পড়ল।
শোনা গেল ২৬ জানুয়ারির রাতে সেনা টহল ছিল খুব জোরদার। এমনকী জল, বিদ্যুৎ সংযোগও কেটে দেওয়া হয়েছিল। বিক্ষোভরত মানুষ সারারাত আগুন জ্বালিয়ে পাহারা দিয়েছেন জমায়েত স্থল। তারই ইতি-উতি আগুন চোখে পড়ল তাঁবু ও ট্রলির সামনে।
আলাপ হল SUCI (AIKKMS) এক সদস্যর সাথে। তিনি এসেছেন মীরাট থেকে। তিনি দিল্লিতে কোরিয়ান ভাষা শেখেন। কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। যাতায়াত করছেন জমায়েতে প্রয়োজন মতো। এই শীত – বর্ষা অগ্রাহ্য করে এখানে থাকার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন— কৃষক প্রকৃতির সাথে লড়েই ফসল ফলায়— তাঁকে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি দুইই সয়ে নিতে হয় — অতএব প্রকৃতির সাথে লড়াই করা কৃষকের কাছে দিল্লির শীত বা গ্রীষ্ম, কোনোটাই প্রখর নয় — মাটিরক্ষার লড়াইয়ে। তাই তাঁরও একই বলিষ্ঠ জবাব — ‘ইয়ে লম্বা চলে গা’ — যতদিন না তিন কালা কানুন ওয়াপস হবে।
দিনের শেষের শেষ সাক্ষাৎটি হল জীবনের শেষ সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া, কিন্তু মননে ও দৃঢ়তায় বলিষ্ঠ এক ৯৩ বছরের বৃদ্ধের (নাকি যুবক বলব?) সাথে। পরে জানা যায় ইনি কৃষক আন্দোলনের বয়স্কতম ব্যক্তি। ছেলে, নাতি, পুতি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মেরঠ থেকে। আছেন জমায়েতে প্রায় একমাস ধরে। বিশালাকৃতি হুঁকার নলটি হাতে নিয়ে কথা বললেন আমাদের সাথে। অভিজ্ঞতা ও বয়সের ভারে ন্যূব্জ নয় বলিষ্ঠ, দৃঢ়, ভঙ্গিতে দৃপ্ত স্বরে জানান — আমি এখানে আছি, যতদিন না তিন কালা কানুন ‘ওয়াপস’ হয়।
২৬ জানুয়ারির লালকেল্লার ঘটনার পরে গাজীপুর যদিও কিছুটা থমমত, একটু চুপচাপ, চোখে পড়ে কিছু মানুষের ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতিও। আগের দিনের কড়া পুলিশি পাহারা, প্রশাসনের জল-বিদ্যুৎ বন্ধ করা, সব অগ্রাহ্য করে তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান করেছেন, করছেন ও করবেন। দুপুরের রোদে ধোঁয়া উঠছে তখনও, তাঁদের অস্থায়ী আস্তানার সামনে রাতের আগুনের। কাছেই বাড়ছে পুলিশি তৎপরতা, আরও paramilitary force এর route march। তবু পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের ফিরে যাবার কথা ভাবেন না। তাঁদের একটাই মন্ত্র — তিন কালা কানুন ওয়াপস — হাম ঘর ওয়াপস’।