সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
২
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল পর্ব
সংযোজনঃ রামমোহন পর্ব
রামমোহন পর্ব ছাপতে চলে যাওয়ার পর আমার এক শুভানুধ্যায়ী পাঠক এ লেখার খসড়া পড়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ এনেছেন। এক, ‘পশ্চিমী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশে অচল’ আমার এই উক্তি বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদলকে যথেষ্ট উৎসাহ জোগাবে, কারণ তারাও এই কথা বলেই হিন্দু রাষ্ট্র চায়। দুই, যদিও আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাংলায় উপনিবেশিকতাঃ প্রতিরোধ ও শিকার’, কিন্তু লেখায় রামমোহন কিসে কিসে উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছিলেন সেকথা থাকলেও তাঁর কাজে উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ কিভাবে ঘটেছিল সেকথা নেই। তাঁর দুটি অভিযোগই যথার্থ এবং গুরুতর, অতএব আর একটু আলোচনার প্রয়োজন আছে।
প্রথমে রামমোহনের কথাটা সেরে নিই। রামমোহনের কাজে আমার সীমিত বিবেচনায় উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ দুভাবে ঘটেছিল। এক, তাঁর ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। দুই, আন্তর্জাতিকতায় তাঁর বিশ্বাসের সজোর ঘোষণার মধ্যে দিয়ে।
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম -- আমাদের দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক ধারার আন্দোলনগুলো তখনো অব্দি ধর্মের ধারাতেই গড়ে উঠত, তার কারণ ভারতবর্ষ পৃথিবীর একমাত্র দেশ ধর্ম যেখানে সমাজপদ্ধতি বা জীবনধারা হিসেবে প্রবাহিত, সাম্প্রতিককালের বসু-দত্তের ভাষায় “[u]nlike the strict Anglo-Saxon positivist approach, ‘dialectics’ do not require a leap of faith – the thought system of India.”১ রামমোহন এই ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসরণেই তাঁর ব্রাহ্মধর্মকে গড়ে তুলেছিলেন এবং পূর্বসূরীদের থেকে আরো তীব্রভাবে ধর্মকে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সে অভিপ্রায় জন ডিগবিকে লেখা চিঠিতে এইভাবে প্রকাশ পেয়েছিল
I regret to say that the present system of religion adhered to by the Hindus is not well calculated to promote their political interest. ....It is, I think, necessary that some change should take place in their religion, at least for the sake of their political advantage and social comfort.২
এই চিঠিতে রাজনৈতিক স্বার্থ কিভাবে ধর্ম দ্বারা সাধিত হতে পারে এবং ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ বলতে রামমোহন ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন এ ব্যাপারগুলো অনেকের কাছেই এখন ধোঁয়াশার মতন। প্রথমে আসা যাক রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্কের কথায়। আমরা যারা স্বাধীন ভারতে জন্মেছি, রাজনীতি সম্বন্ধে তাদের ধারণা পুরোপুরি আলাদা। একেবারে সাম্প্রতিক যারা তারা তো দলীয় রাজনীতির ঘোঁটের ঊর্ধ্বে কোনো রাজনীতির সঙ্গে পরিচিতই নয়। একটু পুরোনো যারা রাজনীতিকে এখনো বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখতে পারি, সেই আমরাও মনে করি রাজনীতি আর ধর্মের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এবং স্বাধীন ভারতের চর্চিত রাজনীতির ধারায় সে সম্পর্ক যখন দেখি, তখন আমরা যারপরনাই বিরক্ত এবং উত্যক্ত বোধ করি। যদিও আমরা যা দেখি সেটা ‘ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার’, ‘রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার বা ধার্মিকতা’ নয়। কিন্তু দুটো যে পরস্পরবিরোধী ব্যাপার তা আমরা মাথায় রাখতে পারি না, তার কারণ উপনিবেশিকতার ধারায় গড়ে ওঠা আমাদের মননে এ ধারণা চেপে বসে আছে যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকতে পারে না। এই ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের রেনেসাঁচর্চা থেকে। রামমোহন থেকে সে চর্চার শুরু এবং এখনো বহমান। উপনিবেশিকতার সঙ্গে আমাদের বৌদ্ধিক সম্পর্ক এতটাই গভীর যে বাংলার নবজাগরণের নামও আমরা রেখেছি ‘বাংলার রেনেসাঁ’, ঠিক যেমন ডিরোজিও হলেন ‘ভারতের বায়রন’, রামগোপাল ঘোষ হলেন ‘ব্ল্যাক ডিমোস্থেনিস’, অন্ধকবি হেমচন্দ্র হলেন ‘বাংলার মিল্টন’, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র হলেন ‘বাংলার গ্যারিক’ ইত্যাদি।
ব্যাপার হচ্ছে আমাদের মত প্রবল ধর্মপ্রাণতার দেশে এবং ধর্ম যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়, ব্যক্তিগত ব্যাপার তো নয়ই, সামাজিক ব্যাপার, রেনেসাঁর মত কোনোকিছু ঘটাই সম্ভব নয়। রেনেসাঁয় চার্চের অনুশাসন আর মুক্তচিন্তার চর্চায় বিরোধ বেধেছিল এবং তার থেকে দুয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক, তার বজ্র-আঁটুনির হাত থেকে ভেঙে বেরোনোর জন্যে বিরোধিতার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানের ভিত্তি যে আরোহী-অবরোহী পদ্ধতি চার্চ তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তার ক্ষেত্র উন্মুক্ত, যে কেউ ইচ্ছে করলে তার শক্তির সাহায্য নিয়ে ভালো কিছু করতে পারে আবার মন্দ কিছুও করতে পারে এবং আমাদের দেশে ধর্মদর্শন আরোহী-অবরোহী পদ্ধতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি। ধর্মকে কেন্দ্র করে আমাদের ইতিহাসে ঘটনার ভালোমন্দ দুটোই প্রবলভাবে ঘটেছে, কিন্তু তার জন্যে ধর্ম মিথ্যে হয়ে যায়নি। সৌভাগ্যের কথা, আমাদের ধর্মনায়করা বারেবারে ধর্মের শুভশক্তিকে অবলম্বন করেই সমাজকে গতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে রামমোহনও সেই চেষ্টাই করেছিলেন এবং এতদ্বারা ‘রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না’ এহেন উপনিবেশিক ধারণার প্রতিরোধও করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মজ্ঞ কেবল ধর্ম নিয়ে থাকবেন আর রাজনীতিজ্ঞ কেবল রাজনীতি নিয়ে থাকবেন এটা খুব ভ্রমাত্মক ও ক্ষতিকর মত। রামমোহনের মত ছিল, তাঁর জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, “ধর্ম ঈশ্বরের, রাজনীতি কি শয়তানের? যাহা কিছু সত্য, পবিত্র ও হিতকর, তাহাই ঈশ্বরের। মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের সহিত পরমেশ্বরের সম্বন্ধ।”৩ রামমোহনের থেকে প্রায় একশ বছর পেরিয়ে এসে গান্ধীজিও প্রায় একই কথা বলেছিলেন (“ধর্মের থেকে যারা রাজনীতিকে আলাদা করে তারা ধর্ম বোঝে না”৪), কিন্তু তাঁর সে কথায় এ দেশের ক্ষমতালোভী এলিটরা কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করে নি। অথচ ঘটনা হচ্ছে আমাদের দেশের কাঠামোতে প্রাক্-ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত রাজনীতির (ও সমাজনীতির) সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তাকে বলে রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার বা ধার্মিকতা, আশিস নন্দীর ভাষায় ‘religious use of politics’৫। এর ঠিক উল্টো পিঠেই অবস্থান ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বা ‘political use of religion’এর, বর্তমানে বিজেপি যার অত্যন্ত সুনিপুণ ব্যবহার করে চলেছে। তবে এ ব্যাপারে বিজেপি একা দোষী নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হয়ে আসছিল। যা ছিল স্যাকরার ঠুকঠাক, বিজেপি তাতেই কামারের এক ঘা দিয়েছে এই মাত্র। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান যা আমরা ব্রিটিশ প্রভুদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের দেশে বিশেষত যে প্রটেস্টান্ট ধর্মপ্রচারকরা এসেছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই ভারতে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ধর্মীয় ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে গেছেন এবং অপরদিকে বিশেষত কোম্পানি আমল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদও নিজেদের স্বার্থে নানাভাবে তাঁদের ধর্মতত্ত্ব এবং সুসমাচারকে প্রভাবিত ও ব্যবহার করে গেছে। এতটাই যে একবার রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বলেছিলেন যে, “[f]irst comes the Missionary, and then comes the Resident, lastly comes the Regiment.”৬
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম কিভাবে লৌকিক অর্থাৎ রাজনৈতিক বা ব্যবহারিক স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে এ প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তখনকার দিনেও উঠেছিল। বেদান্তগ্রন্থের ভূমিকায় তার উত্তরে রামমোহন লিখেছিলেন
তৃতীয় বাক্য এই যে ব্রহ্ম উপাসনা করিলে মনুষ্যের লৌকিক ভদ্রাভদ্র জ্ঞান থাকে না এবং দুর্গন্ধি সুগন্ধি আর অগ্নি ও জলের পৃথক্ জ্ঞান থাকে না অতএব সুতরাং ঈশ্বরের উপাসনা গৃহস্থ লোকের কিরূপে হইতে পারে। উত্তর। তাঁহারা কি প্রমাণে এ বাক্য রচনা করেণ তাহা জানিতে পারি নাই জেহেতু আপনারাই স্বীকার করেণ জে নারদ জনক সনৎকুমারাদি শুক বশিষ্ঠ ব্যাস কপিল প্রভৃতি ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন অথচ ইহারা অগ্নিকে অগ্নি জলকে জল ব্যবহার করিতেন এবং রাজ্যকর্ম্ম আর গার্হস্থ্য এবং শিষ্য সকলকে জ্ঞানোপদেশ যথাযোগ্য করিতেন......৭
এই বাক্যে রামমোহন মোদ্দা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে গোড়ার কথাটা হল ধর্ম এবং ব্রহ্মজ্ঞানী হলে জীবন্মুক্ত হওয়া যায়, অতএব লৌকিক বা ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে ব্রহ্মজ্ঞানীর পক্ষে কোনো বাধা নেই। উদাহরণস্বরূপ তিনি নারদ, জনক, সনৎকুমার, শুক, বশিষ্ঠ, ব্যাস, কপিল ইত্যাদিদের উদাহরণ টেনে এনেছিলেন। তার মধ্যে রাজর্ষি জনক এবং শুকদেবের উদাহরণ বহুচর্চিত। ছোটবেলায় পড়ার সুবাদে রাজর্ষি জনক এবং শুকদেবের কথোপকথনের গল্প, বিশেষ করে শুকদেবের তেলের বাটি নিয়ে শহর পরিক্রমার গল্প হয়ত আমাদের অনেকেরই মনে আছে। শুকদেব বৈদেহ জনকের নির্দেশে তেলের বাটি হাতে শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। তিনি সবই দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর তেলের বাটি থেকে একফোঁটা তেলও মাটিতে পড়েনি। বৈদেহ জনক যখন তাঁকে জিগ্যেস করলেন, এমনটা কী করে সম্ভব হল, তিনি বলেছিলেন, তিনি শহরের সবকিছুই দেখেছেন, কিন্তু কোনোকিছুই আসক্তি নিয়ে দেখেন নি, তাঁর মন ছিল তেলের বাটির দিকে। তখন রাজর্ষি জনক বলেছিলেন যে তিনিও সেভাবেই রাজত্ব চালান, করেন সবকিছুই, কিন্তু তাঁর মন থাকে ব্রহ্মে।
দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থ বলতে রামমোহন ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারটা বোঝা খুব শক্ত না। কৃষি শিল্প বাণিজ্য, জমিদার প্রজা থেকে শুরু করে ব্যবস্থা প্রণয়ন রাজ্যশাসন ও বিচার এই তিন বিভাগের স্বতন্ত্রতা, আইন প্রচারের আগে দেশীয় প্রতিনিধিদের পরামর্শ নেওয়া, দেশীয়দের উচ্চপদ লাভ, মুদ্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কিত আইন—এসব নিয়ে তিনি যা লিখে গেছেন সবই দেশের লোকের হয়ে রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে। রামমোহন ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিলেন না। তিনি যেটা চেয়েছিলেন সেটা হল একদিকে ব্রিটিশ শাসন ধর্মের ধারা অনুসরণ করুক, অপরদিকে ধর্ম দ্বারা চালিত হয়েই তাঁর দেশবাসী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করুক অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্জন করুক। এখানে ধর্ম বলতে মন্দির–মসজিদ–গির্জা বা তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বোঝানো হয়নি, বোঝানো হয়েছিল ধর্ম আমাদের মধ্যে যে নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম দেয় সেই ধর্মকে।
ডিগবিকে লেখা রামমোহনের চিঠির দুটো শব্দ কিন্তু বিতর্কমূলক। অনেক সময়ই মনে হয়েছে রামমোহন যদি ডিগবিকে লেখা তাঁর চিঠিতে ‘social comfort’ শব্দদুটো ব্যবহার না করে ‘social good’ শব্দদুটো ব্যবহার করতেন, তাহলে রামমোহনের নামে এ অভিযোগ আনা যেত না যে তিনি উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু রামমোহন খুব সচেতনভাবেই ‘social comfort’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন কারণ এই শব্দদুটো তিনি পেয়েছিলেন ফ্রান্সিস বেকনের কাছ থেকে। ‘Advancement of Learning’এ বেকন সমাজকল্যাণ অর্থে সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যই বুঝেছেন ([f]or the man seeketh in society comfort, use and protection৮) এই সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে বেকন প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের জন্যে নয়, প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করার চাবিকাঠি হিসেবে (our Saviour showed His power to subdue nature by His miracles৯)। এইখানেই বেকনের ধারণা থেকে ভারতীয় ধারণা আলাদা হয়ে যায়। প্রকৃতিকে বশীভূত ও তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ পরবর্তীকালে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করার প্রবণতা থেকে উৎপন্ন বেকনের সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য (ফ্রান্সিস বেকন ছিলেন একজন অ্যাংলিকান, প্রটেস্টান্টরা যার একটা শাখা। আর এই প্রটেস্টান্ট নীতিবোধের সঙ্গে পুঁজিবাদী উদ্দীপনার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ জানার জন্যে এই বিষয় নিয়ে লেখা ম্যাক্স বেবারের বিখ্যাত বই Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism১০ পড়ে দেখা যেতে পারে) শেষপর্যন্ত স্বাভাবিক ছন্দেই কতিপয় লোকের ভোগে পরিণত হয়। ভারতীয় ধারণায় ভোগকে আদর্শ বলে গ্রহণ করাই হয়নি যে কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনোকিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে আজো ভালো চোখে দেখা হয় না। রামমোহন যে একথাটা তলিয়ে ভাবেন নি তার কারণ তিনি একটা নির্দিষ্ট উত্তাল সময়ের ফসল।
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্মকে অনেকে খ্রিস্টধর্মের অনুকরণ বলতে চান, ফার্কুহার১১ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের রিচার্ড কিং১২ পর্যন্ত (যদিও দুজন পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে পৌঁছন), কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। ভারতবর্ষ সমন্বয়ে বিশ্বাসী, সুতরাং এ অভিযোগ অযথার্থ। কর্তাভজা ধর্মেও খ্রিস্টধর্মের মিশেল ঘটেছিল, তার জন্যে সেটা অনুকরণ হয়ে যায়নি। “কর্তাভজাদের দশ নিষেধবিধি এবং ‘দায়িক মজলিশ’ নামক অনুষ্ঠান যথাক্রমে Ten Commandments এবং confession of sin-এর অনুরূপ একথা স্বীকার্য।”১৩ রামমোহন যেটা করতে চেয়েছিলেন সেটা হল মধ্যযুগীয় তথা সামন্তযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে (হিন্দু)ধর্মকে উদ্ধার, যখন নাকি, ডি ডি কোসাম্বির ভাষায়, “[e]verything regarded as the best in India’s philosophy was then available, but the applications left something to be desired.”১৪ তিনি যে খ্রিস্টের অনুরাগী ছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মের অনেককিছু নিয়েছিলেন, তা থেকে এটা প্রমাণ হয় না যে তিনি খ্রিস্টধর্মের অনুকরণ করেছিলেন।
রামমোহনের আন্তর্জাতিকতা -- আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নেও রামমোহন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারারই অনুসরণ করেছেন। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ ‘সারা বিশ্ব এক পরিবার’ এই তত্ত্বে তাঁরও বিশ্বাস ছিল। আমাদের দেশের উপনিবেশিক শাসনের অধীন থাকা না থাকার প্রশ্নে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ততা স্পষ্ট, কিন্তু ‘সারা বিশ্ব এক পরিবার’ এ বিশ্বাসে কোনো খাদ ছিল না। তিনি যে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন তার মূলে ছিল আন্তর্জাতিকতায় তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। জাতীয়তাবাদ আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান এবং রামমোহন সে উপাদানের বিরোধিতা করেছিলেন।
রামমোহনের আন্তর্জাতিকতা যে বায়বীয় ছিল না, তার প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা। তাঁর বিশ্বজনীনতার শেকড় ছিল এ দেশেই। তবে তাকে জাতীয়তা বলে না, বলে স্বাদেশিকতা। বাংলা স্বাদেশিকতা থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু “আধুনিকতার বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে,” সখেদে লিখেছেন রণজিৎ গুহ, “স্বাদেশিকতা পরিণত হয় রাষ্ট্রক্ষমতার কাঙাল রাজনীতিতে এবং তারই যুগসম্মত রূপ জাতীয়তাবাদে।”১৫ এই জাতীয়তাবাদই ক্রমে ক্রমে হিন্দু জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা -- আসা যাক ‘পশ্চিমী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশে অচল’ একথা ঠিক না ভুল প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার দুধরনের ধারণা ক্রিয়াশীল—পশ্চিমী ও ভারতীয়। পশ্চিমী ধারণা বুদ্ধিজীবী স্তরে, ভারতীয় ধারণা রাষ্ট্রীয় স্তরে। আর জনগণীয় স্তরের কথা যদি বলা যায়, সে স্তরে ধর্মসাপেক্ষতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতাও নেই, কারণ তাদের ধর্মচেতনাটা একেবারে আলাদা ধাঁচের, তাকে বলা যায় লৌকিক ধর্মচেতনা।
ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটা আশিস নন্দী এইভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, “পশ্চিমী ধারণা অনুযায়ী ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আসতে পারে একমাত্র জনসাধারণ্যে ধর্মের অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে এবং রাজনীতিকে ধর্মের হাত থেকে মুক্ত করে। রাজনীতি যত ধর্ম দ্বারা কম সংক্রামিত হবে, রাষ্ট্র ততই ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি পবিত্র শব্দের বিপরীত। কিন্তু ভারতীয় ধারণা অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা পবিত্র শব্দের বিপরীত নয়, জাতিকেন্দ্রিকতা, বিদেশাতঙ্ক এবং ধর্মীয় উন্মাদনার বিপরীত। অর্থাৎ একজন ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে হয় সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে অসম্মান করে অথবা সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে সম্মান করে।”১৬ ভারতীয় বিদ্বজ্জনেরা প্রধানত ‘অনাধুনিক’ (আশিস নন্দী) দ্বিতীয় ধারণাটাকেই গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয় ধারণাটাকে গ্রহণ করার কারণ, আশিস নন্দীর ব্যাখ্যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃস্থানীয়রা বুঝতে পেরেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতার ইয়োরোপীয় ধারণা এদেশে চলবে না, কারণ এদেশে গড়পড়তা ভারতীয় গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ, তাই তাঁরা প্রাক্-আধুনিক ইয়োরোপে চার্চ–রাষ্ট্রের যে বিভাজন-বিতর্ক এদেশে তার আমদানি করতে চাননি।১৭
এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না। আমাদের অনেকেরই হয়ত মনে আছে যে আমাদের সংবিধানে গোড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা ছিল না। এটা যোগ হয় ১৯৭৫ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের সংবিধানের প্রায় খোলনলচে পাল্টে দেন। যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ যোগসাধন সংবিধানের ভূমিকায় ঘটে তার মধ্যে একটা হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। অথচ ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর গণপরিষদে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়, কিন্তু স্বয়ং নেহরু এবং অম্বেদকর শেষপর্যন্ত সংবিধানের ভূমিকায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা এই জন্যে ঢোকাতে চাননি, প্রটেস্টান্ট ধর্ম থেকে উদ্ভূত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা আমাদের দেশে খাটবে না এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। তাঁরা জানতেন ধর্ম আমাদের দেশে পশ্চিমের দেশগুলির মত কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয় (মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে সমাজ আগে ব্যক্তি পরে) এবং গণতন্ত্রকে যদি শক্ত বনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে হয় তাহলে ধর্মপ্রাণ ভারতীয় সমাজের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের সম্পর্কই তার ভিত। তাই এ সম্পর্কে অম্বেদকর বলেছিলেন, “what should be the policy of the state, how the society should be organised in its social and economic side are matters which must be decided by the people themselves according to time and circumstances. It cannot be laid down in the Constitution itself because that is destroying democracy altogether.”১৮
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কোনোকিছু আগে ছিল না এবং তা থাকতেও পারে না। পালরাজারা ঘোষিতভাবেই বৌদ্ধ ছিলেন অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, কিন্তু তাতে দেশে সনাতনধর্মের পক্ষবিস্তার করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মধ্যযুগে যখন সদ্য সদ্য মুসলমান শাসকরা শাসন করতে শুরু করেন তখন কিছু অশান্তি হয়েছিল, কিন্তু ইসলামের সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হওয়ার পর থেকে প্রথমদিকের সে ভুলবোঝাবুঝি কেটে যায় এবং চৈতন্য, নানক, কবির, দাদূ, শঙ্করদেব, রুইদাস, রবিদাস কারুরই ধর্মপ্রচারে কোনো অসুবিধে হয়নি। সংকীর্ণ মানসিকতা প্রাচীন যুগে ছিল, মধ্যযুগেও ছিল। তার হিন্দু মুসলমান নেই।
তবে সত্যি বলতে কি, সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে ভারতীয় লোকসমাজকে জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান, শিখ, ইসাই—এভাবে ভেঙে বিচার করাটাই ভুল। কারণ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ধর্মাচরণে এসব ধর্ম (বিশেষত হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে) এ ওর সঙ্গে ও তার সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে বিশেষ একটি ধর্মের নামে তাদের যে অবস্থান সেটি একটি আপাত-অবস্থান হিসেবেই চিহ্নিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মুসলমানদের উদ্ভব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ইটন১৯ যে বাংলার লৌকিক সমাজের কথা বলেছিলেন মনে হয় সেটা গোটা দেশের সম্পর্কেই খাটে। এই সমাজকে লৌকিক সমাজ হিসেবে এবং এই লৌকিক সমাজের ধর্মচেতনাকে লৌকিক ধর্মচেতনা হিসেবে গ্রহণ করাটাই শ্রেয়। এই লৌকিক ধর্মসমাজের কোনো সাপেক্ষতা নেই, কোনো নিরপেক্ষতাও নেই। যেহেতু এই লৌকিক সমাজের কোনো সাপেক্ষতা নেই, হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় শাসকদলের যে উৎসাহ তারও কোনো ভিত্তি থাকে না।
কেউ বলতে পারেন ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের আপাত-অবস্থানের নিরিখে আমরা যেহেতু কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ খ্রিস্টান ইত্যাদি, সেক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মের ব্যাপারে আমাদের সাপেক্ষতা থাকবেই এবং ধর্মনিরপেক্ষতাটা বস্তুত রাষ্ট্রের ব্যাপার। তাহলেও শব্দটা ধোপে টেঁকে না, কারণ আমাদের দেশে গণতন্ত্র এই লোকসমাজকে বেড় দিয়েই বেড়ে ওঠে এবং নানা ধর্মমতাবলম্বী মানুষজন যখন রাষ্ট্রের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রবেশ করে তখন তাদের পক্ষে তাদের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসকে দরজার বাইরে রেখে আসা অসম্ভব। এরকম পরিস্থিতিতেও আমাদের যেসব রাষ্ট্রনায়ক ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদের সেইসব চেষ্টার ফাঁকগুলোর আলোচনা আশিস নন্দী করেছেন। তবু ব্যক্তিত্বের জোরে ইতিহাসের নজরে তাঁরা খানিকটা পার পেয়ে গেছেন, কিন্তু রাজনীতি যত লোকসমাজে শেকড় গাড়বে, এই পার পাওয়া ব্যাপারটা সহজ থাকবে না, সংকট ঘনীভূত হবে। এই অবস্থা থেকে বেরোনোর একটাই রাস্তা, আমাদের মত বহু ধর্মের দেশে ধর্মচেতনার সঠিক হিসেব কষা। সে হিসেব কষলে আমরা দেখব তার সাপেক্ষতা নেই, নিরপেক্ষতাও নেই।
এখানে ইচ্ছে করেই সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে ‘তাদের’ শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারণ আমাদের, এই মধ্যবিত্তসমাজের, প্রকৃত অর্থে ধর্মচেতনা বলে কিছু নেই, যে কারণে মূল্যবোধ বলেও কিছু নেই। এই মধ্যবিত্তসমাজ দুভাগে বিভক্ত। একটা খুব ছোটো অংশ, মূলত এলিট, ধর্মকে জনগণের আফিং বলে মনে করে এবং ধর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত দেখতে চায়। তা বলে এদের ধর্মচেতনা নেই তা নয়, এদের ধর্মের নাম হল ‘বিজ্ঞান’ (তাও আবার মূলত পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারা)। এরা বিজ্ঞানের খুব ভক্ত, বিজ্ঞান যে ভোগের রাস্তা খুলে দিয়েছে, যে উন্নতির সোপান এদের সামনে হাজির করেছে এদের চোখে তার কোনো বিকল্প নেই, কারণ এরা সেই রাস্তা ধরে চলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। যেহেতু বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে বিশেষ করে এদের নিজেদের নানারকমের আহরণমূলক সাফল্য জড়িয়ে আছে তাই এরা বিজ্ঞানকে অহরহ দেশবাসীর সামনে বিকল্প আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে এবং নিজেরা নিজেদের চোখ ঠারে। দেখেও দেখে না যে ধর্মের মত বিজ্ঞানেরও ভালোমন্দ দুটো করার ক্ষমতাই প্রবল। ধর্মকে কেন্দ্র করে যেমন, তেমনি বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেও আছে ‘বিত্ত ও ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত কিছু অশুভ মানুষের ষড়যন্ত্র’। এরা ভুলে যায় যে এই বিজ্ঞানই আমাদের ক্রমশ ভোগবাদের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। ভুলে যায় যে আজকের দিনে বিজ্ঞান বলতে বেশি বোঝায় আণবিক কিংবা রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্র, পারমাণবিক শক্তি, অ্যাসিড-বৃষ্টি, পরিবেশ দূষণ, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য-ব্যাংকের কারণে ব্যক্তিগত অধিকার লোপ। সেই কোন্ ১৯৩৪ সালে হেনরি মিলার লিখেছিলেন, “[t]he wallpaper with which the men of science have covered the world of reality is falling to tatters. The grand whorehouse which they have made of life requires no decoration.”২০ আজকের দিনে বিজ্ঞান নিয়েও বড় মুখ করে বলার কিছু নেই। বিজ্ঞান অবশ্যই খুব প্রয়োজনীয়, কিন্তু সে যখন পাল্টা ধর্ম হয়ে ওঠে, তখন তার গোঁড়ামোও একইভাবে আমাদের ভাবনাকে ছেয়ে ফেলে এবং বিশেষ করে উপনিবেশিক দেশে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া খুব শক্ত হয়ে যায়। এ গেল একদিকের কথা। অপরদিকে, চরিত্রগতভাবে ফাঁপা মধ্যবিত্তসমাজের বড় অংশটা সংস্কারগতভাবে ধর্মীয় আচারগুলো পালন করে চলে এবং একই সঙ্গে অন্ধের মত বিজ্ঞানেরও অনুসরণ করে চলে, যদিও দুটোর কোনোটার সঙ্গেই তাদের কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই এবং এসব নিয়ে নেই কোনো সুগঠিত ভাবনাচিন্তাও। দুয়েরই আছে নিজ নিজ বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে প্রচুর ভুয়ো অহংকার এবং কথায় কথায় যে কোনো বিষয় নিয়ে ফতোয়া জারি করার প্রবণতা। সবই ক্ষমতামদমত্ততার প্রকাশ। ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুইয়েরই রাজনৈতিক ব্যবহারে তার নিত্য প্রকাশ আমরা দেখি।
এরিক ফ্রম তাঁর ‘Art of Loving’ গ্রন্থে ঈশ্বর ভাবনাকে কেন্দ্র করে দুরকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন--পশ্চিমের ‘Thought Experience’ বা ‘চিন্তাপ্রসূত অভিজ্ঞতা’ এবং পূবের ‘Intense Feeling Experience’ বা ‘নিবিড় অনুভূতিপ্রসূত অভিজ্ঞতা’২১। ভারতীয় ধর্মদর্শনের সঙ্গে তাঁর যদি সম্যক পরিচয় থাকত তাহলে তিনি দেখতেন ভারতবর্ষে নিবিড় অনুভূতিপ্রসূত অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তাপ্রসূত অভিজ্ঞতার কি চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে। এর সবথেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নব্যন্যায়। নব্যন্যায়মতে দ্রব্য বা substance হচ্ছে নয়প্রকার – পৃথ্বী, অপ, তেজস, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মনস। এই তত্ত্ব দ্বারা নব্যন্যায় আমাদের আস্তিক নাস্তিক সমস্ত দর্শনকে পুনর্বিন্যস্ত করেছিল। দ্রব্যের একপ্রকার হচ্ছে আত্মা, যার আবার দুটি ভাগ – জীবাত্মা ও পরমাত্মা। এর ফলে আস্তিক দর্শন যে এতদিন ধরে ঈশ্বরকে (পরমাত্মা) মানবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখে আসছিল, তা আর থাকল না। ঈশ্বর দ্রব্যের ধারণাগত হয়ে গেলেন (তুলনীয় বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ যেখানে পদার্থের পরে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে)। অপরদিকে অবস্তুগুলিকেও দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেখানোর ফলে নাস্তিক বা বস্তুবাদী দর্শনের (চার্বাক) ধারণাও আর থাকল না এবং এই পুরো কাজটাই নব্যন্যায় করেছিল আরোহী পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নব্যন্যায় সিদ্ধান্ত থেকে তত্ত্বের বিশ্লেষণে যায়নি, তথ্যের সমাহার থেকে সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত থেকে তত্ত্বে পৌঁছেছিল। নব্যন্যায় কর্তৃক এই আরোহী পদ্ধতির উদ্বোধনই আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করে। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের ভাষায়, “The masters of Navya Nyaya did not lay down conclusions first and justify them later with theory. They were seriously engaged in following reality wherever it might lead them, imposing as softly as possible their own prejudices. I have admired this trait greatly. It is precisely the same trait that I find admirable among the creative workers of modern science and philosophy.”২২
ব্রাহ্মধর্ম যে পৌত্তলিকতার বিরোধিতায় জন্ম নিয়েছিল, সে বিরোধিতা সেসময় দেশের যা পরিস্থিতি ছিল তাতে প্রয়োজনীয়ই ছিল। হয়তবা এখনো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার আগে এই কথাটাও জানতে হবে যে এই পৌত্তলিকতার মধ্যে দিয়েই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ভোগবাদ থেকে দূরে থাকে এবং এদেশের বহুত্ববাদী কাঠামোকে রক্ষে করে। এবং পৌত্তলিকতার ভাবগত দিক আমাদের ধর্মদর্শনের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। একথা বিশ্বাসযোগ্য না হলে, যে কেউ অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা’র পাঁচ খণ্ড২৩ মন দিয়ে পড়ে দেখুন, পূজাগুলোর ক্ষেত্রে সেখানে সর্বত্রই ‘সমাজের মঙ্গল’ ও ‘সকলের কল্যাণ’এর কথা বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত ভোগবাসনার কথা কোথাও নেই। তা বলে ব্যক্তির জন্যে সেখানে কোনো জায়গা রাখা ছিল না এমনও নয়। সে জায়গাটা হল ‘মানত’, যদিও সেটাও কোনো ভোগবাসনার ব্যাপার নয়, খুব ছোটখাট কামনাপূর্তির আকাঙ্খার ব্যাপার। আর বহুত্ববাদী অস্তিত্বের প্রমাণ পাবার জন্যে শুধু ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা’ নয়, বাংলায় লেখা আমাদের দেশের প্রায় শতবর্ষপ্রাচীন জেলা ইতিহাসগুলো ঘেঁটে দেখুন, দেখবেন জাতিধর্মনির্বিশেষে কিভাবে সামাজিক পরিসরের ব্যাপ্তি ঘটেছে। তারপরেও যদি আমরা মনে করি যে সাধারণ মানুষকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনাটা জরুরি, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আমাদের সন্ধান দিতে হবে আরো উচ্চতর কোনো উপায়ের যে উপায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তারা ভোগবাদ-বিরোধী কাঠামো ও বহুত্ববাদকে রক্ষে করতে পারবে। গত দুশো বছরে সে সন্ধান কি আমরা তাদের দিতে পেরেছি? আমরা কি সে সন্ধান দেবার উপযুক্ত? তাছাড়া পৌত্তলিকতার প্রেক্ষিতকে অগ্রাহ্য করা কোনোমতেই সম্ভব নয়, কারণ তা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি আবশ্যিকভাবেই ধর্মসংস্কৃতি। এই ধর্মসংস্কৃতি নিরীশ্বরবাদ ও ঈশ্বরবাদ উভয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এমনকি নিরীশ্বরবাদও একটা সময় অবতারবাদে এসে মিশেছে। এবং প্রভূত ক্ষেত্রে এসবের সমন্বয় ঘটেছে। এক্ষেত্রে সমন্বয়ের সবথেকে বড় দৃষ্টান্ত শংকর, যে জন্যে তাকে অনেক সময়ই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলা হয়। কিন্তু সেই শংকরাচার্য-অনুগামী দশনামীদের বেলায় কি দেখলাম? দেখলাম তারা অদ্বৈতবাদী, অথচ শৈব। আবার সেই দশনামীদের কাছে দীক্ষা নিলেন শ্রীচৈতন্য, তিনি আবার কৃষ্ণের ভজনা করলেন। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি আবার অদ্বৈতবাদের সঙ্গে মা কালীকে মেশালেন। ভারতীয় ইতিহাসে এরকম মেশানোর গল্প অনেক পাওয়া যায়।
মূল ব্যাপারটা হল আমাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে শ্রদ্ধার ঘাটতি। এই শ্রদ্ধার ঘাটতিও উপনিবেশিকতার ফসল। এই শ্রদ্ধার ঘাটতিই আমাদের এক ধরনের ছাঁচে ঢালা ভাবনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার ফল হয়েছে এই, আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতা প্রচুর ভণ্ডামোকে বেড় দিয়ে বেড়ে উঠেছে।
এসব কথা বলার অর্থ এই নয় যে পৌত্তলিকতার সবকিছুই গুণে ভরা। কিন্তু তার ভেতরে অগুণগুলোর প্রবেশ ঘটেছে প্রধানত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পথ ধরে। জাতভেদকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আর পৌত্তলিকতাকে কেন্দ্র করে তার বাড়বাড়ন্ত। অনেকে বলবেন এতো পুরোহিততন্ত্রের কথা হল। কিন্তু ভুলে গেলে হবে না যে এই পুরোহিততন্ত্র হল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবহমানকাল ধরে এই পুরোহিততন্ত্র তথা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রই গ্রামভারতকে দখলে রেখেছে। সমস্ত ধরনের বিভাজনের প্রশ্রয়দাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের কুসংস্কারের প্রশ্রয়দাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের শোষণের আড়ালদাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখেছেও এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। অর্থাৎ শত্রু ধর্ম নয়, শত্রু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র একদিকে পৌরোহিত্যের মধ্যে অপরদিকে উচ্চবর্ণের মধ্যে এমন ভাবে মিলেমিশে আছে যে আজকের দিনে তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। অম্বেদকর খুব সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ‘মুক্তি, সাম্য, সৌভ্রাত্র’ এই তিন আদর্শেরই বিরুদ্ধে।২৪ সেদিক থেকে দেখলে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র পুঁজিতন্ত্রের বিকাশেরও পরোক্ষ কারণ। অথচ এদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। ব্রাহ্মধর্ম পর্যন্ত আমাদের দেশের সমস্ত ধর্মান্দোলনই তাই মূলগতভাবে ছিল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে। জানি না কথায় কথায় যাঁরা ধর্মকে অভিযোগের কাঠগড়ায় তুলতে চান তাঁরা আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটাকেই আড়াল করতে চান কিনা! অথবা বলা যায় তাঁদের এই শৌখীন প্রগতিচর্চার ফাঁক গলেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আবার মাথা চাড়া দিয়েছে।
পৌত্তলিকতা দীর্ঘ ইতিহাসের ফসল। আদিম সমাজে তার শুরু। ইতিহাসের পর্বে পর্বে নানান উপাদান তার মধ্যে এসে মিশেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে কোনো বিয়োগ নেই, শুধুই যোগ আছে। আদিম সমাজের উপাদানগুলো সামান্য বিবর্তিত হয়ে ক্রমশ যোগ হতে হতে গেছে। বড় পরিবর্তন বলতে একমাত্র এই যে, হিংসা থেকে অহিংসার দিকে তার যাত্রা। তার কারণ কৃষি সমাজে উত্তরণ। বৈদিক ঋষিরা গোরু খেতেন। সমাজ কৃষির দিকে মোড় ফিরল, গোবধ বন্ধ হল। আজকের সেঁজুতি ব্রত এককালের উপজাতীয় স্তরে হত্যার উৎসব। কিন্তু ঝাড়ফুঁকের প্রভাব আজো রয়ে গেছে। উপজাতীয় স্তরের সমাজে ঝাড়ফুঁক ছিল সে আমলের চিকিৎসাবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের চর্চা যাঁরা করতেন, বৈদিক ভারত তাঁদের বলত ‘হোত্র’ বা ‘ভৈষজানি’ বা ‘পুরোহিত’। বৌদ্ধ ভারতে তাঁরা হয়ে গেলেন ‘ভেজ্জ’, আদি মধ্যযুগে ‘ওঝা’ থেকে অন্ত্য মধ্যযুগে ‘গুণিন’। কোসাম্বী বলেছিলেন, “ভারতীয় ধর্মদর্শনের আদিম শেকড়কে স্বীকার করতে এবং দেশে যেসব আদিম বিশ্বাস এখনো টিঁকে আছে সেগুলোর মুখোমুখি হতে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের যে অনীহা, সে অনীহার উৎপত্তি নিপীড়িত উপনিবেশিক জীবনের দীর্ঘ অবমাননা থেকে যার দুর্বহ স্মৃতি আজো অম্নান।”২৫ কোসাম্বী একথা বলেছিলেন ১৯৬২ সালে, কিন্তু কথাটা আজো সত্যি। এ ব্যাপারে নৃতত্ত্বের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রামমোহনের সময় নৃতত্ত্ব হামাগুড়ি দিচ্ছিল, সুধীজনের পক্ষে তার খোঁজ রাখা সেভাবে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আগেও বলেছি, অনস্বীকার্য যে রামমোহনরা দেশের জনগণ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সৌভাগ্যের কথা, পরবর্তীকালে এসব নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্যে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব নামে একটি বিশেষ শাখা তৈরি হয়েছে এবং তার কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। উপনিবেশিক খোলস ছেড়ে এই শাখা যত তাড়াতাড়ি স্বদেশী হয়ে উঠবে ততই মঙ্গল। স্বদেশী, জাতীয়তাবাদী নয়, কারণ জাতীয়তাবাদ, আবার বলছি, আবশ্যিকরূপেই একটি উপনিবেশিক উপাদান।
জানি এখানে সাম্প্রতিককালের রাজনীতি দেশটাকে প্রতিনিয়ত যেভাবে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর প্রতিদিন যেভাবে আছড়ে পড়ছে আঘাতের পর আঘাত, যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোকে চুরমার করার চেষ্টা চলছে, এমন সংকটময় মুহূর্তে খোদ জাতীয়তাবাদের অসারতার দিকে ইঙ্গিত করার ব্যাপারে যাঁরা অন্তর থেকেই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সেইসব লোকজন অসন্তুষ্ট বোধ করবেন এবং অস্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। একথা তো ঠিকই যাঁরা জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বুঝেছেন তাঁদের তুলনায় যাঁরা জাতীয়তাবাদ বলতে এক ধরনের সংশ্লেষে বিশ্বাস করেন তাঁদের ধ্যানধারণা অপেক্ষাকৃত উঁচু মানের। কারণ তাঁদের ধ্যানধারণা আমাদের দেশের লৌকিক সমাজের লৌকিক ধর্মচেতনাকে অনেকটাই ছুঁয়ে যায়। ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইতে হিন্দু-মুসলমানের সংলাপ এইভাবে দেখিয়েছিলেন,
একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন ‘যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’। মুসলমান বলিতেছেন ‘ঠাকুর যথার্থ কহিয়াছেন, সমস্ত জগৎ সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই বিভূতি মাত্র, মানুষ ভেদে যেমন আচারভেদ—পরিচ্ছদভেদ—ভাষাভেদ—তেমনি উপাসনার প্রণালীভেদও হইয়া থাকে। সকলেই এক পিতার পুত্র। সেই পিতা ভিন্ন ভিন্ন পুত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরাইয়া দেখিতেছেন। কিন্তু সকলেরই চামড়ার নীচে লহু লাল বই কাহারোও কাল কাহারোও জরদ নহে।’ একজন ক্ষত্রিয় ঐ কথায় যোগ দিয়া বলিল ‘তাবই কি—আসলে কিছুই তফাৎ নাই—আমরা হিন্দু বলিয়া কি মুসলমানের দেবতা মানি না? আমরাও প্রতিবর্ষেই তাজিয়া করিয়া থাকি। একজন বাঙ্গালী কহিল—‘আমাদিগের দেশে সকল কর্মেই সত্যপীরকে সিন্নি দেওয়া হইয়া থাকে, যিনি সত্যপীর, তিনিই সত্য নারায়ণ।’ আর একজন মুসলমান বলিল, ‘তোমরাই যে আমাদের দেবতা মান, আমরা তোমাদের দেবতা মানি না একথা বলিতে পারিবে না। কোন্ মুসলমান হিন্দু দেবতার এবং ব্রাহ্মণ ঠাকুরদের যথোচিত সম্মাননা না করে? আমার জানত অনেক মুসলমান ব্রাহ্মণদিগকে খরচপত্র দিয়া দুর্গোৎসব করান। দরাপ খাঁ ‘সুরধুণী মুনি কন্যে’ বলিয়া কেমন ভক্তি সহকারে গঙ্গাদেবীর স্তব করিয়া গিয়াছেন তাহা কাহার অজানত আছে?’২৬
কিছুদিন আগে বিশেষ করে ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোর কোনো কোনোটাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে লেখালেখি পড়ছিলাম। তাঁরা প্রায় সকলেই প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ চরিত্রে আলাদা। এক সাংবাদিকের লেখায় পড়ছিলাম, আমাদের দেশে, তাঁর মতে, বাম এবং ডান দুপক্ষই জাতীয়তাবাদকে বুঝতে ভুল করেছে। বামেরা জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করেছে এই জন্যে যে তাদের মতে এটা উপনিবেশিক উপাদান। তেমনি ডানেরা জাতীয়তাবাদ বলতে বুঝেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ [নরম অথবা কড়া], যেটা আসলে জাতীয়তাবাদ নয়, jingoism বা উগ্র সমরপ্রিয় দেশপ্রেম [তাই কি? নাকি উগ্র সমরপ্রিয় দেশপ্রেমের আড়ালে এ আসলে গোটা দেশকে বিশেষত একচেটিয়া পুঁজির বশীভূত করে ফেলার চেষ্টা?]। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এ দুটোর কোনোটাই নয়, সমগ্রের ধারণা (inclusivity) ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অঙ্গীভূত। একথা মানতেই হয় যে ভারতবর্ষ আগে যা ছিল একটা ধারণা, ব্রিটিশরা যখন তাকে রাজনৈতিক দিক থেকে রাষ্ট্রে পরিণত করল, তখন তার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় চেতনার প্রশ্নটাও সামনে এল। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রশ্নটা সামনে আসা এক জিনিস আর রাষ্ট্রের নেশন হয়ে ওঠা আর এক জিনিস। আমিও নিজেকে একজন ভারতীয় হিসেবেই দেখি, তার জন্যে আমায় জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতে লাগছে না। গান্ধীজি তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মনে যে অনেক সংশয় ছিল তা ইয়ং ইন্ডিয়া ও হরিজন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো পড়লেই বুঝতে পারা যায়। তিনি বলেছিলেন, “[i]t is not nationalism that is evil. It is the narrowness, selfishness, exclusiveness, which is the bane of modern nations which is evil. Each wants to profit at the expense of, and rise on the ruin of, the other.”২৭ আমাদের ইদানিংকার চিন্তাবিদরা inclusive শব্দটা কোত্থেকে পেয়েছেন বোঝা যায়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কাঠামোকে রক্ষে করার তাঁদের যে চেষ্টা সে চেষ্টা প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু বর্তমান লেখকের ব্যক্তিগত ধারণা, এতদ্বারা শেষরক্ষে হবে না। এতদ্বারা এ দেশের ধর্মীয় বৈচিত্রকে রক্ষে করা গেলেও জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্রকে রক্ষে করা যাবে না। এবং অচিরে তা ফুটে বেরোবে। এবং তাও যদি কোনোদিন যায়, নেশন হয়ে দাঁড়াবে নয়া সাম্রাজ্যবাদের ধারকবাহক, নয়া নয়া উপনিবেশের সৃষ্টিকর্তা, অন্য দেশের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে শোষকের ভূমিকায়। আমাদের সবাইকে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে একদিন না একদিন বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারায় ঢুকতে হবে। যখন একই সঙ্গে আমার নিজের দেশটাও আমার দেশ আবার গোটা পৃথিবীটাও আমার দেশ (বাজার নয় তা বলে)।
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল পর্ব
ডিরোজিও, ইয়ং বেঙ্গল ও গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত Bengal Early Nineteenth Century (BENC)২৮ এবং Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century (ABENC)২৯ -- এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ডিরোজিও হলেন এদেশে স্বাদেশিকতার উদ্গাতা। রামমোহনে যার আভাসমাত্র পাওয়া গিয়েছিল, তারই অঙ্কুরোদ্গম হয় ডিরোজিওতে। জানি না গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মত গুণী সংকলক ও সম্পাদক, যিনি ‘সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিসন অফ জেনারাল নলেজ’এর নথিপত্র (ABENC) থেকে শুরু করে ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘রিফর্মার’, ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’এর মত পত্রিকায় প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য রচনাগুলি (BENC) পাঠকের সামনে এনে হাজির করেছেন, ডিরোজিওকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করতে অত কুণ্ঠাবোধ করেছেন কেন? ডিরোজিওর যেসব কথাকে কেন্দ্র করে গৌতমবাবু কুণ্ঠিত বোধ করেছেন সেগুলি তাঁর BENCর ভূমিকায় ডিরোজিওর লেখার (On Colonization of India by Europeans) প্রথম উদ্ধৃতিতে নিম্নরূপ
The most superficial observer must perceive that India is maintained in subjection only by Military Force. Withdraw it, and the boasted opinion of the natives, instead of supporting, would immediately prove the cause of the utter subversion of the empire. We have lately read in one of the papers that at Lucknow, during the late Mohurrum, prayers were publicly said, for the destruction of the Company’s government! Now it is evident that if a large number of Europeans be allowed to settle in the country, they would form a counterpoise, in some degree, to the hostile dispositions of the native subjects.৩০
এই উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে যেটা অবাক করে সেটা হল মূল উদ্ধৃত অংশ থেকে গৌতমবাবুর একাধিক লাইন ও শব্দ বাদ দিয়ে যাওয়া, যা আলোচ্য প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মনে হলে করা যেতেই পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে যে বিন্দু চিহ্ন ব্যবহার করা নিয়ম তা করা হয়নি। ফলে পাঠকের ধারণা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক যে ডিরোজিও ঠিক এভাবেই লিখেছিলেন। অতএব প্রথমে ডিরোজিও ঠিক কি লিখেছিলেন তা গৌতমবাবুর সংকলন থেকেই উদ্ধৃত করা যাক
The most superficial observer must perceive that India is maintained in subjection only by Military Force--withdraw it, and the boasted opinion of the natives, instead of supporting, would immediately prove the cause of the utter subversion of the empire. It is generally known, and even confessed by our rulers, that the spirit of the natives, in the Upper Provinces in particular, is any thing but peaceable. We have lately read in one of the papers that at Lucknow, during the late Mohurrum, prayers were publicly said, for the destruction of the Company’s government! Now it is evident that if a large number of Europeans be allowed to settle in the country, they would form a counterpoise, in some degree, to the hostile disposition of the native subjects and in case of internal commotion or of foreign invasion, they will be found to be the only portion of the inhabitants that sincerely co-operates in the defence of British sovereignty.৩১
মনস্ক পাঠক দুটো অংশ পাশাপাশি রেখে পড়লেই বুঝবেন গৌতমবাবু কর্তৃক উদ্ধৃত অংশটিতে কিছু কিছু লাইন ও শব্দ বাদ চলে যাওয়ায় কিভাবে ডিরোজিওর বক্তব্যের মানে পাল্টে গিয়েছে। এই প্রবন্ধে ডিরোজিও যা বলতে চেয়েছিলেন, গোদা বাংলায় তা এই
নিতান্ত ভাসা ভাসা দেখলেও বুঝতে পারা যায় যে এদেশকে শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়েই দমন করে রাখা হয়েছে, এই শক্তি তুলে নিলে যেসব এদেশীয় জাঁক করে [সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে], সাম্রাজ্যের সমর্থন নয়, তারাই তখন হয়ে দাঁড়াবে সাম্রাজ্য ধ্বংসের কারণ। সাধারণভাবে জানা আছে এবং এমনকি শাসকরাও স্বীকার করেছেন যে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষজন শান্তিপ্রিয়। এই সেদিন কাগজে পড়লাম যে লক্ষ্ণৌতে মহরমের পরপর একটা সভায় কোম্পানি সরকারের ধ্বংস চেয়ে প্রার্থনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে প্রচুর ইয়োরোপীয়কে যদি এদেশে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, তারা বড়জোর ক্ষুব্ধ দেশবাসীর জায়গায় একটা ভারসাম্য তৈরি করবে এবং একমাত্র তারাই যা অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বা বিদেশী আক্রমণের সময় ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করবে।
এই অংশে ডিরোজিওর মূল প্রতিপাদ্য ছিল দেশের লোকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ১৭৬৩ সালে জন্ম হওয়া সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৮৩১ সালের ওয়াহাবী বিদ্রোহের কথা আজ আমরা যেভাবে জানি ডিরোজিও হয়ত সেভাবে জানতেন না, কিন্তু আভাসে নিশ্চয়ই জানতেন, তা নাহলে তিনি জনগণের ক্ষোভের কথা এভাবে তুলে ধরতেন না। এদেশের লোক শান্তিপ্রিয়, অথচ সেই শান্তিপ্রিয় লোকগুলোও যে কোম্পানি শাসনের অবসান চায় লক্ষ্ণৌর উদাহরণ দিয়ে তিনি তা দেখিয়েছেন। এবং বোঝাতে চেয়েছেন যে যতই কেননা কোম্পানি সরকার প্রচুর ইয়োরোপীয়কে এখানে থাকার অনুমতি দিয়ে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চান, ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের সমর্থক থাকবে একমাত্র তারাই, দেশের লোক নয়।
এতো ডিরোজিওর ব্রিটিশ-আনুগত্যের প্রকাশ নয়, তাঁর দেশচেতনার তাঁর স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ। ইয়োরোপীয়দের এদেশে এসে বসবাস করা নিয়ে ডিরোজিওর মন্তব্যের একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮২৯ সালে টাউন হলে একটা জনসভা হয়, যে জনসভায় আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম ছিল এদেশে ইয়োরোপীয়দের থাকার ব্যাপারে বহাল বিধিনিষেধের অবসান ঘটানো। স্বয়ং রামমোহন ঐ সভায় প্রস্তাবের সমর্থনে একটা বক্তৃতা দেন, যার শিরোনাম ছিল Views on Settlement in India by Europeans৩২। ঐ ১৮২৯ সালেই ডিরোজিও এবং তাঁর ছাত্ররা মিলে বের করতে শুরু করেন ক্যালাইডোস্কোপ পত্রিকা, যে পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই অংশটা পড়লে বোঝা যায় যে ডিরোজিও ঐ সময়কার উক্ত বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। এবং রামমোহন যেখানে ইয়োরোপীয়দের এখানে বাস করতে আসার পক্ষে, তিনি সেখানে দেশের লোকের মনোভাবকেই প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করেছেন। এবং সে মনোভাব যে ব্রিটিশ শাসনের অনুকূল নয়, তা খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন।
এর একটু পরেই এই প্রসঙ্গের জের টেনে ডিরোজিও আরো যা লেখেন তা নিম্নরূপ
[M]y own inquiries convince me that the conduct of Europeans to their indigenous fellow subjects would tend to alienate them, and ultimately lead to serious consequences. Besides which, I entertain strong doubts whether Europeans can settle in the country without gradually dispossessing the natives of their lands, and causing thereby incalculable misery and dissatisfaction, which together with the inimical spirit by which I have stated they are actuated, would surely be anything but beneficial to the country.৩৩
অর্থাৎ,
ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর করে আমি নিশ্চিৎ হয়েছি যে দেশীয় লোকদের সঙ্গে ইয়োরোপীয়দের আচরণ তাদের আরো বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং শেষপর্যন্ত ফলাফল খুব খারাপ হবে। তাছাড়া, আমার ঘোরতর সন্দেহ ইয়োরোপীয়রা ক্রমাগত এদেশের লোকজনকে তাদের জমি থেকে উৎখাত না করে এদেশে থাকতে পারবে কিনা, যার ফল হবে তাদের আরো দুর্দশা এবং অসন্তোষের মধ্যে ঠেলে দেওয়া এবং তাদের সে বৈরিভাব যার কথা আমি বলেছি, এদেশের পক্ষে আদৌ মঙ্গলজনক হবে কিনা।
সুখের কথা, গৌতমবাবুও ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে ভূমিকায় এই অংশটা প্রায় পুরোটাই উদ্ধৃত করেছেন। এই অংশটুকু থেকে এটা পরিষ্কার যে কোলকাতার গোষ্ঠীপতিদের ভাবনার স্রোত যখন ইয়োরোপীয়দের এদেশে আনার পক্ষে বইছে, ডিরোজিও তখন দেশের লোকের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন। এবং সে দেশ মোটেই গৌতমবাবু কথিত “wealthy classes of zeminders, traders and other professions and whose young men were intoxicated with the glamour and glitter of European civilization”৩৪ নিয়ে গঠিত নয়।
ডিরোজিওর এই প্রবন্ধ (On Colonization of India by Europeans) পুরোটা পড়লে দেখা যায় একমাত্র যে কারণে তিনি উপনিবেশায়নকে শুভ মেনেছেন তা হল ইয়োরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রচলনের দিকটা। সেখানেও তিনি কোম্পানিকে ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “[t]he Company indeed have never evinced a desire to improve the means of education among the natives; but, there will not be wanting benevolent and public spirited individuals of all classes, who will come forward to promote the dissemination of the arts and sciences throughout the empire.”৩৫ অর্থাৎ, দেশীয়দের মধ্যে [ইয়োরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের] শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে কোম্পানির আগ্রহের কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু এই জ্ঞানবিজ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্তরে হিতৈষী এবং জনহিতে উদ্যোগী লোকজনের অভাব হবে না।”
ডিরোজিও তেমন কোনো দেশপ্রেমিক নন প্রমাণ করতে অতঃপর গৌতমবাবু যে প্রবন্ধটিকে ডিরোজিওর ধরে নিয়ে তার থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন এবং তা নিয়ে আলোচনা করেছেন সেটি হল, “Cursory Remarks on the British Government in India”৩৬। কিন্তু এই প্রবন্ধটি পাঠের পর এটি ডিরোজিওর লেখা কিনা তা নিয়ে প্রবল সংশয় জাগে। শুধু এইজন্যে নয় যে ডিরোজিও তাঁর প্রবন্ধে ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে ‘নেশন’ শব্দটা কখনো ব্যবহার করেননি, তিনি সর্বদাই লিখেছেন ‘কান্ট্রি’ এবং ব্রিটিশের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন ‘এম্পায়ার’ শব্দ, এইজন্যেও যে গোটা লেখাটিতে যে ভাবনার ছাপ এবং মানসিকতার পরিচয় আছে তার সঙ্গে ডিরোজিওর ভাবনা ও মানসিকতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম প্রবন্ধে (OCIE) তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যে ঋজু ভঙ্গি, দ্বিতীয় প্রবন্ধের (CRBGI) লিখনপ্রণালীর সঙ্গে তা একেবারেই খাপ খায় না। এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়, উৎসাহী পাঠক প্রবন্ধদুটি মিলিয়ে পড়লে নিজেরাই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন (BENC দেখুন)।
On Colonization of India by Europeans-এর সঙ্গে ডিরোজিওর লেখা কবিতা The Harp of India৩৭, India-My Native Land৩৮ এবং তাঁর আখ্যানকাব্য Fakeer of Jungheera৩৯-র অংশবিশেষ খুঁটিয়ে পড়লে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না যে ডিরোজিও আক্ষরিক অর্থেই এদেশে স্বাদেশিকতার উদ্গাতা। মনে রাখতে হবে এ কবিতাগুলি লেখার প্রায় ষাট বছর বাদে বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে ‘বন্দে মাতরং’এর জন্ম। পাঠকের জ্ঞাতার্থে নিচে India-My Native Land কবিতাটার তর্জমা দেওয়া গেল।
ভারত – আমার স্বদেশ
হে আমার দেশ, গৌরবময় তোমার অতীতকালে
অপরূপ এক জ্যোতির্বলয় বিকীর্ণ হত ভালে
দেবতার মতো পূজিত হয়েছ তখন
কোথায় গেল সে গৌরব, আজ কই সেই সম্ভ্রম?
শেকলে পড়েছে বাঁধা অবশেষে তোমার ঈগল-পাখা
ধরণীতে আজ লুটোচ্ছ ধুলিমাখা।
নেই কোনো মালা গাঁথার মতন চারণকবির কাছে
তোমার জন্যে;
শুধু দুঃখের কাহিনি ছড়িয়ে আছে!
বেশ, তবে যাই কালের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনি
যুগের ঘূর্ণি থেকে সামান্য ক্ষুদ্র দুএকখানি
টুকরো তোমার সুমহান গরিমার
মানবচক্ষু কখনো পাবে না দরশন আর যার
কবির শ্রমের পারিতোষিক তা হবে
এই আশাটুকু পূর্ণ কোরো গো অয়ি হৃতগৌরবে।
(তর্জমার দায় বর্তমান প্রাবন্ধিকের)
এই কবিতায় দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক, কবি তাঁর স্বদেশকে বর্বর, অসভ্য কিংবা অর্ধসভ্য হিসেবে ভাবেননি। বরঞ্চ তিনি তাঁর দেশের গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করেছেন। দুই, তাঁর দুঃখ এই যে সেই গরিমাময় দেশ আজ শেকলে বাঁধা এবং হারিয়ে ফেলেছে সমস্ত গৌরব। কবির একমাত্র আশা এই যে কালের গভীরে ডুব দিয়ে তিনি যেন এই হৃতগৌরব দেশের অতীতের সেই সুমহান গরিমার যৎকিঞ্চিৎ তুলে আনতে পারেন। সেই গৌরবগাথাই কি তাঁর Fakeer of Jungheera-র পাতায় পাতায় ছড়ানো? এবিষয়ে সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন পল্লব সেনগুপ্ত৪০। তিনি দেখিয়েছেন কেমনভাবে তাঁর সীমিত জানার মধ্যে দিয়েই ডিরোজিও তুলে এনেছেন ভারতবর্ষের অপরূপ নিসর্গকে আর তার সঙ্গে সঙ্গে তার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে। তার “মৃদু উষ্ণ বাতাস, ঝর্ণার জলের ভাঙা ভাঙা কুলুকুলু শব্দ, প্রখর সোনালি সূর্যালোক, গঙ্গার ঝিকিমিকি প্রবাহ, সবুজ মাঠে-বনে ঘাস-ফড়িংদের লাফালাফি, রঙ্-বেরঙের ফুলে উজ্জ্বল প্রজাপতিদের ফুরফুরে ওড়াউড়ি, শাল-তমাল-বট-অশ্বত্থের ঠাণ্ডা ছায়া”, আর সেই সঙ্গে “গঙ্গার উপকূলে যজ্ঞোপবীতধারী ব্রাহ্মণদের বেদমন্ত্রপাঠ, কুলললনাদের ব্রতগান, ধর্মশীলার সূর্যবন্দনা।” পাশাপাশি বীভৎস সতীদাহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেও ভোলেন নি, সে আমলে যা ছিল রীতিমত দুঃসাহসের পরিচয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে উদ্যোগী হওয়ায় স্বয়ং রামমোহনকে যেখানে হিন্দু সমাজের দিক থেকে নানা বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেখানে আঠেরো বছরের তরুণ ডিরোজিও নির্ভয়ে তার বর্ণনা দিচ্ছেন যে বর্ণনার মধ্যে পুরো রীতিটার প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা স্পষ্ট বিধৃত। আরো বড় নির্ভীকতার পরিচয় হল হিন্দু নায়িকার প্রেমাস্পদ হিসেবে এক মুসলমান তরুণকে দেখানো। এই দেখানোর মধ্যে ডিরোজিওর লৌকিক ধর্মচেতনার অভিজ্ঞতার পরিচয় স্পষ্ট যেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে সব একাকার হয়ে যায় এবং এই মুসলমান প্রেমিকের জীবনবোধ, পল্লব সেনগুপ্ত যথার্থ লক্ষ করেছেন, কিভাবে তার ধর্মবোধকে ছাপিয়ে যায়, যখন সে বলে,
No more to Mecca’s hallowed shrine
Shall wafted be a prayer of mine
Henceforth I turn my willing knee
From Allah, Prophet, heaven, to thee৪১
‘thee’ এখানে তার পুরোনো প্রেমিকা নলিনী, যাকে সে সতীদাহের চিতা থেকে উদ্ধার করে এনেছিল। Fakeer of Jungheera-র আখ্যানভাগের সঙ্গে শুধু স্কটের ব্যালাডীয় কাব্যের আভাস নয় বা ফরাসি ত্রুবাদুর কাব্যের প্রেরণাও নয়, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’রও অনেক কাব্যের তুলনা করা চলে, যেগুলো এই বাংলারই এবং এই সময়ের কিছু আগে-পরের সৃষ্টি।
গৌতমবাবু লিখেছেন যে ডিরোজিওরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উদারীকরণ চেয়েছিলেন, স্বশাসনের প্রতিষ্ঠা নয় (“...a careful scrutiny of all the issues of Kaleidoscope, reveal that this is the basic trend of the attitude of Derozio and his supporters – ceaseless appeal for liberalization of British rule in India, not its replacement by some form of self-government.”৪২) এখানেও গৌতমবাবু ভুল করেছেন ডিরোজিওর সঙ্গে ডিরোজিওর সমস্ত ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের একাসনে বসিয়ে। ডিরোজিওর ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের লেখা পড়লে মনে হয় মানসিকতার দিক থেকে তাঁরা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল ব্রিটিশ শাসনকে খোলা মনে গ্রহণ করে সে শাসনব্যবস্থার উদারীকরণ চেয়েছিলেন, অপরদল মুখ ফুটে স্বশাসনের (বিদেশী শাসনমুক্তি অর্থে) কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু কাজেকর্মে স্বশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ডিরোজিওর কথা ধরলে দেশের অবস্থাকে কেন্দ্র করে যে দুএকটা লেখা তাঁর আছে (ডিরোজিওর বেশির ভাগ গদ্যই সাহিত্যসংক্রান্ত) সেগুলোর মূল সুর একেবারে স্বতন্ত্র--স্বশাসন চাওয়া যেমন নয় তেমনি ব্রিটিশ শাসনের উদারীকরণ চাওয়াও নয়, অবিচারের অবসান চাওয়া--তা সে যেভাবেই হোক। কখনো তা সাধারণভাবে দেশের লোকের প্রতি অবিচারের অবসান চাওয়া, কখনো বা বিশেষভাবে পূর্ব ভারতীয়দের প্রতি অবিচারের অবসান চাওয়া। ডিরোজিও ঠিক কি চেয়েছিলেন তার স্পষ্টতর আভাস পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। একমাত্র সেখানেই ডিরোজিওর চাওয়ার মূল সুর ধরা পড়েছে। সেটা হল সবরকমের শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। তাঁর Freedom to the Slave কবিতায় পাই
Blest be the generous hand that breaks
The chain a tyrant gave
And, feeling for degraded man,
Gives freedom to the slave.৪৩
তাছাড়া তত্ত্বগতভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বশাসন চাওয়াটা বাংলার বিদ্বৎসমাজের পক্ষে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ছিল, এবং কেউই সেসময় এরকম কিছুর কথা ভাবেন নি। ভাবেন নি তার কারণ একে তো বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশ নতুন ব্যবস্থাপাতিতে নানাভাবে উপকৃত হচ্ছিল, ‘বিদেশী শাসন’ শব্দটার সঙ্গে তাদের পরিচয় তখনো তেমন নিবিড়ও হয়নি, তাছাড়া দেশের লোক তখনো স্বশাসনের হৃতশক্তি পুনরুদ্ধার করে উঠতে পারেনি। দেশতৈষিণী সভায় এ নিয়ে সারদাপ্রসাদ ঘোষ, আর এক ডিরোজিয়ান, বলেছিলেন, “You do not like the brave and noble minded Americans aspire as high as to free yourself from the yoke of the British sway; To take in your own hands the reigns of government and to display in the world striking instances of your courage exerted in the cause of your independence. No, your aspiration is by far much humbler; you only desire that you may be freed from the tyranny and oppression of the local government of this country; and that consequently that a salutary change may be effected in your present degraded condition.”৪৪ বিকল্প পথ হিসেবে তিনি নির্দেশ করেছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অভিযোগ জানানো ও প্রতিবিধান দাবি করা।
উপনিবেশিক দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় সমস্যা হল এই যে তাঁরা সবসময় আজকের ভাবনার পোশাক পরা অতীতকে দেখতে চান এবং দেখতে না পেলে ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা ভুলে যান যে অতীতের ভাবনার পথ ধরেই আমরা আজকের ভাবনায় এসে পৌঁছেছি। চন্দ্রগুপ্তের হাতে কব্জিঘড়ি লাগিয়ে দিতে চাইলে সেটা একটা কালাতিক্রমণ দোষ বা anachronism। অতীতের এইসব চিন্তানায়কদের পক্ষে আজকের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত থাকা সম্ভব ছিল না। সুতরাং তাঁরা তাঁদের সময়ের ওপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের পথ কেটে গেছেন। বিচারটা তখনই ঠিকঠাক সম্ভব যখন তাঁদের সময়েই তাঁদের রেখে তাঁদের ভাবনা ও কর্মধারার পারস্পরিক তুলনার মাধ্যমে ভবিষতের সেই গতিপথের প্রকৃতি নির্ণয়ের চেষ্টা করা হবে।
স্বাদেশিকতা ছাড়াও ডিরোজিওর সমতুল্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল মুক্তচিন্তার প্রসার যা বাংলার নবজাগরণের মূল সুর বেঁধে দিয়েছিল এবং দিকনির্দেশ করেছিল। হিন্দু কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ বাদ দিলে ডিরোজিও যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ও পার্থেনন বা ক্যালাইডোস্কোপের মত পত্রিকা স্থাপনে উদ্যোগী ছিলেন, সেখানে ঘটনা, ধারণা ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে এক স্বতঃবিকাশ প্রক্রিয়ায় পাঠ ও আলোচনা হত। এগুলো ছিল বিশ্লেষণাত্মক তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে মননচর্চার খোলা মঞ্চ। এই মঞ্চের সবথেকে বড় গুণ ছিল কোনো কিছু বিনা বিচারে মেনে না নেওয়ার প্রবণতা তৈরি, প্রশ্ন করতে শেখানো (১৮৩১ সালের ২০ এপ্রিল এইচ. এইচ. উইলসনকে লেখা ডিরোজিওর চিঠি৪৫ এ ব্যাপারে পাঠ করা যেতে পারে)। আমাদের দেশে এ নতুন কিছু নয়। এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই নব্যন্যায় বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই নব্যন্যায়ের চর্চা নানা কারণে স্তিমিত হতে শুরু করে এবং শেষপর্যন্ত ‘পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র’ এই অর্থহীন কূটতর্কের ধারায় পরিণত হয়। এই সময় থেকেই বিশেষত বাঙালি বর্ণহিন্দু সমাজ অজস্র সংস্কারের বেড়াজালে বাঁধা পড়তে শুরু করে, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অধীন হয়ে পড়ে। এক ভিন্ন আধারে ডিরোজিও যেন বিশ্লেষণাত্মক যুক্তিতর্কের সেই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারাকেই ফিরিয়ে আনলেন।
আগেই বলেছি যে মানসিকতার দিক থেকে ডিরোজিওর ছাত্ররা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন বলে মনে হয়--একদল, যাঁরা ব্রিটিশ শাসনকে খোলা মনে গ্রহণ করে সে শাসনব্যবস্থার উদারীকরণ চেয়েছিলেন, অপরদল মুখ ফুটে স্বশাসনের কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু কাজেকর্মে স্বশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলেন। কিন্তু একথাটা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল এই জন্যে যে ডিরোজিও যে কোনো বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্কে ছাত্রদের দীক্ষিত করেছিলেন এবং পক্ষে বিপক্ষে দু’ ধরনের আলোচনাকেই তিনি স্বাগত জানাতেন। ডিরোজিও কর্তৃক অনুসৃত এই আলোচনাপদ্ধতির ছাপ ক্যালাইডোস্কোপের লেখাগুলোতে থেকে গিয়ে থাকতে পারে, যার ফলে কিছু লেখা ইংরেজ শাসনের সমর্থনে এবং কিছু লেখা ইংরেজ শাসনের সমালোচনামূলক হয়ে উঠেছিল। এই সব লেখা থেকে কোন্টা কার লেখা নির্ণয় করাও সম্ভব নয়, কারণ লেখাগুলোর তলায় কোনো নাম থাকত না, থাকত সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর, যেমন E.E. কিংবা S.J. কিংবা F। এমনকি স্বয়ং ডিরোজিওর লেখার তলাতেও কোনো নাম নেই, আছে সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর। লেখার ধাঁচ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ডিরোজিওর লেখাকে যা চিনে নিতে হয়। এই সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষরের কোন্টা কোন্ ডিরোজিয়ানের লেখা তাও বোঝা যায় না।
সুতরাং ক্যালাইডোস্কোপ ছেড়ে আমরা বরঞ্চ সেই সময়ের নথিগুলোর দিকে যাই, যখন নাকি ছাত্রাবস্থা কাটিয়ে ডিরোজিয়ানরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন এবং নতুন নতুন সংস্থা ও পত্রপত্রিকার মধ্যে দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তখন তাঁরা কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ গ্রন্থাগারিক, কেউ মাউন্ট এভারেস্ট মাপছেন, কেউ বা সদর আমীন, কেউ বা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে খান, কেউ কেউ জমিদারিও সামলাচ্ছেন।
আগে জেনে নেওয়া যাক ঈপ্সিত লক্ষ্য বলতে কি বোঝানো হচ্ছে, তারপর দেখা যাবে কি ছিল সেইসব নতুন সংস্থা এবং পত্রিকার সারবস্তু যেগুলোর মধ্যে দিয়ে তাঁরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডিরোজিওর কাছে স্বাদেশিকতার পাঠ নেওয়া এইসব ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের কাছে ঈপ্সিত লক্ষ্য ছিল আত্মশক্তির জাগরণ। এই আত্মশক্তির জাগরণের প্রধান মাধ্যম তাঁরা করেছিলেন একদিকে নারীমুক্তিকে, অপরদিকে রাজনৈতিক অধিকার চেতনা সৃষ্টিকে। একথা ঠিক যে কুলীন প্রথা, বাল্যবিবাহ বা সতীদাহের মত বীভৎস ব্যাপার ছিল প্রধানত বর্ণহিন্দু নারীর সমস্যা, কিন্তু নারীমুক্তির প্রশ্নটি সামগ্রিক বিচারে শুধুমাত্র বর্ণহিন্দু নারীর সমস্যা নয়। এই নারীমুক্তির অভিপ্রায়েই তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন বাংলাভাষার বিকাশকে। এ ব্যাপারে রাধানাথ শিকদারের গল্প চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে আছে।
পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ তৎপদানুযায়ী লেখকগণ বাঙ্গালা ভাষাকে যেরূপ পরিচ্ছদ পরাইয়া তুলিতেছিলেন, তাহা তাঁহার চক্ষুঃশূল হইয়া উঠিল। তিনি বলিতে লাগিলেন যে, “যে ভাষা স্ত্রীলোকে বুঝিবে না তাহা আবার বাঙ্গালা কি?” এই ভাবটা তাঁহার মনকে এমনি অধিকার করিল যে তিনি বাল্যবন্ধু পরম সুহৃদ প্যারীচাঁদ মিত্রকে সরল সহজ বাঙ্গালা লিখিবার জন্য প্ররোচনা করিতে লাগিলেন। উভয়ের সম্পাদকতাতে “মাসিক পত্রিকা” নামক পত্রিকা বাহির হইল; এবং অল্পদিন পরে প্যারীচাঁদ মিত্র “আলালের ঘরে দুলাল” নামক উপন্যাস প্রচার করিলেন।
সরল স্ত্রীপাঠ্য ভাষাতে বাঙ্গালা লেখা রাধানাথের একটা বাতিকের মত হইয়া উঠিয়াছিল। মাসিক পত্রিকাতে কোনও প্রবন্ধ লিখিয়া তিনি স্বীয় পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগকে পড়িয়া শুনাইতেন, তাঁহারা বুঝিতে পারেন কি না। শুনিতে পাওয়া যায় একদিন রাত্রি প্রভাত হইবার পূর্বেই প্যারীচাঁদ মিত্রের গৃহের দ্বারে গিয়া ডাকাডাকি, -- “প্যারি, প্যারি, উঠ উঠ, এবারকার পত্রিকা পড়িয়া তোমার স্ত্রী কি বলিলেন?”৪৬
তবে নারীর অবস্থা নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলীদের নিজেদের মধ্যে মতান্তর ছিল। ১৮৪১ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় তাঁর A Prize Essay on Native Female Education-এ লেখেন, বাঙালি মেয়েরা “drag on lives of the utmost wretchedness and degradation, and are regarded only as servants of the household, and ministers of carnal gratification to their husbands.”৪৭ ১৮৪২ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র বন্ধুকে তিরস্কার করে এর উত্তরে লেখেন, “There are some persons who are ready at all times to find fault with everything relating to the Hindu, and not to make due allowances. If they be pleased to pass a sweeping condemnation on our institutions respecting females, which we have endeavoured to shew were in many respects of an enlightened character, I must beseech them to turn their eyes to the history of some civilized countries, with reference to this subject.”৪৮ এই প্রবন্ধটিও সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা বা সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজের সভায় পঠিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে প্যারীচাঁদ যাজ্ঞবল্ক্য মনু ইত্যাদি থেকে উদাহরণ দিয়ে ভেঙে ভেঙে দেখিয়েছিলেন যে নারীর অবস্থা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহনের ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয় এবং উচ্চকিত আকারে না হলেও প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা তত খারাপ ছিল না, যতটা প্রচারে আনা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক অবনত অবস্থাকে তাঁরা কেউই অস্বীকার করেননি।
একটু খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় ইয়ং বেঙ্গলীদের ইতিহাসের ধারণা গ্রিস, রোম বা ইয়োরোপের বেলায় যতটা স্বচ্ছ এবং গভীর ছিল নিজের দেশের ইতিহাসের বেলায় তা ছিল না। তার কারণ নিজের দেশের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ইতিহাস পড়তেন তা ছিল জেমস মিলের History of British India৪৯। ভারতীয় নারীর হীনাবস্থা সম্পর্কে ধারণার উৎসও সেই জেমস মিল। যে কোনো সভ্যতা কতটা উন্নত তার মাপকাঠি হচ্ছে সে সভ্যতায় মেয়েরা পুরুষের দাসত্ব থেকে কতটা মুক্ত--স্কট রেনেসাঁ চিন্তাবিদ জন মিলারের এই মতকে ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে জেমস মিল দেখিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষ এদিক থেকে খুব অনুন্নত অবস্থায় আছে, তখনকার ভাষার ‘বর্বরাবস্থায়’ আছে।৫০ সামগ্রিক বিচারে এই ইতিহাসের প্রভাব আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদের ওপর যে গভীর ছিল তার প্রমাণ রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর পর্যন্ত এই কলঙ্ক থেকে মুক্তির জন্যে মেয়েদের হয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ইয়ং বেঙ্গলীরাও এই প্রভাবের বাইরে ছিল না। তার প্রমাণ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং সমমনস্ক আরো কেউ কেউ। কিন্তু কেউ কেউ যে একটু অন্যরকমও ভাবছিলেন তার প্রমাণ প্যারীচাঁদ মিত্র।
‘এতদ্দেশীয় লোকদিগের বাঙ্গালাভাষা উত্তমরূপে শিক্ষাকরণের আবশ্যকতা বিষয়ক প্রস্তাব’ এই শিরোনামে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পঠিত হয়েছিল সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভায়। সেটির রচয়িতা ছিলেন উদয়চন্দ্র আঢ্য। উদয়চন্দ্র আঢ্যও ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন, যদিও এঁর কথা বিশেষ শোনা যায় না। এই প্রবন্ধে তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল যে পরাধীনতার দাসত্ব–শৃঙ্খল ঘোচানোর লক্ষ্যে এক আবশ্যিক ধাপ হল মাতৃভাষা শিক্ষা। তাঁর মতে,
মনুষ্যের কর্ম দক্ষতাই প্রাধান্যের কারণ, তাহা যে ইংরেজি ভাষা দ্বারা না হইবে এমত আমার প্রস্তাবের ভাবে বুঝিবেন না, কিন্তু এমত জানিবেন যে দেশের মনুষ্য সেই দেশের ভাষায় কর্ম দক্ষতা হইলে পরাধীন দাসত্বের কারণচ্যুত হইয়া স্ব ২ প্রধান হইতে পারেন, তৎপ্রমাণ দেখুন যে এমত দেশও অদ্যাপি কতিপয় আছে যে তত্রস্থের স্বীয় ২ জাতীয় ভাষার জ্ঞান দ্বারা বৃহত ২ কর্ম নিষ্পন্ন করিতেছেন, রাজার ভাষা বা কোন রাজার সহিত সংসৃষ্ট রাখেন না।৫১
এই প্রবন্ধে ইংরেজদের সম্পর্কে চমৎকার শ্লেষ আছে উদয়চন্দ্রের (নিম্নোদ্ধৃত অংশের গৌতমবাবুকৃত ইংরেজি অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয়),
তাঁহাদিগের গুণের অধিক কি প্রশংসা বাহুল্যমতে করিব, যে যে দেশে আপনারদিগের জ্ঞানের নূতন চমৎকার শক্তি দেখাইতেছেন, তত্তদেশের বিত্ত বিলক্ষণ হস্তগত করিতেছেন, ছি, ছি, ছি! এই সকল দেখিয়াও কি এদেশের লোকেরদের ইচ্ছা হয় না যে ইংগ্লণ্ডীয়েরদের সদৃশ মনুষ্য হইয়া চত্তষ্পাদের ন্যায় মূক থাকিয়া অপরের হস্তোত্তোলনে প্রদত্ত ঘাস জলই আহার করিতে থাকেন।৫২
১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গিয়ে আর এক ডিরোজিয়ান রসিককৃষ্ণ মল্লিক শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি যে দেশে জন্মেছেন সে দেশের ভাষা ছেড়ে বিদেশী ভাষায় বক্তব্য রাখতে হচ্ছে বলে।৫৩
কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর ইয়ং বেঙ্গলীরা বা ডিরোজিয়ানরা একে একে যেসব সংস্থা এবং পত্রপত্রিকার জন্ম দিয়েছিলেন সেগুলি হল যথাক্রমে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা বা সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, দেশতৈষিণী সভা ইত্যাদি এবং বেঙ্গল স্পেক্টেটর, রিফর্মার, মাসিক পত্রিকা ইত্যাদির মত পত্রপত্রিকা। এইসব সংস্থা ও পত্রপত্রিকাকে মঞ্চের মত ব্যবহার করেই তাঁরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করতেন। বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্নীতি ও তার জন্যে সাধারণ মানুষের যে অপরিসীম কষ্ট তাই নিয়ে মুখ খুলেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ডিরোজিওর এক প্রিয় ছাত্র। এই বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে একজন আমন্ত্রিত মাননীয় শ্রোতার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব বেধে যায়, সেই শ্রোতা যে সে কেউ নন, ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন স্বয়ং। ডি এল রিচার্ডসন ছিলেন হিন্দু কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। দক্ষিণারঞ্জনের বক্তব্যের সজোর প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা কেবল ব্রিটিশ সরকারের দোষত্রুটি দেখছ, তাদের ভালো কাজের দিকটা দেখতে পাচ্ছ না। সরকারের বিরুদ্ধে কেবল প্রতিবাদ করতে হিন্দু কলেজের এই হলটা তোমাদের দেওয়া হয়নি। “তাঁর এই বক্তব্যের প্রবল প্রতিবাদ হয় এবং তাঁকে বলা হয় তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে। তিনি রাজি হন না। শেষপর্যন্ত ঠিক হয় ভবিষ্যতে সোসাইটির অধিবেশন হিন্দু কলেজের হলে করা হবে না, অন্য কোনো জায়গা খুঁজতে হবে।৫৪
১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের বিরোধিতাতে মুখ খুলেছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক, যার কথা একটু আগেই বলেছি। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উপনিবেশায়নকে আইনানুগ করা। এই আইনবলে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিংক যিনি এতদিন অব্দি ছিলেন বাংলার গভর্নর জেনারেল, হয়ে গেলেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং সমস্ত অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত হল। বাইরের দিক থেকে এই আইনকে দেখতে যতই মোলায়েম লাগুক, এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল ভারতীয় জনগণের নিপীড়নের কলকাঠি। রসিককৃষ্ণ মল্লিক সেগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। ১৮৩৩ সালের আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আরো ২০ বছরের জন্যে পুনর্জীবিত করা হয় কিন্তু তার বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো আর বহাল রাখা হয়নি। রসিককৃষ্ণ মল্লিক দেখিয়েছিলেন যে কোম্পানির যে বাণিজ্যিক দেনা তা আঞ্চলিক রাজস্ব দিয়ে শোধ করার কথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ হল, রসিককৃষ্ণ মল্লিকের ভাষায়, “We (জনগণ) were already burdened with a heavy debt and yet the British Parliament entail upon us an additional burden to pay the commercial debts of the company.”৫৫ ১৮৩৩ সালের ওই আইনে ধর্মসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় খরচ করার অধিকার গভর্নর জেনারেলকে দেওয়া হয়েছিল। অসামরিক ও সামরিক বাহিনীর লোকজনের জন্যে পাদ্রী আনানোর ব্যাপারে দেশের লোকের কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু দেখা গেল আইনটা এমনভাবেই তৈরি, যাতে এ বাবদে যা প্রয়োজনীয় খরচ তাও রাজস্ব থেকেই ব্যয় করা হবে। তার ওপর অসামরিক ও সামরিক বাহিনীর লোকজনের মধ্যে যারা খ্রিস্টান তাদের জন্যেই শুধু পাদ্রী আসছে না, এদেশের যেসব লোক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবে তাদের জন্যেও পাদ্রী আসছে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় যে আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্যে যে খরচ সে খরচের জোগানও আমাকেই দিতে হবে। রসিককৃষ্ণ মল্লিক এদিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, “money is to be taken out of the hands of the natives to convert them to faith which they consider to be wrong, which they consider to be detrimental for their salvation?”৫৬ রসিককৃষ্ণ মল্লিক দেখিয়েছিলেন যে সুপ্রিম কোর্ট যা নাকি আগে একটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে গভর্নর জেনারেলের অধীন করে দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ হল আগে যাঁরা ছিলেন বিচারপতি, তাঁরা এখন হয়ে গেলেন কিছু ভুলভাল এবং অবিবেচনা-প্রসূত আইনের (যা “passed not for the benefit of India but for the proprietors of Indian stock and the benefit of the people of England”৫৭) প্রশাসনিক রক্ষাকর্তা। সবথেকে বড় কথা, এই আইনে রসিককৃষ্ণ মল্লিকের ভাষায়, “there is not one word about the subject of education. Two additional Bishops have been provided for the comfort of the civil and military servants, but there is no provision whatever for the education of the people of India.”৫৮
সারদাপ্রসাদ ঘোষ, এঁর কথাও আগে বলা হয়েছে, সরাসরি এ দেশের লোককে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেবার ব্যাপারে বর্তমান শাসকদের অনীহার দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “[e]ver since the commencement of the supremacy in this country, the policy of our present rulers has been to deprive us of the enjoyment of political liberty. ... These gentlemen enact laws for the government of millions of human beings, who acknowledge subjection to British Sway, without taking their opinion as to the tendency of those laws which purport to be conducive to their welfare. We are thus rendered ignorant of what passes within the council chamber; and hence is the reason that we are so often governed by laws, which have a pernicious tendency to occasion and perpetuate our political degradation.”৫৯ দেশহিতৈষিনী সভার মঞ্চ থেকে তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছিলেন এক হওয়ার। এই অবস্থার প্রতিবিধানের জন্য প্রথমত আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, দ্বিতীয়ত দেশকে ভালবাসতে হবে, তৃতীয়ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ঐ সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, চতুর্থত বাংলাভাষায় যেসব খবরের কাগজ বেরোয় “they are to write continually on political subjects, pointing out the evils of the government together with the means by which those evils can be remedied; in the same manner as the gentlemen of the ‘British India Society’ are doing at present.”৬০ এবং পঞ্চমত আপনাদের যা কিছু অভাব অভিযোগ আছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করুন এবং প্রতিবিধান চান। এই মুহূর্তের বাস্তবতায় যে বিদেশী শাসনমুক্তির ভাবনা ভাবা সম্ভব নয় সেকথা সারদাপ্রসাদ এই প্রবন্ধেই বলেছিলেন এবং বিকল্প পথ হিসেবে তিনি এই আবেদন-নিবেদনের রাস্তায় হাঁটার কথা বলেছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গলীদের আর এক কীর্তি ছিল বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠা। ১৮৩৯ সালে রামমোহনের বন্ধু উইলিয়ম অ্যাডাম যিনি ভারত ঘুরে এখানকার মানুষের অবস্থা চাক্ষুষ করে গিয়েছিলেন প্রধানত তাঁরই পরামর্শে লন্ডনে জর্জ টমসন৬১ প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের প্রকৃত অবস্থার অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রতিবিধানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দরবার করা। এ দেশের অবস্থা নিজের চোখে দেখার জন্যে সেই জর্জ টমসন ১৯৪৩ সালে কোলকাতায় আসেন। ঐ বছরই তাঁরই অনুপ্রেরণায় ইয়ং বেঙ্গলীরা স্থাপন করেন ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। এই সভার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় দুটি। একদিকে ইংলন্ডের নাগরিকরা যাতে জানতে পারেন এ দেশে ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মানুষের সঙ্গে কি কি অন্যায় করছে সে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের নাগরিকদের ওয়াকিবহাল করা, অপরদিকে সেই অন্যায়গুলির প্রতিবিধানের জন্যে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দাবি জানানো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারবৃদ্ধি এবং নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি অত্যন্ত সরব ছিল, যে জন্যে প্রায় সমকালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ল্যান্ডওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খারাপ ছিল, যদিও দুটোই রাজনৈতিক সংস্থা।
বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির এক অনবদ্য কীর্তি হল কৃষকদের নিয়ে তৈরি তাদের প্রশ্নমালা। বেঙ্গল স্পেক্টেটরের দ্বিতীয় খণ্ড ২৪ সংখ্যায় ১৮৪৩ সালের ২৪ জুলাই যা প্রকাশিত হয়। তিরিশটি প্রশ্নে বিভক্ত অসাধারণ এই প্রশ্নমালাটি পড়তে পারা যায় বিনয় ঘোষের ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’র ষষ্ঠ খণ্ডে৬২, এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে বাহুল্যবোধে যা উদ্ধৃত করা গেল না। তবে সংক্ষেপে মোটামুটি কী কী ধরনের প্রশ্ন এতে ছিল তার আভাস দেওয়া যেতে পারে। কতরকমের চাষী হয় থেকে শুরু করে, কতরকমের জমি হয়, ভিন্ন ভিন্ন রকমের জমিতে বছরে গড়ে কত ফসল হয়, ভিন্ন ভিন্ন রকমের জমিতে বিঘাপ্রতি আবাদ করতে চাষীর কত খরচা পড়ে, চাষী কিভাবে সে টাকার ব্যবস্থা করে, যদি ঋণ করতে হয় তো কী শর্তে করে, তার জীবনযাত্রা কিরকম, কাকে সে আবশ্যক বলে কাকে সুখ বলে কাকেই বা ভোগ বলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ পর্যন্ত বিধৃত বিবরণ থেকে একটা ব্যাপার স্বপ্রকাশ যে রামমোহন থেকে ইয়ং বেঙ্গল (বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার দত্ত সমেত) পর্যন্ত যে কালপর্ব সেই কালপর্বে বাংলায় যা ঘনিয়ে উঠেছিল তা স্বাদেশিকতা, জাতীয়তাবাদ নয়। বলা যায় এ ছিল তৎকালে বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারার ভাবনা। এই স্বাদেশিকতা থেকেই এসেছিল আত্মশক্তির জাগরণের ভাবনা। আত্মশক্তির জাগরণের ক্ষেত্রে প্রধান অবলম্বন করা হয়েছিল নারীমুক্তি এবং রাজনৈতিক অধিকার চেতনা সৃষ্টিকে। এই নারীমুক্তি এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজনেই জোর দেওয়া হয়েছিল বাংলাভাষার বিকাশের ওপর। এ ছিল শক্তির জাগরণ, ক্ষমতার নয়। এসবের মধ্যে ক্ষমতার কাঙাল রাজনীতির কোনো নামগন্ধ ছিল না, যে ক্ষমতার কাঙাল রাজনীতির যুগ সম্মত রূপ, রণজিৎ গুহের ভাষায়, জাতীয়তাবাদ।
আরো একটা কথা। একমাত্র জেমস মিল রচিত ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের এবং মেকলে অনুসৃত নীতির কারণে ছাড়া ডিরোজিয়ানরা উপনিবেশিকতার শিকার খুব একটা হননি। মিলের ইতিহাস যেহেতু সাম্প্রদায়িক ভাগে ভারতকে ভাগ করেই লেখা হয়েছিল, তার নেতিবাচক প্রভাব ডিরোজিয়ানদের ওপর কিছুটা হলেও পড়েছিল। মেকলে অনুসৃত নীতির কারণে নিজের দেশের সংস্কৃতিকে তাঁরা কেউ কেউ হেয় চোখে দেখতে শুরুও করেছিলেন। তবে তা গোড়ার দিকে। নিজেদের ভেতরে প্রশ্নের কোনো অভাব না থাকায় এবং জর্জ টমসনের সাহায্যে তাঁরা অচিরে সে হীনতাও কাটিয়ে ওঠেন। কোনো সন্দেহ নেই যে জর্জ টমসন উপনিবেশিক ভারতকে স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত করতে এ দেশে আসেন নি। তা যদি তিনি আসতেন তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভারতে ঢুকতেই দিত না। কিন্তু তিনি যা করে গিয়েছিলেন তাই যথেষ্ট। তিনি ইয়ং বেঙ্গলীদের বলেছিলেন, “To be of use to your country, you will find it indispensable to possess a knowledge of it.”৬৩ তিনি বলেছিলেন, এখনো পর্যন্ত ভারতের অবস্থা নিয়ে কোনো কিছু একজন বিদেশীর লেখা, বিদেশী শাসক, বিদেশী পরামর্শদাতা, বিদেশী ঐতিহাসিক, বিদেশী কুৎসা রটনাকারী, এমনকি একজন আইনি পরামর্শদাতা পর্যন্ত বিদেশী।৬৪ তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এমন হবে?
এ পর্যন্ত আলোচনার নির্যাস
১. দেখা যাচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার শিকারও হয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করতে অরাজি রামমোহন উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু অন্যদিকে ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম যে জমি পণ্য হয়ে গেল তা বুঝতে না পারাটা এবং কৃষকের মালিকানাস্বত্বকে দখলিস্বত্ব হিসেবে তাঁর মেনে নেওয়াটা হল উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসবের মাশুল দেশের বেশির ভাগ লোককে গুনতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত নারীর হীনাবস্থাকে কেন্দ্র করে এবং বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে একটা সভ্যতার মান নির্ণয়ের যে ইয়োরোপীয় চেষ্টা, তার মধ্যে সত্যতার অভাব ছিল। এক, বর্ণহিন্দু সমাজের বাইরের বৃহত্তর সমাজে নারীর অবস্থা ততটা হীন ছিল না, যতটা ইংরেজরা প্রচারে এনেছিল। অর্থাৎ এটি ছিল আংশিক সত্য মাত্র। দুই, বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে সভ্যতার মান নির্ণয়ের যে ইয়োরোপীয় চেষ্টা, তার মধ্যেও গলদ ছিল। ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষের মানুষজনের সে অর্থে বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। এ দেশের বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভিত্তি ছিল এখানকার আবহাওয়া। তবে বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য বলতে যদি ভোগবাদের অনুসরণ বোঝায় তাহলে সেটা আমাদের দেশে ছিল না। সেটা গড়ে ওঠার কোনো অবকাশও ছিল না, কারণ এটা ছিল কৃষি সভ্যতা, এ দেশের মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বে বিশ্বাস করত না, তারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রকৃতির সহাবস্থানে সহজ সরল জীবনযাপন করাই শ্রেয় মনে করত, যেকথা রামমোহন নিজেও বলেছিলেন।
২. ধর্মনিরপেক্ষতা আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান, আমাদের দেশে যা বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ধর্মচেতনা, তার সাপেক্ষতা নিরপেক্ষতা কোনোটাই নেই। সাধারণ মানুষ মনে করে সকলের মধ্যেই ভগবান আছে, যে যে নামেই ডাকুক। আমরা কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ জৈন এগুলি হচ্ছে আমাদের আপাত-অবস্থান। যেহেতু সাপেক্ষতাও নেই, বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র চাওয়ারও কোনো ভিত্তি থাকে না। এই চাওয়াটা রাজনৈতিক, ধর্মগত নয়।
৩. জাতীয়তাবাদও আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান। জাতীয়তাবাদের ভিত্তি এক ধর্ম এক ভাষা এক জাতি। ভারতবর্ষ এক ধর্ম এক ভাষা এক জাতির দেশ নয়, সুতরাং এ দেশে জাতীয়তাবাদের শেকড় গাড়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। ইয়োরোপের জাতীয়তাবাদের যে ইতিহাস আমরা পড়ি তা খুব উজ্জ্বল নয়। হওয়া উচিত ছিল বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারা, বাংলা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল।
৪. শ্রদ্ধেয় গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় যেভাবে ডিরোজিওকে ও ডিরোজিয়ানদের স্বাদেশিকতার দিক থেকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, পড়লে অবাক মানতে হয়। এ ব্যাপারে কোনো বিতর্কে যাবার অবকাশ এই প্রবন্ধে নেই, শুধু একটা ইঙ্গিত করা যেতে পারে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দুটি বইয়ের যথাক্রমে ABENCর প্রকাশকাল ১৯৫৬ এবং BENCর প্রকাশকাল ১৯৬৮। এই কালপর্বেই বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদের কঠোর সমালোচনার ধারা শুরু হয় এবং ফলশ্রুতিতে এমন অনেক কাজ হয় যা বাঞ্ছিত ছিল না। সত্যি বলতে কি, এই সময় থেকেই বামপন্থী আন্দোলন ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনের সমস্ত উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে শুরু করে।
পরের ও শেষ অধ্যায় আগামী সংখ্যায়
তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যেকার শব্দগুচ্ছ সর্বদাই লেখকের সংযোজন
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. Asoke Basu and Saibal Datta, Indigenous Roots of Modern Science in Colonial Bengal, 2019, The Asiatic Society, Kolkata, p. 10
২. রামমোহন রচনাবলী, প্রধান সম্পাদক. অজিতকুমার ঘোষ, ১৯৭৩, হরফ প্রকাশনী, কোলকাতা, পৃ. ৪৬২
৩. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ১৩৯৭ বাং, পৃ. ২২০
৪. M. K. Gandhi, An Autobiography or My Experiments with Truth, vol 1, 1927, Navajiban Publishing House, Ahmedabad, pp.370-371
৫. Ashis Nandy, The Romance of the State and the Fate of Dissent in the Tropics, 2007, Oxford University Press, New Delhi, ‘An Anti-Secularist Manifesto’, p. 34-60
৬. Pynhunlang NM Shullai, Colonialism, Christianity and Mission Activities In India: A Postcolonial Perspective, International Journal of Humanities and Social Science Studies, vol III Issue V March 2017, p. 326, http://www.ijhsss.com
৭. রামমোহন রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪
৮. Francis Bacon, Of the Advancement of Learning, 1930, J. M. Dent & Sons Ltd, New York, p. 179
৯. ibid, p. 40
১০. Max Weber, The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism, 1950, Charles Scribner’s Sons, New York
১১. পড়ুন J. N. Farquhar, Modern Religious Movements in India, 1915, Macmillan Co., New York
১২. পড়ুন Richard King, Orientalism and Religion, e-library edn., 2001, Routledge, London and New York
১৩. দেবেন্দ্রনাথ দে, কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, সম্পাদক. সত্যব্রত দে, ১৯৯০, জিজ্ঞাসা এজেন্সিস লিমিটেড, কোলকাতা, পৃ ৪ (পাদটীকা দেখুন)
১৪. D. D. Kosambi, Myth and Reality, p. 7
১৫. রণজিৎ গুহ, দয়া -- রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা, ২০১১, তালপাতা, কোলকাতা, পৃ. ১৩৩
১৬. Ashis Nandy, ibid, p. 34-60
১৭. Ashis Nandy, ibid, p. 34-60
১৮. Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches, vol 13, 2014, His address on ‘Article 1’ of The Constitution of India, p. 326
১৯. পড়ুন, Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760, 1997, Oxford University Press, Delhi, Part 2, ‘Bengal under the Mughals’, pp. 137-304
২০. Henry Miller, Tropic of Cancer, 1963 edn, Flammingo, London, p. 170
২১. Erich Fromm, The Art of Loving, 1956, Harper and Row, New York p. 80
২২. Bimal Krishna Matilal, The Navya Nyaya Doctrine of Negation, 1968, Harvard University Press, Massachusetts, see ‘Preface’, p. X
২৩. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা, ১-৫ খণ্ড, সম্পাদক. অশোক মিত্র, ভারতের জনগণনা ১৯৬১, ভল্যুম ১৬, পার্ট ৭বি
২৪. Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches, vol 1, 2014, ‘Annihilation of Caste’, pp. 57-58
২৫. D. D. Kosambi, Myth and Reality, p. 10
২৬. ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্বপ্ন লব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস, ১৩০২, বুধোদয় যন্ত্র, হুগলী পৃ. ১০-১১
২৭. Young India (1919-1932) 18.06.1925, p. 211, English weekly journal, published from Bombay as a bi-weekly, under Gandhiji's supervision from May 7, 1919, and as a weekly from Ahmedabad, with Gandhiji as editor from October 8, 1919,
২৮. Bengal Early Nineteenth Century–Selected Documents, ed. Gautam Chattopadhyay, 1978, Research India Publications, Calcutta
২৯. Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century–Selected Documents (ABENC), ed. Goutam Chattopadhyay, 1956, Progressive Publishers, Calcutta
৩০. Bengal Early Nineteenth Century–Selected Documents (BENC), ed. Gautam Chattopadhyay, 1978, Research India Publications, Calcutta, see ‘Introduction’, p. vii
৩১. BENC, ibid, p. 32
৩২. রামমোহন রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৯
৩৩. BENC, ibid, p. 32-33
৩৪. BENC, ibid, see ‘Introduction’, p. ix
৩৫. BENC, ibid, p. 34
৩৬. BENC, ibid, p. 100
৩৭. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ed. F. B. Bradley-Bart, 1923, Humphrey Milford/Oxford University Press, p.
৩৮. ibid, ibid, p. 2
৩৯. ibid, ibid, p. 137
৪০. পল্লব সেনগুপ্ত, ঝড়ের পাখিঃ কবি ডিরোজিও, ১৯৬০, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ. ২৭
৪১. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ed. F. B. Bradley-Bart, 1923, Humphrey Milford/Oxford University Press, see ‘Fakeer of Junngheera’, p. 171-172
৪২. BENC, ibid, see ‘Introduction’, p. vii-viii
৪৩. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ibid, see ‘Freedom to the Slave’, p. 18
৪৪. BENC, ibid, see ‘Introduction’, see ‘Birth of the Deshutaishunee Shubah, October 1841’, p. 273
৪৫. Pallab Sengupta, Derozio, 2000, Sahitya Akademi, p. 70-74
৪৬. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ, ১৯০৯, এস. কে. লাহিড়ী অ্যান্ড কোং, কোলকাতা, পৃ. ১৪৭-১৪৮
৪৭. Sanjay Seth, Nationalism, Modernity and the “Woman Question” in India and China, The Journal of Asian Studies, vol 72 no. 2 (May 2013), p. 276, http://www.jstor.org/stable/43553178
৪৮. ABENC, ibid, see ‘On Native Female Education’, p. 294
৪৯. পড়ুন James Mill, The History of British India, 1817, www.archive.org
৫০. Sanjay Seth, ibid, p. 274, ibid
৫১. ABENC, ibid, পৃ. ৩-৪
৫২. ibid, ibid, পৃ. ২-৩
৫৩. BENC, ibid, see ‘Town Hall Meeting on January 5, 1835 criticising Charter Act of 1833’, p. 260
৫৪. ABENC, ibid, see ‘Report of Controversy between Dukhinaranjan and Richardson, Bengal Hurkaru, p. 389-399
৫৫. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 261
৫৬. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 262
৫৭. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 261
৫৮. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 264
৫৯. BENC, ibid, see ‘Birth of the Deshutaishunee Shubah October 1841’, p. 266-267
৬০. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 275
৬১. ব্রিটেনের দাসপ্রথা-বিরোধী নেতা, দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে কোলকাতায় এসেছিলেন এবং সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার সভ্যদের অন্তরঙ্গতা অর্জন করেছিলেন।
৬২. সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, সংকলন ও সম্পাদনা. বিনয় ঘোষ, ষষ্ঠ খণ্ড, ১৯৮৩, প্যাপিরাস, কলকাতা, পৃ. ১০৯-১১১
৬৩. BENC, ibid, see ‘On the Formation of British India Society’, p. 200
৬৪. BENC, ibid, ‘ibid’, p. 208-209