সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় বহুল বিতর্কিত তিন কৃষি-বিল আইন হিসাবে গৃহীত হবার পর থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানার বিভিন্ন কৃষক সংগঠন একত্রিত হয়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন তা আমাদের, বিশেষ করে আমার, প্রথম দিকে তেমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু এই কৃষকরাই যখন বিপুল সংখ্যায় জড়ো হয়ে দিল্লির দরজায় কড়া নাড়তে গিয়ে বাধা পড়লেন হরিয়ানা-দিল্লির সীমান্তে, একটু নড়েচড়ে বসতেই হল। দিল্লি থেকে হরিয়ানার সোনেপতমুখী রাজপথের যে জায়গাটিতে কৃষকরা ২৬ নভেম্বর (২০২০) থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্ণায় বসে গেলেন তার নামের ধ্বনির সঙ্গে এক অদ্ভুত সাজুয্য আমাদের পশ্চিমবাংলার গত দশকের কৃষক আন্দোলনের আতুরঘরের। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া ঘরের কাছে হুগলি জেলার সিঙ্গুরের কৃষক-জনতার সোচ্চার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই রাজ্যে এবং কিছুটা হলেও কেন্দ্রীয় স্তরেও এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল। ‘সিঙ্ঘু’ নামটা সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। একসময়ে সিঙ্গুরে বেশ কিছু সময় ধরে আমাদের অনেকের যাতায়াত প্রায় নিয়মিতই হয়ে উঠেছিল, এখন ভিন রাজ্যের দেশ সিঙ্ঘুতে নিয়মিত নাহলেও একবার তো যেতেই হয়। ‘সিঙ্ঘু’ যে সমকালের কৃষক আন্দোলনের ‘মহাতীর্থ’।
সিঙ্ঘুতে কৃষকদের লাগাতার ধর্ণা আর সিঙ্গুরে কৃষকদের প্রতিবাদ - এই দুইয়ের মধ্যে অমিল হয়তো অনেক, কিন্তু মিলও কিছু কম নয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুনর্বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অব্যবহিত পরেই, তাঁর কথায় প্রায় ৩০ বছর ধরে অনুন্নয়নের খরায় হেজে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-উন্নয়নের শ্লোগান নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করলেন। শুরুতেই সিঙ্গুর। সিঙ্গুরের উর্বর কৃষি জমিতে টাটা কোম্পানির মোটর-গাড়ি কারখানা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক রথী-মহারথীরা কাগজ কলমে হিসাব কষে দেখালেন, টাটাদের কারখানা চালু হলে পশ্চিমবঙ্গের ‘জিডিপি’ তো তড়তড় করে পাল তুলে এগোবেই, সঙ্গে সিঙ্গুরের কৃষকরাও জমি হারাবার বিনিময়ে যা পাবেন তা প্রায় চাঁদ প্রাপ্তির সমান। কিন্তু মহা গেঁড়োয় পড়ে গেল সরকার, ‘অশিক্ষিত এঁড়ে’ কৃষকেরা তা বুঝতেই চায়না। উল্টে গড়ে তুললেন প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ঢেউ। কৃষকদের ‘ভাল’ চাওয়া সরকারের লাঠি, গ্যাসের সামনে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কুনাট্যের ফলে প্রতিরোধ হয়তো শেষ পর্যন্ত টিঁকিয়ে রাখা গেলনা, কিন্তু প্রতিবাদের আগুন জ্বলে রইল একই উত্তাপ নিয়ে। শুধু সে নিজেই জ্বললনা, তার আঁচে বহু বছর ধরে অন্যায় সয়ে যাওয়া বন্ধ মুখগুলি হঠাতই গেল খুলে। সরকারের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এই সময় থেকেই ব্যাপক জনমত গড়ে উঠতে লাগল। এই ঘটনাবলীর সবটাই আমাদের জানা এবং জানা বলেই সিঙ্ঘু সীমান্তে কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল দীর্ঘ অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে এক আলোর রেখা।
২০১৯’র নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সাফল্য আর তারপরেই তাদের যথেচ্চাচার আর কথায় কথায় কুৎসিত পেশি আস্ফালন, যার ফলশ্রুতি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং অন্য কিছু জায়গায় কৃষকদের প্রতিবাদ। এইসব ঘটনা কি সিঙ্গুরের সঙ্গে মিলকে ইঙ্গিত করছে না?
সিঙ্ঘু বা টিকরি বা গাজিপুরে কৃষকরা ১০০ দিন পার করেও অদমনীয় জেদ আর লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে কেন বসে রয়েছেন তা এখন সারা দুনিয়া জুড়ে প্রচারিত। কিন্ত আমাদের, ভারতীয়দের অতিরিক্ত পাওনা, এই আন্দোলনের মধ্যে সিঙ্গুরের ছায়া যেমন দেখতে পাচ্ছি তেমনি দেখতে পাচ্ছি দেশময় প্রতিরোধের এক বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর আন্দোলন যেমন সুদুর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, আশা জাগছে, এই দেশে যে জগদ্দল পাথরটা বুকের উপর চেপে বসে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে একটু একটু করে আমাদের শ্বাসরোধ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতেও সিঙ্ঘু-টিকরিতে ধর্ণায় বসা ‘মূর্খ’ কৃষকেরা তেমনি প্রভাব ফেলবেন। এই আশার মশাল যারা বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা সামলানো মুস্কিল। ইচ্ছা থাকলেও অনেকের পক্ষেই আলোর এই চ্ছটা গায়ে মেখে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে কয়েকজনের সেই সৌভাগ্য হয়েছে আমি তাদেরই একজন।
আন্দোলনরত কৃষকরা নিজেদের মতো করে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবেন বলে ২৬ জানুয়ারি (২০২১) দিল্লির পথে ট্র্যাক্টর অভিযান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রত্যেক বছর এই দিনটাতে দিল্লির রাজপথে সৈন্যবাহিনির দাপাদাপি এবং সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্যারেড দেখতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। কৃষকদের ট্যাক্টর মিছিলের ঘোষণা এতদিনের একঘেয়ে অভ্যাসের বিরুদ্ধে এমনই এক অপ্রত্যাশিত আঘাতে উত্তেজিত বোধ করতেই হল। দিল্লির রাজপথ প্রজাতন্ত্র-দিবসে অধিকার করবে সেই জীবিকার মানুষ, গোষ্ঠী হিসাবে দেশে যারা বৃহত্তম। এর থেকে অভিনব ঘটনা আর কি হতে পারে। অতএব সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতেই সিঙ্ঘু যাত্রার দিন নির্বাচন।
দিল্লি শহর থেকে সিঙ্ঘু সড়ক পথে প্রায় ৫০ কিমি। ২৬ জানুয়ারি (২০২১)’র যে ঘটনা নিয়ে শিয়াল বাহিনির হুক্কাহুয়া সেটা বুঝতে এই দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ। সে কথায় পরে আসা যাবে। প্রায় কোন যোগাযোগ ছাড়াই সিঙ্ঘুতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু থাকব কোথায়। তাতো ঠিক নেই। একটা সামান্য যোগাযোগ ছিল, কিন্তু বাজিয়ে দেখলাম সেখানে আমি থাকি এমন উৎসাহ তাঁরা দেখালেন না। ঠিক যেখান থেকে কৃষকদের ধর্ণার জায়গাটা শুরু সেইখানে রাস্তার ধারে বড় একটা জায়গা নিয়ে নবম গুরু শহিদ তেগবাহাদুরের নামে এক স্মৃতি সৌধ তৈরি হয়েছে। খোলা স্টেডিয়ামের মতো অনেকটা। এর নিচে বেশ বড় বড় ঘর রয়েছে দু তিনটা। সৌধের উদ্যানে একটা লঙ্গর। সেইখানে বসে আছি, একটু পরেই রাতের খাবার জুটবে। রাতের থাকার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবছি। আমার পাশে এসে বসলেন এক ভদ্রলোক। ধর্ণার প্রথম দিন থেকেই তিনি সিঙ্ঘুতে। পরিবারের জমি আছে তবে তিনি দিল্লিতে চাকরি করেন। লকডাউনে সেটা খুইয়েছেন। অতএব স্থায়ীভাবে এখানে থাকতে কোন অসুবিধা নেই। তাঁকে সমস্যার কথা বলতেই খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু দিলেন। এবং অবশেষে সমস্যার সমাধানও করে দিলেন। কিষান মজদুর সংঘর্ষ সমিতি (কিষান সংযুক্ত মোর্চা নয়) পরিচালিত তাঁবুগুলির স্টোরের দায়িত্বে থাকা সর্দারজি আমার থাকার দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করলেন। ইনি পেশায় ডাক্তার, কলকাতার গাঙ্গুলীবাগানের কোন এক নার্সিংহোমে কিছুদিন কাজের সুবাদে দুচার লাইন বাংলা বলতে পারেন। কলকাতা বা পশ্চিমবাংলা মানেই ওঁদের কাছে সুভাষ চন্দ্র বোস। তাঁর জন্যই আমার বিশেষ খাতির। সুভাস বোসের কারণেই সিঙ্ঘু বা টিকরিতে আমার বাঙ্গালী পরিচয় সবসময়ই আন্দোলনকারীদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ঐদিনটা ছিল আবার ২৩ জানুয়ারি। সিঙ্ঘুর বিভিন্ন স্থানে নেতাজী স্মরণ চলছে মহা সমারোহে। যাইহোক, থাকার ব্যবস্থা হল সেই তেগবাহাদুর নামাঙ্কিত সৌধের নিচের একটি ঘরে। শোবার জন্য মিলল মোটা গদি আর বেশ গরম একটা কম্বল। বড় ঘরটিতে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক রয়েছেন। তাবুতেই থাকার ইচ্ছা ছিল কিন্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যা পাওয়া গেল তাই নিয়েই সন্তুষ্ট হলাম। এইখানেই কাটল আমার সিঙ্ঘুতে থাকা অসামান্য রঙীন দিনগুলি।
পরের দিন রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোনেপতের দিকে এগোলাম। রাজপথ তো আর নেই। বোঝাও যায়না এটা কোন রাজপথ। সমস্ত পথ জুড়ে খালি তাঁবু, মানুষ আর ট্র্যাকটরের মেলা। রয়েছি ধর্ণার জায়গার একেবারে গোড়ার দিকে। এগোতেই প্রথমে চোখে পড়ল কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি পরিচালিত তাঁবু আর আস্তানায় পরিণত ট্র্যাক্টরের সারি। সেগুলি পার করে এলাম ওদেরই ব্যানার লাগানো এক মঞ্চের সামনে। সেটা পার করে দেখি প্রায় সমস্ত রাস্তা জুড়ে পুলিশের নিজস্ব ঘেরা বেশ বড় জায়গা। তারপরেই মাইলের পর মাইল জুড়ে কৃষকদের তাঁবু আর তাঁবু। সঙ্গে যেমন রয়েছে থাকার জন্য ট্র্যাক্টর বা ট্রলি তেমনি অসংখ্য খালি ট্র্যাক্টর। কয়েকশ মিটার এগোতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মঞ্চ। এই মঞ্চ আগেরটার চেয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থে অনেকটাই বড়। বসার ছাউনিতে, পাঁচশ’র বেশি লোক বসে যেতে পারেন। লাগাতার বক্তৃতা চলছে। ভাষা মূলত পাঞ্জাবী যা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। বক্তৃতার যে অংশে শ্রোতারা উৎসাহে হাততালি দিচ্ছেন সেই অংশের মানে পাশের বসা লোককে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর কদাচিৎ পেয়েছি। আসলে, তাঁরা বক্তৃতার কোন অংশেই আমার কারণে অমনোযোগী হতে চাইছেন না। দ্বিতীয়ত, দুচারজন হিন্দিতে মানে বলে দিলেও, পাঞ্জাবী ভাষার টান এত বেশি যে সঠিক মর্মোদ্ধার হল না। মাথা নেড়েই যেতে হল। এইসব ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। ২৬’র প্রস্তুতির জন্য বিরামহীন ট্র্যাক্টর ঢুকেই চলেছে। মোর্চা থেকে যে বলা হয়েছে দেড় লাখ ট্র্যাক্টরের কথা, অবস্থা দেখে বুঝলাম তা শূন্য গর্জন নয়। আর অসংখ্য মানুষের ছোট ছোট মিছিল মিশছে এই মানুষের সঙ্গমে। এত ভিড় যে মাঝে মাঝে হাঁটাও মুস্কিল হয়ে উঠছে। রাস্তার ধারেই অসংখ্য লঙ্গর। নানা রকম খাবার তৈরি হয়ে চলেছে। মূলত রুটি ডাল আর তরকারি। ক্লান্ত পায়ে ঢুকে পড়েছি এইরকম দুই একটা লঙ্গরে। তাঁরা বসতে দিচ্ছেন, চা খাওয়াচ্ছেন। পুরুষ মহিলা সবাই মিলে আটা বেলছেন, রুটি সেঁকছেন। ঐরকম আয়তনের হাঁড়ি ডেকচি আমি জীবনে দেখিনি। হাঁটতে হাঁটতে সুযোগ পেলেই দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছি। তাঁদের ভাষা কখনো বুঝছি কখনো বুঝছিনা। কিন্তু তাঁদের চোখে মুখে, শরীরে প্রতিজ্ঞার, দৃঢতার ভাষা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। বাড়িয়ে বলা নয়, ঘর সংসার ছেড়ে প্রবল শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে যারা এতদিন নিজেদের দাবীতে অনড় থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা কি ধাতুতে গড়া সেটা বুঝতেই তো যাওয়া। তাঁদের যেটুকু বুঝেছি তার ভিত্তিতেই এই লেখা। অন্যদিকে নেতাদের যেমন রাজেওয়াল বা যোগেন্দ্র যাদব, এঁদের খোঁজ করলেই সবাই কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। নেতৃস্থানীয় কারও সঙ্গে দেখা আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।
পরের দিন বাসে চড়ে চড়ে পৌঁছে গেলাম টিকরিতে। ধর্ণার জায়গাটা ঠিক দিল্লি শহরের প্রান্তেই। সিঙ্ঘুর মতো শহর থেকে অত দূরে নয়। রোহতক দিল্লির রাজপথে এই ধর্ণা। এই পথ দিল্লি সোনেপতের তুলনায় কিছুটা কম চওড়া। ফলে ভীষণ চাপাচাপি করে ট্র্যাক্টর আর তাঁবুর মেলা। যে কোন তাবুর সামনে দাঁড়ালেই উচ্চকিত স্লোগান আর গান। প্রাণশক্তি কাকে বলে তার ধারণা এখানে এসে পাওয়া গেল। কয়েকটি অল্প বয়সী ছেলে একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে ছিল। একটু জিরোতে ওদের সঙ্গে বসে গেলাম। আন্দোলন নিয়ে নানা কথা হল। পরে ওরা আমাকে আমার পায়ের আরামের জন্য নিয়ে গেল যন্ত্র দিয়ে পা মালিশ হয় এমন একটা জায়গায়। দেখতে হয় এদের অভ্যর্থনা। কি যত্ন করে আমাকে বসালো, যন্ত্রে পা রাখতে বলল। কথা হল অনেকের সঙ্গে। এখানের হিন্দি কোন কারণে একটু সড়গড়, হয়তো দিল্লি শহরের খুব কাছে বলে। চা খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও চা খাওয়ার বাহানায় ঢুকে গেলাম একটা লঙ্গরে। সেই সুভাস বোসের কথা, তাঁর লড়াইয়ের কথা, বাঙ্গালীর কথা। আমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সিঙ্ঘুতেই ফিরতে হল কারণ সেখানেই আমার সঙ্গের ব্যাগটা রয়ে গেছে।
সিঙ্ঘুতে ফিরে দেখি কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ মঞ্চের সামনে ব্যাপক ভিড়। হাজার খানেক লোক হবে সেখানে। নেতারা মঞ্চ থেকে কিছু বলছেন আর তীব্র উল্লাস ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। পাশের লোকেদের জিজ্ঞাসা করেও কিছু উত্তর পাচ্ছিনা। সবাই বক্তৃতায় মগ্ন। থাকার জায়গায় ফেরার পথে খোঁজ করতে গেলাম সেই কলকাতায় কাজ করা ডাক্তারবাবুর। উদ্দেশ্য, কটায় মিছিল বেরোবে তা নিয়ে নিশ্চিত হতে। স্টোরে তাঁকে পেলাম না। স্টোরের সামনেই একটা ট্র্যাক্টরের ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাদেরও খোঁজ নেই। শেষে ঐ ট্র্যাক্টরে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আগামী কালের মিছিল শুরুর সময়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে অদ্ভুত আচরণের সম্মুখীন হলাম। প্রায় খেঁকিয়ে উঠে আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন। তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম যথার্থ লোকের অপেক্ষায়। তাঁদের না পেয়ে থাকার জায়গায় ফিরলাম। মোটামুটি জানাই ছিল দশটায় মিছিল বেরোবে। আমার পাশে থাকা লোকজনও সেই কথাই বললেন। মানসিক প্রস্তুতি সেইরকমই রইল।
পরের দিন সকালে ৬ টার কিছু পরে ঘুম ভাঙল। আমার পাশেই শুতেন এক ষাটোর্ধ্ব শিখ ভদ্রলোক। দেখি উনি একেবারে প্যান্ট সার্ট পরে যাত্রার জন্য তৈরি। ওঁর সম্বন্ধে দুচার কথা না বললেই নয়। পাতিয়ালায় থাকেন। সামান্য জমি আছে। ছেলেরাই তা দেখছে। তাঁরা বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আন্দোলনের যোগ দিতে। খুব গুছিয়ে কথা বলেন। পরে একসময় প্রকাশ পেল, তিনি আম আদমি পার্টির সমর্থক। তাঁর মতে, পাঞ্জাবের পরের নির্বাচনে ‘আপ’ই জিতবে। এই কথার ফাঁকে এ ইঙ্গিতও পেলাম, তেগবাহাদুর স্মৃতি সৌধের যে লঙ্গরে সাধারণত আমরা খাবার খাই তা ‘আপ’ দলই চালায়। আমার পাশে ছিলেন ‘রেডস্টার’ দলের ওড়িশা, ছত্তিশগড় থেকে আসা কিছু নেতা কর্মী। তাঁরাও বললেন, অপ্রকাশ্যে কংগ্রেস সহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল এখানে এমনি ভাবে লঙ্গর চালাচ্ছে।
তৈরি হয়ে সাড়ে ৭টা নাগাদ লঙ্গরে পৌঁছে কিছু খেয়ে নিয়ে সবে চায়ের কাপে হাত দিয়েছি। হঠাৎ শুনি হৈ হৈ আওয়াজ। হাইওয়ের একপাশে ১০০ মিটারের মতো কিছু দূরে তেগবাহাদুরের স্মৃতি সৌধ। মাঝখানে একটা পেট্রোল পাম্প যা আপাতত বন্ধ। এছাড়া টোল ট্যাক্স আদায়ের একাধিক লেন। তাই হাইওয়ে ঝট করে নজরে আসে না। কিন্তু আওয়াজটা ঐদিক থেকেই। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি ট্র্যাক্টর বেরিয়ে পড়েছে। বেরোবার মুখটা পুলিশ ছোট করে রেখেছে। তাই ট্র্যাক্টরের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। তার থেকে আসছে শ্লোগান আর উল্লাসের ধ্বনি। তখন ৮টাও বাজেনি। দৌড়ে রাস্তার ধারে গিয়ে একটা মোবাইল টয়লেটের উপরে চড়ে আমার ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, যতদুর চোখ খালি ট্র্যাক্টর আর ট্র্যাক্টর। সেগুলিতো ঠাসাই, আর তার পাশে পাশে শ্লোগান মুখর মানুষের মিছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেই ঐ ভিড়ে মিশে গেলাম। হাঁটছি, কথা বলছি। প্রাণ ভরে মানুষের প্রাণশক্তির আঁচ নিচ্ছি। জীবনে অনেক মিছিলে হেঁটেছি। সমস্ত হাঁটা পথগুলি জুড়লে কতশত মাইল হবে তা জানা নেই। কিন্তু মিছিলের এমন উত্তেজনা, এমন দৃপ্ত ভাবনা, বিশ্বাস আমাকে এর আগে কখনো আচ্ছন্ন করেছে বলে মনে করতে পারছিনা। এক নতুন ভারতবর্ষের উত্থানের সম্ভাবনা যেন দেখতে পাচ্ছি। সামনে পিছনে ব্যাপ্ত মানুষের মহাসমুদ্রের ঢেউ আমার চেতনাকে এমন কোন সুদূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল যার ঠিকানা আমার আগে জানা ছিলনা। প্রস্তাবে যে রিং রোড পরিক্রমার কথা আছে তা শেষ করতে ১০০ কিমি পথ পার হতে হবে। পায়ে হেঁটে তা করা আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব ছিলনা। তাই কখনো গাড়িতে, কখনো বাইকে মাঝে মাঝে উঠছি। মিছিলে হাঁটা লোকজনই তাঁর ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সুদূর কলকাতা থেকে এসেছি এই কথাতো তাঁদের উজ্জীবিত করছেই, এর উপর আছেন আমাদের সুভাষচন্দ্র। এমনি করে এগোবার সময় মাঝে একবার বাধার সম্মুখীন হল মিছিল। বাধার জায়গা থেকে অন্তত ৫০০ মি দূরে আমি। টিয়ার গ্যাস ফাটার আওয়াজ পাচ্ছি। তার ধোঁয়াও দেখতে পেলাম দূর থেকে। আবার মিছিল এগোল। ৫০০ মি এগিয়ে দেখলাম, কৃষকরা পুলিশের তোলা ব্যারিকেড দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন।
পথের অনেক জায়গায় মানুষ জড়ো হয়ে পুষ্প বৃষ্টি করছেন। আবেগ তাঁদের এবং আমাদেরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। হাতে জল, বিস্কুট ধরিয়ে দিচ্ছেন রাস্তার ধারে দাঁড়ানো মানুষেরা। কখনোবা চা। সে জিনিস হাতে নিলে যে তৃপ্তির ছোঁয়া তাঁদের মুখে দেখেছি তা ভোলার নয়। জল বিস্কুট আমার কত উপকার করবে তা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্ত তাঁদের কাছে তার চেয়েও সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মিছিলকারীদের মধ্যে সেইসব জিনিস বিলি করে আন্দোলনের একটা অংশ হতে পারার আনন্দ।
রাস্তায় চলতে চলতে কিছু আলাপের কথা আমাকে একটু দ্বিধায় ফেলে দিল। একজন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘রিং রোডের কথা ছাড়ুন’। নেতারা বললেও তারা নাকি নিজেদের মতো রাস্তা ধরেই যাবেন। সেটা কোন রাস্তা তার উত্তর পরিষ্কার হলনা। একজন বললেন - দিল্লি যখন ঢুকছি আর বেরোবানা। যন্তর মন্তরে বসে যাব। এর মানে উদ্ধার হল যখন, তখন অনেক কিছু ঘটে গেছে। পথের শেষটা আমি একটা গাড়িতে পার করছি। দিল্লি শহর আমার সম্পূর্ণ অচেনা, বছর চল্লিশ আগে সেখানে কয়েক মাস থাকলেও। যার গাড়িতে চড়েছি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম - কোথায় যাচ্ছি। তিনি বললেন, ধারণা নেই। মিছিলের আগের লোকেরা যেখানে যাচ্ছেন, সেইখানেই। কিন্তু আন্দাজে বুঝলাম যে পথে যাচ্ছি তা আর যাই হোক রিং রোড নয়, যদিও যাত্রা শুরুর পর ৫ ঘন্টার বেশি সময় কেটে গেছে। কিছুটা পরেই রাস্তায় ধারে লাগানো দিকচিহ্ন দেখে বুঝলাম, পুরানো দিল্লি স্টেশনের দিকেই চলেছি, যার কাছেই লালকেল্লা।
একসময় গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে হেঁটে লালকেল্লার কাছে পৌঁছলাম। কেল্লা চত্বরে অগুন্তি ট্র্যাক্টর আর মানুষ। যে মিছিল বেরিয়েছে তার খুবই সামান্য অংশ হয়’ত, কিন্তু সমগ্র মিছিলটা এত বড় ছিল যে তার এক ক্ষুদ্রাংশকেও বিরাট বলে দেখাচ্ছে। শিখদের ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহেবকে লালকেল্লার দু তিন জায়গায় উত্তোলিত দেখতে পেলাম এবং কোন মতেই সেই পতাকা জাতীয় পতাকার উপরে নয়, তা গদি মিডিয়া আর বিজেপি যতই প্রচার করুক না কেন। ভেবে উঠতেই পারছিনা সমস্ত পরিকল্পনা এমন পাল্টে গেল কি করে। ধরেই নিয়েছিলাম, দেড়লাখ ট্র্যাক্টর রিং রোডে ঢুকলে এমন জ্যাম হবে, রাতে সিঙ্ঘু ফেরার কোন প্রশ্নই নেই। ভেবেছিলাম, কোন ট্র্যাক্টরে বসে রাত্রিটা কাটিয়ে দেব। বুঝতে পারছি, তেমনটা হবার নয়। অতএব ঘন্টা খানেক পরে সিঙ্ঘু ফেরার পথ ধরলাম।
ফিরতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল তাও বলার মতো। বাতাসে ভাসছে খবর, কৃষকরা নাকি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিলেন। মেট্রো রেল, বাস সব বন্ধ। একসময় মনে হল, সিঙ্ঘু ফেরাই হবেনা আজ। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। মনে হল, রাস্তায় হয়’ত পরে থাকতে হবে, অথবা খুঁজে নিতে হবে কোন হোটেল। ছিটকে পড়েছি সবার থেকে। কোন সঙ্গী নেই। পা আর চলছে না। যাইহোক, কোনমতে সিঙ্ঘু ফিরতে পেরেছিলাম সেই রাত্রে। সেই কাহিনি অবশ্য খুব জরুরী কিছু নয়।
এরপরেও সিঙ্ঘুতে ছিলাম ২ দিনের মতো। এই দুদিনে ২৬ তারিখের বা তার আগের দিনের কিছু না বোঝা না জানা ঘটনার অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেল।
কিষান মজদুর সংঘর্ষ সমিতি বা সংযুক্ত কিষান মোর্চার আলাদা মঞ্চ বা এদের দু’দলের এলাকার মাঝখানটাতে পুলিশ ক্যাম্পের কথা আগেই বলা হয়েছে। ধর্ণার অঞ্চলে ঢুকতে প্রথমেই কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি বা সংক্ষেপে কেএমএসএস-এর এলাকা পড়বে সেটাও জানা। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বা সংক্ষেপে এসকেএম ২৬ তারিখের সমস্ত ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন, কেননা মিছিলের ডাক তাঁরাই দিয়েছিলেন। কিন্তু রিং রোড না ধরে মিছিলের একটা অংশকে লালকেল্লায় নিয়ে যাবার জন্য কেএমএসএসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। পুলিশ ক্যাম্পের এলাকা পার করে ওদের তাঁবু ফেলার জায়গাও কি করে এগিয়ে গেল, সেই প্রশ্ন তুলে পুলিশের সঙ্গে কেএমএসএসের গোপন আঁতাতের ইঙ্গিত তাঁরা দিয়েছেন। আগের দিন কেএমএসএসের সভায় যে তুমুল উল্লাসের আওয়াজ শুনেছিলাম তার ভাষা বুঝিনি সেটা আগে জানিয়েছি। পরে জানলাম, এই সভাতেই যেমন ইচ্ছা তেমন মিছিলকে নিয়ে যাবার কথাই ঘোষণা করা হয়েছিল। এসকেএমের নেতারা এও অভিযোগ তুলেছেন যে তাঁদের এই ঘোষণা জেনেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। আগেই এসকেএম সংসদ অভিযানের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। লালকেল্লার ঘটনার পর তাঁরা সেই অভিযান বাতিল করে দিলেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কেএমএসএসের সেই ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ওরা, মানে এসকেএম, যা বলার বলুক, সংসদ অভিযান নাকি হবেই। ডাক্তারবাবুর এই কথা শোনার পরই এসকেএমের তোলা অভিযোগের সারবত্ত্বা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না। পরে অবশ্য ওঁরাও এই অভিযান বাতিল বলে ঘোষণা করে দিলেন। আবার ভাল করে দেখলাম, সত্যিই তো, পুলিশ ব্যারিকেড ডিঙিয়েই কেএমএসএসের তাঁবু পড়েছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে আগে তাঁবু পড়েছে পরে পুলিস ব্যারিকেড, তাহলেও এই প্রশ্নের উত্তর নেই কি করে পুলিশ দিল্লির দিক থেকে এসে কেএমএসএসের তাঁবু এলাকাটা ছাড়িয়ে ব্যারিকেড গড়ল। এক বৃদ্ধ লোকের খেঁকিয়ে ওঠার কথা আগে লিখেছি। পরে বুঝলাম মিছিল, শুরুর সময় জিজ্ঞাসা করায় তাঁর ওইরকম প্রতিক্রিয়া কারণ এসকেএমের নির্ধারিত সময় ১০টা তাঁরা যে না মেনে আগেই বেরিয়ে যাবেন তা আমার মতো ভিনরাজ্যের বাসিন্দার কাছে প্রকাশ করতে চাননি। এছাড়া সেইদিন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আরও কয়েকজন আমাকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এসকেএম যে এমনটা করেনি তাই নিয়ে আমি নিশ্চিত। এটাও পরে জেনেছি এসকেএম লালকেল্লার ঘটনার কথা জেনে একটা সময়ের পর তাঁদের অভিযানকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিকেলের পরও সিঙ্ঘু থেকে শেষ ট্র্যাক্টরটির বেরোতে অনেক দেরি। তার আর বেরোনো হলনা। যদি রিং রোড ধরেই মিছিলটা এগো’ত তাহলে প্রথম ট্র্যাক্টর সিঙ্গুতে ফিরে এসে বেরোবার অপেক্ষায় থাকা শেষ ট্র্যাক্টরকে দেখতে পেত, এমনটা অনেকেরই বিশ্বাস। দিল্লি অন্তত তিনদিনের জন্য অচল হয়ে থাকত। এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনা দেখা থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হল। এ আমাদের দুর্ভাগ্য।
মিছিল বেরোবার অনেক আগে থেকেই নেতারা বিশেষ করে যোগেন্দ্র যাদব বারবার বলেছিলেন কিষাণ আন্দোলনকে ছোটো করতে শাসকদের দরকার কেবল মাত্র ৯০ সেকেন্ডের একটা অন্য ধরনের ভিডিও। সেটা শাসকরা পেয়ে গেছিল আর তারপরেই সমস্বরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কৃষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে। যদিও ব্যারিকেড ভাঙা ছাড়া আর কোনও ঘটনা তাঁরা ঘটাননি যাকে হিংসাত্মক বলা যায়। সরকার দ্বারা অনুমোদিত পথের সামনে যদি ব্যারিকেড গড়া হয় তাকে ভাঙাও কি হিংসাত্মক? এই প্রশ্নও তো স্বাভাবিক।
সিঙ্ঘু দিল্লি শহর থেকে বহুদূর হবার কারণে প্রশস্ত রাজপথ ধরে ট্র্যাক্টরগুলি প্রবল বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং এরা সেই প্রথম বেরোনো ট্র্যাক্টরগুলিই যাদের মালিকানা ছিল কেএমএসএসের লোকজনদের। যে গতিতে তাঁরা একে ওপরকে টেক্কা দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল, যেন কোন তাড়া তাঁদের মধ্যে কাজ করছে। অনুমান করতে পারি সেই তাড়া নির্ধারিত রাস্তাকে অস্বীকার করার। দিল্লি শহর অনেক দূর হওয়ায় রাস্তা চেনাও মুস্কিল হতে পারে অনেকের কাছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে, একটা সময় তারা অনুমোদিত রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে অননুমোদিত রাস্তা খুলে রেখেছিল। অনেকের দিল্লি পৌছবার রাস্তা না জানার সুযোগ তারা এইভাবে নিয়েছিল। আর মিছিলের মজাই এই, সামনের লোককে অনুসরণ করে চলা। এই ভাবেই এক অসামান্য সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে ২৬ তারিখ।
দিল্লিতে ট্র্যাক্টর অভিযান হয়’ত সফল হয়নি। কিন্তু তারপরেও সিঙ্ঘুর কৃষকদের মনোবল একটুও কমতে আমি অন্তত দেখিনি। যা হবার ছিল তা না হবার কারণে হয়তো একটু হতাশা ছিল কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। এটা ঠিক ২৬ তারিখের কারণেই আমি সিঙ্ঘুতে মানুষে মানুষে ছেয়ে যেতে দেখেছি। পরের দিন থেকেই লোক অনেক কমে গেলেও তাঁবু গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে এমনটা আমার নজরে পড়েনি। তবে মেনে নিতে হবে ২০/২৫ কিমি লম্বা সমাবেশের কতটুকুইবা আমি দেখেছি।
যা দেখতে পাইনি তা নিয়ে একটুও আফশোস নেই। কারণ যা দেখেছি তাই আমার জীবনের তৃপ্তির ভাণ্ড ভরে গেছে। এইটুকু অন্তত বুঝেছি, বর্তমানের সরকার অনেক অন্যায় করেও অনায়াসে পার পেয়ে গেছে। কিন্ত কৃষকদের রোষ থেকে এদের নিস্তার নেই। এই রোষ কেমন করে এবং কবে জাতীয় রূপ নিয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়বে তাই দেখারই প্রতীক্ষায় জেগে থাকা।