সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমি তোমার পাশেই রয়েছি। আমি কোনো মন্দিরে নেই, মসজিদে নেই। কাবাতীর্থে আমি নেই, কৈলাসে আমি নেই। ক্রিয়াকর্মে নেই, যোগে বৈরাগ্যে নেই, আমি সকল নিঃশ্বাসের, নিঃশ্বাসের মধ্যে তোমার পাশে আছি।
এভাবেই নাকি বলতেন কবীর (১৩৯৮ – ১৪৪৮ মতান্তরে ১৫১৮)। কেউ ভাবেন তিনি বৈষ্ণব, কেউ বলেন তিনি শৈব নাথ-যোগী পরম্পরার, কেউ ভাবেন সুফি আর কারও মতে তিনি যত না কবি, তার চেয়ে বেশি সমাজ-সংস্কারক। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সুবাদে কবীরের ভাবধারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর পরিচয় হয়েছিল। গীতাঞ্জলি যে বছর প্রকাশিত হয়, সেই ১৯১০ সালেই রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ও সাহায্যে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত ও সংকলিত কবীর বচনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়, পরবর্তী সময়ে আরও তিন খণ্ড। ১৯১৫-য় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে প্রকাশিত হয় ‘Songs of Kabir’।
মুসলমান ঘরের সন্তান কবীর। রামানন্দের শিষ্য হলেও গৃহস্থ। ভিক্ষা করতেন না, কাপড় বুনে অন্ন সংস্থান করতেন। ঈশ্বরকে সত্য ভাবতেন। বিশ্বকে দেখতেন ঈশ্বরের রূপ। প্রকৃতির বৈচিত্র্য নাকি সেই অরূপেরই লীলা। ব্রহ্ম সর্বত্র সমাহিত। সেই সহজের মধ্যে নিমজ্জিত হতে হবে। কোথাও যাওয়া আসার প্রয়োজন নেই। ঠিক যেমনটি আছে, তেমনটিতে প্রবেশ করাটাই সাধনা। ভাষা তাঁর কাছে প্রবহমান জলধারা। ডুব দিলে শরীর জুড়োয়।
এমন ভাষায় সে কথা বলতে শেখেনি। শেখেনি শুধু নয়, শেখার কথা ভাবেওনি কোনোদিন। এমন কথা তো অধ্যাত্মবাদীরা বলে, ভাববাদে বিশ্বাসীরা বলে। সে বেড়ে উঠেছে ভাষার নমনীয় আত্মীয়তার আলিঙ্গনে নয়, ভাষার বর্ম আত্তীকরণের পথ বেয়ে। নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছে ধ্বনি গাম্ভীর্যে। ঋজুতা নির্মিত হয়েছে নমনীয়তার বিপরীতার্থে। স্বকীয়তা আত্মপ্রতিষ্ঠায়। নিবেদন, সমর্পণ ইত্যাদি হয়েছে যাপনবর্জিত শব্দসম্ভার মাত্র। হাতের ওপর হাত রাখা সহজ কথা নয়, হাতের ভার বইতে পারা সত্যি সহজ নয়।
তাহলে সে নিজে কি সত্যিই সহজ নয়? যে দেশে তার জন্ম ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভুমি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। হয়’ত কেন, সত্যি সত্যিই বাংলার সেই সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামল রূপসুষমার অনেকটুকুই হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম ক্ষেত্র নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়, জলজ গাছের বনভূমি, বরষায় প্লাবিত জলভূমির লাল নীল সাদা শাপলা আর পদ্ম, ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল, শাল-পিয়াল, লালমাটির চড়াই-উৎরাই, রং-বেরঙের নানান জাতের পাখি, ফড়িং-প্রজাপতি-জোনাকি, হলুদ সর্ষ-ক্ষেত্র, শস্যভারে আনত বিস্তৃত ধান্যভূমি, আসুমদ্র-হিমালয়কোল শোভিত অগাধ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, তবুও এই বঙ্গভূমিই যে তারই আঁচল। তারই তো দায়িত্ব ছিল সেই রূপ-ঐশ্বর্যকে ধরে রাখার, যা হারিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার। সে, সেসব কিছুই করেনি, করার কথা ভাবেওনি।
সে কি তাহলে সহজ-সন্ধানী নয়? এই প্রিয় পৃথিবীতে যেখানে অপূর্ণতা, সেখানেই নতুনের সৃষ্টি, বিশেষের সৃষ্টি, বিচিত্রের সৃষ্টি - এই সহজ সত্য সে বুঝতে অক্ষম! প্রাণের শক্তি, গ্রহণ করতে পারার শক্তি, প্রাণের শক্তি, দান করার শক্তি। যে মন গ্রহণ করতে জানে না, সে ফসল ফলাতেও জানে না। সে তো মরুভূমি।
সহজ কথার শক্তি সে জানে না, তা তো নয়। সত্তরের অগ্নিস্পর্শী সময়ে, পুলিশ লকআপে একদিন এক প্রৌঢ় কৃষক কমরেডের জিজ্ঞাসার মুখোমুখী হতে হয়েছিল তাকে। আগের রাতে দীর্ঘ জেরার পর সেই কৃষক মানুষটিকে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছিল, পরের দিন ওই প্রৌঢ়, পুলিশের জিজ্ঞাসার যদি ঠিকঠিক উত্তর না দেয়, তাহলে তার সামনে তার মেয়েকে রেপ করা হবে। আগের রাতের পুলিশী অত্যাচারে বিধ্বস্ত পিতা কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এবার সে কী করবে? কী করা উচিত তার? ভয়ার্ত সেই পিতাকে সে জবাব দিয়েছিল, আপনার যেটা সঠিক মনে হয় তাই করবেন। যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক। তার সঙ্গে সে এও জানিয়েছিল, পরবর্তীকালে যে-কোনো বিরূপ সমালোচনায় প্রয়োজনে তিনি বলতে পারেন, তার পরামর্শেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে আরও বলেছিল, মনে রাখবেন যাদের সঙ্গে অন্ন ভাগ করে নিয়েছিলেন, সেই মুখগুলো। অঘটন কিছু ঘটেনি। সে রাতে কী ঘটেছিল তা অবশ্য বিস্তারিত তার জানা হয়ে ওঠেনি। তবে একটা জানা তার আবারো জানা হয়েছিল সহমর্মিতার শক্তির ভিত সহমতের বন্ধনের থেকেও অনেক বেশি শক্তি ধরে।
সত্তরের গোড়ায় তারাতলা-ব্রেসব্রীজের মেটাল বক্স কারখানায় শ্রমিক-কর্তৃপক্ষ বিরোধে বাইরে থেকে পুলিশ-তাণ্ডবের জবাবে, শ্রমিকেরা কারখানার ছাদ থেকে ইঁট-পাটকেল আর সুতুলি-দড়ি গোলা পাকিয়ে ডিজেল-কেরোসিনে চুবিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে প্রতিরোধ তৈরি করলেও কারখানার মেসিনপত্রের কোন ক্ষতি করেনি। জিজ্ঞাসায় শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন, আজ বা কাল মালিকের সঙ্গে বিরোধের মীমাংসা তো হবেই, কিন্তু মেসিনপত্র ভেঙেচূরে দিলে, কারখানা টিঁকবে না। বোধ করেছিল সে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে তাঁতযন্ত্র ভাঙচূর করে গড়ে ওঠা ল্যুডাইট মুভমেন্টের ব্যর্থ হওয়ার কাহিনী। বৈরীতাই সমাজ-ইতিহাসের শেষ কথা নয়। অন্বেষণ, মর্যাদাপূর্ণ মীমাংসা সূত্রের।
সাধারণের সহমর্মিতার আকাঙ্ক্ষা সে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছিল চন্দননগরে তেলেনিপাড়া চটকলে শ্রমিক আন্দোলনে। ১৯৯৩ সাল। বাংলায় তখন বামফ্রন্ট সরকার। শ্রমিক অসন্তোষের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মিলের অভ্যন্তরে, মিলের বাইরে। উত্তেজিত শ্রমিকেরা মিলের ভিতরের কোন মেশিন বা যন্ত্রপাতির ক্ষতি না করলেও বাইরে ভাঙচূর করেছিলেন সিপিআই, সিপিআই(এম), আরএসপি, কংগ্রেস, বিজেপি সব রাজনৈতিক পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন অফিস। দৌড় করিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের। পরিণতিতে এলাকার যতেক শ্রমিক মহল্লায় নেমে এসেছিল পুলিশী তাণ্ডব, লাঠি গুলি। যে ঘটনার রেশ ধরে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান ভিখারি পাশোয়ান। তাণ্ডবের পরের দিনই একটি তথ্যানুসন্ধানী দলের সঙ্গে সেও ওই এলাকায় গিয়েছিল ঘটনার বিশদ বিবরণ ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণ লিপিবদ্ধ করতে। গোটা এলাকা তখন দৃশ্যে, ধ্বনিতে পুলিশ-প্রশাসনিক ত্রাস। এক শ্রমিক মহল্লায় যখন সে কথা বলছিল, ভিড় ঠেলে কুঠুরীর ভিতর হতে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সী এক মহিলা। কণ্ঠস্বর অবিকল হাবিব তনবীরের প্রযোজনায় চরণদাস চোর নাটকে রানী চরিত্রে অভিনেতা এক দেহাতি নারী। কথায় কথায় সে জিজ্ঞেস করেছিল বাস্তবের সেই রানীকে, অত উত্তেজনার মধ্যেও মিলের ভেতর কোন ভাঙচূর হয়নি কেন? দ্রোহী সে-নারী জানিয়েছিলেন, কল তাদের নিমক জোগায়। জানতে চেয়েছিল সে, ট্রেড ইউনিয়নের ওপর অত ক্রোধের কারণ কি? সেই নারী নিজ-স্বরযন্ত্রে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে জবাব দিয়েছিলেন, আমরা তো জানি নেতারা আমাদের সব দাবিদাওয়া আদায় করে দিতে পারবে না। আমাদের অভাব পুরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সাথ দেবে তো। আমাদের ঘরদুয়ারে যাবে আসবে তো। আপদে বিপদে আমরা আছি বলবে তো। ব্যস আমরা উহাদের কাছে শ্রিফ ওই চাই। দিলে না, লোকেরা বহুত দৌড় করালো। আর কিছু নয়।
সংকট, সহমর্মিতার।
বাংলা তার আদি পর্বে প্রত্যক্ষ করেছে সমাজ-সংস্কৃতি, বিরোধ-মীমাংসায় সহমর্মিতার ইতিহাস। এ-বাংলা মানুষকে সহজ করেই গ্রহণ করে নিতে চায়। মনে রাখতে চায় না, জিইয়ে রাখতে চায় না বিদ্বেষ-বিভাজন। দীর্ঘ তার ইতিহাসে আপন করে নিয়েছে একাধিক ধর্ম সংস্কৃতি সভ্যতা। যে যার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও বাংলায় গড়ে উঠেছিল এক মিলিত সাংস্কৃতিক পরিসর। বিস্তৃত এই জনপদ প্রত্যক্ষ করেছিল খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে, অবৈরী অসম বিন্যাসের সংলগ্নতা, অবিচ্ছিন্নতা। ভিন্নতা নিয়েই মিলন।
ধারাবাহিকতায় শ্রীচৈতন্য লালন। মনের চলন বিদ্যাপতির ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর’। আপ্লুত হয়েছে পদাবলী সাহিত্যের বলিষ্ঠ প্রেমাভিলাসে, ‘চলে নীল সাড়ি নিঙারি নিঙারি/পরান সহিতে মোর।/সেই হৈতে মোর হিয়া নহে থির/মন্মথ জ্বরে ভোর’। জলে-হাওয়ায় অঙ্কুর মেলেছে বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম পদকর্তা চণ্ডীদাসের এক বিশ্বাসী সত্য, প্রবাদপ্রতিম পদে - ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার পরে নাই’। মানবতাবাদ যৌক্তিক আশ্রয় পেয়েছে, লালনের বাউলে, ‘জাত দেয় সে অজাতের দৌড়ে গিয়ে’ অথবা সংকীর্তনে ‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’। অনুসন্ধানী হয়েছে, দীক্ষিত হতে চেয়েছে শাক্ত পদাবলীর কবি রামপ্রসাদ সেনের ভাবসমৃদ্ধ সঙ্গীতে, ‘মন রে কৃষি কাজ জান না।/এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা’।
কান পেতেছি চোখ মেলেছি
ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান।
দুই
সন্ধানে সে খুঁজে পেয়েছে, তার বাঙলার সহমর্মিতার ঘ্রাণ-আস্বাদ। আর্য-ধর্ম, আর্য-সংস্কৃতি বাংলায় এসেছিল প্রধানত গঙ্গা ভাগীরথীর পথ ধরে, কয়েকটি পর্যায়ে। প্রথম যারা এসেছিলেন, তাদের শাস্ত্র ছিল ঋক্ বেদ। প্রাচীন বা প্রাক-বৈদিক ধারা। ‘সদানীরা’ (গণ্ডক/গঙ্গা) পার হয়ে এই জনগোষ্ঠী বসত গড়ে বিহার-বাংলার গঙ্গা-বিধৌত উপত্যকা অঞ্চলে। তারপর অনেক সময়কাল পার হয়ে আসে বৈদিক ধারার মানুষজন। এদের শাস্ত্র যজুর্বেদ আর ব্রাহ্মণ। অর্বাচীন বৈদিক সাহিত্যে প্রাচীন/প্রথম ধারার মানুষজন ‘আসুর’ এবং ‘ব্রাত্য’। অসুর অনার্য নয়, দেবতার বড় ভাই, বুদ্ধিতেও সে ছোট নয়। শুধু ভাষা-দুষ্টতার অপরাধে বারবার এরা দেবতার কাছে পরাজিত হয়। এই অসুরেরা নাকি পূর্বদেশে, কোণঠাসা ‘পতিত’ আর্যভাষীদের পূর্বপুরুষ। কার্তিকের আকাশ-প্রদীপে অবশ্য সেই প্রাচীনের সন্ধান নেই।
সেই সুপ্রাচীন বৈদিক ধারার আর্যবাসীদের দুটি ধারা। প্রথম ও প্রধান দল ‘গ্রামবাসী’। গ্রাম বলতে – একজন কুলপতি ব্রাহ্মণ গৃহস্থ, তার স্বজন পরিজন, শিষ্য-সেবক, দাস-দাসী, আজ্ঞাবাহক-কর্মচারি ইত্যাদি। প্রয়োজনে এক গ্রাম তুলে অন্যত্র নতুন করে গ্রাম পত্তন করতেন এঁরা। কাল-সময় পার হয়ে, কৃষিকাজ প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পর কুলপতি, যাযাবরত্ব ত্যাগ করে গ্রামপ্রধান। অর্থাৎ সামাজিক ইউনিট, গ্রাম। দ্বিতীয় ধারায়, যাদের মর্যাদা গ্রাম্যদের তুলনায় অনেক কম, তারা ‘ব্রাত্য’ (গণ)। আসল মানে, ব্রাত্যের (সমূহের, গণের বা কোন দলের) অন্তর্গত। এদের সামাজিক ইউনিট, ব্রাত। এখানে সকলের সমান অধিকার, একজন দুজন জ্যেষ্ঠ হিসাবে স্বীকৃত।
এইরকম ব্রাত্যেরাই বাংলায় আর্য-সংস্কৃতির প্রথম বাহক ছিল এমনটাই নাকি মনে করা যায়। এদের ধর্মাচারে আর ধর্মচিন্তায় বাইরে থেকে মিশে গিয়েছিল অনেককিছু। কিন্তু প্রাচীন ঋক্ সংস্কৃতির বীজ হারিয়ে যায়নি। জৈন-ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর আর বৌদ্ধ-ধর্মের শাস্তা বুদ্ধ দুজনেই পূর্ব ভারতের মানুষ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই দুই ধর্মের প্রবাহও বাংলায় চলে আসে অনতিবিলম্বেই। গড়ে ওঠে এক সংলগ্নতা। ধর্ম-সংস্কৃতির এই সম্মিলন বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এর ওপর বারবার আছড়ে পড়েছে পশ্চিম থেকে আগত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ঢেউ। আজও।
ইসলাম আসে বাংলায় মাত্র হাজার বছর আগে, ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে, পাল বংশের শাসনকালে। মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্য সূত্রে। বাংলা ভাষার সচলতা বা আদি লিপির উদ্ভব এই পাল বংশের সময়কালেই। ৭৫০ থেকে ১২০০। গৌড় বিক্রমপুর পাটলিপুত্র। গোপাল ধর্মপাল দেবপাল। যুদ্ধপটু। প্রায় অজেয় তার হস্তিবাহিনী। বিস্তৃত সাম্রাজ্য। সম্পন্ন গৃহস্থালী। বাণিজ্য ভূখণ্ড ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য মধ্যএশিয়া। মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ছিল রাজধর্ম। রাজভাষা, পালি, সংস্কৃত আর প্রাকৃত। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ।
পালবংশের শাসন শেষে কর্ণাটক থেকে এসেছে সেনবংশ। লক্ষ্মণ সেন। ১১৭৮ থেকে ১২০৬। রাজধানী নবদ্বীপ। এখানেই জন্মাবেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শচী দেবী-জগন্নাথ মিশ্রের সংসারে বিশ্বম্ভর মিশ্র ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমায়, পরিচিত হবেন নিমাইপণ্ডিত, গৌরাঙ্গচন্দ্র হয়ে চৈতন্যদেবে। নরম, ঋজু উচ্চারণে জানাবেন, ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, যে চণ্ডাল হরিভক্তি পরায়ণ, সে দ্বিজজাতি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) থেকেও শ্রেষ্ঠ। অবশ্য এ-সব, অনেক পরের কথা। তার আগে, বখতিয়ার খিলজি সেনরাজাদের পরাস্ত করে নবদ্বীপের দখল নেবে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে।
ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী বাংলা-বিহার-ওড়িশা শাসন করেছিল আফগানিস্তান থেকে আসা পাশতুন সম্প্রদায়। পাশতুনদের অনেক সম্প্রদায়। প্রধান দুটি, নাশাল আর দিয়ান। দিয়ান থেকে দেওয়ান। নাশালরা পাঠান। আর দেওয়ানরা, ধর্মান্তরিত রাজপুত ও ভূমিহার। ১৫২৬ সালে বাবরের হাত ধরে প্রথম মোগল সাম্রাজ্য তৈরি হলেও, তার পঞ্চাশ বছর পরে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন আফগান সুলতান দাউদ খান করবানিকে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য বাংলা-বিহার-ওড়িশায় তাদের রাজ্যপাট বিস্তার করে। যদিও পুরোপুরি মোগল আমল প্রতিষ্ঠা হতে কেটে গিয়েছিল আরও তিন দশকেরও বেশি সময়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তখন বারো ভুঁইঞাদের প্রতাপ প্রতিপত্তি। অবশেষে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি সারা বাংলাতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ১৬১২ সাল। ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাস্ত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবিভক্ত বাংলার দখল নেয়।
ইংরেজ এসেছে পরাক্রমশালী যোদ্ধা হয়ে নয়, বণিকের বেশে। ১৬১৮ সালে বার্ষিক এককালীন তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজরা সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্যের অনুমতি আদায় করে নেয়। এর কিছু বছর আগে ১৫৯৯ সালে কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ী মাত্র ৩০ হাজার পাউন্ডের ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তৎকালীন মুদ্রামান অনুযায়ী, ২৫ হাজার ভারতীয় মুদ্রার চেয়েও কম। এর পরের বছর রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভারতের সাথে তারা বাণিজ্য শুরু করে। ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে তৎকালীন ভারতের প্রধান সমুদ্র-বন্দর সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তারা। সুরাটে তখন আরও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের একেকজনের মূলধন পুরো ইংরেজ কোম্পানির চেয়েও অনেক অনেক বেশি। ইংরেজদের দৈন্যদশা দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং বিদেশী ইংরেজদের মোটেও গুরুত্ব দিতেন না। এই গুরুত্বহীন, করুণার পাত্র, নামমাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজ একসময় পুরো উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিল। অস্ত্র নয় ষড়যন্ত্র। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুরো ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে ইংরেজ। যুদ্ধ নয় প্রহসন। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানী প্রথম এলিজাবেথ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২১ বছর পর্যন্ত পূর্বভারতে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ দেয়। পরবর্তী সময়ে কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল স্বাধীন রাজা-বাদশাহদের শাসনাধীন। ইংরেজ শাসন শুরুর আগে ভারতভূমি কখনও পরাধীন ছিল না। আর্য, আরব, ইরানী, পাঠান, মুঘল, তুর্কি অর্থাৎ বহিরাগত যারাই এই ভূমিতে রাজনৈতিক কারণে পা রেখেছে, তারাই একে আপন করে নিয়েছে; ভারতের জল-আলো-বাতাসে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছে। এমনকি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণে আসেন, তখন তার বেশ কয়েকজন সেনানায়ক এ দেশের জলবায়ু ও ধনসম্পদে মুগ্ধ হয়ে এখানেই বসত করেছেন। ব্যতিক্রম, ইংরেজ বণিকেরা। এদেশ থেকে ধনসম্পদ লুঠ করে নিজ দেশে পাঠানোর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে শেষ দিন অব্দি। রাজত্বের একবারে শুরুতেই বাঙলার খাদ্যদ্রব্য লুঠ করে আর শিল্প-উৎপাদনকাঠামো ধ্বংস করে ১০ কোটি বাঙালির প্রাণ নিয়েছিল ১৭৭০-এ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে আর ব্রিটিশ-রাজ শেষের কালে ১৯৪৩-৪৪-এ ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণ নিয়ে। খাদ্য, ওষুধ সবকিছু এখান থেকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধরত ব্রিটিশ সেনাদের জন্য। অপ্রয়োজনেও। খাদদ্রব্য মজুত করে গুদামে নষ্ট হতে দিয়ে। এদেশ কোনোদিনই তার স্বদেশ হয়নি। কেবলই অবজ্ঞা আর উপহাস। ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষে অনেক অনেক মানুষ যখন অনাহারে মারা যাচ্ছেন, সে-সময়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল জানিয়েছিলেন, দুর্ভিক্ষ বা না দুর্ভিক্ষ, ভারতীয়রা ইঁদুরের মতো জন্ম দেবে।
তিন
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাংলা ভাষার বিশেষ কোন নাম ছিল না। সাধারণ শিক্ষিত লোকেরা দুটি ভাষার নাম জানতেন, সংস্কৃত (সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রচলিত) আর দেশি ভাষা (প্রাকৃত, লৌকিক)। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম প্রত্যন্তে সাঁওতাল প্রভৃতি অষ্ট্রিকভাষী জাতির বাস। বাংলার বাইরেও ছিল অষ্ট্রিকভাষী, খাসী জাতিগোষ্ঠী। তিব্বত-চীনীয়–ভাষী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কোঁচ, মেচ, রাজবংশী ইত্যাদি জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে। বাংলার মাঝবরাবর রাজমহল পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের মালতো-মালপাহাড়ি ভাষা, দ্রাবিড় ভাষা। হতে পারে প্রাক-আর্য সময়কালে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বসত ছিল। দ্রাবিড় ভাষার কিছু কিছু শব্দ বাংলায় আছে। বেশ কিছু গ্রাম-নাম এ দেশের প্রাচীনতম জনপদবাসী অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়-ভাষীদের কাছ থেকে এসেছে বলে অনুমান করা যায়।
বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ঠ ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু আগেই বিশেষ জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ। শুরু বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য-ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি ও অনার্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা হচ্ছে অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, গোবর্ধন, শরণ, ধোয়ী, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম, কবীন্দবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামের দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ঠ ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সব গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও এইসব রচনা সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। চর্যাপদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ়ার্থ সাংকেতিক রূপবন্ধে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তারা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের ধারাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই। অনেকের মতে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের (রাজত্বকাল ১১৭৮ – ১২০৬) সভাকবি বীরভূমের কেঁদুলি গ্রামের জয়দেব ১২ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচনা করলেন গীতগোবিন্দম্ কাব্য। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা। রাধা-কৃষ্ণের মিলন-বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, পুনর্মিলন। এবং কাব্যের শেষে ভগবানরূপী কৃষ্ণ ভক্ত-রাধার শ্রীচরণ নিজের মাথায় রাখার ইচ্ছাপ্রকাশ, ‘দেহি পদবল্লবমুদারম্’। কাব্য অনুপম সুললিত রচনাশৈলী সমৃদ্ধ।
পরের বেশ-অনেকটা সময়কাল জুড়েই তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের পরিচয় জানা যায় না। কিছু কিছু নিদর্শন নাকি আছে। প্রাকৃত ভাষায় গীতি কবিতার সংকলন, ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’, রামাই পণ্ডিতের গদ্যপদ্য মিশ্রিত ‘শূন্যপুরাণ’, হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’, ‘ডাক ও খনার বচন’ – এই সময়ের রচনা। হয়ত, ধর্মশিক্ষা, শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনেরা, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কেউই লোকভাষা বাংলাকে মান্যতা দেননি।
চৌদ্দ পনেরো শতকেও বাংলার লিখিত সাহিত্য, সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব-ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে। পুরাণ থেকে নিয়েছে বিষয় আর বর্ণনাভঙ্গি। রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত-প্রণয়োপাখ্যান-ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত-ফারসী-আরবী-হিন্দি থেকে অনূদিত হয়েছে বাংলায়। এভাবেই নাকি লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষাসাহিত্যের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। নদীয়া জেলার ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস (১৩৮১ – ১৪৬১) অনুবাদ করলেন রামায়ণ। মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানান অনুষঙ্গে সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ। রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্পও এই অনুবাদে জায়গা করে নিল। পরে বাংলায় অনূদিত হয়েছে আরও অসংখ্য গ্রন্থ।
পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি (আনুমানিক ১৩৭৪ – ১৪৬০)। গ্রাম বিসফি, মহকুমা সীতামারী। মিথিলারাজ দেবসিংহ ও শিবসিংহের সভাসদ। ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।।/ঝম্পি ঘন ঘন — জন্তি সন্ততি/ভুবন ভরি বরি খন্তিয়া।/কান্ত পাহুন কাম দারুন/সঘনে খন শর হন্তিয়া।।/কুলিশ শত শত পাত-মোদিত/ময়ূর নাচত মাতিয়া।/মও দাদুরী ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া।।/তিমির দিক ভরি ঘোর যামিনী/অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।/বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়াবি/হরি বিনে দিন রাতিয়া।।’
বিদ্যাপতি মূলত মৈথিলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেছেন। ভাষার বিশেষ মাধুর্যের জন্য এর নাম ব্রজবুলি। এই ভাষা-সুষমায় প্রভাবিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের কবিরাও। বিশেষভাবে গোবিন্দদাস। জ্ঞানদাসের কিছু কিছু পদও এই ব্রজবুলি ভাষাতেই রচিত। মধ্যযুগের বহু কবি এই ভাষাতেই পদরচনা করেছেন। এমনকি আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যখন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ লেখেন তখন তিনি লেখেন ব্রজবুলি ভাষাতেই।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও বাংলার বহুবিধ লৌকিক ধর্মবিশ্বাস নিয়েই এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলি এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সময়কালের সাহিত্যের মূল বিষয়। আনুমানিক চোদ্দ শতকের শেষার্ধে বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধে বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বনে লেখেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। কবি শাহ মুহম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতকে রচনা করলেন প্রণয়োপখ্যান, ‘ইউসুফ-জোলেখা’। এছাড়াও একাধিক অনুবাদসাহিত্য।
বাংলা সাহিত্যে তখন জোয়ার। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ছাড়াও জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস, যশোরাজ খান, চাঁদ কাজী, রামচন্দ্র বসু, বলরাম দাস, নরহরি দাস, বৃন্দাবন দাস, বংশীবদন, বাসুদেব, অনন্ত দাস, লোচন দাস, শেখ কবির, সৈয়দ সুলতান, হরহরি সরকার, ফতেহ পরমানন্দ, ঘনশ্যাম দাশ, গয়াস খান, আলাওল, দীন চণ্ডীদাস, চন্দ্রশেখর, হরিদাস, শিবরাম, করম আলী, পীর মহম্মদ, হীরামনি, ভবানন্দ প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য কবি। ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। জাতি-সংস্কৃতি সংপৃক্ততায় সবাই-ই বাঙালি।
বৈষ্ণব মতকে কেন্দ্র করে রচিত হ’ল বৈষ্ণব সাহিত্য। পঞ্চাদশ শতকে শ্রী চৈতন্যদেবের ভাব বিপ্লবকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব সাহিত্যের জন্ম। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬ – ১৫৩৪) কোন গ্রন্থ লিখে যাননি অথচ তাকে ঘিরেই জন্ম এই সাহিত্য-ধারার। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। ভাষা, ব্রজবুলি ও বাংলা। দৃষ্টিভঙ্গিতেও এক বড়সড় পার্থক্য। সংস্কৃত সাহিত্যে বিরহ প্রধানত পুরুষের। ঋক্ বেদে পুরুরবার বিরহ, রামায়ণে রামের বিরহ, মেঘদূতে যক্ষের বিরহ। আর এই বঙ্গদেশে, বৈষ্ণব গীতিকাব্যে বিরহ একান্তভাবে নারীরই। এই দেশ, বঙ্গদেশ বাঙালির মাতৃভূমি। উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে, ভারত, পিতৃভূমি।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলা সংস্কৃতিতে এনেছিল অভাবনীয় সব পরিবর্তন। মানবতার প্রতি গৌরববোধ বেড়েছিল। দৈবশক্তিতে মানুষের আস্থা কমে এসেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্যে ধরা পড়েছিল বাঙালির এই মানস পরিবর্তন। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মঙ্গলকাব্যের আন্তর্ধর্মে কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক দেবতায় সংশয় এবং অবিশ্বাসের সময়কাল। ব্রাহ্মণ সন্তানেরাও তাদের পূর্ব সংস্কার ও আভিজাত্য-গৌরব সরিয়ে, অন্তজ সম্প্রদায়ের দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তনে এগিয়ে এসেছেন। ধর্মমঙ্গলের কবি কাব্যরচনায় ধর্মঠাকুরের স্বপ্নাদেশের কথা নয়, গুণগান করেছেন বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের। ভারতচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্রের।
জ্ঞানমার্গের মানুষজন ছিলেন সাধারণভাবে বর্ণবিভাগের সমর্থক। শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা, প্রকৃতিগত কারণে বর্ণ-বিভাজন ছিল উচ্চশ্রেণিতেই সীমাবদ্ধ। চৈতন্য – শাস্ত্রজ্ঞ, নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ – কেটে দিলেন সেই বাঁধ। প্লাবন, মহাপ্লাবন।
বৈষ্ণব একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবেই প্রবর্তিত হয় এক বিশেষ সামাজিক বাস্তবতায় - শাস্ত্রীয় ধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়ায়। ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যেই মানুষে-মানুষে উঁচু-নিচু ভেদ, জাতি-পাতির বাছ-বিচার যখন মনুষ্যত্বের অবমাননায় লিপ্ত, তখন প্রেমের উদার বিচরণে সর্ববিধ সংস্কারমুক্ত মানুষের এক হওয়ার বাসনা থেকেই প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তনা। পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে ক্রমে চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং আরো পরে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্ভব। লালনের গানে এরই প্রতিফলন, ‘জাত দেয় সে অজাতের দৌড়ে গিয়ে’।
বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যিক গুণে অসামান্য। চণ্ডীদাস লিখছেন, ‘সই কেমনে ধরিব হিয়া।/আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/ আমার আঙিনা দিয়া।।/সে বধুঁ কালিয়া না চাহে ফিরিয়া/ এমতি করিল কে।/আমার অন্তর যেমন করিছে/তেমনি করুক সে।।/যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু/ লোকে অপযশ কয়।/সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি/আর যেন কার হয়।।/যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙাইয়া/এমত করিল কে।/আমার পরাণ যেমতি করিছে/তেমতি হউক সে।।’
এই সময়কালের বাংলা কাব্যধারার এক বিশিষ্ট শাখা হল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল মানে কল্যাণ। মধ্যযুগে বিভিন্ন দেব-দেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পৃথিবীতে তাদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী নিয়ে যেসব কাব্য রচিত হয়েছে সেগুলোই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত। দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক এই মঙ্গলকাব্যের সূত্রপাত পনের শতকে। তবে ষোল শতকে এর সর্বাধিক প্রসার হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধির পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়। এছাড়া শাক্ত পদাবলী, নাথসাহিত্য, বাউল ও অন্যান্য লোকসঙ্গীত, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা ইত্যাদি অমূল্য সাহিত্যও এই সময়কালের সৃষ্টি।
হিন্দু-বাঙালি ও মুসলমান-বাঙালি, এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষজনই মঙ্গলকাব্যের রচয়িতা। একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত। বাসও করতেন একই সঙ্গে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তার স্পষ্ট উল্লেখ। প্রধান চরিত্র দরিদ্র কালকেতু, দেবী চণ্ডীর বরে প্রভূত ধনসম্পদ লাভ করে যখন নগর পত্তন করেন, সেই নগর-পরিকল্পনায়,
বাম ভাগে দুর্গা মেলা, তার কাছে নাটশালা
সিংহদ্বার পূর্ব্বে জলাশয়।
খিড়কি উত্তর ভাগে, জলটুঙ্গি তার আগে,
প্রতি বাড়ী কূপের সঞ্চয়।।
পশ্চিমদিগেতে সেহ, তুলিল নমাজ-গৃহ,
দলিজ মসজিদ নানা ছান্দে।
সুধন্যা কোমল, তুলিল রন্ধনশালা,
বিবি চাখে বান্দী তথা রান্ধে।
এবং সেই নগর নির্মাণ করছেন বিশ্বকর্মা। রয়েছেন হনুমান মহাবীর।
মঙ্গলকাব্যের তিনটি প্রধান ঐতিহ্যের মধ্যে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল ছিল অন্যতম। প্রধান চরিত্র, মনসা, চণ্ডী ও ধর্মঠাকুর। এছাড়াও কিছু ছোট ছোট মঙ্গলকাব্য রয়েছে। শিবমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, রায়মঙ্গল, শশীমঙ্গল, শীতলামঙ্গল ও কমলামঙ্গল প্রভৃতি। মনসামঙ্গল ত্রয়োদশ শতকের শেষ থেকে চতুর্দশ শতকের প্রথমে রচনা করেন কানাহরি দত্ত। পরে ১৫ শতকে পদ্মাপুরাণ নাম দিয়ে বিজয় গুপ্ত। এছাড়াও লেখেন আরও কয়েকজন কবি। উল্লেখযোগ্য, কেতকাদাস।
বাংলা লোক সাহিত্যের অপরূপ সম্পদ হল, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলো একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন। সংগ্রহ করেছিলেন, বর্তমান বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা চন্দ্রকুমার দে।
পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্য একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা। ১৯২৬ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাহায্যে পালাগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৭১-১৯৭৫ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক সাত খণ্ডে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রকাশ করেন।
পূর্ব-ময়মনসিংহে সেনরাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের এবং সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রভাব বা আনুগত্য ছিল প্রায় অনুপস্থিত। এই অঞ্চল স্বীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে। রাজারা তাদের রাজত্ব চালাতেন হিন্দু ধর্মের প্রাচীন আদর্শে। সেই হিন্দু ধর্ম ছিল বৌদ্ধ কর্মবাদ ও হিন্দু নিষ্ঠার মিশ্রণ। ব্রাহ্মণের টোলে বেনে ধর্মশাস্ত্র পড়ছে, গন্ধবেনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। যজন যাজন ও যজ্ঞের সময়েই যজ্ঞোপবীতের প্রয়োজন হত, পৈতা ব্রাহ্মণের অপরিহার্য অঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়নি। কোথাও যাওয়ার সময় উত্তরীয় ও উপবীত উভয়ই পোশাকি দ্রব্যের মতো খুঁজে বের করে পরতে হত। কাব্যের নায়ক-নায়িকারা বেনে, বৈশ্য, ব্যাধ, এমনকি ডোম।
ময়মনসিংহ গীতিকায় গৌরীদান প্রথা নেই। এমনকি সতেরো বছর বয়সী মেয়েদের অবিবাহিত দেখা যেত। গীতিকায়, বাংলা ভাষা, সমাজের স্বরূপ। বহু শতাব্দী কাল পাশাপাশি বাস করার জন্য হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। জাতিভেদ নেই। লেখক হিন্দু, মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই। সাহিত্যেও হিন্দু নায়ক, মুসলমান নায়িকা; মুসলমান নায়ক, হিন্দু নায়িকা।
সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও প্রসার এতটাই সমাজ-সম্পৃক্ত হয়েছিল যে, ১৫৭৫-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে এই বাংলায় কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণের প্রচলিত কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে সীতার বয়ানে রচনা করেছেন রামায়ণ। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ। নায়ক সীতা। সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভেতর থেকেই এক নারী রামায়ণ পাঠ করার গোটা দৃষ্টিকোণ বদলে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
আমার দুঃখের কথা গো কহিতে কাহিনী।
কহিতে কহিতে উঠে গো জ্বলন্ত আগুনী॥
জনম-দুঃখিনী সীতা গো দুঃখে গেল কাল।
রামের মতন পতি পাইয়া গো দুঃখেরই কপাল॥
কবি চন্দ্রাবতী নিজেও হয়ে উঠেছিলেন এক কিংবদন্তি। তাঁকে নিয়েও ময়মনসিংহে বাঁধা হয়েছে পালাগান। সমাজ পরিবেশ উদার ও মুক্ত ছিল বলেই এমন কাব্যগাথা রচিত হতে পেরেছিল। ময়মনসিংহ গীতিকায় তাই দেখা মেলে মহুয়া মলুয়াদের।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে শিব-উপাসক সম্প্রদায়ও, যাঁদের ধর্ম ছিল নাথধর্ম। এই সম্প্রদায়ের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতবর্ষে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নাথ অর্থ প্রভু, দীক্ষালাভের পর নামের সাথে তারা ‘নাথ’ শব্দটি যোগ করত। বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের সমন্বয়ে এ ধর্ম গড়ে ওঠে। এই নাথপন্থা, বৌদ্ধ মহাযান আর শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবিদ্যা ও অজ্ঞান থেকে মুক্তির জন্য এবং মহাজ্ঞান লাভ করাই নাথগণের লক্ষ্য ছিল। নাথধর্মের অতীন্দ্রিয়তাবাদের প্রভাব দেখা যায় পরবর্তীকালে বাউল দেহতত্ত্বে।
আরাকান রাজসভার অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩)। কাব্য রচনা করেছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষায়। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। পারদর্শী ছিলেন প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা, প্রায় সবকিছুই। এই মানুষটি, আলাওল, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিল তাঁর রচিত সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
বাউল মতবাদের উপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যই হল বাউল সাহিত্য। সহজিয়া সাধনার বাউল। ভিন্নধর্মী, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, বেশির ভাগই নিরক্ষর। তাদের কথায় সহজপন্থী। পিছনে কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চান না। নদীতে যখন স্রোত, সে তো কোনো দাগ রেখে যায় না। যারা নিজেদের ছোট ছোট প্রয়োজনে কাদার উপর দিয়ে নৌকো নিয়ে টানাটানি করে, তারাই লম্বা আঁচড় রেখে যায় পেছনে। এটা সহজ পথ নয়। ভক্তদের জীবনের মধ্য দিয়ে যে ভক্তিরসের স্রোত বয়ে চলেছে তাতে নিজের ভক্তিরসের ধারাকে মিশিয়ে দিয়ে চলাই আসল কাজ। বাউল ভক্তরা হিন্দু ও মুসলমান সমাজের নিম্নবর্গ থেকে আসা। দেহতত্ত্বের সাধনা।
বাউল সাধকদের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন জগন্মোহন গোসাঁই ও লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। এছাড়াও বাউল গীতিকারদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় প্রায় সব সম্প্রদায়ের মানুষজন - জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই, পাগলা কানাই, শীতলং সাঁই, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, আরকুন শাহ্, সিতালং ফকির, সৈয়দ শাহ্ নূর, শাহ আব্দুল করিম, চান খাঁ পাঠান প্রমুখ। তাদের মাধ্যমেই বাউল মতবাদ বা বাউল সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলার লোক সাহিত্য, লোক সাহিত্যের প্রচলিত সব শাখায় বিস্তৃত। গল্প, ছড়া, ডাক ও খনার বচন, সংগীত, ধাঁধা, প্রবাদ বাক্য, কুসংস্কার ও মিথ। লোকগীতি বাংলা লোক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলার সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। লোকগানে বিভিন্ন শাখা, বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান, ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।
বাংলার লোকসঙ্গীত ধারার বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ বাংলা সঙ্গীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। পরবর্তী দেড়শো বছরে শতাধিক কবি ও সঙ্গীতকার এই সুরে গান রচনা করেছিলেন। তার কাব্য ছিল ‘মধুর, আটপৌরে ও অসংস্কৃত’।
রামপ্রসাদের গান রামপ্রসাদী। তৎকালীন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে এই কালীভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তার গানেও এই সকল ঘটনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই কারণে, তার জীবদ্দশাতেই গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
শাক্তপদাবলী হল কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণির সঙ্গীত শাক্তপদাবলীর একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শাক্তপদাবলীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে। এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকুতি শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সমাজজীবন ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই পদাবলির অধ্যাত্মতত্ত্ব শেষাবধি পর্যবসিত হয়েছে এক জীবনমুখী কাব্যে।
শাক্তপদাবলী ধারাটি বিকাশলাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময় বাংলায় বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তার একটা কারণ দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সতীরূপের শক্তিপীঠগুলির অনেকগুলিই এই বাংলায়। সেই শক্তিপীঠগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে এসেছে শক্তিসাধনা। তারই ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত হয় শাক্তসাহিত্য। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং তার পরেই কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য হলেও পদকর্তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি একে ‘ধর্মেই ধর্মের শেষ’ বলে মনে করেননি। গবেষক ক্ষেত্রগুপ্তের কথায়, ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের চৌহদ্দীতে যে কবি-সম্প্রদায় গড়ে ওঠে তাঁদের সৃষ্টিতে রূপময় জগতের গন্ধ-রস-প্রাণ লেগেছিল, কারণ তাঁদের দর্শন জীবন আর জগৎকে নস্যাৎ করে দেয়নি; তাকে শাশ্বত না বললেও মায়া বলেনি, ভ্রান্তি বলেনি; …’। চর্যাকারগণ যেখানে জগৎ-জীবনকে মায়া-ভ্রান্তিরূপে চিত্রিত করেছেন, সেখানে পদাবলী সাহিত্যে, জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করার আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। বৈষ্ণবীয় প্রেমকথায় তারই আহ্বান;
পিরীতি পিরীতি সব জন কহে / পীরিতি সহজ কথা
বিরিখের ফল নহে পিরীতি / নাহি মিলে যথা তথা॥
পিরীতি অন্তরে পিরীতি মন্তরে, / পিরীতি সাধল যে।
পিরীতি রতন লভিল যে জন। / বড় ভাগ্যবান সে॥
পিরীতি লাগিয়া আপন ভুলিয়া / পরেতে মিশিতে পারে।
পরকে আপন করিতে পারিলে / পিরীতি মিলয়ে তারে॥
‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’ - জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষকে মনুষ্যত্বের উদারলোকে আহ্বান করেছিল বৈষ্ণবরা। তাদের সাধন-ভজন মানুষকে নিয়ে এবং মানুষেরই জন্য। মানবকেন্দ্রিকতা এর অনন্য গুণ। তাই পদাবলীতে বৈষ্ণবীয়তার আড়ালে মানুষ এবং মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের চিত্রই বারবার অঙ্কিত হয়েছে। মধ্যযুগের ধর্ম-সম্পৃক্ত মানস কাঠামোয় প্রতিফলিত মানব-মাহাত্ম্যই।
বাংলার এই ৬০০ বছরের গোটা পর্যায় জুড়ে জাতি বর্ণ ধর্ম সম্প্রদায় নিির্বশেষে এক সমন্বয়ী ধারার বিকাশ ও বিস্তৃতি। অনাহার, দারিদ্র্যর ঘরেও সুজলা সুফলা গ্রাম বাংলার যে শান্তির প্রতিচ্ছবি সেটিই আসল ‘সোনার বাংলা’।
চার
ইংরেজ এল ভারতে। পলাশীর যুদ্ধের পর লুঠ হ’ল মুর্শিদাবাদ রাজকোষ-রাজপ্রাসাদ। সরকার দেউলিয়া। নবাব হতে চেয়ে, ইংরেজদের দাবি অনুযায়ী ঘুষ জোগাড় করতে, মীরজাফর ও মীরকাসিম রাজস্ব বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণ। মুর্শিদকুলি খঁার আমলের চেয়ে বত্রিশগুণ বেশি কর ও খাজনা। মোগল শাসনে খাজনা ছিল কৃষিপণ্য উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের স্বত্ব নেওয়ার পর খাজনা বাড়ে ৫০ ভাগ। সঙ্গে সঙ্গে জমিদারেরাও, প্রান্তিক হিন্দু-মুসলিম প্রজা ও রায়তদের উপর বহুগুণে খাজনা বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত রাজস্ব ও খাজনার চাপে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে কৃষক-কারিগর। খাজনা আদায়ের ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্য ইংরেজরা পরগণা নিলামে চড়াতে শুরু করে। কিনতে থাকে নব্য বিত্তশালী মূলত হিন্দু-বাঙালি জমিদারেরা। ১৬৬০ পরগণার মধ্যে ১০০০ পরগণাই হিন্দু-বাঙালি ধনপতিদের হাতে চলে যায়।
সেসময় বাংলা থেকে কৃষিজ ও প্রাণিজ পণ্য বাদে শুধু মসলিন, রেশম, মোটা সুতি বস্ত্র, রেশমী বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানী করেই বছরে দশ-বারো হাজার কোটি টাকা আয় হ’ত। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, কিশোর মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হ’ত এই বস্ত্রশিল্পে। এছাড়া ইউরোপে সল্টপিটার, ইষ্ট ইণ্ডিজে চাল, চীন ও জাপানে আফিম, আরব, ইরাক ও ইরানে লাল চিনি, মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে মরিচ, আদা, দারুচিনি রপ্তানী হ’ত। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা শুধু বাংলা থেকেই হ’ত।
ক্ষমতায় এসে বৈদেশিক বাণিজ্যে অন্য বিদেশী বণিকদের বাংলা ছাড়া করে দেয় ইংরেজ। রেশম, মসলিন, সুতি কাপড়, চিনি, চাল, আফিম, সল্টপিটার প্রভৃতি পণ্যরপ্তানীর ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। একবার বাজার কুক্ষিগত করেই পণ্যের সংগ্রহ-মূল্য অস্বাভাবিক রকম কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ১৭৬৪-১৭৬৫ সালে বাজার চলতি রুপোর সিক্কা বাতিল ঘোষণা করে নতুন সিক্কার প্রচলন করে। সমস্ত স্থানীয় ব্যবসা কার্যত বন্ধ, বাজার অর্থশূন্য। এছাড়া খাদ্যশস্য উৎপাদন হ’ত যেসব জমিতে, সেখানে জোর করে অত্যধিক লাভজনক ব্যবসাপণ্য আফিম ও নীল চাষ করানোর কারণে অনেক জমি ঊর্বরতা হারিয়ে ফেলে। আফিম যেত চীন-জাপানে, আর ইউরোপে সেই সময় শিল্প বিপ্লব ঘটায় তুঙ্গে ছিল নীলের চাহিদা।
অত্যাচার-নিপীড়ন আর আর্থিক মন্দার কারণে চাষীরা এমনিই চাষ ছেড়ে দিয়েছিল, এর মধ্যে অনাবৃষ্টি আর খরায় ফসল এসেছিল কমে। দেশব্যাপী শুরু হয় অরাজকতা। স্বাভাবিক উৎপাদন হার কমে এলে জমিদারেরা গোমস্তা, দালাল ও ফড়িয়াদের দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে আড়ৎ-গদি খোলায়। অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে উৎপাদন বজায় রাখতে বাধ্য করে। দারোগা, শিকদার, পাইক নামিয়ে জোর করে প্রজাদের দাদন নিতে বাধ্য করত। বাধ্য করত, চাবুক মেরে কম দামে কাপড়, লবণ ও অন্যান্য উৎপাদন-সামগ্রী বিক্রি করতে। অবাধ ও প্রতিযোগিতামুলক একটি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ইংরেজরা এক দাসত্বমূলক নারকীয় যজ্ঞে পরিণত করে।
এমন অবস্থায় ১৭৭০ সালের মাঘ মাসে সারা দেশে ধান কিনে গুদামজাত করা শুরু হলে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) এই মহাদুর্ভিক্ষ ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। বলা ভাল ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৩ সময়কাল জুড়ে এই দুর্ভিক্ষে মারা যান অন্ততপক্ষে ১ কোটি মানুষ। সেই সময়ের বাংলার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ১৭৭১ সালে দুর্ভিক্ষ চলাকালীনও খাজনা বেড়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষকদের বাধ্য করেছিল নীল, পোস্ত ইত্যাদি ক্যাশ ক্রপ উৎপাদনে। ধান নয়। ঘরে, ক্ষেতে কোথাও অন্ন ছিল না। আর একটি বড়সড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সে দশকেই, ১৭৮৩-এ।
উইলিয়াম ডগবির হিসাব থেকে জানা যায়, ১৭৯৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ১০৭ বছরের সময়কালে সারা পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের কারণে মারা গেছে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ। আর ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষে মারা গেছে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ! ১৭৭০ থেকে ১৯০০ - এই ১৩০ বছরে মারা গেছে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। ১৮৬০ সাল থেকে মৃত্যু খাদ্যের অভাবজনিত কারণে নয়, খাদ্যের দাম ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ওড়িশায় ১৫ লক্ষ মানুষ যখন খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে,তখন এই ভারতের বন্দর থেকেই ২০ কোটি টন চাল ব্রিটেনের জন্য জাহাজ বোঝাই হচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত বড়মাপের দুর্ভিক্ষের তালিকা করা হলে রীতিমত চমকে উঠতে হয়। তবু ‘ভদ্র’, ‘সভ্য’ ‘সংস্কৃত’ নাগরিক বাঙালিসমাজ ‘মাস্টারমশায়, আপনি কিছু দেখেননি’তে প্রায় অবিচলিত থেকেছে। প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই সময়কালে প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, কৃষক বিদ্রোহের স্বরূপ সন্ধান। সে ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ' (১৭৬০-১৮০০) হোক, বা ১৭৯৯ সালের ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’, বা ১৮৩১-৩২-এর ‘সঁাওতাল বিদ্রোহ’, এমনকি ১৮৫৭-র ‘সিপাহি অভ্যুত্থান’ যা পরবর্তীকালে চিহ্নিত ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’।
ব্রিটিশ-রাজ প্রতিটি বিদ্রোহ দমনে অমানবিক নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছিল। দাপট দেখিয়েছিল তার অস্ত্রসম্ভারের। আর দুর্ভিক্ষকালে মানুষজনের কোনো সুবিধা দেওয়ার বদলে জানিয়েছিল তত্ত্বকথা। মূলত তিনটি তত্ত্ব। প্রথমটি হচ্ছে, মুক্ত বাণিজ্য নীতি যেখানে বাজার ক্ষমতার উপরে সরকার কোনভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ম্যালথুসিয়ান নীতি – যেখানে ভূমির অনুপাতে জনসংখ্যা অতিরিক্ত হলে ‘প্রকৃতি’ অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে মৃত্যুপথে ঠেলে দেয় এবং ‘ভারসাম্য’ ফিরিয়ে আনে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, যে কাজের জন্য সরকার বাজেট করেনি, সে কাজে সরকার অর্থব্যয়ে প্রস্তুত নয়। অন্তর্বেদন-কথা, এই সময়কাল জুড়ে কলকাতাকেিন্দ্রক বাংলায় যে আলোড়নকারী সমাজ-সংস্কার মূলক বুদ্ধি-যুক্তি-চেতনা উন্মেষকারী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার অন্তর্নিহিতে এই বাস্তবতাজনিত প্রতিঘাত প্রায় অনুপস্থিত!
পাঁচ
প্রাক ব্রিটিশ পর্বেও বাংলায় বড় বড় দুর্ভিক্ষের প্রমাণ আছে। মহাস্থানগড়ের লিপিতে প্রাচীন এক দুর্ভিক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়, সেই দুর্ভিক্ষে পুণ্ড্রনগরের মহাজাতককে ত্রাণ সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে দেখা যায়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরের অস্থির সময়ে বাংলায় আরেকটি দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায় ইতিহােসর পাতায়। আর তৃতীয় আরেকটি দেখা যায় ১৬৬১ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে।
অন্যসময়েও বাংলায় খাদ্যাভাব ছিল না, এমন নয়। মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রধান কবি ছিলেন ভারতচন্দ্র। অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।
ময়মনসিংহ গীতিকার কবি চন্দ্রাবতী রচিত দস্যু কেনারাম পালায়, দুর্ভিক্ষের বিবরণের সঙ্গে আছে মানুষ কেনাবেচাও।
গরুবাছুর বেচিয়া খাইল খাইল হালিধান।
স্ত্রী পুত্র বেচে নাহি গো গণে কুলমান।
পরমাদ ভাবিল মাতুল কেমনে বাচে প্রাণ।
কেনারামে বেচল লইয়া পাঁচ কাঠা ধান॥
চর্যাপদেও অনাহারের নিদর্শন আছে,
‘টালিতে মোর ঘর নাই পড়িবেশি
হাঁড়িতে মোড় ভাত নাহি নিতি আবেশি’।
যার অর্থ দাঁড়ায় টিলাতে আমার ঘর, প্রতিবেশি নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত।
দুর্ভিক্ষের কথা আছে চৈতন্যমঙ্গলেও।
অনাহার আর দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি বাংলায় দাসপ্রথাও ছিল। বাবা-মা সন্তান বিক্রি করে দিচ্ছেন এমনও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ‘চৈতন্য চরণামৃতে’।
‘নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে
কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্রে জানে’।
দাসদের বিক্রয়মূল্যের দলিল দস্তাবেজের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের দামও তুলনামূলক কম। ইবনবতুতা নিজেই আড়াই দিনারে ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলেন, বাজারে কম দামে প্রচুর দাস-দাসী বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। অনাহার আর দুর্ভিক্ষ কিংবা ঋণের কারণে নিজেকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও পাওয়া যায় সেই সব রেকর্ডে। এবং বড়সড় দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে খাদ্য সংকটের ঘটনা খুব দুর্লভ ছিল না।
বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধ শিল্প মসলিনের কথায় যদি আসা যায় সেখানেও তাঁতিদের মজুরী ছিল অস্বাভাবিক রকমের কম। মজুরীর অর্থে জীবন নির্বাহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে শ্রমিকদের, পেটের দায়ে অন্য পেশায় চলে যায় অনেকেই। যে পণ্যের জন্য বাংলার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, সেই শিল্পে মজুরীর এমন দুর্দশা হলে অন্যান্য শিল্পে কী ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
তবু এই বাংলার নামের সাথেই জড়িয়ে আছে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ। সত্যিকার সোনার খনি না থাকলেও এখানে আছে নদী নালা বেষ্টিত নরম মাটি। এমন উর্বর মাটিতে বীজ পুঁতে দিলে মাটি প্রতিদান দেয় বুকভরে। তবে বাঙালির মাটিতে এমন জাদু থাকার পরেও অর্থনৈতিক দারিদ্র্য বাঙালির পিছু ছাড়েনি। বরং চাপা পড়ে থাকা পাতায় দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর খাদ্য সংকটের মতো সমস্যায় জর্জরিত বাংলার ইতিহাস। এতদসত্ত্বেও বাংলায় ছিল এক সদ্ভাব-সম্প্রীতি-বিশ্বাসের এক সমাজ-চিত্র। এমনকি সমৃদ্ধিরও।
ব্রিটিশ আসার আগে খাদ্য-সংকটের সময়ে ভারতীয় শাসকেরা করছাড়, খাদ্যের দাম বেঁধে দেওয়া বা মন্দা-পীড়িত অঞ্চল থেকে খাদ্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। স্থানীয় জমিদার ও অবস্থাসম্পন্ন বণিকেরা কাজের যোগান দিয়ে, লঙ্গরখানা বা ভর্তুকি দিয়ে কম দামে খাদ্য সরবরাহ করে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয়দের এমন দানের প্রথাকে বিরক্তির চোখে দেখত। তারা মনে করত, দান-খয়রাতের সংস্কৃতি দরিদ্রদের হাতপাতার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। ব্রিটিশ শাসকেরা সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যেও দুইটি ভিন্ন ক্যাটাগরি তৈরি করেন। একটি হচ্ছে ‘অভাবগ্রস্ত দরিদ্র’ এবং অন্যটি ‘ধর্মীয় ভিক্ষুক’। ভারতের মানুষ কখনই সাহায্যপ্রার্থীদের কোন ক্যাটাগরিতেতে ভাগ করেনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুষ্ঠিচাল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করা কিংবা ধনী অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দান-দক্ষিণা নিয়ে সাধু-ফকির-দরবেশদের জীবনযাপন এদেশে স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হ’ত। কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতীয় এই রীতিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। বহু ব্রিটিশ এই দেশ থেকে সারা জীবন নবাবের মত চলার সম্পদ সংগ্রহ করে গিয়েছিল, কিন্তু দাতব্য কিছু (যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ বা দীঘি-কূপ খনন) করার কথা ভাবেনি, যেটা এখানকার বিত্তশালীদের সহজাত ছিল।
একদা বাংলা ছিল ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অঞ্চল। রূপো ও অন্যান্য দামী ধাতুর বিনিময়ে পণ্য কিনতে হতো বিদেশীদের। বৃহত্তর বাংলার ত্রিহুত থেকে নাটোর পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫৫ হাজার গ্রামে প্রায় ১ লক্ষ পাঠশালা-মাদ্রাসা চালু ছিল। গ্রামের মানুষের সম্বল সহযোগিতায় চলত শিক্ষাব্যবস্থা। অভদ্র ছাত্র-শিক্ষক, উচ্চবর্ণের গুরু খুব বেশি হলেও শতকরা ১৫ জনের বেশি নয়, মেয়েদেরও পাঠশালা ছিল, জমিদারেরা ছিলেন কৃষক ও কারিগর পালক, অর্থনীতি ছিল বিকেন্দ্রীভূত। (দ্য গোেল্ডন ট্রি, তৃতীয় খণ্ড, ধর্মপাল)। Teresa Hayter, The Creation of World Poverty (Pluto 1990, 2nd edition) গ্রন্থে বলছেন, ১৭৭০-এ ব্রিটেনের মোট জাতীয় আয় ছিল ১২৫ মিলিয়ন ডলার মাত্র। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত সময়ে প্রথমে বাংলা পরে ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকেই সে লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে ১০০০ মিলিয়ন ডলার। সব থেকে বেশি ধনসম্বল লুঠ হয়েছে বাংলা-বিহারের। কোনও কোনও বছরে শুধু কোম্পানি ঘুষ নিয়েছে ১ মিলিয়ন ডলার। "The arrival of the Bengal loot in London soon after (the Battle of Plassey 1757) coincided with the beginning of the industrial revolution in Britain. It has been estimated that the total British plunder of India between 1757 and 1815 amounted to £1000 million; the national income of Britain in 1770 was about £125 million. Direct tribute payments alone through the EIC approximated £1 million in some years.
"The British subsequently proceeded to destroy the industrial economy of India itself. Between 1815 and 1832 the value of Indian cotton goods exported fell from £1.3 million to below £100,000. BY the middle of the 19th century, India was importing a quarter of all British cotton goods.
"The Indian weavers suffered great hardship. Sir Charles Trevelyan declared to a parliamentary inquiry in 1840: "Dacca which used to be the Manchester of India has fallen from a flourishing town to a very poor one. “A governor-general of the EIC wrote in 1835: "The bones of the weavers are bleaching the plains of India." (বিেশ্বন্দু নন্দ লিখিত পাঠ থেকে সংগৃহীত)।
ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের খ্যাতি ছড়িয়ে গেল বিশ্বজুড়ে। শুধু মানী-গুণী-সমাজতাত্ত্বিকদের ভাষ্যে প্রায় অনুল্লেখিত থেকে গেল যে শিল্পবিপ্লবের অন্যতম আর্থিক যোগান গেছে বাংলাকে লুঠ করে, বাংলাকে নিংড়ে নিয়ে, লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে। পলাশী পরবর্তী মাত্র প্রথম ১৩ বছর শাসনে পৃথিবীর তৎকালীন সমৃদ্ধ একটি জনপদ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যেভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তা নেহাতই ব্রিটিশ-শাসকের দস্যুবৃত্তির ফল।
ছয়
পশ্চিমী জ্ঞানচর্চার জগতে পঞ্চদশ শতাব্দী অব্দি দার্শনিক ভিত্তি ছিল জৈব বিশ্ববীক্ষা। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল এক জ্ঞান জগৎ। ভিত্তি ছিল, অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদ এবং খ্রিস্টীয় ধর্মচিন্তা ও নীতিবোধ। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এলেন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন। বিশ্বকে দেখার দুটি পদ্ধতি পাওয়া গেল সপ্তদশ শতাব্দীতে। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) পদ্ধতি হিসেবে আরোহী প্রণালী নির্ভর (Inductive method) নীচ থেকে ওপরে, পরীক্ষা – পর্যবেক্ষণ – সিদ্ধান্ত। অভিজ্ঞতা নির্ভর। সত্য সম্ভাব্য। দেকার্তে (১৬০০-১৬৫০) নিয়ে এলেন অবরোহী তাত্ত্বিক কাঠামো (Deductive method)। ওপর থেকে নীচে। সত্য সার্বিক, অভ্রান্ত। নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) দেখালেন দুইটি বলের (Force) সংঘাতে গতিশীল বস্তুর গতিপথ ও গতি অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করা যায়। প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। ইংল্যান্ডে বুদ্ধিচর্চার জগৎ তখন সমৃদ্ধ। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। প্রাকৃতিক নির্বাচন, যোগ্যতমের বেঁচে থাকা, আকস্মিক মিউটেশন। যন্ত্রের কাজকর্মের পদ্ধতি রৈখিক। কার্যকারণ সম্পর্ক জটিল। উন্নত কাঠামো জটিল ছাড়াও সর্বদা পরিবর্তনশীল। কান্ট আসছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে। ১৭৮১ সালে Critic of Pure Reason এ যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করছেন অভিজ্ঞতাবাদের বিপরীতে।
জ্ঞানচর্চার এই ইতিহাস বেয়ে অথবা মাড়িয়ে-পিষে কিংবা লুণ্ঠন-উপযোগী দক্ষ ব্যবহারিক প্রয়োগে বৃটিশ-শক্তির লাগাতার ভারত-লুঠ। নির্মিত হয়েছে অথবা নির্মাণ করা হয়েছে বৃটিশ-শক্তির দুটি ভিন্ন চরিত্র, নির্মম লুঠেরা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চাকারী। ব্যক্তি-চরিত্র, জাতি-চরিত্র। কখনো বিপরীতধর্মী কখনও সমন্বয়ী। আলো আঁধারী। এবং দুটি ভিন্ন অবস্থান একত্রে একইসঙ্গে।
ক্লাইভকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া আবার ভারতে পাঠানো, এই দ্বৈত সিদ্ধান্ত তারই সাক্ষ্য বহন করে। পলাশীর যুদ্ধশেষে নবাব হতে পারার দরুন মীরজাফর, ক্লাইভকে ঘুষ হিসাবে ৩০ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হয়। সঙ্গে ২৪ পরগনার জায়গীরদারি যার আয় বছরে ৩ লক্ষ টাকা। ক্লাইভের অনৈতিক ও দুর্বিনীত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ১৭৫৭ সালে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ক্লাইভের অনুপস্থিতিতে বিপর্যস্ত ইংরেজদের ডাকে তাকে আবার ভারতে পাঠানো হয় ১৭৬৫ সালে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। কোম্পানি এই বছরেই দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি আদায় করে। বাংলায় নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব আর রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজরা নিজেদের কাছে রাখে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে বাংলার দেওয়ান হন মুর্শিদকুলি খান। সে সময় বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। কিন্তু ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খান রাজধানী ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। ইংরেজ শাসন আমলে রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যায় কলকাতায়। রাজধানীর উপর নির্ভরশীল ভূস্বামী, ব্যবসায়ী সহ অনেকেই ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় যাওয়া শুরু করে। কৃষিভিত্তিক পূর্ব বাংলার জমিদাররা বেশিরভাগই স্থায়ী নিবাস গড়ে রাজধানী কলকাতায়। আর তাদের প্রতিনিধিরা খাজনার জন্য নির্যাতন চালাত বাংলার, বিশেষভাবে পূর্ববাংলার নিরীহ কৃষকদের উপরে। কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার মূল কেন্দ্র। কলকাতা শুধু বাংলা প্রদেশ নয় বরং পুরো ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী ছিল। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ব বাংলার কাঁচামাল দিয়ে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকে কলকাতা এবং আশপাশের অঞ্চলে। কলকাতা আহ্লাদিনী হ’ল। কলকাতা কল্লোলিনী হ’ল।
শিল্পবিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের বাজার তখন বাংলা। খাদ্য শস্য উৎপাদন কমিয়ে কৃষকদের বিভিন্নভাবে বাধ্য করা হ’ল ইংল্যান্ডের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে। কৃষিপণ্যের এই বাজার শুধু ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামালই যোগাল না, কলকাতার ব্রিটিশ-শাসন নির্ভর ‘বাবু’ শ্রেণির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও সূচনা করল। ‘ভদ্র’ শ্রেণির বঙ্গ-সংস্কৃতির এক নতুন নির্মাণেরও শুরু সেই সময়। শুরু সংস্কার আন্দোলনেরও। বাংলার সমাজ পুনর্গঠনে যার প্রভাব হ’ল সুদূরপ্রসারী।
মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ব্রিটিশ শক্তি/ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই সময় আইন-আদালত বা সরকারি অনেক দপ্তরেই কাজকর্ম ফার্সি ভাষাতেই চালু রেখেছিল। এমনকি হেস্টিংসের উদ্যোগে কোম্পানির আর্থিক আনুকুল্যে ১৭৮১ সালে আরবি-ফারসি ভাষা শেখার জন্য ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ও প্রতিষ্ঠা করেন। পরে হিন্দুদের জন্য ভারততত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি।
স্পেনের রানি ইসাবেলার কাছে কলম্বাসের মতই বা তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ছিলেন আন্তোনিও দ্য নেব্রিহা। তিনি জমা দিয়েছিলেন একটি ব্যাকরণ বইয়ের প্রকল্প। বই পড়ে প্রজারা যেন রানীর হুকুমের ভাষা বুঝতে পারে, উত্তর দিতে পারে সেই ভাষাতেই। একই প্রয়োজন কোম্পানির। কোম্পানির প্রয়োজন, ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের স্থানীয় এজেন্ট, যারা উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কোম্পানির যোগাযোগ রাখবে। এজেন্টদের জানা দরকার অন্তত কাজ চালানো ইংরেজি ভাষা। জানা দরকার কোম্পানির হুকুমের ভাষা। জানা দরকার এজেন্টদের ‘উত্তর দেওয়ার আদব-কায়দা’।
ব্রিটিশ বিশ্বাস করতে পারেনি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে। এক, দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে চলা জেরুজালেম দখলের ‘খ্রিস্টান-মুসলমান সংঘর্ষের’ ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড-স্মৃতি এবং দুই, মুসলমান শাসকদের হাত থেকে সদ্য সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ায় আহত ও ক্রুদ্ধ ধর্মীয় অনুগত মুসলমান সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান বিরোধিতা।
এজেন্ট দরকার হয়ে পড়ল মুখ্যত হিন্দু সমাজ থেকে। আবার হিন্দু সমাজ থেকেও দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ দেশীয় অভিজাতদেরও দাবি ছিল, ইংরাজি শেখার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ১৮১৭ সালে গড়ে উঠল হিন্দু সমাজপতিদের উদ্যোগে ‘হিন্দু কলেজ’। নিষিদ্ধ, ‘অ-হিন্দু’দের প্রবেশাধিকার।
কোম্পানির প্রয়োজন এক অনুকূল জনগোষ্ঠীর আনুগত্য। সুতরাং, ১৮২৪ সালে কোম্পানির উদ্যোগে বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য সমাজের সংস্কৃত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো, ‘সংস্কৃত কলেজ’। ১৮৩৫ সালে মেকলে জানালেন তাঁর পরিকল্পনা-কথা, শিক্ষার যাবতীয় উদ্দেশ্য-কথা, সার কথা। ‘We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern - a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.’
সে সময়কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট হওয়া ছিল অনেক লোভনীয়। সে দালাল আহ্লাদিনী। রোজগারের টাকায় কলকাতা তখন কল্লোলিনী।
‘এই সব বলিরেখা খুঁড়ে তুমি খোঁজো
সভ্যতার আলো।
এ যদি সভ্যতা হয় অসভ্যতা কাকে বলি বলো?’
সাত
শাসক, তার শাসনাধীন জনজাতিকে অধীনস্থ রাখার জন্যে, এক, একাধিক, যত পরিকল্পনাই গ্রহণ করুক না কেন, শাসিত মানুষজন তার মধ্য দিয়েও নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারার ব্যাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে বাংলায়ও দেখা যায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার। শুরু মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) সময় থেকে। গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ। একই সঙ্গে বাংলার শ্রীময়ী মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে, ভিন্ন এক নগরকেন্দ্রিক শিকড়বিহীন সংস্কৃতির সূচনা।
ব্রিটিশ প্রভাবিত জ্ঞানচর্চায় বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবন ও বিশ্বাসের নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক নগর-জীবনকে সবিশেষ প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং আরও উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু হয়। মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত ইউরোপীয় জ্ঞান (বিশেষ করে, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য)। এই নতুন ভাবাদর্শগত চেতনা রূপ পায় রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও তার অনুগামীবৃন্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুসারীরা, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গদের কর্মোদ্যমে। এঁরা ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭), জেরেমি বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯), অগুস্ত কোঁত (১৭৯৮-১৮৫৭), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) ও জন স্টুয়ার্ট মিল-এর (১৬০৬-৭৩) মতো পাশ্চাত্যের আরও অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ ও মনীষীর গুণগ্রাহী ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবোধ। বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল (প্রতিষ্ঠিত, ১৭৮৪), শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ (১৮৩৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৮৫৭) মতো প্রতিষ্ঠান।
বাংলার নতুন চিন্তাচেতনায় ওই সময়ে বহু সংখ্যক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সমিতি, সমাজ-সংগঠন। এরই ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত আধুনিক বাংলা গদ্যের সৌধ গড়ে তোলেন। কাব্য ও নাটকে প্রতিমা-পূজা বিরোধী এবং ভাবের দিক থেকে ডিরোজিওপন্থী মাইকেল মধুসূদন দত্ত রীতি ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দ, চতুর্দশপদী বা সনেট, ব্যক্তিবাদ, জড়পার্থিবতা, নাটকে তীক্ষ্ম, তীব্র সংঘাতের উপাদানের প্রবর্তন করেন। সাহিত্য পরিমণ্ডলের কথা ছেড়ে দিলেও বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন মধুসূদন গুপ্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার, জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রমেশচন্দ্র দত্ত , দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্য। মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন প্রথম হিন্দু যিনি শবব্যবচ্ছেদ করেন। মূল চালিকাশক্তি বা প্রেরণা ছিল যুক্তিবাদ আর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সংস্কার। পরবর্তী সময়কালে প্রাধান্য ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী জাতীয়তাবোধের।
হেনরি ডিরোজিও, তাঁর অনুসারীদের মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তানুশীলনে অনুপ্রাণিত করেন। এঁরা ছিলেন টমাস পেইন-এর এজ অব দ্য রিজনস ও রাইটস অব ম্যান-এর অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। এঁরা সম্মিলিতভাবে ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা কমপক্ষে ছয়টি সাময়িকীর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। পার্থিনন (১৮৩০), ইস্ট ইন্ডিয়া (১৮৩১), ইনকুয়্যারার (১৮৩১-৩৪), জ্ঞানাম্বেষণ (১৮৩১-৪০), হিন্দু পাইওনিয়ার (১৮৩৫-৪০) ও বেঙ্গল স্পেক্টেটর (১৮৪২-৪৩)। প্রথম কয়েক বছর তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সনাতন হিন্দুধর্মীয় মতবাদের অসার চিন্তাধারা। পরবর্তীকালে ইয়ং বেঙ্গল চিন্তাধারার অনুসারীরা ঔপনিবেশিক সরকারের নানা ব্যর্থতার দিকেই লক্ষ্য দেয়। রামমোহন ও তার অনুসারীদের আধ্যাত্মিকতা নয়, বিশুদ্ধ যুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন এঁরা। ১৮৪০-এর দশকের শেষ দিকে ব্রাহ্ম সমাজ এর অন্যতম নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিজ্ঞানপন্থী অক্ষয়কুমার দত্তের মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থের অভ্রান্ততা প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। বস্তুত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনের আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী হন, আর অক্ষয়কুমার দত্ত অনুপ্রাণিত হন রামমোহনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কতায়। ১৮৫০-এর দশকে এই সংঘাতে আর একটি মাত্রা যুক্ত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অংশগ্রহণে।
বাংলা গদ্য শুরু হয়েছিল সংস্কৃত গদ্যের চালে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ কথ্যরূপী গদ্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করেন। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হল মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের শিশুশিক্ষা, ১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়। মুদ্রিত হল এই দুই পণ্ডিত বন্ধুর যৌথ মালিকানায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ মুদ্রণাগারে। অপরিসীম ছিল এই পুস্তক ও মুদ্রণ যন্ত্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। শুরু শিশুশিক্ষায় বাঙালি-হিন্দুর জীবনবেদ, লেখাপড়া করে যেই/ গাড়িঘোড়া চড়ে সেই।
চ্যুতি ঘটল কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সঙ্গে, বিদ্যা-শিক্ষার। ভেদ বাড়ল গ্রাম-শহরের। উপেক্ষিত হল গ্রাম।
গুণের বিচার, অবস্থার বিচার, অবস্থানের বিচার সব কিছুই ‘গোপালে-রাখালে’ ঊর্দ্ধকমাবেষ্টিত হল। ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, সাদা-কালো। ‘চিহ্নক ও চিহ্নিত’ সবসময়ই ‘বাইনারি ডিভিশন’ আবদ্ধ। শিক্ষা-বিস্তারে, কোম্পানির অতি মনোযোগ মুসলমান-বাঙালি সমাজকে, কোম্পানি ও অভিজাত হিন্দু সমাজের সমীকরণ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলল। মুসলমান-বাঙালি সমাজের আপত্তি ছিল, ইংরেজি শিক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত হল, ‘হিন্দু কলেজ’ নামকরণে এবং সেখানে ‘অ-হিন্দু’দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণায়।
প্রাক-পলাশী সময়কালে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল নিছকই শিক্ষাকেন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ ও নেটিভ সাহেবসুবোদের ইসলাম-বিদ্বেষ, ইসলাম-ধর্মাবলম্বী শাসকদের শাসন-কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান সমাজ সমকালীন স্রোত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে। আত্মপরিচয় খোঁজে ধর্মে। মাদ্রাসা-শিক্ষা পরিবর্তিত হতে থাকল দ্বীনীশিক্ষায়, ধর্মশিক্ষায়। নতুন নতুন জ্ঞানের উন্মেষ থেকে বঞ্চিত হয়ে মসজিদ, ইমাম, মুয়াজ্জিনদের নির্দেশ-ফতোয়ায় পরিচালিত হতে থাকে বিশাল এক জনগোষ্ঠী।
১৯০৩ সালে মীর মসাররফ হোসেন প্রণীত ও ‘কলিকাতা-টালিগঞ্জ হইতে শ্রী মীর ইব্রাহিম হোসেন দ্বারা প্রকাশিত’ মুসলমানের বাংলা শিক্ষা প্রথম ভাগ বইটির আরম্ভ-পাঠে, আল্লা এক/ আল্লা সকলের বড় / আল্লার কোনও দোষ নাই। কোনো বদনাম নাই।
বর্ণপরিচয়ে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর অনুপস্থিত। শিশুশিক্ষায় সনাতন হিন্দু-ধর্মীয় অনুশাসন অনুপস্থিত, অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের পুস্তক শুরুই হচ্ছে আল্লার অস্তিত্ব বর্ণনে। সম্প্রদায়গত বিভাজন না স্বতন্ত্র অস্তিত্বের উদযাপন? কেমন ভাবে নিরূপণ করা হবে যখন বিষাদসিন্ধুর লেখক শ্রদ্ধেয় মীর মোসারফ হোসেন মুসলমানের বাংলা শিক্ষায় লিখবেন, ‘তোমার হাতে কি পুঁথি / আমার হাতে শিশুশিক্ষা’ অনুকরণে ‘তোমার হাতে কি কেতাব / উত্তর দেয় রমজান আমপারা’।
অন্যদিকে বঙ্কিমের সহজ রচনা শিক্ষায়, ‘ইহা স্মরণে রাখিতে হইবে যে ‘শ্রীযুক্ত বাবু’ শিরোনাম এখনকার দিনে কখনও পরিত্যাগ করা যায় না, আবার ‘মুসলমানকে বাবু লেখা নিষিদ্ধ, মুসলমানকে ‘মৌলবি বা মুন্সী’ লিখিতে হয়। নামের পর সাহেব লিখিতে হয়।’ ব্রাহ্মণ কন্যারা সকলেই নিজের নামের পর দেবী লিখিতে পারেন, শূদ্র কন্যাদিগকে দাসী লিখিতে হয়। পত্র রচনায় চিঠির একেবারে ওপরে মঙ্গলাচরণ বা স্বস্তিবাচন, হিন্দু হলে শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়, ওঁ, শ্রী, শুভম্ ইত্যাদি আর মুসলমান হলে ‘এলাহি খোদা হাফেজ, এলাহি ভরসা।’ পাঠাভ্যাসে শিশু শিখতে থাকবে তার ধর্মীয় পরিচয়। সনাতন হিন্দু ধর্মীয় শিশুশিক্ষায়, ‘উঠ শিশু মুখ ধোও/ পর নিজ বেশ’ হয়ে উঠবে মুসলমানের বাংলা শিক্ষায়, ‘আল্লার নাম করি সবে ফজরে উঠিবে/ মুখ ধুয়ে ওজু করে নামাজ পড়িবে।’
ভাষাতেও তার প্রতিফলন। বাংলা ভাষা ছিল প্রাকৃতের রূপভেদ। গীতিকাগুলি থেকে বোঝা যায় বাংলা ভাষা সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত হতেই তার উদ্ভব। খাজনা, ইজ্জত, জবরদস্তি, শাওন, আশমান এমন সব বহু বহু আরবী-ফারসী শব্দ দেশীয় রূপ ধারণ করেছিল। টোলের পণ্ডিতেরা অপর্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে ভাষার রূপটিই বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৌলবীরাও বেশি বেশি আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার শুরু করলেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় কথ্য ও লিখিত রূপে বড় ধরনের পার্থক্য এসে গেল। পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক বিভাজন, প্রাতিষ্ঠানিক-ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভাষাগত এই ভিন্নতাও খুব সম্ভব প্রভাব ফেলেছিল। বিভাজন অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে স্পষ্টতর হতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ শাসনকালে।
আট
ইতিমধ্যে ১৮৫৩ সালে রেলগাড়ি। ১৮৫৭’য় (২৪ জানুয়ারি) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ট কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পশ্চিমী ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার কাজের বিস্তৃতি ছিল লাহোর থেকে রেঙ্গুন সিংহল। প্রথম আচার্য, লর্ড ক্যানিং ও উপাচার্য, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল। ১৮৫৮ সালের প্রথম দু’জন স্নাতক, যদুনাথ বোস ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘বেথুন স্কুল’ (ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল) স্থাপিত হয়েছে আগেই, ১৮৪৯। বছর ২০-র মধ্যেই স্কুলে ছাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। অভিভাবকদের উদ্দীপনা স্তিমিত। অথচ ১৮৯৩ সালে ৩০ জন ছাত্রীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মহাকালী পাঠশালার ছাত্রীসংখ্যা ১৯০৩ সালে ৪৫০। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাত্রী মাতাজী মহারাণী তপস্বিনীর শিক্ষাদর্শে পাঠ্যসূচিতে সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি, ইত্যাদি। এই শিক্ষাদর্শ কলকাতা সমাজে যথেষ্ট আদৃত। নারী শিক্ষা প্রয়োজনীয় বোধ করেও পশ্চিমী ভাবাদর্শে গঠিত বেথুন স্কুল হারাচ্ছে শিক্ষার্থী আর অন্যদিকে পাঠ্যসূচিতে সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি, ইত্যাদি যুক্ত থাকার কারণে অভিভাবকেরা পছন্দ করছেন মহাকালী পাঠশালা। জাতীয়তাবোধ হিন্দু-জাতীয়তাবোধে নবনির্মিত।
অক্ষয়কুমার দত্ত যুক্তিবাদ, বস্তুনিষ্ঠতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস বিশ্লেষণে উদ্যোগী হন। বিদ্যাসাগর অজ্ঞেয়তাবাদী থেকে যান এবং তার সফল হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলনের (১৮৫৫-৫৬) ফলে ১৮৫৬ সালে প্রণীত আইনের (যা হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহকে বৈধ করে) পরে তিনি ষাটের দশকে কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আরও একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ ক্ষেত্রে এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও তাঁর প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। এই পর্যায়ে অসহযোগিতা ছিল ইংরেজ সরকারেরও। যুক্তিবাদীরা তখন থেকে পরাধীনতা ও আধিপত্যের বিষয়টির প্রতি নীরব থাকতে পারেন নি। কালো আইন পাস (আদালতের ভারতীয় বিচারকগণ, শ্বেতাঙ্গ বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে পারতেন না, এ বৈষম্যমূলক রীতি অবসানের জন্য ওই সময়ে এক আইনের প্রস্তাব করা হয়) সংক্রান্ত বিতর্ক, সিপাহি বিপ্লব (১৮৫৭-৫৮) ও নীলবিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) মতো ঘটনাপ্রবাহ চিন্তাশীল বাঙালি মানসকে জাতীয়তাবাদী পথে পরিচালিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় হরিশচন্দ্র মুখার্জির নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ বা নীলবিদ্রোহ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক (১৮৬০) ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের নীলদর্পনের ইংরেজি অনুবাদ, ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত পাবনার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে রমেশচন্দ্র সেনের ‘বাংলার কৃষক বিদ্রোহ’, ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’-র পটভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীরের (১৭৮২ – ১৮৩১) ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন নিয়ে ১৮৩১-এর ১৩ নভেম্বরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘বাঁশের কেল্লা’র স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠা বা এই ধরনের আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী।
ষাটের দশকে হিন্দু মেলা (১৮৬৭-৮১) ও ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ (১৮৭২) শীর্ষক আলোচনাসভার মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবোধ নতুন মাত্রা পায়। চিরায়ত হিন্দু রচনাগুলির আলোচনা-পর্যালোচনা-মূল্যায়ণ এবং সেই সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজ-দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়ে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন শুরু হয়। এই হিন্দু জাতীয়তাবোধ পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের পথ প্রশস্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়া লীগ (১৮৫৭), ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬), ন্যাশনাল কনফারেন্স (১৮৮৩) ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)।
নব্যহিন্দু ও জাতীয়তাবাদী আবেগের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সমাজ সংস্কারের এই প্রেরণা শিক্ষিত, অভিজাত মুসলমান সমাজেরও মনোযোগ কাড়ে। এগিয়ে আসেন মুসলিম আর্থ-সামাজিক সমস্যার বিষয়ে যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার দেলোয়ার হোসায়েন, সামাজিক বিষয়ের সমালোচক এবং সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন এবং লেখক, শিক্ষাবিদ ও মুসলিম নারীমুক্তির জন্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর মতো মনীষী মানুষজন।
নারী সমাজের নিজস্ব যাপনকথা, প্রথম লেখেন রাসসুন্দরী দেবী (১৮১০ সালে জন্ম পাবনার এক অজ পাড়াগাঁয়, দশ বছরেই বিয়ে), ‘আমার জীবন’। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকের মেয়েদের জীবন-ছবির এক বিশ্বস্ত দলিল। তারপর উল্লেখজনক রচনা কৈলাসবাসিনী দেবীর ( জন্ম ১৮৩৭)। বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। মহিলা হিসেবে প্রথম প্রবন্ধের সঙ্কলন, ‘হিন্দু মহিলাগণের হীন অবস্থা’। সেই প্রথম এক মহিলা হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে প্রতিবাদ করলেন। আলোচনা করলেন, ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাদের সমস্যা, স্ত্রীশিক্ষা ও স্বাধীনতার অভাব নিয়ে। দাবি করলেন মেয়েদের শিক্ষার, বিবাহপরবর্তী জীবন প্রসঙ্গে সংস্কার। মেয়েদের সামাজিক অর্থনৈতিক ভূমিকা পালনের কথা জানালেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ বলা যায়। কৃষ্ণভাবিনী দেবীর লেখা ‘ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা’ বাংলা ভাষায় লেখা কোন নারীর প্রথম ভ্রমণবৃত্তান্ত।
সে সময় মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষও সন্দিহান ছিলেন। মনে করা হত, মেয়েদের নারীসুলভ কোমল গুণগুলি এতে নষ্ট হবে। কৃষ্ণভাবিনী এই মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। রোকেয়া নারীদের আরও ভাল মা বা স্ত্রী হওয়া, নারী-জীবনের এই সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সমকালীন অন্য নারী সমাজ-সংস্কারকদের থেকে তাঁর পার্থক্য এখানেই। তাঁর কাছে নারীমুক্তির অর্থ ছিল পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন। নারী পুরুষের সহকর্মী সহধর্মিণী হবেন, এটাই ছিল তাঁর আশা। তিনি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারীর মুক্তি অসম্ভব। রোকেয়া দাবি করেছিলেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার। নারী যে পুরুষ দ্বারা শোষিত — এই চেতনা প্রথম নারী হিসেবে তিনি তুলে ধরেছিলেন।
বাংলার এই সময়কালীন জ্ঞানচর্চা ও সংস্কার আন্দোলন আখ্যায়িত হয় বাংলার প্রেক্ষাপটে ‘নবজাগরণ’। কিন্তু নতুন এই জাগরণ সমাজ-মানসের ধারাবাহিক উন্মেষের প্রক্ষিতে এল না। বরং বলা ভাল সেই সময়ের ঔপনিবেশিক সরকারের প্রশাসনিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলস্বরূপ এর উদ্ভব। এমনভাবেও ভাবা হয়ত খুব একটা অসঙ্গত হবে না, যদি বলা হয় গৃহীত অনেকানেক ব্যবস্থা অত্যন্ত সচেতন ও পরিকল্পিতভাবেই নেওয়া হয়েছিল যাতে এক বিশেষ সমাজ গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই।
বস্তুত এই শিক্ষিত শ্রেণির আকার-আয়তন ছিল খুবই ছোট আর তা ছিল শহুরে উঁচুতলার ‘ভদ্র’ হিন্দুদের মধ্যেই সীমিত। এই শ্রেণির চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপ বাংলার বৃহত্তর জনসমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি, এমনকি বলতে গেলে কোন প্রভাবই পড়েনি। মুসলিম সমাজ এর প্রভাব থেকে প্রায় বাইরেই থেকে যায়। আর পল্লীজনপদের হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলা চলে।
‘কু’প্রথার, ‘কু’কথার বিরুদ্ধতায় যুক্ত করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল আপামর বঙ্গবাসীকে, সম্প্রদায়গত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেই, তেমন কোনও চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটল না। মূলত, ‘রাষ্ট্র’ বা ‘শাসক’ নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত বোধ করলেন সজ্জন-সম্ভ্রান্তেরা। মধ্যযুগের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উদারতাকে প্রান্তিক করে দিয়ে, বিপন্ন করে দিয়ে, সুদীর্ঘকালের অর্জিত জ্ঞনচর্চার ইতিহাস নস্যাৎ করে দিয়ে এই দেশ যারা দখল করল, লুট করল, তাদেরকেই পরিত্রাতা ভেবে, তাদের কাছেই নিজেদের কার্যত সমর্পণ করলেন বিদ্দজনেরা। সেদিন, নিজেদের উদ্যোগে বাংলার নিজস্ব কৃষ্টির সংস্কৃতায়নে তৎপর হতেন যদি, জাত-ধর্ম-বর্ণের উর্ধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একদা প্রয়াসী বাঙালি সমাজ, এমনভাবে জাতপাত ধর্মে বিভক্ত হয়ে যেত না।
উপেক্ষিত হ’ল বাংলার বৈচিত্র্যের সম্মিলন। এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক ভৌগোলিক অখণ্ডতার ইউরোপীয় রাষ্ট্রনির্মাণের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন বাংলার শিক্ষিত, ভদ্র, পরিশীলিত নগরমনস্ক সমাজ! অনুকরণের মানসিকতা! ইংরাজ বর্ণিত উদ্দেশ্যমূলক নির্মিত ইতিহাস-বিশ্বাস! নিজস্ব ঐতিহ্যের বিস্মরণ! ধর্মীয় বিভাজনকে জাতিতত্ত্বের নির্মাণে বিন্যাস! নব্য বিত্তশালীদের অর্থকৌলিন্য! যুক্তি ও বুদ্ধিতে শানিত কলকাতার সমাজ-বিন্যাসের স্তরে স্তরে ‘চিড়’ হয়েছিল ফাটল। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যে, বৈশ্যে, শূদ্রে; উচ্চবর্ণে, দলিতে; হিন্দু, মুসলমানে। শিক্ষিতে, অশিক্ষিতে; প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে।
‘সপ্তকোটিকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে’ উচ্চারণকালে বঙ্কিমের বাংলা তখন বেঙ্গল - সুবা বাঙ্গালা, সুবা ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড - ওই সাত কোটির মধ্যে কমবেশি অর্ধেক ছিল মুসলমান। এছাড়াও ছিল বিহাির, ওড়িশা ও অন্যান্যরা। হিন্দু-বাঙালি মেরেকেটে দু কোটি। এই হিন্দু-বাঙালিরা মনে করতেন, তারাই একমাত্র বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠতে লাগল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। শহরকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’ বর্ণহিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক কৌলিন্য, সমাজের নমশূদ্র বাঙালী, মূলবাসী জনগোষ্ঠী, দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল। বিচ্ছেদ ঘটল হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর।
বাংলায় মানুষ বেড়ে উঠেছে অনেক বেশি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। বৈচিত্র্য তাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নানানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ধর্ম পরিচয়েও বহুবিধ ভিন্নতা। ফলত হিন্দু ধর্ম এখানে কোন জাতি পরিচয়ে পূর্ণতা পায়নি। পূর্ণতা পাওয়ার কথাও নয়।
শতেক ধর্মাচরণেও একদা বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। সম্পর্কে বিশ্বাস, যাপনে-উৎসবে বিশ্বাস। উদার ধর্মমতে বিশ্বাস। ধর্মমতের উদারত্বে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসবোধ থেকেই গড়ে ওঠে সহনশীলতার পাঠ। ন্যায়-নৈতিকতাবোধ বহুত্বে বিশ্বাস। এমনই মনে হয় শুধু বাংলা কেন প্রাচ্যের বিশ্বাসী মনোজগৎ। তরল পদার্থের মতো আধারের আকারে ধর্মীয় বহুত্ববাদ।
গোটা গ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সর্বজনীন শীতলা পুজো, শীতলার গান, মনসার ভাসান। মাঘই ছিল গ্রামবাংলার প্রকৃত উৎসবকাল। অগ্রহায়ণে ধান, পৌষ কলাই, আখের নতুন গুড়, লোকের হাতে পয়সা-কড়ি, পিঠে-পুলি, নতুন জামা-কাপড়, তখনই তো উৎসব। গ্রাম-সমাজ বিচ্ছিন্ন নগর-মানুষ নির্মাণ করল নিজস্ব উৎসব, দুর্গাপুজো।
নগর সমৃদ্ধ হ’ল না উৎসভূমির আর্দ্রতায়, বিযুক্ত হল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ লোক-সমাজ থেকে। বরং নগর-চলন বিস্তৃত হল ভিন্ন অর্থনীতির গ্রাম-বাংলায়। অ-সমৃদ্ধ হল নগর, নিরক্ত হল গ্রাম। সভ্যতা সংজ্ঞায়িত হল নগর-বিত্তের ধ্যান-ধারণায়। সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য হল একমাত্রিক, একমুখী ধনসম্পদ আহরণ। মুখে মুখে প্রবাহিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে গেল অজ্ঞ-অশিক্ষিত-সংকীর্ণমনাদের সংস্কৃতি।
গ্রামবাংলা গোচরে-অগোচরে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, পরিকল্পনায়-অপরিকল্পনায় অসমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বহুত্বে, ধর্ম-বিশ্বাসী গ্রামসমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় ভাবাদর্শ, বিশ্বাসী ধর্ম নয়। রাজনৈতিক বা সমাজ অর্থনৈতিক স্বার্থে গ্রন্থিত, সুসংবদ্ধ এক রাষ্টীয় মতাদর্শ। 'বিশ্বাসী-ধর্মের' বিপরীতার্থক এক ভাবাদর্শ, আধুনিক পশ্চিমী রাষ্ট্রব্যবস্থা।
নয়
১৯০৫ সালে এল কার্জনের বঙ্গভঙ্গ। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, ত্রিপুরা, মালদহ নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশ, রাজধানী ঢাকা। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে বাংলা প্রদেশ, রাজধানী কলকাতাতেই থেকে যায়।
বাঙলাকে ভাগ করার চিন্তা, ইংরেজদের অনেক আগে থেকেই। ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, ওড়িশা ও আসাম নিয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে গঠিত হয়েছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি। ১৮৭৪-এ আসামকে বাংলা থেকে আলাদা করা হয়। আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় বাংলাভাষী তিনটি জেলা – সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া। অনেক পরে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারত বিভাজনকালে সিলেট পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাঙালি অধ্যুষিত কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলা আর বাংলায় ফিরে আসে না।
১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলা প্রদেশের সীমানা নতুন করে নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। ১৯০৩-এ স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলে আসামের চিফ কমিশনারের অধীনে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। বাঙালিদের সরব বিরোধিতায় সফল হন না।
এরপর ১৯০৪ সালে বড়লাট নিজেই পূর্ব-বাংলার মানুষজনকে নিজেদের পক্ষে টানতে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফর করেন। পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মানুষজনকে নিজের পক্ষে টানতে লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করে মুসলিমদের নানান সুযোগ সুবিধার কথা বলেন। একই সঙ্গে একজন লেফট্যানেন্ট গভর্নর, পৃথক আইন পরিষদ ও রাজস্ব বোর্ডের ঘোষণা করেন।
পূর্ব-বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও লর্ড কার্জন তার পূর্ব-বাংলা সফরে মুসলমানদের ঐক্যের উপরেই জোর দেন বেশি। ধর্মকে সরাসরি ব্যবহার করা হয়। পূর্ব-বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু-বিদ্বেষী মনোভাব বাড়তে থাকে। এছাড়া পূর্ব-বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিচু বর্ণের হিন্দু। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের মতো উঁচু বর্ণের হিন্দুরা থাকতেন কলকাতায়। ফলে মুসলমানদের সাথে সাথে পূর্ব-বাংলার হিন্দুরাও নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই অবস্থান নেন।
সে-সময় অমানুষিক শ্রম দিতেন গ্রাম-বাংলার কৃষক আর ফল ভোগ করত কলকাতার জমিদার। অর্থনৈতিক সংকটে গ্রামের মানুষ শিক্ষাতেও এগোতে পারত না। ফলে কলকাতার লোকেরা সহজে চাকরি পেলেও অবহেলিত গ্রাম-বাংলার লোকেরা চাকরি পেত না সহজে। সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত ছি’ল পূর্ববাংলা। ঢাকা থেকে কর আদায় করে সে কর দিয়ে উন্নয়ন হ’ত কলকাতা, ওড়িশা আর বিহারে। রেল ব্যবস্থার উন্নয়নও ছিল পশ্চিমকেন্দ্রিক। ঢাকার মতো প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের সাথে ছিল না রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে বঙ্গভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় বাংলার হিন্দু, মুসলমান আর ব্রিটিশ শাসকদের ত্রিমুখী এক দ্বন্দ্ব।
শিক্ষিত হিন্দু-বাঙালিরা অনুভব করে, বঙ্গভঙ্গ বাংলা-ভাষাভাষী মানুষজনের মধ্যে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের ওপর কার্জনের সুচিন্তিত আঘাত এবং আসল লক্ষ্য, শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্রুত উত্থানের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব-বাংলার মুসলিম প্রভাব বাড়ানো। সম্পূর্ণ বিহার ও ওড়িশা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাপ্রদেশেও হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। তাই বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্রতর হয়। বাংলার ছাত্র সম্প্রদায়ও জাতীয়তাবাদের ডাকে প্রবলভাবে সাড়া দেয়। নেমে আসে ব্যাপক দমনপীড়ন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। প্রতিবাদ ছিল প্রায় সর্বজনীন।
ওই সময়ের অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো এটিও ছিল ধর্মীয় ভাবধারায় পুষ্ট। সমারোহপূর্ণ পূজা-অর্চনার প্রচলন করা হয়। কালীকে মাতৃভূমির প্রতীক হিসেবে পুরোহিত স্বদেশী ব্রত পাঠ করাতেন। এ রকম ধর্মীয় উদ্দীপনা সাধারণ হিন্দু জনতাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিত। কিন্তু এর বিপরীতে ঐ উন্মাদনা সাধারণ মুসলমানদের চেতনায় প্রতিকূল মনোভাব জাগিয়ে তুলত। মুসলিম মানসকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে।
মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি ১৯০৫ সালে সাতজন নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিত্ব সাক্ষরিত ঘোষণার মাধ্যমে বিভক্তির পক্ষে অবস্থান নিতে মুসলমানদের অনুরোধ জানান। ব্যবসায় ও শিল্পক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকায় মুসলিম সমাজ-মানসে চিন্তা-ভাবনার প্রবণতা ছিল বিভক্তির পক্ষে। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ফাটল বেড়ে যায়। বিভাজনের আরও বড় কারণ ছিল বাংলায় ভূমি ব্যবস্থার প্যাটার্ন। নিজেদের জমিদারি থেকে অনুপস্থিত হিন্দু জমিদারেরা রায়তদের - যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান – আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির কথা প্রায় ভাবতেনই না।
শুরু থেকেই ভারতীয়, বিশেষত বাংলার, প্রচারযন্ত্র বিভক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভায় বিভক্তির প্রস্তাব যতদিন না প্রত্যাহার করা হবে ততদিন ব্রিটিশ দ্রব্যাদি ক্রয় না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। রাখীবন্ধনের দিনটিকে স্মরণ করে রচনা করেন,
বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
জাতীয় চেতনা ডি.এল রায়, রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর দেশাত্মবোধক গানে পুষ্ট হয়।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ রচিত, ‘ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির প্রথম ১০ লাইন পরবর্তীকালে নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠক, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারিতে সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি অর্জন করে।
এই কালসীমাতেই ১৯০৭ সালে সুরাট অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মধ্যপন্থী এবং চরমপন্থী ও বিপ্লবী। চরমপন্থী ভাগের যুবকেরা সশস্ত্র সংগ্রামকে সমর্থন করলেও এর সঙ্গে ধর্মীয় চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য যোগ করায় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বড় অংশই এই আন্দোলনের প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। এছাড়াও ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নেওয়া বা জাতীয় বীর হিসেবে শিবাজীর পূজা প্রচলনের মতো ঘটনা মুসলমানদের আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফল হ’ল, ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লায় সংঘটিত দাঙ্গা এবং এর পরপরই ঐ বছরের এপ্রিল মাসে জামালপুরের দাঙ্গা পরিস্থিতি। হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির মধ্যকার বিরোধ তীব্রতর হয়। এই অবস্থায় ১৯০৭ সালের ১৫ মার্চ তারিখে দুই সম্প্রদায়ের একদল বিশিষ্ট সদস্য ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা অবসানের জন্যে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন। ব্রটিশ-রাজ নিজ স্বার্থেই উদাসীন রয়ে যায়।
ইতিমধ্যে পূর্ববঙ্গ আর আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশে, ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তা সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রথম বৈঠকে প্রস্তাব নেয়, বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর এবং সরকার বিরোধী যে কোন বিক্ষোভ আন্দোলন নিন্দনীয়। অন্যদিকে বাঙালি হিন্দুদের অসন্তোষ নিরসনে রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে বঙ্গভঙ্গ রদ সহ প্রশাসনে নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তন ঘোষণা করেন। এক, ভারত সরকারের রাজধানী কলকাতার পরিবর্তে দিল্লিতে হওয়া উচিত। (দিল্লি ছিল মুসলমানদের একদা গৌরব নগরী। রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে ইংরেজ পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা হারানোর দুঃখে কাতর মুসলমান সম্প্রদায়কে শান্ত করার আশা করছিল)। দুই, প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম – এই পঁাচটি বাংলাভাষী বিভাগ একত্রিত করে একটি প্রেসিডেন্সিতে সংগঠিত করা হবে। তিন, বিহার, ছোটনাগপুর ও ওডিশাকে নিয়ে গঠিত প্রদেশটি শাসনকার্য পরিচালনা করবেন আইন পরিষদসহ লেফটেন্যান্ট গভর্নর। চার, আসাম চিফ কমিশনারের শাসনে প্রত্যাবর্তন করবে। বাংলার পুনরায় একীকরণের দিন ঠিক করা হয় ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল।
বঙ্গভঙ্গ-রদ হিন্দু-বাঙালিদের ক্রোধ কিছুটা সংযত করে বটে, কিন্তু সরকার সমর্থ হয় বাংলার বিক্ষুব্ধ পারিবার্শ্বিক অবস্থা থেকে রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায়। কলকাতাকে কেবল প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় নামিয়ে আনায় কলকাতার ভূ-সম্পত্তিগত মূল্য কমে যায়। রাজনৈতিক কাজকর্মের স্নায়ুকেন্দ্র সরে যাওয়ায় অবধারিতভাবে হিন্দু বাঙালিদের প্রভাব দুর্বল হয়ে যায়। বর্ণ হিন্দু বাঙালি সমাজ-চেতনা সর্বভারতীয় প্রাধান্য বজায় রাখতে নৈকট্য অনুভব করে উত্তর-ভারতীয় হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে।
উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে বাঙালি ছিল ‘অকুলীন, অধঃপতিত’ জাতি-সম্প্রদায়। ইংরেজ আনুকূল্যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে, ‘ইংরেজি’ জানা ও শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ভদ্র’ হিন্দু বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে। ‘প্রশাসনিক উচ্চপদ’ বাঙালির মান্যতা তৈরি করেছিল। এই মান্যতা প্রাচীন হিন্দু-সমাজ তাকে দেয়নি। ‘বাঙালি উচ্চবর্ণীয় হিন্দু-সমাজ’, বৃটিশ শক্তির ‘কৃতজ্ঞতাপাশে’ আবদ্ধ রইল। ইংরেজদের মুসলমান-সংস্কৃতির বিরোধিতায় নিষিক্ত হ’ল, জারিত হ’ল।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব রেখেছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থাটি হিন্দু-মুসলিম মতভেদকে জোরদার করেছে। হিন্দু এবং মুসলমান - এই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। একদিকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেমন হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিস্তৃত হয়েছে, তেমনই বিভক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এক মুসলিম জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত ঘটায় ও তাদেরকে স্বতন্ত্রবাদী রাজনীতিতে যোগদান করতে প্রাণিত করে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯০৯ সালে হিন্দু মহাসভার।
দশ
মধ্যযুগে বাংলার মাটিতে যে সর্বধর্মীয় সম্মিলন গড়ে উঠেছিল তাতে ভাঙন ধরাতে সফল হ’ল ইংরেজ শক্তি। ইংরেজ বিদ্বেষ, হিন্দু অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ মুসলমান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব কুঠুরীতে ঢুকিয়ে দিল। বিচ্ছেদ ঘটলো, হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর। কলকাতাকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’, বর্ণহিন্দু সমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক কৌলিন্য সমাজের নমশূদ্র বাঙালি, মূলবাসী জনগোষ্ঠী, দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ হিন্দু বাঙালিদের আবেগে যতখানি আঘাত হেনেছিল, মুসলমান বাঙালি সেভাবে তাড়িত হয়নি। হিন্দু জমিদারের কাছে বাংলা ভাগের পরিণাম ছিল পূর্ববঙ্গে তার আধিপত্য চলে যাওয়া, অন্যদিকে মুসলমান মধ্যবিত্তের কাছে বঙ্গভঙ্গ মানে পূর্ববঙ্গে মুসলমান-প্রধান একটি প্রদেশের প্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রভেদই হিন্দু-মুসলমানকে এক হতে দেয়নি স্বদেশী পতাকার নিচে। পরে অবশ্য বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির সঙ্কটের বাস্তব দিকগুলি বুঝে নেওয়া ও তার ভিত্তিতে আন্তরিকভাবে কাছাকাছি আসার তাগিদও তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় হিন্দু জমিদার বনাম মুসলমান চাষি – ভূমি-সম্পর্কের এই দ্বন্দ্বই নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের একটা বড় কারণ, তবে মুসলমান-সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে এই বিভাজনে। মুসলমান মধ্যবিত্তের এই দাবিকে মর্যাদা দিয়ে বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে তাদের সংখ্যানুপতিক প্রতিনিধিত্ব দিতে চেয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, বাধা দিয়েছিল হিন্দু কায়েমি স্বার্থ। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের অকাল-প্রয়াণের পর সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯২৫ সালেই গঠিত হয় আরএসএস। ১৯২৮-এর শেষে কংগ্রেস-লিগের সম্পর্ক প্রায় ভেঙে পড়ল মতিলাল নেহরুর বিতর্কের সময়ে। হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু কায়েমী স্বার্থের চাপে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলমানদের ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এবং বাংলা ও পাঞ্জাবে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দাবি নাকচ করে দিল কংগ্রেস। জিন্না ঘোষণা করলেন, শেষ হয়ে গেল কংগ্রেস-লিগ সম্পর্ক। ১৯২৯ মার্চে লিগ পেশ করে তাদের ১৪-দফা দাবি, সে দাবিও মেনে নিল না কংগ্রেস। এরপর লিগ ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি আদায় করে নিলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন একরকম আইনসিদ্ধই হয়ে যায়। বিশের দশকের গোড়ায় অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের (১৯১৯ – ১৯২৪) সুবাদে হিন্দু-মুসলমানের যে সাময়িক মিলন, ভিত তার শক্ত ছিল না, আর তাই আন্দোলনের অকাল পরিসমাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যেই মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো নিয়ে বিরোধ আর তা থেকেই শোচনীয় দাঙ্গা ঘটে যায় কলকাতা ও পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায়।
আইনগত সংরক্ষণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৯৩৭-এ বাঙলার আইন পরিষদে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনে ক্ষমতায় আসে লিগ। কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হকের প্রচার ছিল, দুবলা ডাল ভাত, জমিদারী উচ্ছেদ আর অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯৩৯-এ হিন্দু মহাসভা দাবি তুলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে সামরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। হিন্দুত্বকে একটা জঙ্গি রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। ইতিমধ্যে ১৯৪০ সালের মার্চে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়। বাংলার মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের কথায় তখন পাকিস্তান মানে, হিন্দু নিপীড়ন থেকে মুক্তি। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। ১৯৪২-এ হিন্দু মহাসভার কানপুর অদিবেশনে সাভারকর দাবি তোলেন Hinduise all Politics and Militarise Hindudom. পরের বছর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দাবি তোলেন একটি শক্তিশালী ও বলশালী হিন্দু আন্দোলনের (A strong and virile Hindu movement)। ১৯৪৩-এ এককভাবে বাংলায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করে লিগ। চল্লিশের মাঝামাঝি আরএসএসের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় সারা ভারতে ৭৬,০০০।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৯ আগস্ট ভোরে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করে। কারারুদ্ধ হন কংগ্রেসের বহু প্রথম সারির নেতা। কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন ঘোষণা করা হয়। কারারুদ্ধ হন কংগ্রেস কর্মীরা। প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের হিন্দু-মুসলিম আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং। সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বেরিয়ে আসা, অফিস-আদালতে আগুন লাগানো, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ কেটে দেওয়া, থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি সব কর্মসূচি।
মেদিনীপুর জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয়ে ওঠে এক গণবিদ্রোহ। তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এর গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল ব্যাপক। মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন। ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত-শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচণ্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে ।
’৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যখন মাতঙ্গিনী হাজরা গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন, তমলুকে স্বাধীন সরকার গঠিত হচ্ছে, তখন বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আন্দোলনকে বলছেন ‘অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা’। তাঁর রাজনীতি ছিল এক দিকে মুসলিম-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক। পরবর্তী সময়ে যখন সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতে প্রবেশ করছে, দেশজুড়ে প্রবল উত্তেজনা, তখন শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য হিন্দু যুবকদের আহ্বান করছেন। ২৬ জুলাই, ১৯৪২-এ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন, ‘কংগ্রেস খুব শীঘ্রই যে ব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিতে চলেছে এই যুদ্ধের সময়, তা প্রতিরোধের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। যুদ্ধের জন্য হয়তো তা একটু সীমাবদ্ধ, কিন্তু জনসাধারণের ভোটেই তো আমরা মন্ত্রী হয়েছি। আমরা মন্ত্রীরা মানুষকে বোঝাব যে ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ভারতের জনসাধারণের স্বার্থেই আমাদের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে।’ শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ছিল নীতিগত বিরোধ। এমনকি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় কংগ্রেস সদস্যদের হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের সদস্য হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অন্য দিকে, শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু মানসিকতার ভিতরে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ও সেই চেতনাকে মুসলিম বিদ্বেষে পরিণত করা। এই বিদ্বেষকে তিনি রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের ক্ষতি করবে। ফলে শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তিনি বিরোধিতা করেন। সেটা এতই আপসহীন ছিল যে, শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘সুভাষচন্দ্র আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন, হিন্দু মহাসভা যদি বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন হিসবে মাথাচাড়া দিতে চায়, তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, তা হলে সেটাই করব।’
একদিকে যখন ইংরেজ-বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত শক্তির গণজোয়ার অন্যদিকে মুসলিম লিগ ক্ষমতায় আসায় মুসলমান আধিপত্যের আতঙ্ক ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে হিন্দুদের মধ্যে। ১৯৪১ সালের জনগণনায় অবিভক্ত বাঙলায় মুসলমান বাঙালির জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ আর হিন্দু বাঙালি ৪৪ ভাগ। মুসলমানেরা বাংলা গ্রাস করে ফেলছে, বাঙলার শিক্ষা-সস্কৃতি ইসলামীকরণ করা হচ্ছে, বাংলার কৃষ্টি নষ্ট হতে বসেছে ইত্যাদি অভিযোগে বাংলার হিন্দু সমাজ আলোড়িত। ‘বঙ্গীয় মধ্য শিক্ষা বিল’ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ অস্বাভাবিক রূপ নেয়। সাম্প্রদায়িক প্রচার ওঠে তুঙ্গে। ১৯৪১-এ ঢাকায় একটা দাঙ্গাও হয়ে যায়। ১৯৪৬-এর মার্চ মাসের নির্বাচনে শুধুমাত্র ‘পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়ে ১১৯টি মুসলিম আসনের ১১৪টা আসন পায় লিগ। বাঙালির পোশাকেও তখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। মুসলমানী পোশাকে ধুতি ছেড়ে কুর্তা পাজামার চল।
প্রসঙ্গত, ভারত-শাসন আইন প্রণয়নের পর থেকে ভারত-ভাগ আইন পর্যন্ত অবিভক্ত বাঙলায় চারটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। প্রথম মন্ত্রিসভা, ১ এপ্রিল ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। ফলে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি), মুসলিম লিগ, সংখালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং নিম্ন বর্ণের হিন্দু প্রতিনিধিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে, ফজলুল হক হন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ওই মন্ত্রিসভায় ফজলুল হক ছাড়া আরও দশজন মন্ত্রী ছিলেন এর মধ্যে ৫ জন হিন্দু এবং ৫ জন মুসলিম। পরবর্তীতে মুসলিম লিগের সাথে বিরোধ এবং কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যকার বিরোধে ২ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে ফজলুল হক প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং কৃষক প্রজা পার্টির সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) অংশ এবং কংগ্রেসের হিন্দু সদস্যদের নিয়ে আবার মন্ত্রিসভা গঠিত হয় যা ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা নামে খ্যাত। এই মন্ত্রিসভা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে ফজলুল হক আবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারপর ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লিগের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দিন অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় মন্ত্রিসভা মন্ত্রিসভা গঠন করেন। লিগ নেতৃত্বের মতবিরোধে ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে নাজিমুদ্দিন তার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে সুহরাওয়ারদি বাংলার চতুর্থ মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া পর্যন্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
সুহরাওয়ারদি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই ঘটে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০)। বাংলার প্রায় সাত লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হন। যাবতীয় সম্পত্তি - ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গয়নাগাটি, বাসন-কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। পরের বছরও তাই। এর কারণ ছিল কলেরা, বসন্ত-রোগ ও ম্যালেরিয়া মহামারির প্রার্দুভাব। প্রকৃত পক্ষে,বাঙলায় ১৭৭০ সালের পর সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ।
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘বিনিময় অধিকারদান’ (exchange entitlement)-এ দেখান ১৯৪৩ সালে বাংলায় তেমন বড় রকমের খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কারণ, জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে বিনিময় অধিকারদানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে, কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি এবং অ-কৃষিজীবী শ্রেণি যে মূল্যে তাদের জিনিসপত্র ও শ্রম বিক্রি করেছে তার চেয়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল। বস্তুত কলকাতায় ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিমণ মোটা চাল ৬ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছিল। সেই চালের দাম ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ প্রতিমণ ১৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ মে তা প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়ায়। সঙ্কট তীব্র হলে কোনো কোনো জেলায় প্রতিমণ চাল ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়।
ইংরেজ সরকার এই দুর্ভিক্ষের দায় যথারীতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার - (অক্টোবর মাসে উপকূলীয় জেলাসমূহে ৩২০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষেতের আমন ধানের বিপুল ক্ষতি, এছাড়া ২০, ২২ ও ২৪ ডিসেম্বর কলকাতায় জাপানি বিমান হানা, অসহযোগ আন্দোলনের ভারতব্যাপী বিস্তার ইত্যাদি) – অজুহাত দেয়। সাম্প্রতিক কালে মধুশ্রী মুখার্জি, তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে চার্চিলের বাংলা তথা ভারত বিদ্বেষী নির্মম আচরণ ও গৃহীত নীতিপদ্ধতি এই মন্বন্তরের প্রধান কারণ ছিল। বাঙালি শিখল নতুন সব শব্দ —পোড়ামাটি নীতি, ব্ল্যাকআউট, কালোবাজার, টমি, মা-ফ্যান-দ্যাও, দেশভাগ। ১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর চার্চিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘পোড়ামাটি নীতি’ অর্থাৎ যেসব অঞ্চল ইংরেজরা ছেড়ে চলে যাবে, তা নির্মমভাবে ধ্বংস করতে হবে। অবশ্য এই নীতির একটা ভদ্রস্থ নাম দেওয়া হয়েছিল—‘ডিনায়াল পলিসি’। জাপানিরা সাগরপথে উপকূলে এসে নামতে পারে—এই আশঙ্কায় কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে টানা লাইন টেনে উপকূলীয় এলাকার সব নৌকা ধ্বংস করা হ’ল। ফলে যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হ’ল, পাশের উদ্বৃত্ত জেলা থেকে ধান-চাল আনার কোনো উপায়ই আর রইল না। নৌকা কেড়ে নেওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল জেলে সম্প্রদায়। উপকূলীয় এলাকাগুলো থেকে চাল কেনার জন্য সরকার ২০ লাখ রুপি অগ্রিম দিল মির্জা আহমেদ ইস্পাহানিকে। ইস্পাহানি ছিলেন মুসলিম লিগের অন্যতম বড় আর্থিক যোগানদার ও ব্রিটিশদের বিশেষ তোষামোদকারী। যেহেতু সরকারের পক্ষে কাজ করছে, ফলে ইস্পাহানির ক্ষমতা ছিল কেউ তার দেওয়া দামে চাল বেচতে রাজি না হলে সে চাল জোর করে নেওয়ার। দুর্ভিক্ষের সে দিনগুলোতে মানুষ কচুঘেঁচু, পাতা-লতা এমনকি দূর্বাঘাস খেয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। ক্ষুধার্ত মানুষেরা সে সবও শেষ করে ফেলেছিল! রিলিফ কেন্দ্র থেকে দেওয়া খিচুড়ির পরিমাণও ক্রমেই কমে এসেছিল।
ফজলুল হক ১৯৪২ সালেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে’। কিন্তু চার্চিল বা ইংরেজ সরকারের সেসবে কান দেয়নি। অস্ট্রেলিয়ানরা চেয়েছিল ক্ষুধার্ত বাঙলার জন্য যতটা প্রয়োজন গম পাঠাতে। কানাডাও চেয়েছিল অন্তত একটা জাহাজভরা গম ভারতে পাঠাতে। কিন্তু চার্চিল এ কাজে কোনো জাহাজ দিতে রাজি হননি। অস্ট্রেলিয়া থেকে খাদ্যভরা জাহাজ শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পাঠানো হ’ল, কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার কোনো বন্দরে সে জাহাজ ভিড়ল না! সময়মতো অস্ট্রেলীয় বা কানাডার গম এলে প্রায় ২০ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত।
সে-সময় ক্ষুধায় উন্মাদ দরিদ্র এক কৃষক নিজের বাবা, মা, বউ ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ক্ষুধার্ত অসহায় বাবা, কোলের বাচ্চাটিকে যেমন করে হোক বিক্রি করতে চাইছেন। বিক্রি না করতে পেরে শিশুটিকে একটা কুয়ার মধ্যে ছুড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান! মৃত মায়ের স্তন থেকে দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে শীর্ণকায় শিশু—এ দৃশ্য কলকাতার রাজপথে প্রায়ই দেখা গেছে। কলকাতার ফুটপাতের মৃত্যু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিছু প্রচার পেলেও গ্রামের মৃত্যু নীরবে ঘটেছে এবং অন্ধকারেই রয়ে গেছে। শিয়াল-কুকুরেরা মৃতদেহ টেনে নিয়ে গেছে।
কোথায় গেল বাঙলার খাদ্যশস্য? উধাও হয়ে সব গেল কোথায়? বাংলা সরকার পাঁচ হাজার লাইসেন্স দিয়েছিল খাদ্য সংগ্রহের। ইস্পাহানি ছাড়াও লাইসেন্স পেয়েছিল কিছু ইংরেজ ব্যবসায়ী এবং মুসলিম লিগ সরকারের কাছের সব লোকজন। তারা খাদ্য মজুদ করেছিল, ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে চলছিল এবং অঢেল অর্থ পকেটে ভরছিল। সরকারি অফিসাররাও কম দায়ী ছিলেন না। যেমন যশোর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল কিনে রেলওয়ে প্লাটফর্মে রেখে দিয়েছিলেন। চরম দুর্ভিক্ষের দিনেও সে চাল বাইরে যেতে দেননি। তেমনি ৯০ হাজার টন চাল কলকাতার কাছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে মজুত করে রাখা ছিল। সেসব চাল পরে পচে যায়।
চার্চিলের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই প্রভাবিত ছিল ডারউইনের প্রতিযোগিতাবাদ ও ম্যালথাসের জীবন-মৃত্যুর অনিবার্যতার তত্ত্বে। দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু চার্চিলের বিবেককে নাড়া দেয়নি। ওয়ার ক্যাবিনেটের যে কোনো সভায় বাংলার দুর্ভিক্ষ বা ভারত প্রসঙ্গ এলেই চার্চিল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। এ ক্ষিপ্ততার একাধিক কারণ ছিল। ইতিহাসের দেয়াললিখন তত দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সিংহের থাবা থেকে বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া বাঙালিদের প্রতি চার্চিলের বিদ্বেষ ছিল। বাঙালিরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে। দরিদ্র, অযোগ্য বাঙালি তো মরবেই! আর তা ছাড়া যুদ্ধের কারণে ভারতের কাছে সৃষ্ট ব্রিটেনের বিশাল অঙ্কের ‘স্টার্লিং ঋণ’ শোধ করার দায়টা চার্চিল সহ্যই করতে পারতেন না। আর সে ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছিল! ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের যখন প্রায় শেষ পর্যায়, তখনো খাদ্য চেয়ে ওয়াভেলের টেলিগ্রামের কোনো জবাব দিলেন না চার্চিল; বরং এক টেলিগ্রামে জানতে চাইলেন, ‘গান্ধী এখনো মরছে না কেন!’ চার্চিল বিশ্বাস করতেন এবং বক্তৃতাতেও বলতেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যুগটাই ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ হয়ে থাকবে। কার স্বর্ণযুগ? অবশ্যই ভারতবর্ষবাসীর জন্য নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। স্বর্ণযুগই বটে!
এগার
বাঙলায় সুহরাওয়ারদি সরকারের সময়কালেই, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ও তার পরের দিনগুলোয় ঘটে যায় কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব, কংগ্রেস (নেহরু) যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছিল, সেই ব্যাখ্যায় মুসলিম লিগ (জিন্না) মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপক স্বার্থহানির আশঙ্কায় ওইদিন Direct Action-এর ডাক দেয়। কলকাতায় বাংলার মুসলিম লিগ নেতারা মনুমেন্টের পাদদেশে বিরাট মিটিং-এর আয়োজন করে। মুসলমান ছাড়াও অন্য সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীদেরও সেই জমায়েতে সামিল করার চেষ্টা হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা এই কর্মসূচিকে তাঁদের বিরুদ্ধে বলে মনে করে। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়৷ জাতীয় রাজনীতির আবর্তেই সংঘাতের বীজ উপ্ত ছিল৷ ঘটে যায় দাঙ্গাও। দাঙ্গা দমনে প্রশাসনের ব্যর্থতা (অনীহা!) বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। জেলায় জেলায় এই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নোয়াখালিতে অক্টোবর মাসে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷
তলে তলে জমে ওঠা হিংসা দ্বেষ একটা বিরাট বিস্ফোরণ হয়ে ফেটে পড়েছিল ছেচল্লিশের ১৬ আগস্ট। অমানুষিক নৃশংসতার এক ধারাবাহিক অভিযান। লাশ কঁাধে লোক চলে গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে। ১৯৪৬’র কলকাতাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় খুন হয়েছিলেন ১০,০০০ মানুষ। অথচ এই ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই রশিদ আলি দিবসে হিন্দু-মুসলমান ছাত্র-যুবকদের কলকাতায় বিশাল মিছিল বের হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহের সমর্থনে জাহাজীরা ধর্মঘট করেছিলেন। ২৯ জুলাই ভারতব্যাপী ডাক ও তার সাধারণ ধর্মঘটে কলকাতায় অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছিল। যোগ দিয়েছিল হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ১৬ লক্ষ কারখানা-শ্রমিক, অফিস-কর্মচারি, ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক। সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে পরের দিন ৩০ জুলাই কোন দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি।
দাঙ্গার জন্যে লিগ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন মৌলানা আজাদ। পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার সমালোচনা করেন ফজলুল হকও। ছাত্রনেতা আনিসুজ্জমানের কথায়, ‘আমরা দেখিয়াছি ময়দানের সভায় যাইবার জন্য মিছিলকারী ও লিগওয়ালারা ছোরা ও লাঠিসহ সশস্ত্র হইয়া অবলীলাক্রমে রাস্তায় উভয় পার্শ্বস্থ দোকানসমূহ হিন্দুর দোকানসমূহ লুণ্ঠন করিতে করিতে যাইতেছে। আমরা আরও দেখিয়াছি,সশস্ত্র পুলিশ ইহা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছে আর মনের আনন্দে হাসিয়াছে’। বাঙলার প্রধানমন্ত্রী তখন সুহরাওয়ারদি। নির্বিচার হত্যা লুণ্ঠন ও গৃহদাহ চলতে থাকার সময়ও কোন ব্যবস্থা তিনি নেননি, যদিও সেই ১৬ তারিখের অনেকটা সময়ই তিনি নিজে লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত ছিলেন। মিলিটারি নামে ১৭ তারিখ রাতে কলকাতা তখন রণক্ষেত্র।
বাঙলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যে আজও স্বাভাবিক হতে পারল না, তার একটি প্রধান কারণ এই পর্বের দাঙ্গা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দাঙ্গার রূপ যারা দেখেছেন, ভুলতে পারেন না তঁারা সেই বিভীষিকার কথা, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস। প্রবঞ্চনার বোধ, হিংসার উগ্র প্রকাশ – সহজে মুছে যাওয়ার নয় সেই সব স্মৃতি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার কিংবা নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য দেখা গিয়েছিল, কলকাতা-নোয়াখালি-বিহার-এর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এক লহমায় তাকে নষ্ট করে দিল। চতুর ইংরেজের বিভাজন নীতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান-হিন্দু দুই রাজনৈতিক পক্ষও এর জন্যে সমান ভাবে দায়ী। দাঙ্গার ভাগাভাগি আর উন্মত্ততায় হিন্দু-মুসলমান হারিয়েছিল ‘পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ও দায়বোধ’৷ দাঙ্গা অসাম্প্রদায়িক মানুষকেও কিছু সময়ের জন্যে হলেও সাম্প্রদায়িক করে তুলেছিল৷ আর দাঙ্গার ফলে কলকাতার পাড়াভাগের মধ্যে দিয়ে আভাস পাওয়া গেল ‘বাংলাভাগের ভবিষ্যৎ ছবি’৷
রবীন্দ্রনাথ একদা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে৷ আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই।’ সেই অমোঘ সত্যকথন আজও ভারতকে তাড়া করে চলেছে৷
(পরের অংশ পরবর্তী সংখ্যায়)
যেসব বই, পত্র-পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়েছেঃ
সুকুমার সেন : বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)
দীনেশচন্দ্র সেন : মৈমনসিংহ-গীতিকা
Shashi Tharoor : An Era of Darkness এর The Myth of Enlightened Despotism
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় : ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা
Madhusree Mukherjee : The British Empire and the Ravaging of India during World War II (2010)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ : প্রথম আলো১১ আগস্ট ২০১৭
অবভাষ, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৪
http://roar.media/bangla/main/history/partition-of-bengal-the-background-story
রুবায়েত আমিন : যেভাবে ইংরেজরা খুবলে খেয়েছিল উপমহাদেশ ও বাংলার অর্থনীতি (https://roar.media/bangla/ main/history/how-the-british-destroyed-the-economy-of-the-subcontinent-and-bengal)