সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে যে তিন জন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওড়িয়া লেখকের হাতে অাধুনিক ওড়িয়া সাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, তাঁরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অনুজপ্রতিম সমসাময়িক। তাঁদের মধ্যে সব চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, কবি ও ঔপন্যাসিক ফকিরমোহন সেনাপতি জন্ম লাভ করেছিলেন ১৮৪৩-এ (মৃত্যু ১৯১৮-য়), কবি রাধানাথ রায় জন্মান ১৮৪৮-এ (মৃত্যু ১৯০৮-এ), অার প্রাবন্ধিক ও কবি, তিনজনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, মধুসূদন রাও জন্মান ১৮৫৩-য় (মৃত্যু ১৯১২)। এই তিন জনের মধ্যে ফকিরমোহনের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে কটকের বাইরে। কটকই তখন ছিল ওড়িশার প্রশাসনিক সদর দপ্তর। ফকিরমোহন দেশীয় সামন্ত রাজ্যগুলিতে একজন প্রশাসক হিসেবে কাজ করার পর অধিক বয়েসে কটকে পাকাপাকি ভাবে বাস করার জন্য ফিরে আসেন। কিন্তু অন্য দুজন জীবনের অধিক সময়ই কটকে কাটান এবং শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবিভাগীয় প্রশাসক হিসেবে নিজেদের আলাদা করে চিনিয়ে দেবার মতো কাজ করেন। বাস্তবিক পক্ষে, সে সময় ওড়িশায় শিক্ষার শক্তপোক্ত ইমারতটি তাঁরাই গড়ে দেন। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে পুরীতে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়-সূত্রে বাধা হন, যেখানে মধুসূদন ছিলেন একজন ছাত্র ও রাধানাথ সদ্য যোগদান করেছেন এক শিক্ষক হিসেবে। এই যোগাযোগের ফল প্রথম পাওয়া গেল ১৮৭৬-এ। দুই জনের কবিতা সংকলিত করে কবিতাবলি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। বস্তুত, ১৮৭৬ ছিল একটি জলবিভাজিকার মতো, যা নতুন সৃষ্টিশীল একটি প্রাণসত্তাকে সূচিত করে এবং নতুন নতুন মৌলিক কাজ প্রকাশিত হতে শুরু করে। নতুন একট প্রজন্ম এসেছিল। সৃষ্টির উন্মাদনায় ভরপূর। যেটির লালন হয়েছিল সাধারণ ভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারা ও আরো নির্দিষ্ট করে সমসময়ের বাংলা সাহিত্য এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্কার-আন্দোলন মারফত। এরকমই হবার কথা ছিল যেহেতু রাজনৈতিক ভাবে ওড়িশা, অথবা উত্তরের উপকূলবর্তী জেলাগুলো, যা নিয়ে তখনকার ওড়িশা বিভাগ, তার প্রশাসনিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত একটি অংশই ছিল। এ কারণেই তৎকালীন ওড়িয়া এলিট ভীষণ ভাবেই বাংলার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং বহু বিষয়েই তাঁদের পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান ছিল ততটাই উত্তেজক যতটা উদ্দেশ্যসাধক।
১৮৭৬ সালের মধ্যেই বাংলায় ও বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর এক অসামান্য পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি সাহিত্যে স্বতই আগ্রহান্বিত ছিলেন না অথবা সাহিত্য সাহিত্যের জন্য এই মতেরও অনুবর্তী ছিলেন না। তিনি আগ্রহী ছিলেন এটিকে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কার্যোপযোগিতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে এবং উৎয় ক্ষেত্রেই ইতিমধ্যেই তিনি অবিস্মরণীয় ভাবে নিজের লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। তাঁর উজ্জ্বল, অগ্নিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব অনেকের কাছেই আর্দশ ছিল এবং বিশেষ করে রাধানাথ ও মধুসূদনের কাছে তিনি ছিলেন সন্দেহাতীতে ভাবে এক অনুপ্রেরণা। তাঁর মৃত্যুর পর মধুসূদন অত্যুচ্চ সম্মানের ভাষায় লিখে ছিলেন :
‘‘সাধারণ লোকে মনে করে যে লোকের প্রভূত সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি, ভৃত্যসম্প্রদায় রয়েছে সে-ই প্রকৃত ধনী। কিন্তু প্রকৃত ধনাঢ্য মানুষ তিনি যিনি তাঁর জ্ঞান, চরিত্র ও নৈতিক গুণ মারফত পৃথিবীর উপকার সাধন করেন। এমনকী যদি তাঁর অর্থ বাড়ি-গাড়ি নাও থাকে এবং চূড়ান্ত দরিদ্র হলেও তিনি প্রকৃত ধনাঢ্যই থাকেন। তিনি পৃথিবীর নিকটে একটি অলংকার বিশেষ এবং এমনকী একটি মানবসত্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ঈশ্বরের মতোই সম্মান জানাতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমনই একজন ধনাঢ্য পুরুষ।’’
[ওড়িয়া থেকে ইংরিজিতে অনূদিত, ইংরিজি থেকে বাংলায়]
ওড়িয়া সাহিত্যে প্রথম বিদ্যাসাগরের প্রভাব পড়তে শুরু করে তাঁর বইগুলির ওড়িয়া অনুবাদ মারফত। ওড়িশা প্রথম ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে ১৮০৩ সালে এবং ব্রিটিশ শাসনতন্ত্র ওড়িশায় গুছিয়ে বসতে আরো প্রায় ৫০ বছর সময় নেয়। মিশনারিরা কটকে প্রথম আসে ১৮২২ সালে এবং ওড়িশায় তারা ছাপাখানা স্থাপন করে ১৮৩৭ সালে। এটিই ওড়িশায় সর্বপ্রথম ছাপাখানা। প্রায় ১৮৫০ অবধি সেখানে যা কিছু ওড়িয়া বই ছাপা হত, তার অধিকাংশটাই খৃষ্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৮৫০-এর পরেই, যখন কোম্পানি শাসনকর্তারা শিক্ষাবৃদ্ধির দিকে কিছু নজর দিলেন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের নির্দেশ দিলেন, তখনই কেবল শিক্ষার উদ্দেশ্যে বই ছাপা হতে লাগল। যেগুলো বিশুদ্ধ ধর্মসংক্রান্ত ছিল না। এইভাবে আমাদের হাতে আসতে লাগল নতুন নতুন সব বই-ব্যকরণ, পাটিগণিত, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি। এগুলির সঙ্গে সঙ্গে বরোতে লাগল প্রাচীন ওড়িয়া পাঠ্যগুলি— তালপাতার পুথি থেকে সংগৃহীত প্রাচীন ওড়িয়া কবিদের কাব্যসম্ভার। এই প্রকাশিত নতুন বইগুলির বেশির ভাগটাই ছিল বাংলা ও ইংরিজি উৎস-গ্রন্থের অনুবাদ। এই ব্যবস্থা ৩০ বছর ধরে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে পৌঁছোই, যখন নতুন মৌলিক গ্রন্থ লেখা ও ছাপা হতে শুরু করল এবং রাধানাথ, মধুসূদন ও ফকিরমোহনের মতো লেখকেরা ওড়িয়া সাহিত্যাঙ্গনকে তাঁদের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে এলেন।
খুবই আকর্ষনীয় ব্যাপারটা যে বিদ্যাসাগরের বইয়ের সর্বপ্রথম অনুবাদ করেছিলেন ফকিরমোহন সেনাপতি এবং এইটে কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। বইটা ছিল জীবনচরিত (১৮৪৯) এবং বইটা নিজেই ছিল রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স-এর (Robert & William Chambers) আর্দশস্থানীয় জীবনী-র (Exessplany Biography)-র অনুবাদ। ফকিরমোহনের অনুবাদ প্রকাশ হয় ১৮৬৬ সালে এবং ওড়িয়া ভাষায় এই ধারার বই হিসেবে এইটেই ছিল প্রথম। এই সনেই বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা (১৮৫৪), যেটি ছিল এই নামেরই কালিদাস-এর বিখ্যাত নাটকের গদ্যানুবাদ, সেইটে ওড়িয়া ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে শকুন্তলা উপাখ্যান নামে। এটির অনুবাদ কাজ করেন বনমালী সিংহ। পরে পরে বিদ্যাসাগরের অন্যান্য বইগুিল, যেমন বোধোদয় (১৮৬১) অনুবাদ করেন বিদ্দন্দ পট্টনায়ক (১৮৬৮), সংস্কৃত ব্যকরণের উপক্রমনিকা (১৮৫১) অনুবাদ করেন গোবিন্দ চন্দ্র পট্টানায়ক (১৮৬৮), সীতার বনবাস (১৮৬০) তর্জমা করেন বিদ্দন্দ পট্টনায়ক (১৮৬৯) ব্যকরণ কৌমুদী (১৮৫২-৬২) করেন গোবিন্দ চন্দ্র পট্টনায়ক (১৮৭০) এবং আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩) কেরোয় চন্দ্রনাথ রায়ের অনুবাদে (১৮৭২)। এই সব ঘটনা প্রমাণ করে সামগ্রিক ভাবে ওড়িয়া ভাষায় বিদ্যাসাগরের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণীয়তা। বইগুলি, বিশেষ করে সংস্কৃত ব্যকরণের ওপর লেখা বইগুলি নিঃসন্দেহেই বিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু অন্য বইগুলি— বিশেষ করে জীবনী গ্রন্থগুলি, কথাকহিনিগুলি এবং সীতা ও শকুন্তলার উপাখ্যান আদতে ছিল সাহিত্যকর্ম। সেগুলি পৌঁছেছিল উনিশ শতকের শেষ পর্বের ইংরিজি-শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের নতুন আস্বাদন-স্পৃহার পড়ুয়া সমাজের কাছে। কিছু কিছু অনুবাদ-এর একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে। এইভাবে বোধোদয়-এর ১৮৭৬ নাগাদ তিনটি সংস্করণ করিয়েছে, এবং আখ্যানমঞ্জরী-র ১৮৭৭ এই দুই সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। এছাড়া দুটি বই, বোধোদয় ও সীতার বনবাস-এর দুটি আলাদা অনুবাদ বেরিয়েছে দুজন পৃথক ব্যক্তির দ্বারা।
১৮৬৬-র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল একটি চুল-খাড়া-করা অভিজ্ঞতা যার কবলে পড়ে ওড়িশার বিশ লক্ষ মানুষ মারা যান। ওড়িশার সমাজজীবনে এই দুর্ভিক্ষের ফল ছিল অতি বিস্ময়কর। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ এমন কতগুলি পরিবর্তন আনে যেগুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই ওড়িশার প্রশাসনিক বন্দোবস্তে একটি বড়ো নাড়াচাড়া পড়ে। তখনকার ভারতের সেক্রেটারি স্যার স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট বাংলার থেকে ওড়িশাকে আলাদা করার একটি প্রস্তাব আনেন। তার সঙ্গে সঙ্গেই ওড়িশার শিক্ষানীতিতে অামূল পরিবর্তন আনা হয়। আরো অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, সঙ্গে সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয়ও। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৮, এই এগারো বছরের মধ্যে ওড়িশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৯৪ থেকে করে হয় ৪৫৭৯; কটকের মহাবিদ্যালয়কে উন্নীত করা হয়। ওড়িয়া বিদ্যালয়-শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং বিচারালয়ের রাজভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। তারপর অন্য একটি ক্ষেত্রেও নতুন কাজ শুরু হয়। সর্বপ্রথম ওড়িয়া ছাপাখানা, যেটি প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ওড়িয়া উদ্যোপতিরা সেইটে ১৮৬৬-৭৭ সালে কটক প্রিন্টিং কোম্পানি এ্যান্ড প্রেস নামে আত্মপ্রজন্ম করে। সর্বপ্রথম ওড়িয়া সাপ্তাহিক, উৎকল দীপিকা বেরনোর ক্ষেত্রে এই ছাপাখানার ভূমিকা অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। গৌরীশঙ্কর রায় (১৮৩৮-১৯১৭) নামে একজন অত্যন্য সাহসী ও নিবিষ্ট মানুষ এটির সম্পাদনা করতেন। ওড়িশা ও ওড়িয়াদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মর্যাদার জন্য তিনি অতি সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। এই সমস্ত কিছু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকটায় ওড়িশায় মানসক্ষেত্রে যে জাগরণ ঘটছিল সেদিকে নিয়ে যায় ও তাকে প্রতিফলিত করে। একটি নতুন উপলব্ধির সৃষ্টি হয় ওড়িয়া মানুষদের মধ্যে যে ওড়িশার নিজস্ব একটি সত্তা-পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে এবং সেটি বাংলার বা অন্য কোনো প্রদেশের লাঙ্গুলসম নয়। দ্বিতীয়ত, এটির খুব উচ্চ মানের একটি অতীত রয়েছে, বহু ব্যাপারেই যেটি প্রায় তুলনাহীন এবং তার একটি মহান উত্তরাধিকার আছে। এর ফল সহজেই অনুমেয়। তার মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বাসনা জাগল। এই ভাবে নতুন এক সাহিত্যের উদ্ভব ঘটল। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ অনুৎসাহিত হল। বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছেদ ঘটল সাধারণ ভাবে এবং নির্দিষ্ট করে বিদ্যাসাগর থেকে। ১৮৭৭-এর পর বিদ্যাসাগরের অনুবাদ বন্ধ হয়ে গেল, খুব সম্ভব, বিদ্যাসাগর-অনুবাদের শেষ নথি পাওয়া যায় ১৮৯১ সালে, যে বছরে তাঁর মৃত্যু হয়, যখন সীতানাথ রায় তাঁর বোধোদয় অনুবাদ করেন।
বাস্তবিক পক্ষে তারপর যা ঘটল সেইটে খুব শক্তিশালী এক প্রভাতের আকর্ষণীয় উদাহরণ। যেন বিদ্যাসাগরের প্রভাব আবহাওয়াকে পরিব্যাপ্ত করে দিল এবং তাঁর লিখনের বিষয় ও শৈলী অনেকের কাছেই আর্দশস্থানীয় হয়ে দাঁড়াল। এইটে বিশেষ ভাবে শতাব্দীর বাঁকের মুখে যে ত্রয়ী মহান লেখক আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন মধুসূদন রাওয়ের বিষয়ে খুব বেশি করে সত্যি। বিভিন্ন বিভাগে— যেমন কাব্যে, গদ্যে, শিশু সাহিত্যে, এমনকী অনুবাদেও সহজেই প্রতীয়মান হত যে মধুসূদনের দূর-অনুপ্রেরণা ছিলেন বিদ্যাসাগর। একটি সঠিক উদাহরণ হলো ভবভূতির উত্তররাম চরিতম মারফত যোগােযাগ। বিদ্যাসাগর তাঁর সীতার বনবাস রচনা করেন অংশত ভবভূতির গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে, অন্তত নিজে তিনি তাই বলছেন। তাঁর প্রথম দুই অধ্যায় বেশির ভাগটাই নির্ভর করে ভবভূতির নাট্যের প্রথম অঙ্কের ওপর এবং অবশিষ্টাংশ রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ওপর। কিন্তু বিদ্যাসাগরের রচনা কখনোই মূলের শুধু একটি অনুকরণ ছিল না। তিনি বহু খুঁটিনাটিরই পুনর্বিন্যাস করেছেন এবং সংযোগও করেছেন অনেক খুঁটিনাটি, আর সেটা এমন ভাবে যে তাঁর রচনা একটি বিরাট পুনঃসৃজনই হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক শৈলীতে যার সাথে উত্তররামচরিতম বা রামায়ণের কোনো সম্পর্কই নেই। মধুসূদনের দুটি রচনা আছে এ বিষয়ের ওপর। তার একটি সীতা বনবাস, ১২২ লাইনের একটি কবিতা যেটি ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতাবলিরই একটি অংশ হিসেবে সন্নিবিষ্ট। দ্বিতীয়টি হলো ভবভূতির নাটকের অনুবাদ, গদ্য ও পদ্যে মিলিয়ে করা। এটি ১৮৮৫ থেকে ১৯০৭ এর মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করে।
তাঁর অনুবাদে মধুসূদন খুব বড়ো অংশেই মূলানুস ছিলেন, কিন্তু নিজের কবিতায় তিনি বিদ্যাসাগরের ওপর ভরসা করেছিলেন কবিতাটি শুরু হচ্ছে সেই জায়গায় যেখানে লক্ষণ সীতাকে গভীর বনে ভাগীরথীর তীরে ছেড়ে দিয়ে এসে ঘরে ফিরছেন আর শেষ হচ্ছে যখন মহর্ষি বাল্মীকি সীতাকে তাঁর তপোবনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যাসাগরে এই অংশ দু পৃষ্ঠার শেষ হয় বা বলা যায় গদ্যানুবাদের ৫৫ লাইনে। বর্ণনা প্রধানত ঘটনাধর্মী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন। বিবরণ অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবে পরিস্থিতিকে বিবৃত করছে, বনে সীতার শোচনীয় অসহায় অবস্থা দিয়ে শুরু করে, তপোবনের আশ্রমিক শিশুদের কাছে এই সংবাদ পেয়ে মহর্ষির নিজে তাঁকে নিয়ে যাবার মধ্যে দিয়ে। মধুসূদন ঘটনাক্রমকে অনুসরণ করেছেন এবং ঘটনার খুঁটিনাটির প্রতিও সন্নিষ্ঠ থেকেছেন। কিন্তু তিনি আরো যা করেছেন, সাধারণ ভাবে সীতার শোকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে এক উজ্জীবিত কাব্যাংশকে এনেছেন আর তাঁর কাব্যিক স্পর্শে সম্পূর্ণতই খুবই ঘন এবং দুঃখের, অশ্রুর আবহ সৃষ্যি করেছেন। দুটি রচনাকে মিলিয়ে পড়া খুবই উত্তেজক, বিদ্যাসাগরের ও মধুসূদনের। উভয়েই নিজের নিজের গুণে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং উভয়েই চমৎকার ভাবে যা করতে চায় সেইটে করেছে। কিন্তু মধুসূদনের রচনা হয়তো সম্ভবপরই হত না বিদ্যাসাগরের সোনালি স্পর্শের সাহায্য ছাড়া।
তাঁদের দুজনের এই তুলনা আরো দুটি রচনা প্রসঙ্গে করা যেতে পারে — বিদ্যাসাগরের একটি গদ্য আখ্যান, রামের রাজ্যাভিষেক ও মধুসূদনের একটি কবিতা, শ্রীরাম বনবাস-এর মধ্যে। বিদ্যাসাগরের রচনাটি অসম্পূর্ণ। এটি শুরু হচ্ছে দশরথের রামকে রাজা হিসেবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশে, মন্ত্রনায় এবং পরিশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাকে উচ্ছলিত স্বাগত জানাচ্ছে অযোধ্যাবাসীরা। মধুসূদন শুরু করেন যেখানে বিদ্যাসাগর শেষ করছেন। দশরথের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষ উচ্ছ্বসিত আনন্দে স্বাগত জানায়। কিন্তু সহসাই মেঘ ঘনায় আকাশে, ভোরের সূর্য উদিত হবার আগেই ঢাকা পড়ে যায় এবং গোটা নগরী গভীর দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে রামের বিদায়গ্রহণে এবং বল্কল পরিহিত হয়ে স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে অযোধ্যা ছেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যাসাগরের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, মধুসূদনের ১৮৯৩-এ। আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় বিষয়ের নিরবচ্ছিন্নতায় যেটি উভয়ে এত স্পষ্ট, যদিও আঙ্গিকে ও কৌশলে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিদ্যাসাগরের রচনার শেষ অনুচ্ছেদ আর মধুসূদনের কবিতার প্রথম চার স্তবক পরস্পর সংলগ্ন, যেখানে তাঁরা উভয়েই বিবৃত করছেন প্রায় অভিন্ন উপায়ে, অযোধ্যায় সুখ ও উৎসবের পরিমণ্ডল।
অারো কিছু জায়গাও রয়েছে যেখানে এই সম্পর্ক-সূত্র অাঁচ করা যেতে পারে এবং সেইটের খোঁজ খুবই চিত্তাকর্ষক হয়। বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন উভয়েই ছিলেন দায়বদ্ধ মানুষ। আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে সাধারণ ভাবে দায়বদ্ধ। উভয়েই খুব ভালো করে জানতেন একটি মানুষের চরিত্রের ভিত তৈরি হয় খুব কম বয়েসে এবং এইটে ভালোতর করার ব্যাপারে গোড়ার দিকের বিদ্যায়তনিক পুস্তকগুলির মতো কার্যকরী আর কিছুই হয় না। যদি সেগুলি পরিকল্পনা মাফিক হয় এবং সেগুলিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো যায়। বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত প্রাথমিক পাট্যপুস্তক বর্ণপরিচয় (দুই ভাগ, ১৮৫৭-য় প্রকাশিত)-এর অনেক গুণ রয়েছে। যেমন এর চমৎকার গড়ন, সমান চমৎকার পাঠ-বিভাজন, বিষয় নির্বাচন এবং এক অতুলনীয় শৈলী যেটি একাধারে কথা ও অন্য ধারে নির্ভুল ও শৃঙ্খলাবদ্ধ (শকুন্তলা বা ভ্রান্তিবিলাস-এর শৈলীর থেকে একেবারেই আলাদা)। কিন্তু এর সর্বাধিক স্পষ্ট গুণটি হলো সম্ভবত যে পদ্ধতিতে পাঠগুলিকে সাজানো হয়েছে। একটি মাত্র বাস্তব লক্ষ্যকে নজরে রেখে— যেটি হলো কীভাবে কমবয়েসীদের চরিত্র গঠন করা যাবে। সেখানে সোজাসুজি উপদেশ রয়েছে— যেমন, ‘সদা সত্য বলিবে’, কখন পিতামাতার অবাধ্য হইল না, ‘কাহাকেও গালি দিও না’, ইত্যাদি। তারপর দ্বিতীয়ত এসেছে প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে দিয়ে সঠিক অভ্যাস গঠনের পাঠ, যেমন প্রথম ভাগের চতুর্দশ পাঠ— ‘আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি। কাপড় পরিয়া পড়িতে বসি।’ তারপর একেবারেই অন্যভাবে দ্বিতীয় ভাগ-এর ৪,৫,৬ ও ৭ পাঠে তিনি দেখাচ্ছেন অভ্যাস, আচরণ, চরিত্রের কোন অংশগুলি উন্নীত করতে হবে অন্যগুলির বদলে— সেগুলিও আদর্শ অভ্যাস সন্দেহ নেই, কিন্তু সেগুলি অনুশীলন করলে একটি বালক পুরোদস্তুর মানুষ হয়ে পড়ে। এই সব গুণগুলি মধুসূদন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তিনি তিনটি প্রাথমিক পুস্তক রচনা করেন, শিশুবোধ, বর্ণবোধ ও কালবোধ— যেগুলি এক সঙ্গে বর্ণবোধ (১৮৯৫) নামে প্রকাশিত হয়, যেটি ওড়িয়া ভাষায় সব চেয়ে বিখ্যাত প্রাথমিক পুস্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে; এবং এটি প্রারম্ভিক শিশুশিক্ষা পাঠক্রমকে প্রায় স্বাধীনতাকাল পর্যন্ত শাসন করে। এই পুস্তকটি বিদ্যাসাগরের আদর্শে প্রণীত— এটির গাঠনিক সৌকর্ষে ও কথ্য ভাষার শৃঙ্খলাবদ্ধ শৈলীতে। যদিও এটির মধ্যে এমন এক কাব্যিক উৎকর্ষতা আছে যেটি বিদ্যাসাগরে খুব একটা উপস্থিত নয়। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই মধুসূদনের ক্ষেত্রেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্ররা যুগ যুগ ধরে এই প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বাঁচতে শিখেছে, ভাষাগত ভাবে, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এবং নৈতিক ভাবে।
তাঁদের উভয়েরই শিশুদের অভ্যাস, আচরণ ও চরিত্রগঠনে আন্তরিক ভাবে যুক্ত থাকার মাত্রার ব্যাপ্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। বিদ্যাসাগরের নীতিবোধ ১৮৫১ সালে প্রকাশ পায়। এটি আকারে ছোটো এবং বিদ্যাসাগরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এটি রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স-এর Moral Class Book (নীতি শিক্ষার পাঠ)-এর ওপর ভিত্তি করে রচিত। গদ্যে নীতিশিক্ষা রয়েছে এতে। যেমন ১) কীভাবে প্রাণিদের দেখা উচিৎ, ২) কীভাবে পরিবারের সবার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিৎ, ৩) কঠিন শ্রম, ৪) নিজস্ব চিন্তা ও আত্মনির্ভরতা, ৫) বিনয়নম্রতা ইত্যাদি। তিনি নিম্নলিখিত ভাবে সম্মান নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন কীভাবে কারুর তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি ব্যবহার করা উচিৎ : ‘‘আমাদিগের পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী প্রভৃতি পরিবারবর্গের প্রতি সদা সদয় ও অনুকূল হওয়া উচিত। দেখ, যখন আমরা নিতান্ত শিশু ও একান্ত নিরুপায় ছিলাম, পিতা মাতা অামাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া মানুষ করিয়াছেন এবং আমাদিগের নিমিত্ত কত যত্ন, কত পরিশ্রম ও কতই বা কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। ফলতঃ তৎকালে তাঁহাদের তাদৃশী অনুকম্পা ও তাদৃশ স্নেহ না থাকিলে, আমরা কোন্ কালে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইতাম।’’ মধুসূদনের নীতিরত্নমালা দৃষ্টান্তমালা ও মনিমালা, একসঙ্গে ২১৩ লাইনের কবিতা, অন্তর্বস্তুর দিক থেকে বিদ্যাসাগরের নিকটবর্তী। উদ্দেশ্য একই উৎয়ের— সদাচরণ, সদ্ব্যবহার ও বলিষ্ঠ নৈতিক গুণাবলীকে উন্নীত করা।
মধুসূদন রাওয়ের বর্ণবোধ বা ওড়িয়া প্রাথমিক পুস্তকটির ওপর বিদ্যাসাগরের প্রভাব পরোক্ষ, কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যকরণ, ব্যকরণ কৌমুদী, ওড়িশার বিদ্যালয়গুলিতে একটি কালোত্তীর্ণ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে বহু বহু বছর ধরে। তদুপরি, যে ওড়িয়া ব্যকরণ বইগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় লেখা হচ্ছিল সেগুলি ভীষন ভাবেই বিদ্যাসাগরের আদর্শে প্রণীত। এই প্রবণতা স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত চলে, এবং সেটা এতটাই যে এমনকী আজও যে জনপ্রিয় ব্যকরণ বইগুলি লেখা হয়, যেমন একটির নাম করা যায়, সর্বসার ব্যকরণ অভ্রান্তভাবে দেখিয়ে দেয় বিদ্যাসাগরের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রটিকে। ওড়িয়া সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের প্রভাব সব সময়েই খুবই শক্তিশালী। এমনকী সেই সময়েও, যখন ওড়িয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ওড়িশার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক টানা বাঙালির নাক গলানোর ব্যাপারে খুবই সমালোচনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। এইটে বিশেষ ভাবে ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পঁচিশ বছরের মধ্যে যখন এক শ্রেণির বাঙালিরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ওড়িয়া ভাষাকে উচ্ছেদ/বাতিল করার জন্য। বিদ্যাসাগর খুবই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীয় ছিলেন। এজন্যই মধুসূদন রাও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁকে আদর্শ মানুষ হিসেবে দেখিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে যেটিকে তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিয়েছিলেন। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের কাছেও (রাধানাথ রায়কে ধরে) বিদ্যাসাগরের গদ্য-শৈলী ছিল আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য। ওড়িয়া সাহিত্যের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও ফলন্ত হয়েছে এবং সময়-প্রেক্ষিত বিচার করলে, বিশেষ করে মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সামগ্রিক ভাবে সাহিত্য ও শিক্ষার ওপর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।