সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
শহরের প্রাচুর্য এবং অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে কৃিষ নির্ভর বেেঁচ থাকবার লড়াইয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখন অবধি পাঁচ বছর কেটে গেছে অবর্ণা মুখাইয়ার। এই পাঁচ বছরে তাকে অনেক অনভ্যস্ত সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতি বছরই নতুনতর সমস্যা হাজির হয়েছে। ২০১৮ সালের বন্যায় সমস্ত আবাদ এবং বাসস্থান নষ্ট হবার পর আগের অবস্থায় ফিরতে তাদের আঠেরো মাস টানা পরিশ্রম করতে হয়েছে। সবে শ্বাস ফেলতে না ফেলতে সকলকে বিমূঢ় করে হাজির হয়েছে কোভিড-১৯। এক অচেনা সমস্যা অনিশ্চিত অভিঘাত নিয়ে হাজির। এই অনিশ্চয়তা শুধু অবর্ণা বা তার সঙ্গীদের নয় সারা পৃথিবীকেই এর মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
সারা পৃথিবী এখন এক অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। সেই সঙ্কটের গভীরতা বা প্রতিকারের উপায়, পদ্ধতি নিয়ে সব দেশ যে একমত তাও নয়। এক আলো ঢেকে দেওয়া অন্ধকারের মত অজানা আতঙ্ক যেন সবাইকে পঙ্গু করে ফেলার চেষ্টা করছে। আতঙ্ক কিসের? না মৃত্যুভয়। কে শত্রু জানা নেই, কিন্তু তার ছোঁয়াতে প্রাণ যাবার ভয় আছে। আমরা সবাই জানি এই আতঙ্কের মূল যে অতিমারী তার মারণ ক্ষমতা অন্যান্য প্রচলিত রোগের থেকে অনেক কম, তবুও আমরা প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কার তাড়নায় অস্থির হয়ে আছি। আশঙ্কার কালো মেঘ অনেকেক্ষেত্রেই আমাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে বদলে দিচ্ছে। আমাদের বোধ এবং চিন্তা ভাবনার মূল পরিসর থেকে স্বাভাবিক মানবিকতার ধারণাকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর একান্ত গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার সার্বিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
পৃথিবীর সমস্ত দেশ তাদের যে যার নিজের মত করে অথবা বলা যায় তাদের নিজস্ব আর্থিক ও রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার চেষ্টা করছে। সেখানেও নিজস্ব গোষ্ঠীগত ক্ষমতার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন চেহারা নিচ্ছে। এই অবস্থার বর্তমান চিত্রের সঙ্গে আমরা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগ্য পীড়িত বাঙ্গালি জাতিসত্তার অদূর অতীতের প্রতিরোধহীন দিশাহীন গণনিধনের কথা স্মরণ করতে পারি। কেননা আমরা বাঙ্গালিরা বর্তমানকে আশ্রয় করে বাঁচতে ভালবাসি। সেই বাঁচার ছোট ছোট তরঙ্গ বিভঙ্গের চ্ছটায় মুছে যায় অতীত আর সম্মিলিত ভবিষ্যতচিন্তার সময় বা সুযোগ ঘটে ওঠে না।
বেশিদিনের পুরনো কথা নয়। বিগত ১৯৪৩ সালে এই গণনিধনের অভিশাপ বাঙ্গালি জাতিসত্তার উপর নেমে এসেছিল। খাদ্যের অভাব অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের পথ ধরে। এই দুর্ভিক্ষ সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে গভীরতম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। তৎকালীন বাঙ্গালির মননে স্বর্গের আগের ধাপ ছিল বাংলার নিবিড় গ্রামগুলি। কেননা তারা শহর বা অন্যত্র যেখানেই কাজের সূত্রে থাক না কেন, মৃত্যুর আগে তাদের স্বপ্ন ছিল এই গ্রামে ফিরে আসা। বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের এই গ্রামগুলিই ছিল ভারতবর্ষের উর্বরতম শস্যভাণ্ডারের অধিকার নিয়েই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজশক্তির সংঘাত হয়েছে। তার সাথে ছিল শ্রেষ্ঠতম গুণমানসম্পন্ন কুটিরশিল্প। সেই বর্তমান নিয়েই বাঙ্গালি ছিল সুখী।
কিন্তু অত্যন্ত অল্পদিনেই সেসময় হারিয়ে গেল। সুখী কলরোল মুখরিত কুটিরগুলি পড়ে রইল মনুষ্যবিহীন জন্তুজানোয়ারের অাস্তানা হয়ে। বুনো লতা ঝোপে আচ্ছন্ন হল উঠোন বারান্দা। মা মৃত। সন্তানের মুখে আহারকণা তুলে দেবার হাত নেই। কোথাও এক কণা চালের সংস্থান নেই। ভাত বাংলার প্রধানতম খাদ্য। ১৯৩১-এর সেনসাস অনুযায়ী সাধারণ কৃষিজীবী, কৃষি শ্রমিক কারিগর এবং ছোট ব্যবসায়ীরা বাংলার জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। তাদের দৈনিক মাছ মাংস দুধ ঘি খাবার ক্ষমতা ছিল না। স্বভাবতই তাদের সঞ্চয়ও ছিল না।
সাধারণ কৃষিজীবী মানুষেরা ছিলেন মূলত ভাগচাষী। দু এক বিঘা জমি চাষ করে তাদের মালিককে অর্ধেক ফসল দিতে হতো। দৈনিক মজুর এবং কারিগরদের অবস্থা ছিল আরও করুণ। সুতরাং খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাদের যেটুকু জমানো সংস্থান তা অল্পদিনেই নিঃশেষিত হল। তখন তাদের বাড়ির দরজা জানালা খুলে বিক্রি করা শুরু হলো। সব কিছু হারানোর পর বুনো ফল শাক পাতা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টা চলল। তার মধ্যে কচু, বুনো আলু এবং শাপলা ছিল প্রধান। তাছাড়া ছিল শামুক গেঁড়ি গুগলি। হাওড়া জেলার বহু বাড়ির সামনে গেড়িগুগলির ঢিবি জমে গেল।
কোথাও একদানা খাবার নেই তাদের জন্য। নিজে দিনের পর দিন না খেয়ে সন্তানের মুখে যা হোক খাবার তুলে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টার অন্তে মায়েদের মনে হল সন্তান বিক্রি করে দিলে সে অন্তত অভুক্ত থাকবে না। তার কষ্ট লাঘব হবে। কিংবা চোখের সামনে সন্তানের শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে না পেরে কোন অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়ির সামনে সন্তানকে ফেলে রেখে চোরের মত পালিয়ে যাওয়া ভালো। স্যার জগদীশ প্রসাদ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩-এ বাংলার প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মেমোরান্ডামে এরকম একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন— ফরিদপুরে জেলা শাসকের আদালত কক্ষের এক কোনে একটি পুঁটুলি নিয়ে একজন শীর্ণদেহী মহিলা বসে ছিলেন। সেখান থেকে যখন একজন বয়স্ক মানুষে মৃতদেহ সরানো হচ্ছিল, তখন সেই মহিলা তার পুঁটুলিটি ছুঁড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে ‘‘একেও নিয়ে যাও’’ বলে। মা’র কোল থেকে ঝরে পড়ে মৃত সন্তানের দেহ।
হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড পত্রিকার সাংবাদিক চাঁদপুর থেকে ১১ অক্টোবর, ১৯৪৩-এ খবর পাঠান— বেঙ্গল রিলিফ কমিটির ব্যবস্থাপনায়— ফরিদগঞ্জ থানার অষ্ট-মহামায়াতে খাদ্য বিতরণের কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। সেখানে সন্তান কোলে একজন মা খাবার নিচ্ছিলেন। খাবার নেবার সময়ের মধ্যে তার কোলেই সন্তানের মৃত্যু হয়। কিন্তু মা তার খাবার নেওয়া বন্ধ করেন নি। তারপর সেই খাবার খেয়ে তার মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি চলে যান।
১৯৪৩ সালের বাংলার গ্রামের অবস্থার সাথে আমরা আশ্চর্য মিল দেখতে পাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠে বর্ণিত ১৭৬৮ সালের দুর্ভিক্ষের। আমরা একবার দেখে নিতে পারি সেই আশ্চর্য বর্ণনা। ‘‘গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখিনা। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে, দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে, অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখিনা, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গোচারণে গরু দেখি না, কেবল শ্মশানে শৃগাল কুক্কুর। .... তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।
১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল— লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। .... আশ্বিনে কার্ত্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দু এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তারপরে দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্ত্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।
লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল, তারপর কে ভিক্ষা দেয়! — উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ী বেচিল। জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’’
১৯৪২ সােল সারা বাংলার অনাহার পীিড়ত মানুষের কলকাতায় আসা সুরু হল। একটু খাবারের সন্ধানে। বরং বলা যায় একটু ভাতের ফ্যানের আশায়। জুলাই এর মাঝামাঝি এই সমস্ত মানুষের একটু ফ্যান চাওয়ার আর্তনাদে কলকাতার রাস্তাঘাট ভরে গেল। এখানে সেখানে মানুষ খাবারের জন্য ভিক্ষা চাইতে লাগল। আগস্টের মাঝামাঝি কলকাতার সমস্ত রাস্তা বুভুক্ষু মানুষের স্রোতে নিমজ্জিত হলো। প্রতিটি রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কের গাছের ছায়া তারা খুঁজতে লাগল। আগস্ট মাসের তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে রেলওয়ে স্টেশনগুলির শেড এর নীচে মাথা গোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হল। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পুরো ফুটপাত জুড়ে কাপড় টাঙ্গিয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় নিল বহু মানুষ। দিনের বেলা বড়রা দুএকজন শিশুকে নিয়ে খাবারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। রাত্রিবেলা মিলিত হত এই ছাউনিগুলিতে। ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে সারি সারি স্তরে রাত কাটাত। এই সর্বব্যাপী অনাহারের মধ্যে ততদিনে শুরু হল ম্যালেরিয়া, কলেরা এবং পেটের গন্ডগোল।
১৯৪৩ এর আগষ্ট ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার বর্ণনায় —
খাবার হয়তো প্রাণটাই বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু সামাজিক স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি পরিবার এই সময়ে অল্প খাবারে টেকে না। তবুও লঙ্গরখানাগুলিই পরিবারকে একত্র রাখতে সাহায্য করছিল। ছয়, সাত বা আট বছরের বাচ্চাদের অভিভাবকদের সাথে কলকাতা শহরের হতবুদ্ধি করা বন্ধ দরজার সামনে, পাঁচিলের পাশে সারি সারি ঘুমোতে দেখা গেল। তারা কি আর তাদের ফিরে যাবার ঘর খুঁজে পাবে। কত সঙ্গী, কত পরিবারের সদস্য এই বিশাল শহরের আনাচে কানাচে হারিয়ে গেল।
বাংলা যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখের গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছিল তখন মানব সভ্যতার ইতিহাস ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলার লোক সংখ্যা তখন ছিল ৬ কোটি ৩ লক্ষ। তার মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারান। এর একটা বড় সংখ্যায় মানুষ কলকাতায় খাবারের সন্ধানে এসেছিলেন।
এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপক শ্রী তারক চন্দ্র দাশ কলকাতায় আসা এই সর্বস্বান্ত মানুষদের উপর একটি সমীক্ষা করেন। তিনি লক্ষ করেন যে কলকাতায় আসা মানুষদের মধ্যে ৭১.৫৪% হিন্দু, ২৭.৬৩% মুসলমান এবং ০.৭৯% খ্রীষ্টান। তার মধ্যে ৫৩.৬৮% দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়েন। তবে তিনি কোন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ এর মধ্যে দেখেন নি।
এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার অনুপুঙ্খ বিবরণ দেবার পরিসর এটা নয়। বরং আমরা এই সময় দেশের অন্য অবস্থা এবং তার প্রভাবের কথা ভাবতে পারি।
আমরা আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলেছি। তার ফলশ্রুতিতে বিবিধ সামরিক প্রয়োজনের উপযোগী নীতি প্রয়োগের কথাও জানি। আর ভারতীয় রাজনীতির আকাশ তখন টালমাটাল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দেশের বাইরে। কংগ্রেসের নেতৃবর্গ আগস্ট আন্দোলনের প্রস্তুতিতে বেশি ব্যস্ত। তার মধ্যেও মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২-র গ্রীষ্মে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত নীতি ও পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন এবং এই নীতি ও পরিকল্পনা (বিশেষত Denial Policy) বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সার্বিকভাবে সর্বস্বান্ত করে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
১৯৪২ এর আগস্ট মাসে ‘‘ভারত ছাড়ো’’ আন্দোলন ঘোষণা করে কংগ্রেস। ঘোষণার প্রায় সাথে সাথেই সমস্ত কংগ্রেসের নেতাদের এবং সক্রিয় কর্মীদের ব্রিটিশ সরকার কারাবন্দী করে। মহাত্মা গান্ধীকে পুণেতে গৃহবন্দী করা হয়।
ইতিমধ্যে কলকাতায় অনাহার পীড়িত জনস্রোত আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। বাংলায় তখন হিন্দু মহাসভার সমর্থনে মুসলীম লিগ সরকার, সেই সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। যদিও সারা বাংলা তখন ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত। বাতাসে দেশভাগের গন্ধ। সেই সরকারের সুরাবর্দী এবং শ্যামাপ্রসাদ দূর্ভিক্ষ মোকাবিলায় একসাথে কাজে নামতেই পারলেন না যদিও তাদের মত ছিল একত্র মোকাবিলা করবার বিষয়ে।
১৯৪২ এর এপ্রিল মাসে Food Advisory Council গঠিত হল এবং Food Member নিযুক্ত হল সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করবার জন্য। অন্যতম Food Member স্যার আজিজুল হক ৯ আগষ্ট ১৯৪৩-এ বললেন যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক কেন্দ্রীয় সংসদে বলেছেন— ‘যদিও ঘাটতি আছে, তবুও আমাদের পরবর্তী কিছু মাস চালের কোন প্রয়োজন নেই বরং বাইরে থেকে কিছু গমের আমাদের প্রয়োজন’। নলিনী রঞ্জন সরকার, তৎকালীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জমি দপ্তরের সদস্য এপ্রিল ১৯৪২-এ বলেছিলেন— পাটের পরিবর্তে বেশি জমিতে ধান চাষের দরুন এবং ভালো আবহাওয়ার জন্য বাংলায় ধানের ফলনের ঘাটতি ১৩.৫ লাখ টনের বিপুল উদ্বৃত্তে রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯৪৩-র মে মাসে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তার শিরোনাম ছিল ‘একটি আবেদন ও সতর্কীকরণ’। সেখানে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দাবী প্রকাশ করা হয়। প্রশ্ন ছিল— সত্যিই খাদ্য ঘাটতি আছে কিনা? জবাবে লেখা হয়— ‘‘না, নিশ্চিতভাবে নেই’’।
তবুও অনাহারে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়ের মত প্রাণ হারালেন।
ইতিমধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৪২ এর নভেম্বরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। তিনি তার আগে বাংলার লেজিসলেটিভ এসেম্বলির ডেপুটি স্পিকারকে একটি সুদীর্ঘ বিবৃতি দেন। তার শুরুতে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সেখানে প্রাথমিক কারণের মধ্যে অনাহার পীড়িত মানুষের প্রসঙ্গ নেই। সেখানে আত্মসম্মান বজায় রাখবার কথা আছে। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন ও বিরোধ সম্পর্কিত উদ্ভুত পরিস্তিতি এবং ব্রিটিশ সরকারের এই বিষয়ে অন্যান্য আচরণের কথা আছে। তার কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বিস্তৃত বিবরণ আছে। এমনকি ঘূর্ণিঝড় পীড়িত মানুষদের সাহায্যের অপ্রতুলতার বিস্তৃত বিবরণ আছে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ পীড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাওয়া স্থান পায় নি। সুতরাং বাংলায় Famine Code অনুযায়ী দূর্ভিক্ষ ঘোষণার দাবীর প্রশ্নই নেই। যদিও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী Governor Rutherford কে একটি খোলা চিঠিতে অষ্ট্রেলিয়া থেকে কেনা দানা শস্য আনবার ব্যবস্থা হয় নি তা জানতে চান এবং অভিযোগ করেন এর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা মোচনের প্রচেষ্টা অবহেলিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৮ শতকে বাংলার দূর্ভিক্ষের পর ১৮৮৩ সালের জুন সাথে C.A. Elliot, Famine Code এর খসড়া তৈরি করেন। সেখানে ত্রাণ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে প্রাণহানি প্রতিরোধ করবার কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং এটা আশা করা যায় যে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে আরও কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচত। তবে সেই দাবী আদায়ের জন্য কোন আন্দোলনের খবর পাওয়া যায় না। Governor Rutherford একটি ব্যক্তিগত মেমোতে লিখেছিলেন— 'Famine Code প্রয়োগ করা হয় নি তার কারণ নিয়মমত রেশন দেবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য আমাদের কাছে ছিল না’। Viceroy Lord Wavell মনে করিয়ে দেন— ‘যতক্ষণ না বাংলার খাদ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, ততক্ষণ আমাদের পূর্বের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ ফলত Famine Code এর সহায়তাটুকু ঐ মানুষদের জোটে নি। যদিও বাংলার সাধারণ মানুষ এবং সংবেদনশীল মানুষ, তাদের যথাসাধ্য পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের একত্র করে পরিচালিত করবার মত রাজনৈতিক শক্তি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে নি।
১৯৪২ সালে গৃহবন্দী হবার পর মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৩ সালে অনশন শুরু করবার জন্য স্থির করেন। তার এই সিদ্ধান্তের কথা তিনি বড়লাটকে চিঠির মারফৎ জানান। অনশন শুরু করবার আগে এই বিষয়ে তিনি মোট তিনটি চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিটি চিঠিতে তিনি অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কারণের সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্যের অভাবের কথা উল্লেখ করেন।
ইতিমধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধকরণের আদেশ ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল
কম্যুনিস্ট পার্টিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যারা মহাত্মা গান্ধীর সতর্কবাণী গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছিল। তারা সে কথা মার্চ ১৯৪৩-এর কম্যুনিস্ট পার্টির চতুর্থ ইন্টারন্যাশনালে লিখিত রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল। সে কথা কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’তে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল ‘দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য গান্ধীজীর অনশন’ শিরোনামে।
উপরের বিবৃত ঘটনাপঞ্জী বাঙ্গালী জাতিসত্তার এক ভয়ংকর গণনিধনের ব্যাপকতার চিত্র হিসাবে খুবই সংক্ষিপ্ত এবং অপ্রতুল। তবে দিশাহীন বাঙ্গালী জাতিসত্তার চেহারা এর মধ্যে থেকেই আমরা ধারণা করে নিতে পারি। যে বাঙ্গলায় শুধুমাত্র খাবার না পেয়ে, খাবারের অভাবের জন্য তিরিশ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যে বাঙ্গলায় সেই মৃত্যুমিছিলের বিরুদ্ধে কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে না। ফেমিন কোড বলবৎ করবার দাবী ওঠে না। Denial to Rice এবং Denial to Boat আইনের বিরুদ্ধে কোন ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ওঠে না। সেই বাঙ্গলার বাঙ্গালী আমরা আজ আবার এক অনিশ্চিত সঙ্কটের সামনে দিশাহীন মত্ততায় মগ্ন।
তথ্যসূত্র:
১) Bengal Famine (1943) : As revealed in Survey of the destitutes in Calcutta by Tarak Chandra Das
২) অানন্দমঠ — বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩) Famine in Bengal 1770-1943 - Kali Charan Ghosh
৪) Hungry Bengal: War, Famine, Riot and the end of Empire 1939-1946 — Janam Mukherjee.
৫) The Famine Code — K.S. Singh