সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ও রক্তিপুরবি! ও আলোপুরবি! ও সত্যিভবানী! ও কোলিন সত্যিভবানী!
আমি গভীর বনে যাব। সব বাঘ ভালুকে পাথর করে দাও।
সব কাঁটাকে মোম বানিয়ে দাও। সব সাপকে কাঠি বানিয়ে দাও।
বনের ভিতর থেকে বার করে হরিণদের সামনে দাঁড় করিয়ে দাও।
(জংগলে শিকারে যাবার আগে বাইগাদের মন্ত্র,
Verrier Elwin এর The Baiga থেকে নেওয়া)
ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাকা রাস্তা ধরে এসে বাসটা লামনির বাসস্টপে দাঁড়াতেই হইচই করতে করতে একদল কলেজের ছেলেমেয়ে বাস থেকে নামল, সবার পিছনে খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরা হাসি হাসি মুখে নামলেন ফর্সা, লম্বা, টিকালো নাক প্রভুদত্ত খেরা। হঠাৎ তাকে দেখলে পাঠান বলে মনে হতে পারে। ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় এই নরম মনের মানুষটি হিন্দু কলেজের সামাজিক নৃতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সাল ১৯৮৫ র প্রথম দিকে তিনি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এসেছেন মাইকাল পাহাড়ের জঙ্গলে ফিল্ড স্টাডির জন্য।
উঠেছেন অমরকণ্টকের এক ধর্মশালায়। বেশিরভাগই দিল্লি বা অন্য বড় শহরের ছেলে মেয়ে, পাহাড়ের উপর জঙ্গলে ঘেরা লামনিতে এসে তারা মুগ্ধ, সবার মধ্যেই জঙ্গল পাহাড়ে ঘোরার অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা। তার উপর ভারতবর্ষের অন্যতম আদিম জনজাতি বাইগাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ক্লাসে শোনা বা বইতে পড়ার থেকে জঙ্গলে তাদের গ্রামে তাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের সম্পর্কে জানা, এক আলাদা ব্যাপার। বাইগাদের এক বড় অংশ থাকে অমরকণ্টকের পাশের আচানাকমার জঙ্গলে। লামনি বেশ বড় গ্রাম। বাইগাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দু এক ঘর যাদবও দেখা যায়। ছাত্র ছাত্রীরা তিনটি দলে ভেঙে গ্রামের নানা টোলায় আর্থসামাজিক সমীক্ষা ও বিভিন্ন বিষয়ের অনুসন্ধানের জন্য গেছে। হিন্দি ভালো জানে এরকম কয়েকটি যাদব ছেলে দলগুলির সঙ্গে রয়েছে বাইগাদের পাড়া চেনানের জন্য আর দোভাষী হিসাবে। ঠিক হয়েছে ঘণ্টা দুই তিনেক পরে সকলে ফিরবে বড় রাস্তার ধারের ফরেস্ট অফিসে। প্রথম দিন প্রফেসার খেরা একাই ঘুরে ঘুরে বাইগাদের ও শাল জংগলকে বোঝার চেষ্টা করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
শাল জঙ্গলের পায়ে চলা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মাঝের একটু ফাঁকা জায়গায় একটা শাল গাছের কাটা গুঁড়ির উপর বসে জঙ্গলের শ্যামল, নিবিড় শোভা উপভোগ করছিলেন। অনেকদিন পর ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল, ৩৫ বছর আগের কিশোর বয়সের লাহোরের সেইসব দিনের কথা, দুরন্ত বদমায়েশি, মহল্লার সারি সারি বাড়ির মধ্যে দিয়ে নানা গলিঘুঁজি, সেখানে দাদা দিদি আর পাড়ার বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলা, বেলায় দিদির আর মায়ের ডাক। হঠাৎ এক লহমায় সব শেষ, সাতচল্লিশের দেশভাগ সে দিনের কিশোর প্রভু রাতারাতি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সব কোথায় হারিয়ে গেল, রক্তাক্ত দেশভাগ, শরণার্থী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে দিল্লিতে। পুরো পরিবার ছন্নছাড়া উদ্বাস্তু, তার মন ভারী হয়ে এলো।
এক ঝাঁক টিয়া পাখীর তীক্ষ্ণ ডাকে সম্বিত ফিরতেই দেখলেন সামনের বড় শাল গাছটার পিছন থেকে একটা বালকের হাসি মুখ তার দিকে তাকিয়ে। পাঁচ, ছয় বছরের এক বালক, চুলগুলো এলোমেলো, খালি-গা, গাছের পিছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, তিনি হেসে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন। বালকটি হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল, তার দুষ্টু মুখটা দেখে তার নিজের ছোটবেলার কথা আরো মনে পড়ল। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লজেন্স বার করে দেখিয়ে কাছে আসার ইশারা করলেন কিন্তু বালকের মধ্যে কোন উৎসাহ দেখা গেল না। তারপর হটাতই বড় শাল গাছটার পিছনে সে হারিয়ে যেতেই প্রফেসার খেরার খেয়াল হল যে এই জঙ্গলে বাঘ আছে, সেখানে এতো ছোট ছেলে একলা ঘুরছে ভেবে তার ভয় লাগে। এই প্রথম তিনি ছাত্রদের নিয়ে এসেছেন এই অঞ্চলে, আচানকমারের জঙ্গল সম্পর্কে তার ধারণা খুবই কম।
তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দেখতে গেলেন, তখনই কে যেন তার পরনের পাঞ্জাবি ধরে টানল, মুখ ঘোরাতেই দেখেন ছোট্ট ছেলেটি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে। কখন সে দ্রুত নিঃশব্দে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে তিনি বুঝতেই পারেন নি। তিনি হেসে ফেলেন, বালক তার ছেঁড়া প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা অজানা পাকা লাল ফল বের করে প্রভু খেরার সামনে ধরে, নেবার অনুরোধ। ছেঁড়া প্যান্ট, খালি গা, একমাথা এলোমেলো না আঁচড়ানো চুল, কালো গায়ে ধুলো লেগে, ছেলেটির চোখ দুটি নির্ভয়, সারল্যে ভরা, তার হাসিমুখ দেখে এক লহমায় তিনি হারিয়ে যান। ছেলেটি তাকে হাত ধরে গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর বসায়। দুজনেই দুজনের ভাষা বোঝে না অথচ ইশারায় কথা চলতে থাকে, শুরু হয় কিছু জংলী ফলের বীজ নিয়ে খেলা। কিছুক্ষনের জন্য তিনি হারিয়ে যান লাহোরের শৈশবে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার অভিজ্ঞ নৃতাত্ত্বিকের চোখে ধরা পড়ে এই জঙ্গলের বিষয়ে বালকের জ্ঞান। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে যে ভাবে আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের গবেষণা করেন সেখানে প্রকৃতির নানা বিষয়ের এই জাতিগত আত্মস্থ গভীর জ্ঞান ধরা পড়ে না। তিনি নিজে যখন অসহায় বোধ করছেন জঙ্গলের পরিবেশে সেখানে বালকের আত্মবিশ্বাস ভরপুর। বুঝতে পারলেন এই জঙ্গল তার নিজের জায়গা, এক সহজাত দক্ষতায় তাই সে এতো নিঃশব্দে নানা গাছের মধ্যে দিয়ে দ্রুত তার পিছনে চলে এসেছিল। ভাবতে ভাবতে তিনি উঠে দাঁড়াতেই বালক তাকে হাত ধরে টানতে থাকে জঙ্গলের ভিতরের পায়ে চলা রাস্তার দিকে। দুজনে জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা যাবার পর প্রফেসার খেরা দেখলেন বড় বড় গাছ ঘেরা একটা পরিষ্কার জায়গায় দুরে দুরে বেশ কয়েকটা বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া, ছেলেটা হাত ধরে তাকে তাদের বাড়ির উঠোনে নিয়ে গেল।
সুন্দর করে মাটি দিয়ে নিকানো উঠোন, তিন দিকে তিনটে ঘর, ঘরের সামনে উঁচু করে মাটির সরু বারান্দা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢাকা, উপরে পাতার ছাউনি, বাড়ির পিছনের দিকে বড় বড় শাল গাছ, উঠোনের দুই পাশে দুটো বড় আম গাছ। গাছের ছায়ায় দুটো খাটিয়া পড়ে আছে, এক কোণে মাটিতে নিকানো মেঝেতে কিছু শাল বীজ শুকতে দেওয়া আছে। খাটিয়ার পাশে মাটিতে বসে মাহাতু বাইগা তখন একটা কাঠের টুকরোকে খুব মনোযোগ দিয়ে ছোট কুড়ুল দিয়ে কেটে কিছু বানাচ্ছিল। হঠাৎ খাদির পাজামা পাঞ্জাবি পরা, ফর্সা লম্বা চেহারার একটা মানুষকে ছোট ছেলে মিরনের সঙ্গে ঢুকতে দেখে সে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। অনেকটা এরকম চেহারার গেরুয়া কাপড় পরা সাধু সন্ত তাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে অমরকণ্টকে যায়, গ্রামের সবাই তাদের বাবা বলে। ওর মনে হল এই মানুষটা সেই রকম কোন বাবা, কেবল পোশাকটা একটু আলাদা। প্রভু খেরা হাত জোড় করে নমস্তে বললে মাহাতু কেবল হাত জোড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাহাতু তারপর সেই বালকের দিকে তাকিয়ে ওদের ভাষায় কিছু বলে। প্রভু খেরা শুধু এটুকু বুঝলেন, ছেলেটির নাম মিরন। তিনি খাটিয়ায় বসতেই মিরন দৌড়ে ঘরের থেকে একটা এলুমিনিয়ামের গ্লাসে জল নিয়ে আসে।
প্রভু খেরা খাটিয়ায় বসলে মাহাতু মাটিতে তার পায়ের কাছে বসতে গেলে তিনি তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে খাটিয়ায় তাঁর পাশে বসালেন। মাহাতুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝলেন যে সে অল্প হিন্দি বোঝে, নাম মাহাতু, জাতে বাইগা। তিনি খুশী হলেন যে একদম বাইগা পাড়ায় বাইগা বাড়ির ভিতরে পৌঁছেছেন, সম্ভবত ছাত্রদের কোন গ্রুপ এদিকে আসেনি। মাহাতুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বাড়ির আশপাশ থেকে লোকটির চৌদ্দ পনেরো বছরের ছেলে আর তার বছর সতেরোর মেয়ে কোলে একটা শিশু নিয়ে বেরিয়ে এসে মাহাতুর পাশে দাঁড়াল, মিরন প্রভু খেরার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, আস্তে আস্তে পাড়ার আরো লোক তাকে দেখতে জড় হ’ল। প্রথমে মিরন ছাড়া বয়স্ক সবার মধ্যে কিছুটা সঙ্কোচ আর ভয় ছিল, কিন্তু সময় আস্তে আস্তে কাটতেই তারা নিশ্চিন্ত যে এই মানুষ বন বিভাগ থেকে আসেনি। একদিকে বাইগাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার কৌতূহল অন্যদিকে তার সম্পর্কে মাহাতুর ও পাড়ার সবার কৌতূহল মিলে মিশে একাকার।
তিনি কে কোথা থেকে এসেছেন আর কেন এসেছেন তা বোঝাতে গিয়ে বুঝলেন যে এই দেশ কাল সময় সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, এরা কথা কম বলে বেশির ভাগ নীরবে শোনার আর বোঝার চেষ্টা করে। সবাই ভালো হিন্দি বোঝেনা তার উপর প্রফেসার খেরার কথার টানও অন্য রকম। তারা এটুকু বুঝল যে ইনি দিল্লি বলে একটা জায়গা থেকে এসেছেন। কথা চলতে লাগল, মাহাতু বলল যে তার বাবা মান্ডলার দিকে থাকত তারপর ওদিকে শাল জঙ্গল কমতে থাকায় এদিকে চলে আসে। এই পাড়ার সবাই অন্য কোন জায়গা থেকে এখানে বাড়ি করেছে। তিনি জানতেন যে বাইগারা জঙ্গলে শিকার করে আর জঙ্গলের কন্দমূল ফল সংগ্রহ করে। এরা উত্তরপূর্বের আদিবাসীদের মতো জঙ্গল পরিষ্কার করে ঝুম চাষ করে, যাকে এরা বেওয়ার বলে। এরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। ভাঙা ভাঙা ভাবে কথাবার্তা শুরু হলেও এক সময় দুপক্ষই বার্তালাপ বুঝছিল।
বেওয়ার প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন দাঁড়িয়ে থাকা পাড়ার সব বয়স্ক লোকই দুঃখ করতে লাগলো বেওয়ার বন্ধ হবার জন্য। বন দপ্তর তাদের বেঁচে থাকার রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে। কত পুরানো সময় থেকে এই শাল জঙ্গলই তাদের ঘর, তারা মন মতো বেওয়ার করত আর তখন জঙ্গল কত ঘন ছিল, জঙ্গলে কত শিকার ছিল বরা, হরিণ, খরগোশ, বাঘ ভালুও ছিল। কিন্তু বন দপ্তর শিকার তো বন্ধ করেছেই, বেওয়ারও বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে জঙ্গলও পাতলা হচ্ছে। গল্প করতে করতে দেখলেন বেশির ভাগেরই খালি গা, আপাত দৃষ্টিতে গভীর অভাব মনে হলেও কারুর মধ্যে কোন আভাববোধ নেই, এক অদ্ভুত সন্তোষ। মিরন ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর দেওয়া লজেন্স চুষছে আর মাঝে মাঝে হাসি মুখে ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, ধীরে ধীরে তিনি মিশে গেলেন ওদের সাথে।
একটু পর তিনি হাত ঘড়িতে দেখলেন যে ঘণ্টা দুয়েক কখন কেটে গেছে।
***
মাহাতুকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তের ধারের ফরেস্ট অফিসের বারান্দায় এসে দেখলেন ছাত্রদের একটা দল ফিরে এসেছে, বাকিরাও এসে পড়বে। এখানে ছাত্ররা তাদের দিনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করবে, সেই সময় নানা ব্যাপারে মাহাতুর ব্যাখ্যা খুব কাজে দেবে এই ভেবে তিনি মাহাতুকে নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে ওদের পাড়ার আরো কয়েকজন। এক এক করে ছাত্রদের বাকি দল এসে পড়ল, মিরন দৌড়ে দৌড়ে সকলের ওয়াটার বটলে সামনের টিউবওয়েল থেকে জল এনে দিল। গ্রামের লোকজন অনেকগুলো খাটিয়া এনে সামনের বড় ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের নিচে পেতে দিলে সবাই সেই শীতল ছাওয়ায় বসে কথা বলতে লাগল। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা বাইগাদের দারিদ্র্য নিয়ে, এতো গরীব তারা আগে দেখেনি, বাইগাদের পোশাক আশাক, খাওয়া দাওয়া সব কিছুর মধ্যেই তারা প্রবল দারিদ্র্য খুঁজে পেয়েছে। এ দেখে শহরের শিক্ষিত ছাত্র ছাত্রীদের মন খুবই বিচলিত। মাহাতু, মিরন ও গ্রামের বাকিরা খুবই অবাক চোখে এই সব ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় আলোচনা শুনছিল, বেশিরভাগটাই বুঝছিল না। দলের সঙ্গে গিয়েছিল কম বয়েসি প্যান্ট শার্ট পরা গ্রামেরই বিনোদ যাদব, সে কিছুদিন বিলাসপুরের দোকানে কাজ করেছে। সে মাঝে মাঝে বাইগাদের দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কার নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
প্রফেসার খেরা চুপ করে কথা শুনছিলেন আর দুটো আলোচনার তফাৎ লক্ষ্য করছিলেন। একটু আগে বাইগাদের পাড়ায় যখন বসে ছিলেন একবারও তাদের কথায় কোন অভাব ধরা পড়েনি, বেওয়ার বন্ধ করে দেওয়া আর জঙ্গলে শিকার করতে না দেওয়া ছাড়া তাদের কোন অভিযোগ নেই। জঙ্গলে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেরানো ছাড়া তারা কিছু চায়ও না অথচ তার ছাত্ররা বাইগাদের গভীর অভাব নিয়ে বেশ চিন্তিত। বেশিরভাগ গ্রুপেরই বক্তব্য এদের অনেকের জমি থাকলেও এরা ভাল চাষ করে না, জমিতে উৎপাদন খুবই কম, কারও কারও মতে জমির উৎপাদনশীলতা দ্রুত বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। বিনোদ যোগ করল এরা খুব কুঁড়ে, খালি বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, চাষে মন নেই। এই গ্রামের যে কয়েক ঘর যাদব আছে তারা পরিশ্রম করে বলে তাদের অবস্থা ভালো। মাহাতুরা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল কিন্তু বিনোদের কথা বুঝতে পেরে মাহাতু প্রতিবাদ করে বলে তুই জানিস না আমাদের জমিতে লাঙল দিতে নাই?
প্রফেসার খেরা আস্তে মাহাতুকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন তাদের চাষ করতে নেই? মাহাতু উদাস হয়ে সামনের লম্বা শাল গাছের দিকে তাকিয়ে বলল ভগোয়ান নিজে হাতে বাইগাদের বেওয়ার শিখিয়েছিলেন, এই বলে সে চুপ করে গেল। সবাই তার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল, মিরন তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। সবাই গুছিয়ে বসল কিন্তু মাহাতু চুপ, প্রফেসার খেরা আস্তে মাহাতুর কাঁধে হাত রাখলেন, তবুও সে চুপ। মাঝখান থেকে বিনোদ বলে উঠল স্যার আমি গল্পটা জানি, বলব? মাহতুর চোখের বিরক্তি প্রফেসার খেরার চোখ এড়াল না। তিনি হাত তুলে তাকে থামতে বলে আবার মাহাতুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। ছাত্র ছাত্রীরা প্রফেসার খেরাকে দেখে বুঝে গেছে যে মাহাতু একজন আদিবাসী, এদের একে-ওপরের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ের সংস্কৃতি তাদের মতো নয়। এরা শান্ত, স্থির, কম কথা বলায় অভ্যস্ত। মিরন তখনো তাকিয়ে তার বাবার মুখের দিকে।
লামনিতে থাকার দ্বিতীয় দিন তিনি আবার মাহাতুর বাড়ি গিয়ে দেখেন সে তার ছোট কুড়াল দিয়ে কত সহজে শক্ত শাল কাঠ কেটে বানাচ্ছে কাঠের গোল চাকা। অবাক হয়ে দেখেছিলেন তার হাতের কুড়ালের ভেল্কি, মাহাতু বলছিল কুড়ালের কয়েক কোপেই এরা নাকি একটা তিন মানুষ সমান গাছ কেটে ফেলতে পারে অনায়াসে। মাহাতু জগন, মিরনদের সঙ্গে জঙ্গলে একটু ঘুরতেই বুঝলেন হাতে কুড়াল নিয়ে শাল বনে ঘুরতে যে এদের কি আনন্দ তা বোধহয় বাইগারাই জানে, তার কাছে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মিরনের সাথে পাড়ার বাচ্ছারা তাকে দেখে ঘিরে ধরল। তিনি পকেট থেকে লজেন্স বার করে সবাইকে দিলে, মুহূর্তের মধ্যে ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে মিরনের মতো কয়েকটা ছেলে আর একটা ছেঁড়া ফ্রক পড়া কয়েকটা বাচ্ছা মেয়ে লজেন্স নিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল।
ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে বাইগা জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাহাতুর কাছে শুনেছিলেন যে তার প্রথম পক্ষের বউ তার সাথে বারো বছর ঘর করার পর বছর ছয়েক আগে তারই এক বন্ধুর সাথে ছাপরাওয়ায় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছে। মাহাতুর প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো তার উপর ছেলেমেয়েদের একা সামলাতে একটু অসুবিধা হত কিন্তু তার বড় মেয়ে নিরলি অনেকটা সামলে দিয়েছিল। প্রভু খেরা লক্ষ করছেন এই বলার মধ্যে মাহাতুর মধ্যে কোন রাগ বা অভিমান নেই। তারপর তার দ্বিতীয় পক্ষের বউ তিরনির সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে মাহাতুর ভাব ভালবাসা হয়। বিয়ে করেছে দুজনে তাতেও নিরলি বা বড় ছেলে জগনের মধ্যে কোন আলাদা তিক্ততা বা রাগ নেই। বছর তিনেক আগে নিরলিও বিয়ে করে ছাপরাওয়ারই এক বাইগাকে। এখন সে তার কোলের মেয়েকে নিয়ে এসেছে বাপের বাড়িতে। তিরনিও তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে। সে আর তিরনি রোজ গল্প করতে করতে জঙ্গলে শাল বীজ আর কন্দবাড়ি জোগাড় করতে বেরোয়।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সবাই আবার ফিরে যায় দিল্লিতে, পভু খেরা ব্যাস্ত হয়ে পড়েন কলেজ ও ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে।
***
সেদিন জঙ্গলের ধারে মাহতু একটা বড় গাছের নীচে বসে তার শালপাতার বিড়িতে টান দিতে দিতে সামনে তার সদ্য চাষ করা জমির দিকে তাকিয়ে ছিল, জমির বুকে চিরে একটানা লম্বা লম্বা ফাঁক তার পাশেই সদ্য উপড়ে যাওয়া অল্প শুকানো হলদে সবুজ ঘাসগুলো মুখ থুবড়ে লাইন দিয়ে পড়ে আছে, তারই ভিতর থেকে লাল অল্প ভিজে মাটি বেরিয়ে এসেছে, দু একটা গো বক তখনো মাঠে চরছে। জমির দিকে তাকিয়েই মাহাতুর মন খারাপ হয়ে গেলো, তার ভালো লাগে না এক টানা জমির বুকে লাঙলটাকে চেপে ধরে চালাতে, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে, ভয় লাগে, ধরিত্রী মায়ের শাপের ভয়। কিন্তু উপায় নেই, জঙ্গলের ধারের এই শক্ত পাথরের মতো জমি মধ্যপ্রদেশের বন দপ্তর তাকে বছর চার আগে পাট্টায় দিয়েছে যাতে ও জঙ্গলে বেওয়ার বন্ধ করে। আরও কয়েক বার চাষ দিলে জমিটা তৈরি হবে, তারপর বৃষ্টি হলে সে ধানের বীজ ছড়াবে। গরু দুটো ছায়ায় জাবর কাটছে। গত তিন বছর সে চেষ্টা করছে গোণ্ড আর ওঁরাওদের মতো চাষ করতে কিন্তু ভালো ফসল কোন বছরই হয়নি। যে জমিতে একটা গাছ নেই ঘাস শুকিয়ে যায় সেখানে কি কচি কচি ধানের চারা বাড়ে? সে ভাবে, কে জানে কেমন করে পাহাড়ের নিচের গোণ্ডদের গ্রামে এতো ধান হয়, এই রকম চাষ তার বাপ ঠাকুরদা কেউ কখনো করেনি, কয়েক বছর আগেও সে শাল জঙ্গলের ভিতর বেওয়ার করে এসেছে। সে ভাবে বেওয়ারের মজাই আলাদা, কি ভালো কুটকি আর কোদো হয় তার সঙ্গে জংলি সিম আর বরবটি দিলে তো কথাই নেই।
ভাবতে ভাবতে তার ভারি রাগ হয়, কেন তারা তাদেরই শাল জঙ্গলে নিজের মতো করে বেওয়ার করতে পারবে না? যুগ যুগ ধরে তারা তো এই দিকের জঙ্গলে বেওয়ার করে এসেছে। সব আদিবাসীরা জানে বাইগারা হচ্ছে শাল বনের রাজা, আর আজ কিনা তারা তাদেরই শাল বনে ঘুরলে ফরেস্টের লোকগুলো চেঁচায়। যেখানে ওরা একসময় বাঘ মারত সেখানে তাদের একটা পাখি শিকার করাও মানা, কেন? ওরা তো এখানকার লোকই নয়, ওরা কি করে এই জঙ্গলের দখল পেলো? রাগে, জোরে ওর বিড়িতে শেষ টান দিতেই পিছনের জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে এলো তিরনি, এসে ওর পাশে বসল, চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে, পরনের শাড়িটা ছেঁড়া, হাতে এক গোছা জংলি জাম, একটা জাম মুখে চুষছে। ওর দিকে তাকিয়ে মাহতু তার বিড়িতে টান দিতে দিতে বলে কিছু পেলি? সে হাসতে হাসতে অন্য হাতটা সামনে এনে দেখাল কয়েকটা ছোট কন্দবারি, এখনো ভিজে লালচে মাটি লেগে তাতে।
হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজ, দুজনের মাথা দ্রুত সেদিকে ঘুরল, দেখল জমির অন্য প্রান্তের জঙ্গলের পাশে জগন, একটা ধনু আর বাণ নিয়ে শাল গাছের মাথায় বসা একটা বড় সাদাকালো বকের দিকে তাক করেছে, ছোট মিরনও ঝোপের পিছন থেকে মুখ বার করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে। বাণের দিকে তিনজনেরই চোখ, তিরনির মনে লোভ হয়, ভাবে ঘরে কোদো আছে, কন্দ আর পাখির মাংস দিয়ে আজ সবাই পেট ভরে খাবে, ভাবতে ভাবতে সে মুখে আরো কয়েকটা জাম পোরে। মাহাতু জানে জগনের বাণের টিপ, সেই তাকে শিখিয়েছে ধনুর বাণ দিয়ে শিকার করতে, ও জানে বকটা শেষ, তবুও তাকিয়ে থাকে, মনে একটু গর্ব আর একটু ভয়, ঝোপের ভিতর মিরনের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
কি রে মাহাতু কি খবর? বসে থাকলে হবে? চাষের কতদূর? বলতে বলতে তার জমির অন্য প্রান্ত থেকে ফরেস্টের পাহারাদার লম্বা পেটানো চেহারার যমুনাপ্রসাদ যাদব লম্বা, মোটা লাঠি হাতে উঠে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ফট করে একটা আওয়াজ, বকটা ঝটপট করতে করতে নীচে পড়তে পড়তে একটা শুকনো শালের ডালে মাথা নিচু করে আটকে গেল, এখনো প্রাণটা বেরোয়নি, নড়ছে। যমুনাপ্রসাদ দুর থেকেই কিছু একটা আন্দাজ করেছে কিন্তু তার মনে তখন অন্য চিন্তা, তার আজ দরকার মাহাতুকে। মাহাতু আর তিরনি ভেবেছে যমুনাপ্রসাদ ব্যপারটা খেয়াল করেনি, জগনের শিকার সে দেখেনি। তিরনি মুখ থেকে জামের বীজগুলো ফুঃ ফুঃ করে ফেলল, আর মাহাতু আড়চোখে বকটা দেখে তাকিয়ে থাকল যমুনাপ্রসাদের দিকে, সেও ওদের দিকে তাকাল যেন কিছুই হয় নি, জঙ্গলে তো এমন কত আওয়াজই হয়।
দুজনেই জানে যমুনাপ্রসাদ দেখলে বিপদ। সে কেবল ভাগ চাইবে না বেশি ভাগটা সেই নেবে। না দিলে বড় সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে। মাহাতু বলে করছি গো, চাষ কি বাইগাদের কাজ, সাহেবকে বলো না, ওইদিকের জঙ্গলে একটু বেওয়ার করি! যমুনাও লামনীরই বাসিন্দা, দুজনে দুজনকে অনেক দিন ধরে চেনে, যমুনাপ্রসাদের ঠাকুরদা ইংরেজ আমলে বিহার থেকে লামনিতে আসে সাহেবদের সঙ্গে, তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছে। যমুনা নিজের পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে মাহাতুকে আর তিরনিকে একটা করে দেয়, তারপর তিনজন একসঙ্গে বিড়ি ধরায়।
যমুনা বলে কেন তোকে তো চাষের জমি দিয়েছে। মাহাতু রেগে বলে তুমি যাদব হলে কি হবে, জন্মেছ তো লামনিতে, তুমি কি জান না বাইগাদের ধরতিমায়ের বুক চিরে চাষ করতে নাই? যমুনা বলে জানি জানি কি করবি বল? সাহেবরা নিয়ম করেছে, তোরা জঙ্গল কেটে বেওয়ার করলে জঙ্গল শেষ হয়ে যাবে না! তিরনি পাশ থেকে ফোড়ন কাটে, তা তোমার বিট সাহেব যে গাছ কেটে রাতে গাড়িতে পাঠায়! যমুনা মাহাতুর পাশে বসে বলে তোর তো খুব কথা হয়েছে রে, ওসব বলিস না চুপ কর, আমার নোকরিটা যাবে। একটু থেমে বলে এই চাষ যদি না করিস তবে একটা কাজ করবি? এই বলে বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে আস্তে আস্তে বলে, চল রাজাখোলা বাঁধের মাটি কাটার কাজে হাত লাগাবি। দিনে একশ টাকা পাবি। মাহাতু আর তিরনি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়, দিনে একশ টাকা! যমুনা আরো স্পষ্ট করে বলে তোরা দুজনে দুশো পাবি।
তিরনি আড় চোখে দেখে নিয়েছে ছোটটা ততক্ষণে গাছ থেকে বকটা পেড়ে এনে জগনের সঙ্গে জঙ্গলে মিলিয়ে গেছে। বাড়িতে আজ জমিয়ে খাওয়ার কথা ভেবে ওর আর টাকার কথাটায় তেমন মন উঠল না। সে উঠতে উঠতে মাহাতুকে বলল, তাড়াতাড়ি গাই গুলোকে নদীতে নামিয়ে তুমিও চান করে বাড়ি এসো। যমুনাপ্রসাদের মাথায় তখন বিট অফিসার রামজীবন পাঁড়ের মুখটা ভাসছে। অনেকদিন ধরে বাঁধের জন্য লাখ পাঁচেক টাকা এসে পড়ে আছে, যদি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ না হয় তাহলে টাকা ফেরত পাঠাতে হবে। যমুনাও বিড়িতে শেষ টান দিয়ে উঠতে উঠতে বলে বাঁধের মাটি কাটার কাজে অনেক পয়সা, তোর পাড়ার অন্য বাইগাদেরও বলিস। তারপর যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে জগনকেও নিয়ে আয়, ছেলেটা শিকার করতে গিয়ে ধরা পড়লে ওর কিন্তু জেল হবে, বলতে বলতে ধীরে ধীরে সে জঙ্গলে ঢুকে মিলিয়ে যায় বড় বড় শাল গাছের আড়ালে। কথাটা শুনে মাহাতু বিড়িটা ফেলে থুঃ থুঃ করে কিছুটা থুথু ছিটিয়ে উঠে দাঁড়াল।
***
দিল্লিতে ফিরেও প্রভুস্যার ভুলতে পারছিলেন না আচানাকমারের শাল জঙ্গল, মাহাতু, তিরনি, জগন, নিরলি আর ছোট্ট দুষ্টু মিরানের সঙ্গে এক দঙ্গল ছোট বাচ্ছাকে। পাঁচদিন মাইকাল পাহাড়ের জঙ্গলে ঘোরার পর দিল্লি ফিরেও তার বার বার মনে পড়ছে সেখানকার কথা। তিনি একজন অভিজ্ঞ সামাজিক নৃতাত্ত্বিক, আদিবাসীদের নিয়েই তার কাজ অথচ কিছুতেই কোন এক আশ্চর্য বন্ধনে মাহাতু আর তার পরিবারকে তিনি ভুলতে পারছেন না। প্রভু খেরা একাই থাকেন বিয়ে-থা করেন নি, পড়াশোনা, কলেজ আর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, খুব সহজ সরল জীবন কাটান কিন্তু আচানাকমারের এই ফিল্ড ট্রিপ তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। নৃতত্ত্ববিদ হিসাবে যত না, মানুষ হিসাবে তার থেকে বেশি। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে তার আর মিরনের কোথায় যেন একটা মিল আছে, অথচ দুজনে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা সময়ে আলাদা জায়গার আলাদা দুটো জীবন। তারই মতো মিরনরাও কি উদ্বাস্তু হতে চলেছে।
দিল্লিতে প্রভু খেরা একাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন, বাড়িতে জিনিসপত্রও খুব কম। স্বতীর্থরা তার অতি সাধারণ জীবন যাপন নিয়ে পিছনে হাসি ঠাট্টা করে। পোশাকের মধ্যে খাদির পাজামা পাঞ্জাবি, খাওয়াদাওয়াও খুবই সাধারণ, রুটি ডাল কোন কোন দিন সব্জি আচার। তার খুব কাছের বন্ধু ইতিহাস বিভাগের দিগম্বর মিশ্র তো তাকে প্রায়ই বলে বেশ আছ প্রভু, কোন চিন্তা নেই, দিব্যি ঝাড়া হাত পা। এখন বাড়িতে একা থাকলে তার মাথায় কেবল শাল জঙ্গল, লামনি গ্রাম, মাহাতুর গল্প, মিরনদের মুখ ভাসে। তিনি এরকম আধুনিক সভ্যতার থেকে এতো দুরের কোন সমাজ আগে দেখেননি। সহজ সরল জীবন, নিজেরা নিজেতে সম্পূর্ণ, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে কত কিছু নেই, অভাবই অভাব, অথচ সবাই তাদের সীমিত সম্পদে কতই না সন্তুষ্ট। তাদের অস্তিত্বের নিগড়ে যেন এই জঙ্গল- জীবন, শাল বনই যেন সব। তিনি তো বিয়ে থা না করে ঝাড়া হাত পা কিন্তু মাহাতুরা সংসার করেও কেমন করে যেন তার মতোই, যেন বন্ধনহীন।
সরকার নাকি আচানাকমারকে অভয়ারণ্য বানাতে চলেছে, গভীর জঙ্গলের সব বাইগা গ্রামকেই নাকি সরান হবে। ভাবছিলেন কোথায় যাবে এরা? শাল-জঙ্গল ছাড়া কি করবে? তার মনে পরে মাহাতু যে গল্প সবার সামনে বলে উঠতে পারেনি, একদিন জঙ্গলের ধারে তার জমির পাশে সেই গল্পই বলেছিল তাকে, তিরনি আর মিরনকে। একটানা আবেগহীন গলায় শুনিয়েছিল এক অদ্ভুত গল্প একটা বড় শাল গাছের দিকে তাকিয়ে, যেন সে মনের চোখে দেখছিল আর বর্ণনা করে যাচ্ছিল।
পৃথিবী তৈরি করার পর ভগোয়ান বাইগাকে বললেন কান্দমাল জঙ্গলে গিয়ে কিছু কন্দ খুঁড়ে নিয়ে আসতে আর সে যেন আট দিনের পর ফিরে আসে। তারপর ভগোয়ান বাজারে গিয়ে একটা দোকান খোলে আর সেই দোকান থেকে এক এক করে জিনিস দিতে থাকেন এক এক আদিবাসীকে। হাল দেন গোণ্ডদের, কলম দিলেন ব্রাহ্মণদের, বোতল দিলেন কালারদের, ওজনদারী দিলেন বানিয়াদের, মাছ ধরার জাল দিলেন ধীমারদের, তাঁত দিলেন মাহারদের আর পাংকাদের বললেন তারা যেন গ্রামের দেখাশোনা করে। কিন্তু বাইগা তখনো এসে পৌছায়নি বলে সে কিছুই পেল না। তারপর বাইগা যখন জঙ্গল থেকে ফিরল তখন তিনি সব আদিবাসীদের ডাকেন জগতের একজনকে রাজা বানানোর জন্য।
এতটা বলে মাহাতু সামনের শাল গাছের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে কিছু ভেবে আবার বলতে শুরু করে।
বাকি আদিবাসীরা ভগোয়ানের সভার সব সোনা রুপোর সব আসন দখল করে বসল কিন্তু নাংগা বাইগা কোন আসন না পেয়ে মেঝেতে বাবু হয়ে ভগোয়ানের সামনে বসল। তাই দেখে ভগোয়ান খুশী হয়ে নাঙ্গা বাইগাকে হাতে করে তুলে তাঁর সিংহাসনে নিজের পাশে বসান, বলেন ‘তুমিই হবে জগতের রাজা’। কিন্তু নাঙ্গা বাইগা ভগোয়ানকে বলে তিনি যেন তার বদলে তার ভাই গোণ্ডকে রাজা করেন। একথা শুনে ভগোয়ান খুব খুশী হন এবং নাঙ্গা বাইগার প্রার্থনা মতো গোণ্ডকে রাজা করেন। আর বাইগাদের তার থেকেও বেশি আশীর্বাদ করে যান, বলেন জগতে যত রাজ্য আছে সব একদিন খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়বে, কেবল মাটি দিয়ে তৈরি যে, সেই ভুমিয়ারাজা, পৃথিবীর অধিপতি, সে কখনো পৃথিবীকে ত্যাগ করবে না, তোমাদের জীবন চলবে কেবল ধরিত্রীর উপর নির্ভর করে। তুমি মাটি খুড়ে পাবে কন্দ, তাই খাবে, জঙ্গলের কাঠ কেটে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাবে, তোমার স্ত্রী জঙ্গলের পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করবে। আর তুমি কখনো গোণ্ড আর হিন্দুদের মতো ধরিত্রী মায়ের বুক চিড়ে লাঙল চালাবে না। তুমি গাছ কেটে পুড়িয়ে তাদের ছাইয়ে বীজ বুনবে, তুমি কখনো বড়লোক হবে না। তুমি যখন ধরিত্রীকে ত্যাগ করবে তখন এই জগতে ধরিত্রীর ছোট ছোট জিনিসকে গুছিয়ে ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রাখার জন্য কেউ থাকবে না। তারপর ভগবান নাঙ্গা বাইগাকে দেখালেন কেমন করে বেওয়ার কাটতে হয় আর কেমন করে বীজ বপন করতে হয় সেইসব গাছের পোড়া ছাইতে। তিনি তাকে উপহার দিলেন নানা বীজ বেওয়ারের জন্য। গল্প শেষ হলে মাহতু চুপ করে তাকিয়ে থাকে সামনের শাল গাছের দিকে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, একদিন দিগম্বর মিশ্র তাকে ক্যান্টিনে ধরলেন। হাসতে হাসতে বললেন, কি ব্যাপার প্রভু আপনি এতো উদাসীন হয়ে আছেন কেন? বুড়ো বয়েসে প্রেমে পরলেন নাকি? একমাত্র মিশ্রজির সাথেই প্রভু খেরার হাসি মস্করার সম্পর্ক। তিনি হেসে বললেন কেন নিজে ভাবীর প্রেমে ডুবে আছেন বলে সবাইকে প্রেমে পড়তে দেখছেন। কিছুক্ষণ হাসি মস্করার পর প্রভু খেরা তার আচনাকামার যাওয়ার কথা আর লামনি গ্রাম, মিরন, এই সবের কথা বললেন আর বললেন কেন জানি কিসের আকর্ষণে বারবার তার লামনিতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। দিগম্বর মিশ্র বহুদিন থেকে প্রভু খেরাকে চিনতেন, কম কথার কাজের মানুষ, তার মতো সাচ্ছা ভালো মানুষ তিনি খুব একটা দেখেন নি, প্রভুজিকে খুব ভালোবাসতেন তিনি।
আজ ঠাট্টা করে বললেন শেষে আপনি জংলীদের খপ্পরে পড়লেন! প্রভু খেরা তার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন জংলী! আমার তো মনে হল ওরা আমাদের থেকে বেশি সভ্য। ওটাতো প্রকৃতি ও জঙ্গল নির্ভর একটা আলাদা সভ্যতা, ওরা জানে কেমন করে ঘন জঙ্গলে গাছপালা অন্য জন্তু জানোয়ারদের সাথে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে হয়। অন্যকে শোষণ করে পরজীবী হয়ে বাঁচার কোন বাসনা কারোর নেই, কাউকে কিছু প্রমাণ করতে চায় না, ওরা জানে নিজের মতো বাঁচতে, কারুর রাজা হবার বাসনা নেই, কাউকে কেউ ছোট করতে চায়না, ওখানে মানুষতো অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভর। আমরা ওদের কোণঠাসা করছি ওদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
সব শুনে মিশ্রজি বললেন বেশ তো সামনের গরমের ছুটিতে চলে যান সেখানে, বিলাসপুরে তো আমাদের পৈত্রিক বাড়ি, ওখানে গিয়ে থাকুন আর ওখান থেকে তো আচানাকমার কাছেই। প্রভু খেরা অবাক, বললেন তাই নাকি আপনারা বিলাসপুরের লোক। মিশ্রজি বললেন হাঁ আমার বাবা অনেক আগে বিলাসপুর থেকে দিল্লি চলে আসেন, সেই বাড়িতে এক সময় আমার চাচা থাকত, তিনি মারা যাবার পর এখন তো তালা দেওয়া আছে, আমারা মাঝে মাঝে ছুটিতে যাই। প্রভু খেরা ভাবলেন মন্দ হয় না, একা একা লামনিতে মাহাতুদের সঙ্গে বেশ সময় কেটে যাবে। এমনিতেই তার দিল্লি ভাল লাগে না, ছুটির সময় দিল্লিতে তার খুব একটা করার কিছু থাকে না, বেশিরভাগ সময় লাইব্রেরিতেই কাটান। এই কিছুদিন বাইগাদের নিয়ে ভেরিয়ার এলুইনের বাইগা পড়ে তার লামণিতে ফিরতে আরো ইচ্ছা করছিল। দুই বন্ধু হাসতে হাসতে হাঁটতে লাগলেন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে কলেজের লনের সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে।
***
কয়েক সেট পাজামা পাঞ্জাবি, নিজের ওষুধ আর দরকারি ব্যাক্তিগত ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গরমের ছুটিতে তিনি বিলাসপুরে মিশ্রজিদের পৈত্রিক বাড়িতে। কেয়ারটেকারকে আগে থেকেই খবর দেওয়া ছিল, কাজেই যত্ন আত্তির কোন কমতি ছিল না। বিলাসপুর দিল্লির থেকে অনেক শান্ত শহর, গরম কিন্তু দিল্লির মতোই। তিনি এসে বাসের খোঁজ নিয়ে লামনির উদ্দেশে সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলেন, ফিরবেন সেই বিকালে।
লামনি বাস স্টপে নামতেই অনেকে তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে কথা বলল। তিনি মাহাতুদের পাড়ার দিকে এগোতেই ‘দিল্লিবালে বাবা, দিল্লিবালে বাবা” বলতে বলতে কোথা থেকে এক ঝাঁক ছোট ছোট বাচ্ছার সঙ্গে দৌড়ে এসে মিরন তার হাত ধরল। তিনি পকেটের সব লজেন্স বাচ্ছাদের বিলিয়ে দিলেন, সবাই খুব খুশি। সেই আগের মতোই আছে, ছেঁড়া প্যান্ট আর ফ্রক পড়া একদল বাচ্ছা ছেলে মেয়ে তার সাথে হাঁটতে লাগল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। এবার তিনি তৈরি হয়ে এসেছেন সুতো আর সূঁচ নিয়ে। ঠিক করেছেন বাচ্ছাগুলোর ছেঁড়া জামাকাপড় যতটা পারেন সেলাই করে দিয়ে যাবেন।
মাহাতুর বাড়িতে গিয়ে দেখেন উঠোনে বেশ কয়েকজন গোল করে বসে আছে। খুব আস্তে আস্তে কিছু একটা বিষয়ে গভীর আলোচনা চলছিল। সবারই মুখে চোখে এক ধরনের হতাশা, তাকে দেখে সবাই উঠে পড়তে লাগল। তিনি একটু অবাক হলেন কারণ এরা সাধারণত অহেতুক কোন ব্যাপারে কষ্ট পায় না। এমনিতে বাইগারা খুব কম কথার লোক, হঠাৎ কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক নয় বলে তিনি চুপ করে থাকলেন। তিরনি আর জগন এসে হাসি মুখে তার সাথে কথা বলতে লাগল, যেন কত আপন। উঠোনে দু এক জন হতাশ হয়ে বসে থাকল আর বাকিরা আসতে আসতে বেরিয়ে গেল। একটু ফাঁকা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন সব ঠিক আছে কিনা।
মাহাতু খুব অসহায় ভাবে যা বলল তার মানে দাঁড়ায়, ছয় মাস আগে বন বিভাগের পাহারাদার তাদের গ্রামের যমুনাপ্রসাদ, মাহাতু আর সব বাইগাদের লামনির পাশের জঙ্গলের ভিতর রাজকেলার বাঁধ কাটার কাজ করতে বলে, বন দপ্তর ১০০ টাকা হিসাবে দিন মজুরি দেবে। সেই শুনে বাইগারা ছেলে মেয়ে সবাই বাঁধ তৈরির কাজে লেগে গিয়েছিল সব ছেড়ে। লামনির প্রায় ৩০ জন মেয়ে মরদ মিলে ৩ মাস ধরে জঙ্গলের মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করে। যমুনাপ্রসাদ প্রথম দিকে খুব অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল তাতে ওদের চলে গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর কোন টাকা দেয়নি, এই দেবো দেবো করে। তারপর কাজ শেষ হওয়ার ছয় মাস পরেও তাদের বাকি টাকা তারা পায়নি। যমুনাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলে সে প্রথমে বলছিল সরকারি পয়সা আসতে দেরি হচ্ছে, টাকা এলেই বিট অফিসার দিয়ে দেবে। এদিকে বিট অফিসার রামজীবন পাঁড়ে নাকি মাস খানেক হ’ল অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে গেছে। এখন যমুনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলছে আমি কি করব? বিট অফিসার নাকি সব নিয়ে চলে গেছে।
এদিকে যমুনাপ্রসাদের কথায় তারা বাঁধের কাজ করতে গিয়ে, গত বর্ষায় তারা নিজেদের চাষও করতে পারেনি। তাদের ঘরে আনাজ বাড়ন্ত, মেয়েরা যেটুকু কোদো কুটকি, কন্দ জঙ্গল থেকে নিয়ে আসে তাতে এই খরার মাস আর চলে না। প্রভুজি লক্ষ করলেন কথা বলার মধ্যে মধ্যে কোন আক্রোশ বা হিংসা নেই। তিনি হিসাব করে দেখলেন প্রায় নব্বই হাজার টাকা, যার মধ্যে হয়ত এরা সাকুল্যে পেয়েছে দশ হাজার, ভালো করে ওরা জানেও না কত টাকা পাবে। এদের কাছে হাজার টাকাই অনেক টাকা অথচ তারা যমুনাপ্রসাদকে মারধর করতে যাচ্ছে না বা বন দপ্তর ঘেরাও করছে না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন মাহাতুকে তাহলে কি হবে? মাহাতু বলল কি আর হবে! টাকাটা না দিলে কি করব!
রাত্রে বিলাসপুর ফিরে তার নিজেরও খুব অসহায় লাগছিল। এই মানুষগুলো নিজের মতো আছে তাদের জঙ্গলে তাদের জীবনে। এদেরকে এই ভাবে ঠকানোর কি মানে। তার হঠাৎ মনে হল তিনি কি কিছু করতে পারেন না! পরের দিন লামনি গিয়ে তিনি মাহাতুকে সঙ্গে করে নিয়ে যমুনাপ্রসাদের বাড়ি যান। তাকে মাহাতুর সঙ্গে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। সে বলে পাঁড়েসাহেব তাকে ভয় দেখিয়ে বাইগাদের দিয়ে এই বাঁধ তৈরি করতে বলেছিল। পয়সা দেওয়ার সময় সব পয়সা নিয়ে অন্য জায়গায় বদলি নিয়ে চলে গেছে। গ্রামে এখন তার মুখ দেখানো ভার হয়ে গেছে।
প্রফেসার খেরা বুঝলেন যমুনাপ্রসাদ অনেকটা সত্যি বললেও পুরো সত্যি বলেনি, বিট অফিসার যমুনাপ্রসাদকে অল্প কিছু দিয়ে বাকিটা নিয়ে সরে পড়ছে। তিনি ঠিক করলেন যেমন করেই হোক এর একটা বিহিত করতে হবে। তিনি যমুনাপ্রসাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন বন দপ্তরের এদিককার হেড অফিস বিলাসপুরে। তিনি এমনিতে নরম মানুষ, আজ কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে যমুনাপ্রসাদকে বললেন, বন দপ্তরের ওপরমহলে বিট অফিসারের কথা জানিয়ে এদের টাকার ব্যবস্থা করতে, তিনি আবার ফিরে আসবেন। তিনি ঠিক করলেন সেখানে নিজে যাবেন কথা বলতে। মাহাতু অবাক হয়ে তার আর যমুনাপ্রসাদের কথা শুনছিল, দেখে বুঝেছিল যমুনাপ্রসাদ খুব ভয় পেয়েছে।
ফেরার পথে আরো কয়েকজন গ্রামবাসী জড়ো হ’ল, তাদের কথায় বারবার দিল্লিবালে বাবা শুনে তিনি বুঝতে পারছিলেন তারা তাকে নিয়ে কথা বলছে। মাহাতুকে বলে গেলেন কাল আবার তিনি আসবেন। মাহাতুরা অবাক, এরকম তারা কখনো দেখেনি যে তাদের হকের জন্য কেউ বন দপ্তরের সঙ্গে কথা বলছে। বিলাসপুর ফিরে তিনি ফোন করলেন মিশ্রজিকে, তাকে জানানো প্রথম প্রয়োজন। তিনি সব শুনে বললেন আপনি বাইরের লোক, বিলাসপুরে নতুন, এর মধ্যে জড়াবেন না, আপনার বিপদ হতে পারে। প্রভুদত্ত খেরা অনড়, তিনি নিজে কিছু ব্যবস্থা করবেনই, তার এই দৃঢ়তা দেখে, মিশ্রজি প্রভুজির জন্য ভয় পেলেন, বললেন দাঁড়ান আমাকে একটু খবর নিতে দিন তার আগে আপনি কিছু করবেন না। প্রভুজি মনে মনে ঠিক করলেন কাল গিয়ে গ্রামে যারা কাজ করেছে তাদের দিয়ে একটা দরখাস্ত তৈরি করে দেখা করবেন বন দপ্তরের বিলাসপুর অফিসের প্রধানের সঙ্গে, দরকার হলে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে।
পরের দিন সকালে গেলেন মাহাতুর বাড়ি, গিয়ে দেখেন তার উঠোনে অনেক মেয়ে আর মরদ জড়ো হয়েছে। একজন বলল দিল্লিবালে বাবা এসে গেছে, দৌড়ে মিরন ভিড়ের মধ্যে থেকে এসে তার হাত ধরল। তিনি খাটিয়ায় বসতেই সবাই তার দিকে তাকিয়ে, সেইসব সরল চোখের দৃষ্টিতে রয়েছে বিস্ময় মিশ্রিত আশা। যা ছিল তাদের জীবনের অনেক কিছু মেনে নেবার মতো সেখানে এই অপ্রত্যাশিত আশার আলোয় তারা ভাসছে। সবাই চুপ, প্রফেসার খেরার এবার এই সব দৃষ্টির সামনে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। নিজেকে সামলে কাঁধের ঝোলা থেকে পেন আর কাগজ বের করে দরখাস্ত লিখতে শুরু করলেন। সেই দরখাস্তর শেষে কোনো বাইগার সই পেলেন না সব টিপছাপ, বুঝলেন বাইগাদের সবাই নিরক্ষর, কাছে পিঠে কোন স্কুলই নেই। তাই এত সহজে নিজেদের তৈরি নিয়মে এর বাইরের মানুষদের বেঁধে ফেলা এক অদৃশ্য নিয়মের জালে।
শুরু হল এক অদ্ভুত যুদ্ধ এটা ঠিক বাইগাদের অধিকারের লড়াই নয়, তাদের জীবনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্রষ্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতর থেকে তাদেরই নিয়মের খেলায় ন্যায়বিচার পাবার লড়াই। মিশ্রজি দিল্লী থেকে জানালেন তার একজন আত্মীয় আছেন বিলাসপুরের সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ, তিনি তাকে বলে রেখেছেন। প্রভুজি যেন তার সঙ্গে দেখা করেন। এস পি, ডঃ প্রভু খেরার হিন্দু কলেজের পরিচয় আগেই মিশ্রজির কাছে পেয়েছিলেন, তিনি চাননি আদিবাসীদের ব্যাপারটা দিল্লি পর্যন্ত গড়াক। পরের দিন তিনি পুরো ব্যাপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে প্রভুজির দরখাস্তটা দেখেন। তারপর সোজা ফোন করে বিলাসপুরে তার পরিচিত বন দপ্তরের উচ্চ পদস্থ অধিকর্তাকে পুরো ব্যপারটার গুরুত্ব বুজিয়ে বলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাইগাদের পয়সা দিয়ে দেবার উপর জোর দেন। বিলাসপুরের বন দপ্তরের উপরমহলে এই ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না, তাদের উদ্যোগে খুব দ্রুত বিষয়টার সমাধান হতে থাকে।
এর মধ্যে প্রভুজি বা লামনির দিল্লিবালে বাবা প্রতিদিনই লামনি যেতে থাকেন আর প্রতিদিন একটা করে বাচ্ছার জামা সেলাই করে দিতেন কোন গাছের নীচে বসে। তখন তাকে ঘিরে একদল বাইগা ছেলেমেয়ে তার কাজ দেখত আর হাসত। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ফর্সা লম্বা পাঞ্জাবি পাজামা পড়া বয়স্ক মানুষ শাল গাছের নীচে বাচ্ছাদের মাঝে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে জামা সেলাই করছে। এরকম একদিন মাহাতুর সঙ্গে গ্রামের সবাই দল বেঁধে তার কাছে আসে, সবার সামনে যমুন প্রসাদ। সে খবর দিল কাল বাইগাদের সব টাকা বন দপ্তরের লামনি অফিস থেকে দেওয়া হবে। সে ভীষণ ভয়ে আছে, সে খবর পেয়েছে দিল্লিবালে বাবার কেবল বিলাসপুর নয় ভোপাল এমনকি দিল্লিতেও অনেক বড় বড় লোক বন্ধু। এদিকে তাকে ঘিরে মাহাতুর সঙ্গে গ্রামের মেয়ে মরদ মাঠের মাঝে বসে গল্প জমায়। সবার মধ্যে বড় নিশ্চিন্ত এক অনুভুতি।
কাল তাকে ফিরতে হবে দিল্লি, কিন্তু এ সমস্যা কোন এক সমস্যা নয়। তিনি অনুভব করছিলেন যে এই নিরক্ষর আদিম জনজাতির সামনে আরো অনেক বড় সমস্যা এগিয়ে আসছে। একবার অভয়ারণ্য হয়ে গেলে এরা নিজের দেশেই গৃহহীন বাস্তুহারা হবে।
***
হিন্দু কলেজের বড় প্রেক্ষাগৃহ আজ ভর্তি, সমাজ বিজ্ঞানের ও কলা বিভাগের ছাত্র ও শিক্ষকরা বসে আছে, অন্য বিভাগের কিছু ছাত্রও আছে এ ছাড়াও অন্য কলেজের ছাত্ররাও আজকের এই বক্তৃতা শুনতে এসেছে। বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসার বিদ্যুল্লেখা শ্রীনিভাসন ডায়াসে তখন তার সুন্দর দৃঢ় গলায় বোঝাচ্চিলেন রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে উত্তর আধুনিক সময়ে নৃতত্বে জাতিতত্ত্বের গুরুত্ব নিয়ে। সাধারণত তাঁর মতো জ্ঞানী খ্যাতনামা মনীষাকে কলেজের ছাত্ররা তাদের মধ্যে পায় না। আজ তাই হিন্দু কলেজের পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের শ্রোতামণ্ডলী মুগ্ধ হয়ে তাঁর সহজ ভাষায় জটিল বিষয়ের বিশ্লেষণ শুনছিল। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর আলোচনা পূর্ব ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে এসে শেষ করলেন তখন হিন্দু কলেজের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল।
আজ কয়েক বছর ধরেই হিন্দু কলেজে প্রভু স্যার, মানে অধ্যাপক প্রভুদত্ত খেরার উদ্যোগে সামাজিক নৃতত্ত্ব বিভাগে এই লেকচার সিরিজ চলছে। এই সিরিজে প্রতি মাসে সমাজ বিজ্ঞানের কোন না কোন শাখার বিশিষ্ট জ্ঞানী, গবেষক ব্যক্তিদের আমন্ত্রনি বক্তৃতা এগুলি। এই লেকচারের প্রতি শুধুমাত্র ছাত্রদের মধ্যেই নয় অনেক শিক্ষকদের মধ্যেও বেশ উৎসাহ দেখা যায়, সাধারণত এই ধরনের জ্ঞানী ও পণ্ডিত মানুষদের ছাত্ররা সচরাচর কলেজের গণ্ডীতে দেখে না। ছাত্রদের মধ্যে বসে দীর্ঘদেহী প্রভু খেরা মন দিয়ে লেকচার শুনছিলেন। আজকাল তিনি খুব মন দিয়ে কিছু খোঁজার আর বোঝার চেষ্টা করেন। সব বিষয়ই যেন এক বিশেষ সমজাতীয় সংস্কৃতি, সমাজ ও জাতির দ্বারা তাদের জন্য তৈরি, যারা নিজেদেরই মুলধারা নামে প্রতিষ্ঠা করেছে। যারা এদের বাইরে, তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকেও দেখা হচ্ছে সেই একই মূলধারার লেন্স দিয়ে।
প্রশ্ন-উত্তরের সময় কয়েকটা প্রশ্ন শেষ হলে, প্রভু স্যার হাত তুলে জিজ্ঞাসা করলেন; যে সব আদিবাসী সমাজে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ভোগ এবং উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির কোন নিয়মই মানে না, যারা আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন দক্ষতা অর্জন করে নি, সেই সব সমাজে বর্তমান উত্তর আধুনিক সময়ে কি ধরনের পরিবর্তন আসবে? তাদের ভবিষ্যৎই বা কি? বিদ্দ্যুলেখা দেবী মন দিয়ে প্রশ্নটি শুনে একটু ভাবলেন, আদিবাসী সমাজ জীবন তার গবেষণার বিষয়ের থেকে কিছুটা দুরের। তিনি জানেন হিন্দু কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার হলেও প্রভু খেরার সামাজিক নৃতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষ করে মধ্যভারতের আদিবাসী সমাজ জীবন সম্পর্কে জ্ঞান, আভিজ্ঞতা ও কাজ শিক্ষাবিদ মহলে বহু আলচিত বিষয়।
তিনি কৌতূহলের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে এমন কোন আদিবাসী সমাজ কি আছে যে এখনো ভারতবর্ষের বর্তমান বৃহত্তর বাজার অর্থনীতির বাইরে? বেশিরভাগ আদিবাসীই তো চাষ আবাদের কাজের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর অর্থনীতির অংশ। প্রফেসার খেরা একটু চুপ করে থেকে বললেন ভারতবর্ষে এখনো কিছু আদিবাসী আদিম জনগোষ্ঠী, মূলত হান্টার-গেদারারস আছে যাদের কাছে এই রাষ্ট্রের উপস্থিতি তাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিবন্ধী, আর তারা যেহেতু এই পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার বাইরে তাই রাষ্ট্রের চোখেও তাদের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এদের উৎপাদন ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ, গোষ্ঠীর সকল সদস্যর প্রয়োজন মেটানোর জন্য স্বয়ম্ভর, যাদের সমাজ জীবনে বাজার বা রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নেই, তাদের কি হবে? তাদের সমাজের বাইরের পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন জোর করে তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে, তখন তাদের কি হবে? তারা কি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা ও স্বয়ম্ভর জীবনযাত্রা হারিয়ে ফেলবে না? তাদের জীবিকা ও জীবনযাপন কি গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে না? এবং সবশেষে সেই জনগোষ্ঠীর পরিণাম কি হবে?
প্রফেসার শ্রীনিভাসন চিন্তিত স্বরে বললেন বলা মুশকিল। দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার এরকম বহু জনজাতি হারিয়ে গেছে। একবার তাঁর নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থার জ্ঞান ও দক্ষতা নষ্ট হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব। এর সঙ্গে সেই জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন নতুন ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে গেলে তাঁর পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থায় ফেরার তাগিদও শেষ হয়ে যায়। এরা হয়ত তাদের অন্য জনজাতি হিসাবে যে সাংস্কৃতিক পরিচিতি তা হারাবে। তাঁর কথা শেষ হতেই আরো নানা তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ সংক্রান্ত মেধাবী আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর চলতে থাকে।
মাথা নামিয়ে ছাত্রদের মধ্যে বসে প্রভু স্যার মাথা নিচু করে চিন্তিত মুখে কিছু ভাবতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কানে লেকচার হলের আওয়াজ জঙ্গলের ঝিঁঝিঁর আওয়াজের মতো বাজতে লাগলো, শাল জঙ্গলের বড় বড় শাল গাছের মধ্যে হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সড় সড় করে শুকনো শাল পাতারা অল্প উড়ে উড়ে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। হটাত তাঁর চোখে পড়ল জঙ্গলের বড় শাল গাছের গুঁড়ির পাশ থেকে এক বালক অবাক চোখে তাকে দেখছে, চোখে কোন ভয় নেই কৌতূহল ভরা হাসির ছোঁয়া। তিনি থমকে দাঁড়ালেন হাসি হাসি মুখে বালকটির দিকে তাকিয়ে, এই জঙ্গলে তো বাঘের উপস্থিতির কথা খেয়াল হতেই ভয়ের শিহরণ তাকে ছুয়ে যায়, আর তখনই তার সম্বিত ফিরল সমীরার ডাকে, ‘স্যার লেকচার শেষ হয়ে গেছে, আপনাকে ভোট অফ থাঙ্কস দিতে যেতে হবে’। ছাত্রদের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসার প্রভু দত্ত খেরা।
***
রাতে ঘরে ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবলেন তার এখানে আর প্রয়োজন নেই, কোনদিনই কি ছিল! তিনি তার নিজের প্রয়োজনে হিন্দু কলেজে আসেন, তিনি যখন চলে যাবেন তখন আর কেউ আসবে কিন্তু আচানকমারের মিরনদের কি হবে? এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক নিরক্ষর আদিম জনজাতির শিশুর ভবিষ্যৎ কি? সরকারের কাছে এই প্রান্তিক আদিম জনজাতি কিছু সংখ্যা আর তথ্য ছাড়া কিছু নয়। তাকে ফিরে যেতে হবে সবার আগে বাইগাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা আগামীর বড় সমস্যার জন্য কিছুটা তৈরি হতে পারে। তাকে ফিরে যেতে হবে লামনিতে, বাইগা হয়ে বাস করতে হবে সেখানে, তাহলে বাইরের মূলধারার রাষ্ট্রীয় বিপদ কিছুটা হলেও সংযত হবে।
জীবনের পরবর্তী তিরিশ বছর ডঃ প্রভু দত্ত খেরা হয়ে গেলেন আচানাকমারের দিল্লিবালে বাবায়। বসবাস শুরু করলেন লামনিতে বাইগাদের মতো করে, কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু করলেন ছাপরাওয়ার বাইগাদের স্কুল।
(ডঃ প্রভু দত্ত খেরার জীবনী অবলম্বনে লেখা এক কাল্পনিক কাহিনী। ডঃ খেরা ১৯২৮ শালে লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৯ সালে, একানব্বই বছর বয়েসে দেহত্যাগ করেন, আমরণ বাইগাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে। ছাপরাওয়ায় তার তৈরি স্কুল এখনো নানা অসুবিধার মধ্যেও ঐ অঞ্চলের বাইগা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন করে চলেছে।)
তথ্য সুত্র:
১) The Baiga and the Sal Forest: P D Khera
২) The Baiga, Verrier Elwin
৩) Itineraries of a Reclusive, College Teacher: P.D. Khera (1928–2019: Vinay Kumar Srivastava
Director Anthropological Survey of India
৪) villagers Interview during visit to Achanakmar in April 2021