সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
শেষ পর্ব
জাতীয়তাবাদ থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বেশির ভাগ কথা আগের পর্বেই বলা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে কথা একবার শুরু করলে সহজে শেষ হয় না। কি তাঁর ব্যক্তিগত কর্মময় ও ঝঞ্ঝাময় জীবন, কি তাঁর সমসাময়িক সমাজ, এ সব নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়। এবং একাধিক লেখক লিখেছেনও, যেমন ইন্দ্রমিত্র, বিনয় ঘোষ, অরবিন্দ পোদ্দার, অশোক সেন। কেউ বা গল্পের মত করে, কেউ বা ক্রিটিকাল অ্যানালিসিসের ধারায়। সেসব গল্প এবং ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস এত স্বচ্ছন্দ ও সুন্দর, যে এ লেখায় সেসব কথাই আবার ফিরে বলার কোনো মানে হয় না। অতএব বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অন্য দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা তাঁকে এখানেই ছেড়ে যেতে পারি। সে কথাদুটোর প্রথমটা হল, ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র, লাটসাহেব থেকে শুরু করে সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষজনের সঙ্গে যাঁর সাবলীল সম্পর্ক ছিল। দ্বিতীয়, ১৮৭২ সালে তিনি নিজের জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম, কর্মস্থল শহর কোলকাতা সংক্ষেপে গোটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে কর্মাটাঁড়ে থাকতে চললেন। তাঁর এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যে স্বাদেশিকতার ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল তার শেষ হল আর সেই ১৮৭২ সালেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা, যা অচিরে জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক এবং সুপ্তভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের গর্ভগৃহ হয়ে উঠল।
বঙ্কিমচন্দ্র
ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনামূলক তীক্ষ্ণ ও সরস গদ্য লেখার এবং বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণির উপন্যাসের জনক হওয়ার সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের সাহিত্য সম্রাট। এবং সে উপাধি অযৌক্তিকও নয়। যেভাবে তিনি তাল ঠুকে তাঁর অনবদ্য বাংলা ভাষা ও বিচিত্র বিষয়ের মেলবন্ধনে বাংলা সাহিত্যের আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে অবশ্যই ঐ উপাধি তাঁর প্রাপ্য। লেখনির মধ্যে দিয়ে তিনি দেশকে বহু ব্যাপারে আলো দেখাতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার নিয়মিত চর্চার পথিকৃৎ। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোর সমালোচক। তিনি শিক্ষিত উচ্চ সমাজকে গৌরবের গজদন্তমিনার থেকে নেমে এসে এবং সাহেবদের অনুকরণের পথ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনার গহনে যখন যাই, কতকগুলো ব্যাপারে ঘোরতর সংশয় উপস্থিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার দুটি পর্যায়। এই প্রবন্ধে ১৮৬৩-৬৪ থেকে ১৮৮২ সালকে প্রথম পর্যায় এবং ১৮৮২ থেকে ১৮৯২ সালকে দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাবনার মিল আছে অমিলও আছে। প্রথম পর্যায়ের কিছু কিছু ভাবনার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের কিছু কিছু ভাবনার আন্তঃসম্পর্ক আছে। প্রথম পর্যায়ের কিছু ভাবনা দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে, কিছু ভাবনা দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে আরো জমাট বেঁধেছে। আবার এমনও হয়েছে একই প্রবন্ধের মধ্যে নানা বিরুদ্ধ ভাব ও যুক্তির সমাবেশ ঘটেছে। তবু সামগ্রিক বিচারে প্রথম পর্যায়ের বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে পাই অপেক্ষাকৃত লিবারাল খোলামেলা স্থিতধী এক বঙ্কিমচন্দ্রকে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষত তাঁর সৃষ্টির শেষ দশ বছরে যে বঙ্কিমচন্দ্রকে পাই তিনি হয়ে উঠেছেন ভীষণরকম একমুখী, সংকীর্ণ এবং আক্রমণাত্মক।
বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে আগাগোড়া এক দ্বিমুখিতা (ambivalence) কাজ করেছিল। ১৮৬৩-৬৪ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে তিনি তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন, যেগুলি হল যথাক্রমে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৩-৬৪), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) ও ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯)। এর মধ্যে ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটি আমাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই উপন্যাসেই তিনি প্রথম স্পষ্টভাবে ‘হিন্দুরাজ্য’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই হিন্দুরাজ্যই আজকের হিন্দুরাষ্ট্র চাওয়াতে পরিণত হয়েছে।
মৃণালিনীঃ প্রথমেই সে ব্যক্তি আমাকে “মা” বলিয়া বলিল, “আমি তোমাকে মাতৃ-সম্বোধন করিতেছি—আমি তোমার পুত্র, কোন আশঙ্কা করিও না। আমার নাম মাধবাচার্য, আমি হেমচন্দ্রের গুরু। কেবল হেমচন্দ্রের গুরু এমত নহি; ভারতবর্ষের রাজগণের মধ্যে অনেকের সহিত আমার সেই সম্বন্ধ। আমি এখন কোন দৈবকার্যে নিযুক্ত আছি, তাহাতে হেমচন্দ্র আমার প্রধান সহায়; তুমি তাহার প্রধান বিঘ্ন।”
আমি বলিলাম, “আমি বিঘ্ন?” মাধবাচার্য কহিলেন, “তুমিই বিঘ্ন। যবনদিগের জয় করা, হিন্দুরাজ্যের পুনরুদ্ধার করা, সুসাধ্য কর্ম নহে; হেমচন্দ্র ব্যতীত কাহারও সাধ্য নহে; হেমচন্দ্রও অনন্যমনা না হইলে তাঁর দ্বারাও এ কাজ সিদ্ধ হইবে না। যতদিন তোমার সাক্ষাৎলাভ সুলভ থাকিবে, ততদিন হেমচন্দ্রের তুমি ভিন্ন অন্য ব্রত নাই—সুতরাং যবন মারে কে?”
অতঃপর বঙ্গদর্শন পত্রিকা দিয়ে তাঁর সুষ্ঠুভাবে প্রবন্ধ লেখালেখির শুরু। দ্বিমুখিতার উদাহরণ অনেক আছে। আপাতত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা বঙ্গদর্শনের (১৮৭২) তৃতীয় প্রবন্ধ ‘ভারত-কলঙ্ক’ই বেছে নেওয়া যাক, কারণ এই প্রবন্ধে তিনটি পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সমাবেশ আছে। প্রথমটি হল ভারতবর্ষীয়দের রণকুশলতা বিষয়ে। ইংরেজরা যে অহরহ হিন্দুদের Effeminate Hindus বা হীনবল হিন্দু বলে ছোট করত সেটা তাঁর গায়ে লেগেছিল। তাই ঐ শব্দদুটি দিয়েই ‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধের শুরু। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের চতুর্থ সংস্করণের বিজ্ঞাপনে (১৮৯৩) তিনি নিজেই সে কথা বলেছিলেনঃ
‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধে আমি বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি, ভারতবর্ষের অধঃপতনের কারণ কি। হিন্দুদিগের বাহুবলের অভাব সে সকল কারণের মধ্যে নহে। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুদিগের বাহুবলের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। ব্যায়ামের অভাবে মনুষ্যের সর্বাঙ্গ দুর্বল হয়। জাতি সম্বন্ধেও সে কথা খাটে। ইংরেজ সাম্রাজ্যে হিন্দুর বাহুবল লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু তাহার পূর্বে কখনও লুপ্ত হয় নাই। হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণস্বরূপ আমি রাজসিংহকে লইয়াছি।
তিনি জানতেন যুদ্ধই হল পশ্চিমী সভ্যতার বনিয়াদ, প্রাচ্য সভ্যতা, বিশেষত সত্য, অস্তেয়, অহিংসার দেশ ভারতবর্ষের অবস্থান যার একেবারে বিপরীতে, আর তবু তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষীয়রাও যে যথেষ্ট যুদ্ধ করতে জানত, শুধু সেই কথাটা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন। এখানে তিনি পশ্চিমের যোধশক্তির সঙ্গে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের যোধশক্তির সমকক্ষতা প্রদর্শনের চেষ্টা করলেন। এই যে চেষ্টা এ উপনিবেশিকতার শিকার হওয়া ছাড়া আর কী? আজকালকার ভাষায় এ যেন অনেকটা, ইউরোপীয়দের তৈরি করে দেওয়া মাঠেই তিনি খেলতে নামলেন। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অস্ত্রলোলুপতা, তার শেকড় আছে এই ধরনের ধারণায়। এক আলেক্সজান্ডারের যুদ্ধকালের প্রসঙ্গে ছাড়া প্রধানত ঐতিহাসিক, পুরাতাত্ত্বিক ইত্যাদি উপাদানের তৎকালীন অপ্রতুলতার কারণে প্রাচীন ভারতবর্ষের রণকুশলতার উদাহরণ তিনি অবশ্য তেমন দিতে পারেন নি আর মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তিনি প্রধানত আরবদের উদাহরণ দিয়েছিলেন
...আরব-দেশীয়েরা এক প্রকার দিগবিজয়ী। যখন যে দেশ আক্রমণ করিয়াছে, তখনই তাহারা সেই দেশ জয় করিয়া পৃথিবীতে অতুল সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। তাহারা কেবল দুই দেশ হইতে পরাভূত হইয়া বহিষ্কৃত হয়। পশ্চিমে ফ্রান্স, পূর্বে ভারতবর্ষ। আরব্যেরা মিশর ও শিরিয় দেশ মহম্মদের মৃত্যুর পর ছয় বৎসর মধ্যে, পারস্য দশ বৎসরে, আফ্রিকা ও স্পেন এক এক বৎসরে, কাবুল অষ্টাদশ বৎসরে, তুর্কস্থান আট বৎসরে সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত করে। কিন্তু তাহারা ভারতবর্ষ জয়ের জন্য তিন শত বৎসর পর্যন্ত যত্ন করিয়াও ভারতবর্ষ হস্তগত করিতে পারে নাই। মহম্মদ বিনকাসিম সিন্ধুদেশ অধিকৃত করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি রাজপুতানা হইতে পরাভূত হইয়া বহিষ্কৃত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার মৃত্যুর কিছুকাল পরে সিন্ধু রাজপুতগণ কর্তৃক পুনরাধিকৃত হইয়াছিল। ভারত জয় দিগবিজয়ী আরবদিগের সাধ্য হয় নাই।...
তিনি জানতেন জাতি নিয়ে ইউরোপে কী ভয়ংকর অবস্থা চলেছে আর তবু তিনি সমুদয় আধুনিক ভারতের জন্য জাতিপ্রতিষ্ঠা কামনা করলেন। এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে জাতি শব্দে বঙ্কিমচন্দ্র সর্বদাই nationality বা nation-এর কথা বলেছেন (দেখুন ‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত টীকা)
আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু, রাম হিন্দু, যদু হিন্দু, আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দুমাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল, তাহাতেই আমার মঙ্গল। যাহাতে তাহাদের মঙ্গল নাই, আমারও তাহাতে মঙ্গল নাই। অতএব সকল হিন্দুর যাহাতে মঙ্গল হয়, তাহাই আমার কর্তব্য। যাহাতে কোন হিন্দুর অমঙ্গল হয় তাহা আমার অকর্তব্য। যেমন আমার এইরূপ কর্তব্য আর এইরূপ অকর্তব্য, তোমারও তদ্রূপ, রামেরও তদ্রূপ, যদুরও তদ্রূপ, সকল হিন্দুরই তদ্রূপ। সকল হিন্দুরই যদি এইরূপ কার্য হইল, তবে সকল হিন্দুর কর্তব্য যে একপরামর্শী, একমতাবলম্বী, একত্র মিলিয়া কার্য করে, এই জ্ঞান জাতিপ্রতিষ্ঠার প্রথম ভাগ; অর্ধাংশ মাত্র।
হিন্দুজাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অন্য অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নয়। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল, সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতিপীড়ন করিতে হয়, করিব। অপিচ যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে, তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল হইতে পারে। হয় হউক, আমরা সে জন্য আত্মজাতির মঙ্গলসাধনে বিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিতে হয়, তাহাও করিব। জাতিপ্রতিষ্ঠার এই দ্বিতীয় ভাগ।
দেখা যাইতেছে যে, এইরূপ মনোবৃত্তি নিষ্পাপ পরিশুদ্ধ ভাব বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না। ইহার গুরুতর দোষাবহ বিকার আছে। সেই বিকারে, জাতিসাধারণের এরূপ ভ্রান্তি জন্মে যে, পরজাতির মঙ্গলমাত্রেই স্বজাতির অমঙ্গল, পরজাতির অমঙ্গলমাত্রেই স্বজাতির মঙ্গল বলিয়া বোধ হয়। এই কুসংস্কারের বশবর্তী হইয়া ইউরোপীয়রা অনেক দুঃখ ভোগ করিয়াছে। অনর্থক ইহার জন্যে অনেকবার সমরানল ইউরোপ দগ্ধ করিয়াছে (বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড; বিবিধ প্রবন্ধ)।
এ পর্যন্ত পড়ে আমাদের মনে হয় এ একেবারে আমাদের মনের কথা। আমাদের সাহিত্যসৃষ্টির ঊষাকালেই এমন একজন মানুষ যে এসব কথা উচ্চারণ করে গেছেন তিনি বাস্তবিকই ঋষিকল্প। কিন্তু ঠিক তার অব্যবহিত পরের অনুচ্ছেদেই আমরা কি দেখি?
স্বজাতি-প্রতিষ্ঠা ভালই হউক বা মন্দই হউক, যে জাতিমধ্যে ইহা বলবতী হয়, সে জাতি অন্য জাতি অপেক্ষা প্রবলতা লাভ করে। আজি কালি এই জ্ঞান ইউরোপে বিশেষ প্রধান, এবং ইহার প্রভাবে তথায় অনেক বিষম রাজ্যবিপ্লব ঘটিতেছে। ইহার প্রভাবে ইটালি এক রাজ্যভুক্ত হইয়াছে। ইহার প্রভাবে বিষম প্রতাপশালী নূতন জার্মান সাম্রাজ্য স্থাপিত হইয়াছে। আরও কি হইবে বলা যায় না।
এমত বলি না যে, ভারতবর্ষে এই জাতিপ্রতিষ্ঠা কস্মিন্কালে ছিল না। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, আর্যজাতীয়েরা চিরকাল ভারতবর্ষবাসী নহে। অন্যত্র হইতে ভারতবর্ষে আসিয়া, তদ্দেশ অধিকার করিয়াছিল। প্রথম আর্যজয়ের সময়ে বেদাদির সৃষ্টি হয়, এবং সেই সময়কেই পণ্ডিতেরা বৈদিক কাল কহেন। বৈদিক কালে এবং তাহার অব্যবহিত পরেই জাতিপ্রতিষ্ঠা যে আর্যগণের মধ্যে বিশেষ বলবতী ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ বৈদিক মন্ত্রাদিমধ্যে পাওয়া যায়। তৎকালিক সমাজনিয়ন্তা ব্রাহ্মণেরা যেরূপে সমাজ বিধিবদ্ধ করিয়াছিল, তাহাও ঐ জ্ঞানের পরিচয়স্থল। আর্য বর্ণে এবং শূদ্রে যে বিষম বৈলক্ষণ্য বিধিবদ্ধ হইয়াছে, তাহাও ইহার ফল। কিন্তু ক্রমে আর্যবংশ বিস্তৃত হইয়া পড়িলে আর সে জাতিপ্রতিষ্ঠা রহিল না। আর্যবংশীয়েরা বিস্তৃত ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ অধিকৃত করিয়া স্থানে স্থানে এক এক খণ্ড সমাজ স্থাপন করিল। ভারতবর্ষ এরূপ বহুসংখ্যক খণ্ড সমাজে বিভক্ত হইল। সমাজভেদ, ভাষার ভেদ, আচার ব্যবহারের ভেদ, নানা ভেদ, শেষে জাতিভেদে পরিণত হইল। বাহ্লিক হইতে পৌণ্ড্র পর্যন্ত, কাশ্মীর হইতে চোলা ও পাণ্ড্য পর্যন্ত সমস্ত ভারত-ভূমি মক্ষিকাসমাকুল মধুচক্রের ন্যায় নানা জাতি, নানা সমাজে পরিপূর্ণ হইল। পরিশেষে, কপিলাবস্তুর রাজকুমার শাক্যসিংহের হস্তে এক অভিনব ধর্মের সৃষ্টি হইলে, অন্যান্য প্রভেদের ওপর ধর্মভেদ জন্মিল। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন ধর্ম; আর একজাতীয়ত্ব কোথায় থাকে? সাগরমধ্যস্থ মীনদলবৎ ভারতবর্ষীয়েরা একতাশূন্য হইল (ঐ)।
প্রয়োজনের খাতিরে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিগুলো দিতে হল। দেখা যাচ্ছে এখানে তিনি জাতিপ্রতিষ্ঠার পক্ষেই কথা বলছেন। তিনি ইটালি ও জার্মানির উদাহরণ দিয়েছেন এবং পরোক্ষে বলতে চান যে জাতি-ঐক্যের মধ্যে দিয়ে আমাদেরও সেইরকম ‘বিষম প্রতাপশালী’ হয়ে ওঠা উচিত। যে ইটালি ও জার্মানির উদাহরণ তিনি দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে তাঁর মৃত্যুর (১৮৯৪ সাল) পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই সেই ইটালি ও জার্মানি কোন্ চেহারায় আবির্ভূত হবে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আমাদের দেশেও বাইরে থেকে আসা আর্যরা অনুরূপ জাতিপ্রতিষ্ঠা করেছিল, পরে তারা যখন সারা ভারতময় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন আর সে জাতিপ্রতিষ্ঠা থাকে নি। নানা ভেদ থেকে ক্রমে জাতিভেদের উৎপত্তি হয়ে নানা জাতি নানা সমাজের সৃষ্টি হয়।
এহ বাহ্য, বুদ্ধদেবকে নিয়ে তিনি কী বললেন? শাক্যসিংহ এসে নাকি অন্যান্য প্রভেদের ওপর ধর্মভেদের সৃষ্টি করেন। তখন একজাতীয়ত্ব বলে আর কিছু রইল না, সমগ্র ভারত একতাশূন্য হল। শাক্যসিংহ সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরে অবশ্য বদলে গিয়েছিল এবং শাক্যসিংহকে খুব উঁচুতে স্থান দিয়েছিলেন। বদলে যাওয়া সেই ধারণার কথা তাঁর ‘সাম্য’ প্রবন্ধে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানেও শাক্যসিংহ যে ভারতবর্ষকে একতাশূন্য করেছিলেন, সেই ধারণা পালটে যাওয়ার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।
ঐক্যের জন্য জাতি (nation) জিনিসটা কি এতই দরকারি? আমাদের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি কি মানুষে মানুষে ঐক্যের মাধ্যম ছিল না? এমনকি আধুনিক কালেও হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে যার যার পুণ্যস্থান তাদের সম্প্রদায়গত ঐক্যের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তীর্থযাত্রায় হিন্দুদের মধ্যে বর্ণ বা জাতের ভেদাভেদ করা হয় না। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন যে ভাগ আছে, তীর্থযাত্রায় সে ভেদাভেদ করা হয় না। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে জগদীশ নারায়ণ সরকার দেখিয়েছেন, গ্রামে হিন্দু মুসলমানরা মিলে শান্তিতেই দিন কাটাত। ব্রাহ্মণরা তাদের ম্লেচ্ছ আচারগুলো থেকে দূরেই থাকতেন, কিন্তু তাতে করে গ্রামের মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের কোনো হানি ঘটে নি। নগরে কাজী সংকীর্তন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে শ্রীচৈতন্য যখন রেগে গিয়ে সদলবলে কাজীর বাড়ি ঘেরাও করেন, তখন কাজী বলেছিলেন,
গ্রাম-সম্পর্কে চক্রবর্তী হয় মোর চাচা
দেহ-সম্বন্ধ হইতে হয় গ্রাম-সম্বন্ধ সাঁচা।
নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।।
অর্থাৎ তখন দেহ-সম্বন্ধের থেকে গ্রাম-সম্বন্ধ বেশি মূল্যবান ছিল এবং এই গ্রাম-সম্বন্ধে সকল গ্রামবাসী এক সূত্রে গাঁথা ছিল। পরিবার থেকে গ্রাম বা নগর, সেখান থেকে জনপদ। ব্রিটিশ-সৃষ্ট ভারতবর্ষের অস্তিত্ব তখন ছিল না, কাজেই এই বিন্যাস নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, মুসলমান আমলগুলোতেই বহু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। অতএব জাতি প্রতিষ্ঠার আধুনিক ভাবনায় মেতে গিয়ে বিচিত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে যে ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই এক, ইউরোপের আদলে সেই ভারতবর্ষকে একজাতি-ভাবনায় জারিত করার কোনো দরকার ছিল না। আসলে এর নেপথ্যে কাজ করেছিল হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা।
‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধের শেষাংশে আগের অনুচ্ছেদের জের টেনে তিনি বলছেনঃ
এই ভারতবর্ষে নানা জাতি। বাসস্থানের প্রভেদে, ভাষার প্রভেদে, বংশের প্রভেদে, ধর্মের প্রভেদে, নানা জাতি। বাঙ্গালি, পঞ্জাবী, তৈলঙ্গী, মহারাষ্ট্রী, রাজপুত, জাঠ, হিন্দু, মুসলমান, ইহার মধ্যে কে কাহার সঙ্গে একতাযুক্ত হইবে? ধর্মগত ঐক্য থাকিলে বংশগত ঐক্য নাই, বংশগত ঐক্য থাকিলে ভাষাগত ঐক্য নাই, ভাষাগত ঐক্য থাকিলে নিবাসগত ঐক্য নাই। রাজপুত জাঠ, এক ধর্মাবলম্বী হইলে, ভিন্নবংশীয় বলিয়া ভিন্ন জাতি; বাঙ্গালি বেহারী একবংশীয় হইলে ভাষাভেদে ভিন্ন জাতি; মৈথিলি কনোজী একভাষী হইলে নিবাসভেদে ভিন্ন জাতি। কেবল ইহাই নহে। ভারতবর্ষের এমনই অদৃষ্ট, যেখানে কোন প্রদেশীয় লোক সর্বাংশে এক; যাহাদের এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতি, এক দেশ, তাহাদের মধ্যেও জাতির একতাজ্ঞান নাই। বাঙ্গালির মধ্যে বাঙ্গালিজাতির একতা বোধ নাই, শীকের মধ্যে শীকজাতির একতা বোধ নাই।
ইতিহাসকীর্তিত কালমধ্যে কেবল দুইবার হিন্দুসমাজমধ্যে জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয় হইয়াছিল। একবার, মহারাষ্ট্রে শিবাজী এই মহামন্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন। তাঁহার সিংহনাদে মহারাষ্ট্র জাগরিত হইল। তখন মহারাষ্ট্রীয়ে মহারাষ্ট্রীয়ে ভ্রাতৃভাব হইল। এই আশ্চর্য মন্ত্রের বলে অজিতপূর্ব মোগল সাম্রাজ্য মহারাষ্ট্রীয় কর্তৃক বিনষ্ট হইল। চিরজয়ী মুসলমান হিন্দু কর্তৃক বিজিত হইল। সমুদায় ভারতবর্ষ মহারাষ্ট্রের পদাবনত হইল। অদ্যাপি মারহ্রাট্রা, ইংরেজের সঙ্গে ভারতবর্ষ ভাগে ভোগ করিতেছে।
দ্বিতীয়বারের ঐন্দ্রজালিক রণজিৎ সিংহ। ইন্দ্রজাল খালসা। জাতীয় বন্ধন দৃঢ় হইলে পাঠানদিগের কিয়দংশও হিন্দুর হস্তগত হইল। শতদ্রুপারে সিংহনাদ শুনিয়া, নির্ভীক ইংরেজও কম্পিত হইল। ভাগ্যক্রমে ঐন্দ্রজালিক মরিল। পটুতর ঐন্দ্রজালিক ডালহৌসির হস্তে খালসা ইন্দ্রজাল ভাঙ্গিল। কিন্তু রামনগর এবং চিলিয়ানওয়ালা ইতিহাসে লেখা রহিল।
যদি কদাচিৎ কোন প্রদেশখণ্ড জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয়ে এতদূর ঘটিয়াছিল, তবে সমুদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত? (ঐ)।
‘ভারতবর্ষে নানা জাতি’ তাঁর এই উপলব্ধি বাস্তব সত্য। ‘সমুদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত?’ তাঁর এই আকাঙ্খাও অতি মহৎ। কিন্তু শিবাজীর উদাহরণে ‘চিরজয়ী মুসলমান হিন্দু কর্তৃক বিজিত হইল’ যখন তিনি বলেন, তখন সন্দেহ হয় ‘একজাতীয় বন্ধন’ বলতে প্রকারান্তরে তিনি হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথাই বলছেন না তো?
ঘটনা হচ্ছে চিরজয়ী মুসলমান শিবাজীর শত্রু ছিল না, তাঁর লড়াই ছিল মোগলদের সঙ্গে। তা নাহলে তাঁর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে মুসলমানদেরও সমান জায়গা ছিল। তাঁর প্রশাসনে প্রচুর মুসলমান উচ্চ পদে আসীন ছিল, তাঁর নৌসেনাবাহিনীতে প্রচুর মুসলমান ছিল এবং তুর্কীদের তিনি তাঁর রাজ্যে এসে মসজিদ তৈরির আহ্বান জানিয়েছিলেন। অতএব শিবাজীকে কোনভাবেই শুধুমাত্র হিন্দুদের রাজা বলা যায় না, বরঞ্চ শিবাজীর শাসনকাল ভারতবর্ষের অধিবাসীদের একজাতীয় বন্ধনের (প্রধানত হিন্দু মুসলমানের মেলবন্ধনের) উদাহরণ হিসেবে চমৎকার। তবে এটা ঠিক, যে উপায়ে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সেটা খুবই নিন্দনীয়। শিবাজীর রাজস্বের এবং অন্যান্য খরচের সবটাই আসত লুঠ থেকে। তাঁর সময় সুরাট ছিল মোগলদের অধীনে থাকা এক বিশাল সমৃদ্ধ শহর। মোগলদের অধীনে হলেও সেখানে থাকত প্রচুর হিন্দু ও মুসলমান। তার সঙ্গে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসি বাণিজ্যকুঠীগুলিও ছিল। এই সুরাটকে তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিলেন। তার ওপর তিনি অন্যায়ভাবে তাঁর অধিকৃত এলাকার সর্বত্র দুটি কর বসিয়েছিলেন। চৌথ এবং সরদেশমুখী।
বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ (১৮৯২)। এর দু’ বছর পরেই বঙ্কিমচন্দ্র গত হন। আগেই বলা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন অনেক বেশি সংকীর্ণ ও আক্রমণাত্মক। একমাত্র সামাজিক উপন্যাসগুলি ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসই যবনদের ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু ‘সীতারাম’ উপন্যাসে তিনি যেভাবে যবন প্রসঙ্গে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন, তেমনটা এমনকি ‘আনন্দমঠ’এও হননি।
এদিকে গঙ্গারাম কষ্টে অথচ নির্বিঘ্নে লোকারণ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কষ্টে—কেন না, আসিতে আসিতে দেখিলেন যে, সেই জনতামধ্যে একটা ভারী গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কোলাহল ভয়ানক হইল, লোকসকল সম্মুখে ছুটিতে লাগিল। অশ্বারোহণের কৌশল গঙ্গারাম তেমন জানিতেন না; ঘোড়া সামলাইতেই তাঁহাকে এত ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল যে, তিনি আর কোন দিকে চাহিয়া দেখিতে পারিলেন না যে, কোথায় কি হইতেছে। কেবল “মার! মার!” একটা শব্দ কানে গেল।
লোকারণ্য হইতে কোনমতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গঙ্গারাম অশ্বকে ছাড়িয়া দিয়া, এক বটবৃক্ষে আরোহণ করিলেন, দেখিবেন--কি হইতেছে। দেখিলেন, ভারি গোলযোগ। সেই মহতী জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছে। এক দিকে সব মুসলমান—আর এক দিকে সব হিন্দু। মুসলমানদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি সিপাহী, হিন্দুদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি ঢাল-সড়কিওয়ালা। হিন্দুরা বাছা বাছা জোয়ান, আর সংখ্যাতে বেশী। মুসলমানেরা তাহাদিগের কাছে হঠিতেছে। অনেকে পলাইতেছে। হিন্দুরা “মার মার” শব্দে পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে।...
...মার মার শব্দে হিন্দুরা চারিদিক হইতে চারিদিকে ছুটিতেছে। আবার গঙ্গারাম সবিস্ময়ে শুনিলেন, যাহারা এই মার মার শব্দ করিতেছে, তাহারা মধ্যে মধ্যে বলিতেছে, “জয় চণ্ডিকে! মা চণ্ডী এয়েছেন। চণ্ডীর হুকুম, মার! মার! মার! জয় চণ্ডিকে!” গঙ্গারাম ভাবিলেন, “এ কি এ!” তখন দেখিতে দেখিতে গঙ্গারাম দেখিলেন মহামহীরূহের শ্যামল-পল্লবরাশি-মণ্ডিতা চণ্ডীমূর্তি, দুই শাখায় দুই চরণ স্থাপন করিয়া, বাম হস্তে এক কোমল শাখা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তে অঞ্চল ঘুরাইতে ঘুরাইতে ডাকিতেছে, “মার! মার! শত্রু মার!” ... শ্রীর আর লজ্জা নাই, জ্ঞান নাই, ভয় নাই, বিরাম নাই—কেবল ডাকিতেছে—“মার! শত্রু মার! দেবতার শত্রু, মানুষের শত্রু, হিন্দুর শত্রু—আমার শত্রু—মার শত্রু মার!!”...
এখানেও তিনি চতুর ইংরেজ কর্তৃক চারিয়ে দেওয়া মুসলমান বিদ্বেষের মানসিকতার শিকার হলেন। এও উপনিবেশিকতার আর এক রূপ।
১৯২০ সালে অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ বইতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র রচনাকে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে রেখে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছিলেন। ‘আনন্দমঠ’ অধ্যায়ে বঙ্কিমের যুগ নিয়ে তিনি যা লেখেন তা প্রণিধানযোগ্য। ছোট করে তাঁর কথাগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে পারি। তিনি লেখেন যে, স্বদেশপ্রীতি বা দেশাত্মবোধ ব্যাপারটা বিদেশি, আমাদের দেশে ছিল না। ‘উহা আমরা ইংরাজী শিক্ষার শুভফলরূপে পাশ্চাত্যদেশ হইতে লাভ করিয়াছি।’ এই কথাটা অবশ্য অভিনব নয়, সেকালে অনেকেই এরকম মনে করতেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য ইতিহাস ইত্যাদি পড়ে বাঙালি যখন ‘পলিটিকাল পেট্রিয়টিজম’ শিখল, তখন থেকে এই ভাবটা আমাদের দেশে দানা বাঁধে। এরপর আমাদের দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরা পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে যত নিজেদের দেশের তুলনা করতে লাগলেন, ততই আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা ভেবে ব্যথিত বোধ করতে লাগলেন। ‘তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা কবি ছিলেন, তাঁহারা কাব্যে ও সঙ্গীতে অনল্পমাত্রায় করুণরসের ছড়াছড়ি করিতে লাগিলেন—কেহ কেহ আবার রাজস্থান-প্রভৃতি পাঠ করিয়া রাজপুতগণের স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও মুসলমান-বিদ্বেষ প্রভৃতিকে জাতীয়ভাবরূপে গ্রহণপূর্বক তদবলম্বনে প্রচুর বীররসপূর্ণ কাব্য লিখিতে লাগিলেন।’ উদাহরণস্বরূপ তিনি এইসব কবিরা যেসব গান লিখতেন, তার কিছু কিছু থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন, ‘কতকাল পরে বল ভারত রে/দুখসাগর সাঁতারি পার হবে’ বা ‘বাজ রে শিঙ্গা বাজ এই রবে/সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে’ ইত্যাদি। অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, এঁরা কিন্তু কেউই প্রাদেশিকী প্রীতিকে অর্থাৎ বাংলাকে ভালবাসাকে গুরুত্ব দিতেন না, স্বদেশ বলতে তাঁরা তখন সমগ্র ভারতকেই বুঝতেন। “...ফলকথা এই, কবিগণ সমাজের নবোদ্ভূত রাষ্ট্রীয় চৈতন্যকে একটা ধরিবার ছুঁইবার যোগ্য আকার দান করিয়া দেশমধ্যে একটা জাতীয় ভাবের বন্যা বহাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।... বস্তুতঃ প্রাদেশিক ইতিহাসে অজ্ঞতাহেতুই দেশের প্রথম রাজনৈতিক কবিগণ অতি বড় ভারতবর্ষটাকেই স্বদেশভক্তির প্রথম আলম্বন করিয়াছিল।”
তাছাড়া প্রাদেশিক প্রীতির মধ্যে জাতিগঠনের এবং রণসজ্জার ডাকের সেই উপাদান নেই, য়ূরোপের প্রভাবে যে উপাদান তাঁদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল
...এই সময়ে মধ্য-য়ূরোপে বিসমার্ক-প্রভৃতির চেষ্টায় জাতিগঠন ক্রিয়া বড় দ্রুত ও বড় তীব্র ভাবে চলিতেছিল; এবং ফ্রাঙ্কো-প্রাসিয়ান যুদ্ধের (১৮৭০—খৃষ্টাব্দ) পর সমগ্র য়ূরোপে “সাজ, সাজ, অস্ত্র সংগ্রহ কর, সৈনিকদিগকে শিক্ষা দেও, রণতরী সজ্জিত কর” এইরূপ একটা রব পড়িয়া গিয়াছিল। বাঙ্গালী কবিগণের মধ্যে অনেকেই ঐরূপ বিদেশীয় উত্তেজনায় সংক্রামিত হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু রাজশক্তি যেখানে বিদেশীয়, সেখানে ঐরূপ উত্তেজনার বাহ্য প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বন করিতে হয়। তাই এদেশীয় জাতীয় কবিগণ হিন্দু-মুসলমানের অতীত দ্বন্দ্বের ইতিহাস হইতে তাঁহাদের কাব্যের বস্তু—প্লট বা situation—আহরণ করিয়া তাঁহাদের নব জাগরিত দেশাত্মবোধ ব্যক্ত করিতে লাগিলেন।...
তারপর এল রাজনীতিচর্চাকারীদের কথা। ‘একদল রাজনীতিচর্চাকারী’ যাঁরা ঐসময়ই আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইংরেজ রাজত্বের অবসান তাঁরা চাইতেন না, কারণ সেটা তখনো তাঁদের চোখে সুদূরপরাহত স্বপ্নমাত্র। তার ওপর তাঁদের বিবেচনায় ইংরেজ থাকাই তো ভালো, তাহলে দেশে বর্গী, ঠগ, পিণ্ডারী, চোর, ডাকাত, ছেলেধরা ইত্যাদি অরাজকতা থাকে না। তাঁরা ইংরেজের মুখ থেকে যে সব ‘সাম্যতত্ত্ব, উন্নত রাজনীতি, পরধর্ম, ও পরকীয় আচারের প্রতি শ্রদ্ধার কথা’ শুনেছিলেন, তেমন কথা অন্য কোথাও শোনেন নি। ‘বার্ক, ব্র্যাড্ল, (এবং কিছুকাল পরে) ব্রাইটকে ইঁহারা দেবতার অধিক জ্ঞান করিতেন।’ কবিরা যেমন নিজেদের প্রাণের কথা ভীমসিংহ, বাদল বা পৃথ্বীরাজের মুখে বসাতেন, তাঁরাও তেমনি বার্ক, ব্র্যাড্ল বা ব্রাইটের মুখ থেকে শোনা কথাগুলো মনে গেঁথে নিতে লাগলেন; তাঁদের প্রকাশিত মত উদ্ধৃত করে নিজেদের অভাব-অভিযোগ জানাতে লাগলেন। সিপাহী বিদ্রোহের শেষে মহারাণী ভিক্টোরিয়া যে ঘোষণাপত্র প্রচার করেন, তার নীতিগুলো যাতে কাজে পরিণত হয়, সে বিষয়ে ইংল্যান্ডের ও ভারতের বাইরের রাজপুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। যেহেতু বাংলাদেশে বসে ইংরেজ রাজপ্রতিনিধি সমগ্র ভারতের জন্য বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন করতেন, তাঁদের দৃষ্টিও প্রথম থেকে সমগ্র ভারতের ওপর পড়েছিল। অবশ্য তাঁরা স্থানীয় অভাব-অভিযোগ নিয়েও আন্দোলন, আবেদন-নিবেদন ইত্যাদি করতেন, কিন্তু
সমগ্র ভারতে একটা মিলিত সংহত জাতির সৃষ্টি ইঁহাদের আকাঙ্খিত ছিল। মুসলমানের প্রতি ইঁহাদের বিদ্বেষবোধ বড় একটা ছিল না—কেননা কবিগণের মত কৃত্রিম অবস্থার কল্পনা ইঁহাদের পক্ষে আবশ্যক ছিল না। কবিগণের মুসলমানবিদ্বেষটাও বস্তুত পরজাতির প্রভুত্বে অসহিষ্ণুতার আবরণমাত্র ছিল, উহা আন্তরিক ছিল না। তবে ইহা সত্য যে এই যুগের কবিগণ ভারতের স্বাধীনতা অর্থে হিন্দুজাতির প্রাধান্যই বুঝিতেন।
এ যুগের কবিগণ ভারতের স্বাধীনতা বলতে হিন্দুজাতির প্রাধান্যই বুঝতেন অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তও এ সত্য অস্বীকার করতে পারেন নি। এরপর তিনি লিখেছেন, মুসলমানরা তখন ভারতে আর রাজা নয়, বিদেশীও নয়, তারাও ভারতবাসী ও ইংরেজের অধীন প্রজা, সুতরাং রাজনীতি আন্দোলনকারীদের তাদের বিদ্বেষ করার কারণ ছিল না এবং হিন্দু-মুসলমানে ভেদবোধ করার প্রয়োজন ছিল না। বরং তাঁরা হিন্দু-মুসলমানে একতাই চাইতেন।
বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসে যাই লিখে থাকুন, একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় বঙ্গদর্শনে তাঁর সম্পাদকতাকালেই এমন অন্তত দুটি লেখা বেরিয়েছিল, যাতে অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তের এই বিশ্লেষণের সমর্থন পাওয়া যায়। প্রথম প্রবন্ধটি বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান সংক্রান্ত, দ্বিতীয় প্রবন্ধটির ক্ষেত্র আরো ব্যাপক, আর্য এবং হিন্দুকে নিয়ে। ১৮৭২ সালের জনগণনা হয়ে যাবার পর ‘বঙ্গদেশের লোক সংখ্যা’ প্রবন্ধে তাই নিয়ে বঙ্গদর্শন প্রথম খণ্ডে (১৮৭২) প্রবন্ধটি বেরোয়। কার লেখা জানা যায় না, বঙ্কিমচন্দ্রের নয়, কারণ বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ডে এই প্রবন্ধের নাম নেই। প্রবন্ধটিতে পাই
হিন্দু ১,৮১,০০,৪৩৮
মুসলমান ১,৭৬,০৯,১৩৫
অতএব দেখা যাইতেছে যে, নিজ বাঙ্গালায় হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান। মুসলমান অপেক্ষা পাঁচ লক্ষ মাত্র অধিক হিন্দু আছে। তবে হিন্দুদিগের প্রাধান্য এই যে, মুসলমানেরা প্রায় কৃষক, এবং সামান্য শ্রেণীর লোক। ভদ্রলোক অধিকাংশই হিন্দু, কিন্তু তাই বলিয়া এই বঙ্গদেশকে কেবল হিন্দুর দেশ বলা যায় না। যেমন ইহা হিন্দুর দেশ, সেই রূপই ইহা মুসলমানের দেশ।
দ্বিতীয় খণ্ডের প্রবন্ধটির আলোচনার ক্ষেত্র আরো ব্যাপক। এই প্রবন্ধটির নাম ‘জাতিভেদ’, কার লেখা ঠিক জানা যায় না, তবে প্রবন্ধের নিচে ‘শ্রীযঃ’ দেখে মনে হয় হতে পারে এটি বঙ্গদর্শনের লেখকগোষ্ঠীর অন্যতম যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের লেখা। এই প্রবন্ধে ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ নিয়ে এবং ‘হিন্দু’ শব্দটির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে
...আমাদিগের জাতি নাম (nationality) কি? আর্য বলিলে দুই দোষ হয়। প্রথমতঃ যে পদার্থের নাম আর্য বলিয়া স্থির হইতেছে তাহা কল্পনা মাত্র। এই নামের কোন পাত্র যে কখন পৃথিবীতে ছিল, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। অতএব ঐ নাম দিয়া আমাদিগের জাতি ব্যক্ত করিলে সেই কল্পনাকে চিররক্ষিত প্রত্যক্ষ বস্তু বলিয়া বোধ হইবেক।...
যদি বল আমাদিগের জাতি নাম “হিন্দু” তাহাতেও দোষ হয়। হিন্দু শব্দ “সিন্ধু” নাম হইতে উৎপন্ন। ইহার এক অর্থে সিন্ধু ব্রহ্মপুত্রের অন্তর্গত সমগ্র ভারতবাসিগণকে বুঝাইতে পারে। কিন্তু অনেক খ্রীষ্টান ও মুসলমান হিন্দুস্থান মধ্যে বাস করিয়াও হিন্দুপদে বাচ্য নহেন। বস্তুতঃ হিন্দু শব্দটী ধর্মবোধক। একজাতীয় লোক সকলেই যে এক ধর্মাক্রান্ত হইবেক তাহার কোন সম্ভাবনা নাই। অতএব জাতি প্রকাশ করার নিমিত্ত হিন্দু শব্দ প্রয়োগ করা যায় না।
এই প্রবন্ধে ‘আনন্দমঠ’ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হল না, কারণ এ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই সুন্দর আলোচনা করেছেন। শুধু দুচারটে কথা। আমাদের দেশে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। দুটো আলাদা ক্ষেত্র। ধর্মের কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হয় না। তা যদি না হত তাহলে দেখা যেত হিন্দুধর্মের ধ্বজা ধরে হিন্দুরা নানা দেশ দখল করেছে, যেমনটা কিনা খ্রিস্টধর্মের বেলায় দেখা যায়। বরঞ্চ ইতিহাস বলছে আমাদের দেশে রাজনীতি ধর্মের অনুশাসনের অনুগমন করেছে। রামমোহনের লেখায় যেহেতু রাজনীতির কথা ছিল, তাঁর সময়ও ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। উত্তরে রামমোহন বলেছিলেন, “ধর্ম ঈশ্বরের, রাজনীতি কি শয়তানের? যাহা কিছু সত্য, পবিত্র ও হিতকর, তাহাই ঈশ্বরের। মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের সহিত পরমেশ্বরের সম্বন্ধ।” অর্থাৎ রামমোহন রাজনীতিকেও ‘সত্য, পবিত্র ও হিতকর’রূপে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি যেটা চেয়েছিলেন সেটা হল একদিকে ব্রিটিশ শাসন ধর্মের ধারা অনুসরণ করুক, অপরদিকে ধর্ম দ্বারা চালিত হয়েই তাঁর দেশবাসী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করুক অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্জন করুক। এটা ছিল রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রে এসে ব্যাপারটা উলটে গেল। তিনি খ্রিস্টধর্মেরই ধারায় হিন্দুধর্মের সংগঠিত রূপের কল্পনা করলেন এবং তাঁর সৃষ্ট সন্ন্যাসীদের (সন্তানদল) অ্যাজেন্ডাই হয়ে উঠল মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটানো এবং ইংরেজ রাজত্ব স্থায়ী এবং শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করা। একে বলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ১৯৪০ সালের ১৪ই মে আনন্দবাজার পত্রিকায় মেদিনীপুরে সুভাষচন্দ্রের বিপুল সম্বর্ধনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। সেখানে সম্বর্ধনার উত্তরে অনেক কথার মধ্যে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন
সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছেন। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে। হিন্দু মাত্রেরই তাহার নিন্দা করা কর্তব্য।
ভারতবর্ষ, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য
ইত্যাদি নিয়ে মুসলিমদের ভাবনা
আমরা অনেকেই ভাবি মুসলমানদের মধ্যে যেহেতু বেশির ভাগই কৃষক ছিল, অতএব হিন্দুদের মত তাদের মধ্যে অত শিক্ষিত ছিল না, সুতরাং উচ্চকোটির ধ্যানধারণাও ছিল না। এই ধারণাটা একেবারে ভুল। ১৮৩১ সাল থেকেই স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের মধ্যেও ভাবনার চর্চা আরম্ভ হয়েছিল। বরঞ্চ এক হিসেবে তাঁরা ছিলেন হিন্দুদের থেকেও বেশি শিক্ষিত। যেহেতু তাঁরা একাধারে ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলাভাষায় পড়তে ও লিখতে জানতেন। ‘সভা-রাজেন্দ্র’ দিয়ে তাঁদের সাময়িকপত্র প্রকাশের শুরু। এবং বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থেকেছে।
আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’ (১৯৬৯) বইতে মুসলিমদের ধ্যানধারণার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। তখন এদেশের মুসলমানরা মনে করতেন যে হিন্দুর মত মুসলমানরা তো শুধু ভারতবর্ষ নিয়ে নয় যে ভারতবাসী মুষ্টিমেয় মুসলমানের যা নেই, মুসলমান জাতিটাতেও তা নেই বলে ধরতে হবে। তখনকার লেখকদের মানসপটে যে সুবিশাল মানচিত্র ভেসে উঠত তাতে রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক সীমানা মুছে গিয়ে ধর্মবোধের ভিত্তিতে সব এক হয়ে যেত। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আল এসলাম’এ একজন লেখক সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, “জাতীয়তার যে সীমানা এক দেশ হইতে অপর দেশকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখে, এছলামের সাম্যবাদ তাহা ধ্বংস করিয়াছে।” আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘সাম্যবাদ কথাটা এখানে বড় নয়, তার বদলে সাম্রাজ্য হলেও ক্ষতি ছিল না। আসল কথা, ধর্মীয় পরিচয়ে যখন আমরা নিজেদের চিহ্নিত করি, স্বদেশ তখন খুব ছোট জায়গা হয়ে পড়ে আমাদের জন্যে।’ এইজন্যেই ভারতবর্ষের বাইরের যে মুসলমান জগত, তা আমাদের লেখকদের গভীরভাবে আকর্ষণ করত। স্বদেশের তুলনায় বাইরের মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা হত বেশি, যেমন, চীন, তিব্বত, রাশিয়া, সিরিয়া, বসরা বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থান, আরব বা তুরস্ক। আরব ও তুরস্কের মধ্যে তুরস্কই তখনকার মুসলিমদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেশি। খিলাফত আন্দোলনের (১৯২০-২২) ব্যর্থতার পরে প্রথম বাঙালি মুসলমানের প্যান-ইসলামের মোহ ভাঙতে শুরু করে, স্বদেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও পরিবেশের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘এ ভাবধারার পশ্চাতে নজরুল ইসলামের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। ‘শিখা’ গোষ্ঠীর বুদ্ধিচর্চা ও সওগাতের উদারনৈতিকতাও এ ভাবনাকে গতি দিয়েছিল।’ তবে সমাজে দুটো ভাবধারাই কাজ করছিল। ‘হাফেজ’ (১৮৯৭) পত্রিকায় যেমন আকবর সম্পর্কে সগৌরব আলোচনা দেখি, বিশ শতকে তেমনি ‘ইসলাম দর্শন’এ দেখি আকবরী ও আলমগীরী আদর্শের বিরুদ্ধতার ওপর জোর দিতে। ‘জয়তী’-সম্পাদক যখন (১৯৩০) আকবর-প্রদর্শিত সমন্বয়পন্থা অনুসরণের সুফলের কথা ইঙ্গিত করেছেন, ততদিনে মনে হয় ‘ইসলাম দর্শন’-কথিত আলমগীরী আদর্শেরই আকর্ষণ বেড়েছে মুসলমান সমাজে।
ঊনিশ শতক থেকেই ধর্ম ও সমাজজীবনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান সমাজের স্বাতন্ত্র্যবাদী লক্ষ্য করা গেলেও ‘এই চেতনা সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যবাদের সন্ধান করে নি বলে মনে হয়।’ ঊনিশ শতক থেকে বিংশ শতক জুড়ে বহু পত্রিকা হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী প্রচার করেছিলেন, যেমন, আহমদী, হিন্দু-মুসলমান সম্মিলনী, হিতকরী, কোহিনূর, নবনূর, মোসলেম ভারত, ধূমকেতু, সহচর, গণবাণী, শিখা, জয়তী ইত্যাদি।
তবে এ ধরনের মনোভাব সাধারণভাবে আমাদের সমাজে পরিব্যাপ্ত হয় নি। মিলনের আদর্শ প্রচারের পাশাপাশি বরঞ্চ দেখা গিয়েছিল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ। মিলনপন্থী সেখ ওসমান আলিই ‘কোহিনূরে’ লিখেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমান মিলনের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তার পুনরুত্থান। সমাজের একটা বৃহত্তর অংশে এই সন্দেহ প্রবল হবার সুযোগ পায় বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের সময়ে। ‘ইসলাম-প্রচারক’ প্রচার করেন যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানের কিছু সুবিধে হয়েছে এবং হিন্দুর স্বার্থে কিছু আঘাত লেগেছে বলেই হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন। মুসলমানের প্রতি হিন্দুর বিদ্বেষের উল্লেখও করা হয়েছিল সেই সঙ্গে।...
নওরোজের (১৯২৭) উক্তি সমকালীন মুসলিম লেখকদের ভাবধারাকে প্রকাশ করেছিলঃ
প্রবল অংশ যদি দুর্বল অংশকে পর বলে মনে করে এবং এদেশ “হিন্দু”রই দেশ আর কারো নয় এই কথা সাহিত্যে ও বক্তৃতায় প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, এক কথায় দুর্বল অংশকে বাড়ী ছাড়া করে দেয়, তবে দুর্বল অংশ ত একটা কোথাও তাদের বাড়ী ঠিক করতে চাইবে।...এবং অনেক সময়ে লাচার ও হতাশ হয়েই যারা তাদের পর বলতে চায় তাদের পর ভাবতে বাধ্য হয়।
এই ধরনের ভাবনাই পরবর্তীকালের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা শেকড় গাড়ার মূলে।
উপসংহার
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির-যুগান্তর গোষ্ঠীর গৌরবময় অবদান নিয়ে দু চার কথায় কিছু বলা যায় না। এ এক বিশাল ইতিহাস, যার পরতে পরতে আছে অজস্র মানুষের আত্মবলিদান। ১৯০২ সালের ২৪ মে কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে। অচিরে ঢাকাতেও এর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং পরবর্তীকালে ঢাকাই হয়ে ওঠে অনুশীলন সমিতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। অনুশীলন সমিতির মন্ত্র ছিল ব্রিটিশ তাড়াও এবং উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা। এই উদ্দেশ্যে অনুশীলন সমিতির শাখা হিসেবে প্রচুর গুপ্ত সমিতি তৈরি হয়, যেখানে সর্বতোমুখী শিক্ষা ও শরীরচর্চার আড়ালে সংগ্রামী কার্যক্রম চালানো হত। এটি ছিল একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল। কিছু পরে অনুশীলন সমিতির সহযোগী যুগান্তর গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে আরো বেশি সক্রিয় হয়। তাদের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে কোলকাতা।
কিন্তু এ পর্যন্ত একতরফা তাদের গৌরবের কাহিনিই শুনে এসেছি। আমরা কজন জানি যে এই গৌরবের আরো একটা দিক ছিল, যে দিকটা ছিল আজকের হিন্দু সাম্প্রদায়িতার উত্থানের কারণ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা’ বইতে (প্রথম প্রকাশ ১৯৫১) জীবনতারা হালদার লিখেছিলেনঃ
হিন্দুরা জানে ভাবরাজ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে। পলিটিক্স্ বুঝা এ দেশের হিন্দু নেতাদের কর্ম নয়। মুসলমান নেতারা বাস করে বাস্তব জগতে। পলিটিক্স্ তাহারা হজম করিয়া বসিয়াছে পুরামাত্রায়। একথা আজ এখানে বলিতে বসিতাম না; বলিবার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণও থাকিত না, যদি না আমাদের বিরাট এই সমাজদেহ আজ গলিত কুষ্ঠে পরিপূর্ণ না হইয়া জীবন্ত হইত; যদি আজ মুসলমান ভারতে বাস করিয়াও অভারতীয় না হইত। বাংলা দেশেও আজ মুসলমানেরা বাঙ্গালী বলিতে বাঙ্গালী হিন্দু-সমাজকেই আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দেয়। ভারতবাসী হইয়াও মুসলমান সমাজ আজ পিতৃভূমিরূপে কল্পনা করে আরবকে। ভারতবাসী হিন্দুর চেয়ে তাহার কাছে বেশি আপন আরবী মুসলমান। সমগ্র মুসলমান সমাজ আজ এক বিশ্বব্যাপ্ত অখণ্ড “প্যান-ইসলামিক ষ্টেট”-এর কল্পনায় মশগুল। আর ইহারই প্রাথমিক সোপান হিসাবে তাহার প্রয়োজন পাকিস্তানের।
দুটো কথা বলে এই প্রবন্ধের ইতি টানব। প্রথম কথা, লেখকের চারপাশের আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের জীবনযাপনের ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে বলা যায়, জীবনতারা হালদারের এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেইসব আত্মীয়স্বজন কারোর মধ্যেই মুসলমান সম্পর্কে এরকম ধারণা ছিল না। তাঁদের বাড়িতে মুসলমানরা অবারিতদ্বার ছিলেন (এমনকি লেখকের বাড়িতেও)। সম্ভবত অনুশীলন সমিতির সদস্যদের মধ্যে ভাবনার ভিত্তিতে দুটো ভাগ ছিল।
দ্বিতীয় কথাটা অনুশীলন সমিতির এই ভাবধারা কিভাবে বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাই নিয়ে। সেটা পড়ল কেশব বনিরাম হেড়গেওয়ারের মাধ্যমে। তিনি যে দেশপ্রেমিক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯১১ সালে তিনি কলকাতায় আসেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পড়তে ও একই সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলার অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়ে তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে অনুরূপ বিপ্লবী দল গঠন করা। সদস্য হবার পর ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী, পুলিন দাস, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ইত্যাদিদের কাছাকাছি আসেন তিনি। ১৯১৬ সালে ডাক্তারি পাশ করে নাগপুরে ফিরে গিয়ে মাঝখানে কিছুদিন তিলকের নেতৃত্বে কাজকর্ম করে শেষপর্যন্ত নানা আদর্শগত কারণে স্বয়ং গান্ধীজির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯২৫ সালে নাগপুরে গড়ে তোলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ।
একথা ঠিক, অনুশীলন সমিতির সদস্যদের একাংশের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন মুসলিম-বিদ্বেষ ছিল, ডাঃ হেডগেওয়ার তার উত্তরাধিকার নিয়ে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছিলেন। তাছাড়া মহারাষ্ট্রেও প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিম-বিদ্বেষ ছিল, যদিও প্রশাসক মেজর আর. এ. বেথামের (১৯০৮) লেখায় সে বিদ্বেষের যে বর্ণনা পাই, সেটা যত না প্রকৃত ইতিহাস তার বেশি হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়োজনে। তিনি শিবাজীকে বাল্যাবস্থা থেকেই মুসলিম-বিদ্বেষী হিসেবে বেড়ে ওঠা এক হিন্দু শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন। অবশ্য গজনীর মামুদের অত্যাচারের ফলে হিন্দুরা মুসলিম-বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিল, তাঁর সে বিশ্লেষণ ঠিক। সে যাই হোক, ডাঃ হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কার্যক্রমের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। আজকের এই ব্রাহ্মন্যবাদী দল, এই দলিত পেটানো এবং মেরে ফেলা, এই হরিজনদের ওপর অত্যাচার ডাঃ হেডগেওয়ারের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। ১৯৩৪ সালে ওয়ার্ধাতে সংঘ পরিদর্শনে এসে গান্ধীজি দেখেছিলেন, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, হরিজন, সব এক পঙক্তিতে বসে আহার করছে। দেখে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে ডাঃ হেডগেওয়ারকে বলেছিলেন তাঁর সংঘ নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিতে।