সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সুব্রত দা'কে প্রথম দেখেছি বইমেলায়। কালধ্বনির টেবিলে বসে আছেন একটা চেয়ারে , বেশ সোজা হয়েই, হাত দুটো কোলের ওপর জড়ো করা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ঘাড় ঈষৎ বাঁ দিকে কাৎ। আর শেষ দেখলাম, ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালের ফ্রিজারে শোয়ানো। তার বিশদ বিবরণে গেলাম না!
প্রথমবারের দর্শনে সুব্রত দা আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আমি একটা লিটল ম্যাগাজিন কালধ্বনির টেবিলে রাখতে গিয়েছিলাম, উনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। মেলা শেষে পত্রিকা আনতে গেলে জানা গেল, পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেছে। উনি দামটা দিলেন। আমি একটা অংশ কেটে রাখার কথা বলাতে, আমার ওঁর প্রথম সংলাপ শোনা হল, "আমরা (কালধ্বনি) কোনো টাকা কেটে রাখি না! "
এরপর কালধ্বনির সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত হয়েছি ২০০৯ সাল নাগাদ। যাঁরা কালধ্বনির ঘরে গেছেন, তাঁদের বলা বাহুল্য যে,ওই ঘরে সম্পাদক প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় কতটা ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন! প্রাণের আরাম কথাটা ওখানে গেলে ব্যাখ্যা করতে হয় না, অনুভূত হয়!
কালধ্বনির আড্ডা আমাদের সঞ্জীবনী সুধা, আর সেই সুধা সুব্রত দা'র প্রাণের মাঝে কতখানি ছিল, আমরা , মানে আমাদের বন্ধুরা, যাঁরা একটু পরে কালধ্বনিতে নিয়মিত হয়েছি, তাঁরা খুব দ্রুতই তার খবর পেয়েছি। সুব্রত দা'র উপস্থিতি আমাদের কাছে সুকিয়া স্ট্রিটের আড্ডাতে অন্য মাত্রা দিত, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যি!
এর কারণ, সুব্রতদা'র রসবোধ, যা আমাকে টেনেছে বরাবর এই আড্ডায়। সুব্রতদা আর দুলাল দা'র রসালাপ শুনে আমাদের বিকেল প্রসন্ন হতো, আমি অনুভব করতাম, কেন আমার শহরের সাধক কবি বলেছিলেন, 'আমি চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে চাই!' নকশাল আমলে সুব্রত দা'কে 'আ্যনাইহিলেট' করার পরিকল্পনার কথা সুব্রত দা'র( উনি নিজেও একসময় নকশালপন্থী রাজনীতি করতেন) মুখেই কৌতুকময় বর্ণনায় শুনেছি, তার কারণ 'গোপন' এই পরিকল্পনাটি সংগঠিত হচ্ছিল চলন্ত বাসে, সুব্রত দা'রই আগের সিটে!
আরেকটা কারণে সুব্রতদা আমার সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন। সেটা হল, ওঁর অগাধ পড়াশোনা, বিশেষতঃ কবিতা ও কথাসাহিত্যে। কবিতার মনস্বী পাঠক ছিলেন সুব্রতদা, তবে আমাদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে খুব একটা কথা কখনও হয়নি। সম্ভবত কবিতা পাঠের অনির্বচনীয় স্বাদকে একার করে রাখতে চেয়েছেন তিনি।
কিন্তু কথাসাহিত্যের দীন ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে পেয়েছি অনেক কিছু। শিখতে কতটা পেরেছি, জানি না। পেশায় প্রুফ রিডার ছিলেন তিনি। কিন্তু পড়া বিষয়টা ওর পেশাদারি গণ্ডিকে অতিক্রম করে ওঁকে রসসাগরে অবগাহনের সামর্থ্য যুগিয়েছিল। একটা ছোট উদাহরণ দিই। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটা অনুগল্পের কথা বলার পর উনি বলেছিলেন, "প্রুফ রিডার হিসেবে আমার কাজ পরের লেখায় চলে যাওয়া। কিন্তু এই লেখাটা পড়ে আমি অনেকক্ষণ থুম মেরে বসেছিলাম!" নিত্যদিনের কথাবার্তায় এরকম অনেক অভিজ্ঞতাই আমাদের অর্জন হয়েছে।
যা আমাদের অস্বস্তিকর ঠেকত, তা হল, হঠাৎ হঠাৎ করে সবকিছু থেকে সুব্রত দা'র নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। আমরা যেখানে সুব্রত দা'র উপস্থিতি প্রত্যাশা করতাম, সেখানে হঠাৎই ওঁর বার্তা আসত, না গো! আমার হবে না! আমরা মুষড়ে পড়তাম!
প্রায়ই একটা অভিযোগ সুব্রত দা করতেন। 'আমার ওপরতলায় এক ভদ্রলোক সারারাত কাঠের ওপর হাতুড়ি চালায়। ঠক ঠক, ঠক, ঠক। আমার ঘুম হয় না!' বিষয়টা ওঁর মনে হওয়ার স্তরেই ছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে। এই ভাবে একটা জগৎ রচিত হয়েছিল কী, সুব্রত দা'র মনের মধ্যে! আমরা হয়ত সেই ভুবনের খোঁজ পাইনি! হাসপাতালের শয্যায় সুব্রত দা ওঁর ভরসার, নির্ভরশীলতার একান্ত জন প্রশান্ত দা'র হাত চেপে ধরে রাখতেন, সারাক্ষণ! এক বাঙ্ময় নীরবতা অন্তর্লীন থাকত সেই করস্পর্শে!
প্রথমদিনের নীরব সুব্রত দা আমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল! আর শেষদিনের নিথর সুব্রত দা আমার কাছে দুর্বোধ্যতর হয়ে উঠলেন!
হয়ত আরো কিছু কথা বলার ছিল ওনার। আমাদের শোনার। কিন্তু তার আগে এক আকস্মিক সিগন্যালে ওঁর ট্রেন ছেড়ে গেল!
হতবিহ্বল আমরা বিকেলের প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম !