সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমি মন দিয়ে কবিতা পড়ছি বছর পনেরো। লেখার চেষ্টা করছি বারো বা তেরো বছর ধরে। এই স্বল্প সময়ে একটা কথা আমার প্রায়শই মনে হয়েছে, কবিতার অনেকগুলো পথ, কিন্তু কোনোটাই শর্টকাট নয়। এই দীর্ঘ পথগুলো একেকটা একেক ধরণের। কেউ রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ হয়ে শক্তি ধরে জয়, কেউ হয়তো জয় থেকে শক্তি হয়ে বিনয় হয়ে উৎপল হয়ে স্বদেশ, কেউ হয়তো জীবনানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে সমর সেন হয়ে উৎপল হয়ে ফাল্গুনী। কবিদের নামগুলো এখানে নাম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বলাই বাহুল্য। তাদের গুরুত্ব কবিতার ধরণ বোঝাতে ব্যবহৃত। যাত্রার কোন দশায়, কার কেমন কবিতা ভালো লেগেছে, এই আর কী। এখানে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জার্নিতে, একই স্টেশনে সবার ট্রেন কিন্তু সমান সময় থামে না। কেউ অল্প আবিষ্কারে মুগ্ধতা হারিয়ে সরে যায় তার শাশ্বত খোঁজে, কেউ তন্ন তন্ন করে পাঠ করে নেয় হয়তো সেই স্টেশনেই। কারণ সে মজেছে ওই পাঠে। এর মধ্যে ভুল নেই, বোধ এবং রুচির ওপর নির্ভর করে পথ নির্ধারিত হয় প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকার ক্ষেত্রে। কিন্তু এত শব্দের অবতারণা করছি কেন? এবার খুব সন্তর্পণে, ধীরে সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষত্রে, খানিক আশ্চর্যজনক হলেও, বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩, মালাগা, স্পেন) সারা জীবনে বলা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন উক্তির সাহায্যে আমরা একেকটা গোপন অংশে চোখ রাখার চেষ্টা করব। না, চিত্রশিল্পের চৌহদ্দিতে নয়, কবিতায়।
১।
"Learn the rules like a pro, so you can break them like an artist."
হ্যাঁ, ছন্দ ছাড়াও কবিতা হয়। তার জন্য ছন্দ জানার প্রয়োজন পড়েই, এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না। কিন্তু তবু এই ওপরের অদ্ভুত বাক্য পড়লে মনে হয়, ছন্দ যে সম্যক জানে, তার পক্ষে ছন্দ ধ্বংস করা যে উপায়ে সম্ভব, কোনো ছন্দজ্ঞানহীনের পক্ষে তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর উপায় থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। আমাদের চারপাশে কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে খুব সাধারণ একটা ঘটনা ঘটে। বিপজ্জনক ঘটনা। ছন্দের রীতি না জেনে ছন্দের কবিতা পাঠ এবং সেই কবিতা বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ মতামত প্রকাশ। এই পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরে মানুষ এই সমস্ত মতামতকে ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিতে শুরু করে। দ্যুতির জাহির নকল মণি থেকে হলে চোখের আর দোষ কী! এবং ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমরা খুঁজে পেলাম বাংলা কবিতার সেই অদ্বিতীয় চরিত্রকে, যা আমাদের কখনোই ছেড়ে যাবে না এই সামগ্রিক আলোচনায়। ধাপ্পাবাজি। না আরও নিখাদ করে বলা প্রয়োজন, ভাঁওতাবাজি।
২।
ক) "This idea of art for art’s sake is a hoax"
খ) "There is no abstract art. You must always start with something. Afterward you can remove all traces of reality."
প্রথম ঘোষণাটি পড়ে যে অবধারিত বিরোধিতা জেগে উঠতে পারে, তার সবচেয়ে নিখুঁত উত্তর ঘোষিত হয়েছে দ্বিতীয় উক্তিটিতে। স্বভাবতই এই দুটি উক্তিকে একত্রে দেওয়া অপরিহার্য ছিল। যদিও এই দুটি উক্তিরই পৃথকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে তর্কের পরিসরে।
দ্বিতীয় উক্তিটি অনুযায়ী বলা যায়, কিছুই বিমূর্ত নয় প্রাথমিক সজ্জায়। নিরাকার থেকে আকারের দিকে নয় শিল্পের যাত্রা। তার উৎস আকারাশ্রিত এবং অন্তিমে সে নিরাকার হয়ে উঠতে পারে। বা বলা ভালো, নিরাকার হয়ে ওঠা উচিত। এ সম্পর্কে সংশয় থাকতে পারে, তবুও গ্রহণযোগ্য সত্য এই, অন্তত যুক্তির বিচারে।
বাংলা কবিতায় এই মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রচলন কীসের? এই বিমূর্ত ধারার অপব্যবহারের। অল্পবয়সে অনেক পাঠিকা/পাঠক/কবি যেমন ছন্দের চলনের কারণে অন্তঃসারশূন্য কবিতার প্রতি ক্রমাগত টান অনুভব করে চলেন, তেমনই অনেকেই ঝুঁকে পড়েন ফাঁকা অর্থহীন চাতুরী বোঝাই কবিতার প্রতি, শুধুমাত্র সমান্তরাল চর্চার তকমা লাভের নেশায়। হ্যাঁ, মেইন স্ট্রীম এবং প্যারালাল ধারা (এই শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আমি তর্কের পরিসরে যাবার প্রয়োজনবোধ করলাম না এখন, কারণ সেক্ষেত্রে আসল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যেতে হবে), এই দু’দেশেই অসংখ্য ভালো কবিতা রচিত হয়েছে বাংলাভাষায়, কিন্তু ছন্দের ডুগডুগি এবং নকল আধুনিকতার তাবিজে নষ্টও হয়েছে বহু পাঠক/পাঠিকার সময়, কবির সদিচ্ছা, সততা। আর ঠিক এখানেই, আবারও ফিরে এলেন সেই সম্রাট, আমাদের আলোচনায় যার স্থান সবার ওপরে, যিনি এতই অসৎ এবং এতই ধূর্ত, যে, তাকে ছাড়া বাংলা কবিতা, অন্তত বাজারে যা চলছে, তা অচল। তিনি অদ্বিতীয় ভাঁওতাবাজি।
৩।
ক) "Inspiration exists, but it has to find you working."
খ) "I am always doing that which I cannot do, in order that I may learn how to do it."
লেখা আসছে না। যারা, যারাই অল্পস্বল্প কবিতা লেখার চেষ্টা খুব গুরুত্ব দিয়ে করেছেন, তাদের প্রায় সকলেরই এরকম সময় এসেছে কখনো। কিন্তু কে বা কী আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেয়? এই বিষয়ে বেশি কথা বলা অর্থহীন, কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে, ন্যাকামি তার সর্বোচ্চ শিখরে এসেছে এই প্রসঙ্গের হাত ধরে। “না লিখে থাকতে পারি না”, “দৈববাণীর মতো এল এই লাইনগুলো, আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল”, “লেখা পায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে দ্বিতীয় বক্তব্যটি কিন্তু আংশিক হলেও সত্য। এই প্রসঙ্গে এক ভদ্রলোকের একটা উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারছি না।
-“I decided that it was not wisdom that enabled poets to write their poetry, but a kind of instinct or inspiration, such as you find in seers and prophets who deliver all their sublime messages without knowing in the least what they mean.” (সক্রেটেস, ৪৭০-৩৯৯ খ্রীঃপূঃ)
এই সর্বশেষ উক্তিটি ওপরের দু’খানা উক্তির মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তা তুলনাহীন! আলোচনার ঠিক এই পর্যায়ে, পিকাসোর আরও একটি কথা মনে পড়ে যায়, "Everything you can imagine is real." তাই লেখার বাধা সাময়িক, তাকে দূর করতে অসুবিধে হবে না, যদি নিজের মধ্যে চিন্তাকে স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার দিতে বাধা না থাকে। যদিও এর ফল সামাজিক দিক থেকে খুব একটা সুবিধেজনক নয়। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনি আপনার কল্পনাকে সৎভাবে লেখাতে নামিয়ে আনছেন কি না! নতুবা আবার সেই ধাপ্পার কবলে ফেলবেন। পড়বেন না? তাই হয়?
৪।
ক) "The meaning of life is to find your gift. The purpose of life is to give it away."
খ) "If I don't have red, I use blue."
এই দু’খানা উক্তির আপাত সম্পর্ক হয়তো কিছু নেই। কিন্তু কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এদের একত্রে রাখাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে আমার। আসল কথা হল এই, যে, আমি যা বলতে চাই তা আমি বলব, বাধার তোয়াক্কা না করেই। আবার একই সঙ্গে, এই কথাও গুরুত্বপূর্ণ, ত্যাগের মাধুর্য এবং আবশ্যিকতা উপলব্ধি করা যাচ্ছে কি না! দুঃখের কবিতাও স্বরবৃত্তে লেখা যায়, অক্ষরবৃত্তকে ছেড়ে এসে। সত্যি বলতে পারছেন কি না, সেটুকুই গুরুত্বপূর্ণ! নইলে আপনার প্রবোধচন্দ্র বা নীরেন্দ্রনাথ বা শঙ্খ ঘোষ বা রবীন্দ্রনাথ, সকলই বৃথা যাবে, বলাই বাহুল্য! আর গদ্য ছন্দে ভণ্ডামি তো ক্লাসিকের পর্যায়ে পৌঁছেছে! সে কথায় এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না।
৫।
"Art is the lie that enables us to realize the truth."
এই যে সত্যি বলার কথা বললাম, আর তারপরেই এই উদ্ধৃতি, আশ্চর্য নয়?
না, একেবারেই নয়। বরং এ কথাই সেই আশ্চর্য, যা সত্যের গুরুত্বকে শিল্পের জন্য অপরিহার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লেখা সমস্ত ভান, মিথ্যে সার্থক, যদি তা পাঠিকা/পাঠককে পৌঁছে দিতে পারে তার গন্তব্যে। যেখানে সহজে এগোনো যায় না, যেখানে সহজে পিঠ চাপড়ে দেওয়া যায় না, যেখানে সহজে অস্বীকার করা যায় না। পাণ্ডিত্য ফলানো প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে চললেও চলতে পারে, কবিতা তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, অতীতেও দিয়েছে। ভবিষ্যতেও রেয়াৎ করবে না। বুদ্ধদেব বসু আর জীবনানন্দকে দেখলেই ধারণা আসবে কিছুটা।
৬।
ক) "Without great solitude no serious work is possible."
খ) "The chief enemy of creativity is good sense."
অমোঘ সত্যের দুই বাণী! অপব্যবহারেরও শীর্ষে এই দুই বাণী!
অতি উত্তম এবং অতি অধম দুজনেই নিজেকে উৎকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত করে থাকে আমাদের সমাজে। অতএব, ‘গুড সেন্স’-এর অনুপস্থিতি যে সন্দেহজনক হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কী! তবে তার চেয়েও বেশি আশ্চর্যের এই, যে, কিছু মানুষ বিন্দুমাত্র একাকীত্বে না ভুগেই নামিয়ে চলেছেন ডিপ্রেশনের কড়চা, একা থাকার ক্র্যাশ কোর্স ইত্যাদি। কবিতা সেই মানুষের কাছে সহজে আসে, যে স্বভাবত উৎকেন্দ্রিক। আরোপে উৎকেন্দ্রিকতা নিয়ে এলে, তার ফল যে ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে কথা আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই এত ভণ্ডামির আশ্রয়। তাই এত ফেরেব্বাজি। কিম কি দুক, গোদার দেখলেই জাতে উঠবেন, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা; আত্মস্থ না করতে পারলে ষোলো আনাই কিন্তু মাটি! কাজেই ট্রেণ্ড দেখে জাতে ওঠা খুবই বিপজ্জনক, বলাই বাহুল্য। এবং তার ভিত্তিতে মত প্রকাশ করা, খুন করারই সমতুল্য। কবিতা নিজেই সুন্দর, লিখতে পারলে আপনি বোঝা যায়, তার জন্য আলাদা ধার করা জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না, চর্চার প্রয়োজন পড়ে।
৭) "Good artists copy. Great artists steal."
আলোচনার শেষে এই উক্তিটি রাখতে বাধ্য হয়েছি। কাজেই, আমরা যারা শব্দ টুকছি, তারা বোধে পৌঁছে যাব, এই আশা রাখি। যারা দৃশ্য টুকে নিচ্ছি নির্দ্বিধায়, হাততালিও পাচ্ছি অহরহ, তাদেরও স্বাতন্ত্র্য আসুক। কত পড়েছি তা দিয়ে আর যাই হোক, কবিতা লেখা যে হয় না, এর উদাহরণ অজস্র। আপনার প্রবন্ধ অতুলনীয় হতে পারে, আপনার গদ্যের হাত সোনায় মোড়া হতে পারে, কিন্তু কবিতার জন্য আপনার বোধ প্রয়োজন।
অন্যথায়, সকলই কথার ধাঁধা হয়ে থেকে যাবে দুর্ভাগ্যবশত!