সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
নারী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষা রির্পোট থেকে আমরা জানতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের প্রায় অর্ধেক মেয়ে, কেবলমাত্র বাড়ির কাজ করেই দিন কাটাচ্ছে। রাজ্যে কোভিড পূর্ববর্তী (২০১৯ সাল) সময়ে করা অন্য একটি সমীক্ষা (জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা এন.এইচ.এফ.এস) ২০২২ সালে প্রকাশিত হলে সেই রির্পোটে মুর্শিদাবাদ(৫৫.৪%), বীরভূম(৪৯.৯%), মালদা (৪৯.১%), পশ্চিম মেদিনীপুর(৫৫.৭%), পূর্ব মেদিনীপুর (৫৭.৬%) সহ অন্যান্য জেলার নাবালিকা বিবাহের যে পরিসংখ্যানটি আমরা দেখছি সেটি রীতিমতো উদ্বেগজনক। কাজেই রাজ্যের নানান প্রান্তে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের বেশী হারে নাবালিকাদের বিয়ে হলে, ঘরকন্নার কাজই তাদের ভবিতব্য হবে সে আর নতুন কথা কি!
রাজ্যজুড়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পরিবির্তিত সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে মেয়েদের অকাল বিয়ের কারণ অনুসন্ধানের কাজটি কঠিন। সেদিন সদ্য কলেজ পাশ করা সহকর্মী বলছিল-‘আজকাল ঘটকদের ব্যবসা ডাউন চলছে। ঘটকরা এখন ঘটকালি পিছু পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চাইছে’। মালদা মুর্শিদাবাদের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সহকর্মীটির কথার যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম। ওরা বলছিলেন –‘আমাদের ওখানের গ্রামগুলোতে এখন আর বিয়ের আগে ‘মেয়েদেখা’র আয়োজন করতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। ‘পাত্রী দেখা’র আয়োজন মানে কোন কাকিমা ভালো রাঁধে, কোন বৌদি ভালো সাজায়- সে এক হৈহৈ কাণ্ড। এখন ছেলেমেয়েরা হয় প্রেম করে বিয়ে করছে নয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। কত দূরদূর জেলা থেকে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা সব গ্রামে বউ হয়ে আসছে আপনি ভাবতেও পারবেন না’।
বাংলার নানান প্রান্ত থেকে মেয়েরা যে গ্রামে বউ হয়ে আসছে তার খানিক আভাস পাচ্ছিলাম গতবছর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ছ’টি ব্লকে কাজ করতে গিয়ে। সেখানে দেখছিলাম পঞ্চাশ উর্ধ ব্যক্তিদের পরিবার ও আত্বীয়রা বিবাহ সূত্রে যুক্ত হয়েছেন পাশাপাশি অঞ্চলের মানুষের সাথে। পরবর্তী প্রজন্মের শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকার প্রসঙ্গ উঠতেই সকলে প্রায় একমত –‘এখন কি আর সেসব দিনকাল আছে। কি করে যে ভাব ভালোবাসা হচ্ছে। দুদিন পর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না হয় হুমকি দিচ্ছে- ওর সাথে বিয়ে না দিলে গলায় দড়ি দেবো’। কাজেই ঘটকদের ব্যবসা ডাউন চলাই হোক বা দূর দূর জেলা থেকে নাবালিকা সাবালিকা মেয়েদের বউ হয়ে গ্রামে আসাই হোক এগুলির কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মালদা জেলার চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মী বলছিলেন- ‘আমাদের কাছে যত নাবালিকা বিয়ের কেস আসে তার চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি প্রেম তারপর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মেয়ে প্রেম করছে জানতে পারলে, মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করবে- পরিবারের সম্মানহানি হবে সেই আশঙ্কা থেকেও অভিভাবকরা নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন’।
মাসখানেক আগে একদল মিড-ডে-মিল কর্মীর সাথে আলাপ হয়েছিল। কৌতুহলবশতই সেদিন স্কুলের রান্না ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম । বেশ বড় রান্না ঘরটিতে রান্নার বিরাট আয়োজন। তারই একপ্রান্তে এক ব্যাগ উপুড় করা কয়েকশ পেন, ঢাকা-খোলা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভারী অবাক হয়েছিলাম। শুনলাম এই স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ও উপস্থিতির হার বেশি। প্রায় হাজারখানেক ছাত্রছাত্রীর জন্য রান্না করতে হয়। তাই মিড-ডে-মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বারো থেকে পনেরজন সদস্য রান্না করতে আসেন। পেনের প্রসঙ্গ উঠতেই আঠাশ উনত্রিশ বছরের শীর্ণকায় মা, রান্না করতে করতে খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলছিলেন- ‘কি করবো ম্যাডাম। গরীব ঘরে জন্মেছি। সতের বছর বয়সে বাপমা সেই একটা গরীব ঘরেই বিয়ে দিয়ে দিল। ইস্কুলে রান্না করে কটা টাকাইবা পাই। মেয়েটা এই ইস্কুলে নাইনে পড়ে। নাইন ক্লাসে ঊঠলে দুপুর মিড-ডে-মিল খেতে পায়না। খিদে পাক না পাক ঘন্টা পড়লে খেতে তো ইচ্ছা করে। দশটা টাকা দিতাম মেয়েটা দুপুরে মুড়ি খেতো। তাই নিয়ে সংসারে কি অশান্তি’। একজনের কষ্টের কথা উঠতেই বাকিরা প্রায় সকলে বলছিলেন সংসারের কাজ সামলে কিভাবে তারা সাড়ে দশটায় ইস্কুলে আসেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারটে বাজে। এই গরমে বাড়ি ফিরে রাতের রান্না, সংসারের যাবতীয় কাজ করতে কষ্ট হলেও সেটি মেনে নিতে পারেন কিন্তু মেনে নিতে পারেননা যখন শুনতে হয় ‘সাতদিন রান্না করে যদি ঝালমুড়ি খেতেই একশ টাকা খরচা হয়ে যায় তবে অমন রোজগারের দরকার কি?’। শীর্ণকায় মা খুন্তি হাতে সবজি নাড়তে নাড়তে বললেন- ‘লেখাপড়া জানিনা তাই দিনরাত গতরে খেটে দুটো টাকা রোজগার করি কিন্তু সেখান থেকে মেয়েটাকে টাকা দিতে পারিনা। ওই যে দেখো মেঝেতে পেন ঢালা আছে। একশটা পেনের ঢাকা পরিয়ে দশ টাকা রোজগার করি। বাড়িতে, ইসকুলে কাজের ফাঁকে এটা করি। ঝগড়া অশান্তি কম হয়নি তবু মেয়েটাকে পড়ানোর জন্য করতেই হয়। দুপুরে খিদে পেলে পড়ায় মন থাকবে না। দুদিন পরে ইসকুল আসা বন্ধ করে দেবে’। শুনছিলাম-‘জানো দিদি আমাদের মতো সংসারে লেখাপড়া করে ভদ্রভাবে রোজগারের টাকায় মেয়েদের তাও কিছু অধিকার থাকে কিন্তু মেয়েদের গতরটা সংসারের, তাই গতরে খাটা রোজগারের টাকাটাও সংসারের’।
ওরা বলছিলেন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানটা কত জরুরী। সেটা বোঝাতে ওরা ওদের নিজেরদের কষ্টের কথা, বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থের ওপর তাদের অধিকার না-থাকার কথা মেয়েদের সাথে আলোচনা করেন। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল মায়েরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখাপড়া শিখে মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার কথা ভাবছেন সেখানে নাবালিকাদের বিয়ে ব্যাপারটি অপ্রাসঙ্গিক। এসব আলোচনায় রান্নার গতি স্লথ হয়ে আসছে বুঝেও প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন –‘তোমরা আমাদের অশিক্ষিত মনে করো দিদি। চারদিকে যা পরিস্থিতি। কি ঘটছে জানো তো সব। বাপমা যে কি দুঃখে সাতসকালে মেয়ের বিয়ে দেয়। ইসকুলে যতক্ষণ থাকে মাষ্টার দিদিমনিরা দেখবে, ঘরকে গেলে আমরা, কিন্তু ইসকুল আর ঘরের মধ্যেকার রাস্তাটুকু কে পাহারা দেবে বলো? ইসকুলের দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে দিয়েছে ফোন আনা নিষেধ। ঘরে ঢুকলে সেই ফোনে ফোনে গল্প প্রেম। আজকালকার ছেলেপুলেরা কারো কথা গ্রাঝ্ঝি করে না। আমাদের পাড়ার একটা সেভেনে পড়া মেয়ে প্রেম করতো কেউ জানতে পারেনি। মেয়েটা যেদিন মরলো সেদিন জানা গেল। পুলিশ মেয়েটার ফোন থেকে জানতে পেরেছে ছেলেটা মেয়েটাকে স্টেশনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর রেললাইনে ঠেলে দিয়েছে। পোস্টমর্টম করে জানা গেছে যে মেয়েটার পেটে বাচ্চা ছিল’। পাশ থেকে একজন ছাত্রীর মা বললেন- ‘আমার দেওর তার মেয়েটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলা বন্ধ করিয়েছিল কিন্তু ওই পাড়ার এইটে পড়া মেয়েটার যখন বিয়ের আগেই পেটে বাচ্চা এলো, তা শুনে ভয়ে নাইনে পড়তে পড়তে নিজের মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিল’।
নাবালিকাদের বিয়ে প্রসঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষাকর্মী, চাইল্ড লাইনের কর্মী, সেচ্ছাসেবী সংস্থা, সরকারী আধিকারিক থেকে শুরু করে প্রায় সকলে স্মার্ট ফোনকেই সবথেকে বেশী দায়ী করছেন। সেদিন মালদা জেলার একজন মাষ্টারমশাই বলছিলেন-‘দেখুন এখন বাচ্চা বুড়ো সবার হাতে ফোন। বেশীরভাগ মানুষ মনে করেন স্মার্ট ফোন থেকে ছেলেমেয়েদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ হচ্ছে কিন্তু আমি কো-এড স্কুলে পড়াই। ছেলেমেয়েদের খুব কাছ থেকে দেখি। স্কুল চত্তর তো আছেই, তাছাড়া বন্ধুর দাদা বা বোন, পাশের স্কুলের কেঊ- সহজে আলাপ গল্প প্রেম বাড়ি থেকে পালানো এসব নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা’। আরও বলছিলেন- ‘আমাদের এখানে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। দেখছেন তো এখনও অনেক মেয়ে হিজাব পরে স্কুলে আসে কিন্তু তাই বলে কি ছেলেমেয়েদের মেলামেশা কম? নাকি মেয়েরা গৃহবন্দী?’। স্কুল চত্তরে বা স্কুল যাতায়াতের পথে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার যে অবাধ সুযোগ, তেমনটা আর কোথায় আছে বলুন তো?’।
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সত্যি তো এই কয়েকদিন যাতায়াতের পথে স্কুল ড্রেস পরা ছেলেমেয়েদের আমবাগান, রাস্তার ধারে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখছিলাম। মালদার ইংলিশবাজার এলাকার সেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী হিসেবে তিরিশবছর যিনি কাজ করছেন তিনি মালদা জেলার নাবালিকাদের বিয়ের পরিসংখ্যান শুনে বলছিলেন-‘বছর তিনেক আগেও সেটা ৭২% ছিল। তবে পরিবর্তন যেটা হয়েছে সেটা হলো আগে বিয়ে দেওয়া হতো আর এখন নাবালিকা হোক বা সাবালিকা এখন তারা নিজে বিয়ে করে কিংবা পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু এতে বিপদ হলো ছেলেমেয়েদের এই প্রবণতার ফলে শুধু নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে তা নয় পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাও বাড়ছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান জানতে পারা যায় না। বিহার-সীমান্ত এলাকা পানজিপাড়ায় (জেলা: উত্তর দিনাজপুর) একটা বড় ব্রথেল আছে, সেখানে মেয়েদের বয়েস শুনলে চমকে যাবেন। সেটি মাফিয়ারা চালায় আর সেখানে এম.এল.এ/এম.পি.-দের যাতাযাত। পুলিশ সেখানে যেতে ভয় পায়। সেখান থেকে একটা মেয়েকেও রেসকিউ করা যায় না’।
শিশুমনে এমন ‘প্রেম’ বসতি শুনে খানিক অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। সেদিন ক্লাস থ্রী’র একজন ছাত্রী বলছিল-‘জানেন তো স্যার আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রোপজ করেনি’। ছোটদের মুখে এমন কথা শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে বইকি কিন্তু তার থেকেও বেশি অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেদিন যখন হলঘর ভর্তি ক্লাস সেভেন ও এইট-এর মেয়েরা অকপটে তাদের বন্ধু বা একই ক্লাসে পড়া আত্মীয়দের প্রেম গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা আলোচনা করছিল- ‘জানো দিদি, রিমা সেভেনে পড়তো। ওর পেটে বাচ্চা আছে বুঝতে পারেনি। গোলাপি শাড়িপরা দিদিমনি বুঝতে পেরে বলেছিল ওর মাকে বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা শুনেই রিমা জমিতে যে বিষ দেয় সেই বিষ খেয়ে মরে গেল’। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে যে শিশুরা এমন অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে কিভাবে। শিক্ষকরা বলছিলেন ‘স্কুল ছুটির পর দরজাবিহীন ক্লাসরুম বা আড়াল-আবডাল, যে হারে বাচ্চারা ব্যবহার করে, আপনি ভাবতেও পারবেন না’। নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা বলছিলেন ‘যে হারে শিশু সন্তানদের এবরস্যানের রেট বেড়েছে শুনলে স্তম্ভিত হবেন। মাঝেমাঝে আমরা হতাশ হয়ে বলে ফেলি কি করে এসব ঘটালি? শিশু বলেই হয়তো এরা অকপটে বলতে পারে ‘আমাদের হোগলা বন আছে, আমাদের আমবাগান আছে’।
মনে হচ্ছিল শিশু বা কিশোরকিশোরীদের যৌনমিলনের সুযোগ বা অভিজ্ঞতা যত বাড়বে নাবালিকা বিবাহ, শিশু পাচার, শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলি দিন দিন ততই বেড়ে চলবে। এভাবেই নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হবে, থানা পুলিশের ভয় দেখিয়ে তাদের নিরস্ত্র করাও দিনকে দিন অসম্ভব হলে উঠবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা অভিভাবকদের ‘অশিক্ষিত অসচেতন অভিভাবক’ বলে চিহ্নিত করে ফেলার আগে ‘ইসকুল আর ঘরের মধ্যেকার রাস্তাটুকু কে পাহারা দেবে বলো?’ বা ‘পোস্টমর্টম করে জানা গেছে যে মেয়েটার পেটে বাচ্চা ছিল’-মতো ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানকে ঘিরে আশঙ্কা, উৎকন্ঠাটুকু সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবো। চাইল্ড লাইনের কর্মী অথবা ব্লক স্তরের সি.পি.সি.( চাইল্ড প্রটেকশন কমিটি) কর্মীরা বলছিলেন যে তারা আনুমানিক ৩০- ৪০ শতাংশ নাবালিকার বিয়ের আসরে হাজির হতে পারেন। সেখানে পুলিশসহ প্রশাসনের উপস্থিতিতে বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা বা ভয় দেখান সবই হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অভিজ্ঞতাটি ‘সবেমিলে একটা কেওয়স তৈরি হয় কিন্তু কটা বিয়েইবা আটকাতে পারি?’র মতো হতাশাজনক। মালদার সেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী বলছিলেন-‘এসব ক্ষেত্রে ইনটারভেনশনে এমনটাই হয়। বাবামাকে মুচলেকা পর্যন্ত লেখান হয় তারপর সবাই চলে গেলে রাতের বেলা বাড়ি বন্ধ করে স্বপরিবারে অন্য কোথাও গিয়ে মেয়েটির বিয়ে দেয়। কিন্তু হবে নাই বা কেন বলুন তো? যারা বিয়ের আসরে হাঙ্গামা করে বাড়ি ফিরে গেলেন তারা কোনদিন সেই মেয়েটি স্কুলে যাচ্ছে কিনা তার বিয়ে হয়ে গেল কিনা খোঁজ নেন? আপনি একটু আগে চাইন্ড ম্যারেজের রেকর্ড পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইছিলেন তো, না, সেরকম সঠিক রের্কড কোথাও পাবেন না। প্রথমদিকে চাইল্ড লাইন কর্মী হিসেবে আমাদের মনিটারিং-এ এইসব মেয়েদের নিয়মিত খোঁজ রাখতাম। বাবামা জানতো আমরা খোঁজ রাখছি। কিন্তু সেটা একটা ব্লকের কতটুকু বা জায়গায়! প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এখন সেটাও বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার আট-নয় মাস অন্তর টাকা দেয়, নিয়মিত পারিশ্রমিক না পেলে কর্মীরা কাজ ছেড়ে দেয়। নতুন কর্মী এলাকা চিনে ওঠার আগে, বিভিন্ন স্তরে সি.পি.সি.-র সদস্যদের সাথে পরিচিত হতে হতে আরও কয়েকশ নাবালিকার বিয়ে হয়ে যায়’। সংস্থার সেক্রেটারী বলছিলেন – ‘প্রতিরোধের এই লড়াইটি অসম লড়াই। নাবালিকা বিবাহের ঘটনায় আত্মীয়, প্রতিবেশী থেকে গ্রামবাসীর এককাট্টা সমর্থন থাকে কারণ তারাও কন্যা সন্তানের অভিভাবক’। গ্রামবাসীদের এককাট্টা সমর্থন প্রসঙ্গে সেদিন অফিসে একজন বলছিলেন –‘ নাবালিকার বিয়ের খবর থানা জানতে পারলে থানা থেকে অনেকসময় সিভিক ভলান্টিয়ার্স পাঠায়। নাবালিকার পরিবার সিভিক ভলান্টিয়ার্সদের প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়। গ্রামবাসীরা একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ালে ওরা একা কিছু করতে পারেনা। সে পুলিশই হোক বা ভলান্টিয়ার্স। তাছাড়া ওরা নিজেও মনে করে আহা মেয়েটার বিয়ের আয়োজন হয়েছে সেটা ভেঙে যাবে’। এভাবেই থানার প্রতিনিধির সামনেই নাবালিকাদের বিয়ের মতো ঘটনা ঘটছে।
সিভিক ভলান্টিয়ার্সদের প্রসঙ্গ উঠতেই মূর্শিদাবাদের চাইল্ডলাইনের কর্মী বলছিলেন— ‘জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাটিও খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমরা যখন ইনটারভেনশনে যাই পঞ্চায়েত প্রধান বা মেম্বারকে সঙ্গে পাইনা। যে জনরোষের মধ্যে আমাদের পড়তে হয় তাতে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও জনপ্রতিনিধিরা সঙ্গে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সুবিধে হতো। এসব ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত প্রধান সবার আগে গা ঢাকা দেয়’। জেলার অন্য ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা বলছিলেন-‘সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন থাকলেও আমরা মহিলা বলেই হয়তো গ্রামবাসী সবার আগে আমাদের অ্যাট্যাক করে। একবার হেসো নিয়ে আমাকে মারতে এসেছিল। একজন পুলিশ সেদিন কোন উপায়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। পাশের বাড়িতে থাকা মেম্বার সেদিন পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসেননি’। বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা সি.পি.সি-র সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বিষয়ে ব্লক স্তরের আধিকারিকরাও হতাশা প্রকাশ করছিলেন-‘যে পাড়ায় ঘটনা ঘটছে সেই একই পাড়ায় মেম্বারের বাড়ি, তা সত্ত্বেও তার সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এমনও ঘটনা ঘটছে যে ‘আমি দেখছি আপনারা যান’ এই বলে পুলিশকে সরিয়ে দিয়ে মেম্বার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গ উঠতেই নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের প্রাক্তন কর্মী বলছিলেন –‘ইরিগেশন, ফরেষ্ট ইত্যাদির মতো কিছু ডির্পাটমেন্ট ছাড়া অন্য কোন ডির্পাটমেন্ট পঞ্চায়েতকে পাত্তাই দেয়না। সরকারি দপ্তরগুলি যদি পঞ্চায়েতকে গুরুত্ব না দেয় তবে তারাইবা কেন সরকারকে অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করবে? আবার কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থেও নাবালিকা বিয়ে প্রতিরোধের ঘটনায় এরা সচেতনভাবে আড়ালে থাকতে চান। তবে পুরুলিয়া মুর্শিদাবাদের মতো কিছুকিছু জেলায় আমরা প্রথম থেকে পঞ্চায়েতকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। বহু জায়গাতে আমরা পঞ্চায়েতের সহযোগিতা পেয়েছি’।
এতদিন নাবালিকাদের বিয়ে থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অসচেতনতার জন্য দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমরা জেনে এসেছি। আজ তাতে নতুন করে যুক্ত করছি কোভিডের মতো ঘটনাকে। নারী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত রির্পোটটি দেখে অনেকের মনে হচ্ছে যে কোভিডের সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এমনটা ঘটছে। তাহলে রাজ্যে কোভিড পূর্ববর্তী (২০১৯ সাল) সময়ে করা এন.এইচ.এফ.এস রির্পোটটি? আমরা সেখানে দেখছি রাজ্যের যে পাঁচটি জেলায় নাবালিকা বিবাহের হার বেশি সেখানে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মেয়েদের [মুর্শিদাবাদ (৬৭.৬%),বীরভূম (৭০.৮%), মালদা (৭২.৩%),পশ্চিম মেদিনীপুর (৭০.৯%), পূর্ব মেদিনীপুর (৭৭%)] শিক্ষার হারও উচ্চ অর্থ্যাৎ এরা নবম শ্রেণি বা তার বেশি পড়াশোনা করা সত্ত্বেও সেখানে এধরনের ঘটনা ঘটছে।
সাধারণ নিম্নবিত্ত গরীব মানুষদের ‘অসচেতন’ বলার অসুখটি ভারী সংক্রামক। নাবালিকাদের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই ‘আমরা চাই আপনি এবিষয়ে লিখুন, তাতে করে যদি বাবা-মা একটু সচেতন হয়’-এমন কথা শুনেছি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিরোধকারী প্রায় সকলের মুখে। অকালে বিয়ের কারণ অনুসন্ধানের কাজটি ঠিক এই জায়গাতেই বড্ড কঠিন। আমরা যদি ধরেই নিই যে অভিভাবকদের অসচেতনাই বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে অন্যতম বাধা তবে প্রতিরোধের সঠিক রাস্তাগুলির অনুসন্ধান করবইবা কেমন করে? শুধুমাত্র কলকাতার পাশের জেলাগুলি থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মায়েরা ভোররাতে পেশাগত কারণেই শহরে আসেন। একলা ঘরে অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে সন্তানের প্রেম, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে বা পাড়ার অমুকের মতো ‘অঘটন’ ঘটার সম্ভাবনার বা সন্তানের বিপদের কথা ভেবে মায়ের আতঙ্কটিও কিন্তু স্বাভাবিক। সামাজিক সম্মান হোক বা আত্মসম্মান সেটিকে কি আমরা কালিমালিপ্ত হতে দিতে চাই? গরীব বলে কি সন্তানের জন্য উদ্বেগ বা সামাজিক অসম্মানের ভয় থাকবে না? সামাজিক সমস্যার কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের এই শ্রেণিবিভেদের মানসিকতাটি অভিভাবকদের আশঙ্কা অসম্মান ইত্যাদি প্রসঙ্গে উদাসীন থেকে অসচেতনতার প্রসঙ্গটিকে এভাবেই বারেবারে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কোন অর্থেই সমর্থনযোগ্য না হতে পারে কিন্তু মা যখন মনে করেন ‘ছোটছোট ভাইবোনেদের সাথে মেয়েটাকে একলা ঘরে রেখে আমরা কাজে যাই। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। যদি কোন অঘটন ঘটে। তাই বিয়ে দিয়ে দিলাম। ছেলেটার চপের দোকান আছে। খেয়ে পরে পরিবারের পাঁচটা লোকের সাথে বাঁচবে’। সন্তানকে ঘিরে অভিভাবকের এই আতঙ্কটিকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা না করলে বা সেটিকে অস্বীকার করলে প্রতিরোধের বাঁধনগুলি আলগা হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের জীবনে বহু অনিবার্য পরিস্থিতি থাকে যার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়। গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসটেপিসটে জড়িয়ে থাকে। যার থেকে বেরনোর উপায় থাকে না। আমরা সেটিকে নির্বিচারে অসেচতনতার তকমা দিই।
মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যপারে প্রায়শই শোনা যায়- ‘আমার মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো, ছেলের বাড়ি থেকে বললো টাকাপয়সা লাগবে না তাই বিয়েটা দিয়ে দিলাম’। শুধুমাত্র বিনা পণে বা পণের টাকা কম দেওয়ার সু্যোগ থাকায় কত নাবালিকা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে সে পরিসংখ্যানটি আমাদের অজানা হলেও ২০১৪ সালে দেখেছিলাম তিনটি প্রজন্মের (পিসী, দিদি, মেয়ে) মেয়ের বিয়েতে পণ দিতে গিয়ে এক একটি পরিবারের বছরভর খাদ্য জোগানকারী কৃষি জমি, গয়না, বাসনপত্র, ভিটেমাটি একে একে হাতছাড়া হয়ে গেছে। পরিবারের মহিলা ও পুরুষ সদস্যরা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। পণ নামক সামাজিক ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত এইসব মানুষেরা যদি ‘সচেতন’ হয়েও থাকেন তাহলেও কি অকাল বিয়ের মতো সামাজিক অসুখ থেকে নিজের সন্তানকে তারা আগলে রাখতে পারবেন?
আমাদের সমাজে সন্তানের বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অভিভাবকের সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেও গণ্য করা হয়। কাজেই সামাজিক দায়িত্ব পালনের মানসিকতা থেকেও ‘ভালো ছেলে পেলাম’, ‘আমরা গরীব তায় চারটে মেয়ে, সময় থাকতে মেয়ে পার করতে হবে’ ইত্যাদি যুক্তি অভিভাবকদের দিক থেকে থাকবেই। কিন্তু সেদিন যখন পূর্ব মেদিনীপুরের শিক্ষাকর্মীরা জেলার বেশ কিছু এলাকার জাতপাতের ভেদাভেদকেও অকাল বিয়ের অন্যতম কারণ বলছিলেন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সেদিন সেটি স্বীকার করে নিতে অসুবিধে হলেও মনে হচ্ছিল সমাজে ছড়িয়ে থাকা কারণগুলির কতটুকুই বা আমরা জানি। মাসখানেক আগে পুরুলিয়া থেকে আসা তেরোজন ছেলেমেয়ের সাথে এ নিয়ে আলোচনা চলাকালীন চব্বিশ পঁচিশ বছরের মেয়েটি বলছিল- ‘আমি তো একটা ছ্যেলিয়াকে ভালবাসি কিন্তু উ ছোট জ্যাতের বলিইয়্যে আমার মা-বাপ উয়ার সঙ্গে আমার বিয়া দিবেক নাই’। শুনলাম উপস্থিত একজন ছেলেও একই কারণে যাকে পছন্দ করে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারছে না। জানতে চাইলাম- ‘তোমরা কেউ বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করতে পারবে না? সমস্বরে সেদিন যা শুনেছিলাম প্রাথমিকভাবে তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না-‘এমন করলিয়্যে মা-বাপ শ্রাদ্ধ করব্যেক। লোক ডাক্যিয়ে ভোজ খাওয়াব্যেক’। বাবা-মা ছেলের শ্রাদ্ধ করবে! বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওদের দিকে, শুনছিলাম – ‘নাগো দিদি, ছ্যেলিয়ার শ্রাদ্ধ করব্যেইক নাই। ছ্যেলিয়ারা অজাত্যের বিটিছ্যেলিয়া বিয়া করলিয়্যে বাপমা পত্থম পত্থম দমে অশান্তি করব্যেক, তারপরে বউ ঘরকে লিবেক। বিটিছ্যেলিয়ারা অজাত্যে কুজাত্যে বিয়া করলিয়্যে মা-বাপ উয়ার শ্রাদ্ধ করব্যেক। লোক ডাক্যিয়ে ভোজ খাওয়াব্যেক। আর কুনদিন বিটিছ্যেলিয়াটার মুখ দেইখব্যেক নাই। সব সম্পক্ক খতম করিইয়্যে দিব্যেক ’।
যে কোন সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা কোন বিশেষ জনগোষ্ঠির মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কিনা সেটি খোঁজার চেষ্টা করি। শিশু সুরক্ষা ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মতো শিশুকেন্দ্রিক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অনেকেই বলছেন যে, বিশেষ কোন জাতি বা ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠির নাবালিকাদের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাল্য বিবাহে শিশুরা নিজে যখন যুক্ত হচ্ছে এঁদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সেখানে হয়তো জাতি বা ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে বিশেষ কোন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া এই প্রবণতার কারণ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মুখে স্মার্টফোনের কথাই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার আলাপ প্রেম বিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। বছরখানেক আগে ১৯৯৫ সাল থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার সাথে যুক্ত একদল বয়স্ক কর্মীদের সাথে আলাপচারিতায় শুনছিলাম, সেসময় একটি গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তারা কিভাবে যাতায়াত করতেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ নিজের গ্রাম ছেড়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করতেন না। আজকের মতো সেসময় আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ এতো সক্রিয় ছিল না। আলোচনায় আরো উঠে আসছিল বর্তমানে রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে পারস্পরিক যোগাযোগের বিস্তৃতির কথা। গবেষণার কাজে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে ছটি ব্লকের প্রায় নব্বইটি গ্রামে বহু মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম পরিবারের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাপের বাড়ির যোগাযোগের কথা। শুনে ভারি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আশিউর্ধ মা থেকে শুরু করে পরিবারের বাকি সকলে শুধু বাপের বাড়ি যান তাই নয় বাপের বাড়ির পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবেও সামিল হন। এই ঘটনার সাথে বাল্য বিবাহের যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি দেখে সকলকেই প্রায় একমত হতে শুনছিলাম –‘এখন সবাই বলে ফেসবুকে প্রেম হচ্ছে। আপনি তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেন এখন লোকে গ্রামের বাইরে গিয়ে যেমন রোজগার করছে, হাতে দুপয়সা আসছে তেমন কুটুম্বিতাও বাড়ছে। মামার বাড়ি মাসি পিসীর বাড়িতে আজ বিয়ে বাড়ি কাল মেলা হলে নিমন্ত্রণে পরিবারের লোকজনরা দলবেঁধে সব সেখানে যাচ্ছে। আত্মীয়বাড়িতে ছেলেমেয়েদের নিজেদের মধ্যে আলাপ হচ্ছে, বাড়ি ফিরে কিছুদিন ফোনে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর। তারপর ওই যে বলছিলেন নাবালিকাদের বিয়ে, সেটাই হচ্ছে’। এসব আলোচনায় ছোটবেলার সেই ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ বিতর্ক সভাগুলির কথা মনে পড়ছিল। স্মার্টফোনে কি আর শুধুমাত্র ফেসবুক আর ‘গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর’? মুঠোফোনে যে রঙিন স্বপ্নিল দুনিয়ার হাতছানি? শিশুমন এমন অমোঘ টান কি উপেক্ষা করতে পারে? ষোল বছরের মেয়েটি অকপট-‘আমার বাবার যা সামর্থ্য, বাবা গরীব ঘরেই বিয়ে দেবে। ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পয়সা লাগে। ছেলেটিকে আমার ভালো লাগে। রোজগার করে আমাকে ভালো রাখবে বলেছে। কলকাতা ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছে’। দিনরাত টিভি সিরিয়ালে চাকচিক্যময় জীবন শিশুমনে ভালো রাখার প্যারামিটার সেট করে। ভালো রাখা কিংবা রোজগারের নিশ্চয়তা নিয়ে শিশু মনে প্রশ্ন থাকার কথা নয়, তাই থাকেনা। তবে সামগ্রিকভাবে এমন গভীর সামাজিক অসুখ দারিদ্র্য, শিক্ষা, জাতি, ধর্ম দ্বারা অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথাই বলছেন অকাল বিবাহ প্রতিরোধকারী ‘যোদ্ধা’রা। সেই কারণেই মনে হয়, যে সামাজিক অনুশাসন বাবা-মাকে সন্তানের পারলৌকিক কাজ করতে বাধ্য করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সবার আগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলির গভীরতাকে ও তার সঠিক কারণগুলিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রসঙ্গে কন্যাশ্রী ক্লাবের ভূমিকার কথা উঠতেই চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মীদের অনেকেই বলছিলেন, তারা যেসব কিশোরীদের সাথে কাজ করেন সেইসব নাবালিকা ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’দের মধ্যে অনেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে অথবা বাবা মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। মাসখানেক আগে প্রায় তিনশজন কন্যাশ্রীর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ না হলে হয়তো বিষয়টি নিয়ে এমন ভুল ধারণা আমারও থেকে যেতো। দিনকয়েক আগে যে শিশুটি বিয়ে করবে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে শিক্ষকের কাছে ছুটে এসেছিল প্রশাসকরা তড়িঘড়ি তাকে ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’ বললেন। শিশুদের সাথে কথা বললে বুঝবেন সংখ্যাগরিষ্ঠরাই জানে ইসকুল থেকে টাকা পায়, কেন পায়, এই প্রকল্পের নিয়মাবলি সবই এদের অজানা। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধের প্রভাব খুঁজতে আমরা অভিভাবকদের বদলে শিশুদের ফ্রন্ট লাইনে আনছি বলেই কন্যাশ্রী ক্লাবের ভূমিকাকে বড় করে দেখা হচ্ছে, তাদের নেতিবাচক সমালোচনা করা হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে কি সত্যি তারা এমন গভীর সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে? এমন গুরুতর সমস্যার গভীরতা বোঝার মতো কি তারা বড় হয়েছে? তাছাড়া ব্লক স্তরে গঠিত কন্যাশ্রী বাহিনীর ব্লকে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যন্ত গ্রামের খবর পাবেই বা কি ভাবে? এপ্রসঙ্গে চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মীরা বলছিলেন-‘প্রতিদিন যা ঘটছে তার কত শতাংশ ঘটনাইবা আমরা জানতে পারি। আমরা স্কুলসহ প্রশাসনের শিশু সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি বডির সাথে কাজ করি। তাতেও কি আমরা সব ঘটনা জানতে পারি? এলাকায় এধরনের ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আশা বা অঙ্গনওয়াডি কর্মীরা জানতে পারে কিন্তু তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে যেমন ভয় পায় তেমনি ওই এলাকায় তারা কাজ করতে গিয়ে বাধা পাবে সেই আশঙ্কা থেকেও আমাদের খবর দেয়না। গোপনে খবর দিক বা না দিক এলাকাবাসী এইসব কর্মীদের সন্দেহ করে এবং বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কাজেই জানবেন কেউ পাশে থেকে কিশোরী বাহিনীকে পরিচালনা না করলে তাদের পক্ষে বিয়ে আটকানোর মতো কাজে সামিল হওয়া প্রায় অসম্ভব’।
বাল্য বিবাহের মতো সমস্যাটি কোভিড পরবর্তী সময়ে আরো গুরুতর সমস্যার পরিণত হয়েছে সেটি আমরা অনুমান করতে পারি। তবে এর বিরুদ্ধে কাজ করতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের সামনে সমস্যাটির স্পষ্ট ছবিটি তুলে ধরতে হবে। গতবছর একটি গবেষণা সংস্থার হয়ে ছাত্রছাত্রীদের ড্রপআউট সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে সমীক্ষকরা দেখেছিলেন যে, বহু পরিবারে পনের থেকে আঠের বছর বয়েসের মেয়েদের ড্রপআউট হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল বিয়ে। বহু ক্ষেত্রে দপ্তরের আধিকারিকরা যেমন সমীক্ষকদের সেই তথ্য গোপন রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমনি সমীক্ষকরা অনুমান করছিলেন যে গবেষণা সংস্থাটিও সঠিক তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখবেন। ইতিমধ্যে আমরা জানি শিক্ষা দপ্তরের করা ড্রপআউট লিষ্টটিতে অতি যত্নে হাজার হাজার ড্রপআউট ছাত্রছাত্রীর নাম নথিভুক্ত করা হয়নি। অথচ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা বারবার দাবি করছেন যে কোভিডের সময় যে হারে নাবালক নাবালিকাদের বিয়ে হয়েছে সেটি আন্তরিক ও যথাযথভাবে সমীক্ষা ছাড়া চিহ্নিত করা অসম্ভব। চাইল্ডলাইনের কর্মী বলছিলেন-‘সেসময় আমাদের কাছে পকসো কেসের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। আমি একটা ব্লকের দায়িত্বে আছি, সেখানে বারো থেকে চোদ্দ বছর বয়সি মেয়েরা শুধুমাত্র বাবা, কাকা, দাদু’র দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে এমন কেসের সংখ্যা ছিল দেড়শো জনেরও বেশি। অনেকেই প্রেগনেন্ট হয়ে গিয়েছিল, যাদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। কাজেই আটকানো যাবে না, বাবা-মায়েরা নাবালিকাদের বিয়ে দেবেই’। মালদার স্বেচ্ছাসেবী কর্মী বলছিলেন-‘কোভিডের সময় মেয়েদের বাড়ি থেকে পালানোর ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। তাই দেখে সেসময় আতঙ্কে বাবামায়েরাও নির্বিচারে শিশুকন্যার বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের জেলায় পুলিশ সচরাচর কেস নিতে চায়না, তা সত্ত্বেও জেলার হোমগুলিতে এতো ভীড় যে আমরা সংস্থার পক্ষ থেকে হোমের জায়গা ফাঁকা করার জন্য হোম ও শিশুর বাড়ির মধ্যে লিয়াজোঁর কাজ করি যাতে শিশুটিকে বাড়িতে ফেরান যায়’। এসব বাস্তব উদাহরণ ছাড়াও খবরের কাগজ, টিভির পর্দা জুড়ে শিশুদের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নিত্যদিনের। তাকে ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতোরের আড়ালে সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের আতঙ্ক দোলাচলগুলি চাপা পড়ে যায়। ‘আমার দুটো মেয়ের বয়স ১৪ আর ১৬ বছর। দিদিমণিরা বলতে এসেছিল মেয়েটা কন্যাশ্রীর টাকা পাচ্ছে। মেয়েটার বিয়ে না দিয়ে ওকে পড়াশোনা করাতে। ওই পাড়ার বুড়োটা নাতনিকে ধর্ষণ করে জেলে গেছিল। আজ ছাড়া পেয়েছে। যে নিজের পরিবারে এমন কাজ করে সে পাড়ার মেয়েদের কি ছেড়ে দেবে? দেখাশোনা করছি। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেব’। সাংবাদিক বন্ধুরা এমন পকসো কেসের উদাহরণ দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে বারেবারে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করবেন, রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে এসব নিয়ে যত আন্দোলনের হুঙ্কার দেবে তত সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের আতঙ্কটি শিশুদের বিয়ের পিঁড়ির দিকে এগিয়ে দেবে।
বিয়ের পিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া এইসব শিশুদের বিয়ে আটকাতে যারা কাজ করছেন তাদের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এমন গুরুতর সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঢাল তরোয়ালগুলি ভারি দুর্বল। জেলায় জেলায় তারা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কন্যাশ্রীদের নিয়ে কাবাডি বা ফুটবল দল তৈরি করেছেন! মাষ্টারমশাই বলছিলেন –‘নাবালিকারা শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেও কন্যাশ্রীর টাকা নেবে বলে স্কুলে হাজিরা দেয়। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে দেখি যে মেয়েটি দুবছর পর আবার স্কুলে ভর্তি হবে ও কন্যাশ্রীর টাকা কবে পাবে জানতে এসেছিল, সে রাস্তার ধারে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ভয় পেয়ে কোলের শিশুটিকে লুকোনোর চেষ্টা করছিল’। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও গ্রামবাসী ও রাজনৈতিক দলের চাপে স্কুল নীরবতা পালন করে। কাজেই অকাল বিয়ে প্রতিরোধের কন্যাশ্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছেন বলেই বাল্য বিবাহ রোধে যাদের নিরন্তর লড়াই, তাদের হতাশাটি বড্ড বেশি স্পষ্ট।
এছাড়াও প্রতিরোধকারিরা বিয়ের আসর অব্দি পৌঁছতে পারলেও ওরা জানেন সেই প্রতিরোধটি সাময়িক। ‘প্রশাসন বিয়ের মণ্ডপ থেকে তুলে এনে মেয়েটিকে হোমে রাখার ব্যবস্থা করছে না বলে আমাদের সব চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। কি হবে বলুন তো অমন হৈচৈ করে বিয়ের আসরে হানা দিয়ে?’। প্রতিরোধকারী কর্মীদের সবিনয়ে বলতে চাই আপনারা হোমগুলিকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করছেন? সেদিন সদ্য আলাপচারিতায় কোন একটি জেলার হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী বলছিলেন-‘এখানে কিভাবে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ভাবতে পারবেন না। হোমে রেখে কি লাভ। বাড়িতে ফিরিয়ে দিলে বড় জোর বাপ-মা বিয়ে দেবে। এখানে যা হচ্ছে তার থেকে তো ভালো’। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এতদিন নাবালিকা বিয়েতে ভূমিকা ছিল অভিভাবক তথা পরিবারের। আজ তাতে সামিল হয়েছে ভিকটিম নিজে।
স্কুলে নাবালিকা বিয়ের ঘটনা ঘটছে দেখে শিক্ষকরা কখনো কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানান। তবে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঢাল তরোয়াল বলতে মেয়েদের জন্য সরকারি প্রকল্প ও তাদের আইনি অধিকারগুলি সম্পর্কে ছাত্রীদের অবগত করা ও বিয়ের ফাঁদ পেতে মেয়ে পাচারের মতো ঘটনার ভিডিও ক্লিপিং ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা মূলক অভিযান। অথবা কাউন্সেলিং-এর নামে রাজ্যজুড়ে বাঁধা বুলি ‘কম বয়েসে মেয়েদের বিয়ে হলে শরীরের ক্ষতি হয়, মেয়েদের শরীরে বাচ্চার থলি ঠিক মতো তৈরি হয়না, তাই অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়’- শিশুরা এসব শোনে কিন্তু তাদের কি এইসব সমস্যার গভীরতা বা তার গুরুত্ব বোঝার বয়স? শরীরে বাচ্চার থলি, অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু- এসব তাদের কাছে সবই এবস্ট্রাক্ট (বায়বীয়)। আমরা কি কখনো তাদের শরীরে রি-প্রোডাক্টিভ সিস্টেম সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি? নাবালিকা বিয়ের ফলে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা গার্হস্থ হিংসা কিংবা অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর অসুস্থতা সংক্রান্ত ভিডিও ক্লিপিং ধারাবাহিকভাবে দেখানর পরিকল্পনা করেছি? এগুলিই যে নিশ্চিত রূপে কার্যকরী হবে তার কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও বারবার দেখার ফলে শিশু তার পরিবেশ থেকেই এসব ঘটনার মিল খুঁজে পেতে পারে। যারা মাঠেঘাটে নেমে জনরোষের মুখোমুখি হয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে প্রতিদিন বহু বহু নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে। তাদের মধ্যে কতজনের গণিকালয় আর কতজনের শ্বশুরালয়ে ঠাঁই হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে বিক্ষিপ্তভাবে জানতে পারি শ্বশুরালয়ে ঠাঁই হওয়া শিশুদের কথা, যাদের রাতারাতি শিশু থেকে গৃহবধূ তথা সন্তানের জননীতে রূপান্তর ঘটে। সমাজ তথা পরিবার তাদেরকে একজন পূর্ণবয়স্ক নারী হিসেবে বিবেচনা করে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত পাঁচদিনের সন্তান সদ্য মা হওয়া শিশুকে রাতভর জাগিয়ে রাখে, সেই অভিযোগে নাবালিকা মা তাকে স্তন্যপান না করিয়ে শাস্তি দেয়। ঘরগৃহস্থালির কাজ অবিন্যস্তভাবে পড়ে থাকে। সংসারের চাহিদা অপূর্ণ থাকে, নাবালিকা গৃহবধূর প্রতি স্বামী ও পরিবারের ক্ষোভ জমতে থাকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মেয়েদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এভাবেই বাল্য বিবাহের প্লাবন প্রতিরোধে রাজ্যজুড়ে কর্মীদের নিরন্তর লড়াই কিংবা ‘গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে মহিলাদের সুরক্ষা’ আইনগুলি যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন এমন অন্ধকারময় ছবির সামনে ক্ষীণ আলোর সন্ধান মাঝেমাঝে পাওয়া যায়- ‘যেসব বিয়ে আমরা আটকাতে পারি তার বেশিরভাগই মেয়েটি নিজে বিয়ে করতে চায় না বলেই। তখন সে নিজে কোন না কোন ভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনেক সময় দেখা যায় মেয়ে বিয়ে করতে না চাইলে মা তার পাশে থাকেন’। কিন্তু পথটি তো এমন মসৃণ নয়। কাজেই অমসৃণ পথকে মসৃণ করার পরিকল্পনাটি বাস্তব সম্মত হতে হবে। সংখ্যা যাই হোক তবুও তো পাঁচিলটি উঁচু হলেও তাকে টপকানো সাহস সঞ্চয় করতে পারছে আমাদের গুটিকয়েক শিশুকন্যারাই। কাজেই আমাদের দায়িত্ব হবে তাদের সামনে বাস্তবসম্মত সম্ভাব্য বিপদগুলির স্পষ্ট ছবিটি তুলে ধরা। পোস্টার, দেওয়াল লিখন, আঞ্চলিক সুরে গান বেঁধে জনসচেতনতা মূলক প্রচারের ছবিটি আমাদের কাছে বহু পরিচিত। কিন্তু সেগুলি যে তেমনভাবে কার্যকরী হয়নি সেই অভিজ্ঞতাটিও আমাদের দীর্ঘদিনের। সচেতনতার প্রচারে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ প্রকল্পগুলির উল্লেখ করার প্রয়োজন থাকলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সেগুলির বেনিফিসিয়ারিরা আমাদের র্টাগেট গ্রুপও। কাজেই নতুন করে পরিকল্পনা করতে হলে স্কুলে স্কুলে নিয়মিতভাবে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একেবারে সরাসরি এবিষয়ে আদানপ্রদানের কাজটি যেমন অত্যন্ত জরুরী তেমনি তাদের ফোনে চাইল্ড লাইনসহ অন্যান্য ফোন নম্বরগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কাজটিও জরুরী। তাছাড়া পোস্টার দেওয়াল লিখন পড়ে শিশুরা কি বুঝবে? আমরা শিশুদের মেয়ে পাচারের ভিডিও দেখিয়ে সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কার কথা তাদের জানাতে পারি কিন্তু ভয় দেখিয়ে কি কাউকে মোটিভেট করা যায়? মুঠো ফোনে তারা রঙিন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নের রঙ পালটানোর জন্য দেশের অতীত ও বর্তমান নারীদের প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার জন্য কি আমরা বীরাঙ্গনা নারীদের জীবন কাহিনী, শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ডাক্তার, ঝকঝকে আইটি সেক্টার বা উড়ান চালানোতে পারদর্শী পাইলট মেয়েদের ছবি আঁকতে পারি না? পরীক্ষামূলকভাবে আমরা দেখার চেষ্টা করতে পারি যে ভয় নাকি সাফল্য কোন হাতিয়ারটি শিশুসহ মায়েদের উদবুদ্ধ করছে। কর্মসূত্রে এমন কত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। কতদূর পড়াতে চান এমন প্রশ্নে স্বতফূর্ত প্রতিক্রিয়া শুনেছি যে তাদের মেয়ে যেন ‘গোলাপী শাড়ি পরা দিদিমণি, ইস্কুলের দিদিমণি হতে পারে। পড়াশোনা করে তোমার মতো যেন হয়, তোমার মতো এমন করে যেন কাজ করতে পারে’-এমন কথাও শুনেছি বহুবার। গতবছর নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে আলাপ হয়েছিল একদল খুদেদের সাথে। আলাপচারিতার মাধ্যম হিসেবে আমার সেই পুরানো হাতিয়ার- ‘তোমরা বড় হয়ে কি হতে চাও’। ডাক্তার, ইসকুলের দিদিমণির মতো পরিচিত পেশার উল্লেখ ছিল। তারই মধ্যে ক্লাস ফোরের ছাত্রীটি বললো ‘আমি মডেল হতে চাই’। কৌতূহল হয়েছিল তাই মডেল হতে চাওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলাম। ঝটিতি উত্তর এসেছিল-‘এটিটিউড দেখাব’। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা পরিকল্পনা করবো যে শিশুদের মোটিভেট করতে, আমরা ভয় নাকি স্বপ্ন কোনটি দেখাবো।
সন্তানকে ঘিরে বাবামাও তো স্বপ্ন দেখেন। তাই সন্তানদের সচেতন করার প্রয়াসেই হোক বা স্বপ্ন দেখানোর পরিকল্পনা - বাবা-মায়েরাও তাতেও প্রভাবিত হবেন। নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে কমিউনিটি পার্টিশিপেশনকে সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জীবিকা মিশন ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের অধীনে রাজ্যে ১০.৪৫ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী যুক্ত করা হয়েছে। এভাবে কয়েক লক্ষ মায়েরা প্রভাবিত হলে পরিবার তথা সমাজ প্রভাবিত হবে। প্রভাবিত হবে বিদ্যালয় শিক্ষাটিও। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে মাষ্টারমশাইরা যেদিন বলবেন ‘মেয়েটা পড়াশোনা করে। ফেল না করে অন্য ক্লাসে উঠছে বলে বাবা-মা ওকে কষ্ট করেই পড়াচ্ছেন’ সেদিন নিম্নবিত্ত দরিদ্র বাবা-মা তাদের জীবনের অনিবার্য পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পন না করে বিয়ের পিঁড়ি নয় সন্তানকে বিদ্যালয় আঙিনায় পৌঁছে দেবেন। এমন করেই হয়তো কোন একদিন আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে একদিন অন্ধকার রাত কেটে ভোর হবে।