সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
পাড়ার গৃহবধুরা আমার স্ত্রীকে (অযাচিত) পরামর্শ দিয়েছেন এ. সি. কেনার জন্য। আমার স্ত্রী তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কেন আমাদের এ.সি. দরকার নেই। তার জন্য তাঁকে অন্যের বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে, হজম করতে হয়েছে এবং তাতে অনর্থক শক্তি ক্ষয় হয়েছে। আমাদের পারিবারিক বোঝাপড়া এই যে গাড়ি আর এ.সি. কিনবো না। কিন্তু আমরা যে ওঁদের পরামর্শ শুনছি না সেজন্যে সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অথচ, আমাদেরই দায়িত্ব ছিল ওঁদেরকে গাড়ি বা এ.সি. ছাড়াও যে বেঁচে থাকা যায় সে কথা বোঝানোর। আমরা সেই দায়িত্ব নিলাম না। ফলে ওঁদের বাড়ির গরম নিশ্বাস আমাদের জানালাতে হানা দেবে এবং আমাদের তা সহ্য করতে হবে। আমরা যে পরিবেশে বাস করছিলাম সেই পরিবেশ আমাদের প্রতিবেশী নষ্ট করছেন এবং আমরা সেটা সহ্য করছি। অথচ পরিবেশ তো আমার একার নয়, তাকে ভাল রাখার দায়িত্বও আমার একার নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই দায়িত্ব কার?
এই যে আমরা প্রতিদিনের যাপনে অপরের সাথে বার্তালাপ করি (অর্থাৎ আমাদের day to day engagement) তার গুণাগুণের ওপর নির্ভর করছে, আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে। আবার অন্যভাবে দেখলে, শেষ বার্তালাপ কেমন হবে তা নির্ভর করছে অতীতের সমস্ত ব্যবহার ও বার্তালাপ কী সম্পর্ক তৈরি করেছে, কী অভিজ্ঞতা ও অনুভব অর্জিত হয়েছে, তার উপর।
জিহ্বা, কন্ঠ, ওষ্ঠ, দন্ত, তালু ব্যবহার করে, নিশ্বাস-বায়ুর নিয়ন্ত্রণে আমরা যে শব্দগুলি উচ্চারণ করি, সেটা প্রতিদিনের ব্যবহার ও বার্তালাপের নেহাতই সামান্য অংশ। বাইরের অংশ। সমুদ্রে ভাসমান হিমশৈলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে মাত্র। ভেতরে অদৃশ্য থাকে অসংখ্য শেকড়। সেখানে পরস্পরের জন্য কী সম্মানবোধ আছে বা নেই, একে অপরের মূল্যবোধ জানি ও বুঝি কিনা, বোঝার পর জানতে চাই কিনা সেই মূল্যবোধ কীসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে , সেইসব ভাবনা নির্দেশ দেয় নিশ্বাস-বায়ু কী শব্দের রূপ নেবে। আমাদের সময় কোথায় এতকিছু ভাবার? এর জন্য অনেক দায়িত্ববোধেরও প্রয়োজন। আমাদের সেই দায়িত্ববোধ নেই। আমরা অবহিত নই (বা না দেখার ভান করছি)। এই দায়িত্ববোধের অভাব আমাদের ব্যবহারকে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ বাইরে যে এ.সি. নিয়ে ভাব বিনিময় হচ্ছে তার গভীরে অনেক অদৃশ্য 'ভাবনা' ডুবে আছে। তারই ভিত্তিতে আমি এ.সি. কেনার পরামর্শদাত্রীকে ভাবছি 'ভোগবাদী' আর তিনি বা তাঁরা আমাদের ভাবছেন 'কৃপণ'। এই যে একে অপরের উপর 'ছাপ মেরে' দিলাম, 'দাগিয়ে' দিলাম, তাতে গভীরতর অন্বেষণের পথ বন্ধ হয়ে গেল। এর সত্যি-মিথ্যে নির্ণয় করতে গেলেই দায়িত্ব নিতে হয়। দু'পক্ষকে একই তলে আসতে গেলে অনেক ধৈর্য্য ও অনেক পরিশ্রম দরকার। আমরা দায়িত্ব নিই না, পরিশ্রম করতে চাই না, পরিবেশে 'বিনিয়োগ (investment)' করতে চাই না, 'গা বাঁচিয়ে চলি’। ফলে আমরা সেই পরিবেশই পাই যা আমাদের অযতনে , অবহেলায় গড়ে ওঠে। আমরা বলি, পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে । একথা বলি না যে, পরিবেশ খারাপ করে 'দিচ্ছি' বা 'দিচ্ছেন'। কর্তৃবাচ্যে কর্তা স্থানে 'আমি' রাখছি না কেন ('I -statement' করছি না)? কাউকে দোষ দিতে, সমালোচনা করতেও দায়িত্ব নিতে হয়, নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।
প্রাত্যহিক জীবনে চলতে ফিরতে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কের ভাঙা-গড়া অনুভব করি, মনে আনন্দ বা দুঃখের সঞ্চার হয়। তেমনই অভিজ্ঞতা হয় যখন আমরা প্রকৃতির অন্য সকল অংশীদারের (প্রকৃতির সবার / সবকিছুর) সঙ্গে নিজেদেরকে 'যুক্ত করি, মগ্ন করি', যদি করি তবেই । ভাঙা বা আহত সম্পর্ক যেমন দুঃখের উৎস তেমনই সেখানেই থাকে আপন উদ্যোগে 'জোড়া' দেওয়ার বা 'শুশ্রূষা' করে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ। এমনই সুযোগ ও প্রয়োজন ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির সর্বত্র। কিন্তু এ জন্য আমাদের জীবনের কতটা সময় ও সামর্থ্য নিয়োগ করি? একটু আগেই যে 'দাগিয়ে' দেবার কথা বলছিলাম (যেমন, ঐ মানুষটি খারাপ, এই ছাত্রটি মূর্খ, ঐ জমিটি উষর, ইত্যাদি) সেই অভ্যাস আমাদের নিজেদেরকে যুক্ত হওয়ার/ করার তাগিদ অনেকটাই কমিয়ে দেয় । কারণ, ওইখানে বিচার শেষ, আর ভাবনার দরকার নেই । গতানুগতিক (by default) ভাবে যে পরিবেশে ও পরিস্থিতি পাই, তাই মেনে নিই। অনেকে বলবেন এটাই 'বাস্তব', এটা মেনে নিয়ে 'চলতে’ হয়। আর 'এই ভাবে বাঁচতে গিয়েই বোধহয় সব 'কাজ চলা' হয়ে যায় । যেখানে যেখানে 'বাড়তি উদ্যোগ/ proaction' দরকার সে সব অনাদরে নষ্ট হতে থাকে। আমরা যে যেখানে আছি সেইখানেই এই বাড়তি উদ্যোগ নেবার সুযোগ আছে, সম্ভবনা আছে এবং তা অত্যন্ত জরুরী। এর জন্য কেউ আমাদের বাধ্য (demand) করবে না , আমাদের job description এ 'সাদা-কালোয়' লেখা নাও থাকতে পারে । তবুও করতে হবে। করতে হবে নতুন 'মান / স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করতে। তাহলেই হয়তো একদিন সমাজ সেই মান 'দাবী' করবে। সবটাই সমস্যার কথা নয়। গতানুগতিকতার বাইরের কাজে যুক্ত থাকা জীবনযাপনকে অধিক অর্থবহ (more meaningful) করে তোলে।
ফিরে আসি 'দায়-ভার' নিয়ে আরও কিছু কথায়। অভিজ্ঞতা আর ভাবনার টানে। এখন যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না তা হ’ল জেনেও পরিবেশ খারাপ করা বা পরিবেশ ভাল করার জন্য কিছু না করা 'জীবন যাপন' নিয়ন্ত্রণ হবে কী ভাবে, কে করবেন? এই ধরনের ব্যবহারকে নীতিগত ভাবে বিবেকে ধাক্কা মারার জন্য কোনো সামাজিক মূল্যবোধও নেই, ধর্মের ধুয়ো তুললেও পাপ-পুণ্যের কথা উঠবে না। এর যথাযথ রক্ষাকবচ কী হতে পারে ? আমরা যে 'সমাজে' আছি সে যদি দায়িত্ব না নেয়, সরকার কি এই দায়িত্ব নিতে পারে? নেবে কি? নেবে না বোধহয়। কিন্তু, একেবারেই সম্ভাবনা নেই তা বলছি না। সরকার করেছে। ট্রেনে , বাসে ধূমপান বন্ধ করেছে। কিন্তু, সিগারেট, বিড়ির উৎপাদন বন্ধ করেনি। এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। (সেগুলি নিয়ে এখানে আলোচনা করব না।) সরকার যদি এই সব সামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রির নিয়ন্ত্রণ করতে যায় শিল্পমহল কি তা মেনে নেবে ? খুব সম্ভবত, নেবে না। কাজেই পরিবেশ 'দেবতা'কেই এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং তিনি তাই করছেন। তিনি কি করছেন? শিল্প 'বিপ্লবের' পর থেকেই তিনি নিজেকে যথাসাধ্য বদলেছেন এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন তিনি আরও বদলাবেন। তাপমাত্রা উচ্চতম ও নিম্নতম মাত্রা বদলাবে, ঋতুগুলি তাদের পরিচিত চরিত্র বজায় রাখবে না, ফলে ফসলের সাথে তাদের যে সম্পর্ক আছে তাও বদলে যাবে /যাচ্ছে। ফসলের সাথে সাথে সেই বাস্তুতন্ত্রের অন্য সকল প্রাণীরাও বদলে যাবে। এরকম অজস্র পরিবর্তন হাত ধরাধরি করে আসছে ও আসবে। এই সব পরিবর্তনের হিসেব আমরা করি না। আমাদের সন্তান সন্ততিদের দায় নিই না। আমাদের দেশের / পৃথিবীর মানুষের "বাস্তুতন্ত্রিক বা পরিবেশগত পদচিহ্ন (Echological Foot print) " কবেই আমদের দেশের / পৃথিবীর ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, আমরা এখন ‘ভবিষ্যতের/ উত্তরাধিকারিদের’ পুঁজি লুঠ করে খাচ্ছি। আমাদের এই ফাঁকিবাজি গ্রেটা থানবার্গরা ধরে ফেলেছেন। আমাদের কাছে দাবী করছেন সচেতনতা ও দ্বায়িত্ববোধ।
আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ও প্রতিটি স্তরে আমি আমরা, আমাদের 'দায়িত্ববোধের সীমানা' সঙ্কুচিত করে চলেছি। অথচ, আশা করছি সব ভাল হোক / ভাল হবে। এভাবে হয় না। আমার গ্রামের চাষিরা তাঁদের জমিতে ফসল ফলাতে বাজারে পাওয়া যায় এমন সমস্ত কৃষি-রসায়ন ব্যবহার করছেন। আমি তার সুদূর প্রসারি ফল জানি। তবুও আমি সামান্যতম উদ্যোগ নিইনি। কারণ, আমি ভয় পাই । কারণ, ওই চাষিদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক থাকলে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা যায় আমি সে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করিনি। চাষিদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার জন্যে তাঁদের জমির (যা আমার পরিবেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ) তার সঙ্গেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ওই স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গেও আমার কোনো কার্যকরী সম্পর্ক গড়ে উঠছে না / উঠবে না। অথচ আমি সেই বাস্তুতন্ত্রে বাস করি এবং সেই দূষিত পরিবেশের উৎপাদনে জীবন যাপন করি। আর আশা করি একদিন সরকার আইন করে ঐ সমস্ত বিষ রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। নিতান্তই দূরাশা। কাজের সূত্রে একবার বিহারের বেগুসরাই ও সমস্তিপুরের সব্জি চাষিদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা নিজেদের পরিবারের খাবারের জন্য যে ফসল চাষ করেন সেই জমিতে রাসায়নিক / বিষ প্রয়োগ করেন না। কিন্তু বাজারে বিক্রির জন্য যে ফসল চাষ করেন তাতে বিষ (মাত্রাতিরিক্ত) প্রয়োগ করেন। তাঁদের সঙ্গে বাজারের ক্রেতাদের (মানুষদের) কি পরিচয় , কী সম্পর্ক ? আবার আমরা যখন শুনি চাষিরা দেনার দায়ে আত্মহত্যা করছে , আমাদের কী 'আত্মিক' প্রতিক্রিয়া হয় ? 'প্রতিবেশী', 'সহনাগরিক' এই শব্দবন্ধগুলি আমাদের অন্তরজগতে কোন্ প্রতিচ্ছবি (imegery) সৃষ্টি করে? আত্মকেন্দ্রীক মানুষ আমি, শুধুই মানুষের কথা, মানুষের ভবিষ্যতের কথাই ভাবছি। এই পৃথিবীর আরও যে বাসিন্দা আছেন (অন্য জীব), তাঁদের কথা!
এমন করে দেখলে বুঝতে পারি, আমাদের জীবন যাপনের আপাত ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলি কেমন করে প্রভাবিত করে সারা পৃথিবীকে। প্রভাবিত করে সমগ্র মানব প্রজাতিকে, জলবায়ু, জীব-জড়-প্রকৃতি সব কিছুকে। মানুষ তার যাপনে যেমন যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার ফল তার জীবদ্দশায় যেমন সাময়িক তেমনই এই পৃথিবী ও আগামী প্রজন্মের কাছে সুদূরপ্রসারি।
জীবন যাপনের জন্য কোন্ কোন্ উপকরণ , 'সামগ্রী ও সেবা' অপরিহার্য, তার কোন মানদণ্ড নেই, আমরা রাখতে চাই না। তার উপর বাজারের খেলোয়াড়রা নিত্য নতুন প্রয়োজন ও চাহিদা তৈরি করে চলেছে। আমাদের দৃষ্টি ও বিচার সেই সামগ্রী ও সেবার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ও তৃপ্তির উপর সীমাবদ্ধ। । তার সুদূরপ্রসারি প্রভাব নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। আমি ঠাকুরদার/বাবার তৈই করা মাটির বাড়ি ছেড়ে পাকা বাড়ি তৈরি করেছি। তার জন্যে কয়েক হাজার ঘনফুট উৎপাদনশীল মাটি ধ্বংস করছি, কয়লা পুড়িয়েছি কয়েক টন, পাথর আনিয়েছি পাহাড় কেটে ...আর তা দিয়ে যে বাড়ি তৈরি করেছি সেখানে বাস করতে আমার প্রয়োজন হয়েছে গ্রীষ্মে এ.সি. এবং শীতে রুম-হিটার। আমার ঠাকুরদার মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালের বাড়িতে এসবের দরকার পড়েনি। আগে খড়ের চালের বাড়িতে, কয়েক বছর ছাড়া ছাড়া খড় বদলাতে হ’ত, তাই ধান কাটার পর খড় রাখা থাকত, গরুর খাবার ও ঘর ছাউনির জন্য (পশুপালন ও কৃষি, এই দুটি মিলে যে জীবিকা ব্যবস্থা ছিল তা ভেঙে পড়েছে। এখানে আর তার বিস্তার করছি না। মাঠে পোয়াল / খড় জ্বালানোর কথা এখন আর কেউ ভাবতেই পারেন না। পরিবেশের সঙ্গে যে মরমী সহাবস্থান ছিল, আমি এখন তার থেকে অনেক অনেক দূরে সরে এসেছি।
এই যে একটা বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে অনেক কথা উঠে আসছে এর কারণ এরা কেউই বিচ্ছিন্ন নয়। আমি যখন কোনো বিষয় বা বস্তু নিয়ে ভাবতে বসি তখন তাদের সংশ্লিষ্ট সম্পর্কগুলিই আগে ধরা দেয়। কোনো বিষয় ও বস্তুর অবস্থা বুঝতে গেলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করি। তারা আজ যা হয়ছে তা তাদের বিগত পারস্পরিক সম্পর্কের জন্যই হয়েছে। আবার ভবিষ্যতে কী হবে তাও এই সম্পর্কগুলিই নির্দেশ করে দেবে। এই সম্পর্কগুলি ধনাত্মক (mutually enriching - যে সম্পর্কে একে অন্যকে পুষ্ট করবে) হতে পারে, আবার ঋনাত্মকও (mutually depleting - যখানে একে অপরকে ক্ষয় করবে) হতে পারে। এইরকম কোটি-কোটি সম্পর্ক আমাদের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার বা বোঝার কোনো অবকাশ নেই। এখন প্রশ্ন হ’ল, আমরা এই সম্পর্কগুলি দেখতে পাই তো , ঠিক ঠিক চিনতে পারি (recognise করতে) তো ? না চিনতে পারলে (recognise না করলে) অচেতনে তাদের ক্ষতি করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় । এই কথাটাই একটু বিস্তারিত করবার চেষ্টা করছি। তার আগে, একটা ব্যক্তিগত 'বোধ-এর কথা এইখানে বলে রাখি।
এই যে নানারকম প্রাকৃতিক সম্পদের (সম্পদ শব্দটি বড্ড মানুষের স্বার্থ কেন্দ্রিক। তাঁরা যেন শুধুই আমাদের ভোগ-দখলের জন্য, তাঁদের যেন আপন অস্তিত্ব নেই, অধিকার নেই। মাটি, জল, বাতাস ইত্যাদি , সবই তো প্রকৃতির পরিবেশের অংশ, মানুষও তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু, মানব প্রজাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী যে ভুমিকা পালন করে আসছে আজকে এই প্রজাতিটিকে অন্যদের সমতলে বসিয়ে দিলে তার এতদিনের কর্মফল থেকে তাঁকে অব্যাহতি নেওয়ার সুযোগ হয়ে যাবে।) কথা আমরা বলি তার কোনোটাই একক ভাবে তার ইপ্সিত / বাঞ্ছিত গুণ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থাৎ একক ভাবে কেউ 'সম্পদ' নয়। যেমন, আমাদের যতই জমি থাক, শুধুমাত্র জমি কিছুই উৎপন্ন করতে পারে না। তাকে উৎপাদনশীল হতে গেলে জল, বাতাস, সূর্যের আলো, অজস্র জীবানুর সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। অথচ, যখন কোনো ফসলের (ধরা যাক, ধান) উৎপাদনের হিসাব করা হয় , বলা হয় হেক্টর প্রতি ফলন ৪০০০ বা ৫০০০ কিলোগ্রাম । বলা হয় না ফলন প্রতি ঘন মিটার জলে ৪০০ বা ৫০০ গ্রাম। বলা হয় না তার জন্য কত, কত কার্বন-ডাই-অক্সাইড খরচ হয়েছে, কতো কিলোওয়াট সূর্যের আলো খরচ হয়েছে, কতো কোটি জীবানু কাজ করেছে এবং আরও অনেকের কথাই বলা হয় না। তারা 'taken for granted' , ভাবটা এই যে ওদের কথা আবার আলাদা করে বলতে হবে কেন। সমস্যাটা এইখানেই। তাদের যখন হিসেব করি না , তাদের 'ভালো থাকা - খারাপ থাকার’ও খোঁজ রাখি না। এক সেন্টিমিটার জমির আল কাটা গেলে প্রতিবেশী চাষির মাথা কেটে নিতে যাই কিন্তু হাজার হাজার ঘন মিটার বৃষ্টির জল আমাদের জমির (যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০০ মিমি সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫০০০ ঘন মাটির বৃষ্টির জল পাওয়া যায় তার কতটুকু আমরা ধরে রাখি? ) চলে গেলেও আমরা চিন্তিত হই না । আবার সেই জলের জন্য দু'লক্ষ টাকা খরচ করে ভূগর্ভস্থ জলকে বিদ্যুত জ্বালিয়ে তুলে নিই । ফসলের নাইট্রোজেনের প্রয়োজন মেটাতে হাজার হাজার টাকার ইউরিয়া কিনতে পারি কিন্তু যে জীবানুরা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন ধরে মাটিকে উর্বর করে তাদের জন্য ভাবনা নেই। এই হচ্ছে পরিবেশের বিভিন্ন 'সম্পদের' সাথে আমাদের সম্পর্ক । আমাদের দৈনন্দিন আলোচনায় / ব্যবস্থাপনায় কেউ সম্মান পায়, ভালোবাসা পায় আবার কেউ পায় না। যারা পায় না তারা অনেকেই নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের অবহেলায় জল হারিয়ে যায়, জীবানুরা হারিয়ে যায়, কত উদ্ভিদ (ফসল) ও প্রাণী (মাছ, ব্যাঙ) , কীটপতঙ্গ (মৌমাছি, ভ্রমর) হারিয়ে যায় । কতটুকু সময় আমরা ওদের কথা ভাবি ? ওদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক আছে? যে সম্পর্কহীন পরিস্থিতির কথা হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম। আমরা যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি করেছি তাদের সাথেই বা ওইসব সম্পদের (সামগ্রিক ভাবে পরিবেশের) সম্পর্ক কেমন? পরিবেশ মন্ত্রক, জলসম্পদ মন্ত্রক, (কেন্দ্র বা রাজ্য) তারাই বা কতটা আন্তরিক? এই সম্পর্কগুলির ধনাত্মক পরিবর্তন না হলে আমাদের 'পরিবেশের ' কাঙ্খিত পরিবর্তন কেমন করে হবে?
আমার মনে হয়, আমরা যে যেখানে আছি, জীবনে যা দেখেছি , শুনেছি, কিছু উপলদ্ধি করেছি, বিশ্বাস করেছি, এই সবই আমাদের পরিবেশের সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণার (perceptions) জন্ম দিয়েছে /দিচ্ছে । এইসব ধ্যান-ধারণাই পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই নতুন সম্পর্ক তৈরি করার বা কোনো বর্তমান সম্পর্ককে সংস্কার করতে গেলে মানুষের বর্তমান ধ্যান-ধারণাগুলোর শেকড় পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক - যদি বক্তব্যটা একটু পরিস্কার করা যায়।
জীবিকা উপার্জনের বংশানুক্রমিক অভ্যাস আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে ধারণা শুধু নয়, সম্পদগুলির আপেক্ষিক গুরুত্বও স্থির করে দেয়। একজন ধান চাষি তাঁর জমিতে উপলদ্ধ জলকে যে চোখে দেখেন একজন মাছ চাষি সেই চোখে দেখেন না। একজন হিসেবী ধান চাষি যখন এক ঘন মিটার জলে ৫০০ গ্রাম (বর্তমান বাজার দর দশ টাকা) ধান উৎপাদন করার ভাবেন (বেশিরভাগ চাষি তো হিসেবই করেন না) তখন একজন দক্ষ মাছ চাষি সমপরিমাণ জলে কমপক্ষে ১ কিলোগ্রাম মাছ (বর্তমান বাজার দর ১৫০ টাকা ) উৎপাদন করার চিন্তা করেন। তাই ওদের দু'জনের সাথে জলের তুলনামূলক আর্থিক গুরুত্বও ভিন্ন। যে জেলে ডিঙি নিয়ে নদীতে বা সমুদ্রে যান বা জমিতে পুকুর নির্মাণ করেন, তাঁর কাছে জল মুখ্য সম্পদ, আর ধান চাষির কাছে জল সহায়ক সম্পদ। ধান চাষি যদি মাছ চাষ অভ্যাস করেন তাহলে তাঁর জল সংক্রান্ত ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। তার ফলে জমি ও জল নিয়ে তাঁর কল্পনা (vision) ও পরিকল্পনা বদলে যেতে পারে। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও ঝাড়খণ্ডের অনেক জেলার চাষিদের বিশ্বাস ছিল নীচু ধান জমি (বহাল জমি) ভাল, তার দামও বেশী আর উঁচু টাঁড় বা ডুংরি জমি খারাপ, তার দামও কম। সেই চাষিরা যখন উঁচু জমিতে আমের বাগান ও সব্জি চাষ শিখলেন , তাঁদের ঐ জমির তুলনামূলক বিচার বদলে গেল।
যাঁরা যে ভাবে প্রকৃতির /প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে নিযুক্ত (engage) হন তাঁরা সেই ভাবেই প্রকৃতিকে / প্রাকৃতিক সম্পদকে দেখেন, এবং তেমনই সম্পর্ক স্থাপন করেন। ব্যক্তিগত আস্পৃহাও (aspirations) মানুষের দেখার ধরনে পরিবর্তন আনে এবং তা তাঁর সাথে পরিবেশের নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। আস্পৃহা যদি পরিবেশ সচেতন / বান্ধব না হয় তাহলে তার ফল ভয়ংকর হতে পারে / হয়। বাড়তি উপার্জনের জন্য অনেক মানুষ পরিবেশের সহ্য শক্তির বাইরে চলে যায় এবং সরকার (রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে) তাতে ইন্ধন জোগায়। পাঞ্জাবের বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৬০০ মিলি মিটার হবে। সেই হিসেবে হেক্টর প্রতি বৃষ্টির জল পায় ৬০০০ ঘন মিটার । ওই বৃষ্টির জলের কতটুকু ভূগর্ভস্থ জলস্তরে পৌঁছয়, ওই চাষিরা কি তার হিসেব রাখেন? তাঁদের সাথে কথা বলে তার উত্তর পাইনি। অথচ ওখানকার চাষিরা গভীর নলকূপ বসিয়ে বছরে হেক্টর প্রতি ২০,০০০ ঘন মিটার ভূগর্ভস্থ জল তুলে ধান চাষ করে। তাদের যুক্তি অত্যন্ত সরল, ধানে সরকারি সমর্থন মূল্য আছে যা অন্য খারিফ ফসলে নেই। তাছাড়া জল সেচের জন্য যে বিদ্যুৎ খরচ হয় তার দাম চাষিদের দিতে হয় না। ফলে গত ৩০ বছর ধরে জলস্তর নেমে যাচ্ছে, লাগামহীন। কোথাও কোথাও এই নেমে যাওয়ার পরিমাপ বছরে গড়ে এক মিটার। ওই চাষিরা কেউ গরীব নয়। ওদের হাতে হাতে iPhone , পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য বিদেশে (ইউরোপ /আমেরিকার বিভিন্ন দেশে)। মনে প্রশ্ন আসে এদের দায়বদ্ধতা কোথায়, কার কাছে!
ভূগর্ভস্থ জল সম্বন্ধে তাদের কোনো ভাবনা নেই কেন? ওদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কি স্বপ্ন দেখে ওই গ্রাম, ওই মাটি ,ওই জল নিয়ে? এই সব প্রশ্ন গবেষণার বিষয় হতে পারে। ওই চাষিদের কাছে ওদের জমি ও জলের ব্যবহারের আরও বেশী লাভজনক বিকল্প উপায় নেই এমন নয়। রোপার (রূপনগর) জেলার একজন চাষি ১৫ একর জমি পুকুর নির্মাণ করে মাছ উৎপাদন করছেন, একর প্রতি উৎপাদন ১৫০০ কিলোগ্রাম। একরে যদি ২০০০ কেজি ধান উৎপন্ন হয় , সরকারী সমর্থন মূল্য (২৫ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম) ধরে তার বাজার দর হবে কম-বেশী ৫০ হাজার টাকা (gross)। অন্য দিকে ১৫০০ কিলোগ্রাম মাছের বাজার দর (১০০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম হিসেবে) ১,৫০,০০০ টাকা (আরও পার্থক্য, মাছে সরকারি সমর্থন মূল্য নেই)। ধানের জমিতে ভূগর্ভস্থ জল তুলে যে সেচ দেওয়া হয় তার বেশিরভাগ বাষ্পীভবন ও বাষ্পমোচন (Evapo-transpiration) হয়ে 'খরচ' হয়ে যায়, অন্যদিকে মাছের পুকুরের জল ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে বাড়তি জল যোগান দিতে পারে। এই দু'টি উপার্জনের ধারা কত ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করেছে। ভূমি, ভূগর্ভস্থ জল, বাজার, সরকার, উৎপাদন পদ্ধতিতে রাসায়নিক /বিষের ব্যবহার ...আর সব মিলে হয়তো স্থানীয় পরিবেশের কীটপতঙ্গ, পশুপাখীদের সাথেও ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকবে। আবার ওই অঞ্চলেই অনেক চাষি প্রচলিত ফসলের চাষ না করে পপলার (Populus sp) গাছ লাগিয়েছেন। তাতেও উপরোক্ত সম্পর্কগুলির তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উত্তর দিনাজপুরের কুলিক নদীর (এবং আরও কয়েকটি নদীর) পুনরুজ্জীবন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। সেই সূত্রেই ওখানকার পরিস্থিতি ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওই অঞ্চলে বৈশাখ মাসে একটি লোক-উৎসব ছিল (হয়তো এখনো আছে)। তার একটি অঙ্গ ওই নদীর জলে গৃহপালিত পশুদের স্নান করানো । অর্থাৎ নদীতে অনেক জল ছিল। গ্রামের লোক বলছিল এখন বৈশাখ মাসে নদীতে জল থাকে না। এর প্রধান কারণ গত কয়েক দশকে সমস্ত এক ফসলি জমি তিন ফসলি হয়েছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় জল এসেছে গভীর নলকূপ বসিয়ে। মানুষেরই কাজ। রবি চাষ শুরু হলেই চাষিরা নলকূপ চালু করে মাটির নীচের জল তুলে খালি করে দিচ্ছেন। গরমের ফসলে তা আরও বেশী গভীর থেকে তোলা হচ্ছে। নদী তো অসম্পৃক্ত ভূস্তরের উপর দিয়ে বইতে পারে না। অথচ, স্থানীয় মানুষ যদি সচেতন ভাবে কেবল মাত্র গতানুগতিক ফসল ভিত্তিক জমির ব্যবহারের পথে না গিয়ে 'কৃষি ও মাছের চাষের (agriculture and aquaculture)' একটা মিশ্রণ ঘটাতেন , তাহলে কুলিক শুকিয়ে যেতো না। এখন দরকার সমস্ত 'দায়ভাগীদের (stakeholders)' একসাথে বসে ওই পরিবেশের সমস্ত উপাদানগুলির মধ্যে বাঞ্ছিত সম্পর্কগুলি নির্ণয় করে তার ধারণ ক্ষমতার (carrying capacity) মধ্যে 'সম্পদের' ব্যবহার করে জীবিকার / উপার্জনের পথ খোঁজা।
একবার ট্রেনে দু'জন সহযাত্রীর আলোচনা শুনছিলাম। তাঁরা সম্ভবত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। কয়েক বর্গ কিলোমিটার খনন শুরু হবে। তাঁদের চিন্তার বিষয় ছিল 'Over-burden' সরানোর খরচ। আমার চোখে যা 'উর্বর মাটি' তাঁদের চোখে সেটাই বোঝা (burden) । তাঁদের আগ্রহ নীচে কয়লা নিয়ে। এবং তার সাথে সম্পর্ক কয়লা 'প্রতিপালনের' (husbandry) জন্য নয় । তারপর সেই overburden এর কী হলো, কয়লা তুলে নেবার পর ঐ জায়গার পরিবেশের অবস্থা কি হলো ....সে সব চিন্তার দরকার কী? তারপর তো ওই 'পরিবেশের' আর কোনো 'লেনা-দেনা' থাকার কথা নয়।
এই যে ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন চোখে প্রকৃতিকে দেখেন এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তোলেন এইখানেই প্রকৃতির ও তার সম্পদের ভবিষ্যৎ নির্ণয় হয়ে যায়। এই যে সুস্থায়ী উন্নয়ন ( sustainable development ) নিয়ে এতো ভাবনা , তার সত্যিকারের উত্তর খুঁজতে হলেও আমাদের এই সম্পর্কগুলিকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখার অভ্যাস তৈরী করতে হবে। যে সম্পর্ক একে অপরকে 'পালন পোষনের বা বেড়ে ওঠার' নিশ্চয়তা দেয় না , সেই সম্পর্কের মাধ্যমে যে 'উৎপাদন ব্যবস্থা' গড়ে তুলি তা কেমন করে' সুস্থায়ী (sustainable) হবে ? আমাদের জীবন যাপনে ও জীবিকার সন্ধানে যা কিছু ব্যবহার করি এবং তার জন্য যতরকম সম্পর্ক স্থাপন করি সেগুলি এই ভাবনা নিয়ে দেখতে চাই কিনা সেইটিই আসল কথা। এই মমত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে / গেছে। বিশ্ব-বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না নেমে খোঁজ নিতে পারবো কি আমাদের 'প্রকৃতি' কেমন আছে , কোথায় তাঁর দুঃখ?
এই সম্পর্কগুলি জানতে গেলে, বুঝতে গেলে, কিছু পড়াশোনারও দরকার আছে । আমাদের স্কুলে, কলেজে যত বিষয় পড়েছি মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সবই কাজে লাগে। যেমন উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, আবহ বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সব সব কাজে লাগে। কিন্তু যে ভাবে পড়ানো হয় তা ছাত্রদের ওই বিষয়গুলির জ্ঞান কোথায় কিভাবে প্রয়োজন হতে পারে সেই ধারণা, তার orientation, exposure, কিছুই দেওয়া হয় না। ছাত্রদের মনে ভাল নম্বর পাওয়া ছাড়া আর কোনো কল্পনাই জাগে না।
আমার ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা খুব সাধারণ উদাহরণ দিই। চাষিদের সাথে জমির ও বৃষ্টির জলের সম্পর্ক কেমন হতে পারে! একবার পুরুলিয়া জেলার আড়ষা ব্লকের হেঁসলা গ্রামে গেছি । সময়টা ১৯৯০-৯১ সাল। চাষিরা বললেন, ‘বৃষ্টি হয় না, জোৎস্না রাতে ধান মরে যায়। তাঁরা হেঁয়লি করে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হলো তাঁদের জমির প্রকৃতি। এলাকার ভূস্তরের গঠন ঢালু , বেলে মাটি, তাই মাটির জলধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম, বৃষ্টির জল অল্প সময়েই জমি ছেড়ে চলে যায় ( drains out) । জল-চক্রে (hydrological cycle) কোথায় জলের অবস্থান কতক্ষণ স্থায়ী হয়, সেই সময়কালকে জলের ‘residence-time’ বলা হয়। ওই ইংরেজির বাংলা করে নিই 'জলের বসবাস কাল'। ওখানকার সমস্যা ছিল ওই জমিতে জলের বসবাস কাল অল্প। সেই সমস্যাটাই ওই হেঁয়ালির রূপ নিয়েছে। এও একদিনে হয়নি। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে এই ধারণা চলে আসছে। ভাদ্র মাসে যখন ধানের ফুল আসে তখন যদি বৃষ্টি না হয় তখন উঁচু জমির (ওরা বলেন, বাইদ জমি) ধানক্ষেত শুকিয়ে যায়। এও জানলাম, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে যথেষ্ট বৃষ্টি হয় এবং তার বেশিরভাগ বয়ে যায় (as runoff) । অর্থাৎ, চাষিদের আশা বৃষ্টি তাঁদের ফসলের প্রয়োজন মত হলে ভাল হতো। তাঁরা তো একথা ভাবতে পারতেন যখন বৃষ্টির জল আসবে তখন তা ধরে রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ ওখানে উপলদ্ধ বর্ষার জলের 'বসবাস-কাল' বাড়ানো যেতে পারে। যে জলের মাটির উপর বয়ে যাওয়ার গতি হয়তো প্রতি সেকেন্ডে এক মিটার, সেই জলকেই যদি ভূপৃষ্ঠের নীচে মাটির মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে (through seepage) যেতে হয় তার গতিবেগ কমে সারাদিনে হয়তো 20 মিটার হয়। জলের ও মাটির সহাবস্থানে এই প্রকৃতিটিকে কাজে লাগিয়ে অনেক কাজ করার সম্ভাবনা আছে। সে পথের খোঁজ না করে, সরকারও (কৃষি দফতর ) এই জেলাকে ‘খরাপ্রবন’ বলে দিয়েছে। অথচ এখানকার গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২০০ মিলি মিটার।
এই যে ‘অবৈজ্ঞানিক’ ভাবে 'দাগিয়ে' দেওয়া, এও একধরনের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। এর প্রভাব পড়ে সরকারি পরিকল্পনায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, মানুষের মানসিকতায়। মানুষ তখন আর ওই গণ্ডির বাইরে ভাবতে চান না। ওই বছরের আগের দশকের প্রতি বছরের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক বৃষ্টিপাত বিশ্লেষণ করে ও ওই এলাকার যে জাতের ধান চাষ প্রচলন ছিল তার জীবন চক্রে কখন কেমন জলের প্রয়োজন তার হিসেব নিয়ে, পরে ওই অঞ্চলেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর সামান্য কাজ করে ওখানে ভাদ্র মাসে জলের অভাবে ধান শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান করা গেছে। ওই অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করে পুরুলিয়া , বাঁকুড়া জেলায় এবং ছত্তীশগড় ও ঝাড়খণ্ডের বহু জেলাতে সরকারি উদ্যোগে চাষির ক্ষেতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে । সেই জলে মাছ চাষ হচ্ছে। অর্থাৎ, এই ভাবে চাষির সাথে তাঁদের জলের ও জমির এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সম্পদের সম্পর্কের নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, এত বড় দেশের প্রয়োজনের তুলনায় এ তো কিছুই না। অন্য দিকে, জাতীয় স্তরে অনেক পরিকল্পনায় পরিবেশের প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলিকে অসম্মান করে ধ্বংস করে ফেলা হয় বা (সম্ভবত অজ্ঞানে) ধ্বংস করার কথা ভাবা হয়।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক (তার পরিসর, পরিবার হতে পারে, পাড়া হতে পারে, গ্রাম হতে পারে ...এইভাবে সারা পৃথিবী হতে পারে আবার একটি মানষের নিজের ভিন্ন ভিন্ন সত্তার মধ্যেও হতে পারে) বুঝতে হবে। মানুষের সাথে তার পরিবেশের (তার মাটি, জল, আলো, বাতাস, সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী , চোখে অদৃশ্য এমন কোটি কোটি জীবানু সব কিছুর সাথে ) সম্পর্ক বুঝতে হবে। এবং ওদের মধ্যেই যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে তাকেও বুঝতে হবে। এবং সাথে সাথে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সকল প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের সাথে মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্কগুলির গতিপ্রকৃতি ও বুঝতে হবে। একটু অন্য ভাবেও বলা যায়। এই সম্পর্কগুলিকে যদি আমরা Institutions' relations with Institutions, Resources' relations with Resources, Peoples' relations with People, institutions' relations with People, Institutions's relations with Resources and Peoples' relations with Resources এই ছ'টি দলে ভাগ করি তাহলে বোধহয় বুঝতে একটু সুবিধা হয়। আমাদের চারপাশে যত রকমের ঘটনা ও অবস্থা দেখি সব কিছুই ঐ সম্পর্কগুলির মধ্যেই পড়বে, চারপাশে পড়ে আছে / ঘটে চলেছে। আমি নিরীক্ষণ করার জন্য এই ধাঁচাটা (framework) কাজে লাগিয়েছি, অনেক জটিল পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হয়েছি।
প্রয়োজন কেবল একটু যত্ন করে / ভালবেসে দেখার (নিরীক্ষণ করার)। এই দেখার মধ্যেও যন্ত্রণা আছে। চাষির ফসল নষ্ট দেখলে কষ্ট হবে, ভূমিক্ষয় দেখলে খারাপ লাগবে, নদীর জল ঘোলা দেখলে মন অস্থির হবে, হাড্ডিসার গরু-ছাগল দেখলে, জঙ্গলে আগুন লাগলে ..... প্রকৃতির গায়ে আঁচড়-কামড় দেখলে হয়তো ঘুম আসবে না । এই সব হবে। কারণ আপনি প্রেমে পড়বেন, ভালবাসতে শিখবেন। আর কোন্ ভালবাসা যন্ত্রণার নয়? আর যদি কোথাও ভেঙে পড়া সম্পর্কগুলো জোড়া লাগাতে পারেন , সেও বড় আনন্দের। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য' করে তোলার আনন্দ।
প্রকৃতি তো আপন খেয়ালে পরিবর্তন আনবেই তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু আমাদের হাতে যে সীমিত ক্ষমতা ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে যা আমরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে (অর্থাৎ, আমাদের ব্যবহার/ হস্তক্ষেপ প্রাসঙ্গিক সম্পর্ককে মজবুত করছে নাকি দূর্বল করছে সেইটুকু না বুঝে) তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে প্রয়োগ করে চলেছি, বাজারের দেখানো পথে চলতে শুরু করেছি , সেই গতিকে কখন প্রশ্ন করবো, কেমন করে প্রশ্ন করবো, কোথায় প্রশ্ন করবো? আর এইখানেই সবচেয়ে সহজ কাজটি সবচেয়ে কঠিন করে ফেলি - তা হলো, নিজেকে প্রশ্ন করা, প্রতিদিন করা, নিজের পরিসরেই করা।
কোন্ শৈশবের পাঠ - "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। " (কবি কামিনী রায়)। এখনো বুঝতে পারলাম না। সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ছে , দেখছি আর হা-হুতাশ করছি।