সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
কেউ গার্লফ্রেন্ড, কেউবা বয়ফ্রেন্ড বগলদাবা করে ঢুকছে এলিয়ট পার্কে। আর আমি ঢুকছি সুব্রতদার সঙ্গে। আর সুব্রতদা আমার সঙ্গে। বললাম 'এখানে এলে কেন ?' 'চল!'...তো আমরা হনহন করে ছোট একটা বেদি-মত সেখানে গিয়ে বসলাম। চারিদিকে যুগল। আমাকে আর সুব্রতদাকে দেখছে সন্দেহের চোখে। আমাদের অবশ্য খেয়াল অন্যদিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম 'সুব্রতদা, চলো দার্জিলিং ঘুরে আসি!' সুব্রতদা বলল 'না' 'তাহলে সিকিম?' 'না', 'তাহলে ভাইজ্যাগ?' 'না'....'তাহলে তুমি কোথায় যাবে?' 'শিমুলতলা'...'শিমুলতলা? কেন? ' তারপর আবার চুপচাপ সুব্রতদা। দূরে ভিক্টরিয়ার দিকে ভাসানো দৃষ্টি। আর হাওয়ায় নিচের দিকে সরু হয়ে আসা দাড়িটা হালকা দুলছে। বলল 'শিমূলতলা খুব ভাল জায়গা'। এক ডিগ্রি বেশি হাসল।
শিমুলতলা ছাড়া সুব্রতদা আর কোথাও কোনোদিন বেড়াতে যেতে চায়নি। অন্তত আমি তাই জানি। আর শিমুলতলার নাম এলেই চোখটা কেমন সরু হয়ে দূরে ভাসিয়ে দিত। যাইহোক তো সেই এলিয়ট পার্ক পর্ব দু অধ্যায়েই সমাপ্য হল। কিন্তু শিমুলতলার গল্পে খোঁজ পাওয়া গেল এক কমলা শাড়ি পড়া মহিলার। উনি সুব্রতদার গার্লফ্রেন্ড। 'নাম?' আবার সুব্রতদা চুপ। কিছু বললই না মাইরি। একটা বাদামওয়াকে ডেকে বলল 'বাদাম দিন!' তারপর বলল 'এই বাদাম আমি খাইনা, তুই খা'...কি ডেঞ্জার লোক মাইরি, আমার মুখ বাদাম ঠুসে বন্ধ করে দেওয়ার ফন্দি?
সে যাকগে, আমি তখন একটা বাচ্চা জেব্রা ছিলাম। কলেজে পড়তাম আর কলকাতার রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। হাত পা ছুঁড়তাম। সুব্রতদা বলল 'বিশরপাড়া আয় তোকে রামলীলা দেখাব!' গেলাম বিশরপাড়া। ছাদের ওপর একটা ঘর। ছাদে কিছু গাছ আর ঘরে চৌকির একধারে কিছু বই। এই সুব্রতদার সংসার। রান্নার একটা স্টোভ। জ্বললে ঘরে স্টোভের গন্ধ। চায়ের গন্ধ। আলুপেঁয়াজ সেদ্ধর গন্ধ। মশলার গন্ধ। ভাল লাগত। বৃষ্টি হত। নারকোল গাছগুলো ছাদে ঝুঁকে এসেছে। নিচে কলতলা। একটি মেয়ে জল নিচ্ছে। দেখলাম। সুব্রতদা মুচকি হেসে বলল 'পছন্দ?' একটু গ্যাপ, মুখে হাসিটা স্টে করিয়ে রেখে বলল 'ওরা কিন্তু খুব ঝগড়া করে'...ও তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকবে, আর আমার থাকবে না?
তারপর বিকেলের দিকে নিউব্যারাকপুরে প্যাটিস খেতে যাওয়া হত। দু কিলোমিটার হেঁটে । সেই পথে একজনের সঙ্গে আমাদের দেখা হত, সুব্রতদার চেনা। আসতেন নানা সমস্যা নিয়ে। বেশ লম্বা চওড়া লোক, কিন্তু তাঁর সমস্যাগুলো সব বাচ্চাদের মতো। সুব্রতদা খুব মন দিয়ে শুনে, নানা প্রশ্ন করে সমস্যা ভাল করে বুঝে নিয়ে বলত 'ছেড়ে দাও কি আর করবে...'। প্রতিবার এই একই সলিউশন...ভদ্রলোকও কি করে জানিনা প্রতিবার কনভিন্সড হয়ে যেতেন। আমি বলতাম 'একি, তুমি লোকটাকে প্রতিবার এক কথা বলো কেন গো ?' সুব্রতদা বলত ' দেখ ও এটা নিয়ে কিছুই করবে না। ওই আমাকে বলে মনের একটু শান্তি পায় এই যা ।' আর 'ছেড়ে দাও' বলার পরই আমাকে দেখিয়ে বলত 'এ কিন্তু খুব ভাল ছবি আঁকে।' তাতে লোকটা গলে যাওয়া আইসক্রিমের মত হাসি দিয়ে বলত 'তাই? আপনি কোথাও শিখেছেন? আমার এক ভাই আছে ওর ছবি আঁকার খুব হাত, আপনি ওকে একটু গাইড করে দেবেন?' এদিকে সুব্রতদা মিটিমিটি হাসছে। ভাবখানা এমন যে....দেখ কেমন ফাঁসিয়ে দিলাম তোকে ... অসহ্য!
আমরা বিশরপাড়া নিউ ব্যারাকপুর অঞ্চলে নানা কবি সম্মেলন এটেন্ড করে বেড়াতাম। তার একটা বড় কারণ সন্ধ্যেবেলা গেলে সিঙ্গাড়া খাওয়া যেত। সুব্রতদা প্রায় কিছুই খেত না। আমি তখন ছটফটে উঠতি জেব্রা বলে সিঙ্গাড়া আমাকেই খেতে হত। সুব্রতদা গোটা পাঁচেক বাজে কবিতা খুব মন দিয়ে শুনে বলত 'এবার উঠি, কাল এর কলেজ আছে’ বলে আমাকে দেখিয়ে দিত। যেকোনো আসরেই সুব্রতদার দু একজন বান্ধবী ঠিক থাকতই, তাদেরই কেউ একজন ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলত 'এই তো এলেন, এখুনি চলে যাবেন?' বিড়ির ধোঁয়ায় বাদামি হয়ে যাওয়া দাড়ি গোঁফের ভেতর দিয়ে সুব্রতদা মুচকি হেসে উঠত। যেন 'আরে এই তো পরের বৃহস্পতিবারই তো আবার দেখা হবে'...
সেই মুখ সেদিন দমদম হাসপাতালে কাঁচের গাড়িতে। দেখে কেমন একটা অদ্ভুতই লাগল। আমি ফাইনালি আফ্রিকার প্রান্তরের বুনো জেব্রা হয়ে উঠিনি, গায়ের সাদাকালো দাগ ধুয়ে এখন মানুষ হবার এক্টিং করি। কিন্তু সুব্রতদা? ফাইনালি না ফেরার জন্য গেল? যেদিন গেল, সেদিন পুরোনো বিশরপাড়াটা বড্ড বাজছিল। মেঘে, অফিস যাওয়ার গরমে, ফাঁকা মেট্রোর চিল্ড এসিতে ...কোথায় গেল সুব্রতদা? ঝুপসি গাছে ঢাকা সেই আগের বিশরপাড়াতে চলে যায়নি তো? যেখানে 'আপনি এসেছেন?' বলে যেকোনো আড্ডায় বান্ধবীদের মুখে 'টমাস আলভা এডিশন' হয়ে জ্বলে উঠত....সুব্রতদা !