সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ইংরাজি মিডিয়া শব্দটির প্রচলিত বাংলা অর্থ গণমাধ্যম। এই বাংলা শব্দটি মিডিয়ার কতটা যথার্থ অনুবাদ তা নিয়ে বর্তমান নিবন্ধকারের কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। কারণ, এই মিডিয়া গোত্রের মধ্যেই মাস মিডিয়া বলেও একটি বিষয় রয়েছে। যাইহোক, মিডিয়ার ব্যাকরণগত এবং ভাষান্তর নিয়ে আলোচনার জায়গা এটা নয় বা এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়ও তা নয়। কিন্তু, যে বিষয়ের আলোচনায় এই গৌরচন্দ্রিকাটির অবতারণা, সেখানে প্রাসঙ্গিকতা কিছু বোধহয় থেকেই যায়।
একটা সময় ছিল যখন মিডিয়া কথাটার সেভাবে প্রয়োগের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কারণ, সে সময় মুদ্রিত খবরের কাগজ বা সংবাদপত্রই মিডিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু, সময় এগিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে সেই মিডিয়া গোত্রভুক্ত হয়েছে অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়া বা টেলিভিশন, তারপর একে একে ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মিডিয়া এবং গত দেড়- দু দশকে সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজ মাধ্যম জাঁকিয়ে বসেছে। তাই, আজকে মিডিয়া বলতে এই সব ক’টি মাধ্যমকেই ধরা উচিত।
এতো গেল বিশ্বব্যাপী মিডিয়ার সংসারর-জগতের কথা। এই নিবন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে ভারতে বর্তমান যুগের মিডিয়ার কথা। যদিও, এ কথা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার যে আজকের পৃথিবীতে মিডিয়াকে আর কোনও দেশের সীমানার মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। তবুও, চেষ্টা করা হবে এ দেশের আজকের মিডিয়ার কথাবার্তা আলোচনা করা এবং চরিত্র-চিত্রণেরও একটা প্রয়াস এই লেখায় থাকবে। এ দেশে সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়-বাড়ন্ত প্রতিনিয়ত হলেও আজও মিডিয়া বলতে সাধারণ মানুষ মুলত বোঝাতে চায়, সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে খবরের চ্যানেলগুলির বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা। এ কথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, মানুষের মনে সংবাদপত্রের চাইতেও অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। পাশাপাশি এ কথাও সত্যি, দিনরাত টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে খবর দেখার পরও আজও এ দেশের মানুষের কাছে সকালে প্রথমে খবরের কাগজটিই অবশ্য পাঠ্যের মধ্যে পড়ে। জনান্তিকে জানিয়ে রাখা ভালো, শহুরে উঠতি প্রজন্মের ক্ষেত্রে এ কথাটি কিন্তু একেবারেই প্রযোজ্য নয়। তারা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে মোবাইল ফোনে খবরের কাগজের ডিজিটাল এডিশন-এ চোখ বোলাতে।
যাইহোক, মিডিয়া হল সমাজ ও সময়ের দর্পণ। আর এই মিডিয়াকেই বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভও। এই চতুর্থ স্তম্ভের স্বীকৃতি পাওয়ারও এক ইতিহাস আছে সে আলোচনা এখানে অনাবশ্যক। বরং, সমাজ ও সময়ের দর্পণ হিসেবে মিডিয়ার যে প্রাথমিক এবং আবশ্যিক কর্তব্য তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমানে এ দেশে মিডিয়ার স্বরূপ চেনার চেষ্টা করব। এই সময়ে সমাজে যা ঘটে চলেছে তার সঠিক তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে পাওয়া যাবে এটাই স্বাভাবিক ধরে নিই। এ কথা ঠিক, মিডিয়া বিশেষ করে মুদ্রণ মাধ্যমের মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র একটা সময় পর্যন্ত এ কাজটা পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই করে এসেছে। অনেকটা বলছি এ কারণে যে, সব সময়েই শাসককূল তাঁদের অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক সঠিক তথ্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে সামনে তুলে ধরেনি এবং বিকৃত তথ্যও পরিবেশন করেছে। দেশ ভাগের আগে এবং পরে। দেশভাগের পরের পরিস্থিতি নিয়েই এখানে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আজকের এই ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়ার যুগেও সংবাদপত্রে বা খবরের কাগজে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আজও প্রশ্নাতীত। । তথাকথিত উন্নত বিশ্বের কোথায় কীভাবে প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্রের প্রভাব কতটা সে বিচার না করলেও নিজের দেশে আজও জনমানসে মুদ্রিত খবরের প্রভাব এবং বিশ্বাসযোগ্যতা প্রত্যক্ষ করে সত্যিই একাধারে আনন্দিত এবং হতাশ হই। আনন্দিত হই এই ভেবে, দেখো অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়া সারাদিন ধরে যতই দাপট দেখাক না কেন দিনের শুরুতে এবং মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে আজও প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্রই প্রধান ভরসার জায়গা। আর হতাশ হই এই ভেবে যে, মানুষ মানে সাধারণ পাঠক আদৌ ধরতেই পারছেন না তাঁদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি !
কেন এই শব্দটি ব্যাবহার করলাম। প্রতারণা! কারণ, বর্তমানে দেশে যতগুলি সংবাদপত্র রয়েছে তার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি হয় রাজ্যের নয় কেন্দ্রে শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতা করে। ইনিয়ে বিনিয়ে এরা সর্বদাই শাসক দলের তিলমাত্র কার্যক্রমকে প্রকাশ করতে উদগ্রীব। শাসক দলের বিরোধীদের কথা এরা গুরুত্ব দিয়ে তো ছাপেই না বরং খবরের ভাষায় যথেষ্ট আন্ডারমাইন করে ছাপে। অনেক সময় তিরস্কার বা সমালোচনার সুরেও তা ছাপা হয়। সাধারণ মানুষের বা প্রান্তিক মানুষের প্রাথমিক এবং দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে এরা আশ্চর্যজনক নীরব থাকে এবং ব্যক্তিগত জীবনে এই তথাকথিত মূলস্রোতের কাগজে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সেটা খুব সচেতন ভাবেই তারা করে থাকে। কেন করে থাকে? সোজা কথায়, বিজ্ঞাপনের জন্য! কিন্তু, এতটা সরল নয় বিষয়টি। শাসক দলের ইতিবাচক খবরই শুধু নয়, তাঁদের ছবি ছাপাই নয়, তার উপরেও রয়েছে খুব সচেতন ভাবে সাধারণ এবং প্রান্তিক মানুষের খবর উপেক্ষা করে খারিজ করে দেওয়ার এক অনবদ্য প্রয়াস। তাই বলে কি মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের কোনও খবরই তুলে ধরা হয় না? হয়। যে খবরে মিডিয়ার মালিক এবং তাঁদের বন্ধুজনের স্বার্থে ঘা লাগার তেমন কোনও সম্ভাবনা থাকে না সেই খবরগুলি এবং যে খবরগুলি তাঁদের বাণিজ্যিক স্বার্থ পূরণে কাজে লাগতে পারে বা তাঁদের রাজনৈতিক বন্ধুদের কাজে আসতে পারে সে সব খবর তুলে ধরা হয়। এ সবের ফলে সাধারণ ভাবে মানুষের কাছে মিডিয়া সম্পর্কে যে বার্তা যাচ্ছে তা মিডিয়ার মৌলিক সত্তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। সাধারণ মানুষ এই সব মিডিয়ার খবর নিয়েই মেতে থাকে এবং সামগ্রিক ভাবে গোটা মিডিয়া জগতকেই এক গোত্রে ফেলছে। যারা আদতে মিডিয়ার আসল মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়ে খবর বা তথ্য তুলে ধরে তাদেরও একই গোত্রে ফেলছে এবং তা সেই সব ব্যতিক্রমী ও সৎ সাংবাদিকতাকে না পড়েই বা না জেনেই।
আজ ভারতের মিডিয়া সরাসরি দু’ ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি ভাগ এই নিবন্ধকারের ভাষায় ‘দরবারি মিডিয়া’ এবং অপরটিকে ‘জনবাদী মিডিয়া’। বিষয়টা একটু সবিস্তারে বলা যাক। সারা দেশে যে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত মুদ্রিত সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলি মানুষ পড়ছে বা দেখছে তার অধিকাংশেরই মালিকানা কোনও না কোনও বাণিজ্যিক বা শিল্প গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে। এই সব মিডিয়ার অনেকগুলিই একটা সময় পর্যন্ত গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের শর্ত অনেকখানি মেনেই মানুষের কাছে খবর এবং তথ্য পরিবেশন করত। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই সময় এই সব মিডিয়ার মালিকানা এবং সম্পাদনার দায়িত্ব থাকত মূলত সাংবাদিকদের হাতেই। তখনও মিডিয়া নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির কাছ থেকেও বিজ্ঞাপন পেত।
মোটামুটি ৭-এর দশকের মাঝামাঝির পর থেকে বলা যায়, মিডিয়ার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মাথা ঘামাতে শুরু করল এ দেশে। মিডিয়া যে বিজ্ঞাপন ও বিক্রির মাধ্যমে যথেষ্ট আয়ের জায়গা হতে পারে তা বোঝার পাশাপাশি বণিক ও শিল্পপতিরা এটা বুঝল যে, নিজের হাতে মিডিয়া থাকলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের কাছে তাঁদের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। কারণ, তাঁদের ব্যবসা- বাণিজ্য চালাতে যে নানা রকম সরকারি সুযোগ- সুবিধা দরকার সেগুলি আদায়ের ক্ষেত্রে নিজের হাতে মিডিয়া থাকলে দর কষাকষি করতে সুবিধা হবে। এক কথায়, প্রয়োজনে তাঁরা মিডিয়াকে সরকারের বা বিশেষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। পাশাপাশি, ক্ষমতার অলিন্দেও তাঁদের প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হবে যদি হাতে একটা মিডিয়া থাকে।
এই ঝোঁকটাই কালে কালে ভারতের মিডিয়া বিশেষ করে বড় এবং মাঝারি মিডিয়ায় জাঁকিয়ে বসল। ফল হল এই যে দেশের প্রায় সমস্ত বড় ও মাঝারি মিডিয়ার মালিকানা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাতে গিয়ে পড়ল। এ দেশে সামান্য কয়েকটি বড় মিডিয়া এখনও রয়েছে যার মালিকরা চিরকাল মিডিয়া ছাড়া অন্য কোনও ব্যবসা বা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। কিন্তু, গত দু’ দশকে সেই মিডিয়াগুলিতেও বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী।
শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে শুধু নয়, সেই সব মিডিয়ার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। যে দু’-একটি বড় মিডিয়া এই পথে পা বাড়ায়নি তাদের অস্তিত্ব বর্তমানে সঙ্কটের মুখে। সরকারি বিজ্ঞাপনের এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিজ্ঞাপন পেতে এই মিডিয়াগুলিও এখন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এ কথা এখন আর জানতে কারও বাকি নেই যে, আজ দেশের অধিকাংশ বিশেষ করে বড় মিডিয়ার মালিকানা যাঁদের হাতে তাঁদের অনেকেই সরকার- ঘনিষ্ঠ বা সরকার চালাচ্ছে যে রাজনৈতিক দল সে দলের সদস্য এবং সরকারের পছন্দের কোনও কোনও মিডিয়া মালিক সংসদের উচ্চ কক্ষের অর্থাৎ রাজ্যসভার সদস্যও। এই গোত্রের অন্য মিডিয়াগুলিও সচরাচর সরকারে বা সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনও সংবাদ সাধারণত পরিবেশন করে না কেননা তাহলে বিজ্ঞাপন থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবে। তাই, জন বিরোধী সরকার এবং বেসরকারি প্রকল্পের বিরুদ্ধে এই মিডিয়াগুলিরও প্রায় কেউই কোনও রকম আলোকপাত সচেতন ভাবেই করে না।
সামগ্রিক ভাবে এরাই হল ‘দরবারি মিডিয়া’। এই মিডিয়ার কাজ হল মানুষের সত্যিকারের সমস্যাগুলি উপেক্ষা করে ফলাও সরকারি গুণগান করে সরকারে পক্ষে একটা জনমত তৈরি করা। এই সব মিডিয়া মণিপুরে কী ঘটছে বা দেশের জঙ্গল ধ্বংস করে সেখানকার ভূমিপুত্রদের বাস্তুহারা করার খবর পরিবেশন করে না। এরা কোটি কোটি স্থানান্তরিত শ্রমিকদের নিয়ে খবর করে না, খবর করতে একেবারেই কোনও উৎসাহ দেখায় না পরিবেশ দূষণ ও তাঁর উৎস নিয়ে। মহানগরগুলির মাটির তলায় ক্রমশ জলের স্তর নেমে যাচ্ছে বা শহরের গরিব মহল্লায় এবং গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির করুণ দশার চিত্র না এই সব মিডিয়ার সংবাদপত্রে নিয়মিত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়, না এদের চ্যানেলগুলির ক্যামেরা-বন্দি হয়। এরা দুর্নীতি নিয়ে সে সব খবরগুলিই এমন ভাবে করে থাকে যা থেকে সরকার বা সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা নিরাপদে থাকে। কিন্তু, দুর্নীতির শিকার যারা তাঁদের নিয়ে এরা সেভাবে কোনও খবর করে না। করে না বললে একটু ভুল থেকে যায়, যেটুকু করে তা কেবলই তাৎক্ষণিক ঘটনাভিত্তিক। এই মিডিয়াগুলি ফলাও করে ছাপে বেনারসে দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যা আরতির ছবি, চ্যানেলগুলি তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দেশজুড়ে দেখিয়ে চলে। এই মিডিয়া বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর রাসায়নিক সারের বিজ্ঞাপনে সহাস্য কৃষকের ছবি দেখালেও কৃষি-ভিত্তিক এই দেশের কৃষকের আসল চেহারাটা কখনই দেখায় না। চাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের ঝকঝকে প্যাকেটের ছবি দেখালেও ‘দরবারি মিডিয়া’ কখনই তুলে ধরে না উত্তরাখণ্ডের বা হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ের ধাপে ধাপে বা ছোট ছোট উপত্যকায় যে কৃষকেরা দেরাদুন রাইস চাষ করেন তাঁদের জীবনের প্রাত্যহিকতা। এ রকম হরেক কিসিমের উদাহরণ দেওয়া যায়। যা এই মিডিয়াগুলি সম্পর্কে একটাই বার্তা তা হল সরকার এবং রাজশক্তির প্রতি তাদের দরবারি মনোভাবের। পাঠক, নিশ্চয়ই বোঝেন এই ‘দরবারি মিডিয়া’ কারা চালায় এবং এটা বুঝলেই আশা করি এঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলাদা করে আর বিশেষ কিছু বলার থাকেও না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ‘দরবারি মিডিয়া’ই দেশের মিডিয়ার মূলস্রোত। বেশির ভাগ মানুষের কাছে এরাই পৌঁছয় এবং পাঠক বা দর্শকের অজান্তেই তাঁদের মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যা সাধারণ মানুষ এবং সমাজের পক্ষে আদৌ মঙ্গলবার্তা নয়।
‘দরবারি মিডিয়া’ই কি শেষ কথা! না। ইতিহাস বলছে, সমাজবিজ্ঞান দেখাচ্ছে, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে গঠনমূলক সমাজমনস্কতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মিডিয়া অসাধারণ ভূমিকা পালন করতে পারে শুধু নয় তা করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটা দায়বদ্ধতাও রয়েছে। মানুষের কাছে, সমাজের কাছে। সেই দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এবং সত্যান্বেষণের আন্তরিক তাগিদে বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা সময়ে কিছু মানুষ সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে মানুষের কাছে, জগতের কাছে সত্য তথ্য তুলে ধরার কাজে ব্রতী হয়েছে। এ দেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ভারতে সংবাদপত্রের অর্থাৎ মিডিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই দর্শন থেকেই। কালক্রমে তাঁর অবক্ষয় ঘটলেও আজকের এই ‘দরবারি মিডিয়া’র দাপটের যুগেও বেশ কিছু ব্যতিক্রমী সংবাদপত্র এই চতুর্থ স্তম্ভের মর্যাদাকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও, মানুষের জীবন-জীবিকার আসল ছবিটি তুলে ধরার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মিডিয়ার আর্থিক স্বাস্থ্য একেবারেই ভালো না হলেও, পাঠক বা দর্শক সংখ্যা কম হলেও ধীরে ধীরে এরা কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছে। ‘দরবারি মিডিয়া’র মতো এই মিডিয়ার লক্ষ্য কেবল লাভ বা বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া নয় বরং বলা যায়, আপাত দৃষ্টে দেখা এই ব্যতিক্রমী মিডিয়ার একমাত্র লক্ষ্য দেশের আপামর মানুষের এবং সমাজের যে বিষয়গুলি উপেক্ষিত ও আলোকপাতের দাবি রাখে সেগুলি তুলে ধরা। এই মিডিয়াকে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, ‘জনবাদী মিডিয়া’। অনেকে এই মিডিয়াকে ‘বিকল্প মিডিয়া’ হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন কিন্তু এই নিবন্ধকারের মতে, এই মিডিয়া ‘বিকল্প’’ নয়। সংবাদমাধ্যমের বা গণমাধ্যমের প্রাথমিক কর্তব্য পালন করে চলেছে এই মিডিয়াই। যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে অর্থ নয়, সমৃদ্ধি নয়, ক্ষমতার ভগ্নাংশ লাভ করা নয় বরং, শুধুই মানুষ এবং সমাজের স্বার্থ। তাই, এই মিডিয়াকে ‘জনবাদী মিডিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করাটাই যুক্তি সংত হবে।
একটা অসম লড়াই চলছে। ‘দরবারি মিডিয়া’ আর ‘জনবাদী মিডিয়া’র মধ্যে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ‘দরবারি মিডিয়া’র প্রসার, প্রভাব এবং প্রতিপত্তির কাছে ‘জনবাদী মিডিয়া’ এখনও কোনও উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে, জনমানসে সে ভাবে দাগ কাটতে না পারলেও রাষ্ট্রশক্তির নজরে বললে কম বলা হয় কড়া নজরে রয়েছে এই ‘জনবাদী মিডিয়া’। সেই নজরদারি উপেক্ষা করে ‘জনবাদী মিডিয়া’ প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। তবে, একটা কথা এখানে না বললেই নয়, রাষ্ট্রের রুষ্ট দৃষ্টি সত্ত্বেও ‘জনবাদী মিডিয়া’ কাজ করে গেলেও জনসাধারণের সমর্থন কিন্তু আজও সে ভাবে পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিচ্ছি, লেখাপড়া জানা তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক-মণ্ডলীর বা প্রগতিশীল নাগরিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে যে কাঙ্ক্ষিত ও বেশ কিছু ব্যতিক্রমী সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন তা আজও পাওয়া যাচ্ছে না। ‘দরবারি মিডিয়া’ টিকে আছে সরকার এবং তার বশংবদ শিল্প গোষ্ঠীর বদান্যতায় কিন্তু ‘জনবাদী মিডিয়া’র শক্তি তো আম-জনতা, সেই জনতা কিন্তু আজও সেভাবে ‘জনবাদী মিডিয়া’র দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না।