সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
নানা কারণে ঘুম আসতেই চায় না আজকাল। এলেও, আধ-ঘুম, আধ-স্বপ্ন। সেই স্বপ্নেই কেউ একজন একটা ডিকটেশন নিতে বললেন। নিলুম। যিনি দিচ্ছিলেন ডিকটেশন তিনি বোধ হয় আমার বিছানার পাশেই ছোট্ট টেবিলটায় খাতা-পেনসিল লক্ষ করেছেন। স্বপ্ন দেখলেই লিখে ফেলি। আর ইনি তো ডিকটেশনই দিলেন। তাহলে পড়ুন এবার:
এই যে মশাই, শুনচেন? কোতায় অরুণাচলের বডারে চারটে চীনা জওয়ান পায়চারি করচেলো (আগেই হলপ করে বলিচি, বডারের এ-পারে কোন চীনা এক মুহূর্তের জন্যেও পা-ই রাকেনি), আর মণিপুরে গোটাকয়েক নাক-খাঁদা নিজেদের মধ্যে মারপিট করে মরচেলো, অমনি তো হৈ হৈ শুরু করে দিলেন! কী, না পোদানমন্তী তাঁর দপ্তরের যাবতীয় জরুরি ফাইল পড়া ছেড়ে দিয়ে আর বিশ্বগুরুর বিদেশ ভমণের গুরুতর দায়িত্ব পালন না করে কেন মণিপুরীদের চোকের জল নিজের হাতে মুচিয়ে দিতে গেলেন না! অমনি ভাবলেন সেমিফাইনাল ইলেকশনের খেলায় বাজিমাৎ করবেন! হ্যাট্টিরিকটা দেকলেন? তিন-একে হেরেও কি লজ্জাঘেন্না আচে আপনাদের?
আরে, তিনখানা গোল দিয়ে সবে দিল্লির পাটি-আপিসে একটু মালা-টালা পরচি, কে-একজন অর্বাচীন এসে গোটাকয়েক হ্যাণ্ডবিল মার্কা কাগজ দে গেল! ওই যে আগস্ট মাসে মোটাভাইকে দিয়ে গুটিকয়েক আইনবিষয়ক পোস্তাব আমার রাজদরবারে (ইংরেজের নকল করে আপনারা যাকে পার্লামেন্ট বলেন আর কি!) পড়িয়েচিলুম, সেগুলো নিয়েই আলোচনা! না-কি সমালোচনা, কে জানে! মোদ্দা কতা যেটা বুজলুম, আপনারা আমাদের পেলানটা – সবকিচু কেন – কিচুই বোজেননি।
অম্রিতকালে সবকিচু বদলাচ্চি, আইনই বা না বদলায় কেন? কয়েক বচর ধরে মাজে-মাজেই কিচু কিচু বদলিয়েচি, মীডিয়া তো কতাই বলেনি। তা ছাড়া রাজদরবারে আমাদের লোকই তো বেশি – শুদু বেশিই নয়, অনেক অনেক বেশি – তাই বদলগুলো বেশি কতা না-বাড়িয়েই হয়ে গেল! হয়েই গেল, লোকে বুজতেই পারল না। অ্যাকন আবার অম্রিতকাল বলে কতা, তাই ভাবলুম এবার একটু ভালোমতই বদলানো যাক।
দেকুন, এতদিনে আপনারা সবাই বুজেচেন, এই দেশের বেশির ভাগ গোমাতার-সন্তান-মানুষেরই মাতায় গোবর, যা-ই বলি, যা-ই করি, কিচুই বোজে না। যদি জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে গারদে ঠেলেও দিই, দিব্যি লপ্সি খেয়েও বেঁচে-বত্তে থাকে। এক-আধটা বুড়ো-হাবড়া কেরেশ্চান পাদরি মাজে মদ্যে পটোল তুললেও সেটা তেমন কিচু নয়! আসলে পবলেমটা কোতায় জানেন তো, ওই যে ইংরেজগুলো রাজ্যে রাজ্যে একটা করে আদালত বানিয়ে গেস্ল – আর রাজ্যই বা বলি কেন শুদু, ছোট ছোট জায়গাতেও তো ছাড়েনি, আর সবার মাতার ওপরে একখান পোদান বিচারালয়, (আরে ইংরিজিও জানি মশাই) মানে সুপ্পিম কোট – তাতেই হয়েচে আসল মুশকিল। ওই জায়গাগুলোয় যারা যাওয়া আসা করে, মানে উকিলমোক্তার, জজম্যাজিস্টেট এরা সব, আইনের প্যাঁচপয়জার বোজে। আমাদের পাটিতেও একন এম-এ পাশ, আইন পাশ, এমনকি আমার মতো একজন – সারা পিথিমিতে যার জোড়া নেই কেউ, পিথিমির জন্ম থেকে আজ পজ্জন্ত একজনই ব্যক্তি যে এমন বিষয়ে ফাস কেলাস ফাস যে বিষয় একবারই মাত্তর একজন ছাত্তকে পড়ানো হয়েচেলো, পরীক্ষা নেয়াও হয়েচেলো ঠিকই, কিন্তু আর কোন দিনও হবে না – বাধ্য হয়ে পরীক্ষাটাও আমাকেই, মানে নিজের পরীক্ষা নিজেই নিতে হয়েচেলো, আর তো কেউ কোনদিন পড়েনি এ-বিষয়, থাক সে কতা!
হ্যাঁ, কী যেন বলচিলুম! হ্যাঁ সুপ্পিম কোট! ওরা হটাৎ, বলা নেই কওয়া নেই, বাইশ সালের মে মাসে সেন্টাল আর সব এস্টেট গরমেন্টকে একটা নিদ্দেশ – এক্কেবারে নিদ্দেশ – পাঠিয়ে দিল যে ভারতীয় দণ্ডবিদির ১২৪ (ক) ধারায় আর কোন এফ-আই-আর করা চলবে না! ভাবতে পারেন? তো, আমাদেরও তো বুদ্দি শুদ্দি আচেই, না কি নেই, অ্যাঁ? আমরা ধারাটাই বাতিল করে দিলুম। আর তোকুনি মাতায় এল, ঢের হয়েচে আর নয়!
মাজাকি? একন না অম্রিতকাল? একনো ইংরেজের ফেলে-যাওয়া আইনকানুন? রোসো, সব বদলাচ্চি।
মোটাভাই যা পড়েচে দরবারে, তার এক্কেবারে গোড়ার কতাটা হল পুরোনো নাম বদলিয়ে আমরা সব আইনের নতুন নাম দোব। আর ঔঔঔ-প-প-নিবেশিক নাম নয়, সবই গণতান্তিক নাম। আমরা না গণেশ চতুত্থী করি ফি বচর? তাই তো গণতান্তিক। অ্যাকোন, রাজদরবার যেই না পোস্তাবটা পাশ করিয়ে দেবে, তার পর থেকে ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড-এর নাম বদলিয়ে হবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, কিমিনাল পোসিডিওর কোড-এর নাম ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা আর দি এভিডেন্স অ্যাক্টোকে বলা হবে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনপস্তাব।
কী, হাততালি দিচ্চেন তো? দেকুন, অম্রিতকালেই আসল স্বাধীনতা এল, আমরাই আনলুম। ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে ছিলুম না, নাকখৎ দিয়ে মুচলেকা লিখে আন্দামান থেকে বীরবিক্রমে ফেরৎ এয়েচিলেন আমাদের নেতা। কিন্তু আসল স্বাধীনতা এল আজ। আমরাই আনলুম। বদলিয়ে দিলুম আইনের নাম! জয় ভারত! (ভুলেও ইণ্ডিয়া বলবেন না মশাই)।
বদলিয়ে তো দিলুম, ঠিক কেমন দাঁড়াল ব্যাপারটা? ওই যে আপনাদের সুপ্পিম কোট বলেচেলো না, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় আর কোন এফ-আই-আর করা চলবে না, মনে আচে তো?– তো ঠিক হে, কোই পরোয়া নহী, ধারাটাকেই বদলিয়ে দিলুম আমরা। অ্যাকোন যা করিচি, নতুন বই বেরোলে দেকবেন, ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডই নেই তো আবার ১২৪ (ক) ধারা! অ্যাকোন পাওয়া যাবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫০ ধারা! হুঁ হুঁ। তা-ও আবার নাম বদল করে দিইচি। কয়েক বচর ধরে এই সুপ্পিম কোট আর – কী জানি নাম – নাগরিক অধিকার – হ্যাঁ, ঐ অধিকার আন্দোলনের দলবল – সিডিশন সিডিশন করে চেঁচামিচি করচেলো খুব, বলচিলো স্বাধীন দেশে আবার সিডিশন কী?
আমরা বলচি, ঠিকই তো, এতদিন তো স্বাধীনতা আসেইনি দেশে, এল অ্যাকোন, এই দুহাজার চোদ্দ থেকে। আর, অ্যাকোন তো অম্রিতকাল, যা কিচু ঔপনিবেশিক ছেল সবই আমরা বদলে দেব। গণতান্তিক দেশে আবার সিডিশন বা রাজদ্রোহ কিসের? রাজাই নেই তো রাজদ্রোহ? অ্যাকোন থেকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫০ ধারায় থাকবে অন্তর্ঘাত বা এনডেঞ্জারিং সোভেরিনটির অপরাদের কতা! সবকটাকে এবার ধরব এই নতুন আইনে। ধরব, তাই আইনের খ্যাম্তাটাও বাড়িয়ে নিইচি! ঐ-যে দণ্ডবিদির ১২৪ (ক)-তে তিন বচরের হাজত দিতে পারতুম, অ্যাকোন অন্তর্ঘাতের অপরাদে দিতে পারব সাত বচরের বা এমনকি সারা জীবনেরও হাজত!
তাইলে, আসল কাজটা কী হল, বুজলেন? বুজলেন না তো, তাহলে খোলসা করে বলি। আমরা ভেবেচিলুম সব আইনই বদলিয়ে দেওয়া যাবে। খাতা-কলম নিয়ে যকন বসল আমাদের আইনি পণ্ডিতরা, তারা দেকে শুনে, অনেক তক্কোবিতক্কো করে শেষ পজ্জন্ত বুজল যে, কাজটা শুদু কঠিনই নয়, পেরায় অসম্ভব। সেই আট-নশো বচর আগে থেকে ওই যে ম্যাগনা-কার্টা না কী যেন বলে, সেই আমল থেকে, ওরা আইন লিকচে আর মুচচে, মুচচে আর লিকচে, ওদের কায়দাই আলাদা! অনেক চেষ্টা করলেও বড় জোর শতকরা কুড়ি ভাগ বদলানো যাবে। আশি ভাগই বদলানোর কোন উপায়ই নেই। তাহলে উপায়?
উপায় একটা আচে, বললুম আমি। ঐ-যে সংবিধান-টংবিধান আচে, সব ফেলে দাও, নিয়ে এস মনুসংহিতা। ঐ একখানা বই টুকলি করে ঝেড়ে দাও। ল্যাটা চুকে যাবে!
বই?– আঁতকে উঠল পণ্ডিত – বই কোতায় পাবেন?
কেন, দোকানে পাওয়া যায় না?
পাওয়া হয়তো যায়, পণ্ডিত বলে, কিন্তু মুশকিল হচ্চে কোনো দুখানা বইয়ে একই ছাপা পাওয়া মুশকিল।
মুশকিল, কেন মুশকিল?
পণ্ডিত যা বোজালো, বা বলতে পারেন আমি যা বুজলুম, তা হচ্চে, মনুর আমলে তো ছাপা-টাপা ছিলনি, হাতে-লেকা পুঁথি সব। একটা দেখে অন্যটার নকল। তো, যে পণ্ডিত নকল করে, সে লেকার ফাঁকে ফাঁকে নিজের তৈরি একটা-আধটা শোলোকও ঢুকিয়ে দেয়। আবার সেই পুঁথি দেখে যে নকল করে সে-ও ঢোকায় দুচারখানা। এই করতে করতে যা দাঁড়ায় তা হল, সব পুঁথিই আলাদা আলাদা। অ্যাকোন দেকে কে বলবে কোন পুঁথিটা সত্যি-সত্যিই মনু লিকেচিলেন!
আমি বললুম, তাহলে উপায়?
উপায় একটা আচে, বলে পণ্ডিত। আপনি হলেন দণ্ডমুণ্ডর কত্তা। আপনি যা বলবেন তা-ই আইন। তা ছাড়া, দেকেচেন তো, সব আদালতেই আইন দেবীর চোক বাঁদা থাকে। তার মানে আইন হল অন্দ, দু-চোক কানা, কোন কিচু সে দেকে না, দেকতে পায় না। তাই আমি বলি কি আপনার চোকদুটো বেঁদে দিই। তারপর দশটা দোকানের দশটা আলাদা আলাদা মনুসংহিতা কিনে এনে আপনার সামনে রাকি। বাঁদাচোক আপনি যে-খানা তুলবেন, সেটাকেই আমরা আসল মনুসংহিতা ধরে নোব।
এই পজ্জন্ত কতা তো হয়ে গেল। তারপর দিনের পর দিন চলে যায়, পণ্ডিত আর আসে না, চোকও বাঁদে না, কাজও এগোয় না। শেষ পজ্জন্ত ডেকেই পাটাই পণ্ডিতকে, বলি, কী হল পণ্ডিত?
পণ্ডিত বলে, এতদিনেও সে একজনকেও রাজি করাতে পারেনি আমার চোক বাঁদতে। সবাই নাকি বলচে, এ তো বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁদতে বলচ পণ্ডিত!
তাহলে কী হবে?
আরও কিচুদিন দেকতে হবে, বলে পণ্ডিত।
পরের দিন পণ্ডিত আবার হাজির। বলে, হুজুর, একজনকে নিমরাজি করিয়ে এনিচি। তাকে নিয়ে আসচিলুম, এমন সময় একটা কতা মনে পড়ল।
কী কতা?– শুদোই আমি।
সে বলে, হুজুর, আমার বিশ্বগুরুর কতাটা মনে পড়ে গেল?
বিশ্বগুরুর কতা? কোন্ বিশ্বগুরু? আমি ছাড়া আবার কোন্ বিশ্বগুরুকে পেলে তুমি?
আপনি ছাড়া বিশ্বগুরু আর কে হবে হুজুর? আমি আপনার বিশ্বগুরু হবার কতাই বলচি। দেকুন, অ্যাকোন চোক বেঁদে আপনি যদি ভারত রাষ্ট্রের আইন একা-একাই ঠিক করেন, আজকালকার দিনে মানাবে সেটা? অনেক কিচুই তো বদলিয়ে গেচে পিথিমিতে। অ্যাকোন যদি আপনাকে হুজুর নামে না ডেকে মহারাজ নামে ডাকতে শুরু করি, আপনি কি মেনে নেবেন? ভারত রাষ্ট্রে তো অ্যাকোন কোন মহারাজ নেই। যতই মহারাজের চেয়েও বড় মহারাজ আপনি হোন না কেন, পিথিমির সবাই আপনাকে পোদানমন্তীই বলবে, তাই না? এই যে নতুন দরবার একটা আপনি উদ্বোদন করলেন, তকোন তো সেকেনে কোন মহারাণী বা যুবরাজ ঢুকতেও সাহস পেলনি। আপনি নিজেই নাম দিলেন সংসদ ভবন, নিজেই উদ্বোদন করলেন, এমনকি ভবনের যিনি আপিশিয়াল নেতা – কোন্ এক বিজনেসম্যানের নামে নাম যেনার – ওই আপনার পেচুন পেচুনে ঘুরচিল যিনি – কই, তকনো তো রাজদরবার নাম হলনি! দেকুন হুজুর, বিশ্বগুরু বলে আপনাকে বিশ্ব ততদিনই মানবে যতদিন আপনি পোদানমন্তী! রাজতন্তর তো নেই আজকাল, না? সেটা তো বুজতে হবে।
এই পোজ্জন্ত কতার পর পণ্ডিত বলে, চোক বাঁদা নয়, সে আর একটা বুদ্দি বের করেচে।
তাহলে বোজাও সেটা।
পণ্ডিত বলে, সব আইনেরই একটা নাম থাকে। যেমন ধরা যাক ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড। আমরা এর নতুন নাম দিচ্চি ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। এই যে সংহিতা, এটা হল বহুবচন, তার মানে একটাই আইন নয়, এর মদ্দে অনেক আইন মিলেমিশে আচে। যেগুলো মিলেমিশে আচে সেগুলো এক-একটা ধারা। ওই যে ভারতীয় দণ্ডবিদির কতা বলচিলুম, ওকানে আমরা ঐ দণ্ডবিদির ১২০ (ক) ধারার কতা আলোচনা করিচি। শুদু ভারতীয় দণ্ডবিদি বললে কোন কতাই তো আসলে বলা হল না। কেউই বুজতে পারল না কোন অপরাদের কতা বলচি। এমনকি, ভারতীয় দণ্ডবিদির ১২০ ধারা বললেও কিচুই বোজা যায় না। যেই বললুম, একশো কুড়ির ক, মানে একটা হল, ঠিক না?
দেকুন, পণ্ডিত বলতে থাকে, আইনের ক্ষেত্রে আইনের নাম আর তার ধারা-উপধারা-উপউপধারা, এই সব মিলিয়ে একটা পোসোঙ্গো, মানে ইংরিজিতে বললে একটা কনটেক্সট, তৈরি হয়। তকনই জজসাহেব-উকিল-ব্যারিস্টার পুরো ব্যাপারটা বুজতে পারে। আপনাকে কি বোজাতে পারলুম? – পোশ্নো করে পণ্ডিত।
আমি বলি, হ্যাঁ, ঠিক বুজচি, বলে যাও।
পণ্ডিত বলে, আমরা অনেক হিসেব করে দেকিচি, ঐ যে ঔঔপনিবেশিক আইন আমাদের দেশে অ্যাকোনো চলচে,
মেরে-কেটে তার পাঁচ-ভাগের এক ভাগ আমরা বদলাতে পারব। কিন্তু ওইটুকুতেই আমরা ঘন্টা বাজিয়ে দেব সুপ্পিম কোটে, সামনের দশ-বচ্ছর জজ-ব্যারিস্টারদের আইন খুঁজে বের করতেই চলে যাবে!
আপনাকে হুজুর আগেই বলিচি, পণ্ডিত বলতে থাকে, রাজদ্দোহ আইন অ্যাকোন আমরা বদলিয়েই দিচ্চি। রাজদ্দোহের ১২০(ক)-এর বদলে অ্যাকোন অন্তর্ঘাতের ১৫০ ধারা। সঙ্গে উপধারার অন্ত থাকবে না! অ্যাকোন সরকারের যে-কোন কাজেই পতিবাদটুকু করলেও শাস্তির ব্যবস্তা নিশ্চিত। মিচিল করলেও গণবিক্ষোভের উপধারার বন্দোবস্ত করা হচ্চে। সবার চাইতে বড় কতা হল, অপরাদের বিবরণ শুনে আদালতের উকিল-জজসাহেবদের আইনের বইয়ে তা খুঁজে বের করা! এতদিনের ধারা-উপধারা বাড়িয়ে-কমিয়ে নতুন নম্বর দিয়ে এমন ধাঁধায় ফেলে দেওয়া হবে, যে পশাসনের মুকের দিকেই চেয়ে থাকতে হবে আদালতকে অন্তত দশটি বচ্ছর। কিচ্চুটি খুঁজে পাবে না। আর দশ বচ্ছর যদি এভাবে চালিয়ে যেতে পারি আমরা – পারবই যে তাতে তো ভুল নেই – দেশের শতকরা ষাটজন নাগরিককেই শুদুমাত্ত খেতে পাবার জন্যেই সরকারের ভিক্ষের আশায় বসে থাকতে হয় অ্যাকোনই, দশ বচরের মদ্দে শতকরা কত জনের এই হাল করে দেওয়া যাবে সে তো হুজুর আপনিই জানেন! কাজেই ভোটে জেতা কিচু নয়।
বা বা বা বা বা, আমি খুশি হয়ে বললুম, বুদ্দি তো ভালোই বের কোরোচো, জজ-ব্যারিস্টার আর মানবাধিকারের দেশদ্রোহী গুণ্ডাগুলো তো আর হালে পানি পাবে না মনে হচ্চে।
হ্যাঁ, ঠিক তাই হুজুর, কাজটা আমরা পণ্ডিতরা বসে সব ঠিকঠাক করে নিই, দেকাব তকন। দেকবেন, এমনকি আপনিও – একমাত্ত বিষয়ের একমাত্ত ফাস কেলাস ফাস – চিরকালের জন্যে – আপনি, এমনকি আপনিও বুজবেন না কিচু যতক্কন না করে দেকাই!
বেশ, বাঃ বেশ, বলে আমি উটতে যাচ্চি পণ্ডিত বলল, আর একটা ভালো খবর দোব হুজুর।
দাও, বলে বসলুম ফের।
আইন তো ঠিক আচে, বলে পণ্ডিত, কিন্তু আইনের পোয়োগ? সেটা কে করবে? পুলিশ তো? সেই পুলিশকে এবার থেকে আমরা এমন খ্যাম্তা দেব যে সব অপরাদ ঠাণ্ডা হতে সময় লাগবেনি এট্টুও!
সে ক্যামন?
বলচি হুজুর। অ্যাকোন যে নিয়ম আচে সেই নিয়মে, অর্থাৎ কিমিনাল পোসিডিওর কোডের নিয়ম অনুযায়ী, কোন অবস্তাতেই পুলিশ একজন আসামীকে বিচারের আগে পনের দিনের বেশি হেপাজতে রাকতে পারবেনি। যে অপরাদের অভিযোগে আসামী গেরেপ্তার হয়েচে, পমাণ হলে তার সাজা যদি দশ বচর বা তারও বেশি হয় তাহলে ম্যাজিস্টেট নিজের দায়িত্বে পনের দিনের হেপাজত বাড়িয়ে সেটা ষাট থেকে নব্বই দিন করতে পারে। কিন্তু, কতা আচে এর মদ্দে। পুলিশের হেপাজৎ কিন্তু ঐ পনের দিনই। আসামীকে নব্বই দিন পজ্জন্ত আটকে রাকতে হলে পনের দিনের পর তাকে অন্য কোতাও পাটিয়ে দিতে হবে। জেলে হোক, হাসপাতালে হোক, বা যা-ই হোক। মানে সরাসরি পুলিশের হেপাজত ওই পনের দিনই মাত্তর রইল।
এ তো হল ঐ কিমিনাল পোসিডিওর কোডের কতা। আমাদের ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার একশো সাতাশির দু' নম্বর ধারায় আমরা অন্য কোতাও পাটিয়ে দেবার কতাটা এক্কেবারে মুচে দিয়েচি। রাখুক না পুলিশ নিজেদের হেপাজতে যতদিন ইচ্ছে। আরে, একটা কতা তো ভাবতে হবে। এই জজ-ব্যারিস্টারদের একেবারে বিশ্বাস নেই। শেষ পজ্জন্ত হয়তো বেকসুর খালাসই দিয়ে দিল! পুলিশের নিজের হেপাজতে রাকলে দমদম দাওয়াইটা তো আগেই দেওয়া গেল, কী বলেন হুজুর?
হক কতা, বলি আমি।
শুদু এ-ই নয় হুজুর, আরো আচে। এই আইনে সাঁইতিরিশের খ একটা উপধারা আচে। এই উপধারার নিদ্দেশে দেশের সব থানায় একজন করে ইস্পিশাল সাব-ইনিস্পেক্টর রাখতে হবে। যেই-না কেউ গেরেপ্তার হল সেই থানায়, সেই সাব-ইনিস্পেক্টর থানাবাবু তক্কুনি আসামীর নাম, ঠিকানা আর গেরেপ্তারের কারণ শুদু যে লিকে রাকবে তা-ই নয়, জেলার সদর দপ্তরে আর সেই জেলার সব থানাতেই পাটিয়ে দেবে সেই ডকুমেন্ট। শুদু পাটানো নয়, এমনভাবে পাটানো, যেন সেটা দ্যাকা যায়, থানায় ঢুকলেই সবাই দেকতে পায়। আমরা জানি যে মানবাধিকারের দেশদ্রোহী গুণ্ডাবাহিনী গোপনীয়তার মানবিক অধিকার খব্ব হল খব্ব হল বলে কান্নাকাটি করবে, তা করুক!
আরও একখানা ধারা আপনাকে বলি হুজুর, এই আইনেরই সাতাত্তরের ধারা। ধরুন গেরেপ্তার করা হল কোন অপরাধীকে। কিসের নালিশে? না, সে এমন একটা কিচু করেচে যাতে অন্যের কিচু লোকসান হয়েচে। একনো সাক্কী আসেনি, কোন পমাণ নেই, বিচার শুরুই হয়নি – কিন্তু থানাবাবু যদি মনে করে আর ম্যাজিস্টেট যদি আপত্তি না করে, তাহলে শুদু মাত্তর ঐ নালিশের জোরেই আসামীর সম্পত্তি কোরোক করে, ক্ষতি যাদের হয়েচে তাদের মদ্দে সে তা ভাগ-বাটোয়ারা করে সব কিচু চুকিয়ে দিতে পারবে!
বল কী! আমি আর পারলুম না। পেরায় লাপিয়ে উটলুম! তাইলে তো যোগী, আর তার দেকাদেকি আসামের ওই হিমন্ত বিশ্বশর্মা, আর তাদের দেকাদেকি হরিয়ানায় আর নানান জায়গায় যে বুলডোজার নিয়ে এসে আমাদের লোকজনরা কতো কিচু ভেঙে দিল গুঁড়িয়ে দিল, আর পড়ে রইল যা, বিলিয়ে দিল সবায়ের মদ্দে, এ সব তো নাগরিক সুরক্ষা আইনের কত নম্বর ধারা না উপধারা, তাই অনুযায়ী! মানে, একেবারেই আইনানুগ!
আপনি তাইলে খুশি, হুজুর?
উঁ, মোটামুটি। তবে ঐ যে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনিস্পেক্টর থানাবাবুর কতা বলচিলে না, তারই একটা ভেকান্সিতে আমাকে যদি ফিট করে দিতে পারতে...