সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
খটকাটা তখনই লেগেছিল যখন সহকর্মীরা হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিলেন মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনা একদিন পিছিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। না, কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কথা শুনে নয়। মিজোরামের এনজিও-দের কোঅর্ডিনেশন কমিটির দাবি মেনেই এই সিদ্ধান্ত। উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটিতে অসরকারি সংগঠনগুলির এত জোর! তখনই মনে হচ্ছিল, যেমনটা বুথ ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত করছে, তেমনই নিশ্চয়ই মিজোরামের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে।
খ্রিস্টান প্রধান রাজ্য মিজোরামে রবিবার চার্চে যাওয়ার দিন। তাঁরা এটিকে পবিত্র দিন হিসেবে মানেন। সেদিন কেউ ভোটের গণনা কেন্দ্রে যাবেন না। কাজেই ভোট গণনার দিন বদল হোক। এমনই একটি দাবি তুলেছিল এই কোঅর্ডিনেশন কমিটি। এমন একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের দাবি ও নির্বাচন কমিশনের সেই দাবি মেনে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মিজোরামের রাজনীতির আসল ছবিটি। চার্চ হোক বা নাগরিক সমাজ, তারা কিন্তু এই রাজ্যের রাজনীতির এক বড় চালিকাশক্তি।
এবারের ভোটে যে জো়রাম পিপলস মুভমেন্ট বা জ়েডএমপি জয়ী হয়েছে এবং কংগ্রেস ও মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের দ্বিমুখী রাজনীতি ভেঙে দিয়েছে, তার পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছে নাগরিক সমাজ। যে রাজ্যে চার্চগুলির সংগঠন রাজনৈতিক দলগুলির জন্য কোড অফ কন্ডাক্ট ঠিক করে দেয়, মিজোরাম পিপলস ফোরাম নামে একটি নাগরিক সংগঠন রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে মউ স্বাক্ষর করে বলে দেয় নির্বাচনে কোনও দুর্নীতি করা চলবে না, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন করতে হবে, কাউকে টাকা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে ভোট আদায় করা যাবে না। তারাই ঠিক করে দেয় দুয়ারে দুয়ারে রাজনৈতিক প্রচার বা বড় সভা করা চলবে না, করতে হবে স্ট্রিট কর্নার মিটিং বা পাড়ায় পাড়ায় ছোট সভা, নিজেরাই সব দলের প্রার্থীদের এনে এক মঞ্চে বিতর্কসভার আয়োজন করে, সেই রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের থেকেও যে নাগরিক সমাজ শক্তিশালী হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী রয়েছে!
সদ্য সমাপ্ত মিজোরাম নির্বাচনে ৪০ আসনের বিধানসভায় জ়েডএমপি পেয়েছে ২৭টি আসন, বিদায়ী শাসক দল এমএনপি পেয়েছে ১০টি আসন, কংগ্রেস ১টি ও বিজেপি ২টি। নতুন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরে ১৯৮৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কংগ্রেস ও এমএনপি-ই উত্তর-পূর্বের এই ছোট রাজ্যটিতে (জনসংখ্যা মাত্র ৯ লাখের কাছাকাছি) দফায় দফায় একে অন্যকে হারিয়ে সরকার চালিয়ে আসছিল। এবার জ়েডএমপি সেই প্রথা ভেঙে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে পরিবর্তন আনল মিজোরামের রাজনীতিতে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন জ়েডএমপির লালডুহোমা।
জ়েডএমপি-র সঙ্গে নাগরিক সমাজের সম্পর্ক নিবিড়। এটি আসলে ছ'সাতটি সংগঠনের একটি ছাতা। এর মধ্যে রয়েছে মিজোরাম পিপলস কনফারেন্স, জ়োরাম এক্সোডাস মুভমেন্ট, জ়োরাম ডিসেন্ট্রালাইজেশন ফ্রন্ট, জ়োরাম রিফর্মেশন ফ্রন্ট, মিজোরাম পিপলস পার্টি, এনসিপির মতো গণসংগঠন ও রাজনৈতিক দল। ২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত জ়েডএমপি কয়েকটি ছোট আঞ্চলিক দল ও নাগরিকদের একটি যৌথ সংগঠন হিসেবেই কাজ করছিল। ২০১৭ সালে তারা সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি ছিল না। তারা মূলত অকংগ্রেসি ও অ-এমএনএফ বিরোধী তৃতীয় শক্তি হিসেবেই উঠে এসেছিল মিজোরামের রাজনীতিতে। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ৩৮ জন নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছিল জ়েডএমপি। তাদের মধ্যে ৮ জন নির্দল প্রার্থী জয়ীও হন। সে বছরের নির্বাচনে কংগ্রেসও অত আসনে জয়ী হতে পারেনি। তারা জিতেছিল মাত্র পাঁচটি আসনে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমা ২০১৮ সালে নির্দল হিসেবেই সারছিপ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন। হারিয়েছিলেন তৎকালীন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী লালথানহাওলাকে।
২০১৯ সালের ৩ জুলাই ভারতের নির্বাচন কমিশন জ়েডএমপি নামক এই নাগরিক সংগঠনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জ়েডএমপি রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পাওয়ায় এবং তিনি সেই দলে 'যোগ' দেওয়ায় বিধানসভায় লালডুহোমার বিধায়ক পদ খারিজ করে দেন স্পিকার লালরিনলিয়ানা সাইলো। লালডুহোমা জ়োরাম ন্যাশনালিস্ট পার্টি নামে যে সংগঠনটি তৈরি করেছিলেন, সেটিকেও এই জ়েডএমপির সঙ্গে জুড়ে দেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিধায়ক পদ খুইয়ে পরে লালডুহোমাকে ২০২১ সালে উপনির্বাচনে জিতে ফের বিধানসভায় ফিরতে হয়। এই সংগঠনটি যে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসছে তা বোঝা গিয়েছিল লালডুহোমার উপনির্বাচনের জয় থেকেই। তার পরে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার বিধানসভা এলাকায় জেমাবাওয়ক স্থানীয় নির্বাচনে এবং লুঙ্গলেই পুরসভা নির্বাচনে সাফল্য পায় জ়েডএমপি।
জ়েডএমপি-র সভাপতি প্রাক্তন পুলিশ কর্তা লালডুহোমা (যিনি একসময় ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন এবং কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন ১৯৮৪তে) নিজে প্রায় ৭৫ ছুঁই ছুঁই হলেও তাঁর বিগ্রেড নবীন রক্তে পরিপূর্ণ। শিক্ষিত যুবক যুবতীরা ও নাগরিক সমাজের লোকজন লালডুহোমাকে বরাবর সমর্থন জানিয়ে গেছেন। জ়েডএমপির জয়ী প্রার্থীদের তালিকায় যেমন রয়েছেন জাতীয় ফুটবলার জে জে লালপেখলুয়া, তেমনই রয়েছেন বারিল ভান্নেইসাঙ্গির মতো রেডিও জকি। তাঁদের দু'জনের বয়সই মাত্র ৩২। বারিল রাজ্যের নবীনতম মহিলা বিধায়ক। দু'জনেই হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছেন। লালপেখুয়া বলছেন, তিনি এর আগেও রাজনৈতিক দলগুলির থেকে রাজনীতিতে আসার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তখন তিনি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করলেও এবার গরীবী ও খাদ্যসংকট হঠাতে রাজনীতিতে এসেছেন। প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই জিতেছেন তিনি। অন্যদিকে বারিল এর আগে মিজোরাম পৌরসভায় কাউন্সিলর হলেও, বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। জিতে তাঁর বক্তব্য, তিনি জনগণের কল্যাণের জন্যই নির্বাচনে লড়াই করেছেন। মহিলাদের জন্য যেমন তিনি কাজ করতে চান, তেমনই স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নই হবে তাঁর প্রধান লক্ষ্য। লালপেখুয়া বা বারিল মিজোরামের নবীন ভোটারদের স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরছেন। জয়ীদের তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিকরাও। মিজো সংবাদপত্র ভানগ্লেইনির প্রাক্তন যুগ্ম সম্পাদক লালনঘিনগ্লোভা হমার, একই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক কে সাপডাঙ্গাও এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দু'জনেই মিজোরাম জার্নালিস্ট অ্যাসোশিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত।
ভোটের ফল থেকেই পরিষ্কার, আসলে পরিবর্তন চাইছিল মিজোরামের জনগণ। ১৯৮৭ সাল থেকে একবার কংগ্রেস ও একবার এমএনপি-র সরকার দেখেছেন তাঁরা। বিকল্প পথের সন্ধান তাঁরা করছিলেনই। তাই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অত জন নির্দল প্রার্থীকে জিতিয়ে বিধানসভায় পাঠিয়েছিলেন মিজোরামের ভোটাররা।
মিজোরামের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে রাজ্যের জনগণ বেশ টালমাটাল পথ পেরিয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে পড়েছেন। মিজোদের জন্ম নাকি চিনের ইয়েলুং নদীর ধারে ছিনলুং গুহা বা পাথর থেকে। এর পর তাঁরা বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বসবাস করেছেন। চিনের শান প্রদেশে, বার্মার চিন পাহাড়ে তারপরে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তাঁরা বর্তমান ভারতের এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়েন। সেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধও হয় এলাকা দখল নিয়ে। পরে ১৮৯৫ নাগাদ ইংরেজদের উপনিবেশের মধ্যে আসে মিজোরামের এই অঞ্চলটি। তখন এটি লুসাই পাহাড় নামেই পরিচিত ছিল। ১৮৯৮ সালে অসমের মধ্যে নিয়ে আসা হয় লুসাই অঞ্চলকে। আসা যাওয়া চলতে থাকে ইংরেজ শাসকদের এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের। ইংরেজ শাসকদের তত্ত্বাবধানেই সেখানে প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরি হয়। রাস্তাঘাট তৈরি হতে থাকে। প্রাচীন জনপদের গ্রামের প্রধান বা জাতির প্রধানদের মাথায় রেখে যে শাসনব্যবস্থা মিজোরামে চলছিল, তার আধুনিকীকরণের শুরু সেই সময় থেকেই। ভারতের স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ সালে মিজোরামকে একটি আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। অসমের অধীনেই থাকে সেই জেলা। কিন্তু ১৯৬৬ সালে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। তারা ভারত থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের মর্যাদা দাবি করে। জো জাতিসত্তার জন্য চলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এর মধ্যে ১৯৭২-এ মিজোরামকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অবশেষে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৮৬ সালের ৩০ জুন ভারত সরকার ও এমএনএফ-এর মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আলাদা রাজ্যের মর্যাদা পায় মিজোরাম। বিধানসভা গঠন করা হয়। সেখানে এমএনএফ রাজনৈতিক দল হিসেবে মূল ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নাম লেখায়। সরকারে ক্ষমতায় আসে তারা। এর পর থেকে মিজোরামে কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেয়নি।
এই পুরো ঘটনাক্রমে কিন্তু চার্চ ও নাগরিক সংগঠনগুলি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে গেছে। মিজো সমাজে গ্রামের মোড়লেরাই সবকিছু পরিচালনা করেছেন। খানিকটা সামন্ত্রতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই চলেছে মিজো সমাজ। কিন্তু ব্রিটিশদের প্রভাবে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাজকর্মে যে নতুন প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে উঠছিল, তাঁরা এই সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরির জন্য লড়াই করতে শুরু করেন। একদিকে চার্চ যেমন তাঁদের সহযোগিতা করে, অন্যদিকে এই নতুন প্রজন্ম নাগরিক সংগঠনের মাধ্যমে তাঁদের লড়াই জারি রাখে। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময়েই মিজোরামে ইয়ং মিজো অ্যাসোশিয়েশন তৈরি হয় বা ইয়ং লুসাই অ্যাসোশিয়েশনও সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মিজোরামে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আসার জন্য লড়াই করতে থাকে।
কাজেই মিজোরামের রাজনীতিতে নাগরিক সংগঠনের ভূমিকা নতুন নয়। প্রতিটি নির্বাচনেই তাদের ভূমিকা ছিল। তবে এবার কংগ্রেস ও এমএনএফ-এর দ্বিমুখী লড়াইয়ে বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন এই নতুন প্রজন্ম। একদিকে দুর্নীতির অভিযোগ ও অন্যদিকে সাক্ষরতায় দেশের মধ্যে উপরের দিকে থেকেও রাজ্যের বেহাল অর্থনীতির হাল ফেরাতে না পারার অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছিল সরকার। সেই ইস্যুকেই হাতিয়ার করে দুর্নীতি-মুক্ত ও কাজের সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচনে জিতেছে লালডুহোমার দল। নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই নিজেদের পরিকল্পনার কথা রাজ্যবাসীকে জানিয়েছেন তিনি। ঘোষণা করে দিয়েছেন প্রার্থীদের নাম। আর নাগরিক সমাজ সেই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়েছে। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছে লালডুহোমার জ়েডএমপি।
এমনিতে মিজোরামে জাতিসত্তার রাজনীতি হয়েছে বরাবর। এবারের নির্বাচনে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা (যিনি একসময় গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে মূলধারার রাজনীতিতে আসেন) মিজোদের পরিচয়ের রাজনীতিকেই সামনে রেখেছিলেন। সঙ্গে মণিপুর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা কুকি-জো জনগণের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি। মায়নমার থেকে উৎখাত হয়ে আসা প্রায় ৪৫ হাজার উদ্বাস্তুদের রক্ষার জন্যও তাঁর দল ও সরকার কাজ করেছিল। এর জন্য এনডিএ-র শরিক দল হয়েও ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানতেও নারাজ ছিলেন তিনি। মিজোরামের ভৌগলিক অবস্থান এমনই যে রাজ্যটির বাংলাদেশের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার ও মায়নমারের সঙ্গে ৪০৪ কিলোমিটার (মোট ৭২২ কিলোমিটার) আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যখন এমএনএফ-এর সরকারকে বলছে যে, মায়ানমার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আবার সীমানার ওপারে শান্তিপূর্ণ ভাবে ফিরিয়ে দিতে হবে, তখন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা কেন্দ্র সরকারকে মুখের উপর বলে দিচ্ছেন এটা সম্ভব নয়। কেন্দ্র এই উদ্বাস্তুদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের জন্য চাপ দিলেও মিজো সরকার বলে দিয়েছে যে এতে জাতিদ্বন্দ্ব বাড়বে। মণিপুরেও কুকি জনজাতির সঙ্গে মেইতিদের সংঘর্ষেও কুকিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে মিজো সরকার। আশ্রয় দিয়েছে মণিপুর থেকে আসা উদ্বাস্তুদের। কারণ বৃহত্তর জো জাতির একাত্তিকরণের কথাই মিজোরামের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলি বলে আসছে বরাবর। মায়ানমার হোক বা মণিপুর — এই উদ্বাস্তুরা যে একই ছাতার তলায় আসে তা বার বার বুঝিয়েছেন মিজোরামের রাজনীতিকরা।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যগুলির মতো মিজোরামে বিজেপির প্রভাব বিস্তারের চাকা থমকে যায় মূলত দুটি কারণে — উদ্বাস্তু ইস্যুতে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান ও মণিপুরে জাতিদাঙ্গায় কুকিদের থেকেও মেইতি গোষ্ঠীর প্রতি সেখানকার বিজেপি সরকারের বেশি সহানুভূতি। খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিজোরামে এমনিতেই বিজেপি-কে নিয়ে সন্দিহান রাজ্যের জনগণ। তবু ২০২৩ সালেরই এপ্রিলে ৯৯টি গ্রাম পরিষদের নির্বাচনে ৪১টিতে জয়ী হয় বিজেপি। এমএনএফ সরকারে থেকেও পায় মাত্র ২৫টি গ্রাম পরিষদ, কংগ্রেস পায় ৮টি এবং জ়োরাম পিপলস মুভমেন্ট (জ়েডএমপি) জেতে মাত্র ১টিতে। মারা স্বায়ত্বশাসিত জেলা পরিষদে বিজেপির জয়কে অনেকেই ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। কিন্তু বছরের শেষে বিধানসভার ফলাফল বিজেপিকে হতাশ করে।
অন্যদিকে ২০১৮ সালে এমএনএফ-এর কাছে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া কংগ্রেস ভোটারদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছিল কোনও আঞ্চলিক দলকে জেতানো মানেই আসলে বিজেপিকে জেতানো। খ্রিস্টান-অধ্যুষিত মিজোরামে আঞ্চলিক দলের সেই জয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটিই ছিল রাহুল গান্ধীর দলের প্রচারের মূল সুর। তার কারণও ছিল। কারণ এমএনএফ-এর জোরামথাঙ্গা এনডিএ-র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বিজেপির নর্থ ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের শরিকও এমএনএফ। যদিও মিজোরাম বিধানসভার নির্বাচনে তারা বিজেপির সঙ্গে জোট করেনি। কিন্তু জোরামথাঙ্গার বিজেপির সঙ্গে সখ্য এমনই যে হেরে যাওয়ার পরেও এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে রাজি নন তিনি।
এই রাজনৈতিক দোলাচলের মাঝে জ়েডএমপি একটি নতুন ধরনের রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জিতেছে। একদিকে তারা কুকি ও চিন উদ্বাস্তুদের প্রতি সমর্থনের কথা বলেছে। ঠিক যেমন এমএনএফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আবার অন্য দিকে জোরামথাঙ্গা সরকারের দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছে তারা। তাদের লক্ষ্য রাজ্যের জনগণকে নগদ টাকা দেওয়ার বা আর্থিক সাহায্যের বন্দোবস্তকে পাল্টে দেওয়া। কারণ নির্বাচনী প্রচারে এটিই বার বার উঠে এসেছে যে এই নগদ টাকা দেওযার ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারি টাকা নিয়ে কীরকম দুর্নীতি হয় রাজ্যস্তরে। তাদের ইস্তাহারে জ়েডএমপি ভূমি সংস্কার করা, কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, পশুপালন, রেশম চাষে উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান, উদ্যানপালন বা কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের কথা বলেছে। সঙ্গে প্রশাসনিক সংস্কারের কথাও তারা ইস্তাহারে রেখেছে। যেমন, প্রতিটি গ্রামে গ্রামোন্নয়ন কমিটি গড়া হবে, ব্লক ও জেলা স্তরেও হবে এমন ধরনের উন্নয়ন কমিটি, মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি যাতে বিভিন্ন দফতরের কাজ নজরদারি করতে পারেন, তার জন্য সচেষ্ট হবে নতুন সরকার।
লালডুহোমার ফ্রন্ট কৃষকদের আদা, হলুদ, লঙ্কা ও ঝাঁটা তৈরির গাছের জন্য কৃষকদের কাছে কৃষিপণ্যের নূ্যনতম দাম বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছে। কৃষকদের থেকে সরাসরি পণ্য কেনার কথা ঘোষণা করেছে। কৃষি থেকে রাজ্যের অর্থনীতিকে এবার পর্যটন-নির্ভর করার কথা উঠে এসেছে নির্বাচনী প্রচারে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে লালডুহোমার উপস্থিতিতে অসমের স্টঞ্চ এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে মিজোরামের বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী সংস্থার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মিজোরাম থেকে তাঁরা ৫০০ মেট্রিক টন আদা ও ১০০ মেট্রিক টন লঙ্কা কিনবেন। নূ্যনতম দাম বেঁধে দেওয়া হবে ২০২৪-এর প্রথমেই।
কেরলের পরেই মিজোরামের সাক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি। এখানকার শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের জন্য কাজ ও উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো তৈরিতে তৎপর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লালডুহোমা। মিজোরামেই রয়েছে ভারতীয় জনসঞ্চার সংস্থানের উত্তর-পূর্বের একমাত্র আঞ্চলিক শাখা বা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের মতো জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এনআইটি-র অধ্যাপকদের সঙ্গে দেখা করে নতুন মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, এই সব সংস্থায় কোনও রকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।
লালডুহোমা রাজ্যের নবীন প্রজন্মের হাত ধরে, তাঁদের স্বপ্ন দেখিয়ে নতুন সরকার গড়েছেন। কিন্তু তাঁর দল জ়েডএমপি মূলত শহরাঞ্চলে ভাল ফল করেছে। উত্তর মিজোরামে অবস্থিত রাজধানী আইজল শহর থেকেই ১২টি আসনে জয়ী হয়েছে তারা। অন্যদিকে এমএনএফ এখনও গ্রামাঞ্চলে নিজেদের শক্তি ধরে রেখেছে। ১০টি আসন তাঁরা গ্রামাঞ্চল থেকেই জিতেছে। অবশ্য ভারতীয় রাজনীতিতে একটি রাজনৈতিক দল অনেক দিন ধরে ক্ষমতায় থাকলে পরিবর্তন শুরু হয় শহরাঞ্চল থেকেই। তার পরে সেই পরিবর্তনের ধারা গিয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে।
দায়িত্ব নিয়েই লালডুহোমা কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা চোখে পড়ার মতো। তিনি বলেছেন ২০২৪-এর এপ্রিলে পরবর্তী অর্থবর্ষ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে তিনি রাজ্যের অর্থনীতির হাল ফেরাবেন। ইতিমধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছেন যে এবার থেকে নতুন সরকার এলেই যে বিধায়কদের গাড়ি কেনার জন্য টাকা দেওয়া হয়, তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। মন্ত্রীদের সরকারি বাসভবন মেরামতের বা সাজানোর জন্য খুব দরকার না হলে টাকা দেওয়া হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির জন্য চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর সংখ্যা ছয় থেকে কমিয়ে তিন করা হয়েছে। মন্ত্রীরা এবার থেকে চারের জায়গায় দু'জন কর্মী পাবেন আর বিধায়কেরা দুইয়ের জায়গায় এক করে কর্মী পাবেন। এমনিতে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন রাজপ্রাসাদের মতো নয়। সেখানে সাধারণের অবারিত দ্বার। সামান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু সরকারের ব্যয়ভার লাঘব করতে পদক্ষেপ করতেই হচ্ছে লালডুহোমাকে। একেই মিজোরাম হচ্ছে দেশের মধ্যে অন্যতম গরীব রাজ্য। তাই আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এই ধরনের পদক্ষেপ করতেই হবে নতুন মুখ্যমন্ত্রীকে।
কিন্তু একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন থেকে যাচ্ছে। সত্যিই কি কংগ্রেসের দাবি ঠিক প্রমাণ করে লালডুহোমাও তাঁর পূর্বসূরীর মতো বিজেপির হাত ধরবেন? গেরুয়া শিবিরের খুব ইচ্ছে ছিল ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে তারা ছড়ি ঘোরাতে পারতেন সরকারে। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ে গেছে। মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি ২টি আসন জিতলেও (কংগ্রেস যেখানে ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১টি আসন পেয়েছে) লালডুহোমার জ়েডএমপি প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭টি আসন পেয়েছে (অন্য দিকে বিদায়ী শাসক দল এমএনপি পেয়েছে ৩৫ শতাংশ ভোট ও ১০টি আসন)। ইতিমধ্যেই বিজেপির বিধায়কদের সরকারে শামিল করার জন্য লালডুহোমার উপরে চাপ বাড়তে শুরু করেছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত সেই চাপ আটকে রাখা গেলেও, যদি বিজেপি আবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, তাহলে সেই চাপ কতটা সামলাতে পারবেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী?
সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জ়েএডএমপি-র সরকার চালাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু রাজ্যের রাজস্ব আদায় কম, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্যের উপর ভরসা করতে হয় উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিকে। কেন্দ্রের শাসক দলকে চটিয়ে, তাদের সরকারে না নিয়ে বা তাদের শরিক না হয়ে কি লালডুহোমা চলতে পারবেন?
ইতিমধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছেন যে জোরামথাঙ্গা সরকারের সব দুর্নীতির তদন্ত নতুন সরকার করবে। এমনকী সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার তুলে দিতে তাঁরা পিছপা হবে না। কিন্তু নাগরিক সমাজের বড় সমর্থন পেলেও, টাকা বড় হয়ে উঠবে না তো লালডুহোমার কাছে? কেন্দ্রের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার যে প্রবণতা উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে রয়েছে, তার পরিবর্তন কি ঘটাতে পারবেন লালডুহোমা? কড়া নজর থাকবে রাজনৈতিক মহলের এবং নাগরিক সমাজেরও।
(মূল প্রবন্ধটি নাগরিক.নেট ওয়েব পত্রিকায়)
প্রকাশিত হয়েছিল ৮ ডিসেম্বর ২০২৩)