সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
"তথ্য, যাহাকে ইংরেজিতে fact কহে, সত্য তদপেক্ষা অনেক ব্যাপক। এই তথ্যস্তুপ হইতে যুক্তি ও কল্পনা বলে সত্যকে উদ্ধার করিয়া লইতে হয়। অনেক সময় ইতিহাসের শুষ্ক ইন্ধনের ন্যায় রাশিকৃত তথ্য পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু সত্য কবির প্রতিভাবলে কাব্যেই উদ্ভাসিত হইয়া উঠে।" রবীন্দ্রনাথের কবিমন কাব্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ইতিহাস ও কাব্যের পার্থক্য যেন তিনি ‘ইতিহাসের সত্য’ ও ‘কাব্যের সত্য’ উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেন। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র সম্পর্কে যে উক্তি করেছেন সেখানে যেন ওপরের মন্তব্যটির প্রতিধ্বনি শুনি। মহাভারতের কৃষ্ণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - "মহাভারতে কবি বর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের প্রত্যেকটি তথ্য প্রকৃত না হইতে পারে, কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে তাহার প্রত্যেক বৃত্তান্তটি প্রামাণিক না হইতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য তিনি পাঠকের মনে মুদ্রিত করাইয়া দিয়েছেন তাহা সর্বাপেক্ষা মহামূল্য সত্য।" রবীন্দ্রনাথের সত্যতা-অনুসন্ধিৎসু মন ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছিল – "এক সময়ে রামায়ণ – মহাভারত ছিল ইতিহাস। এখনকার ইতিহাস তাহার সহিত কুটুম্বিতা স্বীকার করিতে অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়; বলে কাব্যের সহিত পরিণীত হইয়া উহার কুল নষ্ট হইয়াছে। এখন তাহার কুল উদ্ধার করা এতই কঠিন হইয়াছে যে, ইতিহাস তাহাকে কাব্য বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছা করে। কাব্য বলে ভাই ইতিহাস, তোমার মধ্যে অনেক মিথ্যা আছে, আমার মধ্যেও অনেক সত্য আছে, এসো আমরা পূর্বের মতো আপস করিয়া থাকি। ইতিহাস বলে না ভাই, পরস্পরের অংশ বাঁটোয়ারা করিয়া বুঝিয়া লওয়া ভালো, জ্ঞান- নামক আমিন সর্বত্রই সেই বাঁটোয়ারা কার্য আরম্ভ করিয়াছে। সত্য রাজ্য এবং কল্পরাজ্যের মধ্যে একটা পরিষ্কার রেখা টানিবার জন্য সে বদ্ধপরিকর।"
মহাকাব্য-পুরাণ-ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতে তাদের আন্তঃসম্পর্কের টানাপোড়েন মাথায় রেখে আমদের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। আবার রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিই। তাঁর ভাষায় "মহাকাব্য সংগ্রহ করিতে হয়, গঠিত করিতে হয়;…মহাকাব্য শিল্প, কেননা তাহা পরহৃদয়ের অনুসরণ মাত্র। এই নিমিত্ত আমরা বাল্মীকি, ব্যাস, হোমর, ভার্জিল প্রভৃতি প্রাচীনকালের কবিদিগের ন্যায় মহাকাব্য লিখিতে পারিব না; কেননা সেই প্রাচীনকালে লোকে সভ্যতার আচ্ছাদনে হৃদয় গোপন করিতে জানিত না, সুতরাং কবি হৃদয় প্রত্যক্ষ করিয়া সেই অনাবৃত হৃদয় সকল সহজেই চিত্রিত করিতে পারিতেন।"
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'এ ইতিহাস শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ‘ইতিহ+আস’ অর্থাৎ যা ছিল। যদিও হরিচরণ এর অর্থের মধ্যে যেমন ‘পুরাবৃত্ত’কে রেখেছেন তেমনি পুরাণ ইত্যাদিকেও রেখেছেন। আর ‘পুরাণ’ কথাটির অর্থ প্রাচীন কাহিনি। বেদোত্তর যুগে পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল, যাদের রচনাকাল আলাদা আলাদা। প্রাচীনতম পুরাণ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আগে লেখা নয়। বিষ্ণুপুরাণ প্রাচীনতম পুরাণের একটি। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভাগবত পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মের দিক থেকে বিচার করলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীন ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চায় পুরাণগুলির ভূমিকা রয়েছে। পন্ডিতদের মতে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনির মধ্যে দিয়ে বেদের দুরূহ অংশ ও গুঢ় দার্শনিক শিক্ষাকে সহজভাবে পরিবেশন করা ও জনপ্রিয় করে তোলা। সেই জন্যই হিন্দুধর্মকে পুরাণের মধ্যে বিকশিত হতে দেখি।
ইউরোপে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ইতিহাস বলতে বোঝাত উচ্চবর্গের মানুষদের গল্প ও তাঁর সঙ্গে ঐশ্বরিক নানা কাহিনি। সেখানের হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন ভাষায় প্রচলিত সুমের, ব্যাবিলন, মিশর থেকে আসা নানা ধরনের মিথ, লেজেন্ডের কাহিনির প্রাধান্য। ইউরোপে নবজাগরণের সময় থেকে ইতিহাসকে নতুনভাবে – অর্থাৎ যা ঘটেছিল সেই মত – নির্মোহ তন্ময় দৃষ্টিতে দেখার শুরু। আমাদের দেশেও উনিশ শতকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস চর্চা শুরু হলেও নানা কারণে তার অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল।
কাব্যের এক বিশেষ রূপ মহাকাব্য। তার আঙ্গিক, স্বরূপ,মহত্ত্ব, বিষয়বস্তু, ভাষা ও ছন্দের গাম্ভীর্য এবং ওজস্বিতা, গভীর ও বিচিত্র জীবনবোধ আর অসাধারণ রসানুভূতি ও অগাধ বিস্ময় – মহাকাব্যের চেহারাকে, চরিত্রকে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার রূপ ও রীতি থেকে আলাদা করেছে। মহাকাব্যের খুঁটিনাটি বিচারের পর সমালোচকেরা জানিয়েছেন যে তার মধ্যে বিরাটত্ব, মহত্ত্ব, বিশাল আয়তন বা ব্যাপ্তি, ভাষা ও ছন্দের গাম্ভীর্য, সময়কাজের/কর্মের ঐক্য, নাটকীয়তা বা উৎকণ্ঠা, দেবতার চেয়ে মানব মহিমার বলিষ্ঠতা প্রকাশ, সর্বজনীন জীবনবোধ, দেশের সর্বজনপ্রিয় গৌরবময় পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কাহিনি, সর্বজনগ্রাহ্য নায়কের মহত্ত্ব ইত্যাদি – এই লক্ষণগুলো নিয়ে মহাকাব্য কালজয়ী হয়।
আমাদের দেশের রামায়ণ, মহাভারত বা গ্রিসের ইলিয়াড, ওডিসি – এই চারটি মহাকাব্যকে মৌলিক মহাকাব্য বলে স্বীকার করেন সকলে। এদের আগে পৃথিবীতে আর কোন মহাকাব্যের খোঁজ পাওয়া যায় না। মহাকবি হোমারের কাল আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ৮ম শতক বা তার আগে আর বাল্মিকি ও ব্যাসের রচনা দুটি আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ৯ম – ১০ম শতকে। তাঁদের নিজস্ব কল্পনার রঙে রাঙিয়ে আপন সৃষ্টি হোমার, ব্যাস, বাল্মীকি হাজির করেছেন আদি মহাকাব্যের চেহারায়। তারাই এই কাব্যরীতির উদগাতা। অবশ্য ‘মহাকাব্য’ নামটি পরে এসছে অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের মারফৎ। বলা যেতে পারে, সেই সুপ্রাচীনকালে ভারতবর্ষে দুজন অসামান্য কবি তাঁদের ‘অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমা’ কবিত্বশক্তির জোরে যে দুটি কাব্য সৃষ্টি করেছিলেন আজও তা আপন প্রভাব নিয়ে বিরাজ করছে। গ্রিসের মহাকবি হোমারও তো এই অবদান রেখে গেছেন। যদিও ভারত ও গ্রিসের মহাকাব্যগুলোর অনেক পার্থক্যও রয়েছে।
প্রকৃতিতে যেমন ভাবে অযত্ন পালিত বনস্পতি তার সমগ্রতা, বিশালতা এবং আদিম পৃথিবীর সমস্ত রহস্য নিয়ে, তার ছায়া দিয়ে, ফল দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, পূর্ণ মহিমায় বিরাজ করে ‘আদি মহাকাব্য’ও সেইরকম মহাকবিদের মনের ভাবনার সরস উর্বর জমিতে অতি স্বাভাবিকভাবে জন্মায় ও বেঁচে থাকে। সেই সুপ্রাচীন যুগের মানুষের হৃদয়বৃত্তি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূর্ত দলিল হিসেবে তারা মানবজাতির অন্তরে যুগ যুগ ধরে অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে। প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার বাল্মীকি বা ব্যাস কেউই নিজেদের সৃষ্টিকে ‘মহাকাব্য’ বলেননি। বরং মহর্ষি দ্বৈপায়ন মহাভারতকে বর্ণনা করেছেন ‘পুরাণ’ বলে, যার অর্থ ‘পুরাকথিত উপাখ্যান’। পাশাপাশি মহাভারতকে ‘ইতিহাস’ বলে বর্ণনা করে এ কথাও বলা হয়েছে যে পৃথিবীতে আগেই কোনও কোনও কবি এই ইতিহাস বলে গেছেন, এখনও কেউ কেউ বলছেন, ভবিষ্যতেও অন্য কবিরা বলবেন। ভারতীয় ধ্যানধারণার বিশাল সংকলন বলা যেতে পারে মহাভারতকে।
ইলিয়াড, ওডিসিতে দেবতাদের অকারণ ষড়যন্ত্র ও মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ঈশ্বরের সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও সেখানে মূল বক্তব্য বাস্তব পৃথিবীর মানব মহিমা প্রচার। রামায়ণ, মহাভারতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনি বহুমাত্রিক ব্যাপ্তি নিয়ে তাঁদের মহিমময় করেছে, যাদের মধ্যে সাবলীলতা ও অকৃত্রিমতার দেখা পাওয়া গেলেও কাব্যের শিল্পগুণকে কোথাও কোথাও ক্ষুণ্ণ করেছে। সমালোচকদের অনেকের মতে আঙ্গিক ও চরিত্র বিচারে রামায়ণ, মহাভারত ‘ইতিহাস’ কিংবা ‘চরিত-কাব্য’ হয়েছে নায়কদের প্রায় গোটা জীবনকাহিনী বিবৃত করে। মহাভারতকে তো ‘প্রাচীন বিশ্বকোষ’ও বলেছেন কেউ কেউ। এবং তা মহাকাব্যের সীমানা পার হয়ে তার মহত্ত্ব আর বিশালতা নিয়ে অসামান্য প্রতিভাধর মহাকবির অসাধারণ কবিকর্ম হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে মহিমাময় স্থান করে নিয়েছে।
একথা অবশ্যই মানতে হবে, কোন দেশের/ সভ্যতায় মহাকাব্য লেখার পেছনে ছিল সেই দেশে লোকপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত দেশের/অঞ্চলের পুরাকাহিনি, লোককথা, কিংবদন্তী, সমকালীন গৌরবময় ঘটনা। এসবকে নিয়ে চারণ কবিরা যেসব গাথা বা কাহিনি রচনা করেছিলেন সেগুলিই পরবর্তীকালে আরও বড় প্রতিভার হাতে মহাকাব্যে রূপায়িত হয়েছিল। অর্থাৎ চারণ কবিদের কাছ থেকে পাওয়া উপকরণ মহাকবিদের অসামান্য প্রতিভায় মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিতে পরিণত হয়ে মহাকাব্য নামে এক শিল্পশাখার জন্ম দিয়েছিল। অর্থাৎ চারণ কবিদের গানে/ কবিতায় ছিল প্রকৃতির ভাণ্ডারে পাওয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু বা ঘটনার হুবহু বর্ণনা। কিন্তু সেখানে শিল্পসত্তার পরিচয় কম থাকত। মহাকাব্য নামের শিল্পরূপের প্রচলন হওয়ার পরে মহাকবির শিল্পীসত্তা তার সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে তাতে প্রাণসঞ্চার করেছিল। সেই সুদূর অতীতের মানুষের জীবনচর্চা, চিন্তাভাবনা ও সংস্কৃতিকে শিল্পরূপ দিয়ে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করার প্রথম চেষ্টা দেশে দেশে অজানা অচেনা চারণ কবিরাই করেছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন প্রাচীন মানব সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পৃথিবীর নানা দেশেই চারণকবিরা সমসময়ের সমাজে অত্যন্ত সম্মানজনক স্থানে ছিলেন।
সে সময় লেখ্য ভাষা আসেনি। স্মৃতিতে ধরে রাখতেন মানবসমাজের নানা অভিজ্ঞতাকে, চলমান ইতিহাস হয়ে পথে পথে গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি মহৎ কল্পনায়ও উদ্দীপ্ত করতেন। শুধু কাহিনি নয়, কাহিনি বর্ণনার উপযুক্ত ভাষা ও ছন্দের স্রষ্টা এই চারণরা যেমন ছিলেন সুশিক্ষিত, তেমনি ছিলেন কবিতা রচনায় দক্ষ। আদিম মানবসমাজ বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক পরিবারে তাদের প্রতিপত্তি ছিল, খ্যাতি ছিল। রাজা বা সামন্তদের সভায় তাঁরা যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা পেতেন। হোমার সম্ভবতঃ নিজে ছিলেন চারণ কবি। প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও চারণ, ভাট বা কথকরা যে বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিলেন তা রামায়ণ, মহাভারত বা হোমারের মহাকাব্যে বলা হয়েছে।
পৃথিবীর আর্য-জনগোষ্ঠীর দেশগুলিতে প্রাচীন চারণকবিদের উদ্ভব। আর সে কারণেই ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে মহাকাব্যের জন্ম হয়েছিল। একমাত্র ‘গিলমগামেস’ সুমের-আক্কাদ ভাষায় রচিত। চারণ কবিদের রচিত সুপ্রাচীন বীরগাথা বা গুরুত্বপূর্ণ গৌরবময় কাহিনির সঙ্গে মহাকাব্য রচনার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ চারণদের রচিত গাথা, কাহিনি, পুরাণ মিথগুলোই ভবিষ্যতের মহাকাব্য রচনার প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে। আর এই কারণে আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই চারণ কবিদের পরে মহাকবিদের আবির্ভাব হয়েছিল। আর্যরা তাদের যুদ্ধের বিজয়কাহিনি, বীরপুরুষদের শৌর্যবীর্যের কাহিনি বা গোষ্ঠীপতিদের বংশমর্যাদা, কীর্তিকাহিনি, জাতীয় গৌরব ও ঐতিহ্য নিয়ে চারণ কবিদের দিয়ে গান রচনা করে দেশে দেশে প্রচার করাত। এ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে গান/ কবিতা রচনা করে চারণেরা রাজদরবারে বিশেষ সম্মানের অধিকারী হতেন। ইলিয়াড, অডিসি, রামায়ণ, মহাভারতে এসবের বর্ণনা রয়েছে। ফ্রান্সের জনপ্রিয় গীতিকবি ত্রুবাদুরেরা ছিলেন চারণ কবিদের সমগোত্রীয়। ত্রুবাদুরদের প্রভাব পড়েছিল দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’তে। ভারতের প্রাচীন সমাজে চারণদের পাশাপাশি ছিলেন ভাট বা কথকেরা।
আর্যদের ছিল গভীর ঐতিহ্যবোধ এবং নিজেদের কীর্তিকে সংরক্ষণ ও প্রসারিত করার মানসিকতা। পাশাপাশি লাতিন, গ্রিক, সংস্কৃত ও পারস্য ঐশ্বর্য, শব্দভাণ্ডার, অন্তর্নিহিত শক্তি, প্রকাশ ক্ষমতা, শ্রুতিমধুরতা ও ঔদার্য যা শিল্পপ্রকাশ ও দার্শনিক চিন্তার পক্ষে উপযোগী ছিল।
মহাকাব্যের উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায়, দেশ বা জাতির জীবনের চরম সংকটময় কাল কেটে যাওয়ার পরে শান্তি ও স্থিতির সময়ে বিপন্ন জাতি বা মানবগোষ্ঠী তাদের দুঃখময় অভিজ্ঞতার নিরিখে সংকটের কারণ ও তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় খোঁজে দেশের পুরাণ, ইতিবৃত্ত, লোককথা, জনশ্রুতির কিংবা সমাজের মহান ব্যক্তির জীবনের মধ্যে। তারই সাহিত্যিক রূপ প্রতিফলিত হয় মহাকাব্যের মধ্যে। বৈদিক যুগের শেষ দিকের কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধের কাহিনি অবলম্বন করে ব্যাস রচনা করেছিলেন মহাভারত। বাল্মীকিও আর্য-অনার্য সংঘাত, রামের বিজয়গৌরব ব্যক্ত করতে রচনা করেছিলেন রামায়ণ। বাল্মীকি ও ব্যাস রাষ্ট্র ও সমাজের চরম বিপর্যয়ের কালে বিপন্ন জাতির মনে নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করে জাতিসত্তার পুনরুজ্জীবনের জন্য এবং সংকটের কালে দেশের ধর্মসংস্কৃতি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশের পুরাবৃত্ত, পুরাণকথা, লোকগাথা, কিংবদন্তী ও সুদীর্ঘকাল ধরে অর্জিত বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সংগ্রথিত করে দুই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। দুই রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ নামে বিস্তৃত ভূখণ্ডের অসংখ্য জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা ঐতিহ্যের মানুষের মধ্যে জাতিগত ঐক্যচেতনা গড়ে তোলা। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদের ঋষিকবি বলেছিলেন – "তোমাদের ইচ্ছা এক হোক, অন্তঃকরণ এক হোক, মন এক হোক, তোমরা যেন সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে এক মত হও।" ঋষিকন্ঠে উচ্চারিত এই মন্ত্রের নির্যাস রামায়ণ, মহাভারত। মহাকাব্য দুটিতে মহাকবিদের এই ঐক্যের উদার আহ্বানই শত বিভেদ বিদ্বেষ সত্ত্বেও আজও আমাদের ভারতবর্ষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের এক দেশ ভারতবর্ষ। এক ধর্ম মানবধর্ম। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে নতুন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই সুপ্রাচীন, সুমহান আহ্বানকে।
বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির সব সৌন্দর্য, আনন্দ, রহস্য, মানব অনুভূতির সব সূক্ষ্ম বিচিত্র কলতান, বিঘ্ন ও সংঘর্ষের মধ্যেও প্রশান্তির ছোঁয়া রামায়ণকে অসাধারণ এক মহাকাব্যরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে যার স্রষ্টা বাল্মীকি প্রকৃত অর্থেই একজন কবি যিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে আপন ভাবনাচিন্তা, জ্ঞানমননের সীমানা পার হয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্যলোকে পৌঁছেছেন। বাল্মীকির অসামান্য কবিপ্রতিভায় কবিতার মায়াময় জগৎ তার সব রহস্য, আনন্দ, বিস্ময় ও সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিয়েছে অনুষ্টুপ ছন্দে বর্ণিত রামায়ণে। রামায়ণে ব্যক্ত প্রাচীনকালের আদিম সরলতা, লাবণ্য আমাদের মুগ্ধ করে। অন্যদিকে মহাভারতে আছে অশান্ত ও দ্বন্দ্বময় নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, দীর্ঘশ্বাস। এই ক্লান্তি, দীর্ঘশ্বাস প্রশমিত করাও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় মানসিক প্রশান্তির খোঁজে ত্যাগ, ভক্তি, ও নিষ্কাম কর্মের ব্যাখ্যা। মহাভারতের সমাজ সার্বিক অবক্ষয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে রামায়ণের জগৎ শান্ত, আত্মমগ্নতায় ভরা তপোবন কেন্দ্রিক। দুই মহাকাব্যের জীবনবোধ ও জীবনচর্চার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এখানেই এদের পার্থক্য বোঝা যায়।
‘সাহিত্যসৃষ্টি’ ও ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ প্রবন্ধে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন রামায়ণ কাহিনির উৎস ও বিবর্তন ধারার মধ্যে ভারতবর্ষের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস কীভাবে ছায়াপাত করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় রামায়ণ কাহিনির মূলে রয়েছে প্রাচীন আর্য ইতিহাসের তিনটি বড় ঘটনা। আর্যরা প্রথমে ছিল প্রধানত মৃগয়াজীবী ও গোধন নির্ভর। আর্যদের রাজ্যবিস্তার ও প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজারা ক্রমে ক্রমে কৃষিনির্ভর হয়ে ওঠে। রাজ্যবিস্তার ও কৃষিবিস্তারের ফলেই আর্য-অনার্য সংঘাত শুরু হয়। অনার্যরা ছিল রাক্ষসজাতীয়। কৃষিবিস্তারের কারণে আর্য অনার্যদের যে সংঘাত, সেটিই হল রামায়ণের অন্যতম মূল কথা। রামায়ণের রূপকার্থে প্রকৃত তাৎপর্য এটিই। সীতা, রাম ও লক্ষণ কৃষি সভ্যতার প্রতীক যাদের প্রবর্তক ও সহায় হলেন বিশ্বামিত্র ও জনক। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বামিত্রের উদ্যোগে রাম সীতার মিলন, পাষাণী অহল্যার উদ্ধার ও রাক্ষসের সঙ্গে সংঘাতের শুরু। কৃষির বিস্তারে বিরোধী রাক্ষসশক্তিকে পরাস্ত করা রামায়ণের বড় ঘটনা। আর্যরা প্রথমে পূর্বভারতে ও দক্ষিণভারতে অনার্যদের প্রতিহত করে কৃষিনির্ভর নতুন সভ্যতার প্রসার ঘটায়। আর্য-অনার্য সংঘাতের মূলে শুধু সভ্যতা নয়, ধর্মেরও বিরোধ ছিল। অনার্যরা, যাদের রাক্ষস নামে অভিহিত করা হত, তারা ছিল শিবের উপাসক। তাদের শৈবশক্তির প্রতীক ছিল হরধনু। হরধনু ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, রামচন্দ্র আর্য সভ্যতার প্রতিনিধি। তিনি অনার্য/ রাক্ষসদের পরাস্ত করতে পারবেন। আর্য-অনার্য দ্বন্দ্বে আর্যরাই জয়ী হয়। নিজেদের কৃষিসভ্যতাকে আর্যরা অনার্যদের হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি শৈবধর্মের ওপর আর্যধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীকালে আর্য-অনার্য সংঘাতের শেষে ধর্ম ও সভ্যতার মধ্যে অনেক সমন্বয় হয়েছিল। ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়দের বিরোধও আদি রামায়ণ কাহিনিতে আছে। এখানে বৃত্তিগত স্বার্থের বিষয়টি যেমন ছিল , তেমনি ধর্মগত মতভেদও ছিল। ব্রাহ্মণরা চেয়েছিল বেদানুসারী কাজে ব্রহ্মার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ক্ষত্রিয়দের কাছে মান্য ছিল বিষ্ণু, যিনি বিশ্বের পালনকর্তা। রামকাহিনির মূলেও এই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বিরোধ ছিল যা ক্ষত্রিয়দের ঘরের ঝগড়া হয়ে গেল। সেই ঝগড়ার কারণেই দশরথ অনিচ্ছা সত্বেও রামকে বনবাসে পাঠাতে বাধ্য হলেন।
বোঝাই যাচ্ছে শুধু “…দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন, পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ দিবেন।।…এখানে এইটুকুই সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নর-চরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেব চরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত – সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত ।” ( ‘রামায়ণ’ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )।
মহাভারত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন পঞ্চনদের তীরে প্রাচীন আর্যজাতির নানা শাখা – ভরত ,কুরু, পুরু ,পাঞ্চাল , তুর্বসু , যদু , অনু , দ্রুহ্য – খ্রীস্টপূর্ব চতুর্দশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ গঙ্গা যমুনার দোয়ার অঞ্চলে নানা শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সময়ে সংঘটিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধই মহাভারতের কাহিনি। খ্রীস্টপূর্ব দশম শতাব্দী নাগাদ সময়ে কুরু ও পাঞ্চালের মধ্যে এই ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’ হয়েছিল বলেই পণ্ডিতদের অনুমান। পূর্বদিকে কুরুবংশীয়রা এগোতে থাকে এবং খ্রীস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে দশম শতকের মধ্যে কোশল, বিদেহ, কাশীরাজ্য প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। তাদের কেন্দ্র ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ, হস্তিনাপুর নিয়ে যমুনার দোয়াব অঞ্চলে যেসব আর্য উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল সেগুলি।
অযোধ্যার ইক্ষাকু বংশের রাজা ও তাঁর পুত্রদের কাহিনি এবং দক্ষিণ ভারতের দিকে আর্যদের রাজ্যবিস্তারের ইতিহাসকে কল্পনায় রাঙিয়ে বাল্মীকি রামায়ণ মহাকাব্য লিখেছিলেন। সেখানে কবির ‘মনোভূমি’ই হল রামের ‘জনমস্থান’। সে কারণে পুরাকাহিনির রামের চেয়ে বাল্মিকির কল্পনার রাম অনেক বড় সত্য হয়ে উঠে চিরকালীন মানবকল্পনাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। সমকালীন ঘটনাবলীর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে নিয়ে সেসময় চারণকবিদের রচিত গান ইত্যাদিই রামায়ণ মহাভারতের প্রধান অবলম্বন। রবীন্দ্রনাথের কথায় –“ রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে তাহা পরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে । পিতা-পুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায় , স্বামী-স্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন , যে প্রীতি- ভক্তির সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে।"
রামায়ণকে বাস্তব সম্পৃক্ত ‘মিথ’ বলে মন্তব্য করে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন – “…রামায়ণ শতশত বৎসর ধরে আমাদের অগণিত জনসাধারণের সামনে মানবিক ব্যাবহারের, ধ্যানধারণার আদর্শ উপস্থাপিত করে তাদের রক্ষন এবং পোষণ করে আসছে। এমনভাবেই রক্ষা করে আসছে যে গত দুশো বছরের পাশ্চাত্য শিক্ষার ধাক্কাতেও ভারত তার সেই পুরনো আদর্শ, ধ্যানধারণার ঐতিহ্য থেকে সরে যায়নি। রামায়ণকে আজও লোকে আদর্শ মনে করে – মিথের এমনই শক্তি। ভারতীয় জীবন এবং সভ্যতার এত বড় ঘটনাটিকে উপেক্ষা করা যায় । …হয়তো এমন দিন আসবে আমাদের ওপর রামায়ণের প্রভাব আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু তখনও ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে লিখে রাখতে হবে আমাদের জীবন ও সমাজে রামায়ণের ভূমিকা কতদূর বিস্তৃত ছিল। নাহলে সেটা হবে অসম্পূর্ণ ইতিহাস।" মহাভারত সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়।
ভারত সংস্কৃতির ইতিহাসে বেদের স্থান অনেক উঁচুতে। বেদের আরেক নাম শ্রুতি, তা মৌখিক সাহিত্য (যেহেতু সেসময়ে লিপির আবিষ্কার হয়নি)। বেদ কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। দেবতা বা ঈশ্বরের কথা থাকলেও তাকে কোনভাবেই ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ বলা যাবে না। আবার বেদ ইতিহাস বা বিজ্ঞান বা ভূগোলের বইও নয়। মানবজাতির কাব্যসাহিত্যের আদিমতম নিদর্শন ঋকবেদ এর মধ্যে দেবতার স্তব করে যে সমস্ত সূক্ত বা কবিতা রয়েছে তার সবগুলোই নানা প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি প্রাচীন বৈদিক লোকবিদের ভাবোচ্ছাস প্লাবিত সহজ সরল প্রশস্তি গীতি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ঋকবেদের মানবিক ও জাগতিক সাহিত্য বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন – “বেদের নাম শুনলেই আমাদের দেশে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই মনে ভয়-ভক্তি সম্বলিত কেমন একটা প্রকাণ্ড ভাবের উদয় হয়। বেদ যে পড়ল, সে একজন ক্ষণ জন্মা পুরুষ – যে বেদ ব্যাখ্যা করল, সে শঙ্কর বা নারায়ণের অবতার। …যে বেদ পড়ল সে মন্ত্রবলে অসাধ্য সাধন করতে পারে। …কিন্ত বাস্তবিক বেদ কী জিনিস? ভিন্ন ভিন্ন কালের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন কারণে ভিন্ন ভিন্ন মহাকবি প্রণীত কতগুলি গান কবিতা ইত্যাদির সংগ্রহমাত্র।" (‘বেদ ও বেদ ব্যাখ্যা’)। অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখেরা এমন মতই পোষণ করেছেন।
হরপ্রসাদ এরপর বলেছেন আজ থেকে প্রায় তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার বৈদিক যুগের মানুষেরা অত্যন্ত সরল দৃষ্টি নিয়ে যে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে দেবতা কল্পনা করে কবিতা রচনা করেছিল, পরবর্তীকালে কীভাবে সেই দেবতাদেরই বেদরচয়িতার পদে বসিয়ে বেদকে ধর্মগ্রন্থে পরিণত করে। “পরে কবির নাম লোপ পেতে লাগল, কবি দেখলেন মাত্র। এইজন্য মাধবাচার্য লিখলেন, যিনি মন্ত্র দেখলেন তিনিই ঋষি। ঋষ ধাতুর অর্থ দর্শন। এই জন্যই কালিদাসের ‘মন্ত্রকৃতাং’ লেখা দেখে ভবভূতি যেন চটে উঠেই লিখলেন ‘মন্ত্রকৃতাং নয়, মন্ত্রদৃশাং। ঋষিরা মন্ত্র করেননি। দেখেছেন মাত্র। বেদের রচয়িতা দেবতা হলেন। শেষে যখন দেবতা ঘুচে গিয়ে একমাবেদ্বিতীয়ং ব্রহ্মা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান মত হয়ে দাঁড়াল, দেবতার বেদ প্রণেতৃত্ব ঈশ্বরে অর্পিত হল। ঈশ্বর নিত্য, বেদও নিত্য হয়ে দাঁড়াল। বেদ ঈশ্বরের বাক্য। ওতে কোনো মিথ্যা নেই; ওটা সত্যময়, ধর্মময়, জ্ঞানময়; এইভাবে কতগুলি গান ধর্মপুস্তক রূপে পরিণত হল ।" (‘বেদ ও বেদ ব্যাখ্যা’)।
ইতিহাস ও পুরাণের মধ্যেকার সূক্ষ্ম পার্থক্যটিকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে, “গল্পগুলি যে ধর্মেরই হোক না কেন, তা প্রকৃতপক্ষে পুরাণ পর্যায়ভুক্ত। যদিও কখনও কখনও ওইগুলির মধ্যে একটু আধটু ঐতিহাসিক সত্য থাকতে পারে”। তিনি এই বিষয়ে আরও বলেছিলেন, পুরাতন পৌরাণিক ব্যাপারগুলিকে রূপকের আকারে চিরস্থায়ী করবার চেষ্টা করলে এবং তাদের নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে কুসংস্কারের উৎপত্তি হয়, আর এটা বাস্তবিকই দুর্বলতা। সত্যের সঙ্গে যেন কোন কিছু আপস না করা হয়। সত্যের উপদেশ দাও, আর কোন প্রকার কুসংস্কারের দোহাই দিতে চেষ্টা কোরো না। অথবা সত্যকে শিক্ষার্থীর ধারণাশক্তির উপযোগী করবার জন্য নামিয়ে এনো না।" একজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিবেকানন্দ বলেছিলেন – “কিছু না কিছু ঐতিহাসিক সত্য সকল পুরাণেরই মূল ভিত্তি। পুরাণের উদ্দেশ্য নানাভাবে পরম সত্য সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া। আর যদিও সেগুলিতে কিছুমাত্র ঐতিহাসিক সত্য না থাকে, তথাপি ওরা যে উচ্চতম সত্যের উপদেশ দিয়ে থাকে, সেই হিসেবে আমাদের কাছে খুব উচ্চ প্রামাণ্য গ্রন্থ। দৃষ্টান্ত স্বরূপ রামায়ণের কথা ধরুন – অলঙ্ঘনীয় প্রামাণ্য গ্রন্থরূপ ওটিকে মানতে হলেই যে রামের মতো কেউ কখনো যথার্থ ছিলেন স্বীকার করতে হবে তা নয়।…রামায়ণে বর্ণিত দশমুখ রাবণের অস্তিত্ব – একটা দশমাথা যুক্ত রাক্ষস অবশ্যই ছিল মানতেই হবে – এমন কী কথা আছে?”
মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র সম্পর্কেও বিবেকানন্দের বক্তব্য ছিল আধুনিক ইতিহাসবেত্তাদের ভাবনার প্রায় কাছাকাছি। তাঁর মতে, “ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবলমাত্র বুদ্ধ এবং মহম্মদই স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্তারূপে দণ্ডায়মান, কারণ সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা জীবদ্দশাতেই শত্রু-মিত্র দুইই লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে…”। অন্যত্র তিনি বলেছিলেন - “আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তো সকলের চেয়ে বেশি অস্পষ্ট। কবি, রাখাল, শক্তিশালী শাসক, যোদ্ধা এবং ঋষি, হয়তো এইসব ভাবনাগুলি একত্র করে এক সুন্দর মূর্তিতে পরিণত করা হয়েছিল।" দুটো জিনিষ এখানে স্পষ্ট – এক বাস্তব ইতিহাসের ঘটনাবলী হিসাবে রামায়ণ মহাভারত বা বেদ পুরাণকে কোনভাবেই গণ্য করা চলে না। রামচন্দ্র বা কৃষ্ণ কেউই বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র নয়।
‘রামকথার প্রাক-ইতিহাস’ প্রবন্ধে ডঃ সুকুমার সেন লিখেছেন – “ইতিহাসনিষ্ঠের ও ধর্মবিশ্বাসীর যাত্রাপথ ভিন্নমুখী। ইতিহাসের পথে এগোতে হলে তথ্যের পাথেয় চাই। যুক্তির যষ্ঠি অবলম্বন চাই।…ধর্মের পথে ধাবমান হলে চাই শুধু সুদৃঢ় বিশ্বাস। ইতিহাসের সিদ্ধান্ত প্রমাণ নির্ভর, আর সে প্রমাণ স্বাধীন, অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবনার ও ধারণার বাইরে থেকে পাওয়া; তা গুরুমুখ নিঃসৃত মন্ত্রের মতো অথবা শাস্ত্র বা বাক্যের মতো স্বতঃপ্রমাণ নয়া ইতিহাসের প্রতিষ্ঠা তথ্যের এবং যুক্তির উপর, ধর্মের প্রতিষ্ঠা বিশ্বাস এবং আচরণ নিষ্ঠার উপর। ইতিহাসের প্রাণ প্রমাণের মধ্যে। ধর্মের প্রাণ প্রমাণের বাইরে।"
রামায়ণ, মহাভারত ইতিহাসের বিবরণ না হলেও দুই মহাকাব্যের বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়কালের সমকালীন সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটেছে এই দুই মহাকাব্যে। দুই মহাকাব্যে বর্ণিত বস্তুগত সংস্কৃতি ও বাস্তবক্ষেত্রে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের থেকে বোঝা যায় যে দুই মহাকাব্যের আদি রূপের সূচনা ৮০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ এবং সর্বশেষ চেহারা বিকশিত হয়েছে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক নাগাদ। ফলে ভাষার দিক থেকেও ব্যাপক স্তর পার্থক্য দেখা গেছে। ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার মতে শুরুতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটিকে নিয়ে যে গাথা কাব্যটি রচিত হয়েছিল তার নাম ছিল ‘জয়’, ৮৮০০ শ্লোকের। মগধ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সময় এটি সম্প্রসারিত হয়ে ‘ভারত’ নাম নেয় এবং শ্লোকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪০০০। আর গুপ্তযুগে এটি এক লক্ষ শ্লোকের বিশাল কাব্য ‘মহাভারত’ হয়ে ওঠে। এই সময় পর্বে এই কাব্যশরীরে অনেক কৃত্রিম সংযোজন হয়েছে। যেমন ‘শ্রীমদভাগবত গীতা’ নামের অংশটি। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে ডি ডি কোসাম্বী, জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখ মানুষেরা সকলেই বলেছেন গীতার কাহিনী বা উপস্থাপনা মহাভারতের বাকি অংশের সাথে মোটেই মেলে না। বিবেকানন্দ ‘গীতাতত্ত্ব’এ প্রশ্ন তুলেছেন যে গীতা সত্যই মহাভারতের অংশ কিনা? বিবেকানন্দ বলেছেন – “অনেকে এরকম অনুমান করেন যে গীতা শঙ্করাচার্য প্রণীত। তাঁদের মতে তিনি ওটি প্রণয়ন করে মহাভারতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন।" তিনি আরও বলেছেন – “শঙ্করাচার্য ভাষ্য রচনা করবার আগে গীতা গ্রন্থটি সর্বসাধারণে ততদূর পরিচিত ছিল না।"
রামায়ণও শুরুতে ছিল ছয় কাণ্ড। অনেক পরে উত্তরকাণ্ড যোগ করে দাঁড়ায় সপ্তকাণ্ড রামায়ণ। শুরুতে শ্লোক সংখ্যা ছিল ৬০০। মধ্যবর্তী সময়ে দাঁড়াল ১২০০০। অবশেষে গুপ্ত আমলে শ্লোকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৪০০০। উত্তরকাণ্ড সংযোজনের পিছনে ব্রাহ্মণ্যবাদের সুনিশ্চিত প্রভাব ছিল। যুগে যুগে অঞ্চলভেদে এদের আলাদা আলাদা পাঠও দেখা যায়।
মহাকাব্যের মধ্যে একটি জাতির অতীতের গৌরব ধরা থাকে। তবু তা কবির কল্পনার ফসল। সৃষ্টির গুণে তা কালজয়ী হয়েছে। বাল্মীকি ও ব্যাস ভারতীয় জীবনাদর্শের নিরিখে খণ্ডিত জীবনের গ্লানি ও সংকীর্ণতাকে ফোটানোর সাথে সাথে পরিপূর্ণ অখন্ড জীবনের মহিমার সামঞ্জস্য বিধান করেছেন। তুলে ধরেছেন সদর্থক জীবনের ছবি। পাশাপাশি দুই কাব্যে নিহিত ট্র্যাজিক রসের গভীর, হৃদয়গ্রাহী আবেদন একে এত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অপরিহার্য উপাদান রামায়ণ, মহাভারত। সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, অভিনয় শিল্পে এবং অসংখ্য প্রবাদ প্রবচনের মধ্যে দুই মহাকাব্য আজও জীবন্ত হয়ে রয়েছে। ভারতীয় সমাজ জীবনে এদের প্রভাব আজও সব ধর্মকে অতিক্রম করে মানব সম্পর্ককে তুলে ধরে রেখেছে। এই উপলব্ধি সত্ত্বেও অমর্ত্য সেনের প্রবাদ প্রতিম উক্তিটি স্মরণ করতেই হবে – “আমাদের অতীতকে বাদ দিয়ে আমরা বাঁচতে পারি না একথা ঠিক; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের অতীতের মধ্যেই বাঁচতে হবে।“ (‘ভারতের অতীত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে’)। আজকের এদেশীয় বাস্তবে কথাটি ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
সহায়ক গ্রন্থঃ-
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ‘রামায়ণ’ প্রবন্ধ, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস ধারা’
২. রাজশেখর বসু – ‘বাল্মীকি রামায়ণ’ সারানুবাদ
৩. রাজশেখর বসু - ‘মহাভারত’ সারানুবাদ
৪. স্বামী বিবেকানন্দ – ‘দেববাণী’, ‘গীতাতত্ত্ব’, স্বামীজির সহিত মাদুবায় একঘন্টা’, ‘স্বামীজির সহিত হিমালয়ে’
৫. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – ‘বেদ ও বেদ ব্যাখ্যা’
৬. সুকুমার সেন – ‘রামকথার প্রাক্ইতিহাস’
৭. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ ১ম খণ্ড
৮. রামশরণ শর্মা – ‘আর্যদের ভারতে আগমন’, ‘প্রাচীন ভারতে বস্তুগত সংস্কৃতি ও সমাজ গঠন’
৯. সুকুমারী ভট্টচার্য – ‘প্রাচীন ভারত’, ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’
১০. সুধীরকুমার করণ – ‘রামায়ণের বিশ্বায়ন’
১১. বীরেশ্বর মিত্র – ‘বিশ্ব মহাকাব্য প্রসঙ্গ’
১২. জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভাগবত-গীতা’
১৩. কোরক সংকলন – রামায়ণ চর্চাঃ ভারতে ও বহির্ভারতে
১৪. ‘জীবনানন্দ’ ক্রমিক সংখ্যা ২৪ – রামায়ণ সংখ্যা