সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
৯ এপ্রিল ২০২৩-এ শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক নোয়ামচমস্কি, আল জাজিরা (টেলিভিশন নেটওয়ার্ক)-য় দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিন, ইসরায়েল এইসব অঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সমাজের পাপ, তাঁর জীবন পরিক্রমার স্মৃতিচিহ্ন এবং তিনি যা বলতে চান সে সম্পর্কে তার মতামত বিনিময় করেছিলেন।
কথায় কথায়, আলোচনায় এসেছে তাঁর নিজের কেরিয়ার ও অবস্থান। এসেছে অতীতে অনেককিছু গ্রহণ করতে না পারার আত্মসমালোচনা।
আল জাজিরা: আপনি নবী আমোস১ কে আপনার প্রিয় বলে অভিহিত করেছেন। নবী, ‘তিনটি পাপের কথা বলেছেন যা ক্ষমাযোগ্য এবং চতুর্থটি কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না’। আপনি সমাজে কী কী পাপ জমা হতে দেখছেন?
চমস্কি: এখন এইসব আলোচনায় যাওয়ার মতো যথেষ্ট সময় আমাদের নেই। আসুন সুস্পষ্ট কথা দিয়ে শুরু করা যাক। আপনি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের বুলেটিনের ‘ডুমসডে ক্লক’২-এর সঙ্গে নিশ্চিতভাবে পরিচিত। এটা এখন এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে মধ্যরাতের আর মাত্র ৯০ সেকেন্ড বাকি থাকতে থামিয়ে রাখা আছে।
মধ্যরাতে পৌঁছে গেলে পর, পৃথিবীতে মানুষের অভিজ্ঞতার সমাপ্তি। সময়কাল ক্রমাগত পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির দিকে ছুটছে। বাড়ছে আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয়ের হুমকি - ইসরায়েল তার অন্যতম প্রধান শিকার।
আর আমাদের নেতারা! তাদের সবচেয়ে বড় পাপ হ’ল তারা জেনেশুনে বিপর্যয়ের দিকেই ছুটছে! আমরা এখন ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ২০’তম বার্ষিকী উদযাপন করছি... স্মরণ করা হচ্ছে শতাব্দীর জঘন্যতম এক অপরাধ! মার্কিন নৌবাহিনী সাম্প্রতিককালে তাদের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক জাহাজ - ইউএসএস ফালুজাহ্ - চালু করেছে। মার্কিন আক্রমণের অন্যতম ভয়াবহ নৃশংসতা স্মরণ করা হচ্ছে। ফালুজাহ্ ছিল... এক সুন্দর শহর। আমেরিকান মেরিনরা এই সুন্দর শহরটি ধ্বংস করে, সেই সময় হত্যা করেছিল হাজার হাজার মানুষ... ফসফরাস, ক্ষয়প্রাপ্ত ইউরেনিয়াম যুক্ত অস্ত্রাদি ব্যবহৃত হওয়ায় সেখানে মানুষ আজও মারা যাচ্ছে।৩
যুদ্ধযানের এমত নামকরণ প্রতীকী হলেও, নৃশংসতার চেয়েও বেশি। বিগত ২০ বছরের দিকে তাকান, দেখুন আপনি মূলধারার কোথাও এমন একটি কাছাকাছি বাক্য খুঁজে পাবেন না, যেখানে বলা হয়েছে, আমেরিকার ইরাক আক্রমণ একটি অপরাধ ছিল - বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। খারাপ সমালোচনা আপনি পাবেন, বড়জোর বলা হয়েছে, এটি 'ভুল'। ইরাকি মানুষজনকে এক অশুভ স্বৈরশাসকের হাত থেকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসাবে এটিকে আবার নিয়ে আসা হয়েছে। উদার ভাষ্যকার দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, যুদ্ধ কেন শুরু হয়েছিল তার কোনো উল্লেখই নেই।
সাদ্দাম হুসেন যখন ইরাকিদের ওপর বিষ প্রয়োগ বা হালাবজা গণহত্যা৪ বা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার অথবা লক্ষ লক্ষ ইরানিকে হত্যা করার মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংঘটিত করছিল, সেসময়ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাদ্দামকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিল। এমনকি় আনন্দেও মেতে উঠেছিল। এই সত্যটুকু আজ উপেক্ষিত।
ইতিহাস নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, আমেরিকা যে ব্যক্তিকে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল তার কাছ থেকেই আবার 'ইরাকিদের বাঁচানোর' চেষ্টা করেছে। ১৯৯০-এর দশকে ইরাকিরা তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে উদ্ধারের জন্যে তেমনভাবে সোচ্চার হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল জঘন্য এবং হিংসাত্মক। ইরাকের নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা পর্যন্ত পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তাদের বিবেচনায় এটা ছিল গণহত্যা। অথচ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাষ্ট্রের অপরাধ লঘু করে ইতিহাস বদলে দিতে সক্ষম হলেন। রাষ্ট্রের পরিধির চারপাশে এমন বহু লোক আছেন যারা এই নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন না, কেননা তারা প্রান্তিক। ইউএসএস ফালুজা সম্পর্কে জানতে চান? আপনি আমেরিকান সংবাদপত্রে এটি পাবেন না। সমালোচনামূলক লেখায় পাবেন। আমার মতো লোকেরা আমেরিকান প্রেস থেকে নয়, আল জাজিরা থেকে এসব জেনেছিলাম।
বিশ্ব উন্নয়নের প্রেক্ষিতে ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩-এ পারমাণবিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য অবস্থান মিনিট-হাতের কাঁটায় ঘোষণার আগে, ‘দ্য বুলেটিন অফ দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস’ ডুমসডে ক্লক, ওয়াশিংটন, ডিসি, ইউএস, এর নির্দেশ-অপেক্ষায় থাকে (লিয়া মিলিস/রয়টার্স)!
আল জাজিরা: ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহু নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আপনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শ্রম থেকে বস্তু নয়, আকারহীন রূপান্তরে অবস্থান অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবে। এবং চূড়ান্ত আমেরিকানাইজড নেতানিয়াহু, আমেরিকানদের মনমতো স্টাইল রপ্ত করে নেবেন। নেতানিয়াহু যুগের দিকে ফিরে তাকালে, আপনি কি মনে করেন এই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল?
চমস্কি: কয়েক বছর ধরে কম-বেশি। কিন্তু ২০০০ সাল বরাবর ইসরায়েলের রাজনীতি বদলে যায়, নেতানিয়াহু আরও ডানদিকে সরে যান। তিনি এখনও জানেন কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তার সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আপনাকে মনে রাখতে হবে, ইসরায়েল সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মতামত পরিবর্তিত হয়েছে। ইসরায়েল ছিল সাধারণভাবে উদারপন্থী আমেরিকান ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে প্রিয়।
এখন একটা পরিবর্তন শুরু হয়েছে... এখন, ইসরায়েলের প্রধান সমর্থক হ'ল উগ্র ডানপন্থী ইভাঞ্জেলিকাল৫ সম্প্রদায়। গত ২০ বা ৩০ বছরে চরম সেমিটিক৬-বিদ্বেষীদের বিরোধিতার কারণে, ইসরায়েলের খুব শক্তিশালী সমর্থক হিসেবে এদের রাজনৈতিক মেরুকরণ করা হয়েছে। বেশিরভাগই চরমপন্থী ইহুদি। অন্যদিকে উদারপন্থী, লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা দূরে সরে গেছে। সর্বশেষ ভোটের ফলাফলের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশি সহানুভূতি রয়েছে। এটা বিশেষভাবে কমবয়সী ইহুদিদের মধ্যে সত্য।
নেতানিয়াহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝেন, তাই তিনি ডানপন্থী এবং তার নির্বাচনী এলাকায় উগ্র ডানপন্থার পক্ষেই শুধু নয় আরো বেশি বেশি ডান হওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল রাখছেন। পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ইরানের সাথে আমেরিকার যৌথ চুক্তির লক্ষ্যে ওবামার পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে যখন কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি আমেরিকান ডানপন্থী, উগ্র ডানপন্থী এবং ইভাঞ্জেলিক্যাল সম্প্রদায়ের সঙ্গেই শুধু কথা বলছিলেন।
তিনি একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, কৌশল পরিবর্তন করেছেন।
আল জাজিরা: আপনি বলেছেন যে ইসরায়েলের সব বড় বড় অবৈধ কর্মকাণ্ড, মার্কিন সমর্থনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তারপরও আমরা দেখছি নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে কংগ্রেসের সামনে তার বক্তব্য দিয়ে প্রকাশ্যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে বিব্রত করছেন এবং ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পক্ষে তার সমর্থন ব্যক্ত করছেন। আর গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে বাকযুদ্ধ! নেতানিয়াহু কি এমন কিছু জানেন যা আমরা আমেরিকান বৈশ্বিক শক্তির পতন সম্পর্কে জানি না? অথবা তিনি কি তার দ্বৈত আচরণ সত্ত্বেও অব্যাহত দ্বিপক্ষীয় মার্কিন সমর্থন নিয়ে জুয়া খেলছেন?
চমস্কি: যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই বিভক্ত হয়ে পড়ছে - ইসরায়েলও। এবারই প্রথম ইসরায়েলি নেতৃত্ব প্রকাশ্যে মার্কিন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বেজালেল স্মোট্রিচ৭, বেন-গভির ৮ এবং মাঝে মাঝে নেতানিয়াহু যখন আমেরিকান নেতৃত্বের কাছে খোলাখুলি ও নির্লজ্জভাবে বলেন, 'আপনি যা চান তা আমরা উপেক্ষা করতে যাচ্ছি' - এটা একবারেই নতুন।
সম্প্রতি ইসরায়েল হয়তো মার্কিন নীতি তেমনভাবে পছন্দ করছে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন কিছু করার দাবি জানাবে, তখন ইসরায়েলকে তা পালন করতে হবেই। ওবামা পর্যন্ত সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেই এটি সত্য ছিল। ট্রাম্প অবশ্য ইসরায়েলি শক্তি, সহিংসতা এবং নিপীড়নের প্রেমে ইসরায়েলকে যা খুশি তা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। গোলান হাইটস অধিভুক্তি, জেরুজালেম অধিগ্রহণ, জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কিত গৃহীত সব নীতি, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনই শুধু নয়, মার্কিন নীতিরও বিরোধী। এমনকি ইসরায়েলের গোলান হাইটস ও জেরুজালেম দখল নিষিদ্ধ করে নিরাপত্তা পরিষদে আনা প্রস্তাব একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে এসে, সে সব উল্টে দিয়েছেন… তিনি মরোক্কোর সাথেও ওই একই কাজ করেছিলেন। মরক্কোর, পশ্চিম সাহারা দখলকেও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এসবই ফিলিস্তিনি পরিস্থিতির সঙ্গে বেশ কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ।
কিন্তু ইসরায়েলের নতুন প্রশাসন, বিশেষ করে বেন-গভির, বেজালেল স্মোট্রিচের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রকে বলছে, 'সরে যাও’। নেতানিয়াহু তো বেশ জোরালো বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, 'আমরা একটা সার্বভৌম দেশ, আমরা যা চাই তাই করব’। এই প্রথম সংঘাত এত স্পষ্ট হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা স্পষ্ট নয়।
দুই-তিন বছর আগে... হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে মার্কিন প্রতিনিধি বেটি ম্যাককলাম ইসরায়েলকে মার্কিন সামরিক সহায়তা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েলকে যেভাবে মার্কিন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তাতে মার্কিন আইন-ই নিয়মিত লঙ্ঘিত হচ্ছে। পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব কিন্তু খুব বেশি দূর এগোনো যায়নি।
মাত্র কয়েক দিন আগে বার্নি স্যান্ডার্স ইসরায়েলকে মার্কিন সহায়তা নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একটি আইন উত্থাপন করেছিলেন...। আমেরিকান নীতিতে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত যে কোনও দেশকে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। এই নীতির এর প্রেক্ষিতে মার্কিন আইনের সঙ্গে এইসব সহায়তার সম্ভাব্য দ্বন্দ্বের তদন্ত দাবি করা হয়েছিল। আইডিএফ (ইসরায়েলি সেনাবাহিনী) জড়িত... এই বিষয়ে তদন্ত হলে, সেটা ইসরায়েলকে মার্কিন সহায়তার বৈধতা নিয়েই বিতর্ক তুলে দেবে, তাই প্রস্তাবটি চাপা পড়ে গেছে।
আমার মনে হয় এইধরনের সব বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে বড় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে... তবে এটা জনমতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি তো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে বহুদিন ধরেই বক্তৃতা, লেখালেখি ইত্যাদি করে আসছি কিন্তু সাম্প্রতিক সময়কালে ইসরায়েলপন্থী বাহিনীর সহিংস শত্রুতার কারণে, এখন যদি ক্যাম্পাসে বক্তৃতা দিতে যাই, তবে আমাকে পুলিশি সুরক্ষা নিতে হবে। হুমকির কারণে আমার বক্তৃতা শেষ হলেই পুলিশ আমাকে আমার গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য জোর করবে। এমনকি আমার নিজের ক্যাম্পাসেও যদি বক্তৃতা দিতাম তাহলেও সিটি পুলিশ এবং ক্যাম্পাস পুলিশ সেখানে থাকত। সবকিছুই আমূল পরিবর্তিত হয়েছে।
যে বিন্দুতে এসে, এই পরিবর্তন এল তা সহজেই সনাক্ত করা যায়, ‘অপারেশন কাস্ট লিড’৯। এটা এতটাই নৃশংস, হিংস্র ছিল যে তরুণরা আর এসব গ্রহণ করতে চাইছে না। আমি মনে করি এটা একটা সত্যিকারের সংক্রান্তি বিন্দু। ক্যাম্পাসের ভেতরের আলোচনায় এটা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ব্র্যান্ডিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সংঘবদ্ধ ইসরায়েলপন্থী ক্যাম্পাসগুলিও... খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের এই মনোভাব ভবিষ্যতে আমাদের সকলের উপর বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে। তাই সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে। আপনি এখনও নীতিতে এটি দেখতে পাচ্ছেন না, তবে আমি মনে করি আপনি এর শুরু দেখতে পারেন।
আল জাজিরা: ইসরায়েলকে ইহুদি জনগণের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আপনি ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন... কিন্তু নাগরিকদের রাষ্ট্র হিসেবে নয়। একই সময়ে, আপনি এমনসব উদাহরণ সামনে এনেছেন, যেখানে আদালত ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা করেছে। যেমন ২০০০ সালের একটা মামলায় আদালত বলেছিল যে, ইহুদি এজেন্সির মাধ্যমে ইসরায়েলের কাটজি’তে যেসব বসতি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেখানে ফিলিস্তিনি দম্পতির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণকে আদালত বৈধতা দিতে পারে না। (আদালত রায় দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের সম্প্রদায় থেকে বাদ দেওয়া যাবে না।) আদালত সম্পর্কে আপনার সামগ্রিক ধারণা কী?
চমস্কি: ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট... ইসরায়েলের ইহুদি নাগরিকদের বিষয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে ভাল রায় দেয়। ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এটা হয় না।
যেমন আপনি কাটজি’র কথা উল্লেখ করেছেন, এমন কয়েকটি রায় রয়েছে। তবে লক্ষ্য করুন যে, সেটা ছিল ২০০০ সাল। ২০০০ সালে, প্রথমবারের মতো, আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য প্রয়োজ্য একটি বন্দোবস্ত, নাগরিকদের মধ্যে যারা ফিলিস্তিনি তাদের বাদ দিতে পারে না। এটা বেশ দুঃখজনক যে ওই সিদ্ধান্তে আসতে এত দেরি হয়ে গেল। এবং প্রকৃতপক্ষে, স্পষ্টতই কাটজি’র ওই সম্প্রদায় এই সিদ্ধান্ত এড়ানোর নিজস্ব উপায় খুঁজে বের করেছেন। আমি মনে করি ফিলিস্তিনি দম্পতি অন্তত আধ ডজন বছর সময় নিয়েছেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। এবং এই সিদ্ধান্তের আশেপাশে কত পথ যে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন কে জানে!
যাই হোক, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে, আদালত সঠিক – যদিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় – তবু এর মোটামুটি একটা শালীন রেকর্ড রয়েছে। আমি নিশ্চিত, আপনি জানেন, সমালোচনা রয়েছে। আইনী ইস্যুতে শীর্ষস্থানীয় ইসরায়েলি সাংবাদিক, সংবাদদাতা মোশে নেগবি... তিনি মূলত দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যু নিয়েই উদ্বিগ্ন থাকেন, তবে তিনি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনি ইস্যুগুলি কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন। অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যে... আদালতের রেকর্ড ভয়াবহ। ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট বিশ্বের একমাত্র বিচার বিভাগীয় সংস্থা যা স্বীকার করে না যে দখলদারিত্ব রয়েছে... এটা শুধু... শাসিত অঞ্চল। এই ভাষ্য বিশ্ব আদালত প্রত্যাখ্যান করেছে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রেড ক্রস সহ আমার পরিচিত কোনো সরকারই মানেনি। সবাই ইসরায়েলের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। শুধু ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টই সরকারের সঙ্গে একমত। সুপ্রিম কোর্ট নিয়মিতভাবে অবৈধ বসতি স্থাপন, অবৈধ দখলদারিত্বের ব্যবস্থা, অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের উপর নৃশংস বিধিনিষেধ, প্রায় প্রতিদিনের সমস্ত সহিংসতার ঘটনায় অনুমোদন দিয়েছে। অনেক সময় পদক্ষেপ নিতে কিছুটা হয়ত বিলম্ব করেছে। তবে সাধারণভাবে রেকর্ডটি অত্যন্ত দুঃখজনক। মানে দু-প্রান্তের মানুষের জন্যে আলাদা আলাদা গল্প।
আল জাজিরা: আপনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের দ্বি-জাতীয় সমাধানের পক্ষে ছিলেন এবং আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে একমাত্র প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। আপনি এখনও বিশ্বাস করেন যে এটি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সমাধান?
চমস্কি: ঠিক। দুই-রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক ঐকমত্য এবং এক-রাষ্ট্র বিকল্পের মধ্যে এখনও বেশ উল্লেখযোগ্য বিতর্ক রয়েছে এবং ‘এক-রাষ্ট্রীয়’ সমাধানসূত্রের সমর্থন ক্রমবর্ধমান, এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ান লুস্টিকের১০ মতো সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
কিন্তু এই বিতর্কে একটা ভুল আছে। তৃতীয় বিকল্পকে বাদ দিচ্ছে, অর্থাৎ ১৯৬৯ সাল থেকে ইসরায়েল পদ্ধতিগতভাবে যে বিকল্পটি বাস্তবায়ন করছে তা হ'ল একটি 'বৃহত্তর ইসরায়েল' তৈরি করা, যা সে দখল করবে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় যে সম্পদ, সেই প্যালেস্টাইনের মানুষজনকেই সে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়।
অর্থাৎ ইসরায়েল নাবলুসকে১১ 'বৃহত্তর ইসরায়েল'-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না। বর্ণবাদী, ইহুদি অধ্যুষিত রাষ্ট্রে একটি বিশাল ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে হবে। সুতরাং এর অর্থ জর্ডান উপত্যকা দখল করে সেখানকার মানুষজনকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া। কোনো না কোনো অজুহাতে… আর তারপর সেটি একটি ইহুদি বসতিতে পরিণত করা। তারা পশ্চিম-তীরের গভীরে অবস্থিত মালেহ-আদুমিমের মতো শহরগুলোর দখল নিল। ১৯৯০-এর দশকে সেখানে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে নির্মাণ করল মনোরম সব আবাসন... মালেহ-আদুমিমে গড়ে ওঠা ভর্তুকিযুক্ত এইসব ভিলা থেকে তেল-আবিবে আপনার চাকরিতে যাওয়া-আসা করতে পারেন এবং জানবেনও না কোনোদিন যে, সেখানে কোনও ফিলিস্তিনি রয়েছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের একীকরণ এবং দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করা সব অঞ্চলে অবশিষ্ট ফিলিস্তিনিদের বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে ... প্রায় ১৬০ বা ততোধিক ছোট ছিটমহল, সবগুলোই ইসরায়েলি বাহিনী দিয়ে ঘেরা। এখানে ফিলিস্তিনিদের তাদের ফসল পরিচর্যা করতে বা তাদের গবাদি পশু রক্ষণাবেক্ষণ করতে বা তাদের জলপাই বাছাই করতে দেওয়া হয় বা কখনো নাও দেওয়া হতে পারে। মূলত সবাই কারাবন্দী।
আসলে বিষয়টা হ'ল রাষ্ট্র কোনওভাবে ফিলিস্তিনদের থেকে মুক্তি পেতে পারি কিনা! এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে বাঁচে। ইতিমধ্যে, সম্প্রতি, মাত্র কয়েক দিন আগে, উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় সরকার উত্তর-পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের অধিকার সম্প্রসারিত করেছে, যাকে ইসরায়েল পশ্চিম সামারিয়া বলে। অধিকৃত সব অঞ্চলে ইসরায়েলের কাছে যা কিছু মূল্যবান, সব নিজস্ব সীমানার অন্তর্গত করে নিচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে একদা জেরুজালেমের ভৌগোলিক আয়তন যা ছিল, এখন তার চেয়ে মোটামুটি পাঁচ গুণ বড়, ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার জন্য আশেপাশের গ্রামগুলি দখল করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া এগিয়েছে... রাডারের ঠিক নিচে। এখন তো তরুণ ইসরায়েলিরা এটাও জানে না যে ওখানে একটি ‘গ্রীন লাইন’১২ রয়েছে।
আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল সম্পর্কে কথা বলতে চান তবে আপনি এখন আর শুধু একটি রাষ্ট্র বা দুটি রাষ্ট্র বলে কথা এগোতে পারবেন না। যা ঘটছে তা নিয়ে আপনাকে কথা বলতে হবে, 'বৃহত্তর ইসরায়েল'। আমি এক-রাষ্ট্রের আইনজীবীদের যুক্তি বুঝতে পারি, কিন্তু আমি মনে করি... ইসরায়েল কখনও নিজেকে ধ্বংস করতে এবং ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত রাষ্ট্রের মধ্যে ইহুদি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে থাকতে সম্মত হবে, এটা প্রায় অকল্পনীয়। অথচ জনসংখ্যার বিন্যাস তেমনই ইঙ্গিত দেয়। এর জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থন নেই। একেবারেই নেই। সুতরাং আমার নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি, আসল বিকল্প হচ্ছে 'বৃহত্তর ইসরায়েল', অথবা যেমন হয়ে আছে তেমন ধরনের এক দ্বি-রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া নয়।
এটি প্রায়শই দাবি করা হয় যে বিশাল জনগোষ্ঠীর নতুন করে বিন্যাস, বাস্তবতার কারণে এখন অসম্ভব। হয়তো বা, হয়তো না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র যদি জোর দেয়, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমঝোতাকে সমর্থন করার জন্য বাকি বিশ্বের সাথে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কেবল অলৌকিকভাবে নয়, বাস্তবে, ইসরায়েল একটি অত্যন্ত গুরুতর সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হবে।
আপনাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে এবং দেখতে হবে গত ৫০ বছরে ইসরায়েলের নীতি কী ছিল। ১৯৭০-এর দশকে ফিরে যান... যখন মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক সীমান্তে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছিল। সঙ্গে সম্ভবত কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন, তবে অবশ্যই দ্বি-রাষ্ট্রীয় নিষ্পত্তি যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমানার মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাসের অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে।
ইসরায়েল তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। জাতিসংঘে ইসরায়েলের প্রতিনিধি ইৎজাক রাবিন ক্ষোভের সঙ্গে এর নিন্দা জানিয়েছিলেন। ইসরায়েল এমনকি এই অধিবেশনে যোগ দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। প্রস্তাব সমর্থন করেছিল- মিশর, জর্ডান, সিরিয়া; যাদের আমরা 'সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্র' বলে চিহ্নিত করে থাকি। একটি দীর্ঘ আন্তর্জাতিক রেকর্ড রয়েছে, সাধারণ পরিষদে অনুরূপ প্রস্তাবের পক্ষে একদিকে ১৫০ আর বিরোধিতায় গোটা কয়েক রাষ্ট্র; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং মার্কিন-নির্ভর রাষ্ট্রগুলি। ইসরায়েল ১৯৭০-এর দশকে নিরাপত্তার চেয়ে সম্প্রসারণকে বেছে নেওয়ার মতো একটি দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বেশ, ঠিক আছে। ইসরায়েল তার নিরাপত্তা ও সহায়তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এটাই দরকষাকষি। আপনি যদি নিরাপত্তার বদলে সম্প্রসারণকে বেছে নেন তবে আপনাকে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতেই হবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার নীতি পরিবর্তন করে, তাহলে ইসরায়েলকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আল জাজিরা: খুব কম বুদ্ধিজীবীই আপনার চেয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। আপনি অ্যাডভোকেসি সম্পর্কিত কোনও পদ যদি গ্রহণ করে থাকেন বা গ্রহণ করেননি, এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে এখন আপনার কি কোনও অনুশোচনা রয়েছে?
চমস্কি: না নেওয়ার জন্য, হ্যাঁ। আমি যা নিয়েছি তা প্রত্যাখ্যান করব না, তবে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আমার করা উচিত ছিল, অথচ করিনি। মার্কিন মানদণ্ড অনুযায়ী, আমি প্রথম থেকেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিপক্ষ ছিলাম। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে আমি যুদ্ধ-বিরোধিতায় বেশ সক্রিয়ও হয়ে উঠেছিলাম... কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১০ বছর আগেই শুরু করা উচিত ছিল। সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রাক্তন উপনিবেশ পুনরুদ্ধারের ফরাসি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে শুরু করেছিল এবং ফরাসিরা ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দখল করতে চেয়েছিল। তার জন্যে সে জেনেভা চুক্তিকে দুর্বল করেছিল, দক্ষিণে একটি ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ৬০ হাজার বা ৭০ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। তখনই বিক্ষোভ শুরু হওয়া উচিত ছিল। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত, কোনও সংগঠিত বিরোধী দল ছিল না। প্রথমেই বিরোধিতা না-করা অপরাধ ছিল। অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল। অন্যান্য বিষয়েও ওই একই রকম।
ইসরায়েলের কথাই ধরুন, শৈশব থেকেই আমার জীবনের প্রধান ইস্যু। আমি ১৯৬৯ সালে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের অপরাধমূলক প্রকৃতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছিলাম - এটি অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। আমি ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়নের সাথে পরিচিত ছিলাম। আমি এটা প্রথম দেখেছি... ১৯৫৩ সালে, কয়েক মাস ইসরায়েলে একটি কিবুৎজে১৩ ছিলাম। এটাই ছিল সেই সময় আরব ও ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানোর অন্যতম উপায়। আমি খুব কমই আরবি জানতাম, ওই শুধুমাত্র কথোপকথনটুকুই অনুসরণ করতে পারতাম। তবু গিয়েছিলাম। আমি মাঝে মাঝে কিবুৎজের একজন আরব প্রচারকের সঙ্গে ঘুরেও বেড়িয়েছি, যিনি দূরান্তের একটি আরব কিবুৎজ পরিচালনা করতেন... আমি তাঁর সঙ্গে গ্রামে গিয়েছিলাম, গ্রামবাসীদের অভিযোগ শুনেছিলাম, জেনেছিলাম রাস্তা পারাপারের অনুমতি পাওয়ার জন্যেও লড়াই করতে হয়। লড়াই না করা পর্যন্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এমনকি বন্ধুত্বপূর্ণ কিবুৎজের মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্যেও রাস্তা পার হতে পারেন না।
আমি দমন-পীড়নের একের পর এক ঘটনা স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছিলাম… এমনকি অ-আশকেনাজি১৪ মরোক্কোর ইহুদি জনগোষ্ঠীর অপমানিত হওয়ার ঘটনাও। এসব বিষয় নিয়ে তখনই কথা বলা উচিত ছিল। সেসময় নিজেকে জড়িত করিনি যতদিন না '৬৭-র যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল অধিকৃত সব অঞ্চলে বসতি স্থাপন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু হতে দেখি। এই ব্যবস্থাপনার প্রসারিত রূপই তো বর্তমান স্থিতি। আমার সেদিনের সমালোচনা বড্ড হালকা ছিল, আর দেরিও করে ফেলেছি অনেক।
আল জাজিরা: আব্রাহাম জোশুয়া হেশেল,১৫ যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধেরও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, একজন নবীকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এইভাবে, 'একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের উপলব্ধিজাত ভাষ্য যা তাঁর স্থিতি ও আত্মার পক্ষে যথেষ্টই ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও তিনি মানব যন্ত্রণার নীরব দীর্ঘশ্বাস হৃদয়াঙ্গম করা থেকে পিছিয়ে আসেন না’। অন্যরা যেমন আপনার কর্মজীবনে প্রতিফলন ঘটায়, সেই অর্থে নোয়ামচমস্কিকে একজন নবী হিসাবে বর্ণনা করা কি সঠিক হবে?
চমস্কি: নবী কী? অস্পষ্ট উৎপত্তির একটি অস্পষ্ট শব্দ। সম্ভবত আক্কাদিয়ান১৬ঋণ, কিন্তু কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না। যাদেরকে নাভিয়েন বলা হত, তারা আজকের দিনে ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ । সেসময় তাঁরা ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নিন্দা করেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, অশুভ রাজারা ইহুদি জনগণকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এনারা রাজাদের অপরাধ এবং নৃশংসতার নিন্দা করেছিলেন, বিধবা এবং এতিমদের জন্য করুণার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আজকের দিনে ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত নামে পরিচিত বিষয়গুলির পরিসীমা প্রায় একই। এইধরনের মতামত যাঁরা পোষণ করেন তাঁদের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনও খুব খারাপ আচরণই করা হয়। মরুভূমিতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারাগারে আটকে রাখা হয়। ইলিয়াহুকে ইস্রায়েলের ঘৃণাকারী বলা হত কারণ তিনি অশুভ রাজার ক্রিয়াকলাপের নিন্দা করার সাহস করেছিলেন। ঠিক আছে, এটা আমাদের পরিচিত। গোটা ইতিহাস জুড়েই এই প্রবাহের অনুরণন। এখন এটা স্পষ্টতই ২৫০০ বছর আগের নয়। এখন এক ভিন্ন জগৎ ... (তবে) কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য থেকেই গেছে।
আল জাজিরা: আপনার বাড়িতে এমন কোনো বস্তু আছে কি, যা আপনার ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে? এবং সেটা কী প্রতিনিধিত্ব করে?
চমস্কি: হ্যাঁ, আমার একটা স্মারক আছে। প্রথম ইন্তিফাদা১৭র সময় আমি কালান্দিয়া শরণার্থী শিবিরে এটা পেয়েছিলাম। ক্যাম্পটি তখন সামরিক কারফিউয়ের অধীনস্থ। সামরিক কারফিউর মধ্যেই পেছনের রাস্তা ধরে আমি কয়েকজন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা ঢুকতে পেরেছিলাম। ইসরায়েলি টহলদারি দলের হাতে ধরা পড়ার আগে আমরা কিছুক্ষণ ক্যাম্পের চারপাশে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। সেখানে, বেড়ার ওপাশে যারা নিজের নিজের বাড়িতে তালাবদ্ধ ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। আমি একটা ক্যানিস্টার কুড়িয়ে নিয়েছিলাম – যেহেতু আমি একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ নই, তাই এটা ঠিক কী ছিল, সেটা বলা সম্ভব নয়, তবে আমার মনে হয়, ওটা একটা টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার ছিল – আক্রমণ করতে আসা ইসরায়েলি বাহিনী এটা ছেড়ে গিয়েছিল। এটা একটা স্মৃতিচিহ্ন, তবে কোনো সময়ে আনন্দদায়ক নয়।
আল জাজিরা: কিন্তু এটা কী প্রতিনিধিত্ব করে?
চমস্কি: এটা এক কঠোর, নৃশংস নিপীড়নের প্রতিনিধিত্ব করে... অধিকৃত সব অঞ্চলে এখন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সহিংসতা এবং নিপীড়ন বাড়ছে... প্রায় প্রতিদিনই এক বা অন্য ধরনের সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে... আইডিএফ দেখছে, কখনও অংশ নিচ্ছে। আপনি হেব্রনের মতো জায়গায় যান, এটা দেখে অবাক লাগে।
এবং গাজার অবস্থা অবশ্যই অনেক খারাপ। আমি গাজায় ছিলাম... এরই মধ্যে কয়েকটি ইসরায়েলি হামলা হয়েছিল। এটি একটি... লজ্জাজনক অপরাধ... ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মূলত কারাবন্দী। খাওয়ার মতো পানীয় জল নেই, শক্তি ব্যবস্থা নেই, নিকাশী ব্যবস্থা ইসরায়েলি সহিংসতায় ধ্বংস হয়ে গেছে। জেলেরা পয়ঃনিষ্কাশন-সংক্রামিত জলসীমার বাইরে কয়েক কিলোমিটারের বেশি যেতে পারে না, ইসরায়েলি গানবোট তাদের আটকে রাখে। এটি আধুনিক যুগের অন্যতম বড় অপরাধ। গোলান মালভূমি। এ নিয়ে এখন আর কেউ কথাও বলে না। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে ট্রাম্প ওই ভূমি অধিকার করে। এই সবই বর্তমান ইসরায়েল।
অনুবাদকের সংযোজন
১। নবি বা পয়গম্বর বলতে সেইসব ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যারা বলেন যে, সৃষ্টিকর্তার সাথে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ বা বার্তা বিনিময় হয়েছে। তারা নিজেরা যে সকল শিক্ষা লাভ করেন তা নিঃস্বার্থভাবে অন্যান্য লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেন। নবিদের অধিকাংশই মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা, সুসংবাদ অথবা সতর্কবার্তা প্রদান করেন।
‘নবী আমোস’, হিব্রু বাইবেল ও খ্রিশ্চিয়ান ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ‘আমোস’ বারোজন স্বল্পখ্যাত ধর্মগুরুর একজন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্তর ইসরাইলের রাজা জেরোবোয়াম II–র রাজত্বকালে বাইবেল ধর্মগ্রন্থের প্রথম লিখিত ভাষ্যের প্রণেতা। সামাজিক ন্যায়, ঈশ্বরের সর্বব্যাপী অস্তিত্ব ও ঈশ্বরীয় আদেশনামা – এই তিনের সমন্বয়ে ‘নবী আমোস’ ধর্ম ও নীতিপ্রচারের প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
২। ‘ডুমসডে ক্লক’ (A Timeline of Conflict, Culture, and Change) এই বছর (২০২৩, ২৪ জানুয়ারি) Science and Security Board of the Bulletin of the Atomic Scientists ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে, পৃথিবীর বুকে ভয়ঙ্কর এক দুর্যোগ (শেষের সেদিন) নেমে আসার সময়ক্ষণের প্রতীকী ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে রাত বারোটা বাজতে আর মাত্র ৯০ সেকেন্ড বাকি রেখেছেন।
৩। ফালুজাহ, ইরাকের একটি শহর। ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসন চলেছিল ২০ মার্চ ২০০৩ থেকে ১ মে ২০০৩। যুক্তি ছিল ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন (১৯৭৯ – ২০০৩) ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মজুদ করছেন (যদিও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এমন কোনও অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি)। ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সাদ্দাম আমেরিকান সেনাদের হাতে ধরা পড়ার পর আমেরিকা সেদেশে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠন করে দেয়। তারপরও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ইরাকি বিদ্রোহীরা কয়েকজন আমেরিকান মেরিনারকে অতর্কিত আক্রমণে হত্যা করলে প্রতিশোধ স্পৃহায় ২০০৪ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর অব্দি আমেরিকান নৌবাহিনী ও স্থলবাহিনী (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গত সহ) ফালুজাহ শহরটিই ধ্বংস করে দেয়। মোটামুটি ৩০০০ বিদ্রোহী/ অসামরিক মানুষ মারা যান অথবা বন্দী হ’ন। আহত অসংখ্য। বাহিনীর ১১০ জন মারা যান।
৪। হালাবজা হত্যাকাণ্ড: সাদ্দাম হোসেনের অনুশাসনকালে ইরাক - ইরান যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, ইরাকি সেনাবাহিনী উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান দখল নেওয়ার ৪৮ ঘন্টা পরে ১৬ মার্চ, ১৯৮০, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও মদতে আলি হোসেন আল-মজিদের (কেমিক্যাল আলি) পরিচালনায় গোটা এলাকা জুড়ে যত্রতত্র অবিরাম রাসায়নিক (মাস্টার্ড গ্যাস, সারিন ও ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট সমন্বিত) বর্ষণ করে। ওইদিনের আগে কমবেশি ৮০,০০০ কুর্দি জনসম্প্রদায়ের অর্ধেক লোককে শহরে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর সরকারি সেনাবাহিনী কুর্দি অধ্যুষিত গ্রাম মফঃস্বলে নামিয়ে এনেছিল অবাধ তাণ্ডব ধ্বংসলীলা। কমবেশি ৫০০০ মানুষ সেদিন মারা গিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সাল অব্দি চলা এই যুদ্ধে আরও ১ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলেন, ৪০০০ গ্রামাঞ্চল ধ্বংস হয়েছিল। ইতিহাসে ইরাক-ই হচ্ছে প্রথম রাষ্ট্র যে তার নিজের দেশের মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল।
৫। ধ্রুপদী প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় বা তাদের কোনো একটি শাখা, বিশেষ করে যারা যিশুখ্রীষ্টের সুসমাচার প্রচারের ওপর সবিশেষ জোর দেয়; ব্যক্তিগত রূপান্তরের অভিজ্ঞতা ও ধর্মগ্রন্থকে বিশ্বাসের একমাত্র ভিত্তি এবং খ্রীষ্টের প্রতি ব্যক্তিগত অঙ্গীকারের প্রাধান্য প্রচার করে।
৬। ভাষা ও নৃতত্ত্বে সেমিটিক (Semitic) শব্দটি প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা শ্রেণিকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। ভাষা বিষয়ক শিক্ষা যেহেতু সাংস্কৃতিক শিক্ষার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত, তাই এই শব্দটি সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য বোঝাতেও ব্যবহৃত হতে থাকে।
ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্ম মূলত সেমিটিক ধর্ম হিসেবে পরিচিত। এই ধর্মগুলো পয়গম্বরীয় ধর্ম যা আল্লাহ’র নবীদের দ্বারা আনীত স্বর্গীয় নির্দেশনায় বিশ্বাসী। সেমিটিক ধর্মগুলোর উদ্ভব ঘটেছে মূলত সেমিটিয় তথা হিব্রু, আরব, আসিরীয় ও ফিনিশীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বাইবেল ও আল কুরান-এর বর্ণনানুসারে নূহ (আ:)-এর এক পুত্রের নাম ‘শাম’ (Shem)। শাম’-এর বংশধরগণ ‘সেমিটিয়’ নামে পরিচিত।
৭। ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদ, ল’ইয়ার ও ২০২২ সাল থেকে অর্থমন্ত্রী।
৮। ইসরায়েলের জাতীয় সুরক্ষা মন্ত্রী, ল’ইয়ার ও ডানপন্থী রাজনীতিবিদ।
৯। গাজা যুদ্ধ, ইসরায়েলের ভাষায়, ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ ও গোটা মুসলিম বিশ্বে গাজা গণহত্যা বা আল ফুরকানের যুদ্ধ নামেও পরিচিত একটি সামরিক সংঘর্ষ, যা গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি আধা সামরিকগোষ্ঠী হামাস ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনির মধ্যে চলে। ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি, ৩ সপ্তাহ ১ দিন ব্যাপী গাজা স্ট্রিপ ও ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে চলা এই সংঘর্ষ আইডিএফ (ইসরায়েলি সেনাবাহিনী)-ই একতরফা বিরতি ঘোষণা করে। এই সংঘর্ষে ১,১৬৬ থেকে ১৪১৭ জন ফিলিস্তিনি ও ১৩ জন ইসরায়েলির মৃত্যু হয়।
১০। ইয়ান স্টিভেন লুস্টিক (জন্ম ১৯৪৯), একজন খ্যাত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। বর্তমানে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মানিত ‘হেম্যান চেয়ার’-অধ্যাপক। তাঁর প্রথম গবেষণার বিষয় ছিল ‘Arabs in the Jewish state: a study in the effective control of a minority population’। ১৯৮০ সালের আগে তিনি আমেরিকান ‘Department of State’–এর ‘Bureau of Intelligence and Research’ এর অধীনে ‘Analyst, specialising in the problems of Israel’s occupation of thr Palestinian territories’ হিসেবে চাকুরি করেছিলেন। ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সময় অব্দি, আরব-ইসরায়েল প্রসঙ্গে যেসব প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন, সেখানে বিভিন্ন দিক থেকে এবং সূত্র ধরে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, একমাত্র হামাস-এর সঙ্গে আলোচনা করেই ইসরায়েল ওই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে এবং ইসরায়েল-প্যালেস্টানিয়ান যুদ্ধমীমাংসা একমাত্র সম্ভব ‘একটি রাষ্ট্র’ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘Paradigm Lost: From Two State Solution to One-state Reality’ বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এটাই।
১১। নাবলুস, জেরুজালেম থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার উত্তরে পশ্চিম তীরের (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) একটি ফিলিস্তিনি শহর। জনসংখ্যা ১,২৬,১৩২। শহরটি ফিলিস্তিনের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। উচ্চশিক্ষার অন্যতম বৃহত্তম ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠান, আন-নাজাহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই শহরেই অবস্থিত। বর্তমানে নাবলুস ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের অধীন।
১২। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের পরের বছর ১৯৪৯-এ ইসরায়েল ও মিশর, লেবানন, জর্ডান আর সিরিয়ার মধ্যে একটা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। আরব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল অর্থাৎ জর্ডান অধিভুক্ত ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’ ও মিশর অধিকৃত গাজা উপত্যকার সঙ্গে ইসরায়েল সীমান্ত ‘গ্রীন লাইন’ টেনে চিহ্নিত করা হয়।
১৩। কিববুৎজ, ইসরায়েলের এক বিশেষ গ্রাম। এই গ্রামে কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তি নেই। সবই গোটা গ্রামের সম্পত্তি। যে যাই কাজ করুক, সবার ভাতা সমান। গোটা গ্রামের রান্না কমিউনিটি কিচেনে। খাওয়া, খাবার হলে। স্ত্রী পুরুষের কাজের বৈষম্য নেই। বাচ্চাদের যত্ন করে বড় করার দায়িত্ব গোটা গ্রামের। সামাজিক সব সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় গ্রাম-সদস্যদের সভায়। শুরু ১৯১০ সালে।
১৪। অ-আশকেনাজি মরোক্কোর ইহুদি: মোটামুটি ৭০ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই মরোক্কো’র ইহুদিরা জেরুজালেমের দেওয়ালের চারপাশে তাদের প্রাচীন গ্রামসমাজ সংস্থাপন করেন। এমনকি পরবর্তী সময়ে তেল-আবিব, হাইফা ও তিয়েরিসাস ঘিরে গড়ে ওঠা বাণিজ্য নগরের নতুন বসতেরও স্থপতি তারা।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতি পাওয়ার পর পূর্ব ইউরোপ, মধ্য ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষজন ভিন্ন ভিন্ন কারণে নতুন রাষ্ট্রে জড়ো হ’ন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যে শুধুমাত্র মরোক্কোর ইহুদি জনসংখ্যা আড়াই/তিন লাখ থেকে নেমে আসে মাত্র পাঁচ হাজারে। বর্তমানে মরোক্কান ইহুদি ইসরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইহুদি সম্প্রদায়।
একসময়ে ইসরায়েলে জড়ো হওয়া বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিদের ভাষা, খাদ্যাভাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আচার-বিচার-বিবাহ রীতি এমনকি উত্তরাধিকার আইনও আলাদা ছিল। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিবাদ-বিরোধও ছিল প্রভূত।
পূর্ব ইউরোপ, মধ্য ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের একেবারেই পৃথক একটি সাংস্কৃতিক গ্রুপ হিসেবে দেখা হ’ত। আশকেনাজি। এরা খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীতে পশ্চিম জার্মানির রাইনল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছিল। সেখান থেকে তারা বা তাদের বংশধররা ইসরায়েলে মাইগ্রেট করে।
১৫। আব্রাহাম জোশুয়া হেশেল: বিশিষ্ট স্কলার। একই সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মানুষ। সমকালীন ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষ-সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র নিয়ে তাঁর চিন্তা চেতনা উদ্বেগ বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে ‘ম্যান ইজ নট অ্যালোন: এ ফিলোসফি অফ রিলিজিয়ন’ (১৯৫১) এবং ‘গড ইন সার্চ অফ ম্যান: এ ফিলোসফি অফ জুডাইজম’ (১৯৫৫) গ্রন্থে।
১৬। আক্কাদিয়ান, একটি বিলুপ্তপ্রায় পূর্ব সেমেটিক ভাষা, প্রাচীন সময়কালে মেসোপটিমিয়ায় ব্যবহৃত হ’ত।
১৭। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপ দখলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র বিদ্রোহ।