সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে শেষ সময়ে সংসদে আচমকা পেশ করা হয় তিনটি বিল:
(১) ভারতীয় ন্যায় সংহিতা যা হবে ভারতীয় দণ্ডবিধির নতুন নাম (২) ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা যা হবে ফৌজদারি দণ্ডবিধির নতুন নাম (৩) ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম অর্থাৎ ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের নতুন কলেবর। বিলগুলি বিরোধী শূন্য লোকসভায় পেশ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। মন্ত্রীর বক্তব্য: প্রচলিত আইনগুলো বৃটিশ আমলের। ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে বৃটিশ প্রভাব ও দাসত্বের মানসিকতা দূর করতে ফৌজদারি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পরিকল্পনা নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। দেখা যাক, প্রকৃত ব্যাপারটা কি!
রাজদ্রোহ (Sedition)
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ হচ্ছে রাজদ্রোহ আইন যা বৃটিশ আমলে চালু করা হয়। প্রস্তাবিত বিেল ১৫০ ধারায় বলা হয়েছে যে ইচ্ছাকৃত ভাবে লেখা বা বক্তব্যের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ, উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সশস্ত্র বিদ্রোহ, দেশবিরোধী কাজকর্ম, বিচ্ছিন্নতাবোধের মানসিকতায় উৎসাহ দেওয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতাকে বিপদের মুখে ফেলার মতো যাবতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সংগে আর্থিক জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে। সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে যে মোদি বা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা বা আন্দোলন করলেই বিরোধীদের দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন আইনে 'দেশবিরোধী কাজকর্ম' বা 'দেশের একতা ও অখণ্ডতা'কে বিপদের মুখে ফেলার কি যে অর্থ প্রশাসন করবে সেখানে আশংকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রস্তাবিত আইন ব্যাপকভাবে বিরোধীদের দমন করার হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে।
যদিও আইন কমিশন সিডিশন রেখে দেবার পক্ষে কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট সিডিশন মামলার বিচার বন্ধ রাখতে বলেছেন। শুধু তাই নয়। সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে ১২৪এ ধারায় এফ আই আর গ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই পটভূমিতে প্রস্তাবিত আইনে ১২৪এ ধারা বাতিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ থেকে ২০২১ মোদি জমানায় ৪২৪টি সিডিশন মামলা এবং ৬৩৪ জন মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অবশ্য এই পর্যায়ে মামলায় সাজার হার মাত্র ৩.৩ শতাংশ।
সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম
এই আইনের ১১১ নং ধারায় সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের সম্পদ ধংস, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার জোগান ব্যাহত করা, পরিকাঠামোর ক্ষতিসাধন, অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবাদ-আন্দোলন এইসব কাজকর্মকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে এই আইন ব্যবহার করা হবে যদিও সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য
১৯৬৭ সালের বেআইনি কার্যকলাপ নিবর্তন আইন (UAPA) রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার ব্যাপক আয়োজন লক্ষ করা যায় । যেমন, মানহানি ।
মানহানি (Defamation)
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির জন্য সর্বোচ্চ সাজা দুই বছর, কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের ৩৫৪ নং ধারায় এই সাজা বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়েছে, সংগে জরিমানা তো আছেই। ফৌজদারিতে মানহানির এতো গুরুত্ব কেন? কারণ, প্রধানত রাজনৈতিক। মানহানি হলে সাধারণত মানুষ দেওয়ানি মামলা করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে থাকেন। কেউ কেউ ফৌজদারি আইনের দ্বারস্থ হন। রাহুল গাঁধীর ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে। প্রস্তাবিত আইনে মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলাও বিপজ্জনক হতে পারে কারণ, মৃত নেতাদের বিরূপ সমালোচনা করলে তাদের আত্মীয়স্বজনেরা মানহানি মামলা দায়ের করতে পারবেন । এই আইনে মানহানির চৌহদ্দি এতটাই বাড়ানো হয়েছে যে যারা কমিকস করেন বা লেখেন, যারা কার্টুনিস্ট বা ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা করে থাকেন, নাটক গ্রুপ, পেইন্টার্স এমনকি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি -- সকলকেই এই আইনের আওতায় টেনে আনা যাবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সমালোচনায় বিপদ হতে পারে । মানহানির যে এতো মান বেড়ে যাবে কে জানত!
মহিলা
প্রস্তাবিত আইনে আঠারো বছরের কম বয়সী মহিলাদের ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাবাসের সাজার কথা বলা হয়েছে।
একই সুপারিশ করা হয়েছে গণপিটুনিতে হত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
ভূয়ো পরিচয় দিয়ে বিয়ে, চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌনতা বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে না করে যৌনতার ঘটনায় অভিযুক্তদের দশ বছর সাজার কথা বলা হয়েছে। গণধর্ষণ প্রমাণে কুড়ি বছরের জেল বা আজীবন কারাবাস হবে অভিযুক্তদের। লক্ষ্যণীয়, বৈবাহিক ধর্ষণের প্রশ্নে এখনো কিছু বলা হয়নি।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতা হল নতুন পেনাল কোড বা IPC. ৫১১টি ধারার জায়গায় সংহিতায় আছে মোট ৩৫৬টি ধারা। প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি বা Criminal Procedure Codeএ আছে ৪৯৮টি ধারা। প্রস্তাবিত ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় আছে ৫৩৩ ধারা। ১৬০টি ধারায় কিছু বদল এনে নতুন ৯টি ধারা যুক্ত হয়েছে। ই এফ আই আর প্রস্তাবিত হয়েছে যা রাজ্যের মধ্যে যেকোনো জায়গা থেকে করা যাবে। দ্রুত বিচারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। শওয়াল শেষ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে রায় ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। এসবের মধ্যে খুব একটা নতুনত্ব আছে বলে মনে হয় না । Indian Evidence Act বা ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের নতুন কলেবর হল ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। সাক্ষ্য আইনের ১৬৭টি ধারা, নতুন আইনে মোট ১৭০িট ধারা রাখা হয়েছে। ডকুমেন্ট এর সংজ্ঞা প্রসারিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পড়বে সমস্ত ধরনের ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল রেকর্ড। এফ আই আর, কেস ডায়েরি, চার্জশিট, রায় -- সবকিছু ডিজিটাইজ করতে হবে। সার্চ ও সিজারের ভিডিও রেকর্ডিং করতে হবে।
সাক্ষ্য আইন অথবা ফৌজদারি কার্যবিধি, এর পরিবর্তন এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়, নামগুলোই নতুন। সময়ের সাথে সাথে এগুলো অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে । প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করাই যায়। হঠাৎ করে নাম পরিবর্তনের কারণ দেখি না। পরিবর্তন হয়েছে দণ্ডবিধির। যার উদ্দেশ্য হল আইনকে কঠোরতর করে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা ।