সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
১৯৪৬ সালে তখনকার বিখ্যাত শিল্পী কমলা ঝরিয়া একটি গান রেকর্ড করেন। গানটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। গানটির শিরোনাম ‘এল পঞ্চাশের আকাল’। লোকগীতির সুরে বাঁধা গানটিতে সদ্য ঘটে যাওয়া বাঙলার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। যে দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে তিরিশ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। শুধুমাত্র খাবারের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ করছেন, সুদূর গ্রাম থেকে খাদ্যের আশায় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা চাইছেন, তাও ভাত বা চাল নয় একটু ভাতের ফ্যান, তাও না পেয়ে লুটিয়ে পড়ছেন, এ অভাগা দেশে সে দৃশ্যও রচিত হয়েছে। অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ যেমন তাদের যথাসাধ্য সাহায্য তেমনি আর একদল সহনাগরিক নিষ্ঠুর কপটতায় ওই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে যথেচ্ছ ধনসম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। সেদিনের সেই মানবতার চূড়ান্ত অবনমনের ছবি গানটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। গানটির ছত্রগুলি এরকম-
ভুলো না – রেখো মনে বাঁচবে যত কাল
সোনার দ্যাশে ক্যান এল পঞ্চাশের আকাল।
ভুলে রব লড়াই এল দেশে
চোরেরা সব দল বাঁধে ভাই রক্ষকেরই বেশে –
তারা বাগিয়ে ভুঁড়ি হাঁকায় জুড়ি লুটের মালে লালে লাল।
এল পঞ্চাশের আকাল॥
ক’রে ভাই মিছড়ি মুড়ি একদর
লুটের বাজার হ’ল শুরু নাইকো কারো লাজডর।
(ধনীর) ব্যাঙ্কে টাকার অঙ্ক বাড়ে গরীবের যায় বলদ হাল –
এল পঞ্চাশের আকাল॥
ঘরহারা সব বাহির হ’ল পথে
(ওদের) মেকি দয়ার ফাঁকি দিলো নুনের ছিটে ক্ষতে –
ওরা ফ্যান বিলিয়ে নাম কিনে নেয়
কাঙাল মরে পালে পাল ---
এল পঞ্চাশের আকাল॥
তকমাধারী ন্যায়ের মালিক যারা
মুখোশ খুলে খোস মেজাজে লুটে বেড়ায় তারা
(আবার) পচায় গোলার ছালায় ছালায়
চিনি আটা ময়দা চাল
এল পঞ্চাশের আকাল॥
চিনে রাখ লোভী রাহুর দল
জেনে রাখ নিত্যকালের নয়তো বাহুর বল ---
নিজে জ্বলো জ্বালো আলো পালাক পিচাশ প্রেতের দল ---
হবে না আর কভু আকাল॥
এখানে গীতিকার বার বার করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন সমাজের একটি অংশকে যারা এই দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে নিজেদের লভ্যাংশ বুঝে নিয়েছিলেন, তাদের দিকে। শুরুতেই তিনি শ্রোতাদের অনুরোধ করেছেন এই আকালের কারণ আজন্ম মনে রাখার জন্য। তিনি কিন্তু একবারও খাদ্যের অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করেন নি। প্রাথমিকভাবে খাদ্যের অপ্রতুলতার কথা তৎকালীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীও উল্লেখ করেন নি। ১৯৪৩ সালের প্রথমার্ধ জুড়ে, যখন দুর্ভিক্ষের করাল থাবা দরিদ্র বঙ্গবাসীর উপর আছড়ে পড়েছে, তখনও বাংলার প্রশাসন প্রকাশ্যে দাবী করেছেন যে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর মতো যথেষ্ট খাদ্যের যোগান রাজ্যে আছে। খাদ্যে অপ্রতুলতা রাজ্যে নেই।
১৯৪২ এর আগষ্ট মাসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ভারত সরকারের যুদ্ধের কারণে পূর্ব ও উপকূলবর্তী ভারতে প্রয়োগ করা পোড়ামাটি নীতির জন্য দূর্ভিক্ষ আসন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে ক্ষমতাচ্যূত হন। খাদ্যমন্ত্রী এইচ এস সুহরাবর্দি ও বিশ্বাস করতেন দূর্ভিক্ষ আসন্ন। কিন্তু তিনি উচ্চতম ব্রিটিশ প্রশাসকদের চাপে ঘোষণা করেন যে বাঙলায় খাদ্যের কোন ঘাটতি নেই। অথচ আকাল এল। দুর্ভিক্ষের সুনামিতে বাঙলার তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ বিনষ্ট হল।
২
ফেমিন কমিশন ১৮৮০ র রিপোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ‘খরার প্রতিক্রিয়ায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত দিনমজুরেরা কর্মহীন হয় সবচেয়ে বেশী.... জনগণের এই অংশ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর হস্তশিল্পীরা চরম দুর্দশাগ্রস্ত হন, যারা মূলত দৈনন্দিন ব্যবসায়ের উপর নির্ভরশীল। খাদ্যের অভাবের জন্য জনগণের এই অংশের দুর্দশা বাড়তে থাকে তা নয় বরং আয় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে খাদ্য কেনার ক্ষমতা তাদের ছিলনা বলেই তাদের দুর্দশা বেড়েছিল। সব থেকে বেশী দুর্ভিক্ষ-পীড়িত জেলাগুলিতেও যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত ছিল। কিন্তু দৈনিক মজুরীর উপর নির্ভরশীল মানুষের আয় করবার কোন পথই খোলা না থাকায় তাদের হাতে খাবার কেনার কোন পয়সা ছিলনা’। অমর্ত্য সেন তার সুবিখ্যাত গবেষণায় ওই দূর্ভিক্ষ খাদ্যের অপ্রতুলতার জন্য হয় নি তা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছেন।
ফিল্ড মার্শাল আর্চিবল্ড ওয়াভেল ১৯৪৩ এর অক্টোবরে লিনলিথগোর জায়গায় ভাইসরয় হিসাবে দায়িত্ব নেন। তখন ভারতের রাজনৈতিক মহল থেকে দূর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের উঠতে থাকে। কিন্তু ভারতের জন্য নিযুক্ত সেক্রেটারি অফ ষ্টেট লিওপোল্ড আমেরি আপত্তি করেন। কিন্তু উত্তরোত্তর ঐ দাবী জোরালো হতে থাকলে আমেরি কারণ অনুসন্ধানের অভিমুখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তব্য খাদ্যের যোগানের সম্পর্কের ভিত্তিতে করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কৌশলে তিনি ম্যালথাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু কোনভাবেই ফেমিন কোড এর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই না। সুতরাং আমরা ফেমিন কোড এর বিষয়ে একবার চোখ ফেরাতে পারি।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৮ শতকে বাংলার দূর্ভিক্ষের পর ১৮৮৩ সালের জুন মাসে, সি এ এলিয়ট ফেমিন কোড এর খসড়া তৈরি করেন, যিনি আগে ১৮৭৭ সালে মাইসোরের জন্য ফেমিন কোড এর খসড়া করেছিলেন । সেখানে ত্রাণ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে প্রাণহানি প্রতিরোধ করবার কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং এটা আশা করা যায় যে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে আরও কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচত। তবে সেই দাবী আদায়ের জন্য কোন আন্দোলনের খবর পাওয়া যায় না। গভর্নর রাদারফোর্ড একটি ব্যক্তিগত মেমোতে লিখেছিলেন— ফেমিন কোড প্রয়োগ করা হয়নি তার কারণ নিয়ম মত রেশন দেবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য আমাদের কাছে ছিল না’ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল মনে করিয়ে দেন— ‘যতক্ষণ না বাংলার খাদ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, ততক্ষণ আমাদের পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ ফলত ফেমিন কোড এর সহায়তাটুকু ঐ মানুষদের জোটেনি।
প্রশাসনিক স্তরে ফেমিন কোড বলতে দূর্ভিক্ষের সময় তা মোকাবিলার জন্য জরুরী কাজের নির্দেশাবলীকে ইঙ্গিত করে। ১৮৮০ সালের আগে দূর্ভিক্ষের ত্রাণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণত পরিকল্পনা বহির্ভূত এড হক ভিত্তিতে করা হত। ১৮৮৩ থেকে ১৯০১ এর মধ্যে ফেমিন কোড এর সামান্য সংশোধণ করা হয়। এই সময় দূর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পাবার জন্য কৃষি বিষয়ক পরিসংখ্যান সংগ্রহ এবং একত্র করবার কথা ভাবা হয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন হয় ১৯০১ এর ফেমিন কমিশন এর সুপারিশ অনুযায়ী। ঐ সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৯৮ এর ফেমিন কমিশন প্রবর্তিত ন্যূনতম মজুরী ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়।
পরবর্তী চল্লিশ বছর তেমন কোন বড় অভাব বা দূর্ভিক্ষের মুখোমুখি ভারতবাসীকে হতে হয়নি। ১৯৪৫ এর ফেমিন এনকোয়ারি কমিশন এর অনুসন্ধান অনুযায়ী ফেমিন কোড এর কার্যকারীতা এই সময় মোটামুটিভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। কেননা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট অভাবের মোকাবিলা করার জন্য প্রশাসনিক স্তরের হস্তক্ষেপ এবং নির্দেশাবলী কার্যকরী হয়েছিল।
কিন্তু বাঙলার ১৯৪৩ এর দূর্ভিক্ষের পিছনে প্রাকৃতিক কারণ বা ফসল কম হওয়া তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না, কেননা এই দূর্ভিক্ষ ছিল মানুষের তৈরী করা। তার উপর যুদ্ধের আবহাওয়ায় পোড়ামাটি নীতির প্রয়োগ। বিশেষত Denial Policy (Denial to Rice এবং Denial to Boat)। এই দুটি নীতির প্রয়োগ বাঙলার গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আয় উপার্জনহীন সর্বহারাতে পরিণত করেছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যানবাহন এবং পরিবহণ ব্যবস্থা বেশির ভাগ নৌকার উপর নির্ভরশীল ছিল। সেই সময় বেশির ভাগ নৌকা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী ভেঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জাপানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে। তার দুটি অংশ এই Denial Policy, যাতে জাপানী সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে পৌঁছলেও রসদের যোগান না পায়। অতিরিক্ত ধানচালের সঙ্গে প্রায় ৪৫০০০ নৌকা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করে দেয়। স্বভাবতই ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাজারে খাদ্যদ্রব্য অগ্নিমূল্য হবার কারণে ত্রাণের ব্যবস্থা শুরু করা হয় নি। কোন কাজের সৃষ্টি করা হয় নি যাতে লোকের কিছু উপার্জন হতে পারে। ফলত লক্ষ লক্ষ মানুষ আয় উপার্জনহীন অবস্থায় খাদ্যের সব ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে সারা বাংলার অনাহার পীড়িত মানুষের কলকাতায় আসা সুরু হল। একটু খাবারের সন্ধানে। বরং বলা যায় একটু ভাতের ফ্যানের আশায়। জুলাই এর মাঝামাঝিএই সমস্ত মানুষের একটু ফ্যান চাওয়ার আর্তনাদে কলকাতার রাস্তাঘাট ভরে গেল। এখানে সেখানে মানুষ খাবারের জন্য ভিক্ষা চাইতে লাগল। আগষ্টের মাঝামাঝি কলকাতার সমস্ত রাস্তা বুভুক্ষু মানুষের স্রোতে নিমজ্জিত হলো। প্রতিটি রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কের গাছের ছায়া তারা খুঁজতে লাগল। আগষ্ট মাসের তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে রেলওয়ে ষ্টেশনগুলির শেড এর নীচে মাথা গোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হল। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পুরো ফুটপাত জুড়ে কাপড় টাঙ্গিয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় নিল বহু মানুষ। দিনের বেলা বড়রা দু একজন শিশুকে নিয়ে খাবারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। রাত্রিবেলা মিলিত হত এই ছাউনিগুলিতে। ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে সারি সারি রাত কাটাত। এই সর্বব্যাপী অনাহারের মধ্যে ততদিনে শুরু হল ম্যালেরিয়া, কলেরা এবং পেটের গন্ডগোল। আরো মানুষ প্রাণ হারাতে লাগলেন সবার চোখের সামনে, উন্মুক্ত আকাশের নীচে।
৩
আমরা আগেই দেখেছি ১৮৮৩ র ফেমিন কোডের বর্ণিত ত্রাণ-নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের প্রাণ রক্ষা করা। অনাহার অর্ধাহারে শীর্ণ কর্মক্ষমতাহীন শ্রমজীবি মানুষদের ‘সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জন’ এর সঙ্গে ‘কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা’ বজায় রাখার উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার কোন তালমিল ঘটলো না। ঋণের জন্য বিব্রত হওয়া বা ত্রাণের জন্য খরচের বোঝা বহন করার থেকে দূর্ভিক্ষ ভালো বলে ব্রিটিশ সরকারের মনে হলো। এই বিষয়ে নিযুক্ত প্রশাসকদের বলে দেওয়া হল ত্রাণের জন্য তেমন খরচ করবার দরকার নেই যাতে সঞ্চয়ের গতি কমে বা মানুষের স্বয়ম্ভরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দূর্ভিক্ষ বা অভাবের পরিস্থিতিতে সামাজিক গঠন এবং মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সেই পরিস্থিতিতেও ত্রাণের জন্য আর্থিক সংকোচন কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
অন্যান্য পদক্ষেপ ছাড়া ফেমিন কোডের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা এবং প্রকৃত ত্রাণের কাজ শুরু করা । এখানে লক্ষণীয় যে পঞ্চাশের আকালে শুধুমাত্র দূর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয় নি তাই নয় কোনো রাজনৈতিক দলও ফেমিন কোড অনুযায়ী দূর্ভিক্ষ ঘোষণার দাবী করেনি। যদিও দূর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের দাবী উঠেছিল এবং অনুসন্ধানকারী কমিশন তৈরী হয়েছিল। ফেমিন কোডের নিয়ম অনুযায়ী দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পর নিম্নলিখিত বিষয়গুলির হিসাব করা প্রয়োজনঃ
১) বিগত দশ বছরের কৃষি উৎপাদনের অবস্থা
২) মৃত্যু হারের অবস্থা
৩) দারিদ্রের অবস্থা
৪) অপরাধ ঘটার মাত্রা ও অবস্থা
৫) অজানা লোকের অন্তঃপ্রবাহ
৬) ক্রমবর্ধমান যাওয়া আসা এবং অস্থিরতার চিহ্নগুলি
৭) গবাদি পশুর অন্যত্র চলে যাওয়া
৮) অভাবের হারের (সাধারণ দামের ৪০%) থেকেও দাম বেড়ে যাওয়া
৯) জনসাধারনের স্বাস্থ্যের অবস্থা
১০) খয়রাতি সাহায্যের স্থানে দুমাসের উপর এক শতাংশের বেশি জনসাধারনের উপস্থিতি
১১) বিগত কয়েক বছরের উপর্যুপরি চাষ নষ্ট হওয়া
১২) বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অভাব
এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও একত্র করবার বাহানায় আড়াল করা থাকে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা। এই বিবিধ ধরনের দুরূহ তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের কাজ পাবার সম্ভাবনা কঠিন করে তোলা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাছাড়া ন্যূনতম মজুরীর বদলে কাজের পরিমানের উপর মজুরী নির্দ্ধারণের নিয়ম সর্বহারা মানুষদের জীবন আরো সংকটপূর্ণ করে তুলল। কোন খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হল না এবং পরিবারের অন্যান্য নির্ভরশীল সদস্যদের ও কোন ত্রাণ দেওয়া হল না। এই ব্যবস্থা কোনভাবেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। সুতরাং দেশ জোড়া কাজের আকালের মধ্যে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশ হিসাবে পরিগণিত হলেন।
যদিও আশ্চর্যজনকভাবে আকালের সময় ত্রাণ বিতরণ করা সামগ্রিক গ্রামোন্নয়নের একটি পন্থা হিসাবে ধরা হতো। এই ত্রাণের মাধ্যমে আপত্কালীন কর্মসংস্থান, সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, গবাদি পশু সংরক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করার সুযোগ ঘটতো। সাময়িক কাজের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিক উন্নয়নে সাহায্য হতো, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্যান্যরা কিছুদিনের জন্য হলেও এই উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের অংশ হতে পারত। তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের আবহেও ফেমিন কোড বর্ণিত এই ত্রাণ নীতি শাসনতন্ত্রের অনেকটাই মানবিক চেষ্টা বলে মনে হয়। কেননা ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পরবর্তীকালে মূলত এই নীতি গুলিই সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক নীতি হিসাবে আরও পরিবর্ধিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে।