সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমরা সবেমাত্র স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েছি। ব্রিটিশরা দুশো বছরের শাসনে শত শত আইন তৈরি করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৭৫টি বছর এই দেশ শাসিত হয়ে আসছে ১৯৪৭-এর আগে ও পরে তৈরি দুই ধরনের আইন দ্বারাই।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসন প্রণয়ন জরুরি। কিন্তু অনেক সময়ই আইনই হয়ে ওঠে অপশাসনে শাসকের অস্ত্র। ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে দুশো বছর অধীনস্ত ভারত নানাভাবে আইনি অপশাসনের শিকার হয়েছে। আবার স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৭৫ বছরেও এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
তবে অবশ্যই ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা চলাকালীন কালো অধ্যায়ের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। একইভাবে এ দেশের সংবাদমাধ্যমের প্রায় আড়াইশো বছরের ইতিহাসের একটি পর্ব নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিজেপি সরকারের চলমান সাড়ে নয় বছরের শাসনামল। যে পর্বে দৃশ্যত কোনও সরকারি বিধি বলবৎ ছাড়াই শাসকেরা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে সক্ষম হয়েছেন।
তুলনায় প্রতিবাদ কার্যত শূন্য। বরং, হরণের চেয়ে এই পর্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে সংবাদমাধ্যমের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে স্বাধীনতা বর্জনের জন্য। বলা চলে আজকের ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। কারণ, স্বাধীনতা মানুষকে প্রশ্ন করার অধিকার, সাহস জোগায়। আজকের ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন করাতেই যত ভয়। তা সে দেশের চলমান রাজনীতি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত থেকে সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে হেনস্থার ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের অভাবনীয় নীরবতাই সবচেয়ে দৃশ্যমান। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার নামে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির তৈরি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ইনডেক্সে ভারতের ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া বা অবনতির খবর হয় বটে, কিন্তু প্রথম সারির খবরের কাগজ সেই ক্রমাবনতির কারণ অনুসন্ধান করে না। আজকের সাংবাদিকতা তাই সব অর্থেই প্রশ্নবিহীন।
আশাকরি, এই মূল্যায়নের জন্য কেউ সব সংবাদমাধ্যমকে এক গোত্রে ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করবেন না। সেটা যে আমার সচেতন সিদ্ধান্ত নয়, এই লেখাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। একজন সাংবাদিক হিসাবেই সংবাদমাধ্যমকে এভাবে কাটাছেঁড়া আমার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত যা সময়ের দাবি বলেও মনে করি।
নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হল আইনের শাসনের পূর্ব শর্ত। নাগরিক অধিকার কোন দেশে সত্যিকার কতটা সুরক্ষিত, তা প্রতিফলিত হয় সংবাদমাধ্যমে। সংবাদমাধ্যমের অধিকারকে তাই স্বাধীন ভারতেও ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকারের ঊর্ধ্বে রাখা হয়নি। শুরুতে আমরা খানিক পিছন ফিরে দেখি পরাধীন ও স্বাধীন দেশে সংবাদপত্র নাগরিক অধিকার রক্ষায় কীভাবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
১৭৭৩ সালের দ্য রেগুলেটিং অ্যাক্ট ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম আইন যা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিষয়ে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষ সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্ত হওয়ার পর সে দেশের সংসদে একের পর এক আইন তৈরি হয়েছে এ দেশকে শাসন করার লক্ষ্যে। বলাই বাহুল্য সেগুলি অনেকাংশে ছিল ব্রিটিশ আইনের প্রতিলিপি।
তেমনই একটি পদক্ষেপ ছিল ১৮৬০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রণয়ন, যার দ্বারা অপরাধের চরিত্র, সংজ্ঞা নিরুপণ এবং সাজা নির্ধারণ করা হল। যেমন খুনের বিচার হবে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায়, ৩০৭ ধারায় মামলা হয় খুনের চেষ্টার অপরাধে।
এমনই একটি ধারা ১২৪ এ। ফৌজদারী দণ্ডবিধির দশ বছরের মাথায় তাতে ধারাটি যুক্ত হওয়ার পর ভারতবাসীর ভাগ্য যেন রাতারাতি আমূল বদলে যায়। পরবর্তী ৭৭ বছর যে ধারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠরোধে ব্রিটিশের সেরা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হল যার ছোঁবল থেকে রেহাই পেলেন না মহাত্মা গান্ধী সহ শত শত স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাসনাধীনে ধারাটিকে বলা হল রাজদ্রোহ। ইংরিজিকে সিডিশন। স্বাধীন ভারতে সিডিশনই হল দেশদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহ। ধারাটির বয়স এখন দেড়শো বছরের বেশি।
অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ‘মৃত আইন’ বা
‘ডেড ল’ হয়ে হারিয়ে যায়নি ধারাটি। বরং দেড়শো পেরিয়ে রীতিমত সজীব এবং অবশ্যই বিতর্কিত। তার কারণ, জন্মলগ্ন থেকে ধারাটির বিতর্কিত বিধান ও আপত্তিজনক প্রয়োগ।
এই একই ধারা ভারতের পাশাপাশি ভিন্ন নামে উপমহাদেশের বাকি দুই দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বলবৎ আছে। মাস কয়েক আগে লাহোর হাইকোর্ট ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেটির কিছু বিধান স্বাধীন ভারতের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী ঘোষণা করে ধারাটি সংশোধনের সুপারিশ করেছে। শীর্ষ আদালত ধারাটি কার্যকরে স্থগিতাদেশও জারি করে, যা পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আবার ভারতের আইন কমিশন সময়ের দাবি মেনে ধারাটি বহাল রাখার পক্ষে মত দেওয়ার পাশাপাশি সেটির কিছু বিধান আরও কঠোর করার সুপারিশ করেছে।
আমরা এই অবকাশে একটু পিছনে ফিরে তাকাই এবং বোঝার চেষ্টা করি আইনের এই একটি ধারা কীভাবে আমাদের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা নাগরিক অধিকারের সামনে খড়্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ধারাটির মূল বক্তব্য হল, কেউ কোনও ভাবে, তা সে লিখিত, মৌখিক বা কোনও দৃশ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে যদি সরকারের অবমাননা করে বা করার চেষ্টা করে, সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ায় বা ছড়ানোর চেষ্টা করে, তা হলে তা দেশদ্রোহিতা বলে গণ্য হবে। আর তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে আজীবন কারাবাস। সঙ্গে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবমাননার ব্যাখ্যা জুড়ে দেওয়া আছে।
যে কোনও সচেতন নাগরিক বুঝবেন, এমন কথা ধারাটিতে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কী হতে পারে। ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে এমন বিধান থাকা মানে বলাই বাহুল্য, সংবাদপত্র পদে পদে সরকার বাহাদুরের গোসার কারণ হবে।
রাজদ্রোহ নামক ধারাটি বলবৎ হওয়ার কারণটি সম্ভবত নিহীত ছিল ১১০ বছর আগে। সে বছর অর্থাৎ ১৭৮০ সালে ভারতের প্রথম সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। ইংরিজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রটির নাম ছিল হিকিজ বেঙ্গল গেজেট। জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন আইরিশ। তিনি যেন ব্রিটিশ প্রভূদের ঘুম কাড়বেন বলেই খবরের কাগজ প্রকাশে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আজকাল উৎকোচ অর্থাৎ ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ গা সহয়া হয়ে গিয়েছে। ঘুষের বিনিময়ে চাকরি তো রাজ্য রাজ্যে পরিচিত অভিযোগ। ভারতের প্রথম সংবাদপত্রের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তদন্তধর্মী সাংবাদিকতা। ব্রিটিশ প্রভূদের অন্দরমহলের অনাচারের ঘটনায় উঁকি দিয়েছিলেন হিকি সাহেব। একটি খবরে দাবি করা হয় গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সুপ্রিম কোর্টের ভারতীয় প্রধান বিচারপতিকে ঘুষ দিয়েছেন। এছাড়া করের বোঝা চাপানো, বাক্ স্বাধীনতা হরণের মতো অভিযোগ নিয়েও সরব হন হিকি। এমনকী পত্রিকাটি ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের বিদ্রোহ করতেও উৎসাহ দিয়েছে, সরকার কাগজটির কণ্ঠরোধে এমন গুরুতর অভিযোগ তুলেছিল।
ভারতের সংবাদপত্র, সাংবাদিকতার মান নিয়ে আজ যত প্রশ্নই থাক, এর সূচনা পর্বে ছিল নীতিনিষ্ঠ, দৃঢ, আপোসহীন অবস্থান। ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হল, খবরের কাগজ ও সাংবাদিকেরা একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। একটি লড়াই ছিল আর একটির পরিপূরক।
সেই নীতিনিষ্ঠ, সাহসী অবস্থানের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন হিকি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চোখে যে কারণে তাঁর কাগজ হয়ে উঠল ‘উদ্ধত’ এবং লেখকেরা হলেন ‘দুর্বৃত্ত’। তবু দমানো যায়নি ভদ্রলোককে। জেলে গিয়েও নয় মাস কাগজ চালিয়ে গিয়েছেন।
অন্যদিকে, হিকিকে জব্দ করতে বারে বারে মানহানির মামলা করেও নিজের গদি বাঁচাতে পারেননি হেস্টিংস। হিকির বেঙ্গল গেজেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে মান্যতা দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দেশে ফিরে যেতে বলে হেস্টিংস ও প্রধান বিচারপতিকে। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রত্রিকাটির অকাল মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। তখনও রাজদ্রোহ আইন প্রণয়নের কথা ব্রিটিশ প্রভূদের মাথায় আসেনি। কারণ, তখনও চালু হয়নি ফৌজদারী দণ্ডবিধি।
বাংলায় সাংবাদিকতার সূচনা হয়েছিল শ্রীরামপুরে। সেটা ১৮১৮ সালের কথা। সেই শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনে প্রকাশিত হল বাংলায় লেখা প্রথম সাময়িকি দিগদর্শন। একই বছরে প্রকাশিত হয় সমাচার দর্পণ। সেটিকেই বাংলায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র হিসাবে ধরা হয়।
নতুন নতুন খবরের কাগজ আত্মপ্রকাশের পাশাপাশি চালু হয়েছে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের আইনি ব্যবস্থাপনা। ব্রিটেনকে আধুনিক উন্নত গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে তারা সংবাদপত্রকে দেখত রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে। হিকিজ বেঙ্গল গেজেট চালুর দু দশকের মাথায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সেন্সরশিপ অফ প্রেস অ্যাক্ট চালু করলেন মূলত ফরাসিদের আটকাতে। ফরাসি বণিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা আটকাতেই মূলত এই প্রি-সেন্সরশিপের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তার প্রভাব পড়েছিল ভারতীয় সংবাদপত্র উদ্যোক্তাদের উপরও।
কাছাকাছি সময়ে ভারতে সংবাদপত্রের বিস্তার আটকাতে ব্রিটিশ সরকার দুটি লাইসেন্সিং আইন চালু করে। প্রথম লাইসেন্সিং রেগুলেশন আইনটি চালু হয়েছিল ১৮২৩ সালে। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সংবাদপত্রের নিবন্ধন। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ছাপাখানাগুলিকেও। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই লাইসেন্স বাতিল করা হত। বন্ধ হয়ে যেত পত্রিকা প্রকাশ। এই আইনের বলি জনপ্রিয় পত্রিকাটি ছিল দ্য কালকাটা জার্নাল। যে পত্রিকা সরকারের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল।
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে দ্বিতীয় লাইসেন্সিং আইনটি চালু হয়েছিল ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহ শুরুর অব্যবহিত পর। লর্ড ক্যাংনিয়ের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে দেশীয় সংবাদপত্রগুলি তো বটেই, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত খবরের কাগজও বিদ্রোহীদের নানাভাবে মদত করছে।
এই পদক্ষেপের আগে প্রথম লাইসেন্সিং আইনটি রদ করে ১৮৩৫ সালে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মেটকাফে। নয়া প্রেস অ্যাক্টের সুবাদে সংবাদপত্র মালিকদের দমবন্ধকর অবস্থার খানিক অবসান ঘটে। এই বিষয়ে গবেষণাকারীরা মনে করেন, ভারতীয় সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ইতিহাসে মেটকাফের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। জেমস অগাস্টাস হিকির মতোই সংবাদপত্রের ইতিহাস তাঁকে বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ।
আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে সংবাদপত্র দেশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য যুগপৎ লড়াই বা সংগ্রাম চালিয়েছে। ফলে তৎকালীন সময়ে কিছু ব্যতিক্রম বাদে সংবাদপত্রের মালিক থেকে শুরু করে সাংবাদিক-অসাংবাদিক সকলেই ছিলেন স্বাধীনতার সৈনিক। খবরের কাগজে চাকরি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বলাই বাহুল্য, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রসার যত বেড়েছে ততই স্বাধীনতার স্পৃহা পল্লবিত হয়েছে। বিশেষ করে মহাবিদ্রোহ সেই পরিস্থিতির বীজ বপন করে দিয়ে যায়।
ব্রিটিশ শাসকেরা উপলব্ধি করতে পারছিলেন ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলি জনগণের আশা আকাঙ্খাকে এমনভাবে তুলে ধরছে যে প্রশাসন প্রতিপদে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। মানুষ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সরকারকে। আর সংবাদপত্রই সাধারণ নাগরিকের মুখে ভাষা জোগাচ্ছে। যদিও ততদিনে স্বাধীনতা অর্জনের পথ ও উপায় নিয়ে একাধিক মত ও পথ তৈরি হয়েছে। গঙ্গার একাধিক শাখা ও উপনদীর মতো কংগ্রেসের অন্দরে নানা মতের স্রোত ঘিরে বিরোধ। কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই তাতে বিন্দুমাত্র গতি হারায়নি। আর এই ব্যাপারে অন্যন্য কর্তব্য পালন করেছিল দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলি।
তাই ১৮৭৮-এ শুধুমাত্র দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির জন্য চালু হল ভিন্ন একটি আইন। কৌশল হিসাবে গ্রহণ করা হল দেশদ্রোহের অভিযোগ। লক্ষণীয় এর ঠিক সাত বছর আগে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যুক্ত হয় ১২৪-এ ধারাটি। অথাৎ মহা দানবীয় ধারা ‘রাজদ্রোহ’। স্বাধীন ভারতে যা দেশদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহ।
লর্ড লিটন ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট চালু করা মাত্র শিশির কুমার ঘোষের অমৃতবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী রাতারাতি তাঁদের বাংলা প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে পুরোটাই ইংরিজি করে নেয়। কাজটা হিমালয়ের মাথায় চড়ার মতো কঠিন ছিল। কিন্তু যে কথা আগে বলছিলাম, ভারতের সাংবাদিকতার সোনালী অতীতের সিংহভাগই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অধ্যায় যখন সাংবাদিকতা ছিল দেশসেবারই এক প্রতিরূপ। অমৃতবাজারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শিশির কুমার নীল বিদ্রোহকে বাংলার প্রথম বিপ্লব বলে অভিহিত করেন। ১৮৭৪-এর পয়লা জানুযারি তাঁর পত্রিকায় তিনি লেখেন, ‘সংবাদপত্র হল একমাত্র উপকরণ যার সাহায্যে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।’
এই পর্বে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাটিয়ট পত্রিকার ভূমিকাও চির স্মরণীয়। নীলকর সাহেবদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই পত্রিকাকে মামলায় বিদ্ধ করার শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই পত্রিকাই সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহকে জাতীয় মহাবিপ্লব বা গ্রেট ইন্ডিয়ান রিভোল্ট বলে অভিহিত করে।
আরও আগে, ভারতে সাংবাদিকতা এবং দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন রাজা রামনমোহন রায়। তিনি ইংরিজির পাশাপাশি বাংলা এবং ফারসি ভাষায় সাময়িকী প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলি ছিল সংবাদ কৌমুদী, ব্রাহ্মণীক্যাল ম্যাগাজিন, মীরাত-উল-আখবার, বঙ্গদূত এবং বেঙ্গল হেরাল্ড। তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারে হাতিয়ার করেছিলেন পত্রিকাগুলিকে।
ভারতে সংবাদপত্রের ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালেই বোঝা যায় কীভাবে স্বাধীনতার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যখন উত্তাল যুক্ত-বঙ্গ তখনই প্রণয়ন করা হয় নিউজপেপার অ্যাক্ট (ইনসাইটমেন্ট টু অফেন্স) আইন। সেটা ১৯০৮ সাল। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার বিপ্লবী পর্ব। অরবিন্দ ঘোষ ততদিনে পাকাপাকিভাবে বাংলায় বসবাস শুরু করেছেন। হাজার হাজার যুবক-যুবতী তাঁর কথায় স্বাধীনতার লড়াইয়ের ডাকে ঘর-সংসার ছাড়ছে। অধূনা বাংলাদেশের বরিশালে ব্রিটিশ পুলিশের নিপীড়নের প্রতিবাদে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় যেন আগুন ছড়িয়ে দিল গোটা বাংলায়। পত্রিকাটি লিখল, ‘দেশের ৩০ কোটি জনগণ তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরলে তবেই এই অত্যাচার বন্ধ হবে।’
কলকাতার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের সেই নির্দেশের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছিল বাংলা সংবাদপত্র। ইংরেজ সার্জেন্টের অত্যাচারের প্রতিবাদকারী কিশোরকে কিংসফোর্ড বেত মারার আদেশ দিলে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সন্ধ্যা পত্রিকায় লেখা হয়, ‘বালক সুশীলের অঙ্গে এই বেত্রাঘাত যেন দেশবাসীর অঙ্গে আঘাত করিল।’ কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ গান লিখলেন, ‘আমায় বেত মেরে কি মা ভোলাবি, আমি কি মায়ের সেই ছেলে?’
ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড দেশীয় সংবাদপত্রগুলির উপরও ছিলেন খড়্গহস্ত। কুখ্যাত এই ইংরেজ বিচারককে মুজফ্ফরপুরে হত্যা করতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি। সেটা ১৯০৮ সাল। সেই বছরই চালু হয় নিউজপেপার অ্যাক্ট (ইনসাইটমেন্ট টু অফেন্স)। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে এমন সংবাদপত্রকে বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় জেলাশাসকদের। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি আমলার অনুমানই যথেষ্ট ছিল।
এই আইনের আদলেই ১৯৩১-এ চালু হয় ইন্ডিয়ান প্রেস (ইমারজেন্সি পাওয়ার্স) অ্যাক্ট। সরকার বিরোধী প্রচারে লিপ্ত সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা এই আইনে প্রাদেশিক সরকারগুলিকে হস্তান্তর করা হয় আরও নিবিড়ভাবে দেশীয় সংবাদপত্রের উপর নজরদারি চালানোর উদ্দেশে।
আগেই উল্লেখ করেছি, দেশ বরেণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে সংবাদপত্রকে হাতিয়ার করেছিলেন। সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য নাম অবশ্যই বাল গঙ্গাধর তিলক এবং মহাত্মা গান্ধী।
১৮৮১-তে প্রকাশিত তিলকের মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা কেশরী শুধু স্বাধীনতার লড়াই নয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতেও গর্জে উঠেছিল। মারাঠা নামে একটি ইংরিজি পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি। তিলকের পত্রিকার হাত ধরেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন গোটা দেশের নজর কেড়েছিল। ইতিপূর্বে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যে রাজদ্রোহ ধারার কথা বলেছি, সেই কুখ্যাত ধারায় তিলককে তিনবার অভিযুক্ত করে ব্রিটিশ প্রশাসন। তাঁকে ছয় বছরের জন্য বার্মা অধূনা মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠায় সরকার।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির লড়াই যুগপৎ চলেছিল বলেই জাতীয় কংগ্রেসের নেতা এবং সভাপতিদের অনেকেই খবরের কাগজ, সাময়িকীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অথবা সম্পাদনার কাজ করেছেন। যেমন লালা লাজপত রায় তিনটি সাময়িকী ‘পাঞ্জাবী’, ‘বন্দেমাতরম’ এবং ‘পিপল’ সম্পাদনা করতেন। ‘লিডার’ সংবাদপত্রের পরিচালন পর্ষদের শীর্ষে ছিলেন মতিলাল নেহরু। ফিরোজ শাহ মেহতা ‘বম্বে ক্রনিক্যাল’ এবং পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ‘হিন্দুস্থান’ সম্পাদনা করতেন। জওহরলাল নেহরুর ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ টিকে ছিল ২০০৮ পর্যন্ত।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর কয়েক আগে ন্যাশনাল হেরাল্ডের সম্পাদকের দায়িত্ব নেহরু সঁপেছিলেন যুগ্ম সম্পাদক তথা প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক এম চলপতি রাউয়ের হাতে। একটি খবর নিয়ে একবার ব্রিটিশ সরকার কড়া মামলা ঠুকল পত্রিকার বিরুদ্ধে। সম্পাদকের জেলযাত্রা নিশ্চিত। নেহরু নিজে তখন জেলে। পত্রিকার লোকজন জেলে গিয়ে তাঁর পরামর্শ চাইলেন, কী করণীয়। ক্ষমা চেয়ে মিটিয়ে নেওয়া হবে কি? নেহরু পরামর্শ দিলেন, ‘কখনই না। সাংবাদিকতার অধিকার, সম্মান নিয়ে আপোস করা চলে না। সম্পাদককে জেল যেতে হলে সেটাই হবে বরং গর্বের।’
গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান কালেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বুঝেছিলেন জনমণে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগাতে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন অপরিহার্য। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন পত্রিকা’। দেশে এসে প্রকাশ করেন, ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’, ‘নবজীবন’, ‘হরিজন’, ‘হরিজন সেবক’ ইত্যাদি। সংবাদপত্রের ইতিহাসের গবেষকেরা একবাক্যে মানেন গান্ধী ছিলেন একজন প্রথম সারির সম্পাদক। একদিকে সংবাদপত্রকে তিনি যেমন সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, অহিংস আন্দোলনে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতে ব্যবহার করেছেন, অন্যদিকে খবরের কাগজকেই হাতিয়ার করেছিলেন সমাজকে অস্পৃশ্যতা মুক্ত করতে।
হরিজন পত্রিকায় সরকার বিরোধী নিবন্ধের জন্য গান্ধীর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের ধারায় মামলা হয়। ব্রিটিশরা এই আইন প্রয়োগ করে শাস্তি দিয়েছে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেহরু এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য নেতাদেরও। এই আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর গান্ধী বলেছিলেন, ‘আইনের চোখে যেটা ইচ্ছাকৃত অপরাধ, নাগরিক হিসাবে আমার কাছে সেটা মহত্তম কর্তব্য।’
গান্ধী সাংবাদিকতাকে এতটাই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন যে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হত না। তাই নিষ্ঠাবান সংবাদপত্র কর্মীর মতো কাগজ বিক্রিতেও ছিলেন সমান মনযোগী। সাংবাদিকতাকে ভালবাসতেন বলেই গান্ধী সম্পাদনার জন্য এক পয়সা বেতন নিতেন না। সাংবাদিকতাকে আর্থিক শৃঙ্খল মুক্ত রাখতেই বিজ্ঞাপন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ৭৫টি বছর কেটে গিয়েছে, সেই রাজদ্রোহ ধারাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ নামে দিব্যি চালু আছে। যদিও স্বাধীনতার পর ব্রিটিশের তৈরি অনেক আইনি বিধানই বাতিল হয়েছে।
আসলে সংবাদমাধ্যমকে সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হলেও আমাদের সংবিধানে সংবাদমাধ্যমের বিশেষ অধিকারের উল্লেখ নেই। সংবিধান প্রণেতাদের যুক্তি ছিল এই অধিকার ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যেই নিহীত আছে। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর ব্যাখ্যা ছিল আরও স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আলাদা করে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা মানেই তা সংবিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। সেটা অনুচিত।
তবে বিশেষ সাংবিধানিক অধিকারও যে সংবাদমাধ্যনের রক্ষাকবচ হতে পারে না, জরুরি অবস্থার দিনগুলিতেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫-এর ২৬ জুন ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেন। বলাই বাহুল্য এরপর আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন আসে না। খবরের কাগজের কণ্ঠরোধ করতে তিন ধরনের পদক্ষেপ করেছিলেন ইন্দিরা। এক, সরকারি বিজ্ঞাপন প্রদানে আমরা-ওরা নীতি প্রণয়ন। দুই, নজরদারীর সুবিধার্থে সব ক’টি নিউজ এজেন্সিকে সংযুক্ত করে দেওয়া। তিন, খবরের কাগজের মালিক ও অংশীদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন।
সংবাদপত্রের উপর সবচেয়ে বিপজ্জনক যে বিধি আরোপিত হয়েছিল তা হল, আগের দিন সন্ধ্যায় সরকারি আমলাদের কাছ থেকে পাশ করিয়ে আনতে হত পরের দিনের কাগজে কী ছাপা যাবে বা কী ছাপা যাবে না। সেই বিধির বেড়াজালে আটকে যায় রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির…….।’ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকারের তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় গণশক্তি’র তৎকালীন সম্পাদক প্রয়াত সরোজ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘আপনাদের উদ্দেশ্য ভাল না। এই কবিতা এখন ছাপা যাবে না।’ মারা যাওয়ার বছর খানেক আগে এক সাক্ষাৎকারে সুব্রতবাবু আমার কাছে তাঁর সেই তরুণ বয়সের ভুলের জন্য অনুশোচনা এবং ভুল স্বীকার করেছিলেন।
জরুরি অবস্থার সেই কালো অধ্যায়ের পর কেটে গিয়েছে ৪৮টি বছর। ইমার্জেন্সি জারি হয়েছিল সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ কার্যকর করে। মাঝরাতে জারি হয়েছিল প্রজ্ঞাপন, দেশবাসী যখন ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বাধীনতা হরণের সেই কালো দিনগুলিতেও সরকারের হয়ে গলা পাঠানোর মহৎ কর্তব্যে লিপ্ত হয়েছিল বেশ কিছু সংবাদপত্র। কিন্তু মূল ধারার সিংহভাগ সংবাদপত্রই মাথা নুইয়ে ছিল পরিস্থিতির চাপে। জরুরি অবস্থা উঠে যেতে অনেক সংবাদপত্রই সংবাদমাধ্যমের নীতি-আদর্শের ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
নয়ের দশকের গোড়া থেকে উদার অর্থনীতি চালিত ভারতবর্ষের নানা ক্ষেত্রের মতো সংবাদমাধ্যমও ক্রমে বদলে যেতে থাকে মূখ্যত দুটি কারণে। এক, সংবাদপত্রের আধুনিকতার দৌড়ে প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিপুল পুঁজির। দুই, বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য সুবিধা লাভের লক্ষ্যে সংবাদপত্র গোষ্ঠীগুলি সরকারের সঙ্গে দূরত্ব ঘুঁচিয়ে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জন্ম নেয় ‘ফিল গুড’ জার্নালিজমের, যা আদতে সরকারের ঢাক বাজানোর সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের একাংশ বরাবরই বৃহৎ পুঁজির বর্ম হিসাবে কাজ করেছে।
স্বাধীনতার আগেও কম-বেশি এই প্রবণতা ছিল। কিন্তু উদার অর্থনীতি পরবর্তী ভারতে সংবাদমাধ্যম নিজেই বৃহৎ পুঁজির অংশ হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমের মালিকানা ক্রমে চলে যায় ভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত কর্পোরেট সংস্থার দখলে।
মালিকানার চরিত্র বদল দুর্বল মেরুদণ্ডের এবং সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিককুল ২০১৪ পরবর্তী সময়ে কার্যত পেশার বিসর্জন নিশ্চিত করেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন না। তিনি নিজে না চাইলে প্রশ্ন করার অধিকার, সুযোগ কোনওটাই নেই। তারপরও ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এখন সরকার ও শাসক দলের মুখপত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কট্টর, নিষ্ঠুরতায় ভরা হিন্দুত্বের পাঠ পেতে এখন আর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পত্র-পত্রিকায় চোখ বোলানোর প্রয়োজন পড়ে না। প্রথম সারির টেলিভিশনের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানের পর্দা জুড়ে বিরাজ করেন অ্যাঙ্কর নামক হিন্দুত্বের সাধক-সাধিকারা। প্রথম সারির, বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের পরিবেশনার সঙ্গে সরকারের এজেন্ডার কোনও ফারাক নেই। বস্তুত, সাংবাদিকতার মান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর জন্য আলাদা করে আর স্বাধীনতার প্রয়োজন পড়ে না। তাই প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করার সুযোগ না দিলেও দীপাবলিতে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলার সাংবাদিকের অভাব হয় না। আসলে সাংবাদিকতা এখন প্রশ্নবিহীন।
অধিকার সরকারেরও আছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের তা একটু বেশিই প্রাপ্য। সংবাদমাধ্যম মিথ্যা, অতিরঞ্জিত, একপেশে খবর পরিবেশন করে না, এমনটা কেউই দাবি করবেন না। চালু ব্যবস্থাটি হল সাধারণ নাগরিক থেকে সরকার, প্রতিবাদ-পত্র পাঠিয়ে নিজের আপত্তি সংবাদমাধ্যমের নজরে আনা। সেই ব্যবস্থায় আমূল বদলে দিয়ে দিন দিন সরকারগুলি প্রতিবাদপত্র না পাঠিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদকের নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঠুকে দিচ্ছে। তাতে একজন সাংবাদিক বা একটি সংবাদমাধ্যমকে শায়েস্তা করার পাশাপাশি বাকিদেরও কড়কে দেওয়া যায়। যেমন, অপছন্দের লেখা, নিবন্ধ ইত্যাদির জেরে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে সরকারগুলির নয়া কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রের অবমাননা বলে চালানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কেরলের টিভি চ্যানেল সংস্থা মিডিয়া ওয়ানের লাইসেন্স বাতিলের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রের অবমাননা বলে দেখানো ভয়ঙ্কর প্রবণতা।
এই প্রসঙ্গে পবন জয়সওয়ালের কাহিনি একটু শুনে নেওয়া যাক। ক্যান্সার অকালে কেড়ে নিয়েছে এই তরুণ সাংবাদিককে। চিকিৎসা করানোর পয়সা ছিল না উত্তরপ্রদেশের একটি দৈনিকের এই জেলা সংবাদদাতার। ক্যান্সার কেড়ে না নিলে আরও নির্মম পরিণতিও হতে পারত তাঁর। স্কুলের মিড-ডে মিলে রুটির সঙ্গে সামান্য চিনিও নয়, এক চিমটি করে নুন দেওয়া হয়েছিল বাচ্চা পড়ুয়াদের। সেই দৃশ্য ভিডিও বন্দি করে খবর করেছিলেন তিনি। যোগী আদিত্যনাথের সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে খবর করার অভিযোগে দেশদ্রোহিতার মামলা ঠুকে দেয়।
হাতরাশ যাওয়ার পথে কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের গ্রেফতার এবং প্রায় দু’ বছর জেলে আটকে রাখাতে বহু সাংবাদিকের কলমের কালি ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনও সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক কিংবা তাঁদের সংগঠন দাবি করতে পারবে না, সিদ্দিকের জামিনে তাদের বিন্দুমাত্র অবদান আছে। সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের যার যার লডাই তাঁর তাঁর, এটাও মোদীর ভারতে নয়া প্রবণতা।
করোনাকালে জনপ্রিয় হিন্দি কাগজ ‘দৈনিক ভাস্কর’-এর উপর সরকারের আয়কর-অভিযানের কথা আমরা জানি। তার আগে ওই সংবাদপত্র করোনা মোকাবিলায় মোদী সরকারের মুখোস খুলে দিয়েছিল। প্রশ্ন তুলেছিল, করোনায় মৃত্যুর সরকারি হিসাব নিয়ে। সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা হলেই সরকার, সরকারের পেয়াদারা কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করেছে।
আমার মতে, করোনাকালেই আমরা ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিকতার কফিনে আরও একটি পেরেক ঠুকেছি ভাষ্য সাংবাদিকতায় (Briefing Journalism) পা মিলিয়ে, যা মহামারী বিদায় নেওয়ার পরও দিব্যি রাজ করে চলেছে। সরকারি ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী-মন্ত্রীদের ভাষ্য তুলে ধরাই মূল ধারার সাংবাদিকতায় প্রধান ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদমাধ্যম জুড়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী এই বললেন, আর ওই বললেন। কেন বললেন, সে ব্যাখ্যা মিডিয়াই উপযাজক হয়ে পরিবেশন করে চলেছে।
মোদী জমানার রোশানল থেকে বাদ যায়নি বিবিসি-ও। গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র ভারত সরকার যে দ্রুততার সঙ্গে নিষিদ্ধ করেছে স্মরণকালের মধ্যে তেমন নজির নেই। মোদী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লুকিয়ে চুরিয়ে যারা তথ্যচিত্রটি দেখেছেন তাঁরা একবাক্যে বলেছেন, খুব নতুন কথা তাতে কিছু নেই। তৎকালীন (২০০২) ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাঙ্গা নিয়ে উৎকণ্ঠা, নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত ইত্যাদি তথ্যগুলি নতুন হলেও দু দশক পর হয়তো ততটা তাৎপর্য আর বহন করে না। তারপরও তথ্যচিত্রটি এ দেশে প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞার কারণ সেটির নির্মাতা বিবিসি, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আছে।
গুজরাত দাঙ্গার দায় থেকে নরেন্দ্র মোদীকে মুক্তি দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। বিবিসি-র তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে সেটাই হতে পারত ভারত সরকার ও গেরুয়া শিবিরের সবচেয়ে বড় ঢাল। আসলে মোদী ও তাঁর অনুচরেরা জানেন, রাজনৈতিক কলঙ্ক কখনও আদালতের রায়ে মোছে না, এমনকী জনতার আদালতে বিপুল ভোটে জিতে এলেও না। তাই যদি হত, তাহলে ১৯৮০-র লোকসভা ভোটে জেতার পরই ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারতেন। আজও যে কলঙ্কের বোঝা তাঁর দলকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
বিবিসি-র পরিণতিও আর পাঁচটা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মতো হয়েছে। তারা আয়কর ফাঁকি দিয়েছে কী দেয়নি, আমরা জানি না। সেটি একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। সরকার তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভুত কিছু পেয়ে থাকতেই পারে। প্রশ্ন হল, গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তথ্যচিত্র প্রকাশের পর পর আয়কর হানাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সাজানো কঠিন। আসলে মোদী সরকার বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমকে শাসনে কূটনীতির কূটকৌশল নিয়েছে। যেমনটা আমরা কূটনীতির জগতে দেখে থাকি। ভারত ন্যায্য কারণে পাকিস্তানের দূতকে বহিষ্কার করা মানেই ইসলামাবাদ নয়া দিল্লির প্রতিনিধিকে সে দেশ ছাড়ার চিঠি ধরাবে। মোদী সরকারের বিরোধিতা, সমালোচনা মানেই দুয়ারে ইডি, আয়কর, সিবিআই।
এই লেখার গোড়ায় ইমার্জেন্সির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি। সেই সব দিনে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে সম্পাদক-সহ হাজার দুই সাংবাদিককে জেলে ঢুকিয়েছিল পুলিশ। সরকার বিরোধী লেখালেখির জন্য প্রায় সাত হাজার লেখককেও জেলের ভাত খেতে হয়। স্বাধীন ভারতে তা ছিল এক কলঙ্কময় অধ্যায়। যদিও বিশেষ রাজনৈতিক সংকট সংবিধান ও আইনের অপব্যবহার করেই অন্ধকারের দিকে দেশকে ঠেলে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। আজ অঘোষিত জরুরি অবস্থার স্বরূপটি ভিন্ন। স্বাধীনতার অমৃতকালে দেশ প্রত্যক্ষ করছে, সংবাদমাধ্যমের অধিকারহরণের দীর্ঘমেয়াদী, সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা কী নিপুণ কৌশলে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর সর্বশেষ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১। দু-তিন বছর আগেও তাতে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০।
পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার, এত দ্রুত অধঃপতনের এমন নজির দ্বিতীয়টি নেই। আরও আশ্চর্যের, প্রেস ফ্রিডমে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার থেকেও আমরা পিছিয়ে। প্রথম দেশটি জন্মলগ্ন থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনার শাসনাধীন। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন সেনা শাসনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের প্রতি তা চরম নির্মমতায় ভরা। মুসলিম ও বৌদ্ধরা সে দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। আর সেই দুর্দশার কাহিনি গোটা বিশ্ব জানতে পারছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের সুবাদেই।
পাকিস্তানেও সেনার রক্তচক্ষু প্রত্যক্ষ করেই সংবাদমাধ্যমকে টিকে থাকার লড়াই চালাতে হয়। দেশটিতে গণতন্ত্রের ধারণাটি এতটাই ভঙ্গুর যে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সেখানে একটি সরকারও পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। ইমরান খান অনেক প্রত্যাশা জাগিয়েও শেষে সেনার আস্থা হারিয়ে বিদায় নিয়েছেন। তিনি সেনাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। কিন্তু তাঁর কথা, তাঁর দলের প্রতিবাদ আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ গোটা বিশ্ব জানতে পারছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের সুবাদেই। মিডিয়া তাঁর কথা চেপে যাচ্ছে, এই মর্মে কোনও জোরালো অভিযোগ প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা যায়নি। অন্যদিকে, ভারতে রাহুল গান্ধী গত এক দশক যাবৎ প্রচার না পেয়ে উল্টে সংবাদমাধ্যমকেই স্বাধীনতা হরণ নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। যে দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, সেনা যেখানে শাসন ব্যবস্থায় নাক গলানোর সাহস পায়নি, নিয়ম করে ভোট হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর মাতৃভূমিকে গণতন্ত্রের জন্মভূমি বলে বড়াই করেন, সে দেশেই কিনা সংবাদমাধ্যমের নাভিশ্বাস উঠেছে। নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কী ভয়ঙ্কর!
এমন পরিস্থিতির জন্য সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদ কিংবা কোনও কালাকানুনের ধারা প্রয়োগ করতে হয়নি। সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা আজ স্বেচ্ছায় নতজানু। ব্রিটিশ ভারতের দুশো বছর এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৬, অর্থাৎ ২৭৬ বছরে শেষের সাড়ে নয় বছর আলাদা অধ্যায় বৈকি।