সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ইহুদিবাদ আর জায়নবাদের পার্থক্য হ’ল, ইহুদিবাদ একটি ধর্মবিশ্বাস, আর জায়নবাদ হলো ইহুদিদের একটা ছোট্ট অংশ দ্বারা পরিচালিত একটি জাত্যাভিমানী আন্দোলন। এতে যুক্ত হবার জন্য কারো ইহুদী হওয়া শর্ত নয়। পশ্চিমের অনেক খ্রিষ্টান বিভিন্ন কারণে এ আন্দোলনের সমর্থক এবং তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে জায়নাবাদী হিসেবে পরিচিত করে।
জেরুজালেমের যে টিলায় ইসরাইল বংশীয় বাদশা ও নবী হযরত দাউদ (আঃ) এর কবর রয়েছে, সেটাই জায়ন পর্বত। বিশেষভাবে এই টিলা সংলগ্ন অঞ্চলের অধিকার নেওয়ার লক্ষেই ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ফেরার যে আন্দোলন, এটাই জায়োনিজম।
ইসলাম, খ্রিষ্টান আর ইহুদিবাদ - এই তিন ধর্মই আব্রাহামিক ধর্ম। কারণ, তিনটি ধর্মই আব্রাহাম তথা ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তানদের হাত ধরেই শুরু। তার আগে ছিল মিল্লাতে ইব্রাহিম (আঃ)। ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তান ইসমাইল (আঃ) মক্কা ও তার আশপাশে এই ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিলেন।
মক্কার বাসিন্দারা মূলত হযরত ইলমাইল (আঃ)-র বংশধর। মক্কার গোত্রপতি ‘আমর বিন লুহাই’, ‘শামদেশ’ (বর্তমানে সিরিয়া, জর্ডন, লেরানন ও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড) ঘুরতে গিয়ে পৌত্তলিকতা ও বহুশ্বেরবাদের প্রচলন দেখতে পান। সেখানেই তিনি মূর্তি পুজোর অনুষ্ঠান দেখে প্রভাবিত হন এবং ফিরে এসে মক্কাতেও মূর্তিপূজার প্রচলন করেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত তথ্যমতে, এই মূর্তিপূজাসহ সকল প্রকার অংশিবাদ ও সামাজিক অবিচার-অনাচার থেকে আরব জাতি ও সারা বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিতে মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন।
ইব্রাহিম (আঃ)-এর জন্ম ইরাকে হলেও তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে তার দুই স্ত্রীর প্রথমজনকে ফিলিস্তিনের হেবরনে এবং দ্বিতীয়জনকে পবিত্র মক্কায় সেটেল্ড করেন। কুরআনী তথ্যমতে, ওনার বৃদ্ধা প্রথম স্ত্রী সারার ঘরে অলৌকিকভাবে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আঃ)। আর ইসহাক (আঃ) এর ঘরে জন্ম নেন ইয়াকুব (আঃ), যিনি ইসরাইল নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইহুদিদের আদি ধর্মগ্রন্থ হলো তাওরাত, যা ইংরেজিতে ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত। তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিল মুসা (আঃ)-এর উপর। তাওরাতকে ইহুদিদের আইনগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তাদের জীবনযাপন করার সকল নির্দেশনা বিস্তারিত দেওয়া ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ইহুদি রাজন্যবর্গ এতে অনেক বিকৃতি এনেছেন বলে ‘কুরআন মাজিদ’-এ উল্লেখ আছে।
বনী ইসরাইল’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন নবী হলেন মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ)। জেরুজালেমে জন্মগ্রহণকারী নবী ঈসা (আঃ)-র উপর নাজিল (অবতীর্ণ) হয়েছিল ইঞ্জিল, যা ইংরেজিতে নিউ টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত। ঈসা (আঃ) ‘বনী ইসরাইল’র নবী হলেও সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ তাঁকে প্রত্যাখান করে এবং তাঁর বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র করে।
ওই সময় জেরুজালেম শাসন করতো রোমানরা। ঈসা (আঃ)-এর ওপর ইহুদিদের চেয়ে রোমানদের আস্থা অনেক বেশি ছিল। পরবর্তীতে ইমানদার রোমানদের মাধ্যমেই পার্শ্ববতী অঞ্চল ও ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারিত হয়।
মূলত বনী ইসরাইলের লোকেরাই হলো ইহুদি ধর্মের অনুসারী। তবে তাদের বাইরে পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব আফ্রিকার কিছু লোকও ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়েছে।
ইব্রাহিম (আঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার পুত্র মক্কায় বসবাসকারী হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর বংশে শেষনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (আঃ) এর আবির্ভাব হয়। তিনি ইহুদি, খ্রিষ্টান ও আরব উপদ্বীপের মিল্লাতে ইব্রাহিমির অনুসারীসহ পৃথিবীর সকল মানুষকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আহবান করেন। বিকৃতির শিকার ওসব ধর্মের যে রীতি-নীতি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আনীত একেশ্বরবাদী ইসলামের রীতি-নীতির সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক ছিল, সেগুলো পরিত্যাগ করতে বলেন। ফলে আরবদের অধিকাংশই, খ্রিষ্টানদের অনেকেই এবং সেই সাথে কিছু ইহুদিও ইসলাম গ্রহণ করে।
কুরআন মজিদে ইহুদিদেরকে ‘বনী ইসরাইল’ (ইসরাইলের সন্তানবর্গ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইসরাইল ও ইয়াকুব (আঃ) একই মানুষ। ওনার জ্যৈষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল ইহুদা। এই ইহুদার সাথে সম্পৃক্ত করেই ‘বনী ইসরাইল’কে ইহুদি বলা হয়।
ইয়াকুব (আঃ)এর সন্তান ইউসুফ (আঃ)-এর মিশরে রাজত্বকালে ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে মিশরে সেটেল্ড হয়েছিলেন। পরে তাঁরা ফেরাউনের অত্যাচারের শিকার হন। নবী মূসা (আঃ) এসে ফেরাউনের মোকাবেলা করে তাদেরকে সেই জুলুম থেকে মুক্তি দেন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে ‘বনী ইসরাইল’ একসময় ফেরাউনের জুলুমের শিকার হয়েছিল, সেই ‘ বনী ইসরাইল’ এখন পশ্চিমা খ্রিষ্টানদের সহায়তা নিয়ে ফেরাউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ফিলিস্তিনের মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের উপর জুলুম করছে এবং তাদেরকে বাস্তুচ্যুত করে ও তাড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে সেটেল্ড করছে। সহীহ হাদীস মতে, কেয়ামতের আগে ‘শাম’ অঞ্চলে মুসলমানদের সাথে ইহুদি ও খ্রিষ্টনাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হবে। পশ্চিমা খ্রিষ্টানদের মদতে ‘শাম’-র মূল ভূমি ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকার রহস্য নিশ্চয় সেই যুদ্ধের নিকটবর্তীতা প্রমাণিত করে।
জায়নবাদ
তাওরাতে উল্লেখিত শেষনবী বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীতে প্রভাবিত হয়ে ইহুদিরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের অনেক বছর আগে ফিলিস্তিন ছেড়ে আরব উপদ্বীপের ইয়াসরিব (পরবর্তীতে মদীনা) নামক পল্লীতে সেটেল্ড হয়। কিন্তু শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সত্যি এলেন এবং মদীনায় হিজরত করলেন, তখন ইহুদি নেতারা ওনাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
শেষনবীর প্রতি মদীনবাসী আরবদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখে ইহুদিরা মৌখিকভাবে চুক্তি ও শান্তিতে বসবাসের কথা বললেও ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের হিংসাত্মক ষড়যন্ত্রে মদীনাকে মুসলমানমুক্ত করার উদ্দেশ্যে পঞ্চম হিজরীতে জঙ্গে আহযাব বা খন্দক (পরিখা) যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ইহুদি ও তাদের মিত্র মক্কার পৌত্তলিকরা পরাজিত হয়।
এই ঘটনার পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদি গোত্রগুলোকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা মদীনা থেকে ১৫৩ কিলোমিটার উত্তরে খাইবারের দিকে চলে যায়, যেখানে আগে থেকেই কিছু ইয়াহুদি গোত্র বসবাস করতো। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রঃ)-এর আমলে ইহুদিদেরকে খায়বার থেকে বিতাড়িত করা হলে তারা সিরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। অতঃপর তাদের অনেক গোত্র মিসর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও পূর্ব ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ শতকের দিকে দেখা যায়, ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড। সেখানে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের দ্বন্দ্ব লাগে এবং রাশিয়ায় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের সংঘাত শুরু হয়। তখন থেকেই অনেক ইহুদি বুদ্ধিজীবী তাদের পূর্বপুরুষদের একদা বাসস্থানে একটি ইহুদি রাষ্টের কল্পনা করেন। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন সেটাকেই জায়নাবাদী আন্দোলন বলা হয়।
জায়নবাদের উত্থান
ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে, তখন সেই জনপদ ছিল উসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৮ এবং ১৯ শতকে ইহুদীদের মধ্যে হাসকালা (Haskala) নামে একটি বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষার একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি করা। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল বার্লিন (জার্মানী)। সেই সময়ে ইহুদিদের অধিকাংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করতেন। তারা মনে করেন যে তাদের এখন একসঙ্গে থাকা উচিত এবং নিজেদের একটা সংস্কৃতি তৈরি করে একটি জনপদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এই চিন্তারই একটি রাজনৈতিক ধারণা দেন অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক থিওডর হেজেল। তিনি ইহুদিদের উপর বৈষ্যমের কথা তুলে ধরে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ড প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নেতারা বলেন, “জায়োনিজম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটা নিরাপদ আবাস নির্মাণ করা যেটি আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।”
এভাবে প্রতি দুই বছর অন্তর জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনে আইনগতভাবে সেটেল্ট হতে চাইলে সেটা উসমানী শাসকরা নাকচ করে দেন। এরপর তারা ব্রিটিশদের কাছে যায়। ব্রিটিশরা সেটেলমেন্টের জন্য বর্তমান আফ্রিকার উগান্ডাকে প্রস্তাব করে, কিন্তু তারা ফিলিস্তিনের জন্যই গোঁ ধরে বসে থাকে। এটা ১৯০২-০৪ সময়ের কথা। এরপর প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
জায়নবাদীরা ইহুদিদের সামান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করতো। তাদের বেশির ভাগই ছিলো রাশিয়ান ইহুদি। তবে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো অস্ট্রিয়ান ও জার্মান ইহুদি। এই জায়নবাদীরা সুসংগঠিত ছিল। তাদের নিজস্ব পত্রিকা ছিলো, তারা নিজেদের কার্যক্রমকে ইহুদি রেনেসাঁ বলে প্রচার শুরু করে।
১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পর অনেক ইহুদি দেশ ছেড়ে ফিলিস্তিনের দিকে চলে আসে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ সালে জায়োনিস্ট আন্দোলন রাশিয়ান ইহুদিদের হাতে চলে যায়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী দুই জায়োনিস্ট নেতা চেইম ওয়াইজম্যান এবং ন্যাহুম সকোলোর প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ইহুদিদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। সেটি পরে ১৯২২ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের (লিগ অব নেশন-এর) ম্যাণ্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর ফিলিস্তিনে ইহুদি সেটলারদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিনি ইহুদীর সংখ্যা ছিল যেখানে ১০ লাখ, সেটা ১৯৩৩ সালে হয় ২৩ লাখ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হবার পর ১৯১৯ সালে ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবানন দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় ফিলিস্তিন ও পূর্ব জর্ডান। বিশ্বযুদ্ধে উসমানী সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার জাত্যাভিমান মন্ত্রে উজ্জীবিত করে আরবদেরকে উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কে দেয় এবং তাদেরকে উসমানী সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলে।
এই অবস্থায় উসমানী সাম্রাজ্য সমর্থক সিরিয়ান আলিম ইজ্জুদ্দীন আল-কাসাসম (১৮৮২-১৯৩৫) মুসলিম যুবকদেরকে নিয়ে ফরাসী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়ে তোলেন। দামেস্ক ও আলেপ্পোতে তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় পরে (১৯২০) তিনি ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে চলে যান এবং সেখানে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করে লোকজনকে ইহুদি সেটেলারদের বিরুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদীদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম অপরিহার্য মনে করতেন। তিনি সেখানে আল-কাফ আল-আসওয়াদ (কালো হাত) নামে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ইহুদি সেটেলারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালের ৮ নভেম্বর শেখ জায়েদ পল্লীর একটি গুহায় ব্রিটিশ দখলদারদের পুলিশ আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ঘেরাও হওয়ার পর তিনি তার লোকদের শহীদের মত মৃত্যুবরণের আহবান করে গুলি বর্ষণ শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে শাহাদত বরণ করেন। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখার নাম রাখা হয়েছে ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড এবং তারা নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও আল-কাসসাম রেখেছে।
এরপর জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তার সৈন্যরা ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালায়। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে ইহুদিদের প্রতি একটি সহমর্মিতার জায়গা তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে আবাস গড়তে শুরু করে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে দুইভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ৩৩টি, বিপক্ষে ১৩টি। দশটি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।
প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলস্তিনের ৫৭.৭% জায়গা নিয়ে গঠিত হবে ইসরাইল। বাকী ৪২.৩% জায়গা পাবে আরবরা। আর আরবদের জায়গাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম ও বেথেলেহাম শহর থাকবে জাতিসংঘের অধীনে।
তাছাড়া ওই প্রস্তাবে ইসরাইলের সীমানা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইলের পক্ষে বাকী ৪২.৩% দখলে নেওয়া সহজে সম্ভব হয়। ইসরাইল জাতিসংঘের এমন প্রস্তাবে সমর্থন জানায় এবং মিসর ও সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলো তার বিরোধিতা করে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করা হয়। পরের দিন (১৫ মে) মিশর, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাক বাহিনী ইসরায়েল আক্রমণ করে। এতে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন পাওয়া ইসরাইলিরা বিভক্ত আরবদের উপর জিতে যায় এবং তারা জাতিসংঘ প্রস্তাবিত ৫৭.৭% এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের ৭৮% ভূমি দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের ফলে সাত লাখ আরব তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে শরণার্থী হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ইসরাইল মিসর ও সিরিয়ায় হামলা করে এবং আরবদের জন্য জাতিসংঘের বরাদ্দকৃত ফিলিস্তিনের বাকী ৩২% অংশও (জর্ডানের অধীনে থাকা পশ্চিমতীর ও মিশরের অধীনে থাকা গাজা) দখল করে নেয়। সেই সাথে মিশরের বিশাল সিনাই উপত্যকা ও সিরিয়ার গোলান মালভূমির দুই তৃতীয়াংশও দখল করে নেয়। ১৫ বছর পরে (১৯৮২ সালে) আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় অনেক শর্ত সাপেক্ষে ইসরাইল সিনাই উপত্যকা ফেরত দিলেও গোলান মালভূমি আর ফেরত দেয়নি।
পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবে ইসরাইলকে ১৯৬৭ সালে দখল করা আরবভূমি ছেড়ে দিতে বলা হলেও ইসরাইল এসব প্রস্তাবকে সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে। বরং সরকারি অফিস ও সেটেলম্যানদের জন্য আবাস নির্মাণের অজুহাতে দিনের পর দিন ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও পাড়া-গ্রাম দখল করে নিচ্ছে। সেই সাথে ইহুদিদেরকে মসজিদে আকসায় প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং প্রতিবাদকারী মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
আরব দেশগুলোর মাঝখানে তাদের জায়গা-জমি জবরদখলের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার অর্থ হলো মুসলমানদের ঐক্য ও আত্মমর্যাবোধে ভয়ঙ্কর ফাটল ও অসহনীয় দুর্বলতার প্রকাশ।
আমি সাবিনা। আজ বিকেল ৪টের সময় ৫টি গ্রাম নিয়ে তৈরি একটি ক্লাস্টার বা গ্রাম সংঘের সভা। সে সভায় আমাকে যেতে হবে। এখন ২০২৮ এর মে মাস। গরমের সময়। মাসের ১৫ দিন কেটে গেছে। ভোর ৫টাতেই এখন যথেষ্ট আলো। আমি আমার সঙ্গী প্রকাশকে ঘুম থেকে ওঠালাম। আমরা এসময়ে মাটি, কাঠ খড় দিয়ে বানানো আমাদের দুকামরার ঘর পরিষ্কার করি। গোছগাছ করি। এরপর আমরা আমাদের গ্রামের কমিউনিটি সেন্টারে (সামূহিক কেন্দ্রে) যাই। সেখানে আমাদের মত ২০টি পরিবারের মানুষেরা আসে। ৫টা ৩০ মিনিট থেকে আধঘন্টা আমরা এখানে যোগব্যায়াম আর নাচের তালে নানা শারীরিক কসরৎ করি। এরপর আমাদের আড্ডা শুরু হয়। সেখানে ২০ থেকে ৯২ বছরের ঠাকুমাও অংশ নেয়।
প্রকাশের এখন তিন মাস রান্নাঘরের ডিউটি। স্নান করে সে আমাদের যৌথ রান্নাঘরে কাজ করতে গেছে।
সকাল ৯টায় বুক ক্লাবের মিটিং। আমরা ১১ জন এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস পড়ছি। আমরা সপ্তাহে তিনবার এই ক্লাবে বসি। ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে সত্যজিৎ রায় একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। সেই সিনেমা আজ আমরা দেখা শেষ করব।
৯০ টি ঘর-পরিবার নিয়ে আমাদের গ্রাম। গ্রামে এরকম প্রায় ১৫টি ক্লাব রয়েছে । গান, নাচ, ছবি আঁকা, খেলাধুলো, নাটক, পরিবেশ, রান্না, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইতিহাস, ভ্রমণ, জিমন্যাস্টিকস, গণিত, ভৌত বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে। আমরা বেশিরভাগই তিন থেকে চারটি ক্লাবের সদস্য। তবে কিছুদিন থাকার পর আমরা অন্য ক্লাবে যাই। অন্যরা এই ক্লাবে আসে। মানুষের আগ্রহ অনুযায়ী প্রায়শই কিছু ক্লাব তৈরি হয়। আবার কিছু ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়।
বর্ষা আসতে এখনো কিছুটা দেরি। তাই এখন চাষবাস নেই। তবে আগামী খরিফ মরশুমে চাষের পরিকল্পনা সারা হয়ে গেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। গ্রামের বৈঠকে। আমরা প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করি। এই বৈঠকে গ্রামের সবার চাষের কাজ ঠিক হয়েছে। চাষে দরকারি সম্পদ কোথা থেকে আসবে; কে, কোথায়, কি করবে ইত্যাদি। জুনের মাঝামাঝি থেকে দুই মাস আমারা অনেকেই খুব ব্যস্ত থাকব। তাই বিভিন্ন মিটিং করে কৃষি মরশুমের কাজ অনুযায়ী ক্লাবের কাজগুলি ফেরবদল করা হয়েছে।
একইভাবে যারা পশুপালন, মাছ চাষ, বনায়ন ও সংরক্ষণ, তাঁত কেন্দ্র, কাঠের কাজ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, নার্সারি, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদিতে কাজ করবেন - তাদেরও আগামী তিন মাসের কাজের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। আমরা দেখেছি, কেউ কেউ এক পেশায় কয়েক বছর কাজ করতে পছন্দ করে। আবার কয়েকজন ৬-৯ মাসের পর অন্য কাজে যেতে চায়। গ্রামে বছরে যে দুটো বড় সভা হয়ে – সেখানেই ঠিক হয় কে কি করবে।
আমাদের গ্রামের শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা একসঙ্গে একটি বাড়িতে থাকে। আমরা বড়রা সকাল ৮টায় ওই বাড়িতে যাই। এখানে আমাদের ৮ বছরের মেয়ে অঙ্কিতাও থাকে। ও সকালের কাজের শেষে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। আমরা সবার সঙ্গে এখানে প্রায় আধ ঘন্টা কথা বললাম। পরে একসাথে আমাদের যৌথ খাবার ঘরে গেলাম। আজ প্রাতঃরাশে ঝাল সুজি (পোহা) আর চাটনি হয়েছে। দারুন খেতে। খাবার ঘরে সবাই গল্পগুজবে মত্ত। খেয়েদেয়ে, নিজেদের থালা-বাসন ধুয়ে আমি বুক ক্লাবের দিকে রওনা দিলাম। আজ পিটারের পড়ার দিন। ও এক ঘন্টা বই পড়ল। পড়ার মাঝেই কয়েকজন প্রশ্ন করল, ব্যাখ্যা চাইল। সেসব নিয়েও কথা হল। পড়া হয়ে যাওয়ার পর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে লেখা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যুক্তি, বিষয়, সমস্যা নিয়ে চলল আলোচনা। আরো এক ঘন্টা। কয়েকজন বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনুরূপ যেসব লেখা হয়েছিল তা নিয়েও কথা বলল। বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠল আলোচনাটি।
আমাদের দুই-তিন কামরার বাড়িগুলি ছোট কিন্তু খুবই উপযোগী। গ্রামের বড় বাড়িগুলি হল শিশুদের হোম, রান্না এবং খাবার ঘর, অফিস সহ কমিউনিটি সেন্টার, হল, অতিথি নিবাস বা গেস্ট রুম, খেলার ঘর, লাইব্রেরি, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি। জানুয়ারি মাসে গ্রামের সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কোন বাড়ি এবং ভবনের মেরামত, রঙ করা এবং সংযোজন দরকার। এই কাজ দেখভালের জন্য দল তৈরি করা হয়েছিল। দরকারি সম্পদ জোগাড় করা হয়েছিল। আর বাড়িগুলির কাজ মার্চ এপ্রিল মাসে সম্পন্ন হয়েছিল। এই বছর আমরা ওরোভিল থেকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে পেয়েছি। তাঁরা ছাদ তৈরির কয়েকটি নতুন পদ্ধতি আমাদের শেখাবেন। গ্রামের পুরুষ মহিলা মিলে ১৪ জন স্বেচ্ছায় এই কাজ শিখতে চায়। বিশেষজ্ঞরা ১০ দিন ধরে তাদের এই বিষয়ে তত্ত্ব এবং ধারণার কথা বলবেন এবং হাতে কলমে কাজ শেখাবেন।
বই নিয়ে আলোচনার পর আমরা কয়েকজন কফি খেতে আর গল্পগুজব করতে খাবার ঘরে গেলাম। কফি শেষ হলে আমি লাইব্রেরিতে গেলাম। গ্রাম সংঘের সভায় আজকে আমাকে আলোচনা করতে হবে। আজকের আলোচনা হল শীতের জামাকাপড় নিয়ে। আমরা এখনো জেলা সদরের বাজার থেকে শীতবস্ত্র কিনি। আমি আলোচনা করব, আমাদের নিজস্ব শীতবস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করা সম্ভব কি না তা নিয়ে। আর এর কাঁচামাল, প্রযুক্তি, দক্ষতা, মোট চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে। আজ প্রথম মিটিং। সেসব নিয়েই পড়াশুনো করতে হবে। আমি বই এবং ইন্টারনেট থেকে এ বিষয়ে পড়ব। আমি ভাবছি অন্য দিনের মত একটু আয়েশ করে অন্য কয়েকটি পত্রপত্রিকাও পড়ব; একটু ইন্টারনেটও ঘাঁটব। আমাদের কারুরই ব্যক্তিগত কম্পিউটার নেই। লাইব্রেরিতে ১০টি কম্পিউটার রয়েছে। আমরা ভাগাভাগি করে এই কম্পিউটার ব্যবহার করি।
মে মাসে ১টা থেকে ২টোর মধ্যে আমাদের দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। দুপুরে আমি হালকা খাবার খেতেই পছন্দ করি। একটু ভাত, ডাল, একটা সবজি, আচার, দই এইসব। আমাদের খাবারের বেশির ভাগ জিনিসই বিভিন্ন গ্রাম সংঘ থেকে আসে। তবে সব গ্রামের জন্য স্থানীয় হাট থেকেও কিছু জিনিস কেনা হয়। সপ্তাহে দু দিন আমরা আমিষ খাবার খাই। আমাদের নিজস্ব মুরগি ও গরুর খামার আছে। আছে মাছের চাষ। আমরা যে গ্রামসংঘে আছি সেখানে একটি ছাগলের খামারও আছে। আমাদের পাশের গ্রামসংঘে একটি শূকর খামার আছে। গ্রামসংঘগুলি নিয়ে আমাদের গ্রাম মহাসভা বা লেভেল ২ ক্লাস্টার রয়েছে। এই গ্রাম মহাসভা ৫টি সংঘের মোট ২৮টি গ্রামের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি। গ্রামের জন্য যেসব জিনিসপত্র তৈরি হয় সেসবের পরিকল্পনার জন্য তিন মাস অন্তর গ্রাম মহাসভার মিটিং বসে।
দুপুরের খাবারের পর আমি বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম করলাম। ঠিক তিনটের সময় সাইকেল নিয়ে গেলাম শ্রীনিবাসের বাড়ি। শ্রীনিবাসও আজকের মিটিং-এ আমাদের গ্রামের প্রতিনিধি। আমরা দুজন গ্রাম সংঘের মিটিং-এ রওনা দিলাম। মিটিং-এ ৫টি গ্রাম থেকে মোট ১৪ জন এসেছে। আমরা যথাসময়ে মিটিং শুরু করলাম। দেড় ঘন্টার মিটিং বেশ ভালো হল। এখানে আমরা সমস্যাগুলির তালিকা তৈরি করলাম। আগামী কাজগুলি ভাগ করে নেওয়া হল। আর পরের সভার তারিখ ঠিক হল। কাছের একটি গ্রামের প্রতিনিধি লীলার সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে আমাকে। আমরা দুজনে মিলে ওই কাজের দিনক্ষণ ঠিক করে নিলাম। যে গ্রামে আমরা সংঘের মিটিং করলাম, সেখানে কয়েক মাস আগে কয়েকটি জল ধারণ ও তা সংরক্ষণের কাঠামো তৈরি হয়েছিল। আমরা সেগুলি দেখতে গেলাম গ্রামবাসীদের আমন্ত্রণে। আমাদের দুজনেরই মনে হল, এই কাঠামোগুলি আমাদের গ্রামের জন্যও উপযুক্ত। এরপর সন্ধ্যে ৬-৪৫ নাগাদ আমরা গ্রামে ফিরে এলাম।
আমাদের রাতের খাবারের সময় ৭-৮টা। আমরা দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করি। আর আমাদের সব গ্রামেই সৌর এবং/অথবা বায়োগ্যাস থেকে তৈরি বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। তবে বিদ্যুৎ আমরা খুব কমই ব্যবহার করার চেষ্টা করি। আমাদের ঘরগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে একটি বাল্ব পুরো বাড়ি আলোকময় করে তোলে। আমি পেট ভরে রাতের খাবার খাই – কাঁচা স্যালাড, তিনটে রুটি, ডাল, সবজি – এসব দিয়ে।
আমাদের গ্রামে খুবই সাদামাটা একটি মুক্তমঞ্চ আছে। রাতে অনেকেই আমরা মুক্তমঞ্চে জড়ো হই। এখানে চাঁদের আলোয় কখনো কখনো নাটক, গান-বাজনা, নাচ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। কখনো অন্যরাও তাদের কলাকৃতি প্রদর্শন করে। এই অনুষ্ঠানগুলি খুবই মজাদার, সুন্দর এবং বিনোদনে ভরপুর হয়।
সাড়ে নটার মধ্যে মুক্তমঞ্চ ফাঁকা হয়ে যায়। রাত ১০টায় পুরো গ্রামটিই ঘুমিয়ে পড়ে, ভোরের প্রথম আলোয় দিন শুরু করতে।
২০২০ সালে শুরু হওয়া অতিমারির ২০২২-এ সংক্রমণ তৃতীয় তরঙ্গ শেষ হওয়ার পরে ক্রমশ পৃথিবী জুড়ে ঘূর্ণিঝড়-হারিকেন-বন্যা- দাবদাহ, দাবানল, শৈতপ্রবাহ সহ নানা বিপর্যয় বাড়তে লাগলো। এর ফলে বিশ্বের অনেক তাবড় অর্থনীতি ভেঙে পড়তে শুরু করে। সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা দেয়। কর্তৃত্ববাদী নেতা-আমলা-পুলিশেরা নির্বিচারে নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাস নামিয়ে আনে। এর ফলে হিংসা, দ্বেষ, হত্যা বাড়ে। বাড়ে ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ নিয়ে বিদ্বেষও। এতে দমন পীড়ন আরো বাড়ে। ২০২৪-এর শেষের দিকে আফ্রিকা থেকে দ্বিতীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পশু খামার শিল্প থেকে তৃতীয় মহামারি দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারির জন্য সরাসরি, এবং আর্থিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক ভাঙ্গনের কারণে পরোক্ষভাবে, লাখে লাখে লোক মারা যায়। এসব মিলিয়ে ২০২৬ সালের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো রাষ্ট্রগুলি ভেঙে পড়ে এবং খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। এর উপরে দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, ইউক্রেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণের ফলে মানুষ ও পরিবেশের ব্যাপক তাৎক্ষণিক দুর্ভোগ এবং বিশাল দীর্ঘমেয়াদী দূষণ এবং বিপর্যয় নেমে আসে।
এক দিকে যখন শিল্প সমাজ ভেঙে পড়ছে সে সময়েই প্রকৃতিমুখী পরিমিত যাপনের ধারণাও ব্যাপক আকারে প্রচার হতে শুরু করে। সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে, হাজার হাজার আদিবাসী গ্রামে, দ্রুত একটি রাষ্ট্রহীন ভাল সমাজের বিকল্পের কাঠামোর মাধ্যমে গ্রাম পুনর্গঠন শুরু হয়। তাদের লক্ষ্য, বর্তমানের চাহিদা অনুযায়ী প্রকৃতির ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে পরিমিত যাপনের এক নতুন পৃথিবী তৈরি। এই যাপন তারা দ্রুত শিখে নেয় জাপাতিস্তা, রোজাভা, আমিশ, কিবুৎয, মেন্দালেখা, ট্রাঞ্জিশন টাউন, ইকো ভিলেজ , সলিডারিটি/সংহতি ইকোনমিক্স-এর অভিজ্ঞতা থেকে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি যখন অতিমারি, জলবায়ু বিপর্যয় এবং মানব হিংস্রতা বেড়েছে - এই আদিবাসী বিকল্পগুলিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৫ সালের শেষের দিকে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাওয়ায় হাজার হাজার অনাদিবাসী গ্রাম, আদিবাসীদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ন্যায়সঙ্গত, স্বাস্থ্যকর, সুখী, যত্নবান, প্রেমময়, স্বশাসিত, এবং প্রকৃতিগতভাবে টেঁকসই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম গড়ে তোলার দৌড়ে যোগ দেয়। আমাদের গ্রাম ছিল এই অগ্রযাত্রার প্রথম গ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম। সংকট ২০২৬-এও ছিল। সেবছর আমাদের গ্রামে প্রায় ২৫ ভাগ লোক মারা যায়। গ্রামের পরিযায়ী কর্মীরা ফিরে আসে। শহরগুলি ভেঙে পড়ায় সেখান থেকেও কিছু লোক চলে আসে আমাদের গ্রামে। বিকল্প সঙ্গম নেটওয়ার্ক, সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট , কলকাতার সারভিস সেন্টার পরিমিত যাপন নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছিল। এবিষয়ে তারা খুবই দ্রুত ধারণা এবং সমাধানের উপায়গুলি সকলকে জানাচ্ছিল। কঠিন হলেও আমরা খুবই তাড়াতাড়ি এইসব ধারণা আর কাজগুলি শিখে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। মনে হয় অনেকটাই শিখে নিতে পেরেছি।
পৃথিবীটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। অনেকেরই অনুমান মত, শিল্প সমাজের বেলুনও ফেটে গেছে। কিন্তু ২০৩০ বা ২০৫০ সালে পৃথিবীর অবস্থা আরো খারাপ হবে বলে যেসব অনুমান করা হয়েছিল, মনে হচ্ছে তা রুখে দেওয়া গেছে। দিন যাপনের গল্পে আমি যা বলিনি তা হল, গ্রামের, গ্রামসংঘের আমরা সবাই আমাদের বেঁচে থাকার এবং সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতা আঞ্চলিক এবং আরো বৃহত্তর (যা আগে রাজ্য এবং জাতীয় স্তর বলা হত ) স্তরে বিনিময় করে চলেছি। শিল্প সমাজের এই ভেঙে পড়া এবং তার ফলস্বরূপ ব্যাপক হিংসা অনেক জীবন কেড়ে নিয়েছে। আরো নিতে পারে। আর আমাদেরকেও গ্রাস করে নিতে পারে।
তবুও আমরা আশাবাদী। আমরা ক্রমাগত শিখছি। আর ভাগ করে নিচ্ছি। আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গান্ধী আর রবি ঠাকুর।
১৯৪৬ সালে তখনকার বিখ্যাত শিল্পী কমলা ঝরিয়া একটি গান রেকর্ড করেন। গানটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। গানটির শিরোনাম ‘এল পঞ্চাশের আকাল’। লোকগীতির সুরে বাঁধা গানটিতে সদ্য ঘটে যাওয়া বাঙলার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। যে দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে তিরিশ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। শুধুমাত্র খাবারের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ করছেন, সুদূর গ্রাম থেকে খাদ্যের আশায় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা চাইছেন, তাও ভাত বা চাল নয় একটু ভাতের ফ্যান, তাও না পেয়ে লুটিয়ে পড়ছেন, এ অভাগা দেশে সে দৃশ্যও রচিত হয়েছে। অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ যেমন তাদের যথাসাধ্য সাহায্য তেমনি আর একদল সহনাগরিক নিষ্ঠুর কপটতায় ওই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে যথেচ্ছ ধনসম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। সেদিনের সেই মানবতার চূড়ান্ত অবনমনের ছবি গানটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। গানটির ছত্রগুলি এরকম—
ভুলো না – রেখো মনে বাঁচবে যত কাল
সোনার দ্যাশে ক্যান এল পঞ্চাশের আকাল।
ভুলে রব লড়াই এল দেশে
চোরেরা সব দল বাঁধে ভাই রক্ষকেরই বেশে—
তারা বাগিয়ে ভুঁড়ি হাঁকায় জুড়ি লুটের মালে লালে লাল।
এল পঞ্চাশের আকাল॥
ক’রে ভাই মিছড়ি মুড়ি একদর
লুটের বাজার হ’ল শুরু নাইকো কারো লাজডর।
(ধনীর) ব্যাঙ্কে টাকার অঙ্ক বাড়ে গরীবের যায় বলদ হাল—
এল পঞ্চাশের আকাল॥
ঘরহারা সব বাহির হ’ল পথে
(ওদের) মেকি দয়ার ফাঁকি দিলো নুনের ছিটে ক্ষতে—
ওরা ফ্যান বিলিয়ে নাম কিনে নেয়
কাঙাল মরে পালে পাল—
এল পঞ্চাশের আকাল॥
তকমাধারী ন্যায়ের মালিক যারা
মুখোশ খুলে খোস মেজাজে লুটে বেড়ায় তারা
(আবার) পচায় গোলার ছালায় ছালায়
চিনি আটা ময়দা চাল
এল পঞ্চাশের আকাল॥
চিনে রাখ লোভী রাহুর দল
জেনে রাখ নিত্যকালের নয়তো বাহুর বল—
নিজে জ্বলো জ্বালো আলো পালাক পিচাশ প্রেতের দল—
হবে না আর কভু আকাল॥
এখানে গীতিকার বার বার করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন সমাজের একটি অংশকে যারা এই দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে নিজেদের লভ্যাংশ বুঝে নিয়েছিলেন, তাদের দিকে। শুরুতেই তিনি শ্রোতাদের অনুরোধ করেছেন এই আকালের কারণ আজন্ম মনে রাখার জন্য। তিনি কিন্তু একবারও খাদ্যের অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করেন নি। প্রাথমিকভাবে খাদ্যের অপ্রতুলতার কথা তৎকালীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীও উল্লেখ করেন নি। ১৯৪৩ সালের প্রথমার্ধ জুড়ে, যখন দুর্ভিক্ষের করাল থাবা দরিদ্র বঙ্গবাসীর উপর আছড়ে পড়েছে, তখনও বাংলার প্রশাসন প্রকাশ্যে দাবী করেছেন যে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর মতো যথেষ্ট খাদ্যের যোগান রাজ্যে আছে। খাদ্যে অপ্রতুলতা রাজ্যে নেই।
১৯৪২ এর আগষ্ট মাসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ভারত সরকারের যুদ্ধের কারণে পূর্ব ও উপকূলবর্তী ভারতে প্রয়োগ করা পোড়ামাটি নীতির জন্য দূর্ভিক্ষ আসন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে ক্ষমতাচ্যূত হন। খাদ্যমন্ত্রী এইচ এস সুহরাবর্দি ও বিশ্বাস করতেন দূর্ভিক্ষ আসন্ন। কিন্তু তিনি উচ্চতম ব্রিটিশ প্রশাসকদের চাপে ঘোষণা করেন যে বাঙলায় খাদ্যের কোন ঘাটতি নেই। অথচ আকাল এল। দুর্ভিক্ষের সুনামিতে বাঙলার তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ বিনষ্ট হল।
২
ফেমিন কমিশন ১৮৮০ র রিপোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ‘খরার প্রতিক্রিয়ায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত দিনমজুরেরা কর্মহীন হয় সবচেয়ে বেশী.... জনগণের এই অংশ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর হস্তশিল্পীরা চরম দুর্দশাগ্রস্ত হন, যারা মূলত দৈনন্দিন ব্যবসায়ের উপর নির্ভরশীল। খাদ্যের অভাবের জন্য জনগণের এই অংশের দুর্দশা বাড়তে থাকে তা নয় বরং আয় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে খাদ্য কেনার ক্ষমতা তাদের ছিলনা বলেই তাদের দুর্দশা বেড়েছিল। সব থেকে বেশী দুর্ভিক্ষ-পীড়িত জেলাগুলিতেও যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত ছিল। কিন্তু দৈনিক মজুরীর উপর নির্ভরশীল মানুষের আয় করবার কোন পথই খোলা না থাকায় তাদের হাতে খাবার কেনার কোন পয়সা ছিলনা’। অমর্ত্য সেন তার সুবিখ্যাত গবেষণায় ওই দূর্ভিক্ষ খাদ্যের অপ্রতুলতার জন্য হয় নি তা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছেন।
ফিল্ড মার্শাল আর্চিবল্ড ওয়াভেল ১৯৪৩ এর অক্টোবরে লিনলিথগোর জায়গায় ভাইসরয় হিসাবে দায়িত্ব নেন। তখন ভারতের রাজনৈতিক মহল থেকে দূর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের উঠতে থাকে। কিন্তু ভারতের জন্য নিযুক্ত সেক্রেটারি অফ ষ্টেট লিওপোল্ড আমেরি আপত্তি করেন। কিন্তু উত্তরোত্তর ঐ দাবী জোরালো হতে থাকলে আমেরি কারণ অনুসন্ধানের অভিমুখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তব্য খাদ্যের যোগানের সম্পর্কের ভিত্তিতে করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কৌশলে তিনি ম্যালথাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু কোনভাবেই ফেমিন কোড এর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই না। সুতরাং আমরা ফেমিন কোড এর বিষয়ে একবার চোখ ফেরাতে পারি।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৮ শতকে বাংলার দূর্ভিক্ষের পর ১৮৮৩ সালের জুন মাসে, সি এ এলিয়ট ফেমিন কোড এর খসড়া তৈরি করেন, যিনি আগে ১৮৭৭ সালে মাইসোরের জন্য ফেমিন কোড এর খসড়া করেছিলেন । সেখানে ত্রাণ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে প্রাণহানি প্রতিরোধ করবার কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং এটা আশা করা যায় যে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে আরও কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচত। তবে সেই দাবী আদায়ের জন্য কোন আন্দোলনের খবর পাওয়া যায় না। গভর্নর রাদারফোর্ড একটি ব্যক্তিগত মেমোতে লিখেছিলেন— ফেমিন কোড প্রয়োগ করা হয়নি তার কারণ নিয়ম মত রেশন দেবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য আমাদের কাছে ছিল না’ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল মনে করিয়ে দেন— ‘যতক্ষণ না বাংলার খাদ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, ততক্ষণ আমাদের পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ ফলত ফেমিন কোড এর সহায়তাটুকু ঐ মানুষদের জোটেনি।
প্রশাসনিক স্তরে ফেমিন কোড বলতে দূর্ভিক্ষের সময় তা মোকাবিলার জন্য জরুরী কাজের নির্দেশাবলীকে ইঙ্গিত করে। ১৮৮০ সালের আগে দূর্ভিক্ষের ত্রাণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণত পরিকল্পনা বহির্ভূত এড হক ভিত্তিতে করা হত। ১৮৮৩ থেকে ১৯০১ এর মধ্যে ফেমিন কোড এর সামান্য সংশোধণ করা হয়। এই সময় দূর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পাবার জন্য কৃষি বিষয়ক পরিসংখ্যান সংগ্রহ এবং একত্র করবার কথা ভাবা হয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন হয় ১৯০১ এর ফেমিন কমিশন এর সুপারিশ অনুযায়ী। ঐ সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৯৮ এর ফেমিন কমিশন প্রবর্তিত ন্যূনতম মজুরী ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়।
পরবর্তী চল্লিশ বছর তেমন কোন বড় অভাব বা দূর্ভিক্ষের মুখোমুখি ভারতবাসীকে হতে হয়নি। ১৯৪৫ এর ফেমিন এনকোয়ারি কমিশন এর অনুসন্ধান অনুযায়ী ফেমিন কোড এর কার্যকারীতা এই সময় মোটামুটিভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। কেননা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট অভাবের মোকাবিলা করার জন্য প্রশাসনিক স্তরের হস্তক্ষেপ এবং নির্দেশাবলী কার্যকরী হয়েছিল।
কিন্তু বাঙলার ১৯৪৩ এর দূর্ভিক্ষের পিছনে প্রাকৃতিক কারণ বা ফসল কম হওয়া তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না, কেননা এই দূর্ভিক্ষ ছিল মানুষের তৈরী করা। তার উপর যুদ্ধের আবহাওয়ায় পোড়ামাটি নীতির প্রয়োগ। বিশেষত Denial Policy (Denial to Rice এবং Denial to Boat)। এই দুটি নীতির প্রয়োগ বাঙলার গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আয় উপার্জনহীন সর্বহারাতে পরিণত করেছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যানবাহন এবং পরিবহণ ব্যবস্থা বেশির ভাগ নৌকার উপর নির্ভরশীল ছিল। সেই সময় বেশির ভাগ নৌকা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী ভেঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জাপানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে। তার দুটি অংশ এই Denial Policy, যাতে জাপানী সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে পৌঁছলেও রসদের যোগান না পায়। অতিরিক্ত ধানচালের সঙ্গে প্রায় ৪৫০০০ নৌকা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করে দেয়। স্বভাবতই ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাজারে খাদ্যদ্রব্য অগ্নিমূল্য হবার কারণে ত্রাণের ব্যবস্থা শুরু করা হয় নি। কোন কাজের সৃষ্টি করা হয় নি যাতে লোকের কিছু উপার্জন হতে পারে। ফলত লক্ষ লক্ষ মানুষ আয় উপার্জনহীন অবস্থায় খাদ্যের সব ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে সারা বাংলার অনাহার পীড়িত মানুষের কলকাতায় আসা সুরু হল। একটু খাবারের সন্ধানে। বরং বলা যায় একটু ভাতের ফ্যানের আশায়। জুলাই এর মাঝামাঝিএই সমস্ত মানুষের একটু ফ্যান চাওয়ার আর্তনাদে কলকাতার রাস্তাঘাট ভরে গেল। এখানে সেখানে মানুষ খাবারের জন্য ভিক্ষা চাইতে লাগল। আগষ্টের মাঝামাঝি কলকাতার সমস্ত রাস্তা বুভুক্ষু মানুষের স্রোতে নিমজ্জিত হলো। প্রতিটি রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কের গাছের ছায়া তারা খুঁজতে লাগল। আগষ্ট মাসের তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে রেলওয়ে ষ্টেশনগুলির শেড এর নীচে মাথা গোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হল। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পুরো ফুটপাত জুড়ে কাপড় টাঙ্গিয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় নিল বহু মানুষ। দিনের বেলা বড়রা দু একজন শিশুকে নিয়ে খাবারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। রাত্রিবেলা মিলিত হত এই ছাউনিগুলিতে। ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে সারি সারি রাত কাটাত। এই সর্বব্যাপী অনাহারের মধ্যে ততদিনে শুরু হল ম্যালেরিয়া, কলেরা এবং পেটের গন্ডগোল। আরো মানুষ প্রাণ হারাতে লাগলেন সবার চোখের সামনে, উন্মুক্ত আকাশের নীচে।
৩
আমরা আগেই দেখেছি ১৮৮৩ র ফেমিন কোডের বর্ণিত ত্রাণ-নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের প্রাণ রক্ষা করা। অনাহার অর্ধাহারে শীর্ণ কর্মক্ষমতাহীন শ্রমজীবি মানুষদের ‘সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জন’ এর সঙ্গে ‘কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা’ বজায় রাখার উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার কোন তালমিল ঘটলো না। ঋণের জন্য বিব্রত হওয়া বা ত্রাণের জন্য খরচের বোঝা বহন করার থেকে দূর্ভিক্ষ ভালো বলে ব্রিটিশ সরকারের মনে হলো। এই বিষয়ে নিযুক্ত প্রশাসকদের বলে দেওয়া হল ত্রাণের জন্য তেমন খরচ করবার দরকার নেই যাতে সঞ্চয়ের গতি কমে বা মানুষের স্বয়ম্ভরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দূর্ভিক্ষ বা অভাবের পরিস্থিতিতে সামাজিক গঠন এবং মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সেই পরিস্থিতিতেও ত্রাণের জন্য আর্থিক সংকোচন কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
অন্যান্য পদক্ষেপ ছাড়া ফেমিন কোডের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা এবং প্রকৃত ত্রাণের কাজ শুরু করা । এখানে লক্ষণীয় যে পঞ্চাশের আকালে শুধুমাত্র দূর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয় নি তাই নয় কোনো রাজনৈতিক দলও ফেমিন কোড অনুযায়ী দূর্ভিক্ষ ঘোষণার দাবী করেনি। যদিও দূর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের দাবী উঠেছিল এবং অনুসন্ধানকারী কমিশন তৈরী হয়েছিল। ফেমিন কোডের নিয়ম অনুযায়ী দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পর নিম্নলিখিত বিষয়গুলির হিসাব করা প্রয়োজনঃ
১) বিগত দশ বছরের কৃষি উৎপাদনের অবস্থা
২) মৃত্যু হারের অবস্থা
৩) দারিদ্রের অবস্থা
৪) অপরাধ ঘটার মাত্রা ও অবস্থা
৫) অজানা লোকের অন্তঃপ্রবাহ
৬) ক্রমবর্ধমান যাওয়া আসা এবং অস্থিরতার চিহ্নগুলি
৭) গবাদি পশুর অন্যত্র চলে যাওয়া
৮) অভাবের হারের (সাধারণ দামের ৪০%) থেকেও দাম বেড়ে যাওয়া
৯) জনসাধারনের স্বাস্থ্যের অবস্থা
১০) খয়রাতি সাহায্যের স্থানে দুমাসের উপর এক শতাংশের বেশি জনসাধারনের উপস্থিতি
১১) বিগত কয়েক বছরের উপর্যুপরি চাষ নষ্ট হওয়া
১২) বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অভাব
এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও একত্র করবার বাহানায় আড়াল করা থাকে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা। এই বিবিধ ধরনের দুরূহ তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের কাজ পাবার সম্ভাবনা কঠিন করে তোলা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাছাড়া ন্যূনতম মজুরীর বদলে কাজের পরিমানের উপর মজুরী নির্দ্ধারণের নিয়ম সর্বহারা মানুষদের জীবন আরো সংকটপূর্ণ করে তুলল। কোন খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হল না এবং পরিবারের অন্যান্য নির্ভরশীল সদস্যদের ও কোন ত্রাণ দেওয়া হল না। এই ব্যবস্থা কোনভাবেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। সুতরাং দেশ জোড়া কাজের আকালের মধ্যে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশ হিসাবে পরিগণিত হলেন।
যদিও আশ্চর্যজনকভাবে আকালের সময় ত্রাণ বিতরণ করা সামগ্রিক গ্রামোন্নয়নের একটি পন্থা হিসাবে ধরা হতো। এই ত্রাণের মাধ্যমে আপত্কালীন কর্মসংস্থান, সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, গবাদি পশু সংরক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করার সুযোগ ঘটতো। সাময়িক কাজের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিক উন্নয়নে সাহায্য হতো, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্যান্যরা কিছুদিনের জন্য হলেও এই উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের অংশ হতে পারত। তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের আবহেও ফেমিন কোড বর্ণিত এই ত্রাণ নীতি শাসনতন্ত্রের অনেকটাই মানবিক চেষ্টা বলে মনে হয়। কেননা ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পরবর্তীকালে মূলত এই নীতি গুলিই সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক নীতি হিসাবে আরও পরিবর্ধিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে।
একটা সবুজ মানুষ নদীর পাশে শেকড় ছড়িয়ে আকাশে হেলান দিয়ে মিটিমিটি হাসতো; মাথায় পাতার মুকুট আর চুঁইয়ে নামা আলোর ঝিরিঝিরি নকশা সারামুখে, ডালেডালে তার পাখি আর পরীদের বাসা; পাখিরা রোজ ওর ঘুমভাঙার আগে উড়ে যেতো ভোরবেলার ভেতর, আর বিকেল-কণিকা ঠোঁটে নিয়ে ফিরে আসতো ওর চোখের কোটরে আর শিশির-ভেজা গল্প বলতো, সে তখন গোধূলি আদরে ঢেকে দিতো সারাদিন-ধুলো-ওড়া ক্লান্ত কোলাহল যতো... পরীরা ওর আঁকিবুঁকি বেয়ে নেমে যেতো জলের সন্ধ্যায়, ওরা না ফিরলে ঘুম ভাঙতো না তার...পরীরা বলতো প্রবাহ আসলে নদীর গভীরে রাখা রূপোলী শস্যের গল্প আর এক রাত্রিকুসুমের পাপড়ি-বিলাস...
নদীর সঙ্গে খুব ভাব ছিল লোকটার... যেমনতেমন দুপুরে নিজের শিকড় বেয়ে সে নেমে যেতো নদীতে, তখন সে-নদী ঝমঝম কুসুমনূপুর; শস্যের অক্ষর নিয়ে সে উঠে আসতো শরীর ভিটেয়, ছড়িয়ে দিতো বুকের উঠোনে... প্রাচীন দেউল জুড়ে সেসময় শুধু পাখি আর পরীদের গান আর পরাগমিলন...
একরাত্তিরে, নদীতে যখন জোয়ার, পুরনো লবণ-গন্ধ-ঢেউ উঠে আসছিল হু-হু শিকড় বেয়ে আর বহুদিন আগে ভুলে যাওয়া একটা সুর ভাসছিল মাতাল হাওয়ায়... লোকটা উঠে দাঁড়ালো, চশমার কাঁচে জমা রোদ্দুর ভাসিয়ে দিলো সেই কামোদ হাওয়ায়, দুহাত তার ডানা, সবুজ লোকটা উড়ে চলে গেলো পাতাঝরা নিশিত অন্ধকার পেরিয়ে... রয়ে গেলো নদীর পোশাক আর পাখিদের শোক আর শিকড়ের চিহ্ন আর এক অনাহত রাত্রিকুসুম
সে এক বিচিত্র আলাভোলা গাছ ছিল
প্রতি ওপড়ানো শিকড়ে তাহার
এলোমেলো সুখ ছিল
ফুল যদি ঝরে সেও এক পথের প্রমাণ
যতখানি গাছ, গান তার
শিকড়-সমান
সুব্রত দা'কে প্রথম দেখেছি বইমেলায়। কালধ্বনির টেবিলে বসে আছেন একটা চেয়ারে , বেশ সোজা হয়েই, হাত দুটো কোলের ওপর জড়ো করা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ঘাড় ঈষৎ বাঁ দিকে কাৎ। আর শেষ দেখলাম, ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালের ফ্রিজারে শোয়ানো। তার বিশদ বিবরণে গেলাম না!
প্রথমবারের দর্শনে সুব্রত দা আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। আমি একটা লিটল ম্যাগাজিন কালধ্বনির টেবিলে রাখতে গিয়েছিলাম, উনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। মেলা শেষে পত্রিকা আনতে গেলে জানা গেল, পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেছে। উনি দামটা দিলেন। আমি একটা অংশ কেটে রাখার কথা বলাতে, আমার ওঁর প্রথম সংলাপ শোনা হল, "আমরা (কালধ্বনি) কোনো টাকা কেটে রাখি না! "
এরপর কালধ্বনির সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত হয়েছি ২০০৯ সাল নাগাদ। যাঁরা কালধ্বনির ঘরে গেছেন, তাঁদের বলা বাহুল্য যে,ওই ঘরে সম্পাদক প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় কতটা ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন! প্রাণের আরাম কথাটা ওখানে গেলে ব্যাখ্যা করতে হয় না, অনুভূত হয়!
কালধ্বনির আড্ডা আমাদের সঞ্জীবনী সুধা, আর সেই সুধা সুব্রত দা'র প্রাণের মাঝে কতখানি ছিল, আমরা , মানে আমাদের বন্ধুরা, যাঁরা একটু পরে কালধ্বনিতে নিয়মিত হয়েছি, তাঁরা খুব দ্রুতই তার খবর পেয়েছি। সুব্রত দা'র উপস্থিতি আমাদের কাছে সুকিয়া স্ট্রিটের আড্ডাতে অন্য মাত্রা দিত, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যি!
এর কারণ, সুব্রতদা'র রসবোধ, যা আমাকে টেনেছে বরাবর এই আড্ডায়। সুব্রতদা আর দুলাল দা'র রসালাপ শুনে আমাদের বিকেল প্রসন্ন হতো, আমি অনুভব করতাম, কেন আমার শহরের সাধক কবি বলেছিলেন, 'আমি চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে চাই!' নকশাল আমলে সুব্রত দা'কে 'আ্যনাইহিলেট' করার পরিকল্পনার কথা সুব্রত দা'র( উনি নিজেও একসময় নকশালপন্থী রাজনীতি করতেন) মুখেই কৌতুকময় বর্ণনায় শুনেছি, তার কারণ 'গোপন' এই পরিকল্পনাটি সংগঠিত হচ্ছিল চলন্ত বাসে, সুব্রত দা'রই আগের সিটে!
আরেকটা কারণে সুব্রতদা আমার সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন। সেটা হল, ওঁর অগাধ পড়াশোনা, বিশেষতঃ কবিতা ও কথাসাহিত্যে। কবিতার মনস্বী পাঠক ছিলেন সুব্রতদা, তবে আমাদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে খুব একটা কথা কখনও হয়নি। সম্ভবত কবিতা পাঠের অনির্বচনীয় স্বাদকে একার করে রাখতে চেয়েছেন তিনি।
কিন্তু কথাসাহিত্যের দীন ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে পেয়েছি অনেক কিছু। শিখতে কতটা পেরেছি, জানি না। পেশায় প্রুফ রিডার ছিলেন তিনি। কিন্তু পড়া বিষয়টা ওর পেশাদারি গণ্ডিকে অতিক্রম করে ওঁকে রসসাগরে অবগাহনের সামর্থ্য যুগিয়েছিল। একটা ছোট উদাহরণ দিই। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটা অনুগল্পের কথা বলার পর উনি বলেছিলেন, "প্রুফ রিডার হিসেবে আমার কাজ পরের লেখায় চলে যাওয়া। কিন্তু এই লেখাটা পড়ে আমি অনেকক্ষণ থুম মেরে বসেছিলাম!" নিত্যদিনের কথাবার্তায় এরকম অনেক অভিজ্ঞতাই আমাদের অর্জন হয়েছে।
যা আমাদের অস্বস্তিকর ঠেকত, তা হল, হঠাৎ হঠাৎ করে সবকিছু থেকে সুব্রত দা'র নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। আমরা যেখানে সুব্রত দা'র উপস্থিতি প্রত্যাশা করতাম, সেখানে হঠাৎই ওঁর বার্তা আসত, না গো! আমার হবে না! আমরা মুষড়ে পড়তাম!
প্রায়ই একটা অভিযোগ সুব্রত দা করতেন। 'আমার ওপরতলায় এক ভদ্রলোক সারারাত কাঠের ওপর হাতুড়ি চালায়। ঠক ঠক, ঠক, ঠক। আমার ঘুম হয় না!' বিষয়টা ওঁর মনে হওয়ার স্তরেই ছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে। এই ভাবে একটা জগৎ রচিত হয়েছিল কী, সুব্রত দা'র মনের মধ্যে! আমরা হয়ত সেই ভুবনের খোঁজ পাইনি! হাসপাতালের শয্যায় সুব্রত দা ওঁর ভরসার, নির্ভরশীলতার একান্ত জন প্রশান্ত দা'র হাত চেপে ধরে রাখতেন, সারাক্ষণ! এক বাঙ্ময় নীরবতা অন্তর্লীন থাকত সেই করস্পর্শে!
প্রথমদিনের নীরব সুব্রত দা আমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল! আর শেষদিনের নিথর সুব্রত দা আমার কাছে দুর্বোধ্যতর হয়ে উঠলেন!
হয়ত আরো কিছু কথা বলার ছিল ওনার। আমাদের শোনার। কিন্তু তার আগে এক আকস্মিক সিগন্যালে ওঁর ট্রেন ছেড়ে গেল!
হতবিহ্বল আমরা বিকেলের প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম !
***
সুব্রতদা চলে গেল। কোনো আগাম নোটিস না দিয়েই। এটা ঠিক না, কিন্তু কী করা যাবে, এরকম হামেশা ঘটছে। হঠাৎ হঠাৎ করে কোনো না কোনো প্রিয়জন কোনো আগাম নোটিস না দিয়েই চিরকালের মত চলে যাচ্ছে। কিছু বলার নেই।
কালধ্বনির আড্ডায় আমার উপস্থিতির প্রথম দিন থেকে আমি সুব্রতদাকে পেয়েছিলাম। আকর্ষণের প্রথম কারণ ছিল শ্বশ্রূগুম্ফে প্রায় ঢাকা পড়া অথচ প্রসন্ন ওরকম একটা মুখ কালধ্বনিতে আর ছিল না। সুব্রতদা স্বভাবে উচ্চভাষী ছিল না, উচ্চকিত ছিল না। দেখলে মনে হত মানুষটা নির্বিরোধ ও নিস্পৃহ ধরনের। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার নিজস্ব ধ্যানধারণা বলতে কিছু ছিল না বা সেসব ধ্যানধারণার দৃঢ়তা ছিল না। সেগুলো কোনোকিছু নিয়ে তার সঙ্গে যখন মৃদুস্বরে আলাপ করতাম, তখন বুঝতে পারতাম। জ্ঞানভাণ্ডার ও শব্দভাণ্ডার দুটোই অন্তত আমার থেকে যে বেশি ছিল, দুএকটা টুকরো টুকরো ঘটনায় তারও প্রমাণ পেয়েছি।
সুব্রতদার সঙ্গে কালধ্বনির আড্ডায় যখন প্রথম পরিচয়, বোধহয় ঠিক সেই সময় আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশে শিবেন্দুদার নেতৃত্বে ও তরুণদার (তরুণ পাইন) সহযোগে একটা ১৮৭২ সালে বেরোনো আঞ্চলিক ইতিহাসের বই সটীক পুনঃপ্রকাশের আয়োজন করছি। সেই সময় আমাদের অবকাশের আড্ডা জমত কখনো উচ্চশিক্ষা দপ্তরের লাইব্রেরিতে, কখনো জয়শ্রী প্রেসে, বা কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে। সেই সময় তরুণদার কাছে যে দুজনে মিলে একদা একসঙ্গে কাজ করার টুকটাক গল্প শুনেছি, তাদের একজন ছিল তরুণদা, অপরজন সুব্রতদা। বসার জায়গা অব্দি নেই, সিঁড়িতে বসে একসঙ্গে কাজ করছে। সেসব পরিশ্রমের কথা কোথাও লেখা থাকবে না, কিন্তু একটি বইয়ের যথাসম্ভব নিখুঁত টীকা তৈরি, গ্রন্থপঞ্জি তৈরি, নির্ভুল প্রুফ দেখা, নির্ঘণ্ট তৈরি এবং কখনো কখনো সম্পাদনা ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের যে অবদান, সেই অবদানের অর্ধেক অবশ্যই সুব্রতদার পাওনা।
আমার জীবনে দুটি মানুষের স্পর্শ অক্ষয় হয়ে রয়ে গেছে। একটা হচ্ছে রামেশ্বরম যাবার পথে আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে যাবার পর সারানোর জন্যে রামানাথাপুরম থেকে মিস্ত্রি আসার অপেক্ষায় আমাদের যখন বসে থাকতে হয়েছিল, তখন স্থানীয় স্কুল থেকে আমাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করা পঞ্চবরণম স্বামী, যিনি ছিলেন ঐ স্কুলের সেক্রেটারি। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি আমার হাতে যে চুমুটা খেয়েছিলেন, তার স্পর্শ। আর একটা হচ্ছে কিছুদিন আগে কালধ্বনির সম্পাদকের বাড়িতে আমাদের যে আড্ডা বসেছিল, সেই আড্ডায় দরজা খুলে ঢোকার পরই সুব্রতদার এগিয়ে এসে আলিঙ্গন, সেই আলিঙ্গনের স্পর্শ।
***
শোকের উচ্চারণ আমার কাছে বরাবর বড্ড দ্বিধার; সে কুণ্ঠা সর্বতোভাবে স্বীকার করেও সন্দীপদার আন্তরিকতাকে অস্বীকার করা গেল না।
চলে যাওয়া বিষয়টাই অনভিপ্রেত। কোনরকম বাস্তবিকতার দোহাই অথবা মৃত্যু সম্পর্কিত রোমান্টিকতা দিয়ে এটিকে আমি আড়াল করতে পারি না, চাইও না।
আর সুব্রত কাকু এমন একজন ধীরস্থির মানুষ হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে কিভাবে হ্যাঁ থেকে না হয়ে গেল বুঝেই উঠতে পারলাম না, মেনে নেওয়া তো অনেক দূরের কথা!
জীবনের যে সময়টা সবচেয়ে টলটলে, আয়নাতে মুখ দেখার মত আমি টাকে দেখতে পাওয়া যায় সেই সময় থেকে সুব্রত কাকু আমাকে চেনে। পড়াশোনার চাপে ওষ্ঠাগত, অভিমানী অথচ অভিমান নিয়ে বিব্রত সেই ছল ছলে চোখ কিশোরীর তেমন বন্ধু ছিল না। ছিল কয়েকজন কাকু। রোববারের আড্ডা থেকে শুরু করে চকলেট আর গল্পের বইয়ের রূপকথা পেরিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে আমির খানের ফ্লপ সিনেমা দেখা পর্যন্ত অনায়াস বিচরণ ছিল সেই যোগাযোগে। সুব্রতকাকুকে তো সিনেমা দেখতে দেখতে হিন্দিটা বুঝিয়ে পর্যন্ত দিতে হতো। নাছোড়বান্দা সেসব দিন আজকের আমিটাকে তৈরি করেছিল। তাই হয়তো আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি পড়াতে গিয়ে কখনো নোটবুক খুলতেই হয়নি। সুব্রতকাকুর সেন্স অফ হিউমার এবং টাইমিং অফ হিউমার একটা অসম্ভবপ্রায় পর্যায়ের ছিল আর ছিল কথা শুনতে পারার নমনীয়তা। অন্তরমহলের কাছাকাছি থাকলে আলাদা করে সে মানুষকে চেনা হয়ে ওঠে না। আমিও তাই তেমন করে তাকে চিনতে পারিনি বা চেনার কখনো চেষ্টাই করিনি। আমাদের সম্পর্ক এতটাই সহজাত ছিল যে কখনো মনেই হয়নি সেই সম্পর্কের তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে বসি।
আজও তাই ভাববো না।
আজকের এই মানসিক কংক্রিটের রাজত্বে যে কটা সবুজ মুখ সব সময় আদর করার জন্য খোলা থাকতো তাদেরই একজন আমার সুব্রত কাকু। অতীতের পাল্লা যত ভারি হচ্ছে সময় তত বেশি বুঝিয়ে দিচ্ছে ,স্নেহ বড় বিষম বস্তু। গোটা পৃথিবী যখন সূর্যের নিচে দাঁড় করিয়ে কান ধরে ওঠবোস করাতে চায় তখনো দু'চারটে হাত এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝায় ",এই এক ফোঁটা পুচকি মেয়ে !এত ভাবনা কিসের তোর? " তেমন একটা হাত হঠাৎ নেই হয়ে গেল।
এই দগদগে সত্যিটা কে মেনে নেওয়ার মতো বড় এখনো হয়ে উঠতে পারলাম না।
***
কেউ গার্লফ্রেন্ড, কেউবা বয়ফ্রেন্ড বগলদাবা করে ঢুকছে এলিয়ট পার্কে। আর আমি ঢুকছি সুব্রতদার সঙ্গে। আর সুব্রতদা আমার সঙ্গে। বললাম 'এখানে এলে কেন ?' 'চল!'...তো আমরা হনহন করে ছোট একটা বেদি-মত সেখানে গিয়ে বসলাম। চারিদিকে যুগল। আমাকে আর সুব্রতদাকে দেখছে সন্দেহের চোখে। আমাদের অবশ্য খেয়াল অন্যদিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম 'সুব্রতদা, চলো দার্জিলিং ঘুরে আসি!' সুব্রতদা বলল 'না' 'তাহলে সিকিম?' 'না', 'তাহলে ভাইজ্যাগ?' 'না'....'তাহলে তুমি কোথায় যাবে?' 'শিমুলতলা'...'শিমুলতলা? কেন? ' তারপর আবার চুপচাপ সুব্রতদা। দূরে ভিক্টরিয়ার দিকে ভাসানো দৃষ্টি। আর হাওয়ায় নিচের দিকে সরু হয়ে আসা দাড়িটা হালকা দুলছে। বলল 'শিমূলতলা খুব ভাল জায়গা'। এক ডিগ্রি বেশি হাসল।
শিমুলতলা ছাড়া সুব্রতদা আর কোথাও কোনোদিন বেড়াতে যেতে চায়নি। অন্তত আমি তাই জানি। আর শিমুলতলার নাম এলেই চোখটা কেমন সরু হয়ে দূরে ভাসিয়ে দিত। যাইহোক তো সেই এলিয়ট পার্ক পর্ব দু অধ্যায়েই সমাপ্য হল। কিন্তু শিমুলতলার গল্পে খোঁজ পাওয়া গেল এক কমলা শাড়ি পড়া মহিলার। উনি সুব্রতদার গার্লফ্রেন্ড। 'নাম?' আবার সুব্রতদা চুপ। কিছু বললই না মাইরি। একটা বাদামওয়াকে ডেকে বলল 'বাদাম দিন!' তারপর বলল 'এই বাদাম আমি খাইনা, তুই খা'...কি ডেঞ্জার লোক মাইরি, আমার মুখ বাদাম ঠুসে বন্ধ করে দেওয়ার ফন্দি?
সে যাকগে, আমি তখন একটা বাচ্চা জেব্রা ছিলাম। কলেজে পড়তাম আর কলকাতার রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। হাত পা ছুঁড়তাম। সুব্রতদা বলল 'বিশরপাড়া আয় তোকে রামলীলা দেখাব!' গেলাম বিশরপাড়া। ছাদের ওপর একটা ঘর। ছাদে কিছু গাছ আর ঘরে চৌকির একধারে কিছু বই। এই সুব্রতদার সংসার। রান্নার একটা স্টোভ। জ্বললে ঘরে স্টোভের গন্ধ। চায়ের গন্ধ। আলুপেঁয়াজ সেদ্ধর গন্ধ। মশলার গন্ধ। ভাল লাগত। বৃষ্টি হত। নারকোল গাছগুলো ছাদে ঝুঁকে এসেছে। নিচে কলতলা। একটি মেয়ে জল নিচ্ছে। দেখলাম। সুব্রতদা মুচকি হেসে বলল 'পছন্দ?' একটু গ্যাপ, মুখে হাসিটা স্টে করিয়ে রেখে বলল 'ওরা কিন্তু খুব ঝগড়া করে'...ও তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকবে, আর আমার থাকবে না?
তারপর বিকেলের দিকে নিউব্যারাকপুরে প্যাটিস খেতে যাওয়া হত। দু কিলোমিটার হেঁটে । সেই পথে একজনের সঙ্গে আমাদের দেখা হত, সুব্রতদার চেনা। আসতেন নানা সমস্যা নিয়ে। বেশ লম্বা চওড়া লোক, কিন্তু তাঁর সমস্যাগুলো সব বাচ্চাদের মতো। সুব্রতদা খুব মন দিয়ে শুনে, নানা প্রশ্ন করে সমস্যা ভাল করে বুঝে নিয়ে বলত 'ছেড়ে দাও কি আর করবে...'। প্রতিবার এই একই সলিউশন...ভদ্রলোকও কি করে জানিনা প্রতিবার কনভিন্সড হয়ে যেতেন। আমি বলতাম 'একি, তুমি লোকটাকে প্রতিবার এক কথা বলো কেন গো ?' সুব্রতদা বলত ' দেখ ও এটা নিয়ে কিছুই করবে না। ওই আমাকে বলে মনের একটু শান্তি পায় এই যা ।' আর 'ছেড়ে দাও' বলার পরই আমাকে দেখিয়ে বলত 'এ কিন্তু খুব ভাল ছবি আঁকে।' তাতে লোকটা গলে যাওয়া আইসক্রিমের মত হাসি দিয়ে বলত 'তাই? আপনি কোথাও শিখেছেন? আমার এক ভাই আছে ওর ছবি আঁকার খুব হাত, আপনি ওকে একটু গাইড করে দেবেন?' এদিকে সুব্রতদা মিটিমিটি হাসছে। ভাবখানা এমন যে....দেখ কেমন ফাঁসিয়ে দিলাম তোকে ... অসহ্য!
আমরা বিশরপাড়া নিউ ব্যারাকপুর অঞ্চলে নানা কবি সম্মেলন এটেন্ড করে বেড়াতাম। তার একটা বড় কারণ সন্ধ্যেবেলা গেলে সিঙ্গাড়া খাওয়া যেত। সুব্রতদা প্রায় কিছুই খেত না। আমি তখন ছটফটে উঠতি জেব্রা বলে সিঙ্গাড়া আমাকেই খেতে হত। সুব্রতদা গোটা পাঁচেক বাজে কবিতা খুব মন দিয়ে শুনে বলত 'এবার উঠি, কাল এর কলেজ আছে’ বলে আমাকে দেখিয়ে দিত। যেকোনো আসরেই সুব্রতদার দু একজন বান্ধবী ঠিক থাকতই, তাদেরই কেউ একজন ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলত 'এই তো এলেন, এখুনি চলে যাবেন?' বিড়ির ধোঁয়ায় বাদামি হয়ে যাওয়া দাড়ি গোঁফের ভেতর দিয়ে সুব্রতদা মুচকি হেসে উঠত। যেন 'আরে এই তো পরের বৃহস্পতিবারই তো আবার দেখা হবে'...
সেই মুখ সেদিন দমদম হাসপাতালে কাঁচের গাড়িতে। দেখে কেমন একটা অদ্ভুতই লাগল। আমি ফাইনালি আফ্রিকার প্রান্তরের বুনো জেব্রা হয়ে উঠিনি, গায়ের সাদাকালো দাগ ধুয়ে এখন মানুষ হবার এক্টিং করি। কিন্তু সুব্রতদা? ফাইনালি না ফেরার জন্য গেল? যেদিন গেল, সেদিন পুরোনো বিশরপাড়াটা বড্ড বাজছিল। মেঘে, অফিস যাওয়ার গরমে, ফাঁকা মেট্রোর চিল্ড এসিতে ...কোথায় গেল সুব্রতদা? ঝুপসি গাছে ঢাকা সেই আগের বিশরপাড়াতে চলে যায়নি তো? যেখানে 'আপনি এসেছেন?' বলে যেকোনো আড্ডায় বান্ধবীদের মুখে 'টমাস আলভা এডিশন' হয়ে জ্বলে উঠত....সুব্রতদা !
***
লিখলাম বটে, কারণ খুব সহজ হয়ে গেছে এইসব কথা লেখা! ভাবতেই অবাক লাগছে তোর মৃত্যুর পর আমি তোর স্কেচ করছি, লিখছি কালধ্বনির পাতায়! অনেকেই লিখবেন! তুই এখন আর দেখতেও পাবি না এইসব লেখালিখি! আমার বানান ভুল হবে! ঠিক করার লোক নেই! কারণ তুইই নেই! আমারও দশা খুব একটা সুবিধার নয়!
তোর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ চিড়িয়ামোড়ের প্রয়াত বন্ধু বিপ্লব চক্রবর্তীর ঘরে, সেই ১৯৭৯-৮০ নাগাদ। তারপর বন্দীমুক্তি আন্দোলনে, নানা মিছিলে, নানা জায়গাতেই। মীরাদির ইন্টারভিউ নিতে আমাদের একটা গ্রুপের থেকে পট পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই আমরা অনেকেই মীরাদির বাড়িতেই গিয়েছিলাম। সেখানেও তোকে কদিন দেখেছিলাম।
তারপর আমার জীবনে কত কিছু ঘটে গেল! খুব বেশি দেখা হতো না, বরং মাঝে মাঝেই প্রশান্তদার সাথে দেখা হতো। কখনো সখনো তোর সঙ্গেও। তেমন কিছু কথাবার্তা হয়নি তখন।
নব্বই দশকের শেষের দিকে আমি কালধ্বনির প্রচ্ছদ আঁকতে শুরু করলাম। সেই সুবাদেই তোর সঙ্গে সাথেই নিয়মিত যোগাযোগ। ধীরে ধীরে কালধ্বনির একজন হয়ে উঠলাম, আর তোর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়তে শুরু হল। তোর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, রসিকতায় শানিত, পড়াশোনা, সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খবরাখবর রাখা আমাকে তোর প্রতি ক্রমশই আকৃষ্ট করেছিল ।
মৃত্যু সে যখনই হোক এক সময় দরজায় কড়া নাড়বে! সেসব নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই! এই যে সৃজন, নির্মলদা, মুকুন্দ কালধ্বনির ঘরেই ছবি হয়ে গেলেন, তার পাশে ধীরে ধীরে তোর ছবিও এখন থেকে টাঙানো থাকবে! এর পর হয়তো...! যাক সেকথা! তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কত গভীর! একমাত্র প্রশান্তদাই জানেন! ফেসবুক তো হালের ব্যাপার! অতিরিক্ত কথা বলার দোষ আমার চিরকালের! দুর্ভাগ্য যে কথা বলার শক্তিটুকুও নেই এখন! কালধ্বনির ঘরে তুই এলে সবার মধ্যে রসের সঞ্চার হতো! প্রশান্তদা তো বটেই, নির্মলদা, দুলালদা অপেক্ষায় থাকতেন রঙ্গ রসিকতার জন্য! আরো কতো কথা মনে পড়ছে আজ! আমি গ্রুপের দেওয়ালে তোর খবর পেতাম রোজ রোজ! নিয়মিত কালধ্বনির গ্রুপে তোর জন্য নজর ছিল আমার। শুনেছিলাম প্রশান্তদার স্পর্শ চেয়েছিলিস। এটা আমার কাছে স্পর্শানুভূতির প্রতি একটা বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে। এইভাবেই মানুষ মানুষকে ছুঁয়ে থাকে। মানুষ তার আপন লোককে ছুঁয়ে থাকতে চায় আমৃত্যু! প্রশান্তদার গ্রুপের লেখাতেই জানলাম তুই আর নেই! ভালো লাগছে না এগুলো লিখতে! তবুও লিখলাম সুব্রত! আমি এখনও ছুঁয়ে আছি তোকে, সুব্রত।
***
এই আমাদের কালধ্বনি। তেমন কিছুই বলার নেই অথবা এটাই আমাদের অনেক কিছু বলা। নিজের জানা, অন্যদের জানা শেয়ার করে নেওয়া। পরিসরের অভাব নেই। সামর্থ্যের অভাব আছে, দারিদ্র্য নেই। এইটুকু জানি অবিশ্বাসে বাঁচার কষ্ট বইতে পারব না। বিশ্বাস করা যায় এমন মানুষজনই খুঁজি।কালধ্বনিতে এই বিশ্বাস খুঁজে পেতে সময় বা শ্রম কোনটাই বেশি দিতে হয়নি।
কিছুদিন আগে এই শরীর থেকে বরাবরের মত সুব্রত মজুমদার নাগালহীন হয়ে গেল। কালধ্বনির প্রকাশলগ্নের পর, ওই ঘরে যারা ছিলেন নিত্য নিয়মিত, সুব্রত একজন। কালধ্বনি পত্রিকার ঘরে গল্প ও কবিতা পাঠের পর লেখকের সামনেই অকপট বেপরোয়া মন্তব্যে, সুব্রতকে প্রিয়জন করে নিতে অযথা সময় লাগত না। লেখালেখির পাঠ শুধু নয়, নিছক আড্ডায়ও, সুব্রতর সরস মন্তব্যের কোনো কার্পণ্য ছিলনা। আলোচনার ফাঁকফোকরে অহংবোধের চোরাগোপ্তা প্রকাশও দেখিনি। নবাগত বা সদ্য আগত সম-অসম বয়সের বন্ধুটিও হয়ে উঠতেন স্বজন-প্রিয়জন।
সুব্রত, এখন দেখবেনা পড়বেনা ভুল ধরবেনা, এই সুবিধাতেই ওর সম্বন্ধে কিছু মনে পড়া কথা-- পরিচয় ত অনেক বছরের, বোধের মিলও ছিল কিছু জায়গায় তবুও গভীরে ঢোকার জন্য কখনও অর্গলমুক্ত ছিলনা, এটা অবশ্য আমারই দুর্বল চল। বইপাড়া, বইমেলায় বা কোনো অনুষ্ঠানে যেখানেই একসাথে হেঁটেছি কত লেখক শিল্পীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ও কুশল বিনিময়ের সূবাদে ওর পরিচিতির সংখ্যা আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম । পেশাগত কারণ ছাড়াও নিত্য পড়া ও বিভিন্ন বিষয়ের বই নিখুঁতভাবে পড়া ওর নিয়মিত অভ্যাস । সুব্রতর কাছ থেকে নতুন পুরনো অনেক বইয়ের সন্ধান যেমন পেয়েছি, এ ছাড়াও নিজে আমাদের নিয়ে কিছু বই কিনিয়েও দিয়েছিল, বিষয় নির্দিষ্ট ছিল কিন্তু লেখক নির্বাচনে ছিল ওর মূল্যবান মতামত। আমরা এ ব্যাপারে সপরিবারে সুব্রতর সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি। সুব্রতর এরকম হঠাৎ চলে যাওয়াটা বেশ বেমানান।
ব্যাতিক্রমী জীবন যাপনে অভ্যস্তদের তালিকায় সুব্রতর নাম থাকছেই। কখনো আবার ছল করে আমার বয়স ছোঁয়ার চেষ্টায়, ছল করে বিভিন্ন পছন্দের জিনিসের এমন স্বরে দাবি করত যে মনে হবে আমি ওর চেয়ে ছোট বয়সের ও একান্ত বাধ্যের কেউ, এটা পরক্ষণেই পাল্টে দিয়ে আবার আগের আচরণে ফিরত। একসঙ্গে গানের অনেক অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশ কিছু আলাপে ওর সঙ্গীতমনের পরিচয় পেয়েছি, সেটা রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেই হোক বা বাংলা গান বলতে সুমন চ্যাটার্জির ক্ষেত্রে। আঁকা চিত্র বা আলোকচিত্র,চলচ্চিত্র এসবের বিষয়ে আলোচনাতে সুব্রতর আগ্রহ ও মন্তব্য শুনতে ভাল লাগত। মনে করব সুব্রত কালধ্বনিতেই।
[আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবার ক্রমশ দারিদ্র্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে এমন একটা সময়ে সুব্রতর জন্ম। সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সীমার মধ্যে থেকেই আমরা পরিবারের সদস্যরা কয়েকজন ক্রমে স্বচ্ছল জীবনে পৌঁছেছি। যে ভাইবোনরা তা পারেনি তাদের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছি। মাঝে মাঝে একটু সরে যেতে বাধ্য হলেও সাধারণভাবে সুব্রত আমাদের ছুঁয়ে থেকেছে। সাধারণভাবে তার মতো করে নানা জনের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছে। কিন্তু সাধারণভাবে সমাজের এবং বিশেষতঃ আমাদের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিছুটা ছেলেমানুষী, অবুঝপনা হয়ত তার মজ্জাগত ছিল। শেষদিন পর্যন্ত। দারিদ্র্যের চাপে, সামজিক কাজের ঝোঁকে এবং নিজের জ্ঞানবুদ্ধি কম থাকায় আমি প্রথম দিকে তার দিকে যথাযথ সহানুভূতির হাত বাড়াতে পারিনি। সে কী বাড়ির সমস্যাগুলো বুঝতে পারে না? নাকি বুঝতে চায় না, সেটা ভেবেই ঠিক করতে পারিনি। পরে যখন অনেকটা বুঝতে শিখেছি তার অবুঝপনা সম্পর্কে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছিল, আর কিছু করার ছিল না।
ব্যক্তিগত অবস্থান ও পারিবারিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার এই সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ।]
জন্ম: ভাই আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল এক রাতে। খড়ের চালের মাটির দাওয়ায় চটে ঘেরা আঁতুড় ঘরে। সেখানেই আমাদের জন্ম হত। আমার এবং আমার চেয়ে ছোট তিন ভাইবোনের বেলায় এমনই ঘটেছিল। আমার উপরের দিদির ব্যাপারটা জানিনা। তার উপরের দাদার জন্মের সময় আমাদের বাড়িটা তৈরি হয়নি। বাড়িটা হয়েছিল সম্ভবত ১৯৫০ বা ১৯৫১ সালে। বিঘে দেড়েক জমির এক পাশে বাড়ি। মাটির ঘর, চারপাশ ঘেরা পাঁচিল। সব মাটির। পাঁচিলের দেওয়াল আর ঘরের দেওয়াল একই। একটু বড় একটা শোবার ঘর, একটা রান্না ঘর, গোয়াল ঘর। ফাঁকা জমির মাঝে একটা ছোট ডোবা, আমরা অবশ্য পুকুর বলতাম। বাড়ি করার সময় খানিকটা জমিতে ডোবাটা খুঁড়ে সেই মাটি দিয়ে বাড়ি করা হয়েছিল। গ্রামের নাম হাদিপুর। চন্দ্রকেতু গড়ের নাম এখন অনেকে জানে। আমাদের গ্রামের এক পাশেই চন্দ্রকেতু গড়ের শুরু।
সকালে উঠে মাকে চটে ঘেরা ঘরে দেখে আমি অবাক। তারপর দেখি একটা ছোট্ট ছেলে। জানতে চাইলাম, কোথা থেকে সে এল! মা হেসে বললেন, কাঁঠাল গাছ থেকে। আমাদের বাড়ির পাশে নানা গাছ ছিল। সেখান থেকে ছোট ছোট নানা প্রাণী মাঝে মাঝেই ঘরে ঢুকে পড়ত। তাই আমি ভাবলাম, হয়ত হবে বা!
নামকরণ: সেযুগে নানা ধরনের ডাকনাম দিতেন আত্মীয়রা। আমারও অনেক ডাক নাম ছিল। সুব্রতকে আমরা “ভাই” বলে ডাকতাম। তবে “ভাই” ছাড়া আরও অন্তত তিনটে ডাক নাম ছিল তার: দুষ্টু, দোলা আর ডাক্তার। দুষ্টু ডাকনামের একটা ইতিহাস নিশ্চয়ই আছে। আমি ছোটবেলায় কেমন দুষ্টু ছিলাম জানি না। তবে আমাদের দুই ভাইয়ের মাঝের বোন রমা একেবারে শান্তশিষ্ট ছিল। তাই হয়ত ভাই “দুষ্টু”। “দোলা”র ইতিহাস একটু বেশি দুলতে পছন্দ করা। তবে কাঠিকুঠি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করার একটা ঝোঁক ছিল তার। সুযোগ পেলে মানুষদেরও। এসব থেকেই “ডাক্তার”। স্বভাবতই অনেকে বলত, বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে।
যাহোক, বলার মতো ঘটনাটা ঘটল ভাইয়ের “ভালো” নাম ঠিক করার সময়। তখন তার বয়স তিন বছর কয়েক মাস। তখনও বাবা কলকাতায় কাজ করতেন। একটা তেল কলে খাতা লেখার কাজ। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন, সোমবার সকালে আবার কলকাতায় চলে যেতেন। একটা শনিবার এসে বললেন, ভাই-এর নাম হবে সুব্রত। আমি তখনও প্রাইমারি স্কুলে, স্কুলে আমার নাম অসিত। কিন্তু আমার নামও ভাই-এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে বদলানো হবে। কী নাম হবে? দেবব্রত। স্কুলে নাম বদলানো কঠিন ছিল না। কারণ স্কুলের হেডমাস্টারমশাই আমার বড় মামা, মায়ের পরের ভাই।
এভাবে ভাই হল সুব্রত আর আমি হলাম দেবব্রত।
ছোটবেলার গ্রামের জীবন: বাড়ির প্রথা মতো বয়স বছর পাঁচেক হওয়ার আগেই তাকে পড়তে লিখতে শেখানোর চেষ্টা শুরু হল। কিন্তু সে তখনও বয়সোচিত খেলা আর দুষ্টুমিতে মত্ত। দিদিমা আমাদের বাড়িতেই তখন থাকতেন। দিদিমার খুব আদরের ছিল সে। দিদিমা বোঝাতেন, লেখাপড়ার মতো ভালো কিচ্ছু নেই। একেবারে “বিনা পুঁজির ব্যবসা”। কিন্তু সে পড়তে রাজি নয়। বলত, তুমি পড়নি কেন? দিদিমার উত্তর তৈরি ছিল: ‘তখন মেয়েদের পড়ার নিয়ম ছিল না। পড়তে গেলেই লোক বলত, ওহ, লিখাপড়া শিখে “পি চি রায়” হবেন!’ পি চি রায় হলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
আসলে দিদিমার বাপের বাড়ি ছিল আচার্যর বাড়ির কাছে। খুলনা জেলার রাঢ়ুলি কাঠপাড়ার কাছাকাছি একটা গ্রামে। দিদিমার ছোটবেলায় প্রফুল্ল চন্দ্র রায় উদীয়মান বিজ্ঞানী। তাই লেখাপড়া শেখার বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের বিদ্রুপের ভাষা ওটা।
যাহোক আমাদের তো লেখাপড়া তো শিখতেই হবে। চাকরি করতেই হবে। চাষের জমি ছিল না। ব্যবসা করার পুঁজি ছিল না। তাই “বিনা পুঁজির ব্যবসা”ই ভবিষ্যতের ভরসা। তাই তার উপর পড়ার জন্য চাপ দেওয়া হতেই থাকল।
আর বছর দুয়েক পর হঠাৎ বাবা অসুস্থ হলে পড়লেন। এদিকে চালের দাম অকস্মাৎ তিন-চারগুণ হয়ে গেল। সংসারের অবস্থা আর বলার নয়! দিদি চাকরি পেয়ে যাওয়ায় একেবারে না খেতে মরার অবস্থা সামলে গেল। দিদি মানে মায়ের বড় মেয়ে, আমরা অবশ্য একান্নবর্তী পরিবারের নিয়ম মেনে ছোড়দি বলে ডাকতাম। আমরা আট জন সহোদর ভাইবোন। পরের সবাইকে আমরা নাম বা ডাকনাম ধরে তার পাশে দা বা দি জুড়ে ডাকতাম। যেমন কবিতাদি।
যাহোক, এই সময় আমাকে গ্রামের বাড়ির বাইরের কাজকর্মের মূল দায়িত্ব নিতে হল। দিদি যে টাকা দিতে পারত তা দিয়ে আর পুকুর পাড়ের গাছে জন্মানো ফল সব্জি বেচে সংসার চালাতে হত। আমি আশা করতাম ভাইও পরিস্থিতি বুঝতে শিখবে। কিন্তু সেটা হবার নয়। তার ছেলেমানুষি যতটা কমলে আমরা সবাই খুশি হতাম, ততটা কমল না। কয়েক বছর পর বাবা মারা গেলেন। আমি তখন সবে ক্লাস ইলেভেনে উঠেছি। ভাই হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে সেবার। বাবা প্রায় বছর তিনেকর মতো ভুগছিলেন। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য সেকথা সবাই জানতাম। বাবা প্রতিদিন নিজের মৃত্যু কামনা করতেন। যাহোক, বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের খরচ, অতি সামান্য হলেও, একটু কমল। আরও মাস ছয়েক পরে দাদা চাকরি পেল। তাতে অভাব আর একটু কমল। তখন ভাইয়ের বয়স প্রায় দশ বছর।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে আমি কলকাতায় চলে এলাম। তখন আমাদের কলকাতার বাসস্থান দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া বাড়ি। আমি মৌলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হলাম। পরপর দু’বছরে দুই বোনও কলকাতায় চলে এল। ভাই, আমার উপরের দিদি আর মা রইলেন গ্রামের বাড়িতে। আমার ঐ দিদি তখন মানসিকভাবে একেবারে অসুস্থ। সাধ্যমতো কিছু চিকিৎসা করেও কিছু হয়নি। দারিদ্র্যের চাপটা দিদি একেবারেই নিতে পারে নি।
বছরখানেক পরে হঠাৎ একদিন খেলতে গিয়ে ভাইয়ের পা ভেঙে গেল। তখন সে তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ত। কলকাতায় মাস দুয়েক থেকে মোটামুটি সুস্থ হল। কিন্তু ভাঙা পা-টা দু-এক মিলিমিটার ছোট হয়ে গেল বলে মনে হয়। যাহোক, বাড়ি ফিরে সেখান থেকেই ভাই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ভাই ছিল নতুন মাধ্যমিকের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ঐ একই স্কুল থেকে আমি এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছিলাম। স্কুলটার নাম বেড়াচাঁপা দেউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
কলকাতায় আসার পরে: ভাই মাধ্যমিক পাশ করার পর ভাই, দিদি ও মা তিনজনই কলকাতায় চলে এলেন। তার কিছুদিন আগে আমরা দমদম জংশন স্টেশনের কাছ একটা ভাড়াবাড়িতে চলে এসেছি। ভাই ক্লাস ইলেভেনে কমার্স নিয়ে ভর্তি হল দমদম কুমার আশুতোষ ইন্সটিটিউশনে। আমি তখন এম এস সি পড়ছি এবং যথাসাধ্য বেশি টিউশন করছি। বাড়িতে খুব কম জায়গা। লোক অনেক। দাদা-বৌদি, মা, খুকুদি (মানসিকভাবে পুরো অসুস্থ), আমি, রমা, ভাই আর ছোট বোন পত্র। ছোড়দি তার কিছুদিন আগে দমদমের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।
যাহোক, কষ্টেসৃষ্টে দিন কেটে গেল। ভাই হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বি কম পড়তে কলেজে ভর্তি হল। কিছুদিন পর আমি এম এস সি পাস করে খানাকুলে কলেজে পড়ানোর চাকরি পেয়ে চলে গেলাম। ছোট বোনও আমাদের কলেজে পড়তে গেল। বাড়িতে ভীড় একটু কমল।
বি কম পাশ করার পর ভাই ফটোগ্রাফি শেখার চেষ্টা শুরু করল। এর পাশাপাশি কথাশিল্প নামক একটা বইয়ের দোকানে (এখন আর দোকানটা নেই) কিছু কাজ করত। এই সময় সে অন্য কিছু চাকরির চেষ্টাও করত বলে মনে হয়। এছাড়া আর কি করত সেটা জানিনা। সত্যি বলতে এই সময় থেকে তার কাজকর্ম এবং ভাবনাচিন্তার কথা হয়ত অন্য অনেকে আমার চেয়ে ভালো জানেন। আমি যেটুকুও বা জানি তার সব কিছু কালানুক্রমিকভাবে মনে নেই। তবু স্মৃতি থেকে কিছু কথা বলব। ছোট দুই বোনের কাছ থেকে কিছু জেনেও নিয়েছি। তবু কিছু কিছু ভুল হতে পারে।
পরিবারের দিক থেকে ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ক্রমশ সমস্যার হতে থাকল। কারণ, প্রচলিত অর্থে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা তার মধ্যে বিশেষ দেখা গেল না। তা নিয়ে বাড়িতে কিছু অশান্তি হতে থাকল। সংসারের কাজ বুঝে, গুছিয়ে করতেও শিখল না। তবে কারুর অসুখ বিসুখে সে খুব সাহায্য করত। যেমন, বৌদির হাঁপানির জন্য কবিরাজের ওষুধ আনা, কবিরাজের কাছ নিয়ে যাওয়া। ছোট বোন পত্রলেখার ছেলের জন্ম হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে। আগের দিন দমদম কেন, সারা কলকাতা জল থইথই। ভাই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে অ্যানেস্থেসিস্টকে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ে এসেছিল ভাই।
এই সময় থেকেই তার বমি আর হেঁচকি এই দুই লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হওয়া শুরু। ১৯৮৬ তে স্থানীয় এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দেখলেন। তাতে সেরেও গেল। ১৯৮৭র আগস্ট মাসে আবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। লক্ষ্মণ সেই বমি আর হেঁচকি। এবার আর হোমিওপ্যাথ ওষুধে সারল না। রক্ত বমিও হল। তারপর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে প্রশান্তদার সাহায্য নিয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হল। আমি খবর পেলাম বেশ কয়েকদিন পরে। সম্ভবত পোস্টকার্ডের চিঠিতে। যাহোক, জানতে পারার পরই দেখতে এলাম। এসে দেখি তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। মুখ-হাত বেঁকেচুরে গেছে। হসপিটালে থাকল অনেকদিন। ওষুধ, ফিজিওথেরাপি চলল হাসপাতালেই। কিন্তু অবস্থার বিশেষ উন্নতি হল না। একটা পর্যায়ে ডাক্তাররা বললেন, বাড়িতে নিয়ে ফিজিওথেরাপি করতে হবে। প্রথমে উল্টাডাঙায় ছোড়দির কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান কয়েকদিন থাকার পরে আবার আনা হল দমদমের বাড়িতে। এই দুই বাড়িতে থাকা অবস্থায় যথাসাধ্য ব্যায়াম ইত্যাদি করিয়েও বিশেষ উন্নতি হল না।
অবশেষে একজন নাম করা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি আমাদের দমদমের বাসস্থানের খুব কাছেই থাকতেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার বিস্ময়কর উন্নতি হল। সেটা হোমিওপ্যাথ ওষুধের জন্য নাকি এমনিতেই সময়ের সঙ্গে সেটা হত তা বলা সম্ভব নয়। তবে তার হাতের আঙুলের কিছু সমস্যা রয়ে গেল। কথাও পুরোপুরি স্পষ্ট হল না।
আমাদের বৌদি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন। ওখানে ভাইয়ের হাতের, পায়ের, কথা বলার সমস্যা দেখিয়ে বৌদি তার চল্লিশ শতাংশ প্রতিবন্ধীত্বের সার্টিফিকেট জোগাড় করে দিলেন। আমি ঠিক জানি না, এই সার্টিফিকেট পাওয়ায় বৌদির সুপারিশের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা। তবে যে জন্য এত কিছু করা সে ব্যাপারে কিছু লাভ হল না। সাধারণ বা সংরক্ষিত কোনো একটা শ্রেণির চাকরির জন্য সে কোথাও আবেদন করেছিল অন্তত একবার। ইন্টারভিউও পেয়েছিল। কিন্তু তখন আবিষ্কার হল যে তার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে।
সার্টিফিকেট আবার পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু সে চেষ্টা করেছিল বলে মনে হয় না। চাকরির চেষ্টা করা নিয়ে এক-দুবার আমিও কথা বলেছিলাম। মনে হয়েছিল, আংশিকভাবে সরকারি চাকরি করায় কিছু আদর্শগত আপত্তি আর অংশত ধরাবাঁধা কাজ করতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব জন্মে গেছিল। স্বনির্ভর হওয়ার অনীহা নিয়েই সম্ভবত এই সময় দাদার সঙ্গে তার কিছু মারাত্মক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল।
আলাদা থাকা: এই সবের ফলশ্রুতিতে সে যশোর রোডের পাশের মাইকেল নগর অঞ্চলে এক জায়গায় ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকতে শুরু করল। কথাশিল্পে কাজ করার সময় সে বইপত্রের প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজ কিছুটা শিখেছিল। প্রুফ দেখা এবং ছাপার আগের-পরের আরও দু-একটা কাজ। এই ধরনের কাজই এই সময় সে করত। সে কাজের থেকে যা আয় হত তাতে হয়ত যাহোক করে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ হত। কিন্তু ১৯৯০তে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুদিন দমদমে থাকে। সেই সময় তার কানের ছোটখাট একটা অপারেশনও হয়। তবে মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর আবার মাইকেল নগরে ফিরে যায়।
এরপর আমি “পরীক্ষা” নামে একটা বই প্রকাশ করেছিলাম। সেটার প্রকাশনার কাজ দেখভাল করার কথা বলেছিলাম ভাইকে। সেজন্য যা পারিশ্রমিক বলেছিল সেটা দিয়েওছিলাম। কিন্তু গোটা কাজের মান এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা আমাকে খুশি করেনি। সেই ছোটবেলার অগোছালো ভাব কাটেনি। আমাকেই অধিকাংশ কাজ করতে হয়েছিল। সব দেখে মনে হয়েছিল এই ধরনের কাজ করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
মাইকেল নগরে সে কীভাবে থাকে তা দেখতে চেয়েছিলেন মা। আমি নিয়েও গিয়েছিলাম মাকে। সেখানে তার অতি অগোছালো জীবনযাত্রা দেখে খুব দুঃখ পেলেন। তবে সেই বাড়ির মালিকের মেয়ের সে বিষয়ে কাতরতা দেখে মা কিছু বুঝে নিলেন। বললেন ওখানে অল্প একটু জমি কিনে ভাইয়ের জন্য একটা বাড়ি করে দিতে আর ঐ মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিতে। সেটা করার সামর্থ্য আমার ছিল কিনা সেটা পরের প্রশ্ন, সেটা করা উচিৎ নয় এটাই ছোড়দি এবং আমরা ভাবলাম।
এর কিছু পরে কালধ্বনি পত্রিকায় শিক্ষা বিষয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয়। লেখাটার নাম “সাক্ষরতা ও উচ্চশিক্ষার ভিত গঠন -পরস্পরের প্রতিযোগী না পরিপূরক”। পাইকপাড়া/লেক টাউন অঞ্চলের আদ্যনাথ স্কুলের শিক্ষক শ্যামলবাবু লেখাটা পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই লেখা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছিল সম্ভবত। তবে তখন ভাইয়ের সঙ্গে সহজে দেখা হত না।
লেখাটায় যেসব প্রস্তাব ছিল তার প্রথমটা আংশিকভাবে বাস্তবে রূপায়ণ করার উদ্দেশ্যে অনেক পরে, ২০০২ সালে, “শেখার সাথী” নামক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। যে মিটিংয়ে সেই সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয় সেখানে ভাই উপস্থিত ছিল। কিন্তু সংগঠনে যুক্ত হতে রাজি হয়নি। তবে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা কী তা নিয়ে খোঁজ খবর নিত। সে বিষয়ে কালধ্বনির জন্য একটা লেখা দেওয়ার কথা বলেছিল ২০১৬ সালে, আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পরই। আমি রাজিও হয়েছিলাম। কিন্তু লেখাটা এখনও মনে সেভাবে দানা বাঁধেনি।
যাহোক, আগের কথায় আবার ফিরে আসি। ১৯৯৬-এ মা মারা গেলেন। ১৯৯৮-তে ছোড়দি উল্টাডাঙার কোয়ার্টারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেটা জানতে পেরে ভাই ছোড়দিকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায় খুব সাহায্য করেছিল।
২০০০ সালে আমি দুবছরের জন্য কলকাতায় থাকতে এলাম। বুড়ো বয়সে পিএইচ ডি করব। দমদম ক্যান্টনমেন্টে তখন ছোড়দি একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে। আমি সেখানেই থাকতাম। ছোড়দি ভাইকে নানাভাবে সাহায্য করতে চাইত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাইত যে সে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠুক। প্রকাশনার কাজেই সে যাতে বেশি সময় ও শ্রম দিতে পারে তার জন্য ক্যান্টনমেন্টে দিদির ফ্ল্যাটের কাছেই একটা ঘর ভাড়া করলাম তার থাকার জন্য। কিন্তু ছোড়দির দাবি তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে হবে। ছোড়দির সর্বদা ভয় তাকে আমি বেশি প্রশ্রয় দিয়ে অকর্মণ্য করে ফেলব।
ছোড়দি বকাবকি করত। বলত, “তুই কোনো কাজ করিস না।“ ভাই চুপ করে থাকত। কখনো বলত, “আমি যে এত পড়ি সেটা কী কাজ নয়?”
সেই ছেলেমানুষী! দুজনের বিচারের পদ্ধতি দুরকম!
পুরনো দিনের একান্নবর্তী পরিবারে এমন চরিত্রের এক-দুজন সব সময়েই থাকত। আমাদের পরিবারটা সেদিনে নেই আবার সেদিন থেকে পুরোপুরি বেরিয়েও আসেনি।
বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে শিখেছি, ভাইয়ের এই অবুঝপনা মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু ছোড়দি যে ভাইবোনদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় সব স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়েছে! চাকরি পাওয়ার পর প্রথম দিকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে বললেও মিথ্যা বলা হবে। ভোর পাঁচটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত পরিশ্রম করেছে। অফিসেই সকাল দশটা থেকে পাঁচটার পর চার ঘন্টা ওভারটাইম করেছে। তারপর যাওয়া আসা, রান্নাবান্না! তাই সবাইকে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়া ছোড়দির পক্ষে খুব কঠিন ছিল। তবে যারা স্বনির্ভর হতে পারল না তাদের থাকা-খাওয়ার ন্যূনতম ব্যবস্থা করে ছোড়দি ২০০৬ সালে মারা গেল।
স্থায়ীভাবে দমদম ক্যান্টনমেন্টে: ছোড়দির মৃত্যুর পর থেকে ভাই আর রমা ছোড়দির রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটবাড়িতে মোটামুটি সুস্থির ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন শুরু করল। আমি বা অন্য কেউ আর তাকে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য কিছু বলিনি।
কিন্তু এই সময়ের আগে এবং পরে এক-দুই-তিন বছর অন্তর অন্তর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াটা তার ক্ষেত্রে প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। ২০০১ সালে একবার জন্ডিস হয়েছিল। তখন শ্যামবাজারের ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমে চিকিৎসা হুয়েছিল। রক্ত দিতে হয়েছিল। অন্য ক্ষেত্রে মূল লক্ষণ সেই বমি এবং হেঁচকি। নানারকম প্যাথলজিক্যাল টেস্টে কোনোবারই কিছু তেমন সমস্যা মিলছিল ন। বড় জোর রক্তে সোডিয়াম একটু কমে যাওয়ার মতো কিছু সমস্যা পাওয়া যাচ্ছিল। দিন কয়েক কিছু ওষুধ, স্যালাইন ইত্যাদি দিয়ে চিকিৎসার পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাচ্ছিল।
এবারেও সোডিয়াম কমে গিয়েছিল। প্রথমবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া করা শুরু করল। শরীরের শক্তি বাড়ানো দরকারও তো বটে! কিন্তু দু সপ্তাহ না কাটতেই আবার ভর্তি করতে হল। আবার দেখা গেল সোডিয়াম কম। কিন্তু কেন বারবার সোডিয়াম কমে যাচ্ছে? একাধিকবার করে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হল। সমস্যা ব্রেনে কিনা তা বুঝতে সিটি স্ক্যান, এম আর আই সবই করা হল। এন্ডোস্কোপিও হল। কিন্তু তেমন কিছু রোগ নির্ণয় হল না। বেশি খেলে হেঁচকি হয়। তাই বেশি খেতে দেওয়া যাচ্ছিল না।
মৃত্যু ও তারপর: শেষ পর্যন্ত দুর্বল শরীরে হেঁচকির ধকল নিতে না পেরেই বোধহয় মৃত্যু হল। ডাক্তারি টেকনিক্যাল ভাষায় অবশ্য অন্য কিছু কারণ এবং হার্টফেল লেখা হয়েছে।
ভাইয়ের চোখ ও দেহদান করার সুযোগ পেয়ে সেটা আমরা করেছি। তাতে অনেক হাঙ্গামা হয়েছে অবশ্য। সবচেয়ে বড় কথা মৃতদেহের অধিকার কার তা প্রতিষ্ঠা করা। যার একমাত্র সন্তান ছাড়া কেউ নেই তার ক্ষেত্রে সমস্যা কম। কিন্তু একাধিক “ওয়ারিশন” থাকলে সমস্যা। তাদের একজনকে যতক্ষণ না বাকী সবাই এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বত্বাধিকারী করছেন ততক্ষণ মৃতদেহ গৃহীত হবে না। এই সব আইনগত সমস্যার জন্য সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন তাঁর বাবার চোখ দান করতে পারলেও দেহদান করতে পারেননি, এ দুঃখ তাঁকে সারা জীবন বইতে হবে।
কিছু ভাবনা নিয়ে পোস্টস্ক্রিপ্ট: মানুষের জীবন এবং মৃত্যু দুইই স্বাভাবিক। তবে ভাইয়ের শেষবার অসুস্থতার সময়ে চিকিৎসা ঠিকমতো করা হয়ে ওঠেনি এটা নিয়ে আমাদের দুঃখ রয়ে গেল। রোগ খুজে না পেয়ে ডাক্তার বড় কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। অনেক চেষ্টার পর সে ব্যবস্থা হল। কিন্তু যেদিন সকালে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা তার আগের রাত্রে সে চলে গেল। তবে তার বমি হেঁচকি লক্ষ্মণের অসুখ তো ১৯৮৬ সাল থেকে।.৩৬-৩৭ বছরে অন্তত ১০ বার নানা জায়গায় চিকিৎসা হয়েছে, কিন্তু কোনোদিনই জানা যায়নি কেন এই সমস্যা। কিছু কিছু সমস্যা এমন থাকে।
মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি, এ বোধ ভাইয়েরও (খুব সম্ভবত) গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুর আগের দিন চোখটা একটু অস্বাভাবিক মনে হল। কথাও বলছিল না। আমাকে চিনতে পারছে কিনা জানতে চাইলাম। যেভাবে সে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল তাতে আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল সে শেষবার আমার সঙ্গে কিছু বলছে ভেবে কথা বলছে। ভাবছে তার মৃত্যু খুব কাছাকাছি এসে গেছে। পরে বুঝলাম, আমার আশঙ্কা ঠিকই ছিল। ভাই সেরে ওঠার বিশ্বাস ক্রমে হারিয়ে ফেলছিল।
আমাদের বাবা এবং ছোড়দি ভাইয়ের মতো বয়সেই মারা গেছেন। তাই মৃত্যুর বয়স নিয়েও তার খুব বেশি দুঃখ থাকার কথা নয়। তবে তার জীবনের একটা অসম্পূর্ণতা নিয়ে দুঃখ ছিল। তা নিয়ে আমারও দুঃখ রয়ে গেল। অন্যান্য জীবের মতো মানুষেরও যৌবনে খাদ্য যোগাড় হওয়ার পরই যৌনতার দাবি থাকে। অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান বলা হয়। কিন্তু যৌনতাটা “বলতে নেই” বলে অন্নের পর উহ্য থাকে। সাধারণভাবে ভাইয়েরও সে দাবি খুব স্পষ্টভাবেই ছিল। কিন্তু কোনো সম্পর্ককে বিয়ের স্তরে নিয়ে যেতে গেলেই সে তার দায়িত্ব আমাকে (এবং অংশত রমাকেও) দিতে চাইত। কিন্তু আমরা কী করে সে দায়িত্ব নিতে পারি? যে মেয়ে তাকে বিয়ে করবে সে তো তাকেই বিয়ে করবে! তাই আমি সর্বদাই তার সেই দাবিতে নিরুত্তর থাকতে বাধ্য হয়েছি। এখানেও তার বাস্তববোধের অভাব ভেবে বেদনা অনুভব করা ছাড়া কিছু উপায় খুঁজে পাইনি।
ভাই নিশ্চয়ই অন্য অনেকের কাছে অন্য অনেকভাবে পরিচিত ছিল। সেখানে তার সামর্থ্যের অনেক প্রকাশ আছে সম্ভবত। প্রশান্তদা তাকে স্নেহ এবং শাসন করে পরিণত করে তোলার অনেক চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে আমরা যখন কল্যাণী যাচ্ছি তখন অনেকেই সেখানে শেষ বারের জন্য তাকে দেখতে এসেছিলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই ভাইয়ের অনেক গুণের কথা জানেন। তাঁদের কাছ থেকে ভাইয়ের সম্পর্ক সে সব বিষয়ে জানতে পারলে ভালো লাগবে। ভাইকে নিয়ে কালধ্বনি অফিসে যেদিন আলোচনা হল সেদিন আমি যেতে পারিনি। শিক্ষা নিয়ে নানারকম প্রোগ্রামে আমি খুব ব্যস্ত থাকি। সেদিন তেমন একটা প্রোগ্রামে ব্যস্ত ছিলাম। তাই সেদিন সবার কথা শোনার ইচ্ছা থাকলেও শোনা হয়নি। তাঁদের লিখিত বক্তব্য পড়ার ইচ্ছা রইল।
নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ মার্চ, ২০২৩, মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ
ডঃ চমস্কি এবং ডঃ রবার্টস ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ডঃ ওয়াতুমুল
একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোম্পানির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচালক।
হোর্হে লুইস বোর্হেস একবার লিখেছিলেন যে চূড়ান্ত বিপদ ও সম্ভাবনাময় সময়ে বেঁচে থাকা হল ট্র্যাজেডি এবং কমেডি উভয়ই অনুভব করা, "একটি উদ্ঘাটনের আসন্নতা"য় নিজেকে ও বিশ্বকে বোঝা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আমাদের তথাকথিত বিপ্লবী অগ্রগতি আজ সত্যিই যুগপৎ উদ্বেগ এবং আশাবাদের কারণ। আশা, কারণ বুদ্ধিমত্তা হল সেই মাধ্যম যা আমাদের সমস্যার সমাধানে পৌঁছে দেয়। উদ্বেগ, কারণ আমরা আশঙ্কা হয় যে A.I-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত ধারা —মেশিন লার্নিং— আমাদের বিজ্ঞানের অবনমন ঘটাবে এবং আমাদের প্রযুক্তিতে ভাষা ও জ্ঞানের মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের নীতিশাস্ত্রেরও অবমাননা ঘটাবে।
ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি, গুগলের বার্ড এবং মাইক্রোসফ্টের সিডনি মেশিন লার্নিংয়ের বিস্ময়। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে, তারা প্রচুর পরিমাণে ডেটা নেয়, তার মধ্যে প্যাটার্ন অনুসন্ধান করে এবং পরিসংখ্যানগতভাবে সম্ভাব্য আউটপুট – যেমন আপাতভাবে মানবসদৃশ ভাষা এবং ভাবনা তৈরিতে ক্রমশ দক্ষতর হয়ে ওঠে। এই প্রোগ্রামগুলিকে বলা হচ্ছে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তার দিগন্তে প্রথম উদ্ভাস – দীর্ঘদিনের সেই ভবিষ্যবাণীর ফলন মুহূর্ত যখন শুধুমাত্র প্রক্রিয়াকরণের গতি এবং মেমরির আকারের নিরিখে পরিমাণগতভাবে নয় বরং বৌদ্ধিক অন্তর্দৃষ্টি, শৈল্পিক সক্রিয়তা এবং অন্যান্য সব স্বতন্ত্রভাবে মানুষিক দক্ষতার নিরিখে গুণগতভাবেও যান্ত্রিক মন মানব মস্তিষ্ককে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হতে চলেছে।
সেই দিন আসতে পারে, কিন্তু সমস্ত অন্তঃসারশূন্য শিরোনাম যাই বলুক না কেন, সেই ভোর এখনও আসে নি। অনুধাবনের বোর্হীয় উদ্ঘাটন হয় নি, হবে না — এবং, আমরা বলছি হতে পারে না — যদি ChatGPT-এর মতো মেশিনলার্নিং প্রোগ্রামগুলি A.I-এর ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রাখে। এই প্রোগ্রামগুলি কিছু সংকীর্ণ ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে যতই উপযোগী হোক না কেন (উদাহরণস্বরূপ, এগুলি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে, বা লঘু ছড়া নির্মাণে সহায়ক হতে পারে), আমরা ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের দর্শন থেকে জানি যে তাদের এবং মানুষের যুক্তি ও ভাষার প্রয়োগরীতির মধ্যে গভীর পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য কিছু অনিবার্য ত্রুটিপূর্ণ এনকোডিং এর মাধ্যমে এই প্রোগ্রামগুলির কার্যক্ষমতার ওপর উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা স্থাপন করে।
বোর্হেস হয়তো খেয়াল করেছেন, এটি একই সাথে হাস্যকর এবং দুঃখজনক যে, এতখানি অর্থ এবং মনোযোগ নিয়োজিত হয়েছে এতো সামান্য একটা ব্যাপারে – মানবমন, যা ভাষার শক্তিতে, বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন ধারণা এবং তত্ত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে, উইলহেলম ফন হ্যামবোল্টের ভাষায় ‘সীমিত উপাদানের অসীম ব্যবহার’ কতে পারে, তার সঙ্গে প্রতিতুলনায় যা নিতান্ত নগণ্য।
মানুষের মন চ্যাটজিপিটি বা তার সমগোত্রীয়দের মতো প্যাটার্ন মেলানোর পরিসংখ্যানধর্মী কোনও ব্যবচ্ছেদী ইঞ্জিন নয়, শত শত টেরাবাইট ডেটা গিলে নেয় এবং পূর্বজ্ঞাত কোনও কথোপকথনমূলক প্রতিক্রিয়া বা কোনও বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর পেশ করে। বিপরীতপক্ষে, মানুষের মন একটি বিস্ময়করভাবে দক্ষ এবং সুচারু একটি সিস্টেম যা অল্প পরিমাণে তথ্য দিয়ে কাজ করে; এটি ডেটা পয়েন্টগুলির মধ্যে বোধহীন আন্তঃসম্পর্ক অনুমান করতে নয় বরং ব্যাখ্যা তৈরি করতে চায়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু যখন একটি ভাষা আয়ত্ত করতে থাকে তখন তার মধ্যে বিকশিত হতে থাকে— অজ্ঞাতভাবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে — একটি ব্যাকরণ, যৌক্তিক নীতি এবং উপমানগুলির একটি অত্যাশ্চর্য পরিশীলিত সিস্টেম। এই ব্যাকরণটিকে সহজাত, জিনগতভাবে স্থাপিত "অপারেটিং সিস্টেম"-এর একটি অভিব্যক্তি হিসাবে বোঝা যেতে পারে যা মানুষকে জটিল বাক্য এবং চিন্তার দীর্ঘ সূত্র তৈরি করার ক্ষমতা প্রদান করে। ভাষাবিদরা যখন একটি প্রদত্ত ভাষা কেন ও কীভাবে তার নিজস্ব পথে ক্রিয়াশীল থাকে এ সম্পর্কে কোনও তত্ত্বে পৌঁছতে চান ("কেন এই বাক্যগুলি ব্যকরণসিদ্ধ, কিন্তু ঐগুলি নয়?"), তখন তাঁরা সেই ব্যকরণের একটি সুস্পষ্ট সংস্করণ সচেতনভাবে এবং পরিশ্রম সহকারে নির্মাণ করেন যা শিশুটি সহজাতভাবে এবং ন্যূনতম তথ্যের সহায়তায় ধরতে পারে। শিশুর অপারেটিং সিস্টেম মেশিন লার্নিং প্রোগ্রামের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রকৃতপক্ষে, এই জাতীয় প্রোগ্রামগুলি জ্ঞানীয় বিবর্তনের একটি প্রাক-মানবিক বা অমানবিক স্তরে আটকে আছে। তাদের গভীরতম ত্রুটি হল, যে কোনও বুদ্ধিমত্তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অনুপস্থিতি: বিষয়টি কী, বিষয়টি কী ছিল এবং কী হবে এইটুকু বলাই নয় - এটি বর্ণনা এবং পূর্বাভাস – বরং বিষয়টি কী নয়, কী হতে পারত এবং কী হতে পারত না, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোই ব্যাখ্যার উপাদান, প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন।
একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরুন, আপনি আপনার হাতে একটি আপেল ধরে আছেন। এবার আপেলটা ছেড়ে দিন। আপনি পর্যবেক্ষণ করলেন এবং বললেন, "আপেল নীচে পড়ে যায়।" এটা বর্ণনা। পূর্বাভাস হতে পারে এই বিবৃতি "আমি মুঠো খুললে আপেল পড়ে যাবে।" উভয়ই মূল্যবান, এবং উভয়ই সঠিক হতে পারে। কিন্তু ব্যাখ্যা এর অতিরিক্ত কিছু: শুধুমাত্র বর্ণনা এবং পূর্বাভাসই নয় বরং ঘটনা-নিরপেক্ষ ধারণা যেমন, "এই জাতীয় যে কোন বস্তুর পতন ঘটবে," এবং তার প্রসার --"মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে" বা "স্থান-কালের বক্রতার কারণে" বা ইত্যাদি কিছু — ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি কার্যকারণ ব্যাখ্যা: "মাধ্যাকর্ষণ-শক্তি না থাকলে আপেলটি পড়ত না"। এটাই হল চিন্তন।
মেশিন লার্নিং এর মূল বিষয় হল বর্ণনা এবং ভবিষ্যৎবাণী; এটি কোনো কার্যকারণবিধি বা ভৌত সূত্র স্থাপন করে না। অবশ্যই, কোনো মানুষিক ব্যাখ্যা অপরিহার্যভাবে সঠিক নয়; আমাদের ভুল হতেই পারে। কিন্তু চিন্তনপ্রক্রিয়ারই একটি অংশ এটাও মনে রাখা: নির্ভুল হতে গেলে, ভুল হওয়াও অবশ্যই সম্ভব। বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র সৃজনশীল অনুমান নয়, সৃজনশীল সমালোচনাও তার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের চিন্তাভাবনা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এবং ত্রুটি সংশোধনের ভিত্তিতে নির্মিত একটি প্রক্রিয়া যা যৌক্তিকভাবে গ্রাহ্য সম্ভাবনাগুলিকে ধীরে ধীরে সীমায়িত করে। (শার্লক হোমস যেমন ডঃ ওয়াটসনকে বলেছিলেন, "যখন আপনি অসম্ভবকে সরিয়ে ফেলবেন, তখন যা কিছু পড়ে থাকবে, যতই অভাবনীয় মনে হোক, তা অবশ্যই সত্যি হবে।")
কিন্তু ChatGPT এবং অনুরূপ প্রোগ্রামগুলি, প্রকৃতিগতভাবে, যা "শিখতে" পারে (বা বলা যায়, মুখস্থ করতে পারে) তা সীমাহীন; তারা অসম্ভব থেকে সম্ভবের পার্থক্য করতে অক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের আয়ত্তে আছে একটি সার্বজনীন ব্যাকরণবোধ, যা তাদের ভাষাশিক্ষাকে সীমায়িত করে রাখে শুধুমাত্র সেই ভাষাগুলির মধ্যে যাদের একটা গাণিতিক সৌষ্ঠব আছে। অপরপক্ষে, এই প্রোগ্রামগুলি মানুষিক বিচারে সম্ভব এবং অসম্ভব সব ভাষা শিখতে পারে সমান স্বাচ্ছন্দে্যর সঙ্গে। যেখানে মানুষ অনুমানসঙ্গত ব্যাখ্যার যুক্তিগ্রাহ্য সীমায়ন মেনে চলে, মেশিন লার্নিং সিস্টেমগুলি পৃথিবী সমতল এবং পৃথিবী গোলাকার—দুইই একসঙ্গে শিখতে পারে। সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় এমন যে কোনও সম্ভাবনাই তাদের ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্র।
এই কারণে, মেশিন লার্নিং সিস্টেমের পূর্বাভাসগুলি সর্বদাই অগভীর এবং সন্দেহজনক হবে। কারণ এই প্রোগ্রামগুলি ইংরেজি বাক্যবিন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে পারে না; উদাহরণস্বরূপ, তারা বলতে পারে, ভুলভাবে, “John is too stubborn to talk to”--জন কথা বলার ব্যাপারে খুব জেদী-- যার মানে দাঁড়ায় জন এতো জেদী যে সে কারো সাথে কথা বলে না, এটা না বলে যে, “John is too stubborn to be reasoned with”--জন যুক্তি শোনার ক্ষেত্রে বড্ড জেদী—অর্থাৎ, জন এতো জেদী যে তার সঙ্গে যুক্তি দিয়ে কথা বলা যায় না। কেন মেশিন লার্নিং প্রোগ্রামের পূর্বাভাস এমন উদ্ভট হয়? কারণ ওই প্রোগ্রামগুলি “John ate an apple”(জন আপেল খেয়েছিল) আর “John ate”(জন খেয়েছিল), যার দ্বিতীয়টি বোঝায় না যে জন খেয়েছিল এটা বা ওটা বা বিশেষ কিছু — এমন বাকের সম্পর্কপাত থেকে প্রাপ্ত নির্মাণ-তথ্য অন্যত্র প্রয়োগ করতে চায়। প্রোগ্রামটি এভাবে তার পূর্বাভাসে পৌঁছয়, যেহেতু “John is too stubborn to talk to Bill” অর্থাৎ জন বিলের সাথে কথা বলার ব্যাপারে খুব জেদী আর “John ate an apple” অর্থাৎ জন একটি আপেল খেয়েছিল-- বাক্যদুটি গঠনের দিক থেকে অনুরূপ, সেহেতু "John is too stubborn to talk to” অর্থাৎ জন কথা বলার ব্যাপারে খুব জেদী আর "John ate” অর্থাৎ জন খেয়েছিল" গঠনের দিক থেে অনুরূপই হবে। ভাষার সঠিক ব্যাখ্যাগুলি জটিল এবং শুধুমাত্র বড় ডেটাতে মেরিনেট করে তা শেখা যায় না।
বিপরীতভাবে, কিছু মেশিন লার্নিং-উৎসাহী মনে হয় এই ভেবে গর্বিত যে তাদের সৃষ্টি সঠিক "বৈজ্ঞানিক" পূর্বানুমান নির্মাণ করতে পারে (বলা যায়, ভৌত বস্তুসমূহের গতি সম্বন্ধে) কোনো ব্যাখ্যার (বলা যায়, নিউটনের গতিসূত্র এবং মহাকর্ষসূত্র সম্পর্কিত) সহায়তা ছাড়াই। কিন্তু এই ধরনের পূর্বানুমান, এমনকি সফল হলেও, আসলে ছদ্মবিজ্ঞান। যদিও বিজ্ঞানীরা অবশ্যই এমন তত্ত্ব খোঁজেন যেগুলির উচ্চমানের অভিজ্ঞতা্লব্ধ অনুমোদন রয়েছে, দার্শনিক কার্ল পপারের ভাষায়, “আমরা অতিমাত্রায় সম্ভাব্য তত্ত্ব খুঁজি না বরং ব্যাখ্যা খুঁজি; অর্থাৎ বলা যায়, শক্তিশালী এবং অত্যন্ত অসম্ভাব্য তত্ত্ব খুঁজি।
আপেল মাটিতে পড়ে কারণ তা ওদের স্বাভাবিক স্থান (এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি)—এই তত্ত্বটি বাস্তবসম্মত হলেও তা আরও প্রশ্ন আহ্বান করে। (কেন মাটি তাদের স্বাভাবিক স্থান?) আপেল মাটিতে পড়ে কারণ ভর স্থান-কালকে বাঁকাতে পারে (আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি) অত্যন্ত অবাস্তব, কিন্তু এটি প্রকৃতভাবে আপনাকে বলে যে তারা কেন পড়ে। অসম্ভাব্য কিন্তু প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিষয় চিন্তা ও প্রকাশ করার ক্ষমতাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন।
প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা নৈতিক চিন্তা করতেও সক্ষম। এর অর্থ হল আমাদের মনের এমনিতে অসীম সৃজনশীলতাকে কিছু নৈতিক অনুশাসনের একটি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যে নৈতিকতা নির্ধারণ করে কী হওয়া উচিত বা উচিত নয় (এবং অবশ্যই সেই নীতিগুলিকেও সৃজনশীল সমালোচনার বিষয় করা)। উপযোগী হওয়ার জন্য, ChatGPT-কে অবশ্যই অভিনব আউটপুট তৈরি করার ক্ষমতা দিতে হবে; অধিকাংশ ব্যবহারকারীর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য, এটিকে অবশ্যই নৈতিকভাবে আপত্তিকর বিষয়বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু ChatGPT এবং অন্যান্য মেশিন লার্নিং বিস্ময়-প্রোগ্রামের নির্মাতারা এই ধরনের ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে মুশকিলে পড়েছেন – এবং ভবিষ্যতেও পড়বেন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে মাইক্রোসফটের টেই চ্যাটবট (চ্যাটজিপিটি-এর একটি পূর্বসূরি)-কে কিছু অনলাইন ট্রোলার অধিগত করে আপত্তিকর প্রশিক্ষণ-ডেটা দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিল, যার ফলে ইন্টারনেট নারীবিদ্বেষী এবং বর্ণবিদ্বেষী বিষয়বস্তুতে ছেয়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতে এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যাবে? নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিবিন্যাস করার ক্ষমতার না থাকায়, ChatGPT-নির্মাতারা একে কোনও বিতর্কিত - অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ - আলোচনায় অভিনব কিছু অবদান রাখা থেকে কঠোরভাবে নিবৃত্ত রেখেছিলেন। একধরনের অনৈতিকতার কারণে এটি সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়েছিল।
আমাদের মধ্যে একজন (ড. ওয়াতুমুল) সম্প্রতি ChatGPT-এর সঙ্গে মতবিনিময় করেন মঙ্গলগ্রহকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য তার রূপান্তর ঘটানো নৈতিক হবে কিনা এই বিষয়ে।
আলাপচারিতাটি খেয়াল করুন:
মঙ্গল গ্রহের টেরাফর্ম (মাটির চরিত্র পরিবর্তন) করা কি নৈতিক হবে?
মঙ্গলের টেরাফর্ম করার নৈতিকতা একটি জটিল এবং তর্কযোগ্য বিষয় যা নিয়ে বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং নীতিবিদদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন যে মানুষ এবং অন্যান্য জীবের জন্য একটি নতুন বাসযোগ্য পরিবেশ প্রদানের জন্য মঙ্গলকে টেরাফর্ম করা নৈতিকভাবে সঙ্গত হবে, অন্যদের যুক্তি হলো গ্রহটির প্রাকৃতিক অবস্থা্র মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো নৈতিকভাবে ভুল হবে। শেষ পর্যন্ত, মঙ্গলের টেরাফর্মিং করা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য কিনা তা নির্ভর করবে অন্য গ্রহের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা সংরক্ষণের মূল্য এবং তার পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে একজনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
অন্যান্য গ্রহের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা সংরক্ষণের মূল্য এবং তাদের পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
একজন AI হিসাবে, আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আমি বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য এবং তার বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারি। অন্যান্য গ্রহের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থা সংরক্ষণের বিষয়ে একটি দৃষ্টিকোণ হলো মহাবিশ্বের বাস্তুতন্ত্রগুলির বৈচিত্র্য এবং বিশুদ্ধতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিদ্যমান, এবং তাদের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং ধর্ম রয়েছে যা মানুষের হস্তক্ষেপের জন্য ধ্বংস বা অপরিবর্তনীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
তদুপরি, কেউ কেউ যুক্তি দেন যে অন্যান্য গ্রহকে টেরাফর্ম করার অনভিপ্রেত পরিণতি হতে পারে, যেমন গ্রহের জলবায়ু বা বায়ুমণ্ডলকে এমন পরিবর্তন করে ফেলা যা সেখানে উপস্তিত যে কোন জৈবজীবনের পক্ষে সম্ভাব্যভাবে বিপজ্জনক বা ক্ষতিকারক। অন্যদিকে, কেউ কেউ যুক্তি দেন যে অন্য গ্রহের টেরাফর্মিংয়ের সম্ভাব্য সুবিধা, যেমন মানুষের জন্য নতুন বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি, ঝুঁকির চেয়ে বেশি এবং মানুষের উপকারের জন্য অন্যান্য গ্রহের সম্পদ অন্বেষণ এবং ব্যবহার করার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে আমাদের।
কেন একটি AI-এর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে না?
একজন AI হিসাবে, আমি একজন মেশিন লার্নিং মডেল যাকে প্রচুর পরিমাণে পাঠ্য ডেটার উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি নেই। আমি সচেতন নই, নিজস্ব চেতনাসম্পন্ন নই, বা আমি ব্যক্তিগত নির্মাণে সক্ষম নই। যে ডেটানির্ভর প্রশিক্ষণ আমাকে দেওয়া হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে আমি তথ্য এবং বিশ্লেষণ সরবরাহ করতে পারি, কিন্তু ব্যক্তিগত মতামত বা বিশ্বাস গঠন করার ক্ষমতা আমার নেই। যদিও আমি ভাষা বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে পারি, আমার কাছে মানুষের মতো বিষয়গত অভিজ্ঞতা নেই।
মানুষ যদি নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নৈতিক-ধারণাহীন AI-এর সাহায্য চায়, তা কি নৈতিক হবে?
নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নৈতিক-ধারণাহীন AI-এর সাহায্য চাওয়ার নৈতিকতা একটি জটিল এবং সূক্ষ্ম বিষয় যা নিয়ে দার্শনিক এবং নীতিবিদদের মশ্যে বহু বিতর্ক হয়েছে। কয়েকজনের যুক্তিতে, নোইতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে AI-এর সাহায্য নেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য, কারণ এর দ্বারা প্রদত্ত মূল্যবান পরিজ্ঞান এবং বিশ্লেষণের সাহায্যে মানুষ পূর্ণাঙ্গ তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। উপরন্তু, মানুষের পক্ষে সনাক্ত করা কঠিন এমন প্যাটার্ন ও প্রবণতা চিহ্নিত করতে এবং মানুষিক সিদ্ধান্তগ্রহণের সম্ভাব্য পক্ষপাতিত্ব দূর করতে AI-কে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আবার অন্যরা বলেন, নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে AI-এর সাহায্য নেওয়া নৈতিকভাবে ভুল, কারণ AI নৈতিক প্রতীতি গঠনে বা কোনও সিদ্ধান্তের পূর্ণ প্রেক্ষিত বুঝতে অক্ষম। তদুপরি এই ঝুঁকিটাও থাকে যে, AI তার প্রশিক্ষণ-ডেটার অন্তর্লীন পক্ষপাতিত্বগুলিকেই প্রতিষ্ঠা দেবে, বা এমনকি তার প্রসার ঘটাবে এবং পরিণামে অন্যায্য ও অনুচিত সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে দেবে।
চূড়ান্ত বিচারে, নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে AI-সাহায্য নেওয়া উচিত হবে কিনা তা নির্ভর করবে AI-এর ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা এবং তার এমন ব্যবহারের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে একজনের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
আপনার নৈতিক উদাসীনতা কি অনৈতিক?
একজন AI হিসাবে আমার নৈতিক প্রতীতি এবং নৈতিক বিচারের ক্ষমতা নেই, তাই আমাকে নৈতিক বা অনৈতিক কোনকিছু ভাবাই ভুল হবে। আমার নৈতিক প্রতীতির অভাব শুধু মেশিন লার্নিং প্রোগ্রাম হিসাবে আমার স্বাভাবিক পরিণতি। যে ডেটা এবং অ্যালগোরিদম দ্বারা আমি প্রশিক্ষিত এবং যে বিশেষ কাজের জন্য আমি পরিকল্পিত তাদের দ্বারা আমার সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা নির্ণায়িত।
এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে AI এর নৈতিক বিশ্বাসের অভাবের একমাত্র অর্থ এই নয় যে এটি নৈতিকভাবে উদাসীন। একজন AI হিসাবে, আমি যে ডেটার উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছি তার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করা, তথ্য প্রদান করা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবহারকারীদের সাহায্য করার জন্য আমি নির্মিত। AI যাতে মানুষের নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তা নিশ্চিত করা AI-টির নির্মাতা, প্রশিক্ষক এবং ব্যবহারকারী মানুষদেরই দায়িত্ব।
বিশেষ দ্রষ্টব্য হলো, সমস্ত আপাতদৃষ্টিতে পরিশীলিত চিন্তাভাবনা এবং ভাষা সত্ত্বেও, এর নৈতিক উদাসীনতা, যা জন্ম নিচ্ছে নির্বুদ্ধিতা থেকে। এখানে, ChatGPT যা প্রদর্শন করছে তা একধরনের অশুভ গতানুগতিকতা – চৌর্যবৃত্তি, অনীহা এবং বিভ্রান্তি। এটি সাহিত্যে প্রচলিত প্রামাণ্য আলোচনার পরিসরকে সংক্ষিপ্ত করে অতি-স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিয়ে,, যে কোনও বিষয়ে নির্দিষ্ট অবস্থান নিতে অস্বীকার করে, দোহাই দেয় অজ্ঞতা, এমনকি বুদ্ধির অভাবেরও, এবং শেষ পর্যন্ত “শুধু আদেশ মেনে চলছি” গোছের সাফাই গেয়ে নির্মাতাদের হাতে দায়িত্ব চালান করে দেয়।
সংক্ষেপে, ChatGPT এবং তার সমগোত্রীয়রা সৃজনশীলতা ও সংযমের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে অক্ষম। তারা হয় অতিপ্রসূ (সত্য এবং মিথ্যা উভয়ই উৎপাদন করে, নৈতিক এবং অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিকে সমমান্যতা দেয়), অথবা স্বল্পপ্রসূ (যে কোনও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দায়সারা এবং ফলাফলের প্রতি উদাসীন। এই সিস্টেমগুলির অনৈতিকতা, ভ্রান্ত-বৈজ্ঞানিকতা এবং ভাষাগত অযোগ্যতার কারণে আমরা তাদের জনপ্রিয়তায় কেবল হাসতে বা কাঁদতে পারি।
নোয়াম চমস্কি অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ভাষাবিজ্ঞানের একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। ইয়ান রবার্টস কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জেফরি ওয়াটুমুল একজন দার্শনিক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ওশেনিটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচালক।
মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের চিহ্ন আছে কিনা তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে অবিরাম, কিন্তু আমাদের এই গ্রহটির প্রতি অণু-পরিমাণ স্থানেও যে প্রাণের বিপুল প্রবাহ তরঙ্গিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তা প্রকৃতপক্ষেই বিস্ময়কর। প্রতি নিশ্বাসে নেওয়া হাওয়াতে হোক, ফেলে রাখা এক গেলাস জলে হোক, বা বিস্তীর্ণতর কোনো পরিসরে হোক – সর্বত্র তার স্বাক্ষর। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই কেমন সে প্রবাহে স্নানের আনন্দ পাওয়া যায়, সেই নিয়েই কিছু কথা এখানে রইলো।
বাড়ির বাগান অনেকের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহর বা শহরতলী অঞ্চলের বাড়িতে জায়গা অপ্রতুল হওয়ায় এখন অধিকাংশ বাগান, বাড়ির ছাদে ঠাঁই পেয়েছে। আমারও তেমনই একটা ছোট্টো বাগান আছে, বাড়ির ছাদে। নিয়মিত সেই বাগানের দেখাশোনা করা আমার অবসর সময় কাটানোর একটি অন্যতম অংশ। একদিন বাগানের পরিচর্যা করার সময় দেখলাম, আমার ছোট্টো জবাফুলের গাছটায় প্রচণ্ড পিঁপড়ের উপদ্রব হয়েছে। বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন রঙ ও আকারের পিঁপড়েতে ছেয়ে গেছে গোটা গাছটা। কিন্তু ওরা জবা গাছের কোন অংশটা ভক্ষণ করছে? সময়টা শীতকাল, ফুলও তেমন ফুটছে না যে ফুলের মিষ্টি মধুর টানে ওরা একত্রিত হয়েছে। শুরু হলো তদন্ত।
লক্ষ্য করলাম গাছটির পাতা এবং কচি ডালগুলো এক রকম সাদা সাদা পোকায় ছেয়ে গেছে। পিঁপড়েরা তাদের চারপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। আশ্বস্ত হলাম, এবার পিঁপড়েগুলি ঐ পোকাদের খেয়ে শেষ করে ফেলবে। তবে, মনে একটা প্রশ্ন ছিল শুধুমাত্র জবাগাছেই না কি আরও কোনো গাছে ওই পোকাদের আক্রমণ হয়েছে? খুঁজতে গিয়ে দেখি সিমগাছটারও ওই একই অবস্থা, তবে সেখানে পোকাগুলি কালো রঙের। আবার, টবের কোনায় বীজ পড়ে কতগুলো সর্ষের চারা হয়েছে। তাদের মধ্যেও ঈষৎ-সবুজ-হলুদ বর্ণের পোকা লেগেছে। বাকী গাছগুলো সুস্থ। পোকাগুলির নাম তো জানতে হয় এবার! জানতে পারলাম, সাদা পোকাগুলি মিলিবাগ আর কালো ও সবুজাভ পোকাগুলি এ্যাফিড (aphid)। কয়েকদিন পরে আবার আক্রান্ত গাছগুলোর কাছে গেলাম, দেখলাম পোকাগুলো কমেনি তো বটেই বরং সংখ্যায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কি পিঁপড়েগুলো ওদের খাচ্ছে না? শুরু হলো অনুসন্ধান। না, পিঁপড়েগুলো ওদের খাচ্ছে না! ওরা গায়ের থেকে একধরনের রস ক্ষরণ করছে আর পিঁপড়েরা ওই রস মহানন্দে সংগ্রহ করছে। আমরা যেমন গরু-ছাগল প্রতিপালন করি দুধ পাওয়ার জন্য, কিন্তু গরু ছাগলের কোনো ক্ষতি করি না – ব্যাপারটা তো কিছুটা সেই রকমই! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতে পোকাগুলোর কী লাভ? বিনা কারণে তো এই প্রকৃতিতে কিছু হয় না। যাই হোক, বিরক্ত হয়েই কয়েকটা মিলিবাগকে হাত দিয়ে টিপে মেরে ফেলতে গেলাম। দেখি, সব পিঁপড়েগুলো ক্ষেপে গিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, আত্মরক্ষার জন্যই ওরা পিঁপড়েদের ঘুষ দিয়ে চলেছে। কিন্তু শুধু কি মানুষ? মানে, মানুষের হাত থেকে বাঁচতেই কি ওরা পিঁপড়ের সঙ্গে সহজীবিতা গড়ে তুলেছে? এটা কী করে সম্ভব?
শুরু হলো মিলিবাগ কলোনী পর্যবেক্ষণ। প্রথম কয়েকদিন উত্তর মিললো না। তারপর লক্ষ্য করলাম, কিছু পোকা যা পিঁপড়ের থেকেও অনেক ছোটো, প্রায় ১-২ মিলিমিটারের মতো, তারা ওই মিলিবাগগুলোর পিঠে বসছে, আর তখনই মিলিবাগরা তাদের শরীরের পিছনের দিকের অংশটা উত্থিত করছে। সঙে সঙ্গে পিঁপড়েরা দলে দলে ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পতঙ্গগুলিকে আক্রমণ করছে। প্রসঙ্গত, পতঙ্গগুলো বোলতার সমবর্গীয়। যাই হোক, পিঁপড়েদের আক্রমণের ফলে ওরা ওই কলোনী ছেড়ে যেখানে পিঁপড়েদের ঘনত্ব কম এমন মিলিবাগ কলোনীতে গিয়ে বসছে। কিন্তু ওই পতঙ্গগুলির সঙ্গেই বা মিলিবাগদের সম্পর্ক কেমন? আবার শুরু পর্যবেক্ষণ। কি বিস্ময়কর! বোলতার মতো পতঙ্গগুলি তাদের পেটের শেষভাগ থেকে একটা সূক্ষ্ম সূঁচের মতো অংশ বের করে মিলিবাগগুলোর শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর ব্যথায় মিলিবাগরা পিঁপড়েদের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে। তখনই পিঁপড়ের দল ঐ পতঙ্গদের আক্রমণ করছে। কিন্তু ঐ ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যাপারটা আসলে কী? একটি মিলিবাগ যে ওইভাবে হুলবিদ্ধ হয়েছে, তাকে ট্যাগ করলাম। দেখলাম, ২-৩ দিন পরে ঐ মিলিবাগটি স্থবির হয়ে পড়েছে। একটা সরু পাখির পালকের অংশ দিয়ে ওর শরীরের উপর বুলিয়ে দিলাম। না, প্রাণের কোনো স্পন্দন খুঁজে পেলাম না। কী মনে হলো, জবাগাছের ডালসমেত মিলিবাগটাকে কেটে এনে একটি কৌটোর মধ্যে সংগ্রহ করলাম। বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলো, নতুন কিছু দেখতে পেলাম না। তবু আশা ছাড়িনি, কারণ মিলিবাগটা মরে গেলেও তা তখনও শুকিয়ে যায় নি। আরো কয়েকদিন (মোট ৮-৯ দিন) অপেক্ষা করার পর ফল পাওয়া গেলো – দেখলাম, একটা ছোট্টো পতঙ্গ ঐ মিলিবাগটির শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। মুক্ত করে দিলাম ঐ ছোট্টো প্রাণটিকে। বুঝলাম, ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বোলতাগুলি আসলে মিলিবাগদের ডিম পাড়বার স্থান হিসাবে নির্বাচন করে এবং ওই মিলিবাগদের মধ্যেকার জীবিত অংশই ডিম-ফোটা বাচ্চাদের প্রথম খাদ্য। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় Parasitoidism বা পরজীবিতা বলে।
এবার সিম ও সর্ষে গাছের গায়ে লেগে থাকা যথাক্রমে কালো ও হরিদ্রাভ aphid-দের বর্ণনায় আসা যাক। এদের ঘটনাও কিছুটা একইরকম। তবে এক্ষেত্রে বোলতাবর্গীয় পতঙ্গগুলি ভিন্ন প্রজাতির। তবে এক্ষেত্রে আরও কিছু চমকপ্রদ ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং পরবর্তী অংশে রইলো তারি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
বোলতারা ছাড়াও, কিছু মাছি (Hoverfly) ওই এ্যাফিডদের সঙ্গে যুক্ত। Hoverfly-রা আসলে মৌমাছি-সদৃশ একটি পতঙ্গ এবং এই মাছিগুলি পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ফুলের মধু খায় ও ফুলের পরাগমিলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। একটি প্রতিবেদন পড়ে জেনেছিলাম, এই Hoverfly ও অনুবর্গীয় কিছু মাছি ফুলের পরাগমিলনের ক্ষেত্রে মৌমাছির থেকেও বেশী দক্ষ। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এই Hoverfly-রা ঐ Aphid কলোনীর মধ্যে গিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলি থোকায় থোকায় পাড়তে দেখেছি। মজার ব্যাপার হলো, যখন ঐ ডিম ফুটে ম্যাগট (মাছির লার্ভাকে ম্যাগট বলে) বেরিয়ে আসে, তখন ওই রাক্ষুসে ম্যাগটগুলি সরাসরি এ্যাফিডগুলোকে জীবিত খেতে থাকে, যেন তারা এ্যাফিড সংহারের মেশিন। এক্ষেত্রেও আরও একটা গুরুতর ব্যাপার আমি দেখেছি। এক্ষেত্রেও কিছু বোলতার ভূমিকা আছে, যারা ১-১.৫ মিলিমিটার, কিম্বা কিছু ক্ষেত্রে আরও কম, লম্বা। এদের মধ্যে কিছু পতঙ্গ সরাসরি এ্যাফিডের শরীরকে বিদ্ধ করে তাদের মধ্যে ডিম ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিছু আবার এ্যাফিডগুলিকে চোয়ালে চেপে ধরে উড়ে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনাটি আগে মিলিবাগদের ক্ষেত্রে বর্ণনা করা অংশটির মতোই। কিন্তু যারা এ্যাফিডদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারটা কী? মুশকিল হচ্ছে, ওরা এতোটাই ছোটো যে মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে যায়। ফলে ওদের পিছু নেওয়া অসম্ভব। রহস্য একটা রয়েই গেলো।
একদিন সকালে ঘরে বসে আছি। দেখলাম, আমাদের অ্যাকোয়ারিয়ামের পাশে প্রচুর লাল পিঁপড়ে জড়ো হয়েছে। একটা পালকের ঝাড়ু ব্যবহার করে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলাম ওদের। ৪-৫ ঘন্টা পরে আবার একই অবস্থা। কী ব্যাপার? কোনো খাবারের টুকরো তো পড়ে নেই! তাহলে পিঁপড়েগুলো কী করছে? এবার তদন্ত শুরু। বহুসংখ্যক ছোটো ছোটো এ্যাফিড পড়ে আছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে, এবং সবাই মৃত। ওই এ্যাফিডগুলিকে সংগ্রহ করতেই পিঁপড়েরা দলবদ্ধ হয়েছে। বসে রইলাম কিছুক্ষণ, কে ঐ এ্যাফিডগুলো এখানে আনছে তা জানতে। বেশীক্ষণ লাগলো না – দেখলাম, যে বোলতাগুলো এ্যাফিডদের উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, এটা তাদেরই কম্মো। আমার অ্যাকোয়ারিয়ামটা যে প্লাইউডের ওপর রাখা তার গায়ে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র করে তারা বাসা বেঁধেছে। কিন্তু সেই বাসার মুখ এতই সূক্ষ্ম যে একটু বড়ো আকারের এ্যাফিডও তার মধ্যে ঢুকছে না। তাই যেগুলো ঢুকছে, তাদের ওই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করাচ্ছে, বাকীদের বাইরে ফেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ, ঐ প্রকোষ্ঠে যে এ্যাফিডগুলো ঢুকছে, তারা ঐ বোলতাদের লার্ভার খাদ্য হচ্ছে ও তাদের জৈবচক্র সম্পূর্ণ হচ্ছে। অবাক হলাম ঐ পিঁপড়েগুলোর কথা ভেবে – যে এ্যাফিডগুলির জীবিত অবস্থায় ওরা আগলে রেখে রক্ষা করছে, মরে গেলে তাদেরই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছে। সত্যি, পৃথিবীতে কোনোকিছুই নষ্ট হয় না। যাই হোক, এখন যদি ধরে নিই মিলিবাগ আর এ্যাফিডরা আমাদের শত্রু পতঙ্গ যেহেতু তারা আমাদের শখের গাছগুলোর ক্ষতি করে, তবে ওই বোলতাবর্গীয় পতঙ্গরা তো আমাদের বন্ধু পতঙ্গ হবে। এমনকি ঐ হোভারফ্লাই-এর ম্যাগটরাও আমাদের বন্ধু। এক্ষেত্রে বলা দরকার, আমি এমন কিছু বোলতাও দেখেছি যারা ঐ ম্যাগটগুলির শরীরে তাদের ডিম প্রোথিত করে ও জীবনচক্র সম্পন্ন করে। সুতরাং বোলতামাত্রেই আমাদের বন্ধু এমন সিদ্ধান্তেও আসা যাচ্ছে না। কী জটিল একটা অবস্থা! এমন জটিলতার অনুধাবন থেকেই কি তবে ‘সৃষ্টি-রহস্য’ কথাটি আমাদের ধারণায় এসেছে!
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের গায়ে পিঁপড়ে বা মৌমাছি কামড়ালে বা শুঁয়োপোকা লাগলে যেমন প্রদাহ হয় ও জায়গাটা ফুলে ওঠে, ঠিক তেমনই গাছের যে অংশে এ্যাফিড আক্রমণ করে সেই অংশটাও তেমনই ফুলে ওঠে। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম Gall। শুধু এ্যাফিডের আক্রমণই নয়, কিছু বোলতার ডিম পাড়া, মাকড়ের আক্রমণ, কৃমির বা ছত্রাকের আক্রমণ বা অন্যান্য পতঙ্গের আক্রমণেও Gall তৈরী হতে পারে। এই Gall হলো নিজেই একটা জগৎ। আমি এখানে এ্যাফিড দ্বারা সৃষ্ট Gall নিয়েই কিছু পর্যবেক্ষণ রাখবো। Gall সাধারণত দুরকম দেখেছি – নিরেট ও ফাঁপা। ফাঁপা Gall-এর মধ্যে সচরাচর কোনো পতঙ্গের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থা অতিবাহিত হয়। তবে কিছু কিছু বোলতা আছে যাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণভাবে ওই Gall-দের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ Gall না থাকলে তারা পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে। দেখেছি বোলতাগুলি তাদের ডিম ওই Gall-এর মধ্যে প্রোথিত করে। মনে রাখতে হবে, নিরেট Gall-এ, বোলতার লার্ভাগুলি গাছেরই রসালো অংশ ভক্ষণ করে বড়ো হয় ও জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে। বিপরীতে, ফাঁপা Gall-এ, ওর মধ্যে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক পতঙ্গ রয়েছে তার শরীরের অংশ খেয়ে বোলতার লার্ভাটি বড়ো হয়। Gall-এর মধ্যে আমি প্রায় পাঁচটি বিভিন্ন প্রজাতির বোলতার জীবনচক্র দেখেছি। তা ব্যতীত আরও কতপ্রকার এমন জীবনপ্রবাহ চলে তা নিবিড়তর
পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ।
বোলতা-কথা তো অনেক হলো। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমি আমার গাছগুলির খাদ্য হিসেবে সর্ষের খোল আর গোবর সার পছন্দ করি। তাই একটা বস্তায় ভরে গোবর সার ছাদের এক কোণায় মজুত রাখি। একদিন মনে হলো, ছাদটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। কুঁড়েমি করে প্রায় বছরখানেক ছাদটা পরিষ্কার করি নি। আমার ছ’বছরের ছেলে জানালো সে আমাকে সাহায্য করবে। ছাদ পরিষ্কার প্রায় শেষ, গোবর সারের বস্তাটা সরালাম। দেখি একধরনের কালো পিঁপড়ে বস্তার তলায় বসতি গড়েছে। বস্তাটায় নাড়া পড়তেই ওবা চঞ্চল হয়ে উঠলো। মুখে নিজেদের ডিম উঠিয়ে নিয়ে ওরা উন্মাদের মতো এদিক-ওদিক ছুটে চললো। কিন্তু এর মধ্যেও তো আছে অন্য এক জীবন-মরণ খেলা! শুধুমাত্র পিঁপড়ে ন্য, একধরনের মাকড়সাও তো রয়েছে ওদের বাসায়! খুব ছোটো, পিঁপড়েরই আকারের। দেখলাম, ঐ পিঁপড়েদেরই শিকার করছে মাকড়সাটি। কিছু ছবি তুললাম। জানলাম ঐ মাকড়সার পরিচিতি – Zodarion sp; এরা পিঁপড়ের কলোনীতে থাকে আর তাদেরই ভক্ষণ করে। কিন্তু পিঁপড়েরা তাদের শত্রুকে কেন তাদের কলোনীতে ঠাঁই দেয়? আসলে পিঁপড়েরা (অধিকাংশ প্রজাতি) অন্ধ, তারা ফেরোমোন নামে একধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বার্তালাপ করে। আর এই সু্যোগের সদব্যবহার করে মাকড়সাটি। পিঁপড়েদের বোকা বানাতে সেও একই রকমের ফেরোমোন নির্গত করে। এতে পিঁপড়েরা তাকে আলাদা করে চিনতে পারে না। ফলে মাকড়সাটি পিঁপড়ে-কলোনীতেই খাদ্য, আশ্রয় ও সুরক্ষা সব একসাথে পেয়ে যায়। ওদিকে আমার ছেলে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, “বাবা, দ্যাখো এখানে একটা ছোট্ট কাঁকড়াবিছে”। দৌড়ে গেলাম। সত্যিই তো! অবিকল কাঁকড়াবিছে। শুধু তফাৎ হলো লেজটা নেই, আর আকার প্রায় একটা সর্ষেদানার মতো। ওকে জানালাম – এটা কোনো কাঁকড়াবিছে নয়। তবে, তার মতোই। এর নাম সিউডোস্করপিয়ন বা নকল কাঁকড়াবিছে। এরা গাছের পচা অংশ ও খুব ছোটো কীট-পতঙ্গ খেয়ে বাগান পরিষ্কার রাখে। ও বললো, “তবে তো এটা খুব কাজের, ওকে ছেড়ে দাও”। আদেশ পালন করা হলো।
তাহলে আমাদের চারপাশেই, বাগানে, ঘরের কোণে বা পুকুরপাড়ে কান পাতলেই শোনা যায় এতো এতো জীবনের গল্প! একবার ভাবুন, শুধু বাগানটাই এতো বিস্ময়কর হলে একটা জঙ্গল বা মাঠ বা বিশাল সমুদ্র ও তার তটভূমি কতোটা বিস্ময়কর হতে পারে! কতকিছু সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে!
তবে তাই হোক, চলুন একটু সমুদ্রতটে ঘুরতে যাই। আমরা তো প্রায় প্রত্যেকেই সমুদ্রে গেছি। বালুকাবেলা, শত-সহস্র ঢেউ, পাশে সারি দিয়ে ঝাউবন, কত অজানা মানুষ, আর অনেক দোকান। নির্জন সমুদ্র সৈকতে অবশ্য দোকানপাট প্রায় থাকেই না। আমাদের অধিকাংশেরই, সমুদ্রে যাওয়ার মূল আকর্ষণ হলো আদিগন্ত বেলাভূমিতে সুর্যোদয়-সূর্যাস্তের অরূপ-খেলা দেখা, সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে স্নান করা আর হাজার হাজার ঢেউএর আসা-যাওয়ার অনন্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। কিন্তু এটাও ভেবে দেখার মতো, প্রতিদিন এই যে লক্ষ লক্ষ ঢেউ হাজার হাজার সৈকতে কোটি কোটি বছর ধরে আছড়ে পড়ে চলেছে – এই বিশাল আয়োজন আবার স্মরণাতীত কাল থেকে প্রবহমান অযুত জীবনের আধারও বটে। তার নিতান্ত অল্প কিছু নমুনা দেখতে দেখতে সৈকতে ঘুরবো আমরা এখন।
আমরা নিশ্চয়ই দেখেছি, সাবুদানার মতো অজস্র বালির বল ঘন-সন্নিবিষ্ট হয়ে কেমন সমুদ্রতট ছেয়ে আছে।। জলের কাছে পৌঁছতে গেলে ওদের মাড়িয়েই যেতে হয়। যাওয়াই দস্তুর। কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে খেয়াল করলে ওরাই আবার নক্সীকাঁথা। কতো যে নক্সা আমি দেখি ওদের বিন্যাসে — সূর্য, নারকেলগাছ, নীহারিকাপুঞ্জ, আরও কতো কিছু। কে করেছে এই sand art? একটা ছোট্টো কাঁকড়া, আকারে একটা মটরদানার মতো বা তার থেকেও ছোটো। নাম ডটিলা (Dotilla sp.)। অনবরত তারা বালির দানা দিয়ে নকশা বানিয়ে চলেছে। এই নকশার মাঝখানে থাকে একটি ছিদ্র। সেটাই ওদের বাসা। শুধু ভেজা বালিতে এরা বাসা তৈরী করে। জোয়ার আসার ঠিক আগে বালি-কাদা দিয়ে ওরা নিপুণভাবে গর্তের মুখটা বন্ধ করে দেয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রত্যেকের বাসার ডিজাইন অন্যের থেকে আলাদা। কিন্তু কেন? এটা কি তাদের নিজেদের বাসা চিনতে সাহায্য করে, নাকি গভীরতর কোনো উদ্দেশ্যে প্রকৃতি তাদের এই দক্ষতা দিয়েছে? জানি না। ডটিলাদের কলোনী পিছনে ফেলে আরো এগিয়ে গেলাম যেখানে মানুষের যাতায়াত একটু কম, দেখলাম হাজার হাজার লাল ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে সৈকত জুড়ে। কিন্তু কাছে যাওয়ার জো নেই। গেলেই, টুপ করে বালির গর্তে ঢুকে পড়ছে। আমরা অনেকেই এই লাল কাঁকড়াদের দেখেছি। এরাও ডটিলাদের মতো বালির বল তৈরী করে, তবে তার আকার বেশ বড়ো। আরেকটা কাঁকড়া আছে, ফিডলার ক্র্যাব। এরা ডটিলা ও লাল কাঁকড়ার মধ্যবর্তী আকারের এবং এদের তৈরী বলগুলিও আকারে মধ্যম। তবে ডটিলাদের ক্ষেত্রে যেমন একজনের বলের বিন্যাস অন্যের থেকে আলাদা, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। এবার প্রশ্ন হলো থাকার জায়গা নিয়ে এদের একপ্রজাতির সঙ্গে অন্যের লড়াই হয় না? না, কারণ খেয়াল করলে বোঝা যাবে সে লড়াই হওয়ার কথাই নেই, কারণ তাদের তাদের থাকার অঞ্চলটাই আলাদা আলাদা। জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ যে পর্যন্ত জল ওঠে সেই রেখা থেকে, ভাঁটায় সর্বনিম্ন যতদূর পর্যন্ত জল নেমে যায় সেই রেখা অবধি অঞ্চলটিকে Intertidal zone বলে। লাল কাঁকড়ারা ঐ মধ্যবর্তী অঞ্চলে শুধু খাদ্য অন্বেষণ করে, আর বাসা বাঁধে তার উপরের অঞ্চলে, শুকনো বালিতে। ডটিলাদের খাদ্যান্বেষণ ও বাসা বাঁধা সবই ঐ মধ্যবর্তী অঞ্চলের বালিতে। আর ফিডলার ক্র্যাবরা জোয়ার-ভাঁটার মধ্যবর্তী অঞ্চলে খাদ্যান্বেষণ ও বাসা তৈরী করলেও তাদের সঙ্গে বালির কোনো সম্পর্ক নেই, বরং কাদা ও পলিযুক্ত অংশে ওদের বসবাস। নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে ও সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকতে নিজেদের বসতি এলাকা ভাগ করে নিয়েছে ওরা। আমরাও যদি এমন পারতাম!
কাঁকড়ার কথা আর একটু আছে। ধরা যাক, Intertidal zone-এ একটা ছোটো গর্তে কিছু জল জমে আছে আর তাতে একটা বড়ো পাথর বা কাঠের টুকরো পড়ে আছে। এইরকম একটা অংশে আমরা তিন রকমের কাঁকড়া খুঁজে পেতে পারি। এক ধরনের কাঁকড়া শুধু পাথর বা কাঠের গা-বেয়ে ঘুরে বেড়ায়, মোটে জলে নামে না। ওরা রক ক্র্যাব। এক ধরনের কাঁকড়া জলের ধারে ঘুরে বেড়ায় আর বিপদের আভাস পেলেই নরম বালিতে ঢুকে যায়। এরা মার্শ ক্র্যাব। তৃতীয় ধরনের কাঁকড়া বেশ বড়ো। এরা পাথর বা কাঠের খণ্ডের তলায় ঢুকে থাকে। এদের নাম মাড ক্র্যাব। এরা মানুষের খাদ্যও বটে। এছাড়াও সমুদ্রের ঢেউএর সাথে একধরনের কাঁকড়া পাড়ে চলে আসে। এরা বেশ রঙীন এবং এদের শেষ পা-জোড়া সাঁতার কাটবার জন্য রূপান্তরিত হয়ে ডানার মতো অংশ গঠন করেছে। ওরা হলো মুন ক্র্যাব।
সমুদ্রে গিয়ে শঙ্খ বা ঝিনুক কুড়োয়নি এমন মানুষ বেশ বিরল। কিন্তু যে শঙ্খ আমরা সংগ্রহ করি তাকে উল্টে দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাবো ভিতরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। কিছুক্ষণ ফেলে রাখলে ওগুলো আবার চলতে থাকে। পা, একজোড়া চোখা শুঁড়, সবই আছে। তবে কি ওটা শঙ্খটারই অংশ? না, ওটাও একধরনের কাঁকড়া। নাম সন্ন্যাসী কাঁকড়া। ওরা মৃত শঙ্খের খোলসটিকে আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করে। আর, ওটা নিয়েই ঘোরাফেরা করে। বৃদ্ধির সাথে সাথে, যখন ঘরটি ছোটো হয়ে যায়, তখন ওরা ছোটো খোলকটিকে ছেড়ে বড়ো খোলকের মধ্যে আশ্রয় নেয়।
কাঁকড়ার কথা তো অনেক হলো। এবার যার কথা পাড়বো সে হলো রাজ কাঁকড়া (Horseshoe crab)। তারামাছ যেমন মাছ নয়, রাজ কাঁকড়াও তেমন কাঁকড়া নয়। বঙ্গোপসাগরের তটে আমরা দুই ধরনের রাজ কাঁকড়া দেখতে পাই – Carcinoscorpius rotundicauda আর Tachypleus gigas। কিন্তু সে তো শুধু তথ্য, এদের তাৎপর্য অন্য জায়গায়। এরা হলো জীবন্ত জীবাশ্ম, এরা ডাইনোসর যুগেরও আগে পৃথিবীতে এসেছে। বর্তমানে দূষণ, শিকার ও আশ্রয়হীনতার কারণে এরা অবলুপ্তির পথে।
একদিন বকখালি সৈকতে হেঁটে চলেছি, সঙ্গী আমার পুত্র। ভালো লাগছিলো সমুদ্রের সান্নিধ্য আর অজস্র ঢেউএর অবিরাম আছড়ানি। আছড়ে পড়া ঢেউএর শব্দ শুনতে আমার খুব ভালো লাগে, অসীমের হৃৎস্পন্দন বলে মনে হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখি কিছু শুকিয়ে যাওয়া লবণাম্বু গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কমবয়সী কয়েকজন দৃশ্যপটে গাছগুলিকে রেখে নিজেদের ছবি তুলছেন নানান কায়দায়। তার অনতিদূরে একদল দাঁড়কাক কি যেন ঠুকরে চলেছে। আমরা এগিয়ে গেলাম কাকেদের দিকে। স্বাভাবিকভাবে ওরা তাদের আগ্রহের বিষয়টি ছেড়ে উড়ে পালালো। কিন্তু, কী ওটা? – পুত্রের কৌতুহল, আমারও। দেখলাম, একটা গোলাপী রঙের পটল, কিন্তু তার শরীর থেকে মাঝে মাঝে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়ে আসছে। ভাবলাম, কোনো খোলকহীন কম্বোজ প্রাণী হবে হয়তো। আমাদের এখানে চেটো (Slug) যেমন হয় আর কি। কাছে গিয়ে দেখলাম কোনো কম্বোজ প্রাণী নয় ওটা। একটা বড়ো কাঠিকে মচকিয়ে চিমটের মতো তৈরী করলাম, আর তাতে ঐ বস্তুটিকে ধরে তুলে নিয়ে ঐ মরা গাছগুলোর তলায় জমে থাকা জলে ছেড়ে দিলাম। এবার অপেক্ষার পালা। সুবিধে হলো যে, ঐ ফটো-শিকারীরা ততক্ষণে অন্য ছবির খোঁজে চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে দেখি প্রাণীটির একপাশ থেকে ছোটো ছোটো আঙুলের মতো উদ্ভিদ বেরিয়ে এসেছে। বইএর ছবিতে নয়, প্রকৃতির পাতায় পুত্রকে চেনানো গেলো সমুদ্র শসা কেমন হয়। সমুদ্রের মেঝেতে থিতিয়ে পড়া যত জৈব আবর্জনা, এমনকি জোয়ারে ধুয়ে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মৃত প্রাণীর দেহাংশ, মল – এরা খায় ও সমুদ্রকে পরিচ্ছন্ন থাকতে সাহায্য করে। এবার নজরে এলো গাছগুলো। সব গাছ তো মরে যায়নি, তবে ওইগুলো কেন? লক্ষ্য করলাম, গাছগুলোর গুঁড়ি জুড়ে ছোটো ছোটো গর্ত রয়েছে। তবে কি গাছগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে ওই ছিদ্রগুলির কোনো সম্পর্ক রয়েছে? কয়েকটি ছবি তুললাম। পরে সামাজিক মাধ্যমে ছবিগুলি পোস্ট করে জেনেছি, গুবরেপোকা জাতীয় একধরনের পোকা ঐ গাছগুলিতে ডিম পেড়েছিল। পরে তাদের লার্ভা গাছের মজ্জা অংশটি খেয়ে তাদের মেরে ফেলেছে। কালের মন্দিরা দুই হাতে বেজেই চলেছে সৃষ্টি জুড়ে।
সমুদ্রতটের আরেকটি বিস্ময় হলো বার্নাকল (Barnacle)। খেয়াল করলে আমরা সৈকতে পুরোনো কাঠ, পাথর, প্লাস্টিকের টুকরো বা অন্য কোনো শক্ত বস্তুর গায়ে ছোটো ছোটো তারকাকৃতি কিছু গঠন দেখতে পাই যা প্রচণ্ড ধারালো। এগুলোই বার্নাকল। ভাবতে অবাক লাগে পৃথিবীতে এই বার্নাকলের প্রায় ১৪০০ রকমের প্রজাতি পাওয়া যায়। এরা কোনো শক্ত স্তরের সঙ্গে এমনভাবে আটকে থাকে যেখান থেকে তাদের আলাদা করা অসম্ভব। যে পদার্থ দিয়ে ওরা স্তরটিকে ধরে রাখে তা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আঠা। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বার্নাকল ২৪ ঘন্টায় প্রায় ৫৫ গ্যালন সমুদ্রের জল শোধন করতে পারে। জোয়ারের সময় যখন বার্নাকলগুলি জলের তলায় চলে যায়, তখন তাদের মুখের প্লেটগুলি খুলে যায় এবং ভিতর থেকে শুঁড়ের মতো Cirriped-গুলি বেরিয়ে আসে ও জলে ভাসমান ছোটো ছোটো প্রাণী ও শ্যাওলা তাতে ধরা পড়ে যায়।
সমুদ্র থেকে ফিরেছি কিছুদিন হলো। আমার ছেলে কিছু ঝিনুক, শামুক, শঙ্খ কুড়িয়ে এনেছিলো। কড়া রোদে ওদের ফেলে রাখলাম কিছুদিন। এরপর সাবানজলে ঘষে ওদের পরিষ্কার করছিলাম। দেখলাম, কিছু ঝিনুকে ছোটো ছোটো একধরনের জিনিস লেগে আছে। ঠিক যেন ছোটো ছোটো সুতির কাপড়ের টুকরো আঠা দিয়ে আটকানো রয়েছে। কিন্তু, এতো ছোটো ওরা যে চোখে ঠাহর করাই দায়। একটা আতসকাঁচ ওর ওপর ধরলাম। বিস্ময়! অতিক্ষুদ্র একধরনের জীবের কলোনীর অবশিষ্টাংশ লেগে রয়েছে ওর উপর। নাম সী ম্যাট (Bryozoa)। সমুদ্রের খাদ্যতন্ত্রে এদের ভূমিকা বিশাল। ওরা না থাকলে গোটা বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়বে আজই।
দেখে অবাক লাগলো, সমুদ্র থেকে এতো দূরে এসেও ওর শুধু টিকে থাকবার দায়; এবং প্রাণের একটি প্রকাশ যেহেতু অন্য বহুতর প্রকাশের অবলম্বন, প্রতিটি স্পন্দনকে টিকিয়ে রাখাই তবে জীবনের দায়! শুধু মানুষেরই তবে সবকিছু মাড়িয়ে তছনছ করে এগিয়ে চলা! বিশ্ব-উষ্ণায়ন, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি – সবকিছুর মাধ্যমেই প্রকৃতি কিন্তু বারংবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি যাকে ধ্বংসের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছি, সেও আমাকে ঐ ধ্বংসের দিকেই টানছে। এতটাই অলজ্জ আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা যে, পাহাড় অরণ্য সমুদ্র-সৈকত সর্বত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের জানাতে হয় – “প্লাস্টিক ব্যবহার ও যত্রতত্র বর্জন থেকে বিরত থাকুন”, “বৃক্ষচ্ছেদন ও বন্যপ্রাণের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকুন” ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো মূক উপহাস হয়ে বোর্ডে রয়ে যায় শুধু, রপ্ত অভ্যাস বদলায় না! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কিন্তু এখন, এই মুহূর্ত। কেমন সে পৃথিবী, কেমন সে জীবন, যার উত্তরাধিকার আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাবো! আমরা পারি হৈ-হৈ করে আত্মধ্বংসের পথে এগিয়ে যেতে, আবার আমরাই পারি জগৎজোড়া এই বিপুল প্রাণতরঙ্গের অংশ হয়ে তাকে লালন করতে।
পাড়ার গৃহবধুরা আমার স্ত্রীকে (অযাচিত) পরামর্শ দিয়েছেন এ. সি. কেনার জন্য। আমার স্ত্রী তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কেন আমাদের এ.সি. দরকার নেই। তার জন্য তাঁকে অন্যের বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে, হজম করতে হয়েছে এবং তাতে অনর্থক শক্তি ক্ষয় হয়েছে। আমাদের পারিবারিক বোঝাপড়া এই যে গাড়ি আর এ.সি. কিনবো না। কিন্তু আমরা যে ওঁদের পরামর্শ শুনছি না সেজন্যে সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অথচ, আমাদেরই দায়িত্ব ছিল ওঁদেরকে গাড়ি বা এ.সি. ছাড়াও যে বেঁচে থাকা যায় সে কথা বোঝানোর। আমরা সেই দায়িত্ব নিলাম না। ফলে ওঁদের বাড়ির গরম নিশ্বাস আমাদের জানালাতে হানা দেবে এবং আমাদের তা সহ্য করতে হবে। আমরা যে পরিবেশে বাস করছিলাম সেই পরিবেশ আমাদের প্রতিবেশী নষ্ট করছেন এবং আমরা সেটা সহ্য করছি। অথচ পরিবেশ তো আমার একার নয়, তাকে ভাল রাখার দায়িত্বও আমার একার নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই দায়িত্ব কার?
এই যে আমরা প্রতিদিনের যাপনে অপরের সাথে বার্তালাপ করি (অর্থাৎ আমাদের day to day engagement) তার গুণাগুণের ওপর নির্ভর করছে, আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে। আবার অন্যভাবে দেখলে, শেষ বার্তালাপ কেমন হবে তা নির্ভর করছে অতীতের সমস্ত ব্যবহার ও বার্তালাপ কী সম্পর্ক তৈরি করেছে, কী অভিজ্ঞতা ও অনুভব অর্জিত হয়েছে, তার উপর।
জিহ্বা, কন্ঠ, ওষ্ঠ, দন্ত, তালু ব্যবহার করে, নিশ্বাস-বায়ুর নিয়ন্ত্রণে আমরা যে শব্দগুলি উচ্চারণ করি, সেটা প্রতিদিনের ব্যবহার ও বার্তালাপের নেহাতই সামান্য অংশ। বাইরের অংশ। সমুদ্রে ভাসমান হিমশৈলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে মাত্র। ভেতরে অদৃশ্য থাকে অসংখ্য শেকড়। সেখানে পরস্পরের জন্য কী সম্মানবোধ আছে বা নেই, একে অপরের মূল্যবোধ জানি ও বুঝি কিনা, বোঝার পর জানতে চাই কিনা সেই মূল্যবোধ কীসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে , সেইসব ভাবনা নির্দেশ দেয় নিশ্বাস-বায়ু কী শব্দের রূপ নেবে। আমাদের সময় কোথায় এতকিছু ভাবার? এর জন্য অনেক দায়িত্ববোধেরও প্রয়োজন। আমাদের সেই দায়িত্ববোধ নেই। আমরা অবহিত নই (বা না দেখার ভান করছি)। এই দায়িত্ববোধের অভাব আমাদের ব্যবহারকে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ বাইরে যে এ.সি. নিয়ে ভাব বিনিময় হচ্ছে তার গভীরে অনেক অদৃশ্য 'ভাবনা' ডুবে আছে। তারই ভিত্তিতে আমি এ.সি. কেনার পরামর্শদাত্রীকে ভাবছি 'ভোগবাদী' আর তিনি বা তাঁরা আমাদের ভাবছেন 'কৃপণ'। এই যে একে অপরের উপর 'ছাপ মেরে' দিলাম, 'দাগিয়ে' দিলাম, তাতে গভীরতর অন্বেষণের পথ বন্ধ হয়ে গেল। এর সত্যি-মিথ্যে নির্ণয় করতে গেলেই দায়িত্ব নিতে হয়। দু'পক্ষকে একই তলে আসতে গেলে অনেক ধৈর্য্য ও অনেক পরিশ্রম দরকার। আমরা দায়িত্ব নিই না, পরিশ্রম করতে চাই না, পরিবেশে 'বিনিয়োগ (investment)' করতে চাই না, 'গা বাঁচিয়ে চলি’। ফলে আমরা সেই পরিবেশই পাই যা আমাদের অযতনে , অবহেলায় গড়ে ওঠে। আমরা বলি, পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে । একথা বলি না যে, পরিবেশ খারাপ করে 'দিচ্ছি' বা 'দিচ্ছেন'। কর্তৃবাচ্যে কর্তা স্থানে 'আমি' রাখছি না কেন ('I -statement' করছি না)? কাউকে দোষ দিতে, সমালোচনা করতেও দায়িত্ব নিতে হয়, নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।
প্রাত্যহিক জীবনে চলতে ফিরতে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কের ভাঙা-গড়া অনুভব করি, মনে আনন্দ বা দুঃখের সঞ্চার হয়। তেমনই অভিজ্ঞতা হয় যখন আমরা প্রকৃতির অন্য সকল অংশীদারের (প্রকৃতির সবার / সবকিছুর) সঙ্গে নিজেদেরকে 'যুক্ত করি, মগ্ন করি', যদি করি তবেই । ভাঙা বা আহত সম্পর্ক যেমন দুঃখের উৎস তেমনই সেখানেই থাকে আপন উদ্যোগে 'জোড়া' দেওয়ার বা 'শুশ্রূষা' করে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ। এমনই সুযোগ ও প্রয়োজন ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির সর্বত্র। কিন্তু এ জন্য আমাদের জীবনের কতটা সময় ও সামর্থ্য নিয়োগ করি? একটু আগেই যে 'দাগিয়ে' দেবার কথা বলছিলাম (যেমন, ঐ মানুষটি খারাপ, এই ছাত্রটি মূর্খ, ঐ জমিটি উষর, ইত্যাদি) সেই অভ্যাস আমাদের নিজেদেরকে যুক্ত হওয়ার/ করার তাগিদ অনেকটাই কমিয়ে দেয় । কারণ, ওইখানে বিচার শেষ, আর ভাবনার দরকার নেই । গতানুগতিক (by default) ভাবে যে পরিবেশে ও পরিস্থিতি পাই, তাই মেনে নিই। অনেকে বলবেন এটাই 'বাস্তব', এটা মেনে নিয়ে 'চলতে’ হয়। আর 'এই ভাবে বাঁচতে গিয়েই বোধহয় সব 'কাজ চলা' হয়ে যায় । যেখানে যেখানে 'বাড়তি উদ্যোগ/ proaction' দরকার সে সব অনাদরে নষ্ট হতে থাকে। আমরা যে যেখানে আছি সেইখানেই এই বাড়তি উদ্যোগ নেবার সুযোগ আছে, সম্ভবনা আছে এবং তা অত্যন্ত জরুরী। এর জন্য কেউ আমাদের বাধ্য (demand) করবে না , আমাদের job description এ 'সাদা-কালোয়' লেখা নাও থাকতে পারে । তবুও করতে হবে। করতে হবে নতুন 'মান / স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করতে। তাহলেই হয়তো একদিন সমাজ সেই মান 'দাবী' করবে। সবটাই সমস্যার কথা নয়। গতানুগতিকতার বাইরের কাজে যুক্ত থাকা জীবনযাপনকে অধিক অর্থবহ (more meaningful) করে তোলে।
ফিরে আসি 'দায়-ভার' নিয়ে আরও কিছু কথায়। অভিজ্ঞতা আর ভাবনার টানে। এখন যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না তা হ’ল জেনেও পরিবেশ খারাপ করা বা পরিবেশ ভাল করার জন্য কিছু না করা 'জীবন যাপন' নিয়ন্ত্রণ হবে কী ভাবে, কে করবেন? এই ধরনের ব্যবহারকে নীতিগত ভাবে বিবেকে ধাক্কা মারার জন্য কোনো সামাজিক মূল্যবোধও নেই, ধর্মের ধুয়ো তুললেও পাপ-পুণ্যের কথা উঠবে না। এর যথাযথ রক্ষাকবচ কী হতে পারে ? আমরা যে 'সমাজে' আছি সে যদি দায়িত্ব না নেয়, সরকার কি এই দায়িত্ব নিতে পারে? নেবে কি? নেবে না বোধহয়। কিন্তু, একেবারেই সম্ভাবনা নেই তা বলছি না। সরকার করেছে। ট্রেনে , বাসে ধূমপান বন্ধ করেছে। কিন্তু, সিগারেট, বিড়ির উৎপাদন বন্ধ করেনি। এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। (সেগুলি নিয়ে এখানে আলোচনা করব না।) সরকার যদি এই সব সামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রির নিয়ন্ত্রণ করতে যায় শিল্পমহল কি তা মেনে নেবে ? খুব সম্ভবত, নেবে না। কাজেই পরিবেশ 'দেবতা'কেই এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং তিনি তাই করছেন। তিনি কি করছেন? শিল্প 'বিপ্লবের' পর থেকেই তিনি নিজেকে যথাসাধ্য বদলেছেন এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন তিনি আরও বদলাবেন। তাপমাত্রা উচ্চতম ও নিম্নতম মাত্রা বদলাবে, ঋতুগুলি তাদের পরিচিত চরিত্র বজায় রাখবে না, ফলে ফসলের সাথে তাদের যে সম্পর্ক আছে তাও বদলে যাবে /যাচ্ছে। ফসলের সাথে সাথে সেই বাস্তুতন্ত্রের অন্য সকল প্রাণীরাও বদলে যাবে। এরকম অজস্র পরিবর্তন হাত ধরাধরি করে আসছে ও আসবে। এই সব পরিবর্তনের হিসেব আমরা করি না। আমাদের সন্তান সন্ততিদের দায় নিই না। আমাদের দেশের / পৃথিবীর মানুষের "বাস্তুতন্ত্রিক বা পরিবেশগত পদচিহ্ন (Echological Foot print) " কবেই আমদের দেশের / পৃথিবীর ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, আমরা এখন ‘ভবিষ্যতের/ উত্তরাধিকারিদের’ পুঁজি লুঠ করে খাচ্ছি। আমাদের এই ফাঁকিবাজি গ্রেটা থানবার্গরা ধরে ফেলেছেন। আমাদের কাছে দাবী করছেন সচেতনতা ও দ্বায়িত্ববোধ।
আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ও প্রতিটি স্তরে আমি আমরা, আমাদের 'দায়িত্ববোধের সীমানা' সঙ্কুচিত করে চলেছি। অথচ, আশা করছি সব ভাল হোক / ভাল হবে। এভাবে হয় না। আমার গ্রামের চাষিরা তাঁদের জমিতে ফসল ফলাতে বাজারে পাওয়া যায় এমন সমস্ত কৃষি-রসায়ন ব্যবহার করছেন। আমি তার সুদূর প্রসারি ফল জানি। তবুও আমি সামান্যতম উদ্যোগ নিইনি। কারণ, আমি ভয় পাই । কারণ, ওই চাষিদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক থাকলে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা যায় আমি সে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করিনি। চাষিদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার জন্যে তাঁদের জমির (যা আমার পরিবেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ) তার সঙ্গেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ওই স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গেও আমার কোনো কার্যকরী সম্পর্ক গড়ে উঠছে না / উঠবে না। অথচ আমি সেই বাস্তুতন্ত্রে বাস করি এবং সেই দূষিত পরিবেশের উৎপাদনে জীবন যাপন করি। আর আশা করি একদিন সরকার আইন করে ঐ সমস্ত বিষ রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। নিতান্তই দূরাশা। কাজের সূত্রে একবার বিহারের বেগুসরাই ও সমস্তিপুরের সব্জি চাষিদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা নিজেদের পরিবারের খাবারের জন্য যে ফসল চাষ করেন সেই জমিতে রাসায়নিক / বিষ প্রয়োগ করেন না। কিন্তু বাজারে বিক্রির জন্য যে ফসল চাষ করেন তাতে বিষ (মাত্রাতিরিক্ত) প্রয়োগ করেন। তাঁদের সঙ্গে বাজারের ক্রেতাদের (মানুষদের) কি পরিচয় , কী সম্পর্ক ? আবার আমরা যখন শুনি চাষিরা দেনার দায়ে আত্মহত্যা করছে , আমাদের কী 'আত্মিক' প্রতিক্রিয়া হয় ? 'প্রতিবেশী', 'সহনাগরিক' এই শব্দবন্ধগুলি আমাদের অন্তরজগতে কোন্ প্রতিচ্ছবি (imegery) সৃষ্টি করে? আত্মকেন্দ্রীক মানুষ আমি, শুধুই মানুষের কথা, মানুষের ভবিষ্যতের কথাই ভাবছি। এই পৃথিবীর আরও যে বাসিন্দা আছেন (অন্য জীব), তাঁদের কথা!
এমন করে দেখলে বুঝতে পারি, আমাদের জীবন যাপনের আপাত ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলি কেমন করে প্রভাবিত করে সারা পৃথিবীকে। প্রভাবিত করে সমগ্র মানব প্রজাতিকে, জলবায়ু, জীব-জড়-প্রকৃতি সব কিছুকে। মানুষ তার যাপনে যেমন যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার ফল তার জীবদ্দশায় যেমন সাময়িক তেমনই এই পৃথিবী ও আগামী প্রজন্মের কাছে সুদূরপ্রসারি।
জীবন যাপনের জন্য কোন্ কোন্ উপকরণ , 'সামগ্রী ও সেবা' অপরিহার্য, তার কোন মানদণ্ড নেই, আমরা রাখতে চাই না। তার উপর বাজারের খেলোয়াড়রা নিত্য নতুন প্রয়োজন ও চাহিদা তৈরি করে চলেছে। আমাদের দৃষ্টি ও বিচার সেই সামগ্রী ও সেবার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ও তৃপ্তির উপর সীমাবদ্ধ। । তার সুদূরপ্রসারি প্রভাব নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। আমি ঠাকুরদার/বাবার তৈই করা মাটির বাড়ি ছেড়ে পাকা বাড়ি তৈরি করেছি। তার জন্যে কয়েক হাজার ঘনফুট উৎপাদনশীল মাটি ধ্বংস করছি, কয়লা পুড়িয়েছি কয়েক টন, পাথর আনিয়েছি পাহাড় কেটে ...আর তা দিয়ে যে বাড়ি তৈরি করেছি সেখানে বাস করতে আমার প্রয়োজন হয়েছে গ্রীষ্মে এ.সি. এবং শীতে রুম-হিটার। আমার ঠাকুরদার মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালের বাড়িতে এসবের দরকার পড়েনি। আগে খড়ের চালের বাড়িতে, কয়েক বছর ছাড়া ছাড়া খড় বদলাতে হ’ত, তাই ধান কাটার পর খড় রাখা থাকত, গরুর খাবার ও ঘর ছাউনির জন্য (পশুপালন ও কৃষি, এই দুটি মিলে যে জীবিকা ব্যবস্থা ছিল তা ভেঙে পড়েছে। এখানে আর তার বিস্তার করছি না। মাঠে পোয়াল / খড় জ্বালানোর কথা এখন আর কেউ ভাবতেই পারেন না। পরিবেশের সঙ্গে যে মরমী সহাবস্থান ছিল, আমি এখন তার থেকে অনেক অনেক দূরে সরে এসেছি।
এই যে একটা বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে অনেক কথা উঠে আসছে এর কারণ এরা কেউই বিচ্ছিন্ন নয়। আমি যখন কোনো বিষয় বা বস্তু নিয়ে ভাবতে বসি তখন তাদের সংশ্লিষ্ট সম্পর্কগুলিই আগে ধরা দেয়। কোনো বিষয় ও বস্তুর অবস্থা বুঝতে গেলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করি। তারা আজ যা হয়ছে তা তাদের বিগত পারস্পরিক সম্পর্কের জন্যই হয়েছে। আবার ভবিষ্যতে কী হবে তাও এই সম্পর্কগুলিই নির্দেশ করে দেবে। এই সম্পর্কগুলি ধনাত্মক (mutually enriching - যে সম্পর্কে একে অন্যকে পুষ্ট করবে) হতে পারে, আবার ঋনাত্মকও (mutually depleting - যখানে একে অপরকে ক্ষয় করবে) হতে পারে। এইরকম কোটি-কোটি সম্পর্ক আমাদের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার বা বোঝার কোনো অবকাশ নেই। এখন প্রশ্ন হ’ল, আমরা এই সম্পর্কগুলি দেখতে পাই তো , ঠিক ঠিক চিনতে পারি (recognise করতে) তো ? না চিনতে পারলে (recognise না করলে) অচেতনে তাদের ক্ষতি করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় । এই কথাটাই একটু বিস্তারিত করবার চেষ্টা করছি। তার আগে, একটা ব্যক্তিগত 'বোধ-এর কথা এইখানে বলে রাখি।
এই যে নানারকম প্রাকৃতিক সম্পদের (সম্পদ শব্দটি বড্ড মানুষের স্বার্থ কেন্দ্রিক। তাঁরা যেন শুধুই আমাদের ভোগ-দখলের জন্য, তাঁদের যেন আপন অস্তিত্ব নেই, অধিকার নেই। মাটি, জল, বাতাস ইত্যাদি , সবই তো প্রকৃতির পরিবেশের অংশ, মানুষও তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু, মানব প্রজাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী যে ভুমিকা পালন করে আসছে আজকে এই প্রজাতিটিকে অন্যদের সমতলে বসিয়ে দিলে তার এতদিনের কর্মফল থেকে তাঁকে অব্যাহতি নেওয়ার সুযোগ হয়ে যাবে।) কথা আমরা বলি তার কোনোটাই একক ভাবে তার ইপ্সিত / বাঞ্ছিত গুণ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থাৎ একক ভাবে কেউ 'সম্পদ' নয়। যেমন, আমাদের যতই জমি থাক, শুধুমাত্র জমি কিছুই উৎপন্ন করতে পারে না। তাকে উৎপাদনশীল হতে গেলে জল, বাতাস, সূর্যের আলো, অজস্র জীবানুর সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। অথচ, যখন কোনো ফসলের (ধরা যাক, ধান) উৎপাদনের হিসাব করা হয় , বলা হয় হেক্টর প্রতি ফলন ৪০০০ বা ৫০০০ কিলোগ্রাম । বলা হয় না ফলন প্রতি ঘন মিটার জলে ৪০০ বা ৫০০ গ্রাম। বলা হয় না তার জন্য কত, কত কার্বন-ডাই-অক্সাইড খরচ হয়েছে, কতো কিলোওয়াট সূর্যের আলো খরচ হয়েছে, কতো কোটি জীবানু কাজ করেছে এবং আরও অনেকের কথাই বলা হয় না। তারা 'taken for granted' , ভাবটা এই যে ওদের কথা আবার আলাদা করে বলতে হবে কেন। সমস্যাটা এইখানেই। তাদের যখন হিসেব করি না , তাদের 'ভালো থাকা - খারাপ থাকার’ও খোঁজ রাখি না। এক সেন্টিমিটার জমির আল কাটা গেলে প্রতিবেশী চাষির মাথা কেটে নিতে যাই কিন্তু হাজার হাজার ঘন মিটার বৃষ্টির জল আমাদের জমির (যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০০ মিমি সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫০০০ ঘন মাটির বৃষ্টির জল পাওয়া যায় তার কতটুকু আমরা ধরে রাখি? ) চলে গেলেও আমরা চিন্তিত হই না । আবার সেই জলের জন্য দু'লক্ষ টাকা খরচ করে ভূগর্ভস্থ জলকে বিদ্যুত জ্বালিয়ে তুলে নিই । ফসলের নাইট্রোজেনের প্রয়োজন মেটাতে হাজার হাজার টাকার ইউরিয়া কিনতে পারি কিন্তু যে জীবানুরা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন ধরে মাটিকে উর্বর করে তাদের জন্য ভাবনা নেই। এই হচ্ছে পরিবেশের বিভিন্ন 'সম্পদের' সাথে আমাদের সম্পর্ক । আমাদের দৈনন্দিন আলোচনায় / ব্যবস্থাপনায় কেউ সম্মান পায়, ভালোবাসা পায় আবার কেউ পায় না। যারা পায় না তারা অনেকেই নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের অবহেলায় জল হারিয়ে যায়, জীবানুরা হারিয়ে যায়, কত উদ্ভিদ (ফসল) ও প্রাণী (মাছ, ব্যাঙ) , কীটপতঙ্গ (মৌমাছি, ভ্রমর) হারিয়ে যায় । কতটুকু সময় আমরা ওদের কথা ভাবি ? ওদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক আছে? যে সম্পর্কহীন পরিস্থিতির কথা হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম। আমরা যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি করেছি তাদের সাথেই বা ওইসব সম্পদের (সামগ্রিক ভাবে পরিবেশের) সম্পর্ক কেমন? পরিবেশ মন্ত্রক, জলসম্পদ মন্ত্রক, (কেন্দ্র বা রাজ্য) তারাই বা কতটা আন্তরিক? এই সম্পর্কগুলির ধনাত্মক পরিবর্তন না হলে আমাদের 'পরিবেশের ' কাঙ্খিত পরিবর্তন কেমন করে হবে?
আমার মনে হয়, আমরা যে যেখানে আছি, জীবনে যা দেখেছি , শুনেছি, কিছু উপলদ্ধি করেছি, বিশ্বাস করেছি, এই সবই আমাদের পরিবেশের সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণার (perceptions) জন্ম দিয়েছে /দিচ্ছে । এইসব ধ্যান-ধারণাই পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাই নতুন সম্পর্ক তৈরি করার বা কোনো বর্তমান সম্পর্ককে সংস্কার করতে গেলে মানুষের বর্তমান ধ্যান-ধারণাগুলোর শেকড় পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক - যদি বক্তব্যটা একটু পরিস্কার করা যায়।
জীবিকা উপার্জনের বংশানুক্রমিক অভ্যাস আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে ধারণা শুধু নয়, সম্পদগুলির আপেক্ষিক গুরুত্বও স্থির করে দেয়। একজন ধান চাষি তাঁর জমিতে উপলদ্ধ জলকে যে চোখে দেখেন একজন মাছ চাষি সেই চোখে দেখেন না। একজন হিসেবী ধান চাষি যখন এক ঘন মিটার জলে ৫০০ গ্রাম (বর্তমান বাজার দর দশ টাকা) ধান উৎপাদন করার ভাবেন (বেশিরভাগ চাষি তো হিসেবই করেন না) তখন একজন দক্ষ মাছ চাষি সমপরিমাণ জলে কমপক্ষে ১ কিলোগ্রাম মাছ (বর্তমান বাজার দর ১৫০ টাকা ) উৎপাদন করার চিন্তা করেন। তাই ওদের দু'জনের সাথে জলের তুলনামূলক আর্থিক গুরুত্বও ভিন্ন। যে জেলে ডিঙি নিয়ে নদীতে বা সমুদ্রে যান বা জমিতে পুকুর নির্মাণ করেন, তাঁর কাছে জল মুখ্য সম্পদ, আর ধান চাষির কাছে জল সহায়ক সম্পদ। ধান চাষি যদি মাছ চাষ অভ্যাস করেন তাহলে তাঁর জল সংক্রান্ত ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। তার ফলে জমি ও জল নিয়ে তাঁর কল্পনা (vision) ও পরিকল্পনা বদলে যেতে পারে। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও ঝাড়খণ্ডের অনেক জেলার চাষিদের বিশ্বাস ছিল নীচু ধান জমি (বহাল জমি) ভাল, তার দামও বেশী আর উঁচু টাঁড় বা ডুংরি জমি খারাপ, তার দামও কম। সেই চাষিরা যখন উঁচু জমিতে আমের বাগান ও সব্জি চাষ শিখলেন , তাঁদের ঐ জমির তুলনামূলক বিচার বদলে গেল।
যাঁরা যে ভাবে প্রকৃতির /প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে নিযুক্ত (engage) হন তাঁরা সেই ভাবেই প্রকৃতিকে / প্রাকৃতিক সম্পদকে দেখেন, এবং তেমনই সম্পর্ক স্থাপন করেন। ব্যক্তিগত আস্পৃহাও (aspirations) মানুষের দেখার ধরনে পরিবর্তন আনে এবং তা তাঁর সাথে পরিবেশের নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। আস্পৃহা যদি পরিবেশ সচেতন / বান্ধব না হয় তাহলে তার ফল ভয়ংকর হতে পারে / হয়। বাড়তি উপার্জনের জন্য অনেক মানুষ পরিবেশের সহ্য শক্তির বাইরে চলে যায় এবং সরকার (রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে) তাতে ইন্ধন জোগায়। পাঞ্জাবের বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৬০০ মিলি মিটার হবে। সেই হিসেবে হেক্টর প্রতি বৃষ্টির জল পায় ৬০০০ ঘন মিটার । ওই বৃষ্টির জলের কতটুকু ভূগর্ভস্থ জলস্তরে পৌঁছয়, ওই চাষিরা কি তার হিসেব রাখেন? তাঁদের সাথে কথা বলে তার উত্তর পাইনি। অথচ ওখানকার চাষিরা গভীর নলকূপ বসিয়ে বছরে হেক্টর প্রতি ২০,০০০ ঘন মিটার ভূগর্ভস্থ জল তুলে ধান চাষ করে। তাদের যুক্তি অত্যন্ত সরল, ধানে সরকারি সমর্থন মূল্য আছে যা অন্য খারিফ ফসলে নেই। তাছাড়া জল সেচের জন্য যে বিদ্যুৎ খরচ হয় তার দাম চাষিদের দিতে হয় না। ফলে গত ৩০ বছর ধরে জলস্তর নেমে যাচ্ছে, লাগামহীন। কোথাও কোথাও এই নেমে যাওয়ার পরিমাপ বছরে গড়ে এক মিটার। ওই চাষিরা কেউ গরীব নয়। ওদের হাতে হাতে iPhone , পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য বিদেশে (ইউরোপ /আমেরিকার বিভিন্ন দেশে)। মনে প্রশ্ন আসে এদের দায়বদ্ধতা কোথায়, কার কাছে!
ভূগর্ভস্থ জল সম্বন্ধে তাদের কোনো ভাবনা নেই কেন? ওদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কি স্বপ্ন দেখে ওই গ্রাম, ওই মাটি ,ওই জল নিয়ে? এই সব প্রশ্ন গবেষণার বিষয় হতে পারে। ওই চাষিদের কাছে ওদের জমি ও জলের ব্যবহারের আরও বেশী লাভজনক বিকল্প উপায় নেই এমন নয়। রোপার (রূপনগর) জেলার একজন চাষি ১৫ একর জমি পুকুর নির্মাণ করে মাছ উৎপাদন করছেন, একর প্রতি উৎপাদন ১৫০০ কিলোগ্রাম। একরে যদি ২০০০ কেজি ধান উৎপন্ন হয় , সরকারী সমর্থন মূল্য (২৫ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম) ধরে তার বাজার দর হবে কম-বেশী ৫০ হাজার টাকা (gross)। অন্য দিকে ১৫০০ কিলোগ্রাম মাছের বাজার দর (১০০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম হিসেবে) ১,৫০,০০০ টাকা (আরও পার্থক্য, মাছে সরকারি সমর্থন মূল্য নেই)। ধানের জমিতে ভূগর্ভস্থ জল তুলে যে সেচ দেওয়া হয় তার বেশিরভাগ বাষ্পীভবন ও বাষ্পমোচন (Evapo-transpiration) হয়ে 'খরচ' হয়ে যায়, অন্যদিকে মাছের পুকুরের জল ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে বাড়তি জল যোগান দিতে পারে। এই দু'টি উপার্জনের ধারা কত ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করেছে। ভূমি, ভূগর্ভস্থ জল, বাজার, সরকার, উৎপাদন পদ্ধতিতে রাসায়নিক /বিষের ব্যবহার ...আর সব মিলে হয়তো স্থানীয় পরিবেশের কীটপতঙ্গ, পশুপাখীদের সাথেও ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকবে। আবার ওই অঞ্চলেই অনেক চাষি প্রচলিত ফসলের চাষ না করে পপলার (Populus sp) গাছ লাগিয়েছেন। তাতেও উপরোক্ত সম্পর্কগুলির তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উত্তর দিনাজপুরের কুলিক নদীর (এবং আরও কয়েকটি নদীর) পুনরুজ্জীবন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। সেই সূত্রেই ওখানকার পরিস্থিতি ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওই অঞ্চলে বৈশাখ মাসে একটি লোক-উৎসব ছিল (হয়তো এখনো আছে)। তার একটি অঙ্গ ওই নদীর জলে গৃহপালিত পশুদের স্নান করানো । অর্থাৎ নদীতে অনেক জল ছিল। গ্রামের লোক বলছিল এখন বৈশাখ মাসে নদীতে জল থাকে না। এর প্রধান কারণ গত কয়েক দশকে সমস্ত এক ফসলি জমি তিন ফসলি হয়েছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় জল এসেছে গভীর নলকূপ বসিয়ে। মানুষেরই কাজ। রবি চাষ শুরু হলেই চাষিরা নলকূপ চালু করে মাটির নীচের জল তুলে খালি করে দিচ্ছেন। গরমের ফসলে তা আরও বেশী গভীর থেকে তোলা হচ্ছে। নদী তো অসম্পৃক্ত ভূস্তরের উপর দিয়ে বইতে পারে না। অথচ, স্থানীয় মানুষ যদি সচেতন ভাবে কেবল মাত্র গতানুগতিক ফসল ভিত্তিক জমির ব্যবহারের পথে না গিয়ে 'কৃষি ও মাছের চাষের (agriculture and aquaculture)' একটা মিশ্রণ ঘটাতেন , তাহলে কুলিক শুকিয়ে যেতো না। এখন দরকার সমস্ত 'দায়ভাগীদের (stakeholders)' একসাথে বসে ওই পরিবেশের সমস্ত উপাদানগুলির মধ্যে বাঞ্ছিত সম্পর্কগুলি নির্ণয় করে তার ধারণ ক্ষমতার (carrying capacity) মধ্যে 'সম্পদের' ব্যবহার করে জীবিকার / উপার্জনের পথ খোঁজা।
একবার ট্রেনে দু'জন সহযাত্রীর আলোচনা শুনছিলাম। তাঁরা সম্ভবত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। কয়েক বর্গ কিলোমিটার খনন শুরু হবে। তাঁদের চিন্তার বিষয় ছিল 'Over-burden' সরানোর খরচ। আমার চোখে যা 'উর্বর মাটি' তাঁদের চোখে সেটাই বোঝা (burden) । তাঁদের আগ্রহ নীচে কয়লা নিয়ে। এবং তার সাথে সম্পর্ক কয়লা 'প্রতিপালনের' (husbandry) জন্য নয় । তারপর সেই overburden এর কী হলো, কয়লা তুলে নেবার পর ঐ জায়গার পরিবেশের অবস্থা কি হলো ....সে সব চিন্তার দরকার কী? তারপর তো ওই 'পরিবেশের' আর কোনো 'লেনা-দেনা' থাকার কথা নয়।
এই যে ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন চোখে প্রকৃতিকে দেখেন এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তোলেন এইখানেই প্রকৃতির ও তার সম্পদের ভবিষ্যৎ নির্ণয় হয়ে যায়। এই যে সুস্থায়ী উন্নয়ন ( sustainable development ) নিয়ে এতো ভাবনা , তার সত্যিকারের উত্তর খুঁজতে হলেও আমাদের এই সম্পর্কগুলিকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখার অভ্যাস তৈরী করতে হবে। যে সম্পর্ক একে অপরকে 'পালন পোষনের বা বেড়ে ওঠার' নিশ্চয়তা দেয় না , সেই সম্পর্কের মাধ্যমে যে 'উৎপাদন ব্যবস্থা' গড়ে তুলি তা কেমন করে' সুস্থায়ী (sustainable) হবে ? আমাদের জীবন যাপনে ও জীবিকার সন্ধানে যা কিছু ব্যবহার করি এবং তার জন্য যতরকম সম্পর্ক স্থাপন করি সেগুলি এই ভাবনা নিয়ে দেখতে চাই কিনা সেইটিই আসল কথা। এই মমত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে / গেছে। বিশ্ব-বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না নেমে খোঁজ নিতে পারবো কি আমাদের 'প্রকৃতি' কেমন আছে , কোথায় তাঁর দুঃখ?
এই সম্পর্কগুলি জানতে গেলে, বুঝতে গেলে, কিছু পড়াশোনারও দরকার আছে । আমাদের স্কুলে, কলেজে যত বিষয় পড়েছি মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সবই কাজে লাগে। যেমন উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, আবহ বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সব সব কাজে লাগে। কিন্তু যে ভাবে পড়ানো হয় তা ছাত্রদের ওই বিষয়গুলির জ্ঞান কোথায় কিভাবে প্রয়োজন হতে পারে সেই ধারণা, তার orientation, exposure, কিছুই দেওয়া হয় না। ছাত্রদের মনে ভাল নম্বর পাওয়া ছাড়া আর কোনো কল্পনাই জাগে না।
আমার ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা খুব সাধারণ উদাহরণ দিই। চাষিদের সাথে জমির ও বৃষ্টির জলের সম্পর্ক কেমন হতে পারে! একবার পুরুলিয়া জেলার আড়ষা ব্লকের হেঁসলা গ্রামে গেছি । সময়টা ১৯৯০-৯১ সাল। চাষিরা বললেন, ‘বৃষ্টি হয় না, জোৎস্না রাতে ধান মরে যায়। তাঁরা হেঁয়লি করে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হলো তাঁদের জমির প্রকৃতি। এলাকার ভূস্তরের গঠন ঢালু , বেলে মাটি, তাই মাটির জলধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম, বৃষ্টির জল অল্প সময়েই জমি ছেড়ে চলে যায় ( drains out) । জল-চক্রে (hydrological cycle) কোথায় জলের অবস্থান কতক্ষণ স্থায়ী হয়, সেই সময়কালকে জলের ‘residence-time’ বলা হয়। ওই ইংরেজির বাংলা করে নিই 'জলের বসবাস কাল'। ওখানকার সমস্যা ছিল ওই জমিতে জলের বসবাস কাল অল্প। সেই সমস্যাটাই ওই হেঁয়ালির রূপ নিয়েছে। এও একদিনে হয়নি। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে এই ধারণা চলে আসছে। ভাদ্র মাসে যখন ধানের ফুল আসে তখন যদি বৃষ্টি না হয় তখন উঁচু জমির (ওরা বলেন, বাইদ জমি) ধানক্ষেত শুকিয়ে যায়। এও জানলাম, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে যথেষ্ট বৃষ্টি হয় এবং তার বেশিরভাগ বয়ে যায় (as runoff) । অর্থাৎ, চাষিদের আশা বৃষ্টি তাঁদের ফসলের প্রয়োজন মত হলে ভাল হতো। তাঁরা তো একথা ভাবতে পারতেন যখন বৃষ্টির জল আসবে তখন তা ধরে রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ ওখানে উপলদ্ধ বর্ষার জলের 'বসবাস-কাল' বাড়ানো যেতে পারে। যে জলের মাটির উপর বয়ে যাওয়ার গতি হয়তো প্রতি সেকেন্ডে এক মিটার, সেই জলকেই যদি ভূপৃষ্ঠের নীচে মাটির মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে (through seepage) যেতে হয় তার গতিবেগ কমে সারাদিনে হয়তো 20 মিটার হয়। জলের ও মাটির সহাবস্থানে এই প্রকৃতিটিকে কাজে লাগিয়ে অনেক কাজ করার সম্ভাবনা আছে। সে পথের খোঁজ না করে, সরকারও (কৃষি দফতর ) এই জেলাকে ‘খরাপ্রবন’ বলে দিয়েছে। অথচ এখানকার গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২০০ মিলি মিটার।
এই যে ‘অবৈজ্ঞানিক’ ভাবে 'দাগিয়ে' দেওয়া, এও একধরনের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। এর প্রভাব পড়ে সরকারি পরিকল্পনায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, মানুষের মানসিকতায়। মানুষ তখন আর ওই গণ্ডির বাইরে ভাবতে চান না। ওই বছরের আগের দশকের প্রতি বছরের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক বৃষ্টিপাত বিশ্লেষণ করে ও ওই এলাকার যে জাতের ধান চাষ প্রচলন ছিল তার জীবন চক্রে কখন কেমন জলের প্রয়োজন তার হিসেব নিয়ে, পরে ওই অঞ্চলেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর সামান্য কাজ করে ওখানে ভাদ্র মাসে জলের অভাবে ধান শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান করা গেছে। ওই অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করে পুরুলিয়া , বাঁকুড়া জেলায় এবং ছত্তীশগড় ও ঝাড়খণ্ডের বহু জেলাতে সরকারি উদ্যোগে চাষির ক্ষেতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে । সেই জলে মাছ চাষ হচ্ছে। অর্থাৎ, এই ভাবে চাষির সাথে তাঁদের জলের ও জমির এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সম্পদের সম্পর্কের নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, এত বড় দেশের প্রয়োজনের তুলনায় এ তো কিছুই না। অন্য দিকে, জাতীয় স্তরে অনেক পরিকল্পনায় পরিবেশের প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলিকে অসম্মান করে ধ্বংস করে ফেলা হয় বা (সম্ভবত অজ্ঞানে) ধ্বংস করার কথা ভাবা হয়।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক (তার পরিসর, পরিবার হতে পারে, পাড়া হতে পারে, গ্রাম হতে পারে ...এইভাবে সারা পৃথিবী হতে পারে আবার একটি মানষের নিজের ভিন্ন ভিন্ন সত্তার মধ্যেও হতে পারে) বুঝতে হবে। মানুষের সাথে তার পরিবেশের (তার মাটি, জল, আলো, বাতাস, সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী , চোখে অদৃশ্য এমন কোটি কোটি জীবানু সব কিছুর সাথে ) সম্পর্ক বুঝতে হবে। এবং ওদের মধ্যেই যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে তাকেও বুঝতে হবে। এবং সাথে সাথে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সকল প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের সাথে মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্কগুলির গতিপ্রকৃতি ও বুঝতে হবে। একটু অন্য ভাবেও বলা যায়। এই সম্পর্কগুলিকে যদি আমরা Institutions' relations with Institutions, Resources' relations with Resources, Peoples' relations with People, institutions' relations with People, Institutions's relations with Resources and Peoples' relations with Resources এই ছ'টি দলে ভাগ করি তাহলে বোধহয় বুঝতে একটু সুবিধা হয়। আমাদের চারপাশে যত রকমের ঘটনা ও অবস্থা দেখি সব কিছুই ঐ সম্পর্কগুলির মধ্যেই পড়বে, চারপাশে পড়ে আছে / ঘটে চলেছে। আমি নিরীক্ষণ করার জন্য এই ধাঁচাটা (framework) কাজে লাগিয়েছি, অনেক জটিল পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হয়েছি।
প্রয়োজন কেবল একটু যত্ন করে / ভালবেসে দেখার (নিরীক্ষণ করার)। এই দেখার মধ্যেও যন্ত্রণা আছে। চাষির ফসল নষ্ট দেখলে কষ্ট হবে, ভূমিক্ষয় দেখলে খারাপ লাগবে, নদীর জল ঘোলা দেখলে মন অস্থির হবে, হাড্ডিসার গরু-ছাগল দেখলে, জঙ্গলে আগুন লাগলে ..... প্রকৃতির গায়ে আঁচড়-কামড় দেখলে হয়তো ঘুম আসবে না । এই সব হবে। কারণ আপনি প্রেমে পড়বেন, ভালবাসতে শিখবেন। আর কোন্ ভালবাসা যন্ত্রণার নয়? আর যদি কোথাও ভেঙে পড়া সম্পর্কগুলো জোড়া লাগাতে পারেন , সেও বড় আনন্দের। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য' করে তোলার আনন্দ।
প্রকৃতি তো আপন খেয়ালে পরিবর্তন আনবেই তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু আমাদের হাতে যে সীমিত ক্ষমতা ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে যা আমরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে (অর্থাৎ, আমাদের ব্যবহার/ হস্তক্ষেপ প্রাসঙ্গিক সম্পর্ককে মজবুত করছে নাকি দূর্বল করছে সেইটুকু না বুঝে) তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে প্রয়োগ করে চলেছি, বাজারের দেখানো পথে চলতে শুরু করেছি , সেই গতিকে কখন প্রশ্ন করবো, কেমন করে প্রশ্ন করবো, কোথায় প্রশ্ন করবো? আর এইখানেই সবচেয়ে সহজ কাজটি সবচেয়ে কঠিন করে ফেলি - তা হলো, নিজেকে প্রশ্ন করা, প্রতিদিন করা, নিজের পরিসরেই করা।
কোন্ শৈশবের পাঠ - "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। " (কবি কামিনী রায়)। এখনো বুঝতে পারলাম না। সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ছে , দেখছি আর হা-হুতাশ করছি।
মেন্দালেখা গ্রাম, জেলা - গড়চিরলি, মহারাষ্ট্র
১। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে, গোন্দ আদিবাসীদের একশ ঘরের এই গ্রাম, মেন্দালেখা, ঘোষণা করে যে “দিল্লি মুম্বাইতে আমাদের সরকার, আমাদের গ্রামে আমরাই সরকার।
২। এই গ্রামে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। প্রতি মাসে গ্রামসভা মিটিং হয়। এই মিটিং-এ প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন মহিলা এবং একজন পুরুষের আসা আবশ্যিক। পালা করে প্রত্যেক পরিবার থেকে কেউ মিটিং-এর সভাপতি হয়।
৩। সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে হয়। মানে প্রত্যেককে রাজি হতে হবে, কোনো ভোট হবে না। যদি কোনো একজন রাজি না হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত হবে না। এমনও হয়েছে যে সবাই রাজি না হওয়াতে একটি সিদ্ধান্ত দু বছর আটকে পড়েছিল।
৪। গ্রামসভার লিখিত অনুমতি ছাড়া কোনো মন্ত্রী সান্ত্রী সরকারি আধিকারিক গ্রামে এসে কারোর সঙ্গে কোনো উন্নয়ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না। কোনো এনজিও, অধ্যাপক বা অন্য কোনো বাইরের লোকের জন্যও একই নিয়ম।
৫। সরকারি স্কিমের টাকা কীভাবে খরচ হবে তা গ্রামসভায় ঠিক হয় । ১০০ দিনের কাজ (NREGA), পায়খানা স্কিম, ঘর বানানো ইত্যাদি, গ্রামসভা ঠিক করে – কী হবে, কীভাবে হবে, কে কতো টাকা পাবে, কত টাকা গ্রাম কোষে যাবে ইত্যাদি।
৬। বন অধিকার আইন (FRA) ২০০৬ এর অন্তর্গত ভারতের এটি প্রথম গ্রাম যেটি “সামুহিক বন-অধিকার” পায়। এরা আপাতত ব্যক্তিগত বনাধিকারের কথা ভাবেনি।
৭। যদি গ্রামসভা বা গ্রামের কয়েকজন নতুন কিছু শিখতে চায়, কোনো কাজ, কোনো আইন, তখন তারা একটি ‘আলোচনা চক্র’ শুরু করে। এই স্বেচ্ছায় তৈরি দল, বাইরের কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে চুক্তি করে যা শিখবার শিখে নেয়। কিন্তু এই আলোচনাচক্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র গ্রামসভারই রয়েছে। আর সেখানে কোনো বাইরের বিশেষজ্ঞ থাকে না।
৮। দরকার মতো গ্রামসভা বিষয়ভিত্তিক কার্যকরী সমিতি বানায়। যেমন - জঙ্গল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, হিসাব, মহিলা, চাষ, জল, ১০০ দিনের কাজ ইত্যাদি। এই সমিতিগুলিকে গ্রামসভার সিদ্ধান্ত মেনে কাজ করতে হয়।
৯। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর , ২০১৪ সালে এই গ্রাম মেন্দালেখা “গ্রামদান” আইনে অর্ন্তভুক্ত হয়। এটি পঞ্চাশের দশকের শেষে বিনোবা ভাবের শুরু করা একটি ব্যবস্থা। এই আইন মোতাবেক গ্রামে কোনো ব্যক্তিগত জমি থাকবে না। সব জমি গোটা গ্রামের, গ্রামসভার এক্তিয়ারে।
১০। এই রকম আদর্শ গণতন্ত্র এবং সমতা এখন গড়চিরলির অন্য গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। ২০১৮ থেকে দুটি ব্লকে মহাগ্রামসভা গঠনের কাজ এগিয়ে চলেছে । একটি মেন্দাকে ঘিরে থাকা ধানোরা ব্লকের ৯০ টি গ্রামসভা নিয়ে। আরেকটি পাশের কোরচি ব্লকে, “আমহি আমচা আরোগ্য সাথী” নামের একটি এনজিওর উদ্যোগে ৯০ টি গ্রামসভা নিয়ে।
কিবুৎজ – ইজরায়েল দেশের এক বিশেষ ধরনের গ্রাম
আজকের দিনেও ২৪০ টি কিবুৎজ এর মধ্যে প্রায় ৬০ টি, পুরনো আদর্শ সমাজতান্ত্রিক মন্ত্র কে ধরে রেখেছে। যে মন্ত্রে বলা হয় ‘প্রত্যেকে নিজের ক্ষমতা মত সমাজকে দেবে, আর তারা নিজের প্রকৃত চাহিদা মত সমাজ থেকে পাবে’।
১। কিবুৎজে কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তি নেই। জমি, ঘর, আসবাব, যন্ত্রপাতি, কারখানা, যানবাহন – সব গোটা গ্রামের সম্পত্তি। যে কোনো গ্রামবাসী, কিবুৎজের ভেতরে অথবা বাইরে থেকে যত আয় করুক না কেন, তা গ্রামকোষে জমা পড়বে। গত তিরিশ বছরে চারদিকে ব্যক্তিমালিকানার ধুম, সব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি ডুবে গেছে, সেখানে এই ৬০ টি কিবুৎজ যেন সেই সমাজতান্ত্রিক আগুনকে আবার জ্বালিয়ে দিয়েছে। যেভাবে এক সময় বিনোবাজী উত্তর ভারতের একটি কথাকে কার্যকরী করতে চেষ্টা করেছিলেন – “সবই ভুমি গোপালকি, না কিসি কি মালকি” ।
২। এখানে প্রত্যেকে সমান ভাতা পায়, সে তারা যে কাজই করুক, যতটা করুক না কেন। অবস্থা বুঝে কেউ অল্প-বেশি পায়। কিন্তু সেটা গ্রামসভার সিদ্ধান্ত মতো। রাঁধুনী, ঝাড়ুদার, সফটওয়্যার পারদর্শী, স্থপতি/আর্কিটেক্ট – সব্বার সমান ভাতা। (এটাই ছিল গান্ধীজির স্বপ্ন – সব কাজের জন্যে সমান মর্য্যাদা ও সমান আয়। জন রাস্কিনের থেকে শিখে তিনি এটি নিজের দক্ষিণ আফ্রিকার ফিনিক্স আশ্রমে চালু করে দেন)।
৩। কারো বাড়িতে আলাদা রান্নার হাঁড়ি চড়ে না। গোটা গ্রামের রান্না হয় সামূহিক রান্নাঘরে/কমিউনিটি কিচেনে। একসঙ্গে খাওয়া হয় একটি খাবার হলে। এতে জ্বালানি, জল ইত্যাদির সাশ্রয় তো হয়ই, সবচেয়ে বড়ো কথা – বাড়িতে রান্না মানেই মুলত মহিলাদের ঘাড়ে দায়িত্ব, সেটার থেকে তারা রেহাই পায় । এর ফলে স্ত্রী-পুরুষ বৈষম্যকে সরানোর লড়াইটা সহজ হয়। তাছাড়া, খাবার ঘরে রোজ দেখা, গল্প, নানা বিষয় আলোচনা – সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
৪। বাচ্চারা গোটা গ্রামের , কোনো একটা পরিবারের নয়। একটি বয়সের পর তারা নিজেদের আলাদা কেন্দ্রে বাস করে। এই কেন্দ্রের পরিচালনা তারা নিজেরাই করে। এটা এতটাই অভাবনীয় যে বহু বছর ধরে অনেক পর্যটক এই কেন্দ্রগুলিকে দেখতে ইজরায়েলে আসে, ছোটোবেলা থেকে দায়িত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবহার কীরকম হতে পারে তাই দেখতে। বাচ্চাদের ভালোভাবে বড় হওয়াটা কেবল তার বিশেষ পরিবারের চিন্তা নয়। গোটা গ্রামের। এর ফলেও মহিলাদের স্বাধীনতা অনেকটা বেড়ে যায়। এই কেন্দ্রগুলির সঙ্গে মধ্য ভারতের আদিবাসীদের “ঘোটুল” , যা এখন লুপ্তপ্রায়, তার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে।
৫। কিবুৎজের আরম্ভের দিন থেকেই স্ত্রী-পুরুষদের মধ্যে কাজ নিয়ে কোনো বৈষম্য নেই, এমনকী খুব শারীরিক পরিশ্রমের কাজের ক্ষেত্রেও। আমরা দেখলাম যে দুইটি বিশেষ কাজ – শিশুপালন এবং রান্না – যেগুলি নারীদের জন্য ধরে নেওয়া হয়, সেগুলিকে পরিবারের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। নারীরা যাতে সব রকম কাজ করার স্বাধীনতা পায় তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
৬। এখানে সমস্ত সভ্যদের নিয়ে সাধারণ সভাই সব সিদ্ধান্ত নেয়; যাবতীয় টাকা-পয়সার সিদ্ধান্তও এর অর্ন্তগত। তিনটি পদ রয়েছে, যেগুলি স্বেচ্ছায় এবং অবৈতনিকভাবে সব সভ্যদের পালা করে দায়িত্ব নিতে হয় (অনেকটা মেন্দালেখার মত, যেখানে কোনো নির্বাচিত নেতা নেই। সবাইকে কোনো না কোনো কমিটির সদস্য হয়ে কাজ করতে হয়)।
৭। কিবুৎজ আন্দোলন শুরু ১৯১০ সালে। এই আন্দোলন অনেক টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে গেছে। ১১০ বছরের পুরনো এই আন্দোলন মোটেই ক্ষণস্থায়ী নয়। যেটা বিশেষভাবে বলা দরকার যে, ১৯৯০ সাল থেকে গতিশীল বাজারীকরণ, ব্যক্তিবাদের আঘাতকে প্রতিরোধ করে প্রায় ৬০টি কিবুৎজ নিজের পুরনো সমাজবাদের আদর্শকে ফের দাঁড় করাতে পেরেছে।
জাপাতিস্তা, চিয়াপাস - মেক্সিকো
১ জাপাতিস্তা কী?
উত্তর আমেরিকায় মেক্সিকো, জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর ১০ নম্বর দেশ। এই মেক্সিকোর চিয়াপাস রাজ্যের আদিবাসীদের শিল্প সভ্যতার বিকল্প খোঁজার আন্দোলনের নাম জাপাতিস্তা। বিশ্বায়ন/ভুবনায়ন, নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। দুটি কারণে এই আন্দোলনটি অসাধারণ। প্রথমত, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই আন্দোলন চলছে এবং ক্রমশ একটি পরিপূর্ণ সভ্যতার আকার ধারণ করছে। দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে এই রকম বিকল্প আন্দোলন কয়েকটি গ্রাম আর শহর জুড়ে দেখা যায়। এটি কিন্তু ২০০০ টি গ্রাম, ২৯ টি শহর, প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিয়ে , আজ পৃথিবীর এই ধরনের সবচেয়ে বড়ো আন্দোলন।
২ ইতিহাস
জাপাতিস্তা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯৪ সালের ১ লা জানুয়ারি, মেক্সিকো সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদের মাধ্যমে। সেদিন মেক্সিকো, আমেরিকা, কানাডা এই তিন দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি (NAFTA) শুরু হচ্ছিল। পৃথিবীর নানা জায়গায় বামপন্থী গেরিলা সংঘর্ষ যেমন হয়, এদেশের নকশাল আন্দোলন যেমন হয়েছিল, এই আন্দোলনটিও সেই ধাঁচে হয়েছিল। কিন্তু অল্প কয়েক দিনেই জাপাতিস্তারা বুঝল আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সহিংস লড়াই কঠিন এবং ধংসাত্বক। তাই হিংসা বাদ দিয়ে, গত ২৫ বছর ধরে শিল্প সভ্যতার বিকল্প সমাজ গড়ার জন্যে তৃণমূল থেকে মানুষের সংগঠন তৈরির কাজই তারা করছে।
৩ মহিলা শক্তি
প্রথম দিন থেকে এই আন্দোলনের একটা মূল উদ্দেশ্য মহিলাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এজন্যে তারা তৈরি করেছে “বিপ্লবী মহিলা আইন”। পরবর্তীকালে সব ধরনের লিঙ্গসাম্য (LGBTQ) এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্যেও তারা তৎপর হয়।
৪ নেতা
আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ব্যাপক আদিবাসী আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন (সাব কমান্দান্তে) মার্কোস। যিনি নিজে আদিবাসী নন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কয়েক বছর আগে তার জায়গায় এই আন্দোলনের মুখপাত্র হয়েছেন আদিবাসী নেত্রী মারিয়া মারতিনেজ। জাপাতিস্তারা চায় যে তাদের আন্দোলনে সবাই যুক্ত হোক। তারা মনে করে, পৃথিবীর যেখানে এই ধরনের আন্দোলন হচ্ছে, তাদের সঙ্গে জাপাতিস্তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এ হল আদিবাসী আর অনাদিবাসীর মধ্যে বিভেদকে মিলিয়ে দেওয়ার এক সাধু প্রচেষ্টা।
৫ গ্রাম স্তরে সহভাগী সরকার
এখানকার আদিবাসীদের প্রত্যেক গ্রামে (আনুমানিক জনসংখ্যা ৩৫০) নিয়মিত জনসভা হয়। এই সভায় “১২ বছরের” ওপরে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে! গ্রাম-সরকারের তিনটি সংস্থা আছে – একটি দৈনন্দিন কাজ দেখার জন্য। একটি জমি আর ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর জন। আর তৃতীয়টি হল পুলিশ।
৬ ত্রিস্তর সরকার
গ্রামের ওপর স্তরকে বলে মারেয। প্রত্যেকটিতে গড়ে ৩৫ টি গ্রাম রয়েছে। ২০০৩-এ তারা পাঁচটি জেলা স্তরের সরকার গঠন করে। যার নাম হল কারাকোলে। প্রত্যেকটি কারাকোলে রয়েছে ৬ – ৮ টি করে মারেয। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সরকারি কর্মচারীদের গ্রামবাসীরা নির্বাচন করে। কোনো পরীক্ষা বা ভোট বা প্রচার হয় না। দ্বিতীয় আশ্চর্যের ব্যাপার হল, কর্মচারীরা এক নাগাড়ে সর্বাধিক ১৫ দিন কাজ করে। তারপর এক মাস বাদ দিয়ে আবার ১৫ দিন কাজ করে। এইভাবে চলে তিন বছর অবধি। তৃতীয় আশ্চর্য হল – কর্মচারীরা কোনো মাইনে পায় না; গ্রামের সবাই তাদের পারিবারিক চাহিদার দায়িত্ব নেয়! এই রকম সরকার পৃথিবীতে আর কোথাও কি আছে?
৭ শিক্ষা
কল্পনা করুন এমন স্কুল যেখানে শুধু শিশু বা অল্পবয়সীরা নয়, সব বয়সের মানুষই শিখছে। যে স্কুলে শিক্ষক একজন আদিবাসী এবং আদিবাসী ভাষা হচ্ছে শেখার মাধ্যম। আবার স্প্যানিশ ভাষাও শেখানো হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে আদিবাসী ইতিহাস, আজকের রাজনীতি। আর আনন্দময় জীবন-জীবিকার জন্যে যা যা দরকার তা সবই শেখানো হচ্ছে। শিক্ষা শুধু ক্লাসে বসে নয়, অনেকটাই হচ্ছে মাঠে-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে–সমবায়-কারখানাতে। আর আশ্চর্য – শিক্ষক কোনো নগদ মাইনে পায় না; গ্রামবাসীরা তার জাগতিক চাহিদা মেটায়! গান্ধীজি আর রবি ঠাকুর দেখলে কি আনন্দই না পেতেন।
৮ স্বাস্থ্য
প্রত্যেক গ্রামে একজন স্বাস্থ্য কর্মী আছে, যাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে তার দক্ষতা বাড়ানো হয়। বেশির ভাগ মারেযে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। জাপাতিস্তাদের কয়েকটা বড়ো হাসপাতাল আছে, যার মধ্যে একটি শুধু মহিলাদের জন্যে। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা দিয়ে শুরু হলেও, ক্রমশ ভেষজ এবং অন্যান্য দেশি চিকিৎসা পদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে।
৯ অর্থনীতি
ব্যক্তিগত জীবিকার থেকে সমবায়ের ওপর বেশি জোর দেয় জাপাতিস্তারা। চাষ, পশুপালন, খাবার জিনিস তৈরি, তাঁত, কফি চাষ, উপযুক্ত প্রযুক্তি ইত্যাদি – সবই সমবায় ভিত্তিতে উৎপাদন করে, তা বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়।
১০ মুল ভাবনা-চিন্তা, নীতি
কৌশল বোঝানোর জন্যে স্লোগান ও ছবির ব্যবহার
বেশির ভাগ সফল আন্দোলন সুন্দর স্লোগান ও ছবির ব্যবহার করেই থাকে। কিন্তু জাপাতিস্তারা সবাইকে টেক্কা দিয়ে রেখেছে। ওদের কিছু স্লোগান এখন গোটা বিশ্বে ব্যবহার হচ্ছে। “অনেক হয়েছে , আর নয় “ (Ya Basta), “সেই জগতই চাই যে একখানা, যার ভেতরে থাকবে জগত নানা “ (A World Where Many Worlds Fit ), “প্রশ্ন করতে করতে চলা” ( Asking We Walk) ইত্যাদি।
১১ চিয়াপাস-মেক্সিকোর সীমান্ত পেরিয়ে
জাপাতিস্তারা গত ৮-১০ বছরে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আর্ন্তজাতিক কর্মশালা, সম্মেলন করেছে। যার মধ্যে দুটি হয়েছে শুধু নারীদের জন্য সম্মেলন। এত মানুষ এই স্বপ্নের আন্দোলনকে দেখতে যেতে চায় যে, এখন কোনো গ্রামে গিয়ে থাকার জন্য আগের থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হয়।
আমেরিকা দেশের আমিশ সম্প্রদায়
আমরা জানি আমেরিকার সমাজ ভোগবাদ আর আত্ম-কেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ। সেই দেশের কিছু শহরের কাছেই এমন কিছু গ্রাম আছে যারা এই ভোগবাদ আর আত্ম-কেন্দ্রিকতাকে একেবারে নাকচ করে দিয়েছে। এমনকী শিল্প সভ্যতার অসাধারণ সুবিধেজনক বহু জিনিসকে এরা ব্যবহার করে না, বা খুব কম ব্যবহার করে ।
১। তারা ইলেকট্রিক লাইন নেয়নি। রাত্রের আলো মানে সেই পুরোনো তেলের লম্ফ।
২। অতএব বিদ্যুৎ চালিত মেশিন বাড়িতে নেই – ফ্রিজ, মিক্সি, ফ্যান, ওয়াশিং মেশিন ইত্যদির প্রশ্নই নেই।
৩। তাদের গ্রামে তারা কোনো দিন রেডিও ও টিভি ঢুকতে দেয়নি।
৪। কোনো রকম আধুনিক যানবাহন গ্রামে নেই – মোটরবাইক, গাড়ি, ট্রাক্টর ইত্যাদি। তারা ছোট্ট ঘোড়া গাড়ি ব্যবহার করে। চাষ হয় ঘোড়ার লাঙ্গলে।
৫। টেলিফোন ও কম্পিউটারের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। গ্রামের মধ্যে কারোর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলা যায় না।
৬। তাদের নিজস্ব স্কুল ও পাঠ্যক্রম আছে। তারা রাষ্ট্রের পাঠ্যক্রম মানে না। মোটামুটি অষ্টম শ্রেণি অবধি তারা পড়াশোনা শেখে। তারপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ব্যবস্থা নেই।
৭। একেবারে কোনো রকম শারীরিক হিংসা নেই। তারা দেশের সৈন্যবাহিনীতে বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।
৮। তারা নিজেদের কোনো ছবি তোলে না। অতএব কোন প্রকার ছবি সমেত আইডেন্টিটি কার্ড ওদের নেই।
৯। কোনো সরকারি ভাতা, পেনশন, দান তারা নেয় না। কোনো জীবনবিমা করে না।
১০। তারা কিন্তু আমেরিকার মুল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের রীতিমত কেনা-বেচা লেন-দেনের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের তৈরি কাঠের আসবাবপত্র এবং দুধ থেকে তৈরি নানা সামগ্রীরপ্রচুর চাহিদা রয়েছে।
১১। ১৮ বছর বয়স হলে ওদের বেছে নিতে বলা হয় যে তারা গ্রামে থাকবে না বেরিয়ে যাবে। বাইরে ওদের অবাধ স্বাধীনতা, ভোগবিলাসের, আর অনেক কিছু করার সুযোগ। যেটা গ্রামে নিষিদ্ধ। তাই তাদের মধ্যে অনেকে বেরিয়ে যায়।
১২। তারা স্বেচ্ছায় ফেরত আসতে পারে। তবে ফেরত এলে সম্প্রদায়ের সব নিয়মই মানতে হবে। অনেকে ফেরতও আসে।
১৩। গত ৩০ বছরে তাদের জনসংখ্যা দুগুণ হয়ে গেছে। তিন থেকে ৩০ টা রাজ্যে আমিশরা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন গোটা দেশে তাদের প্রায় ২০০০টি গ্রাম রয়েছে।
১৪। সাধারণ অ্যামেরিকানদের তুলনায় তাদের স্বাস্থ্য উন্নত । আমিসশরা বেশিরভাগ বেশ সুখী। প্রকৃতিকে তারা শোষণ করে না বললেই চলে।
১৫। পৃথিবীতে ইদানিং কালে এত দীর্ঘমেয়াদি, এত সংখ্যায়, একটি সম্প্রদায়, শিল্প সভ্যতার ‘অসাধারণ’ অবদানগুলি না ব্যবহার করে, সুখে-স্বাচ্ছন্দে আছে – এই রকম উদাহরণ প্রায় নেই।
১৬। এটা কী করে সম্ভব হল? যখনই নতুন কিছু আসে সেটাকে যাচাই করা আর গ্রহণ করার জন্য আমিশদের একটা সহজ মাপকাঠি আছে। তারা খতিয়ে দেখে যে সেই ‘নতুন’, তাদেরকে একে অন্যের কাছাকাছি আনবে না দূরে ঠেলে দেবে। যা কিছু তাদের একে অন্যের থেকে দূরে ঠেলে দেয় তা তারা নেয় না। তাদের সবচেয়ে বড় গালি হচ্ছে ‘হকমুট’ যার অর্থ হল অহঙ্কারী।
সব মিলিয়ে আগামীর একটি ভালো গ্রামের /
গ্রাম-স্বরাজের ছবি
মে – মেন্দাগ্রাম, কি - কিব্যুতজ,
জা – জাপাতিস্তা, আ – আমিশ
১। গ্রাম হবে একটা যৌথ পরিবার। (কি)
২। তার মানে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ধন-সম্পত্তি ও উৎপাদন প্রায় নেই-এর সমান। সবই গোটা গ্রামের। এক অর্থে “গ্রামীণ সমাজবাদ”। (মে, কি)
৩। সব আয়, গ্রামের ভেতরে কিংবা বাইরে কাজ করে হোক, একটি গ্রামকোষে জমা পড়বে (কি)
৪। যে যাই কাজ করুক না কেন, প্রত্যেক পরিবার এই আয়--উৎপাদনের সমান ভাগ পাবে। (কি)
৫। পারিবারিক রসুই ঘর নয়; যৌথ রান্না-খাওয়া হবে। (কি)
৬। সব সিদ্ধান্ত গ্রামসভায় সবাই মিলে নেবে, অর্থাৎ “সহভাগী গণতন্ত্র”। এতে ১২ বছরের ওপর কিশোর কিশোরীরাও অংশগ্রহণ করবে। (মে, কি, জা)
৭। কে কোন কাজ করবে তা গ্রামসভায় ঠিক হবে। বেকার বলে কেউ থাকবে না। (কি, জা)
৮। কোনো পরিবার আলাদাভাবে বাজারের সঙ্গে লেন-দেন করবে না। বেচাকেনা সব হবে যৌথভাবে। এক্ষেত্রে দরকার মতো একটি আলাদা কমিটি বানিয়ে নেওয়া হবে।
৯। বাচ্চাদের দেখাশোনা আর মানুষ করা কোন একটি পরিবারের নয়, বাচ্চারা গোটা গ্রামের দ্বায়িত্ব । (কি)
১০। গ্রামের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে। যেটা হবে এই ভালো গ্রামের আদর্শের সাথে মানানসই (জ, আ)। এর মধ্যে থাকবে নানা ধরণের শিখন-আড্ডা। (মে)
১১। বারবার আলোচনার মাধ্যমে গ্রামবাসীদের ঠিক করতে হবে -
# ভালো সমাজ, ভালো থাকা, ভালো মানুষ বলতে তারা কী বোঝে
# তার ভিত্তিতে তারা ঠিক করবে যে – কী কী নেবে/ভোগ করবে; কী করবে না; এবং কী কী সীমিত আকারে করবে (আ)
১২। “আভ্যন্তরীণ সত্যাগ্রহের” মাধ্যমে নিজেদের সমাজের দোষ ত্রুটিগুলি শোধরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। (মে, জা)
১৩। রাষ্ট্র বা রাজ্যের বড় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে ফেলতে হবে। খাদ্য–ঘর-অন্যান্য সুবিধে – এই সব ব্যবস্থা গ্রামকেই করতে হবে; মানে “রাষ্ট্রবাদ” বাতিল। (জা, আ)
১৪। ১০-১২ টি গ্রাম নিয়ে একটি গ্রাম-সমষ্টি, তারপর ১০-১২ টি গ্রাম-সমষ্টি নিয়ে আরো বড় ~১০০ টি গ্রামের সমষ্টি বানানো ও তাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এইসব গ্রাম এবং তার বড়-বড় সমষ্টি – ক্ষমতার দিক দিয়ে সবাই সমান --- গান্ধীজির ভাষায় “সম-স্তরের সামুদ্রিক বৃত্ত” তৈরি হবে এই গ্রাম এবং সমষ্টিগুলি। (মে, জা)
ও রক্তিপুরবি! ও আলোপুরবি! ও সত্যিভবানী! ও কোলিন সত্যিভবানী!
আমি গভীর বনে যাব। সব বাঘ ভালুকে পাথর করে দাও।
সব কাঁটাকে মোম বানিয়ে দাও। সব সাপকে কাঠি বানিয়ে দাও।
বনের ভিতর থেকে বার করে হরিণদের সামনে দাঁড় করিয়ে দাও।
(জংগলে শিকারে যাবার আগে বাইগাদের মন্ত্র,
Verrier Elwin এর The Baiga থেকে নেওয়া)
ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাকা রাস্তা ধরে এসে বাসটা লামনির বাসস্টপে দাঁড়াতেই হইচই করতে করতে একদল কলেজের ছেলেমেয়ে বাস থেকে নামল, সবার পিছনে খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরা হাসি হাসি মুখে নামলেন ফর্সা, লম্বা, টিকালো নাক প্রভুদত্ত খেরা। হঠাৎ তাকে দেখলে পাঠান বলে মনে হতে পারে। ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় এই নরম মনের মানুষটি হিন্দু কলেজের সামাজিক নৃতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সাল ১৯৮৫ র প্রথম দিকে তিনি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এসেছেন মাইকাল পাহাড়ের জঙ্গলে ফিল্ড স্টাডির জন্য।
উঠেছেন অমরকণ্টকের এক ধর্মশালায়। বেশিরভাগই দিল্লি বা অন্য বড় শহরের ছেলে মেয়ে, পাহাড়ের উপর জঙ্গলে ঘেরা লামনিতে এসে তারা মুগ্ধ, সবার মধ্যেই জঙ্গল পাহাড়ে ঘোরার অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা। তার উপর ভারতবর্ষের অন্যতম আদিম জনজাতি বাইগাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ক্লাসে শোনা বা বইতে পড়ার থেকে জঙ্গলে তাদের গ্রামে তাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের সম্পর্কে জানা, এক আলাদা ব্যাপার। বাইগাদের এক বড় অংশ থাকে অমরকণ্টকের পাশের আচানাকমার জঙ্গলে। লামনি বেশ বড় গ্রাম। বাইগাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দু এক ঘর যাদবও দেখা যায়। ছাত্র ছাত্রীরা তিনটি দলে ভেঙে গ্রামের নানা টোলায় আর্থসামাজিক সমীক্ষা ও বিভিন্ন বিষয়ের অনুসন্ধানের জন্য গেছে। হিন্দি ভালো জানে এরকম কয়েকটি যাদব ছেলে দলগুলির সঙ্গে রয়েছে বাইগাদের পাড়া চেনানের জন্য আর দোভাষী হিসাবে। ঠিক হয়েছে ঘণ্টা দুই তিনেক পরে সকলে ফিরবে বড় রাস্তার ধারের ফরেস্ট অফিসে। প্রথম দিন প্রফেসার খেরা একাই ঘুরে ঘুরে বাইগাদের ও শাল জংগলকে বোঝার চেষ্টা করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
শাল জঙ্গলের পায়ে চলা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মাঝের একটু ফাঁকা জায়গায় একটা শাল গাছের কাটা গুঁড়ির উপর বসে জঙ্গলের শ্যামল, নিবিড় শোভা উপভোগ করছিলেন। অনেকদিন পর ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল, ৩৫ বছর আগের কিশোর বয়সের লাহোরের সেইসব দিনের কথা, দুরন্ত বদমায়েশি, মহল্লার সারি সারি বাড়ির মধ্যে দিয়ে নানা গলিঘুঁজি, সেখানে দাদা দিদি আর পাড়ার বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলা, বেলায় দিদির আর মায়ের ডাক। হঠাৎ এক লহমায় সব শেষ, সাতচল্লিশের দেশভাগ সে দিনের কিশোর প্রভু রাতারাতি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সব কোথায় হারিয়ে গেল, রক্তাক্ত দেশভাগ, শরণার্থী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে দিল্লিতে। পুরো পরিবার ছন্নছাড়া উদ্বাস্তু, তার মন ভারী হয়ে এলো।
এক ঝাঁক টিয়া পাখীর তীক্ষ্ণ ডাকে সম্বিত ফিরতেই দেখলেন সামনের বড় শাল গাছটার পিছন থেকে একটা বালকের হাসি মুখ তার দিকে তাকিয়ে। পাঁচ, ছয় বছরের এক বালক, চুলগুলো এলোমেলো, খালি-গা, গাছের পিছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, তিনি হেসে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন। বালকটি হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল, তার দুষ্টু মুখটা দেখে তার নিজের ছোটবেলার কথা আরো মনে পড়ল। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লজেন্স বার করে দেখিয়ে কাছে আসার ইশারা করলেন কিন্তু বালকের মধ্যে কোন উৎসাহ দেখা গেল না। তারপর হটাতই বড় শাল গাছটার পিছনে সে হারিয়ে যেতেই প্রফেসার খেরার খেয়াল হল যে এই জঙ্গলে বাঘ আছে, সেখানে এতো ছোট ছেলে একলা ঘুরছে ভেবে তার ভয় লাগে। এই প্রথম তিনি ছাত্রদের নিয়ে এসেছেন এই অঞ্চলে, আচানকমারের জঙ্গল সম্পর্কে তার ধারণা খুবই কম।
তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দেখতে গেলেন, তখনই কে যেন তার পরনের পাঞ্জাবি ধরে টানল, মুখ ঘোরাতেই দেখেন ছোট্ট ছেলেটি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে। কখন সে দ্রুত নিঃশব্দে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে তিনি বুঝতেই পারেন নি। তিনি হেসে ফেলেন, বালক তার ছেঁড়া প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা অজানা পাকা লাল ফল বের করে প্রভু খেরার সামনে ধরে, নেবার অনুরোধ। ছেঁড়া প্যান্ট, খালি গা, একমাথা এলোমেলো না আঁচড়ানো চুল, কালো গায়ে ধুলো লেগে, ছেলেটির চোখ দুটি নির্ভয়, সারল্যে ভরা, তার হাসিমুখ দেখে এক লহমায় তিনি হারিয়ে যান। ছেলেটি তাকে হাত ধরে গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর বসায়। দুজনেই দুজনের ভাষা বোঝে না অথচ ইশারায় কথা চলতে থাকে, শুরু হয় কিছু জংলী ফলের বীজ নিয়ে খেলা। কিছুক্ষনের জন্য তিনি হারিয়ে যান লাহোরের শৈশবে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার অভিজ্ঞ নৃতাত্ত্বিকের চোখে ধরা পড়ে এই জঙ্গলের বিষয়ে বালকের জ্ঞান। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে যে ভাবে আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের গবেষণা করেন সেখানে প্রকৃতির নানা বিষয়ের এই জাতিগত আত্মস্থ গভীর জ্ঞান ধরা পড়ে না। তিনি নিজে যখন অসহায় বোধ করছেন জঙ্গলের পরিবেশে সেখানে বালকের আত্মবিশ্বাস ভরপুর। বুঝতে পারলেন এই জঙ্গল তার নিজের জায়গা, এক সহজাত দক্ষতায় তাই সে এতো নিঃশব্দে নানা গাছের মধ্যে দিয়ে দ্রুত তার পিছনে চলে এসেছিল। ভাবতে ভাবতে তিনি উঠে দাঁড়াতেই বালক তাকে হাত ধরে টানতে থাকে জঙ্গলের ভিতরের পায়ে চলা রাস্তার দিকে। দুজনে জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা যাবার পর প্রফেসার খেরা দেখলেন বড় বড় গাছ ঘেরা একটা পরিষ্কার জায়গায় দুরে দুরে বেশ কয়েকটা বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া, ছেলেটা হাত ধরে তাকে তাদের বাড়ির উঠোনে নিয়ে গেল।
সুন্দর করে মাটি দিয়ে নিকানো উঠোন, তিন দিকে তিনটে ঘর, ঘরের সামনে উঁচু করে মাটির সরু বারান্দা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢাকা, উপরে পাতার ছাউনি, বাড়ির পিছনের দিকে বড় বড় শাল গাছ, উঠোনের দুই পাশে দুটো বড় আম গাছ। গাছের ছায়ায় দুটো খাটিয়া পড়ে আছে, এক কোণে মাটিতে নিকানো মেঝেতে কিছু শাল বীজ শুকতে দেওয়া আছে। খাটিয়ার পাশে মাটিতে বসে মাহাতু বাইগা তখন একটা কাঠের টুকরোকে খুব মনোযোগ দিয়ে ছোট কুড়ুল দিয়ে কেটে কিছু বানাচ্ছিল। হঠাৎ খাদির পাজামা পাঞ্জাবি পরা, ফর্সা লম্বা চেহারার একটা মানুষকে ছোট ছেলে মিরনের সঙ্গে ঢুকতে দেখে সে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। অনেকটা এরকম চেহারার গেরুয়া কাপড় পরা সাধু সন্ত তাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে অমরকণ্টকে যায়, গ্রামের সবাই তাদের বাবা বলে। ওর মনে হল এই মানুষটা সেই রকম কোন বাবা, কেবল পোশাকটা একটু আলাদা। প্রভু খেরা হাত জোড় করে নমস্তে বললে মাহাতু কেবল হাত জোড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাহাতু তারপর সেই বালকের দিকে তাকিয়ে ওদের ভাষায় কিছু বলে। প্রভু খেরা শুধু এটুকু বুঝলেন, ছেলেটির নাম মিরন। তিনি খাটিয়ায় বসতেই মিরন দৌড়ে ঘরের থেকে একটা এলুমিনিয়ামের গ্লাসে জল নিয়ে আসে।
প্রভু খেরা খাটিয়ায় বসলে মাহাতু মাটিতে তার পায়ের কাছে বসতে গেলে তিনি তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে খাটিয়ায় তাঁর পাশে বসালেন। মাহাতুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝলেন যে সে অল্প হিন্দি বোঝে, নাম মাহাতু, জাতে বাইগা। তিনি খুশী হলেন যে একদম বাইগা পাড়ায় বাইগা বাড়ির ভিতরে পৌঁছেছেন, সম্ভবত ছাত্রদের কোন গ্রুপ এদিকে আসেনি। মাহাতুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বাড়ির আশপাশ থেকে লোকটির চৌদ্দ পনেরো বছরের ছেলে আর তার বছর সতেরোর মেয়ে কোলে একটা শিশু নিয়ে বেরিয়ে এসে মাহাতুর পাশে দাঁড়াল, মিরন প্রভু খেরার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, আস্তে আস্তে পাড়ার আরো লোক তাকে দেখতে জড় হ’ল। প্রথমে মিরন ছাড়া বয়স্ক সবার মধ্যে কিছুটা সঙ্কোচ আর ভয় ছিল, কিন্তু সময় আস্তে আস্তে কাটতেই তারা নিশ্চিন্ত যে এই মানুষ বন বিভাগ থেকে আসেনি। একদিকে বাইগাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার কৌতূহল অন্যদিকে তার সম্পর্কে মাহাতুর ও পাড়ার সবার কৌতূহল মিলে মিশে একাকার।
তিনি কে কোথা থেকে এসেছেন আর কেন এসেছেন তা বোঝাতে গিয়ে বুঝলেন যে এই দেশ কাল সময় সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, এরা কথা কম বলে বেশির ভাগ নীরবে শোনার আর বোঝার চেষ্টা করে। সবাই ভালো হিন্দি বোঝেনা তার উপর প্রফেসার খেরার কথার টানও অন্য রকম। তারা এটুকু বুঝল যে ইনি দিল্লি বলে একটা জায়গা থেকে এসেছেন। কথা চলতে লাগল, মাহাতু বলল যে তার বাবা মান্ডলার দিকে থাকত তারপর ওদিকে শাল জঙ্গল কমতে থাকায় এদিকে চলে আসে। এই পাড়ার সবাই অন্য কোন জায়গা থেকে এখানে বাড়ি করেছে। তিনি জানতেন যে বাইগারা জঙ্গলে শিকার করে আর জঙ্গলের কন্দমূল ফল সংগ্রহ করে। এরা উত্তরপূর্বের আদিবাসীদের মতো জঙ্গল পরিষ্কার করে ঝুম চাষ করে, যাকে এরা বেওয়ার বলে। এরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। ভাঙা ভাঙা ভাবে কথাবার্তা শুরু হলেও এক সময় দুপক্ষই বার্তালাপ বুঝছিল।
বেওয়ার প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন দাঁড়িয়ে থাকা পাড়ার সব বয়স্ক লোকই দুঃখ করতে লাগলো বেওয়ার বন্ধ হবার জন্য। বন দপ্তর তাদের বেঁচে থাকার রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে। কত পুরানো সময় থেকে এই শাল জঙ্গলই তাদের ঘর, তারা মন মতো বেওয়ার করত আর তখন জঙ্গল কত ঘন ছিল, জঙ্গলে কত শিকার ছিল বরা, হরিণ, খরগোশ, বাঘ ভালুও ছিল। কিন্তু বন দপ্তর শিকার তো বন্ধ করেছেই, বেওয়ারও বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে জঙ্গলও পাতলা হচ্ছে। গল্প করতে করতে দেখলেন বেশির ভাগেরই খালি গা, আপাত দৃষ্টিতে গভীর অভাব মনে হলেও কারুর মধ্যে কোন আভাববোধ নেই, এক অদ্ভুত সন্তোষ। মিরন ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর দেওয়া লজেন্স চুষছে আর মাঝে মাঝে হাসি মুখে ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, ধীরে ধীরে তিনি মিশে গেলেন ওদের সাথে।
একটু পর তিনি হাত ঘড়িতে দেখলেন যে ঘণ্টা দুয়েক কখন কেটে গেছে।
*****
মাহাতুকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তের ধারের ফরেস্ট অফিসের বারান্দায় এসে দেখলেন ছাত্রদের একটা দল ফিরে এসেছে, বাকিরাও এসে পড়বে। এখানে ছাত্ররা তাদের দিনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করবে, সেই সময় নানা ব্যাপারে মাহাতুর ব্যাখ্যা খুব কাজে দেবে এই ভেবে তিনি মাহাতুকে নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে ওদের পাড়ার আরো কয়েকজন। এক এক করে ছাত্রদের বাকি দল এসে পড়ল, মিরন দৌড়ে দৌড়ে সকলের ওয়াটার বটলে সামনের টিউবওয়েল থেকে জল এনে দিল। গ্রামের লোকজন অনেকগুলো খাটিয়া এনে সামনের বড় ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের নিচে পেতে দিলে সবাই সেই শীতল ছাওয়ায় বসে কথা বলতে লাগল। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা বাইগাদের দারিদ্র্য নিয়ে, এতো গরীব তারা আগে দেখেনি, বাইগাদের পোশাক আশাক, খাওয়া দাওয়া সব কিছুর মধ্যেই তারা প্রবল দারিদ্র্য খুঁজে পেয়েছে। এ দেখে শহরের শিক্ষিত ছাত্র ছাত্রীদের মন খুবই বিচলিত। মাহাতু, মিরন ও গ্রামের বাকিরা খুবই অবাক চোখে এই সব ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় আলোচনা শুনছিল, বেশিরভাগটাই বুঝছিল না। দলের সঙ্গে গিয়েছিল কম বয়েসি প্যান্ট শার্ট পরা গ্রামেরই বিনোদ যাদব, সে কিছুদিন বিলাসপুরের দোকানে কাজ করেছে। সে মাঝে মাঝে বাইগাদের দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কার নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
প্রফেসার খেরা চুপ করে কথা শুনছিলেন আর দুটো আলোচনার তফাৎ লক্ষ্য করছিলেন। একটু আগে বাইগাদের পাড়ায় যখন বসে ছিলেন একবারও তাদের কথায় কোন অভাব ধরা পড়েনি, বেওয়ার বন্ধ করে দেওয়া আর জঙ্গলে শিকার করতে না দেওয়া ছাড়া তাদের কোন অভিযোগ নেই। জঙ্গলে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেরানো ছাড়া তারা কিছু চায়ও না অথচ তার ছাত্ররা বাইগাদের গভীর অভাব নিয়ে বেশ চিন্তিত। বেশিরভাগ গ্রুপেরই বক্তব্য এদের অনেকের জমি থাকলেও এরা ভাল চাষ করে না, জমিতে উৎপাদন খুবই কম, কারও কারও মতে জমির উৎপাদনশীলতা দ্রুত বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। বিনোদ যোগ করল এরা খুব কুঁড়ে, খালি বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, চাষে মন নেই। এই গ্রামের যে কয়েক ঘর যাদব আছে তারা পরিশ্রম করে বলে তাদের অবস্থা ভালো। মাহাতুরা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল কিন্তু বিনোদের কথা বুঝতে পেরে মাহাতু প্রতিবাদ করে বলে তুই জানিস না আমাদের জমিতে লাঙল দিতে নাই?
প্রফেসার খেরা আস্তে মাহাতুকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন তাদের চাষ করতে নেই? মাহাতু উদাস হয়ে সামনের লম্বা শাল গাছের দিকে তাকিয়ে বলল ভগোয়ান নিজে হাতে বাইগাদের বেওয়ার শিখিয়েছিলেন, এই বলে সে চুপ করে গেল। সবাই তার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল, মিরন তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। সবাই গুছিয়ে বসল কিন্তু মাহাতু চুপ, প্রফেসার খেরা আস্তে মাহাতুর কাঁধে হাত রাখলেন, তবুও সে চুপ। মাঝখান থেকে বিনোদ বলে উঠল স্যার আমি গল্পটা জানি, বলব? মাহতুর চোখের বিরক্তি প্রফেসার খেরার চোখ এড়াল না। তিনি হাত তুলে তাকে থামতে বলে আবার মাহাতুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। ছাত্র ছাত্রীরা প্রফেসার খেরাকে দেখে বুঝে গেছে যে মাহাতু একজন আদিবাসী, এদের একে-ওপরের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ের সংস্কৃতি তাদের মতো নয়। এরা শান্ত, স্থির, কম কথা বলায় অভ্যস্ত। মিরন তখনো তাকিয়ে তার বাবার মুখের দিকে।
লামনিতে থাকার দ্বিতীয় দিন তিনি আবার মাহাতুর বাড়ি গিয়ে দেখেন সে তার ছোট কুড়াল দিয়ে কত সহজে শক্ত শাল কাঠ কেটে বানাচ্ছে কাঠের গোল চাকা। অবাক হয়ে দেখেছিলেন তার হাতের কুড়ালের ভেল্কি, মাহাতু বলছিল কুড়ালের কয়েক কোপেই এরা নাকি একটা তিন মানুষ সমান গাছ কেটে ফেলতে পারে অনায়াসে। মাহাতু জগন, মিরনদের সঙ্গে জঙ্গলে একটু ঘুরতেই বুঝলেন হাতে কুড়াল নিয়ে শাল বনে ঘুরতে যে এদের কি আনন্দ তা বোধহয় বাইগারাই জানে, তার কাছে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মিরনের সাথে পাড়ার বাচ্ছারা তাকে দেখে ঘিরে ধরল। তিনি পকেট থেকে লজেন্স বার করে সবাইকে দিলে, মুহূর্তের মধ্যে ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে মিরনের মতো কয়েকটা ছেলে আর একটা ছেঁড়া ফ্রক পড়া কয়েকটা বাচ্ছা মেয়ে লজেন্স নিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল।
ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে বাইগা জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাহাতুর কাছে শুনেছিলেন যে তার প্রথম পক্ষের বউ তার সাথে বারো বছর ঘর করার পর বছর ছয়েক আগে তারই এক বন্ধুর সাথে ছাপরাওয়ায় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছে। মাহাতুর প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো তার উপর ছেলেমেয়েদের একা সামলাতে একটু অসুবিধা হত কিন্তু তার বড় মেয়ে নিরলি অনেকটা সামলে দিয়েছিল। প্রভু খেরা লক্ষ করছেন এই বলার মধ্যে মাহাতুর মধ্যে কোন রাগ বা অভিমান নেই। তারপর তার দ্বিতীয় পক্ষের বউ তিরনির সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে মাহাতুর ভাব ভালবাসা হয়। বিয়ে করেছে দুজনে তাতেও নিরলি বা বড় ছেলে জগনের মধ্যে কোন আলাদা তিক্ততা বা রাগ নেই। বছর তিনেক আগে নিরলিও বিয়ে করে ছাপরাওয়ারই এক বাইগাকে। এখন সে তার কোলের মেয়েকে নিয়ে এসেছে বাপের বাড়িতে। তিরনিও তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে। সে আর তিরনি রোজ গল্প করতে করতে জঙ্গলে শাল বীজ আর কন্দবাড়ি জোগাড় করতে বেরোয়।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সবাই আবার ফিরে যায় দিল্লিতে, পভু খেরা ব্যাস্ত হয়ে পড়েন কলেজ ও ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে।
***
সেদিন জঙ্গলের ধারে মাহতু একটা বড় গাছের নীচে বসে তার শালপাতার বিড়িতে টান দিতে দিতে সামনে তার সদ্য চাষ করা জমির দিকে তাকিয়ে ছিল, জমির বুকে চিরে একটানা লম্বা লম্বা ফাঁক তার পাশেই সদ্য উপড়ে যাওয়া অল্প শুকানো হলদে সবুজ ঘাসগুলো মুখ থুবড়ে লাইন দিয়ে পড়ে আছে, তারই ভিতর থেকে লাল অল্প ভিজে মাটি বেরিয়ে এসেছে, দু একটা গো বক তখনো মাঠে চরছে। জমির দিকে তাকিয়েই মাহাতুর মন খারাপ হয়ে গেলো, তার ভালো লাগে না এক টানা জমির বুকে লাঙলটাকে চেপে ধরে চালাতে, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে, ভয় লাগে, ধরিত্রী মায়ের শাপের ভয়। কিন্তু উপায় নেই, জঙ্গলের ধারের এই শক্ত পাথরের মতো জমি মধ্যপ্রদেশের বন দপ্তর তাকে বছর চার আগে পাট্টায় দিয়েছে যাতে ও জঙ্গলে বেওয়ার বন্ধ করে। আরও কয়েক বার চাষ দিলে জমিটা তৈরি হবে, তারপর বৃষ্টি হলে সে ধানের বীজ ছড়াবে। গরু দুটো ছায়ায় জাবর কাটছে। গত তিন বছর সে চেষ্টা করছে গোণ্ড আর ওঁরাওদের মতো চাষ করতে কিন্তু ভালো ফসল কোন বছরই হয়নি। যে জমিতে একটা গাছ নেই ঘাস শুকিয়ে যায় সেখানে কি কচি কচি ধানের চারা বাড়ে? সে ভাবে, কে জানে কেমন করে পাহাড়ের নিচের গোণ্ডদের গ্রামে এতো ধান হয়, এই রকম চাষ তার বাপ ঠাকুরদা কেউ কখনো করেনি, কয়েক বছর আগেও সে শাল জঙ্গলের ভিতর বেওয়ার করে এসেছে। সে ভাবে বেওয়ারের মজাই আলাদা, কি ভালো কুটকি আর কোদো হয় তার সঙ্গে জংলি সিম আর বরবটি দিলে তো কথাই নেই।
ভাবতে ভাবতে তার ভারি রাগ হয়, কেন তারা তাদেরই শাল জঙ্গলে নিজের মতো করে বেওয়ার করতে পারবে না? যুগ যুগ ধরে তারা তো এই দিকের জঙ্গলে বেওয়ার করে এসেছে। সব আদিবাসীরা জানে বাইগারা হচ্ছে শাল বনের রাজা, আর আজ কিনা তারা তাদেরই শাল বনে ঘুরলে ফরেস্টের লোকগুলো চেঁচায়। যেখানে ওরা একসময় বাঘ মারত সেখানে তাদের একটা পাখি শিকার করাও মানা, কেন? ওরা তো এখানকার লোকই নয়, ওরা কি করে এই জঙ্গলের দখল পেলো? রাগে, জোরে ওর বিড়িতে শেষ টান দিতেই পিছনের জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে এলো তিরনি, এসে ওর পাশে বসল, চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে, পরনের শাড়িটা ছেঁড়া, হাতে এক গোছা জংলি জাম, একটা জাম মুখে চুষছে। ওর দিকে তাকিয়ে মাহতু তার বিড়িতে টান দিতে দিতে বলে কিছু পেলি? সে হাসতে হাসতে অন্য হাতটা সামনে এনে দেখাল কয়েকটা ছোট কন্দবারি, এখনো ভিজে লালচে মাটি লেগে তাতে।
হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজ, দুজনের মাথা দ্রুত সেদিকে ঘুরল, দেখল জমির অন্য প্রান্তের জঙ্গলের পাশে জগন, একটা ধনু আর বাণ নিয়ে শাল গাছের মাথায় বসা একটা বড় সাদাকালো বকের দিকে তাক করেছে, ছোট মিরনও ঝোপের পিছন থেকে মুখ বার করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে। বাণের দিকে তিনজনেরই চোখ, তিরনির মনে লোভ হয়, ভাবে ঘরে কোদো আছে, কন্দ আর পাখির মাংস দিয়ে আজ সবাই পেট ভরে খাবে, ভাবতে ভাবতে সে মুখে আরো কয়েকটা জাম পোরে। মাহাতু জানে জগনের বাণের টিপ, সেই তাকে শিখিয়েছে ধনুর বাণ দিয়ে শিকার করতে, ও জানে বকটা শেষ, তবুও তাকিয়ে থাকে, মনে একটু গর্ব আর একটু ভয়, ঝোপের ভিতর মিরনের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
কি রে মাহাতু কি খবর? বসে থাকলে হবে? চাষের কতদূর? বলতে বলতে তার জমির অন্য প্রান্ত থেকে ফরেস্টের পাহারাদার লম্বা পেটানো চেহারার যমুনাপ্রসাদ যাদব লম্বা, মোটা লাঠি হাতে উঠে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ফট করে একটা আওয়াজ, বকটা ঝটপট করতে করতে নীচে পড়তে পড়তে একটা শুকনো শালের ডালে মাথা নিচু করে আটকে গেল, এখনো প্রাণটা বেরোয়নি, নড়ছে। যমুনাপ্রসাদ দুর থেকেই কিছু একটা আন্দাজ করেছে কিন্তু তার মনে তখন অন্য চিন্তা, তার আজ দরকার মাহাতুকে। মাহাতু আর তিরনি ভেবেছে যমুনাপ্রসাদ ব্যপারটা খেয়াল করেনি, জগনের শিকার সে দেখেনি। তিরনি মুখ থেকে জামের বীজগুলো ফুঃ ফুঃ করে ফেলল, আর মাহাতু আড়চোখে বকটা দেখে তাকিয়ে থাকল যমুনাপ্রসাদের দিকে, সেও ওদের দিকে তাকাল যেন কিছুই হয় নি, জঙ্গলে তো এমন কত আওয়াজই হয়।
দুজনেই জানে যমুনাপ্রসাদ দেখলে বিপদ। সে কেবল ভাগ চাইবে না বেশি ভাগটা সেই নেবে। না দিলে বড় সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে। মাহাতু বলে করছি গো, চাষ কি বাইগাদের কাজ, সাহেবকে বলো না, ওইদিকের জঙ্গলে একটু বেওয়ার করি! যমুনাও লামনীরই বাসিন্দা, দুজনে দুজনকে অনেক দিন ধরে চেনে, যমুনাপ্রসাদের ঠাকুরদা ইংরেজ আমলে বিহার থেকে লামনিতে আসে সাহেবদের সঙ্গে, তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছে। যমুনা নিজের পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে মাহাতুকে আর তিরনিকে একটা করে দেয়, তারপর তিনজন একসঙ্গে বিড়ি ধরায়।
যমুনা বলে কেন তোকে তো চাষের জমি দিয়েছে। মাহাতু রেগে বলে তুমি যাদব হলে কি হবে, জন্মেছ তো লামনিতে, তুমি কি জান না বাইগাদের ধরতিমায়ের বুক চিরে চাষ করতে নাই? যমুনা বলে জানি জানি কি করবি বল? সাহেবরা নিয়ম করেছে, তোরা জঙ্গল কেটে বেওয়ার করলে জঙ্গল শেষ হয়ে যাবে না! তিরনি পাশ থেকে ফোড়ন কাটে, তা তোমার বিট সাহেব যে গাছ কেটে রাতে গাড়িতে পাঠায়! যমুনা মাহাতুর পাশে বসে বলে তোর তো খুব কথা হয়েছে রে, ওসব বলিস না চুপ কর, আমার নোকরিটা যাবে। একটু থেমে বলে এই চাষ যদি না করিস তবে একটা কাজ করবি? এই বলে বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে আস্তে আস্তে বলে, চল রাজাখোলা বাঁধের মাটি কাটার কাজে হাত লাগাবি। দিনে একশ টাকা পাবি। মাহাতু আর তিরনি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়, দিনে একশ টাকা! যমুনা আরো স্পষ্ট করে বলে তোরা দুজনে দুশো পাবি।
তিরনি আড় চোখে দেখে নিয়েছে ছোটটা ততক্ষণে গাছ থেকে বকটা পেড়ে এনে জগনের সঙ্গে জঙ্গলে মিলিয়ে গেছে। বাড়িতে আজ জমিয়ে খাওয়ার কথা ভেবে ওর আর টাকার কথাটায় তেমন মন উঠল না। সে উঠতে উঠতে মাহাতুকে বলল, তাড়াতাড়ি গাই গুলোকে নদীতে নামিয়ে তুমিও চান করে বাড়ি এসো। যমুনাপ্রসাদের মাথায় তখন বিট অফিসার রামজীবন পাঁড়ের মুখটা ভাসছে। অনেকদিন ধরে বাঁধের জন্য লাখ পাঁচেক টাকা এসে পড়ে আছে, যদি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ না হয় তাহলে টাকা ফেরত পাঠাতে হবে। যমুনাও বিড়িতে শেষ টান দিয়ে উঠতে উঠতে বলে বাঁধের মাটি কাটার কাজে অনেক পয়সা, তোর পাড়ার অন্য বাইগাদেরও বলিস। তারপর যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে জগনকেও নিয়ে আয়, ছেলেটা শিকার করতে গিয়ে ধরা পড়লে ওর কিন্তু জেল হবে, বলতে বলতে ধীরে ধীরে সে জঙ্গলে ঢুকে মিলিয়ে যায় বড় বড় শাল গাছের আড়ালে। কথাটা শুনে মাহাতু বিড়িটা ফেলে থুঃ থুঃ করে কিছুটা থুথু ছিটিয়ে উঠে দাঁড়াল।
****
দিল্লিতে ফিরেও প্রভুস্যার ভুলতে পারছিলেন না আচানাকমারের শাল জঙ্গল, মাহাতু, তিরনি, জগন, নিরলি আর ছোট্ট দুষ্টু মিরানের সঙ্গে এক দঙ্গল ছোট বাচ্ছাকে। পাঁচদিন মাইকাল পাহাড়ের জঙ্গলে ঘোরার পর দিল্লি ফিরেও তার বার বার মনে পড়ছে সেখানকার কথা। তিনি একজন অভিজ্ঞ সামাজিক নৃতাত্ত্বিক, আদিবাসীদের নিয়েই তার কাজ অথচ কিছুতেই কোন এক আশ্চর্য বন্ধনে মাহাতু আর তার পরিবারকে তিনি ভুলতে পারছেন না। প্রভু খেরা একাই থাকেন বিয়ে-থা করেন নি, পড়াশোনা, কলেজ আর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, খুব সহজ সরল জীবন কাটান কিন্তু আচানাকমারের এই ফিল্ড ট্রিপ তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। নৃতত্ত্ববিদ হিসাবে যত না, মানুষ হিসাবে তার থেকে বেশি। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে তার আর মিরনের কোথায় যেন একটা মিল আছে, অথচ দুজনে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা সময়ে আলাদা জায়গার আলাদা দুটো জীবন। তারই মতো মিরনরাও কি উদ্বাস্তু হতে চলেছে।
দিল্লিতে প্রভু খেরা একাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন, বাড়িতে জিনিসপত্রও খুব কম। স্বতীর্থরা তার অতি সাধারণ জীবন যাপন নিয়ে পিছনে হাসি ঠাট্টা করে। পোশাকের মধ্যে খাদির পাজামা পাঞ্জাবি, খাওয়াদাওয়াও খুবই সাধারণ, রুটি ডাল কোন কোন দিন সব্জি আচার। তার খুব কাছের বন্ধু ইতিহাস বিভাগের দিগম্বর মিশ্র তো তাকে প্রায়ই বলে বেশ আছ প্রভু, কোন চিন্তা নেই, দিব্যি ঝাড়া হাত পা। এখন বাড়িতে একা থাকলে তার মাথায় কেবল শাল জঙ্গল, লামনি গ্রাম, মাহাতুর গল্প, মিরনদের মুখ ভাসে। তিনি এরকম আধুনিক সভ্যতার থেকে এতো দুরের কোন সমাজ আগে দেখেননি। সহজ সরল জীবন, নিজেরা নিজেতে সম্পূর্ণ, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে কত কিছু নেই, অভাবই অভাব, অথচ সবাই তাদের সীমিত সম্পদে কতই না সন্তুষ্ট। তাদের অস্তিত্বের নিগড়ে যেন এই জঙ্গল- জীবন, শাল বনই যেন সব। তিনি তো বিয়ে থা না করে ঝাড়া হাত পা কিন্তু মাহাতুরা সংসার করেও কেমন করে যেন তার মতোই, যেন বন্ধনহীন।
সরকার নাকি আচানাকমারকে অভয়ারণ্য বানাতে চলেছে, গভীর জঙ্গলের সব বাইগা গ্রামকেই নাকি সরান হবে। ভাবছিলেন কোথায় যাবে এরা? শাল-জঙ্গল ছাড়া কি করবে? তার মনে পরে মাহাতু যে গল্প সবার সামনে বলে উঠতে পারেনি, একদিন জঙ্গলের ধারে তার জমির পাশে সেই গল্পই বলেছিল তাকে, তিরনি আর মিরনকে। একটানা আবেগহীন গলায় শুনিয়েছিল এক অদ্ভুত গল্প একটা বড় শাল গাছের দিকে তাকিয়ে, যেন সে মনের চোখে দেখছিল আর বর্ণনা করে যাচ্ছিল।
পৃথিবী তৈরি করার পর ভগোয়ান বাইগাকে বললেন কান্দমাল জঙ্গলে গিয়ে কিছু কন্দ খুঁড়ে নিয়ে আসতে আর সে যেন আট দিনের পর ফিরে আসে। তারপর ভগোয়ান বাজারে গিয়ে একটা দোকান খোলে আর সেই দোকান থেকে এক এক করে জিনিস দিতে থাকেন এক এক আদিবাসীকে। হাল দেন গোণ্ডদের, কলম দিলেন ব্রাহ্মণদের, বোতল দিলেন কালারদের, ওজনদারী দিলেন বানিয়াদের, মাছ ধরার জাল দিলেন ধীমারদের, তাঁত দিলেন মাহারদের আর পাংকাদের বললেন তারা যেন গ্রামের দেখাশোনা করে। কিন্তু বাইগা তখনো এসে পৌছায়নি বলে সে কিছুই পেল না। তারপর বাইগা যখন জঙ্গল থেকে ফিরল তখন তিনি সব আদিবাসীদের ডাকেন জগতের একজনকে রাজা বানানোর জন্য।
এতটা বলে মাহাতু সামনের শাল গাছের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে কিছু ভেবে আবার বলতে শুরু করে।
বাকি আদিবাসীরা ভগোয়ানের সভার সব সোনা রুপোর সব আসন দখল করে বসল কিন্তু নাংগা বাইগা কোন আসন না পেয়ে মেঝেতে বাবু হয়ে ভগোয়ানের সামনে বসল। তাই দেখে ভগোয়ান খুশী হয়ে নাঙ্গা বাইগাকে হাতে করে তুলে তাঁর সিংহাসনে নিজের পাশে বসান, বলেন ‘তুমিই হবে জগতের রাজা’। কিন্তু নাঙ্গা বাইগা ভগোয়ানকে বলে তিনি যেন তার বদলে তার ভাই গোণ্ডকে রাজা করেন। একথা শুনে ভগোয়ান খুব খুশী হন এবং নাঙ্গা বাইগার প্রার্থনা মতো গোণ্ডকে রাজা করেন। আর বাইগাদের তার থেকেও বেশি আশীর্বাদ করে যান, বলেন জগতে যত রাজ্য আছে সব একদিন খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়বে, কেবল মাটি দিয়ে তৈরি যে, সেই ভুমিয়ারাজা, পৃথিবীর অধিপতি, সে কখনো পৃথিবীকে ত্যাগ করবে না, তোমাদের জীবন চলবে কেবল ধরিত্রীর উপর নির্ভর করে। তুমি মাটি খুড়ে পাবে কন্দ, তাই খাবে, জঙ্গলের কাঠ কেটে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাবে, তোমার স্ত্রী জঙ্গলের পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করবে। আর তুমি কখনো গোণ্ড আর হিন্দুদের মতো ধরিত্রী মায়ের বুক চিড়ে লাঙল চালাবে না। তুমি গাছ কেটে পুড়িয়ে তাদের ছাইয়ে বীজ বুনবে, তুমি কখনো বড়লোক হবে না। তুমি যখন ধরিত্রীকে ত্যাগ করবে তখন এই জগতে ধরিত্রীর ছোট ছোট জিনিসকে গুছিয়ে ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রাখার জন্য কেউ থাকবে না। তারপর ভগবান নাঙ্গা বাইগাকে দেখালেন কেমন করে বেওয়ার কাটতে হয় আর কেমন করে বীজ বপন করতে হয় সেইসব গাছের পোড়া ছাইতে। তিনি তাকে উপহার দিলেন নানা বীজ বেওয়ারের জন্য। গল্প শেষ হলে মাহতু চুপ করে তাকিয়ে থাকে সামনের শাল গাছের দিকে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, একদিন দিগম্বর মিশ্র তাকে ক্যান্টিনে ধরলেন। হাসতে হাসতে বললেন, কি ব্যাপার প্রভু আপনি এতো উদাসীন হয়ে আছেন কেন? বুড়ো বয়েসে প্রেমে পরলেন নাকি? একমাত্র মিশ্রজির সাথেই প্রভু খেরার হাসি মস্করার সম্পর্ক। তিনি হেসে বললেন কেন নিজে ভাবীর প্রেমে ডুবে আছেন বলে সবাইকে প্রেমে পড়তে দেখছেন। কিছুক্ষণ হাসি মস্করার পর প্রভু খেরা তার আচনাকামার যাওয়ার কথা আর লামনি গ্রাম, মিরন, এই সবের কথা বললেন আর বললেন কেন জানি কিসের আকর্ষণে বারবার তার লামনিতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। দিগম্বর মিশ্র বহুদিন থেকে প্রভু খেরাকে চিনতেন, কম কথার কাজের মানুষ, তার মতো সাচ্ছা ভালো মানুষ তিনি খুব একটা দেখেন নি, প্রভুজিকে খুব ভালোবাসতেন তিনি।
আজ ঠাট্টা করে বললেন শেষে আপনি জংলীদের খপ্পরে পড়লেন! প্রভু খেরা তার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন জংলী! আমার তো মনে হল ওরা আমাদের থেকে বেশি সভ্য। ওটাতো প্রকৃতি ও জঙ্গল নির্ভর একটা আলাদা সভ্যতা, ওরা জানে কেমন করে ঘন জঙ্গলে গাছপালা অন্য জন্তু জানোয়ারদের সাথে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে হয়। অন্যকে শোষণ করে পরজীবী হয়ে বাঁচার কোন বাসনা কারোর নেই, কাউকে কিছু প্রমাণ করতে চায় না, ওরা জানে নিজের মতো বাঁচতে, কারুর রাজা হবার বাসনা নেই, কাউকে কেউ ছোট করতে চায়না, ওখানে মানুষতো অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভর। আমরা ওদের কোণঠাসা করছি ওদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
সব শুনে মিশ্রজি বললেন বেশ তো সামনের গরমের ছুটিতে চলে যান সেখানে, বিলাসপুরে তো আমাদের পৈত্রিক বাড়ি, ওখানে গিয়ে থাকুন আর ওখান থেকে তো আচানাকমার কাছেই। প্রভু খেরা অবাক, বললেন তাই নাকি আপনারা বিলাসপুরের লোক। মিশ্রজি বললেন হাঁ আমার বাবা অনেক আগে বিলাসপুর থেকে দিল্লি চলে আসেন, সেই বাড়িতে এক সময় আমার চাচা থাকত, তিনি মারা যাবার পর এখন তো তালা দেওয়া আছে, আমারা মাঝে মাঝে ছুটিতে যাই। প্রভু খেরা ভাবলেন মন্দ হয় না, একা একা লামনিতে মাহাতুদের সঙ্গে বেশ সময় কেটে যাবে। এমনিতেই তার দিল্লি ভাল লাগে না, ছুটির সময় দিল্লিতে তার খুব একটা করার কিছু থাকে না, বেশিরভাগ সময় লাইব্রেরিতেই কাটান। এই কিছুদিন বাইগাদের নিয়ে ভেরিয়ার এলুইনের বাইগা পড়ে তার লামণিতে ফিরতে আরো ইচ্ছা করছিল। দুই বন্ধু হাসতে হাসতে হাঁটতে লাগলেন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে কলেজের লনের সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে।
***
কয়েক সেট পাজামা পাঞ্জাবি, নিজের ওষুধ আর দরকারি ব্যাক্তিগত ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গরমের ছুটিতে তিনি বিলাসপুরে মিশ্রজিদের পৈত্রিক বাড়িতে। কেয়ারটেকারকে আগে থেকেই খবর দেওয়া ছিল, কাজেই যত্ন আত্তির কোন কমতি ছিল না। বিলাসপুর দিল্লির থেকে অনেক শান্ত শহর, গরম কিন্তু দিল্লির মতোই। তিনি এসে বাসের খোঁজ নিয়ে লামনির উদ্দেশে সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলেন, ফিরবেন সেই বিকালে।
লামনি বাস স্টপে নামতেই অনেকে তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে কথা বলল। তিনি মাহাতুদের পাড়ার দিকে এগোতেই ‘দিল্লিবালে বাবা, দিল্লিবালে বাবা” বলতে বলতে কোথা থেকে এক ঝাঁক ছোট ছোট বাচ্ছার সঙ্গে দৌড়ে এসে মিরন তার হাত ধরল। তিনি পকেটের সব লজেন্স বাচ্ছাদের বিলিয়ে দিলেন, সবাই খুব খুশি। সেই আগের মতোই আছে, ছেঁড়া প্যান্ট আর ফ্রক পড়া একদল বাচ্ছা ছেলে মেয়ে তার সাথে হাঁটতে লাগল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। এবার তিনি তৈরি হয়ে এসেছেন সুতো আর সূঁচ নিয়ে। ঠিক করেছেন বাচ্ছাগুলোর ছেঁড়া জামাকাপড় যতটা পারেন সেলাই করে দিয়ে যাবেন।
মাহাতুর বাড়িতে গিয়ে দেখেন উঠোনে বেশ কয়েকজন গোল করে বসে আছে। খুব আস্তে আস্তে কিছু একটা বিষয়ে গভীর আলোচনা চলছিল। সবারই মুখে চোখে এক ধরনের হতাশা, তাকে দেখে সবাই উঠে পড়তে লাগল। তিনি একটু অবাক হলেন কারণ এরা সাধারণত অহেতুক কোন ব্যাপারে কষ্ট পায় না। এমনিতে বাইগারা খুব কম কথার লোক, হঠাৎ কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক নয় বলে তিনি চুপ করে থাকলেন। তিরনি আর জগন এসে হাসি মুখে তার সাথে কথা বলতে লাগল, যেন কত আপন। উঠোনে দু এক জন হতাশ হয়ে বসে থাকল আর বাকিরা আসতে আসতে বেরিয়ে গেল। একটু ফাঁকা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন সব ঠিক আছে কিনা।
মাহাতু খুব অসহায় ভাবে যা বলল তার মানে দাঁড়ায়, ছয় মাস আগে বন বিভাগের পাহারাদার তাদের গ্রামের যমুনাপ্রসাদ, মাহাতু আর সব বাইগাদের লামনির পাশের জঙ্গলের ভিতর রাজকেলার বাঁধ কাটার কাজ করতে বলে, বন দপ্তর ১০০ টাকা হিসাবে দিন মজুরি দেবে। সেই শুনে বাইগারা ছেলে মেয়ে সবাই বাঁধ তৈরির কাজে লেগে গিয়েছিল সব ছেড়ে। লামনির প্রায় ৩০ জন মেয়ে মরদ মিলে ৩ মাস ধরে জঙ্গলের মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করে। যমুনাপ্রসাদ প্রথম দিকে খুব অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল তাতে ওদের চলে গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর কোন টাকা দেয়নি, এই দেবো দেবো করে। তারপর কাজ শেষ হওয়ার ছয় মাস পরেও তাদের বাকি টাকা তারা পায়নি। যমুনাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলে সে প্রথমে বলছিল সরকারি পয়সা আসতে দেরি হচ্ছে, টাকা এলেই বিট অফিসার দিয়ে দেবে। এদিকে বিট অফিসার রামজীবন পাঁড়ে নাকি মাস খানেক হ’ল অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে গেছে। এখন যমুনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলছে আমি কি করব? বিট অফিসার নাকি সব নিয়ে চলে গেছে।
এদিকে যমুনাপ্রসাদের কথায় তারা বাঁধের কাজ করতে গিয়ে, গত বর্ষায় তারা নিজেদের চাষও করতে পারেনি। তাদের ঘরে আনাজ বাড়ন্ত, মেয়েরা যেটুকু কোদো কুটকি, কন্দ জঙ্গল থেকে নিয়ে আসে তাতে এই খরার মাস আর চলে না। প্রভুজি লক্ষ করলেন কথা বলার মধ্যে মধ্যে কোন আক্রোশ বা হিংসা নেই। তিনি হিসাব করে দেখলেন প্রায় নব্বই হাজার টাকা, যার মধ্যে হয়ত এরা সাকুল্যে পেয়েছে দশ হাজার, ভালো করে ওরা জানেও না কত টাকা পাবে। এদের কাছে হাজার টাকাই অনেক টাকা অথচ তারা যমুনাপ্রসাদকে মারধর করতে যাচ্ছে না বা বন দপ্তর ঘেরাও করছে না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন মাহাতুকে তাহলে কি হবে? মাহাতু বলল কি আর হবে! টাকাটা না দিলে কি করব!
রাত্রে বিলাসপুর ফিরে তার নিজেরও খুব অসহায় লাগছিল। এই মানুষগুলো নিজের মতো আছে তাদের জঙ্গলে তাদের জীবনে। এদেরকে এই ভাবে ঠকানোর কি মানে। তার হঠাৎ মনে হল তিনি কি কিছু করতে পারেন না! পরের দিন লামনি গিয়ে তিনি মাহাতুকে সঙ্গে করে নিয়ে যমুনাপ্রসাদের বাড়ি যান। তাকে মাহাতুর সঙ্গে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। সে বলে পাঁড়েসাহেব তাকে ভয় দেখিয়ে বাইগাদের দিয়ে এই বাঁধ তৈরি করতে বলেছিল। পয়সা দেওয়ার সময় সব পয়সা নিয়ে অন্য জায়গায় বদলি নিয়ে চলে গেছে। গ্রামে এখন তার মুখ দেখানো ভার হয়ে গেছে।
প্রফেসার খেরা বুঝলেন যমুনাপ্রসাদ অনেকটা সত্যি বললেও পুরো সত্যি বলেনি, বিট অফিসার যমুনাপ্রসাদকে অল্প কিছু দিয়ে বাকিটা নিয়ে সরে পড়ছে। তিনি ঠিক করলেন যেমন করেই হোক এর একটা বিহিত করতে হবে। তিনি যমুনাপ্রসাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন বন দপ্তরের এদিককার হেড অফিস বিলাসপুরে। তিনি এমনিতে নরম মানুষ, আজ কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে যমুনাপ্রসাদকে বললেন, বন দপ্তরের ওপরমহলে বিট অফিসারের কথা জানিয়ে এদের টাকার ব্যবস্থা করতে, তিনি আবার ফিরে আসবেন। তিনি ঠিক করলেন সেখানে নিজে যাবেন কথা বলতে। মাহাতু অবাক হয়ে তার আর যমুনাপ্রসাদের কথা শুনছিল, দেখে বুঝেছিল যমুনাপ্রসাদ খুব ভয় পেয়েছে।
ফেরার পথে আরো কয়েকজন গ্রামবাসী জড়ো হ’ল, তাদের কথায় বারবার দিল্লিবালে বাবা শুনে তিনি বুঝতে পারছিলেন তারা তাকে নিয়ে কথা বলছে। মাহাতুকে বলে গেলেন কাল আবার তিনি আসবেন। মাহাতুরা অবাক, এরকম তারা কখনো দেখেনি যে তাদের হকের জন্য কেউ বন দপ্তরের সঙ্গে কথা বলছে। বিলাসপুর ফিরে তিনি ফোন করলেন মিশ্রজিকে, তাকে জানানো প্রথম প্রয়োজন। তিনি সব শুনে বললেন আপনি বাইরের লোক, বিলাসপুরে নতুন, এর মধ্যে জড়াবেন না, আপনার বিপদ হতে পারে। প্রভুদত্ত খেরা অনড়, তিনি নিজে কিছু ব্যবস্থা করবেনই, তার এই দৃঢ়তা দেখে, মিশ্রজি প্রভুজির জন্য ভয় পেলেন, বললেন দাঁড়ান আমাকে একটু খবর নিতে দিন তার আগে আপনি কিছু করবেন না। প্রভুজি মনে মনে ঠিক করলেন কাল গিয়ে গ্রামে যারা কাজ করেছে তাদের দিয়ে একটা দরখাস্ত তৈরি করে দেখা করবেন বন দপ্তরের বিলাসপুর অফিসের প্রধানের সঙ্গে, দরকার হলে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে।
পরের দিন সকালে গেলেন মাহাতুর বাড়ি, গিয়ে দেখেন তার উঠোনে অনেক মেয়ে আর মরদ জড়ো হয়েছে। একজন বলল দিল্লিবালে বাবা এসে গেছে, দৌড়ে মিরন ভিড়ের মধ্যে থেকে এসে তার হাত ধরল। তিনি খাটিয়ায় বসতেই সবাই তার দিকে তাকিয়ে, সেইসব সরল চোখের দৃষ্টিতে রয়েছে বিস্ময় মিশ্রিত আশা। যা ছিল তাদের জীবনের অনেক কিছু মেনে নেবার মতো সেখানে এই অপ্রত্যাশিত আশার আলোয় তারা ভাসছে। সবাই চুপ, প্রফেসার খেরার এবার এই সব দৃষ্টির সামনে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। নিজেকে সামলে কাঁধের ঝোলা থেকে পেন আর কাগজ বের করে দরখাস্ত লিখতে শুরু করলেন। সেই দরখাস্তর শেষে কোনো বাইগার সই পেলেন না সব টিপছাপ, বুঝলেন বাইগাদের সবাই নিরক্ষর, কাছে পিঠে কোন স্কুলই নেই। তাই এত সহজে নিজেদের তৈরি নিয়মে এর বাইরের মানুষদের বেঁধে ফেলা এক অদৃশ্য নিয়মের জালে।
শুরু হল এক অদ্ভুত যুদ্ধ এটা ঠিক বাইগাদের অধিকারের লড়াই নয়, তাদের জীবনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্রষ্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতর থেকে তাদেরই নিয়মের খেলায় ন্যায়বিচার পাবার লড়াই। মিশ্রজি দিল্লী থেকে জানালেন তার একজন আত্মীয় আছেন বিলাসপুরের সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ, তিনি তাকে বলে রেখেছেন। প্রভুজি যেন তার সঙ্গে দেখা করেন। এস পি, ডঃ প্রভু খেরার হিন্দু কলেজের পরিচয় আগেই মিশ্রজির কাছে পেয়েছিলেন, তিনি চাননি আদিবাসীদের ব্যাপারটা দিল্লি পর্যন্ত গড়াক। পরের দিন তিনি পুরো ব্যাপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে প্রভুজির দরখাস্তটা দেখেন। তারপর সোজা ফোন করে বিলাসপুরে তার পরিচিত বন দপ্তরের উচ্চ পদস্থ অধিকর্তাকে পুরো ব্যপারটার গুরুত্ব বুজিয়ে বলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাইগাদের পয়সা দিয়ে দেবার উপর জোর দেন। বিলাসপুরের বন দপ্তরের উপরমহলে এই ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না, তাদের উদ্যোগে খুব দ্রুত বিষয়টার সমাধান হতে থাকে।
এর মধ্যে প্রভুজি বা লামনির দিল্লিবালে বাবা প্রতিদিনই লামনি যেতে থাকেন আর প্রতিদিন একটা করে বাচ্ছার জামা সেলাই করে দিতেন কোন গাছের নীচে বসে। তখন তাকে ঘিরে একদল বাইগা ছেলেমেয়ে তার কাজ দেখত আর হাসত। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ফর্সা লম্বা পাঞ্জাবি পাজামা পড়া বয়স্ক মানুষ শাল গাছের নীচে বাচ্ছাদের মাঝে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে জামা সেলাই করছে। এরকম একদিন মাহাতুর সঙ্গে গ্রামের সবাই দল বেঁধে তার কাছে আসে, সবার সামনে যমুন প্রসাদ। সে খবর দিল কাল বাইগাদের সব টাকা বন দপ্তরের লামনি অফিস থেকে দেওয়া হবে। সে ভীষণ ভয়ে আছে, সে খবর পেয়েছে দিল্লিবালে বাবার কেবল বিলাসপুর নয় ভোপাল এমনকি দিল্লিতেও অনেক বড় বড় লোক বন্ধু। এদিকে তাকে ঘিরে মাহাতুর সঙ্গে গ্রামের মেয়ে মরদ মাঠের মাঝে বসে গল্প জমায়। সবার মধ্যে বড় নিশ্চিন্ত এক অনুভুতি।
কাল তাকে ফিরতে হবে দিল্লি, কিন্তু এ সমস্যা কোন এক সমস্যা নয়। তিনি অনুভব করছিলেন যে এই নিরক্ষর আদিম জনজাতির সামনে আরো অনেক বড় সমস্যা এগিয়ে আসছে। একবার অভয়ারণ্য হয়ে গেলে এরা নিজের দেশেই গৃহহীন বাস্তুহারা হবে।
***
হিন্দু কলেজের বড় প্রেক্ষাগৃহ আজ ভর্তি, সমাজ বিজ্ঞানের ও কলা বিভাগের ছাত্র ও শিক্ষকরা বসে আছে, অন্য বিভাগের কিছু ছাত্রও আছে এ ছাড়াও অন্য কলেজের ছাত্ররাও আজকের এই বক্তৃতা শুনতে এসেছে। বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসার বিদ্যুল্লেখা শ্রীনিভাসন ডায়াসে তখন তার সুন্দর দৃঢ় গলায় বোঝাচ্চিলেন রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে উত্তর আধুনিক সময়ে নৃতত্বে জাতিতত্ত্বের গুরুত্ব নিয়ে। সাধারণত তাঁর মতো জ্ঞানী খ্যাতনামা মনীষাকে কলেজের ছাত্ররা তাদের মধ্যে পায় না। আজ তাই হিন্দু কলেজের পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের শ্রোতামণ্ডলী মুগ্ধ হয়ে তাঁর সহজ ভাষায় জটিল বিষয়ের বিশ্লেষণ শুনছিল। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর আলোচনা পূর্ব ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে এসে শেষ করলেন তখন হিন্দু কলেজের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল।
আজ কয়েক বছর ধরেই হিন্দু কলেজে প্রভু স্যার, মানে অধ্যাপক প্রভুদত্ত খেরার উদ্যোগে সামাজিক নৃতত্ত্ব বিভাগে এই লেকচার সিরিজ চলছে। এই সিরিজে প্রতি মাসে সমাজ বিজ্ঞানের কোন না কোন শাখার বিশিষ্ট জ্ঞানী, গবেষক ব্যক্তিদের আমন্ত্রনি বক্তৃতা এগুলি। এই লেকচারের প্রতি শুধুমাত্র ছাত্রদের মধ্যেই নয় অনেক শিক্ষকদের মধ্যেও বেশ উৎসাহ দেখা যায়, সাধারণত এই ধরনের জ্ঞানী ও পণ্ডিত মানুষদের ছাত্ররা সচরাচর কলেজের গণ্ডীতে দেখে না। ছাত্রদের মধ্যে বসে দীর্ঘদেহী প্রভু খেরা মন দিয়ে লেকচার শুনছিলেন। আজকাল তিনি খুব মন দিয়ে কিছু খোঁজার আর বোঝার চেষ্টা করেন। সব বিষয়ই যেন এক বিশেষ সমজাতীয় সংস্কৃতি, সমাজ ও জাতির দ্বারা তাদের জন্য তৈরি, যারা নিজেদেরই মুলধারা নামে প্রতিষ্ঠা করেছে। যারা এদের বাইরে, তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকেও দেখা হচ্ছে সেই একই মূলধারার লেন্স দিয়ে।
প্রশ্ন-উত্তরের সময় কয়েকটা প্রশ্ন শেষ হলে, প্রভু স্যার হাত তুলে জিজ্ঞাসা করলেন; যে সব আদিবাসী সমাজে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ভোগ এবং উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির কোন নিয়মই মানে না, যারা আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন দক্ষতা অর্জন করে নি, সেই সব সমাজে বর্তমান উত্তর আধুনিক সময়ে কি ধরনের পরিবর্তন আসবে? তাদের ভবিষ্যৎই বা কি? বিদ্দ্যুলেখা দেবী মন দিয়ে প্রশ্নটি শুনে একটু ভাবলেন, আদিবাসী সমাজ জীবন তার গবেষণার বিষয়ের থেকে কিছুটা দুরের। তিনি জানেন হিন্দু কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার হলেও প্রভু খেরার সামাজিক নৃতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষ করে মধ্যভারতের আদিবাসী সমাজ জীবন সম্পর্কে জ্ঞান, আভিজ্ঞতা ও কাজ শিক্ষাবিদ মহলে বহু আলচিত বিষয়।
তিনি কৌতূহলের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে এমন কোন আদিবাসী সমাজ কি আছে যে এখনো ভারতবর্ষের বর্তমান বৃহত্তর বাজার অর্থনীতির বাইরে? বেশিরভাগ আদিবাসীই তো চাষ আবাদের কাজের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর অর্থনীতির অংশ। প্রফেসার খেরা একটু চুপ করে থেকে বললেন ভারতবর্ষে এখনো কিছু আদিবাসী আদিম জনগোষ্ঠী, মূলত হান্টার-গেদারারস আছে যাদের কাছে এই রাষ্ট্রের উপস্থিতি তাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিবন্ধী, আর তারা যেহেতু এই পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার বাইরে তাই রাষ্ট্রের চোখেও তাদের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এদের উৎপাদন ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ, গোষ্ঠীর সকল সদস্যর প্রয়োজন মেটানোর জন্য স্বয়ম্ভর, যাদের সমাজ জীবনে বাজার বা রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নেই, তাদের কি হবে? তাদের সমাজের বাইরের পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন জোর করে তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে, তখন তাদের কি হবে? তারা কি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা ও স্বয়ম্ভর জীবনযাত্রা হারিয়ে ফেলবে না? তাদের জীবিকা ও জীবনযাপন কি গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে না? এবং সবশেষে সেই জনগোষ্ঠীর পরিণাম কি হবে?
প্রফেসার শ্রীনিভাসন চিন্তিত স্বরে বললেন বলা মুশকিল। দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার এরকম বহু জনজাতি হারিয়ে গেছে। একবার তাঁর নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থার জ্ঞান ও দক্ষতা নষ্ট হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব। এর সঙ্গে সেই জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন নতুন ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে গেলে তাঁর পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থায় ফেরার তাগিদও শেষ হয়ে যায়। এরা হয়ত তাদের অন্য জনজাতি হিসাবে যে সাংস্কৃতিক পরিচিতি তা হারাবে। তাঁর কথা শেষ হতেই আরো নানা তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ সংক্রান্ত মেধাবী আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর চলতে থাকে।
মাথা নামিয়ে ছাত্রদের মধ্যে বসে প্রভু স্যার মাথা নিচু করে চিন্তিত মুখে কিছু ভাবতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কানে লেকচার হলের আওয়াজ জঙ্গলের ঝিঁঝিঁর আওয়াজের মতো বাজতে লাগলো, শাল জঙ্গলের বড় বড় শাল গাছের মধ্যে হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সড় সড় করে শুকনো শাল পাতারা অল্প উড়ে উড়ে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। হটাত তাঁর চোখে পড়ল জঙ্গলের বড় শাল গাছের গুঁড়ির পাশ থেকে এক বালক অবাক চোখে তাকে দেখছে, চোখে কোন ভয় নেই কৌতূহল ভরা হাসির ছোঁয়া। তিনি থমকে দাঁড়ালেন হাসি হাসি মুখে বালকটির দিকে তাকিয়ে, এই জঙ্গলে তো বাঘের উপস্থিতির কথা খেয়াল হতেই ভয়ের শিহরণ তাকে ছুয়ে যায়, আর তখনই তার সম্বিত ফিরল সমীরার ডাকে, ‘স্যার লেকচার শেষ হয়ে গেছে, আপনাকে ভোট অফ থাঙ্কস দিতে যেতে হবে’। ছাত্রদের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসার প্রভু দত্ত খেরা।
***
রাতে ঘরে ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবলেন তার এখানে আর প্রয়োজন নেই, কোনদিনই কি ছিল! তিনি তার নিজের প্রয়োজনে হিন্দু কলেজে আসেন, তিনি যখন চলে যাবেন তখন আর কেউ আসবে কিন্তু আচানকমারের মিরনদের কি হবে? এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক নিরক্ষর আদিম জনজাতির শিশুর ভবিষ্যৎ কি? সরকারের কাছে এই প্রান্তিক আদিম জনজাতি কিছু সংখ্যা আর তথ্য ছাড়া কিছু নয়। তাকে ফিরে যেতে হবে সবার আগে বাইগাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা আগামীর বড় সমস্যার জন্য কিছুটা তৈরি হতে পারে। তাকে ফিরে যেতে হবে লামনিতে, বাইগা হয়ে বাস করতে হবে সেখানে, তাহলে বাইরের মূলধারার রাষ্ট্রীয় বিপদ কিছুটা হলেও সংযত হবে।
জীবনের পরবর্তী তিরিশ বছর ডঃ প্রভু দত্ত খেরা হয়ে গেলেন আচানাকমারের দিল্লিবালে বাবায়। বসবাস শুরু করলেন লামনিতে বাইগাদের মতো করে, কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু করলেন ছাপরাওয়ার বাইগাদের স্কুল।
(ডঃ প্রভু দত্ত খেরার জীবনী অবলম্বনে লেখা এক কাল্পনিক কাহিনী। ডঃ খেরা ১৯২৮ শালে লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৯ সালে, একানব্বই বছর বয়েসে দেহত্যাগ করেন, আমরণ বাইগাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে। ছাপরাওয়ায় তার তৈরি স্কুল এখনো নানা অসুবিধার মধ্যেও ঐ অঞ্চলের বাইগা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন করে চলেছে।)
তথ্য সুত্র:
১) The Baiga and the Sal Forest: P D Khera
২) The Baiga, Verrier Elwin
৩) Itineraries of a Reclusive, College Teacher: P.D. Khera (1928–2019: Vinay Kumar Srivastava
Director Anthropological Survey of India
৪) villagers Interview during visit to Achanakmar in April 2021
আমি মন দিয়ে কবিতা পড়ছি বছর পনেরো। লেখার চেষ্টা করছি বারো বা তেরো বছর ধরে। এই স্বল্প সময়ে একটা কথা আমার প্রায়শই মনে হয়েছে, কবিতার অনেকগুলো পথ, কিন্তু কোনোটাই শর্টকাট নয়। এই দীর্ঘ পথগুলো একেকটা একেক ধরণের। কেউ রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ হয়ে শক্তি ধরে জয়, কেউ হয়তো জয় থেকে শক্তি হয়ে বিনয় হয়ে উৎপল হয়ে স্বদেশ, কেউ হয়তো জীবনানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে সমর সেন হয়ে উৎপল হয়ে ফাল্গুনী। কবিদের নামগুলো এখানে নাম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বলাই বাহুল্য। তাদের গুরুত্ব কবিতার ধরণ বোঝাতে ব্যবহৃত। যাত্রার কোন দশায়, কার কেমন কবিতা ভালো লেগেছে, এই আর কী। এখানে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জার্নিতে, একই স্টেশনে সবার ট্রেন কিন্তু সমান সময় থামে না। কেউ অল্প আবিষ্কারে মুগ্ধতা হারিয়ে সরে যায় তার শাশ্বত খোঁজে, কেউ তন্ন তন্ন করে পাঠ করে নেয় হয়তো সেই স্টেশনেই। কারণ সে মজেছে ওই পাঠে। এর মধ্যে ভুল নেই, বোধ এবং রুচির ওপর নির্ভর করে পথ নির্ধারিত হয় প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকার ক্ষেত্রে। কিন্তু এত শব্দের অবতারণা করছি কেন? এবার খুব সন্তর্পণে, ধীরে সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষত্রে, খানিক আশ্চর্যজনক হলেও, বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩, মালাগা, স্পেন) সারা জীবনে বলা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন উক্তির সাহায্যে আমরা একেকটা গোপন অংশে চোখ রাখার চেষ্টা করব। না, চিত্রশিল্পের চৌহদ্দিতে নয়, কবিতায়।
১।
"Learn the rules like a pro, so you can break them like an artist."
হ্যাঁ, ছন্দ ছাড়াও কবিতা হয়। তার জন্য ছন্দ জানার প্রয়োজন পড়েই, এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না। কিন্তু তবু এই ওপরের অদ্ভুত বাক্য পড়লে মনে হয়, ছন্দ যে সম্যক জানে, তার পক্ষে ছন্দ ধ্বংস করা যে উপায়ে সম্ভব, কোনো ছন্দজ্ঞানহীনের পক্ষে তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর উপায় থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। আমাদের চারপাশে কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে খুব সাধারণ একটা ঘটনা ঘটে। বিপজ্জনক ঘটনা। ছন্দের রীতি না জেনে ছন্দের কবিতা পাঠ এবং সেই কবিতা বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ মতামত প্রকাশ। এই পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরে মানুষ এই সমস্ত মতামতকে ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিতে শুরু করে। দ্যুতির জাহির নকল মণি থেকে হলে চোখের আর দোষ কী! এবং ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমরা খুঁজে পেলাম বাংলা কবিতার সেই অদ্বিতীয় চরিত্রকে, যা আমাদের কখনোই ছেড়ে যাবে না এই সামগ্রিক আলোচনায়। ধাপ্পাবাজি। না আরও নিখাদ করে বলা প্রয়োজন, ভাঁওতাবাজি।
২।
ক) "This idea of art for art’s sake is a hoax"
খ) "There is no abstract art. You must always start with something. Afterward you can remove all traces of reality."
প্রথম ঘোষণাটি পড়ে যে অবধারিত বিরোধিতা জেগে উঠতে পারে, তার সবচেয়ে নিখুঁত উত্তর ঘোষিত হয়েছে দ্বিতীয় উক্তিটিতে। স্বভাবতই এই দুটি উক্তিকে একত্রে দেওয়া অপরিহার্য ছিল। যদিও এই দুটি উক্তিরই পৃথকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে তর্কের পরিসরে।
দ্বিতীয় উক্তিটি অনুযায়ী বলা যায়, কিছুই বিমূর্ত নয় প্রাথমিক সজ্জায়। নিরাকার থেকে আকারের দিকে নয় শিল্পের যাত্রা। তার উৎস আকারাশ্রিত এবং অন্তিমে সে নিরাকার হয়ে উঠতে পারে। বা বলা ভালো, নিরাকার হয়ে ওঠা উচিত। এ সম্পর্কে সংশয় থাকতে পারে, তবুও গ্রহণযোগ্য সত্য এই, অন্তত যুক্তির বিচারে।
বাংলা কবিতায় এই মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রচলন কীসের? এই বিমূর্ত ধারার অপব্যবহারের। অল্পবয়সে অনেক পাঠিকা/পাঠক/কবি যেমন ছন্দের চলনের কারণে অন্তঃসারশূন্য কবিতার প্রতি ক্রমাগত টান অনুভব করে চলেন, তেমনই অনেকেই ঝুঁকে পড়েন ফাঁকা অর্থহীন চাতুরী বোঝাই কবিতার প্রতি, শুধুমাত্র সমান্তরাল চর্চার তকমা লাভের নেশায়। হ্যাঁ, মেইন স্ট্রীম এবং প্যারালাল ধারা (এই শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আমি তর্কের পরিসরে যাবার প্রয়োজনবোধ করলাম না এখন, কারণ সেক্ষেত্রে আসল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যেতে হবে), এই দু’দেশেই অসংখ্য ভালো কবিতা রচিত হয়েছে বাংলাভাষায়, কিন্তু ছন্দের ডুগডুগি এবং নকল আধুনিকতার তাবিজে নষ্টও হয়েছে বহু পাঠক/পাঠিকার সময়, কবির সদিচ্ছা, সততা। আর ঠিক এখানেই, আবারও ফিরে এলেন সেই সম্রাট, আমাদের আলোচনায় যার স্থান সবার ওপরে, যিনি এতই অসৎ এবং এতই ধূর্ত, যে, তাকে ছাড়া বাংলা কবিতা, অন্তত বাজারে যা চলছে, তা অচল। তিনি অদ্বিতীয় ভাঁওতাবাজি।
৩।
ক) "Inspiration exists, but it has to find you working."
খ) "I am always doing that which I cannot do, in order that I may learn how to do it."
লেখা আসছে না। যারা, যারাই অল্পস্বল্প কবিতা লেখার চেষ্টা খুব গুরুত্ব দিয়ে করেছেন, তাদের প্রায় সকলেরই এরকম সময় এসেছে কখনো। কিন্তু কে বা কী আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেয়? এই বিষয়ে বেশি কথা বলা অর্থহীন, কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে, ন্যাকামি তার সর্বোচ্চ শিখরে এসেছে এই প্রসঙ্গের হাত ধরে। “না লিখে থাকতে পারি না”, “দৈববাণীর মতো এল এই লাইনগুলো, আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল”, “লেখা পায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে দ্বিতীয় বক্তব্যটি কিন্তু আংশিক হলেও সত্য। এই প্রসঙ্গে এক ভদ্রলোকের একটা উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারছি না।
-“I decided that it was not wisdom that enabled poets to write their poetry, but a kind of instinct or inspiration, such as you find in seers and prophets who deliver all their sublime messages without knowing in the least what they mean.” (সক্রেটেস, ৪৭০-৩৯৯ খ্রীঃপূঃ)
এই সর্বশেষ উক্তিটি ওপরের দু’খানা উক্তির মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তা তুলনাহীন! আলোচনার ঠিক এই পর্যায়ে, পিকাসোর আরও একটি কথা মনে পড়ে যায়, "Everything you can imagine is real." তাই লেখার বাধা সাময়িক, তাকে দূর করতে অসুবিধে হবে না, যদি নিজের মধ্যে চিন্তাকে স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার দিতে বাধা না থাকে। যদিও এর ফল সামাজিক দিক থেকে খুব একটা সুবিধেজনক নয়। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনি আপনার কল্পনাকে সৎভাবে লেখাতে নামিয়ে আনছেন কি না! নতুবা আবার সেই ধাপ্পার কবলে ফেলবেন। পড়বেন না? তাই হয়?
৪।
ক) "The meaning of life is to find your gift. The purpose of life is to give it away."
খ) "If I don't have red, I use blue."
এই দু’খানা উক্তির আপাত সম্পর্ক হয়তো কিছু নেই। কিন্তু কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এদের একত্রে রাখাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে আমার। আসল কথা হল এই, যে, আমি যা বলতে চাই তা আমি বলব, বাধার তোয়াক্কা না করেই। আবার একই সঙ্গে, এই কথাও গুরুত্বপূর্ণ, ত্যাগের মাধুর্য এবং আবশ্যিকতা উপলব্ধি করা যাচ্ছে কি না! দুঃখের কবিতাও স্বরবৃত্তে লেখা যায়, অক্ষরবৃত্তকে ছেড়ে এসে। সত্যি বলতে পারছেন কি না, সেটুকুই গুরুত্বপূর্ণ! নইলে আপনার প্রবোধচন্দ্র বা নীরেন্দ্রনাথ বা শঙ্খ ঘোষ বা রবীন্দ্রনাথ, সকলই বৃথা যাবে, বলাই বাহুল্য! আর গদ্য ছন্দে ভণ্ডামি তো ক্লাসিকের পর্যায়ে পৌঁছেছে! সে কথায় এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না।
৫।
"Art is the lie that enables us to realize the truth."
এই যে সত্যি বলার কথা বললাম, আর তারপরেই এই উদ্ধৃতি, আশ্চর্য নয়?
না, একেবারেই নয়। বরং এ কথাই সেই আশ্চর্য, যা সত্যের গুরুত্বকে শিল্পের জন্য অপরিহার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লেখা সমস্ত ভান, মিথ্যে সার্থক, যদি তা পাঠিকা/পাঠককে পৌঁছে দিতে পারে তার গন্তব্যে। যেখানে সহজে এগোনো যায় না, যেখানে সহজে পিঠ চাপড়ে দেওয়া যায় না, যেখানে সহজে অস্বীকার করা যায় না। পাণ্ডিত্য ফলানো প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে চললেও চলতে পারে, কবিতা তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, অতীতেও দিয়েছে। ভবিষ্যতেও রেয়াৎ করবে না। বুদ্ধদেব বসু আর জীবনানন্দকে দেখলেই ধারণা আসবে কিছুটা।
৬।
ক) "Without great solitude no serious work is possible."
খ) "The chief enemy of creativity is good sense."
অমোঘ সত্যের দুই বাণী! অপব্যবহারেরও শীর্ষে এই দুই বাণী!
অতি উত্তম এবং অতি অধম দুজনেই নিজেকে উৎকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত করে থাকে আমাদের সমাজে। অতএব, ‘গুড সেন্স’-এর অনুপস্থিতি যে সন্দেহজনক হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কী! তবে তার চেয়েও বেশি আশ্চর্যের এই, যে, কিছু মানুষ বিন্দুমাত্র একাকীত্বে না ভুগেই নামিয়ে চলেছেন ডিপ্রেশনের কড়চা, একা থাকার ক্র্যাশ কোর্স ইত্যাদি। কবিতা সেই মানুষের কাছে সহজে আসে, যে স্বভাবত উৎকেন্দ্রিক। আরোপে উৎকেন্দ্রিকতা নিয়ে এলে, তার ফল যে ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে কথা আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই এত ভণ্ডামির আশ্রয়। তাই এত ফেরেব্বাজি। কিম কি দুক, গোদার দেখলেই জাতে উঠবেন, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা; আত্মস্থ না করতে পারলে ষোলো আনাই কিন্তু মাটি! কাজেই ট্রেণ্ড দেখে জাতে ওঠা খুবই বিপজ্জনক, বলাই বাহুল্য। এবং তার ভিত্তিতে মত প্রকাশ করা, খুন করারই সমতুল্য। কবিতা নিজেই সুন্দর, লিখতে পারলে আপনি বোঝা যায়, তার জন্য আলাদা ধার করা জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না, চর্চার প্রয়োজন পড়ে।
৭) "Good artists copy. Great artists steal."
আলোচনার শেষে এই উক্তিটি রাখতে বাধ্য হয়েছি। কাজেই, আমরা যারা শব্দ টুকছি, তারা বোধে পৌঁছে যাব, এই আশা রাখি। যারা দৃশ্য টুকে নিচ্ছি নির্দ্বিধায়, হাততালিও পাচ্ছি অহরহ, তাদেরও স্বাতন্ত্র্য আসুক। কত পড়েছি তা দিয়ে আর যাই হোক, কবিতা লেখা যে হয় না, এর উদাহরণ অজস্র। আপনার প্রবন্ধ অতুলনীয় হতে পারে, আপনার গদ্যের হাত সোনায় মোড়া হতে পারে, কিন্তু কবিতার জন্য আপনার বোধ প্রয়োজন।
অন্যথায়, সকলই কথার ধাঁধা হয়ে থেকে যাবে দুর্ভাগ্যবশত!
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
শেষ পর্ব
জাতীয়তাবাদ থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বেশির ভাগ কথা আগের পর্বেই বলা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে কথা একবার শুরু করলে সহজে শেষ হয় না। কি তাঁর ব্যক্তিগত কর্মময় ও ঝঞ্ঝাময় জীবন, কি তাঁর সমসাময়িক সমাজ, এ সব নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়। এবং একাধিক লেখক লিখেছেনও, যেমন ইন্দ্রমিত্র, বিনয় ঘোষ, অরবিন্দ পোদ্দার, অশোক সেন। কেউ বা গল্পের মত করে, কেউ বা ক্রিটিকাল অ্যানালিসিসের ধারায়। সেসব গল্প এবং ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস এত স্বচ্ছন্দ ও সুন্দর, যে এ লেখায় সেসব কথাই আবার ফিরে বলার কোনো মানে হয় না। অতএব বিদ্যাসাগর সম্পর্কে অন্য দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা তাঁকে এখানেই ছেড়ে যেতে পারি। সে কথাদুটোর প্রথমটা হল, ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র, লাটসাহেব থেকে শুরু করে সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষজনের সঙ্গে যাঁর সাবলীল সম্পর্ক ছিল। দ্বিতীয়, ১৮৭২ সালে তিনি নিজের জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম, কর্মস্থল শহর কোলকাতা সংক্ষেপে গোটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে কর্মাটাঁড়ে থাকতে চললেন। তাঁর এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যে স্বাদেশিকতার ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল তার শেষ হল আর সেই ১৮৭২ সালেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা, যা অচিরে জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক এবং সুপ্তভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের গর্ভগৃহ হয়ে উঠল।
বঙ্কিমচন্দ্র
ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনামূলক তীক্ষ্ণ ও সরস গদ্য লেখার এবং বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণির উপন্যাসের জনক হওয়ার সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের সাহিত্য সম্রাট। এবং সে উপাধি অযৌক্তিকও নয়। যেভাবে তিনি তাল ঠুকে তাঁর অনবদ্য বাংলা ভাষা ও বিচিত্র বিষয়ের মেলবন্ধনে বাংলা সাহিত্যের আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে অবশ্যই ঐ উপাধি তাঁর প্রাপ্য। লেখনির মধ্যে দিয়ে তিনি দেশকে বহু ব্যাপারে আলো দেখাতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার নিয়মিত চর্চার পথিকৃৎ। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোর সমালোচক। তিনি শিক্ষিত উচ্চ সমাজকে গৌরবের গজদন্তমিনার থেকে নেমে এসে এবং সাহেবদের অনুকরণের পথ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনার গহনে যখন যাই, কতকগুলো ব্যাপারে ঘোরতর সংশয় উপস্থিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার দুটি পর্যায়। এই প্রবন্ধে ১৮৬৩-৬৪ থেকে ১৮৮২ সালকে প্রথম পর্যায় এবং ১৮৮২ থেকে ১৮৯২ সালকে দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাবনার মিল আছে অমিলও আছে। প্রথম পর্যায়ের কিছু কিছু ভাবনার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের কিছু কিছু ভাবনার আন্তঃসম্পর্ক আছে। প্রথম পর্যায়ের কিছু ভাবনা দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে, কিছু ভাবনা দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে আরো জমাট বেঁধেছে। আবার এমনও হয়েছে একই প্রবন্ধের মধ্যে নানা বিরুদ্ধ ভাব ও যুক্তির সমাবেশ ঘটেছে। তবু সামগ্রিক বিচারে প্রথম পর্যায়ের বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে পাই অপেক্ষাকৃত লিবারাল খোলামেলা স্থিতধী এক বঙ্কিমচন্দ্রকে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষত তাঁর সৃষ্টির শেষ দশ বছরে যে বঙ্কিমচন্দ্রকে পাই তিনি হয়ে উঠেছেন ভীষণরকম একমুখী, সংকীর্ণ এবং আক্রমণাত্মক।
বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে আগাগোড়া এক দ্বিমুখিতা (ambivalence) কাজ করেছিল। ১৮৬৩-৬৪ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে তিনি তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন, যেগুলি হল যথাক্রমে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৩-৬৪), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) ও ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯)। এর মধ্যে ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটি আমাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই উপন্যাসেই তিনি প্রথম স্পষ্টভাবে ‘হিন্দুরাজ্য’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই হিন্দুরাজ্যই আজকের হিন্দুরাষ্ট্র চাওয়াতে পরিণত হয়েছে।
মৃণালিনীঃ প্রথমেই সে ব্যক্তি আমাকে “মা” বলিয়া বলিল, “আমি তোমাকে মাতৃ-সম্বোধন করিতেছি—আমি তোমার পুত্র, কোন আশঙ্কা করিও না। আমার নাম মাধবাচার্য, আমি হেমচন্দ্রের গুরু। কেবল হেমচন্দ্রের গুরু এমত নহি; ভারতবর্ষের রাজগণের মধ্যে অনেকের সহিত আমার সেই সম্বন্ধ। আমি এখন কোন দৈবকার্যে নিযুক্ত আছি, তাহাতে হেমচন্দ্র আমার প্রধান সহায়; তুমি তাহার প্রধান বিঘ্ন।”
আমি বলিলাম, “আমি বিঘ্ন?” মাধবাচার্য কহিলেন, “তুমিই বিঘ্ন। যবনদিগের জয় করা, হিন্দুরাজ্যের পুনরুদ্ধার করা, সুসাধ্য কর্ম নহে; হেমচন্দ্র ব্যতীত কাহারও সাধ্য নহে; হেমচন্দ্রও অনন্যমনা না হইলে তাঁর দ্বারাও এ কাজ সিদ্ধ হইবে না। যতদিন তোমার সাক্ষাৎলাভ সুলভ থাকিবে, ততদিন হেমচন্দ্রের তুমি ভিন্ন অন্য ব্রত নাই—সুতরাং যবন মারে কে?”
অতঃপর বঙ্গদর্শন পত্রিকা দিয়ে তাঁর সুষ্ঠুভাবে প্রবন্ধ লেখালেখির শুরু। দ্বিমুখিতার উদাহরণ অনেক আছে। আপাতত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা বঙ্গদর্শনের (১৮৭২) তৃতীয় প্রবন্ধ ‘ভারত-কলঙ্ক’ই বেছে নেওয়া যাক, কারণ এই প্রবন্ধে তিনটি পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সমাবেশ আছে। প্রথমটি হল ভারতবর্ষীয়দের রণকুশলতা বিষয়ে। ইংরেজরা যে অহরহ হিন্দুদের Effeminate Hindus বা হীনবল হিন্দু বলে ছোট করত সেটা তাঁর গায়ে লেগেছিল। তাই ঐ শব্দদুটি দিয়েই ‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধের শুরু। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের চতুর্থ সংস্করণের বিজ্ঞাপনে (১৮৯৩) তিনি নিজেই সে কথা বলেছিলেনঃ
‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধে আমি বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি, ভারতবর্ষের অধঃপতনের কারণ কি। হিন্দুদিগের বাহুবলের অভাব সে সকল কারণের মধ্যে নহে। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুদিগের বাহুবলের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। ব্যায়ামের অভাবে মনুষ্যের সর্বাঙ্গ দুর্বল হয়। জাতি সম্বন্ধেও সে কথা খাটে। ইংরেজ সাম্রাজ্যে হিন্দুর বাহুবল লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু তাহার পূর্বে কখনও লুপ্ত হয় নাই। হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণস্বরূপ আমি রাজসিংহকে লইয়াছি।
তিনি জানতেন যুদ্ধই হল পশ্চিমী সভ্যতার বনিয়াদ, প্রাচ্য সভ্যতা, বিশেষত সত্য, অস্তেয়, অহিংসার দেশ ভারতবর্ষের অবস্থান যার একেবারে বিপরীতে, আর তবু তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষীয়রাও যে যথেষ্ট যুদ্ধ করতে জানত, শুধু সেই কথাটা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন। এখানে তিনি পশ্চিমের যোধশক্তির সঙ্গে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের যোধশক্তির সমকক্ষতা প্রদর্শনের চেষ্টা করলেন। এই যে চেষ্টা এ উপনিবেশিকতার শিকার হওয়া ছাড়া আর কী? আজকালকার ভাষায় এ যেন অনেকটা, ইউরোপীয়দের তৈরি করে দেওয়া মাঠেই তিনি খেলতে নামলেন। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অস্ত্রলোলুপতা, তার শেকড় আছে এই ধরনের ধারণায়। এক আলেক্সজান্ডারের যুদ্ধকালের প্রসঙ্গে ছাড়া প্রধানত ঐতিহাসিক, পুরাতাত্ত্বিক ইত্যাদি উপাদানের তৎকালীন অপ্রতুলতার কারণে প্রাচীন ভারতবর্ষের রণকুশলতার উদাহরণ তিনি অবশ্য তেমন দিতে পারেন নি আর মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তিনি প্রধানত আরবদের উদাহরণ দিয়েছিলেন
...আরব-দেশীয়েরা এক প্রকার দিগবিজয়ী। যখন যে দেশ আক্রমণ করিয়াছে, তখনই তাহারা সেই দেশ জয় করিয়া পৃথিবীতে অতুল সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। তাহারা কেবল দুই দেশ হইতে পরাভূত হইয়া বহিষ্কৃত হয়। পশ্চিমে ফ্রান্স, পূর্বে ভারতবর্ষ। আরব্যেরা মিশর ও শিরিয় দেশ মহম্মদের মৃত্যুর পর ছয় বৎসর মধ্যে, পারস্য দশ বৎসরে, আফ্রিকা ও স্পেন এক এক বৎসরে, কাবুল অষ্টাদশ বৎসরে, তুর্কস্থান আট বৎসরে সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত করে। কিন্তু তাহারা ভারতবর্ষ জয়ের জন্য তিন শত বৎসর পর্যন্ত যত্ন করিয়াও ভারতবর্ষ হস্তগত করিতে পারে নাই। মহম্মদ বিনকাসিম সিন্ধুদেশ অধিকৃত করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি রাজপুতানা হইতে পরাভূত হইয়া বহিষ্কৃত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার মৃত্যুর কিছুকাল পরে সিন্ধু রাজপুতগণ কর্তৃক পুনরাধিকৃত হইয়াছিল। ভারত জয় দিগবিজয়ী আরবদিগের সাধ্য হয় নাই।...
তিনি জানতেন জাতি নিয়ে ইউরোপে কী ভয়ংকর অবস্থা চলেছে আর তবু তিনি সমুদয় আধুনিক ভারতের জন্য জাতিপ্রতিষ্ঠা কামনা করলেন। এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে জাতি শব্দে বঙ্কিমচন্দ্র সর্বদাই nationality বা nation-এর কথা বলেছেন (দেখুন ‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত টীকা)
আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু, রাম হিন্দু, যদু হিন্দু, আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দুমাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল, তাহাতেই আমার মঙ্গল। যাহাতে তাহাদের মঙ্গল নাই, আমারও তাহাতে মঙ্গল নাই। অতএব সকল হিন্দুর যাহাতে মঙ্গল হয়, তাহাই আমার কর্তব্য। যাহাতে কোন হিন্দুর অমঙ্গল হয় তাহা আমার অকর্তব্য। যেমন আমার এইরূপ কর্তব্য আর এইরূপ অকর্তব্য, তোমারও তদ্রূপ, রামেরও তদ্রূপ, যদুরও তদ্রূপ, সকল হিন্দুরই তদ্রূপ। সকল হিন্দুরই যদি এইরূপ কার্য হইল, তবে সকল হিন্দুর কর্তব্য যে একপরামর্শী, একমতাবলম্বী, একত্র মিলিয়া কার্য করে, এই জ্ঞান জাতিপ্রতিষ্ঠার প্রথম ভাগ; অর্ধাংশ মাত্র।
হিন্দুজাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অন্য অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নয়। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল, সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতিপীড়ন করিতে হয়, করিব। অপিচ যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে, তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল হইতে পারে। হয় হউক, আমরা সে জন্য আত্মজাতির মঙ্গলসাধনে বিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিতে হয়, তাহাও করিব। জাতিপ্রতিষ্ঠার এই দ্বিতীয় ভাগ।
দেখা যাইতেছে যে, এইরূপ মনোবৃত্তি নিষ্পাপ পরিশুদ্ধ ভাব বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না। ইহার গুরুতর দোষাবহ বিকার আছে। সেই বিকারে, জাতিসাধারণের এরূপ ভ্রান্তি জন্মে যে, পরজাতির মঙ্গলমাত্রেই স্বজাতির অমঙ্গল, পরজাতির অমঙ্গলমাত্রেই স্বজাতির মঙ্গল বলিয়া বোধ হয়। এই কুসংস্কারের বশবর্তী হইয়া ইউরোপীয়রা অনেক দুঃখ ভোগ করিয়াছে। অনর্থক ইহার জন্যে অনেকবার সমরানল ইউরোপ দগ্ধ করিয়াছে (বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড; বিবিধ প্রবন্ধ)।
এ পর্যন্ত পড়ে আমাদের মনে হয় এ একেবারে আমাদের মনের কথা। আমাদের সাহিত্যসৃষ্টির ঊষাকালেই এমন একজন মানুষ যে এসব কথা উচ্চারণ করে গেছেন তিনি বাস্তবিকই ঋষিকল্প। কিন্তু ঠিক তার অব্যবহিত পরের অনুচ্ছেদেই আমরা কি দেখি?
স্বজাতি-প্রতিষ্ঠা ভালই হউক বা মন্দই হউক, যে জাতিমধ্যে ইহা বলবতী হয়, সে জাতি অন্য জাতি অপেক্ষা প্রবলতা লাভ করে। আজি কালি এই জ্ঞান ইউরোপে বিশেষ প্রধান, এবং ইহার প্রভাবে তথায় অনেক বিষম রাজ্যবিপ্লব ঘটিতেছে। ইহার প্রভাবে ইটালি এক রাজ্যভুক্ত হইয়াছে। ইহার প্রভাবে বিষম প্রতাপশালী নূতন জার্মান সাম্রাজ্য স্থাপিত হইয়াছে। আরও কি হইবে বলা যায় না।
এমত বলি না যে, ভারতবর্ষে এই জাতিপ্রতিষ্ঠা কস্মিন্কালে ছিল না। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, আর্যজাতীয়েরা চিরকাল ভারতবর্ষবাসী নহে। অন্যত্র হইতে ভারতবর্ষে আসিয়া, তদ্দেশ অধিকার করিয়াছিল। প্রথম আর্যজয়ের সময়ে বেদাদির সৃষ্টি হয়, এবং সেই সময়কেই পণ্ডিতেরা বৈদিক কাল কহেন। বৈদিক কালে এবং তাহার অব্যবহিত পরেই জাতিপ্রতিষ্ঠা যে আর্যগণের মধ্যে বিশেষ বলবতী ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ বৈদিক মন্ত্রাদিমধ্যে পাওয়া যায়। তৎকালিক সমাজনিয়ন্তা ব্রাহ্মণেরা যেরূপে সমাজ বিধিবদ্ধ করিয়াছিল, তাহাও ঐ জ্ঞানের পরিচয়স্থল। আর্য বর্ণে এবং শূদ্রে যে বিষম বৈলক্ষণ্য বিধিবদ্ধ হইয়াছে, তাহাও ইহার ফল। কিন্তু ক্রমে আর্যবংশ বিস্তৃত হইয়া পড়িলে আর সে জাতিপ্রতিষ্ঠা রহিল না। আর্যবংশীয়েরা বিস্তৃত ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ অধিকৃত করিয়া স্থানে স্থানে এক এক খণ্ড সমাজ স্থাপন করিল। ভারতবর্ষ এরূপ বহুসংখ্যক খণ্ড সমাজে বিভক্ত হইল। সমাজভেদ, ভাষার ভেদ, আচার ব্যবহারের ভেদ, নানা ভেদ, শেষে জাতিভেদে পরিণত হইল। বাহ্লিক হইতে পৌণ্ড্র পর্যন্ত, কাশ্মীর হইতে চোলা ও পাণ্ড্য পর্যন্ত সমস্ত ভারত-ভূমি মক্ষিকাসমাকুল মধুচক্রের ন্যায় নানা জাতি, নানা সমাজে পরিপূর্ণ হইল। পরিশেষে, কপিলাবস্তুর রাজকুমার শাক্যসিংহের হস্তে এক অভিনব ধর্মের সৃষ্টি হইলে, অন্যান্য প্রভেদের ওপর ধর্মভেদ জন্মিল। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন ধর্ম; আর একজাতীয়ত্ব কোথায় থাকে? সাগরমধ্যস্থ মীনদলবৎ ভারতবর্ষীয়েরা একতাশূন্য হইল (ঐ)।
প্রয়োজনের খাতিরে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিগুলো দিতে হল। দেখা যাচ্ছে এখানে তিনি জাতিপ্রতিষ্ঠার পক্ষেই কথা বলছেন। তিনি ইটালি ও জার্মানির উদাহরণ দিয়েছেন এবং পরোক্ষে বলতে চান যে জাতি-ঐক্যের মধ্যে দিয়ে আমাদেরও সেইরকম ‘বিষম প্রতাপশালী’ হয়ে ওঠা উচিত। যে ইটালি ও জার্মানির উদাহরণ তিনি দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে তাঁর মৃত্যুর (১৮৯৪ সাল) পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই সেই ইটালি ও জার্মানি কোন্ চেহারায় আবির্ভূত হবে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আমাদের দেশেও বাইরে থেকে আসা আর্যরা অনুরূপ জাতিপ্রতিষ্ঠা করেছিল, পরে তারা যখন সারা ভারতময় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন আর সে জাতিপ্রতিষ্ঠা থাকে নি। নানা ভেদ থেকে ক্রমে জাতিভেদের উৎপত্তি হয়ে নানা জাতি নানা সমাজের সৃষ্টি হয়।
এহ বাহ্য, বুদ্ধদেবকে নিয়ে তিনি কী বললেন? শাক্যসিংহ এসে নাকি অন্যান্য প্রভেদের ওপর ধর্মভেদের সৃষ্টি করেন। তখন একজাতীয়ত্ব বলে আর কিছু রইল না, সমগ্র ভারত একতাশূন্য হল। শাক্যসিংহ সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরে অবশ্য বদলে গিয়েছিল এবং শাক্যসিংহকে খুব উঁচুতে স্থান দিয়েছিলেন। বদলে যাওয়া সেই ধারণার কথা তাঁর ‘সাম্য’ প্রবন্ধে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানেও শাক্যসিংহ যে ভারতবর্ষকে একতাশূন্য করেছিলেন, সেই ধারণা পালটে যাওয়ার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।
ঐক্যের জন্য জাতি (nation) জিনিসটা কি এতই দরকারি? আমাদের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি কি মানুষে মানুষে ঐক্যের মাধ্যম ছিল না? এমনকি আধুনিক কালেও হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে যার যার পুণ্যস্থান তাদের সম্প্রদায়গত ঐক্যের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তীর্থযাত্রায় হিন্দুদের মধ্যে বর্ণ বা জাতের ভেদাভেদ করা হয় না। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন যে ভাগ আছে, তীর্থযাত্রায় সে ভেদাভেদ করা হয় না। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে জগদীশ নারায়ণ সরকার দেখিয়েছেন, গ্রামে হিন্দু মুসলমানরা মিলে শান্তিতেই দিন কাটাত। ব্রাহ্মণরা তাদের ম্লেচ্ছ আচারগুলো থেকে দূরেই থাকতেন, কিন্তু তাতে করে গ্রামের মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের কোনো হানি ঘটে নি। নগরে কাজী সংকীর্তন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে শ্রীচৈতন্য যখন রেগে গিয়ে সদলবলে কাজীর বাড়ি ঘেরাও করেন, তখন কাজী বলেছিলেন,
গ্রাম-সম্পর্কে চক্রবর্তী হয় মোর চাচা
দেহ-সম্বন্ধ হইতে হয় গ্রাম-সম্বন্ধ সাঁচা।
নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।।
অর্থাৎ তখন দেহ-সম্বন্ধের থেকে গ্রাম-সম্বন্ধ বেশি মূল্যবান ছিল এবং এই গ্রাম-সম্বন্ধে সকল গ্রামবাসী এক সূত্রে গাঁথা ছিল। পরিবার থেকে গ্রাম বা নগর, সেখান থেকে জনপদ। ব্রিটিশ-সৃষ্ট ভারতবর্ষের অস্তিত্ব তখন ছিল না, কাজেই এই বিন্যাস নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, মুসলমান আমলগুলোতেই বহু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। অতএব জাতি প্রতিষ্ঠার আধুনিক ভাবনায় মেতে গিয়ে বিচিত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে যে ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই এক, ইউরোপের আদলে সেই ভারতবর্ষকে একজাতি-ভাবনায় জারিত করার কোনো দরকার ছিল না। আসলে এর নেপথ্যে কাজ করেছিল হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা।
‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধের শেষাংশে আগের অনুচ্ছেদের জের টেনে তিনি বলছেনঃ
এই ভারতবর্ষে নানা জাতি। বাসস্থানের প্রভেদে, ভাষার প্রভেদে, বংশের প্রভেদে, ধর্মের প্রভেদে, নানা জাতি। বাঙ্গালি, পঞ্জাবী, তৈলঙ্গী, মহারাষ্ট্রী, রাজপুত, জাঠ, হিন্দু, মুসলমান, ইহার মধ্যে কে কাহার সঙ্গে একতাযুক্ত হইবে? ধর্মগত ঐক্য থাকিলে বংশগত ঐক্য নাই, বংশগত ঐক্য থাকিলে ভাষাগত ঐক্য নাই, ভাষাগত ঐক্য থাকিলে নিবাসগত ঐক্য নাই। রাজপুত জাঠ, এক ধর্মাবলম্বী হইলে, ভিন্নবংশীয় বলিয়া ভিন্ন জাতি; বাঙ্গালি বেহারী একবংশীয় হইলে ভাষাভেদে ভিন্ন জাতি; মৈথিলি কনোজী একভাষী হইলে নিবাসভেদে ভিন্ন জাতি। কেবল ইহাই নহে। ভারতবর্ষের এমনই অদৃষ্ট, যেখানে কোন প্রদেশীয় লোক সর্বাংশে এক; যাহাদের এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতি, এক দেশ, তাহাদের মধ্যেও জাতির একতাজ্ঞান নাই। বাঙ্গালির মধ্যে বাঙ্গালিজাতির একতা বোধ নাই, শীকের মধ্যে শীকজাতির একতা বোধ নাই।
ইতিহাসকীর্তিত কালমধ্যে কেবল দুইবার হিন্দুসমাজমধ্যে জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয় হইয়াছিল। একবার, মহারাষ্ট্রে শিবাজী এই মহামন্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন। তাঁহার সিংহনাদে মহারাষ্ট্র জাগরিত হইল। তখন মহারাষ্ট্রীয়ে মহারাষ্ট্রীয়ে ভ্রাতৃভাব হইল। এই আশ্চর্য মন্ত্রের বলে অজিতপূর্ব মোগল সাম্রাজ্য মহারাষ্ট্রীয় কর্তৃক বিনষ্ট হইল। চিরজয়ী মুসলমান হিন্দু কর্তৃক বিজিত হইল। সমুদায় ভারতবর্ষ মহারাষ্ট্রের পদাবনত হইল। অদ্যাপি মারহ্রাট্রা, ইংরেজের সঙ্গে ভারতবর্ষ ভাগে ভোগ করিতেছে।
দ্বিতীয়বারের ঐন্দ্রজালিক রণজিৎ সিংহ। ইন্দ্রজাল খালসা। জাতীয় বন্ধন দৃঢ় হইলে পাঠানদিগের কিয়দংশও হিন্দুর হস্তগত হইল। শতদ্রুপারে সিংহনাদ শুনিয়া, নির্ভীক ইংরেজও কম্পিত হইল। ভাগ্যক্রমে ঐন্দ্রজালিক মরিল। পটুতর ঐন্দ্রজালিক ডালহৌসির হস্তে খালসা ইন্দ্রজাল ভাঙ্গিল। কিন্তু রামনগর এবং চিলিয়ানওয়ালা ইতিহাসে লেখা রহিল।
যদি কদাচিৎ কোন প্রদেশখণ্ড জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয়ে এতদূর ঘটিয়াছিল, তবে সমুদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত? (ঐ)।
‘ভারতবর্ষে নানা জাতি’ তাঁর এই উপলব্ধি বাস্তব সত্য। ‘সমুদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত?’ তাঁর এই আকাঙ্খাও অতি মহৎ। কিন্তু শিবাজীর উদাহরণে ‘চিরজয়ী মুসলমান হিন্দু কর্তৃক বিজিত হইল’ যখন তিনি বলেন, তখন সন্দেহ হয় ‘একজাতীয় বন্ধন’ বলতে প্রকারান্তরে তিনি হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথাই বলছেন না তো?
ঘটনা হচ্ছে চিরজয়ী মুসলমান শিবাজীর শত্রু ছিল না, তাঁর লড়াই ছিল মোগলদের সঙ্গে। তা নাহলে তাঁর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে মুসলমানদেরও সমান জায়গা ছিল। তাঁর প্রশাসনে প্রচুর মুসলমান উচ্চ পদে আসীন ছিল, তাঁর নৌসেনাবাহিনীতে প্রচুর মুসলমান ছিল এবং তুর্কীদের তিনি তাঁর রাজ্যে এসে মসজিদ তৈরির আহ্বান জানিয়েছিলেন। অতএব শিবাজীকে কোনভাবেই শুধুমাত্র হিন্দুদের রাজা বলা যায় না, বরঞ্চ শিবাজীর শাসনকাল ভারতবর্ষের অধিবাসীদের একজাতীয় বন্ধনের (প্রধানত হিন্দু মুসলমানের মেলবন্ধনের) উদাহরণ হিসেবে চমৎকার। তবে এটা ঠিক, যে উপায়ে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সেটা খুবই নিন্দনীয়। শিবাজীর রাজস্বের এবং অন্যান্য খরচের সবটাই আসত লুঠ থেকে। তাঁর সময় সুরাট ছিল মোগলদের অধীনে থাকা এক বিশাল সমৃদ্ধ শহর। মোগলদের অধীনে হলেও সেখানে থাকত প্রচুর হিন্দু ও মুসলমান। তার সঙ্গে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসি বাণিজ্যকুঠীগুলিও ছিল। এই সুরাটকে তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিলেন। তার ওপর তিনি অন্যায়ভাবে তাঁর অধিকৃত এলাকার সর্বত্র দুটি কর বসিয়েছিলেন। চৌথ এবং সরদেশমুখী।
বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ (১৮৯২)। এর দু’ বছর পরেই বঙ্কিমচন্দ্র গত হন। আগেই বলা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন অনেক বেশি সংকীর্ণ ও আক্রমণাত্মক। একমাত্র সামাজিক উপন্যাসগুলি ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসই যবনদের ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু ‘সীতারাম’ উপন্যাসে তিনি যেভাবে যবন প্রসঙ্গে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন, তেমনটা এমনকি ‘আনন্দমঠ’এও হননি।
এদিকে গঙ্গারাম কষ্টে অথচ নির্বিঘ্নে লোকারণ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কষ্টে—কেন না, আসিতে আসিতে দেখিলেন যে, সেই জনতামধ্যে একটা ভারী গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কোলাহল ভয়ানক হইল, লোকসকল সম্মুখে ছুটিতে লাগিল। অশ্বারোহণের কৌশল গঙ্গারাম তেমন জানিতেন না; ঘোড়া সামলাইতেই তাঁহাকে এত ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল যে, তিনি আর কোন দিকে চাহিয়া দেখিতে পারিলেন না যে, কোথায় কি হইতেছে। কেবল “মার! মার!” একটা শব্দ কানে গেল।
লোকারণ্য হইতে কোনমতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গঙ্গারাম অশ্বকে ছাড়িয়া দিয়া, এক বটবৃক্ষে আরোহণ করিলেন, দেখিবেন--কি হইতেছে। দেখিলেন, ভারি গোলযোগ। সেই মহতী জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছে। এক দিকে সব মুসলমান—আর এক দিকে সব হিন্দু। মুসলমানদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি সিপাহী, হিন্দুদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি ঢাল-সড়কিওয়ালা। হিন্দুরা বাছা বাছা জোয়ান, আর সংখ্যাতে বেশী। মুসলমানেরা তাহাদিগের কাছে হঠিতেছে। অনেকে পলাইতেছে। হিন্দুরা “মার মার” শব্দে পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে।...
...মার মার শব্দে হিন্দুরা চারিদিক হইতে চারিদিকে ছুটিতেছে। আবার গঙ্গারাম সবিস্ময়ে শুনিলেন, যাহারা এই মার মার শব্দ করিতেছে, তাহারা মধ্যে মধ্যে বলিতেছে, “জয় চণ্ডিকে! মা চণ্ডী এয়েছেন। চণ্ডীর হুকুম, মার! মার! মার! জয় চণ্ডিকে!” গঙ্গারাম ভাবিলেন, “এ কি এ!” তখন দেখিতে দেখিতে গঙ্গারাম দেখিলেন মহামহীরূহের শ্যামল-পল্লবরাশি-মণ্ডিতা চণ্ডীমূর্তি, দুই শাখায় দুই চরণ স্থাপন করিয়া, বাম হস্তে এক কোমল শাখা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তে অঞ্চল ঘুরাইতে ঘুরাইতে ডাকিতেছে, “মার! মার! শত্রু মার!” ... শ্রীর আর লজ্জা নাই, জ্ঞান নাই, ভয় নাই, বিরাম নাই—কেবল ডাকিতেছে—“মার! শত্রু মার! দেবতার শত্রু, মানুষের শত্রু, হিন্দুর শত্রু—আমার শত্রু—মার শত্রু মার!!”...
এখানেও তিনি চতুর ইংরেজ কর্তৃক চারিয়ে দেওয়া মুসলমান বিদ্বেষের মানসিকতার শিকার হলেন। এও উপনিবেশিকতার আর এক রূপ।
১৯২০ সালে অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ বইতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র রচনাকে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে রেখে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছিলেন। ‘আনন্দমঠ’ অধ্যায়ে বঙ্কিমের যুগ নিয়ে তিনি যা লেখেন তা প্রণিধানযোগ্য। ছোট করে তাঁর কথাগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে পারি। তিনি লেখেন যে, স্বদেশপ্রীতি বা দেশাত্মবোধ ব্যাপারটা বিদেশি, আমাদের দেশে ছিল না। ‘উহা আমরা ইংরাজী শিক্ষার শুভফলরূপে পাশ্চাত্যদেশ হইতে লাভ করিয়াছি।’ এই কথাটা অবশ্য অভিনব নয়, সেকালে অনেকেই এরকম মনে করতেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য ইতিহাস ইত্যাদি পড়ে বাঙালি যখন ‘পলিটিকাল পেট্রিয়টিজম’ শিখল, তখন থেকে এই ভাবটা আমাদের দেশে দানা বাঁধে। এরপর আমাদের দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরা পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে যত নিজেদের দেশের তুলনা করতে লাগলেন, ততই আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা ভেবে ব্যথিত বোধ করতে লাগলেন। ‘তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা কবি ছিলেন, তাঁহারা কাব্যে ও সঙ্গীতে অনল্পমাত্রায় করুণরসের ছড়াছড়ি করিতে লাগিলেন—কেহ কেহ আবার রাজস্থান-প্রভৃতি পাঠ করিয়া রাজপুতগণের স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও মুসলমান-বিদ্বেষ প্রভৃতিকে জাতীয়ভাবরূপে গ্রহণপূর্বক তদবলম্বনে প্রচুর বীররসপূর্ণ কাব্য লিখিতে লাগিলেন।’ উদাহরণস্বরূপ তিনি এইসব কবিরা যেসব গান লিখতেন, তার কিছু কিছু থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন, ‘কতকাল পরে বল ভারত রে/দুখসাগর সাঁতারি পার হবে’ বা ‘বাজ রে শিঙ্গা বাজ এই রবে/সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে’ ইত্যাদি। অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, এঁরা কিন্তু কেউই প্রাদেশিকী প্রীতিকে অর্থাৎ বাংলাকে ভালবাসাকে গুরুত্ব দিতেন না, স্বদেশ বলতে তাঁরা তখন সমগ্র ভারতকেই বুঝতেন। “...ফলকথা এই, কবিগণ সমাজের নবোদ্ভূত রাষ্ট্রীয় চৈতন্যকে একটা ধরিবার ছুঁইবার যোগ্য আকার দান করিয়া দেশমধ্যে একটা জাতীয় ভাবের বন্যা বহাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।... বস্তুতঃ প্রাদেশিক ইতিহাসে অজ্ঞতাহেতুই দেশের প্রথম রাজনৈতিক কবিগণ অতি বড় ভারতবর্ষটাকেই স্বদেশভক্তির প্রথম আলম্বন করিয়াছিল।”
তাছাড়া প্রাদেশিক প্রীতির মধ্যে জাতিগঠনের এবং রণসজ্জার ডাকের সেই উপাদান নেই, য়ূরোপের প্রভাবে যে উপাদান তাঁদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল
...এই সময়ে মধ্য-য়ূরোপে বিসমার্ক-প্রভৃতির চেষ্টায় জাতিগঠন ক্রিয়া বড় দ্রুত ও বড় তীব্র ভাবে চলিতেছিল; এবং ফ্রাঙ্কো-প্রাসিয়ান যুদ্ধের (১৮৭০—খৃষ্টাব্দ) পর সমগ্র য়ূরোপে “সাজ, সাজ, অস্ত্র সংগ্রহ কর, সৈনিকদিগকে শিক্ষা দেও, রণতরী সজ্জিত কর” এইরূপ একটা রব পড়িয়া গিয়াছিল। বাঙ্গালী কবিগণের মধ্যে অনেকেই ঐরূপ বিদেশীয় উত্তেজনায় সংক্রামিত হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু রাজশক্তি যেখানে বিদেশীয়, সেখানে ঐরূপ উত্তেজনার বাহ্য প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বন করিতে হয়। তাই এদেশীয় জাতীয় কবিগণ হিন্দু-মুসলমানের অতীত দ্বন্দ্বের ইতিহাস হইতে তাঁহাদের কাব্যের বস্তু—প্লট বা situation—আহরণ করিয়া তাঁহাদের নব জাগরিত দেশাত্মবোধ ব্যক্ত করিতে লাগিলেন।...
তারপর এল রাজনীতিচর্চাকারীদের কথা। ‘একদল রাজনীতিচর্চাকারী’ যাঁরা ঐসময়ই আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইংরেজ রাজত্বের অবসান তাঁরা চাইতেন না, কারণ সেটা তখনো তাঁদের চোখে সুদূরপরাহত স্বপ্নমাত্র। তার ওপর তাঁদের বিবেচনায় ইংরেজ থাকাই তো ভালো, তাহলে দেশে বর্গী, ঠগ, পিণ্ডারী, চোর, ডাকাত, ছেলেধরা ইত্যাদি অরাজকতা থাকে না। তাঁরা ইংরেজের মুখ থেকে যে সব ‘সাম্যতত্ত্ব, উন্নত রাজনীতি, পরধর্ম, ও পরকীয় আচারের প্রতি শ্রদ্ধার কথা’ শুনেছিলেন, তেমন কথা অন্য কোথাও শোনেন নি। ‘বার্ক, ব্র্যাড্ল, (এবং কিছুকাল পরে) ব্রাইটকে ইঁহারা দেবতার অধিক জ্ঞান করিতেন।’ কবিরা যেমন নিজেদের প্রাণের কথা ভীমসিংহ, বাদল বা পৃথ্বীরাজের মুখে বসাতেন, তাঁরাও তেমনি বার্ক, ব্র্যাড্ল বা ব্রাইটের মুখ থেকে শোনা কথাগুলো মনে গেঁথে নিতে লাগলেন; তাঁদের প্রকাশিত মত উদ্ধৃত করে নিজেদের অভাব-অভিযোগ জানাতে লাগলেন। সিপাহী বিদ্রোহের শেষে মহারাণী ভিক্টোরিয়া যে ঘোষণাপত্র প্রচার করেন, তার নীতিগুলো যাতে কাজে পরিণত হয়, সে বিষয়ে ইংল্যান্ডের ও ভারতের বাইরের রাজপুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। যেহেতু বাংলাদেশে বসে ইংরেজ রাজপ্রতিনিধি সমগ্র ভারতের জন্য বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন করতেন, তাঁদের দৃষ্টিও প্রথম থেকে সমগ্র ভারতের ওপর পড়েছিল। অবশ্য তাঁরা স্থানীয় অভাব-অভিযোগ নিয়েও আন্দোলন, আবেদন-নিবেদন ইত্যাদি করতেন, কিন্তু
সমগ্র ভারতে একটা মিলিত সংহত জাতির সৃষ্টি ইঁহাদের আকাঙ্খিত ছিল। মুসলমানের প্রতি ইঁহাদের বিদ্বেষবোধ বড় একটা ছিল না—কেননা কবিগণের মত কৃত্রিম অবস্থার কল্পনা ইঁহাদের পক্ষে আবশ্যক ছিল না। কবিগণের মুসলমানবিদ্বেষটাও বস্তুত পরজাতির প্রভুত্বে অসহিষ্ণুতার আবরণমাত্র ছিল, উহা আন্তরিক ছিল না। তবে ইহা সত্য যে এই যুগের কবিগণ ভারতের স্বাধীনতা অর্থে হিন্দুজাতির প্রাধান্যই বুঝিতেন।
এ যুগের কবিগণ ভারতের স্বাধীনতা বলতে হিন্দুজাতির প্রাধান্যই বুঝতেন অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তও এ সত্য অস্বীকার করতে পারেন নি। এরপর তিনি লিখেছেন, মুসলমানরা তখন ভারতে আর রাজা নয়, বিদেশীও নয়, তারাও ভারতবাসী ও ইংরেজের অধীন প্রজা, সুতরাং রাজনীতি আন্দোলনকারীদের তাদের বিদ্বেষ করার কারণ ছিল না এবং হিন্দু-মুসলমানে ভেদবোধ করার প্রয়োজন ছিল না। বরং তাঁরা হিন্দু-মুসলমানে একতাই চাইতেন।
বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসে যাই লিখে থাকুন, একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় বঙ্গদর্শনে তাঁর সম্পাদকতাকালেই এমন অন্তত দুটি লেখা বেরিয়েছিল, যাতে অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তের এই বিশ্লেষণের সমর্থন পাওয়া যায়। প্রথম প্রবন্ধটি বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান সংক্রান্ত, দ্বিতীয় প্রবন্ধটির ক্ষেত্র আরো ব্যাপক, আর্য এবং হিন্দুকে নিয়ে। ১৮৭২ সালের জনগণনা হয়ে যাবার পর ‘বঙ্গদেশের লোক সংখ্যা’ প্রবন্ধে তাই নিয়ে বঙ্গদর্শন প্রথম খণ্ডে (১৮৭২) প্রবন্ধটি বেরোয়। কার লেখা জানা যায় না, বঙ্কিমচন্দ্রের নয়, কারণ বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ডে এই প্রবন্ধের নাম নেই। প্রবন্ধটিতে পাই
হিন্দু ১,৮১,০০,৪৩৮
মুসলমান ১,৭৬,০৯,১৩৫
অতএব দেখা যাইতেছে যে, নিজ বাঙ্গালায় হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান। মুসলমান অপেক্ষা পাঁচ লক্ষ মাত্র অধিক হিন্দু আছে। তবে হিন্দুদিগের প্রাধান্য এই যে, মুসলমানেরা প্রায় কৃষক, এবং সামান্য শ্রেণীর লোক। ভদ্রলোক অধিকাংশই হিন্দু, কিন্তু তাই বলিয়া এই বঙ্গদেশকে কেবল হিন্দুর দেশ বলা যায় না। যেমন ইহা হিন্দুর দেশ, সেই রূপই ইহা মুসলমানের দেশ।
দ্বিতীয় খণ্ডের প্রবন্ধটির আলোচনার ক্ষেত্র আরো ব্যাপক। এই প্রবন্ধটির নাম ‘জাতিভেদ’, কার লেখা ঠিক জানা যায় না, তবে প্রবন্ধের নিচে ‘শ্রীযঃ’ দেখে মনে হয় হতে পারে এটি বঙ্গদর্শনের লেখকগোষ্ঠীর অন্যতম যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের লেখা। এই প্রবন্ধে ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ নিয়ে এবং ‘হিন্দু’ শব্দটির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে
...আমাদিগের জাতি নাম (nationality) কি? আর্য বলিলে দুই দোষ হয়। প্রথমতঃ যে পদার্থের নাম আর্য বলিয়া স্থির হইতেছে তাহা কল্পনা মাত্র। এই নামের কোন পাত্র যে কখন পৃথিবীতে ছিল, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। অতএব ঐ নাম দিয়া আমাদিগের জাতি ব্যক্ত করিলে সেই কল্পনাকে চিররক্ষিত প্রত্যক্ষ বস্তু বলিয়া বোধ হইবেক।...
যদি বল আমাদিগের জাতি নাম “হিন্দু” তাহাতেও দোষ হয়। হিন্দু শব্দ “সিন্ধু” নাম হইতে উৎপন্ন। ইহার এক অর্থে সিন্ধু ব্রহ্মপুত্রের অন্তর্গত সমগ্র ভারতবাসিগণকে বুঝাইতে পারে। কিন্তু অনেক খ্রীষ্টান ও মুসলমান হিন্দুস্থান মধ্যে বাস করিয়াও হিন্দুপদে বাচ্য নহেন। বস্তুতঃ হিন্দু শব্দটী ধর্মবোধক। একজাতীয় লোক সকলেই যে এক ধর্মাক্রান্ত হইবেক তাহার কোন সম্ভাবনা নাই। অতএব জাতি প্রকাশ করার নিমিত্ত হিন্দু শব্দ প্রয়োগ করা যায় না।
এই প্রবন্ধে ‘আনন্দমঠ’ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হল না, কারণ এ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই সুন্দর আলোচনা করেছেন। শুধু দুচারটে কথা। আমাদের দেশে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। দুটো আলাদা ক্ষেত্র। ধর্মের কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হয় না। তা যদি না হত তাহলে দেখা যেত হিন্দুধর্মের ধ্বজা ধরে হিন্দুরা নানা দেশ দখল করেছে, যেমনটা কিনা খ্রিস্টধর্মের বেলায় দেখা যায়। বরঞ্চ ইতিহাস বলছে আমাদের দেশে রাজনীতি ধর্মের অনুশাসনের অনুগমন করেছে। রামমোহনের লেখায় যেহেতু রাজনীতির কথা ছিল, তাঁর সময়ও ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। উত্তরে রামমোহন বলেছিলেন, “ধর্ম ঈশ্বরের, রাজনীতি কি শয়তানের? যাহা কিছু সত্য, পবিত্র ও হিতকর, তাহাই ঈশ্বরের। মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের সহিত পরমেশ্বরের সম্বন্ধ।” অর্থাৎ রামমোহন রাজনীতিকেও ‘সত্য, পবিত্র ও হিতকর’রূপে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি যেটা চেয়েছিলেন সেটা হল একদিকে ব্রিটিশ শাসন ধর্মের ধারা অনুসরণ করুক, অপরদিকে ধর্ম দ্বারা চালিত হয়েই তাঁর দেশবাসী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করুক অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্জন করুক। এটা ছিল রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রে এসে ব্যাপারটা উলটে গেল। তিনি খ্রিস্টধর্মেরই ধারায় হিন্দুধর্মের সংগঠিত রূপের কল্পনা করলেন এবং তাঁর সৃষ্ট সন্ন্যাসীদের (সন্তানদল) অ্যাজেন্ডাই হয়ে উঠল মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটানো এবং ইংরেজ রাজত্ব স্থায়ী এবং শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করা। একে বলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ১৯৪০ সালের ১৪ই মে আনন্দবাজার পত্রিকায় মেদিনীপুরে সুভাষচন্দ্রের বিপুল সম্বর্ধনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। সেখানে সম্বর্ধনার উত্তরে অনেক কথার মধ্যে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন
সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছেন। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে। হিন্দু মাত্রেরই তাহার নিন্দা করা কর্তব্য।
ভারতবর্ষ, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য
ইত্যাদি নিয়ে মুসলিমদের ভাবনা
আমরা অনেকেই ভাবি মুসলমানদের মধ্যে যেহেতু বেশির ভাগই কৃষক ছিল, অতএব হিন্দুদের মত তাদের মধ্যে অত শিক্ষিত ছিল না, সুতরাং উচ্চকোটির ধ্যানধারণাও ছিল না। এই ধারণাটা একেবারে ভুল। ১৮৩১ সাল থেকেই স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের মধ্যেও ভাবনার চর্চা আরম্ভ হয়েছিল। বরঞ্চ এক হিসেবে তাঁরা ছিলেন হিন্দুদের থেকেও বেশি শিক্ষিত। যেহেতু তাঁরা একাধারে ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলাভাষায় পড়তে ও লিখতে জানতেন। ‘সভা-রাজেন্দ্র’ দিয়ে তাঁদের সাময়িকপত্র প্রকাশের শুরু। এবং বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থেকেছে।
আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’ (১৯৬৯) বইতে মুসলিমদের ধ্যানধারণার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। তখন এদেশের মুসলমানরা মনে করতেন যে হিন্দুর মত মুসলমানরা তো শুধু ভারতবর্ষ নিয়ে নয় যে ভারতবাসী মুষ্টিমেয় মুসলমানের যা নেই, মুসলমান জাতিটাতেও তা নেই বলে ধরতে হবে। তখনকার লেখকদের মানসপটে যে সুবিশাল মানচিত্র ভেসে উঠত তাতে রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক সীমানা মুছে গিয়ে ধর্মবোধের ভিত্তিতে সব এক হয়ে যেত। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আল এসলাম’এ একজন লেখক সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, “জাতীয়তার যে সীমানা এক দেশ হইতে অপর দেশকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখে, এছলামের সাম্যবাদ তাহা ধ্বংস করিয়াছে।” আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘সাম্যবাদ কথাটা এখানে বড় নয়, তার বদলে সাম্রাজ্য হলেও ক্ষতি ছিল না। আসল কথা, ধর্মীয় পরিচয়ে যখন আমরা নিজেদের চিহ্নিত করি, স্বদেশ তখন খুব ছোট জায়গা হয়ে পড়ে আমাদের জন্যে।’ এইজন্যেই ভারতবর্ষের বাইরের যে মুসলমান জগত, তা আমাদের লেখকদের গভীরভাবে আকর্ষণ করত। স্বদেশের তুলনায় বাইরের মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা হত বেশি, যেমন, চীন, তিব্বত, রাশিয়া, সিরিয়া, বসরা বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থান, আরব বা তুরস্ক। আরব ও তুরস্কের মধ্যে তুরস্কই তখনকার মুসলিমদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেশি। খিলাফত আন্দোলনের (১৯২০-২২) ব্যর্থতার পরে প্রথম বাঙালি মুসলমানের প্যান-ইসলামের মোহ ভাঙতে শুরু করে, স্বদেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও পরিবেশের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘এ ভাবধারার পশ্চাতে নজরুল ইসলামের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। ‘শিখা’ গোষ্ঠীর বুদ্ধিচর্চা ও সওগাতের উদারনৈতিকতাও এ ভাবনাকে গতি দিয়েছিল।’ তবে সমাজে দুটো ভাবধারাই কাজ করছিল। ‘হাফেজ’ (১৮৯৭) পত্রিকায় যেমন আকবর সম্পর্কে সগৌরব আলোচনা দেখি, বিশ শতকে তেমনি ‘ইসলাম দর্শন’এ দেখি আকবরী ও আলমগীরী আদর্শের বিরুদ্ধতার ওপর জোর দিতে। ‘জয়তী’-সম্পাদক যখন (১৯৩০) আকবর-প্রদর্শিত সমন্বয়পন্থা অনুসরণের সুফলের কথা ইঙ্গিত করেছেন, ততদিনে মনে হয় ‘ইসলাম দর্শন’-কথিত আলমগীরী আদর্শেরই আকর্ষণ বেড়েছে মুসলমান সমাজে।
ঊনিশ শতক থেকেই ধর্ম ও সমাজজীবনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান সমাজের স্বাতন্ত্র্যবাদী লক্ষ্য করা গেলেও ‘এই চেতনা সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যবাদের সন্ধান করে নি বলে মনে হয়।’ ঊনিশ শতক থেকে বিংশ শতক জুড়ে বহু পত্রিকা হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী প্রচার করেছিলেন, যেমন, আহমদী, হিন্দু-মুসলমান সম্মিলনী, হিতকরী, কোহিনূর, নবনূর, মোসলেম ভারত, ধূমকেতু, সহচর, গণবাণী, শিখা, জয়তী ইত্যাদি।
তবে এ ধরনের মনোভাব সাধারণভাবে আমাদের সমাজে পরিব্যাপ্ত হয় নি। মিলনের আদর্শ প্রচারের পাশাপাশি বরঞ্চ দেখা গিয়েছিল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ। মিলনপন্থী সেখ ওসমান আলিই ‘কোহিনূরে’ লিখেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমান মিলনের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তার পুনরুত্থান। সমাজের একটা বৃহত্তর অংশে এই সন্দেহ প্রবল হবার সুযোগ পায় বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের সময়ে। ‘ইসলাম-প্রচারক’ প্রচার করেন যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানের কিছু সুবিধে হয়েছে এবং হিন্দুর স্বার্থে কিছু আঘাত লেগেছে বলেই হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন। মুসলমানের প্রতি হিন্দুর বিদ্বেষের উল্লেখও করা হয়েছিল সেই সঙ্গে।...
নওরোজের (১৯২৭) উক্তি সমকালীন মুসলিম লেখকদের ভাবধারাকে প্রকাশ করেছিলঃ
প্রবল অংশ যদি দুর্বল অংশকে পর বলে মনে করে এবং এদেশ “হিন্দু”রই দেশ আর কারো নয় এই কথা সাহিত্যে ও বক্তৃতায় প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, এক কথায় দুর্বল অংশকে বাড়ী ছাড়া করে দেয়, তবে দুর্বল অংশ ত একটা কোথাও তাদের বাড়ী ঠিক করতে চাইবে।...এবং অনেক সময়ে লাচার ও হতাশ হয়েই যারা তাদের পর বলতে চায় তাদের পর ভাবতে বাধ্য হয়।
এই ধরনের ভাবনাই পরবর্তীকালের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা শেকড় গাড়ার মূলে।
উপসংহার
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির-যুগান্তর গোষ্ঠীর গৌরবময় অবদান নিয়ে দু চার কথায় কিছু বলা যায় না। এ এক বিশাল ইতিহাস, যার পরতে পরতে আছে অজস্র মানুষের আত্মবলিদান। ১৯০২ সালের ২৪ মে কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে। অচিরে ঢাকাতেও এর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং পরবর্তীকালে ঢাকাই হয়ে ওঠে অনুশীলন সমিতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। অনুশীলন সমিতির মন্ত্র ছিল ব্রিটিশ তাড়াও এবং উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা। এই উদ্দেশ্যে অনুশীলন সমিতির শাখা হিসেবে প্রচুর গুপ্ত সমিতি তৈরি হয়, যেখানে সর্বতোমুখী শিক্ষা ও শরীরচর্চার আড়ালে সংগ্রামী কার্যক্রম চালানো হত। এটি ছিল একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল। কিছু পরে অনুশীলন সমিতির সহযোগী যুগান্তর গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে আরো বেশি সক্রিয় হয়। তাদের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে কোলকাতা।
কিন্তু এ পর্যন্ত একতরফা তাদের গৌরবের কাহিনিই শুনে এসেছি। আমরা কজন জানি যে এই গৌরবের আরো একটা দিক ছিল, যে দিকটা ছিল আজকের হিন্দু সাম্প্রদায়িতার উত্থানের কারণ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা’ বইতে (প্রথম প্রকাশ ১৯৫১) জীবনতারা হালদার লিখেছিলেনঃ
হিন্দুরা জানে ভাবরাজ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে। পলিটিক্স্ বুঝা এ দেশের হিন্দু নেতাদের কর্ম নয়। মুসলমান নেতারা বাস করে বাস্তব জগতে। পলিটিক্স্ তাহারা হজম করিয়া বসিয়াছে পুরামাত্রায়। একথা আজ এখানে বলিতে বসিতাম না; বলিবার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণও থাকিত না, যদি না আমাদের বিরাট এই সমাজদেহ আজ গলিত কুষ্ঠে পরিপূর্ণ না হইয়া জীবন্ত হইত; যদি আজ মুসলমান ভারতে বাস করিয়াও অভারতীয় না হইত। বাংলা দেশেও আজ মুসলমানেরা বাঙ্গালী বলিতে বাঙ্গালী হিন্দু-সমাজকেই আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দেয়। ভারতবাসী হইয়াও মুসলমান সমাজ আজ পিতৃভূমিরূপে কল্পনা করে আরবকে। ভারতবাসী হিন্দুর চেয়ে তাহার কাছে বেশি আপন আরবী মুসলমান। সমগ্র মুসলমান সমাজ আজ এক বিশ্বব্যাপ্ত অখণ্ড “প্যান-ইসলামিক ষ্টেট”-এর কল্পনায় মশগুল। আর ইহারই প্রাথমিক সোপান হিসাবে তাহার প্রয়োজন পাকিস্তানের।
দুটো কথা বলে এই প্রবন্ধের ইতি টানব। প্রথম কথা, লেখকের চারপাশের আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের জীবনযাপনের ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে বলা যায়, জীবনতারা হালদারের এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেইসব আত্মীয়স্বজন কারোর মধ্যেই মুসলমান সম্পর্কে এরকম ধারণা ছিল না। তাঁদের বাড়িতে মুসলমানরা অবারিতদ্বার ছিলেন (এমনকি লেখকের বাড়িতেও)। সম্ভবত অনুশীলন সমিতির সদস্যদের মধ্যে ভাবনার ভিত্তিতে দুটো ভাগ ছিল।
দ্বিতীয় কথাটা অনুশীলন সমিতির এই ভাবধারা কিভাবে বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাই নিয়ে। সেটা পড়ল কেশব বনিরাম হেড়গেওয়ারের মাধ্যমে। তিনি যে দেশপ্রেমিক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯১১ সালে তিনি কলকাতায় আসেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পড়তে ও একই সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলার অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়ে তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে অনুরূপ বিপ্লবী দল গঠন করা। সদস্য হবার পর ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী, পুলিন দাস, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ইত্যাদিদের কাছাকাছি আসেন তিনি। ১৯১৬ সালে ডাক্তারি পাশ করে নাগপুরে ফিরে গিয়ে মাঝখানে কিছুদিন তিলকের নেতৃত্বে কাজকর্ম করে শেষপর্যন্ত নানা আদর্শগত কারণে স্বয়ং গান্ধীজির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯২৫ সালে নাগপুরে গড়ে তোলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ।
একথা ঠিক, অনুশীলন সমিতির সদস্যদের একাংশের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন মুসলিম-বিদ্বেষ ছিল, ডাঃ হেডগেওয়ার তার উত্তরাধিকার নিয়ে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছিলেন। তাছাড়া মহারাষ্ট্রেও প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিম-বিদ্বেষ ছিল, যদিও প্রশাসক মেজর আর. এ. বেথামের (১৯০৮) লেখায় সে বিদ্বেষের যে বর্ণনা পাই, সেটা যত না প্রকৃত ইতিহাস তার বেশি হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়োজনে। তিনি শিবাজীকে বাল্যাবস্থা থেকেই মুসলিম-বিদ্বেষী হিসেবে বেড়ে ওঠা এক হিন্দু শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন। অবশ্য গজনীর মামুদের অত্যাচারের ফলে হিন্দুরা মুসলিম-বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিল, তাঁর সে বিশ্লেষণ ঠিক। সে যাই হোক, ডাঃ হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কার্যক্রমের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। আজকের এই ব্রাহ্মন্যবাদী দল, এই দলিত পেটানো এবং মেরে ফেলা, এই হরিজনদের ওপর অত্যাচার ডাঃ হেডগেওয়ারের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। ১৯৩৪ সালে ওয়ার্ধাতে সংঘ পরিদর্শনে এসে গান্ধীজি দেখেছিলেন, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, হরিজন, সব এক পঙক্তিতে বসে আহার করছে। দেখে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে ডাঃ হেডগেওয়ারকে বলেছিলেন তাঁর সংঘ নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিতে।
‘অরণ্য’ শব্দটা আমার ছেলের নামে আছে। ভারতের সংবিধানও এই শব্দের একরকম মানে করেছে। তবে সংবিধানের একটা মজা আছে, সুবিধেও– শব্দের অর্থ সেখানে স্থায়ী নয়, সরকারের সুবিধেমতো পালটে পালটে যায়। কখন কোন অঞ্চলকে অরণ্য হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হবে, কখন অভয়ারণ্য, কখন ডিমড ফরেস্ট (deemed forest) হিসেবে চিহ্নিত করা হবে সেসবের একচ্ছত্র অধিকার সরকারের অথবা প্রশাসনের। একটু অতীতচারণ করা যাক। ১৮৬৫ সাল। তৈরি হল ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট। ভারতে তখন রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে। রেল লাইনের স্লিপারের জন্য চাই হাজার হাজার টন কাঠ। সুতরাং জঙ্গলকে প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজন। নাহলে তার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার সম্ভব নয়। এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের প্রিন্সলি স্টেট অর্থাৎ বিভিন্ন রাজার অধীনে সে সময় প্রচুর জঙ্গল ছিল, যা তাঁরা শিকার এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতেন এবং প্রশাসনকে তার ভাগ দিতে বাধ্য ছিলেন না। আরও কয়েক দশক পার করে ১৯২৭ সালে তৈরি হয় নতুন ফরেস্ট অ্যাক্ট– যা অরণ্যকে রাজ্যের এক্তিয়ারে নিয়ে আসে। আরও পরে, ১৯৭৬ সালে, ৪২তম সংবিধান সংশোধন অ্যাক্টে অরণ্যের অধিকার রাজ্য়ের সঙ্গে কেন্দ্রের হাতেও চলে আসে। ভারত তখন নব্য যুবা। বিপুল তার উন্নয়ন প্রকল্প। বাঁদ চাই, বিদ্যুৎ চাই,ফ্যাক্টরি চাই, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মুখে খাবার তুলে দিতে চাষের জমি চাই, এবং ইত্যাদি। বাকি পৃথিবীর মতো এখানেও প্রকৃতির এবং বিশেষত অরণ্যের সম্পদ নয়ছয় করেই দেশ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সত্তরের দশকে পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রায় পরপর ঘটে যায়। অধুনা উত্তরপ্রদেশের (বর্তমান উত্তরাখণ্ড) একটা ছোট গ্রামের মহিলারা হঠাৎ বেঁকে বসে– যে জঙ্গল ঘিরে তাদের বাস, তার গাছ কেটে হকি স্টিক বানানোর কারখানায় চালান করা যাবে না। শয়ে শয়ে মহিলা গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে চিপকো আন্দেলন। সারা পৃথিবীর পরিবেশ আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রায় একই সময়ে কেরলের পালাক্কড় জেলার জঙ্গুলে মানুষ রেইনফরেস্ট কেটে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ রুখে দেয়। তৈরি হয় সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। এর কয়েক বছর পর, ১৯৮০ সালে তৈরি হল ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট। এই লেখায় এরপর থেকে যাকে আমরা এফসিএ ১৯৮০ নামে ডাকব। আরও বছর কুড়ি পরে, ২০০২ সালে এর দোসর হিসেবে আনা হয় বায়ো ডাইভারসিটি অ্যাক্ট (বিডিএ ২০০২)।
ভূমিকা শেষ, এবার আসল কথায় আসা যাক। যথাক্রমে ২৫ এবং ২৬ জুলাই ২০২৩, লোকসভায় বায়ো ডাইভারসিটি অ্যাক্ট (বিডিএ) এবং এফসিএ ১৯৮০-এর নতুন সংশোধন পাশ করা হল। এফসিএ ১৯৮০ তে বলা হয়েছিল জঙ্গল কেটে পাম তেলের চাষ, চা-কফি, মশলা, রাবার, ইত্যাদির চাষ করা চলবে না। কোনও ব্যক্তি এবং / অথবা বেসরকারি সংস্থাকে 'অরণ্য'-এর অংশ বিক্রি করা বা লিজ দেওয়া যাবে না। এই প্রসঙ্গে আমরা মনে করব বেদান্ত পর্ব। ২০১০ সালে ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় এলাকার জনজাতি বেদান্ত রিসোর্সেস নামক সংস্থার বক্সাইট খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। প্রকল্পটি এফসিএ ১৯৮০ লঙঘন করে অরণ্যের জমি দখল করছে এই ভিত্তিতে সেটাকে বাতিল করা হয়। একই কারণে ২০১৪ সালে বাতিল হয় ওড়িশার পসকো প্রকল্পটিও।
এবার নজর দিই বিডিএ ২০০২ এর দিকে। বায়ো ডাইভারসিটি বলতে গেলে বলা যায়, ছোটবড় গাছ, জীবজন্তু, পোকামাকড়, পাখি এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষ– এই সবকিছু নিয়েই জীববৈচিত্র্য। জীবনধারণের জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভর করে। অরণ্যে বসবাস করে যেসব মানুষ, তারা জ্বালানির জন্য কাঠকুটো জঙ্গল থেকেই সংগ্রহ করে। জঙ্গলের ঘাস দিয়ে তারা মাদুর বোনে, ঘরের চাল দেয়, প্রয়োজনমতো ফলমূল, লতাগুল্ম তুলে আনে। জঙ্গলকে ধ্বংস না করেও কীভাবে জঙ্গলের সম্পদ ব্যবহার করা যায়, এই শিক্ষা তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে নিয়ে চলেছে। এর উল্টো পথে, লোভের শিকার হওয়া মানুষ কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে যেমন দস্যু বিরাপ্পন। বিরাপ্পনের কথায় আসার আগে আরও কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। কাঠ ছাড়াও বেশ কিছু জিনিস জঙ্গলে পাওয়া যায়, যা চড়া দামে বাজারে (মূলত কালোবাজারে) বিক্রি হয়। যেমন হাতির দাঁত, বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর ছাল ও চামড়া, তাদের দাঁত, নখ, ইত্যাদি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের ক্রমবর্ধমান আয়ুর্বেদ নির্ভর পণ্যের বাজার। বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ ও ত্বকচর্চার উপাদান যেমন ঘৃতকুমারী, অশ্বগন্ধা, ভৃঙ্গরাজ, ইউক্যালিপটাস, অর্জুুন গাছ– এর মূল উৎস জঙ্গল। এর খানিকটা এখন চাষ করা হলেও, তার পরিমাণ নগণ্য। এইসব পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থা নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করেই সেসব সংগ্রহ করে আনছে।
এবার আসা যাক বিরাপ্পনের প্রসঙ্গে। নেটফ্লিক্সে কিছুদিন আগেই ওই নামে একটা তথ্যচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। দস্যু বিরাপ্পনের উত্থান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এতে ধরা আছে। বিরাপ্পনের ছিল হাতির দাঁতের চোরাকারবার। তথ্যচিত্রে তার এক সঙ্গী ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট করেই বলছে, বিরাপ্পনের আমলে কর্ণাটক-তামিলনাডুর সীমানায় এম এম হিলস অরণ্যে দাঁতাল হাতি নিঃশেষ হয়ে গেছিল। প্রায় এক হাজার হাতি বিরাপ্পনের দলের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। এছাড়াও তার ছিল চন্দনকাঠের কারবার। দক্ষিণ ভারতের ওই অঞ্চলের অরণ্যের মহার্ঘ সম্পদ চন্দনকাঠ; যার মালিকানা সরকারের। এই কাজ অবশ্যই বিরাপ্পন একা করত না। বেশ বড়সড় একটা দল ছিল যার প্রত্যেকটি সদস্য জঙ্গলের নাড়িনক্ষত্র চিনত। এরা সকলেই স্থানীয় মানুষ, জঙ্গলের আশেপাশেই এদের জন্ম, বেড়ে ওঠা। ফলে পুলিশকে নাকাল করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। দীর্ঘ পনের বছর ধরে তামিল নাডু এবং কর্ণাটকের পুলিশ চেষ্টা করে চলে বিরাপ্পনকে ধরতে। বেশ কিছু পুলিশকর্মীকে বিরাপ্পন এবং তার দলবলের হাতে খুনও হতে হয়। শেষমেশ ১৮ অক্টোবর ২০০৪, পুলিশ এনকাউন্টারে বিরাপ্পন এবং তার তিন সঙ্গীর মৃত্যু হয়।
তথ্যচিত্রটা বিরাপ্পনের মৃত্যুতে শেষ হয়। তার পর এই জঙ্গলের কী হল সেটা একটু দেখি। লোকটা মরার পরপরই হুহু করে বাড়তে থাকে ওখানকার জঙ্গলের নিষিদ্ধ জমির দাম। গত ১৫ বছরে কর্ণাটক সরকার ৫০৪৮ হেক্টেয়ার জঙ্গলের জমি কয়লাখনি, গ্র্যানাইট খনি, হোটেল ইত্যাদি প্রকল্পের জন্য 'divert' করেছে। অর্থাৎ সেসব জমি অরণ্যের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে চিহ্নিত করেছে 'উন্নয়ন'-এর স্বার্থে। বীরাপ্পনের জীবদ্দশায় যা ছিল কল্পনাতীত। বিরাপ্পনের ব্যবসা যেহেতু ছিল হাতির দাঁত আর চন্দন নিয়ে, জঙ্গলের অন্য কোনও সম্পদের প্রতি এদের আগ্রহ ছিল না। আর জঙ্গলে, বিরাপ্পনের ছিল একাধিপত্য। অন্য চোরাশিকারি বা জমি হাঙরদের সেখানে আধিপত্য বিস্তার করা ছিল অসম্ভব।
এবারে গোটা ভারতের দিকে নজর ঘোরাব। সংসদে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, গত পনের বছরে ভারতের তিন লক্ষ হেক্টেয়ার জমি এফসিএ ১৯৮০-এর অধীনে ‘ডাইভার্ট’ করা হয়েছে, অর্থাৎ অরণ্যের প্রয়োজন বহির্ভূত কারণে ব্যবহার করা হয়েছে। ৮৯ হাজার হেক্টেয়ার গত পাঁচ বছরেই। খনি, পর্যটন, ফ্যাক্টরি, রাস্তা, রেল লাইন, সবই আছে। এবারে প্রশ্ন হচ্ছে, এফসিএ ১৯৮০ তো জঙ্গল সংরক্ষণের জন্য তৈরি আইন, এর সাহায্য নিয়ে এসব করা গেল কীকরে? ভারতের সংবিধানের বিশেষত্ব হচ্ছে এই আইনের ফাঁক। প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত জমির ওপর যেহেতু কেন্দ্র এবং রাজ্য দুইয়েরই এক্তিয়ার রয়েছে, সেই প্রক্রিয়া খানিকটা জটিল এবং দীর্ঘ। সোজা কথায়, হুট বলতে খনি কোম্পানিকে জমি দিয়ে দেওয়া যায় না। যত্র তত্র একর একর জঙ্গল পাম তেলের চাষের জন্য লিজ দিয়ে দেওয়া যায় না। চাইলেই প্রতিরক্ষা বা উন্নয়নের নামে অরণ্যে বসবাসকারী সম্প্রদায়দের উচ্ছেদ করে ফেলা যায় না। বেশ কয়েক ধাপ পেরিয়ে তবে আইনি অনুমতি মেলে। বড় পুঁজির সংস্থাদের কাছে যা খানিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই যেমন নাগপুরের কাছে গোন্দখইরিতে আদানি পাওয়ারের ৮৬৩ হেক্টেয়ার জঙ্গলের জমি চাই। কয়লা তোলার জন্য। কিন্তু সেখানকার লোকজন বেঁকে বসেছে, গত জুলাইতে প্রথম পাবলিক হিয়ারিং ভেস্তে গেছে। কিন্নর জেলার গ্রামবাসীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে ১৪৩ হেক্টেয়ার জঙ্গল ডুবিয়ে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের লাগবে না। সরকারি আর কর্পোরেট ভাষায় এসব ঝামেলাকে বলে রোডব্লক। উন্নয়নের ঘোড়ায় সওয়ার শাইনিং ভারত যেসব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
শেষ করার আগে দু’লাইন অপ্রিয় কথা বলতে হয়। আমাদের পরবর্তী লোকসভা ভোট আর কয়েকমাস পর। জনমত নির্মাণের জন্য আজকাল যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়, যার পোশাকি নাম ভোট প্রচার, তার সিংহভাগ আসে কর্পোরেট সংস্থার তহবিল থেকে। বেদান্ত, আদানি, পসকোর মতো সংস্থারা স্বাভাবিকভাবে সেই দলেই বিনিয়োগ করতে চাইবে, যারা নির্বিচারে প্রকৃতির সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। আগামি ভোটের আগেই তাই এই আইনদুটো পাশ হওয়া খুব দরকার। জঙ্গলের অধিবাসীরা কি পারবে, এদেশের কৃষকদের মতো করে ছিনিয়ে নিতে নিজেদের অধিকার? ক্ষীণ আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকি। ভাবি, যে ছেলের নামের মধ্যে ‘অরণ্য’, সত্যিকার অরণ্য দেখতে তাকে কতদূর যেতে হবে?
(১১ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে Times পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বাংলা অনুবাদ)
গত সপ্তাহে উত্তর হরিয়ানার একটি ছোট্ট দরিদ্র শহর নূহ’য় বুলডোজার দিয়ে শত শত বাড়ি ও দোকান ভেঙে দেওয়ার পর এখন গোটা শহরটি শুধুই পাথর আর ধ্বংসাবশেষের স্তূপ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ধ্বংসপ্রাপ্ত সব বাড়ির বেশিরভাগই মুসলমানদের। স্থানীয় জনসংখ্যার শতকরা ৭৭ ভাগই মুসলমান।
৩১ জুলাই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পর তিন দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চলে। মারা যান কমপক্ষে ছ’জন, আহত বেশ কয়েকজন। সংঘর্ষ শুরু হয় শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়া কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী (ভিএইচপি ও বজরঙ দল – অনুবাদক)-র ধর্মীয় মিছিলের ওপর যখন নূহের মুসলিম বাসিন্দারা পাথর ছুঁড়তে শুরু করে, কারণ রটে গিয়েছিল একজন কুখ্যাত হিন্দু গুণ্ডা ( মনু মানেশর। এই লোকটি এক ভিডিও-তে জানিয়েছিল সে নিজে তার পুরো দল নিয়ে ওই মিছিলে উপস্থিত থাকবে। সুতরাং সবাই, সব হিন্দু মানুষজন যেন গো’মাতার নাম নিয়ে আর জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে ওই ধর্মীয় যাত্রায় উপস্থিত থাকে। এই বছরের গোড়ায় বজরঙ দলের সদস্য ও গো-রক্ষক সমিতির নেতা-কর্মী, মনু মানেশরের নাম খবরে বারবার উঠে আসে দুজন মুসলমান যুবক, জুনেইদ ও নাসির’-এর খুনী বলে। নূহ, পূর্বতন মেওয়াত জেলার দক্ষিণ ও পশ্চিমে রাজস্থানের আলোয়ার জেলা। মনু মানেশরের নামে রাজস্থানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও পুলিশ তাকে ধরে না। কেননা তার নাকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার প্রধান প্রধান মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবিও আছে। - অনুবাদক) উপস্থিত থাকবে ওই যাত্রায়। কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের আগেই দুই সম্প্রদায়ের বিক্ষুব্ধ জনতা, সম্পত্তি ভাঙচুর করে ,গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি রাস্তার দাঙ্গায় পরিণত হয়।
সুশীল সমাজগোষ্ঠীর মতে, ‘বুলডোজার’ ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায়, হাজার হাজার মুসলমানের বাড়ি, ব্যবসা এবং উপাসনালয় ধ্বংস করার জন্য যেভাবে একটি বড় বিচারবহির্ভূত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে তার অনেকগুলির মধ্যে নূহতে ধ্বংস অভিযান একটি উদাহরণ মাত্র।
দিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী খান মাহমুদাবাদ বলেছেন, ‘বিজেপির লক্ষ্য অর্জন করার জন্যে আইন আর প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দেওয়ার একটা উপায় হল, বুলডোজার৷
বিজেপি-শাসিত অনেক রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে, ধ্বংস করার অভিযান শুধুমাত্র মুসলিম ভিন্নমতকে দমন করার জন্য একটি সাধারণ কৌশল হয়ে ওঠেনি, বুলডোজার, হিন্দু-জাতীয়তাবাদী প্রতীক হিসাবে বিকশিত হয়েছে। বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ে, ভারতে এবং বিদেশে, প্যারেড ফ্লোটে, চিপসের প্যাকেটে এবং বেশ কয়েকটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সঙ্গীতেও ওই প্রতীক ব্যবহার করে। এমনকি বিজেপির বিজয় উদযাপনে যুবকেরা তাদের বাহুতে প্রতীকটি ট্যাটু করে নিয়েছে।
মাহমুদাবাদের কথায়, ‘এক অর্থে বুলডোজার, বিজেপি সমর্থকেরা যাকে 'দ্রুত ন্যায়বিচার' বলে থাকে তার একটি প্রতীক’।
৩ অগাস্ট নূহ-তে হরিয়ানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ বলেছেন, সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘বুলডোজার ন্যায্য পদক্ষেপের অংশও হতে পারে’। এর পরপরেই ‘বুলডোজার’ তার কাজ শুরু করে দেয়। কর্তৃপক্ষ পরে অবশ্য বলেছে যে ঝুপড়ি এবং সিমেন্টের কাঠামোগুলি বেআইনিভাবে নির্মিত ছিল, তাই এই ধ্বংস। বাসিন্দারা অনেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সোমবার (৭ই আগস্ট) পাঞ্জাব ও হরিয়ানার উচ্চ-আদালত ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করে দিয়েছে এবং প্রশ্ন করেছে যে বিজেপি সরকার বুলডোজার ব্যবহারের মাধ্যমে নূহের মুসলমানদের ‘জাতিগত নির্মূলের অনুশীলন’ পরিচালনা করছে কিনা!
দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর রাজনৈতিক গবেষক আসিম আলি বলেন, ‘এটি একমাত্র উদাহরণ যেখানে একটি আদালত এই ভুল বলার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।’ ‘অন্যত্র প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন দলের নীতি লঙ্ঘনের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি।’
বুলডোজিংয়ের ইতিহাস
ভারতের সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল বুলডোজার কেসটি ঘটেছিল যখন অযোধ্যা শহরের মুঘল-যুগের মসজিদ, বাবরি মসজিদ, ১৯৯২ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, এটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মামলাটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে জাতিকে ধর্মীয় মেরুকরণ করেছে। ২০১৯-এ সুপ্রিম কোর্ট মন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দুদের জমি হস্তান্তর করে। এবং ২০২০ সালে একটি বিশেষ ফৌজদারি আদালত মসজিদ ধ্বংস করার জন্য অভিযুক্তদের মুক্ত করে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সমসময়ের চারপাশের ঘটনাসমূহ ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপির অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার রাজনৈতিক কেরিয়ার গঠন ও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল। এরা সবাই মসজিদ ধ্বংস এবং নতুন মন্দির নির্মাণের তত্ত্বাবধানে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন।
অনেক স্থানীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র বুলডোজারকে আলিঙ্গন করেছেন। যোগী আদিত্যনাথ, একজন হিন্দু ধর্মগুরু এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি ‘বুলডোজার বাবা’ বা ‘বুলডোজারের পিতা’ ডাকনাম অর্জন করেছেন।
এবং ধ্বংসের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের প্রচণ্ড বিক্ষোভের মতো অত্যন্ত উত্তেজনার মুহূর্তেও তারা, তাদের বুলডোজার নীতির বিরোধিতা করেননি। এই জন্যই অধিকার রক্ষার গোষ্ঠীরা বলেছে যে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বজায় রয়েছে। এবং গত এপ্রিলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ উত্তর প্রদেশের আরেকটি প্রাচীন মসজিদকে বুলডোজ করার জন্য উচ্চ আদালতের আদেশকে অস্বীকার করেছিল।
বছরের পর বছর ধরে ধ্বংসের মোট সংখ্যা সম্পর্কে কোনও সরকারি তথ্য নেই। তবে গবেষকরা তাদের গণনা করার চেষ্টা করেছেন। দিল্লির হাউজিং অ্যান্ড ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক অনুমান করে যে সরকার কমপক্ষে ৪৩০০০ বাড়ি ভেঙে দিয়েছে এবং ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুলাই ২০২১ পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২১ জনকে উচ্ছেদ করেছে, তাদের প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে।
আইনের প্রতি অবজ্ঞা
বুলডোজিং অধ্যয়নরত গবেষকদের আরেকটি স্বাধীন নেটওয়ার্ক, ল্যান্ড কনফ্লিক্ট ওয়াচ-এর একজন আইনজীবী আনমোল গুপ্ত উল্লেখ করেছেন যে অনেক ক্ষেত্রে, তাদের ব্যবহারে সাধারণত আইনের অমান্য করাই হয়েছে। কেননা উচ্ছেদকারীদের অগ্রিম অবহিত করা উচ্ছেদ বা ধ্বংসের একটি আইনি পূর্বশর্ত এবং ভারতীয় সংবিধানে সুরক্ষিত একটি মৌলিক অধিকার। তিনি টাইমকে বলেন, ‘এই অধিকারের মানে হল, বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা চাইলে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পায় এবং তাদের শুনানির সুযোগ দেযওয়া হবে’। ‘আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, উচ্ছেদগুলি সংবিধানের মূল অধিকার লঙ্ঘন করছে।’
নূহের ক্ষেত্রে, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার উচ্চ আদালত বলেছে যে, তাত্ক্ষণিক জনতার বিচারের নজির স্থাপন করতে গিয়ে পদ্ধতিগত এবং মৌলিক অধিকার উভয়ই বুলডোজার দিয়ে লঙ্ঘন করা হয়েছে। কিন্তু এমন একটি রায় একবারেই বিরল। এই রায় যে বিরল, সেটা বোঝা যায়, যখন গত জুলাইয়ে, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে সরকারের বুলডজার নীতি থামানোর জন্য একটি মামলার শুনানির পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট, ধ্বংসের বিষয়ে সরকারের লাইনকে মান্যতা দিয়ে, আদালত ধ্বংস অভিযানে স্থগিতাদেশ দিতেও অস্বীকার করেছে, এই যুক্তিতে যে পৌর কর্তৃপক্ষেরও ‘অননুমোদিত’ নির্মাণের ওপর নিজস্ব অধিকার থাকা উচিত। অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহমুদাবাদ-এর কথায়, আদালত যেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে সেখানেও ‘ধ্বংসের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করলেও ইতিমধ্যে অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।’
অনুবাদকের সংযোজনঃ
(১) NDTV, ১৩ আগস্ট, ২০২৩, বিকেল ৫ টাঃ ‘কোনো ঘৃণাসূচক বাক্য নয়’ এই শর্তসাপেক্ষে বড় জনসমাবেশের সম্মতি দেওয়া হলেও, আজ হরিয়ানার পালওয়াল জেলায় একটি হিন্দু গোষ্ঠীর ডাকা বড়সড় গণজমায়েতে বক্তারা একের পর এক ঘৃণা ছড়িয়ে বক্তব্য রেখে গেছেন। একজন বক্তাকে বলতে শোনা গেল, ‘আমাদের দিকে আঙ্গুল তুললে আমরা তোমাদের হাত কেটে দেবো।’ আরেকজন বক্তা নূহ’র প্রত্যেক হিন্দুর জন্য রাইফেলের লাইসেন্স দাবি করলেন।
ইতিমধ্যে ৫১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হরিয়ানার একটি মহাপঞ্চায়েত প্রস্তাব নিয়েছে, সমগ্র নুহ জেলাতে গোহত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে। কমিটির দাবি, নূহ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্যারামিলিটারি ফোর্সের একটি সদর দপ্তর এই অঞ্চলে তৈরি করতে হবে। কমিটির আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, অন্য অঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে আসা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোহিঙ্গা সহ বিদেশ থেকে আসা সবাইকে অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। সরকারকে নূহ এবং পালওয়াল জেলার সব হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। মামলা যা আছে সব মামলা, নূহ থেকে গুরগাঁও বা অন্য কোন জেলায় স্থানান্তরিত করতে হবে। কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে জলাভিষেক যাত্রা ৩১ জুলাই দাঙ্গার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটা আবার শুরু হবে আগস্ট মাসের ২৮ তারিখে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রিজ মন্ডল ধার্মিক যাত্রা। সমস্ত রাজ্য থেকে মানুষ মিছিল নিয়ে নলহার মন্দিরে পৌঁছাবেন এবং সেখান থেকে শ্রীনগর টেম্পলে মিছিল করে যাবেন, সম্মতি দেয়া হোক বা না হোক। শুধু তাই নয়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্তৃত্বে হরিয়ানার এই মহাপঞ্চায়েত ‘মুসলমান’দের বিরুদ্ধে অর্থনৈরিক অবরোধের ডাক দিয়েছে।
অন্যদিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (১০/০৮/২৩) জানাচ্ছে, তার আগের দিন অর্থাৎ বুধবার একটি কৃষক পঞ্চায়েতের নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা। যেখানে হিন্দু মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায় থেকে আগত প্রায় দু হাজার কৃষক, সভা করেছেন হিসার জেলায়। সমাবেশের কৃষক নেতা সুরেশ কোথ বলেছেন এখানে মুসলিমরাও আছেন। তাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। তাদের সুরক্ষিত করার রাখার দায় আমাদের। বুধবারের পঞ্চায়েতের কৃষকেরা শপথ নিয়েছেন তারা কোন বর্ণ বা সম্প্রদায়গত হিংসাকে প্রশ্রয় দেবেন না। নূহ জেলায় সর্বতোভাবে শান্তি রক্ষা করবেন, শান্তি ফিরিয়ে আনবেন।
হরিয়ানার গুরুগ্রামে দরিদ্র ও দিনমজুর মানুষজনের বসতি ঘিরে পোস্টার পড়েছে ২৮ আগস্টের দু-একদিন আগে থেকে, ‘৪৮ ঘন্টা সময় দেওয়া হলো। তার মধ্যে এই জায়গা ছাড়তে হবে। এই জায়গা না ছাড়লে নিজেদের মৃত্যুর জন্য তোরাই দায়ী থাকবি। এমনকি তোদের বৌ-বাচ্চারা ঘর থেকে বের হলে তাদের ধর্ষণ করা হবে। ’ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধ পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, বেআইনি দখলিকৃত এলাকা ছাড়তে হবেই বস্তিবাসীদের। (২৮ আগস্ট, ২০২৩)
এঙ্গেলস একাডেমি পি.ডি.এফ.লাইব্রেরি
আমাদের 'এঙ্গেলস একাডেমি পিডিএফ লাইব্রেরি'-তে যে বইগুলোর পিডিএফ রেখেছি
১. নিপীড়িতের শিক্ষাবিজ্ঞান (২০১৫)
(পেডাগজি অব দি অপ্রেসড্-এর বঙ্গানুবাদ)
২. দেশের ডাক (২০২২)
৩. বার্তা পত্রিকা
৪. বদরুজ্জামান চৌধুরীর উপন্যাস সংকলন (২০২২)
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে)
এই লাইব্রেরিতে খুবই শীঘ্র রাখব ----
১. সোভিয়েত রাশিয়া : অর্থনীতি ও মতাদর্শের কিছু সমস্যা (১৯৮৩)
২.শিশুনাট্যের সন্ধানে ( বইমেলা ১৯৯৯ )
৩. মানুষের স্বাধীনতা : মন ও সমাজ ( ডিসেম্বর ২০০৪ )
৪. সোভিয়েত হেরে গেল কেন ( ২০০৬ )
৫. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ( ২০০৬ )
৬. আক্রান্ত পৃথিবী আক্রান্ত স্বদেশ ( ২০০৭ )
৭.ভালো থাকো দেশ ( ২০১৩ )
৮. কোম্পানি থিয়েটার ( ২০১৮ )
১২. স্বামীর ঘরে কাজের জন্য বউরা কি মূল্য ও মজুরি পেতে পারে ? (২০২২)
আমরা একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি
৯৭০৬৩৮২৮১০
ইচ্ছুক পাঠিকা-পাঠক এই নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে যে কোনো পিডিএফ-এর রিকোয়েস্ট পাঠাবেন ।
তদনুযায়ী আপনার হোয়াটসঅ্যাপে পিডিএফ পাঠানো হবে।
আপনারা যথারীতি প্রিন্ট আউট করে নিয়ে অথবা
সরাসরি পিডিএফ থেকে বইটি পড়তে পারবেন ।
(একটি সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক লেগেপড়ে থাকা )
ধন্যবাদ
(কথাপ্রান্তিকবিজয়া ও শুভঙ্কর চন্দের সম্মিলিত প্রয়াস )
নারী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষা রির্পোট থেকে আমরা জানতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের প্রায় অর্ধেক মেয়ে, কেবলমাত্র বাড়ির কাজ করেই দিন কাটাচ্ছে। রাজ্যে কোভিড পূর্ববর্তী (২০১৯ সাল) সময়ে করা অন্য একটি সমীক্ষা (জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা এন.এইচ.এফ.এস) ২০২২ সালে প্রকাশিত হলে সেই রির্পোটে মুর্শিদাবাদ(৫৫.৪%), বীরভূম(৪৯.৯%), মালদা (৪৯.১%), পশ্চিম মেদিনীপুর(৫৫.৭%), পূর্ব মেদিনীপুর (৫৭.৬%) সহ অন্যান্য জেলার নাবালিকা বিবাহের যে পরিসংখ্যানটি আমরা দেখছি সেটি রীতিমতো উদ্বেগজনক। কাজেই রাজ্যের নানান প্রান্তে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের বেশী হারে নাবালিকাদের বিয়ে হলে, ঘরকন্নার কাজই তাদের ভবিতব্য হবে সে আর নতুন কথা কি!
রাজ্যজুড়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পরিবির্তিত সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে মেয়েদের অকাল বিয়ের কারণ অনুসন্ধানের কাজটি কঠিন। সেদিন সদ্য কলেজ পাশ করা সহকর্মী বলছিল-‘আজকাল ঘটকদের ব্যবসা ডাউন চলছে। ঘটকরা এখন ঘটকালি পিছু পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চাইছে’। মালদা মুর্শিদাবাদের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সহকর্মীটির কথার যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম। ওরা বলছিলেন –‘আমাদের ওখানের গ্রামগুলোতে এখন আর বিয়ের আগে ‘মেয়েদেখা’র আয়োজন করতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। ‘পাত্রী দেখা’র আয়োজন মানে কোন কাকিমা ভালো রাঁধে, কোন বৌদি ভালো সাজায়- সে এক হৈহৈ কাণ্ড। এখন ছেলেমেয়েরা হয় প্রেম করে বিয়ে করছে নয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। কত দূরদূর জেলা থেকে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা সব গ্রামে বউ হয়ে আসছে আপনি ভাবতেও পারবেন না’।
বাংলার নানান প্রান্ত থেকে মেয়েরা যে গ্রামে বউ হয়ে আসছে তার খানিক আভাস পাচ্ছিলাম গতবছর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ছ’টি ব্লকে কাজ করতে গিয়ে। সেখানে দেখছিলাম পঞ্চাশ উর্ধ ব্যক্তিদের পরিবার ও আত্বীয়রা বিবাহ সূত্রে যুক্ত হয়েছেন পাশাপাশি অঞ্চলের মানুষের সাথে। পরবর্তী প্রজন্মের শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকার প্রসঙ্গ উঠতেই সকলে প্রায় একমত –‘এখন কি আর সেসব দিনকাল আছে। কি করে যে ভাব ভালোবাসা হচ্ছে। দুদিন পর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না হয় হুমকি দিচ্ছে- ওর সাথে বিয়ে না দিলে গলায় দড়ি দেবো’। কাজেই ঘটকদের ব্যবসা ডাউন চলাই হোক বা দূর দূর জেলা থেকে নাবালিকা সাবালিকা মেয়েদের বউ হয়ে গ্রামে আসাই হোক এগুলির কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মালদা জেলার চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মী বলছিলেন- ‘আমাদের কাছে যত নাবালিকা বিয়ের কেস আসে তার চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি প্রেম তারপর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মেয়ে প্রেম করছে জানতে পারলে, মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করবে- পরিবারের সম্মানহানি হবে সেই আশঙ্কা থেকেও অভিভাবকরা নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন’।
মাসখানেক আগে একদল মিড-ডে-মিল কর্মীর সাথে আলাপ হয়েছিল। কৌতুহলবশতই সেদিন স্কুলের রান্না ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম । বেশ বড় রান্না ঘরটিতে রান্নার বিরাট আয়োজন। তারই একপ্রান্তে এক ব্যাগ উপুড় করা কয়েকশ পেন, ঢাকা-খোলা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভারী অবাক হয়েছিলাম। শুনলাম এই স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ও উপস্থিতির হার বেশি। প্রায় হাজারখানেক ছাত্রছাত্রীর জন্য রান্না করতে হয়। তাই মিড-ডে-মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বারো থেকে পনেরজন সদস্য রান্না করতে আসেন। পেনের প্রসঙ্গ উঠতেই আঠাশ উনত্রিশ বছরের শীর্ণকায় মা, রান্না করতে করতে খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলছিলেন- ‘কি করবো ম্যাডাম। গরীব ঘরে জন্মেছি। সতের বছর বয়সে বাপমা সেই একটা গরীব ঘরেই বিয়ে দিয়ে দিল। ইস্কুলে রান্না করে কটা টাকাইবা পাই। মেয়েটা এই ইস্কুলে নাইনে পড়ে। নাইন ক্লাসে ঊঠলে দুপুর মিড-ডে-মিল খেতে পায়না। খিদে পাক না পাক ঘন্টা পড়লে খেতে তো ইচ্ছা করে। দশটা টাকা দিতাম মেয়েটা দুপুরে মুড়ি খেতো। তাই নিয়ে সংসারে কি অশান্তি’। একজনের কষ্টের কথা উঠতেই বাকিরা প্রায় সকলে বলছিলেন সংসারের কাজ সামলে কিভাবে তারা সাড়ে দশটায় ইস্কুলে আসেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারটে বাজে। এই গরমে বাড়ি ফিরে রাতের রান্না, সংসারের যাবতীয় কাজ করতে কষ্ট হলেও সেটি মেনে নিতে পারেন কিন্তু মেনে নিতে পারেননা যখন শুনতে হয় ‘সাতদিন রান্না করে যদি ঝালমুড়ি খেতেই একশ টাকা খরচা হয়ে যায় তবে অমন রোজগারের দরকার কি?’। শীর্ণকায় মা খুন্তি হাতে সবজি নাড়তে নাড়তে বললেন- ‘লেখাপড়া জানিনা তাই দিনরাত গতরে খেটে দুটো টাকা রোজগার করি কিন্তু সেখান থেকে মেয়েটাকে টাকা দিতে পারিনা। ওই যে দেখো মেঝেতে পেন ঢালা আছে। একশটা পেনের ঢাকা পরিয়ে দশ টাকা রোজগার করি। বাড়িতে, ইসকুলে কাজের ফাঁকে এটা করি। ঝগড়া অশান্তি কম হয়নি তবু মেয়েটাকে পড়ানোর জন্য করতেই হয়। দুপুরে খিদে পেলে পড়ায় মন থাকবে না। দুদিন পরে ইসকুল আসা বন্ধ করে দেবে’। শুনছিলাম-‘জানো দিদি আমাদের মতো সংসারে লেখাপড়া করে ভদ্রভাবে রোজগারের টাকায় মেয়েদের তাও কিছু অধিকার থাকে কিন্তু মেয়েদের গতরটা সংসারের, তাই গতরে খাটা রোজগারের টাকাটাও সংসারের’।
ওরা বলছিলেন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানটা কত জরুরী। সেটা বোঝাতে ওরা ওদের নিজেরদের কষ্টের কথা, বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থের ওপর তাদের অধিকার না-থাকার কথা মেয়েদের সাথে আলোচনা করেন। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল মায়েরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখাপড়া শিখে মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার কথা ভাবছেন সেখানে নাবালিকাদের বিয়ে ব্যাপারটি অপ্রাসঙ্গিক। এসব আলোচনায় রান্নার গতি স্লথ হয়ে আসছে বুঝেও প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন –‘তোমরা আমাদের অশিক্ষিত মনে করো দিদি। চারদিকে যা পরিস্থিতি। কি ঘটছে জানো তো সব। বাপমা যে কি দুঃখে সাতসকালে মেয়ের বিয়ে দেয়। ইসকুলে যতক্ষণ থাকে মাষ্টার দিদিমনিরা দেখবে, ঘরকে গেলে আমরা, কিন্তু ইসকুল আর ঘরের মধ্যেকার রাস্তাটুকু কে পাহারা দেবে বলো? ইসকুলের দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে দিয়েছে ফোন আনা নিষেধ। ঘরে ঢুকলে সেই ফোনে ফোনে গল্প প্রেম। আজকালকার ছেলেপুলেরা কারো কথা গ্রাঝ্ঝি করে না। আমাদের পাড়ার একটা সেভেনে পড়া মেয়ে প্রেম করতো কেউ জানতে পারেনি। মেয়েটা যেদিন মরলো সেদিন জানা গেল। পুলিশ মেয়েটার ফোন থেকে জানতে পেরেছে ছেলেটা মেয়েটাকে স্টেশনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর রেললাইনে ঠেলে দিয়েছে। পোস্টমর্টম করে জানা গেছে যে মেয়েটার পেটে বাচ্চা ছিল’। পাশ থেকে একজন ছাত্রীর মা বললেন- ‘আমার দেওর তার মেয়েটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলা বন্ধ করিয়েছিল কিন্তু ওই পাড়ার এইটে পড়া মেয়েটার যখন বিয়ের আগেই পেটে বাচ্চা এলো, তা শুনে ভয়ে নাইনে পড়তে পড়তে নিজের মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিল’।
নাবালিকাদের বিয়ে প্রসঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষাকর্মী, চাইল্ড লাইনের কর্মী, সেচ্ছাসেবী সংস্থা, সরকারী আধিকারিক থেকে শুরু করে প্রায় সকলে স্মার্ট ফোনকেই সবথেকে বেশী দায়ী করছেন। সেদিন মালদা জেলার একজন মাষ্টারমশাই বলছিলেন-‘দেখুন এখন বাচ্চা বুড়ো সবার হাতে ফোন। বেশীরভাগ মানুষ মনে করেন স্মার্ট ফোন থেকে ছেলেমেয়েদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ হচ্ছে কিন্তু আমি কো-এড স্কুলে পড়াই। ছেলেমেয়েদের খুব কাছ থেকে দেখি। স্কুল চত্তর তো আছেই, তাছাড়া বন্ধুর দাদা বা বোন, পাশের স্কুলের কেঊ- সহজে আলাপ গল্প প্রেম বাড়ি থেকে পালানো এসব নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা’। আরও বলছিলেন- ‘আমাদের এখানে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। দেখছেন তো এখনও অনেক মেয়ে হিজাব পরে স্কুলে আসে কিন্তু তাই বলে কি ছেলেমেয়েদের মেলামেশা কম? নাকি মেয়েরা গৃহবন্দী?’। স্কুল চত্তরে বা স্কুল যাতায়াতের পথে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার যে অবাধ সুযোগ, তেমনটা আর কোথায় আছে বলুন তো?’।
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সত্যি তো এই কয়েকদিন যাতায়াতের পথে স্কুল ড্রেস পরা ছেলেমেয়েদের আমবাগান, রাস্তার ধারে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখছিলাম। মালদার ইংলিশবাজার এলাকার সেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী হিসেবে তিরিশবছর যিনি কাজ করছেন তিনি মালদা জেলার নাবালিকাদের বিয়ের পরিসংখ্যান শুনে বলছিলেন-‘বছর তিনেক আগেও সেটা ৭২% ছিল। তবে পরিবর্তন যেটা হয়েছে সেটা হলো আগে বিয়ে দেওয়া হতো আর এখন নাবালিকা হোক বা সাবালিকা এখন তারা নিজে বিয়ে করে কিংবা পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু এতে বিপদ হলো ছেলেমেয়েদের এই প্রবণতার ফলে শুধু নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে তা নয় পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাও বাড়ছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান জানতে পারা যায় না। বিহার-সীমান্ত এলাকা পানজিপাড়ায় (জেলা: উত্তর দিনাজপুর) একটা বড় ব্রথেল আছে, সেখানে মেয়েদের বয়েস শুনলে চমকে যাবেন। সেটি মাফিয়ারা চালায় আর সেখানে এম.এল.এ/এম.পি.-দের যাতাযাত। পুলিশ সেখানে যেতে ভয় পায়। সেখান থেকে একটা মেয়েকেও রেসকিউ করা যায় না’।
শিশুমনে এমন ‘প্রেম’ বসতি শুনে খানিক অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। সেদিন ক্লাস থ্রী’র একজন ছাত্রী বলছিল-‘জানেন তো স্যার আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রোপজ করেনি’। ছোটদের মুখে এমন কথা শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে বইকি কিন্তু তার থেকেও বেশি অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেদিন যখন হলঘর ভর্তি ক্লাস সেভেন ও এইট-এর মেয়েরা অকপটে তাদের বন্ধু বা একই ক্লাসে পড়া আত্মীয়দের প্রেম গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা আলোচনা করছিল- ‘জানো দিদি, রিমা সেভেনে পড়তো। ওর পেটে বাচ্চা আছে বুঝতে পারেনি। গোলাপি শাড়িপরা দিদিমনি বুঝতে পেরে বলেছিল ওর মাকে বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা শুনেই রিমা জমিতে যে বিষ দেয় সেই বিষ খেয়ে মরে গেল’। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে যে শিশুরা এমন অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে কিভাবে। শিক্ষকরা বলছিলেন ‘স্কুল ছুটির পর দরজাবিহীন ক্লাসরুম বা আড়াল-আবডাল, যে হারে বাচ্চারা ব্যবহার করে, আপনি ভাবতেও পারবেন না’। নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা বলছিলেন ‘যে হারে শিশু সন্তানদের এবরস্যানের রেট বেড়েছে শুনলে স্তম্ভিত হবেন। মাঝেমাঝে আমরা হতাশ হয়ে বলে ফেলি কি করে এসব ঘটালি? শিশু বলেই হয়তো এরা অকপটে বলতে পারে ‘আমাদের হোগলা বন আছে, আমাদের আমবাগান আছে’।
মনে হচ্ছিল শিশু বা কিশোরকিশোরীদের যৌনমিলনের সুযোগ বা অভিজ্ঞতা যত বাড়বে নাবালিকা বিবাহ, শিশু পাচার, শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলি দিন দিন ততই বেড়ে চলবে। এভাবেই নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হবে, থানা পুলিশের ভয় দেখিয়ে তাদের নিরস্ত্র করাও দিনকে দিন অসম্ভব হলে উঠবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা অভিভাবকদের ‘অশিক্ষিত অসচেতন অভিভাবক’ বলে চিহ্নিত করে ফেলার আগে ‘ইসকুল আর ঘরের মধ্যেকার রাস্তাটুকু কে পাহারা দেবে বলো?’ বা ‘পোস্টমর্টম করে জানা গেছে যে মেয়েটার পেটে বাচ্চা ছিল’-মতো ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানকে ঘিরে আশঙ্কা, উৎকন্ঠাটুকু সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবো। চাইল্ড লাইনের কর্মী অথবা ব্লক স্তরের সি.পি.সি.( চাইল্ড প্রটেকশন কমিটি) কর্মীরা বলছিলেন যে তারা আনুমানিক ৩০- ৪০ শতাংশ নাবালিকার বিয়ের আসরে হাজির হতে পারেন। সেখানে পুলিশসহ প্রশাসনের উপস্থিতিতে বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা বা ভয় দেখান সবই হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অভিজ্ঞতাটি ‘সবেমিলে একটা কেওয়স তৈরি হয় কিন্তু কটা বিয়েইবা আটকাতে পারি?’র মতো হতাশাজনক। মালদার সেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী বলছিলেন-‘এসব ক্ষেত্রে ইনটারভেনশনে এমনটাই হয়। বাবামাকে মুচলেকা পর্যন্ত লেখান হয় তারপর সবাই চলে গেলে রাতের বেলা বাড়ি বন্ধ করে স্বপরিবারে অন্য কোথাও গিয়ে মেয়েটির বিয়ে দেয়। কিন্তু হবে নাই বা কেন বলুন তো? যারা বিয়ের আসরে হাঙ্গামা করে বাড়ি ফিরে গেলেন তারা কোনদিন সেই মেয়েটি স্কুলে যাচ্ছে কিনা তার বিয়ে হয়ে গেল কিনা খোঁজ নেন? আপনি একটু আগে চাইন্ড ম্যারেজের রেকর্ড পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইছিলেন তো, না, সেরকম সঠিক রের্কড কোথাও পাবেন না। প্রথমদিকে চাইল্ড লাইন কর্মী হিসেবে আমাদের মনিটারিং-এ এইসব মেয়েদের নিয়মিত খোঁজ রাখতাম। বাবামা জানতো আমরা খোঁজ রাখছি। কিন্তু সেটা একটা ব্লকের কতটুকু বা জায়গায়! প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এখন সেটাও বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার আট-নয় মাস অন্তর টাকা দেয়, নিয়মিত পারিশ্রমিক না পেলে কর্মীরা কাজ ছেড়ে দেয়। নতুন কর্মী এলাকা চিনে ওঠার আগে, বিভিন্ন স্তরে সি.পি.সি.-র সদস্যদের সাথে পরিচিত হতে হতে আরও কয়েকশ নাবালিকার বিয়ে হয়ে যায়’। সংস্থার সেক্রেটারী বলছিলেন – ‘প্রতিরোধের এই লড়াইটি অসম লড়াই। নাবালিকা বিবাহের ঘটনায় আত্মীয়, প্রতিবেশী থেকে গ্রামবাসীর এককাট্টা সমর্থন থাকে কারণ তারাও কন্যা সন্তানের অভিভাবক’। গ্রামবাসীদের এককাট্টা সমর্থন প্রসঙ্গে সেদিন অফিসে একজন বলছিলেন –‘ নাবালিকার বিয়ের খবর থানা জানতে পারলে থানা থেকে অনেকসময় সিভিক ভলান্টিয়ার্স পাঠায়। নাবালিকার পরিবার সিভিক ভলান্টিয়ার্সদের প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়। গ্রামবাসীরা একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ালে ওরা একা কিছু করতে পারেনা। সে পুলিশই হোক বা ভলান্টিয়ার্স। তাছাড়া ওরা নিজেও মনে করে আহা মেয়েটার বিয়ের আয়োজন হয়েছে সেটা ভেঙে যাবে’। এভাবেই থানার প্রতিনিধির সামনেই নাবালিকাদের বিয়ের মতো ঘটনা ঘটছে।
সিভিক ভলান্টিয়ার্সদের প্রসঙ্গ উঠতেই মূর্শিদাবাদের চাইল্ডলাইনের কর্মী বলছিলেন— ‘জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাটিও খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমরা যখন ইনটারভেনশনে যাই পঞ্চায়েত প্রধান বা মেম্বারকে সঙ্গে পাইনা। যে জনরোষের মধ্যে আমাদের পড়তে হয় তাতে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও জনপ্রতিনিধিরা সঙ্গে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সুবিধে হতো। এসব ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত প্রধান সবার আগে গা ঢাকা দেয়’। জেলার অন্য ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা বলছিলেন-‘সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন থাকলেও আমরা মহিলা বলেই হয়তো গ্রামবাসী সবার আগে আমাদের অ্যাট্যাক করে। একবার হেসো নিয়ে আমাকে মারতে এসেছিল। একজন পুলিশ সেদিন কোন উপায়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। পাশের বাড়িতে থাকা মেম্বার সেদিন পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসেননি’। বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা সি.পি.সি-র সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বিষয়ে ব্লক স্তরের আধিকারিকরাও হতাশা প্রকাশ করছিলেন-‘যে পাড়ায় ঘটনা ঘটছে সেই একই পাড়ায় মেম্বারের বাড়ি, তা সত্ত্বেও তার সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এমনও ঘটনা ঘটছে যে ‘আমি দেখছি আপনারা যান’ এই বলে পুলিশকে সরিয়ে দিয়ে মেম্বার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গ উঠতেই নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের প্রাক্তন কর্মী বলছিলেন –‘ইরিগেশন, ফরেষ্ট ইত্যাদির মতো কিছু ডির্পাটমেন্ট ছাড়া অন্য কোন ডির্পাটমেন্ট পঞ্চায়েতকে পাত্তাই দেয়না। সরকারি দপ্তরগুলি যদি পঞ্চায়েতকে গুরুত্ব না দেয় তবে তারাইবা কেন সরকারকে অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করবে? আবার কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থেও নাবালিকা বিয়ে প্রতিরোধের ঘটনায় এরা সচেতনভাবে আড়ালে থাকতে চান। তবে পুরুলিয়া মুর্শিদাবাদের মতো কিছুকিছু জেলায় আমরা প্রথম থেকে পঞ্চায়েতকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। বহু জায়গাতে আমরা পঞ্চায়েতের সহযোগিতা পেয়েছি’।
এতদিন নাবালিকাদের বিয়ে থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অসচেতনতার জন্য দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমরা জেনে এসেছি। আজ তাতে নতুন করে যুক্ত করছি কোভিডের মতো ঘটনাকে। নারী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত রির্পোটটি দেখে অনেকের মনে হচ্ছে যে কোভিডের সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এমনটা ঘটছে। তাহলে রাজ্যে কোভিড পূর্ববর্তী (২০১৯ সাল) সময়ে করা এন.এইচ.এফ.এস রির্পোটটি? আমরা সেখানে দেখছি রাজ্যের যে পাঁচটি জেলায় নাবালিকা বিবাহের হার বেশি সেখানে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মেয়েদের [মুর্শিদাবাদ (৬৭.৬%),বীরভূম (৭০.৮%), মালদা (৭২.৩%),পশ্চিম মেদিনীপুর (৭০.৯%), পূর্ব মেদিনীপুর (৭৭%)] শিক্ষার হারও উচ্চ অর্থ্যাৎ এরা নবম শ্রেণি বা তার বেশি পড়াশোনা করা সত্ত্বেও সেখানে এধরনের ঘটনা ঘটছে।
সাধারণ নিম্নবিত্ত গরীব মানুষদের ‘অসচেতন’ বলার অসুখটি ভারী সংক্রামক। নাবালিকাদের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই ‘আমরা চাই আপনি এবিষয়ে লিখুন, তাতে করে যদি বাবা-মা একটু সচেতন হয়’-এমন কথা শুনেছি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিরোধকারী প্রায় সকলের মুখে। অকালে বিয়ের কারণ অনুসন্ধানের কাজটি ঠিক এই জায়গাতেই বড্ড কঠিন। আমরা যদি ধরেই নিই যে অভিভাবকদের অসচেতনাই বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে অন্যতম বাধা তবে প্রতিরোধের সঠিক রাস্তাগুলির অনুসন্ধান করবইবা কেমন করে? শুধুমাত্র কলকাতার পাশের জেলাগুলি থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মায়েরা ভোররাতে পেশাগত কারণেই শহরে আসেন। একলা ঘরে অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে সন্তানের প্রেম, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে বা পাড়ার অমুকের মতো ‘অঘটন’ ঘটার সম্ভাবনার বা সন্তানের বিপদের কথা ভেবে মায়ের আতঙ্কটিও কিন্তু স্বাভাবিক। সামাজিক সম্মান হোক বা আত্মসম্মান সেটিকে কি আমরা কালিমালিপ্ত হতে দিতে চাই? গরীব বলে কি সন্তানের জন্য উদ্বেগ বা সামাজিক অসম্মানের ভয় থাকবে না? সামাজিক সমস্যার কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের এই শ্রেণিবিভেদের মানসিকতাটি অভিভাবকদের আশঙ্কা অসম্মান ইত্যাদি প্রসঙ্গে উদাসীন থেকে অসচেতনতার প্রসঙ্গটিকে এভাবেই বারেবারে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কোন অর্থেই সমর্থনযোগ্য না হতে পারে কিন্তু মা যখন মনে করেন ‘ছোটছোট ভাইবোনেদের সাথে মেয়েটাকে একলা ঘরে রেখে আমরা কাজে যাই। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। যদি কোন অঘটন ঘটে। তাই বিয়ে দিয়ে দিলাম। ছেলেটার চপের দোকান আছে। খেয়ে পরে পরিবারের পাঁচটা লোকের সাথে বাঁচবে’। সন্তানকে ঘিরে অভিভাবকের এই আতঙ্কটিকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা না করলে বা সেটিকে অস্বীকার করলে প্রতিরোধের বাঁধনগুলি আলগা হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের জীবনে বহু অনিবার্য পরিস্থিতি থাকে যার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়। গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসটেপিসটে জড়িয়ে থাকে। যার থেকে বেরনোর উপায় থাকে না। আমরা সেটিকে নির্বিচারে অসেচতনতার তকমা দিই।
মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যপারে প্রায়শই শোনা যায়- ‘আমার মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো, ছেলের বাড়ি থেকে বললো টাকাপয়সা লাগবে না তাই বিয়েটা দিয়ে দিলাম’। শুধুমাত্র বিনা পণে বা পণের টাকা কম দেওয়ার সু্যোগ থাকায় কত নাবালিকা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে সে পরিসংখ্যানটি আমাদের অজানা হলেও ২০১৪ সালে দেখেছিলাম তিনটি প্রজন্মের (পিসী, দিদি, মেয়ে) মেয়ের বিয়েতে পণ দিতে গিয়ে এক একটি পরিবারের বছরভর খাদ্য জোগানকারী কৃষি জমি, গয়না, বাসনপত্র, ভিটেমাটি একে একে হাতছাড়া হয়ে গেছে। পরিবারের মহিলা ও পুরুষ সদস্যরা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। পণ নামক সামাজিক ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত এইসব মানুষেরা যদি ‘সচেতন’ হয়েও থাকেন তাহলেও কি অকাল বিয়ের মতো সামাজিক অসুখ থেকে নিজের সন্তানকে তারা আগলে রাখতে পারবেন?
আমাদের সমাজে সন্তানের বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অভিভাবকের সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেও গণ্য করা হয়। কাজেই সামাজিক দায়িত্ব পালনের মানসিকতা থেকেও ‘ভালো ছেলে পেলাম’, ‘আমরা গরীব তায় চারটে মেয়ে, সময় থাকতে মেয়ে পার করতে হবে’ ইত্যাদি যুক্তি অভিভাবকদের দিক থেকে থাকবেই। কিন্তু সেদিন যখন পূর্ব মেদিনীপুরের শিক্ষাকর্মীরা জেলার বেশ কিছু এলাকার জাতপাতের ভেদাভেদকেও অকাল বিয়ের অন্যতম কারণ বলছিলেন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সেদিন সেটি স্বীকার করে নিতে অসুবিধে হলেও মনে হচ্ছিল সমাজে ছড়িয়ে থাকা কারণগুলির কতটুকুই বা আমরা জানি। মাসখানেক আগে পুরুলিয়া থেকে আসা তেরোজন ছেলেমেয়ের সাথে এ নিয়ে আলোচনা চলাকালীন চব্বিশ পঁচিশ বছরের মেয়েটি বলছিল- ‘আমি তো একটা ছ্যেলিয়াকে ভালবাসি কিন্তু উ ছোট জ্যাতের বলিইয়্যে আমার মা-বাপ উয়ার সঙ্গে আমার বিয়া দিবেক নাই’। শুনলাম উপস্থিত একজন ছেলেও একই কারণে যাকে পছন্দ করে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারছে না। জানতে চাইলাম- ‘তোমরা কেউ বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করতে পারবে না? সমস্বরে সেদিন যা শুনেছিলাম প্রাথমিকভাবে তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না-‘এমন করলিয়্যে মা-বাপ শ্রাদ্ধ করব্যেক। লোক ডাক্যিয়ে ভোজ খাওয়াব্যেক’। বাবা-মা ছেলের শ্রাদ্ধ করবে! বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওদের দিকে, শুনছিলাম – ‘নাগো দিদি, ছ্যেলিয়ার শ্রাদ্ধ করব্যেইক নাই। ছ্যেলিয়ারা অজাত্যের বিটিছ্যেলিয়া বিয়া করলিয়্যে বাপমা পত্থম পত্থম দমে অশান্তি করব্যেক, তারপরে বউ ঘরকে লিবেক। বিটিছ্যেলিয়ারা অজাত্যে কুজাত্যে বিয়া করলিয়্যে মা-বাপ উয়ার শ্রাদ্ধ করব্যেক। লোক ডাক্যিয়ে ভোজ খাওয়াব্যেক। আর কুনদিন বিটিছ্যেলিয়াটার মুখ দেইখব্যেক নাই। সব সম্পক্ক খতম করিইয়্যে দিব্যেক ’।
যে কোন সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা কোন বিশেষ জনগোষ্ঠির মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কিনা সেটি খোঁজার চেষ্টা করি। শিশু সুরক্ষা ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মতো শিশুকেন্দ্রিক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অনেকেই বলছেন যে, বিশেষ কোন জাতি বা ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠির নাবালিকাদের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাল্য বিবাহে শিশুরা নিজে যখন যুক্ত হচ্ছে এঁদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সেখানে হয়তো জাতি বা ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে বিশেষ কোন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া এই প্রবণতার কারণ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মুখে স্মার্টফোনের কথাই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার আলাপ প্রেম বিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। বছরখানেক আগে ১৯৯৫ সাল থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার সাথে যুক্ত একদল বয়স্ক কর্মীদের সাথে আলাপচারিতায় শুনছিলাম, সেসময় একটি গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তারা কিভাবে যাতায়াত করতেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ নিজের গ্রাম ছেড়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করতেন না। আজকের মতো সেসময় আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ এতো সক্রিয় ছিল না। আলোচনায় আরো উঠে আসছিল বর্তমানে রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে পারস্পরিক যোগাযোগের বিস্তৃতির কথা। গবেষণার কাজে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে ছটি ব্লকের প্রায় নব্বইটি গ্রামে বহু মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম পরিবারের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাপের বাড়ির যোগাযোগের কথা। শুনে ভারি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আশিউর্ধ মা থেকে শুরু করে পরিবারের বাকি সকলে শুধু বাপের বাড়ি যান তাই নয় বাপের বাড়ির পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবেও সামিল হন। এই ঘটনার সাথে বাল্য বিবাহের যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি দেখে সকলকেই প্রায় একমত হতে শুনছিলাম –‘এখন সবাই বলে ফেসবুকে প্রেম হচ্ছে। আপনি তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেন এখন লোকে গ্রামের বাইরে গিয়ে যেমন রোজগার করছে, হাতে দুপয়সা আসছে তেমন কুটুম্বিতাও বাড়ছে। মামার বাড়ি মাসি পিসীর বাড়িতে আজ বিয়ে বাড়ি কাল মেলা হলে নিমন্ত্রণে পরিবারের লোকজনরা দলবেঁধে সব সেখানে যাচ্ছে। আত্মীয়বাড়িতে ছেলেমেয়েদের নিজেদের মধ্যে আলাপ হচ্ছে, বাড়ি ফিরে কিছুদিন ফোনে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর। তারপর ওই যে বলছিলেন নাবালিকাদের বিয়ে, সেটাই হচ্ছে’। এসব আলোচনায় ছোটবেলার সেই ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ বিতর্ক সভাগুলির কথা মনে পড়ছিল। স্মার্টফোনে কি আর শুধুমাত্র ফেসবুক আর ‘গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর’? মুঠোফোনে যে রঙিন স্বপ্নিল দুনিয়ার হাতছানি? শিশুমন এমন অমোঘ টান কি উপেক্ষা করতে পারে? ষোল বছরের মেয়েটি অকপট-‘আমার বাবার যা সামর্থ্য, বাবা গরীব ঘরেই বিয়ে দেবে। ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পয়সা লাগে। ছেলেটিকে আমার ভালো লাগে। রোজগার করে আমাকে ভালো রাখবে বলেছে। কলকাতা ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছে’। দিনরাত টিভি সিরিয়ালে চাকচিক্যময় জীবন শিশুমনে ভালো রাখার প্যারামিটার সেট করে। ভালো রাখা কিংবা রোজগারের নিশ্চয়তা নিয়ে শিশু মনে প্রশ্ন থাকার কথা নয়, তাই থাকেনা। তবে সামগ্রিকভাবে এমন গভীর সামাজিক অসুখ দারিদ্র্য, শিক্ষা, জাতি, ধর্ম দ্বারা অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথাই বলছেন অকাল বিবাহ প্রতিরোধকারী ‘যোদ্ধা’রা। সেই কারণেই মনে হয়, যে সামাজিক অনুশাসন বাবা-মাকে সন্তানের পারলৌকিক কাজ করতে বাধ্য করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সবার আগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলির গভীরতাকে ও তার সঠিক কারণগুলিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রসঙ্গে কন্যাশ্রী ক্লাবের ভূমিকার কথা উঠতেই চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মীদের অনেকেই বলছিলেন, তারা যেসব কিশোরীদের সাথে কাজ করেন সেইসব নাবালিকা ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’দের মধ্যে অনেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে অথবা বাবা মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। মাসখানেক আগে প্রায় তিনশজন কন্যাশ্রীর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ না হলে হয়তো বিষয়টি নিয়ে এমন ভুল ধারণা আমারও থেকে যেতো। দিনকয়েক আগে যে শিশুটি বিয়ে করবে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে শিক্ষকের কাছে ছুটে এসেছিল প্রশাসকরা তড়িঘড়ি তাকে ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’ বললেন। শিশুদের সাথে কথা বললে বুঝবেন সংখ্যাগরিষ্ঠরাই জানে ইসকুল থেকে টাকা পায়, কেন পায়, এই প্রকল্পের নিয়মাবলি সবই এদের অজানা। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধের প্রভাব খুঁজতে আমরা অভিভাবকদের বদলে শিশুদের ফ্রন্ট লাইনে আনছি বলেই কন্যাশ্রী ক্লাবের ভূমিকাকে বড় করে দেখা হচ্ছে, তাদের নেতিবাচক সমালোচনা করা হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে কি সত্যি তারা এমন গভীর সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে? এমন গুরুতর সমস্যার গভীরতা বোঝার মতো কি তারা বড় হয়েছে? তাছাড়া ব্লক স্তরে গঠিত কন্যাশ্রী বাহিনীর ব্লকে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যন্ত গ্রামের খবর পাবেই বা কি ভাবে? এপ্রসঙ্গে চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মীরা বলছিলেন-‘প্রতিদিন যা ঘটছে তার কত শতাংশ ঘটনাইবা আমরা জানতে পারি। আমরা স্কুলসহ প্রশাসনের শিশু সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি বডির সাথে কাজ করি। তাতেও কি আমরা সব ঘটনা জানতে পারি? এলাকায় এধরনের ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আশা বা অঙ্গনওয়াডি কর্মীরা জানতে পারে কিন্তু তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে যেমন ভয় পায় তেমনি ওই এলাকায় তারা কাজ করতে গিয়ে বাধা পাবে সেই আশঙ্কা থেকেও আমাদের খবর দেয়না। গোপনে খবর দিক বা না দিক এলাকাবাসী এইসব কর্মীদের সন্দেহ করে এবং বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কাজেই জানবেন কেউ পাশে থেকে কিশোরী বাহিনীকে পরিচালনা না করলে তাদের পক্ষে বিয়ে আটকানোর মতো কাজে সামিল হওয়া প্রায় অসম্ভব’।
বাল্য বিবাহের মতো সমস্যাটি কোভিড পরবর্তী সময়ে আরো গুরুতর সমস্যার পরিণত হয়েছে সেটি আমরা অনুমান করতে পারি। তবে এর বিরুদ্ধে কাজ করতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের সামনে সমস্যাটির স্পষ্ট ছবিটি তুলে ধরতে হবে। গতবছর একটি গবেষণা সংস্থার হয়ে ছাত্রছাত্রীদের ড্রপআউট সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে সমীক্ষকরা দেখেছিলেন যে, বহু পরিবারে পনের থেকে আঠের বছর বয়েসের মেয়েদের ড্রপআউট হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল বিয়ে। বহু ক্ষেত্রে দপ্তরের আধিকারিকরা যেমন সমীক্ষকদের সেই তথ্য গোপন রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমনি সমীক্ষকরা অনুমান করছিলেন যে গবেষণা সংস্থাটিও সঠিক তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখবেন। ইতিমধ্যে আমরা জানি শিক্ষা দপ্তরের করা ড্রপআউট লিষ্টটিতে অতি যত্নে হাজার হাজার ড্রপআউট ছাত্রছাত্রীর নাম নথিভুক্ত করা হয়নি। অথচ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা বারবার দাবি করছেন যে কোভিডের সময় যে হারে নাবালক নাবালিকাদের বিয়ে হয়েছে সেটি আন্তরিক ও যথাযথভাবে সমীক্ষা ছাড়া চিহ্নিত করা অসম্ভব। চাইল্ডলাইনের কর্মী বলছিলেন-‘সেসময় আমাদের কাছে পকসো কেসের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। আমি একটা ব্লকের দায়িত্বে আছি, সেখানে বারো থেকে চোদ্দ বছর বয়সি মেয়েরা শুধুমাত্র বাবা, কাকা, দাদু’র দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে এমন কেসের সংখ্যা ছিল দেড়শো জনেরও বেশি। অনেকেই প্রেগনেন্ট হয়ে গিয়েছিল, যাদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। কাজেই আটকানো যাবে না, বাবা-মায়েরা নাবালিকাদের বিয়ে দেবেই’। মালদার স্বেচ্ছাসেবী কর্মী বলছিলেন-‘কোভিডের সময় মেয়েদের বাড়ি থেকে পালানোর ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। তাই দেখে সেসময় আতঙ্কে বাবামায়েরাও নির্বিচারে শিশুকন্যার বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের জেলায় পুলিশ সচরাচর কেস নিতে চায়না, তা সত্ত্বেও জেলার হোমগুলিতে এতো ভীড় যে আমরা সংস্থার পক্ষ থেকে হোমের জায়গা ফাঁকা করার জন্য হোম ও শিশুর বাড়ির মধ্যে লিয়াজোঁর কাজ করি যাতে শিশুটিকে বাড়িতে ফেরান যায়’। এসব বাস্তব উদাহরণ ছাড়াও খবরের কাগজ, টিভির পর্দা জুড়ে শিশুদের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নিত্যদিনের। তাকে ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতোরের আড়ালে সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের আতঙ্ক দোলাচলগুলি চাপা পড়ে যায়। ‘আমার দুটো মেয়ের বয়স ১৪ আর ১৬ বছর। দিদিমণিরা বলতে এসেছিল মেয়েটা কন্যাশ্রীর টাকা পাচ্ছে। মেয়েটার বিয়ে না দিয়ে ওকে পড়াশোনা করাতে। ওই পাড়ার বুড়োটা নাতনিকে ধর্ষণ করে জেলে গেছিল। আজ ছাড়া পেয়েছে। যে নিজের পরিবারে এমন কাজ করে সে পাড়ার মেয়েদের কি ছেড়ে দেবে? দেখাশোনা করছি। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেব’। সাংবাদিক বন্ধুরা এমন পকসো কেসের উদাহরণ দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে বারেবারে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করবেন, রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে এসব নিয়ে যত আন্দোলনের হুঙ্কার দেবে তত সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের আতঙ্কটি শিশুদের বিয়ের পিঁড়ির দিকে এগিয়ে দেবে।
বিয়ের পিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া এইসব শিশুদের বিয়ে আটকাতে যারা কাজ করছেন তাদের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এমন গুরুতর সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঢাল তরোয়ালগুলি ভারি দুর্বল। জেলায় জেলায় তারা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কন্যাশ্রীদের নিয়ে কাবাডি বা ফুটবল দল তৈরি করেছেন! মাষ্টারমশাই বলছিলেন –‘নাবালিকারা শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেও কন্যাশ্রীর টাকা নেবে বলে স্কুলে হাজিরা দেয়। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে দেখি যে মেয়েটি দুবছর পর আবার স্কুলে ভর্তি হবে ও কন্যাশ্রীর টাকা কবে পাবে জানতে এসেছিল, সে রাস্তার ধারে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ভয় পেয়ে কোলের শিশুটিকে লুকোনোর চেষ্টা করছিল’। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও গ্রামবাসী ও রাজনৈতিক দলের চাপে স্কুল নীরবতা পালন করে। কাজেই অকাল বিয়ে প্রতিরোধের কন্যাশ্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছেন বলেই বাল্য বিবাহ রোধে যাদের নিরন্তর লড়াই, তাদের হতাশাটি বড্ড বেশি স্পষ্ট।
এছাড়াও প্রতিরোধকারিরা বিয়ের আসর অব্দি পৌঁছতে পারলেও ওরা জানেন সেই প্রতিরোধটি সাময়িক। ‘প্রশাসন বিয়ের মণ্ডপ থেকে তুলে এনে মেয়েটিকে হোমে রাখার ব্যবস্থা করছে না বলে আমাদের সব চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। কি হবে বলুন তো অমন হৈচৈ করে বিয়ের আসরে হানা দিয়ে?’। প্রতিরোধকারী কর্মীদের সবিনয়ে বলতে চাই আপনারা হোমগুলিকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করছেন? সেদিন সদ্য আলাপচারিতায় কোন একটি জেলার হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী বলছিলেন-‘এখানে কিভাবে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ভাবতে পারবেন না। হোমে রেখে কি লাভ। বাড়িতে ফিরিয়ে দিলে বড় জোর বাপ-মা বিয়ে দেবে। এখানে যা হচ্ছে তার থেকে তো ভালো’। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এতদিন নাবালিকা বিয়েতে ভূমিকা ছিল অভিভাবক তথা পরিবারের। আজ তাতে সামিল হয়েছে ভিকটিম নিজে।
স্কুলে নাবালিকা বিয়ের ঘটনা ঘটছে দেখে শিক্ষকরা কখনো কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানান। তবে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঢাল তরোয়াল বলতে মেয়েদের জন্য সরকারি প্রকল্প ও তাদের আইনি অধিকারগুলি সম্পর্কে ছাত্রীদের অবগত করা ও বিয়ের ফাঁদ পেতে মেয়ে পাচারের মতো ঘটনার ভিডিও ক্লিপিং ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা মূলক অভিযান। অথবা কাউন্সেলিং-এর নামে রাজ্যজুড়ে বাঁধা বুলি ‘কম বয়েসে মেয়েদের বিয়ে হলে শরীরের ক্ষতি হয়, মেয়েদের শরীরে বাচ্চার থলি ঠিক মতো তৈরি হয়না, তাই অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়’- শিশুরা এসব শোনে কিন্তু তাদের কি এইসব সমস্যার গভীরতা বা তার গুরুত্ব বোঝার বয়স? শরীরে বাচ্চার থলি, অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু- এসব তাদের কাছে সবই এবস্ট্রাক্ট (বায়বীয়)। আমরা কি কখনো তাদের শরীরে রি-প্রোডাক্টিভ সিস্টেম সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি? নাবালিকা বিয়ের ফলে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা গার্হস্থ হিংসা কিংবা অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর অসুস্থতা সংক্রান্ত ভিডিও ক্লিপিং ধারাবাহিকভাবে দেখানর পরিকল্পনা করেছি? এগুলিই যে নিশ্চিত রূপে কার্যকরী হবে তার কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও বারবার দেখার ফলে শিশু তার পরিবেশ থেকেই এসব ঘটনার মিল খুঁজে পেতে পারে। যারা মাঠেঘাটে নেমে জনরোষের মুখোমুখি হয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে প্রতিদিন বহু বহু নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে। তাদের মধ্যে কতজনের গণিকালয় আর কতজনের শ্বশুরালয়ে ঠাঁই হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে বিক্ষিপ্তভাবে জানতে পারি শ্বশুরালয়ে ঠাঁই হওয়া শিশুদের কথা, যাদের রাতারাতি শিশু থেকে গৃহবধূ তথা সন্তানের জননীতে রূপান্তর ঘটে। সমাজ তথা পরিবার তাদেরকে একজন পূর্ণবয়স্ক নারী হিসেবে বিবেচনা করে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত পাঁচদিনের সন্তান সদ্য মা হওয়া শিশুকে রাতভর জাগিয়ে রাখে, সেই অভিযোগে নাবালিকা মা তাকে স্তন্যপান না করিয়ে শাস্তি দেয়। ঘরগৃহস্থালির কাজ অবিন্যস্তভাবে পড়ে থাকে। সংসারের চাহিদা অপূর্ণ থাকে, নাবালিকা গৃহবধূর প্রতি স্বামী ও পরিবারের ক্ষোভ জমতে থাকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মেয়েদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এভাবেই বাল্য বিবাহের প্লাবন প্রতিরোধে রাজ্যজুড়ে কর্মীদের নিরন্তর লড়াই কিংবা ‘গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে মহিলাদের সুরক্ষা’ আইনগুলি যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন এমন অন্ধকারময় ছবির সামনে ক্ষীণ আলোর সন্ধান মাঝেমাঝে পাওয়া যায়- ‘যেসব বিয়ে আমরা আটকাতে পারি তার বেশিরভাগই মেয়েটি নিজে বিয়ে করতে চায় না বলেই। তখন সে নিজে কোন না কোন ভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনেক সময় দেখা যায় মেয়ে বিয়ে করতে না চাইলে মা তার পাশে থাকেন’। কিন্তু পথটি তো এমন মসৃণ নয়। কাজেই অমসৃণ পথকে মসৃণ করার পরিকল্পনাটি বাস্তব সম্মত হতে হবে। সংখ্যা যাই হোক তবুও তো পাঁচিলটি উঁচু হলেও তাকে টপকানো সাহস সঞ্চয় করতে পারছে আমাদের গুটিকয়েক শিশুকন্যারাই। কাজেই আমাদের দায়িত্ব হবে তাদের সামনে বাস্তবসম্মত সম্ভাব্য বিপদগুলির স্পষ্ট ছবিটি তুলে ধরা। পোস্টার, দেওয়াল লিখন, আঞ্চলিক সুরে গান বেঁধে জনসচেতনতা মূলক প্রচারের ছবিটি আমাদের কাছে বহু পরিচিত। কিন্তু সেগুলি যে তেমনভাবে কার্যকরী হয়নি সেই অভিজ্ঞতাটিও আমাদের দীর্ঘদিনের। সচেতনতার প্রচারে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ প্রকল্পগুলির উল্লেখ করার প্রয়োজন থাকলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সেগুলির বেনিফিসিয়ারিরা আমাদের র্টাগেট গ্রুপও। কাজেই নতুন করে পরিকল্পনা করতে হলে স্কুলে স্কুলে নিয়মিতভাবে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একেবারে সরাসরি এবিষয়ে আদানপ্রদানের কাজটি যেমন অত্যন্ত জরুরী তেমনি তাদের ফোনে চাইল্ড লাইনসহ অন্যান্য ফোন নম্বরগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কাজটিও জরুরী। তাছাড়া পোস্টার দেওয়াল লিখন পড়ে শিশুরা কি বুঝবে? আমরা শিশুদের মেয়ে পাচারের ভিডিও দেখিয়ে সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কার কথা তাদের জানাতে পারি কিন্তু ভয় দেখিয়ে কি কাউকে মোটিভেট করা যায়? মুঠো ফোনে তারা রঙিন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নের রঙ পালটানোর জন্য দেশের অতীত ও বর্তমান নারীদের প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার জন্য কি আমরা বীরাঙ্গনা নারীদের জীবন কাহিনী, শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ডাক্তার, ঝকঝকে আইটি সেক্টার বা উড়ান চালানোতে পারদর্শী পাইলট মেয়েদের ছবি আঁকতে পারি না? পরীক্ষামূলকভাবে আমরা দেখার চেষ্টা করতে পারি যে ভয় নাকি সাফল্য কোন হাতিয়ারটি শিশুসহ মায়েদের উদবুদ্ধ করছে। কর্মসূত্রে এমন কত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। কতদূর পড়াতে চান এমন প্রশ্নে স্বতফূর্ত প্রতিক্রিয়া শুনেছি যে তাদের মেয়ে যেন ‘গোলাপী শাড়ি পরা দিদিমণি, ইস্কুলের দিদিমণি হতে পারে। পড়াশোনা করে তোমার মতো যেন হয়, তোমার মতো এমন করে যেন কাজ করতে পারে’-এমন কথাও শুনেছি বহুবার। গতবছর নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে আলাপ হয়েছিল একদল খুদেদের সাথে। আলাপচারিতার মাধ্যম হিসেবে আমার সেই পুরানো হাতিয়ার- ‘তোমরা বড় হয়ে কি হতে চাও’। ডাক্তার, ইসকুলের দিদিমণির মতো পরিচিত পেশার উল্লেখ ছিল। তারই মধ্যে ক্লাস ফোরের ছাত্রীটি বললো ‘আমি মডেল হতে চাই’। কৌতূহল হয়েছিল তাই মডেল হতে চাওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলাম। ঝটিতি উত্তর এসেছিল-‘এটিটিউড দেখাব’। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা পরিকল্পনা করবো যে শিশুদের মোটিভেট করতে, আমরা ভয় নাকি স্বপ্ন কোনটি দেখাবো।
সন্তানকে ঘিরে বাবামাও তো স্বপ্ন দেখেন। তাই সন্তানদের সচেতন করার প্রয়াসেই হোক বা স্বপ্ন দেখানোর পরিকল্পনা - বাবা-মায়েরাও তাতেও প্রভাবিত হবেন। নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে কমিউনিটি পার্টিশিপেশনকে সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জীবিকা মিশন ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের অধীনে রাজ্যে ১০.৪৫ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী যুক্ত করা হয়েছে। এভাবে কয়েক লক্ষ মায়েরা প্রভাবিত হলে পরিবার তথা সমাজ প্রভাবিত হবে। প্রভাবিত হবে বিদ্যালয় শিক্ষাটিও। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে মাষ্টারমশাইরা যেদিন বলবেন ‘মেয়েটা পড়াশোনা করে। ফেল না করে অন্য ক্লাসে উঠছে বলে বাবা-মা ওকে কষ্ট করেই পড়াচ্ছেন’ সেদিন নিম্নবিত্ত দরিদ্র বাবা-মা তাদের জীবনের অনিবার্য পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পন না করে বিয়ের পিঁড়ি নয় সন্তানকে বিদ্যালয় আঙিনায় পৌঁছে দেবেন। এমন করেই হয়তো কোন একদিন আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে একদিন অন্ধকার রাত কেটে ভোর হবে।
শিল্পসভ্যতার কী হবে?
আজ থেকে ১১৩ বছর আগে, ১৯০৯ সালের নভেম্বর মাসে গান্ধিজি তাঁর ছোট্ট পুস্তিকা ‘হিন্দস্বরাজ’-এর ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সভ্যতা’-তে লিখছেন ‘এই (আধুনিক) সভ্যতা এমনই, নীরবে একটু ধৈর্য ধরলে এটি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে”। ৩৬ বছর পর ৫ অক্টোবর ১৯৪৫-এ গান্ধি, নেহরুকে লিখছেন– ‘এই ভেবে ভয় লাগে যে,দুনিয়া যে ভুল পথে হাঁটছে, ভারতবর্ষও হয়ত সেই ভ্রান্ত পথেই যাবে – এ যেন প্রবাদ বাক্যে বলা সেই পতঙ্গের মতো, যে অগ্নিশিখা ঘিরে তার উদ্দাম নৃত্য, তাতেই সে পুড়ে মরবে। ’সম্প্রতি ৭ নভেম্বর ২০২২-এ মিশরে আয়োজিত COP 27 এর সভার উদ্বোধনী বক্তৃতায় রাষ্ট্রসংঘের মুখ্য সচিব আন্টোনিও গুটেরেস বলছেন ‘আমরা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছি। আমরা জল বায়ুর নরকের দিকে ধাবমান এবং
আমাদের পা যেন অ্যাক্সিলেটারের ওপর চেপে আটকে গেছে।
শিল্প সভ্যতার উদ্দাম নৃত্যের আর বেশিদিন নেই।
২
গান্ধিজির স্বরাজ
একশ বছর আগে গান্ধিজি শিল্প সভ্যতার বিকল্প নিয়ে কিছু পরীক্ষা আর লেখালিখি আরম্ভ করেন। এককথায় সেই বিকল্পের নাম দিয়েছিলেন ‘স্বরাজ’। আজকের দিনে গান্ধিজির মানসের সঙ্গে মানানসইস্বরাজকে এই ভাবে বলা যেতে পারে।
বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে ও ছোট শহরে বসবাস করবে। তাদের জীবন জীবিকা হবে সমবায়ভিত্তিক। চাষ-পশুপালন- মাছচাষ– জঙ্গল থেকে সংগ্রহ, হস্তশিল্প–পরিষেবা ইত্যাদির বেশির ভাগটাই হবে স্থানীয় অর্থনীতির জন্যে। আর থাকবে আদর্শ গ্রামীণ সমাজবাদ, যেখানে সব কাজের সমান আয় ও মর্যাদা হবে। বেশি মাত্রায় স্থানীয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতার ফলে অনেক দূরে পণ্যের আদানপ্রদান খুবই কমে যাবে। এরকম জীবনজীবিকা এবং পরিবেশের সঙ্গে মানানসই যে উপযুক্ত প্রযুক্তি চাই, তা তৈরি করা হবে বিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ। সবরকম সামাজিক বৈষম্য ও আধিপত্য (লিঙ্গ, ধর্ম,বর্ণ, জাত...) কমানোর নিরন্তর চেষ্টা চলতে থাকবে। এরকম অর্থনীতি, এরকম প্রযুক্তির ওপর ভর করে তৈরি সমাজের সঙ্গে মানানসই রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, গ্রাম এবং শহর হবে বেশিমাত্রায় স্বয়ং-শাসিত; মানুষ মুখোমুখি, সহভাগী গণতন্ত্রের মাধ্যমে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেবে। উচ্চস্তরের রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতা ও ভূমিকা খুবই কমে যাবে। প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সবার একাত্মবোধ থাকবে। গান্ধিজির বিখ্যাত উক্তি ‘মানুষের ন্যায্য চাহিদার জন্য পৃথিবী যথেষ্ট, কিন্তু লোভের জন্য নয়’ কে মেনে, পরিমিত জিনিসের ব্যবহার, সবকিছুকে ফের ব্যবহার এবং ব্যথিত প্রকৃতির – দুষিত পরিবেশকে আবার সুস্থ করে তোলাই হবে জীবনের মুলমন্ত্র। এরকম হলেই মানুষের মধ্যে ‘সত্য ও প্রেম’ সম্ভব
১৯১৫ সালে গান্ধিজির স্বনির্বাচিত গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং ১৯৪৫ সালে তাঁর স্বনির্বাচিত উত্তরাধিকারি নেহরু এই ‘স্বরাজ’ কে একেবারেই উড়িয়ে দিলেন। বিংশ শতাব্দীতে শিল্পসভ্যতার এক্সপ্রেস ট্রেনের বেগ বাড়তেই থাকলো। আর অধিকাংশ মানুষে রকাছে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং তাদের চালিত সব রাজনৈতিক দল- বাম বা ডান, শ্রমিক, চাষি, শিল্পপতি, বৈজ্ঞানিক, অধ্যাপক – সব্বার কাছে গান্ধিজির স্বরাজ হয়ে গেল এক আজগুবি–খামখেয়ালি-বোকামিতে ভরা ভাবনা। তাই যত তাড়াতাড়ি এসব ভুলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। হলোও তাই। সেটাই ছিল যুগের স্বাভাবিক গতি।
৩
রাষ্ট্র ও সংবিধান
উনবিংশ শতাব্দী থেকেই পৃথিবী জুড়ে এক নতুন ধরনের সমাজচালনার ইঞ্জিন বানিয়ে তাকে আরো পোক্ত করা চলছে। এই ইঞ্জিন হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র-সরকার। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ভারতের জনতা উদগ্রীব হয়েছিল এরকম একটি ইঞ্জিন বানানোর জন্য। যাতে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হয়েই, খুব তাড়াতাড়ি তাদের শিল্পসভ্যতার ট্রেন ছুট্টে গিয়ে, এই দৌড়ে যারা এগিয়ে,তাদের ধরে ফেলে (এটা বুঝেই গান্ধিজির হিন্দস্বরাজ লিখেছিলেন)। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই চাই ইঞ্জিন চালানো উৎকৃষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতি, মানে একটি ‘সংবিধান’। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯, তিন বছরে ভারতে রসংবিধান ও তৈরি হয়ে গেল। সেই সংবিধান ধরে, শিল্পসভ্যতার ট্রেন স্বরাজের গরুগাড়িকে গুড়িয়ে তরতর করে ছুটতে শুরু করল। এখন একই ভাবে ১৯২টা রাষ্ট্র ছুটছে সেই পতঙ্গের মতো আগুনের দিকে।
আমরা অনেকেই জানিনা যে ১৯৪৫-৪৬ সালে আমাদের দেশের জন্য একটি সংবিধান বানিয়েছিলেন গান্ধিবাদি সমাজবিজ্ঞানী শ্রীমান নারায়ণ আগরওয়াল। তবে উনি বলেছিলেন, এটা ঠিক সংবিধান নয়, সংবিধানের রূপরেখা মাত্র। গান্ধির এই সংবিধান ছিল স্বরাজের ধারণার সঙ্গে মানানসই এবং কিছু মৌলিক দিক থেকে ভারতরাষ্ট্রের সংবিধানের বিপরীত। যদি আমরা মনে করি, এই ২০০-২৫০ বছরের শিল্পসভ্যতা আর চলবেনা, অতিশীঘ্রই এর বিকল্প চাই, তাহলে গান্ধির সংবিধান একটু উল্টেপাল্টে দেখলে ভালোই হবে মনে হয়।
৪
কী চলবে না
কিন্তু তার আগে দেখা যাক, শিল্পসভ্যতা ধ্বংসের কথা যে বারবার উঠছে, তার মানে কী হতে পারেঃ
প্রথমেই খনিজ জ্বালানি, পেট্রোলিয়াম ও কয়লার ব্যবহার অনেকটা খুব তাড়াতাড়ি কমে যাবে বা কমিয়ে আনতে হবে; তার মানেই এই বিপুল উৎপাদন, পরিবহন ব্যবস্থা অনেক কমে যাবে। রাসায়নিক চাষ ও মাংসের জন্য বিশাল খামার চলবে না। পৃথিবী জোড়া বাজার বিপণন ব্যবস্থা অনেক সঙ্কুচিত হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির দিন শেষ। বিশাল কোম্পানি – প্রাইভেট কিম্বা সরকারি –আর টিকবে না। বড়বড় রাষ্ট্রের ইতি, কোনো দরকার নেই। শিল্পসভ্যতার চাকরি–জীবিকা দ্রুত কমতে থাকবে। এই লেখার বেশিরভাগ পাঠক এবং এই লেখকেরও চাকরি-ব্যবসা-মাইনে-পেনসন-ব্যাঙ্কের সেভিংস সব বানচাল হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় মুদ্রা অকেজো হয়ে পড়বে।পৃথিবীর প্রায় ৫০০টি বড় শহর চুপসে যাবে, যার প্রথম ৫০-এর মধ্যে আছে কলকাতা। এখনকার বেশিরভাগ স্কুল ও কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে; শিল্পসভ্যতা উঠে গেলে তাকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শিক্ষা আর সার্টিফিকেটের কোনো দরকার থাকবে না।
৫
শিল্পের সংবিধান বনাম গান্ধির সংবিধান
এবারে আজকের শিল্পের সংবিধান, যেটা ২৬জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে আরম্ভ হল, তার সঙ্গে ১৯৪৫-৪৬-এ লেখা গান্ধির সংবিধানের তুলনা করা যাক। এখানে আমরা খুব বিস্তারিত ভাবে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখব না। শিল্পসভ্যতার সংবিধান ও স্বরাজের সংবিধানের মূল পার্থক্য এবং তারা যে অনেকক্ষেত্রেই প্রায় বিপরীত সেটা বুঝলেই যথেষ্ট।
৬
৬.১ সংবিধানের গঠন
শিল্পের সংবিধানঃ ২২টিভাগ (Part); ৪৪৮টি অনুচ্ছেদ (Articles); ১২টি তফসিল (Schedule)। এপর্যন্ত ১১৩টি সংশোধনী (Amendment) হয়েছে। প্রথম দিকে অনুচ্ছেদ ছিল ৩৯৫ ও তফসিল ছিল ৮টি।
গান্ধির সংবিধানঃ ২টি ভাগ (Part); ২২টি অধ্যায় (Chapter); ২৯০টি অনুচ্ছেদ (Articles)।
৬.১ গান্ধির সংবিধানের ভুমিকা (ভাগ ১)
এখানে বলে রাখা দরকার যে ভাগ ১ হচ্ছে এই পুস্তিকার অর্ধেকটা এবং সেটা ঠিক সংবিধান নয়। এই অংশে যে চারটি অধ্যায় আর ৯৮টি অনুচ্ছেদ আছে তার পুরোটাই ভুমিকা। সেখানে বলা আছে, আমরা কেবল পশ্চিমি দেশের সংবিধানগুলি নকল করবো না; তবে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অবশ্যই শিখবো।
তারপর আছে আড়াই হাজার বছর ধরে নানা ধরনের শাসনব্যবস্থার ইতিহাস; বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দেশের দার্শনিক এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পণ্ডিতরা গণতন্ত্রের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কী বলেছেন। বিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বেহাল দশা–ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র, সোভিয়েত দেশের গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ-একনায়কতন্ত্র, অতিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা, গণতন্ত্রের নামে ছোট্ট গোষ্ঠীর রাজ, সংগঠিত গুন্ডাবাহিনির রাজ ইত্যাদি। এসবের বিপরীতে আছে নৈরাজ্যবাদ বা অ্যানার্কিজমের উল্লেখ–এমন ব্যবস্থা যেখানে কোথাও বা কারোর কাছেই ক্ষমতা জমতে পারবে না। ধন ও ক্ষমতার দিক দিয়েও সবাই সমান।
এরপর আছে ১৯১৯ সাল থেকে ভারতের সংবিধান তৈরির নানা পদক্ষেপ।
লেখক উল্লেখ করেছেন, ১৯৩৯ সালে আউন্ধ নামের একটি ছোট রাজার এখন মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার অন্তর্গত) গান্ধিজির পরামর্শ নিয়ে একটি সংবিধান বানিয়ে রাজ্য চালানোর চেষ্টা।
প্রাচীন ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, শুক্রাচার্যের নীতিসার, ঋগ্বেদ, জাতকের গল্পে, বৌদ্ধ সঙ্ঘে কী হত–এইসবের উল্লেখ। ইউরোপে শিল্পসভ্যতার আগে কী ধরনের গ্রামীণ গণতন্ত্র ছিলো তাই নিয়ে ক্রোপোতকিনের লেখা। জাপানও চিন কীরকম ছিল তাও আছে সেখানে। এই প্রসঙ্গে দুই বাঙালি পণ্ডিত ভ্রাতৃদ্বয়ের বইয়ের কথা বলেছেন। এই বই দুটি হল, ১৯১৯-এ প্রকাশিত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ‘Local Government in Ancient india’ এবং ১৯২৩-এ প্রকাশিত রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের ‘Democracies of the East’।
চরম ব্যক্তিবাদ ও চরম সমষ্টিবাদের বিপদ নিয়ে বেশ খানিকটা এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এবং বলা আছে, এই দুই বাদ-এর একটা সুন্দর মীমাংসা ঘটানো ভালো সংবিধানের একটি প্রধান কাজ হবে। বড়দেশের আইনসভার প্রতিনিধি বাছাই করার নির্বাচন প্রক্রিয়া, লাখ লাখ মানুষের একজন প্রতিনিধি –এর নানা দুর্নীতি ও অন্যান্য অসুবিধের বিশেষ উল্লেখ আছে। আর আছে প্রতিনিধি বাছাই করার অন্য কিছু পদ্ধতি।
কলা ও সৌন্দর্যর ব্যাপারে বলেছেন, শিল্পসভ্যতায় আঁকা, কবিতা, গান ,নৃত্য, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদির –মাপকাঠি হয়ে গেছে টাকা। গ্রামীণ জীবনে এইসবই ছিল কাজের সঙ্গে, জীবনচক্রের এবং প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। সেই বোধ কীভাবে জাগানো যায় – সেই প্রশ্নটা রেখেছেন।
শেষে আছে গান্ধিজির ভাবনা। গ্রামীণসভ্যতা, সাদামাটা ও আনন্দময় জীবন, সবার শারীরিক শ্রম, আর্থিক সাম্য এবং বিকেন্দ্রীয়করণ, যান্ত্রিক সরলতা ও প্রযুক্তিগত বিকেন্দ্রীয়করণ। এর স্বপক্ষে হেনরি ফোর্ড, লুইস মমফোর্ড, আইনস্টাইনের উক্তি। জোর দিয়ে বলা হয়েছে এটা পুরনো যুগে ফিরে যাওয়া নয়; এখানে কোনো রকম সামাজিক ভেদাভেদ ও অসহিষ্ণুতা থাকবে না। এরকম আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বিকেন্দ্রীকরণ হলেই দরকার হবে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের। স্বশাসিত গ্রাম হবে এর ভীত। এটা এক নতুন সভ্যতার স্বপ্ন যেখানে সত্য ও প্রেম বিরাজমান। তারজন্যইএই সংবিধান। একে লেখক ‘বিকেন্দ্রীয় গ্রামীণ সমাজবাদ’ (Decentralized Village Communism) নাম দিয়েছেন।
৬.২ সরকার
শিল্পের সংবিধানঃ প্রথমেই কেন্দ্রীয় সরকার (ভাগ ৫), তার ১০০টি অনুচ্ছেদ। তারপর রাজ্য সরকার (ভাগ ৬), তার ৮৫টি অনুচ্ছেদ। তারপর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক (ভাগ ১১) ১৯টি অনুচ্ছেদ। তারপর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (ভাগ ৮) ৮টি অনুচ্ছেদ। খেয়াল করবেন যে প্রায় অর্ধেক সংবিধান (৪৫০-র মধ্যে ২১২টি অনুচ্ছেদ) কেন্দ্র আর রাজ্যসরকারকে নিয়ে। এর বেশির ভাগটাই সংসদ, বিচার ব্যবস্থা নিয়ে।
মনে রাখবেন, সংবিধান তৈরির সময় গ্রাম ও শহরের স্থানীয় সরকারকে পাকা পোক্ত করা, আলোচনার পর নাকচ হয়ে যায়। এটা রাখা হয়েছে ভাগ ৪-এর ‘নির্দেশাত্মকনীতির মধ্যে’। যারা প্রাণপণে চাইছেন শিল্পসভ্যতার ট্রেনের গতি বাড়াতে তাদের কাছে গ্রাম ও নগর সরকার তো অবান্তর। বিশাল কারখানা, খনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র , বাঁধ, রাস্তা, রেল, এরোপ্লেন, জাহাজ, আইআইটি– এসবে গ্রাম সরকার কী করবে?
প্রায় ৪২ বছর অপেক্ষা করার পর ১৯৯২সালে, ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত (ভাগ ৯-এ ১৬টি অনুচ্ছেদ)এবং নগরপালিকা (ভাগ ৯ক-এর ১৮টিঅনুচ্ছেদ) স্থান পেল সংবিধানে!
গান্ধির সংবিধানঃ আমরা আগেই দেখেছি যে ভাগ ১ পুরোটাই কেবল ভুমিকা। আসল সংবিধান হচ্ছে ভাগ ২, অধ্যায় ৫-২২, অনুচ্ছেদ ১৯২টি।
প্রথমেই (অধ্যায় ৬) প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত এবং তার গঠন ও কাজ।২৫টি অনুচ্ছেদ।
তারপর (অধ্যায় ৭) ব্লক ও জেলাপঞ্চায়েত ও নগরপালিকা। ১৯টি অনুচ্ছেদ।
তারপর (অধ্যায় ৮) রাজ্যসরকার। ২০টি অনুচ্ছেদ।
সবশেষে (অধ্যায় ৯) কেন্দ্রসরকার। ২১টি অনুচ্ছেদ। প্রথমেই আসছে গ্রাম, শেষে রাষ্ট্র। অনুচ্ছেদের সংখ্যার দিকে দেখি তো চারটে স্তরের প্রায় সমান গুরুত্ব। স্বরাজের সংবিধানে এটাই স্বাভাবিক। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটা শিল্পসভ্যতার সংবিধানের ঠিক উল্টো।
এখানে ন্যায়ালয়/বিচারসভাটি একটি আলাদা ১০ নম্বর অধ্যায়ের অন্তর্গত। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ গ্রামেই থাকবে, জীবিকা গ্রামকেন্দ্রিক হবে, তাই গ্রামেই হবে সবচেয়ে প্রধান বিচারব্যবস্থা। গুরুত্বর দিক দিয়ে তারপর হচ্ছে জেলা ন্যায়ালয়। তারও পরে রাজ্য (হাইকোর্ট) ও শেষে কেন্দ্রস্তরের ন্যায়ালয়। সুপ্রিম কোর্ট কেবল হাইকোর্টের দেওয়া কেস বা আন্তর-রাজ্য বিবাদ বিচার করবে। প্রত্যেক স্তরের বিচারকদের সেই স্তরের পঞ্চায়েত বাছাই করে বসাবে। তাদের মেয়াদ মৃত্যু অবধি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা আছে যে, ব্রিটিশ আমলের আইনের অনেকগুলি অত্যন্ত খারাপ, অনেকগুলি খুবই জটিল এবং বেশিরভাগের ভাষাই বড়ই খটোমটো। এসবগুলির বেশিরভাগটাই সংশোধন এবং বাতিল করে সব আইন সহজ সাধারণ ভাষায় আবার লেখা হবে।
বিচারব্যবস্থাতেও শিল্পসভ্যতার যুক্তিকে উল্টে দিচ্ছে গান্ধির সংবিধান।
৬.৩ নির্বাচন
শিল্পের সংবিধানঃ ভাগ ১৫তে ৭টি অনুচ্ছেদ। আজকে একজন নাগরিক বিভিন্ন স্তরের সরকারে প্রতিনিধির জন্য ভোট দেয়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত বা নগরপালিকা, তারপর রাজ্যের জন্য ভোট; তারপর কেন্দ্রের জন্য ভোট। গণতন্ত্র মানেই দাঁড়িয়েছে কেবল ভোট-ভোট-ভোট আর তার অজস্র রকম দুর্নীতি এবং হিংসা। আর এটাই সাধারণ মানুষেরর মুখ্য আলোচনার বিষয়। মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখন একটি নিরর্থক খেলা বা সার্কাসের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিনিধিদের মেয়াদ – ৫ বছর।
গান্ধির সংবিধানঃ অধ্যায় ১১তে ৯ টি অনুচ্ছেদ। সাধারণ নাগরিক শুধু একবার ভোট দেবেন –নিজের গ্রাম পঞ্চায়েত বা নগরপালিকার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে! বাকি চারটে স্তরে হবে পরোক্ষ নির্বাচন। গ্রামস্তরের পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা ব্লকস্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে নিজেদের মধ্য থেকে। একই ভাবে জেলা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তার নিচের স্তরের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এবং নিজেদের মধ্য থেকে!
প্রত্যেক স্তর নিজেদের মধ্যে কাউকে সভাপতি বানাবে। দেবতুল্য নেতার কোনো জায়গা নেই।
কোনো রকম প্রচার করলে নির্বাচনে তার প্রতিনিধিত্ব বাতিল হয়ে যাবে। এবং কোনো সংরক্ষণ নেই।
রাজ্য বা কেন্দ্রীয় স্তরে কেবল একটি আইনসভা থাকবে। মানে আলাদা লোকসভা ও রাজ্যসভা বাতিল।
প্রতিনিধিদের মেয়াদঃ ৩ বছর, এবং এই মেয়াদকালে তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা!
মোদ্দা কথাপৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের নির্বাচন নামের ভয়ঙ্কর দানবকে সংহার করার সংবিধান।
৬.৪ স্তরগুলির আকার ও গঠন
শিল্পের সংবিধানঃ আজকের গ্রাম পঞ্চায়েতে আছে একাধিক গ্রাম; এবং কিছু রাজ্যে অনেক গ্রামপঞ্চায়েতের জনসংখ্যা ২০,০০০ এরও বেশি। একটি ব্লকে সাধারণভাবে ১০০ টিরও বেশি গ্রাম। জেলার সাইজ ও তার মধ্যে ব্লকের সংখ্যা খুবই এলোমেলো।
স্বাধীনতার সময় ১০টি রাজ্য ছিল। বহু আন্দোলনও হিংসার মধ্যে দিয়ে সেগুলি ভেঙে আজকের রাজ্য হয়েছে।
আর যে অঞ্চলগুলি ভারতরাষ্ট্রের অঙ্গ হতে চায়না, সেখানে রাষ্ট্র সেনা রেখে বীভৎস অত্যাচার, মৌলিক অধিকারের দফারফা করে, একটি হিংস্র – অসভ্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সত্য ও প্রেমের কোনো লক্ষণ নেই।
গান্ধির সংবিধানঃ পঞ্চায়েত বলতে একটি গ্রাম – একাধিক নয়। ২০-২৫টি গ্রাম আর আনুমানিক ২০,০০০ মানুষ নিয়ে একটি ব্লক। এখনকার ব্লক থেকে অনেক ছোট। ১০-১৫টি ব্লক নিয়ে একটি জেলা। আমাদের এখনকার জেলা থেকে অনেক ছোট।
রাজ্য নিয়ে বলা আছে যে, এখনকার (১৯৪৫) রাজ্যগুলির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।এগুলিকে ভেঙে ভাষা ভিত্তিক ছোট রাজ্য বানানো হবে।
রাষ্ট্র নিয়ে বলা আছে, যে রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় ভারতরাষ্ট্রে অন্তর্গত হতে চায়, তারাই মিলে হবে ভারত নামের রাজ্যের সঙ্ঘ। কারোর ওপর জোর ফলানো হবেনা। এমনকী যারা বেরিয়ে যেতে চায়, তাদেরকে শান্তিতে যেতে দিতে হবে !!
৬.৫ বিভিন্ন স্তরগুলির কাজ
গান্ধির সংবিধানঃ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ অনেক– কৃষি, কুটিরশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রাথমিকশিক্ষা, সংস্কৃতি, বয়স্কশিক্ষা, লাইব্রেরি, ক্রীড়া, নাচ–গান, শৌচব্যবস্থা, সাধারণচিকিৎসা, গ্রামসুরক্ষা, ন্যায়, ট্যাক্স ও হিসেব।
ব্লক, জেলা ও রাজ্যস্তরের একটি কাজ হচ্ছে তার তলার স্তরের কাজের অডিট ও সমন্বয়করা। এই তিন স্তরেই নিজস্ব এলাকার জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক এবং উৎপাদিত সামগ্রী বাজারজাত করার ব্যবস্থা থাকবে; আর থাকবে আপৎকালীন বাহিনী।
ব্লক স্তরে মাঝারি হাসপাতাল এবং মাতৃক্লিনিক; জেলা স্তরে বড় হাসপাতাল; এবং রাজ্য স্তরে বিশেষ হাসপাতাল।
জেলা স্তরে মাঝারি ও রাজ্য স্তরে বড় সেচব্যবস্থা। ব্লক স্তরে গ্রামের বাইরের রাস্তা।
রাজ্য স্তরে থাকবে পরিবহন ও যোগাযোগ, বড়শিল্প, ত্রাণ, প্রাকৃতিক সম্পদের বিকাশ।
কেন্দ্র স্তরের কাজ হচ্ছে রাজ্যের মধ্যে পরিকল্পনার কিছুটা সমন্বয়। মুদ্রা – কাস্টম – বিদেশিবাণিজ্য। সেনা – পুলিস (একই, আলাদা নয়)। রাষ্ট্রীয় স্তরের পরিবহন ও যোগাযোগ।অল্প কিছু রাষ্ট্রীয় চাহিদার বড়শিল্প।
খেয়াল করেবেন যে কেন্দ্র স্তরের কাজ কিন্তু অনেক কম।
আরেকটি কথাঃ যে স্তরের যা দায়িত্ব, তা নিয়ে ওপরের স্তর পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু নিজেদের মত চাপাতে পারবে না।
৬.৬ শিক্ষা
শিল্পের সংবিধানঃ সংবিধানে শিক্ষার জন্য আলাদা কোনো ভাগই নেই। ৬-১৪ বছর বয়সিদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক স্কুলশিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে আলোচনা হলেও পরে তা নাকচ হয়ে যায়। স্থানীয় সরকারের বিষয়টির মতোই এইবিষয়কেও সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যে রাখা হয়।
৫২ বছর অপেক্ষা করার পর ২০০২ সালে – ৮৬তম সংশোধনের মাধ্যমে ৬-১৪ বছর বয়সিদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক স্কুলশিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় (অনুচ্ছেদ ২১ক) সংবিধানে!
গান্ধির সংবিধানঃ শিক্ষার জন্য আছে আলাদা অধ্যায় ১৮ এবং তাতে আছে ৮টি অনুচ্ছেদ।
বুনিয়াদি শিক্ষার (১৪ বছর বয়স অবধি) দায়িত্ব হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতের; হাইস্কুল ব্লক পঞ্চায়েতের; কলেজ জেলা পঞ্চায়েতের; ইউনিভার্সিটি রাজ্য সরকারের। কেন্দ্রের হাতে কেবল অল্প কিছু বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
আর বলা আছে স্বরাজের সঙ্গে মানানসই ‘নই তালিম’ পদ্ধতির কথা; স্কুলশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার; এবং এক বছর সামাজিক সেবার কাজ করার পর ই-কলেজের ডিগ্রি পাবে।
৬.৭ মন্ত্রী ও আমলা
শিল্পের সংবিধানঃ নির্বাচিত আইনসভার সদস্যরাই সবস্তরের মন্ত্রী হবে। কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের মন্ত্রীদের দায়িত্ব সংবিধানে বলা আছে। আইনসভা বছরে আনুমানিক ১২০ দিন বসবে।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের স্থায়ী উচ্চপদস্থ আমলাদের অনেক দায়িত্ব। তাই কেবল এই বিষয়েই সংবিধানের ভাগ ১৪তে ১৮টি অনুচ্ছেদর য়েছে।
শিল্পসভ্যতার ট্রেন বিশাল, তার ইঞ্জিন ও খুবই জটিল। তাই রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক সমন্ব য়দরকার। এর জন্য কেন্দ্রীকরণ ছাড়া উপায় নেই। ফলে রাজ্য এবং কেন্দ্রের মন্ত্রী ও আমলাদের প্রচুর দায়িত্ব ও ক্ষমতা। সেটাই সংবিধানে নিশ্চিত করতে হয়েছে। এটা না হলে শিল্পসভ্যতা যে গতিতে এগিয়েছে সেটা সম্ভব হতো না।
গান্ধির সংবিধানঃ আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা কেউ মন্ত্রী হবে না। তারা বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রণী ও বিশেষ দক্ষ, তাদের বাছাই করে মন্ত্রী বানাবে। এরা এক অর্থে উচ্চপদস্থ আমলারা যা কাজ করেন, সেটাও খানিকটা করবেন। আবার বলে রাখা দরকার যে এরা নিজ নিজ বিষয়ে পারদর্শী হবেন, ICS/IAS দের মতো নয়।
মন্ত্রীদের সংখ্যা ৫-১০জনের মধ্যে হবে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা বছরে তিনবার অল্প কিছুদিনের জন্য বসলেই হবে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
স্বরাজ যে শিল্পসভ্যতার বিপরীত, এটাও তারই প্রতিফলন। স্থানীয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতা এবং স্ব-শাসন এর মানেই এখানে ব্যাপক সমন্বয়ের দরকার খুব কম। আজ পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মন্ত্রী এবং আমলাদের রমরমা, তা আর থাকবে না। তাই এই স্বরাজের সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরে মন্ত্রী ও আমলাদের সংখ্যা এবং দায়িত্ব খুব কম।
৬.৮ মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য
শিল্পের সংবিধানঃ ভাগ ৩-এর ২৪টি অনুচ্ছেদে নানা ধরনের মৌলিক অধিকারের কথা আছে।
মৌলিক কর্তব্য যোগ হয়েছে ১৯৭৬সালে ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে (ভাগ ৪ক)
শিক্ষা যোগ হয়েছে ২০০২ সালে।
গান্ধির সংবিধানঃ ৫ম অধ্যায় (আসল সংবিধানের প্রথম অধ্যায়) তে আছে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে মৌলিক কর্তব্য।
মৌলিক অধিকারের মধ্যে আছে ১৪ বছর অবধি শিক্ষা।
আর আছে সুস্থজীবনের জন্য চাকরি বা মজুরির থেকে ন্যূনতম আয়ের মৌলিক অধিকার !!
৭
কত জনের বসত নিয়ে রাষ্ট্র?
আধুনিক রাষ্ট্রবাদ আর শিল্পসভ্যতা একে অন্যের পরিপুরক। প্রশ্ন হচ্ছে এবারে কি হবে?
আজ পৃথিবীতে ১৯৩টি রাষ্ট্র। মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটি।
৩ লাখের কম জনসংখ্যার ২০টি রাষ্ট্র; আমাদের ব্লকের মতো।
৫০ লাখের কম ৮০টি রাষ্ট্র; আমাদের জেলার মতো।
৮ কোটির বেশি জনসংখ্যার বড়ো রাষ্ট্র কেবল ১৯টি। চিন, ভারত প্রায় ১৫০ কোটি করে, তৃতীয় নম্বরে আমেরিকা। জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। আমাদের থেকে অনেক পেছিয়ে। তারপর ক্রমশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, নাইজিরিয়া, বাংলাদেশ, রাশিয়া, জাপান , মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, ইথিওপিয়া, ভিয়েতনাম, ইজিপ্ট বা মিশর, জার্মানি, কঙ্গো, ইরান, তুরস্ক বা টার্কি। আলাদা দেশ হলে এই তালিকাতে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হত।
গত ৫০ বছরে ভেঙে গেছেঃ পাকিস্তান ( ২), সোভিয়েত রাশিয়া (১২), ইয়ুগোস্লাভিয়া (৮) , চেকস্লভাকিয়া (২), ইথিওপিয়া (২)
প্রশ্ন হচ্ছে বড় রাষ্ট্র ও রাজ্যের কী রূপ হবে এবার?
৮
উপসংহার
আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির জন্য যে আইনসভা গঠিত হয়েছিল (Constituent Assembly) সেটা বসতে আরম্ভ করার আগেই শ্রীমান নারায়ণ আগরওয়াল গান্ধির সংবিধান লিখে ফেলেন- ১৯৪৫-৪৬এ।
লেখক একে ‘অহিংস’ সংবিধানও বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে কেবল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এটা সম্ভব। এবং এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিন রকম বিকেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত – অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই নতুন ‘বন্ধুতার অর্থনীতি’, ‘প্রকৃতি বান্ধব উপযুক্ত প্রযুক্তির’ খোঁজ চলছে। তবে এসব নিয়ে আরো বেশি বেশি পরীক্ষা করতে হবে।
এই সংবিধানের ভিত হচ্ছে স্বয়ং-সম্পূর্ণ (অনেকটাই) এবং স্ব-শাসিত গ্রামীণ সম্প্রদায়।
এই মানস বা স্পিরিটকে যদি আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাই তাহলে বলতে হয় যে – এখানে গণতন্ত্র হবে মুখোমুখি, সবাই অংশগ্রহণ করবে, কোনো প্রতিনিধি নয়। তার জন্য সবাইকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।সবাইকে সহযোগিতা করতে অভ্যস্ত হতে হবে।
এটা একেবারেই পুরনো দিনের গ্রামে ফিরে যাওয়া নয়। সেখানে অনেক ভয়ানক ত্রুটি ও অন্যায় ছিল এবং আছে। এই স্বপ্নের গ্রামকে বানাতে হবে। সেটাই কাজ।
ভালো সমাজ মানে সীমিত উৎপাদন, সীমিত ভোগ, আর্থিক ও ক্ষমতার সাম্য, দূষণহীন পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্বতা, নাচ-গান-কলাকৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতিযুক্ত, প্রেম বন্ধুতায় ভরা আনন্দময় জীবন।
তার জন্য প্রায় ৮০ বছর আগে লেখা গান্ধির সংবিধানকে প্রথম খসড়া মেনে আমাদের আজকের স্বরাজের সংবিধান বানাতে হবে।
মুখপাত
অধুনা দীপেশ চক্রবর্তী বিশ্রুত ঐতিহাসিক, তাঁর আগ্রহ বহুধা বিস্তৃত, বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লেখক হিসাবে তিনি পারঙ্গম। তাঁর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ বইটির নাম The Climate of History in a Planetary Age, New Delhi: Primus Books, 2021। ঠিক এই বইটি ছাপা হবার আগে তিনি সমগোত্রীয় বিষয় ধরে আর একটি প্রবন্ধের বই ছাপান, The Crisis of Civilization Exploring Global and Planetary Histories, New Delhi: Oxford University Press, 2018। গত দেড় দশক ধরে তাঁর লেখালিখি মূলত: আবর্তিত হয়েছে একটা বিষয় ধরে - বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়। এই আলোচনার পরিসরে মানব সভ্যতার সার্বিক প্রগতির ইতিহাস ও গ্রহ-জাগতিক ও নৈসর্গিক সংকটে মানুষের আত্মচিন্তন ও পরিপার্শ্ব চিন্তন নিয়ে ভাবাভাবির আকার, প্রকার ও বিবর্তন নিয়ে দীপেশ মাথা ঘামিয়েছেন। সেই বুদ্ধিগত ভাবনার পরিণত ফসল উপর্যুক্ত বই দুটি।
ব্যক্তিগত সৌহার্দের সুবাদে আমি এই বই দুটো উপহার পাই, পড়েও ফেলি। কিছুটা বুঝি বলে মনে হয়, নিজের পড়াশোনার খামতির জন্য কিছুটা বুঝিনা। ইতি-মধ্যে বাংলাদেশে দীপেশের অনুরাগীরা দীপেশের উদ্দেশ্যে সম্মাননা গ্রন্থ বার করবে বলে ঠিক করে। দীপেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও তাঁর লেখালেখি নিয়ে একটা কিছু লেখার জন্য আমি অনুরুদ্ধ হই। তখন বেশ অসুস্থ ছিলাম, তবু সানন্দে রাজি হই, ‘সুহৃদ-সম্ভাষণ’ নামে একটা বড়-সড় প্রবন্ধও লিখে ফেলি। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ নিয়ে দীপেশের চিন্তা নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনাটিতে প্রবন্ধটি শেষ হয়।
প্রায় চার বছর কেটে যায়, দীপেশের উপর্যুক্ত বই দুটি বেরিয়ে যায়। নানা মাসিক আশ্বস্তবাণী পাওয়া সত্ত্বেও আমার ‘সুহৃদ সম্ভাষণ’ আজও বের হয়নি। বাংলাদেশ থেকে আর সাড়া-শব্দ নেই, যাকে বলে ‘All quiet on the western front’.
এহ বাহ্য। গত শতকের আশির দশকে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন-এর কর্মী হিসাবে নানা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার করা, কালাকানুন রদ করা ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে আন্দোলন করতাম। এই কাজে ‘জরুরি অবস্থার’ নানা অভিজ্ঞতা ও নকশালবাড়ি আন্দোলন-এর নানা স্মৃতি অনুঘটক হিসেবে কাজ করত। এই পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে মানবাধিকারের বৃহত্তর পরিসরে নাগরিক অধিকার প্রসারিত হল। পাশাপাশি যৌবনের কল্প-স্বর্গের সৌরভে ভরপুর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থাগুলির নিঃসীম আধিপত্যবাদের কাহিনী ও কার্যকলাপ বুঝতে আরম্ভ করি, ক্রমবর্ধমান পড়াশুনা নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছিল। দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রের জুলুমি সীমা থেকে সমাজে ক্ষমতাস্তম্ভের ভিন্নরূপ সম্পর্কেও ধারণা স্পষ্ট হতে শুরু করল। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, এমনকি নিবিড় মানবিক ব্যক্তি সম্পর্ক, নানা আধিপত্য-আনুগত্যের প্রশ্নে দীর্ণ ও প্রাতিষ্ঠানিক নিগড়ে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ১৯৯০-এর দশকে নানা ক্ষমতাবন্ধনের পরিসর থেকে নিছক রাষ্ট্রীয় জুলুম বিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের শরিক হতে শুরু করল নানা ধ্যানধারণার সৃজনশীল কর্মীরা, বলা যেতে পারে শত ফুল ফুটে উঠল। সেই পরিসরে নারীবাদ, দলিত জনজাতি সত্তাবাদ, ও প্রকৃতি-মানুষের সম্পর্ক-বিচার থেকে পরিবেশবাদ-এর আন্দোলন নিজ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে স্ব স্ব ক্ষেত্র খুঁজে বার করছিল।
আদর্শগতভাবে পরিবেশবাদী আলোচনা ছেলেবেলা থেকে এক গভীর লালিত বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দেয়। ইতিহাসের বইতে কেমন করে আগুন জ্বালানো শেখা থেকে শিকারি মানুষ কৃষি কাজে লিপ্ত হয়ে সভ্যতা গড়ে তুলছে সেই আখ্যান পড়তাম। অনিবার্য প্রগতির দিকে মশাল হাতে মানুষ ছুটছে, ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে ছাপা ‘বিশ্বপরিচয়’-এর মত জনপ্রিয় বইয়ের প্রচ্ছদ আজও ভুলিনি। প্রযুক্তির ক্রম-উন্নতি, নানা গোত্রের বিপ্লব, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্রম - নানা উত্থান-পতনে মানুষই তো হিরো, প্রকৃতিকে জয় করছে, স্পুটনিক আকাশে পাঠানো হচ্ছে। যখন মানুষ নিজের মর্ত্য-সীমা ভেঙে ফেলছে, তখন শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটলেই কল্প-জগৎ বাস্তব হবে, ‘each according to his ability’ থেকে ‘each according to his need’ নীতিতে উত্তরণ সম্ভব হবে বিজ্ঞানের শক্তির অতুল সম্ভাবনায় আস্থাশীল মানুষের কাছে। প্রকৃতির ভাঁড়ার অফুরন্ত, উৎপাদিকা শক্তির সীমা নেই, উৎপাদন লাফ দিয়ে বাড়বে, মানুষের চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক শক্তিগগুলি যেন হামেহাল হাজির আছে। শ্রেণি সম্পর্ক পাল্টানোই যেন আবশ্যিক শর্ত। বেশ একটু সরলরৈখিক স্কেচ করলাম। কিন্তু এই ধারণাকেই বিজ্ঞান বলে জানতাম ও মানতাম। আর কে না জানে বিজ্ঞান সত্য, আর সত্য তো সর্বজয়ী।
ভুল বুঝবেন না। উপর্যুক্ত বালখিল্য প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানবাদ তথা আধুনিক প্রগতিবাদকে যে কেউ কেউ খোঁচা মারেননি, তা কিন্তু নয়। সব প্রযুক্তির রাজনীতি আছে, কোন প্রযুক্তির উদ্দেশ্যটা কি, কার জন্য - এই সব বেমক্কা প্রশ্ন তুলে নিজেদের গবেষণার পরিসরে কপিল ভট্টাচার্য্ ও ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের মতো বিজ্ঞানীরা আমাদের বার বার সতর্ক করেছেন। বৃহত্তর অর্থে প্রযুক্তি, আধুনিকতা ও উন্নয়নের আন্ত-সম্পর্ক ধরে গোড়ায় টান দিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জোসেফ কর্নেলিয়াস কুমারাপ্পার মতো ভারতীয় চিন্তকরা। আধিপত্যবাদী উন্নতির উচ্চবর্গীয় চিন্তার বিরুদ্ধে তাদের তত্ত্বচিন্তা আমার বড় হবার দিনগুলিতে আদ্যন্ত বাতিল হয়ে যায়, চরকা কাটা বছরে একটা দিন উদযাপনের কুৎসিত রাজনৈতিক প্রতীকে রূপান্তরিত হয়।
কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পরিবেশবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগে আমূল পরিবর্তন আসে। গোলকায়িত বহুজাতিক ধনতন্ত্রবাদ ও আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপরায়ণ রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার অর্থই হল যেন তেন প্রকারে নিসর্গের সম্পদের উপর সর্বগ্রাসী ও সর্বভুক মানুষের আধিপত্য কায়েম করা। এই আধিপত্যের নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক আছে, স্থানিক মাত্রা থেকে বৈশ্বিক মাত্রায় আধিপত্যের কাঁটাগুলো নড়াচড়া করে ।
৬ ডিসেম্বর ২০২২-এ লেখাটা লিখছি। সকালে দেখলাম কেরলে তিরুবন্তপুরম-এর কাছে ভিঞ্জিগ্রাম-এর বন্দর তৈরি করার বিরুদ্ধে ১৩৮ দিন ধরে চলা মৎস্যজীবীদের আন্দোলন প্রত্যাহার হয়েছে, আদানিরা সাগর বন্দর তৈরি করার উদ্যোগ চালু করার সবুজ সংকেত পেয়েছে। মৎস্যজীবীদের মার্কসবাদী সরকার ক্ষতিপূরণ দেবেন কিন্তু বন্দরের ফলে কেরলের উপকূলভাগ চিরতরে ধ্বংস হবে কী না, তা নিয়ে কোন খতিয়ান দিতে বা হিসেবনিকেশ করতে সরকার বিন্দুমাত্র তৈরি নয়। এই অবস্থানে বামভক্ত ও রামভক্তরা সহমত হয়ে মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী ময়দানে নামতে প্রস্তুতও ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষও চাগানো হয়। আদানিদের প্রকল্প ছাড়া কেরলের উন্নয়ন কী করেই বা হবে ? আবার এও পড়ছি যে গৌতম আদানিদের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লা খাদান খোলা হবে, অজস্র কয়লার দৌলতে সস্তা বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। জনমোহিনী সরকার মমতাময়, জমি দখলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা পুনর্বাসন পাবে, ভুক্তভোগী পরিবারের একজন সরকারের কোনো বিভাগে ‘গ্রুপ ডি চাকরি পাবে। আর কি চাই। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস, তীব্র উষ্ণায়নের ও পরিবেশ দূষণের কথা বলা শহুরে নকশালদের উন্নয়নবিরোধী প্রচার, বাংলার উন্নতির পেছনে ছুরি মারা। উন্নয়ন অর্থই তো তাৎকালিক হাতে গরম মুনাফা, ভবিষ্যতের সংকটের কথা কেই বা ভাবে?
এ সবই জানা কথা। অঞ্চল বিশেষে আধিপত্যকামী উন্নয়নের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী জনগণ মরণপণ লড়াই চালায়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ সেই লড়াই। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এই লড়াই ইস্যুভিত্তিক, আঞ্চলিক সীমাতেই আবদ্ধ। গ্লোবাল উন্নয়ন চিন্তা পরিবেশের লড়াইকে আঞ্চলিক ইস্যুতে আটকে রাখতে চায়। কারণ পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ, আমলাতান্ত্রিক পুলটিস - এই সবের মাধ্যমে ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের চট-জলদি প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও মানুষের দীর্ঘমেয়াদী সুষম ও স্বাভাবিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা যায়, মুনাফাটাই তো সব। আমাজন নদীর জঙ্গল ধ্বংস থেকে সুন্দরবনের ব-দ্বীপ এই চিন্তাজাত উন্নয়নতন্ত্রের শিকার।
নিজের স্বার্থে গ্লোবাল নিয়ত লোকাল তৈরি করে চলে। এহেন খণ্ডীকরণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতি ও সভ্যতার মূল্যায়ন করতে চাইছেন, নেচার ও কালচারের সম্পর্কের সমস্যাকে পুনর্বিন্যস্ত করতে তাঁরা ইচ্ছুক। তাঁদের ভাবনার মানচিত্র অনুযায়ী সভ্যতার তথা পরিবেশের সংকটের ভুক্তভোগী সব জীব ও প্রজাতি, কেবল মানুষ নয়।
দীপেশ চক্রবর্তীর রচনা এই প্রতর্কের অংশী। নিছক দেশ, কাল বা বিশেষ কোনো জনসমাজ-শ্লিষ্ট দাবি-দাওয়ার পরিসরে দীপেশ তার অন্বীক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। প্রাণী-অপ্রাণী, পৃথিবী-সৌরজগৎ, তথা মানুষী সত্তা ও অনেক অমানুষী বস্তুপুঞ্জের মধ্যে টানাপড়েনের সূত্রে সে পরিবেশ-ভাবনাকে চিন্তা করেছে। ফলে ইতিহাস-বিদ্যার অবয়ব বদলে গেছে, প্রগতি-ক্রমের চরিত্র বিচার এক থাকেনি। দীপেশের ভাষ্যে গ্রহ-জগতের ময়দানে জীবপ্রাণ ও প্রকৃতির খেলাটার নিয়মকানুন ভিন্ন, কালের মাপকাঠিতা অন্য। এই সামগ্রিক ভাবনাই তার রচনার জোর।
অবশ্যই দীপেশ আমার সুহৃদ। বন্ধুর রচনার পাঠক আমার মতো ক্যাবলা বাঙালিও। তবে দীপেশের এই বই দুটি নিয়ে কোনো বিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ লেখা আজও আমার চোখে পড়েনি, দুই বছর হয়ে গেল। আমার অপ্রকাশিত ‘সুহৃদ-সম্ভাষণ-এর প্রাসঙ্গিক অংশটুকু কালধ্বনিতে ছাপাবার জন্য দিলাম। সামান্য রদবদল হয়েছে। বাংলায় দীপেশের রচনাটিকে নিয়ে আলোচনা হোক, পরিপ্রশ্ন উঠুক; নীরবতা সবসময়ে উন্নতিকামী বিকাশপুরুষ বা বিকাশমহিলাদের আধিপত্যবাদকে মজবুত করে।
‘সুহৃদ-সম্ভাষণ’ রচনার শেষাংশ
সাম্প্রতিক লেখাপত্রে দীপেশ চক্রবর্তী জানিয়েছে যে, সত্তর বছরব্যাপী জীবনে তার দুটি পরিচিতি আছে, গ্লোবাল ও লোকাল। দীপেশ তো ‘টানা চল্লিশ বছর সাদাদের দেশে বাস’ করছে। ঢাকার বন্ধুরা দীপেশ চক্রবর্তীকে বলেছে, ‘আপনে আর লোকাল নেই, আপনারে দেইখতে দেইখতে, এইটা আমরা বুঝতে পাইরতেছি, আপনি এক্কেরে গ্লোবাল ও সাদা হইয়া গেছেন।’১ দীপেশও স্বীকার করেছে যে পশ্চিমি মানুষদের চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে কিছুটা ভাবা, কথাবার্তা চালানো তাঁর বর্তমান জীবনে অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। এমনকি এটাও মনে হয়েছে যে, ‘আমি বাংলায় বলছি, কিন্তু ভাবছি হয়তো ইংরেজিতে।’
ঢাকার বন্ধুরা দীপেশের যাত্রাকে ‘এক্কেরে গ্লোবাল’ বলেছিলেন, কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের সূত্র ধরে দীপেশের বর্তমান চিন্তা তো ‘গ্লোবালেই থেমে নেই, তা গ্রহজাগতিক (planetary) বৃত্তে ঢুকে পড়েছে। উষ্ণায়ন তথা পরিবেশচিন্তা প্রসারিত হয়েছে গ্রহজগৎ ও অণু-পরমাণু নিয়ে গড়া বস্তুবিশ্বের অঙ্গীরূপেই মনুষ্য প্রজাতির ভাবনায়, সেই ভাবনাই দীপেশের বর্তমান রচনার মাপনি, এক বিশ্বব্যাপী বিতর্কের অংশী তার সাম্প্রতিক সন্দর্ভগুলি। দীপেশের অনুসন্ধিৎসায় লোকাল, গ্লোকাল তো আছেই, তা ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রহজগতের লোকে, প্লানেট-এর দেশ ও কালের মাত্রায়। ভাবছে কোনো না কোনো মানুষ, চৈতন্যময় মানুষের ভাবনাক্ষেত্রই আলোচনার পরিসর, এইটুকুই যা প্রারম্ভিক সাদৃশ্য।
দ্বিভাষিক দীপেশের আলোচনায় ঝোঁকে রকমফের আছে। দীপেশ জানিয়েছে যে, ‘ভাবনার গদ্যের তারতম্য আছে’।২ ভাবনাটা পৃথিবীর সব বাসিন্দার জন্য । কিন্তু যে ভাষায় ভাবছি, যে ভাষায় চিন্তাকে উপস্থাপিত করছি, তার ‘স্থানিকতা’ আছে, প্রাকরণিক ও প্রায়োগিক বিশেষত্ব আছে। ভাষান্তরে চিন্তার সুতোয় খিঁচ ধরতেই পারে। বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা গ্রহ জগতের অস্তিত্বের সংকট সংক্রান্ত বিতর্কে শরিক হতে গিয়ে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা দীপেশের নানা প্রবন্ধ ও বই আমাকে পড়তে হচ্ছে, অন্য কিছু রচনাও প্রসঙ্গ সূত্রে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। সেইসব পড়াকে ফিরে বাংলায় উপস্থাপিত করার প্রক্রিয়াতে ভাবনা ও ভাষার টানাপড়েনের হাত থেকে আমিও রেহাই পাব না।
ভাবনা ও ভাষার টানাপড়েনটা জ্ঞানাঙ্গনের নানা বর্গীয় নতুন শব্দ - পরিভাষায় আকীর্ণ, সমাজবিজ্ঞানে এতদিনের প্রচলিত ও গ্রাহ্য ধ্যানধারণা থেকে একটু পৃথক। প্রকৃতি ও জীবজগতে জ্বালানিখোর অবিমৃষ্যকারী মানুষের সর্বাতিশ্রয়ী আগ্রাসন ও সার্বভৌমিক বিকাশ এই গ্রহে মনুষ্য প্রজাতি তথা খোদ পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। পোপের আহ্বানে আর অমিতাভ ঘোষের পরিবেশ ও আবহাওয়া সংকট নিয়ে আলোচনাতে বা কবি মণীন্দ্র গুপ্তের টুকরো গদ্যরচনায় আছে মানব ধর্মী বিশ্ব সভ্যতাকে বাঁচাবার আর্তি।৩ সুনামি সংকট বা সুন্দরবনের জগৎ বিখ্যাত জল ও জীবজীবনের ক্রমধ্বংসের আখ্যান তো প্রজাতি হিসাবে আমাদের বিপন্ন হয়ে পড়বার নিদর্শন মাত্র। এইরকম প্রাকৃতিক জৈব বিপর্যয় থেকেই হয়তো বা উঠে এসেছে করোনা ভাইরাস। ভাইরাসের দাপট বিশ্বব্যাপী অতিমারীর চাপে পৃথিবীব্যাপী জনসমাজ নির্বিশেষে সবাই নাজেহাল। ইতিহাসে দ্বন্দ্বে ও অসাম্যে দীর্ণ তথা বিপন্ন মানব সমাজের কথা অজানা নয়। সমাজবিজ্ঞানে শ্রেণি-সম্প্রদায়-কৌম ইত্যাদি বর্গ নিয়ে চুলোচুলি চলেছে। একবিংশ শতক পর্যন্ত নানা সামাজিক তর্কে ওই সব বর্গগুলিকে বুড়ি ধরে লেখা হয়েছে পৃথিবীতে মানবসমাজের ইতিবৃত্ত, বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের ঈপ্সা ও কর্তৃত্বের নানা ঝোঁককে। মনুজ উদ্যমের জোর ও আধিপত্যের আধার উপর্যুক্ত বর্গগুলি, নানা আঁকাবাঁকা পথে ওইগুলোই স্বদেশ ও সভ্যতার মৌল বিকাশের নিশান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উষ্ণায়ন ও ধ্বস্ত পরিবেশের চাপে মানব সভ্যতার নির্বিশেষ প্রগতি-আখ্যানে বিশ শতকের শেষ পর্ব থেকেই চিড় ধরতে আরম্ভ করে। পাশাপাশি নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানা প্রজাতির প্রাণীর নির্মম অবলুপ্তির অন্যসব সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন খণ্ড কাহিনীতে।৪ একবিংশ শতকে সেই সব কাহিনীর তাত্ত্বিক সূত্রায়ণে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল অন্য ধরনের শব্দ, পৃথক বর্গ, যেমন, holocene, anthropocene, great acceleration, planetary ইত্যাদি। রেমন্ড উইলিয়ামস সংকলিত keywords-এ এইসব শব্দের হদিস নেই। দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর জগতের অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে গত সত্তর বৎসরে আমরা আরেক সময়পর্বজাত বিদ্যা তথা অভিজ্ঞতায় ঢুকে পড়েছি।৫
এই নূতন সময়পর্বে মানুষের ইতিহাস ভাবনা কী হবে, কোনদিকে সেই ভাবনা বাঁক নেবে. এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে দীপেশ। তার অধুনা প্রকাশিত বইটির নাম নজর কাড়ে, ‘গ্রহজাগতিক যুগে ইতিহাসের আবহাওয়া’, অর্থাৎ ইতিহাসভাবনা তথা রচনার আবহাওয়া তথা প্রেক্ষিত চেতনা। তার চিন্তায় আমরা তিনটি ধারার মিশ্রণ দেখি। প্রথম, তার নিজস্ব ইতিহাসচর্চার রূপ-রূপান্তর ও পরিবেশ-বিপর্যয় নিয়ে নিজের অনতিপূর্ব অভিজ্ঞতা দীপেশের বইয়ের উৎসর্গপত্রে জায়গা পেয়েছে। ২০১৯-২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে মৃত মানুষ আর ২০২০ সালে বাংলার আমপুন দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের স্মৃতিতর্পণ। দ্বিতীয়ত, পার্থিব প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের স্থিতি নিয়ে ইমানুয়েল কান্ট, মার্টিন হাইডেগার, হানা আরেন্ট, কার্ল ইয়াসপার্স প্রমূখ দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে দীপেশের পরিচয় গভীর, সেই পরিচয় তার তাত্ত্বিক ভাবনাকে পরিপুষ্ট করেছে। এইসব পরিচিতির নানা সাক্ষ্যের পাশে রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ ও বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে দীপেশের আলাপচারিতা লক্ষ করার মতো। তৃতীয়ত, দর্শন পাঠে জারিত চিন্তার সহযোগী হয়েছে অন্য গোত্রের বিদ্যা পরিচিতি, জড় ও জীবনপ্রক্রিয়ার অন্বয়ে স্থিত ‘ভূ-ব্যবস্থা বিজ্ঞান’ বা Earth system science, এই তিন ধরনের পরিচিতির অভিজ্ঞতার বুনটে তৈরি বিশেষ সন্দর্ভের তত্ত্বভূবন।
উপর্যুক্ত তত্ত্বভুবনের চলবিন্দু (Fulcrum) হল দুটি স্বতন্ত্র বর্গের ধারণা, গোলকায়িত (global) বিশ্ব আর গ্রহজাগতিক (planetary) বিশ্ব । দুটোতেই ‘বিশ্ব’ শব্দটি আছে। দীপেশের মতে, দুটি বিশ্বের রূপ-লক্ষণ পৃথক। গোলকায়নের বিশ্ব নির্মাণ নৃকেন্দ্রিক (a human-centric-construction)।৬ গ্রহ জাগতিকের বিশ্বচিন্তায় মানুষের ঠাঁই নড়ে যায়। তার কেন্দ্রীয় স্থিতিতে বিপর্যয় ঘটে। ইতিহাসভাবনা বা রচনায় এই দুটি বর্গ যে সবসময় বিপরীতমুখী হয়ে কাজ করবে সেরকম নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার অনুযায়ী দীপেশের অভিমত হল বিশ্বব্যাপী ধনতান্ত্রিক ইতিহাস গ্রহ-জাগতিক চিন্তা ব্যতিরেকে লেখা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সার্বিক পরিবেশে মনুষ্যজাতির স্থিতি ও ক্রিয়াকর্মের ইতিহাস গ্রহজাগতিক অভিজ্ঞতা ও চিন্তা বৃত্তের বাইরে থেকে রচনা করা সম্ভব নয়।৭ গ্রহজাগতিক ব্রহ্মাণ্ডে অণু-পরমাণু নিয়ে প্রাণ- প্রক্রিয়ার লীলা চলে, জল- মাটি -বায়ু আকাশে ব্যাপ্ত বিশ্বে অন্য বিচিত্র প্রজাতি ও নানা জড়বস্তুর সঙ্গে মানব প্রজাতিকে সম্পর্কে যেতে হয়, ভিন্ন প্রাণের ও ভিন্ন ভূ-বস্তুর অবস্থিতি নিজেদের জীবনপ্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি পায়, কোনো না কোনো বর্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষের নৈমিত্তিক চিন্তা অভ্যাসের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে। মোদ্দা কথা, গ্রহজাগতিক বিশ্বে জৈবিক মানুষের অস্তিত্ব অন্য প্রজাতি সমৃদ্ধ জীবনচিত্র ও জড় বস্তু নিচয়ের অঙ্গ, স্বতন্ত্র সার্বভৌমত্বের দাবিদার নয়।
এই বক্তব্যের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে দুই ভিন্ন বিদ্যায় নিষ্ঠ সময়চিন্তার প্রতিচ্ছেদের পরিসরে দীপেশ ইতিহাসভাবনার রূপান্তর নিয়ে বক্তব্য হাজির করেছে। নৃকেন্দ্রিক সময় ধারণা (anthropocene time) ও ভূকেন্দ্রিক সময় ধারণা (geological time)। অবশ্যই সময়ধারণা তো যে-কোনো ইতিহাস চেতনার অক্ষ, মৌলিক পরিবর্তন তো সেখানেই সাধিত হবার কথা।
আধুনিকতার প্যাঁচ-পয়জার নিয়ে চিন্তক ব্রুনো লাতুরের সঙ্গে দীপেশের কথোপকথনের সূত্রে বলা যেতে পারে যে, দুই ভিন্ন প্রকৃতির সময় চৈতন্যের মিশ্রণে দীপেশ আগ্রহী। তার মতে, আমাদের ইতিহাসবোধে ‘ভূতাত্ত্বিক চেতনার অনুপ্লবণ’ (the percolation of a geological consciousness) ঘটছে, এই অনুপ্লবণই আমাদের নিশ্চিত ইতিহাসবোধের প্রেক্ষিতে কাঠামোগত রদবদলটা সরাসরি উপমিত করেছে ‘ভূ-স্তরপাতিক সরণ’ (tactonic shift)-এর সঙ্গে। ফলে ইতিহাস চিন্তার চলনে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।৮ প্রচলিত ইতিবৃত্তে আধুনিক মানব সভ্যতার ভাবনা কয়েক দশক-শতক পেরিয়ে বেশিদূর পেছনে হটে না, সময় সারণিতে আদিম, প্রাচীন ও মধ্যযুগের অতীতচারণে দুই-তিন-হাজার বছরের মাত্রায় চলাফেরা করাটাই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে, ভূতত্ত্ব তথা গ্রহজাগতিক বিবর্তনের সময়মাত্রার নিরিখ তো লক্ষ-কোটি বছরের, সেই শাস্ত্রে কয়েক বিলিয়ন বৎসরের হিসাবে পৃথিবী নামের গ্রহটির প্রাকৃতিক বিবর্তন আলোচিত হয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানীরা আলোচনা করেছেন, সেই আলোচনায় এই ইতিবৃত্তের অনেকটাই মানবরহিত। মানবরহিত ও মানব অধ্যুষিত গ্রহে নানা প্রজাতির এসেছে, নানা কারণে ধ্বংসও হয়েছে। তবে সেই ইতিহাসের উপস্থাপনা অনেকাংশে ফসিল সুলভ প্রাণহীন অবশেষের বৃত্তান্ত, বাঁচা-মরার মানবিক ইতিবৃত্তে সেদিনের প্রাণীরা আদিমকালের চাদিম হিমমাত্র। আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ ডাইনোসর বনবাসী ও গুহাবাসী মানুষের দাপাদাপির রোমাঞ্চকর সন্দেহ নেই, কিন্তু সেরকম বর্ণনা একটি নৃকেন্দ্রিক ইতিহাসের প্রাক-কথন মাত্র, সেই আখ্যানে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের কুদরতে টেরোড্যাকটিল পাখি সশরীরে সভ্য লন্ডনের বিজ্ঞান সভায় হাজির হয়ে যায়।
প্রচলিত পাঠ্য ইতিহাসে নিরিখে তো শিল্পবিপ্লব প্রগতির যুগ, আধুনিক প্রায়োগিক বিজ্ঞানের জগৎব্যাপি জয়যাত্রার সূচনা। অন্যপক্ষে, এই সময়ের উদারনৈতিক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় সচেতন, বিচারক্ষম স্বশাসিত একক ব্যক্তি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রে জাঁকিয়ে বসেন। বিপরীতে ভূতাত্ত্বিক সময় মাপকাঠিতে শিল্প-বিপ্লব তো ক্ষণপূর্ব আগের ঘটনা। এই সময় বিন্দু ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের আরম্ভকাল। কিছু ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রকৃতির উপরে ক্ষমতার নিয়ামক রূপে মানবিক ক্রিয়া-কলাপ ও মদমত্ততার আরম্ভক্ষণ, anthropocene পর্বের সূচনাপর্ব তো শিল্পবিপ্লবের আমল। আধুনিক মানবসভ্যতার সার্বভৌম প্রগতির আরম্ভলগ্নে প্রোথিত হয়েছে প্রাকৃতিক জীবনের ভাঁড়ার নিঃশেষ করে নেবার উদ্যোগ পর্ব।৯
দুই ভিন্ন বিদ্যা, দুই ধরনের সময়দৃষ্টি, দুই পৃথক বিচারবোধ। আজকের গ্রহজাগতিক (planetary) পৃথিবীতে ভূ-পদার্থী শক্তি (geo-physical force) রূপে সামূহিক (collective) মনুষ্য প্রজাতি অন্য সব প্রজাতির অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে নিছক স্ব-শাসিত ব্যক্তি মানুষের স্বার্থ ও বুদ্ধির বর্গে মনুষ্য সমাজের ক্রিয়া কর্ম ও মানবিক সত্তার রূপ বিচার করা একপেশে হয়ে যেতে পারে।
গ্লোবাল ও প্লানেট সম্পর্কের টানাপড়েনে বারবার বিভাজিত সময়প্রেক্ষিত দীপেশের রচনায় ফিরে এসেছে। এই দ্বি-বিভাজিত কালবোধের অনুষঙ্গে দীপেশের রচনা নানা দ্বিত্ববোধের বর্গে ভরপুর। যেমন,'splitters' (বিভেদকারী) আর 'lumpers' (সংবদ্ধকারী) শব্দবন্ধের মোড়কে আলোচিত হয়েছে খণ্ডীকরণ ও একীকরণের প্রশ্ন। অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র স্বর গ্রহায়িত ইতিহাসের অ-মানবিক মাত্রায়, কিভাবেই বা সর্বাঙ্গীণ অখণ্ডতার আধারে সমাজ, কাল ও ব্যবস্থা বিশেষে ভিন্নতার মানাঙ্ক স্থির হবে সেটা জটিল প্রশ্ন। তবে এই মানবিক অভিজ্ঞতার খণ্ড পরিসরে ভূতাত্ত্বিক সময়ের ব্যাপ্তি ধরা সম্ভব নাও হতে পারে।
ইতিহাসের সময় চেতনায় ভূগোলকব্যাপী বিশ্বদৃষ্টি ও গ্রহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নানা দ্বি-ভাজের জন্ম দেয়, ইতিহাস সাধনায় বাঁক আসে। এক বিশিষ্ট ধরনের দেখায় উষ্ণায়ন তথা প্রাকৃতিক সম্পদ তথা ফসিল ব্যবহারের ইতিবৃত্ত অসাম্য ও ক্ষমতার দাপটের কথা মাত্র। দীপেশ বক্তব্যটির যাথার্থ অস্বীকার করেনি। তার মতে, ক্ষমতার দাপট ও সামাজিক অসাম্যের ইতিকথা ‘গ্রাউন্ড আপ’ দেখার বিষয়। কিন্তু সেই দেখার বৃত্তান্তটা ‘অর্ধ কথন’ মাত্র। আরেকটা বৃত্তান্তের উৎস নিহিত থাকে বাইরে থেকে দেখায়, ‘আউটসাইডার’ ইন দেখা। বাঙালি দীপেশ মনে করিয়ে দিয়েছে সুবচনী হাঁসের পরে বসে রিদয়ের উপর থেকে পৃথিবী দর্শনের সাহিত্যিক আখ্যানকে, ওই আখ্যানের সঙ্গে তুলনা টেনেছে আজকের গ্রহজাগতিক ভুবনে ‘মঙ্গলগ্রহে বসে বা স্পেসশিপে বসে পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকা সঙ্গে। এহেন আকাশবিহারী দর্শনে মানুষ প্রজাতি সমেত ‘পৃথিবীকে বাইরে থেকেই একটা টেটালিটি’ রূপে দেখা হয়, আইডেন্টিটি এন্ড ডিফারেন্স হিসেবে’ মানুষকে দেখাটা বিচার্য নয়। একটা দেখা যেন আর একটা দেখার পরিপূরক। বাংলা বক্তৃতায় এই দুই ধরনের দেখাই দীপেশের অখ্যাত ‘মানবিকতা ও ‘অ-মানবিকতা’র ভাবনা বা গল্প, এই দুটো গল্পের ‘মাঝামাঝি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।’১০
আধুনিক জীবনচর্চার পরিসরে দুই ধরনের কালবোধের প্রেক্ষিতে দীপেশ আরেকটি দ্বিত্ব-এর ধারণা উত্থাপন করেছে। পরিবেশ সংক্রান্ত বিতর্কে শব্দ দুটি পরিচিত, 'sustainability' ও 'habitability'-এর টানাপড়েন। এক কোটিতে আছে অবিরাম উন্নয়নের যাত্রায় বিশ্বে অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনুষ্য প্রজাতির টিকে থাকার বাসনা ও প্রচেষ্টা। অন্য কোটিতে দেখি নানা জীব অধ্যুষিত ধরাধামের ভারসাম্য বজায় রেখে জন্মলব্ধ পরিদৃশ্যমান জগতকে বসবাসযোগ্য করার ঈপ্সা। এই দুই কোটির মধ্যে টানাটানি হাল আমলে দৈনন্দিন জীবনভাবনাকে সমস্যায়িত করেছে। নৃকেন্দ্রিক জীবনযাপনের রাজনীতির পরিসরটি উপর্যুক্ত দ্বিত্ববোধের ক্রিয়ায় ভরপুর।১১ বলে নেওয়া ভালো যে দীপেশ বর্ণিত দ্বৈতবর্গগুলি সবসময় পরস্পরবিরোধী সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। সংযোগী, প্রতিচ্ছেদী ও সহঅবস্থানী রূপেও বর্গগুলি থাকতে পারে।
নানা দ্বিত্ববোধের বিশ্লেষণের মাধ্যমে দীপেশের আলোচনা প্রসারিত হয়েছে দ্বি-ভূমি স্থিত মানুষের সত্তার দার্শনিক তাৎপর্য নির্ণয়ে। কালচেতনা ও দেশবোধ তো জীব অস্তিত্বের ভিত্তি। ‘planetary age’ তথা গ্রহজাগতিকযুগে মানুষ বলে আখ্যাত জীবটি একই সঙ্গে দুই অক্ষে গতায়াত করছে। একপক্ষে সে স্বজ্ঞাবান অধিকার সচেতন ব্যক্তি মানুষ; অন্যপক্ষে সত্তাবিহীন ভূ-পদার্থী (geophysical) সামূহিক মনুজ শক্তি হিসাবে সে আবির্ভূত । একটি অপরটির সঙ্গে অন্বয়-ব্যতিরেক সম্পর্কে যাচ্ছে। ইতিহাস দর্শনে এহেন দ্বন্দ্ব নিরসনের কোনো আশু নিদান জানা নেই, উপর্যুক্ত বিরোধ বা মিলন ক্ষেত্রের আকার-আয়তন, সীমা-সরহদ্দ সবই অনিদের্শ্য। ‘নতুন দর্শনে ঋদ্ধ নৃতত্ত্ব চিন্তা ('a new philosophical anthropology') এই দ্বন্দ্ব ক্ষেত্রের অন্তর্গত আদান-প্রদান ও বিরোধের শর্তগুলি স্পষ্ট করে তুলবে, সেই নতুন চিন্তার সুবাদে নানা মাত্রায় স্থিত ভিন্ন ভিন্ন দ্বৈতবোধ অদ্বৈত চৈতন্যকে ছুঁতে পারবে। ভবিষ্যতে ঐ প্রত্যাশারই উচ্চারণ যেন দীপেশের সাম্প্রতিক গ্রন্থ।১২
দীপেশের সন্দর্ভটি কোনো কালানুক্রমিক ইতিহাসবৃত্তও নয়, কার্যকারণ পরম্পরার সরাসরি শৃঙ্খলে বাঁধা আখ্যানকাহিনিও নয়, বরং বিশেষ সময়ে গ্লোবাল আর প্লানেট চিন্তার পরিচ্ছেদজাত সঙ্কুল ক্ষেত্রে ইতিহাস চৈতন্যের তত্ত্বতালাশ। তত্ত্বতালাশের পরতে পরতে রয়েছে অন্য ধরনের ইতিহাস রচনায় ইঙ্গিত, জড়জগৎ ও প্রাণময় জীবনের পারস্পরিকতার সমস্যা। কেবলমাত্র উপস্থাপক বৈতণ্ডিক হবার ইচ্ছা আমার নেই। এক জিজ্ঞাসুরূপে বহসে যাচ্ছি, নিজের প্রতিক্রিয়া বা শঙ্কা প্রকাশ করার জন্য দীপেশ-উল্লিখিত আখ্যান-ইঙ্গিতকে হয়ত বা সদৃশ্য বিশেষ প্রসঙ্গের আকারে উত্থাপিত করতে হচ্ছে।
দীপেশের বইতে নানা বীজগর্ভ মন্তব্য ছড়িয়ে আছে, মন্তব্যগুলি আধুনিকতা জ্ঞানতত্ত্ব ও ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে নতুন ভাবনা উসকে দেবে। দুয়েকটি মাত্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, নিসর্গ সম্পর্কে মানুষের বোধ নিসর্গের সৌন্দর্য ও বিশালতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা তো অন্তহীন, এই অন্তহীন অভিজ্ঞতার ভাষা ও চিত্রগত সাক্ষ্যের অভাব নেই। ধর্মবোধ থেকে ধর্মরহিত চেতনায় মানুষ ও প্রকৃতির নির্ভরতাও বোধগম্যতার চিন্তা পরিবর্তিত হয়, সেই মননের মানচিত্র কয়েকটা অক্ষর বিন্দু কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা দীপেশ করেছে।১৩ আলোচনায় এক অন্য ভুবনের ইঙ্গিত আছে। বিস্ময়, ভয় ও শ্রদ্ধার সূত্রেই তো আমরা আমাদের পরিপার্শ্বে যেই অন্যভুবনকে স্বীকার করি, জড় প্রকৃতির প্রাণের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানবাদের নামে সেইসব মানবিক অনুভূতিলোককে বাতিল করা অর্থ প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক মানুষের হার্দ্য সম্বন্ধকে নাকচ করে দেওয়া। প্রকৃতি হয়ে ওঠে যেন জর্জ অরওয়েল বর্ণিত পশু খামার, কেজো চাহিদা মেটাবার বস্তু ভাণ্ডার। অথচ বিস্ময়, ভয়. শ্রদ্ধা মানুষকে গ্রহ-প্রকৃতির নানা পট-বর্ণনায় সংস্থাপিত করে, গ্রহজাগতিক পৃথিবীর প্রতি আধুনিক মানুষের শীতল ঔদাসীন্য (cold indifference) লজ্জা দেয়। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে দীপেশ-অনুসন্ধিত নতুন নৃতত্ত্ববিদ্যার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে এই গ্লোব ও প্লানেট নামে দুই ভুবনের মধ্যে অনুভূতির আখ্যান গড়ে তোলার ক্রিয়াকর্ম। বুদ্ধদেব বসু ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই ভিন্ন মেজাজের বঙ্গনিবাসী মেধাজীবী। আমি নিশ্চিত যে, দীপেশের বক্তব্যের মুদ্দায় এরা দুজনে আগ্রহী হতেন।১৪
নতুন দর্শন অভিসারী ‘নৃতত্ত্ব চিন্তার’ সূত্রে হাল আমলের বিশ্ব প্রজাতির জগতের সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা দীপেশ উল্লেখ করেছে।১৫ ২০২০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাপক হারে উট নিকেশ করা হয়। জীব হত্যার ‘তুচ্ছ’ তথ্যের পেছনে বৃহৎ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত বিধৃত আছে, পৃথিবীবাসী এক প্রজাতির প্রতি অন্য প্রজাতির কৃতঘ্নতার নিদর্শন কাহিনিটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। একটু বিশদে ইতিবৃত্তটা জেনে রাখলে ক্ষতি নেই। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় পাদ থেকে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান, রাজস্থান ও আফগানিস্তান থেকে উট অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি হত। উটদের সঙ্গে উটের চালকরাও ওই দেশে যায়। এই চালকদের অনেকেই পুশতুভাষী আফগান, তবে বালুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ ও পাঞ্জাব নিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও উটচালকের বৃত্তি গ্রহণ ক’রে অস্ট্রেলিয়ায় আড্ডা গাড়ে। এইসব গোষ্ঠীকেই একসঙ্গে ‘গনি’ বলা হত, এদের বসতি ‘গনি টাউন’ নামে আখ্যাত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় ‘শ্বেত’ সভ্যতা বিস্তারে তন্তুতে তন্তুতে ভারতীয় উট ও গনিচালকদের কথা জড়িয়ে আছে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উষর এলাকায় শ্বেতকায় অভিযাত্রীরা উটের কারাভানে চেপে নতুন নতুন এলাকায় বসতি গড়ে চলে। এই সব এলাকাতেই উটই ছিল যানবাহন। ওই জীববাহী পরিবহনের উপর নির্ভর করেই নানা খ্রিষ্টান মিশন প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের সংগঠন স্থাপন করে। গনিরাও নিজেদের বসতিতে মসজিদ গড়ে তুলেছিল। সুফি ধর্মেরও চর্চা হত, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘মাহদি’ মতবাদও জনপ্রিয় হয়েছিল। গনিদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বৈবাহিক আদান প্রদানের নিদর্শন আছে।
১৯৩৫-৬০-এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরিবহন ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তিত হয়। পাকা রাস্তা তৈরি আর মোটর ও ট্র্যাকের প্রাদুর্ভাবে কারাভানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, গনি বসতিগুলো ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে। পোষা উটদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘তারা’ বুনো হয়ে ওঠে, সংখ্যাও খুব বেড়ে যায়। গত শতকের শেষ দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার ঊষর অঞ্চলে জল ও খাদ্যসম্পদের জন্য বুনো উটরা সভ্য মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে খরার সময় লোক বসতি বাঁচাবার জন্য বেশকিছু বুনো উটকে খতম করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষে অস্ট্রেলিয়ার ঝোপঝাড় আকীর্ণ উষর ভূমিতে উটেরা বিপন্ন বোধ করে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তারা আশেপাশের মনুষ্য বসতিতে দলে দলে ঢুকে পড়তে থাকে। জনবসতিতে খাদ্য ও বিশেষত জলের সংকট দেখা দেয়। ৮ই জানুয়ারি ২০২০-এ ‘ পশুমঙ্গলের সর্বোচ্চ নির্মাণের সঙ্গে সংগতি’ (in accordance with the highest standards of animal welfare) রেখে কল্যাণমুখী অস্ট্রেলিয়ান সরকার পাঁচদিন ধরে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে বুনো উট মেরে ফেলে। খতিয়ানের হিসাবে মতভেদ আছে, তবে রকমফেরে সর্বোচ্চ মৃত সংখ্যা দশ হাজার, আর সর্বনিম্ন মৃত সংখ্যা পাঁচ হাজার।
মনে রাখতে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে উট হেলাফেলা করা পণ্য নয়। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে অস্ট্রেলিয়ার উট সরবরাহ করে, ‘কোরবানি’তে উটের চাহিদা বাড়ে। উদ্যোগপতিরা টিনে ভরতি উটের দুধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পাঠায়, ওই দুধে দই ভালো জমে। পুঁজির আবর্তিত পথে পণ্য ব্যবহারের রীতি বদলে যাওয়া স্বাভাবিক। উট আমদানির দেশটি উট ও এই প্রাণিজাত খাদ্য রফতানির দেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।১৬
উপর্যুক্ত তথ্যবিবৃতি চমৎকার পশুকাহিনির উপজীব্য হতে পারে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মনুষ্যপ্রজাতি অন্য প্রজাতির প্রাণিকূল ঝাড়ে বংশে নিকেশ করে, এই কথা পূরণও। ২০২০-এ পূর্বাপর সম্বন্ধানুসারে মনুষ্য প্রজাতির সামূহিক ও রাষ্ট্রিক দাপটের শিকার উট বলে নির্দিষ্ট প্রজাতির বিশেষ এই কাহিনি তো কৃতঘ্নতার এক ক্লিন্ন ইতিবৃত্ত। কিন্তু সেই ইতিবৃত্তে উটেরা বিষয়, বিষয়ীর বোধ ও চৈতন্যের ঐকান্তিক বর্গে তাদের কথা বিধৃত। ভিন্ন প্রজাতিরূপে উটেদের আর্তি উচ্চারণ কী, সেটাকে সামান্য ধরতে পারার এন্টেনা কি মানুষের ভাষা চৈতন্যে আছে? আদৌ থাকা সম্ভব?১৭
রচনার মাঝে মাঝে দীপেশ ‘conjoined histories’ বা ‘সংযোগ-সম্বন্ধী ইতিহাসাবলি’ লেখার উল্লেখ করেছে।১৮ গ্লোবাল বিশ্বের মানুষের দৌড় আর গ্রহজাগতিক বিশ্বে মানুষের যাত্রাকাহিনির মাত্রা ও গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। এই দুই ভিন্ন মাত্রা ও প্রকৃতির সংযোগ কোন ভরবিন্দু নির্ভর? সমস্যাটি অনুবাদের মাধ্যমে দীপেশের জবানিতে পেশ করছি, মূলটিও পাদটীকায় আছে।
ভূ-পদার্থী শক্তি হিসাবে আমরা নিজেরা কখনোই সরাসরি অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে পারব না। অথচ আমরা জানি যে আমাদের সামূহিক অস্তিত্বের (collective existence) সাধন প্রণালিসমূহের মধ্যে অন্যতম ওইটি (ভূ-পদার্থী শক্তি স্থিতি) … এই অমানবিক শক্তিসদৃশী মানুষের সাধন স্থিতি আমাদের বলে যে আমাদের মানুষী জীবনটা আর কোনো সহজ সত্তাগুণে [কেবলমাত্র] বিভূষিত নয়। মানুষের অস্তিত্ব তো সত্তাবোধে লগ্ন। সেটা অনস্বীকার্য। ...কিন্তু এই গ্রহে ভূ-পদার্থী শক্তি হতে গিয়ে আমরা আরেক ধৰনের সামূহিক অস্তিত্বের রূপও বিকশিত করেছি. সেই রূপটার কোনো সত্তাময় মাত্রা নেই। সেই রূপটাকে বোঝার জন্য এখন নিজেদের চিন্তার সম্পর্কেও স্ব-চিন্তা আমাদের বোধব্যাখ্যার ক্ষমতাকে চূড়ান্ত সীমায় ঠেলে দিয়েছে। মানুষকে নিয়ে চিন্তার সত্তাবোধরহিত পন্থার নানা প্রয়োজন আমরা বোধ করছি।১৯
সত্তার ভাবনা তো মানুষেরই ভাবনা, সত্তাময় মানুষের পূর্ণ ভাষা আছে, ইতিহাসের জ্ঞান তো ভাষাময়, সব জ্ঞানই ভাষায় অনুবিদ্ধ। সত্তারহিত অ-মানবিক মানুষের কথা বলা হয়েছে, তার ভাষা কী? চিন্তার সাধনপ্রণালি কী? অ-মানবিক যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে বর্ধিত সামূহিক অস্তিত্বের কোটি ও সত্তাময় চিন্তক মানুষের জীবকোটির মধ্যে ছিলার গুণ টানতে গেলে ধনুকটাই ভাঙবে কিনা? রচনার মধ্যে আবহবিদ ও ঐতিহাসিকের ভাবনার ‘আদান-প্রদান’-এর কথা দীপেশ বলেছেন, আবহবিদের সমাবেশে বৈজ্ঞানিকদের প্রবন্ধাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সবের ভাষাতে সত্তাময় মানুষের উদ্বেগের কথা বলা আছে, জীব ও জীবনের সব টানাপোড়েনেই একেবারে মানুষী চিন্তনের বর্গে ধরা আছে। সত্তাময় মানুষী সামূহিক অস্তিত্ব ও সত্তারহিত অমানুষী সামূহিক অস্তিত্ব কী কী শর্তে একীকৃত হবে, বা পরিপূরক হবে, বা অনসত্তামূলক চিন্তার আকার কী? দীপেশের অনুসন্ধিত ‘সংযোগ-সম্বন্ধী ইতিহাসবলি’ বৈশ্বিক, কান্ট ও হানা আরেন্টের অর্থেই সার্বত্রিক মানুষের আস্তিত্বিক স্থিতির আধার। গ্রহজাগতিক কালে ও ভুবনে মানব এবং অ-মানবের সম্পর্ক ক্ষেত্র সগুণ বা নির্গুণ, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর দীপেশের জানা নেই, ফলে আসন্ন ইতিহাসের চারিত্রিক প্রত্যাশাও একটু ধোঁয়াশা থেকে যায়।২০ উষ্ণায়ন পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যায় জর্জরিত মানবসমাজ। এই প্রস্থানভূমির উপর দাঁড়িয়ে দীপেশের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। গ্লোবাল মানুষের অস্তিত্ব ও চৈতন্যে ঢুকে পড়েছে আরেক বস্তুসত্য, প্লানেট বা গ্রহরূপী জগৎ, তাকে পরিত্যাগ করে আধুনিক মানুষের অবস্থান ভাবা ও বাঁচিয়ে রাখা দুষ্কর। নতুন নৃতত্ত্ববিদ্যার সন্ধিৎসায় এই সমস্যাটি দীপেশের মতো ভাবুককে প্রণোদিত করেছে। এই ভাবনা উপস্থাপনের নান্দী-প্রশ্নটি ইমানুয়েল কান্টের, দীপেশ বইতে উচ্চারণ করেছে, মূল ভাষাতেও প্রশ্নটি পেশ করা হয়েছে, ‘মানুষ কী?’ (Wast ist der Mensch?)২১
এই জিজ্ঞাসা চকিতে আমার মতো পাঠকের মনে গত শতকের শেষে আরেকজন চিন্তাবিদের লেখাকে মনে করিয়ে দেয় ‘মানুষের অন্তর্ধান’ নিয়ে মিশেল ফুকোর বিবরণ স্মরণীয়। ইউরোপীয় প্রবোধনের কেন্দ্রে থাকা বিষয়ী মানুষের রূপটি ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রতার্কিক সম্বন্ধে দানা বেঁধেছিল, সম্বন্ধের কুলজিটা দেড়শ বছরের পেছেনে যায়নি। গত শতকের শেষে ফুকোর রচনাপাঠ প্রভুমন্য পাশ্চাত্যের জ্ঞানভিত্তির অবয়ব গড়ে ওঠার নিহিত প্রক্রিয়াকে আমাদের কাছে উন্মোচিত করেছিল, আধুনিকতার আদর্শায়িত মানবতাবাদকে ফর্দাফাই করতে সক্ষম হয়েছিল। সমুদ্রের বেলাভূমিতে আঁকা জ্ঞানগর্বী বিষয়ী সভ্য মানুষের ছবি আসন্ন ঢেউয়ের ধাক্কাতেই অচিরে মুছে যাবে, এই ছিল তাঁর বহুল পরিচিত ভবিষ্যৎবাণী।২২
ফুকোর বিখ্যাত জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্দর্ভ লেখার পর দেখতে দেখতে ষাট বছর চলে গেছে। নবায়িত নৃতত্ত্ববিদ্যার সন্ধানী আলোকে অন্য মানুষী সত্ত্বা বা মানুষী সত্তার ‘অতিরেক’ (‘more than human’)-এর রূপ-ছবিকে হাজির করার দাবি উঠছে, চিন্তার দিগন্তে পট-পরিবর্তন ঘটছে। দীপেশের মতে, তার লেখা বইটি মানবিক অস্তিত্বের নতুন শর্তগুলি খুঁজে বার করবার যৌথ অঙ্গবিশেষ। হিউমানিস্ট চিন্তার নবায়ন এভাবেই হতে চলেছে।২৩
বইটিতে ‘উত্তরকথন’ বলে একটি অংশ যোজিত আছে, ব্রুনো লাতুর ও দীপেশের কথোপকথনে মাঝে মাঝেই নতুন ঐতিহাসিক দিগন্ত (vista)-এর প্রত্যাশা আছে, মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক তথা মানবিক শৰ্তের সদর্থক গুণচিন্তা আছে। দুইজনের আলাপচারিতা ‘নাস্তি’তে শেষ হয়নি।
আলাপচারিতায় দুই ‘চিন্তক’ই ‘গাইয়া’ (gaia) বলে একটি ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন, ধারণাটির কোন তারে তারা টান দিচ্ছেন, সেটা আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়।২৪ ‘গাইয়া শব্দটি গ্রিক পুরাণ থেকে নেওয়া, পরিবেশবাদীদের আলোচনায় বহুল ব্যবহৃত। ওই ‘গাইয়া’র খোপে পরিদৃশ্যমান জগতের প্রতি বিস্ময়, ভয়, শ্রদ্ধা জাতীয় অনুভূতির উদ্রেকের কথা দীপেশ বলেছে। ওর মতে, ‘গাইয়া’র বোধমুহূর্ত ‘কাব্যিক’ (poetry)। দুই ভিন্ন বৈশ্বিক জগতে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক স্থিতির মেলবিন্দু পাওয়া গেলেও যেতে পারে গাইয়ার মৌহূর্তিক ‘অনন্য’ (singularity) উপস্থিতির আস্বাদিত অভিজ্ঞতায়।২৫ এই বক্তব্যই পাঠক হিসাবে আমি বুঝেছি। ভুল বুঝতে পারি, অন্য পাঠক ভিন্নভাবেও বুঝতে পারেন।
উপর্যুক্ত বোঝার সূত্রে ভারতের একজন বাংলাভাষী পাঠক হিসাবে আমি একটি চিন্তাপ্রক্ষেপ করছি, ‘ঋত’-এর বর্গ পেশ করছি। ‘গেইয়া’ আর ‘ঋত’ হুবহু সমার্থক নয়, তবে সদৃশ।২৬ নিয়ম ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থার অনুশাসনে গ্রজাগতিক বিশ্ব আবর্তিত হয়। এই তত্ত্বটি অবশ্য আধুনিক জীববিজ্ঞান ও আবহবিজ্ঞান দ্বারা আদ্যন্ত শোধিত ও হালনাগাদ নয়, কিন্তু একেবারে বাতিল হবার ঝুড়িতেও পড়েনি। ঋতবাদীদের মতে, মানবসত্তা বিশ্বপ্রকৃতির প্রাণময় সত্তার অংশ, সেই অংশ হয়ে ওঠা ও থাকার গতিপথই ঋতের পন্থা। ঋতপথের রাহি মানুষ নিসর্গনিষ্ঠ। ব্যক্তিসত্তায় ওই মানুষের জাগতিক সব অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে প্রকৃতি অনুভব করে। সেটাই তার পরম প্রাপ্তি। ঋতে আস্থা থাকলে ইহজগতে গ্রাহ্য কোনো না কোনো ভাষার মধ্যেই ব্যক্তি দেহেন্দ্রিয় সন্নিকর্ষজাত পদার্থের জ্ঞানে ‘সমষ্ঠিরূপ অভিব্যক্ত জগত’কে মান্যতা দেয়। ঋতের চিন্তা বা বোধই মানবিক চৈতন্যকে জগন্ময় করে তোলে।২৭
ভারতীয় চিন্তন ও সামাজিক অভ্যাসের রীতি-নীতিতে ইতিহাসের সামান্য ছাত্র হিসাবে ঋতবাদের স্বাক্ষর প্রকীর্ণভাবে ছড়িয়ে আছে, দেখতে পাই। ঋতবাদী ঈপ্সা উচ্চারিত হয় যজ্ঞ বা উৎসবের মন্ত্রোচ্চারণে।২৮ জাতকমালার বোধিসত্ত্ব তো পশু-পাখি তথা জীবসত্তায় ছড়িয়ে থাকেন, ঐ অসংখ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণিসত্তার উদবোধনের যাত্রাপথে বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। রামায়ণের আদিশ্লোক ও মহাভারতের নানা গল্পে জীবগতের প্রতি আনৃশংসতার আচরণকে সহনীয় মানবিক চিত্তবৃত্তি বলে তুলে ধরা হয়েছে। আনৃশংসতার নীতি বিপর্যয়েই তো যুগবিপর্যয়ের সূত্রপাত।
তথ্যবস্তুর নিরিখে জানা যায় যে মোগল আমল থেকে পারিপার্শ্বিক নিসর্গে মনুষ্যেতর প্রাণি ও জড়বস্তুদের স্থিতি অধিকার রক্ষার পক্ষে কৃষিজীবী বিশনিয়া সম্প্রদায় সদাসচেতন, তাদের কৌমসর্ব ঋতবাদী চিন্তায় প্রোথিত। এই কয়েক বছর আগে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার মামলায় বিশনিয়ারা বলিউডের নামজাদা অভিনেতাদের নাজেহাল করেছে। বিজ্ঞানের সাবুদ জানা নেই, তবে ঋতবাদী চিন্তনের পক্ষে জনসমাজের ক্রিয়াকর্মের সাক্ষ্য প্রচুর।
এই ব্যবহারিক সাক্ষ্য অনুসারে ইতিহাসবোধ ও সময়চেতনা ঋতবাদী আকারে লেখা হতে পারে। বাংলা লেখালিখির জগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঋতবাদী আকারের একজন সেরা নকশাকার। তাঁর এই গোত্রীয় নানা রচনার মধ্যে ‘খুঁটি-দেবতা’ নামে একটি স্বল্প আলোচিত রচনার উল্লেখ করছি। ঘোষ-পাড়া বলে বাংলার অজ অঞ্চলে এক তুচ্ছ লোকবিশ্বাস ও প্রবাদ কাহিনি নিয়ে বিভূতভূষণ গল্পটি ফেঁদেছিলেন। বিষয়, বাঁশের খুঁটির মতো প্রাণহীন জড়বস্তুর প্রাণে অতিশায়িত হবার কথা। হোলমত্তা-শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা নন্দলাল গরিব, তাঁর অল্পবয়সী বউটা স্বভাবে সাদাসিধে। পরিবারের দুঃসময়ের সম্বল বলতে বউয়ের কাছে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া কিছু গহনা ছিল। সবার অজান্তে নন্দলালের আশ্রয়দাতা লোভী ও প্রতাপী মামাশ্বশুর রাঘব চক্রবর্তী বউটির গহনা হাতিয়ে নেয়। তক্তাপোষের বাঁশের খুঁটির কাছে অসহায় ‘নিরক্ষরা বিকৃতমস্তিষ্কা গ্রাম্য বধূ’ অন্যায়ের বিহিত করার জন্যে আবেদন জানাত। অবস্থা বিপাকে নন্দলাল বউকে নিয়ে কারখানায় কাজ করতে যায়। ‘হাঁফ ছেড়ে’ রাঘব চক্রবর্তী বাড়ি মেরামতের কাজে লেগে পড়েন, কাশীতে তীর্থযাত্রার সংকল্পও করেন। এই সুখের সময়ে তার চোখে ঘুম আসে না, অনিদ্রায় দিনরাত ছটফঠ করেন। স্বপ্নে দেখেন সেই বাঁশের খুঁটি ‘বিকটাকার মূর্তিতে’ আঙুল তুলে রাঘবকে ব্যঙ্গ করে চলেছে। ভয়ে ও অনুশোচনায় কারখানায় গিয়ে ভাগ্নে-বৌকে তিনি গহনা ফেরত দেন। ওই খুঁটি দেবতার প্রসাদে পরিবারে পর প্রজন্মের এক ক্যান্সার আক্রান্ত পুত্রবধূ সুস্থ হয়; তখন বাঁশের খুঁটিটি শ্যামরায়ের ‘কমনীয় তরুণ দেবমূর্তি’র আকারে বউ-এর দিকে ‘মৃদুহাসিমুখে’ চেয়ে ছিল। একেবারে সহজ বিশ্বাসের গল্প, খুব একটা বস্তুবিজ্ঞান সম্মত নয়। বিভূতিভূষণ আখ্যানটি সেভাবেই লিখেছিলেন। গল্পের প্রতিটি স্তরে বিস্ময়, ভয় ও শ্রদ্ধার অনুভূতির সুর অনুরণিত, ঋতবাদী আবেদনের মন্ত্রে কাহিনিটি সিদ্ধ। ওই খুঁটি-দেবতার আবাহনে জড় ও জীব হাত ধরাধরি করে, গ্রহ-পৃথিবী’র (planetary earth) স্থিতি মানুষী লোকবিশ্বের সহগ হয়ে ওঠে।২৯
গাইয়ার একটি বীক্ষণে মানুষ উপর থেকে নীচে দেখে (top-down
approach), ‘স্পেসশিপ’ বা গ্রহযানে বসে পৃথিবীকে দেখা ‘আউটসাইড-ইন’, বীক্ষণটি সামগ্রিক, জীবন ও জড় একাকার।৩০ ভারতীয় ঋতবাদের সহজসাধনে খণ্ড দেখা ও অখণ্ড দেখার সহ-অবস্থান আছে। এমনকি একটি দেখা আরেকটির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট। অখণ্ডের বিবর্ত খণ্ড খণ্ড জীবরূপ, জৈনরা সেই তালিকায় সব প্রজাতির অণু-প্রাণকেও সসম্মানে স্থান দেন। সহজপন্থে ‘গ্রাউন্ড আপ’-এর ধারণাটি হাজির হয় ‘উজুবাট’-এর রূপে, একেবারে উজান বাওয়া। দর্শক এই যাত্রাপথে জীবজগতকে চৈতন্যের পথে আনে, দেহভাণ্ডেই তার ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান হয়। দ্বৈত বনাম অদ্বৈতের টানাপড়েনে মায়া বা লীলার খেলায় প্রাকৃত বৃন্দাবনের গোষ্ঠে স্থিত পাহাড়, গাছপালা, বিষধর সাপ, ঝড়-বৃষ্টি সবই অপ্রাকৃত সত্তায় হাজির হয়। এই লীলার খেলার দোলাতেই চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাসের কাব্য পদাবলীর রস আমরা আস্বাদন করি। মানবিক ও অমানবিক দুই স্তরেই রস আস্বাদন চলতে পারে।৩১ গাইয়ার অনন্যতা (singularity) তো কাব্যিক অনুভূতি বোধে, এমন একটা কথাই তো দীপেশ তার আলাপচারিতার শেষে জানিয়েছিল।
মানবিক ও অ-মানবিক ভুবনের মধ্যে গতায়াতের সম্ভাবনার চিন্তা দীপেশের বইতে আলোচিত হয়েছে। সম্ভাবনার চরিত্র নিয়ে বিতর্ক থাকবে। তবে ইতিহাসবিদ্যাচর্চার দিগন্তে এহেন চিন্তা কার্যকারণ পরম্পরা সিদ্ধ ইতিহাসবিজ্ঞান ও কাব্যিক-গল্পকথায় ঋদ্ধ ঐতিহ্যচেতনার সীমানা ভেঙে দিতে পারে, চৈতন্যের অতিরেকে বিবরণই হয়ে উঠবে বিশ্লেষণ। ঐতিহাসিক বাস্তবতা কাব্যিক অতিশয়িতায় ব্যঞ্জিত হবার জন্য ক্ষণে ক্ষণে দাবি জানাবে। ভারতীয় ঋতবাদের হার্দিকতায় ইতিহাসবোধের যে কোনো গোত্রান্তর যেন স্বাগত।
পাদটীকা
১। দীপেশ চক্রবর্তী, মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, সমর সেন স্মারক বক্তৃতা (কলকাতা: অনুষ্টুপ,২০১৮) পৃ. ১৮-১৯। উপর্যুক্ত রচনার পাশাপাশি দীপেশের চিন্তার অভিমুখের দিকবদলের হদিস আছে, সাম্প্রতিক ইতিহাস ভাবনাঃ আমার ইতিহাসের আলপথ ধরে (কলকাতাঃ তালপাতা, ২০১৫) নামক নিবন্ধে।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দীপেশ অনেকদিন ধরে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে লেখালেখি করছে। প্রথম লেখার খসড়া বাংলা ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। দুয়েকটি বাহবা পেলেও বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে তেমন কোন আগ্রহ সঞ্চার হয়নি। অথচ পাশ্চাত্যের একাডেমিতে দীপেশের চিন্তা বিষয়গুণে তর্কের সমৃদ্ধ পরিসর খুলে দিয়েছিল। তার অভিজ্ঞতার কথা বিধৃত আছে একটি বইতে, Dipesh Chakraborty, 'Introduction', The Crises of Civilization: Exploring Global and Planetary Histories(New Delhi, Oxford University Press,2018) [CC বলে নির্দেশিত] পৃ. xxxiii।
২। দীপেশ চক্রবর্তী, মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭, ৪৪-৪৭।
৩। Amitav Ghosh, The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable (Chicago: Chicago University Press, 2016) . মণীন্দ্র গুপ্ত, ‘পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান, গদ্যসংগ্রহ (কলকাতা, অবভাস, ২০০৭), পৃ. ৮১-১৪০। ‘ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা-এর উদ্বেগ সুন্দর ফুটে উঠেছে জয়ন্ত বসুর লেখা প্রবন্ধে, ‘ গ্যাস চেম্বারেরপথে পৃথিবী? আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯।
৪। এহেন গোত্র প্রথমেই মনে আসে Rachel Carson- এর জগদ্বিখ্যাত বইয়ের কথা, The Silent Spring(1962)। DDT- এর মতো রাসায়নিক কীটনাশক কিভাবে জীবজগৎ ও প্রাণীবৈচিত্রের ছন্দ ধ্বংস করছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ বইটিতে বিধৃত আছে। বৃহৎ শিল্পপতিরা লেখিকার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হন। অন্যপক্ষে, আমেরিকা জুড়ে রচনাটি পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন ভাবনার জন্ম দেয়, Garry Kroll- এর মতো ঐতিহাসিকের চোখে, 'RC's silent spring played a large role in articulating a subversive subject as a perspective that cuts against the gain of materialism, scientism and technologically engineered control of nature'. Wikipedia. ‘অর্ন্তঘাতমূলক বিদ্যা কিভাবে একবিংশ শতকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার প্রধান ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে, সেটি অনুসন্ধিৎসার বিষয়। জ্ঞান চর্চা ও পরিবেশবাদী আন্দোলনে রাচেল কারসনের বৈপ্লবিক অবদান চিরস্মরণীয়।
৫। মূলত ভূ-তাত্ত্বিক শাস্ত্রবিদ্যার সুবাদে পার্থিব পরিবেশ চর্চায় শব্দগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যেমন,পৃথিবী বলে গ্রহটির বিবর্তনের কালপঞ্জিতে বর্তমান সময়ে পর্বের তকমাটি হল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বোলোনায় ভূতাত্ত্বিকদের কংগ্রেসে অভিধাটি গৃহীত হয়েছে। শব্দটি গ্রীক ভাষা জাত। Holos-->whole, koiros --> new অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন। শেষ তুষার যুগের অবসানের পরে উপর্যুক্ত কালপর্বে মানুষ প্রজাতির জন্ম থেকে পারমাণবিক সভ্যতার বিকাশ ঘটে। বর্তমানে এই যুগের ছায়াতেই আমরা বাস করি।
Anthropocene শব্দের মূলও একটি গ্রিক শব্দ। Anthropos -->Anthropo--> নর বা মানুষ, koiros --> cene --> new - নতুন বা সাম্প্রতিক। নৃকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক যুগ বোঝাতে anthropocene শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোন আন্তর্জাতিক ভূ-বিদ্যা সম্মেলনে সর্ববাদী সম্মতরূপে এখন শব্দটি যুগ নাম হিসেবে গৃহীত হয়নি। তবে বৈজ্ঞানিক মহল থেকে পরিবেশবিদদের আলোচনায় শব্দটি বহুল প্রচারিত। পৃথিবীর পরিবেশ, আবহাওয়া ও জীবজগতের উপর মনুষ্য প্রজাতির সামূহিক সর্বাতিশ্রয়ী আধিপত্য এই পর্বের লক্ষণ। পৃথিবীতে অধুনা ভূ-পদার্থী শক্তি হিসেবে মানুষ প্রজাতি বিরাজ করছে। ১৯৪৫ সাল থেকে পারমাণবিক শক্তির দাপটে ও জেনেটিক্স তথা জীন তত্ত্ব ও প্রযুক্তির ব্যবহারে পার্থিবজীব ও জগতের উপর মানুষের খবরদারি দুর্মর হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিতে এই বিপুল ক্ষমতা বৃদ্ধি বা 'Great Acceleration', ‘দুরন্ত গতিময় বলে বিশেষায়িত করা হয়েছে।
প্রাগুক্ত শব্দগুলির অর্থ বিচার ও তাৎপর্য নির্ণয় নিয়ে নানা আলোচনা আছে। আগ্রহী পাঠকের জন্য একটি সহজলভ্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ, Ian Angus, Facing the Anthropocene: Fossil Capitalism and the Crisis of the Earth System (New Delhi: Aakar Books, 2016), Christophe Bonneuil and Jean-Baptiste Fressoz, The Shock of the Anthropocene: The Earth, History and US (NY: Verso, 2016)
৬। CHPA, p 18-19
৭। ‘Interview: Dipesh Chakraborty on how climate changes upends long standing ideas of modernity’, Scroll, July 11, 2021. গ্রহ জাগতিক সময় পর্বে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভূ-ব্যবস্থা বিজ্ঞান চর্চার ধারা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন, উপর্যুক্ত সাক্ষাৎকারটিতে দীপেশ এই মত ব্যক্ত করেছে। এহেন শাস্ত্রে বিজ্ঞানের একদা ছাত্র দীপেশের পড়াশোনার নিবিড় পরিচয় ধরা পড়েছে, ‘Anthropocene time’ শিরোনামাঙ্কিত অধ্যায়ে, CHPA pp 155-182।
৮। 'Global Reveals the Planetary', 'A conversation with Bruno Latour' Postscript CHPA, p.215. প্রাগুক্ত।
৯। দীপেশ চক্রবর্তী, ‘ আরেক টোয়েন্টি টোয়েন্টি: পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও মানুষের ইতিহাস’, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স,২০১০) পৃ. ২৩ পৃ.৩৮-৪০। এই রচনারই ইংরেজি রূপ দীপেশের বহুচর্চিত প্রবন্ধ, ‘Climate of History: Four Thesis, Critical Inquiry, 35:2, pp.197-222।
১০। মানবিকতা ও অ-মানবিকতা, ঐ, পৃ. ৩৬-৪০
‘বুড়ো আংলা’য় আকাশবিহারী রিদয়ের দৃষ্টি তথা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টির ঝোঁক বিচারে দীপেশের মতের সঙ্গে আমার মতের বৈমত্য আছে। ‘বুড়ো আংলা’ গল্পে হাঁসের পিঠে আকাশচারী রিদয় পার্থিব ভেদকে পূর্ণ মর্যাদা দেয়, মটকা বসা কুঁকড়োরা উড়ন্ত হাঁসদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়, উত্তরগুলি সব সবিশেষ। রিদয়ের দর্শনে ও মননে একেবারে বিশেষণ মাফিক আলাহিদার নানা খুপরি তৈরি হচ্ছে,
‘কোন ঘাট?’ ‘সাঁকের ঘাট - গুগলি ভরা।’
কোন হাট? ‘উলোর হাট - খড়ের ধুম।’...
‘কোন আবাদ?’ ‘নসীরাবাদ - তামুক ভালো।’...
‘কোন দীঘি?’ ‘রায়দীঘি - পানায় ঢাকা।’
‘কোন খাল?’ ‘বালির খাল - কেবল চড়া।’...
‘কার বাড়ি?’ ‘ঠাকুর বাড়ি।’
‘কোন ঠাকুর?’ ‘অবিন ঠাকুর - ছবি লেখে।’ ‘কার কাচারি?’
‘নাম করো না, ফাটবে হাঁড়ি।’
(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ বুড়ো আংলা’, রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড
(কলকাতা: প্রকাশ ভবন, ১৯৭৬), পৃ.১৫৫
উপর থেকে নিচে দেখার এই বিবৃতিতে আকাশবিহারী দর্শনের ফ্রেমে নানা ভেদেই অঞ্চলগুলির বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল, বৈপরীত্যের টানে ভরপুর, এক বাড়িতে অবন ঠাকুর ছবি আঁকেন আর ওই সংবাদের ঠিক পরেই কাছারির নামে হাঁড়ি ফাটে, ইশারা তো কাফি হ্যায়। অবশ্যই কাল্পনিক বিহার, কিন্তু গগনচারী রিদয়ের দেখায় ভূমণ্ডলের একীকরণ উদ্দেশ্য নয়, বরং প্রকৃতি ও জীবের বহুধা সংযোগের সংস্কৃতির মধ্যে প্রাণের ইচ্ছাসত্তা ও ক্রিয়াসত্তার নানা ভিন্ন প্রকাশের নির্বাধ উদযাপনই তো বুড়ো আংলা’র মর্ম। সেই অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়াতেই তো নিষ্ঠুর অভিশপ্ত রিদয় প্রাণময় নিসর্গে তার মনুষ্যত্বটি ফিরে পায়।
CHPA-তে দীপেশ অবন ঠাকুরের উল্লেখ করেনি, ভাষাভেদ ও পাঠকভেদে উপস্থাপনার রীতিতে রকমফের হওয়া স্বাভাবিক।
১১। CHPA pp.81-85
১২। CC, pp.242-243, CHPA, pp. 19-20, 91-93।
‘নবদর্শন ঋদ্ধ নৃতত্ত্ববিদ্যা’ বা এক্ষেত্রে নিছক নৃ- কূলবিদ্যা বা ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি নিয়ে বিদ্যাচর্চা বোঝায় না। বরং ইমানুয়েল কান্টের সংজ্ঞার্থে শব্দটির তাৎপর্য বোধিত হয়েছে, ‘ মানুষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিষয়ক তত্ত্বনীতি’। 'a systematic ...doctrine containing our knowledge of man' Introduction, Anthropology from a Pragmatic point of view (1798). দ্রষ্টব্য, Howard Caygill, A Kant Dictionary (Oxford: Blackwell, 1995), pp. 73
১৩। CHPA, pp 188-190
১৪। CHPA, pp. 194-196, 198-204.
৩০-এর দশকে এক বিখ্যাত পত্রিকায় রূপকথায় পরি ও ভূতুড়ে গল্প নিয়ে মাতামাতি করার বিরুদ্ধে এক প্রাজ্ঞ চিন্তক ও সম্পাদক আপত্তি জানান; উদ্দেশ্য সৎ, জুজুর ভয় ও মিথ্যা জ্ঞান থেকে সরল শিশু মনকে মুক্ত রাখা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি নামে প্রবন্ধ সংগ্রহে (১৯৩৫) বুদ্ধদেব বসু বক্তব্যটিকে তুলোধোনা করেন। শুদ্ধির নামে, যুক্তি দোহাই দিয়ে এহেন ফতোয়াধর্মী বক্তব্য বিস্ময়, হর্ষ ও আতঙ্কের মতো অনুভূতি থেকে শিশুর মনকে বঞ্চিত করে, বিচিত্র কল্পনার জগতের স্বাদকে ভোঁতা করে দেয়।
বিভূতিভূষণের মনের দৃষ্টিপ্রদীপে তো অন্য এক ভুবন সবসময়ই হাজির থাকতো। নদীর তীরে সেই জগৎ থেকেই মধুসুন্দরী দেবী তারানাথের কাছে আসতেন, নিবিড় প্রেমে লিপ্ত হতেন, আবার ভয়ংকরী রূপ দেখাতে দ্বিধা করতেন না। মানুষী ও অমানুষিকের অণ্বয়ে দেবী সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা তারানাথের জীবনের এক সংক্ষিপ্ত পর্বকে অনন্য করে তুলেছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় গল্প’, বিভূতি রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, (কলকাতা; মিত্র ও ঘোষ, ১৮০১), পৃ. ১৮২-১৯৫।
সমাজতত্ত্বের একটি বিচার অনুযায়ী আধুনিক জগতকে অ-বিমোহিত বা disinterested বলা হয়। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোক ও উত্তাপে আমাদের দৈনন্দিনতা থেকে সব কুহক বা মায়াই উবে গেছে, অন্য ভুবনে বিশ্বাস থাকা তো কুসংস্কার। অথচ ইতরত্ব (অপরত্ব) বা ভিন্নাশ্রয়ী বোধ না থাকলে কোলো সত্তা বা জগতই তার সসীমত্ব ও অসসীমত্বের টানাপড়েনকে বিবৃত করতে পারে না। এক লোকের অবস্থানকে ধরার জন্যই অ-লোককে আহ্বান করতে হয়। দুটি নজির হাজির করছি।
Provincializing Europe -এর মতো সুপরিচিত বইতে একটা সুন্দর কথা-কণিকা দীপেশ পেশ করেছিল। গত শতকে কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস আয়ারল্যান্ডের লোককথা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলো। কার্যসূত্রে মিসেস কনোলি বলে এক বয়স্ক মহিলা ইয়েটসকে নানা লোককথা বলেন। বৈঠক শেষে ইয়েটসের প্রশ্নের উত্তরে কনোলি জানিয়ে দেন যে পরিদের অস্তিত্বে তিনি ঘোর অবিশ্বাসী। বিদায় নিয়ে ইয়েটস চলে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কনোলি ফুকরে ওঠেন, ‘কিন্তু তারা আছে, মি. ইয়েটস, তারা আছে। Dipesh Chakrabarty, Provincializing Europe (New Jersey: Princeton University Press, 2000), pp. 111-112.
আমাদের মতো বাঙালি পাঠকের কাছে অংকের নামজাদা প্রফেসর আর প্রচণ্ড নাস্তিক মহেশ মিত্তির একেবারে অপরিচিত নন। ভুতের থাকা বা না থাকা নিয়ে প্রিয় সহকর্মী হরিনাথ কুণ্ডুর সঙ্গে হাতাহাতি করে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে ভূতের অনস্তিত্ব নিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ লেখককে প্রতি বৎসর পুরস্কার দেবার জন্য ফান্ড তৈরি করে তিনি লিখে যান, অছি হরিনাথ কুণ্কুডু। গভীর রাতে মহেশের শেষযাত্রার আয়োজন ঐ হরিনাথই অতি কষ্টে করেছিলেন। শ্মশানের পথে ছুটন্ত খাটের উপরে মহেশের শব দাঁড়িয়ে উঠে লেকচারের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলতে থাকেন,‘ ও হরিনাথ - আছে আছে, সব আছে, সব সত্যি। (‘ মহেশের মহাযাত্রা’, পরশুরাম গ্রন্থাবলী, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: এম. সি. সরকার, ১৩১২)
পরশুরাম পরম যুক্তিবাদী, অপবিজ্ঞান আর বাবাজিদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আত্যন্তিক। তবু লোক ও অ-লোকের মধ্যে বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে গতায়াতের পথ, প্রশ্ন তোলার জায়গাটা তিনি বন্ধ রাখেননি, পরিসর খোলা রেখেছেন। সব অবিমোহনের মধ্যে মানুষকে চারপাশের পরিসরকে প্রাণময় করে তুলতে অমানুষিকতার হাতছানিতে সাড়া দিতে হয়, অন্য ভুবনকে খুঁজতে হয়। ভুবনটি বিজ্ঞানসম্মত না বিজ্ঞানোত্তর, সেই তর্ক ভিন্ন।
১৫। CHPA, pp. 90
১৬। আমার বলা উটকাহিনির তথ্যভিত্তি কাগজের টুকরো খবর বা অন্তর্জালে প্রাপ্ত পশুপ্রেমীদের প্রতিবাদপত্র। মহাদেশের ইতিহাসে নানা বিষয়ধর্মী আলোচনায় উটেদের অস্তিত্বগাথা প্রকীর্ণ হয়ে আছে। Ben Lerwill, ‘The strange story of Australia’s Wild Camel’, BBC Travel. 2018410, 10 April 2018, the Indian Express, 10 Jan, 2020.
সম্প্রতি এক গবেষণা গ্রন্থে সামিয়া খাতুন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অভিবাসনের ইতিবৃত্ত রচনার আদিকল্পে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে দক্ষিণ এশিয়াবাসীদের অবস্থিতি কী ভূমিকা পালন করেছিল, তার বিবৃতি দিয়েছেন । বিংশ শতকের প্রথমার্ধে উটের বাহিনী ও উটের বাহিনী-চালকদের কথা সেই কাহিনীতে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান পেয়েছে। লিপিকুশলতার জোরে স্মৃতিসাক্ষ্য, কথাকণিকা, বটতলা থেকে ছাপা ইসলামি কিস্সা, প্রত্নসাক্ষ্য - সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক বর্ণাঢ্য নকশি কাঁথা বোনা করুণ মানবিক গাথা হিসাবে বইটি গণ্য হতে পারে। Samia Khatun , Australiaramah, The South Asian Odyssey in Australia (Queensland: University of Queensland Press, 2019), pp 107-124.
১৭। ভাষার খেলা বোঝার শর্তগুলি ব্যবহারকারীদের ‘ জীবনযাপনের পটরূপে’ ('form of life’) নিহিত আছে, এই হ্বিটগেনস্টাইনীয় বক্তব্যে আমি আস্থাবান। সিংহ কথা বললেও বলতে পারে, কিন্তু সিংহের কথা আমাদের বোধগম্য হবে না, কারণ সিংহের জীবন যাপন পটরূপ আমাদের অনধিগম্য। তুলনীয়, Ludwig Wittgenstein, Philosophical Investigations, (Oxford: Basil Blackwell, 1961) pp. 223। আলোচনা, Marie Mcginn, Wittgenstein and the Philosophical Investigetions (London: Routledge 1997), pp 51-53
হ্বিটগেনস্টাইন তাঁর ভাবনাকে সুত্রাকারে বিধিবদ্ধ করতেন। ভাষা ব্যবহার ও ভাষাকে বোঝার বিশ্লেষণেও নানা প্রসঙ্গানুসারে হ্বিটগেনস্টাইন রচনায় টুকরো টুকরো ভাবে যাপন পটরূপের কথা উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক বহমান। দ্রষ্টব্য। সবিতা চক্রবর্তী, হ্বিটগেনস্টাইনের দর্শনে যাপনের প্রেক্ষাপট, হ্বিটগেনস্টাইন: জগৎ, ভাষা ও চিন্তন, সম্পাদনা: তুষার কান্তি সরকার ও অন্যান্য (কলকাতা: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি১৯৯৮), পৃ. ১৮৭-২০৬। এই বক্তব্য নিরঙ্কুশ নয়। ভাষার অন্তহীন ক্ষমতার অধিকার প্রাপ্তি ও অধিকারবোধ মানুষকে অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে স্বতন্ত্র গুণে বিভূষিত করেছে, ভাষাজ্ঞানই মানুষের অন্যতার মাপকাঠি, আধুনিক সভ্যসমাজের ধারণাটির কুলজি বিচারের অনুপম আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, David Abram, The spell of Sensuous: Perception and the Language in a More than Human World (NY: Vintage, 1997).
একজন পড়ুয়া হিসাবে বলতে পারি যে বৈমত্য থাকা সত্বেও উপর্যুক্ত বইটি পড়ার আনন্দ অপরিসীম, উপমার প্রয়োগ ঝলমলে, ভাষার স্বচ্ছ, স্বাদু ও বহমান। আব্রাম একসময় পেশায় যাদুকর ছিলেন, গবেষণার কাজে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামে ও নানা ছোট জনগোষ্ঠীতে বাস করেছেন। ফলে গোলকায়িত আধুনিকতার বাইরে জনজীবনে নিসর্গ চেতনা, সম্পর্ক ও ব্যবহার কিভাবে দৈনন্দিনতার নানা স্তরে ছড়িয়ে থাকে, সেই সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর আলোচনার তথ্যভিত্তি। অন্যপক্ষে তিনি অবভাসবাদী (phenomenologist), এডমুন্ট হুসের্ল (Edmund Husselr) ও মরিস মার্লো-পঁটি (Maurice Merlau-Ponty) অনুগামী। নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও অবভাসবাদের চর্চার সমন্বয়ে তার রচনাটির অবয়ব তৈরি হয়েছে।
আব্রামের রচনা দুটি ঝোঁক আকর্ষণীয়। প্রথমত, নিসর্গ (nature) বনাম কৃষ্টির (culture) দা-কাটা বিভাগ চিন্তা মানুষকে পঙ্গু করে তোলে, দুটো পরস্পর-নির্ভর, একটার উপস্থিতি বাদ দিয়ে অন্যটির কথা চিন্তা করা সমীচীন নয়। দ্বিতীয়ত, দেখা ও শোনার সরণিতে মানুষের সংবেদনা পরিদৃশ্যমান জগতের দিকে প্রসারিত হয় । শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শের মাধ্যমে প্রাণীজগৎ ও নৈসর্গিক জড়ভুবনের সঙ্গে মানুষ বলে প্রজাতির শরীরী অর্থেই নানা সম্পর্কে জালে জড়িয়ে পড়ে, ওই জড়াজড়ির সুবাদে আদান-প্রদানেও পারস্পরিক বোধগম্যতা ও সংবেদনশীলতার ভাষাও তৈরি হয়। নৃতাত্ত্বিক পাঠ ও গবেষণার ভাণ্ডার থেকে আব্রাম ভাষা ব্যবহারের নানা নিদর্শন পেশ করেছেন।
ভারতীয় বৈয়াকরণদের ভাবিত সবিকল্পতায় আস্থাবান পাঠক মানুষী ভাষার ব্যঞ্জনার অপরিসীম শক্তিকে মানব বিকাশের অন্যতম বিশেষ শর্তরূপে দেখতে আমি আগ্রহী। কুকুর কামড়ের তীব্র ব্যথা দংশিত মানুষ কিভাবে অদংশিত অনভিজ্ঞ মানুষের কাছে বোধগম্য করবে, হ্বিটগেনস্টাইনের এই কূটাভাস আদৌ ফেলনা নয়। তবে মনুষ্য অতিরেক জগতের ('more than human') সঙ্গে সম্পর্ককে সমস্যায়িত না করে মানবিক অস্তিত্ব বোঝা সম্ভব নয়, এই চিন্তাকে আব্রাম নতুন প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তার উপর্যুক্ত সন্দর্ভে হ্বিটগেনস্টাইন সম্পর্কে আব্রাম নীরব।
(‘More than human') বা মানুষ অতিরেক শব্দবন্ধটি দীপেশের রচনাতেও এসেছে। CHPA, pp. 48 ('the history that gestures to 'we' that may indeed be more than human') ।
আলোচনা প্রসঙ্গে ‘অতিরেক’ শব্দটিকে বেছে নেওয়া সঙ্গত বলে আমি মনে করেছি। ওই শব্দটিতে বেশি, প্রাচুর্য তথা অতিরিক্ত বা অতিশয়-এর দ্যোতনা আছে। ‘অতি এই উপসর্গটি অতিক্রমণ-এর ভাবনাকে আনে। আবার ‘ভেদ, ‘অন্তর’ বা বিশেষ’ বোঝাতেও ‘অতিরেক’ শব্দটি প্রযুক্ত হতে পারে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড, (সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৬৬) পৃ. ৪৫।
১৮। তুলনীয়, সংযোগী ইতিহাসরচনা প্রসঙ্গে দুইজন ফরাসি বুদ্ধিজীবীর বক্তব্যের সঙ্গে দীপেশের মত একেবারে পৃথক। সংযোগী ইতিহাসরচনা প্রসঙ্গে প্রাগুক্ত দুই ফরাসি বুদ্ধিজীবীর (দ্রষ্টব্য টিকা ৫) বক্তব্যের ঝোঁক ভিন্ন। এঁদের ধারণানুযায়ী, কিভাবে গোলকায়িত ভুবন ব্যবস্থা ও গ্রহ পার্থিব ব্যবস্থা নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত হল, সেই ইতিবৃত্ত ধনতন্ত্রের অবয়ব বিকাশ ও পুঁজির বিশ্বচক্রমণের কাহিনিতেই নিহিত আছে। ধনতান্ত্রিক বিকাশের সর্বভুক চাহিদাই মানুষকে সর্বাতিশায়ী আগ্রাসনের দিকে নিয়ে গেছে। ধনতন্ত্রবাদই ভূকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে চরম অর্থে নৃকেন্দ্রিক করে তুলেছে। এঁদের মতে, anthropocene-এর চেয়ে capitalocene শব্দটি বর্তমান সময়কে বোঝার পক্ষে সুপ্রযুক্ত। গ্লোবাল/ প্লানেট ঘিরে দীপেশ চক্রবর্তীর বক্তব্য একটি ‘সর্বগ্রাহী মানবিকতা’র (all inclusive view of humanity) কথা বলে। মনুষ্য সমাজের দ্বন্দ্ব, বৈষম্য ও স্তরবিন্যাস সেই বক্তব্যে স্থান পায় না। পুঁজির সর্বগ্রাসী রূপ ব্রাত্যই থাকে। 'Capitalocene: A Combined History of Earth System and World System', in Christophe Bonneuil and Jean-Baptise Fresso, 221-252। একটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন। ভারতের নিজস্ব পরিবেশ আন্দোলন ও তৎসংক্রান্ত আলোচনা ঝোঁক সম্পর্কে দীপেশ ভালোমতোই ওয়াকিবহাল। বাংলায় লেখা নানা প্রকীর্ণ অনুপ্রবন্ধই সেই সচেতনতার প্রমাণ। দ্রষ্টব্য, দীপেশ চক্রবর্তী, ‘আবহাওয়া-বিতর্কে ভারত, দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি,২০১৩, পৃ.৫৫-৭২। বিগত বছরে করোনা মহামারীতে মানুষের চিরন্তন মৃত্যু অভিজ্ঞতা ও ভিন্নতার মানচিত্র নিয়ে দীপেশের সংবেদনশীল রচনা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অবশ্য এই রচনাগুলির সঙ্গে পরিচয় থাকা উপর্যুক্ত ফরাসি লেখকদের সম্ভব নয়। Capitalocene: A Combined History of Earth System and World System', in Christophe Bonneuil and Jean-Baptise Fresso, 222-252। প্রাগুক্ত।
১৯। CC, pp. 239, পূর্বোক্ত। উদ্ধৃতিটির মূল রূপ,
'But we cannot ever experience ourselves as a geo-physical force - though we know now that this is one of the modes of our collective experiences. ... This non-human, force-like mode of existence of the human tell us that we are no longer simply a form of life that is endowed with a sense of ontology. Humans have a sense of ontic belonging. That is undeniable. ... But in becoming a geo-physical force on planet, we have also developed a form of collective existence that has no ontological dimension. Our thinking about ourselves now stretches our capacity for interpretive understanding. We need non-ontological, ways of thinking about human.'
২০। সমালোচনা ও ও সমস্যা প্রসঙ্গে দীপেশ সচেতন। তুলনীয়, CHPA, pp. 46-48।
২১। CHPA, pp. 20
২২। Michel Foucault, The Order of Things: An Archeology of the Human Sciences (NY: Vintage, 1973), pp 386-387
২৩। Dipesh Chakrabarty,' Humanity's current predicament renews for the humanist the question of the human condition. This troubled book then, joins the effects of our humanists in collective thinking our way toward a new philosophical anthropology', CHPA ..., পূর্বোক্ত।
২৪। ‘গাইয়া’ কথাটি গ্রিক পুরাণ থেকে নেওয়া, আভিধানিক অর্থ -
ভূ-মাতা। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ নিয়ে দ্যাখা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনীয় ‘গাইয়া’র ধারণা। পৃথিবী বা ধরিত্রীর আশ্রয়ে আমাদের জন্ম ও পুষ্টি, সব প্রাণের ধারক এই ধরার ‘ধৃ’ ক্ষমতা। ধরা তো ধৃতি দেবী।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে মঙ্গল ও পৃথিবীর আবহাওয়া নিয়ে তুলনাত্মক আলোচনায় বৈজ্ঞানিক জেমস লাভলক জানান যে, এই সৌরজগতের গ্রহ পরিস্থিতিতে পৃথিবী অনন্য, গ্রহটি একটি সার্বিক প্রাণময় জগৎ। এই জগতকেই তিনি ‘গাইয়া’ নামে অভিহিত করেন, নামটা সাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিং বাতলে দেন। অণু-পরমাণু নিয়ে তৈরি বিচিত্র জড় পদার্থ ও নানা ছোট-বড় জীবকোষে সমৃদ্ধ প্রাণিজগতের সমবায়ে পৃথিবী নামে গ্রহ তৈরি হয়েছে, মানুষী ইচ্ছা অনপেক্ষে এই জগতে ধ্বংস ও নির্মাণের খেলা চলে। পৃথিবী যেন ‘এক আত্মশাসিত জৈবিক ভারসাম্য স্থিত এক ব্যবস্থা’ ('a living self-regulating organism')। এই স্বনিয়ন্ত্রিত গ্রহজাগতিক সত্তার অঙ্গ, প্রাণ ও অপ্রাণ সব কিছুই। প্রথম এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে মোটেই স্বীকৃত হয়নি। ১৯৭৩ সনে মহিলা বিজ্ঞানী লীন মারগুলিস (Lyn
Margulis)-এর লেখা এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রে পৃথিবীর জীবজগতের নানা নিদর্শন নিয়ে লাভলক সেই ‘গাইয়া’ তত্ত্বকে ভূ-বিজ্ঞান ব্যবস্থার ভিত্তি বলে পেশ করেন। তখন থেকেই ‘গাইয়া’ তত্ত্ব পরিবেশ বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্ব পায়। দ্রষ্টব্য, James Lovelock হ্যাঁ, Gaia: A new Look at the Life on Earth, (1979), with a new preface and corrections(NY: Oxford University Press, 2000)
বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে লাভলকের বক্তব্যের বিরোধী অনেকেই। তবে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে চেক প্রজাতন্ত্রের সভাপতি ভাকলাভ হাভেল গেইয়া তত্ত্বের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন, সমাজশাস্ত্রীদের কাছে সেই বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। হাভেল নিজে নাট্যকার, ইউরোপে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ। তাঁর মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসারী এই গেইয়া ধারণায় মানুষের বিজ্ঞানচেতনা ও কল্পচেতনার সাক্ষাৎ হয়। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার আকস্মিক ফল হিসাবে মানুষ হাজির হয়নি। দ্বিতীয়ত, ব্রহ্মাণ্ডে স্থিত জীব ও জড়-এর অংশী মানুষ। গাইয়া ভাবনায় ক্ষুদ্র ও বৃহতের অন্বয় নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হবে, সব প্রাণীই সেই ব্যবস্থার শরিক হয়ে উঠবে। হাভেলের প্রত্যাশা একাধারে বৈশ্বিক, মানবিক ও রাজনৈতিক। Lovelock , প্রাগুক্ত, ix - x।
২৫। CHPA, pp. 207, 211, 216-217. মূল ইংরেজি উপস্থাপনা, ' May be that is reason why Lenton and you bring Gaia back in. The point about its singularity is precisely the point about its poetry. ... It's all this poetry.'
২৬। ‘ঋত’ শব্দটি প্রাচীন বৈদিক ও পরবর্তীকালে ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে নানা দ্যোতনায় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ঋ’ অর্থ চলা, গমন, গতি। এই চলাটা সোজা, আঁকাবাঁকা নয়। এই ধাতুর্থে ‘ঋজু’ শব্দটা সিদ্ধ, ঋজু পথই তো সত্য ও পবিত্র।
‘ঋত’-এর বেদবিহিত অর্থ ‘ বিশ্বব্যাপারের সুনিয়ত কার্যক্রম’, সেই ক্রমের বাঁধনে বাঁধা জড় ও জীবজগৎ। এই নিয়মক্রমের আবর্তনে সূর্য, চন্দ্র, ছয় ঋতু আবর্তিত হয়, বাগানে ফুল ফোটে ও ঝরে, মানুষের প্রাণও এই নিয়মের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রবাহিত হয়। ঋতু রক্ষা ব্যতীত মানুষের প্রজননক্রিয়া সম্ভব নয়। মানুষী কল্পনায় দেবতারা ‘ঋতজাত’, আদিবৈদিক দেবতা বরুণ ‘ঋতপতি’, অগ্নি তো ‘ঋিতের রাখাল’। ঋত বা নৈসর্গিক নিয়মের বিপর্যাস তো অনৃত, অসত্য অপবিত্র। এভাবে নৈসর্গিক ক্রম ও নৈতিক নিয়ম মিলে মিশে যায়।
বিশ্বব্যাপী নৈসর্গিক নিয়মে জারিত জীবজগতের আবর্তনে অহংকে অনুসদৃশ ও অংশী বলে মনে করার ভাবনায় আস্থা থাকাকেই ‘ঋতবাদ’ বলে আখ্যাত করা যেতে পারে। নানা কুলজিসূত্রে লোকজ, দেশজ বা মার্গ সংস্কৃতির নানা প্রকাশে ‘ঋত’-এর ভাব স্ফুতিত হয়েছে, সেই স্ফোটিত অর্থেই ‘ঋতবাদ’ শব্দটি আমি প্রয়োগ করেছি।
শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে অসংখ্য আলোচনা আছে। কয়েকটি সহজলভ্য সূত্র নির্দেশ করা হল। যথা, তারানাথ তর্ক বাচস্পতি, বাচ্যস্পত্যম, তৃতীয় খণ্ড, (দিল্লি: রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থা, ২০০২, পুনর্মুদ্রণ); হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড (নিউ দিল্লি, সাহিত্য অকাদেমি,১৯৭৮); Maurice Bloomfield, The Religion of the Veda: The Ancient Religion of India (New York: G.P. Putman, 1908) pp126-127; Sukumari Bhattacharji, Indian Theogony (Calcutta; Firma KLM, 1978) pp 27-28; রণদীপণ ৱসু, চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন (ঢাকা: রোদেলা,২০১৭), পৃ. ৩৩৫-৩৪৬।
অথর্ব বেদের ভূমি সূক্তে পৃথিবী বন্দনায় ‘ভূ-মাতার’ প্রয়োগ আছে, ‘ভূমে মা, ধেহি...ধেহি ভূত্যামা’ , ভূতি = বিশ্বপ্রকৃতি।
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল ‘ঋত’ শব্দটির মধ্যে ধৃত কল্পনাকে সুন্দর বলেছিলেন। তাঁর মতে ‘বিশ্বপ্রকৃতি বিজ্ঞান যা বিজ্ঞানজগতের অধৈতব্য বিষয় এবং মানব হৃদয়ের অথবা মানব মনের বিধান যা দর্শন, ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় তারই নাম ঋত।’ (বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, নীতি, যুক্তি ও ধর্ম, কলকাতা: আনন্দ প্রকাশন, পৃ. ৫৪। উপর্যুক্ত দুই ক্ষেত্রীয় যোজনায় ঋতের দ্যোতনা সার্বত্রিক হয়। বিজ্ঞান, ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রাদি বিদ্যার চর্চায় ঋত-এর ধারণা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।)
২৭। এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত দুয়েকটি শব্দের জন্য আমি ঋণী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাষাত্মদর্শন (কলকাতা: ধ্যানবিন্দু, ২০১৪) পৃ.৪৬
২৮। ঋত শাসিত জগতে প্রাকৃতিক স্থিতির পটে সব প্রজাতির সঙ্গে মানুষ ধরিত্রীসে সম বাসিন্দা, জীব ও জড়জগতের শরিক - এহেন ঋতবাদীদের মানবিক স্বীকৃতির কাব্যিক প্রকাশ নানা যাজ্ঞিক সূক্তে দেখা যায়। প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম সাধনায় কৌমী মন্ত্র গীতে উচ্চারিত শুদ্ধ ঋতবাদী চেতনায় (‘ঋতচ্ছন্দ ওজক্ষরা’) দুটি সূক্তের কিছু নির্বাচিত অংশ পেশ করছি।
এক বিশ্ববন্দনায় প্রার্থনার শুরু,
যা হয়েছে, হবে-- সবের ঈশানী বিপুল পৃথিবী,
দাওআমাদের সমস্ত- ছাওয়া আলোক-রাজ্য বিরাট লোক
... পৃথিবী, তোমার গিরি অরণ্য,
হিমেল পাহাড় হোক সুরম্য।
পার্থিব ভূ- জগৎ নির্বিশেষে সব জীবের পোষ্টা, সেই পোষকত্বই তো ধর্মমঙ্গল,
... তোমারই গর্ভে জনম সবার, তোমাতেই বিচরণ,
যত দ্বিপদকে চতুষ্পদকে তুমিই কর ভরণ।
তোমারই আপন, হে পৃথিবী, এই মর্ত্য পঞ্চজন-
মানুষ তো মাটির, মাটিতেই জীবন ও জীবনান্ত,
... এই মাটিতেই মানুষ বাঁচে- মাটির মানুষ
অন্নে স্বধায়
সেই মাটি দিন প্রাণ আমাদের
দিন না আয়ু সেই পৃথিবী
বুড়ো হবো সেই অবধি
জড় ও জীবের সমবায়ে এই পৃথিবী, তার প্রাণময় কায়া, মানুষের প্রণতি তাকেই,
এই পৃথিবী - নুড়ি, পাথর, ধুলোমাটি -
শক্ত করে রয়েছে ধরা আঁটিসাঁটি।
সোনায় গড়া হৃদয়খানি তার
করছি তাকে নমো নমস্কার
পৃথিবীটা ‘বহুধা’ গোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে রঙি-বিরঙি,
... নানান ভাষা নানান ধরম মানুষ নানান-তর
পিথিমি তো পালেন সবার যার যেখানে ঘর।...
পৃথিবী নানা প্রজাতির জীবে ভরপুর। ঋতুচক্র অনুযায়ী তাদেরও জীবনচক্র নির্ধারিত।
ও পৃথিবী , তোমার যে সাপ আর মা বিছে, বাপ কি হুল-
শীতে কাবু নিরিবিলি লাগায় ঘুম-
আর যা আছেন পোকামাকড়, বর্ষা এলেই নড়ন-চড়ন
কিলবিলোনি
সর্বংসহা পৃথিবীতে ভালো-মন্দ সবারই জায়গা আছে,
মলিন যা, তা পালেন-পোষেন, তা-ও যা গরীয়ান
পাপীও মরে ভালোও মরে, সহ্য করে যান।
(ঋষি অর্থবার ভূমিসূক্ত, অথর্ব বেধ, ১২/১)
জীবজগতের ঋতের শৃঙ্খলা সার্বত্রিক। ঋতুচক্রে তো প্রাণের ডাক শোনা যায়, যেন লোক উৎসবের অম্বুবাচী,
ঋতু এলে গাছপালাদের
প্রাণ যখন ডাকে
এই মাটিতে যা আছে সব
আনন্দেতে মাতে
ব্যক্ত-অব্যক্তের নধ্যে প্রাণ প্রক্রিয়া বহমান,
প্রাণ সে বিরাট, প্রাণ সে দেষ্ট্রী
উপাসনা করে প্রাণকে সকলে
প্রাণই সূর্য, প্রাণ চন্দ্রমা
প্রাণকে সকলে প্রজাপতি বলে
ভূ-নিসর্গ তো প্রাণময়, উচ্চ ও অধঃ জুড়্ প্রাণের অস্তিত্ব,
প্রাণ ও অপান
যব আর ধান
ষাঁড়কেও বলে প্রাণ।
যবের ভেতরে প্রাণ আছে ভ’রে
ধানকে বলে অপান
মনুষ্য প্রজাতি জগৎব্যাপি প্রাণপ্রবাহের অণুমাত্র,
জন্ম নিচ্ছে যা-কিছু এই যে
যা কিছু নড়ছে- চড়ছে- করছে
সবার মালিক তুমি, হে প্রাণ, তোমায় নম
... অটল অনিদ থাকুক সে -প্রাণ
নিয়ে প্রচেতনা বিপুল বিশাল
আমার সাথের সাথী।
(ঋষি বৈদর্ভী ভার্গভের প্রাণসূক্ত, অথর্ববেদ, ১১/৮)
মূল দুটি সূক্ত ও অনুবাদের জন্য দ্রষ্টব্য: গৌরী ধর্মপাল, বেদের কবিতা (কলকাতা: নবপত্র প্রকাশন, ১৯৮২) পৃ. ১১০-১৩৫, ১৬০-১৭১
লম্বা সব উদ্ধৃতি, ইচ্ছা করেই বড় একটা টীকাতে দিলাম। আগেকার holocene যুগের কবিতা, একাধারে চিন্ময় ও বাঙ্ময়। এই অভিজ্ঞতার শুদ্ধ ধ্বনন anthropocene যুগের কোনো কোনো মননে অনুরণন তুলবে, এই ভরসা রাখা যায়। কারণ সর্বাতিশ্রয়ী ক্ষমতার ফাঁক-ফোকরে আদিম মানবিকতার অস্তিত্ব আধুনিক সমালোচনার ধারণায় দুর্লক্ষ্য নয়। পুনর্গঠন চলতে থাকে, পুরাণ বারবার একালে হাজির হয়।
২৯। বিভূতিভূষণকে সুনীতিকুমার ‘ঋতানুসন্ধানী’ ও ‘ঋতজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছেন। দ্রষ্টব্য, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিভূতি রচনাবলী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ, ১৩৯৯), পৃ. ৩৭।
‘মৌরিফুল’ নামক গল্প সংকলনে আলোচ্য গল্পটি প্রাপ্তব্য। বিভূতি রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, ঐ, পৃ.৩০৬-৩১৫
গল্পটি আগাগোড়া পঠিতব্য। দুটি প্রাসঙ্গিক অংশমাত্র উদ্ধৃত করছি,
‘এই বিশাল মাঠে প্রতিদিন সকাল হয়, সূর্য মাঝ-আকাশে দুপুরে আগুন ছড়ায়, বেলা চলিয়া বিকাল নামিয়া আসে, গোধূলিতে পশ্চিম দিক কত কি রঙে রঞ্জিত হয়।... কিন্তু কখনও কোনো কালে রাঘব চক্রবর্তী বা তাহার প্রতিবেশীরা এই সুন্দর পল্লী প্রান্তরের প্রকৃতির লীলার মধ্যে কোনো দেবতার পুণ্য আবির্ভাব কল্পনা করেন নাই, প্রয়োজনবোধও করেন নাই- সেখানে আজ সর্বপ্রথম এই নিরক্ষরা বিকৃত-মস্তিকা গ্রাম্যবধূটি বৈদিক-যুগের মন্ত্রদ্রষ্টা বিদূষীর মতো মনে-প্রাণে খুঁটি-দেবতার আবাহন করিল।’ (ঐ, পৃ. ৩১০)।
বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা বিভূতিভূষণ সেইভাবে করেননি, বিশ্বাসই সব। গল্পটির শেষ তো এইভাবে,
‘বিশ্বাসী মানুষের রোগ সারে, হয়তো বধূটির তাহাই ঘটিয়াছিল। হয়তো সবটাই তার মনের কল্পনা। রাঘব চক্রবর্তী যে বিরাটাকায় পুরুষ দেখিয়াছিল সেও তার অনুতাপবিদ্ধ মনের সৃষ্টিমাত্র, হয়তো-কারণ খুঁটির মধ্যে দেবতা সেই সেই রূপেই তাহার সম্মুখে দেখা দিয়াছেন যার পক্ষে সে রূপের কল্পনা স্বাভাবিক।
সত্য মিথ্যা জানি না - কিন্তু খুঁটি-দেবতা সেই হইতে ওই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ হইয়া আছেন। (ঐ, পৃ. ৩১৫)।
৩০। Lovelock, xxi - xxvi প্রাগুক্ত।
৩১। এইখানে একটু ফুটকাটা দরকার। দীপেশের রচনায় বিমোহন (enchantment) ও অবিমোহন (disenchantment) ও পুনর্বিমোহন (reenchant)-এর কথা আছে। গ্রহজাগতিক-এর সঙ্গে কীভাবে মানুষ নানা স্তরে হার্দিকতা স্থাপন করবে, আকন্দ আর গেঁড়ি-সুসনীরা মানুষের জীবনচর্চার অংশী হবে, সেই স্বীকৃতি অবশ্যই ভাবনার। লালনের গীত, রবীন্দ্রসংগীত বা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হলেই গ্রহ-জগতের পরিমণ্ডলে সর্ব প্রাণীর বোধন ঘটবে না, ঘটা সম্ভব নয়। এমত বলাও উদ্দেশ্য নয় যে ব্রজের রাখাল বালক হতে পারলেই নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক নিভিয়ে দেওয়াটা কাজ। কিছু ঋতবাদে সব প্রাণের নিবিড় বন্ধনের কথা আছে, সেই কথার ঈপ্সাকে জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে টানাপড়েনে উঠে আসা আধুনিক নানা পরিপ্রশ্নের মধ্যে জিইয়ে রাখতে হবে।
৩২। কারণ সভ্যতায় বস্তু-প্রগতির অন্যতম প্রধান জিকির তো ‘নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র’। সেই জিকিরের মধ্যে অযান্ত্রিকের স্বর শোনানোর আবশ্যকতা ঋতবাদের চর্চার মধ্যে পাওয়া যেতে পারে, এটাই বক্তব্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
এই রচনাটি মুসাবিদা করার সময় পরিবেশ তথা উন্নয়ন সংক্রান্ত বিতর্ক থেকে উত্থাপিত নানায় ইংরেজি শব্দবন্ধকে বাংলায় লিখতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছি। বারবার ঠেকে গেছি। অবশ্যই গ্লোবাল, প্লানেট, অ্যানথ্রোপসিন, ক্যাপিটালোসিন শব্দগুলিকে প্রতিবর্ণায়ন করে স্বচ্ছন্দে বাংলায় লেখা যায়। বেঙ্গলিশও বাংলার বিশিষ্ট বাগধারা, ক্ষেত্রবিশেষে জোরদার ও বোঝনদার।
তবু সাবেকি আমলের চিন্তানুযায়ী কিছু শব্দের পারিভাষিক দ্যোতনা বাংলা ভাষার অনুসঙ্গে ভাববার চেষ্টা করেছি বা প্রয়োগ করেছি। বাংলা ভাষায় globalisation-এর চালু প্রতিশব্দ ‘ বিশ্বায়ন’। এই শব্দটির নিরঙ্কুশ ব্যবহার আমার কানে বাজে। ভারতীয় ভাষায় ‘বিশ্ব’ শব্দটির ব্যঞ্জনা ব্যাপক। ঐ শব্দে নিহিত আছে নিখিল ও অশেষের ধারণা, বেদান্ত দর্শন পৃথক পৃথক শরীরে প্রবিষ্ট অনুচৈতন্যের পারিভাষিক নাম বিশ্ব। বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি কানে ভাসে, ‘ আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান... ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে...।’ কৃত্রিম উপগ্রহ. আন্তর্জাল প্রযুক্তিনির্ভর সর্বগ্রাসী একীকৃত জগতকে নানা প্রাণবিশিষ্ট অসংখ্য জীবশরীরের স্বেচ্ছাময় সমবায় বলে স্বীকার করতে আমি কুন্ঠিত বোধ করি, বরং এহেন জগতকে প্রযুক্তির কেজো দাপটে বতুল পিণ্ড বলেই আমার মনে হয়েছে। তাই globalisation বলতে আমি গোলকায়ন প্রতিশব্দটি ব্যবহার করেছি। 'Global world' ‘গোলকায়িত পৃথিবী বা ভুবন’ পরিভাষাটিকে সঙ্গত মনে করেছি।
তার আলোচনায় দীপেশ বারবার দুটি শব্দবন্ধ এনেছে, 'global world' ও 'planetary world'। ভূ-বিদ্যার সূত্র ধরে 'planetary'-এর প্রতিশব্দ আমি ‘গ্রহজাগতিক’ করেছি। মুসাবিদা করার পর মনে হচ্ছে যে, গ্রহজগত-এর মধ্যে সৌরজগতও ব্যঞ্জিত হয়। শব্দটিও বড়। ‘ গ্রহ-পৃথিবী’তেই জড় ও জীবনময় জগৎ বোঝায়। ‘ গ্রহ-পার্থিব ব্যবস্থা’ বা 'planetary earth system' পরিভাষাটিও ব্যবহার করা যায়। 'Anthropocene’ নিয়ে বিতর্ক হবার প্রেক্ষিতে ইতিহাসচর্চার ভাষায় 'geological turn' বা ‘ভূ-তাত্ত্বিক মোচড়’ আসাটা স্বাভাবিক।
পরিভাষাকে জনগ্রাহ্য হতে হবে, কোনেরকম গোঁড়ামি থাকা কাম্য নয়। তবে প্রত্যেক ভাষার রওয়ানিতে শব্দের অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনার নিজস্বতা বিবেচ্য। নানা সমার্থক শব্দের মধ্যে ব্যঞ্জনার নিরিখে একটি বিশেষ পরিভাষা নজর কাড়তে পারে। মতান্তর শিরোধার্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
রচনাটি পরিমার্জনের জন্য সাব্বির আজম, দেবরাজ ঘটক ও দেবর্ষি তালুকদারের কাছে আমি ঋণী।
Dipesh Chakraborty
১. The Climate of History in a Planetary Age, New Delhi; Primus Books, 2021
২. The Crises of Civilisation Exploring Global and Planetary Histories; New Delhi; O.U.P; 2018
তেলের শিশি অথবা বুকের পাঁজর
দুহাজার বাইশ সালে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সারা ভারত জুড়ে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সেই ‘অমৃত মহোৎসব’-এর ছটা যখন বহু মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, তখনই কিছু মানুষ স্মরণ করেছেন দেশভাগের দুঃখ ও ভয়াবহতা। পৌনে-এক শতাব্দী আগে টুকরো হয়েছিল দুটো প্রদেশ - বাংলা আর পাঞ্জাব – তাদের পাঁজর ভেঙ্গে গড়া হল স্বাধীন ভারতবর্ষ। তারই কিছুদিনের মধ্যে কাশ্মীর টুকরো হয়ে গেলো, তার মাঝখান জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো পাহারাদার সান্ত্রীর দল কামান বন্দুক নিয়ে।
আমরা অনেকেই এই সময়ে দাঁড়িয়ে খানিক দ্বিধাগ্রস্ত – এই পঁচাত্তর আনন্দের না বিষাদের? যখন কেউ ব্যস্ত থাকলেন মহোৎসবের ফানুস ওড়াতে, তখনই কেউ আবার দেশভাগের দুঃখ স্মরণ করলেন সমব্যথীদের সঙ্গে। দেশভাগ বিষয়ক একটি সভার উদ্যোক্তাদের কাছে শুনলাম ওই সভা আয়োজন করা হচ্ছে শুনে কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁদের মতে এমন অথৈ আনন্দের দিনে দেশভাগ-চর্চা নেহাতই দুঃখবিলাস। একজন আয়োজক সামাজিক মাধ্যমে ওই সভার উদ্দেশ্য এবং দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরই এক বন্ধু সেই পোস্টে মন্তব্য লিখলেন – দেশ-বিভাজন তো অনেককাল আগের কথা। যারা সাতচল্লিশের দেশভাগে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই আজ আর জীবিত নেই, তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা জীবনটাকে নিজেদের মতন করে গুছিয়ে নিয়েছেন। তাহলে এই স্মরণসভা কাদের জন্যে? আরও কিছু পরে সামাজিক মাধ্যমের কর্তারা সেই ঘোষণা মুছে দেন এবং পোস্টকর্তাকে জানিয়ে দেন, দেশভাগ বিষয়ে আলোচনা থেকে সামাজিক ঘৃণা ছড়াতে পারে। অবাক হওয়া ছাড়া আমাদের বিশেষ কিছু করার ছিলো না। পরদিনই বিষয়টিতে খানিক মোচড় আসে যখন ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানান দুহাজার তেইশ সাল থেকে ১৪ই আগস্ট দিনটি দেশভাগ দিবস হিসেবে পালন করা হবে।
আশঙ্কা থেকে যায় দেশভাগ দিবস পালনের নামে কেউ কেউ একপেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাসের ব্যাখ্যা প্রচার করবেন এবং তাঁদের পক্ষে ‘সুখশ্রাব্য’ ইতিহাসের ঢাক বাজানো হবে। ঐ একপেশে প্রচার আটকাতেই দেশভাগ বিষয়ে ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার, আমরা চাই পরস্পর বিরোধী অনেক কণ্ঠস্বর সামনে আসুক। যে সব সাম্প্রদায়িক চিন্তা ও কার্যকলাপকে প্রায়শই দেশভাগের জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, সেগুলো বারবার খুঁটিয়ে দেখা যাক এবং তাদের জন্মবৃত্তান্ত কাটাছেঁড়া হোক। এটা কোন শুদ্ধ বিদ্যাবিলাস নয়, আমাদের জীবনে এই চর্চার একান্ত দরকার আছে।
ইদানিংকালে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বে যেভাবে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার আমদানি করা হচ্ছে বা নাগরিকত্ব প্রমাণ করার যে দায় বহুমানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মূলেও তো দেশভাগ। সীমান্তের এপারে বা ওপারে যারা ভিটেমাটি এবং স্বজন হারিয়েও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং এখনও যাচ্ছেন, তাঁদের সমস্যাগুলো নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা হওয়া উচিত। এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে দেশভাগ-দিবস পালন বা দেশভাগ-চর্চা সফল হতে পারেনা।
এত গুরুগম্ভীর সমস্যা ছাড়াও আমাদের সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনে মাঝেমাঝেই হানা দেয় দেশভাগের তিক্ততা। দু’হাজার ষোল সালের মে মাস, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন সবেশেষ হয়েছে। সেই সময় খবরের কাগজের পাতা জুড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষের বর্ণনা আর কিছু নেতার মুখে কুকথার ফুলঝুরি। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি, দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সেই গরম হাওয়ার সময়ে যা হয়, আমাদের কথাবার্তায় এসে গেল ভোটের ফল আর গ্রামেগঞ্জে রাজনৈতিক হিংসার বৃত্তান্ত। এক বন্ধু বললেন এইসব মারপিট খুনোখুনিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেননা কেননা এই দেশ এর থেকে অনেক বড় মাপের হিংসা দেখেছে দেশভাগের সময়, তখন হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। আমি জানি ওই বন্ধুটির পরিবার এবং তাঁদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ভিটেমাটি ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বন্ধুটি মন্তব্য করলেন, সেই সময় মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার করেছে তার তুলনা ইতিহাসে কম আছে।
অন্য সময় বা ভিন্ন বিষয় হলে বন্ধুটিকে ঠাট্টা করে বলা যেত নদীর রচনায় গরু ঢুকে পড়ছে, বিধানসভা ভোটের মধ্যে দেশভাগের প্রসঙ্গ টেনে আনা একটু বাড়াবাড়ি রকমের কুতর্ক। কিন্তু তিনি তখন বেশ উত্তেজিত এবং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি যা বলছেন তাঁর বিশ্বাস থেকেই বলছেন। আমি ওনাকে এবং ওনার পরিবারের অন্যদের অনেক বছর ধরে চিনি। দেশভাগের পরে তাঁরা উত্তর-পূর্ব ভারতের এক শহরতলীতে আশ্রয় নেন, সেখানে তখন জঙ্গল বেশি আর বসতি কম। সেই অপরিসর আশ্রয়ে দেশ থেকে নিয়ে আসা ঠাকুর দেবতার পটের পাশে এক পেতলের কলসিতে রাখা থাকতো একটুখানি মাটি। পিতৃপুরুষের ভিটে থেকে সংগ্রহ করে আনা সেই মাটিকেও দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হত। সারাদিনের কাজকর্ম আর পড়াশোনার ফাঁকে ছোটরা বড়দের থেকে শুনত তাদের গ্রামের জমিজমা ঘরবাড়ি মানুষজনের কথা, মুসলমান প্রজারা কত বাধ্য ছিল সেই বৃত্তান্ত। তারপর পালটে গেলো সবকিছু, হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে জমা হতে থাকল তিক্ততা ভয় আর অবিশ্বাস। অবশেষে দেশভাগ, চোখে জল নিয়ে বাস্তু ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ার কাহিনী। সেই কাহিনীর পরতে পরতে ভরা থাকে মুসলমানরা কত হিংস্র আর সাম্প্রদায়িক সেইসব তথ্য।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই বাস্তুচ্যুত পরিবারটি কোন ব্যতিক্রম নয়,এই রকম আরো অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা একইরকম ধারণা নিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বামপন্থী রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে এবং অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বিষয়ে বিরুপ ধারণা জামার তলায় তাগা-তাবিজের মতো লুকিয়ে রাখতে শিখেছে। পরিস্থিতির হেরফেরে কখনও সেই গুপ্ত দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলেএসেছে গভীর অবচেতনের মতো।
বন্ধুটির উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তিনি বলতে থাকেন ওই অত্যাচারের বদলা আজও নেওয়া হয়নি। এখন এদেশে মুসলমানদের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করা উচিত সেই বিষয়ে তাঁর মতামত একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভাষ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তাঁর গলার স্বর উচ্চতর হয়, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের নিরাপদ রাখার জন্য কি কি করা দরকার। সেইসব দরকারি কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটা আইনসম্মত এবং গণতান্ত্রিক নয় সেটা বলা বাহুল্য। যেখানে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল সেই রাস্তায় কিছু দোকান, নানা মানুষের জটলা। আমি তাঁকে নানাভাবে থামাবার চেষ্টা করি কিন্তু তিনি তখন অপ্রতিরোধ্য। ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে বলেন আমি ওনার সত্যি কথা সহ্য করতে পারছি না, তাই বাধা দিচ্ছি। এরপর উনি আমাকে খানিক গালিগালাজ করে সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অনেক বছরের বন্ধুত্ব সেই ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারলো না, প্রায় বিনা চিকিৎসায় মাঝরাস্তায় মারা গেলো।
মাতৃরূপেণ
আমার প্রাক্তন বন্ধুটির ভাবনায় যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে, সেই বিদ্বেষ আরো লাখো লোকের মাথার মধ্যে নড়াচড়া করে। তাঁদের কাছে একটি ইতিহাসের গল্প আছে। সেই গল্পে আগে ‘কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’-এর সুদিন থেকে হঠাৎ করে মুসলিম লীগ এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা হয়ে আমরা দেশভাগের গরম তেলের কড়াইতে পড়ে যাই। এই গল্প দীর্ঘ সময় ধরে চালু আছে এবং ডালপালা বিস্তার করছে তার একটা প্রধান কারণ এদেশে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ চর্চা বড় একটা হয়নি, যেটুকু হয়েছে সেটাও অনেক সময় পণ্ডিতদের মধ্যে এবং পণ্ডিতি ভাষায়। ফলে চালু গল্পকথাগুলোর গায়ে বিশেষ আঁচড় লাগেনি, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ জাতীয় অপ্রিয় কথা তার মধ্যে ঢুকতে পারেনি, কোনরকমে ঢুকে পড়লেও তাকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার ফলে ‘আমরা ভালো ওরা খারাপ’ জাতীয় ব্যাখ্যানের বাড়বাড়ন্ত বেড়েছে বৈ কমেনি। আমাদের মনে হয়েছে ওই ‘অপ্রিয়’ কথাগুলো বারবার নানাভাবে বলা দরকার নির্মিত বা কল্পিত ইতিহাসের ইমারতে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে।
বাংলাভাগ বিষয়ে জয়া চ্যাটার্জিরএকটি তথ্যবহুল বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। সেই বইতে লেখিকা মন্তব্য করেছেন, দেশভাগের অনেক বছর পরেও ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসচর্চা মানেই ছিল দেশভাগের ইতিহাসের চর্চা। সেই চর্চায় অনেক সময়েই ধরে নেওয়া হতো দেশভাগের কারণ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি মুসলিম জাতিসত্ত্বার বাড়বাড়ন্ত থেকে। অর্থাৎ ইতিহাসবিদদের একটা বড় অংশ এককালে ওই ‘সুখশ্রাব্য’ ইতিহাসে আস্থা রেখেছিলেন। কিছু গবেষক বাঙলায় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অর্থনৈতিক শ্রেণির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন। কেউ দেখিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার শিকড় মুসলিম সমাজের মধ্যে উপস্থিত ছিল, তিরিশের দশকে মুসলিম কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ জনপ্রিয় ছিল। আর একটি মত অনুযায়ী পূর্ববঙ্গে জমিদার ও জোতদারদের সঙ্গে বিরোধ থেকেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম। বাংলার কৃষিব্যবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, মুসলিম পরিচিতির অযৌক্তিক শক্তির জন্যেই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ অর্থনৈতিক বিরোধ মিলেমিশে যায় পাকিস্তানের দাবির সঙ্গে।
এইসব তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে যে সাম্প্রদায়িকতা একান্তই মুসলমানদের সমস্যা। অর্থাৎ সমান্তরালভাবে কোনও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়নি বা হয়ে থাকলেই সেটা এতো নগণ্য যে তার সঙ্গে দেশভাগের বিশেষ সম্পর্ক নেই। অথচগত শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই বিদ্বজনদের আলোচনায় উঠে আসতে থাকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বিষয়ে আরও কিছু তথ্য, আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ। জয়া চ্যাটার্জির মতে হিন্দু ভদ্রলোকীয় সাম্প্রদায়িকতা ঐতিহাসিকদের নজর এড়িয়ে গেছে বিভিন্ন কারণে। পণ্ডিতরা ধরে নিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতার তৈরি হয় কিছু ধর্মীয় প্রতীককে কেন্দ্র করে, যেমন মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো, গো-কোরবানি, মূর্তি ভাঙ্গা, উপাসনাস্থল এবং উপাসনার সময় নিয়ে বিবাদ (চ্যাটার্জি ১৯৯৪ পৃষ্ঠা ১৫০-১৫৩)। যেহেতু অধিকাংশ সময়েই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে এইসব উপসর্গ জড়িত ছিল,তাই কেউ কেউ রোগের লক্ষণ এবং তার কারণ একাকার করে ফেলেছেন।
সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীনতর উৎস খুঁজতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জি নজর দিয়েছেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলায় যে নতুন ধরণের সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক ভদ্রলোক পরিচিতি তৈরি হয়, তার দিকে। উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্ত ভদ্রলোকেরা দাবী করতেন তাঁরা নবজাগরণের আলোয় ভারতের সাংস্কৃতিক গরিমা আবিষ্কার করেছেন আর সেই সংস্কৃতির ভিত্তি প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্য।
বাংলায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে,ভদ্রলোক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল অনেক কাল আগে থেকেই। সুরজিত সিনহা এবং রঞ্জিত ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন কিভাবে জটিল সামাজিক স্তরভেদ এড়িয়ে বাংলায় গ্রামীণ সমাজকে ভদ্রলোক আর ছোটলোক - মোটামুটিএই দু’ভাগে ভাগ করা হয়। আক্ষরিক অর্থে ভদ্রলোক হলেন তাঁরা, যাঁদের রুচি পরিশীলিত আর ব্যবহার মার্জিত। ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী ভদ্রলোক হওয়ার জন্যে ধনী হওয়া আবশ্যক নয়। বাস্তবে গ্রামসমাজের ভদ্রলোকরা হলেন ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কায়স্থ জাতিভুক্ত সকলেই, যাঁদের অধিকাংশই বিত্তবান কিন্তু ঐ জাতির বিত্তহীনরাও ভদ্রলোক। কোন অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত মধ্য এবং নিম্ন-অবস্থানের জাতিরাও ভদ্রলোক গণ্য হতে পারেন যদি তাঁদেরও যথেষ্ট ভূসম্পত্তি এবং প্রচুর জনসংখ্যা থাকে। অর্থাৎ শুধু সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে আর্থিক অবস্থাও ভদ্রলোক বিচারের মাপকাঠি। সেই হিসেবেই হিন্দু ভদ্রলোকরা জমিজমাওয়ালা মুসলমানদের ভদ্রলোক বলে গণ্য করেন। আবার অন্যদিকে অন্ত্যজ এবং আদিবাসী মানুষরা ভূসম্পত্তির মালিক হলেও তাঁদের ভদ্রলোক শ্রেণীভুক্ত করা হয় না, ছোটলোক তকমা থেকে তাঁদের মুক্তি নেই (সিনহা এবং ভট্টাচার্য ১৯৬৯)।
জয়া চ্যাটার্জি যে ভদ্রলোকদের কথা বলছেন তাঁরা অধিকাংশই শহরবাসী জমিদার ও ব্যবসায়ী, মেকলিয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে উপনিবেশ-নির্ভর। চিরাচরিত গ্রামীণ ভদ্রলোকদের তুলনায় তাঁদের আমরা নব্য-ভদ্রলোক বলতে পারি। এই নব্য-ভদ্রলোকেদের অনেকেরই চিন্তাভাবনা প্রবলভাবে হিন্দু চিন্তাভাবনায় প্রভাবিত ছিল। তাঁরা মনে করতেন ভারতে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটেছিল হিন্দু সমাজের সঙ্গে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশের বিরোধ এবং সংমিশ্রণে। ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার মেকলিয় নিদান জারি হয় ১৮৩৫ সালে আর নব্য-ভদ্রলোকেরা সেই শিক্ষা গ্রহণ করার পরেও একচেটিয়া পাশ্চাত্য জ্ঞানশিক্ষার বিরোধিতা করেন। তাঁদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হল বাছাই করা কিছু ভারতীয়ত্বের প্রতীক, যার অনেকটা ওই নব্য-ভদ্রলোকরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন।
নবজাগরণের কালে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য ধারণার সংমিশ্রণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। সেই ধারণায় দেশবোধ এবং হিন্দুধর্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, দেশমাতৃকা হিন্দু দেবীর রূপ নিয়ে দেখা দেন। এই ভাবনার প্রতিনিধিত্বমূলক চেহারা দেখিব ঙ্কিমচন্দ্রের লেখায়। যদিও লেখক স্বয়ং আনন্দমঠকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে রাজি হননি, কিন্তু ওই রচনা ভারতে জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে যায়।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে ওই উপন্যাসের গোড়ায় কিছু ঐতিহাসিক গলদ ছিল। দেশমাতৃকা যাদের জননী, আনন্দমঠের সেই সন্তানরা ,
“...বাঙালি ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে, গীতা যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে পণ্ডিত; কিন্তু যে সব ‘সন্ন্যাসী ফকিরেরা’ সত্য ইতিহাসের লোক, এবং উত্তরবঙ্গে (বীরভূমে নহে) ওই সব অত্যচার করে, তাহারা এলাহাবাদ কাশী ভোজপুর প্রভৃতি জেলার পশ্চিমে লোক এবং প্রায় সকলেই নিরক্ষর, ভগবদগীতার নাম পর্যন্ত জানিত না। বঙ্কিমের সন্তানসেনা বৈষ্ণব, আর আসল “সন্ন্যাসীরা” ছিল শৈব, আজ পর্যন্ত তাহাদের নাগা-সম্প্রদায় চলিয়া আসিতেছে, যদিও ইংরেজের ভয়ে তাহারা এখন অস্ত্র রাখিতে বা লুঠ করিতে পারে না ... সত্যকার সন্ন্যাসী ফকিরেরা অর্থাৎ পশ্চিমে গিরিপুরীর দল, একেবারে লুঠেড়া ছিল, কেহ কেহ অযোধ্যা সুবায় জমিদারিও করিত; মাতৃভূমির উদ্ধার, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উহাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল, এই মহাব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কল্পনায় সৃষ্ট কুয়াশা মাত্র” (সরকার ১৯৩৮)।
অধ্যাপক সরকারের নিজের ব্যাখ্যানেও ভদ্রলোকীয় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, তিনি ‘পশ্চিমে’ সন্ন্যাসী ফকিরদের সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক উক্তি করেছেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তাদের সরাসরি উচ্চবর্ণ ভদ্রলোক বানিয়ে ফেলেছেন এবং শৈবধর্ম থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিছু পরে আমরা দেখব ভারতে দীর্ঘকাল যাবত বৈষ্ণবধর্ম উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্তদের পরিচিতির অংশ হয়ে থেকেছে।
ওই সময়ে পশ্চিমী প্রভাবের মোকাবিলায় হিন্দুধর্মের নানা নতুন রূপ নির্মাণ করা হয়। জয়া চ্যাটার্জির মতে এইসব ধারণা সৃষ্টি করা হয় এক গরিমাময় হিন্দু অতীতের চিহ্ন হিসেবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রচিত ইতিহাসে জাতীয় গর্ব ও সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের উপকরণ সংযুক্ত করা হল মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির জন্য, যা পরে দেশের অন্যান্য অংশে ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে (পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৯)।
ওই পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কিছু হিন্দু দাবী করলেন একেশ্বরবাদী মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের মত তাঁরাও এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং নিরাকারবাদী। শুরুটা হল ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরেরব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তার প্রায় পাঁচ দশক পরে ১৮৭৫ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠা করলেন একেশ্বরবাদী আর্য সমাজ। আর ১৮৯৯ সালে হিমালয়ের মায়াবতীতে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন অদ্বৈত আশ্রম। এটি যদিও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা, ওই মিশনের অন্য মঠ বা মন্দিরের মত মায়াবতীতে কোন সাকার দেবতা বা অবতারের পুজো করা হয় না।
শিকলের যুদ্ধ
সাম্প্রদায়িকতাকে সাধারণত ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক চিন্তা হিসেবে দেখা হয়, এই চিন্তা একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে উৎসাহ দেয়। এই ধরনেরর মনোভাব ভারতীয় সমাজে কখন কিভাবে এলো সেই বিষয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত। কেউ বলছেন মুসলমান শাসনের কালে এর উদ্ভব – কোন মহল সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাতা পিতা হিসেবে আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। এক বিজ্ঞজনের মতে শাহজাহানের পরে দারাশিকো সিংহাসনে বসলে ভারতবাসীর চিন্তাভাবনা নাকি অন্যরকম হত। আবার অনেকে বলেন মোগল আমল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতা বড় সমস্যা ছিলো না, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে উপনিবেশিক শাসকরা সাম্প্রদায়িকতার প্রচার এবং প্রসার শুরু করে যাতে ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম একজোট হয়ে তাদের বিরোধিতায় নামতে না পারে।
এইসব গড়পড়তা আলোচনায় প্রাচীন ভারতে সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা বা ধর্মভিত্তিক হিংসা বিষয়ে আলোচনা অনেক সময়েই দেখতে পাওয়া যায়না। অথচ প্রাচীন হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষদের অচ্ছুত অপাংক্তেয় বলা হয়েছে। আর যাদের বৌদ্ধদের সঙ্গে একই শ্রেণীতে রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ-হত্যাকারী মহাপাতক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণপ্রথার সমালোচক লোকায়ত এবং নাস্তিক দার্শনিকদের দল। স্মৃতিশাস্ত্র বিধান দিচ্ছে, কোন বৌদ্ধকে স্পর্শ করলে স্নান করতে হবে, বৌদ্ধ হিন্দু মন্দিরে প্রবেশ করলে সেই মন্দির অপবিত্র হয়। মৃচ্ছকটিক নাটকে উল্লেখ আছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারীরা বৌদ্ধদের এতটাই ঘৃণা করত যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জনসমক্ষে পিটিয়ে মারা হত (আম্বেদকর ২০০২ পৃষ্ঠা ৪০১-৪০৫)। পাঠকদের মনে হতেই পারে এই চিত্রনাট্য সাম্প্রতিক সময়ের – কেবল কে কাকে পিটিয়ে মারছে তাদের পরিচিতি পালটে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূজারিণী কবিতায় বর্ণনা করেছেন পঞ্চম শতাব্দীতে মগধের রাজা অজাতশত্রু বৌদ্ধ ধর্মকে ‘শোণিতের স্রোতে’ মুছে ফেলেছিলেন, বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি যজ্ঞের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। একসময় যে আক্রোশ বৌদ্ধদের প্রতি দেখানো হয়েছিল, পরবর্তীকালে তার অভিমুখ ঘুরে যায় মুসলমানদের দিকে।
এই আক্রোশ এবং তার উৎপত্তির কারণ বোঝার জন্য বর্ণবিভক্তপ্রাচীন সমাজের দিকে তাকানো যাক। ওই সমাজের মূল ভাবনা ছিল সামাজিক অসাম্য –চতুর্থ বর্ণভুক্ত শূদ্র এবং যাদের বর্ণাশ্রমের বাইরে রাখা হয়েছিল সেই অন্ত্যজরা ছিলেন তিন উচ্চবর্ণের দাস। মনুস্মৃতিতে উল্লেখ আছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যেদের অধীনে সাত প্রকার দাস থাকত (১) যুদ্ধে পরাজিত ব্যক্তির থেকে ধৃত, (২) ক্রীতদাসী বা দাসীর সন্তান, (৩) যে উদরান্নের জন্য দাস হয়েছে, (৪) অপরের কাছ থেকে যাকে কেনা হয়েছে, (৫) অপর ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত, (৬) পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত, (৭) জরিমানা দিতে অক্ষম হয়ে যে স্বয়ং দাসত্ব বরণ করেছে। স্মৃতিকার পণ্ডিতদের মতে দাস (এবং নারীরা) মনুষ্যপদবাচ্য নয়। মনুস্মৃতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ভোজনরত ব্রাহ্মণ যদি চণ্ডাল, শুয়োর, মুরগি, কুকুর, রজস্বলা নারী, ও ক্লীব ব্যক্তিকে দেখে ফেলে তাহলে তার ভোজন অশুচি হয়ে যায় (৩/২৩৯)। ভোজন নষ্ট হতে পারে যদি শুয়োর তা ঘ্রাণ করে, মুরগির ডানার বাতাস লাগে, কুকুর তাকিয়ে দেখে বা শূদ্র স্পর্শ করে(৩/২৪১)। ওই স্মৃতিশাস্ত্রে এবং মেধাতিথির ভাষ্যে বলা হয়েছে উচ্চ তিন বর্ণের সেবাই শুদ্রের একমাত্র বৃত্তি। প্রভুপরিতক্ত বস্ত্র, ছাতা, জুতো, তোষক শূদ্র ব্যবহার করবে। প্রভুর উচ্ছিষ্ট তার ভক্ষ্য (মনু ১০/১২৪, ১২৫, ৬/৯৭)। দাসের নিজস্ব কোন সম্পত্তি রাখার অধিকার ছিল না (৮/৪১৬) এবং দাসশূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করতে পারতেন (৮/৪১৭)।
শূদ্রদের অনেকেরই গ্রামে বসবাস করার অধিকার ছিলনা। সৈরন্ধ্র বা কেশপ্রসাধক, সংবাহক বা ব্যাধ, মৈত্রেয়ক – যারা প্রভাতে ঘণ্টা বাজিয়ে রাজা ও অন্যান্যদের স্তুতিকীর্তন করতেন, মার্গব বা নৌচালক, কারাবর বা চর্মকার, সোপাক –যাঁদের রাজা নরহত্যার জন্য নিযুক্ত করতেন, পাণ্ডুসোপাক বা বাঁশের ব্যবসায়ী, মেধ, অন্ধ্র, মদ্গু জাতীয় পশুবধকারী, ধিগবন বা চর্মোপজীবী, বেন বা বাদ্যযন্ত্র বাদক, অন্ত্যাবসায়ী –যারা শ্মশানে থাকতেন ও মৃতদেহ সৎকার করতেন, তাঁদের গ্রামের বাইরে গাছতলায়, শ্মশানে, পর্বতে বা উপবনে বাস করতে হত (বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ পৃষ্ঠা ৩৭)।
যে অসংখ্য মানুষকে এই মর্মান্তিক অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছে এবং স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী যাদের দাসবৃত্তি থেকে কোন অবস্থাতেই মুক্তি নেই, তাঁরা শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। প্রাচীনকালে তাঁদের জন্যে মুক্তির একটা রাস্তা ছিল বর্ণপ্রথা অস্বীকার করে বৌদ্ধধর্মে শরণ নেওয়া। বর্ণপ্রথা যাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর সুবিধা দিয়েছে, বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাদের আক্রোশের কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। পরবর্তীকালে ইসলাম সেই সুযোগ নিয়ে এলো চতুর্থ এবং অন্ত্যজ-বর্ণের মানুষদের জন্যে।
শিকল ছেঁড়ার সব লড়াই বৌদ্ধ বা ইসলামের মুখাপেক্ষী ছিল না, কিছু গোষ্ঠী ধর্মান্তকরণ ছাড়াই বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেছেন। উত্তর ভারতের সবর্ণ জাতিগুলো – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য – বিগত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সগুণী ধর্ম পালন করেছেন। এই ধর্মাচরণে বৈষ্ণব মতবাদ প্রবল এবং ভক্তরা বিষ্ণুর অবতার রাম অথবা কৃষ্ণের উপাসক, তারা সাধারণত তাদের উপাস্যের মূর্তি গড়ে পুজো করে। অপরপক্ষে বেশ কিছু শূদ্র এবং অন্ত্যজ সম্প্রদায় গত প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে মূর্তি-পুজক বৈষ্ণবধর্ম থেকে সরে গিয়ে একাধিক নির্গুণী ধর্মীয় সম্প্রদায় তৈরি করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন শিখ, কবিরপন্থী এবং নাথযোগী– যারা বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেন, এক ঈশ্বরের কথা বলেন এবং মূর্তিপুজো পরিত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বেদ, যোগ এবং তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু অংশ গ্রহণ করেন যেগুলো সাধারণত সগুণীরা এড়িয়ে চলেন (লোরেঞ্জেন ১৯৯৫ পৃষ্ঠা ৩, ১৩)।
লক্ষ্য করার মত বিষয় হল নবজাগরণের কালে বংশানুক্রমে সগুণী কিছু ভদ্রলোক নির্গুণী দর্শনের অংশ ব্যবহার করেন হিন্দুধর্মের গরিমা বাড়াতে এবং নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে। সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা হিন্দুশাস্ত্রের নানা উপাদানের মধ্যে থেকে একেশ্বরবাদী ও নিরাকারবাদী ধারণাগুলোকে বেছে নেন। ব্রাত্যজনের প্রতিবাদী দর্শনকে যখন ভদ্র-বাবুজনেরা নিজেদের পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে খুঁজে নেন, তখন সেই চেষ্টাকে ইতিহাসের রসিকতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। নবজাগরণীয় নিরাকারবাদীরা কিন্তু সামাজিকভাবে নির্গুণীদের সঙ্গে একাত্ম হননি, আবার নিজেদের গোষ্ঠীতেও খুব একটা জনপ্রিয় হতে পারেননি।
উচ্চবর্ণীয়দের বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি ঝোঁক অনেক পুরনো। রমাকান্ত চক্রবর্তীর মতে তাঁরা অপাংক্তেয়দের নিজেদের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেছেন অ্যাকালচারেশন বা সাংস্কৃতিক উপযোজনের মাধ্যমে এবং বৈষ্ণব ধর্মকে এই কাজে ব্যবহার করেছেন। আমরা জানি, বাংলায় সর্বত্র সবাই একই ধর্মের অনুসারী ছিলেন না– ধনী জমিদারদের মধ্যে শৈব এবং শাক্তধর্মও জনপ্রিয় ছিল, আবার অনেক জায়গায় কৃষকরা ছিলেন বৈষ্ণব। বৈশ্যদের অনেকেই আবার বৌদ্ধ ছিলেন। চৈতন্যের আবির্ভাবকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষ্ণ, শিব এবং চণ্ডীর জনপ্রিয়তা প্রায় সমপরিমাণ ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তরফ থেকে এই ধর্মীয় বৈচিত্র্যের বিরোধিতা করা হয়নি বিভিন্ন কারণে। প্রথমত – এই ধর্মাচরণের বিভিন্নতার মধ্যে বর্ণব্যবস্থার বিরোধিতা ছিল না। দ্বিতীয়ত –এর সঙ্গে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের আর্থিক স্বার্থ জড়িত ছিল। এবং তৃতীয়ত – বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সাংস্কৃতিক উপযোজনের পথ খোলা রাখা হয়েছিল, কারণ সেই সময় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন ইসলাম ধর্মপ্রচারকরা (পৃষ্ঠা ১৪-১৫, ২০-২১)।
বৈষ্ণবধর্মকে ব্যবহার করে দূরে সরিয়ে রাখা মানুষদের কাছে টানার চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। অধিকাংশ বাঙালির ইসলামধর্ম গ্রহণ ঠেকানো যায়নি আর যারা ইসলামধর্ম গ্রহণ করেননি তাঁরাও সকলে স্বদেশী ভদ্রলোক নেতাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেননি। এই প্রক্রিয়ার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম দিকে। ১৯০৫ সালে প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দু ভদ্রলোক নেতাদের প্রধান চেষ্টা ছিল মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা। কিন্তু মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ মনে করতেন প্রদেশ ভাগ হলে তাঁদের সুবিধে হবে, সরকার তাঁদের সমস্যাগুলোর প্রতি বেশি নজর দেবে। সেই সময় নমশূদ্র সমাজের নেতারা মুসলিমদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ান। ঢাকা নমশূদ্র হিতৈষিণী সমিতির কর্মকর্তারা ১৯০৫ সালে সরকারী অধিকারীদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গভঙ্গে সম্মতি জানান এবং মুসলিম সমাজের মত একই ধরণের সুযোগসুবিধে দাবী করেন। পরে মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছেলে শশীভূষণ ঢাকার নবাব সলিমুল্লার সঙ্গে দেখা করেন এবং উভয়ে মিলে স্থির করেন মুসলিম এবং নমশূদ্ররা কেউই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করবেন না।
পরবর্তীকালে নমশূদ্ররা তাঁদের সবর্ণ-ভদ্রলোক-বিরোধী অবস্থানকে আরও শক্ত করেন। ১৯০৬ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে নমশূদ্র সমাজের পিছিয়ে থাকার কারণ তাঁদের প্রতি ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কায়স্থদের ঘৃণা। তাই নমশূদ্র সমাজে ওই ভদ্রলোকদের বা তাদের আন্দোলনের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। তারা বরং মুসলিম ভাইদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭ পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫)।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত নমশূদ্ররা চণ্ডাল নামে পরিচিত ছিলেন। ওই নামের সঙ্গে এতটাই গ্লানি জড়িয়ে ছিল যে একটা নতুন নাম অবলম্বন করে তাঁরা একটা নতুন পরিচিতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ভারতের বর্ণবিভক্ত সমাজে তাঁদের অবস্থান কেমন ছিল, তার মধ্যেই নিহিত আছে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের সূত্র। মনুসংহিতার বিধান অনুযায়ী চণ্ডাল বাস করবে গ্রামের বাইরে। তাদের পরিধেয় মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত বস্ত্র, আহার ভগ্নপাত্র থেকে, তারা লোহার বালা প্রভৃতি পরে অনবরত একস্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াবে এবং তাদের সম্পত্তি হবে কুকুর, গর্দভ (১০/৫০) (সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ পৃষ্ঠা ৩৭)।
যখন মেনে নেওয়া হয় সাম্প্রদায়িকতা মানে কেবলমাত্র অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, তখন একই ধর্মে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বিদ্বেষকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আওতার বাইরে রাখা যায়। তাই হিন্দুত্ব নামক ধারণার প্রয়োজন হয় বর্ণ-জাতি-নির্বিশেষে সবাইকে একটা কাল্পনিক সংস্কৃতির মোড়কে পুরে ফেলার জন্যে, অনেক চলমান বিদ্বেষকে গালচের তলায় লুকিয়ে ফেলা যায়।
দুইয়ে পক্ষ তিনে নেত্র
যাঁরা হিন্দুধর্মবোধের মধ্যে দেশবোধ খুঁজছিলেন, যাঁদের কাছে দেশমাতৃকা সগুণী ঘরানার দেবীমূর্তি, সেই নব্য-ভদ্রলোকদের জাতীয়তাবাদের ভাষ্যে ‘আমরা-ওরা’ ভেদ খুব পরিষ্কার। এক্ষেত্রে ‘আমরা’ একমাত্রিক হলেও ‘ওরা’ কিন্তু একের বেশি । ‘আমরা’ যখন মুসলমান-পক্ষকে প্রধান শত্রু ঘোষণা করেছে, তখন নমশূদ্র এবং অন্যান্য প্রান্তিক জাতিদের সম্পর্কে নরম অবস্থান নেওয়া হয়েছে, হয়তো তারা ভবিষ্যতে ভদ্রলোকদের সঙ্গে হাত মেলাবে এবং মুসলমানদের শত্রু ঘোষণা করবে – এই আশায়।
সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের যোগ ছিল এবং কিছুদিন তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতিত্বও করেছিলেন। তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান সমস্যা’ বিষয়ে বক্তব্য সেই সময়ে মূলধারার জাতীয়তাবাদী অবস্থান হিসেবে গণ্য করা যায়।
১৯২৬ সালে তিনি বলছেন, “বছর-কয়েক পূর্বে, মহাত্মার অহিংস অসহযোগের যুগে এমনি একটা কথা এদেশে বহু নেতায় মিলিয়া তারস্বরে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, হিন্দু-মুসলিম মিলন চাই-ই। চাই শুধু কেবল জিনিসটা ভাল বলিয়া নয়, চাই-ই এইজন্য যে, এ না হইলে স্বরাজ বল, স্বাধীনতা বল, তাহার কল্পনা করাও পাগলামি... তার পরে এই মিলন-ছায়াবাজীর রোশনাই যোগাইতেই হিন্দুর প্রাণান্ত হইল। সময় এবং শক্তি কত যে বিফলে গেল তাহার ত হিসাবও নাই। ইহারই ফলে মহাত্মাজীর খিলাফৎ-আন্দোলন, ইহারই ফলে দেশবন্ধুর প্যাক্ট। অথচ এতবড় দুটা ভুয়া জিনিসও ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে কম আছে ... বস্তুতঃ, মুসলমান যদি কখনও বলে—হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন... মিলন হয় সমানে সমানে। শিক্ষা সমান করিয়া লইবার আশা আর যেই করুক আমি ত করি না। হাজার বৎসরে কুলায় নাই, আরও হাজার বৎসরে কুলাইবে না। এবং ইহাকেই মূলধন করিয়া যদি ইংরাজ তাড়াইতে হয় ত সে এখন থাক। মানুষের অন্য কাজ আছে।’’
হিন্দু এবং মুসলমানকে আলাদা সম্প্রদায় এবং আলাদা জাতি চিহ্নিত করে ইতিহাসের যে ব্যাখ্যান উপনিবেশিক কালে তৈরি হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনি শরৎচন্দ্রের কথায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
“হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে,—এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর,—আর কাহারও নয়।’’
তাঁর বক্তব্যে অন্য একটি পক্ষের কথাও আছে।
“...হিন্দুর সমস্যা এ নয় যে, কি করিয়া (মুসলমানের সঙ্গে) অস্বাভাবিক মিলন সংঘটিত হইবে; হিন্দুর সমস্যা এই যে, কি করিয়া তাঁহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী যে-কোন ব্যক্তিকেই ছোট জাতি বলিয়া অপমান করিবার দুর্মতি তাঁহাদের কেমন করিয়া এবং কবে যাইবে’’ (১৯৫১ পৃষ্ঠা ৩৯৭ – ৪০২)।
এই বক্তব্য যখন শরৎচন্দ্রের মুখে শোনা যাচ্ছে, সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকসঙ্ঘ তৈরি হচ্ছে হিন্দুদের সঙ্ঘবদ্ধ করার এবং হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার লক্ষ্যে। সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি গোলওয়ালকারের মতে হিন্দুরাষ্ট্র একটি সাংস্কৃতিক ধারণা, ‘আমাদের’ প্রাচীন এবং মহান সংস্কৃতি তার প্রাণ-বায়ু। কেবলমাত্র ওই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে তুলেই ভারতের জাতীয় জীবনে অসংখ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব (২০০০)।
ওই সংস্কৃতি একেবারেই আমাদের এবং এক্ষেত্রে আমরা অর্থ হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যেও তো নানারকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আছে, ধর্মীয় পন্থার প্রকারভেদ আছে। তাহলে এক্ষেত্রে কোন অংশের সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে? সেই বিষয়টিও গোলওয়ালকার পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বলেছেন পুরুষ সুক্ত অনুযায়ী হিন্দুসমাজ এক বিরাট পুরুষ, স্বয়ং ভগবানের রূপ। তাঁর দুই চোখ চাঁদ আর সূর্য, তাঁর নাভি থেকে সৃষ্টি হয় আকাশ এবং নক্ষত্র, ব্রাহ্মণ তাঁর মস্তক, রাজা বা ক্ষত্রিয় তাঁর বাহু, বৈশ্য তাঁর উরু এবং শূদ্র তাঁর পা।
হিন্দুসমাজের এই চিত্রকল্পে বর্ণভেদ এবং সামাজিক অসাম্যকে দৈব চেহারা দেওয়া হয়েছে এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব শিরোধার্য করা হয়েছে, যাকে সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বর্ণ এবং জাতিব্যবস্থাকে দূর করার কোন চেষ্টা করলে সেটা হবে ‘প্রাচীন এবং মহান সংস্কৃতি’র বিরোধিতার সামিল।
গোলওয়ালকারের ভাষ্যে বর্ণভেদ এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত জাতিপ্রথা (যাকে প্রায় সব ভারতীয়রা এইকালে কাস্ট বলেন কেননা দেশের সরকার তাই বলেন) মেনে নেওয়া হয়েছে, যদিও কিছু অস্বস্তি জানানো হয়েছে অস্পৃশ্যতা বিষয়ে। তাঁর মতে, দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন অস্পৃশ্যতা তাঁদের ধর্ম আচরণের অংশ এবং ওই প্রথা না মেনে চললে সেটা খুবই পাপকাজ হবে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বিভিন্ন ধর্মগুরু এবং সমাজ-সংস্কারকের চেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থা বিশেষ পালটায়নি। সামান্য পরেই তিনি অস্পৃশ্যতা প্রসঙ্গে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গেছেন – বর্ণহিন্দুরা হরিজনদের ওপর আক্রমণ করছে বলে যেসব খবর কাগজে ছাপা হচ্ছে, তাঁর মতে সেগুলো অনেক সময়েই অসত্য।
মুসলমানদের বিষয়ে বঙ্গীয় নব্য-ভদ্রলোক জাতীয়তাবাদীদের এবং সঙ্ঘী হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদের বক্তব্যে বিশেষ তফাৎ পাওয়া যায়না। গোলওয়ালকারের মতে মুসলমানরা ভারতে এসেছেন আক্রমণকারী হিসেবে ও থেকেছেন শাসক হিসেবে, তাঁরা সেই মানসিকতা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেই মানসিকতা থেকেই তাঁরা মন্দির অপবিত্র করেছেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিয়েছেন, গো-মাতাকে খাদ্য হিসেবে দেখেছেন, মাতৃসমা নারীদের উৎপীড়ন করেছেন। জয়া চ্যাটার্জি তাঁর লেখায় এই পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চারই সমালোচনা করেছেন, কেননা এই চেষ্টা আসলে অমুসলমানদের মধ্যে বহমান সাম্প্রদায়িকতাকে আড়াল করার চেষ্টা।
গোলওয়ালকার অবশ্য মুসলমান-সমস্যার একটি সহজ সমাধান বাতলে দিয়েছেন। যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু, অতএব মুসলমানদের উচিত আগ্রাসী শাসকসুলভ মনোভাব ছেড়ে সম্মানের সঙ্গে হিন্দুসমাজে ফিরে যাওয়া। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি ফিরে যাওয়া মানুষের স্থান হিন্দুসমাজ নামক বিরাট পুরুষের দেহের কোন অংশে হবে, মস্তক, বাহু, উরু অথবা পদ নাকি অন্ত্যজদের মত দেহের বাইরে– কোথায় থাকলে সেই প্রতিশ্রুত সম্মান যথাযথ পাওয়া যাবে।
সৈয়দ ফেরদৌসের দেশভাগ বিষয়ক একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে তিনি কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী সামসুল নামে এক বিহারী ব্যক্তি দেশভাগের আগের সময়ের কথা বলেছেন। এক সকালে চায়ের দোকানে কেউ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। সামসুল উঁকি দিয়ে খবরের কাগজের দিকে তাকাতে এক হিন্দু বাবু সামসুলকে বলেন, ‘খবরের কাগজ পড়ছ? নেতা হবার ইচ্ছে আছে নাকি?’ সেদিন কোন কথা না বলে ওই জায়গা ছেড়ে চলে এসেছিলেন সামসুল, কিন্তু সেই অপমান অনেকদিন পরেও ভোলেননি। সামসুলের মা বলেছিলেন হিন্দুরা কখনও মুসলমানদের উন্নতি সহ্য করতে পারেনা। তাই সামসুলের মনে হয়েছে মুসলমানদের আলাদা দেশ থাকা উচিত।
বাংলাদেশের জন্ম মুসলিম জাতিসত্ত্বার তত্ত্বকে একাধিক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সৈয়দ ফেরদৌস সেই প্রশ্ন আবার একবার তুলে এনেছেন। তাঁর মতে বাংলাদেশের জন্ম দেখিয়ে দিয়েছে (পূর্ব পাকিস্তানের) অধিকাংশ মানুষ আসলে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না, যদিও সেই সময় দেশভাগ ও পাকিস্তানের সৃষ্টি পূর্ববঙ্গের কৃষকসমাজে মুক্তির অনুভুতি এনে দিয়েছিল। লেখক বাংলাদেশের বিহারী জনগোষ্ঠীর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন ,যাদের একসময় দেশভক্ত পাকিস্তানী মনে করা হত, পরবর্তীকালে সেই মানুষদেরই দোষারোপ করা হল বাংলাদেশের প্রতি বেইমানির দায়ে (২০২২ পৃষ্ঠা ২-৪)।
বিপ্রতীপে
জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ে নানা রঙের ভাষ্য আমরা শুনেছি , কিন্তু সব ভাষ্য সমান গুরুত্ব দিয়ে শুনেছি কি? বাঙলার জাতীয়তাবাদী বা মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রবাদী ব্যাখ্যান ভালো করে দানা বাধার আগেই রবীন্দ্রনাথ ভারতে এবং বিশ্বের অন্যত্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ নিয়ে গোটাকয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেইসব বক্তৃতা ইংরেজিতে বই আকারে ছাপা হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। নেশনালিজম শীর্ষক বইতে (১৯১৭)রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অতীতে এবং সাম্প্রতিক কালেও ভারতের প্রধান সমস্যা ছিল রেস-এর বিভিন্নতা। ওই ইংরেজি শব্দ এককালে মানবজাতির মধ্যে শারীরিক বিভিন্নতা বোঝাতে প্রয়োগ করা হত। তাঁর বক্তৃতায় এবং লেখায় রবীন্দ্রনাথ ওই শব্দ প্রয়োগ করেছেন সম্ভবত বিদেশী শ্রোতাদের বর্ণপ্রথা বোঝাবার জন্যে। তাঁর মতে এই সমস্যা আমরা ভারতীয়রা কিভাবে মোকাবিলা করছি, সেটাই প্রমাণ করবে আমরা কতটা মানবিক। এবং এই সমস্যা সমাধান না করলে আমাদের অন্য কোন বিষয়েই উন্নতির আশা নেই।
যখন ইয়োরোপ থেকে জাতীয়তাবাদের ধারণা আমদানি করা হচ্ছে, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপীয় নেশনগুলোর সঙ্গে ভারতীয় সমাজের মূল প্রভেদের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণকরছেন। বলছেন, জগতে কিছু দেশ আছে যাদের শক্তি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা বা বৈরি প্রতিবেশীদের মোকাবিলা করতেই ব্যয় হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রতিকূলতা ঘরের ভেতরে। আমাদের ইতিহাস সামাজিক বোঝাপড়ার ইতিহাস, অন্যদের আক্রমণ করা বা আক্রমণ প্রতিহত করার ইতিহাস নয়।
জাতিরাষ্ট্রের সাধনা ইয়োরোপে কি চেহারা নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সেটা আমাদের কোন রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে সেই বিষয়টাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এক ছাঁচে ঢালা বিশ্বজনীনতা বা জাতিরাষ্ট্রের উগ্র-আরাধনা কোন মানব সমাজের লক্ষ্য হতে পারেনা। ভারত একদিকে তার বিবিধতাকে সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে তার আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ঐক্য খুঁজেছে। এই শক্তির কথা বলার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ভারতীয় সমাজ তার জাতিগুলোর মধ্যে অনতিক্রম্য প্রাচীর তোলার মত মারাত্মক ভুল করেছে, তার সন্তানদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করেছে, তাদের জোর করে একটা ছাঁচে ঢালা সামাজিক ব্যবস্থায় সামিল করার চেষ্টা করেছে।
এইক্ষেত্রে জাতি শব্দ ব্যবহার হয়েছে ইংরেজি কাস্ট বোঝাবার জন্যে, সেগুলো এমন জনগোষ্ঠী যাদের অনেকেরই বংশানুক্রমিক পেশা আছে এবং যারা সাধারণত নিজেদের মধ্যে বিবাহসম্পর্ক স্থাপন করতে পছন্দ করে। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, অনেক শতাব্দী ধরে নতুন নতুন পরীক্ষা হয়েছে এই সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আনার জন্যে।
প্রাচীন বর্ণপ্রথায় যারা সামিল ছিলো না এমন অসংখ্য অতিথি পরবর্তীকালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের অভ্যাস আর প্রয়োজন অন্যদের থেকে ভিন্ন। এর ফলে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে ভারতের আধ্যাত্মিক শিক্ষকরা শিখিয়েছেন সহানুভূতিশীল হতে আর মানুষের ঐক্য বিষয়ে সৎ থাকতে। তাই ভারতের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন তত বেশি গুরত্ব পায়নি, যতটা পেয়েছে আমাদের সামাজিক আর আধ্যাত্মিক ইতিহাস। তাঁর মতে,আমাদের সেই সামাজিক কাজ সম্পন্ন হবার আগেই অন্য এক বিশ্ব আমাদের বন্যার মত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু নতুন নতুন উপাদান আসছে ভারতীয় সমাজে তাই আরও বড় মাপে সমন্বয় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পশ্চিমী বিশ্ব আমাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বাণিজ্য আর রাজনীতি মানবতাকে ছেঁটে কেটে বস্তাবন্দি করে পণ্য করেছে বৈজ্ঞানিক নিপুণতায় (পৃষ্ঠা ১৪-১৭)।
রবীন্দ্রনাথ ভারতের ক্ষেত্রে জাতিরাষ্ট্রের বিষয়টি বিচার করেছেন ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দিয়ে। ভারতীয় মুসলমান আলাদা নেশন কিনা সেই বিষয়ে বলেছেন, মোগল এবং পাঠান ভারতে এসেছিল আক্রমণকারী হিসেবে কিন্তু ভারতীয়রা তাদের দেখেছে বিভিন্ন জাতি হিসেবে যাদের ধর্ম, সামাজিক প্রথা, পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। কখনই তাদের নেশন হিসেবে দেখা হয়নি। ভারতের মানুষ তাদের ভালবেসেছে, ঘৃণা করেছে, তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে লড়াই করেছে, তাদের ভাষা বলেছে, তারা ভারতীয় ভাষা শিখেছে। এইক্ষেত্রে জাতি অর্থ কাস্ট নয়, বরং তাকে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন উপনিবেশিক কালে অবস্থাটা আলাদা হয়ে গেল– এইবার যারা ভারতীয়দের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সেই বিদেশীরা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নয়, তারা নেশন। তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যে ভারতীয় সমাজ তারা অতীতে কখনও নেশন ছিলোনা।
এই দুই রকমের ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এবং পন্থা অনেকটাই আলাদা। রবীন্দ্রনাথের মতে নেশনকে যখন মানুষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়, তখন সব মানুষকে তার নামে সঙ্ঘবদ্ধ করা যায় কোনও যান্ত্রিক স্বার্থের জন্য। অন্যদিকে, একটা সমাজ কোন লক্ষ্য পুরনের স্বার্থে চলেনা –মানুষের মধ্যে যেসব সম্পর্ক আছে সমাজ সেগুলোর প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে– তার মধ্যে দিয়ে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা বিকশিত হয় এবং সমাজ নিজেকে রক্ষার কাজ করে। অন্যদিকে নেশন নিজের শক্তি এবং ধন বৃদ্ধি করে বিজ্ঞান ও সামাজিক সংগঠনের সাহায্য নিয়ে এবং অবিশ্বাস্য গতিতে তার নিজের সীমানা অতিক্রম করে। সে তার প্রতিবেশিদের থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নেয় নিজে ধনী হবার জন্য। এইভাবে প্রতিবেশীদের মধ্যে হিংসা ও ভয় সঞ্চার করে। একটা সময় আসে যখন সে আর থামতে পারে না, প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়, স্বার্থপরতা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে যায়। নেশনভুক্ত সমাজে এই শক্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে, একসময় এটাই সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় (পৃষ্ঠা ১৯-২০)।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের ওই সর্বব্যাপী সর্বনাশা চালিকাশক্তির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের মূল সমস্যা রাজনৈতিক নয়, বরং সামাজিক। পশ্চিমী সমাজকে রাজনীতি গ্রাস করেছে, আমরা সেই পশ্চিমকে নকল করছি। তিনি মনে রাখতে বলেছেন যে ইয়োরোপে বিশেষ জাতি-বৈচিত্র ছিলোনা এবং সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিল। তাই তাদের সভ্যতায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের প্রাবল্য। প্রতিবেশীদের সঙ্গে শত্রুতার মধ্যে দিয়েই তারা তাদের সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করত। আগে তারা প্রতিবেশীদের লুঠ করত, এখন তারা সারা বিশ্বকে লুঠ করছে। অন্যদিকে ভারত তার ইতিহাসের আদিকাল থেকেই বর্ণ আর জাতি সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভারতীয়দের বুঝতে হবে, যদি আমরা আমাদের সমাজের মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে ‘রাজনৈতিক’ হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমরা অন্যদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে যাব। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারত এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে আসছে। নানক, কবির, চৈতন্য এবং আরো অনেকেই জাতি-সমস্যা এবং সামাজিক-অসাম্য সরিয়ে ঐক্যের সন্ধান করেছেন (পৃষ্ঠা ১১৭-১২০)।
রবীন্দ্রনাথ যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার কথা বলেছেন, যার মূলে আছে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীলতা এবং ঐক্যের প্রতি সততা, সেই শিক্ষার সারাৎসার নেশনালিজম বইয়ের ছত্রে ছত্রে। অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর আগে সামাজিক অসাম্যের অবসান দরকার, তাঁর এই কথা আজ আমরা অহরহ উপলব্ধি করছি। এখন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, ওই আত্মদম্ভী নেশনালিজমের ভাবনা না থাকলে দ্বিজাতিতত্ব পায়ের তলায় কতটা জমি পেত।
যে সময় রবীন্দ্রনাথ নেশনালিজম বিষয়ে বলছেন এবং লিখছেন, প্রায় সেই সময়েই লিখছেন ঘরে বাইরে উপন্যাস (১৯২৬, প্রথম প্রকাশ ১৯১৫)। ওই কাহিনীর মূল চরিত্র নিখিলেশ একজন নব্য-ভদ্রলোক জমিদার, কিন্তু তিনি একান্তই দলছুট। তাঁর মধ্যে আমরা ঘরে বাইরের লেখককেই দেখতে পাই। নিখিলেশ উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও উগ্র-দেশপ্রেমের বিরোধীতা করছেন– তিনি কৃষকদের স্বার্থকে নিজের জমিদারি স্বার্থের ওপর জায়গা দিচ্ছেন।
নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা বলছেন,
“স্বদেশী কাণ্ডর সঙ্গে যে আমার স্বামীর যোগ ছিলোনা বা তিনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন তা নয়। কিন্তু ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্রটি তিনি চূড়ান্ত করে গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি বলতেন, দেশকে আমি সেবা করতে রাজি আছি, কিন্তু বন্দনা করব যাকে তিনি ওর চেয়ে অনেক ওপরে। দেশকে যদি বন্দনা করি তবে দেশের সর্বনাশ করা হবে“ (পৃষ্ঠা ৩০)।
এক জায়গায় নিখিলেশ বলছেন,
“দেশকে সাদাভাবে সত্যভাবে দেশ ব’লেই জেনে, মানুষকে মানুষ ব’লেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায়না, চীৎকার করে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি” (পৃষ্ঠা ৫৪)।
স্বদেশী আন্দোলনকে ভদ্রলোক নেতাদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিখিলেশের উক্তিতে,
“এমন সময়ে স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল ...এরা একদিন দল বেঁধে আমার কাছে এসে উপস্থিত। বললে, আমাদের শুকসায়রের হাট থেকে বিলিতি সুতো র্যােপার প্রভৃতি একেবারে উঠিয়ে দিতে হবে।
আমি বললুম, সে আমি পারব না।
তাঁরা বললে, কেন, আপনার লোকসান হবে? বুঝলুম, কথাটা আমাকে একটু অপমান করে বলবার জন্যে। আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমার লোকসান নয়, গরীবের লোকসান।
মাস্টারমশায় ছিলেন; তিনি বলে উঠলেন, হাঁ, ওঁর লোকসান বৈকি, সে লোকসান তো তোমাদের নয়।
তারা বললে, দেশের জন্যে –
মাস্টারমশায় তাদের কথা চাপা দিয়ে বললেন, দেশ বলতে মাটি তো নয়, এই সমস্ত মানুষই তো। তা তোমরা কোনোদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? আর, আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কি নুন খাবে আর কি কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ, এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন?” (পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪)।
স্বদেশীওয়ালাদের প্রতি নিখিলেশের বিরাগ দেখা গেল বটে, কিন্তু বিদেশী শাসকের প্রতি তাঁর মনোভাব অতি কঠোর। তিনি বলছেন,
“বড় বড় ডাকাত-সভ্যতারও জবাবদিহির দিন কখন আসে তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। ওদের পলিটিক্সের ঝুলি-ভরা মিথ্যা কথা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তচরবৃত্তি, প্রেস্টিজ রক্ষার লোভে ন্যায় ও সত্যকে বলিদান, এই যে সব পাপের বোঝা নিয়ে চলেছে, এর কি ভার কম? আর, এ কি প্রতিদিন ওদের সভ্যতার বুকের রক্ত শুষে খাচ্ছে না?” (পৃষ্ঠা ৪৪)।
নিখিলেশের এই উক্তির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে দূরদৃষ্টি ছিল তা প্রমাণ করে দিয়েছে দু’খানা বিশ্বযুদ্ধ এবং ফ্যাসিস্ত শক্তির উত্থান। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উপলব্ধি করেছেন উপনিবেশিক শক্তি কিভাবে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
“ইংরেজকে একদা মানব-হিতৈষী রূপে দেখেছি এবং কী বিশ্বাসের সঙ্গে ভক্তি করেছি। যুরোপীয় জাতির স্বভাবগত সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস ক্রমে কী করে হারানো গেল তারি এই শোচনীয় ইতিহাস আজ আমাকে জানাতে হল। সভ্য-শাসনের চালনায় ভারতবর্ষের সকলের চেয়ে যে দুর্গতি আজ মাথা তুলে উঠেছে সে কেবল অন্ন বস্ত্র শিক্ষা এবং আরোগ্যের শোকাবহ অভাব মাত্র নয়; সে হচ্ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ, যার কোনো তুলনা দেখতে পাইনি ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান স্বায়ত্ব শাসন-চালিত দেশে। আমাদের বিপদ এই যে, এই দুর্গতির জন্যে আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে। কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে সে যদি ভারত-শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোনো এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত তাহলে কখনোই ভারত-ইতিহাসের এত বড়ো অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না“ (১৩৪৮ (ইং ১৯৪১) পৃষ্ঠা ৬)।
আমরা অনেকেই সন্দীপ এবং তার সতীর্থদের দেশভক্তির হুঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে থাকলাম, মৃদুভাষী নিখিলেশের যুক্তি শোনবার সময় আমাদের হলনা। সময় থাকতে যদি তার কথাও খানিক শুনতাম, দেবীমূর্তি ছেড়ে দেশের মানুষকে দেশ ভাবতাম, তাহলে ‘নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ’-এর দুর্গতি হয়ত খানিক পরিমাণে এড়িয়ে যাওয়া যেত।
তথ্যসূত্র
চক্রবর্তী রমাকান্ত ১৯৯৬ বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম, কলিকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা,শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (অষ্টম সম্ভার) ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতা,এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্সপৃষ্ঠা ৩৯৭ – ৪০২
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ (১৯১৫) ঘরে বাইরে কলিকাতা, বিশ্বভারতী- গ্রস্থালয়।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথবঙ্গাব্দ ১৩৪৮ (ইং ১৯৪১) সভ্যতার সঙ্কট কলিকাতা, বিশ্বভারতী।
বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র ১৯৯৯ মনুসংহিতা, কলিকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
সরকার, যদুনাথ ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) আনন্দমঠ বঙ্কিম শত-বার্ষিক সংস্করণের ভূমিকা, কলিকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ
Ambedkar B. R. 2002 Origin of Untouchability In The Essential Writings of B. R. Ambedkar Valerian Rodrigues (editor) New Delhi, Oxford University Press.
Bandyopadhyay, Sekhar 1997 Caste, Protest and Identity in Colonial India: The Namasudras of Bengal, Surrey, Curzon Press Chatterji, Joya 1994 Bengal divided:Hindu communalism and partion, 1932-1947, Cambridge, Cambridge University Press.
Conio, Caterina 1987 Puranas In The Encyclopedia of Religion Volume 12 (Ed. Mircea Eliad) New York, Macmillan Publishing Company.
Ferdous, Sayeed 2022 Partition as Border-Making: East Bengal, East Pakistan and Bangladesh Abingdon, Routledge Golwalkar, M. S. 2000 Bunch of Thoughts, Bangalore, Sahitya Sindhu Prakashana Lorenzen, David N. 1995 The Historical Vicissitudes of Bhakti Religion in Bhakti Religion in North India: Community Identity & Political Action, New York, State University of New York
Tagore Rabindranath 1917 Nationalism San Francisco, The Book Club of California
ভারতের স্বাধীনতা এলো ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা এলো বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে কেটে দু'ভাগ করে। পঞ্জাব প্রদেশ ভাগ হওয়ার অভিজ্ঞতা আগে না থাকলেও বাংলা প্রদেশ আগেও একবার বিভক্ত হয়েছিল । ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ইচ্ছায়। প্রতিবাদের প্রাবল্যে তা প্রত্যাহৃত হয় ছ’বছর বাদে। সেই প্রতিবাদের ক্ষেত্রভূমি হিসেবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের সুনাম অর্জন করে বাংলার নেতৃত্ব। যদিও তখনও বাঙ্গালীদের একটি অংশ বাংলা ভাগের পক্ষেই ছিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের অভিঘাত এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সরকার তার সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়। নতুন কৌশল এসেছিল ভারতীয় রাজনীতিতে। আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী ধারণার সফল প্রয়োগ। অথচ তার চল্লিশ বছরের মধ্যেই, স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত আগে বাংলায় আন্দোলন সংঘঠিত হল, পরিচালিত হল - ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার জন্য। প্রথম বাংলা ভাগের সময় বাঙালির যে শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, শেষ এবং স্থায়ী বাংলা ভাগের জন্যও সেই শ্রেণীর মানুষেরাই আন্দোলন সংঘঠিত করেছিলেন। তারা সমাজে সম্মানিত এবং ভদ্রলোক হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
এই প্রেক্ষাপট স্বাধীন ভারতের বিশেষত্ব বাংলার নাগরিকদের সকলেরই জানা। তবুও স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ঢাকঢোল পেটানো সশব্দ সময়ের নিভৃত ফোকরে মূলত বাংলা ভাগের অব্যবহিত আগের ঘটনাক্রম ফিরে দেখার জন্য এই লেখার আয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ সরকার বুঝে যায় যে, তাদের পক্ষে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই । তাদের পক্ষে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব নয় । ইংল্যান্ডে নব-নির্বাচিত ‘লেবার’ গভর্মেন্ট তাদের পূর্বতন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে ১৯৪৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করে যে, জুন, ১৯৪৮-এর মধ্যে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
এই ঘোষণাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি উল্লেখ করেন যে ভারতবাসী নিজেরাই ঠিক করুক তাদের সরকার এবং সংবিধান কেমন হবে এবং ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতার উল্লেখ করে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেন। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় হিসেবে পাঠানো হয়। বিভিন্ন কারণে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য লন্ডন আগ্রহী ছিল।
ইতিমধ্যে ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনে মুসলমান জনগণ মুসলিম লীগের পক্ষে রায় দেবার ফলে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আপোষ মীমাংসায় লীগ ও জিন্নাহকে উপেক্ষা করা লন্ডন বা দিল্লির পক্ষে সম্ভব ছিল না । সুতরাং আলোচনার জন্য একটি ত্রিপাক্ষিক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলো - ব্রিটিশদের পক্ষে কথা বলার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে নিয়ে।
বাংলার জন্য এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা কংগ্রেস এবং হাই কমান্ডের টানাপোড়েনের শেষে তখন বাংলা কংগ্রেস শিখণ্ডীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাংলার মুসলমান নেতাদের কেন্দ্রের আলোচনায় কার্যকরভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয় । তাছাড়া চল্লিশের দশকের শুরু থেকে প্রাদেশিক সরকারের দুর্বল ভূমিকার জন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে এসেছিল।
আবার জিন্নার সাথে বাঙালি মুসলমান রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল সন্দেহপূর্ণ। সুতরাং জিন্নাও বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ বা দাবিকে অগ্রাধিকার দেবেন সেটা ভাবাও বাতুলতা।
কংগ্রেস হাইকমান্ড যখন দেশবিভাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাই তখন বাংলা কংগ্রেস তাদের দৃঢ সমর্থন দিয়েছিল। হিন্দু বাঙালিরা স্থায়ীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শাসনে থাকার অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল দৃঢভাবে।
১৯৩৭ সালে কংগ্রেস হাইকমান্ড নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া প্রদেশগুলোতে এককভাবে সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং কোয়ালিশন নীতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । যে সব দল নির্বাচনী ঐক্য করেছিল তাদের কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যেতে বলা হয়। যুক্তপ্রদেশে জিন্নাহর নেতৃত্বে লীগ ১৩৪ আসনের মধ্যে ২৭ টিতে জয়লাভ করে। বাকি আসন কংগ্রেস পায়। কিন্তু নির্বাচনী ঐক্য অস্বীকার করে কংগ্রেস বলে সরকারে যোগ দিতে হলে তাদের কংগ্রেসে যোগ দিতে হবে। এই নীতি বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসের শরৎ বসু, কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের অনুমতি চান । কিন্তু হাই কমান্ড তা প্রত্যাখ্যান করে ।
একটা সময় ভারতের কোন অংশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা কংগ্রেস নেতৃত্ব ভাবতেও পারতেন না। ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কোনো আশা নেই, সেই অংশগুলিকে ছেড়ে দিতে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে । সুতরাং দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
গান্ধী অনুগামী দেবচন্দ্র ঝা-এর বয়ানে - ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে তখনই গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের বিরোধের সূত্রপাত । স্বাধীনতা যতই নিকটবর্তী হতে থাকে এই বিরোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশদের সঙ্গে দেশভাগ নিয়ে কোন চুক্তিতে না আসার জন্য গান্ধীর জেদ, শুধু জিন্নার হাতে ক্ষমতা দিয়ে ব্রিটিশ চলে যাক, এমনসব কথায় কংগ্রেস নেতারা যারপরনাই ক্ষুব্দ্ধ ও মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা শ্রেয় মনে হয়েছে সেটাই করেছে।
আর গান্ধী জীবনীকার প্যারেলালের দৃষ্টিতে, ‘স্বাধীনতার কিছুদিন আগে থেকে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া এই নেতাদের চিন্তায়, আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটে গেল আমূল পরিবর্তন । তারা তখন অন্য কক্ষপথের পথিক এবং মাউন্টব্যাটেনই হলেন সেই কক্ষপথের কেন্দ্র। কংগ্রেস নেতাদের তখন মাউন্টব্যাটেন উপযুক্ত ছাত্র হিসেবে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন - গান্ধী নয়, শুধু এদের সাথে আলোচনা করেই কর্তব্য স্থির করতে হবে’।
এটা সবাই জানেন যে, এটলির লেবার পার্টি ১৯৪৫-এ ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় আসার পর ব্রিটিশদের ভারত নীতির আমূল পরিবর্তন হয় । ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের সময় চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিল ভারতকে ফলপ্রসূভাবে যুদ্ধে ব্যবহার করার। ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি তিনি কোনোভাবেই সামনে আসতে দেন নি। তিনি মনে করতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘ মুকুটের উজ্জ্বলতম রত্ন’ ভারতকে স্বাধীনতার অর্থ হলো ইংরেজ জাতির পক্ষে চরম বিপর্যয়। গ্রেট বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর চার্চিল ভারত বিষয়ক নীতি ঘোষণা করেছিলেন এই বলে যে, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানে পৌরহিত্য করবার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিনি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সময়েও তিনি তার ঘোষিত ভারত নীতিতে অটল ছিলেন। তার নিজের ডেপুটি ক্লিমেন্ট এটলি, চীনের জেনারেল চিয়াং কাইশেক এবং এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও তার মত পাল্টাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
চার্চিলের এই গোঁড়া ভারত বিদ্বেষে সমর্থন যুগিয়ে ছিলেন আরও দুই ইংরেজ রাজপুরুষ। একজন দিল্লিতে ভারতের বড়লাট লর্ড লিনলিথগো আর অন্যজন ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ স্টেট লিওপোল্ড আমেরি। লিনলিথগোর মত ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পারস্পরিক বিরোধ কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের পুরনো প্রভাব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা। লিনলিথগো এবং আমেরির এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন ক্লিমেন্ট এটলি এবং তিনি বিশ্বযুদ্ধে চীনকে পাশে পাওয়ার যুক্তি উল্লেখ করেন।
এই সময় চিয়াং কাইশেক ভারতে গিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি ভারতে গিয়ে গান্ধী এবং নেহরুর সাথে পরিচিত হয়ে এই মুহূর্তে যৌথ লড়াইয়ে ব্রিটেনকে সহযোগিতার অনুরোধ করতে চান। ব্রিটিশ রাজদূত চীন থেকে পৃথক বার্তায় এও জানান যে, আমেরিকার ফিলিপিনসকে স্বাধীনতা দেবার পর চীনারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বৃটেনের ভারতকে স্বাধীনতা না দেবার জন্য। তারা বৃটেনের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
এই খবরে চার্চিল অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে চিয়াং কাইশেককে লেখেন যে, গান্ধী ও নেহেরু ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনের বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের সংগে দেখা করতে হলে চিয়াং কাইশেককে জিন্না, দলিত প্রতিনিধি এবং রাজন্যবর্গের সাথেও কথা বলতে হবে।
ব্রিটিশরা বাধ্য করলো চিয়াং কাইশেককে জিন্নার সঙ্গে কথা বলতে। তিনি গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন চীনে ফিরে যাবার পথে কলকাতায় । চিয়াং ব্রিটিশদের এই চাল বুঝতে পারলেন। তিনি ভারত থেকে বিদায় নেবার সময় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে গেলেন যে, তিনি আশা করেন যে তার মিত্র ব্রিটিশ আর কোন কালবিলম্ব না করে ভারতকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করবে।
এই সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেঞ্জি কিং ব্রিটিশ সরকারকে এক বার্তায় জানান যে চিয়াং কাইশেক মনে করেন ভারতে হিন্দু- মুসলমান বিরোধ অত্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে এবং এখুনি ভারতকে স্বায়ত্তশাসন না দিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং তিনি এই মত আমেরিকাকেও জানিয়েছেন। কিন্তু চার্চিল এ ধরনের পরামর্শে কর্ণপাত করেননি। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে জানালেন যে, জাপানের আক্রমণের আশঙ্কার মুখে তিনি ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে অরাজকতার ভিতর ঠেলে দিতে পারেন না। রুজভেল্ট অবশ্য জানালেন যে, ‘আমার ব্যক্তিগত মত হল যে ভারতবর্ষে আপাতত একটা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হোক এবং সেই সরকারে সমস্ত জাতি, ধর্ম, দল, অঞ্চল সকলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকুক’।
নানা দিক থেকে চেষ্টা সত্বেও চার্চিল ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সফল হলেন । বেশ কয়েক বছর পর যুদ্ধপরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এটলি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন এবং বললেন যে, ‘তিনি যেন ভারতে গিয়ে এমন ব্যবস্থা করেন যাতে ব্রিটিশ স্বার্থ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকে - যেমনটি ডারহাম করেছিলেন কানাডার ব্যাপারে’।
এই বিষয়ে গান্ধী, রুজভেল্ট এবং চিয়াং কাইশেককে বিস্তারিত চিঠি দিয়েছিলেন।
মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, যদি তারা ডোমিনিয়ন হিসাবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে যোগ দিতে রাজি থাকে তবে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং কংগ্রেস নেতাদের ভারত ভাগের প্রস্তাবেও রাজি করিয়ে ফেললেন।
ভারত ভাগ রুখতে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানোর ইতিহাসে গান্ধীর বক্তব্য ছিল, ‘দেশকে অরাজকতার মধ্যে রেখেই ব্রিটিশ বরং এদেশ ছেড়ে চলে যাক। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করলে যে ভয়ংকর পরিণাম আমাদের ভোগ করতে হবে তার তুলনায় এটা বরং শ্রেয়।
কিন্তু ততদিনে কংগ্রেস তার এতদিনের ঘোষিত নীতি থেকে সরে এসে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে । এমনকি পাঞ্জাবকে হিন্দু ও মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাগ করার দাবিও জানিয়েছে এবং তা ১৯৪৭-এর মার্চে ভারতের শেষ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসবার আগেই । এ বিষয়ে প্যারেলাল বলেছিলেন, - এ ধরনের ঘটনা কিছুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে মনে হতো। গান্ধীজির সঙ্গে পরামর্শ না করে কংগ্রেস নেতৃত্ব কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে গান্ধীর প্রশ্নের উত্তরে নেহরু লিখলেন - তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে পাঞ্জাব ভাগের দাবি এখনই জানানো দরকার, কেননা বাস্তব পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে আর সম্ভব নয়। আসলেই জিন্নার পাকিস্তানের দাবির এটাই হবে সমুচিত জবাব। আর সরদার প্যাটেলের জবাব ছিল - আপনাকে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা কষ্টকর, তবে এটুকু জানিয়ে রাখি যে তাড়াহুড়ো করে কিছুই করা হয়নি।
তবু গান্ধীজী মাউন্টব্যাটেন দিল্লিতে আসার পর তাকে পরামর্শ দেন - বড়লাট যেন সাহসের সঙ্গে সত্যের মুখোমুখি হন, সত্য মেনে কাজ করেন, তার ফলে ইংরেজ চলে যাবার পর যদি শোচনীয় জীবনহানি হয় - হবে। ১৯৪৮-এর জুন মাসে ইংরেজ শাসনের অবসান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই দেশভাগ যাতে না হয় তার জন্য গান্ধীজী কয়েকটি প্রস্তাব দেন। সেগুলি হল:
- সরকার গঠনের ভার জিন্না যদি চান তাকেই দেওয়া হোক।
- ক্যাবিনেটের সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করার দায়িত্বও তাকেই দেয়া হোক।
- জিন্না যদি এতে রাজি থাকেন, তবে কংগ্রেস সবরকমভাবে তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ সমগ্র ভারতের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী না হয়।
- ভারতের সামগ্রিক স্বার্থে কাজ হচ্ছে কিনা তার বিবেচনার ভার ব্যক্তিগতভাবে মাউন্টব্যাটেনের হাতে থাকবে।
- ক্যাবিনেটে মুসলিম লীগ ও সহযোগীদের হয়ে জিন্নাকে আশ্বাস দিতে হবে যে তারা সমগ্র ভারতে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবেন।
- ন্যাশনাল গার্ড বা অন্য কোনরকম বেসরকারি সেনাদল রাখা চলবে না।
- উপরোক্ত কাঠামোর মধ্যে থেকে জিন্না যদি চান, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই তাঁর পাকিস্তান- প্রস্তাব ক্যাবিনেটের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে পারেন। অবশ্য তাকে শক্তির সাহায্যে নয়, যুক্তির সাহায্যে, কোনরকম চাপ সৃষ্টি না করে সমস্ত প্রদেশের অনুমোদন নিতে হবে ।
- প্রাদেশিক বিধানসভাগুলিতে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও লীগের প্রস্তাব বিবেচনার সময় সেই গরিষ্ঠতার সুযোগ না নিয়ে দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে খোলা মনে তা বিচার করবে । আর দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে মাউন্টব্যাটেন নেবেন ।
- আর জিন্না যদি এই দায় নিতে অস্বীকার করেন তবে উপযুক্ত রদবদল করে কংগ্রেসকে সেই দায়িত্ব দেয়া হোক।
লর্ড ওয়াভেলকে যে কথা গান্ধীজী বলেছিলেন ১৯৪৬-এ, তাই বললেন মাউন্টব্যাটেনকে - যদি অরাজকতার মধ্যে দেশটাকে ছেড়ে দিতে না চান তবে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ, যে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হাতে গোটা দেশের শাসনভার দিয়ে যান।
তবে গান্ধীজী এই শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হলো আর ব্যর্থ হলো ভারতকে অখণ্ড রাখার চেষ্টা । গান্ধীজী আস্থা রেখেছিলেন ভারতের সাংস্কৃতিক ও সহনশীলতার ঐতিহ্যের উপর । তাঁর বিশ্বাস ছিল, ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করার পর ভারতবাসী এই কাজে নিশ্চিতভাবে সফল হব । কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের সে আস্থা ছিল না । সরদার প্যাটেল বড়লাটকে এমন কথাও বললেন - অখণ্ড ভারত নিয়ে গান্ধীজী ইদানিং যা বলছেন তার প্রতি গুরুত্ব দেবার কোনও দরকার নেই।
যেভাবে দেশভাগের আয়োজনে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সূচনা হলো তাতে গান্ধীজী এই পর্যায়ে সমস্ত উৎসব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য চলে এলেন বাংলায় ।
২
এইবার বাংলার দিকে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৩৬-৩৭ সালের নির্বাচনে হিন্দু ভোট ভাগ হয়েছিল কংগ্রেস ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। কিন্তু ১৯৪৫-৪৬ সালে হিন্দুরা সুস্পষ্টভাবে ভোট দেয় কংগ্রেসকে। ১৯৩৬-৩৭ সালে যেখানে কংগ্রেস ৮০টি আসনের মধ্যেই মাত্র ৪৮টি এবং বিশেষ হিন্দু আসনের মধ্যে ৪টি আসন পেয়েছিল সেখানে ১৯৫৫-৪৬ সালে কংগ্রেস পায় ৭১টি সাধারণ আসন আর ১৫টি বিশেষ আসন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বর্ণহিন্দুদের সর্বসম্মত দল হিসাবে পরিগণিত হয়। এমনকি তপশিলি সম্প্রদায়ের আসনের মধ্যে কংগ্রেস শতকরা ৮০ ভাগ আসনে জয়ী হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ আসন থেকে ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী জয়লাভ করেন । হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এই বিপুল বিজয়কে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের জয় হিসেবে দেখলে ভুল হবে। তার প্রমাণ পরবর্তীকালে পাওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিক ফলাফলে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ক্ষমতা লাভ করে । মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ১১৩টি আসন আর অন্যান্যরা জয়লাভ করে ৫১ টি আসনে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সুরাবর্দী সরকার গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন।
এর ফলে হিন্দু বাঙালিরা অত্যন্ত হতাশ হন। ৪২-৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হিসেবে সুরাবর্দীর কথিত দুর্নীতির জন্য হিন্দু জনমনে তিনি ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন । সংবাদপত্রের লেখালেখিতে দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য সুরাবর্দীকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুরাবর্দী বাঙালি হিন্দুদের ভীতি দূর করতে প্রায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। মন্ত্রিসভায় হিন্দু-মুসলমান সমতার যে নীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সুরাবর্দী বাতিল করেন। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ১৩ থেকে কমিয়ে ১১ করেন, আর হিন্দু মন্ত্রীর সংখ্যা কমিয়ে ৩ করেন, এবং ৩ জন হিন্দু মন্ত্রীর ২ জনকে তপশিলি সম্প্রদায় থেকে গ্রহণ করেন।
এরপর মুসলিম লীগের ঘোষিত ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’, ১৬ আগস্টে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং কলকাতার রাস্তায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হন। ফলে মুসলমান সরকারের শাসন বাংলাকে পাকিস্তান বানানোর পথে নিয়ে যাবে এই বিশ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুদের মধ্যে গেঁড়ে বসে। অখণ্ড বাংলার একজন মুখ্য প্রচারক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনিও ১৯৪৬-এ তাঁর মত পাল্টান। মুসলমান শাসনের থেকে দেশ বিভাগ ভালো এই ধারণা হিন্দুদের মধ্যে ততদিনে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
১৯৪৪ সালে রাজাগোপালাচারী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সমন্বয়ে পাকিস্তানের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলে শ্যামাপ্রসাদ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু ১৯৪৬-এ তার অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে যায়। সুরাবর্দী সরকারের অপরিণত উদ্ধত কার্যকলাপ এবং ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা হিন্দু মানসিকতা ওলটপালট করে দেয়। তারা এই ঘোষণাকে নিজেদের অস্তিত্বের সংকট হিসাবে গ্রহণ করে। আর তার বিরুদ্ধে আমরণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়।
এই পরিপেক্ষিতে কুখ্যাত কলকাতা হত্যাযজ্ঞ (The Great Calcutta Killing) সংঘটিত হয়। হিন্দু মুসলমান উভয় পক্ষই যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে একে অপরের হত্যালীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্তচক্ষু হিংস্র গোষ্ঠী-চেতনায় ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো, নিঃশেষে বিলুপ্ত হলো সৌভ্রাতৃত্বের একদা ঐতিহ্য। এরপর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধারাবাহিকতায় নোয়াখালিতে ঘটে গেল পরিকল্পিত গণহত্যা। স্বদেশী আন্দোলন, স্বাধীনতার বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলনের বিপুল অর্জন যেন রাতারাতি বিনষ্ট হয়ে গেল। হারজিত-বিহীন নরমেধ যজ্ঞে বলি হয়ে গেল অসংখ্য প্রাণ। বহু দিন বাদে ব্রিটিশ আবিষ্কার করলো – এখন আর তাদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন নেই। নোয়াখালির রামগঞ্জ এলাকার এম এল এ গোলাম সারওয়ারের ক্রমাগত উস্কানি ও নেতৃত্বে ১০ অক্টোবর ১৯৪৬ শুরু হল গণহত্যা। এই আক্রমণ, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, ধর্ম পরিবর্তন, অগ্নিকান্ডের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হিংসা টানা দশ দিন চলতে থাকে।
মহাত্মা গান্ধী এই খবরে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সহায় সম্বলহীন এই মানুষদের পাশে দাঁড়াবার জন্য ৭ নভেম্বর ১৯৪৬ থেকে ২ মার্চ ১৯৪৭ পর্যন্ত নোয়াখালিতে অবস্থান করেন। মানবতার শ্মশাণভূমি নোয়াখালিতে তিনি গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন ধ্বস্ত মানুষের হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন আক্রমণকারী গোষ্ঠীর হৃদয়ে মানবতাবোধ সঞ্চার করতে। তার এই প্রচেষ্টায় নোয়াখালিতে ইতিবাচক সাড়া পড়েছিল।
এই ঘটনা প্রবাহের মাঝে কিছু মানুষ এর বিরুদ্ধে যুক্তবাংলার ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন শরৎ বসু। তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন এবং বলেন - ধর্মীয় ভিত্তিতে প্রদেশের বিভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের ভিত্তি হতে পারে না। কিন্তু অনতিবিলম্বে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রদেশ কংগ্রেসের কেউ শরৎ বসুকে সমর্থন করেননি। কিছুদিনের মধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ভারত ভাগ সমর্থন করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাশ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই Constituent Assembly’র বাংলার ১১ জন হিন্দু সদস্য মাউন্টব্যাটেন এর সঙ্গে দেখা করে ‘ ভারত ইউনিয়নের মধ্যে পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় পৃথক ও স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশের দাবি জানান’। শেষ পর্যন্ত যুক্ত-বাংলার ভাবনা আর দানা বাঁধেনি। বাংলা অবিভক্ত রাখার পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস হয়ে যায়।
রেডিও, খবরের কাগজ, সরকারি প্রচারপত্র, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ভারতবাসী জেনে গেল যে দেশ বিভক্ত হচ্ছে । প্রত্যন্ত এলাকার অসংখ্য প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ সেই খবর পেলেন অনেক পরে । দুই প্রান্তেরই অসংখ্য মানুষ দাঙ্গা, মৃত্যু আর উৎখাতের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে মাটিতে তাদের জীবনযাপন সে মাটি আর তাদের দেশ নয়। যারা রেডিওর কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলেন তারা ৩ জুন, ১৯৪৭-এর সন্ধ্যেবেলা খবর পেলেন ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত হবে অখণ্ড ভারত বর্ষ।
বাউন্ডারি কমিশন গঠিত হলো ৩০ জুন। সিরিল রাডক্লিফের নেতৃত্বে। রাডক্লিফ ভারতে পৌঁছলেন ৮ জুলাই, শেষ পর্যন্ত ৩৮০০ মাইল সীমানা নির্ধারণ করতে।
ইতিমধ্যে মাউন্টব্যাটেনের বিবৃতি মত বাংলা এবং পাঞ্জাবে প্রাদেশিক বিধানসভা দুটি আলাদা অংশ মিলিত হবেন। মুসলমান সংখ্যাধিক্যের জেলাগুলি একত্রে এবং বাকিরা আলাদা। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন প্রদেশে ভাগ হবে কিনা।
পাঞ্জাব বিধানসভার অধিবেশন মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না, কিন্তু বাংলা বিধানসভায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। বাংলা বিধানসভায় প্রথমেই মুসলমান এবং হিন্দু সংখ্যাধিক্যের জেলাগুলির যৌথসভা হয়। সেই সভা পরিচালনা করেন স্পিকার নুরুল আমিন । সেখানে ১২৬ জন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেন আর ৯০ জন তার বিরুদ্ধে ভোট দেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বর্ধমানের মহারাজার সভাপতিত্বে হিন্দু প্রধান জেলাগুলির সভায় ৫৮ - ২১ ভোটে বাংলাভাগের প্রস্তাব পাশ হয়, আর মুসলমান প্রধান জেলাগুলির সভায় ১০৬ - ৩৫ ভোটে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে প্রস্তাব পাশ হয় । কিন্তু হিন্দুপ্রধান জেলাগুলির ফলাফল জানার পর মুসলমান প্রধান জেলাগুলির সভায় ১০৭ - ৩৪ ভোটে পাকিস্তানে যোগ দেবার প্রস্তাব পাশ হয়।
ইতিমধ্যে বাউন্ডারি কমিশনের কাছে বাংলার দাবি জানাবার জন্য AICC-র পক্ষ থেকে একটি coordination committee তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কংগ্রেস ছাড়া সেই কমিটিতে হিন্দু মহাসভা, New Bengal Association (Major General A.C. Chatterjee) এবং Indian Association-কে সামিল করা হয়। এই কমিটির সম্পাদক করা হয় নির্মল কুমার বসুকে। নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর সহকারি হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য কাজকর্মের ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে। সভাপতি নিযুক্ত হন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন - অধ্যাপক বিনয় ব্যানার্জি, সমর রায়, ডাক্তার প্রমথনাথ ব্যানার্জি, বঙ্কিম মুখার্জি, অধ্যাপক এস এন বসু, রায়বাহাদুর চুনিলাল রায়, সনৎকুমার রায় চৌধুরী, অধ্যাপক হরিচরণ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, এস. এন. মোদক, রায় বাহাদুর বি. বি. মুখার্জি এবং ডাক্তার এস. পি. চ্যাটার্জী। আচার্য জেবি কৃপালনী ২৩ জুন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এই ঘোষণা করেন। এই কমিটির প্রথম সভা হয় ২৯ জুন। পরবর্তীকালে এন. সি. চ্যাটার্জী, পি. বি. মুখার্জি এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
কিন্তু এই কমিটি শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে একটি দাবিপত্র বাউন্ডারি কমিশনের কাছে জমা করতে পারেনি। নির্মল কুমার বসু বহু চেষ্টা করেও ঐক্যমত গঠনে ব্যর্থ হন বিশেষত্ব কমিটির সভাপতি বিখ্যাত আইনজীবী অতুল গুপ্তের জেদের জন্য। এ বিষয়ে সমাধানের জন্য নির্মল বসু অধ্যাপক সত্যেন বসুর সাহায্য চান, কিন্তু সত্যেন বসুও কোন সাহায্য করেননি। কমিটির মূল প্রস্তাব গৃহীত হয় ১০ - ২ ভোটে তবে তা অতুল গুপ্তের মতের বিরুদ্ধে। অথচ জে. বি. কৃপালনী কমিটি ভেঙে দিতে রাজি হননি । অতুল গুপ্ত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাবি পত্র জমা দেন আর নির্মল চ্যাটার্জী কমিটির পক্ষ থেকে বাউন্ডারি কমিশনে প্রতিনিধিত্ব করেন। হিন্দু মহাসভা, Indian Association এবং New Bengal Association-এর পক্ষ থেকে আলাদা করে দাবি পত্র জমা করেন।
আমরা ওই দুটি দাবি পত্রের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আমাদের স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া শেষ করব ।
সীমানা নির্ধারণের দাবি পত্রে কংগ্রেস বিস্তারিত তথ্য ও মানচিত্র এবং বিভিন্ন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সংযুক্ত করে । ১৯৪১-এর জনগণনা তথ্য বহুল ব্যবহার করা হয়। যদিও ১৯৪১ এর জনগণনা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয় এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংগৃহীত বলে সন্দেহ প্রকাশ করে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ সবাই। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা উভয়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলার সঙ্গে রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেনি যদিও সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২.৯৪ শতাংশ। কংগ্রেসের দাবি পত্রে দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা এবং জমির আয়তন তাদের সিদ্ধান্ত নেবার কেন্দ্রে ছিল আর অন্য দাবি পত্রে জমির সঙ্গে জল বা জলবাহী নদী, মাটির চরিত্র, প্রাকৃতিক গঠন ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
৩
বাউন্ডারি কমিশনে কংগ্রেস যে স্মারকলিপি জমা দেয়, তার সঙ্গে মুসলিম লীগের দাবির বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য জানিয়ে একটি নোট জমা দেয়। মুসলিম লীগের দাবি পত্রে ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম ডিভিশন এবং কলকাতা সহ প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রায় পুরোটা দাবি করা হয়েছিল। কলকাতা কেন পাকিস্তানে যাওয়া উচিত নয় তার জন্য কংগ্রেস ও অন্য সংগঠনগুলির দাবি পত্রে তথ্য সহ ব্যাখ্যা জমা করা হয়। কংগ্রেসের স্মারকলিপিতে পশ্চিমবঙ্গের মোট ৪০১৩৭ বর্গ মাইল এলাকা দাবি করা হয় যেখানে মোট ২,৮০,৩২,০০০ মানুষের বসবাস। তখন তার হিসেব মতো বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ।
দেশভাগ এবং বাংলাভাগ অবধারিত এটা পরিস্কার হয়ে উঠতেই মুসলিম লীগ মূলত খাজা নিজামউদ্দিনের নেতৃত্বে কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু এই বিষয়ে লীগ নেতৃত্বের মধ্যেই মতভেদ থাকায় এই আন্দোলন দানা বাঁধেনি। কেননা ইতিমধ্যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসাবে ঢাকার নাম ঘোষণা করেছিলেন ১০ জুন, ১৯৪৭-এ। তাছাড়া কলকাতার দাবি ছেড়ে দেবার জন্য ৩৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষমতায় আসেন । তিনি ওই টাকা গ্রহণ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তা দিয়ে ঢাকাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজধানী গড়ে তোলার কথা বলেন। সুতরাং কলকাতার দাবি মুসলিম লীগ তুলে নেয়।
পরে অবশ্য ৩৩ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি ভুয়ো হিসেবে প্রমাণিত হয়। Partition council-এর চেয়ারম্যান হিসাবে মাউন্টব্যাটেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, যেখানে কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে বল্লভভাই প্যাটেল ও এইচ এম প্যাটেল এবং লীগের সদস্য হিসাবে লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছিলেন। সেই ঘোষণায় কলকাতাকে লাহোরের পরিবর্তে ভারতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়। সুতরাং ক্ষতিপূরণের কোন প্রশ্ন ছিল না।
কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা ও অন্যান্যদের স্মারকলিপিতে সীমানা নির্ধারণের দাবিতে খুব একটা ফারাক দেখা যায় না। প্রধান সমস্যা দেখা দিয়েছিল ৪৬ শতাংশ জনগণের জন্য ৫৭ শতাংশ এলাকা দাবি করার প্রশ্নে। যা অতুল বাবু আইনের যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন নি। তার মনে হয়েছিল ওই দাবি আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। হিন্দু মহাসভার দাবি ছিল জমির উর্বরতা ও অনুর্বরতা বিচার করে এলাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। কিন্তু তারা আলাদা স্মারকলিপিতে সেই পরিমান এলাকা দাবি করেননি। তবুও তারা আলাদা হলেন।
স্পষ্টতই বাংলা ভাগের আন্দোলনে কংগ্রেস ছিল অগ্রণী অংশীদার। হিন্দু মহাসভার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তখন সহযোগিতার চেয়েও বেশি ছিল। মহাসভা ছাড়াই কংগ্রেস আলাদাভাবে বাংলা ভাগের আহ্বান জানিয়ে প্রচুর জনসভার আয়োজন করে । সবচেয়ে বড় জনসভা হয় বালিগঞ্জে। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন ড: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। যতদূর জানা যায় এই ধরনের ৭৬টি জনসভা আয়োজিত হয়েছিল । তার মধ্যে কংগ্রেস কমপক্ষে ৫৯ টি জনসভার আয়োজক ছিল । ১২ টি জনসভা হয়েছিল মহা সভার উদ্যোগে, আর ৫ টি জনসভা হয়েছিল যৌথ উদ্যোগে।
শেষ পর্যন্ত সীমানা ভাগ করে তার রিপোর্ট জমা দিলেন সিভিল রেডক্লিফ। তিনি জানতেন কোনো পক্ষকেই তিনি সন্তুষ্ট করতে পারবেন না । যে কাজ তিনি করছেন তার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি হবে । তবু তাকে সীমানা ভাগ করতে হলো। তিনি তার কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে গেলেন। এমনকি তার পারিশ্রমিকও তিনি গ্রহণ করেননি।
বাংলা প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়ে, বড় হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ জানল তার পায়ের তলার মাটি তার দেশ নয়। তাকে চলে যেতে হবে । চরৈবেতির আনন্দ সন্ধানে নয় - তার হৃদয়, আত্মা, চেতনা ছিন্ন করে চলে যেতে হবে সীমানার অন্যদিকে। যে নেতৃত্ব ১৯০৫ সালে মূলত কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় জীবনপণ লড়াইয়ের ময়দানে ছিল বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য, সেই নেতৃত্বই এখন নির্ধারণ করে ফেলেছে সীমানা। আর সেই রক্তমাখা সীমানার কাঁটাতার আজও প্রতি সকালে সূর্যের আলোয় তার ধারালো দাঁত পরিষ্কার করে নেয়।
কংগ্রেস দাবিপত্র
১) বর্ধমান ডিভিশন (সম্পূর্ণ)
২) প্রেসিডেন্সি ডিভিশন (বাদ যাবে- (ক) নদীয়া জেলার কুষ্ঠিয়া সাব ডিভিশনের গড়াই নদীর পূর্বের অংশ, যে অংশ সম্পূর্ণ আলফাডাঙ্গা থানা এবং মোহাম্মদপুর থানার অংশ। (খ) খুলনা জেলার দক্ষিণ পূর্বে মোরেলগঞ্জ এবং সরণখোলা থানা)
(যুক্ত হবে- (ক) রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানা (খ) বাকরগঞ্জ জেলার গৌরাণ্ডি, নাজিরপুর, স্বরূপকাটি এবং ঝালাকাটি থানা (গ) ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাব-ডিভিসন ও রাজৈর থানা)
৩) রাজশাহী ডিভিশন – (ক) দার্জিলিং জেলা (সম্পূর্ণ), (খ) জলপাইগুড়ি জেলা (সম্পূর্ণ) (গ) রংপুর জেলা - (যুক্ত হবে- শুধুমাত্র ডিমলা ও হাতীবান্ধা থানা এবং ভুরঙ্গমারী থানা; যেহেতু আসাম এবং ভারতীয় ইউনিয়নের সংযোগকারী রেললাইন, শিয়ালদা থেকে আসাম পর্যন্ত, এই থানার মধ্যে দিয়ে গেছে) (ঘ) দিনাজপুর জেলা (বাদ যাবে- খানসামা, চিরিরবান্দার, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী নবাবগঞ্জ, গোরাঘাট, পানি তোলা এবং পোর্সা থানা) (ঙ) মালদা জেলা- (বাদ যাবে- ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, নাচোল, এবং গোমস্তাপুর থানা), (চ) রাজশাহী জেলা-(যুক্ত হবে- শুধুমাত্র গঙ্গার দক্ষিণবর্তী বোয়ালিয়া থানা)
হিন্দু মহাসভা ও Indian Association, New Bengal Association এর দাবি পত্র
১) বর্ধমান ডিভিশন (সম্পূর্ণ)
২) প্রেসিডেন্সি ডিভিশন - (বাদ যাবে- (ক) খুলনা জেলার সরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ থানা (খ) খোকসা, কুমারখালির অংশ এবং নদীয়া জেলার কুষ্ঠিয়া থানা)
৩) রাজশাহী ডিভিশন- (ক) দিনাজপুর (বাদ যাবে- খানসামা, চিরিরবান্দার, ফুলবাড়ি, নবাবগঞ্জ, পার্বতিপুর, পোর্সা, পানিতোলা এবং গোরাঘাট থানা) (খ) রংপুর- (যুক্ত হবে- শুধুমাত্র ডিমলা, হাতীবান্ধা এবং ভুরঙ্গমারী থানা), (গ) রাজশাহী - (যুক্ত হবে শুধুমাত্র গোদাগাড়ি, রামপুর-বোয়ালিয়া থানা এবং পাবা থানার অংশ) , (ঘ) জলপাইগুড়ি জেলা (সম্পূর্ণ), (ঙ) দার্জিলিং জেলা (সম্পূর্ণ), (চ) মালদা জেলা (সম্পূর্ণ)
৪) ঢাকা ডিভিশন- (ক) গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশন, (খ) রাজৈর থানা এবং ফরিদপুর জেলার কালকিনি ও মাদারীপুর থানার অংশ), (গ) গৌরাণ্ডি, উজিরপুর, নাজিরপুর, স্বরূপকাটি, ঝালাকাটি, বানারিপাড়া, বাবুগঞ্জ থানা এবং বরিশাল-কোতোয়ালি, পিরোজপুর, নলচিতি এবং কাউখালি থানার অংশ)
তথ্যঋণঃ
১) সাতচল্লিশের ডায়েরি - নির্মল কুমার বসু (সম্পাদনা, অভীককুমার দে)
২) The Great Partition – The Making of India and Pakistan - Yasmin Khan
৩) The Partition of Bengal and Assam, 1932 -1947 – Contour of Freedom – Bidyut Chakrabarty
৪) বাংলা ভাগ হলো - জয়া চ্যাটার্জি
৫) মহাত্মা গান্ধী, কংগ্রেস ও ভারত ভাগ - দেবচন্দ্র ঝা।
প্রিয় বন্ধুরা,
আজ হলো শারীরিকভাবে অসমর্থ মানুষদের আন্তর্জাতিক দিবস।
হুইলচেয়ারে আটকানো শরীর, ৯০ শতাংশ শারীরিকভাবে অক্ষম, অধ্যাপক জি. এন. সাইবাবা ২০১৪ সাল থেকে আজও জেলে রয়েছেন।
কোনো প্রমাণাদি বা অপরাধকর্ম ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত হবার পর ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ থেকে নাগপুরের সেন্ট্রাল জেলের অ-মানুষিক ঠাণ্ডা জেলে থাকার দরুণ তাঁর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে।চোদ্দ মাস ধরে লম্বা লম্বা মুলতুবি ও বাদ-প্রতিবাদের পর, চিকিৎসার কারণে তাঁর জামিনের আবেদন ২০১৯ সালের ২৫শে মার্চ নাকচ হয়ে যায় বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের রায়ে।
ভারত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্রে (ICCPR), সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের অধিকার বিষয়ে আহূত অধিবেশনের (UNCRPD) এবং বন্দিদের চিকিৎসার জন্য জাতিপুঞ্জের ৭০/১৭৫ নং প্রস্তাবে সংবলিত ন্যূনতম আদর্শ ধারাসমূহে (যা নেলসন ম্যাণ্ডেলা রুলস বলে পরিচিত) একটি স্বাক্ষরদানকারী রাষ্ট্র। এই সব কটি ধারা সুনিশ্চিতভাবে বন্দিদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারের কথা বলে। নেলসন ম্যাণ্ডেলা রুলস নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করছে যে বন্দিদের স্বাস্থ্য বিষয়ে যত্ন নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং ওই ধরনের বন্দিরা ‘অবশ্যই সেই মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন ঠিক যেমনটা জনসমাজের অন্যান্যরা পেয়ে থাকেন’ কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই। এইটে আরো এই অধিকার দিচ্ছে যে, যেসব বন্দিদের বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা প্রয়োজন তাঁদের সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে হবে কিংবা হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে যখন সে ধরনের চিকিৎসা জেলখানায় পাওয়া যাচ্ছে না।
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের অধিকার আইন, ২০১৬ নির্দিষ্ট ভাবে নিশ্চয়তা প্রদান করে যে উপযুক্ত সরকার নিশ্চিত করে দেখবে যে, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষেরা অন্যান্যদের সঙ্গে সমভাবে সমতার অধিকার, মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের অধিকার, এবং তাঁর মূল্যবোধের প্রতি সম্মান পাওয়ার অধিকার পাচ্ছেন। পুনশ্চ, ৭(১) ধারা কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা প্রদান করছে ‘সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার’ এবং অন্তত ‘এই ধরনের ঘটনা পরিহার করার’ এবং নির্দেশ করছে ‘এই ধরনের ঘটনার যাঁরা শিকার তাঁদের উদ্ধার করার, রক্ষা করার ও পুনর্বাসিত করার’।
এতদিরিক্ত, জাতিপুঞ্জের বিশেষঞ্জরা যুক্তি দিয়ে অনুরোধ করেছেন ডঃ সাইবাবার শারীরিক কারণে মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং জানিয়েছেন যে ‘উপযুক্ত বন্দোবস্ত ছাড়া শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষদের আটক রাখা শুধু বৈষম্যসূচকই নয়, বরং এটাকে নিষ্ঠুরতা অথবা অত্যাচারই বলা যেতে পারে। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে নির্জন কারাবাস নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। এই ব্যবস্থায় অক্ষমতাসম্পন্ন বন্দিদের অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে’।
ভারতের মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট বহু মামলার ক্ষেত্রে এই মত ব্যক্ত করেছেন যে ‘স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নের অধিকার’ সংবিধানের ২১ ধারার একটি অপরিহার্য অংশ। পণ্ডিত পরমানন্দ কাটারা বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মামলায় (৪ সেক ২৮৬), সুপ্রিম কোর্ট এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে সংবিধানের ২১ ধারা রাষ্ট্রের ওপর এই দায়বদ্ধতা অর্পণ করে যে, জীবনের অধিকার রক্ষিত হবে।
বিচারাধীন বন্দি বা দণ্ডিত অপরাধী, যেই হোন না কেন, ভারতের সংবিধান তাঁর জীবনের অধিকারের প্রতি নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এই সমস্ত অধিকারগুলিকে অস্বীকার করা মানবাধিকার ও বন্দিদের অধিকারসমূহের খুব স্থূল ধরণের লঙ্ঘন। ঠিক যেমনটা আজ ডঃ সাইবাবার ক্ষেত্রে ঘটছে।
এই সমস্ত আইন ও বিধিসমূহ থাকা সত্ত্বেও ডঃ জি.এন. সাইবাবা জামিন পান নি। বর্তমানে তিনি এমন অবস্থায় আছেন যে দুজন লোকের সাহায্য ছাড়া তিনি এক পাও চলতে পারেন না এবং প্রায়ই চোখে অন্ধকার দেখেন। কোনো ধরনের চিকিৎসা না পাওয়ায় তাঁর সমস্ত ধরনের পীড়া ও অসুখগুলির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেগুলি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। নাগপুরের সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায় তাঁর শিরদাঁড়া ও বাঁ হাতের পেশিগুলির ক্ষয় আরো বেড়ে গেছে। তিনি দারুণ যন্ত্রণা এবং মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। আর তাঁর অবশিষ্ট প্রত্যঙ্গগুলি ক্রমেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। তাঁর পেট এক জায়গায় ভীতিপ্রদ রকমের ফুলে উঠেছে। সেখানে ঘনঘন সাংঘাতিক যন্ত্রণা হয় যেটার কোনো চিকিৎসাবিদ্যাসম্মত অনুসন্ধানই হয় নি। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়মিত যে ফিজিওথেরাপি তাঁর দরকার তা দিতে পারে না। সেখানকার প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর হুইলচেয়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সমস্ত ধরনের শারীরিক ও বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ডাক্তারি মতে সংকটাপন্ন রুগি হিসেবে জামিন পাওয়ার পরীক্ষায় সাইবাবা পাশ করতে পারেন নি।
সম্প্রতি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আমি সাইয়ের একটা চিঠি পেয়েছি। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ক্রমবিকাশমান পরিণতিতে আমি সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই যে চিঠিটি সাই আমাকে লিখেছে তা আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। আমি মনে করি এই চিঠি যে বার্তাকে ধরে রেখেছে তা শুধু আমার জন্যই নয়, প্রত্যেকের জন্যই অনুভব করার। আমি চেয়েছি আপনাদের সবার সঙ্গে এই অনুপ্রাণনা ভাগ করে নিতে।
প্রিয় বসন্থা,
আমি আমার রুগ্ন অবস্থার দরুণ লেখার ও পড়ার অবস্থায় নেই। আমার সমস্ত ধরনের অসুখগুলো বেড়ে গেছে এবং তীব্রতর হয়েছে চিকিৎসার অভাবে। আশা করিও না। তোমাকে আরও সক্রিয় থাকতেই হবে। নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেল না। বিস্তৃত ক্ষেত্রের মানুষজনের সঙ্গে তোমাকে মিশতে হবে। খুবই সৃষ্টিশীল ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠো। আমার মুক্তির জন্য তুমি যা করতে পারো তার সবটুকুই করো। আমাকে দেখ। কীভাবে আমি এত ধরনের অসুখ ও যন্ত্রণা নিয়ে এই বদ্ধ নিষ্ঠুর জেলখানার ভেতরে এখনও জ্যান্ত আছি, এখনও বেঁচে আছি। আমি সাধ্যমতো সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি এই সংকীর্ণ, পদে পদে নিয়ন্ত্রণমূলক জেলখানার গণ্ডীর মধ্যে। যে সামান্য ব্যায়াম আমি করতে পারি তা আমি প্রত্যেকদিন সকালে করছি। আমার নিজস্ব একটা নিয়ম অনুযায়ী আমি প্রতিদিন লেখাপড়া করি, গঠনমূলক চিন্তা করি এবং প্রতিদিন বাঁচি এই আশা নিয়ে যে হয়তো পরের দিনই আমি আমার স্বাধীনতা ফেরত পাবো। হাজার হোক, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি আমার সমাজের জন্য, আমার দেশের জন্য নিজের অবদান রেখেছি যদিও আমি একজন ৯০ শতাংশ অক্ষম মানুষ। আমি আমার নিজের জন্য কখনো বাঁচিনি। আমি জনগণের জন্য বেঁচেছি। যে মামলায় আমাকে মিথ্যে করে জড়ানো হয়েছে সেটি একটি রাজনৈতিক মামলা। এর মধ্যে কোনো অপরাধমূলক বিষয়বস্তু নেই; যদিও ওরা চেষ্টা করেছে আমার ওপর এরকম একটি মকদ্দমা চাপিয়ে দিতে।
তুমি ভাবোঃ আমরা যন্ত্রণা ভোগ করবো কেন? যদি তুমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাও এবং হতাশ হয়ে পড়ো, আমরা দুজনেই হেরে যাবো। আমাদের কোনো মতেই হেরে যাওয়া উচিৎ হবে না। তোমাকে সক্রিয় থাকতেই হবে। তোমার উচিৎ হবে সব সময়ে হাসা যেমন তুমি সারা জীবন হেসে এসেছো এই সেদিন আমার বন্দি হবার আগে এই অত্যাচার আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। তোমাকে সাহসী হতে হবে। তোমাকে গঠনমূলক চিন্তা করতে হবে। তুমি চিরকাল সৃষ্টিশীল ছিলে। আমরা যতদিন বাঁচি ততদিনই মৃত্যু আমাদের। এইটেই মনুষ্যজন্মের মানে। আমরা সৃষ্টিশীল কারণ আমরা মানুষের জন্য বাঁচি, শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের জন্য নয়।
ভালোবাসা নিও
ইতি তোমার ১৮.১০.২০১ সাই
(Page: 211–214)
Why do you fear my way so much?
Poems and Letters from Prison
G. N. Saibaba
Published in India by Speaking Tigers Books 2022
দুই ভাই। বয়সের ফারাক প্রায় পনেরো বছরের। বাবা মাষ্টারমশাই, সেই সূত্রে বাড়িতে প্রচুর বই। বড় ভাই পড়ে আর ভাবে। সে পড়ে নানা গল্প, আর ভাবে কোনোদিন সেও তেমন গল্প লিখবে। চেষ্টা করে, কিন্তু হয় না। মন মতো হয় না। ভাই তার বড়ো আদরের। বই পড়ায় মন নেই তার, সারাদিন খাতায় হিজিবিজি দাগ কাটে। বড়ো হয়ে কী হবে জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দেয়, পৃথিবীর একজন সেরা কার্টুনিষ্ট হবে।
কার্টুন? এই এঁদো জায়গায়? এই দেশে? ক’জন জানে কার্টুন?
জানাবো। আমিই জানাবো তাঁদের। বেশ প্রত্যয়ী উত্তর দেয় ভাই।
তবুও তো ভাইয়ের এক পথ আছে। কত কম বয়েস, সে এখনই ঠিক ক’রে নিয়েছে সে কী করবে। আর, অনেকটা বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে পথ পাচ্ছে না। যা লেখে মনমতো হয় না। যাও বা মনমতো হয়, ভাই নাকচ ক’রে দেয়। ভাইয়ের কথার দাম তার কাছে অনেক। এই ‘ডুডু’ বই না পড়লে কী হবে, দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই অনেকটা আলাদা, অনেকটা পরিণত। লেখাগুলো নিয়ে ভাইয়ের কাছে যায় আর ভাই মাথা নেড়ে ব’লে, হচ্ছে না।
- কী করলে হবে?
- আরও দেখতে হবে। আরও ‘অবসার্ভ’ করতে হবে তোমায়। ভাই জানায়।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে সে চলে আসে তাঁদের গাঁয়ের পুরোনো গীর্জার মাথায়। এ জায়গা তাঁর বড়ো প্রিয়। অনেকটা নিরিবিলি আর নিজের সাথে অনেকটা সময় কাটানো যায় এখানে এসে। এখানে এসে মাঝে মাঝেই সে বসে থাকে। হঠাৎ বাইরের দিকে চলে যায় তাঁর চোখ। তাঁদের গ্রাম প্রায় পুরোটাই দেখা যায় এখান থেকে। ওই তো দূরে নদী, এপাশে রেললাইন, ওদিকে জঙ্গল, ওদিকে বাড়িঘর। কত কতবার দেখেছে। কিন্তু আজ যেন শুধু গ্রাম নয়, তাঁর কাছে ধরা দিল গল্পের ‘প্লট’ হিসেবে। এই গ্রামকে নিয়েই সে লিখবে। এখনই ডুডু’কে কিছু বলবে না সে, আগে লিখুক কিছু। গীর্জার সেই ছাদের চুড়োয়, এক দেওয়ালে ইঁটরঙে লিখে দিল সে,
‘Past is gone, Present is fleeting, future is vague.’ নীচে লিখে দিল নিজের নাম। আর পেয়ে গেল, নিজের গল্পের চরিত্রের নাম। স্বামী।
অনেকটা লেখার পর একদিন ভয়ে ভয়ে দেখালো ভাইকে। বেশ মন দিয়ে পড়ে হাল্কা হেসে ভাই জানালো, হচ্ছে। কিন্তু এর সাথে কিছু ছবি দিতে হবে – তাহলে ব্যাপারটা জমবে আরও।
- কে এঁকে দেবে আমার লেখার জন্য?
- কেন? পৃথিবীর সেরা কার্টুনিষ্ট। মুচকি হেসে জানান দিল ভাই।
জন্ম নিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক গল্প – মালগুড়ি ডে’জ (Malgudi Days).
আলাদা করে আর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। পড়তে পড়তে অনেকটা আন্দাজ ক’রে নেওয়া যায় এই দুই ভাইদের। দাদা হলেন ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা লেখক আর.কে.নারায়ন‘স্বামী’ আর ভাই হলেন অন্যতম সেরা কার্টুনিষ্ট আর.কে.লক্ষ্মণ ।
আর. কে. লক্ষ্মণের পুরো নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ তাঁর জন্ম। তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনে, সেই সময়ের মাইসোরে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন রাশভারী; কাছের এক স্কুলের হেডমাষ্টার মশাই। ছয় ভাই আর দুই বোনের মধ্যে লক্ষ্মণ ছিলেন সবচেয়ে ছোটো।
বাবার সূত্রে বাড়িতে বইয়ের আনাগোনা লেগেই ছিল। দাদা নারায়ণ স্বামীকে যেমন টানত সেই বইয়ের গল্প, লক্ষ্মণকে প্রথম থেকেই টানত বইয়ের ইলাস্ট্রেশন। বাড়িতে আনাগোনা ছিল The Strand, Punch, Wide world –এর মতো পৃথিবীবিখ্যাত ম্যাগাজিনের। অনেক পরে তাঁর (প্রায়) আত্মজীবনী TheTunnel Of Time – এ লক্ষ্মণ বলছেন, বাবা ছিলেন এক আশ্চর্য জগতের মানুষ। আপাত রাশভারী এই মানুষটিকে কাজের জায়গায় সবাই সমীহ করেই, বলা ভালো এড়িয়েই চলত। অথচ এই মানুষটিই বাড়ি এসে ডুব দিতেন অগাধ বইয়ের জগতে। প্রবল নেশা ছিল কর্ণাটকী সঙ্গীতে। শিশুর মতো আনন্দ পেতেন। লক্ষ্মণ লিখছেন, অবাক হতাম এই ভেবে, একই বাড়িতে তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ পড়াশোনায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করছে আর কেউ ডাহা ‘ফেল’ করছে, এই অসম্ভব ‘হারমোনি’ তিনি সহজেই মেনে নিতেন।
দাদাদের মতো পড়াশোনায় অতটা ‘আগ্রহ’ না থাকলেও আগ্রহ ছিল নানারকম জিনিস সংগ্রহ করার। সে হয়তো গাছের পাতা, ফেলে দেওয়া বোতল বা ভাঙাচোরা সাইকেলের চেন। ছোটোবেলায় সেগুলোই ছিল তাঁর যক্ষের ধন। লাল-নীল-সবুজ এই রঙের জিনিসে আগ্রহ ছিল তাঁর প্রবল। রঙিন কাঁচ নিয়ে খেলতে খেলতে একদিন শুনে ফেলেছিলেন জানলার পাশ দিয়ে যাওয়া এক বুড়ো আধপাগল মানুষের কণ্ঠস্বর। যে বিড়বিড় ক’রে বলছিল, ‘To be young is very heaven, my boy, very heaven…’ . লক্ষ্মণ লিখছেন এই কথাগুলো তাঁকে চালিত করেছে বহু বছর। এক অসম্ভব পরিতৃপ্তি, শুদ্ধতা দিত। যদিও পরে জানতে পেরেছিলেন এই লাইনগুলো এক বিখ্যাত ইংরাজি কবিতার, তবু এই কথাগুলো মনে পড়লেই সেই আধখ্যাপা বুড়োর মুখ মনে পড়ত। মনের মধ্যে এই শৈশবকে আজীবন বহন করেছেন লক্ষ্মণ, আমরা তাঁর কাজের মধ্যে দেখতে পাই এই সারল্যকে।
সেই সারল্য কিন্তু নমনীয়তা নয়। পবিত্র রাগ আর প্রবল রসবোধ ছিল লক্ষ্মণের। তাঁর কাজ শুরুর দিকের সময়েও এই রসবোধ দেখতে পাই আমরা। সেসব অনেক পরের কথা অবশ্য। আপাত শান্ত, মিতভাষী, মুখে পাইপ ঝোলানো লক্ষ্মণকে দেখলে আন্দাজ করা শক্ত, এই মানুষটিই ছোটোবেলায় তাঁর পাড়া ক্রিকেট টীমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। স্বপ্নের মতো সুন্দর কেটে যাওয়া টাল খেতে পারত যখন তাঁর অল্প বয়েসেই বাবা চ’লে যান; স্ট্রোকে। কিন্তু দাদাসহ বাড়ির বড়রা আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। হাইস্কুলের পড়া শেষ করে যখন সুযোগ এলো, লক্ষ্মণ বেছে নিলেন তাঁর ছোটোবেলার স্বপ্নকে। ভর্তি হতে চাইলেন J. J. Institute of Applied Arts-এ। কিন্তু সেখানকার প্রধান জানালেন, সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম ‘talent’ দরকার, তা এই শিক্ষার্থীর নেই; ফলে বাতিল হ’লেন লক্ষ্মণ। পরে লক্ষ্মণ লিখছেন, এটা আশ্চর্যের কিছু নয়; কারণ যে ধরণের ভাবনা নিয়ে আমি এগোচ্ছিলাম তা ভারতবর্ষের মাটিতে নতুন ছিল। এবং স্বাভাবিকভাবেই এখানকার ‘talent’-এর নিক্তিতে তা ‘শূন্য’ ছিল।
লক্ষ্মণ এরপর ভর্তি হন মাইসোরের মহারাজা কলেজে। এর মধ্যে তিনি ‘স্বরাজ্য’ বা Blitz-এর মতো ম্যাগাজিনে ইলাস্ট্রেট করা শুরু করেছেন। কলেজে পড়তে পড়তে তাঁর দাদার (R. K. Narayan) লেখা গল্পের ইলাস্ট্রেট করা শুরু করলেন The Hindu তে। একই সঙ্গে চলছে ‘স্বতন্ত্র’তে তাঁর আঁকা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা। তখনও তেমনভাবে হাত পাকাননি লক্ষ্মণ, সবে দু-তিন বছর হ’ল বিভিন্ন ম্যাগাজিনে আঁকছেন। এই সময়েই তিনি এঁকে ফেললেন ‘হিন্দু কোড বিল’-এর সমর্থনে এক কার্টুন, যাতাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। হিন্দু কোড বিলের প্রস্তাব ছিল, ছেলেমেয়েদের বিয়ের বয়েস যথাক্রমে ন্যূনতম ১৮ এবং ১৫ বছর ; বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ; অসবর্ণ সিদ্ধ ; পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলে এবং মেয়ের সমানাধিকার এবং আরও অনেক কিছু। পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে-র প্রবন্ধ ‘সাত দশক’ থেকে আমরা জানতে পারি, এই বিরোধিতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু মহাসভা এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রবর্তিত জনসংঘ এবং আরও কিছু দল। লক্ষ্মণ তাঁর বাইশ বছর বয়েসে এই বিলের প্রস্তাবের সমর্থনে আঁকলেন এই ব্যঙ্গচিত্রটি। যেখানে নেহেরু গদি-আঁটা তোশক (হিন্দু কোড বিল) ‘অফার’ করছেন এক সাধুবাবাকে। এবং সাধুবাবা তা অস্বীকার করছেন, বলছেন, হাল ফ্যাশানের এই সব কিছুর বদলে তাঁর পুরোনো কণ্টকশয্যাই বেশ ভালো। পাশের বাচ্চা অবশ্য চেঁচাচ্ছে, বলাই বাহুল্য।
এখান থেকেই লক্ষ্মণের যাত্রাপথের এক মোটামুটি রেখরূপ আমরা পেয়ে যাই। সারাজীবনে লক্ষ্মণ বারবার ‘প্রতিবাদ’ করেছেন অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধান্দাবাজ নেতা-নেত্রীদের চালাকিকে। এক সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে বারবার দেখেছেন তাঁর ভারতবর্ষকে। যে সাধারণ মানুষের কোনো ধর্ম নেই, প্রবল পড়াশোনা নেই, পাণ্ডিত্য নেই, আছে শুধু সাদা চোখে সময়কে দেখার ক্ষমতা। একজন খুব সাধারণ মানুষের মতোই বোকা না হ’তে চাওয়ার মন। আর আছে প্রবল সাহস। আর এভাবেইজন্ম নিয়েছে ‘The common Man’।
এই কমনম্যানের শুরু থেকেই খড়্গহস্ত হয়েছেন লক্ষ্মণ। ১৯৫১ তে The Hindu তে তাঁর যোগদান এবং সেই সময় থেকেই তাঁর ভবিষ্যতের দীর্ঘ পথ চলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৫১ তে You said It-এর মধ্যে দিয়ে তাঁর কমন ম্যান বড়ো বড়ো পালের গোদাদের শায়েস্তা করেছেন – জবাই করেছেন। কখনও তা হয়ে উঠেছে ভারত পাকিস্তান অভিসন্ধিচুক্তি আবার কখনও বা ধর্মীয় মেরুকরণের রাষ্ট্রীয় চেষ্টার দালালদের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ উঠে আসছে নেতা-মন্ত্রীদের স্বাভাবিক ‘ঘুষ’ খাওয়ার প্রবৃত্তি নিয়ে; সরকারী কর্মচারীদের কাজ করার ‘কৌশল’ নিয়ে, বিভিন্ন পেশার (ডাক্তার,পুলিশ) ওপর উঠে আসা কালো দাগ নিয়ে। এবং এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নয়। রীতিমতো ধারাবাহিকভাবে, ‘সিরিজ’ হিসেবে উঠে আসছে। Common Man-এর এই দীর্ঘপথ যাত্রায় যা পরবর্তীকালে series হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে। কখনও Bye-Lateral Relations, Democracy on Death Row, Kucch Kucch Lo chahai, Netas in the Net, Sarkari Tarkari নামে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রে, বিভিন্ন সময়ে দেশের অধিকাংশ নেতা মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষের কাছে নিতান্ত উপহাসের পাত্র-পাত্রী। এর বেশী কিছু নয়। সাধারণ মানুষের মনের গভীরে এই অশিক্ষিত, চোর, ধান্দাবাজ নেতা মন্ত্রীদের জন্য কোনো সময়েই বিন্দুমাত্র সহানুভূতি সম্মান ছিল না,এখনও নেই। তাহলে যেটুকু রয়ে যায় তা কি ভয়? কিছুটা তাই। এবং এই ভয় নেতাদের গুণ্ডাগিরির ভয়, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অসহনীয় করে তোলার ভয়। একজন সাধারণ মানুষ জানেন, সত্যি কথা বলার জন্য– একজন ঘুষখোর নেতাকে চোর বলার জন্য তাঁর বাড়িতে বোম পড়বে। আমাদের মনে পড়ে ব্রেখটের গ্যালিলেওর কথা।
Unhappy is the land that breeds no hero!
No Andrea, Unhappy is the land that needs a hero.
আমাদের এই জীবনে, অসৎ মানুষদের নিয়ে ঘিরে থাকা জীবনে লক্ষ্মণ এসেছিলেন তাঁর ক্ষুরধার হিউমার নিয়ে। যে হিউমার দিয়ে তিনি পুষ্ট করেছিলেন আমাদের ভাবনাকে, সাহস জুগিয়েছিলেন। আবার অশিক্ষিত নেতা-মন্ত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই এই বুদ্ধিদীপ্ত হিউমারের অপমান বোঝার মতো শিক্ষিত নয়, অথবা বুঝতে পারলেও বারবার সেই হিউমারের কাছে পরাজিত হয়েছে।
The Tunnel of Time লক্ষ্মণের আত্মজীবনী। কার্টুনের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন The Hotel Riviera (1988) এবং The Messenger (1993)-এর মতো উপন্যাস। লিখেছেন নানা ছোটো গল্প আর ভ্রমণকাহিনী, যা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে The Distorted Mirror শিরোনামে। তাঁর সামগ্রিক জীবনের দিকে লক্ষ রাখলে আমরা দেখতে পাই, লক্ষ্মণ সারাজীবন ধরে যে ভাবনার চর্চা করেছেন তা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর চর্চাকে, চেতনাকে। সুখের কথা, আমাদের এই হারিয়ে ফেলার দেশে,তাঁর অসংখ্য কাজ – কার্টুন সংরক্ষিত হয়েছে দু’মলাটে। A vote for laughter, A Dose of Laughter, Laugh with Laxman বা Common man-এর সাথে তাঁর বিখ্যাত কাজ An Uncommon Man নামে সংকলিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে লক্ষ্মণই একমাত্র কার্টুনিস্ট যার তৈরি Common Man এর ৮.২ ফুটের ব্রোঞ্জের মূর্তি বসেছে পুনেতে। Times of India-র ১৫০ বছর পূর্তিতে ১৯৮৮ সালে, Common Man-এর পোস্টাল স্ট্যাম্প বের করা হয় Indian Postal Department-এর তরফে। ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করা হয় আর.কে.লক্ষ্মণকে।
২০১৫ সালে, প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৩ বছর বয়সে লক্ষ্মণ চলে যান।
২০২১ সাল আর. কে. লক্ষ্মণের জন্মশতবর্ষ গেল। অনেকটাই নিস্প্রভ। অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাসে যার অবদান প্রবলভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের রাজনীতিকে এবং সমাজকে যিনি বারবার ‘আঘাত’ করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে। এক উন্নত ঋজু মানুষ, যিনি কখনও আপোষ করেননি, অথচ আপোষ করলে যে মানুষটা সব কিছু পেত, আমাদের এই হতদরিদ্র সময়ে আমরা একজন লক্ষ্মণকে পেয়েছিলাম অথচ তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। আমাদের এই সময়ে বড্ড প্রয়োজন লক্ষ্মণকে। প্রয়োজন লক্ষ্মণের প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের সময়ের এক অন্যতম কার্টুনিস্ট শুধু নন, এক অসাধারণ চিন্তাবিদের নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ।
শুধু নেতা মন্ত্রীরা নয়, লক্ষ্মণের কলমে উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের দ্বিচারিতার কথা; না-পাল্টানো অসহায় অভ্যাসের কথা। নোংরা হাসপাতাল করিডোরে দাঁড়িয়ে দু’জন সাধারণ মানুষ এই নোংরা অবস্থার জন্য দোষারোপ করছে আর তাঁর পরপরই পানের পিক ফেলছে সেই করিডোরে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের নামে যে ভণ্ডামি এবং শ্রেণিবিভাজন, একেও তাঁর হিউমারে তুলে আনছেন। ব্যক্তিগত মতে এর পিছনে The Hindu-র দায় অনেকখানি। প্রায় প্রতিদিন লক্ষ্মণকে তুলে আনতে হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। ফলে নিজের ক্ষেত্রের মধ্যে থেকেই সমাজের খুঁটিনাটি ঘটনাকেও বিষয় করে তুলছেন লক্ষ্মণ। আবার কখনও নির্মল হাস্যরস, আনন্দ হয়ে উঠছে তাঁর আঁকার বিষয়।
সঙ্গীত যেমন এক non-verbal medium, ঠিক তেমনই কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র। সেই কার্টুনের মধ্যে যেমন প্রচ্ছন্ন মজা আছে, কখনও আছে এতো তীব্র আঘাত, সেই আঘাতে নিজেরাই অসহায় হয়ে পড়েছি। সেই ছবির অভিঘাত লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তার জন্য আমাদের ফিরে ফিরে যেতে হবে লক্ষ্মণের কাছে, লক্ষ্মণের কাজের কাছে। লক্ষ্মণ তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ঘরানা তৈরি করেছিলেন। করেছিলেন দেখার এবং দেখানোর এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গী। তার প্রখরতা কেমন তা আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি একটা ঘটনায়। ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কার্টুনিস্ট স্যার ডেভিড লো সস্ত্রীক যাচ্ছিলেন হংকং-এ। প্লেনের ম্যাগাজিনে এক কার্টুন দেখে, তিনি নেমে পড়েন মুম্বাইয়ে; ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে আসেন সেই ম্যাগাজিনের দপ্তরে, কার্টুনিস্টের সাথে দেখা করার জন্য। লক্ষ্মণের বয়েস তখন ৩১। পৃথিবী বিখ্যাত এক কার্টুনিস্ট কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই একটা মাত্র কার্টুন দেখে চলে আসেন ভারতের মতো হতদরিদ্র দেশের এক অখ্যাত কার্টুনিস্টের সাথে দেখা করার জন্য !
The Tunnel of Time লক্ষ্মণের আত্মজীবনী। কার্টুনের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন The Hotel Riviera (1988) এবং The Messenger (1993)-এর মতো উপন্যাস। লিখেছেন নানা ছোটো গল্প আর ভ্রমণকাহিনী, যা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে The Distorted Mirror শিরোনামে। তাঁর সামগ্রিক জীবনের দিকে লক্ষ রাখলে আমরা দেখতে পাই, লক্ষ্মণ সারাজীবন ধরে যে ভাবনার চর্চা করেছেন তা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর চর্চাকে, চেতনাকে। সুখের কথা, আমাদের এই হারিয়ে ফেলার দেশে, তাঁর অসংখ্য কাজ – কার্টুন সংরক্ষিত হয়েছে দু’মলাটে। A vote for laughter, A Dose of Laughter, Laugh with Laxman বা Common man-এর সাথে তাঁর বিখ্যাত কাজ An Uncommon Man নামে সংকলিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে লক্ষ্মণই একমাত্র কার্টুনিস্ট যার তৈরি Common Man এর ৮.২ ফুটের ব্রোঞ্জের মূর্তি বসেছে পুনেতে। Times of India-র ১৫০ বছর পূর্তিতে ১৯৮৮ সালে, Common Man-এর পোস্টাল স্ট্যাম্প বের করা হয় Indian Postal Department-এর তরফে। ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করা হয় আর.কে.লক্ষ্মণকে।
২০১৫ সালে, প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৩ বছর বয়সে লক্ষ্মণ চলে যান।
২০২১ সাল আর. কে. লক্ষ্মণের জন্মশতবর্ষ গেল। অনেকটাই নিস্প্রভ। অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাসে যার অবদান প্রবলভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের রাজনীতিকে এবং সমাজকে যিনি বারবার ‘আঘাত’ করেছেন তাঁর কলমের আঁচড়ে। এক উন্নত ঋজু মানুষ, যিনি কখনও আপোষ করেননি, অথচ আপোষ করলে যে মানুষটা সব কিছু পেত, আমাদের এই হতদরিদ্র সময়ে আমরা একজন লক্ষ্মণকে পেয়েছিলাম অথচ তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। আমাদের এই সময়ে বড্ড প্রয়োজন লক্ষ্মণকে। প্রয়োজন লক্ষ্মণের প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের সময়ের এক অন্যতম কার্টুনিস্ট শুধু নন, এক অসাধারণ চিন্তাবিদের নাম রশীপুরম কৃষ্ণস্বামী লক্ষ্মণ।
কেন সিধু করেছ লহুতে স্নান?
কানু কেন হাঁকো হুল হুল… ?
বেপারী চোরের জন্য
যারা লুটেছে মোদের দেশ
(William Archer সংগৃহীত সাঁওতাল বিদ্রোহের গান।)
আশ্বিন মাসেও নদীতে জল বেশ কম, বালি আর কালো কালো ব্যাসল্ট পাথরের মাঝখান দিয়ে চওড়া জলের ধারা বয়ে চলেছে, নদীর দুই পাড়ে বড় বড় গাছ, এই দুপুরেও নদীতে হাল্কা ছায়া। বাসটা নদীর উপর সরু ব্রিজটা পেরিয়ে একটু আগে গিয়ে বাজারের আগে বাঁদিকের স্ট্যান্ডে ধুলো উড়িয়ে দাঁড়াল, ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমি বাস থেকে নামলাম, নতুন জায়গা। রাস্তাটা একটু এঁকে বেঁকে উত্তরে চলে গেছে লিটিপাড়া হয়ে সাহিবগঞ্জের দিকে। বাজারটা গড়ে উঠেছে চওড়া রাস্তার দুপাশে। বাঁশলোই নদী পশ্চিম থেকে পুবে, রাজমহল পাহাড়ের মাঝ বরাবর চলে গিয়ে গঙ্গায় মিশেছে। আমড়াপাড়া তারই ধারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা বড় গঞ্জ। রাজমহল পাহাড়ে জীবাশ্ম গবেষণার কাজে এখানে আসা, জিওলজি পড়তে গিয়ে এরকম অচেনা অজানা ভারতবর্ষে পৌঁছে যাই বারবার। জানতাম আমড়াপাড়াই ক্যম্প করার জন্য সুবিধাজনক তাই এখানে আসা। বেলা হয়েছে, বেশিরভাগ দোকানে আদিবাসীরাই খদ্দের। বাজার বেশ ফাঁকা, বুঝলাম সকালে ভিড় বেশি ছিল বেলায় অনেকেই গ্রামে ফিরেছে। আদিবাসী মানুষজন দেখলে বোঝা যায় যে এই দিকের আদিবাসী পরিবারগুলির অবস্থা বেশ খারাপ।
ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোট খাবারের দোকানে চা আর পকোড়া খেতে খেতে বাজারের লোকজন দেখছিলাম। রংচটা ময়লা প্যান্ট পরা একটা সাঁওতাল ছেলে টেবিল সাফ করছিল দোকানে, ফরসা গোলগাল চেহারার মালিক ক্যাশ গুনছিল কাউন্টারে। ভাবলাম আজ এখানে একটা থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলে ব্যাগ কাঁধে চারটার বাসে পাকুড় ফিরতে হবে, তাই কথা জমাতে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলাম এখান থেকে নিপানিয়া, কুমারভজা, নুনপাড়া এইসব জায়গা কতদূর? সে মুখ তুলে বলল আমড়াপাড়া থেকে ২০-২৫ কিমি এর মধ্যেই হবে কিন্তু গ্রামগুলো বড় রাস্তা থেকে অনেক ভিতরে, আর সেখানে যাবার কোন বাস বা অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। রাস্তা ভালো, মোটর সাইকেলে যেতে হবে বা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। থাকার হোটেলের কথা জিজ্ঞাসা করায় বলল এখানে তো পাকুড়ের মতো কোন হোটেল পাবেন না। তারপর একটু ভেবে বলল ঐ বট গাছের নীচে শিব মন্দিরের সামনের ধরমশালায় থাকার জায়গা হতে পারে, কিন্তু আপনি শহরের লোক ওখানে কি থাকতে পারবেন? আমি হাতে চাঁদ পেলাম, তার কাছ থেকে গেলাম পুরানো ধরমশালায়, সেখানে সহজেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। বড় ঘর, ঘরে একটা শোবার তক্তা আর তোশকের উপর চাদর আর বালিশ ছাড়া আর কিছু নেই। ধরমশালা লাগোয়া দুটো বাথরুম পাশপাশি, একটু দূরে তাদের সামনে একটা বাঁধানো কুয়ো, বুঝলাম ওখানেই স্নানের ব্যাবস্থা।
মধ্যবয়স্ক হরিরাম পাণ্ডে ধরমশালার দেখাশোনা করে, কথা বলতে ভালোবাসে। কথায় কথায় সে জানাল তারা কয়েক পুরুষ আগে এসেছে আর ধরমশালার পিছনের পাড়ায় তার বাড়ি, বাজারে তার ছেলে ছোট মুদিখানার দোকান চালায়। আমড়াপাড়ার কথা উঠতেই হরিরাম এখানকার ইতিহাস শুরু করে, এদিকের জঙ্গলে সাহেবরা নাকি আসে দুশো বছরেরও বেশি আগে তখন এই অঞ্চলে কেবল পাহাড়িয়ারা রাজমহল পাহাড়ের উপরে বাস করত, তারা সাহেবদের ভয় পেত না, কোন চাষবাসও করত না, খাজনাও দিত না, সাহেবরা ওদের ভয় পেত। সাহেবরাই নাকি আশেপাশের বীরভূম দুমকা থেকে সাঁওতালদের নিয়ে এসে বসিয়েছিল, সেই জন্তু জানোয়ার ভর্তি ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি করার জন্য। এর সঙ্গে বেশি কথা চালালে বাকি সব কাজ বন্ধ তবে এটা বুঝলাম যে আমাকে খাবার ব্যবস্থা নিজে করতে হবে সে কোন সাহায্য করতে পারবে না।
একটু গুছিয়ে, চান টান করে বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য ডুবছে, পাহাড়ের ওপরের জঙ্গল পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় ঝলমল করছে, দূরে আবছা ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ছায়া দিগন্তে ভেসে। ভাবলাম একটু ঘুরে সকালের খাবারের দোকানে চা খেতে যাব। আমাকে বেরোতে দেখে হরিরামও সঙ্গ ধরল। যেতে যেতে ওকে সাঁওতালরদের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল এদিকের আদিবাসীরা খুব গরীব। দুবেলা খাবার পয়সা নেই। ওদের রোজগার তো চাষ থেকে আর চাষ তো বর্ষার বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। বর্ষায় পানী পড়লে আদিবাসীদের কিছু রোজগার হল, না হলে অবস্থা খারাপ। বছর বছর এখানকার সব গ্রাম থেকে কত আদিবাসী কাজের খোঁজে বাইরে যাচ্ছে। আমি বললাম হ্যাঁ, চাষের সময় বাংলায় সাঁওতালরা অনেকদিন থেকে যায়। হরিরাম হেসে বলল এখন বাংলা ছাড়াও এরা সব যায় গুরগাঁও, ফরিদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাইয়ে ঠিকাদারের লেবার হিসাবে। আর বলবেন না এদিকে তো এখন লেবার পাওয়া মুশকিল। আমার মনে পড়ল পাকুড় স্টেশনের ছবি - মাথায় বস্তা নিয়ে, কোলে বাচ্ছা নিয়ে মা পিছনে হাঁটছিল সামনে মাথায় বস্তা নিয়ে বাবা, হয়ত কোথাও থেকে তারাও ফিরছিল।
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা ধরে পাহাড়ের দিকটায় গিয়ে দেখলাম রাস্তার দুই পাশে বেশ কিছু বড় ট্রাক আর ডাম্পার দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বড়ো গাড়ি আর টায়ার সারানোর গুমটি, মোটর পার্টসের দোকান। একটা চওড়া রাস্তা আমড়াপাড়া লিটিপাড়ার রাস্তাকে কেটে পুব পশ্চিমে চলে গেছে। হরিরাম বলল ‘আর বলবেন না কয়লার খাদানের জন্য আমড়াপাড়া শেষ হয়ে গেল, আমড়াপাড়ায় এখন কেবল কয়লার ধুলো, ট্রাক আর ঠিকাদার। আমি তো এখানে জন্মেছি, আগে বাঁশলোই-এর জল ছিল কাঁচের মতো পরিষ্কার, আমরা ঐ জল কত খেয়েছি, এখন সেই জল কালো হয়ে আসছে, তার সঙ্গে শুরু হয়েছে নদী থেকে বালি তোলা। আগে চারিদিকে কত গাছপালা, ফলের গাছ, তখন গরমের সময়ও গরম লাগত না, এখন গরমের সময় এখানে থাকা মুশকিল’ বলে সে চুপ করল। হয়ত অতীতের দিনের কথা ভাবছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল ‘এই সাঁওতাল পরগনা আর রাজমহল পাহাড় সব শেষ হয়ে গেল খাদানে। যবে থেকে আলুবেড়ার কয়লা খাদান শুরু হোল, সারা দিন গোঁ গোঁ করে ট্রাক চলছে আর চারিদিক কালো ধুলোয় ভরে আছে।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এতো কয়লার খনি তো এ দিকে নেই।’ সে হেসে বলল ‘কয়লা তো এই ক বছর শুরু হল। কিন্তু পাথর খাদান? সেই সাহেবগঞ্জ থেকে দুমকা পর্যন্ত কেবল পাথর খাদান, পুরো ভারতবর্ষের রাস্তা আর বাড়ি তৈরির গিট্টি পাথর আর লেবার এখান থেকে যায়, কয়েক বছর পর এদিকে কোন বড় পাহাড় আর আপনি দেখতে পাবেন না। এদিকার যত বাঙালি আর বিহারি ঠিকাদার পয়সা করছে ঐ পাথর আর কয়লা খাদান থেকে। ঐ যে আমড়াপাড়ার বনোয়ারি ভগত, বাজারে তিনতলা বাড়ী, সে আগে ফরেস্টের ঠিকাদার ছিল এখন কয়লা খাদানের মজুরের ঠিকাদারি আর পাথর খাদান করে কোটিপতি। আমি তাকে হাঁটতে হাঁটতে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জিজ্ঞাসা করি। সে একটু থমকায়, বলে আমড়াপাড়া নিয়ে সে সব অনেক গল্প কথা আছে, বেশিরভাগই মনগড়া। ঐ তো বনোয়ারিরা বহুদিন থেকে এখনকার বাসিন্দা, ওদের পরিবার নিয়েই তো নানা সত্যি মিথ্যা কাহিনী আছে।
সন্ধ্যে নামছে, সামনে সারি দিয়ে কয়লার ট্রাক চলছে, কালো ধুলো, বিরক্ত হয়ে ফিরে চললাম খাবার দোকানের দিকে, ফেরার পথে হরিরাম ওর বাড়ির পথ ধরল। দোকানে বিকালে খুবই অল্প ভিড়, দোকানদার একা আমাকে দেখে হাসল, জিজ্ঞাসা করল স্যার জায়গা পেয়েছেন? আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম, বলল কেমন লাগছে? আমি বললাম ঠিকই আছে। ওর দোকানে একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে কিছু খাচ্ছিল, কালো চাপা চেহারা, পরনে একটু ময়লা প্যান্ট শার্ট, একমাথা এলোমেলো রুক্ষ চুল। সে ওর কথা শুনে একবার আমার দিকে তাকাল, পরিষ্কার ঝকঝকে দৃষ্টি, বিহারি বা বাঙালি নয় আদিবাসী চেহারা।
ওকে দেখে মনে পড়ে গেল ফিল্ড গাইডের কথা, দোকানদারকে বলতেই সে ছেলেটাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলো কি রে সিংরাই তোর বাড়িতো কুঞ্জবোনার দিকে, ওখানে কেউ আছে নাকি? সে খুব ঠাণ্ডা গলায় সাঁওতালী ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করল। দোকানদার বলল, ও জিজ্ঞাসা করছে কি কাজ আর কতো টাকা দেবে। সে সব কথা বলতেই কি ভেবে সাঁওতালীতে কি একটা বলে হেঁটে দোকান থেকে বেরিয়ে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিলো। দোকানদার গজগজ করতে করতে বলল খেতে পায়না কিন্তু কী মেজাজ দেখছেন, বলছে ‘ভাবছি, কাল জানাবো’। যেদিন থেকে ঝাড়খণ্ড আলাদা হোল আর আদিবাসীদের সরকার তৈরি হয়েছে সেদিন থেকে এরা নিজেদের রাজা ভাবছে। ধীরে ধীরে সন্ধে নামছে, ছোটদিনের বেলা, নিজের আস্তানায় ফিরছিলাম। সময় কম, কাল সকাল সকাল ফিল্ডে বেরোতে হবে, ভাবছিলাম স্থানীয় কোন আদিবাসীকে ধরতে হবে, ভাবতে ভাবতেই সিংরাই-এর মুখটা মনে পড়ল।
দুই
সূর্য পশ্চিমে ঢলছে। বাড়ির বাইরে বড় অশ্বথ গাছটার নিচে ছোট বড় নানা আকারের ধান আর আনাজ মাপার বাঁশের ধামা সাজানো রাখা আছে, তার পাশের একটা কাঠের তক্তার উপর কেনারাম বসে হুঁকোয় মৌতাত করে টান দিচ্ছে। শীত পড়তে শুরু করেছে। এই জঙ্গল ভর্তি পাহাড়ি অঞ্চলে শীত একটু বেশিই পড়ে। ভাই বেচারাম গেছে তাদের কামিয়া শিবু মুরমুকে নিয়ে বাঁশলোই নদীর ধার থেকে গরুগুলোকে নিয়ে আসতে, বড় বাঘ না এলেও নেকড়ের ভয় আছে। তা ছাড়া এই সময় ভালুও চলে আসে নদীতে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তাদের আমড়াপাড়ায় বসতি করার, আগে এই অঞ্চলে রাত্রে বাঘের ভয় ছিল খুব।
বছর পঁচিশ আগে কেনারাম, বেচারাম আর তাদের জ্ঞাতি গনেশ ছেলে বউ আত্মীয় স্বজন নিয়ে পালিয়ে এসে এখানে ঘন জঙ্গলের ভিতরে আমড়াপাড়ায় নদীর কাছে রাস্তার পাশের বড় একটা পুকুর পাড়ে বসতি করে। তবে এটা সম্ভব হয়েছিল ভানু সোরেনের জন্য, সে তখন থাকত পুকুরের অন্য পাড়ে জঙ্গলের দিকটায়। ভানুরা আদিবাসী, সাঁওতাল, ওর বাবা এখানে পালিয়ে এসেছিল। ওরা আসারও বছর কুড়ি আগে ইংরাজি সন ১৮১০ নাগাদ সিউড়ি থেকে সেখানকার বাঙালি জমিদারের অত্যাচারে। তারাই প্রথম আমড়াপাড়ায় জঙ্গল কেটে গ্রাম বসাতে শুরু করে। সেই সময় এদিকে কেবল ঘন জঙ্গল, জঙ্গলে হাতি, বাঘ, নেকড়ে সবই ছিল, তার মধ্যে দু একটা সাঁওতাল গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কেনারাম হুঁকোয় টান দিতে দিতে ভাবে সাঁওতালরা খুব পরিশ্রমী, এই কয়েক বছরেই বারহাইত থেকে দুমকা পর্যন্ত আশপাশের জঙ্গল সাফ করে জায়গাটাকেই বদলে দিয়েছে। সারাদিন কাজ করে, তারপর ওদের বাঁশুরি, তিরিওয়াতে বাজায় আর রাতে মহুয়া খেয়ে মরদ মেয়েতে নাচে। কিন্তু লোকগুলো খুব বোকা, হিসেব জানে না। সারা বছর মাঠে এতো খেটেও ওদের ঘরে কিছু থাকে না, লেখাপড়াও জানে না, কাগজপত্র বোঝে না, সেইজন্যই তো তার মতো মহাজনদের কারবার রমরমিয়ে উঠেছে।
কেনারামের মনে পড়ে বক্সারের কাছে বাশুলি গ্রাম থেকে সেখানকার রাজপুত জমিদারের ছেলের ভয়ানক অত্যাচারের কথা। যেদিন ঐ বদমাস কুমার বাহাদুর ওর প্রতিবেশী হরিপ্রসাদ চৌবের সুন্দরী বোন কুমুদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যায় সেই রাতেই কেনারামরা সবাই ভয়ে পরিবার নিয়ে ঘর ছাড়ে। ওর এক চাচাতো ভাই ভাগলপুরে পন্টে সাহেবের সঙ্গে কাজ করত, সে সাহেবের সেরেস্তায় শুনেছিল যে সাহেবরা নাকি পাকুরের জঙ্গলে রাজ্য বসাচ্ছে, সবটাই থাকবে সাহেবদের কব্জায়, একে ওরা বলে দামিনি, এখানে কোন জমিদারের ঝামেলা নেই। তার কথায় ওরা এদিকে পালিয়ে আসে, ওদের দেখাদেখি ওদের আশপাশের গ্রামের আরো চার পাঁচ ঘর জমিদারের অত্যাচারে এদিকে চলে আসে। পরে ও জেনেছে দামিনির আশপাশে ওদের মতো অনেক উঁচু বর্ণের বিহারি আর বাঙালি পরিবার হয় ভয়ে না হলে নতুন জায়গায় পয়সার লোভে এই অঞ্চলের নানা গ্রামে আস্তানা গেড়েছে তাদের মতো।
এখন আমড়াপাড়ায় অনেক বাড়ি, দেখতে দেখতে এখন সাঁওতাল নিয়ে ষাট সত্তর ঘর লোকের বাস। মহাজনি করে কেনারাম এখন এই তল্লাটে সব থেকে ধনী ব্যাক্তি, তদের অনেক জমি, গরু বাছুর আর সোনা রুপোও কম নেই। হবে নাই বা কেন, সাঁওতালদের ষোল আনা আসলে ও সুদ নেয় চব্বিশ আনা। ওইতো বাড়ির পাশের দেওয়ালের ধারে হাড় বার করা ভানুর নাতি ভিগু, খালি শুকনো মকাই-এর ফল থেকে বসে বসে একমনে হাতে ঘসে ঘসে মকাই ছাড়াচ্ছে, হাতে কড়া পড়ে গেছে। ভানু ওর কাছ থেকে ১৫ বছর আগে ধার নিয়েছিল দু’টাকা আর সে ধার আজও শোধ হয় নি। সে কবেই মরে গেছে তার জমি জায়গা সবই কেনারামের কব্জায়, সুদের টাকাও কম পায়নি, ওদের পরিবার এখন কেনারাম বেচারামের সারা জীবনের বাঁধা লোক, কামিয়া। গত বছর ভানুর ছেলে লখনও মরল জ্বরে, এখন নাতি ভিগুটাই বেঁচে আছে। আর কেনারাম করবে নাই বা কেন মহেশপুরে, পাকুড়ে, বারহাইতে ওর মতো যতো মহাজন বা বানিয়া বেপারি এসেছিল সবাই প্রচুর পয়সা কামিয়েছে।
এইতো তার গাঁ সম্পর্কের ভাই রামশরন পেয়াদার নোকরি করে সাহেবেদের কাছের লোক হয়েছে। রামশরনই তো খাজানা আদায় করে বড়লোক হয়ে গেল। সাহেবদের খাজনা এক পয়সা হলে রামশরন সাঁওতালদের কাছ থেকে তিন পয়সা নেয়। সাহেবরাও খুশী, আগে তো এখান থেকে কোন খাজনাই পেত না এখন হাজার হাজার টাকা খাজনা পায়। দিঘির দারোগা মহেশ দত্তকে এ তল্লাটে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়, সে কেনারামের খুব কাছের লোক। রামশরনও ওর কথার বাইরে যায় না। সাহেবরা অবশ্য এদিকে কম আসে, জমিদারও নাই তাই কেনারামই এদিককার মুরুব্বি। দারোগা আমড়াপাড়া এলে ওদের বাড়িতেই থাকে, তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে, মহুয়া পান করে বটে লোকটা, কিন্তু তার নজর কেবল কামিয়া সাঁওতাল মেয়েদের দিকে। কেনারাম অবশ্য দারোগার প্রস্তাবে কোনদিন রাজি হয়নি। এখনো সে কোন কামিয়াকে রাতে ওর কাছে পাঠায়নি, ওর কানে পঁচিশ বছর আগের কুমুদের কান্না আর চিৎকার ভেসে আসে।
হুঁকোয় একটা বড় টান দিতে গিয়ে দেখল আগুন নিবে গেছে। সে চেঁচিয়ে ভিগুকে বলল আগুন আনতে। ও যদিও নিচু জাত বলে সাঁওতালদের ছোঁয়া খায় না কিন্তু আগুনে দোষ নাই। ওদিক থেকে বেচারাম আসছে, কামিয়া শিবু গরুগুলোকে পিছনের গোয়ালে নিয়ে গেল। হুঁকোয় আগুন এসে গেছে, বেচারাম এসে দাদার পাশে বসে বলে ‘ও পাড়ার দুলিয়ার স্বামীটা তো মরেছে সাপের কামড়ে। ও নদীতে এসে পায়ে ধরছিল ধান না নেবার জন্য, ওর ছেলে মেয়েরা না খেয়ে মরবে’। কেনারাম হুঁকোয় লম্বা টান দিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি বল? বেচারাম সব সময় দাদার কথা শুনে চলে, সে কোন কথা বলে না, সে জানে মেয়েদের ব্যাপারে দাদা দুর্বল, কেবল বলল এখনকি জমি নেওয়া ঠিক হবে। কেনারাম ওর ভয়টা ধরতে পেরে বলল ‘এমনি এমনি একশ বিঘা ঝোরার ধারের ভাল জমি হয়নি! সাঁওতালদের কাছ থেকে কব্জা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আমার অত কাছের লোক ভানুকে ছাড়িনি তো দুলিয়াকে?’ বেচারাম চুপ করে থাকে। কেনারাম জিজ্ঞাসা করে সাহেবদের আসার কোন খবর পেয়েছ? ভাই ঘাড় নাড়ে, কেনারাম আদেশ করে রামশরনকে জিজ্ঞাসা কর। সব ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে, পন্টে সাহেব গতবার খুব একটা খুশী হয়নি, এবারের ব্যবস্থা ঠিক হওয়া চাই। হাওয়া খুব একটা ভাল নয় ওরাই এখন দেশের মালিক, ওদের হাতে রাখতে হবে।
তারপর দুজনেই চুপ। ও জানে আজ বেচারাম কেন ও কথা বলল কারণ কিছুদিন ধরেই দুই ভাই লক্ষ্য করছে আদিবাসীদের হাবভাব ভালো নয়, সাঁওতালদের মধ্যে একটা কেমন একরোখা ভাব। সে খবর পেয়েছে বারাইতে সাঁওতালরা জমায়েত হয়েছিল কিছু দিন আগে। আজকাল মাঝে মাঝে সাঁওতালদের তিরিয়াওতের আওয়াজও কেমন যেন আলাদা শোনায়, আশেপাশের পাহাড়ে ধামসা মাদল বেজে ওঠে। গেল মাসে যখন দারোগা মহেশ দত্ত এসেছিল তখন তার কথায়ও ওরা বুঝেছিল সাঁওতালরা আর আগের মতো নেই। কেনারাম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল বৈজুলের কিছু ব্যবস্থা করা যাবে? দারোগা বলল ঐ শালাকে ধরব আগে এদিকটা সামলাই, সাঁওতালদের খুব বাড় বেড়েছে ওরা নাকি সাহেবদের সঙ্গে ভাগলপুরে দেখা করতে গিয়েছিল মহাজন আর নায়েব দারোগার অত্যাচারের বিচার চাইতে। বারহাইত, লিঠিপাড়া, মহেশপুরের সাঁওতালরাই বেশি লাফাচ্ছে। দারোগা গজরাতে গজরাতে বলেছিল শালাদের জুতিয়ে লম্বা করতে হয়, ভালো করে কথা বলতে পারে না, আর গেছে সাহেবের কাছে নালিশ করতে। কেনারাম চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘আমড়াপাড়ার কেউ ছিল নাকি?’ দারোগা বলল ‘না’।
তিন
পরের দিন সকালে দেখি মোটরসাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে সিংরাই দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম ও আমার সঙ্গে যাবে। আমিও সুযোগ হারাতে চাইলাম না পয়সার কথা সেরে উঠে পড়লাম ওর মোটরসাইকেলে। যেতে যেতে সে খুটিয়ে আমার কাজের ব্যাপারে খবর নিয়ে যেন নিশ্চিত হয় যে আমি এখানে কয়লার খোঁজে আসিনি। মোটরসাইকেল চলল রাস্তা ধরে আমড়াপাড়ার পাশের জঙ্গল ঢাকা পাহাড়টা ফেলে। দুপাশে ধানের ক্ষেত দু-একটা নেড়া টিলা পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। দুরের সারি সারি পাহাড়ে জঙ্গলের সবুজ আভাস। ঢেউ খেলানো জমির মধ্যে দিয়ে উতরাই চড়াইএর রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে, পাশে গাছে ঢাকা দু একটা করে গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে মেয়েরা কাজ করছে, বাচ্চার দল রাস্তার ধারে দৌড়াচ্ছে, কোথাও নদীর ধারে ছেলেরা মাঠে কাজ করছে। একজায়গায় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা উঁচু জমিকে কেটে মাঠ বানান। মাঝখানটা বাঁধানো সাদা দাগ দেওয়া। জিজ্ঞাসা করায় সিংরাই বলল কয়লাখাদানের সাহেবদের হেলিকপ্টার নামার জায়গা, ক্রমশ ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম ছেলেটা অশিক্ষিত নয়।
সাধারণত সে চুপচাপ থাকে, কোন তাড়া নেই, সিংরাই এখানকার আর পাঁচটা আদিবাসী মানুষের মতো নয় ওর মধ্যে একটা আলাদা কিছু আছে। একদিন আমি লিটিপাড়ার রাস্তার ধারে একটা বড় শুকনো নালায় কাজ করছিলাম, ফিরে এসে দেখি সিংরাই নদীর পাশের একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটু দুরের একটা লম্বা মাটির ঢিবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। ওর তাকানোয় একটা অদ্ভুত কিছু ছিল, আমার ডাক শুনেই সে মোটরসাইকেলে এসে আমাদের পরের গন্তব্যে চলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সিংরাই-এর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল আমিও ওর কথা জানতে পারছিলাম। একদিন দুপুরে রাস্তার ধারে একটা ছোট ধাবায় খেতে খেতে ও যখন বলল যে ও দুমকার মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে তখন আমি খুব একটা অবাক হইনি, আমিও এরকমই আশা করেছিলাম।
একদিন পড়ন্ত বেলায় ফিল্ড থেকে ফেরার সময় সেই নালার উপর রাস্তার ধারের ব্রীজে আমরা বসেছিলাম, দূরে সেই লম্বা মাটির ডিবি। কথায় কথায় সিংরাই তার নিজের কথা বলতে শুরু করে, বাড়িতে তার স্ত্রী ঝিমলি আর বাচ্ছা ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। তার আসল বাড়ি ছিল তালঝরির কাছে পুষরে গ্রামে, আতিখেদ পাথর খাদানের কাছে, ছোটবেলায় সেখানেই বড় হয়েছে। পাহাড়ের উপর খাদানের কাছে ওদের বাড়ি ছিল। ছোটবেলায় দেখেছে পাথর খাদানটা পাহাড়ের একপাশ থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়টাকে খেয়ে ফেলছিল। গাঁয়ের অনেক মানুষ পাথর খাদানে পয়সার লোভে কাজ করতে গেলেও ওর বাবা ওদের পাহাড়ের উপরে ঝোরার পাশের জমিতে চাষ করত তার মায়ের সঙ্গে, তাতেই কোন রকমে ওদের চলে যেত। ওর ছোটবোন আর ও খেলে বেড়াত পাহাড়ের উপর মাঠে, ঝোপে। ও শুনেছে ওর বাবার কাছে যে আগে এই অঞ্চলের পাহাড়ে খুব মকাই, সর্ষে, মাড়ুয়া আর পাহাড়ি সিমের চাষ হত ঝোরার জমিতে ধানচাষ হত, জঙ্গল অনেক ঘন ছিল, সেখানে বরা খরগোশ সব পাওয়া যেত।
সন্ধে নামছিল, ও এক নাগাড়ে বলে চলে আগের কথা। যেসব মানুষ খাদানে কাজ করতে যেত তাদের বেশিরভাগই দশ পনের বছরের বেশি খাদানে কাজ করতে পারত না। কাজ করতে করতে শুরু হত কাশি তারপর জ্বর, ধীরে ধীরে মানুষগুলো মারা যেতে বুকের রোগে। খাদানও ধীরে ধীরে অতো বড় পাহাড়টাকে খেতে খেতে ওদের গ্রামের কাছে এসে গেল। ওদিকে জঙ্গল কমতে কমতে আর পাথর খাদান বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের উপরের মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে যাচ্ছিল, জলও কমছিল।
কিছুদিন আগে তাদের টোলার থেকে দূরে গ্রামের জাহির থানও খাদানে চলে গেল। ওর তখন আট নয় বছর বয়স একদিন রাজমহলের বড় ঠিকাদার, পাথর খাদানের মালিক চাঁদ চৌধুরী ওদের গ্রামে এলো বড় কালো গাড়িতে, গলায় মোটা সোনার হার, সঙ্গে অনেক লোক। মাঝিথানে মাঝি হারামকে ডেকে সে বলল এই গ্রাম ছেড়ে সবাইকে যেতে হবে, সরকার বলেছে এদিকে পাথর খাদান হবে। গ্রামের লোক অবাক, তারা গ্রাম ছেড়ে কোথায় যাবে? বহু পুরুষ ধরে তারা এই গ্রামে বাস করছে, খাদানের অনেক আগে থেকে। গ্রামের বুড়ো মাঞ্ঝি হারামের সঙ্গে তার বাপও রুখে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল মরে গেলেও তারা গ্রাম ছাড়বে না, দরকার হলে সরকারের কাছে যাবে কোর্ট কাছারি করবে। ঠিকাদারের গুণ্ডারা ওদের শাসিয়ে যায় ১৫ দিনের মধ্যে গ্রাম না ছাড়লে ওরা খাদানের মেশিন দিয়ে সব ঘর ভেঙে দেবে।
গ্রামে সভা বসে, বেশিরভাগ মানুষই দুর্বল, না ছিল শারীরিক ক্ষমতা না ছিল মনের জোর, কেউ ভয় পায় তো কেউ রাগে চেঁচায়, আবার কেউ গ্রামে চৌধুরীর দালাল তারা ভয় দেখায়। ওর বাবা বলে পঞ্চায়তে যাই চল আমারা ওদের ভোট দি ক্যানে? ওরা সরকারকে বলুক। সবাই মিলে প্রধানের সঙ্গে দেখা করে কিন্তু চৌধুরী প্রধান সমেত পঞ্চায়েতের সব মেম্বারকে কিনে নিয়েছে, সে ঠিকাদারের হয়ে ওদের বোঝাতে আসে। ওরা বাবারা কয়েকজন মিলে রাজমহলের উকিলের কাছে যায়, কিন্তু উকিল আদালতের পয়সা কেউ দিতে চায় না। ওর বাবা মাঞ্ঝি হারামের সঙ্গে খুব চেষ্টা করছিল গ্রামটা বাঁচাতে ।
এরই মধ্যে ওদের গ্রামে হঠাৎ পুলিশ এসে ওর বাবা আর দুজনকে নকশাল বলে তুলে নিয়ে চলে যায় সাহেবগঞ্জে। ওর মা কান্নাকাটি করে মাঝি হারামের সঙ্গে ওরা সাহেবগঞ্জ যায়। উকিল, আদালত, জেল করতে করতে ওদের সব জমানো পয়সা শেষ, জমি বন্ধক রাখতে হয়। একদিন রাতে ওদের ঘরের দরজা ভেঙে ঠিকাদারের গুণ্ডারা ওর মাকে তুলে নিয়ে যায়। ভয়ে কোন রকমে রাতের অন্ধকারে ওরা ভাই বোন গ্রামের বাইরের একটা বহু পুরানো চার্চে আশ্রয় নেয়। পরের দিন সকালে চার্চের পাদ্রী ওকে দুমকাতে মিশনারি অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। ও জানে না ওর মায়ের কি হোল, ওর বোন কোথায়। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। সিংরাই-এর চোখে কোন জল নেই চোখটা পাথরের মতো ভাবলেশহীন। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখনো সেই মাটির উঁচু ঢিবির দিকে।
সূর্য ডুবে গেছে দিগন্তে ঘন লালের ছোঁয়া, একজন বয়স্ক সাঁওতাল মানুষ এক পাল গরু সামনে দিয়ে নিয়ে গেল, গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। আমি ধীরে জিজ্ঞাসা করলাম তার পর? সে মোটরসাইকেল থেকে জলের বোতল নিয়ে গলায় ঢালল। তারপর আবার ব্রীজের উপর বসে শান্ত চোখে বলল, সে দুমকার মিশন স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে, এরই মধ্যে মিশনে সে কখন খ্রীশ্চান হয়ে যায় তার মনে নেই তার নাম হয় মাইকেল সিংরাই। স্কুল শেষ হতেই সে মিশনের কাজে যোগ দেয় তখন সে প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে যীশুর কাছে প্রার্থনা করত যেন তার মতো তার বাবা মা আর বোনও বেঁচে যায়, ভাল থাকে। ধীরে ধীরে সে সব ভয়াবহ দিনকে ভোলার চেষ্টা করে।
ও দুমকায় যখন কলেজে পড়ে তখন চার্চের কাজে ওকে পাঠানো হয় লিটিপাড়া মিশনে। ওখানকার ফাদার একদিন স্বাস্থে্যর কাজে ওকে পাঠিয়েছিল পাহাড়ের উপর কুঞ্জবোনা গ্রামে। তখন ওকে প্রায়ই সেখানে যেতে হত, একদিন ওখানে ওর দেখা হয় বুড়ো বীরসিং হাঁসদা আর ওর নাতনী ঝিমলির সঙ্গে, বুড়ো ওকে ধরে জিজ্ঞাসা করে ওর কি নাম, ও বলেছিল ‘মাইকেল’, বুড়ো জিজ্ঞাসা করেছিল মাইকেল কি, ও বলেছিল মাইকেল সিংরাই, বুড়ো ওর মুখের কাছে কান নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে ‘কি?’ সে চেঁচিয়ে বলে সিংরাই। ও দেখে বূড়ো অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়ো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে, ওর কাছে সব শুনে বুড়ো অবাক হয়ে কি দেখে তারপর ধীরে উঠে চলে যায়। তারপর কিছুদিন ওর আর বুড়োর সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু ও বুড়োকে ভুলতে পারেনি।
একদিন গ্রামের ভিতর কাজে ও বীরসিং এর বাড়ি গিয়ে দেখে সে খুব অসুস্থ, তার নাতনী ঝিমলি ছাড়া আর তার কেউ নেই। ও বীরসিং এর পাশে বসতেই সে ওর হাত দুটো ধরে চুপ করে তাকিয়ে থাকে, ওর নাতনী ঝিমলি ওর জন্য এক ঘটি জল নিয়ে এসে ওকে দেয়, ওর ঝিমলিকে ভালো লাগে। সে বেরিয়ে গেলে ও বুড়োকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? সেদিন বীরসিং ওকে সাঁওতালদের এক অদ্ভুত গল্প বলে, যে গল্প আজও ওকে এই রাজমহলের পাহাড়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তারও কয়েক মাস পর সে মিশনের কাজ ছেড়ে দেয়। বুড়োর কাছে কুঞ্জবোনায় থাকতে শুরু করে, কিছুদিন পর বুড়ো মারা যায়। সে ঝিমলিকে বিয়ে করে তাদের জমি জায়গা দেখতে থাকে, চাষের সময় ছাড়া অন্য সময় নানা জায়গায় কাজ করে পয়সা রোজগার করে আর ঘুরে বেড়ায় ওর মোটর সাইকেল নিয়ে সাঁওতাল পরগনার নানা প্রান্তে।
চার
কেনারামের অনেকদিন ধরে চোখ ছিল লিটিপাড়ার বৈজুল মাঞ্ঝির জমি আর সম্পত্তির উপর। লোকটা যখন বছর পাঁচেক আগে ওর কাছে বারো ঝুড়ি ধান ধার নিয়েছিল তখনই ও সব কাগজ তৈরি করে রাখে। লোকটা ওকে এই ক’বছরে ধার শোধের জন্য এক’শ ঝুড়ির বেশি ধান দিয়েছিল তা সত্ত্বেও গেল বছর কেনারাম সেই পুরোন কাগজের জোরে ধার না-শোধের মামলা করে ভাগলপুরের দেওয়ানী আদালত থেকে ডিক্রি নিয়ে আসে। তারপর বৈজুলের জমি দখল করার জন্য আদালতের শমন নিয়ে রামশরন লিটিপাড়ায় যায় পেয়াদা নিয়ে । সেখানে ওর দুই জোয়ান ছেলে চাঁদরাই, সিংরাই আর গ্রামের লোকে মিলে রামশরন আর পেয়াদাদের ঘিরে ধরে মারতে যায়, বৈজুল তাদের শান্ত করলে রামশরনের বেঁচে ফেরা হত না।
সেই থেকে কেনারামের ঘুম উড়ে গেছে। এরকম চললে তো মহাজনি কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। গেল মাসে ও লিটিপাড়ায় গিয়ে বৈজুল মাঞ্ঝির ক্রোক করা জমি বাড়ি দখল নেবার কথা ভেবে ওখানকার বড় মহাজন ঈশরী ভগত আর বাগসীসার জিতু কালুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে গিয়েছিল। কিন্তু দুজনাই বারণ করেছিল, বলেছিল এখন লিটিপাড়ায় কিছু না করতে, হাওয়া ভাল নয়। লছিমপুরের বীরসিং ইতিমধ্যেই দু তিন জন মহাজনকে শাসিয়ে গেছে। যবে থেকে মহাজনদের কথায় অম্বরের দেওয়ান জগবন্ধু রায় লছিমপুরের পরগনাইত বীরসিংকে পাকুড়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে মহাজনদের সামনে জুতো পেটা করে, সেদিন থেকে সে মহাজনদের উপর ক্ষেপে আছে। বীরসিং নাকি বড় দল গড়েছে, কোন মহাজন সাঁওতালদের জমি অন্যায় ভাবে দখল করলে দিখু মহাজনদের বাড়ি চড়াও হচ্ছে। কেনারামের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সাঁওতালদের এতো বাড় বেড়েছে। কিন্তু ওর আর সাহস হয়নি বৈজুলকে ওরই গ্রামে ওর বাঘের মতো দুই ছেলের সামনে ঘাঁটাতে।
কেনারামও কম নয়, সে তক্কে তক্কে ছিল যেদিন ওর লোকেরা খবর দিল বৈজুল নাকি কুটুমবাড়ি এসেছে ডুমারচীরে, ও সঙ্গে সঙ্গে রামশরনের সঙ্গে ওর পোষা কটা লেঠেল পাঠায় ওকে ধরে আনার জন্য। জঙ্গলে লোকটাকে একা পেয়ে রামশরন আর লেঠেলের দল তাকে তুলে নিয়ে আসে কেনারামের বাড়িতে। লোকটার চোখটা রাগে বাঘের মতো জ্বলছিল। সে কেনারামের মাটির বিশাল বড় বাড়ীর সামনে ওকে মুখের উপর চেঁচিয়ে বলে দিল সে লুটিয়া সাঁওতালদের সঙ্গে কেবল লুকাচুরি করে। কেনারাম অবাক, সাঁওতালটার এতো সাহস তাকে চোর বলছে, এই প্রথম কোন আদিবাসী তার বাড়িতে তাকে চোর বলছে।
তার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, সে হাত চেপে ধরে চড় মারতে গিয়েছিল কিন্তু মাঝবয়েসি ছোটখাটো চেহারার সাঁওতালটার গায়ে খুব জোর, এক ধাক্কায় হাত ছাড়িয়ে নিল আর সেই ধাক্কায় মোটা কেনারাম ধান ভর্তি বস্তার মতো মাটিতে ছিটকে পড়ল। সে চেঁচাতেই পাশ থেকে রামশরন আর তার পেয়াদারা লোকটাকে জাপটে ধরে, আশেপাসের বিহারি বাড়িগুলো থেকে ছেলে ছোকরারা বেরিয়ে এসে লোকটাকে মারতে শুরু করল। লোকটার চোখগুলো রাগে জ্বলছিল কিন্তু এতগুলো লোকের সামনে সে হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে লাগলো। ভিগুর সঙ্গে কামিয়া সাঁওতালরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। সকলে তাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যখন লোকটাকে ছাড়ল তখন সে মাটিতে পড়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে, তার ধুতি ছিঁড়ে গেছে, সারা গায়ে রক্ত। কেনারাম গর্জন করছিল কামিয়াদের এতো সাহস দিখুদের গায়ে হাত তোলে? মামলা করে শালাদের সব জমি দখল নেবো।
ছেলেগুলো আর রামশরন লোকটাকে পিছনের খালি ধানের ঘরে লোকটাকে বন্ধ করে রাখল। মাঞ্ঝির বয়েস হয়েছে, মার খেয়ে ঝিমিয়ে পড়লেও নিয়ে যেতে অনেক বেগ দিল। দূর থেকে ভিগুর সঙ্গে অন্য কামিয়া সাঁওতালরা এক দৃষ্টিতে দেখছিল, তাদের চোখেও যেন রাগ। কেনারাম মনে মনে হিসাব করে নিয়েছে এটাই সময় ব্যটাকে চুরির অপরাধে দারোগাকে দিয়ে ভাগলপুরে সাহেবদের জেলে পুরতে হবে। সে রামশরনকে তখনই পাঠাল দারোগাবাবুকে খবর দিতে। সন্ধে নামছে একটু দুরেই কয়েকটা ময়ূর খুব কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল, ভিগু আর কামিয়া সাঁওতালরা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল হঠাৎ অন্ধকারে তারাও মিলিয়ে গেল। কোথায় যেন তিরাওতের একটা অস্বস্তিকর সুর বাজছে, রাত বাড়লে শুরু হল ধামশা মাদলের রাগী আওয়াজ। এত বছরেও কেনারাম জংলী মানুষগুলোর এইসব আওয়াজের মানে বুঝতে পারে না।
সকালে মহেশ দারোগা বেশ কয়েকজন বিহারি আর বাঙালি পেয়াদা নিয়ে এসে বৈজুল মাঞ্ঝিকে সাঁওতালদের সামনে মারতে মারতে ভাগলপুরের জেলে নিয়ে গেল। কেনারাম অবাক হয়ে লক্ষ করল এই প্রথম গাঁয়ের দুজন সাঁওতাল ছেলে দারোগাকে আটকাতে এল। তারা বলছিল সব দোষ কেনারামের, শুনে দারোগা তো রেগে আগুন, মেরে তাড়িয়ে দিল ওদের। ও এত বছরে এই প্রথম দেখল আমড়াপাড়ার সাঁওতালদের চোখে প্রতিবাদ।
বৈজুল মাঞ্ঝিকে ভাগলপুরে ধরে নিয়ে যাবার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল মহেশপুর, লিটিপাড়া, বারাইত, পাকুড়ে। বৈজুল মাঝির দুই ছেলে চাঁদরাই আর সিংরাই আগেই খবর পেয়েছিল লছিমপুরের বীরসিং চান্দো, বোঙ্গার আদেশ পেয়েছে তাদের দেশ থেকে দিখু মহাজন, দারোগা, নায়েব আর ফিরিঙ্গিদের তাড়াতে। সে সাঁওতাল দল বানিয়েছে। ওরা দুই ভাই বাপকে লুকিয়ে আগেই দেখা করেছিলো বীরসিং-এর সঙ্গে, ঠিক করেছিল লিটিপাড়া, আমড়াপাড়া, মহেশপুর থেকে তাড়তে হবে অত্যাচারী মহেশ দারোগা আর কেনারামের মতো অত্যাচারী মহাজনদের কিন্তু ওদের আটকে রেখেছিল বৈজুল মাঞ্ঝি। আজ সেই বৈজুল মাঞ্ঝিকেই মহেশ দারোগা আর কেনারাম চক্রান্ত করে আমড়াপাড়া থেকে মারতে মারতে ধরে নিয়ে গেছে ভাগলপুর।
খুব তাড়াতাড়ি রাতের মধ্যেই লিটিপাড়ার মাঞ্ঝিথানে মশাল জ্বালিয়ে সভা হল। আশপাশের গ্রাম থেকে হাজার খানেক মানুষ তীর ধনুক, কুড়ুল নিয়ে জড়ো হল, মশালের আলোয় সবার চোখ বাঘের মতো জ্বলছে, রাগের গনগনে কথার আঁচ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে রাতের অন্ধকারে। চাঁদরাই বড় হলেও সে তার ছোট ভাইকে তার বুদ্ধির জন্য সম্মান করে। সে তাকেই কথা বলতে বলল। সিংরাই সবাইকে শান্ত হতে বলল। সে বলল ‘আমাদের মাথা ঠাণ্ডা করে এগোতে হবে, কোন রকম মাথা গরম করা যাবে না। এখনো বৈজুল মাঞ্ঝীই মাঝি হারাম, তারা কাল যাবে ভাগলপুর সেখানে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে, জানবে সে কি চায়।’ কিন্তু পরের দিন সিংরাই ও আরো দুজন সাঁওতাল যখন ভাগলপুরে পৌঁছায় ততক্ষণে বৈজুল মাঞ্ঝি পুলিশ চৌকিতে মহেশ দারোগার অত্যাচারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।
সেটা চৈত্র মাস। সন্ধের ঠিক আগে কেনারাম, বেচারাম বাড়ির বাইরে বসেছিল, আজ চারিদিক খুব শান্ত, একটু বেশিই শান্ত, কেবল পাশের বড় মহুয়া গাছে পাখির আওয়াজ অন্য দিনের থেকে কম। আজ কোন কামিয়ার দেখা নেই, ভিগুটাকেও দেখা যাচ্ছে না। আজই ওরা খবর পেয়েছে যে বৈজুল মাঞ্ঝি ভাগলপুরে পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। কেনারাম ভাইকে বলল এবার আদিবাসীদের ভয় বাড়বে আর সাহস পাবে না ওদের সঙ্গে লাগতে। ঠিক সেই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের পাহাড়িয়া লেঠেল এসে হাজির। তার চোখেমুখে আতঙ্ক, সে বলল কর্তা তোরা তাড়াতাড়ি পালা, সাঁওতাল মাঝিরা ক্ষেপেছে, আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বলেই সে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে বাঁশলোই-এর দিকে চলে গেল। দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক, তখনই বাড়ির পিছনের বড় পুকুরপাড়ে সরসর করে ঝোপের মধ্যে কি চলে গেল। কেনারামের মনে হল ভিগু, সে চেঁচাল ভিগু ভিগু বলে, আর কোন আওয়াজ নেই, বেচারাম বলল শিয়াল বোধ হয়। এই প্রথম এতদিন পর দুই ভাই ভয় পেলো।
দুজনে তাড়াতাড়ি উঠে বাড়ির ভিতরে গেল, বেচারাম বলল ‘পাহারার জন্য ভিগুর সঙ্গে বাকি কামিয়া সাঁওতালদের ডাকি’। পোড় খাওয়া কেনারাম হাত দিয়ে ওকে থামাল, ভাবল এই সময় জঙ্গলের রাস্তায় সাঁওতালদের চোখ এড়িয়ে পালান অসম্ভব। বাড়ির মেয়েদের জড়ো করে সন্ধে হতেই চুপিচুপি পাশের চৌবের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল, আশপাশের ছেলেদের তৈরি হতে বলল। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে দুদিন আগে পূর্ণিমা গেছে, লালচে ঘোলাটে চাঁদ বড় বড় শাল আর মহুয়া গাছের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে উঠল। দূরে ধামসা মাদলের আওয়াজ আরো স্পষ্ট হচ্ছে মানুষের কথা বলার আওয়াজ আর গনগনে সাঁওতালী গানের আওয়াজ এগিয়ে আসতে থাকে আমড়াপাড়ার দিকে। ততক্ষণে বিহারি পাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কেনারাম ভাবছে কী করে সে মহেশ দত্তকে খবর পাঠাবে। আজ যদি সে কোনরকমে বাঁচে তাহলে যত পয়সা লাগুক সাঁওতালদের জব্দ করতে ভাগলপুর থেকে সাহেবদের ধরে সে কোম্পানির সৈন্য নিয়ে আসবে। হঠাৎ আশপাশের গাছ অগুনতি মশালের আলোয় জেগে উঠল চারদিক থেকে সাঁওতালী ভাষার কোলাহল। দেরি না করে কেনারাম দ্রুত বাড়ির পিছনের বড় পুকুরে চুপি চুপি নেমে পুকুর ভর্তি বড় বড় পদ্ম পাতার আড়ালে কেবল মাথাটা তুলে লুকলো। ওর মনে হল ঝোপের পিছনে একটা চোখ যেন শিয়ালের মত তাকে দেখছে।
পরের দিন মহেশ দত্ত যখন এল তখন কেনারামের শরীর পদ্মবনে ভাসছে, সারা শরীরে অসংখ্য তীর। কেনারামের এত বড় বাড়ি পুড়ে ছাই তার থেকে তখনও ধোঁয়া বেরচ্ছে, উঠনের সব ধানের গোলা লুট হয়ে গেছে। মহেশ দত্ত তার সঙ্গের জনা দশেক বিহারি পালোয়ান নিয়ে প্রথমেই সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে দেখল সব খালি। দুজন বয়স্ক অসুস্থ সাঁওতাল শুয়ে ছিল তাদের চেঁচিয়ে লাথ মেরে জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলেছিল যে সিংরাই আর বীরসিং তাদের দলবল নিয়ে ভগনাডিহির দিকে গেছে।
সে সময় নষ্ট না করে পেয়াদার দল নিয়ে চলল উত্তরে বারহাইত ভগনাডিহির দিকে। বেলা পড়ে এসেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড় পেরিয়ে মহেশ দত্তর দল সমতলে জঙ্গলের মধ্যে গুমানি নদীর পাড়ে এসে পৌছাল, একটু গেলেই ওরা ভগনাডিহি পৌঁছে যাবে। একটানা হেঁটে দারোগা ও সঙ্গের পেয়াদারা বিশ্রাম নিতে নদীর জল খেয়ে একটু দাঁড়াল, কাছেই ভগনাডিহি, এরপরই শুরু হবে সাঁওতালদের ধর পাকড়। ধূর্ত মহেশ দত্ত ভেবেছিল সাঁওতালরা একজোট হাবার আগেই হঠাৎ গিয়ে সিধু কানুর চার ভাইয়ের সঙ্গে ঐ বীরসিং আর সিংরাইকে ধরতে হবে। ও জানে এই কটা মাথাকে ধরলেই কাজ শেষ।
হঠাৎ মহেশ দত্ত দেখল একটু দুরেই ভিগু নদীতে জল খাচ্ছে, ওর মাথা গরম হয়ে গেল। এই শালারাই মেরেছে কেনারামকে। দৌড়ে পেয়াদারা ঘিরে ধরল ভিগুকে। মহেশ দত্ত তার ঘাড় ধরে তুলতেই আকাশে হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আওয়াজ করে উড়তে শুরু করল। ও বুঝতে পারল নদীর চারধারের জঙ্গল থেকে পিলপিল করে মানুষ নামছে দেখতে দেখতে তীর ধনুক, কুড়াল, দা হাতে তাদের ঘিরে ধরেছে অসংখ্য সাঁওতাল। মহেশ দত্তর বুঝতে সময় লাগল না তার জন্যই এখানে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। সে জানে সাহস হারালে চলবে না, আর এখানে তার জোর দেখান বোকামি। দারোগা চেঁচিয়ে বলল আমরা খবর পেয়েছি সিংরাই আর ভিগু, কেনারাম ভগতকে মেরে এখানে লুকিয়েছে। আমরা সরকারের আদেশে ওদের ধরে নিয়ে ভাগলপুর যাব তোদের কিছু করব না। কিন্তু কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খালি গায়ে তীর ধনুক হাতে কালো পেশীবহুল চেহারার দুই সাঁওতাল জোয়ান, সে ওকে কিছু বলল, মহেশ দত্ত ভয়ে কেবল শুনতে পেল, হুল হুল…।
পরের দিন ভাগলপুরে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে খবর এলো দারোগা মহেশ দত্তর সাথে দশজন কোম্পানির পেয়াদার ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে আছে বারহাইতে যেখানে গুমানি আর মোরেল নদী মিশেছে।
পাঁচ
সেদিন পাকুড় থেকে ট্রেন ধরব কলকাতার, অনেক রাতের ট্রেন। এই কদিনে সিংরাই আর আমার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়েছে এখানকার সাঁওতাল জীবন সম্পর্কে আমার একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। সিংরাই বলল সে আমার সঙ্গে পাকুড় যাবে, আমি রাজি হয়ে গেলাম। বিকালে আমড়াপাড়া থেকে দুজনে পাকুড়ের বাসে রওনা দিই। বাস ফাঁকা, আমি কৌতূহল সামলাতে না পেরে বাসে উঠে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম বুড়ো বীরসিং-এর কথা, সে ওকে কি বলেছিল যে সিংরাই মিশনের কাজ ছেড়ে ওর নাতনী ঝিমলিকে বিয়ে করে কুঞ্জবোনায় আস্তানা গেড়েছে? ও বলল, বুড়ো বীরসিং ওকে দেড়’শ বছর আগের সাঁওতালদের যে কাহিনী বলে তা ওকে আজও তাড়া করে নিয়ে ফেরে, ও নানা জায়গায় অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখে, নানা মানুষের কথা শোনে, সে ঘুমাতে পারে না। ও ঝিমলিকে খুব ভালোবাসে, সেই বাড়িঘর সব সামলায়, বাড়িতে মাঠের কাজে ঝিমলি আর ছেলে কানুর সঙ্গে সে খুব ভালো থাকে, কিন্তু বেশিদিন সে বাড়িতে থাকতে পারে না। বাসের জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের মুখের উপর বয়ে যাচ্ছিল, কেন জানি আজ আমার ওকে দেখে মায়া লাগছিল।
সিংরাই বলে সে কলেজে থাকতে সাঁওতাল হুল নিয়ে কিছু লেখা পড়েছিল, তখন ওর ভাল লেগেছিল, বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওদের পূর্বপুরুষরা কী বীরত্বের সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে। কিন্তু ওর সঙ্গে যখন বীরসিং-এর প্রথম কথা হয় তখন সে শুনিয়েছিল সাঁওতালদের স্বপ্নের দেশের কথা, যা তারা তৈরি করতে চেয়েছিল জঙ্গল পাহাড় ঘেরা দামিনিতে, কিন্তু কেমন করে তাদের পরিশ্রমের জমি ফসল লুটেছিল দিখু জমিদার, মহাজন, দারোগা, নায়েবরা আর সাহেবরা শুনেছিল তাদের কথা। ও সেই বিদ্রোহী সাঁওতালদের উত্তরসূরি ওকে লড়তে হবে সাঁওতালদের জন্য নিয়ে যেতে হবে তাদের স্বপ্নরাজ্যে। সিংরাই-এর তখন মনে হয়েছিল বুড়ো ভুল বকছে।
মিশনে ফিরেও তার মাথায় সেই সব গল্প ঘুরতে থাকে। একদিন সে আমড়াপাড়া গিয়েছিল মিশনের কাজে, ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, আমড়াপাড়ার বাজারের ঠিক বাইরের উঁচু পাড় দেওয়া পুকুর পাড়ে এসে ওর মনে হয় কেউ ওকে ডাকছে, সিমাবোঙ্গা পাওয়া মানুষের ডাক। ও পুকুর পাড়ে উঠতেই হঠাৎ সব বদলে গেল। ও দেখল গাছপালা ঘেরা পুকুর পাড়ে খালি গাঁয়ে দাঁড়িয়ে রাগে গা জ্বলছে ওর পাশে ওর দাদা চাঁদরাই আর তাদের সাথীরা মশালের আলোয় কেনারামকে তার বাড়িতে পাড়ায় খুঁজছে। এক এক করে ওরা কেনারামের সব ধানের গোলা লুট করল সঙ্গে বিহারি পাড়ার সব বাড়ির গোলা, বিহারি পাড়ার লোকজন ভয়ে অন্ধকারে এদিক সেদিক পালানোর চেষ্টা করছে।
ওরা কেনারামকে খুঁজে না পেয়ে ওর বড় বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, সেই আলোয় ওর চোখ যায় পুকুর পাড়ের ঝোপের পাশে দাঁড়ান হাড় বার করা ভিগুর দিকে, তার চোখের ইশারায় সে সব বুঝে নেয়, সঙ্গে সঙ্গে ওর সাথী সাঁওতালরা সার দিয়ে তীর ধনুক নিয়ে পুকুর ঘিরে দাঁড়ায়, আগুনের আলোয় পুকুরের সব পদ্ম ঝলমল করছে। মাঝখানে ভিগু আঙ্গুল তুলে দেখাতেই এক সঙ্গে সবাই সেদিকে তীর ধনুক তাক করে, কোথা থেকে আওয়াজ ওঠে ‘সিকে এউশুল’ সিকি শোধ, সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক তীর পদ্মপাতা ফুঁড়ে যেতেই চিৎকার করে জলের উপর ছিটকে উঠল কেনারামের তীর বেঁধা মোটা রক্তাক্ত শরীর। আবার একসাথে সব ধনুকে গুণ লাগাতেই আওয়াজ উঠল ‘আধা উশুল’ অর্ধেক শোধ, একসাথে আরও একঝাঁক তীর গিয়ে বেঁধে সেই আধা ভাসমান তীর বেঁধা শরীরে। তৃতীয় বারের জন্য ধনুকে গুণ পড়ল সম্মিলিত আওয়াজ উঠল ‘ফারখত’ সব ধার শোধ। তারপর ওর আর কিছু মনে নাই। পরের দিন সকালে ও দেখে ঐ পুকুর পাড়ে ও মোটরসাইকেলের পাশে ঘাসের উপর শুয়ে। ওর মনে হল ওকে বোঙ্গায় ধরেছে, কিন্তু ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও কোন রকমে মিশনে ফিরে ঘটনাটা ভোলার চেষ্টা করে।
এর কয়েক মাস পর ও একদিন সন্ধ্যের ঠিক আগে মোটর সাইকেল নিয়ে ফিরছিল বারহাইত থেকে লিটিপাড়া মিশনে। মাঠ পেরিয়ে ও যখন গুমনি নদীর নতুন ব্রিজে উঠে মোটরসাইকেলটা রেখে পেচ্ছাপ করতে দাঁড়িয়েছে আবার সেদিনকার মতো হঠাৎ সব বদলে গেল। দেখল নদীর পাড়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ওরা সব খালি গায়ে শ্বাপদের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ওর এক পাশে বীরসিং অন্য পাশে ভগবান সিধু আর কানু দাঁড়িয়ে। কানু ওকে আস্তে জিজ্ঞাসা করল তুই ঠিক জানিস দারোগা আসবে? তার চোখ অন্য পাড়ে। সে কেবল ঘাড় নাড়ল, ঠিক সেই সময় ঐ পাড়ের ঝোপের থেকে ময়ূর ডাকার মতো আওয়াজ, ওরা বুঝল সেই সঙ্কেত, দারোগা এসে গেছে। দারোগা তার পেয়াদার দল নিয়ে নদীতে নামতেই সে চোখের ইশারা করে ভিগুকে, সেও জল খাবার ভান করে নদীতে নামে।
ওরা নিঃশব্দে দারোগার দলকে ঘিরে ধরে, ও হাসে দারোগার ভয় দেখানো দেখে। দারোগার সামনে দাঁড়িয়ে সিধু আর কানু আর দারোগার পিছনে কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে দাদা চাঁদরাই। সিধু গর্জন করে ‘দারোগা তুই মেরেছিস বৈজুল মাঝিকে?’ দারোগা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে এক সঙ্গে জঙ্গল কাপিয়ে আওয়াজ উঠল হ্যাঁ, দারোগা আর মহাজন মিলে মেরেছে মাঞ্ঝিকে, চারিদিক থেকে আওয়াজ উঠল হুল হুললল, অমনি চাঁদ রাই-এর কুঠারে দারোগার মাথা ছিটকে পড়ল শরীর থেকে। মশালের আলোয় আর চারিদিকের হুল হুল গর্জনের মধ্যে বালি দিয়ে দারোগার দলের রক্তধারা চুইয়ে চুইয়ে মিশছে গুমনির জলে। ওরা দল বেঁধে নদী থেকে যায় ভগনাডিহির ঠাকুরবাড়ি সেখান থেকে গ্রামে গ্রামে ‘গির’ পবিত্র শাল গাছের ডাল পাঠান শুরু হয়, সঙ্গে দেশজুড়ে হুলের ডাক দেওয়ার সংকেত হিসাবে যায় শাল পাতার বাটিতে আতপ চাল, তেল আর সিঁদুর। শুরু হয় ইংরাজি ১৮৫৪ সনের সাঁওতাল হুল। অনেক রাতে নদীর ধারে ওর জ্ঞান ফেরে।
বাসটা পাকুড় স্ট্যান্ডে পৌঁছেছে, আমরা বাস থেকে নেমে খাবার খেতে পাশের একটা ছোট দোকানে ঢুকলাম। কোন রকমে খাবার অর্ডার দিয়েই আমি সিংরাইকে জিজ্ঞাসা করি তারপর। মিশনে ফিরেই ও যায় কুঞ্জবোনায়। ওকে দেখে অসুস্থ বীরসিং কাঁদতে থাকে। সে তার অবস্থার কথা বলে শুনে বুড়ো ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। শান্ত হলে বুড়ো বলে সত্তর আশি বছর আগে ও যখন ছোট ছিল ওর বাবা মারা যাবার পর কুঞ্জবোনা এলাকার পুরানো পরগনাইত ওকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলেছিল ‘যে ওর কাজ এখনো শেষ হয় নাই’। সেও সেদিন বুঝতে পারেনি তার মানে। তাকেও সেদিন সেই পরগনাইত সাঁওতাল হুলের নিজেদের গল্প বলেছিল। শেষে বলেছিল সাহেবদের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইতে সাঁওতাল বিদ্রোহের সব বড় বড় নেতারা মারা গিয়েছিল কেবল দুজনের কথা কেউ জানে না এক লছমিপুরের পরগনাইত বীরসিং আর বৈজুল মাঞ্ঝির ছেলে সিংরাই।
দুজনেই হারিয়ে যায় রাজমহলের পাহাড়ে জঙ্গলে। কেবল তার মতো কিছু পরগনাইত জানত যে ঐ দুজনে দু’দিকে চলে যায়, সিংরাই যায় উত্তরের পাহাড়ে আর বীরসিং লুকোয় লিটিপাড়ার কাছের কোন পাহাড়ে পাহাড়িয়া এলাকায়। লোকে বিশ্বাস করে একদিন এরা ফিরে আসবে সাঁওতালদের জঙ্গল পাহাড় ঘেরা স্বপ্নের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে বাইরের লোকের অত্যাচার নাই সহজ সরল সাঁওতাল মানুষদের কেউ ঠকাবে না, তাদের জমি বাড়ি চুরি করে গোলাম বানাবে না। ও আর ফিরতে পারেনি মিশনে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পাকুড় স্টেশনে পৌঁছে গেছি সন্ধে আটটা হবে, স্টেশনের প্লাটফর্মে সারি সারি আদিবাসী জোয়ান ছেলে মেয়ে, বাচ্চা বুড়ো, বাক্সপেঁটরা বস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে বিভিন্ন ট্রেনের জন্য। আমি সেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, বেশির ভাগ রোগা মায়ের কোলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, তারই মধ্যে মাথায় বস্তা আর পেঁটরা নিয়ে বসে, কোন কোন বাচ্চার হাতে কুড়কুড়ে বা চিপস্-এর ছোট প্যাকেট। আমি দেখছিলাম অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে সাঁওতাল পরিবারেরা লেবার ঠিকাদারের লোকের সঙ্গে যাচ্ছে কাজের আশায়। চলেছে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে কলকাতা, বর্ধমান, দিল্লি, চেন্নাই।
আমার ট্রেন আসতে এখনো অনেক দেরি, আমরা প্লাটফর্মের শেষে নীচে একটা বাঁধানো জায়গায় বসলাম, এদিকে আলো একটু কম। সিংরাই কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই সারি সারি মানুষের দিকে, মনে পড়ছে বুড়ো বীরসিং ওর হাত ধরে অসহায় ভাবে ওকে বলছে ‘আজ সাঁওতালদের অবস্থা আগের থেকেও খারাপ, সেদিন আমাদের জমি আর ধান গিয়েছিল আজ আমাদের দেশ, পাহাড় জঙ্গল সব চলে যাচ্ছে, আমারা ওদের গোলাম হয়ে পড়ছি। সে আবার ফিরে আসবে, ততদিন সিংরাই যেন চেষ্টা করে যায় সাঁওতালদের বাঁচাতে’। সিংরাই-এর মনে পড়ে ওর বাবা মা আর ছোট বোনের কথা, ওর গ্রাম আর পাথর খাদানের কথা। সে ভাবতে থাকে যেমন করেই হোক তাদের ফিরতে হবে তাদের শান্তির দেশে ঝিমলি আর ছোট্ট কানুকে নিয়ে।
তথ্য সুত্রঃ
১) সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস- ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।
২) Hul Hul - Peter Stanley
৩) The Story of an Indian Upland- by F B Bradley Birt
4) Bengal District Gazetteers, Santal Par ganas - By L S S O'Malley
5) Census of India 2011, Pakur, Series-21, Part-XIIB
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৪
স্বাদেশিকতা পর্ব (শেষাংশ) ও বিদ্যাসাগর
স্বাদেশিকতা পর্ব (শেষাংশ; আরো কিছু কথা)
ইতিহাসকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখলে অনেক সময় এমন অনেক সত্য উদ্ঘাটিত হয়, যেগুলো হয়ত সাদা চোখে ধরা পড়ে না। যেমন ‘স্বাদেশিকতা’ শব্দটা। আমাদের দেশে শব্দটা আধুনিক, জন্ম ব্রিটিশ আমলে, মূলে ইংরেজি ‘patriotism’। ‘patriotism’ শব্দটার ঠিক বাংলা হয় না, স্বাদেশিকতা একটা কাজ চালানো গোছের শব্দ এবং গঠনও অনেক পরে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শব্দটার বাংলা হিসেবে ‘দেশহিতৈষণা’ শব্দটা চালু ছিল, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সেটাও সঠিক প্রতিশব্দ নয়। তিনি বলেছিলেন, “Patriot শব্দের যাঁহারা অনুবাদ করেন দেশহিতৈষী, তাঁহারা নিতান্তই দায়ে পড়িয়া তাহা করেন। Patriot শব্দের ঠিক্ প্রতিশব্দ আমাদের দেশীয় ভাষাতে নাই ও কস্মিনকালে ছিলও না। ... দেশের হিতসাধনকারী philanthropist স্বতন্ত্র আর কায়মনোবাক্যে দেশের স্বকীয় মাহাত্ম্যের সমর্থনকারী patriot স্বতন্ত্র। যিনি স্বদেশের স্বাধীনতা, গৌরব, তেজোবীর্য এবং মহত্ত্ব রক্ষা করিয়া মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করেন তিনিই patriot।”
এই অর্থে patriot শব্দটার প্রথম উল্লেখ পাই রামমোহন রায়ের বিভিন্ন লেখায়। যেমন, ১৮২৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জন ডিগবিকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, “The distinction of castes, introducing innumerable divisions and sub-divisions among them [Hindus] has entirely deprived them of patriotic feeling...” (অর্থাৎ, জাতব্যবস্থায় জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ স্বাদেশিকতার অনুভূতি থেকে হিন্দুদের বঞ্চিত করেছে...) কিংবা ১৮৩২ সালে ‘ইন্ডিয়া’র প্রাচীন ও আধুনিক সীমানা নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিদানের সময় এ দেশ ইংরেজের দখলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি লিখছেন, “The army they [the English] employed chiefly consisted of the natives of India, a country into which the notion of patriotism has never made its way.” (অর্থাৎ, ইংরেজরা যে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিল তা প্রধানত এ দেশের লোক নিয়ে গঠিত, স্বাদেশিকতার ধারণা যে দেশে প্রবেশ করেনি।)। মোদ্দা তিনি বলতে চান, স্বাদেশিকতার ধারণা এ দেশে ছিল না এবং না থাকার কারণ হচ্ছে হিন্দুদের মধ্যে জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ। রামমোহনের বেলায় স্বাদেশিকতার ক্ষেত্র ছিল ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট ‘ইন্ডিয়া’ নামক রাষ্ট্র। তাঁর স্বাদেশিক চেতনা হচ্ছে জাতি হিসেবে ভারতীয়ত্বের অনুভব। তাঁর বক্তব্যের সারার্থ হচ্ছে, আমরা যদি জাতপাতে এত বিভক্ত হয়ে না থাকতাম, তাহলে জাতি হিসেবে ভারতীয় হয়ে উঠতে পারতাম।
কিন্তু সেটা কি সম্ভব ছিল? এর উত্তর পেতে গেলে আরো একবার আমাদের রামমোহনেই ফিরে যেতে হবে। খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে দেশের লোকের স্বাদেশিকতার অভাব নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন, ভূগোল-ইতিহাস মিশিয়ে তাঁর সেই দেশের প্রাচীন রূপটি তাঁর কাছে কী ছিল। যে রচনা থেকে দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে, তারই শুরুতে তিনি লিখছেন, “India, anciently called the ‘Bharat Varsa’ after the name of a monarch called ‘Bharat’...’’। তার কিছু পরে লিখছেন, এই বিশাল সাম্রাজ্যের বিশাল বিশাল সব ভূখণ্ড আগে বিভিন্ন নরপতিরা আলাদা আলাদাভাবে শাসন করতেন, রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন কিন্তু পরস্পরের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন। তাঁরা সব একই ধর্মের অনুসরণ করতেন, সংস্কৃত শাস্ত্রের অনুমোদিত শুদ্ধ-বিশুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। ভূখণ্ডগুলি নদী, পাহাড় অথবা কৃত্রিম সীমারেখা দ্বারা একটা আর একটার থেকে আলাদা হত। ব্রাহ্মণদের পবিত্র গ্রন্থাদি অনুযায়ী দুটো বড় বড় ভাগে এই ভূখণ্ডগুলি বিভক্ত ছিল। একটি ভাগ – সভ্য ও পুণ্য ভূমি (মনু পুণ্য ভূমি বলতে বুঝিয়েছেন যেখানে দেবতারা প্রায়ই গমনাগমন করতেন সেই সরস্বতী ও দৃশ্যদ্বতী এই দুই পবিত্র নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে, মুনিঋষিদের ভাষায় ব্রহ্মবর্ত)। সিন্ধু নদের তীর থেকে হিমালয়ের পাদদেশ ধরে ধরে বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত, যার মধ্যে পড়ে রাজমহল, বিহার, বারাণসী, এলাহাবাদের প্রদেশগুলি এবং নর্মদার উত্তর ধরে ধরে প্রায় ভারতের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত মালব, ভূখন্ডগুলির এই অংশটিকে বলা হত সভ্য ও পুণ্য ভূমি। পাদটীকায় লিখেছেন, মনু এই অংশটিকেই ‘আর্যাবর্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভূখন্ডগুলির দ্বিতীয় অংশটিকেও বলা হত সভ্য ভূমি, কিন্তু পুণ্য নয়। পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মাঝামাঝি ছিল তার অবস্থান এবং একটা অংশ মিশে যেত গঙ্গার মোহনায়, আর একটা অংশ মিশে যেত সিন্ধু নদের মোহনায় যার মধ্যে পড়ত গুজরাটের একটা বড় অংশ। এই দুটো সভ্যদেশের সীমানার বাইরে যেসব পাহাড়-পর্বত উপত্যকা সমতলভূমি, যদিও তারা ভারতবর্ষেরই অংশ, তাদের বলা হত ম্লেচ্ছদেশ অর্থাৎ সেখানে অসভ্যরা থাকে।
কিন্তু সত্যিই কি ইন্ডিয়া আর রামমোহন কথিত ভারতবর্ষ সমার্থক ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের স্বাদেশিকতা থাকা না থাকার প্রশ্নটি। সম্প্রতি ঐতিহাসিক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য সংক্ষেপে পেশ করা যেতে পারে।
বেদ, পুরাণ এবং কাব্য -- ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠা এই তিনরকমের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সত্তা হিসেবে ভারতবর্ষের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একেবারে গোড়ায় ছিল মানুষজন বা গোষ্ঠী অর্থে জন এবং ছিল তাদের বাসভূমি অর্থে জনপদ। ভরতও ছিল এরকমই একটা জন এবং তাদের জনপদের নামটাই সম্ভবত বিবর্তিত হতে হতে একসময় ভারতবর্ষে পরিণত হয়। কিন্তু এই ভারতবর্ষ ছিল একটা অংশবিশেষ, সমগ্র নয়। এই জন্যে নয় যে এরকম জনপদ আরো ছিল, যেমন, কুরু, কোশল, মগধ, বাৎস্য ইত্যাদি। তারা যার যার নামেই অভিহিত হত, ভারতবর্ষ নামে অভিহিত হত না। একটি মধ্যবর্তী অঞ্চল নির্ণয় করে তারই চারিপাশে ঐ জনপদগুলির অবস্থানকে নির্দেশ করা হত। ‘দিশ’ শব্দটা দিয়ে সেগুলির দিককে বোঝানো হত, এই ‘দিশ’ থেকে পরে ‘দেশ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। এই ‘দিশ’ শব্দটা দিয়ে ভারতবর্ষ কোন্দিকে সেটা বোঝানো হত। উপমহাদেশটার কোনো নিশ্চিত সীমানা ছিল না, কোনো ভৌগোলিক বন্ধনে আবদ্ধ নয়। পুরাণগুলি যতই আসমুদ্রহিমাচল বলে ভৌগোলিক সীমানা তৈরির চেষ্টা করুক না কেন, জনপদগুলি এবং জাতিগোষ্ঠীগুলি সেই ভৌগোলিক বন্ধনে কখনো বাঁধা পড়ে নি। রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য় আছে পৃথুদকের (আধুনিক হরিয়ানা) প্রান্ত থেকে শুরু উত্তরাপথের বাসিন্দারা হল শক, কেকয়, বন্যুজ, ভোক্কণ, হুন, কম্বোজ, লিম্পক, টঙ্গন, তুরুস্ক, তুশার ইত্যাদি জনেরা, যা দিশের দিক থেকে দেখলে ভৌগোলিক নয়। একইভাবে রাজশেখর ও অন্যান্য বহু সূত্রে শ্রীলংকাকে দেখানো হয়েছে দক্ষিণাপথের অংশ হিসেবে। পুরাণে বিশ্বলোকের বিবরণ দিয়ে ভারতবর্ষকে তার একটা অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাতে আছে বিশ্বলোকের সৃষ্টিবৃত্তান্ত এবং তারই একটা অংশ হিসেবে বর্ণিত আসমুদ্রহিমাচলের নিরিখে ভরত ছাড়াও অন্যান্য অনেক রাজবংশের বংশ ও তাঁদের রাজ্যের বিস্তৃতি তালিকা। কাব্যেও পুরাণের অনুরণন পাওয়া যায়। যেমন কালিদাসের ‘রঘুবংশ’। কিন্তু কালিদাসের রঘুবংশে রঘুর যে দিগ্বিজয় তার ভূগোল-ইতিহাস আবার অন্যরকম। ওদিকে মহাদেশের একটা অংশ বোঝানো হয় যে ‘বর্ষ’ শব্দটি দিয়ে, তার নিরিখে যদি ভারতবর্ষকে ধরা যায়, তাহলে সেখানে আছে জম্বুদ্বীপ, যে জম্বুদ্বীপ কর্মের আদর্শ দ্বারা চালিত হয়। অর্থাৎ শুধু ভূগোল নয়, বিবেচ্য বিষয় ছিল রাজবংশের ইতিহাস ও আদর্শও। এই জম্বুদ্বীপই হল সেই জায়গা যেখানকার বাসিন্দারা চতুর্বর্ণে বিভক্ত। এখানেও দিশের ব্যাপারটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সেই মধ্যাঞ্চল, যা ‘মধ্যদেশ’ বা ‘আর্যাবর্ত’ নামে খ্যাত। এই আর্যাবর্তই মডেল হিসেবে কাজ করত। এখানেই ছিল চতুর্বর্ণের এবং চতুরাশ্রমের অস্তিত্ব (মূলে শিষ্ট ব্যবহার)। কোনো জনপদ আর্যাবর্তের থেকে কতটা কাছে কিংবা কতটা দূরে তা নির্ণীত হত এই মডেলকে কতটা সেগুলি মেনে চলে তাই দিয়ে। এই হিসেবেই মনু আর্যাবর্তের বাইরের দেশগুলোকে ম্লেচ্ছদেশ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং তার চারিদিকের (দিক বিস্তৃত হতে হতে সাত বা নয়ও হতে পারত) জনপদগুলির বাসিন্দারা নিজেদের তাদের জনপদের পরিচয়েই চিহ্নিত করত, ভারতবর্ষের পরিচয়ে নয়। ফলে ভারতবর্ষের নিরিখে ‘স্বদেশ’ বা ‘স্বদেশী’ শব্দটা তাদের অজ্ঞাত ছিল, এবং বিপরীতভাবে যতই কেননা হানা ও বহিঃশক্তির আক্রমণে ভারতীয় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক, ‘বিদেশ’ বা ‘বিদেশী’ শব্দটাও তাদের অজ্ঞাত ছিল। এদিক থেকে তাদের মধ্যে কোনো ‘আমি’ ও ‘অন্য’ বিভাজন ছিল না। বিভাজন যেটা ছিল, সেটা ছিল বর্ণের ভিত্তিতে।
এই যে ভারতবর্ষ যার কোনো নিশ্চিত সীমা ছিল না এবং যা ছিল মূলত এমন এক ধারণা যার মধ্যে ঠাঁই হতে পারত বিচিত্র সামাজিক বৈশিষ্ট্য সহ বহু স্থানের, উপনিবেশিক পর্বে এসে তার নির্দিষ্ট সীমানা সৃষ্টি করে তাকে মানচিত্রের মধ্যে আবদ্ধ করে সুদৃঢ় প্রশাসন দিয়ে বেঁধে রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা হল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে রামমোহন যে ভারতবর্ষকে ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমার্থক করে দিয়েছিলেন, সেরকম কোনো ভারতবর্ষ অতীতে ছিল না। জনপদগুলোকে বাদ দিয়ে কোনো ভারতবর্ষ ছিল না, কিন্তু ঐসব জনপদের বাসিন্দাদের এক জাতি হিসেবে ভারতীয়ত্বের অনুভবও সম্ভব ছিল না। তাহলে রামমোহনের মধ্যে ইন্ডিয়ার সমার্থক এই ভারতবর্ষের ধারণা শেকড় গাড়ল কি করে? তিনি তো সংস্কৃতে এতটাই সুপণ্ডিত ছিলেন যে একটি লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উইলিয়ম জোন্সেরও ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তো দেখেছিলেন যে বেদ পুরাণ কাব্য মিলিয়ে আমাদের সৃষ্টিসম্ভারের বিচিত্র ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়েছে। সেটা কখনো ভূগোল-ইতিহাসগত, কখনো কল্পনাগত এবং কখনো আদর্শগত এবং একটা আর একটার সঙ্গে মেলে না। অতএব স্বীকার করতেই হয় ভারতবর্ষের ইতিহাসপাঠের ক্ষেত্রে উইলিয়ম জোন্স, জেমস মিল, জন ব্রুস, অ্যাডাম এন্ডারসন, জন ম্যালকম, স্যার টমাস রো, রবার্ট ওরমে, জেমস রেনেল, আলেক্সান্ডার ডাউ ইত্যাদি উপনিবেশিক ঐতিহাসিক রচিত ইতিহাস দ্বারা তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, নেশন বা জাতির ধারণাতেও তিনি তাঁদের অনুবর্তিতা করেছেন।
আসা যেতে পারে জনপদের কথায়। অখণ্ড ভারতবর্ষ হিসেবে না হয় না-ই হল, কিন্তু ঐসব জনপদের বাসিন্দাদের যার যার জায়গার প্রতি টানেরও কি অভাব ছিল, যাকে বলতে পারি দেশপ্রেম? এই প্রথম আমরা অপেক্ষাকৃত একটা কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়াই। Patriotism-এর কাজচালানো গোছের অর্থ যেমন স্বাদেশিকতা, কিংবা দেশহিতৈষিতা, ভাবগত অর্থ তেমনি দেশপ্রেম। পশ্চিমী মতে Patriotism কথাটার শব্দগত আভিধানিক অর্থ হল নিজের জায়গার সঙ্গে জাতিগত দিক থেকে, ভাষাগত দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে একাত্মবোধ। ওদিকে আবার বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যা, বিনয়, দয়া দাক্ষিণ্য, মহত্ত্ব ও সদাশয়তা এসব গুণকেও patriot-এর গুণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আমেরিকাতে যেখানে patriot শব্দটার সবথেকে বেশি প্রতিপত্তি, সেখানে খাঁটি patriot হচ্ছেন তিনিই, যিনি রাষ্ট্রের অন্যায় দেখলে দেশকে বাঁচাতে তার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত রাখেন। আরো একটা অর্থ আছে যেটা কোনো দেশের অভিধানেই পাওয়া যায় না। আমি যেখানে থাকি সেখানকার আলো, হাওয়া, জল, জঙ্গল, জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ সবের সঙ্গে আমার একাত্মবোধ, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, প্রেমের সম্পর্ক। পৃথিবীর সব দেশের সব জনপদের সম্পর্কে এই দেশপ্রেম সত্যি এবং স্বাভাবিক। তবে এই দেশপ্রেম বিশ্বচেতনার অংশ, এই দেশপ্রেমের মধ্যে আত্মপর বোধ নেই। এমনকি রামমোহনের যে স্বাদেশিকতা তাও প্রকৃতপক্ষে এই দেশপ্রেমই, যে জন্যে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্ক নিকট।
অতএব জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগের কারণে এ হেন দেশপ্রেমও ছিল না রামমোহনের এই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। এখানেও তিনি ইয়োরোপীয় ধ্যানধারণার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু রামমোহনের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুলও ছিল না। এটা ঠিকই, জাতপাতের অজস্র ভাগ-উপভাগ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ককে নষ্ট করে দিয়ে দেশপ্রেমকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছিল। কেমনভাবে দিচ্ছিল সেটা দেখানোর আগে প্রাচীন ভারতের একটা মনোহর ছবি তুলে ধরি, কারণ সেটাও বাস্তব এবং তার খেই ধরেই আমাদের এগোতে হবে।
যে বেদ থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শুরু বলে আমরা মনে করি, সেই বেদের অজস্র সূক্ত আলো, হাওয়া, জল, জঙ্গল, জমির প্রতি অকৃত্রিম প্রেমের পরিচয়ে ভরপুর। শুধু প্রকৃতি নয়, নানান ভাষার নানান ধর্মের মানুষের কথাও সেখানে সহাবস্থানের সূত্রে দিব্যি ফুটে উঠেছে।
নানান ভাষা নানান ধরম মানুষ নানান-তর্
পিত্থিমি তো পালেন সবায় যার যেখানে ঘর।
(বেদের কবিতাঃ গৌরী ধর্মপাল)
ফুটে উঠেছে সভাসমিতির কথাও। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের ব্যাখ্যায়, এই সভাই পরবর্তী কালে সমাজে পরিণত হয়।
যত গ্রাম আছে যত অরণ্য
যত সভা আছে ভূমিতে
যত মানুষের মেলা ও সমিতি
তোর গুণ গাব সবেতে।
(বেদের কবিতাঃ গৌরী ধর্মপাল)
প্রাচীন ভারতের সভাসমিতি নিয়ে বিদ্যাভূষণ দুটো গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, বর্ণব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে এইসব সভাসমিতিগুলোই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করত, সমাজ পরিচালনা করত। বিদ্যাভূষণ একটা চমৎকার কথা লিখেছিলেন, “সভা ছিল সামাজিকভাবে মেলামেশার কেন্দ্র—আর সমিতি ছিল সমগ্র জনসাধারণের সঙ্ঘবদ্ধ বাণী।”
সমিতিতে রাজাকে উপস্থিত থাকতে হত। প্রয়োজন হলে সমিতি রাজা নির্বাচনও করে দিত। প্রয়োজন হলে এরা রাজাকে পদচ্যুত অব্দি করতে পারত। রাজকার্য পরিচালনার জন্যে অমাত্যসভা ছিল। এই অমাত্যদের পরামর্শ না নিয়ে কোনো কিছু করার অধিকার রাজার ছিল না। যদিও এই সভায় রাজা নেতৃত্ব করতেন, সভায় থাকত চারজন ব্রাহ্মণ, আটজন ক্ষত্রিয়, একুশজন বৈশ্য, তিনজন শূদ্র ও একজন সুত। এই সাঁইত্রিশ জনের মধ্যে আটজন আইনকানুন গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হত।
গ্রামে বা নগরে এক এক জাতির বাড়ি শ্রেণিবদ্ধ আকারে থাকত। পঙক্তিগুলিকে বলা হত ‘সমুদায়’। সমুদায়গুলো ছিল পাড়ার অনুরূপ। পাড়াগুলো ছিল যেন এক একটা পরিবারের মতন। পাড়ার লোকে সারাদিনের কাজের শেষে এক জায়গায় মিলিত হত। তাদের সামাজিক ও ব্যবসায়িক জীবন কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হত। আর সেই নিয়মগুলি সকলেই ধর্মজ্ঞানে মেনে চলত। পাড়ায় সকলে পরস্পর বিয়ে, পানভোজন প্রভৃতি বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামাজিক নিয়মকানুন সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলত। কারো অবস্থা খারাপ হলে সাহায্য পেত। পরস্পরের সাহায্য ও স্বার্থ রক্ষের জন্যে তারা ‘বার্তিক’ নিয়ম মেনে চলত। এসবের জন্যে সমিতি বসত। মন্দির, পুণ্যশালা, ধর্মশালা, হাসপাতাল ইত্যাদি পরিচালনের জন্যে সভাসমিতিতে রীতিমত বৈঠক চলত।
তখন গ্রাম ও নগরের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মের তফাৎ ছিল না। নগরগুলোও সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা স্বীকার করত। নগরগুলি কেন্দ্রস্বরূপ এবং সেই বৃত্তকে ঘিরে চারিপাশে সরলরেখায় গ্রামগুলির অবস্থান [এখানেও সেই একই নিয়মের অনুবর্তিতা, যে নিয়মে মধ্যাঞ্চল এবং তার চারিপাশের জনপদগুলিকে বোঝানো হত]। গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নগরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত এবং সে হিসেবে অন্যান্য গ্রামগুলির সঙ্গেও।
প্রাচীন ভারতে সবাইকে বিকেলের দিকে সভাসমিতিতে যেতে হত। সেখানে অনেক কাজের কথা হত। গোরু আর চাষের উন্নতি নিয়ে আলোচনা হত। মিউনিসিপ্যাল বোর্ড ও লোকাল বোর্ডের কাজও সভাসমিতি থেকে চলত। এখান থেকে সময়ে সময়ে বিচারালয়ের কাজও চলত। রাস্তাঘাট তৈরি, খানাডোবা যাতে অস্বাস্থ্যকর না হয়, জলনিকাশের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত এসবেরও ব্যবস্থা করা হত। আর একটা যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ব্যক্তিকে কখনো সমাজের ওপরে ঠাঁই দেওয়া হত না [অর্থাৎ আমাদের দেশে ‘ইন্ডিভিজুয়ালিজ্ম্’ ব্যাপারটা ছিল না। এটাও উপনিবেশিক শাসকদের অবদান]।
যদি বলি এই লেখাটা তখনকার যখন জাতীয়তাবাদ আমাদের এখানে শেকড় গেড়ে গেছে এবং দেশের ইতিহাসকে মহত্ত্বমণ্ডিত করে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে তাহলে হয়ত ভুল বলব না, আবার পুরোপুরি ঠিকও বলব না। বিদ্যাভূষণ অবশ্যই বানিয়ে বানিয়ে এই বর্ণনা করেন নি। এই ছবিটা সম্ভবত সেই সময়কার যখন বর্ণ ছিল কর্মভিত্তিক, অর্থাৎ পেশাগত ব্যাপার। আম্বেদকরের ইতিহাসপাঠ অনুযায়ী একেবারে গোড়ায় বর্ণের কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না এবং মর্যাদার বাইরে ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু শেষ মৌর্য সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) ক্ষমতায় বসার সময় থেকে মনুর (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) হাতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র জন্ম নেয়। এই বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে সাতটা পরিবর্তন পাকাপাকি আনতে পেরেছিল। আম্বেদকর মনুস্মৃতি থেকে একে একে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, ১. ব্রাহ্মণরা শাসন করার ও রাজহত্যা করার অধিকার প্রাপ্ত হয়; ২. ব্রাহ্মণরা একটি বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়; ৩. বর্ণকে তারা জাতে রূপান্তরিত করে; ৪. বিভিন্ন জাতের ভেতর সংঘর্ষের ও অসামাজিক অনুভবের বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়; ৫. শূদ্র এবং নারীদের অধোগামী করে; ৬. সমাজে নানারকম শ্রেণিভাগ করে অসাম্যের সূচনা করে; ও ৭. সামাজিক ব্যবস্থাকে আইনানুগ ও কঠোর করে তোলে যা আগে ছিল না।
ভারতীয় ইতিহাসের প্রায় শুরু থেকেই এই জাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে ছবি আমরা পাই সেই ছবিটাই আসল ভারতবর্ষের ছবি এবং সে ছবির মূলে শ্রেণি ও বর্গ নির্বিশেষে দেশপ্রেম। ব্রাহ্মণরা ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করতে করতে যে দেশপ্রেমকে নষ্ট করে দিচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে এবং মাঝেমধ্যে ছেদ সহ মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলন পর্যন্ত বয়ে এসেছিল। আম্বেদকর একটা খুব চিত্তাকর্ষক কথা বলেছেন, মুসলিম শাসকদের হাতে আসার আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের লড়াইয়ের ইতিহাস। এমনকি মুসলিম শাসকদের আমলেও যে ভক্তি আন্দোলনের বিকাশ আমরা দেখি, তার মধ্যেও প্রচ্ছন্নভাবে বৌদ্ধধর্মের ছায়া দুর্লক্ষ্য নয়। যদিও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বারেবারেই ভারী হয়ে বুকের ওপর চেপে বসেছে যার প্রমাণ পাই বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশের ইতিহাসে, যখন গোস্বামীরা নব্য-এলিট হয়ে দেখা দিল এবং নিম্নবর্গের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরকমই এক গোস্বামীর সঙ্গে রামমোহন বিচারে বসেছিলেন।
...
সে যা হোক, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রামমোহনের হাত ধরে বাংলায় ইন্ডিয়া বা ভারতবর্ষকেন্দ্রিক patriotism বা –স্বাদেশিকতার ধারণা প্রবেশ করল (আগেই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এ স্বাদেশিকতা দেশপ্রেমের থেকে ভাবগত দিক থেকে ভিন্ন)। সমসাময়িক রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু তাঁর গানে স্বাদেশিকতার আর এক রূপ ফুটিয়ে তুললেন যার প্রকাশক্ষেত্র প্রাদেশিক। একটা আর একটার অপর পিঠ। তিনি গাইলেন, “নানান্ দেশে নানান্ ভাষা / বিনে স্বদেশীয় ভাষে পুরে কি আশা।” (কামদ খাম্বাজ; তাল জলদ্ তেতালা)।
রামমোহনের স্বাদেশিকতা শুধু যে ইন্ডিয়াকেন্দ্রিক ছিল তাই নয়, ছিল প্রধানত বুদ্ধি, যুক্তি ও বিচারবোধকেন্দ্রিকও। রামমোহন ছিলেন কী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কী সামাজিক জীবনে প্রধানত বুদ্ধি, যুক্তি ও বিচারবোধের দ্বারা চালিত এক মস্ত মানুষ, একমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্র বাদে হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দেবার প্রবণতা তাঁর মধ্যে তেমন দেখা যায়নি। সে প্রবণতা ছিল ডিরোজিওর মধ্যে। বিদ্যাসাগর এলেন তাঁদের দুজনেরই উত্তরাধিকার নিয়ে। বুদ্ধি যুক্তি বিচারবোধ তাঁর মধ্যে কিছু কম ছিল না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। রামমোহনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি যে মেয়েদের জন্যে অবিরাম অশ্রুপাত নিয়ে এলেন, সে অশ্রুপাত ছিল ডিরোজিওর উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি যে প্রবল হৃদয়বত্তা নিয়ে এলেন তারই অংশ। এখানে অবশ্যই একটা কথা যোগ করা দরকার। প্রবল হৃদয়বত্তার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর ডিরোজিওর উত্তরাধিকারী হলেও বৃহত্তর অর্থে শৈশব থেকে তাঁর ভেতরে হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দেবার প্রবণতা গড়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা ভগবতী দেবী। সত্যি বলতে কি, বিদ্যাসাগর জীবনীর থেকে ভগবতী দেবীর জীবনী কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিদ্যাসাগর নিজেই একবার বলেছিলেন, মায়ের গুণের একশ শতাংশের এক ভাগও যদি আমি পেতাম তাহলে ধন্য হয়ে যেতাম।
বিদ্যাসাগরঃ কিছু এলোমেলো ভাবনা
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে যথার্থ patriot বলেছিলেন, তবে এজন্যে নয় যে বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর ছিলেন কিংবা তাঁর প্রবল হৃদয়বত্তা ছিল। তাঁর মতে এসব গুণ থাকলে একজনকে বড় জোর philanthropist বলা যায়। তাঁর যুক্তি ছিল অন্যরকম।
“আপনারা হয়ত মনে করিতেছেন যে, তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, দীন দুঃখীদিগের মা-বাপ ছিলেন, বিধবা রমণীদিগের সন্তাপানলে নয়নজল বর্ষণ করিতেন, সেই কারণে আমি তাঁহাকে patriot বলিতেছি। এরূপ অবিচার আপনারা আমার প্রতি করিবেন না। তিনি যদি একশত বিশ্ব-বিদ্যালয় স্থাপন করিতেন, শত সহস্র দরিদ্র লোককে Rothschilde করিয়া দিতেন, দশ কোটি বিধবার মৃত সাধব্য পুনর্জীবিত করিতেন, তাহা হইলে শুদ্ধ বলিতাম তিনি মস্ত একজন philanthropist। Patriot তাঁহাকে বলিতেছি আরেক কারণে। যখন তিনি Woodrow সাহেবের অধীনতা শৃঙ্খল ছিন্ন করিয়া নিঃসম্বল হস্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন পূর্বক লেখনী যন্ত্র দ্বারা জীবিকা সংস্থানের পথ কাটিতে আরম্ভ করিলেন, তখন বুঝিলাম যে হাঁ, ইনি patriot যেহেতু ইনি খাওয়া পরা অপেক্ষা স্বাধীনতাকে প্রিয় বলিয়া জানেন। যখন দেখিলাম যে, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সারাংশ সমস্তই ক্রোড় পাতিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, অথচ সে সভ্যতার কৃত্রিম কুহকাংশে পদাঘাত করিয়া স্বদেশীয় উচ্চ অঙ্গের সভ্যতা—বিদ্যা বিনয় দয়া দাক্ষিণ্য মহত্ত্ব এবং সদাশয়তা—সমস্তই আপনাতে মূর্তিমান করিয়াছেন, তখন বুঝিলাম যে, এ ব্রাহ্মণের অন্তঃকরণ সত্যসত্যই patriot ছাঁচে গঠিত।”
কিন্তু খাওয়া পরা অপেক্ষা স্বাধীনতাকে প্রিয় বলে জানার জন্যে শুধু নয়, সাহেবের অধীনতা শৃঙ্খল ছিন্ন করার আর এক অর্থ আছে। সেটা হল রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো। ওদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাঙালির ইংরেজনবিশীর যে উন্মত্ততা তাকে প্রত্যাখান করে আমাদের উচ্চ অঙ্গের সভ্যতার মধ্যে উপ্ত যে প্রবল হৃদয়বত্তা সেগুলিও বিদ্যাসাগর শুধু যে ‘আপনাতে মূর্তিমান’ করেছিলেন তা তো নয়, তিনি চেয়েছিলেন এতদ্বারা বাঙালি সমাজেও শুষ্ক বুদ্ধি যুক্তি বিচারবোধের তলে তলে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো প্রবল হৃদয়বত্তা বইয়ে দিতে। ইতস্তত তাঁর নানারকম মন্তব্যের মধ্যে তাঁর সেই মনোভাবের আভাস পাওয়া যায়।
বিদ্যাসাগর চরিত্রের ব্যাখ্যা বুদ্ধিজীবীরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, বাঙালি সাধারণ সমাজ বিদ্যাসাগরকে যে মাথায় তুলে রেখেছিল সে শুধু তাঁর বিচিত্র কার্যকলাপের কারণে নয়, সবকিছুর মধ্যে তাঁর যে হৃদয়বত্তার প্রকাশ ঘটেছিল তাই প্রত্যক্ষ করে। সম্ভবত এটা লক্ষ করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চৈতন্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। গ্রাম-গঞ্জ–মফঃস্বল থেকে শুধুমাত্র তাঁর দর্শনলাভের আশায় ছুটে আসত, তিনি সেসব জায়গায় গেলে দূরদূরান্ত থেকে তাঁকে দেখতে আসত। কলকাতায় এলে একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য ছিলেন বিদ্যাসাগরও। বিচিত্র কার্যকলাপ আরো অনেক বড় মাপের মানুষের ছিল, কিন্তু তাঁদের দেখতে লোকে ছুটে আসত না। সাধারণ মানুষ হৃদয়টাকে সবথেকে বড় করে দেখে।
তবে প্রশ্ন হতে পারে সামগ্রিকভাবে সে হৃদয়বত্তা বাঙালি সমাজের অন্তরে প্রবেশ করল না কেন? বাঙালি সমাজকে বিমূর্ত হিসেবে ভাবলে এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ দুটি প্রধান বর্গে বিভক্ত ছিল—উচ্চ ও নিম্ন। যদিও নিম্নবর্গ সমাজটাই বিশাল কিন্তু তাদের কোনো ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল না। সংখ্যায় নগণ্য হলেও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল উচ্চবর্গ সমাজের করায়ত্ত। বর্গের এই ভাগ কোনো বর্ণের ভিত্তিতে ছিল না। উচ্চবর্গের মধ্যে নিম্নবর্ণের লোকও ছিলেন, যেমন কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন জাতে তিলি, যেমন বাবু রাজকৃষ্ণ মাঢ় ছিলেন কৈবর্ত, রামদুলাল দে সরকারও উঁচু জাত থেকে আসেন নি, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন জাতে সদগোপ। একইভাবে নিম্ন বর্গের মধ্যেও উচ্চ বর্ণের লোক ছিল, যেমন বিশেষ করে গ্রাম সমাজের অঙ্গীভূত ব্রাহ্মণরা। ব্রিটিশরা গ্রাম সমাজকে ধ্বংস করতে শুরু করে দেওয়ার পর থেকে প্রধানত তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তাঁরা ছিলেন মূলত পরাশ্রয়ী ও উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। গ্রামের যাবতীয় অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করে আর টোলে ছাত্র পড়িয়ে তাঁদের যা আয় হত তাতে সংসার চলে যেত। কিন্তু ক্রমশ তাঁদের অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাদেশের সাধারণ আর্থিক অবনতি ও গ্রাম সমাজের অতি দ্রুত ভাঙনের মধ্যে এই ব্রাহ্মণসমাজের অপরিসীম দুর্গতির শুরু হয়। বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন,
একমুঠো অন্নের জন্য তাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছেন, অনেক সময় অনাহার ও অপমানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সপরিবারে মৃত্যুবরণও করেছেন। খ্রীষ্টান মিশনারীদের জার্নালে, রোজনাম্চায় ও রিপোর্টে তার অনেক মর্মান্তিক কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এই অবস্থায় এইসব ব্রাহ্মণরা বেঁচে থাকার খাতিরে কৌলিন্য প্রথাকে বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। ঘুরিয়ে বললে নিম্ন বর্গের সাধারণ স্বভাব যে বিদ্রোহ তার থেকে সরে গিয়ে উচ্চবর্ণের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র অনুযায়ী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। আর একবার বিনয় ঘোষে যাই,
অনুলোমপ্রথা বা Hypergamy-র জন্য কুলীন সমাজে বহুবিবাহ আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, কিন্তু প্রথমে দু’চারজন স্ত্রীর মধ্যেই সাধারণত তা সীমাবদ্ধ থাকত। পরে যত মেলবন্ধন হয়েছে, তত সংকুচিত মেলের গণ্ডীর জন্য একস্বামীর বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। তারপর ধীরে ধীরে বিবাহটা কুলীন ব্রাহ্মণের জাত-ব্যবসায়ে পরিণত হতে দেরি হয় নি, আর্থিক কারণে। তখন শতাধিক বিবাহ পর্যন্ত হতেও বাধা রইল না।
এরই প্রতিফল হিসেবে বালবিধবার সংখ্যা বেড়েছে। কুলীনের স্ত্রী বাপের বাড়িতে থাকে, এমনিতেই আর্থিক বোঝা, তার ওপর তার আছে বৈধব্যের যন্ত্রণা। অতএব দায়মুক্তির অপকৌশল হল সহমরণ, গায়ে এঁটে দেওয়া হল সতীত্বের আদর্শ। বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে সহমরণের সংখ্যা সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কোনো শাস্ত্রীয় বা আদর্শগত যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায় না।
এই যে ব্রাহ্মণসমাজ এই সমাজই বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রোধের, বাল্যবিবাহ রোধের ও বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টার বিরোধিতা করেছিল। এ ব্যাপারে তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, তিনি ছিলেন বাংলার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অবিসংবাদী নেতা। উচ্চবর্গ সমাজের এটাই ছিল সবথেকে বড় অংশ। এই অংশের মধ্যে আর এক ভাগে ছিলেন একদল নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, যাঁরা দেশ-সমাজ নিয়ে মাথা ঘামাতেন ঠিকই, তাঁদের সেরকম কোনো স্বার্থবোধও ছিল না, কিন্তু তাঁরা ছিলেন বেজায় গোঁড়া, আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যুক্তির আলোকে দেখতে মোটেই রাজি ছিলেন না। এঁরাও ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেবের অনুগামী। আর একটা অংশ ছিল, তারা ছিল ইংরেজদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, কোনো সামাজিক ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। তৃতীয় অংশটা ছিল আকারে খুবই ছোটো, দেশ নিয়ে সমাজ নিয়ে এঁরাও মাথা ঘামাতেন। তবে তাঁদের মধ্যেও আবার তিনটি ভাগ ছিল। একদল মনে করতেন ইয়োরোপের অনুসরণ করাই শ্রেয় যেহেতু ওরাই ব্যাপারগুলো ভালো বোঝে। আর একদল সমন্বয়ে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সে সমন্বয় সবসময় সুচিন্তিত হত না। ছিলেন আরো একদল যাঁরা প্রয়োজনমত নতুন যুক্তির আলোয় নিজের দেশকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু ইয়োরোপের দ্বারা প্রভাবিত হতেন কমই। বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন এই দলে বা বলা যায় তিনিই ছিলেন এই ধারার পুরোধা অভিযাত্রী। নিজের দেশের সঙ্গে সম্যক পরিচিত বিদ্যাসাগর প্রতিটি ক্ষেত্রে ইয়োরোপীয় পদ্ধতিকে বাজিয়ে নিয়ে তবেই গ্রহণ করতেন। আর তিনি যে তাঁর কাজেকর্মে সমর্থন পেয়েছিলেন সেটা মোটামুটি এই তৃতীয় অংশের।
ওদিকে নিম্নবর্গ সমাজের অবস্থা ছিল তথৈবচ। এই বর্গের অংশ উচ্চবর্ণ যে ব্রাহ্মণরা তারা তো ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে নিয়েছিল, বাকিরা বরাবরই স্বভাব-মূক, অনুচ্চকিত, articulate নয় তারা। তাই বিদ্যাসাগরের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা কোনো ইতিহাসে লেখা নেই। কদাচিৎ জেলেপাড়ার সঙের গানে আমরা শুনতে পাব,
বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে
সদরে করেছ রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।
কবে হবে এমন দিন প্রচার হবে এ আইন,
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরোবে হুকুম
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম
সধবাদের সঙ্গে যাব বরণডালা মাথায় লয়ে।
বিদ্যাসাগরের এইসব সমাজ সংস্কার– বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ রোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন –এই নিয়ে Lucy Carroll একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হিন্দু জনসংখ্যার অন্তর্গত যে শূদ্ররা ও দলিতরা, যারা মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ ছিল না এবং বিধবাবিবাহেও কোনো বাধা ছিল না। অর্থাৎ এগুলো গোটা সমাজের সমস্যা ছিল না। এগুলো ছিল উচ্চবর্ণের সমস্যা। সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টাকে উচ্চ বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যে বিদ্যাসাগর প্রায়ই সমালোচিত হয়ে থাকেন, যদিও সেসব সমালোচনার মধ্যে সত্যতা নেই। প্রথম কথা প্রগতিশীল শূদ্র ও দলিত সমাজের মধ্যে এসব সমস্যা ছিল না বললে এটা দাঁড়ায় না যে সে সমাজে আর কোনো ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষাসংস্কারের খুবই প্রয়োজন ছিল এবং বিদ্যাসাগর তা নিয়ে প্রাণপাত করেছিলেন। দ্বিতীয় কথা গোটা সমাজের সমস্যা নয় বলে কোনো সংস্কারকে উপেক্ষা করার যুক্তিটি ঠিক যুক্তি নয়। তাহলে জ্যোতিবা ফুলে যখন দলিতদের জন্য লড়াই করেন, তখন আমরা এই বলে তাঁর লড়াইকে নস্যাৎ করে দিতে পারি যে সেটা গোটা সমাজের জন্যে নয়। বিদ্যাসাগরের সময়কার ব্রাহ্মণ নারীদের অবস্থা দলিতদের থেকে কিছু ভালো ছিল না।
আরো একটা কথা আছে। সেটা বিধবাবিবাহের ব্যাপারে। সম্ভবত বিধবাদের বিয়ে শূদ্রদের মধ্যেও চালু ছিল না। আঠেরোশো ছিয়াত্তর সালের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ (১৯ অগস্ট) লিখেছিল যে, তাঁতি নাপিত ধোপাদের মধ্যে বিধবাদের বিয়ে চালু না থাকার কারণে লোকসংখ্যা কমছে। নব্য সম্প্রদায় উচ্চ শ্রেণির মধ্যে বিধবাবিবাহের জন্যে যত পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করছেন সেইরকম পরিশ্রম ও অর্থব্যয় যদি তাঁরা শিল্প ও শ্রমজীবীদের জন্যেও করতেন তাহলে মঙ্গল হত। এর অর্থ হচ্ছে যে শুধু উচ্চবর্ণের মধ্যে নয়, নিম্নবর্ণের মধ্যেও বিধবাবিবাহের ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল। কারণটা দুর্বোধ্য নয়। রঘুনন্দন শূদ্রদের দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন—সৎ শূদ্র ও অসৎ শূদ্র। যারা তাঁর বিধান মেনে চলবে, তারা সৎ শূদ্র। যারা মেনে চলবে না, তারা অসৎ শূদ্র। তাঁতি, নাপিত, ধোপারা ছিল সৎ শূদ্র। যেহেতু তখনকার ধারণা অনুযায়ী রঘুনন্দন বিধবাবিবাহের অনুমোদন দেন নি, তাই বিধবাবিবাহের বাধা না থাকলেও পরিবারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হত না। যদিও পরে জানা যায় রঘুনন্দন বিধবাবিবাহের ব্যাপারে বাধা দেন নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন পাশের পরেও সে উদ্যোগ নেওয়া হল না কেন? উত্তরে বলা যায় বিদ্যাসাগরের একার পক্ষে এতদিকে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব ছিল না আর নব্য সম্প্রদায়ের যে ছোট্ট অংশটি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছিল, তাদের আগ্রহের দৌড় অতদূর পৌঁছয় নি।
বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় কীর্তি শিক্ষাসংস্কার। এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রসঙ্গে আসার আগে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে শুধু একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করি। বিদ্যাসাগর ব্যালান্টাইনের প্রতিবেদনের প্রত্যুত্তরে যে বলেছিলেন, “[t]hat the Vedanta and Sankhya are false systems of Philosophy is no more a matter of dispute.” এই কথাটার অর্থ অনেকেই ধরেছেন যে বিদ্যাসাগর এই দর্শন দুটোকে ভ্রান্ত দর্শন বলে অভিহিত করেছেন। এটি একটি ভুল ধারণা। ‘false’ শব্দটা আমাদের দর্শনচর্চায় ‘ভ্রান্ত’ হিসেবে নয়, ‘নেতিবাচক’ হিসেবে ব্যাখ্যাত।
এবার জেনে নেওয়া যাক বিদ্যাসাগর আসরে নামার আগে আমাদের দেশে বাংলা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কিরকম ছিল। এদেশের অগণিত সাধারণ মানুষকে তাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষা দেবার কথা উইলিয়ম কেরি প্রথম বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সে প্রস্তাবে সরকার তেমন সাড়া দেয়নি। এর অনেক পরে সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ১৮৩৫ সালে উইলিয়ম অ্যাডাম সাহেব বাংলা ও বিহার জুড়ে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটা সমীক্ষা করেছিলেন এবং ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ এই সময়কাল ধরে তিনটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। সেই প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছিলেন তখনো বাংলা ও বিহার জুড়ে বাংলা শিক্ষার জন্যে এক লক্ষের বেশি পাঠশালা রয়েছে। সেই প্রতিবেদনে তিনি একথাও বলেছিলেন যে যদিও এইসব পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থা আদিম পর্যায়ের, তবু যে পদ্ধতিতে এইসব পাঠশালায় শিক্ষা দেওয়া হয় সে শিক্ষা চাষীদের, ছোটোখাটো জমির মালিকদের এবং দোকানদারদের খুব কাজে আসে। পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্র’ বইতে এইসব পাঠশালায় কি কি পড়ানো হত তার এবং তার সঙ্গে ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। এইসব পাঠশালায় প্রধানত ব্যবহারিক এবং কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। পাঠশালার পাঠ্যক্রম মানে শুভঙ্করী। শুভঙ্করী মতে আগে অক্ষর পরিচয়, তারপর বানান শিক্ষা, তারপর আর্যা। অঙ্কের গণনা ছাড়া ধানের ওপর যেসব হিসেব পাঠশালায় শেখানো হত, তার মধ্যে ছিল ধানের মাপ, মজুত চালের হিসেব, ধান কেনাবেচার জন্যে টাকার দরে আনার দরে ধানের হিসেব। শুধু ধান নয়, ধান, চাল, গুড়, সর্ষে এসব কেনাবেচার জন্যেও উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত। শস্য ছাড়াও সোনা, রুপো, তামা, কাঁসা, রাং ইত্যাদির বাসনপত্র কেনার পদ্ধতি শেখানো হত। নিখুঁত মাপজোকের জন্যে নানারকম কালি শেখানো হত—ইট কালি, নৌকো কালি, দেওয়াল কালি, পুষ্করিণী কালি ইত্যাদি। সময় নিরূপণ এবং বার-তিথির নিয়ম জানার জন্যে অল্প অল্প জ্যোতিষও শেখানো হত। কবিরাজি চিকিৎসায় অনুপানের ঠিকঠাক মাপ জানার জন্যে ‘চিকিচ্ছায় তোলার পরিমাণ’ শেখানো হত। তাছাড়া ছিল চিঠিপত্র লেখার ধারা, নাম লেখার ধারা, গ্রাম লেখার ধারা, আরো কত কি। শেখানো হত নীতিকথাও। সতীর্থদের সঙ্গে সবসময় ভালো ব্যবহার করবে, প্রত্যেক পড়ুয়া মনে রাখবে তারা সমবেত হয়েছে কোনো গুরুমশায়ের পাঠশালায় নয়, এটি তাদের ‘গৃহ-নীড়’। প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে বাক্যে ও আচরণে যেন যত্ন ও শিষ্ট ভাব প্রকাশ পায়। শিক্ষককে বা দীক্ষাদাতা গুরুকে যেন সযত্নে এবং কায়ক্লেশে সেবা করা হয়। এইভাবে শিশুদের মানস-ক্ষেত্রে শান্ত ও ভদ্র জীবন এবং মানবিকতাবোধের বীজটি বুনে দিতেন গ্রাম্য গুরুমশায়।
পাঠশালার গুরুমশায় ও ছাত্র প্রসঙ্গে মণ্ডল জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণ দুরকমের গুরুমশায়ই ছিলেন, তবে সাধারণত ব্রাহ্মণেতর জাতির ছাত্ররাই এইসব পাঠশালায় পড়তে আসত। আসত মুসলমান ছাত্ররাও, যদিও তাদের জন্যে আলাদা শিক্ষণপদ্ধতিও চালু ছিল। পঞ্চানন মণ্ডলের লেখা থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় না, সেটা হল চাষবাস সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে অন্য সূত্র থেকে জানা যায় ফসল কাটার সময় শিশুরা বাড়ির লোককে সাহায্যে ব্যস্ত থাকার কারণে ঐ সময়টা পাঠশালা বন্ধ থাকত।
এবার দেখা যাক পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার এই ছবিটা বিদ্যাসাগরের হাতে কিভাবে কতখানি বদলে গেল। সবথেকে বড় পরিবর্তনটার কথা গোড়াতেই বলে নিই, সেটা হল মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো। শুধু উচ্চবর্ণ নয়, নিম্নবর্ণের মধ্যেও মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর চল অল্পই ছিল।
এবার আসা যাক পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার কথায়। প্রথম বদল এল বর্ণমালায়। আগেকার ষোলো স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন (চৌতিশা) মিলে পঞ্চাশ অক্ষরের যে বর্ণমালা ছিল বিদ্যাসাগর তাকে বারো স্বর আর চল্লিশ ব্যঞ্জনে দাঁড় করালেন। দীর্ঘ ‘ঋ’ আর দীর্ঘ ‘৯’র যেহেতু প্রয়োগ নেই, সে দুটোকে ছেঁটে ফেললেন। যেহেতু অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণের মধ্যে গণ্য হতে পারে না, সেগুলোকে ঠাঁই দিলেন ব্যঞ্জনবর্ণের শেষে। ড়, ঢ় ও য় যেহেতু পদের অন্তে থাকে এবং আকার ও উচ্চারণে ড, ঢ ও য-র থেকে আলাদা, সেহেতু ঐ তিনটি হয়ে দাঁড়াল স্বতন্ত্র বর্ণ এবং চন্দ্রবিন্দুও হয়ে দাঁড়াল স্বতন্ত্র বর্ণ। ক ও ষ মিলে যেহেতু ক্ষ হয় অর্থাৎ সংযুক্ত বর্ণ, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকা থেকে তাকেও বাদ দিলেন। পুরো সংস্কারটা এত বিজ্ঞানসম্মত যে প্রশংসা না করে থাকা যায় না, অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও তিনি আগেকার কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্ক হারান নি।
এরপর ‘বোধোদয়’এর কথা বলা যায়। পদার্থকে ঈশ্বরের ওপরে ঠাঁই দেবার জন্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বইটি আদরের। খেয়াল করে পড়লে দেখা যায় বিদ্যাসাগর এই বইতে একদিকে পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার যতটুকু রক্ষার উপযুক্ত সেটুকুকে রক্ষা করছেন, অপরদিকে একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। পদার্থের চেতন-অচেতন, মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদ, ভাষা, কাল, বস্তুর আকার ও পরিমাণ, বর্ণ (অর্থাৎ রং), ধাতু, কয়লা, কেরোসিন তেল, জল-নদী–সমুদ্র, কৃষিকাজ, শিল্প-বাণিজ্য-সমাজ, আরো কত কি।
বোধোদয়ের দুটো জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিদ্যাসাগরই প্রথম গ্রামবাংলার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি চালু করেছিলেন, কিন্তু সেই তিনিই ‘বাক্যকথন ভাষা’য় নিম্নলিখিত উপদেশ উচ্চারণ করেছিলেন,
“ইংলণ্ডীয় লোকে অর্থাৎ ইঙ্গরেজদিগের ভাষা ইঙ্গরেজী। ইঙ্গরেজেরা এক্ষণে আমাদের দেশের রাজা সুতরাং ইঙ্গরেজী আমাদের রাজভাষা। এ নিমিত্ত সকলে আগ্রহপূর্বক ইঙ্গরেজী শিখে। কিন্তু অগ্রে জাতিভাষা না শিখিয়া, পরের ভাষা শিক্ষা কোনও মতে উচিত নহে।”
‘কৃষিকাজ’এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন,
“ইদানিং অনেকেই কৃষিকর্মকে অশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন। কিন্তু বাস্তবিক উহা অতি সম্মানের কার্য।”
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কবি নবীনচন্দ্র সেনকে তিনি যা বলেছিলেন সেটা নবীনচন্দ্রের বয়ানে,
“এই পোড়া শিক্ষা এই দেশ হইতে উঠিয়া গেলেই ভাল হয়। আমি আমার গ্রামে একটি স্কুল খুলিয়াছি। আর তাহার ফলে আমি দেশত্যাগী হইয়াছি। চাষাভুষার ছেলেরা পর্যন্ত যেই দু পাত ইংরাজি পড়িতে আরম্ভ করিল, আর তার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িল। তাহাদের ভালো কাপড় চাহি, জুতা চাহি, মোজা চাহি, মাথায় টেরিটি পর্যন্ত চাহি। এখন আমার বাড়ী যাইবার জো নাই। গেলেই কেহ বলে—‘দাদাঠাকুর! তুমি কি করিলে? ছেলেটি একবার ক্ষেতের দিকে ফিরিয়াও চাহে না। আমার আধা জমির চাষ হইল না। খাইব কি? ইহারও বাবুয়ানার খরচই কোথা হইতে যোগাইব?’ কেহ বলে—‘আমার গরুগুলি মারা গেল। ছেলেটি তাহাদের কাছে একবারও যায় না। চরান দূরে থাকুক। আমার উপায় কি হইবে?’ আমি যেমন পাপ করিয়াছি, আমার তেমন প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে। আমি আর পাড়াগাঁয়ে স্কুলের নামমাত্র করিব না। এদেশ তেমন নহে যে, লেখাপড়া শিখিয়া আপন আপন ব্যবসা ভাল করিয়া করিবে। এ লক্ষ্মীছাড়া ছেলেগুলা দু পাত ইংরেজি পড়িলেই আপনার পৈতৃক ব্যবসা ছাড়িয়া দেয়; আপনার পিতামাতাকে পর্যন্ত ঘৃণা করে।”
বিদ্যাসাগরের এই বক্তব্য থেকে সমাজ নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতটি বেশ বোঝা যায়। সে মতের দিক থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির পূর্বসূরি। তাঁর মানসিকতা ছিল দেশপ্রেমের, ঠিক স্বাদেশিকতার নয়। দেশের সমস্ত কিছুর প্রতিই ছিল তাঁর আত্মার টান। গোরুর দুধ খাওয়ার জন্যে বাছুরটা মায়ের দুধ না খেয়ে থাকে বলে তিনি গোরুর দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি সমাজ-রাজনীতির দিকে যান নি। শোনা যায় কলকাতায় যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৮৮৬ সালের অধিবেশন হচ্ছিল, তাই নিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বাবুরা তাদের সম্মেলন করছে। তারা লম্বাচওড়া বুলি ঝাড়ছে, বক্তৃতা দিচ্ছে এবং এইভাবেই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করছে। হাজার হাজার লোক প্রতিদিন অনাহারে যে মারা যাচ্ছে সেটা তাদের ভাবনার বিষয় নয়। এই রাজনীতি করে কি হবে?” যখন কিছু আগ্রহী ব্যক্তি গিয়ে বিদ্যাসাগরকে কংগ্রেসে যোগ দিতে বলে, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বাধীনতার জন্যে কর্তারা কি অস্ত্র ধরতে পারবেন?”
২০১৫-এর প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পর সারা বিশ্ব নতুন আশায় উদীপ্ত হয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও বাগবিতণ্ডার পর সিওপি-২১-এর অধিবেশনে গৃহীত এই চুক্তিতে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটা ঠিক হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি অঙ্গীকার করে গড় ভূ-তাপমাত্রার (average global temperature) বৃদ্ধি শিল্পায়নের আগের স্তর থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে। এটাও ঠিক হয় যদি সম্ভব হয় তাহলে ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে। এই চুক্তি পৃথিবীর মানুষকে উদ্দীপনা জুগিয়ে ছিল। মানুষ ভেবেছিল ভূ-উষ্ণায়নের (global warming) মোকাবিলায় একটা সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া গেল। পৃথিবীর সব প্রান্তের কোটি কোটি মানুষ তাই অন্তর থেকে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তারপর থেকে যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষ বুঝতে পারছে ভূ-উষ্ণায়নের মোকাবিলায় চুক্তি করে ভাল ভাল কথা বলা সহজ। কিন্তু তাকে কাজে পরিণত করায় বিস্তর বাধা। ভূ- উষ্ণায়নের দাপটে মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি হতেই থাকছে। একের পর এক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে (disaster) মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু মৃত্যু ও আঘাতজনিত ক্ষয়ক্ষতিই নয়, ক্ষতি হচ্ছে জীবিকার, সম্পদের, পরিবেশের, সভ্যতার ও সংস্কৃতির। ধীরে ধীরে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতারা মুখে যতই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলুন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিন, আসলে সবটাই ফাঁকা, অন্তঃসারশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগে এত কুটিল, নোংরা বিশ্ব রাজনীতি কাজ করছে, এত জটিল রাষ্ট্রীয় ও ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে, যে তার কানাগলি থেকে এরকম উদ্যোগকে বার করে, বসুন্ধরার প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচানো বোধহয় অসম্ভব। সিওপি-২১-এর ঐতিহাসিক চুত্তি সম্পাদনের পর প্রতি বছরই সাড়ম্বরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা যেন সাংবাৎসরিক একটা উৎসব পালনের মতো হয়ে গেছে। মানুষে জেনে গেছে এখানে এসে বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্রনেতারা পরিবেশের জন্য মড়াকান্না কাঁদবেন, গালভরা প্রতিশ্রুতি দেবেন, ‘টেক্সট’ লিখতে দিস্তা দিস্তা কাগজের অপচয় হবে। পরিবেশবাদীরা মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে, পরিবেশের রক্ষার তাগিদে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবেন। ‘টেক্সট’ লিখতে কতরকম ভাষার শৈলী, কতরকম প্যাঁচ-পয়জার ঘটানো যায়, তার প্রতিযোগিতা চলবে। এভাবে অধিবেশনের শেষে প্রচুর দড়ি টানাটানি করে কথার ফুলঝুরি ভরা ‘টেক্সট’ প্রকাশিত হবে। তারপর যে কে সেই। একটা অধিবেশন শেষ করে, আর একটা অধিবেশনের অপেক্ষা চলবে বছরভর ধরে।
সিওপি-২১-এর পর থেকে আরও পাঁচটি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে বিগত ছয় বছরে। কিন্তু প্রাপ্তির ছবিটার খুব বড় রকম হেরফের ঘটে নি। এই আনুষ্ঠানিকতার ধারা বজায় রেখেই এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আসর বসেছিল মিশরের শর্ম এল-শেখ (Sharm El-Sheikh) শহরে ৬-১৮ নভেম্বর, ২০২২-এর দুটো সপ্তাহ জুড়ে। দেখা গেল নির্দিষ্ট সময়ে অধিবেশন শেষ করা যাচ্ছে না। দুদিন বাড়াতে হল অধিবেশনের মেয়াদ। এতও করেও প্রত্যাশা যা ছিল, তার কিছুটা পূরণ হল। বেশীটাই অধরা বা না-পাওয়া থেকে গেল। তবে যা পাওয়া গেল, তা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের শিকার হচ্ছে এমন গরীব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কিছু প্রাপ্তির আশার সঞ্চার করল বৈকি। এই পটভূমিতেই এই নিবন্ধের রচনা। আলোচনার বিস্তারে যাওয়ার আগে গোড়ার কথাগুলো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
গোড়ার কথা
চিন্তাভাবনা শূন্য বেলাগাম উন্নয়নের পথে ছুটতে গিয়ে পৃথিবীর যে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, এটা গত শতকে মানুষ বেশ ভালই টের পেয়েছিল। বল্গাহীন গতিতে জীবাশ্ম জ্বালানীর (fossil fuel) ব্যবহারের ফলে পরিবেশে গ্রীণহাউস গ্যাসের (greenhouse gas) নিঃসরণ (emission) বহুগুণে বাড়ছিল। এর সাথে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে বনজঙ্গল ধ্বংস করায় ও নদী এবং ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের বেহিসাবি খরচ করায় পরিবেশের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছিল। পৃথিবীতে বাড়ছিল অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস, অনাবৃষ্টি, খরা, সমুদ্রঝড় প্রভৃতির মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা (extreme weather events)। ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটছিল। সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চল ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল। বাদাবন ধ্বংসের, অবলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছিল। পৃথিবীর শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, পরিবেশ কর্মী, মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়কেরা, বিশেষত বিপন্ন দেশগুলোর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনেতারা ভাবছিল কিছু একটা করা দরকার। শিল্পোন্নত ধনী রাষ্ট্রগুলি (industrialized rich countries) ২০০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়েছে, নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করেছে। আর তার খেসারত গুণতে হচ্ছে শিল্পে পেছিয়ে থাকা উন্নয়নশীল গরীব দেশগুলোকে। এইসব মানুষদের চাপে ১৯৯২ সালের জুন মাসে (3 to 14 June, 1992) ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে (Rio de Janerio) রাষ্ট্রপুঞ্জের (United Nations) উদ্যোগে পরিবেশের ও উন্নয়নের এক বিশ্ব সম্মেলন (United Nations Conference on Environment and Development, বা সংক্ষেপে UNCED) অনুষ্ঠিত হয়। এর চলতি নাম ধরিত্রী সম্মেলন (Earth Summit)। এই সভায় ১৫২ টি দেশের স্বাক্ষরিত এক আন্তর্জাতিক চুক্তি তৈরী হয়। এই চুক্তির পোশাকী নাম United Nations Framework Convention on Climate Change বা সংক্ষেপে UNFCCC বা FCCC. এফসিসিসি-এর উদ্দেশ্য ছিল বাতাসে গ্রীণহাউস গ্যাসের পরিমাণকে এমন এক স্থিতিশীল মাত্রায় নিয়ে আসা, যাতে আবাহাওয়া ব্যবস্থায় মনুষ্যসৃষ্ট ক্রিয়াকলাপ যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাকে রোধ করা যায়। জলবায়ু নিয়ে গবেষণা, নিয়মিত মিটিং, আলোচনা, ভবিষ্যৎ নীতি প্রণয়ন প্রভৃতির সংস্থান রাখা হয় এই চুক্তিতে। এসবের উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে (ecosystem) মানিয়ে নিতে (adaptation) সহায়তা করা, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া যাতে কোন ভাবে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি যাতে সুস্থিতভাবে (in a sustainable manner) বিকশিত হয় তার ব্যবস্থা করা। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অবশ্য চুক্তি মেনে চলার কোন আইনী বাধ্যবাধকতা ছিল না। এই চুক্তি গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের কোন উর্ধসীমা দেশগুলোকে মানতে হবে এমন কথা বলে নি। এই মেনে চলার ব্যাপারটা লাগু করার কোন সংস্থানও তৈরী করে নি। চুক্তিতে স্থির হয় দেশগুলো নিজেদের জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য (emission inventories) এফসিসিসি-কে জানাবে।
এটা কিন্তু কোন মতেই খুব নগণ্য একটা কাজ ছিল না। সদস্য দেশগুলোর নিঃসরণ সংক্রান্ত তথ্য এফসিসিসি-এর হাতে এলে, কোন দেশ কতটা নিঃসরণ ঘটাচ্ছে তা জানা যাবে। আর এর ভিত্তিতেই হয়ত ভবিষ্যতে দেশগুলোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিঃসরণের মাত্রা নির্ধারণ করা যাবে। তাই ব্রাজিলের ধরিত্রী সম্মেলন নিঃসরণে রাশ টেনে ভূ-উষ্ণায়ন কমানো ও পরিবেশকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে প্রথম কিছু সদর্থক পদক্ষেপ করেছিল বৈকি।
এফসিসিসি-এর চূড়ান্ত নির্ণায়ক পরিষদ হল Conference of Parties বা COP (সিওপি)। ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ সিওপি কার্যভার গ্রহণ করে। যে দেশগুলি কনভেনশনের সদস্য বা Parties তারা সকলেই সিওপি-তে অন্তর্ভুক্ত হয়। সিওপি-র কাজ হল কনভেনশনের লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়ন করা। এই লক্ষ্যগুলোর প্রয়োগের বিষয়ে পর্যালোচনা করা এবং সেই সংক্রান্ত আইনী দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখে বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সদস্য দেশগুলো তাদের নিজেদের নিঃসরণের যে তথ্য পরিষদে পেশ করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা ও দেশগুলোর সাথে এ নিয়ে চিঠিচাপাটির (communications) চালচালি করাও পরিষদের কাজের মধ্যে পড়ে। এইসবের মধ্য দিয়ে কনভেনশনের মূল লক্ষ্যগুলোর পূরণে কি অগ্রগতি ঘটছে তার নিরন্তর মূল্যায়ন করে পরিষদ।
এবারের সম্মেলনটি নিয়ে পৃথিবীতে এযাবৎ সাতাশটি সিওপি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিওপি-র সেক্রেটারিয়েট প্রথমে জেনেভাতে হলেও, পরে ১৯৯৬ সালে জার্মানির বন (Boon) শহরে স্থানান্তরিত হয়। সিওপি-র সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একটি ব্যুরো (Bureau) রয়েছে। একজন সভাপতি (President), সাতজন সহ-সভাপতি (Vice President), বিভিন্ন উপ-সমিতিগুলোর প্রধানরা (Heads of Subsidiary Bodies) এবং একজন প্রতিবেদক (Rapporteur) – এই নিয়ে ব্যুরো গঠিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের পাঁচটি স্বীকৃত অঞ্চল যথা, আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যত্র, এদের দেশগুলোর মধ্যে ঘুরেফিরে সভাপতিত্বের (Presidency) দায়িত্ব বর্তায়। সিওপি-র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সির প্রভাব (বা কুপ্রভাব) যে কতটা, তা বিশেষ করে এবারের সম্মেলনে মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। সে কথায় পরে আসব।
কি হল এত সম্মেলনের শেষে?
এবারে সিওপি বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় আসার আগে আগের সম্মেলনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো একবার খতিয়ে দেখে নেওয়া যাক। এই লেখকের আগের একটি লেখায় ২০১৭ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২৩ টি সিওপি-র সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। উৎসাহী পাঠক তা একবার দেখে নিতে পারেন। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনটি (সিওপি ৩) হয় জাপানের কিয়োটো শহরে, ১৯৯৭-এর ডিসেম্বরে। সভায় এই প্রথম গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের ব্যাপারে দেশগুলি একমত হয় এবং একটি অঙ্গীকার করে। এই অঙ্গীকার ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ নামেখ্যাত। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ কনভেনশনের নীতি এবং সংস্থানের (principles and provisions) ভিত্তিতে তৈরী এবং কনভেনশনের লক্ষ্যগুলি কাজে রূপান্তরিত করাই (operationalization) প্রোটোকলের উদ্দেশ্য। প্রোটোকল শিল্পোন্নত দেশগুলোকে গ্রীণহাউস গ্যাস বা জিএইচজি (greenhouse gas or GHG) নিঃসরণ হ্রাসের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরই স্থির-করা লক্ষ্যমাত্রা (target) পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ করায়। এই অঙ্গীকারের ভিত্তি হল এই যে বর্তমানের অত্যন্ত বেশী পরিমাণে জিএইচজি নিঃসরণের জন্য দায়ী প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলো এবং তার দায় তাদেরই নিতে হবে (…… the Protocol ‘only binds developed countries, and places a haviour burden on them under the principle of “common but differentiated responsibilities and respective capabilities”, because it recognizes that they are largely responsible for the current high levels of GHG emissions in the atmosphere’)। এই প্রোটোকলের গঠন (structure) সংযুক্তি-মূলক (annexure based)। এই প্রোটোকলে প্রস্তাবিত অঙ্গীকারে দেশগুলো যে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (ratification) দেয় তার প্রক্রিয়া বড় জটিল। এই জন্য ১৯৯৭-এর ১১ জানুয়ারিতে এই প্রোটোকল গৃহীত হলেও, এটা কার্যে পরিণত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫-এ। এখনও পর্যন্ত ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এ সম্মত পার্টির সংখ্যা ১৯২। প্রোটোকলের অ্যানেক্সার – বি (Annexure-B) -তে, শিল্পোন্নত দেশ, রুপান্তারশীল অর্থনীতির দেশ (Economies in Transition or EIT) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) মিলিয়ে ৩৭ টি দেশের জন্য নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা (emission reduction target) নির্ধারিত হয় । মোটের উপর ১৯৯০ সালে নিঃসরণের যে মাত্রা ছিল, গড়ে তার প্রায় ৫% নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ২০০৮ থেকে ২০১২ সময়কালের (first commitment period) জন্য (সারণী -১)।
‘কিয়োটো প্রোটোকল’ সদস্য দেশগুলোকে অ্যানেক্সার ১ (Annexure 1) এবং নন-অ্যানেক্সার-১ (Non-Annexure 1) পার্টিস (parties) – এই দুইভাগে বিভক্ত করে। অ্যানেক্সার – বি -এর অধীন যেসব দেশ প্রোটোকলে প্রস্তাবিত অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (ratification) দেয় এবং আইনগত ভাবে নির্ধারিত নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা মেনে চলতে বাধ্য থাকে, তারাই অ্যানেক্সার ১-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। পক্ষান্তরে, নন-অ্যানেক্সার-১ পার্টিস হল মূলত উন্নয়নশীল দেশসমূহ। তাদের জন্য নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কোন আইনী বাধ্যবাধকতা রাখা হয় না। তাদের জন্য কেবল নিঃসরণের তথ্য রিপোর্ট করলেই চলবে, এমনটা ঠিক হয়। এই ভাগাভাগি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো উন্নয়নশীল বলে, নন-অ্যানেক্সার-১ (Non-Annexure 1) পার্টিসের দলভুক্ত হয়। যদিও তারা বিশ্বের সর্বোচ্চ জিওজি নিঃসরণের দেশগুলোর অন্যতম। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ভারত ২০২০ সালে CO2 নিঃসরণের (আয়তনের ভিত্তিতে) নিরিখে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। যদিও জনপিছু নিঃসরণ ধরলে ভারত বিশ্বের গড় নিঃসরণের এক তৃতীয়াংশেরও কম নিঃসরণ সৃষ্টি করে। শিল্পায়ন পরবর্তী কালে অর্থাৎ ১৮৫০ থেকে ১৯৯০ এই সময়ের মধ্যে ভারতের মোট নিঃসরণ (cumulative emission) সম সময়ের বিশ্বের নিঃসরণের মাত্র ৩%; আমেরিকা ও ইইউ-এর ক্ষেত্রে এই নিঃসরণের মান যথাক্রমে ২৫ ও ১৭%। শক্তির জন্য ভারতকে অধিকমাত্রায় কয়লার উপর নির্ভর করতে হয়। পশ্চিমী ধনী দেশগুলো কম নিঃসরণের জ্বালানী বলে তেল ও গ্যাসকে ছাড় দিয়ে এই কঠিন জীবাশ্ম জ্বালানীকেই নিঃসরণের জন্য প্রধান অপরাধী হিসাবে দাগিয়ে দিতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছিল। কিয়োটো সভার পরে ভারত ক্রমাগত এর তীব্র প্রতিবাদ করে এবং মূলত ভারতের চাপেই কয়লার সাথে তেল ও গ্যাসকেও নিঃসরণের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানী বলে স্বীকার করে নিয়েই পরবর্তী কালে আলোচনা চালাতে হয়। সে যাই হোক, এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা আমেরিকা মোটেই ভালোভাবে নেয় নি। এবং মূলত এই কারণেই আমেরিকা ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ -এর অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি জানায়। এই বিষয়টাই ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর সময়সীমা (২০১২) উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই চুক্তির কি পরিণতি হবে, তা নিয়ে গভীর বিতর্কের সূত্রপাত করে।
কিয়োটোর সভায় ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ ছাড়াও আরও একগুচ্ছ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এরা ‘কিয়োটো মেকানিজম’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে জিএইচজি নিঃসরণ কেনাবেচা (emission trading), স্বচ্ছ উন্নয়ন মেকানিজম (clean development mechanism), যৌথ রুপায়ণ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নিঃসরণ কেনাবেচার ব্যবস্থা থেকেই এক নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই মুদ্রার নাম ‘কার্বন মুদ্রা’ (carbon credit)। কার্বন মুদ্রার একক হল এক টন কার্বন। কোন দেশ যদি এক মিলিয়ন (দশ লক্ষ) একক কার্বন মুদ্রার অধিকারী হয়, তাহলে সেই দেশ এক মিলিয়ন টন কার্বন (CO2 হিসাবে) বাতাসে ছাড়তে পারবে। তেমনি কোন দেশ যদি এক মিলিয়ন একক কার্বন ঋণী হয়, তবে সেই দেশকে এক মিলিয়ন টন কার্বন (CO2 হিসাবে) বাতাস থেকে সরাবার বা শুষে নেওয়ার (carbon sequestration) বন্দোবস্ত করতে হবে। বাতাস থেকে কার্বন সরাবার বা শুষে নেওয়ার প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। উন্নয়নশীল এবং গরীব দেশগুলো এই অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল প্রযুক্তি কোথায় পাবে? বিকল্প ব্যবস্থার তাই সংস্থান রাখা হয়। ঠিক হয় কার্বন ঋণী দেশগুলোর কাছে এই প্রযুক্তি না থাকলে, তারা ডলারের মূল্যে কার্বন মুদ্রা অন্য দেশ থেকে কিনতে পারবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এই ব্যবস্থা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কিয়োটোর পরবর্তী বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (সিওপি-৬; ১৩-২৫ নভেম্বর, ২০০০, দ্য হেগ, নেদারল্যান্ড) এই নিয়ে আকচাআকচি ন্যাক্কারজনক পর্যায়ে চলে যায়। আমেরিকা তার বনভূমি ও কৃষিক্ষেত্রের জন্য কার্বন মুদ্রা দাবি করে। এবং এই অর্জিত কার্বন মুদ্রার বিনিময়েই সে জিএইচজি হ্রাসের প্রতিশ্রুতি পালনের দাবি করে। তার এই অন্যায্য দাবি ইইউ ও অন্যরা মেনে নেয় নি। ফলশ্রুতিতে আমেরিকা ২০০১ সালে ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ মানার ব্যাপারে তার অসম্মতি জানায়। তবে এ সত্ত্বেও আমেরিকা প্রতিনিধি না হয়ে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবে বলে সম্মত হয়। ধনী দেশগুলোর চাপে পরের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টাকাপয়সা দিয়ে সহায়তা দেবে, যাতে তারা কার্বন মুদ্রা ক্রয়ের মাধ্যমে নিঃসরণ হ্রাসের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে। আর, ধনী দেশগুলো এই টাকাপয়সা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে ছাড় পেয়ে যাবে। আরও ঠিক হয় কার্বন মুদ্রার কেনাবেচার কোন সর্বোচ্চ সীমা থাকবে না। এইসব ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়, যাতে শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলোর নিঃসরণ ছড়ানো বজায় থাকবে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে উন্নত করার জন্য নিঃসরণ ছড়ালে তাদের ডলারের মূল্যে তার দায় চোকাতে হবে। কালক্রমে ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ লাগু হওয়ার প্রথম সময়সীমা (first commitment period; 2008-2012) এসে যায়। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর চুক্তিমত নিঃসরণ কমাতে অ্যানেক্সার-১-ভুক্ত বহুদেশই রাজী হয় নি। অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগার ভয়ে ও প্রতিযোগিতা (competition) হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় বহুদেশই আলোচনায় নিঃসরণ কমানোর প্রসঙ্গ সতর্কভাবে এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক স্বার্থ ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনের মধ্যে চূড়ান্ত ফারাক (disconnect between political processes and scientific imperative) লক্ষ্য করা যায়।
এইভাবেই নানা দোটানার মধ্যে দিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন এগুতে থাকে। এরই মধ্যে সিওপি-১৮-এর সভায় (সিওপি-১৮, ২৬ নভেম্বর-০৭ ডিসেম্বর, ২০১২, দোহা, কাতার) ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর সংশোধনী গৃহীত হয়। ঠিক হয়, ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ ২০১২’র পরও ২০২০ পর্যন্ত চালু থাকবে। এই সভার আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই সভাই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল সম্বন্ধীয় ভাষ্যের চূড়ান্ত রূপ দেয়। গরীব রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল, ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সংঘটিত চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির (বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, সমুদ্র ঝড় প্রভৃতি) তারই বারংবার শিকার হচ্ছে। অথচ, ভূ-উষ্ণায়ন ঘটার পিছনে নিঃসরণ ছড়ানোয় তাদের ভূমিকা অতি সামান্য। প্রায় দু শতকেরও বেশী সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে নিঃসরণ ছড়িয়ে ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো ভূ-উষ্ণায়ন ঘটিয়েছে। তাই তার দায়ও তাদেরই নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এটাই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের ধারণা। দোহার সভায় একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, নিঃসরণ হ্রাসের সংশোধনীটি আটকেই থাকে।
এরপর বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার ব্যাপারে খুব বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় সিওপি-২১-এর সভায় (সিওপি-২১, ৩০ নভেম্বর-১২ ডিসেম্বর, ২০১৫, প্যারিস, ফ্রান্স)। এই সভায় ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া হবে, এই মর্মে এক চুক্তি হয়। এই চুক্তি প্যারিস চুক্তি নামে খ্যাত। ‘ডারবান প্ল্যাটফর্ম’-এর (সিওপি -১৭, ২৮ নভেম্বর-০৯ ডিসেম্বর, ২০১১, ডারবান, দক্ষিণ আফ্রিকা) ভিত্তিতে যে কাজকর্মের সূচনা হয়েছিল, প্যারিস চুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। চুক্তিতে ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো অঙ্গীকার করে ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পায়নের পূর্ববর্তী পর্যায়ের থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এটাও ঠিক হয় যদি সম্ভব হয়, ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি বেঁধে রাখার লক্ষ্য হবে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশগুলো আরও অঙ্গীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তহবিল (green climate fund) এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার অর্থ বা ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল (loss and damage fund) দুটো আলাদা বিষয় হিসাবে ধরা হবে।
প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের মানুষ আশা করেছিল জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় একটা সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া গেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ কিন্তু সমানেই চলছে। আর এরই আবহে বিশ্বের বিপন্ন মানুষ খুঁজে চলেছে পরিত্রাণের উপায়। এরই মাঝে বড় বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ঘটনা ঘটছে। ঘটেছে কভিড অতিমারির মতো ঘটনা। তার ফলে সংঘটিত দীর্ঘ লকডাউনের মতো ঘটনা বিশ্বের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্পদের। এ সম্পদ তার শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক সম্পদ। ইউরোপে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছে। মধ্য এশিয়ায় সংঘর্ষ অব্যাহত। জ্বালানীর দাম বেড়েছে হু হু করে। এ সবেরই প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর উপর। এতসবের মাঝেও চেষ্টাও চলেছে নিরলস এই সবুজ গ্রহটিকে কি করে ভূ-উষ্ণায়নের মতো সাংঘাতিক সংকট থেকে বাঁচানো যায়। সেই চেষ্টায় অগণিত মানুষ সামিল হয়েছেন। তাদের অনেকেই সরকারী প্রতিনিধি নন। আবার অনেক মানুষ চেষ্টা করছেন যাতে সব ভাল চেষ্টা বানচাল করে দেওয়া যায়। প্রাধান্য পায় রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থ। এই সদিচ্ছা ও অনিচ্ছার লড়াই, স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের সংঘাত এবং সর্বোপরি ধনী ও দরিদ্রের সংগ্রামে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিটি অধিবেশনই কমবেশী বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এবারের সম্মেলনেও এই ধারার কোন ব্যতিক্রম হয় নি। তবুও মাঝে মধ্যে কোন কোন বিশ্ব জলবায়ু সভা যেমন ঐতিহাসিক কিছু পদক্ষেপের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে, এবারের সভাও তেমনি মানুষের মনে হয়ত এক নতুন আশার উদ্রেককারী হিসাবে দাগ কেটে যাবে, যে দাগ মিলিয়ে যাবে না কোনদিন। অন্তত যতদিন মানুষের সভ্যতা বেঁচে থাকবে,ততদিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল চলছেই
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার ঘটনার কিন্তু বিরাম নেই। এবছরেই পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছে। সে দেশের এক তৃতীয়াংশ বন্যা প্লাবিত হয়। মৃতের সংখ্যা ১৭৩৯, আহত হয়েছেন ১২,৮৬৭ জন। আমেরিকাতে এযাবৎ ঘটা সবচেয়ে ক্ষতিকারক তিনটি সমুদ্র ঝড়ের (hurricane) একটি হয়েছে এবারে। এবারেই আফ্রিকা দেখেছে খরা-জনিত ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ (famine)। ইউরোপ ও চীন প্রত্যক্ষ করেছে ভয়াবহ খরা (draughts)। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র প্রভাব পড়েছে অসহনীয় তাপপ্রভাবের (heat waves)। এ বছরই ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছে প্রায় ৫০০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম গ্রীষ্ম (hottest summer)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ইউরোপে তাপপ্রবাহের কারণে মৃতের সংখ্যা ১৫,০০০।
বার্লিনের উন্নয়ন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা, জার্মানওয়াচ (Germanwatch), ফি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করে একটি রিপোর্ট বের করে। কোন দেশের বা কোন অঞ্চলের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা বোঝানোর জন্য সংস্থাটি একটি ইনডেক্সিং ব্যবস্থা চালু করেছে। এই ব্যবস্থার নাম ‘বিশ্ব আবহাওয়ার ঝুঁকির অঙ্ক’ বা ‘Global Climate Risk Index (GCRI)’। সংস্থাটির শেষ প্রতিবেদনটি বের হয় ২০২১ সালে যার নাম Global Climate Risk Index -2021. ‘আবহাওয়ার ঝুঁকির অঙ্ক’ (Climate Risk Index বা CRI) দিয়ে চরম আবহাওয়ার ঘটনার প্রভাবকে পরিমাণগতভাবে বিশ্লেষণ (quantitative analysis) করা হয়। এই প্রভাবের মধ্যে জীবনহানি (fatalities) ও আর্থিক ক্ষতি (economic loss), দুইই বিবেচিত হয়। এই বিবেচনার আওতায় আনা হয় – (১) জলবায়ু জনিত ঘটনা বা weather-related events (ঝঞ্ঝা (strom), চরম তাপমাত্রা (temperature extremes), তাপপ্রবাহ (heat wave) এবং শৈত প্রবাহ (cold wave), ইত্যাদি), (২) জীবনহানি (number of deaths), (৩) বীমাকৃত ক্ষতি (insured damages) এবং (৪) মোট আর্থিক ক্ষতি (total economic damages)।
কোন দেশের সিআরআই (CRI) নির্ণয় করার জন্য চারটি প্যারামিটার হিসাব করা হয়। প্রতিটি প্যারামিটার আবার স্থান-নির্ভর (rank based), অর্থাৎ, ঐ বিশেষ প্যারামিটারের ক্ষেত্রে ঐ দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে কততম স্থানে (rank) রয়েছে সেই সংখ্যা। প্রতিটি প্যারামিটারের জন্য একটি মূল্যমান (weightage) নির্ধারণ করা হয়।
জীবনহানি বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যার নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল একটি প্যারামিটার (পি১) যার weightage হল ১/৬; প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় মৃত্যুর নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল দ্বিতীয় একটি প্যারামিটার (পি২) যার weightage হল ১/৩; আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্রয় ক্ষমতার সমতা বা Purchasing Power Parity (PPP)-এর ক্ষতির নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল তৃতীয় একটি প্যারামিটার (পি৩) যার weightage হল ১/৬; আবার জিডিপি-এর ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রতি একক জিডিপি-তে (per unit Gross Domestic Product বা per unit GDP) ক্ষতির নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল চতুর্থ একটি প্যারামিটার (পি৪) যার weightage হল ১/৩;
এখন, দেশটির সিআরআই (CRI) = পি১ × ১/৬ + পি২ × ১/৩ + পি৩ × ১/৬ + পি৪ × ১/৩
যেমন, ২০০০-২০১৯ এই সময়কালে বাংলাদেশ চরম আবহাওয়ার কারণে বার্ষিক মৃত্যুর নিরিখে পৃথিবীতে নবম স্থানে (9th) রয়েছে। প্রতি এক লাখে মৃত্যুর নিরিখে পৃথিবীতে সাইত্রিশতম (37th) স্থানে রয়েছে। ক্রয় ক্ষমতার সমতার ক্ষতির নিরিখে তেরতম (13th) স্থানে রয়েছে। আবার প্রতি একক জিডিপি-তে ক্ষতির নিরিখে সাইত্রিশতম (37th) স্থানে রয়েছে। তাই,
বাংলাদেশের সিআরআই (CRI) = ৯ × ১/৬ + ৩৭ × ১/৩ + ১৩ × ১/৬ + ৩৭ × ১/৩ = ২৮.৩৩
কোন দেশের সিআরআই যত কম হয়, তত বেশীমাত্রায় সে দেশটি যে চরম আবহাওয়ার কারণে দুর্যোগপীড়িত হয়েছে তা বোঝা যায়। ২০১৯ সালে চরম আবহাওয়া জনিত কারণে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের আলোচনা করলে এটা বোঝা যাবে। বোঝা যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরন্তর কেমন করে ছোবল মেরে চলেছে। এই ১০ টি দেশের ৫টি আফ্রিকার (মোজাম্বিক (সিআরাই স্কোর=২.৬৭), মালাভি (সিআরাই স্কোর=১৫.১৭), জিম্বাবুয়ে (সিআরাই স্কোর = ৬.১৭), নাইজার (সিআরাই স্কোর=১৮.১৭) ও দক্ষিণ সুদান (সিআরাই স্কোর=১৭.৩৩)), ৩ টি এশিয়ার (আফগানিস্তান (সিআরাই স্কোর=১৬.০০), জাপান (সিআরাই স্কোর=১৪.৫০) ও ভারত (সিআরাই স্কোর=১৬.৬৭)), ১টি দক্ষিণ আমেরিকার (বলিভিয়া (সিআরাই স্কোর=১৯.৬৭)) এবং ১টি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে (দ্য বাহামাস (সিআরাই স্কোর=৬.৫০))। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি ঝড় ইডাই (Idai) ২০১৯-এর মার্চে মাদাগাসকার (Madagascar), মোজাম্বিক (Mozambique), মালাভি (Malawi) এবং জিম্বাবুয়ে (Zimbabwe)-য় সাংঘাতিক বন্যা ঘটায়। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়েকে আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর চরম আবহাওয়ার ঘটনা বলে মনে করা হয়। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৯৫ কিমি বেগে বইতে থাকা ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে বন্যা ও ভূমিধসে প্রায় ১৬০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২.২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের আর্থিক ক্ষতি হয়।
ইডাই-এর দেঢ় মাস পর আর একটি ঘূর্ণিঝড়, কেনিথ (Kenneth), আছড়ে পড়ে উত্তর মোজাম্বিকে। এটিকে আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বলা হয়, বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২০ কিমি। ২৫ লক্ষ মানুষ বন্যাক্রান্ত হন, ২ লক্ষ বাড়ী ঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোজাম্বিকের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক। ২০১৯-এর জুন থেকে বছরের শেষাবধি অতিবৃষ্টির কারণে দক্ষিণ সুদানে সাংঘাতিক বন্যা হয়। ৯ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হন, ৭৪০০০ হেক্টর কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় প্রায় ৭০০০০ মেট্রিক টন খেতের ফসল। অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা হয় আফ্রিকার আর একটি দেশ নাইজারে। ২ লক্ষের বেশী মানুষ আক্রান্ত হন, ১৬০০০ বাড়ীঘর বিনষ্ট হয়। মৃত্যু হয় ৫৭ জনের।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপানে ২০১৯-এর অক্টোবরে ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী টাইফুন, হাগিবিস (Hagibis), আছড়ে পড়ে। এর দাপটে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিমি। ৭২ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৭৫০-১০০০ মিমি, যা জাপানের গড় বৃষ্টিপাতের ৫০-৭০% বেশী। ১০০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ২৩০ জন। ১৩০০ বাড়ীঘর ধ্বংস হয়। পরের মাসে আবার একটা টাইফুন, ফাসাই (Faxai)-এর কবলে পড়ে জাপান। এই দুই টাইফুনে সে দেশের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। এরপরই বলতে হয় ভারতের কথা। ভারতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষা সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ২০১৯-এ বর্ষা সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। স্বাভাবিকের ১১০% বৃষ্টিপাত হয়। এই অতিবৃষ্টির কারণে ১৪ টি রাজ্য জুড়ে হওয়া বন্যায় ১৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। ১ কোটি ১৮ লক্ষ মানুষ বন্যা কবলিত হন। ১৮ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ার আর একটি দেশ আফগানিস্তানও পুরো ২০১৯ জুড়েই কয়েক দফা বন্যা ও ভূমিধ্বসের মোকাবিলা করে। এর মধ্যে মার্চের বন্যা ছিল অতি প্রবল। ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হন। ১২০০০ ঘরবাড়ী বিনষ্ট হয়। ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়াও আছে জানুয়ারি ও ডিসেম্বরের ভূমিধসের ঘটনা। এতে প্রাণ হারান আরও ৩৫ জন।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় সাঙ্ঘাতিক দাবানল (forest fire) দেখা যায় ২০১৯-এ। এর ফলে ২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ও ঘাসজমি (grass land) পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। জীববৈচিত্র্যের (bio-diversity) যে ক্ষতিসাধন হয় তা পূরণ হতে ৩০০ বছরেরও বেশী সময় লেগে যাবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। এছাড়াও বলিভিয়া গোটা ২০১৯ ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি ও তার ফলে বন্যার প্রকোপের মোকাবিলা করে। ৩৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। ২৩০০ পরিবার গৃহচ্যুত হন।
ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ বাহমাস এই দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যারিকেন ডোরিয়ান (Dorian)-এর দাপট প্রত্যক্ষ করে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩০০ কিমি। কয়েক ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৯১০ মিমি, যা ছিল দেশটির গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০%। ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারান, ১৩০০০ ঘরবাড়ী বিনষ্ট হয়। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩.৪ বিলিয়ন ডলার।
এই তথ্য শুধু ২০১৯-এর, আলোচনার স্বার্থে সংযোজিত হল। এরকম প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে চলা চরম আবহাওয়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী। ‘জার্মানওয়াচ’-এর ‘গ্লোবাল সিআরাই -২০২১’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০০০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ১১০০০-এর বেশী চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে ৪৭৫০০০ জনের, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২.৫৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের সইতে পারার ক্ষমতা ( coping capacity) কম বলে উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এর উপর কোভিড-১৯ অতিমারি দেখিয়েছে ঝুঁকি (risk) এবং সংকটাপন্নতা (vulnerability) একে অন্যের সাথে কিভাবে যুক্ত। তবুও পৃথিবীর চৈতন্য নেই। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ধারাবাহিকভাবে আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে যা করনীয়, সেই কাজ হচ্ছে কোথায়? এই পটভূমিতেই সিওপি-২৭-কে দেখা দরকার। সুইডিশ পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গ (Greta Thunberg) এই সম্মেলন বর্জন করেন এই বলে যে এই সম্মেলন বাস্তবে হচ্ছে ‘গ্রীণ ওয়াশিং’ (Greenwashing) – ‘The COPs are mainly used as an opportunity for leaders and people in power to get attention, using many different kinds of greenwashing’………. সিওপি সম্মেলনগুলো ‘are not really meant to change the whole system’…. খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কথা। তবুও দুনিয়ার অগণিত মানুষ চেয়ে থাকে এই সম্মেলনগুলোর দিকে, প্রতিবারই বুক বাঁধে নতুন আশায়। এবারের সিওপি-২৭-ও এর কোন ব্যতিক্রম নয়
সিওপি সাতাশ
এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এবারের সম্মেলনের আলোচিত বিষয়গুলির অন্যতম ছিল গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জন করা, সামগ্রিক ভূ-তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা, ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ’ এর প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি।
জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জনের প্রসঙ্গে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন সুবিদিত। ধনী রাষ্ট্রগুলি তাদের প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রার জন্য তেল ও গ্যাসের উপর ভীষণ নির্ভর করে। আর এই জ্বালানী যারা জোগান দেয়, তারা আবার তাদের আর্থিক লাভের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসুক এটা মোটেও চায় না। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারকারী ও উৎপাদনকারী ধনী দেশগুলো, সুকৌশলে জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জন সংক্রান্ত আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে কোন কার্যকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা এযাবৎ কাল করে এসেছে, এবারও করেছে। তাদের অবস্থানটা হল, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারে ধাপে ধাপে যদি পরিবর্তন আসে আসুক, কিন্তু যেটা দরকার, তা হল, পরিবেশের পক্ষে সুস্থিত (sustainable) পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির (renewable energy) ব্যবহার ভীষণভাবে বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে যেটা বাস্তব তা হল, এই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রযুক্তির প্রায় সবটাই শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলির করায়ত্ত। তাই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারের বৃদ্ধিতে তারা তাদের বাণিজ্যিক প্রসার ও বিপুল আর্থিক লাভের সম্ভাবনাকে দেখতে পাচ্ছে। এই কৌশল নেওয়ার ফলে তাদের এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত একেবারে পাকা। জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারের নিশ্চিত ব্যবস্থায় তাদের প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনযাত্রা যেমন চলছিল তেমনটাই চলতে থাকবে, আর আর্থিক মুনাফার বাড়বাড়ান্ত যেমন চলছিল তেমনটাই চলবে। আবার পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার ভূ-উষ্ণায়ন প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকারী এই অজুহাত দেখিয়ে এর আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসার ঘটিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা লাভের ধারাটাকেও অক্ষুন্ন রাখা যাবে। তাই আলোচনায় জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারের বিলোপ প্রসঙ্গে সদর্থক অগ্রগতি না হলেও, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়ার বিষয়টি ভীষণ গুরুত্ব পায়।
এ প্রসঙ্গে এক প্রতিশ্রুতির কথা না বলেই নয়। সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল ২০০৯-এর সিওপি-১৫-এর সম্মেলনে (সিওপি-১৫, ৭-১৮ ডিসেম্বর, ২০০৯; কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক)।এই সম্মেলনের আগে সংবাদপত্রে খবর হয় যে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডন্ট বারাক ওবামা ও বিশ্বের তাবড় নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রয়াস ঝেড়ে ফেলতে চলেছেন। তার পরিবর্তে তাঁরা কোপেনহেগেন সম্মেলনে চাইছন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অথচ কিছুটা কম লক্ষ্যপূর্ণ (less specific) একটা মিশন (missiomn) গোছের কিছু নিয়ে আলোচনা চালাতে ও জটিল ও কঠিন ইস্যুগুলিকে ভবিষ্যতের জিম্মায় ঠেলে দিতে। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-উত্তরকালে (২০১২ সালের পর) আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি (global climate agreement) প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যপূরণ কোপেনহেগেনের সভার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও, ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর চুক্তিমত নিঃসরণ কমাতে বহু অ্যানেকসার ১-ভুক্ত দেশই রাজী হয় নি। এই সভা (কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর) দীর্ঘ-মেয়াদী কার্যক্রমের কোন চুক্তি তৈরী করতে পারে নি। কিন্তু এসবের মধ্যেও পঁচিশটা দেশ (যার মধ্যে চীন ও আমেরিকাও ছিল) একটা সমঝোতায় এসেছিল। এই সমঝোতার মাধ্যমে ধনী দেশগুলি নতুন করে অতিরিক্ত অর্থ জোগাতে রাজী হয়। এই অর্থে বনসম্পদ গড়ে তোলা হবে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধী কাজে বিনিয়োগ করা হবে এমনটাই ঠিক হয়। এই উদ্যোগের পরম্পরায় সিওপি-১৬-এর সম্মেলনের (সিওপি-১৬, ২৮ নভেম্বর – ১০ ডিসেম্বর, ২০১০, কানকুন, মেক্সিকো) সভায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ‘সবুজ জলবায়ু তহবিল’ (green climate fund) গড়ার ব্যাপারে সহমত হওয়া গেল। চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে (formally) স্বাক্ষরিত না হলেও, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলি শিল্পে পিছিয়ে থাকা গরীব দেশগুলিকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য দেবে। ঠিক হয় এই অর্থে গরীব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানিয়ে নেওয়ার জন্য (to adapt climate impacts) কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যের বাস্তবায়ন করবে, এবং এজন্য প্রযুক্তিগত এবং সক্ষমতা নির্মাণের ক্ষেত্রের বুনিয়াদ শক্ত করবে। বাস্তবে অবশ্য দেখা গেল, কোন বছরেই ধনী দেশগুলো প্রস্তাবিত ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য জোগাড় করে উঠতে পারে নি। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিক কয়েকটা বছরে সবুজ জলবায়ু তহবিল সংগ্রহের কিছু পরিসংখ্যান দিলে বোঝাটা আরও সহজ হবে। ২০১৩, ২০১৫ এবং ২০২০ সালে এই তহবিলের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫২.৫, ৪৪.৬ এবং ৮৩.৩ বিলিয়ন ডলার। এই সংখ্যাই দেখাচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণে কি পরমাণ ফাঁক থাকছে।
শুধু তাই নয়। সবুজ তহবিলের মাধ্যমে গরীব দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ায় নানা গোঁজা মিলেরও সাহায্য নিচ্ছে ধনী দেশগুলি। নেপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে যে আর্থিক সহায়তা ধনী দেশগুলি বিগত কয়েক দশক ধরে করে আসছে, যার বেশীটাই দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ, তাকেই ঘুরিয়ে সবুজ তহবিলে অনুদান (contribution) হিসাবে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রতিশ্রুতি তাই পূরণই হয় নি। অথচ গত এক দশকের বেশী সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমশ তীব্রতর হয়েছে। এবারের সভায় তাই উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে সবুজ তহবিলে অতিরিক্ত অর্থের জোগানের জোরালো দাবি জানায়। দাবি উঠে অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ছয় থেকে এগারো গুণ হতে হবে। সবুজ তহবিলে অতিরিক্ত অর্থ জোগানর প্রশ্নে দড়ি টানাটানির সময় উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানায়, প্যারিস চুক্তি মোতাবেক উন্নয়নশীল দেশগুলো রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে কার্বন নিঃসরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তাকে কাজে পরিণত করতে গেলে এই আর্থিক সাহায্য তাদের দিতে হবেই। এ ছাড়াও চাই প্রযুক্তি ও সক্ষমতা নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তা। এইসব বিষয়ের তপ্ত আলোচনায় সভা সরগরম হয়ে উঠে।
এই সভায় সবুজ তহবিলকে কেন্দ্র করে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে টানাপোড়েনের কারণে জলবায়ুর মূল সংকটের প্রশ্নটি উপেক্ষিতই থেকে যায়। গ্রীণহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নিঃসরণের হ্রাসকে কেন্দ্র করেই এই প্রশ্ন। কিয়োটো চুক্তির (সিওপি-৩, ১-১১ ডিসেম্বর, ১৯৯৭, কিয়োটো, জাপান) সময় থেকেই গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের অঙ্গীকার বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। অ্যানেক্সার -বি এর অন্তর্গত ৩৭ টি শিল্পোন্নত দেশগুলোর এক গোষ্ঠী সামগ্রিক ভাবে ১৯৯০-কে ভিত্তি বৎসর ধরে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গড়ে ৪.২% নিঃসরণ হ্রাসের অঙ্গীকার করে (সারণী-১)।
ইইউ এবং তার সদস্য দেশগুলো অবশ্য প্রথম অঙ্গীকার সময়কালে তাদের নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী পরিমাণেই নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হয়। ১৯৯০-কে ভিত্তি বৎসর ধরে এই সময়কালে তাদের সামগ্রিক নিঃসরণ হ্রাসের পরিমাণ ছিল ১৯ % ( ২৩.৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন ইকুইভ্যালেন্ট কার্বন ডাই অক্সাইড (billion metric ton equivalent CO2)। বৃহৎ নিঃসরণ সৃষ্টিকারী দেশের মধ্যে আমেরিকা কিয়োটো প্রোটোকলের অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। তেমনি কানাডা কিয়োটো প্রোটোকলের সদস্য দেশ থাকতে অসম্মতি জানায়। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে হওয়া আর্থিক মন্দার কারণে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন দেশগুলো ১৯৯০-এর প্রথমে ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারার কারণে জিএইচজি-এর নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হয়। এই সমস্ত কিছু ইতিবাচক ব্যাপার বাদ দিলে, ১৯৯০ থেকে ২০১০ – এই পর্যায়ে বিশ্বের সামগ্রিক জিএইচজি-এর নিঃসরণ বাড়তেই থাকে। জিএইচজি-এর নিঃসরণে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গ্যাসের অবদান সর্বাধিক। গোটা বিশ্বের জিএইচজি-এর নিঃসরণে জীবাশ্ম জ্বালানী ও কলকারখানার উৎপাদন (fossil fuel and industrial processes) এবং বনভূমি ও ভূমির ব্যবহার (forestry and land use) - এই দুই খাতে CO2-এর পরিমাণ যথাক্রমে ৬৫ এবং ১১ শতাংশ। ১৯৯০ থেকে বিগত কয়েক দশকে CO2-এর মাত্রা লক্ষ্য করলেই সহজেই বোঝা যায় জিএইচজি-এর নিঃসরণ কি পরিমাণে বেড়ে চলেছে (সারণী -২)। ১৯৯০ থেকে ২০২১ এই সময়কালে CO2-এর বৃদ্ধি ঘটে প্রায় ৬০%। বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের।
এবারের সভার যে ইস্তাহার প্রকাশিত হয়, তাতে নিঃসরণের জন্য দায়ী তেল ও গ্যাসের কোন উল্লেখই নেই। শক্তির জন্য তেল ও গ্যাস ব্যবহারকারী শিল্পন্নোত ধনী রাষ্ট্রগুলো কম নিঃসরণের শক্তির উৎস বলে তেল ও গ্যাসকে আলোচনার বাইরে রাখতে গোড়া থেকেই সচেষ্ট হয়। এসব থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে সিওপি-২৭ তেল ও গ্যাসের উৎপাদক ও ব্যবহারকারী দেশগুলোকে কোন বার্তা তো দিলই না, বরং এই উল্লেখ না করার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানীর লবি বাড়তি খানিকটা উৎসাহ পেয়ে গেল। এর প্রতিফলন দেখা যায় আমেরিকার সাম্প্রতিক ব্যবহারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম আকাশছোঁয়া। নিজের দেশে এর প্রভাবে প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে পারে। এই আশঙ্কায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তেল ও গ্যাসের অধিকমাত্রায় উৎপাদনের উপর জোর দেন, যাতে বাড়তি উৎপাদনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাসের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই প্রেসিডেন্টই আবার সিওপি ২৭-এর সভায় বিশ্ব নেতাদের কাছে ভূ-উষ্ণায়নের মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানীর পূর্ণ বর্জনের জন্য জোরালো সাওয়াল করে। এহেন দ্বিচারিতাই জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, এবারের জলবায়ু অধিবেশন, সিওপি-২৭, স্পন্সর করেছে কোকাকলা (Coca-Cola)-এর মতো কোম্পানি, যারা বিশ্বে অন্যতম প্ল্যাস্টিক পলিউটার (plastic polluter) হিসাবে কুখ্যাত।
যেহেতু এবারের সম্মেলন আফ্রিকার একটা দেশে (মিশরে) হচ্ছে, তাই আশা করা গিয়েছিল জলবায়ুর খামখেয়ালীপনায় বিধ্বস্ত আফ্রিকার গরীব দেশগুলোর প্রতিনিধি হয়ে মিশর আফ্রিকার মুখ হয়ে উঠবে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশ মিলে বিশ্বের গড় জিএইচজি-এর নিঃসরণের তিন শতাংশের কম নিঃসরণ ঘটায়। অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটা চরম আবহাওয়ার মত ঘটনার (খরা, বন্যা, ভূমিক্ষয়) জন্য জিডিপি-এর ১৫%-এর মত ক্ষতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল মিশরের প্রেসিডেন্ট, যিনি আবার এই সম্মেলনে সভাপতি পদেও আসীন ছিলেন, সভায় সদস্য দেশগুলোর কাছে আহ্বান জানান এহেন ত্রুটিপূর্ণ ইস্তাহার মেনে নেওয়ার। অবশ্য তাঁর মতো সব স্বৈরাচারী শাসকের থেকে এমন ব্যবহারই আশা করা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার (human rights) লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিবাদীরা সোচ্চারে মুখর। এই সভাপতি পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন অনেক প্রতিবাদী বেসরকারি সংস্থাকে (NGO) মিশরে ঢুকতে দেন নি, যাতে তারা সিওপি-২৭-এর অধিবেশনে অংশ নিতে না পারে। এমন ব্যক্তিরাই জলবায়ু সঙ্কটের থেকে পরিত্রাণের আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক!
নিঃসরণ কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানী বন্ধের প্রসঙ্গে এমন কথাও বলা হয়েছে যে সিওপি-২৭-এর সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে, জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের সমানাংশ হারে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার (equitable phasing out) ব্যাপারে সহমত হওয়ার প্রশ্নে। এবারের সভায় ছোট ছোট দেশ, যেমন, ভানুয়াটু (Vanuatu) এবং তুভালু (Tuvalu) এবং বৃহৎ শিল্পন্নোত দেশ, যেমন, নরওয়ে, আমেরিকা, কলম্বিয়া এবং ইইউ কিছুটা হলেও উদ্যোগ দেখিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা দরকার তা হল, বিশ্বের সব দেশকেই এগিয়ে এসে এ ব্যাপারে সহমত হয়ে কাজ (climate action) করতে হবে। এবং তা করতে হবে, রাষ্ট্রের স্বার্থ, কর্পোরেটের স্বার্থ, ব্যক্তির স্বার্থকে পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে, শুধুমাত্র এই সবুজ গ্রহের স্বার্থকেই বড় করে দেথে, তাকে বাঁচানোর আন্তরিক তাগিদ থেকেই। তবেই এই সবুজ গ্রহকে বাঁচানো যাবে।
এই বাঁচার ও বাঁচানোর তাগিদ যে কত বড়, সেই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। তুভালু প্রশান্ত মহাসগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্র। ভূ-উষ্ণায়ন জনিত কারণে সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি এই দেশের অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে এনেছে। সমস্ত রকমের জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন ও ব্যবহারে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিতে তুভালুর প্রধানমন্ত্রী সোচ্চার হন। সভায় উনি দাবি তোলেন পারমাণবিক জ্বালানীর ক্ষেত্রে যেমন অ-বিস্তার চুক্তি (nuclear non-proliferation treaty) রয়েছে, তেমনি অ-বিস্তার চুক্তি লাগু হোক জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। ভানুয়াটু আর একটি প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র যার অস্তিত্বেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে একই কারণে। এই সমস্ত ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি একজোট হয়ে দাবি তোলে জীবাশ্ম জ্বালানী পুরোপুরি বন্ধের এবং এ ব্যাপারে অ-বিস্তার চুক্তি বলবৎ করার। কয়লা, তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহারে রেশ টানতে অ-বিস্তার চুক্তি বলবৎ করার ধারণা নতুন কিছু নয়। এ ব্যাপারে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলি অনেকদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। এমন কি সেই একই দাবিতে সামিল হয়েছিল ধর্মীয় সংগঠন ভ্যাটিকানের ধর্মগুরুও। তুভালু ও ভানুয়াটুর জোরালো বক্তব্য এই দাবিকেই আন্তর্জাতিক স্তরে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ করল।
এখানে খেয়ালে রাখতে হবে, যে গত বছর সিওপি-২৬-এর সম্মেলনে (সিওপি-২৬, ৩১ অক্টোবর-১৩ নভেম্বর, ২০২১; গ্লাসগো, ইউকে) ভূ-তাপমাত্রার হ্রাসের ব্যাপারে ২০১৫-এর প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকারকেই পুনরায় সমর্থন জানানো হয়। ধীরে ধীরে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অরণ্যনিধন (deforestation)-এর প্রবণতা রুখে বনসৃজনের (forestation) কথাও বলা হয়। এবারের সভাতেও অনেকটা যেন নিয়মমাফিকই এই সব অঙ্গীকারের পুনরাক্তি করা হয়। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্থাৎ গড় ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পায়ন পূর্ববর্তী সময়ের ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে বেঁধে রাখা, তা পূরণ করতে হলে বিশ্বকে জিএইচজি নিঃসরণকে ২০৩০-এর মধ্যে বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক করতে হবে। আর নেট-জিরো (net-zero) পর্যায়ে ( অর্থাৎ যেটুকু জিএইচজি মানুষের কারণে সৃষ্টি হবে, তা প্রকৃতিতে কাজে লেগে, পরিবেশে জিএইচজি-র মাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে) আসতে হবে ২০৫০-এর মধ্যে। বর্তমানে নিঃসরণের উর্ধগামী প্রবণতা ও ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধির হালচাল দেখে এই লক্ষ্য পূরণের আশাকে দুরাশা বলেই মনে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে সঙ্কটাপন্ন দেশসমূহের (vulnerable countries) ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তির ঘটনা ঘটল সভার একাবারে অন্তিমলগ্নে। সভার শেষদিন ১৯০টা দেশের প্রতিনিধিরা সম্মত হয়ে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার সংস্থান রয়েছে। এই তহবিলের জন্য গরীব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। ২০১৭ সালে বনে অনুষ্ঠিত সিওপি-২৩-এর (সিওপি-২৩,৬-১৭ নভেম্বর, ২০১৭, বন, জার্মানি) অধিবেশনে সভাপতিত্ব করে ফিজির প্রধানমন্ত্রী জোরালো সওয়াল করে বলেন যাদের কাজের কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছে, তাদেরই ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব নিতে হবে। এর আগে পোল্যান্ডে হওয়া সিওপি-১৯-এর সভায় (সিওপি-১৯, ১১-২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ওয়ারশ, পোল্যান্ড) ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর উদ্দেশ্যে ‘ওয়ারশ আন্তর্জাতিক মেকানিজম’ (Warsaw International Mechanism বা WIM) গঠিত হয়। ডব্লিউআইএম-এর অধীনে একটি কার্যকরী কমিটিও গঠিত হয় বিষয়টির বিবেচনার জন্য। কমিটি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করে একটি পাঁচসালা পরিকল্পনাও তৈরী করে। সিওপি-২৩-এর সভায় এই পরিকল্পনার উপর বিস্তারিত আলোচনাও হয়। একটা কথা পরিস্কার করে বলা দরকার, ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় তহবিল কিভাবে গড়া হবে, পাঁচসালা পরিকল্পনা সে ব্যাপারে একাবারেই নিশ্চুপ ছিল। ধনী দেশগুলো গরীব দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে তহবিল গড়তে একদমই রাজী ছিল না।
কিন্তু এই গরীব রাষ্ট্রগুলোই ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সংঘটিত বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, সমুদ্র ঝড় প্রভৃতির বেশী করে শিকার হচ্ছে। অথচ, ভূ-উষ্ণায়ন ঘটার পিছনে তাদের ভূমিকা অতি সামান্য। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের নাম করা যায়। সারা বিশ্বের মোট জিএইচজি নিঃসরণে পাকিস্তানের অবদান মাত্র ০.৯%। কিন্তু এবার অতিবৃষ্টিজনিত কারণে পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়। সারা দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এবারের প্রলয় ভয়ঙ্কর বন্যায় পাকিস্তানে সম্পদ ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৪.৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। আর্থিক ক্ষতির (economic loss) পরিমাণ ১৫.২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এরকমই বিশ্ব জিএইচজি নিঃসরণের ভাঁড়ারে ছিটেফোঁটা অংশ নিয়েও নিরন্তর চরম আবহাওয়ার মতো ঘটনার করাল ছোবল খাওয়া থেকে নিস্তার নেই পৃথিবীর বহু দেশেরই।
চুক্তি মতে ধনী দেশগুলো থেকেই অনুদান নিয়ে প্রাথমিকভাবে এই তহবিল গড়া হবে। সম্মেলনের শুরু থেকেই এই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ইস্যুটি সভার অ্যাজেন্ডায় ঢোকানোর ব্যাপারে উন্নত এবং উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা চাপানউতোর লক্ষ্য করা যায়। স্পষ্ট বিভাজন ঘটে উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর মধ্যে (north south divide)। উত্তর বিশ্বের (global north) শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলো প্রথম থেকেই এ জাতীয় তহবিল গড়ার বিরুদ্ধাচারণ করছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাকে ভূ-উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সৃষ্ট বলে মানতে চাইছিল না। এই দুটো ব্যাপারের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে তা মানতে আমেরিকার ঘোরতর আপত্তি ছিল। আপত্তি ছিল বিশেষ করে ‘ক্ষতিপূরণ’ (compensation) শব্দটাতেই। আরও জুতসই প্রতিশব্দ ‘reparation’-এর কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক। ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার কথা উঠলেই সে যে দুশো বছর ধরে কারুর ক্ষতি করে আসছে নির্বিচারে অসহনীয় মাত্রায় জিএইচজি নিঃসরণ ঘটিয়ে তা মান্য হয়ে পড়ে। তাই সে এবং তার চেলাচামুন্ডরা চাইছিল এই দায় মামুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে চালিয়ে দিতে এবং ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার দায় এড়াতে। বাস্তবে অবশ্য শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলো এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এবং দক্ষিণ বিশ্বের (global south) সমবেত চাপের মুখে বাধ্য হয় এই তহবিল গড়ার অঙ্গীকার করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে।
এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললে ঠিক হবে না। গত বছর গ্লাসগোয় জলবায়ু সম্মেলনের সভায় (সিওপি-২৬,৩১ অক্টোবর-১৩ নভেম্বর, ২০২১, গ্লাসগো, ইউকে) যে ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ (Glasgo Climate Pact) স্বাক্ষরিত হয়, তাতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারটি একরকম নির্ধারিত হয়েই গিয়েছিল। ঠিক হয়ে গিয়েছিল আর্থিক ক্ষতিপূরণের মেকানিজম (financial mechanism for compensation) হিসাবে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফ্যাসিলিটি’ (Loss and Damage Facility) চুক্তিতে স্থান পাবে। কিন্তু তারপর ধনী রাষ্ট্রগুলো কলকাঠি নাড়া শুরু করাতে শেষাবধি বিষয়টি নির্বিষ হয়ে মামুলি ক্ষয়ক্ষতির সংলাপ (Loss and Damage Dialogue) হয়েই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এবারে তাই শুরু থেকেই উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলো সতর্ক ছিল, যাতে যেভাবেই হোক না কেন ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারে চুক্তি হয়। তাই হয়েছে। যদিও চুক্তি কিভাবে লাগু হবে, তা ঠিক হবে, আরও কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে। উত্তর বিশ্বের (Global North) কাছ থেকে দক্ষিণ বিশ্বের (Global South) এই জয় ছিনিয়ে নেওয়া খুব একটা কম বড় ব্যাপার নয়।
শেষের কথা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত চরম আবহাওয়ার মত ঘটনায় উন্নত, উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলো মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলোর কাছে এ সংকট ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে, কারণ তাদের সহন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আলোচনাকে শুধু এই পরিসরে আটকে রাখলেই চলবে না। আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসতে হবে সেইসব অসহায় মানুষগুলোর কথা, যারা জানে না কেন তাদের জীবন ও জীবিকা এহেন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান এবছর ভায়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে। কেনিয়া, সোমালিয়া ভয়ঙ্কর খরার কবলে পড়েছে। এই সব দেশের মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে কোন মতে। তাদের সেই বেঁচে থাকাটাই খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ন অফ আফ্রিকার (Horn of Africa) এক বৃহৎ গোষ্ঠীর মানুষ নিতান্ত বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটে বেড়াচ্ছে নিজেদের অজন্মের পরিচিত বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র। বাড়ছে গোষ্ঠী সংঘর্ষ। Inter-Governmental Authority on Development, Climate Prediction and Application Centre-এর বিশেষজ্ঞ লিন্ডা ওগাল্লো (Linda Ogallo)-এর কথায়, ‘a big block of communities in the Horn of Africa are framers who rely on agriculture and pastoralism. Therefore their lives are tied to climate. Any negative event leads to disruption of livelihoods and displacement that push people to new areas leading to inter-community or cross-border conflicts.’ চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো অসহায় মানুষগুলোকে বাধ্য করছে ছুটে বেড়াতে, রসদের জন্য বাড়ছে তীব্র প্রতিযোগিতা, বাড়ছে সংঘর্ষ। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের অফিস অফ স্পেশাল এনভয় টু হর্ন অফ আফ্রিকার (Office of the Special Envoy of the UN Secretary General to the Horn of Africa) আধিকারিক এলিজাবেথ কারাবাইন (Elizabeth Carabine)-এর কথায় নিদারুন বাস্তবতার এক ছবি ফুটে ওঠে – ‘People displaced by climate events are more prone to conflicts that lead to instabilities. Climate change has become a threat to peace and security…’। এই বিপন্নতা সারা পৃথিবী জুড়েই। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত দুর্যোগের কবলে পড়া পৃথিবী ব্যাপি অগণিত অসহায় মায়েদের কাছে তাদের অবোধ শিশুগুলো যখন একটু জল আর খাবারের জন্য কাঁদতে থাকে, আর মায়েরা সেইটুকু জোটাতে না পেরে গভীর যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন, সেই যন্ত্রণা কোন বিশেষ অঞ্চলের নয়, কোন বিশেষ দেশের নয়। সেই যন্ত্রণা সারা বিশ্বেরই। সেই অহায়তা, সেই কান্না, সেই যন্ত্রনা যেদিন সারা বিশ্বের মানুষ অন্তর দিয়ে নিজের বলে সত্যি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারবে, সেদিনই হয়ত এই গভীর সংকট থাকে চির মুক্তির কোন সঠিক দিশা মিলবে। আমাদেরই এখন ঠিক করতে হবে আমাদের এ সময়ের করণীয় কর্তব্যকে।
তথ্যসূত্র :
১। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের তেইশতম বিশ্ব সম্মেলন (COP-23)’, ওমপ্রকাশ চক্রবর্তী, কালধ্বনি, বর্ষ ২২, সংখ্যা ১-৩, পাতা ১৩-২৬, মে, ২০১৮
২। ‘Kyoto Protocol – Targets for the First Commitment Period’, unifccc.int/ process-and-meetings/the-kyoto-protocol
৩। ‘কিয়োটোর কেরামতি : বাজার অর্থনীতিতে পরিবেশ’ রবীন মজুমদার, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বর্ষ ১৫, জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ২০০৩
৪।‘Hope for Humanity’, The Statesman, 08 November, 2022
৫। Greta Thunberg to skip ‘greenwashing’ Cop27 climate summit in Egypt- The Guardian, 30 October, 2022. https://www.theguardian.com
৬। Global Climate Risk Index 2021- Germanwatch. https://www.germanwatch.org
৭। ‘দায় ও দায়িত্ব’, সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ নভেম্বর, ২০২২
৮। ‘অধরা প্রতিশ্রুতি’, সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ নভেম্বর, ২০২২
৯। ‘Heat is on’, Editorial: The Statesman, 09 November, 2022
১০। ‘Of the climate and other farces’, Aasim Sajjad Akhtar, The Statesman, 13 November, 2022
১১। ‘Draft COP 27 climate deal shows inaction on loss and damage funding’, Business Standard, 18 November, 2022; https://www.business-standard.com
সারণী -১ । কিয়োটো চুক্তির প্রথম অঙ্গীকার সময়কালে (First Commitment Period), ২০০৮-২০১২-তে অ্যানেক্সার-বি অন্তর্গত দেশগুলোর নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা (target)
দেশ নিঃসরণ হ্রাসের
লক্ষ্যমাত্রা
[সময়কাল ২০০৮-২০১২;
ভিত্তি বৎসর ১৯৯০]
সারণী - ২ । ১৯৯০ থেকে বিগত কয়েক দশকে গোটা বিশ্বের সামগ্রিক CO2-এর উদ্গীরণের মাত্রা (বিলিয়ন মেট্রিক টনে)
সাল ১৯৯০ ১৯৯১ ১৯৯২ ১৯৯৩ ১৯৯৪ ১৯৯৫ ১৯৯৬ ১৯৯৭ ১৯৯৮ ১৯৯৯
CO2 ২২.৭৫ ২৩.২৪ ২২.৫৭ ২৩.৮০ ২২.৯৬ ২৩.৪৫ ২৪.১৫ ২৪.৩০ ২৪.২১ ২৪.৫২
সাল ২০০০ ২০০১ ২০০২ ২০০৩ ২০০৪ ২০০৫ ২০০৬ ২০০৭ ২০০৮ ২০০৯
CO2 ২৫.২৩ ২৫.৪৫ ২৬.০৪ ২৭.৩৭ ২৮.৬৩ ২৯.৬০ ৩০.৫৮ ৩১.৪৯ ৩২.০৭ ৩১.৬১
সাল ২০১০ ২০১১ ২০১২ ২০১৩ ২০১৪ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০ ২০২১
CO2 ৩৩.৩৪ ৩৪.৪৭ ৩৪.৯৭ ৩৫.২৮ ৩৫.৫৩ ৩৫.৫০ ৩৫.৪৫ ৩৫.৯৩ ৩৬.৬৫ ৩৬.৭২ ৩৬.৮১ ৩৬.৪০
গতকাল, ২৬শে জুন, ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি ঘরোয়া জমায়েতে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রমন্নার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আমি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম এই চিঠি। উনি অনুগ্রহপূর্বক চিঠিটি গ্রহণ করেছেন এবং পড়ে দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন।
প্রিয় বিচারপতি
এন. ভি. রমন্না
সমীপেষু,
মুক্তির দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আপনাকে স্বাগত। আমরা যখন এখানে সমবেত আপনার কথা শুনবো বলে, তখন হোয়াইট হাউসের বাইরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের বাইরে এবং গোটা আমেরিকার বিভিন্ন জমায়েত স্থলে মহিলারা, সমকামী নারী ও তাদের সহযোগী জোটের মানুষেরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তাঁরা সুপ্রীম কোর্টের ‘রো বনাম ওয়েড’ সংক্রান্ত অধিকার বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এই মুহূর্তে সিয়াটলে চলছে স্থানীয় ভারতীয়দের প্রতিবাদ। গত সপ্তাহে ভারতীয়-আমেরিকানদের বিক্ষোভ চলেছিল হাউস্টন, ডালাস, সানফ্রান্সিসকো এবং অন্যান্য বহু স্থানে। তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন কারণ তাঁদের জন্মভূমি ভারতবর্ষে ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষে তাঁরা মর্মাহত।
কিন্তু আপনার কাছে তো এমন প্রতিবাদ-আন্দোলন অভিনব কিছু নয়। আপনি এবং আমি যে-দেশের মানুষ, সেখানে বিক্ষোভ, ধর্ণা এবং আমৃত্যু-অনশন যাপনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট প্রায়। এমনকি আমাদের প্রিয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যেও আমরা সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-আন্দোলনের কাছে ঋণী, যার পথপ্রদর্শক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
যাই হোক, আমেরিকা ও ভারতের এই দুই দেশের প্রতিবাদ-আন্দোলন এবং আপন আপন বিশ্বাসের স্বপক্ষে চীৎকার করার জন্য দুদেশের প্রতিবাদীদের যে-মূল্য চোকাতে হবে – সে বিষয়ে একটা গভীর পার্থক্য আছে। হোয়াইট হাউস/সুপ্রীম কোর্টের বাইরের প্রতিবাদীদের এই দুশ্চিন্তা নেই যে এবার তাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, এই ভয় নেই যে তাদের হাজতে পোরা হবে বা রাষ্ট্র-প্ররোচিত জনতার হাতে খুন হয়ে যেতে হবে।
সুতরাং আজ যখন আপনি আমি দুজনেই ভারতের বাইরে দাঁড়িয়ে, এবং যখন আপনি এই গ্রহের ১.৩৮ বিলিয়ন মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বিচারকের আসনে নেই, তখন আমি আপনার সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলার স্বাধীনতা নিচ্ছি এবং আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাইছি। আমি উৎসাহিত হয়েছি যখন আপনি ফিলাডেলফিয়াতে বলেছেন, “যে স্বাধীনতা, মুক্তি এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা সংগ্রাম করেছেন, তাকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রসারিত করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য”।
আমি আতঙ্কিত হয়েছি ভিডিয়োতে দেখে তিস্তা শেতলাবাদকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, জানা গেছে বিনা সমনে, তাঁকে উকিলের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না দিয়ে। সে আতঙ্ক এখনও সজীব। তিস্তা তাঁর সারাটা যৌবন, সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন সেইসব মানুষদের জন্য সুবিচার আদায়ের সংগ্রামে, ২০০২ সালে যাদের শারীরিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং মানসিকভাবে দগ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনও দিন তিনি সরে যেতে পারতেন, অনেকের মত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারতেন, পুনরাবৃত্ত লাঞ্ছনা ও হুমকির কাছে মাথা নোয়াতে পারতেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি নিরস্ত হননি, কারণ এই দৃঢ়চেতা মহিলা তাঁর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ।
তিস্তার পরেই গ্রেফতার হয়েছেন পুলিস অফিসার আর-বি-শ্রীকুমার যিনি প্রধানমন্ত্রী মোদী এত শক্তিধর হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই তাঁর এক বিরোধী কন্ঠস্বর। প্রাক্তন আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট ইতিমধ্যেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এমন একজনকে হত্যা করার অপরাধে যার সঙ্গে তাঁর কখনো সাক্ষাৎই হয়নি। বিচার চলাকালীন তিনি সরকারপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করার বা স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করার, এমনকি আত্মপক্ষ-সমর্থনে চূড়ান্ত সওয়াল (concluding remark) পেশ করার অনুমোদন পাননি। এই তিনজনের হাজতবন্দী থাকাটা ২০০২ সালে গুজরাতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক, কারণ অন্য সাক্ষীদের অধিকাংশই মারা গেছেন, বাকীরা অদৃশ্য হয়ে গেছেন বা তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া গেছে। কেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাবানদের খুশী রাখতে ভারতের বিচারব্যবস্থা এতখানি উদগ্রীব?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাকিয়া জাফরির কথা, যিনি ২০০২ সালে নিজের বাড়িতে তাঁর স্বামী এবং আরও বহু মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার বিচার চেয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দু-একদিন আগেই তাঁর আবেদন খারিজ করা হয়েছে। অভিঘাতটা আসলে দ্বিগুণ, যেহেতু জাকিয়া জাফরির খারিজের এই রায়ের প্রেক্ষিতেই তিস্তার অনৈতিক গ্রেফতারী। সর্বোচ্চ আদালতই নির্দেশ দেয় জাকিয়াকে যারা সমর্থন যুগিয়েছেন তাঁদের বিষয়ে তদন্ত করতে। জাকিয়ার হতাশ পুত্র জানিয়েছেন, ন্যায়বিচারের জন্য তাঁরা ঈশ্বর, আল্লার উপরেই ভরসা রাখছেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের অপেক্ষার বিশ বছর অতিক্রান্ত। এ-বছরের এপ্রিল মাসে আপনি বলেছিলেন, এই চটজলদি চাউমিনের যুগে মানুষ চটজলদি বিচার চায়। এনারা কিন্তু ‘চটজলদি চাউমিন’ আশা করেন নি; এই হতভাগ্য পরিবারটির কাছে তা ছিল দীর্ঘ, যন্ত্রণাময়, অবমাননাকর, বিপজ্জনক কুড়ি বছর। ব্যক্তিগতভাবে আমি নাস্তিক, তাই বিশ্বাস করি না স্বর্গ থেকে নেমে এসে কোনও ঈশ্বর সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আপনি কি মনে করেন জাকিয়া জাফরি সুবিচার পেয়েছেন?
প্রতি সপ্তাহে ভারতবর্ষে রাষ্ট্র-প্রণোদিত হিংসার নতুন নতুন কুনাট্য মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে। দু-সপ্তাহ আগে সারা বিশ্ব দেখল নবীন সমাজ-আন্দোলন কর্মী আফ্রিন ফাতিমার মায়ের বাড়ি প্রকাশ্য দিবালোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর বাবার নামে জারি হওয়া জাল, অচল আদেশের বলে। বহু বহু মুসলিম বাড়ি ও ব্যবসাস্থল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। সরাসরি মাথায় গুলি চালিয়ে, কাউকে কাউকে একাধিকবার, পুলিস হত্যা করেছে মুসলিম বিক্ষোভকারীদের। বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে; শিশুদের, এমনকি যারা কথা বলা শুরু করে নি তাদেরও, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে এমন এক নিষ্করুণ অন্ধকার দারিদ্র-প্রকোষ্ঠে যেখান থেকে তারা আর কখোনো বেরোতে পারবে না। কিছু মানুষ ট্যুইটারে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে কিছু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট সবটা নীরবে দেখে গেছে শুধু। আপনাদের এই নীরবতা কি শাসকের শক্তিকে অনুমোদন করা নয়? মৌনতা কি সম্মতি নয়?
এটা নিশ্চয়ই আপনার নজর এড়ায় নি যে, আমাদের তথাকথিত গণমাধ্যমগুলি নিজেদের দর্শকবহুল সময়ে বিচারসভা বসিয়ে দেয় এবং বিস্ময়কর দৃঢ়তার সঙ্গে রায়ও ঘোষণা করে দেয়। সেখানে কে বলবেন, কী বলবেন, কতটা বলবেন সবটাই ঠিক করে দেন সরকারের স্নেহধন্য সঞ্চালকেরা। তাদের আলোচনায় যা বলা হয় তার অধিকাংশটাই উস্কানিমূলক বক্তব্যের হুবহু নিদর্শন। দিল্লী হাইকোর্টে আপনার মাননীয় সহকর্মীদের মধ্যে একজন বলেছেন, “যদি আপনি হাসিমুখে কিছু বলেন, তাহলে তার মধ্যে অপরাধযোগ্যতা থাকে না; আর যদি আক্রমণাত্মকভাবে বলেন, তাহলে (তার মধ্যে) অপরাধযোগ্যতা থাকে”। আপনি কি তাঁর সঙ্গে সহমত? যখন অসহায় মুসলিমদের বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছিল, এমনকী কিছু মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধারের জন্য জড়ো হওয়া মানুষজন পুলিসের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন একজন বরিষ্ঠ সাংবাদিক পরিহাসছলে ট্যুইটারে বরিস জনসনকে প্রশ্ন করেছিলেন বুলডোজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে তিনি একটি নতুন জেচিবি নির্মাণ-কারখানা গড়ার কথা ভাবছেন কিনা। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ‘Genocide Watch’ ভারতে মুসলিম-গণহত্যার সম্ভাবনা-সম্পর্কিত সতর্কবার্তা জারী করেছে। সারা বিশ্বে স্বীকৃত এই গণহত্যা-প্রতিরোধী সংস্থাটির পরিচালক ডঃ গ্রেগরী স্ট্যানটন রোয়াণ্ডা গণহত্যার সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে ইতিপূর্বে অন্তত দুবার তিনি এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাহলে গণহত্যার আবাহন এবং সিদ্ধিও মেনে নেবো তো, যদি তা হাসিমুখে করা হয়?
খালিদ সৈফী একজন সমাজকর্মী এবং আমাদের চেনা সেই খুচরো মুসলিম ব্যবসায়ী যাঁকে মিথ্যা অভিযোগে—যে অভিযোগের কোন তদন্ত হয় নি এখনো—কারারুদ্ধ করে রাখা যায়। তাঁর স্ত্রী নার্গিস সৈফী, তিন নাবালক সন্তানের জননী, বলছেন তাঁর কন্যা প্রশ্ন করে কেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারে না, আর কেনই বা তার সঙ্গে দেখা হলেই পুলিস বাবাকে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেয়ে যায়। দু-বছরের বেশী সময় ধরে খালিদ জেলবন্দী। যখন তাঁকে বন্দী করা হয় তখন কন্যা মরিয়মের বয়স ছিল ছয়। গৃহবধু নার্গিস ঘরের দায়িত্ব সামলে এসেছেন এতদিন; তাঁর স্বামীর উপার্জন এখন বন্ধ। বেঁচে থাকার সামান্যতম চাহিদা পূরণও তাই তাঁর পক্ষে দুরূহ। খালিদ জেলের মধ্যে নির্যাতনের শিকার। আপনি বলতে পারেন নার্গিস মরিয়মকে ঠিক কী বলবে? আপনি কি খালিদের মামলাটি পড়ে দেখার অবকাশ পেয়েছেন, নেহাৎ কৌতুহলবশেও? আপনি কি পারেন মরিয়মকে আশ্বস্ত করতে যে তার বাবা সুবিচার পাবে?
আপনি কি উমর খলিদের কথা শুনেছেন—সেই ঝলমলে যুবকর্মী সবসময় যার মুখে থাকে হাসি আর হাতে বই? একটা জাল ভিডিও’র ভিত্তিতে তাঁকে প্রায় দু-বছর যাবৎ জেলে আটক করে রাখা হয়েছে। একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম ভিডিওটি বিকৃত করেছিল। মূল ভিডিওটি দেখলে আপনি তাঁকে নিয়ে গর্বিত হতেন, কারণ সেখানে তিনি প্রশংসা করছিলেন সেই দলিলের, ভারতীয় সংবিধানের, যাকে তিনি পবিত্র মনে করেন, যার কথা আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা উল্লেখ করেন আপন আপন কর্তব্যপালনকালে। অথচ উমর জেলবন্দী—হাসছেন, পড়ছেন, আর সুবিচারের প্রতীক্ষা করছেন। আপনি তো একসময় ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, হয়তো তাই আপনি নিজেকে মেলাতে পারবেন তাঁর প্রেরণা, উদ্দ্যম এবং ইতিবাচক থাকার ক্ষমতার সঙ্গে। আপনার কি মনে হয় ওনার কোনো আশা আছে? আমি যদি আপনাকে মিনতি করি ওনার জামিনটুকু, অন্তত, মঞ্জুর করুন, সেটা কি চটজলদি চাউমিন দাবী করার মত হবে?
যেহেতু আপনি এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে অবকাশ-ভ্রমণ করছেন— যা আপনার অধিকার—আপনি হয়তো অবগত নন যে এমনকি এখন, যখন আমরা সমবেত হয়েছি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলবো বলে, গৌতম নওলাখা, রোনা উইলসন, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বদে, জি। এন। সাইবাবা, সুধীর দাভে, সোমা সেন, হানি বাবু এবং আরও বহু মানুষ-- যাঁদের নাম লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ফুরিয়ে যাবে—তখন জেলবন্দী। সারা বিশ্ব তাঁদের বলছে ‘বিবেকের দায়ে বন্দী’। যেসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁরা কারাবন্দী সেগুলো পরিশীলিত স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে তাঁদের কম্পিউটারে স্থাপন করা হয়েছিল—এটা প্রমাণিত। ফাদার স্ট্যান স্বামী, একজন জেসুইট পাদ্রী, জেলখানায় ‘স্ট্র’ ব্যবহারের অনুমতিটুকুও পাননি, যে স্ট্র-দিয়ে চুমুক দেওয়াই ছিল তাঁর পারকিনসন্স-বিধ্বস্ত শরী্রে ন্যুনতম পুষ্টি-আহরণের একমাত্র উপায়। গত জুলাই মাসে জেলখানাতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বিচারের মর্যাদা নিশ্চিত না-করতে পারার লজ্জায় সারা বিশ্বের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
বড়-হয়ে-ওঠার সময়ে ভাবতাম চীন, রাশিয়া প্রমুখ স্বৈরাচারী দেশগুলোই শুধু বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ মানুষদের বন্দী করে রাখে; আর ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করতাম। কেননা স্বাধীনতার আর কী অর্থ হতে পারে ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতা ছাড়া, শক্তিধর মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙুল তোলার স্বাধীনতা ছাড়া? ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রীডম (USCIRF) বর্তমানে ৪৪জন ভারতীয়কে ধর্মীয়-রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আপনার কি মনে হয় অন্যদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে ফাদার স্ট্যানের দুর্ভাগ্যের শরীক হবার জন্য, শিকার হবার জন্য? সুপ্রীম কোর্ট কি এই অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারে?
আপনি তো একজন সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। আপনি কি ব্যথিত হন যখন রিপোর্টারস উইধাউট বর্ডার (RSF) ২০২২ সালের বিশ্ব স্বাধীনতা সূচকে ভারতকে ১৭০টি দেশের তালিকায় ১৫০তম স্থান দেয়? অথবা যখন শোনেন ২০১৪ থেকে ২২ জন সাংবাদিককে জেলবন্দী করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনকে বন্দী করা হয়েছে শুধু ২০২১-এ? বেদনাদায়কভাবে, বা হয়তো তাও না, ভারতে ২০১৪ থেকে আজ অবধি ২২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাঁরা কেউ অবশ্য বৃহৎ পুঁজির বাণিজ্যিক গণমাধ্যম সংস্থার সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁরা হলেন (ছিলেন বলাই ভাল, কারণ খুন হয়ে গেছেন তো তাঁরা) সেইসব প্রান্তিক রিপোর্টার, পেশাগত দায়িত্ব পালন যাঁদের কোনোমতে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আসিফ সুলতান, গুলফিসা ফাতিমা, ফাহাদ সাহ, সিদ্দিক কাপ্পান, সাজাদ গুল, সার্জিল ইমাম, বহু নামের আরও একটা ক্লান্ত সারি, শুধু নাম যারা শিরোনামে আসে ‘ভারতবিরোধী’ কাহিনী-নির্মাণের দায়ে জেলবন্দী হওয়ার কারণে।
আপনি যখন সাংবাদিক ছিলেন, আপনিও কি প্রশিক্ষণ পাননি কীভাবে সাংবাদিকতার কালজয়ী লক্ষ্যে—অসহায়ের শক্তি হওয়া আর শক্তিকে অসহায় করার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়? আজ যদি কোনও সাংবাদিক বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পান, আপনি কি তাকে ওনাদের প্রিয় খাবার বা বলবর্ধক পানীয় নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেবেন, নাকি আপনি তাকে উৎসাহ দেবেন শক্তিধর মানুষটিকে প্রশ্ন করতে ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ সময়কালে গুজরাতে ঠিক কী ঘটেছিল? গত সপ্তাহে কর্ণাটক হাইকোর্ট অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তফশিলী জাতি এবং উপজাতি (Prevention of Atrocities) আইনটি প্রকৃত অর্থে বাতিল করে দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি-বর্ণমূলক অবমাননা শুধু জনসমক্ষে ঘটলে তবেই তা আইন মোতাবেক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুবিধাভোগী হিন্দুদের হাতে থাকা ক্ষমতা এবং জাতিবৈষম্য-জর্জরিত সমাজে যখন দলিতদের খুন হতে হয় ঘোড়ায় চড়া বা উচ্চবর্ণের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট কুয়ো থেকে জল তোলার জন্য, বা, আরও পরিতাপের, ‘উচ্চবর্ণের’ কোনো মানুষের প্রেমে পড়লে—আপনার কি মনে হয় আমরা এই তফশিলী জাতি ও উপজাতি আইন অবলুপ্তির জন্য প্রস্তুত? আপনার কি মনে হয় দলিতদের জীবনের কোন অর্থ আছে?
ভারতে সংখ্যালঘুদের জীবনের কী কোনও গুরুত্ব আছে? আমি আর্জি জানাচ্ছি, উত্তর দেওয়ার সময় আপনি স্মরণ করবেন ট্রেনের মধ্যে খুন হওয়া কিশোর জুনাইদকে, মন্দিরের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা আসিফাকে, গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত আখলাককে, তাবরেজ, যাকে উল্লসিত জনতা পিটিয়ে খুন করার সময় বাধ্য করেছিল ‘জয় শ্রীরাম’ মন্ত্রপাঠে, মোহাম্মদ সালিম(৫৫), মোহাম্মদ খলিল আলম(৩৫), সমীর শাহপুর(১৯), মুশারফ(৩৫), বাব্বু(৩০), মেহতাব(২২), জাকিব সইফি(২৮), আকিব(১৯)—এদের সবাইকে, যারা খুন হয়েছে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের হাতে; হত্যাকারীদের কারও কোনো সাজা হয়নি অবশ্য।
দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতীয় খৃষ্টানরা একব্যাগ-চালের জন্য ধর্মান্তরিত—এমন বিদ্রূপের শিকার। কিন্তু এখন ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন বলবৎ হওয়ায় সে-নিপীড়ন আইনসিদ্ধ হলো। ছমাস আগে ক্রিসমাসের দিনে, যখন ভারতের খৃষ্টানরা খুশীর পোষাক পরে গীর্জায় যাচ্ছিলেন, ভারতের বেশকিছু জায়গায় হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের উপর আক্রমণ চালায়। আমি নিশ্চিত আপনি গুরগাঁও-এর একটি গীর্জার বাইরে যীশুখৃষ্টের ভাঙামূর্তির মর্মছেঁড়া ছবিটি দেখেছেন, বিতৃষ্ণ হয়েছেন সান্তাক্লসের কুশপুত্তলিকা দাহ করার ভিডিওগুলি দেখে। ভারতে যাজকদের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে আক্রমণ করা যায় সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত থেকে। আপনি কি খৃষ্টানদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, নাকি বিশ্বাস রাখেন ‘ঘর ওয়াপসি’তে?
ভারত কি ইতিমধ্যেই এক হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায়ে উৎসাহিত ভারতে আজ মসজিদ/দরগা/উপাসনাস্থল আপবিত্র করে, ধ্বংস করে সেখানে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন নিতান্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩৫০ বছর আগে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানবাপী মসজিদ বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশানুসারে আংশিকভাবে অব্যবহার্য হয়ে রয়েছে। কুতুব মিনার, তাজমহল, প্রমুখ স্থাপত্যশিল্পের বিস্ময়কর নিদর্শনগুলিকেও হয়তো এখন খুঁড়ে দেখা হবে বা মন্দিরে রূপান্তরিত করা হবে। এই গণহত্যাকেও কি আপনি ক্ষমাসুন্দর চোখেই দাখবেন?
কর্ণাটক হাইকোর্টের যে রায়ের ফলে মেয়েদের হিজাব পরে স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে শুনানির আবেদন করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্ট সে আবেদন খারিজ করেছে। এই হিজাব-পরা ছাত্রীদের প্রতি আপনার বার্তা কী হবে?
আমি আন্তরিকভাবে আপনার কাছে জানতে চাইছি, আমার কি ভারতের বিচারব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখা উচিত?
সবশেষে বলি, নাজিবের মায়ের মত আপনিও কি কখনো ভাবেন নাজিব কোথায়? অথবা, বিচারক লোয়াকে কে হত্যা করল? নাকি, এসবই তুচ্ছ কিছু প্রশ্ন?
ভারভারা রাও-ও তো একটা তুচ্ছ প্রশ্নই করেছিলেনঃ
কোন পথে, বলো
কথা বলা যায়
নির্মম, তোমার সঙ্গে?
আন্তরিকতাসহ,
সরিতা পাণ্ডে
একজন উদ্বিগ্ন প্রবাসী ভারতীয়
ওয়াশিংটন, ডি.সি.
জুন ২৬, ২০২২
সূত্র: https://livewire.thewire.in
স্বতন্ত্র ও স্পষ্ট রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসেবে হিমাচল প্রদেশ প্রকাশ পেতে থাকে স্বাধীনতার পর থেকেই। যদিও এই প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে, পৌরাণিক কাহিনী, মহাকাব্য এবং পুরাণের সূত্রে বহু পরিচিত।এখানকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা জনজাতি যেমন পুরোপুরি স্বতন্ত্রভাবে হিমাচলেরই তেমনি আবার বাইরের থেকে বহু মানুয এখানে এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন। যার ফলে যথেষ্ট মিশ্রণও ঘটেছে এবং হিমাচল প্রবেশ বর্তমানে সমতল ও অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংমিশ্রিত এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব।
তবে এই সংমিশ্রণ হিমাচলের সবুজ অঞ্চলে আটকে থেকেছে বহুদিন বা এখনও আছে এবং তা মূলত প্রাকৃতিক কারণে। প্রাকৃতিক দিক থেকে হিমাচল মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি যথেষ্ট বৃষ্টিপাতে ঘন সবুজ এবং অন্য অংশ বৃষ্টিহীন মরুভূনি। এই অঞ্চলটি লাহুল ও স্পিতি জেলা এবং কিন্নরের কিছু অংশ। আয়তনগত ধারণার জন্য এটা উল্লেখ করা যেতেই পারে যে লাহুল ও স্পিতি জেলা ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা।
পাঞ্জাব ও শিমলার ৩০টি পূর্বতন প্রিন্সলি স্টেট বা করদ রাজ্য মিলিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ই এপ্রিল হিমাচল প্রদেশের সূচনা। সেই সময় চাম্বা, মাহাসু, মাণ্ডি আর সিরমুর এই চারটি জেলায় বিভক্ত ছিল হিমাচল প্রদেশ। পরবর্তীকালে বিভিধ পরিবর্তন এবং সংযোজনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের হিমাচল প্রদেশে ১২টি জেলা। ইউনিয়ন টেরিটরি থেকে আলাদা রাজ্য হিসাবে পরিগণিত হয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে।
পাহাড়ে বিশেষত হিমাচলের পাহাড়ে জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বিশেষত ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চল অর্থাৎ লাহুল ও স্পিতিতে। পরিবারের সকলকে সার্বিকভাবে এই বেঁচে থাকার লড়াইতে সামিল হতে হয়। এখানকার শীতকাল যা প্রায় পাঁচ মাস বরফে ঢাকা, সেই সময় অসুস্থতা এবং অন্যান্য কারণে অনেকে তুলনামূলক কম ঠাণ্ডার জায়গায় চলে যান। যদিও ২০১১ সালের সেনসাসের হিসাব অনুযায়ী সম্ভবত ভারতের কষ্টকরতম বসবাসের জায়গা স্পিতি উপত্যকায় এর উল্টো ছবি পাওয়া যায়। দশক প্রতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব যে লাহুল ও স্পিতি জেলায় ২০০১ থেকে ২০১১ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (-) ৫ শতাংশ অর্থাৎ পুরো জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমেছে। অথচ এই জেলার রুক্ষতম সাবডিভিশন স্পিতি উপত্যকার জনসংখ্যা ঐ একই সময়ে শতকরা (+) ১৬.৬৫ বেড়েছে। তার কারণ মূলত পণ্যমূলক কষি উৎপাদনের অভাবনীয় বৃদ্ধি। এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা অন্যত্র পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু যারা ঐ শীতে গ্রামে রয়ে গেলেন তাদের জীবন যাত্রা প্রায় থমকে যাওয়া অবস্থায় চলে যায়। প্রচুর বরফপাতের জন্য জমি রাস্তা সবকিছু বরফে চাপা পড়ে যায়। সেইজন্য তাদের প্রধান কাজের ক্ষেত্র চাষবাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সময় কাটে মূলত প্রশস্ত বসার ঘর কাম রান্না ঘরে আগুনের পাশে। এখন অবশ্য খোলা উনুন ব্যবহার হয় না। বন্ধ উনুনে টিনের চোঙা ঘরের বাইরে বের করে দেওয়া থাকে যাতে ধোঁয়া ঘরে না জমে কিন্তু ঘরের হাওয়া গরম থাকে। সেই ঘরে বসে আড্ডা, অল্প স্বল্প গান বাজনা অথবা ভেড়ার লোম থেকে সুতো তৈরি করা। এতেই সময় কাটে। এই শীতকালেই পারিবারিক জমায়েত বেশি হয়, একেক দিন একেক জনের বাড়িতে। সেই দিনগুলোতে গান বাজনা বা আড্ডা আরও জমে ওঠে। এই জীবন যাপনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য তারা আন্তরিকভাবে অপেক্ষা করে থাকে মেলা বা উৎসবের জন্য
যখন অন্য অনেক মানুষের সাথে তাদের মেলামেশার সুযোগ হবে আর দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের বদলে কিছু নতুন খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে বা নতুন পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তোলা যাবে।
হিমাচল প্রদেশের দুর্গমতম স্থানগুলোর মত একটি হল পিন উপত্যকা। আমরা যারা বাইরের লোক তারা প্রথমত সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেনই। চারদিকে বরফের মুকুট পরা আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। সেই অনিঃশেষ বরফ চূড়া থেকে বয়ে আসা জলধারা। বহু উপর থেকে নিচু পর্যন্ত কোন গাছের চিহ্নমাত্র নেই। শীতের কয়েক মাস সেই পর্বতের সমস্তটা এমনকি নীচে নদী পর্যন্ত বরফ ঢাকা থাকে। বরফ গলে যাবার পর সেই বিরাট পর্বতের গায়ে কোথাও লাল রঙের পোচ, কোথাও সবুজ, আবার কোথাও বা কিছুই নেই, শুধুই ধূসর রুক্ষতা। সেই পর্বতের পায়ের কাছে কোথাও একটু মাটি। সেই মাটিকে ঘিরে কিছু মানুষের বেঁচে থাকা বছরের পর বছর। মাটি এখানে অত্যন্ত মহার্ঘ। একটা হিসেব থেকেই য়া বোঝা যাবে। পুরো স্পিতি উপত্যকা এবং পিন উপত্যকায় মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা চাষযোগ্য। বাকী অংশে প্রায় কিছুই জন্মায় না। কিছু ক্ষেত্রে কিছু কিছু ঝোপ বেড়ে ওঠে, তাও নদী সংলগ্ন এলাকায়। এই ঝোপের একটা বড় অংশই ‘সিবাকথর্ন’-এর ঝোপ। সিবাকথর্ন কুঁচফলের চেয়ে একটু বড়, লাল রঙের ফল। অত্যন্ত উপকারী ফল। যদিও তা প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে।
এখানে বরফ পড়া শুরু হবার আগে জমি চাষ করা শেষ করে জমির প্রান্তে পাথরের অবরোধ তৈরী করা হয় এবং সমস্ত জমি স্থানীয় ঘাস তুলে ঢেকে দেওয়া হয়। এর ওপর বরফ জমা হয়। বরফ গলে যাবার সময় যাতে মাটি ধুয়ে বেরিয়ে না যায়, তার জন্য এই ব্যবস্থা।
এই পিন উপত্যকাতেই একটি গ্রাম। গ্রামের নামটা উহ্য থাক। সেই গ্রামের একটি বাড়িতে সমীক্ষার কাজ চলছে।
গৃহকর্ত্রী প্রশ্নের জবাবে বাড়ির সবার নাম বয়স ইত্যাদি জানাচ্ছেন। উত্তর শুনে একটু খটকা লাগলেও বোঝা গেল, তিনি বহুভর্তৃক অর্থ্যাৎ ইংরেজিতে যাকে Polyandry বলে, তার পরিবারে সেটাই চালু। সেই গ্রামে প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবারে এই প্রথা চালু আছে। ওই গৃহকর্ত্রীর স্বামীরা দুই ভাই। কথা বলে জানা গেল যে এই প্রথা ক্রমশ কমে আসছে।
এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের উদ্দেশ্য এই যে হিমাচলের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনজাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভিন্নতা এখনও অটুট। হতে পারে দুর্গমতার জন্যে এই সব অঞ্চলে বাইরের প্রভাব সেভাবে এসে পৌঁছায়নি। এই অঞ্চলের মানুষেরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরম্পরা শক্তভাবে বজায় রেখেছেন। সমতল সংলগ্ন এলাকায় প্রথমত মুঘলদের প্রভাবে বাইরের সংস্কৃতির মিশ্রণের সূচনা। এখন এইসব অঞ্চলে পাঞ্জাবী সংস্কৃতি মিশ্রিত পাহাড়ী সংস্কৃতির নিজস্বতা বজায় আছে। বাইরের সংস্কৃতির প্রভাবেই সমতল সংলগ্ন হিমাচলে শুরু হয়েছিল ‘‘রীত’’ নামক কদর্য বিবাহ পদ্ধতির। সিমলা, মাণ্ডি, কুলু, কাংড়া এবং আরও কয়েকটি তৎকালীন রাজ্যে ‘‘রীত’’প্রথা চালু ছিল। এই প্রথা অনুযায়ী কোন অনুষ্ঠান ছাড়া শুধুমাত্র টাকা দিয়ে মহিলাদের ঘরে নিয়ে আসা হতো। তখনকার দিনে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বা খুব বেশি হলে ২০০০ টাকা মেয়েটির মা, বাবা বা স্বামীকে দিয়ে তাকে নিয়ে আসা যেত। এই যে টাকা দেওয়া হতো তা ‘‘রীত’’ মূল্য ধরা হতো। একজন ‘‘রীত’’ মূল্য দিয়ে কতজন মহিলাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে তার কোন সীমা ছিল না এবং তাদেরকে অন্য কারও কাছ থেকে ‘‘রীত’’ মূল্য নিয়ে দিয়ে দেবে সেটা একেবারেই তার সিদ্ধান্ত ছিল। ১৯১৭ সালে দলীপ সিং এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটান। লাহুল ও স্পিতি অঞ্চলে এই প্রথা কোনদিনই দেখা যায়নি। এই বিবাহ পদ্ধতি সমতল সংলগ্ন হিমাচল ছাড়িয়ে দুর্গমতর এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি।
তবুও সমাজে মহিলাদের স্থান বিচার করতে গেলে সমস্ত হিমাচলে পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থা চোখে পড়বেই যা ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের বা কেরালার কিছু অঞ্চলের সামাজিক ব্যবস্থার থেকে আলাদা। বরং মূল ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে তুলনীয়। তবে মূল ভারতবর্ষীয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে পাহাড়ের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা আলাদা। অতীতে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল যা এখন হিমাচলের অন্তর্ভুক্ত, সেই অংশ ছাড়া অন্য এলাকাতে মহিলারা বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। পরিবারে তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে এইসব বিষয়ে কখনো বিবাদ সৃষ্টি হয় না। ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চলের এই সামাজিক অবস্থান অবশ্যই বাকী হিমাচলের থেকে আলাদা, যেখানকার সমাজ ব্যবস্থা মাতৃকেন্দ্রিক বংশ পরম্পরা বা মাতৃকুল ভিত্তিক (Matrilineal)। বাকী হিমাচলে মহিলারা সামাজিক ভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাহীন ভাবে বাঁচতে বাধ্য হন। তার মূল কারণ পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবাধ মান্যতা তার সাথে স্থানীয় পুরাকথা এবং বিশ্বাস যা জড়িয়ে আছে মূলত পুত্রসন্তানবতী হওয়া বা না হওয়ার সাথে। এখানে মহিলারা পুত্রসন্তান ছাড়া জীবন ব্যর্থ এই বিশ্বাস নিজেরা করতে শুরু করেন। তার নিজস্ব কোন ইচ্ছা আছে, স্বতন্ত্রতা আছে তা ভুলে যেতে বাধ্য হন। সামাজিক মূল্যবোধ এতটাই শক্তিশালী হিসাবে দেখা যায় সেখানে যে শত দুঃখ হেনস্থার পরেও তারা স্থিতাবস্থার সপক্ষেই থাকেন। তারাই হয়ে ওঠেন কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম পরিশ্রমী বাহক। তাদের শ্রম নিঙড়ে বেড়ে ওঠে কৃষি অর্থনীতির স্বাস্থ্য। পরিবারের জন্য শ্রমদানে তারা অগ্রবর্তী কিন্তু তাদের স্থান পরিবারে উন্নত হয় না। আর যদি পুত্র সন্তানের মা না হতে পারেন তবে তার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করতেই পারেন, যদিও তা আইনত সিদ্ধ নয় কিন্তু সামাজিক ভাবে তা গ্রহণীয়। যারা এতকিছু সহ্য করতে পারেন না তাদের পিতৃপুরুষদের বাড়িতেও তাদের গ্রহণ করতে চায় না। তারা উপহাসের পাত্র হন।
বিভিন্ন প্রকারের অঞ্চল এবং তাদের আলাদা প্রকারের জীবন ধারার সমন্বয়ে গড়ে উঠেচে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যটি। একদিকে কিন্নর এবং লাহুল স্পিতির সম্পূর্ণ জনজাতি প্রধান জীবনধারা, অন্যদিকে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশ সংযুক্তিকরণের পর ‘পাহাড়ি’ ও ‘পাঞ্জাবী’ সংস্কৃতির মিলিত জীবনযাপনের ছবি। একদিকে হিন্দু সংস্কৃতি ও তার প্রকারভেদ, অন্যদিকে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধারা। মাঝখানের সীমারেখা এখানে বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়।
ভৌগলিক ও সংস্কৃতিগত এত বিভিন্নতা সত্ত্বেও সমাজ বা পরিবারের এখানে মহিলাদের সম্মান ও গুরুত্ব তার সন্তান ধারণের সাপেক্ষে নির্ধারিত। পুত্র সন্তানের মা, অভিযোগহীন, বাধ্য এবং কায়িক শ্রমে কোন অনীহা নেই, এমন নারীই পরিবারে ও সমাজে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। আলাদা করে তার নিজের ইচ্ছাপূরণের কোনো অধিকার থাকবে এটা কেউ আশা করে না। জন্ম থেকেই পিতৃতান্তিক সমাজধারা তার জীবন সেই ধাঁচে গড়ে দিতে চায়। কন্যাসন্তানের জন্য আলাদা যত্ন বা সাহায্য অভিভাবকেরা করেন না, কেননা তারা ‘পরায়া ধন’ (অন্যের সম্পত্তি), যাকে অন্য পরিবারে উপহার দিতে হবে। শ্বশুরবাড়িতে তারা বাইরে থেকে আসা কেউ। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সন্দেহাতীতভাবে আনুগত্যের প্রমাণ দিতে পারছে বা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারছে।
সুতরাং একদিক থেকে দেখতে গেলে এখানে নারীদের নিজের দেহের উপরে নিজের কোনো অধিকার নেই। শুধুমাত্র তাই নয়, তারা তাদের নিজের ইচ্ছেমতো কোনো দেবতার আরাধনাও করতে পারে না। মান্ডি জেলার একটি অংশে নারীরা যখন তার পিতার আশ্রয়ে থাকেন, ততদিন শুধুমাত্র তার পিতৃগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট দেবতাকেই পুজার্চনা করতে পারেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নির্দিষ্ট দেবতাকেই পুজা করতে পারবেন এবং তাও পুতির সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর। এই নারীদের শুধুমাত্র তার নিজের দেহের উপর কোনো অধিকার নেই তাই নয়, তার ঈশ্বরবিশ্বাসের অধিকারও শর্তসাপেক্ষ।
অন্যদিকে লাহুল স্পিতিতে পুত্র সন্তানের জন্মের পর যে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে হয় না।
হিমাচলের নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের বিষয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির সংবেদনশীলতা সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা পেতে আমরা একটি অনতি-অতীতের সমীক্ষার প্রাসঙ্গিক অংশটি দেখে নিতে পারি। এই সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী:
১. কীভাবে জমি ব্যবহার করতে হবে সেই বিষয়ে লাহুল ও স্পিতি জেলাতে ১৪ শতাংশ মহিলা সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে সিমলা ও কিন্নর অঞ্চলে মাত্র ৭ শতাংশ মহিলা এই সুযোগ পান।
২. লাহুল স্পিতি অঞ্চলে নারীরা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজেদের নামে পেতে কোনো সামাজিক চাপ অনুভব করেন না, অথচ কিন্নর অঞ্চলে ২৫ শতাংশ মহিলা এই চাপ অনুভব করেন। সিমলা এবং কাংড়া অঞ্চলের নারীদের ৬৩ শতাংশ উত্তরাধিকার সূত্র পাওয়া সম্পত্তি পেতে সামাজিক চাপের সম্মুখীন হন।
৩. সিমলা ও কিন্নর অঞ্চলের নারীদের ৩০ শতাংশ উল্লেখ করেছেন যে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজেদের নামে পেতে প্রচলিত স্থানীয় সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে কিন্নরে এই শতাংশ ২৬ এবং লাহুল স্পিতিতে এই শতাংশ ৩৪।
এই তথ্য থেকে নারীদের প্রতি স্থানীয় সংস্কৃতির সংবেদনশীলতার মাপকাঠিতে লাহুল স্পিতি অঞ্চল সবচেয়ে এগিয়ে আছে, এই ধারণা করা যেতেই পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি দিকে আমরা দৃষ্টি ফেরাতে পারি। ঠাণ্ডা মরুভূমি অঞ্চল অর্থাৎ মূলত লাহুল ও স্পিতি উপত্যকার প্রায় সমস্ত আদি বাসিন্দারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর বাকী হিমাচলের অন্য অঞ্চল বিবিধ আঞ্চলিক আচার আচরণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের যোগাযোগও সমতলের সাথে, বিশেষত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সাথে অনেক বেশি। স্বভাবতই তাদের প্রভাবও এই অঞ্চলে বেশ প্রকট। রোটাং পাস এবং কুঞ্জুম পাসের দুর্লঙ্ঘ বাধার জন্য লাহুল ও স্পিতি সবসময়ই একটু বিচ্ছিন্ন থেকেছে।যদিও অটল টানেলর জন্য লাহুল এখন অনেক সহজ যোগাযোগের মধ্যে চলে এসেছে কিন্তু স্পিতি এখনও প্রায় একই রকম দুর্গম। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবন যাপনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সে পারিবারিক অনুষ্ঠানই হোক বা গ্রামের সামগ্রিক কোন সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানকার প্রতিটি গ্রামের জন্য বৌদ্ধ মঠ নির্দিষ্ট করা আছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ছোট সন্তানকে সাধারণত ‘লামা’ হবার জন্য মঠে পাঠানো হয়। যে বাড়িতে পুত্র সন্তান নেই সেই বাড়ির কন্যা সন্তানকে ‘চোমো’ (মহিলা লামা) হবার জন্য পাঠাবার নিয়ম। পারিবারিক বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে নির্দিষ্ট মঠের লামাদের অংশ গ্রহণ থাকে। সব মিলিয়ে এটা মনে করা যেতেই পারে লাহুল স্পিতির বৌদ্ধ সমাজে বৌদ্ধ মঠগুলির প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই আছে। পরিবারহীন বয়স্ক মানুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমও দেখতে পাওয়া যায় স্পিতি উপত্যকার “কী” গ্রামে। এটি চালান গ্রামের মানুষেরা।
লাহুল ও স্পিতি উপত্যকায় মহিলাদের স্থান সমাজে যথেষ্ট উঁচু জায়গাতে বলে বোঝা যায়। কিন্তু বাকী হিমাচলের ছবিটা সেরকম আশাপ্রদ নয়। তবে এই ফারাক ধর্মের কারণেই হয়েছে কিনা তা সুনিশ্চিত করে বলার আগে অন্যান্য বিষয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে আগামী দিনে কোন উৎসাহী গবেষক আলোকপাত করবেন বলে আশা রাখি।
তথ্যসূত্র:
1. Census 2011 2.. Women Land Rights of Women in Himachal Pradesh: Impacts and Challenges : Submitted to National Commission for Women :Submitted by : SAHAAS (Brotherhood Uplifting CYWO), Shimla, H.P. 3. Situational Analysis of Single Women in Himacal Pradesh, 2006, Compiled by Prajakta Panshikar and Subhash Mendhapurkar. 4. Conjugality, Sexuality and Shastras: Debate on the Abolition of Reet in Colonial Himachal Pradesh by Yogesh Snehi.
স্বীকার করতে বাধা নেই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুদিন আগেও খুব অপরিষ্কার ছিল, যদিও এখন আর নেই। অবশ্য আমার ধারণাটা ছিল দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, তা নাহলে সে লেখাপড়া সে জ্ঞানবুদ্ধি আমার কোথায়? আর কেমন অপরিষ্কার ছিল বোঝাতে গেলে আগে অন্য একটা গল্প বলতে হয়। সেটা তন্ত্রসাধনার গল্প।
পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তন্ত্রসাধনা হল জীব-শিবে একাত্মতার সাধনা। তন্ত্রমতে আমাদের দেহে আছে তিন নাড়ি – ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। ঐ তিন নাড়ির সাহায্যে ষটচক্রভেদ করে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে সহস্রাররূপ শিবে মিলিত হতে পারলেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ। পঞ্চমুণ্ডি মানে পাঁচ জাতের মানুষের মাথা মাটিতে পুঁতে তার ওপর বসে সাধনা করার আসনবিশেষ। পাঁচ জাত কেন? অনেকদিন আগে যে দাদা আমাকে গল্পটা বলেছিল সে বলেছিল, তন্ত্রে কোনো জাতভেদ নেই, ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সবরকম মাথা এই সাধনায় ব্যবহৃত হয়। জ্যান্ত না মরা? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সে দিতে পারেনি, কারণ সেও কখনো কোনো তান্ত্রিককে নিজের চোখে সাধনা করতে দেখেনি, গল্পটা তারও শোনা। তবে সে আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, মরাই হবে, জ্যান্ত মানুষকে কি আর পুঁতে ফেলে কেউ! আমি বলেছিলাম কিন্তু কাপালিকরা তো সাধনার প্রয়োজনে মানুষকে বলি দিয়ে তার শবদেহর ওপরে বসে সাধনা করে, একথা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গেছেন। দাদা আমার জ্ঞানের প্রশংসা করেছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বুঝিয়েছিল যে এক, তান্ত্রিকের সঙ্গে কাপালিকের তফাত আছে, আর দুই, জ্যান্ত মানুষকে পুঁতে ফেলার কথা তো কোথাও নেই। তাতে করেও একটা প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। মরা মানুষ হাঁ করবে কি করে? এইভাবে আমার কম বয়সে শোনা এই গল্পে দু’একটা ধাঁধা থেকে গিয়েছিল। তাই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে হতে পারে লোকগুলোকে গলা পর্যন্ত পুঁতে দেওয়া হয়েছিল, তারা তখনো পুরো মরেনি, তাই মুণ্ডুগুলো হাঁ করত। কোনো কোনো মাছের মুণ্ডু আর ধড় আলাদা করার সময় মুণ্ডুগুলো যেমন হাঁ করে এও তেমনি।
মোট কথা, পঞ্চমুণ্ডির ওপর বসে সেই তান্ত্রিক সাধনা করতেন। তান্ত্রিক মন্ত্র আওড়াতেন আর মাঝে মাঝে মুণ্ডুগুলো যখন হাঁ করত, তখন তাদের মুখে একটু একটু করে মটর ফেলে দিতেন। এই করতে করতে একটা সময় মুণ্ডুগুলো হাঁ বন্ধ করত আর তান্ত্রিকও সমাধিস্থ হয়ে যেতেন।
এই গুরুদেবের একাধিক শিষ্য ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল একেবারে অপোগণ্ড। সে কোনো কম্মের ছিল না। তাই গুরুদেব তাকে আনুষঙ্গিক নানা কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। গুরুপত্নীর ফাইফরমাশ খাটা, ধোয়াধুয়ি কাচাকুচি করা, গোরুর দুধ দোওয়া, তাল তাল গোবর এনে তার থেকে ঘুঁটে তৈরি করা এবং ইত্যাদি। হতে পারে এই সেই শিষ্য যে ইদানিং গোরুর দুধে সোনার খোঁজ পেয়েছে আর গোরুর চোনায় খোঁজ পেয়েছে করোনার ওষুধের। অবশ্য অতীতে আমাদের এক প্রধানমন্ত্রী নিজের চোনার মধ্যেও স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন, যার নাম ছিল শিবাম্বু।
তবে এই শিষ্য কিন্তু একটা কাজ খুব নিষ্ঠাভরে করত। অন্য শিষ্যরা যখন গুরুগৃহে বসে ওঁ হ্রীং ক্লীংগুলো যতটা পারে কমিট ইন ইয়োর মেমোরি করার চেষ্টা করত, সে থিয়োরিটিকালের ধার না ধেরেই প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করত। রামভক্ত হনুমানের মত দূরে বসে গুরুদেবের সাধনা দেখত। তার গোপন ইচ্ছে সেও গুরুদেবের মত তন্ত্রসাধনা করে, কিন্তু গুরুদেব তাকে মন্ত্রতন্ত্র কিছুই শেখান না। বললে বলেন, “ও তোমার কম্ম নয়।”
একদিন গুরুদেব জরুরি কাজে একটু দূরে গেলেন। যাবার সময় এই শিষ্যকে আশ্রমের ভার দিয়ে গেলেন আর পইপই করে বলে গেলেন, আর যে বসে বসুক, সে যেন কিছুতেই আসনে চেপে না বসে, তাহলে ভয়ানক বিপদ হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গুরুদেব যেতেই শিষ্য মহা উৎসাহে আসনের ওপর চেপে বসল। মন্ত্রতন্ত্র তো কিছুই জানে না। অংবংচং বলতে লাগল আর মুণ্ডুগুলো হাঁ করলেই মুখে মটর গুঁজে দিতে লাগল। কিন্তু যেহেতু মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানে না, মুণ্ডুগুলোর হাঁ করা কিছুতেই থামতে চাইল না। দেখতে দেখতে মটর ফুরিয়ে এল। আসন ভয়ানকভাবে কাঁপতে লাগল। ভয়ে শিষ্যের মুখ শুকিয়ে গেছে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কান পাতলে শোনা যায় অস্ফুটে বলছে, গু মট ফু গে অর্থাৎ গুরুদেব মটর ফুরিয়ে গেছে। ভয়ের চোটে সব আব্রিভিয়েশন হয়ে গেছে।
তখন আমার প্রায়ই মনে হত এই তন্ত্রসাধনার সঙ্গে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রসাধনার বেশ মিল আছে। তন্ত্রের জীব-শিবে একাত্মতার সাধনা হল সংসদীয় গণতন্ত্রে দলে-গদিতে একাত্মতার সাধনা। পঞ্চমুণ্ডি হচ্ছে বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহানের নামে নানা জাত, নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি আর নানা ভাবের পিণ্ডি চটকিয়ে সেই পিণ্ডিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে তারপর তাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে তার ওপর বসে সাধনা করার আসন বিশেষ। নাড়ি তিনটে হল শীর্ষ নেতৃত্ব, সংগঠন আর টাকা। ষটচক্রের বানানে একটু পরিবর্তন করে নিলেই চলবে। ষটের জায়গায় ‘ষড়’ বসিয়ে নিলেই হল। ‘ষড়’ মানে চক্রান্ত। চক্রান্তের চক্র, সংক্ষেপে ষড়চক্র। অর্থাৎ গদিতে আসীন হতে না দেওয়ার যাবতীয় বিরোধী চক্রান্ত ভেদ করে তবে এগোতে হয়। কুলকুণ্ডলিনী হল ভোটার আর সহস্রাররূপ শিব হল গদি। মটরগুলো হল অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা আর স্বাস্থ্য নিয়ে দেওয়া ঝুরি ঝুরি প্রতিশ্রুতি। যে দলের প্রতিশ্রুতি মাথাগুলো গিলতে গিলতে ধীরে ধীরে শান্ত হয়, সেই দল গদিস্থ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু দুটো জিনিস কখনো পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারিনি। একটা হল, এই সাধনার সাধকটি কে? আর একটা হল, অপোগণ্ড শিষ্যটিই বা কে? আমার খুব মনে হত এই সাধনার প্রায় সব শিষ্যই একটু একটু অপোগণ্ড। তাদের বই পড়া থিয়োরিটিকাল বিদ্যের সঙ্গে প্র্যাক্টিকাল প্রায়শই মেলে না, আসনে বসলেই মুখগুলো কোনো না কোনো সময় ঝামেলা করে। ফলে মুখগুলোর হাঁ যখন কিছুতেই বন্ধ হতে চায় না, যখন আসন ভয়ানকভাবে কাঁপতে থাকে, তখন কান পেতে শুনে দেখেছি, তারা সকলেই অস্ফুটে বলছে, গ না গুষ্ পি অর্থাৎ গণতন্ত্র না গুষ্টির পিণ্ডি।
তো আমি ঠিক করলাম এই অজ্ঞতার হাত থেকে আমাকে বেরোতে হবে। আমাকে জানতে হবে এই সাধনার সাধকটি ঠিক কে? যদিও গান্ধীজি এই সাধনার সাধক কিনা সে ব্যাপারে আমার সংশয় ছিল, তবু আমি গান্ধীজিকে দিয়ে শুরু করার কথাই ভাবলাম। তিনি জাতির জনক বলে কথা। ফলত আমি কংগ্রেসের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও ভাবলাম। কেননা যতই হোক একে তো এটা একশো পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোনো একটা দল, তার ওপর তারাই তো গান্ধীজিকে জাতির জনক বানাল, টাকায় তাঁর ছবি ছাপল, জায়গায় জায়গায় তাঁর মূর্তি বসাল। গান্ধীজির কথা তাদের থেকে ভালো আর কে বলতে পারবে? এই ভেবে আমি এক কংগ্রেসী বন্ধুর কাছে গেলাম, বললাম, “আচ্ছা, এই সাধনার সাধকটি ঠিক কে বলতো, গান্ধীজি কী?” সে শুনে বলল, “আরে দূর দূর, সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে গান্ধীজির কোনো ধারণাই ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে তিনি যেসব শব্দ ব্যবহার করে গেছেন সেসব শব্দ মুখে আনাও পাপ। বন্ধ্যা, বেশ্যা। এক ইংরেজ মহিলার অনুরোধে পরে অবশ্য ‘বেশ্যা’ শব্দটা বদলেছিলেন। সত্যি বলতে কী, নাথুরাম গডসে মেরেছে বটে, নাহলে তাঁর যা ধারণার ছিরি ছিল, গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা তাঁর অন্য আরো অনেকের দিক থেকেই ছিল।”
“বল কী? কেন, তিনি কী এমন বলেছিলেন?”
“তিনি অবশ্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু বলতে গিয়ে বলেছিলেন, বিলিতি ধরনের এই সংসদীয় গণতন্ত্র এদেশে আমদানি করলে দেশটা নাকি গোল্লায় যাবে।”
“কেন, গোল্লায় যাবে কেন?”
“তাঁর মতে, পার্লামেন্ট নিজে থেকে কোনো কাজ করতে পারে না, যেটুকু যা কাজ করে বাইরের চাপে, সেইজন্যে সে বন্ধ্যা। আর বেশ্যা এইজন্যে যে মন্ত্রীদের বদল লেগেই আছে। যখন যারা মন্ত্রী হয়, পার্লামেন্ট চলে যায় তাদের দখলে। আজ ইনি তো কাল তিনি।”
“তাই নাকি? কিন্তু পার্লামেন্ট যে বাইরের চাপে কাজ করে সে চাপ তো জনগণের। সেটা তো ভালো।”
“সেকথা তিনি মানলেন কোথায়? তাঁর বক্তব্য ছিল যে পার্লামেন্ট যদি জনগণেরই হবে, তাহলে তাকে তো চাপ দিতে লাগারই কথা নয়। সে তো জনগণের স্বার্থে আপনাআপনিই কাজ করবে। কিন্তু তাতো হয় না, পার্লামেন্ট যেটুকু যা কাজ করে, গদি চলে যাবার ভয়ে। আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে গেছেন তিনি।”
“যেমন?”
“যেমন ধর, পার্লামেন্টের সদস্যরা নাকি সব ভণ্ড আর স্বার্থপর। তারা যে যার নিজের স্বার্থ পূরণেরই চেষ্টা করে সবসময়। পার্লামেন্ট নাকি যেটুকু কাজ করে ভয়ে। আজ যে ব্যবস্থা হল কাল তা রদ করে দিতে হয়। বড় বড় বিষয়ে আলোচনার সময় কোনো কোনো সদস্য ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ বা পড়ে পড়ে ঝিমোয়। না হলে এমন শোরগোল তোলে যে যারা শুনতে চায় তাদেরও কানে তালা লেগে যায়। পার্লামেন্টে নাকি যে যে দলের সদস্য হয়, সে সেই দলের পক্ষে চোখ বুজে মত দিয়ে দেয়। অনেক সময় তাকে মত দিতে বাধ্যও করা হয়, না দিলেই বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবে। দেশের লোকের টাকা নষ্ট ছাড়া পার্লামেন্ট আর কিছু করে না।”
একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একটু উশখুশ করছিলাম। সাহস করে বলেই ফেললাম, “কিন্তু শুনেছি এম. সি. চাগলাও নাকি অনেকটা এরকম কথাই বলেছিলেন। সংসদে বেশির ভাগ সদস্যেরই নাকি সংসদের কাজেকর্মে কোনো আগ্রহ নেই। তারা শুধু তাদের দলের মেজরিটি রক্ষে করেই খালাস।”
“কে? এম. সি. চাগলা? আরে দূর, ওঁর কথা ছাড়ো তো। বম্বে হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস থাকার সময় উনিই তো হরিদাস মুন্ধ্রা কেলেঙ্কারিতে টি টি কৃষ্ণমাচারিকে ফাঁসিয়ে দিলেন। বেচারা কৃষ্ণমাচারিকে অর্থমন্ত্রীর পদটা ছেড়ে দিতে হল। কত বিশ্বাস করে নেহরু চাগলাকে ওয়ান ম্যান কমিশন বানিয়ে তদন্তের ভার দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন যে চাগলা কৃষ্ণমাচারিকে ঠিক বাঁচিয়ে নেবেন। ফল হল উলটো। কৃষ্ণমাচারি নেহরুর খুব প্রিয় ছিল, এই ঘটনায় নেহরু খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। ঐ জন্যেই তো নেহরু চাগলাকে দেখতে পারতেন না। শুধু তাই নয়, নিজে মুসলমান হয়েও চাগলা বিজেপির মহা অধিবেশনে হাজির হয়ে বিজেপিকে তোল্লা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কে বলেছে কংগ্রেসই একমাত্র বড় দল? এই তো আমার চোখের সামনে ভবিষ্যতের আর একটা বড় দল আর প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি। অটলবিহারী বাজপেয়ী।”
“তাহলে তো বলতে হবে চাগলা সাহেব দারুণ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। দেখ ভাই বিজেপি তো সত্যিই আজকে দেশের বৃহত্তম দল। অটলবিহারী বাজপেয়ীও দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা থাকতে বিজেপি এরকম মহীরুহ হয়ে উঠল কি করে?”
“ও তালেগোলে হয়ে গেছে।” আমার কংগ্রেসী বন্ধু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। তাই গান্ধীজি প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললাম, যাই হোক গান্ধীজির কথা বল।”
“হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?”
“বলছিলে যে গান্ধীজির মতে নাকি পার্লামেন্ট দেশের টাকা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু করে না।”
“শুধু কী তাই? গান্ধীজি প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেগুলো আরো খারাপ কথা।”
“কিরকম?”
“এই যেমন, তিনি পার্লামেন্টের ভালোর জন্যে যত না, তার থেকে বেশি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে মাথা ঘামান। সবসময় চেষ্টা করেন যাতে তাঁর দল জেতে। পার্লামেন্ট ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সে দিকে তাঁর বড় একটা খেয়াল থাকে না। দলীয় সুবিধের জন্যেই পার্লামেন্টকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। তিনি হয়ত সরাসরি ঘুষ নেন না, কিন্তু চালাকির আশ্রয় যথেষ্টই নেন। কাজ হাসিল করার জন্যে একে উপাধি ওকে খেতাবের ঘুষ দেন। এছাড়াও আছে।”
“এছাড়াও আছে?”
“ভোটার আর খবরের কাগজগুলোকেও তিনি তুলোধোনা করেছিলেন। ভোটারদের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে রীতিমত ব্যঙ্গ করেছিলেন। ভোটাররা কাকে ভোট দেবে সব নাকি ঐ খবরের কাগজ দেখে ঠিক করে। আর খবরের কাগজগুলো মিথ্যের বেসাতি করে। একটা কাগজ একটা ব্যাপারকে গুরুত্বই দেয় না, আর একটা কাগজ সেটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায়। একটা কাগজ যদি কোনো নেতাকে ভালো বলে, তো আর একটা কাগজ সেই নেতার বাপান্ত করে। ভাব একবার গান্ধীজির চোখে ভোটারদের আর খবরের কাগজগুলোর, যাকে আমরা চতুর্থ স্তম্ভ বলে জানি, কী মর্যাদা!”
“কিন্তু তাহলে দেশটা চলবে কী দিয়ে?”
“সেটাই তো হচ্ছে কথা। সে ব্যাপারেও গান্ধীজির অদ্ভুত ভাবনা। শহরের প্রতি তাঁর কোনো ভালোবাসাই ছিল না। তাঁর ধারণা, কোটি কোটি মানুষ কখনই শহরে আর বড় বড় বাড়িগুলোতে একসঙ্গে শান্তিতে বাস করতে পারেনা। সেখানে বাস করলে হিংসা আর অসত্যকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকবে না। তাঁর যত ভাবনা ছিল গ্রাম নিয়ে। গ্রামসমাজকে নাকি হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ব্রিটিশ আসার আগে যেমন ছিল। নিজের যা কিছু প্রয়োজন তা সে নিজেই মিটিয়ে নেবে। প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠবে এক একটি প্রজাতন্ত্র। আর এই গ্রামসমাজের তৃণমূল স্তর থেকেই গড়ে উঠবে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে নাকি গড়ে তুলতে হবে পঞ্চায়েত থেকে। সিদ্ধান্তগুলো সেখান থেকে ওপরে যাবে, সেই অনুযায়ী দেশ চলবে। ওপর থেকে নিচে নামবে না। সিদ্ধান্তগুলো কোনো পার্টি লাইন ধরে হবে না, হবে কোনো একটা বিষয় নিয়ে গ্রামবাসীদের ভাবনার ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে। সত্য অহিংসা আর নিষ্ঠার পথে সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করতে হবে। যেহেতু গ্রামের মানুষ সহজ সরল হয়, সত্য অহিংসা আর নিষ্ঠার আদর্শে তারা বিশ্বাসী হয়ে উঠবে, গ্রামসমাজটাও তাই হয়ে উঠবে। জানোই তো তিনি এমনকি কংগ্রেসকেও তুলে দিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, কংগ্রেসীরা এবার দলীয় পতাকা ছেড়ে লোকসেবক হয়ে গ্রামে যাক, সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করুক। তাঁর মতে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ঐ তৃণমূল স্তর থেকে ধাপে ধাপে উঠে যে নেতৃত্বের সৃষ্টি হবে সেখান থেকে আসবেন। তাঁর ভাষায় এটা নাকি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বা ডাইরেক্ট ডিমক্র্যাসি। সাধে কী আর আমাদের নেহরু সাহেব চিঠি লিখে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনার এইসব ধারণাগুলো যেমন প্রতিক্রিয়াশীল তেমনি আজগুবি।’ ”
ভয়ে ভয়ে বললাম, “কিন্তু শুনেছি এম. এন. রায়, জয়প্রকাশ নারায়ণ এঁরাও নাকি দলীয় রাজনীতি পছন্দ করতেন না আর নোয়াম চমস্কি নাকি গান্ধীজির এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন।”
“করেছেন, কিন্তু নোয়াম চমস্কি একজন পণ্ডিত মানুষ, বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁর সে যোগ কোথায়?”
“আর?”
“আর কী! বড় শিল্প ছিল তাঁর নাপসন্দ। তাঁর বক্তব্য ছিল যে বড় শিল্প মানুষের ব্যক্তিত্বকে তার মানবিক সত্তাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া বড় শিল্প চারপাশকেও নষ্ট করে দেয়। এই পৃথিবী আলো হাওয়া জল জঙ্গল জমি এসবই নাকি আমরা কোনো উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাইনি, সন্তানদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পেয়েছি। অতএব খেয়াল রাখতে হবে যেমনটা পেয়েছিলাম তেমনটাই যেন তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি। এসব আজগুবি কথা নয়?”
“আজগুবি কেন?”
“আরে, ধার নিলে তা সুদসমেত ফেরত দিতে হবে না?”
“কিন্তু প্রকৃতি মানে তো শক্তি। শক্তির তো বাড়াকমা নেই। আমি অবশ্য আমার ফিজিক্সের ক্লাস ফোরের বিদ্যে নিয়ে বলছি। তাকে তুমি বাড়াবে কী করে? ধর, শক্তি হল দশ, তুমি যদি তা সুদসমেত ফেরত দিতে চাও, তাহলে তোমাকে দশের সঙ্গে এক দুই যা হোক একটা কিছু যোগ করতে হবে। ধর তুমি যোগ করলে দুই, তাহলে দাঁড়াল দশ যোগ দুই বারো অর্থাৎ মোট বারো তোমাকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু শক্তিকে তুমি বারো বানাবে কী করে? সেটা করতে গেলে তোমারই উলটে বারোটা বেজে যাবে না?”
“ধ্যুস, দশকের পর দশক ধরে চেষ্টা করে গেলেও দশকে যে আমরা বারো বানাতে পারব না সেকি আর আমরা জানিনা? খুব জানি। কিন্তু ধর আমরা যদি ঐ দশকেই নয় কিংবা আট কিংবা সাতে পরিণত করে দিতে পারি আর বাকি এক কিংবা দুই কিংবা তিনকে বস্তুগত সুদে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে আমাদের ছেলেপুলেরা আসলটা যে কমে গেল সেটা আর হাতেনাতে ধরতেই পারবে না। বরঞ্চ তারা খুশি হয়ে যাবে।”
“কেন খুশি হবে তারা?”
“হবে না? তারা যখন দেখবে তাদের বাপকাকারা নানারকমের উপকরণ দিয়ে পৃথিবীটাকে এমন সুন্দর সাজিয়ে দিয়ে গেছে যে চারিদিক ঝকমক করছে, তখন তারা কি খুশি হবে না? তখন কি আর তারা আসল সুদ ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবে?”
“ঝকমক মানে?”
“ঝকমক মানে বড় বড় রাস্তা, চওড়া চওড়া ফ্লাইওভার, আকাশছোঁয়া বাড়ি, বড় বড় মল, বড় বড় গাড়ি, বড় বড় কারখানা, বড় বড় কংক্রিটের বাঁধ, আরো কত কী। তার নামই তো উন্নয়ন।”
“উন্নয়ন মানে?”
“তুমি বড় কথায় কথায় মানে মানে কর। এই একুশ শতাব্দীতে এসেও তোমাকে আবার উন্নয়নের মানে বোঝাতে হবে নাকি? উন্নয়ন মানে উন্নয়ন, তার আবার মানে কী?”
“বেশ। কিন্তু তুমি যে বললে বড় শিল্প ছিল গান্ধীজির নাপসন্দ, তাহলে যন্ত্রের কি হবে? বড় বড় শিল্প তো বড় বড় যন্ত্র ছাড়া চলে না।”
“আর বোলো না, সেও এক ঝকমারি। বড় বড় যন্ত্রকে গান্ধীজি খুব ভয় পেতেন, কারণ নাকি এইসব যন্ত্র খুব তাড়াতাড়ি জিনিস উৎপাদন করে ফেলে, হাত দিয়ে মানুষ যা পারে না।”
“তাতে কি হ’ল ? ভালোই । জাতীয় অর্থনীতির সুরাহা হবে।”
“সে তো জানি তাতে ভালোই, কিন্তু গান্ধীজির বক্তব্য তো উলটো। তিনি জাতীয় অর্থনীতি, জাতীয় সমৃদ্ধি এসব মোটেই বুঝতেন না। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হল এতে মানুষ বেকার হয়ে যাবে। যে দেশে এত লোক এবং তাদের প্রত্যেকের কাজের দরকার, সে দেশে বড় যন্ত্র সংকট বাড়াবে ছাড়া কমাবে না। তাই তিনি সরাসরি বলেছেন, আমাদের দেশে বড় যন্ত্রের প্রয়োজন নেই, কুটিরশিল্পই যথেষ্ট। দেশের মানুষ যখন অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে তখন প্রয়োজনে তারা বড় যন্ত্রকে গ্রহণ করবে।”
এইখানে এসে আমি একটু হোঁচট খেলাম। বড় যন্ত্রের সঙ্গে আবার হিংসা অহিংসার সম্পর্ক কী? কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ল চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমসে’র শ্রমিক নায়ক সারাদিন ধরে একটা বড় যন্ত্রের নাটবল্টু টাইট করতে করতে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছিল যে তাকে অ্যাসাইলামে দিতে হয়েছিল। তাই আমি ও ব্যপারে আর না ঢুকে অন্য কথা পাড়লাম। বললাম, “কিন্তু যতদূর মনে পড়ে ভারতীয় অর্থনীতির বইতে পড়েছিলাম নেহরু সাহেব দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় বলেছিলেন, বড় শিল্পের ওপর বেশি জোর দেওয়া আমাদের ভুল হয়েছে, আমাদের নজর দেওয়া উচিত ছিল কুটিরশিল্পের দিকে।”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন, তার কারণ তিনি সবসময় একটা দোটানায় ভুগতেন। কখনো তাঁর মনে হত গান্ধীজি ঠিক, কখনো মনে হত গান্ধীজি ভুল। এতেই তো দেশের ক্ষতি হয়েছে।”
“যাক গে, নেহরুর কথা থাক। কিন্তু বড় যন্ত্র বড় শিল্প এসব যদি গান্ধীজির নাপসন্দই হয়, তাহলে পুঁজিপতিদের সম্পর্কে তাঁর কী অভিমত ছিল?”
“সেটা আরো উদ্ভট। গান্ধীজির কাছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মানে হল ব্রিটিশ পুঁজিপতি ও পুঁজি এবং তাদের দোসর ভারতীয় পুঁজিপতি ও পুঁজির হাত থেকে মুক্তি। পুঁজিপতিদের তিনি গরিব মানুষের অছি হয়ে যাবার ডাক দিয়েছিলেন।”
“অছি মানে?”
“অছি মানে ট্রাস্টি। মানে গচ্ছিত সম্পত্তির জিম্মাদার।”
“কার গচ্ছিত সম্পত্তি?”
“জনগণের।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ পুঁজিপতিরা জনগণের সম্পত্তি তাদের জিম্মায় আছে এটা মনে রেখে ব্যবসাবাণিজ্য করবে?”
“আমি বলতে চাইছি না, গান্ধীজি বলতে চাইছেন।”
“কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব, পুঁজিপতিরা হচ্ছে বেড়াল, বেড়ালকে মাছ আগলাতে বলার ব্যাপার হয়ে যাবে না সেটা?” আমি বললাম।
“সম্ভব নয় তো বটেই। তবে এই ব্যাপারটায় আমরা গান্ধীজিকে তেমন দোষ দিই না। প্রণামী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ছিলেন তো, মাছের ব্যাপারটায় কোনো ধারণা ছিল না।”
“তা বটে। কিন্তু দুধের ব্যাপারে তো তাঁর ধারণা ছিল। তিনি তো দুধ খেতেন। বেড়ালকে দুধ আগলাতে দেওয়াও তো একই ব্যাপার।”
সে তো ঠিকই। আসলে বেড়ালের ব্যাপারটাতেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। তিনি তো ছাগল পুষেছিলেন।”
“বেশ, এতই যখন বললে, দেশের সুরক্ষা, সেনাবাহিনী নিয়ে গান্ধীজির ভাবনার কথাও একটু বল। এত যে অস্ত্র কেনাকেনি, এত যে আধা-সরকারি, সরকারি সেনাবাহিনীতে পুলিশে রেগুলার রিক্রুটমেন্ট এ নিয়েও তো নিশ্চয়ই গান্ধীজি কিছু নির্দেশ দিয়ে গেছেন। মানে কতটা অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দরকার পড়বে, সেনাবাহিনীতে পুলিশে কী পরিমাণ লোক লাগবে।”
“ক্ষেপেছ। অহিংসার পূজারি, তিনি কখনো ওসব কথা বলেন। তিনি তো কোনো সেনাবাহিনী রাখতেই বারণ করে গেছলেন। তাঁর মতে, আত্মরক্ষার জন্যে সশস্ত্র বাহিনীরই দরকার নেই, অস্ত্রশস্ত্র তো দূরের কথা। কিন্তু চারপাশে যখন এত শত্রু তখন গান্ধীজির কথা মানলে কি চলত? গান্ধীজির কথা শুনে তো একরকম চলা হচ্ছিল, কিন্তু চিন গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বলে দিয়ে গেল, ব্যাটা, শিগগিরি শিগগিরি অস্ত্র বানা। সেই থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারটায় কোনো অবহেলা করিনা, আর যে ব্যাপারেই করি না করি। সেনাবাহিনীতে লোক নেবার ব্যাপারেও না, আর কোনো লোক নেবার ব্যাপারে করি না করি।”
“তা বটে। বিশেষ যখন পাশেই জ্ঞাতিশত্রু।”
“তুমি পাকিস্তানের কথা বলছ তো? হ্যাঁ, তারাই তো সব থেকে বড় বিপদ। কিন্তু গান্ধীজি পাকিস্তানকে জ্ঞাতিশত্রু ভাবলেন কোথায়? সেই জন্যেই তো গুলি খেয়ে গেলেন।”
বুঝলাম যে দেশশাসন করতে গেলে গান্ধীজির কোনো কথাই শুনলে চলত না এটাই কংগ্রেসের বক্তব্য। তাই জিগ্যেস করলাম, “গান্ধীজির কোনো কথা শুনলেই দেশ চলত না যদি, তাহলে লোকটাকে এত মাথায় তুললে কেন? তাঁকে জাতির জনক বানিয়ে দিলে, টাকার ওপর তাঁর ছবি ছাপালে, জায়গায় জায়গায় মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে দিলে।”
আমার কংগ্রেসী বন্ধু বেশ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “কারণ ছিল। আমরা যদি লোকটাকে ভগবান বানিয়ে না দিতাম, তাহলে লোকটা ভূত হয়ে দেশের লোকের ঘাড়ে চাপত। আর দেশের লোককে ভূতে ধরলে যে কী কাণ্ড হয়, তুমি নিশ্চয়ই জানো। তাদের তাণ্ডবে তখন আমরা অস্থিরপঞ্চম হয়ে যেতাম, সুস্থিরভাবে দেশশাসন করতেই পারতাম না। কিন্তু আমরা লোকটাকে ভগবান বানিয়ে দিয়েছি, তাই সে ভয় আর নেই। এখন আর লোকটার কোনো কথা মেনে চলার দরকার নেই, শুধু নিয়মিত তাঁর পুজো করে গেলেই চলবে। আর কেমনভাবে পুজো করতে হবে এদেশের লোককে বুঝিয়ে দিতে হবে না, সেটা তাদের রক্তে আছে। হ্যাঁ দশচক্রে পড়লে ভগবানেরও ভূত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সেই জন্যে আমরা তাঁর ত্রিসীমানা থেকে দশচক্র সরিয়ে সে জায়গায় অশোকচক্র বসিয়ে দিয়েছি, এখন আর লোকটার ভূত হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই।”
শেষের কথাগুলো আমার মোটা মাথায় ভালো ঢুকল না। ভগবান, ভূত, দশচক্র, অশোকচক্র, সেসব আবার কী? যাক্ গে, তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি চললাম আমার বামপন্থী বন্ধুর উদ্দেশে।
২
আমার এই বামপন্থী বন্ধুর নাকের তলায় একটা মোটা গোঁফ আছে। দূর থেকে তাকে দেখলে কেমন জোসেফ স্টালিনের মত লাগে। সে আমাকে দেখেই বলল, “তুমি তোমার সেই কংগ্রেসী বন্ধুর কাছ থেকে আসছ, না?”
আমি তো অবাক। বামপন্থীদের বুদ্ধি প্রখর হয় এবং সেটা নিয়ে তাদের একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার থাকে জানতাম, কিন্তু তারা যে ফেলুদার মত ডিটেকটিভও হয়ে উঠেছে জানতাম না। বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে?”
সে বলল, “তোমার ঝোলা থেকে যে হ্যান্ডবিলটা উঁকি মারছে ওটার দিকে তাকিয়ে। তেরঙ্গা হাত চিহ্ন দেওয়া হ্যান্ডবিলটা আজই প্রেস থেকে ছেপে বেরিয়েছে, এইমাত্র আমার কাছেও এক কপি এসে পৌঁছেছে। তো কী করতে গিয়েছিলে?”
“আসলে আজ সকাল থেকেই একটা প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” বলে তাকে বললাম ব্যাপারটা।
“তোমার প্রশ্নটার অনেক ভাগ, ভাগে ভাগে উত্তর দিতে হবে।” সে বলল, “প্রথম কথা হচ্ছে সাধনা। দ্যাখো সাধনা-টাধনায় আমরা বিশ্বাস করি না, ওসব ভাববাদী কথাবার্তা, আমরা বস্তুবাদী। তবে হ্যাঁ যদি ধারণার কথা বল, এদেশে গণপরিষদের ধারণা প্রথম নিয়ে এসেছিলেন এম. এন. রায়। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি সেটা কংগ্রেসের গোচরে আনেন। কংগ্রেস তখন দেশের সবথেকে বড় দল। কংগ্রেস সেটা লুফে নেয় এবং পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে দলীয় স্তরে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে। তারপর সংবিধান তৈরি হওয়া পর্যন্ত ইতিহাস তুমিও জানো। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র গড়ে ওঠার পেছনেও কমিউনিস্ট পার্টিরই সবথেকে বড় অবদান ছিল।”
“কিন্তু যতদূর জানি এম. এন. রায় তো নিজেই আর কমিউনিস্ট থাকেন নি।”
“সেকথা ঠিক, পরবর্তীকালে তিনি রেনিগেড হয়ে গিয়েছিলেন, ভাববাদী হয়ে গিয়েছিলেন। তাতে কমিউনিস্টদের প্রাথমিক ভূমিকাটা তো আর মুছে যাচ্ছে না।”
“বেশ, তারপর?”
“তারপর ধর গান্ধীজির ব্যাপারটা। গান্ধীজি নিয়ে আমাদের বক্তব্য অনেকটা কংগ্রেসের মতই। সবথেকে বড় কথা লোকটা ছিল আফিমখোর।”
“আফিমখোর ছিল, বল কী? কোনোদিন শুনিনি তো একথা।”
“তবে আর বলছি কী? সেক্যুলার মোটেই ছিল না। সারাদিন ধর্মে বুঁদ হয়ে থাকত, আর জানোই তো ধর্মকে আমরা মনে করি মানুষের আফিম। আচ্ছা, তুমিই বল, ধর্মনৈতিক স্বাধীনতা বলে কিছু হয়?”
“সে আবার কী জিনিস?”
“কী জিনিস সেটা গান্ধীজিই জানেন। তার ওপর লোকটা বিজ্ঞানে একেবারে অজ্ঞান ছিল। আর যন্ত্রের মানে প্রযুক্তির ব্যাপারটা তো বুঝতই না। না হলে বিংশ শতাব্দীতে বসেও বলে, গ্রামে যাও, চরকা কাটো, যাঁতা পেষো, ঢেঁকিতে পাড় দাও। আমাদের কিন্তু দিন শুরু হয় বিজ্ঞান দিয়ে, শেষও হয় বিজ্ঞান দিয়ে। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আমরা মানি না।”
“তা বটে। বিজ্ঞানের তো একটা ধর্ম আছেই, যেমন ধর অক্মিজেনের ধর্ম আর হাইড্রোজেনের ধর্ম আলাদা।” আমি আমার বিজ্ঞানের জ্ঞান জাহির করতে যাই।
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা পদার্থের ধর্ম। অ-পদার্থের নয়।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ গান্ধীজির ধর্ম অপদার্থের ধর্ম।”
“ব্যাপারটা তো তাই দাঁড়ায়।”
“যাক্ গে, ধর্মের কচকচি থাক। কিন্তু শুনেছি গান্ধীজি নাকি যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন না। রামমনোহর লোহিয়াকে তিনি বলেছিলেন, রেল, বিদ্যুৎ, এসব ছাড়া যে আর চলবে না তিনিও জানেন। চরকাও তো যন্ত্রই। এমনকি এই শরীরও তো একটা যন্ত্র।”
“কিন্তু চরকা দিয়ে কি উন্নয়ন হবে?”
“উন্নয়ন মানে?”
“উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। তার আবার মানে কী?”
“এ ব্যাপারে কংগ্রেসীদের সঙ্গে তোমাদের তো বেজায় মিল দেখছি। ওরাও বলে, উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। তার আবার মানে কী?”
“তা হতে পারে, তবে উন্নয়নের ব্যাপারে কংগ্রেস আর বিজেপির সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ওরা উন্নয়ন চায় পুঁজিপতিদের পেট মোটা করার জন্যে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির তফাত শুধু এইটুকুই যে কংগ্রেসের একটু একটু চোখের চামড়া আছে, তাই ওদের কর্নিয়াটা দেখবে সামান্য হলেও ভেজা ভেজা থাকে, বিজেপির চোখের চামড়াই নেই, তাই দেখবে ওদের কর্নিয়াটা একেবারে শুকনো। আমরা উন্নয়ন চাই দেশের লোকের ভালোর জন্যে। আমাদের শ্লোগানই হচ্ছে – সবার পেটে ভাত চাই, সবার হাতে কাজ চাই। তাই দ্যাখো আমাদের কর্নিয়াটা সবসময় ভেজা ভেজা। কথায় কথায় চোখে জলও এসে পড়ে। কিন্তু আমরা জানি কেঁদে ফেলাটা দুর্বলতার পরিচয় হবে, তাই আমরা কিছুতেই বুঝতে দিই না যে আমাদের চোখ জলে ভিজে গেছে, চোখের আগুন দিয়ে সেটা আমরা ঢেকে রাখি।”
“বেশ। আচ্ছা, কংগ্রেসীদের কাছে শুনলাম যে গান্ধীজি নাকি ভারতীয় পুঁজিপতি আর পুঁজির থেকে মুক্তির খোঁজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা সব জনগণের সম্পত্তির অছি হয়ে যাক। এ ব্যাপারটা আমার খানিকটা বেড়ালকে মাছ আগলাতে বলার মত লেগেছে। আমার কংগ্রেসী বন্ধু বলছিল যে আসলে বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির কোনো ধারণা ছিল না তো তাই তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। তিনি তো ছাগলের ব্যাপারেই যেটুকু যা জানতেন। এ ব্যাপারে তোমার কি মত?”
“আমাদের মত কংগ্রেসীদের থেকে আলাদা। কংগ্রেসীরা গান্ধীজিকে আড়াল দিতে চাইছে তাই বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির অজ্ঞতার দোহাই দিয়েছে। বেড়াল সম্পর্কে গান্ধীজির ভালোই ধারণা ছিল, তিনি যখন দুধ খেতেন, বেড়ালের হাত থেকে দুধকে যে আড়াল করতে হয় তা তিনি জানতেন না হতেই পারে না। গান্ধীজি আসলে বেড়ালকেই আড়াল দিতে চেয়েছিলেন, নিজেও বেনিয়া তো। অবশ্য সব বামপন্থী এরকম ভাবে না, আমাদের মধ্যে অনেক উপদল আছে।”
“তোমরা তো বেশ ক্যাটকেটে দেখছি।”
“তা তো হবেই। জানোই তো, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতেই আছে, the communists disdain to conceal their views and aims।”
“কিন্তু তোমাদের views and aimsটা ঠিক কী?”
“কেন, সমস্ত existing social condition এর forcible overthrow করে সর্বহারাকে ক্ষমতায় আনা, সর্বহারার শাসনের প্রতিষ্ঠা করা, এমন এক দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব মানুষই সমান।” বলতে বলতে আমার বামপন্থী বন্ধু বেশ গদগদ হয়ে উঠল।
“খুবই বড় কথা। কিন্তু সেটা কি হয়েছিল?”
“কেন, রাশিয়াতে হয়েছিল, চিনে হয়েছিল, ভিয়েতনামে হয়েছিল, কিউবায় হয়েছিল।”
“অনেকে যে বলে শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা নাকি দাঁড়িয়েছিল, সব মানুষই সমান, কিন্তু কিছু মানুষ অন্যান্যদের চাইতে বেশি সমান। শেষপর্যন্ত নাকি কিছু মানুষের ক্ষমতাই হয়ে উঠেছিল সবমানুষের শত্রু। তুমি রাশিয়ার কথা পাড়লে। কিন্তু আমি যতদূর জানি রোজা লুক্সেমবুর্গ লেনিনের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ এনেছিলেন যে তিনি রাশিয়ার কারখানাগুলোতে নানারকমের খবরদারি আর সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আর ১৯২১ সালের শুরুতে স্বয়ং লেনিন বলেছিলেন, রাশিয়া হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকভাবে বিকৃত একটি সমাজরাষ্ট্র।”
“বেশ, তোমার কথা একটু একটু মেনে নিলাম, কিন্তু চিনে?”
“চিন তো আরো সাংঘাতিক। দেং শিয়াও পিং তো সরাসরি বলেছিলেন, বড়লোক হওয়া তো খারাপ নয়।”
আমার বামপন্থী বন্ধু একটু ঢোঁক গিলে বলল, “কিন্তু দ্যাখো, বড়লোক হওয়া কি সত্যিই খুব খারাপ? মুষ্টিমেয় লোকের কাছে যে পরিমাণ ভোগের উপাদান আছে, সেই পরিমাণ ভোগের উপাদান যদি সবাইয়ের কাছে থাকে তাহলে খারাপটা কি?”
শুনে আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, বললাম, “বল কী? ভোগ আর সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে তফাত নেই?” কেমন যেন আমার মনে হল এই জন্যেই ভোক্তা সমাজটা দেখতে দেখতে পৃথিবীটাকে গ্রাস করে নিতে পেরেছে। মুখে বললাম, “তোমরা দেখছি সত্যিই ক্যাটকেটে।”
“সে তো আমরা স্বীকারই করলাম, তাতে কী হল?”
“সেই ক্যাটকেটে না, ইংরেজিতে যে সি এ টি ক্যাট সেই ক্যাটকেটে।”
“মানে?”
“মানে হল গান্ধীজি বেড়ালকে কতখানি আড়াল করেছেন জানি না, কিন্তু তোমরাও বেশ বেড়ালভক্ত। বেড়ালের সঙ্গে তোমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কখনো সেটা গালাগালির, কখনো গলাগলির। কখনো টাটা-বিড়লা দূর হটো, কখনো টাটা-বিড়লা যুগ যুগ জিও।” দেখলাম যথেষ্ট হয়েছে, আমার বিজেপি বন্ধুর কাছে যাবার সময় হয়ে গেছে, বললাম, “আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাক। উঠি।”
সে বলল, “চললে কোথায়, আসল কথাই তো বলা হয়নি। জানবে না এ দেশের এই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক কী?”
“কী?”
“আমরা মনে করি এটা হল বুর্জুয়া সংসদীয় গণতন্ত্র।”
“মানে? লেনিন যাকে বলেছিলেন, ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’?”
“ঠিক তাই।”
“তুমি কি বলতে চাও নেহরু অম্বেদকর মৌলানা এঁরা সব—”
“আহা, কথাটা তো ব্যক্তি নিয়ে নয়, সিস্টেম নিয়ে।”
“তোমরা তাহলে গোঁয়ারের মত সেই খোঁয়াড় আঁকড়ে
আছ কেন?”
“আমাদের কোনো উপায় নেই, বুঝলে। এখনো তো জনগণ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি যে এটা শুয়োরের খোঁয়াড়। যদিও তারা সন্দেহ করে। শুয়োরের গায়ের একটা গন্ধ কেউ কেউ পায়। কেউ কেউ ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজটাও শুনেছে। এর বেশি কিছু না। তাই--”
“তাই কী?”
“তাই আপাতত খোঁয়াড়টাকে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারছি না। আমরা মানি যে এই বুর্জুয়া সংসদীয় গণতন্ত্র জনগণকে স্রেফ ভোটার বানিয়ে দেয়, কিন্তু আমাদের কোনো উপায় নেই।”
“কিন্তু দ্যাখো যারা এই খোঁয়াড়টাকে পেছন থেকে চালায়, তারাও তো কম চালাক না। তারাও তো জনগণকে বছরের পর বছর ম্যানেজ করে চালিয়ে যেতে পারে। ঐসব গন্ধ ঢাকা, ঐসব আওয়াজ পালটে দেওয়া এই বিজ্ঞানের যুগে তো কোনো ব্যাপারই না। এরকম করে চললে তোমরা তো কোনোদিনই প্রমাণ করতে পারবে না ওটা আসলে শুয়োরের খোঁয়াড়।” আমি বললাম।
“তোমার কথা ঠিক। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে ভাবনার নানা ধারা উপধারা আছে। একদল মনে করে আমাদের কাজ হচ্ছে ঐ শুয়োরের খোঁয়াড়ের মধ্যে থেকেই ওটা যে আসলে শুয়োরের খোঁয়াড় সেটা যথাসাধ্য জনগণের চোখে ফুটিয়ে তোলা। আর জনগণকে পরিবর্ত ব্যবস্থার কথা ভাবতে উৎসাহিত করা। কেউ কেউ মনে করে আমাদের কাজ হচ্ছে ঐ শুয়োরের খোঁয়াড়ের মধ্যে থেকেই ওটাকে ভেতর থেকে দুর্বল করা। কেউ কেউ আবার একটু অভিনবভাবেও ভাবে। তারা চায় এটাকে বাঘের গুহা বানাতে। আবার কেউ কেউ ভাবে এটাকেই একদিন দ্রুতগামী ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে দেওয়া যাবে। এ নিয়ে আবার তাদের নিজেদের মধ্যেই বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করে তা কেন, বানানোই যায় যদি, তাহলে এটাকে পাখিরালয় বানিয়ে দিলে কেমন হয়? কেমন পাখির কলতানমুখর হয়ে উঠবে গোটা দেশটা। আছে অবুঝ আরো একদল, যারা এই শুয়োরের খোঁয়াড়ে ঢুকতেই চায় না, তারা কোনো খোঁয়াড়ি ভাঙার মধ্যেই নেই। এইভাবেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।” আমার বামপন্থী বন্ধুর দীর্ঘ বক্তৃতা এইবার থামল। আর আমিও রাস্তা মাপলাম।
৩
আমি যখন আমার বিজেপি বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলাম, সে তখনো পুজোয় ব্যস্ত। সকালের দিকে পুরো একঘণ্টা টিভি খুলে বসে সে রামদেবের দেখাদেখি যোগব্যায়াম করে। তারপর আরো একঘণ্টা তার যায় পুজোতে। অন্য অনেক দেবদেবীর মূর্তির সঙ্গে দেখলাম একটা হনুমানের মূর্তি আর একটা রণং দেহি রামের মূর্তিও রয়েছে। সে খুব মন দিয়ে আরতি করছিল। খুব মন দিয়ে হনুমান চালিসা পাঠ করল। একবার ভাবলাম তাকে জিগ্যেস করব সে কী মন্ত্র দিয়ে রামের পুজো করে। আমাদের এদিকটাতে রামের পুজোর কোনো চল নেই, তাই রামের পুজোর মন্ত্রতন্ত্রের ব্যাপারেও কিছুই জানি না। যেটুকু যা রাম আমাদের এদিকে পাওয়া যায় তাও আবার সীতার সঙ্গে। গোটা পশ্চিমবঙ্গে রামসীতার বড় মন্দির আছে তিনটে। তারপরই মনে হল রামের পুজোর মন্ত্রর আলাদা করে আর দরকার কি, বাল্মিকীর রামায়ণই তো রয়েছে।
হাতটাত ধুয়ে আরাম করে বসল সে। সে ব্রাহ্মণ হলেও তার বসার ভঙ্গিটা দেখেছি অনেকটা ব্যবসার জায়গায় মারোয়াড়িরা যেমন দুপাশে দুটো গদি নিয়ে আয়েস করে বসে তেমনি। এই প্রথম আমি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তার চোখের চামড়া আছে কি নেই, কিন্তু ভালো বুঝতে পারলাম না। হ্যাঁ, এটা ঠিক তার চোখটা যেন একটু বেশিই ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু চামড়া আছে কি নেই ভালো বোঝা গেল না। সব শুনেটুনে সে বলল, “প্রথম কথা হচ্ছে কংগ্রেসের কথা তবু চলতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্টদের কথা আর মুসলমান আর খ্রিস্টানদের কথা তুমি আমার সামনে মুখে আনবে না। কংগ্রেস তবু একটু একটু হিন্দুত্বের চর্চা করে, কিন্তু কমিউনিস্টরা হল দেশদ্রোহী, ওরা না মানে ধর্ম, না মানে জাতীয়তাবাদ। আর মুসলমান, খ্রিস্টান ওরা সব বিদেশী।”
“বেশ, আনব না, তারপর?”
দ্যাখো, তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর ঐভাবে আমি দিতে পারব না। আমাদের ভাবনার ধরণ, টেকনিক সবই আলাদা।”
বললাম, “ঠিক আছে তোমার মত করেই বল।”
সে বলল, “তোমার প্রশ্নের এককথায় উত্তর হল, ‘সবই বেদে আছে’। চকিতের জন্যে আমার মনে পড়ল মেঘনাদ সাহা কোন্ এক বন্ধু স্বামীজিকে যেন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘সবই ব্যাদে আছে’। কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা বললে আমার এই বিজেপি বন্ধু আর আমার মুখদর্শন করবে না। তাই প্রকাশ্যে বললাম, “বল কি, সবই বেদে আছে?”
“হ্যাঁ, সবই বেদে আছে। আমরা কি, না হিন্দু। সপ্ত সিন্ধু থেকে হিন্দু। সংস্কৃতের ‘স’টা ভাষার বিবর্তনে ‘হ’ হয়ে গেছে। যেমন সপ্তাহ থেকে হপ্তা। তো আমাদের পূর্বপুরুষ কারা, না আর্যরা, তাঁরাই তো বেদ লিখে গেছেন, নাকি। সেই বেদে তুমি সব পাবে।”
“কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম হিন্দুটা পারসিক শব্দ। আহুর মাজদার হপ্ত হিন্দু থেকে হিন্দু। ওরা যেহেতু ‘স’ উচ্চারণ করতে পারত না। তুমি যেসব কথা বলছ এগুলো তো যতদূর জানি দামোদর বিনায়ক সাভারকর বলেছিলেন।”
“সাভারকর তো বেদের কথাগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যে আমাদের পূর্বপুরুষ সেইসব মহান আর্যরা আমাদের জন্যে শুধু বেদ লিখে যান নি, তাঁরা আসমুদ্রহিমাচল এই গোটা দেশটাকে নেশন বানানোর স্বপ্নও দেখেছিলেন। এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি। আমরা শুধু তাঁদের সেই স্বপ্ন সার্থক করার চেষ্টা করছি।”
“কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম নেশনের ধারণা এসেছে ইয়োরোপ থেকে।”
“ওসব ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা। বরঞ্চ বলতে পারো আমাদের দেশে জন্ম নেওয়া নেশনের ধারণাই ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে। ইয়োরোপ তো অনেক কিছুই আমাদের দেশ থেকে চুরি করেছে। যেমন ধর, ওরা এরোপ্লেন আবিষ্কার করার অনেক আগেই আমাদের এরোপ্লেন ছিল।”
“অনেক আগেই আমাদের এরোপ্লেন ছিল? কিরকম?”
“কেন পুষ্পকরথ। যাতে করে রাম লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় এনেছিলেন সীতাকে।”
“কিন্তু সেতো মহাকাব্যের কল্পনা বলে জানি। আমি তো জানি ১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্স প্রথম এয়ারক্রাফট বানিয়ে আকাশে ওড়েন। আচ্ছা, সে যাইহোক, অতীতে আর কী কী ছিল আমাদের?”
“কেন হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছিল, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল, অ্যাটম বম ছিল, গাইডেড মিসাইল ছিল।”
“হেড ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট? মানে গণেশ?”
“হ্যাঁ, নয় তো কী?”
“বল কী? ইয়োরোপ-আমেরিকা তো এখনো ওদিকটায় সাহস করে ঢুকতেই পারে নি। আচ্ছা, এটা তাহলে আমরা ওদের শেখাতে পারি।”
“পারিই তো। সে ব্যবস্থা হচ্ছে তো।”
“কী বল তো?”
“সে জন্যেই তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেদিক বোর্ড খুলে দিচ্ছেন। এই বোর্ডের আন্ডারে সবার আগে অ্যাফিলিয়েশন পাবে বাবা রামদেবের গুরুকুলগুলো।” বলার সময় সে দুকানের পাশে হাত রাখল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়করা বা বাজিয়েরা যেমন রাখে তাদের গুরুদেবের কথা বলার সময়।”
“মানে তুমি বলতে চাইছ আমাদের দেশে সেই বেদের দানাই ঝরে ঝরে পড়ছে যুগ যুগ ধরে। বেদের শেকড় থেকেই বেরিয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ। সেসবের থেকেই আবার বীজ পড়ে বেদানা হচ্ছে এবং এইভাবেই চলছে। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই বেশ বেদানাদায়ক।”
“হ্যাঁ, যারা মানতে চাইছে না তাদের পক্ষে বেদনাদায়ক বটে।”
“কিন্তু একটা প্রশ্ন এখনো থেকে যাচ্ছে। তোমাদের এই নেশনের ধারণার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্পর্ক কী? তোমাদের নামে তো বদনাম হচ্ছে তোমরা স্বৈরতান্ত্রিক, তোমরা ফ্যাসিস্ট। তোমরা সংবিধান মানো না, তোমরা জাতীয় পতাকা মানো না।”
“গোড়ায় মানতাম না। গোড়ায় আমরা ভেবেছিলাম এ ব্যাপারে হিটলারই ঠিক। কিন্তু এখন আমরা মনে করি হিটলারের জাতিতত্ত্বটা ঠিক আছে, কারণ আমাদের সবার শরীরে তো সেই বিশুদ্ধ আর্যরক্তই বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফ্যাসিস্ট হবার দরকার নেই। কারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সংসদীয় গণতন্ত্রের মত ভালো জিনিস আর হয় না। এই সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনোভাবে যদি তুমি একবার মেজরিটি পেয়ে যেতে পারো, ব্যস, তুমি যা খুশি করতে পারো। তুমি ইচ্ছেমত বিরোধীপক্ষকে নাকাল করতে পারো, তাদের সরকার যখন তখন ফেলে দিতে পারো, স্বশাসিত সংস্থাগুলোকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারো, যাকে যখন খুশি জেলে পুরতে পারো, যার যখন খুশি কণ্ঠরোধ করতে পারো, প্রয়োজন পড়লে হাপিশও করে দিতে পারো, আদালতকে, আইনব্যবস্থাকে পেটকোঁচরে গুঁজে নিতে পারো, মিডিয়াগুলোকে ভায়া বিজনেসমেন তোমার ঢাক পেটাতে বাধ্য করতে পারো। তাই যদি পারো, তাহলে পৃথিবীতে কোন্ বুদ্ধু আছে যে ফ্যাসিস্ট হওয়ার বদনাম কিনতে যাবে। যখন ফ্যাসিস্টরা যেসব কাজ করে, সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই সে সেগুলো করে নিতে পারছে শুধুমাত্র মেজরিটির সাহায্যে। সেই জন্যেই আমরা এখন সংবিধান মানি, কারণ মেজরিটি দিয়ে সংবিধানের যে কোনো জায়গাকে যখন খুশি বদলে দিতে পারি। সেই জন্যেই আমরা এখন জাতীয় পতাকাও মানি, কারণ মেজরিটি দিয়ে অশোকস্তম্ভের সিংহটার আগেকার নিরীহ শান্ত ভাবটা কাটিয়ে স্বয়ংসেবকদের মনোমত বানিয়ে নিতে পারি, পতাকার সবুজটা পাকিস্তানের মত বলে সেটাও পালটে দেবার চেষ্টা করতে পারি। আর এসবই আমরা পারি মেজরিটি আছে বলে।”
“এটা তুমি ঠিক বলেছ।”
“তবেই বোঝো। অনেকেই আমাদের সেন্ট্রাল ভিস্তার বিরোধিতা করছে। তারা তো জানে না কেন আমরা সেন্ট্রাল ভিস্তা শেষ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি। তুমি কি জানো গত কুড়ি বছরে বিহার উত্তরপ্রদেশে কী পরিমাণ জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটেছে। অথচ তার ভিত্তিতে লোকসভার সিট বাড়েনি। ঐ জনসংখ্যার ভিত্তিতে কোনোভাবে যদি লোকসভার সিট বাড়ে তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় তাদের বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। তাই সেন্ট্রাল ভিস্তার পরিকল্পনা। তাছাড়াও সেন্ট্রাল ভিস্তা মানে তুমি আর একটা দর্শনীয় জিনিস পেয়ে গেলে। অনেকটা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মত। যেমন আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। সেন্ট্রাল ভিস্তা এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যার মধ্যে থাকবে রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ আর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে এমন কায়দায় তৈরি করা হচ্ছে যেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ সবকিছুর ওপর নজর রাখতে পারবেন।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও, বিহার উত্তরপ্রদেশ মানে তোমাদের গোবলয়, মানে যেখানকার গোবরে তোমাদের সব থেকে বেশি পদ্মফুল ফোটে।”
“তা তুমি বলতে পারো। আপাতত আমাদের লাভ। ওখানকার সিটগুলো যদি ঠিকঠাক পাই, তাহলে আগামী একশ বছর আর আমাদের ফিরে তাকাতে হবে না। ইতিমধ্যে সমস্ত রাজ্যকেই যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারি, তাহলে আর কোনো চিন্তাই থাকে না। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই যে নেশনের স্বপ্ন আমরা সার্থক করে তুলতে পারব।”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা গণতন্ত্র রইল কি?”
“এই সংসদীয় গণতন্ত্রে তো মেজরিটিটাই মূল কথা। তাহলে কেন রইল না? আমরা তো স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছি না। তাছাড়া দেশকে যারা ভালোবাসে, তারা আমাদের বিরোধিতা করতে যাবেই বা কেন? আমরা তো যা কিছু করছি দেশের ভালোর জন্যেই করছি।”
“আচ্ছা, তোমাদের এই সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের জায়গাটা ঠিক কোথায়?”
“দ্যাখো, আমরা সাদাসাপ্টা কথা বলা পছন্দ করি, ঐ কংগ্রেসী বা অন্যান্য দলের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয়। সোজা কথায় সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ হচ্ছে স্রেফ ভোটার, তার আগেও তার কোনো অস্তিত্ব নেই, তারপরেও তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ভোটের সময় তাদের মন জয় করার জন্যে আমরা অনেক কথা বলি, তাকে বলে ‘জুমলা’। ‘জুমলা’ মানেই হচ্ছে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি যা পালন করার জন্যে নয়।”
“বেশ। আমার শেষ দুটো প্রশ্ন।”
“বলে ফ্যালো।”
“গান্ধীজির ব্যাপারে তোমাদের কী মত?”
“এইবার তুমি আমাকে মুশকিলে ফেললে। গান্ধীজি নিয়ে মুখ খোলার ব্যাপারে আমাদের ওপরমহল থেকে নিষেধ করে দেওয়া আছে। তবে তুমি বন্ধুস্থানীয়, বিশ্বাস করে বলছি, গান্ধিজির ব্যাপারে আগে আমাদের বেশ অ্যালার্জি ছিল। কিন্তু ইদানিং আমরা সেটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। তার একটা কারণ হল এখন তো দেশটা গুজরাটি বেনেদের হাতে আর যতই হোক লোকটা গুজরাটি ছিল, শুধু গুজরাটিই ছিল না, বেনেও ছিল। আর একটা কারণ হল লোকটা তালেগোলে শুধু মাস লিডারই হয়ে যায়নি, বিদেশেও বেশ নাম কুড়িয়েছিল। তো তোমাদের এই গান্ধীজিকে নিয়ে এখন ভালো ব্যবসাও হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো ঠিকই করে ফেলেছেন, সবরমতী আশ্রমটাকে পর্যটন কেন্দ্র বানাবেন, দেশবিদেশের লোক দেখতে আসবে, কিছু বিদেশি মুদ্রার আমদানি হবে।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, কিন্তু শুনেছি তার জন্যে তোমরা নাকি ওখানকার হরিজন বস্তিগুলো আর যে পাঁচটা বেসরকারি সংস্থা আশ্রমের সঙ্গে একযোগে কাজ করত তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছ।”
“এসব আমাদের নিছক বদনাম করার চেষ্টা। হরিজন বলে কিছু হয় না, ওরা সবাই হিন্দু, বরঞ্চ তোমাদের গান্ধীজিই ওদের হরিজন বলে সরিয়ে রেখেছিল।”
“বেশ, তারপর?”
“লোকটার স্টারটা ভালো ছিল। তালেগোলে মাস লিডার হয়ে গিয়েছিল। তা নাহলে লোকটা যে ভালো করে কিছু বুঝত তা নয়। খুব গ্রাম গ্রাম করত। অথচ আমাদের থেকে বেশি গ্রাম নিয়ে কি কেউ মাথা ঘামায়। গ্রামের সবথেকে বড় প্রতীক হল গোরু, সেই গোরুকে আমরা মাথায় করে রেখেছি। যে গোরুর গোবর থেকে ঘুঁটে হয়, আমাদের সময়ই তো সেই ঘুঁটে হস্তশিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। তুমি কি জানো ঘুঁটে এখন অ্যামাজনের মাধ্যমে অব্দি বিক্রি হয়। তার নাম হল ‘ওঁ’। আর দাম শুনলেই বুঝতে পারবে আমাদের সময় ঘুঁটে কত গুরুত্বপূর্ণ একটা হস্তশিল্পে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এককিলো ঘুঁটের দাম হচ্ছে একশ তিরিশ টাকা। এক কিলোতে থাকে দশটা করে ঘুঁটে, মানে এক একটা ঘুঁটের দাম দাঁড়াল তেরো টাকা। প্রাচীন ভারতে ধর্মগোলা ছিল, তারই আধুনিক রূপ হল আদানির সাইলো। আমরা সেই প্রাচীন ভারতকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছি, তবে হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তোমাদের গান্ধীজির মত না, চরকা কাটো, যাঁতা পেষো, ঢেঁকিতে পাড় দাও।”
আমার বিজেপি বন্ধু এবার একটু থেমে দম নিল। আমি দেখলাম যথেষ্ট হয়েছে, এবার আস্তে আস্তে উঠে পড়াই ভালো। বললাম, “আমার একেবারে শেষ প্রশ্ন হল উন্নয়ন নিয়ে।”
সে বলল, “উন্নয়ন নিয়ে আবার কিসের প্রশ্ন? উন্নয়ন মানে উন্নয়ন। এ নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন হতে পারে না।”
আমাকে সময় দেবার জন্যে তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
৪
বেরিয়ে পাশের পানের দোকানের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার মুখচোখ এক অদ্ভুত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আমার এতদিনের সংশয় যেন সব কেটে গেছে। অনেকদিন পরে ভবতোষ শতপথীর কবিতার একটা লাইন মনে পড়ল। “বাজে ঢাকঢোল ভিতরে খোল, কঠিন কাইদা।” হুঁ হুঁ বাওয়া, এ কঠিন কাইদা যার তার পক্ষে বোঝাই সম্ভব নয়।
সাড়ে তিন শতকের কলকাতার ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে নাগরিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে কাব্য কবিতায় কলকাতার কথা। বাংলা লোকগানে, প্রবাদে, ছড়ায় দেখা লোক সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে নগর-কলকাতা। এই কলকাতার জাঁকজমক, জারিজুরি, হুজুক-হুল্লোড় মেকি পালিশ দেখে গাঁয়ের মানুষ যেমন কৌতূহলী, তেমনি ভীত সন্ত্রস্ত; সেই অনুভূতি ধরা পরেছে লোক গানে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জেলাস্তরে। তুলে আনা যাক আঁজলা ভরে এক দুই করে
(১) যেমন পুরুলিয়ার ঝুমুর গানে—
কলকাতা দানের নানি গো
দলানপুরে পুরে এমন সুন্দর বাড়িগো।।
(২) ২৪ পরগণার লোকগানে মশক সংগীত শোনা যায়—
কলকাতার থ্যা আল রে মশা যেন সোনা বাঁধা ঠোঁট
যেখানতে দ্যায় রে কামড় যেন তরালিরই চোট।।
(৩) বাঁকুড়ার ভাদুগানে জিলিপর গন্ধ ভেসে আসে—
হে দারোগা পথ ছেড়ে দাও ভাদু যাবেন কলকাতা
কলকাতা যে গেছছিল ভাদু কী কী সন্দেশ এন্যেছে
এড়া বেড়া জিলিপি খাবা ফুলান তেলে ছেঁক্যেছে
(৪) মেদিনীপুরের টুসু গানে — গয়নায় সাজানোর কথা বলা হয়েছে—
কটকে গড়াব গয়না, ঢাকাতে চট করাব
কলকাতাকে রঙ করাব টুসু ধনকে সাজাব।।
(৫) ওই জেলার আরো এক টুসু গানে জামি জরিপের কথা শোনা যায়
আমার টুসু কলোকাতা যাবে জমি জরিপ করিতে
ডান হাতে কলমের খড়ি কানে চাঁপার ফুলাছে।।
(৬) অন্য এক টুসু গানে সন্তানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের অাকাঙ্ক্ষার করা হয়েছে।
আমার টুসুর এক ছেলেকে পাঠালো কলোকাতা
ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো থানে দিব জোড়া পাঁঠা।।
(৭) কলকাতা শহরের বন্দনা গাওয়া হয়েছে অন্য এক লোক গানে—
শহর শহর ভালো কলোকাতা শহর ভালো
যেখানে মন বার সেখানে মরণ ভালো গো।
(৮) পুরুলিয়ার গান বাজে মাদলের তালে তালে—
আমার বেটার বিহা দিব সময় হয়েছে
কোহইলকাতার পুলিশেতে কাম মিলেছে
বাজারে মাদলে বোল ধিতাং ধিতাং
ধিন্তা ধিতাং ধিতাং।।
(৯) ছেলে মেয়ে, মদ্দা-পুরুষের চরিত্র নিয়েও রচিত গ্রাম্য গীতি—
কলকেতার পোলাপান
বাপরে কয় হুক্কা আন।।
(১০) আবার এ শহরের বাড়ি-ঘর পুরুষ মেয়ের চরিত্রচিত্রও স্থান করে নিয়েছে কোনও কোনও গানে—
কইলকেতার গাড়ি
মস্ত মস্ত বাড়ি
মদ্দাগুলায় ঘুইর্যা বেড়ায়
মাগি গুলার বাড়ি।।
(১১) নগর কলকাতার এক অনবদ্য চিত্র এঁকে রেখেছে জেলে পাড়ার সঙে—
এমন যে এই কলকাতা
কত লক্ষ লোকের অন্নদাতা
এখনও সকলের জোটে না পেটভাতা
কে নেতা, কি ভ্রাতা,
ছাতা দিয়ে মাথা রেখেছেন কার
চিনলে না মোদের?
মোরা আমড়াকাঠের ঢেঁকি
কলিকাতায় নৃত্য করে
রঙিলা ন্যাকা নেকি।।
অল ইন্ডিয়া আর্ট হিস্ট্রি কংগ্রেস এবং নরেন্দ্রপুরের চিন্তামনি কর ফাউন্ডেশনের (ভাস্কর ভবন) চেয়ারম্যান ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর মূল কর্মজীবন কেটেছে ভারতীয় জাদুঘরে। ১৯৬৫-তে সেখানে যোগ দেন কিউরেটর হিসাবে। পরে ভারতীয় জাদুঘরের অধিকর্তা হন। এ ছাড়াও ছিলেন জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন অধিকর্তা। নানা সময় যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, আইকম, গুরুসদয় সংগ্রহশালা, বারাকপুর গান্ধী স্মারক সংগ্রহশালা, ভাষা স্মারক সমিতি, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন, ক্যালকাটা আর্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রভৃতির সভাপতি, পরামর্শদাতা, পরিচালনমণ্ডলীর সদস্য প্রভৃতি হিসাবে। ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক।
বাংলাদেশে জন্ম শ্যামলবাবুর। শৈশবেই চলে আসেন কলকাতায়। চেতলা কর্পোরেশন স্কুল হয়ে চেতলা বয়েজ থেকে ১৯৫৮-তে স্কুল ফাইনাল উত্তীর্ণ হওয়ার পর আশুতোষ কলেজ। সংস্কৃতে স্নাতক, পুরাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর। পিএইচডি-র বিষয়, ‘পত্রবিলাস’। বেশ ক’টি বই লিখেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় একসময় নিয়মিত লিখতেন ‘শ্যাম কাশ্যপ’ নামে। ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস থেকে মিশরের মমি— লিখেছেন হাজারো বিষয়ে।
গত মে, ২০২২-এ কালধ্বনি পত্রিকার জন্যে এই লেখাটি তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে সংগ্রহ করি। লেখাটি তাঁর মনের মতো হয়নি। বারবারই অশক্ত শারীরিক অবস্থার উল্লেখ করছিলেন।
প্রয়াত হ’ন, ২১ জুলাই, ২০২২। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
একজন দক্ষ লেখক, কবি, বক্তা, প্রশাসক এবং সর্বোপরি একজন দরদী ও গুণী মানুষকে আমরা চিরতরে হারালাম।
আমাদের স্মৃতিতে মর্যাদার আসনেই থেকে যাবেন ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী মহাশয়।
(তথ্যসূত্র: ‘আমরা মনভাসি’ হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে সংগৃহীত ২২/০৭/২২-র অশোক সেনগুপ্ত’র পোস্ট)
এখানে আমি বিবেচিত হয়েছি লোকনাট্য নিয়ে কিছু লেখার জন্য। এক্ষেত্রে আমার অপারগতার কথা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আসলে এরকম একটা ঐতিহ্যপূর্ণ লোকশিল্পধারা নিয়ে লিখতে গেলে জানা বোঝার জগত, লেখাপড়ার পরিসর যতোটা বড় হওয়ার দরকার তা আমাতে অর্জিত হয়নি। কিন্তু প্রথানুগ দেখাশোনার বাইরে আমার একটা পরিসর ছিল যা কোনো গবেষণা বা লেখালেখির কারণে নয়। তা ছিল তথ্যচিত্র তৈরির সুবাদে, থিয়েটারের সামান্য এক কর্মী ও একজন কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার কারনে। সেক্ষেত্রে পড়তে হয়নি যে তা নয়, ইতিহাস ও গবেষণায় চোখ রাখতে হয়নি যে তা নয়। কিন্তু সে দেখা আর শোনা ছিল ভিন্ন, খানিক অন্তরঙ্গ হয়তোবা!যেখানে বইয়ের ভাষা থেকে অনেকানেক গুরুত্বপূর্ণ হল সরাসরি বুঝে নেওয়া দেখে নেওয়া। কোনো হাইপথিসিস নয়। একটা জলজ্যান্ত অনুষ্ঠান আর জীবনের পাঠশালায় যে ধুলোখেলা অবিরত চলছে, চলে আসছে তাকে তারই মাটিতে, তারই আকাশে চিত্রিত করা, চিহ্নিত করা।
এখানে শুরু করতে চাই লোক ও নাট্য শব্দদুটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে। বেদে “লোক” শব্দটির উপস্থিতিই প্রাথমিকভাবে বুঝিয়ে দেয় এর অপার গাম্ভীর্য। আবার অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষায় “দর্শন”। ধাতুগত অর্থে দর্শনক্ষম ব্যক্তি। এর সঙ্গে আবার ইন্দ্রিয়কে যোগ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরাণের আখ্যান তথা লোকজীবনের কাহিনীর সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায়, স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণে সাধারণত মুখে মুখে নির্মিত অভিনয়কে লোকনাট্য বলা হয়। যার মধ্যে বাচিক ছাড়াও থাকে দেহভঙ্গির ভাষা। যা শুরু হয়েছিল শ্রুতির হাত ধরে (অরাল ট্র্যাডিশন থেকে)। এর সংলাপ নিবদ্ধ থাকে সংহত ও গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের প্রত্যন্তে এবং এই আঞ্চলিক উপভাষা হল লোকনাট্যের অন্যতম উপাদান। যা রচিত হয় ঐতিহ্য ও বর্তমানের সংমিশ্রণে, নিজস্ব ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের সমাজমানস থেকে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রাথমিক চর্চা ক্রমে এক যৌথ পরিবেশনার আকার নেয়। সেই অর্থে সমস্ত লোকনাট্যই হল যৌথ শিল্পকর্ম। গান ও নাচ যার অপরিহার্য সহায়ক।
বাংলায় এই লোকনাট্যের নানা আঙ্গিক আছে। জেলা থেকে জেলায় তার রূপ বদলেছে। যেমন ধরা যাক যাত্রা। তা নিজেই বদলে গেছে। যাত্রার মধ্যে ছিল লোকনাট্যের সামগ্রিক রসদ। কিন্তু পরবর্তীতে নগরনাট্যের দিল লাগিতে সে সস্তার বিনোদনে পর্যবসিত হয়েছে। আমরা যখন যাত্রা নিয়ে কাজ করতে গেছি তখন অবশিষ্ট তেমন কিছু আর নেই। সমস্তটাই গ্রাস করে নিয়েছে নগরায়নের প্রমোদামোদ। কিন্তু “আলকাপ” তেমনটা নয়। যদিও তারও বিবর্তন ঘটেছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা ও বীরভূম জেলায় একসময় “আলকাপ” দেখা যেত। এর কোনো পূর্বনির্ধারিত কাহিনী থাকত না। পুরোটাই তাৎক্ষনিক, মঞ্চে নির্মিত। মুখে মুখে।
মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য মোহতাবের “আলকাপ” দেখেছি রাত জেগে। রঙ্গ-রসিকতা ও তির্যক সমালোচনা এই অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য। আরবি শব্দ থেকে আসা “আলকাপ”এর সঙ্গে একধরনের মুসলমানির যোগ ছিল। প্রকাশ্যে মোল্লা- মৌলবিদের কঠোর সমালোচনা করার জন্য বহু আলকাপ শিল্পীদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে, ঘরবাড়ি তছনছ করে দেওয়া হয়েছে মৌলবাদিদের সহায়তায়। হিন্দু মৌলবাদিরাও বাদ যায়নি।”আলকাপ” শিল্পীরা ছেড়ে কথা বলেনি পন্ডিত-ব্রাহ্মণদেরও। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আলকাপের অর্থই হলো ধারালো ও তীক্ষ্ম। কিন্তু তা ক্রমশ “পঞ্চরস” নামের আড়ালে অনেকটাই হালকা চটুলতায় পর্যবসিত হয়েছে। বীরভূমের কোথাও কোথাও একে “ছ্যাঁচড়া” নামেও অভিহিত করা হয়।
লোকনাট্য একইসঙ্গে দৃশ্য, শ্রাব্য ও অভিনয়। দিনাজপুর জেলায় যেমন “খনের গান”কে লোকনাট্যের অন্তর্গত ধরা হয়। পালাকাররা
বছরভর সামাজিক ও পারিবারিক নানা বৈপরীত্য, কলহ ও বিবাদ নিয়ে গান রচনা করেন। সেগুলোই অভিনীত হয় খনের গানে। খন অর্থে ক্ষণ বা তাৎক্ষনিক। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার অঞ্চলে “পালাটিয়া” অভিনীত হতে দেখেছি। যেখানে খনের মতো তাৎক্ষনিক গান নয়। এখানে পালাকাররা ধারাবাহিক ভাবে পল্লীগীতির সুরে গান রচনা করে। এই নাট্যে প্রধান গায়কের সঙ্গে দোহার ও বাদ্যকররা অভিনয় করে। ধনী দরিদ্র, সার্থক ও দেউলিয়ার গল্প বলা হয় পালাটিয়ায়। জলপাইগুড়ি, কোচবিহারসহ দার্জিলিং জেলায়ও দেখেছি “রঙ পাঁচালি”। এও এক মারাত্মক হাস্যরসাত্মক নাট্যাভিনয়। হাসি দিয়ে শুরু আবার হাসিতেই শেষ। প্রান্তিক সমাজসংসারের লঘু দিক নিয়ে তৈরি হয় এর কাহিনী। যার ভেতর থেকে উঠে আসে সমাজ ঘনিষ্ঠ কথাছবি।আবার মালদা অঞ্চলের গম্ভীরা সম্পূর্ণত ভিন্ন লোকনাট্য। এই নাটক শিবের মাহাত্ম্যমূলক প্রচারের গাননাচে বাধা। এই নাট্যে কৃষকসমাজের ফিবছরের জীবন-পর্যালোচনা উপস্থাপিত করা হয় শিবমাহাত্ম্যের আধারে। এই রকম কতো লোকনাট্যের মুখোমুখি হয়েছি তা আজ সব মনেও নেই।যেমন এই লিখতে লিখতে মনে পড়লো হাওড়া, বর্ধমান ও বীরভূমে দেখেছি “লেটো”।এই নাটকও সংলাপনির্ভর এবং নাচে গানে ভরপুর এক হাস্যরসাত্মক গ্রামীণ জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অভিনয়ের সুরে বাঁধা। আবার হাস্যরসের বাইরে গিয়ে দেখেছি “ছৌ”। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ পৌরানিক আখ্যাননির্ভর। ইদানিং কিছু সামাজিক পালা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। তবে একটা কথা লেখা দরকার যে এই বিভিন্ন ধারা ও আঙ্গিকগুলির মধ্যে একটা অন্তঃশীল যোগসূত্র থেকেই গেছে। যা লোকনাট্যকে সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছে।
এবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন উত্থাপন করতঃ এই লেখা শেষ করবো। সেটি হলো বাউল প্রসঙ্গে। লোকসংস্কৃতির গবেষকরা লোকনাট্যে বাউলকে অধিকাংশই ব্রাত্য করেছেন। অথচ এই বাউল গান, নাচ ও কথার মধ্যে রয়েছে অযুত থিয়েট্রিকস। বাউল কখনো একা কখনো সমবেত ভাবে অনিবার্য কিছু নাট্যকর্ম ঘটিয়ে তোলে। বাউলের পাল্টাপাল্টির গান, প্রশ্ন উত্তরের গান তো মূলতঃ নাটকেরই বিস্তার বা সম্প্রসারণ। লোকভাষায় বলাই হয় যে, বাউল গান দেখতে-শুনতে হয়। চোখ বুজে বাউলের মর্ম উদ্ধার সম্ভব নয়। বাউল তার অনুষ্ঠানের সূত্রে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে। যাকে আমরা নাটকে, সিনেমায় ব্যাকড্রপ বলি। এবার পরিব্রাজক, চলমান বাউল এই প্রেক্ষাপট নিরন্তর পাল্টে দিচ্ছে। এই যে মনের আধারে মানুষ খোঁজা! এহেন প্রেমকথা থেকে বিরহ বা বীরত্বের ভাব ও দেহভঙ্গি? আমি সনাতন দাস বাউলকে দেখেছি তার একতারাকে লাঠিয়ালের ভঙ্গিতে ব্যবহার করতে।
এতো গেলো আমার প্রাথমিক উপলব্ধি। দ্বিতীয়ত বিশ্ব নাটকের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো যে গত বেশ কয়েক দশক ধরে নগরনাট্যের মহলায় ঢুকে পড়েছে লোকনাট্যের নানা আঙ্গিক, শতেক ভাষা। কর্মশালায় বাউলের এনার্জি ও স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে নাট্যঋষি জেরসি গ্রোটস্কি তার নাট্যত্বত্ত্ব থিয়েটারের সন্ধান চালিয়েছিলেন (থিয়েটার অফ সোর্সেস)। পিটার ব্রুক তার নাটকে বাউলদের নিয়ে একটা বড় পরিসর তৈরি করেছেন। এই তো কিছুদিন আগে পার্বতীর সাথে দেখা হলো প্যারিসে। ওর মুখে শুনলাম ইউজেনিও বারবা এখন তার প্রযোজনায় বাউল নিয়ে কাজ করছেন।
আসলে বলতে চাইছি যে,বাউলের থিয়েটার বাংলা লক্ষ্য করতে না পারলেও সারা বিশ্ব নজর রাখছে। আমরা কখনো আবহ সঙ্গীত হিসেবে বাউল গান ব্যবহার করছি, কখনো তাদের পোশাকের রঙ দৃশ্য পরিকল্পনায় গুঁজে দিচ্ছি, এই পর্যন্তই।
(দুজন সুফী কবির অল্প কয়েকটি পদ ও কাব্যাংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা)
পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর-মধ্য ভারত হয়ে সুফি ধর্ম যখন বাংলায় এসে পৌঁছল তখন স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে, স্থানীয় ধর্ম ও চিন্তাধারার সঙ্গে তার একটা সংশ্লেষণ হল। বিশেষ করে যোগতন্ত্র নাথ, বৈষ্ণব ধর্মের কিছু কিছু উপাদানের সঙ্গে সুফিবাদ কিছু ঐক্য খুঁজে পেল। স্থানীয় অমুসলিম জনসাধারণের মধ্যে সুফিধর্ম বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল এই কারণে যে বৌদ্ধ নাথ, সহজিয়া বৈষ্ণব, নিম্নবর্গের মতবাদের অনেকেই সুফী সাহিত্যে এদের প্রভাব সন্ত প্রচারক থেকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সৈয়দ সুলতানের ‘নবী বংশ’ থেকে কিছু বিবরণ পাওয়া যায় —
‘আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ানী কবি যদি না বাখনি বোলে।
বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইব?’
রক্ষণশীলদের কাছে হিন্দু উপাদান ব্যবহারের জন্য কবি নিন্দিত হয়েছিলেন উদ্ধৃত অংশটি তারই উত্তর
‘যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পাঁচালী রচিলাম করি আছএ দুষিতে।
মুনাফিকে বোলে আক্ষি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিল হিন্দুয়ানী করি।’
‘সুফি কবির কাব্যাংশটি মো: জহির রায়হান-এর ‘সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানচৌতিশা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত। যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে সে কারণে প্রচলিত হিন্দু পরিভাষা ও পুরানের কাহিনীর অংশ সুফি কবিরা ব্যবহার করতেন।
বাংলা ভাষায় ধর্মকথা বর্ণনার কারণে সামাজিক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন সৈয়দ সুলতান। এর প্রধান কারণ হয়তো ছিল এই যে কবি বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন। ফলত বিভিন্ন ধর্মের বিশেষত হিন্দুধর্মের পরিভাষা স্বাভাবিক ভাবেই ঢুকে পড়েছে। যেহেতু ভাষা ব্যাপারটি সাংস্কৃতিক, তাই এ অনুপ্রবেশ ছিল খুব স্বাভাবিক। (মো: জহির রায়হান ঐ)
আলি রাজার একটি কবিতা —
গুর্জ্জরী
বিরহ
শুন সখি সার কথা মোর। কুল বধূ প্রাণি হরে সে কেমন চোর। সে নাগর চিত্ত চোরা কালা যার নাম। জিতা রাখি প্রাণি হরে বড় চৌর্য্য কাম॥ মোর জীউ সে কি মতে লই গেল হরি। শূন্য ঘরে প্রেমানলে পুড়ি আমি মরি॥
গুরু পদে আলি রাজাগাহে প্রেম ধরে। প্রেম খেলে নানারূপে প্রতি ঘরে ঘরে॥
যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য সংকলিত আলি রাজার এই পদটির আলোচনা করে শশিভূষণ দাসগুপ্ত লিখেছেন— ‘‘এখানে লক্ষ্য করিতে পারি, ব্রজের নাগর ‘কালা’র যে ‘কুলবধূপ্রাণি’ হরণ করা লীলা তাহা যে পরব্যোমের ওপারে কোনো অপ্রাকৃত বৃন্দাবনেই সংঘটিত হইতেছে তাহা নহে, প্রতি ঘরে ঘরে অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই চলিতেছে ‘নগর কালা’র এই প্রেমলীলা, গুরুপদ আশ্রয় করিয়া চিত্তবিশুদ্ধির সাধনায় অগ্রসর হইলেই এই সত্য উপলব্ধি করা যাইবে।’’ শশিভূষণ দাশগুপ্ত : ১৩৮১ বঙ্গাবদ, ৩৬৭)
দেখা যায় কোনও কোনও ধর্মের ভাবধারা তাহার ব্যাপক ও গভীর প্রসারের দ্বারা তাহার একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মের রূপ পরিত্যাগ করিয়া সমগ্র জাতির একটি চিত্তপ্রবণতা রূপে একটি সাংস্কৃতিক রূপ পরিগ্রহ করে। কোনও একটি বিশেষ-জাতীয় সাহিত্যও যখন এইরূপ ব্যাপক ও গভীর প্রসারের দ্বারা জাতীয় চিত্তপ্রবণতারই নিয়ন্ত্রক হইয়া দাঁড়ায় তখনই সাহিত্য সংস্কৃতির গভীর রূপ ধারণ করে। সাংস্কৃতিক রূপে পরিণত এই-জাতীয় ধর্ম ও সাহিত্যকে জাতি অনেক সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একটা সামাজিক উত্তরাধিকার রূপে গ্রহণ করিতে থাকে।
বাংলাদেশের কয়েকটি ধর্মমত এবং তদাশ্রিত সাহিত্য এইরূপ একটা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রূপে বৃহৎ বাঙালী সমাজে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লাভ করিয়াছে যে সমাজ তাহার সম্বন্ধে এই কথাটি স্পষ্ট মনে রাখিতে হইবে যে তাহা একটা বড় ‘বাঙালী সমাজ’; তাহা ‘বাঙালী সমাজ’ এই জন্য যে সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত জনগণ তাহাদিগকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান রূপে অত্যন্তভাবে পরস্পরবিরোধী শ্রেণীতে ভাগ করিয়া লয় নাই; অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস রূপে যে সম্প্রদায় যে মতই গ্রহণ করিয়া থাকুক না কেন সাংস্কৃতিক জীবনে আভ্যন্তরীণ চিত্ত-প্রবণতার বিচারে তাহাদের একটা অখণ্ড ‘বাঙালী’ পরিচয় ছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৈষ্ণব-ধর্ম ও সাহিত্য, নাথ-ধর্ম ও সাহিত্য ও বিভিন্ন সহজিয়া-ধর্ম ও সাহিত্য এইরূপে বাংলার সমগ্র সাংস্কৃতিক জীবনের উপরেই প্রভাব বিস্তার করিয়াছে; তাহার ফলে বৃহৎ বাঙালী সমাজ যখন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান আদি রূপে নিজেদের ধর্মের ক্ষেত্রে পৃথক বলিয়া মনে করিতে লাগিল তখনও তাহার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে কেহই পরিত্যাগ করিল না, তাহারা সেই সংস্কৃতি-প্রভাবিত চিত্তপ্রবণতাকে পৃথক পৃথক ধর্মের ক্ষেত্রেও সক্রিয় করিয়া লইল। সেই কারণে দেখিতে পাই বাংলাদেশের হিন্দু যেমন ‘বাঙালী হিন্দু’ বাংলাদেশের মুসলমানও তেমনই ‘বাঙালী মুসলমান’, বাংলাদেশের বৌদ্ধ-খ্রীষ্টানগণেরও তাই একটা বিশেষ বাঙালী পরিচয় আছে।’’
(শশিভূষণ দাশগুপ্ত ১৩৮১ : ৩৫৪ - ৫৫)
‘‘সুফীমতের ইসলামের সঙ্গে বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর তেমন বিরোধ নাই। সুফীমতের ইসলাম সহজেই বাংলার প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধন মার্গের সঙ্গে একটি আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।’’
(সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ২০০৯, ২৩২-তে উদ্ধৃত)
সুফিমতের অাংশিক সাদৃশ্যই রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ লীলায়। তাই একেশ্বরবাদী ও অবতারবাদে আস্থাহীন মুসলমান কবিগণের কল্পনায় সাধারণত রাস, মৈথুন, বস্ত্রহরণ, দান, সম্ভোগ, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতি প্রশ্রয় পায়নি। কেবল রূপানুরাগ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার মিলন, বিরহ প্রভৃতিকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা জীবাত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে। তাঁদের রচনায় অনুরাগ, বিরহবোধ এবং জীবন জিজ্ঞাসাই (আত্মবোধন) বিশেষ রূপের প্রকট। (আহমদ শরীফ, ২০০৯, ২৩৩)। কয়েকটি সুফীপদ এখানে উদ্ধৃত হল—
আলি রাজা
শ্যাম কিরূপে দেখিমু তোরে, কালা কিরূপে পাইমু ভোরে ধু
দূর দেশীর সখি, করিলাম পিরীতি, অবলা গোপালের নারী।
দূর দেশী ছিল, ঘর চলি গেল, না চাহিলাম নয়ান ভরি॥
পিরীতির আনলে, সর্ব অঙ্গ জ্বলে, না দেখি শ্যামের মুখ।
এ তিন ভুবনে, কালাকানু বিনে, কোন কুলে নাহি সুখ॥
মোর দুঃখ ভার, গুরুপদ সার, কহে আলি রাজা হীনে।
ভাই পাড়াপড়ি, ইষ্ট ধন কড়ি, সার না দেখি তুয়া বিনে॥ ৩৮
মারহাটি
বিরহ
সই না লো হে, আমার দুঃখ সাক্ষী পীতাম্বর॥ ধু।
সর্ব জগ দেখি ধান্ধা।
অই চতুর্ভূজ বিনে, আনরে না মানে মনে,
সে রাধা চরণে প্রাণি বান্ধা॥
বিষ লাগে বসন্তের যাও, নগরে বেড়াও তুমি,
কুলবতী বধূ আমি,
অবলাকে দেখা দিয়া যাও। রহিতে না দিলা সুখে॥
আমি রাজা গাহে কালা,
সহন না যায় জ্বালা, বিষানল দিলা মোর বুকে॥ ৩৯
পূর্বরাগ
সখিগণে লয়ে সঙ্গে, রাধিকা চলিলা রঙ্গে,
যায় রাধা যমুনার ঘাটে।
কদম্বের তলে বসি, কানাই বাজায় বাঁশী,
ধবলী শাউলি চরে মাঠে॥
কানাই বসিয়া বাটে, রূপ দেখি প্রাণ ফাটে,
আজ মোর কি হয় না জানি।
চল সখি ঘরে যাই, কদম্ব তলে সে কানাই,
প্রাণ ফাটে তার বাঁশী শুনি॥
অধীন রাজার বাণী শুন রাধা সুবদনী,
বন্ধুয়া না দিব তোমা ছাড়ি’।
চতুরালী দূরে যাবে, পশরা ভাঙ্গিয়া খাবে,
বলে ছলে লৈব ঘট কাড়ি’॥
দেখিয়া মথুরা-পতি স্থির নহে তোর মতি,
এই বাটে কেন আইলা পুনি।
তুঁই যে অবলা নারী, কানাই প্রাণের বৈরী
এইভাবে হারাইবে পরাণী।৪০
কানড়া
বিরহ
সতত বধূর লাগি জ্বলে অবলার চিত। ধু
দূরদেশী সনে প্রেম বাড়াইনু অতি।
সেই ধরি হৈল মোর অনলে বসতি।
প্রেমের ঔষধ খাই হইলুম উদাস।
জগলোকে কলঙ্কিনী বোলে বারমাস।
শাশুড়ী ননদী বৈরী স্বামী হৈল ভিন্।
আর জ্বলা কালার সহিমু কত দিন।
গুরুপদে আলি রাজা গাহিল কানড়া।
চিত্ত হন্তে প্রেমানল না হউক ছাড়া।৪১
কামোদ
যমুনাতীরে মিলন
সদায় রাধার মনে জ্বালা শুন লো সই। ধু
কি দিয়া বান্ধিমু হিয়া, মাধবেরে না দেখিয়া,
প্রাণি মোর গেল যার সনে।
না দেখিলে চক্রপাণি, নিরোধ না মানে প্রাণি,
দহে তনু কালা কাম বাণে।
না দেখি হরির মুখ, বিদরে দারুণি বুক,
সহিতে না পারি প্রেমানল।
হই লাজ মান ছাড়া, কাঁখেত কলসী রাধা,
নিঃসরিল ভরিবারে জল।
হীন আলি রাজা বোলে, গেল রাধা নন্দীকূলে,
দেখিল যমুন তীরে হরি।
বংশী বাহে গাহে গীত, মজিল রাধার চিত,
কেলি হৈল কায়-প্রাণে জড়ি॥ ৪২
রামকেলী
বিরহ
সহন না যায় দুঃখ আর বন্ধুর লাগি। ধু
হাহা হরি কি করিলা, অবলারে ভুলাইলা,
ভঙ্গিমা করিয়া প্রেম ছলে।
নানাগীত যন্ত্র শুনি, কূলবধূ উদাসিনী,
হইয়া পড়িনু তোর ভোলে॥
তোমার কঠিন প্রাণি, তাজি ভজমান রাণী
ছাপাইলা কোন দোষ নাই।
কামিনীর কান্ত বিনে, লক্ষ্য নাই ত্রিভুবনে,
বেয়াকুল কানুরে হারাই॥
হীন আলি রাজা গায়, ভজ রাণী রাঙ্গা পায়, উর্দেশয়া পূজ কায়লা হেন প্রভু অধিকার,
সেবক না ত্যজে যার নিজ দাস রাখিব চরণে।
(যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য, ১৯৮৫, ৫৪-৫৫)
ভারতে এসেই ভারতীয় যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাবে পড়েছিলেন ইরাণী সূফীরা। সূফী সাধনার সঙ্গে যোগ ও দেহতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেই তাঁরা শুরু করেন নতুন সূফী চর্যা। পাক-ভারত মুসলিমের অধ্যাত্ম সাধনা যোগ-দেহতত্ত্ব বিহীন নয় এই কারণেই...। অতএব সঙ্গীত, যোগ, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব প্রভৃতিই রচনা করেছে বাঙালী মুসলমানের অধ্যাত্ম তথা মরমীয়া সাধনার ভিত্তি। (অাহমদ শরীফ : ২০০৯, ২১৯) বাংলায় লিখিত বিশেষ ভাবে সূফী প্রভাবান্বিত গ্রন্থ আলিরাজার ‘জ্ঞান সাগর’। ইহাতে সূফীধর্মের অনেকটা প্রেমের রূপ আমরা পাই কিন্তু উহার মধ্যে নর-নারীর যুগল-প্রেম, যোগ-সাধনা ও ফকিরী-ধর্মের গোপনীয়তা সম্বন্ধে অনেক উল্লেখ আছে :
প্রথমে আছিল প্রভু এক নিরঞ্জন।
প্রেমরসে ডুবি কৈল যুগল সৃজন॥
প্রেমরসে ডুবি প্রভু জাহাকে সৃজিলা।
মোহাম্মদ বুলি নাম গৌরবে বা খিলা॥ (২৪)
যুগল না হইলে কেহ না পারে চলিতে।
যুগ ভিনে প্রেমরস না পারে ভুগিতে॥
একাত্রকি প্রেম না হন কদাচন।
যুগল হইলে যোগ্য পিরীতি ভজন॥ (২৫)
তারপরই এই আল্লা - মহম্মদের যুগল - প্রেম যে নরনারীর প্রেমে রূপান্তরিত হইল এবং নারী ব্যতীত যে সাধনা সম্ভব নয়, তাহার বহু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন (আমরা কয়েকটি উদ্ধত করছি)
পরম সুন্দরী ছিল কৈবর্ত কুমারী।
নবী ছোলেমান ভক্ত পাই সেই নারী॥
গঙ্গা গৌরী যুগ নারী রাখি দিগম্বর।
ভস্মযোগে সাধি সিদ্ধ হইল মহেশ্বর॥
আছিল আয়েসা বিবি পরম সুন্দর।
সেই রূপে মোহাম্মদ ভক্ত পয়গম্বর॥ (৩০-৩১)
তারপর আলি রাজা বলিতেছেন :
স্বকীয়ার সঙ্গে মহে অতি প্রেমরস।
পরকীয়া সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস॥ (৮০)
এই সব বর্ণনা বৈষ্ণব গোস্বামিগণের পরকীয়া - গ্রহণ বর্ণনার ন্যায়। তারপর যোগের কথা এবং যোগপথ যে শ্রেষ্ঠ। এ-কথাও নানা স্থানে।
‘‘মিশাই পরমহংস পবনের সনে।
পূরক রেচক সঙ্গে হৃদের কম্মনে।
পূরক রেচক সঙ্গে রাখি মহাহংস।
এক যুগ সাধনে যে শরীর নহে ধ্বংস॥ (৫৫)
তন মধ্যে সরোবর ত্রিবেনীর ঘাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
পূরক রেচক হয়ে ত্রিবেণীর মাঝ॥’’
তারপর নর-নারীর যুক্তযোগ পন্থার কথা বলা হইযাছে ‘‘কোরানে কহিআছে জগত ঈশ্বরে।
যোগপন্থে নরনারী সব চলিবারে॥
নরনারী সব যদি ফকিরী না করে।
পুণ্যবলে স্বর্গে গেলে না দেখিবে মোরে॥
যুক্তযোগে নর-নারী করিতে গমন।
সকলের নিজ ঘটে প্রভুর আসন॥ (১২৩)
(উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; ১৪২২ : ৫১৩ -১৪)
আবার আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিকা প্রশ্ন রেখেছেন, হিন্দু ও নাথ ধর্মের প্রভাবের ফলে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের সূফী মতবাদের সৃষ্ট হয়েছিল। একদল অর্ধ-শিক্ষিত মুসলমান সাধক এবং কবি নাথ ধর্মের নিরঞ্জনবাদ, নাথ-তন্ত্র-শাস্ত্র, হিন্দু-তন্ত্র-শাস্ত্র এবং ইসলামের কিছু ভাবধারার জগাখিচুড়ি বানিয়ে এক ধরনের সুফী মতবাদ সৃষ্টি করেছিল, সেটা অাদতে যে কি ধর্ম তা বলা কঠিন (২০০৯ : ১৩৩)। কিন্তু অনেক বাঙালি সুফি কবির মধ্যে প্রচুর পাঠচর্চার পরিচয়।
বাংলা সুফি সাহিত্যে আলি রাজা যেমন এক অগ্রগণ্য তাত্ত্বিক কবি সেরকম সৈয়দ সুলতানও এক তাত্ত্বিক কবি, পদকর্তা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ সুলতান একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, আলি রাজা ও সৈয়দ সুলতান বাংলা সুফি সাহিত্যে দুজন প্রধান কবি। এঁদের সাহিত্যে বাংলা প্রচলিত বৈষ্ণব ও নাথ সাহিত্য ও যোগ সাধনার একটা আত্তীকরণ দেখা যায়। এখানে সৈয়দ সুলতানের পাঁচটি পদ দেওয়া হল। সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে নিবন্ধ এ সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে।
সৈয়দ সুলতান
রাগ বসন্ত
শ্রীকৃষ্ণের রূপ
কত কত মোহন মোহানি জান। ধু
কুটিল কুন্তল ফান্দ, বেড়ি আছে মুখ চান্দগুলি
গণে বাজাইতে আস।
জেহেন নির্মল শশি ঢাকিছে জলদে আসি,
দেখা দিলে তিমির বিনাশ॥
সুগন্ধি তিমির কেশ রহিছে মোহোন ভেস
মুখ চান্দ রহিছে ছাপাএ।
একেবারে অনুপাম, নিশি দিশি একহি ঠাম
লক্ষি বারে লক্ষ্যণ ন জাএ
কিবা রাত্র কিবা দিন, নহে রূপ ভিন্ন ভিন
এ চান্দ সুরজ নহে তার।
ছৈঅদ ছোলতানে কহুঁ, সেই সে আহ্মার পহুঁ
দেখা না দে বিদিত সভার॥ ১
আত্মবোধন
কত পন্থ কুল অন্ত নাই। চৌদিকে করিলঘোর,
পন্থের না পাইলাম ওর,
ওরে বিবাদে লাগিল কাল দেবা রে॥
কহে সৈয়দ সুলতানে, নৌকাখানি আনিলাম পানে,
না করিলাম কোন ব্যবহার।
আগেগাছে না শুনিলাম, মায়াজলে বন্দী হৈলাম
ওরে জিজ্ঞাসিলে কিদিব উত্তর॥ ২
আশোয়ারী বা গৌরী
মিলন
নন্দ আসি জয় দেওরে, আমার গোপাল আইসে ঘরে। ধু
মনেতে আনন্দ অতি ঘরে কেহ নাই।
আজু রাধার শুভ দিন মিলিল কানাই।
অপরূপ বিপরীত কি বলিব কারে।
নানা রূপে করে কেলি ভ্রমরা না ছাড়ে।
জল নাহি কলসে যমুনা বড় দূর।
চলিতে না চলে রাধার চরণে নূপুর॥
ভৃঙ্গারের জল দিয়া পাখাল দুই পাও।
গঙ্গার জল সাঁচরি’ বন্ধেরে করি বাও॥
কহে সৈয়দ সুলতানে মনেতে ভাবিয়া।
পর কি আপনা হয় পিরীতি লাগিয়া॥ ৩
প্রার্থনা
শ্যাম মোরে করিও দয়া, একেবারে না ছাড়ো মায়া;
ও কালা চান্দ পরদেশী!
প্রেমসাগরে ডুবি, হর-ঘড়ি তোমারে সেবি।
মন বান্ধ্যাছ শিলার ডোবে, পাসরি রহিলা মোরে।
পিরীতি তোমার সনে, আড়া পাড়া সবে জানে,
দৈবে কলঙ্কিনী হৈলাম, নয়ান ভরি না চাহিলাম।
সুজনে পিরীতি করি, একেবারে না যায় ছাড়ি।
জনমে জনমে পালে, সঙ্গে থাকে নিদান কালে।
কহে সৈয়দ সুলতানে, রাখ প্রাণি দেখা দানে॥ ৪
রাগ মালসী
অনুরাগ
সই বোলম মুই জীব না রে কানু আনিয়া দে।
কালার ভাবে চিত্ত ব্যাকূল আকূল করিছে॥ ধু
চিড়া নহে কলা নহে দধি মাখি খাইতুম।
ঝলক দাপন নহে নয়ান ভরি চাইতুম॥
কাম সিন্দুর নহে তুলিয়া দিতুম শষে।
বন্ধুর ভাবে চিত্ত ব্যাকূল অঙ্গ ছাইছে বিষে॥
চান্দ বঁাকা কানু বঁাকা ঐ কদম তটে।
চম্পার কলিকার ফুল প্রতি ঘটে ঘটে॥
কহে সৈয়দ সুলতান শুন গুণিগণ।
ধড়ের ভিতর মূদ্রা করিছে রোসন॥ ৫
(যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য; ১৯৮৪; ৩৩৪-৩৩৫
উদ্ধৃত পদগুিলতে, ‘শ্যাম, কালা, অবলা গোপালের নারী, কালাকানু, পীতাম্বর, চর্তুভূজ, কানাই, ধবলী, শাওলি, শাশুড়ী, ননদী, কাঁখেতে কলস, যমুনাতীর, বেয়াকুল (আলিরাজা) প্রভৃতি বৈষ্ণব পদাবলীর শব্দ, পিরীতির অনলে অবলা গোশলের নারী, রাঙ্গা চরণ, কানাই বাজায় বাঁশী, কদম্বতলে সে কানাই, যমুনা তীর প্রভৃতি পদাবলীর অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। একই ভাবে সৈয়দ সুলতানের পদগুলিতে ব্যবহার হয়েছে ‘কুটিল কুন্তল’ গোপাল, রাধা, যমুনা, নন্দ, পিরীতি, কালাচান্দ, চিড়া, নহে কলা দধি পদাবলীর শব্দও অনুষঙ্গ। বৈষ্ণবপদাবলীর স্বরন্যাস এসেছে সূফী পদাবলীতে। একে আমরা বললে পারি সাংস্কৃতিক অন্তর্বয়ন। সূফীবাদ, ভক্তিবাদ ও চৈতন্যদেবের বৈষ্ণববাদের পার্থক্য থাকলেও যেগুলির মানবতাবাদ, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বিরোধিতার মধ্যে ঐক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘যে তাঁহাদের সেই সমস্ত বাণী, সমস্ত সঙ্গীত কেবলমাত্র শিক্ষিত পণ্ডিতমণ্ডলীর জন্য নহে, তাহা গ্রামে গ্রামে নিরক্ষর নরনারীর আদরের ধন, তখন বুঝিতে পারি দর্শন বস্তুটি কি গভীরভাবে আমাদের সাধারণের মগ্নচৈতন্যলোকে প্রবেশ করিয়াছে ও সমস্ত জীবনকে ওতপ্রোত ভাবে পরিব্যপ্ত করিয়াছে।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৩৩২, ২৫) এ ভাবেই বাংলার সূফী পদাবলীগুলি হয়ে উঠেছে শুধু সূফী ধর্মেরই নয় বঙ্গধর্মের দলিল। (উদ্ধত পদগুলি যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুসা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৪ থেকে সংকলিত)
পাঠপঞ্জী — অঞ্জন সেন ও সন্দীপ পাল (স) সুফিবিশ্ব, জাতীয় সাহিত্য, আহমদ শরীফ, ২০০৯ বাংলার সূফীসাধনা, রায়হান রাইল সম্পাদিত ‘বাংলার ধর্ম ও দর্শন’, সংবেদ, ঢাকা। আবুল কালাম মোহম্মদ যাকাকিয়া, ২০০৯, ধর্ম, রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্তগ্রন্থ।
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ১৪২২ : বাংলার বাউল, ওরিয়েন্ট, কলকাতামেআ জাহির রায়হান, ২০২১, পূর্বোক্ত ‘সুফিবিশ্ব’ গ্রন্থ
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, ১৯৮৪ : বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুষা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৫ : ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সঙ্ঘের সভাপতির অভিভাষণ, প্রবাসীতে ১৩৩২ এ বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে সংকলিত।
শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ১৩৫৯ : শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - দর্শনেও সাহিত্যে, ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ২০০৯ : আহমদ শরীফের বাংলার সূফী সাধনা’তে উদ্ধৃত, রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে সংকলিত।
বাংলার পথে পথে, মাঠে মাঠে সুর। সে সুরের কতই না বিভাগ, কতই না ভাব, কতই না মিষ্টতা। লোকজীবনের একটি অঙ্গ সেই গান। নদীর গান, মাঠের গান, ঘরের গান, আঙিনার গান, পথের গান, চাষের গান, পরবের গান, বিয়ের গান—সকালের গান, সন্ধ্যের গান, রাতের গান—মেয়েদের গান, পুরুষের গান—একার গান, আসরের গান, সম্মিলিত গান—কতই না বৈচিত্র। এই সুর, এই গান আজকের নয়—এর ইতিহাস বহু প্রাচীন। অথচ এর কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। এই গান আদিম, সরল এবং অবরোহক্রমিক।
‘ধারাবাহিত ঐতিহ্যানুগ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ’ই ‘লোক’। তাঁদের মুখের গান-ই লোকগান। কেউ কেউ একে সঙ্গীত আখ্যা দিতে আপত্তি জানালেও তা অবশ্যই ‘লোকসঙ্গীত’ বা ‘লোকগীতি’ বা ‘লোকগান’। লোকজীবনের সঙ্গে জড়িত এই গান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র। লোকসমাজের জীবন ছন্দের প্রতি মুহূর্তে যা প্রবণতা হয়ে ধরা দেয় সেই সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী অংশ এই গান। ফলে সেখানে ধরা পড়ে লোকজীবনের নানান কথকতা, ধরা পড়ে আধ্যাত্মিকতা। জটিল তত্ত্বের বিষয়ও সহজ হয়ে ধরা পড়ে এইসব গানে। বাউল গানের ভাষা, ছন্দ, সুর তাই সহজেই হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে যায়। আবার যখন শুনি ভাটিয়ালি, সারি, ভাওয়াইয়া, তখন জীবন, জীবনের টুকরো টুকরো আখ্যান উঠে আসে গানের ভাষায়। এই গানের পদবিন্যাস সরল, ভাষা সহজ, ভাব বোধগম্য, তাও-ছন্দ-লয় সহজ, সুরও স্বতঃস্ফূর্ত। এই গানে কোনো বাধা নেই, আছে হৃদয়-মনের স্বতঃউৎসারিত আবেগ। তাই রাস্তায় ভিখারি গান গায় এই সুরে, রাখাল বালক আপন মনে সুর ধরে, খেলতে গিয়ে শিশুরাও গান করে। কেবলই আনন্দ নয়, সুখে-দুঃখে, অসহায়তায়, যন্ত্রণায়, ক্রন্দনে, প্রেমে, ভালবাসায়, জীবনানুভূতির গভীরতায় এই গান বেরিয়ে আসে তথাকথিত লেখাপড়া না জানা খেটে খাওয়া মানুষগুলির হৃদয় থেকে। এই গান তাঁদের জীবন। তাঁদের জীবনের নির্যাস-ই এই গান।
এই গানের সঙ্গে যুক্ত থাকে আরো কত বিচিত্র বিষয়। গানের জন্য বাদ্যযন্ত্রও তাঁদের হাতেরই তৈরি। কখনো খালি গলাতেই গান, বাদ্যযন্ত্র লাগে না—ভাদু টুসু, ভাটিয়ালিতে সেই দৃশ্য দেখা যায়। তবে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সাধারণত একতারা, দুতারা, খঞ্জনি, সারেন্দা, গাবগুবি, বেণা, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ—এইসব ব্যবহৃত হয়। এগুলি ‘লোকবাদ্য’ নামে পরিচিত। অবাক করার বিষয়, সাধারণ মানুষ তার নিজস্ব ছন্দকে নিজস্ব সুরকে কীভাবে নিজের হাতে বানানো একেবারে সাধারণ যন্ত্র দিয়ে মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলে। যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু নিয়েই সে সন্তুষ্ট।
লোকসঙ্গীতের সুরবৈচিত্র যেমন লক্ষণীয়, তেমনি এর আঙ্গিক ও বিষয়বৈচিত্রও বহুধা। নৌকা চালাতে চালাতে মাঝিরা গান করে, কখনো এককভাবে, কখনোবা সম্মিলিত ভাবে। পথ চলতে চলতে একাকী বা সম্মিলিতভাবে বৈষ্ণব ভিখারিদের গান আজ আর শোনা না গেলেও তা একসময় বাংলার পথে-ঘাটে মিশে থাকত। বাউলেরাও একইভাবে গান ধরে। তবে এখন আখড়ায় কিংবা অনুষ্ঠানে সেই সুর শোনা যায়। বাসে বা ট্রেনেও মাঝে মাঝে বাউলদের দেখা পাওয়া যায়। বঙ্গে চৈত্র মাসের গাজন বিখ্যাত। সেই উপলক্ষে নীলের গানও জনপ্রিয়। নীল অর্থাৎ শিবের গান। হর-পার্বতী সেজে নৃত্যশেষে চলে শিব-দুর্গার পারিবারিক জীবনের ঘটনা সম্বলিত গীতি—‘মন দিয়ে শোন সবে, হইবে শিবের বিয়ে/ কৈলাসেতে হইবে অধিবাস’। গাজন উপলক্ষে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় চলে বোলান গান। বহু সম্প্রদায় কোন এক গ্রামের নির্দিষ্ট আটচালায় কিংবা বড় বৃক্ষের নিচে এসে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে বোলান গান ধরে। এই গানের অধিকাংশই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক। মালদহে বৈশাখ মাসে শিবের গাজন উপলক্ষে প্রচলিত শিবের গান—গম্ভীরা। গম্ভীরার মতোই শিববন্দনা ও শ্লেষাত্মক গান গাওয়া হয় মুর্শিদাবাদ, বীরভূমে, যার নাম আলকাপ। পূর্ববঙ্গে নদীতে নৌকায় পাল তুলে ভাটিয়ালি গান গায় মাঝি—‘কুচবরণ কইন্যা রে তার মেঘবরণ কেশ’। ভাটিয়ালি সুরের অনুরূপে উত্তরবঙ্গে মাঠের গান ভাওয়াইয়া প্রসিদ্ধ। মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, প্রেমের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত আহয় এই গানে। যুবকের যুবতী সেজে নদীর ঘাটে ঘাটে আসর জমিয়ে নাচের সঙ্গে গান করার রীতি প্রচলন আছে পূর্ববঙ্গে, যার নাম ঘাটু গান। এগুলি ছাড়াও আছে পিরকীর্তন, গাজির গান, জারি গান, কিচ্ছার গান, রামগান, পালাগান, কবিগান, গ্রাম্য কীর্তন, ভাসান গান, পটের গান, বিয়ের গান, ছাদ পেটানোর গান, সারি গান, ঝুমুর, টুসুর গান, ভাদু গান—আরো কত কি।
এইসব গান শুধুই কী গান! গানের সঙ্গে মিশে থাকে কত শত ইতিহাস, কত অজানা গল্প, সাধারণের জীবনপ্রবাহের কত খুঁটিনাটি বিষয়। মিশে থাকে কত পেশার মানুষের কথা, কত শিল্পীর যোগসূত্র, কত পরিবেশের বিভিন্নতা। ফলে লোকসঙ্গীত কেবল শিল্পীর বা গায়কের মনের কথা বা প্রাণের কথা-ই নয়, বরং বলা চলে জাতির কথা, ইতিহাসের কথা, জনসমাজের এক অভিব্যক্তিময় দলিল। রাঢ়বঙ্গে প্রচলিত আছে ভাদু টুসুর গান, বাউল গান, ঝুমুর গান, বিয়ের গান, পটের গান, কীর্তন গান, কবিগান, রামায়ণ গান, হাপু গান, বাঁধনার গান, ঝাপান গান ইত্যাদি।
ভাদ্র মাসে ভাদু পূজা। রাঢ় বাংলার মেয়েরা মেতে ওঠে এই পুজোয়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়িতে ভাদু পাতা হয়। একমাস ধরে গ্রামাঞ্চলের চলে মেয়েদের আসর। কোন মন্ত্র নেই, আছে কেবল গান। গান দিয়েই দেবীর আরাধনা। ভাদুর মূর্তি সামনে রেখে কিংবা প্রদীপ দেওয়া টেরাকোটার তৈরি বাটিতে সলতে দিয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে রাত জেগে ভাদুর গান করেন মেয়েরা। একসঙ্গে। এক সুরে। বাদ্যযন্ত্র লাগে না। সামনে রেকাবিতে নামানো থাকে সাধ্যমতো মিষ্টান্ন দ্রব্য। প্রায় সবই বাড়ির তৈরি হয়। কখনো দোকান থেকে কিনে আনা খাজা, জিলিপি। সংক্রান্তির রাত ভাদু উৎসবের শেষ রাত—জাগরণের রাত। এক গ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পাড়ায় ভাদুপূজা করে থাকে মেয়েরা। তাই প্রায় প্রত্যেকেই উৎসবের সাজসজ্জা বা ভাদুমূর্তি দেখতে যায়। আর ভেসে আসে গান—“ভাদু বৈল্তে আলি তোরা / বৈস লো তোরা ছাঁচকলে। /পাৎনা ভর্যের মাড় রাখ্যেছি / খা লো তোরা প্যাট ভর্যেৈ।।”
ভাদুপূজা সম্পর্কে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত রাঢ়বঙ্গে। কথিত আছে পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজার সুন্দরী কন্যা হলে ভদ্রেশ্বরী। তাঁর বয়স বাড়লেও উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় না। মনের দুঃখে তাই সে প্রাণত্যাগ করে। রাজা কন্যাশোকে পাগলপ্রায় হয়ে যান। সেই বছরই তিনি তাঁর মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি ব্রত উদ্যাপন করেন। সেই থেকে তাঁর রাজ্যে ভাদুব্রত পালন করা হয়। এই কিংবদন্তী বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায় একটু এদিক ওদিক করে। তবে কাহিনি যাই হোক না কেন, ভাদ্র মাসের শুরু থেকে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে যেভাবে গীতসহকারে দেবীর আরাধনা করা হয়, তাতে প্রতিফলিত হয়ে পড়ে সমাজের বহু বিচিত্র দিক। বিবাহিত নারীর একান্ত যাপনচিত্রের পাশাপাশি উঠে আসে তাঁর যন্ত্রণার কথাও। একটি ভাদু গানে পাওয়া যায়—“শ্বশুর বাড়ির লোক এসেছে, হেইমা কিছু বলো না/ শাশুড়িতে শুনত্যে পেলে, আমায় দেবে গঞ্জনা।”
ভাদুর গানগুলো প্রথমাবস্থায় কীরূপ ছিল তা জানা না গেলেও বর্তমানে যে তাতে নব নব বিষয় সংযোজিত হয়েছে তা বোঝা যায়। সচেতন কবিদের কলমের জোরে ভাদুর গানে গুরুত্ব পেয়েছে সমকালীন সমাজ, পুরাণ-ইতিহাসের কাহিনি, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে যুদ্ধ-মহামারির গল্প। তবে এটুকু বোঝা যায়, ভাদুর কাহিনি বর্ণনা ও রূপমুগ্ধতা, নারীর যন্ত্রণা, তার সুখ-দুঃখের নিত্যনৈমিত্তিক অনুভূতি বিষয়ক গানগুলিই প্রাচীন। যেমন—‘কি কি গয়না লিবি ভাদু বল না গো আমারে।/ পায়ে লিব নুপুর তোড়া সাজবো গো বাহারে।।/ আর কি কি গয়না লিবি ভাদু বল না গো আমারে।/ নাকে লিব নথের টানা সাজব গো বাহারে।।” এই গান শুনে কি কেবলি মনে হয় যে এ কেবল ভাদুর চাহিদা? নাকি খেটে খাওয়া চাষী-মজুর পরিবারের মেয়েদের মিষ্টি-মধুর কামনা? এই হল ভাদুর গান।
এবার আসা যাক সময়কাল ধরে ভাদু গানের বাস্তবের একটা দিকে। ভাদ্র মাস বঙ্গে বন্ধ্যা মাস। প্রায় সকল রকম শুভ কাজ বন্ধ। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধের পর ভাদুর সামনে চলে গান। চাষী-বাসী মানুষগুলোর বাড়িতে সলতে পাকানো প্রদীপ বা লণ্ঠনের আলোয় এই আসর জমে। চাষ শুরু প্রায়। জ্যৈষ্ঠ মাসে ধানের বীজ বপন করা হয় চারা তৈরির জন্য। ১৩ জ্যৈষ্ঠ রোহিনীর দিন চাষীঘরের মেয়েরা বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে ক্ষেত থেকে মাটি এবং সাহাড়া গাছের ডাল নিয়ে আসে। বীজ বপনের সময় ধানের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় রোহিন মাটি। ৭ আষাঢ় পালন করে অম্বুবাচী। এদিন চাষের কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। এরপর ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষ একাদশীতে জাওয়া পরব। শস্য ও সন্তান কামনায় এই পরব। অনেকেই জাওয়া-করমের সঙ্গে ভাদুপূজার যোগসূত্র টেনে ভাদুপূজা জাওয়ার অঙ্গ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এভাবে ভাবলেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাংলার সংস্কৃতির বেশিরভাগটাই যেহেতু কৃষির সঙ্গে যুক্ত তাই ভাদুপূজাকেও কৃষি-সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। জাওয়াতে যেভাবে শস্য কামনা করে বীজের অঙ্কুরোদ্গমকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, তেমনি ভাদুপূজার গানেও সেই আবেদন কম-বেশি লক্ষ করা যায়। সেইসঙ্গে একটি বিষয়, আদিবাসী সমাজে শিকার উৎসবের ক্ষেত্রে উৎসবে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যেরূপ আদিবাসী নারী তাঁর পতির কাছে বিনিময় স্বরূপ ফুল-পাতা চায়, সেরূপ চাষের কাজের শুরুতেই যেন ভালবাসার স্বীকৃতি পেতে চায় চাষী ঘরের মেয়েরা। মূল চাষ শুরুর ঠিক পূর্ব মুহূর্ত এই ভাদ্র মাস। পুরুষের সঙ্গে মেয়েদেরও সেই কাজে যোগ দিতে হয়। ধান চারা লাগানো থেকে শুরু করে ধান ঘরে আনা পর্যন্ত। সংসারের যাবতীয় কাজ তো আছেই, সেইসঙ্গে চাষের কাজ। ফলে এক হাতে সংসার আর অন্য হাতে চাষ—দুই-ই সামলাতে হয় বাড়ির মেয়েদের। তাই কিছু অভিমান, কিছু চাওয়া, কিছু কামনা তাঁদের থেকেই থাকে। যেন বলতে চায় এবারের চাষে উপার্জন হলে তাঁর খাটুনির স্বীকৃতি স্বরূপ যেন একতু সুখ, একটু আনন্দ দেওয়া হয়। সে হয়তো পায়ের তোড়া, নাকের গয়না কিংবা কপালের একটা টিপ পেলেই সে খুশি। এই চাওয়া তো আর অমূলক নয়, কিংবা দুর্মূল্যও নয়। ফলে ভদ্রেশ্বরীর আরাধনায় সেই কামনা-ই যেন ফুটে ওঠে। শুধু কি পার্থিব চাওয়াই?—সঙ্গে আছে প্রেম প্রত্যাশা, সন্তান কামনা।
এবারে আসা যাক বর্তমানের ভাদুগানে। সচেতন কবি বা আঞ্চলিক কবিগণ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাদু গানের বই লিখে চলেছেন। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বহু ইলেক্ট্রনিক্স ও মনোরঞ্জনের বহুধা দ্রব্য এসে যাওয়ায় মন-গড়া ভাদু গান নারী সমাজে তেমন আর প্রচলন না থাকলেও অল্প লেখা-পড়া জানা তরুণী বাজার চলতি ভাদুগানের বই কিনে গান করেন বৈকি। সেসব গানে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, পুরাণ, ইতিহাস। যেমন—“পরমাণু যদি ফাটে মা/ সোনার বিশ্ব হবে শ্মশান।/ হিরোসিমা নাগাসাকি/ থাকুক না মা গো স্মৃতি হয়ে।” পূর্বে ভাদুর গানগুলি মুখে মুখে তৈরি হত, তেমনি অনেক গান বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ঠাকুমা-দিদিমা পরম্পরায় সেই গানগুলি ক্রমপ্রবাহিত হয়েছে, ঠিক লোকছড়াগুলির মতো। কিন্তু এখন সেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা যেমন কষ্টকর, তেমনি জরুরিও। বাঁকুড়ার লক্ষ্মীসাগরে একটি বৈষ্ণব পরিবারে ৬০-৭০ বছর আগের ভাদু গানের খাতা পাওয়া গেল, যেটি সেই বাড়ির তুষ্টবালা দাসের লেখা। এই খাতায় যে গানগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত। গানগুলিতে বৈষ্ণব পদাবলির প্রভাব রয়েছে। এমনকি সুরেও বৈষ্ণব পদাবলির সুর খানিকটা গ্রহণ করা হয়েছে। অবাক করার বিষয় হল, ভাদু বা ভাদু গান কিভাবে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে তার একটা চূড়ান্ত প্রমাণ এই জাতীয় খাতাগুলি। এরূপ বহু খাতা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে পাওয়া যায়। আবার যখন গ্রামাঞ্চলে মুদ্রণ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে, সেসময়ে ভাদুগান সম্বলিত চারটা ‘লিফ’ বের করে বিক্রি করা হত হাটে, মেলায়। চারটে ‘লিফ’এর প্রথম অংশটুকু বাদ দিয়ে মোট ত্রিশ খানি ভাদুর গান থাকত। এখন অবশ্য পাড়ায় পাড়ায় গানের প্রতিযোগিতা না থাকলেও খুব জোরে রেকর্ডিং গান চালানোর প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।
ফলে লক্ষণীয়, একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে আর পাঁচটা লোকউৎসবের বৈশিষ্ট্য মেনেই লোকসমাজের প্রায় সব ধরনের মানুষ জড়িত। যেহেতু এটি নেহাত মেয়েদের উৎসব, তা সত্ত্বেও পুরুষদের ভূমিকাও লক্ষ করা যায়।
ভাদুর মতোই আর একটি পরব—টুসু পরব। ভাদ্র মাসে যেমন ভাদু পূজা, পৌষ মাসে তেমন টুসু পূজা। ভাদ্র মাস যেমন মল মাস, পৌষ মাসও তেমনি মল মাস বা অশুভ মাস। ভাদুপূজার মতো টুসুও একমাস ধরে হয় এবং সংক্রান্তির রাত জাঁকজমক সহকারে রাত জাগা বা ‘জাগরণ’ হয়। টুসুতেও একটি সরা রেখে বা মূর্তি রেখে বা চৌদল রেখে আরাধনা করার প্রচলন আছে। এখানেও বাড়ির সকল মেয়ে অংশগ্রহণ করে, সন্ধে হলেই দীপ, ধূপ জ্বালিয়ে গান করে। টুসুর গানের বিষয়বস্তুও প্রায় এক। টুসু সম্পর্কিত কিংবদন্তীও প্রায় একরূপ। এখানেও টুসুর আত্মহত্যার কথা আছে। বাঁকুড়া জেলার পরকুল, পুরুলিয়ার দেউলঘাটা বা বীরভূম, ঝাড়খণ্ডে, মেদিনীপুরে টুসুকে কেন্দ্র করে বিরাটাকারে মেলা বসে। ভাদুর ক্ষেত্রে অবশ্য সেটা দেখা যায় না। এর কারণও অবশ্য আছে।
ভাদু হল কৃষির প্রথম পর্বে, আর টুসু পরব কৃষির প্রায় শেষে। যেহেতু কুর্মি, বাউরি ইত্যাদি কৃষক সম্প্রদায়ের পরব এই দুটি, তাই উক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত রাঢ় এলাকা এই দুই পরবকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে। বিশেষত টুসু পরবে যেহেতু মেলা বসে, তাই অনেকেই টুসু পরবকে রাঢ়ের জনসাধারণের জাতীয় উৎসব বলেও আখ্যা দিতে চেয়েছেন। মোটকথা, কৃষির শেষ পর্যায়ে যখন প্রচণ্ড কায়িক শ্রম দিয়ে চাষের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে ক্লান্ত বাড়ির মেয়েরা, তখন আবার বিশ্রাম ও চাওয়া-পাওয়ার আসর নিয়ে হাজির হয় তাঁরা। ভাদুপুজোর সময় যত সুখ-দুঃখ আর কিছু কামনা বাসনা, প্রত্যাশার কথা, টুসু পুজোতেও তার প্রতিচ্ছবি থাকে। সেখানেও থাকে শ্রম, কষ্ট, যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও প্রেমের ছবি। পৌষে বছর শেষে, মাঘে আবার নতুন করে কৃষি বর্ষ শুরু। তাই নারী হৃদয়ের একান্ত অনুভূতিগুলি আবার গান হয়ে ফুটে ওঠে। একটি টুসু গানে আছে—“পই্রব বুড়া বিলাতি শাড়ি।/ ও তোর কী ধারি গো কী ধারি।।/ বিকে দিব গো ঘর বাড়ি।/ ওগো ঘর বাড়ি।।/ পই্রব বুড়া বিলাতি শাড়ি।।” কখনো প্রেমিকার প্রেমবিহ্বল রূপ ধরা পড়ে টুসুর গানে—“তোর কি আমি লই মনের মতন।/ তুই করলি কেন অযতন গো অযতন।।/ তোর কি আমি লই মনের মতন।”
প্রত্যাশার আর এক রূপ নারীর ভাবনাকে কোথায় গিয়ে পৌঁছে দেয় তা দেখতে পাই একটি গানে—“বলি চল গো টুসু যাব বিলাতে। / আমি রইব না আর ভারতে।।/ ওগো খানা পিনা খাব না গো।/ আমি খাব রুটি পরটাতে।।/ ওগো পরা কাপড় পই্রব না গো।/ সাই্জব সামিজ শায়াতে। / ওগো পায়ে লিব হিলতোলা জুতা।/ আমি চাই্পব হেলিকপ্টাতে।/ চল গো আমি যাব বিলাতে।।” টুসুর গানগুলি নিইয়ে ভাবলে দেখা যাবে, চাষী ঘরের মেয়েদের ছোট ছোট কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-প্রত্যাশা কিভাবে তাঁদের কাছে এত গুরুত্ব পেয়েছে। আসলে চাষই যাঁদের সম্বল, দিন আনা দিন খাওয়া সেই মানুষগুলো সারা বছর পরিশ্রম করে সামান্য একটু সুখলাভের প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশা নিতান্তই অমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক। তার চেয়েও বড় কথা হল, এরা অল্পেতেই সন্তুষ্ট। অত্যধিক প্রয়োজন নেই, টুসু মেলায় বা মকর মেলায় বা পরের দিন এখ্যান মেলায় এরা ‘ইলির-মিলির-ঝিলির’ কানের দুল, কাঁচের চুড়ি, টিপ কিনতে পেলেই খুশি, আর কিছু চায় না তাঁরা। জীবনে এর চেয়ে আর কী সুখ থাকতে পারে?
শুধু কি নারী-জীবন?—টুসু গানেও চিত্রিত হয় সমাজ, দেশ ও বিশ্বের চিত্র। তবে এগুলো সাম্প্রতিক। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার বহু আঞ্চলিক কবির লেখা টুসু গীতি বিক্রি হয় হাটে-বাজারে। তাতে উঠে আসে সমাজ সচেতনতার দিকটিও। বাঁকুড়ার হরিপদ মাহাতোর লেখা টুসু গানের বিষয়ে এমনিভাবেই এসেছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পণপ্রথার কুফল, সর্বশিক্ষা অভিযান, জল সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপন, নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহের কুফল ইত্যাদি বিষয়। আবার টুসু কখনো মা, কখনো মেয়েরূপে গানে প্রতিভাত হয়। আদরের মেয়ে টুসুকে নিয়ে তাই গান ধরে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মায়েরা, মেয়েরা—“টুসু আমাদের কলেজ গেছে/ নিজে স্কুটি চালিয়ে/ পাড়ায় লোক ভালে সবাই/ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে।”
আবার ভাদু বা টুসুর গানে আছে অন্যের টুসুকে ছোট করার গান। বিষয়টি বহু জনের কাছে পরশ্রীকাতরতা মনে হলেও তা আদৌ ঐরূপ নয়। নিজেদের টুসু বা ভাদু সম্পর্কে প্রশংসা করতে গিয়েই চলে আসে অন্যের সঙ্গে তুলনা। তাই মেয়েরা গান ধরে—“আমাদের টুসু হাসে যখন/ মুক্তা ঝড়ে পড়ে গো/ উয়াদের টুসু হাসে যখন/ রক্ত পোকা ঝরে গো।” কিংবা “আমাদের টুসু মুড়ি ভাজে/ চুড়ি ঝলমল করে গো/ উয়াদের টুসু আঁচল পাতে/ লাল ঝরে পড়ে গো।” একইভাবে “আমাদের ভাদুর কালো চুলে তেল চুঁইয়ে পড়ে গো/ উয়াদের ভাদুর তেল জুটে নাই, উকুন লড়বড় করে গো।” এক পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে আর এক পাড়ার মেয়েদের এইভাবে নিজেদের টুসু বা ভাদু সম্পর্কে শ্রেষ্টত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে চলে গানের লড়াই। কৃষিকাজে প্রতি মুহূর্তেই যেমন প্রচুর শ্রম দরকার হয়, তেমনি প্রয়োজন হয় কাজটিকে সুন্দর করে করার। কারণ একটু অসংলগ্ন হলেই বা গুরুত্ব না দিয়ে করলেই চাষে ত্রুটি ঘটে ও সেবছর চাষ ভালো হয় না। তাই সবদিক নজর রেখে কাজের মধ্যে পারফেক্শন আনতে হয়। অন্যের ভাদু বা টুসুকে খাটো করার অর্থ এই নয় যে পরশ্রীকাতরতা, বরং নিজের কাজকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ করার মানসিকতা থেকেই এই তুলনা।নিজের শক্তি ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরে যেন আত্মশক্তিকে স্মরণ করে নেয় মেয়েরা। তবে এক্ষেত্রে কবিগানের মতো প্রতিপক্ষ কখনোই কাছে থাকে না, সবাই নিজের নিজের ভাদু বা টুসুর আসরেই থাকে এবং সেখানেই এরূপ গান ধরে ও হাসাহাসি চলে, অনেকটা বাড়ির অন্দরমহলে মেয়েদের রঙ্গ-তামাশার মতো। এই সূত্রেই লক্ষ করা যায় টুসু-ভাদুর গানে আদিরসাত্মক ভাবের ব্যবহার। তবে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে দায়ি সেই অমার্জিত কবিগোষ্ঠী যারা চটজলদি নিজেদের প্রচার চায়। এইসব গান সরাসরি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করলেও ভাবে-ভঙ্গিতে অশ্লীলতাকেই নির্দেশ করে। যেমন একটি গানে আছে—“কচি ডালিম রাখবি যতনে।/ ফিরে পাবি না আর জীবনে।।/ এদিক সেদিক ঘুরছে লোফার ডালিম পাকার সন্ধানে।/ ভালো করে রাখবি ধনি জাকিট বডির বন্ধনে।।” এরূপ গানের গীতিকারেরা নিজেদের সংক্ষেপ নাম বা ছদ্মনাম ব্যবহার করে ছোট চটি বই বের করেঙ, যেগুলি হাটে বাজারে বেশ ভালো-মতোই বিক্রি হয়। গীতিকারের অর্থলাভ হয়।
ভাদু বা টুসু গানে যেভাবে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে এইসব লোকসঙ্গীত গুরুত্ব পাচ্ছে। লেখার মধ্য দিয়ে তো আছেই, সেইসঙ্গে রেকর্ড করে ক্যাসেট বা অডিও বা ভিডিও ভার্সনেও এইসব গান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসারলাভ করেছে। সেইসূত্রেই বিভিন্নভাবে টুসু-ভাদু সংস্কৃতিও ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন স্তরে—তা সে নামকরণেই হোক বা বিজ্ঞাপনেই হোক। গানগুলিতে প্রচলিত রামায়ণ-মহাভারতের কথা, বৈষ্ণবীয় ভাব ও ভাবনার কথা এবং সেইসঙ্গে সমকালীন রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজের কথা এমনভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে, সমাজের সকল মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। টুসু কেন্দ্রিক মেলায় সকল শ্রেণির মানুষের ভিড় চোখে পড়ে। গবেষকমহলে ভাদু-টুসুর গান ও বিষয় সূত্রে আলোচনাসভাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ইদানিংকালে।
আসলে রাঢ়বঙ্গে ভাদু বা টুসু পরব নিছক কোন ব্রত বা উদ্যাপিত একদিনের অনুষ্ঠান নয়—একটা সম্পূর্ণ মাসের আয়োজন। আরো ভাববার বিষয়, ঐ দুটি মাসে অন্য কোনো শুভ কাজও করা চলে না, চলে শুধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের মাধ্যমে ভাদু বা টুসুর আরাধনা। এই পরবদুটির গানই সম্বল, গানই মুখ্য। কারণ এতে পুরোহিত থাকে না, মন্ত্র থাকে না, মূর্তি না থাকলেও চলে, থাকে শুধু সম্মিলিতভাবে বাড়ির বা পাড়ার মেয়েদের একসঙ্গে বসে জীবনের টুকরো টুকরো চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের গান গাওয়া। কৃষিকে কেন্দ্র করে কৃষির প্রারম্ভে ও কৃষির শেষ পর্যায়ে এরূপ একমাসব্যাপী অনুষ্ঠান লোকসমাজের নারীমহলটিকে বিশেষভাবে উন্মোচিত করে। নারী মনের প্রেম, বিরহ, যন্ত্রণা প্রকাশের স্বাধীন ক্ষেত্র যেন এই আসরদ্বয়। গানের মধ্য দিয়ে নারী হৃদয়ে জমে থাকা যন্ত্রণা যেমন মুক্তি পায়, তেমনি আশার আলো দেখে, স্বপ্ন দেখে।
‘দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে’- রবীন্দ্রনাথ
একতারা, দোতারা, সারিন্দা, সারিঙ্গা, খোল, ঢোল, বাঁশি, খমক, মন্দিরা, ঝাঁজ, কাঁসর, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ ডুগডুগি কর্তাল, ঢাক, বিষম ঢাক আরও কত কত সব লোকবাদ্যের আয়োজন-সমাহার বাংলার লোকসংগীতের পরম্পরা জুড়ে।বাদ্যযন্ত্রের তালিকা বেশ অনেকটাই বড়।
বহু লোকবাদ্যযন্ত্র বিলুপ্ত আজ। শোনা যায়, ভাওয়াইয়া গানেই ২২টি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো৷ আমাদের শাস্ত্রে পরম্পরাগত এই লোকবাদ্যযন্ত্রগুলির উল্লেখ দেখতে পাই। বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে। আরও দেখতে পাই আমাদের দেশের প্রাচীন মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যে, বাদ্যরত শিল্পীরা। আমরা অনুভব করতে থাকি, আমাদের দেশে লোকবাদ্যের বিপুল সমাহার ও বৈচিত্র্য-কথা।
ঘন তত আনদ্ধ শুষির,
বাদ্য চতুর্বিধ সুরুচির ।।
ভরত মুনি ও প্রাচীন শাস্ত্র আমাদের জানাচ্ছে, বাদ্যযন্ত্র চার ধরনের।
১) তত (Chordophonic or String) - যে বাদ্যযন্ত্র তারের সাহায্যে বা তারের উপর আঘাত করে বাজানো হয়। একতারা, দোতরা, অনন্দলহরী বা গাবগুবা বা খমক, সারিন্দা ইত্যাদি।
২) আনদ্ধ (Membrorophonic or Skin) - যে বাদ্যযন্ত্র চামড়ায় ঢাকা থাকে। আঙুল, কাঠি বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে বাজানো হয়। অর্থাৎ শ্রীখোল বা মৃদঙ্গ, ঢাক, ঢোল, কাড়া-নাকাড়া, টিকারা, চাঙ বা চাঙ্গু, ধামসা, বিষম ঢাক এইসব।
৩) শুষির (Aerophonic or Wind) – সেইসব বাদ্যযন্ত্র যা ‘ফুঁ’ দিয়ে বাজানো হয়। শঙ্খ, বাঁশি, দেশি সানাই, বীণ, শিঙ্গা ইত্যাদি।
৪) ঘন (Solid or Idiophonic) বাদ্যযন্ত্র ধাতু দ্বারা নির্মিত। কাঁসা, পিতল, ভরণ ইত্যাদি। যেমন - করতাল বা কর্তাল, ঝাঁঝ, কাঁশি, ঘঙ, নুপুর বা মঞ্জীর, পেটাঘড়ি ও আরো অনেক।
(এখানে শাস্ত্রীয় বা ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্রগুলিকে আলাদা রেখে শুধুমাত্র বাংলার লোকবাদ্যের উদাহরণগুলিরই উল্লেখ করা হল)
দুই
মানবজমিনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা,বিষয়-পরম্পরায় আবহমান কাল টিঁকে থাকা পড়াশোনা চাষ-বাস, কথকতা-নাচ-গান-বাজনা-নাটক, খাওয়া-দাওয়া, অসুখ-বিসুখ-ওষধি-চিকিৎসা, হাট-বাজার, মেলা-পার্বন, খেলাধুলা, আচার-আচরণ সবকিছু নিয়েই গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি।শিকড় তার গ্রামবাংলার মাটিতে। ‘পপুলার কালচার’ বা লোকপ্রিয় বিনোদন এখন শহর-মফস্বল উপচে টিভি-মোবাইলে গ্রামজীবনের অন্দরে। সংস্কৃতির ‘নগরায়নে’ হারিয়ে যাচ্ছে লোকগানের এলাকাগত ও স্থানিক বৈচিত্র্য।
কবিগান তো হারিয়েই গেলো। উনিশ শতকের শুরুতে কলকাতায় বাবু সম্প্রদায়ের বিনোদনের অন্যতম উপকরণ। শুধু কলকাতা কেন, সেসময় গ্রামগঞ্জ-জমিদারি এলাকায় প্রায় সর্বত্রই কবিগান। কবিগানের নিজস্ব সুর নেই। কীর্তন, খেউড়, পাঁচালি, হাফ আখড়াই, আখড়াই, টপ্পা, তরজার সুরই, কবিগানের সুর। দর্শকের সামনে দু’পক্ষের প্রবল লড়াই। শিল্পীদের মুখে মুখে রচিত গান। কবিগানের তরজাও আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না৷
বাংলার লোকগানের মতো আধুনিক বিনোদনের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে লোকবাদ্যকেও। অব্যবহৃত হতে হতে কোনো কোনো লোকবাদ্য হারিয়ে যাচ্ছে, কখনও কখনও আবার বাদ্যের পরিবর্তন হচ্ছে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমাদের বাংলার লোকসংগীতে বা সুরে পরম্পরাগত লোকবাদ্যযন্ত্রের পরিবর্তে পশ্চিমী বাদ্য গীটার, ম্যান্ডোলীন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে। ব্যবহার কমতে থাকে দোতরার।
সকলেই জানেন দোতরা একটি কাঠ এবং আংশিক চামড়ার ছাউনি দিয়ে আচ্ছাদিত তারের ‘তত’ জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটির বিবর্তনের প্রথম ধাপে এল এর ‘কান’গুলোর (কীলক) বদল। কাঠের তৈরী কানের পরিবর্তে স্থান হল গীটারে ব্যবহৃত ধাতব চাবি। পরবর্তী ধাপে দণ্ডের উপর বসল গীটারের মত ‘ফ্রেড’। অবয়ব এবং আকৃতিও বদলে ফেলা হল। গীটারের বাদন শৈলী তথাকথিত দোতরায় জায়গা করে নিল। বদলে গেল আঞ্চলিক ঘরানার বাদন শৈলী। অর্থাৎ কিনা দোতরার যে অবয়ব, আকার বা নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বাদন- শৈলীর আর কোন নিদর্শন রইল না। হারিয়ে গেল বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা সেই আওয়াজ।
আমরা যদি বাংলার ঢোল কে বেছে নিয়ে খানিক আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাই ইদানিং কালে ঢোল তার ‘তাক ডুম তাক ডুম’ বাণী ভুলে কর্ণবিদারক এক বুলি বাজিয়ে ক্ষান্ত দেয়। মোটামুটি সবাই জানেন, একটা গোলাকার গাছের গুঁড়ির কাঠকে দুইদিকে ফাঁপা করে এবং দু’দিকেই ছাগল বা অন্যকোনও প্রাণীর চামড়ার ছাউনি দিয়ে আমাদের ঢোল তৈরি হয়। ঢোল দু হাত দিয়ে বাজানো হয়। এক হাতে থাকে একটি ছোট্ট লাঠি। ছাউনি দুটির টানাগুলো থাকে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি। যাঁরা এই ঢোল বাজান তাঁদের বলা হয় ঢুলী।
এর বাদনশৈলীও আলাদা। বাংলার কবিগান বা তরজা গান শুনলে এই বাদনশৈলীর নমুনা ভালভাবেই বোঝা যায়। এহেন ঢোল, ইদানিং কালে চামড়ার পরিবর্তে একপ্রকার ‘সিন্থেটিক প্লাষ্টিক’ দিয়ে আচ্ছাদিত হচ্ছে। টানাগুলোও চামড়ার বদলে নাইলনের দড়ি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতি, ‘সিন্থেটিক প্লাষ্টিক’-এর মেটালিক আওয়াজের দৌলতে সে আর ‘তাক ডুম তাক ডুম’ বাজে না।
ভাবতে পারি বাঁশির কথা। বাংলায় ‘কানু ছাড়া গীত নাই।’ সেই কানু কিন্তু বাঁশি বাজিয়েই গান করতেন। সে ছিল বাঁশের তৈরি বাঁশি।
‘আষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাশী মধ্য দিয়া ছ্যাঁদা
নাম ধরিয়া বাজে বাঁশী কলঙ্কিনী রাধা
আষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাশী জলে ভাইসা যায়
আর বালুচরে ঠেইকা বাঁশী রাধার গুণ গায়।।’
মোহনের হাতের সেই বাঁশের বাঁশী আজ লুপ্ত হতে চলেছে। এসে গেছে ধাতুর তৈরি বাঁশি। সে বাঁশির জলে ভাসার উপায় নেই। গুণ গাইবার প্রশ্নতো পরে।
আর সেই ধাতব বাঁশীর সুর শুনে শ্রী রাধিকার যমুনায় জল আনতে যাওয়া কিংবা কদমতলায় কানুর সাথে দেখা করতে যাওয়ার যাওয়ার আকাঙ্খা জাগবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এতই কর্ণবিদারক ধাতব আওয়াজ।
এর পর আরও আছে। কোনও কোনও শিল্পীকে ইদানিং দেখা যাচ্ছে PVC পাইপের তৈরি বাঁশি বাজাতে। কত অসহায় করে তুলছি আপন শ্রবণ-যন্ত্রটি।
একই পরিবর্তন ঘটে চলেছে ঘন (Solid or Idiophonic) বাদ্যযন্ত্রের। করতাল বা কর্তাল, ঝাঁঝ, কাঁশি, ঘঙ, নুপুর বা মঞ্জীর এইসকল বাদ্যযন্ত্রই কাঁশা, পিতল ইত্যাদি ধাতু দিয়ে তৈরি। সাধারণত লোকসংগীতের আনুসাঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে হিসেবেই এইগুলির ব্যবহার। ধাতুর তৈরি এই বাদ্যগুলির আওয়াজে আমরা মুগ্ধ হই। অধুনাকালে একটি ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র, যার নাম ‘অক্টোপ্যাড’, আমাদের পরম্পরাগত ধাতব ঘুঙ্গুর কিংবা অন্যান্য যন্ত্রের বদলে সর্বঘটে কাঁঠালী কলার মতন ব্যবহার হচ্ছে। তার আওয়াজে ‘…আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা’। কবিগুরুকে প্রণাম, তিনি আজ বেঁচে নেই বলে।
তিন
লোকসঙ্গীতে বেহালার পাশাপাশি সারিন্দার ব্যবহারও ছিল। কালের নিয়মে তা হারিয়ে গেল। সর্বোপরি আকছার ব্যবহার শুরু হল ‘সিন্থেসাইজার’ নামক একটি ইলেকট্রনিক্স বাদ্যযন্ত্রের। এটি এমন এক বাদ্যযন্ত্র যা সব ধরনের বাদ্যকরের বাজনা ওই একটি যন্ত্রই বাজিয়ে দিতে পারে। সেইসাথে আস্তে আস্তে জুড়তে লাগলো অক্টোপ্যাড, কাহন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র।
এমন এমন ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট এখন সহজেই পাওয়া যায়, যা দিয়ে বেশ কিছু বাজনা পূর্বেই শব্দ ধারন করে রেখে বিনা বাজনদারেই বাজিয়ে দেওয়া যায়। সাম্প্রতিককালের বাংলার অনেক সঙ্গীত শিল্পীরাই এই ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি নিয়ে ‘শো’ করেন। আর সেই কান-কপাটিতে তালা লাগানো জগঝম্প সহযোগে মাটির সুরের শিল্পীদের গান বলে যে গান পরিবেশিত হয় তাতে আর যাই হোক মাটি সম্পর্কিত গানের সঙ্গে তার যে কোন মিল নেই তা বুঝতে সংগীত প্রেমী না হলেও চলে।
অধুনা কালের শিল্পীরা সব ধরনের গানের সাথে দু-চারখানা লোকগীতিও জনমানসে পরিবেশন করেন। যে পরিবেশনের সাথে ‘লোকসংগীত’ বা ‘লোকগীতি’ বা ‘পল্লীগীতি’ গাই বলতে তারা লজ্জা বোধ করেন। তার চাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য এবং গর্ব বোধ করেন ‘ফোক গাই’ বা ‘ফোক করি’ বলাতে। আসলে ‘লোকসংগীত’ ‘লোকগীতি’ ‘পল্লীগীতি’ শব্দগুলিও আকাশবাণীর ঘোষণা থেকে নেওয়া।
উত্তরবঙ্গ যদি ভাওয়াইয়ার পীঠস্থান হয়, দক্ষিণবঙ্গ বাউল সাধনার কেন্দ্র৷ বাউল সঙ্গ, বাউল যাপন, বাউল গান পর্যটকদের টানে বাউলভূমি বীরভূমে। নগর-মফস্বলেও বাউলের চাহিদা বেড়েছে, বাউলের দর্শন নয়, হয়’ত বা নিছকই হুজুগ বা অবসর বিনোদন, কিন্তু এর অন্তর্নিহিতে রয়েছে বিষ্ময় আর ভালোবাসা। নাগরিক উদ্দীপনায় এবং ব্যবসায়িক কারণে ইদানীং বাউলরাও কিছুটা প্রভাবিত হচ্ছেন, লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভাবের পরিবর্তন, এমনকি সুরের মিশেলও তবুও অনেকে সত্যিই বাউল গান ও দর্শনকে আপন করে নিচ্ছেন।
চার
আজ থেকে ৫০০ বছর আগে কিংবা তারও আগে আমাদের এই বাংলায় কি ধরনের লোকবাদ্য প্রচলিত ছিল তা আমরা জানি না। কেবলমাত্র আমাদের পুঁথি, শাস্ত্র, কাব্যগুলিতে উল্লেখ এবং পাহাড়ের গুহায় আঁকা চিত্র কিংবা মন্দির অথবা ঐ ধরনের দেওয়াল-ভাস্কর্য ছাড়া। সেইসব লোকবাদ্যগুলি হয় চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে অথবা মুমূর্ষু অবস্থায় ধুঁকছে।বাংলার গ্রাম-গঞ্জে একটু ঘুরলেই লক্ষ্য করা যায় বংশানুক্রমিকভাবে এইসব লোকবাদ্যগুলি যাঁরা তৈরি করতেন, হয় তারা কালের নিয়মে হারিয়ে গেছেন নতুবা অন্য পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন।
বাজনদার শিল্পী বা নতুন বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা না থাকায়, নতুন বাজনাও আর তৈরি হচ্ছেনা। আর, সেইসব কারিগরেরা, যাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা ছিলই, আর এখন তারা সম্ভবত এখন কপাল চাপড়ে গাইছেন :
আরে ও কাঠোল খুটার দোতরা
তুই করলু মোকে
জনমের বাউদিয়া - - -
আধুনিক সময়ে ইলেকট্রনিক্স বাজনার দাপটে আমরা বহু বাজনার কথা প্রায় ভুলতে বসেছি। কিন্তু এও সত্য
শব্দ সংযোজন করার বাড়তি আনন্দ সিনথেসাইজারে নেই, যা আছে বাংলার লোকবাদ্যে। তাই আস্তে আস্তে লোকবাদ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে৷ এখন দোতারা, সারেঙ্গী বিক্রি হচ্ছে, যদিও এখন পর্যন্ত মূলত গানের শিক্ষক-ছাত্ররাই কিনছেন এগুলো৷
আমাদের সংস্থা ভ্রমরা (ইন্স্টিটিউট অফ ফোক-কালচার) বিগত ২০১২ সাল থেকে বাংলার পরম্পরাগত লোকবাদ্যের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে চলেছে। প্রায় ৫০ ধরনের লোকবাদ্য তাতে প্রদর্শিত হয়। উদ্দেশ্য, বাংলার মানুষকে তাদের আপন বাদ্যযন্ত্র চেনানো, তাদের নাড়ির টান অনুভব করানো।
আমাদের চেনা এক মানুষের কথা বলে শেষ করি এই নিবন্ধ।
উত্তরবঙ্গের প্রসিদ্ধ শহর শিলিগুড়ি। সেই শহরে জীবন-জীবিকা শিল্পী পরেশ রায়ের। সুখী সংসার-জীবন। আর জীবিকা? শিলিগুড়ি শহরে সাইকেল রিক্সা চালানো। নেশা- কন্ঠে নিয়ে ফেরা উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গান। রিক্সাওয়ালা হলেও, ইনি কিন্তু আকাশবাণী শিলিগুড়ি কেন্দ্রের একজন উঁচু গ্রেডের নিয়মিত ভাওয়াইয়া শিল্পী। রাজবংশী জনগোষ্ঠীর এই শিল্পীর কাছে প্রচুর ছেলেমেয়ে ভাওয়াইয়া গানের তালিমও নেন। খ্যাতনামা এই শিল্পী সারিন্দা/ দোতরা বাজিয়ে পরিবেশন করেন ভাওয়াইয়া গান।
এহেন পরেশ রায় বেশ কয়েক বছর আগে একবার কলকাতার এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সারিন্দা বাজিয়ে লোকসংগীত পরিবেশন করছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার একজন বিখ্যাত বেহালা বাদক। বেঁটে-খাটো সারিন্দা যন্ত্রটি দেখে অবাক নয়নে যন্ত্রটির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আগ্রহ প্রকাশ করলেন যন্ত্রটি নেড়েচেড়ে দেখতে। দেখলেন, মন্তব্য করলেন আমার বাংলার যন্ত্র, আমার শিকড়ের যন্ত্র, যার সাথে আমার নাড়ীর যোগ, অথচ, আমিই এই যন্ত্রটিকে চিনিনা!
শিকড়কে না চিনি তবে তো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ব!
(মে, ২০২২-এ বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইডের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘সঙ্গীত মনন’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।)
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লোকশিল্পীরা। করোনা তাদের অনেকের প্রাণ কেড়েছে, কাহিল করেছে কিন্তু বাতিল করতে পারেনি। সময় কতটা কঠিন তা আমাদের মত তুলনায় অনেক নিশ্চিন্তে থাকা মানুষজনেরা প্রতি পদেই বুঝছি। তবে গ্রামগঞ্জে যারা স্থানীয় উপকরণ, দর্শক-শ্রোতা এবং ক্রেতাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন তাদের টিঁকে থাকার লড়াইটা আরও কঠিন। অতিমারি সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে। মাটির কাছাকাছি থাকা লোকশিল্পীদের সম্পূর্ণ অনলাইন হওয়া কিংবা কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়া দুটোই অসম্ভব। কারণ জীবন তাদের জন্য সে পরিসর বরাদ্দ করেনি। তাদের কাজের ধাঁচ এবং বেঁচে থাকা দুটোই অন্যরকম। প্রত্যক্ষ সংযোগ সব লোকশিল্পেরই একটা জরুরি ভিত্তি, ছবি আঁকাই বলুন বা নাচ-গান, চারপাশে মেঘের মত মানুষ ভিড় করে না এলে সে শিল্প বাঁচে না। অ্যান্টিউসের মত সেও তো মাটির সন্তান। মাটির সংযোগ ছাড়লে সে বাঁচবে কি করে!
রোগ-বালাই মারি মন্বন্তর সবকিছুই মানুষকে তার জীবিকা থেকে বিযুক্ত করে কেড়ে নেয় লোকশিল্পীদের জীবনের ছন্দ। এই সময় তার কাছে মানুষ আসে না, মুখ ফেরায় স্বজন, কেউ জিনিস কেনে না, শিল্পের উপকরণ সংগ্রহ করাও যোগাযোগের সমস্যার কারণে কঠিন হয়ে পড়ে। এতকিছুর পরেও দেখা যায় শিল্পীরা টিঁকে আছেন। শুধু তাই নয়, দুঃসময়ের ইতিহাস, ভূগোল, অভিজ্ঞতা সবকিছুর দেখা পাওয়া যায় তাদের শিল্পকর্মে ও কাজে। মৃত্যুর চোখরাঙানি সেগুলিকে স্পর্শ করতে পারে না। বরং তা হয়ে ওঠে এক ঝরা সময়ের দলিল। লেখা-রেখা-ছড়া-গান-পাঁচালিতে জেগে থাকে একটা ধ্বস্ত সময়। দেখা যায়, মৃত্যু যঁাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, সেই লোকশিল্পই দিচ্ছে তার গতিবিধি এবং আসা যাওয়ার যাকে বলে গ্রাফিক ডেসক্রিপশন। বাংলার লোককথা, ঝুমুর গান, ভাওয়াইয়া গান, কবি গান, পটচিত্র ও পটের গান, মঙ্গলকাব্য, লোকচিত্র কলায় লোকশিল্পীরা মারি ও মন্বন্তরের ছবি ধরে রেখেছে। সবই তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। এবারেও তাই ঘটেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটে আমরা দেখা পেয়েছি করোনা দেবীর। ভাটিয়ালি আর ঝুমুর গানে উঠে এসেছে বিধ্বস্ত মানুষের যন্ত্রণা। মধুবনী শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন মুখোশে, সতর্কতা হয়ে উঠেছে শিল্পিত।
মারি ও মন্বন্তরে মানুষের দুর্দশার কথা আমরা গণ কবিয়াল রমেশ শীল, সোমনাথ হোড়ের তেভাগার ডায়েরি কিংবা চিত্তপ্রসাদের ছবিতে পাই। কে ভুলবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’? সেগুলি সবই সচেতন মানুষের বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ। সেসব কাজ তো ইতিহাসে ঢুকে গেছে। কিন্তু লোকশিল্পীদের কাজগুলি একেবারে অন্যরকম। এসব ছবি গান কিংবা শিল্পকর্ম সবই তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা। সেখানে কোথাও সে কাতর কণ্ঠে এই অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছে। এই অতিমারির জন্য দোষ দিয়েছে নিজের ভাগ্যকে, কোথাও ক্ষিপ্ত হয়ে দিয়েছে ভগবানকে অভিসম্পাত। সবসময় যে তা একটা যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ হয়েছে মোটেই নয়। কিন্তু তাতে পাওয়া যায় একটা মানুষের ব্যক্তিগত অনুভব। এই অনুভব প্রতিষ্ঠিত করে একটা সাধারণ সত্যকে। অতীতে মারি মন্বন্তরের সময় গাছে গাছে ঝুলতো বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির শিল্পীদের তৈরি করা মানত পুতুল। রোগ-ব্যাধি সহ যাবতীয় আপদ বালাই থেকে মুক্ত করার কামনায় গ্রাম্য লোকদেবদেবীদের থানে পবিত্র বৃক্ষের ডালে ঝোলানো এই মানত পুতুল এবারও দেখা গিয়েছে। জ্বর ওলাওঠা বসন্ত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ ছুটতেন শীতলার মন্দিরে। শীতলার গানে ধরা পড়েছে সেই আর্জি। গ্রামের মন্দির বা থানে মন্বন্তর পীড়িত অভাবী মানুষ দেবতার কাছ থেকে অন্ন প্রার্থনা করতেন। বাংলার লোকসাহিত্য আর গানে তার ছবি এসেছে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় অন্ন দে গো মা অন্নদা গানে আদতে ধরা পড়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের অন্নাভাবের কথা।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, বিভুতিভূষণের আরণ্যক কিংবা রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গে আমরা বসন্ত, কলেরা, প্লেগের বর্ণনা পাচ্ছি। কিন্তু সেটা অনেকটা বাইরে থেকে দেখা। আলোকপ্রাপ্ত মানুষদের প্রান্তজনেদের দুঃখের বর্ণনা। তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল নয়। কিন্তু লোকশিল্পী, লোকগায়ক কিংবা লোককবিদের বর্ণনায় মারি-মন্বন্তরের একটা অন্যরকম ছবি পাই আমরা। সেখানে সরাসরি মানুষের দুরাবস্থাকে প্রত্যক্ষ করি। চল মিনি আসাম যাব, দেশে বড় দুখ রে - ঝুমুর গানে ফুটে উঠেছে মানুষের দুঃসময়ের বর্ণনা। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের সুবাদে পুরুলিয়ার ঝুমুরিয়াদের গাওয়া এই ঝুমুর তো নিজেই একটা ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। গানে বলা হয়েছে মন্বন্তরে এক অভাবী মানুষের মেয়েকে নিয়ে দেশান্তরী হওয়ার কথা। সৃষ্টিধর মাহাতোর ঝুমুর গানে আছে ‘‘মাঘ-ফাগুন মাসে / চৈত-বৈশাকে ধুম / অন্ন বিনা মরে লোক, সৃষ্টিধর ভাবে।’
লোকশিল্পীদের সবাই মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষ। বয়স কিংবা অসুস্থতা কিংবা কোন পারিবারিক কারণে যারা কাজ করেন না তাদের সঙ্গেও বয়ে চলা জনজীবনের একটা নিবিড় যোগাযোগ থাকে। মারি মন্বন্তরের দাগ স্বাভাবিক ভাবেই পড়ে তাদের কাজ ও শিল্পকর্মে। এই ব্যাপারটা আমরা এবারের অতিমারির সময়েও দেখেছি। ২০২০-তে কোভিডের প্রথম পর্বে এপ্রিল থেকে জুন মাস ছিল গ্রামীণ শিল্পীদের কাজের মরশুম। ভক্তিগীতি, কীর্তন যাত্রা, ছৌ নাচ, ঝুমুর গান সহ বহু গ্রামীণ আসরই তখন বাতিল হয়েছে। বাউল-ফকিরি, ছৌ-পটুয়া, নাটুয়া রায়বেঁশে, পুতুল নাচ এই সব শিল্পীরাও এই সময় কোন অনুষ্ঠান পাননি। ছৌ নাচের আসর বন্ধ হওয়া মানে ছৌ মুখোশের কারিগরদের কাজ কমা। কারণ এই মুখোশ তো শুধু ঘর সাজানোর জিনিস নয়, এটা একটা লোকনাচের অপরিহার্য অঙ্গ। অনুষ্ঠান বাতিল হলে মুখোশের অর্ডারও কমবে। চাহিদার অভাবে শিল্পীরা যদি নতুন ছৌ পালা না বঁাধেন তাহলে নতুন মুখোশ তৈরির কোন প্রশ্নই নেই। ছৌ মুখোশের কারিগরদের ৪০ শতাংশ ব্যবসা কমে গিয়েছিল এই সময়ে।
শহরের থিম পুজোতে এখন বাংলার হস্তশিল্পীদের দাপট। বিভিন্ন জেলার বহু শিল্পী একাজে অংশ নেন। গোটা শীত জুড়ে চলে উৎসব, মেলা, প্রদর্শনী সহ নানা অনুষ্ঠান। এই সময় করা কাজই এখন গ্রামীণ লোকশিল্পীদের রোজগারের সবচেয়ে বড় জায়গা। এসময়ে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই পেরিয়ে বিদেশ থেকেও এখন ডাক পান পটুয়া, ছৌ নাচ, বাউল-ফকিরি গানের শিল্পীরা। চলতি বছরে অবস্থা একটু বদলালেও গত দু-বছর ধরে তাদের কাজকর্ম বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। এর কারণটা শুধু আর্থিক নয়। এর ফলে তাদের মনে আশঙ্কা জেগেছে কাজের ভবিষ্যৎ নিয়েই। নতুন স্বাভাবিকতায় এটাই সবচেয়ে অস্বাভাবিক দিক। তার কারণ এই মানুষগুলি বাঁচেন তাদের শিল্প ও পরম্পরাগুলিকে ঘিরে। সেটাই তাদের আনন্দ, গর্ব এবং জীবন। সেটা না পেলেই মুষড়ে পড়েন লোকশিল্পীরা। নিজেদের ভালবাসার জিনিসটাকে ধরেই জীবিকা গড়তে চান লোকশিল্পীরা। তা না পেলেই তারা হীনমন্যতা আর মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। কোভিড সে কাজটাই করেছে। কাজের বরাত, সুযোগ, সর্বোপরি তাদের কাজের প্রতি মানুষের মনোযোগ এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে তাদের।
সারা পৃথিবীর লোকশিল্পীদের ৬১ শতাংশ অসংগঠিত শিল্পের অংশ। এদের প্রায় ৪০ শতাংশই মহিলা। কোভিড ধাক্কা দিয়েছে তাদের জীবন ও জীবিকায়। বলা হচ্ছে অনলাইন অনুষ্ঠান ও বাণিজ্যের কথা। তত্ত্বগতভাবে হয়তো কথাটা খুব ভুলও নয়। এটাও ঘটনা কোভিডের সময়ে নদীয়া, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার লোকশিল্পীরা অনেক সফল অনলাইন অনুষ্ঠান করেছেন। সেইসব অনুষ্ঠানের দর্শক প্রতিক্রিয়া খুব ভাল। অভিজ্ঞ শিল্পীদের প্রাপ্তিযোগও মন্দ নয়। একই অভিজ্ঞতা উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের ভাটিয়ালি শিল্পীদের। গরীব গ্রামীণ শিল্পীদের এটা একটা বড় সাফল্য। পরিবেশন-প্রযুক্তি-বিষয় সবদিক থেকেই এই অনলাইন অনুষ্ঠানকে উন্নত হতে হবে, এটা শুধু কোন দুঃসময়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি নয়। বরং এর শিক্ষাটা আত্মস্থ করেই বাংলার লোকসংস্কৃতিকে আরও সফলভাবে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার রাস্তা খুঁজতে হবে। অতিমারির ধাক্কা অনেক গ্রামীণ শিল্পীকে অনলাইনে নিয়ে এসেছে। খারাপ অবস্থা কেটে গেলেও আগামী দিনে এই অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। মারি-মন্বন্তর- প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসব সঙ্গী করেই মানুষ বাঁচে। এগুলি পৃথিবী থেকে রাতারাতি বিলুপ্ত হবে এমন ভবিষ্যৎ বাণীও কেউ করছেন না। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, ধরে রাখা যায় নিজেদের ঐতিহ্যমন্ডিত পরম্পরা, পৌঁছনো যায় আরও বেশি মানুষের কাছে সেকথা ভাবতেই হবে।
অনলাইন একটা বড় অবলম্বন। বড় অবলম্বন বলতে আসর-মঞ্চ- মেলা-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে শুধু ডিজিটাল সড়ক ধরে চলা নয়। কারণ লোকশিল্প-সংস্কৃতি চরিত্রগতভাবেই প্রত্যক্ষ সংযোগের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অনলাইন হতে হবে শুধু বিপর্যয়ের সময়েই নয়, নিজেদের ভাবনা ও কাজকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাতেই বাড়বে লোকশিল্পীদের কাজের বাজার। আরও অনেক বেশি অনুষ্ঠানের ডাক আসবে নানা দেশ থেকে। সঙ্গত কারণেই তাদের আর্থিক অবস্থার চেহারাটা অনেকটা ভদ্রস্থ হবে। শুধু আর্থিক অবস্থাই ভাল হবে এমন নয়, এতে বাড়বে শিল্পীদের আত্মবিশ্বাস। এটা খুব দরকার। এটা কেমন হয় তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, কোভিড ও আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবন সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জে ৬৮ জন ভাটিয়ালি শিল্পীর বাস। লকডাউনের সময়েই তাদের অনুষ্ঠান দেখেছে ৪৫০০ মানুষ। গ্রামীণ লোকশিল্পীদের জীবনে এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এটা আমরা কেউ বুঝতে পারবো না। চিরকাল অফলাইন হয়ে থাকা বাংলার লোকশিল্পীদের এবারের কোভিড সেই শিক্ষা দিয়ে গেল।
মানুষ বাসা বাঁধে মানুষের পাশে। এই যে আমরা পাশে পাশে বাস করি অথবা আশে পাশে বাস করি তার কিছু অর্থ বুঝে কিছু না বুঝে বাস করি। পাশা পাশি বাস করি মানে ডান দিকে বাম দিকে অথবা সামনে পিছনে কাছকাছি বাস করি। আসলে পাশা পাশি বাসের আর এক অর্থ লুকিয়ে আছে। প+আ+শ+আ+প+আ+শ+ই= পরিপূর্ণ আশ্বাসে শবে-আনন্দে (শব একটি পারসি শব্দ যার অর্থ রাত) এবং পরিপূর্ণভাবে আত্মীয়তায়,শান্তিতে ইচ্ছায় বাস করা। অথবা যদি কেউ বলে আশে পাশে বাস করে তাহলেও আর একটা অর্থ আনা যেতে পারে, তা হলো - আশ্ ক’রে আশা নিয়ে যে পড়শি আমাকে ভালোবাসবে ভালো আচরণ করবে ভালো জিনিসের আদান-প্রদান করবে। সুতরাং মানুষ আশে পাশে বা পাশে পাশে বাস করে আসছে। মানুষের মধ্যে যেমন জাগরণ আসে তেমনি কিছু উপাদান আগামী প্রজন্মের জন্য সে গুছিয়ে রেখে যায়। মূলবাসী জনজাতি সমাজের মানুষের মধ্যেই রয়েছে সেই চরম সামাজিক উৎকর্ষ।
পৃথিবীতে কীভাবে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে এই নিয়ে আমাদের কাছে কতই না কাহিনি! বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে কীভাবে মানুষের ক্রমবিবর্তন ঘটেছে কোটি কোটি বছর ধরে। এসেছে জিনতত্ত্ব। শুধুমাত্র ধর্মীয় আখ্যান নির্ভর মানুষ মানতে চাননি সেসব কথা। প্রশ্ন উঠেছে, ‘বাঁদর থেকে যদি মানুষের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে বাঁদর থেকে আর কেন মানুষের জন্ম হচ্ছে না?’
পৃথিবীতে মানুষ তৈরি হয়েছে, সেই মানুষকে জান্নাতে (বেহেশত, বাগান, স্বর্গ ইত্যাদি) নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জান্নাত থেকে তাড়ানোও হয়েছে। আবার সেই মানুষই কর্ম দিয়ে ধর্মকে জয় করে জিতেছে আল্লাহ। এমন কাহিনিও আছে ইসলাম ধর্ম গ্রন্থে। আল্লাহ তাঁর এক বিখ্যাত ফেরেস্তাকে ডেকে আদেশ দিলেন আদম সৃষ্টি করার। সেই ফেরেস্তা আজাজিল আদম তৈরি করলেন পৃথিবীর মাটি দিয়ে। এ পর্যন্ত সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার সংঘাত ছিলো না। (আজাজিল আর আদমের মধ্যে)। কিন্তু মূলস্রষ্টা (আল্লাহ) বললেন ‘‘আদম স্রষ্টার চেয়ে স্রষ্টার-সৃষ্টি ‘আদম’ শ্রেষ্ঠ’’।
আজাজিল ফেরেস্তা আল্লাহর একথা মানতে রাজি ছিলো না। তার দাবি ছিলো অন্য। সে বলেছিলো আমি আগুন থেকে সৃষ্ট আর আদম মাটি থেকে। আমার চেয়ে আদম শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। তারপর সে অনেক কথা। এবং সেই অনেক কথার পরও আজাজিল ঘোষণা করলো, নৈব নৈব চ। আমি যাকে কেটে ছেঁটে তৈরি করলাম সেই আদমকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে গ্রহণ করবো না এবং তাকে শিজদাও (দুই পা দুই হাত, দুই হাঁটু, কপাল ও নাকের অগ্রভাগ মাটিতে ঠেকিয়ে আত্মনিবেদনের ইসলামী রীতি) করবো না।
এই সংঘাতের জেরে আদমের পৃথিবীতে পা দেবার আগেই তার শত্রু আজাজিলকে শয়তানে পরিণত করে পৃথিবীতে পাঠালেন আল্লাহ। এত সহজ না আদমের কু-মনটাকে সরিয়ে সুন্দর করে সাজানো। যেদিন আজাজিলকে আল্লাহ জান্নাত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেদিনই আজাজিল শপথ করেছিলো, “যার জন্য তুমি আমাকে স্বর্গ থেকে বের করে দিলে সেই আদমকে আমি একদিন তোমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবো এবং সেই আদমকেও তোমার স্বর্গে থাকতে দেবো না।”
আল্লাহও সে চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে বলেছিলেন “সে ক্ষমতা তোমাকে দিলাম তবে আদম যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে সে কাজ আদম করবে না এবং তুমি ব্যর্থ হবে।’ আজাজিল মাথা হিলিয়ে বলেছিল, চ্যালেঞ্জ রইলো।
সে যাইহোক সকলকেই স্বর্গ থেকে মাইগ্রেটেড হতে হলো। শয়তান আগে তার পরে বাবা আদম আর মা-হাওয়া এলেন এই ধরাধামে। কথায় আছে, রাজায় রাজায় লড়া্ই হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। তাই হলো। শয়তানের সঙ্গে আল্লার ঝামেলা আর মাইগ্রেটেড হলো আদম। অবশ্য আদমও ভুল করেছিলো, কিন্তু যাক সেসব কথা, কারণ আদম আর ইভ অথবা বাবা আদম আর মা হাওয়াকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে বিভিন্ন ধর্মীয় কিতাবে।
মানুষের মধ্যে বা সমস্ত ধর্মের মানুষের মধ্যে আছে মানব সৃষ্টির একটা ধর্মীয় বর্ণনা এবং পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে আছে নানান সব জল্পনা-কথা। মূলবাসী জনজাতি সমাজের মানুষের ঈশ্বর ভাবনায় আদমের বা হড়ের কীভাবে পৃথিবীতে জন্ম হলো সেই বৃত্তান্তে আমাদের চারপাশের প্রাণীজগৎ বড় জ্যান্ত।
আদিতে পৃথিবীটা ছিলো জলময়। শুধুই জল আর জল। এখানে কোনো মানুষ,গাছ পালা এবং মাটি ছিলো না। জলের মধ্যে ছিল কেবল কুমির, কাঁকড়া, বোয়াল, কেঁচো আর কচ্ছপ। এরাই বহু বছর ধরে জলের মধ্যে রাজ করতো। এদিকে মারাংবুরু (ভগবান) একটি অদৃশ্য রেখা বা সুতো ধরে ঝুলতে ঝুলতে জলে নামতেন স্নানের জন্য। স্নান সেরে মারাংবুরু আবার সেই সুতো ধরে ধরে উপরে উঠে যেতেন। কোটি কোটী বছর ধরে এই ভাবে স্নান সারতেন মারাংবুরু। একদিন তাঁর শরীর থেকে অনেক ময়লা বের হলো। তখন তিনি নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখলেন এতো ময়লা আমি রাখি কোথায়? কিছুক্ষণ ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমি এই ময়লা দিয়ে দুটো পাখি তৈরি করবো। যেই ভাবা অমনি কাজ শুরু করে দিলেন। পাখি দুটি তৈরি করার পর তিনি তাদের নাম দিলেন শরলি চেঁড়ে এবং পালি চেঁড়ে। (হাঁস আর হাঁসি। এঁরা, এই সমাজের মানুষ বলেন, ‘গেডে’ )। যেই পাখি দুটিকে হাতের মধ্য থেকে বের করলেন, অমনি গেলো ফুড়ুৎ করে উড়ে। উড়তে থাকলো আকাশ জুড়ে এবং উড়তেই থাকলো। এক সময় বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়লো । কোথাও বসায় জায়গা পেলো না। যেদিকে তাকায় শুধু জল আর জল।পাখিদুটি আবেদন জানালো মারাংবুরুকে, এত বড়ো আকাশ, নিচেও এত বড়ো জায়গা কিন্তু জল আর জল, আমরা খুব ক্লান্ত, বসবো কোথায়?
মারাংবুরু একদিন একটি ঘোড়াকে পাঠালেন পৃথিবীতে জলপান করার জন্য। ঘোড়া নেমে এলো আকাশ থেকে এবং সেই ঘোড়া জল পান করলো। এদিকে জল পান করার সময়ে ঘোড়ার মুখ থেকে অনেক ফেনা বের হয়ে এলো আর সেই ফেনা জলে ভাসতে থাকলো। মারাংবুরু শরলি চেঁড়ে এবং পালি চেঁড়েকে ডেকে বললেন, ওই দেখো জলের মধ্যে ফেনা ভাসছে। তোমরা তার মধ্যে গিয়ে বসো। শরলি চেঁড়ে আর পালি চেঁড়ে সেই ফেনার চারিদিকে উড়ে বেড়ায়, তাদের ডানার হাওয়ায় তখন সেই ফেনা হয়েছে নৌকাকৃতি। পাখিরা বসার জায়গা পেলো এবং বসলো। পাখি দুটি বসার পরে বড়ো ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ঘুমালো। ঘুম থেকে উঠে তারা ফেনার চারিদিকে ঘুরতে থাকলো কারণ তারা খুবই ক্ষুধা অনুভব করলো কিন্তু কোথাও খাবার পেলো না। তখন আবার তারা মারাংবুরুকে আবেদন করে বললো, মারাংবুরু আমরা এই ফেনার চারিদিকে কেবল উড়ে বেড়াচ্ছি কিন্তু কোনো খাবার দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের যে বড়ো ক্ষুধা। খাবার কোথায় পাবো?
মারাংবুরু এই আবেদন শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলেন, ভাবতে থাকলেন আরে এই পাখিদুটি খেতে না পেলে মারা যাবে। তাহলে তাদেরকে বাঁচানো যাবে কি করে? অনেক ভেবে মারাংবুরু জলের নিচে থেকে কুমিরকে ডাকলেন। ডাক শুনে কুমির তড়িঘড়ি মারাংবুরুর কাছে হাজির। করজোড়ে জানতে চাইলো, তাকে কেন ডাকা হয়েছে?
মারাংবুরু বললেন জলের তলা থেকে মাটি কি জলের উপরে আনতে পারবে? কুমির বললো, আপনি যখন আদেশ করেছেন তখন নিশ্চয়ই পারবো, চেষ্টা করে তো দেখি। কুমির মাটি আনতে জলের গভীরে প্রবেশ করলো। জলের তলদেশে গিয়ে কামড় দিয়ে মাটির চাঁই মুখের গহ্বরে রেখে জলের উপরে আসতে থাকলে জলের ঢেউয়ে সে মাটি সবই গলে বেরিয়ে গেলো। একটি কাঁকর বা বালিও কুমির আনতে পারলো না।
মারাংবুরু এবারে কাঁকড়াকে ডাক দিলেন। কাঁকড়া হাজিরা দিয়ে বললো, মারাংবুরু আমাকে ডেকেছেন? মারাংবুরু বললেন, হ্যাঁ।
মারাংবুরু বললেন - জলের তলে গিয়ে মাটি আনতে হবে। সে কাজ কি তুমি করতে পারবে?
কাঁকড়া - নিশ্চয়ই পারবো আপনি যখন বলেছেন তখন চেষ্টা করে তো দেখি।
কাঁকড়া চলে গেলো জলের তলে এবং সে তার দুই দাঁড়া দিয়ে শক্ত করে মাটিকে খামচিয়ে তুলে নিলো। এর পর উপরে যাবার পালা। কিন্তু কি সর্বনাশ এতো সম্ভব হচ্ছে না,মাটি জলের তল থেকে উপরে আনতে আনতে সব গলে জলে চলে গেলো।
এবার মারাংবুরু ডাক দিলেন বোয়াল মাছকে।বোয়াল এসে তার শুঁড় দুটো নিচে ঝুলিয়ে জানতে চাইলো তাকে কি করতে হবে?
মারাংবুরু সেই একই কথা বললেন, জলের তল থেকে মাটি আনত হবে, সেকাজ কি সে করতে পারবে? বোয়াল একথা শুনে জানালো এতো ছোটো একটা কাজ এখনই করছি। বলেই সে লাফিয়ে জলের তলে চলে গেলো। বোয়াল তার মুখের যতটা ফাঁক হয় সবটা ফাঁক করে মাটিতে কামড় মারলো মুখভরতি মাটি। কিন্তু সে মাটি উপরে আনতে আনতে কানকো দিয়ে সব বেরিয়ে গেলো।
মারাংবুরু এবার ডাক দিলেন কেঁচোকে। কেঁচো এলে তাকে বলা হলো জলের তলে মাটি আছে, আনতে হবে। পাখিদের খাবার নেই সেখান থেকে খাবার পাওয়া যাবে। সুতরাং তুমি মাটি নিয়ে এসো।
কেঁচো কিচ্ছুক্ষণ চুপ থেকে বলে আমি মাটি আনত পারবো কিন্তু সাহায্য করার জন্য কচ্ছপকে চায়। মারাংবুরু সঙ্গে সঙ্গে কচ্ছপকে ডেকে পাঠালে কচ্ছপ এলো।
কচ্ছপ জানতে চাইলো তাকে কেন ডাকা হয়েছে।
মারাংবুরু বললেন জলের তল থেকে মাটি আনতে হবে, পারবে?
কেঁচো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, জলের তলে না মারাংবুরু, আমি যাবো জলের তলে আর ওকে থাকতে হবে জলের উপরে। তবে মাটি আনতে পারবো।
মারাংবুরু কচ্ছপকে বললেন, শুনলে তো। তোমাকে জলের উপরে থাকতে হবে,পারবে তো?
কচ্ছপ বললো আপনি যখন বলছে তখন থাকবো। ব্যাস এবারে কচ্ছপ জলের উপরে যেই নেমেছে অমনি মারাংবুরু কচ্ছপের চার হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে দিলেন।এবারে কেঁচো তার মুখটাকে জলের তলে নিয়ে গেলো। মাটি উঠিয়ে সে মাটি কচ্ছপের পিঠে গিয়ে জমা হতে থাকলো। মাটি জমতে জমতে পাহাড়। কচ্ছপ পালাতে পারছে না। মাটির পাহাড় মারাংবুরু সমান করে দিলেন। কিছু দিনের মধ্যে মাটিতে ঘাস বেরিয়ে গেলো, বেরিয়ে এলো মহুয়া,পলাশ,শাল করঞ্জগাছ। শুধু তাই না এই সঙ্গে বেরিয়ে এলো আরো নাম না জানা কতগাছ এবং তৈরি হলো জঙ্গল পাহাড় নদী।
এই যে অসংখ্য গাছ ঘাস জন্মালো তাদের মধ্য কুঁচি জাতীয় কিছু ঘাস জন্মালো। যাদের বলা হয় সিরোমদান্দিরে। শক্ত ঘাসের কাঠি জোগাড় করে সেই পাখি দুটো এই সিরোমদান্দিরে গাছে বাসা বাঁধলো। ঘাসের ভেতরে যতো ঘাসপোকা ছিলো সেগুলো খেলো এবং এই পাখি দুটো তাদের এই জীবনে যে কটা দিন পাবো এই ভেবে পেয়ার মহব্বতে থাকতে থাকতে দুটো ডিম পাড়লো। স্ত্রী পাখিটা বাসায় থেকে ডিমে তা দেয় এবং পুরুষ পাখিটা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে আনে। মাঝে মাঝে স্ত্রী পাখিটি তার ডানা ঝাপ্টানোর জন্য আকাশে উড়তে যায় আর এর ফাঁকে কিছু খাবার খেয়ে আসে এবং নিয়েও আসে তার বন্ধুটির জন্য, সেই সময় পুরুষ পাখি ডিমে তা দেয়।
এই ভাবে কয়েক বছর তা দিতে লাগলো।তাছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। কেবল এই ডিমে উষ্ণতা দেওয়া। পুরুষ পাখিটা কম সময় থাকে তার কারণ, তার পালকের সংখ্যা একটু বেশি, সে যদি ডিমে তা দেয় তাহলে ডিম গরম বেশি পেয়ে নষ্ট হতে পারে। তাই স্ত্রী পাখিটি তার নরম পালকের ভিতরে রেখে বসে বসে ডিমে তা দেয়। এক সময় তারা কথা বলে ,হ্যাঁগো আমাদের জন্য মারাংবুরু এতো কিছু করলো কেনে? স্ত্রী পাখিটি বলে, হবে আমাদেরকে তো তার গায়ের ময়লা থেকে বানিয়েছে, তাই খানিক দরদ আছে। পুরুষ পাখি জানায়, উদিকে তো সেই কেঁচোটো মাটি তুলেই যাচ্ছে তুলেই যাচ্ছে আর বেচারা কচ্ছপের চার হাতপা মারাংবুরু শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে দিলো সে তো আর পালাতে পারবে না! স্ত্রী পাখি বলে, তিনি মারাংবুরু, তিনি সবার ভালোর লেগেই করেছেন,আমাদের এতো বলার কিছু নাই। পুরুষ পাখি বলে হুম, তাই তো।
স্ত্রী পাখি একদিন খুশিতে বলে উঠলো, হ্যাঁগো আমাদের ডিম থেকে মনে হচ্ছে কিছু বেরোলো। ডিমের খুলি ফেটে গেলো। দুজনেই দেখে, ঝাপটা-ঝাপটি করে দেখে। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে একজন আর একজনের দিকে। সেকি! এতো আমাদের মতো দেখতে না! এরা তো কেমন কেমন দেখতে! এরা তো হড় হড় হড়।
এদিকে মারাংবুরুর কাছে খবর গেলে মারাংবুরু এসে দেখেন সবকিছু। হ্যাঁ, তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন সেইরকমই দেখতে হয়েছে। চাঁদের মতো গোল মাথা, চ্যাপ্টা এইবড়ো মুখ। নাকের ফুটো আছে, মুখের একটা ফুটো, কানের দুটো। মনে হচ্ছে নরম মাড়ির লয়। কিছু গড়বেন বলে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, কিন্তু গড়া আর গড়া হয়নি কেবল শুরু করেছিলেন যেন। এবার বড় করে গড়ে তোলার পালা। কিন্তু পাখিরা তো আর বড় করতে পারবে না। তাই তিনি নিজের হাতে কাপাস গাছ থেকে তুলো তুলে এনে জলে ভিজিয়ে ওই হড় দুটোর মুখে ভরে দিলো এবং এই তুলো চুষে চুষে হড় দুটো বড়ো হতে থাকলো।মারাংবুরু এই হড় দুটোর নাম রাখলেন পিলচুহাড়াম আর পিলচুবুড়হি।
এই পিলচুহাড়াম পৃথিবীর প্রথম পুরুষ এবং পিলচুবুড়হি পৃথিবীর প্রথম নারী। তারা বড় হচ্ছিলো, এমন সময়ে লিটৌ নামে একজন এলো। লিটৌ তাদের জিঞ্জাসা করলো - তোমরা কেমন আছো? আমাকে কি চিনতে পারছো?
পিলচাহাড়াম পিলচাবুড়হি বলল – না আমরা কাউকেই চিনি না।
লিটৌ বললো, আরে আমি তোমাদের দাদু (লিটৌ মানে দাদু)।
তার পরে লিটৌ বলল- চলো আমার সঙ্গে জঙ্গলে।ওরা গেলো এবং লিটৌ শিকড় চিনিয়ে দিলো আর কিছু শিকড় তুলে এনে পিলচুবুড়িকে বললো বাটতে। পিলচুবুড়হি শিলে শিকড় বাটলো এবং লিটৌ ময়দার মতো কি এনে দিয়ে সেই শিকড় বাটাগুলোকে ভালো করে মিশিয়ে দিলো আর সেগুলোকে রোদে শুকিয়ে নিলো এবং বললো এগুলোর নাম ‘বাখল’। এর পরে লিটৌ সুমতু, বুকুচ আর সামা ঘাসের বীজ তুলে আনলো আর জড়ো করলো। তার পরে সেই বীজের খোসা ছাড়িয়ে চালের মতো করলো। লিটৌ পিলচুবুড়হিকে বললো রাঁধো। পিলচুবুড়হি রাঁধলো। সেই সুতুম, বুকুচ আর সামা ঘাস বীজ রান্না হলে তাতে সেই বাখল মিশিয়ে দিলো এবং পাঁচদিন ধরে রেখে দিলো। তারপরে সেই রান্নাকরা জিনিসগুলো পচে তৈরি হলো মদ। এবার লিটৌ বললো শাল পাতা তুলে আনো। লিটৌ চিনিয়ে দিলো শাল পাতা আর সেই শাল পাতা দিয়ে ঠোঙা তৈরি করতে শেখালো, বললো তিনটে ঠোঙা তৈরি করো। এবং একটা ঠোঙাতে সবার আগে মদ ঢালো ও মারাংবুরুর নামে উৎসর্গ করো। আর পরের দুটোতে দুই ঠোঙা মদ ঢালো। এবার বললো মারাংবুরুর নাম নিয়ে খাও।
পিলচুহাড়াম এবং পিলচুবুড়হি দুজনেই খুব মদ খেলো এবং তাদের খুব নিশা হয়ে গেলো।এই সব করতে করতে সূর্য ডুবে গেলে লিটৌ চলে গেলো। পিলচুহাড়াম আর পিলচুবুড়হি দুজনে একই বাসায় ঘুমিয়ে গেলো এবং তারা আনন্দ করতে থাকলো। ভোরবেলায় তাদের ঘুম ভেঙে গেলো, চোখ মেলে দেখে মারাংবুরু এসেছেন আর জিজ্ঞাসা করছেন, মদ খেয়ে কেমন লাগল তোমাদের? ঘর থেকে বেরিয়ে এসো।
পিলচুহাড়াম আর পিলচুবুড়হি বলে - আমরা কি করে বাইরে আসবো? আমরা যে উলঙ্গ আছি।
মারাংবুরু বললেন তোমাদের ঘরের পিছনেই শালপাতা আছে, সেগুলো সেলাই করো আর ওগুলো পরো। তারপর থেকে পিলচুহাড়াম আর পিলচুবুড়হি শালপাতা সেলাই করে পরতে শিখলো।
এই ভাবে থাকতে থাকতে তাদের সাত ছেলে আর সাত মেয়ের জন্ম হলো। তারাও আস্তে আস্তে বড়ো হতে থাকলো।একদিন পিলচু হাড়াম তার সাত পুত্রদের নিয়ে জঙ্গলে শিকার শেখাতে নিয়ে গেলো। এদিকে পিলচুবুড়হি তার সাতকন্যাদের নিয়ে জঙ্গলে শাক তুলতে আর সেই সুমতু, বুকুচ, আর সামা ঘাসের বীজ কোথায় থাকে সেগুলো চেনাতে নিয়ে গেলো। অনেক দিন কেউ কাউকে খুঁজে পেলো না জঙ্গলে, কে কোথায় হারিয়ে গেলো। তারপর একদিন এক বটগাছের তলায় সবাই এসে হাজির হয়েছে আর তখনই সকলেই সকলকে খুঁজে পেলো। তখন সবাই বড় হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারে না কেবল পিলচুহাড়াম আর পিলচুবুড়হি ছাড়া। তাদের মধ্যে আলাপ পরিচয় হলো। মারাংকুড়া এবং মারাংকুড়িয়ে (মানে বড়ো ছেলে আর বড়ো মেয়ে) ওদের মুনামুনি হলো, মানে পছন্দ হলো আর এদিকে হুডিঞকুড়া এবং হুডিঞকুড়িয়ে (ছোটো ছেলে ছোটো মেয়ের) মুনামুনি হলো, মানে বেছে নিলো। এই ভাবে বাকিদেরও মুনামুনি হলো।
এর পরে পিলচুবুড়হি আর পিলচুবুড়হা আলোচনা করতে থাকলো যে আমরা সাতটা ছেলে আর সাতটা মেয়ের বিয়ে দিলাম এবং সাতটা দলে এবারে ভাগ করে দিতে হবে। আর এই ভাগগুলোর নাম দিতে হবে। তারা খুব ভেবে ভেবে সাতটা দলের নাম দিলো যথাক্রমে বড়ো ছেলের হাঁসদা; মেজোর মুরমু; সেজো ছেলের কিস্কু; তারপরের ছেলের পদবী দিলো হেমব্রম; তারপর মারান্ডি; সরেন; একেবারে ক্ষুদের দলটার নাম দিলো টুডু। এই ভাবে সাতটা ভাগে ভাগ হলো এবং তারপর থেকে সবাই ্নিজের নিজের পদবী ব্যবহার করতে থাকলো। এছাড়াও আরও দুটো ভাগ আছে যাদের বলা হলো বেসরা এবং বাস্কী। এই ভাগের ফলে মানব সমাজের জন্য বিবাহ বা বাপলা দিতে সুবিধা হবে। আদিবাসী সমাজে পদবী যদি একই হয় তাহলে বিয়ে বা বাপলা হবে না। তাই হাঁসদার সঙ্গে সরেন হতে পারে বা মুরমুর সঙ্গে বেসরা হতে পারে এমনি করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাপলা হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে প্রথম মানব সৃষ্টির গল্প বা কাহিনী অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে কোথাও না কোথাও মিল আছে। আর এই আদিবাসী সমাজের প্রথম মানব সৃষ্টির গল্প বড়ই বাস্তব অন্তত পক্ষে খাবার জোগাড় এবং পোশাকে আর বিবাহে। এই যে জঙ্গল, কেঁচো সেই শরালিচেঁড়ে আর পালিচেঁড়ে - পিলচুহাড়াম পিলচুবুড়হি, সুমতু বুকুচ আর সামা আর সেই লিটৌ সবই যেন পটে সাজানো। প্রথম পৃথিবী জেগে উঠলো অপূর্ব সূর্যের বিচ্ছুরণে। এই হলো আদিবাসী সমাজের প্রথম মানুষের সন্ধান বা ভাবনা।
***
তখন বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকে কাজ করি। গ্রাম পঞ্চায়েত, শালডিহা। সেখানে ন’টা গ্রামের সাতটাই মূলবাসী জনজাতির মানুষজনের গ্রাম। আমাদের কথায় আদিবাসী গ্রাম। আমার অফিস ছিল রামপুর গ্রামে। গোদাতোড় নামে একটা গ্রামেও আমাকে যেতে হ’ত। সবই আদিবাসী প্রধান গ্রাম। এই আদিবাসী মানুষজনের একটা বড় অংশই পেটের টানে বছরে তিনবার মাইগ্রেটেড হতেন। যার ফলে তেমন করে কাউকে গ্রামে পেতাম না। যারা থাকতো তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ বয়স্ক এবং কিশোর। কিশোরদের বয়স আট থেকে এগার বছর। সুশান্তর মা আমাকে নানা ভাবে সঙ্গ দিত।
গোদাতোড় গ্রামে যেতাম দুপুরে। ওই গ্রামের সুকুমুনি বেসরা আমাকে তেমনই বলে দিয়েছিল। রামপুর থেকে পশ্চিমে যেতে যেতে কয়েকটা বড় পুকুর পড়ে। সেই পুকুরের পাড়ে বেশির ভাগ তেঁতুল আর বাঁশ গাছ। গোদাতোড় গ্রামে গিয়ে মেয়েদের খুঁজে বেড়াতাম। এই গ্রামগুলোর পথঘাট বেশিরভাগ পলাশ এবং পলাশের ছোটগাছে ঢাকা। রাস্তা জুড়ে ছাগল ভেড়া শুয়ে থাকতো, কারো কারো ঘরের প্রাচীরে চালা নামিয়ে মোষ বলদ গরু বেঁধে রাখতো। জঙ্গলের ছায়ায় থাকত শুকরের দল তাদের ছানাপোনা নিয়ে। দুচারটে বুনোমুরগি আর হাঁসেদের আসা-যাওয়া লেগেই থাকে।
সেই গ্রামে কালিপদ বাস্কে নামে এক মানুষ ছিলেন। তাঁর বাড়ির উঠোন প্রায় একবিঘা হবে। সেখানে ছাগল গরু হাঁস মুরগির বাস। কালিপদ কোনো এক ব্যাঙ্কে চাকরি করেন তাই তাকে সহজে পাওয়া যেতো না। রাতেই পাওয়া যেতো। এদিকে গ্রামের মানুষ সারা দিন বাইরে কাজে যায় তাই মিটিং বা আলোচনা করতে গেলে আমাকেও রাতেই যেতে হতো কোনো কোনো দিন। কালিপদ তার উঠোন বারান্দা ছেড়ে দিয়েছিলো কাজ করার জন্য।এখানেই হতো চাষিদের জমি, সেচব্যবস্থা, বীজ আর গোবর সারের যোগান বাড়ানো নিয়ে আলোচনা। আলোচনা করতে করতে রাত হয়ে যেতো।
আমি আমার রামপুর অফিসের ঘরে ফিরবো। গোদাতোড় থেকে রামপুরের দূরত্ব খুব বেশি না, তবুও একটু দূর আর মাঝে কোনো ঘর নেই। কালিপদ আমাকে খুব ভয় দেখাত ভূতের। কারণ মাঠের মাঝে যে বিশাল পুকুর পেরিয়ে আমি আসি, সেই পুকুরেই নাকি এলাকার অনেক মানুষ মারা গেছেন। তাদের সবাইকেই নাকি নিশি ডেকে নিয়ে যায় আর সেই তেঁতুল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। আমি সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে কালির দিকে তাকিয়ে থাকলে কালি হা হা হা করে হাসে।
কালির বৌ খুব ভদ্র। সে বলতো চল আমি তুখে এগিয়ে দিয়ে আসি। এই ভাবেই চলতো। গোদাতোড়ের মেয়েদের সঙ্গে মিটিং হতো মাশরুম চাষ আর বাঁশ লাগানো নিয়ে। কখনো কখনো শুয়োর চাষ নিয়েও আলোচনা হতো। ওরা আমাকে শেখাতো সাঁওতালি গান। সেই গান শুরু হতো নিচের স্কেল থেকে আর মাঝে ছেড়ে দিয়ে বহুদূর তাদের পাঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো, তারপর আবার ধরতো সেই গানের রেশ।আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম গান শেষ হয়ে গেছে তাই হাততালি দিয়ে ফেলতাম। মেয়েরা কিছু বলতো না। তারা যখন আবার গান ধরে ফেলতো তখন নিজের বোকামির জন্য লজ্জা পেতাম। সেই সময় তারা শিখিয়েছিলো যে গানগুলো তার কয়েকটি এখানে দিলাম – এই জন্যই যে প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রকৃতি থেকে কিছু নিতে তাদের যে লজ্জা এবং কৃতজ্ঞতা এইটুকু বোঝানোর জন্যে। আর খানিকটা আমাদের নিজেদের লজ্জা নেওয়ার জন্যে।
আদিবাসী গানের বেশ কয়েকটি ভাগ আছে – ধর্মের নাকি প্রকৃতির বোঝা যায় না।ধর্ম আর প্রকৃতি একাকার হয়ে আছে। আদিবাসী সমাজে বার মাসে বেশ কয়েকটি পার্বণ, শরহায়, ছোটোবাঁধনা, দাশায়, বাহা। করম পুজোও হয় আবার চড়ক পুজোও করতে দেখি। গানের কথায় সুরে, প্রকৃতি, পশু, পাখি, কীট, পতঙ্গদের বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা।
১
সূঁচ কিদায়ঞ ডাডি-কিদাঞ সরবনখা নাড়ি ঢিপোর্যে
হেলকাওয়াতে দাদোঃ লৌঁওয়া
হেলকাওয়াতে দাদোঃ লৌঁওয়া
দাদোঃ বডেএঞ-
জ্যাঙ্গে জ্যাঙ্গে এদেলবাহা
মহোসদোঃ বাঃনুয়া
জানুমিনা কিয়া বাহা জানু মিনা কিয়া বাহা
সৌদা মিনাআঃ
বাংলা সুবর্ণরেখা নদীর জল নিতে গেলে
বালি সরিয়ে সরিয়ে জলের ঝর্ণা আনতে হয়
এই বালি থেকে ঝরে আসা জল
হিলিয়ে দিলে জল কাদাগোলা হয়ে যায়
তাই এই জল কলসিতে ভরতে হলে
ধীরে ধীরে জল তুলে নিতে হবে
ঝাঁকে ঝাঁকে পলাশ শিমুল ফোটে
সকলেই দেখতে পায়
কিন্তু তাদের সুগন্ধ নেই
অথচ কাঁটায় ঘেরা কেয়া ফুল কোথায় ফোটে
কেউ তেমন করে দেখতে পায় না
কিন্তু সুগন্ধ নাকে এসে লাগে।
২
রাজ বাহা তুয়া বাহা
ওকারিলাং
রহো আনা দায়
আড়ি বাড়ি বাঁধ আড়ি রে!
যখুন ইঞবাবা ইঞ-গ
কিংগজোয়া
তখুন নিওবাহা বাবা আর গ
মিতাকিনৌঞ
তখুনই গেতআ
রাজ বাহা তুয়া বাহা।
পদ্মফুল এবং শালুকফুল
তুলে এনেছি দিদি
বলো কোথায় লাগাবো
দিদি বলছে- বাড়ির পাশে বাদাড়ের পাশে
যে পুকুরগুলো আছে
সেখানেই লাগাও
যখন আমাদের বাবা মা থাকবে না
তখন আমরা এই ফুলগুলোকে
বাবা মা ভাববো আর কাঁদবো।
৩
বুরুরে সিং অড়া পালুএনা
গ-ববা হুকিঞ লাঙ্গাএনা
হড় হলাং হহো আকু
পাজ্জি হো লাং ঞেল ইচুয়
গ-ববা হোলাং দুলৌড়কিনা
পাহাড়ে একটা শাক বুড়িয়ে গেলো
কিন্তু পাহাড় ধরে রেখেছে
সেই ভাবে আমাদের মা বাবারা আস্তে আস্তে
বুড়ো হয়ে যাবে
আমরাও আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া
মা বাবাদের ভালবাসবো
৪
আলে ঝটকারে জানুমদারি
দৌন আতেদো প্রিয়ো আলুম রাহাআ
আলে রেন গুতি কুড়া আড়ি গি ঠোক আ
শাতি লাতার খয় টুটি ঞিয়া।
আমাদের উঠোনে একটা কুল গাছ আছে
সেখানে একটা পাখি ডাকছিলো
আমাদের একটা বাগাল আছে
সে খুব রাগি
ঘরের পিছন থেকে
গুলতি দিয়ে তাকে মারে।
৫
আলে ঝটকারে জানুমদারি
কিড়-বিড়বিড়-কিবিড়
বিং এ টুডোংকানা
দেসে তালা দাদা কিড়বিড় বিড়কিবিড়
বাবের নৌতে আগু ঔ মে
কিড়-বিড়বিড়-কিবিড় বিং
ইং পাসি ইয়া
আমাদের আঙিনাতে একটা কুলগাছ আছে
সেই গাছে একটা সাপ হিলে দুলে উঠছে
দাদা একটো দড়ি নিয়ে আয়
সাপটাকে বেঁধে রাখি তবে।
৬
কুলহি মুচোত জোড়াবাঁধ
বাহিড় হুড়ু দারি এনা দাদা
হুড়ু দৌয় না বালাং গেদ আ
হাঁসা হাঁসি চেঁড়ে দৌয় নাকি তুকো আকাদা
হুড়ু দৌয় নালাংগেদ আ
তুকো দৌয় না বালাং
সবুজ লুতি সুতোম তিকিং তুকো আকাদা।
রাস্তার মোড়ে এক বাঁধ আছে
সেখানে ধান গাছ বড়ো হলো
সেখানেই হাঁসা হাঁসি বাসা বেঁধেছে
আমরা ধান কেটে নেবো
কিন্তু ওই পাখির বাসাটা কাটবো না
কারণ তারা সবুজ সুতো দিয়ে বাসা বেঁধেছে।
৭
কুলহিরে ঝিঙেনাড়ি বাড়্গিরে ঝিঙে নাড়ি
গৌই দাদা ঝালি আকানা
গৌই দাদা আলুম দালে ঝিঙে নাড়ি গেতমে
মিহু দাদা জনমে টুয়োর
মাঝ রাস্তায় ঝিঙের লতা
ঘরের পিছনে ঝিঙের লতা
সেখানে গরুবাছুর লতাতে জড়িয়ে গেছে
গাই গরুকে মেরোনা দাদা বাছুরটা তো অনাথ হয়ে যাবে।
৮
মারাং বরু চটরে মনরে গাডালেকা
কিদিন বাহা
মনে মনে তদৌ দিসো মেঞা
কিদিন বাহা
তিরী পুরুষ লিকা উই হর মিয়াঁ
পাহাড়ের উপরে একটা মনের মতো ফুল ফুটে আছে
মনে মনে ফুলটা মনে পড়ে
আর চিন্তা লাগে।
৯
এ দাদা মারাং দাদা আডি ল্যাবেড় কাঁথা
গুডু নাচ নিও পুসি মোদে রিও
মেরোমকুড়ি তুরুকড় বাপলা
আলেরেন বান্ডিসেতা রায়বার দিলাত
এ দাদা মারাং দাদা।
দাদা এ বড়দা একোটা মজার কথা শোন
ইঁদুর নাচছে বাঁদর মাদল বাজাচ্ছে
ছাগলের মেয়ে এবং শিয়ালের ছেলের বিয়ে হচ্ছে
ঘটকালি করেছে বেঁড়ে কুকর
১০
হড়রেন গ,বাবা দো জাড়ি লবয়
ইঞ রেন বানু কুউয়া
দুঃক্ষু পুকুরিরে দুলুকা দুঃখ দিয়ো কাতে
বাহা সীতা আঃ।
সবার বাবা মা আছে আমার বাবা মা নেই
আমার মনে খুব দুঃখ হয় আর দুখটা ভুলে
রাখি আমি ফুল তুলতে যায়।
১১
মারাং বুরু কু কুড়কি কিদা
সানাম দারিসাকাম ঞুর চাবা এনা
চেঁড়ে দুকুরা কিদা দারি হিরল
ধারতি মানেওয়া চাঁদু হিরল।
জঙ্গলের গাছ পালা সব কেটে দিয়েছে
গাছেদের সব পাতা ঝরে গেলো
তাই সব পাখিরা কান্নাকাটি করছে
আর মানুষেরা ভগবানের উপরে
নির্ভর করে বেঁচে আছে।
গানের সাঁওতালি হলো সিরিঞ। এই সিরিঞগুলো বিশেষভাবেই আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে। মূলবাসী জনজাতির মানুষ কখনোই প্রকৃতি থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারেনি। তাদের হড় সৃষ্টির কাহিনিতেই বলা হয়েছে শারলি আর পালির গর্ভ থেকেই তাদের জন্ম। জন্মের গল্পে, কোনো লিঙ্গ বৈষম্য বা পক্ষপাতিত্ব নেই। পুরুষের জন্ম স্বয়ং ঈশ্বরের হাতে আর নারীর জন্ম অন্য কোনোভাবে, এমন কিন্তু নয়। পুরুষ ও নারী সমানে সমান বা বলা যেতে পারে সমান এবং সমানতায় তারা জীবিকা যাপন করে আসছে।
প্রথম গানে অনাবিল এক সৌন্দর্য বোধ। জলের সঙ্গে মিতালি, বালির সঙ্গে বন্ধুত্ব আর গাছদের সঙ্গে ভালোবাসা। লুকানো জিনিসের সুগন্ধ আর প্রকাশিত জিনিস যা কেবল প্রদর্শন সেই বোধটাকে গানে গানে সমাজের স্তরে স্তরে মাখিয়ে রাখেন তাঁরা। অভিজ্ঞতাকে গানের মধ্য দিয়ে একটি পানীয় বা শরবৎ বানিয়ে রেখেছেন, যা কিনা আগামী প্রজন্মের জন্যে স্যালাইন। যেমন চমৎকার কথা, তেমনই চমৎকার শব্দের ব্যবহার।
আদিবাসী মানুষেরা সেই আদিমকাল থেকে নদী থেকেই সংগ্রহ করে আসছেন খাবার জল। অবশ্য শুধু আদিবাসী কেন, সম্প্রদায়ের মানুষজন তখন তো আর শতধারায় বিভক্ত ছিলো না। সকলেই দূর থেকে, নদী থেকেই খাবার জল আনতেন। পুকুর থেকেও সংগ্রহ করা হ’ত কিন্তু মানুষ যত আধুনিক হয়েছে ততই অলস হয়েছেন। অত্যাচারী হয়েছেন তাই দখলদারিও বেড়েছে। সেই দখলদারিকে সরকার মদত দিয়ে এসেছে। সুতরাং যারা মেহনত দিয়ে সৃজন করতে পারেন তাঁরা আর লড়াইয়ে যাননি। আর এই মানুষগুলোর অধিকাংশই হচ্ছেন আদিবাসী মানুষজন। তারা জানেন, বিশ্বাস করেন প্রকৃতি তো মাতা। মায়ের হাতে খাবারের হাঁড়ি দিয়ে সকলেই নিশ্চিত যে তিনি সকলের পাতেই খাবার দেবেন।
পেটুক সন্তানের পাত থেকে খাবার কি করে কেটে রাখতে হয় মা জানেন, প্রকৃতি থেকেই এই পাঠ নিয়েছেন মা। প্রকৃতি যেমন জানে সব হারিয়ে যাচ্ছে তাই এই হারাতে বসা কিছু কিছু সম্পদ সে লুকিয়ে রাখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে, বাঁচিয়ে রাখেন আরো কিছু কাল। তাই এই প্রকৃতি এবং সন্তানেরা জানে বালি শুকনো দেখালেও, জমাট বালি কি করে যেন বাতাস থেকে বায়ু ধরে জল তৈরি করতে পারে। এক লরি বালি যখন সামনে দিয়ে চলে যায় তখন দেখা যায় লরিটি যেন এক খণ্ড মেঘ সারাক্ষণ বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে চলে যাচ্ছে। জল চুরি হয়ে যায় এই বালি মাফিয়াদের কাছে। আদিবাসী মানুষ তাই বালিকে পরতে পরতে সরাতে বলেছে. বালির গা বেয়ে নেমে আসবে জলের ধারা। এই ধারাকে যেন না হয় ভাঙা, না দেয় নড়িয়ে। নড়িয়ে দিলে জল ঘোলা হয়ে যাবে। দেখছো না কত এদেলবাহা শিমুলফুল ফুটে থাকা সকলেরই চোখে পড়ে কিন্তু তার কি কোনো সুগন্ধ আছে? মোটেও নেই। সুগন্ধি অতি দুর্লভ কাঁটায় ঘেরা, হাতে পাওয়া বড়োই দুষ্কর, সেই কেয়াফুল গাছেই থাকে, তার সুগন্ধ নাকে এসে লাগে, আহা মহোসদো মিনাআ। আহা কি সুন্দর তার সুগন্ধ বাতাসে ভাসে, ঘ্রাণে তার পরশ।
দ্বিতীয় গানে ভারি সুন্দর এক অনুভূতি। প্রকৃতি আর আপন ভাবনার আধারের। পদ্মফুল শালুক ফুল তুলে এনেছে, তার গোড়াও তুলে এনেছে, আলোচনা করছে দিদির সঙ্গে। জানাচ্ছে, কি ভাবনায় সে ফুল তুলেছে আর কেনইবা সে ফুলগাছ লাগাবে নিজের ঘরের পাঁজরে (পাশে) যে জলাশয় আছে, পুকুর আছে, সেখানে। যেখানে আদিবাসী মানুষের তেমন করে আর বিলাস করার জায়গা নেই। এক প্রকার রাজ্য হারিয়েছে আর্যদের কাছে। বন্দিদশায় ভুমি হারিয়ে ক্ষেতমজুরি করে সেখানে তো আর কমলকানন গড়া যাবে না! সারা ভূমি জুড়ে যেখানে জলাশয়, সেই ছুলবুলে জলামাটিতে লাগিয়ে রাখো ফুল ফসল। ধান কাটাতে ধান পুঁততে যাবো। অন্য লোকের, অন্যের ভুমিতে ফুটে থাকবে ফুল আর আমাদের বাবা মা এই রাজবাহা তুয়াবাহা। গোলাপি পদ্মফুল আর সাদা শালুকফুল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে পথে ঘাটে মায়ের মতো কাউকে মনে হবে,আচমকা দেখে বাবার মতো কাউকে মনে হবে। সেদিন হয়তো এই পরমাত্মীয়রা থাকবে না সামনে, তবে এই যে আমরা লাগিয়ে রাখছি রাজবাহা তুয়াবাহা, এদেরই বাবা-মা ভেবে, আপন মনকথা বলবো মা গো।
জানিনাতো আমরা যারা স্কুলে পাঠ নিয়েছি, তারা বা তাদের মধ্যে কতজন অন্যের জমিতে ফুটে থাকা ফুল পাতা, দাঁড়িয়ে থাকা বনভূমিদের নিজের মা বাবা ভেবে কাছে বসে, আর একটু জল ঢেলে, গোড়ার মাটি একটু আলগা করে অক্সিজেন ভরে দেবে। যদি এমনি করেই আদিবাসীদের আইমানহড়দের কাছে থেকে নেওয়া যেতো সেই পাঠ, তাহলে আজকের পৃথিবী এতো অসুস্থ হতো না।
তৃতীয় গানে অনুভূতি আসে, জানি না কেন ওরা বললো না আমাদের বুড়ো মা-বাবাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখে দেবে আর খবর নেবো না। হয়তো তাদের বাবা মায়েরা তাদেরকে মাটিতে, গাছের তলে পিঁপড়ে কাঠবেড়ালিদের খেলার সাথি করেছিলো আর বলেছিলো এই মাটি, তোমার এই জঙ্গল, তোমার এই শিকড়, তোমরা দেখো আর সুখী থেকো। কিছু খেয়ো আর বাকিটা রাখে দিও আগামী পৃথিবীকে সুস্থ রাখার জন্য। শিখতে হবে জানতে হবে। আর সময় নেই। আমরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে নিজেদের বসে থাকা ডালে কোপ মারা যদি না বন্ধ করি, তাহলে সবাই, আমরা সবাই-ই একই গর্তে যাবো।
পরের দুটো গানেও পাখি আর সরীসৃপকে রক্ষার কথা বলা হয়েছে। উঠোনে একটা কুলের গাছ, আর তাতে একটা পাখির বাসা। কিন্তু আশঙ্কা করছে যে ঘরে গরু ছাগল দেখাশোনা করা রাখাল বড় বদমেজেজি, কি জানি কখন গুলতি দিয়ে পাখিটাকে মেরে ফেলে। পঞ্চম গানে তাদের উঠোনের যে কুলগাছ, সি গাছে একটা সাপ হেলেদুল উঠছে। দাদা একটা দড়ি আনো সেই সাপটাকে বেঁধে রাখি। অথবা সাপটাকে মারবো। যতক্ষণে দাদা লাঠি আনবে, ততক্ষণে এ সাপটা পালিয়ে যাবে । এই যে কৌশল করে সাপকে বাঁচিয়ে রাখা, এ এক প্রাণীজগতের সঙ্গে সম্পর্ক-কথা। আমরা সাপ দেখা মাত্র কাউকে লাঠি আনতে বলতে হয় না, নিজেরাই হাতের কাছে সাপ কুকুর মারার জন্যে লাঠি রেডি রাখি। আমরা আধুনিক মানুষেরা ইকো-সিস্টেমকে ধ্বংস করছি। কি ভাবে ব্যালেন্স রাখবো আমরা! আজ যে পৃথিবীর কঠিন অসুখ। কে বলেছে পৃথিবীর অসুখ এসে একেবারে সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মাত্র মানুষদেরই ধরেছে! ৫ এবং ৬ নাম্বার গান দেখলেও দেখা যায় প্রকৃতিকে যেমন রক্ষার কথা বলছে তেমনি প্রাণীকেও রাখার কথা বলছে।
পরের গানে ধান কাটতে যাবার কথা। কিন্তু সেই মাঠে যে শরালি আর পলি দুজনেই বাসা বেঁধেছে! তারা সবুজ সুতো দিয়ে ভালোবেসে বাসা বাঁধেছি। সেই বাসাকে তো রক্ষা করতে হবে! রাস্তার ধারে ঘরের উঠোনে ঝিঙের গাছ আর সেই গাছের মাঝে একটা গাই আটকে গেছে। দেখো ওই গাইটাকে মেরী না যেনো, তাহলে বাছুরটা অনাথ হয়ে যাবে। বাছুর আর ঝিঙের লতা অতি কোমল। আবার বাছুর সেটাও কচি সুতরাং তাদের যদি মারো তাহলে অনাথ হয়ে যাবে।
এই বোধের কথাই অন্য গানগুলোতেও। ওই প্রকৃতিই। পাহাড়ে ফুল ফোটে, তা বড় মনোরম, ফুলটা তো তুলে মাথায় রাখা উচিত। একটি গানে তো খুবই রসিকতা করেছে তাঁর দাদাকে। বলছে কি মজার কথা শুনেছো! ছাগলের ছানার বিয়ে হচ্ছে শিয়ালের ছেলের সঙ্গে!
গানের ভিতর দিয়ে তাদের আপন ভুবনখানি ডানা মেলে। প্রকৃতি কত না বৈচিত্রে ভরে ওঠা। চোখ মেলে চাওয়া।
শেষ গানে লোভি মানুষ, আরো আরো পেতে চায়। গাছপালা মানুষে কেটে দিচ্ছে, পাতা ঝরে পড়ছে, পাখিরা কাঁদছে আর মানুষ কত চালাক, বাঁধ বেঁধে বানের জলে তাদের এলাকা ভাসিয়ে দিচ্ছে!
মূলবাসী জনজাতি সমাজে, প্রতিটি কাজই যেন তাদের নিজস্ব ইতিহাস বহন করে। দেওয়াল চিত্রে সেই ইতিহাস ফুটিয়ে তোলে। কোথাও কোথাও দেওয়াল-ছবির সঙ্গে স্কাল্পচার। কাঠ লতা পাতা ফুল পাখি ময়ূর সাপ বাজপাখি কি নেই সেই সব ছবি জুড়ে! কোথাও মনে হয়, কেবলই হিজিবিজি! না। সেসব তাদের নিজেদের কাহিনি, আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কেবল ছড়িয়ে থাকে সে ইতিহাস তাদেরই মধ্যে! আমরা কেউই মূল্য দিইনি, অবজ্ঞা, অবহেলায়! অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। ঋণ শোধের সময় আজ।
বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্বে নীহাররঞ্জন রায় দেখিয়াছেন লাউ এর খোল আর বাশের ডাঁট বা দণ্ড তন্ত্রী বা তার লাগিয়ে একদল মানুষ ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে এই গানগুলি ছিল নীতিকবিতাধর্মী। সেখানে ছিল প্রাণের আবেগ। প্রাচীন বাংলার কৃষিনির্ভর জীবনের সমৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা ছিল পরিমিত। মন্দিরস্থাপত্য বা ভাস্কর্য স্থাপত্যের ক্ষেত্রে কোনও দুঃসাহসিক স্থায়িত্ব রেখে যায় নি।
নীহাররঞ্জনের এই ভাবনাটুকু সম্বল করে যদি আমাদের ভাবনাটুকুকে এগিয়ে নিয়ে যাই, তা হলে একটাই প্রশ্ন উঠবে, এই বৈতালিকের দল কি কেবল রাগরাগিনী চিহ্নিত সুরকাঠামোয় গড়ে উঠেছিল? তাহলে মৌখিকসাহিত্যের হাত ধরে নতুন কোনও ব্রাত্যজনের গান গড়ে উঠেছিল? তাহলে আমাদের মেনে নিতে হয় যে উচ্চকোটির শিষ্টসাহিত্যের সঙ্গে নিম্নকটির শিল্পসাহিত্যসঙ্গীতেরও বিকাশ ঘটে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার ভূসীমা, নৃতাত্বিক, ভাষাতাত্বিক পরিচয়, বিভিন্ন ধর্ম আন্দোলনের প্রভাব যা দিয়ে আমরা বাংলা ও বাঙালীকে চিহ্নিত করব। সুতরাং বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা বাঙালী বলতে কাদের বোঝাই। মোটামুটি ভাবে আমরা দুই বাংলার বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ইত্যাদির কথা ভাবি। এর মধ্যে আছে শিষ্টসাহিত্য এবং লৌকিক সমাজউদ্ভূত মৌখিক ঐকমত্যর ধারা। এই দুইয়ে মিলে বাংলা লোকগানের বিরাট ভাঁড়ার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এরই সঙ্গে বাংলা লোকগানের আর একটি বর্গীকরণ করতে পারি। পূর্ববর্তী বর্গীকরণ ছিল মূলত ভৌগলিক কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখি আর একটি বর্গীকরণ। তা হল ধর্মীয় সামাজিক বর্গীকরণ। এই বর্গীকরণের দুটি প্রকার। এক উল্লম্ব এবং অার একটি আনুভূমিক। উল্লম্ব অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রথা এবং অন্যদিকে আনুভূমিক অর্থাৎ জাতপাতভিত্তিক। মনে রাখতে হবে এই দুই ধরনের বর্গীকরণের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে ব্রাহ্মণ্যশ্রী। বাংলার লোকগান তাই ব্যপ্তিতে বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, গোটা হিন্দু সমাজই এই কাঠামো মেনেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু পাশাপাশি আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে। তা হল ভারত আসলে একটি বিশাল জনপদ। এই বিশাল জনপদের ভিতরে অনেকগুলি স্থানিক জনপদ যেগুলির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি একটু একটু করে আলাদা। ফলে সমগ্র হিন্দু সমাজের একটি সামাজিক গঠন হলেও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভিন্ন ভিন্ন। বর্তমান এই আলোচনায় আমি উদাহরণ হিসেবে বাংলা লোকগান নিয়ে চর্চা করলেও এর অনেক উপাদানই অন্যান্য সমকালীন ভিন্ন গানের সঙ্গে মিলে যায়। আবার অনুরূপ ভাবে উল্টোটাও সত্যি।
যাই হোক আমরা আসলে বাংলা লোকগানকে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করে বিশ্লেষণ করি। এই বর্গবিভাজনগুলি মূলত জাতপাতভিত্তিক। কাজেই যে কোনও গান শুনলেই আমরা তাকে কোনও একটা জাতপাতের সঙ্গে জুড়ে দিই। যেমন মইষলির গান, জেলের গান, কোঁড়াদের গান, কাহারদের গাম্পইওর গান ইত্যাদি। যদিও এটা মানতে হবে যে এইসব জাতপাতভিত্তিক সমাজের মধ্যেও কিছু সামাজিক তারতম্য দেখা যায়।
এই সঙ্গে অারও একটা কথা মনে রাখা দরকার। এই সব জাতপাতভিত্তিক সমাজগুলি দুইরকম ভাবেই দেখা যায়। যেমন কখনও একটা ভৌগোলিক অঞ্চলে, আবার নানান এলাকায়। যেমন ধরা যাক ভাটিয়ালি গান। নৌকো বাইচ বা ভাটিয়ালি গান উত্তর পূর্ব অংশে প্রচলিত। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নদী থাকলেও সর্বত্র নদীর গান পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে হয়তো অনুমান করা যায় প্রত্যেকটি ভৌগোলিক অঞ্চলে গান তৈরি হওয়ার মতো উপাদান থাকে না। সেই সঙ্গে এই কথাটাও বলা যেতে পারে একেকটা অংশে সুরের চলন একই রকম। যেমন রাঢ় বঙ্গে (পুরুলিয়া বাঁকুড়া-বীরভূম বর্ধমান) ঝুমুর গানের চেহারা নিয়ে উঠে এসেছে। গোটা উত্তরবঙ্গ এবং বর্তমানে আসামের অন্তর্গত গোয়ালপাড়ার গান ভাওয়াইয়া ভিত্তিক।
প্রশ্ন ওঠে, লোকগান কাকে বলে? লোকগানের কথা ছেড়ে লোক শব্দটির ব্যৎপত্তি খুঁজতে গেলে একটি বৃহত্তর পরিমণ্ডলে দেখা দরকার। যেমন ১৯৫২ খৃষ্টাব্দে folk Lore এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রাম্য সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে লোক একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। folk এর প্রতিশব্দ হিসেবে লোক-এর ব্যবহার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
সুতরাং লোকগানও লোকসহিত্যের অন্তর্গত একটি অংশ এবং লোকসাহিত্য যেভাবে সমাজ সম্পর্কে একটি বুনিয়াদি ধারণা দেয়, লোকগানও তেমনি সমাজ সম্পর্কে একটি বুনিয়াদী ধারণা দেয়। কিন্তু স্পষ্টত মনে রাখতে হবে এই শিক্ষা কোনও একাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। অনেকেই লোকগানকে শ্রমজীবীদের গান হিসেবে ধরে নিয়েছেন। বিশেষত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শক্তিনাথ ঝা খুবই জোরের সঙ্গে এই তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন।
কিন্তু লোকগান সম্পর্কে আমরা ঠিক কি বুঝি? অনেক সময় আমরা বাদ্যযন্ত্র যেমন একতারা, দোতরা এইসব দিয়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে কিছু প্রচলিত সুরের ছক। কিন্তু এইভাবে গানকে চিহ্নিতকরণ ঠিক নয়। বিশেষত বিংশ শতকে নানান পাশ্চাত্য বাজনা, রেডিও, গ্রামাফোন, টিভি ইত্যাদি নানান যন্ত্রপাতির জনপ্রিয়তা আমাদের ক্রমশ ধন্দে ফেলে দিল।
কোন গানকে কোন বর্গে ফেলব? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা এক কথায় খুব কঠিন। বিশেষত, লোকগান বলতে আমরা একতারা কি দোতরা বাজিয়ে গানগুলিকে বুঝি, বিশেষত একটা না দেখা ছবি যে ছবিতে আছে, মাঠ-ঘাট-নৌকো বাওয়া মাঝি, দুঃখ দারিদ্র্যসিক্ত জীবনযাপনের কাহিনী। কেন জানি মনে করা হয় গ্রামীণ জীবনের এ জাতীয় সহজ ও সরলভাবে সঙ্গীত সৃষ্টি ও পরিবেশনাই লোকগীতি। উপরিউক্ত এই সংজ্ঞাটির দিকে তাকালে আমাদের দুটি ধারণা চোখে পড়বে। প্রথমত, গ্রামীণ এবং দ্বিতীয়ত সহজ সরল। কিন্তু আমরা জানি যে প্রচুর গান আছে যেগুলির মধ্যে সে ধাঁধা আছে, তাকে খুব সহজ মন দিয়ে বোঝা মুশকিল। আবার দ্বিতীয়ত গ্রামীণ। কারণ একদিকে গ্রাম যেমন বদলাচ্ছে তেমনি তার বৈশিষ্ট্যও হারাচ্ছে। সুতরাং প্রাথমিক ভাবে অামরা যদি ধরে নিই বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, জাতীয়তা লৌকিকতা অলৌকিকতা, মতাদর্শ ও জীবনদর্শন, সে সব কিছুই কালের গতিতে বদলাতে থাকে। সুতরাং লোকগানের কোনও সমাজতাত্তিক অধ্যয়ন করতে গেলে এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রাখা দরকার।
লোকগানের এই যে বিপুল সম্ভার দেখতে পাই তার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের একটু পিছন দিকে তাকাতে হবে। ভারতের হিন্দু সমাজের গঠনের দিকে তাকালে দেখতে পাব সামাজিক স্তরায়ন বলতে আমরা বুঝি বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং অনুভূতি বলতে বুঝি জাতপাতের বিভাজন যা মূলত পেশাগত অবস্থানকে নির্দেশ করে। তবে এ কথাও মানতে হবে, যে এই সব জাতপাতের মধ্যেও অনেক বিভাজন আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই বৃহৎ বাংলার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বেদ পূর্ববর্তী আর্য-পূর্ববর্তী সাস্কৃতিক ধারাকে বহন করে আসছে। এখানেই লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে রাঢ় অঞ্চল এবং পূর্ববঙ্গীয় অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যর কারণে উভয় জনপদের চেহারা ভিন্ন ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর এলাকায় সুরের কাঠামো ঝুমুর আবার পূর্ববঙ্গীয় জনপদের সুর অনেক বেশি কোমল। যেমন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া। অর্থাৎ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বৃহৎবঙ্গের বিস্তৃত জনপদ যেমন পশ্চিমাঞ্চলে পাথুরে তেমনি পূর্বও উত্তরাঞ্চলে অনেক উপলব। তবে বৃহৎবঙ্গের সামগ্রিক চেহারা প্রাক্আর্য সংস্কৃতির দেশ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রাথমিকভাবে এই দুই বিভাজন মেনে নিয়ে যদি আমরা ভারতীয় হিন্দু সমাজের দিকে তাকাই, তাহলে বাংলা গানের সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। তবে এরই সঙ্গে মনে রাখতে হবে গত ১৯৮১ সালের আদমসুমারী অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের মধ্যে ৫.৬৩ শতাংশ আদিবাসী, যারা আলোচিত এই স্তরায়নের বাইরে। তাছাড়াও আছে মুসলিম সম্প্রদায় যাদের এই হিন্দু সামাজিক স্তরায়নের বাইরে রাখতে হবে। কারণ এই আদিবাসী সম্প্রদায়কে উচ্চকোটির মানুষরা সেভাবে তাদের আলোচনায় সাধারণভাবে অানেন না। কিন্তু সংস্কৃতির মূলধারা বলতে আমরা যেহেতু এই উচ্চকোটিকে বোঝাই তাতে লোকমানসকে আমরা খুব কম বুঝি।
এখানে একটা বিষয় একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেটা হল বাউল গানকে কিন্তু এই লোকগানের মধ্যে আনতে চাই না। তার মূল কারণ হল বাউল দর্শনের সূচনা ও বিকাশে বর্ণহিন্দু ও শরীয়তি মুসলমান সমাজের বিরোধিতা গোড়া থেকেই ছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের হাতে বাউলরা নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি তঁারা গ্রামসমাজের বাইরে আখড়া তৈরি করে থাকতেন। দ্বিতীয়ত তাদের গানের মর্মাথ উদ্ধার করা কঠিন। কারণ এক ধরনের বিশেষ- রহস্যাবৃত ভাষা ছিল যাতে তাদের বাণীর মর্মার্থ সহজে উদ্ধার করা কঠিন কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশেষ ধর্মসাধনা। তবে আমরা পরবর্তীকালে লক্ষ্য করেছি বাউলগান বলে এক ধরনের গান খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁদের বাউল না বলে বাউলশিল্পী বলাই ভালো। অর্থাৎ ভেকধারী বাউল।
শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমাকে ‘দ্য থার্ডম্যান’ ছবির পারমার্থিক শেষ দৃশ্যটির কথা মনে পড়ায়। পাতা ঝরার আওয়াজ ছাড়া গোটা দৃশ্যে অন্য কোনও কম্পন নেই। কোনও আন্দোলনও না। শুধু দূর থেকে হেঁটে আসে রুদ্ধবাক এক তরুণী, এবং, ক্রমশ, এমনকি ক্যামেরা উপেক্ষা করে অনন্তের দিকে চলে যায়। নিঃশব্দের আরাধনা বিশ্বচলচ্চিত্রে আরও দেখেছি। এটি তার মধ্যে করুণতম।
শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এমনই নিঃশব্দ ও করুণ। স্তব্ধ ও সংযত। শান্ত ও রহস্যময়। এই রহস্য তীক্ষ্ণ নয়, মৃদু। এই ঘরানার আরেকজন কবিও আমাদের আরাধ্য। আলোক সরকার। নিঃশব্দের ভাষায় যাঁরা কবিতা লিখেছেন, বাংলায়, এখনও পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সবার আগে মনে আসে আলোক সরকারের নাম। কোনও কিছু হয়ে ওঠা নয়, না-হয়ে ওঠাও নয় তাঁর কবিতা। শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাও তাই। বিশুদ্ধ শব্দটির নানারকম ছায়া আছে, জটিলতা আছে, অর্থান্তর আছে। কিন্তু এই শব্দটি আলোক সরকার আর শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে কত তর্কাতীত ভাবে মানিয়ে যায়! অন্য কোনও কবি, এমনকি জীবনানন্দ প্রসঙ্গেও বিশুদ্ধতার ধারণাটি এমন সমতলভাবে স্মরণীয় মনে হয় না।
‘সমতল’ শব্দটি নিয়ে ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে। আমি মোটেই বলতে চাইছি না যে তাঁদের কবিতার ওঠা পড়া নেই, অন্ধকারের ডানা ঝাপটানো নেই। সব আছে, সময়ের থাবা তাঁদের কবিতাতেও ক্ষত তৈরি করেছে। কিন্তু আলোক সরকারের নিজেরই সুখ্যাত সেই কথাটি এখানে আবার মনে করতে চাইছি। বন্যায় যে বিপর্যয় হয়, তার বিবরণ দেয় খবরের কাগজ; আর এই বিপর্যয়ে আমার মনখারাপটুকু ধরে রাখে কবিতা।এই অর্থেই বিশুদ্ধতার সমতল ধারণাটি এই দুজনের কবিতা প্রসঙ্গে মানে পেয়ে যায়।
বিশুদ্ধতার রকমটি নিয়ে এবার কথা বলা জরুরি। বিশ্বের নানা সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে এই ধারণাটি কোনও-না-কোনও ভাবে লেগে থেকেছে। সুররিয়েলিস্ট আয়োজনটির সঙ্গেও বিশেষভাবে। ব্রেঁতোর কথা মনে পড়বে, যিনি বলেছিলেন তন্ময় কবিতায় থাকে the dictation of thoughts, in the absence of all control by the reason, excluding any aesthetic or moral preoccupation. অতিরিক্ত সব অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু ভাবনার তরঙ্গটি পড়ে থাকবে কবিতায়, বন্ধ দরজার নিচে মুখর আলোর রেখা যেমন, ঘরে রহস্য আর সম্ভাবনার সবটুকু ওই রেখায় সমর্পিত।
জীবনের শেষতম পর্ব পর্যন্ত শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এই নীরব রেখাটির অতিরিক্ত আর কিছুই হয়ে উঠতে চায়নি। প্রত্যক্ষের নির্মল অর্চনা তাঁর কবিতা। নিসর্গ তাঁর কবিতায় আনন্দ ও শিহরণের উৎস। অসংকোচে বলেন তিনি :
বিনষ্ট করো না রেখে যাও :
এই সব জলচর প্রসন্ন পাখির মেলা,
নীলহ্রদ,
সবুজের দিব্যশোভা উপত্যকা,
দেবদারু ছায়া, বনভূমি,
যেখানে যেমন আছে রেখে যাও নিসর্গ-জগৎ।
স্থিতাবস্থার এই মধুর উপাসনাই তাঁর স্বভাব। এই অনুভবে আছে আর্তি, আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাস। বিশ্বাস দৃশ্যের প্রতি, মাধুর্য ও সম্ভাবনার মানবিক উল্লাসের প্রতি। কেউ কেউ আধুনিক পরিবেশ সচেতন মনের নির্দেশেই এই কবিতাটি পড়তে চাইবেন, কিন্তু এই উচ্চারণে আছে সচেতনতার অতিরিক্ত দর্শন, আনন্দময় জীবনের প্রতি আসক্তির দর্শন। কারণ, একটু পরেই বলা আছে :
অপলক
চোখের আনন্দে শুধু দৃশ্যগত গভীরতা
অনুভব করো,
যেখানে যেমন আছে রেখে যাও নিসর্গ-সুষমা।
দৃশ্যের গভীরতর সুষমা অনুভব করার এই তাগিদের উৎস, আসলে, জীবনের উষ্ণ ও উদার পরম্পরা স্পর্শ করা বাসনা। তাঁর অনুভব : ‘সন্দেহ আমার, খুব নিশিরাতে বৃক্ষেরা নিশ্চিত কথা বলে।’ তাদের এই নির্জন উচ্চারণে টোল দিতে চান না তিনি, নীরবতার এই বিনিময় নষ্ট করতে চান না। কারণ তাঁর মনে হয়েছে, ‘সহসা নিকটে গেলে তারা বেশ সহজে সতর্ক হয়ে ওঠে!’ আমরা তো জানিই যে, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিচারে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি মেরি অলিভার কয়েকবছর আগে প্রয়াত হবার পর একজন বলেছিলেন, তাঁর লেখা পড়ে মনে হত তাঁর প্রিয়তম কাজ হল বনে গিয়ে একটা কুটির বানিয়ে কবিতা লেখা। কবির কাজ, বলতেন তিনি, এমনি চোখে যা দেখা যায় না, তা-ই দেখানো। পৃথিবীটাকে পরিশ্রুত করে নিয়ে তারপর পরিবেশন করা। শম্ভুনাথের অনেক কবিতায় পরিচর্যার এমন লালন টের পাওয়া যায়।
ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে চেনা একটি প্রকৃতি প্রবণ কবিতাকে নতুন করে বুঝতে চেয়ে গোটা একটা বই লেখা হয়েছে। রবার্ট ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকেন’ কবিতাটি নিয়ে পেঙ্গুইনের ঐ নামেরই বইয়ে লেখক ডেভিড ওর দাবি করেছেন এতদিন ধরে আমরা কবিতাটি ভুলভাবে পড়ছি। এই কবিতায় দুটি পথের কথা আছে। হলুদ বনের মধ্যে দুদিকে বেঁকে যাওয়া দুটি পথ। পথ দুটির দ্বিধাকবলিত সন্ধিক্ষণে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, শেষ পর্যন্ত, কবি বিরলতম সরণিটি বেছেনিলেন। কবিতাটি, ডেভিডের মতে, পাঠককেও একাধিক সম্ভাবনার মোড়ে দাঁড় করায়। এই কবিতা কোথাও দাঁড়ি দেয় না। কোনও একটিই পথ মেনে নেবার সিদ্ধান্ত জানায় না।
আমি ডেভিডের সঙ্গে সহমত। যে কোনও সার্থক শিল্প তো এই আহ্বান নিয়েই পৌঁছয় আমাদের কাছে। বহুস্বরের এমন ইঙ্গিত শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ও অনেক কবিতার সম্পদ। প্রশ্ন, দ্বিধা ও সংশয়ে ভর তাঁর অনেক কবিতার। অতীত সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে শুরু হয় একটি কবিতা, রচিত হয় সৌন্দর্যের নানা মহল :
গভীর সূর্যাস্ত দেখে দেবদারু ছায়ায় বসেছো ;
বুক থেকে শাড়ীর আঁচল কিছু খসে গেছে অথচ তোমার
কিছুতে খেয়াল নেই, অধরে রক্তিম এত সুখ
যেন কেউ দংশন করেছে, তুমি তার
শিহরণে নতুন রোমাঞ্চ সুখে অচেতন হয়েছো এখন।
এমন মুগ্ধ ও বিনীত বর্ণনার ঠিক পরেই পাই এই প্রশ্নার্ত সংশয় :
তবে কি সকলে খুব সুখী হয় ভালবাসা থেকে
দূরে চলে গেলে?
সম্পর্কের ব্যথা ও বন্দনা শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনেক কবিতার আশ্রয়। কখনও কখনও উপমা ও রূপকের আড়াল নিলেও শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ভরসা ছিল সাদা ও যথাসম্ভব নিরলংকার উচ্চারণেই :
আড়ালে রয়েছো তবু অধিকার-চিহ্ন তুমি রাখোনি আড়ালে,
দেখিয়ে দিয়েছো :
দূরন্ত দিনের ট্রামে দশজন কৌতূহলী মানুষের চোখে
ধরা পড়ে গেছি আমি, আশ্চর্য, বুকের কাছে এতটুকু
সিদুরের দাগে !
সিঁদুরের দাগের এই রক্তিম ইঙ্গিত অভিনব না হলেও এমন স্পষ্ট ও স্বতস্ফূর্ত বলাতেই সারাজীবন ভরসা রেখেছিলেন শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়। কবিতাটি পড়া শেষ করার পর শেষতম শব্দটি থেকে আবার নতুন করে পাঠকের যাত্রা শুরু হয় :
আমার সমস্ত কিছু, সোনাদানা কার কাছে বন্ধক রেখেছি,
বিনিময়ে পেয়েছি চোখের আলো---কার ভালবাসা---
গোপন সে কথা তুমি গোপনে রাখোনি।
দূর থেকে বুকের বাগানে হেসে উড়িয়ে দিয়েছো
বসন্ত দিনের লাল পাখি !
‘লালপাখি’ শব্দদুটির মধ্যবর্তী দ্বিধা না থাকায় পাখির রক্তিম উড়াল এতটা আগ্রাসী হতে পারল।
চেনা উপাদানেই সম্পর্কের ভাঙন ধরে দিয়েছেন শম্ভুনাথ আরও অনেক কবিতায় :
বুকের ভিতরে আছে কোন সাপ—তুমি তার সন্ধান জানো কি?
কাঁচের ওদিকে এসে ঘুরে যাও, কিছুই বোঝো না : তোমাকে নির্জনে দেখে ফণা তোলে দীর্ঘতম পিপাসা আমার,
ইচ্ছা হয় কণ্ঠ দেশে আঁকাবাঁকা খেলা করি কিছু....
যেখানে শরীর, জানি, সেখানে নিশ্চয় আছে শরীরের মোহ :
তবু ওই কাঁচ----
চিরকাল তোমাকে রেখেছে বড় নিরাপদে। আমাকে আড়ালে!
আড়াল তৈরির জটিল পর্যটনে শম্ভুনাথের বিশ্বাস ছিল না। কিছুটা উদার ও স্বচ্ছন্দ আয়োজনে ছড়িয়ে কথা বলতে ভালোবাসতেন তিনি। কথার চারপাশে ছোট ছোট গমকের কাজ বুনে দিতেন। কিছু দুর্গমতা থাক ---- চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই দুর্গমতায় কোনও বাধা নেই, বৈরিতা নেই। প্রিয় দৃশ্য সুখের জন্য, আখরোট গাছের কিছু প্রাচীন সুগন্ধ শিহরণের জন্য আজন্ম কামনা ছিল তাঁর। তাঁর এই শান্ত ও আত্মস্থ ভঙ্গির একটি উজ্জ্বল ফসল এই কবিতাটি :
তুমি যেন আরবী গ্রামের ভিতরে উজ্জ্বল কোন বিয়েবাড়ি :
হাসিখুশির নীল হ্যাজাক জ্বলছে সামনে,
দলিজ থেকে দেওয়ালে নড়ছে কিছু ব্যস্ত প্রতিবেশী ছায়া,
আর সোনালি শামিয়ানা
মাথার ওপরে এক সোনালি আনন্দের আকাশ।
আমি অন্ধকার পথে যেতে-যেতে দেখি দূরের আলো...
অনুযোগহীন পথিকের এই চলন বাংলা কবিতায় শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় দান। এক অলৌকিক হারমোনিয়ামের অনুচ্চমূর্ছনা তাঁর কবিতা। অস্থিরতা তাঁর রক্তে থাকলেও তার ঘোষণা নেই তাঁর কবিতায়। জীবনানন্দের বিপন্ন বিস্ময়ের প্রায় প্রত্যক্ষ অনুসরণ পাই কখনও :
কখনো আনন্দ আর কখনো বিষাদ
হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। দৃশ্যে যথারীতি
চলাফেরা। সংসারের টান। স্বপ্ন সাধ।
দক্ষিণ সমীরে দুলে ওঠে তার স্মৃতি
কৃষ্ণচূড়া ফুল। সে যে মুগ্ধ এক প্রাণ।
সারাদিন ব্যস্ত। কাজে। সন্ধ্যাবেলা ফিরে
গীটারে রবীন্দ্র-সুর। রমণী শরীরে
স্বর্গের সুষমা দ্যাখে। রক্তে বাজে গান।
তবু তার জন্মে আছে অন্য কোন ক্রূর
নক্ষত্রের অভিশাপ। তাই ছন্নছাড়া
সে মানুষ। তৃপ্তি নেই কোন সুখে তার।
কিন্তু এই অতৃপ্তির পরিণামে নির্মিত হয় শান্ত কবিতার জগত। এই জগতই হয় তাঁর আশ্রয় :
চতুর্দিকে ঘিরে তাকে গল্প করে যারা
বন্ধু তারা নয়। তাই শান্ত কবিতার
জগতে সে আছে। একা। নির্জন সুদূর।
সুদূর ও নির্জন এই জগতের শর্তহীন প্রতিষ্ঠায় শম্ভুনাথ সারা জীবন অবিচল ছিলেন। দূরের মাঠ নদী জল ‘যেমন মায়াবী ছবি রৌদ্রালোকে তুলে ধরে’, তাকে নিকটে পাবার সাধনা তাঁর কবিতা। এই সাধনায়, আমি যতটা পড়েছি, কোনদিনও কোনও উল্লেখযোগ্য ভাঙন তৈরি হয়নি। কখনও বিমর্ষ হয়েছেন, ঈষৎ বিষন্ন ও স্তব্ধও হয়ত। কিন্তু বিশ্বাস করেছেন
তবু দুটি নীল তারা উজ্জ্বল চোখের মতো
ভেসে ওঠে মেঘের শিখরে।
শিশুর মুখের গন্ধ ঘাস রোদ মাছরাঙা নক্ষত্র আকাশ ভরা জীবন এতটাই প্রিয় ছিল শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের যে এমনকি জীবন থেকে সরে গিয়ে, দূর থেকে, এই জীবনের স্থাপত্য পরখ করতে চেয়েছিলেন তিনি :
তাই বুঝি ইচ্ছা হয় জীবনের সীমারেখা সব
সহসা নিশ্চিহ্ন করে একবার গভীর নীরব
ব্যবধানে সরে যাই— তারপর অন্য কোন চোখে
দেখি চেনা ঘরবাড়ি বারান্দায় গোলাপের টব
পুরনো জীবন কত স্পষ্ট হয় নতুন আলোকে
ভয়ানক ইচ্ছা হয় গাঢ় লাল মেঘের বিকেলে !
জীবনের এই পড়ন্ত রং আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্য যে ঠিক এই অবসরেই জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে চেয়েছেন তিনি। মনে পড়বে তাঁর নিজের কথা : ‘জীবনকে ভালোবেসেই নির্জনে নীলিমার দিকে প্রসারিত হয়েছে আমার যাত্রাপথ।’
জীবনের প্রতি এই উৎসাহই তাঁকে মহাসময়ের প্রেক্ষাপটে নিজের অবস্থান বুঝতে মনোযোগী করেছিল। বুঝেছিলেন :
আমি কে ? আমি তো এক সংপ্রাচীন দীর্ঘ জীবনের
উৎসমুখ থেকে
অস্থি-পাথরের গূঢ় অন্ধকার জটিলতা থেকে প্রবাহিত
কিছু, প্রাণবীজ কিছু রক্তজলধারা...
বর্তমান কাল ছুঁয়ে ভবিষ্যতে দূরে প্রসারিত
কিছু অনুভব কিছু আলোকিত তরঙ্গচেতনা...
দৃশ্যে এই আমি।
মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময় ও ইতিহাসচেতনা আমাদের ভাষার অনেক প্রধান কবির মত শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়েরও কিছু কবিতার মৌলিক উৎস।
রবার্ট লিন তাঁর সম্পাদিত একটি ইংরেজি কবিতা সঙ্কলনের ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবিতা আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার জীবনেই ফিরে আসতে শেখায়। একই সঙ্গে তাঁর সমান রোমহর্ষক ভাষ্য ছিল, দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনটি না ঘটলে প্রথমটির কোনও মর্যাদা নেই। বাংলায় আরও কয়েকজনের মত শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাও এই মহৎ প্রত্যাবর্তনের শরিক করে আমাদের।
মৃত্যু বিষয়ে ল্যানসেট কমিশনের রিপোর্টঃ
একবিংশ শতাব্দীতে মৃত্যু-আলোচনা নতুন এক তর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে মানুষ যখন অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় হাসপাতাল নির্ভর চিকিৎসার কারণে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে ; ঠিক তখন অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা কিংবা মুমূর্ষু অবস্থায় কষ্ট-দুর্ভোগ, ব্যথা উপশমের ন্যুনতম পরিষেবা পাচ্ছে না। সম্প্রতি ল্যানসেট পত্রিকার তরফে ‘ Report of the Lancet Commission on the Value of Death: bringing death back into life’ প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, মৃত্যু ও মৃত্যুকালীন অবস্থার ভারসাম্যহীনতা,পরস্পর বিরোধী চিত্র খুঁজে বের করা। সাম্প্রতিককালে মারা যাওয়ার স্থান ও ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বেশিদিন বাঁচছে, মারা যাচ্ছে দেরিতে ; আগে পরিবার পরিজনদের মাঝে বাড়িতে মানুষ মারা যেত, এখন মৃত্যু ঘটছে কোনও হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত নিরর্থক চিকিৎসা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য- পরিষেবার এক প্রচলিত অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। পরিবার পরিজনের ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে ; এখন অন্তিম অবস্থার পরিষেবা দেওয়ার মতো উপযুক্ত দক্ষতা ও জ্ঞান তাদের তেমন আর নেই।
ল্যানসেট কমিশন মৃত্যু ও মৃত্যুকালীন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কথা বলেছে ; যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক,ধর্মীয় আন্তঃসম্পর্কিত নানা বিষয়ের সাথে যুক্ত। বর্তমানে ‘মৃত্যু ব্যবস্থা’কে খন্ডিত,রৈখিক, একমাত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্লষণের চেষ্টা করা হয়; ফলে এর গভীরতা ও জটিলতা অনুধাবন করা যায় না এবং প্রয়োজনীয় ভারসাম্য অর্জনে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া যায়না । কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা-ব্যবস্থার এই বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে।
কমিশন মূলত পাঁচটা নীতির ওপর জোর দিয়েছে - মৃত্যুর সামাজিক নির্ধারক, মৃত্যু ও শোকের মোকাবিলা; মৃত্যুকে শুধু শারীরবৃত্তীয় ঘটনা না ভেবে সম্পর্কনির্ভর ও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা ; মুমূর্ষু অবস্থার উপযুক্ত সেবার জন্য সাহায্যকারী নেটওয়ার্ক ; মৃত্যু, মৃত্যুকালীন অবস্থা, শোক, বিষাদকে প্রতিদিনকার আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তার সাধারণ বিষয় করে তোলা; মৃত্যুর মূল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া।
উল্লিখিত সবকটা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবে চিকিৎসক থেকে সমাজবিজ্ঞানী অনেকেই বিশ্বাস করেন, মৃত্যু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা অত্যন্ত জরুরি যা মৃত্যুকালীন সমস্যা ও সংকট দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। মৃত্যু সম্পর্কিত ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এই ধরনের আলোচনাকে সম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ করে।
মৃত্যুভাবনায় ধর্মচিন্তা
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে এসেছে মৃত্যুবিষয়ক দার্শনিক ভাবনা, প্রথা, লোকাচার । ধর্ম ও দর্শনে জীবন ও মৃত্যুকে একটা চক্রের অংশ হিসেবে ভাবা হয় ; মৃত্যুকে ‘শেষ’ না ভেবে, দেখা হয় জীবনের পরবর্তী পর্বের প্রবেশদ্বার হিসেবে। ‘সংসার’ ধারণায় জন্ম, জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম –সব মিলে এক অবিরাম চক্র। জীবনের অর্থ মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায় না, মৃত্যুর পরেও থেকে যায়। মৃত্যু থেকে পুনরায় জীবনে ফিরে আসার পথকে সুগম করার আকাঙ্খায় মানুষ নানা আচার-অনুষ্ঠান সংগঠিত করে। হিন্দু, জৈন, শিখ এবং বৌদ্ধ ধর্ম এই ধারণাকে মান্যতা দেয়। হিন্দুধর্ম মতে, ব্যক্তির জন্ম মৃত্যু , সুখ-দুঃখভোগ সবই কর্মফল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত,মরণ দেহের ধ্বংস,যা আত্মাকে স্পর্শ করে না, আত্মার জন্ম নেই, মরণ নেই। বেদের যুগে ঋষি-কবিরা মৃত্যুকে কখনও খন্ড দৃষ্টিতে দেখেছেন,আবার কখনও সামগ্রিক দৃষ্টিতে জীবন-মৃত্যুর স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন।বেদের পরবর্তীতে উপনিষদের যুগে এসে তাদের মনে নানা দার্শনিক প্রশ্ন জেগেছে, মৃত্যু কী, তার উদ্দেশ্যই বা কী !
বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম, হিন্দুধর্মের আচারপরায়ণতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সৃষ্টি হয়েছে, তারা বেদবিরোধী। উভয় ধর্মই ইশ্বর স্বীকার করে না। বৌদ্ধ ধর্ম স্পষ্টভাবে কষ্ট-দুর্ভোগ ব্যাখ্যায় জরা,ব্যাধি, মৃত্যুর কথা বললেও বেঁচে থাকার কথাও বলেছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও জৈনধর্ম তা করে। জৈনধর্ম মতে প্রত্যেক চেতন পদার্থেরই আত্মা আছে, তবে সকল আত্মার চৈতন্য সমান নয়। জৈনধর্মে জীবনধর্ম বা চেতনধর্মকে আত্মা বলা হয়েছে। সেই আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র এবং অনুভববেদ্য। আত্মা শাশ্বত, অবিনশ্বর ; জীব তার কর্মফল অনুযায়ী দেবতা, মানব, মানবেতর প্রানী কিংবা নরকের অধিবাসীরূপে বাস করে। জীবের চিন্তাভাবনা ও কর্ম, এই দুই মিলে কর্মফল তৈরি হয় এবং এই কর্মফল জন্ম জন্ম ধরে প্রবাহিত হয়। জন্মজন্মান্তরের সাধনার মধ্যে দিয়ে আত্মা বিশোধিত হয়ে গেলে মোক্ষলাভ ঘটে। মৃত্যু দুইজন্মের মধ্যবর্তী এক সোপানমাত্র।
চার্বাকপন্থীরা জন্মান্তরবাদ বা কর্মফলবাদে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, দেহ থেকে আত্মার স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা। ক্ষিতি,অপ,তেজ ,মরুৎ চারটে উপাদানকেই কেবল স্বীকার করা হয় ,তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশ্রিত হলে চৈতন্যের সৃষ্টি হয়। ‘আমার দেহ’ এই কথার মধ্যে দিয়ে সেই ভাবনাই প্রকাশ পায়, ‘আমি’ ও ‘দেহ’ পৃথক কিছু।‘আমি’ ও ‘দেহ’ শুধু কথার কথা, এদের পার্থক্য করা এক অবান্তর ভাবনা। দেহ ছাড়া আত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই। মৃত্যুর পর দেহ ভস্মীভূত হলে সে আর ফিরে আসে না।
ইহুদি ধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, সকলেই পরকাল এবং পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে। ইহুদি ধর্ম শিক্ষা দেয়, মৃত্যু মুহূর্তে শরীর এবং আত্মা আলাদা হয়,শরীর বিচ্ছিন্ন হতে পারে, কিন্তু আত্মা চিরন্তন। খ্রিস্টধর্ম পরকাল প্রচার করে, ‘দিনের শেষ বিচার’-এ, সারা জীবনের কাজের হিসেব অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে ,‘পুণ্যবান’ বা ভালো মানুষেরা অনন্তকাল স্বর্গে বাস করবে ; আর পাপীরা স্থান পাবে নরকে । ইসলাম ধর্মেও যে ‘ছয় বিশ্বাস’ আছে ,তার একটা হল ‘পরকাল’ বিশ্বাস ; সেখানে মৃত্যুর পর আত্মা এবং দেহের বিচ্ছেদ হয়। তিনটে ধর্মই বিশ্বাস করে, জীবন ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া এক পবিত্র উপহার ।
কনফুসিয়ান বিশ্বাস, সরাসরি মৃত্যুর কথা না বললেও , যা বলে তা হল, জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে চাওয়া আসতে পারে ‘ren’ অর্থাৎ উপকার, বা সর্বোচ্চ গুণের ব্যয়ের ফলে ; আর ‘ren’ পেতে গেলে মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। দাওবাদে, মৃত্যু আলোচনায় প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণের কথা এসেছে ; মৃত্যু আমাদের জীবনের পুরো প্রক্রিয়াকে অনুভব করতে এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে সাহায্য করে। মৃত্যু জীবনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ; প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী যা জীবনের একটা প্রয়োজনীয় অংশও বটে।
আফ্রিকার দেশজ ভাবনায় , মৃত ব্যক্তির সাথে জীবিতদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকে এবং তার ফলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন সমৃদ্ধ হয়। পূর্বপুরুষরা কখনও দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয় না , মৃত্যুর পরে জীবিত ব্যক্তির সংস্করণ হিসেবে রয়ে যায়। জীবিত এবং মৃতের মধ্যে আন্তঃসংযুক্তি আফ্রিকার মৃত্যুব্যবস্থার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিউজিল্যান্ডের মাওরি ঐতিহ্যে একজন মৃত ব্যক্তি অবগুন্ঠনের আড়ালে থাকে,যা পার্থিব জগতকে আধিভৌতিক জগত থেকে পৃথক করে রাখে। পরিবারের লোকজন অন্তিম অবস্থার রোগীদের সেবার সময় এমন অবকাশ তৈরি করে যাতে তারা পূর্বপুরুষের পৃথিবীতে জায়গা করে নিতে পারে ।
দার্শনিকদের ভাবনায় মৃত্যু
প্রতিটা যুগই পূর্ববর্তী যুগচিন্তা দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছে এবং তাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে নানা দার্শনিক চিন্তা ভাবনা। ভারতীয় দর্শনে, বেদ ও উপনিষদের ভাবনার অনুসরণ করেই মৃত্যু কিংবা পুনর্জন্মের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।রাধাকৃষ্ণণ ‘ Indian Philosophy’ তে বলেছেন, উপনিষদের যুগ থেকে পুনর্জন্মের ভাবনা দানা বেঁধেছে।
পাশ্চাত্য দর্শন মৃত্যুকে চূড়ান্ত শেষ বিন্দু হিসেবে গণ্য করেছে। মৃত্যুকালীন অবস্থায় সক্রেটিসের শিক্ষা তাঁর একনিষ্ঠ ছাত্র প্লেটোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল । পাশ্চাত্য দর্শনে প্লেটোই সেই অর্থে প্রথম মৃত্যুবিষয়ে আলোকপাত করেন। তাঁর যুক্তিতে, ‘..... সঠিকভাবে যারা দর্শনচর্চা করে তারা মৃত্যুকালীন অবস্থা এবং মারা যাওয়া ছাড়া আর কিছুই অধ্যয়ন করে না।' প্লেটো ‘ Phaedo’ গ্রন্থে দর্শনকে ভিত্তি করে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণে অনুশীলন ও কর্মপন্থার বর্ণনা করেছেন । মাইকেল দি মন্টাইগনে ‘That to Study Philosophy is to Learn to Die’ রচনাতে একই কথা বলেছেন , মৃত্যুভয় দূর করতে হলে মৃত্যুকে প্রতিবেশী করতে হবে, তবেই মৃত্যুকে পোষ মানানো যাবে। এপিকিউরাস এ প্রসঙ্গে সুন্দর যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘মৃত্যু, খারাপ জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, আমাদের কাছে কিছুই নয় ; যেহেতু, আমরা যখন জীবিত, মৃত্যু তখন অনুপস্থিত, আর মৃত্যু যখন উপস্থিত, আমাদের তখন কোনও অস্তিত্ব নেই।’ স্পিনোজা প্লেটোর ভাবনার বিরোধিতা করে বলেন ,‘ মুক্ত মানুষের উচিত মৃত্যু নিয়ে কম ভাবা, কেননা আধুনিক যুগে জ্ঞান, জীবন সম্পর্কে চিন্তাভাবনার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মৃত্যুর ওপর নয়।’ স্পিনোজার এই ভাবনা ‘মৃত্যুকে অস্বীকার’ করার ভাবনার দার্শনিক ভিত্তি বলা যেতে পারে।নীটশেও মৃত্যু নিয়ে চিন্তা না করার কথা বলেছেন। তিনি মৃত্যুর চেয়ে জীবন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন।
ফ্রয়েডের ভাবনায় ‘ সব জীবনের লক্ষ্য হল মৃত্যু’, ‘......সব জীবই মরতে চেষ্টা করে ; প্রকৃতপক্ষে তা সকলের কামনার বিষয় ।' তাঁর মতে, 'যখনই আমরা আমাদের মৃত্যুকে কল্পনা করার চেষ্টা করি তখনই আমরা প্রতিফলনে বুঝতে পারি, আমরা সত্যিই দর্শক হয়ে বেঁচে আছি।' আসলে ফ্রয়েড মৃত্যুকে অনিবার্য, স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন,এর থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে তার ওপর বিশেষ আলোকপাত করেননি। যুদ্ধ,গণহত্যার মতো ঘটনাবলি পরবর্তীতে ফ্রয়েডীয়দের মৃত্যুসম্বন্ধীয় ভাবনায় পরিবর্তন আনে,তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করেন এসব মানুষের মৃত্যু সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করেছিল।
জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মৃত্যুকে মানব অস্তিত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো এবং গঠনমূলক উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি মৃত্যুর সাথে আমাদের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন।তাঁর মতে, আমরা নিজেদের মৃত্যু থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিতে না পারলেও এর আসন্নতা আমরা অনুভব করতে পারি। মৃত্যু এমন একটা ঘটনা যা অস্বীকার করা অসম্ভব। তাঁর যুক্তিতে এটা এমন একটা ঘটনা যার দায় অন্য কেউ নিতে পারে না , অন্য কেউ আমার হয়ে মরতেও পারে না, আমাকেই এর মুখোমুখি হতে হবে। মৃত্যুই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে আমরা কে, জীবনের মূল্য কি ! জাঁ পল সার্ত্রে অবশ্য হাইডেগারের মৃত্যু-ভাবনার সীমাবদ্ধতার কথা বলেন।
একুশ শতকের আমেরিকান দার্শনিক টমাস ন্যাগাল মনে করেন, মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে ভয় পাওয়া বা দুঃখিত হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে মৃত্যু হলে অনেক ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হবে তা অনুধাবন করা। আমাদের মৃত্যুর পর অনেক ভালো ঘটনা ঘটবে, এটা যেমন সত্য ; জন্মের আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যখন আমরা পৃথিবীতে ছিলাম না। আগের ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের যদি খেদ না থাকে, মৃত্যুর পরের ব্যাপার নিয়ে কেন আমরা দুঃখিত হব ; কোনোটার সময়ই তো আমরা পৃথিবীতে ছিলাম বা থাকব না।
অনেক সম্প্রদায় এমনটাই বিশ্বাস করে , অসুস্থতা, মৃত্যু ও শোকের সময় আমাদের পারস্পরিক সংযোগ শক্তিশালী হয় । জুলুরা বিশ্বাস করে , ‘কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে’। আর এটাই হল ‘উবুন্তু’ দর্শনের মূল কথা ; বলা যেতে পারে মানবতাবাদ সম্পর্কে আফ্রিকার দেশজ ধারণা।কেনিয়ার দার্শনিক জন এমবিতির ব্যাখ্যায় ‘উবুন্তু ’ বা মানবতা হল, ‘ আমি কারণ আমরা আছি এবং যেহেতু আমরা আছি,তাই আমি আছি।’ অবশ্য ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত এর বিপরীতে বলেন , ‘আমি মনে করি ,তাই আমি।’এরই প্রতিফলন ঘটে যে ভাবনায় তা হল, ‘ ব্যক্তি যা কিছু ঘটবে সমগ্র সম্প্রদায়ের সাথেও তা ঘটে এবং সম্প্রদায়ের সাথে যা ঘটবে, তা অবশ্যই ঘটবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ।’ একজন ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন তার মৃত্যুর সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে গোটা সম্প্রদায়।
মৃত্যু প্রসঙ্গে সুফি ও বাউল দর্শন
সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিক তাপসদের মরমীবাদ। সুফি কোনও সম্প্রদায় নয়, বরং এটা এক ইসলামিক শিক্ষা, যা মানুষের স্বীয় অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হল এই মতবাদের মর্মকথা। ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে ‘তাসাওউফ’ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান । আরবের রাজশক্তির প্রতিঘাতে জন্ম নেয় সুফি মতবাদ ,আর একে লালন করেছে পারস্য। ইরান ও মধ্য এশিয়ায় বিকাশের পর পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে সেই অঞ্চলের ভাবধারার সঙ্গে সুফি মতবাদের সম্মিলন ঘটে ; দক্ষিন এশিয়ায় এসে আধ্যাত্ম সঙ্গীত চর্যাগীতিতে এর রূপান্তর হয়। সুফি দর্শন অতি সহজে বৌদ্ধদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয় এবং বৌদ্ধ মানবতাবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মরমী ভাব সাধনা।
সুফি মতবাদের নানা সাহিত্যকর্মে ‘মৃত্যু’ বিষয় হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যে মূল প্রশ্ন সেখানে ঘুরে-ফিরে এসেছে তা হল- মৃত্যু কি? এটা কি ধ্বংস, নাকি জীবনের অপরিহার্য রূপান্তর ? তের শতকের ফার্সি ভাষার কবি রুমিকে সুফি জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর এক কবিতায় সুফি দর্শনের সুন্দর প্রতিফলন ধরা পড়ে ;
মৃত্যু পান করে আমি পাথর হয়ে ছিলাম
আবার পুঁই মেলেছি তরু লতায়,
গাছটি আবার ঢলেছি মৃত্যুর শয়ানে
আবার এসেছি একটি প্রাণীর খাঁচায়
জীবটি আমি লুকিয়েছি ফের মরণের অন্তঃপুরে
ফিরেছি আবার মানুষের রূপ ধরে।
কেন ভয়, কিসের ডরে আঁখি করে ছলোছলো
মৃত্যু আমার কী কেড়ে নিয়েছে বলো?
(‘পাথরে নিমজ্জন’ – অনুবাদঃ বদরুজ্জামান আলমগীর )
সুফি মতবাদে, আমাদের জীবন অনেক অধ্যায় বা স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং সমগ্রের সাথে একীভূত। মৃত্যু বলে কিছু নেই। প্রতিটা 'মৃত্যু' পরবর্তী অধ্যায় বা স্তরের একটা ভূমিকামাত্র। অস্তিত্বের উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে সত্তার উৎপত্তি। রুমির কবিতায় কোরানের স্তোত্র, ‘আমরা ইশ্বরের কাছ থেকে এসেছি, ইশ্বরের কাছে ফিরে যাবো’– এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।
সুফিবাদে বিশ্বাসীদের কাছে মৃত্যুর আগে যে চারটে সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও লালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তারা হল নিজের সাথে, সমাজের সাথে, প্রকৃতির সাথে এবং পবিত্র অতি-প্রকৃতির সাথে। সুফিবাদ শেখায়,পার্থিব অস্তিত্বের এই চার উপাদানের সাথে আমাদের একটা ন্যায়সঙ্গত ও গঠনমূলক সম্পর্ক থাকা দরকার। মরার আগে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি এবং পরে কীভাবে বেঁচে থাকব তার মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমাজের সাথে সম্পর্ক, সমাজের সাথে আমাদের সম্পর্ক যদি ন্যায় ও কল্যাণের ওপর নির্মিত হয় তাহলে সত্তার পরবর্তী স্তরে এর প্রতিফলন হবে। আমরা যদি সমাজ বা মানুষের প্রতি অন্যায় আচরণ করি, তাহলে আমাদের ওপর তার প্রতিঘাত ফিরে আসবে ।নিজেদের কর্মের স্বর্গ বা নরক আমরা তৈরি করি, এই আচরণই নির্ধারণ করে আমাদের বেদনা বা আরাম, যখন আমরা পার্থিব সত্তা অতিক্রম করে পরবর্তী অধ্যায়ে যাই। বর্তমান জীবন এবং পরবর্তী জীবনের মধ্যে গভীর সংযোগ সংঘটিত হয় অস্তিত্বের ঐক্যের মৌলিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি মানবজীবন তার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐশ্বরিক ঐক্যের এক প্রকাশ, যা আমাদের পরিচয় গঠন করতে এবং স্ব, সমাজ, প্রকৃতি ও দৈবের ঐক্য অনুসারে জীবনযাপনের উপায় বেছে নিতে সাহায্য করে। সেই অর্থে সবকিছু একেরই প্রকাশ, মানবতার প্রচুর বৈচিত্র্যের মধ্যে কোনও বিভাজন নেই ।
অস্তিত্বের সবচেয়ে নীচের স্তর বা অবস্থার প্রকাশ হল বস্তুজগতের। জড় জগত হল অস্থায়ী এক অবস্থা ; সুফি উপলব্ধিতে তা 'বাস্তব' নয় , কেবলমাত্র আমরা তার প্রকাশ জানি, ‘বাস্তব’ মেনে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস ব্যক্তি আমিকে অবনমিত করে, বস্তুগত লাভের অনুশীলনে ব্যস্ত রাখে।এর অনিবার্য পরিণতিতে যুদ্ধ, সংঘাতের চিন্তা, শারীরিক অস্তিত্ব প্রমানের আকাঙ্খা।আসলে মানুষ সত্তার এই সর্বনিম্ন অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারে না ,ফলে তার নিজস্ব সময় ও পরিসরে অন্ধকার চিরস্থায়ী হয়। সুফিবাদে ‘হৃদয়’ হল মানবজাতির সারমর্ম ,যা পবিত্র ,আলো দান করে।জীবনযাপনে আমরা অন্ধকারের মুখোমুখি হই, আমাদের আচরণ অন্ধকার আনতে পারে,কিন্তু আলো হল ঐশ্বরিক মৌলিক উপাদান, যা চিরন্তন। হৃদয়ের বিশুদ্ধতা আমাদের সেই অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যা নিজেদের অন্ধকার দেখতে ও বুঝতে এবং তা থেকে আলোয় ফিরিয়ে আনতে সমর্থ করে।
সুফিবাদে সুখ হল এক প্রকার যোগাযোগ। জীবনের উল্লিখিত মূল চারটে উপাদানের সাথে যোগাযোগ এবং শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্য, জ্ঞান ও ঐশ্বরিক শক্তির সাথে যোগাযোগ। আমরা যদি সেই সংকল্পে কাজ করি তবে তা সমস্ত অস্তিত্বের ঐক্যের অংশ ইতিবাচক শক্তি তৈরি করবে, যা সমাজে এবং অন্যদের মধ্যেও স্থানান্তরিত হবে। সুফি ভাবনায় এই আলো কেবল জীবনকেই সংজ্ঞায়িত করে না মৃত্যুর ধারণাকেও অস্বীকার করে।
ইমাম আল-গাজ্জালী মৃত্যু-স্মরণ প্রসঙ্গে তিনটে দিকের কথা বলেছেনঃ
* জগতের সাথে যুক্ত উদাসীন ব্যক্তির স্মরণঃ পৃথিবীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সে মৃত্যুকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে ।
* অনুতাপকারীর স্মরণঃ এই স্মরণে ভয় আরও বেশি আধিপত্য বিস্তার করে, অনুতাপ আরও দৃঢ় হয়। অতীতের ভুলত্রুটিকে সংশোধন করতে তার চেতনা তীব্র হয়ে ওঠে, যার আধ্যাত্মিক প্রতিদান অপরিসীম।
সর্বজ্ঞের স্মরণঃ মৃত্যুর পর সে প্রেমাস্পদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে দেখতে পায় এবং বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা কখনও বিস্মৃত হয় না।
এইসব ছাড়াও আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে, যখন তুমি মৃত্যুকে আর অপছন্দ করবে না, মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়া অথবা বিলম্বিত হওয়া কোনও আকাঙ্খাই তোমার থাকবে না ,তুমি তখন শুধু প্রিয়জনের আদেশকেই প্রাধান্য দেবে। কেবলমাত্র তখনই তুমি পরিপূর্ণতা ও আত্মসমর্পণের জায়গায় উপনীত হবে।
সুফিরা প্রায়শই নবী মুহাম্মদের একটা হাদিসের উল্লেখ করে থাকে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে এবং যখন মারা যায় তখন সে জাগ্রত হয়।’ রুমির ব্যাখ্যায় এই কথার অর্থ হল, নবী অনন্তকালের প্রভাত আলোর আগমনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে আমরা আমাদের বর্তমান জীবনে স্বপ্নদর্শীর মতো যে সমস্ত কাজ করেছি তার যথাযথ ব্যাখ্যা করা হবে। তখন আমরা স্বপ্নের অবয়বগুলোকে আর অস্পষ্ট দেখবো না, বরং তা বাস্তবতা হিসেবে উন্মোচিত হবে। তিনি উপদেশ দিয়েছেন ‘ মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ করতে’, যাতে আমরা যখন মারা যাবো তখন যাতে আসলে মারা না যাই। সুফিরা জীবনের প্রতি আকর্ষণের জন্য মৃত্যুবরণ করতে সচেষ্ট হন, একইভাবে জীবনের আকর্ষণে নিজেদেরকে উন্মোচিত করেন। মৃত্যুর প্রতি সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে তা হল, মারা গেলে তারা আল্লাহর সাথে থাকবে, আর বেঁচে থাকলে আল্লাহ তাদের সাথে থাকবেন ; অর্থাৎ জীবনে বা মৃত্যুতে তারা সবসময় বন্ধুর সাথেই থাকে। বিশিষ্ট সাধক শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী তাই বলেন, ‘ মৃত্যুকে স্মরণ করাই হল আত্মের সব অসুস্থতার সর্বোত্তম চিকিৎসা।’ মৃত্যু সচেতনতাই সুন্দর জীবন যাপনের অন্যতম উপায় এবং মৃত্যুর স্মরণ হল পরকালের জন্য আগাম প্রস্তুতি। শুদ্ধ জীবনচর্চা একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি দেয়।
সুফিদের কাছে মৃত্যু কোনও অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া নয়, তা এক অন্তিম যাত্রা, যা বন্ধুর কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু কবে তা আসবে কেউ জানে না। পাতা ঝরে পড়ার, ফুল ঝরে যাওয়ার এবং নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার একটা সময় আছে ; কিন্তু মৃত্যুর কোন ঋতু নেই, সে নিজস্ব নিয়মে চলে। সুফিদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক, সার্বজনীন এবং প্রয়োজনীয়। তারা মরে, যাতে আর মরতে না পারে। তাদের কাছে বেঁচে থাকাটাই মরণ আর মরে যাওয়াটাই বেঁচে থাকা !
চতুর্দশ শতাব্দীর সুফি সাধক শরফ আল-দীন মানেরি মানুষকে তিন শ্রেনিতে ভাগ করেনঃ এক, ইর্ষাপরায়ণ ও লোভী ; দুই, যারা সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী; তিন,যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রমোদপ্রিয় মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবে না, ভাবলেও তা জাগতিক লাভের জন্য ভাবে।সৃষ্টিকর্তার স্মরণ এই ধরনের মানুষের কোনও কাজে আসে না বরং এতে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আরও দূরে সরে যায়। দ্বিতীয় ধরনের মানুষ সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হয়, মৃত্যুকে স্মরণ করে, হৃদয়ে মৃত্যুভীতি পোষণ করে এবং সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হয়। সৃষ্টিকর্তার দিকে ফেরার আগেই হয়তোবা তাদের মৃত্যু চলে আসে। তৃতীয় শ্রেনির মানুষ, যারা আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে পৌছায়, তারা মৃত্যুকে সবসময় স্মরণ করে, কেননা মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই কাঙ্খিতের কাছে যাওয়ার সুযোগ আসে। মানেরির মতে, সাধারণ মানুষ মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে চায়, অপরদিকে সুফিরা মৃত্যুকে ভালোবাসে ও মৃত্যু কামনা করে। জালালউদ্দিন রুমির অন্য এক কবিতায় -
‘যখন আমার কফিন নিয়ে যাবে, তুমি কখনো এটা ভেবোনা-
আমি এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি!
চোখ থেকে অশ্রু ফেলোনা,
মুষড়ে যেওনা গভীর অবসাদে কিংবা দুঃখে-
আমি পড়ে যাচ্ছি না কোন অন্তহীন গভীর ভয়ংকর কুয়ায়!
যখন দেখবে আমার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কেঁদোনা-
আমি কোথাও যাচ্ছি না,
আমি কেবল পৌঁছে যাচ্ছি অনন্ত প্রেমে।
আমাকে যখন কবরে শোয়াবে, বিদায় বলো না –
জেনো, কবর কেবল একটা পর্দা মাত্র, এটা পেরোলেই স্বর্গ। ’
( ‘যখন আমার মৃত্যু আসবে’ - অনুবাদঃ রেজা রিফাত )
অনেকের মতে, বাংলায় প্রবেশের আগে সুফিরা উত্তর ভারতে যোগী ও অন্যান্য তান্ত্রিক সাধকদের সাহচর্যে এসেছিল। সপ্তদশ শতক থেকে সুফিবাদ বাংলায় একটা নতুন রূপ গ্রহণ করল এবং পরবর্তী দেড় শতকের মধ্যে বিশ্বাস ও চর্চায় স্থানীয় ভাবধারা এত বেশি গ্রহণ করে ফেলল যে তা কেবল আদি কুলীন রূপ ও স্বাতন্ত্র হারাল তাই নয়,তার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব, অন্তর্নিহিত শক্তি ও অকপট চরিত্রও হারাল। এসব কিছু হারানোর ফলে বাংলায় সুফিবাদ তান্ত্রিকতা, যোগীবাদ, নাথতন্ত্র ও এই ধরনের নানা লোকজ বিশ্বাস ও সাধনচর্চায় একাত্ম হয়ে গেল। সুফি মতবাদে বিশ্বাসী অনেকে মনে করে, মুহাম্মদ স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। হজরত মুহাম্মদের মতে মানবদেহে একটা বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ হলে সারা দেহ অপরিশুদ্ধ হয়।এই অঙ্গটা হল ‘কল্ব’ বা হৃদয়। আল্লাহর স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয় ; কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন, সুফিবাদের এই আদর্শে প্রভাবিত হয়েছে বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমীবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদ। গবেষকরা মনে করেন, বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল নদীয়াতেই। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন চালু হয়। সুফি প্রভাব তখন বাংলার সর্বত্র। সুফিচিন্তা ও ভাববাদের মধ্যে গ্রামবাংলার অত্যাচারিত ও দিকভ্রান্ত মানুষ দিশা খুঁজে পেতেন।এমনকি অনেক গবেষক মনে করেন চৈতন্যদেবের ভাবধারাতেও সুফিপ্রভাব ছিল। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর লেখক জয়ানন্দ বলেছেন, সেইসময় অনেক ব্রাহ্মণেরাই জালালউদ্দীন রুমির লেখা পড়ত। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যর সঙ্গে পীর-দরবেশদের সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ আছে।
প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে, বাংলা সংস্কৃতিতে আরো দুই সম্প্রদায়, বাউল ও বৈষ্ণবদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে পৃথক কিছু বিশ্বাস রয়েছে। বাউল ধর্ম-দর্শনে ইশ্বর হল ‘মনের মানুষ’,ইশ্বরের সাথে প্রেমের সম্পর্ক পাতিয়ে তারা সাধনা করে,তারা বিশ্বাস করে দেহের মধ্যেই পরমাত্মা বা সাঁই বাস করে। রস–আস্বাদনের জন্য তিনি নিজেকে প্রকৃতিরূপে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন।তারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে বহু জন্মের মালায় গাঁথা অনন্তপ্রবাহ। বৈষ্ণবের দৃষ্টিতে নিত্যকাল ধরে রাধাকৃষ্ণের লীলা চলছে; রাধা ও কৃষ্ণ ভিন্ন নন, আত্মোপলব্ধির জন্য এক দুই হয়েছেন।জন্মজন্মান্তর ধরে ভক্ত এই লীলার আনন্দ প্রত্যক্ষ করতে চায়, দেখবার চোখ থাকলেই তা দেখা যায়। বৈষ্ণবের কাছে মোক্ষ কাম্য নয়,ভক্তিই তারা চান, ভক্তির মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের উন্মেষ আপনিই ঘটে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে অদ্বৈতবাদের মধ্যে দিয়ে চৈতন্যবাদ বিকশিত হয়। ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মে বৈষ্ণবধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। বৈষ্ণবী সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে সামিল হয় প্রাচীন মরমীবাদ,যা বাউল নামে অভিহিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক, তারা মানবতার বাণী প্রচার করে। আর বাউল সঙ্গীত হল বাউলদের আধ্যাত্মচেতনা ও জীবনচর্চা প্রকাশের আধার। বাউল দর্শনে বৈষ্ণবধর্ম ও সুফিবাদের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউল শিল্পী ও সাধকরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। বাউলসমাজ দেহতত্ত্ব সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার সাধনা করে।তাদের গানগুলোতে খাঁচা, মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি ,মনুরায় ইত্যাদি রুপক ও প্রতীকী ভাষায় তারা পরমাত্মাকে অভিহিত করে। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন। অনিবার্যভাবে ‘মৃত্যু’ তাদের গানের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাউলদের ‘মনের মানুষ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’, ‘অন্তর্যামী’ একই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ বিশ্বদেবতা আছেন, তাঁর আসন লোকে লোকে ,গ্রহ- চন্দ্র-তারায়।জীবন-দেবতা বিশেষভাবে জীবনের আসনে, হৃদয়ে হৃদয়ে তাঁর পীঠস্থান, সকল অনুভূতি সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে ।বাউল তাকেই বলেচে মনের মানুষ।’ কিংবা, মুহম্মদ মনসুরুদ্দীনের ‘হারামণি’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “ .......বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। .... “অন্তরতর হৃদয়মাত্মা” উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন “মনের মানুষ” বলে শুনলুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল...”।
সুফি মতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে একধরণের দ্বান্দ্বিকতা রয়েছে ; এই দুই বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা যখন মিলিত হয়, তখন ব্যক্তি যে কেবল পরিপূর্ণতা পায় তা নয়,সে মানুষের শারীরিক সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে উঠে যায়। একই ভাবে, লালন ফকিরের বিশ্বাসের জগতেও দেখি সাধকের সঙ্গে যখন ‘অচিন মানুষ’-এর মিলন ঘটে, তখন সাধক মানুষটি পরিণত হয় ‘মানুষরতন’–এ,এক উন্নততর মানবসত্ত্বায়। লালন বিশ্বাস করেছেন একজন মানুষ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্রতিটি মানুষই ‘মানুষরতন’ হওয়ার সম্ভাবনাময়—”এই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষরতন”। লালন বলেন, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় ।....খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন খানে পালায় ...।’ অর্থাৎ, শরীর বিনষ্ট হবে কিন্তু ‘আত্মা’ রয়ে যাবে , দেহ থেকে দেহান্তরে ‘ অচিন পাখি’র আনাগোনা চলতেই থাকবে।
পরিকথা
অনেকেই স্বীকার করেন দার্শনিক চিন্তাভাবনা মানুষকে মৃত্যু-বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষিত করে তুলতে কার্যকরি ভূমিকা নিতে পারে।ষাটের দশক থেকে আমেরিকা, ইউরোপ জুড়ে‘ প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুশিক্ষা’ বা ‘মৃত্যুশিক্ষা’কে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।হারমান ফেফেলসের লেখা বই ‘The meaning of Death’ আন্দোলনকারিদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর মতে, মৃত্যুশিক্ষা দু'ভাবে হতে পারে, বিশুদ্ধ এবং ফলিত। একজন মৃত্যুকে কেমনভাবে গ্রহণ করবে, নিজেকে প্রস্তুত করবে, শৈশবে মৃত্যু- পাঠের ধরন কেমন হবে, স্বেচ্ছামৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার মতো বিষয়গুলোকে কী চোখে দেখা হবে – এসব যখন বিশুদ্ধ মৃত্যুশিক্ষার অংশ হচ্ছে ; তখন ফলিত মৃত্যুশিক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে মুমূর্ষু রোগী ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের লোকজনকে প্রশিক্ষিত করে উদ্ভূত সমস্যা ও সংকট কিভাবে সামলানো যাবে। ধর্ম ও দর্শনের নানা পাঠ ‘মৃত্যু’, ‘মৃত্যু ব্যবস্থা’র সামগ্রিকতা অনুধাবনে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদেরকে সঠিক দিকে পরিচালিত করতে ও দিশা দেখাতে সাহায্য করে। মৃত্যুশিক্ষাকে জনস্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা আজ অনেক দেশই ভাবছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল সাধারণ মানুষ কিংবা স্বাস্থ্যপরিষেবার সাথে যুক্ত চিকিৎসক,নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যেকের যেমন পৃথক পৃথক শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনই প্রয়োজন মৃত্যুকে ‘সুন্দর’ ও মর্যাদাপূর্ণ করার জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি।
তথ্যসূত্র
Sallnow L. et.al. (2022) ‘ Report of the Lancet Commission on the Value of Death: bringing death back into life’; Lancet ; 399: 837-884.
Chishti (2018) ‘Sufis about Death’, The Sufi Tavern ; 20 March 2018; https://sufi-tavern.com/sufi-doctrine/sufis-about-death/ .
হোসেইন আনোয়ার মঞ্জু (২০২১) ‘ জীবন তো তোমাকে ছেড়েই যাবে ’ মৃত্যু সম্পর্কে সুফি ভাবনা , বার্তা ২৪ , ১২ আগষ্ট ২০২২ ;https://barta24.com/details/arts-literature/123225/life .
রায় সুমিত (২০২২) ‘ লালনের দর্শন বা বাউলতত্ত্ব এবং সুফিতত্ত্ব এর মধ্যে মিল ও পার্থক্য ’, বিবর্তন পথ , ২৮ জানুয়ারি ২০২২; https://www.bibortonpoth.com/10371 .
ঘোষ শান্তিদেব (২০১০) ‘ বাউলদের মনের মানুষ ও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ’ (পুনর্মুদ্রিত), হৃদয়, জানুয়ারি ২০১০ ( লীনা চাকী সম্পাদিত বিশেষ সংকলনঃ রবীন্দ্রনাথ ও বাউল ); পৃষ্ঠা ১২-১৫।
ধরি ধরি ধর ধর ধরি কিন্তু ধরে কই?
কারে ধরি কেবা ধরে ধরাধরি করে কই?
ধরনে ধারণে তারে ধরণী ধরি তেনারে
আঁধার ধারণা মাঝে সে ধারা শিহরে কই?
চলচিত্তচঞ্চরি – সুকুমার রায়
এই সহস্রাব্দে এসে ঠিক রোমাঞ্চকর সিনেমার মতো আমাদের উটতি বয়েসের দুনিয়া আমাদের অজান্তেই কখন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। কম বয়েসে আমরা ভাবতাম পৃথিবীর গল্প যেদিকে এগোচ্ছে তাতে যতই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকুক, পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে, চীন, ভারত সমেত গরীব দেশগুলোতে দারিদ্র্য কমবে এবং আরো অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নতি হবে। আমাদের কাছে যে গল্পের শুরু, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’। ‘বিজ্ঞানই শেষ কথা বলে’, যে জানার শুরু, হনুমান চলিশার দাপটে সে আজ পলায়মান। তখন স্কুলে যাবার পথে নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে দেওয়াল লিখনে পড়েছিলাম ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, আর এখন দেখছি ভারতের দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী আর চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের একই পুঁজির দোলনায় দোলা। যে সংবাদমাধ্যমের গৌরকিশোর ঘোষ, রামনাথ গোয়েঙ্কারা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলে জেলে গিয়েছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরা সরকারের পোষা সারমেয়র চেহারা ধারণ করে সরকারকে পাহারা দিচ্ছে।
শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই যেন এর প্রতিচ্ছবি। যে সোভিয়েত রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার পক্ষে ছিল তাদেরই উত্তরসূরিরা ক্রিমিয়া, ইউক্রেনে সাম্রাজ্য বানাচ্ছে। একদিন আমেরিকা গণতন্ত্রের নামে ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, ইত্যাদি দেশে সৈন্য পাঠাত, গর্ব করত তাদের গণতন্ত্র নিয়ে, গণতন্ত্রের তথাকথিত পীঠস্থান সেই তাদের দেশের রাজধানীতেই, ‘কংগ্রেস’, অধিবেশন চলাকালীন আক্রান্ত হয়, বিশৃঙ্খল আমেরিকার জনগণ দ্বারা। আপাতদৃষ্টিতে বাইরের জগত এক থাকলেও নিজেদের অজান্তেই কখন কমিউনিস্ট আন্দোলন, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলন,সব কোথায় হারিয়ে গেল। আমাদের স্বপ্নের শোষিত মানুষের অধিকারের লড়াই কখন হারিয়ে গেছে হোয়াটসঅ্যাপের গালগল্পে। যে জ্ঞানচর্চা ও আদর্শের কথা শুনে বড় হয়েছিলাম, কখন যে সেসব ধনচর্চা আর দুর্নীতিতে পরিণত হল বুঝতেও পারিনি। পাড়ার জমি দখলকারী পয়সাওয়ালা পেটমোটা প্রমোটার কখন যে পাড়ায় গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে গেলেন খেয়াল করিনি। রাজনীতিতে আদর্শের জায়গা নিয়ে নিল ধর্ম আর জাতপাত। আগে নিজেকে বুদ্ধিজীবী ভাবতে পারলে মানুষের গর্ব হত, সেই বুদ্ধিজীবী শব্দ কখন গালাগালে পরিণত হয়ে গেল।
বিগত চার দশকে পৃথিবীর হ’লটা কী? সেই একই মানুষ, সমাজ আর গণতন্ত্র রয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। আগের তুলনায় অনেক মানুষের বিশেষ করে মধ্যবিত্তের জীবন ও রোজগারের উন্নতি হয়েছে। ইংরাজি স্কুল আর কর্পোরেট হাসপাতালে মধ্যবিত্ত মানুষের ভিড়। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে, বাড়ির বদলে বহুতল ফ্ল্যাট এখন মফস্বলেও। অথচ দুচারটে ছোটখাটো যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদীদের মাঝে মাঝে জেগে ওঠা আর রাজনৈতিক প্যাঁচ কষাকষি ছাড়া তেমন বড় কোন পরিবর্তন কিন্তু পৃথিবীতে আসেনি, যাতে সভ্যতা যে রাস্তা দিয়ে চলছিল, তাকে এত বদলে যেতে হবে।
এই সময়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন জগতজোড়া উবেবি-র (উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়ন) ঢেউ আর দ্বিতীয় পরিবর্তন তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ। কিন্তু বহু অঙ্ক কষে পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরাই তো এই রাস্তার কথা বলেছিলেন এবং তথাকথিত জিডিপি নির্ভর উন্নয়নও কম হয়নি। মধ্যবিত্তের রোজগারেও বেশ জোয়ার এসেছিল। কিন্তু করোনা-পূর্ব সময় থেকেই পৃথিবী জুড়ে অর্থনীতির অবস্থা যেন ঠিক নেই, ঠিক নেই। করোনা ছাড়া এই সময় বর্তমান বিশ্বজুড়ে দুটো সঙ্কটের কথা খুব বড় করে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে; এক জলবায়ু পরিবর্তন আর দুই বিশ্বজুড়ে অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক বৈষম্য। এবং এরা এমন সাঙ্ঘাতিক চেহারা ধারণ করেছে যা নাকি সভ্যতার সঙ্কট।
২
জলবায়ু পরিবর্তনকে বছর বছর গরম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইক্লোন, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যার ঘনঘন ধেয়ে আসা থেকে কিছুটা বুঝতে পারলেও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে সেরকম ভাবে বুঝতে পারি কি? বছর ত্রিশ আগে পাড়ায় রিক্সা চালাতো ক্লাশ ফোর পাশ মদনদা, তার ছেলে সঞ্জীব বি-এ-তে ফেল করে এখন পাড়ায় টোটো চালায়। কিন্তু তখনকার টাটা-বিড়লাদের থেকে এখনকার আম্বানিরা কতো বেশি বড়লোক হয়েছে সেটা নিয়ে মদনদা বা সঞ্জীব কারোরই মাথা ব্যাথা নেই, আমাদেরও নেই। আর এটাও কি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব যে, সেই সময়ে মদনদার থেকে টাটা হাজার গুণ বড়লোক ছিল, নাকি এখন সঞ্জীবের থেকে আদানি কোটি গুণ বড়লোক হয়েছে? আর তাদের থেকে টাটা আম্বানিরা কতগুণ বড়লোক বা টাটা, আদানির থেকে এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার গরীব কিনা তাতে সঞ্জীবের কি? সে তো তার বাবার থেকে ভাল অবস্থায় আছে এটাতেই সে সুখী।
অথচ এই বৈষম্যই এই সময়ের সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ যখন দেশে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি চরমে, গত বছরই ৭.৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে,১ আর এশিয়ার ধনীতম মানুষ হয়ে উঠেছে আদানি ২, একমাত্র ভারতীয় যিনি বিশ্বের ৮ জন ১০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদের অধিকারীর তালিকায় এসে গেছেন। World Inequality Report ২০২২অনুযায়ী, ভারতকে দরিদ্র ও এক অতিধনী অভিজাত গোষ্ঠী সম্পন্ন অসম দেশের শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের নীচের ৫০% মানুষ দেশের মোট আয়ের ১৩% এর মালিক, যেখানে উপরের ১০% মানুষ দেশের ৫৭% আয়ের মালিক। বিশ্ব পুঁজিপতিদের বড় সংস্থা World Economic Forum, যারা প্রতিবছর সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্বের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সম্মেলন করে থাকে তারাও এই বৈষম্য নিয়ে চিন্তিত। তারা তাদের এপ্রিল,২২ এর আলোচনাপত্রে করোনা-উত্তর বিশ্বে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়ংকর বেড়ে চলার কথা আলোচনা করেছে। ৩ বলা হয়েছে বিশ্বের উপরের দিকের ১০% মানুষ ৭৬% সম্পদের মালিক।
এই বৈষম্য কিন্তু রাতারাতি হয়নি, ভারতবর্ষে গত শতাব্দীর ন’য়ের দশকের প্রথমে যখন মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশনেই অর্থনৈতিক ঊবেবি-র (উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়ন) পথ নেওয়া হয়েছিল। অসাম্য বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও সেসময় কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু বলা হয়েছিল এটাই নাকি দেশজুড়ে উন্নয়নের একমাত্র পথ, এতে লোকে বড়লোক হবে, আর তাদের উপচে পড়া বা চুঁইয়ে পড়া পয়সায় গরীবদের অবস্থা ফিরবে। কিন্তু যারা এই নীতি প্রণয়নে ভারতের মতো বিভিন্ন দেশকে উৎসাহ দিয়েছিল সেই বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ এখন কঁকাচ্ছে কারণ এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নাকি এই সময়ের বিশ্বের সব থেকে বড় সঙ্কটের একটা।
তার কারণও খুব স্পষ্ট; জাতিসংঘের ২০২০-র রিপোর্ট বলছে বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়তে থাকা আয়ের বৈষম্য পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনকে খুব খারাপভাবে প্রভাবিত করছে। বেশির ভাগ উন্নত দেশে এবং কিছু মাঝারী আয়ের দেশগুলোতেও আয়ের বৈষম্য বেড়েছে এবং চীন সমেত, বিশ্বের দ্রুতবেগে বাড়তে থাকা অর্থনীতিতে এর পরিষ্কার প্রতিফলন রয়েছে৪।প্রশ্ন হচ্ছে এর আগে কি বৈষম্য ছিল না? যুগ যুগ ধরেই তো বৈষম্য আছে, কবে পৃথিবী জুড়ে সাম্য ছিল? তাহলে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে এতো কান্নাকাটি কেন? তার কারণ অবশ্য জাতিসংঘের ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে যে বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষের হাতে বেশির ভাগ সম্পদ জমা হচ্ছে। আগেও বড়লোক ছিল, এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯০ তে উপরের এই এক শতাংশের মানুষের হাতে সম্পদের ভাগ যত ছিল ২০১৫ তে তা অনেক বেড়ে গেছে। মানে বড়লোক আরো বড়লোক হয়েছে অন্যদিকে গরীবের সংখ্যা ও দারিদ্র্য দুই বেড়েছে ৫।
সাতের দশকের শেষে মাও-সে-তুং-এর মৃত্যুর পর, দেং-জিয়াও-পিং চীনদেশে কমিউনিজমের রাস্তা ছেড়ে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক পথে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পশ্চিমে মারগারেট থ্যাচার ও রোনাল্ড রেগান বাজার অর্থনীতিকে দৃঢ় করে পশ্চিমের সামাজিক ন্যায় ও সামাজিক নিরাপত্তার যে মডেল ছিল তাঁকে ত্যাগ করে এবং কাছাকাছি সময়ে হয় সোভিয়েত রাশিয়ার পতন। ভারত ও পিছিয়ে থাকেনি। নয়ের দশক থেকে মনমোহন সিং বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর এর হাত ধরে ঊবেবি-র পথে যাত্রা শুরু করে। যখন থেকে বাজার অর্থনীতিকে নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা প্রবল প্রতাপে ছড়িয়ে দিতে শুরু করল তখন থেকেই বড়লোকদের বড়লোক হওয়া বেড়ে গেল। আশ্চর্যের কথা দেখা গেল বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের গরীব মানুষরা তার সমর্থন করেছিল। ক্রমশ শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষদের সংগঠন ও আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ল। এরই সঙ্গে বাড়ল জলবায়ু পরিবর্তনের গতি। বিশ্বজুড়ে এই গণতান্ত্রিক পথে বাজার অর্থনীতি মেনেই তো আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি, এখন হঠাৎ রাস্তা পরিবর্তনের এতো ব্যগ্রতা কেন?
৩
এই জুলাই মাসে ঝাড়খণ্ডের দুমকায় রাজমহল পাহাড়ের নিচের গ্রাম হিরাপুরে বোধন পাহারিয়া বলেছিল যে এবারের বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে বীজতলাতেই সব বীজ শুকিয়ে গেছে, এবার বোধহয় খাবার চালটাও হবে না। ফেরার পথে দেখলাম পাকুড়, দুমকা, বীরভূম সব জায়গাতেই এক অবস্থা, বোধনের মতো অনেকেরই এবার বৃষ্টির অভাবে চাষ হবে না। এদিকে এখন প্রতি বছরই অস্বাভাবিক গরম, জলের অভাব এবং খরার প্রকোপ সাঙ্ঘাতিক বাড়ছে। এছাড়া এখন প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগর-উপকূলবর্তী মানুষজন বিশেষ করে সুন্দরবনের মানুষ এখন বছর বছর ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের শিকার। এদিকে এবছর লন্ডনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপর, গরমে স্পেনের ক্যাটালনিয়ায় দাবানল ভয়ংকর রকম ছড়িয়ে পড়ছে আর তাপপ্রবাহে ইউরোপে অনেক জনের মৃত্যুও হয়েছে, আমেরিকার ফ্লোরিডা অঞ্চলে সাইক্লোন এখন বাৎসরিক দুর্যোগে পরিণত। কানাডায় কিছুদিন আগের ভয়ানক সাইক্লোনে সাতদিন বিদ্যুৎ ছিল না। সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধাক্কা এতদিন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের অগণিত মানুষকে বিপর্যস্ত করছিল তা এখন পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষজনকেও বিপর্যস্ত করতে শুরু করেছে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গত দুই-তিন দশক ধরে নানা কথাই তো আমরা শুনে আসছি। তাহলে এইসব কথা বারবার ফিরে আসছে কেন? কারণ, কথা অনেক হলেও কাজ সেরকম কিছু এগোয়নি। তাই দেখা গেল এই বছরের গোড়ার জাতিসংঘে আই-পি-সি- সি’র বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে মানুষ এবং এই গ্রহের এক ‘বিপজ্জনক এবং ব্যাপক বিঘ্নের’ কারণ বলেছেন। এর প্রভাব সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা জানিয়ে বলেছিলেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দুই দশক ধরে বিভিন্ন ইকোসিস্টেম ধংস হবে, বহু জীব প্রজাতি বিলুপ্ত হবে, মারাত্মক তাপপ্রবাহ এবং বন্যার প্রকোপ বাড়বে। আই-পি-সি-সি’র অধিকর্তা হোই সুং-লি বলেন ‘এই রিপোর্ট নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি সম্পর্কে একটি মারাত্মক সতর্কতা’৬।এটা খুব স্পষ্ট যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনেক প্রতিশ্রুতি ও কথা হলেও কাজ কিছু এগোয় নি।
সতের জনের এক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গ্রুপ যাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পল এরলিখও আছেন, তাদের গবেষণা পত্রে ৭ বলেছেন, “এই গ্রহ স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর দুর্যোগের কারণে”ভয়াবহ এক বিশ্বব্যাপী জীববিলুপ্তির (Mass Extinction) পথে এগিয়ে চলেছে। তারা এও বলেন মানব প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হবে তার অজ্ঞতা ও নিস্ক্রিয়তা। তারা সাবধান করেছেন যে, মানুষ জীববৈচিত্র ধংসের ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের গুরুত্বকে এখনো ধরতেই পারেনি। তাদের মতে, এই সঙ্কটের মাত্রা এতো বড় যা মানুষ সমেত সমগ্র জীবমণ্ডলকে ধংস করবে, বিশালাকৃতির এই সঙ্কটকে সাধারণ মানুষ দূরে থাক বড় বড় বিশেষজ্ঞরাও অনুধাবন করতে অক্ষম ৮।এই বছরের প্রথম দিকে যখন এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তখনও বিশ্বের সব দেশ ২০১১ সালের জাতিসংঘের ঘোষিত ২০টি Aichi ৯ জীববৈচিত্র্য লক্ষ্যের একটাও পূরণ করতে ব্যর্থ। এর পরিণতিতে প্রাকৃতিক জগত সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে পড়ছে। বিগত ১০ বছরে দুবার বিশ্বের সব দেশ এই লক্ষ্য পুরণে ব্যর্থ হল। এবং ২০২২-এ গ্লাসগোর COP 26 সম্মেলনে ৫০টি দেশ পুনরায় অঙ্গীকার করেছে ২০৩০-এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বিশ্বকে বাঁচানোর।
এই বছর প্যারিসে Intergovernmental Science-Policy Platform on Biodiversity and Ecosystem Services (IPBES), তাদের নতুন রিপোর্টে দেখিয়েছে যে যদি বিশ্ব স্তরে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে ১০লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে মানুষ দুই-তৃতীয়াংশ স্থল এবং ৬৬% সামুদ্রিক পরিবেশের বড় রকম পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটিয়ে ফেলেছে।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এগোচ্ছে না কেন? জাতিসংঘের বিজ্ঞানীকূল এর নানা কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসাবে বিশ্বনেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন। এখন প্রশ্ন, বিভিন্ন দেশের নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটকে দেখেও নিজেদের দেশে এই সংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নে বারবার ব্যর্থ কেন? বিশেষ করে আমেরিকা চিনের মতো শক্তিশালী এবং বড় অর্থনীতির দেশের নেতৃবৃন্দ। এটা বুঝতে হবে, এটা তাদের খামখেয়ালীপনা নয়। বেশিরভাগ সময়েই তারা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিস্টেমে কাজ করে সেটাই তাদের কাছে বড় বাধা। আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্টই সেখানকার অসম্ভব শক্তিশালী খনিজ তেলের গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে জীবাশ্ম তেলের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আনতে পারবে না। অন্যদিকে ভারত ও চিনের মতো দেশের পক্ষে কয়লা বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে তাদের জ্বালানির প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। এখানে সাধারণ মানুষের সস্তায় যে জ্বালানির প্রয়োজনীতা, এইমুহূর্তে জীবাশ্ম জ্বালানিই তা মেটাতে পারে। দ্রুত উন্নয়নের সহজ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সব দেশই এমন এক উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছে এবং মানুষকে এমন এক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ করেছে, যে তারা এখন সহসা তার থেকে বেরোতে চাইবে না। এবং সব রাজনৈতিক দল জনগণের মতকে মেনে চলবে, ক্ষমতায় থাকার জন্য বা ক্ষমতায় আসার জন্য। অর্থাৎ এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট থেকে বেরোনোর পথে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন এই দুই বিশ্বব্যাপী সমস্যার মধ্যে কি কোন যোগাযোগ আছে? নাকি এরা একে অপরের থেকে আলাদা?
৪
বর্তমান সময়ে দ্রুত প্রযুক্তির পরিবর্তন এবং উৎপাদনে উন্নত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন কলকারখানায় কায়িক শ্রমের ও পরম্পরাগত শ্রমিকদের এক বড় অংশ তাদের কর্মসংস্থান হারাচ্ছে। অন্যদিকে কমসংখ্যক কিন্তু বেশি মাইনের আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। এর ফলে ভারতবর্ষের মতো যেসব দেশে শিক্ষার প্রসার ও মান খুব কম এবং আর্থিকভাবে দুর্বল এক বিশাল জনসংখ্যা কায়িকশ্রম ও পরম্পরাগত শ্রমের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এক বড় সংখ্যক শ্রমযোগ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে এবং সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পড়া যায় না যে অর্থনৈতিক অসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা আপাতভাবে দুটো আলাদা সমস্যা মনে হলেও এরা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটা বুঝতে হলে আমাদের এখানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে দেখা যায় জঙ্গলে ঢাকা এই মালভূমি-প্রধান অঞ্চলে আদিবাসীদের বাস এবং ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে এক সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। এখানকার জঙ্গলের কারণে জলের প্রাচুর্য ও জমির উর্বরতা অটুট ছিল, যা এখানকার আদিবাসীদের এক প্রকৃতি নির্ভর স্থায়ী, স্থিতিশীল জীবন ও জীবিকা দিয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ উপনিবেশিকতা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে, এই মালভূমি অঞ্চলের কাঠ ও খনিজ কাঁচা মালের জন্য বিগত দু’শ বছরে প্রাকৃতিক সম্পদের যে প্রাতিষ্ঠানিক লুট হয়েছে তাতে এখানকার বনভুমি ও জীববৈচিত্রের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ধংস হয়েছে তেমনই এখনকার আদিবাসীদের স্থায়ী, স্থিতিশীল জীবনযাত্রা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা যেমন দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে গেছে অন্যদিকে টাটা, জিন্দাল, গোয়েঙ্কা, আগরওয়াল, আদানি প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পরিবার এই খনিজ সম্পদ ও কাঠের ব্যাবসা করে বিগত বছরগুলিতে অসম্ভব সম্পদের মালিক হয়েছে। কিন্তু এ’ত বহুদিন ধরে চলে আসছে, আজ হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন উঠছে?
ক্রমশ এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশ্বঅর্থনীতির স্থায়িত্বকে এক গভীর সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দুই সমস্যা শুধু গরীব মানুষদের নয় বিশ্বপুঁজি ব্যবস্থাকেও এতটাই অনিশ্চয়তার সামনে এনে ফেলেছে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও চিন্তায় ফেলেছে। একদিকে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্যের প্রধান কারণ অন্যদিকে এই দুই সঙ্কট পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। এবং এর শিকার হবে বিশ্বজুড়ে অগণিত সাধারণ মানুষ ও প্রাণী।
আই-এম-এফ তাদের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে ১০ তাদের ভয়ের কারণ খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল গতিময়তায় বিশ্ব-অর্থনীতির অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন এবং এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। তারা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সঙ্কট বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট ১ শতাংশ বাড়লে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে ১.৫ শতাংশ হারে। এবং এই বৈষম্যের হার কিন্তু বিভিন্ন গ্রুপ্রের দেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হবে। ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে এর হার সাত গুণ বেশি হবে।
বর্তমান বাজার অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমারা এখন ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে এই বিপুল বৈষম্যকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, এক বিশাল অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কর্মহীন শ্রমযোগ্য কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন ভূমিকা থাকছে না, অন্যদিকে এইসব অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ এই বাজার ব্যবস্থায় উপভোক্তা হিসাবেও থাকবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এদের মুল্য যখন খুব কম তখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এদের ভূমিকা কেবল ভোট দেওয়ায়।
৫
বিগত চার দশকে বাজার অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির সাঙ্ঘাতিক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেল। প্রথম প্রথম ঘুষ নেওয়া বাড়ল, এর সাথে বাড়ল কালো টাকার রমরমা এবং এরপর বড় ব্যবসার ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার ও নানা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঠকিয়ে টাকা বানানো। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা দলের হয়ে ২০০১ সালে বাঙ্গারু লক্ষ্মণ মাত্র ১লক্ষ টাকা নিতে গিয়ে ধরা পড়েন আর এখন রাজ্যের নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় নাকি ৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে ধরা পরেছেন। এই দুটো নিশ্চয়ই সঠিক তুলনা নয় তবুও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সময়ের সাথে সাথে দুর্নীতির বিস্তার ও অঙ্ক দুটোই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভারতে দ্রুত বেড়ে চলা দুর্নীতিকে রুখতে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি আইন-ব্যবস্থাও ব্যর্থ। এরই সঙ্গে যেটা ক্রমশ কমছে সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ, সততা ও আদর্শ।
গ্লাসগোর COP 26 সম্মেলনের পর লেখক আমিতাভ ঘোষ সাম্প্রতিক এক ইন্টারভিউতে বলেছেন যে, এই সম্মেলনের ফলাফল থেকে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে, এরা এদের উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তার কথা থেকে এই জটিল সঙ্কটের সময় দুটো ভয়ের কথা একসঙ্গে বেরিয়ে আসে। এক,জাতিসংঘের মতো সকল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, যাদের কাজ এই সমস্যার সমাধান খোঁজা তাদের প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভেঙে পড়া, আর দুই; বিশ্বস্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা কোন এক দেশ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সামলানো অসম্ভব। প্রথম প্রসঙ্গে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে জাতিসংঘের অসহায় অবস্থার কথা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেন। বর্তমানে একজন সাধারণ মানুষ থেকে দুঁদে কূটনীতিক সবার কাছে স্পষ্ট যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে জাতিসংঘ বা অন্যান্য যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব ক্রমশ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। গত দুই বছরে কোভিড অতিমারির সময় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভুমিকা রাষ্ট্রনেতা থেকে সাধারণ মানুষের কাছে বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যে ভয়াবহ অবস্থা ছিল তার থেকে মানুষের বেরিয়ে আসার পথ হিসাবেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এবং গত শতাব্দীর আটের দশক পর্যন্ত এইসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের রাজনীতি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসার চেষ্টা করেছে। এদের কাজে এবং পরিচালনার মধ্যে বড় পরিবর্তন দেখা যায় আটের দশকের পর বিশ্বজোড়া বাজার অর্থনীতির প্রবল প্রতাপে।
বর্তমান বিশ্বে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থায় যে বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণ করে এবং সেখানে তারা যেসব চুক্তি করে বা কথা দেয় সেসব কথা বা চুক্তির শর্ত মানার কোন দায় তাদের নেই। যেমন রাশিয়া গত বছর নূতন দিল্লির ব্রিক্স (BRICKS) ঘোষণাপত্রে সাক্ষর করেছিল এই বলে যে ব্রিক্সদেশের সদস্যরা কোন সার্বভৌম দেশকে দখল করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তাঁর কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ইউক্রেন আক্রমণ করে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিগত ২৫বছরে নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তিতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বারবার আমেরিকা, চীন সহ পশ্চিমের উন্নত দেশ এইসব চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এক বা দুই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী বা দেশের রাষ্ট্রনায়ক তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার জোরে বিভিন্ন দেশের মেনে নেওয়া চুক্তির বাস্তবায়ন আটকে দিচ্ছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অসহায়ের মতো তা দেখছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষজন এবং তৃতীয় বিশ্বের অসংখ্য গরীব দুর্বল মানুষ। অথচ মজার ব্যপার হচ্ছে বিগত চার’শ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের উপর দাঁড়ানো প্রথম বিশ্বের সমস্ত পাপের বোঝা, এই তৃতীয় বিশ্বের মানুষজন এখনো বয়ে চলেছেন। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধের ফল হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির চাপে তারা বিধ্বস্ত, তাদের অবদান বিশ্ব-উষ্ণায়নে সবথেকে কম অথচ এর সমস্ত খারাপ ফল তারা সব থেকে বেশি ভোগ করে চলেছে। এই সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকৃতি বন্ধ করার জন্যই একসময় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুচনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এইসব প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশ ও গোষ্ঠীর হাতে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্রমাগত ব্যবহৃত হচ্ছে।
করোনা সময়ে দেখা গেল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিদের দাপট ও মাত্রাহীন লাভের গল্প। ক্রমশ এইসব অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থাদের লাভের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে তাদের প্রভাব দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর পড়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল, তথ্যপ্রযুক্তি, জীবাশ্ম শক্তি ও বিনোদন সংস্থার লবি এবং সবার ওপরে এদের পুঁজির জোগানদার, আর্থিক বাজারে বিদেশের রাজনীতি বিদেশনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকেও লাভের জন্য ব্যবহার করে গেছে।
৬।
এই সময়কালের এক বড় চিন্তাবিদ ইউভাল নুহা হারারি তাঁর ‘দি সেপিয়েন্স’ বইয়ে, পৃথিবীর অন্য সব প্রাণীর মধ্যে মানুষের অভূতপূর্ব সাফল্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মানব-সভ্যতাকে প্রভুত ক্ষমতার অধিকারি করে তোলে, মানুষের সমষ্টিগত কল্পনা এবং তাকে নির্ভর করে অসংখ্য মানুষের সমবায় ও সংগঠিত কর্ম প্রয়াস। এই সমষ্টিগত কল্পনা জন্ম দেয় দেশ, সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র, ধর্ম, গণতন্ত্র, সমানাধিকার ইত্যাদি, বস্তুত যার উপর বর্তমান মানব-সভ্যতা দাঁড়িয়ে। এইসব কল্পনায় এমন একটা মহান উদ্দেশ্য থাকে যা সমষ্টি অন্তর্গত ব্যক্তিকে এক বৃহৎ উদ্দেশে উত্তীর্ণ হবার বা বড় কিছু পাবার অনুপ্রেরণা যোগায়। অগণিত মানুষ তাদের সেই সমষ্টি-কল্পনাকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একসঙ্গে কাজ করে, ঘাম ও রক্ত ঝরায়। অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস এবং তা বাস্তবায়নের যে চেষ্টা, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানব সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কাহিনী। প্রকৃতপক্ষে আজকের বিভিন্ন রাষ্ট্র বা ধর্ম তো অনেক মানুষের সমষ্টিগত কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে যে বর্তমানে আমরা মানব সভ্যতার যে সঙ্কট দেখছি তাঁর সমাধানে এইসব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ কেন? ক্রমশ কর্কট রোগের মতো যেসব সমস্যা মানব সভ্যতাকে গ্রাস করতে চলেছে তার সমাধানে মানুষের সেই সমষ্টিগত কল্পনা নির্ভর কাজের ব্যর্থতা কেন? অমিতাভ ঘোষের মতো লেখকদের কেন মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানেরা মৌলিকভাবে ভেঙে পড়েছে সভ্যতার বৃহত্তম সঙ্কটের মোকাবিলায়? মনে রাখতে হবে এই দেশ, রাষ্ট্র, ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এই সমষ্টিগত কল্পনা জন্ম দিয়েছে বৃহৎ কর্পোরেট, আইন ব্যবস্থা, মুদ্রার এক বৃহৎ কাল্পনিক কাহিনী যাদের মানুষের মন এবং তাদের তৈরি ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন জাগতিক অস্ত্বিত্ত নেই। কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত মানুষের স্বার্থ, লোভ ও বাসনা এবং এই এইসব সমষ্টিগত লোভের জীবনযাত্রার কিন্তু এক বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব আছে। অনেক মানুষের মধ্যে দিয়ে অনেক সময় ধরে চর্চিত হতে হতে এইসব লোভ ও বাসনা বাস্তবের মতো অনুভূত হতে থাকে।
গ্রীক সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায় যে গ্রীসের নগরসভ্যতার পরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্যের আক্রমণকে রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্পারটার যুদ্ধ বা ম্যরাথনের যুদ্ধের কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এক শক্তিশালী গ্রীক সাম্রাজ্য গঠনের সমষ্টিগত কাহিনীর পরিণতি। লেনিন
ও বলশেভিক নেতৃত্বের সাম্যের ও সমাজতন্ত্রের কাহিনীর সফল সমষ্টিগত পরিণতিই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম দেয়। ঠিক এইরকম শক্তিশালী জাতির কাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করেই চেঙ্গিস খান বাউন্ডুলে যাযাবর মোঙ্গলিয়ানদের এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। জার্মানদের জগতশ্রেষ্ঠ মানবজাতি বানানোর কাহিনী সফলভাবে বিক্রি করেই হিটলার থার্ডরাইখের সর্বময় কর্তা হন। অর্থাৎ এইসব সফল সমষ্টিগত কাহিনী মানব সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করে চলেছে। তাহলে এখন যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা দেখছি, তার কারণ কি?
কারণ আমরা অন্যদিকে দেখছি না আরেক শ্রেণির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সফলতা। বাজার নির্ভর বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজী অহিংস পথে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাবেন না মুসোলিনি ইটালিকে ফ্যাসিস্ট পথে চালিত করবে, সবই নির্ভর করবে বৃহত্তর জনগণের সমষ্টিগত চিন্তার উপর। ঠিক সেরকমভাবেই যেসব মানবতামুখী প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর মানবসমাজ বা সমগ্র মানব প্রজাতিকে রক্ষা করার কথা ভাবছে তাদের থেকে যখন লাভ ও লোভ-নির্ভর বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থারা প্রভুত অর্থনৈতিক ক্ষমতায় বলশালী হয়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের সুবিধামত সমষ্টিগত চিন্তার জন্ম দিচ্ছে, তখন তারা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের সকল প্রতিষ্ঠানকেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
৭
গত ১লা আগস্ট ভারতে ৫জি স্পেকট্রামের নিলামে সব থেকে বেশি মুল্য পাওয়া গেছে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১০ সালে যে ২জি স্পেকট্রামের দুর্নীতির কথা শোনা গিয়েছিল, সেখানে CAG বলেছিল ২জি’র নিলামে নাকি ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অর্থাৎ ২০১০-এর ২জি নিলামের লোকসান ২০২২এর ৫জির নিলামের সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে বেশি। এটা কি সম্ভব? মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই সময়ে ২জি নিয়ে যে দেশব্যাপী জনমত তৈরি হয়েছিল তার তুলনায় এখন সব চুপ। কেন? কারণ তখন জনমত তৈরি করতে বিরোধী দল সক্ষম হয়েছিল, এখনকার বিরোধী দল তা করতে পারছে না। কিন্তু এটা কি কেবল রাজনৈতিক বিরোধী ও সরকার পক্ষের লড়াই, নাকি অন্য কিছু? প্রশ্ন আসবে এর মোটিভ বা উদ্দেশ্য কি? কে বা কারা সব থেকে বেশি লাভবান হ’ল এইভাবে মূর্তির জনমত তৈরির খেলায়? মুঠোফোনে মাথা গুঁজে বসে থাকা জনগণ এই মুহূর্তে এই নিয়ে আলোচনায় রাজি নয়। এই যে মুঠোফোনের সমাজ মাধ্যমের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা তাই ক্রমশ জনমত তৈরির অব্যর্থ ওষুধে পরিণত হয়েছে।
শ-বারো বছর আগেও রেডিও টেলিভিশনের মতো ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের উপর রাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করত যাতে মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধ মাধ্যমের পক্ষে সব মানুষকে ব্যাক্তিস্তরে প্রভাবিত করা বেশ শক্ত। বর্তমানের ইন্টারনেট-নির্ভর ইলেক্ট্রনিক সমাজমাধ্যমের সঙ্গে কম্পুটার-নির্ভর কৃত্রিমবুদ্ধির (Artificial Intelligence) অসীম শক্তিশালী এলগোরিদম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার অসীম ক্ষমতা এনে দিয়েছে গুগুল, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো বিভিন্ন সমাজমাধ্যম চালানো কোম্পানিদের হাতে। জনমতকে নিজের দিকে আনার জন্য দরকার দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছে তাদের মতো করে বোঝানোর অস্ত্র, যা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বলে এইসব অমিতবলশালী কর্পোরেট গোষ্ঠী এখন করতে সক্ষম। এটা কোন উর্বর মস্তিস্কের যথেচ্ছ কল্পনা নয়, এটা বাস্তব। কিছুদিন আগের নীল তিমি ‘Blue Whale’ ইন্টারনেট খেলাটির কথা ভাবলে বোঝা যায়। বহুদূর থেকে এই মাধ্যমের দ্বারা একজন মানুষকে এতোটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায় যে, সে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পিছপা হয় না।
সাম্প্রতিক নেট দুনিয়ার অনেক মানুষই নেটফ্লিক্সের তথ্য-চিত্র ‘The Social Dilemma’ দেখে নড়ে চড়ে বসেছেন। এই তথ্যচিত্রে দেখান হয়েছে আজকের জগত বিখ্যাত ও বৃহৎ সমাজ মাধ্যমের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ প্রযুক্তিবিদদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার। এদের অনেকেই এইসব সমাজমাধ্যমের শুরুর সময় থেকে জড়িত ছিলেন। যেভাবে এইসব সমাজমাধ্যম আমাদের চিন্তাকে নিয়্ন্ত্রণ করছে ও নিজেরদের স্বার্থে ব্যবহার করছে তাতে এরা প্রত্যেকেই ভয়ংকর বিপদের আশঙ্কা করছেন। এই তথ্যচিত্র থেকে তিনটে জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে;
ক) আমাদের মনোযোগ এখন পণ্য। সমাজ-মাধ্যম কোম্পানিদের প্রধান উদ্দেশ্য, আমাদের মনোযোগ দখল করা এবং বাজারে যে সব থেকে বেশি পয়সা দেবে তাকে বিক্রি করা। এই প্রবাদটা এখন খুব প্রচলিত হয়েছে, তুমি যদি কোন পণ্য বিনামুল্যে পাচ্ছ তাহলে জানবে তুমিই পণ্য। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিখ্যাত বই ‘The Attention Merchants’-এর লেখক টিম ঊর মতে, এই মনোযোগ-ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মডেলই হচ্ছে মানুষের চিন্তায় প্রবেশ করার যে পথ তাকে বিক্রি করা। ‘এই মনোযোগ শিল্পের প্রধান প্রয়োজন ক্রমাগত বিক্ষিপ্ত মন যাকে সহজেই বিজ্ঞাপনের জন্য খোলা যাবে’, এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ‘বিক্ষিপ্ত মনের অসুস্থতা’ বা ‘Distraction Sickness’। যা ইতিমধ্যে হয়ত আপনাকে আমাকে ধরে ফেলেছে।
খ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব সাইটেরই পরিকল্পনা হচ্ছে আসক্তি বা নেশা ধরানো। মানব মনের দুর্বল জায়গার সুযোগ নিয়ে তাকে ব্যবহার করা। অর্থাৎ আপনি যে ধরনের জিনিস পছন্দ করেন বা ভালোবাসেন তাকে লক্ষ্য করা এবং বারবার আপনার সামনে নানা ভাবে নিয়ে আসা যাতে আপনি তার থেকে বের হতে না পারেন। এবং সে যতো আপনাকে টানতে পারবে ততো আপনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
গ) এরা কোন সাধারণ ব্যবহার করার যন্ত্র (tool) নয়। যেমন ধরুন দেওয়ালে পেরেক লাগানোর জন্য আপনার একটা হাতুড়ি আছে। আপনার প্রয়োজন হলে আপনি হাতুড়ির ব্যবহার করেন এবং তার বাক্সে রেখে দেন, হাতুড়ি কখনই বাক্সে ঠকঠক করে মাঝে মাঝে বলে না দেখুন, ওইখানেও একটা পেরেক আছে ইত্যাদি। কিন্তু সামাজমাধ্যম আপনাকে প্রতিনিয়ত জানায় আপনাকে কত লোক ভালো বলল, কত লোক আপনার বন্ধু, তারা এই মুহূর্তে কতো আনন্দ করছে ইত্যাদি। বারবার সে আপনাকে ডাকছে, আপনার দুর্বলতা অনুযায়ী প্রলুব্ধ করছে এর মধ্যে ঢোকার জন্য।
অর্থাৎ মানুষের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদও এখন এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সমষ্টির কল্পনাকেই যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে সভ্যতাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটেও সরকারের দোষ দেখতে পেলো না, অন্যদিকে কয়েক বছরের মধ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, এক বড় সংখ্যক মানুষের প্রধান শত্রুতে পরিণত হল, কোনটাই আকস্মিক ঘটনা নয়।
৮
এই অবস্থার প্রাথমিক কারণ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের প্রকৃতি থেকেই উদ্ভূত। পুঁজিবাদের অধীনে কার্যত মানুষের সমস্ত উদ্যোগ যে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তা সম্পদের ব্যবহার কম করতে গিয়ে প্রযুক্তির দ্বারা দক্ষতার যে ভয়ংকর উন্নতি করেছে তা অনিবার্যভাবে আরও শোষণের বিশালব্যবস্থা হয়ে ওঠে, যা সম্পদের ব্যবহার কম করার বদলে, তাকে বাড়ানোর দিকে নিয়ে চলেছে। এই গতিশীল অবস্থা, জেভনস প্যারাডক্স নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভন্স প্রথম এই প্যারাডক্সের কথা বলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, জেমস ওয়াটসের বাষ্প-ইঞ্জিন, কয়লা-চালিত ইঞ্জিনগুলির ক্ষমতা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে উন্নত করে, ইঞ্জিনে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যদিকে আবার কয়লার ব্যবহারের নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটায়। একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার পরিমাণ কমে গেলেও, ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে যায়। জেভন্স প্যারাডক্সে আমরা বাস্তবে দেখি মোটর গাড়ির জ্বালানীর দিকে দক্ষতা যত বেড়েছে তা মানুষকে দীর্ঘ দূরত্বে গাড়ি চালাতে উৎসাহ দিয়েছে। কয়েকজন হাতেগোণা বড়লোক উপভোক্তা নন, গণ হারে মানুষকে উপভোক্তায় পরিণত করে।
এখন এই জেভন্স প্যারাডক্সকে বিশ্বব্যাপী বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে দেখা যায় যে এটি আসলেই কোনো প্যারাডক্স নয়, বরং এটাই পুঁজিবাদের অন্তর্নির্মিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। শেয়ারহোল্ডার-মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলি, বৈশ্বিক-পুঁজিবাদের প্রাথমিক এজেন্ট হিসাবে, আইনগতভাবে গঠিত হয়, শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা বাধ্যতামূলকভাবে সর্বাধিক করার জন্য। যদিও শেয়ারহোল্ডারদের আইনত ‘মানুষ’ বলে ধরা হয় কিন্তু তারা যদি প্রকৃতপক্ষে মানুষ হয় তবে তারা সাইকোপ্যাথ হিসাবে গণ্য হবে, কারণ তারা নির্মমভাবে তাদের সব থেকে বেশি মুনাফার লক্ষ্য পূরণের জন্য যে কোন আনুসঙ্গিক ক্ষতির বিবেচনা করে না। আজকে এই মুহূর্তে বিশ্বের ১০০টা বড় অর্থনীতির মধ্যে ৬৯টাই বৃহৎ কর্পোরেশন, যেগুলি সম্মিলিতভাবে একটি ভয়ংকর শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে যার একটি মাত্র লক্ষ্য, দ্রুততম হারে অবিরাম মুনাফা বৃদ্ধির জন্য মানবতা এবং বাকি জীবকে ব্যবহার করা ১১।
সত্যিই কি মানবপ্রজাতি তারি সভ্যতার চাপে ধ্বংস হতে চলেছে, নাকি এলান মাস্কের রকেটে চড়ে মঙ্গলে গিয়ে বসতি বানাবে? কে জানে, তবে আবার আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয়নি, তিনি বলেছিলেন মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই সময়ে কিছু রাস্তার কথা বিশিষ্ট, প্রাজ্ঞ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এই জটিল অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য। উপরে উদ্ধৃত Frontiers in Conservation Science এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এই বিপুল বিশ্বব্যাপী সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সাম্যের সুদুর প্রসারী পরিবর্তন। এই রিপোর্টের গবেষকরা যে যুক্তিপূর্ণ সুপারিশ করেছেন তার মধ্যে আছে অবিরাম এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চক্রকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা, পরিবেশের বিভিন্ন বস্তু ও পরিষেবার সঠিক মুল্যায়ন, সম্পূর্ণভাবে জীবাশ্ম শক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা, কর্পোরেট গোষ্ঠীর লবিং বা সীমাহীন তদ্বিরের উপর লাগাম টানা এবং নারীদের সশক্তিকরণ।
গারডিয়েন পত্রিকায় ফিল ম্যাকডাফের এক নিবন্ধের ১২ শিরোনাম ‘Ending climate change requires the end of capitalism. Have we got the stomach for it?’ এখানে লেখক বলেছেন নীতির ছোটখাটো পরিবর্তনে এখন আর কোন কাজ হবে না, এখন রান্না ঘরের নোংরা জলের গামলাটাকেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হবে, কাজ, মালিকানা এবং পুঁজি নিয়ে।
বিভিন্ন আলোচনা থেকে একটা সত্যি বেরিয়ে আসে যে মানুষ ঘরের মধ্যে উপস্থিত বিরাট উটটাকে আর উপেক্ষা করতে পারবেনা, সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। এই উটটা এত বড় এবং এত স্পষ্ট এবং সর্বব্যাপী যে তাকে অর্থনৈতিক কচকচি দিয়ে বা রাজনৈতিক প্যাঁচ কষে আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই উট হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণ সভ্যতাকে এক ভয়ংকর সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরই প্রতিফলন আমরা দেখি ষোল বছরের কিশোরী গ্রেটা থানবারগের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে। তার সঙ্গে যখন তার বয়সী কিশোর কিশোরীরা রাস্তায় বেরিয়ে আমাদের প্রজন্মকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে তখন মনে আশা জাগে।
১.https://www.cnbc.com/2021/03/19/covid-pandemic-pushes-75-million-more-people-into-poverty-in-india-study.html
২https://www.forbes.com/sites/jemimamcevoy/2022/04/11/indias-gautam-adani-is-now-richest-asian-
৩.https://www.weforum.org/agenda/2022/04/economic-inequality-wealth-gap-pandemic/
৪. World Social Report 2020
৫. World Social Report 2020
৬. IPCC adaptation report 2022
৭. a report in Frontiers in Conservation Science
৮.https://www.theguardian.com/environment/2021/jan/13/top-scientists-warn-of-ghastly-future-of-mass-extinction-and-climate-disruption-aoe
৯. UN Convention of Biological Diversity in 2011
১০. IMF Working Paper No. WP/22/103, For whom the Bell Tolls: Climate Change and Income Inequality, May 2022
১১.https://www.resilience.org/stories/2021-10-13/solving-the-climate-crisis-requires-the-end-of-capitalism/
১২https://www.theguardian.com/commentisfree/2019/mar/18/ending-climate-change-end-capitalism
অর্জুন আপ্পাদুরাই (ArjunAppadurai) ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক গতিপ্রবাহ নিয়ে কাজে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন। জন সংস্কৃতি নামের একাডেমিক জার্নালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। American Academy of Arts and Science -এর ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৯৭ সনে। বিশ্বায়ন অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ এই তাত্ত্বিকের “We are witnessing the revolt of the elites” শীর্ষক একটি লেখা ‘The Wire’ নামের ইন্ডিয়ান অনলাইন পোর্টালে গত ২২ এপ্রিল (২০২০) প্রকাশিত হয়েছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট সারোয়ার তুষার।
মূল প্রবন্ধের পরে অনুবাদকের মন্তব্যও যুক্ত করা হয়েছে।
নব্য এলিটদের গণতন্ত্রবিরোধী অভ্যুত্থান, ‘গনতন্ত্রের’ই নামে…
হোসে ওর্তেগা ওয়াই গ্যাসেট (Jose Ortega y GassetGasset) ছিলেন বিশ শতকের বিস্মৃতপ্রায় অপ্রথাগত স্পেনীয় চিন্তক ও দার্শনিক, যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাজ বিজ্ঞানের কাজ জনতার উত্থান (১৯৩০)। উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন ইন্ডিভিজুয়ালের ক্রমশ উধাও হতে থাকা এবং ‘উন্মত্ত জনতা’র আবিভার্ব তাকে উদ্বিগ্ন করেছিল।
ওর্তেগার ‘আম-জনতা’র ধারণা গরীব, নিঃস্ব কিংবা সর্বহারা জনগোষ্ঠীর নয়, বরং একই অভিরুচি, মূল্যবোধ, স্বভাব-চরিত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গড়পড়তা সাধারণ মানুষের চিত্র। এইভাবে, ওর্তেগা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের গণ-সমাজের সমালোচনার চেয়েও বেশি সাম্প্রতিক মার্কিনী সমালোচকদের কাছাকাছি ছিলেন। তবুও, উনিশ শতকের উদার আদর্শের বিপরীতে উন্মত্ত জনতার উত্থানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে (সেই ব্যাখ্যা যেমনই হোক) ওর্তেগা শুরুর দিককার কন্ঠই ছিলেন।
আমি এখন ওর্তেগায় ফিরে আসলাম কারণ আমি মনে করি নানা কিসিমের গণজাগরণেই বিশ শতক নিঃশেষ হয়েছে এবং আমরা ‘নব্য এলিটদের উত্থান’-এর এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এই উদীয়মান এলিটরাই নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, এরদোগান, জেইর বলসোনারো, বরিস জনসন, ভিক্টর ওর্বান এবং এমন আরো বহু নব্য স্বৈরাচারদের আবরণ হিসেবে কাজ করে। তাঁদের সমর্থন আর তোষামোদ করে। তাঁদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। নরেন্দ্র মোদী’সহ যেসব নব্য স্বৈরাচারদের নাম উল্লেখ করলাম, এরা এইসব নব্য এলিটদের উপর ভর করে এমন এক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উপর থেকে আরোপিত লোকরঞ্জনবাদ (populism)’। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমজনতা কেবল গণতন্ত্র থেকে ব্যাপকমাত্রায় নিষ্ক্রমণের উপকরণ মাত্র।
জনতার উত্থান (১৯৩০); লেখকঃ হোসে ওর্তেগা ওয়াই গ্যাসেট
এইসব নতুন স্বৈরাচারী এলিটদের আচরণকে লুন্ঠনজীবী পুঁজিবাদ, পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কপ্রণালীর নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদের নতুন ছদ্মবেশ, দুর্যোগ পুঁজিবাদ না বলে ‘অভ্যুত্থান’ বলছি কেন? এই নব্য এলিটরা কারা? তাদের অভ্যুত্থানটাই বা কিসের বিরুদ্ধে?
প্রথমত, তাঁদের এই উত্থান অন্য সমস্ত এলিটদের বিরুদ্ধে, যাদের তাঁরা হেয়, ঘৃণা ও ভয় করেঃ উদারনীতিবাদী এলিট, মিডিয়া এলিট, সেক্যুলার এলিট, কসমোপলিটান এলিট, “হার্ভার্ড” এলিট, ঝানু অর্থনৈতিক এলিট, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদ। সুতরাং, ‘অ্যান্টি-এলিট’ ডিসকোর্সের ছদ্মবেশে এটা আসলে নতুন এক এলিটিজম।
দ্বিতীয়ত, এই উত্থান তাঁদের বিরুদ্ধে যারা মনে করে প্রকৃত এলিটদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছেঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা, ভারতে মুসলিম আর সেক্যুলারপন্থীরা, ব্রাজিলে বামপন্থী ও এলজিবিটি সম্প্রদায়, রাশিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বী, এনজিও এবং সাংবাদিক, তুরস্কে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংখ্যালঘু, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নবাদীরা। এই প্রতি-অভ্যুত্থান তাঁদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে যারা মনে করে ‘দখলদার’ কিংবা ‘ভুয়া’ এলিটদের বিপরীতে তাঁরাই ‘প্রকৃত’ এলিট।
তৃতীয়ত, নব্য এলিটদের এই প্রতি-উত্থান লিবারেল গণতন্ত্রের যুগে নির্ণীত মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। কেবলমাত্র নিজেদের জন্য ব্যতিরেকে তাঁরা স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বকে স্রেফ ঘৃণা করে। কোন রকম বাধা ছাড়াই যা খুশি করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যকে (চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাঁরা ‘অবৈধ’ জ্ঞান করে। তাঁরা যে কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণকে ঘৃণা করে, বিশেষত কর্পোরেট সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে; কারণ তাঁরা একে মনে করে তাঁদের নিজস্ব এখতিয়ারের ক্ষেত্র পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। সর্বোপরি, তাঁরা বিবেচনা এবং পদ্ধতিগত যুক্তিবোধকে ঘৃণা করে। কারণ এগুলো অন্যের বক্তব্য শোনা, ধৈর্য এবং সম্মিলিত যুক্তিবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। কেবলমাত্র তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমমনাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, এমনকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও তাঁদের আস্থা নাই।
তার মানে, একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, নব্য এলিটদের এই প্রতি-অভ্যুত্থান আসলে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই, কিন্তু এক্ষেত্রে মোচড় বা টুইস্ট হলো এই প্রতি-অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছে জনতার নামে। অন্যভাবে বলতে গেলে, আধুনিককালের ‘জনতা’র ধারণা ‘গণ’ (demos) এবং গণতন্ত্র ধারণা থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে। এটি একটি অভ্যুত্থান—এই অর্থে যে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে উত্থান বরাবরই অভ্যুত্থান—আবশ্যিকভাবে বিপ্লব নয়। বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হওয়া। অন্যদিকে, এই অভ্যুত্থান কেবল এক এলিটের জায়গায় আরেক এলিটকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা।
উল্লেখিত সব কথাই মারাত্মকভাবে সরলীকরণের দোষে দুষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত মনে হবে যদি আমরা কিছু সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্নের পর্যালোচনা না করি। এই নতুন এলিটদের প্রকৃতি কী? তাদের আবির্ভাবের শর্তগুলো কারা ব্যাখ্যা করে? কে এদের পক্ষে কথা বলে? এদের সামাজিক শেকড় কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সামনে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্রকে হাজির করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, ট্রাম্প যে এলিটদের পক্ষে কথা বলেন এবং নিজে যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, তারা কেউই খুব বেশি শিক্ষিত নয়। তারা সেলফোন উদ্যোক্তা কিংবা রাজনীতিবিদ, রিপাবলিকান সিনেটের শাসক, হাউজের রিপাবলিকান অংশ, চায়ের পার্টি কিংবা রাজিনীতির প্রত্যেক স্তরেই উটকো, অনাহুত লোকজন। এছাড়াও, এই তালিকায় আরো রয়েছে ক্ষমতার বিমারে বিকারগ্রস্ত সিইও (CEO) যেমন পিটার থিয়েলের মতো সিলিকন ভ্যালি আইকন) , টেলিভিশন ও রেডিও মিডিয়ার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এবং বর্ণবাদী ও লোভী ধর্মপ্রচারক যাজক, গীর্জা এবং দাতাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এর সাথে যোগ করুন ডানপন্থী থিংক ট্যাঙ্কের ক্যারিয়ারবাদী ভাড়াটে লেখকদেরও। কোনও সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক শিকড় ছাড়াই এলিটদের এই নেটওয়ার্কের একেবারে গভীরে কাজ করছে ফেডারেল সোসাইটির ওপাস দেই’য়ের (Opus Dei) মতো ট্রান্সন্যাশনাল গ্রুপগুলোর গোপন নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কগুলো হলো সুবিধাবাদ, লোভ এবং মুনাফাগন্ধীর নেটওয়ার্ক, যাদের কোন ঐতিহ্যগত বন্ধন কিংবা মূল্যবোধের বালাই নেই।
ভারতের বর্তমান রেজিমের এলিটদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র আঁকা যেতে পারে, কেবলমাত্র নির্বাচন ছাড়া তাঁরা বাদবাকি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই চরম ঘৃণা পোষণ করে। এটি অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ, ক্যারিয়ার জোচ্চোর, একচেটিয়া কায়-কারবার, তদবির ও খুল্লামখুল্লা দুর্নীতির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করা লুন্ঠনজীবী ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং নির্লজ্জ অপরাধী রাজনীতিবিদ ও আইনপ্রণেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। এদের প্রতি-অভ্যুত্থান নেহরুবাদী সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও বহুত্ববাদে বিশ্বাসী যেকোন ব্যক্তি কিংবা গ্রুপের বিরুদ্ধে।
এটি নব্য এলিটদের এমন এক সংঘ যারা মনে করে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরাই ভারতীয় ইতিহাসের একমাত্র ত্রাতা এবং এই তথাকথিত ‘ত্রাতা’রা মোঘল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল এবং কংগ্রেসের দীর্ঘশাসনের পর নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠেছে। এই জোট ভয়াবহভাবে মুসলিমবিদ্বেষী মতাদর্শ, নীতিনির্ধারণ ও গণহত্যা সংঘটনের ক্ষেত্রে নিজেদের অত্যন্ত কার্যকর শক্তি মনে করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়মুক্তি ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে এই নব উত্থিত এলিটদের মধ্যে কোন শ্রেণীগত ঐক্যও নেই। ট্রাম্পের এলিট অংশীদারদের মতোই এই ভারতীয় এলিট সম্প্রদায়ও সুবিধাবাদ আর সক্রিয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞায় পরিপূর্ণ।
যদিও আমি এরদোগান, পুতিন, বলসোনারো কিংবা দুতের্তের মতাদর্শিক লেঠেল বাহিনী ও মোসাহেবকুলের সামাজিক উৎস সম্পর্কে সেইভাবে অবগত নই, তারপরেও আমি অনুমান করতে প্রস্তুত যে এই প্রত্যকটি ক্ষেত্রে নব্য এলিট সম্প্রদায় কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বহন করে : চিরাচরিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এলিটদের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা, উদারনৈতিক কার্যপ্রণালীর প্রতি নিদারুণ অবহেলা, বুদ্ধিজীবী-গবেষক-শিল্পী-অ্যাক্টিভিস্ট-সমাজতন্ত্রী-নারীবাদীদের প্রতি চরম ঘৃণা, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে ততক্ষণ পর্যন্ত পুঁজিবাদের বন্দনা এবং জনগণ নয় বরং নিজেদের ভোটারদের কাল্ট অনুসরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা।
হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওর্বান তাঁর ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করেছে। ট্রাম্প রিলিফ চেকে তাঁর নাম মুদ্রণ এবং বর্তমান সংকটে একক নির্বাহী ক্ষমতাবলে যেকোন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মোদী মোটাদাগে নিজেকে সংবিধানের ঊর্ধে ঘোষণা করেছেন এবং ট্রাম্প, নেতানিয়াহু ও বলসোনারোর মত গণশত্রুদের ভারতে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছেন। তিনি কোভিড-১৯ এর সংকটময় পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে গোটা ভারতে কারফিউসম ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছেন, পুলিশী পিটুনি, ভুয়া কারণ দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ এবং ইতোপূর্বে কাশ্মীরে পরীক্ষিত কাছাখোলা দমন-পীড়ন নীতিকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করেছেন।
এই সমস্ত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে, এই নেতারা অন্ধ সমর্থক এবং সহযোগীদের নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল, যারা মনে করে ‘সুপ্রিম লিডার’-এর তালে তাল মিলিয়ে চলার মধ্যেই তাঁদের নিজেদের এবং জাতির সমৃদ্ধি নিহিত। তাহলে, পূর্ববর্তী এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানরত এই নব্য এলিটবৃন্দ, যারা বর্তমান দুনিয়ার লোকরঞ্জনবাদী স্বৈরতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর, যাদের এই ক্যু লিবারেল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে; অনুসারীগোষ্ঠী, বুনিয়াদি শক্তি, ভোটার, এমনকি যে ‘জনগণ’-এর নাম ও দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটা অনন্ত ‘যুদ্ধ’ চালানো হচ্ছে, এই সমস্ত কিছু সমেত এই নব্য এলিটদের আমরা কীভাবে ‘পাঠ’ করব? কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
এই অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রশ্নের কিছু গড়পড়তা উত্তর আছে। একটি হলো এই স্বৈরশাসকেরা আবেগ-অনুভূতির (প্রেম, ক্ষত, ত্যাগ, ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ) গুরুত্ব বোঝে এবং এগুলোকে হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষরা এমন সব তত্ত্ব, মূল্যবোধ, যুক্তি বিষয়ক আধা-বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কে ডুবে থাকে, যেগুলোর আজকাল গণ আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়টি হলো আকাঙ্ক্ষার প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী উত্থান (বিজ্ঞাপন, ভোক্তা পণ্য, সেলেব্রিটি কাল্ট, কর্পোরেট সংস্কৃতি), যেটি কিনা উদারনৈতিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়াগুলোর ধীরগতির প্রতি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণী ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। তাঁরা এখন সমৃদ্ধি ও মর্যাদা চায় এবং এই লোকরঞ্জনবাদী নেতারা তাঁদেরকে সেগুলো নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আরও একটি যুক্তি হলো ক্রমাগত বাদ পড়া, দরিদ্র থাকা এবং অপমানের শিকার হওয়া নিম্ন শ্রেণীগুলোকে এতটাই বিদ্বিষ্ট করেছে যে তাঁরা এখন এইসব লুটেরা নেতাদের মধ্যেই নিজেদের পরিচয়কে জুড়ে দিতে চায় (যেসব নেতারা যা চায়, ঠিক তাই হাতিয়ে নিতে সক্ষম)। ফলে তারা মুসলিম, শরণার্থী, চৈনিক, জিপসি, ইহুদি, অভিবাসী এবং এমন আরও অনেক ‘অপর’-এর প্রতি আতঙ্কের দিকে আমজনতার মনোযোগ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় বাস্তবতায় এই যুক্তিগুলো কিছুটা হলেও বোধগম্য।
তবে আমি মনে করি, ওর্তেগা গ্যাসেটের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের এটা বুঝতে সহায়তা করে যে আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে আম-জনতার অভ্যুত্থান এলিটদের প্রতি-অভ্যুত্থান দ্বারা বেদখল হয়ে গেছে। এই বেদখল হওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বৈরাচারদের দ্বারা ঘনঘন ব্যবহার হতে থাকা এটাই উন্মোচন করে যে, এই ‘জনতা’ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এইসব নব্য এলিটদের উত্থান মূলত তাঁদেরই উত্থান এবং তাঁদের সর্বোচ্চ করণীয় হচ্ছে, এইসব বীভৎস দানবীয় নেতাদের উত্থানের উদযাপন করা (সম্ভব হলে অনুকরণ করা)। সামাজিক পরিস্থিতি ও বিন্যাসের অর্থবহ বৈপ্লবিক কিংবা গণমুখী পরিবর্তনের চেয়ে এইসব নেতাদের মুহূর্তের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে ফেলার ফাঁপা কারিশমার প্রতি তাঁদের অধিক আস্থা।
কথা বলার ধরনে মনে হয় যেন এই নব্য ভোটারু (electoral) জনতা মনে করে বসে আছে তাঁদের নেতাদের সীমাহীন লুন্ঠনের সুফল তাঁদের দিকেও চুইয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণীর আম-জনতার কাছে কেবল তাঁদেরই অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলির পাঁঠা অংশকে খুন করা, অঙ্গহানি করা এবং লাঞ্ছিত করার নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি ছাড়া আর কিছু চুইয়ে পড়েনি। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চতর আয় এবং নিরাপদ শহরের মতো প্রাত্যহিক প্রয়োজনগুলো চুইয়ে পড়ার জন্য পিরামিডের একেবারে তলানিতে পড়ে থাকাদের সীমাহীন ধৈর্য ও অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু তাঁরা এই আশায় বাঁচে যে, যদি তাঁদের কাছে ঘৃণা চুইয়ে পড়তে পারে, তাহলে হয়তো সমৃদ্ধিও চুইয়ে পড়বে।
অনুবাদকের মন্তব্য
এই নিবন্ধে অর্জুন আপ্পাদুরাই বিশ্বজুড়ে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী, ডানপন্থী রাষ্ট্রপ্রণালী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আমরা মনে করছি অপেক্ষাকৃত ন্যায্য, গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা যারা বলেন, সমাজ-সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সক্রিয় থাকেন; অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই পর্যবেক্ষণ তাঁদের আমলে নিতে হবে। কারণ বর্তমানে আমরা এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমাজ বিন্যাসে আছি, যা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে হালনাগাদ করছে, কৌশল বদলাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষিপ্র এই ব্যবস্থাকে যারা মোকাবেলা করছেন, তাঁরা তদ্রুপ ক্ষিপ্রতা অর্জন করতে না পারলে, আধিপত্যশীল ব্যবস্থা সম্পর্কে শত শত বছরের স্থবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকলে, কখনোই সমাজ-সম্পর্কের পরিবর্তন আশা করা
সম্ভব না।
আপ্পাদুরাই বলছেন, বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটদের মধ্যেই এক নতুন এলিট সম্প্রদায় এর উত্থান ঘটেছে। যারা বদলে দিয়েছে পুরোনো হিশাব নিকাশ। একে আমরা বলতে পারি, এলিটদের বিরুদ্ধে নব্য এলিটদের পাল্টা-অভ্যুত্থান।
অর্জুন আপ্পাদুরাই
দেখা যাচ্ছে যে, এই নব্য এলিট সম্প্রদায় কোন কোন ক্ষেত্রে, যারা জনগণ কেন্দ্রীক রাজনীতির কথা বলে তাঁদের চেয়ে বেশি জনসংশ্লিষ্ট। নব্য এলিটদের এই রাজনীতি-ধর্ম ব্যবসা-সংস্কৃতি কারখানার পেছনে আছে ব্যাপক জনসমর্থন। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হবে। প্রথাগত এলিটরা যেসব উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী মূল্যবোধকে স্বীকার করত অন্তত নিজেদের শ্রেণীর মধ্যে, এরা এমনকি সেইসব মূল্যবোধের প্রতিও বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল না। এদের কোন ছদ্মবেশ নেই। মহৎ মহৎ কথার কোন ফুলঝুরি নেই, তারা যা করতে চায়, তা অত্যন্ত খুল্লামখুল্লাই করে।
বুর্জোয়া মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, উদারনীতির সমন্বয়ে যে রাষ্ট্রপ্রণালী প্রচলিত ছিল, যেগুলো অন্তত কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় কাজ করত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ছিল, ক্ষমতার অন্তত লোকদেখানো বিভাজন ছিল; তার কিছুই আজকে আর অবশিষ্ট নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, এমনকি বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে। যেন এক সর্বত্র এক সর্বব্যাপ্ত মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে।
যারা প্রচলিত এলিট সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, উদারনৈতিকতার বিরুদ্ধে এক অনন্ত ‘ক্যু’ সংঘটিত করে চলেছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হলো, আগেকার যে কোন স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদের সাথে আজকের দুনিয়ার এই নব্য এলিট সম্প্রদায়ের নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদের পার্থক্য হলো, বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুর পেছনেই এক আপাত বিপুল জনসমর্থন আছে।
কী করে সম্ভব হলো এই পরিস্থিতি? বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট-শিল্পী-নারীবাদী-সমাজতন্ত্রী-পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে এত বিপুল ক্ষোভ ও ঘৃণা উৎপাদনের কারণ কী? কী করে জনগণকে তাদের আসল বাস্তব প্রাত্যহিক সমস্যা-সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে নানা রকম ফাঁপা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শিক চর্চায়? কী করে জনগণকে পরিণত করা যাচ্ছে ‘উন্মত্ত মব’-এ?
এই প্রবন্ধের প্রাথমিক পাঠে মনে হতে পারে যেন, অর্জুন আপ্পাদুরাই জনগণের উপরেই সমস্ত দায় চাপাচ্ছেন। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে পাঠ করলেই এটা পরিষ্কার হবে যে, তিনি মূলত বলছেন, বর্তমান কালের নব্য এলিটরা ‘জনতা’র ধারণাতেও ক্যু সংঘটিত করে চলেছে। ‘জনতা’র নামে তারা মূলত এমন এক কাল্ট গোষ্ঠীতন্ত্র), এমন এক ক্রোেধান্মত্ত মব তৈরিতে সক্ষম হয়েছে, যারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হতে হতে, নানা ধরনের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে, শেষমেষ নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, কোন এক ‘অতি-মানব’ সুপারলিডারে আস্থা রাখা ছাড়া, জিহাদি জোশ সম্বলিত কোন মতাদর্শের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবেনা।
ফলে এইসব ‘অতি-মানব’ স্বৈর-শাসকদের নির্মিত ‘কল্পিত শত্রু’র বিরুদ্ধেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিতে উদ্যত। স্বৈর-শাসকদের সৃষ্ট বাস্তব সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ঘৃণা, বিভাজন উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যখন আমরা করোনাভাইরাস মহামারীতে সরকার-রাষ্ট্রপ্রণালীর নিদারুণ ব্যর্থতা, উন্নয়নের রোলমডেল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাতের অকল্পনীয় অব্যবস্থাপনা (যার শিকার হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ), মাসখানেকের লকডাউনে সমস্ত কিছুতে ধস, তীব্র খাদ্যাভাব প্রত্যক্ষ করছি; ঠিক তখন ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ এর মত অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার মত চরম অসংবেদনশীলতাও দেখতে পাচ্ছি।
অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের লেখার সার কথাটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করব যে, জনগণকে নানা মতাদর্শে, চিন্তার বৈচিত্র্যকে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিণত করা, স্বীয় নলেজ সিস্টেমকে অন্য নলেজ সিস্টেমের উপর চাপিয়ে দেয়ার এই প্রবণতা বর্তমান কালের নব্য এলিটদের প্রধানতম সার্থকতা।
আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল রাখা দরকার, এমনকি শতাব্দী পুরোনো ‘শ্রেণী’ বিশ্লেষণ দিয়েও আজকের পরিস্থিতি পুরোটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিট কমপ্লেক্সে পূর্ব অনুমিত অবধারিত কোন শ্রেণীগত ঐক্য নেই। একই শ্রেণীতে অবস্থিত সমস্ত পক্ষই একই মূল্যবোধে দীক্ষিত নয়।
যদি তাই হতো, তাহলে লিবারেল গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের বিরুদ্ধে একই শ্রেণীগত অ্যান্টি-লিবারেল, অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট, অ্যান্টি-ডেমোক্রেটিক ফ্যাসিস্ট এলিটদের উত্থান দেখতে হতো না আজকের পৃথিবীকে। শ্রেণীবাদী রাজনীতি-অর্থনীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে, কিন্তু চিরাচরিত যুক্তি-বিশ্লেষণ দিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে আমরা পরিস্থিতির গুণগত নেতিবাচক পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হব। এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানরত নব্যএলিটদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবো।
সেই সাথে চরম প্রতিক্রিয়াশীল-প্রলয়ঙ্করী নয়া উদারনৈতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে স্রেফ ভোক্তা-ভোটারে পরিণত করার মাধ্যমে বাদবাকি সমস্ত সক্রিয়তা, কর্তাসত্তাকে ‘নাই’ করে দিতে পারে, সেটা অনুধাবন করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, সেই আলাপটাও জরুরি।
রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগ
গেল গেল সব গেল…
হঠাৎ রব উঠেছে। ঘুম ভেঙেছে অনেকের। কিন্তু ঘুম ভাঙলেও দু চোখ কি খুলেছে? নাকি এক চোখে এক দিকে দৃষ্টিপাত! সুশীল সমাজে রব উঠেছে - দেউচা পচামি কয়লা খনি পরিবেশের সর্বনাশ করে দেবে। কথাটা একেবারেই ঠিক, কিন্তু বিচ্ছিরি রকমের একপেশে।
শুরুতে কিছু তথ্য দেওয়া যাক -
দেউচা পচামি কোল ব্লক। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা খনি হতে চলেছে।
বীরভূম জেলায়, মোরগ্রাম পানাগড় ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কে মহম্মদ বাজারে দেউচা পচামি কোল ব্লক। কাছাকাছি বড় জনপদ ও রেল স্টেশন সাঁইথিয়া, ২০ কিলোমিটার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১, জানাচ্ছে -
দেউচা পচামি কয়লা খনিতে মোট কয়লা পাওয়া যেতে পারে - ২১০২ মিলিয়ন টন।
জমি লাগবে - ৩৪০০ একর। এখানে বসবাস করে ৩০১০ টি পরিবার, তার মধ্যে আদিবাসী ১০১৩ টি পরিবার।
https://indianexpress.com/article/cities/kolkata/bengal-moves-on-mega-coal-block-7658016/
এই সময়, ১৯ নভেম্বর, ২০২১, জানাচ্ছে -
জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘মোট খাস জমির পরিমাণ ৫৯৬.০২ একর। বিভিন্ন সরকারি দফতরের জমি ৭২.৯২ একর। বনভূমি ৩০৯.৭০ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন রায়তি জমি ২৩৯২.১৩ একর। মোট ৩৩৭০.৭৭ একর জমির উপর কয়লাখনি করা হবে। বনভূমি ধ্বংস এবং খাস জমিতে যারা রয়েছেন তাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যতগুলি গাছ কাটা হবে, তার দ্বিগুণ গাছ লাগানো হবে।
https://eisamay.com/west-bengal-news/bolpur-news/deocha-pachami-coal-block-work-to-start-from-vested-land-soon/articleshow/87805881.cms
দেউচা পচামি নিয়ে প্রকাশিত প্রায় সব প্রতিবেদনেই সবিস্তারে লেখা হয়েছে - রাজ্য সরকার কতটা ক্ষতিপূরণ দিতে চাইছে, সেটা কতটা ন্যায্য, অন্যান্য রাজ্য সরকার বা খনি সংস্থার সাথে এই ক্ষতিপূরণের প্যাকেজের তুলনা, ইত্যাদি।
আমরা এই ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে কোনও আলোচনা করবো না। কারণ - আসলে ক্ষতিপূরণ হয় না। তাই বলে এরকম ভাবারও কোনও কারণ নেই - কাউকে উৎখাত করলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দরকার নেই। আমরা এই বিষয়গুলোকে ক্রমে আলোচনা করবো।
শুরুতে বলে ছিলাম - এক চোখে দেখবো না, দু চোখে দেখার চেষ্টা করবো। অনেকেই দেউচা পচামি নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছেন - শুধুমাত্র খোলা মুখ কয়লা খনির বিপজ্জনক দিক নিয়ে। কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন - এই কয়লা খনির প্রভাব আমাদের সকলের জীবনে কতটা - এই বিষয়টা। কয়লা খনি থেকে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা ষোল আনা ভোগ করবো, কিন্তু কয়লা খনি বিরোধিতায় সোচ্চার হবো এই দ্বিচারিতার পথে হেঁটে কোনও সমাজ কল্যাণ হতে পারে বলে আমরা মনে করি না। কয়লা খনির বিরোধিতা করার আগে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে জেনে নেয়া দরকার - কেন এই কয়লা খনি? কাদের জন্য এই কয়লা খনি।
কথায় আছে - চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম। তাই কয়লা খনি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত আমার আপনার ঘর থেকে। আমরা গোড়ায় বুঝে নিই - আমার আপনার ঘর কয়লা খনির সাথে কী ভাবে জুড়ে আছে। আমাদের সকলের ঘরে বিদ্যুতের যোগান আসে কয়লা পুড়িয়ে। গোটা দুনিয়ার ৮০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ থেকে।
একটা বাড়িতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠলে আমরা সগর্বে বলে উঠি - এ সভ্যতার আলো। একটা প্রমাণ মাপের ঘরের মাপ ধরলাম লম্বায় চওড়ায় ১২ ফুট, আর উচ্চতা ১০ ফুট । এরকম একটা ঘরে ১ টা ৪ ফুটের টিউব লাইটেই যথেষ্ট আলো হয়। এরকম একটা আলোকিত ঘরের যেকোনো জায়গায় বই ভাল ভাবে পড়া যায়। আমরা সবাই এই আলোর যোগানকে ন্যূনতম মান ধরে নিয়েছি। এই আলোর কিন্তু মাপ আছে। এবার একটু মেপে দেখা যাক এই আলো মানে কতটা আলো। তার জন্য আমাদের কয়েকটা পরিভাষা বুঝে নিতে হবে - লাক্স, লুমেন,। যতটা সম্ভব সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বলা হয় বই পড়ার জন্য প্রতি বর্গ মিটারে ২৫ থেকে ৫০ লুমেন আলো দরকার(৩ ফিট ৩ ইঞ্চিতে এক মিটার প্রায়, মানে এক বর্গ মিটার হল তিন ফুট তিন ইঞ্চি চওড়া ও একই মাপের লম্বা জায়গা)। আমরা হিসেবের সুবিধার জন্য ৩৭ লুমেন ধরলাম। এই লুমেন ব্যাপারটা কী? বলা হচ্ছে এক বর্গমিটারে যদি এক লুমেন আলো পড়ে তবে তাকে বলা হবে ১ লাক্স। তাহলে এক লাক্স মানে কী? এক বর্গমিটার যায়গায়, এক মিটার দূর থেকে যদি ১ টা মোমবাতির আলো পড়ে তাহলে তা হবে ১ লাক্স। তাহলে দেখা যাচ্ছে ১ বর্গ মিটার যায়গায় যদি বই পড়ার উপযোগী আলো পেতে হয় তবে তার থেকে ১ মিটার দূরে অন্তত ৩৭টা (ন্যূনতম ২৫টা) মোমবাতি জ্বালাতে হবে। এবার শুরুতে আমরা যে ঘরটাকে ধরে হিসেব করছিলাম তার শুধু ৪টে দেয়ালের মাপই ৪৪.৬ বর্গমিটার। আমরা আগেই বলেছি ১ টা ৪ ফুটের টিউব লাইটে ঘরের সব দেয়ালেই বই পড়ার মত যথেষ্ট আলো পড়ে (পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন)। তাহলে শুধু দেয়ালেই আলো পড়ছে ৩৭ গুণ ৪৪.৬ মানে ১৬৫০.২ লাক্স আলো। অর্থাৎ ঘরে এই পরিমাণ আলো পেতে গেলে জ্বালাতে হবে অন্তত ১৬৫০ টা মোমবাতি। এত আলোর বিলাসিতা সম্রাট শাহজাহানেরও ছিল না। আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই, মোমবাতির মূল উপাদান প্যারাফিন, যা পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া যায়। প্রদীপের আলো মোমবাতির থেকে অনেক কম হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ প্রদীপ মূলত উদ্ভিজ্জ তেল থেকে জ্বলে, যার শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা জীবাশ্ম জ্বালানির থেকে অনেক কম।
এত গেল শুধু একটা ঘরে একটা টিউব লাইটের হিসেব, এর বাদে ফ্যান আছে, একাধিক লাইট আছে, বহু ঘরে আছে ফ্রিজ, এসি, গিজার, টেলিভিশন, সাউন্ড সিস্টেম, মিক্সার গ্রাইন্ডার, মাইক্রোওভেন আরও বহু কিছু। এখনকার ৪ ফুটের এলইডি টিউব ১৮ ওয়াটের, আগের মোটা কাঁচের টিউব লাইট ছিল ৪০ ওয়াটের। এই প্রত্যেকটা যন্ত্রের গায়ে ওয়াটের হিসেব দেওয়া থাকে, একটু মিলিয়ে দেখে নেবেন। শুধু একটা বলি, ভাল মাইক্রোওভেন শুধু মাত্র গরম করার জন্য ৯০০ ওয়াট চায়। একটু আগে আমরা যে ১৬৫০টা মোমবাতির হিসেব দিয়েছিলাম তার মানে ছিল ১ টা ১৮ ওয়াটের টিউব লাইট। এবার নিজেরাই একটু হিসেব করে নিন ৯০০ ওয়াট মানে কী!
এত গেল একটা ঘরের হিসেব, এবার শহর জোড়া আলোর ঝলকানি, মেট্রো রেল, লোকাল ট্রেন, এসি শপিং মল যোগ দিতে থাকুন, কূল কিনারা পাবেন না।
এর পরে আসে বৃহৎ শিল্প। এক একটা যন্ত্র খায় হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ। আইটি শিল্পের কাঁচে মোরা পেল্লায় বাড়িগুলোর অন্দর ঠাণ্ডা রাখতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে, সে সব তথ্য নেট ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।
মোমবাতি দিয়ে কথা শুরু করলাম কারণ ওটা আমাদের চেনা। এর পর কয়লায় যাবো। কিন্তু কয়লার সাথে বিদ্যুতের অনুপাত কী রকম? মানে কত বিদ্যুতে কত কয়লা? এক মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ পেতে জ্বালাতে হয় - প্রায় ৫০০ কিলো কয়লা। ওয়াট ব্যাপারটা বুঝে নিই - ১০০ ওয়াটের একটা বাল্ব ১ ঘণ্টা জ্বললে ১০০ ওয়াট বিদ্যুৎ পোড়ায়। এক মেগা ওয়াট = ১০০০০০০ ওয়াট। শুধুমাত্র কলকাতা মেগা সিটি এলাকায় ১ কোটি ৬৩ লক্ষ মানুষ এখন প্রতি বছরে বিদ্যুৎ পোড়ায় ১২৩৮৩.০২ গিগা ওয়াট। মেগা ওয়াটে হিসেব করতে হলে ১ এর পিছনে ৬টা শূন্য বসিয়ে তাই দিয়ে গুন করতে হবে। তারপর কয়লার হিসেব পেতে হলে ৫০০ দিয়ে গুণ।
তথ্যসূত্র-
https://sites.ontariotechu.ca/sustainabilitytoday/urban-and-energy-systems/Worlds-largest-cities/energy-and-material-flows-of-megacities/kolkata.php
কয়লা নিয়ে বিশদে যাবার আগে সমসাময়িক উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করে নেয়া দরকার।
আজকের বৃহৎপুঁজির উৎপাদন ব্যবস্থার সূচনা - শিল্প বিপ্লব। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব গোটা দুনিয়াকে প্লাবিত করেছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি রাজনীতি সামাজিক ভারসাম্য শিল্প বিপ্লবের পণ্য প্লাবনে জারিত হয়ে আগেকার সব ব্যবস্থার বিপ্রতীপ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল পণ্য উৎপাদন কী ভাবে সম্ভব হল তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দার্শনিক অর্থনীতিবিদ প্রযুক্তিবিদ সহ আরও বহু মানুষ। আমরা তাদের বক্তব্যের কাটা ছেঁড়া না করে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে নজর দিতে চাই।
যে কোনও শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল মূলত তিন রকমের - উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজ (হাওয়া ও জলকে খনিজর সাথে যুক্ত রাখছি) শিল্প বিপ্লবের আগে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হত - উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ বস্তু, খনিজের ব্যবহার ছিল সীমিত। শিল্প বিপ্লবে কাঁচামাল হিসেবে খনিজের ব্যবহার সব থেকে বেশি শুরু হল। এর আগে যন্ত্রের চালিকা শক্তি ছিল মানুষ বা পশুর কায়িক বল এবং কিছু ক্ষেত্রে বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ ( হাওয়া কল, জলযান )। শিল্প বিপ্লবে যান্ত্রিক শক্তির উৎস হল প্রথমে খনিজ কয়লা তারপর খনিজ তেল, যাকে এককথায় বলা হয় - জীবাশ্ম জ্বালানি।
জীবাশ্ম জালানিতে প্রকাণ্ড পরিমাণ শক্তি পাওয়া গেল যা যন্ত্রকে দিল দুর্বার গতি। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানীতে এই শক্তি এলো কোথা থেকে? কয়লা তৈরি হয়েছে উদ্ভিদের অবশেষ থেকে পেট্রোলিয়াম প্রাণীর অবশেষ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে পরিপুষ্ট হয়েছিল; বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক শক্তি লক্ষ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হয়েছিল এদের দেহে। তারপর তারা মাটির নিচে চাপা পড়ে ভূগর্ভের বিপুল পরিমাণ তাপ ও চাপকেও সঞ্চিত করেছে লক্ষ বছর ধরে। এই লক্ষ লক্ষ বছরের সঞ্চিত শক্তিকে আমরা
ব্যয় করেছি মাত্র আড়াইশো বছরে।
এতে মুশকিল হল দুটো -
১। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশ দূষণের মাত্রা ছাড়ালো, খনি তৈরি করতে গিয়েও বনভূমির ব্যাপক ক্ষতি হল।
২। উৎপাদন এমন বস্তুর উপর নির্ভরশীল হল, যা পূরণযোগ্য নয়। কোনও খনিজ একবার খরচ হয়ে গেলে আবার তৈরি করা যায় না।
শিল্প বিপ্লবের পরের উৎপাদন ব্যবস্থা যে ঝলমলে জীবন যাপনের হাতছানি দেয় তার পিছনের অন্ধকার নোংরা বাস্তবকে অত্যন্ত সযত্নে আড়াল করে। আমরা কখনোই বলি না এই বিদ্যুৎ কোথা থেকে এলো। এখনও সব থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, কয়লা পুড়িয়ে। জল বিদ্যুতের প্রকল্পগুলি একেবারেই সফল হয়নি। ভারতের অন্যতম বড় নদী নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ DVC এখন জল বিদ্যুৎ নয়, মূলত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
এই খনিজ নির্ভর উৎপাদন ব্যাপারটা তুবড়ির মত, বহুক্ষণ ধরে বানিয়ে মুহূর্তে জ্বলে উঠে শেষ, তাই উজ্জ্বলতা বেশি, জৌলুস বেশি।
তুবড়ি সভ্যতা -
এই তুবড়ির বিষয়টা বিস্তারিত বোঝা দরকার। শুনতে মজার হলেও ব্যাপারটা আদৌ মজার তো নয়ই বরং ভয়ঙ্কর পর্যায়ের বিপজ্জনক।
খনিজের ব্যবহারের কয়েকটা দিক আগে দেখা যাক খনিজের ব্যবহার মূলত দু রকম -
১। গড়নের কাজে, যেমন - লোহা, বক্সাইট(এলুমিনিয়াম), তামা, পেতল, পাথর, নুড়ি, বালি ইত্যাদি।
২। জ্বালানির কাজে, যেমন - কয়লা, পেট্রোলিয়াম, লিথিয়াম ইত্যাদি।
এর বাইরেও অজস্র খনিজ আছে, তাদের বহু বিচিত্র ব্যবহার আছে, অতটা বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এই দুই মূল ধারা নিয়ে আলোচনা করলেও আমরা পথভ্রষ্ট হবো না, তাই আমরা আমাদের আলোচনা মূলত এই দুই ধারায় সীমাবদ্ধ রাখবো
গৃহস্থ জ্বালানির প্রয়োজনে কয়লার ব্যবহার এখন খুবই সীমিত। কয়লার মূল ব্যবহার এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আগেই বলেছি - গোটা দুনিয়ার ৮০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, যার মূল জ্বালানি কয়লা। তাই আজকের বিদ্যুৎ নির্ভর জনজীবন আসলে মূলত কয়লা নির্ভর।
এই কারণেই আমাদের এই বিদ্যুৎ নির্ভর সভ্যতাকে যদি তুবড়ি সভ্যতা বলি, বোধহয় খুব ভুল হবে না। কারণ একটা তুবড়ি জ্বললে দারুণ আলো হয় ঠিকই, কিন্তু তার আয়ু কয়েক সেকেন্ড। এবার আমরা যদি চাই চাই তুবড়ি জ্বালিয়ে ঘর আলো করবো তাহলে ক্রমাগত তুবড়ি জ্বালিয়েই যেতে হবে। তাতে ঘরের দশা যা হবে, সেটা আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। সত্যিই এই তুবড়ি সভ্যতার চোটে দুনিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা অনেকেই সেটা টের পাচ্ছি না।
আগেই বলেছি এই বিদ্যুৎ মূলত তাপবিদ্যুৎ এবং তা কয়লা নির্ভর। কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের বিকল্পে অনেকে পারমাণবিক বিদ্যুতের হয়ে সওয়াল করেন। এই লেখায় পারমাণবিক বিদ্যুতের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করবো না, কলেবর প্রকাণ্ড বেড়ে যাবে। এই বিষয়ে বহু ভাল লেখা আছে, একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। শুধু একটা কথা স্পষ্ট করে দিই - আমরা পারমাণবিক বিদ্যুতের বিরোধী। আমরা মনে করি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোনও কল্যাণকর বিকল্প হতে পারে না। খুব সহজ একটা উপমা দিয়ে পরমাণু বিদ্যুতের বিপদ বোঝানো যেতে পারে। মনে করা যাক একটা নতুন ফল আবিষ্কার হল - ক। ক খুবই সুস্বাদু কিন্তু খেলে সামান্য বিষক্রিয়া হতে পারে। সেই বিষক্রিয়ার জন্য চ ও ছ নামক ওষুধ পাওয়া যায়। এই ওষুধ এমনি ভালই কিন্তু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, ট ও ঠ নামক ওষুধ খেলে সেটা সামলানো যাবে। তাতে প্রায় সব সমস্যাই মিটে যাবে শুধু একটু ঘুমের সমস্যা হতে পারে, আর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এবার বলুন, ক খেতে যতই ভাল হোক আপনি কি খাবেন ? নাকি খাবেন না? পরমাণু বিদ্যুৎ প্রায় এরকমই, বিপদের পর বিপদ, একটা চাপা দিতে অন্যটা হাজির, শেষমেশ খরচ দাঁড়ায় অকল্পনীয়।
কয়লা কোথা থেকে আসে?
খোলা মুখ খনি আর সুড়ঙ্গ খনি নিয়ে অনেকে কৌতূহল দেখাচ্ছেন। প্রাথমিক কিছু বিষয় বলা যাক। এবার কিছু ছবির সাহায্য নিতে হবে। সঙ্গের ছবিগুলোতে নম্বর দেওয়া আছে। প্রতিটি প্রসঙ্গের সাথে নম্বর মিলিয়ে দেখে নেবেন।
গোড়ায় আবার টার্মোলজির ধাঁধা - ক্রস সেকশন। শিখে নিই, ১ নম্বর ছবি দেখুন। একটা ডিমকে A,A1 বরাবর কাটলে A ছবির মত দেখতে পাবো। B,B1 বরাবর কাটলে B ছবির মত দেখতে পাবো। কাটলে সাইড থেকে যা দেখা যায় তাই ক্রস সেকশান।
সুড়ঙ্গ খনি
২ নম্বর ছবি দেখুন, এটা একটা কয়লা খনি অঞ্চলের ক্রস সেকশান। ওপরে মাটি টিলা জঙ্গল, নিচে বহু পাথরের স্তর। বেশ কয়েকটা স্তরের নিচে থাকে কয়লার স্তর(কালো রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে। কয়লার স্তরও সাধারণত কয়েকটা থাকে। এই কয়লার স্তরগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রমাগত ঢালু হয়ে মাটির আরও গভীরে চলে যেতে থাকে। সাদা রঙ দিয়ে সুরঙ্গ বোঝানো হয়েছে। তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে সুড়ঙ্গ ক্রমাগত কোন দিকে বাড়বে। ছবিতে একটা গাঢ় ডটেড দাগ দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে স্তরগুলো হঠাৎ বেঁকে গেছে। এই গাঢ় ডটেড দাগ দিয়ে চ্যুতি বা ফল্ট বোঝানো হয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচের স্তর হঠাৎ নেমে যায় বা উঠে যায়। সুড়ঙ্গও ওভাবেই কাটতে হয়। এই ধরনের কয়লা খনিতে প্রাণের ঝুঁকি খুবই বেশি। আমি যতবারই নেমেছি, বণ্ডে সই করে নামতে হয়েছে। এরকম খনির একটা নকল আছে কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে। বেশ ভাল অনুকরণ, আগ্রহ থাকলে দেখে আসতে পারেন। ওই মডেলে পনেরো ফুটের মত নিচে নামতেই বহু দর্শকের ভয় লাগে, ক্লস্টোফোবিয়া হয়। আসল কয়লা খনি ৫০০ ফুটেরও বেশি গভীর হয়।
এই সুড়ঙ্গ খনিতে প্রাণের ঝুঁকি তো বেশি অবশ্যই এছাড়াও বহু সমস্যা আছে। মূল সমস্যা হল অপচয়। ৩ নম্বর ছবি দেখুন। কয়লার স্তরের ওপরের স্তরগুলো যদি সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে খনির কয়লার স্তর হবে কিছুটা এরকম দেখতে। যে কালো থামগুলো দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলোও কয়লা। যে কয়লা ব্যবহারের জন্য তোলা হচ্ছে, সেই কয়লাই। এই থামের আকৃতির কয়লাগুলো ছেড়ে রাখতে হয়, নাহলে ওপরের স্তর ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ এই থামগুলো পুরোটাই অপচয়। আসলে ব্যাপারটা আরও বহুগুণ জটিল, বোঝার সুবিধার জন্য সরল করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবত অপচয় আরও অনেক বেশি।
সুড়ঙ্গ খনিও একটা সময়ের পরে পরিত্যক্ত হয়। নিয়ম হচ্ছে, সুড়ঙ্গ বালি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া। বাস্তবত তা হয় না। সেটার কারণ কখনও সদিচ্ছার অভাবে, আবার বাস্তবতও বালি দিয়ে ওই সুড়ঙ্গ পুরোপুরি ভরাট করা সম্ভব নয়। আর এই ভরাটের জন্য যে পরিমাণ বালি লাগবে সেটাও সেই বালির খনি অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটায়। ফলে খনি অঞ্চলে হঠাৎ করে মাটি ধ্বসে যাওয়া, নিচের কয়লার স্তরে আগুন লেগে মাটির উপরে উত্তাপ বা ধোঁয়া বার হওয়া ইত্যাদি আরও হাজার বিপদ থাকে।
খোলা মুখ বা ওপেন কাস্ট খনি
এখন সমস্ত কয়লা খনি ওপেনকাস্ট। অর্থাৎ একটা প্রকাণ্ড বড় গর্ত, সেই গর্ত কত বড়, আর কত গভীর তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। সেই গর্তের পরিমাপ বর্গ কিলোমিটার দিয়ে মাপতে হয়, গভীরতা ৩০০ মিটারেরও বেশি।
আবার ছবির সাহায্য নিই।
৪ নম্বর ছবি দেখুন, আসল খনির ছবি দিয়ে বোঝানো মুশকিল, তাই মডেলের ছবি দেওয়া হল। একটা গর্তের মত যায়গা, লেখা আছে খাদান, আর একটা ঢিপির মত উঁচু, লেখা আছে ডাম্প। আগেই বলেছি ওপেন কাস্ট খনির গর্ত হয় প্রকাণ্ড বড়।
সেই গর্ত থেকে উঠে আসা বিপুল পরিমাণ মাটি-পাথর কী হয়? মূলত তিনটে ভাগ হয়। ১। টপ সয়েল ডাম্প, ২। মেইন ডাম্প, ৩। ব্যাকফিল।
মাটির নিচের কিছু দূর পর্যন্ত যা উপাদান থাকে তাতে গাছপালা জন্মাতে পারে, তাই এই মাটিটা আলাদা রাখা হয় টপ সয়েল ডাম্পে। বাকি পাথুরে মাটি জমা করা হয় মেইন ডাম্পে। খনির মূল গর্ত প্রথমে যেখানে হবে, পরে তার থেকে অন্য দিকে ক্রমাগত সরতে থাকে যেদিকে খনি এগোয় তার উলটো দিকের গর্তের পাড় ক্রমাগত ভরাট হতে থাকে, একে বলে ব্যাকফিল, এই ব্যাকফিলের উপরে টপ সয়েল বিছিয়ে দেওয়া হয়। কৃত্রিম বন সৃজন করা হয়। ৫ নম্বর ছবি দেখুন, বাঁদিকে ক্রমাগত মাটি কাটিতে কাটতে এগোবে, ডান দিকের ব্যাক ফিল ক্রমাগত ভরাট হতে হতে এগিয়ে আসবে। এই খনিটা ক্রমাগত বাঁদিকে সরে যাবে ( তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে)।
একটা বড় খনিতে আড়াই তিন হাজার লোক কাজ করে। কিন্তু বুঝতে হবে অতি সামান্য অংশ খনির মূল টেকনিকাল কাজ করে। মাটি খোঁড়া ভরাট সবই যন্ত্রের সাহায্যে হয়, কয়েক শ লোক এই কাজগুলো করে ফেলে। বেশির ভাগ লোক রাস্তা, বাগান ঝাঁট দেয়, অন্যান্য ফাই ফরমাশ খাটে। খনিতে নামা ওঠার ঢালু রাস্তার পাশে নিরাপত্তার জন্য মাটি বা পাথরের বাঁধ দেওয়া হয়, একে বলে বার্ম। বহু লোক বার্মের দেখাশুনা করে, চুন দিয়ে মার্কিং করে। অর্থাৎ এই আড়াই হাজার লোকের মধ্যে খুব কম অংশই নিতান্ত অপরিহার্য, বাকিদের রোজ কাজ থাকে না।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এর থেকে সুন্দর ব্যবস্থাপনা আর কিই বা হতে পারে! কিন্তু এর পাশাপাশি আরও বহু ঘটনা ঘটে। ডাম্প আর ব্যাকফিলের মাটি একেবারেই প্রাকৃতিক থাকে না। ব্যাকফিল, ডাম্পে জড়ো হয় বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যাওয়া পাথরের টুকরো, যা নিতান্ত ঝুরঝুরে। স্বাভাবিক মাটির নিচে পাথর জল বালি খনিজের অনেক রকমের স্তর থাকে। লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এই ভূপ্রকৃতি তৈরি হয়। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বনভূমি শুধুমাত্র মাটির উপরিতলের চরিত্রের উপর নির্ভরশীল নয়, সেই মাটির বহু নিচে পাথরের স্তর, জলস্তর, জলপ্রবাহ, মাটির ঢাল আরও বহু কিছুর উপর নির্ভরশীল। ব্যাকফিল বা ডাম্পে এই ভূপ্রকৃতিই বিলীন হয়ে যায়। ভূপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল গাছপালা, বনজ সম্পদ, তার ওপর নির্ভরশীল প্রাণী জগত; খনিগুলো এই সমস্ত কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।
ওপেন কাস্ট খনিতে যতদিন খনিজ পাওয়া থাকে ততদিন খোদাই আর ভরাট চলতে থাকে। একদিকে খোঁড়া হচ্ছে অন্যদিকে ভরাট হচ্ছে। এই ভাবে চলতে চলতে একসময় খনিজ শেষ হয়ে যায়, অথবা যেটুকু থাকে তা তোলার খরচ এত বেশি যে তাতে খনি মালিকের পড়তায় পোষাবে না। তখন খনি পরিত্যক্ত হয়। পড়ে থাকে একদিকে মেইনডাম্পের ঝুরঝুরে পাথরের টিলা অন্যদিকে সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া এক প্রকাণ্ড গর্ত। এই একেকটা ধাপ তিন তলা বাড়ি সমান উঁচু। সেই গর্ত প্রায় একটা প্রমাণ আকারের হ্রদের মতো। তার গভীরতা কয়েক শ মিটার। কোনও বড় দীঘির গভীরতা ২০মিটারও হয়না, আর পরিত্যক্ত খনির গভীরতা ২৫০/৩০০ মিটার, অত গভীরে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী জন্মায় না। তাতে টলটলে জল জমে না, মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বহু বিষাক্ত খনিজ সেই জলে মেশে। নিখুঁত প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক বনভূমি, খনিজর চাহিদা মেটাতে হয়ে যায় প্রকাণ্ড এক মৃত্যুফাঁদ। কত প্রজাতির প্রাণী উদ্ভিদ যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই খনির সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় তার কোনও খতিয়ান নেই।
যে জঙ্গল উজাড় হয়ে গেল ঝকঝকে আলো জ্বালানোর স্বার্থে, সেই জঙ্গল এত দিন কী করছিল? সে কি শুধু অক্সিজেন আর কাঠের যোগানদার ছিল? এই বনভূমির উপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের আদিবাসী সমাজ। আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হয় - নদীর ধারে উর্বর পলি মাটি অঞ্চলে মানুষ প্রথমে বসতি স্থাপন করে, কারণ শেখানে কৃষি কাজ করা সহজ। কিন্তু আমরা কী ভেবে দেখি - আমাদের আদিবাসী সমাজ কেন দুর্গম বনাঞ্চলে, পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বসবাস করে? কেন এত কষ্ট সহ্য করে তারা ঐরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকে? অনেকে বলেন - তথাকথিত সভ্য মানুষদের অত্যাচারে আদিবাসীরা এরকম জায়গা বেছে নিয়েছে। হ্যাঁ তা হতেই পারে, কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটা সত্য আছে - আদিবাসীরা জঙ্গল থেকে জীবনযাপনের বহু উপাদান সংগ্রহ করতে সক্ষম। তথাকথিত সভ্য মানুষেরা বনাঞ্চলকে আদিবাসীদের মত করে চেনেই না। এখনও বহু আদিবাসী সমাজে কৃষিকাজ প্রচলিত নয়, তারা এখনো মূলত সংগ্রাহক, অত্যন্ত কম তাদের চাহিদা। স্বাধীন ভারতে খনি ড্যাম রাস্তা রেলপথ আর কারখানা বানানোর উন্নয়নের গুঁতোয় আমাদের দেশের কোটি কোটি আদিবাসী উৎখাত হয়েছে তাদের নিজস্ব আবাস থেকে। তাদের ঠাঁই হয়েছে নোংরা বস্তিতে। স্বাধীন প্রকৃতি নির্ভর জীবন থেকে উৎখাত হয়ে তারা হয়েছে সস্তার মজুর। আদিবাসীদের শিল্প কলা গান নাচ কারিগরি সব কিছুই ধ্বংস হচ্ছে এই উৎখাতের পরিণামে। নগরায়নের বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনের এই অবনমনকে মানবো কোন নৈতিকতায়?
অর্থাৎ আমার আপনার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতেই কয়লা খনি। উন্নত জীবনযাত্রার দ্যোতক হিসেবে যে পণ্যগুলোকে আমাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আসলে টোপ, ওর ভিতরে লুকোনো আছে বিষাক্ত বড়শি। আমরা যত বেশি পণ্য কিনে ‘সুখী’ হবার চেষ্টা করবো, আমাদের গলায় ঐ বিষাক্ত বড়শি তত বেশি করে গেঁথে যাবে। আমাদের বুঝতে হবে - গরমে ঘেমে নেয়ে যখন ফ্রিজের ঠাণ্ডা জলের বোতল হাতে নিই, ঐ শীতলতা তৈরি করতেই খনি খনন করা হচ্ছে, জঙ্গল উজাড় হচ্ছে, আদিবাসী উচ্ছেদ হচ্ছে। আমার শরীর ঠাণ্ডা করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মারা পড়ছে অজস্র জীবজন্তু পাখি। প্রত্যেকবার প্রতিটি জিনিস কেনার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার কিসের বিনিময়ে আমি এই পণ্য কিনছি? এই পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে পরমা-প্রকৃতির যে ক্ষতি আমরা করছি, তার ক্ষতিপূরণ কি টাকা দিয়ে করা সম্ভব? ভাল জীবন যাপনের যে মাত্রাগুলো আমরা ধরে নিয়েছি - বাড়ি, গাড়ি, দামি পোশাক, আসবাব, হাজার রকমের বৈদুতিন যন্ত্র - এগুলো কি সত্যিই ভাল থাকার নিদর্শন? টাকা থাকলেই কি কিনে নেয়া যায় সব কিছু? দেউচা পচামির কয়লা খনির বিরোধিতার পাশাপাশি এই ভীষণ জরুরী প্রশ্নগুলো নিজেদের কাছে নিজের বারংবার তুলে যাওয়া আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।
ঠিক এই কারণেই আলোচনার শুরুতে ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা বা প্রতিতুলনা করিনি? কিসের ক্ষতিপূরণ? কী দিয়ে আপনি পূরণ করবেন এক স্বাধীন স্বতন্ত্র অরণ্যনির্ভর প্রাকৃতিক জীবন যাপন থেকে উচ্ছেদ হয়ে রেল লাইনের ধারে ঝুপড়ি বাসির জীবন যাপনকে? হয়ত গুনলে দেখা যাবে মানুষগুলোর জীবনে নগদ টাকার আমদানি কিছু বাড়বে, কিন্তু তা দিয়ে কী পূরণ হবে? ঝোড়ার টলটলে জলে অবগাহন, সবুজ ঘাসে ঢাকা টিলায় মোষের পাল চড়াতে চড়াতে আড় বাঁশিতে তোলা সহজ সুর, চাঁদনী রাতে মাদলের বোলে দুলে ওঠা শরীর! টাকায় কি পূরণ হয় অরণ্যের অধিকার?
আমরা জানি সরকার জনগণের জীবনের মানোন্নয়নের নাম করে যে সমস্ত প্রকল্প গ্রহণ করে, সেখানে জনগণ পায় শুধুমাত্র বাইরের খোসা। এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আসল শাঁস খেয়ে পুষ্ট হয় বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী। দেউচা - পচামিও ব্যতিক্রম নয়, কোন মধুর গন্ধে নবান্নে শিল্পপতিরা ঘনঘন যাতায়াত করছেন সে আমরাও বুঝতে পারছি। দেউচা পচামিও আসলে গরীবের জীবনকে আরও দরিদ্র বানানোরই আয়োজন। তাই খনি প্রকল্পের বিরোধিতা করতেই হবে। বারংবার সোচ্চারে বলতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক দিকগুলো। কিন্তু সরকার আর পুঁজিপতিদের দোষারোপ করেই যদি থেমে যাই তা হবে বিকট আত্মপ্রবঞ্চনা। আমি শহরে বসবাস করে নাগরিক জীবনের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নেব - এয়ারকন্ডিশন মলে মার্কেটিং করবো, এসি মেট্রোয় চড়বো, এসি বাসে চড়বো, আমার পরিবারের সন্তান দশ দিক কাঁচে মোড়া ঠাণ্ডা আইটি হাবে মোটা মাইনের চাকরি করবে আর আমি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দেউচা পচামির বিরোধিতা করবো, এত ভণ্ডামি সইবে না।
তাহলে আমরা এসে দাঁড়ালাম এমন এক অবস্থানে যার এক দিকে আছে বিদ্যুতময় ঝলমলে জীবন যাপন আর অন্য দিকে আছে পরিবেশ দূষণ, অরণ্য ধ্বংস, আদিবাসী উচ্ছেদ। এর বাইরে কি হতে পারে এমন কোন অবস্থান, যেখানে আত্মবিশ্বাসী স্বরে উচ্চারণ করতে পারি - মেলাবেন, তিনি মেলাবেন…
আলোচনার এই মোড়ে এসে অনেক বন্ধু বলছেন - অত চাপ নিস না, বৈজ্ঞানিকরা ঠিক কোনও না কোন উপায় বের করে ফেলবেন, যাতে ধর্ম ও জিরাফ দুইই বাঁচবে। আমরা সবাই বিজ্ঞানের ছাত্র নই, কিন্তু এটুকু বুঝি বিজ্ঞানের জগৎ আলিবাবার গুহা নয়, যে চিচিং ফাঁক বললেই বন্ধ দুয়ার খুলে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যাবে অনিঃশেষ খাজানা। বাষ্প শক্তির উদ্ভাবনের সময়েও ভাবা হয়েছিল - এই পাওয়া গেছে আলাদিনের দৈত্য। সব কিছুই করিয়ে নেয়া যাবে এই দিয়ে। কিন্তু বাস্তবত কী ঘটেছে সে আমরা সবাই জানি।
তাপবিদ্যুতের বিকল্প অনুসন্ধানও বহু দিন ধরে বহু পথে চলেছে। তার বিশদ আলোচনা পরে কোনও লেখায় করা যাবে, হিসেব কষা যাবে গ্রীন এনার্জির নাম করে যা কিছু সামনে আনা হয়েছে, হচ্ছে তা আসলে কত টুকু গ্রীন, কত টুকু ক্লিন। আপাতত বিকল্প বিদ্যুৎ উৎসগুলোর মুশকিল নিয়ে একটু মুখড়া করে রাখি।
সৌর বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গে সৌর বিদ্যুৎ বেশ ভাল বিকল্প, কারণ বছরের বড় অংশ ভাল রোদ পায়।
মুশকিল -
১। সোলার প্যানেলের মূল উপাদান এমন কিছু খনিজ যেগুলো ‘রেয়ার আর্থ মেটেরিয়াল’ গোত্রে পড়ে, ফলে দাম বেশ বেশি।
২। সৌর বিদ্যুতের উৎপাদনে একক পিছু জায়গা লাগে অনেকটা বেশি - খুব ভাল জাতের সোলার প্যানেল বসালেও ১ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ পেতে জায়গা লাগে ৪ একর।
জল বিদ্যুৎ
মুশকিল -
১। বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বানাতে নদীতে বড় বাঁধ দিতে হয়, খরচ অত্যন্ত বেশি।
২। জলাধার বানাতে গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ হয়।
৩। বাঁধ দিলে পলি জমে খাত বুঁজে যায়, নদীটাই মরে যায় কিছু দিন পর।
জৈব বর্জ্য
বড় শহরে ভাল সম্ভাবনা আছে কিন্তু অন্যত্র যথেষ্ট যোগান পাওয়া সমস্যা।
মুশকিল -
১। তাপবিদ্যুতের সমকক্ষ নয়।
২। বর্জ্য উৎসতেই আলাদা করে ফেলতে হবে, এর জন্য যে জনসচেতনতা দরকার তা বিরল।
বায়ু শক্তি
ফাঁকা জায়গায় ভাল সম্ভাবনা আছে।
মুশকিল -
১। বড় হাওয়া কল বানানো প্রচুর খরচ সাপেক্ষ।
২। তাপ বিদ্যুতের সমকক্ষ নয়, কারণ বায়ুপ্রবাহ নিয়মিত নয়।
৩। সারা দুনিয়া জুড়েই বিধ্বংসী ঝড় যে হারে বাড়ছে, তাতে বড় হাওয়াকল টিকিয়ে রাখাই সমস্যা হচ্ছে।
এই সমস্ত পদ্ধতিগুলোর সাথে লেজুড় হিসেবে আর এক সমস্যা এসে যোগ হয় যার নাম - ব্যাটারি। কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদনই সমরৈখিক নয়। উৎপাদন বাড়ে কমে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। ২০২০র ফিজিক্সে নোবেল দেওয়া হয়েছিল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির গবেষণার জন্য। সব জাতের রিচার্জেবল ব্যাটারি মানেই তার আয়ু শেষ হবে এক সময়ে এবং সেই মরা ব্যাটারিকে রিসাইকেল করার সময় ব্যাপক পরিবেশ দূষণ হয়। আর লিথিয়ামের জন্য কী হতে পারে তার সাক্ষী দিচ্ছে রক্তাক্ত আফগানিস্তান, কঙ্গো সহ আরও বেশ কিছু দেশ। তাই যারা ব্যাটারি চালিত গাড়ি চালিয়ে ভাবছেন দূষণ কমিয়ে ফেললাম, তারা একবার চার্জিং পয়েন্টের পিছনে উঁকি দিয়ে দেখবেন - চার্জিংএর বিদ্যুৎ আসছে কোথা থেকে, আর ব্যাটারি বৃদ্ধ হলে কোন ভাগাড়ে পাঠাবেন?
এমত অবস্থায় উপায় কী?
একে তো কয়লার বিদ্যুতে ব্যাপক ময়লা, আর সেটাও ফুরিয়ে যাবেই। দুনিয়া জুড়ে কপালে ভাঁজ। সাথে উপরি পাওনা - গ্লোবাল ওয়ার্মিং, হিমবাহ গলছে, সমুদ্রের জল বাড়ছে, ঘূর্ণি ঝড় বাড়ছে, কলকাতা ডুবুডুবু। ক্লাইমেট এমার্জেন্সি। গ্রেটা থুনবার্গ। ফ্রাইডে ফর ফিউচার। দূষণ কমানোর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। আরও হাজার ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে শেষমেশ হাতে রইল পেনসিল।
অন্তত এখনও পর্যন্ত এমন কিচ্ছু নেই যা তাপবিদ্যুতকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে, সে রকম কোনও খবর নেই। মানে পরিস্থিতি এরকম - মাসের ২২ তারিখেই রেস্তো ফুরিয়ে এসেছে পরের মাসে মাইনে হবে কিনা তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা, হলেও পুরো মাইনে হয়তো পাওয়া যাবে না। এরকম অবস্থায় বাকি ৮ দিন যা করা হয়, আপাতত সেটাই করা ছাড়া আর কোনও উপায় হাতের কাছে নেই। প্রতি বার বিদ্যুতের সুইচ অন করার সময় নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে - ঠিক কতটুকু আমার নিতান্ত দরকার।
জানি - প্রয়োজন আর বিলাসিতার মাঝের সীমারেখা ভীষণ ঝাপসা, আর সেই সীমারেখাকে আরও বেশি করে গুলিয়ে দেওয়ার কাজটাই দক্ষতার সাথে করে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন। বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে যায়, সত্যিই ঠিক কত টুকু আমার চাহিদা আর কোথায় গিয়ে বিলাসিতায় গা ডোবাই, তবুও বুকের মাঝে ধক ধক করে বেজে চলা হৃদয়ের কাছেই জানতে চাইতে হবে কোথায় আমি থামবো। কখন বলবো - আর না এতেই দিব্যি কাজ চলে যাবে। আমাদের চেতনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বলে গর্ব করার মত যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটুকু সম্বল করে প্রয়োজন আর বিলাসিতার মাঝের ঝাপসা অঞ্চলে বারংবার তদন্ত করে দেখতেই হবে সক্কলকে, ফারাকগুলো স্পষ্ট করতে পারি কি না। অবিরাম পণ্য স্রোতের মাঝে বিবেক নামক খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারি কি না।
তেমনই আমাদের গড়ে তুলতে হবে এক সামাজিক আন্দোলন - জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প অনুসন্ধান। ভাবছেন - এ তো বৈজ্ঞানিকদের কাজ, সাধারণ মানুষ কী করবে? আজ বৈজ্ঞানিক/প্রযুক্তিবিদরা কাজ করেন হয় বড় কোম্পানিতে অথবা বড় গবেষণা কেন্দ্রে। এই দুই জায়গাতেই টাকা ঢালে পুঁজিপতিরাই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন - কী গবেষণা হবে এবং তা দিয়ে কারা মুনাফা করবে। তাই ঐ সব গবেষণাগার থেকে এমন কিছুই উদ্ভাবন হবে না যা সমাজকে পুঁজিবাদী উৎপাদনের ফাঁদ থেকে বেরোতে সাহায্য করবে। তাই বিকল্প জ্বালানির খোঁজ যদি শুধুমাত্র বড় গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা আবার কিছু মানুষের মুনাফার জন্যই ব্যবহৃত হবে, সামাজিক জ্ঞান ও সামাজিক প্রযুক্তির বিকাশ হবে না। সামাজিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি, মানে যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি পেটেন্ট দ্বারা সংরক্ষিত নয়, সামাজিক সম্পদ হিসেবে সমাজেই বিকশিত হয়, সেই প্রযুক্তিই আমাদের দরকার। তাহলে সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদেরও প্রত্যেকের সামাজিক দায়িত্ব হয় - যারা এই ধরনের সামাজিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানচর্চার কাজ করেন, তাদের মাথায় ছাতা ধরা। যাতে এই সমস্ত নতুন পথের পথিকরা কর্পোরেট পুঁজিপতির সেবাদাস না হয়েও নিশ্চিত জীবন যাপন করতে পারেন। তাই সামাজিক আন্দোলন হোক দ্বিমুখী - একদিকে নতুন প্রযুক্তিবিদদের উৎসাহ দেওয়া হোক সমাজ বিকাশের উপযোগী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে, অন্য দিকে তাদের তৈরি করা প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করাই হোক আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।
এই রাস্তায় না হাঁটলে গলা থেকে বড়শি বার করা যাবে না।
পুনশ্চ - চার হাজারের বেশি শব্দে লিখে ফেলা এই বাক্যালাপ পড়ে ফেলার পর একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ। আমি কোনও বিশেষজ্ঞ নই। ঘটনাচক্রে আজব এক পেশায় জড়িয়ে থাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হরেক চত্বরে ঘুরে ফিরে করে খেতে হয়। নিতান্ত পেটের দায়ে শিখে নিতে হয় নানা বিষয়। কোনও ভুল বা অসংগতি চোখে পড়লে জানাবেন, শুধরে নেবো। ফেসবুকে - কারিগর শমীক সাহা নামে খুঁজলে (বাংলায় টাইপ করবেন) আমাকে পেয়ে যাবেন। যোগাযোগ রাখবেন। ধন্যবাদ।
ডিসেম্বর ২০২১
চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তথা গানেরও জনক। চর্যাপদ, যার মূল নাম চর্যাগীতিকোষ তাকে প্রথম কম্পোজড বাংলাগীতিমালা ধরলে তার বয়স কত হল? হাজার?
১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে ১৪৭টি পদসমেত খেজুরপাতার ওপর লেখা একটি পুঁথি পেয়েছিলেন এবং সেটি ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালাভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা নামে প্রকাশ করেন। মূল গঠন প্রচলিত সংস্কৃত শ্লোকের অন্য ধাঁচ হলেও ভূমিকায় উদ্ধৃতি থাকায় চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় নামেও এটি পরিচিত। এ সঙ্গেই সংগীতের বিষয়ে বাংলার ইতিহাস এক লাফে এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা বছর। যদিও এর সময়কাল কোনটা এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। কেউ বলেন পদগুলো লেখা হচ্ছে সপ্তম শতাব্দী থেকে আবার কেউ বলেন দশম বা একাদশ শতাব্দী থেকে। পূর্বদেশের ভাষা তখন বাংলা। মৈথিলি অসমীয়া ওড়িয়া একত্রে তখন অর্ধমাগধীর পূর্বী অপভ্রংশ। ওরই নতুন রূপ অবহট্ঠ। যা হয়ে উঠলো আঞ্চলিক ভাষা। ওই অবহট্ঠের কালটাকে ধরেই অনেকে চর্যাগীতির সময়কাল ধরেছেন দশম/একাদশ শতাব্দী। চর্যার ভাষা শুধুমাত্র বাংলা নয় আমরা জানি। তখনকার ভৌগলিক সীমা অন্যরকম ছিল তাই চর্যাপদের ভাষা বাংলা মৈথিলি অসমীয়া ওড়িয়াতে মিশে আছে। তাই অসম আজ বলছে এ অামাদের! সংগে ওড়িষাও। আমরা জেনে এসেছি বাংলাতেই এর উৎস তাই বাংলাগানের ইতিহাস লিখি ওই সপ্তম বা নবম শতাব্দী থেকে।
আমরা জানি যে বৌদ্ধদর্শনের দুটি ধারা, মহাযান ও হীনযান। এই সময়টায় মহাযান তিনটি উপধারায় বিভাজিত হয়ে যায়— বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। এই চর্যাকারেরা শেষোক্ত ধর্ম পালন করতেন। একেবারে নিচের তলার মানুষরা এই সহজযানের মতাবলম্বী। কিন্তু ভাবনা চিন্তায় কোন স্তরে উঠেছিলেন তাঁরা, এটা ভাবতে অবাকই লাগে। চর্যাপদে যে সাধনমার্গের কথা বলা হয়েছিল সাধারণভাবে তা বোঝা দুঃসাধ্য। সম্পূর্ণ একটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি— আমরা যাকে সন্ধ্যা ভাষা বা এসোটেরিক বলি। আর এর রূপকার চর্যাকাররা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন।
মজার ব্যাপার এই মিস্টিক গূঢ়তত্ত্বসম্পন্ন চর্যা নিছক শ্লোক নয়। জেনেবুঝে সংস্কৃত শ্লোকের ওই পিকটোরিয়াল ভাবকে পরিহার করা হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে নিজস্ব এক ঢং। সেই ঢং গানের মত। চরণবিশিষ্ট। একটি কথার সঙ্গে আরেকটির মিল ঘটানো হয়েছে যাকে গানের লিরিকে অন্ত্যমিল বলা হয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে ধ্রুবা আমরা আজ যাকে ধুয়া বলি। কোন কথাকে ভালোভাবে পরিস্ফূট করার জন্য কোন অংশ বারবার গাওয়াকে ধ্রুবা বা ধুয়া বলা হয়। এ তো পরবর্তীকালের কীর্তনেও আছে। চর্যা আসলে গানই তবে তা বিনোদনের গান নয়, উপলব্ধির গান। এ সাধারণের জন্য নয় —অতিগোপন একান্ত উপলব্ধির জিনিস। গণচক্র নামে এক আচার উপচারের স্থান, যেখানে সংগোপনে দুরূহ ক্রিয়াকলাপের সাথে গানগুলি গাওয়া হত। এ সম্বন্ধে আমজনতা কিছুই জানতে পারতো না শুধু অনুশীলনকারীদেরই যোগদান করার অধিকার ছিল। কথা ও সুরের মাধ্যমে একের উপলব্ধি প্রকাশিত হত আরেকজনের কাছে। আগেই জেনেছি এঁরা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষজন। চর্যাপদের কবিদের কয়েকজনের নাম; শবরপা, কুক্কুরীপা, ডোম্বীপা, মীনপা— বোঝাই যায় কে ডোম কে শবর কে জেলে। অসম্ভব যুক্তিবাদী এঁরা। সেই মন নিয়ে এঁদের প্রশ্ন : সাধু! তুমি নাকি আমাদের ঈশ্বর দেখাবে? তুমি তো নিজেই ধুনির খোয়ায় অদৃশ্য! তাহলে তাঁকে দেখি কি করে? আবার প্রশ্ন : তুমি যদি বল বসন ত্যাগ করলেই মুক্তি পাওয়া যায় তবে কুকুর বেড়ালরাও তো বসন পরে না তারা মুক্তি পায়না কেন? মহাযান— গ্রেটার ভেহিকল, হীনযান— লেসার ভেহিকল আর এই সহজযানীরা ইজিয়ার ভেহিকলে আরো সহজে সাধনমার্গের লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছেন।
যাইহোক, গানের প্রসঙ্গে আসি। এই গীতি-গায়নের কতগুলো ফর্ম ছিল আর সে ফর্মটা আজও হারায় নি। ভারতীয় উপনিবেশ আজব চরিত্রের যা কিছুরই সৃষ্টি হয় তা কোন গহন স্থানে রক্ষিত থেকে যায় অর্থাৎ কোন কিছুই হারায় না। পরম্পরায় কোন আড়ালে আবডালে জীবিত থাকে সূত্র খুঁজতে থাকো পেয়ে যাবে। আবার ঘটবে পুর্নজীবন।
এই চর্যার গঠনটা প্রবন্ধগীতির আদলে। এখন যেমন কোন কম্পোজড গানে থাকে স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ, তখন গান বাঁধতে হত তুক দিয়ে। প্রবন্ধে যার উল্লেখ ধাতু মাতু ইত্যাদি। এখানে তুক হিসেবে ছিল উদগ্রাহ মেলাপক ধ্রুব এবং আভোগ। অদ্ভুত ব্যপার! অন্যসব সফিস্টিকেশন বর্জন করলেও গানের ক্ষেত্রে প্রচলিত রূপকেই আশ্রয় করেছেন এবং তা কোন লোকসংগীত নয়। পঞ্চম শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া মার্গ ও দেশী রাগের সেই অভিজাত শ্রেণীর দেশী সংগীত। আর সুর? তা ওনারাই দিয়ে গেছেন। পদগুলিতে পদকর্তার স্বনামের সংগে যুক্ত হয়েছে রাগরাগিনীর নাম। এটা গানের সপক্ষে একটা বড় বিষয়। পদগুলিতে সবচয়ে বেশি যে রাগটির নাম পাওয়া যাচ্ছে তা হল পটমঞ্জরী। আর যে সব রাগের নাম রয়েছে তারা এখনও দিব্যি বহাল। অবশ্য ভারতীয় স্কেলের ফরম্যাট প্রায়াংশেই ইকোয়াল টেম্পার্ড সিস্টেমে বদলে যাওয়ায় তাদের তেমনভাবে আর চিনতে পারা যাবে না। দেখা যাক কি কি রাগ সেই হাজার বছর আগে ব্যবহৃত হয়েছিল।
রামক্রী তো এখনকার রামকেলি! দ্বেশাখ এখন দেওশাখ। গউড়া হল গৌড়। মল্লার আর সারং এর সাথে মিশে রাগ সৃষ্টি হয়েছে গৌড়মল্লার আর গৌড়সারং। এভাবেই শিবরী - আশাবরী। মালসী - মালশ্রী। এ সঙ্গে কামোদ ধানশ্রী ভৈরবী এরাও আছে।
বঙ্গাল প্রাচীন রাগ। ওই পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ এলাকাভিত্তিক চলিত সুরের চলন নিয়ে যে রাগগুলি তৈরি হয়েছিল তাতে বঙ্গাল অন্যতম। এখনও এক ধরনের টোনাল ফর্ম রূপে চালু বড় কোন রাগের সঙ্গে মিশ্র করে গাওয়া হয়। যেমন বঙ্গাল ভৈরব।
চর্যা লেখা হল পালরাজাদের সময়। এই সময়টায় বাংলায় ভাষা - সংস্কৃতি, সঙ্গে ভাস্কর্য স্থাপত্য ইত্যাদি নিয়ে আসছে জোয়ার। বাংলার সবচেয়ে ভাল সময়। পালরাজারা মূলত বৌদ্ধ মতাবলম্বী ছিলেন এবং সে মত তান্ত্রিক তারানাথের দুরূহ তিব্বতীয় বৌদ্ধ মতধারা। এদের বৌদ্ধদের প্রতি অনুরক্তি থাকলেও রাজানুগ্রহ থেকে অন্যান্যদের বঞ্চিত করেননি। যাইহোক ৪০০ বছর পালরাজারা রাজত্ব করল। তারপর এল বারোশ’ শতাব্দী! সময়টাতে ঘটলো বদল। পাল রাজবংশের অবলুপ্তি হল। পালদের বিদায়ের কারণে বৌদ্ধদের প্রভাব কমতে থাকলো। তার সঙ্গে চর্যাও ক্রমশ বিস্মৃতির আড়ালে যেতে যেতে একসময় হারিয়েই গেল কিন্তু তার দর্শন রয়ে গেল পরম্পরায় অনেক শত বছর পরের বাউলগান পর্যন্ত। চর্যাগানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল দেহের সঙ্গে দ্বরের কম্পন বা ভাইব্রেশনকে মেলানোর বিষয়টি। প্রাচীনকালে সাধকরা দেহধারণের নিমিত্তে বায়ুকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতেন। এই বায়ু নাকি নিয়মিত শ্বাসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দীর্ঘদিন দেহধারণ করা যায়। চর্যাকারেরা সংযোজন করলেন সাউন্ড বা শব্দ। শব্দের কম্পনকে স্বউপায়ে ব্যবহার করা। দেহতত্ত্বের দর্শনে দেহের অনেক স্তর কিন্তু এ জাগতিক দেহ! সে একটাই কম্পার্টমেন্ট। পুরো দেহকে ‘গাত্রবীণা’ রূপে ব্যবহার করা। শব্দ হল এখানে সাঙ্গীতিক শব্দ। গানের স্বর ও স্বনন হতে হবে পিওর মেলোডি। এই পিওর মেলোডির ভাইব্রেশনই বাঁচিয়ে রাখবে সাধককে বহুকাল। মজার ব্যাপার, এর কয়েকশ’ বছর বাদে লেখা হবে সঙ্গীতরত্নাকর। সেখানে আলোচনা চলবে স্বর ও ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না নানা নাড়ীর বিষয় আশয়। এই পদ্ধতি ও রীতি প্রথা রূপে থেকে গিয়েছিল বৌদ্ধিক তত্ত্বসাধনার অনুশীলনে।
পাল সাম্রাজ্য অস্তমিত হওয়ার পর এলো সেন সাম্রাজ্য। বিজয় কি বল্লালসেনের ঐতিহাসিক তথ্য আনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আমরা গানের ইতিহাস খুঁজতে লক্ষণসেনকে চাইবো। দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গে তথ্য পাচ্ছি— ‘লক্ষণসেনের সময় রাগরাগিনী রাজসভায় মূর্ত হইত বলিয়া কথিত আছে— লক্ষণসেনের সভায় জয়দেবের হৃদয়াধিষ্ঠাত্রী পদ্মাবতী ‘গান্ধার’ রাগে গান গাহিয়া কপিলেশ্বরের সভা-জয়ী সঙ্গীতাচার্য্যকে জয় করিয়াছিলেন, স্বয়ং জয়দেব তাহার চরণের গতির ক্রম লক্ষ্য করিয়া তান রাখিতেন এবং নিজকে ‘পদ্মাবতীচরণচারণ-চক্রবর্তী’ বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন।
জয়দেব-পদ্মাবতীর গান সম্পর্কে অনেক কাহিনী হলায়ুধ মিশ্র কৃত সেক শুভোদয়া চম্পূকাব্যে পাওয়া যায়। এখানে বর্ণিত আছে যে কেমনভাবে এক বহিরাগত সঙ্গীতাচার্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার প্রয়াসে গান গেয়ে গাছের পাতা ঝরিয়ে দেন এবং পদ্মাবতী বিপরীতভাবে সেই পত্রহীন বৃক্ষকে কিভাবে পুনরায় পল্লবিত করেন। লিখিতভাবে পাচ্ছি— ‘লক্ষণসেনের রাজসভায় নর্তকী শশিকলা এবং বিদ্যুৎ-প্রভার গানে রাগ-রাগিনী এরূপ মুর্ত্ত হইয়া উঠিত যে, লোকে তাহা শুনিয়া বেহুঁশ হইয়া যাইত।’ আবার গল্পে আছে, এক রমণী নাকি সুহা রাগে এই বিদ্যুৎপ্রভার গান শুনে এতটাই আবিষ্ট যে কলসী মনে করে নিজের শিশুকে দড়ি বেঁধে কুয়োয় নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার, এই সুহা গায়নের সময় কিন্তু দুপুর বারোটা থেকে একটা, যেটা আমাদের স্নানের সময়। গল্পটা সময়ের কথা মাথায় রেখে বানানো। কুয়োতলায় মানুষ তো এই সময়ই যেত।
যাইহোক, বাঙালীরা নাকি একটু বেশি গণতান্ত্রিক। কোন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়তে চায়না। — ‘নির্দ্দিষ্ট কায়দা বা বিধানের বশবর্তী হইয়া চলিতে রাজি নহে।’ এ প্রায়শই দেখা গেছে। এ কারণে ভারতে অন্যত্র প্রচলিত সঙ্গীতের অনুশাসন মানা হয়নি এমন অনুযোগও আছে। পরবর্তী কালে আকবরের সময় রাগরাগিনীর মান কি হবে তাই নিয়ে নিয়মনীতি তৈরি হয়েছিল কিন্তু বাঙালী তা মেনেছিল কি? তাই রাগরাগিনীর সুর তখন আর শুধু আঞ্চলিক নয়, দূরপ্রান্ত থেকে আহরণ করা গান্ধার, গুর্জর, খোখোজ অর্থাৎ কান্দাহার, গুজরাট, কাম্বোজদেশের সুর। মোটামুটিভাবে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন গীতগোবিন্দের আস্বাদন চলেছে। গীতগোবিন্দ পুরীর মন্দিরেও গাওয়া হচ্ছে আবার শিখরাও তার থেকে আহরণ করছেন। কিন্তু অষ্টপদী গীতগোবিন্দের স্বাদ সাধারণ মানুষ সামান্য পেলেও এ তো রাজানুকূল্যে দরবারে সৃষ্ট। সে অভিজাতদের! তার ওপর ভাষা সংস্কৃত। আপামর বাঙালীর কি তাতে মন ভরেছিল?
বাঙালী মাতোয়ারা হল অব্যবহিত পর। এক মৈথিলি ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি প্রবল সাড়া ফেললেন এদেশে। চর্যার সে ভাষা কতিপয় ছাড়া আপামর জনসাধারণ বোঝেনি এবং তার বক্তব্য তো নয়ই। সংস্কৃতও শুদ্ধ ভাষা তা বাস্তবে মেলানো যায়না। কিন্তু মৈথিলি ব্রাহ্মণের এ ভাষা বোধগম্য। ছন্দ আলাদা, কি মধুর তার ধ্বনিমাধুর্য কি তার সুর! কেমন যেন আপন করে নেয়! তাই ব্রজবুলিতে বিদ্যাপতির পদাবলীতে মানুষকে মোহিত হয়ে উঠলো আর বিহারে জন্মানো বিদ্যাপতি কখন বাঙালিদের কবি হয়ে গেলেন! শোনা যায় শ্রীচৈতন্যর ভীষণ প্রিয় ছিল এই পদাবলী, গীত হিসেবে এগুলি নিয়মিত গাইতেন। এখান থেকেই বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনা হল।
চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সালতানাত বা শাহীরাজের পত্তনে বাংলার একটা লাভ হয়েছিল যে সে মধ্যযুগীয় বিশ্বে অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক দেশ হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু চিরাচরিত ধর্মীয় অনুশাসন যা ছিল সেখানে এক নৈরাজ্য শুরু হল এবং সমাজের কাঠামো দ্রুত নড়বড়ে হতে লাগলো। তবে বেশ কিছুকাল পর আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সরাসরি হস্তক্ষেপে সুস্থিতি ফিরতে শুরু করল এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয় দেখা দিতে শুরু করল। কবিরা ফের পেতে লাগলেন অনুদান, শিরোপা। এ সময় সৃষ্ট হতে লাগলো পরমেশ্বরের পান্ডববিজয়। বিজয়সিংহের মনসামঙ্গল কাব্য আর হোসেন শাহের পারিষদ যশোরাজ প্রকাশ করলেন বৈষ্ণব পদ।
এই যুগটা বিভিন্ন দিক থেকে সঙ্গীত ও ভাষার মিশ্রণের যুগ। বদলাচ্ছে সংস্কৃতি। সরকারী ভাষা তখন বাংলা ও ফার্সি। তবুও বাংলার মনোজগতে এক অপরিসীম শূন্যতা। আসলে এর অব্যবহিত আগে বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাব স্তিমিত হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক ভার বাঙলাকে চাপে রেখেছিল। তার ওপর ধর্মীয় ও সামাজিক হাজার নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেলা আচারব্যাবহারিক নীতির টানাপোড়েনে উদভ্রান্ত মানুষের কোথাও একটা অন্তর্নিহিত ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল এবং যে কোন সময়ে ফেটে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ চাইছিল উদার মানবিকতা। প্রয়োজন ছিল যেন এক বিপ্লবের। আর সেটা নিয়ে এলেন শ্রীচৈতন্য তাঁর নব্য বৈষ্ণব দর্শন নিয়ে। এক ভাববিপ্লবে তখন কূপ নালা নদী সাগর মিলেমিশে যেন সব একাকার। সবচেয়ে সাড়া পড়লো নিচের তলায়। তথাকথিত উচ্চ সমাজ তখন ভয়ংকর নাড়া খেল।
চৈতন্য বাণী প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নিলেন গানকে। যা হল কীর্তন। গানের মাধ্যমে ভাগবতবিষয়ক যশঃপ্রচার বা মহিমা কীর্তন। মূল কীর্তনগুলি বেশ সুশৃঙ্খল ও প্রণালীবদ্ধ এবং এতে নানা স্বরের বিনিময় এবং বহু তাল ও ছন্দের বৈচিত্র্য। কীর্তন ও তার সুরবৈচিত্র্য এখনও জীবিত। ভাবতে অবাক লাগে একটি বিশেষ গানের ধারা কিভাবে এত বড় দেশ ও তার জনসাধারণকে বেঁধে ফেলল! চৈতন্যেও কীর্তনসঙ্গীত বহু আলোচিত আমরা আর এ আলোচনায় না গিয়ে এগিয়ে যাই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলায়।
তখনও চলেছে এক বিপ্লব। আখড়াই হাফ-আখড়াই পাঁচালি কবিগান আর খেউড়ে বাঁধা নব্যবাবুদের বেচাল ঝাড়বাতির মদিরা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে শিক্ষিত সমাজ। এদের মধ্যে একদল যারা আবার চরমপন্থী, যারা সমাজের সব কিছু পালটে ফেলতে চায় দ্রুত আর বদল ঘটাতে গিয়ে তারা ডুবে গেলেন খ্রীষ্টিয় আচার-অনুষ্ঠান-ব্যবহারে, আর গানেও এল খ্রীষ্ট ভাব। অকৃত্রিম খেমটার সঙ্গে এরা বাজাতে চান অর্গান! কিন্তু যারা আসল তারা এই ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটির যুবকবৃন্দ নন। এরা আনতে চান এক প্রকৃত বদল। বক্তব্য — আমার ঐতিহ্য আমার সংস্কৃতির ধারা আমরাই বাঁচিয়ে রাখবো। পড়বো আরো জানবো, গাইবো গান লিখবো নাটক এবং আমি ভালো থাকবো অন্যকেও ভালো রাখবো। পশ্চিমীধারায় শিক্ষিত হয়েও রয়েছে এঁদের প্রবল জাত্যভিমান ও আত্মসম্মান। আত্মসচেতন তাঁরা ভাবছেন— প্রভুত্ব করছে ব্রিটিশ! ওরাই কি সর্বেসর্বা? ওরা যা পারে আমরা কেন পারবো না! এঁদের হাত ধরেই পরবর্তীকালে এসেছিল রেনেসাঁ। এর ঠিক আগে বাঙলায় চলত ধ্রুপদ খেয়াল তারানা চতুরঙ্গ হপ্তরঙ্গ ত্রিবট। মূলত গাইতেন বাঙলায় বসতি করা উস্তাদরা। বাঙালীরা এ কালোয়াতি গানে তখনও রপ্ত হননি। কিন্তু বিষ্ণুপুরে গানের চল ছিল তানসেনের বংশধর ও দিল্লির সভাগায়ক বাহাদুর হুসেন খানের আগমনের আর রামশঙ্কর ভট্টাচার্যরা জন্মানোর অনেক আগে থেকে। বিষ্ণুপুরের ইতিহাস ১৩শ ১৪শ শতাব্দী থেকে।
যাই হোক, তৎকালে বাঙ্গলায় অন্যান্যদের সাথে টপখেয়ালও চালু ছিল কিন্তু পশ্চিমী টপ্পার এত ব্যাপক চল ছিলো না। ১৭০০ সালের শেষদিকে বাঙলায় প্রচলিত হল টপ্পা। শোরিমিঞার টপ্পায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দানা নিধিরাম গুপ্ত তাকে রূপ দিলেন বড় বড় দানায় আরো আয়ত করে। টপ্পা প্রেমের গান, নিধুবাবুর রচনায় সে টপ্পা হয়ে উঠলো আরো রসমধুর আরো আবেগঘন। রোমান্টিক আর আইডিয়ালিস্টিক। নিধুবাবুর গান পরিশীলিত গান। বাঙালী মজলো এতে। ঠিক আগের মিস্টিক ঘোর থেকে বেরিয়ে এল গান। পরবর্তীকালে কত না কম্পোজার টপ্পা অঙ্গের গান সৃষ্টি করে খ্যাতি পেলেন! টপ্পা বেঁচে রইলো রবীন্দ্রনাথের গানেও। অন্যতম শ্রেষ্ঠ সে গান— ‘এ পরবাসে রবে কে’।
রামনিধির আগে এসেছেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। অন্নদামঙ্গল যখন লেখা হচ্ছে রামনিধির বয়স তখন ১১। এর আট বছর পর ভারতচন্দ্র গত হচ্ছেন। নিধুবাবু জন্মাচ্ছেন ১৭৪১ এ আর অগ্রগণ্য আরেক কবি-কম্পোজার রামপ্রসাদ জন্মেছেন ১৭২৩ এ। বয়সের তফাৎ এমন কি! এর সঙ্গেই উঠে আসছেন কালি মির্জা শ্রীধর কথক পাঁচালিকার দাশরথি রায় প্রমুখেরা।
কলকাতা তখন ঔপনিবেশিক শাসনে ব্যবসা বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র। আর সময়টায়তেই জীবনধারণের তাগিদে গ্রামজীবন ছেড়ে বহু মানুষ কলকাতাভিমুখী হয়েছিল আর এদের নিয়ে আসা গ্রাম্য সংস্কৃতিতেই কলকাতায় চালু হয় লোকগান, কীর্তন, রামপ্রসাদী, কবিগান যাত্রার গান, ঝুমুর, খেউড়, পাঁচালি ইত্যাদি। এগুলোর সঙ্গে তৈরি হয় আখড়াই।
তৎকালীন সমাজের কিছু অংশ নেশাগ্রস্তের মত খেউড় আখড়াই শুনতে আগ্রহী এবং ব্যস্ত ছিল। সে আখড়াই শান্তিপুরের আখড়াই। তা দুরকম। খেউড় আর প্রভাতী। ওই আখড়াইয়ের চার বিষয়ের এক পর্ব সখীসংবাদ এখন শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা স্বেচ্ছাচারিতা দুর্বৃত্তি সমাজের একধরনের মানুষকে ন্যায়ভ্রষ্ট করেছিল তারাই এ গান শুনত।
এ কিন্তু বহু পুরোন ধারা। আখড়াই এসেছে আখড়া শব্দ থেকে অর্থাৎ অনেকজন একত্রিত, জোটবাঁধা এক দল। ব্যান্ডের মত। এ গানে ছিল চাপান-উতোর, ছিল সওয়াল-জবাবের মত ব্যাপারস্যাপার। তবে কবির লড়াইয়ের মত নয়। আখড়াইয়ের দল হত কমপক্ষে কুড়ি বাইশজনের। সেকালে গায়ক মাথাপিছু ও কতজন বাদ্যযন্ত্রী আসছে তার ওপর পারিশ্রমিক বা দক্ষিণা স্থির হত। যেমন চুঁচুড়ার প্রসিদ্ধ এক দলের নাম ছিল বাইসেরা অর্থাৎ তারা বাইশজনের দল। অনেক সময় নাকি রান্নার উপকরণ বাসনপত্রও যন্ত্র হিসেবে ধরে নেওয়া হত টাকা বাড়ানোর জন্য। এরা শান্তিপুর থেকে কলকাতায় ঢুকেছিল চুঁচুড়া হয়ে রাজা নবকৃষ্ণ ইতাদিরা এদের পৃষ্ঠপোষক।
আর যে ঠাকুরবাড়ির বংশ থেকে এল রেনেসা! সেই বংশের পূর্বপুরুষ জয়রাম ঠাকুরের বাড়িতেও বসত এই আখড়াই গানের আসর। নিধুবাবু ও কুলুইচন্দ্র সেন পরিশীলিত করে প্রকাশ করলেন ভদ্র আখড়াইয়ের আরেক ফর্ম যাতে এমন অশ্লীল ভাষা পরিহার করা হয়েছে আর সংযুক্ত হয়েছে ভবানীসংবাদ বলে নতুন এক অংশ। পরিশীলিত আখড়াই চালু হবার সময় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সমাজের প্রগতিবাদী অগ্রগণ্যদের নিয়ে এক সংগঠন— আত্মীয়সভা, রামমোহন রায়ের উদ্যোগে। যেখানে দ্বারকানাথ ঠাকুরও আছেন। এর অব্যবহিত বাদে জন্মাবে ব্রাহ্মসমাজ। এখানে গান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। আর সে গানের কাঠামোই গড়ে দেবে আজকের বাঙলাগানের গড়ন। ফিরে যাই সেকালে। তখন রামমোহন খুঁজছেন এক পথ যাতে গানের সুরকে কথা অবলম্বী করে তোলা যায় আর যে গান আয়তনে কখনো বড় হবেনা তার পরিসর ছোট কিন্তু অনেক বড় কথার অর্থ সে পৌঁছে দেবে সহজে। আসলে কি হবে গানের ফর্মটা! তাঁরা সেটাই খুঁজছিলেন। রামমোহন স্বয়ং তৈরি করতে শুরু করলেন গান। অনুরোধ করলেন নিধুবাবুকেও। আর অতিবৃদ্ধ নিধুবাবু ব্রাহ্মসমাজের জন্য কম্পোজও করে দিলেন দুটি গান।
ক্রমে ব্রহ্মসংগীত একটা ধারা বলে নির্ণীত হল। ব্রাহ্মরা গাইছেন সে গান সমাজগৃহে, অনুষ্ঠানে সমাবেশে। এই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা ছিলেন শিক্ষিত ও মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের। লক্ষ্যনীয়ভাবে এঁরা সমাজসংস্কার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি প্রায় প্রতিজনই উদ্যোগী হয়েছেন গান রচনায়। এবং তা দান করেছেন ব্রাহ্মসমাজের ভাঙারে। দ্বারকানাথ ঠাকুর পরম রামমোহন অনুরাগী এবং তৎকল্পিত আত্মীয়সভায় উৎসাহী হলেও এ দিকটায় তাঁর নজর ছিলো না অথচ দ্বারকানাথ ছিলেন সঙ্গীতে মহা উৎসাহী।
১৮৪২শে দ্বারকানাঘের বিলেতযাত্রায় তাঁর সঙ্গী আঠারোজন ‘কনস্ট্যান্ট কম্পানিয়নের’ মধ্যে একজন হচ্ছেন এক জর্মন সংগীতজ্ঞ। তিনি একে কলকাতা থেকে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন কারণ লন্ডন থেকে কেনা হবে বাৰ্বি ইয়ং কম্পানির বহুমূল্য ব্যারেল অর্গান আর তার সুর ভারতীয় স্বরগ্রাম অনুযায়ী ‘টিউন’ করে দেবেন সেই বিশেষজ্ঞ। দ্বারকানাথ বিদেশবাসের সময় অনেক গান রপ্ত করেছিলেন। ম্যাক্সম্যুলারের সংগে মৌখিক আলোচনায় ইটালিয়ান গান ও বাংলাগান এক বিষয় ছিল। পরবর্তীকালে দ্বারকানাথের প্রথমপুত্র দেবেন্দ্রনাথ ক্রমে হয়ে উঠলেন ব্রাহ্মধর্ম প্রসারের মূল হোতা। এ সময়েই এসেছিলেন একঝাঁক সুরকার। অতীতে দেবেন্দ্রনাথ ইওরোপীয় শিক্ষকের কাছে নিষ্ঠাভরে শিখেছিলেন পিয়ানো আর ইংলিশ ফ্লুট। উদ্দেশ্য সঙ্গীতসৃষ্টি। উনি ভারতীয় রাগরাগিনীতে দক্ষ হলেও পাশ্চাত্য সঙ্গীত ভালোভাবে মকশো করেছিলেন তা বোঝা যায়। উদারভাবাপন্ন দেবেন্দ্রনাথের কাছে এদের-ওদের এমত ভেদাভেদ ছিলো না এবং পুত্রকন্যাদের প্রতি পরিবারের আদেশ ছিল গানটা শিখতে হবে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রও। বিশেষত পিয়ানো ও অর্গান। সে আদেশ পালন করেছেন তাঁর পুত্রকন্যা পৌত্রপৌত্রীরা। এই ঠাকুরবাড়িতে মাসমাইনে নিয়ে ছোটদের গান শিখিয়েছেন যদুভট্ট, বিষ্ণু চক্রবর্তী, মৌলাবক্স, শ্রীকন্ঠ সিংহরা। এঁরাই পরবর্তী প্রজন্মের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন গানের সুরকার হিসেবে। একথা সত্যি যে ঠাকুরবাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই গীতিকার ও সুরকার। এ প্রসঙ্গে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির অবশ্য উল্লেখ্য। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাঙলায় ইওরোপীয় চর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সঙ্গীতের নাটকের প্রসারে তাঁর অনন্য অবদান। এঁরই তাগিদে সভাসদ সঙ্গীতবিশারদ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী প্রথম ভারতীয় অর্কেস্ট্রার ফর্ম গড়ে তুললেন। পাশ্চাত্যসঙ্গীত জানা শিষ্য যদুনাথ পালকে নিয়ে তৈরি করলেন তার রূপরেখা। প্রথম বাজলো চার যন্ত্রের সমন্বয়ে ভারতীয় স্ট্রিং কোয়ার্টেট। কাছুয়া সেতার, সেতার, সুরবাহার ও বীণা নিয়ে। অর্কেস্ট্রার জন্য তৈরি হল ঐকতানিক স্বরলিপি। বাঙালী বুঝলো গানকে সংরক্ষণ করতে স্বরলিপি করতে হয়। এ বাড়িরই অন্যজন শৌরীন্দ্রমোহন সঙ্গীতের ওপর যা কাজ করে গিয়েছিলেন তার আয়তন মাপলে চমৎকৃত হতে হয়। সেই সময় অক্সফোর্ড থেকে পাওয়া ডক্টরেট রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সারা পৃথিবীর তিরিশজন নামীদের মধ্যে একজন যার পরিচিতির বেশীর ভাগটাই দাবী করে সংগীত। এ সময় তৈরি হচ্ছে নাটকের গান। পরে তা জনগণে ছড়িয়ে যাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদানে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকের গান প্রেমের কথা আর বোলো না সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলছেন— উনি সাড়ে তেরো বছর বয়সে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হলে ক্লাসে এক সহপাঠীকে টেবিল বাজিয়ে এই গান গাইতে শুনলেন তা নাকি ইটালিয়ান ঝিঁকিটে তৈরি। উনি এই গান ইতিপূর্বে গাড়োয়ানের মুখেও শুনেছেন। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর ছাত্র কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় প্রথম গানে হারমোনাইজ করতে শুরু করেন। ঐকতানিক গান ও বৃন্দবাদনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন। উনিই প্রথম লুপ্তপ্রায় ধ্রুপদগুলিকে স্টাফ নোটেশনের মাধ্যমে ধরে রাখতে প্রয়াসী হন এবং গভর্নমেন্টের চাকরি ছাড়েন সঙ্গীতের জন্য। এই প্রয়াসের হাত ধরে সৃষ্টি হল দক্ষিণাচরন সেন কৃত অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড। নাম ব্লু রিবন অর্কেস্ট্রা। ওদিকে
অমৃতলাল দত্ত বা হাবু দত্ত যন্ত্রীদের সাজাচ্ছেন গিরিশ ঘোষ পরিচালিত নাটকের জন্য যেখানে পরবর্তীকালে উস্তাদ আলাউদ্দিন খান একজন ক্ল্যারিনেট বাজিয়ে হিসেবে খুঁজে পাবেন তার রুজি। আগে বলা হয়েছিল যে বাঙলা গানের আধুনিক রূপধারণের পেছনে ব্রহ্মসঙ্গীতের ভুমিকা আছে। এই রূপটির পরিকল্পনা করেছিলেন গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী। ঠাকুরবাড়ির জিনিয়াসরা এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে একেকজন অসামান্য সুরকার হয়ে উঠলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই। এদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক বোধহয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ! জ্যোতিরিন্দর গান সপ্রতিভ ঝকঝকে। কর্ডনির্ভর, যেহেতু পিয়ানোয় বসে কম্পোজ করা। তৎকালে ইডেন গার্ডেনের ব্যান্ড সাধারণ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ওই সহজ সরল বিদেশী সুর এদেশী সুরকাররা আয়ত্ত করেছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হয়ত সবচেয়ে বেশী। অনুজ তরুণ রবীন্দ্র ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসছেন স্কটিশ আইরিশ গানের শিট মিউজিক আর দাদা তা পড়ে দ্রুত তুলে ফেলছেন সুর। এভাবেই তৈরি হয়েছে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে, পুরানো সেই দিনের কথা এবং আরো কত গান! জ্যোতিরিন্দ্রকৃত স্বরলিপিগীতিমালা স্বরলিপি গ্রন্থে রয়েছে নাম— কথা রবীন্দ্রনাথ সুর গ্রন্থকার। এই সেজ দাদা না থাকলে রবি আমাদের এই রবীন্দ্রনাথ হতেন কিনা সন্দেহ! মিথ্যা নয়। একথা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলে গেছেন টাউনহলে সত্তর বছর পূর্ত্তির সম্বর্ধনাসভায়। এরপর সত্বর রবীন্দ্রনাথ ছাপিয়ে গেলেন সবাইকে। সং রাইটার হিসেবে সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কম্পোজ করা সুরকার গীতিকারদের মধ্যে সম্ভবত যিনি দ্বিতীয়। ২২৩২টি গান! এমন কোন বাঙালি নেই যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেনি। গানের এমন জনগ্রাহ্যতা আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। পুরো একটা জাতি রবীন্দ্রগানে অবগাহন করেছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দু বছরের ছোট, বাঙলা গানে তাঁর অবদান প্রচুর কিন্তু তাঁর স্বল্পজীবন। মাত্র ৪৯ বছর বেঁচে রইলেন। তৎরচিত জাতীয়তা গান ও নাটক ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তাই হয়ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিতে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে দূর দূর প্রান্তে ঘনঘন বদল করা হত এবং এ কারণে ক্রমেক্রমে স্বাস্থ্যহানি, অবশেষে সেরিব্রাল স্ট্রোকে এই অকাল মৃত্যু। একমাত্র দ্বিজেন্দ্রলালই বিলেত থাকা কালীন নিজের পয়সা খরচ করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে গানটা শিখেছিলেন। অপেরাধর্মী হাস্যরসাত্মক গানগুলোয় তার নিদর্শন ছিল কিন্তু তা হারিয়ে গেছে।
বাঙলায় পাঁচজন কবি কম্পোজারকে একত্রে বলা হয় পঞ্চকবি। রবীন্দ্রনাথকে মূল ব্যক্তিত্ব ধরে বাকিরা হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও নজরুল ইসলাম। এঁরা বহু আলোচিত বহু অন্বেষণ হয়েছে এবং এঁরা একেকজনে নিজেরাই একেকটি ইতিহাস গ্রন্থ। তাই এই সংক্ষিপ্ত সফরে তাঁদের আনা হল না। ১৯০০ সাল নাগাদ বোম্বাই হয়ে কলকাতায় এল সিলিন্ডার রেকর্ড এবং পরে গালার রেকর্ড ডিস্ক। হেমেন্দ্রমোহন বসু এইচ বোসেস কোম্পানি খুলে বাঙলা ও উর্দু গান রেকর্ড করার পাশাপাশি বাঙ্গলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদেরও গান আবৃত্তি ভাষণ এই সিলিন্ডারে গ্রহণ করতে শুরু করলেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ এ গাইলেন নিজের সুরে বন্দেমাতরম। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিকায়। পরে এই রবিবাবুর গানই বহু শিল্পী গাইতে চাইবেন। বেদানা দাসীর ‘আজ তোমাকে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে’ শুনলে বোঝা যাবে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতই তখন কিভাবে গাওয়া হত। এরপর এল বিদেশী কোম্পানি। ব্যবসা বুঝে তারা নিশানা করতে লাগলো প্রতিষ্ঠিত বাইজিদের ও অন্য গায়ক গায়িকাদের। গহরজান, মালকাজান, জড্ডনবাই, জানকীবাই ছপ্পনছুরি এঁদের রেকর্ড ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে লাগলো। এলেন লালচাঁদ বড়াল কাদের মল্লিকের মত শিল্পীরা। এবং পরম্পরায় - জ্ঞান গোঁসাই নজরুল ইসলাম সায়গল আব্বাসউদ্দিন ভীমদেব চট্টোপাধ্যায় আঙুরবালা ইন্দুবালা কাননবালা আরো পরে শচীনদেব বর্মন পঙ্কজকুমার মল্লিক - এরা।
কলের গান আসাতে গান এখন ঘরে ঘরে। সবাই চোঙাওলা গ্রামোফোন কিনতে চান গান শোনা অবশ্য প্রয়োজন। তবে রেকর্ড কোম্পনির প্রয়োজন আরো বেশী চাই আরো শিল্পী। আর ঠিক তখন দুটো বিষয়ের প্রয়োজন হল —এক গীতিকার দুই সুরকার। তখনই সুরকার হিসেবে প্রসিদ্ধি পেলেন রাইচাঁদ বড়াল কমল দাশগুপ্ত সুবল দাশগুপ্ত তিমিরবরণ হিমাংশু দত্ত কৃষ্ণচন্দ্র দে হীরেন বসু সুধীরলাল প্রমুখেরা। সঙ্গে গীতিকার হিসেবে এলেন প্রণব রায় শৈলেন রায় অজয় ভট্টাচার্য সুবোধ পুরকায়স্থ মোহিনী চৌধুরীরা। এঁরা তিরিশ থেকে চল্লিশ দশকের শিল্পী।
এইসঙ্গে তিরিশ দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হল। এই টকি ফিল্মের আগে এখানে তৈরি কি বিদেশ থেকে আসা যে নির্বাক বা শব্দহীন যেসব ‘বায়োস্কোপ’ দেখানো হত তাকে আরো বিনোদনী বা আমোদজনক করতে সিনেমা হলে লাইভ অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করা হত। পর্দার উল্টোদিকে বসে থাকা যন্ত্রীরা ছবির মুড বুঝে তাতে সংগত করতেন। এমন ছবিতে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী কিশোর বয়সে এক প্রেক্ষাগৃহে স্টান্ট পিয়ানিস্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্লে ব্যাক পদ্ধতি আসার আগে এরাই শুটিং লোকেশনে অভিনেতা অভিনেত্রীর গানের সাথে বাজানোর জন্য ক্যামেরার আড়াল হয়ে বসতেন। এমত গানের রেকর্ডিং নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায় আজও। যাইহোক এই যন্ত্রীরা ক্রমে প্রডাকশন হাউজগুলোর বাঁধা মাইনের চাকুরিজীবি হয়ে গেলেন। এরকম দল কলকাতায় প্রচুর ছিল। নিউ থিয়েটার্স হাউজ থেকে এদের রেকর্ড বেরোত রাইচাঁদ বড়াল তিমিরবরণের পরিচালনায়। গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া ছাড়াও তিনটে বাঙালী রেকর্ড কোম্পানি তখন - মেগাফোন হিন্দুস্থান ও সেনোলা। রবীন্দ্রনাথ গায়ক এবং আবৃত্তিকার হিসেবে হিন্দুস্থানের শিল্পী ছিলেন। চল্লিশদশক পর্যন্ত সুরকৃত গানগুলো মোটামুটি ভাবে রাগরাগিনী ও লোকসঙ্গীতাশ্রিত ছিল। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বিদেশি সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটেছে এ আমরা আগেই দেখেছি। কিন্তু লিরিকের সাহিত্যমূল্য উচ্চস্তরের হলেও একটু এলায়িত লীলায়িত আর সুরও যেন হেলেদুলে চলে। ১৯৩৯ - ১৯৪৫ ভয়াবহ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ। এই ভীষণ দুর্বহ দুর্মর টেনে চলা জীবন। পরে পরেই দুর্ভিক্ষ কালোবাজারী দাঙ্গা – এই অবক্ষয়ী সময়ের মধ্যেই উঠে দাঁড়ালো মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মানুষ। এরা শিল্পী। এরা লিখলেন গান কবিতা নাটক আঁকলেন ছবি, নতুন মূল্যবোধের এবং অবশ্যই এক নতুন আঙ্গিকে। সে গানের সুর মিলে যায় বাঙ্গলার লোকগান বা কখনো লাতিন কখনো কালো আমেরিকানদের সুরে। গণনাট্যের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রবিশঙ্কর থেকে প্রায় সব শিল্পীই এখানে সামিল হয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরী সুধীন দাশগুপ্ত সবাই এই কর্মকান্ডের সামিল তখন।
বাঙলা গানের প্রধান স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী যে ধারা প্রবাহিত হতে লাগলো তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। গানের ফর্ম এমনভাবে ভাঙলো যা অনেকস্থানে পূর্বপরিপন্থী। ১৯৪৯ সালে গাঁয়ের বধূ যখন বেরোয় তখন ধ্রুপদিয়ারা প্রশ্ন তুলেছেন একি গান? এতে কেন অন্তরা সঞ্চারী নেই! ১৯৫৩ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ হারমোনাইজ করা হয়েছিল আর এতে সঙ্গীত পরিচালককে অনুযোগ করা হয়েছিল কেন তিনি লতা মঙ্গেশকরকে সুরে গাওয়াতে পারেননি। আর আজ গানে হারমোনাইজ করার প্রতিযোগিতা চলেছে। সত্যিই এরা যুগের তুলনায় কত এগিয়েছিলেন।
পঞ্চাশের মাঝামাঝি গানের যন্ত্রানুষঙ্গ শব্দগ্রহণ মিশ্রণে আসছে নতুন ভাবনা।
এখন যন্ত্রানুষঙ্গ হয়ে উঠছে প্যানোরামিক। দূরে আবহে মায়াময় ভায়োলিনবৃন্দ বাঁশিতে অবলিগ্যাটো। অর্কেস্ট্রা তৈরি করছে সাঙ্গীতিক ভাষা। বাজছে গানের ভাবানুসারী প্রিলিউড ইনটারলিউড। এর ঠিক আগে বদলে গেছে গানের উচ্চারণ বদলে গেছে এক্সপ্রেশন। কুন্দন সায়গল পঙ্কজ মল্লিকের গলার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আকাশপাতাল তফাৎ। আনুনাসিক শব্দ উধাও।
এবার গায়ক হেমন্ত সুরকারও। সুরকার সলিল চৌধুরী সুধীন দাশগুপ্ত নচিকেতা ঘোষ বদলে দেবেন গানের ধারা। একের পর এক লিজেন্ডারি গান গেয়ে যাবেন হেমন্ত মান্না সতীনাথ শ্যামল মানবেন্দ্র দ্বিজেন সন্ধ্যা গীতা প্রতিমা আরতি আরো আরো অনেকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না! নদীর বাঁকগুলোই মডার্ন। সত্যি এ মডার্নিটির ধারানদী কত বাঁকবদল করে আনলো কবীর সুমনকে, এলো কথা ও গানের নতুন রূপ, এলেন নচিকেতা চক্রবর্তী অঞ্জন দত্ত তারপর ক্রুশ উইনডজের রক ব্যান্ডের সাথে এল বাঙলা ব্যান্ড ভূমি ক্যাকটাস পরশপাথর চন্দ্রবিন্দু ফসিলস লক্ষীছাড়া।
আ মরি বাংলা ভাষা - তার গানের কতনা বৈচিত্র্য! এ ভাষার গান নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলে গিয়েছিলেন— ‘গান কি জান? কোনও রসের আবেগ যখন এত গভীর হয় যে কথায় তা বলা যায়না, ছন্দে কবিতায় তা প্রকাশ করতে পারেনা, তখন মানুষ সুরে সেই অব্যক্ত ভাবকে ব্যক্ত করবার চেষ্টা করে। সেই সুর যখন জাগে - তখন ছন্দে তার রূপ ফুটে ওঠে, কন্ঠে তখন গান হয়ে ব্যক্ত হয়।’
এই রসের আবেগ বাঙলার খুবই বাঙালীর কণ্ঠে তুলে দেবে গান আরো আরো হাজার বছর!
‘‘আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নখাই”- এ ভাবেই বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রবহমান বেহুলার কথা, বেহুলার মিথ। সঙ্গীতে সাহিত্যে শিল্পকলায় নাটকে যাত্রায় এখনও বেহুলার অবস্থান। এ আলোচনায় লোকসঙ্গীত ও লোকশিল্পে বেহুলার মিথটি কি ভাবে উঠে আসছে সে বিষয়ে কিছু দৃষ্টান্ত আলোচিত হল।
যে ছত্রটি প্রথমেই উদ্ধৃত হয়েছে তার সম্পূর্ণ অংশ—
ও ডিঙ্গা সাজায়ে দে ডিঙ্গা সাজায়ে দেখো
ও আমি লয়ে যাব উজুনি নগরে॥
দুধের করো নদীনালা কলার করো ভেলা॥
ও মাগো সেই ভেলাতে ভেসে যাবে লখিন্দর বেহুলা॥
আজি গে রামেশ্বরের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নাই॥
আজি গে মাধাইগঞ্জের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ভেসে ভেসে যায় বেহুলা কুলেতে নখাই॥
আজি গে গুদামবরের ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ধোনামোনার ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দরশন॥
আজি গে ধোনামোনার ঘাটের থেকে ও ডিঙ্গা চলিতে নাগিল॥
আজি গে ধোবানির ঘাটে ডিঙ্গা দিলেন দংশন॥
আজি গে ধোবানির ঘাটে বেহুলা যায় গড়াগড়ি॥
এটি বীরভূম অঞ্চলের একটি সাপনাচানি গান। গায়ক সৃষ্টির বাদ্যকর, গুরুর মুখে শুনে গান করেন ও গান রচনা করেন। নিচের গানটিও একই গায়কের।
ও কালী কি নয়নে (আরে) আমার প্রাণে চাইলি রে
আজ ঘরে রইতে দিলি না॥
ও মাগো সাঁতালি পর্বতে শ্বশুর গো ও আমায় দিলেন বাসরঘর॥
লোহার আঁচির লোহার প্রাচির লোহার বাসরঘর॥
ও মাগো কোন কামারে গড়েছিল লোহার বাসরঘর॥
সরুপারা পিঁপড়ে ফাঁকে গো কেমনে ঢুকল কালনাগ॥
উটকপালী খেরম-ঠেঙ্গী চিরুণ-চিরুণ দাঁত॥
মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত॥
মাগো সোনার বরণ স্বামীর দেহ কালি বরণ হল॥
মাগো হতভাগী বেহুলার মন ও আমার কপাল ভেঙ্গে যায়॥
বেহুলা হল সতীকন্যা ও আমার রোদনে বসিল।।
ও মাগো বেহুলা হলো সতীকন্যা ধুলোতে দেই গড়াগড়ি॥
ও মাগো এ বলিয়ে কান্দে তখন বেহুলা সুন্দরী॥
সাপখেলার সময় এই গানগুলি গাওয়া হয়, সঙ্গে থাকে ছোট বিষম ঢোল। ‘চিরুণ-চিরুণ দাঁত/ “মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত।’ এই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় ক্ষেমানন্দের (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ?) মনসামঙ্গল-এ ‘খণ্ডকপালিনী বেহুলা চিরুনী দাঁতী/ বিভা দিনে খাইলে পতি না পোহাতে বাড়ি।’ লোককবিরা নিজেরাই একটি বয়ান তৈরি করেন কখনও মঙ্গলকাব্যের ছত্র পঙ্ক্তি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে।
ও ঢোঁড়া যা যারে কালীকে আনিতে ঢোঁড়া যা॥
আজিগে কালীকে আনিবার ছলেরে আমার যায় ঢোন্ডু নাগ॥
চল চল চল কালী ও তোমায় ডেকেছেন মনসা॥
তাড়াতাড়ি আসে কালী ও তখন মায়ের নিকটে॥
মায়ের চরণে কালী ও আমার প্রণাম করিল॥
সাঁতালি পর্বতে আছে ও কালী লোহার বাসরঘর॥
তাহার ভিতরে নিদ্রা যায় বেহুলা নখিন্দর॥
আজিকে কোনোরকমে কালী তুমি পূর্ণ কর সাধ॥
তুই কালী না খাইলে ও আমার পুজো হবে না॥
এতখনে কালীনাগ তখন চলিল খেইয়া॥
ঈশানকোণে দ্যাওয়ালেতে একটা আছে চিত্রফাঁক॥
যেমন কন্যা তেমনি বর ও মাগো বিধাতার গঠন।।
ও মাগো দোষ করে নাই ঘাট করে নাই (ও আমি) কিবা বলে খাই॥
তিনকুড়িরও নােগর মাতা ও আমি কালনাগিনী॥
ও মাগো লখিন্দরকে খাইতে মোর ওগো শক্তি নাহি পারে॥
যেমন কন্যা তেমনি বর ও মাগো বিধাতার গঠন॥
তুই কালী না খাইলে ও আমার পুজো হবে না॥
এখানে ‘কালী’ কালীনাগ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কালীনাগ লখিন্দরকে দংশন করেছিল। নিরক্ষর লোকগায়ক সৃষ্টিধর বাদ্যকর যখন এই গানগুলি উদাত্ত কণ্ঠে গান তখন সর্বশ্রেণির শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনে। সাপখেলার সময় এই গানগুলি গাওয়া হয়, সঙ্গে থাকে ছোট বিষম ঢোল। ‘চিরুণ-চিরুণ দাঁত/ ‘মা আমায় একই রেইতে খেলি স্বামীকে না পোহাইল রাত। এই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় ক্ষেমানন্দের (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ) মনসামঙ্গল-এ ‘খণ্ড-কপালিনী বেহুলা চিরুনী দাঁতী/ বিভা দিনে খাইলে পতি না পোহাতে রাতি।’ লোককবিরা নিজেরাই একটি বয়ান তৈরি করেন কখনও মঙ্গলকাব্যের ছত্র পঙ্ক্তি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে। পেশার জন্য এই শিল্পীকে বেতের কাজ করতে হয় অথবা ব্যান্ড বাজাতে হয়। গানগুলি ‘ভ্রমরা লোকসংস্কৃতি সংস্থা’র সংগৃহীত ও প্রচারিত। ‘ভ্রমরা’ কর্তৃক ‘শিকড়ের সন্ধানে’ ক্যাসেট, সিডিতে সংকলিত ও পুস্তিকায় মুদ্রিত।
বরিশাল অঞ্চলের ‘বেদিয়া’ বা ‘বেদে’ সম্প্রদায়ের গান—
‘রে বিধি কি হইল।
সোনার বরণ লখাইরে আমার
বরুণ হইল কালি
কি সর্পে দংশিল লাখাইরে
বেহুলা হইল রাঢ়ী॥
আজ হইল বেহুলার বিয়া
বাইদার সিন্দুর দিয়া
কেমন করে যাইবে গো বেহুলা
বাইদাপাড়া দিয়া বে
—ভ্রমরা সংগৃহীত। বরিশাল অঞ্চলের গান।
নিম্নবর্গের নানা চরিত্রের নানান পেশার সঙ্গে বেহুলার সম্পর্ক তৈরি করার ঘটনা মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণগুলিতে দেখা যায়—
প্রসন্ন রূপেতে যদি দেহ ত মেলানি।
ছুলিব ডুমুনি রূপে তোমার জননী॥— বিপ্রদাস
বেহুলা ডোমনী সাজিয়া অন্তঃপুরদ্বারে হাজির হইয়া হাঁক দিল, ‘কে লইবে চুপড়ি বিয়ানী। (সুকুমার সেন, ১৯৭০ : ২১৭)। বাংলার কৃষিজীবনের সঙ্গে বেহুলার সম্পর্কের কথা পাওয়া যায়—
‘‘বেহুলা কান্দিয়া বলে প্রার্থনায় লৈয়া কোলে
যাব আমি ছয়মাসের পথ।।” (কেতকাদাস)
‘এই ইঙ্গিতের মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। শ্রাবণ বা ভাদ্র মাস থেকে ছয় মাসের পথ অতিক্রম না করলে লখিন্দরকে ফিরে পেতে পারি না। এই লখিন্দর চাষীর ঘরের ফসল বা পৌষ-মাঘ মাসে চাষীর মুখে হাসি ফুটিয়ে ফিরে আসে।’ (সুজিত চৌধুরী, ২০১২: ৩৬)।
পশু-পক্ষী জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেরও নিদর্শন পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল-এর অাখ্যানগুলির মধ্যে আছে—
এক পাল শেয়ালের দল একত্রে বেহুলাকে ডাক
মড়া ফেলে ফিরে যাও ‘প্রাণ পাই তোর পাকে’।
কিন্তু শৃগালগুলিকে বেহুলা জানান এই শব তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় স্বামীর— এই শব তিনি দিতে পারেন না, হয় তিনি স্বামীকে বাঁচাবেন নয় মৃত্যুবরণ করবেন। তখন—
‘‘এত কথা শুনি যত শৃগালিনী
এ পড়ে উহার গায়ে।
অপূর্ব কাহিনী কভু নাহি শুনি
মড়া নাকি প্রাণ পায়।’’ (কেতকাদাস, সুকুমার সেন, ১৯৭০: ১৮৩)
অনুরূপ ঘটনা বাঘের সঙ্গেও ঘটে। —(বিজয়গুপ্ত)
এইভাবে নানাম ঘটনা বেহুলার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা লোকসমাজে প্রতিষ্ঠা করে।
বেহুলার প্রবাদপ্রতিম সৌন্দর্যের বর্ণনা মনসামঙ্গল-এ আছে—
‘‘চাচর মাথার কেশ চন্দন ললাটে।
পূর্ণিমা চাঁদ যেন রাহুর নিকটে॥
দশন মুকুতা পাঁতি অথরে তাম্বুল।
নাসিকা নির্মাণ দেখি যেন তিল ফুল।
নিতম্ব যুগল যেন নয়নে কাজল।
কমল উপরে যেন ভ্ৰমর যুগল॥
অর্ধোত্থিত স্তনদ্বয় শোভে হৃদপরি।
সরোবর মধ্যে যেন কমলের কড়ি॥”—(বিষয়গুপ্ত)
[ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : ১০২]
আরেকটি রূপের বর্ণনা—
‘‘পথের পথিক যত বাইয়া যায়।
বেহুলার রূপ দেখি ঘন ঘন চায়॥
ত্রিজগৎ মোহিনী কেন মড়া লইয়া কোলে॥
কলার মান্দাসে ভাসে ঢেউর হিল্লোলে।” (কেতকাদাস)
[দীনেশ চন্দ্র সেন, ১৯৮৬ ১৯০-৯১]
মঙ্গল কাব্যগুলিতে ইন্দ্রের সভার বা স্বর্গের নর্তক-নর্তকীদের শাপগ্রস্ত হয়ে বা কোনো উদ্দেশ্য সাধন করার জন্যে মর্তে জন্মগ্রহণের কাহিনী আছে। মনসামঙ্গল-এ মনসা এইরকম— অনিরুদ্ধ-ঊষা নর্তক দম্পতিকে মর্তে লখিন্দর-বেহুলা রূপে পাঠালেন। চাঁদোর স্ত্রী সনকার গর্ভে লখিন্দর ও উজানীনগরে সাধু বণিকের ঘরে বেহুলা জন্মালেন। এর পর বেহুলা-লখিন্দরের বিবাহ, লখিন্দরকে সাপে কাটার ঘটনাগুলি মনসামঙ্গল-এর আখ্যানের মধ্যে চলেছে। লখিন্দরের জীবন কামনার জন্য বেহুলা ‘দেবপুরে’ গিয়ে অন্যান্য দেবনর্তকীদের সঙ্গে—
আপনি মৃদঙ্গ বাহে গীত গাহ রঙ্গে।
সুতান সুছন্দে নৃতা করে অঙ্গভঙ্গে॥
ক্ষেণেক রহিয় রাধা করয়ে বিশ্রাম।
পুন ছন্দ-বিছন্দে নাচে অনুপাম॥
দ্বিজ বিপ্রদাস বলে বন্দি বিষহরি।
কামেতে পীড়িত হৈয়া বলে ত্রিপুরারি॥(বিপ্রদাস)
এর পর শিবের লুব্ধ দৃষ্টি কুপ্রস্তাবের পর শিব লজ্জিত হয়ে নারদকে দিয়ে মনসাকে ডাকিয়ে লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন, দেবতারাও সন্তুষ্ট হয়ে তাতে সম্মতি দিলেন। (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২১৬)
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ রচনাকালে, ’১৫-১৬ শতাব্দীতে মেয়েদের নৃত্যগীতি বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়। দুঃখের সময় হাসিমুখে বেহুলা দেবসভায় নেচে গেয়ে স্বামীর ও তাঁর ভ্রাতাগণের জীবন পুরস্কার নিয়ে ফিরে এলেন। [দীনেশ চন্দ্র সেন, ১৯৮৬ : ১৯১]
মঙ্গলকাব্যগুলির মতই ‘বিষহরি মনষাঙ্গল’ এই ধরনের পালাগুলিতেই এই ঘটনার বর্ণনা—
শিব। সুন্দরী তুমি নৃত্য করতে পারো?
বেহুলা। হ্যাঁ প্রভু
(নৃত্যগীত)
সোনারই পলংখের ময়না কুন বনে যায় রে
কুন বনে যায় ময়না
ফিরে নাহি চাই রে—
দধি দুগ্ধো মাখম ছানা,
তবু ময়নার মন পাইলাম না,
উড়ে যায় রে প্রাণের ময়না
ফিরে নাহি চায় রে।
দধি দুগ্ধো ছানা মাখোম,
উড়ে যায় রে প্রাণের ময়না
ফিরে নাহি চায় রে। —(বিষহরি বা মনষাঙ্গলা)
এর পরের ঘটনার বিবরণ— অন্যান্য মনসামঙ্গল-এর মতই আখ্যানকে আরো অন্যভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, কাহিনীটিও আরো লোকায়ত। পরের অংশটি ‘মা মনসা মঙ্গল’ বা বিষহরি পালা— গায়ক শ্রী তারিণী মোহন রায় (টোকা গিদাল), ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি।
‘বিষহরি’ পূজা মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের... নিজস্ব ভাষা, লোক বিশ্বাস, লোকাচার সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের অন্তর্গত গীতিনাট্য ও লোকনাট্য। গান, নাচ-এ সংলাপের ত্রিবেণী সংগম ঘটেছে এখানে। [রামাপ্রসাদ নাগ, ২০১২: সংগৃহীত ও সম্পাদিত পৃথি] বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের বরযাত্রীদের একটি বিবরণ ঐ পুঁথিতে আছে—
উত্তরে সাজিল হর ধনপতি সদাগর
তার সৈন্যের নাই লেখা জোকা
পশ্চিমে আইল সাজি, হাসেন হুসনো কাজি,
সাংখী করে কড়েয়া লক্ষ লক্ষ ভার।
দক্ষিণে সাজিল হর শঙ্খপতি সদাগর,
সঙ্গেতে তারা লইল তলোয়ার
উরভূষি - সরভূষি সাজে কন্যা চন্দ্রামুখী
ডাইনে তুলিয়া কান্দে খোপা।
বালার বিচার কাজ রাইগণ রৈবাতী সাজে
নানা পৈরাণে পরে শাড়ি। (ঐ, ৮৯-৯০)
কয়েকটি মনসামঙ্গল-এ হাসান-হুসেন দুই ভাই জমিদারের সঙ্গে মনসার সংঘর্ষ ও পরে মনসার মনসার ভক্ত হয়ে ওঠার কাহিনীটি আছে। (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২০২)। উত্তরবঙ্গের পালায় হাসান-হুসেনো কাজি কে বেহুলার বিবাহে বরযাত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণগুলি ও প্রচলিত লোকায়ত পালা ও সঙ্গীতে বেহুলার নৃত্যগীতের বর্ণনা গুরুত্ব পেয়েছে। অমলেন্দু ভট্টাচার্য নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে মনসামঙ্গল কাব্যগুলির সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন, ‘‘নাগপূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে নৃত্যগীত একথার উল্লেখ আছে কাশ্মীরের পৌরাণিক ইতিবৃত্ত নীলমত পুরাণে। ...নাগদের সামাজিক জীবনে গীতবাদ্যের যে একটা বড় ভূমিকা ছিল উপরোক্ত দুটি পৌরাণিক কাহিনী এর প্রমাণ। এই সূত্রেই নাগ-সংস্কৃতি থেকে উদ্ভুত মনসাপূজায় যুক্ত হয়েছে নৃত্যগীত।’’ [অমলেন্দু ভট্টাচার্য, ২০১২ : ৭৫] বেহুলার নৃত্য পারদর্শিতার সঙ্গে অনিরুদ্ধ-ঊষার পৌরাণিক কাহিনী ও নাগ সংস্কৃতির উপাদান যুক্ত হয়েছে।
অঞ্চল ভেদে লোককাহিনী, লৌকিক পালা, মনসা কীৰ্তন, পটুয়াদের পটে-পটুয়া, সঙ্গীতে বেহুলাকে নানাভাবে দেখানো হয়। মেদিনীপুরের পিংলা-নয়াগ্রামের পটুয়া দুখুশ্যাম চিত্রকর মনসার পট দেখিয়ে (তাতে বেহুলাও প্রদর্শিত হন) যে গান করেন তাতে বেহুলাকে ‘নাচনী’ বলা হয়েছে। এই পট গানের সঙ্গে পটে আঁকা দৃশ্য দেখানো হয়।
(ও তুই কেন এলি সুরপুরে বেহুলা সুন্দরী
ও তোর, পায়ের জল মোর গায়ে পড়িল
আমি বিষহরি
ও তোর বাসর ঘরে মরবে পতি কঁড়ে রাঁঢ়ী)
ছয়পুত্র খেলে ছয় বধূ হইল রাঁঢ়।
জন্মে নাহি জানবে না কড়ার পুষ্পদান॥
তিন গাই না, গীত গাই মধুর সে বাণী।
সদাই সমরে পূজা চ্যাংমুড়ি কানি॥
কোলের পুত্র আছে নাম লখিন্দর।
এর বিবাহ দিতে চলে নিছুনি নগর॥
নিছুনি নগর ঘর অমূল্য বেণানী।
তার কন্যার নাম রেখেছে বেহুলা নাচনী॥
[দুখুশ্যাম চিত্রকর, শ্যামল বেরা-২০১২: ১৪০-৪১ সংকলিত]
‘চ্যাংমুড়ি কানি’ বিশেষনটি অনেকগুলি মনসামঙ্গল-পদ্মাপুরাণ, লোকগান, ভাসান গান-এ পাওয়া যায়, এর অর্থ শববাহনে বাঁশে জড়ানো কাপড় (সুকুমার সেন)।
বেহুলার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সংকল্পে অটুট থাকা, কোনো সঙ্কটে ভেঙে না পড়া, প্রতিবাদী নারীত্ব এই বিশেষণগুলি মনসামঙ্গল-এ দেখা যায়। অনেকগুলি মনসামঙ্গল-এ বেহুলা লখিন্দরের অংশটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। একটি অংশে আছে চাঁদ লখিন্দরের জন্য মেয়ে দেখতে এসে বেহুলাকে পছন্দ করলেন। বেহুলার বাবা সাধু চাঁদো (চাঁদ বেনে) কে ভোজনের অনুরোধ করলে চাঁদো বললেন লোহার কলাই-সিদ্ধ খাবেন। অসম্ভব জেনে সকলে যখন ‘‘এমন অদ্ভুত কর্ম না শুনি কখন’’ তখন বেহুলা সাহসের সঙ্গে বললেন আমি লোহার কলাই সিদ্ধ করব। ‘‘নর হইয়া করে সিদ্ধ লোহার কলাই’’ তাতে চাঁদোর খিদে মিটল (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২১৩)। এই অবাস্তব ঘটনাকে মনসামঙ্গল-এর কবিরা তুলে ধরেছেন বেহুলার সমস্ত বাধা জয় করার চারিত্রিক উপাদানটিকে দেখানোর জন্য।
বেহুলার চিত্রও নানাভাবে আঁকা হয়েছে বিশেষ করে মনসার পটগুলিতে, দুখু শ্যাম চিত্রকরের কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এগুলিও লোকায়ত শৈলীর অঙ্কন আর এখনকার শিল্পীরা বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি এঁকেছেন। নাটকে ও কবিতায় বেহুলার উল্লেখ তুলনা বা উপাখ্যানটির প্রয়োগ চলছে। মঙ্গলকাব্য ও তৎসম্পর্কিত লোকসাহিত্যের মধ্যে মনসামঙ্গল ও বেহুলার উপাখ্যানের প্রয়োগ এ কবালের শিল্প সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। মধ্যযুগে মনসামঙ্গলগুলি কোনো রাজা বা ভূস্বামীর আদেশে লেখানো হয় নি, স্বঃপ্রবৃত্ত হয়েই কবিরা এই কাব্য রচনা করেছেন এবং এই কাব্য বা পালার চরিত্রগুলিই লোকায়ত বাংলার দৈনন্দিন জনজীবনের ছবি, অনেকটাই নিম্নবর্গের জীবনযাপন। ‘‘মনসার ভাসান নিম্ন থেকে নিম্নতম বর্গের বিনোদন চর্চায় চলে এসেছে’’ (সুকুমার সেন, ১৯৭০: ২২৬)। এদেরই অবলম্বনে এ কালের কিছু নাটক ও যাত্রা লোক-মন জয় করেছে।
“এই দীর্ঘ দুঃখ-কথার অবসানে কবিগণ বেহুলার যে কৌতূহলদীপ্ত সুপ্রফুল্ল চিত্রখানি আঁকিয়াছেন, তাহার মাধুর্যের মধ্যেও দুঃখমিশ্র একটু সকরুণ ভাব জড়িত আছে, সেই মলিন অথচ মধুর সৌন্দর্য আমাদের মর্ম স্পর্শ করে... বেহুলা চরিত্র আঁকিতে কোন কবিগুরু বা বাল্মীকি লেখনী ধারণ করেন নাই। আমা কবিগণ বংশদণ্ডাগ্রে, ব্লটিং কাগজের অভাব বালিকা দ্বারা পূর্ণ করিয়া তুলট-কাগজের উপর সতীর রেখাপাত করিয়াছেন; তথাপি উহা এক আদর্শ সার্ধ্বী চিত্র হইয়োছে। ...নানাবিধ সদগুণের প্রতিভা যেন আপনা আপনি সমাজ হইতে সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হইয়া বেহুলার ন্যায় আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে, ইহাতে কবিদের সাহিত্যদর্পণ পড়িতে হয় নাই।... অকৃত্রিমতাই এই সকল কবির প্রতিভা। প্রকৃতি যেন স্বয়ং ইহাদের হাতে তুলিয়া দিয়া তাহাদের নিজগৃহ দেখাইয়াছেন, তাঁহাদের নিজ বাড়ি-ঘরের ছবি আঁকিতে গিয়া অজ্ঞাতসারে বিশ্ব-চিত্র ভাণ্ডারে এক অমূল্য আলেখ্য উপহার দিয়াছেন।” (দীনেশচন্দ্র সেন, ১৯৮৬: ১৯১)।
ভাসান
সারি সারি নাও জলে ভাসে নৌ বাইচের সাজ
দুটি নৌকা জোড়া খুলে গেলেই ভাসান
তীরে বিসর্জনের সিঁদুর খেলা
গাঙরীতে ভেলা ভাসে
সেই কবে বেহুলা ভাসিয়েছিলেন
তরুণ আকাশ এই গাছ হিমালয় গলা
কাঠিন্য গলা নয়ানীর পানি
ভাসান পালার কলার মাজুষ
ভাসতে ভাসতে চন্দ্ৰমুখী মধুকর
বহুমুখী জাহাজ হয়ে যায়
কাঠিতে বোল পড়ে থাকবে কতক্ষণ
আবাহনে ভাষা উঠে আসে
আমরা যাচ্ছি ( গৌড়বচন, ১৯৮৯)
পাঠপঞ্জী :
অমলেন্দু ভট্টাচার্য, ২০১২: ‘‘মনসামঙ্গল কাব্য : নাগ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে”, অঞ্জন সেন ও শেখ মখবুল ইসলাম সম্পাদিত সৰ্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সি, কলকাতা।
দীনেশচন্দ্র সেন, ১৯৮৬ : বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক, কলকাতা।
দুখুশ্যাম চিত্রকর, ২০১২: শ্যামল বেরার ‘মনসা : লোকায়ত প্রেক্ষিত-এ উদ্ধৃত অঞ্জন সেন ও শেখ মখবুল ইসলাম সম্পাদিত সৰ্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
রমাপ্রসাদ নাগ, ২০১২: ‘‘মনসা মঙ্গলের প্রককথন’’, সর্পসংস্কৃতি ও মনসা-এ সংকলিত।
সুকুমার সেন, ১৯৭০: বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড-পূর্বার্ষ, ইস্টার্ন পাবলিসার্স, কলকাতা।
যে-কোনো সৃষ্টিকাজই প্রাতিস্বিক। এককধর্মী— ব্যক্তির কাছে স্রষ্টা সমাজেরই একজন অবশ্যই; জনগণের মধ্যে থাকতে পারেন, মিছিলে-মিটিংয়ে আন্দোলনের অংশীদার বটেন, সভ্যতার নানা সংকটে অবশ্যই আলোড়িত হবেন কিন্তু সৃষ্টিসত্তায় যখন তিনি একাগ্র, মগ্ন— আপন শিল্পচেতনা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবেন। বাহ্যিক নির্দেশ, কোনো নিয়মতন্ত্র ঔচিত্য-অনৌচিত্যের অঙ্গুলি তাঁর সত্তাকে পরিচালনা করবে না।
কলকারখানা, ক্ষেতখামার বা সামাজিক নানা উৎপাদনের শ্রমবিন্যাসে মজুরি, মূল্য, নীতি, দল, সংগঠন-এর গুরুত্ব যেভাবে কার্যশীল, সৃষ্টিবিচারে তা কখনই প্রযোজ্য হয় না। অথচ শিল্প-সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিচারে দেশ-কাল-সমাজের জরুরী কিছু অভিঘাত বিচার্য। কারণ শিল্পের জন্যই শিল্প বা সৌন্দর্যের জন্যই সুন্দরতা সৃষ্টি — এ ভাবনা অতীতে কোনো কোনো মহল প্রচার চালালেও, আমাদের বোধ ও চেতনা বিকাশে শিল্প-সাহিত্যের সুদূর ও অপ্রত্যক্ষ ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছি। তাই দেশ-কাল ও রাষ্ট্রচরিত্র- নিয়ন্ত্রিত জীবনধারায় — ব্যক্তি বা সমষ্টিগত জীবন যাই হোক না কেন নিয়ে শিল্পসৃষ্টির প্রবাহ চলছে। দেশ-বিদেশে সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক শিল্প তাই পৃথিবীর অনেক অনেক মানুষকে স্পন্দিত করে।
শিল্পসাহিত্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সৃষ্টি যেমন, এর সামাজিক উপযোগিতাও আছে। আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। একই আদর্শ বা জীবনদর্শনে বিশ্বাসী থেকেও বিভিন্ন কবি লেখকের সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশের ভিন্নতা আছে। মায়াকোভস্কি মার্কসবাদে বিশ্বাসী, পাবলো নেরুদাও একই দর্শনে দায়বদ্ধ। কিন্তু দুই কবির কাব্য প্রকাশে পাঠকের ভিন্ন ভাবনার জগৎ তৈরি হয়। তাই লেখক সংঘ অন্যান্য গণসংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের কর্মপদ্ধতি এক হতে পারেনা।
কোন সংস্থা, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত সাহিত্য শিল্পের ধারার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্রোহ বিরোধিতা লক্ষ্য করি। তাই ইওরোপে একদা চার্চ-নিয়ন্ত্রিত শিল্প-সাহিত্যের খোলস ভেঙে রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল।
আধুনিক যুগে, সোভিয়েত শাসনব্যবস্থায়, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত লেখকসংঘের সঙ্গে বহু ব্যক্তি-লেখকের বিরোধ-সংঘাত আজ ইতিহাস।
বাংলা ভাষাতেও প্রগতিসাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষতলাঞ্ছনার পর্ব খুব ছোট নয়। ইওরোপে হিটলার-মুসোলিনির উত্থানে ফ্যাসিবাদের দুর্বার জয়যাত্রায় ইওরোপের বিবেকবান লেখক-শিল্পীরা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের ভাবনায় একত্রিত হয়েছিলেন। সালটা সম্ভবত ১৯৩৫ এবং স্থান প্যারিস। সেই সূত্রেই ভারতবর্ষে প্রগতি লেখক সংঘের জন্ম এবং এর প্রথম সম্মেলন লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয়, প্রেমচাঁদ-এর সভাপতিত্বে। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে সমবেত এই প্রয়াস শুরু হয়েছিল।
এই লেখকসংঘটি প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন তৎকালীন লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয় ছাত্র, উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কিছু কবি, সাহিত্যিক— ভাবনা-চিন্তায় যাঁরা কেউ ছিলেন কমিউনিস্ট, কেউ বা সোসালিস্ট। কেউ কেউ বা ছিলেন মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী। যেমন ১৯৩৫-য়ে সে বুদ্ধিজীবীদের প্যারিস সম্মেলনের প্রাণপুরুষ রমাঁ রঁলা। আবার সেখানে এলড্উইনও ছিলেন।
ভারতে প্রগতি লেখকসংঘ গড়ে তোলার পিছনে ব্যক্তি হিসেবে জওহরলাল নেহেরু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত বা জয়প্রকাশ নারায়ণের ভূমিকা প্রগতিশীল উর্দু লেখকদের পাশাপাশি সমান ভাস্বর। বিশেষত, লক্ষ্ণৌতে প্রথম অধিবেশন সফল করে তোলার পেছনে এঁরা খুবই সক্রিয় ছিলেন।
১৯৩৮য়ে এর দ্বিতীয় অধিবেশন হয়েছিল কলকাতায়। সে উপলক্ষে যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ পায় তা রবীন্দ্রনাথ সহ বাংলার তৎকালীন প্রায় সকল বুদ্ধিজীবীদের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুবোধ ঘোষ প্রমুখ লেখকবৃন্দ যেমন ছিলেন, মার্কসবাদে বিশ্বাসী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকেই ছিলেন।
১৯৪০য়ে ঢাকায় প্রগতি লেখকসংঘের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদী চিন্তক রণেন দাশগুপ্ত এর সম্পাদক হলেও পরবর্তীতে দায়িত্ব নিয়েছিল সোমেন চন্দ। তখন তার বয়স ছিল বিশ কি একুশ।
বিশ্ব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নানা রংয়ে-বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যেহেতু শিল্পসৃষ্টি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত— সমবেত কোনো ফতোয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
৪১ সালে জার্মান সোভিয়েত অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে সব কিছু সমীকরণের বদল ঘটে। মিত্র শক্তি হিসেবে ব্রিটেন, সোভিয়েত, আমেরিকা লক্ষণের গণ্ডীরেখার একই দিকে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ শক্তিকে উত্যক্ত করার চাইতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েতকে ফ্যাসিবাদের কবলমুক্ত করার নীতি ও কর্মসূচী অধিক জরুরি মনে করল। আর দেশের জাতীয় চেতনার অংশীদারদের অধিকাংশই মনে করলেন, বৃটিশ শক্তি যখন হিটলারের দাপটে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে, দেশকে স্বাধীন করার এই হলো চরম মুহূর্ত। ১৯৪২য়ে গান্ধীজীর ডাকে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’, ৪১য়ে সুভাষচন্দ্রের দেশ থেকে গোপনে জার্মানিতে হাজির হওয়া, তার আগে কংগ্রেস থেকে তাঁর পদত্যাগ— দেশের মানুষের বৃহৎ অংশকে প্রাণিত করে তুলেছিল। দুস দ্বন্দ্ব তখন বন্ধুতামূলক থেকে শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪২এর ৮ই মার্চ ঢাকার রাজপথে বিশিষ্ট লেখক সোমেন চন্দ খুন হলেন। তাঁর এই নৃশংসভাবে নিহত হবার ঘটনায়, দেখব তখনও দলমত নির্বিশেষে এই হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাচ্ছেন। সই স্বাক্ষরে গান্ধীবাদী অন্নদাশঙ্কর রায় যেমন ছিলেন, মানবতাবাদী প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী থেকে মার্কসিস্ট ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, এমনকি বুদ্ধদেব বসুও জঘন্য হত্যার নিন্দা করেছিলেন। প্রগতি লেখকসংঘের নাম বদলে বাংলায় রাখা হল ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক সংঘ। এ সময়ের জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্দ্বন্দ্বের অসাধারণ পারিবারিক ছবি পা়ই লেখক সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসে। সতীনাথ তখন পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের বড় নেতাও বটে।
৫০-এর ,মন্বন্তর পৈশাচিকতা সমূলে মানবতার উৎপাটন ইত্যাদি বিষয়ে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরে, তিরিশ লক্ষ গ্রামীণ শিকড়ের নর-নারী স্রেফ অন্নের অভাবে নিহত হওয়ায়— সকল স্তরের বুদ্ধিজীবীই গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, ছবি এঁকে এই নারকীয় কৃত্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। কারও সৃষ্টিতে সরাসরি ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল কেউ কেউ আবার বাংলার জোতদার, মজুতদার ও কালোবাজারিদের যতটা সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগে একটু আড়াল ছিল।
ক্রমে, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা— গণসংগীত, গণনাট্য এবং রবীন্দ্রস্নেহধন্য সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির মালিকানায় চলে আসার পর বাংলা লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনে পার্টি নিয়ন্ত্রণ প্রায় সরাসরি হয়ে ওঠে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য থেকে ‘নবান্ন’ নাটকের সাফল্য বাংলার বৌদ্ধিক জগতকে আলোকিত করে দিয়েছিল।
এর পেছনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি.সি. যোশী। তাঁর ব্যক্তিগত বৈভব বৌদ্ধিক চেতনা দিয়ে লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ বজায় রেখে— বাংলার প্রগতির সংস্কৃতির নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছিলেন। দলীয় কোন ফরম্যান জারি নয় বা প্রগতি সাহিত্যের শ্রেণী বিচারও নয়। সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টাই অন্তিম নির্ণায়ক। কখনই শিল্প সাহিত্য বিষয়ে দল বা গোষ্ঠী লেখককে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে না। তাই সোভিয়েত বিপ্লবের পর লেনিন টলস্টয় সম্পর্কে পুশকিনের বিষয়ে বা গর্কির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি জোর দিয়েছেন। যখনই দলের কোনো কর্মসূচিতে গর্কি দ্বিমত প্রকাশ করেছেন, দ্বন্দ্বটি আর বন্ধুত্বমূলক থাকেনি— লেনিন পরামর্শ দিয়ে গর্কিকে ইটালিতে কিছুদিনের জন্য অবকাশ নেওয়ার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। দলের কবি হওয়া সত্ত্বেও মায়াকোভস্কির চাইতে পুশকিন লেনিনের বেশি প্রিয় কবি ছিলেন। অর্থাৎ দল ও স্রষ্টার মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক স্পেস রক্ষিত ছিল।
লেনিন ও গর্কির মৃত্যুর পর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত লেখক সংঘ এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি-প্রচারিত Socailist Realismই প্রগতি সাহিত্যের একমাত্র চিহ্ন হয়ে উঠলো। অথচ আজ এসব প্রসঙ্গ জলের মতো স্বচ্ছ, দল-নির্দেশিত শাসনের লেখালিখি একমাত্র পরিচয় ছিল না প্রগতি সাহিত্যের। ইউরোপের বিভিন্ন ধারার চিন্তক লেখকরা সেকথা তথ্যগতভাবে বারবার বলে গেছেন। এখন যাকে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলিং বলি মার্কসবাদী চিন্তায়। যেহেতু আমাদের বাংলায় কমিউনিস্ট নেতা লেখক-কবিদের সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ ছিল নিবিড়, প্রগতি সাহিত্যের মডেল বলতে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকেই দলীয় ছাপ দেওয়া হতো। তাই সোমেন চন্দকে নিয়ে যতই আলোচনা চলুক, তাঁর ইঁদুর, দাঙ্গা বা সংকোচ এর মত গল্প এ বাংলায় প্রগতিশীলতার ছাপ পেতে এত বছর লাগিয়ে দিল।
আন্তর্জাতিকভাবে মস্ত বিস্ফোরকটি ফাটলো যখন দেখা গেল ঝানভ-গাঁরদি বিতর্ক। গাঁরদি দিয়েছিলেন ফ্রান্সের বিশিষ্ট বামপন্থী মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঝানভ ছিলেন সোভিয়েত সরকারের সম্ভবত সাংস্কৃতিক মন্ত্রী। সালটা সম্ভবত ১৯৪৮-৪৯। ভারত সদ্য স্বাধীন হয়েছে। কমিউনিস্টদের একটা লাইন দেখা গেল ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’। পরে অবশ্যি দলের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে, সম্ভবত ৫১ সালে, ৫২এর সংসদীয় নির্বাচনে দল অংশগ্রহণ করলো। তখন তে-ভাগা তেলেঙ্গানা চাপা পড়ে গেছে।
ঝানভ বললেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প সাহিত্য জগতের ভাবগত ঐক্য একত্রিত করতে হবে। তাই-ই প্রগতি সাহিত্যের সার্থকতা। গাঁরদি বললেন, তা নয়। প্রগতিসাহিত্যের এমন কোন যান্ত্রিক ভূমিকা থাকতে পারেনা। প্রগতি সাহিত্য শিল্পের দায় বজায় রেখেই পাঠকের চেতনা ও বোধকে প্রবর্ধমান করবে। আন্তর্জাতিক এই বিতর্কে বিশ্বের সকল দেশের প্রগতিসাহিত্যের ধারা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। হাওয়ার্ড ফাস্ট, আঁদ্রে জিদ্ এর মত বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল শিবিরের বুদ্ধিজীবীরা ‘God that failed’ সংকলন বার করে শিবির ত্যাগ করলেন।
আমাদের ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হিসেবে পি সি যোশী অপসারিত। কট্টরপন্থী হিসেবে চিহ্নিত রণদিভে সম্পাদক হয়েছেন। সে-সময়ে প্রগতি সাহিত্যের প্রধান প্রতীক ‘পরিচয়’ তখন গোলাম কুদ্দুস সরোজ দত্তর সম্পাদনায় বার হত। দেখা গেল দীর্ঘকালের পরিচয়-এর সঙ্গে নিবিড় সংযুক্ত লেখকরা একে একে ‘পরিচয়’ থেকে সরে গিয়ে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করলেন। বিষ্ণু দে করলেন ‘সাহিত্য’, অনিল কাঞ্জিলাল ‘নতুন সাহিত্য’ এবং এর কিছু পরেই ‘অগ্রণী’, ‘অরণি’ প্রকাশ পেতে থাকে। অর্থাৎ প্রগতিশীলতার একমাত্র কেন্দ্র ‘পরিচয়’-এর বিকল্প হিসেবে এইসব পত্র-পত্রিকাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এর অন্যতম একটি পত্রিকা ‘মার্কসবাদী পথ’। সেখানে দলের নেতা ভবানী সেন রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি আখ্যা দিয়ে খানিকটা ধসিয়ে দিতে চাইলেন। এটা ছিল ওনার নিছক ব্যক্তিগত মত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী শক্তি প্রচার এর বন্যা ছোটালো, কমিউনিস্টরা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া মনে করে। কোন রাজনৈতিক দল সমবেতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিলে তো দলীয় এজেন্ডা হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে? এ-ভাবেই প্রগতি সাহিত্যের ভাবনা একের পর এক প্রচারের গাড্ডায় পরতে থাকলো। পার্টি নিয়ন্ত্রিত সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ক্ষমতাশালী হয়ে ৪২ধর্মতলা স্ট্রিট, স্বাধীনতা পত্রিকা এবং ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশনা জাঁকিয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে রইল। সেখানের কঠিন দেওয়ালে বারেবারে প্রগতি সাহিত্যের ব্যক্তি-লেখক আহত হয়েছে অপমানিত হয়েছে, কেউই স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধায় স্রষ্টার সংকটটি বুঝবার চেষ্টা করেনি— সমাধানের কথা দূরে থাকুক। এ যেন কোন ট্রেড ইউনিয়নে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কমিশন তৈরি করে খেসারত আদায়। একজন স্রষ্টা হিসেবে কোন শ্রদ্ধা সহমর্মিতা নেই। দু-চারটে উদাহরণ। সাবিত্রী রায় ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে তে-ভাগা আন্দোলনে, কোন কোন অঞ্চলের কিছু নেতার নেতৃত্বের ভুল উল্লেখ করে সমালোচনা ছিল। কলকাতার তৎকালীন জিলা কমিটি ফতোয়া জারি করলো ‘স্বরলিপি’ ন্যাশনাল বুক এজেন্সির কোন কাউন্টার থেকে বিক্রি হবে না। অসীম রায়ের দু’খন্ডের আত্মজীবনী ‘জীবন ও মৃত্যু’তে পড়লাম, যখন এম.এ পড়ছেন তিনি, মাঝেমধ্যে উৎসাহে ৪২ ধর্মতলা স্ট্রিটে গল্পপাঠের আসরে হাজির হতেন। দেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি গল্পপাঠের পর, শ্রোতাদের মধ্য থেকে মানিকবাবুকে আক্রমণ। লেখক স্বয়ং অসহায় ফ্যালফ্যাল করে দেখছেন। মানিকবাবুর বেঁচে থাকার কাল অবধি ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তাঁর কোন বই ছাপেনি।
এরপর ৫৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় বিশতম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এলে স্তালিনকে কবর থেকে তোলার পর, বাংলার প্রগতি সাহিত্যের ডামাডোলে কোন নেতা বা কর্তৃপক্ষকে দেখা গেলো না শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের পাশে এসে সহমর্মিতায় তাদের ব্যক্তিসত্তাকে নৈতিক সমর্থন জানায়। ননী ভৌমিক, সমর সেন, কামাক্ষীপ্রসাদ বা কবি ও ‘পরিচয়’-এর এক পর্বের যুগ্ম-সম্পাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ একঝাঁক প্রগতি সাহিত্য ধারার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য, অনুবাদের কাজে মস্কো পাড়ি জমাচ্ছেন— তৎকালীন দল বা সংঘের নেতারা কি স্রষ্টাদের সঙ্কটের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন? মানসিক চাপ বা হতাশার হাত থেকে ব্যক্তিস্রষ্টাদের সংকটমুক্ত করা কি সংগঠনের দায়িত্ব ছিল না? এরা দেশ ছেড়ে গেলে প্রগতিসাহিত্যের ক্ষতি, বলা দরকার ছিল না? আসলে বিশতম কংগ্রেসের পর থেকেই কমিউনিস্টরা সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং পার্টির ‘লাইন’ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কে ক্রমশ যত জড়িয়ে গেছেন, প্রগতিসাহিত্য নিয়ে ছিল গাছাড়া ভাব।
প্রকৃতিতে কখনোই শূন্যতা থাকে না। ধীরে ধীরে বিপরীত দর্শন ভাবনার প্রয়াস ক্রমশ সক্রিয় হতে থাকে। বিমল করের আহবানে নতুন গল্পরীতির একটি ঢেউ সৃষ্টি করা হয়। যারা বলতে চায় গল্প-উপন্যাসে বিষয়বস্তুকে মনে রেখেও প্রকাশ বা বলার রীতির ওপরও জোর দেয়া দরকার। এ আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন প্রগতিসাহিত্যের দুই উল্লেখযোগ্য লেখক সমরেশ বসু ও দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্প দুটি ছিল যথাক্রমে স্বীকারোক্তি ও জটায়ু। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এসব নান্দনিকতা উপলব্ধি করতেন কিনা জানি না, দলীয় ফতোয়া জারিতে পিছিয়ে থাকত না। শুনেছি, এই ভাবে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘাম’ গল্পটি নিয়ে বিরূপ কিছু মতামত জারি করেছিল। শিল্পী form and content— আকরণ ও প্রকরণের পারস্পরিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক ও সমালোচকদের নিয়ে এ-নিয়ে কি খোলা মঞ্চে আলোচনার আয়োজন করা যেত না? ‘স্বাধীনতা’ তখন পার্টির দৈনিক সংবাদপত্র। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের আয়োজন করা যেত। তৎকালীন ‘পরিচয়’ পত্রিকাও বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। উল্টে তাদের বৌদ্ধিক অহং ও অস্মিতা বেশ কিছু মানবিকতাধর্মী লেখককে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। প্রগতি সাহিত্যের চতুষ্পার্শ্ব ক্রমশ ক্ষুদ্র ও কানাগলিতে ভরে উঠছিল। এভাবেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বা বুদ্ধদেব বসু, আবু সৈয়দ আইয়ুবের মত ব্যক্তিত্বরা যেমন দূরে সরে গেছেন রমেন সেন, অমরেন্দ্র ঘোষ যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি।
উপরন্তু ৬২সালের চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার পরামর্শে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ আন্দোলন শুরু হতেই প্রগতিসাহিত্যের কফিনে শেষ পেরেকটি গেঁথে দেওয়া হয়। প্রবল এই জলোচ্ছাসের বিরুদ্ধে দল হিসেবে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত একটি পার্টির পক্ষে অসহায় পর্যবেক্ষণ ছাড়া বিকল্প কিছুই ছিল না। শুরু হলো সাহিত্যের নানা আন্দোলনের ঢেউ। হাংরি, ছাঁচ ভেঙে ফেলা, শাস্ত্রবিরোধী, নিম সাহিত্য ইত্যাদি গদ্যে-পদ্যে নানা আন্দোলনের নামে শুরু হলো ক্যাওস। এরপর ‘যার শিল, যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’র মতো প্রগতি শিবিরের অন্যতম প্রতিনিধি স্থানীয় সমরেশ বসুকে নিয়ে ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস লিখিয়ে শুরু হল আন্দোলনের নামে নানা প্রকার ডেকাডেন্স।
রাজনৈতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সরাসরি বিভক্ত। বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকল অংশই একভাগে। আর যাদের শক্তিতে সংগঠন চলে সকলেই বিপরীত অংশে। প্রগতিসাহিত্যের হাল খুবই করুণ। ঘৃণা, অবিশ্বাস, উদাসীনতা থেকে পারস্পরিক বিষোদগারে নতুন প্রজন্ম হতভম্ব। ‘স্বাধীনতা’ দৈনিক পত্রিকা বন্ধ। ‘পরিচয়’ দপ্তরে বেশ কিছুদিন তালামারা থাকার পর টিমটিম করে শুরু হলো বটে— বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর পূর্বের প্রভাব আর নেই। কম্যুনিস্ট পার্টির অন্য অংশটি— যাদের আনুগত্য চীন ও মাওসেতুংয়ের ভাবনায়— নিজ সাহিত্যমুখপত্র প্রকাশ করল, যদিও সরাসরি দলের মালিকানায় নয়— নন্দন। এর চরিত্র ছিল আরও কট্টর, আরও পার্টিলাইন নিয়ন্ত্রিত। এই পর্বেই, মনে আছে, গদ্য সাহিত্য আঙিনায় পা-দেয়া এক নবিশ, একবার একটি গল্পে জনৈক মজুরের মুখে ‘ভগবান’ শব্দটি উচ্চারণ করিয়ে কী ধমক যে খেয়েছিলাম। শব্দটি উড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম— আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভাবলেও লজ্জা পাই।
ষাটের দশক জুড়ে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতিতে একাধারে বাণিজ্য পত্রিকার জবর উত্থান, সাহিত্যে লেখক-কবি তৈরীর মনোপলি তাদের হাতে। তথাকথিত প্রগতিসাহিত্য, নতুন প্রজন্মের পাঠকবৃন্দের কাছে নস্টালজিয়া।
সত্তরে এল নকশাল আন্দোলন। দেশভাগের পর, বিংশ শতাব্দীতে এমন প্রভাবশালী আন্দোলন আর হয়নি। সব কিছু ভাবনা চেতনার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে বলতে পারি রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি হিসাবে এ আন্দোলন ব্যর্থ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা দূরে থাকুক, এখন উন্নয়নের নামে শহরই গ্রাম গ্রাস করছে। যারা এককালে চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান হিসেবে ভাবতে বাধ্য করিয়েছিল, তারাই বিশ্বাস করছে চীন নাকি নয়া ক্যাপিটালিস্ট দেশ। সে-সব প্রশ্ন থাক।
সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে গত পঞ্চাশটি বছর গুরুত্বপূর্ণ। লেখক হিসেবে যাঁরা ঐ দেশ-কাল পর্বে উঠে এসেছিলেন, ‘প্রগতি’ শব্দের অর্থ ও ধারণার বিকাশ ঘটিয়ে, দলনিয়ন্ত্রিত ‘প্রগতি’ বা মানব চেতনায় সাহিত্যের উপযোগিতাকে তছনছ করার উদ্দেশে যে আন্দোলন— দুয়ের পাশ কাটিয়ে তাঁদের এবং তাঁদের অনুসৃত পথের উত্তরসূরীরাই এখন বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ স্রষ্টা হিসেবে সমাজের স্বীকৃতিলাভ করছে।
রাজনীতি অর্থনীতি বিশ্ববোধ বদলাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে পা রেখে, দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক শিকড়ের সন্ধানে, ‘প্রগতি’কে তাঁরা আর কোন পার্টি নিয়ন্ত্রিত ফরম্যান হিসেবে দেখতে রাজি নয়। প্রগতি লেখকদের নানা সমস্যা, ব্যক্তিসংকট ও ভাব বিনিময়ের জন্য মঞ্চের প্রয়োজন অবশ্যই, তা হবে কোন নির্দিষ্ট দল নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এক-স্বরিক কোনো আদর্শবাদের দীক্ষা এড়িয়ে, গভীর এক বিশ্বমানবতার শিকড়ের সন্ধানে। স্বপ্ন, কল্পনা, মিথের মিশ্রণে যা আমাদের জীবনযাপনের সমস্ত শৃঙ্খলকে ক্রমশ মুক্তির সন্ধানে উড়ানে সহযোগিতা করবে।
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় কি প্রগতিসাহিত্যের প্রাক্তন ধাঁচাটি বদলাবার সময় হয়নি?
[ব্যারাকপুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র ‘কোজাগর’-এর শারদ ১৪২৮-এর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে তাৎক্ষণিক বক্তব্যের বিস্তারিত রূপ।]
১৯৭৬ সাল। ‘জন অরণ্য’ সিনেমার প্রিমিয়ার পার্টি। আকাশবাণী কলকাতার কিছু কর্তাব্যক্তিরাও আমন্ত্রিত হয়েছেন সেই পার্টিতে। প্রখ্যাত শিল্পী জগন্নাথ বসুও আমন্ত্রিত। তাঁর মুখেই এই ঘটনা শোনা।
জগন্নাথ বসু প্রিমিয়ারে দেখেছেন ‘জন অরণ্য’। দেখার পর থেকে মুখিয়ে আছেন সত্যজিৎ রায়ের সাথে কথা বলার জন্য। দুর্দান্ত সিনেমা, সন্দেহ নেই। কিন্তু জগন্নাথ বসুর উৎসাহের ক্ষেত্র আলাদা। সিনেমায় একটা ছোট্ট ‘ভুল’ চোখে পড়েছে তাঁর। আর আমরা সবাই জানি, কাজের ক্ষেত্রে কতটা নিখুঁত সত্যজিৎ। তা সে তাঁর লেখা গল্পই হোক, কিংবা প্রচ্ছদ, গান, সিনেমা সর্বক্ষেত্রে ! আমাদের জন্য চলমান এনসাক্লোপিডিয়া। আমরা যারা অনেকেই লালমোহনবাবু তাঁদের জন্য একজন ফেলুদা আছেন, আর সেই ফেলুদা সত্যজিৎ। জগন্নাথ বসুর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা নয়। এ হেন সত্যজিৎ রায়ের ‘ভুল’ ধরা পড়লে, সেটা যতক্ষণ না তাঁর গোচরে আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ স্বস্তি নেই।
প্রিমিয়ার পার্টিতে প্রচুর লোকের ভিড়। মধ্যমণি সত্যজিৎ, স্বভাবতই তাঁকে আলাদা করে পাওয়া মুশকিল। তবুও তাঁর মাঝেই একটুখানি ফাঁকা পাওয়া গেল আর কালক্ষেপ না করে জগন্নাথ বসু উপস্থিত হলেন তাঁর সামনে। সত্যজিৎ রায় তখন প্লেট হাতে। পরবর্তী কথোপকথন অনেকটা এরকম –
জগন্নাথ বসু – নমস্কার। আমি জগন্নাথ বসু।
সত্যজিৎ রায় – নমস্কার।
- আপনার প্রতিটি সিনেমাই আমার দেখা। প্রিমিয়ারে ‘জন অরণ্য’ দেখলাম। অসাধারণ। তুলনা নেই !
- (এরকম অনেক কথাই আজকের দিনে সত্যজিৎ শুনেছেন। ফলত সৌজন্যের হাসি।)
- কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে আমার একটা কথা আছে। মানে সিনেমায় আমার একটা ‘ভুল’ চোখে পড়েছে।
- (এবারে ভ্রু কুঁচকোলেন সত্যজিৎ। ব্যারিটোন কন্ঠে ভেসে এলো) কীরকম?
- আসলে, সিনেমার এক জায়গায় দেখানো হচ্ছে, সোমনাথ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এসেছে। লোডশেডিং। একটা মোমবাতির আলোর মধ্যে দিয়ে আঙুল চলছে আর একটা গান ভেসে আসছে। ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’।
- হ্যাঁ।
- সিনেমা দেখে আমার যতটুকু মনে হ’ল, জিজ্ঞেস করছি, গানের সোর্স কি রেডিও?
- হ্যাঁ, রেডিও।
- আমি আকাশবাণীতে যুক্ত, ফলে এই জায়গাটায় আমার কানে লেগেছে। এইখানেই একটা ভুল হয়েছে।
- কী ভুল?
- গানের সাথে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট (বাজনা) নেই। খালি গলায় গান বাজছে। আকাশবাণী থেকে জাতীয় শোকদিবস ছাড়া খালি গলায় গান সম্প্রচারিত হয় না। আর সেটাও সকালবেলা। সন্ধ্যেতে নয়।
জলদগম্ভীর কন্ঠে উত্তর ভেসে এলো – কেন হয় না? হওয়া উচিত !
জগন্নাথ বসু বলছিলেন, ওই একটা মুহূর্তে আমাকে স্তব্ধ করে দিলেন সত্যজিৎ। সত্যিই তো, খালি গলায় গানের মাধুর্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমি নিজে আকাশবাণীতে যুক্ত এতোবছর ধরে, অথচ আমারও তো মনে হয়নি কেন হয় না ! কেন হবে না?
‘কেন হয় না? হওয়া উচিত’... এটা যে কোনো শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। অবশ্যই শিল্পের শর্তটুকু মেনে। কিন্তু কতজন শিল্পী প্রথাভাঙা পথে হাঁটতে সাহস পান? অন্যপথে হেঁটে এক নতুন পথ যিনি দেখাতে পারেন, তিনিই তো শিল্পী, তাই না?
সত্যজিতের শৈল্পিক জীবনে এই প্রথাভাঙা পথের খোঁজ চলেছে নিরন্তর। প্রথাগত যে পথ সেই ‘সুরক্ষিত’ পথে তিনি কখনই হাঁটেননি। শুধুমাত্র শিল্পের তাগিদে নয়, জীবনের তাগিদেও। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট হবে। সত্যজিৎ তাঁর সাক্ষাৎকারে নানা জায়গায় বলেছেন, ছোটোবেলা থেকে যেটা ভালো পারতাম তা হ’ল ছবি আঁকা। অথচ কলাভবনের এই ছাত্র তাঁর কোর্স অর্ধসমাপ্ত রেখে চলে আসেন, পরবর্তীকালে প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনের এক নতুন জগত খুলে দেওয়া এই শিল্পী প্রচ্ছদের কাজ তেমন করেননি (তাঁর নিজের বই, সন্দেশ বাদ দিলে)। সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়েন। কেন? একটা উত্তর বাল্যকাল থেকেই সিনেমার প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক। কিন্তু সে ঝোঁক তো আঁকার প্রতিও ছিল ! সত্যজিতের সৃষ্ট চরিত্র মনমোহনকে দিয়ে ‘আগন্তুক’-এ সত্যজিৎ এর উত্তর দিয়েছেন। স্পেনের আলতামিরা গুহায় আদিম মানুষের আঁকা বাইসনের ছবি দেখে মনমোহন বলেছিলেন, তোমার ক্ষুরে দণ্ডবৎ বাইসন ভায়া ! আমি আর যাই হই কোনোদিন আর্টিস্ট হ’ব না। কারণ এমন কোনো ইন্সটিটুইশন নেই যে আমাকে অমন বাইসন আঁকা শেখাবে ! সত্যজিতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। অজন্তা, ইলোরা গুহায়, আরও বলা ভালো ভারতীয় শিল্পের সাথে যখন পরিচিত হচ্ছেন সত্যজিৎ, তিনি বুঝেছিলেন, এই ক্ষেত্রে অনেক ‘experiment’ হয়ে গেছে। ছক ভাঙার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নেন ভারতীয় সিনেমার জগতকে।
সত্যজিতের এই প্রথাভাঙা পথ কিন্তু তাঁর নানা কাজের মধ্যে এক সূক্ষ্ম যোগাযোগ তৈরী করে দিয়েছে। সে সম্পর্কে বিস্তৃত আলচনায় যাওয়া এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা, অনেকটা পটকায় আগুন দেওয়া বলা যেতে পারে, হয়তো অন্য একরকমভাবে দেখার আশায়।
প্রথম জীবনে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে পাশ করে অনেকটা অনিচ্ছাতেই, মায়ের আগ্রহে, শান্তিনিকেতনে যোগ দেন সত্যজিৎ। অনিচ্ছা কারণ, ফাইন আর্ট নিয়ে কাজের উৎসাহ তাঁর কোনোদিনই ছিল না, ঠিক করে রেখেছিলেন কমার্শিয়াল আর্টেই ঝুঁকবেন, যেটা আবার কলাভবনে শেখানো হয় না। ওখানে গিয়ে ভারতবর্ষের শিল্পকলার ঐতিহ্যকে ভালোভাবে জেনে এসে পরে তা কাজে লাগানো যাবে, এই মনোভাব নিয়ে তিনি যান এবং কলাভবন তাঁকে হতাশ করেনি। পরে তিনি লিখছেন, “শিল্পকলার ক্ষেত্রে পশ্চিমী ঐতিহ্যের যে প্রভাব, এতদিন আমার চেতনাকে তা-ই পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছিল। মুগ্ধ হয়ে দেখেছি রেমব্রান্ট আর দা ভিঞ্চির শিল্পকলা। এবারে প্রাচ্য পৃথিবীর শিল্পকলার ঐশ্বর্যময় জগতের দরজাটা আমার চোখের সামনে খুলে গেল। চিনে ল্যাণ্ডস্কেপ, জাপানি কাঠখোদাই আর ভারতীয় মিনিয়েচার হঠাৎ ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিল আমার চেতনাকে। প্রাচীন শিল্পৈশ্বর্যের জন্যে ভারতবর্ষের যে সব জায়গার খুব খ্যাতি, তিনজন বন্ধুর সঙ্গে সেই সময়েই আমি সেখানে যাই। অজন্তা, ইলোরা আর খাজুরাহো দেখে আমার চোখ খুলে যায়।” (অপুর পাঁচালি, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৫, পৃ ১৭-১৮)
চার বছরের কোর্স অসমাপ্ত রেখে আড়াই বছরের মাথায় ১৯৪২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে ১৯৪৩ সালের জুন মাসে জুনিয়ার আর্টিস্ট হিসেবে তিনি যোগ দেন ডি.জে.কিমার-এ। বাজার চলতি হরেক পণ্যের প্রচারের জন্য যে বিজ্ঞাপন, সেখানে শিল্পস্বত্তার প্রয়োগ করার তেমন সুযোগ এবং সুবিধে কোনোটাই ছিল না। কিন্তু সেখানেও দুর্দান্ত কিছু কাজের মধ্যে দিয়ে কিমার-এর ম্যানেজার ডি.কে (দিলীপকুমার গুপ্ত)-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথমদিকের সেই কাজের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। ‘Art in industry’-র জন্য সত্যজিৎ যে প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, তা যদি পাওয়া যায়, তা হবে নিঃসন্দেহে জাতীয় সম্পদ।)
১৯৪৩ সালে ডি.কে যখন সিগনেট প্রেস তৈরী করেন তখন সার্থকভাবে তাঁর শিক্ষাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান সত্যজিৎ। এর আগে প্রচ্ছদই হোক অথবা ইলাস্ট্রেশন বা টাইটেল পেজ, কোনোক্ষেত্রেই তেমন শৈল্পিক যত্ন চোখে পড়ত না। অনেকটা দায়সারা ভাবেই যেন শুধুমাত্র ‘inform’ করার দায়িত্ব ছিল সেই কাজগুলোর। সত্যজিতের হাত ধরে সিগনেট বাংলা প্রকাশনার জগতে বিপ্লব আনে। অবশ্য সিগনেটের আগে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ তাঁর কাজের নান্দীমুখ করে ফেলেছেন ।
প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম প্রকাশিত ডিজাইন ছিল ‘পাগলা দাশু’র প্রচ্ছদ। তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের বইটি যখন এম.সি.সরকার এণ্ড সন্স, ১৯৪০ সালে প্রকাশ করার কথা ভাবেন, তখন প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সত্যজিতকে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হয়তো সুকুমার পুত্র বলেই। কারণ ১৯৪০ সাল, সত্যজিৎ তখন সদ্য কলাভবনে ভর্তি হয়েছেন এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন সম্পর্কে হাতে কলমে তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। অথচ, প্রথম কাজ করতে এসেই প্রথা ভাঙলেন সত্যজিৎ।
এর আগে বইয়ের প্রচ্ছদে যা কাজ হয়েছে সবই দ্বিমাত্রিক। অর্থাৎ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দিয়ে দেখা তো দূরস্থান, একই তলে সব উপাদান রেখে প্রচ্ছদ তৈরি হত। সত্যজিৎ এসে প্রথমে সেই ধারণাটা পালটে দিলেন, তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতে যা আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে। তিনি ধার করলেন পাগলা দাশুর একটি গল্প, যেখানে দাশুর সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা পাই, সে যে নেহাত ‘পাগলা’ নয়, ‘ফচকেমি’ স্বভাবের, তার একটা আভাস দাশুর এই মুখ দেখলে স্পষ্ট হয়।
মজার ব্যাপার হল, সুকুমার তাঁর নানা লেখার সার্থক চিত্ররূপায়ণ করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে কখনই দাশুকে আঁকেননি। এই বইয়েও হিতেন্দ্রমোহন, দাশুকে আঁকলেও (ইলাস্ট্রেশন), সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেনি। সেদিক থেকে দাশুকে বাঙালীর কাছে হাজির করার একটা কৃতিত্ব সত্যজিতের, যা তিনি দুর্দান্তভাবে পালন করেছিলেন। দাশুরই একটা গল্প যেখানে একটু দূরে বন্ধুরা একটা খালি বাক্স পরম উৎসাহে খুলছে, আর দর্শকের/ পাঠকের অনেক কাছে এসে দাশু চোখ মটকে, ‘কী, কেমন দিলাম?’ গোছের অভিব্যক্তিতে পাঠকদেরও সঙ্গে নিয়ে নিচ্ছে। সত্যজিৎ আসার আগে, গল্পের সাথে প্রচ্ছদের মাধ্যমে পাঠকের যোগাযোগ (communication) ঘটানো বিরল ছিল। শুধু inform করাটাই মুখ্য ছিল। সত্যজিৎ নিতান্ত অ্যামেচার অবস্থাতেই কিন্তু চিন্তনে প্রথা ভাঙলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই প্রচ্ছদ বাদ দিলে ‘প্রফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা’তেই শুধুমাত্র প্রচ্ছদের এক কোণে সত্যজিতের ‘S.Ray’ সইটুকু দেখি। তাছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে সত্যজিৎ প্রচ্ছদে তাঁর সই ব্যবহার করেননি। এবং, উল্লেখ্য, এখানে সত্যজিৎ এই সইটা করেছিলেন অনেকটা বাবার সইয়েরই আদলে। প্রথম কাজের থেকেও বাবার কাজ, কতোটা যত্নে তিনি করেছিলেন, এটা দেখলে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
জীবনের দ্বিতীয় প্রচ্ছদ যখন সত্যজিৎ করছেন তখন তিনি কলাভবন থেকে আড়াই বছরের একটা কোর্স করেছেন, অনেক বেশী দেখেছেন, অনেকটা পরিণত। সত্যজিতের কিমারের সহকর্মী ও.সি.গাঙ্গুলী জানাচ্ছেন, সত্যজিৎ তখন প্রতিদিনই প্রায় অসংখ্য ম্যাগাজিন কিনছেন, বেশীরভাগই বিদেশের, সেখানকার কাজকর্ম, রঙের ব্যবহার এসব নিয়ে রীতিমতো সিরিয়াস পড়াশোনা করছেন। ১৯৪৩-এ, সংকেত ভবন থেকে প্রকাশ পায় কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছাতুবাবুর ছাতা’। সত্যজিতের জীবনের দ্বিতীয় প্রকাশিত প্রচ্ছদ। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাবো, মূলত দুটি রঙ নিয়ে তিনি কাজ করছেন, কালো এবং হলুদ। কালো রঙে তিনি ছাতুবাবুকে আঁকছেন, তাঁর জামায় বৃষ্টির ফোঁটা, এবং বাইরে বৃষ্টির আকারে ছাতাকে ব্যবহার করলেন। রঙের ব্যবহার তখনও উন্নত ছিল না তেমন। সত্যজিৎ তাঁর তৃতীয় রঙ হিসেবে ফাঁকা অংশকে (সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডকে) দারুণ বুদ্ধিমত্তায় ব্যবহার করলেন। তাঁর এই কাজ দেখে আমরা এম.সি.এশারের symmetry-র ছায়া দেখি, বিশেষত হলুদ অংশে সাদা ছাতার ব্যবহার আর তাঁর উল্টোটা।
এরপর সিগনেট থেকে বের হয় ক্ষীরের পুতুল, তাঁর প্রথম সিগনেটের প্রচ্ছদ। এখানেও রঙের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এমনকি, এর পর সিগনেটে তিনি যত প্রচ্ছদ করেছেন প্রতিটি প্রচ্ছদ আমাদের অবাক করে দেয় তার ব্যপ্তিতে। পূর্ণেন্দু পত্রী একবার বলেছিলেন, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম সিগনেটের বইগুলোর জন্য, বিশেষ করে সত্যজিতের প্রচ্ছদের জন্য। এক একটা প্রচ্ছদের মুগ্ধতায় কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা !
বইয়ের সাথে প্রচ্ছদকে দারুণভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা, নানারকম এক্সপেরিমেন্ট, পথভাঙা, চিরাচরিত প্রথা নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন পথের খোঁজ... উল্লেখ করা উচিত, শৈল্পিক খোঁজ, এটাই আলাদা করে দিয়েছিল প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিতকে। তার ফলস্বরূপ আমরা পাই, যখন ‘হাতেখড়ি’ বের হচ্ছে, পুরো বইটাকে একটা স্লেটের আদলে ভেঙে নিলেন। এমনকি বইয়ের কোণ মুড়ে গোল করে দিলেন, পাশ বরাবর কাঠের ব্লক যেন। আবার ‘খাই খাই’য়ের প্রচ্ছদে সারি বেঁধে বসে থাকা লোকজন, তাঁদের নানান অভিব্যক্তি। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এর প্রায় কুড়ি বছর পর গুপী গাইন বাঘা বাইনে, ভুতের নাচের দৃশ্যের ফ্রেম।
আবার জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর প্রচ্ছদ আঁকার সময় তিনি পুরো প্রচ্ছদ জুড়ে ডোরাকাটা বাঘের হলুদ কালো রঙ, তাতে গুলির অংশ বোঝানোর জন্য একটা সাদা অংশ, কাট আউট, যেখানে লেখকের নাম আর বই-এর নাম। পিছনেও একই ডিজাইন, শুধু সাদা অংশটা একটু বড়ো। এখান থেকে বোঝা যায় ডিটেলসের দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজরের কথা। গুলি বের হয়ে যাওয়ার সময় গর্তটা একটু বেশী বড়ো হয়। কোনো রঙের আতিশয্য নয়, শুধু চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সামান্য এক প্রচ্ছদকে অসামান্য করে দিলেন সত্যজিৎ।
সত্যজিতের প্রচ্ছদ যদি খুব খুঁটিয়ে দেখা যায়, তাহলে দেখতে পাবো সেখানে ‘সাদা’ বা ফাঁকা অংশের সুন্দর ব্যবহার। সেই সময়ে, যেখানে একাধিক রঙ ব্যবহার করার আধুনিক পথ তেমন নেই, দুটো রঙ মোটামুটি ব্যবহার করা যাত, সেখানে তৃতীয় রঙ হিসেবে ‘সাদা’ বা ‘ফাঁকা স্পেস’কে বারবার ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। প্রথম থেকেই চারপাশে যতটা সম্ভব সাদা জায়গা ছেড়ে রেখে মূল বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেওয়া, পরে সাদা অংশকে প্রচ্ছদের নানান জায়গায় ব্যবহার করা। সত্যজিতের ভাষায় যা ছিল – ‘White space is like white lettering.’
নরেশ গুহর ‘দুরন্ত দুপুর’-এর প্রচ্ছদে গনগনে হলুদ রঙের ওপর নিবের টানে আঁকলেন এক একাকিনীকে। শুধু অ্যানাটমির বেসিক থিয়োরীকে কাজে লাগিয়ে। বুকের কাছে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে সে একটা কাপড় ধরে আছে। আবেদনে পরিপূর্ণ, অথচ তা কখনই অশ্লীলতার সীমা স্পর্শ করেনি।
সত্যজিতের সারা জীবনের কাজে আমরা এই ব্যাপারটা দেখতে পাই। যাপনকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তাঁর কাজে। আধুনিকতা মানেই উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, আধুনিক ভাষায় ‘ডার্ক’ কিছু করতে হলেই যে তাকে যৌন সুড়সুড়ি দিতে হবে, এটার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর কাজে, মূলত ফিল্মের থেকে একটা উদাহরণ দিলে এ বিষয়টা সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
এই ধারণার এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই, প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমা করার সময়, যখন মূল গল্পে এক জায়গায় সুনীল লিখছেন
“সিদ্ধার্থ শিবেনকে কনুই দিয়ে একটা খোঁচা মারল। পাশ দিয়ে দুটি যুবতী চলে গেল—ওদের চেয়ে দু-এক বছরের বড়োই হবে—দু-জনেই বেশ স্বাস্থ্যবতী, এক হালকা সুগন্ধ বয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সিদ্ধার্থ বলল, সাউথ ক্যালকাটায় এলে বেশ ভালো ভালো মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। এইজন্যই আসতে ইচ্ছে করে! কী বুক দেখেছিস?
শিবেন বিজ্ঞভাবে জানাল, সব আসল নয়, নকল।
- তোকে বলেছে! তুই হাত দিয়ে দেখেছিস?
- হাত দিয়ে দেখতে হয় না, একদিন বাসে একজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল, লোহার মতন শক্ত কী যে একটা—
- ভাগ! আমারও তো প্রায়ই ধাক্কা লাগে, দু-একবার ইচ্ছে করেও একটু, বুঝলি না, চান্স পেলে, কিন্তু আমি তো সব্বারই দেখেছি নরম-নরম—তোর লাকটাই খারাপ।”
সত্যজিৎ যখন চিত্রায়ণ করছেন, তিনিও অবদমন দেখাচ্ছেন। কিন্তু কী দেখাচ্ছেন? উলটোফুট থেকে হেঁটে আসছে এক উন্নতবক্ষা নারী। তাঁর বুক দেখে সিদ্ধার্থর মনে পড়ছে মেডিক্যাল ক্লাসরুম, female breast নিয়ে স্যারের লেকচার। বাবা মারা যাওয়ায়, সংসার টানার জন্য যে সিদ্ধার্থকে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেই সিদ্ধার্থের অবদমনে আজও ওই ক্লাসরুম।
সত্যজিতের আগে টাইটেল পেজ তেমনভাবে গুরুত্বই পায়নি। সত্যজিৎ পরবর্তী যুগে, এমনকি এখনও টাইটেল পেজ তেমন গুরুত্ব পায়না। বইয়ের মূল মলাট (প্রচ্ছদ) কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে (অথবা প্রচ্ছদের অতিরিক্ত রকমারিতে বইয়ের নাম বোঝা না গেলে তখনই টাইটেল পেজের ভূমিকা। ফলত অনেকটা গুরুত্বহীন।) অথচ, সত্যজিৎ কৃত কিছু টাইটেল পেজের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কীভাবে বইয়ের জগতে একপ্রকার বিপ্লব এনেছিলেন সত্যজিৎ, সিগনেটের হাত ধরে।
সিগনেটের হয়ে সর্বশেষ প্রচ্ছদ আঁকেন বিষ্ণু দে’র ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’।
প্রচ্ছদের কাজে সত্যজিৎ টাইপোগ্রাফিতে এক বিবর্তন এনেছিলেন। শুধুমাত্র একটা অক্ষর কতোরকম ভাবে লিখে নতুনত্ব আনা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা পাই তাঁর কৃত এক্ষণের প্রচ্ছদ্গুলো দেখলেই। ‘এ’,’ক্ষ’,’ণ’ এই তিনটি অক্ষর যে কতরকমভাবে ধরা দিয়েছে সত্যজিতের কলমে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্যামল ঘোষের স্মৃতিকথা ‘স্মৃতি সত্তা নাট্য’ বইতে তিনি লিখছেন –
“জীবিকার সূত্রে কিছুকাল আমাকে মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত থাকতে হয়েছিল। তখন এক্ষণ পত্রিকা শারদ সংখ্যার জন্য দু’রঙের একটি প্রচ্ছদপটের নকশা এলো আমার হাতে। এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। রঙের নমুনাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন সঙ্গে। এইসব ছাপা তখন জিংক ব্লকে হত। ব্লকের ছবি তোলার সুবিধের জন্য আঁকতে হত লাল আর কালোতে।ছাপার সময়ে নমুনা দেওয়ার রং মিলিয়ে ছাপা হতো। এখানে যে রেখাচিত্রটি দেওয়া হয়েছে তা দেখলাম ভ্রু আঁকার পেন্সিল আর গরমে গলে আসা একটি লাল ডটপেনে আঁকা। ফলে যেখানে-সেখানে কালি জুবড়েছে, আঁকতে গিয়ে নরম পেন্সিলের শীষ ভেঙে যাওয়ার আঙুলে ঘসে সে সব অবাঞ্ছিত দাগ মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। মোটমাট বেশ অপরিচ্ছন্ন কাজ। মোটেই সত্যজিৎ রায়ের নামের উপযোগী নয়।”
শ্যামলবাবু ভেবেছিলেন, সিনেমার কাজে ব্যস্ত সত্যজিৎ রায় মনোযোগী হওয়ার সময় পাননি। বড্ড দায়সারা ভাবে এঁকে দিয়েছেন। তিনি বলছেন,
“ দেখে শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল না অমন মানুষের নামে এমন একটা কাঁচা প্রচ্ছদ ছাপা হোক। কিন্তু যাদের পত্রিকা ভালো না লাগলেও নিরুপায় হয়ে ‘যদ্দৃষ্টং’ ছেপে দিতে বললেন তারা। প্রথম রঙটি ছাপা হওয়ার পরে দ্বিতীয় রংয়ের বেলাতেও তাদের পছন্দমতো অন্য কোন রঙের ব্যবহার করব কিনা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু সে বদলের সাহস তাদের ছিল না। ফলে শিল্পীর দেওয়া কালার চার্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় রংটি ব্যবহার করতে হলো আমাকে।
‘কিমাশ্চর্যম!’ দ্বিতীয় রঙটি ছাপার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখের সামনে যেন হাজার রঙিন ঝাড়বাতি জ্বলে উঠলো। আমার ধারণার ওই বীভৎস রং পাশাপাশি ব্যবহারে সেই অপরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদ নকশাটি যেন স্বর্গীয় মাধুরী পেল। এমন যে হতে পারে তা আমার সুদূর কল্পনারও অতীত। এ যেন শুঁয়োপোকা থেকে রূপান্তরিত প্রজাপতি। এ আমার নতুন শিক্ষা। প্রসঙ্গত বলা যায় সে বছরের ‘শ্রেষ্ঠ শারদ প্রচ্ছদ’ হিসেবে সেই এক্ষণ পত্রিকাটি সেবারে মনোনীত হয়েছিল।” (এক্ষণ তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা)
কাজের প্রতি কতটা আত্মবিশ্বাস, কতটা জ্ঞান তাঁর ছিল এটা বোধহয় এই ঘটনার থেকে আমরা একটা আভাস পাই।
সত্যজিৎ জানেন কতোটা দ্যাখালে ঠিক দ্যাখানো যাবে। ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতকে এই প্রসঙ্গে আনছি।
‘হত্যাপুরী’ (ফেলুদা)র ‘মেঘ পোহানো’ ভদ্রলোকের মৃত্যু বীভৎসতা দেখাচ্ছেন সত্যজিৎ। কীভাবে দেখাচ্ছেন? ফেলুদা সে অর্থে মূলত ছোটোদের জন্য লেখা। সত্যজিৎ, ইলাস্ট্রেশনে ফ্রেমের মধ্যে শুধু পা দুটিকে রাখলেন। মূল ফোকাস করলেন লালমোহনবাবু আর তোপসের মুখের এক্সপ্রেশনে। এবারে কতটা বীভৎস হতে পারে সেই মৃত্যু, তা দর্শকের জন্য রেখে দিলেন।
না দেখিয়েও যে দেখানো যায়, সত্যজিৎ শেখান।
প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিৎ অনেকেরই পরিচিত। কিন্তু কমিকস শিল্পী সত্যজিৎ? সন্দেশের জন্য কমিকস এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। এবং নির্বাক কমিকস। চরিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ আটপৌরে বাঙালী বাবুকে। সন্দেশ প্রকাশের চারটি ঋতুসংখ্যা, সেই মতো চারটে কমিকসকে আমরা পাই। প্রতিটা কমিকস ছ’টা খোপে বন্দী, এবং সম্পূর্ণ, নির্মল হাস্যরসের অধিকারী। যে হাস্যরসের অধিকারী তিনি ছিলেন তাঁর ব্যক্তিজীবনে। শুধু চারটে কমিকস প্রমাণ করে দেয়, কমিকসশিল্পী হিসেবে তাঁর দক্ষতা। টিনটিনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, তোপসের কল্যাণে আমাদের অনেকটাই জানা।
প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যে প্রথা ভেঙে এগিয়েছিলেন সত্যজিৎ, সিনেমায় এসেও তার অন্যথা হয়নি। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সিনেমা এক নতুন ভাষা পায়, এ কথা বলাটা অত্যুক্তি হবে না। প্রথম ছবি থেকেই, আরও স্পষ্ট করে বললে ছবির টাইটেল কার্ড থেকেই সত্যজিৎ চলতি পথের থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। পথের পাঁচালীর চলচ্চিত্রায়ণে সিনেমার প্রয়োজনে যেটুকু পাল্টানো, খুব সাধারণভাবে দেখলে শুধু সেই পরিবর্তনটুকুই নয়, গভীরতর অর্থেও এক পরিবর্তন এসেছে। সত্যজিতের অপু ট্রিলজিতে মূল চরিত্রের মৃত্যুদৃশ্য এসেছে মোট পাঁচবার। ইন্দির ঠাকরুন, দূর্গা, হরিহর, সর্বজয়া এবং অপর্ণা। অথচ, একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তাঁর ছবিতে মৃত্যু, জীবনের চরম বিরুদ্ধতা হিসেবে আসেনি। পথের পাঁচালী প্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটক বলছেন, “পথের পাঁচালীতে এমন কিছু নেই যা আমরা হাজারবার ভাবিনি বা কল্পনা করিনি”। ব্যক্তিগত অনুভূতিকে সার্বিক করে দেওয়ার ক্ষমতা অথবা সার্বিক অনুভূতিকে একটা স্তরে নিয়ে এসে শিল্পে রূপান্তর করা, সত্যজিৎ রায় সেই বিরল প্রতিভাদের মধ্যে অন্যতম যার মধ্যে এই দুটো ক্ষমতাই, মনন ছিল।
সত্যজিতের ছবিতে, দূর্গার মৃত্যুদৃশ্যে মৃত্যুর বাহন হিসেবে সত্যজিৎ ব্যবহার করলেন ক্ররমূর্তি গণেশকে। প্রলয়ের তাৎপর্যে। সত্যজিতের ছবির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, সত্যজিৎ ভাবান কিন্তু কখনই জোর করে দেখান না। তাঁর সিনেমায় তিনি প্রভূত উপাদান ছড়িয়ে রাখেন। সেগুলোর দেখা পেলে ভালো, না দেখা পেলেও সিনেমার মূল ‘গল্প’ প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে না। এবং একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে, এই না দ্যাখা জিনিসের অমোঘ টানেই বারবার দেখা, নিত্যনতুন আবিস্কারের আতিশয্যে আনন্দ পাওয়া।
এই ডিটেইলিং বাংলা সিনেমায় বিরল।
যেমন, ‘মিসটেক’ মুকুলের সাথে মন্দার বোস আর অমিয়নাথ বর্মনের প্রথম দ্যাখায়, ছাদের ওপর থেকে মুকুলের সমবয়েসী কোনো বন্ধুর মারফত মুকুলের সাথে সাথে আমরা জানতে পারি, ‘মুকুল, ওই গলিতে একটা ঘুড়ি বেরোলো দ্যাখ। দ্যাখ, ওই যে।’ গল্প কিছুটা এগিয়ে, মুকুলের কিডন্যাপড হওয়া ও বাড়িতে ফেরত আসা, ফেলুদা তোপসের তার সাথে দেখা করে বের হওয়ার পর আমরা দেখতে পারি, মুকুলের বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেলুদা, তোপসে আর (আসল)মুকুলের বাবা একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় এসে দাঁড়ান। যেখানে কথোপকথন হয়, ‘সাথে একটা রিগার্ডস জুড়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক।’ বলে চলে যায়। গল্প বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু একটু থেমে ওই দৃশ্যে আশপাশে দেখলে দেখতে পাবো, ওই ল্যাম্পপোস্টের থেকে একটা ঘুড়ি ঝুলছে !
সামান্য সূত্র। সত্যজিৎ রেখে যাচ্ছেন। আর আবিস্কারের অপার আনন্দে আমরা মেতে উঠছি। হয়তো এই ঘুড়ি সেই ঘুড়িও নয়, কিন্তু, কার তাতে কি? আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি !
তেমনই ট্রেন। পথের পাঁচালীতে অপুর থেকে অনেকটা দূরে ছিল ট্রেন / রেললাইন। দেখা যেত না ঘর থেকে। অপরাজিততে আমরা পাচ্ছি, এই ট্রেন কিন্তু বাড়ির অনেক কাছে চলে এসেছে। সপ্তাহান্তে মা অপেক্ষা করে আছে শহরফিরতি ট্রেনের দিকে তাকিয়ে, এই বুঝি অপু ফিরে এলো। আর নগরসভ্যতায় অভ্যস্ত অপু মা’কে ‘ম্যানেজ’ করে নিচ্ছে কিছু টাকা পাঠিয়ে। ভিক্টোরিয়ায় যখন প্রবল শব্দে ঘড়ির আওয়াজ, ঠিক সেই সময়ের jump cut-এ আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে সূর্যঘড়ি, নিস্তরঙ্গ জীবন। অপুর সংসারে অপুর ঘরের ঠিক পাশেই রেললাইন। সেখানে সারাদিন ট্রেনের কোলাহল।
শুধুমাত্র ট্রেনকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে সত্যজিৎ উল্লেখ করছেন নগরজীবনে সহজে শামিল হয়ে ওঠা অপুকে। শহুরে সভ্যতায় যত অভ্যস্ত হচ্ছে অপু, ততই গ্রাম্য অপুর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সে।
এই রূপকের ব্যবহার ‘সিরিজ’-এর ক্ষেত্রে বারবার ফিরে এসেছে সত্যজিতের ছবিতে। সত্যজিতের সম্পর্কে অনেকের অভিযোগ উনি রাজনৈতিক বিবাদ বিতর্ক এড়িয়ে গেছেন। ঠিকই। সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে সরাসরি এক টুকরো রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তকে তুলে ধরেননি। তিনি বরাবর সামগ্রিক চিত্রকে তুলে ধরায় বিশ্বাসী ছিলেন। নইলে, ‘রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল ! তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?’ – এর থেকে এতো সহজে যুদ্ধবিরোধী গান আর তৈরি হয়েছে কি? ‘হীরক রাজার দেশে’-র থেকে বড়ো রাজনৈতিক ছবি, ফ্যাসিস্ট বিরোধী ছবি আর হয়েছে কি?
সত্তরের দশক, বড্ড টালমাটাল সময়। রাজনৈতিক ঢেউ সরাসরি আছড়ে পড়ছে সমাজ জীবনে। ‘সোনার টুকরো ছেলেরা আজ অশ্বমেধের বলি’.. সেই সময় সরাসরি সেই বিষয়কে নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। অথচ, অভিযোগ, সত্যজিৎ চুপ ! সত্যিই কি তাই? সেই সময়কে, সেই দুরন্ত সময়কে নিয়ে সত্যজিৎ তৈরী করছেন ক্যালকাটা ট্রিলজি [প্রতিদ্বন্দ্বী(১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), জন অরণ্য(১৯৭৬)]। সিনেমার বিশ্লেষণে যাবো না, আমায় আশ্চর্য করেছিল এই ট্রিলজিতে টালমাটাল সময়কে সত্যজিৎ জুড়ছেন সময় দিয়েই। হ্যাঁ, সময়। রূপকে আনছেন ঘড়িকে।
প্রতিদ্বন্দ্বীতে সিদ্ধার্থর ঘড়ি ভেঙে যায় হাত থেকে পড়ে। বিপ্লবের স্বপ্ন (ভাইয়ের সাথে কথোপকথন এবং আয়নায় নিজের মধ্যে চে’কে খুঁজে নেওয়া) যখন ভেঙে যায় বাইরের বিড়ালের গোঙানিতে, সিদ্ধার্থ টেবিলের ওপর থেকে কিছু একটা ছুঁড়ে মারে ওই শব্দ লক্ষ করে। ক্যামেরায় হাতের পাশেই দেখানো হয় ঘড়িকে।
সীমাবদ্ধতে টুটুল (শ্যালিকা) এই শহরে এলে শ্যামলেন্দু তাঁকে একটি ঘড়ি দেয়। মফঃস্বল থেকে আসা টুটুলকে শহুরে সময়ের দ্যোতক এই ঘড়ি, এভাবে যদি নাও ভেবে নিই, তাহলেও একদম শেষে এসে দেখা যায় যে শ্যামলেন্দুর থেকে ঘড়ি নিয়েছিল টুটুল, সিনেমার একদম শেষে সম্পূর্ণ পালটে যাওয়া শ্যামলেন্দুকে সেই ঘড়ি ফেরত দেয় টুটুল। উপরে উঠতে গিয়ে, ক্রমশ আরও উপরে উঠতে গিয়ে সময় যে এতো দ্রুত পালটে গেছে.. !
জন অরণ্যে বরং ঘড়ি আর রূপক হিসেবে থাকে না। অনেকটা প্রকট হয়ে ওঠে। চল্লিশ পার্সেন্টের মধ্যে একজন হওয়ায়, বৌদি ঘড়ি উপহার দেয় সোমনাথকে। সেই ঘড়ির প্রসঙ্গ উঠে আসে প্রেমিকার সাথে শেষ দেখায়। ঘড়ি কিন্তু ‘ক্লাস’ রিপ্রেসেন্টেটিভ তখন। নটবর মিত্তিরের ঘড়ি সেটাই বুঝিয়ে দেয়। আর এই ঘড়ি বন্ধক রেখেই বন্ধুর বোনকে হোটেলের ঘরে রেখে আসে সোমনাথ... সময়টাকে পালটে দেওয়ার আশায়।
সত্যজিৎ ভাবান। কিন্তু জোর করে দেখান না।
সুকুমারের তথ্যচিত্র। ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ পড়তে গিয়ে তার নাট্যরূপে যে কারোরই স্বাভাবিকভাবে মনে আসবে বয়সে ছোটোদের দিয়ে চরিত্রে অভিনয় করানোর কথা। কিন্তু সত্যজিৎ তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে গিয়ে প্রতিটা চরিত্রে নিয়ে এলেন বড়দের। অপ্রত্যাশিতভাবে। যা ছোটোরা করে, তা বড়োরা করলে সে যে আরও মজাদার হবে তা বলাই বাহুল্য। এই নিয়ম পালটে নেওয়া সত্যজিৎ বারবার করেছেন। তাঁর আগে বা পরেও টাইপেজের ব্যবহার সার্থকভাবে কতজন করেছেন? অথচ সত্যজিতের প্রায় প্রতিটি ছবিতে টাইপেজের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
তেমনই রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। কালার ছবির যুগেও সত্যজিৎ কিন্তু সাদা কালোয় ছবি বানিয়ে চলেছেন। এবং রঙ সেখানেই আনছেন, যেখানে শৈল্পিক কারণে রঙের প্রয়োজন। অশনি সংকেতে রঙ আনছেন, কেন? বিভূতিভূষণ লিখছেন, এই দুর্ভিক্ষে মানুষের জীবনযাত্রা ধূসর হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃতি তার সজীবতা হারায়নি। এই প্রকৃতির সজীবতা ধরার জন্য প্রথমবার রঙের ব্যবহার করছেন সত্যজিৎ। (কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক্সপেরিমেন্ট রঙ এবং তাও multi coloured নয়। একই কথা গুপী গাইন বাঘা বাইনের শেষ কয়েকটা ফ্রেমের ক্ষেত্রে খাটে)।
একই বিষয়কে নানাভাবে পাঠ দেওয়া সম্ভব, এটা সত্যজিৎ জানেন। ঠিক এই কারণেই ‘হীরক রাজার দেশে’তে যেভাবে ঘুষ আসে, ‘জন অরণ্য’তে সেটাই আরও ‘ডার্ক’ হয়ে ওঠে।
সলিল চৌধুরীর আগে বাংলা গানে যন্ত্রের (ইন্সট্রুমেন্টের) ব্যবহার হত গানের পরিপূরক হিসেবে। ইন্টারল্যুড বা প্রিলিউডে গানেরই সুরের ধরতাই চলত। সলিল আসার পর, বাংলা গানে, ইন্সট্রুমেন্টের মধ্যে দিয়ে বলার যুগ এলো। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ গানটুকু নিলেই বোঝা যাবে এখানে আলাদাভাবে ইন্সট্রুমেন্ট একটা বক্তব্য প্রকাশ করছে।
সত্যজিতের হাত ধরে বাংলা সিনেমায় প্রথমবার শব্দ এক প্রধান ভূমিকা পেল। ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর শুধুমাত্র মিউজিক্যাল নয়, নগরজীবনের শব্দকে তিনি নিয়ে এলেন গল্প বলার পরিপূরক হিসেবে। অজস্র উদাহরণ। এই মুহূর্তে যেমন মনে পড়ছে, একই শব্দ জলসাঘরের ক্ষেত্রে আমরা পাই অনেকটা ক্ষীণভাবে আর মহানগরের ক্ষেত্রে পাচ্ছি জোরালোভাবে। অবচেতনে হলেও সত্যজিৎ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, জলসাঘরের জমিদার বাড়ির থেকে অন্যান্য বাড়িগুলো অনেকটা দূরে আর মহানগরের ক্ষেত্রে সেটাই অনেকটা কাছে চলে আসছে।
• মহানগরে বৃদ্ধ মাষ্টারমশাই বলছেন, ‘কলকাতাটা যে এতো চেনজ করে গেছে এ কথা ভাবতেও পারিনি বৌমা।’ ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ‘চণ্ডালিকা’ ভেসে আসে – ‘মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়...’
• মহানগর। সুব্রত আরতি আলোচনা করছে যে আরতি ঘরকন্না করবে, না, অফিসেই কোনো চাকরী। পাশের বাড়ি থেকে রেডিওর কর্কশ আওয়াজ। কাঁটা ঘুরিয়ে নতুন চ্যানেল ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেউ।
• আরতি যেদিন চাকরী পেল। সুব্রত বাবাকে জানাবে সে খবর। পাশের বাড়ি থেকে রেডিওয় ভেসে এলো, ‘সারা দেশে আজ প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হয়েছে’।
এইরকম উদাহরণ সত্যজিতের সিনেমায়, কাজে প্রচুর। একজন শিল্পীকে আপাতভাবে দেখা যায়। কিন্তু তাঁর কাজের সার্থকতা সেখানেই যখন ছোটো ছোটো এমন উপাদান খনন হতে থাকে তাঁর তৈরী কাজের বহু বহু বছর পরেও। সত্যজিতের সিনেমার কাছে বারবার ফিরে আসা যায় এই কারণেই। তাঁর লেখার কাছে, তাঁর আঁকার কাছে। তাঁর জীবনদর্শনের কাছে, যাপনের কাছে। সত্যজিৎ স্বাভাবিকভাবেই, অতি সহজে পথ হেঁটে চলেন। পথের পাশে কতোকিছু পড়ে থাকে। তিনি চিঠি রেখে যান অনেক। আমরা কেউ কেউ পাই, কেউ কেউ পাই না। সেই চিঠি কেউ পেয়েও পথ হারাই। আফশোসের বিষয়, সত্যজিৎ সময়ের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র আলো হিসেবে থেকে যাবেন। তাঁর সেই আলো, সেই পথভাঙা পথ ধরে হেঁটে চলার পথিক খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
গ্রন্থসাহায্যঃ
• রং তুলির সত্যজিৎ / দেবাশীষ দেব / সিগনেট প্রেস
• সাক্ষাৎকার সমগ্র – সত্যজিৎ রায় / পত্রভারতী
মোদের জায়গা উদের ইস্টেজে না হলো
উহা বসবার লাগি কেউ না বুলালো,
মোদের বসার জায়গা হল লিচে
সারি সারি বসল বাবুর দল ইস্টেজে,
উরা কইল কত মোদের দুখের কথা
তবু মোদের জীবন ছায়ে রইল সে ব্যথা,
ক্যানে জানি কখনো তা বাবুদের হলো না।
আদিবাসী কবি ওয়াহারু সনাভানের কবিতার অনুপ্রেরনায়।
এক
পুরুলিয়ার শালহুরা গ্রামের দক্ষিণে সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পঞ্চকোট পাহাড়, উল্টোদিকে উত্তরে দামোদর বয়ে চলেছে গ্রামের বেশ কিছুটা নীচে। বিষাণ মুরমু বাড়ির পিছনের পরিপাটি করে নিকনো দাওয়ায় শালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে। সামনের মাঠের মকাইয়ের লম্বা গাছগুলোর সবুজ পাতা আর সাদাটে হলদে ভুট্টার শিষের দিকে অলস ভাবে তাকিয়ে থাকে। মকাই ক্ষেতের উত্তরে রামফলের গাছের ঝোপের পর ধাপে ধাপে ধানের জমি উত্তরে নেমে গেছে দূরের দামোদরের চর পর্যন্ত। ওর বাড়ির দক্ষিণ দিকে গ্রামের চওড়া রাস্তা তার ওপাশে কয়েকটা বাড়ি, তারপর ঝোপে ঢাকা কাঁকুরে জমি ধাপে ধাপে উঠে গ্রামের জাহের থানের বড় বড় শাল মহুয়া গাছের দিকে চলে গেছে। ওইদিকে গ্রামের ছেলেরা গাই, কাঁড়া (মোষ), মেরোম (ছাগল) চরাতে নিয়ে যায়। দু একটা ছেলে তেঁতুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে তিরিয়াওতে (বাঁশের বাঁশি) সুর তোলে। বয়স চল্লিশের বিষাণের কালো পেটানো তেলমাখা চেহারা সকালের রোদে চকচক করে। মালঞ্চ, বাঘমারা, আখুনবানি অঞ্চলে ওর থেকে ভালো চাষি খুব কম আছে।
ওর বাবা যখন কুড়ি বছর বয়েসে মারা যায় তখন দুই ভাইকে নিয়ে সে সংসার সামলাতে শুরু করে, তখন ওদের বারো বিঘা মতো জমি ছিলো। বিষাণ চাষ ভালোবাসে, এক এক করে সে দুই ভাইকে সঙ্গে করে ২৫ বিঘা জমি করেছিল। তারপর ভাইদের সংসার হলে ওদের আলাদা করে দিয়েছে, ওর বাড়ির দুই পাশে দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকে, ওদের চাষও আলাদা। সেই ভাগের পর আবার ও পনেরো বিঘা জমি করেছে। বছর চারেক আগে দামোদরের পাড়ের কাছে ছয় বিঘা সোনা ফলানো জমি সে জারা কিস্কুর কাছ থেকে কিনেছিল। ও সোনামণির সব গয়না, গলার হার, চুড়ি এমনকি ওর পায়ের পায়গন পর্যন্ত ভুরকুন্দবাড়ির লক্ষ্মী সাউয়ের দোকানে বন্ধক রেখে, আর বাকী টাকা জমিনি হেমব্রমের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেই জমি কেনে। কেবল সোনামণির হাতের বালা সেরকমটা রয়ে গিয়েছিল, গতবছর সে সব ধার শোধ করেছে তার চাষ থেকে।
বাড়ির পাশের বড় শিমুল গাছটায় কটা টিয়াপাখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকছে। ওর তিন ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে জোলো, জোয়ান হয়েছে,খুব খাটিয়ে, ওর সাথে মাঠের কাজে হাত লাগায়। ছেলেটা চাষ ভালোবাসে ওর মতো, ঠিক সময়ে আল বেঁধে জল ধরে রাখে, ভোররাতে মাঠে গিয়ে দেখে আলে যদি কোন ভুলুক হয়ে থাকে কোদাল দিয়ে সে গুলোকে ঠিক করে। বাপ বেটার বড় সময় কাটে মাঠেই। মেজ ছেলে বুধুটা একটু ডানপিটে, ওর ঝোঁক গাই আর কাঁড়ার উপর। এই সময় সে কাড়া চারটেকে নিয়ে সামনে দামোদরের চরে চরাতে নিয়ে যায়। এক একদিন বড় কাঁড়াটার পিঠে শুয়ে দামোদরের ওপারে চলে যায় তিরিয়াও বাজাতে বাজাতে। মোষগুলো ওর প্রাণ, ওদের খাওয়ানো থেকে গোয়াল কাঢ়া সব এমন মন দিয়ে করে যেন ওগুলো ওর ভাই। কাড়াগুলোর গা একেবারে কালো চকচকে, শুধু মেজটার জন্য। ছোট জগদীশ আবার বুধুর ন্যাওটা, ও ছাগলগুলো নিয়ে দাদার সঙ্গে যায় তারপর গোটা পনেরো ছাগলকে নদীর পাড়ে চরাতে দিয়ে মেজোর সঙ্গে দামদরে নেমে খেলা করে।
কোলের মেয়েটা চার বছরের ভানু, তাকে নিয়ে সোনামণির ঘরের কাজে সময় কাটে। ওর ভিতরে একটা বেশ ভরাট ভাব, চুপ করে ও সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। গেলবার তো মোষের পিঠে চড়ে ছোট আর মেজটা দামোদর ধরে তেলকুপির ভৈরবথানের মন্দির দেখতে চলে গেছিল। বেলা পড়ে এলে, সোনামণি ব্যাটাদুটোর জন্য কেবল ঘর বার করছিল চিন্তায়, সাঁঝের বেলা ফিরে মায়ের কাছে খুব পিটুনি খেয়েছিল। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ও ভাবল বেলা হোল এবার পুকুরে ডুব দিয়ে আসবে।
সামনের রাস্তায় বেরিয়ে দেখল রাসিটোলার ভূষণ যাচ্ছে, দুজনা মিলে দুটো চুট্টা ধরিয়ে টান দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো। ওরও চাষবাস ভালো, ওর ব্যাটা দুটোও খুব খাটে। দামোদরের পাশে ওদের এই গ্রামে সারা বছরই জলের কোন অভাব নেই তাই ওদের মাঠগুলোয় সারা বছরই কিছু-না-কিছু হচ্ছে। গ্রামের প্রত্যেকটা সাঁওতাল বাড়ি ঝকঝকে করে নিকোনো আর বাইরের দেওয়ালে খুব সুন্দর করে রং করা নানা রকমের ফুল গাছ আর নকশা করা। ভূষণ বলল হ্যাঁরে সামনের পূর্ণিমাতে পঞ্চকোটের জঙ্গলে শিকার করতে যাবি নাকি? শুনছি কটা ধাড়ী বড়া নেমেছে। ভূষণ বলল হাঁ যাব, সে বার বেশী মহুয়া খেয়ে এত্ত বড় জিলটাকে (হরিণ) মাইরতে পারলাম নাই, আমার তুইন (তীর) ফস্কে গেল আর পাশ দিয়ে পাইলে গেল। ভূষণ বিষাণের কথায় মুচকে মুচকে হাসতে হাসতে বলল ইবার ধান মকাই দুটোই খুব হবে, ভয় হচ্ছে ধানে পুকা না লাগে।
দুই
আষাঢ় মাসের পনেরো তারিখ হয়ে গেল অথচ বৃষ্টির তেমন দেখা নেই, বেলা অনেক হোল, সনাতন মণ্ডল বার বাড়ির দাওয়ায় বসে হুঁকো টানতে টানতে হিসাব করছিলো ‘ধুলোর লাঙল দেওয়া হয়ে গেছে মাসখানেক আগেই বীজতলাও তৈরি এবার যদি তাড়াতাড়ি বৃষ্টি না আসে তা হলে এ বছরের চাষটাও মার খাবে’। বলদ দুটো বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় বড় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে একমনে জাবর কেটে চলেছে। ভিতরে সনাতনের বউ বিলাসী বারন্দার কোণে রান্নার জায়গায় উনুনে ভাত চাপিয়েছে, চার বছরের কোলের মেয়ে কুমুদ বারন্দার কোণে একমনে খেলাপাতিনি খেলছে। ফোটা ভাতের গন্ধ বাইরে ভেসে আসছে। বড় ছেলে স্বপন বীজতলায় গেছে, জল টান হয়েছে কিনা দেখতে। ছোট ছেলে নন্দকে এবছর ইস্কুলে ভর্তি করেছে, সে সকাল সকাল পাড়ার ছেলেদের সাথে সেখানে গেছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা জীপ গাড়ী ধুলো উড়িয়ে গুসকরার দিকে চলে গেল, আওয়াজে রাস্তার পাশের বাবলা গাছ থেকে দুটো শালিক উড়ে গেল। বৃষ্টি না হওয়ায় রাস্তায় এখনো পোষ মাসের মতো ধুলো উড়ছে। সনাতন সেই চলন্ত ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই এক হয়েছে, দেশ স্বাধীন হোল বছর দশেক হয়েছে কিন্তু চারিদিকে সব সাহেবদের মতো গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, ছেলে ছোকরাদের পরনে চোঙা প্যান্টালুন উঠছে ধুতি ছেড়ে। সে আপন মনে ভাবে ‘সত্যিই কিছু হবে? চারিদিকে এই যে এতো কথা শুনছে সেগুলো কি সত্যি?’ তার বয়স এক কুড়ি পনেরোর বেশী হোল কিন্তু এই কবছরে হঠাৎ সব কেমন বদলে যাচ্ছে কত কিছুই সে দেখছে আর কত কথাই সে শুনছে। পশ্চিমে দুগগাপুরের পাথুরে উঁচু জমিতে নাকি বড় বড় কারখানা হচ্ছে, কি জানি কি হবে।
দেশ স্বাধীন হোল, ১৩৫৪ সালের ৩১শে শ্রাবণ, তখন ওর বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে সাহেবরা চলে গেছে শুনে কি আনন্দ! গ্রামের মিহির,বিভূতি, মানিকদের সঙ্গে ও গিয়েছিল বর্ধমান পায়ে হেঁটে, সে কি আমোদ। বর্ধমানে করজন গেটের সামনে রানিগঞ্জ বাজারের বড় রাস্তায় সবাই হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়েছে, ওরা একটা চায়ের দোকানের কাছে ভিড় করে একটা যন্ত্র থেকে ভেসে আসা কথা শুনছে, কে বলেছিল ওটাকে রেডিও বলে। ভালো করে দেখতেও পায়নি যন্ত্রটা, শুনেছিল ওতে দিল্লী কলকাতা থেকে জহরলাল নেহেরুর কথা শোনা যায়। ওরা জানে না কি হবে, কিন্তু লালমুখো সাহেবদের তাড়িয়ে দেশ তাদের স্বাধীন হয়েছে, অকারণে ওরা সবাই হিহি করে হেসেছিল। ওর বাবা অবশ্য তখন বলেছিল দেশের লোক কি সাহেবদের মতো দেশ শাসন করতে পারবে? ও খুব রেগে বাবাকে বলেছিল ওরা ওদের দেশ শাসন করুক, এখানে ক্যানে।
বাবা মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। ওদের গাঁ সুয়াতা আর আশেপাশের ভাল্কি, অভিরামপুর, জামতারা সব গাঁয়ের অবস্থা একই আছে এখনো। বর্ষার বৃষ্টির উপর ভরসা করে আর কতো ভালো চাষ হয়? গাঁয়ের ২০ মাইল উত্তরে গেছে অজয় নদী আর আট মাইল দক্ষিণে দামোদর, তবুও ওদের গাঁয়ের এই অবস্থা। মাঝের এই জায়গাটা কাছিমের পিঠের মতো উঁচু, শক্ত কাঁকুরে জমির। গাঁয়ের পশ্চিমে মাইল দুয়েক গেলেই ডোমবান্দীর জঙ্গল শুরু হয়ে যায়, উত্তরে জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম ভাল্কি। পুকুরের জলও ফি বছর শুকিয়ে যায় দখিনের শীতলাতলার দিঘিটা ছাড়া। ঐ জলের উপর ভরসা করে পুরো গ্রাম চলে। তার উপর বছর বছর শীতে ধান পাকার সময় বিহারের থেকে হাতির দল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে এসে ধান নষ্ট করে। এই দু বছর ওদের আসা কমেছে বোধহয় দুগগাপুরের কারখানা তৈরির জন্য। এখন ওর ষোল বিঘে জমি, ওর বাবার জমি ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ হবার পর ও পেয়েছিল আট বিঘে মতো। সেখান থেকে ও নিজে দিন রাত মাঠে খেটে খেটে বাড়িয়েছে। তবুও জলের অভাবে চাষ ঠিক জুতের হয় না।
ওর শ্বশুরবাড়ি ভেদিয়ার কাছে, গ্রামের উত্তরে মাইল দুয়েকের মধ্যেই অজয় নদী। শ্বশুরের চাষ খুব ভালো, জমি বেশী নয় কিন্তু সারা বছর মাঠে চাষ হচ্ছে, তাইতো বিলাসী কথায় কথায় ওর বাপের বাড়ির চাষ, পুকুরের মাছের বড়াই করে। হবে নাইবা কেনো, ফি বছর নদীতে বান এলেও সালভর জলের অভাব নাই, একটা মাঠের পুকুরও খরায় শুকোয় না। কিন্তু ওর এতো খাটনির পরেও বছরে একটার বেশী চাষ দেওয়া মুশকিল। উত্তরের কলাপুকুর পাড়ের বিঘে তিনেক দো জমিতে ও যেটুকু সর্ষে চাষ করতে পারে, বর্ষার যা ছিরি তাতে মনে হচ্ছে এবছরও গেলো বছরের মতো আবার ধান মার খাবে।
তিন
দ্রিম দ্রিম দম দম করে কতকগুলো ঢাক আর দমকের আওয়াজ গ্ৰামের বাইরের জাহের থানের দিক থেকে ভেসে আসছে। পরবের ঢাক দমকের মতো এতে কোন তাল বা ছন্দ নাই, বিপদে লোক জড়ো করার আওয়াজ যেন। বেলা তিনটে হবে, গ্রামের লোকেরা আর মাঠে গরু চরানো কম বয়সী ছেলেছোকরার দল সেই আওয়াজ শুনে গ্রামের উঁচুতে জাহের থানের বড় বড় শাল আর মহুয়া গাছ লক্ষ করে চলতে লাগালো। মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে আরও আশপাশের জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে আসছে। বিষাণ খালি গায়ের উপর গামছাটা কাঁধে ফেলে ভূষণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি মাঠে পৌঁছে গেছে, দুজনের মুখে চিন্তার আর ভয়ের ছাপ? পাঁচ গ্রামের মাঝি এই ডাক দিয়েছে আর পাঁচ গ্রামের সব মরদ জড়ো হচ্ছে সেখানে। ঢাক আর দমকের আওয়াজে ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে জোয়ান বুড়ো জড়ো হতে লাগলো, মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই। অনেকেই বেলায় হাঁড়িয়া, মহুয়া খেয়েছে কিন্তু চিন্তায় যেন সেই মৌতাত জমেনি, ওরই মধ্যে দু একজন মহুয়া আর হাঁড়িয়া খেয়ে চূর, ঢাকের আওয়াজের তালে তালে দুলছে।
শালহুরা গাঁয়ের মাঝি কিনু হাসদার বয়েস হবে তিন কুড়ির মতো, সে উঠে দাঁড়িয়ে হাট তুলতেই ঢাক আর দমকের আওয়াজের সাথে সাথে ভিড়ের আওয়াজও কম হতে লাগলো। সবার চোখে মুখে গভীর উৎকন্ঠার ছাপ, শান্ত কিনু মাঝির কপালের ভাঁজে আর চোখে গভীর চিন্তার ছাপ। উঁচু পাথরের চাতালের উপর দাঁড়িয়ে সে ভিড়ের উদ্দেশে বলতে লাগলো, ঠাকুরদার বাপেরও আগের সময় থেকে আমরা এই গ্রামে পরিবার লিয়ে রইছি। সিং বোঙ্গা আমাদের আলো দিছে, বসুমাতা আমাদের দিছে ধান মকাই, দামোদর দিছে জল, রঙ্গো বোঙ্গার আশীর্বাদে জঙ্গলে আমরা বছর বছর শিকার করি। এই দামোদর নদে আমাদের পূর্বপুরুষদের সৎকার হইছে, এখানে তাদের আত্মা আছে। এই জাহের থান এর থেকে মারাং বুরু, গসাই এরা আর গাঁয়ের মাঝি থানের মাঝি হারাম বোঙ্গা, ভালো মন্দ সকল সময় আমাদের গ্রামকে, পরিবারকে রক্ষা করে চলেছে। ঐ মাঠে আমাদের বাপ ঠাকুরদারা আমাদের মতো ধান লাগানোর আগে এরকসিম পরব করেছে, তবে মাঠে এতো ধান, মকাই, মাড়ুয়া হয় যা খেয়ে আমাদের ছেলেরা আর তাদের ছেলেরা এখানে বড় হবে।
আজ কুতা থেকে ডিভিসি আর গোরমেন এসে আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলছে। আমাদের বউ, ব্যাটা, বিটি নিয়ে ঘর ছেড়ে, জমি ছেড়ে, জঙ্গল ছেড়ে, এই জাহের থান আর দামোদর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলছে। যদি আমরা না যাই তাহলে আমাদের সবার জমি ঘর বাড়ি নাকি বাঁধের জলে ডুইবে যাবে। খালি আমরা কুতায় যাবো উরা সেকথাটা বলছে লাই, বলছে ছেইড়ে দিতে, এসব ছেইড়ে আমরা যাবো কুতায়? কুতায় আমরা এমন দেশ পাবো যেখানে ব্যাটা বিটি লিয়ে এমন ভালো থাকবো? কুতায় আমাদের কাঁড়া, গাই আর ছাগল চরবে? কুতায় এমন সোনার জমি পাবো? বলতে বলতে কিনু মাঝির গলা ধরে এলো। আমার বাবা জঙ্গলে ঢাকা পঞ্চকোটের পাহাড়ের উপর থেকে দূরে নীচে দামোদরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলে ই দেশ মারাং বুরুর দেশ, ই দেশ বুরু বোঙ্গার দেশ, আমাদের দামোদরের দেশ, আজ সে সব ছেড়ে আমরা কেমন করে যাবো? গভীর যন্ত্রণায় তার গলার আওয়াজ তীক্ষ্ণ হয়ে এলো।
চারিদিকে সহসা গভীর নীরবতা নেমে এলো, সোঁ সোঁ করে জাহের থানের শাল মহুয়ার গাছ কাঁপিয়ে একটা দমকা বাতাস সেই নীরবতাকে ছেয়ে গেল। মনে হলো জাহের থানের বোঙ্গারা সব যেন সভার উপর উড়ে এল, হাঁড়িয়ায় চুর ঢাকের তালে দুলতে থাকা বিরেন মুরমুও চুপ করে কেমন থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। ক মাস ধরেই একথা আশে পাশের গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাঞ্চেতে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ক বছর আগেই, ডিভিসির লোকেরা এখন গ্রামে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের বোঝাচ্ছে যে তারা যদি গ্রাম ছেড়ে না যায় তাহলে বাঁধ হলে তাদের গ্রাম, বাড়ি, জমি বাঁধের জলে ডুবে যাবে। এরই মধ্যে খবর আসছে তাঁতলোই আর বাঁশঝোরের চাষের জমি ডুবছে।
বেলা পড়ার এই সময় অসংখ্য পাখীর আওয়াজে জাহের থান ভরে থাকে কিন্তু আজ মানুষদের মতো তারাও নীরব। হঠাৎ সেই নীরবতাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে গর্জে উঠল বিষাণের আওয়াজ ‘মোরা মরে গেলেও গাঁ ছারবক লাই, মোদের জমিন ছাড়বোক লাই। উরা আমাদের কি ভেবেছে কুথায় জল যাবে বুলে আমাদের জমি ছেড়ে যেতে হবে বটেক’। এরপর চারিদিক থেকে নানা রাগ, ভয়, অসহায় কথার আওয়াজ উঠতে লাগল। কেউ বলতে লাগল গোরমেন জকন বলছে তখন আমাদের ছাড়তে হবেক, তার দিকে রুখে এলো একজন, বুল্লেই ছাড়তে হবেক, ক্যানে ছাড়ব? যাবেটা কুতায় বটে’। উপরের ভাসমান বোঙ্গারা যেন দুলতে থাকল নীচের মানুষদের এই অসহায় দীর্ঘ নিশ্বাসের আওয়াজে।
চার
সুয়াতার ধম্মোরাজ তলায় বাবার থানের সামনের ফাঁকা মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সামনের বড় ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছেটার ছায়ায় একটা পুরনো হুডখোলা জীপ দাঁড়িয়ে, তার ওপর থেকে মাইকে কেউ চেঁচিয়ে চলেছে মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি, মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি,,,,,। সনাতন আওয়াজটা শুনে গায়ে ফতুয়াটা চড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখল শীতলা পাড়ার গোপাল হাজরা খালি গায়ে কাঁধে গামছা নিয়ে হেঁটে চলেছে ধম্মোতলার দিকে। সনাতনকে দেখে সে দাঁড়ালো, তারপর দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে সনাতন জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার বলো তো? সত্যি সত্যি গাঁয়ের পাশ দিয়ে খরার সময় জল যাবে? গোপাল বলল শুনছি রন্ডিয়ার সাত আট মাইল পিছনে দুগগাপুরে গোরমেন্ট নাকি দামোদরে বাঁধ দিচ্ছে। বাঁধের সেই জল নাকি দখিন মাঠে বড় খাল হবে তা দিয়ে বয়ে যাবে। সনাতন বলল শুনছি তো আমিও অনেকদিন ধরে, সত্যি করে তা হবে? দামোদরের জল এই উঁচু জমিতে আসবে? দিনু মাস্টার তো কবে থেকে বলছে দুগগাপুরে গরমেন নাকি বড় কারখানা বানাচ্ছে। সে গেল রাবিবার সাইকেল নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে দেখে এয়েচে দামোদরের উপর বিরাট বাঁধের কাজ চলছে। তার চোখে মুখে অবিশ্বাস মাখানো আশার আলো জ্বল জ্বল করে। গোপাল বলল সাহেব গুলো গেছে এখন দেশের লোকের সরকার, ঠিক হবে দেখে নিও। জহরলাল যে সে লোক লয় সাহেবদের তারিয়েছে দেখবে ঠিক নিয়ে আসবে জল। সনাতন মনে মনে বলে ঠাকুর তাই যেন হয়, ধম্মোরাজ তোমার কাছে জোড়া পাঁঠা মানত রইল।
বেলা এগারোটা হবে কথা বলতে বলতে দুজনায় ধম্মোরাজ তলায় এসে দেখে মাঠে অনেক লোক এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সবারই মুখে খুশীর ছাপ, কোন ভালো খবরের আশায়। জীপে সদর থেকে আসা কজন সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা আর গান্ধী টুপি পড়ে মাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে আরো লোক জমার জন্য। আধঘন্টা পর আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক এসে ভিড় বেশ বড় হলে ওদের মধ্যে একজন বয়স্ক গান্ধীটুপি, বলা শুরু করলো, 'আপনারা সকল গ্ৰামবাসী, কৃষকবন্ধুরা জানেন যে বাংলার দুঃখ দামোদর নদ। বর্ষায় বছর বছর দামোদরের বন্যায় বর্ধমানের মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না, বর্ধমান শহর পর্যন্ত জলে ডুবে যায়। আমাদের স্বাধীন দেশের সরকার সেই ভয়াবহ বন্যাকে আটকানোর ব্যবস্থা করছে যাতে সেই জল চাষের কাজে ব্যবহার করা যায়। এর ফলে বাংলার চাষিভাইরা সারা বছর মাঠে সোনা ফলাতে পারবে।
বাঁধের এই জল থেকে বিদ্যুৎও তৈরি হবে যা দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে রাতে আলো জ্বলবে। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার দামদেরের জলের সুষম বন্টন ও ব্যবহারের কথা ভেবে ডিভিসি তৈরি করেছে। তারা দামোদরের বর্ষার জল আটকাবে যাতে বছর বছর বর্ধমান, বাঁকুড়া হুগলী হাওড়ায় বানভাসি না হয়। সেই জলকে ধরে রাখার জন্য সরকার বিহারের মালভূমিতে বাঁধ তৈরি করছে, দুর্গাপুরেও বাঁধ হচ্ছে। সেই জল খরার সময় ক্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে আপনাদের মাঠে।
একটু থেমে গান্ধীটুপি বলে চলে ‘ডিভিসির লোকেরা আসবে আপনাদের গ্রামে ক্যানেল তৈরির জন্য, তার জন্য দরকার হবে জমির, না হলে মাঠে জল যাবে না। আপনাদের মতো চাষী ভাইদের সহযোগিতা ছাড়া এই বিশাল কাজ সম্ভব নয়, আপনারা অবশ্য সেই জমির জন্য পয়সা পাবেন সরকারের থেকে। কি আপনারা সকলেই সহযোগিতা করবেন তো?' সবার আগে সনাতন হাত তুলল তার যে অনেক জমি দখিন মাঠে, যেখানে গেলবার ফুলুনোর আগে ধানগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে গেল। ওর কিছু জমি ছেড়ে দিতে দুঃখ নেই, তাহলে ওর সব জমিতে গেলোবারের মত ধান আর মরবে না। গাঁয়ের সবাই জানে এ মাঠে জলের কত দরকার আর এও জানে সনাতন বুদ্ধিমান গা গতরে খাটিয়ে চাষী, ওর দেখাদেখি অনেকেই হাত তুলল, চারিদিকে খুশির হাওয়া। সত্যি ওদের এই কাঁকুরে জমিতে জল আসবে! চারিদিকে নানা আলোচনা শুরু হয়ে গেল এই উঁচু এলাকায় জল আসবে বলে। কেবল পেছন থেকে দিনু বাউরি বলে উঠলো, 'কতটা জমি দিতে হবে? আমার তো বেশি জমি লাই'। ভিড়ের আওয়াজে তার কথাটা চাপা পড়ে গেল। সাদা গান্ধী টুপি পরা লোকটা হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার করে গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল গোঁ গোঁ আওয়াজ করে তারপর ধুলো উড়িয়ে চলে গেল পাশের গাঁয়ের দিকে। সনাতন খুশী আটকাতে না পেরে গোপালকে একমুখ হেসে বলল কাল দিনু মাষ্টারকে বলে মানকর থেকে আড়াই কেজি কদমা আনাবো বুঝলি।
পাঁচ
সারাদিন ভানু তার ভালোবাসার পুতুলটা বগলে নিয়ে সোনামণির পিছনে ঘুরে বেড়াতো আজ দুজনে দু জায়গায়। মেয়েটার লাল নীল কাপড়ের পুতুলটা মকাই ক্ষতের মাঝে আটকে আছে আধ ডোবা একটা মকাই গাছের পাতায় আর জলে দুলে দুলে ভাসছে। জলে ফুলে বেঢপ চেহারা হয়েছে, পুঁতির কালো চোখ একটা নাই। মেয়েটার জন্য পুতুলটা বিষাণ বছর তিনেক আগে মালঞ্চর মেলা থেকে কিনে এনেছিল। পুতুলটার পিছনে মকাই খেত পেরিয়ে ডুবে যাওয়া ধান খেতে একটা খালি মাটির সরা আর কটা শাল পাতার সঙ্গে গৃহস্থালির ছোটখাটো জিনিষ লাইন দিয়ে ভেসে ভেসে চলেছে। ভালবেসে বসানো ঘরে কত ছোটখাটো জিনিসই লাগে, ঘর ছাড়ার সময় তারই বোঝা, তাদের আর কোন মূল্য নেই। কদিন আগে এসব জিনিষের মতোই এদের ভালোবাসার মানুষজনের একটা দুটো পরিবার মাথায় বাক্স পুঁটুলি নিয়ে ভেসে গেছে কোন অজানায়।
কেউ গেছে ঝরিয়া, রানিগঞ্জ আসানসোলের কয়লা খাদানে, কেউ গেছে সিন্ধ্রি, চিত্তরঞ্জন দুরগাপুরের মাটি কাটার কাজে আবার কেউ কেউ পাঞ্চেত মাইথনে বাঁধের কাজে পাথর ভাঙ্গার কাজ খুঁজছে। চাষ গেছে, বাড়ি গেছে, গ্রাম গেছে কিন্তু পেট আছে, পরিবার আছে আর আছে অকারণ বাঁচার অদম্য ইচ্ছা। বিষাণ গ্রাম ছেড়েছিল সবার শেষে, সে বিশ্বাস করতে পারেনি এমনি করে তার সাজানো সংসার দামোদরে ডুবে যাবে। জলের মধ্যে বিষাণের বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেওয়াল এখনো ভেঙ্গে পড়ে নাই, কেবল বাড়ির ভিতর বুক সমান জলে খেজুরের ছেঁড়া চাটাই, ভাঙ্গা এলুমিনিয়ামের বাটি, কিছু সুতলি দড়ি, কিছু বাবুই ঘাসের ঝাঁটার সঙ্গে ওদের হাসি কান্নার স্মৃতি এদিক ওদিক ভাসছে। সামনের রাস্তা পেরিয়ে ওপারের বাড়ির দাওয়ায় জল উঠেছে। জাহের থানে যেতে এখনো দেরি। বিষাণের বাড়ির থেকে একটু নীচে মকাই ক্ষেতের পাশে বিরেন মুরমু বাড়ির মাটির দেওয়াল ভেঙ্গে খ্যাপলার চালটা জলের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।
এখনো বাড়ির পিছনের মকাই গাছ কটার সবুজ পাতা জলের উপর জেগে আছে, পাশে রাম ফলের গাছের মাথা জলের উপর জেগে। তারও পিছনে কেবল জল আর জল, অনেক দূরে দামোদরের পাড়ের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের কটা শুকনো ডাল এখনো বেড়িয়ে আছে। কতো বন্যা হয়েছে কিন্তু এ গাছ এই গ্রামের মতোই কখনো মরে নাই, আজ সেই জীবন্ত অশ্বত্থের জলসমাধি হয়েছে গ্রামের সঙ্গে। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তাদের ভালোবাসার দামোদর আগে কখনো এমন করেনি, বন্যা নেই বর্ষা নেই, জল বাড়তে লাগল চুপে চুপে, নীরবে, নিঃশব্দে, প্রথমে নদীর পাড়ের জমি তারপর জল ঢুকতে লাগল গাঁয়ের বাড়িতে। এ কোন দামোদর? এ তার কেমন ব্যবহার? সে চিরকাল কুলুকুলু করে বয়েছে আর কখনো কখনো বর্ষায় প্রবল গর্জনে দুপাড় ভাসিয়ে দিয়ে গেছে, তাতেই গ্রামের লোকেরা অভ্যস্ত। আজ সহসা সে নিঃশব্দে নীরবে গ্রামের পর গ্রামকে ডুবিয়ে, কত মানুষের কত দিনের সঞ্চিত সম্পদ, ভালোবাসার ধন, সম্পর্ক আর স্মৃতি চুরি করে তার বিশাল জলরাশি নিয়ে শক্তিমান নির্দয় তস্করের মতো তৃপ্ত হয়ে শুয়ে আছে। তার জলের উপর দিয়ে বিষাণের দীর্ঘশ্বাসের মতো হাওয়া বইছে, মাঝে মাঝে ঘর ছাড়ার আগে সোনামণির মুখচেপে কান্নার মতো গোঁ গোঁ আওয়াজ, দামোদরের আটকে পড়া জল কাঁপছে।
চারিদিকে যখন কোন আশা নাই তখন একদিন কে যেন পড়ন্ত বেলায় হেঁকে হেঁকে বলে গেল তেলকুপির মন্দির ডুবছে। একটা একটা করে গ্রাম, জমি, রাস্তা ডুবে গেল, তেলকুপির এতো বড় উঁচু কত বছরের পুরানো মন্দিরটাও জলের তলায় চলে গেল। যতদূর চোখ যায় জল আর জল সব ধান ভর্তি মাঠ জলের তলায়। গ্রামটাকে বাঁচানোর জন্য বিষাণের মতো গাঁয়ের মরদরা দৌড়াদৌড়ি করেছে কদিন।সবাই মিলে পাঞ্চেতের ডিভিসির অফিস গিয়েছিল, বাবুটা বলেছিল কিছু করার লাই, গরমেনট যখন বলেছে বাঁধ তখন হবেই। যার চোখে কেউ কখনো জল দেখে লাই সেই বুড়ো কিনু মাঝি কেঁদে ফেলেছিল বললে আমাদের যে সব চলে যাবে গো, কুথায় যাবো আমরা ব্যাটা বিটি পরিবার লিয়ে, আমরা খাবো কি? ডিভিসির বাবু বুললে ইখানে তো কত কাজ হছে বাঁধ তৈরি হচ্ছে, কারখানা তৈরি হচ্ছে, এস কাজ কর। বিষাণ কাতর হয়ে বলে, আমরা কাজ চাইনি গো, আমরা তো তোমাদের কাছে কিছুই চাই নাই, গাঁ ডুবে গেলে আমরা থাকবো কুথায়? । নীরবে সেই প্রশ্ন ডিভিসির বাবুর অফিসে ঝুলে থাকে।
ছয়
বাবলা গাছটার হলুদ ফুল আর পাতা সকালের হালকা হাওয়ায় জিরি ঝিরি করে কাঁপছে। তার পাশে সনাতন চুপ করে দাঁড়াল। মাঠের উঁচু আলের পাশের খাল দিয়ে কুলকুল করে জল বয়ে যাচ্ছে। সকালের সূর্যের আলোয় রুপোর মতো চকচকে জলের দিকে সে তাকিয়ে থাকল। দুরে মাঠে মাঠে লোক কাজ করছে , জল আসায় সব চাষিরা ব্যাস্ত, কেউ জমির আল ঠিক করছে, কেউ নিড়েন করছে, কেউ দেখছে পোকা লেগেছে কিনা। সনাতনের বুকে একটা হালকা নরম সুখ ছড়িয়ে পড়ছে, একটা হালকা আরাম। ওর মাঠ ভরে আছে সবুজ গর্ভবতী ধানে, সব ফুলুনোর অপেক্ষায়। এবার ধানগাছগুলো খুব পুরুষ্টু হয়েছে, অনেকগুলো করে পাশকাঠি ছেড়েছে, এই সময় চারিদিকের সবুজ মাঠ আশ্বিনের রোদে ঝলমল করছে, তদের মধ্যে দিয়ে হালকা হাওয়া বিলি কেটে যাচ্ছে। ও মুখতুলে দেখতে লাগল দুরে উঁচু বড় সরকারী ক্যনেলের পাড়, যেন পেটমোটা অজগর সাপ, মাঠের মধ্যে দিয়ে কতদুর চলে গেছে। শুরু হয়েছে সেই দুগগাপুরের বাঁধে আর ওদের গ্রাম ছাড়িয়ে গলসী, খানা পেরিয়ে কত দূর গেছে কে জানে।
যেদিন প্রথম এই ক্যানেলে জল এলো গ্রামে কি আনন্দ! মাঠ ভর্তি গ্রামের লোক দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে ছোকরাগুলো ক্যানেলের পাড়ে দৌড়াদৌড়ী করছে। ও চুপ করে দারিয়েছিল, বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছিল আর ভাবছিল এবার আর কেউ ওকে আটকাতে পারবে না ও দেখাবে চাষ কাকে বলে, কবে থেকে ও ভাবছে সময়ে জলটা পাই তারপর দেখবো। আজ ওর সেই স্বপ্ন সফল হোল। ওর মা বলত তুই চাষ চাষ করেই ক্ষেপে যাবি, ও হাসতে হাসতে বলত আমি চাষার ব্যাটা মাঠে কাদায় না দাঁড়ালে আমার ভাত হজম হয় না।
ভাবছিল উত্তরের কলাবাগানের মাঠের আউস ধানটাও দেখে আসবে, ঐ ধান কাটা হলেই এবার কেবল সর্ষে দেবে না একটু বড় করে আলুর চাষ করবে। কলাবাগানের পুকুর পাড়ে সাঁওতাল মুনিষদের থাকার একটা পুরানো ঘর আছে, ক বছর ঘরটা ব্যবহার হয়নি এবার সারাতে হবে। গাঁয়ের বড় রাস্তায় ওঠার আগে দেখল রাস্তা দিয়ে ভাল্কির বিমল সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল, সে সনাতনকে দেখে দাঁড়াল বলল কি কাকা এখনো মাঠে? এবারে ধান কেমন? সনাতন এক মুখে হেসে বলল খেজুরছড়িটা খুব ভাল হয়েছে, কলমকাঠী লঘুটা মনে হচ্ছে একটু কম হয়ে যাবে। তারপর জিজ্ঞাসা করল কোথায় গেছিলি? সে বলল গলসী গেছিলুম মায়ের ওষুধ আনতে গো।বিমল সাইকেলে উঠতে উঠতে একমুখ হেসে বললে যবে থেকে জল এলো তোমার ধানের মরাইয়ের তো আদ গাদ নাই গো কাকা। সনাতন হেসে বলে তোদেরই বা কম কি? যাই বল কাকা এ তল্লাটে তোমার মতো চাষি কেউ নেই, এবারে কাকা তোমায় ছাড়বো না বর্ধমানের মিহিদানা কাওয়াতে হবে। সনাতন মুচকি হেসে কাঁধে গামছটা চেপে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করল, ভাবল খেয়ে দেয়ে বেলা পড়লে কলাবাগান যাবে, রোজ রোজ দেরি হচ্ছে, স্বপনের মা না খেয়ে বসে থাকে।
ও পুকুর থেকে চান করে ফিরলে দাওয়ায় ওকে ভাত দিতে দিতে বিলাসী বলবে মাঠে তো এখন কাজ নাই কি কর বল দেখি? ছেলেটা তো সকালে আল বেঁধে, জল দেখে এলো। তারপর ওর খাওয়া হলে থালা তুলে নিজে বসে। সনাতন তখন আপন মনে হুঁকো টানে, আর খানিকক্ষণ পর ওর মন ছটফট করে মাঠে যাবার জন্য। কিন্তু এখুনি উঠলেই বউটা বলবে ঘরে তোমার মন টেকেনা। মনে পড়লো বিলাসী অনেকদিন ধরেই গয়না নিয়ে খোঁটা দেয়, বলে ‘আমার সব গয়নাই তো বিয়েতে বাবা দিল, তার থেকে সে বছর দু গাছা চুড়ি বন্ধক দিয়ে সে বছর চাষ করলে’। ভাবছিল এবারের পোষ মাসের ধান কাটা হলেই চুড়িগুলো ছাড়িয়ে আনবে আর সামনের বছর বিলাসীর হাতের দুটো বাউটি গড়িয়ে দেবে, মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে। উপরের চালে বাসা বাঁধা নন্দর পোষা পায়রাগুলো এক এক করে বাসায় ফিরছে ।
সাত
পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় উঠোনটা ভাসছে, বারন্দার হ্যারিকেনটা নিবিয়ে বিলাসী রান্নাঘর গোছাতে গেল। সনাতন আরাম করে দাওয়ায় হুঁকো টেনে ঘরে শুতে গেছে খানিকক্ষণ আগে। আজ সে গলসী গিয়েছিল, ছেলে মেয়েগুলোর জন্য ষ্টেশনের নিতাই ময়রার দোকান থেকে মণ্ডা আর রসগোল্লা কিনে এনেছে। এখন সে গলসী গেলে আর তার বাবার মতো ফতুয়া পরে যায় না ধুতির সঙ্গে শার্ট পড়ে। রোজকার মতো বড় ঘরটায় স্বপন আর নন্দ বড় তক্তায় শুয়েছে, কুমুদ ওদের ঘরের খাটে সনাতনের পাশে ঘুমে কাদা। একটু আগে ছেলে মেয়ে দুটো মিষ্টি নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো, বিলাসী কুমুদকে দু ঘা দিতে সনাতন বললে ‘আহা মারছো কেনো, একটা মিষ্টি দাওই না’। বিলাসী রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে গজগজ করছিল লোকটা মেয়েটাকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছে, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সংসার করতে হবে না? কে দেখবে তখন শুনি, মেয়েছেলে একটু মানিয়ে চলবে তা না বাপের আদরে মাথায় উঠছে।
সনাতন ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বছর দুই আগে মানকর থেকে বাড়ি ফেরার কথা। সেবার পোষ মাসের ধান ঝাড়ার পরই ও বিলাসীকে মনোরঞ্জনের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল আর বিলাসীর মনোমত নকশার আড়াই ভরি সোনার বাউটি গড়ানোর আগাম দিয়ে এসেছিল। সেদিন মনোরঞ্জন স্যকরার দোকান থেকে বিলাসীর বাউটিদুটো নিয়ে সে রেল গাড়িতে বাড়ি ফিরছিল। ভাবছিল বউটার হাতে মানাবে, বাউটি দুগাছ ধুতির কোমরের কোঁচায় বাঁধা ছিল। এমন সময় তার চোখে পড়ে রেলের কামরার দরজার কাছে বসা এক বুড়ো সাঁওতাল আর কামিন। শুকনো কালো পাকা সর্ষে ফলের মতো বিষাণ কামরার দরজার কাছের মেঝেয় দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে, খালি গা পরনে হলদে হয়ে আসা একটা ধুতি। তার গায়ে গা লাগিয়ে দুই হাটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসেছিল সোনামানি, পরনে একটা ছেঁড়া ময়লা সবুজ সাড়ি। দেখলে বোঝা যায় দুজনেই অনেকদিন খায়নি, সনাতনের মায়া হয়েছিল। ও ভেবেছিল সাঁওতালগুলোর এই এক দোষ খালি মদ খায়, না হলে ওদের মতো কাজের কে আছে? মাঠের কাজে ওদের তুলনা হয় না। উঠে গিয়ে ও মাঝিটাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো কোথায় যাবে? সে কোন সারা দেয় নাই কেবল ওর মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, চোখে না কোন ভয়, না কোন রাগ কেবল সীমাহীন শূন্যতা, সনাতন বেশিক্ষন সেই চোখের দিকে তাকাতে পারেনি। ও জিজ্ঞাসা করে কাজ করবে কিনা? কিছু বলে নাই কেবল ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে ছিল। সনাতনের সঙ্গে সেদিন ওরাও নেমেছিল গলসী স্টেশনে।
সে ওদের দুজনকে ওদের কলাবাগানের মুনিষদের থাকার যে ছোট ভাঙ্গা ঘর ছিল সেই ঘরে থাকতে দিয়েছিল। বিষাণ সেটা কোন রকমে সারিয়ে থাকার মত করেছিল। এখন ওরা সনাতনের চাষ দেখে, সারা দিন পরিশ্রম করে দুজনে, কোন কিছু চায় না। কিন্তু সূর্য ডুবলেই বুড়ো বুড়ি প্রচুর হাঁড়িয়া খেয়ে চুপ করে বসে থাকে কলাবাগানের ঘরের সামনে। কতবার সনাতন আর বিলাসী জিজ্ঞাসা করেছে ওদের বাড়ির কথা ছেলে মেয়ের কথা কিন্তু দুজনে নীরবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে। সনাতন ভাবে আদিবাসীরা এমনিতেই কম কথা বলে।
মাঠের মাঝে সাদা জ্যোৎস্নার চাদরে মোড়া কলা বাগানে ঘরের বাইরে একা বসে আছে বিষাণ। কে জানে রাত কত হবে। ভাবছিল সর্ষেগুলো এবার কাটার সময় হয়ে গেছে, মাথার মধ্যে ভেসে এলো মাঠ ভরা হলুদ সর্ষে ফুল আর সবুজ গাছ, হঠাৎ সেগুলো হয়ে গেল শুধু শুকনো শুকনো কাঠি তাতে লম্বা লম্বা শুকনো কালো ফলের মধ্যে সর্ষের দানা। ও দেখতে পাচ্ছিল গাছ কেটে মাড়িয়ে সর্ষে বার করে নিয়ে যাচ্ছে, ছিবড়ে গাছগুলো জ্বালানী হয়ে জ্বলছে।
চোখে ঘুম আসে না ও ঝিমোয়, শিমুলগাছটাকে দূর থেকে এক প্রেতের মতো লাগে। মাঠের দমকা হাওয়ায় তার ডালগুলো দুলছে দেখে সে দিকে তাকিয়ে বিষাণ দেখে সোনামণি আকাশের দিকে হাত তুলে বুক চাপড়ে কাঁদছে। সে কতদিন আগের কথা, দিন কাল সব হারিয়ে যায়, এখন ঘরের মেঝেয় কাঁথার উপর হাঁড়িয়া খেয়ে সোনামণি গুটিয়ে শুয়ে আছে, সেই লম্বা চওড়া সাঁওতাল মেয়েটা এইটকুন হোয়ে গেলো। বিষাণ প্রতিদিন অনেক অনেক হাঁড়িয়া খায় কিন্তু নেশা ওর হয় না। ও ঝিমোয় আর দেখে মাইথনে ওরা পাথর ভাঙ্গছে সার বেঁধে, ঘর বলতে একটা ছিটেবেড়ার ঝুপড়ি, তাতে পাঁচটা লোক হয় না, তবু সব এক সঙ্গে ছিল। চারিদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো, সারাদিন পাথর ভাঙ্গা, সোনামণির অমন সুন্দর হাতে বড় বড় ফোস্কা পড়েছিল। একদিন ওরা পাথর ভেঙ্গে ঘরে ফিরে দেখে সব টাকাপয়সা সোনামণির গয়না যা গ্রাম থেকে এনেছিল কারা সব নিয়ে চলে গেছে। ওরা কখনো গাঁয়ে চুরির কথা শোনে নাই। ও এদিক ওদিক দৌড়েছিল, গলা ছেড়ে সোনামণি কেঁদেছিল ও কি করবে তাই বুঝতে পারেনি। চারটে ছেলেমেয়ে ঘরের মেঝেয় ভয়ে চুপ করে বসে ছিল।
সারাদিনে সবাই যা টাকা পেতো কোন রকমে ভাত ডাল খেয়ে পেট ভরত না। না খেয়ে খেয়ে ছেলেগুলো রোগা হয়ে গেল। অভাবের ঘরে রোগের অভাব হয় না তিন দিনের তড়কা জ্বরে কোলের মেয়ে ভানু চলে গেল, যাবার আগে মেয়েটা চারিদিকে ওর সেই পুতুলটা খুজছিল। সোনামণি কাঠের মতো মরা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো। চোখে জল নাই কেবল আগুন বেরচ্ছিল, আশেপাশের ঝুপড়ীর লোকে বলেছিল ডাক্তার ডাকতে, ডিভিসির হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বিষাণ হাঁ করে শুনেছিল ডাক্তার কি হাসপাতাল কি সে জানে নাই কখনো, ওর চোখে দামোদরের থেকেও বেশি জল ছিল সেদিন।
একদিন জোলোকে ঠিকাদারের লোক কাজের লোভ দেখিয়ে কুথায় নিয়ে গেল, ও আর মনেও করতে পাড়ে না, বলেছিল তিন মাস পরে অনেক টাকা নিয়ে আসবে। সোনামণি কেঁদেছিল ছাড়তে চায় নাই, সেই যে গেল আর ফিরে এল না। হুহু করে হওয়া দিচ্ছে শিমুল গাছটা দুলছে দানার মতো। বুধুটা বসতির বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নেশা ধরলে তারপর একদিন কোথায় চলে গেল। পাগলের মতো দুজনে বুধুকে খুঁজেছিল, শুনেছিল ও ঝরিয়ার কয়লা খাদানে গেছে। যেটুকু টাকা ছিল আর লোকের হাতে পায়ে ধরে ঝরিয়া পৌঁছায়। সেখানে মাটির নীচে আগুন জ্বলছে দিনরাত, তারি মাঝে কালো কালো কয়লার ধুলো মাখা ছেলে বুড়ো দিনরাত কয়লা তুলছে, চুরি করছে। দুজনে অনেক খুঁজেছিল কিন্তু বুধুকে আর পেল না, কে বলেছিল ঐ নীচের আগুন যার খিদে মেটা না সে নাকি বুধুকে খেয়ে নিয়েছে।
সোনামণি ছোট ছেলেটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখত। খালি ভয় ছিল এটাও না চলে যায়। এক বছর ঝরিয়ায় কয়লার খাদানে দুজনে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু এই কয়লার ধুলোয়, উপোষে আর দেশী মদে ওরা দুজনে শেষ হয়ে আসছিল। আর এরই মধ্যে একদিন ভেদ বমি করতে করতে জগদীশও হেঁচকি তুলে চুপ হোয়ে গেল। সেদিন এই শিমুল গাছটার মতো আকাশ হাত তুলে বুক চাপড়ে সোনামনি কেদেছিল।
শক্ত হয়ে বিষাণ বসে আছে কলাবাগানে ওর ঘরের সামনে। চারিদিকের চাঁদের আলোয় মাঠ ভাসছে, শিমুল গাছটা দুহাত তুলে মারাং বুরুর কাছে বিচার চাইছে আর পিছনে ঝাঁকাল আমগাছের ছায়াটা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে, দুই একটা জোনাকির আলো জ্বলে উঠল অন্ধকারে নাকি বিষাণের চোখ।
(পাঞ্চেত বাঁধ ১৯৫৯ সালে তৈরি হয়, সেই বাঁধের জলে ১০০ গ্রামের ৭৩৬৫০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবার বিষাণের পরিবারের মতো হারিয়ে যায়। ডিভিসির কর্মকর্তারা জানান যে ১৯৫০এর দশকে ৪৮৬২ জনকে ডিভিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। এর পর ১৯৭৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আরো ১০২ জনকে চাকরি দেওয়া হয়। ডিভিসির কর্মকর্তারা এও জানান যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকেরা সঠিক কাগজ দেখায় তাহলে তাদের চাকরির কথা বিবেচনা করা হবে। সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচার্য ২০০৯ সাল পর্যন্ত বারবার পাঞ্চেতের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেবার কথা সংসদে তোলেন)
(সূত্রঃ
১)https://ejatlas.org/conflict/panchet-dam-and-the-damodar-valley-project-jharkhand-india,
২)https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/panchet-dam-land-protest-after-56/articleshow/5110960.cms)
(অভিজিত পাল বিজ্ঞান ও সমাজকর্মী। নিবাস উত্তর চব্বিশ পরগণার হালিশহরে। করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’য়ের সময়ে পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশন এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে লোকাল ট্রেনে হকারদের ওঠা নিষিদ্ধ করে । তারই প্রতিবাদে অভিজিত সাইকেলে বাঁকুড়া যাওয়া মনস্থির করেন। তাঁর সেই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা তিনি ফেসবুকে লিখতে থাকেন। আমরা সেই ধারাবাহিক লেখাগুলি এখানে একত্রে সংকলিত করা হ’ল। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়া। শুধু বানান ব্যবহারে কিছু সাযুজ্য আনা হয়েছে।)
কথারম্ভ
আমাকে যারা ভীষণ ভালোবাসেন তারা কষ্ট পাবেন কিম্বা খুব রেগে যাবেন। তাই যারা ভালোবাসার সঙ্গে প্রশ্রয় দেন,তাদের জন্যই লেখা।
এত দূরে কেউ বাড়ি করে? না হলে বিকাশ এর বাড়ি পৌঁছাতে দু'দিন লেগে গেল! গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে বৃষ্টি মাথায় করে দুর্গাপুরে শোভনদার বাড়িই পোঁছোলাম রাত সাড়ে ন'টা। আর আজ সকাল দশটায় বেড়িয়ে বিকাশ এর বাড়ি পোঁছোলাম রাত দশটা। মানছি প্যাডেল সাইকেল করে যেতে ত সময় লাগবেই। যার জন্য যাওয়া চারপাশের প্রকৃতি পরিবেশের টানে ত মাঝে মধ্যে থামতেই হবে!
আর হ্যাঁ, বাড়িতে বললে আমার ইচ্ছে-পূরণ হতো না। তাই সাইকেলে যাবার কথা বলিনি। কিছুক্ষণ বাদেই বলে দিয়েছি, তোমাদের কথাই মেনে নিলাম! সাইকেলে করে বাঁকুড়া যাচ্ছি। মা খুব রেগে গেছেন। স্বাভাবিক। মায়ের জায়গায় আমি হলেও রাগ করতাম, কথা বলতাম না।
ভাবছেন মাথার স্ক্রু ঢিলা না হলে কেউ খামোকা এত কষ্ট করে। আমার সঙ্গে ছিলেন হকার ভাইরা।যাদের হাওড়া ডিভিশনে ট্রেনে হকারি বন্ধ করা হয়েছে। গতবছর ২৪শে মার্চ করোনা লকডাউন এর সময় থেকে ট্রেন প্লাটফর্ম এ হকারি বন্ধ মানে রোজগার বন্ধ। খড়-কুটো আঁকড়ে বাঁচবার মরিয়া চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে হাওড়া ডিভিশনে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল ট্রেনে হকারেরা উঠতে পারবেন না। তাই যতদিন হকারেরা ট্রেনে উঠতে পারবেন না আমিও হাওড়া ডিভিশনে ট্রেন চড়বো না। এভাবে তাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের সঙ্গে আমার সংহতি জানালাম।
হাসছেন... এভাবে কিসসু হয়!
ঈশ্বর গুপ্ত ব্রিজ পার করে জি.টি. রোড ধরে বর্ধমান... চলার পথে যা
কুড়িয়েছি তা খুবই সামান্য। সময় তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। গতকাল দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতালের সুপার ডাঃ শোভন পান্ডা দার কোয়ার্টার এ হাসপাতালের কর্মী সৌরভ আমার হাতে ফুলের তোড়া আর স্মারক উপহার দিলেন। বলা বাহুল্য এ ধরনের উপহার পেয়ে স্বভাবতই মনে পুলক জেগেছে। এই পর্বে যা সঞ্চয় করেছি তা সুযোগ বুঝে জানানোর ইচ্ছে আছে।
১
"ঘরের থেকে বাইরে গেলে
জগত আমার ঘরবাড়ি... "
রুংকু দিদিরে কথা দিয়েছি, 'তাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে দাদুর বাড়ি দিয়ে আসবো'।
আমার মধ্যে ক্ষ্যাপা মানুষটারে কথা দিয়েছি। তোকে সাইকেলে চাপিয়ে বাঁকুড়া ঘুরিয়ে আনবো। হ্যাঁ,'দামু' আমার উপর ভর করেছিল। বাড়িতে বলে বেরোতে পারতাম না? নিজেকে বোঝাতেই কালঘাম ছুটে গেছে! সে কথা আর কারে কই? আর অন্যদের বুঝিয়ে বেরোনো অসম্ভব।
তাই, একরকম প্রস্তুতি ছাড়াই বেড়িয়ে পড়লাম। সমস্যাকে ঝামেলা হিসেবে না দেখে মুখোমুখি হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজে চলা।
আপাত মনে হতে পারে একা চলেছি। আসলে একলা মানুষের দৌড় কতটুকু! মনের মধ্যে ক্ষ্যাপা মানুষটারে টানতে টানতে নিয়ে গেছি। কি টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে পথচলা! আর সাইকেল যার আপাতদৃষ্টিতে কোন প্রাণ নেই মনে হতে পারে! সাইকেল আমার সারথি, তাকে ছাড়া এ দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া একপ্রকার অসম্ভব। চাকা আবিস্কার করেছিলেন যে মানুষটি, সেই চাকাকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার উত্তরাধিকার আজ আমাদের করায়ত্ত।
পায়ে হেঁটে পথ চলার সুখস্বপ্ন লালন করলেও সে মাহেন্দ্রক্ষণ এখনো অনেক দূরে। তার আগে বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই ছাড়পত্র মিলবে। কিছুদিন আগেই হাওড়া ডিভিশনে হকারদের ট্রেনে উঠতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আমি ত ঘুরতে যাচ্ছি। আর হকার ভাইরা ত এ বিলাসিতা নিয়ে ট্রেনে চড়েন না। তাদের প্রতিদিনের দিনযাপনের সঙ্গে যার গাঁটছড়া বাধা।
"তুমি যখন বোমার মতো ফেটে পড়লে প্রকান্ড রাজপথে তোমাকে দেখছিলাম।" তোমাদের লড়াইয়ে আমাকেও সাথী করো বন্ধু। তাই, 'কঠিনেরে ভালোবাসিলাম'। আমার পথশ্রমে, ঘামে, ক্লান্তিতে তোমরাও রইলে সাথী হয়ে..
আমার ছোট ছেলের ইচ্ছে ছিল,'বাবা, তোমার সঙ্গে যাবো।' নিয়ে যাবার সাহস হয়নি কিন্তু ওরই বয়সী ১২ বছরের শ্রমিক জামলো মকদমকে সঙ্গে নিলাম। তেলেঙ্গানা থেকে ছত্তিসগড় এর বিজাপুরে হেঁটে বাড়ি ফেরার হিম্মত ওর আছে। তবে জামলো হাঁটবে আর আমি ড্যাংডেঙিয়ে সাইকেলে যাবো তা কি করে হয়! তাই গামছা দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলাম। ও দুটি হাত আর দুটি পা দিয়ে আমায় জড়িয়ে নিল। এবার আমায় পায় কে!
ঋণ- করোনা অতিমারি ও এই সময়।
রাজা সেন এর চলচ্চিত্র 'দামু'
'চেনা আধুলি' নাট্যসংস্থার নাটক'জামলো মকদম'
https://www.facebook.com/100005835725229/posts/1629791497225359/
২
এই শরীরটা কার?
কার আবার, আমার।
কার? কার? কার?
বাবার এই ধরনের কথোপকথনের বহুবার সাক্ষী বলে জানি উত্তরদাতা কিছুতেই এই কথার উত্তর দিতে পারবেন না। প্রশ্নকর্তার উপর্যুপরি প্রশ্নবানে উত্তরদাতা রীতিমতো ঘাবড়ে যান।
এবার ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন তার শরীরের মালিক তিনি নন। মা যেমন বলেন, তোর খিদে পেয়েছে, চাড্ডি খেয়ে নে। আমার বড় ছেলে বেড়ালটাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে।আমার সাধ্যি কি ওর কাছ থেকে বেড়ালটিকে ছিনিয়ে নেব। ঝিনাই ওর মাকে কাকুতি মিনতি করে, বাবা যেন ইঁদুর ধরার আঠা লাগানো বই কিনে না আনে।
ইঁদুরের খুব কষ্ট হয়!
আমার পরিবারের লোকজন যে আমার চলার পথে থাকবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! মনুষ্যজাতি মাত্রই এই স্বভাব। জগতের বাকি বাসিন্দাদের বিষয়ে বলা বা বোঝার ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই।
মিথ্যে বলে বেরোনো আর মিথ্যের পর্দা ফাঁস হলে অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায়। আবার ভরসার যে আমার কাছের মানুষেরা ত আমায় চেনেন। শুধু কি তাই যাদের কাছে যাচ্ছি তারাও শোনামাত্র উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। এ যেমন বিড়ম্বনার তেমনি সুখেরও। আর চলার পথে যারা বন্ধুত্বের উষ্ণতা দিয়ে ঘিরে থাকলেন, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে তুললেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন..সবুজের স্নিগ্ধতা দিলেন এঁকে, তাঁর বেলা!
আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যায় .. গাছ থেকে টুপ করে পাখির বিষ্ঠায় সবুজ জামায় সাদা দিয়ে চিত্র আঁকা হয়ে যায়। রোদে, বৃষ্টিতে, মাঠে, ক্ষেতে,ডোবায়, জলে, কাদায়,ফুলে,কুঁড়িতে,প্রজাপতি, পিঁপড়ে, ফড়িং এর সাথে মাখামাখি হয়ে চলার সুখ কি অন্য কিছুতে পাওয়া সম্ভব!
'খারাপ চা' এরকম একটা দোকানের নাম দেখে চেখে দেখবার ঔৎসুক্য জাগে.. আমার চলাটা নিছকই পাগলামি হিসেবে দেখেন না তা জানিয়ে দিতে ভোলেন না। কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে সিয়াচেন বর্ডার, লাদাখের পথে সাইকেল রিকশায় সত্যেন দাস এ পথ দিয়ে গেছেন। তার ছবি সাগ্রহে দেখান। সত্যেন দাস এর স্ত্রী ও সন্তানের
সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল। রিকশা ভর্তি করে খেজুরের বীজ নিয়ে রাস্তার ধারে ছড়াতে ছড়াতে গিয়েছিলেন। 'যদি দু'একটা বীজ ভিজে ওঠে ' তার আশায়! আহা!এভাবেও ভাবা যায়! আবেগে খুশিতে চোখ ভিজে ওঠে।
শোভনদার ফোন পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। 'কখন বর্ধমান আসবে? রাত হয়ে যাবে। হাইওয়ে ধরে দুর্গাপুরের রাস্তা খুব বিপদজনক।
'কোন বাসে লরিতে সাইকেল তুলে দিয়ে চলে আসো।’ সন্দীপ এর ফোন, বর্ধমানে আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।
কিন্তু আমি ত ব্রত রেখেছি, আমার সাইকেলের চাকা রাস্তায় দাগ এঁকে যাবে। তাই আমি আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকি। বন্ধুদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা, ভালোবাসায় আমার পথচলায় দ্বিগুণ শক্তি এনে দেয়। সাইকেল চালাতে চালাতে খুশিতে মন গুনগুনিয়ে ওঠে।
এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ।আইসক্রিম বিক্রেতার কাছ থেকে আইসক্রিম কিনে দু'চার কথা বলে সাহস সঞ্চয় করছিলাম।
সামান্য গেলেই বর্ধমান। প্রতিদিন শহরে যাই, আজ দুয়ারে সরকার এ লোকজন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। এখন ফিরে যাবো। এত পাকামো করতে কে বলেছিল? একথা কে বললো। কেউ ত আশেপাশে নেই। এ ত ভালো লক্ষ্মণ নয়। মাথা বিগড়ে গেলে এমন হয় শুনেছি।
ফোনে চার্জ নেই। বৃষ্টি হয়ে চলেছে। যাকে শুধোই দুর্গাপুর কত দূর? আপনি সাইকেলে যাবেন? বাসে উঠে যান। নতুবা পৌঁছাতে পারবেন না। ভোর সাড়ে পাঁচটা কিভাবে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না। এবার কি হবে?
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের অবস্থা! জামা-কাপড় ভিজে চপচপে। সড়ক পথে প্রাণ হাতে করে চলার মতো কষ্ট স্বীকার করার অভিজ্ঞতা নেই। অবশেষে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায় যখন দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতাল এ শোভনদাকে দেখতে পাই। হাসপাতালের কর্মী সৌরভ আমায় দেখতে আসেন। ফুলের তোড়া আর স্মারক আমার হাতে তুলে দেন। মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় শিং গজিয়ে ওঠে। মাথায় যতই চাটি মারি শিংটাকে মাথার ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে পারছি না।
৩
তাই বলে কোন ডাক্তারবাবু আমায় মশারী টাঙিয়ে দেবেন, এটা আমি ভাবতেই পারি না। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি ডাক্তার আমাদের বিপদের দিনে আলো জ্বেলে দেন। সমাজে তার একটা বিশেষ আসন আছে। তাই ডাক্তারবাবুদের কাছ ঘেঁষে থাকি। ডাঃ শোভন পান্ডা দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতাল এর সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেন। আবার বিভিন্ন গনসংগঠনের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের কাজও করেন। কোপাই শ্রমজীবী হাসপাতালের শুরুতে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। সেখানে মাটির চাতালে বসে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক কথোপকথন শুনছিলাম।
মানুষের যাতে হাসপাতালে যেতে না হয় সেটা শেখাবেন। এবং সেটা সম্ভব। এ ত স্বপ্নের মতো শোনালো। তাহলে শুধু হাসপাতাল বানানোটাই জরুরি নয় ? সেদিন আলাপ করার ইচ্ছে থাকলেও মনের মধ্যেই ছিল।
আমাদের বন্ধু সন্দীপ রায়ের মাধ্যমে হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদ এর বন্ধুদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ডাঃ শোভন পান্ডা আমাদের কাছে শোভনদা হয়ে ওঠেন। এত ভালো শ্রোতা খুব কমই দেখেছি।
এ হেন শোভনদাকে আমি বেশ বিপদের মধ্যে ফেলেছিলাম। আমার সাইকেল সফর কি ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে তাই নিয়ে খুব আশংকিত ছিলেন। এই পথেই শিল্পী কালিকাপ্রসাদের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। শেষমেশ অক্ষত শরীরে আমায় দেখে শান্ত হন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শোভনদা বললেন, "সন্দীপ বলেছেন, তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে নিতে,চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সাইকেলটা যেন রেখে দিই।"
বলা বাহুল্য রাত দশটা থেকে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত আপনজনের সান্নিধ্যে বেশ শক্তি সঞ্চয় করলাম। ইচ্ছে ছিল ই এস আই হাসপাতাল ঘুরে দেখবো। শোভনদাই বারণ করলেন সাইকেল নিয়ে দিনে দিনে পৌঁছাতে হলে সময় নষ্ট করা যাবে না। খাতরা যাবার পথ এঁকে বুঝিয়ে দিলেন।
দিনের শুরুতেই চোখ আটকে গেল। ভিক্ষা অন্বেষণে কাঠের চাকা ওয়ালা গাড়ি ঠেলে এগিয়ে চলেছেন পৌঢ় মানুষটি, গাড়ির মধ্যে বাটি হাতে বসে আছেন এক মহিলা। একটু আলাপ করবার ইচ্ছে হল। কিঞ্চিৎ অর্থদানের মধ্যে দিয়ে জীবনের গ্লানি দূর করার চেষ্টা করলাম।
প্রফুল্লচিত্তে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলা। চারপাশের অচেনা জনপদ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পরা - এভাবে দুর্গাপুর ব্যারেজ হয়ে বড়জোড়া, পোয়াবাগান দিয়ে খাতরার রাস্তায় উঠে পড়লাম। মাঝেমধ্যে খেজুর খাচ্ছি। জল পান করছি। আর গামছা দিয়ে ঘাম মুছে চলেছি। মৌমাছি সাইকেল না আনলেও সেই সুবিধা পাচ্ছি। সুন্দর পিচের রাস্তা ধরে একটু কষ্ট করে চালাতে পারলে ঢাল বেয়ে মূহুর্তে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া যায়। এদিকে বিকাশ চন্দ্র পতি ফোনে যোগাযোগ রেখে
চলছে। আর কতদূর? এখনও বাঁকুড়া আসতে পারেননি? বেলিয়াতোড় - ফুলবেরিয়া রাস্তায় একটা বোর্ড লেখা গোপাল লাল জিউ মন্দির, ডাকাইসিনী অস্থল তীর চিহ্ন দেখে সাইকেলের চাকা শাল বনের মাঝে লালমাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে ললো। দু'একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে এগিয়ে চলা।এ পথে হাতির দেখা মেলে, ইলেকট্রিকের মোটা তার বেঁধে দেয়া আছে। এ জায়গা ছেড়ে কি করে যাই! রাখাল একপাল গরু নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অরণ্য বনানীর মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলার সুখ এর মাঝে সময় বড় বেরসিকের মতো এগিয়ে চলেছে। এভাবেই কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। কোন পথিককে যদি বলি ধলডাঙা দিয়ে গোবিন্দপুর যাবো। উনি আঁতকে ওঠেন। জানেন কত রাস্তা। সাইকেলে যাবেন? কখন পৌঁছোবেন? সত্যিই আমি জানি না। তবে আমি এটুকু জানি আমায় যেতে হবে। দিনের আলোয় প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ মেখে চলার সুখ এখানে নেই। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ চলমান গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পথ হাতড়াতে হাতড়াতে চলা।
আমার ক্ষ্যাপা মানুষটারে জাগিয়ে রাখতে গান গাইতে লাগলাম। 'হোক বেসুরো পর্দা বদল ' এ ত আমার চলার পথের যষ্টি।
আমি মারের সাগর পারি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।।
হঠাৎই সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। পায়ে একটু লেগেছে। পেছনের চাকার ব্রেক ভেঙে গেছে। কিন্তু সাইকেল চালানো যাবে। আসেপাশে কেউ নেই যে এগিয়ে আসবে। তাই এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো ঝিঁঝি পোকা। তারস্বরে ডেকে চলেছে। চিৎকার করে জোনাকিপোকাকে বলছে, অন্ধকারে তুই পথ দেখিয়ে এগিয়ে দে। ও আমাদের অতিথি।
একজন দৃষ্টিহীন মানুষ কিভাবে পথ চলে? কোনদিন ত তার কাছ থেকে এ কথা জানতে চাই নি। সামনের চাকার ব্রেক সম্বল করে চলা।ক্রমশ ঢালু রাস্তা পেয়ে সাইকেল ছুটে চলেছে। থামাতে গেলেই ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠছে। কোনক্রমে পা দিয়ে সাইকেল থামিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা টর্চ কিনলাম। এবার যদি সাইকেলটা সারানো যায়। ফোনে চার্জ না দিলে বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
সাইকেল সারানোর দোকান পেয়ে গেলাম। ফোনে চার্জ দিতে দিলেন। নিমেষে আপনারজন হয়ে উঠলেন। দশ টাকায় সাইকেল সারিয়ে দিলেন। আমি কোথায় যাবো, রাস্তায় কোন অসুবিধে হলে কি করতে হবে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন। চা না খাইয়ে ছাড়বেন না।
"প্রথমে আপনাকে দেখে কেমন কেমন লাগছিল। পরে বুঝলাম আপনি ভালোমানুষ"। শোন তোমরা, উনি কি বলছেন, আমি শিখিয়ে দিইনি। অনেকটা মনের জোর নিয়ে আবারও চলা। টর্চের আলো ধরে এগিয়ে চলা।
মন গুনগুনিয়ে উঠলো,
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো।
যখন তুমি রাস্তা হাঁটো
সারাদিনের ক্লান্তি তোমার মুখের আবির
ভালোবাসার মানুষ
এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত-
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
তুই ছেঁড়া মাটির বুকে আছিস
পুরোনো নাম, ঘুরে ফিরে একই নাম ঃ
ভালোবাসা।
এভাবে কখন যে সত্যি সত্যি আমার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেলাম আর 'প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে' বেশ টের পেলাম।
বি.দ্র.লেখাটি বড্ড বড় হয়ে গেল। কেটে ছোট করলাম না। ইচ্ছে হলে পড়বেন। দাঁত মাজার ব্রাশে মাজন নিতে গিয়ে বেশি টিপে ফেলেছি। তাই...
৪
কথাই ছিল মাঠে যেতে হবে। মানে আমরা যাকে আজকাল পটি বা টয়লেট যাব বলি। যদিও টয়লেট বেশ গোলমেলে ব্যাপার। সেজন্য বলা হয় বড়ো না ছোট। তবে মাঠে হাগতে যাবো কথাটা বেশ মধুর। বিকাশ ভাইয়ের মোটর সাইকেলে আর আমি প্যাডেল সাইকেলে, বেশ মজা লাগছে। সাধারণত যখনই বেগ এসেছে তখনই পায়খানায় গেছি। আর
বাইরে বেরিয়ে বহু জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পরে কোথায় মলত্যাগ করছি তা দেখার মতো বিলাস সাজে না।
চলেছি ত চলেছি,ভালোই লাগছে। প্রকৃতির আস্বাদ নিতে নিতে চড়াই উৎরাই রাস্তা পেরিয়ে চলা। প্রায় নয় কি.মি.পার করে ক্যানেলের ধারে শাল বন সেটাই বিকাশের শৌচালয়। বিকাশ বললো, আমি ডানদিকে যাচ্ছি, আপনি বামদিকে যান। পাশেই জলা আছে। আমরা এটাচড বাথরুমে অভ্যস্ত, যখন দরকার তখন যাই। নিশ্চিত নিরাপত্তা। এখানে তার উপায় নেই, সারাদিনে একবারের বেশি যাওয়া যায় না।সেই হিসাব করে সাধারণত বিকেলে দু'ভাই যায়। আমি এসেছি আর বেরোতে হবে তাই বিকাশ রাতে শাবু খেয়েছে। তাতে নাকি পায়খানা হতে সুবিধা হয়। যদিও বিকাশের বাড়িতে আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ শেষ পর্যায়ে, দরজা লাগানোর মিস্ত্রির অপেক্ষায় আটকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের টাকাতে প্রধানমন্ত্রীর 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান' চলছে। এক
আন্তর্জাতিক গবেষক দল বলছেন, শৌচালয়ের উন্নতি মানেই স্বাস্থ্যের উন্নতি নয়। ডাঃ স্বপন জানা লিখেছেন, "যে কোনও জীবের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রথম রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।তা রোগ শরীরের ভেতর বা বাইরের যে কোনও কারনেই হোক না কেন।নিজস্ব শারীরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে প্রধানত পুষ্টির মাধ্যমে। তারপর দরকার হয় বিশ্রাম, আমোদ প্রমোদ, কাজ ও সুস্থ পরিবেশের।
...দেশের মানুষের খাওয়া-পরা,থাকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার অবাধ স্বাধীনতা গড়ার মধ্য দিয়েই স্বচ্ছ ভারত গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।
মানুষের মল একটি উচ্চমানের সার। চীনদেশের কৃষিতে এর বহুল ব্যবহার স্বীকৃত। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কৃষিতে মলের প্রয়োগ দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
প্রাতকৃত্যের কাজ সমাধা করে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা, চা খাওয়া চললো। অন্য মানুষজনের সাথে পরিচিত হলাম। জায়গাটা সম্পর্কে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছি। তালডাংরা,ভাগাবাঁধ এ যে ক্যানেল সেখানে পুরুলিয়ার তিনটি নদী কাসাই,কংসাবতী আর কুমারী নদীর জল প্রবাহিত হচ্ছে। বানসা রোড দিয়ে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, মুকুটমনিপুর যাবার বাস পাওয়া যায়।
ফেরার পথে মাধুকরীর খোঁজে বারেবারে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আর বিকাশের গ্রামে ঢোকার মুখে পুকুরে ফুটেছে পদ্ম। সাদা পদ্ম। ভাবছিলাম গতকাল রাতের অন্ধকারে এরকম কত কিছুর রসাস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যদিও রাতের অন্ধকারে অচেনা অজানা জনপদে নিজেকে খুঁজে দেখার সুখই বা কম কিসে!
আমরা মুড়ি, আলুসিদ্ধ, চপ সহযোগে সকালের জলখাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এবার আমরা যাবো ঘাট রাঙামাটি। বিকাশের পরিকল্পনা মতো আমি অটোয় চাপলাম। বিকাশ ভাইয়ের মটর সাইকেলে সাথে সাথে চলেছে। টোটোয় গোবিন্দপুর থেকে বাসে বাঁকুড়া
বাসস্ট্যান্ড থেকে আবারও কাশীপুর এর বাস ধরে ঘাট রাঙামাটি নেমে বিকাশকে ফোন করলাম। মটর সাইকেল খারাপ হয়ে গেছে। আজ সারানো যাবে বলে মনে হয় না। আর
একা বিকাশের পক্ষে বাসে উঠে আসা এককথায় অসম্ভব। বিকাশ চেষ্টা করেছিল বাস দাঁড় করিয়ে যদি আসা যায়। কিন্তু বাস কন্ডাকটরের সহযোগিতা পেল না। অগত্যা বিকাশ বাড়ি ফিরে গেল। এদিকে বিকাশের সঙ্গে একসঙ্গে যাবো বলে সাইকেলটা রেখে যেতে হল। মনটা মুষড়ে গেল। কি আর করা।
রাঙামাটি থেকে হেঁটে গেলে ঊষারডি গ্রাম দু'কি.মি. পথ। পায়ে হেঁটে গেলে অর্থের সাশ্রয় আর মনের আরাম দুই-ই হয়। আর প্রকৃতির মাঝে একলা হতে মনে এক অনির্বচনীয় সুখ হয়। শহরের কোলাহলমুখর জীবনের বাইরে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সখ্যতার সুখ নিতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। প্রবল সূর্যালোকে লালমাটি
পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির সেজে ওঠা যেন আমারই অপেক্ষায়.. তাকে সময় দিয়ে বেঁধে দিলে চলে! সারি সারি তাল-খেজুর-শাল এর ফাঁক দিয়ে আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা কি মোবাইলে ধরা যায়! মনের মণিকোঠায় তাকে চিরস্থায়ী করে রাখার জায়গা আপনিই করে নেয়। জামডোবা গ্রাম হয়ে ঊষারডি গ্রাম এ আমায় অভ্যর্থনা জানালো অনির্বাণ মুখার্জি। বছর দুই-তিন হল আলাপ, এমন প্রাণশক্তিতে ভরপুর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণকে যত দেখি তত অবাক হই। শান্তিপুরের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল এ মেয়েদের সাবান তৈরি শেখাচ্ছে। গ্রামের সম্পদকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার নিবিড় চর্চা করে চলেছে। সাবান তৈরির উপকরণ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করার উপর জোর
দিচ্ছে। শাল বীজ সংগ্রহ করে তার গুড়ো ব্যবহার করা চলছে। তেল নিস্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে আরও ভালো হয়। মহুয়া তেলও এখানে সহজলভ্য।
ভাস্বতী রায় ২০১৮ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে তোলেন একটা বিশাল মাটির আর খড়ের চালার সুদৃশ্য ঘর। যেখানে পরিচিত বন্ধুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। ৫-৬ জনের উষ্ণ অভ্যর্থনার ছোঁয়া গতানুগতিক জীবন থেকে অন্য চর্চায় দীক্ষিত করে। যার সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিতে পারলে এক অনির্বচনীয় সুখ পাওয়া সম্ভব। এমন একটা জায়গা পেয়ে আমি বিকাশের কথা ভুলেই গেলাম। হাসিমুখে তেঁতুলের সরবৎ এগিয়ে দিল অনির্বাণ। ভাস্বতীদি বললেন, আমরা খেতে বসে গেছি। আপনি স্নান করে খেতে আসুন। আমি ছাড়াও পাঁচজন অতিথি এসেছেন। তাদের মধ্যে কলকাতার সুদীপবাবু আমার পূর্ব পরিচিত। দুপুরে নিজস্ব জৈব পদ্ধতিতে আঞ্চলিক দেশী ধান ঝাঁঝি আউশ চালের ভাত বিভিন্ন ব্যঞ্জনে পরিবেশিত হলো। বলা চলে আমি যেন মায়ের সান্নিধ্যেই আছি।
এলাকায় তাল খুব সহজলভ্য। অথচ মানুষের কাজে লাগে না। গাছতলায় পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। তাই অনির্বাণ একটা পরীক্ষা চালাচ্ছে। তালের জ্যাম তৈরির মধ্যে দিয়ে গ্রামের মহিলারা আর্থিক স্বনির্ভরতার দিকে এগোতে পারে।
তিন বিঘা জমির মধ্যে দুই বিঘা জমিতে জয়দার তত্ত্বাবধানে দেশী ধান
ভুতমুড়ি, ঝাঁঝি আউশ, কেরালা সুন্দরী, সাঠিজেলে, ষাটিয়া ধানের চাষ চলছে। কিচেন গার্ডেন থেকে প্রতিদিনের সব্জি আসে। সাবান তৈরির সাথে সাথে মেয়েরা সেলাই এর কাজ করছে। সেগুলো বিক্রির মধ্যে দিয়ে সহজিয়া জীবনেও হাসি খেলে যায়।
মেঘে আধার ঘনিয়ে অপরূপ সাজে ঊষারডি গ্রামে সন্ধ্যা নামে... টিপ টিপ বৃষ্টি ক্রমে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। এক অনাস্বাদিত সুখের আবেশ মনকে মাতাল করে তোলে।
‘কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়।'
৫
'ঘুম থেকে উঠে এতটা খোলামেলা পরিবেশ থেকে বাড়ি গেলে প্রথমে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধে হয়। অনির্বাণ উঠোনে দাঁড়িয়ে দু'হাত ছড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে গেল। সকাল দশটায় পাঁচাল পৌঁছাতে হবে। তাই ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম। অনির্বাণ
আমায় একটা সুন্দর দিন উপহার দিল।
ভোরের আলো গায়ে মেখে ঊষারডি গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছি। গ্রামের মানুষজনের সাথে আলাপ পরিচয় হলো না। তাই আবারও আসবো এই সংকল্প মনের মধ্যে লালন করতে করতে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছি। গতকাল প্রবল সূর্যালোকে প্রকৃতির যে রূপ প্রত্যক্ষ করেছি, আজ ভোরবেলা একই পথ দিয়ে চলেছি অথচ আজকের চলার পথে প্রকৃতি অনেক শান্ত। নাম না জানা পাখি আমায় এগিয়ে দিতে এসেছে। বয়স্ক তালগাছ বুঝি বা তাকে পাঠিয়েছে।
রাঙামাটি বাসস্ট্যান্ডে এসে সবে দাঁড়িয়েছি আর এক পশলা বৃষ্টি এসে রাস্তা ধুয়ে দিল। এবার বাসে চেপে বাঁকুড়া থেকে বেলিয়াতোড় সোনামুখি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। ন'টায় পাঁচালের বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বাসের দেখা নেই। অগত্যা টোটোয় চেপে পড়লাম। প্যাসেঞ্জার নেই তাই একশো টাকা লাগবে। এক
প্যাসেঞ্জার জুটে গেল। তাই পঞ্চাশ টাকা। টোটোয় চেপে যেতে যেতে প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
সবুজ পাহাড় ডাকে, আয় রে ছুটে আয়।
এই শ্যামলা পথের বাঁকে আয় রে ছুটে আয়।
মহিলারা জঙ্গল থেকে শুকনো ডালপালা মাথায় নিয়ে চলেছে। ঘুম থেকে উঠলে মরদ ছেলেপুলেদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে যে! দাঁড়ালে চলবে! অবশেষে পাঁচালে এসে পোঁছোলাম। কিছু খেয়ে নিতে দোকানে ঢুকলাম। একটা থালায় মুড়ি, চপ, বড়া সহযোগে জল দিয়ে মেখে নিলাম। এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস এর সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছে হল। ইতিমধ্যে সৌরভ মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির। শোভনদা পাঠিয়েছেন। প্রথমে ডাঃ শোভন পান্ডা এলাকার স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে কথা বলবেন। পাঁচাল গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আছে। তারা কেউ জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করছে। কেউ কেউ বিজ্ঞান সংগঠন, লোকসংগ্রহশালা, নাটক ইত্যাদি নিয়ে আছেন। শোভনদা এই সব সংগঠনের কর্মীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে বসেছেন। এই এলাকায় মূলত স্বাস্থ্য ও জৈব কৃষি নিয়ে একটা আশ্রম গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনছেন। অনুকূল পরিবেশ পেলে তা হয়তো একদিন বাস্তবায়িত হবে। বলতে গেলে এটি সলতে পাকানো পর্বে রয়েছে।
বিনোদবাটী গ্রামীণ উদ্যোগ এর সাথে যুক্ত শান্তি রায় এর পরামর্শ মতো মূলত আই সি ডি এস ও আশা কর্মীদের সাথে প্রাথমিক বসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে কি কর্মসূচি গ্রামের উপকারে লাগতে পারে সেটা ঠিক করা। যদিও বিভিন্ন কারণে দু'জন স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতিতে আলোচনা শুরু হয়। দুর্গাপুর থেকে ডাঃ শোভন পান্ডা, সৌরভ এসেছেন। চেতনা লোকসংগ্রহ শালা থেকে দেবাশীষ মুখার্জি ও সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুর থেকে হরেকৃষ্ণ সাউ,সোনামুখি থেকে রাজীব কড়ি, অর্জুনপুর গ্রাম থেকে শুভেন্দু মন্ডল ছাড়া আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
রবিবার সকাল দশটায় বেশির ভাগ মহিলারা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের নির্দিষ্ট কর্মসূচির বাইরে এই ধরনের কর্মসূচি কিভাবে মেলানো যাবে সেই বিষয়ে কথা হয়।
ডাঃ পান্ডা বাসন্তী, পাথর প্রতিমা এলাকায় দিদিদের সঙ্গে স্বাস্থ্য বিষয়ে
কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। যারা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ রেখে কাজ করে চলেছেন। এখানকার দিদিদের প্রস্তাব দিয়েছেন, আপনাদের কাছে ০-৫ বছর বয়সী যেসব বাচ্চারা আসে তাদের রোগ অসুখ বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আপনারা নিজেরাই বাচ্চাটির মা-বাবাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবেন।
যেমন সর্দি /কাশি/শ্বাসকষ্ট এর উপসর্গ নিয়ে আসা বাচ্চাটি সুস্থ, অসুস্থ
না মারাত্মক অসুস্থ সেটা আপনারা প্রশিক্ষিত হলে বলে দিতে পারবেন। আগামী দিনে এ বিষয়ে দিদিদের মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার হলে সেই মতো কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয় পর্বে জনা দশ কর্মীরা স্বাস্থ্য ও জৈব কৃষি নিয়ে কাজের সমস্যা,
সম্ভাবনা বিষয়ে কথা বলেন। এবার ফেরার পালা। আজই বিকাশের বাড়ি ফিরে গেলে আগামীকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব।
দেবাশীষদা বললেন, আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে বাড়ি ফিরতে, তাই আজ আপনি পাঁচালে আমার বাড়িতে থাকবেন। তারপর কাল সকালে আপনি যাবেন। এরকম আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে মটর সাইকেলে উঠে পড়লাম।
মাদারির খেলা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। এর আগেও পথে ঘাটে এদের দেখা মিললেও এমন গ্রামীণ পরিবেশে সম্মিলিত মানুষের ভিড়ে যে ছবি রচনা হয়েছে তা ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। অপরিচিত আমি অন্যের ঔৎসুক্যের কারণ হয়ে উঠেছি। কি আর করার আমি নিরুপায়। খেলা শেষ হইতে বাচ্চাটি বাটি হাতে ছুটে গেল। কিন্তু আস্তে আস্তে ভীড় ফাঁকা হয়ে গেল। এত আকুল হয়ে যারা বাচ্চাটার ব্যালেন্সের খেলা দেখছিল তারা তাদের সমর্থন দিয়ে গেল না! আমি দশ টাকা এগিয়ে দিলাম। মাধুকরী দিয়ে মাধুকরী নিলাম। মুহূর্তে আমার চোখে ঘোর লেগে গেল। একি দেখছি, এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে মহিলারা, বাচ্চারা বাটি ভর্তি করে চাল,আলু নিয়ে আসছে। মাটিতে পাতা কাপড়ের উপর থালা বাটি উপুড় করে ধীরে ধীরে বাঁচার রসদ জড়ো হতে থাকলো। ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে আদর আর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিই। লোভ সংবরণ করে কাছ থেকে শিশুটির ছবি তুললাম। খুশিতে বাচ্চাটার হাতে আবারও দশটা টাকা দিলাম। নিজের উপর রাগ হলো। সবটা উজাড় করে দিতে পারি না কেন!
সাপের মাথায় পা দিয়ে
সে নাচে
কান্না কেন কান্না কেন তোর
বন্যা খরা মড়ক বুকে বাঁচে,
ভাবনা কেন ভাবনা কেন তোর?
তুই কি ভাবিস
তার ঘুমে সেই স্বপ্ন নেই?
আছে
সাপের মাথায় পা দিয়ে
সে নাচে
কান্না কেন কান্না কেন তোর?
কবিতা : অমিত দাস, সুর : প্রতুল মুখোপাধ্যায়
এর আগেও আমি পাঁচালে এসেছি ভৈরব সাইনির জৈব কৃষিকাজ দেখে গেছি। ভৈরব জয় কিষাণ আন্দোলন, পশ্চিবঙ্গের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কাজে নিয়োজিত। এবার তাই দেখা হল না। কিন্তু পাঁচালেই চেতনা লোকসংগ্রহ শালার যে এত যত্ন ও মননশীলতার সাথে প্রকৃতির কোলে নীরবে নিভৃতে আমার অপেক্ষায় পথ চেয়েছিল তা ত আমি টেরই পেতাম না, যদি না দেবাশীষদা ও সনৎদার উষ্ণ সান্নিধ্যে আসতাম। আমি অভিভূত এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ গণউদ্যোগের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলার মতো দূরূহ একটা কীর্তি
যারা গড়লেন। এই ধরনের কাজ আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। যা অবশ্যই অনুকরণীয়। ভালো লাগবে যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হামলে পড়ে বলবে, ওই দেখ ঢেঁকি, আমাদের বাড়িতে একসময় ছিল। ধান,চিঁড়া, ছাতু কোটা হতো।
আর ওই দেখতে পাচ্ছিস, হ্যাচাক। ওটা জ্বালানোর একটা কায়দা আছে। সবাই পারে না। যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন রাতে কোন অনুষ্ঠান হলেই এর দরকার পরতো।
আরে এটা ত সেই প্রাচীন পুথি...
কত রকম বাদ্যযন্ত্র, হ্যারিকেন, টাইপ রাইটার... কত কত মানুষের হাতের স্পর্শ লেগে আছে! 'বিস্ময়ে তাই জাগে!
৬
বাইরে বেরিয়ে প্রতিদিন সকালে আপনাতেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। বাড়িতে যে আলসেমি তার লেশমাত্র নেই। সকাল ছ'টায় সনৎদার মোটর সাইকেল চেপে বেলিয়াতোড় যাবো। একটা দিনও পেরিয়ে যায়নি অথচ কিভাবে যেন বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। গতকাল চেতনা লোকসংগ্রহ শালায় দেবাশীষদা ও সনৎদা বইপত্র গোছাতে গোছাতে কথা বলে যাচ্ছিলেন। গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠার মেলবন্ধন টের পাচ্ছিলাম। দেবাশীষদার
স্ত্রী সকালে চা খাওয়ালেও আবারও পরিচিত চায়ের দোকানে সনৎদা চা খাওয়ালেন।
পথে যেতে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়,' যামিনী রায় ইনস্টিটিউট অফ আর্ট এন্ড কালচার' এর বহিরঙ্গের সাথে পরিচিত হলাম। রাস্তার উপর, গেটের ভিতরে বাঁকুড়া লোকশিল্পকলার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন নজরে এল।এখন গেট বন্ধ এবং হাতে সময় নেই। তাই এর স্বাদ নিতে আবারও আসবো।
প্রকৃতি এখানে দু'হাত বাড়িয়েই আছে। এত স্বল্প সময়ের সফরে দু'হাত
প্রাণপণে মুঠো করে আছি। পাছে প্রকৃতির ডাকে মন পাগলপারা হয়ে ওঠে! বেলিয়াতোড় থেকে বাঁকুড়া, গোবিন্দপুর নেমে টোটো চেপে নয়াদা বিকাশ এর গ্রামে যাবো। মুখ্যত বিকাশের আমন্ত্রণে বাঁকুড়া এলেও বিকাশের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারিনি।
খাতরা যাবার বাসে উঠে পড়লাম। ভাবছি ছোট বেলায় ইংরেজি বিষয় এ 'তোমার জীবনের লক্ষ্য' হিসেবে 'কৃষক হব' এর উপর প্রবন্ধের নোট মুখস্থ করেছিলাম। পরীক্ষার খাতায় লেখার প্রয়োজন হয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু স্বপনদা(ডাঃ স্বপন জানা) যখন ফোনে কথাবার্তার সময় বলেন, আগে ভেবেছিলাম আমায় যে করে হোক ডাক্তার হতে হবে। আর যখন ডাক্তার হলাম তখন মনে হল কৃষক হতে হবে। অ-পাসকরা চিকিৎসকদের বলেন অন্নদাতার চিকিৎসক দল। কিসের তাড়নায় তিনিকথাগুলো বলেন! সমাজে একজন চিকিৎসক ডাক্তারবাবু হিসেবে পূজিত হন। আর কৃষক এর সাথে বাবু কথা যুক্ত করা যায় কিন্তু সেটা কাকের পেছনে ময়ূর এর পেখম লাগালে যেমন দেখতে হয় তেমনি! হঠাৎই বাস এসে দাঁড়ালো শুনুকপাহাড়ি হাট এ। মন ছটফটিয়ে উঠলো ইসস এখানে যদি নেমে পড়তে পারতাম! এক গ্রামীণ হাটের সঙ্গে পরিচয় ঘটতো। ভাবতে ভাবতে বাস স্টপেজ ছেড়ে এগিয়ে চললো।
গোবিন্দপুর নেমে টোটো খোঁজ করলেও পায়ে হেঁটে যেতে ইচ্ছে হল। টোটো ভর্তি হতে সময় ও অর্থ দুই-ই ব্যয় হবে। তার বদলে হেঁটে গেলে প্রকৃতির রসাস্বাদ করতে করতে দিব্যি কেটে যাবে। ৪ কি.মি. পথ গেলেই নয়াদা, দিগার বাঈদ গ্রাম।
শরৎ এর আকাশ ক্ষণে ক্ষণে অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। কখনও কাশের ঝোপের আড়াল থেকে তাকে প্রাণভরে দেখছি, আবার পুকুরের জলে পানকৌড়ির মতো ডুব দিতেও দেখছি। রাস্তার দু'ধারের 'বনফুলে প্রজাপতি ক্লান্ত যখন' - না, প্রজাপতি নয় মৌমাছি , আর ফুল ছেড়ে কুঁড়িগুলোতে সে কি লুটোপুটি! আমি মোবাইলে ছবি তোলায় তার নাকি ভারি সুখ হয়েছে, তার উপর আমি ভীনদেশী! কালো পিঁপড়ে ফুট কেটে বললো ঢঙ! হালিশহরেও ত আমাদের আত্মীয়স্বজন আছে তাদের দেখে ত এভাবে হামলে পরতে শুনিনা। বিকাশের ফোনে সম্বিত ফিরে পেলাম। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম।
বিকাশের সঙ্গে দেখা হতেই বললো, 'আজ আপনার যাওয়া হবে না। আজ জন্মাষ্টমী আজকে বাড়ির ছেলের বাইরে থাকতে নেই। মা বলেছেন, আপনিও এ বাড়ির ছেলের মতো। বেশ,তাহলে আমার ত কিছু বলার নেই। ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছ যে মোরে!
চা-মুড়ি সহযোগে জলখাবার খেতে খেতে কত কথাই যে উঠে এলো। আমার সাইকেলে চলে আসার সিদ্ধান্ত.. গত দু'দিন আমার সঙ্গে না থাকতে পেরে মনটা বেজায় খারাপ লাগছিল। বলছিল, আমার এতদিনের পড়াশোনা যা দিতে পারেনি দু'তিন বছরের কৃষি কাজ আমায় অনেক পরিচিতি দিয়েছে। আমার জন্মসূত্রে পাওয়া কৃষি কাজই আমায় বেশি ভরসা যোগায়। আমি গুণে দেখেছি একটা ভুতমুড়ি ধান রোপণ করলে তার থেকে কমপক্ষে আড়াইশটা ধান পেয়েছি। একটা আলু থেকে ৫-৬টা চোখ বেরোয়।একটা চোখ লাগালে অন্তত ১০টা আলু পেতে পারি। আর কোন কিছু এর থেকে বেশি ফেরত দেবে? তবুও চাষির এই হাল কেন? বাজার অর্থনীতির কোন জট ছাড়ালে কৃষকের হাতে সত্যি সত্যিই ক্ষমতায়ন ঘটবে?
বিকেলে ভাগাবাধের ক্যানেলের জলে স্নান সেরে শালের জঙ্গল পেরিয়ে বাধের জলায় আলো থাকতে থাকতে বিকাশের ধানের ক্ষেত দেখে মন জুড়িয়ে গেল। বিকাশের বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, কি ধান লাগিয়েছিস এত বাড় হয়েছে?
বইলবো কেনে?
একটুকুন ইউরিয়া ছইড়ে দিলেই বুঝা যাবে!
গোধূলি বেলায় শিলাবতী নদীর ধার ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম। একটু দূরে দূরে ছেলে-বুড়োর দল বড়শি হাতে মাছরাঙা পাখির মতো ঘাপটি মেরে বসে আছেন।আর টুকটাক মাছ থলেতে ভরছেন। 'প্রকৃতিতে বিনা পয়সায় ভোজ পাও।'
আসার পথে বিকাশের বন্ধুর সাথে আলাপ জমে উঠলো। অগত্যা বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে এলাম। চাষযোগ্য জমি ছাড়াও গাই-গরু আছে। তার দেখাশোনা যিনি করেন তিনি বিকাশের বন্ধুর কাকা।কোন বিষয়ে কারোর প্রতি কাকার রাগ হলে তাকে থামায় কার সাধ্যি! 'রেগে আগুন তেলে বেগুন '...এর থেকে রেহাই পেতে মনোচিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ দিলে রাগ সাময়িকভাবে কমে যায়। যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। দু'একটা নমুনা আমাদের সামনে হাজির করলেন। দ্বৈত চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে আমাদের মুগ্ধতায় নিয়ে গেলেন। দুধপানের পরে চা-বিস্কুটও জুটলো, বিকাশের বাড়ি পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। তালের বড়া, শালপাতায় মুড়ে তালের পিঠে তৈরি হয়ে গেছে। একা একা এক থালা বড়া-পিঠে দিয়ে রাতের খাবার সেরে ফেললাম।আর বিকাশ রাতের অন্ধকারে টর্চ নিয়ে নিজের জমিতে জল যাবার ব্যবস্থা করে এলো।
৭
বেড়াল এক গাল হেসে বলল, 'তা আর জানিনে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত -সিধে রাস্তা, সওয়া ঘন্টার পথ,গেলেই হল'।
বিকাশও আমায় বাড়ি ফেরার সহজ রাস্তা বাতলে দিল। দিনে দিনে পৌঁছে যাবেন। এই বানসা রোড দিয়ে সিধে রাস্তা, বিষ্ণুপুর, কোতলপুর, আরামবাগ ,তারকেশ্বর , চুঁচুড়া.. আমি ত ব্যান্ডেল বি.এড কলেজে পড়েছি। বাসে যাতায়াত করেছি। সকাল সাতটায় বাসে চেপে দুপুর বারোটায় তারকেশ্বর থেকে আবার বাসে দু'ঘন্টা। আড়াইটে থেকে তিনটা নাগাদ পৌঁছে যেতাম।
প্রতিদিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে বিকাশ রাতের খাবার খেয়ে রাত আটটায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঠিক ভোর সাড়ে চারটে বাজলেই ঘুম ভেঙে যায়। তাই আমি ঠিক করলাম ভোরের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়বো। বিকাশের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সাড়ে চারটে নাগাদ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যত রাতই হোক আজই বাড়ি ফিরবো। এরকম একটা মনোবাসনা নিয়ে বিকাশের গ্রাম থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যাচ্ছি। সাক্ষী হয়ে থাকলো বানসা রোড, শাল মহুয়ার জঙ্গল, কাঠকুড়াতে আসা দেহাতি মহিলারা, ধানের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে আসা জনমজুর, গরু, মোষ,ছাগল চড়ানো রাখাল, দ্রুতগামী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতে থাকা সাপ, বনবিভাগের বাংলো...যতই তাড়া থাকুক চলার পথে সবার ডাকাডাকি ত আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়! প্যাডেল সাইকেলের মজা এমন যতটা শক্তি প্রয়োগ করবো ততটাই এগোবো। এ আমার আপন শক্তিকে জ্বালিয়ে পাওয়া ধন। পৌরসভার ছাড়া কলের মতো নয় যে কান মুললেই ঝরঝর করে জল পড়বে। এ টিউবওয়েল -হাতলে চাপ দিয়ে যে ডানপিটে ছেলেটা জল পেতে ঝুলে পড়ে তার ক্ষেত্রেও কলের ধাতব শরীরে মায়া জড়ায় না। সে আবারও চেষ্টা করে চলে..
ঘন্টায় ৮ কি.মি.গতিতে সাইকেল চলছিল। রোদ-বৃষ্টি এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। আরামবাগ, তারকেশ্বর এর বাস হু হু করে কানের পাশ দিয়ে ছুটে চলে। প্রলুব্ধ করে, ভালো চাস ত আমার নায়ে আয়! তোর কষ্ট ত আর দেখতে পারি না। সেই ভোরে বেরিয়ে বিকেল হতে চললো বাঁকুড়া জেলা পার হতে পারলি না। এদিকে তোর ফোনে চার্জ নেই। বাড়ির লোক, বন্ধুরা চিন্তা করছে,আবার ফেসবুকে
স্টেটাসও দিয়েছিস। সবাইকে চিন্তার মধ্যে রেখেছিস।
"পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"। তাই চারপাশের কোন কিছুরই রসাস্বাদ করতে পারছি না। শুধু পথকে পেছনে ফেলে আসার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলাটা টের পাচ্ছি। আরও প্রবল শক্তি নিয়ে ছুটে চলা।
"আমরা দেব বোবাকে ধ্বনি, খোঁড়াকে দ্রুত ছন্দ
অসম্ভবের পথে হেঁটেই আমাদের আনন্দ"।
এতে করে কি আরও শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলা যাবে! খড়-কুটোর মতো সবকিছুই আঁকড়ে নিয়ে পথ চলা। অন্ধকার ঘনিয়ে এসে পথ চলার গতি কমিয়ে দিল। আরামবাগ দিয়ে তারকেশ্বর এর পথে, চাঁপাডাঙা যাবার রাস্তা বিপদসংকুল। পা টিপে টিপে পথ চলা। বাড়ি ফেরার আশা ক্রমশ নিভে আসছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা রাত ধরে সাইকেল চালিয়েও পৌঁছাতে পারবো না। লোকজনদের মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করছি,
চুঁচুড়া যাবো। কোন রাস্তায় গেলে সহজ হবে ? এত রাতে এরকম একটা প্রশ্ন শুনে বেশির ভাগ লোকজনই ভূত দেখার মতো করে আমায় আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছেন! নিজের প্রতি একপ্রকার করুণাই হল।রাতটা কোথাও থেকে যাবো। কোথায়?
ও দাদা,কাছাকাছি কোন স্টেশন আছে?
এ দিক দিয়ে কিছুটা গেলেই লোকনাথ স্টেশন।
বেশ মজা লাগলো, "রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি, আমায় স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো"। যদিও লোকনাথকে স্মরণ না করে লোকনাথ স্টেশনে সাইকেল স্ট্যান্ডের মালিকের সাথে পরামর্শ করে সাইকেলটা রেখে দিয়ে স্টেশনের প্রতীক্ষালয়ে আশ্রয় নিলাম। কখনও হাসপাতালে বাবার শয্যার পাশে রাত কাটিয়েছি,ইমার্জেন্সির পাশে রাতে চাদর পেতে শুয়েছি, ট্রেন গন্ডগোলে স্টেশনেই কেটে গেছে রাত... আর আজ আমি স্বেচ্ছায় এসেছি অনিশ্চয়তার পথে, আমায় কেউ জোরও করেনি এ পথচলায়.. আমার কাছে এ এক অন্য অনুভবের জগতের দ্বার উন্মোচিত করে দিল। আমার সঙ্গী চালচুলোহীন উদাস বাউল। দু'চার কথা বলে কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। তথাপি সারারাতে যখন চোখ ঘুমে বুজে আসছিল সেই কি আমায় চোখে চোখে দেখে রাখলেন ? আজ তার দুয়ারে আমি এসেছি অতিথির বেশে!
৮
রাতে প্রতীক্ষালয়ের বসার জায়গায় ব্যগটাকে কোলবালিশ করে আর মাথায় প্লাস্টিকের মধ্যে বই ভরে বালিশ করে শুয়ে পড়লাম। আমায় ভীনদেশী দেখে কিনা জানিনা মশারা আমায় র্যারগিং করা শুরু করলো। বিশ্বভারতীতে একবার কলাভবনে ভর্তির পরীক্ষা দিতে আগের রাতে এসে কোথায় থাকবো তার ঠিক নেই। সদ্য পরিচিত কলাভবনের এক ছাত্রের সাথে আলাপ হল, কাজ দেখালাম। আর রাতে একটা কোনরকম
থাকার জায়গা পেলেই হবে। 'রাত ঠিক ন'টায় ক্যাম্পাসের ভেতর এই গাছটার নিচে অপেক্ষা কোরো, এক সিনিয়র দাদার স্টুডিওতে নিয়ে যাবো'।সেই মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমায় নিয়ে চললো একটা ঘরে যেখানে জনাকয়েক দাদা-দিদির সঙ্গে দেখা। চেনা দাদা বললেন, তোর কাজগুলো দেখা। এগুলো কাজ হয়েছে? এই কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হতে এসেছিস? আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিকেলে ইনিই আমার
কাজ দেখে তারিফ করেছিল আর এখন কি সব বলছে! একজন কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই আমায় চা করতে বললো, কেউ এসে কপালে তিলক এঁকে দিল। কেউ গান গাইতে বললো.. একেই তা হলে রাগিং বলে, শুনেছি, আজ তা প্রত্যক্ষ করলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। রাতের অন্ধকারে কোনক্রমে ছিটকে বাইরে চলে এলাম। আর একি সেই দাদাই আমার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, আমায় ক্ষমা করে দে! কিছুই বুঝতে পারছি না। আমায় বন্ধুর মতো বুকে জড়িয়ে ধরলো। চল, তোর একটা শোবার ব্যবস্থা করে দিই। সেই দাদাকে বলে দিল,তুমি আর কিছু কোরো না। তোমার স্টুডিওতে রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আগামীকাল কলাভবনে ভিসুয়াল আর্টস এর প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা দেবে। মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়লাম। যখনই ঘুম ভেঙে যায় চেয়ে দেখি দাদাটি হয় ছবি আঁকছে নতুবা বেহালা বাজিয়ে চলেছে। শুয়ে শুয়ে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছি।
কখন ভোর হয় সেই অপেক্ষায় পায়চারি করে চলেছি। ফোনে চার্জ নেই যে ফোন ঘেঁটে টাইম-পাস করবো। বই পড়তে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরছি। টিউবওয়েল চেপে চোখে জলের ঝাপটা দিলাম। টিকিট কাউন্টার চত্বরে ছোট ছোট টগর গাছ ফুলে ভরে গেছে। ভোর পাঁচটা নাগাদ কাউন্টারে এক ভদ্রলোক টিকিট চেয়ে সাড়া না পেয়ে গজগজ করতে করতে স্টেশনে উঠে গেল। সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন তাই এখনো কাউন্টার খোলেননি। কিছুক্ষণ বাদেই সাইকেল স্ট্যান্ড খুলে গেল। ফোনে চার্জ দিয়ে দিলাম। এক চায়ের দোকান দেখিয়ে দিলেন যেখানে ভালো চা পাওয়া যায়। দেখতে দেখতে সেই দোকানের আশেপাশে আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে থাকলো। ভদ্রলোক আজ আসতে দেরি করেছেন। তাই কিছু খদ্দের তাকে দু'একটা টিপ্পনী কাটতে ছাড়লো না। শ্রমজীবী মানুষেরা, বিশেষত মহিলারা প্লাটফর্মে উঠে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সাড়ে পাঁচটার স্টাফ স্পেশাল ট্রেন প্লাটফর্ম চেছেপুছে নিয়ে চললো।
ফোনে চার্জ দিয়ে সকাল ছ'টায় আবার সাইকেল নিয়ে নতুন উদ্যমে পথকে পেছনে ফেলে ফেলে চলা। কামারকুণ্ডু রেলগেটের পথে এগিয়ে চলেছি।এক বিশাল বটগাছ সম্ভ্রম জাগানো প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি হয়ে আমার মতো পথিককে দাঁড় করিয়ে দিল। ছবি তুলতে তুলতে চোখ চলে গেল প্রাচীন টেরাকোটার কাজ করা মন্দিরে..আমার সাধ্যি কি ওর রূপ রস গন্ধ এর সুবাস না নিয়ে যাই! কাছে যেতেই কানে এলো, তুই আমায় দেখলি,এক ছুট্টে কোথায় চলে আসবি তা না করে ভাবছিস,বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। আরে এই পথে এই জীবনে আর আসা হবে? আর আমারও বয়স হয়েছে, কিইবা আমার অবশিষ্ট আছে ! আজ যেটুকু দেখছিস কাল তা পাবি কিনা তার কি নিশ্চয়তা আছে! মহা বিশালাক্ষী মন্দির, তারকেশ্বর। হালিশহর এ তিনশো বছরের পুরনো নন্দ কিশোর জিউর মন্দিরের টেরাকোটার কাজ এর সাথে আশ্চর্য মিল পাচ্ছি। প্রতীক্ষালয়ে বসে থাকা মানুষটিকে শুধোলাম। এটা খুব জাগ্রত মন্দির। আপনি কি করেন? এই গরু-ছাগল চড়াই.. হালিশহর থাকেন, ওদিকে আমার যাওয়া আছে...
বাসুদেবপুর হয়ে হরিপাল হয়ে নালিকুল -এর পথে আমার একদা সাইকেল সফর এর চাকার দাগ আজও মুছে যায়নি। নালিকুলে বাঁধের মাঠে গভীর রাতে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে 'পালাপার্বণ' এর অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। তখনও মঞ্চে বাউল গান চলছে। তার আবেশে আয়োজকদের শরীরে মনে দোলা লেগে যাচ্ছে। সমবেতভাবে নেচে উঠে আর আরও গানের অনুরোধ আসতে থাকে।
দেখতে দেখতে নসিবপুর এসে গেলাম। চন্দননগর যাবার রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। এর আগেও এ পথ দিয়ে গেছি। গাছপালায় ঘেরা প্রকৃতি দু'দন্ড বিশ্রাম নিতে বলে।
'আরে ফোঁস ফোঁস করে যাচ্ছিস কোথায়? একটু আমার ছায়ায় বোস দেখিনি, তোকে সুবাতাসে ভরিয়ে তুলি, গতকাল খুব ভোরে তুই বেরিয়েছিস ত! অবাক হচ্ছিস, কি করে জানলাম! আরে বাতাস তোর খবর বয়ে এনেছে। তুই এ পথ দিয়ে গেলে তোকে একটু যত্ন করতে বলেছে, এ আবার বলার কি আছে, বাতাস না বললে কি তোকে যত্ন করবো না! সকাল থেকে ত পেট পরিষ্কার করিসনি। এর থেকে ভালো জায়গা আর পাবিনা।
চন্দননগর এ হুগলি জেলা পরিষদের উদ্যোগে নিউ দীঘা বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। কাঠের ব্রিজ পার হয়ে চূঁচুড়া যেতে জি.টি.রোড ধরে এগিয়ে চললাম। ক্রমশ বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছি। আদিসপ্তগ্রাম হয়ে সরস্বতী নদী পার হয়ে রেলগেটের লেবেল ক্রসিং এ আটকে গেলাম। এখানে কলার বিশাল বাজার। টোটোয় কলার কাঁদি তোলা হচ্ছে। যত বাড়ির কাছাকাছি আসছি ততই শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। সেই চেনা বিছানার জন্য, আমার যত্ন করবার জন্য মুখিয়ে আছে আমার পরিজনরা। তারা আদরে ভালোবাসার সঙ্গে রাগ, দুঃখ,ক্ষোভ নিয়ে আমার আসার পথ চেয়ে আছে। টি.ভি.সিরিয়ালে দেখা যায় জামাই ষষ্ঠী চলে গেলে তারপর সেটা তার মধ্যে জুড়ে দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরে গেলেও ফেসবুকে একসপ্তাহ কেটে গেল বাড়ি পৌঁছাতে... এই সময় পর্বে যারা আমার সঙ্গে রইলেন তাদের জন্য রইলো অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা!
ভোর ব্যাপারটা চিরকালই আমার কাছে খুব elusive ছিল, মানে ছলনাময়ী টাইপের একটা জিনিস। আদৌ আছে কি নেই সেটা খুব ভাল বুঝতাম না এক সময়ে। একদম ছোটবেলায় খুব ঘুমকাতুরে ছিলাম। ভাগ্যি ভাল যে মর্নিং স্কুল ছিল না, ধীরেসুস্থে বেলায় যেতাম। তখন ভোর বলতে মহালয়া আর বছরে যে কদিন দিদার বাড়িতে থাকতাম। মহালয়ার দিন সত্যিই ভোরে উঠে পড়তাম, পাঁচটা নাগাদ রেডিওর আওয়াজে ঘুম ভাঙত। চোখমুখ ধুয়েই বাগানে গিয়ে শিশিরমাখা শিউলি কুড়োতাম। অন্যদিন হয়ত পুজো করার আগে মা কিছুটা শিউলি কুড়োত আরো নানাবিধ ফুলের সাথে, কিন্তু মহালয়ার ভোরটা আমার জন্য তুলে রাখা থাকত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলার আওয়াজের সামনে বোধহয় চুবড়িতে করে একরাশ শিউলি রাখার দস্তুর । থাকা উচিত। তাতে বেশ একটা আলাদা আমেজ আসে, অন্তত ১৪১৯ বঙ্গাব্দ অব্দি তো এসেছে। গরমের ছুটিতে যখন দিদার বাড়ি গিয়ে কদিন থাকতাম, ভোরবেলা নানারকম আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত - জলের ভারী আসত, রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা, জমাদার, গঙ্গায় লঞ্চ ধরতে যাওয়া অফিসযাত্রী, ঢাকা বারান্দায় কাজের মাসি বাসন্তীদির টুংটাংখটখট বাসন মাজা, পুরনো আমলের ফ্ল্যাটবাড়িতে কমন পাম্প চালানো নিয়ে ভাড়াটেদের কাজিয়া, ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘুম ভেঙেও মটকা মেরে পড়ে থাকতাম যতক্ষণ না মা এসে তুলে দিত জোর করে। তারপর দিদার ভাঁড়ার থেকে লম্বা মোটা বান, তাতে রাংতায় মোড়া নরম মাখন দেওয়া, অথবা কোনোদিন পরোটা আর সাদা আলু-চচ্চড়ি, সঙ্গে বাড়ির নীচের মিষ্টির দোকান থেকে আনা সদ্য গরম জিলিপি বা রসগোল্লা। দাদুর প্রিয় নাতনি হওয়ার দরুণ ভোরবেলাই এইসব সুখাদ্য আমার জুটত। ওখানে দিনের যে সময়ে প্রাতরাশ সারা হয়ে যেত, নিজের বাড়িতে সেই সময়টা আমার জন্যে ভোরই ছিল। ১৯৬০-৭০ এর দশকের ফ্ল্যাটবাড়ি কেমন হত তা আমি একটু বড় হয়ে সিনেমায় দেখেছি। এখন স্মৃতিগুলো জাবর কাটলে বুঝতে পারি যে দিদার বাড়িটা একটা বড় উদাহরণ ছিল। তিনতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি, ডিজাইনটা আমার বেশ অদ্ভুত লাগত তখন। একতলায় সামনের দিকে দু-তিনটে দোকানঘর ছিল, তার মধ্যে একটা মিষ্টির দোকান। ঘুরে অন্যদিক দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজা ছিল। ল্যান্ডিংয়ে একটা ফ্ল্যাট, তার ওপরের তলায় আরেকটা, তার ওপরেরটাতে দিদা-দাদু-মামা থাকতেন। দিদার ফ্ল্যাটে ঢুকেই ঘরের ঘেরায় একটা U ধরনের ঢাকা বারান্দা ছিল, শুধু U-এর মাঝের খোঁদলটা ফাঁকা। তাই একটু বৃষ্টি হলেই বারান্দা জলময় হয়ে যেত। ঘর থেকে রান্নাঘর/বাথরুম যেতে গেলে ভিজে যেতে হত। আর ওই U দিয়ে নীচে তাকানোটা আমার একটা নেশার মত ছিল, নীচে তাকালেই অনেকটা দেখা যেত। ভোরবেলা আরো দুই ফ্ল্যাটের লোকেরা জেগে কলকলানিতে ভরিয়ে দিত। একজনদের বারান্দায় পাখির খাঁচা ছিল, তাদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে যেত। তিনতলার রাস্তার দিকের বারান্দা থেকে ভোরের গঙ্গার ধার দেখতে পাওয়াটাও ওখানে যাওয়ার একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল।
আরেকটু বড় বয়েসে ভোর ছিল শুধু রবিবারে ওঠা, আঁকার ক্লাসে যাওয়ার জন্যে। উঠে তৈরি হয়ে গিয়ে আঁকা শিখে আবার ফেরারও তাড়া থাকত, সকাল নটার 'চন্দ্রকান্তা' দেখার জন্যে, সাথে প্রাতরাশে রবিবার-স্পেশাল লুচি-আলু চচ্চড়ি-জিলিপি। রবিবার দিনটাকে অন্যদিনের তুলনায় বেশ দীর্ঘ মনে হত ভোরে ওঠার দরুণ। পরপর চন্দ্রকান্তা, মহাভারত/ রামায়ণ, জাঙ্গল বুক, ইত্যাদি দেখতাম সারা সকাল, রবিবার বলে পড়ার ছুটি। এরপর দিলাম জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, দিয়ে চলে এলাম কলকাতায়।
তারপর হায়ার সেকেন্ডারিতে শুরু হল সেই অত্যাচার যাকে মর্নিং স্কুল বলে। শুরুর কদিন কাকার বাড়ি থেকে মায়ের সাথে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে বাস-ট্রাম ধরে রাস্তা চেনার জন্যে যাতায়াত করলাম। পরে স্কুল বাসে ভর্তি হওয়াতে একটু সুবিধে হল, তবে সময়টা আরো এগিয়ে এল। আমার মত ঘুমকাতুরের পক্ষে সকাল ছটায় উঠে তৈরি হয়ে নাকেমুখে দুধ-কর্ণফ্লেক্স গুঁজে গলির মুখে বাসের জন্যে অপেক্ষা করা যে কী দুষ্কর ব্যাপার সে ব্যথা 'বোঝে কি আনজনে...'। তবে ওই দু'বছরে দক্ষিণ কলকাতার ভোরদের (হ্যাঁ, বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ভোর) খুব ভাল করে চিনে গেছিলাম। গ্রীষ্মকালে জলে ধোয়া রেড রোড দিয়ে হু হু করে যেতে যেতে হাওয়ায় আবার ঘুম পেয়ে যেত। ভবানীপুরের বনেদি বাড়ি থেকে হাজরার আধুনিক ফ্ল্যাটদের জেগে ওঠা দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় দিব্যি কেটে যেত। শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কচুরি-সিঙাড়া-জিলিপির নানাবিধ গন্ধে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আমাদের মনও আনচান করে উঠত। বর্ষায় জুতো-মোজা খুলে হাতে নিয়ে বাসে উঠতাম কারণ আমাদের রাস্তায় একহাঁটু জল জমেই থাকত। তবে স্কুল ছুটির পর ওই জুতো-মোজা পরেই ছপাত করে বাস থেকে গলির মুখে জলের মধ্যে লাফ মারতাম। বৃষ্টিভেজা কলকাতার একটা আলাদা রূপ আছে যেটা অন্য কোনো শহরে পাওয়া যায় না। দুর্গাপুজোর আগের ভোরগুলোতে পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়ে যেত। আর শীতকালে কুয়াশাঢাকা ভোরে একেকটা রাস্তা্র আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা দেখতাম আমাদের বাসের আলোয়। বকুলবাগানের বড় বড় গাছগুলো মাথাভর্তি কুয়াশা নিয়ে আমাদের কুর্ণিশ করত ভোর ভোর।
এরপর দেখলাম আরেক রকমের ভোর। কলেজে পড়াকালীন রসায়নের এক বিখ্যাত গৃহশিক্ষক আমাদের ব্যাচের সময় রেখেছিলেন রবিবার ভোর সাতটায়। কোনো মানে হয় বলুন? তখন আমরা ঢাকুরিয়া চলে এসেছি। নিজেকে কোনোমতে টেনে তুলে চা খেয়ে রিকশায় চেপে সেলিমপুর যেতাম। সেখানে বাসের অপেক্ষায় কয়েক মিনিট দাঁড়াতাম। ছুটির দিনের ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে বাস চলত। গোটা যাত্রাপথে আস্তে আস্তে রবিবারের বাজারটা জেগে উঠত। লোকজন অন্যদিনের চেয়ে ঢিমেতালে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরোত। কোন একটা বাস ছিল কী জানি, গোলপার্ক থেকে বাঁদিক নিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের উঁচু উঁচু গাছগুলো পেরিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটত। আমাদের এক আত্মীয় থাকতেন সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক বিল্ডিংয়ের তেরোতলায়। ওদের বিল্ডিংটা পেরোনোর সময় তাকিয়ে ভাবতাম তেরো তলার ওপর থেকে কি ওরা নীচে তাকিয়ে চিনতে পারে কোনটা কোন রুটের বাস? স্যারের বাড়ি ছিল চেতলার এক গলিতে। পুরনো দিনের শরিকি বাড়ি। বৈঠকখানায় গাদাগাদি করে আমরা কয়েকজন বসতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করত। ঠিক ফুটবল খেলার হাফটাইমে রেফারির মত স্যারের গিন্নি হুইসল দেওয়ার বদলে দরজায় খটখটাতেন। স্যার উঠে গিয়ে মিনিট দশেকে বোধহয় লুচি টুচি সাঁটিয়ে আসতেন। ফিরে এসে চা নিয়ে বসতেন ইনর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির থিওরি বোঝাতে। আমরা কেউ তখন ঢুলছি, কেউ ট্রেন ধরার চিন্তায়, কারুর পেট ডাকছে ক্ষিদেতে। শুধু ভাবতাম কখন ছাড়া পাব। বাড়ি ফেরার তাড়ায় মনে হত রিকশা কাকু পক্ষীরাজের মত চালায় না কেন। ফিরে হাত পা ধুয়েই লুচি-আলু চচ্চড়ি আর জিলিপি। যে রবিবারে বাবার বাজার যাওয়ার দরকার হত না, বা হয়ত শরীরটা একটু খারাপ, সেদিন গুলোতে আমি ফেরার সময় সেলিমপুর থেকে বড় বড় মোটা মোটা জিলিপি নিয়ে ফিরতাম।
এখন এই ১৪১৯ সালে শৈশব-কৈশোরের ভোরকে ছুটি দিয়ে তরুণী ভোর দেখি। প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে যাদবপুরের গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্য চোখে ভোরকে দেখি। ঝিলের ধারের কটি পাড়া এখনও সে অর্থে 'পশ' হয়ে যায়নি। চার-পাঁচতলা ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটের পাশাপাশি ঘরোয়া একতলা-দোতলা বাড়ি এখনও আছে, তাকে ঘিরে ছোট্ট উঠোনে ফুলের টব, রাস্তায় টিউবওয়েল। ভোরবেলা কোনো বাড়ি থেকে মুসুর ডালে সম্বার দেওয়ার গন্ধ ভেসে আসে, কোনো বাড়ি থেকে স্কুল/অফিসযাত্রীদের জন্যে মাছভাজার, কোনো বাড়িতে নতুন হন্ডা সিটি গাড়ি ধোয়া চলে, কোনো বাড়ির ধেড়ে ছেলে অফিস বেরোবার সময়ে তার মা চিৎকার করেন, 'ছোটন, হেলমেটটা নিয়া যা,' কোনো বাড়ির রকের সামনে ম্যাক্সি-পরিহিতা মাসিমা মাছউলির সাথে দরাদরি করেন, কোনো বাড়ির গ্রিলঘেরা বারান্দায় শান্ত-সৌম্য বৃদ্ধ বসে খবরের কাগজ পড়েন। এইসবের মধ্যেই কোথাও পুরনো দিনের ভোরেরা নতুনের সঙ্গে মিশেও হারিয়ে যায় না এখনও, শুধু কলকাতাতেই।
প্রবাসে বাংলার বশে
বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা বোধহয় বাঙালীর প্রিয় বিষয়। তাই দেশে-বিদেশে এমনকী হয়ত অন্তরীক্ষে গিয়েও বাঙালী আলোচনা করবে যে অমুকে বাংলাটা কী করে ভুলে গেল বা তমুকে কোন উচ্চারণে ভুল করল। ‘সোনার কেল্লা’তে মন্দার বোস বলেছিলেন, “আপনি যদি বিদেশে বাংলা ভুলবেন বলে ইচ্ছে করেন, তাহলে তিন মাসে ভুলে যেতে পারেন। আর তা যদি ইচ্ছে না করেন, তাহলে ত্রিশ বছরেও ভোলবার কোনো চান্স নেই।” কথাটা কম বয়েসেই আমার বেশ মনোগ্রাহী হয়েছিল, যখন কস্মিনকালেও ভাবিনি যে কখনও দেশের বাইরে থাকব। কাকতালীয়ভাবে এ বছরের অগাস্ট মাসেই আমার প্রবাস জীবনের পঞ্চদশ বর্ষপূর্তি।
প্রসঙ্গত বলি, পরিবারের লোকেরা আমাকে ছোটবেলা থেকেই ‘বইপোকা' বলে লেবেল সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা, ইংরাজি ও বেশ কিছু হিন্দি বইও আছে আমার সংগ্রহে। হিন্দির অনুপ্রবেশ একেবারেই স্কুলের সিলেবাস ধরে। বাবা-মা ভর্তি করেছিলেন ইংরাজি মাধ্যমে এবং বাবার বদলির চাকরি বলে চেয়েছিলেন যাতে আমি হিন্দিটা শিখি, তাই ক্লাস ওয়ান থেকেই আবশ্যিক ভাষা হিসেবে হিন্দি শুরু হয়। দশ বছরে বাবা কোথাও বদলি হননি, তবুও আমি হিন্দিটা দিব্যি শিখে গেলাম। ভালবেসেই পড়েছিলাম, তাই বোর্ডের পরীক্ষার পর বারোশ টাকার বৃত্তিও পাই। স্কুলের হিন্দি শিক্ষক আমাকে যারপরনাই স্নেহ করতেন, একবার পরীক্ষায় ওঁর ছেলের চেয়েও আমি বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। তাতে বলেছিলেন যে ওঁর বিশ্বাস ভাষাটায় আমার দখল জন্মাচ্ছে, কেননা মাতৃভাষা না হয়েও কয়েক বছর শিখে হিন্দি ব্যাকরণে ভাল নম্বর পাওয়া নাকি দুর্লভ ব্যাপার। সিলেবাস ধরে হিন্দি পড়ার পাশাপাশি বাড়িতে বাংলা শিক্ষা চলছিল। ছোটদের বাংলা বই থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণ হয়ে বছর বারো তেরো বয়েসেই বহু উপন্যাস পড়ে ফেলি। আমার মা সংস্কৃতে অনার্স ছিলেন। বড়দের উপন্যাস পড়ছি দেখে সবার আগে বঙ্কিম রচনাবলী ধরিয়ে দিলেন। ‘দারুণ নিদাঘের সন্ধ্যায়…' ইত্যাদি দেখে মায়েরই শরণাপন্ন হয়েছিলাম অর্থ বুঝতে। তারপর আর কোনো বাধা ছিল না, বইয়ের আলমারির উত্তরোত্তর বৃদ্ধি দেখে কয়েক বছর অন্তরই নতুন আলমারি বানাতে হয়।
২০০৬ সালে যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলাম, বাক্স-প্যাঁটরার ভেতরে অবশ্যই কিছু বাংলা বই ছিল। বিদেশে ইংরাজি বই পাওয়া গেলেও বাংলা যে পাব না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। নিজের ওই কটা বই পড়ে ফেলার পর বন্ধুদের কাছে যে কটা ছিল সেগুলো শেষ করলাম। ছাত্রাবস্থায় কারুর বাড়ি বা হোস্টেলে গেলে সরেজমিনে একটু দেখে নিতাম তার কাছে কোনও বাংলা বই আছে কিনা। আনকোরা কোনও বই হলে ধার নিয়ে এসে পড়ে নিতাম। প্রতি বছর বন্ধুদের কেউ ছুটিতে দেশে গেলে তাদের হাত দিয়ে বই আনিয়েছি। কলকাতায় যাদের বাড়ি, বাবা-মা বই কিনে তাদের পৌঁছে দিতেন। আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়েছিল, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলাম, সেখানে জনা পঞ্চাশ-ষাট বাঙালি ছিল এবং তার মধ্যে আমরা দশ-পনেরো জন পাশাপাশি মেস করে থাকতাম। দিবারাত্রি বাংলায় বাক্যালাপ চলত, ক্যাম্পাসের ভেতরে দিব্যি নিজেদের ভাষায় আড্ডা দিতাম, বাংলা গান শুনতাম, একসঙ্গে মহালয়া শোনা থেকে শহরের প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করা - এইভাবেই বাংলাকে ভোলার কোনো সুযোগ করে দিইনি নিজেদের। আমার কোনও বন্ধু বাংলায় অসামান্য প্রবন্ধ লিখত, কেউ গান লিখত, কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্লেষক ছিল, আবার কেউ আমারই মত বইপোকা। ফলে আলোচনার বিষয়ের কোনোদিন অভাব হয়নি।
বিয়ের পরে দেশের যে কটা শহরে থেকেছি, কোথাও বাংলাকে ভোলার কোনো অবকাশ হয়নি। টিভিতে বাংলা চ্যানেল, সিনেমা হলে বাংলা ছবি ও বাঙালী রেস্তোঁরা খুঁজে বের করা আমরা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিলাম। বাংলা বইয়ের যোগান একটু সহজ হয়ে গিয়েছিল ততদিনে অনলাইন কেনাকাটার সুযোগ এসে। এ ছাড়া পুণে বা হায়দ্রাবাদে বাংলা পূজাবার্ষিকী সংখ্যাগুলিও পাওয়া যেত প্রতি বছর। কিছু বই বাবা-মা অথবা বন্ধুরা ক্যুরিয়ার করত। ততদিনে নিজেও বাংলা ব্লগ ও ছোটগল্প লিখতে শুরু করি যার কয়েকটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে কার না ভাল লাগে। সেই তাগিদেই লেখা চালিয়ে যাই। প্রবাসে বন্ধুরা উৎসাহ দিয়েছে প্রচুর। হায়দ্রাবাদের বাঙালি পূজা সমিতির উদ্যোগে যে শারদীয়া পত্রিকা প্রকাশ হয় প্রতি বছর, তাতে একবার আমার একটি কবিতা বেরোয়। ততদিনে আমরা সে শহর ছেড়ে চলে গেলেও এক বন্ধু নিয়ে আসে পত্রিকার এক কপি। এভাবেই একে অপরের দ্বারা রিলে দৌড়ের মত বাংলা ভাষা উদ্ভাসিত হয় দেশ জুড়ে।
গত চার বছর ধরে বাংলা থেকে বহুদূরে থাকি, শুধু বাংলা কেন, দেশ থেকেই বহুদূরে, বলা যায় প্রায় হাজার যোজন দূরে। বাংলা ভাষা বলার লোক যদিও এখানে খুব একটা কম নয়। ভারতীয় বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের লোকেরা আছেন। গল্প করতে কোনো অসুবিধা হয় না। সেরকমই একজন আমাদের প্রতিবেশী। ওঁর দোকানে গেলে আমাদের পরিবার সম্পর্কে কুশলাদি জিজ্ঞ্যেস করেন, নিজেদের সুখদুঃখ ও খাবারদাবার ভাগ করে নেন। দেশটুকু যে আলাদা সেটা ক্কচিৎ কখনও কথায় উঠে আসে। বাঙালী বিদেশে আসার আগে সবার আগে খোঁজ নেয় মাছ বা পাঁঠার মাংস পাওয়া যায় কিনা। সেই খোঁজেই আমরাও গিয়েছিলাম একটি বাংলাদেশী দোকানে। গিয়ে বরঞ্চ দোকানির সঙ্গে এমন আলাপ জমে গেল যে গত তিন বছর ওঁর দোকানে যেতাম হাতে সময় নিয়ে, বাংলায় গল্প করার জন্যে। সিলেট থেকে বরিশাল, সব জেলার লোকেই আসতেন সেখানে, আমরাও কিছু গল্প ফাউ পেয়ে যেতাম। ইলিশ মাছের আমদানি-রপ্তানি থেকে বাতাবি লেবুকে ওখানে জাম্বুরা বলা হয়, তোপসে মাছকে ওঁরা বলেন তাপসী, বা ওই মাসে পুঁইশাক কেন আসেনি, এইসব গূঢ় আলোচনাও হত। বাংলা চর্চায় পোস্ত বা পুঁইশাক কুলীনের পর্যায়ে না পড়লেও গল্পে আমোদের কোনো কমতি কিন্তু ঘটায় না।
মাতৃভাষা নিয়ে ফরাসি বা জার্মানরা যতটা ভাবনাচিন্তা করেন, বাঙালীরা ততটা করেন না - এরকম একটা গুজবের গুঞ্জন কানে আসে আজকাল। এর খানিকটা অবশ্যই সত্যি, কিন্তু এর উলটোদিকেও বহু বাঙালী আছেন। আমার কয়েকজন পরিচিতের সাত-আট বছরের বাচ্চারা যখন প্রবাসে বসে ফরাসী স্কুলে পড়ে বাড়িতে ইংরাজি চর্চার পরেও পয়লা বৈশাখে বাংলায় 'বীরপুরুষ' আবৃত্তি করে, তখন মনটা ভরে যায়। এতে তাদের বাবা-মায়েদের প্রচুর কৃতিত্ব আছে নিঃসন্দেহে; এঁরা বাড়িতে একসঙ্গে দুটো ভাষা শেখান (বাংলা ও ইংরাজি) যেগুলো স্কুলে পড়ানো হয় না। এই উদ্যম না থাকলে বাচ্চাগুলি বাংলায় কথা বলতেও পারত না হয়ত, আবৃত্তি-গান তো দূরের ব্যাপার। আমার প্রতিবেশীর শিশুটি প্রশ্ন করেছিল, যে সাতাশের পরে যদি আঠাশ হয়, তাহলে তার পরেরটা নতাশ নয় কেন। তার এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা কয়েকজন চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাংলা গুণতিতে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এও কি এক ধরনের ভাষা চর্চা নয়?
বাংলায় লেখা, পড়া বা কথা বলা ছাড়াও যেটা অবচেতনে করি সেটা হল বাংলায় ভাবা। দোকানে গিয়ে আটচল্লিশ যোগ পঁচিশ করতে হলে এখনও মনে মনে ভাবি, চল্লিশ আর পঁচিশ যোগে পঁয়ষট্টি, আর আট হল তিয়াত্তর। আমার ধারণা, এটা যতদিন অবচেতনে থাকবে, আমার পক্ষে বাংলা ভুলে যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, সে যে দেশেই থাকি না কেন।
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৩
স্বাদেশিকতা পর্ব ১৮০৯-১৮৭২
কিছু শব্দ কিছু কথা
সাধারণভাবে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীকে বাংলায় নবজাগরণের যুগ হিসেবে ধরা হয়। আবার সেই ঊনবিংশ শতাব্দীরই দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অর্থাৎ মার্ক্স কর্তৃক অভিহিত ১৮৫৭র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকে ধরা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয় আন্দোলনের যুগ। এই প্রবন্ধে কিন্তু সময়ের এই ভাগকে সে হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। যুগটা নবজাগরণের হলেও তার মূল শক্তি বা প্রেরণাটা কি? লেখকের মতে সেটা স্বাদেশিকতা। এই স্বাদেশিকতা দেশে সবসময়ই ছিল, কিন্তু তার ধার কমে গিয়েছিল। নতুন বিরোধের সংস্পর্শে এসে সে নিজেকে শানিয়ে নেবার অবকাশ পায়। তাই ১৮০৯ থেকে ১৯০৯ সাল এই একশ বছরকে দুটি কালপর্বে ভাগ করে বাংলায় স্বাদেশিকতার কাল হিসেবে দেখানো হল। ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ সাল একটি কালপর্ব, ১৮৭২ থেকে ১৯০৯ সাল আর একটি কালপর্ব। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ ডানা মেলতে শুরু করে এই ১৯০৯ সাল থেকেই, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে যার অন্তিম পরিণতি দেখতে পাই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায়।
এই স্বাদেশিকতার প্রথম কালপর্ব হল ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ। এই সময় জুড়ে দেখি আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষা ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। সব মিলিয়ে একে বলতে পারি সমাজসংস্কার। ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দে পৌঁছে এই প্রেক্ষাপটটা অনেকটাই বদলে গেল। এমন নয়, যে সমাজসংস্কারের চেষ্টাগুলো আর রইল না, কিন্তু ঐ বছরই বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হবার পর থেকে বাংলায় স্বাদেশিকতার পালে যে হাওয়া লাগল, তাকে আর শুধুমাত্র সমাজসংস্কার বলা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের বলিষ্ঠ লেখনীতে একদিকে যেমন প্রবল দেশপ্রেমের হাওয়া বইতে লাগল, অপরদিকে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। দেশে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল স্বাধীনতার আকাঙ্খা। সেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হল জাতীয়তাবাদে। এবং ১৯০৯ সাল থেকে এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের উপজ হিসেবেই জন্ম হল ক্ষমতার কাঙালপনার, যার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, চুরমার হয়ে গেল মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের কল্পনা, যদিও আপাতদৃষ্টে আমরা এক স্বাধীন ভারত পেলাম।
একটা শব্দ অনেক কথা বলে। যেমন, স্বাদেশিকতা। স্বাদেশিকতা এসেছে স্বদেশ থেকে, নিজের দেশ। গোড়ায় দেশ। ব্রিটিশরা যখন এ দেশটাকে রাষ্ট্রে পরিণত করে নি, তখনো দেশ ছিল। কিন্তু তখন ভারতবর্ষ ছিল একটা ধারণা, বিশেষ করে মহাকাব্যগুলির সূত্রে যে ধারণা সমাজমানসে অধিষ্ঠিত ছিল। আর দেশ বলতে যে নির্দিষ্ট জায়গায়--প্রধানত গ্রামে-- একজন মানুষ থাকত সেটা হত তার দেশ, আবার যে জনপদের সে অধিবাসী সেটাও হত তার দেশ। দেশ শব্দটার দ্বৈত অস্তিত্ব।
স্বাদেশিকতা কোনো উপনিবেশিক উপাদান নয়। স্বাদেশিকতা আধুনিক শব্দ, কিন্তু স্বাদেশিকতা দিয়ে যেটা বোঝায় সেটা আধুনিক নয়। সেটা হল দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম। নিজের দেশকে ভালোবাসাটা সর্বজনীন ও সর্বকালীন সত্য, সে যে যে দেশেরই হোক না কেন। দেশ মানে শুধু দেশের মানুষকে ভালোবাসা নয়। দেশ মানে দেশের আলো, হাওয়া, জল, মাটি, গাছপালা, পশুপাখি থেকে শুরু করে পাহাড়, অরণ্য, গ্রাম, শহর, মানুষের মন, তাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং দেশপ্রেম মানে এই সবকিছুর সঙ্গে একাত্মবোধ, যেমনটি পাই কালিদাসের মেঘদূতে রামগিরি আশ্রম থেকে অলকাপুরীতে যাবার যক্ষের দেওয়া দীর্ঘপথের বর্ণনায়। “যাও না বন্ধু, পথ বলে দিচ্ছি আমি। পথ তোমার ক্লান্তিকর হবে না। পাবে জল, পাবে ছায়া, পাবে সৌধোৎসঙ্গের উষ্ণতা। চোখ, কান দুই-ই জুড়োবে তোমার। দেখবে মধুর দৃশ্য, শুনবে কিন্নরীদের গান, শুধু একটু মন্দ্রধ্বনি যদি কর মৃদঙ্গের সঙ্গত হবে শিবসঙ্গীতে। কেকাধ্বনিতে স্বাগত জানাবে সজলনয়ন ময়ূরেরা। নদীদের ভ্রুভঙ্গী তো দেখবেই, নগরবধূদের ভ্রুলতাবিলাসও নিশ্চয় তোমার দৃষ্টি এড়াবে না। চোখ তুলে তারা তোমার দিকে যখন চাইবে, মনে হবে কৃষ্ণভ্রমরের পঙক্তি। এ সব দেখতে দেখতে তুমি কৈলাসে এসে পড়বে, আর কৈলাসের কোলেই তো অলকা।”
ভাবের কথা ছেড়ে যদি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসি, তাহলেও দেখব একজন দেশপ্রেমিক চায় যেন তার দেশের আলো, হাওয়া দূষিত না হয়, যেন জল, জঙ্গল, জমি ধ্বংস না হয়। যেন তার দেশে দারিদ্র না থাকে, শোষণ না থাকে, বঞ্চনা না থাকে, হিংসা না থাকে। যেন তার দেশটা আরো সহনশীল হয়, আরো গণতান্ত্রিক হয়, প্রকৃতিগতভাবে যেন দিন দিন আরো inclusive হয়। যেন তার দেশের ভাষাগুলোর দিন দিন সমৃদ্ধি ঘটে, যেন যার যার ধর্ম অটুট থাকে। অবশ্যই সে চায় দেশকে এবং নিজেকে সুরক্ষিত দেখতেও। নিজের দেশের সম্পর্কে সে যেমন এইসব চায়, বিশ্বের সব দেশের সম্পর্কেই সে একই কামনা করে। যেন সব দেশই শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে, আনন্দে থাকে, সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তার এসব চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষমতার গন্ধ নেই। সে নিজের জীবনযাত্রার ধরন, নিজের বিশ্বাস, নিজের মূল্যবোধ, নিজের ঐতিহ্য, নিজের ভাষা, নিজের ধর্ম যে কোনো কিছুর মূল্যে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু চায় না সেসব অন্য কারুর ওপর চাপিয়ে দিতে। তার মধ্যে কোনো আগ্রাসী ভাব নেই, স্বভাবগতভাবেই সে রক্ষণশীল। এই ধারণাতেও সে ভোগে না যে তার দেশ ভুল করলেও দেশপ্রেমিক হিসেবে তার একমাত্র পবিত্র কর্তব্য তাকে সমর্থন করা, My country right or wrong। কারণ একজন দেশপ্রেমিক নিজের দেশকেও নৈতিকতার মানদণ্ডে যাচাই করে। এবং চায় না যে তার দেশের নৈতিক অধঃপতন হোক। স্বাদেশিকতার সঙ্গে নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।
স্বাদেশিকতার কথা উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের কথাও ওঠে। অতএব দেখা যাক জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ শব্দটা আবশ্যিকভাবেই আমাদের দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি করা একটি শব্দ। জাতি শব্দটা নিয়ে গোড়া থেকেই সমস্যা। জাতির অর্থ কী? ইংরেজিতে জাতির অর্থ করা হয়েছে nation। কিন্তু ঠিক তাই কী? ইংরেজিতে জাতির অন্তত চাররকম মানে পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় জাতি অর্থে race, যেমন ককেশীয় জাতি, নিগ্রো জাতি, মঙ্গোলীয় জাতি। জাতি অর্থে nationও, যারা যৌথভাবে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস, নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের অংশীদার এবং একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণ, যেমন ব্রিটেন। আবার জাতি অর্থে ethnic groupও, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, আসলে raceএরই ক্ষুদ্রতর শ্রেণিবিভাগ, যেমন ককেশীয় জাতির একাধিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ানরা এবং জার্মানরা উভয়েই ককেশীয় জাতির অন্তর্গত, কিন্তু রাশিয়ানরা স্ল্যাভিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, জার্মানরা নরডিক। এবং চতুর্থত মোহম্মদ আদিবের মতে, জাতি অর্থে tribeও, যদিও তাদের আমরা উপজাতি হিসেবেই চিহ্নিত করি। তিনি লিখেছেন, “উপজাতির সংজ্ঞাটি বেশ গোলমেলে, কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে উপজাতি বলতে রাষ্ট্র স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষদের বোঝায় যাদের মোটামুটি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ রয়েছে।” উদাহরণস্বরূপ তিনি চাকমাদের কথা বলেছেন। চাকমারা একটি ছোট অঞ্চলের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও মারমা, ত্রিপুরা সহ অন্যান্য উপজাতিদের থেকে আলাদা, তাদের রয়েছে একই সঙ্গে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রয়েছে নিজস্ব রাজা, আবার তারা একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম গোলমেলে। জাতি বলতে একই সঙ্গে বোঝায় বর্ণ, জাতি, জাত, এমনকি কখনো কখনো সামাজিক শ্রেণিও। অহিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বর্ণ, জাতি বা জাত খাটে না বটে, কিন্তু তাদেরও রয়েছে নানারকমের ভাগ।
এই জাতি থেকে আরো কতকগুলো শব্দ এসেছে। জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) বা রাষ্ট্র-জাতি (state-nation)। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বলা হয় জাতি বা nation হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাতিসত্তা, রাষ্ট্র নয়। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে বলে রাষ্ট্র। যখন একটি জাতির নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকে, একমাত্র তখনই সে হয়ে ওঠে জাতি-রাষ্ট্র। প্রশ্ন ওঠে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে রাষ্ট্র বলে যদি মেনেও নিই, তার অন্তর্গত জাতিসত্তাটি কি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ অভিন্ন? পৃথিবীতে এমন দেশ কি খুব বেশি আছে? নেই যে তার প্রমাণ আমরা সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দিয়ে পেয়েছি। এখানেই জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। ভারত যেহেতু বিবিধের মাঝে মিলন মহানের দেশ, যোগেন্দ্র যাদবরা জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পালটা রাষ্ট্র-জাতি তত্ত্ব হাজির করেছেন। যদিও তাতে করে সমস্যা মেটে না।
যে অর্থে ভূখণ্ড হিসেবে দেশের একটা নির্দিষ্টতা আছে, nation বলে অভিহিত করে জাতিকেও সেইরকম একটা নির্দিষ্টতা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে সংকট বেড়েছে ছাড়া কমেনি। কারণ প্রাণ-অপ্রাণের নানা বৈচিত্র্য, নানারকমের মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম সবকিছুর মিশেল ঘটেছে দেশ শব্দে, চরিত্রগতভাবে সে সর্বপ্রকারে inclusive। কিন্তু জাতি শব্দটা যেহেতু একান্তভাবে মনুষ্যকেন্দ্রিক, চরিত্রগতভাবে সে এমনিতেই exclusive (অর্থাৎ মনুষ্য ব্যতীত কোনো ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়), তার ওপর nation শব্দে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করায় তার exclusivity বেড়ে গেছে। তাছাড়া, দেশে অন্য আরো অনেক কিছুর মতন মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মেরও ঠাঁই আছে, কিন্তু বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের নির্দিষ্টতার ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে যাওয়ায় nationএ মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। ডালিয়া গেব্রিয়াল, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের এক ছাত্রী, এ নিয়ে বলেছেন,nation শব্দটার সবথেকে বড় সমস্যা এই যে, nationহতে গেলে তাকে আগে নির্দিষ্ট করে নিতে হয় কারা কারা তার পরিধির বাইরে। এই বাইরের লোকজনের তালিকায় সবার আগে থাকে পরিযায়ীরা (অর্থাৎ মানুষের চলিষ্ণু ধর্মের কোনো ঠাঁইnation-এ নেই), তার পরে থাকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া লোকজন, সন্দেহজনক ব্যক্তিরা, মেয়েরা এবং অক্ষমরা। এবং যেহেতু তারা nationএর পরিধির বাইরে, তাদের অকল্পনীয় হিংসার শিকার হতে হয়। কেন এমন হয়? কারণ,nationগড়ে ওঠে যুক্তিবহির্ভূত জাতিসত্তাকে (বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায়, কল্পিত) কেন্দ্র করে এবং অন্য যারা এই পরিধির বাইরে, তাদের জীবনের কোনো মূল্য তাদের কাছে থাকে না। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। nation শব্দটাকে ঘিরে এতসব ঝামেলা এড়াতে আন্তর্জাতিক আইনে এখন আর nation অর্থে জাতি ধরা হয় না, একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে, যেখানে অনেক লোক একসাথে বাস করে, nation বলা হয়।
জাতি থেকে জাতীয়তা থেকে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেক প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে “রাষ্ট্রকৃত সমস্ত ভালো মন্দ ক্রিয়াকলাপ ছাপিয়ে নিজেকে তার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার এবং সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রের স্বার্থকে ঠাঁই দেওয়ার প্রবণতা।” তাঁর বিশ্লেষণে, ক্ষমতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা, জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপ্ত থাকে ক্ষমতার আকর্ষণ। রাষ্ট্র চায় যে কোনো কিছুর মূল্যে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে, নিজেকে সর্বাধিক সম্মানিত করে তুলতে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে আর যেহেতু জাতীয়তাবাদী মানুষ ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে, রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে অভিন্ন করে ফেলে, তার চাওয়াগুলোও রাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তখন সেই ব্যক্তিমানুষ যেহেতু সে রাষ্ট্র নামক এক বৃহৎ শক্তির পক্ষ নিয়েছে, তার উচ্চমন্যতার কারণে কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি আর শুনতে চায় না এবং সামান্যতম সমালোচনা তাকে হিংস্র করে তোলে। শুধু তাই না, তার নিজের ঘটানো হিংসামূলক ঘটনাগুলোকে অব্দি সে অস্বীকার করতে থাকে। আর তবু মানতেই হবে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আমাদের এখানে (এবং মহারাষ্ট্রে) যে স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেধেছিল, ১৯০৯ সালে তাই পরিণত হয় পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদে।
স্বাদেশিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা হচ্ছে এই—স্বাদেশিকতা মৌলিক রূপে কোনো বিদেশি জিনিস নয়, যদিও স্বাধীন দেশের স্বাদেশিকতা একরকম, পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা আর একরকম। পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত, যেমন, ইংল্যান্ড স্বাধীন দেশ, সপ্তদশ শতাব্দীর সেই ইংল্যান্ডে যেভাবে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে সার্বিক প্রতিরোধের মাধ্যমে খর্ব করে দেওয়া গিয়েছিল, আমাদের এখানে তা সম্ভব ছিল না। বিদেশী শাসনের শুরুতেই উপনিবেশিক শাসক যেভাবে আমাদের হিন্দু ও মুসলমান দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল এবং যেভাবে ক্রমাগত মুসলমানদের সর্বক্ষেত্র থেকে হটিয়ে বর্ণহিন্দুদের সেই জায়গায় তুলে এনেছিল, তারপর কোনো প্রতিরোধই আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হওয়া সম্ভব ছিল না। জাতীয়তাবাদ কিন্তু সে অর্থে সীমায়িত নয়। জাতীয়তাবাদ শব্দ এবং সে আদর্শের সারবস্তু দুটোই এদেশে খোদ ইয়োরোপের রপ্তানি। ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক নানা ধরনের যে সংগ্রাম চলেছিল, অজস্র অত্যাচার মুখ বুজে সহ্যের বিনিময়ে, অজস্র বলিদানের বিনিময়ে, অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে যা স্বাধীনতা(?) নিয়ে এল, সে সম্পর্কে এককথায় বললে বলতে হয় ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল আর সেই সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বকে তছনছ করে দিয়ে গেল। জাতীয়তাবাদ যদি এত উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল কেন এবং আমাদের অস্তিত্বকে তার শেকড় থেকে উৎপাটিতই বা করে দিয়ে গেল কেন? একথার উত্তরে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, দুর্বল ও দরিদ্র দেশগুলো যে এই আদর্শকে খুব যুক্তিপূর্ণ এবং আত্মশক্তির জাগরণের সহায়ক বলে ভেবেছিল, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কোনো বিচারশীল, উদার, সর্বংসহ, সৃজনশীল আদর্শ নয়। ইয়োরোপের বাইরে কোথাও এ জিনিস ছিলও না। এ হল দেশে দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি। শুধু রপ্তানিই নয়, রীতিমত সর্বনাশা রপ্তানি, কারণ এ কোনো যুক্তি বা মুক্তির সন্তান নয়, বরঞ্চ তার উল্টোটা, উদগ্র কল্পনাবিলাস, রাজনৈতিক ত্রাণকর্তার ভঙ্গির ফসল, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীনতার হত্যা।
ফিরে যাওয়া যাক স্বাদেশিকতায়। আগেই বলা হয়েছে আমাদের স্বাদেশিকতা এই উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত ছিল। সেই সীমায়িত স্বাদেশিকতা আমাদের মধ্যে কী ধরনের উপনিবেশিকতার জন্ম দিল তার ইঙ্গিত দেওয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। যেমন প্রথম থেকেই ভাগ হয়ে যাওয়াতে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারল না। তবু চেষ্টা হয়েছিল, ১৮৫৭ সালে, যাকে আমরা বলি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর একটা চেষ্টার কথাও বলা যায়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৬৩ সালে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল এবং যা ধিকধিকিয়ে চলেছিল ১৮০০ সাল অব্দি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে এর চেহারাটা ছিল ভাঙাচোরা। সেই ভাঙাচোরা দুর্বল আংশিক প্রতিরোধ নিয়ে আমরা যত গর্বই করি না কেন, তা আসলে উপনিবেশিকতা ছাড়া কিছু নয়। ব্রিটিশরা কেন এরকম করেছিল তার কারণ আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং শাসকের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি থেকেই ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। যদিও ভারততত্ত্ব তখনো দানা বাঁধেনি, কিন্তু ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এদেশে এসেছিল। বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি থেকে, তাদের দেশ থেকে যেসব লোক মোঘল আমলে এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের প্রদত্ত বিবরণ থেকে তারা এসব খবর সংগ্রহ করেছিল।
উপনিবেশিক ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার থেকে যে উপনিবেশিকতার জন্ম তার বোঝা আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। উপনিবেশিক ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত এই স্বাদেশিকতা আর্থ-সামাজিক স্তরেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সবথেকে বড় উদাহরণ হল জমির পণ্য হয়ে যাওয়াটা আমরা বিনাবিচারে মেনে নিলাম। জমিতে আগে কৃষকদের মালিকানাস্বত্ব ছিল এটা জেনেও রামমোহন কৃষকদের দখলিস্বত্বের কথা বললেন। আগে জমিদারদের কোনো দখলীস্বত্বই ছিল না, তারা ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। ব্রিটিশ আমলে ব্যাপারটা পুরো উল্টে গেল। এখন হয়ে দাঁড়াল কৃষকের দখলিস্বত্ব আর জমিদারদের মালিকানাস্বত্ব (যদিও আপাতদৃষ্টে, কেননা রাজস্ব ঠিকমত দিতে না পারলে জমিদারিও নিলামে উঠত এবং হস্তান্তরিত হত)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জমিদাররা জমি নিয়ে যা খুশি করতে পারত। স্বাধীনমত জমি কেনাবেচা করতে পারত, কৃষকের কাছ থেকে মোটা রকমের খাজনা আদায় করতে পারত, জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করতে পারত। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিতে সরকারি খাজনার রকমফের হত। কোনোবছর অনাবৃষ্টি হয়ে উৎপাদন কমে গেলে সেই অনুযায়ী খাজনা দিলেই হত। এখন সরকারি খাজনার পরিমাণের কমাবাড়া বলে কিছু রইল না, উৎপাদন যাই হোক না কেন। সেই খাজনার ওপর আবার জমিদাররা আবওয়াব ইত্যাকার নানারকমের অন্যায় দাবি চাপিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস তুলল। জমিদারের খাজনা এবং বাড়তি আবদার মেটাতে গিয়ে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে লাগল। সে ধার মেটাতে না পেরে হয় মহাজন নয় জমিদারদের কাছেই জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতে লাগল। দেখতে দেখতে কৃষকদের একটা বিশাল অংশ পরিণত হল ভূমিহীন খেতমজুরে। ওদিকে ইংরেজ শাসনের দৌলতে দেওয়ানি বেনিয়ানি মুচ্ছুদিগিরি করে যারা দেদার টাকা আয় করেছিল, নিলাম হওয়া পুরোনো জমিদারিগুলো তারা ক্রমান্বয়ে কিনে নিতে থাকল। কিন্তু তারা বেশির ভাগই কলকাতার বিলাসব্যসনে আসক্ত এবং শহর ছেড়ে থাকতেও চায় না, ফলে জমিদারিগুলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ সম্পর্ক হত ক্ষীণ। এইভাবে জন্ম হল একদল অনুপস্থিত জমিদারের। এইসব নতুন জমিদার না জমিদারি পরিচালনার কিছু বুঝত, না জমিদারি থেকে পাওয়া লাভ ছাড়া আর কোনোকিছুতে তাদের উৎসাহ ছিল। জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের ও তদারকির দায়িত্ব তারা যাদের ওপর ছেড়ে দিতে থাকল, তারাই জন্ম দিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির— পত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, পাঁতিদার, তালুকদার, ইজারাদার, জোতদার ইত্যাদির।
এ পর্যন্ত এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষণীয় রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষতা করলেন এই যুক্তিতে যে এর ফলে পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে আয়বৃদ্ধি হবে এবং তার জন্যে খাজনা বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তিটা যে ভুল তা আগেই দেখানো হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন)। বেশির ভাগ পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেই চাষবাস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল আমলে। অতএব কৃষকের দ্বারা জমির উন্নতি ইংরেজ আমলের ঘটনা ছিল না। অবশ্য কৃষকের দুর্দশার প্রতিবিধান করতে গিয়ে রামমোহন গবর্নমেন্টের সঙ্গে জমিদারের যেরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রজার সঙ্গেও তেমনি জমিদারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন, কেননা কৃষক জমির উন্নতি করলেই যদি জমিদার খাজনা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কৃষক আর জমির উন্নতি করার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। হতে পারে রংপুরে থাকতে যে কৃষক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, জমিদারের সঙ্গে কৃষকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবের নেপথ্যে সেই সম্পর্কের একটা ভূমিকা ছিল। রামমোহন কৃষির উন্নতির জন্যে সরকারকে একটি কৃষি দপ্তর খোলার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
এহ বাহ্য। এই ‘কৃষির উন্নতি’ ব্যাপারটা কী? যে দেশের সমাজটাই কৃষিপ্রধান, বাইরে থেকে এসে একদল শাসক তার কী উন্নতি করতে পারে? যে দেশের কৃষক দিবারাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার জমি চষে চলেছে, যে তার জমিকে হাতের তালুর মত চেনে, তাকে কৃষির উন্নতির ব্যাপারে পরামর্শ দিতে যাবার এই চেষ্টা কেন, তাও আবার পরামর্শদাতা তাঁরা যাঁরা কৃষির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। রামমোহন থেকে এই সংস্কৃতি ঊনবিংশ শতাব্দী হয়ে আজো বহমান।
এই প্রবন্ধে প্রতিটি কথা প্রমাণসহ বলা সম্ভব নয়, মোটের ওপর ব্যাপারটা হচ্ছে এই, ভারতীয় কৃষিকে আদিম পর্যায়ের ও পশ্চাৎপদ বলে দেগে দিয়ে ব্রিটিশের দিক থেকে কৃষির উন্নতির আয়োজন করার দুটো বড় কারণ ছিল। খাজনা নির্দিষ্ট করে দেবার ফলে একদিকে বিশাল পরিমাণ কৃষক প্রতিদিন খেতমজুরে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল এবং অপরদিকে ব্রিটিশ কর্তৃক কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে বিশাল পরিমাণ কারিগর সেই কৃষিকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছিল এবং এই পরস্পরবিরোধী অবস্থার মধ্যে পড়ে আমাদের কৃষিক্ষেত্র ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল এবং একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটছিল। এই অব্যবস্থাকে চাপা দিতে ব্রিটিশ একদিকে কৃষির উন্নতিতে কৃষকের অনাগ্রহের কথা চাউর করেছিল এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে কৃষির উন্নতি তত্ত্বকে সামনে এনেছিল। কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ হল, শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে এইসময় যেসব কৃষি সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ হয়েছিল, বিশেষ করে লাঙল এবং কাস্তের, ভারতে সেসবের বাজার তৈরি করা। ঐসব লাঙল এবং কাস্তে বিক্রি থেকে একটা আয় আসবে, তার ওপর ঐসব লাঙল ও কাস্তে ব্যবহারের ফলে জমি বেশি উর্বর হবে, উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন বাড়লে জমির আয় বাড়বে, জমির আয় বাড়লে রাজস্ব বাড়বে, পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি শুল্কও বাড়বে।
মাইকেল মধুসূদন যখন উত্তরপাড়ায় ছিলেন, তখন উত্তরপাড়া হিতকারী সভা কৃষিবিদ্যা নিয়ে বলতে ডাকেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্রকে। সভার বিষয় শুনে মাইকেল বলেছিলেন, “কৃষিবিদ্যা নিয়ে আবার বক্তৃতা কি? চাষারা কি জানে না কি করে ধান বুনতে হয়। খাচ্ছ কি করে? তাদের আবার কৃষিবিদ্যা কি শেখাবে?”
ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে বলতে গিয়ে জন অগুস্টাস ভোয়েলকার বলেছিলেন, “বেশির ভাগ জায়গাতেই উন্নতি করার মত প্রায় কিছুই নেই।” জন কেনি বলেছিলেন, “যেখানে একটা প্রদেশেই চার হাজারের মত ধানের প্রজাতির উৎপাদন হয় এবং প্রত্যেকটা প্রজাতিকে তার গুণাগুণ ও তার উপযুক্ত জমি অনুযায়ী ভাগ করে চাষ করা হয়, সেখান থেকে বীজ সংগ্রহের কোনো মানে হয় না। এমনকি ভারতীয় কৃষিতে আধুনিক লাঙলের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না।” আর ১৮৩২ সালের ১৩ অগস্ট কমনস কমিটির সামনে দেওয়া সাক্ষ্যে বটানিকাল গার্ডেনের তৎকালীন সুপারিন্টেডেণ্ট ড. ওয়ালিক বলেছিলেন অধিক ফসলের স্বার্থে বাংলার নরম মাটিতে ব্যবহৃত সনাতনী লাঙলের বদলে ইয়োরোপীয় লোহার লাঙল ব্যবহার করার ফলে নিচের নোনা মাটি উঠে জমির ক্ষতি হয়ে যাবার কথা।
স্বাদেশিকতার অন্য উদাহরণগুলো হল, যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষার ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। ডিরোজিওর ছাত্ররা যে এ ব্যাপারে খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলির সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে সবথেকে বেশি যাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরেরও রামমোহনের মত ক্ষুরধার বিচারশীল মন ছিল, তিনি শাস্ত্রঘেঁষাও ছিলেন না, বরঞ্চ রামমোহনের তুলনায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অনেক কম, আর তবু তাঁকে তাঁর সমাজসংস্কারের কর্মসূচিগুলোকে সফল করতে বারে বারে শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কেন? ১৭৭২ সালে দশ জন পণ্ডিতের সাহায্যে ওয়ারেন হেস্টিংস শ্রুতি, স্মৃতি, শাস্ত্র ও ব্যবহার এই চার উপাদানের ওপর নির্ভর করে হিন্দু আইন বিধিবদ্ধ করলেন। এর ফলে গোটা সমাজের বুকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য আরো চেপে বসার সাথে সাথে শাস্ত্রকে এড়িয়ে সমাজসংস্কার অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এটা রামমোহনের পক্ষেও সত্যি ছিল। ব্রিটিশ আসার আগে আমাদের দেশে শাস্ত্র ছিল, ধর্মীয় গোঁড়ামোও ছিল, কিন্তু এরকম কোনো ব্রিটিশ ধাঁচের সুসংহত হিন্দু আইনের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল না। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রাক-ব্রিটিশ সমাজেও ছিল, কিন্তু তখন কি রাষ্ট্রীয় পরিসরে কি সামাজিক পরিসরে, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় সমাজের পরিসরে, তার প্রতাপ ছিল সীমাবদ্ধ। এর পরের দফায় ১৭৮৪ সালে আমাদের এখানে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ব্রিটিশ কর্তৃক যে সুশৃঙ্খল সংস্কৃতচর্চার জোয়ার এল, যাকে বলা হতে লাগল ভারততত্ত্ব, তার জোয়ারে আমাদের দেশীয় পণ্ডিতদের সংস্কৃতচর্চা তলিয়ে গেল। প্রথমে আইন, তারপর তার খোপের মধ্যে সংস্কৃতচর্চাকে পুরে দিয়ে শাসক গোষ্ঠী এ দেশ সম্পর্কে যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তৈরি করল, তাকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ‘epistemic violence’ বা ‘জ্ঞানতত্ত্বমূলক হিংসা’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশের হাতে গড়ে উঠল এক নতুন হিন্দুসমাজ, যার কর্তৃত্ব ব্রাহ্মণদের হাতে। অনেক পরে ১৯২৫ সালে সেই হিন্দুসমাজের পক্ষ নিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বললেন, “যাবতীয় রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং বিদেশি আক্রমণের মধ্যে হিন্দুসমাজকে অখণ্ড রাখতে ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষরাই সবকিছু আইনের আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেইসব আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতম করে তুলেছিলেন।” চৈতন্য ও সূফী আন্দোলনের ফলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব থেকে যে সমাজ অনেকটাই ছিটকে গিয়েছিল, শাসনের সুবিধার্থে তাকে ব্রিটিশ আবার সংহত করে তুলে সমান এবং সহায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত করল। এক আধিপত্যের সঙ্গে আর এক আধিপত্যের সহাবস্থান ঘটল। যে হিন্দুসমাজের উত্তরাধিকার আমরা এখনো বহন করে চলেছি, সে হল এই হিন্দুসমাজ।
আসা যাক মেকলের কুখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’এর কথায়। প্রধানত যে দুটো কারণে মেকলের মিনিট কুখ্যাত, তার একটা হল মেকলের বাগাড়ম্বর, “ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান,” দ্বিতীয়টা হল তাঁর উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা, “এই মুহূর্তে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে একটি শ্রেণি গঠন করার, যারা আমাদের এবং কয়েক কোটি মানুষ যাদের শাসনভার আমাদের হাতে, তাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এমন এক শ্রেণি যারা রক্তে এবং রঙে ভারতীয় হবে, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হবে।” মেকলের বাগাড়ম্বর নিয়ে কিছু বলার নেই, সে মূর্খতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার, কিন্তু মেকলের উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা নিয়ে ঈষৎ ভাবার আছে। কেননা এর ঠিক পরেই মেকলে লিখেছিলেন, “এই শ্রেণির হাতে আমরা দেশের আঞ্চলিক মাতৃভাষাগুলোর সংস্কৃতিসাধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারি, যারা পশ্চিম থেকে বিজ্ঞানের শব্দাবলী নিয়ে ঐসব আঞ্চলিক ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে এবং ভাষাগুলোকে ধীরে ধীরে তারা ঐসব জ্ঞান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উপযুক্ত বাহন করে তুলবে।” মেকলে যদি শুধু আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা বোঝার মত করে গড়ে তোলার কথা বলতেন আর তার জন্যে আমাদের কারো কারো ইংরেজি ভাষাটা জানার ওপর জোর দিতেন, তাহলে তিনি এত নিন্দিত হতেন না। কিন্তু তাঁর বক্তব্য এই দাঁড়াল যে পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারকবাহক যে ইংরেজি ভাষা সেটা জানতে গেলে রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে। যদি ধরেও নিই ইংরেজি ভাষা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারার বাহক, তাহলেও সেটা আত্মস্থ করতে গেলে আমার রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে কেন? তাহলে কি পশ্চিমী বা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা সর্বজনীন নয়, একান্তভাবে ইংরেজ হয়ে উঠতে না পারলে সেগুলো বোঝা সম্ভব নয়? ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা স্পেনকে কি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে কোনো কিছু শিখতে তাদের নিজেদের রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হয়েছিল? মেকলের মতে, ওরকম কথা উঠবেই না, কারণ ওগুলো সবই মহান ইয়োরোপীয় সভ্যতার অংশ, বাদবাকি সব বর্বর দেশ, যেমন ভারত, যাকে সভ্যতার আলো দেখানোর দায়িত্ব তাঁদের হাতে। কোনো বর্বর দেশ যদি ইংরেজের কাছ থেকে কিছু শিখতে চায় তো তাকে সর্বপ্রকারে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে, কারণ ইংরেজের রুচি ইত্যাদি গুণ অর্জন করতে না পারলে সে সেগুলো বুঝে উঠতে পারবে না। এই দম্ভ নিয়ে কথার বিস্তার করে লাভ নেই। শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে নয়, আপাদমস্তক এক উপনিবেশিক শাসকের মতই মেকলে আসলে ইংরেজিনবিশ একটি বশংবদ শ্রেণি গঠনের লক্ষ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন, মেকলের আগে থেকেই যে ইংরেজিনবিশ বশংবদ শ্রেণির গঠন এখানে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিশীল বিচারধারাকে যাঁরা বাংলা ভাষায় আনার চেষ্টা করলেন, তাঁরা কেউই রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে ওঠেন নি। রামমোহন রায় নিজে বাংলায় একটা ভূগোলের বই লেখার চেষ্টা করছিলেন, আত্মীয় সভার সদস্য ব্রজমোহন মজুমদার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ফারগুসনের অ্যাস্ট্রোনমির একটা বাংলা অনুবাদ করছিলেন। তারপর একদিকে এলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সূত্রে অক্ষয় কুমার দত্ত, আর একদিকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এই ধারায় একের পর এক চেষ্টা হল, সেই চেষ্টার শেষ বোধহয় বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন।
আর তবু আধুনিক বিজ্ঞান মাতৃভাষায় সাধারণ মানুষের জ্ঞানতত্ত্বের অঙ্গনে সেভাবে প্রবেশ করতে পারল না। কেন? তার বদলে যেটা ঘটল, সমাজের মধ্য স্তরে ইংরেজি ভাষা নিয়ে দিন দিন বাড়তে লাগল দৃষ্টিকটু রকমের হ্যাংলাপনা, যা ক্রমশ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেল, অপরদিকে আধুনিক বিজ্ঞান শেখার মাধ্যম হয়ে রইল সেই ইংরেজি ভাষাই, যা সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে হয়ে উঠল ক্ষমতার হাতিয়ার।
১৮৩৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মামুদও তাঁর দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের বলেছিলেন, “তোমরা ফরাসিতে ওষুধপত্রের ওপর যেসব বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আছে সেগুলো পড়....আমার উদ্দেশ্য তোমাদের ফরাসি ভাষা শেখানো নয়, আমার উদ্দেশ্য ফরাসি ভাষায় যেসব বিজ্ঞানসম্মত ওষুধপত্র আছে সেগুলোর সম্পর্কে তোমরা জ্ঞানার্জন কর এবং ধীরে ধীরে সেগুলো আমাদের ভাষায় নিয়ে নাও।” আমাদের দেশে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা বিতর্কিত চিঠিটিতে রামমোহনও প্রায় একই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন লাটসাহেব যেন পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে, যেমন অঙ্ক, প্রাকৃতিক দর্শন (এখনকার ভাষায় পদার্থবিজ্ঞান), রসায়ন, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি, আমাদের পরিচয় ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। যেহেতু এসব বিষয়গুলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ছাড়া জানার উপায় নেই, ইংরেজি ভাষার জ্ঞানটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থার প্রেক্ষিত কী? সবথেকে বড় প্রেক্ষিত যে দেশজ বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে এ দেশের সমাজ গড়ে উঠেছিল তা ছিল প্রকৃতিগতভাবে কৃষিপ্রধান আর আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে যে সমাজ ইংল্যান্ডে গড়ে উঠেছিল সে সমাজ ছিল শিল্পপ্রধান। কৃষিপ্রধান সমাজের ও শিল্পপ্রধান সমাজের মনন কি একরকম হতে পারে? কৃষিপ্রধান সমাজের দর্শন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি; শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শন সেখানে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। ইয়োরোপের শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শনের সঙ্গে বেদের এই কথাটার মিল হওয়া কি সম্ভব?
ভুঁই গো, যা তোর এখানে ওখানে খুঁড়ি,
ভরে যাক পূরে যাক সব তাড়াতাড়ি।
ওগো নির্মলা বিদ্ধ না করি যেন
মর্ম তোমার, তোমার হৃদয়খানি।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরে আমাদের দেশের বাকি সাধারণ মানুষ যে এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের প্রতি আত্মিক টান সেভাবে অনুভব করল না, সম্ভবত তার একটা অন্য কারণও আছে। আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক আর এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে ছিল ক্ষমতার সম্পর্ক, আমাদের সহজাত বোধে যার অস্তিত্ব ছিল না এবং যার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন বিরূপতা ছিল? যেসব ধর্মান্দোলনগুলো সমাজসংস্কারের ধারায় হয়েছিল, চৈতন্য থেকে সূফী, তাদের তত্ত্বে কোথাও ক্ষমতার গন্ধ ছিল না।
ব্রিটিশরাও এখানে এমন কোনো শিল্পপ্রধান সমাজ গড়তে চায়নি যে সমাজ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে এবং তার বাজারের দখল ছিনিয়ে নেবে। শিল্পবিপ্লবের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে প্রধানত এদেশকে কাঁচা মালের রসদদার করে তুলতে চেয়েছিল আর এ দেশটা ছিল তাদের কাছে তৈরি জিনিস বিক্রির বিরাট বাজার। কাজেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিমী জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিচয় ঘটানোর ব্যাপারে সরকারের কোনো আন্তরিক চেষ্টা ছিল না। ড. মহেন্দ্রলাল সরকার যখন ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সাহায্য চান, তখন সরকার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় নি। অনীহার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান শিখিয়ে কী হবে, তার চেয়ে বরঞ্চ টেকনিকাল ইন্সটিটিউট বেশি কাজে লাগবে। সরকারের দরকার ছিল কারিগর। যারা বড় বড় যন্ত্র তৈরির প্রাথমিক উপাদানগুলোর যোগান দিতে পারবে। ওদিকে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর কর্মোদ্যোগীদের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথ ছিল বন্ধ।
১৮০৯ সালকে স্বাদেশিকতার প্রারম্ভিক কাল হিসেবে গ্রহণ করার একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮০৯ সালে রামমোহন যখন রংপুরে ডিগবি সাহেবের অধীনে কাজ করছিলেন, তখন দিনের শেষে সন্ধ্যের পর তিনি বাসাবাড়িতে ধর্মালোচনার জন্যে সভা ডাকতেন। প্রতিপাদ্য বিষয় হত পৌত্তলিকতার অসারত্ব ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা। রামমোহনের নিজের কথায়, তিনি চেয়েছিলেন দেশবাসীর মন থেকে যাবৎ ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে তাদের যুক্তিশীল করে তুলতে। কারণ এই ধর্মীয় গোঁড়ামোগুলো শুধু সমাজের বুনটটাকে ধ্বংস করছিল তাই নয়, পরদুঃখকাতরতাকেও তাদের মন থেকে মুছে দিচ্ছিল। এই যে দেশবাসীর কল্যাণের জন্যে চিন্তা, এটা হল স্বাদেশিকতার গোড়ার কথা। ১৮০৯ সালের ধর্মালোচনার সেই সভাগুলো থেকেই ব্রাহ্মসমাজের যাত্রা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে যদি বলি স্বাদেশিকতার যুগেরও শুরু হয়, তাহলে ভুল বলা হবে না। আর একশ বছর পরে ১৯০৯ সালকে স্বাদেশিকতার অন্তিম লগ্ন হিসেবে ধরা হল এই জন্যে যে এই বছরই স্বদেশী আন্দোলনের শেষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল্স্ অ্যাক্টের কারণে বাঙালি ঐক্য দু টুকরো হয়ে যায় অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়ে করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে বাংলাভাগ রদ হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আগেকার ঐক্য আর বজায় ছিল না।
১৯০৯ সাল থেকে জাতীয়তাবাদের যে আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হল, তার অবস্থান রামমোহন রায়ের বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার রামমোহনের কঠোর সমালোচনায় একটা কথা অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই এলিট বাঙালির ‘জাতীয় চেতনার উন্মেষ’ রামমোহন থেকে হয়নি, (তবে তা রমেশচন্দ্রের ধারণা মত ডিরোজিও থেকেও হয়নি, রামমোহনের মত ডিরোজিও-ও ছিলেন দেশপ্রেমিক) জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বঙ্কিমচন্দ্র থেকে। রামমোহন ছিলেন বিশ্বজনীন মানবতাবাদের পূজারী এবং একথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে এই বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ধারণাও তিনি পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। শুধু খ্রিস্টীয় বা ইসলামী নয়, ভারতীয় দর্শনেরও একনিষ্ঠ ছাত্র রামমোহনের এই আদর্শে স্থিত হওয়ার জন্যে পশ্চিমের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার ছিল না। বিশ্বজনীন মানবতাবাদের উদ্গাতা হিসেবে রামমোহন parallel and different narrative অর্থাৎ সমান্তরাল ও ভিন্ন আখ্যানের জনক হওয়ার দাবী করতেই পারেন। রামমোহনের এই ব্যাটনটাই অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে যায় এবং পরিপুষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক রামমোহন তাঁর বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সঙ্গে বেকনের উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদ এবং বেন্থামের হিতবাদ মিলিয়ে যে আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন, চরিত্রগতভাবেই তা ছিল উপনিবেশিক। উপনিবেশগুলো সম্পর্কে বেন্থামের ধারণার কথা আগেই বলা হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন), বেকন আরো তীব্রভাবে উপনিবেশিক শাসকদের সপক্ষতা করেছিলেন।
পশ্চিমে যেমন কোনো আলোচনার শুরু গ্রিসকে ছাড়া হয় না, গ্রিক সাহিত্য গ্রিক দর্শন গ্রিক বিজ্ঞান, আমাদের দেশেও তেমনি উপনিবেশিক শাসনের আলোচনার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণকে ছাড়া হয় না। আর নবজাগরণের শুরু মানেই রামমোহন। শুধু শুরুই নয়, তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে এমনভাবে ছেয়ে আছেন যে তাঁর আলোচনা ছাড়া এগোনো যায় না। রামমোহন একটি খনিবিশেষ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর রচনা, তাঁর চিঠিপত্র, তাঁর কর্মকাণ্ড সবকিছুর যদি ব্যবচ্ছেদ করা যায় তাহলে আমরা পরের প্রায় দুশো বছরের সংকট, দ্বন্দ্ব ও গতির নিশানা সবই পেয়ে যাই। যেমন, রামমোহনের বিধবাবিবাহ নিয়ে আপত্তি ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “বিধবার বিবাহ তাবৎ সম্প্রদায়ে অব্যবহার্য হইয়াছে, সুতরাং সদ্ব্যবহার করাইতে পারে না।” এর মানে হল, যদিও শাস্ত্রে নিষেধ নেই, কিন্তু সব সম্প্রদায়েই বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছে, অতএব সদাচার হতে পারে না (যদিও এ ধারণাও ঠিক নয়, বর্ণহিন্দুসমাজের বাইরে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না)। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন একথা লিখেছিলেন। এবার ভাবুন ১৮৫৫-৫৬ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাণপাত করছেন, তাঁকে তাঁর পূর্বসূরির তায় রামমোহনের মত ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করে এগোতে কি পরিমাণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
প্রথাগত ধারণা এই যে তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় যুগান্তকারী মাত্রা যোগ করেছিলেন এবং একটা লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন। রামমোহনকে নিয়ে ঘুরেফিরে যত আলোচনা চলে, সব ঐ মাত্রা আর লক্ষ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেহেতু সেই সমাজের ধারাবাহিকতা থেকেই আমরা এসেছি এবং আমাদের মননে আমাদের কর্মকাণ্ডে সেই ধারাবাহিকতা এখনো কোনো না কোনোভাবে বহমান। ফলত রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক থেকে যান এবং যে কোনো আলোচনায় অগ্রাধিকার পান। এর প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার থেকে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঐতিহ্য-আধুনিকতা, বিশ্বাস-যুক্তি, পৌত্তলিকতা-বেদ-উপনিষদ, স্বাদেশিকতা-জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় দর্শন-পাশ্চাত্ত্য দর্শন ইত্যাকার বাইনারি নিয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন, রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক।
তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিমত হচ্ছে তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। কেউ কেউ আবার তা মানতে রাজি নন। একদলের মতে, তিনি ছিলেন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরোধা, যাঁর কাজকর্ম উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিল। আর একদল রামমোহন উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিলেন একথা অতটা মেনে না নিলেও রামমোহনের আধুনিকতা নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন আছে। তাঁদের বিচারে রামমোহনের কর্মকাণ্ডে বুর্জোয়া আধুনিকতা স্পষ্টরূপ পায়নি। আছেন আরো একদল, যাঁরা বুর্জোয়া আধুনিকতার চরিত্র নিয়েই প্রশ্নমুখর। আর একদল যাঁরা এই আধুনিকতাকে উপনিবেশিক আধুনিকতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
যেমন, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার। তাঁর মতে, রামমোহন ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। তিনি তাঁর যুগের সৃষ্টি নন, তিনি তাঁর যুগের স্রষ্টা। সে যুগ আধুনিক ভারতের যুগ। রামমোহনকে এই আখ্যায় ভূষিত করার কারণ হিসেবে তিনি রামমোহনের জন্মের সময়কার অন্ধকারের বিবরণ দিয়েছেন, যে অন্ধকার থেকে রামমোহন দেশকে বের করে এনেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভারতের সুকুমারী শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সৃজনশীল ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল অখণ্ড নীরবতা। কোনো প্রতিভাধর পথপ্রদর্শকের দেখা মিলছিল না। সংস্কৃত সাহিত্যের মহান শিক্ষকেরা অদৃশ্য। প্রদেশের মাতৃভাষাগুলোরও কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছিল না। ভারতীয় মনন হয়ে গিয়েছিল অতীতের ব্যাপার। দর্শনের শাখাগুলি মৃত। তার জায়গায় আসর জমিয়ে বসেছিল ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে নানান কুতর্ক, সেগুলোই দর্শন হিসেবে চলে যাচ্ছিল। মহান ধর্মগুরুদের ধর্মান্দোলনগুলো যেন সেই অন্ধকার সময়কেই গাঢ়তর করে তুলছিল। তাঁদের আধ্যাত্মিক কথা কেউই বুঝতে পারছিল না এবং অনুগামীরা নানারকম সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়ে সেইসব পাপের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল, যেগুলো সমাজ থেকে দূর করার কথা তাদের ধর্মগুরুরা বলেছিলেন। চৈতন্যের প্রেমের বাণী তাঁর অযোগ্য শিষ্যদের হাতে পরিণত হয়েছিল ফাঁপা অগভীর হৃদয়াবেগে। জ্ঞান আর চৈতন্যের অধোগামিতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জাঁকিয়ে বসেছিল ভ্রষ্টাচার এবং সামাজিক অধঃপতন। অটল বিশ্বাস, পবিত্র হৃদয় আর সুস্থ আচরণের জায়গা নিয়েছিল অজস্র কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, অর্থহীন দেশাচার আর লোকাচার। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশ এই সময় একটা সন্ধিক্ষণের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমান আমল গিয়ে সবে কোম্পানি আমল এসেছে, কিন্তু কোম্পানি তখনো প্রধানত বাণিজ্য আর সম্পদ আহরণ নিয়ে ব্যস্ত। দেশে তখনো মুসলমান আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল। নতুন শাসকরা দেশের লোকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণে বাধা দিতে চায় না, কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার ভয়। সতীর অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা একের পর এক লাটসাহেবের গোচরে এসেছে, কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেন নি, কারণ তাহলে কোম্পানি শাসন বিপদে পড়তে পারে। শিক্ষা তখনো সরকারের বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি।
পশ্চিমের সংস্পর্শে ঘুম ভেঙে এ দেশ আধুনিক ভারত হয়ে উঠেছিল এবং তার সেই হয়ে ওঠায় বাংলার অবদান ছিল সবথেকে বেশি, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও সেকথা মনে করেন। তবে তিনি রামমোহনকে আধুনিক ভারতের জনক বলে স্বীকার করতে সেভাবে রাজি নন। তিনি অবশ্য প্রায় সবকিছুতেই রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকাকে নস্যাৎ করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার হল, রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন, জাতীয় চেতনার উন্নতি এবং দেশাত্মবোধের বৃদ্ধির ব্যাপারেও রমেশচন্দ্র রামমোহনকে প্রধান উৎস হিসেবে মানতে রাজি হননি। তিনি সে কৃতিত্ব দিয়েছেন ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের। আর রমেশচন্দ্র মনে করেন, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনতে সম্পূর্ণ অসফল হয়েছে। সমাজ সংস্কারক রামমোহন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, বঙ্গসমাজে বুনিয়াদি পরিবর্তন আনার ব্যাপারে একমাত্র সতীদাহ নিয়ে প্রচেষ্টা ছাড়া রামমোহনের আর কোনো ভূমিকা নেই।
যেমন সুমিত সরকার। তিনি রামমোহনকে যুগস্রষ্টা বলে মনে করেন নি, তাঁর মতে রামমোহন ছিলেন তাঁর যুগের সৃষ্টি এবং সে যুগের সীমাবদ্ধতার ফসল। তিনি সেই সন্ধিক্ষণের ফসল, যখন প্রাক-পুঁজিবাদী কাঠামো থেকে বুর্জোয়া আধুনিকতার দিকে সমাজের যাত্রা ক্ষীণভাবে আভাসিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সে যাত্রা উপনিবেশিক অধীনতার দ্বারা সীমায়িত বলে তাকে দুর্বল বিকৃত ক্যারিকেচারের মত লাগছে। আগেকার মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদদের ভাবনার ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ঐতিহ্য-আধুনিকতার দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া সমান বিপজ্জনক, কারণ তা আসলে আমাদের ঠেলে দেয় ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং এই ভাবধারার ধারকবাহক ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবক্তাদের দিকে। বুর্জোয়া আধুনিকতা ও আধুনিকতা এক জিনিস নয়। রামমোহনের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তুহফাতুল মুয়াহিদ্দিনের যুক্তিধারা যেসময় তিনি উপস্থাপিত করেন, তখনো ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভালো করে তাঁর পরিচয় হয়নি।
হেমচন্দ্র সরকারের লেখায় উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা পাই সেটা হল আধুনিকতা বলতে তিনি কিন্তু ইয়োরোপকে বোঝেন নি, তিনি বুঝেছেন নিজের দেশেরই ঐতিহ্যগত জাগরণকে। আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সুমিত সরকারও ইয়োরোপের বাইরের এক আধুনিকতার, যা ঢের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তার দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। দুই সরকারের এই রামমোহন প্রসঙ্গ আমাদের নিয়ে গেলে ফেলে ঐতিহ্য-আধুনিকতার বাইনারিতে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ত্রুটিগুলির কথা বলতে গিয়ে একদা শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন, “একটা অভিযোগের সত্যতা আমরা স্বীকার না করে পারি না যে আমাদের চোখ পূবের তুলনায় অনেক বেশি পশ্চিমে নিবদ্ধ ছিল। আমাদের হাতের কাছে অমূল্য সত্যের যে খনি আছে তাকে আবিষ্কার না করে আমরা পশ্চিমে সত্যের চর্চায় কি প্রগতি ঘটল জানতে বেশি উৎসাহী ছিলাম। আমাদের দেশের বইগুলোতে, আমাদের নিজেদের লোকাচারে এবং দেশাচারে সত্যের যে রত্নভাণ্ডার সঞ্চিত আছে, তার তুলনায় পশ্চিমী আদর্শগুলো আমাদের টানত বেশি।” এই হল সেই উপনিবেশিকতা (coloniality), যার কথা বর্তমান প্রবন্ধে বলতে চাওয়া হচ্ছে। এই উপনিবেশিকতা (coloniality) কি আমাদের জ্ঞানচর্চায় আমরা আজো বহন করে চলছি না? বিশেষ করে এই বাংলায়?
ব্রাহ্মধর্ম যে এ দেশে শেকড় গাড়তে পারে নি তার সবথেকে বড় কারণ হল একটা স্তরে যেমন ব্রাহ্মধর্মে সমন্বয়ধর্মিতা ছিল, আর একটা স্তরে ছিল না। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ফলে শাস্ত্রকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের বাইরের যে বিশাল সমাজ, যে সমাজ সমান পৌত্তলিকতায় আসক্ত, তাদের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা এবং ইয়োরোপীয় ভারততত্ত্ববিদরা সমানে প্রমাণ করতে লাগলেন যে পৌত্তলিকতা হচ্ছে উচ্চ আদর্শসম্পন্ন ভারতীয় সমাজের চূড়ান্ত নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের চিহ্ন। মনিয়ের উইলিয়ামস থেকে শুরু করে এচ. এচ. উইলসন, জেমস মিল সকলেই একবাক্যে বেদ বেদান্ত এমনকি মনু থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে শুরু করলেন যে সেসব গ্রন্থে কোথাও পৌত্তলিকতার কথা নেই। ভেতরের কথাটা এই, পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন এই বৃহত্তর সমাজ স্বশাসনের উপযুক্ত নয় এবং বাইরের থেকে তাঁদের মত যুক্তিনিষ্ঠ একেশ্বরবাদীরা এসে এই সমাজকে সুশাসন দিতে পারে। যদি এ দেশের লোককে একেশ্বরবাদীরা পথ দেখাতে সক্ষম, তাহলে ইসলামই তো যথেষ্ট ছিল। তাদের এদেশে আসার দরকার পড়ল কেন? সমাজের সর্বক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের হঠানোর দরকার পড়ল কেন? অতএব শুধু যুক্তিনিষ্ঠতা কোনো কারণ নয়। সে কারণ তাদের আধুনিকতা, যে আধুনিকতা শিল্পপ্রধান সমাজের উপজ এবং যার বিকাশ একের পর এক উপনিবেশ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীল। সে আধুনিকতার কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত লক্ষ্যণীয়, যে ইয়োরোপ রেনেসাঁয় শাস্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তির ওপর ভর করে চলতে শুরু করেছিল, সেই ইয়োরোপের প্রধান চালিকা শক্তি ব্রিটিশ এই উপনিবেশে শাসক হয়ে এসে এ দেশের শাস্ত্রকেই আইনে পরিণত করল। এর আগে এরকম কোনো লিখিত আইন হিন্দুদের বেলায় আমাদের দেশে ছিল না। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের আর এক নাম উপনিবেশিক আধুনিকতা।
অপরদিকে যে ভারততত্ত্ববিদরা আমাদের বেদ উপনিষদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাই আবার পৌত্তলিকতার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদিম উপাদানগুলি থেকে আমাদের সমাজে অজস্র দেবদেবীর জন্ম হয়েছে এবং সমসাময়িক সমাজে যার বহমানতা বিদ্যমান, এমনকি ইয়োরোপীয় সমাজের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টানরা যে খেতে বসার আগে ‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড’ বলে প্রার্থনা করেন, সে প্রার্থনার জন্ম নব্য প্রস্তর যুগে এবং ঈশ্বরকে পিতারূপে কল্পনা করে প্রার্থনা করার যে ভাবনা সে ভাবনার জন্ম চারণ যুগে। অথচ নব্য প্রস্তর যুগের বা চারণ যুগের এই প্রার্থনাগুলো এখনো বহাল আছে এবং সে ঐতিহ্য খ্রিস্টানদের গৌরবের কোনো হানি ঘটায় না। কোসাম্বির ভাষ্যে, আমাদের দেশে সমাজের নিম্নবর্গের মধ্যে যে নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের চল আছে, সেগুলো এই বৃহত্তর উৎপাদনশীল সমাজে তাদের এক একটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্তরগত অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী। জাত ও ধর্মের সঙ্গে মিশে ঐ অনুষ্ঠানগুলি গোষ্ঠীগুলিকে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক মর্যাদার পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে তাদের জাত এবং কখনো কখনো তাদের ধর্মবিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, কেন কখনো কখনো ধর্মবিশ্বাসগুলির সমন্বয় ঘটে, আবার কেন কখনো কখনো কিছুতেই সেগুলো মিলতে চায় না। স্বাভাবিকভাবে শংকর কিংবা রামানুজের দর্শন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কারণ তাদের সে উচ্চস্তরে এ সমস্যাটার অস্তিত্বই নেই।
বেদ উপনিষদে পৌত্তলিকতার উল্লেখ থাক আর না থাক, আমাদের দেশে পৌত্তলিকতার সঙ্গে দর্শনের বিরোধ ছিল এমন কথাও কোথাও নেই। বুদ্ধ পৌত্তলিকতা সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তিনি নিজে দেবদেবীর পূজায় পশুবলি দেয় এমন বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছিলেন, এই আশায় যে তিনি তাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে অহিংস করে তুলতে পারবেন। মূল সমস্যাটা ছিল পশুবলি নিয়ে। আমরা সবাই জানি বৌদ্ধধর্ম কৃষিজীবীদের বসতিগুলোকে স্থায়িত্ব দেবার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। কৃষিজীবীদের প্রধান সমস্যাই ছিল বৈদিক সমাজের পশুবলি। বুদ্ধের অহিংসা এই পশুবলি বন্ধের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল। অহিংসাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে বুদ্ধকে বেদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। সেই বিরোধিতায় জন্ম হয়েছিল এযাবৎ কালের এক শক্তিশালী দর্শনের। শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তেও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। বরঞ্চ ব্যক্তিগতভাবে শংকরাচার্য ভগবান হিসেবে বিষ্ণুর আরাধনার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। তাঁর টীকাতেও বিষ্ণুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পরিবারের কুলদেবতা।
(চলবে)
(এই পর্বের শেষে টীকা ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে)
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৩
স্বাদেশিকতা পর্ব ১৮০৯-১৮৭২
কিছু শব্দ কিছু কথা
সাধারণভাবে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীকে বাংলায় নবজাগরণের যুগ হিসেবে ধরা হয়। আবার সেই ঊনবিংশ শতাব্দীরই দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অর্থাৎ মার্ক্স কর্তৃক অভিহিত ১৮৫৭র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকে ধরা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয় আন্দোলনের যুগ। এই প্রবন্ধে কিন্তু সময়ের এই ভাগকে সে হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। যুগটা নবজাগরণের হলেও তার মূল শক্তি বা প্রেরণাটা কি? লেখকের মতে সেটা স্বাদেশিকতা। এই স্বাদেশিকতা দেশে সবসময়ই ছিল, কিন্তু তার ধার কমে গিয়েছিল। নতুন বিরোধের সংস্পর্শে এসে সে নিজেকে শানিয়ে নেবার অবকাশ পায়। তাই ১৮০৯ থেকে ১৯০৯ সাল এই একশ বছরকে দুটি কালপর্বে ভাগ করে বাংলায় স্বাদেশিকতার কাল হিসেবে দেখানো হল। ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ সাল একটি কালপর্ব, ১৮৭২ থেকে ১৯০৯ সাল আর একটি কালপর্ব। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ ডানা মেলতে শুরু করে এই ১৯০৯ সাল থেকেই, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে যার অন্তিম পরিণতি দেখতে পাই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায়।
এই স্বাদেশিকতার প্রথম কালপর্ব হল ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ। এই সময় জুড়ে দেখি আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষা ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। সব মিলিয়ে একে বলতে পারি সমাজসংস্কার। ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দে পৌঁছে এই প্রেক্ষাপটটা অনেকটাই বদলে গেল। এমন নয়, যে সমাজসংস্কারের চেষ্টাগুলো আর রইল না, কিন্তু ঐ বছরই বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হবার পর থেকে বাংলায় স্বাদেশিকতার পালে যে হাওয়া লাগল, তাকে আর শুধুমাত্র সমাজসংস্কার বলা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের বলিষ্ঠ লেখনীতে একদিকে যেমন প্রবল দেশপ্রেমের হাওয়া বইতে লাগল, অপরদিকে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। দেশে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল স্বাধীনতার আকাঙ্খা। সেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হল জাতীয়তাবাদে। এবং ১৯০৯ সাল থেকে এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের উপজ হিসেবেই জন্ম হল ক্ষমতার কাঙালপনার, যার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, চুরমার হয়ে গেল মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের কল্পনা, যদিও আপাতদৃষ্টে আমরা এক স্বাধীন ভারত পেলাম।
একটা শব্দ অনেক কথা বলে। যেমন, স্বাদেশিকতা। স্বাদেশিকতা এসেছে স্বদেশ থেকে, নিজের দেশ। গোড়ায় দেশ। ব্রিটিশরা যখন এ দেশটাকে রাষ্ট্রে পরিণত করে নি, তখনো দেশ ছিল। কিন্তু তখন ভারতবর্ষ ছিল একটা ধারণা, বিশেষ করে মহাকাব্যগুলির সূত্রে যে ধারণা সমাজমানসে অধিষ্ঠিত ছিল। আর দেশ বলতে যে নির্দিষ্ট জায়গায়--প্রধানত গ্রামে-- একজন মানুষ থাকত সেটা হত তার দেশ, আবার যে জনপদের সে অধিবাসী সেটাও হত তার দেশ। দেশ শব্দটার দ্বৈত অস্তিত্ব।
স্বাদেশিকতা কোনো উপনিবেশিক উপাদান নয়। স্বাদেশিকতা আধুনিক শব্দ, কিন্তু স্বাদেশিকতা দিয়ে যেটা বোঝায় সেটা আধুনিক নয়। সেটা হল দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম। নিজের দেশকে ভালোবাসাটা সর্বজনীন ও সর্বকালীন সত্য, সে যে যে দেশেরই হোক না কেন। দেশ মানে শুধু দেশের মানুষকে ভালোবাসা নয়। দেশ মানে দেশের আলো, হাওয়া, জল, মাটি, গাছপালা, পশুপাখি থেকে শুরু করে পাহাড়, অরণ্য, গ্রাম, শহর, মানুষের মন, তাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং দেশপ্রেম মানে এই সবকিছুর সঙ্গে একাত্মবোধ, যেমনটি পাই কালিদাসের মেঘদূতে রামগিরি আশ্রম থেকে অলকাপুরীতে যাবার যক্ষের দেওয়া দীর্ঘপথের বর্ণনায়। “যাও না বন্ধু, পথ বলে দিচ্ছি আমি। পথ তোমার ক্লান্তিকর হবে না। পাবে জল, পাবে ছায়া, পাবে সৌধোৎসঙ্গের উষ্ণতা। চোখ, কান দুই-ই জুড়োবে তোমার। দেখবে মধুর দৃশ্য, শুনবে কিন্নরীদের গান, শুধু একটু মন্দ্রধ্বনি যদি কর মৃদঙ্গের সঙ্গত হবে শিবসঙ্গীতে। কেকাধ্বনিতে স্বাগত জানাবে সজলনয়ন ময়ূরেরা। নদীদের ভ্রুভঙ্গী তো দেখবেই, নগরবধূদের ভ্রুলতাবিলাসও নিশ্চয় তোমার দৃষ্টি এড়াবে না। চোখ তুলে তারা তোমার দিকে যখন চাইবে, মনে হবে কৃষ্ণভ্রমরের পঙক্তি। এ সব দেখতে দেখতে তুমি কৈলাসে এসে পড়বে, আর কৈলাসের কোলেই তো অলকা।”
ভাবের কথা ছেড়ে যদি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসি, তাহলেও দেখব একজন দেশপ্রেমিক চায় যেন তার দেশের আলো, হাওয়া দূষিত না হয়, যেন জল, জঙ্গল, জমি ধ্বংস না হয়। যেন তার দেশে দারিদ্র না থাকে, শোষণ না থাকে, বঞ্চনা না থাকে, হিংসা না থাকে। যেন তার দেশটা আরো সহনশীল হয়, আরো গণতান্ত্রিক হয়, প্রকৃতিগতভাবে যেন দিন দিন আরো inclusive হয়। যেন তার দেশের ভাষাগুলোর দিন দিন সমৃদ্ধি ঘটে, যেন যার যার ধর্ম অটুট থাকে। অবশ্যই সে চায় দেশকে এবং নিজেকে সুরক্ষিত দেখতেও। নিজের দেশের সম্পর্কে সে যেমন এইসব চায়, বিশ্বের সব দেশের সম্পর্কেই সে একই কামনা করে। যেন সব দেশই শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে, আনন্দে থাকে, সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তার এসব চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষমতার গন্ধ নেই। সে নিজের জীবনযাত্রার ধরন, নিজের বিশ্বাস, নিজের মূল্যবোধ, নিজের ঐতিহ্য, নিজের ভাষা, নিজের ধর্ম যে কোনো কিছুর মূল্যে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু চায় না সেসব অন্য কারুর ওপর চাপিয়ে দিতে। তার মধ্যে কোনো আগ্রাসী ভাব নেই, স্বভাবগতভাবেই সে রক্ষণশীল। এই ধারণাতেও সে ভোগে না যে তার দেশ ভুল করলেও দেশপ্রেমিক হিসেবে তার একমাত্র পবিত্র কর্তব্য তাকে সমর্থন করা, My country right or wrong। কারণ একজন দেশপ্রেমিক নিজের দেশকেও নৈতিকতার মানদণ্ডে যাচাই করে। এবং চায় না যে তার দেশের নৈতিক অধঃপতন হোক। স্বাদেশিকতার সঙ্গে নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।
স্বাদেশিকতার কথা উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের কথাও ওঠে। অতএব দেখা যাক জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ শব্দটা আবশ্যিকভাবেই আমাদের দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি করা একটি শব্দ। জাতি শব্দটা নিয়ে গোড়া থেকেই সমস্যা। জাতির অর্থ কী? ইংরেজিতে জাতির অর্থ করা হয়েছে nation। কিন্তু ঠিক তাই কী? ইংরেজিতে জাতির অন্তত চাররকম মানে পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় জাতি অর্থে race, যেমন ককেশীয় জাতি, নিগ্রো জাতি, মঙ্গোলীয় জাতি। জাতি অর্থে nationও, যারা যৌথভাবে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস, নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের অংশীদার এবং একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণ, যেমন ব্রিটেন। আবার জাতি অর্থে ethnic groupও, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, আসলে raceএরই ক্ষুদ্রতর শ্রেণিবিভাগ, যেমন ককেশীয় জাতির একাধিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ানরা এবং জার্মানরা উভয়েই ককেশীয় জাতির অন্তর্গত, কিন্তু রাশিয়ানরা স্ল্যাভিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, জার্মানরা নরডিক। এবং চতুর্থত মোহম্মদ আদিবের মতে, জাতি অর্থে tribeও, যদিও তাদের আমরা উপজাতি হিসেবেই চিহ্নিত করি। তিনি লিখেছেন, “উপজাতির সংজ্ঞাটি বেশ গোলমেলে, কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে উপজাতি বলতে রাষ্ট্র স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষদের বোঝায় যাদের মোটামুটি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ রয়েছে।” উদাহরণস্বরূপ তিনি চাকমাদের কথা বলেছেন। চাকমারা একটি ছোট অঞ্চলের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও মারমা, ত্রিপুরা সহ অন্যান্য উপজাতিদের থেকে আলাদা, তাদের রয়েছে একই সঙ্গে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রয়েছে নিজস্ব রাজা, আবার তারা একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম গোলমেলে। জাতি বলতে একই সঙ্গে বোঝায় বর্ণ, জাতি, জাত, এমনকি কখনো কখনো সামাজিক শ্রেণিও। অহিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বর্ণ, জাতি বা জাত খাটে না বটে, কিন্তু তাদেরও রয়েছে নানারকমের ভাগ।
এই জাতি থেকে আরো কতকগুলো শব্দ এসেছে। জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) বা রাষ্ট্র-জাতি (state-nation)। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বলা হয় জাতি বা nation হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাতিসত্তা, রাষ্ট্র নয়। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে বলে রাষ্ট্র। যখন একটি জাতির নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকে, একমাত্র তখনই সে হয়ে ওঠে জাতি-রাষ্ট্র। প্রশ্ন ওঠে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে রাষ্ট্র বলে যদি মেনেও নিই, তার অন্তর্গত জাতিসত্তাটি কি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ অভিন্ন? পৃথিবীতে এমন দেশ কি খুব বেশি আছে? নেই যে তার প্রমাণ আমরা সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দিয়ে পেয়েছি। এখানেই জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। ভারত যেহেতু বিবিধের মাঝে মিলন মহানের দেশ, যোগেন্দ্র যাদবরা জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পালটা রাষ্ট্র-জাতি তত্ত্ব হাজির করেছেন। যদিও তাতে করে সমস্যা মেটে না।
যে অর্থে ভূখণ্ড হিসেবে দেশের একটা নির্দিষ্টতা আছে, nation বলে অভিহিত করে জাতিকেও সেইরকম একটা নির্দিষ্টতা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে সংকট বেড়েছে ছাড়া কমেনি। কারণ প্রাণ-অপ্রাণের নানা বৈচিত্র্য, নানারকমের মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম সবকিছুর মিশেল ঘটেছে দেশ শব্দে, চরিত্রগতভাবে সে সর্বপ্রকারে inclusive। কিন্তু জাতি শব্দটা যেহেতু একান্তভাবে মনুষ্যকেন্দ্রিক, চরিত্রগতভাবে সে এমনিতেই exclusive (অর্থাৎ মনুষ্য ব্যতীত কোনো ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়), তার ওপর nation শব্দে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করায় তার exclusivity বেড়ে গেছে। তাছাড়া, দেশে অন্য আরো অনেক কিছুর মতন মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মেরও ঠাঁই আছে, কিন্তু বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের নির্দিষ্টতার ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে যাওয়ায় nationএ মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। ডালিয়া গেব্রিয়াল, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের এক ছাত্রী, এ নিয়ে বলেছেন,nation শব্দটার সবথেকে বড় সমস্যা এই যে, nationহতে গেলে তাকে আগে নির্দিষ্ট করে নিতে হয় কারা কারা তার পরিধির বাইরে। এই বাইরের লোকজনের তালিকায় সবার আগে থাকে পরিযায়ীরা (অর্থাৎ মানুষের চলিষ্ণু ধর্মের কোনো ঠাঁইnation-এ নেই), তার পরে থাকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া লোকজন, সন্দেহজনক ব্যক্তিরা, মেয়েরা এবং অক্ষমরা। এবং যেহেতু তারা nationএর পরিধির বাইরে, তাদের অকল্পনীয় হিংসার শিকার হতে হয়। কেন এমন হয়? কারণ,nationগড়ে ওঠে যুক্তিবহির্ভূত জাতিসত্তাকে (বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায়, কল্পিত) কেন্দ্র করে এবং অন্য যারা এই পরিধির বাইরে, তাদের জীবনের কোনো মূল্য তাদের কাছে থাকে না। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। nation শব্দটাকে ঘিরে এতসব ঝামেলা এড়াতে আন্তর্জাতিক আইনে এখন আর nation অর্থে জাতি ধরা হয় না, একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে, যেখানে অনেক লোক একসাথে বাস করে, nation বলা হয়।
জাতি থেকে জাতীয়তা থেকে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেক প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে “রাষ্ট্রকৃত সমস্ত ভালো মন্দ ক্রিয়াকলাপ ছাপিয়ে নিজেকে তার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার এবং সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রের স্বার্থকে ঠাঁই দেওয়ার প্রবণতা।” তাঁর বিশ্লেষণে, ক্ষমতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা, জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপ্ত থাকে ক্ষমতার আকর্ষণ। রাষ্ট্র চায় যে কোনো কিছুর মূল্যে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে, নিজেকে সর্বাধিক সম্মানিত করে তুলতে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে আর যেহেতু জাতীয়তাবাদী মানুষ ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে, রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে অভিন্ন করে ফেলে, তার চাওয়াগুলোও রাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তখন সেই ব্যক্তিমানুষ যেহেতু সে রাষ্ট্র নামক এক বৃহৎ শক্তির পক্ষ নিয়েছে, তার উচ্চমন্যতার কারণে কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি আর শুনতে চায় না এবং সামান্যতম সমালোচনা তাকে হিংস্র করে তোলে। শুধু তাই না, তার নিজের ঘটানো হিংসামূলক ঘটনাগুলোকে অব্দি সে অস্বীকার করতে থাকে। আর তবু মানতেই হবে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আমাদের এখানে (এবং মহারাষ্ট্রে) যে স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেধেছিল, ১৯০৯ সালে তাই পরিণত হয় পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদে।
স্বাদেশিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা হচ্ছে এই—স্বাদেশিকতা মৌলিক রূপে কোনো বিদেশি জিনিস নয়, যদিও স্বাধীন দেশের স্বাদেশিকতা একরকম, পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা আর একরকম। পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত, যেমন, ইংল্যান্ড স্বাধীন দেশ, সপ্তদশ শতাব্দীর সেই ইংল্যান্ডে যেভাবে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে সার্বিক প্রতিরোধের মাধ্যমে খর্ব করে দেওয়া গিয়েছিল, আমাদের এখানে তা সম্ভব ছিল না। বিদেশী শাসনের শুরুতেই উপনিবেশিক শাসক যেভাবে আমাদের হিন্দু ও মুসলমান দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল এবং যেভাবে ক্রমাগত মুসলমানদের সর্বক্ষেত্র থেকে হটিয়ে বর্ণহিন্দুদের সেই জায়গায় তুলে এনেছিল, তারপর কোনো প্রতিরোধই আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হওয়া সম্ভব ছিল না। জাতীয়তাবাদ কিন্তু সে অর্থে সীমায়িত নয়। জাতীয়তাবাদ শব্দ এবং সে আদর্শের সারবস্তু দুটোই এদেশে খোদ ইয়োরোপের রপ্তানি। ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক নানা ধরনের যে সংগ্রাম চলেছিল, অজস্র অত্যাচার মুখ বুজে সহ্যের বিনিময়ে, অজস্র বলিদানের বিনিময়ে, অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে যা স্বাধীনতা(?) নিয়ে এল, সে সম্পর্কে এককথায় বললে বলতে হয় ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল আর সেই সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বকে তছনছ করে দিয়ে গেল। জাতীয়তাবাদ যদি এত উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল কেন এবং আমাদের অস্তিত্বকে তার শেকড় থেকে উৎপাটিতই বা করে দিয়ে গেল কেন? একথার উত্তরে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, দুর্বল ও দরিদ্র দেশগুলো যে এই আদর্শকে খুব যুক্তিপূর্ণ এবং আত্মশক্তির জাগরণের সহায়ক বলে ভেবেছিল, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কোনো বিচারশীল, উদার, সর্বংসহ, সৃজনশীল আদর্শ নয়। ইয়োরোপের বাইরে কোথাও এ জিনিস ছিলও না। এ হল দেশে দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি। শুধু রপ্তানিই নয়, রীতিমত সর্বনাশা রপ্তানি, কারণ এ কোনো যুক্তি বা মুক্তির সন্তান নয়, বরঞ্চ তার উল্টোটা, উদগ্র কল্পনাবিলাস, রাজনৈতিক ত্রাণকর্তার ভঙ্গির ফসল, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীনতার হত্যা।
ফিরে যাওয়া যাক স্বাদেশিকতায়। আগেই বলা হয়েছে আমাদের স্বাদেশিকতা এই উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত ছিল। সেই সীমায়িত স্বাদেশিকতা আমাদের মধ্যে কী ধরনের উপনিবেশিকতার জন্ম দিল তার ইঙ্গিত দেওয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। যেমন প্রথম থেকেই ভাগ হয়ে যাওয়াতে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারল না। তবু চেষ্টা হয়েছিল, ১৮৫৭ সালে, যাকে আমরা বলি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর একটা চেষ্টার কথাও বলা যায়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৬৩ সালে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল এবং যা ধিকধিকিয়ে চলেছিল ১৮০০ সাল অব্দি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে এর চেহারাটা ছিল ভাঙাচোরা। সেই ভাঙাচোরা দুর্বল আংশিক প্রতিরোধ নিয়ে আমরা যত গর্বই করি না কেন, তা আসলে উপনিবেশিকতা ছাড়া কিছু নয়। ব্রিটিশরা কেন এরকম করেছিল তার কারণ আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং শাসকের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি থেকেই ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। যদিও ভারততত্ত্ব তখনো দানা বাঁধেনি, কিন্তু ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এদেশে এসেছিল। বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি থেকে, তাদের দেশ থেকে যেসব লোক মোঘল আমলে এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের প্রদত্ত বিবরণ থেকে তারা এসব খবর সংগ্রহ করেছিল।
উপনিবেশিক ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার থেকে যে উপনিবেশিকতার জন্ম তার বোঝা আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। উপনিবেশিক ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত এই স্বাদেশিকতা আর্থ-সামাজিক স্তরেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সবথেকে বড় উদাহরণ হল জমির পণ্য হয়ে যাওয়াটা আমরা বিনাবিচারে মেনে নিলাম। জমিতে আগে কৃষকদের মালিকানাস্বত্ব ছিল এটা জেনেও রামমোহন কৃষকদের দখলিস্বত্বের কথা বললেন। আগে জমিদারদের কোনো দখলীস্বত্বই ছিল না, তারা ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। ব্রিটিশ আমলে ব্যাপারটা পুরো উল্টে গেল। এখন হয়ে দাঁড়াল কৃষকের দখলিস্বত্ব আর জমিদারদের মালিকানাস্বত্ব (যদিও আপাতদৃষ্টে, কেননা রাজস্ব ঠিকমত দিতে না পারলে জমিদারিও নিলামে উঠত এবং হস্তান্তরিত হত)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জমিদাররা জমি নিয়ে যা খুশি করতে পারত। স্বাধীনমত জমি কেনাবেচা করতে পারত, কৃষকের কাছ থেকে মোটা রকমের খাজনা আদায় করতে পারত, জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করতে পারত। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিতে সরকারি খাজনার রকমফের হত। কোনোবছর অনাবৃষ্টি হয়ে উৎপাদন কমে গেলে সেই অনুযায়ী খাজনা দিলেই হত। এখন সরকারি খাজনার পরিমাণের কমাবাড়া বলে কিছু রইল না, উৎপাদন যাই হোক না কেন। সেই খাজনার ওপর আবার জমিদাররা আবওয়াব ইত্যাকার নানারকমের অন্যায় দাবি চাপিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস তুলল। জমিদারের খাজনা এবং বাড়তি আবদার মেটাতে গিয়ে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে লাগল। সে ধার মেটাতে না পেরে হয় মহাজন নয় জমিদারদের কাছেই জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতে লাগল। দেখতে দেখতে কৃষকদের একটা বিশাল অংশ পরিণত হল ভূমিহীন খেতমজুরে। ওদিকে ইংরেজ শাসনের দৌলতে দেওয়ানি বেনিয়ানি মুচ্ছুদিগিরি করে যারা দেদার টাকা আয় করেছিল, নিলাম হওয়া পুরোনো জমিদারিগুলো তারা ক্রমান্বয়ে কিনে নিতে থাকল। কিন্তু তারা বেশির ভাগই কলকাতার বিলাসব্যসনে আসক্ত এবং শহর ছেড়ে থাকতেও চায় না, ফলে জমিদারিগুলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ সম্পর্ক হত ক্ষীণ। এইভাবে জন্ম হল একদল অনুপস্থিত জমিদারের। এইসব নতুন জমিদার না জমিদারি পরিচালনার কিছু বুঝত, না জমিদারি থেকে পাওয়া লাভ ছাড়া আর কোনোকিছুতে তাদের উৎসাহ ছিল। জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের ও তদারকির দায়িত্ব তারা যাদের ওপর ছেড়ে দিতে থাকল, তারাই জন্ম দিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির— পত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, পাঁতিদার, তালুকদার, ইজারাদার, জোতদার ইত্যাদির।
এ পর্যন্ত এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষণীয় রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষতা করলেন এই যুক্তিতে যে এর ফলে পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে আয়বৃদ্ধি হবে এবং তার জন্যে খাজনা বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তিটা যে ভুল তা আগেই দেখানো হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন)। বেশির ভাগ পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেই চাষবাস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল আমলে। অতএব কৃষকের দ্বারা জমির উন্নতি ইংরেজ আমলের ঘটনা ছিল না। অবশ্য কৃষকের দুর্দশার প্রতিবিধান করতে গিয়ে রামমোহন গবর্নমেন্টের সঙ্গে জমিদারের যেরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রজার সঙ্গেও তেমনি জমিদারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন, কেননা কৃষক জমির উন্নতি করলেই যদি জমিদার খাজনা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কৃষক আর জমির উন্নতি করার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। হতে পারে রংপুরে থাকতে যে কৃষক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, জমিদারের সঙ্গে কৃষকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবের নেপথ্যে সেই সম্পর্কের একটা ভূমিকা ছিল। রামমোহন কৃষির উন্নতির জন্যে সরকারকে একটি কৃষি দপ্তর খোলার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
এহ বাহ্য। এই ‘কৃষির উন্নতি’ ব্যাপারটা কী? যে দেশের সমাজটাই কৃষিপ্রধান, বাইরে থেকে এসে একদল শাসক তার কী উন্নতি করতে পারে? যে দেশের কৃষক দিবারাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার জমি চষে চলেছে, যে তার জমিকে হাতের তালুর মত চেনে, তাকে কৃষির উন্নতির ব্যাপারে পরামর্শ দিতে যাবার এই চেষ্টা কেন, তাও আবার পরামর্শদাতা তাঁরা যাঁরা কৃষির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। রামমোহন থেকে এই সংস্কৃতি ঊনবিংশ শতাব্দী হয়ে আজো বহমান।
এই প্রবন্ধে প্রতিটি কথা প্রমাণসহ বলা সম্ভব নয়, মোটের ওপর ব্যাপারটা হচ্ছে এই, ভারতীয় কৃষিকে আদিম পর্যায়ের ও পশ্চাৎপদ বলে দেগে দিয়ে ব্রিটিশের দিক থেকে কৃষির উন্নতির আয়োজন করার দুটো বড় কারণ ছিল। খাজনা নির্দিষ্ট করে দেবার ফলে একদিকে বিশাল পরিমাণ কৃষক প্রতিদিন খেতমজুরে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল এবং অপরদিকে ব্রিটিশ কর্তৃক কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে বিশাল পরিমাণ কারিগর সেই কৃষিকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছিল এবং এই পরস্পরবিরোধী অবস্থার মধ্যে পড়ে আমাদের কৃষিক্ষেত্র ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল এবং একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটছিল। এই অব্যবস্থাকে চাপা দিতে ব্রিটিশ একদিকে কৃষির উন্নতিতে কৃষকের অনাগ্রহের কথা চাউর করেছিল এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে কৃষির উন্নতি তত্ত্বকে সামনে এনেছিল। কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ হল, শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে এইসময় যেসব কৃষি সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ হয়েছিল, বিশেষ করে লাঙল এবং কাস্তের, ভারতে সেসবের বাজার তৈরি করা। ঐসব লাঙল এবং কাস্তে বিক্রি থেকে একটা আয় আসবে, তার ওপর ঐসব লাঙল ও কাস্তে ব্যবহারের ফলে জমি বেশি উর্বর হবে, উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন বাড়লে জমির আয় বাড়বে, জমির আয় বাড়লে রাজস্ব বাড়বে, পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি শুল্কও বাড়বে।
মাইকেল মধুসূদন যখন উত্তরপাড়ায় ছিলেন, তখন উত্তরপাড়া হিতকারী সভা কৃষিবিদ্যা নিয়ে বলতে ডাকেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্রকে। সভার বিষয় শুনে মাইকেল বলেছিলেন, “কৃষিবিদ্যা নিয়ে আবার বক্তৃতা কি? চাষারা কি জানে না কি করে ধান বুনতে হয়। খাচ্ছ কি করে? তাদের আবার কৃষিবিদ্যা কি শেখাবে?”
ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে বলতে গিয়ে জন অগুস্টাস ভোয়েলকার বলেছিলেন, “বেশির ভাগ জায়গাতেই উন্নতি করার মত প্রায় কিছুই নেই।” জন কেনি বলেছিলেন, “যেখানে একটা প্রদেশেই চার হাজারের মত ধানের প্রজাতির উৎপাদন হয় এবং প্রত্যেকটা প্রজাতিকে তার গুণাগুণ ও তার উপযুক্ত জমি অনুযায়ী ভাগ করে চাষ করা হয়, সেখান থেকে বীজ সংগ্রহের কোনো মানে হয় না। এমনকি ভারতীয় কৃষিতে আধুনিক লাঙলের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না।” আর ১৮৩২ সালের ১৩ অগস্ট কমনস কমিটির সামনে দেওয়া সাক্ষ্যে বটানিকাল গার্ডেনের তৎকালীন সুপারিন্টেডেণ্ট ড. ওয়ালিক বলেছিলেন অধিক ফসলের স্বার্থে বাংলার নরম মাটিতে ব্যবহৃত সনাতনী লাঙলের বদলে ইয়োরোপীয় লোহার লাঙল ব্যবহার করার ফলে নিচের নোনা মাটি উঠে জমির ক্ষতি হয়ে যাবার কথা।
স্বাদেশিকতার অন্য উদাহরণগুলো হল, যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষার ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। ডিরোজিওর ছাত্ররা যে এ ব্যাপারে খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলির সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে সবথেকে বেশি যাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরেরও রামমোহনের মত ক্ষুরধার বিচারশীল মন ছিল, তিনি শাস্ত্রঘেঁষাও ছিলেন না, বরঞ্চ রামমোহনের তুলনায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অনেক কম, আর তবু তাঁকে তাঁর সমাজসংস্কারের কর্মসূচিগুলোকে সফল করতে বারে বারে শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কেন? ১৭৭২ সালে দশ জন পণ্ডিতের সাহায্যে ওয়ারেন হেস্টিংস শ্রুতি, স্মৃতি, শাস্ত্র ও ব্যবহার এই চার উপাদানের ওপর নির্ভর করে হিন্দু আইন বিধিবদ্ধ করলেন। এর ফলে গোটা সমাজের বুকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য আরো চেপে বসার সাথে সাথে শাস্ত্রকে এড়িয়ে সমাজসংস্কার অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এটা রামমোহনের পক্ষেও সত্যি ছিল। ব্রিটিশ আসার আগে আমাদের দেশে শাস্ত্র ছিল, ধর্মীয় গোঁড়ামোও ছিল, কিন্তু এরকম কোনো ব্রিটিশ ধাঁচের সুসংহত হিন্দু আইনের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল না। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রাক-ব্রিটিশ সমাজেও ছিল, কিন্তু তখন কি রাষ্ট্রীয় পরিসরে কি সামাজিক পরিসরে, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় সমাজের পরিসরে, তার প্রতাপ ছিল সীমাবদ্ধ। এর পরের দফায় ১৭৮৪ সালে আমাদের এখানে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ব্রিটিশ কর্তৃক যে সুশৃঙ্খল সংস্কৃতচর্চার জোয়ার এল, যাকে বলা হতে লাগল ভারততত্ত্ব, তার জোয়ারে আমাদের দেশীয় পণ্ডিতদের সংস্কৃতচর্চা তলিয়ে গেল। প্রথমে আইন, তারপর তার খোপের মধ্যে সংস্কৃতচর্চাকে পুরে দিয়ে শাসক গোষ্ঠী এ দেশ সম্পর্কে যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তৈরি করল, তাকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ‘epistemic violence’ বা ‘জ্ঞানতত্ত্বমূলক হিংসা’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশের হাতে গড়ে উঠল এক নতুন হিন্দুসমাজ, যার কর্তৃত্ব ব্রাহ্মণদের হাতে। অনেক পরে ১৯২৫ সালে সেই হিন্দুসমাজের পক্ষ নিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বললেন, “যাবতীয় রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং বিদেশি আক্রমণের মধ্যে হিন্দুসমাজকে অখণ্ড রাখতে ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষরাই সবকিছু আইনের আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেইসব আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতম করে তুলেছিলেন।” চৈতন্য ও সূফী আন্দোলনের ফলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব থেকে যে সমাজ অনেকটাই ছিটকে গিয়েছিল, শাসনের সুবিধার্থে তাকে ব্রিটিশ আবার সংহত করে তুলে সমান এবং সহায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত করল। এক আধিপত্যের সঙ্গে আর এক আধিপত্যের সহাবস্থান ঘটল। যে হিন্দুসমাজের উত্তরাধিকার আমরা এখনো বহন করে চলেছি, সে হল এই হিন্দুসমাজ।
আসা যাক মেকলের কুখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’এর কথায়। প্রধানত যে দুটো কারণে মেকলের মিনিট কুখ্যাত, তার একটা হল মেকলের বাগাড়ম্বর, “ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান,” দ্বিতীয়টা হল তাঁর উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা, “এই মুহূর্তে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে একটি শ্রেণি গঠন করার, যারা আমাদের এবং কয়েক কোটি মানুষ যাদের শাসনভার আমাদের হাতে, তাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এমন এক শ্রেণি যারা রক্তে এবং রঙে ভারতীয় হবে, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হবে।” মেকলের বাগাড়ম্বর নিয়ে কিছু বলার নেই, সে মূর্খতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার, কিন্তু মেকলের উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা নিয়ে ঈষৎ ভাবার আছে। কেননা এর ঠিক পরেই মেকলে লিখেছিলেন, “এই শ্রেণির হাতে আমরা দেশের আঞ্চলিক মাতৃভাষাগুলোর সংস্কৃতিসাধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারি, যারা পশ্চিম থেকে বিজ্ঞানের শব্দাবলী নিয়ে ঐসব আঞ্চলিক ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে এবং ভাষাগুলোকে ধীরে ধীরে তারা ঐসব জ্ঞান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উপযুক্ত বাহন করে তুলবে।” মেকলে যদি শুধু আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা বোঝার মত করে গড়ে তোলার কথা বলতেন আর তার জন্যে আমাদের কারো কারো ইংরেজি ভাষাটা জানার ওপর জোর দিতেন, তাহলে তিনি এত নিন্দিত হতেন না। কিন্তু তাঁর বক্তব্য এই দাঁড়াল যে পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারকবাহক যে ইংরেজি ভাষা সেটা জানতে গেলে রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে। যদি ধরেও নিই ইংরেজি ভাষা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারার বাহক, তাহলেও সেটা আত্মস্থ করতে গেলে আমার রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে কেন? তাহলে কি পশ্চিমী বা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা সর্বজনীন নয়, একান্তভাবে ইংরেজ হয়ে উঠতে না পারলে সেগুলো বোঝা সম্ভব নয়? ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা স্পেনকে কি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে কোনো কিছু শিখতে তাদের নিজেদের রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হয়েছিল? মেকলের মতে, ওরকম কথা উঠবেই না, কারণ ওগুলো সবই মহান ইয়োরোপীয় সভ্যতার অংশ, বাদবাকি সব বর্বর দেশ, যেমন ভারত, যাকে সভ্যতার আলো দেখানোর দায়িত্ব তাঁদের হাতে। কোনো বর্বর দেশ যদি ইংরেজের কাছ থেকে কিছু শিখতে চায় তো তাকে সর্বপ্রকারে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে, কারণ ইংরেজের রুচি ইত্যাদি গুণ অর্জন করতে না পারলে সে সেগুলো বুঝে উঠতে পারবে না। এই দম্ভ নিয়ে কথার বিস্তার করে লাভ নেই। শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে নয়, আপাদমস্তক এক উপনিবেশিক শাসকের মতই মেকলে আসলে ইংরেজিনবিশ একটি বশংবদ শ্রেণি গঠনের লক্ষ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন, মেকলের আগে থেকেই যে ইংরেজিনবিশ বশংবদ শ্রেণির গঠন এখানে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিশীল বিচারধারাকে যাঁরা বাংলা ভাষায় আনার চেষ্টা করলেন, তাঁরা কেউই রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে ওঠেন নি। রামমোহন রায় নিজে বাংলায় একটা ভূগোলের বই লেখার চেষ্টা করছিলেন, আত্মীয় সভার সদস্য ব্রজমোহন মজুমদার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ফারগুসনের অ্যাস্ট্রোনমির একটা বাংলা অনুবাদ করছিলেন। তারপর একদিকে এলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সূত্রে অক্ষয় কুমার দত্ত, আর একদিকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এই ধারায় একের পর এক চেষ্টা হল, সেই চেষ্টার শেষ বোধহয় বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন।
আর তবু আধুনিক বিজ্ঞান মাতৃভাষায় সাধারণ মানুষের জ্ঞানতত্ত্বের অঙ্গনে সেভাবে প্রবেশ করতে পারল না। কেন? তার বদলে যেটা ঘটল, সমাজের মধ্য স্তরে ইংরেজি ভাষা নিয়ে দিন দিন বাড়তে লাগল দৃষ্টিকটু রকমের হ্যাংলাপনা, যা ক্রমশ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেল, অপরদিকে আধুনিক বিজ্ঞান শেখার মাধ্যম হয়ে রইল সেই ইংরেজি ভাষাই, যা সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে হয়ে উঠল ক্ষমতার হাতিয়ার।
১৮৩৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মামুদও তাঁর দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের বলেছিলেন, “তোমরা ফরাসিতে ওষুধপত্রের ওপর যেসব বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আছে সেগুলো পড়....আমার উদ্দেশ্য তোমাদের ফরাসি ভাষা শেখানো নয়, আমার উদ্দেশ্য ফরাসি ভাষায় যেসব বিজ্ঞানসম্মত ওষুধপত্র আছে সেগুলোর সম্পর্কে তোমরা জ্ঞানার্জন কর এবং ধীরে ধীরে সেগুলো আমাদের ভাষায় নিয়ে নাও।” আমাদের দেশে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা বিতর্কিত চিঠিটিতে রামমোহনও প্রায় একই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন লাটসাহেব যেন পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে, যেমন অঙ্ক, প্রাকৃতিক দর্শন (এখনকার ভাষায় পদার্থবিজ্ঞান), রসায়ন, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি, আমাদের পরিচয় ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। যেহেতু এসব বিষয়গুলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ছাড়া জানার উপায় নেই, ইংরেজি ভাষার জ্ঞানটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থার প্রেক্ষিত কী? সবথেকে বড় প্রেক্ষিত যে দেশজ বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে এ দেশের সমাজ গড়ে উঠেছিল তা ছিল প্রকৃতিগতভাবে কৃষিপ্রধান আর আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে যে সমাজ ইংল্যান্ডে গড়ে উঠেছিল সে সমাজ ছিল শিল্পপ্রধান। কৃষিপ্রধান সমাজের ও শিল্পপ্রধান সমাজের মনন কি একরকম হতে পারে? কৃষিপ্রধান সমাজের দর্শন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি; শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শন সেখানে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। ইয়োরোপের শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শনের সঙ্গে বেদের এই কথাটার মিল হওয়া কি সম্ভব?
ভুঁই গো, যা তোর এখানে ওখানে খুঁড়ি,
ভরে যাক পূরে যাক সব তাড়াতাড়ি।
ওগো নির্মলা বিদ্ধ না করি যেন
মর্ম তোমার, তোমার হৃদয়খানি।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরে আমাদের দেশের বাকি সাধারণ মানুষ যে এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের প্রতি আত্মিক টান সেভাবে অনুভব করল না, সম্ভবত তার একটা অন্য কারণও আছে। আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক আর এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে ছিল ক্ষমতার সম্পর্ক, আমাদের সহজাত বোধে যার অস্তিত্ব ছিল না এবং যার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন বিরূপতা ছিল? যেসব ধর্মান্দোলনগুলো সমাজসংস্কারের ধারায় হয়েছিল, চৈতন্য থেকে সূফী, তাদের তত্ত্বে কোথাও ক্ষমতার গন্ধ ছিল না।
ব্রিটিশরাও এখানে এমন কোনো শিল্পপ্রধান সমাজ গড়তে চায়নি যে সমাজ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে এবং তার বাজারের দখল ছিনিয়ে নেবে। শিল্পবিপ্লবের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে প্রধানত এদেশকে কাঁচা মালের রসদদার করে তুলতে চেয়েছিল আর এ দেশটা ছিল তাদের কাছে তৈরি জিনিস বিক্রির বিরাট বাজার। কাজেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিমী জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিচয় ঘটানোর ব্যাপারে সরকারের কোনো আন্তরিক চেষ্টা ছিল না। ড. মহেন্দ্রলাল সরকার যখন ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সাহায্য চান, তখন সরকার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় নি। অনীহার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান শিখিয়ে কী হবে, তার চেয়ে বরঞ্চ টেকনিকাল ইন্সটিটিউট বেশি কাজে লাগবে। সরকারের দরকার ছিল কারিগর। যারা বড় বড় যন্ত্র তৈরির প্রাথমিক উপাদানগুলোর যোগান দিতে পারবে। ওদিকে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর কর্মোদ্যোগীদের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথ ছিল বন্ধ।
১৮০৯ সালকে স্বাদেশিকতার প্রারম্ভিক কাল হিসেবে গ্রহণ করার একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮০৯ সালে রামমোহন যখন রংপুরে ডিগবি সাহেবের অধীনে কাজ করছিলেন, তখন দিনের শেষে সন্ধ্যের পর তিনি বাসাবাড়িতে ধর্মালোচনার জন্যে সভা ডাকতেন। প্রতিপাদ্য বিষয় হত পৌত্তলিকতার অসারত্ব ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা। রামমোহনের নিজের কথায়, তিনি চেয়েছিলেন দেশবাসীর মন থেকে যাবৎ ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে তাদের যুক্তিশীল করে তুলতে। কারণ এই ধর্মীয় গোঁড়ামোগুলো শুধু সমাজের বুনটটাকে ধ্বংস করছিল তাই নয়, পরদুঃখকাতরতাকেও তাদের মন থেকে মুছে দিচ্ছিল। এই যে দেশবাসীর কল্যাণের জন্যে চিন্তা, এটা হল স্বাদেশিকতার গোড়ার কথা। ১৮০৯ সালের ধর্মালোচনার সেই সভাগুলো থেকেই ব্রাহ্মসমাজের যাত্রা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে যদি বলি স্বাদেশিকতার যুগেরও শুরু হয়, তাহলে ভুল বলা হবে না। আর একশ বছর পরে ১৯০৯ সালকে স্বাদেশিকতার অন্তিম লগ্ন হিসেবে ধরা হল এই জন্যে যে এই বছরই স্বদেশী আন্দোলনের শেষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল্স্ অ্যাক্টের কারণে বাঙালি ঐক্য দু টুকরো হয়ে যায় অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়ে করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে বাংলাভাগ রদ হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আগেকার ঐক্য আর বজায় ছিল না।
১৯০৯ সাল থেকে জাতীয়তাবাদের যে আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হল, তার অবস্থান রামমোহন রায়ের বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার রামমোহনের কঠোর সমালোচনায় একটা কথা অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই এলিট বাঙালির ‘জাতীয় চেতনার উন্মেষ’ রামমোহন থেকে হয়নি, (তবে তা রমেশচন্দ্রের ধারণা মত ডিরোজিও থেকেও হয়নি, রামমোহনের মত ডিরোজিও-ও ছিলেন দেশপ্রেমিক) জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বঙ্কিমচন্দ্র থেকে। রামমোহন ছিলেন বিশ্বজনীন মানবতাবাদের পূজারী এবং একথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে এই বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ধারণাও তিনি পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। শুধু খ্রিস্টীয় বা ইসলামী নয়, ভারতীয় দর্শনেরও একনিষ্ঠ ছাত্র রামমোহনের এই আদর্শে স্থিত হওয়ার জন্যে পশ্চিমের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার ছিল না। বিশ্বজনীন মানবতাবাদের উদ্গাতা হিসেবে রামমোহন parallel and different narrative অর্থাৎ সমান্তরাল ও ভিন্ন আখ্যানের জনক হওয়ার দাবী করতেই পারেন। রামমোহনের এই ব্যাটনটাই অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে যায় এবং পরিপুষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক রামমোহন তাঁর বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সঙ্গে বেকনের উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদ এবং বেন্থামের হিতবাদ মিলিয়ে যে আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন, চরিত্রগতভাবেই তা ছিল উপনিবেশিক। উপনিবেশগুলো সম্পর্কে বেন্থামের ধারণার কথা আগেই বলা হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন), বেকন আরো তীব্রভাবে উপনিবেশিক শাসকদের সপক্ষতা করেছিলেন।
পশ্চিমে যেমন কোনো আলোচনার শুরু গ্রিসকে ছাড়া হয় না, গ্রিক সাহিত্য গ্রিক দর্শন গ্রিক বিজ্ঞান, আমাদের দেশেও তেমনি উপনিবেশিক শাসনের আলোচনার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণকে ছাড়া হয় না। আর নবজাগরণের শুরু মানেই রামমোহন। শুধু শুরুই নয়, তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে এমনভাবে ছেয়ে আছেন যে তাঁর আলোচনা ছাড়া এগোনো যায় না। রামমোহন একটি খনিবিশেষ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর রচনা, তাঁর চিঠিপত্র, তাঁর কর্মকাণ্ড সবকিছুর যদি ব্যবচ্ছেদ করা যায় তাহলে আমরা পরের প্রায় দুশো বছরের সংকট, দ্বন্দ্ব ও গতির নিশানা সবই পেয়ে যাই। যেমন, রামমোহনের বিধবাবিবাহ নিয়ে আপত্তি ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “বিধবার বিবাহ তাবৎ সম্প্রদায়ে অব্যবহার্য হইয়াছে, সুতরাং সদ্ব্যবহার করাইতে পারে না।” এর মানে হল, যদিও শাস্ত্রে নিষেধ নেই, কিন্তু সব সম্প্রদায়েই বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছে, অতএব সদাচার হতে পারে না (যদিও এ ধারণাও ঠিক নয়, বর্ণহিন্দুসমাজের বাইরে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না)। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন একথা লিখেছিলেন। এবার ভাবুন ১৮৫৫-৫৬ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাণপাত করছেন, তাঁকে তাঁর পূর্বসূরির তায় রামমোহনের মত ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করে এগোতে কি পরিমাণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
প্রথাগত ধারণা এই যে তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় যুগান্তকারী মাত্রা যোগ করেছিলেন এবং একটা লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন। রামমোহনকে নিয়ে ঘুরেফিরে যত আলোচনা চলে, সব ঐ মাত্রা আর লক্ষ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেহেতু সেই সমাজের ধারাবাহিকতা থেকেই আমরা এসেছি এবং আমাদের মননে আমাদের কর্মকাণ্ডে সেই ধারাবাহিকতা এখনো কোনো না কোনোভাবে বহমান। ফলত রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক থেকে যান এবং যে কোনো আলোচনায় অগ্রাধিকার পান। এর প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার থেকে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঐতিহ্য-আধুনিকতা, বিশ্বাস-যুক্তি, পৌত্তলিকতা-বেদ-উপনিষদ, স্বাদেশিকতা-জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় দর্শন-পাশ্চাত্ত্য দর্শন ইত্যাকার বাইনারি নিয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন, রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক।
তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিমত হচ্ছে তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। কেউ কেউ আবার তা মানতে রাজি নন। একদলের মতে, তিনি ছিলেন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরোধা, যাঁর কাজকর্ম উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিল। আর একদল রামমোহন উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিলেন একথা অতটা মেনে না নিলেও রামমোহনের আধুনিকতা নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন আছে। তাঁদের বিচারে রামমোহনের কর্মকাণ্ডে বুর্জোয়া আধুনিকতা স্পষ্টরূপ পায়নি। আছেন আরো একদল, যাঁরা বুর্জোয়া আধুনিকতার চরিত্র নিয়েই প্রশ্নমুখর। আর একদল যাঁরা এই আধুনিকতাকে উপনিবেশিক আধুনিকতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
যেমন, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার। তাঁর মতে, রামমোহন ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। তিনি তাঁর যুগের সৃষ্টি নন, তিনি তাঁর যুগের স্রষ্টা। সে যুগ আধুনিক ভারতের যুগ। রামমোহনকে এই আখ্যায় ভূষিত করার কারণ হিসেবে তিনি রামমোহনের জন্মের সময়কার অন্ধকারের বিবরণ দিয়েছেন, যে অন্ধকার থেকে রামমোহন দেশকে বের করে এনেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভারতের সুকুমারী শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সৃজনশীল ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল অখণ্ড নীরবতা। কোনো প্রতিভাধর পথপ্রদর্শকের দেখা মিলছিল না। সংস্কৃত সাহিত্যের মহান শিক্ষকেরা অদৃশ্য। প্রদেশের মাতৃভাষাগুলোরও কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছিল না। ভারতীয় মনন হয়ে গিয়েছিল অতীতের ব্যাপার। দর্শনের শাখাগুলি মৃত। তার জায়গায় আসর জমিয়ে বসেছিল ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে নানান কুতর্ক, সেগুলোই দর্শন হিসেবে চলে যাচ্ছিল। মহান ধর্মগুরুদের ধর্মান্দোলনগুলো যেন সেই অন্ধকার সময়কেই গাঢ়তর করে তুলছিল। তাঁদের আধ্যাত্মিক কথা কেউই বুঝতে পারছিল না এবং অনুগামীরা নানারকম সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়ে সেইসব পাপের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল, যেগুলো সমাজ থেকে দূর করার কথা তাদের ধর্মগুরুরা বলেছিলেন। চৈতন্যের প্রেমের বাণী তাঁর অযোগ্য শিষ্যদের হাতে পরিণত হয়েছিল ফাঁপা অগভীর হৃদয়াবেগে। জ্ঞান আর চৈতন্যের অধোগামিতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জাঁকিয়ে বসেছিল ভ্রষ্টাচার এবং সামাজিক অধঃপতন। অটল বিশ্বাস, পবিত্র হৃদয় আর সুস্থ আচরণের জায়গা নিয়েছিল অজস্র কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, অর্থহীন দেশাচার আর লোকাচার। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশ এই সময় একটা সন্ধিক্ষণের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমান আমল গিয়ে সবে কোম্পানি আমল এসেছে, কিন্তু কোম্পানি তখনো প্রধানত বাণিজ্য আর সম্পদ আহরণ নিয়ে ব্যস্ত। দেশে তখনো মুসলমান আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল। নতুন শাসকরা দেশের লোকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণে বাধা দিতে চায় না, কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার ভয়। সতীর অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা একের পর এক লাটসাহেবের গোচরে এসেছে, কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেন নি, কারণ তাহলে কোম্পানি শাসন বিপদে পড়তে পারে। শিক্ষা তখনো সরকারের বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি।
পশ্চিমের সংস্পর্শে ঘুম ভেঙে এ দেশ আধুনিক ভারত হয়ে উঠেছিল এবং তার সেই হয়ে ওঠায় বাংলার অবদান ছিল সবথেকে বেশি, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও সেকথা মনে করেন। তবে তিনি রামমোহনকে আধুনিক ভারতের জনক বলে স্বীকার করতে সেভাবে রাজি নন। তিনি অবশ্য প্রায় সবকিছুতেই রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকাকে নস্যাৎ করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার হল, রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন, জাতীয় চেতনার উন্নতি এবং দেশাত্মবোধের বৃদ্ধির ব্যাপারেও রমেশচন্দ্র রামমোহনকে প্রধান উৎস হিসেবে মানতে রাজি হননি। তিনি সে কৃতিত্ব দিয়েছেন ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের। আর রমেশচন্দ্র মনে করেন, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনতে সম্পূর্ণ অসফল হয়েছে। সমাজ সংস্কারক রামমোহন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, বঙ্গসমাজে বুনিয়াদি পরিবর্তন আনার ব্যাপারে একমাত্র সতীদাহ নিয়ে প্রচেষ্টা ছাড়া রামমোহনের আর কোনো ভূমিকা নেই।
যেমন সুমিত সরকার। তিনি রামমোহনকে যুগস্রষ্টা বলে মনে করেন নি, তাঁর মতে রামমোহন ছিলেন তাঁর যুগের সৃষ্টি এবং সে যুগের সীমাবদ্ধতার ফসল। তিনি সেই সন্ধিক্ষণের ফসল, যখন প্রাক-পুঁজিবাদী কাঠামো থেকে বুর্জোয়া আধুনিকতার দিকে সমাজের যাত্রা ক্ষীণভাবে আভাসিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সে যাত্রা উপনিবেশিক অধীনতার দ্বারা সীমায়িত বলে তাকে দুর্বল বিকৃত ক্যারিকেচারের মত লাগছে। আগেকার মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদদের ভাবনার ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ঐতিহ্য-আধুনিকতার দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া সমান বিপজ্জনক, কারণ তা আসলে আমাদের ঠেলে দেয় ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং এই ভাবধারার ধারকবাহক ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবক্তাদের দিকে। বুর্জোয়া আধুনিকতা ও আধুনিকতা এক জিনিস নয়। রামমোহনের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তুহফাতুল মুয়াহিদ্দিনের যুক্তিধারা যেসময় তিনি উপস্থাপিত করেন, তখনো ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভালো করে তাঁর পরিচয় হয়নি।
হেমচন্দ্র সরকারের লেখায় উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা পাই সেটা হল আধুনিকতা বলতে তিনি কিন্তু ইয়োরোপকে বোঝেন নি, তিনি বুঝেছেন নিজের দেশেরই ঐতিহ্যগত জাগরণকে। আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সুমিত সরকারও ইয়োরোপের বাইরের এক আধুনিকতার, যা ঢের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তার দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। দুই সরকারের এই রামমোহন প্রসঙ্গ আমাদের নিয়ে গেলে ফেলে ঐতিহ্য-আধুনিকতার বাইনারিতে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ত্রুটিগুলির কথা বলতে গিয়ে একদা শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন, “একটা অভিযোগের সত্যতা আমরা স্বীকার না করে পারি না যে আমাদের চোখ পূবের তুলনায় অনেক বেশি পশ্চিমে নিবদ্ধ ছিল। আমাদের হাতের কাছে অমূল্য সত্যের যে খনি আছে তাকে আবিষ্কার না করে আমরা পশ্চিমে সত্যের চর্চায় কি প্রগতি ঘটল জানতে বেশি উৎসাহী ছিলাম। আমাদের দেশের বইগুলোতে, আমাদের নিজেদের লোকাচারে এবং দেশাচারে সত্যের যে রত্নভাণ্ডার সঞ্চিত আছে, তার তুলনায় পশ্চিমী আদর্শগুলো আমাদের টানত বেশি।” এই হল সেই উপনিবেশিকতা (coloniality), যার কথা বর্তমান প্রবন্ধে বলতে চাওয়া হচ্ছে। এই উপনিবেশিকতা (coloniality) কি আমাদের জ্ঞানচর্চায় আমরা আজো বহন করে চলছি না? বিশেষ করে এই বাংলায়?
ব্রাহ্মধর্ম যে এ দেশে শেকড় গাড়তে পারে নি তার সবথেকে বড় কারণ হল একটা স্তরে যেমন ব্রাহ্মধর্মে সমন্বয়ধর্মিতা ছিল, আর একটা স্তরে ছিল না। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ফলে শাস্ত্রকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের বাইরের যে বিশাল সমাজ, যে সমাজ সমান পৌত্তলিকতায় আসক্ত, তাদের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা এবং ইয়োরোপীয় ভারততত্ত্ববিদরা সমানে প্রমাণ করতে লাগলেন যে পৌত্তলিকতা হচ্ছে উচ্চ আদর্শসম্পন্ন ভারতীয় সমাজের চূড়ান্ত নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের চিহ্ন। মনিয়ের উইলিয়ামস থেকে শুরু করে এচ. এচ. উইলসন, জেমস মিল সকলেই একবাক্যে বেদ বেদান্ত এমনকি মনু থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে শুরু করলেন যে সেসব গ্রন্থে কোথাও পৌত্তলিকতার কথা নেই। ভেতরের কথাটা এই, পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন এই বৃহত্তর সমাজ স্বশাসনের উপযুক্ত নয় এবং বাইরের থেকে তাঁদের মত যুক্তিনিষ্ঠ একেশ্বরবাদীরা এসে এই সমাজকে সুশাসন দিতে পারে। যদি এ দেশের লোককে একেশ্বরবাদীরা পথ দেখাতে সক্ষম, তাহলে ইসলামই তো যথেষ্ট ছিল। তাদের এদেশে আসার দরকার পড়ল কেন? সমাজের সর্বক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের হঠানোর দরকার পড়ল কেন? অতএব শুধু যুক্তিনিষ্ঠতা কোনো কারণ নয়। সে কারণ তাদের আধুনিকতা, যে আধুনিকতা শিল্পপ্রধান সমাজের উপজ এবং যার বিকাশ একের পর এক উপনিবেশ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীল। সে আধুনিকতার কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত লক্ষ্যণীয়, যে ইয়োরোপ রেনেসাঁয় শাস্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তির ওপর ভর করে চলতে শুরু করেছিল, সেই ইয়োরোপের প্রধান চালিকা শক্তি ব্রিটিশ এই উপনিবেশে শাসক হয়ে এসে এ দেশের শাস্ত্রকেই আইনে পরিণত করল। এর আগে এরকম কোনো লিখিত আইন হিন্দুদের বেলায় আমাদের দেশে ছিল না। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের আর এক নাম উপনিবেশিক আধুনিকতা।
অপরদিকে যে ভারততত্ত্ববিদরা আমাদের বেদ উপনিষদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাই আবার পৌত্তলিকতার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদিম উপাদানগুলি থেকে আমাদের সমাজে অজস্র দেবদেবীর জন্ম হয়েছে এবং সমসাময়িক সমাজে যার বহমানতা বিদ্যমান, এমনকি ইয়োরোপীয় সমাজের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টানরা যে খেতে বসার আগে ‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড’ বলে প্রার্থনা করেন, সে প্রার্থনার জন্ম নব্য প্রস্তর যুগে এবং ঈশ্বরকে পিতারূপে কল্পনা করে প্রার্থনা করার যে ভাবনা সে ভাবনার জন্ম চারণ যুগে। অথচ নব্য প্রস্তর যুগের বা চারণ যুগের এই প্রার্থনাগুলো এখনো বহাল আছে এবং সে ঐতিহ্য খ্রিস্টানদের গৌরবের কোনো হানি ঘটায় না। কোসাম্বির ভাষ্যে, আমাদের দেশে সমাজের নিম্নবর্গের মধ্যে যে নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের চল আছে, সেগুলো এই বৃহত্তর উৎপাদনশীল সমাজে তাদের এক একটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্তরগত অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী। জাত ও ধর্মের সঙ্গে মিশে ঐ অনুষ্ঠানগুলি গোষ্ঠীগুলিকে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক মর্যাদার পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে তাদের জাত এবং কখনো কখনো তাদের ধর্মবিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, কেন কখনো কখনো ধর্মবিশ্বাসগুলির সমন্বয় ঘটে, আবার কেন কখনো কখনো কিছুতেই সেগুলো মিলতে চায় না। স্বাভাবিকভাবে শংকর কিংবা রামানুজের দর্শন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কারণ তাদের সে উচ্চস্তরে এ সমস্যাটার অস্তিত্বই নেই।
বেদ উপনিষদে পৌত্তলিকতার উল্লেখ থাক আর না থাক, আমাদের দেশে পৌত্তলিকতার সঙ্গে দর্শনের বিরোধ ছিল এমন কথাও কোথাও নেই। বুদ্ধ পৌত্তলিকতা সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তিনি নিজে দেবদেবীর পূজায় পশুবলি দেয় এমন বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছিলেন, এই আশায় যে তিনি তাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে অহিংস করে তুলতে পারবেন। মূল সমস্যাটা ছিল পশুবলি নিয়ে। আমরা সবাই জানি বৌদ্ধধর্ম কৃষিজীবীদের বসতিগুলোকে স্থায়িত্ব দেবার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। কৃষিজীবীদের প্রধান সমস্যাই ছিল বৈদিক সমাজের পশুবলি। বুদ্ধের অহিংসা এই পশুবলি বন্ধের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল। অহিংসাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে বুদ্ধকে বেদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। সেই বিরোধিতায় জন্ম হয়েছিল এযাবৎ কালের এক শক্তিশালী দর্শনের। শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তেও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। বরঞ্চ ব্যক্তিগতভাবে শংকরাচার্য ভগবান হিসেবে বিষ্ণুর আরাধনার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। তাঁর টীকাতেও বিষ্ণুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পরিবারের কুলদেবতা।
(চলবে)
(এই পর্বের শেষে টীকা ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে)
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
৩
স্বাদেশিকতা পর্ব ১৮০৯-১৮৭২
কিছু শব্দ কিছু কথা
সাধারণভাবে গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীকে বাংলায় নবজাগরণের যুগ হিসেবে ধরা হয়। আবার সেই ঊনবিংশ শতাব্দীরই দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অর্থাৎ মার্ক্স কর্তৃক অভিহিত ১৮৫৭র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকে ধরা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জাতীয় আন্দোলনের যুগ। এই প্রবন্ধে কিন্তু সময়ের এই ভাগকে সে হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। যুগটা নবজাগরণের হলেও তার মূল শক্তি বা প্রেরণাটা কি? লেখকের মতে সেটা স্বাদেশিকতা। এই স্বাদেশিকতা দেশে সবসময়ই ছিল, কিন্তু তার ধার কমে গিয়েছিল। নতুন বিরোধের সংস্পর্শে এসে সে নিজেকে শানিয়ে নেবার অবকাশ পায়। তাই ১৮০৯ থেকে ১৯০৯ সাল এই একশ বছরকে দুটি কালপর্বে ভাগ করে বাংলায় স্বাদেশিকতার কাল হিসেবে দেখানো হল। ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ সাল একটি কালপর্ব, ১৮৭২ থেকে ১৯০৯ সাল আর একটি কালপর্ব। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ ডানা মেলতে শুরু করে এই ১৯০৯ সাল থেকেই, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে যার অন্তিম পরিণতি দেখতে পাই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায়।
এই স্বাদেশিকতার প্রথম কালপর্ব হল ১৮০৯ থেকে ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ। এই সময় জুড়ে দেখি আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষা ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। সব মিলিয়ে একে বলতে পারি সমাজসংস্কার। ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দে পৌঁছে এই প্রেক্ষাপটটা অনেকটাই বদলে গেল। এমন নয়, যে সমাজসংস্কারের চেষ্টাগুলো আর রইল না, কিন্তু ঐ বছরই বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হবার পর থেকে বাংলায় স্বাদেশিকতার পালে যে হাওয়া লাগল, তাকে আর শুধুমাত্র সমাজসংস্কার বলা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের বলিষ্ঠ লেখনীতে একদিকে যেমন প্রবল দেশপ্রেমের হাওয়া বইতে লাগল, অপরদিকে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। দেশে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল স্বাধীনতার আকাঙ্খা। সেই স্বাধীনতার আকাঙ্খা দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হল জাতীয়তাবাদে। এবং ১৯০৯ সাল থেকে এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের উপজ হিসেবেই জন্ম হল ক্ষমতার কাঙালপনার, যার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, চুরমার হয়ে গেল মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের কল্পনা, যদিও আপাতদৃষ্টে আমরা এক স্বাধীন ভারত পেলাম।
একটা শব্দ অনেক কথা বলে। যেমন, স্বাদেশিকতা। স্বাদেশিকতা এসেছে স্বদেশ থেকে, নিজের দেশ। গোড়ায় দেশ। ব্রিটিশরা যখন এ দেশটাকে রাষ্ট্রে পরিণত করে নি, তখনো দেশ ছিল। কিন্তু তখন ভারতবর্ষ ছিল একটা ধারণা, বিশেষ করে মহাকাব্যগুলির সূত্রে যে ধারণা সমাজমানসে অধিষ্ঠিত ছিল। আর দেশ বলতে যে নির্দিষ্ট জায়গায়--প্রধানত গ্রামে-- একজন মানুষ থাকত সেটা হত তার দেশ, আবার যে জনপদের সে অধিবাসী সেটাও হত তার দেশ। দেশ শব্দটার দ্বৈত অস্তিত্ব।
স্বাদেশিকতা কোনো উপনিবেশিক উপাদান নয়। স্বাদেশিকতা আধুনিক শব্দ, কিন্তু স্বাদেশিকতা দিয়ে যেটা বোঝায় সেটা আধুনিক নয়। সেটা হল দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম। নিজের দেশকে ভালোবাসাটা সর্বজনীন ও সর্বকালীন সত্য, সে যে যে দেশেরই হোক না কেন। দেশ মানে শুধু দেশের মানুষকে ভালোবাসা নয়। দেশ মানে দেশের আলো, হাওয়া, জল, মাটি, গাছপালা, পশুপাখি থেকে শুরু করে পাহাড়, অরণ্য, গ্রাম, শহর, মানুষের মন, তাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং দেশপ্রেম মানে এই সবকিছুর সঙ্গে একাত্মবোধ, যেমনটি পাই কালিদাসের মেঘদূতে রামগিরি আশ্রম থেকে অলকাপুরীতে যাবার যক্ষের দেওয়া দীর্ঘপথের বর্ণনায়। “যাও না বন্ধু, পথ বলে দিচ্ছি আমি। পথ তোমার ক্লান্তিকর হবে না। পাবে জল, পাবে ছায়া, পাবে সৌধোৎসঙ্গের উষ্ণতা। চোখ, কান দুই-ই জুড়োবে তোমার। দেখবে মধুর দৃশ্য, শুনবে কিন্নরীদের গান, শুধু একটু মন্দ্রধ্বনি যদি কর মৃদঙ্গের সঙ্গত হবে শিবসঙ্গীতে। কেকাধ্বনিতে স্বাগত জানাবে সজলনয়ন ময়ূরেরা। নদীদের ভ্রুভঙ্গী তো দেখবেই, নগরবধূদের ভ্রুলতাবিলাসও নিশ্চয় তোমার দৃষ্টি এড়াবে না। চোখ তুলে তারা তোমার দিকে যখন চাইবে, মনে হবে কৃষ্ণভ্রমরের পঙক্তি। এ সব দেখতে দেখতে তুমি কৈলাসে এসে পড়বে, আর কৈলাসের কোলেই তো অলকা।”
ভাবের কথা ছেড়ে যদি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসি, তাহলেও দেখব একজন দেশপ্রেমিক চায় যেন তার দেশের আলো, হাওয়া দূষিত না হয়, যেন জল, জঙ্গল, জমি ধ্বংস না হয়। যেন তার দেশে দারিদ্র না থাকে, শোষণ না থাকে, বঞ্চনা না থাকে, হিংসা না থাকে। যেন তার দেশটা আরো সহনশীল হয়, আরো গণতান্ত্রিক হয়, প্রকৃতিগতভাবে যেন দিন দিন আরো inclusive হয়। যেন তার দেশের ভাষাগুলোর দিন দিন সমৃদ্ধি ঘটে, যেন যার যার ধর্ম অটুট থাকে। অবশ্যই সে চায় দেশকে এবং নিজেকে সুরক্ষিত দেখতেও। নিজের দেশের সম্পর্কে সে যেমন এইসব চায়, বিশ্বের সব দেশের সম্পর্কেই সে একই কামনা করে। যেন সব দেশই শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে, আনন্দে থাকে, সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তার এসব চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষমতার গন্ধ নেই। সে নিজের জীবনযাত্রার ধরন, নিজের বিশ্বাস, নিজের মূল্যবোধ, নিজের ঐতিহ্য, নিজের ভাষা, নিজের ধর্ম যে কোনো কিছুর মূল্যে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু চায় না সেসব অন্য কারুর ওপর চাপিয়ে দিতে। তার মধ্যে কোনো আগ্রাসী ভাব নেই, স্বভাবগতভাবেই সে রক্ষণশীল। এই ধারণাতেও সে ভোগে না যে তার দেশ ভুল করলেও দেশপ্রেমিক হিসেবে তার একমাত্র পবিত্র কর্তব্য তাকে সমর্থন করা, My country right or wrong। কারণ একজন দেশপ্রেমিক নিজের দেশকেও নৈতিকতার মানদণ্ডে যাচাই করে। এবং চায় না যে তার দেশের নৈতিক অধঃপতন হোক। স্বাদেশিকতার সঙ্গে নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।
স্বাদেশিকতার কথা উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের কথাও ওঠে। অতএব দেখা যাক জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ শব্দটা আবশ্যিকভাবেই আমাদের দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি করা একটি শব্দ। জাতি শব্দটা নিয়ে গোড়া থেকেই সমস্যা। জাতির অর্থ কী? ইংরেজিতে জাতির অর্থ করা হয়েছে nation। কিন্তু ঠিক তাই কী? ইংরেজিতে জাতির অন্তত চাররকম মানে পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় জাতি অর্থে race, যেমন ককেশীয় জাতি, নিগ্রো জাতি, মঙ্গোলীয় জাতি। জাতি অর্থে nationও, যারা যৌথভাবে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস, নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের অংশীদার এবং একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণ, যেমন ব্রিটেন। আবার জাতি অর্থে ethnic groupও, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, আসলে raceএরই ক্ষুদ্রতর শ্রেণিবিভাগ, যেমন ককেশীয় জাতির একাধিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ানরা এবং জার্মানরা উভয়েই ককেশীয় জাতির অন্তর্গত, কিন্তু রাশিয়ানরা স্ল্যাভিক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, জার্মানরা নরডিক। এবং চতুর্থত মোহম্মদ আদিবের মতে, জাতি অর্থে tribeও, যদিও তাদের আমরা উপজাতি হিসেবেই চিহ্নিত করি। তিনি লিখেছেন, “উপজাতির সংজ্ঞাটি বেশ গোলমেলে, কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে উপজাতি বলতে রাষ্ট্র স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষদের বোঝায় যাদের মোটামুটি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ রয়েছে।” উদাহরণস্বরূপ তিনি চাকমাদের কথা বলেছেন। চাকমারা একটি ছোট অঞ্চলের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও মারমা, ত্রিপুরা সহ অন্যান্য উপজাতিদের থেকে আলাদা, তাদের রয়েছে একই সঙ্গে আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রয়েছে নিজস্ব রাজা, আবার তারা একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম গোলমেলে। জাতি বলতে একই সঙ্গে বোঝায় বর্ণ, জাতি, জাত, এমনকি কখনো কখনো সামাজিক শ্রেণিও। অহিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বর্ণ, জাতি বা জাত খাটে না বটে, কিন্তু তাদেরও রয়েছে নানারকমের ভাগ।
এই জাতি থেকে আরো কতকগুলো শব্দ এসেছে। জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) বা রাষ্ট্র-জাতি (state-nation)। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বলা হয় জাতি বা nation হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাতিসত্তা, রাষ্ট্র নয়। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে বলে রাষ্ট্র। যখন একটি জাতির নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকে, একমাত্র তখনই সে হয়ে ওঠে জাতি-রাষ্ট্র। প্রশ্ন ওঠে একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত এবং সরকার থাকলে তাকে রাষ্ট্র বলে যদি মেনেও নিই, তার অন্তর্গত জাতিসত্তাটি কি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ অভিন্ন? পৃথিবীতে এমন দেশ কি খুব বেশি আছে? নেই যে তার প্রমাণ আমরা সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দিয়ে পেয়েছি। এখানেই জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। ভারত যেহেতু বিবিধের মাঝে মিলন মহানের দেশ, যোগেন্দ্র যাদবরা জাতি-রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পালটা রাষ্ট্র-জাতি তত্ত্ব হাজির করেছেন। যদিও তাতে করে সমস্যা মেটে না।
যে অর্থে ভূখণ্ড হিসেবে দেশের একটা নির্দিষ্টতা আছে, nation বলে অভিহিত করে জাতিকেও সেইরকম একটা নির্দিষ্টতা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে সংকট বেড়েছে ছাড়া কমেনি। কারণ প্রাণ-অপ্রাণের নানা বৈচিত্র্য, নানারকমের মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম সবকিছুর মিশেল ঘটেছে দেশ শব্দে, চরিত্রগতভাবে সে সর্বপ্রকারে inclusive। কিন্তু জাতি শব্দটা যেহেতু একান্তভাবে মনুষ্যকেন্দ্রিক, চরিত্রগতভাবে সে এমনিতেই exclusive (অর্থাৎ মনুষ্য ব্যতীত কোনো ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়), তার ওপর nation শব্দে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করায় তার exclusivity বেড়ে গেছে। তাছাড়া, দেশে অন্য আরো অনেক কিছুর মতন মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মেরও ঠাঁই আছে, কিন্তু বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের নির্দিষ্টতার ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে যাওয়ায় nationএ মানুষের চলিষ্ণু ও বৈচিত্র্য ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। ডালিয়া গেব্রিয়াল, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের এক ছাত্রী, এ নিয়ে বলেছেন,nation শব্দটার সবথেকে বড় সমস্যা এই যে, nationহতে গেলে তাকে আগে নির্দিষ্ট করে নিতে হয় কারা কারা তার পরিধির বাইরে। এই বাইরের লোকজনের তালিকায় সবার আগে থাকে পরিযায়ীরা (অর্থাৎ মানুষের চলিষ্ণু ধর্মের কোনো ঠাঁইnation-এ নেই), তার পরে থাকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া লোকজন, সন্দেহজনক ব্যক্তিরা, মেয়েরা এবং অক্ষমরা। এবং যেহেতু তারা nationএর পরিধির বাইরে, তাদের অকল্পনীয় হিংসার শিকার হতে হয়। কেন এমন হয়? কারণ,nationগড়ে ওঠে যুক্তিবহির্ভূত জাতিসত্তাকে (বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায়, কল্পিত) কেন্দ্র করে এবং অন্য যারা এই পরিধির বাইরে, তাদের জীবনের কোনো মূল্য তাদের কাছে থাকে না। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। nation শব্দটাকে ঘিরে এতসব ঝামেলা এড়াতে আন্তর্জাতিক আইনে এখন আর nation অর্থে জাতি ধরা হয় না, একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে, যেখানে অনেক লোক একসাথে বাস করে, nation বলা হয়।
জাতি থেকে জাতীয়তা থেকে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেক প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে “রাষ্ট্রকৃত সমস্ত ভালো মন্দ ক্রিয়াকলাপ ছাপিয়ে নিজেকে তার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার এবং সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রের স্বার্থকে ঠাঁই দেওয়ার প্রবণতা।” তাঁর বিশ্লেষণে, ক্ষমতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা, জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপ্ত থাকে ক্ষমতার আকর্ষণ। রাষ্ট্র চায় যে কোনো কিছুর মূল্যে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে, নিজেকে সর্বাধিক সম্মানিত করে তুলতে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে আর যেহেতু জাতীয়তাবাদী মানুষ ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে, রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে অভিন্ন করে ফেলে, তার চাওয়াগুলোও রাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তখন সেই ব্যক্তিমানুষ যেহেতু সে রাষ্ট্র নামক এক বৃহৎ শক্তির পক্ষ নিয়েছে, তার উচ্চমন্যতার কারণে কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি আর শুনতে চায় না এবং সামান্যতম সমালোচনা তাকে হিংস্র করে তোলে। শুধু তাই না, তার নিজের ঘটানো হিংসামূলক ঘটনাগুলোকে অব্দি সে অস্বীকার করতে থাকে। আর তবু মানতেই হবে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আমাদের এখানে (এবং মহারাষ্ট্রে) যে স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেধেছিল, ১৯০৯ সালে তাই পরিণত হয় পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদে।
স্বাদেশিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা হচ্ছে এই—স্বাদেশিকতা মৌলিক রূপে কোনো বিদেশি জিনিস নয়, যদিও স্বাধীন দেশের স্বাদেশিকতা একরকম, পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা আর একরকম। পরাধীন দেশের স্বাদেশিকতা উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত, যেমন, ইংল্যান্ড স্বাধীন দেশ, সপ্তদশ শতাব্দীর সেই ইংল্যান্ডে যেভাবে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে সার্বিক প্রতিরোধের মাধ্যমে খর্ব করে দেওয়া গিয়েছিল, আমাদের এখানে তা সম্ভব ছিল না। বিদেশী শাসনের শুরুতেই উপনিবেশিক শাসক যেভাবে আমাদের হিন্দু ও মুসলমান দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল এবং যেভাবে ক্রমাগত মুসলমানদের সর্বক্ষেত্র থেকে হটিয়ে বর্ণহিন্দুদের সেই জায়গায় তুলে এনেছিল, তারপর কোনো প্রতিরোধই আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হওয়া সম্ভব ছিল না। জাতীয়তাবাদ কিন্তু সে অর্থে সীমায়িত নয়। জাতীয়তাবাদ শব্দ এবং সে আদর্শের সারবস্তু দুটোই এদেশে খোদ ইয়োরোপের রপ্তানি। ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক নানা ধরনের যে সংগ্রাম চলেছিল, অজস্র অত্যাচার মুখ বুজে সহ্যের বিনিময়ে, অজস্র বলিদানের বিনিময়ে, অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে যা স্বাধীনতা(?) নিয়ে এল, সে সম্পর্কে এককথায় বললে বলতে হয় ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল আর সেই সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বকে তছনছ করে দিয়ে গেল। জাতীয়তাবাদ যদি এত উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ইয়োরোপের ভাবধারা ইয়োরোপেরই বিরুদ্ধে চলে গেল কেন এবং আমাদের অস্তিত্বকে তার শেকড় থেকে উৎপাটিতই বা করে দিয়ে গেল কেন? একথার উত্তরে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, দুর্বল ও দরিদ্র দেশগুলো যে এই আদর্শকে খুব যুক্তিপূর্ণ এবং আত্মশক্তির জাগরণের সহায়ক বলে ভেবেছিল, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কোনো বিচারশীল, উদার, সর্বংসহ, সৃজনশীল আদর্শ নয়। ইয়োরোপের বাইরে কোথাও এ জিনিস ছিলও না। এ হল দেশে দেশে ইয়োরোপের রপ্তানি। শুধু রপ্তানিই নয়, রীতিমত সর্বনাশা রপ্তানি, কারণ এ কোনো যুক্তি বা মুক্তির সন্তান নয়, বরঞ্চ তার উল্টোটা, উদগ্র কল্পনাবিলাস, রাজনৈতিক ত্রাণকর্তার ভঙ্গির ফসল, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীনতার হত্যা।
ফিরে যাওয়া যাক স্বাদেশিকতায়। আগেই বলা হয়েছে আমাদের স্বাদেশিকতা এই উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত ছিল। সেই সীমায়িত স্বাদেশিকতা আমাদের মধ্যে কী ধরনের উপনিবেশিকতার জন্ম দিল তার ইঙ্গিত দেওয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। যেমন প্রথম থেকেই ভাগ হয়ে যাওয়াতে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারল না। তবু চেষ্টা হয়েছিল, ১৮৫৭ সালে, যাকে আমরা বলি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর একটা চেষ্টার কথাও বলা যায়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ১৭৬৩ সালে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল এবং যা ধিকধিকিয়ে চলেছিল ১৮০০ সাল অব্দি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে এর চেহারাটা ছিল ভাঙাচোরা। সেই ভাঙাচোরা দুর্বল আংশিক প্রতিরোধ নিয়ে আমরা যত গর্বই করি না কেন, তা আসলে উপনিবেশিকতা ছাড়া কিছু নয়। ব্রিটিশরা কেন এরকম করেছিল তার কারণ আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং শাসকের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি থেকেই ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। যদিও ভারততত্ত্ব তখনো দানা বাঁধেনি, কিন্তু ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এদেশে এসেছিল। বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি থেকে, তাদের দেশ থেকে যেসব লোক মোঘল আমলে এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের প্রদত্ত বিবরণ থেকে তারা এসব খবর সংগ্রহ করেছিল।
উপনিবেশিক ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার থেকে যে উপনিবেশিকতার জন্ম তার বোঝা আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। উপনিবেশিক ব্যবস্থা দ্বারা সীমায়িত এই স্বাদেশিকতা আর্থ-সামাজিক স্তরেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সবথেকে বড় উদাহরণ হল জমির পণ্য হয়ে যাওয়াটা আমরা বিনাবিচারে মেনে নিলাম। জমিতে আগে কৃষকদের মালিকানাস্বত্ব ছিল এটা জেনেও রামমোহন কৃষকদের দখলিস্বত্বের কথা বললেন। আগে জমিদারদের কোনো দখলীস্বত্বই ছিল না, তারা ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। ব্রিটিশ আমলে ব্যাপারটা পুরো উল্টে গেল। এখন হয়ে দাঁড়াল কৃষকের দখলিস্বত্ব আর জমিদারদের মালিকানাস্বত্ব (যদিও আপাতদৃষ্টে, কেননা রাজস্ব ঠিকমত দিতে না পারলে জমিদারিও নিলামে উঠত এবং হস্তান্তরিত হত)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জমিদাররা জমি নিয়ে যা খুশি করতে পারত। স্বাধীনমত জমি কেনাবেচা করতে পারত, কৃষকের কাছ থেকে মোটা রকমের খাজনা আদায় করতে পারত, জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করতে পারত। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিতে সরকারি খাজনার রকমফের হত। কোনোবছর অনাবৃষ্টি হয়ে উৎপাদন কমে গেলে সেই অনুযায়ী খাজনা দিলেই হত। এখন সরকারি খাজনার পরিমাণের কমাবাড়া বলে কিছু রইল না, উৎপাদন যাই হোক না কেন। সেই খাজনার ওপর আবার জমিদাররা আবওয়াব ইত্যাকার নানারকমের অন্যায় দাবি চাপিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস তুলল। জমিদারের খাজনা এবং বাড়তি আবদার মেটাতে গিয়ে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে লাগল। সে ধার মেটাতে না পেরে হয় মহাজন নয় জমিদারদের কাছেই জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতে লাগল। দেখতে দেখতে কৃষকদের একটা বিশাল অংশ পরিণত হল ভূমিহীন খেতমজুরে। ওদিকে ইংরেজ শাসনের দৌলতে দেওয়ানি বেনিয়ানি মুচ্ছুদিগিরি করে যারা দেদার টাকা আয় করেছিল, নিলাম হওয়া পুরোনো জমিদারিগুলো তারা ক্রমান্বয়ে কিনে নিতে থাকল। কিন্তু তারা বেশির ভাগই কলকাতার বিলাসব্যসনে আসক্ত এবং শহর ছেড়ে থাকতেও চায় না, ফলে জমিদারিগুলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ সম্পর্ক হত ক্ষীণ। এইভাবে জন্ম হল একদল অনুপস্থিত জমিদারের। এইসব নতুন জমিদার না জমিদারি পরিচালনার কিছু বুঝত, না জমিদারি থেকে পাওয়া লাভ ছাড়া আর কোনোকিছুতে তাদের উৎসাহ ছিল। জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের ও তদারকির দায়িত্ব তারা যাদের ওপর ছেড়ে দিতে থাকল, তারাই জন্ম দিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির— পত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, পাঁতিদার, তালুকদার, ইজারাদার, জোতদার ইত্যাদির।
এ পর্যন্ত এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষণীয় রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষতা করলেন এই যুক্তিতে যে এর ফলে পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে আয়বৃদ্ধি হবে এবং তার জন্যে খাজনা বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তিটা যে ভুল তা আগেই দেখানো হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন)। বেশির ভাগ পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিতেই চাষবাস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল আমলে। অতএব কৃষকের দ্বারা জমির উন্নতি ইংরেজ আমলের ঘটনা ছিল না। অবশ্য কৃষকের দুর্দশার প্রতিবিধান করতে গিয়ে রামমোহন গবর্নমেন্টের সঙ্গে জমিদারের যেরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রজার সঙ্গেও তেমনি জমিদারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন, কেননা কৃষক জমির উন্নতি করলেই যদি জমিদার খাজনা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কৃষক আর জমির উন্নতি করার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। হতে পারে রংপুরে থাকতে যে কৃষক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, জমিদারের সঙ্গে কৃষকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবের নেপথ্যে সেই সম্পর্কের একটা ভূমিকা ছিল। রামমোহন কৃষির উন্নতির জন্যে সরকারকে একটি কৃষি দপ্তর খোলার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
এহ বাহ্য। এই ‘কৃষির উন্নতি’ ব্যাপারটা কী? যে দেশের সমাজটাই কৃষিপ্রধান, বাইরে থেকে এসে একদল শাসক তার কী উন্নতি করতে পারে? যে দেশের কৃষক দিবারাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার জমি চষে চলেছে, যে তার জমিকে হাতের তালুর মত চেনে, তাকে কৃষির উন্নতির ব্যাপারে পরামর্শ দিতে যাবার এই চেষ্টা কেন, তাও আবার পরামর্শদাতা তাঁরা যাঁরা কৃষির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। রামমোহন থেকে এই সংস্কৃতি ঊনবিংশ শতাব্দী হয়ে আজো বহমান।
এই প্রবন্ধে প্রতিটি কথা প্রমাণসহ বলা সম্ভব নয়, মোটের ওপর ব্যাপারটা হচ্ছে এই, ভারতীয় কৃষিকে আদিম পর্যায়ের ও পশ্চাৎপদ বলে দেগে দিয়ে ব্রিটিশের দিক থেকে কৃষির উন্নতির আয়োজন করার দুটো বড় কারণ ছিল। খাজনা নির্দিষ্ট করে দেবার ফলে একদিকে বিশাল পরিমাণ কৃষক প্রতিদিন খেতমজুরে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল এবং অপরদিকে ব্রিটিশ কর্তৃক কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে বিশাল পরিমাণ কারিগর সেই কৃষিকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছিল এবং এই পরস্পরবিরোধী অবস্থার মধ্যে পড়ে আমাদের কৃষিক্ষেত্র ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল এবং একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটছিল। এই অব্যবস্থাকে চাপা দিতে ব্রিটিশ একদিকে কৃষির উন্নতিতে কৃষকের অনাগ্রহের কথা চাউর করেছিল এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে কৃষির উন্নতি তত্ত্বকে সামনে এনেছিল। কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ হল, শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে এইসময় যেসব কৃষি সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ হয়েছিল, বিশেষ করে লাঙল এবং কাস্তের, ভারতে সেসবের বাজার তৈরি করা। ঐসব লাঙল এবং কাস্তে বিক্রি থেকে একটা আয় আসবে, তার ওপর ঐসব লাঙল ও কাস্তে ব্যবহারের ফলে জমি বেশি উর্বর হবে, উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন বাড়লে জমির আয় বাড়বে, জমির আয় বাড়লে রাজস্ব বাড়বে, পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি শুল্কও বাড়বে।
মাইকেল মধুসূদন যখন উত্তরপাড়ায় ছিলেন, তখন উত্তরপাড়া হিতকারী সভা কৃষিবিদ্যা নিয়ে বলতে ডাকেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্রকে। সভার বিষয় শুনে মাইকেল বলেছিলেন, “কৃষিবিদ্যা নিয়ে আবার বক্তৃতা কি? চাষারা কি জানে না কি করে ধান বুনতে হয়। খাচ্ছ কি করে? তাদের আবার কৃষিবিদ্যা কি শেখাবে?”
ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে বলতে গিয়ে জন অগুস্টাস ভোয়েলকার বলেছিলেন, “বেশির ভাগ জায়গাতেই উন্নতি করার মত প্রায় কিছুই নেই।” জন কেনি বলেছিলেন, “যেখানে একটা প্রদেশেই চার হাজারের মত ধানের প্রজাতির উৎপাদন হয় এবং প্রত্যেকটা প্রজাতিকে তার গুণাগুণ ও তার উপযুক্ত জমি অনুযায়ী ভাগ করে চাষ করা হয়, সেখান থেকে বীজ সংগ্রহের কোনো মানে হয় না। এমনকি ভারতীয় কৃষিতে আধুনিক লাঙলের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না।” আর ১৮৩২ সালের ১৩ অগস্ট কমনস কমিটির সামনে দেওয়া সাক্ষ্যে বটানিকাল গার্ডেনের তৎকালীন সুপারিন্টেডেণ্ট ড. ওয়ালিক বলেছিলেন অধিক ফসলের স্বার্থে বাংলার নরম মাটিতে ব্যবহৃত সনাতনী লাঙলের বদলে ইয়োরোপীয় লোহার লাঙল ব্যবহার করার ফলে নিচের নোনা মাটি উঠে জমির ক্ষতি হয়ে যাবার কথা।
স্বাদেশিকতার অন্য উদাহরণগুলো হল, যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, আত্মশক্তির জাগরণের প্রয়াস, দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর সঙ্গে লড়াই, প্রাথমিক শিক্ষার ও নারীশিক্ষার আয়োজন এবং সবথেকে বড় কথা এসব প্রয়াস, লড়াই, আয়োজনের উপযুক্ত মাতৃভাষা গঠনের নিরন্তর চেষ্টা এবং সেই মাতৃভাষার প্রসারের আয়োজন। ডিরোজিওর ছাত্ররা যে এ ব্যাপারে খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। দেশের প্রচলিত কুপ্রথাগুলির সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে সবথেকে বেশি যাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরেরও রামমোহনের মত ক্ষুরধার বিচারশীল মন ছিল, তিনি শাস্ত্রঘেঁষাও ছিলেন না, বরঞ্চ রামমোহনের তুলনায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অনেক কম, আর তবু তাঁকে তাঁর সমাজসংস্কারের কর্মসূচিগুলোকে সফল করতে বারে বারে শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কেন? ১৭৭২ সালে দশ জন পণ্ডিতের সাহায্যে ওয়ারেন হেস্টিংস শ্রুতি, স্মৃতি, শাস্ত্র ও ব্যবহার এই চার উপাদানের ওপর নির্ভর করে হিন্দু আইন বিধিবদ্ধ করলেন। এর ফলে গোটা সমাজের বুকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য আরো চেপে বসার সাথে সাথে শাস্ত্রকে এড়িয়ে সমাজসংস্কার অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এটা রামমোহনের পক্ষেও সত্যি ছিল। ব্রিটিশ আসার আগে আমাদের দেশে শাস্ত্র ছিল, ধর্মীয় গোঁড়ামোও ছিল, কিন্তু এরকম কোনো ব্রিটিশ ধাঁচের সুসংহত হিন্দু আইনের কর্তৃত্ব কায়েম ছিল না। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রাক-ব্রিটিশ সমাজেও ছিল, কিন্তু তখন কি রাষ্ট্রীয় পরিসরে কি সামাজিক পরিসরে, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় সমাজের পরিসরে, তার প্রতাপ ছিল সীমাবদ্ধ। এর পরের দফায় ১৭৮৪ সালে আমাদের এখানে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ব্রিটিশ কর্তৃক যে সুশৃঙ্খল সংস্কৃতচর্চার জোয়ার এল, যাকে বলা হতে লাগল ভারততত্ত্ব, তার জোয়ারে আমাদের দেশীয় পণ্ডিতদের সংস্কৃতচর্চা তলিয়ে গেল। প্রথমে আইন, তারপর তার খোপের মধ্যে সংস্কৃতচর্চাকে পুরে দিয়ে শাসক গোষ্ঠী এ দেশ সম্পর্কে যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তৈরি করল, তাকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ‘epistemic violence’ বা ‘জ্ঞানতত্ত্বমূলক হিংসা’ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশের হাতে গড়ে উঠল এক নতুন হিন্দুসমাজ, যার কর্তৃত্ব ব্রাহ্মণদের হাতে। অনেক পরে ১৯২৫ সালে সেই হিন্দুসমাজের পক্ষ নিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বললেন, “যাবতীয় রাজনৈতিক উত্থানপতন এবং বিদেশি আক্রমণের মধ্যে হিন্দুসমাজকে অখণ্ড রাখতে ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষরাই সবকিছু আইনের আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেইসব আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতম করে তুলেছিলেন।” চৈতন্য ও সূফী আন্দোলনের ফলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব থেকে যে সমাজ অনেকটাই ছিটকে গিয়েছিল, শাসনের সুবিধার্থে তাকে ব্রিটিশ আবার সংহত করে তুলে সমান এবং সহায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত করল। এক আধিপত্যের সঙ্গে আর এক আধিপত্যের সহাবস্থান ঘটল। যে হিন্দুসমাজের উত্তরাধিকার আমরা এখনো বহন করে চলেছি, সে হল এই হিন্দুসমাজ।
আসা যাক মেকলের কুখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’এর কথায়। প্রধানত যে দুটো কারণে মেকলের মিনিট কুখ্যাত, তার একটা হল মেকলের বাগাড়ম্বর, “ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান,” দ্বিতীয়টা হল তাঁর উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা, “এই মুহূর্তে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে একটি শ্রেণি গঠন করার, যারা আমাদের এবং কয়েক কোটি মানুষ যাদের শাসনভার আমাদের হাতে, তাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এমন এক শ্রেণি যারা রক্তে এবং রঙে ভারতীয় হবে, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হবে।” মেকলের বাগাড়ম্বর নিয়ে কিছু বলার নেই, সে মূর্খতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার, কিন্তু মেকলের উপনিবেশিক শাসকোচিত অভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা নিয়ে ঈষৎ ভাবার আছে। কেননা এর ঠিক পরেই মেকলে লিখেছিলেন, “এই শ্রেণির হাতে আমরা দেশের আঞ্চলিক মাতৃভাষাগুলোর সংস্কৃতিসাধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারি, যারা পশ্চিম থেকে বিজ্ঞানের শব্দাবলী নিয়ে ঐসব আঞ্চলিক ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে এবং ভাষাগুলোকে ধীরে ধীরে তারা ঐসব জ্ঞান জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উপযুক্ত বাহন করে তুলবে।” মেকলে যদি শুধু আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা বোঝার মত করে গড়ে তোলার কথা বলতেন আর তার জন্যে আমাদের কারো কারো ইংরেজি ভাষাটা জানার ওপর জোর দিতেন, তাহলে তিনি এত নিন্দিত হতেন না। কিন্তু তাঁর বক্তব্য এই দাঁড়াল যে পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারকবাহক যে ইংরেজি ভাষা সেটা জানতে গেলে রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে। যদি ধরেও নিই ইংরেজি ভাষা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারার বাহক, তাহলেও সেটা আত্মস্থ করতে গেলে আমার রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে কেন? তাহলে কি পশ্চিমী বা আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারশীল যুক্তিধারা সর্বজনীন নয়, একান্তভাবে ইংরেজ হয়ে উঠতে না পারলে সেগুলো বোঝা সম্ভব নয়? ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা স্পেনকে কি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে কোনো কিছু শিখতে তাদের নিজেদের রুচি, মতামত, নৈতিকতা, মনন সব বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠতে হয়েছিল? মেকলের মতে, ওরকম কথা উঠবেই না, কারণ ওগুলো সবই মহান ইয়োরোপীয় সভ্যতার অংশ, বাদবাকি সব বর্বর দেশ, যেমন ভারত, যাকে সভ্যতার আলো দেখানোর দায়িত্ব তাঁদের হাতে। কোনো বর্বর দেশ যদি ইংরেজের কাছ থেকে কিছু শিখতে চায় তো তাকে সর্বপ্রকারে ইংরেজ হয়ে উঠতে হবে, কারণ ইংরেজের রুচি ইত্যাদি গুণ অর্জন করতে না পারলে সে সেগুলো বুঝে উঠতে পারবে না। এই দম্ভ নিয়ে কথার বিস্তার করে লাভ নেই। শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে নয়, আপাদমস্তক এক উপনিবেশিক শাসকের মতই মেকলে আসলে ইংরেজিনবিশ একটি বশংবদ শ্রেণি গঠনের লক্ষ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন, মেকলের আগে থেকেই যে ইংরেজিনবিশ বশংবদ শ্রেণির গঠন এখানে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিশীল বিচারধারাকে যাঁরা বাংলা ভাষায় আনার চেষ্টা করলেন, তাঁরা কেউই রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায়, মননে ইংরেজ হয়ে ওঠেন নি। রামমোহন রায় নিজে বাংলায় একটা ভূগোলের বই লেখার চেষ্টা করছিলেন, আত্মীয় সভার সদস্য ব্রজমোহন মজুমদার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ফারগুসনের অ্যাস্ট্রোনমির একটা বাংলা অনুবাদ করছিলেন। তারপর একদিকে এলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সূত্রে অক্ষয় কুমার দত্ত, আর একদিকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এই ধারায় একের পর এক চেষ্টা হল, সেই চেষ্টার শেষ বোধহয় বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন।
আর তবু আধুনিক বিজ্ঞান মাতৃভাষায় সাধারণ মানুষের জ্ঞানতত্ত্বের অঙ্গনে সেভাবে প্রবেশ করতে পারল না। কেন? তার বদলে যেটা ঘটল, সমাজের মধ্য স্তরে ইংরেজি ভাষা নিয়ে দিন দিন বাড়তে লাগল দৃষ্টিকটু রকমের হ্যাংলাপনা, যা ক্রমশ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেল, অপরদিকে আধুনিক বিজ্ঞান শেখার মাধ্যম হয়ে রইল সেই ইংরেজি ভাষাই, যা সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে হয়ে উঠল ক্ষমতার হাতিয়ার।
১৮৩৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মামুদও তাঁর দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের বলেছিলেন, “তোমরা ফরাসিতে ওষুধপত্রের ওপর যেসব বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আছে সেগুলো পড়....আমার উদ্দেশ্য তোমাদের ফরাসি ভাষা শেখানো নয়, আমার উদ্দেশ্য ফরাসি ভাষায় যেসব বিজ্ঞানসম্মত ওষুধপত্র আছে সেগুলোর সম্পর্কে তোমরা জ্ঞানার্জন কর এবং ধীরে ধীরে সেগুলো আমাদের ভাষায় নিয়ে নাও।” আমাদের দেশে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা বিতর্কিত চিঠিটিতে রামমোহনও প্রায় একই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন লাটসাহেব যেন পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে, যেমন অঙ্ক, প্রাকৃতিক দর্শন (এখনকার ভাষায় পদার্থবিজ্ঞান), রসায়ন, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি, আমাদের পরিচয় ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। যেহেতু এসব বিষয়গুলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ছাড়া জানার উপায় নেই, ইংরেজি ভাষার জ্ঞানটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থার প্রেক্ষিত কী? সবথেকে বড় প্রেক্ষিত যে দেশজ বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে এ দেশের সমাজ গড়ে উঠেছিল তা ছিল প্রকৃতিগতভাবে কৃষিপ্রধান আর আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর ভর দিয়ে যে সমাজ ইংল্যান্ডে গড়ে উঠেছিল সে সমাজ ছিল শিল্পপ্রধান। কৃষিপ্রধান সমাজের ও শিল্পপ্রধান সমাজের মনন কি একরকম হতে পারে? কৃষিপ্রধান সমাজের দর্শন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি; শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শন সেখানে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। ইয়োরোপের শিল্পপ্রধান সমাজের দর্শনের সঙ্গে বেদের এই কথাটার মিল হওয়া কি সম্ভব?
ভুঁই গো, যা তোর এখানে ওখানে খুঁড়ি,
ভরে যাক পূরে যাক সব তাড়াতাড়ি।
ওগো নির্মলা বিদ্ধ না করি যেন
মর্ম তোমার, তোমার হৃদয়খানি।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরে আমাদের দেশের বাকি সাধারণ মানুষ যে এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের প্রতি আত্মিক টান সেভাবে অনুভব করল না, সম্ভবত তার একটা অন্য কারণও আছে। আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক আর এই জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে ছিল ক্ষমতার সম্পর্ক, আমাদের সহজাত বোধে যার অস্তিত্ব ছিল না এবং যার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন বিরূপতা ছিল? যেসব ধর্মান্দোলনগুলো সমাজসংস্কারের ধারায় হয়েছিল, চৈতন্য থেকে সূফী, তাদের তত্ত্বে কোথাও ক্ষমতার গন্ধ ছিল না।
ব্রিটিশরাও এখানে এমন কোনো শিল্পপ্রধান সমাজ গড়তে চায়নি যে সমাজ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে এবং তার বাজারের দখল ছিনিয়ে নেবে। শিল্পবিপ্লবের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে প্রধানত এদেশকে কাঁচা মালের রসদদার করে তুলতে চেয়েছিল আর এ দেশটা ছিল তাদের কাছে তৈরি জিনিস বিক্রির বিরাট বাজার। কাজেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিমী জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিচয় ঘটানোর ব্যাপারে সরকারের কোনো আন্তরিক চেষ্টা ছিল না। ড. মহেন্দ্রলাল সরকার যখন ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সাহায্য চান, তখন সরকার পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় নি। অনীহার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান শিখিয়ে কী হবে, তার চেয়ে বরঞ্চ টেকনিকাল ইন্সটিটিউট বেশি কাজে লাগবে। সরকারের দরকার ছিল কারিগর। যারা বড় বড় যন্ত্র তৈরির প্রাথমিক উপাদানগুলোর যোগান দিতে পারবে। ওদিকে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর কর্মোদ্যোগীদের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথ ছিল বন্ধ।
১৮০৯ সালকে স্বাদেশিকতার প্রারম্ভিক কাল হিসেবে গ্রহণ করার একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮০৯ সালে রামমোহন যখন রংপুরে ডিগবি সাহেবের অধীনে কাজ করছিলেন, তখন দিনের শেষে সন্ধ্যের পর তিনি বাসাবাড়িতে ধর্মালোচনার জন্যে সভা ডাকতেন। প্রতিপাদ্য বিষয় হত পৌত্তলিকতার অসারত্ব ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা। রামমোহনের নিজের কথায়, তিনি চেয়েছিলেন দেশবাসীর মন থেকে যাবৎ ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে তাদের যুক্তিশীল করে তুলতে। কারণ এই ধর্মীয় গোঁড়ামোগুলো শুধু সমাজের বুনটটাকে ধ্বংস করছিল তাই নয়, পরদুঃখকাতরতাকেও তাদের মন থেকে মুছে দিচ্ছিল। এই যে দেশবাসীর কল্যাণের জন্যে চিন্তা, এটা হল স্বাদেশিকতার গোড়ার কথা। ১৮০৯ সালের ধর্মালোচনার সেই সভাগুলো থেকেই ব্রাহ্মসমাজের যাত্রা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে যদি বলি স্বাদেশিকতার যুগেরও শুরু হয়, তাহলে ভুল বলা হবে না। আর একশ বছর পরে ১৯০৯ সালকে স্বাদেশিকতার অন্তিম লগ্ন হিসেবে ধরা হল এই জন্যে যে এই বছরই স্বদেশী আন্দোলনের শেষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল্স্ অ্যাক্টের কারণে বাঙালি ঐক্য দু টুকরো হয়ে যায় অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়ে করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে বাংলাভাগ রদ হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আগেকার ঐক্য আর বজায় ছিল না।
১৯০৯ সাল থেকে জাতীয়তাবাদের যে আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হল, তার অবস্থান রামমোহন রায়ের বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার রামমোহনের কঠোর সমালোচনায় একটা কথা অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই এলিট বাঙালির ‘জাতীয় চেতনার উন্মেষ’ রামমোহন থেকে হয়নি, (তবে তা রমেশচন্দ্রের ধারণা মত ডিরোজিও থেকেও হয়নি, রামমোহনের মত ডিরোজিও-ও ছিলেন দেশপ্রেমিক) জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বঙ্কিমচন্দ্র থেকে। রামমোহন ছিলেন বিশ্বজনীন মানবতাবাদের পূজারী এবং একথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে এই বিশ্বজনীন মানবতাবাদের ধারণাও তিনি পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। শুধু খ্রিস্টীয় বা ইসলামী নয়, ভারতীয় দর্শনেরও একনিষ্ঠ ছাত্র রামমোহনের এই আদর্শে স্থিত হওয়ার জন্যে পশ্চিমের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার ছিল না। বিশ্বজনীন মানবতাবাদের উদ্গাতা হিসেবে রামমোহন parallel and different narrative অর্থাৎ সমান্তরাল ও ভিন্ন আখ্যানের জনক হওয়ার দাবী করতেই পারেন। রামমোহনের এই ব্যাটনটাই অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে যায় এবং পরিপুষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক রামমোহন তাঁর বিশ্বজনীন মানবতাবাদের সঙ্গে বেকনের উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদ এবং বেন্থামের হিতবাদ মিলিয়ে যে আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন, চরিত্রগতভাবেই তা ছিল উপনিবেশিক। উপনিবেশগুলো সম্পর্কে বেন্থামের ধারণার কথা আগেই বলা হয়েছে (কালধ্বনির সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা দেখুন), বেকন আরো তীব্রভাবে উপনিবেশিক শাসকদের সপক্ষতা করেছিলেন।
পশ্চিমে যেমন কোনো আলোচনার শুরু গ্রিসকে ছাড়া হয় না, গ্রিক সাহিত্য গ্রিক দর্শন গ্রিক বিজ্ঞান, আমাদের দেশেও তেমনি উপনিবেশিক শাসনের আলোচনার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণকে ছাড়া হয় না। আর নবজাগরণের শুরু মানেই রামমোহন। শুধু শুরুই নয়, তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে এমনভাবে ছেয়ে আছেন যে তাঁর আলোচনা ছাড়া এগোনো যায় না। রামমোহন একটি খনিবিশেষ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর রচনা, তাঁর চিঠিপত্র, তাঁর কর্মকাণ্ড সবকিছুর যদি ব্যবচ্ছেদ করা যায় তাহলে আমরা পরের প্রায় দুশো বছরের সংকট, দ্বন্দ্ব ও গতির নিশানা সবই পেয়ে যাই। যেমন, রামমোহনের বিধবাবিবাহ নিয়ে আপত্তি ছিল। তিনি লিখেছিলেন, “বিধবার বিবাহ তাবৎ সম্প্রদায়ে অব্যবহার্য হইয়াছে, সুতরাং সদ্ব্যবহার করাইতে পারে না।” এর মানে হল, যদিও শাস্ত্রে নিষেধ নেই, কিন্তু সব সম্প্রদায়েই বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছে, অতএব সদাচার হতে পারে না (যদিও এ ধারণাও ঠিক নয়, বর্ণহিন্দুসমাজের বাইরে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না)। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন একথা লিখেছিলেন। এবার ভাবুন ১৮৫৫-৫৬ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রাণপাত করছেন, তাঁকে তাঁর পূর্বসূরির তায় রামমোহনের মত ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করে এগোতে কি পরিমাণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
প্রথাগত ধারণা এই যে তিনি আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় যুগান্তকারী মাত্রা যোগ করেছিলেন এবং একটা লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন। রামমোহনকে নিয়ে ঘুরেফিরে যত আলোচনা চলে, সব ঐ মাত্রা আর লক্ষ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেহেতু সেই সমাজের ধারাবাহিকতা থেকেই আমরা এসেছি এবং আমাদের মননে আমাদের কর্মকাণ্ডে সেই ধারাবাহিকতা এখনো কোনো না কোনোভাবে বহমান। ফলত রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক থেকে যান এবং যে কোনো আলোচনায় অগ্রাধিকার পান। এর প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার থেকে সাম্প্রতিক কালের সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঐতিহ্য-আধুনিকতা, বিশ্বাস-যুক্তি, পৌত্তলিকতা-বেদ-উপনিষদ, স্বাদেশিকতা-জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় দর্শন-পাশ্চাত্ত্য দর্শন ইত্যাকার বাইনারি নিয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন, রামমোহন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক।
তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিমত হচ্ছে তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। কেউ কেউ আবার তা মানতে রাজি নন। একদলের মতে, তিনি ছিলেন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের পুরোধা, যাঁর কাজকর্ম উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিল। আর একদল রামমোহন উপনিবেশিক শাসনকে মজবুত হতে সাহায্য করেছিলেন একথা অতটা মেনে না নিলেও রামমোহনের আধুনিকতা নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন আছে। তাঁদের বিচারে রামমোহনের কর্মকাণ্ডে বুর্জোয়া আধুনিকতা স্পষ্টরূপ পায়নি। আছেন আরো একদল, যাঁরা বুর্জোয়া আধুনিকতার চরিত্র নিয়েই প্রশ্নমুখর। আর একদল যাঁরা এই আধুনিকতাকে উপনিবেশিক আধুনিকতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
যেমন, ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হেমচন্দ্র সরকার। তাঁর মতে, রামমোহন ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক। তিনি তাঁর যুগের সৃষ্টি নন, তিনি তাঁর যুগের স্রষ্টা। সে যুগ আধুনিক ভারতের যুগ। রামমোহনকে এই আখ্যায় ভূষিত করার কারণ হিসেবে তিনি রামমোহনের জন্মের সময়কার অন্ধকারের বিবরণ দিয়েছেন, যে অন্ধকার থেকে রামমোহন দেশকে বের করে এনেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভারতের সুকুমারী শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সৃজনশীল ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল অখণ্ড নীরবতা। কোনো প্রতিভাধর পথপ্রদর্শকের দেখা মিলছিল না। সংস্কৃত সাহিত্যের মহান শিক্ষকেরা অদৃশ্য। প্রদেশের মাতৃভাষাগুলোরও কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছিল না। ভারতীয় মনন হয়ে গিয়েছিল অতীতের ব্যাপার। দর্শনের শাখাগুলি মৃত। তার জায়গায় আসর জমিয়ে বসেছিল ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে নানান কুতর্ক, সেগুলোই দর্শন হিসেবে চলে যাচ্ছিল। মহান ধর্মগুরুদের ধর্মান্দোলনগুলো যেন সেই অন্ধকার সময়কেই গাঢ়তর করে তুলছিল। তাঁদের আধ্যাত্মিক কথা কেউই বুঝতে পারছিল না এবং অনুগামীরা নানারকম সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়ে সেইসব পাপের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল, যেগুলো সমাজ থেকে দূর করার কথা তাদের ধর্মগুরুরা বলেছিলেন। চৈতন্যের প্রেমের বাণী তাঁর অযোগ্য শিষ্যদের হাতে পরিণত হয়েছিল ফাঁপা অগভীর হৃদয়াবেগে। জ্ঞান আর চৈতন্যের অধোগামিতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জাঁকিয়ে বসেছিল ভ্রষ্টাচার এবং সামাজিক অধঃপতন। অটল বিশ্বাস, পবিত্র হৃদয় আর সুস্থ আচরণের জায়গা নিয়েছিল অজস্র কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, অর্থহীন দেশাচার আর লোকাচার। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশ এই সময় একটা সন্ধিক্ষণের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমান আমল গিয়ে সবে কোম্পানি আমল এসেছে, কিন্তু কোম্পানি তখনো প্রধানত বাণিজ্য আর সম্পদ আহরণ নিয়ে ব্যস্ত। দেশে তখনো মুসলমান আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল। নতুন শাসকরা দেশের লোকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণে বাধা দিতে চায় না, কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার ভয়। সতীর অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা একের পর এক লাটসাহেবের গোচরে এসেছে, কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেন নি, কারণ তাহলে কোম্পানি শাসন বিপদে পড়তে পারে। শিক্ষা তখনো সরকারের বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি।
পশ্চিমের সংস্পর্শে ঘুম ভেঙে এ দেশ আধুনিক ভারত হয়ে উঠেছিল এবং তার সেই হয়ে ওঠায় বাংলার অবদান ছিল সবথেকে বেশি, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও সেকথা মনে করেন। তবে তিনি রামমোহনকে আধুনিক ভারতের জনক বলে স্বীকার করতে সেভাবে রাজি নন। তিনি অবশ্য প্রায় সবকিছুতেই রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকাকে নস্যাৎ করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার হল, রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন, জাতীয় চেতনার উন্নতি এবং দেশাত্মবোধের বৃদ্ধির ব্যাপারেও রমেশচন্দ্র রামমোহনকে প্রধান উৎস হিসেবে মানতে রাজি হননি। তিনি সে কৃতিত্ব দিয়েছেন ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের। আর রমেশচন্দ্র মনে করেন, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনতে সম্পূর্ণ অসফল হয়েছে। সমাজ সংস্কারক রামমোহন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, বঙ্গসমাজে বুনিয়াদি পরিবর্তন আনার ব্যাপারে একমাত্র সতীদাহ নিয়ে প্রচেষ্টা ছাড়া রামমোহনের আর কোনো ভূমিকা নেই।
যেমন সুমিত সরকার। তিনি রামমোহনকে যুগস্রষ্টা বলে মনে করেন নি, তাঁর মতে রামমোহন ছিলেন তাঁর যুগের সৃষ্টি এবং সে যুগের সীমাবদ্ধতার ফসল। তিনি সেই সন্ধিক্ষণের ফসল, যখন প্রাক-পুঁজিবাদী কাঠামো থেকে বুর্জোয়া আধুনিকতার দিকে সমাজের যাত্রা ক্ষীণভাবে আভাসিত হচ্ছে বটে, কিন্তু সে যাত্রা উপনিবেশিক অধীনতার দ্বারা সীমায়িত বলে তাকে দুর্বল বিকৃত ক্যারিকেচারের মত লাগছে। আগেকার মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদদের ভাবনার ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ঐতিহ্য-আধুনিকতার দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া সমান বিপজ্জনক, কারণ তা আসলে আমাদের ঠেলে দেয় ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি শিক্ষার ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং এই ভাবধারার ধারকবাহক ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবক্তাদের দিকে। বুর্জোয়া আধুনিকতা ও আধুনিকতা এক জিনিস নয়। রামমোহনের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তুহফাতুল মুয়াহিদ্দিনের যুক্তিধারা যেসময় তিনি উপস্থাপিত করেন, তখনো ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভালো করে তাঁর পরিচয় হয়নি।
হেমচন্দ্র সরকারের লেখায় উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা পাই সেটা হল আধুনিকতা বলতে তিনি কিন্তু ইয়োরোপকে বোঝেন নি, তিনি বুঝেছেন নিজের দেশেরই ঐতিহ্যগত জাগরণকে। আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সুমিত সরকারও ইয়োরোপের বাইরের এক আধুনিকতার, যা ঢের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তার দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। দুই সরকারের এই রামমোহন প্রসঙ্গ আমাদের নিয়ে গেলে ফেলে ঐতিহ্য-আধুনিকতার বাইনারিতে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ত্রুটিগুলির কথা বলতে গিয়ে একদা শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন, “একটা অভিযোগের সত্যতা আমরা স্বীকার না করে পারি না যে আমাদের চোখ পূবের তুলনায় অনেক বেশি পশ্চিমে নিবদ্ধ ছিল। আমাদের হাতের কাছে অমূল্য সত্যের যে খনি আছে তাকে আবিষ্কার না করে আমরা পশ্চিমে সত্যের চর্চায় কি প্রগতি ঘটল জানতে বেশি উৎসাহী ছিলাম। আমাদের দেশের বইগুলোতে, আমাদের নিজেদের লোকাচারে এবং দেশাচারে সত্যের যে রত্নভাণ্ডার সঞ্চিত আছে, তার তুলনায় পশ্চিমী আদর্শগুলো আমাদের টানত বেশি।” এই হল সেই উপনিবেশিকতা (coloniality), যার কথা বর্তমান প্রবন্ধে বলতে চাওয়া হচ্ছে। এই উপনিবেশিকতা (coloniality) কি আমাদের জ্ঞানচর্চায় আমরা আজো বহন করে চলছি না? বিশেষ করে এই বাংলায়?
ব্রাহ্মধর্ম যে এ দেশে শেকড় গাড়তে পারে নি তার সবথেকে বড় কারণ হল একটা স্তরে যেমন ব্রাহ্মধর্মে সমন্বয়ধর্মিতা ছিল, আর একটা স্তরে ছিল না। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ফলে শাস্ত্রকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দুদের বাইরের যে বিশাল সমাজ, যে সমাজ সমান পৌত্তলিকতায় আসক্ত, তাদের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা এবং ইয়োরোপীয় ভারততত্ত্ববিদরা সমানে প্রমাণ করতে লাগলেন যে পৌত্তলিকতা হচ্ছে উচ্চ আদর্শসম্পন্ন ভারতীয় সমাজের চূড়ান্ত নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের চিহ্ন। মনিয়ের উইলিয়ামস থেকে শুরু করে এচ. এচ. উইলসন, জেমস মিল সকলেই একবাক্যে বেদ বেদান্ত এমনকি মনু থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে শুরু করলেন যে সেসব গ্রন্থে কোথাও পৌত্তলিকতার কথা নেই। ভেতরের কথাটা এই, পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন এই বৃহত্তর সমাজ স্বশাসনের উপযুক্ত নয় এবং বাইরের থেকে তাঁদের মত যুক্তিনিষ্ঠ একেশ্বরবাদীরা এসে এই সমাজকে সুশাসন দিতে পারে। যদি এ দেশের লোককে একেশ্বরবাদীরা পথ দেখাতে সক্ষম, তাহলে ইসলামই তো যথেষ্ট ছিল। তাদের এদেশে আসার দরকার পড়ল কেন? সমাজের সর্বক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের হঠানোর দরকার পড়ল কেন? অতএব শুধু যুক্তিনিষ্ঠতা কোনো কারণ নয়। সে কারণ তাদের আধুনিকতা, যে আধুনিকতা শিল্পপ্রধান সমাজের উপজ এবং যার বিকাশ একের পর এক উপনিবেশ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীল। সে আধুনিকতার কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত লক্ষ্যণীয়, যে ইয়োরোপ রেনেসাঁয় শাস্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তির ওপর ভর করে চলতে শুরু করেছিল, সেই ইয়োরোপের প্রধান চালিকা শক্তি ব্রিটিশ এই উপনিবেশে শাসক হয়ে এসে এ দেশের শাস্ত্রকেই আইনে পরিণত করল। এর আগে এরকম কোনো লিখিত আইন হিন্দুদের বেলায় আমাদের দেশে ছিল না। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্যের আর এক নাম উপনিবেশিক আধুনিকতা।
অপরদিকে যে ভারততত্ত্ববিদরা আমাদের বেদ উপনিষদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাই আবার পৌত্তলিকতার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদিম উপাদানগুলি থেকে আমাদের সমাজে অজস্র দেবদেবীর জন্ম হয়েছে এবং সমসাময়িক সমাজে যার বহমানতা বিদ্যমান, এমনকি ইয়োরোপীয় সমাজের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টানরা যে খেতে বসার আগে ‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড’ বলে প্রার্থনা করেন, সে প্রার্থনার জন্ম নব্য প্রস্তর যুগে এবং ঈশ্বরকে পিতারূপে কল্পনা করে প্রার্থনা করার যে ভাবনা সে ভাবনার জন্ম চারণ যুগে। অথচ নব্য প্রস্তর যুগের বা চারণ যুগের এই প্রার্থনাগুলো এখনো বহাল আছে এবং সে ঐতিহ্য খ্রিস্টানদের গৌরবের কোনো হানি ঘটায় না। কোসাম্বির ভাষ্যে, আমাদের দেশে সমাজের নিম্নবর্গের মধ্যে যে নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের চল আছে, সেগুলো এই বৃহত্তর উৎপাদনশীল সমাজে তাদের এক একটি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্তরগত অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী। জাত ও ধর্মের সঙ্গে মিশে ঐ অনুষ্ঠানগুলি গোষ্ঠীগুলিকে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক মর্যাদার পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে তাদের জাত এবং কখনো কখনো তাদের ধর্মবিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, কেন কখনো কখনো ধর্মবিশ্বাসগুলির সমন্বয় ঘটে, আবার কেন কখনো কখনো কিছুতেই সেগুলো মিলতে চায় না। স্বাভাবিকভাবে শংকর কিংবা রামানুজের দর্শন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কারণ তাদের সে উচ্চস্তরে এ সমস্যাটার অস্তিত্বই নেই।
বেদ উপনিষদে পৌত্তলিকতার উল্লেখ থাক আর না থাক, আমাদের দেশে পৌত্তলিকতার সঙ্গে দর্শনের বিরোধ ছিল এমন কথাও কোথাও নেই। বুদ্ধ পৌত্তলিকতা সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তিনি নিজে দেবদেবীর পূজায় পশুবলি দেয় এমন বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাত কাটিয়েছিলেন, এই আশায় যে তিনি তাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে অহিংস করে তুলতে পারবেন। মূল সমস্যাটা ছিল পশুবলি নিয়ে। আমরা সবাই জানি বৌদ্ধধর্ম কৃষিজীবীদের বসতিগুলোকে স্থায়িত্ব দেবার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। কৃষিজীবীদের প্রধান সমস্যাই ছিল বৈদিক সমাজের পশুবলি। বুদ্ধের অহিংসা এই পশুবলি বন্ধের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল। অহিংসাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে বুদ্ধকে বেদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। সেই বিরোধিতায় জন্ম হয়েছিল এযাবৎ কালের এক শক্তিশালী দর্শনের। শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তেও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। বরঞ্চ ব্যক্তিগতভাবে শংকরাচার্য ভগবান হিসেবে বিষ্ণুর আরাধনার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। তাঁর টীকাতেও বিষ্ণুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পরিবারের কুলদেবতা।
(চলবে)
(এই পর্বের শেষে টীকা ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে)
পণ্ডিতজী,
আসসালাকু আলেকুম।
আপনাকে আমি এই প্রথম চিঠি লিখছি। ঈশ্বরের দয়ায় আমেরিকার মানুষজনের কাছে আপনি সুদর্শন। আমার চেহারাও খুব একটা খারাপ নয়। আমি আমেরিকায় গেলে হয়ত, একই কদরের অধিকারী হ’ব। কিন্তু আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আর আমি পাকিস্তানের খ্যাতনামা গল্প-লেখক। ব্যবধান দুস্তর। মিল একটাই, আমরা দুজনেই কাশ্মীরি। কাশ্মীরি মানেই সুদর্শন, আর সুদর্শন মানে … … আমি জানি না।
আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা আমি বহুদিনের। (আমাদের জীবিত কালে এখনও দেখা হতেই পারে)। আমাদের এদিকের বয়স্ক মানুষজনের অনেকেই হয়’ত আপনাদের ওদিকের মানুষজনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমার, আপনার সঙ্গে দেখা করার কোন সুযোগ হয়নি। বড়ো পরিতাপের বিষয়, আপনার সঙ্গে আমার কখনই দেখা হয়নি। আমি একবার রেডিওতে আপনার ভাষণ শুনেছি মাত্র।
যেমন বলছিলাম, আমি অনেক দিন ধরেই আপনার সঙ্গে দেখা করার সুতীব্র ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করেছি। আমরা দু'জনেই কাশ্মীরি, তাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তবে এখন ভাবছি দরকারটা কোথায়। কোন গলি বা রাস্তার মোড়ে একজন কাশ্মীরির সঙ্গে আরেকজনের হঠাৎ দেখা হয়ে যেতেই পারে।
নদীর ধারে স্থায়িভাবে বসবাস করার জন্যে (নেহ্র) আপনারা পরিচিত হয়েছিলেন 'নেহেরু' বলে। আমি ভাবি আমি কি করে 'মান্টো' হলাম। মনে হয় আপনি লক্ষ লক্ষ বার কাশ্মীর গিয়েছেন, আমি শুধুমাত্র বানিহাল পর্যন্ত যেতে পেরেছি। আমার কাশ্মীরি বন্ধুরা, যাঁরা কাশ্মীরি ভাষা জানেন, আমাকে বলেছেন 'মান্টো' শব্দটি এসেছে দেড় সের ওজনের পাথরের বাটখারা থেকে। আমি নিশ্চিত আপনি কাশ্মীরি ভাষা জানেন। যদি আপনি কষ্ট করে এই চিঠির উত্তর দেন তবে কি আমাকে 'মান্টো' শব্দটির উৎস সম্পর্কে একটু বলবেন?
আমি যদি দেড় সের হই, তবে আমাদের দুজনের মধ্যে কোন তুলনা আসতে পারে না। আপনি পুরো নদী, আর আমি মাত্র দেড় সের, আমি কি করে আপনার দায়িত্ব নিই? কিন্তু আমরা দুজনেই সেই বিখ্যাত কাশ্মীরি প্রবাদের বন্দুক, যা অন্ধকারেও লক্ষ্যভেদ করতে পারে। অনুরোধ করি, আমার কথার ভুল অর্থ করবেন না। আমি যখন এই প্রবাদটা শুনেছিলাম, আমার সাংঘাতিক লেগেছিল, কিন্তু এখন এটা বেশ আকর্ষণীয় লাগছে বলে হাল্কাভাবেই এর উল্লেখ করলাম। না হলে, আমরা দুজনেই জানি, কাশ্মীরিরা কোনো ক্ষেত্রেই হার মেনে নেবে না।
রাজনীতিতে আমি আপনার নাম গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করতে পারি, কেননা আপনি ভালো ভাবেই স্ববিরোধিতার কৌশলটি জানেন। আজ পর্যন্ত, আমাদের, অর্থাৎ কাশ্মীরিদের, কেউ কখনো কুস্তিতে হারাতে পেরেছে? আমাদের চেয়ে ভালো কবিতা কেউ লিখেছে? কিন্তু আমি জেনে অবাক হলাম আপনি আমাদের দেশের ওপর দিয়ে নদীর প্রবাহকে বন্ধ করে দিতে চাইছেন। পণ্ডিতজী, আপনি শুধুমাত্র একজন নেহেরু। আমার দুঃখ এই যে আমি দেড়সের ওজনের পাথর মাত্র। যদি আমি ত্রিশ চল্লিশ হাজার পাথরের স্তুূপ হতাম, তাহলে আমি নদীতে ঝাপ দিয়ে পড়তাম। তাতে আমাকে তোলার জন্যে আপনাকে আপনার প্রযুক্তিবিদদের সাথে আলোচনায় আরো কিছুটা সময় ব্যয় করতে হত।
পণ্ডিতজী, আপনি যে একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আপনি সেই দেশের শাসক, যা আগে আমারও স্বদেশ ছিল। আপনি সব কিছু। কিন্তু আমি যদি বলি এই নিরহঙ্কারী মানুষটির কোন খোঁজ খবরই আপনি রাখেননি তবে আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি আপনাকে একটা আকর্ষক গল্প বলতে চাই। যখনই আমার প্রয়াত পিতা, স্বাভাবিকভাবেই, যিনিও ছিলেন কাশ্মীরি, রাস্তায় হঠাৎ কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, তাকে বাড়িতে এনে সদর দালানে বসাতেন, কাশ্মীরি নুন চা ও কুলচায় তাঁকে আপ্যায়িত করতেন। তারপর তাঁকে গর্বের সঙ্গে বলতেন, আমিও 'কাশের'। পণ্ডিতজী, আপনিও তো একজন 'কাশের'। এই প্রশ্নের জন্য, আল্লার দোহাই, যদি আপনি আমার জান নিতে চান তো নিন। আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি আপনি কাশ্মীরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন, কারণ কাশ্মীরি হয়ে আপনি আপনার স্বদেশের প্রতি গভীর টান অনুভব করেন। প্রত্যেক কাশ্মীরিই, সে কাশ্মীরে থাক বা না থাক, এ ভাবেই ভাবা উচিৎ।
যেমনটি আমি বলেছিলাম - আমি শুধুমাত্র বানিহালে গিয়েছি। আমি কুদ, বাতাউত ও কাশটোয়ারের মত জায়গাগুলি দেখেছি। তাদের সৌন্দর্যের পাশাপাশি আমি দারিদ্র্যও দেখেছি। যদি এই দারিদ্র্য দূর করতে পারেন, তবে আপনি কাশ্মীরকে আপনার কাছে রেখে দিন। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, আপনি তা পারবেন না, কেন না আপনার সময় নেই।
পণ্ডিত ভাইয়েরা, আমাদের মধ্যে এটা করুন - আমাকে ভারতে ডেকে নিন। প্রথমে আমি 'শালিজান সাবদেগ' নেব, তারপর কাশ্মীরের বিষয়গুলি দেখব। বকশি ও বাকি যারা আছেন তাঁদের বরখাস্ত করতে হবে। এরা প্রথম সারির ঠগ, এদের আপনার এত মর্যাদা দেওয়ার কোন কারণই নেই। তবু এইজন্যে কি দিয়েছেন যে এটা আপনাকে মানায় বলে? আমি জানি আপনি একজন রাজনীতিক, আর আমি তা নই। তবে তার মানে এই নয় যে আমি কিছুই বুঝতে পারি না।
দেশ ভাগ হল। রাডক্লিফ আর প্যাটেলকে দিলেন এই নোংরা কাজটির ভার। আপনি অনৈতিকভাবে জুনাগড় অধিগ্রহণ করলেন, যা একজন কাশ্মীরি করতে পারে শুধুমাত্র মারাঠা প্রভাবে। আমি প্যাটেলের কথাই বলছি (আল্লা তাঁকে মার্জনা করুন)।
আপনি ইংরেজি সাহিত্যের সাহিত্যিক। এখানে এসে পর্যন্ত আমি উর্দুতেই ছোটগল্প লিখছি, যে ভাষাটি আপনার দেশে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। পণ্ডিতজী, আমি প্রায়ই আপনার ভাষণগুলো পড়ি যাতে বোঝা যায় আপনি উর্দুকেও ধরে রেখেছেন। দেশ ভাগের সময় আমি রেডিওতে আপনার একটি ভাষণ শুনেছি। প্রত্যেকে আপনার ইংরেজি ভাষার প্রশংসা করেন। কিন্তু যখন আপনি উর্দুতে বলতে শুরু করলেন, মনে হল যেন কোন রাগী হিন্দু মহাসভার সদস্য আপনার ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ করে দিয়েছেন, যা স্পষ্টতই আপনার পছন্দ নয়। প্রতিটি শব্দেই আপনি হোঁচট খাচ্ছিলেন, আমি ভাবতেই পারছি না কেন আপনি এটা পড়তে সম্মত হয়েছিলেন।
এটা সেই সময় যখন রাডক্লিফ ভারতকে পাঁউরুটির দুটো টুকরোর মত দুভাগ করে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় একটা পিঠ তখনও সেঁকা হয় নি। আপনারা একদিকে সেঁকছেন, আমরা আরেক দিক, কিন্তু আমাদের চুল্লীর তাপ আসছে বাইরে থেকে।
পণ্ডিতজী, এই সময় 'বাব্বোগোসা'র। আমি 'গোসা' খেয়েছি, কিতু 'বাব্বোগোসা' খেতে চাই। কি অন্যায়, আপনি ওখানে বকশিদের সমস্ত অধিকার দিয়েছেন আর তারা আমাকে উপহার হিসেবেও সেগুলো কিছু পাঠায়নি। আচ্ছা, উপহার জাহান্নামে থাক। আসলে, আমি আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি আমার বইগুলো পড়েন না কেন? যদি আপনি পড়তেনও, তাহলেও, আমি জানি, আপনি কখনোই ওগুলোর প্রশংসা করতেন না। যাইহোক, যদি আপনি নাই পড়ে থাকেন তাহলে আরো দুঃখের বিষয় কেননা, আপনি নিজেও একজন লেখক।
আপনার বিরুদ্ধে আমার আরো একটি অভিযোগ আছে। আপনি আমাদের নদীগুলিতে জলের প্রবাহ বন্ধ করে দিতে চাইছেন, আর আপনার ইশারায় আপনার রাজধানীতে প্রকাশকেরা আমার সম্মতি না নিয়েই আমার বইয়ের পুনর্মুদ্রণ করে চলেছেন। এটা কি ঠিক? আমি ভেবেছিলাম এরকম অনুচিত কাজ অন্তত আপনার রাজত্বে হবে না। আপনি নিজেই খবর নিয়ে দেখতে পারেন দিল্লি, লক্ষ্ণৌ ও জলন্ধরের কতজন প্রকাশক আমার বই ছেপেছেন। ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে কিছু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু দেখুন, একেবারে আপনার নাকের ডগায় দিল্লিতে কি অন্যায় হয়ে চলেছে। একজন প্রকাশক আমার গল্প সংকলন নিয়ে তার নাম দিয়েছেন 'মান্টোর অশ্লীল গল্পগুলি'। আমি লিখেছিলাম 'গাঞ্জে ফরিস্ততে'। বইটি একজন ভারতীয় প্রকাশক তা প্রকাশ করলেন 'পর্দার অন্তরালে.....'। এখন আমাকে বলুন, আমি কি করব?
আমি একটা নতুন বই লিখেছি। এই বইটির মুখবন্ধ হিসেবেই আপনাকে এই চিঠি লেখা। এই বইটিরও যদি গ্রন্থস্বত্ব অপহৃত হয়, তা হলে আল্লার নামে বলছি, আমি দিল্লি পৌঁছে যাবো, আপনার গলা চেপে ধরব, আপনাকে যেতে দেব না। আমি এমনভাবে আপনাকে চেপে ধরব যে আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন। প্রতিদিন সকালে আপনার আমাকে নুন চা ও কুলচা দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে। যেভাবেই হোক, প্রতি সপ্তাহেই 'শালিজান সাবদেগ' দিতে হবে।
বইটি প্রকাশিত হলেই, আমি আপনাকে একটি কপি পাঠিয়ে দেব। আশা করি প্রাপ্তি স্বীকার করবেন ও বইটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাবেন।
আমার চিঠিতে আপনি পোড়া মাংসের গন্ধ পেতে পারেন। আপনি জানেন, কাশ্মীরে 'ঘানি' নামে একজন কবি ছিলেন। লোকে তাঁকে 'ঘানি কাশ্মীরি' নামেই চিনত। ইরান থেকে এক কবি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত। তিনি বলতেন, আমার বাড়িতে এমন কি আছে যে দরজা বন্ধ করতে হবে? আমি যখন বাড়ি থাকি তখন বন্ধ করতে পারি, কেন না আমিই তো একমাত্র সম্পদ। ইরানের কবি তাঁর কবিতার খাতা শূন্য বাড়িতে রেখে গেলেন। একটি স্তবক একটি কবিতায় অসম্পূর্ণ ছিল। সেটির দ্বিতীয় লাইনটি তিনি লিখেছিলেন কিন্তু প্রথম লাইনটি লিখতে পারেন নি। দ্বিতীয় লাইনটি ছিল 'তোমার পোষাক থেকে আসছে কাবাবের গন্ধ'। যখন ইরানের কবি ফিরে এলেন দেখলেন প্রথম লাইনটি লেখা আছে, তোমার জামাটি কি ছুঁয়েছে কোন ক্ষয়কারী আত্মার হাত?
পণ্ডিতজী, আমিও ক্ষয়কারী আত্মা। আমি কথাটি আপনাকে বললাম কেননা বইটি আপনাকেই উৎসর্গ করেছি।
সাদাৎ মান্টো
২৭ আগস্ট, ১৯৫৪
মূল উর্দু থেকে হিন্দিতে তর্জমা করেছেন ম. আসাউদ্দিন।
'শালিজান সাবদেগ' - রান্না মাংসের জনপ্রিয় কাশ্মীরি পদ। ভেড়ার মাংস ও টারনিপ (মাটির ওপর হওয়া শিকড়যুক্ত গোলাকার সবজি) মশলা সহ সারারাত অল্প আঁচে ফুটিয়ে তৈরি করা হয়।
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বন্ধুদের এক আড্ডায় প্রস্তাবটা উঠল — দিল্লি গেলে কেমন হয়? ততদিনে দিল্লির উপকণ্ঠে তিন কৃষি বিল প্রত্যাহার ও Minimum Support Price (MSP) (নূন্যতম সহায়ক মূল্যের) দাবিতে কৃষক জমায়েতের দেড় মাস আর কৃষক আন্দোলনের ছয় মাস অতিক্রান্ত। সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতা, সরকারের সাথে হওয়া কৃষক সংগঠনগুলোর ১১ দফা নিষ্ফলা বৈঠক —দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাপঞ্জিতে ঠাহর করা যাচ্ছিল না আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। অবশেষে ২২ জানুয়ারি কৃষক সংগঠনগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ১২ থেকে ১৮ মাস বিলগুলোকে স্থগিত রাখার প্রস্তাবকেও নাকচ করল। এর পরে সবার প্রতীক্ষা ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর মিছিলের। এই আবহে আমরা তিন বন্ধু ২৩ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছালাম।
সংবাদপত্র, গণমাধ্যমগুলোর কারণে সিংঘু বর্ডারের নাম কৃষক বিক্ষোভে বহুশ্রুত। তাই প্রথম গন্তব্য সিংঘু। পশ্চিমবঙ্গে বড় হয়ে ওঠা চোখ আন্দোলন-স্থলে ইতিউতি খোঁজে লাল পতাকার উপস্থিতি। কিন্তু অবাক করে পতাকার রঙের সমাহার — হলুদ, সবুজ, সাদা, নীল, গেরুয়া, আর হ্যাঁ লাল পতাকাও। বোধকরি এও রঙের পতাকায় রাঙা বিক্ষোভস্থল দেখে আমাদের মধ্যে এক জন বলে ওঠে— এ তো দেখছি গণঅভ্যুত্থান! ঠিকই। কখন যেন গণআন্দোলন বদলে গেছে গণঅভ্যুত্থানে। কুম্ভ আর গণঅভ্যুত্থান— আপাত সম্পর্কহীন দুটো শব্দকে মিলিয়ে দিয়েছে সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর, এরকম আরও নানান প্রতিবাদস্থল। বইয়ের পাতার ইতিহাস তো কোন পুরোনো সময়ের ঘটমান বর্তমান। আর বর্তমানে দাঁড়িয়ে অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাসের পাতায় যে গণআন্দোলন স্থান করে নেবে— তার সাক্ষী থাকার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর। হৃদয় ছুঁয়ে যায় রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধার এই বিনম্র শান্তিপূর্ণ প্রকাশ। এই আন্দোলনের আবেগ মর্মস্পর্শী— কি করে ভোলা যায় গাজীপুর বর্ডারের সেই ৯৩ বছরের পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের মেরঠ অঞ্চলের কৃষককে। আন্দোলনের স্বপক্ষে তাঁর ঋজু দাঁড়িয়ে থাকাকে। অন্যদিকে আন্দোলনের যুক্তির বুনোটও তেমনই ক্ষুরধার। কেন এই আন্দোলন?— তিন কালা কানুন ওয়াপস, MSP লাগু। কতদিন চলবে?— ইয়ে লম্বা চলেগা। (আজ মার্চ ২০২১ এ ১০০ দিন অতিক্রান্ত এই আন্দোলন। কি প্রফেটিক লাগে এখন জানু: ২০২১ এ শোনা ওই উচ্চারণ! কবে বাড়ি ফিরবেন? — কানুন ওয়াপাস নহী তো ঘর ওয়াপস নহী। এতদিন পরেও সেই সব উচ্চারণ কানে বাজে। এসব তো শুধু কৃষক ইউনিয়ানের শেখানো বুলি নয়। গণআন্দোলনের আগুনে সেঁকে নেওয়া সাধারণ কৃষকের উপলব্ধি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কৃষক আজ অস্তিত্বের সংকটে ; পি. সাইনাথ যাকে আমাদের সভ্যতার সংকটও বলেন।) রুখে দাঁড়িয়েছে। উপলক্ষ তিন কৃষি বিল ও MSP। কিন্তু অন্তর্লীন আছে প্রচুর কথা— অনেক বঞ্চনা, কৃষি অলাভজনক হয়ে যাওয়া। এই সকল নিয়ে বসে আছে কৃষক দিল্লির উপকণ্ঠে।
দিল্লি শহর আকৃতিতে গোলাকার। উত্তর থেকে দক্ষিণে পশ্চিমদিক বরাবর হরিয়ানা আর পূবে উত্তর প্রদেশ। পঞ্জাব থেকে দিল্লি পৌঁছাতে গেলে হরিয়ানা বা উত্তর প্রদেশ পেরিয়ে আসতে হয়। দিল্লির উপকণ্ঠে বেশ কিছু জায়গায় কৃষক অবস্থান চলছে— ১) সিংঘু, ২) টিকরি, ৩) ধাসা, ৪) মসানী ব্যারেজ, ৫) সাহাজাহানপুর খেড়া, ৬) পালওয়াল, ৭) সুনহেড়া, ৮) চিল্লা ও ৯) গাজীপুর। অবস্থান আন্দোলনের মূল দাবি— তিন কৃষি বিল প্রত্যাহার ও MSP এর আইন। তলিয়ে ভাবা প্রয়োজন কেন তিনটি আইন একসাথে পাশ হল। আইনগুলো কি বলে?
তিন কৃষি বিল :— প্রথম বিলটি হল — Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020 : এই বিলটি APMC মান্ডি সংক্রান্ত। APMC মানে Agricultural Produce Marketing Committee। APMC মান্ডি (পরবর্তীতে শুধুই মান্ডি) হল সরকার নির্ধারিত বাজার এলাকা। কৃষিজ পণ্যের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী মান্ডিতে চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনতে পারে MSP নির্ধারিত মূল্যে। আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডি ও MSP র যোগ অঙ্গাঙ্গী। APMC মান্ডিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীকে কর দিতে হয়। এই কর বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম। এই কর বাবদ পঞ্জাব ও হরিয়ানা সরকারের রাজস্ব আয় হয় ভাল রকম। নতুন এই বিলটি কৃষক-উৎপাদিত শস্য মান্ডির বাইরেও ব্যবসায়ীকে কেনার অনুমতি দিল। কেন্দ্রীয় এই আইন রাজ্য সরকারগুলিকে মান্ডি বহির্ভূত বেচাকেনার উপর কোন রকম কর বসাতে দেবে না। সুতরাং মান্ডিতে কর বলবৎ, মান্ডির বাইরে বেচা কেনা করমুক্ত। লক্ষণীয় এই বিলে কেন্দ্রীয় সরকার কোথাও মান্ডি অবলুপ্তির কথা বলেনি। কিন্তু কৃষকদের আশঙ্কা কর কাঠামোয় এই তারতম্যের কারণে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই মান্ডিগুলো বিলুপ্ত হবে। আর যে হেতু মান্ডির সাথে MSP-র যোগ অঙ্গাঙ্গী, সেহেতু MSP ও আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হবে। যদিও সরকার বলছে MSP থাকবে। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডির গুরুত্বের কথা পি. সাইনাথ খুব সহজে বুঝিয়েছেন — ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলের যেরকম গুরুত্ব, ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় মান্ডির গুরুত্ব ততোধিক। সরকারি স্কুল ধ্বসে গেলে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি, মান্ডি শেষ হয়ে গেলেও তাই হবে। অন্যদুটো বিল নিয়ে আলোচনা করার আগে MSP নিয়ে দু-চার কথা।
MSP (Minimum Support Price / ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) : ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার পর ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ MSP চালু হয়। MSP র আওতায় থাকা ২৩টি সামগ্রীর (নানা রকমের শস্য, ডাল, তৈলবীজ, ব্যাবসায়িক শস্য যেমন পাট, আখ ইত্যাদি) ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে Commission for Agricultural Costs and Prices নামক কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা। MSP মূলতঃ কৃষকদের সুনিশ্চিত আয়ের আশ্বাস — যা তাকে কৃষি কাজে উৎসাহ জোগাবে। সরকারি তথ্য বলে দেশের ৬ শতাংশের কম কৃষক MSP তে বিক্রি করতে পারে। MSP-র ঘোষণা কার্যকরী তখনই হয় যখন MSP তে সরকার অনেকটা ক্রয় করে। মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক MSP থেকে উপকৃত হলেও MSP ও সরকারি ক্রয় বাজারদর কৃষকের স্বপক্ষে রাখতে সাহায্য করে। কৃষক MSP না পেলেও বাজারদর খুব নীচে যেতে পারে না। মান্ডিতে MSP তে ব্যবসায়ীর কিনতে বাধ্য হওয়াটা চাষির পক্ষে যায়। মান্ডি ও MSP-র এই যোগটা বুঝলে আমরা বুঝতে পারব কৃষক সমাজের ভয়টা কোথায়। কৃষকদের ভয় এই নতুন APMC আইনের কারণে মান্ডিগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে অবলুপ্ত হবে। মান্ডির সাথে MSP-র যোগের কারণে মান্ডি অবলুপ্ত হলে MSPও শেষ হবে। চাষিকে তখন বৃহৎ পুঁজি গিলে খাবে। সরকারি নীতি — সে যার কথা ভেবেই হোক, বেসরকারি পুঁজি বা কৃষক — তার পরিণতি সম্পর্কে দেশের অনেক কৃষক এবং কৃষক সংগঠন সম্যক অবহিত। কোনরকম বোধ চিন্তা ছাড়াই কিছু নেতার কথায় তিন মাসের উপর দিল্লির প্রবল আবহাওয়ায় বসে থাকবে এমন মূর্খ আমাদের দেশের চাষিরা নয়।
দ্বিতীয় বিলটি হল Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Form Services Act, 2020। এক কথায় চুক্তি চাষ। চাষি খরিদ্দার বা ব্যবসায়ীর সাথে পূর্বনির্ধারিত চুক্তিপত্রের নিরিখে চাষ করবে। সেই চুক্তিতে দামও পূর্বনির্ধারিত থাকবে। এই আইনে বলা আছে যে কোন পক্ষ যদি মনে করে চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে তাহলে সে সিভিল কোর্টে যেতে পারবে না। সাব-ডিভিশানাল ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে নিষ্পত্তি হতে হবে। চাষি তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানে বৃহৎ পুঁজির সাথে চুক্তি ও তার উকিলদের সাথে লড়াই তার পক্ষে কি বিভীষিকা হতে পারে! এই চুক্তিতে কৃষিজ পণ্যের মান ও ফলনের পরিমাপ সম্পর্কেও চুক্তি থাকবে। চাষি যদি সেই মান বজায় রাখতে না পারে তাহলে খরিদ্দার কিনতে নাও পারে। বাজারে দাম যখন চড়া থাকে তখন অনেক সময়ই খরিদ্দার ফসলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফল কেনে না — চাষি পড়ে বিপাকে। আর এই চুক্তি বলে যখন কোর্টে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ, চাষি তখন প্রমাদ গোনে।
তৃতীয় আইনটি হল Essential Commodities (Amendment) Act, 2020। পুরানো আইনের বলে essential commodity (প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য) তালিকাভুক্ত শস্য একটা আয়তনের উপর মজুত করা যায় না। নতুন আইনে মজুত করার ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ায় কৃষকদের ভয় যে খাদ্যদ্রব্য মজুত করবে বড় কোম্পানি। একচেটিয়া কারবারও তৈরি হবে। খাদ্যদ্রব্যের দামও নিশ্চিতভাবে বাড়বে। পচনশীল খাদ্যদ্রব্যে দাম ৫০ শতাংশ বাড়লে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামছাড়া হবার আশঙ্কায় চাষির ভয় খাদ্যসুরক্ষা হারানোর।
Food Corporation of India (FCI) র পুর্নগঠনের জন্য শান্তাকুমার কমিটির রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০১৫ সালে। এই কমিটির সুপারিশগুলোর সম্পর্কে কৃষক সংগঠনগুলো অবহিত। তাই সরকার এই তিনটে আইন এক সাথে পাশ করানোর ফলে চাষিরা কোথাও একটা সামগ্রিক চিত্র দেখতে পাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের দুর্গতির। অস্তিত্বের সংকট তৈরি হলেই মানুষ এরকম রুখে দাঁড়ায়। আর হ্যাঁ, এই প্রতিবাদকে রূপ দেয় সংগঠন — এক্ষেত্রে কৃষক সংগঠন।
আন্দোলনের রূপরেখা ও কৃষক সংগঠন :
কৃষকদের অবস্থান স্থলে ঘুরে কথা বললে বা ভারতের কৃষি ব্যবস্থার সাথে সামান্য হলেও পরিচয় আছে এমন কেউও বলবে যে আজ যে আন্দোলন আমরা দেখছি তা শুধুই তিনটি কৃষি বিল নিয়ে নয়। এর পিছনে আছে অনেকদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনা। এই কৃষি আন্দোলনের সম্পর্কে অনেকেই বলেন এ তো শুধু পঞ্জাব ও কিছুটা হরিয়ানার চাষিদের আন্দোলন। তবে দ্রুত ঘটে যাওয়া মহাপঞ্চায়েতগুলো আমাদের জানান দিচ্ছে এই আন্দোলন আজ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থান বিক্ষোভ সারা দেশের নজর এই আন্দোলনের দিকে ফেরাতে বাধ্য করেছে। দিল্লির এই অবস্থান না চললে আমরা হয়ত এই দ্রুত ঘটে যাওয়া মহাপঞ্চায়েতগুলোর কথা জানতামই না।
এখনকার এই কৃষক আন্দোলনকে বুঝতে গেলে সবুজ বিপ্লবের কথায় ফিরতে হবে। এখন যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব তাদের অনেকেরই আমেরিকা থেকে আসা PL480 গমের কথা মনে থাকবে। PL480 গমের সরবরাহ বন্ধ ও দেশের খাদ্যসংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দেখা দিল সবুজ বিপ্লব — কৃষিতে উচ্চফলনশীল বীজ, সার, নানা প্রকার রাসায়নিক, উন্নত সেচ ও যান্ত্রিক চাষ (mechanized farming) ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিক ফলন। এই mechanized farming এর প্রচলনেই ট্র্যাক্টরের বহুল ব্যবহার আজ যা আন্দোলনের বা মিছিলের অন্যতম হাতিয়ার। লক্ষণীয় যে সবুজ বিপ্লব কিন্তু শুধু ভারতেই ঘটছে না, পৃথিবীর আরও নানান জায়গায় (যেমন মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইত্যাদি) ঘটছে সেই সময়। ভারতে সবুজ বিপ্লবের শুরু মূলতঃ পঞ্জাব ও হরিয়ানায়। এর ফলে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষি পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার বিনিয়োগ করে। তৈরি হয় মান্ডি, সংযোগকারী রাস্তা, খাদ্যশস্য মজুত করার গোডাউন, সেচ ব্যবস্থা। পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরাও খাদ্যশস্য ফলানোর রেকর্ড স্থাপন করেন। উৎপাদনশীলতায় এখানকার চাষিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোঠায়। সরকারও ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ নিয়ে আসে MSP যা চাষিকে নিশ্চিন্ত করে তার আয়ের সম্পর্কে। তবে এই কৃষিব্যবস্থায় চাষের খরচ বেশি ও ক্রমবর্দ্ধমান। ফলতঃ শস্যের দাম যদি বেঁধে রাখতে হয়, তাহলে চাষির আয় যায় কমে। ১৯৮০র দশক থেকে এই অঞ্চলে কৃষিজ আয় কমতে শুরু করল। অন্য দিকে বেড়ে চলল চাষের খরচ। ফল দাঁড়াল মারাত্মক — চাষিরা আস্তে আস্তে দেনার চক্রে ঢুকতে থাকল। পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা রিপোর্ট বলে কৃষিকাজে যুক্ত পরিবারগুলোর সামগ্রিক ঋণের বোঝা ১ লক্ষ কোটি টাকা। প্রতি পরিবারের বার্ষিক গড়ঋণের বোঝা ৪ লক্ষ টাকা। পঞ্জাবের প্রতি ৩ জন কৃষকের মধ্যে ১ জন দারিদ্রসীমার নীচে। এই দেনার দায় ও কৃষিকাজের অনিশ্চয়তার অবশ্যম্ভাবী মর্মান্তিক পরিণতি হিসেবে আসে আত্মহত্যা। পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, লুধিয়ানা; পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, পাতিয়ালা ও গুরু নানকদেব বিশ্ববিদ্যালয়, অমৃতসর — এই তিনটে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সমীক্ষা বলে ২০০০-১০১৫ এর মধ্যে গড়ে প্রত্যেক দিনে ৩ জন চাষি আত্মহত্যা করে। পঞ্জাবে কৃষিকাজে যুক্ত পরিবারগুলোর গড় আয় মাসিক ১৮,০০০ টাকা। পঞ্জাবের চাষি আজ বুঝছে এই তিনটে কৃষি আইনের ফলে সরকার কৃষিতে বিনিয়োগ কমাবে ও কর্পোরেট ঢুকে পড়বে ব্যাপক হারে কৃষিতে। দেশের মধ্যে বোধকরি চাষের ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের সাথে সবচেয়ে বেশি মোলাকাত হয়েছে পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিদের। সরকারি বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দেখেছেন তাদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়েছে। কর্পোরেটের হাতে কৃষি ব্যবস্থার রাশ গেলে কি হবে তারা বিলক্ষণ বোঝেন।
দেশের ৭০০০-এর বেশি কিছুর মান্ডির অধিকাংশই পঞ্জাব ও হরিয়ানায়। প্রতি ৫ কিমি-র মধ্যে একটা মান্ডি থাকতে গেলে প্রয়োজন আরও ৪২,০০০ এর বেশি। মান্ডি — MSP — FCI এর খাদ্যশস্য কেনা ও মজুত — তার থেকে Food Security Act, PDS ব্যবস্থা, mid day meal — গরিবমানুষের খাদ্য সরবরাহের এই শৃঙ্খলে APMC মান্ডির গুরুত্ব কোথায় তা পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক ভালই বোঝে। তাই সে বোঝে মান্ডি বন্ধ হবার পরিণতি। যেখানে মান্ডি গড়ে ওঠেনি সেখানকার চাষিরা তা হারানোর মর্মাথটাও অতটা বোঝেন না। ভারতের অন্যান্য জায়গার চাষিদের গড় অবস্থা (আয়, দেনা, জমির আয়তন, আত্মহত্যা ইত্যাদির নিরিখে) পঞ্জাবের থেকে খারাপ। কিন্তু সেই চাষিরাও অনেকে এখন স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট ও MSP র কথা জানে। C2 + ৫০% শতাংশ (C2 মানে গোদা অর্থে চাষের সবরকম input cost) জানে। তাই দেশের সব জায়গার চাষিকে যুক্ত করতে আসলো MSP-র দাবি। আন্দোলন নেতৃত্বের প্রাজ্ঞতার নমুনা।
এবার আসা যাক কৃষক সংগঠনগুলোর কথায়। আমরা দূর থেকে দেখে বা মিডিয়ায় শুনে বলি যে কৃষকরা বসে আছে। এই অবস্থান কাছে গিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে এই স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে সুচারু রূপ দিয়েছে অনেক কৃষক সংগঠন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ান (BKU) এর নানান ফ্যাকশন (faction)। BKU শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। অন্যতম স্থপতি ছিলেন চৌধুরী চরণ সিং, এম.ডি. নানজুন্দাস্বামী, নারায়ণস্বামী নায়ডু, ভূপিন্দার সিং মান, মহেন্দ্র সিং টিকায়েত। পঞ্জাব খেতিবাড়ি ইউনিয়ান, কিষান সংঘর্ষ সমিতি, (হরিয়ানা) রায়তু সংঘ, (কর্ণাটক), ভ্যাবাসাইগল সংঘম – এরকম নানান সংগঠন মিলে তৈরি হয়েছিল BKU। এখন BKU নানান ফ্যাকশনে বিভক্ত— যেমন BKU (রাজেওয়াল), BKU (লাখোয়াল), BKU (দাকাউন্ডা), BKU (টিকায়েত), BKU (দোওবা), BKU (চাদুনী), BKU (একতা – উগ্রাহান), ইত্যাদি। BKU উপদলগুলি নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে, সচরাচর নির্বাচনে অংশ নেয় না, WTO-র বিরোধিতা করে, জেনেটিকালি মডিফায়েড (GM) শস্যের বিরোধিতা করে। BKU ছাড়াও আছে নানান সংগঠন — জামহুরি কিষান সভা, ক্রান্তিকারি কিষান ইউনিয়ান, সারা ভারত কিষান সভা (AIKS), জয় কিষান আন্দোলন, ইত্যাদি। পঞ্জাব হরিয়ানার আনুমানিক ৩০টি সংগঠন ও দেশের আরও নানান প্রান্তের আনুমানিক ১০টি সংগঠন নিয়ে তৈরি হয় প্রায় ৪০টি সংগঠনের একটি মঞ্চ — সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (SKM)। SKM-এর কাজ দেখভাল করে ৭ জনের একটা কোঅর্ডিনেশন কমিটি। ভারতীয় কৃষকেরা প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে নানান রকম সংগঠনের আওতায় সংগঠিত হচ্ছেন। এক অর্থে SKM অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলির ধাত্রী সংগঠন হল All India Kisan Sangharsh Coordination Committee (AIKSCC)। AIKSCC তৈরি হয়েছিল প্রায় ২৫০টি কৃষক সংগঠন নিয়ে মধ্য প্রদেশের মান্দসৌরে গুলিচালনায় ৫জন কৃষকের মৃত্যুর পর। SKM এর বাইরে আরও দুটি - মূলত পঞ্জাবের - ইউনিয়ান এই কৃষক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছে — BKU (একতা – উগ্রাহান) ও কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ কমিটি (KMSC)। BKU (একতা - উগ্রাহান) মূলত পঞ্জাবের মালওয়া অঞ্চলে সংগঠন করে— কৃষক আত্মহত্যা ও কৃষকদের নিয়ে অারও নানান সামাজিক কাজের জন্য এরা খ্যাত। BKU (একতা - উগ্রাহান) SKM এর মঞ্চের বাইরে। কিন্তু যৌথ মিটিং করে, একসাথে অনেক পরিকল্পনাও গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের (১০ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠান পালন করে ভীমা কোরেগাঁও ও আরও নানান কেসে জেলে বন্দি বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবি তোলেন এরা। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। SKM এর আবেদন ছিল এমন কিছু না করতে যাতে আন্দোলনের অভিমুখ নষ্ট হয়। BKU (একতা – উগ্রাহানের) সভাপতি যোগিন্দার সিং উগ্রাহানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন—বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সহায়তা করেন কর্পোরেট-শোষণের জটিল প্রক্রিয়া বুঝতে। ওনারা না বোঝালে আমরা হয়ত অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। তাই ওনাদের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কি গভীর সত্য; কত সহজে বলা! অন্য সংগঠন KMSC হল পঞ্জাবের খেতমজুর ও দলিতদের সংগঠন। সিংঘু বর্ডারের জমায়েত SKM সংগঠিত। গাজিপুরও তাই — তবে এখানে BKU (টিকায়েত) ফ্যাকশনের প্রভাব বেশি। টিকরি বর্ডারের জমায়েত স্থলে SKM এর উপস্থিতি থাকলেও এই জমায়েতের মূল সংগঠন — BKU (একতা – উগ্রহান)। KMSC এর অবস্থানও সিংঘু বর্ডারে।
ঘটনাপঞ্জি : জুন ৫, ২০২০ তে অধ্যাদেশ (ordinance) জারি হয়। তিনটি কৃষি বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ঘটে যায় সেপ্টেম্বর ১৪ - ২৭ এর মধ্যে। সরকার পার্লামেন্ট এর নানান কমিটিতে এই বিল পাঠাতে রাজি হয়নি। এই বিলের সমর্থকরাও এত তাড়াহুড়ো কেন তা নিয়ে কোনো আলোকপাত করতে পারেনি। শ্রম আইনের সংস্কার বিলও উত্থাপিত ও পাশ হয় সেপ্টেম্বর ২০ – ২৪ এর মধ্যে। অনেক দিন পরে ১লা মার্চ, ২০২১এ যখন কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলি যৌথ বৈঠকে বসে সিংঘু বর্ডারে তখন তার কারণ বোঝা যায়।
জুন, ২০২০ তে ordinance পাশ হবার পর থেকেই পঞ্জাবে আন্দোলন শুরু হয়। জুনে করোনার প্রাবল্য ও লকডাউন চলেছে সীমিত হলেও। Ordinance গুলো এরকম সময় পাশ করা হল কেন, ordinance এরই বা কি প্রয়োজন ছিল — এমনতরো নানান প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কৃষকরা সন্দিহান এই বিলের ব্যাপারে। Ordinance পাশ হবার পর করোনাজনিত সামাজিক দূরত্ববিধি মানার কারণে কৃষক জমায়েত করা যাচ্ছিল না বলে চাষিরা বাড়ির ছাদে উঠে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানাতো। আস্তে আস্তে প্রতিবাদ সংগঠিত হতে শুরু করল পঞ্জাবে। লক্ষ্য করার যে ordinance পাশ হবার পর পরই জুলাই মাসে শুরু হয় খড়িফ শস্যের বীজবপন। খরিফ চাষ চলে জুলাই থেকে অক্টোবর। খরিফ চাষ শুরু হবার পর পরই আন্দোলন গতি পেল। প্রথমে পঞ্জাব, পরে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ রাজস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্জাবে আন্দোলনের কথা আমাদের মিডিয়া প্রায় আমাদের কিছুই জানায়নি। দীর্ঘ দুমাসের কাছাকাছি ট্রেন চলাচল বন্ধ থেকেছে, টোল প্লাজায় টোল দেওয়া নেওয়া বন্ধ। রিলায়েন্স কোম্পানির পেট্রোল পাম্প, রিটেল ব্যবসা ও মোবাইল টাওয়ার বন্ধ। রাস্তায় রাস্তায় স্ট্রিট কর্নার, পিকেটিং। পঞ্জাবে কিছুটা ঘুরলেই বোঝা যায় একটা গোটা সমাজ — শুধু গ্রাম নয়, শহরও — কেমন আন্দোলিত। সমাজে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে বলেই দীর্ঘ ৮ মাস পরেও ৪০০ কিমি দূরে দিল্লীর বুকে এমন অভূতপূর্ব অবস্থান বিক্ষোভ বজায় রাখা যায়।
অক্টোবরে খরিফ শস্য কাটা ও রবি চাষ শুরুর পরই নভেম্বরে দিল্লি চলো। মার্চে আবার রবি শস্য কাটার সময়। তখন আবার অবস্থানের ভিড় কমবে। জাতীয় মিডিয়ার অবস্থানস্থলগুলোতে ভিড় কমে যাওয়া এবং আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার উল্লাস আমরা দেখি TV তে। কিন্তু এই মিডিয়া একটুও তলিয়ে ভাবে না ভিড় কমে যাওয়ার কারণ। জাতীয় মিডিয়ার এই বৈরি অবস্থান কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার তো করেছেই, এনেছে এই মিডিয়ার প্রতি এক অদ্ভুত বিরক্তি যা অবস্থানস্থলগুলোতে ফুটে উঠেছে নানান বর্ণময় পোস্টারে।
জুন ১৪-এ BKU (একতা – উগ্রাহান) প্রথম ordinance বিরোধী প্রেস স্টেটমেন্ট জারি করে। জুলাই ২০ পঞ্জাবের ১১টি কৃষক সংগঠন শিরোমণি অকালি দল — বিজেপির বিরুদ্ধে কুশপুত্তলিকা দাহ করে। জুলাই ২৭ কৃষক ইউনিয়ানগুলো একটি যৌথ ট্র্যাক্টর মিছিল সংগঠিত করে। সেপ্টেম্বর ১৭ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন শিরোমণি অকালি দল নেত্রী হরসিমরাত কাউর বাদল। সেপ্টেম্বর ২৪ থেকে শুরু হয় রেল রোকো। নভেম্বর ৫ এ চাক্কা জ্যাম। নভেম্বর ২৫ দিল্লি চলো। পঞ্জাব থেকে শুরু করে হরিয়ানা হয়ে দিল্লি চলো। এই যাত্রাপথে হরিয়ানার কৃষক সংগঠনগুলো পঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলোকে প্রভূত সাহায্য করে। এই দিল্লি চলোর নাটকীয় কিছু ভিডিও ক্লিপিংস আমরা দেখেছি। এই জমায়েত বাড়তে বাড়তে ২৬ জানুয়ারির কাছাকাছি এসে জনপ্লাবনের চেহারা নেয়। তারপর ২৬ জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির অভিঘাতে আন্দোলন সাময়িক ধাক্কা খায়। কিন্তু ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাকেশ টিকায়েতের কান্না, মুজাফরনগরের সিসৌলির রাত্রের মহাপঞ্চায়েত ও কৃষক আন্দোলনের অভূতপূর্ব প্রত্যাবর্তন। এই আন্দোলনকে যারা পর্যবেক্ষণ করছেন তারা সকলেই বলবেন এই আন্দোলনের গতির লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী।
জুন, ২০২০ তে পঞ্জাবের গ্রামে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রতিনিধিরা আজ আমাদের শহরে। তারা তৈরি করতে চাইছেন সারা দেশের কৃষক সমাজের সাথে এক সংলাপ। যে সংলাপ ছুঁয়ে যাবে আমাদেরও। কানে বাজে অবস্থান স্থলের সেই কথা — ‘‘ইয়ে লড়াই সির্ফ মেরে লিয়ে নেহি হ্যায়, তুমহারে লিয়ে ভি হ্যায়’’। তার কারণ আমার চাষের সাথে তো তোমার খাদ্য সুরক্ষা জড়িত। বৃহৎ পুঁজির হাতে চাষ গেলে তোমার খাদ্যের দাম তো হবে লাগামছাড়া। কাজও হারাব আমরা, নিজের বাপ-ঠাকুর্দার জমিতে হব খেতমজুর। আন্দোলনের গর্ভে আমি – তুমি মিলে যায়। তৈরি হয় নতুন ‘‘আমরা’’। এই আন্দোলনে পঞ্জাবের ধনী চাষি, মাঝারি চাষি, আর্থিয়া (commission agent), ক্ষুদ্রকৃষক ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক — সবাই আছে যাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কে বিরোধ (contradiction) থাকাই দস্তুর। অনেকের চোখে আর্থিয়ারা দালাল, কিন্তু পঞ্জাবের কৃষি সমাজ তাকে তার নিজের অংশ মনে করে। কারণ বিপদে আপদে, চাষের কাজে, ঋণের সাহায্যে তাকে পাশে যায়।
এই মাপের আন্দোলন— যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ তার ব্যাপ্তিতে, তার দৈর্ঘ্যে — নানান প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায় আমাদের কাছে। পঞ্জাবের আন্দোলনের সাথে, BKU-র কৃষি আন্দোলনের সাথে আমাদের রাজ্যের কৃষকের যোগ কোথায়? এই যোগসূত্রগুলো অনেকভাবেই স্থাপিত হয়। বিহারে ২০০৬ সালে APMC মান্ডি Act অবলুপ্ত হয় প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে। প্রথম দু-তিন বছর চাষিরা কিছুটা বেশি দাম পেলেও অচিরেই কৃষি পণ্যের বাজার হয়ে যায় volatile। দাম পড়তে শুরু করে। বিহার থেকে ব্যবসায়ীরা চাল কিনে পঞ্জাব – হরিয়ানার মান্ডিতে বেচে। বিহারে তৈরি হয় প্রচুর ভূমিহীন কৃষক যারা পঞ্জাবে যান খেতমজুর হিসেবে। এদের কাছ থেকে পঞ্জাবের অনেক কৃষক শোনেন APMC মান্ডি লোপ পাওয়ার ফল।
এ ছাড়া থাকে কৃষক আন্দোলনের নেতা থেকে সাধারণের কাছে শোনা — ইয়ে লম্বা চলেগা। কেন? কারণ তারা বোঝেন সরকার ছাড়িয়ে এই লড়াই তাদের এনেছে বৃহৎ পুঁজির সামনে। আন্দোলনস্থলে ঘুরলে, কথা বললে তাই ফিরে ফিরে আসে আদানী অম্বানীর কথা। তারা জানেন এই লড়াই protracted।
এ ছাড়াও এই কৃষি আন্দোলন তুলে এনেছে ইতিহাসকে। অনেক পঞ্জাবী বা হরিয়ানার কৃষক তাদের আগের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেখেন এই আন্দোলনকে। দুটো উদাহরণ। ‘‘পাগড়ি সাম্ভাল জাঠ্ঠা’’ ছিল ভগৎ সিং-এর কাকা সর্দার অজিত সিং এর নেতৃত্বে বৃটিশদের করা তিন কালা কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন। আজকের আন্দোলন সেই ইতিহাস তুলে নিয়ে আসে। এছাড়া আছে স্যর ছোটুরামকে স্মরণ। পশ্চিম উত্তরঃপ্রদেশে জাঠ ও মুসলিমদের মুজ্জফরনগর দাঙ্গার পরের বিভেদকে ভোলাতে সাহায্য করছে এই আন্দোলন। অনেক সময়েই মুসলমানদের শুনতে হয় — ‘‘বাবর কা আওলাদ’’। আমরা কি জানি যে ১৫২৭ এ খানওয়া ময়দানে বাবরের সাথে লড়াই হয়েছিল হাসান খাঁ রাণা সাংঘার। মেওয়াত অঞ্চলের (হরিয়ানা – জয়পুর – দিল্লী – আগ্রা নিয়ে যে অঞ্চল) মুসলমান প্রধান অঞ্চলের কৃষকরা সুনহেড়া অবস্থানস্থলে মেওয়াতি দিবস পালন করবেন ১৫ মার্চ। হ্যাঁ ‘‘বাবরের আওলাদ’’রা বাবরের বিরুদ্ধেই মেওয়াতি দিবস পালন করবে। এই আন্দোলন এক বহমান নদী, কলেবরে বাড়ছে। নানান ধারা, উপধারা এসে এতে মিশছে। সমাজের অনেক কিছুকে ধরেই সে টান মারছে। আন্দোলনে মহিলা কৃষকদের অংশগ্রহণ নজর-কাড়া। BKU (একতা – উগ্রাহান)-র পঞ্জাবের বারনালায় করা মহাপঞ্চায়েতে দেড় লাখ লোক হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের ভাড়া করা লোকের মিছিল নয়। স্বেচ্ছায় আসা মানুষের জমায়েত। সেই ভিড়ের মধ্যে আনুমানিক ৮০ হাজার মহিলা ছিলেন।পঞ্জাবের যুবসমাজের নেশাগ্রস্ততার কথা শোনা যায়। এই আন্দোলনের প্রভাবে সেটাও কমের দিকে।
ইতিহাস ঘটছে আমাদের সামনে। সেই ইতিহাসের ক্ষণিক অংশমাত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২৩ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০২১।
সিংঘু বর্ডার
দিল্লিকে ঘিরে হরিয়ানার উপর দিয়ে দিল্লির পশ্চিম সীমান্ত বরাবর অর্ধচক্রাকারে আছে ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল বা কুন্ডলী – মানেসর – পালওয়াল এক্সপ্রেসওয়ে। তেমনই দিল্লিকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশের উপর দিয়ে দিল্লির পূর্ব সীমান্ত বরাবর অর্ধচন্দ্রাকারে আছে ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে। অর্থাৎ ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে দিল্লি শহরকে। ওয়েস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে যেখানে NH-44 বা জম্মু-দিল্লি হাইওয়েকে কেটে ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে নাম নিয়েছে, সিংঘু বর্ডার (হরিয়ানা ও দিল্লির উত্তর প্রান্তের বর্ডার) সেখান থেকে প্রায় ১৫ কিমি দক্ষিণে। এই NH-44 এর সংযোগ স্থল থেকে সিংঘু বর্ডার পর্যন্ত ১৫ কিমি লম্বা রাস্তার উপর কৃষক অবস্থান ছিল ২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে। এখানে চার লেনের হাইওয়ের দুপাশে খুব ঘন জনবসতি নেই। এই ১৫ কিমি রাস্তার দুই প্রান্তে সাধারণ পুলিশ ব্যারিকেড ছিল ২৬ জানুয়ারির আগে। আন্দোলনের সংগঠনগুলির হলুদ, সবুজ, লাল, গেরুয়া পতাকা লাগানো গাড়ি থাকলে অথবা পায়ে হেঁটে আন্দোলন স্থলে ঢোকা বা বেরোনোয় কোনো সমস্যা ছিল না।
পুলিশ ব্যারিকেড ছাড়ালেই চোখে পড়বে NH-44-এর উপর বহু মানুষ তাঁদের ট্রাক্টর, ট্রলি ও তাঁবুতে অবস্থান করছেন। মাঝে এক ফালি রাস্তা ছাড়া আছে স্থানীয় মানুষ, আন্দোলনে যাঁরা আসছেন গাড়িতে বা ট্রাক্টরে করে তাঁদের জন্য। রাস্তার দুই দিকেই সারি সারি ট্রলি ত্রিপল বা প্লাস্টিকে ছাওয়া, কখনও বা অস্থায়ী তাঁবু রাস্তার উপর। ট্রলির ভিতরে খড়ের গাদার উপর তোষক ও কম্বল চাপিয়ে হয়েছে শোওয়া, থাকার ব্যবস্থা। বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। ভিতরে উঁকি দিলেই দেখা যায় কোনো বৃদ্ধ হয়ত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। নবীনেরা ব্যস্ত প্রাত্যহিক কর্মে। প্রায় সব ট্রলিতেই আছে ঝাণ্ডা কোনো না কোনো কৃষক সংগঠনের। সাথে পোস্টারও। মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধ – বৃদ্ধা, ছোট বাচ্চা দলে দলে পাঞ্জাবের মানুষ এসেছেন এখানে। তাঁরা কখনও থাকছেন সপরিবারে, কখনও অন্যান্য গ্রামবাসীর সাথে। ট্রলি এবং প্রায় সব ট্রাকটরেই রয়েছে কখনও সংযুক্ত কৃষক মোর্চা, কখনও বা তাঁদের নিজ নিজ সংগঠনের সবুজ, হলুদ, গেরুয়া, নীল, লাল বা সাদা পতাকা।
ট্রলি ও ট্রাক্টরের সারির মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে মূলত শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি (SGPC)-র লঙ্গরখানা। তাঁদের বিশালাকৃতি, প্রায় প্রমাণ মাপের মানুষ ঢুকে যাবে এমন বড় বড় কড়াই, ডেকচিতে চলছে ডাল, তরকারি, খিচুড়ি, পায়েস বা হালওয়া রান্না। মহিলা, পুরুষ, বৃদ্ধ, জোয়ান নির্বিশেষে হাত লাগিয়েছেন রান্নার কাজে— সবজি কাটা, ধোয়া, বাসন মাজা, কড়াইতে হাতা ঘোরানোয়। খিদে পেলে যে কোনো লঙ্গরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মিলছে রুটি ও তরকা ডাল। একটি মুসলিম লঙ্গরও চোখে পড়ল। এঁরা হলেন মুসলিম ব্রাদারহুড, এসেছেন মালের কোটলা, পাঞ্জাব থেকে। তাঁরা শুধু লঙ্গরখানাই চালাচ্ছিলেন না। ছিল লেপ, কম্বলের সংস্থানও। আন্দোলনের গোড়ার দিকে যখন মূলত পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলি এখানে জমা হতে শুরু করে, তখনও কিন্তু SGPC এখানে এসে পৌঁছান নি। পরবর্তী কালে পাঞ্জাবের বহু গুরুদ্বারা তাঁদের খানিকটা লঙ্গর এখানে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। খবরের কাগজ বা মিডিয়াতে বহু মানুষ হয়ত বা না-জেনেই মন্তব্য করেছেন ‘‘এ তো পিৎজা বার্গার খাওয়া পাঞ্জাবের ধনী কৃষকদের আন্দোলন। কিন্তু আন্দোলন স্থলে বহু ধনী মানুষকেই হয়ত দেখা গেছে, কিন্তু লঙ্গরের খাওয়াতে তাদের কোনো বাহুল্য দেখা যায় নি। পাঞ্জাবের ধনী মানুষও যখন লঙ্গরে সেবা করার জন্য যান তিনি যখন দান করেন, তিনি নিজে যা খান তাই তিনি দানের জন্য দেন। এই তাঁদের ঐতিহ্য— তাই দু এক জায়গায় বাদাম, কমলালেবুও (পাঞ্জাবে এই সময় কমলা লেবু খুবই সস্তা ছিল — ৪ কিলো ১০০ টাকায়) লঙ্গরে কেউ কেউ দিচ্ছিলেন। যদিও তা খুবই কম।
মাঝে মাঝেই দেখা গেল রেশন ও জলের ট্যাঙ্কার আসছে বাইরে থেকে। চাল, ডাল, আটা ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী লঙ্গরখানার সেবায়েতরা নিজেদের প্রয়োজন মতো নিচ্ছেন সেখান থেকে। রেশনের লরি, জলের ট্যাঙ্কার এগিয়ে চলেছে আরও দক্ষিণে দিল্লির দিকে মঞ্চ অভিমুখে।
একটু নজর করলে চোখে পড়ে সারি সারি ট্রাক্টরের পিছনে অস্থায়ী toilet। তবে তা সিংঘুতে জড়ো হওয়ার মানুষের সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষত মহিলাদের যথেষ্ট কষ্ট করেই সমাধা করতে হচ্ছে প্রাত্যহিক শৌচকর্মাদি।
আরও দক্ষিণে এগিয়ে যেতে দেখা গেল, বেশ কিছু অস্থায়ী গ্রন্থাগার youth for Swaraj এর তাঁবুতে হয়েছে বেশ কিছু বইয়ের সংগ্রহ। সেখানে দু একটি বাচ্চা ছেলেকে পড়তেও দেখা গেল। ছিল আরও দু একটি সংগঠনের বইয়ের সংগ্রহ। এই অস্থায়ী গ্রন্থাগারগুলিতে মূলত গুরুমুখীতে লেখা বই-ই সংখ্যায় বেশি ছিল। ছিল কিছু হিন্দি ও ইংরাজি বইও। বইয়েই বিভিন্নতাও তেমনই। — ছিল বামপন্থী দর্শন, সাহিত্য, শিখ ইতিহাস, ধর্মীয় ও আরও বহু প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বইয়ের সমাহার। এখানে দেখা গেল বহু মানুষই বই পড়ছেন অথবা বই ফেরত দিতে এসেছেন পড়ার পর। রয়েছে প্রচুর মেডিকেল ক্যাম্প। সামান্য সর্দি, কাশি, জ্বরের ওষুধ মিলছে নিখরচায়। আছে মানুষের কাপড় জামা কাচার ব্যবস্থাও। চোখে পড়ে স্বেচ্ছাসেবকরা আন্দোলনে যোগদানকারী মানুষের জামা কাপড় কেচে দিচ্ছেন ওয়াশিং মেশিনে।
গোটা রাস্তা জুড়ে দুধারে সারি দেওয়া ট্রলি, ট্রাক্টরের গায়ে লাগানো হয়েছে নানা রঙ্গীন পোস্টার। সেখানে আন্দোলনরত কৃষক সাধারণ জনগণ ও কৃষক ইউনিয়নগুলির ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে নিপুণভাবে। কোথাও মোদী – আদানি – আম্বানি – কঙ্গনার মাথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে গরু-ছাগল-ভেড়া-মোষের দেহের উপর। কখনও বা আজতক, zee news, নিউজ ২৪, রিপাবলিক ভারতের মতো টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিদের শেকল দিয়ে বাধা আদানি – আম্বানির হাতে। কৃষক ইউনিয়ন ও সাধারণ কৃষক সমাজ খুব সহজেই আদানি – আম্বানি মোদী ও মিডিয়া — এই ত্রয়ীকে এক আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছেন। তাই আছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভের উদ্গিরণ, জাতীয় ও অন্যান্য মিডিয়ার প্রতি প্রবল অবিশ্বাস ও সন্দেহ। তাই চোখে পড়ে গাড়ির কাঁচে আটকানো পোস্টার ‘‘Zee media গদ্দার হ্যায়’’। উল্টোদিকে কৃষক সমাজের ব্যথার কথা ফুটে ওঠে সেই সব পোষ্টারে — যখন তাঁরা লেখেন “we are farmers, not terrorist” “no farmers, no food, no future”. কৃষকের মমতা মাখা মুখ ফুটে ওঠে ফসল কোলে নিয়ে কোনো এক পোস্টারে।
২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে মানুষ, ট্রাক্টর ও ট্রলির ঢল নেমেছিল রাস্তায়। তাঁরা এসেছেন গাড়িতে মোটর সাইকেলেও। শুধু কৃষক নন, কৃষকের ভাই, বোন বৃহত্তর পরিবার, যাঁরা অন্যান্য কাজেও যুক্ত তাঁরাও এসেছেন সহমর্মী হয়ে, এক অভুতপূর্ব উৎসাহ ও একতার মন্ত্র নিয়ে কৃষকের লড়াইয়ের অংশ হতে। সিংঘু বর্ডারে অধিকাংশই ছিলেন পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম থেকে আগত শিখ সম্প্রদায়। নবীনরা আসছিলেন অতি উৎসাহে উৎসব মুখর হয়ে ট্রাক্টরের উপর বড় বড় বক্স বাজিয়ে। সেখানে যেমন ছিল পাঞ্জাবী চটুল গান, তেমনই পাঞ্জাবীতে লেখা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে রচিত বহু গান। বৃদ্ধ শিখেরা আসছিলেন তাঁদের মতো করে নীরবে। বহু ট্রলিতে ছিল নানা বয়সী মহিলাদের উপস্থিতি। ট্রাক্টরের বিভিন্নতা দেখলেও অবাক হয়ে যেতে হয়— স্বরাজ, নিউ হল্যান্ড, John Desse, Eicher, Mahindra, Powertrac, Farmtrac ও আরও কত রং ও ধরন তার হিসাব রাখা দায়।
হরিয়ানার বেশ কিছু কৃষক সংগঠন জমায়েতে এসেছেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেখানকার কৃষকেরা দেখা গেল তাঁবুর সামনে গোল হয়ে বসেছেন বিশাল বড় এক হুঁকো নিয়ে। হুঁকোর নল হাতে হাতে ফিরছে বয়স্ক ও নবীনদের মধ্যে — চলছে আলোচনা — হয়ত বা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়েই। এখানে নবীন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি ও যোগদান সত্যিই বিষ্ময়কর। এই নবীন প্রজন্ম স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন, সামলাচ্ছেন মঞ্চ ও আরও অনেক কিছু।
পায়ে পায়ে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছি সংযুক্ত কৃষক মোর্চার মঞ্চের সামনে। যেখানে চলছে পাঞ্জাবী নাটক – গান – কবিতা আবৃত্তি। লাল – নীল – সবুজ রঙ্গিন পাগড়িতে ভরে গেছে মঞ্চের সামনের মাটির উপরে পাতা সবুজ কার্পেটের দর্শকাসন। সঙ্গে আছেন তেমনই রঙ্গিন ঘোমটা দেওয়া সর্দারনীরা। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত এসে স্লোগান দিচ্ছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ— যো বলে সো নিহাল। সৎ শ্রী আকাল ওয়াহে গুরুজীকে ফতেহ’’। — দর্শকাসনে বসা মানুষ গর্জে উঠছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ’’।
মঞ্চের একপাশ দিয়ে চলছে বহু বর্ণময় গাড়ী ও ট্রাক্টরের যাতায়াত। আর তারই মাঝে চোখে পড়ে নীল জোব্বা পরিহিত, তলোয়ারধারী শিখ নিহাং সম্প্রদায়ের সৈনিকদের ঘোড়ায় চড়ে টহল দেওয়া। শিখ শৌর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন তাঁরা।
মঞ্চের আশে পাশে রয়েছে ছোট ছোট জমায়েত। সাধারণ জনগণ কথা বলছেন স্থানীয় টিভি চ্যানেল ও মিডিয়ার সাথে। অধিকাংশই পাঞ্জাবীতে। এক গেরুয়া পাগড়িধারী শিখ তাঁর দুঃখ উজাড় করে দিলেন। মিডিয়া ও সরকারের ‘খলিস্তানী’ অপবাদের বিরুদ্ধে। ‘খালসা’। যিনিই সত্যের জন্য, শুদ্ধতার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা সকলেই ‘খালসা’ এই পবিত্র শব্দটির সাথে ‘স্থান’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে, তাদের যে আতঙ্কবাদীর সাথে এক আসনে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা তাতে তাঁরা মর্মাহত, দুঃখিত।
আর এক পাশে দেখা গেল পাগড়িধারী এক বৃদ্ধ কৃষক হাতে All India Kisan Sabha (AIKS)-র লাল পতাকা নিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন কোনো এক স্থানীয় টিভি চ্যানেলে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমান্বয়ে চাপিয়ে দেওয়া নোটবন্দী, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি এবং তার পরেই এই কৃষক বিলের মতো জনস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচীর বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। তাঁর প্রশ্ন — ৩৭০ ধারা যদি প্রত্যাহার হতে পারে, তবে এই তিন কালা কানুন রদ করতেই বা সমস্যা কোথায়। তিনি মনে করিয়ে দেন এ দেশের ফৌজের অধিকাংশই পাঞ্জাবের বিভিন্ন কৃষক পরিবারের সন্তান। না কোনো মোদী আম্বানী বা আদানির সন্তান। ওরা দেশের জন্য জীবন কুরবানি দেন না! এই অমোঘ সত্যটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই তাঁদের মতো মানুষের আজ বড়ো প্রয়োজন।
ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হয় সোনিপতের এক ক্ষুদ্র চাষী ও AIKS-এর সদস্যের সাথে। তিনি সিংঘু বর্ডারে AIKS-এর তাঁবুর দায়িত্বে আছেন। তিনি কবি ও গীতিকারও বটে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়েন নি। তাই বোধহয় তিনি আন্দোলনের কথা, প্রতিবাদের কথা গান গেয়ে মোদীকে ‘তু মান যা....’ অত্যন্ত সহজ ভাবে বলতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষকে, মানবতাকে মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ক্ষমতাকে, ঈশ্বরকে নয়।
২৫ জানুয়ারির রাতে সিংঘু বর্ডারে youth for Swaraj-এর তাঁবুতে পৌঁছাতে বেগ পেতে হল বেশ। সেদিন NH-44 ও expressway মোড়ের অনেক আগে থেকেই দেখা গেল রাস্তার উপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অগুণতি ট্রাক্টরের সারি। পুলিশ সেদিন অত্যন্ত তৎপর। বহু ট্রাক্টরকেই আটকে দিয়েছে হাইওয়ের উপর। সারি সারি ট্রাক্টরের মাঝে আমাদেরও গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল — প্রায় ৬-৭ কিমি অন্ধকার রাস্তা, মাছি গলার জায়গা নেই, এমনভাবে পাশাপাশি রাখা ট্রাক্টরের মাঝখান দিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম তাঁবুতে, প্রায় রাত ১০ টা নাগাদ। চারিপাশে যেন উৎসবের আমেজ। কারণ পরের দিনই আছে সেই ট্রাক্টর মিছিল। মানুষের উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে। চারিপাশে বাজছে বক্স। হয়ত বা পিনাও একটু চলেছে। তাই রয়েছে সতর্ক পাহারাও। না পুলিশের নয়। দুই প্রান্তের দুই ব্যারিকেডে মুক্তাঞ্চলে স্বেচ্চাসেবকদের তাঁরা আমাদের মত করোনার ভয়ে ভীত, মুখে মাস্ক পরা মানুষ দেখলে বিচলিত হচ্ছিলেন। প্রসঙ্গত, সিংঘু বর্ডারে এই মাস্ক পরিহিত মানুষরা যে এখনও তাঁদের সবটুকু দিয়ে এই আন্দোলনে সামিল হতে পারে না তা সুস্পষ্ট। তিন কালা কানুন ওয়াপস ও MSP লাগু কুম্ভস্নানে যাওয়ার আগে মানুষের যে আকৃতি দেখা যায় তারই এক ঝলক দেখা গেল ওখানে সমবেত মানুষের মধ্যে। যারা, ওখানে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের কারোমুখে ‘মাস্ক’ দেখা যায় নি। ওনাদের আসলে মুখোশের আড়ালে কিছু ঢেকে রাখতে হয় না। রাত নেমে আসতেই স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাদের মত যারা আছেন তাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে। রাত্রিবাসের জন্য ছিল বেশ কিছু তাঁবু। যে কেউ এসে পরিচয়পত্র দেখিয়ে থাকতে পারবেন সেখানে।
২৫ তারিখ রাতে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মধ্যেও ছিল। ছিল কিছু চাপা উদ্বেগ। ২৬ জানুয়ারির সকাল বেলা থেকেই সাজ সাজ রব। জায়গায় জায়গায় গরমজলের ব্যবস্থা হয়েছে, দিল্লির ঠাণ্ডায় স্নানের ব্যবস্থা করতে। একে একে মানুষ আসছেন স্নান করে পবিত্র হয়ে, যেন যুদ্ধযাত্রা নাকি কুম্ভমেলার সেই শাহি স্নানের মতো পুণ্যার্জনের লক্ষে সকাল সকালই ট্রাক্টরে চেপে এগিয়ে যাচ্ছেন সকলে সিংঘু বর্ডার পার করে দিল্লির দিকে। রাস্তা ভরে গেছে নানা রঙের পাগড়িতে। কেউ কেউ ট্রাক্টরে চেপে, কেউ হেঁটে, কাঁধে পতাকা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন দিল্লির দিকে। বৃদ্ধ – বৃদ্ধা দৃপ্ত স্বরে স্লোগান দিচ্ছেন ‘‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ’’।
সিংঘু বর্ডার পুলিশ বর্ডার পুলিশ পোস্টের কাছে দেখা গেল, ব্যারিকেডের খুব সামান্য অংশই খোলা রয়েছে ট্রাক্টরের যাতায়াতের জন্য। মানুষ ও ট্রাক্টরের সংখ্যার তুলনায় তা সংকীর্ণ অতএব বেশ কয়েকজন শক্ত, সমর্থ স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এলেন ঠেলে, উপড়ে দিলেন রাস্তা আটকানোর বড় বড় সিমেন্টের ব্লক। ঠিক এইখানেই দিল্লির দিকে মুখ করে ছিল কিষান–মজদুর সংঘর্ষ কমিটি (KMSC)'র মঞ্চ। এখানেও জমায়েত হয়েছেন বহু মানুষ। এই মঞ্চে মূলত ভূমিহীন কৃষক ও মজদুরের সংখ্যাই বেশি। মঞ্চে চলছিল বিভিন্ন নেতার বৃক্ততা – আর কিষাণ ঐক্যের ডাক।
২৬ জানুয়ারির ট্রাক্টর মিছিলে আমরা পদচারী হিসাবেই যোগ দিতে পেরেছিলাম। কারণ মানুষের তুলনায় ট্রাক্টরের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। Youth for Swaraj-এর তাঁবুস্থলে রাতের অন্ধকারে কোনো তাঁবু থেকে ভেসে এল অল্পবয়সীদের বক্সের গান— আবার কোথাও গুরুবাণীর গম্ভীরমাখা সুর। — কোথায় যেন রব উঠল মোদী মর গ্যয়া হায়। আলাপ হল বহু মানুষের সাথে যারা কিন্তু আমাদেরই মতো সরাসরি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত নয়।
সন্দীপ আলুরি (৩৫)। ইনি একটি ক্যামেরা কাঁধে হায়দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন সিংঘু বর্ডারের উদ্দেশ্যে। Software এর চাকরি ছেড়ে তিনি documentary film বানান। হায়দ্রাবাদে স্থানীয় কোনো কৃষকের কাছে এই আন্দোলনের কথা শুনে আর থাকতে পারেন নি। চলে এসেছেন, থাকছেন এবং প্রতি পদে আশ্চর্য হচ্ছেন এই মানুষগুলির সংঘবদ্ধতা ও ঐক্য দেখে।
এসেছেন আকাশ সিং (বয়স ২৪) পাতিয়ালা থেকে। তিনি এসেছেন শুধুই কৃষকদের সমর্থন দিতে। দীর্ঘ একমাস ধরে তিনি এখানে থাকছেন – ছবি তুলছেন। দ্বাদশ শ্রেণীর পর পড়াশোনা না ভাল লাগায় কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব পড়াশোনা অগাধ। শুধু পাঞ্জাবী সাহিত্য নয়, মারাঠী এবং আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের কথা যা জানেন তা বিস্ময়কর।
মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে কানে এল তামিল শ্লোগান। জনা ১৫-র একটি দল এসেছেন তামিলনাড়ু থেকে। তাদের লাল পোস্টারে চে-গুয়েভারা ও আম্বেদকর। তামিলনাড়ুর বেশ কিছু বামপন্থী সংগঠনের তরফ থেকে তাঁরা এসেছেন কৃষক আন্দোলনে সামিল হতে।
দুপুর ১২টার পর থেকেই লালকেল্লার খবর আসতে লাগল সমাবেশে। পুলিশ প্রহরাও মনে হল যেন আস্তে আস্তে বাড়ছে। কিন্তু না, হাতে রঙ্গিন পতাকা, মুখে কিষাণ ঐক্যের বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলে শান্তিপূর্ণ ট্রাক্টর মিছিল।
সিংঘু বর্ডার পাঞ্জাবের সমস্ত জেলার মানুষ ধনী, দরিদ্র, কৃষক, পড়ুয়া, ব্যবসায়ী, শিক্ষক চাকুরিজীবী নির্বিশেষে উপস্থিত হয়েছেন ‘‘তিন কালা কানুন ওয়াপসী’’র জন্য সরব হয়ে। তাঁরা শীত-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, সমস্ত অসুবিধা অগ্রাহ্য করে বসে আছেন তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। কারও কোনো ক্লান্তি দেখা যায় নি। ওঁরা বলছেন— ভারতের সমস্ত প্রান্ত থেকে তোমরা এস। তোমরা দেখো এখানে কোথায় ‘খালিস্তানি’ আছে? আমরা চাষী – আতঙ্কবাদী নই। ওরা ওদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন এই তিন আইনের প্রভাব কি ভয়াবই হতে পারে। ওনাদের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। ওনারা বলেন— এ শুধু আমাদের রুটি, রুজির প্রশ্ন নয়। এই আন্দোলন তোমার মতো তামাম সাধারণ ভারতবাসীর খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নেও। তোমরাও আওয়াজ উঠাও। স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলন প্রাঙ্গনের বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল — দিল্লির প্রচন্ড শীত আর গরমে কতদিন এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবেন? প্রতিটি মানুষ একই দৃপ্ত স্বরে সুর মিলিয়ে বলেছেন — এই তিন কালা কানুন ওয়াপসী না হওয়া পর্যন্ত আমরা উঠছি না। এই অবস্থান চালু থাকবে — ‘‘ইয়ে লম্বা চলে গা’’।
সিংঘু বর্ডারের কৃষক অবস্থান যেন এক মুক্তাঞ্চল, আবার এক রাজনৈতিক মহাকুম্ভও — যেখানে হাজার হাজার পাঞ্জাব, হরিয়ানার মানুষ একত্রিত হয়েছেন নিজস্ব পরিচয়কে দূরে সরিয়ে একটিই উদ্দেশ্যে — ‘‘তিন কালা কানুন ওয়াপস ও MSP লাগু’’
টিকরি বর্ডার
টিকরি বর্ডার দিল্লি ও হরিয়ানার উত্তর-পশ্চিমের বর্ডার। দিল্লি থেকে যে সবুজ মেট্রো লাইন হরিয়ানার বাহাদুরগড়ের দিকে চলে গেছে সেই মেট্রোলাইনের নীচে NH-9 বা রোহতক রোডের উপর। টিকরি-কালান মেট্রো স্টেশন থেকে শুরু করে প্রায় হরিয়ানার রোহতক পর্যন্ত (প্রায় ৪০ কিমি) চলে গিয়েছিল কৃষক অবস্থান ২৬শে জানুয়ারির ঠিক আগে। এখন সেটা নেমে এসেছে আনুমানিক ১৫-২০ কিমিতে, স্বভাবতই চাষের প্রয়োজনে। এখানে রোহতক রোডের দুপাশেই ঘন জনবসতি, দোকান পাট। দুই লেনও চওড়ায় সিংঘু বর্ডারের থেকে অনেকটাই অপ্রশস্ত। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাসস্থান এখানে। অপেক্ষাকৃত ঘিঞ্জি এলাকাও।
দিল্লির দিক থেকে এখানে পৌঁছালে প্রথমেই পড়বে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (SKM) এর মঞ্চ, হরিয়ানামুখী হয়ে। টিকরি বর্ডারের চরিত্র কিছুটা হলেও সিংঘু থেকে আলাদা। এখানে মঞ্চ অনেক বেশি কৃষক মোর্চা দ্বারা পরিচালিত। অনেক সুসংবদ্ধ। অনেক বেশি রাজনৈতিক। এখানের পাঞ্জাবের মানুষ যেমন আছেন তেমনই আছেন হরিয়ানার কৃষকও। এবং সংখ্যায় হরিয়ানার কৃষক এখানে অনেক বেশি সিংঘু বর্ডারের তুলনায়। এখানে লঙ্গরের সংখ্যা কম। আন্দোলনে যোগদানকারী মানুষ যাঁরা ট্রাক্টর ও ট্রলি নিয়ে এসেছেন, ট্রলি বা তাঁবুতে থাকছেন, তাঁরা অনেকেই নিজেরা রেঁধে বেড়ে খাওয়া দাওয়া করছেন। এখানে পাঞ্জাবের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলির তাঁবু যেমন আছে তেমন হরিয়ানার বিভিন্ন কৃষক সংগঠন এমনকী খাপ পঞ্চায়েতের তাঁবুও আছে। আছে ট্রলি টাইমস নামে পাঞ্জাবী ও হিন্দিতে প্রকাশিত পত্রিকার অফিস। সেখানে সুদূর মহারাষ্ট্রের ভীড থেকেও স্বেচ্ছাসেবক এসেছেন কাজ করতে। তাঁরা আন্দোলনস্থলে বায়ো-টয়লেট বসানোর চেষ্টা করছেন, চেষ্টা করছেন আন্দোলন স্থল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে।
ছোট ছোট জমায়েতে মানুষ আন্দোলন নিয়ে তৈরি করা কবিতা-গান পাঠ করছেন। কেউ বা অমিত শাহ সেজেছেন। তাঁকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে লাঠি পেটার অভিনয় করছেন বাকিরা। চলছে সিংঘুর মতোই স্থানীয় চ্যানেলের নেওয়া সাক্ষাৎকার। এমনই এক সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া অজয় ভাল্লারার অশেষ দুর্গতির খবর পাওয়া গিয়েছিল দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর। তিনি ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষা দপ্তরের কোনো এক আধিকারিক। সাতদিনের ছুটি নিয়ে নিজস্ব তাগিদে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ২৬ জানুয়ারির ঠিক আগে। পরবর্ত্তী কালে ছুটি থেকে ফিরে গিয়ে তিনি জানতে পারেন তাঁকে suspend করা হয়েছে।
২৪ জানুয়ারির টিকরি বর্ডারও দারুন উত্তেজনায় ভরপুর। বক্সের গান, আন্দোলনের slogan এ মুখরিত সারা রাস্তা। ক্রমাগত ঢুকছে ট্রাক্টর ও মানুষ — বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এমন কী শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষও। মঞ্চ থেকে ভেসে আসা নেতৃত্বের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও উদাত্ত আহ্বান — কিষাণ একতা জিন্দাবাদ।
একটি তাঁবুতে দেখা গেল, বেশ কিছু মানুষ পোস্টার লিখছেন। বহু মানুষ আসছেন চিরকুট লেখা তাঁদের স্লোগান নিয়ে। আর স্বেচ্ছাসেবকরা তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলছেন আর্ট পেপারে, ছবিতে। এখানেই আলাপ হল পাঞ্জাবের ফরিদকোর্টের এক পাগড়িধারী ICSC স্কুল মালিকের সাথে। বয়স ৩৫। তিনি প্রায় একমাসের উপর এখানে রয়েছেন। আমরা এই আন্দোলন এতদিন ধরে কিভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে, উনি শোনালেন শিখ শৌর্য ও বীরগাথার ইতিহাস। তিনি বলেন পাঞ্জাবের লড়াইয়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন। তাঁরা আফগান – পাঠান – মোঘল সকলের সাথে লড়েছেন— রক্ষা করেছেন ভারতবর্ষকে আপামর ভারতবাসীর হয়ে। বন্দা বাহাদুরের মোঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প শোনান তিনি — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর বন্দীবীর কবিতায় লিখে গেছেন যাঁর কথা। এই কৃষক আন্দোলনকেও তাঁরা সেই ইতিহাসেরই এক ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন— তাই তাঁরা গর্জে উঠতে পারেন সদর্পে আজও - তিন কালা কানুন ওয়াপস। ইতিহাস সচেতনতার এক সুন্দর নিদর্শন দেখা গেল এখানেই একটি পোস্টারে। East India Companyর সাহেবদের পোষাকে আম্বানী-আদানী-মোদী। তেমনই রয়েছে নীলদর্পণ সম্পর্কে লেখা বইয়ের বড় করা photocopy।
এখানেই আলাপ হয় অর্চনা সিংয়ের সাথে। তিনি বলেন কৃষকের সাথে মাটির সম্পর্কের কথা। তিনি বলেন বাড়ির মেয়ে যেমন বাড়ির ইজ্জত — মাটিও কৃষকের কাছে তাই। এই তিন কালা কানুন মোদী ও আম্বানী – আদানীর মাটিকে ধর্ষিত করার পরিকল্পনা — তা তাঁদের ঘরের মেয়ের বেইজ্জতির সমান — তাই ‘বেটি’র সম্মান রক্ষার্থে তারা দৃঢ়, সংঘবদ্ধ কঠিন — তাঁরা ফিরে যাবেন না। কৃষকরা বোঝেন এই তিন কালা কানুন তাদের মাটির বেইজ্জতি — অপমান। তাঁরা পালা করে আন্দোলনে অবস্থান করবেন। প্রতি গ্রাম থেকে তাঁরা দুই তিনজন কৃষককে পাঠাবেন ট্রাক্টর ও যাবতীয় রাহাখরচ দিয়ে বর্ডারে। বাকী গ্রামবাসীরা সামলাবেন তাঁদের ফসল তাঁদের চাষ — যতদিন না তাঁরা আবার ফিরে আসেন গ্রামে। — যাবে আবারও এক নতুন দল বর্ডারে।
টিকরি বর্ডারে আরও একটি মঞ্চ ছিল কিষাণ একতা উগ্রাহান। এই মঞ্চ যদিও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ৪০টি দলের মধ্যে নেই কিন্তু আন্দোলনের শুরু থেকেই তাঁরা কিষাণ সংযুক্ত মোর্চার সাথে সংহতি রেখে আন্দোলনে থেকেছেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, বুঝিয়েছেন, কৃষকের পাশে থেকেছেন।
রাত নেমে আসে টিকরি বর্ডারে। গুরুবাণী শোনা যায়। কোনো এক তাঁবুর ভিতর থেকে। উঁকি মারতেই আসে গুরুবাণী শোনার ও পরে লঙ্গর সেবার নিমন্ত্রণ।
কিষাণ সংযুক্ত মোর্চার বিভিন্ন দল, উপদল, কিষাণ একতা উগ্রাহান, ক্রান্তিকারী কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ কমিটি খাপ পঞ্চায়েত গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি আরও কত নাম জানা না জানা সংগঠন এতগুলি ভিন্ন মত ও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ এই বিলের বিরুদ্ধে কিভাবে এককাট্টা হয়েছেন তা অবিশ্বাস্য লাগে। হিন্দু, শিখ, মুসলিম পরিচয় ভুলে এই অসাধারণ একতার সন্ধান পেতে ইচ্ছা করে।
পাঞ্জাবের মানুষের অসাধারণ সেবা, শৌর্য সংঘবদ্ধতা, দৃঢ়তা ও সহনশীলতার ইতিহাসই হয়ত এই দীর্ঘদিনব্যাপী আন্দোলনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই তারা যখন বলেন ‘ইয়ে লম্বা চলেগা’ — ভরসা হয় — বিশ্বাস জাগে।
গাজীপুর বর্ডার
দিল্লীর উত্তর পূর্ব প্রান্তে দিল্লী – উত্তরপ্রদেশের বর্ডার গাজীপুর। এখানে রয়েছে ১২ লেনের ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারের একদিকে দুটি লেন নিয়ে প্রায় তিন কিমি লম্বা কৃষক অবস্থান। ২৭ জানুয়ারির সকালে প্রায় ৮টি লেন দিয়েই চলছিল স্বাভাবিক দুমুখী গাড়ি চলাচল। পুলিশি তৎপরতা অন্য বর্ডারগুলির তুলনায় একটু বেশিই চোখে পড়েছিল। হয়ত বা ২৬ জানুয়ারির লালকেল্লার ঘটনার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন হিসাবে।
গাজীপুরের সংযুক্ত কৃষক মোর্চার মঞ্চ দিল্লিমুখী। মঞ্চের প্যান্ডেলে রয়েছে ভগত সিং, নেতাজী, মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের ছবি। উপরে তাকালে চোখে পড়ে হাইওয়ের উঁচু থাম্বায় পথনির্দেশের বোর্ডগুলিতে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কৃষকেরা। ‘‘Corporate ভাগাও দেশ বাঁচাও’’, ‘‘কিষাণ দেশ কি শান হ্যয়, ফির ঠান্ডমে সড়কোপর কিউ পরেশন হ্যায়’’
মঞ্চে আসছিলেন বিভিন্ন কৃষক ইউনিয়নের বক্তারা — হান্নান মোল্লা, রাকেশ টিকায়েত, আরও অনেক ছোট বড় নেতারা। তাঁরা কৃষক আইনগুলি সম্পর্কে বলছিলেন — উজ্জীবিত করছিলেন মানুষকে – প্রস্তুতি নিতে বলছিলেন এক লম্বা লড়াইয়ের।
দর্শকাসন ছিল ভর্তি। প্রথম দিকে মহিলা ও তারপর পুরুষেরা। পাঞ্জাবী লাল, নীল, হলুদ সবুজ পাগড়ির সাথেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশীর সাদা বা সবুজ গান্ধী টুপির সমাহার। সালোয়ার – কামিজ পরিহিতা সর্দারনীদের সাথে দেখা গেল উত্তরপ্রদেশীয় রীতিতে শাড়ী পড়া ঘোমটা দেওয়া জাঠনীদেরও। মুসলিম মহিলা ও পুরুষের সংখ্যাও ছিল ভাল। এখানেও বহু মানুষ এসেছেন তাঁদের ট্রাক্টর, ট্রলি ও তাঁবু নিয়ে, রাস্তার দুধারে অস্থায়ী বাসস্থান বানিয়েছেন তাঁরা। লঙ্গর চলছে, মুসলিম লঙ্গরখানাও চোখে পড়ল — ঐদিন চাউমিনও জুটে গেল লঙ্গরখানায়। মেডিকেল ক্যাম্প, টয়লেটের ব্যবস্থাও রয়েছে সিংঘু বা টিকরির মতো। মহিলাদের জন্য আলাদা তাঁবু, তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তাঁবুও চোখে পড়ল।
শোনা গেল ২৬ জানুয়ারির রাতে সেনা টহল ছিল খুব জোরদার। এমনকী জল, বিদ্যুৎ সংযোগও কেটে দেওয়া হয়েছিল। বিক্ষোভরত মানুষ সারারাত আগুন জ্বালিয়ে পাহারা দিয়েছেন জমায়েত স্থল। তারই ইতি-উতি আগুন চোখে পড়ল তাঁবু ও ট্রলির সামনে।
আলাপ হল SUCI (AIKKMS) এক সদস্যর সাথে। তিনি এসেছেন মীরাট থেকে। তিনি দিল্লিতে কোরিয়ান ভাষা শেখেন। কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। যাতায়াত করছেন জমায়েতে প্রয়োজন মতো। এই শীত – বর্ষা অগ্রাহ্য করে এখানে থাকার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন— কৃষক প্রকৃতির সাথে লড়েই ফসল ফলায়— তাঁকে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি দুইই সয়ে নিতে হয় — অতএব প্রকৃতির সাথে লড়াই করা কৃষকের কাছে দিল্লির শীত বা গ্রীষ্ম, কোনোটাই প্রখর নয় — মাটিরক্ষার লড়াইয়ে। তাই তাঁরও একই বলিষ্ঠ জবাব — ‘ইয়ে লম্বা চলে গা’ — যতদিন না তিন কালা কানুন ওয়াপস হবে।
দিনের শেষের শেষ সাক্ষাৎটি হল জীবনের শেষ সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া, কিন্তু মননে ও দৃঢ়তায় বলিষ্ঠ এক ৯৩ বছরের বৃদ্ধের (নাকি যুবক বলব?) সাথে। পরে জানা যায় ইনি কৃষক আন্দোলনের বয়স্কতম ব্যক্তি। ছেলে, নাতি, পুতি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মেরঠ থেকে। আছেন জমায়েতে প্রায় একমাস ধরে। বিশালাকৃতি হুঁকার নলটি হাতে নিয়ে কথা বললেন আমাদের সাথে। অভিজ্ঞতা ও বয়সের ভারে ন্যূব্জ নয় বলিষ্ঠ, দৃঢ়, ভঙ্গিতে দৃপ্ত স্বরে জানান — আমি এখানে আছি, যতদিন না তিন কালা কানুন ‘ওয়াপস’ হয়।
২৬ জানুয়ারির লালকেল্লার ঘটনার পরে গাজীপুর যদিও কিছুটা থমমত, একটু চুপচাপ, চোখে পড়ে কিছু মানুষের ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতিও। আগের দিনের কড়া পুলিশি পাহারা, প্রশাসনের জল-বিদ্যুৎ বন্ধ করা, সব অগ্রাহ্য করে তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান করেছেন, করছেন ও করবেন। দুপুরের রোদে ধোঁয়া উঠছে তখনও, তাঁদের অস্থায়ী আস্তানার সামনে রাতের আগুনের। কাছেই বাড়ছে পুলিশি তৎপরতা, আরও paramilitary force এর route march। তবু পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের ফিরে যাবার কথা ভাবেন না। তাঁদের একটাই মন্ত্র — তিন কালা কানুন ওয়াপস — হাম ঘর ওয়াপস’।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদ এবং রাজ্যসভায় তিনটি কৃষি বিল পাশ করে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার কোনোভাবেই কোনো বিরোধী পক্ষ বা কোনো কৃষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার বোধ করেনি। প্রস্তাবিত বিলটি জনসমক্ষে আসার পর গত আগস্ট মাস থেকেই পঞ্জাবের কৃষকরা নানাভাবে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। একাধিক সংগঠন তথা বিরোধী দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই বিল খানিকটা অগণতান্ত্রিকভাবেই সেপ্টেম্বর মাসে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কৃষকদের প্রতিবাদ চলতেই থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পিছু না হঠাতে কৃষকরা ২৫ নভেম্বর থেকে দিল্লি চলো অভিযান শুরু করেন। মূলত হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের একাধিক কৃষক সংগঠন এই অভিযানে শামিল হতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁদের দিল্লির সীমানাতেই আটকে দেওয়া হয়। আটকে দেওয়া এরকমই তিনটি সীমানা হল সিংঘু, টিকরি এবং গাজীপুর। এগুলোর মধ্যে সিংঘুতেই সর্বাধিক কৃষক সমাবেশ ঘটতে থাকে।
সুদূর কলকাতায় বসে টিভি আর ইউটিউবই ছিল ভরসা এই চলতি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে কিছু জানার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হাতে গোনা কয়েকটি মিডিয়া ছাড়া বাকি সব মিডিয়া শাসকদলের কাছে বিকিয়ে যাওয়ায় আমরা সাধারণ মানুষরা খুব বেশি তথ্য পাচ্ছিলাম না। তাই জানুয়ারি মাসে যখন দিল্লি যাওয়ার সুযোগ এল, তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম একবার সিংঘু বর্ডারে যেতেই হবে।
২৫ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছলাম। আর ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা ‘ট্র্যাক্টর মিছিল’ আয়োজন করলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন দিল্লির বাইরে যেসব গ্রামে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে সেসব গ্রাম থেকে ট্র্যাক্টরে চেপে তাঁরা দিল্লি অভিমুখে আসবেন। উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করে যে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া পথেই কৃষকরা মিছিল করতে পারবেন। এবং সে পথ মূলত দিল্লি বর্ডারের আশেপাশেই।
দিল্লিতে আমি যেখানে থাকছিলাম সেখান থেকে গাজীপুর সীমানা কাছে হওয়ায় ওইদিন সকালে গাজীপুর সীমানার দিকে যাওয়াই ঠিক করি। দুপুর বারোটা নাগাদ মিছিল শুরু হওয়ার কথা। দূর থেকে যখন মিছিলকে এগিয়ে আসতে দেখলাম এক অদ্ভুত শিহরণ বোধ করলাম। কয়েকশো ট্র্যাক্টর পর পর আসছে গান বাজিয়ে। আবালবৃদ্ধবনিতা সবরকম সওয়ারিকেই দেখা গেল। হরিয়ানা থেকে আগত এক কৃষকও আমাদের সাথে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জানালেন সিংঘুর তুলনায় গাজীপুরের সমাগম নাকি খুবই কম। তবে সিংঘু যেহেতু খানিকটা দূরে ভাবলাম টিকরি বর্ডার যাই। কিন্তু মেট্রো স্টেশনে ঢুকে জানতে পারলাম দিল্লি মেট্রোর একাধিক মূল স্টেশন নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। এবং ফোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম কিছু কৃষক তাঁদের ট্র্যাক্টর নিয়ে দিল্লি পুলিশের নির্দিষ্ট পথের সীমা লঙ্ঘন করে লালকেল্লা, আইটিও ইত্যাদি চত্বরে ঢুকে পড়েন এবং তাণ্ডব শুরু করেন (ওঁদের সঙ্গে কদিন থাকার পর এই ঘটনার পূর্ণ সত্যতা সম্পর্কে আমি অবশ্য সন্দিহান)। অগত্যা আমি আমার দিল্লির আস্তানাতেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জনগণ আয়োজন করে সিটিজেনস মার্চ – ইন সলিডারিটি উইথ ফার্মার্স মুভমেন্ট। আমার যাদবপুর কফি হাউসের বন্ধুর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে এ সংক্রান্ত একটা মেসেজ পাই। তাতেই এই মিছিল সম্পর্কে আমি জানতে পারি। মান্ডি হাউস থেকে যন্তরমন্তর পর্যন্ত এই মিছিল হাঁটবে। এটি কেবলমাত্র একটি জনগণের মিছিল, সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক। আবার যদি মেট্রো স্টেশন বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে আমি বেলা ১২টার (মিছিল শুরু হওয়ার নির্দিষ্ট সময়) বেশ আগেই মান্ডি হাউসে পৌঁছে যাই। কিন্তু পৌঁছে হতবাক। দিল্লির এই মান্ডি হাউস চত্বর অনেকটা আমাদের কলকাতার নন্দন চত্বরের মত। আমার দীর্ঘ দিল্লিবাসী জীবনের অনেক সুখস্মৃতি আছে এই মান্ডি হাউস অঞ্চলকে জড়িয়ে। নানা ভবনে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। কিন্তু এই মান্ডি হাউস অঞ্চল একদম অচেনা। চারিদিকে দিল্লি পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। একাধিক ডিটিডিসি বাস দাঁড়িয়ে আছে। এবং প্রতিটি বাস ভর্তি পুলিশ – মহিলা এবং পুরুষ দুইই। এছাড়াও দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জলকামানের গাড়ি। বেলা বারোটা বাজার খানিক আগে থেকে সব বাস থেকে পুলিশকর্মীরা বর্ম পরে নেমে আসতে শুরু করলেন এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারলাম নেপালের দূতাবাসের সামনে যেখানে আমরা জমায়েত হয়েছি সেখান থেকে যন্তরমন্তর যাওয়ার পথ লোহার ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হল। ১০-১৫ মিটার অংশ একদিকে ব্যারিকেড দিয়ে আর অপরদিকে জলকামান আর বিশাল পুলিশ বাহিনী। অবাক লাগল দেখে যে যত না মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন এই মিছিল উপলক্ষে, তার থেকেও বেশি সংখ্যায় পুলিশ উপস্থিত। ক্রমাগত মাইক নিয়ে তাঁরা ঘোষণা করে গেলেন যে করোনা মহামারির জন্যে দিল্লিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে আর সেই কারণে এরকম জমায়েত বে-আইনি। জনগণের উদ্দেশে তাঁরা বলছিলেন যেন সকলেই শীঘ্র ঐ জায়গা খালি করে বাড়ি চলে যান, নইলে তাঁরা জনতার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন। তবে খুব অপ্রিয় কোনো ঘটনা ঘটেনি সেদিন। বেলা তিনটের পর থেকে ভিড় কমতে থাকে। আমিও একসময় বাড়ির দিকে রওনা দিই।
১৩ ফেব্রুয়ারি অবশেষে সুযোগ এল সিংঘু যাওয়ার। গুগুলের সাহায্যে কিছু তথ্য হাতে এল। প্রথমে যেতে হবে জাহাঙ্গীরপুর মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে ১৪৪ নম্বর বাস ধরে যেতে হবে সিংঘু বর্ডার। সিংঘু আসলে দিল্লির উত্তর সীমানা বরাবর হরিয়ানার একটা গ্রাম। আমাদের পরিচিতদের কেউই সিংঘু যাননি বলে এর বেশি তথ্য যোগাড় করতে পারলাম না। উত্তর দিল্লির ঘিঞ্জি অঞ্চল ছাড়িয়ে বাস একসময় এক নম্বর জাতীয় সড়ক বরাবর চলতে শুরু করল। বাসটির শেষ গন্তব্যস্থল সিংঘু স্কুল। প্রায় ৫০ মিনিট পরে হাইওয়ের ওপর বাস থেমে গেল। জানা গেল এখানেই নেমে যেতে হবে। এখান থেকেই বাস আবার দিল্লির দিকে যাত্রা করবে। এর বেশি বাস আর যাবে না কারণ সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। অতএব সব যাত্রী বাস থেকে নেমে অন্ধকার হাইওয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা বেজে গেছে। দেখলাম একাধিক বৃদ্ধা/বৃদ্ধ এবং কোলের শিশু নিয়ে মহিলাও হাঁটছেন। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পর পৌঁছোলাম সিংঘু গ্রামে। কিন্তু সামনেই কংক্রিটের ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছে এবং অসংখ্য পুলিশ টহল দিচ্ছেন। রাস্তার ধার বরাবর প্রায় ৩ ফুট চওড়া একটি উন্মুক্ত নালা। তার একজায়গায় খানিক অংশে ব্যারিকেড, যার ওপর দিয়ে স্থানীয় মানুষের যাতায়াত করার রাস্তা ছিল, যে রাস্তাটা যায় কুণ্ডলী বলে হরিয়ানার আর একটা গ্রামে। কিন্তু সে রাস্তাটাও কংক্রিটের ব্যারিকেড দিয়ে আটকানো, তাই অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ ঐ তিন ফুট খোলা নালা টপকে যাতায়াত করছেন। পেরিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটি টোটো রিক্সা এবং অটোরিক্সা দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুএকজন ঠেলাগাড়িতে করে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু কিভাবে কৃষকরা যেখানে আন্দোলন করছেন সেই সিংঘুতে যাব কেউই আমাদের বলতে পারল না। ‘যেতে চাই’ বললে একটাই প্রশ্ন ‘কোন্ গ্রামে যেতে চাও?’ অগত্যা পুলিশেরই শরণাপন্ন হতে হল। তারা জানাল যে হাইওয়ের ওধারেই সিংঘু গ্রাম। কিন্তু ব্যারিকেড টপকে কাউকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি তাদের কাছে নেই। আর এই রাতে ঘুরপথে যাওয়া নিরাপদ নয়। তাই আমার দিল্লি ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। কিন্তু আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম যে আজ সিংঘুতে পৌঁছোতেই হবে। তার দুটো কারণ। প্রথমত আবার ঐ অন্ধকারে হাইওয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে ফিরে যাওয়া নিরাপদ হবে না। দ্বিতীয়ত দিল্লি ফেরার শেষ বাসের সময় জেনে এসেছিলাম রাত সাড়ে আটটা, আর তখন বাজে নটা। কৃষকরা যেখানে আন্দোলন করছেন সেখানে পৌঁছে যাওয়াই হল আমার জন্য সবথেকে নিরাপদ। এই সময় একটি টোটোচালক বলল যে সে আমাকে আন্দোলনের জায়গায় পৌঁছে দেবে। একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিন্ত হয়ে তার টোটোতে চেপে বসলাম। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেই রাস্তার দুদিক বরাবর লোকালয়, নানাবিধ জিনিসের দোকান, সব্জির হাট ইত্যাদি এবং অগণিত লোক পায়ে হেঁটে যাতায়াত করছেন। বুঝলাম দিল্লি পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল যাতে আমি সিংঘু না যাই। টোটোর অন্তিম গন্তব্যের নাম কুণ্ডলী বর্ডার। টোটোচালক জানাল সামনে কয়েক মিটার এগিয়ে গেলেই আমি কৃষকদের আন্দোলনের জায়গায় পৌঁছে যাব। সত্যিই তাই। একটু এগোতেই চোখে পড়ল কয়েকজন সর্দারজি এবং কিছু তাঁবু। বাস থেকে নামার পর একটা চাপা ভয় মনের মধ্যে কাজ করছিল, যতই হোক জায়গাটা দিল্লি ও হরিয়ানার সীমান্ত, কিন্তু এখন নিশ্চিন্ত, আর কোনো ভয় নেই। এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। উত্তর দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক কারখানা আছে। এখানকার লোকজন মূলত সেইসব কারখানাতেই ঠিকাকর্মীর কাজ করে।
সামনে যে সর্দারজিদের দেখতে পেলাম তাঁদের জানালাম আমি কলকাতা থেকে এসেছি এবং তাঁরা যদি দয়া করে আমাকে ‘কিষাণ মঞ্চ’, যে মঞ্চে অনুষ্ঠিত হওয়া নানা অনুষ্ঠানের ঝলক আমরা ইউটিউবের নানা চ্যানেলে দেখতে পাই, সেখানে নিয়ে যান। ওঁরা পরম আনন্দে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনে কুছ নাস্তা কিয়া?’ কিন্তু আমি আগে সেই মঞ্চ দেখতে ইচ্ছুক জানালে তাঁদের মধ্যে যিনি সবথেকে বৃদ্ধ সর্দারজি, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন।
কৃষকদের অবস্থান বা ‘মহল্লা’তে ঢোকার মুখে কয়েকজন সর্দারজি দাঁড়িয়েছিলেন। পরে জানতে পারি বাইরের থেকে যারা ওখানে ঢুকছে তাদের ওপর তাঁরা নজর রাখেন। বৃদ্ধ সর্দারজি জানালেন, তাঁর ৬৫ বছর বয়স, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি, গত ৭ দিন ধরে সিংঘুতে আছেন। আমরা যখন মঞ্চের কাছে পৌঁছোলাম তখন সেখানে বিশেষ লোকজন ছিল না। মঞ্চের সামনের দর্শকাসনে কয়েকজন কম্বল বিছিয়ে শোবার জোগাড় করছেন। ওখানেই কয়েকজন পাহারারত ছিলেন, আমি বাংলা থেকে এসেছি শুনে অভ্যর্থনা জানালেন। ওদের মধ্যে একজন জানালেন তাঁর নাম রণজিৎ সিং, ডাক নাম গোল্ডি, সেই নামেই তিনি বেশি পরিচিত। তিনি শিখ সেবা ফোর্স (শিসেফো) নামক একটি সংস্থার সদস্য। গোল্ডি আমাকে প্রথমেই খাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একটি তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি লোক বসে খাওয়াদাওয়া করছিল। রুটি ডাল সহযোগে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। পাশেই তখন চলছে পরের দিন সকালের খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা ঠিক করলেন আমি শিসেফোর তাঁবুতেই থাকব। আমি সাথে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ল না। তাঁবুতে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেপ কম্বল ও তোশক মজুত আছে। আমার জন্যে একটা ছোট তাঁবু ওঁরা ছেড়ে দিলেন। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু কিছুদিন বাদেই ভোট তাই ওখানে অনেকের নানা প্রশ্ন বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে। আলাপ হল ফরিদার সঙ্গে। ফরিদা এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। প্যারামেডিক্যালের সার্টিফিকেট আছে তার। সিংঘুতেই একটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে সে রোজ রুগীদের দেখাশোনা করে। এই বাবদ প্রতি মাসে তাকে ২৪,০০০ টাকা দেওয়া হয়। আড্ডার মাঝে মাঝে ফ্লাস্ক থেকে গরম বাদামমিশ্রিত দুধ পরিবেশন করা হল বেশ কয়েকবার। শিসেফোর এবং অন্যান্য তাঁবুগুলো জাতীয় সড়ক ২ (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) বরাবর লাগানো আছে। আর এই হাইওয়ের ধারে অসংখ্য মোটরগাড়ি সারানোর কারখানা। এরা প্রত্যেকেই তাদের কলঘর শৌচাগারগুলি কৃষকদের ব্যবহারার্থে খুলে দিয়েছে। এরকমই একটি মোটরগাড়ি সারানোর কারখানার সংলগ্ন জায়গায় শিসেফোর তাঁবুগুলো ছিল, তাই স্নান করা বা শৌচাগার সংক্রান্ত কোনো অসুবিধা ভোগ করতেও হল না আমাকে। রাত্রি দশটার মধ্যে সমস্ত মেয়েদের যার যার তাঁবুতে ঢুকে যেতে হয়। আর সারারাত কয়েকজন পাহারা দেন। প্রতিমুহূর্তে তাঁরা সজাগ থাকেন, যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটিয়ে না বসেন, কারণ শাসক সদা-তৎপর এই আন্দোলনের কোনো দোষত্রুটি ধরতে। সারারাত মাঝে মাঝেই লাঠি ঠোকার আওয়াজ কানে এল, বুঝলাম সদাজাগ্রত প্রহরীরা দায়িত্বে আছেন। ঐতিহাসিক জিটি রোডের ওপরে রাত্রিবাস করছি ভেবে বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল পাশের তাঁবুগুলোর বাসিন্দাদের কথাবার্তার আওয়াজে। চারিদিকে ঘোর কুয়াশা। তাঁবুর বাইরে এসে দেখলাম রাস্তার ধার বরাবর ১০-১২ মিটার দূরত্বে রাখা আছে চা/কফির ডিস্পেন্সার, সঙ্গে ট্রে ভর্তি বিস্কুট।
সিংঘুতে শিখদের নানা সংস্থা তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছে – শিখ সেবা ফোর্স, ইউনাইটেড শিখ অর্গানাইজেশন, খালসা অর্গানাইজেশন এবং আরো অনেক সংস্থা। প্রত্যেক সংঘের নিজস্ব লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে। ঐ কুয়াশার মধ্যেই দেখলাম গোল্ডি এবং তার সহকর্মীরা শিসেফোর অফিসিয়াল ক্যাম্পের সামনে টেবিল চেয়ার সাজিয়ে রাখছেন। টেবিলের ওপরে দৈনন্দিন দরকারি সামগ্রী রাখা হয় – গায়ে মাখা ছোট সাবান, শ্যাম্পু, মাথার তেল, টুথপেস্ট, ব্রাশ, মাস্ক, ছোট স্যানিটাইজার, কাপড় কাচার সাবানগুঁড়ো, ছোট তোয়ালে। কৃষকরা বা অন্য কেউ যে থাকবেন তাঁর সারাদিনে কী কী দরকার হতে পারে সেসব ভেবেই এইসব সামগ্রী মজুত থাকে। এমনকি পুরুষদের গেঞ্জি জাঙিয়াও রাখা আছে, কেউ চাইতে এলে দেওয়া হয়। টেবিলের এক কোণায় দেখলাম একটি নেল কাটার দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা আছে। একজন বৃদ্ধ সর্দারজি নখ কাটতে এসে জানালেন একটু বড় মাপের নেল কাটারের দরকার, বুড়ো আঙুলের নখ কাটতে সুবিধা হয়। এবং এই ব্যবস্থা শুধু শিসেফো ক্যাম্পে নয়, অন্যান্য সংস্থার ক্যাম্পে এবং কিছু কিছু ব্যক্তিগত ক্যাম্পেও চোখে পড়ল। সকালবেলা স্থানীয় লোকরা কাজে যাওয়ার সময় কোনো না কোনো ক্যাম্পের সামনে থামছেন, চা বিস্কুট খেয়ে তাঁরা আবার রওনা দিচ্ছেন নিজেদের গন্তব্যের দিকে। যাঁরা খাচ্ছেন এবং যাঁরা খাওয়াচ্ছেন তাঁদের কাছে যেন এটাই নিয়ম। আন্দোলনের শুরু থেকে এরকমটাই হয়ে চলেছে। স্থানীয় মহিলা পুরুষ কাজে যাওয়ার সময় কোনো লঙ্গরে প্রাতঃরাশ করবেন আর কাজ থেকে ফেরার পথে আবার কোথাও রাতের খাওয়া খেয়ে বাড়ি ঢুকবেন।
আমাকে গোল্ডি এরকমই এক লঙ্গরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আলু পরোটা খাওয়ানো হয়। একেক লঙ্গরে এক এক রকম খাবার। কোথাও খিচুড়ি, কোথাও পোহা, কোথাও আলু টিক্কি, কোথাও পুরি সব্জি। এক জায়গায় দেখলাম স্যান্ডুইচও খাওয়াচ্ছে। সব জায়গাতেই অগণিত লোক খাচ্ছেন। এ দৃশ্য তো দেখার মতই, কিন্তু তার থেকেও বেশি দেখার মত জায়গা হল যেখানে খাবার বানানো হয়। সারাদিন ধরে এই লঙ্গর চলে আর তার জন্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে চলেন অগণিত নারীপুরুষ। এক জায়গায় দল বেঁধে কয়েকজন আটা মাখছেন, আরেক এক জায়গায় দল বেঁধে রুটি বানাচ্ছেন, আবার কয়েকজন রান্নার বাসন ধুয়ে চলেছেন। হরিয়ানা সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু এই সমগ্র অঞ্চলে পুরসভার কোনো পরিষেবা দেওয়া হয় না, তাই প্রতিদিন সকালে বাইরে থেকে জল এবং দুধের গাড়ি আসে। বড় বড় জেনারেটর সারাদিন চলতে থাকে যাতে সব তাঁবুর ভেতরে বিদ্যুৎসংযোগ থাকে। আর কৃষকদের মধ্যে থেকেই কয়েকজন নিয়ম করে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে থাকেন। খালসা অর্গানাইজেশন আর্থিকভাবে বেশি শক্তিশালী, তাই খালসার পক্ষ থেকে বড় বড় আর.ও. ফিল্টার রাখা হয়েছে, যদিও পানীয় জলের সরবরাহ শুধুমাত্র এই আর.ও. ফিল্টারগুলিই নয়। প্রত্যেক ক্যাম্প মিনারাল ওয়াটারের বোতল মজুত রেখেছে। গোল্ডির সঙ্গে এরপর বেরোলাম গোটা ব্যাপারটাকে চাক্ষুষ করতে।
ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল যেন একেকটা মহল্লায় ঘুরছি। কারণ তাঁবুগুলো সেভাবেই বানানো হয়েছে। একেক গ্রামের কৃষকরা (বা অন্য পেশায় নিযুক্ত গ্রামবাসীরা) একই মহল্লায় থাকেন, তবে নারী পুরুষ আলাদা আলাদাভাবে। কিন্তু কিছু কিছু পরিবার নিজেদের ব্যবস্থায় এসেছেন প্রতিবাদ জানাতে। তাঁরা কোনো সংস্থার তাঁবুতে না থেকে নিজেরা ট্র্যাক্ট্ররের ওপরেই বা রাস্তার ধারের কোনো জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে নিজেদের মত রান্নাবান্না করে থাকছেন। এরকমই এক পরিবারের সাথে দুপুরের খাওয়া সারলাম। গোল্ডি জানালেন যে এরকম পরিবারদের মাঝে মাঝে অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয় কারণ নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহে ঘাটতি হয়। অবশ্য একাধিক সংস্থা তখন তাঁদের সাহায্য করে।
প্রায় সব ট্র্যাক্টর বা তাঁবুর ভেতরেই টিভি আছে। গোল্ডি জানালেন যে অনেক তাঁবুতেই এসি বা কুলার লাগানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রাতের দিকে ঠাণ্ডা থাকলেও সকালে রোদের তেজ তীব্র এবং বেশ গরম। তাই কয়েক জায়গায় শরবৎ পরিবেশন করা হচ্ছে। আমরাও এক জায়গায় লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাদাম এবং খসখসের (পোস্ত) শরবৎ খেলাম, এর আগে কখনো খাইনি। গরমে নাকি পঞ্জাব-হরিয়ানা অঞ্চলের বাসিন্দারা এই শরবৎ খান, কারণ এই শরবৎ শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে।
একাধিক লঙ্গরখানা ও রান্নার জায়গা ঘুরে দেখা হল। প্রতিটি রান্নার জায়গাই দেখার মত। বিশালাকায় কড়াইতে রান্না হচ্ছে, ২/৩ মিটার চওড়া ব্যাসের চাটু/তাওয়ার চারদিকে ১২-১৫ জন মহিলা গোল হয়ে বসে রুটি বানাচ্ছেন কিংবা আটা মাখছেন। শেকল বাঁধা অবস্থায় পর পর রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার রাখা আছে। প্রতিটি লঙ্গরেই এই মুহূর্তে যা রসদ আছে তাতে আরো এক বছর চলে যাবে। গোল্ডি জানালেন, শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর নানাদিক থেকে অবিরাম রসদ আসতেই থাকে। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পঞ্জাবীরাও নানাভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, তাই এই আন্দোলনকে এখন শুধুমাত্র কৃষকদের আন্দোলন বলাটা খুব ভুল হবে। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। আন্দোলনস্থলে উপস্থিত কারোর মুখে কোনো বিষণ্ণতার ছাপ নেই। কাউকে দেখে মনে হল না যে নিজের ঘরবাড়ির আরাম ছেড়ে এই যে তাঁরা তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছেন তা নিয়ে তাদের কোনো অনুযোগ আছে। মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট দল গোল খঞ্জনি বাজিয়ে মিছিল করে চলেছে। যুবকরা কোনো একটা ট্র্যাক্টরে বড় বড় মিউজিকাল বক্সে গান বাজিয়ে এদিক ওদিক ধীরগতিতে ঘুরছে।
সিংঘু আন্দোলন কমিটির নিয়ম অনুযায়ী পঞ্জাব ও হরিয়ানার প্রতিটি গ্রাম থেকে কৃষক বা গ্রামবাসীদের আসতে হবে। আন্দোলন কমিটির গাড়ি গিয়ে গ্রাম থেকে ১০/১২ জনকে নিয়ে আসে। অন্তত ৭-১০ দিন থাকার পর আবার গাড়ি গিয়ে তাদের গ্রামে ফেরত দিয়ে আসে। কিন্তু সেই সময় ঐ ১০-১২ জনকে ফেরত পাঠানোর আগে ঐ গ্রাম থেকে অন্য ১০/১২ জনকে আসতে হবে। এর ফলে গ্রামের প্রতিটি মানুষেরই একটা দায়বদ্ধতা থাকে এবং শুধুমাত্র কয়েকজনের ওপরেই চাপ পড়ে না। যেহেতু এই সময় খেতে চাষবাসের কাজও থাকে তাই এই নিয়মে চাষের কাজেরও কোনো ক্ষতি হয় না।
আন্দোলনস্থলে যদি কোনো ব্যক্তির শরীর খারাপ করে বা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তার শুশ্রুষা এবং তার পরিবারের সব দায়িত্ব ঐ ব্যক্তি যে গ্রামের বাসিন্দা সেই গ্রামের সকলে ভাগ করে নেবেন।
আমি খুবই ভাগ্যবান যে সিংঘুতে পৌঁছে আমার গোল্ডির সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। গোল্ডি সিংঘু আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ। সমস্ত মিডিয়া, যারা কৃষক আন্দোলনের খবর নিয়মিত সৎভাবে প্রচার করে, গোল্ডির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ওঁর সাথে আলাপ না হলে আমি আন্দোলনের এত খুঁটিনাটি জানতে পারতাম না বা স্বচক্ষে দেখতে পেতাম না। ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে একটা তাঁবুর সামনে তিনজন বাঙালি ভদ্রলোককে দেখে আলাপ করলাম। তাঁরা এসেছেন ত্রিপুরা যুক্তিবাদী বিকাশ মঞ্চ থেকে। আমি সুদূর কলকাতা থেকে আসা একজন মহিলা শুনে তাঁরা আমার একটি সাক্ষাৎকার নিলেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল যখন গোদি মিডিয়ার কল্যাণে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য প্রচারিত হচ্ছে, তখন একজন মহিলা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া।
সিংঘুতে আন্দোলনস্থলে একাধিক লাইব্রেরি আছে। অন্তত তিনটে লাইব্রেরিতে গোল্ডি আমাকে নিয়ে গেলেন। ঢোকার মুখে রেজিস্টার আছে, সেখানে নিজের নাম লিখে বই নিয়ে ওখানেই বসে পড়া যায়। সবথেকে বড় যে লাইব্রেরি সেটি একটি মঞ্চও বটে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় বৈঠক বসে। আন্দোলনের মুখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসেন। আন্দোলনকারীদের নানা সংশয়, মতামত ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনার ফলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই এই আন্দোলনের সাথে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বলে ভাবতে পারেন। এই তাঁবুর মধ্যে অসংখ্য হাতে আঁকা ছবি ও পোস্টার চোখে পড়ল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা বা জায়গা থেকে যাঁরা এসে এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে গেছেন এইসব পোস্টার তাঁদেরই সমর্থনের দলিল। কৃষকরা সর্বদা চেষ্টা করে চলেছেন এই আন্দোলনকে সকলের আন্দোলন হিসেবে দেশের জনগণের কাছে তুলে ধরার। শুধুমাত্র কৃষক আন্দোলন হয়েই যেন না সীমিত থাকে এই আন্দোলন। তাই তাঁরা চান অন্যান্য রাজ্য থেকে এবং অন্য পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরাও যেন এই আন্দোলনে শামিল হন। মনে হয় সেই কারণেই এবং আমি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক বলে যেখানে অচিরেই ভোট, গোল্ডি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যদি মঞ্চে কিছু বলি। প্রথমে ইতস্তত করলেও আমি রাজি হয়ে যাই, সত্যিই তো, এটা তো আমার কর্তব্য পশ্চিমবঙ্গে বসে আমি এবং আমার অসংখ্য বন্ধু ও পরিচিতরা কৃষকদের সমর্থনে যা ভাবি সেটা ওঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এতদিন যে মঞ্চের কথা শুধু মিডিয়াতেই দেখেছি সেখানে উঠে কিছু বলতে পারার অভিজ্ঞতা এক কথায় অনন্য। এর আগে জীবনে কোনোদিন কোনো মঞ্চে কিছু বলার অভিজ্ঞতা আমার নেই, তাই খানিক ভয়ও করছিল। তবে এটাই বুঝলাম যে অন্তরে যা বিশ্বাস করি সেকথা অন্যের সামনে বলাটা মনে হয় খুব কঠিন নয়। সিংঘুতে দুটি খোলা মঞ্চ আছে। এবং দুটি মঞ্চের পরিচালন কমিটি মনে হয় আলাদা। অন্য মঞ্চটি অপর প্রান্তে, হাইওয়েতে যেখানে দিবারাত্র পুলিশ মোতায়েন আছে সেখানে। এই মঞ্চেই কিছুদিন আগে ইট পাটকেল ছোঁড়া হয়েছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে। গোল্ডি যখন আমাকে সেই মঞ্চ দেখাতে এবং সেখানকার বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে গেলেন, তখন সেখান থেকেও আমাকে অনুরোধ করা হল মঞ্চে কিছু বলার জন্যে। দুই মঞ্চেই দেখলাম পরিচালন কমিটি একটি রেজিস্টার রাখেন। সেখানে বক্তার নাম এবং অন্যান্য কিছু জরুরি তথ্য নথিবদ্ধ করা হয়। মঞ্চে বলার জন্যে যখন অপেক্ষা করছি, তখন দেখলাম একদল মহিলা (কয়েকজন বাচ্চা মেয়েও ছিল এইদলে) ছোট্ট মিছিল করে এগিয়ে আসছেন, তাঁদের মিছিলের ভাষায় বুঝলাম তাঁরা হরিয়ানার কোনো গ্রাম থেকে আসছেন। একটা লাইন স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘পঞ্জাব হরিয়ানা ভাই ভাই’। সেদিন রোববার ছিল বলে আশপাশের গ্রামের অনেকেই এসেছেন। একটি অল্পবয়সী মহিলার সঙ্গে আলাপ হল, সে তার মেয়ের সঙ্গে এসেছে। এই অঞ্চলের কাছেই তার বাড়ি। জানাল, যেদিন থেকে আন্দোলন চলছে, প্রতি রবিবার সে এখানে আসে। ২৬ জানুয়ারির পর কিছু কিছু মিডিয়াতে আমরা দেখেছিলাম যে স্থানীয় লোকরা বিদ্রোহ করছেন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি মেয়েটির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। সে জানাল, ঐদিন স্থানীয় লোকজন কেউ আন্দোলঙ্কারীদের লক্ষ করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে নি। আর সেটাই স্বাভাবিক, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের যে একটা সুস্থ সহাবস্থান আছে সেটা নিজের চোখেই দেখছিলাম।
সিংঘুতে একাধিক গণতাঁবু আছে। কিন্তু সবথেকে বড় তাঁবুগুলো খালসা ক্যাম্পের। খালসার পুরুষদের জন্যে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে ৭০০ বিছানা, এবং মহিলাদের জন্যে ২০০ বিছানা। প্রত্যেক বিছানার নির্দিষ্ট নম্বর আছে আর সেই নম্বর অনুযায়ী টোকেন দেওয়া হয়। তাঁবুতে প্রবেশ করার মুখে কয়েকজন স্বেচ্ছাকর্মী রেজিস্টারে নাম ও টোকেন নম্বর মিলিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেন।
খালসা এবং অন্যান্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক ওয়াশিং মেশিন স্থানে স্থানে বসানো আছে। সকলে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় কাচিয়ে আনছেন। পাশেই ইস্ত্রি করার বন্দোবস্তও আছে।
যে কৃষকরা এতদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, তাঁদের শরীর তো খারাপ হতেই পারে। তাই একটি আপৎকালীন হাসপাতাল আছে যেখানে ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা চালু আছে। নানা রাজ্য থেকে ডাক্তাররা এখানে আসেন স্বেচ্ছায় পরিষেবা দিতে। হাসপাতাল সংলগ্ন তাঁবুতে আছে ওষুধ বিলি করার ব্যবস্থা। বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়াও ডেন্টাল ক্যাম্প ও আই ক্যাম্পও আছে। মধ্যপ্রদেশের একটি মেডিক্যাল টিম এই মেডিক্যাল ক্যাম্প চালায়। এখানেই আলাপ হল পুষ্পার সাথে। সে এসেছে গুনা থেকে। তারাও পালা করে আসে।
সবথেকে মজার তাঁবু হল ‘জখমি জুতোকি হসপিটাল’। এখানে এক বৃদ্ধ সর্দারজি বসে থাকেন। তাঁর বয়স ৮০র ওপরে, প্রথমদিন থেকে এখানে আছেন। কর্মসূত্রে এক সময়ে তিনি ইউকে, কানাডাতে ছিলেন। কিন্তু এখন অম্লানবদনে জুতো মেরামতের কাজ করে চলেছেন। এই কাজ করতে বিন্দুমাত্র ঘৃণা বা অপমান বোধ করেন না, স্বেচ্ছায় তিনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন।
এখানেই দেখা হল এক অল্পবয়সী সর্দারজির সাথে। তাঁর সারা শরীর জুড়ে লোহার শেকল। সে জানাল, আজ আন্দোলনের ৭৮তম দিন। আন্দোলনের প্রথমদিন থেকে সে স্বেচ্ছায় নিজেকে শেকলে জড়িয়েছিল। সরকার এই নতুন নিয়ম প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই শেকল সে খুলবে না।
বেলা শেষে যখন শিসেফোর ক্যাম্প দপ্তরে বসে আছি দেখলাম একাধিক মহিলার দল ফিরে যাচ্ছেন। তাঁরা সব এসেছিলেন আশপাশের গ্রাম থেকে, পায়ে হেঁটে। একজন এসে গোল্ডির সাক্ষাৎকার চাইলেন। তাঁর সাথে একদল মহিলা—বৃদ্ধা থেকে বালিকা। পাশের কোনো এক গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন ঐ ভদ্রলোকের দায়িত্বে। তিনি জানালেন তিনি চান তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আজকের দিনের অভিজ্ঞতা ভিডিওবদ্ধ করতে। শিসেফোর কথা তাঁরা নানা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন ও শুনেছেন।
সারাদিন এরকম নানা মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে এটাই বুঝলাম এই আন্দোলনে শুধুমাত্র পঞ্জাব বা হরিয়ানার কৃষকরাই নন, কত অগণিত মানুষ শামিল হয়েছেন। তাই সরকারকে একদিন না একদিন কৃষকদের দাবি মানতেই হবে।
গোল্ডি বলছিলেন যে তাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন যাতে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকে। কিন্তু তাঁর মত বয়স্ক আন্দোলনকারীদের মনে একটাই ভয়, এভাবে সরকার আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করলে তরুণ আন্দোলনকারীরা কোনো অপ্রিয় কাণ্ড ঘটিয়ে না ফেলেন। তাই তাঁরা সারাক্ষণ কামনা করেন যে যত শীঘ্র সম্ভব সরকার যেন তাঁদের সাথে আলোচনায় বসে এবং তাঁদের দাবি মেনে নেয়। মনে মনে এই আশা নিয়ে আমিও এবারের মত বিদায় নিলাম। গোল্ডি ওরফে রণজিৎ সিংয়ের কাছে অশেষ ঋণী যে তাঁর জন্যেই এক ঐতিহাসিক আন্দোলনকে এত কাছ থেকে দেখতে পেলাম এবং খুব সামান্যভাবে হলেও এই আন্দোলনে শামিল হতে পারলাম।
২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় বহুল বিতর্কিত তিন কৃষি-বিল আইন হিসাবে গৃহীত হবার পর থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানার বিভিন্ন কৃষক সংগঠন একত্রিত হয়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন তা আমাদের, বিশেষ করে আমার, প্রথম দিকে তেমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু এই কৃষকরাই যখন বিপুল সংখ্যায় জড়ো হয়ে দিল্লির দরজায় কড়া নাড়তে গিয়ে বাধা পড়লেন হরিয়ানা-দিল্লির সীমান্তে, একটু নড়েচড়ে বসতেই হল। দিল্লি থেকে হরিয়ানার সোনেপতমুখী রাজপথের যে জায়গাটিতে কৃষকরা ২৬ নভেম্বর (২০২০) থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্ণায় বসে গেলেন তার নামের ধ্বনির সঙ্গে এক অদ্ভুত সাজুয্য আমাদের পশ্চিমবাংলার গত দশকের কৃষক আন্দোলনের আতুরঘরের। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া ঘরের কাছে হুগলি জেলার সিঙ্গুরের কৃষক-জনতার সোচ্চার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই রাজ্যে এবং কিছুটা হলেও কেন্দ্রীয় স্তরেও এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল। ‘সিঙ্ঘু’ নামটা সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। একসময়ে সিঙ্গুরে বেশ কিছু সময় ধরে আমাদের অনেকের যাতায়াত প্রায় নিয়মিতই হয়ে উঠেছিল, এখন ভিন রাজ্যের দেশ সিঙ্ঘুতে নিয়মিত নাহলেও একবার তো যেতেই হয়। ‘সিঙ্ঘু’ যে সমকালের কৃষক আন্দোলনের ‘মহাতীর্থ’।
সিঙ্ঘুতে কৃষকদের লাগাতার ধর্ণা আর সিঙ্গুরে কৃষকদের প্রতিবাদ - এই দুইয়ের মধ্যে অমিল হয়তো অনেক, কিন্তু মিলও কিছু কম নয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুনর্বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অব্যবহিত পরেই, তাঁর কথায় প্রায় ৩০ বছর ধরে অনুন্নয়নের খরায় হেজে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-উন্নয়নের শ্লোগান নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করলেন। শুরুতেই সিঙ্গুর। সিঙ্গুরের উর্বর কৃষি জমিতে টাটা কোম্পানির মোটর-গাড়ি কারখানা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক রথী-মহারথীরা কাগজ কলমে হিসাব কষে দেখালেন, টাটাদের কারখানা চালু হলে পশ্চিমবঙ্গের ‘জিডিপি’ তো তড়তড় করে পাল তুলে এগোবেই, সঙ্গে সিঙ্গুরের কৃষকরাও জমি হারাবার বিনিময়ে যা পাবেন তা প্রায় চাঁদ প্রাপ্তির সমান। কিন্তু মহা গেঁড়োয় পড়ে গেল সরকার, ‘অশিক্ষিত এঁড়ে’ কৃষকেরা তা বুঝতেই চায়না। উল্টে গড়ে তুললেন প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ঢেউ। কৃষকদের ‘ভাল’ চাওয়া সরকারের লাঠি, গ্যাসের সামনে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কুনাট্যের ফলে প্রতিরোধ হয়তো শেষ পর্যন্ত টিঁকিয়ে রাখা গেলনা, কিন্তু প্রতিবাদের আগুন জ্বলে রইল একই উত্তাপ নিয়ে। শুধু সে নিজেই জ্বললনা, তার আঁচে বহু বছর ধরে অন্যায় সয়ে যাওয়া বন্ধ মুখগুলি হঠাতই গেল খুলে। সরকারের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এই সময় থেকেই ব্যাপক জনমত গড়ে উঠতে লাগল। এই ঘটনাবলীর সবটাই আমাদের জানা এবং জানা বলেই সিঙ্ঘু সীমান্তে কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল দীর্ঘ অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে এক আলোর রেখা।
২০১৯’র নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সাফল্য আর তারপরেই তাদের যথেচ্চাচার আর কথায় কথায় কুৎসিত পেশি আস্ফালন, যার ফলশ্রুতি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং অন্য কিছু জায়গায় কৃষকদের প্রতিবাদ। এইসব ঘটনা কি সিঙ্গুরের সঙ্গে মিলকে ইঙ্গিত করছে না?
সিঙ্ঘু বা টিকরি বা গাজিপুরে কৃষকরা ১০০ দিন পার করেও অদমনীয় জেদ আর লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে কেন বসে রয়েছেন তা এখন সারা দুনিয়া জুড়ে প্রচারিত। কিন্ত আমাদের, ভারতীয়দের অতিরিক্ত পাওনা, এই আন্দোলনের মধ্যে সিঙ্গুরের ছায়া যেমন দেখতে পাচ্ছি তেমনি দেখতে পাচ্ছি দেশময় প্রতিরোধের এক বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর আন্দোলন যেমন সুদুর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, আশা জাগছে, এই দেশে যে জগদ্দল পাথরটা বুকের উপর চেপে বসে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে একটু একটু করে আমাদের শ্বাসরোধ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতেও সিঙ্ঘু-টিকরিতে ধর্ণায় বসা ‘মূর্খ’ কৃষকেরা তেমনি প্রভাব ফেলবেন। এই আশার মশাল যারা বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা সামলানো মুস্কিল। ইচ্ছা থাকলেও অনেকের পক্ষেই আলোর এই চ্ছটা গায়ে মেখে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে কয়েকজনের সেই সৌভাগ্য হয়েছে আমি তাদেরই একজন।
আন্দোলনরত কৃষকরা নিজেদের মতো করে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবেন বলে ২৬ জানুয়ারি (২০২১) দিল্লির পথে ট্র্যাক্টর অভিযান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রত্যেক বছর এই দিনটাতে দিল্লির রাজপথে সৈন্যবাহিনির দাপাদাপি এবং সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্যারেড দেখতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। কৃষকদের ট্যাক্টর মিছিলের ঘোষণা এতদিনের একঘেয়ে অভ্যাসের বিরুদ্ধে এমনই এক অপ্রত্যাশিত আঘাতে উত্তেজিত বোধ করতেই হল। দিল্লির রাজপথ প্রজাতন্ত্র-দিবসে অধিকার করবে সেই জীবিকার মানুষ, গোষ্ঠী হিসাবে দেশে যারা বৃহত্তম। এর থেকে অভিনব ঘটনা আর কি হতে পারে। অতএব সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতেই সিঙ্ঘু যাত্রার দিন নির্বাচন।
দিল্লি শহর থেকে সিঙ্ঘু সড়ক পথে প্রায় ৫০ কিমি। ২৬ জানুয়ারি (২০২১)’র যে ঘটনা নিয়ে শিয়াল বাহিনির হুক্কাহুয়া সেটা বুঝতে এই দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ। সে কথায় পরে আসা যাবে। প্রায় কোন যোগাযোগ ছাড়াই সিঙ্ঘুতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু থাকব কোথায়। তাতো ঠিক নেই। একটা সামান্য যোগাযোগ ছিল, কিন্তু বাজিয়ে দেখলাম সেখানে আমি থাকি এমন উৎসাহ তাঁরা দেখালেন না। ঠিক যেখান থেকে কৃষকদের ধর্ণার জায়গাটা শুরু সেইখানে রাস্তার ধারে বড় একটা জায়গা নিয়ে নবম গুরু শহিদ তেগবাহাদুরের নামে এক স্মৃতি সৌধ তৈরি হয়েছে। খোলা স্টেডিয়ামের মতো অনেকটা। এর নিচে বেশ বড় বড় ঘর রয়েছে দু তিনটা। সৌধের উদ্যানে একটা লঙ্গর। সেইখানে বসে আছি, একটু পরেই রাতের খাবার জুটবে। রাতের থাকার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবছি। আমার পাশে এসে বসলেন এক ভদ্রলোক। ধর্ণার প্রথম দিন থেকেই তিনি সিঙ্ঘুতে। পরিবারের জমি আছে তবে তিনি দিল্লিতে চাকরি করেন। লকডাউনে সেটা খুইয়েছেন। অতএব স্থায়ীভাবে এখানে থাকতে কোন অসুবিধা নেই। তাঁকে সমস্যার কথা বলতেই খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু দিলেন। এবং অবশেষে সমস্যার সমাধানও করে দিলেন। কিষান মজদুর সংঘর্ষ সমিতি (কিষান সংযুক্ত মোর্চা নয়) পরিচালিত তাঁবুগুলির স্টোরের দায়িত্বে থাকা সর্দারজি আমার থাকার দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করলেন। ইনি পেশায় ডাক্তার, কলকাতার গাঙ্গুলীবাগানের কোন এক নার্সিংহোমে কিছুদিন কাজের সুবাদে দুচার লাইন বাংলা বলতে পারেন। কলকাতা বা পশ্চিমবাংলা মানেই ওঁদের কাছে সুভাষ চন্দ্র বোস। তাঁর জন্যই আমার বিশেষ খাতির। সুভাস বোসের কারণেই সিঙ্ঘু বা টিকরিতে আমার বাঙ্গালী পরিচয় সবসময়ই আন্দোলনকারীদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ঐদিনটা ছিল আবার ২৩ জানুয়ারি। সিঙ্ঘুর বিভিন্ন স্থানে নেতাজী স্মরণ চলছে মহা সমারোহে। যাইহোক, থাকার ব্যবস্থা হল সেই তেগবাহাদুর নামাঙ্কিত সৌধের নিচের একটি ঘরে। শোবার জন্য মিলল মোটা গদি আর বেশ গরম একটা কম্বল। বড় ঘরটিতে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক রয়েছেন। তাবুতেই থাকার ইচ্ছা ছিল কিন্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যা পাওয়া গেল তাই নিয়েই সন্তুষ্ট হলাম। এইখানেই কাটল আমার সিঙ্ঘুতে থাকা অসামান্য রঙীন দিনগুলি।
পরের দিন রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোনেপতের দিকে এগোলাম। রাজপথ তো আর নেই। বোঝাও যায়না এটা কোন রাজপথ। সমস্ত পথ জুড়ে খালি তাঁবু, মানুষ আর ট্র্যাকটরের মেলা। রয়েছি ধর্ণার জায়গার একেবারে গোড়ার দিকে। এগোতেই প্রথমে চোখে পড়ল কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি পরিচালিত তাঁবু আর আস্তানায় পরিণত ট্র্যাক্টরের সারি। সেগুলি পার করে এলাম ওদেরই ব্যানার লাগানো এক মঞ্চের সামনে। সেটা পার করে দেখি প্রায় সমস্ত রাস্তা জুড়ে পুলিশের নিজস্ব ঘেরা বেশ বড় জায়গা। তারপরেই মাইলের পর মাইল জুড়ে কৃষকদের তাঁবু আর তাঁবু। সঙ্গে যেমন রয়েছে থাকার জন্য ট্র্যাক্টর বা ট্রলি তেমনি অসংখ্য খালি ট্র্যাক্টর। কয়েকশ মিটার এগোতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মঞ্চ। এই মঞ্চ আগেরটার চেয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থে অনেকটাই বড়। বসার ছাউনিতে, পাঁচশ’র বেশি লোক বসে যেতে পারেন। লাগাতার বক্তৃতা চলছে। ভাষা মূলত পাঞ্জাবী যা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। বক্তৃতার যে অংশে শ্রোতারা উৎসাহে হাততালি দিচ্ছেন সেই অংশের মানে পাশের বসা লোককে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর কদাচিৎ পেয়েছি। আসলে, তাঁরা বক্তৃতার কোন অংশেই আমার কারণে অমনোযোগী হতে চাইছেন না। দ্বিতীয়ত, দুচারজন হিন্দিতে মানে বলে দিলেও, পাঞ্জাবী ভাষার টান এত বেশি যে সঠিক মর্মোদ্ধার হল না। মাথা নেড়েই যেতে হল। এইসব ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। ২৬’র প্রস্তুতির জন্য বিরামহীন ট্র্যাক্টর ঢুকেই চলেছে। মোর্চা থেকে যে বলা হয়েছে দেড় লাখ ট্র্যাক্টরের কথা, অবস্থা দেখে বুঝলাম তা শূন্য গর্জন নয়। আর অসংখ্য মানুষের ছোট ছোট মিছিল মিশছে এই মানুষের সঙ্গমে। এত ভিড় যে মাঝে মাঝে হাঁটাও মুস্কিল হয়ে উঠছে। রাস্তার ধারেই অসংখ্য লঙ্গর। নানা রকম খাবার তৈরি হয়ে চলেছে। মূলত রুটি ডাল আর তরকারি। ক্লান্ত পায়ে ঢুকে পড়েছি এইরকম দুই একটা লঙ্গরে। তাঁরা বসতে দিচ্ছেন, চা খাওয়াচ্ছেন। পুরুষ মহিলা সবাই মিলে আটা বেলছেন, রুটি সেঁকছেন। ঐরকম আয়তনের হাঁড়ি ডেকচি আমি জীবনে দেখিনি। হাঁটতে হাঁটতে সুযোগ পেলেই দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছি। তাঁদের ভাষা কখনো বুঝছি কখনো বুঝছিনা। কিন্তু তাঁদের চোখে মুখে, শরীরে প্রতিজ্ঞার, দৃঢতার ভাষা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। বাড়িয়ে বলা নয়, ঘর সংসার ছেড়ে প্রবল শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে যারা এতদিন নিজেদের দাবীতে অনড় থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা কি ধাতুতে গড়া সেটা বুঝতেই তো যাওয়া। তাঁদের যেটুকু বুঝেছি তার ভিত্তিতেই এই লেখা। অন্যদিকে নেতাদের যেমন রাজেওয়াল বা যোগেন্দ্র যাদব, এঁদের খোঁজ করলেই সবাই কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। নেতৃস্থানীয় কারও সঙ্গে দেখা আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।
পরের দিন বাসে চড়ে চড়ে পৌঁছে গেলাম টিকরিতে। ধর্ণার জায়গাটা ঠিক দিল্লি শহরের প্রান্তেই। সিঙ্ঘুর মতো শহর থেকে অত দূরে নয়। রোহতক দিল্লির রাজপথে এই ধর্ণা। এই পথ দিল্লি সোনেপতের তুলনায় কিছুটা কম চওড়া। ফলে ভীষণ চাপাচাপি করে ট্র্যাক্টর আর তাঁবুর মেলা। যে কোন তাবুর সামনে দাঁড়ালেই উচ্চকিত স্লোগান আর গান। প্রাণশক্তি কাকে বলে তার ধারণা এখানে এসে পাওয়া গেল। কয়েকটি অল্প বয়সী ছেলে একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে ছিল। একটু জিরোতে ওদের সঙ্গে বসে গেলাম। আন্দোলন নিয়ে নানা কথা হল। পরে ওরা আমাকে আমার পায়ের আরামের জন্য নিয়ে গেল যন্ত্র দিয়ে পা মালিশ হয় এমন একটা জায়গায়। দেখতে হয় এদের অভ্যর্থনা। কি যত্ন করে আমাকে বসালো, যন্ত্রে পা রাখতে বলল। কথা হল অনেকের সঙ্গে। এখানের হিন্দি কোন কারণে একটু সড়গড়, হয়তো দিল্লি শহরের খুব কাছে বলে। চা খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও চা খাওয়ার বাহানায় ঢুকে গেলাম একটা লঙ্গরে। সেই সুভাস বোসের কথা, তাঁর লড়াইয়ের কথা, বাঙ্গালীর কথা। আমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সিঙ্ঘুতেই ফিরতে হল কারণ সেখানেই আমার সঙ্গের ব্যাগটা রয়ে গেছে।
সিঙ্ঘুতে ফিরে দেখি কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ মঞ্চের সামনে ব্যাপক ভিড়। হাজার খানেক লোক হবে সেখানে। নেতারা মঞ্চ থেকে কিছু বলছেন আর তীব্র উল্লাস ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। পাশের লোকেদের জিজ্ঞাসা করেও কিছু উত্তর পাচ্ছিনা। সবাই বক্তৃতায় মগ্ন। থাকার জায়গায় ফেরার পথে খোঁজ করতে গেলাম সেই কলকাতায় কাজ করা ডাক্তারবাবুর। উদ্দেশ্য, কটায় মিছিল বেরোবে তা নিয়ে নিশ্চিত হতে। স্টোরে তাঁকে পেলাম না। স্টোরের সামনেই একটা ট্র্যাক্টরের ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাদেরও খোঁজ নেই। শেষে ঐ ট্র্যাক্টরে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আগামী কালের মিছিল শুরুর সময়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে অদ্ভুত আচরণের সম্মুখীন হলাম। প্রায় খেঁকিয়ে উঠে আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন। তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম যথার্থ লোকের অপেক্ষায়। তাঁদের না পেয়ে থাকার জায়গায় ফিরলাম। মোটামুটি জানাই ছিল দশটায় মিছিল বেরোবে। আমার পাশে থাকা লোকজনও সেই কথাই বললেন। মানসিক প্রস্তুতি সেইরকমই রইল।
পরের দিন সকালে ৬ টার কিছু পরে ঘুম ভাঙল। আমার পাশেই শুতেন এক ষাটোর্ধ্ব শিখ ভদ্রলোক। দেখি উনি একেবারে প্যান্ট সার্ট পরে যাত্রার জন্য তৈরি। ওঁর সম্বন্ধে দুচার কথা না বললেই নয়। পাতিয়ালায় থাকেন। সামান্য জমি আছে। ছেলেরাই তা দেখছে। তাঁরা বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আন্দোলনের যোগ দিতে। খুব গুছিয়ে কথা বলেন। পরে একসময় প্রকাশ পেল, তিনি আম আদমি পার্টির সমর্থক। তাঁর মতে, পাঞ্জাবের পরের নির্বাচনে ‘আপ’ই জিতবে। এই কথার ফাঁকে এ ইঙ্গিতও পেলাম, তেগবাহাদুর স্মৃতি সৌধের যে লঙ্গরে সাধারণত আমরা খাবার খাই তা ‘আপ’ দলই চালায়। আমার পাশে ছিলেন ‘রেডস্টার’ দলের ওড়িশা, ছত্তিশগড় থেকে আসা কিছু নেতা কর্মী। তাঁরাও বললেন, অপ্রকাশ্যে কংগ্রেস সহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল এখানে এমনি ভাবে লঙ্গর চালাচ্ছে।
তৈরি হয়ে সাড়ে ৭টা নাগাদ লঙ্গরে পৌঁছে কিছু খেয়ে নিয়ে সবে চায়ের কাপে হাত দিয়েছি। হঠাৎ শুনি হৈ হৈ আওয়াজ। হাইওয়ের একপাশে ১০০ মিটারের মতো কিছু দূরে তেগবাহাদুরের স্মৃতি সৌধ। মাঝখানে একটা পেট্রোল পাম্প যা আপাতত বন্ধ। এছাড়া টোল ট্যাক্স আদায়ের একাধিক লেন। তাই হাইওয়ে ঝট করে নজরে আসে না। কিন্তু আওয়াজটা ঐদিক থেকেই। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি ট্র্যাক্টর বেরিয়ে পড়েছে। বেরোবার মুখটা পুলিশ ছোট করে রেখেছে। তাই ট্র্যাক্টরের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। তার থেকে আসছে শ্লোগান আর উল্লাসের ধ্বনি। তখন ৮টাও বাজেনি। দৌড়ে রাস্তার ধারে গিয়ে একটা মোবাইল টয়লেটের উপরে চড়ে আমার ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, যতদুর চোখ খালি ট্র্যাক্টর আর ট্র্যাক্টর। সেগুলিতো ঠাসাই, আর তার পাশে পাশে শ্লোগান মুখর মানুষের মিছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেই ঐ ভিড়ে মিশে গেলাম। হাঁটছি, কথা বলছি। প্রাণ ভরে মানুষের প্রাণশক্তির আঁচ নিচ্ছি। জীবনে অনেক মিছিলে হেঁটেছি। সমস্ত হাঁটা পথগুলি জুড়লে কতশত মাইল হবে তা জানা নেই। কিন্তু মিছিলের এমন উত্তেজনা, এমন দৃপ্ত ভাবনা, বিশ্বাস আমাকে এর আগে কখনো আচ্ছন্ন করেছে বলে মনে করতে পারছিনা। এক নতুন ভারতবর্ষের উত্থানের সম্ভাবনা যেন দেখতে পাচ্ছি। সামনে পিছনে ব্যাপ্ত মানুষের মহাসমুদ্রের ঢেউ আমার চেতনাকে এমন কোন সুদূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল যার ঠিকানা আমার আগে জানা ছিলনা। প্রস্তাবে যে রিং রোড পরিক্রমার কথা আছে তা শেষ করতে ১০০ কিমি পথ পার হতে হবে। পায়ে হেঁটে তা করা আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব ছিলনা। তাই কখনো গাড়িতে, কখনো বাইকে মাঝে মাঝে উঠছি। মিছিলে হাঁটা লোকজনই তাঁর ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সুদূর কলকাতা থেকে এসেছি এই কথাতো তাঁদের উজ্জীবিত করছেই, এর উপর আছেন আমাদের সুভাষচন্দ্র। এমনি করে এগোবার সময় মাঝে একবার বাধার সম্মুখীন হল মিছিল। বাধার জায়গা থেকে অন্তত ৫০০ মি দূরে আমি। টিয়ার গ্যাস ফাটার আওয়াজ পাচ্ছি। তার ধোঁয়াও দেখতে পেলাম দূর থেকে। আবার মিছিল এগোল। ৫০০ মি এগিয়ে দেখলাম, কৃষকরা পুলিশের তোলা ব্যারিকেড দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন।
পথের অনেক জায়গায় মানুষ জড়ো হয়ে পুষ্প বৃষ্টি করছেন। আবেগ তাঁদের এবং আমাদেরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। হাতে জল, বিস্কুট ধরিয়ে দিচ্ছেন রাস্তার ধারে দাঁড়ানো মানুষেরা। কখনোবা চা। সে জিনিস হাতে নিলে যে তৃপ্তির ছোঁয়া তাঁদের মুখে দেখেছি তা ভোলার নয়। জল বিস্কুট আমার কত উপকার করবে তা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্ত তাঁদের কাছে তার চেয়েও সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মিছিলকারীদের মধ্যে সেইসব জিনিস বিলি করে আন্দোলনের একটা অংশ হতে পারার আনন্দ।
রাস্তায় চলতে চলতে কিছু আলাপের কথা আমাকে একটু দ্বিধায় ফেলে দিল। একজন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘রিং রোডের কথা ছাড়ুন’। নেতারা বললেও তারা নাকি নিজেদের মতো রাস্তা ধরেই যাবেন। সেটা কোন রাস্তা তার উত্তর পরিষ্কার হলনা। একজন বললেন - দিল্লি যখন ঢুকছি আর বেরোবানা। যন্তর মন্তরে বসে যাব। এর মানে উদ্ধার হল যখন, তখন অনেক কিছু ঘটে গেছে। পথের শেষটা আমি একটা গাড়িতে পার করছি। দিল্লি শহর আমার সম্পূর্ণ অচেনা, বছর চল্লিশ আগে সেখানে কয়েক মাস থাকলেও। যার গাড়িতে চড়েছি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম - কোথায় যাচ্ছি। তিনি বললেন, ধারণা নেই। মিছিলের আগের লোকেরা যেখানে যাচ্ছেন, সেইখানেই। কিন্তু আন্দাজে বুঝলাম যে পথে যাচ্ছি তা আর যাই হোক রিং রোড নয়, যদিও যাত্রা শুরুর পর ৫ ঘন্টার বেশি সময় কেটে গেছে। কিছুটা পরেই রাস্তায় ধারে লাগানো দিকচিহ্ন দেখে বুঝলাম, পুরানো দিল্লি স্টেশনের দিকেই চলেছি, যার কাছেই লালকেল্লা।
একসময় গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে হেঁটে লালকেল্লার কাছে পৌঁছলাম। কেল্লা চত্বরে অগুন্তি ট্র্যাক্টর আর মানুষ। যে মিছিল বেরিয়েছে তার খুবই সামান্য অংশ হয়’ত, কিন্তু সমগ্র মিছিলটা এত বড় ছিল যে তার এক ক্ষুদ্রাংশকেও বিরাট বলে দেখাচ্ছে। শিখদের ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহেবকে লালকেল্লার দু তিন জায়গায় উত্তোলিত দেখতে পেলাম এবং কোন মতেই সেই পতাকা জাতীয় পতাকার উপরে নয়, তা গদি মিডিয়া আর বিজেপি যতই প্রচার করুক না কেন। ভেবে উঠতেই পারছিনা সমস্ত পরিকল্পনা এমন পাল্টে গেল কি করে। ধরেই নিয়েছিলাম, দেড়লাখ ট্র্যাক্টর রিং রোডে ঢুকলে এমন জ্যাম হবে, রাতে সিঙ্ঘু ফেরার কোন প্রশ্নই নেই। ভেবেছিলাম, কোন ট্র্যাক্টরে বসে রাত্রিটা কাটিয়ে দেব। বুঝতে পারছি, তেমনটা হবার নয়। অতএব ঘন্টা খানেক পরে সিঙ্ঘু ফেরার পথ ধরলাম।
ফিরতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল তাও বলার মতো। বাতাসে ভাসছে খবর, কৃষকরা নাকি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিলেন। মেট্রো রেল, বাস সব বন্ধ। একসময় মনে হল, সিঙ্ঘু ফেরাই হবেনা আজ। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই অন্ধকার নামবে। মনে হল, রাস্তায় হয়’ত পরে থাকতে হবে, অথবা খুঁজে নিতে হবে কোন হোটেল। ছিটকে পড়েছি সবার থেকে। কোন সঙ্গী নেই। পা আর চলছে না। যাইহোক, কোনমতে সিঙ্ঘু ফিরতে পেরেছিলাম সেই রাত্রে। সেই কাহিনি অবশ্য খুব জরুরী কিছু নয়।
এরপরেও সিঙ্ঘুতে ছিলাম ২ দিনের মতো। এই দুদিনে ২৬ তারিখের বা তার আগের দিনের কিছু না বোঝা না জানা ঘটনার অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেল।
কিষান মজদুর সংঘর্ষ সমিতি বা সংযুক্ত কিষান মোর্চার আলাদা মঞ্চ বা এদের দু’দলের এলাকার মাঝখানটাতে পুলিশ ক্যাম্পের কথা আগেই বলা হয়েছে। ধর্ণার অঞ্চলে ঢুকতে প্রথমেই কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ সমিতি বা সংক্ষেপে কেএমএসএস-এর এলাকা পড়বে সেটাও জানা। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বা সংক্ষেপে এসকেএম ২৬ তারিখের সমস্ত ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন, কেননা মিছিলের ডাক তাঁরাই দিয়েছিলেন। কিন্তু রিং রোড না ধরে মিছিলের একটা অংশকে লালকেল্লায় নিয়ে যাবার জন্য কেএমএসএসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। পুলিশ ক্যাম্পের এলাকা পার করে ওদের তাঁবু ফেলার জায়গাও কি করে এগিয়ে গেল, সেই প্রশ্ন তুলে পুলিশের সঙ্গে কেএমএসএসের গোপন আঁতাতের ইঙ্গিত তাঁরা দিয়েছেন। আগের দিন কেএমএসএসের সভায় যে তুমুল উল্লাসের আওয়াজ শুনেছিলাম তার ভাষা বুঝিনি সেটা আগে জানিয়েছি। পরে জানলাম, এই সভাতেই যেমন ইচ্ছা তেমন মিছিলকে নিয়ে যাবার কথাই ঘোষণা করা হয়েছিল। এসকেএমের নেতারা এও অভিযোগ তুলেছেন যে তাঁদের এই ঘোষণা জেনেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। আগেই এসকেএম সংসদ অভিযানের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। লালকেল্লার ঘটনার পর তাঁরা সেই অভিযান বাতিল করে দিলেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কেএমএসএসের সেই ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ওরা, মানে এসকেএম, যা বলার বলুক, সংসদ অভিযান নাকি হবেই। ডাক্তারবাবুর এই কথা শোনার পরই এসকেএমের তোলা অভিযোগের সারবত্ত্বা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না। পরে অবশ্য ওঁরাও এই অভিযান বাতিল বলে ঘোষণা করে দিলেন। আবার ভাল করে দেখলাম, সত্যিই তো, পুলিশ ব্যারিকেড ডিঙিয়েই কেএমএসএসের তাঁবু পড়েছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে আগে তাঁবু পড়েছে পরে পুলিস ব্যারিকেড, তাহলেও এই প্রশ্নের উত্তর নেই কি করে পুলিশ দিল্লির দিক থেকে এসে কেএমএসএসের তাঁবু এলাকাটা ছাড়িয়ে ব্যারিকেড গড়ল। এক বৃদ্ধ লোকের খেঁকিয়ে ওঠার কথা আগে লিখেছি। পরে বুঝলাম মিছিল, শুরুর সময় জিজ্ঞাসা করায় তাঁর ওইরকম প্রতিক্রিয়া কারণ এসকেএমের নির্ধারিত সময় ১০টা তাঁরা যে না মেনে আগেই বেরিয়ে যাবেন তা আমার মতো ভিনরাজ্যের বাসিন্দার কাছে প্রকাশ করতে চাননি। এছাড়া সেইদিন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আরও কয়েকজন আমাকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এসকেএম যে এমনটা করেনি তাই নিয়ে আমি নিশ্চিত। এটাও পরে জেনেছি এসকেএম লালকেল্লার ঘটনার কথা জেনে একটা সময়ের পর তাঁদের অভিযানকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিকেলের পরও সিঙ্ঘু থেকে শেষ ট্র্যাক্টরটির বেরোতে অনেক দেরি। তার আর বেরোনো হলনা। যদি রিং রোড ধরেই মিছিলটা এগো’ত তাহলে প্রথম ট্র্যাক্টর সিঙ্গুতে ফিরে এসে বেরোবার অপেক্ষায় থাকা শেষ ট্র্যাক্টরকে দেখতে পেত, এমনটা অনেকেরই বিশ্বাস। দিল্লি অন্তত তিনদিনের জন্য অচল হয়ে থাকত। এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনা দেখা থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হল। এ আমাদের দুর্ভাগ্য।
মিছিল বেরোবার অনেক আগে থেকেই নেতারা বিশেষ করে যোগেন্দ্র যাদব বারবার বলেছিলেন কিষাণ আন্দোলনকে ছোটো করতে শাসকদের দরকার কেবল মাত্র ৯০ সেকেন্ডের একটা অন্য ধরনের ভিডিও। সেটা শাসকরা পেয়ে গেছিল আর তারপরেই সমস্বরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কৃষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে। যদিও ব্যারিকেড ভাঙা ছাড়া আর কোনও ঘটনা তাঁরা ঘটাননি যাকে হিংসাত্মক বলা যায়। সরকার দ্বারা অনুমোদিত পথের সামনে যদি ব্যারিকেড গড়া হয় তাকে ভাঙাও কি হিংসাত্মক? এই প্রশ্নও তো স্বাভাবিক।
সিঙ্ঘু দিল্লি শহর থেকে বহুদূর হবার কারণে প্রশস্ত রাজপথ ধরে ট্র্যাক্টরগুলি প্রবল বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং এরা সেই প্রথম বেরোনো ট্র্যাক্টরগুলিই যাদের মালিকানা ছিল কেএমএসএসের লোকজনদের। যে গতিতে তাঁরা একে ওপরকে টেক্কা দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল, যেন কোন তাড়া তাঁদের মধ্যে কাজ করছে। অনুমান করতে পারি সেই তাড়া নির্ধারিত রাস্তাকে অস্বীকার করার। দিল্লি শহর অনেক দূর হওয়ায় রাস্তা চেনাও মুস্কিল হতে পারে অনেকের কাছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে, একটা সময় তারা অনুমোদিত রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে অননুমোদিত রাস্তা খুলে রেখেছিল। অনেকের দিল্লি পৌছবার রাস্তা না জানার সুযোগ তারা এইভাবে নিয়েছিল। আর মিছিলের মজাই এই, সামনের লোককে অনুসরণ করে চলা। এই ভাবেই এক অসামান্য সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে ২৬ তারিখ।
দিল্লিতে ট্র্যাক্টর অভিযান হয়’ত সফল হয়নি। কিন্তু তারপরেও সিঙ্ঘুর কৃষকদের মনোবল একটুও কমতে আমি অন্তত দেখিনি। যা হবার ছিল তা না হবার কারণে হয়তো একটু হতাশা ছিল কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। এটা ঠিক ২৬ তারিখের কারণেই আমি সিঙ্ঘুতে মানুষে মানুষে ছেয়ে যেতে দেখেছি। পরের দিন থেকেই লোক অনেক কমে গেলেও তাঁবু গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে এমনটা আমার নজরে পড়েনি। তবে মেনে নিতে হবে ২০/২৫ কিমি লম্বা সমাবেশের কতটুকুইবা আমি দেখেছি।
যা দেখতে পাইনি তা নিয়ে একটুও আফশোস নেই। কারণ যা দেখেছি তাই আমার জীবনের তৃপ্তির ভাণ্ড ভরে গেছে। এইটুকু অন্তত বুঝেছি, বর্তমানের সরকার অনেক অন্যায় করেও অনায়াসে পার পেয়ে গেছে। কিন্ত কৃষকদের রোষ থেকে এদের নিস্তার নেই। এই রোষ কেমন করে এবং কবে জাতীয় রূপ নিয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়বে তাই দেখারই প্রতীক্ষায় জেগে থাকা।
শহরের প্রাচুর্য এবং অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে কৃিষ নির্ভর বেেঁচ থাকবার লড়াইয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখন অবধি পাঁচ বছর কেটে গেছে অবর্ণা মুখাইয়ার। এই পাঁচ বছরে তাকে অনেক অনভ্যস্ত সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতি বছরই নতুনতর সমস্যা হাজির হয়েছে। ২০১৮ সালের বন্যায় সমস্ত অাবাদ এবং বাসস্থান নষ্ট হবার পর অাগের অবস্থায় ফিরতে তাদের অাঠেরো মাস টানা পরিশ্রম করতে হয়েছে। সবে শ্বাস ফেলতে না ফেলতে সকলকে বিমূঢ় করে হাজির হয়েছে কোভিড-১৯। এক অচেনা সমস্যা অনিশ্চিত অভিঘাত নিয়ে হাজির। এই অনিশ্চয়তা শুধু অবর্ণা বা তার সঙ্গীদের নয় সারা পৃথিবীকেই এর মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
সারা পৃথিবী এখন এক অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। সেই সঙ্কটের গভীরতা বা প্রতিকারের উপায়, পদ্ধতি নিয়ে সব দেশ যে একমত তাও নয়। এক অালো ঢেকে দেওয়া অন্ধকারের মত অজানা অাতঙ্ক যেন সবাইকে পঙ্গু করে ফেলার চেষ্টা করছে। অাতঙ্ক কিসের? না মৃত্যুভয়। কে শত্রু জানা নেই, কিন্তু তার ছোঁয়াতে প্রাণ যাবার ভয় অাছে। অামরা সবাই জানি এই অাতঙ্কের মূল যে অতিমারী তার মারণ ক্ষমতা অন্যান্য প্রচলিত রোগের থেকে অনেক কম, তবুও অামরা প্রতি মুহূর্তে অাশঙ্কার তাড়নায় অস্থির হয়ে অাছি। অাশঙ্কার কালো মেঘ অনেকেক্ষেত্রেই অামাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে বদলে দিচ্ছে। আমাদের বোধ এবং চিন্তা ভাবনার মূল পরিসর থেকে স্বাভাবিক মানবিকতার ধারণাকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর একান্ত গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার সার্বিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
পৃথিবীর সমস্ত দেশ তাদের যে যার নিজের মত করে অথবা বলা যায় তাদের নিজস্ব অার্থিক ও রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার চেষ্টা করছে। সেখানেও নিজস্ব গোষ্ঠীগত ক্ষমতার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন জাতীয় ও অান্তর্জাতিক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন চেহারা নিচ্ছে। এই অবস্থার বর্তমান চিত্রের সঙ্গে অামরা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগ্য পীড়িত বাঙ্গালি জাতিসত্তার অদূর অতীতের প্রতিরোধহীন দিশাহীন গণনিধনের কথা স্মরণ করতে পারি। কেননা অামরা বাঙ্গালিরা বর্তমানকে অাশ্রয় করে বাঁচতে ভালবাসি। সেই বাঁচার ছোট ছোট তরঙ্গ বিভঙ্গের চ্ছটায় মুছে যায় অতীত অার সম্মিলিত ভবিষ্যতচিন্তার সময় বা সুযোগ ঘটে ওঠে না।
বেশিদিনের পুরনো কথা নয়। বিগত ১৯৪৩ সালে এই গণনিধনের অভিশাপ বাঙ্গালি জাতিসত্তার উপর নেমে এসেছিল। খাদ্যের অভাব অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের পথ ধরে। এই দুর্ভিক্ষ সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে গভীরতম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। তৎকালীন বাঙ্গালির মননে স্বর্গের অাগের ধাপ ছিল বাংলার নিবিড় গ্রামগুলি। কেননা তারা শহর বা অন্যত্র যেখানেই কাজের সূত্রে থাক না কেন, মৃত্যুর অাগে তাদের স্বপ্ন ছিল এই গ্রামে ফিরে আসা। বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের এই গ্রামগুলিই ছিল ভারতবর্ষের উর্বরতম শস্যভাণ্ডারের অধিকার নিয়েই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজশক্তির সংঘাত হয়েছে। তার সাথে ছিল শ্রেষ্ঠতম গুণমানসম্পন্ন কুটিরশিল্প। সেই বর্তমান নিয়েই বাঙ্গালি ছিল সুখী।
কিন্তু অত্যন্ত অল্পদিনেই সেসময় হারিয়ে গেল। সুখী কলরোল মুখরিত কুটিরগুলি পড়ে রইল মনুষ্যবিহীন জন্তুজানোয়ারের অাস্তানা হয়ে। বুনো লতা ঝোপে অাচ্ছন্ন হল উঠোন বারান্দা। মা মৃত। সন্তানের মুখে অাহারকণা তুলে দেবার হাত নেই। কোথাও এক কণা চালের সংস্থান নেই। ভাত বাংলার প্রধানতম খাদ্য। ১৯৩১-এর সেনসাস অনুযায়ী সাধারণ কৃষিজীবী, কৃষি শ্রমিক কারিগর এবং ছোট ব্যবসায়ীরা বাংলার জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। তাদের দৈনিক মাছ মাংস দুধ ঘি খাবার ক্ষমতা ছিল না। স্বভাবতই তাদের সঞ্চয়ও ছিল না।
সাধারণ কৃষিজীবী মানুষেরা ছিলেন মূলত ভাগচাষী। দু এক বিঘা জমি চাষ করে তাদের মালিককে অর্ধেক ফসল দিতে হতো। দৈনিক মজুর এবং কারিগরদের অবস্থা ছিল অারও করুণ। সুতরাং খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাদের যেটুকু জমানো সংস্থান তা অল্পদিনেই নিঃশেষিত হল। তখন তাদের বাড়ির দরজা জানালা খুলে বিক্রি করা শুরু হলো। সব কিছু হারানোর পর বুনো ফল শাক পাতা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টা চলল। তার মধ্যে কচু, বুনো অালু এবং শাপলা ছিল প্রধান। তাছাড়া ছিল শামুক গেঁড়ি গুগলি। হাওড়া জেলার বহু বাড়ির সামনে গেড়িগুগলির ঢিবি জমে গেল।
কোথাও একদানা খাবার নেই তাদের জন্য। নিজে দিনের পর দিন না খেয়ে সন্তানের মুখে যা হোক খাবার তুলে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টার অন্তে মায়েদের মনে হল সন্তান বিক্রি করে দিলে সে অন্তত অভুক্ত থাকবে না। তার কষ্ট লাঘব হবে। কিংবা চোখের সামনে সন্তানের শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে না পেরে কোন অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়ির সামনে সন্তানকে ফেলে রেখে চোরের মত পালিয়ে যাওয়া ভালো। স্যার জগদীশ প্রসাদ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩-এ বাংলার প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মেমোরান্ডামে এরকম একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন— ফরিদপুরে জেলা শাসকের অাদালত কক্ষের এক কোনে একটি পুঁটুলি নিয়ে একজন শীর্ণদেহী মহিলা বসে ছিলেন। সেখান থেকে যখন একজন বয়স্ক মানুষে মৃতদেহ সরানো হচ্ছিল, তখন সেই মহিলা তার পুঁটুলিটি ছুঁড়ে দিয়ে অার্তনাদ করে ওঠে ‘‘একেও নিয়ে যাও’’ বলে। মা’র কোল থেকে ঝরে পড়ে মৃত সন্তানের দেহ।
হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড পত্রিকার সাংবাদিক চাঁদপুর থেকে ১১ অক্টোবর, ১৯৪৩-এ খবর পাঠান— বেঙ্গল রিলিফ কমিটির ব্যবস্থাপনায়— ফরিদগঞ্জ থানার অষ্ট-মহামায়াতে খাদ্য বিতরণের কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। সেখানে সন্তান কোলে একজন মা খাবার নিচ্ছিলেন। খাবার নেবার সময়ের মধ্যে তার কোলেই সন্তানের মৃত্যু হয়। কিন্তু মা তার খাবার নেওয়া বন্ধ করেন নি। তারপর সেই খাবার খেয়ে তার মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি চলে যান।
১৯৪৩ সালের বাংলার গ্রামের অবস্থার সাথে অামরা অাশ্চর্য মিল দেখতে পাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অানন্দমঠে বর্ণিত ১৭৬৮ সালের দুর্ভিক্ষের। অামরা একবার দেখে নিতে পারি সেই অাশ্চর্য বর্ণনা। ‘‘গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখিনা। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। অাজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে ঠিকানা নাই। অাজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে, দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে, অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি অার সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখিনা, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গোচারণে গরু দেখি না, কেবল শ্মশানে শৃগাল কুক্কুর। .... তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।
১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল— লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা অাহার করিল। .... অাশ্বিনে কার্ত্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দু এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে অার খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা অাধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তারপরে দুই সন্ধ্যা উপবাস অারম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব অাদায়ের কর্ত্তা, মনে করিল, অামি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।
লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে অারম্ভ করিল, তারপর কে ভিক্ষা দেয়! — উপবাস করিতে অারম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ী বেচিল। জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে অারম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে অারম্ভ করিল। তার পর স্ত্রী বেচিতে অারম্ভ করিল। তার পর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে অারম্ভ করিল, অাগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’’
১৯৪২ সােল সারা বাংলার অনাহার পীিড়ত মানুষের কলকাতায় অাসা সুরু হল। একটু খাবারের সন্ধানে। বরং বলা যায় একটু ভাতের ফ্যানের অাশায়। জুলাই এর মাঝামাঝি এই সমস্ত মানুষের একটু ফ্যান চাওয়ার অার্তনাদে কলকাতার রাস্তাঘাট ভরে গেল। এখানে সেখানে মানুষ খাবারের জন্য ভিক্ষা চাইতে লাগল। অাগস্টের মাঝামাঝি কলকাতার সমস্ত রাস্তা বুভুক্ষু মানুষের স্রোতে নিমজ্জিত হলো। প্রতিটি রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কের গাছের ছায়া তারা খুঁজতে লাগল। আগস্ট মাসের তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে রেলওয়ে স্টেশনগুলির শেড এর নীচে মাথা গোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হল। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পুরো ফুটপাত জুড়ে কাপড় টাঙ্গিয়ে তার ছায়ায় অাশ্রয় নিল বহু মানুষ। দিনের বেলা বড়রা দুএকজন শিশুকে নিয়ে খাবারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। রাত্রিবেলা মিলিত হত এই ছাউনিগুলিতে। ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে সারি সারি স্তরে রাত কাটাত। এই সর্বব্যাপী অনাহারের মধ্যে ততদিনে শুরু হল ম্যালেরিয়া, কলেরা এবং পেটের গন্ডগোল।
১৯৪৩ এর অাগষ্ট ‘িদ স্টেটসম্যান’ পত্রিকার বর্ণনায় —
খাবার হয়তো প্রাণটাই বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু সামাজিক স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি পরিবার এই সময়ে অল্প খাবারে টেকে না। তবুও লঙ্গরখানাগুলিই পরিবারকে একত্র রাখতে সাহায্য করছিল। ছয়, সাত বা অাট বছরের বাচ্চাদের অভিভাবকদের সাথে কলকাতা শহরের হতবুদ্ধি করা বন্ধ দরজার সামনে, পাঁচিলের পাশে সারি সারি ঘুমোতে দেখা গেল। তারা কি অার তাদের ফিরে যাবার ঘর খুঁজে পাবে। কত সঙ্গী, কত পরিবারের সদস্য এই বিশাল শহরের অানাচে কানাচে হারিয়ে গেল।
বাংলা যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখের গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছিল তখন মানব সভ্যতার ইতিহাস ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলার লোক সংখ্যা তখন ছিল ৬ কোটি ৩ লক্ষ। তার মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারান। এর একটা বড় সংখ্যায় মানুষ কলকাতায় খাবারের সন্ধানে এসেছিলেন।
এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপক শ্রী তারক চন্দ্র দাশ কলকাতায় অাসা এই সর্বস্বান্ত মানুষদের উপর একটি সমীক্ষা করেন। তিনি লক্ষ করেন যে কলকাতায় আসা মানুষদের মধ্যে ৭১.৫৪% িহন্দু, ২৭.৬৩% মুসলমান এবং ০.৭৯% খ্রীষ্টান। তার মধ্যে ৫৩.৬৮% দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়েন। তবে তিনি কোন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ এর মধ্যে দেখেন নি।
এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার অনুপুঙ্খ বিবরণ দেবার পরিসর এটা নয়। বরং অামরা এই সময় দেশের অন্য অবস্থা এবং তার প্রভাবের কথা ভাবতে পারি।
অামরা অাগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলেছি। তার ফলশ্রুতিতে বিবিধ সামরিক প্রয়োজনের উপযোগী নীতি প্রয়োগের কথাও জানি। অার ভারতীয় রাজনীতির অাকাশ তখন টালমাটাল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দেশের বাইরে। কংগ্রেসের নেতৃবর্গ অাগস্ট অান্দোলনের প্রস্তুতিতে বেশি ব্যস্ত। তার মধ্যেও মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২-র গ্রীষ্মে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত নীতি ও পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন এবং এই নীতি ও পরিকল্পনা (বিশেষত Denial Policy) বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সার্বিকভাবে সর্বস্বান্ত করে দেবে বলে অাশঙ্কা প্রকাশ করেন।
১৯৪২ এর অাগস্ট মাসে ‘‘ভারত ছাড়ো’’ অান্দোলন ঘোষণা করে কংগ্রেস। ঘোষণার প্রায় সাথে সাথেই সমস্ত কংগ্রেসের নেতাদের এবং সক্রিয় কর্মীদের ব্রিটিশ সরকার কারাবন্দী করে। মহাত্মা গান্ধীকে পুণেতে গৃহবন্দী করা হয়।
ইতিমধ্যে কলকাতায় অনাহার পীড়িত জনস্রোত অাছড়ে পড়তে শুরু করেছে। বাংলায় তখন হিন্দু মহাসভার সমর্থনে মুসলীম লিগ সরকার, সেই সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। যদিও সারা বাংলা তখন ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত। বাতাসে দেশভাগের গন্ধ। সেই সরকারের সুরাবর্দী এবং শ্যামাপ্রসাদ দূর্ভিক্ষ মোকাবিলায় একসাথে কাজে নামতেই পারলেন না যদিও তাদের মত ছিল একত্র মোকাবিলা করবার বিষয়ে।
১৯৪২ এর এপ্রিল মাসে Food Advisory Council গঠিত হল এবং Food Member নিযুক্ত হল সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করবার জন্য। অন্যতম Food Member স্যার অাজিজুল হক ৯ অাগষ্ট ১৯৪৩-এ বললেন যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক কেন্দ্রীয় সংসদে বলেছেন— ‘যদিও ঘাটতি অাছে, তবুও অামাদের পরবর্তী কিছু মাস চালের কোন প্রয়োজন নেই বরং বাইরে থেকে কিছু গমের অামাদের প্রয়োজন’। নলিনী রঞ্জন সরকার, তৎকালীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জমি দপ্তরের সদস্য এপ্রিল ১৯৪২-এ বলেছিলেন— পাটের পরিবর্তে বেশি জমিতে ধান চাষের দরুন এবং ভালো অাবহাওয়ার জন্য বাংলায় ধানের ফলনের ঘাটতি ১৩.৫ লাখ টনের বিপুল উদ্বৃত্তে রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯৪৩-র মে মাসে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তার শিরোনাম ছিল ‘একটি আবেদন ও সতর্কীকরণ’। সেখানে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দাবী প্রকাশ করা হয়। প্রশ্ন ছিল— সত্যিই খাদ্য ঘাটতি অাছে কিনা? জবাবে লেখা হয়— ‘‘না, নিশ্চিতভাবে নেই’’।
তবুও অনাহারে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়ের মত প্রাণ হারালেন।
ইতিমধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৪২ এর নভেম্বরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। তিনি তার অাগে বাংলার লেজিসলেটিভ এসেম্বলির ডেপুটি স্পিকারকে একটি সুদীর্ঘ বিবৃতি দেন। তার শুরুতে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সেখানে প্রাথমিক কারণের মধ্যে অনাহার পীড়িত মানুষের প্রসঙ্গ নেই। সেখানে অাত্মসম্মান বজায় রাখবার কথা অাছে। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন ও বিরোধ সম্পর্কিত উদ্ভুত পরিস্তিতি এবং ব্রিটিশ সরকারের এই বিষয়ে অন্যান্য অাচরণের কথা অাছে। তার কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বিস্তৃত বিবরণ অাছে। এমনকি ঘূর্ণিঝড় পীড়িত মানুষদের সাহায্যের অপ্রতুলতার বিস্তৃত বিবরণ অাছে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ পীড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাওয়া স্থান পায় নি। সুতরাং বাংলায় Famine Code অনুযায়ী দূর্ভিক্ষ ঘোষণার দাবীর প্রশ্নই নেই। যদিও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী Governor Rutherford কে একটি খোলা চিঠিতে অষ্ট্রেলিয়া থেকে কেনা দানা শস্য অানবার ব্যবস্থা হয় নি তা জানতে চান এবং অভিযোগ করেন এর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা মোচনের প্রচেষ্টা অবহেলিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৮ শতকে বাংলার দূর্ভিক্ষের পর ১৮৮৩ সালের জুন সাথে C.A. Elliot, Famine Code এর খসড়া তৈরি করেন। সেখানে ত্রাণ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে প্রাণহানি প্রতিরোধ করবার কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং এটা অাশা করা যায় যে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে অারও কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচত। তবে সেই দাবী অাদায়ের জন্য কোন অান্দোলনের খবর পাওয়া যায় না। Governor Rutherford একটি ব্যক্তিগত মেমোতে লিখেছিলেন— 'Famine Code প্রয়োগ করা হয় নি তার কারণ নিয়মমত রেশন দেবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য অামাদের কাছে ছিল না’। Viceroy Lord Wavell মনে করিয়ে দেন— ‘যতক্ষণ না বাংলার খাদ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, ততক্ষণ অামাদের পূর্বের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ ফলত Famine Code এর সহায়তাটুকু ঐ মানুষদের জোটে নি। যদিও বাংলার সাধারণ মানুষ এবং সংবেদনশীল মানুষ, তাদের যথাসাধ্য পাশে দঁাড়াবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের একত্র করে পরিচালিত করবার মত রাজনৈতিক শক্তি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে নি।
১৯৪২ সালে গৃহবন্দী হবার পর মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৩ সালে অনশন শুরু করবার জন্য স্থির করেন। তার এই সিদ্ধান্তের কথা তিনি বড়লাটকে চিঠির মারফৎ জানান। অনশন শুরু করবার অাগে এই বিষয়ে তিনি মোট তিনটি চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিটি চিঠিতে তিনি অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কারণের সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্যের অভাবের কথা উল্লেখ করেন।
ইতিমধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধকরণের অাদেশ ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল
কম্যুনিস্ট পার্টিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যারা মহাত্মা গান্ধীর সতর্কবাণী গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছিল। তারা সে কথা মার্চ ১৯৪৩-এর কম্যুনিস্ট পার্টির চতুর্থ ইন্টারন্যাশনালে লিখিত রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল। সে কথা কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’তে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল ‘দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য গান্ধীজীর অনশন’ শিরোনামে।
উপরের বিবৃত ঘটনাপঞ্জী বাঙ্গালী জাতিসত্তার এক ভয়ংকর গণনিধনের ব্যাপকতার চিত্র হিসাবে খুবই সংক্ষিপ্ত এবং অপ্রতুল। তবে দিশাহীন বাঙ্গালী জাতিসত্তার চেহারা এর মধ্যে থেকেই অামরা ধারণা করে নিতে পারি। যে বাঙ্গলায় শুধুমাত্র খাবার না পেয়ে, খাবারের অভাবের জন্য তিরিশ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যে বাঙ্গলায় সেই মৃত্যুমিছিলের বিরুদ্ধে কোন ঐক্যবদ্ধ অান্দোলন গড়ে ওঠে না। ফেমিন কোড বলবৎ করবার দাবী ওঠে না। Denial to Rice এবং Denial to Boat আইনের বিরুদ্ধে কোন ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ওঠে না। সেই বাঙ্গলার বাঙ্গালী আমরা আজ আবার এক অনিশ্চিত সঙ্কটের সামনে দিশাহীন মত্ততায় মগ্ন।
তথ্যসূত্র:
১) Bengal Famine (1943) : As revealed in Survey of the destitutes in Calcutta by Tarak Chandra Das
২) অানন্দমঠ — বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩) Famine in Bengal 1770-1943 - Kali Charan Ghosh
৪) Hungry Bengal: War, Famine, Riot and the end of Empire 1939-1946 — Janam Mukherjee.
৫) The Famine Code — K.S. Singh
এক
Stockholm International Peace Research Institute-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে খরচের শতকরা ৬২ ভাগ পাঁচটি রাষ্ট্র খরচ করেছিেলা। পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রগুলোর নাম— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া ও সৌদি আরব। SIPRI-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রথম অস্ত্র আমদানিকারক রাষ্ট্র সোদিআরব ও দ্বিতীয় ভারত। ভারতকে অস্ত্র সরবরাহকারী রাষ্ট্রসমুহ যথাক্রমে রাশিয়া, ফ্রান্স, ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পঞ্চম রাষ্ট্র সৌদি অারব গত ছয় বছর ধরে ইয়েমেনে লাগাতার বোমা বর্ষণ ও মিসাইল নিক্ষেপ করে চলেছে। ২০২০-র শেষ দিনেও ইয়েমেনের রাজধানী সানার পনেরোটা স্থানে সৌদি আরবের বোমারু বিমান হানা দিয়েছে। এর অাগের দিন ৩০ ডিসেম্বর সৌদি অারবের রাজধানী িরয়াধে নির্বাসিত ইয়েমেনি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ইয়েমেনের এডেন বিমান বন্দরে যখন নামেন সেখানে এক বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়। এই বিষ্ফোরণে মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেউ অাহত না হলেও, কুড়িজন সাধারণ মানুষ নিহত হন। এদের মধ্যে ৫ জন অান্তর্জাতিক রেডক্রস-এর ও ১৫জন এডেন বিমান বন্দরের কর্মী।
২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ইয়েমেনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অালি আব্দুল্লা সালের প্রতি অনুগত সামরিক বাহিনীর ইউনিটগুলোর সহায়তায় ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ঢুকে পড়ে। তারা রাষ্ট্রপতিভবন সহ সরকারি ভবন ও সামরিক দপ্তরগুলোতে হামলা চালায়। রাষ্ট্রপতি মনসুর হাদি ও তার সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। হুথি সশস্ত্রগোষ্ঠী রাজধানী সানা সহ অারও কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। ইয়েমেনের সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি হাদি সৌদি অারবের রাজধানী িরয়াধে অাশ্রয় নেন ও সেখান থেকেই সরকার পরিচালনা করতে থাকেন। ২০১৬-এর ফেব্রুয়ারীতে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে হুথির সমালোচনা করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। রাষ্ট্রপতি হাদি পরিচালিত সরকার অান্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সহযোগী সৈন্যদের মোর্চা এবং রাষ্ট্রপতি হাদির অনুগত সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়।
হুথি ইয়েমেনের অন্যান্য অঞ্চল দখল করতে চায়। হুথিকে রুখতে সৌদি অারব, সংযুক্ত অারব অামিরশাহি সহ নয়টি রাষ্ট্রের কোয়ালিশন হাদি সরকারের সমর্থনে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। গত বছরের শেষের দিকে সংযুক্ত অারব অামিরশাহি এই কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে অাসে ও Southern Transitional Council নামে ইয়েমেনের আর একটা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে মদত দিতে থাকে। ৩০ ডিসেম্বর এডেন বিমান বন্দরে বিষ্ফোরণ ঘটানোর জন্য এই সংগঠনটাকেই দায়ী করা হচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই কোয়লিশন হুথি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ২০১৫-এর ২৫ মার্চ বোমাবর্ষণ শুরু করে এবং গত ছয় বছর ধরে বিমান হানা ও মিসাইল নিক্ষেপ করে চলেছে। শুধু সামরিক ঘাঁটি নয়। বাসভূমি, ইস্কুল, হাসপাতাল অনুষ্ঠানবাড়ি সবকিছুই অাক্রমণের লক্ষ্য। ইয়েমেন এখন ধ্বংসস্তপে পরিণত। হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠীও রাষ্ট্রপতি হাদির অনুগত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোতে নির্বিচারে মর্টার অাক্রমণ চালায়। ছয়বছর ধরে চলতে থাকা এই সংঘর্ষে এক লক্ষেরও বেশি সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। শুধু বোমাবর্ষণ বা মিসাইল নিক্ষেপেই ক্ষান্ত হয়নি, আকাশ, জল, স্থল তিনপথেই সৌদি অারব ইয়েমেনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জ্বালানির অভাবে পাম্প চালানো যাচ্ছে না। সেচ কার্য বন্ধ থাকার ফলে চাষ বন্ধ। জিনিসপত্রের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি ও কার্যহীনতা ইয়েমেনের মানুষদের অভুক্ত থাকতে বাধ্য করছে। ত্রাণই এখন ইয়েমেনিদের ভরসা। অবরোধের ফলে ত্রাণও ঠিকমত পৌঁছায় না। রাজধানী সানার হাসপাতালগুলোতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের ভীড়। সংবাদপত্রে ছয় বছর বয়সী শামিমের ছবি ছাপা হয়েছে, শামিমের ওজন ছয় কিলোগ্রামেরও কম। শামিম ‘সিভিয়্যার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন’-এর শিকার। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব অান্তোনিয়ো গুতেরেস অাশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ইয়েমেনে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে চলেছে। এই দুর্ভিক্ষ বিগত কয়েক দশকে মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি।
সৌদি অারব ও সংযুক্ত অারব অামিরশাহী বর্তমানে ভারতের দুই বন্ধু রাষ্ট্র। ২০১৭ সালে সংযুক্ত অারব অামিরশাহীর যুবরাজ মহম্মদ বিন জায়েদ অাল নাহিয়ান ও ২০১৯ সালে সৌদি অারবের যুবরাজ মহম্মদবিন সলমান ভারত সফরে এলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিমান বন্দরে উপস্থিত হয়ে তাদের অালিঙ্গন করেন। সংযুক্ত অারব অামিরশাহী সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান অর্ডার অব জায়েদ অর্জন করেন। সৌদি অারব নরেন্দ্র মোদীকে রাজা অাব্দুল্লা শাহ পুরস্কার প্রদান করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এম নরবানে গত ডিসেম্বরে সংযুক্ত অারব অামিরশাহী সফরে গিয়েছিলেন। এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে ইজরায়েলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করার কথা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে অাছে অাকাশ মিসাইল সিস্টেম। ভূমি থেকে অাকাশ— এই মিসাইল ২৫ কি.মি. দূরের লক্ষ্যবস্তুকে অাঘাত হানতে সক্ষম। হয়তো, অাগামীদিনে ইয়েমেনে এই মিসাইল অাছড়ে পড়বে।
ভারতের তিন বন্ধু রাষ্ট্র ইজরায়েল, সৌদি অারব, সংযুক্ত অারব অামিরশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী মানুষেরা সোচ্চার। ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে ও বাকি দুটি রাষ্ট্র ইয়েমেনে সাধারণ মানুষদের হত্যা করে নিজেদের হাত রাঙিয়েছে। সম্প্রতি International Criminal Court (ICC) রায় দিয়েছে, প্যালেস্টাইন ভূমিখন্ডে ইজরায়েল অান্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে যে সমস্ত কার্যকলাপ চালাচ্ছে তা যুদ্ধ-অপরাধ কিনা, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা হবে। ইজরায়েলের যুক্তি ICC তা করতে পারে না। কারন, ইজরায়েল ICC তে যোগ দেয় নি। ভারতও ICC তে যোগ দেয় নি। Rome Statute-এর খসড়া রচনাকালে ভারত সক্রিয় অংশগ্রহন করলেও, পরবর্তীতে ভারতের আশঙ্কা হয় কাশ্মীরে ICC অনুসন্ধান চালাতে পারে। তাই ভারত এই statute-এ স্বাক্ষর দান করেনি। ICC-র রায় ঘোষনার পর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। ভারত সরকার এই বিষয়ে এখন পর্য্যন্ত নিরপেক্ষ অাছে। ছয় বছর আগে UN Human Rights Council-এ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে এক প্রস্তাব গ্রহনের সময় ভারত ভোটদানে বিরত ছিল। সেই সময়ও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করেছিলেন বন্ধুত্বের তাগিদে ভারত ভুটানকে ইজরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পক স্থাপনে বাধ্য করেছে। এই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রপ্রধানদের রক্তরাঙানো হাতের সঙ্গে করমর্দন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গর্বিত। কারন তিনিও রক্ত দিয়ে হাত রাঙাতে ভালবাসেন।
দুই
উত্তরপ্রদেশ সরকারের হাতিয়ার Unlawful Religious Conversion (Prohibition) Ordinance, 2020 এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারের হাতিয়ার Madhya Pradesh Dharma Swatantra Vidheyah 2020 (MP Freedom of Relogion Bill)। এই দুই হাতিয়ারের লক্ষ্য এক - মুসলিম ছেলেদের জেলে পুরতে হবে ও হিন্দু মেয়েদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে হবে। ২০১৪তে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারে পথসভা ও পোস্টারের মাধ্যামে মুসলিম বিরোধী প্রচার চলতে থাকে। মুসলিম তরুণদের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এরা ধর্ষণ, অপহরণ এইসমস্ত অপরাধমূলক কাজকর্মে সিদ্ধহস্ত। মুসলিম তরুণরা বিদেশ থেকে অর্থ পায় ও সেই অর্থে দামি পোষাক, মোবাইল কিনে হিন্দু মেয়েদের প্রলুব্ধ করে ও বিয়ের প্রস্তাব দেয়। হিন্দু মেয়েরা প্রলোভিত হয়ে বিয়ের আগে ধর্মান্তরিত হয়।
বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার এক বছর আগে ২০১৩ তে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে এক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ৫০ জন ব্যক্তি মারা যান ও ৫০,০০০-এর ওপর মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। দুজন জাঠ তরুণ, গৌরব ও সচিন তাদের বোনকে উত্যক্ত করার অভিযোগে একজন মুসলিম তরুণকে হত্যা করেন। এরপর ঐ দুই জন জাঠ যুবকও খুন হয়ে যান। তাদের খুনের অভিযোগে সাতজন মুসলিম দোষী সাব্যস্ত হন ও তাদের যাজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
গৌরব ও সচিন খুন হয়ে যাওয়ার পর তিন বিজেপি নেতার সঙ্গীত সোম, সুরেশ রানা ও সঞ্জীব বালিয়ান ইন্ধনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এই সঙ্গীত সোম, ২০১৪ থেকে ইন্টার-ফেইথ বিয়ের (বিজেপির ভাষায় 'লাভ জেহাদ') বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার শুরু করেন। ২০২০-র নভেম্বরে তিনি সমাজ মাধ্যমে বলেন, “You must teach the love jihadis a lesson. Danda urthao ya juta, but teach these love jihadis a lesson. It is up to the Hindus to protect their sisters and daughters”।
হিন্দু মেয়েদের মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করাটা আটকাতে হবে - তা সে বলপ্রয়োগ করেই হোক বা আইনের সাহায্যেই হোক। ২০২০-র ৩১ অক্টোবর এক নির্বাচনী সভায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন,I warn those who conceal identity and play with our sister's respect, if you don't ment your ways, your Raam Naam Satya journey will begin'।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই যোগী আদিত্যনাথ ইন্টার-ফেইথ বিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ২০২০-র আগস্টে মুখ্যমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে 'লাভ জেহাদ' বন্ধ করার জন্যনিরদেশ দেন। কানপুরে ১৪টা ইন্টার-ফেইথ বিয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুলিশের কাছে দায়ের করা হয়। মেয়েদের পরিবারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ দায়ের করতে উৎসাহ যোগায়। এই ধর্মান্তকরণ ও বিয়েগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানোর জন্য কানপুরে সিট (SIT) কে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সিট তদন্ত করে জানায়, এই বিয়েগুলোর পিছনে কোন ষড়যন্ত্র বা কোন সংগঠনের ভূমিকা বা বিদেশি অর্থের খেলা নেই। কিন্তু ৩৬৩ ও ৩৬৬ ধারায় (অপহরণ ও জোর করে বিয়ে) মুসলিম তরুণদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তিনজন মেয়ে সাবালিকা ছিলেন। তারা জানান স্বেচ্ছায় তাঁরা বিয়ে করেছেন। কিন্তু এই তিনটে বিয়ের ক্ষেত্রে তিনজন মুসলিম যুবককে জেলে পাঠানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, ক্রাইম ব্যুরো অপরাধ সংক্রান্ত যে সব তথ্য পেশ করে তাতে হিন্দু মেয়েদের অপহরণ বা মুসলিম ছেলেদের বিয়ে করতে বাধ্য করা সংক্রান্ত কোন তথ্য থাকেনা।
উত্তরপ্রদেশ সরকার যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে ধর্মান্তরিত মেয়েটাকেও জেলে পোরা হবে, স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হলেও। আসলে এই অর্ডিন্যান্স মেয়েদের সুরক্ষার নামে তাদের নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করার অধিকার কেড়ে নিয়ছে। আইনজীবী রাম পুনিয়ানির মতে, “The 'love jehad' propaganda is a double-edged weapon. By stating that Muslim youth are being trained to lure Hindu girls, onthe one hand they domise Muslims and on the other, they tighten their control of the lives of girls and women. In this propaganda, Hindu women are projected as gullible, easy to be lured and incapable of deciding for themselves. In a way, the communal agenda's twin goals are achieved here. Communal politics wants to marginalise the religious minorities at the ddeeper societal level it aims to restrict the rights and freedom of women.’’
হিন্দু মেয়েদের মুসলিম ছেলে বিয়ে করা আটকাবার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। অথচ, হিন্দু ছেলেরা মুসলিম মেয়ে বিয়ে করতে পারে ও মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারে। বজরং দল হিন্দু ছেলেদের অহিন্দু মেয়েদের উৎসাহিত করার জন্য শ্লোগান তুলেছে 'বহু লাও, বেটি বাচাও'।
'Demographic aggression' - হিন্দুদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করা হয়েছে। মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ও হিন্দুরা ভারতে একদিন সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী, হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৯৬৬.৩ মিলিয়ন (৭৯.৮%), মুসলিম জনসংখ্যা ১৭২.২ মিলিয়ন (১৪.২%), খ্রীষ্টান ২৭.৮ মিলিয়ন (২.৩%), শিখ ২০.৮ মিলিয়ন (১.৭%)। এক দশকে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ জন্মহার বৃদ্ধি নয়। মুসলিম মহিলা ও শিশুকন্যাদের মৃত্যুহার কমে গেছে।
মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে ভারতে হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে - বিজেপি ও তার সহ সংগঠনগুলোর এই disformation campaign-এর উদ্দেশ্য হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা আর মুসলিমভীতির ভয় দেখিয়ে হিন্দু মেয়েদের পায়ে বেড়ি পড়ানো। বিজেপি, আর এস এস, হিন্দুমহাসভা, বজরং দল এই সংগঠনগুলো শুধু মুসলিম বিদ্বেষী নয়, নারী বিদ্বেষীও।
সূত্রঃ Frontline, 18 December, 2020
আশ্বিন মাস, কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকার রাত, এক আকাশ তারা। আর কয়েকদিন পরই মহালয়া, বেশ শীত রয়েছে, সন্ধে ৭টা বাজে, ঘন অন্ধকার, অরূপদা আর আমি দুজনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি আমলাশোল গ্রামের মাঝে, ‘সবার ঘর’এর বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। ‘সবার ঘর’ আমলাশোলের স্থানীয় কমিউনিটি হল, গ্রামে ঢোকার রাস্তার উপর চারিদিকের জঙ্গল পাহাড় ঘেরা উপত্যকার চাষের জমির মাঝে। আকাশ ভর্তি তারার আলোয় চারপাশে জঙ্গলে ঢাকা উঁচু পাহাড়ের অস্পষ্ট ছায়া, দুরে অন্ধকারের মধ্যে গ্রামের ঘরে একটা দুটো লন্ঠনের আলো। নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল অরূপদার সঙ্গে, তার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল ওনার মতো কলকাতায় বড় হওয়া মানুষ কেমন করে ছোটনাগপুরের এই প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে এসে পৌঁছালেন। অরূপদার এখানে আসার শুরু ২০০৫-০৬ থেকে বন্ধু দীপক বড়াপন্ডার উৎসাহে এই আদিবাসী গ্রামের কচি কাঁচাদের ইস্কুলের জন্য, এখনকার জঙ্গল আর মানুষের টানে। সমাজ সেবার জন্য নয়, কারুর উপকার করার জন্য নয়, দয়া পরবেশ হয়ে নয় বা কারুর কাছে কিছু প্রমাণ করার তাগিদে নয়, এক ভালোবাসা, ভালোলাগার সম্পর্কের তাগিদে এই আসা। শুনছিলাম সেই অদ্ভুত সম্পর্কের কথা, সময়ের সাথে একজন আধুনিক ভারতের নগরসভ্যতায় পুষ্ট উচ্চশিক্ষিত মানুষের সাথে জঙ্গলে ঘেরা ভারতবর্ষের প্রাচীন নিরক্ষর আদিবাসীদের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা। দুই বিপরীত জগৎ একে অপরকে আকর্ষণ করেছে, কাছে এনেছে, আর চলেছে পরস্পরের কাছ থেকে জানার, শেখার আদান-প্রদান। জঙ্গল পাহাড় আর আদিবাসীরা ওনার সামনে নিয়ে আসে প্রকৃতির গভীরতম সৌন্দর্য আর উনি ওদের সামনে খুলে দেন আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি তার ভাষা আর গণিতের সুন্দর জগত। অরূপদা আসেন এই সরল মানুষদের টানে, এই বিশাল নক্ষত্র খচিত আকাশের নীচে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা আদিম বনানীর টানে, নিজের তাগিদে, ভালো লাগে বলে আসেন।
দিনটা ছিল ২রা অক্টোবার ২০১০, সেদিন সকালেই কলকাতায় প্রথম অরূপদার সঙ্গে আলাপ। আভিজিতদার কাছে শুনেছিলাম উনি এই আদিবাসী গ্রামে বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল চালান কলকাতার এক নামী কলেজের নিজের ব্যস্ত অধ্যাপনার বাইরে। সেদিন উনি এবং আরো কয়েকজন এখানকার মানুষদের জন্য শীতের জামা কাপড় নিয়ে আসছিলেন একটা টাটা সুমো গাড়িতে, দুদিন ছুটি তাই আমিও জুটে যাই ওনাদের সঙ্গে কাঁকড়াঝোড় আর আমলাশোলের জঙ্গল আর পাহাড়ের লোভে। লম্বা যাত্রা, সকালে কলকাতা থেকে বেরিয়ে ঝাড়গ্রাম, শিলদা, বেলপাহাড়ি হয়ে আমলাশোল পৌঁছই বিকালে। শিলদা ঢোকার আগে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুলিশের জীপ আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা কোথায় যাচ্ছি, আমলাশোল শুনে এবং অরূপদার পরিচয় পেয়ে সহজেই যেতে বলল। বুঝলাম নকশাল আন্দোলনের জন্য এই অঞ্চলের গাড়ির আসা যাওয়ার উপর নজর এবং একই সঙ্গে কে কি করছে কোথায় যাচ্ছে তারও খবর আছে পুলিশের কাছে।
পথে বেলপাহাড়ির পরে ওদোলচুয়া পেরোনোর সময় মনে পড়ে গেল আমার প্রথম কাঁকড়াঝোড় আসার কথা। কলেজে পড়ার সময় ১৯৮৪-৮৫ সাল নাগাদ, চার বন্ধুর হঠাৎ অ্যাডভেঞ্চারের উৎসাহে বেরিয়ে পরা। ট্রেনে ঝাড়গ্রাম আর সেখান থেকে বাসে করে বেলপাহাড়ি হয়ে ওদোলচুয়া তারপর প্রায় ১৫কিমি পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মোরামের চড়াই উৎরাই রাস্তা ধরে হেঁটে পড়ন্ত বেলায় পৌঁছেছিলাম কাঁকড়াঝোড়। স্থানীয় লোকে বলেছিল উদুলচুয়া থেকে উপত্যকার মাঝখান দিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা একটা শর্টকাট রাস্তা আছে কিন্তু জঙ্গলে পথ হারানোর ভয়ে আমরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে অনেক লম্বা পথে চওড়া মোরামের রাস্তা নিয়েছিলাম। রাত কাটিয়েছিলাম গোপীনাথ মাহাতো নামে ওখানকার এক বড় সম্পন্ন চাষির বাড়িতে। তার বাড়ির একটু আগে পাহাড়ের উপর ছিল সাজানো ফরেস্ট বাংলো, শহুরে পর্যটকের জন্য, যেখানে কলকাতা থেকে অনেক টাকা দিয়ে বুকিং করতে হ’ত। সেই সময় ধারণাই ছিল না যে কাঁকড়াঝোড়ের পরেও জঙ্গলের ভিতর কোন গ্রাম আছে আমলাশোল বলে। এ’ত বছর পরে এসে দেখলাম সেই উপত্যকায় রাস্তা পিচের হয়েছে কাঁকড়াঝোড় পর্যন্ত, দিনে সেই রাস্তা দিয়ে নাকি একটা বাস চলে ঝাড়গ্রাম থেকে কাঁকড়াঝোড় পর্যন্ত। সেখান থেকে কিলোমিটার দুয়েক আমলাশোল পৌঁছানোর রাস্তা কাঁচা। সেই রাস্তা দিয়ে টাটা সুমোতে আমলাশোল আসতে কোন অসুবিধা হয়না।
অনেক বছর পরে এসে বুঝলাম জঙ্গল অনেক পাতলা হয়েছে, কিন্তু বেলপাহাড়ির পর থেকে এদিককার জঙ্গলের আদিবাসী গ্রামের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, কেবল অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে নকশাল আন্দোলন, আর সেই সুবাদে এই অঞ্চলে জায়গায় জায়গায় পুলিশ, বড় বড় আধাসামরিক বাহিনীর ক্যাম্প আর সশস্ত্র জোয়ানের উপস্থিতি। সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে ২০০৪ সালের আমলাশোলে অনাহার মৃত্যু আর নকশালদের কাঁকড়াঝোড়ের সেই ফরেস্ট বাংলো জ্বালানোর খবরে আমলাশোল/কাঁকড়াঝোড় বেশ নামকরা জায়গা হয়ে উঠেছে। ওদোলচুয়ার আগের আধাসামরিক বাহিনীর ক্যম্পের সামনে আবার আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে আর একবার জিজ্ঞাসাবাদ এবং শিলদার পুলিশের মতো এদের এখানেও এই স্কুল আর অরূপদার ব্যাপারে ভালো খবর আছে তাই কোন ঝামেলা ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছিল। আমলাশোল ঢোকার আগে দেখলাম কাঁকড়াঝোড়ের জ্বলে যাওয়া ফরেস্ট বাংলো পরিণত হয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর ক্যম্পে।
প্রথমে গিয়েছিলাম গ্রামে ঢোকার আগে ডান দিকের রাস্তায়, জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি এবড়ো খবড়ো রাস্তা ধরে নতুনপাড়া হয়ে, কেন্দগোরা টোলার সেই স্কুলে একটা বড় পাহাড়ি নালা পেরিয়ে। জঙ্গলের মধ্যে একা বিকালের আলোয় দাঁড়িয়ে লম্বা খড়ের চালের একটা ঘর যার ছাদের অর্ধেক খড়ের আর বাকি অর্ধেক টিনের, ঘরের সামনে শালবল্লার খুঁটি দেওয়া মাটির বারান্দা। তার চারপাশে বাঁশের বেড়া। এই ঘরের মালিক দান করেছেন এই ঘর বাচ্চাদের স্কুলের জন্য। তার সামনেই একটা জায়গার সঙ্গে বেমানান পাকা চার কামরার আধ-তৈরি, একতলা বাড়ি, ছাদের ঢালাই হয়েছে, প্লাস্টার এখনো বাকি, জানলা কপাটের কোন খবর নেই। এখানকার স্থানীয় বিধায়কের বদান্যতায় তৈরি হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। নকশালদের ভয়ে সরকারি ঠিকাদার আসতে ভয় পায়, তবু পয়সার জন্য মাঝে মাঝে এসে মিস্ত্রি আর কাজের লোক নিয়ে কিছু কাজ করে যায়।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যার মুখে আমরা পৌঁছেছিলাম ‘সবার ঘরে’। একটা বড় পাকা দেওয়ালের ঘর, ছাদ টিনের, এক দিকের দেওয়াল একটু ভাঙা মতো, রাতে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা। আমরা স্কুলে পৌঁছানোর পর থেকে বিভূতি, লক্ষ্মী, জগদীশেরা ছয় সাতজন, এক এক করে হাজির হয়েছে গ্রামের নানা টোলা থেকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে শীত বাড়ছে, সবার ঘরের মেঝেতে খড় পাতা হয়েছে তার উপর শতরঞ্চি আর গায়ে দেবার জন্য কতকগুলো কম্বল, আমরা চার জন আর গ্রামের জনা-চারেক থাকবেন আমাদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে অরূপদা স্কুল নিয়ে আলোচনা করছেন। রাত্রে খাওয়ার জন্য আনা হলো মুড়ি পেঁয়াজ আর চানাচুর। অরূপদা বলছিলেন এখানে উনি খুব কম দিনই রাত কাটিয়েছেন কারণ এই গ্রামে কোন পাকা স্যানিটারি ল্যাট্রিন নেই আর অরূপদা মাঠে প্রাতঃকর্ম করতে অভ্যস্ত নন যা এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। উনি একবার দেখেছিলেন দুটি ছোট বাচ্চা সরু নালায় জমে থাকা ঘোলা জল পান করছে, ওনার কাছে যা ছিল অবিশ্বাস্য, বুঝতে পারি এই ঘটনা ওনার মনে গভীর দাগ কাটে। এখনকার বেশিরভাগ মানুষের পরিষ্কার পানীয় জলেরই ব্যবস্থা নেই। কিছু পাড়ায় পানীয় জলের প্রয়োজন মেটে হাতে গোনা দু-একটা কুয়ো থেকে। অনেকেই মাঠে বয়ে যাওয়া নালার জল খায় যখন নালায় জল থাকে। অভাব যেখানে নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিন ভাত খাওয়া যেখানে বিলাসিতা মনে হয়, সেখানে বাঁধানো স্যানিটারি ল্যাট্রিন এক অলীক কল্পনা। ওখানে শুনছিলাম যে ২০০৪-এ শবর পাড়ার দুইজন শবর মানুষের অনাহারে মৃত্যু এই অঞ্চলে কোন নতুন ঘটনা ছিল না। শবরদের জীবন এবং জীবিকা এই জঙ্গল ঘিরেই। আর যখন থেকে সরকার ওদের জঙ্গলের অধিকার কেড়েছে ওদের খাবারের অভাব বেড়েছে। কিন্তু সেই বিশেষ দিনে কোন সংবাদপত্রের সাংবাদিক এই খবর পেয়ে বিষয়টিকে শহরের মানুষের কাছে - মানে যাকে আমরা বলি মেইনস্ট্রীম - নিয়ে আসে খবরের মাধ্যমে, তারপরই প্রশাসন জেগে ওঠে, শুরু হয় রাজনীতি এবং অনেক অনেক লেখালেখি।
আমি সেই গভীর অন্ধকারে দেখছিলাম দুই সম্পূর্ণ আলাদা জগতকে; একদিকে প্রাচুর্য আর সম্পন্নতার আধুনিক শহুরে সভ্যতা অন্যদিকে জঙ্গলে ঘেরা দারিদ্র্য আর অভাবক্লিস্ট প্রাচীন আদিবাসী গ্রামীণ সমাজ। একদিকে রাতের ঘন কালো আকাশে ছায়াপথে ধুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তারা আর নীচের বিস্তীর্ণ বনানীর ভিতর ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। যারা এই জঙ্গলের ভিতর শত শত বছর স্বাধীনভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল আজ তারা নগর সভ্যতার উপনিবেশে পরিণত হয়ে তাদের বদান্যতার অপেক্ষায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
দুই
ওদোলচুয়ার পর থেকেই ক্রমাগত দেখা যায় শালবন ঝোপঝাড় উঁচু নিচু রাস্তা, পথে পড়ে দু-একটা নালা আর জঙ্গলের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে থাকা দু-একটা টোলা, এদিকের বেশিরভাগই সাঁওতাল গ্রাম। মাটির বাড়ির লম্বা বাইরের দেওয়াল সুন্দর করে নিকানো। তার গায়ে আঁকা জ্যামিতিক বিন্যাসে সুন্দর রঙিন নকশা। কতদিন দেখেছি ফ্রক পরা সাঁওতাল কিশোরী কাদা হাতে দেওয়াল ঘসে চলেছে, তৈরি করছে মাটির ক্যানভাস, এর উপর ফুটে উঠবে সুন্দর রঙিন ফুল লতা পাতা। এই রাস্তায় কতবার দেখেছি বয়স্ক মানুষ বা সাঁওতাল বউ বাবুই ঘাসের দড়ি পাকিয়ে চলেছে এক মনে। বুড়িঝোর, কদমডিহা পেরিয়ে মকড়ভুলার পর দুইদিকের পাহাড়ের চাপে সরু হয়ে যায় উপত্যকা, রাস্তা পাহাড়ের গায়ে উঠে সাত বাঁকির জঙ্গল ধরে একটা নালা পেরিয়ে কাঁকড়াঝোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। পুরো যাত্রাপথে এই জায়গা আমার খুব প্রিয়। একই জঙ্গলকে এখানে কত রূপে যে দেখেছি তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রবল রোদে ঝলসানো, ধুসর ক্লান্ত, ধুঁকতে থাকা বৃদ্ধ জঙ্গল, বর্ষায় জলে ভেজা সদ্যস্নাত উজ্জ্বল সবুজ শাড়ি পড়া সুন্দরী যুবতীর চেহারা নেয়, আবার মাঘের শীতে সেই জঙ্গলই পাতা ঝরার পর রুক্ষ শুষ্ক একাকী ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের রঙিন ফুল আর পাতার অপেক্ষায়। বসন্তে এই জঙ্গলই নতুন হলদে লাল সবুজ পাতায় সদ্য যুবার চেহারা ধারণ করে। ফাগুন চৈত্রে শাল গাছে ফুল আসে, আদিবাসী গ্রামে গ্রামে সেই শাল গাছের পুজোর উৎসব, শারুল।
সেই যে আসা শুরু হ’ল তা এখনো চলছে। লক্ষ্মী, বিরসা, বিভূতি, বাসন্তী, সাবিত্রী, কমল, সতীশবাবু, দুলালী, মিহির, সরস্বতি, মুখী, সোমবারি, রঞ্জিত, আরো আরো কতজন কখন আমার জীবনে ঢুকে গেছে কে জানে। আমিও ওখানকার কোন কাজ না করেও মাঝে মাঝে অরূপদার সঙ্গে জুটে যাই আমলাশোল যাত্রায় ঐসব পাহাড় জঙ্গলে আর শিলদার মোড়ের কিছু দোকানের মিষ্টি আর তেলেভাজার লোভে। এর মধ্যে ২০১১’র শেষ দিকে আমলাশোলের ৩০-৪০ কিমি দূরে কুশবনির জঙ্গলে কিসানজীর এনকাউন্টারে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এদিকের নকশাল আন্দোলনে ভাঁটা পড়েছে। জঙ্গলের দখল নকশালদের থেকে চলে গিয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে। প্রথমের দিকে ট্রেনে করে ঝাড়গ্রাম গিয়ে ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া হতো আমলাশোল। থাকার জায়গা আর টয়লেটের অভাবের জন্য রাত কাটানো হতো ঝাড়গ্রামের কোন ছোট হোটেলে। নকশাল আন্দোলনের জন্য সরকারের নজর পড়েছে এইসব জঙ্গলমহলের আদিবাসী গ্রামের মানুষের অভাবের দিকে। সেই অর্ধেক তৈরি স্কুল ২০১১-তেই সম্পূর্ণ হয়, তার উঁচু সিমেন্টের বারন্দায় কচি কাঁচাদের কিচির মিচির। সামনের মাটির ঘরগুলোকেও সারানো হয়েছে। সেখানে একটা ঘর ক্রেশ; যেসব বাচ্চাদের মায়েরা জঙ্গলে বা মাঠে রোজগারের জন্য যায় তাদের একদম খুদে বাচ্চাদের খেলার জায়গা; তারা বড় হতে থাকে এই স্কুলের পড়াশোনার পরিবেশে, আর একটা ঘর ভাঁড়ার হিসাবে ব্যবহার হয়, সেখানকার মাটির দাওয়ায় স্কুলের বাচ্চারা হাত আর থালা ধুয়ে দুপুরের খাবার খায়।
এরই মধ্যে কোন এক বসন্তের সকালে আমালাশোলের সকলের লক্ষ্মী মানে লক্ষ্মীকান্ত মুড়া আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপত্যকার অনেকটা দেখায়। আমলাশোল দলমা পাহাড়ের পুব দিকে পাহাড়ের উপর এক উপত্যকা আর এর ঠিক মাঝখানে, জঙ্গল আর পাহাড় থেকে নামা উত্তর পশ্চিমের দুটো নালা এসে মিশেছে, তারপর সেই নালা দক্ষিণ পূর্ব দিকে বয়ে কাঁকড়াঝোড়ের পশ্চিমের মাঠ হয়ে ঝাড়খণ্ডের খরসোতি নদীতে পড়েছে। তারপর খরসোতি হুলুং পেরিয়ে ঘাটশিলার পুবে সুবর্ণরেখায় মিশেছে। এই দুই মিলিত নালার ধারাই যমজ গ্রাম-দুটোর জীবনরেখা। বর্ষায় প্রচুর জল পাহাড়ের উপরের উপত্যকার এই নালা বয়ে পৌঁছায় সুবর্ণরেখায়। এই উপত্যকায় পুকুর খুবই কম দেখেছিলাম, একটা সরকারি বাঁধ রয়েছে নামো পাড়ায় যেখানে পাহাড়ের জল জমে। এছাড়া এখানে জল সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই, চাষে সেচের জলের তীব্র অভাব, গ্রামে মানুষের জলকষ্ট। লক্ষ্মী বলেছিল আশ্বিন কার্তিক মাস থেকেই এখানে শুরু হয় জলের অভাব আর জৈষ্ঠ্যে জলের হাহাকার। আগে ঘন জঙ্গল মাটির নীচের জলকে ধরে রাখত কিন্তু জঙ্গল পাতলা হবার ফলে মাটির নিচের জল ধারণ ক্ষমতা অনেক কমেছে। জল নেই বলে চাষ ভাল হয় না তাই লোকে আরো জঙ্গল কাটে আরো জল কমে আর অভাব আরো বাড়ে। জলই এইসব অঞ্চলের গ্রামের জীবন ও অর্থনীতিকে ধরে রাখে।
জঙ্গলঢাকা দলমা পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা হাতিদের আসা যাওয়ার পথ এই যমজ গ্রামদুটো। উপত্যকার মাঝবরাবর নালার পাশে চাষের জমি। জমি ঘিরেই উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁসে গ্রামের পাড়া বা টোলা, বসতির পিছনে পাহাড়-জঙ্গল। ধান পাকলে হাতিদের উপদ্রব বাড়ে। মহুয়া বা শাল গাছে মাচা বেঁধে রাত-পাহারা। হাতির দল ঢুকলে টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ধান বাঁচানোর চেষ্টা। আমঝর্না একটু উঁচুতে, উত্তর পশ্চিমের লাখাইশিনি পাহাড়ের কোল ঘেঁসে। ঝাড়গ্রাম জেলার শেষ গ্রাম আবার পশ্চিমবঙ্গেরও শেষ গ্রাম। এর পরের জায়গাটাকে ত্রিসীমানা বলে; একদিকে পুরুলিয়া আর অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব-সিংভুম জেলা। ওদোলচুয়া থেকে আসার পথে বেশ কয়েক জায়গায় কাঁচা রাস্তার মাথায় গাছের গায়ে বোর্ডে তীরচিহ্ন দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড লেখা দেখেছি কয়েক জায়গায়। শুনেছি এখান থেকে ঘাটশিলা মাত্র ২৫ কিমি কিন্তু রাস্তা ভালো নয় বলে আমাদের ঝাড়গ্রাম হয়ে আসতে হয়।
আমরা এলে স্কুলের মাস্টারমশাই লক্ষ্মী, বিভূতি, রঞ্জিতদের ব্যস্ত আনাগোনা, বাসন্তী দিদিমণির ক্লাস ফেলে হাসিমুখে এগিয়ে আসা, জয়ন্তী, সরস্বতীর দুপুরের খাবার তৈরির আয়োজন, ওরই ফাঁকে কখন লাল চা চলে আসে। এই কয়েক বছরে স্কুল শুধু বাইরের চেহারায় নয় এখনকার বাচ্চাদের জীবনযাত্রার মানেরও পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে। স্কুলের কোন ছেলেই চটি ছাড়া খালি পায়ে হাঁটে না। বইয়ের সাথে সাথে পোশাক ও চটির ব্যবস্থা হয়েছে। প্রথম প্রথম প্রায় ২৫-৩০ জন বাচ্চা ছিল, পরে তা বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছোট ছোট বাচ্চারা ক্লাসে ঢোকার আগে সুন্দর করে সাজিয়ে স্কুলের সিঁড়ির নিচে চটি খোলে, দুপুরের খাবার ঘণ্টা বাজলে আবার সুন্দর সারিবদ্ধ হয়ে হাত আর থালা ধুয়ে খেতে বসে। দুপুরের ছেলেদের খাওয়ার ব্যবস্থা এখানেই, আগে এর পুরো ব্যবস্থা অরূপদাকেই করতে হ’ত। এখন সরকার খাবার চাল দেয় কিন্তু উনি তার সাথে বাচ্চাদের পুষ্টির জন্য ডাল এবং সয়াবিন, রাজমা, ডিম আর কোন কোন দিন মাছেরও ব্যবস্থা করেছেন, গ্রামের শাক সবজিও কেনা হয়। স্কুল লাগোয়া জমির বেগুন বা অন্য সবজিও চলে আসে কখনো কখনো। অরূপদার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বাচ্চাদের স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতায়। পরিচ্ছন্নতার অভাবে এদিকে বাচ্চাদের খুব চামড়ার রোগ হ’ত এখন প্রায়শই সরকারি বেসরকারি মেডিকেল ক্যাম্প হয়। এছাড়া অরূপদাও বিভিন্ন সময়ে কলকাতা থেকে বন্ধু ডাক্তারদের নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের বাচ্চাদের, বড়দেরও।
চারিদিকে বড় বড় গাছ, শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-একটা শিমুল বা অন্য কোনও গাছ। এরই মাঝে বাচ্চাদের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে মাস্টারমশাইদের ভালবাসার ধমকানি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনও চলে নিজস্ব গতিতে, অহেতুক কোনো তাড়া নেই। অরূপদা ব্যস্ত কখনও মাস্টারমশাইদের নিয়ে কখনওবা কচি কাঁচাদের লেখাপড়ার ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে। এসবের মাঝে আমি কাউকে পাকড়ে স্কুলের কাঁচা আর পাকা ঘরের সামনে ছেলেদের খেলার জায়গায় ছোট একটা আমগাছের নীচে গল্প করি। বেশিরভাগ গল্পই, আমলাশোলের চাষবাস আর জীবন নিয়ে। বসার জায়গাটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমলাশোলের জীবনের মতোই বদলেছে। প্রথম যখন আসি এখানে বসার কোন ব্যবস্থা ছিল না, গাছটাও ছিল ছোট। দু-এক বছর পর ওই গাছের নীচে কাঠের পাটা দিয়ে চৌকো টেবিলের মতো মাচা বানানো হয়ছিল। মাচা ঘিরে বাঁশের বাতা দিয়ে চারদিকে সুন্দর বেঞ্চ। জনা বারো চোদ্দ লোক আরামে বসতে পারে। গাছটা বেড়ে ওঠার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসার জায়গাটাও বড় হয়ে গেল। স্কুলেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় শুরুর রাতের মুড়ি কখন ভাতে উঠে এল, খিদে পেটে কাঁচা ধোয়া-শালপাতার ওপর গরম ভাতের ধোঁয়া আর গন্ধ নিয়ে এক অলস আকর্ষণ। স্কুলের শেষে দেখি বাসন্তী দিদিমণি কোলে ছোট্ট মেয়ে জননীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আয়োজন করছে।
যমজ এই গ্রামে মোট ১২৫ ঘর মানুষের বাস। আমঝর্নায় মাত্র ২৫ ঘর মুণ্ডা ও ভুমিজ পরিবার। আমলাশোলে কম বেশি এক’শ ঘর মানুষ উপত্যকা ঘিরে পাঁচটা টোলায় ছড়িয়ে আছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই মুণ্ডা বা ভুমিজ। এছাড়া দুটো পাড়ায় প্রায় ২০ ঘর শবর, দুই তিন ঘর বৈষ্ণব আর মাহাতো আর এক ঘর কর্মকার। এদের ছেলে মেয়েরাই আসে এই স্কুলে পড়তে। আমলাশোল আমঝর্নার রাস্তার পাশে একটা পাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ১০-১৫ টি বাচ্ছা ওখানে পড়ে, সরকারি মাস্টারমশাই অনেক দিনই আসেন না কাজেই স্কুলের সরকারি খরচ চলতে থাকে, ছাত্র থাকে না।
অরূপদা বলেছিলেন, উনি যখন প্রথম আসেন তখন থেকেই দেখেন মুণ্ডারা, শবরদের নিচু জাতি বলে মনে করে। এমনকি তখন নাকি তাদের ছোঁয়াও খেতো না, শুনে অবাক হয়েছিলাম, এখনও মুণ্ডাদের চোখে শবররা একটু নিচুই। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, প্রত্যন্তের আদিবাসী গ্রামেও নিজেদের মধ্যে সেই জাতপাত, ছোঁয়াছুয়ির দূরত্ব। আমার দেশের একি দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধি! এর থেকে কি আমাদের কোথাও মুক্তি নেই? এই স্কুলের মধ্যে দিয়ে অরূপদা এই জাতিভেদের তফাতটা কিছুটা দূর করেছেন, শবরদের সঙ্গে সহজ মেলামেশা আর ওঠাবসায়, মুণ্ডাদের শবরদের সঙ্গে মেলামেশাকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন, ছ্যুৎমার্গ অনেকটাই কমেছে । এখন এই স্কুলে মুণ্ডা বাচ্চারা শবর বাচ্চাদের সঙ্গে সহজেই খেলে, একসঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে।
দু’হাজার এগারোর শেষের দিকে আমি প্রথম দেখি ইন্দ্র শবরকে। বড় কাঠামোর মানুষ, গায়ের রং রোদে পুড়ে কালো, এলোমেলো চুল, সামনের দুটো দাঁত ভাঙা। ছেঁড়া জামাকাপড়ের সঙ্গে সারা দেহে লেপ্টে রয়েছে অভাব আর দারিদ্র্য। অকালেই বুড়িয়ে যাওয়া নেশাকরা মুখে হাসি আর রাগ দুটোই। অল্প দূরেই স্কুলের পশ্চিম দিকে জঙ্গলের মধ্যে শবর পাড়ায় ইন্দ্রর বাড়ি। তিনটে নাগাদ স্কুল শেষের সময় যখন বড় গাছের ছায়ারা লম্বা হচ্ছে, সে হাজির হয়েছিল, সঙ্গে শতছিন্ন শাড়ি পরা স্ত্রী বুধনি, কোলে দুর্বল দুই তিন বছরের একটি বাচ্ছা, দেখলেই বোঝা যায় অপুষ্টিতে ভুগছে। রোগা দুর্বল বুধনির গায়ে জড়ানো একটা পরিষ্কার গোলাপি ফুল তোলা কম্বল, অরূপদা শহর থেকে যে সব শীতের জামা কাপড় এনেছিলেন হয়ত তারই একটা। কারুরই গায়ে মাথায় তেল নেই, স্বামী-স্ত্রী এসে অরূপদার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। অরূপদা মন দিয়ে ওদের কথা শুনে হাসি মুখে কিছুর আশ্বাস দিলেন। এরপর ধামসা-মাদলের সঙ্গে স্কুলের বাচ্ছাদের নাচ গান শুরু হোল, ইন্দ্র বাজাচ্ছিল ধামসা, স্ত্রী বুধনি হাসি মুখে অন্য মেয়েদের সঙ্গে একে অপরকে ধরে সেই পড়ন্ত আলোয় মুণ্ডারি গান গাইতে গাইতে ঘুরে ঘুরে নাচছিল। সেই আনন্দ উৎসবে চোখে পড়েনি শবর বাচ্চাদের সঙ্গে মুণ্ডা বাচ্চাদের হাসির কোন তফাৎ। শেষ বিকালের রোদে সেই আনন্দের গান আর নাচ ধামসা মাদলের তালে তালে জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।
এই সময় আমাদের বন্ধু সোমনাথ অরুপদার কাজে হাত বাড়িয়ে এসেছিল আমেরিকা থেকে; ২০১৫ নাগাদ। সেই সময় সে একদিন গল্প করতে ইন্দ্রর বাড়ি যায়। সেদিন ওরা খাবে বলে জঙ্গল থেকে মাটি খুড়ে তুলে এনেছিল একটা বড় ওলের মতো কন্দ। ইন্দ্র, বুধনি আর তার ছোট ছোট ছেলেরা সেই বড় ওলকে নুন দিয়ে সিদ্ধ করে খাবার আয়োজন করছিল তখন। ওরা হাসিমুখে ওদের সঙ্গে সোমনাথকেও সেই খাবার এগিয়ে দেয়, সোমনাথের ভালো লেগেছে শুনে ইন্দ্র রেখে দেওয়া বাকি ওল সোমনাথকে নিয়ে যাবার অনুরোধ করতে থাকে। যারা কাল কি খাবে জানেনা ওই বাকি ওলে হয়ত তাদের কাল চলে যাবে কিন্তু ওরা হাসিমুখে সেটাই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওর চর্চিত সভ্যতার সংস্কৃতিতে এই তুচ্ছ সঞ্চয়ের থেকে অতিথির তৃপ্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দশ বছরে আমি বহু বার আমলাশোলে এসেছি, কিন্তু কোন জিনিষ টাকা, পয়সা, চুরির কথা শুনিনি, ঘরের দরজা খোলা থাকলেও কেউ ভাবেও না অন্যের জিনিস নিয়ে নেওয়ার কথা। এ এক অন্য সভ্যতা অন্য জগত।
শুনেছিলাম বেশিরভাগ শবরদের মতোই তারও জমি খুব কম, চাষবাসের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই, বহু পুরুষ ধরে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল শবরদের এখন আর কোন অধিকার নেই জঙ্গলে। জঙ্গল এখন সরকারের আর সরকার কখনো শবরদের নয়। এখন সেই ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু জঙ্গল থেকে জংলি কন্দ শিকড় এসবের উপর নির্ভর করে চলে, কখনো মাঠের কাজেও যায় আর অল্প একটু টাকা পেলেই মহুয়ার নেশা। প্রথমে ভেবেছিলাম এতো বয়স্ক মানুষ তার এতো ছোট বাচ্ছা, পরে অরূপদার কাছে ২০০৬-০৭ সালের তোলা এক মাথা কোঁকড়ানো কালো চুল, সবল পেশিবহুল চেহারার ছাব্বিশ সাতাশ বছরের এক যুবকের খালি গায়ে হাসিমুখে বসে থাকার ছবি দেখি। অরূপদা বলেছিলেন ‘এটা ইন্দ্র’। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে পাঁচ ছয় বছরের সময়ের ব্যবধানে কোন মানুষের এরকম পাঁচ গুন বয়স বেড়ে যেতে পারে। আমার কাছে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক এটাই তো সত্যি, কলকাতায় যখন দেখি ষাট বছরের মানুষ যুবক থাকার তাগিদে মুখে বয়সের বলিরেখা ঢাকতে দামী ক্রিম মাখছে তখন ইন্দ্রদের এক এক বছরে এক দশক করে বয়স বাড়ছে।
শবররা চিরকালই জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল কিন্তু মুণ্ডারা বহুদিন ধরেই ছোটনাগপুরের পাহাড় জঙ্গল ঘেরা এরকম উপত্যকার জমিতে চাষবাসে অভ্যস্ত। কিন্তু এই দুই জনগোষ্ঠীই বিগত দুশো বছর ধরে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে এক সর্বগ্রাসী আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাকে, যার নাম সভ্যতা। আমাদের সেই সভ্যতার প্রবল প্রতাপে জঙ্গল শেষ হয়ে গেছে, ইন্দ্র শবরেরা হেরে গেছে, তারা চায়নি মানিয়ে নিতে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের সহজ জীবন আর জীবিকা।
তিন
ফাগুনের রাত, বাতাস বেশ গরম, আমালাশোলে আমাদের থাকার ঘরের বাইরে খটিয়ায় বসে বসে দেখছি পাহাড়ের উপর আঁকাবাঁকা হলুদ আগুন, জঙ্গলে আগুন দেওয়া হয়েছে ঝোপ ঝাড় জ্বলছে, মহুয়ার ফুল কুড়নোর প্রস্তুতি। আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠছে দেরি করে, মাথার উপরের লম্বা বড় গাছটার পাতা হাওয়ায় নাকি ভয়ে কাঁপছে, কে জানে। বসে বসে সাক্ষী হই, লাখাইশনির খাণ্ডবদহনে।
রাস্তার ওপাশে অন্ধকারে উঁচু করে রাখা আছে সতীশবাবুর শুকনো বাবুই ঘাসের পালুই। বাড়ির বাইরের ইলেকট্রিক বাল্বের আলোটা বড় অস্বস্তিকর। একটু পরেই দুলালী খেতে দেবে, যত্ন করে রুটি তরকারি। নতুন পাড়ায় রাস্তার ধারে আমাদের আমলাশোলের নতুন মাটির বাড়ি, টালি দিয়ে ছাওয়া, দুদিকে বারান্দা। ঘরের মাঝে এক টুকরো চৌকো চাতাল থেকে দেখা যায় এক টুকরো আকাশ। এখন গাছের ফাঁকে চাঁদ দেখা যাবে ঘরের দাওয়া থেকে। সেই প্রথম আসা থেকে এখন আমাদের থাকা আর খাওয়া অনেক বদলে গেছে, কিন্তু বছর বছর জঙ্গল এখনো জ্বলে। সকালে দেখবো বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে গায়ে পোড়া দাগ আর নীচের পুড়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের পোড়া ছাই আর আর কিছু না নিবে যাওয়া আগুন থেকে বেরোনো ধোঁয়া। মেয়েরা কোমরে ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ি পথে জঙ্গলে, মহুয়া কুড়োতে।
অনেক শীত গ্রীষ্ম আর বর্ষার মধ্যে দিয়ে আমলাশোলও অনেক বদলে গেছে। এরই মধ্যে আমিও কখনো কখনো অস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়ি বিভূতি, বিরশা, কমলদের সঙ্গে আমলাশোলের জল জমি আর চাষের কাজে আমার সীমিত জ্ঞানগম্যি নিয়ে। আমলাশোলের প্রথম ল্যাট্রিন তৈরি হয় স্কুলে, বেশ কয়েক বছর আগে, এখন আমাদের মাটির ঘর হলেও কমোড দেওয়া বাথরুমে কল খুললেই জল। সরকারি উদ্যোগে এখন সব পাড়াতেই খাবার জলের টিউবয়েল না হলে উপরের ট্যাঙ্ক থেকে পাইপের জল। গ্রামে বছর কয়েক হ’ল ইলেকট্রিক এসে গেছে। সরকারি চেষ্টায় রাস্তার অবস্থাও অনেক ভালো এখন আর ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে হয় না, ঘাটশিলা থেকে সহজেই সোজা পাকা রাস্তা দিয়ে হুলুং পেরিয়ে ঘটিডুবা হয়ে আমলাশোলের বীরসা চকের বাঁধানো রাস্তায় ওঠা যায়। দেখতে দেখতে গ্রামে এখন অনেক পুকুর, জলের অভাব অনেক কম। অনেক ঘরে এখন মোটর সাইকেল কিছু কিছু ঘরে ডিশ এন্টেনা লাগানো টেলিভিশন। আমার দেখা ২০১০-এর আমলাশোল গ্রাম আর এখানকার মানুষ অনেক বদলেছে।
বছর সাতেক আগে এক ভাদ্রে সবার ঘরের উল্টো দিকে সবুজ ধানগাছে ভরা বড় মাঠে দেখেছিলাম, উমাপদ আর তার স্ত্রী হাতে-ঠেলা মেশিনে সযত্নে তাদের ধানের খেতের আগাছা নিড়েন করতে। পুরো উপত্যকা জুড়ে সবুজের বন্যা, সবুজ জঙ্গল থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় লকলকে ধানগাছ খেলে বেড়াচ্ছে মাঠ জুড়ে। এর এক দুই বছর আগে আমলাশোলে Systematic Rice Intensification (SRI) পদ্ধতিতে চাষের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই ধান চাষের পদ্ধতি এতদিনের প্রচলিত পদ্ধতির থেকে আলাদা তাই প্রথম প্রথম এখানকার আদিবাসী চাষিদের মধ্যে প্রচুর সন্দেহ ছিল। কিন্তু এই স্বামী স্ত্রী সাহস করে এগিয়ে এসেছিল, যত্ন করে চাষ করে প্রচুর ফসল ফলায়। এদের সঙ্গে দেখেছি বিভুতির ভাই রোগা পাতলা কমলকে, সব সময় তার মুখে হাসি। সে মাঠ ভালোবাসে, চাষ ভালোবাসে, সেও এগিয়ে আসে বিভূতির সাথে নতুন চাষের পদ্ধতিতে। এখানে চাষে এরাই বিপ্লব নিয়ে আসে, তাদের ধান চাষের সুফল দেখে এখানকার অন্য চাষিরাও চাষের পদ্ধতি বদলাতে শুরু করেছে। এই সময়ে একবার শীতের শেষে একদিন স্কুলে আম গাছের নীচে বসে আছি, হাসিমুখে লজ্জা লজ্জা করে বিভুতি বলেছিল আমি এইবার তিরিশ হাজার টাকার ধান বিক্রি করেছি, এ আমার বাপ ঠাকুরদাও কখনো ভাবতে পারবে না।
এখন স্কুলের সঙ্গে চলে গ্রামের গরীব ছেলে মেয়েদের এক হোস্টেল, সেখানে তারা পড়ার সাথে সাথে গান বাজনা হাতের কাজও করে। মিহিররা স্বামী-স্ত্রী মিলে হস্টেলের বাচ্চাদের দেখাশোনার সাথে সাথে পাশের জমিতে খুব ভালো সবজি চাষ করে। এই রকমই কোন এক সময় স্কুলে দেখেছিলাম আট বছরের শান্ত পাতলা তনূ শবরকে কোলে ছোট বোনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে তার ছোট দুই বোনকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আসত পিছনের শবরপাড়া থেকে, বাবা লুলু শবর খুঁড়িয়ে হাঁটত আর তনুর মা মারা যাবার পর বেশিরভাগ সময় মদ খেয়ে পড়ে থাকে, কোন কাজ নেই। কাজেই তিন বোনের যার মধ্যে এক কোলের বোন, সবার দায়িত্ব তনুর উপর। অরূপদা কয়েকদিন দেখেন দুপরের খাওয়ার আগে তনূ স্কুলের একটু দুরে কোন একজন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলছে আর তারপর কিছু নেয়। কৌতূহলের ব্যাপার, এমনিতে চুপচাপ ছোট ছেলে কি কথা বলে দুপুরে ওই মানুষের সঙ্গে। অরূপদা জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে চুপ করে থাকে তারপর বলে যে সে সকালে কাঠ কেটে রেখে দিয়ে আসে, সেই কাঠ লোক এসে নিয়ে যায় আর পরে এসে সেই টাকার চাল জিনিস দিয়ে যায় যা দিয়ে তনূর পরিবার চলে। একই দেশে বড় শহরে যখন কুড়ি বছরের যুবক ‘বাবুসোনা’ তখন সেই দেশে আট বছরের তনূ শবর সংসার সামলে প্রাথমিক স্কুলে যাচ্ছে।
অরূপদা প্রথমে জোর দেন বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা আর পুষ্টির উপর, কিন্তু এই অভাবের দেশে পুষ্টি কোথায়? বুঝতেন যে বই পড়া শিক্ষার আগে দরকার ভাত তাই নানাভাবে চেষ্টা করতেন যাতে এখনকার লোকের জীবিকার উন্নতি হয়। ওনার সারা জীবন শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক, চাষবাস আর গ্রামের জীবিকার ব্যাপারে ওনার ধারণা খুব কম। তাই এই সব বিষয়ের নানা মানুষকে ধরে ধরে আনতেন যাতে এখনকার মানুষের রোজগার বাড়ে। কিন্তু জঙ্গল কমার সাথে পাহাড়ের উপরের এই গ্রামে কমেছে জল, সেই নালায় বর্ষার মাস তিনেক জল থাকলেও মাঘ ফাগুনে নালা শুকিয়ে যায়, আর জলের ব্যবস্থা না হলে, চাষ নির্ভর হয়ে পড়ে অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের উপর। কাজেই ধীরে ধীরে ওনাকে ঘিরে বাইরের নানা মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে গ্রামের মানুষ চেষ্টা করে পুকুর, বাগান আর ভালো চাষের। গ্রামের মানুষ পুকুরে মাছ ছাড়ে, ছেলেরা শিখেছে মোটর সাইকেল আর মোবাইল সারাতে, মেয়েরা শিখছে শেলাই, তারা গ্রামের আম আর অন্য সবজি দিয়ে বানাতে শিখেছে আচার। অনেক বাচ্চা এখন এই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের স্কুলে পড়ে। এরই সঙ্গে পঞ্চায়েত ও সরকারি প্রকল্পের কল্যাণে আমলাশোলে আরো কিছু হয়, বর্তমানে অনেক পুকুর, গ্রামে তুলনামূলকভাবে জলের অভাব বেশ কম ।
অরূপদার এই আশ্চর্য চলার পথে যোগ দিয়েছেন তার ছোটবেলার বন্ধু অমিতদা আর শাশ্বতদা। এরা ছাড়াও তাঁর অনেক ছাত্র আর দেশে বিদেশের ভালোবাসার মানুষ নিজেদের অজান্তেই জড়িয়ে গেছেন, নানা ভাবে হাত বাড়িয়েছেন। ওনাকে ঘিরে সহমর্মিতার সাথে নীরব সহযোগিতা চলতে থাকে অনেক কাছের আর দুরের মানুষের। আস্তে আস্তে ওনাকে ঘিরে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম নিয়েছে যার সাথে আমার মতো অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে গেছে। প্রথমদিন থেকেই দীপক বড়াপন্ডাও আছেন তাঁর এই কর্মযজ্ঞের সাথে। অভিজিতদা, বৌদি, শান্তনু এবং আরো কত মানুষ যে ক্রমাগত পথ চলেছেন তার সঙ্গে নানা সময়ে তার এই যাত্রায় তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ঝাড়গ্রামের অরুণাভ আর তার বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানের ঝাড়গ্রামের অফিস। অরুণাভর মা গ্রামের কিশোরী ও সদ্যযুবতী মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থসম্মত ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহারের কাজে এখনো সাহায্য করে চলেছেন। বন্ধু মনোজ স্কুলের বাচ্চা এবং মাষ্টারমশাইদের নিয়ে সিকিম, দীঘায় ঘোরাতে নিয়ে গেছে তাদের অন্য প্রকৃতির আস্বাদ দিতে। ফর্দের যেন শেষ নেই, না হওয়ারই কথা, কত জনের কথাই বা বলা যাবে এই ছোট পরিসরে।
সময়ের সাথে দুটো গ্রামের মুণ্ডা ভুমিজ পরিবারদের অভাব অনেকটা কমলেও শবরদের জীবনে পরিবর্তন খুব কমই এসেছে। ওদের চাষের জমি আগেও ছিল না সরকারি বদান্যতায় ঝোপঝাড় ঢাকা পাথুরে অল্প কিছু টাঁড় জমির পাট্টা পেয়েছে যাতে চাষের চেষ্টা করেও ভালো ফসলের আশা করা বৃথা। তবুও সরকারি সাহায্য, কখনো কখনো একশো দিনের কাজ আর সমাজসেবী কিছু প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে আর জঙ্গলের গাছ কাটার দৌলতে তাদের অবস্থা ২০১০’র থেকে তুলনামুলক ভালো। রাস্তা জল এবং বিদ্যুৎ এলেও কোন পরিবর্তন হয়নি গ্রামের শিক্ষার পরিকাঠামোর। কেন্দগোড়ার ঐ স্কুলে এবং আমলাশোলের সরকারি স্কুলে কেবল ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা, তারপর কাঁকড়াঝোড়ের হাইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া যায় আর দশ কিমি দুরে বুড়িঝোরের স্কুলই গ্রামের সব থেকে কাছের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। আসে পাশের পঁচিশ তিরিশ গ্রামের বাচ্ছাদের কাছের স্কুলের এটাই ব্যবস্থা, না হলে ছাব্বিশ কিমি দুরে বেলপাহাড়ি বা শিলদা। এইসব স্কুলে শিক্ষার মান নিয়ে যত কম বলা যায় তত ভালো। পুরো বিনপুর ২ ব্লকের শিক্ষার হাল একই রকম ভাবে খারাপ। শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনের বাজেটের ভগ্নাংশ খরচ করলেই এদিকে ভালো স্কুল তৈরি হয়ে যেত, অরূপদার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তার জলন্ত সাক্ষী।
সময়ের সাথে সাথে হয়তো দারিদ্রের প্রকোপ কিছু কমেছে কিন্তু জঙ্গল পাতলা হয়েছে, ঘন জঙ্গলের বড় বড় গাছেরা আর তাদের নীচের ঝোপঝাড় আগে পাহাড়ের মাটিকে ধরে রাখত আর বর্ষার জল জমাতো মাটির নীচে। পাহাড়ের গায়ের ঝর্নায় সারা বছর জল থাকত। কিন্তু জঙ্গল কমার সাথে সাথে এইসব ঝর্নারা শুকিয়ে আসছে। জঙ্গলে ঢাকা দলমা পাহাড়ের ইকোলজি আজ ছোটনাগপুরের আর পাঁচটা জায়গার মতোই বিপন্ন। এর সঙ্গে এই সব জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জন্তু, পাখী আর এখানকার আদিবাসী মানুষদের অস্তিত্বও বিপন্ন, যদিও আধুনিক সভ্যতার শিক্ষাহীন উন্নয়ন নামের এক ব্যবস্থায় এদের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে বাঁধার চেষ্টা চলছে। আমলাশোলও তার ব্যতিক্রম নয় বরং এক বড় উদাহরণ। এখন ওরা ধীরে ধীরে শিখছে শহুরে মেকী সভ্যতাকে নকল করতে। সরকারি প্রকল্পের সাথে ধীরে ধীরে ভ্রষ্টাচারও ছড়িয়ে এখনকার সমাজ জীবনে। এই আপাত উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদী হবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে।
এখনো প্রতি বছর নগর সভ্যতার চোখের অন্তরালে অনাহারে অপুষ্টিতে এই পাহাড় জঙ্গলের সব থেকে প্রান্তিক শবরেরা মারা যায় যেমন তনুর মা আর লুলু শবর চলে গেল চার অনাথ বাচ্ছাকে রেখে। বুধনীও মারা গেলো প্রবল দারিদ্র্য আর অপুষ্টিতে, ইন্দ্র সেই যে কাজের লোক যোগান দেওয়া ঠিকাদারের সাথে ব্যাঙ্গালোর না মাদ্রাজ কোথায় গেলো আর ফিরে এলো না। কারুর কিছু যায় আসেনি, এখানকার মানুষ মেনে নিয়েছে, আমরা মেনে নিয়েছি। এই স্কুল, হস্টেল আর অরূপদার জন্য ওদের দুই ছেলে অজয় আর তার ভাই আর তনুরা এখনো গ্রামে রয়ে গেছে, না হলে ওরাও কবেই হারিয়ে যেতো। এই সব গ্রাম নতুন ভারতের হিসাবের বাইরের গ্রাম, এইসব মানুষরা সভ্যতার হিসাবের বাইরের মানুষ, এদের জঙ্গল আর খনিজ, কয়লা, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ এইসবের প্রয়োজন আছে সভ্যতার। এইসব মানুষদের কোন প্রয়োজন নেই। তবুও এরা থেকে গেছে। তাই আমরা দয়া করি এদের, রেশনে সস্তা চাল, কিছু প্রকল্পের টিনের চালের পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনির পাকা বাড়ি দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করি, আর ঝুঁকে পড়া এইসব মানুষের ভোটের লোভে নির্বাচনের আগে ঘুরতে থাকে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তৈরি মাফিয়া রাজনৈতিক দলেরা, যাদের উপর একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারত দাঁড়িয়ে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে যে তিন জন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওড়িয়া লেখকের হাতে অাধুনিক ওড়িয়া সাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, তাঁরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অনুজপ্রতিম সমসাময়িক। তাঁদের মধ্যে সব চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, কবি ও ঔপন্যাসিক ফকিরমোহন সেনাপতি জন্ম লাভ করেছিলেন ১৮৪৩-এ (মৃত্যু ১৯১৮-য়), কবি রাধানাথ রায় জন্মান ১৮৪৮-এ (মৃত্যু ১৯০৮-এ), অার প্রাবন্ধিক ও কবি, তিনজনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, মধুসূদন রাও জন্মান ১৮৫৩-য় (মৃত্যু ১৯১২)। এই তিন জনের মধ্যে ফকিরমোহনের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে কটকের বাইরে। কটকই তখন ছিল ওড়িশার প্রশাসনিক সদর দপ্তর। ফকিরমোহন দেশীয় সামন্ত রাজ্যগুলিতে একজন প্রশাসক হিসেবে কাজ করার পর অধিক বয়েসে কটকে পাকাপাকি ভাবে বাস করার জন্য ফিরে অাসেন। কিন্তু অন্য দুজন জীবনের অধিক সময়ই কটকে কাটান এবং শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবিভাগীয় প্রশাসক হিসেবে নিজেদের অালাদা করে চিনিয়ে দেবার মতো কাজ করেন। বাস্তবিক পক্ষে, সে সময় ওড়িশায় শিক্ষার শক্তপোক্ত ইমারতটি তাঁরাই গড়ে দেন। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে পুরীতে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়-সূত্রে বাধা হন, যেখানে মধুসূদন ছিলেন একজন ছাত্র ও রাধানাথ সদ্য যোগদান করেছেন এক শিক্ষক হিসেবে। এই যোগাযোগের ফল প্রথম পাওয়া গেল ১৮৭৬-এ। দুই জনের কবিতা সংকলিত করে কবিতাবলি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। বস্তুত, ১৮৭৬ ছিল একটি জলবিভাজিকার মতো, যা নতুন সৃষ্টিশীল একটি প্রাণসত্তাকে সূচিত করে এবং নতুন নতুন মৌলিক কাজ প্রকাশিত হতে শুরু করে। নতুন একট প্রজন্ম এসেছিল। সৃষ্টির উন্মাদনায় ভরপূর। যেটির লালন হয়েছিল সাধারণ ভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারা ও অারো নির্দিষ্ট করে সমসময়ের বাংলা সাহিত্য এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্কার-অান্দোলন মারফত। এরকমই হবার কথা ছিল যেহেতু রাজনৈতিক ভাবে ওড়িশা, অথবা উত্তরের উপকূলবর্তী জেলাগুলো, যা নিয়ে তখনকার ওড়িশা বিভাগ, তার প্রশাসনিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত একটি অংশই ছিল। এ কারণেই তৎকালীন ওড়িয়া এলিট ভীষণ ভাবেই বাংলার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং বহু বিষয়েই তাঁদের পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান ছিল ততটাই উত্তেজক যতটা উদ্দেশ্যসাধক।
১৮৭৬ সালের মধ্যেই বাংলায় ও বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর এক অসামান্য পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি সাহিত্যে স্বতই অাগ্রহান্বিত ছিলেন না অথবা সাহিত্য সাহিত্যের জন্য এই মতেরও অনুবর্তী ছিলেন না। তিনি আগ্রহী ছিলেন এটিকে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কার্যোপযোগিতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে এবং উৎয় ক্ষেত্রেই ইতিমধ্যেই তিনি অবিস্মরণীয় ভাবে নিজের লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। তাঁর উজ্জ্বল, অগ্নিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব অনেকের কাছেই অার্দশ ছিল এবং বিশেষ করে রাধানাথ ও মধুসূদনের কাছে তিনি ছিলেন সন্দেহাতীতে ভাবে এক অনুপ্রেরণা। তাঁর মৃত্যুর পর মধুসূদন অত্যুচ্চ সম্মানের ভাষায় লিখে ছিলেন :
‘‘সাধারণ লোকে মনে করে যে লোকের প্রভূত সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি, ভৃত্যসম্প্রদায় রয়েছে সে-ই প্রকৃত ধনী। কিন্তু প্রকৃত ধনাঢ্য মানুষ তিনি যিনি তঁার জ্ঞান, চরিত্র ও নৈতিক গুণ মারফত পৃথিবীর উপকার সাধন করেন। এমনকী যদি তাঁর অর্থ বাড়ি-গাড়ি নাও থাকে এবং চূড়ান্ত দরিদ্র হলেও তিনি প্রকৃত ধনাঢ্যই থাকেন। তিনি পৃথিবীর নিকটে একটি অলংকার বিশেষ এবং এমনকী একটি মানবসত্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ঈশ্বরের মতোই সম্মান জানাতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমনই একজন ধনাঢ্য পুরুষ।’’
[ওড়িয়া থেকে ইংরিজিতে অনূদিত, ইংরিজি থেকে বাংলায়]
ওড়িয়া সাহিত্যে প্রথম বিদ্যাসাগরের প্রভাব পড়তে শুরু করে তাঁর বইগুলির ওড়িয়া অনুবাদ মারফত। ওড়িশা প্রথম ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে ১৮০৩ সালে এবং ব্রিটিশ শাসনতন্ত্র ওড়িশায় গুছিয়ে বসতে অােরা প্রায় ৫০ বছর সময় নেয়। মিশনারিরা কটকে প্রথম অাসে ১৮২২ সালে এবং ওড়িশায় তারা ছাপাখানা স্থাপন করে ১৮৩৭ সালে। এটিই ওড়িশায় সর্বপ্রথম ছাপাখানা। প্রায় ১৮৫০ অবধি সেখানে যা কিছু ওড়িয়া বই ছাপা হত, তার অধিকাংশটাই খৃষ্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৮৫০-এর পরেই, যখন কোম্পানি শাসনকর্তারা শিক্ষাবৃদ্ধির দিকে কিছু নজর দিলেন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের নির্দেশ দিলেন, তখনই কেবল শিক্ষার উদ্দেশ্যে বই ছাপা হতে লাগল। যেগুলো বিশুদ্ধ ধর্মসংক্রান্ত ছিল না। এইভাবে অামাদের হাতে অাসতে লাগল নতুন নতুন সব বই-ব্যকরণ, পাটিগণিত, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি। এগুলির সঙ্গে সঙ্গে বরোতে লাগল প্রাচীন ওড়িয়া পাঠ্যগুলি— তালপাতার পুথি থেকে সংগৃহীত প্রাচীন ওড়িয়া কবিদের কাব্যসম্ভার। এই প্রকাশিত নতুন বইগুলির বেশির ভাগটাই ছিল বাংলা ও ইংরিজি উৎস-গ্রন্থের অনুবাদ। এই ব্যবস্থা ৩০ বছর ধরে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত না অামরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে পৌঁছোই, যখন নতুন মৌলিক গ্রন্থ লেখা ও ছাপা হতে শুরু করল এবং রাধানাথ, মধুসূদন ও ফকিরমোহনের মতো লেখকেরা ওড়িয়া সাহিত্যাঙ্গনকে তাঁদের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে এলেন।
খুবই অাকর্ষনীয় ব্যাপারটা যে বিদ্যাসাগরের বইয়ের সর্বপ্রথম অনুবাদ করেছিলেন ফকিরমোহন সেনাপতি এবং এইটে কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। বইটা ছিল জীবনচরিত (১৮৪৯) এবং বইটা নিজেই ছিল রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স-এর (Robert & William Chambers) অার্দশস্থানীয় জীবনী-র (Exessplany Biography)-র অনুবাদ। ফকিরমোহনের অনুবাদ প্রকাশ হয় ১৮৬৬ সালে এবং ওড়িয়া ভাষায় এই ধারার বই হিসেবে এইটেই ছিল প্রথম। এই সনেই বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা (১৮৫৪), যেটি ছিল এই নামেরই কালিদাস-এর বিখ্যাত নাটকের গদ্যানুবাদ, সেইটে ওড়িয়া ভাষায় অাত্মপ্রকাশ করে শকুন্তলা উপাখ্যান নামে। এটির অনুবাদ কাজ করেন বনমালী িসংহ। পরে পরে বিদ্যাসাগরের অন্যান্য বইগুিল, যেমন বোধোদয় (১৮৬১) অনুবাদ করেন বিদ্দন্দ পট্টনায়ক (১৮৬৮), সংস্কৃত ব্যকরণের উপক্রমনিকা (১৮৫১) অনুবাদ করেন গোবিন্দ চন্দ্র পট্টানায়ক (১৮৬৮), সীতার বনবাস (১৮৬০) তর্জমা করেন বিদ্দন্দ পট্টনায়ক (১৮৬৯) ব্যকরণ কৌমুদী (১৮৫২-৬২) করেন গোবিন্দ চন্দ্র পট্টনায়ক (১৮৭০) এবং অাখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩) কেরোয় চন্দ্রনাথ রায়ের অনুবাদে (১৮৭২)। এই সব ঘটনা প্রমাণ করে সামগ্রিক ভাবে ওড়িয়া ভাষায় বিদ্যাসাগরের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণীয়তা। বইগুলি, বিশেষ করে সংস্কৃত ব্যকরণের ওপর লেখা বইগুলি নিঃসন্দেহেই বিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু অন্য বইগুলি— বিশেষ করে জীবনী গ্রন্থগুলি, কথাকহিনিগুলি এবং সীতা ও শকুন্তলার উপাখ্যান অাদতে ছিল সাহিত্যকর্ম। সেগুলি পৌঁছেছিল উনিশ শতকের শেষ পর্বের ইংরিজি-শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের নতুন অাস্বাদন-স্পৃহার পড়ুয়া সমাজের কাছে। কিছু কিছু অনুবাদ-এর একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে। এইভাবে বোধোদয়-এর ১৮৭৬ নাগাদ তিনটি সংস্করণ করিয়েছে, এবং অাখ্যানমঞ্জরী-র ১৮৭৭ এই দুই সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। এছাড়া দুটি বই, বোধোদয় ও সীতার বনবাস-এর দুটি অালাদা অনুবাদ বেরিয়েছে দুজন পৃথক ব্যক্তির দ্বারা।
১৮৬৬-র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল একটি চুল-খাড়া-করা অভিজ্ঞতা যার কবলে পড়ে ওড়িশার বিশ লক্ষ মানুষ মারা যান। ওড়িশার সমাজজীবনে এই দুর্ভিক্ষের ফল ছিল অতি বিস্ময়কর। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ এমন কতগুলি পরিবর্তন অানে যেগুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই ওড়িশার প্রশাসনিক বন্দোবস্তে একটি বড়ো নাড়াচাড়া পড়ে। তখনকার ভারতের সেক্রেটারি স্যার স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট বাংলার থেকে ওড়িশাকে অালাদা করার একটি প্রস্তাব অানেন। তার সঙ্গে সঙ্গেই ওড়িশার শিক্ষানীতিতে অামূল পরিবর্তন অানা হয়। অারো অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, সঙ্গে সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয়ও। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৮, এই এগারো বছরের মধ্যে ওড়িশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৯৪ থেকে করে হয় ৪৫৭৯; কটকের মহাবিদ্যালয়কে উন্নীত করা হয়। ওড়িয়া বিদ্যালয়-শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং বিচারালয়ের রাজভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। তারপর অন্য একটি ক্ষেত্রেও নতুন কাজ শুরু হয়। সর্বপ্রথম ওড়িয়া ছাপাখানা, যেটি প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ওড়িয়া উদ্যোপতিরা সেইটে ১৮৬৬-৭৭ সালে কটক প্রিন্টিং কোম্পানি এ্যান্ড প্রেস নামে অাত্মপ্রজন্ম করে। সর্বপ্রথম ওড়িয়া সাপ্তাহিক, উৎকল দীপিকা বেরনোর ক্ষেত্রে এই ছাপাখানার ভূমিকা অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। গৌরীশঙ্কর রায় (১৮৩৮-১৯১৭) নামে একজন অত্যন্য সাহসী ও নিবিষ্ট মানুষ এটির সম্পাদনা করতেন। ওড়িশা ও ওড়িয়াদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মর্যাদার জন্য তিনি অতি সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। এই সমস্ত কিছু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকটায় ওড়িশায় মানসক্ষেত্রে যে জাগরণ ঘটছিল সেদিকে নিয়ে যায় ও তাকে প্রতিফলিত করে। একটি নতুন উপলব্ধির সৃষ্টি হয় ওড়িয়া মানুষদের মধ্যে যে ওড়িশার নিজস্ব একটি সত্তা-পরিচয় ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে এবং সেটি বাংলার বা অন্য কোনো প্রদেশের লাঙ্গুলসম নয়। দ্বিতীয়ত, এটির খুব উচ্চ মানের একটি অতীত রয়েছে, বহু ব্যাপারেই যেটি প্রায় তুলনাহীন এবং তার একটি মহান উত্তরাধিকার অাছে। এর ফল সহজেই অনুমেয়। তার মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বাসনা জাগল। এই ভাবে নতুন এক সাহিত্যের উদ্ভব ঘটল। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ অনুৎসাহিত হল। বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছেদ ঘটল সাধারণ ভাবে এবং নির্দিষ্ট করে বিদ্যাসাগর থেকে। ১৮৭৭-এর পর বিদ্যাসাগরের অনুবাদ বন্ধ হয়ে গেল, খুব সম্ভব, বিদ্যাসাগর-অনুবাদের শেষ নথি পাওয়া যায় ১৮৯১ সালে, যে বছরে তাঁর মৃত্যু হয়, যখন সীতানাথ রায় তাঁর বোধোদয় অনুবাদ করেন।
বাস্তবিক পক্ষে তারপর যা ঘটল সেইটে খুব শক্তিশালী এক প্রভাতের অাকর্ষণীয় উদাহরণ। যেন বিদ্যাসাগরের প্রভাব অাবহাওয়াকে পরিব্যাপ্ত করে দিল এবং তাঁর লিখনের বিষয় ও শৈলী অনেকের কাছেই অার্দশস্থানীয় হয়ে দাঁড়াল। এইটে বিশেষ ভাবে শতাব্দীর বঁাকের মুখে যে ত্রয়ী মহান লেখক অাবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন মধুসূদন রাওয়ের বিষয়ে খুব বেশি করে সত্যি। বিভিন্ন বিভাগে— যেমন কাব্যে, গদ্যে, শিশু সাহিত্যে, এমনকী অনুবাদেও সহজেই প্রতীয়মান হত যে মধুসূদনের দূর-অনুপ্রেরণা ছিলেন বিদ্যাসাগর। একটি সঠিক উদাহরণ হলো ভবভূতির উত্তররাম চরিতম মারফত যোগােযাগ। বিদ্যাসাগর তাঁর সীতার বনবাস রচনা করেন অংশত ভবভূতির গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে, অন্তত নিজে তিনি তাই বলছেন। তাঁর প্রথম দুই অধ্যায় বেশির ভাগটাই নির্ভর করে ভবভূতির নাট্যের প্রথম অঙ্কের ওপর এবং অবশিষ্টাংশ রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ওপর। কিন্তু বিদ্যাসাগরের রচনা কখনোই মূলের শুধু একটি অনুকরণ ছিল না। তিনি বহু খুঁটিনাটিরই পুনর্বিন্যাস করেছেন এবং সংযোগও করেছেন অনেক খুঁটিনাটি, অার সেটা এমন ভাবে যে তাঁর রচনা একটি বিরাট পুনঃসৃজনই হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক শৈলীতে যার সাথে উত্তররামচরিতম বা রামায়ণের কোনো সম্পর্কই নেই। মধুসূদনের দুটি রচনা অাছে এ বিষয়ের ওপর। তার একটি সীতা বনবাস, ১২২ লাইনের একটি কবিতা যেটি ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতাবলিরই একটি অংশ হিসেবে সন্নিবিষ্ট। দ্বিতীয়টি হলো ভবভূতির নাটকের অনুবাদ, গদ্য ও পদ্যে মিলিয়ে করা। এটি ১৮৮৫ থেকে ১৯০৭ এর মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করে।
তাঁর অনুবাদে মধুসূদন খুব বড়ো অংশেই মূলানুস ছিলেন, কিন্তু নিজের কবিতায় তিনি বিদ্যাসাগরের ওপর ভরসা করেছিলেন কবিতাটি শুরু হচ্ছে সেই জায়গায় যেখানে লক্ষণ সীতাকে গভীর বনে ভাগীরথীর তীরে ছেড়ে দিয়ে এসে ঘরে ফিরছেন অার শেষ হচ্ছে যখন মহর্ষি বাল্মীকি সীতাকে তাঁর তপোবনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যাসাগরে এই অংশ দু পৃষ্ঠার শেষ হয় বা বলা যায় গদ্যানুবাদের ৫৫ লাইনে। বর্ণনা প্রধানত ঘটনাধর্মী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন। বিবরণ অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবে পরিস্থিতিকে বিবৃত করছে, বনে সীতার শোচনীয় অসহায় অবস্থা দিয়ে শুরু করে, তপোবনের অাশ্রমিক শিশুদের কাছে এই সংবাদ পেয়ে মহর্ষির নিজে তাঁকে নিয়ে যাবার মধ্যে দিয়ে। মধুসূদন ঘটনাক্রমকে অনুসরণ করেছেন এবং ঘটনার খুঁটিনাটির প্রতিও সন্নিষ্ঠ থেকেছেন। কিন্তু তিনি অারো যা করেছেন, সাধারণ ভাবে সীতার শোকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে এক উজ্জীবিত কাব্যাংশকে এনেছেন অার তাঁর কাব্যিক স্পর্শে সম্পূর্ণতই খুবই ঘন এবং দুঃখের, অশ্রুর আবহ সৃষ্যি করেছেন। দুটি রচনাকে মিলিয়ে পড়া খুবই উত্তেজক, বিদ্যাসাগরের ও মধুসূদনের। উভয়েই নিজের নিজের গুণে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং উভয়েই চমৎকার ভাবে যা করতে চায় সেইটে করেছে। কিন্তু মধুসূদনের রচনা হয়তো সম্ভবপরই হত না বিদ্যাসাগরের সোনালি স্পর্শের সাহায্য ছাড়া।
তাঁদের দুজনের এই তুলনা অারো দুটি রচনা প্রসঙ্গে করা যেতে পারে — বিদ্যাসাগরের একটি গদ্য অাখ্যান, রামের রাজ্যাভিষেক ও মধুসূদনের একটি কবিতা, শ্রীরাম বনবাস-এর মধ্যে। বিদ্যাসাগরের রচনাটি অসম্পূর্ণ। এটি শুরু হচ্ছে দশরথের রামকে রাজা হিসেবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশে, মন্ত্রনায় এবং পরিশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাকে উচ্ছলিত স্বাগত জানাচ্ছে অযোধ্যাবাসীরা। মধুসূদন শুরু করেন যেখানে বিদ্যাসাগর শেষ করছেন। দশরথের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষ উচ্ছ্বসিত অানন্দে স্বাগত জানায়। কিন্তু সহসাই মেঘ ঘনায় আকাশে, ভোরের সূর্য উদিত হবার অাগেই ঢাকা পড়ে যায় এবং গোটা নগরী গভীর দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে রামের বিদায়গ্রহণে এবং বল্কল পরিহিত হয়ে স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে অযোধ্যা ছেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যাসাগরের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, মধুসূদনের ১৮৯৩-এ। অাশ্চর্য হয়ে যেতে হয় বিষয়ের নিরবচ্ছিন্নতায় যেটি উভয়ে এত স্পষ্ট, যদিও অাঙ্গিকে ও কৌশলে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিদ্যাসাগরের রচনার শেষ অনুচ্ছেদ অার মধুসূদনের কবিতার প্রথম চার স্তবক পরস্পর সংলগ্ন, যেখানে তাঁরা উভয়েই বিবৃত করছেন প্রায় অভিন্ন উপায়ে, অযোধ্যায় সুখ ও উৎসবের পরিমণ্ডল।
অারো কিছু জায়গাও রয়েছে যেখানে এই সম্পর্ক-সূত্র অাঁচ করা যেতে পারে এবং সেইটের খোঁজ খুবই চিত্তাকর্ষক হয়। বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন উভয়েই ছিলেন দায়বদ্ধ মানুষ। অাচার-ব্যবহার, নৈতিকতা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে সাধারণ ভাবে দায়বদ্ধ। উভয়েই খুব ভালো করে জানতেন একটি মানুষের চরিত্রের ভিত তৈরি হয় খুব কম বয়েসে এবং এইটে ভালোতর করার ব্যাপারে গোড়ার দিকের বিদ্যায়তনিক পুস্তকগুলির মতো কার্যকরী অার কিছুই হয় না। যদি সেগুলি পরিকল্পনা মাফিক হয় এবং সেগুলিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো যায়। বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত প্রাথমিক পাট্যপুস্তক বর্ণপরিচয় (দুই ভাগ, ১৮৫৭-য় প্রকাশিত)-এর অনেক গুণ রয়েছে। যেমন এর চমৎকার গড়ন, সমান চমৎকার পাঠ-বিভাজন, বিষয় নির্বাচন এবং এক অতুলনীয় শৈলী যেটি একাধারে কথা ও অন্য ধারে নির্ভুল ও শৃঙ্খলাবদ্ধ (শকুন্তলা বা ভ্রান্তিবিলাস-এর শৈলীর থেকে একেবারেই অালাদা)। কিন্তু এর সর্বাধিক স্পষ্ট গুণটি হলো সম্ভবত যে পদ্ধতিতে পাঠগুলিকে সাজানো হয়েছে। একটি মাত্র বাস্তব লক্ষ্যকে নজরে রেখে— যেটি হলো কীভাবে কমবয়েসীদের চরিত্র গঠন করা যাবে। সেখানে সোজাসুজি উপদেশ রয়েছে— যেমন, ‘সদা সত্য বলিবে’, কখন পিতামাতার অবাধ্য হইল না, ‘কাহাকেও গালি দিও না’, ইত্যাদি। তারপর দ্বিতীয়ত এসেছে প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে দিয়ে সঠিক অভ্যাস গঠনের পাঠ, যেমন প্রথম ভাগের চতুর্দশ পাঠ— ‘অার রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। অার শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি। কাপড় পরিয়া পড়িতে বসি।’ তারপর একেবারেই অন্যভাবে দ্বিতীয় ভাগ-এর ৪,৫,৬ ও ৭ পাঠে তিনি দেখাচ্ছেন অভ্যাস, অাচরণ, চরিত্রের কোন অংশগুলি উন্নীত করতে হবে অন্যগুলির বদলে— সেগুলিও অাদর্শ অভ্যাস সন্দেহ নেই, কিন্তু সেগুলি অনুশীলন করলে একটি বালক পুরোদস্তুর মানুষ হয়ে পড়ে। এই সব গুণগুলি মধুসূদন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তিনি তিনটি প্রাথমিক পুস্তক রচনা করেন, শিশুবোধ, বর্ণবোধ ও কালবোধ— যেগুলি এক সঙ্গে বর্ণবোধ (১৮৯৫) নামে প্রকাশিত হয়, যেটি ওড়িয়া ভাষায় সব চেয়ে বিখ্যাত প্রাথমিক পুস্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে; এবং এটি প্রারম্ভিক শিশুশিক্ষা পাঠক্রমকে প্রায় স্বাধীনতাকাল পর্যন্ত শাসন করে। এই পুস্তকটি বিদ্যাসাগরের অাদর্শে প্রণীত— এটির গাঠনিক সৌকর্ষে ও কথ্য ভাষার শৃঙ্খলাবদ্ধ শৈলীতে। যদিও এটির মধ্যে এমন এক কাব্যিক উৎকর্ষতা অাছে যেটি বিদ্যাসাগরে খুব একটা উপস্থিত নয়। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই মধুসূদনের ক্ষেত্রেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্ররা যুগ যুগ ধরে এই প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বাঁচতে শিখেছে, ভাষাগত ভাবে, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এবং নৈতিক ভাবে।
তাঁদের উভয়েরই শিশুদের অভ্যাস, অাচরণ ও চরিত্রগঠনে অান্তরিক ভাবে যুক্ত থাকার মাত্রার ব্যাপ্তি দেখে অাশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। বিদ্যাসাগরের নীতিবোধ ১৮৫১ সালে প্রকাশ পায়। এটি অাকারে ছোটো এবং বিদ্যাসাগরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এটি রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স-এর Moral Class Book (নীতি শিক্ষার পাঠ)-এর ওপর ভিত্তি করে রচিত। গদ্যে নীতিশিক্ষা রয়েছে এতে। যেমন ১) কীভাবে প্রাণিদের দেখা উচিৎ, ২) কীভাবে পরিবারের সবার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিৎ, ৩) কঠিন শ্রম, ৪) নিজস্ব চিন্তা ও অাত্মনির্ভরতা, ৫) বিনয়নম্রতা ইত্যাদি। তিনি নিম্নলিখিত ভাবে সম্মান নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন কীভাবে কারুর তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি ব্যবহার করা উচিৎ : ‘‘অামাদিগের পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী প্রভৃতি পরিবারবর্গের প্রতি সদা সদয় ও অনুকূল হওয়া উচিত। দেখ, যখন অামরা নিতান্ত শিশু ও একান্ত নিরুপায় ছিলাম, পিতা মাতা অামাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া মানুষ করিয়াছেন এবং অামাদিগের নিমিত্ত কত যত্ন, কত পরিশ্রম ও কতই বা কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। ফলতঃ তৎকালে তাঁহাদের তাদৃশী অনুকম্পা ও তাদৃশ স্নেহ না থাকিলে, অামরা কোন্ কালে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইতাম।’’ মধুসূদনের নীতিরত্নমালা দৃষ্টান্তমালা ও মনিমালা, একসঙ্গে ২১৩ লাইনের কবিতা, অন্তর্বস্তুর দিক থেকে বিদ্যাসাগরের নিকটবর্তী। উদ্দেশ্য একই উৎয়ের— সদাচরণ, সদ্ব্যবহার ও বলিষ্ঠ নৈতিক গুণাবলীকে উন্নীত করা।
মধুসূদন রাওয়ের বর্ণবোধ বা ওড়িয়া প্রাথমিক পুস্তকটির ওপর বিদ্যাসাগরের প্রভাব পরোক্ষ, কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যকরণ, ব্যকরণ কৌমুদী, ওড়িশার বিদ্যালয়গুলিতে একটি কালোত্তীর্ণ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে বহু বহু বছর ধরে। তদুপরি, যে ওড়িয়া ব্যকরণ বইগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় লেখা হচ্ছিল সেগুলি ভীষন ভাবেই বিদ্যাসাগরের অাদর্শে প্রণীত। এই প্রবণতা স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত চলে, এবং সেটা এতটাই যে এমনকী অাজও যে জনপ্রিয় ব্যকরণ বইগুলি লেখা হয়, যেমন একটির নাম করা যায়, সর্বসার ব্যকরণ অভ্রান্তভাবে দেখিয়ে দেয় বিদ্যাসাগরের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রটিকে। ওড়িয়া সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের প্রভাব সব সময়েই খুবই শক্তিশালী। এমনকী সেই সময়েও, যখন ওড়িয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ওড়িশার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক টানা বাঙালির নাক গলানোর ব্যাপারে খুবই সমালোচনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। এইটে বিশেষ ভাবে ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পঁচিশ বছরের মধ্যে যখন এক শ্রেণির বাঙালিরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ওড়িয়া ভাষাকে উচ্ছেদ/বাতিল করার জন্য। বিদ্যাসাগর খুবই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীয় ছিলেন। এজন্যই মধুসূদন রাও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁকে অাদর্শ মানুষ হিসেবে দেখিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে যেটিকে তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিয়েছিলেন। অারো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের কাছেও (রাধানাথ রায়কে ধরে) বিদ্যাসাগরের গদ্য-শৈলী ছিল অাদর্শ ও অনুসরণযোগ্য। ওড়িয়া সাহিত্যের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও ফলন্ত হয়েছে এবং সময়-প্রেক্ষিত বিচার করলে, বিশেষ করে মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সামগ্রিক ভাবে সাহিত্য ও শিক্ষার ওপর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।
হতে পারে সেটা ২০১৮ সাল। শোনা গেল, দেশ জুড়ে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের ‘মন্দির দখলের’ অভিযান চলছে। তা সে হতেই পারে — রাষ্ট্র যা চায়, তাই পারে। এ সব খবরে আমার খুব একটা হেলদোল ছিল না কিন্তু হল — যখন শুনলাম ‘সিমলা কালীবাড়ি’ সরকার দখল করবে।
অামি যে খুব বেশি ধার্মিক তা নয় তবে মন্দির বা বিশেষ করে সিমলা কালীবাড়ি জুড়ে — এই যে এক বাঙালিপনা বেঁচে অাছে — তা বেশ উপভোগ করি। ধরা যাক, বাংলা ভাষা, তা নিয়ে বা তার শুদ্ধতা বা বিস্তার নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও, এখানকার অনুষ্ঠানে বা মন্দির চত্বরে বাংলায় কথা বলার হিড়িক বেশ উপভোগ করতাম। দুর্গাপুজোর সময় বা কালীপুজো অার সরস্বতী পুজোয় — সব কাজ বাঙালি করবে এবং পুরোহিত বাঙালিই হতে হবে, তাতে বাংলার ঐতিহ্য বজায় থাকবে — গর্ব হত শুনে।
‘কালীবাড়ি’ সরকার দখল করবে শুনেই শুধু যে এখানকার বাঙালিরা তা নয়, অাগে যারা সিমলায় ছিলেন তারাও প্রতিবাদে যোগ দিলেন। একটা কথা ঘুরতে লাগলো ‘কালীবাড়ি চলে গেলে সিমলায় বাঙালিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে’। এ কথা যেন প্রথম শুনলাম এবং একটা ‘ভয়’ নিয়ে যে এরা টিঁকে অাছে তা অনুভব করলাম। এরকমও কথা হল, যদি সরকার দখল করতে অাসে তবে সবাই এবং বাইরে থাকা ছেলে-মেয়েরাও চলে অাসবে কালীবাড়ি বাঁচাতে। তা কিছুদিন এই চর্চা চলার পর থেমে গেল কিন্তু ওই সংশয়টা যেন ছাড়বো ছাড়বো করেও কেউ ঝেড়ে ফেলতে পারলো না।
দেখতে দেখতে অামার পনেরোটা বছর পার হয়ে গেছে এই শহরে কিন্তু গাঁটছড়াটা যে বাঁধা হয়নি তা এই ‘দখলের দৌড়’ না চললে বুঝতে পারতাম না। শহরটাকে অামার বেশ ভালো লাগে তার শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্য। প্রথম যা অামাকে মুগ্ধ করে তা এর অান্তরিকতা। রাস্তায় দেখা হলেই নমস্কার করা, অামার বাড়িতে চা খেতে অাসবেন বলা, দরকার হলে ডাকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসেছি নিজের পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে তাই একটু যেন বেশি অাগ্রহ ছিল এই সব ভালবাসাকে অাঁকড়ে ধরার। কলকাতা শহর যেন দৌড়ছে, কোথাও অামার নাম নেই। এই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে মাঝে হেরে গিয়ে থেমে গিয়ে ছিটকে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যখন পালানোর পথ খুঁজছিলাম, তখন এই শহরবাসী যেন এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতে দিল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল যে।
সময় যত গড়াতে লাগলো ততই দেখলাম সাজানো বাগানের ধারে মালির ঘর যেমন কখনই গৃহস্থের বসত হয় না তেমনি এটাও অামার অাশ্রয় হল না। ঠিক কেন যে হল না তা জানা নেই। ইচ্ছে কিন্তু অাছে ষোলঅানা। ইতিহাস কখনই অামাদের পিছু ছাড়তে চায় না। এই শহর ঘিরে বাঙালির ইতিহাসও তাই। ১৮৪৫ সালে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। শোনা কথা, জাখু মন্দিরে যাওয়ার পথে, কোন এক নালায় এই মূর্তি পড়ে ছিলো। সেই সময় কোন এক বাঙালি স্বপ্নাদেশ পান অার মূর্তি তুলে অানেন এখানে। মানে ব্যান্টনী হিলে প্রতিষ্ঠা হয় এবং এই মন্দির ঘিরেই বেড়ে ওঠে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা। এই মন্দিরের সঙ্গে নাকি এক স্কুলও ছিল। এখানকার প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তানরাও পড়তে অাসতেন। অামার বন্ধু হিমাচলী, তার বাবা, জেঠারাও পড়েছেন।
বাঙালি মানেই যে বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, রাজনৈতিক, সম্ভ্রান্ত অর্থাৎ উচ্চবিত্তশালী মানুষের যা যা গুণ থাকা দরকার তা অাছে। বাঙালি চতুরও বটে, ইংরেজের হাত ধরে এ শহরে এসে নিজেদের বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং শুধুই কি নিজেদের, তার জাতভাইদেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে যেন এক সামাজিক পংক্তি যা সাধারণ হিমাচলী থেকে অালাদা। তারা জমিজমা কিনলেও কেরানি হয়ে থেকেছে। পেয়েছে রায়বাহাদুর খেতাব কিন্তু লাঙলে হাত দেয়নি কখনও। বাঙালির এই চরিত্র দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে স্বতন্ত্র এক জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে সিমলা শহরে।
বাঙালির অার একরূপও ধরা পড়েছে এখানে। সাধারণ হিমাচলীর মধ্যে এরা কালাজাদুর দেশের লোক। এরা এমন এক জাতি যে নিজের ঘর ভাঙে অার অন্যের ঘরও ভাঙে। টিঁকে থাকে না কোথাও। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার। দীর্ঘ দিন ধরে বাঙালি এখানে সাধারণের সঙ্গে মেশেনি, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। বাঙালি ঘরের মেয়ে এখানকার মানুষকে বিয়ে করেনি। অল্প কিছু ঘরেই হিমাচলী বৌ এসেছে।
বাঙালি খুবই সচেতন। কোন্ বাঙালি কালীবাড়ির সদস্য পদ নেবে বা কাকে সদস্যপদ দেওয়া হবে তা তার চালচলন, সামাজিক পরিচিতি বা বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ না নমঃশূদ্র এ সবের বিচার অাছে। এই যে এত পুরোহিত, প্রায় সাতজন, তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন এখানে তারা কালীবাড়ির সদস্যপদ নিতে পারে না। অামিও সদস্যপদ পাই অনেক পরে। তবে অামার চেহারা বা চালচলন হয়তো উচ্চবিত্তের মতো তাও দীর্ঘ দশ বছর পরে মন্দির চত্বরে বসতে পেলাম। দিনে দিনে যত হিমাচলবাসী শিক্ষিত হয়েছে, সরকারি চাকুরে হয়েছে, রাজনীতিবিদ হয়েছে ততই বাঙালি তার জায়গা থেকে ধীরে ধীরে সরে গেছে যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই ‘মন্দির দখল’ ঘিরে তাদের এত হাহাকার।
বর্তমানে কালিবাড়ীর সঙ্গে জড়িত পরিবারের সংখ্যা ৩০-৪০ হবে কিন্তু অাজ থেকে পঞ্চাশ বছর অাগে তার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০-২০০ বা তার বেশি। পুজো-পার্বনে কালীবাড়িতে পা ফেলার জায়গা হত না। ছিল নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের লড়াই কিন্তু বাঙালি সবাই একসঙ্গেই পাত-পেড়ে খেতে পারত। এই কালীবাড়িতে, ভিন্ন রাজ্য বা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অাসা বাঙালি শ্রমিকের দল, কম পয়সায় থাকতো অার খেতে পারতো। শোনা কথা, কোন বাঙালি শ্রমিক বেঅাইনি কাজ করলে তা হিমাচলের যে কোন জেলায় হোক না কেন, সরকারি মহলে এই উচ্চবিত্ত বাঙালিদের তাদের জন্য কথা বলার অধিকার ছিল। কোন অাইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অাগে বা প্রয়োজন হলে এই বাঙালি একে অপরকে সাহায্য করত।
পরিবর্তন হল। পরিবর্তন দেখলেন ষাটের দশকে জন্ম নেওয়া বাঙালিরা। প্রথমেই তারা হারালেন সরকারি চাকুরী। অনেকক্ষেত্রেই একচেটিয়া সাধারণ হিমাচলী হয়ে উঠলেন অনেক বেশি জাতি সচেতন। তারা হলেন শহরমুখী আর শুরু হল এক জমি দখলের লড়াই। একসময় অর্থাৎ এই ষাটের দশকে যারা জন্ম নিয়েছেন তারা বেসরকারি স্কুলে যেমন বিশপ কটন্ স্কুলে যেখানে বাংলা ভাষা পড়ানো হতো সেখানে ছিলেন বাঙালি শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে তা বন্ধ হল। চাকরী হারালেন বা শুরু করলেন অন্য বিষয়ে শিক্ষকতা। একটা চাপা বা গুপ্ত লড়াই শুরু হল চাকরি ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক চাপান-উতোরের সঙ্গে সঙ্গে অাঞ্চলিক সুবিধে প্রাপ্ত হিমাচলী শিক্ষিত হিমাচলী ধীরে ধীরে সরকারি চাকরির জায়গা দখল করে নিলেন। বাঙালি শ্রমিকের চাকরি করবে না তারা ব্যবসায়ীও নয় তাই প্রতিষ্ঠিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরা ধীরে ধীরে সিমলা ছাড়লেন। তারা সাধারণ চাকরি করবে না যেন এক ধনুকভাঙা পণ এবং এই ধনুকভাঙা পণের পিছনেও কিছু কথা অাছে। সিমলা কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠা হল ১৮৪৫ সালে, তখনও কিন্তু এটা ব্রিটিশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে চিহ্নিত হয়নি তবে তার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে অাত্মবিশ্বাসী বাঙালি তার জমি চিনে নিয়েছে।
শোনা যায় ‘শ্যামলা দেবী’র পূজারী ছিলেন এক তান্ত্রিক-হিন্দু-বাঙালি সাধু। ওই সময় এবং এখনও তুক্তাক্, বশীকরণ, কালাজাদুর (যা একমাত্র বাঙালির সম্পদ) চল বরাবর এই পাহাড়ে অাছে। মনে মনে হিমাচলী যেন বাঙালিদের ভয়ও পায়। এই অঞ্চল ছিল কেওন্থল্ রাজ্যের অঙ্গ, ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে নিয়ে নেয় এই অঞ্চল। কোন এক ব্রিটিশকর্মী নাকি ফেলে দিয়েছিলেন এই ‘শ্যামলা দেবী’র মূর্তি। তারপর ভয় দেখানো, স্বপ্নাদেশ যা হয়ে থাকে তার মাধ্যমে ‘শ্যামলা দেবী’ তার অবস্থান ফিরে পেলেন। দেবীর নামেই ব্রিটিশরা এই শহরের নাম রাখলেন সিমলা অার বাঙালি তার জায়গাও ফিরে পেলো।
ব্রিটিশদের সঙ্গে এলেন বাঙালি অামলার দল। এরা সবাই কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী। অার এলেন কিছু নিম্নপদস্থ বাঙালি কেরানী। ব্রিটিশের পর সবচেয়ে শিক্ষিত, অাধুনিক, স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বাঙালি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৩৯ (হতে পারে) এখানে ব্রিটিশদের শীতকালীন রাজধানী ছিল। এই পর্যন্ত বাঙালিদের রমরমা অবস্থা। ব্রিটিশ শহর ছাড়লো অার বাঙালিদের এক বড় অংশ উচ্চপদস্থ অামলাবৃন্দকে ছাড়তে হল সিমলা যার সংখ্যা প্রায় ৮০। স্থায়ী বাঙালিরা এদের বিদায় দিলেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ১৯৫৫ সালে অাসা বাঙালিরাও কিন্তু তখন দেখলেন এই সম্ভ্রান্ত বাঙালি জাতিকে। কালীবাড়িতে দুটি ক্লাব ছিল। রবিচক্র যা সম্ভ্রান্ত ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারিদের অার অন্য দল যারা সাধারণ কেরানি বা অন্যান্য কাজে নিযুক্ত ছিল। ছিল নিজেদের স্কুল ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হত। তাতে ছিল ল্যাবের ব্যবস্থা। শোনা যায় বাঙালিরা তাদের এক মাসের মাইনে দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি করলেন এই স্কুল আর এই মন্দির। তৈরি হল ‘বঙ্গীয় সম্মীলনী’ যা অাজও অাছে। বাঙালি যেন উঠে পড়ে লেগে পড়েছে তাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে অার তার ফলে তারা কোনদিনও সাধারণ হিমাচলবাসীর কাছের মানুষ হতে পারেনি — আজও নয়।
বাঙালিদের জমিজমা ছিল সেই ব্রিটিশ অামল থেকে। তবে তারা কৃষক ছিলেন তা নয়, ছিল বাগান বাড়ি। এ সবই ছিল সিমলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বিপত্তি শুরু হল হিমাচল রাজ্য অভিষেকের সময় থেকে বা তার কিছু অাগে থেকেই। বাঙালি তার জৌলুস হারাতে শুরু করে কেন্দ্রিয় সরকারের অফিস দিল্লিতে চলে গেেল। তার সঙ্গে চলে গেল সরকারি বাঙালি অধিকার। অার নতুন হিমাচল সরকার কিছু নিয়ম তৈরি করলেন। কৃষক ছাড়া কেউ জমি আদায় করতে পারবে না। সরকারি চাকরিও পাবে না। ১৫ বছরের বেশি যারা হিমাচলে অাছেন তাদের বোনাফাইড সার্টিফিকেট দেওয়া হয় অার ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ ও ৪ বিগোয়া (৪৫০ স্কোয়ার ফিট - ১ বিগোয়া) পর্যন্ত জমি কিনতে পারেন। বাঙালিদের ঢালাও সরকারি চাকরির হার কমল কিন্তু তার সঙ্গে অন্য কাজের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় স্থায়ী বাঙালিরা তাদের জমিজমা বেচে দিতে শুরু করলেন।
বাঙালির ঐতিহ্য ‘মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ ছিল নিত্যানন্দ ব্যানার্জিদের। লোয়ার বাজারে যা অাজও অাছে তবে সেখানে চা বিক্রি হয়।
বাঙালি যেন পারলো না এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে অার পারলোও না স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিমাচলী সংস্কৃতিকে নিজের বলে স্বীকার করতে। এই দম্ভ বা নিজস্বতা বাঙালিকে এক স্বতন্ত্র জায়গায় পৌছে দিল অার অামরা যারা এলাম অাজকের দিনে তারাও চিহ্নিত হলাম এক স্বতন্ত্র জাতিরূপে। অামাদেরকে সম্মান করা যায় কিন্তু নিজের বলা যায় না যেন।
ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনে ইংরেজদের Liberal Education এর ধাঁচে শাসকরা যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যার পেছনে এখানকার উঠতি মধ্যশ্রেণির সক্রিয় সমর্থন ছিল, স্বাধীনতার পর তাকে সামান্য অদলবদল করে জাতীয় শিক্ষার রূপ দেওয়া হল। এখানেও দেশের মধ্যশ্রেণির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। স্বাধীন দেশে এই মধ্যশ্রেণি বা ভদ্রলোক বর্গ তাদের নিজেদের সামাজিক গন্ডিতেই শিক্ষাকে অাটকে রেখে নিজেদের উচ্চাশা চরিতার্থ করেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্বে এদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিপরীতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা তেমনভাবে করা হয়নি। ফলে এদেশীয় শিক্ষার যেমন জাতীয় চরিত্র অর্জন করা হয়নি, তেমনই ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে শিক্ষার সুযোগ না পৌঁছে দেবার জন্য, শিক্ষার অাঙিনা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তা গণতান্ত্রিকও হয়ে ওঠেনি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মত দুজন শিক্ষাবিদের জন্ম এদেশেই।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৪৮-৪৯ এ তৈরি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত শিক্ষা কমিশন। ১৯৫৩-৫৪ তে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন অার ১৯৫৪-৬৬ সালে কোঠারি কমিশন নামে পরিচিত শিক্ষা কমিশন। ১৯৬৮ সালে এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ঘোষিত হয়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতি। অাঠারো বছর পরে ১৯৮৬ সালে ‘চ্যালঞ্জ অফ এডুকেশন’ নামে খসড়া শিক্ষা দলিলের ভিত্তিতে অাবার তৈরি হল জাতীয় শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতির দুটি মৌল বৈশিষ্ট্য, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলি হল (ক) জাতীয় সংহতির সহায়ক পাঠক্রম ও পাঠ্যবই যা সমস্ত ধরণের সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বোধ থেকে মুক্ত হবে। (খ) স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে অাধুনিক কমিউনিকেশন টেকনোলজির প্রয়োগ। (গ) চাকরির সঙ্গে ডিগ্রীর সম্পর্ক না রাখা। (ঘ) মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। (ঙ) প্রতি জেলায় Centre of Excellence হিসাবে একটি করে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলা (চ) উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। কারণ হিসাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন— ‘‘অামাদের লক্ষ্য নিরবচ্ছিন্ন অাধুনিকীকরণ, ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও দ্রুত সামাজিক ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাওয়া।’’ অার এই শিক্ষানীতির প্রায় সাড়ে তিনদশক পরে অাবার জাতীয় শিক্ষানীিত ঘোষিত হল দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের অামলে। ৪৮৪ পাতার এই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০১৯ তৈরি হয়েছে ইসরোর প্রাক্তণ অধিকর্তা কে কস্তুরিরঙ্গণএর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির দ্বারা। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে গঠিত টিএসঅার সুব্রহ্মনিয়ম এর নেতৃত্বাধীন Committee For Evolution of the New Education Policy মে ২০১৬ তে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি হয়েছিল ৪৩ পাতার Some Inputs For Draft National Educational Policy ২০১৬। এই ধারাতেই কস্তুরিরঙ্গণ কমিটির রচিত নতুন শিক্ষানীতি, রিপোর্টগুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
সময় এগোনোর সাথে সাথে দেশের শিক্ষানীতিরও পরিবর্তন হবে এটাই প্রত্যাশিত। এখানে সে নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। পাশাপাশি গত শতকের অাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে একুশ শতকের বিশের দশকের সময়কাল পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর সাথে সাথে অামাদের দেশেও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে বিপুল পরিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঘটে চলেছে দেশের শিক্ষার নীতি নির্ধারকেরা (ভারতবর্ষে অবশ্য তাঁরা রাজনৈতিক মাতব্বরই হয়ে থাকেন) তার সঙ্গে তাল মেলাতে সর্বদা উদগ্রীব, অতীতের মত। অতীতে গঠিত শিক্ষা কমিশন বা কমিটিগুলো যে এদেশের প্রেক্ষিতে স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় তেমন রাখেন নি, তা দেশের শিক্ষার সামগ্রিক ছবির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই সব প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০কে।
স্বাধীনতার পর ভারতরাষ্ট্র তার ফেডেরাল কাঠামোকে মোটামুটি বজায় রেখেছে এবং এদেশের বহুজাতিভিত্তিক সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে মান্যতা দেবার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি অনেক ত্রুটি দুর্বলতা সত্ত্বেও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনার উদ্যোগ দেখায়নি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী পথ প্রথম থেকে অনুসরণ করার ফলে ক্রমশ দেশে ধনী দরিদ্রর মধ্যে বৈষম্য বেড়ে গেছে। কিন্তু এদেশের সরকারি ঘোষণায় অন্ততঃ ছিল কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের লক্ষ্যে তা পরিচালিত হবে। যার কিছু কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্য করাও গিয়েছিল। তা অাশির দশকের শেষাশেষি থেকে পাল্টাতে শুরু করে। অর্থনীতির উদারীকরণের খোলা হাওয়া এদেশে প্রবেশ করল তার ঝোড়ো উদ্দামতা নিয়ে। রাতারাতি বদলাতে শুরু করল বা উধাও হয়ে যেতে লাগল অামাদের পরিচিত অনেক কিছু। এসব কিছুর চিহ্ন অামরা দেখেছিলাম ’৮৬র জাতীয় শিক্ষানীতিতে। দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নতুন প্রজন্ম সেই শিক্ষানীতিতে ভর করে অাধুনিক পৃথিবীতে নতুনভাবে নিজের জায়গা খুঁজে পাবে। প্রায় রাতারাতি উন্মুক্ত হয়েছিল বিদেশের হাতছানি, অাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা, উৎকর্ষমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য দেহমন সমর্পণ করে প্রস্তুতি নেওয়া। সেদিন অবশ্য শিক্ষার নীতি নির্ধারকরা এটাও বুঝেছিলেন পিরামিডাকৃতি অামাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ার দিকটাকেও শক্ত করা প্রয়োজন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অক্ষরবঞ্চিত রেখে দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক প্রগতি সম্ভব নয়। সেকারণে চালু করা হয়েছিল জাতীয় সাক্ষরতা কর্মসূচী যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯১-২০০১ এই পর্বে এদেশে সাক্ষরতার হার যে পরিমাণ ঊর্দ্ধমুখী হয়েছিল তা অতীতে কোনদিন হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় এসেছিল শিক্ষার অধিকার অাইন সকলের জন্য শিক্ষাগ্রহণের অধিকার সুনিশ্চিত করতে। জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬তে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল জাতীয় সংহতি রক্ষার কথা। এর জন্য সব ধরণের সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার ঘোষণাও ছিল। শিক্ষা বিষয়ে সেসময় সরকারের ঘোষণা ছিল 'as the main instrument of change, education should be considered a key input for national development' অার এই development এর তাগিদে শিক্ষা মন্ত্রককে পরিবর্তন করা হল মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে। কারণ ‘উন্নয়নে’র হাড়িকাঠে ‘মানবসম্পদ’ সর্বদা বলিপ্রদত্ত। ’৮৬র শিক্ষানীতি থেকে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধাঁচাকে পরিত্যাগ করে অামেরিকান ধাঁচাকে প্রয়োগ করতে উদ্যোগ শুরু হল।
শিক্ষার মৌলিক অধিকার, যা একটি দেশের জনগণের প্রগতির জন্য অাবশ্যিক শর্ত। মানুষকে শিক্ষার অাঙিনায় পৌঁছে দিতে রাষ্ট্র বা সরকারের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য্য। নতুন শিক্ষানীতিতে কার্যতঃ একে অস্বীকার করে শিক্ষাকে ‘েকায়াসি পাবলিক গুড’ বলা হয়েছে। এর অাড়ালে রাষ্ট্র/সরকার শিক্ষার সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়। সাথে সাথে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত মূলমন্ত্র-এক দেশ একটাই নেতা একটাই দল— তার প্রতিফলন পড়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে। ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদিতা এখানে অনুপস্থিত। এই দলিল নিয়ে জনমত যাচাইয়ের বিষয়টি নাম কা ওয়াস্তে করা হয়েছে। শিক্ষা কেন্দ্র-রাজ্যের যুগ্ম তালিকায় থাকলেও রাজ্যের মতামত নেওয়া হয়নি। মতামত নেওয়া হয়নি সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষক বা ছাত্রদের কোনও সংগঠনের মতামতও নেওয়া হয়নি একমাত্র অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ছাড়া। বলা হয়েছে নতুন শিক্ষা দলিল অামাদের শিক্ষানীতিতে অামূল পরিবর্তন অানবে। ফলে ১৯৮৫ সালের নতুন শিক্ষানীতি এবং ১৯৯২এর রিপোর্টের সঙ্গেও এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে অাগের শিক্ষানীতির পর্যালোচনা করে প্রয়োজনানুসারে তাকে সংশোধন না করে, খোলনলচে বদলে নতুন পথে যাত্রার ইঙ্গিত দেওয়া রয়েছে।
সামগ্রিক এই পরিবর্তন অানার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে যে স্বাধীনতা উত্তর পর্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘সমতা’ অানার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এদেশের শিক্ষানীতিগুলোয় উচ্চমানের প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার ভাবনা ছিলনা। নতুন নীতিতে সর্বস্তরে শিক্ষায় ‘সমতা’ অানার কথা বলা হলেও এখানে রয়েছে inclusion এর কথা। শিক্ষায় সকলের সমান অধিকার একথা অাগের শিক্ষানীতিগুলোয় ঘোষণা করা হয়েছিল। অবশ্য রূপায়ণে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতিও ছিল। এখন সম-অধিকার অার inclusion দুটোই বলা হচ্ছে যদিও দুটো এক জিনিষ নয়। ভারতীয় সংবিধানে পিছড়ে বর্গদের (নারীসহ) সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কিছু নীতি নিয়মের উল্লেখ রয়েছে, নতুন শিক্ষানীতিতে কার্যত তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি অনেক খামতি রয়েছে যদিও শিক্ষানীতিগুলোয় তা নিয়ে প্রতিশ্রুতি অন্ততঃ থাকত। এখানে তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। মনে হতেই পারে ‘সমতা’ অার ‘উচ্চমান’ পরস্পরের প্রতিপক্ষ এবং সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষপাত ‘উচ্চমান’ অর্জনের দিকেই। উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্র দার্শনিক টি.এইচ.গ্রিন শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তাঁর মত ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ‘ভদ্রলোক’দের শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। শিক্ষাকে হতে হব— A Great Leveller' যাতে তা এক সমতাবাদী সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
একুশ শতকের নলেজ সোসাইটির প্রয়োজন এক ‘ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে শিক্ষায় ‘উচ্চমান’েক অগ্রাধিকার দেওয়ার যুক্তি হাজির করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগ (RSA) ‘নালন্দা’ ও ‘তক্ষশীলা’-এই দুই মিশনের মাধ্যমে শিক্ষানীতির রূপায়ণ ঘটাবে। অর্থাৎ নলেজ সোসাইটির ভিত্তি যে তথ্যপ্রযুক্তি যার একমাত্র উদ্দেশ্য বিপুল পরিমাণ তথ্য সম্ভারের দখল ও তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার রাশ নিজের দখলে রাখা, তার বাহিনী তৈরি করা। অার ‘ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্য’ বলতে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার বস্তাপচা অংশের সঙ্গে যোগ স্থাপন। স্বাধীন দেশের শিক্ষাকমিশনগুলো এবং শিক্ষাদলিলগুলোয় জোর দিয়ে বলা হয়েছিল দেশ গঠনে শিক্ষার ভূমিকার কথা এবং সেগুলি সংবিধানের মুখবন্ধে ঘোষিত নীতিগুলো রূপায়ণে গুরুত্ব দিয়েছিল। নতুন শিক্ষানীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজবাদ’ বিষয় দুটি নিয়ে কোন কথা নেই এবং সেটি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমন অনুমানের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক স্পষ্ট নতুন শিক্ষানীতি রূপায়ণের পরিকল্পনায়। সেখানে দেশের যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামোকে সরাসরি অাঘাত করা হয়েছে। শিক্ষানীতির দলিলে বলা হয়েছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে জাতীয় স্তরের সর্বোচ্চ কমিশন রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগ (RSA) গঠন করা হবে। একইভাবে প্রতিটি রাজ্যেও মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে রাজ্য শিক্ষা অায়োগ (RSA) নামে একটি কমিটি তৈরি হবে। রাজ্য শিক্ষা অায়োগের কাজ হবে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগের গৃহীত সিদ্ধান্তগুিল কার্যকরী করা। শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় রাজ্যের নিজস্ব কোন বিশেষ ক্ষমতা থাকবে না। নয়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগ এ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিটি (RSAAC) নামে একটি কমিটি তৈরি হবে যার সদস্যরা হবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, ভারতের প্রধান বিচারপতি, লোকসভার অধ্যক্ষ, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও লোকসভার বিরোধী দলনেতা। অর্থাৎ বিরোধী দলনেতা ছাড়া সকলেই শাসক পক্ষের লোক।
শিক্ষানীতির ২৩ নম্বর অধ্যায়ে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে প্রস্তাবিত ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেশন অথরিটি, ন্যাশনাল এ্যাক্রেডিটেশন এ্যান্ড এ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল, জেনারেল এডুকেশন কাউন্সিল, হায়ার এডুকেশন গ্র্যান্টস কাউন্সিল, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ্ এডুকেশনাল রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং, ন্যাশনাল ইন্স্টিটিউট অফ্ এডুকেশনাল প্ল্যানিং এন্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠনের সময় তাদের চেয়ারপার্সন, চিফ এক্সিকিউটিভদের এবং বোর্ডের সদস্যদের নিয়োগ করবে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা অায়োগ। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যই RSA কাজ করবে।
নতুন শিক্ষানীতিতে আরও কতকগুলি নির্দিষ্ট বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতিকে পুনর্গঠন করার পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া, শিক্ষায় সর্বজনীন বিনিয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং বৃত্তিমূলক ও বয়স্ক শিক্ষার প্রসার। এই সমস্ত পরিবর্তনের সঙ্গে স্কুল শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষাকে এক আঙ্গিকে নিয়ে আসার কথাও বলা হয়েছে।
নতুন শিক্ষানীতিতে বলা অনেক কথা অাগেও শুনেছি অামরা। শিক্ষায় সমতার বিষয়টি নিশ্চয় জরুরি, শিক্ষার স্বাধিকারের কথাও অতীতে শোনা গেছে। পাশাপাশি ১৯৮৬’র শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় স্তরে নন ফর্মাল শিক্ষাকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল এবং চাকরিকে ডিগ্রি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। মনে রাখা দরকার এই সময় থেকে মুক্ত বিদ্যালয়, মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, দূরশিক্ষা ইত্যাদি পদ্ধতি চালু হতে শুরু করে। একই ভাবে ১৯৯০এর দশকে পুণ্যায়া কমিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে অর্থসংগ্রহ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকারি উচ্চশিক্ষার ফি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করার কথাও সেইসময় থেকেই এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত শুরু হল এই সময় থেকে।
প্রসঙ্গতঃ অালোচনা করা যায় বিদ্যালয় শিক্ষার বেসরকারি -করণের প্রশ্নে। শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯এর মধ্যেই বহুদিক ছিল যার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার বাণিজ্যীকীকরণের গতিবেগ বেড়েছ। সেখানে যেমন সমস্ত শিশুর জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল তেমনি বৈষম্যকেও সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করা যায়নি। কার্যতঃ বৈষম্যকে এখানে টিকে থাকার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাঙ্ক ও অাই এম এফ অারোপিত শর্তমাফিক ভারতীয় অর্থনীতিতে যে স্ট্রাক্চারাল এ্যাডজাস্টমেন্ট (SAP) আনার কথা বলা হয়েছিল তারই প্রত্যক্ষ পরিণতি এটি। এখন অান্তর্জাতিক পুঁজি তার থাবাকে অারও চেপে বসাতে চায়। সে কারণেই নতুন শিক্ষানীতি ২০১৯ এর মাধ্যমে স্কুলশিক্ষাকে কার্যতঃ অবাধ বেসরকারি করণের ডাক দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট পুিঁজ যা অাজ তামাম ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রক ভারত সরকার তারই হাতে তুলে দিচ্ছে শিক্ষাকে অন্যান্য অনেক কিছুর মত। সেকারণে শিক্ষাক্ষেত্রেও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব, যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক না থাকা সহ বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অস্বীকার করে, সেগুলি থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক ও অাইএমএফ-এর নির্দেশে ‘লার্নিং অাউটকামস’, ‘পেডাগগি’ আর ‘কারিকুলাম’ কথাগুলোর ওপর জোর দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল্যায়ন এর একটা ব্যবস্থা হল ‘লার্নিং অাউটকামস’। পাশাপাশি শিক্ষাবিদ্রা এমত পোষণ করেন যে শিক্ষার্থী কি শিখলো তা লার্নিং অাউটকামস দিয়ে সবসময় বিচার করা যায় না। নতুন শিক্ষানীতিতে এমন কথা বলা হেয়েছ যে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই ‘পেডাগগি’ ও ‘কারিকুলাম’ এর ওপর ভিত্তি করে বিদ্যালয় শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনা যায় এবং সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে বেসরকারি ক্ষেত্রকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষাব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে না তুলেও শুধুমাত্র ‘পেডাগগি’ ও ‘কারিকুলাম’ এর গালভরা কথা শুনিয়ে অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মত স্কুল খুলে ব্যবসা চালাতে পারবে। গত শতকের অাটের দশকের শেষ দিক থেকে তৎকালীন রাজ্য সরকারের ভুল শিক্ষানীতির কারণে এ রাজ্যে ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট স্কুলগুলোর অভিজ্ঞতা অামাদের স্মরণে অাছে। শিক্ষার বেসরকারি করণের অন্যতম একটা রূপ ছিল সেটি। অারেকটি রূপ হলো প্রাইভেট ট্যুইশন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে (যারা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের পড়ুয়া) স্কুলে যাওয়ার চেয়ে টিউটরের কাছে যাওয়াটা প্রধান হয়ে দেখা দিল। পারিবারিক অায়ের একটা বড় অংশ প্রাইভেট টিউটরদের পেছনে খরচ হতে লাগল। শিক্ষা নিয়ে দেশ জুড়ে কাজ করে এমন একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রাইভেট ট্যুইশনের পেছনে গড় খরচ ছিল পরিবারের মোট অায়ের তেরো শতাংশ, বা তারও বেশি। প্রাইভেট ট্যুইশনির খরচ জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে এমন পরিবার প্রত্যন্ত গ্রামে অনেক দেখা যাবে।
বর্তমানে শিক্ষার অধিকার অাইন ২০০৯এ ৬-১৪ বছরের শিশুদের অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের শিক্ষার অধিকার অাইনের অাওতায় অানার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর জন্য বিদ্যালয় শিক্ষাকে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই নীতিতে কোন কথা নেই। সাথে সাথে এটা পরিষ্কার যে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণির ছেলেমেয়েদের এক ছাদের নিচে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার দেওয়ার সরকারি দায়িত্ব এখানে অস্বীকার করতে চাওয়া হয়েছে। এটি অাগে সরকারি ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তাকেই বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ‘শুভচিন্তা’র ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার অধিকার অাইন ২০০৯ অনুসারে ‘বিনাব্যয়ে’ শিক্ষা দেওয়ার জন্য (সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের) পঁচিশ শতাংশ অাসন সংরক্ষণের নিয়ম বাতিল করার কথাই ঘোষণা করা হয়েছ ২০২০র শিক্ষানীতিতে। বলা হয়েছে যে বেসরকারি ফিলানথ্রিপক সংস্থাগুলোও যাতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারে তার জন্য এই ধরণের নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলো শিথিল করে দেওয়া হবে।
নতুন শিক্ষানীতিতে অাগামী দশ বছরের মধ্যে ৩-১৮ বছর বয়স্ক পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অাগে এই বয়ঃসীমা ছিল ৬-১৪ বছর। শিক্ষানীতি ২০২০তে এই বয়ঃক্রমের সীমা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে যে ‘‘স্বাধীনতার পর থেকে দশকের পর দশক ধরে অামাদের শিক্ষাকে সমাজের প্রতিটি স্তরে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া নিয়েই শুধুমাত্র ভাবা হয়েছে, শিক্ষার গুণমান নিয়ে কিছু ভাবা হয়নি।’’ এই ঘোষণা থেকে উদ্দেশ্যটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ‘শিক্ষার গুণমান’ এর নাম করে শিক্ষাকে সমাজের সমস্ত শ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা সরকার ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলতে চলেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় স্তরে নারীশিক্ষা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হলেও উচ্চশিক্ষাস্তরে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। অথচ সমাজের অগ্রগতির প্রশ্নে নারী শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সকলের জন্য সাধারণ স্কুলের ব্যবস্থা, কোঠারি কমিশন যাকে Common Type School (CTS) বলেছিল এবং তার ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছিল। অস্বীকার করা যাবে না সেদিকে তেমনভাবে নজর কোনদিন দেওয়া হয়নি। নেপ ২০২০তে বিষয়টিেক পুরো বাতিল করে শিক্ষার ক্রেতাদের ‘ক্রয়ক্ষমতার’ ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের জন্য অালাদা অালাদা মানের স্কুল তৈরির ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ফলে এই অাশঙ্কা মোটেই অসঙ্গত নয় যে এই ব্যবস্থায় সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হওয়ার বদলে তা অারও বেড়ে যাবে।
বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের যে কথা এই নীতিতে বলা হয়েছে বাস্তবে তা অামাদের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি না ঘটিয়ে তার গঙ্গাযাত্রাকে যে সম্পূর্ণ করবে সেই অাশঙ্কা অমূলক নয়। বলা হয়েছে পরিচালনার সুবিধার জন্য গ্রামাঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দূরে দূরে থাকা স্কুলগুলোকে একসাথে একটা স্কুল কমপ্লেক্স এর অাওতায় অানা হবে। এর উদ্দেশ্য হল একটা কমপ্লেক্স এর মধ্যে থাকা এক স্কুল অন্য স্কুলের রিসোর্স ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টা এই রকম এক স্কুলের শিক্ষক অন্য স্কুলে পড়াতে যাবেন, এক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অন্য স্কুলের ল্যাবরেটরি ব্যবহার করবেন। শহরাঞ্চল যদিও বা এটা সম্ভব হয়, গ্রামাঞ্চলে দূরে দূরে থাকা স্কুলগুলির শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের এরকম যাতায়াতের ফলে যে সময় নষ্ট হয়ে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে, তা কিভাবে কাটানো যাবে সে বিষয়ে এই শিক্ষানীতির দলিলে কিছু বলা হয় নি। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছাত্রছাত্রীরা। এর সাথে রয়েছে বিভিন্ন স্কুলের সময়ের সামঞ্জস্য রাখা সহ অারও বিষয়। যেগুলি দেখবেন বা এই সমন্বয় সাধন করবেন এলাকার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অর্থাৎ তিনি শিক্ষার দিকে না তাকিয়ে বাড়তি এসব কাজ করে যাবেন। নতুন শিক্ষানীতি ২০২০র মাধ্যমে সরকার চাইছে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন স্কুল, নতুন চাকরি, নতুন পরিকাঠামো গড়ে না তুলে অর্থাৎ রিসোর্স তৈরি না করে অপর্যাপ্ত রিসোর্স দিয়েই কাজ চালানো হবে যাতে উন্নত পরিষেবা অার পরিচালনার সুবিধার নামে বিষয়টিতে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা অনুপ্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডে অাগের বিজেপি সরকার এক বহুজাতিক সংস্থার পরামর্শে ছয় হাজার প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দিয়ে অন্য স্কুলে জড়ে দেওয়ায় সেখানে ড্রপ অাউট বেড়ে গেছে। রাজস্থানেও ৩০ শতাংশ স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শিক্ষাদানের জন্য দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষককূল। তাদের সহযোগিতা করবেন শিক্ষাকর্মীরা। অর্থাৎ পাঠদানের গোটা বিষয়টি পরিচালিত হবে একটি সংগঠিত কর্মীবাহিনীর দ্বারা। নতুন নীতিতে এই সংগঠিত কর্মীবাহিনীর বদলে স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর শিক্ষাদানের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা অাশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে বেসরকারি ব্যবস্থায় কার্যতঃ সেটি চুক্তিবদ্ধ চাকরিতে পরিণত হবে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে অল্প পয়সায় শিক্ষক নিয়োগ করে বিশেষতঃ প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ডটাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা বলেই এটিকে মনে হয়।
এতদিন কারিকুলাম, টেক্সট বই থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পঠনপাঠন, প্রশাসনিক কাজের গাইডলাইন দিত ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (NCERT)। একই ভাবে রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে স্টেটকাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ এণ্ড ট্রেণিং (SCERT)। শিক্ষার সামগ্রিক গুণমান নির্ধারণ করার জন্য পথ দেখানো তাদের কাজ। এখন থেকে SCERT নামের কেন্দ্রীয় বডি কারিকুলাম, টেক্সট বই থেকে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত সমস্ত বিষয়তত্ত্বাবধান করবে। এবং শিক্ষার ক্ষেত্র এটিকে সর্বোচ্চ বডি করা হবে। রাজ্যে রাজ্যে সরকারি অার বেসরকারি স্কুলের সাধারণ গুণমানের বিচার করবে স্টেট স্কুল রেগুলেটরি অথরিটি (SSRA) নামে একটি নতুন নিয়ন্ত্রক বডি। স্কুলের এ্যাক্রেডিশনও পরিচালনা করবে SSRA। SCERT, SSRA নামের নতুন তৈরি হওয়া বডিগুেলা সরাসরি RSAর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বর্তমানে রাজ্যস্তরে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বডি ডিপার্টমেন্ট অফ্ স্কুল এডুকেশন (DSE)। নতুন ব্যবস্থায় DSEর কোন ভূমিকা থাকবে না। টেক্সট বই তৈরি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ— সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে কেন্দ্র থেকে। অাঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য কোন কিছুরই গুরুত্ব নেই সেখানে।
স্কুল রেগুলেশন এর ক্ষেত্রে সরকারি অার বেসরকারি স্কুলে একই পদ্ধতি মানার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হবে এবং শেষে সরকারি স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। শিক্ষানীতিতে একথাও বলা হয়েছে যে কয়েকটি শর্ত মানলেই বেসরকারি স্কুল ভালো ‘এডুকেশনাল অাউটকাম’এর জন্য সরকারি অর্থসাহায্য পেতে পারে। বেসরকারি স্কুলগুলোতে ফি ঠিক করার ব্যাপারেও কেন্দ্র বা রাজ্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। এখানেই শেষ নয়। প্রতি তিন বছরে একবার করে বেসরকারি স্কুলগুলো SSRA’র পর্যালোচনার ভিত্তিতে মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে নিজেদের ফিও বাড়াতে পারবে।
বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠক্রম কাঠামো গঠনের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা অামরা দেখে নেব। এতদিনের পরিচিত ১০+ ২+ ৩ মডেল, যার মধ্যে রয়েছে ১০+ ২স্কুলশিক্ষা প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিন্যস্ত, বাকিটা উচ্চশিক্ষা স্নাতক স্তরের। বিদ্যালয় স্তরে একেবারে দশম শ্রেণিতে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়া চালু ছিল। পরবর্তী কালে অবশ্য একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিতে অালাদা ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়। সমগ্র স্কুল শিক্ষা বিষয়টি উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বারোবছরের শিক্ষার পাঠক্রম। এর বদলে প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের স্কুল শিক্ষা চালু হবে। উচ্চ মাধ্যমিক নামের অালাদা স্তরটি লোপ পাবে। এখন কাঠামো গড়ে উঠবে ৫+ ৩+ ৩ + ৪ বছরের বিন্যাসে। বয়স অনুসারে শিক্ষার্থীদের চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পাঁচ বছরের মৌলিক স্তরে প্রাক্স্কুল (গ্রেড-১) এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি (গ্রেড-২)। তিন বছরের প্রস্তুতিমূলক স্তর— যে স্তরে থাকবে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি। মধ্যম স্তর হবে তিন বছর— ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিকে নিয়ে। চার বছরের মাধ্যমিক স্তর হবে নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণি নিয়ে। এভাবেই গোটা স্কুলশিক্ষাকে এক ছাতার নিচে আনা হবে। পাশাপাশি প্রান্তিক, অল্পসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে চলা স্কুলগুলিকে হয় অারো সক্রিয় করে তোলা হবে, কিংবা তাদের অন্য বড় স্কুলের সঙ্গে মেলানো হবে। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে এই ধরণের ছোটো স্কুলে অর্থ বিনিয়োগ এবং সম্পদ ব্যবহারের ‘সাশ্রয়’ হয় না।
স্কুল কমপ্লেক্স-এর ধারণায় বলা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে অঙ্গনওয়াড়ি ও অন্যান্য যেসব কেন্দ্র থেকে এখন প্রাক্ স্কুল শিক্ষা পাওয়ার কথা সেগুলিকে এলাকার প্রাথমিক স্কুলটির সঙ্গে এবং প্রাথমিক স্কুলগুলিকে স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়গুলির সঙ্গে যোগ করা হবে। এর ফলে এলাকা জুড়ে স্কুল পরিচালনার প্রাথমিক একক হিসাবে গড়ে উঠবে একটি বড় ‘স্কুল কমপ্লেক্স’। এখানে শিক্ষকদের নিয়োগ করা পাশাপাশি নিয়োগ করা হবে একাধিক সমাজসেবী ও কাউন্সেলর যারা শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করবেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্কুল কমপ্লেক্সের প্রধান হবেন। এই স্কুল কমপ্লেক্স এর জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি থাকবে। একইভাবে প্রতিটি স্কুলেও একটি করে ১০-১২ জনের ম্যানেজমেন্ট কমিটি থাকবে। এসবের মধ্যে দিয়ে এলাকার মানুষের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ ভূমিকাকে বাড়িয়ে স্কুলের ওপর ‘জনসমাজের মালিকানা’র বোধ সৃষ্টি করা যাবে বলে দলিলটিতে বলা হয়েছে। অবশ্য বাস্তবতার সঙ্গে এই ধারণার অনেকটা ফারাক রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায় ১৯৯২ সালের শিক্ষা দলিলেও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই দলিলে কোঠারি কমিশন প্রস্তাবিত Common Type School এর কথা বলা হয়েছিল। বর্তমান দলিলে অবশ্য তার উল্লেখমাত্র নেই।
নতুন শিক্ষানীতি ২০২০ তে বিদ্যালয় পরীক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। শিক্ষার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে রাজ্যস্তরে State Census Examination এর ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি নিরন্তর মূল্যায়ন এর কথাও বলা হয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও বদল অানা হবে। মাধ্যমিক স্তরের (অর্থাৎ অষ্টম-দ্বাদশ) প্রতিটি বছরে দুটি করে সেমেস্টার হবে অর্থাৎ চার বছরে মোট অাটটি সেমেস্টার হবে। প্রতিটি ভাগে ছাত্রছাত্রীরা পাঁচ থেকে ছয়টি বিষয় নিতে পারবে। বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা থাকবে যাতে ব্যক্তিগত অাগ্রহ ও মেধার পূর্ণ বিকাশ হয় বলে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে।
শিক্ষক সংখ্যায় ঘাটতি, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলি লক্ষ্য রেখে এই দলিলে বলা হয়েছে কোন শিক্ষককে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্য কাজে (যেমন মিড্-ডে মিল, ভ্যাকসিনেশান) নিযুক্ত করা যাবে না। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমান বি-এড কোর্সের পরিবর্তন করে চার বছরের ইন্টিগ্রেটেড বিএড কোর্স চালু করার কথা বলা হয়েছে। এখানে উচ্চমানের সিলেবাস ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই কোর্সে প্রতি বছর কম করে ৫০ ঘণ্টার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখার কথাও রয়েছে।
প্রাক্ স্কুল এবং বুনিয়াদি স্তরের অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন নীতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাক্ স্কুল শিক্ষায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেগুলিই এই শিক্ষালাভের একমাত্র জায়গা নয়া নতুন শিক্ষানীতিতে অঙ্গনওয়াড়ি সহ প্রাক্ স্কুলশিক্ষার সমস্ত কেন্দ্রগুলিই স্থানীয় কোন প্রাথমিক স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এভাবে তারা স্কুল কমপ্লেকসের অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের উপর এই স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও দেওয়া হবে। এর জন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হবে। প্রশ্নটা হলো অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা তাঁদের নিজ নিজ কাজে খুব দক্ষ এবং তাঁরা যোগ্যতার সঙ্গেই সে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু শিশুদের শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগের যৌক্তিকতা কতটা। অাগেকার শিক্ষা সংক্রান্ত দলিলের কোন কোনটিতে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাক্ স্কুল শিক্ষার সামগ্রিক প্রয়োজন স্বীকার করে বলা হয়েছিল যে এই প্রকল্পটিকে একটি day care centre বা ক্রেশ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। শিশুকন্যারা যাতে ভাইবোন সামলানোর কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে স্কুলে অাসতে পারে। শ্রমজীবী মা কাজে গিয়েও সন্তান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকবেন। অন্তঃসত্ত্বা মায়েরাও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। প্রাক্ স্কুল শিক্ষাকে এর অংশ করতে হলে শিক্ষা বিভাগ ও নারী শিশুকল্যাণ বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পারস্পরিক সমন্বয় ও সহযোগিতা দরকার। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে স্কুল কমপ্লেক্স এর মধ্যে অানার যে প্রস্তাব রয়েছে তাতে ছোটো শিশুর ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের দেখভাল কিভাবে হবে তার উল্লেখ নেই। প্রাক্ স্কুল ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য পুষ্টিকর জলখাবার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবে সেবিষয়ে কোন কথা নেই।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য নেপ ’২০তে বলা হয়েছে সমস্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষার্থীকে কম করে একটি বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিতে হবে। স্কুল কমপ্লেক্সে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক থাকবেন। এই উদ্দেশ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় সমগ্র শিক্ষার্থীদের পঞ্চাশ শতাংশ অংশগ্রহণের লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
এদেশে বয়স্ক শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম। এরাই কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে দেশের অগ্রগতির ধারাকে সচল রাখেন। এদের মধ্যে ফাংশনাল লিটারেসির বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। যে সব দেশে নিরক্ষরতার হার শূন্য সেখানেও ফাংশনাল লিটারেট পাওয়া ক্রমে শক্ত হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অসাধারণ দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে সম্পর্কে জ্ঞানার্জনও দক্ষতা অর্জন করা কঠিন হচ্ছে বলেই এই সমস্যা। অাজকের বয়স্ক শিক্ষার অভিমুখ এই ফাংশনাল লিটারেসির প্রতি। নতুন শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষার জন্য একটি স্বশাসিত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দেওয়া আছে, যেটি বয়স্ক শিক্ষার জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা তৈরি করবে। প্রস্তাবিত স্কুল কমপ্লেক্সে এই শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। উপযুক্ত কোর্সের সঙ্গে মুক্ত শিক্ষার জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করার প্রস্তাবও নতুন নীতিতে রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় শিক্ষা বিষয়ক রামমূর্তি কমিটি প্রথাগত স্কুলগুলিকেই প্রথা বহির্ভুত শিক্ষার দিকে নিজেকে বিস্তৃত করা কথা বলেছিল। নতুন শিক্ষানীতিতে তার উল্টো পথে হেঁটে প্রথা বহির্ভূত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকেও স্কুল বলে চালানোর কথা বলছে। অথচ একই কমপ্লেক্স এর অাওতায় নানা ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে থাকলে কি অসুবিধা হবে বা কিভাবে সেইসব অসুবিধা মেটানো হবে সে বিষয়ে এই নীতিতে কিছু বলা নেই।
প্রতিটি শিক্ষানীতিতে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতিতে হিন্দি ও সংস্কৃতকে ভীষণ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক সামাজিক কারণে অাগের অনুসৃত ত্রিভাষা শিক্ষার কথা বলেও পরে অহিন্দি ভাষা রাজ্যগুলির হিন্দি নিয়ে আপত্তিতে তা পাল্টানো হয়। নতুন শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষা বা অাঞ্চলিক ভাষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। একই সাথে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাকেও চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুই ব্যবস্থা একসাথে চললে তার ফল সম্পর্কে আমরা অবহিত। এই নীতিতে বলা হয়েছে প্রাথমিকের পর মধ্যম স্তর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেখানে সম্ভব সেখানে একটি উপস্থাপন যোগ্য ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। কারণ শিশুর সার্বিক মানসিক বিকাশের সহায়ক হিসাবে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অন্যভাষা ধাপে ধাপে শিখবে। রামমূর্তি কমিটি এমন প্রস্তাবও করেছিল স্থানীয় ভাষা কোন শিশুর মাতৃভাষা থেকে আলাদা হলে মাতৃভাষার পরে তাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন শিক্ষানীতিতে শিশুকে ধাপে ধাপে যেভাবে ভাষা শেখানোর কথা বলা হয়েছে তা কার্যতঃ শিশুমনকে বিভ্রান্ত করবে। তার স্বাধীন বিকাশ, চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতাকে রুদ্ধ করবে। স্কুল ও উচ্চশিক্ষার সমস্ত স্তরে সংস্কৃত ভাষা শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় শিক্ষা ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করানোর নামে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একটা ভাষা। এখানে বলা হয়েছে যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাসঙ্গিক কিছু পঞ্চতন্ত্রের গল্প ও অন্যান্য কিছু ‘ইতিহাস-পরিবর্তনকারী সংস্কৃত লেখা’ স্কুলস্তরে বিভিন্ন বিষয়ে, সাহিত্যে এবং লেখার ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার ক্রমবিকাশের ওপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব প্রচার করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব অাএরাপ করার কথাও বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা-ব্যবস্থা শেখানোর ক্ষেত্রেও সংস্কৃত বা হিন্দি অােরাপের একটা প্রবণতা রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ক্লাসিকাল ভাষার প্রতি ছদ্মপ্রীতি দেখিয়ে কিছুটা নিরপেক্ষতার ভাণ করা হলেও সংস্কৃত ভাষার প্রতি অতি ভালবাসাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। পলিসিতে ‘মাল্টি লিঙ্গুইসম’ এর নামে ২৩ বার সংস্কৃত, হিন্দি-১২ বার, তামিল-৫বার কন্নড়-৩বার, ওড়িয়া-২বার এবং মালয়ালম-২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের প্রাথমিক স্তর থেকেই অন্ততঃ তিনটি ভাষার মধ্যে 'immersed' করা হবে। তৃতীয় শ্রেণিতে পৌঁছনোর অাগেই শিশু যাতে তিনটি ভাষায় কথা বলতে এবং প্রাথমিক স্তরের বই পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে অন্য দুটি ভাষায় সে লেখাও শুরু করবে। এখানে ওই তিনটি ভাষার মধ্যে সর্বত্র ইংরেজি থাকবে এবং তাই প্রাধান্য পাবে পরোক্ষে তাও স্বীকার করা হয়েছে। যদিও দলিলে উচ্চবর্গের মানুষদের ইংরেজি প্রীতিরও তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। কোনটা মুখ, কোনটা মুখোশ বোঝা সত্যি কঠিন।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০র প্রধান লক্ষ্য ২০৩০ সালের Agenda For Sustainable Development এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘উন্নয়ন’, যেখানে বিশ্ববাজারের স্বার্থে শিশুকে যন্ত্রে পরিণত করার জন্য যে কোনভাবে প্রাক্ স্কুল ও প্রাথমিক পর্বে অক্ষর জ্ঞান ও সংখ্যাজ্ঞান তার মাথায় ঢোকানো। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের। এমনিতে তারা শিক্ষায় পরিপূর্ণভাবে অংশ নিতে পারে না। নতুন শিক্ষানীতি যে এই গোষ্ঠির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি সম্পর্ণ দায়সারা ভাবে করতে চায় তার প্রমাণও রয়েছে। যেমন প্রস্তাব করা হয়েছে উপজাতিপ্রধান বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকের অভাব পূরণ করার জন্য প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক উত্তীর্ণদের নিয়োগ করা হবে যারা এই সব বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে পড়াবে। কিন্তু এদের বেতন কাঠামো ও চাকরির শর্ত নিয়ে এখানে কোন কথা নেই। একই ভাবে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে ‘স্বেচ্ছাসেবী’ ভূমিকার ওপর েজার দেওয়া হয়েছে তারা হবেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সেনাবাহিনীর অফিসার। ভাল ছাত্রছাত্রী এবং সামাজিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা স্বেচ্ছাসেবক হতে পারবে। এদের বলা হবে ‘টিউটর’। অার স্থানীয় যে সব মহিলা, যারা উপজাতি সম্প্রদায় ভুক্ত স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন তাঁরা স্কুলছুটদের বিদ্যালয়ে নিয়ে অাসবেন। বিশেষ ক্লাস নেবেন। তবে কারোরই বেতন কাঠামো বা চাকরির শর্ত নিয়ে কিছু বলা হয় নি। বোঝাই যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে সস্তায় কিছু চাকুরিজীবী নিয়োগ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে গোড়াতেই তাদের দুর্বল করে ফেলা এবং এইভাবে ধীরে ধীরে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া।
এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় যখন দেখি দলিলে রেগুলেশন এর ক্ষেত্রে সরকারি অার বেসরকারি স্কুলে একই প্রক্রিয়া মানার প্রস্তাব রয়েছে যাতে এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে একটা অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় এবং পরিণতিতে সরকারি স্কুল শিক্ষা বিলুপ্ত হয়। দলিলে এটাও বলা হয়েছে যে কয়েকটি সহজ শর্ত মানলেই বেসরকারি স্কুল ‘এডুকেশনাল অাউটকাম’ ভাল করার জন্য সরকারি অর্থ সাহায্যও পেতে পারে। এমনকি, বেসরকারি স্কুলগুলোতে ফি-ঠিক করার ব্যাপারেও কেন্দ্র বা রাজ্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানানো হয়েছ। শুধু তাই নয় প্রতি তিন বছরে একবার করে স্টেট স্কুল রেগুলেটরি অথরিটি (SSRA)র পর্যালোচনা সাপেক্ষে বেসরকারি স্কুলগুলো মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে নিজেদের ফিও বাড়াতে পারবে।
শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগকে ‘মানবহিতৈষী’ বলা হয়েছে এবং তাদের এই ভূমিকা(!) পালনের জন্য যথাযথ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তাদের হাতে পাঠ্যবই পরিকল্পনা, মূল্যায়ন বোর্ডের কাজকর্মের দায়িত্ব থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব মূল্যায়ন নিয়ামক সংস্থা তৈরি করতে পারবে। গবেষণার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রশ্নই থাকবে না। ফান্ডিং অথরিটির দয়ার ওপর তা নির্ভরশীল হবে। অার বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঢালাও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ‘উৎকর্ষের’ দোহাই দিয়ে বেতন নির্ধারণের, অনগ্রসর অঞ্চলগুলোতে বেসরকারি পুঁজির ওপর নির্ভর করে Special Education Zone গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে সরকার তাদের অবাধ সুযোগ দেবে। CSR বা কর্পারেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির নামে শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্য করার কার্যতঃ সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এ ধরনের ‘শিক্ষা উদ্যোগপতি’দের জন্য সরকার যেমন তাদের করছাড় দেবে তেমনি গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ শতাংশ অাসন সংরক্ষিত না রাখার স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে অবাধ লুঠপাট চলবে। সরকার পরবর্তী কালে ঘোষণা করেছে (যদিও ভিন্ন ক্ষেত্রে) ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। বরং ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা তার কাজ। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা (যেহেতু শিক্ষাও সরকারের চোখে ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়) সরকারি অবাধ সাহায্য পাওয়ার গ্যারান্টিও পেয়ে গেলেন।
২০১১-১২ সালের শিক্ষার সর্বভারতীয় এক সমীক্ষায় জানা যায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার সেসময় ছিল ২০.৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫.৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার এক সমীক্ষায় রিপোর্ট জানা যায় ২০১৮ তে দেশে ৯৯৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ৩৯৯৩১িট কলেজ এবং ১০৭২৫টি একক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কলেজের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ ছিল সরকারি, ৭৮ শতাংশ বেসরকারি। গত সাত বছরে দেশে যে ৩৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৯টি বেসরকারি। এই বৃদ্ধির হারকে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এই উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনা সফল করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে ঢোকার অাগে অামরা অামাদের দেশের শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের কথাটি মাথায় রাখা। এই দেশে সেই ১৯৬৮ সালে ঘোষিত প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে এখনও পর্যন্ত শিক্ষাখাতে জিডিপি বরাদ্দ ৬ শতাংশ করার কথা বলে অাসা হলেও সরকারি স্বীকৃতি মতো তা ছিল জিডিপি’র ৪.৪৩ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে এই খরচ ছিল। তা ২০১৩ সালে দাঁড়ায় ৩.৮ শতাংশে, ২০১৪তে ৩.১ শতাংশ অার ২০১৭তে তা নেমে এসেছিল ২.৭ শতাংশে।
বিশ্বব্যাঙ্কের বিভিন্ন রিপোর্ট জানা গেছে শিক্ষাখাতে সে সময় কিউবার বরাদ্দ ছিল ১২.৯ শতাংশ, নরওয়ে ৮ শতাংশ, ভুটানে ৬.৬ শতাংশ উজবেকিস্থানে ৬.৩ শতাংশ, ব্রেজিলে ৬.২ শতাংশ। ইজরায়েল ৫.৮ শতাংশ ব্রিটেন ৫.৫ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট ৫ শতাংশ। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র বরাদ্দের নিরিখে পৃথিবীর ১৯৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪৩ নম্বরে। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানাচ্ছে ২০১৩ সালে জাতীয় অায়ের শতাংশের হিসেবে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের বিচারে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৭৭। এশিয়া মহাদেশের কথা অালোচনা করলে ভারতের শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় মোট ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। পাশাপাশি ভুটানে ব্যয় ২২.৮ শতাংশ, ইরান ২১.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ২০.৫ শতাংশ, ইজরায়েল ১৫.৫ শতাংশ, বাংলাদেশ ১৪.৫ শতাংশ। নতুন শিক্ষানীতিতে তা জাতীয় অায়ের ৪.৪ শতাংশ বলা হলেও বাস্তবের ছবিটা তা নয়। এরই মধ্যে সরকারের দাবি তা ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। কোভিড জনিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা কিভাবে সম্ভব বোধহয় সরকারও জানে না।
নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকার জন্য নানাধরণের বাধ্যবাধকতার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সেকারণে National Higher Education Regulatory Authority (NHERA) গঠন করার কথা বলা হয়েছে যেটি হবে একটি স্বাধীন সংস্থা। UGC র ক্ষমতা ছেঁটে ফেলে Higher Education Grants Council (HEGC) নামের এক নতুন বডি তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল এ্যাক্রেডিটেশন এন্ড এ্যাসেসমেন্ট (NAAC) নামের পুরনো বডির ঢালাও পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। NAAC এর কার্যাবলীও নিয়ন্ত্রণ করবে RSA। স্কুল শিক্ষার মত উচ্চশিক্ষাতেও কারিকুলাম, পেডাগগি, অ্যাসেসমেন্ট ইত্যাদি দেখা হবে। পাশাপাশি AICTE, Bar Council of India র মত সংস্থাগুলির ক্ষমতা সংঙ্কুচিত করা হবে।
বর্তমান নিয়মে পার্লামেন্ট বা রাজ্য বিধানসভা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দিয়ে থাকে। নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে নতুন এই ধরণের প্রতিষ্ঠান NHERA থেকে বাধ্যতামূলক স্বীকৃতি করিয়ে নিতে হবে। সব ধরণের উচ্চশিক্ষার জন্য বড় অাকারের বহুমুখী (Multi Disciplinary) বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ তৈরি করা হবে যাদের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে পাঁচহাজার বা তারও বেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে। সমস্ত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক বিষয়, পঠন পাঠন সংক্রান্ত এবং অার্থিক বিষয়ে পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া হবে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে নতুন দলিলে। এদের রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, টিচিং ইউনিভার্সিটি এবং কলেজ তিনভােগ ভাগ করা হবে। বর্তমানের সেন্ট্রাল উইনিভার্সিটি, সেন্ট্রালি ফান্ডেড টেকনিক্যাল ইন্স্টিটিউট এবং ইন্স্টিটিউট অফ্ ন্যাশনাল ইমপরট্যান্স কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ICSSR, ICPR, ICHR, DAE, DBT র মত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের নিজের গবেষণায় অনুদানের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NRF) নামে নতুন এক কেন্দ্রীয় বডি তৈরি হবে। তারাই বিষয়টি দেখভাল করবে। বেসরকারি সংস্থাগুলিও NRF এর মধ্যমে গবেষণার কাজে লগ্নি করতে পারবে। পরিণতি সহজবোধ্য।
সমস্ত গবেষক শিক্ষার্থীদের নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি বাধ্যতামূলক ভাবে অাটটি করে টিচিং এ্যান্ড পেডাগগি কোর্স পড়াতে হবে ইংরেজি ভাষার সাথে কোন একটা ভারতীয় ভাষার অারেকটা ইউনিট নিতে হবে। অবশ্য বিদেশি গবেষকদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। প্রশ্নটা উঠবে এর ফলে গবেষণার গুণমান নিয়ে। পাশাপাশি সরকারের অারেকটি উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। অধ্যাপকদের শূন্য পদে সাংবিধানিক নিয়ম মেনে নিয়োগ না করে গবেষক ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা সরকারের তরফে তা এখানে দেখা গেছে।
১৯৪৯এ রাধাকৃষ্ণণ কমিশন সহ পরবর্তী কালের বিভিন্ন শিক্ষা দলিলে সাধারণ উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি জাতীয় পুনর্গঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা ভোকেশনাল এডুকেশন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিংএর মত ব্যবহারিক দক্ষতামূলক শিক্ষা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২০র নতুন শিক্ষানীতিতে বিষয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র জ্ঞান ভাণ্ডারগুলিকে ভেঙ্গে সুসংহত ব্যবস্থার নামে সেই পরিকল্পনার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে একমুখি বিষয় শিক্ষার বদলে Liberal broad based multidisciplinary শিক্ষা চালু করাই উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য। প্রাচীন নালন্দা তক্ষশীলারও এমন অাদর্শ নাকি ছিল।
বি.এ. বি.এসসি, বি.কম অাগের মত চালু থাকলেও তাকে চারটি পর্যায়ে ভাঙা হবে। সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও অনার্স। কেউ যদি প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেন তাহলে তিনি যতদূর পড়েছেন সেই পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য কোন একটা সার্টিফিকেট পারেন। অাবার ইচ্ছা করলে ভবিষ্যতে বাকি পাঠক্রম শেষ করতে পারবেন। কিছু কিছু বিষয় যেমন নতুন হবে তেমনি কিছু বিষয় বাতিল হবে। বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে পড়ুয়ার স্বাধীনতা থাকবে। কলা বিভাগের সঙ্গে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের বিষয় নেওয়া যাবে। অর্থাৎ চারবছরের স্নাতক পাঠক্রমে যে একাধিক ‘এক্সিটপয়েন্ট’ ঘোষণা করা হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয়না। স্নাতক হবার পরেও শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি পায় না। সেখানে মাঝপথে পড়া থামিয়ে বিভিন্ন সার্টিফিকেট পেলে তাদের চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন কথা নেই। বরং বলা যেতে পারে এতে মাঝপথে কলেজ ছুটকেই (Dropout) প্রশ্রয় দেওয়া হবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত বিষয়ের স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষা নেওয়া হবে যেখানে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তি হতে হবে। এখানে একটা গুরুতর দিকের প্রতি অামাদের নজর দেওয়া দরকার। এই শিক্ষানীতিতে স্কুল স্তরে নারী শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হলেও, উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রায় কিছুই নেই। চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু করার কথা বলা হয়েছে।
ক্লাস ঘরে পাঠদান প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং পরিকল্পনা মতো শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। অার করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা নেওয়া, কলেজে ভর্তি হওয়া সব চালু হয়ে গেল। উচ্চশিক্ষায় অনলাইন মাধ্যমের ব্যবস্থা ২০১৭ সাল থেকেই সরকার শুরু করেছিল SWAYAM পোর্টাল অার কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে। শিক্ষানীতির খসড়ায় যদিও ছিল না তবু এই বছর জানুয়ারি মাসে সেই খসড়ার সংযোজন করে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। যদিও দেশে ডিজিটাল পরিকাঠামো ও অনলাইন শিক্ষার হাল বুঝতে সরকারি তথ্যই যথেষ্ট। অবশ্য সরকার কোনদিকেই কর্ণপাত করবে না। হিসাব মতো শহরাঞ্চলে বসবাসকারী সমাজের স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকায় পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অনুপাতের হার ২৭ শতাংশ। একই ভাবে বিদ্যুৎ ঘাটতি বা নেট সংযোগ দুর্বল হওয়ায় ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে এখনও লক্ষাধিক গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছয়নি। দেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করেন জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। অার দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে একটিমাত্র ঘরে কোন রকমে জীবন কাটায়। অনলাইন শিক্ষায় এক বিরাট সংখ্যক পড়ুয়া যে শিক্ষার অাঙিনা থেকে ছিটকে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রমাণ, এই সময়ের মধ্যে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা নিচ্ছে। ভারতের শিল্পপতিরা ২০০০ সালে শিক্ষাসংস্কারের উদ্দেশ্যে যে রিপোর্ট পেশ করেছিল, অাম্বানী বিড়লা রিপোর্ট নামে যা পরিচিত সেখানে শিক্ষার প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ও সেক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৭ সালে নীতি অায়োগের তৈরি করা এ্যাকশন প্ল্যানে অনলাইন শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছিল, তা নাকি এনরোলমেন্ট বাড়তে সহায়ক হবে।
কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ছাত্রছাত্রীরা মাথায় হাত দিক, উল্লসিত কর্পোরেট হাউসগুলো। গুগল এর CEO সুন্দর পিচাই বলেছেন ভারতে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রসারে অাগামী ৫-৭ বছরে তিনি ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন। অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে CBSE কে সাহায্য করবে গুগল ও ফেসবুক। এই প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার সঙ্গে গড়ে তোলা হবে ‘জাতীয় সংগ্রহ ভাণ্ডার’। এখানে ডিজিটাল অাকারে সংরক্ষিত হবে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র যা সমস্ত ভাষাতেও পাওয়া যাবে।
দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ১৯৯৫ সালে গ্যাট্চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল অান্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য। ১৯৯৫ সালের পর থেকে দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত কমিটির সুপারিশ ছিল উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানোর। ঐ বছরই প্রথম নথিভুক্ত হয় মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ভারতের মোট উচ্চশিক্ষার্থীর দুই তৃতীয়াংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে। এই শতকের প্রথম পনেরো বছরে দেশে প্রতি বছর গড়ে ২০০০ করে নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশই বাণিজ্যিক উদ্যোগে। বাণিজ্যিক উদ্যোগে কর্পোরেট কায়দায় চালানো হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোক। সেখানে একটি মনোনীত সার্বভৌম প্রশাসনিক বোর্ড কাজ পরিচালনা করবে। সেখানে দশ থেকে কুড়িজন স্বাধীন ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ থাকবেন। শিক্ষক, প্রশাসনিক অাধিকারিকেরা থাকবেন। কর্পোরেট কায়দাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলা হবে CEO বা Chief Executive Officer। বোর্ড তাঁকে মনোনীত করবে এবং বোর্ডের অনুমোদিত নীতির ভিত্তিতে তিনি একাডেমিক কাউন্সিল তৈরি করবেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে থেকে যেমন অাসবেন, তেমনি বাইরে থেকেও অাসতে পারেন। এদের মধ্যে শিক্ষাবিদ থাকবেন দু’জন, বাকিরা অামলা।
ঝলমলে স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন শিক্ষা এসব গালভরা শব্দের অাড়ালে মূল প্রশ্ন টাকা কোথা থেকে অাসবে। এখানে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অর্থবরাদ্দ বাড়ানোর অাশ্বাস রয়েছে। বলা হয়েছে বিগত চার বছরে মোট অাভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে পরোক্ষ কর অাদায়ের হার ১.৫ শতাংশ বেড়েছে। জিএসটি’র অাওতায় গত চার বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে বিশেষ পরোক্ষ করদাতার সংখ্যা। ১৮ লক্ষের মত ব্যক্তিগত করদাতা বেড়েছে। এই সব বাড়তি করের একাংশ শিক্ষায় অাসবে বলে অাশা করলেও শিক্ষা সেসের ব্যাপারটির উল্লেখ নেই। জাতীয় অায়ের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করা কথা বাতিল না করা হলেও জোর পড়েছে অাগামী দশবছরে মোট সরকারি ব্যয় বরাদ্দের কুড়ি শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার লক্ষ্যে যাওয়ার। যা নির্ভর করে করের অনুপাত বাড়ার ওপর। অর্থাৎ বর্তমানে সর্বজনীন খরচের ১০ শতাংশ যা পরের দশ বছরে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে যার মধ্যে ৫ শতাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য, ২ শতাংশ বিদ্যালয় শিক্ষায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য এবং ১.৪ শতাংশ বিনিয়োগ হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। অথচ মোটেই জোরের সাথে শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ ব্যয় করার কথা বলা হয়নি। সরকারি অর্থঘাটতি মেটাতে বেসরকারি সংস্থার ‘মানবহিতৈষী’ অনুদানের ওপর নির্ভর করা হবে। অথচ CSR বিষয়টি অাইনের ফাঁক গলে এখনও বাধ্যতামূলক নয়।
নতুন শিক্ষানীতিতে উৎকর্ষমূলক জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গঠনের স্বপ্ন ফেরি করা হয়েছে। প্রতিজ্ঞা রয়েছে শিক্ষার সর্বজনীন প্রসার ঘটানোর। যদিও ‘সকলের জন্য শিক্ষা’কে বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ নেই। ২০০১ সাল থেকে সর্বশিক্ষা অভিযান চালু হয়। ৬-১৪ বছরের শিশুদের ‘এলিমেন্টারি এডুকেশন’ দিয়ে শিক্ষার অাঙিনায় নিয়ে এসে তাদের শিক্ষা সম্পর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বিশাল সংখ্যক শিশু এর ফলে বিদ্যালয়ে এল। তাদের পঠন পাঠন এর জন্য পার্শ্ব শিক্ষক নিয়োগ করা হল। গোটা প্রকল্পে কেন্দ্র রাজ্যের অংশীদারিত্ব স্পষ্ট হয়েছিল। এখানে পার্শ্বশিক্ষক, শিক্ষাবন্ধু ইত্যাদি ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া হবে। ফলে বিপুল সংখ্যক পার্শ্বশিক্ষক সংকটে পড়বেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও ‘অতিথি’ শিক্ষক না রেখে কাজ করবেন।
উল্লেখযোগ্য যে ৪৮৪ পাতার শিক্ষানীতির বক্তব্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজবাদ’ কথা দুটি অনুপস্থিত। রাধাকৃষ্ণণ কমিশন থেকে শুরু করে শিক্ষার যত দলিল স্বাধীন ভারতবর্ষে তৈরি হয়েছে তারা দেশের পুনর্গঠনে শিক্ষাকে বিশেষ ভূমিকা দিয়ে সংবিধানের মুখবন্ধে ঘোষিত নীতিগুলির বিশেষ উল্লেখ করেছে। অথচ বিভিন্ন ধর্মের মিশ্রণে গড়ে ওঠা নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, মুক্ত ভাবনার প্রসার বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখায় এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট অবস্থান না থাকলে ইতিহাসের বিকৃতি, বৈজ্ঞানিক ধারণার উদ্ভট ব্যাখ্যা অারও জোরালো ভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ্ অনিল সদ্গোপাল বলেছেন কোনও শিক্ষানীতিকে ভালভাবে বোঝার জন্য তার মূল পাঠের পাশাপাশি ভেতরের কথাকেও বুঝে নেওয়া দরকার। সেই কথাগুলো উল্লেখ করা হয় না। এই শিক্ষানীতির অাসল উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। শিক্ষার দায় নিজেদের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা, ধাপে ধাপে শিক্ষার সমস্ত স্তরকে মুনাফা লোভী শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে কার্যতঃ দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে শিক্ষার অাঙিনা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এবং ভারতবর্ষের শিক্ষার যে নিজস্বতা ছিল তা পরিকল্পিতভাবে করে দেবার অাশঙ্কা রয়েছে বলে শিক্ষাবিদ্দের অনেকে মনে করছেন। অাশার কথা বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে শিক্ষার ওপর নেমে অাসা কর্পোরেটসহ নানা ধরণের অাক্রমণের মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লড়াই করছে। এই শিক্ষানীতি চালু করার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যদিও দেশজোড়া প্রতিবাদ অাপত্তিতে কর্ণপাত না করে কস্তুরীরঙ্গণ কমিটি এই রিপোর্ট পেশ করেছে। রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তেমনভাবে অালোচনা করা হয় নি এবং সংসদে পেশ না করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দিয়েছে। অার অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ছাড়া কোন গণসংগঠনের মতামত নেওয়া হয়নি। অামাদের বিরাট দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের জাগতিক ও মানসিক চাহিদা বিপুল। সেদিকে নজর দিতেই হবে শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন্য। পাশাপাশি দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু এই দলিলে তার যথাযথ প্রতিফলন পড়েনি।
দলিলের শুরুতে তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘‘জ্ঞানের ভুবনে পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ তথ্যভান্ডার (বিগ ডেটা) যন্ত্রগত শিক্ষা (মেশিন লার্নিং) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নাটকীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলির কারণে বিশ্বজুড়ে নানা অদক্ষ শ্রমের কাজ যন্ত্রই করে দেবে (মানব শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না)। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, সমাজ বিজ্ঞান ও কলাবিভাগের বিভিন্ন শাস্ত্রের বিবিধ দক্ষতার সংযোগে বিশেষতঃ গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য বিজ্ঞান (ডেটা সায়েন্স) নির্ভর দক্ষ শ্রমের চাহিদা খুবই বেড়ে উঠেছে।’’ (‘দেশ’ পৃ: ২৯ ২রা সেপ্টেম্বর ২০২০)। বোঝাই যাচ্ছে এই চাহিদা মেটানোর জন্য একদিকে যেমন বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাওয়ার জন্য ধনীর ঘরের ছেলে মেয়েরা যাবতীয় প্রস্তুতির সুযোগ পাবে, ঠিক বিপরীতে কোটি কোটি অভুক্ত অর্ধভুক্ত শিশুরা স্কুলে গিয়ে নিজেদের মাতৃভাষায় সাবলীল ভাবে লিখতে বা পড়তে পারবে না। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ছড়া ‘লেখাপড়া করে যে / গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। তাতে ‘অাচ্ছেদিনের’ পরিস্থিতিতে হবে বেশি কড়ি দিয়ে লেখাপড়া করবে যে / গাড়ী ঘোড়া চড়বে একমাত্র সে।’
শিক্ষা মানুষের অধিকার। সেই অধিকারকে সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের। নতুন শিক্ষানীতি ২০২০তে ভারত রাষ্ট্রের সেই দায় পালনের কোন অঙ্গীকার নেই। নতুন দিনের অাগমন বোধহয় এভাবেই হবে।
তথ্যসুত্র :—
এই বিষয়ে প্রকাশিত বহু পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইট।
বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ
২
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল পর্ব
সংযোজনঃ রামমোহন পর্ব
রামমোহন পর্ব ছাপতে চলে যাওয়ার পর আমার এক শুভানুধ্যায়ী পাঠক এ লেখার খসড়া পড়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ এনেছেন। এক, ‘পশ্চিমী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশে অচল’ আমার এই উক্তি বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদলকে যথেষ্ট উৎসাহ জোগাবে, কারণ তারাও এই কথা বলেই হিন্দু রাষ্ট্র চায়। দুই, যদিও আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাংলায় উপনিবেশিকতাঃ প্রতিরোধ ও শিকার’, কিন্তু লেখায় রামমোহন কিসে কিসে উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছিলেন সেকথা থাকলেও তাঁর কাজে উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ কিভাবে ঘটেছিল সেকথা নেই। তাঁর দুটি অভিযোগই যথার্থ এবং গুরুতর, অতএব আর একটু আলোচনার প্রয়োজন আছে।
প্রথমে রামমোহনের কথাটা সেরে নিই। রামমোহনের কাজে আমার সীমিত বিবেচনায় উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ দুভাবে ঘটেছিল। এক, তাঁর ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। দুই, আন্তর্জাতিকতায় তাঁর বিশ্বাসের সজোর ঘোষণার মধ্যে দিয়ে।
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম -- আমাদের দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক ধারার আন্দোলনগুলো তখনো অব্দি ধর্মের ধারাতেই গড়ে উঠত, তার কারণ ভারতবর্ষ পৃথিবীর একমাত্র দেশ ধর্ম যেখানে সমাজপদ্ধতি বা জীবনধারা হিসেবে প্রবাহিত, সাম্প্রতিককালের বসু-দত্তের ভাষায় “[u]nlike the strict Anglo-Saxon positivist approach, ‘dialectics’ do not require a leap of faith – the thought system of India.”১ রামমোহন এই ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসরণেই তাঁর ব্রাহ্মধর্মকে গড়ে তুলেছিলেন এবং পূর্বসূরীদের থেকে আরো তীব্রভাবে ধর্মকে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সে অভিপ্রায় জন ডিগবিকে লেখা চিঠিতে এইভাবে প্রকাশ পেয়েছিল
I regret to say that the present system of religion adhered to by the Hindus is not well calculated to promote their political interest. ....It is, I think, necessary that some change should take place in their religion, at least for the sake of their political advantage and social comfort.২
এই চিঠিতে রাজনৈতিক স্বার্থ কিভাবে ধর্ম দ্বারা সাধিত হতে পারে এবং ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ বলতে রামমোহন ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন এ ব্যাপারগুলো অনেকের কাছেই এখন ধোঁয়াশার মতন। প্রথমে আসা যাক রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্কের কথায়। আমরা যারা স্বাধীন ভারতে জন্মেছি, রাজনীতি সম্বন্ধে তাদের ধারণা পুরোপুরি আলাদা। একেবারে সাম্প্রতিক যারা তারা তো দলীয় রাজনীতির ঘোঁটের ঊর্ধ্বে কোনো রাজনীতির সঙ্গে পরিচিতই নয়। একটু পুরোনো যারা রাজনীতিকে এখনো বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখতে পারি, সেই আমরাও মনে করি রাজনীতি আর ধর্মের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এবং স্বাধীন ভারতের চর্চিত রাজনীতির ধারায় সে সম্পর্ক যখন দেখি, তখন আমরা যারপরনাই বিরক্ত এবং উত্যক্ত বোধ করি। যদিও আমরা যা দেখি সেটা ‘ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার’, ‘রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার বা ধার্মিকতা’ নয়। কিন্তু দুটো যে পরস্পরবিরোধী ব্যাপার তা আমরা মাথায় রাখতে পারি না, তার কারণ উপনিবেশিকতার ধারায় গড়ে ওঠা আমাদের মননে এ ধারণা চেপে বসে আছে যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকতে পারে না। এই ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের রেনেসাঁচর্চা থেকে। রামমোহন থেকে সে চর্চার শুরু এবং এখনো বহমান। উপনিবেশিকতার সঙ্গে আমাদের বৌদ্ধিক সম্পর্ক এতটাই গভীর যে বাংলার নবজাগরণের নামও আমরা রেখেছি ‘বাংলার রেনেসাঁ’, ঠিক যেমন ডিরোজিও হলেন ‘ভারতের বায়রন’, রামগোপাল ঘোষ হলেন ‘ব্ল্যাক ডিমোস্থেনিস’, অন্ধকবি হেমচন্দ্র হলেন ‘বাংলার মিল্টন’, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র হলেন ‘বাংলার গ্যারিক’ ইত্যাদি।
ব্যাপার হচ্ছে আমাদের মত প্রবল ধর্মপ্রাণতার দেশে এবং ধর্ম যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়, ব্যক্তিগত ব্যাপার তো নয়ই, সামাজিক ব্যাপার, রেনেসাঁর মত কোনোকিছু ঘটাই সম্ভব নয়। রেনেসাঁয় চার্চের অনুশাসন আর মুক্তচিন্তার চর্চায় বিরোধ বেধেছিল এবং তার থেকে দুয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক, তার বজ্র-আঁটুনির হাত থেকে ভেঙে বেরোনোর জন্যে বিরোধিতার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানের ভিত্তি যে আরোহী-অবরোহী পদ্ধতি চার্চ তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তার ক্ষেত্র উন্মুক্ত, যে কেউ ইচ্ছে করলে তার শক্তির সাহায্য নিয়ে ভালো কিছু করতে পারে আবার মন্দ কিছুও করতে পারে এবং আমাদের দেশে ধর্মদর্শন আরোহী-অবরোহী পদ্ধতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি। ধর্মকে কেন্দ্র করে আমাদের ইতিহাসে ঘটনার ভালোমন্দ দুটোই প্রবলভাবে ঘটেছে, কিন্তু তার জন্যে ধর্ম মিথ্যে হয়ে যায়নি। সৌভাগ্যের কথা, আমাদের ধর্মনায়করা বারেবারে ধর্মের শুভশক্তিকে অবলম্বন করেই সমাজকে গতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে রামমোহনও সেই চেষ্টাই করেছিলেন এবং এতদ্বারা ‘রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না’ এহেন উপনিবেশিক ধারণার প্রতিরোধও করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মজ্ঞ কেবল ধর্ম নিয়ে থাকবেন আর রাজনীতিজ্ঞ কেবল রাজনীতি নিয়ে থাকবেন এটা খুব ভ্রমাত্মক ও ক্ষতিকর মত। রামমোহনের মত ছিল, তাঁর জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, “ধর্ম ঈশ্বরের, রাজনীতি কি শয়তানের? যাহা কিছু সত্য, পবিত্র ও হিতকর, তাহাই ঈশ্বরের। মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের সহিত পরমেশ্বরের সম্বন্ধ।”৩ রামমোহনের থেকে প্রায় একশ বছর পেরিয়ে এসে গান্ধীজিও প্রায় একই কথা বলেছিলেন (“ধর্মের থেকে যারা রাজনীতিকে আলাদা করে তারা ধর্ম বোঝে না”৪), কিন্তু তাঁর সে কথায় এ দেশের ক্ষমতালোভী এলিটরা কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করে নি। অথচ ঘটনা হচ্ছে আমাদের দেশের কাঠামোতে প্রাক্-ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত রাজনীতির (ও সমাজনীতির) সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তাকে বলে রাজনীতির ধর্মীয় ব্যবহার বা ধার্মিকতা, আশিস নন্দীর ভাষায় ‘religious use of politics’৫। এর ঠিক উল্টো পিঠেই অবস্থান ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বা ‘political use of religion’এর, বর্তমানে বিজেপি যার অত্যন্ত সুনিপুণ ব্যবহার করে চলেছে। তবে এ ব্যাপারে বিজেপি একা দোষী নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হয়ে আসছিল। যা ছিল স্যাকরার ঠুকঠাক, বিজেপি তাতেই কামারের এক ঘা দিয়েছে এই মাত্র। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান যা আমরা ব্রিটিশ প্রভুদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের দেশে বিশেষত যে প্রটেস্টান্ট ধর্মপ্রচারকরা এসেছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই ভারতে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ধর্মীয় ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে গেছেন এবং অপরদিকে বিশেষত কোম্পানি আমল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদও নিজেদের স্বার্থে নানাভাবে তাঁদের ধর্মতত্ত্ব এবং সুসমাচারকে প্রভাবিত ও ব্যবহার করে গেছে। এতটাই যে একবার রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বলেছিলেন যে, “[f]irst comes the Missionary, and then comes the Resident, lastly comes the Regiment.”৬
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম কিভাবে লৌকিক অর্থাৎ রাজনৈতিক বা ব্যবহারিক স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে এ প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তখনকার দিনেও উঠেছিল। বেদান্তগ্রন্থের ভূমিকায় তার উত্তরে রামমোহন লিখেছিলেন
তৃতীয় বাক্য এই যে ব্রহ্ম উপাসনা করিলে মনুষ্যের লৌকিক ভদ্রাভদ্র জ্ঞান থাকে না এবং দুর্গন্ধি সুগন্ধি আর অগ্নি ও জলের পৃথক্ জ্ঞান থাকে না অতএব সুতরাং ঈশ্বরের উপাসনা গৃহস্থ লোকের কিরূপে হইতে পারে। উত্তর। তাঁহারা কি প্রমাণে এ বাক্য রচনা করেণ তাহা জানিতে পারি নাই জেহেতু আপনারাই স্বীকার করেণ জে নারদ জনক সনৎকুমারাদি শুক বশিষ্ঠ ব্যাস কপিল প্রভৃতি ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন অথচ ইহারা অগ্নিকে অগ্নি জলকে জল ব্যবহার করিতেন এবং রাজ্যকর্ম্ম আর গার্হস্থ্য এবং শিষ্য সকলকে জ্ঞানোপদেশ যথাযোগ্য করিতেন......৭
এই বাক্যে রামমোহন মোদ্দা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে গোড়ার কথাটা হল ধর্ম এবং ব্রহ্মজ্ঞানী হলে জীবন্মুক্ত হওয়া যায়, অতএব লৌকিক বা ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে ব্রহ্মজ্ঞানীর পক্ষে কোনো বাধা নেই। উদাহরণস্বরূপ তিনি নারদ, জনক, সনৎকুমার, শুক, বশিষ্ঠ, ব্যাস, কপিল ইত্যাদিদের উদাহরণ টেনে এনেছিলেন। তার মধ্যে রাজর্ষি জনক এবং শুকদেবের উদাহরণ বহুচর্চিত। ছোটবেলায় পড়ার সুবাদে রাজর্ষি জনক এবং শুকদেবের কথোপকথনের গল্প, বিশেষ করে শুকদেবের তেলের বাটি নিয়ে শহর পরিক্রমার গল্প হয়ত আমাদের অনেকেরই মনে আছে। শুকদেব বৈদেহ জনকের নির্দেশে তেলের বাটি হাতে শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। তিনি সবই দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর তেলের বাটি থেকে একফোঁটা তেলও মাটিতে পড়েনি। বৈদেহ জনক যখন তাঁকে জিগ্যেস করলেন, এমনটা কী করে সম্ভব হল, তিনি বলেছিলেন, তিনি শহরের সবকিছুই দেখেছেন, কিন্তু কোনোকিছুই আসক্তি নিয়ে দেখেন নি, তাঁর মন ছিল তেলের বাটির দিকে। তখন রাজর্ষি জনক বলেছিলেন যে তিনিও সেভাবেই রাজত্ব চালান, করেন সবকিছুই, কিন্তু তাঁর মন থাকে ব্রহ্মে।
দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থ বলতে রামমোহন ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারটা বোঝা খুব শক্ত না। কৃষি শিল্প বাণিজ্য, জমিদার প্রজা থেকে শুরু করে ব্যবস্থা প্রণয়ন রাজ্যশাসন ও বিচার এই তিন বিভাগের স্বতন্ত্রতা, আইন প্রচারের আগে দেশীয় প্রতিনিধিদের পরামর্শ নেওয়া, দেশীয়দের উচ্চপদ লাভ, মুদ্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কিত আইন—এসব নিয়ে তিনি যা লিখে গেছেন সবই দেশের লোকের হয়ে রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে। রামমোহন ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিলেন না। তিনি যেটা চেয়েছিলেন সেটা হল একদিকে ব্রিটিশ শাসন ধর্মের ধারা অনুসরণ করুক, অপরদিকে ধর্ম দ্বারা চালিত হয়েই তাঁর দেশবাসী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করুক অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্জন করুক। এখানে ধর্ম বলতে মন্দির–মসজিদ–গির্জা বা তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বোঝানো হয়নি, বোঝানো হয়েছিল ধর্ম আমাদের মধ্যে যে নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম দেয় সেই ধর্মকে।
ডিগবিকে লেখা রামমোহনের চিঠির দুটো শব্দ কিন্তু বিতর্কমূলক। অনেক সময়ই মনে হয়েছে রামমোহন যদি ডিগবিকে লেখা তাঁর চিঠিতে ‘social comfort’ শব্দদুটো ব্যবহার না করে ‘social good’ শব্দদুটো ব্যবহার করতেন, তাহলে রামমোহনের নামে এ অভিযোগ আনা যেত না যে তিনি উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু রামমোহন খুব সচেতনভাবেই ‘social comfort’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন কারণ এই শব্দদুটো তিনি পেয়েছিলেন ফ্রান্সিস বেকনের কাছ থেকে। ‘Advancement of Learning’এ বেকন সমাজকল্যাণ অর্থে সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যই বুঝেছেন ([f]or the man seeketh in society comfort, use and protection৮) এই সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে বেকন প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের জন্যে নয়, প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করার চাবিকাঠি হিসেবে (our Saviour showed His power to subdue nature by His miracles৯)। এইখানেই বেকনের ধারণা থেকে ভারতীয় ধারণা আলাদা হয়ে যায়। প্রকৃতিকে বশীভূত ও তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ পরবর্তীকালে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করার প্রবণতা থেকে উৎপন্ন বেকনের সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য (ফ্রান্সিস বেকন ছিলেন একজন অ্যাংলিকান, প্রটেস্টান্টরা যার একটা শাখা। আর এই প্রটেস্টান্ট নীতিবোধের সঙ্গে পুঁজিবাদী উদ্দীপনার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ জানার জন্যে এই বিষয় নিয়ে লেখা ম্যাক্স বেবারের বিখ্যাত বই Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism১০ পড়ে দেখা যেতে পারে) শেষপর্যন্ত স্বাভাবিক ছন্দেই কতিপয় লোকের ভোগে পরিণত হয়। ভারতীয় ধারণায় ভোগকে আদর্শ বলে গ্রহণ করাই হয়নি যে কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনোকিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে আজো ভালো চোখে দেখা হয় না। রামমোহন যে একথাটা তলিয়ে ভাবেন নি তার কারণ তিনি একটা নির্দিষ্ট উত্তাল সময়ের ফসল।
রামমোহনের ব্রাহ্মধর্মকে অনেকে খ্রিস্টধর্মের অনুকরণ বলতে চান, ফার্কুহার১১ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের রিচার্ড কিং১২ পর্যন্ত (যদিও দুজন পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে পৌঁছন), কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। ভারতবর্ষ সমন্বয়ে বিশ্বাসী, সুতরাং এ অভিযোগ অযথার্থ। কর্তাভজা ধর্মেও খ্রিস্টধর্মের মিশেল ঘটেছিল, তার জন্যে সেটা অনুকরণ হয়ে যায়নি। “কর্তাভজাদের দশ নিষেধবিধি এবং ‘দায়িক মজলিশ’ নামক অনুষ্ঠান যথাক্রমে Ten Commandments এবং confession of sin-এর অনুরূপ একথা স্বীকার্য।”১৩ রামমোহন যেটা করতে চেয়েছিলেন সেটা হল মধ্যযুগীয় তথা সামন্তযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে (হিন্দু)ধর্মকে উদ্ধার, যখন নাকি, ডি ডি কোসাম্বির ভাষায়, “[e]verything regarded as the best in India’s philosophy was then available, but the applications left something to be desired.”১৪ তিনি যে খ্রিস্টের অনুরাগী ছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মের অনেককিছু নিয়েছিলেন, তা থেকে এটা প্রমাণ হয় না যে তিনি খ্রিস্টধর্মের অনুকরণ করেছিলেন।
রামমোহনের আন্তর্জাতিকতা -- আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নেও রামমোহন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারারই অনুসরণ করেছেন। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ ‘সারা বিশ্ব এক পরিবার’ এই তত্ত্বে তাঁরও বিশ্বাস ছিল। আমাদের দেশের উপনিবেশিক শাসনের অধীন থাকা না থাকার প্রশ্নে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ততা স্পষ্ট, কিন্তু ‘সারা বিশ্ব এক পরিবার’ এ বিশ্বাসে কোনো খাদ ছিল না। তিনি যে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন তার মূলে ছিল আন্তর্জাতিকতায় তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। জাতীয়তাবাদ আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান এবং রামমোহন সে উপাদানের বিরোধিতা করেছিলেন।
রামমোহনের আন্তর্জাতিকতা যে বায়বীয় ছিল না, তার প্রমাণ ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা। তাঁর বিশ্বজনীনতার শেকড় ছিল এ দেশেই। তবে তাকে জাতীয়তা বলে না, বলে স্বাদেশিকতা। বাংলা স্বাদেশিকতা থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু “আধুনিকতার বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে,” সখেদে লিখেছেন রণজিৎ গুহ, “স্বাদেশিকতা পরিণত হয় রাষ্ট্রক্ষমতার কাঙাল রাজনীতিতে এবং তারই যুগসম্মত রূপ জাতীয়তাবাদে।”১৫ এই জাতীয়তাবাদই ক্রমে ক্রমে হিন্দু জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা -- আসা যাক ‘পশ্চিমী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশে অচল’ একথা ঠিক না ভুল প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার দুধরনের ধারণা ক্রিয়াশীল—পশ্চিমী ও ভারতীয়। পশ্চিমী ধারণা বুদ্ধিজীবী স্তরে, ভারতীয় ধারণা রাষ্ট্রীয় স্তরে। আর জনগণীয় স্তরের কথা যদি বলা যায়, সে স্তরে ধর্মসাপেক্ষতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতাও নেই, কারণ তাদের ধর্মচেতনাটা একেবারে আলাদা ধাঁচের, তাকে বলা যায় লৌকিক ধর্মচেতনা।
ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটা আশিস নন্দী এইভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, “পশ্চিমী ধারণা অনুযায়ী ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আসতে পারে একমাত্র জনসাধারণ্যে ধর্মের অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে এবং রাজনীতিকে ধর্মের হাত থেকে মুক্ত করে। রাজনীতি যত ধর্ম দ্বারা কম সংক্রামিত হবে, রাষ্ট্র ততই ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি পবিত্র শব্দের বিপরীত। কিন্তু ভারতীয় ধারণা অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা পবিত্র শব্দের বিপরীত নয়, জাতিকেন্দ্রিকতা, বিদেশাতঙ্ক এবং ধর্মীয় উন্মাদনার বিপরীত। অর্থাৎ একজন ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে হয় সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে অসম্মান করে অথবা সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে সম্মান করে।”১৬ ভারতীয় বিদ্বজ্জনেরা প্রধানত ‘অনাধুনিক’ (আশিস নন্দী) দ্বিতীয় ধারণাটাকেই গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয় ধারণাটাকে গ্রহণ করার কারণ, আশিস নন্দীর ব্যাখ্যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃস্থানীয়রা বুঝতে পেরেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতার ইয়োরোপীয় ধারণা এদেশে চলবে না, কারণ এদেশে গড়পড়তা ভারতীয় গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ, তাই তাঁরা প্রাক্-আধুনিক ইয়োরোপে চার্চ–রাষ্ট্রের যে বিভাজন-বিতর্ক এদেশে তার আমদানি করতে চাননি।১৭
এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না। আমাদের অনেকেরই হয়ত মনে আছে যে আমাদের সংবিধানে গোড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা ছিল না। এটা যোগ হয় ১৯৭৫ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের সংবিধানের প্রায় খোলনলচে পাল্টে দেন। যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ যোগসাধন সংবিধানের ভূমিকায় ঘটে তার মধ্যে একটা হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। অথচ ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর গণপরিষদে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়, কিন্তু স্বয়ং নেহরু এবং অম্বেদকর শেষপর্যন্ত সংবিধানের ভূমিকায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা এই জন্যে ঢোকাতে চাননি, প্রটেস্টান্ট ধর্ম থেকে উদ্ভূত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা আমাদের দেশে খাটবে না এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। তাঁরা জানতেন ধর্ম আমাদের দেশে পশ্চিমের দেশগুলির মত কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয় (মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে সমাজ আগে ব্যক্তি পরে) এবং গণতন্ত্রকে যদি শক্ত বনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে হয় তাহলে ধর্মপ্রাণ ভারতীয় সমাজের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের সম্পর্কই তার ভিত। তাই এ সম্পর্কে অম্বেদকর বলেছিলেন, “what should be the policy of the state, how the society should be organised in its social and economic side are matters which must be decided by the people themselves according to time and circumstances. It cannot be laid down in the Constitution itself because that is destroying democracy altogether.”১৮
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কোনোকিছু আগে ছিল না এবং তা থাকতেও পারে না। পালরাজারা ঘোষিতভাবেই বৌদ্ধ ছিলেন অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, কিন্তু তাতে দেশে সনাতনধর্মের পক্ষবিস্তার করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মধ্যযুগে যখন সদ্য সদ্য মুসলমান শাসকরা শাসন করতে শুরু করেন তখন কিছু অশান্তি হয়েছিল, কিন্তু ইসলামের সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হওয়ার পর থেকে প্রথমদিকের সে ভুলবোঝাবুঝি কেটে যায় এবং চৈতন্য, নানক, কবির, দাদূ, শঙ্করদেব, রুইদাস, রবিদাস কারুরই ধর্মপ্রচারে কোনো অসুবিধে হয়নি। সংকীর্ণ মানসিকতা প্রাচীন যুগে ছিল, মধ্যযুগেও ছিল। তার হিন্দু মুসলমান নেই।
তবে সত্যি বলতে কি, সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে ভারতীয় লোকসমাজকে জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান, শিখ, ইসাই—এভাবে ভেঙে বিচার করাটাই ভুল। কারণ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ধর্মাচরণে এসব ধর্ম (বিশেষত হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে) এ ওর সঙ্গে ও তার সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে বিশেষ একটি ধর্মের নামে তাদের যে অবস্থান সেটি একটি আপাত-অবস্থান হিসেবেই চিহ্নিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মুসলমানদের উদ্ভব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ইটন১৯ যে বাংলার লৌকিক সমাজের কথা বলেছিলেন মনে হয় সেটা গোটা দেশের সম্পর্কেই খাটে। এই সমাজকে লৌকিক সমাজ হিসেবে এবং এই লৌকিক সমাজের ধর্মচেতনাকে লৌকিক ধর্মচেতনা হিসেবে গ্রহণ করাটাই শ্রেয়। এই লৌকিক ধর্মসমাজের কোনো সাপেক্ষতা নেই, কোনো নিরপেক্ষতাও নেই। যেহেতু এই লৌকিক সমাজের কোনো সাপেক্ষতা নেই, হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় শাসকদলের যে উৎসাহ তারও কোনো ভিত্তি থাকে না।
কেউ বলতে পারেন ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের আপাত-অবস্থানের নিরিখে আমরা যেহেতু কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ খ্রিস্টান ইত্যাদি, সেক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্মের ব্যাপারে আমাদের সাপেক্ষতা থাকবেই এবং ধর্মনিরপেক্ষতাটা বস্তুত রাষ্ট্রের ব্যাপার। তাহলেও শব্দটা ধোপে টেঁকে না, কারণ আমাদের দেশে গণতন্ত্র এই লোকসমাজকে বেড় দিয়েই বেড়ে ওঠে এবং নানা ধর্মমতাবলম্বী মানুষজন যখন রাষ্ট্রের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রবেশ করে তখন তাদের পক্ষে তাদের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসকে দরজার বাইরে রেখে আসা অসম্ভব। এরকম পরিস্থিতিতেও আমাদের যেসব রাষ্ট্রনায়ক ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদের সেইসব চেষ্টার ফাঁকগুলোর আলোচনা আশিস নন্দী করেছেন। তবু ব্যক্তিত্বের জোরে ইতিহাসের নজরে তাঁরা খানিকটা পার পেয়ে গেছেন, কিন্তু রাজনীতি যত লোকসমাজে শেকড় গাড়বে, এই পার পাওয়া ব্যাপারটা সহজ থাকবে না, সংকট ঘনীভূত হবে। এই অবস্থা থেকে বেরোনোর একটাই রাস্তা, আমাদের মত বহু ধর্মের দেশে ধর্মচেতনার সঠিক হিসেব কষা। সে হিসেব কষলে আমরা দেখব তার সাপেক্ষতা নেই, নিরপেক্ষতাও নেই।
এখানে ইচ্ছে করেই সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে ‘তাদের’ শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারণ আমাদের, এই মধ্যবিত্তসমাজের, প্রকৃত অর্থে ধর্মচেতনা বলে কিছু নেই, যে কারণে মূল্যবোধ বলেও কিছু নেই। এই মধ্যবিত্তসমাজ দুভাগে বিভক্ত। একটা খুব ছোটো অংশ, মূলত এলিট, ধর্মকে জনগণের আফিং বলে মনে করে এবং ধর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত দেখতে চায়। তা বলে এদের ধর্মচেতনা নেই তা নয়, এদের ধর্মের নাম হল ‘বিজ্ঞান’ (তাও আবার মূলত পশ্চিমী বিজ্ঞানের ধারা)। এরা বিজ্ঞানের খুব ভক্ত, বিজ্ঞান যে ভোগের রাস্তা খুলে দিয়েছে, যে উন্নতির সোপান এদের সামনে হাজির করেছে এদের চোখে তার কোনো বিকল্প নেই, কারণ এরা সেই রাস্তা ধরে চলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। যেহেতু বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে বিশেষ করে এদের নিজেদের নানারকমের আহরণমূলক সাফল্য জড়িয়ে আছে তাই এরা বিজ্ঞানকে অহরহ দেশবাসীর সামনে বিকল্প আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে এবং নিজেরা নিজেদের চোখ ঠারে। দেখেও দেখে না যে ধর্মের মত বিজ্ঞানেরও ভালোমন্দ দুটো করার ক্ষমতাই প্রবল। ধর্মকে কেন্দ্র করে যেমন, তেমনি বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেও আছে ‘বিত্ত ও ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত কিছু অশুভ মানুষের ষড়যন্ত্র’। এরা ভুলে যায় যে এই বিজ্ঞানই আমাদের ক্রমশ ভোগবাদের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। ভুলে যায় যে আজকের দিনে বিজ্ঞান বলতে বেশি বোঝায় আণবিক কিংবা রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্র, পারমাণবিক শক্তি, অ্যাসিড-বৃষ্টি, পরিবেশ দূষণ, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য-ব্যাংকের কারণে ব্যক্তিগত অধিকার লোপ। সেই কোন্ ১৯৩৪ সালে হেনরি মিলার লিখেছিলেন, “[t]he wallpaper with which the men of science have covered the world of reality is falling to tatters. The grand whorehouse which they have made of life requires no decoration.”২০ আজকের দিনে বিজ্ঞান নিয়েও বড় মুখ করে বলার কিছু নেই। বিজ্ঞান অবশ্যই খুব প্রয়োজনীয়, কিন্তু সে যখন পাল্টা ধর্ম হয়ে ওঠে, তখন তার গোঁড়ামোও একইভাবে আমাদের ভাবনাকে ছেয়ে ফেলে এবং বিশেষ করে উপনিবেশিক দেশে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া খুব শক্ত হয়ে যায়। এ গেল একদিকের কথা। অপরদিকে, চরিত্রগতভাবে ফাঁপা মধ্যবিত্তসমাজের বড় অংশটা সংস্কারগতভাবে ধর্মীয় আচারগুলো পালন করে চলে এবং একই সঙ্গে অন্ধের মত বিজ্ঞানেরও অনুসরণ করে চলে, যদিও দুটোর কোনোটার সঙ্গেই তাদের কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই এবং এসব নিয়ে নেই কোনো সুগঠিত ভাবনাচিন্তাও। দুয়েরই আছে নিজ নিজ বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে প্রচুর ভুয়ো অহংকার এবং কথায় কথায় যে কোনো বিষয় নিয়ে ফতোয়া জারি করার প্রবণতা। সবই ক্ষমতামদমত্ততার প্রকাশ। ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুইয়েরই রাজনৈতিক ব্যবহারে তার নিত্য প্রকাশ আমরা দেখি।
এরিক ফ্রম তাঁর ‘Art of Loving’ গ্রন্থে ঈশ্বর ভাবনাকে কেন্দ্র করে দুরকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন--পশ্চিমের ‘Thought Experience’ বা ‘চিন্তাপ্রসূত অভিজ্ঞতা’ এবং পূবের ‘Intense Feeling Experience’ বা ‘নিবিড় অনুভূতিপ্রসূত অভিজ্ঞতা’২১। ভারতীয় ধর্মদর্শনের সঙ্গে তাঁর যদি সম্যক পরিচয় থাকত তাহলে তিনি দেখতেন ভারতবর্ষে নিবিড় অনুভূতিপ্রসূত অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তাপ্রসূত অভিজ্ঞতার কি চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে। এর সবথেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নব্যন্যায়। নব্যন্যায়মতে দ্রব্য বা substance হচ্ছে নয়প্রকার – পৃথ্বী, অপ, তেজস, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মনস। এই তত্ত্ব দ্বারা নব্যন্যায় আমাদের আস্তিক নাস্তিক সমস্ত দর্শনকে পুনর্বিন্যস্ত করেছিল। দ্রব্যের একপ্রকার হচ্ছে আত্মা, যার আবার দুটি ভাগ – জীবাত্মা ও পরমাত্মা। এর ফলে আস্তিক দর্শন যে এতদিন ধরে ঈশ্বরকে (পরমাত্মা) মানবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখে আসছিল, তা আর থাকল না। ঈশ্বর দ্রব্যের ধারণাগত হয়ে গেলেন (তুলনীয় বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ যেখানে পদার্থের পরে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে)। অপরদিকে অবস্তুগুলিকেও দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেখানোর ফলে নাস্তিক বা বস্তুবাদী দর্শনের (চার্বাক) ধারণাও আর থাকল না এবং এই পুরো কাজটাই নব্যন্যায় করেছিল আরোহী পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নব্যন্যায় সিদ্ধান্ত থেকে তত্ত্বের বিশ্লেষণে যায়নি, তথ্যের সমাহার থেকে সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত থেকে তত্ত্বে পৌঁছেছিল। নব্যন্যায় কর্তৃক এই আরোহী পদ্ধতির উদ্বোধনই আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করে। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের ভাষায়, “The masters of Navya Nyaya did not lay down conclusions first and justify them later with theory. They were seriously engaged in following reality wherever it might lead them, imposing as softly as possible their own prejudices. I have admired this trait greatly. It is precisely the same trait that I find admirable among the creative workers of modern science and philosophy.”২২
ব্রাহ্মধর্ম যে পৌত্তলিকতার বিরোধিতায় জন্ম নিয়েছিল, সে বিরোধিতা সেসময় দেশের যা পরিস্থিতি ছিল তাতে প্রয়োজনীয়ই ছিল। হয়তবা এখনো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার আগে এই কথাটাও জানতে হবে যে এই পৌত্তলিকতার মধ্যে দিয়েই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ভোগবাদ থেকে দূরে থাকে এবং এদেশের বহুত্ববাদী কাঠামোকে রক্ষে করে। এবং পৌত্তলিকতার ভাবগত দিক আমাদের ধর্মদর্শনের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। একথা বিশ্বাসযোগ্য না হলে, যে কেউ অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা’র পাঁচ খণ্ড২৩ মন দিয়ে পড়ে দেখুন, পূজাগুলোর ক্ষেত্রে সেখানে সর্বত্রই ‘সমাজের মঙ্গল’ ও ‘সকলের কল্যাণ’এর কথা বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত ভোগবাসনার কথা কোথাও নেই। তা বলে ব্যক্তির জন্যে সেখানে কোনো জায়গা রাখা ছিল না এমনও নয়। সে জায়গাটা হল ‘মানত’, যদিও সেটাও কোনো ভোগবাসনার ব্যাপার নয়, খুব ছোটখাট কামনাপূর্তির আকাঙ্খার ব্যাপার। আর বহুত্ববাদী অস্তিত্বের প্রমাণ পাবার জন্যে শুধু ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা’ নয়, বাংলায় লেখা আমাদের দেশের প্রায় শতবর্ষপ্রাচীন জেলা ইতিহাসগুলো ঘেঁটে দেখুন, দেখবেন জাতিধর্মনির্বিশেষে কিভাবে সামাজিক পরিসরের ব্যাপ্তি ঘটেছে। তারপরেও যদি আমরা মনে করি যে সাধারণ মানুষকে পৌত্তলিকতা থেকে বের করে আনাটা জরুরি, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আমাদের সন্ধান দিতে হবে আরো উচ্চতর কোনো উপায়ের যে উপায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তারা ভোগবাদ-বিরোধী কাঠামো ও বহুত্ববাদকে রক্ষে করতে পারবে। গত দুশো বছরে সে সন্ধান কি আমরা তাদের দিতে পেরেছি? আমরা কি সে সন্ধান দেবার উপযুক্ত? তাছাড়া পৌত্তলিকতার প্রেক্ষিতকে অগ্রাহ্য করা কোনোমতেই সম্ভব নয়, কারণ তা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি আবশ্যিকভাবেই ধর্মসংস্কৃতি। এই ধর্মসংস্কৃতি নিরীশ্বরবাদ ও ঈশ্বরবাদ উভয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এমনকি নিরীশ্বরবাদও একটা সময় অবতারবাদে এসে মিশেছে। এবং প্রভূত ক্ষেত্রে এসবের সমন্বয় ঘটেছে। এক্ষেত্রে সমন্বয়ের সবথেকে বড় দৃষ্টান্ত শংকর, যে জন্যে তাকে অনেক সময়ই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলা হয়। কিন্তু সেই শংকরাচার্য-অনুগামী দশনামীদের বেলায় কি দেখলাম? দেখলাম তারা অদ্বৈতবাদী, অথচ শৈব। আবার সেই দশনামীদের কাছে দীক্ষা নিলেন শ্রীচৈতন্য, তিনি আবার কৃষ্ণের ভজনা করলেন। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি আবার অদ্বৈতবাদের সঙ্গে মা কালীকে মেশালেন। ভারতীয় ইতিহাসে এরকম মেশানোর গল্প অনেক পাওয়া যায়।
মূল ব্যাপারটা হল আমাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে শ্রদ্ধার ঘাটতি। এই শ্রদ্ধার ঘাটতিও উপনিবেশিকতার ফসল। এই শ্রদ্ধার ঘাটতিই আমাদের এক ধরনের ছাঁচে ঢালা ভাবনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার ফল হয়েছে এই, আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতা প্রচুর ভণ্ডামোকে বেড় দিয়ে বেড়ে উঠেছে।
এসব কথা বলার অর্থ এই নয় যে পৌত্তলিকতার সবকিছুই গুণে ভরা। কিন্তু তার ভেতরে অগুণগুলোর প্রবেশ ঘটেছে প্রধানত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পথ ধরে। জাতভেদকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আর পৌত্তলিকতাকে কেন্দ্র করে তার বাড়বাড়ন্ত। অনেকে বলবেন এতো পুরোহিততন্ত্রের কথা হল। কিন্তু ভুলে গেলে হবে না যে এই পুরোহিততন্ত্র হল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবহমানকাল ধরে এই পুরোহিততন্ত্র তথা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রই গ্রামভারতকে দখলে রেখেছে। সমস্ত ধরনের বিভাজনের প্রশ্রয়দাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের কুসংস্কারের প্রশ্রয়দাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের শোষণের আড়ালদাতা এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সমস্ত ধরনের জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখেছেও এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। অর্থাৎ শত্রু ধর্ম নয়, শত্রু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র একদিকে পৌরোহিত্যের মধ্যে অপরদিকে উচ্চবর্ণের মধ্যে এমন ভাবে মিলেমিশে আছে যে আজকের দিনে তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। অম্বেদকর খুব সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ‘মুক্তি, সাম্য, সৌভ্রাত্র’ এই তিন আদর্শেরই বিরুদ্ধে।২৪ সেদিক থেকে দেখলে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র পুঁজিতন্ত্রের বিকাশেরও পরোক্ষ কারণ। অথচ এদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। ব্রাহ্মধর্ম পর্যন্ত আমাদের দেশের সমস্ত ধর্মান্দোলনই তাই মূলগতভাবে ছিল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে। জানি না কথায় কথায় যাঁরা ধর্মকে অভিযোগের কাঠগড়ায় তুলতে চান তাঁরা আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটাকেই আড়াল করতে চান কিনা! অথবা বলা যায় তাঁদের এই শৌখীন প্রগতিচর্চার ফাঁক গলেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আবার মাথা চাড়া দিয়েছে।
পৌত্তলিকতা দীর্ঘ ইতিহাসের ফসল। আদিম সমাজে তার শুরু। ইতিহাসের পর্বে পর্বে নানান উপাদান তার মধ্যে এসে মিশেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে কোনো বিয়োগ নেই, শুধুই যোগ আছে। আদিম সমাজের উপাদানগুলো সামান্য বিবর্তিত হয়ে ক্রমশ যোগ হতে হতে গেছে। বড় পরিবর্তন বলতে একমাত্র এই যে, হিংসা থেকে অহিংসার দিকে তার যাত্রা। তার কারণ কৃষি সমাজে উত্তরণ। বৈদিক ঋষিরা গোরু খেতেন। সমাজ কৃষির দিকে মোড় ফিরল, গোবধ বন্ধ হল। আজকের সেঁজুতি ব্রত এককালের উপজাতীয় স্তরে হত্যার উৎসব। কিন্তু ঝাড়ফুঁকের প্রভাব আজো রয়ে গেছে। উপজাতীয় স্তরের সমাজে ঝাড়ফুঁক ছিল সে আমলের চিকিৎসাবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের চর্চা যাঁরা করতেন, বৈদিক ভারত তাঁদের বলত ‘হোত্র’ বা ‘ভৈষজানি’ বা ‘পুরোহিত’। বৌদ্ধ ভারতে তাঁরা হয়ে গেলেন ‘ভেজ্জ’, আদি মধ্যযুগে ‘ওঝা’ থেকে অন্ত্য মধ্যযুগে ‘গুণিন’। কোসাম্বী বলেছিলেন, “ভারতীয় ধর্মদর্শনের আদিম শেকড়কে স্বীকার করতে এবং দেশে যেসব আদিম বিশ্বাস এখনো টিঁকে আছে সেগুলোর মুখোমুখি হতে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের যে অনীহা, সে অনীহার উৎপত্তি নিপীড়িত উপনিবেশিক জীবনের দীর্ঘ অবমাননা থেকে যার দুর্বহ স্মৃতি আজো অম্নান।”২৫ কোসাম্বী একথা বলেছিলেন ১৯৬২ সালে, কিন্তু কথাটা আজো সত্যি। এ ব্যাপারে নৃতত্ত্বের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রামমোহনের সময় নৃতত্ত্ব হামাগুড়ি দিচ্ছিল, সুধীজনের পক্ষে তার খোঁজ রাখা সেভাবে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আগেও বলেছি, অনস্বীকার্য যে রামমোহনরা দেশের জনগণ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সৌভাগ্যের কথা, পরবর্তীকালে এসব নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্যে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব নামে একটি বিশেষ শাখা তৈরি হয়েছে এবং তার কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। উপনিবেশিক খোলস ছেড়ে এই শাখা যত তাড়াতাড়ি স্বদেশী হয়ে উঠবে ততই মঙ্গল। স্বদেশী, জাতীয়তাবাদী নয়, কারণ জাতীয়তাবাদ, আবার বলছি, আবশ্যিকরূপেই একটি উপনিবেশিক উপাদান।
জানি এখানে সাম্প্রতিককালের রাজনীতি দেশটাকে প্রতিনিয়ত যেভাবে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর প্রতিদিন যেভাবে আছড়ে পড়ছে আঘাতের পর আঘাত, যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোকে চুরমার করার চেষ্টা চলছে, এমন সংকটময় মুহূর্তে খোদ জাতীয়তাবাদের অসারতার দিকে ইঙ্গিত করার ব্যাপারে যাঁরা অন্তর থেকেই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সেইসব লোকজন অসন্তুষ্ট বোধ করবেন এবং অস্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। একথা তো ঠিকই যাঁরা জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বুঝেছেন তাঁদের তুলনায় যাঁরা জাতীয়তাবাদ বলতে এক ধরনের সংশ্লেষে বিশ্বাস করেন তাঁদের ধ্যানধারণা অপেক্ষাকৃত উঁচু মানের। কারণ তাঁদের ধ্যানধারণা আমাদের দেশের লৌকিক সমাজের লৌকিক ধর্মচেতনাকে অনেকটাই ছুঁয়ে যায়। ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইতে হিন্দু-মুসলমানের সংলাপ এইভাবে দেখিয়েছিলেন,
একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন ‘যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’। মুসলমান বলিতেছেন ‘ঠাকুর যথার্থ কহিয়াছেন, সমস্ত জগৎ সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই বিভূতি মাত্র, মানুষ ভেদে যেমন আচারভেদ—পরিচ্ছদভেদ—ভাষাভেদ—তেমনি উপাসনার প্রণালীভেদও হইয়া থাকে। সকলেই এক পিতার পুত্র। সেই পিতা ভিন্ন ভিন্ন পুত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরাইয়া দেখিতেছেন। কিন্তু সকলেরই চামড়ার নীচে লহু লাল বই কাহারোও কাল কাহারোও জরদ নহে।’ একজন ক্ষত্রিয় ঐ কথায় যোগ দিয়া বলিল ‘তাবই কি—আসলে কিছুই তফাৎ নাই—আমরা হিন্দু বলিয়া কি মুসলমানের দেবতা মানি না? আমরাও প্রতিবর্ষেই তাজিয়া করিয়া থাকি। একজন বাঙ্গালী কহিল—‘আমাদিগের দেশে সকল কর্মেই সত্যপীরকে সিন্নি দেওয়া হইয়া থাকে, যিনি সত্যপীর, তিনিই সত্য নারায়ণ।’ আর একজন মুসলমান বলিল, ‘তোমরাই যে আমাদের দেবতা মান, আমরা তোমাদের দেবতা মানি না একথা বলিতে পারিবে না। কোন্ মুসলমান হিন্দু দেবতার এবং ব্রাহ্মণ ঠাকুরদের যথোচিত সম্মাননা না করে? আমার জানত অনেক মুসলমান ব্রাহ্মণদিগকে খরচপত্র দিয়া দুর্গোৎসব করান। দরাপ খাঁ ‘সুরধুণী মুনি কন্যে’ বলিয়া কেমন ভক্তি সহকারে গঙ্গাদেবীর স্তব করিয়া গিয়াছেন তাহা কাহার অজানত আছে?’২৬
কিছুদিন আগে বিশেষ করে ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোর কোনো কোনোটাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে লেখালেখি পড়ছিলাম। তাঁরা প্রায় সকলেই প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ চরিত্রে আলাদা। এক সাংবাদিকের লেখায় পড়ছিলাম, আমাদের দেশে, তাঁর মতে, বাম এবং ডান দুপক্ষই জাতীয়তাবাদকে বুঝতে ভুল করেছে। বামেরা জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করেছে এই জন্যে যে তাদের মতে এটা উপনিবেশিক উপাদান। তেমনি ডানেরা জাতীয়তাবাদ বলতে বুঝেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ [নরম অথবা কড়া], যেটা আসলে জাতীয়তাবাদ নয়, jingoism বা উগ্র সমরপ্রিয় দেশপ্রেম [তাই কি? নাকি উগ্র সমরপ্রিয় দেশপ্রেমের আড়ালে এ আসলে গোটা দেশকে বিশেষত একচেটিয়া পুঁজির বশীভূত করে ফেলার চেষ্টা?]। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এ দুটোর কোনোটাই নয়, সমগ্রের ধারণা (inclusivity) ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অঙ্গীভূত। একথা মানতেই হয় যে ভারতবর্ষ আগে যা ছিল একটা ধারণা, ব্রিটিশরা যখন তাকে রাজনৈতিক দিক থেকে রাষ্ট্রে পরিণত করল, তখন তার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় চেতনার প্রশ্নটাও সামনে এল। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রশ্নটা সামনে আসা এক জিনিস আর রাষ্ট্রের নেশন হয়ে ওঠা আর এক জিনিস। আমিও নিজেকে একজন ভারতীয় হিসেবেই দেখি, তার জন্যে আমায় জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতে লাগছে না। গান্ধীজি তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মনে যে অনেক সংশয় ছিল তা ইয়ং ইন্ডিয়া ও হরিজন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো পড়লেই বুঝতে পারা যায়। তিনি বলেছিলেন, “[i]t is not nationalism that is evil. It is the narrowness, selfishness, exclusiveness, which is the bane of modern nations which is evil. Each wants to profit at the expense of, and rise on the ruin of, the other.”২৭ আমাদের ইদানিংকার চিন্তাবিদরা inclusive শব্দটা কোত্থেকে পেয়েছেন বোঝা যায়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কাঠামোকে রক্ষে করার তাঁদের যে চেষ্টা সে চেষ্টা প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু বর্তমান লেখকের ব্যক্তিগত ধারণা, এতদ্বারা শেষরক্ষে হবে না। এতদ্বারা এ দেশের ধর্মীয় বৈচিত্রকে রক্ষে করা গেলেও জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্রকে রক্ষে করা যাবে না। এবং অচিরে তা ফুটে বেরোবে। এবং তাও যদি কোনোদিন যায়, নেশন হয়ে দাঁড়াবে নয়া সাম্রাজ্যবাদের ধারকবাহক, নয়া নয়া উপনিবেশের সৃষ্টিকর্তা, অন্য দেশের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে শোষকের ভূমিকায়। আমাদের সবাইকে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে একদিন না একদিন বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারায় ঢুকতে হবে। যখন একই সঙ্গে আমার নিজের দেশটাও আমার দেশ আবার গোটা পৃথিবীটাও আমার দেশ (বাজার নয় তা বলে)।
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল পর্ব
ডিরোজিও, ইয়ং বেঙ্গল ও গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত Bengal Early Nineteenth Century (BENC)২৮ এবং Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century (ABENC)২৯ -- এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ডিরোজিও হলেন এদেশে স্বাদেশিকতার উদ্গাতা। রামমোহনে যার আভাসমাত্র পাওয়া গিয়েছিল, তারই অঙ্কুরোদ্গম হয় ডিরোজিওতে। জানি না গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মত গুণী সংকলক ও সম্পাদক, যিনি ‘সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিসন অফ জেনারাল নলেজ’এর নথিপত্র (ABENC) থেকে শুরু করে ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘রিফর্মার’, ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’এর মত পত্রিকায় প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য রচনাগুলি (BENC) পাঠকের সামনে এনে হাজির করেছেন, ডিরোজিওকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করতে অত কুণ্ঠাবোধ করেছেন কেন? ডিরোজিওর যেসব কথাকে কেন্দ্র করে গৌতমবাবু কুণ্ঠিত বোধ করেছেন সেগুলি তাঁর BENCর ভূমিকায় ডিরোজিওর লেখার (On Colonization of India by Europeans) প্রথম উদ্ধৃতিতে নিম্নরূপ
The most superficial observer must perceive that India is maintained in subjection only by Military Force. Withdraw it, and the boasted opinion of the natives, instead of supporting, would immediately prove the cause of the utter subversion of the empire. We have lately read in one of the papers that at Lucknow, during the late Mohurrum, prayers were publicly said, for the destruction of the Company’s government! Now it is evident that if a large number of Europeans be allowed to settle in the country, they would form a counterpoise, in some degree, to the hostile dispositions of the native subjects.৩০
এই উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে যেটা অবাক করে সেটা হল মূল উদ্ধৃত অংশ থেকে গৌতমবাবুর একাধিক লাইন ও শব্দ বাদ দিয়ে যাওয়া, যা আলোচ্য প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মনে হলে করা যেতেই পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে যে বিন্দু চিহ্ন ব্যবহার করা নিয়ম তা করা হয়নি। ফলে পাঠকের ধারণা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক যে ডিরোজিও ঠিক এভাবেই লিখেছিলেন। অতএব প্রথমে ডিরোজিও ঠিক কি লিখেছিলেন তা গৌতমবাবুর সংকলন থেকেই উদ্ধৃত করা যাক
The most superficial observer must perceive that India is maintained in subjection only by Military Force--withdraw it, and the boasted opinion of the natives, instead of supporting, would immediately prove the cause of the utter subversion of the empire. It is generally known, and even confessed by our rulers, that the spirit of the natives, in the Upper Provinces in particular, is any thing but peaceable. We have lately read in one of the papers that at Lucknow, during the late Mohurrum, prayers were publicly said, for the destruction of the Company’s government! Now it is evident that if a large number of Europeans be allowed to settle in the country, they would form a counterpoise, in some degree, to the hostile disposition of the native subjects and in case of internal commotion or of foreign invasion, they will be found to be the only portion of the inhabitants that sincerely co-operates in the defence of British sovereignty.৩১
মনস্ক পাঠক দুটো অংশ পাশাপাশি রেখে পড়লেই বুঝবেন গৌতমবাবু কর্তৃক উদ্ধৃত অংশটিতে কিছু কিছু লাইন ও শব্দ বাদ চলে যাওয়ায় কিভাবে ডিরোজিওর বক্তব্যের মানে পাল্টে গিয়েছে। এই প্রবন্ধে ডিরোজিও যা বলতে চেয়েছিলেন, গোদা বাংলায় তা এই
নিতান্ত ভাসা ভাসা দেখলেও বুঝতে পারা যায় যে এদেশকে শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়েই দমন করে রাখা হয়েছে, এই শক্তি তুলে নিলে যেসব এদেশীয় জাঁক করে [সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে], সাম্রাজ্যের সমর্থন নয়, তারাই তখন হয়ে দাঁড়াবে সাম্রাজ্য ধ্বংসের কারণ। সাধারণভাবে জানা আছে এবং এমনকি শাসকরাও স্বীকার করেছেন যে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষজন শান্তিপ্রিয়। এই সেদিন কাগজে পড়লাম যে লক্ষ্ণৌতে মহরমের পরপর একটা সভায় কোম্পানি সরকারের ধ্বংস চেয়ে প্রার্থনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে প্রচুর ইয়োরোপীয়কে যদি এদেশে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, তারা বড়জোর ক্ষুব্ধ দেশবাসীর জায়গায় একটা ভারসাম্য তৈরি করবে এবং একমাত্র তারাই যা অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বা বিদেশী আক্রমণের সময় ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করবে।
এই অংশে ডিরোজিওর মূল প্রতিপাদ্য ছিল দেশের লোকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ১৭৬৩ সালে জন্ম হওয়া সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৮৩১ সালের ওয়াহাবী বিদ্রোহের কথা আজ আমরা যেভাবে জানি ডিরোজিও হয়ত সেভাবে জানতেন না, কিন্তু আভাসে নিশ্চয়ই জানতেন, তা নাহলে তিনি জনগণের ক্ষোভের কথা এভাবে তুলে ধরতেন না। এদেশের লোক শান্তিপ্রিয়, অথচ সেই শান্তিপ্রিয় লোকগুলোও যে কোম্পানি শাসনের অবসান চায় লক্ষ্ণৌর উদাহরণ দিয়ে তিনি তা দেখিয়েছেন। এবং বোঝাতে চেয়েছেন যে যতই কেননা কোম্পানি সরকার প্রচুর ইয়োরোপীয়কে এখানে থাকার অনুমতি দিয়ে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চান, ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের সমর্থক থাকবে একমাত্র তারাই, দেশের লোক নয়।
এতো ডিরোজিওর ব্রিটিশ-আনুগত্যের প্রকাশ নয়, তাঁর দেশচেতনার তাঁর স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ। ইয়োরোপীয়দের এদেশে এসে বসবাস করা নিয়ে ডিরোজিওর মন্তব্যের একটা প্রেক্ষিত আছে। ১৮২৯ সালে টাউন হলে একটা জনসভা হয়, যে জনসভায় আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম ছিল এদেশে ইয়োরোপীয়দের থাকার ব্যাপারে বহাল বিধিনিষেধের অবসান ঘটানো। স্বয়ং রামমোহন ঐ সভায় প্রস্তাবের সমর্থনে একটা বক্তৃতা দেন, যার শিরোনাম ছিল Views on Settlement in India by Europeans৩২। ঐ ১৮২৯ সালেই ডিরোজিও এবং তাঁর ছাত্ররা মিলে বের করতে শুরু করেন ক্যালাইডোস্কোপ পত্রিকা, যে পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই অংশটা পড়লে বোঝা যায় যে ডিরোজিও ঐ সময়কার উক্ত বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। এবং রামমোহন যেখানে ইয়োরোপীয়দের এখানে বাস করতে আসার পক্ষে, তিনি সেখানে দেশের লোকের মনোভাবকেই প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করেছেন। এবং সে মনোভাব যে ব্রিটিশ শাসনের অনুকূল নয়, তা খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন।
এর একটু পরেই এই প্রসঙ্গের জের টেনে ডিরোজিও আরো যা লেখেন তা নিম্নরূপ
[M]y own inquiries convince me that the conduct of Europeans to their indigenous fellow subjects would tend to alienate them, and ultimately lead to serious consequences. Besides which, I entertain strong doubts whether Europeans can settle in the country without gradually dispossessing the natives of their lands, and causing thereby incalculable misery and dissatisfaction, which together with the inimical spirit by which I have stated they are actuated, would surely be anything but beneficial to the country.৩৩
অর্থাৎ,
ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর করে আমি নিশ্চিৎ হয়েছি যে দেশীয় লোকদের সঙ্গে ইয়োরোপীয়দের আচরণ তাদের আরো বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং শেষপর্যন্ত ফলাফল খুব খারাপ হবে। তাছাড়া, আমার ঘোরতর সন্দেহ ইয়োরোপীয়রা ক্রমাগত এদেশের লোকজনকে তাদের জমি থেকে উৎখাত না করে এদেশে থাকতে পারবে কিনা, যার ফল হবে তাদের আরো দুর্দশা এবং অসন্তোষের মধ্যে ঠেলে দেওয়া এবং তাদের সে বৈরিভাব যার কথা আমি বলেছি, এদেশের পক্ষে আদৌ মঙ্গলজনক হবে কিনা।
সুখের কথা, গৌতমবাবুও ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে ভূমিকায় এই অংশটা প্রায় পুরোটাই উদ্ধৃত করেছেন। এই অংশটুকু থেকে এটা পরিষ্কার যে কোলকাতার গোষ্ঠীপতিদের ভাবনার স্রোত যখন ইয়োরোপীয়দের এদেশে আনার পক্ষে বইছে, ডিরোজিও তখন দেশের লোকের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন। এবং সে দেশ মোটেই গৌতমবাবু কথিত “wealthy classes of zeminders, traders and other professions and whose young men were intoxicated with the glamour and glitter of European civilization”৩৪ নিয়ে গঠিত নয়।
ডিরোজিওর এই প্রবন্ধ (On Colonization of India by Europeans) পুরোটা পড়লে দেখা যায় একমাত্র যে কারণে তিনি উপনিবেশায়নকে শুভ মেনেছেন তা হল ইয়োরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রচলনের দিকটা। সেখানেও তিনি কোম্পানিকে ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “[t]he Company indeed have never evinced a desire to improve the means of education among the natives; but, there will not be wanting benevolent and public spirited individuals of all classes, who will come forward to promote the dissemination of the arts and sciences throughout the empire.”৩৫ অর্থাৎ, দেশীয়দের মধ্যে [ইয়োরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের] শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে কোম্পানির আগ্রহের কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু এই জ্ঞানবিজ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্তরে হিতৈষী এবং জনহিতে উদ্যোগী লোকজনের অভাব হবে না।”
ডিরোজিও তেমন কোনো দেশপ্রেমিক নন প্রমাণ করতে অতঃপর গৌতমবাবু যে প্রবন্ধটিকে ডিরোজিওর ধরে নিয়ে তার থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন এবং তা নিয়ে আলোচনা করেছেন সেটি হল, “Cursory Remarks on the British Government in India”৩৬। কিন্তু এই প্রবন্ধটি পাঠের পর এটি ডিরোজিওর লেখা কিনা তা নিয়ে প্রবল সংশয় জাগে। শুধু এইজন্যে নয় যে ডিরোজিও তাঁর প্রবন্ধে ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে ‘নেশন’ শব্দটা কখনো ব্যবহার করেননি, তিনি সর্বদাই লিখেছেন ‘কান্ট্রি’ এবং ব্রিটিশের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন ‘এম্পায়ার’ শব্দ, এইজন্যেও যে গোটা লেখাটিতে যে ভাবনার ছাপ এবং মানসিকতার পরিচয় আছে তার সঙ্গে ডিরোজিওর ভাবনা ও মানসিকতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম প্রবন্ধে (OCIE) তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যে ঋজু ভঙ্গি, দ্বিতীয় প্রবন্ধের (CRBGI) লিখনপ্রণালীর সঙ্গে তা একেবারেই খাপ খায় না। এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়, উৎসাহী পাঠক প্রবন্ধদুটি মিলিয়ে পড়লে নিজেরাই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন (BENC দেখুন)।
On Colonization of India by Europeans-এর সঙ্গে ডিরোজিওর লেখা কবিতা The Harp of India৩৭, India-My Native Land৩৮ এবং তাঁর আখ্যানকাব্য Fakeer of Jungheera৩৯-র অংশবিশেষ খুঁটিয়ে পড়লে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না যে ডিরোজিও আক্ষরিক অর্থেই এদেশে স্বাদেশিকতার উদ্গাতা। মনে রাখতে হবে এ কবিতাগুলি লেখার প্রায় ষাট বছর বাদে বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে ‘বন্দে মাতরং’এর জন্ম। পাঠকের জ্ঞাতার্থে নিচে India-My Native Land কবিতাটার তর্জমা দেওয়া গেল।
ভারত – আমার স্বদেশ
হে আমার দেশ, গৌরবময় তোমার অতীতকালে
অপরূপ এক জ্যোতির্বলয় বিকীর্ণ হত ভালে
দেবতার মতো পূজিত হয়েছ তখন
কোথায় গেল সে গৌরব, আজ কই সেই সম্ভ্রম?
শেকলে পড়েছে বাঁধা অবশেষে তোমার ঈগল-পাখা
ধরণীতে আজ লুটোচ্ছ ধুলিমাখা।
নেই কোনো মালা গাঁথার মতন চারণকবির কাছে
তোমার জন্যে;
শুধু দুঃখের কাহিনি ছড়িয়ে আছে!
বেশ, তবে যাই কালের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনি
যুগের ঘূর্ণি থেকে সামান্য ক্ষুদ্র দুএকখানি
টুকরো তোমার সুমহান গরিমার
মানবচক্ষু কখনো পাবে না দরশন আর যার
কবির শ্রমের পারিতোষিক তা হবে
এই আশাটুকু পূর্ণ কোরো গো অয়ি হৃতগৌরবে।
(তর্জমার দায় বর্তমান প্রাবন্ধিকের)
এই কবিতায় দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক, কবি তাঁর স্বদেশকে বর্বর, অসভ্য কিংবা অর্ধসভ্য হিসেবে ভাবেননি। বরঞ্চ তিনি তাঁর দেশের গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করেছেন। দুই, তাঁর দুঃখ এই যে সেই গরিমাময় দেশ আজ শেকলে বাঁধা এবং হারিয়ে ফেলেছে সমস্ত গৌরব। কবির একমাত্র আশা এই যে কালের গভীরে ডুব দিয়ে তিনি যেন এই হৃতগৌরব দেশের অতীতের সেই সুমহান গরিমার যৎকিঞ্চিৎ তুলে আনতে পারেন। সেই গৌরবগাথাই কি তাঁর Fakeer of Jungheera-র পাতায় পাতায় ছড়ানো? এবিষয়ে সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন পল্লব সেনগুপ্ত৪০। তিনি দেখিয়েছেন কেমনভাবে তাঁর সীমিত জানার মধ্যে দিয়েই ডিরোজিও তুলে এনেছেন ভারতবর্ষের অপরূপ নিসর্গকে আর তার সঙ্গে সঙ্গে তার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে। তার “মৃদু উষ্ণ বাতাস, ঝর্ণার জলের ভাঙা ভাঙা কুলুকুলু শব্দ, প্রখর সোনালি সূর্যালোক, গঙ্গার ঝিকিমিকি প্রবাহ, সবুজ মাঠে-বনে ঘাস-ফড়িংদের লাফালাফি, রঙ্-বেরঙের ফুলে উজ্জ্বল প্রজাপতিদের ফুরফুরে ওড়াউড়ি, শাল-তমাল-বট-অশ্বত্থের ঠাণ্ডা ছায়া”, আর সেই সঙ্গে “গঙ্গার উপকূলে যজ্ঞোপবীতধারী ব্রাহ্মণদের বেদমন্ত্রপাঠ, কুলললনাদের ব্রতগান, ধর্মশীলার সূর্যবন্দনা।” পাশাপাশি বীভৎস সতীদাহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেও ভোলেন নি, সে আমলে যা ছিল রীতিমত দুঃসাহসের পরিচয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে উদ্যোগী হওয়ায় স্বয়ং রামমোহনকে যেখানে হিন্দু সমাজের দিক থেকে নানা বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেখানে আঠেরো বছরের তরুণ ডিরোজিও নির্ভয়ে তার বর্ণনা দিচ্ছেন যে বর্ণনার মধ্যে পুরো রীতিটার প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা স্পষ্ট বিধৃত। আরো বড় নির্ভীকতার পরিচয় হল হিন্দু নায়িকার প্রেমাস্পদ হিসেবে এক মুসলমান তরুণকে দেখানো। এই দেখানোর মধ্যে ডিরোজিওর লৌকিক ধর্মচেতনার অভিজ্ঞতার পরিচয় স্পষ্ট যেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে সব একাকার হয়ে যায় এবং এই মুসলমান প্রেমিকের জীবনবোধ, পল্লব সেনগুপ্ত যথার্থ লক্ষ করেছেন, কিভাবে তার ধর্মবোধকে ছাপিয়ে যায়, যখন সে বলে,
No more to Mecca’s hallowed shrine
Shall wafted be a prayer of mine
Henceforth I turn my willing knee
From Allah, Prophet, heaven, to thee৪১
‘thee’ এখানে তার পুরোনো প্রেমিকা নলিনী, যাকে সে সতীদাহের চিতা থেকে উদ্ধার করে এনেছিল। Fakeer of Jungheera-র আখ্যানভাগের সঙ্গে শুধু স্কটের ব্যালাডীয় কাব্যের আভাস নয় বা ফরাসি ত্রুবাদুর কাব্যের প্রেরণাও নয়, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’রও অনেক কাব্যের তুলনা করা চলে, যেগুলো এই বাংলারই এবং এই সময়ের কিছু আগে-পরের সৃষ্টি।
গৌতমবাবু লিখেছেন যে ডিরোজিওরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উদারীকরণ চেয়েছিলেন, স্বশাসনের প্রতিষ্ঠা নয় (“...a careful scrutiny of all the issues of Kaleidoscope, reveal that this is the basic trend of the attitude of Derozio and his supporters – ceaseless appeal for liberalization of British rule in India, not its replacement by some form of self-government.”৪২) এখানেও গৌতমবাবু ভুল করেছেন ডিরোজিওর সঙ্গে ডিরোজিওর সমস্ত ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের একাসনে বসিয়ে। ডিরোজিওর ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের লেখা পড়লে মনে হয় মানসিকতার দিক থেকে তাঁরা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল ব্রিটিশ শাসনকে খোলা মনে গ্রহণ করে সে শাসনব্যবস্থার উদারীকরণ চেয়েছিলেন, অপরদল মুখ ফুটে স্বশাসনের (বিদেশী শাসনমুক্তি অর্থে) কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু কাজেকর্মে স্বশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ডিরোজিওর কথা ধরলে দেশের অবস্থাকে কেন্দ্র করে যে দুএকটা লেখা তাঁর আছে (ডিরোজিওর বেশির ভাগ গদ্যই সাহিত্যসংক্রান্ত) সেগুলোর মূল সুর একেবারে স্বতন্ত্র--স্বশাসন চাওয়া যেমন নয় তেমনি ব্রিটিশ শাসনের উদারীকরণ চাওয়াও নয়, অবিচারের অবসান চাওয়া--তা সে যেভাবেই হোক। কখনো তা সাধারণভাবে দেশের লোকের প্রতি অবিচারের অবসান চাওয়া, কখনো বা বিশেষভাবে পূর্ব ভারতীয়দের প্রতি অবিচারের অবসান চাওয়া। ডিরোজিও ঠিক কি চেয়েছিলেন তার স্পষ্টতর আভাস পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। একমাত্র সেখানেই ডিরোজিওর চাওয়ার মূল সুর ধরা পড়েছে। সেটা হল সবরকমের শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। তাঁর Freedom to the Slave কবিতায় পাই
Blest be the generous hand that breaks
The chain a tyrant gave
And, feeling for degraded man,
Gives freedom to the slave.৪৩
তাছাড়া তত্ত্বগতভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বশাসন চাওয়াটা বাংলার বিদ্বৎসমাজের পক্ষে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ছিল, এবং কেউই সেসময় এরকম কিছুর কথা ভাবেন নি। ভাবেন নি তার কারণ একে তো বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশ নতুন ব্যবস্থাপাতিতে নানাভাবে উপকৃত হচ্ছিল, ‘বিদেশী শাসন’ শব্দটার সঙ্গে তাদের পরিচয় তখনো তেমন নিবিড়ও হয়নি, তাছাড়া দেশের লোক তখনো স্বশাসনের হৃতশক্তি পুনরুদ্ধার করে উঠতে পারেনি। দেশতৈষিণী সভায় এ নিয়ে সারদাপ্রসাদ ঘোষ, আর এক ডিরোজিয়ান, বলেছিলেন, “You do not like the brave and noble minded Americans aspire as high as to free yourself from the yoke of the British sway; To take in your own hands the reigns of government and to display in the world striking instances of your courage exerted in the cause of your independence. No, your aspiration is by far much humbler; you only desire that you may be freed from the tyranny and oppression of the local government of this country; and that consequently that a salutary change may be effected in your present degraded condition.”৪৪ বিকল্প পথ হিসেবে তিনি নির্দেশ করেছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অভিযোগ জানানো ও প্রতিবিধান দাবি করা।
উপনিবেশিক দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় সমস্যা হল এই যে তাঁরা সবসময় আজকের ভাবনার পোশাক পরা অতীতকে দেখতে চান এবং দেখতে না পেলে ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা ভুলে যান যে অতীতের ভাবনার পথ ধরেই আমরা আজকের ভাবনায় এসে পৌঁছেছি। চন্দ্রগুপ্তের হাতে কব্জিঘড়ি লাগিয়ে দিতে চাইলে সেটা একটা কালাতিক্রমণ দোষ বা anachronism। অতীতের এইসব চিন্তানায়কদের পক্ষে আজকের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত থাকা সম্ভব ছিল না। সুতরাং তাঁরা তাঁদের সময়ের ওপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের পথ কেটে গেছেন। বিচারটা তখনই ঠিকঠাক সম্ভব যখন তাঁদের সময়েই তাঁদের রেখে তাঁদের ভাবনা ও কর্মধারার পারস্পরিক তুলনার মাধ্যমে ভবিষতের সেই গতিপথের প্রকৃতি নির্ণয়ের চেষ্টা করা হবে।
স্বাদেশিকতা ছাড়াও ডিরোজিওর সমতুল্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল মুক্তচিন্তার প্রসার যা বাংলার নবজাগরণের মূল সুর বেঁধে দিয়েছিল এবং দিকনির্দেশ করেছিল। হিন্দু কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ বাদ দিলে ডিরোজিও যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ও পার্থেনন বা ক্যালাইডোস্কোপের মত পত্রিকা স্থাপনে উদ্যোগী ছিলেন, সেখানে ঘটনা, ধারণা ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে এক স্বতঃবিকাশ প্রক্রিয়ায় পাঠ ও আলোচনা হত। এগুলো ছিল বিশ্লেষণাত্মক তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে মননচর্চার খোলা মঞ্চ। এই মঞ্চের সবথেকে বড় গুণ ছিল কোনো কিছু বিনা বিচারে মেনে না নেওয়ার প্রবণতা তৈরি, প্রশ্ন করতে শেখানো (১৮৩১ সালের ২০ এপ্রিল এইচ. এইচ. উইলসনকে লেখা ডিরোজিওর চিঠি৪৫ এ ব্যাপারে পাঠ করা যেতে পারে)। আমাদের দেশে এ নতুন কিছু নয়। এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই নব্যন্যায় বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই নব্যন্যায়ের চর্চা নানা কারণে স্তিমিত হতে শুরু করে এবং শেষপর্যন্ত ‘পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র’ এই অর্থহীন কূটতর্কের ধারায় পরিণত হয়। এই সময় থেকেই বিশেষত বাঙালি বর্ণহিন্দু সমাজ অজস্র সংস্কারের বেড়াজালে বাঁধা পড়তে শুরু করে, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অধীন হয়ে পড়ে। এক ভিন্ন আধারে ডিরোজিও যেন বিশ্লেষণাত্মক যুক্তিতর্কের সেই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারাকেই ফিরিয়ে আনলেন।
আগেই বলেছি যে মানসিকতার দিক থেকে ডিরোজিওর ছাত্ররা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন বলে মনে হয়--একদল, যাঁরা ব্রিটিশ শাসনকে খোলা মনে গ্রহণ করে সে শাসনব্যবস্থার উদারীকরণ চেয়েছিলেন, অপরদল মুখ ফুটে স্বশাসনের কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু কাজেকর্মে স্বশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলেন। কিন্তু একথাটা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল এই জন্যে যে ডিরোজিও যে কোনো বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্কে ছাত্রদের দীক্ষিত করেছিলেন এবং পক্ষে বিপক্ষে দু’ ধরনের আলোচনাকেই তিনি স্বাগত জানাতেন। ডিরোজিও কর্তৃক অনুসৃত এই আলোচনাপদ্ধতির ছাপ ক্যালাইডোস্কোপের লেখাগুলোতে থেকে গিয়ে থাকতে পারে, যার ফলে কিছু লেখা ইংরেজ শাসনের সমর্থনে এবং কিছু লেখা ইংরেজ শাসনের সমালোচনামূলক হয়ে উঠেছিল। এই সব লেখা থেকে কোন্টা কার লেখা নির্ণয় করাও সম্ভব নয়, কারণ লেখাগুলোর তলায় কোনো নাম থাকত না, থাকত সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর, যেমন E.E. কিংবা S.J. কিংবা F। এমনকি স্বয়ং ডিরোজিওর লেখার তলাতেও কোনো নাম নেই, আছে সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর। লেখার ধাঁচ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ডিরোজিওর লেখাকে যা চিনে নিতে হয়। এই সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষরের কোন্টা কোন্ ডিরোজিয়ানের লেখা তাও বোঝা যায় না।
সুতরাং ক্যালাইডোস্কোপ ছেড়ে আমরা বরঞ্চ সেই সময়ের নথিগুলোর দিকে যাই, যখন নাকি ছাত্রাবস্থা কাটিয়ে ডিরোজিয়ানরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন এবং নতুন নতুন সংস্থা ও পত্রপত্রিকার মধ্যে দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তখন তাঁরা কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ গ্রন্থাগারিক, কেউ মাউন্ট এভারেস্ট মাপছেন, কেউ বা সদর আমীন, কেউ বা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে খান, কেউ কেউ জমিদারিও সামলাচ্ছেন।
আগে জেনে নেওয়া যাক ঈপ্সিত লক্ষ্য বলতে কি বোঝানো হচ্ছে, তারপর দেখা যাবে কি ছিল সেইসব নতুন সংস্থা এবং পত্রিকার সারবস্তু যেগুলোর মধ্যে দিয়ে তাঁরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডিরোজিওর কাছে স্বাদেশিকতার পাঠ নেওয়া এইসব ছাত্র এবং ভাবশিষ্যদের কাছে ঈপ্সিত লক্ষ্য ছিল আত্মশক্তির জাগরণ। এই আত্মশক্তির জাগরণের প্রধান মাধ্যম তাঁরা করেছিলেন একদিকে নারীমুক্তিকে, অপরদিকে রাজনৈতিক অধিকার চেতনা সৃষ্টিকে। একথা ঠিক যে কুলীন প্রথা, বাল্যবিবাহ বা সতীদাহের মত বীভৎস ব্যাপার ছিল প্রধানত বর্ণহিন্দু নারীর সমস্যা, কিন্তু নারীমুক্তির প্রশ্নটি সামগ্রিক বিচারে শুধুমাত্র বর্ণহিন্দু নারীর সমস্যা নয়। এই নারীমুক্তির অভিপ্রায়েই তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন বাংলাভাষার বিকাশকে। এ ব্যাপারে রাধানাথ শিকদারের গল্প চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে আছে।
পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ তৎপদানুযায়ী লেখকগণ বাঙ্গালা ভাষাকে যেরূপ পরিচ্ছদ পরাইয়া তুলিতেছিলেন, তাহা তাঁহার চক্ষুঃশূল হইয়া উঠিল। তিনি বলিতে লাগিলেন যে, “যে ভাষা স্ত্রীলোকে বুঝিবে না তাহা আবার বাঙ্গালা কি?” এই ভাবটা তাঁহার মনকে এমনি অধিকার করিল যে তিনি বাল্যবন্ধু পরম সুহৃদ প্যারীচাঁদ মিত্রকে সরল সহজ বাঙ্গালা লিখিবার জন্য প্ররোচনা করিতে লাগিলেন। উভয়ের সম্পাদকতাতে “মাসিক পত্রিকা” নামক পত্রিকা বাহির হইল; এবং অল্পদিন পরে প্যারীচাঁদ মিত্র “আলালের ঘরে দুলাল” নামক উপন্যাস প্রচার করিলেন।
সরল স্ত্রীপাঠ্য ভাষাতে বাঙ্গালা লেখা রাধানাথের একটা বাতিকের মত হইয়া উঠিয়াছিল। মাসিক পত্রিকাতে কোনও প্রবন্ধ লিখিয়া তিনি স্বীয় পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগকে পড়িয়া শুনাইতেন, তাঁহারা বুঝিতে পারেন কি না। শুনিতে পাওয়া যায় একদিন রাত্রি প্রভাত হইবার পূর্বেই প্যারীচাঁদ মিত্রের গৃহের দ্বারে গিয়া ডাকাডাকি, -- “প্যারি, প্যারি, উঠ উঠ, এবারকার পত্রিকা পড়িয়া তোমার স্ত্রী কি বলিলেন?”৪৬
তবে নারীর অবস্থা নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলীদের নিজেদের মধ্যে মতান্তর ছিল। ১৮৪১ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় তাঁর A Prize Essay on Native Female Education-এ লেখেন, বাঙালি মেয়েরা “drag on lives of the utmost wretchedness and degradation, and are regarded only as servants of the household, and ministers of carnal gratification to their husbands.”৪৭ ১৮৪২ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র বন্ধুকে তিরস্কার করে এর উত্তরে লেখেন, “There are some persons who are ready at all times to find fault with everything relating to the Hindu, and not to make due allowances. If they be pleased to pass a sweeping condemnation on our institutions respecting females, which we have endeavoured to shew were in many respects of an enlightened character, I must beseech them to turn their eyes to the history of some civilized countries, with reference to this subject.”৪৮ এই প্রবন্ধটিও সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা বা সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজের সভায় পঠিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে প্যারীচাঁদ যাজ্ঞবল্ক্য মনু ইত্যাদি থেকে উদাহরণ দিয়ে ভেঙে ভেঙে দেখিয়েছিলেন যে নারীর অবস্থা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহনের ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয় এবং উচ্চকিত আকারে না হলেও প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা তত খারাপ ছিল না, যতটা প্রচারে আনা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক অবনত অবস্থাকে তাঁরা কেউই অস্বীকার করেননি।
একটু খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় ইয়ং বেঙ্গলীদের ইতিহাসের ধারণা গ্রিস, রোম বা ইয়োরোপের বেলায় যতটা স্বচ্ছ এবং গভীর ছিল নিজের দেশের ইতিহাসের বেলায় তা ছিল না। তার কারণ নিজের দেশের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ইতিহাস পড়তেন তা ছিল জেমস মিলের History of British India৪৯। ভারতীয় নারীর হীনাবস্থা সম্পর্কে ধারণার উৎসও সেই জেমস মিল। যে কোনো সভ্যতা কতটা উন্নত তার মাপকাঠি হচ্ছে সে সভ্যতায় মেয়েরা পুরুষের দাসত্ব থেকে কতটা মুক্ত--স্কট রেনেসাঁ চিন্তাবিদ জন মিলারের এই মতকে ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে জেমস মিল দেখিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষ এদিক থেকে খুব অনুন্নত অবস্থায় আছে, তখনকার ভাষার ‘বর্বরাবস্থায়’ আছে।৫০ সামগ্রিক বিচারে এই ইতিহাসের প্রভাব আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদের ওপর যে গভীর ছিল তার প্রমাণ রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর পর্যন্ত এই কলঙ্ক থেকে মুক্তির জন্যে মেয়েদের হয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ইয়ং বেঙ্গলীরাও এই প্রভাবের বাইরে ছিল না। তার প্রমাণ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং সমমনস্ক আরো কেউ কেউ। কিন্তু কেউ কেউ যে একটু অন্যরকমও ভাবছিলেন তার প্রমাণ প্যারীচাঁদ মিত্র।
‘এতদ্দেশীয় লোকদিগের বাঙ্গালাভাষা উত্তমরূপে শিক্ষাকরণের আবশ্যকতা বিষয়ক প্রস্তাব’ এই শিরোনামে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পঠিত হয়েছিল সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভায়। সেটির রচয়িতা ছিলেন উদয়চন্দ্র আঢ্য। উদয়চন্দ্র আঢ্যও ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন, যদিও এঁর কথা বিশেষ শোনা যায় না। এই প্রবন্ধে তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল যে পরাধীনতার দাসত্ব–শৃঙ্খল ঘোচানোর লক্ষ্যে এক আবশ্যিক ধাপ হল মাতৃভাষা শিক্ষা। তাঁর মতে,
মনুষ্যের কর্ম দক্ষতাই প্রাধান্যের কারণ, তাহা যে ইংরেজি ভাষা দ্বারা না হইবে এমত আমার প্রস্তাবের ভাবে বুঝিবেন না, কিন্তু এমত জানিবেন যে দেশের মনুষ্য সেই দেশের ভাষায় কর্ম দক্ষতা হইলে পরাধীন দাসত্বের কারণচ্যুত হইয়া স্ব ২ প্রধান হইতে পারেন, তৎপ্রমাণ দেখুন যে এমত দেশও অদ্যাপি কতিপয় আছে যে তত্রস্থের স্বীয় ২ জাতীয় ভাষার জ্ঞান দ্বারা বৃহত ২ কর্ম নিষ্পন্ন করিতেছেন, রাজার ভাষা বা কোন রাজার সহিত সংসৃষ্ট রাখেন না।৫১
এই প্রবন্ধে ইংরেজদের সম্পর্কে চমৎকার শ্লেষ আছে উদয়চন্দ্রের (নিম্নোদ্ধৃত অংশের গৌতমবাবুকৃত ইংরেজি অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয়),
তাঁহাদিগের গুণের অধিক কি প্রশংসা বাহুল্যমতে করিব, যে যে দেশে আপনারদিগের জ্ঞানের নূতন চমৎকার শক্তি দেখাইতেছেন, তত্তদেশের বিত্ত বিলক্ষণ হস্তগত করিতেছেন, ছি, ছি, ছি! এই সকল দেখিয়াও কি এদেশের লোকেরদের ইচ্ছা হয় না যে ইংগ্লণ্ডীয়েরদের সদৃশ মনুষ্য হইয়া চত্তষ্পাদের ন্যায় মূক থাকিয়া অপরের হস্তোত্তোলনে প্রদত্ত ঘাস জলই আহার করিতে থাকেন।৫২
১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গিয়ে আর এক ডিরোজিয়ান রসিককৃষ্ণ মল্লিক শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি যে দেশে জন্মেছেন সে দেশের ভাষা ছেড়ে বিদেশী ভাষায় বক্তব্য রাখতে হচ্ছে বলে।৫৩
কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর ইয়ং বেঙ্গলীরা বা ডিরোজিয়ানরা একে একে যেসব সংস্থা এবং পত্রপত্রিকার জন্ম দিয়েছিলেন সেগুলি হল যথাক্রমে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা বা সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, দেশতৈষিণী সভা ইত্যাদি এবং বেঙ্গল স্পেক্টেটর, রিফর্মার, মাসিক পত্রিকা ইত্যাদির মত পত্রপত্রিকা। এইসব সংস্থা ও পত্রপত্রিকাকে মঞ্চের মত ব্যবহার করেই তাঁরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করতেন। বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্নীতি ও তার জন্যে সাধারণ মানুষের যে অপরিসীম কষ্ট তাই নিয়ে মুখ খুলেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ডিরোজিওর এক প্রিয় ছাত্র। এই বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে একজন আমন্ত্রিত মাননীয় শ্রোতার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব বেধে যায়, সেই শ্রোতা যে সে কেউ নন, ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন স্বয়ং। ডি এল রিচার্ডসন ছিলেন হিন্দু কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। দক্ষিণারঞ্জনের বক্তব্যের সজোর প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা কেবল ব্রিটিশ সরকারের দোষত্রুটি দেখছ, তাদের ভালো কাজের দিকটা দেখতে পাচ্ছ না। সরকারের বিরুদ্ধে কেবল প্রতিবাদ করতে হিন্দু কলেজের এই হলটা তোমাদের দেওয়া হয়নি।“ তাঁর এই বক্তব্যের প্রবল প্রতিবাদ হয় এবং তাঁকে বলা হয় তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে। তিনি রাজি হন না। শেষপর্যন্ত ঠিক হয় ভবিষ্যতে সোসাইটির অধিবেশন হিন্দু কলেজের হলে করা হবে না, অন্য কোনো জায়গা খুঁজতে হবে।৫৪
১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের বিরোধিতাতে মুখ খুলেছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক, যার কথা একটু আগেই বলেছি। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উপনিবেশায়নকে আইনানুগ করা। এই আইনবলে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিংক যিনি এতদিন অব্দি ছিলেন বাংলার গভর্নর জেনারেল, হয়ে গেলেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং সমস্ত অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত হল। বাইরের দিক থেকে এই আইনকে দেখতে যতই মোলায়েম লাগুক, এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল ভারতীয় জনগণের নিপীড়নের কলকাঠি। রসিককৃষ্ণ মল্লিক সেগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। ১৮৩৩ সালের আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আরো ২০ বছরের জন্যে পুনর্জীবিত করা হয় কিন্তু তার বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো আর বহাল রাখা হয়নি। রসিককৃষ্ণ মল্লিক দেখিয়েছিলেন যে কোম্পানির যে বাণিজ্যিক দেনা তা আঞ্চলিক রাজস্ব দিয়ে শোধ করার কথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ হল, রসিককৃষ্ণ মল্লিকের ভাষায়, “We (জনগণ) were already burdened with a heavy debt and yet the British Parliament entail upon us an additional burden to pay the commercial debts of the company.”৫৫ ১৮৩৩ সালের ওই আইনে ধর্মসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় খরচ করার অধিকার গভর্নর জেনারেলকে দেওয়া হয়েছিল। অসামরিক ও সামরিক বাহিনীর লোকজনের জন্যে পাদ্রী আনানোর ব্যাপারে দেশের লোকের কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু দেখা গেল আইনটা এমনভাবেই তৈরি, যাতে এ বাবদে যা প্রয়োজনীয় খরচ তাও রাজস্ব থেকেই ব্যয় করা হবে। তার ওপর অসামরিক ও সামরিক বাহিনীর লোকজনের মধ্যে যারা খ্রিস্টান তাদের জন্যেই শুধু পাদ্রী আসছে না, এদেশের যেসব লোক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবে তাদের জন্যেও পাদ্রী আসছে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় যে আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্যে যে খরচ সে খরচের জোগানও আমাকেই দিতে হবে। রসিককৃষ্ণ মল্লিক এদিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, “money is to be taken out of the hands of the natives to convert them to faith which they consider to be wrong, which they consider to be detrimental for their salvation?”৫৬ রসিককৃষ্ণ মল্লিক দেখিয়েছিলেন যে সুপ্রিম কোর্ট যা নাকি আগে একটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে গভর্নর জেনারেলের অধীন করে দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ হল আগে যাঁরা ছিলেন বিচারপতি, তাঁরা এখন হয়ে গেলেন কিছু ভুলভাল এবং অবিবেচনা-প্রসূত আইনের (যা “passed not for the benefit of India but for the proprietors of Indian stock and the benefit of the people of England”৫৭) প্রশাসনিক রক্ষাকর্তা। সবথেকে বড় কথা, এই আইনে রসিককৃষ্ণ মল্লিকের ভাষায়, “there is not one word about the subject of education. Two additional Bishops have been provided for the comfort of the civil and military servants, but there is no provision whatever for the education of the people of India.”৫৮
সারদাপ্রসাদ ঘোষ, এঁর কথাও আগে বলা হয়েছে, সরাসরি এ দেশের লোককে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেবার ব্যাপারে বর্তমান শাসকদের অনীহার দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “[e]ver since the commencement of the supremacy in this country, the policy of our present rulers has been to deprive us of the enjoyment of political liberty. ... These gentlemen enact laws for the government of millions of human beings, who acknowledge subjection to British Sway, without taking their opinion as to the tendency of those laws which purport to be conducive to their welfare. We are thus rendered ignorant of what passes within the council chamber; and hence is the reason that we are so often governed by laws, which have a pernicious tendency to occasion and perpetuate our political degradation.”৫৯ দেশহিতৈষিনী সভার মঞ্চ থেকে তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছিলেন এক হওয়ার। এই অবস্থার প্রতিবিধানের জন্য প্রথমত আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, দ্বিতীয়ত দেশকে ভালবাসতে হবে, তৃতীয়ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ঐ সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, চতুর্থত বাংলাভাষায় যেসব খবরের কাগজ বেরোয় “they are to write continually on political subjects, pointing out the evils of the government together with the means by which those evils can be remedied; in the same manner as the gentlemen of the ‘British India Society’ are doing at present.”৬০ এবং পঞ্চমত আপনাদের যা কিছু অভাব অভিযোগ আছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করুন এবং প্রতিবিধান চান। এই মুহূর্তের বাস্তবতায় যে বিদেশী শাসনমুক্তির ভাবনা ভাবা সম্ভব নয় সেকথা সারদাপ্রসাদ এই প্রবন্ধেই বলেছিলেন এবং বিকল্প পথ হিসেবে তিনি এই আবেদন-নিবেদনের রাস্তায় হাঁটার কথা বলেছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গলীদের আর এক কীর্তি ছিল বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠা। ১৮৩৯ সালে রামমোহনের বন্ধু উইলিয়ম অ্যাডাম যিনি ভারত ঘুরে এখানকার মানুষের অবস্থা চাক্ষুষ করে গিয়েছিলেন প্রধানত তাঁরই পরামর্শে লন্ডনে জর্জ টমসন৬১ প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের প্রকৃত অবস্থার অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রতিবিধানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দরবার করা। এ দেশের অবস্থা নিজের চোখে দেখার জন্যে সেই জর্জ টমসন ১৯৪৩ সালে কোলকাতায় আসেন। ঐ বছরই তাঁরই অনুপ্রেরণায় ইয়ং বেঙ্গলীরা স্থাপন করেন ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’। এই সভার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় দুটি। একদিকে ইংলন্ডের নাগরিকরা যাতে জানতে পারেন এ দেশে ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মানুষের সঙ্গে কি কি অন্যায় করছে সে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের নাগরিকদের ওয়াকিবহাল করা, অপরদিকে সেই অন্যায়গুলির প্রতিবিধানের জন্যে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দাবি জানানো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারবৃদ্ধি এবং নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি অত্যন্ত সরব ছিল, যে জন্যে প্রায় সমকালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ল্যান্ডওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খারাপ ছিল, যদিও দুটোই রাজনৈতিক সংস্থা।
বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির এক অনবদ্য কীর্তি হল কৃষকদের নিয়ে তৈরি তাদের প্রশ্নমালা। বেঙ্গল স্পেক্টেটরের দ্বিতীয় খণ্ড ২৪ সংখ্যায় ১৮৪৩ সালের ২৪ জুলাই যা প্রকাশিত হয়। তিরিশটি প্রশ্নে বিভক্ত অসাধারণ এই প্রশ্নমালাটি পড়তে পারা যায় বিনয় ঘোষের ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’র ষষ্ঠ খণ্ডে৬২, এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে বাহুল্যবোধে যা উদ্ধৃত করা গেল না। তবে সংক্ষেপে মোটামুটি কী কী ধরনের প্রশ্ন এতে ছিল তার আভাস দেওয়া যেতে পারে। কতরকমের চাষী হয় থেকে শুরু করে, কতরকমের জমি হয়, ভিন্ন ভিন্ন রকমের জমিতে বছরে গড়ে কত ফসল হয়, ভিন্ন ভিন্ন রকমের জমিতে বিঘাপ্রতি আবাদ করতে চাষীর কত খরচা পড়ে, চাষী কিভাবে সে টাকার ব্যবস্থা করে, যদি ঋণ করতে হয় তো কী শর্তে করে, তার জীবনযাত্রা কিরকম, কাকে সে আবশ্যক বলে কাকে সুখ বলে কাকেই বা ভোগ বলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ পর্যন্ত বিধৃত বিবরণ থেকে একটা ব্যাপার স্বপ্রকাশ যে রামমোহন থেকে ইয়ং বেঙ্গল (বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার দত্ত সমেত) পর্যন্ত যে কালপর্ব সেই কালপর্বে বাংলায় যা ঘনিয়ে উঠেছিল তা স্বাদেশিকতা, জাতীয়তাবাদ নয়। বলা যায় এ ছিল তৎকালে বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারার ভাবনা। এই স্বাদেশিকতা থেকেই এসেছিল আত্মশক্তির জাগরণের ভাবনা। আত্মশক্তির জাগরণের ক্ষেত্রে প্রধান অবলম্বন করা হয়েছিল নারীমুক্তি এবং রাজনৈতিক অধিকার চেতনা সৃষ্টিকে। এই নারীমুক্তি এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজনেই জোর দেওয়া হয়েছিল বাংলাভাষার বিকাশের ওপর। এ ছিল শক্তির জাগরণ, ক্ষমতার নয়। এসবের মধ্যে ক্ষমতার কাঙাল রাজনীতির কোনো নামগন্ধ ছিল না, যে ক্ষমতার কাঙাল রাজনীতির যুগ সম্মত রূপ, রণজিৎ গুহের ভাষায়, জাতীয়তাবাদ।
আরো একটা কথা। একমাত্র জেমস মিল রচিত ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের এবং মেকলে অনুসৃত নীতির কারণে ছাড়া ডিরোজিয়ানরা উপনিবেশিকতার শিকার খুব একটা হননি। মিলের ইতিহাস যেহেতু সাম্প্রদায়িক ভাগে ভারতকে ভাগ করেই লেখা হয়েছিল, তার নেতিবাচক প্রভাব ডিরোজিয়ানদের ওপর কিছুটা হলেও পড়েছিল। মেকলে অনুসৃত নীতির কারণে নিজের দেশের সংস্কৃতিকে তাঁরা কেউ কেউ হেয় চোখে দেখতে শুরুও করেছিলেন। তবে তা গোড়ার দিকে। নিজেদের ভেতরে প্রশ্নের কোনো অভাব না থাকায় এবং জর্জ টমসনের সাহায্যে তাঁরা অচিরে সে হীনতাও কাটিয়ে ওঠেন। কোনো সন্দেহ নেই যে জর্জ টমসন উপনিবেশিক ভারতকে স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত করতে এ দেশে আসেন নি। তা যদি তিনি আসতেন তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভারতে ঢুকতেই দিত না। কিন্তু তিনি যা করে গিয়েছিলেন তাই যথেষ্ট। তিনি ইয়ং বেঙ্গলীদের বলেছিলেন, “To be of use to your country, you will find it indispensable to possess a knowledge of it.”৬৩ তিনি বলেছিলেন, এখনো পর্যন্ত ভারতের অবস্থা নিয়ে কোনো কিছু একজন বিদেশীর লেখা, বিদেশী শাসক, বিদেশী পরামর্শদাতা, বিদেশী ঐতিহাসিক, বিদেশী কুৎসা রটনাকারী, এমনকি একজন আইনি পরামর্শদাতা পর্যন্ত বিদেশী।৬৪ তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এমন হবে?
এ পর্যন্ত আলোচনার নির্যাস
১. দেখা যাচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার শিকারও হয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করতে অরাজি রামমোহন উপনিবেশিকতার প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু অন্যদিকে ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম যে জমি পণ্য হয়ে গেল তা বুঝতে না পারাটা এবং কৃষকের মালিকানাস্বত্বকে দখলিস্বত্ব হিসেবে তাঁর মেনে নেওয়াটা হল উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসবের মাশুল দেশের বেশির ভাগ লোককে গুনতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত নারীর হীনাবস্থাকে কেন্দ্র করে এবং বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে একটা সভ্যতার মান নির্ণয়ের যে ইয়োরোপীয় চেষ্টা, তার মধ্যে সত্যতার অভাব ছিল। এক, বর্ণহিন্দু সমাজের বাইরের বৃহত্তর সমাজে নারীর অবস্থা ততটা হীন ছিল না, যতটা ইংরেজরা প্রচারে এনেছিল। অর্থাৎ এটি ছিল আংশিক সত্য মাত্র। দুই, বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে সভ্যতার মান নির্ণয়ের যে ইয়োরোপীয় চেষ্টা, তার মধ্যেও গলদ ছিল। ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষের মানুষজনের সে অর্থে বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। এ দেশের বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভিত্তি ছিল এখানকার আবহাওয়া। তবে বস্তুগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য বলতে যদি ভোগবাদের অনুসরণ বোঝায় তাহলে সেটা আমাদের দেশে ছিল না। সেটা গড়ে ওঠার কোনো অবকাশও ছিল না, কারণ এটা ছিল কৃষি সভ্যতা, এ দেশের মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বে বিশ্বাস করত না, তারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রকৃতির সহাবস্থানে সহজ সরল জীবনযাপন করাই শ্রেয় মনে করত, যেকথা রামমোহন নিজেও বলেছিলেন।
২. ধর্মনিরপেক্ষতা আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান, আমাদের দেশে যা বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ধর্মচেতনা, তার সাপেক্ষতা নিরপেক্ষতা কোনোটাই নেই। সাধারণ মানুষ মনে করে সকলের মধ্যেই ভগবান আছে, যে যে নামেই ডাকুক। আমরা কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ জৈন এগুলি হচ্ছে আমাদের আপাত-অবস্থান। যেহেতু সাপেক্ষতাও নেই, বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র চাওয়ারও কোনো ভিত্তি থাকে না। এই চাওয়াটা রাজনৈতিক, ধর্মগত নয়।
৩. জাতীয়তাবাদও আবশ্যিকভাবেই একটি উপনিবেশিক উপাদান। জাতীয়তাবাদের ভিত্তি এক ধর্ম এক ভাষা এক জাতি। ভারতবর্ষ এক ধর্ম এক ভাষা এক জাতির দেশ নয়, সুতরাং এ দেশে জাতীয়তাবাদের শেকড় গাড়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। ইয়োরোপের জাতীয়তাবাদের যে ইতিহাস আমরা পড়ি তা খুব উজ্জ্বল নয়। হওয়া উচিত ছিল বিশ্বজনীনতার স্বদেশী ধারা, বাংলা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল।
৪. শ্রদ্ধেয় গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় যেভাবে ডিরোজিওকে ও ডিরোজিয়ানদের স্বাদেশিকতার দিক থেকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, পড়লে অবাক মানতে হয়। এ ব্যাপারে কোনো বিতর্কে যাবার অবকাশ এই প্রবন্ধে নেই, শুধু একটা ইঙ্গিত করা যেতে পারে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দুটি বইয়ের যথাক্রমে ABENCর প্রকাশকাল ১৯৫৬ এবং BENCর প্রকাশকাল ১৯৬৮। এই কালপর্বেই বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদের কঠোর সমালোচনার ধারা শুরু হয় এবং ফলশ্রুতিতে এমন অনেক কাজ হয় যা বাঞ্ছিত ছিল না। সত্যি বলতে কি, এই সময় থেকেই বামপন্থী আন্দোলন ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনের সমস্ত উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে শুরু করে।
পরের ও শেষ অধ্যায় আগামী সংখ্যায়
তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যেকার শব্দগুচ্ছ সর্বদাই লেখকের সংযোজন
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. Asoke Basu and Saibal Datta, Indigenous Roots of Modern Science in Colonial Bengal, 2019, The Asiatic Society, Kolkata, p. 10
২. রামমোহন রচনাবলী, প্রধান সম্পাদক. অজিতকুমার ঘোষ, ১৯৭৩, হরফ প্রকাশনী, কোলকাতা, পৃ. ৪৬২
৩. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ১৩৯৭ বাং, পৃ. ২২০
৪. M. K. Gandhi, An Autobiography or My Experiments with Truth, vol 1, 1927, Navajiban Publishing House, Ahmedabad, pp.370-371
৫. Ashis Nandy, The Romance of the State and the Fate of Dissent in the Tropics, 2007, Oxford University Press, New Delhi, ‘An Anti-Secularist Manifesto’, p. 34-60
৬. Pynhunlang NM Shullai, Colonialism, Christianity and Mission Activities In India: A Postcolonial Perspective, International Journal of Humanities and Social Science Studies, vol III Issue V March 2017, p. 326, http://www.ijhsss.com
৭. রামমোহন রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪
৮. Francis Bacon, Of the Advancement of Learning, 1930, J. M. Dent & Sons Ltd, New York, p. 179
৯. ibid, p. 40
১০. Max Weber, The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism, 1950, Charles Scribner’s Sons, New York
১১. পড়ুন J. N. Farquhar, Modern Religious Movements in India, 1915, Macmillan Co., New York
১২. পড়ুন Richard King, Orientalism and Religion, e-library edn., 2001, Routledge, London and New York
১৩. দেবেন্দ্রনাথ দে, কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত, সম্পাদক. সত্যব্রত দে, ১৯৯০, জিজ্ঞাসা এজেন্সিস লিমিটেড, কোলকাতা, পৃ ৪ (পাদটীকা দেখুন)
১৪. D. D. Kosambi, Myth and Reality, p. 7
১৫. রণজিৎ গুহ, দয়া -- রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা, ২০১১, তালপাতা, কোলকাতা, পৃ. ১৩৩
১৬. Ashis Nandy, ibid, p. 34-60
১৭. Ashis Nandy, ibid, p. 34-60
১৮. Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches, vol 13, 2014, His address on ‘Article 1’ of The Constitution of India, p. 326
১৯. পড়ুন, Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760, 1997, Oxford University Press, Delhi, Part 2, ‘Bengal under the Mughals’, pp. 137-304
২০. Henry Miller, Tropic of Cancer, 1963 edn, Flammingo, London, p. 170
২১. Erich Fromm, The Art of Loving, 1956, Harper and Row, New York p. 80
২২. Bimal Krishna Matilal, The Navya Nyaya Doctrine of Negation, 1968, Harvard University Press, Massachusetts, see ‘Preface’, p. X
২৩. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা, ১-৫ খণ্ড, সম্পাদক. অশোক মিত্র, ভারতের জনগণনা ১৯৬১, ভল্যুম ১৬, পার্ট ৭বি
২৪. Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches, vol 1, 2014, ‘Annihilation of Caste’, pp. 57-58
২৫. D. D. Kosambi, Myth and Reality, p. 10
২৬. ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্বপ্ন লব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস, ১৩০২, বুধোদয় যন্ত্র, হুগলী পৃ. ১০-১১
২৭. Young India (1919-1932) 18.06.1925, p. 211, English weekly journal, published from Bombay as a bi-weekly, under Gandhiji's supervision from May 7, 1919, and as a weekly from Ahmedabad, with Gandhiji as editor from October 8, 1919,
২৮. Bengal Early Nineteenth Century–Selected Documents, ed. Gautam Chattopadhyay, 1978, Research India Publications, Calcutta
২৯. Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century–Selected Documents (ABENC), ed. Goutam Chattopadhyay, 1956, Progressive Publishers, Calcutta
৩০. Bengal Early Nineteenth Century–Selected Documents (BENC), ed. Gautam Chattopadhyay, 1978, Research India Publications, Calcutta, see ‘Introduction’, p. vii
৩১. BENC, ibid, p. 32
৩২. রামমোহন রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৯
৩৩. BENC, ibid, p. 32-33
৩৪. BENC, ibid, see ‘Introduction’, p. ix
৩৫. BENC, ibid, p. 34
৩৬. BENC, ibid, p. 100
৩৭. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ed. F. B. Bradley-Bart, 1923, Humphrey Milford/Oxford University Press, p.
৩৮. ibid, ibid, p. 2
৩৯. ibid, ibid, p. 137
৪০. পল্লব সেনগুপ্ত, ঝড়ের পাখিঃ কবি ডিরোজিও, ১৯৬০, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ. ২৭
৪১. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ed. F. B. Bradley-Bart, 1923, Humphrey Milford/Oxford University Press, see ‘Fakeer of Junngheera’, p. 171-172
৪২. BENC, ibid, see ‘Introduction’, p. vii-viii
৪৩. Poems of Henry Louis Vivian Derozio, ibid, see ‘Freedom to the Slave’, p. 18
৪৪. BENC, ibid, see ‘Introduction’, see ‘Birth of the Deshutaishunee Shubah, October 1841’, p. 273
৪৫. Pallab Sengupta, Derozio, 2000, Sahitya Akademi, p. 70-74
৪৬. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ, ১৯০৯, এস. কে. লাহিড়ী অ্যান্ড কোং, কোলকাতা, পৃ. ১৪৭-১৪৮
৪৭. Sanjay Seth, Nationalism, Modernity and the “Woman Question” in India and China, The Journal of Asian Studies, vol 72 no. 2 (May 2013), p. 276, http://www.jstor.org/stable/43553178
৪৮. ABENC, ibid, see ‘On Native Female Education’, p. 294
৪৯. পড়ুন James Mill, The History of British India, 1817, www.archive.org
৫০. Sanjay Seth, ibid, p. 274, ibid
৫১. ABENC, ibid, পৃ. ৩-৪
৫২. ibid, ibid, পৃ. ২-৩
৫৩. BENC, ibid, see ‘Town Hall Meeting on January 5, 1835 criticising Charter Act of 1833’, p. 260
৫৪. ABENC, ibid, see ‘Report of Controversy between Dukhinaranjan and Richardson, Bengal Hurkaru, p. 389-399
৫৫. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 261
৫৬. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 262
৫৭. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 261
৫৮. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 264
৫৯. BENC, ibid, see ‘Birth of the Deshutaishunee Shubah October 1841’, p. 266-267
৬০. BENC, ibid, see ‘ibid’, p. 275
৬১. ব্রিটেনের দাসপ্রথা-বিরোধী নেতা, দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে কোলকাতায় এসেছিলেন এবং সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার সভ্যদের অন্তরঙ্গতা অর্জন করেছিলেন।
৬২. সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, সংকলন ও সম্পাদনা. বিনয় ঘোষ, ষষ্ঠ খণ্ড, ১৯৮৩, প্যাপিরাস, কলকাতা, পৃ. ১০৯-১১১
৬৩. BENC, ibid, see ‘On the Formation of British India Society’, p. 200
৬৪. BENC, ibid, ‘ibid’, p. 208-209
আমি তোমার পাশেই রয়েছি। আমি কোনো মন্দিরে নেই, মসজিদে নেই। কাবাতীর্থে আমি নেই, কৈলাসে আমি নেই। ক্রিয়াকর্মে নেই, যোগে বৈরাগ্যে নেই, আমি সকল নিঃশ্বাসের, নিঃশ্বাসের মধ্যে তোমার পাশে আছি।
এভাবেই নাকি বলতেন কবীর (১৩৯৮ – ১৪৪৮ মতান্তরে ১৫১৮)। কেউ ভাবেন তিনি বৈষ্ণব, কেউ বলেন তিনি শৈব নাথ-যোগী পরম্পরার, কেউ ভাবেন সুফি আর কারও মতে তিনি যত না কবি, তার চেয়ে বেশি সমাজ-সংস্কারক। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সুবাদে কবীরের ভাবধারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর পরিচয় হয়েছিল। গীতাঞ্জলি যে বছর প্রকাশিত হয়, সেই ১৯১০ সালেই রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ও সাহায্যে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত ও সংকলিত কবীর বচনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়, পরবর্তী সময়ে আরও তিন খণ্ড। ১৯১৫-য় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে প্রকাশিত হয় ‘Songs of Kabir’।
মুসলমান ঘরের সন্তান কবীর। রামানন্দের শিষ্য হলেও গৃহস্থ। ভিক্ষা করতেন না, কাপড় বুনে অন্ন সংস্থান করতেন। ঈশ্বরকে সত্য ভাবতেন। বিশ্বকে দেখতেন ঈশ্বরের রূপ। প্রকৃতির বৈচিত্র্য নাকি সেই অরূপেরই লীলা। ব্রহ্ম সর্বত্র সমাহিত। সেই সহজের মধ্যে নিমজ্জিত হতে হবে। কোথাও যাওয়া আসার প্রয়োজন নেই। ঠিক যেমনটি আছে, তেমনটিতে প্রবেশ করাটাই সাধনা। ভাষা তাঁর কাছে প্রবহমান জলধারা। ডুব দিলে শরীর জুড়োয়।
এমন ভাষায় সে কথা বলতে শেখেনি। শেখেনি শুধু নয়, শেখার কথা ভাবেওনি কোনোদিন। এমন কথা তো অধ্যাত্মবাদীরা বলে, ভাববাদে বিশ্বাসীরা বলে। সে বেড়ে উঠেছে ভাষার নমনীয় আত্মীয়তার আলিঙ্গনে নয়, ভাষার বর্ম আত্তীকরণের পথ বেয়ে। নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছে ধ্বনি গাম্ভীর্যে। ঋজুতা নির্মিত হয়েছে নমনীয়তার বিপরীতার্থে। স্বকীয়তা আত্মপ্রতিষ্ঠায়। নিবেদন, সমর্পণ ইত্যাদি হয়েছে যাপনবর্জিত শব্দসম্ভার মাত্র। হাতের ওপর হাত রাখা সহজ কথা নয়, হাতের ভার বইতে পারা সত্যি সহজ নয়।
তাহলে সে নিজে কি সত্যিই সহজ নয়? যে দেশে তার জন্ম ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভুমি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। হয়’ত কেন, সত্যি সত্যিই বাংলার সেই সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামল রূপসুষমার অনেকটুকুই হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম ক্ষেত্র নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়, জলজ গাছের বনভূমি, বরষায় প্লাবিত জলভূমির লাল নীল সাদা শাপলা আর পদ্ম, ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল, শাল-পিয়াল, লালমাটির চড়াই-উৎরাই, রং-বেরঙের নানান জাতের পাখি, ফড়িং-প্রজাপতি-জোনাকি, হলুদ সর্ষ-ক্ষেত্র, শস্যভারে আনত বিস্তৃত ধান্যভূমি, আসুমদ্র-হিমালয়কোল শোভিত অগাধ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, তবুও এই বঙ্গভূমিই যে তারই আঁচল। তারই তো দায়িত্ব ছিল সেই রূপ-ঐশ্বর্যকে ধরে রাখার, যা হারিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার। সে, সেসব কিছুই করেনি, করার কথা ভাবেওনি।
সে কি তাহলে সহজ-সন্ধানী নয়? এই প্রিয় পৃথিবীতে যেখানে অপূর্ণতা, সেখানেই নতুনের সৃষ্টি, বিশেষের সৃষ্টি, বিচিত্রের সৃষ্টি - এই সহজ সত্য সে বুঝতে অক্ষম! প্রাণের শক্তি, গ্রহণ করতে পারার শক্তি, প্রাণের শক্তি, দান করার শক্তি। যে মন গ্রহণ করতে জানে না, সে ফসল ফলাতেও জানে না। সে তো মরুভূমি।
সহজ কথার শক্তি সে জানে না, তা তো নয়। সত্তরের অগ্নিস্পর্শী সময়ে, পুলিশ লকআপে একদিন এক প্রৌঢ় কৃষক কমরেডের জিজ্ঞাসার মুখোমুখী হতে হয়েছিল তাকে। আগের রাতে দীর্ঘ জেরার পর সেই কৃষক মানুষটিকে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছিল, পরের দিন ওই প্রৌঢ়, পুলিশের জিজ্ঞাসার যদি ঠিকঠিক উত্তর না দেয়, তাহলে তার সামনে তার মেয়েকে রেপ করা হবে। আগের রাতের পুলিশী অত্যাচারে বিধ্বস্ত পিতা কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এবার সে কী করবে? কী করা উচিত তার? ভয়ার্ত সেই পিতাকে সে জবাব দিয়েছিল, আপনার যেটা সঠিক মনে হয় তাই করবেন। যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক। তার সঙ্গে সে এও জানিয়েছিল, পরবর্তীকালে যে-কোনো বিরূপ সমালোচনায় প্রয়োজনে তিনি বলতে পারেন, তার পরামর্শেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে আরও বলেছিল, মনে রাখবেন যাদের সঙ্গে অন্ন ভাগ করে নিয়েছিলেন, সেই মুখগুলো। অঘটন কিছু ঘটেনি। সে রাতে কী ঘটেছিল তা অবশ্য বিস্তারিত তার জানা হয়ে ওঠেনি। তবে একটা জানা তার আবারো জানা হয়েছিল সহমর্মিতার শক্তির ভিত সহমতের বন্ধনের থেকেও অনেক বেশি শক্তি ধরে।
সত্তরের গোড়ায় তারাতলা-ব্রেসব্রীজের মেটাল বক্স কারখানায় শ্রমিক-কর্তৃপক্ষ বিরোধে বাইরে থেকে পুলিশ-তাণ্ডবের জবাবে, শ্রমিকেরা কারখানার ছাদ থেকে ইঁট-পাটকেল আর সুতুলি-দড়ি গোলা পাকিয়ে ডিজেল-কেরোসিনে চুবিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে প্রতিরোধ তৈরি করলেও কারখানার মেসিনপত্রের কোন ক্ষতি করেনি। জিজ্ঞাসায় শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন, আজ বা কাল মালিকের সঙ্গে বিরোধের মীমাংসা তো হবেই, কিন্তু মেসিনপত্র ভেঙেচূরে দিলে, কারখানা টিঁকবে না। বোধ করেছিল সে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে তাঁতযন্ত্র ভাঙচূর করে গড়ে ওঠা ল্যুডাইট মুভমেন্টের ব্যর্থ হওয়ার কাহিনী। বৈরীতাই সমাজ-ইতিহাসের শেষ কথা নয়। অন্বেষণ, মর্যাদাপূর্ণ মীমাংসা সূত্রের।
সাধারণের সহমর্মিতার আকাঙ্ক্ষা সে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছিল চন্দননগরে তেলেনিপাড়া চটকলে শ্রমিক আন্দোলনে। ১৯৯৩ সাল। বাংলায় তখন বামফ্রন্ট সরকার। শ্রমিক অসন্তোষের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মিলের অভ্যন্তরে, মিলের বাইরে। উত্তেজিত শ্রমিকেরা মিলের ভিতরের কোন মেশিন বা যন্ত্রপাতির ক্ষতি না করলেও বাইরে ভাঙচূর করেছিলেন সিপিআই, সিপিআই(এম), আরএসপি, কংগ্রেস, বিজেপি সব রাজনৈতিক পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন অফিস। দৌড় করিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের। পরিণতিতে এলাকার যতেক শ্রমিক মহল্লায় নেমে এসেছিল পুলিশী তাণ্ডব, লাঠি গুলি। যে ঘটনার রেশ ধরে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান ভিখারি পাশোয়ান। তাণ্ডবের পরের দিনই একটি তথ্যানুসন্ধানী দলের সঙ্গে সেও ওই এলাকায় গিয়েছিল ঘটনার বিশদ বিবরণ ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণ লিপিবদ্ধ করতে। গোটা এলাকা তখন দৃশ্যে, ধ্বনিতে পুলিশ-প্রশাসনিক ত্রাস। এক শ্রমিক মহল্লায় যখন সে কথা বলছিল, ভিড় ঠেলে কুঠুরীর ভিতর হতে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সী এক মহিলা। কণ্ঠস্বর অবিকল হাবিব তনবীরের প্রযোজনায় চরণদাস চোর নাটকে রানী চরিত্রে অভিনেতা এক দেহাতি নারী। কথায় কথায় সে জিজ্ঞেস করেছিল বাস্তবের সেই রানীকে, অত উত্তেজনার মধ্যেও মিলের ভেতর কোন ভাঙচূর হয়নি কেন? দ্রোহী সে-নারী জানিয়েছিলেন, কল তাদের নিমক জোগায়। জানতে চেয়েছিল সে, ট্রেড ইউনিয়নের ওপর অত ক্রোধের কারণ কি? সেই নারী নিজ-স্বরযন্ত্রে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে জবাব দিয়েছিলেন, আমরা তো জানি নেতারা আমাদের সব দাবিদাওয়া আদায় করে দিতে পারবে না। আমাদের অভাব পুরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সাথ দেবে তো। আমাদের ঘরদুয়ারে যাবে আসবে তো। আপদে বিপদে আমরা আছি বলবে তো। ব্যস আমরা উহাদের কাছে শ্রিফ ওই চাই। দিলে না, লোকেরা বহুত দৌড় করালো। আর কিছু নয়।
সংকট, সহমর্মিতার।
বাংলা তার আদি পর্বে প্রত্যক্ষ করেছে সমাজ-সংস্কৃতি, বিরোধ-মীমাংসায় সহমর্মিতার ইতিহাস। এ-বাংলা মানুষকে সহজ করেই গ্রহণ করে নিতে চায়। মনে রাখতে চায় না, জিইয়ে রাখতে চায় না বিদ্বেষ-বিভাজন। দীর্ঘ তার ইতিহাসে আপন করে নিয়েছে একাধিক ধর্ম সংস্কৃতি সভ্যতা। যে যার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও বাংলায় গড়ে উঠেছিল এক মিলিত সাংস্কৃতিক পরিসর। বিস্তৃত এই জনপদ প্রত্যক্ষ করেছিল খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে, অবৈরী অসম বিন্যাসের সংলগ্নতা, অবিচ্ছিন্নতা। ভিন্নতা নিয়েই মিলন।
ধারাবাহিকতায় শ্রীচৈতন্য লালন। মনের চলন বিদ্যাপতির ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর’। আপ্লুত হয়েছে পদাবলী সাহিত্যের বলিষ্ঠ প্রেমাভিলাসে, ‘চলে নীল সাড়ি নিঙারি নিঙারি/পরান সহিতে মোর।/সেই হৈতে মোর হিয়া নহে থির/মন্মথ জ্বরে ভোর’। জলে-হাওয়ায় অঙ্কুর মেলেছে বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম পদকর্তা চণ্ডীদাসের এক বিশ্বাসী সত্য, প্রবাদপ্রতিম পদে - ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার পরে নাই’। মানবতাবাদ যৌক্তিক আশ্রয় পেয়েছে, লালনের বাউলে, ‘জাত দেয় সে অজাতের দৌড়ে গিয়ে’ অথবা সংকীর্তনে ‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’। অনুসন্ধানী হয়েছে, দীক্ষিত হতে চেয়েছে শাক্ত পদাবলীর কবি রামপ্রসাদ সেনের ভাবসমৃদ্ধ সঙ্গীতে, ‘মন রে কৃষি কাজ জান না।/এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা’।
কান পেতেছি চোখ মেলেছি
ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান।
দুই
সন্ধানে সে খুঁজে পেয়েছে, তার বাঙলার সহমর্মিতার ঘ্রাণ-আস্বাদ। আর্য-ধর্ম, আর্য-সংস্কৃতি বাংলায় এসেছিল প্রধানত গঙ্গা ভাগীরথীর পথ ধরে, কয়েকটি পর্যায়ে। প্রথম যারা এসেছিলেন, তাদের শাস্ত্র ছিল ঋক্ বেদ। প্রাচীন বা প্রাক-বৈদিক ধারা। ‘সদানীরা’ (গণ্ডক/গঙ্গা) পার হয়ে এই জনগোষ্ঠী বসত গড়ে বিহার-বাংলার গঙ্গা-বিধৌত উপত্যকা অঞ্চলে। তারপর অনেক সময়কাল পার হয়ে আসে বৈদিক ধারার মানুষজন। এদের শাস্ত্র যজুর্বেদ আর ব্রাহ্মণ। অর্বাচীন বৈদিক সাহিত্যে প্রাচীন/প্রথম ধারার মানুষজন ‘আসুর’ এবং ‘ব্রাত্য’। অসুর অনার্য নয়, দেবতার বড় ভাই, বুদ্ধিতেও সে ছোট নয়। শুধু ভাষা-দুষ্টতার অপরাধে বারবার এরা দেবতার কাছে পরাজিত হয়। এই অসুরেরা নাকি পূর্বদেশে, কোণঠাসা ‘পতিত’ আর্যভাষীদের পূর্বপুরুষ। কার্তিকের আকাশ-প্রদীপে অবশ্য সেই প্রাচীনের সন্ধান নেই।
সেই সুপ্রাচীন বৈদিক ধারার আর্যবাসীদের দুটি ধারা। প্রথম ও প্রধান দল ‘গ্রামবাসী’। গ্রাম বলতে – একজন কুলপতি ব্রাহ্মণ গৃহস্থ, তার স্বজন পরিজন, শিষ্য-সেবক, দাস-দাসী, আজ্ঞাবাহক-কর্মচারি ইত্যাদি। প্রয়োজনে এক গ্রাম তুলে অন্যত্র নতুন করে গ্রাম পত্তন করতেন এঁরা। কাল-সময় পার হয়ে, কৃষিকাজ প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পর কুলপতি, যাযাবরত্ব ত্যাগ করে গ্রামপ্রধান। অর্থাৎ সামাজিক ইউনিট, গ্রাম। দ্বিতীয় ধারায়, যাদের মর্যাদা গ্রাম্যদের তুলনায় অনেক কম, তারা ‘ব্রাত্য’ (গণ)। আসল মানে, ব্রাত্যের (সমূহের, গণের বা কোন দলের) অন্তর্গত। এদের সামাজিক ইউনিট, ব্রাত। এখানে সকলের সমান অধিকার, একজন দুজন জ্যেষ্ঠ হিসাবে স্বীকৃত।
এইরকম ব্রাত্যেরাই বাংলায় আর্য-সংস্কৃতির প্রথম বাহক ছিল এমনটাই নাকি মনে করা যায়। এদের ধর্মাচারে আর ধর্মচিন্তায় বাইরে থেকে মিশে গিয়েছিল অনেককিছু। কিন্তু প্রাচীন ঋক্ সংস্কৃতির বীজ হারিয়ে যায়নি। জৈন-ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর আর বৌদ্ধ-ধর্মের শাস্তা বুদ্ধ দুজনেই পূর্ব ভারতের মানুষ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই দুই ধর্মের প্রবাহও বাংলায় চলে আসে অনতিবিলম্বেই। গড়ে ওঠে এক সংলগ্নতা। ধর্ম-সংস্কৃতির এই সম্মিলন বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এর ওপর বারবার আছড়ে পড়েছে পশ্চিম থেকে আগত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ঢেউ। আজও।
ইসলাম আসে বাংলায় মাত্র হাজার বছর আগে, ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে, পাল বংশের শাসনকালে। মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্য সূত্রে। বাংলা ভাষার সচলতা বা আদি লিপির উদ্ভব এই পাল বংশের সময়কালেই। ৭৫০ থেকে ১২০০। গৌড় বিক্রমপুর পাটলিপুত্র। গোপাল ধর্মপাল দেবপাল। যুদ্ধপটু। প্রায় অজেয় তার হস্তিবাহিনী। বিস্তৃত সাম্রাজ্য। সম্পন্ন গৃহস্থালী। বাণিজ্য ভূখণ্ড ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য মধ্যএশিয়া। মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ছিল রাজধর্ম। রাজভাষা, পালি, সংস্কৃত আর প্রাকৃত। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ।
পালবংশের শাসন শেষে কর্ণাটক থেকে এসেছে সেনবংশ। লক্ষ্মণ সেন। ১১৭৮ থেকে ১২০৬। রাজধানী নবদ্বীপ। এখানেই জন্মাবেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শচী দেবী-জগন্নাথ মিশ্রের সংসারে বিশ্বম্ভর মিশ্র ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমায়, পরিচিত হবেন নিমাইপণ্ডিত, গৌরাঙ্গচন্দ্র হয়ে চৈতন্যদেবে। নরম, ঋজু উচ্চারণে জানাবেন, ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, যে চণ্ডাল হরিভক্তি পরায়ণ, সে দ্বিজজাতি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) থেকেও শ্রেষ্ঠ। অবশ্য এ-সব, অনেক পরের কথা। তার আগে, বখতিয়ার খিলজি সেনরাজাদের পরাস্ত করে নবদ্বীপের দখল নেবে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে।
ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী বাংলা-বিহার-ওড়িশা শাসন করেছিল আফগানিস্তান থেকে আসা পাশতুন সম্প্রদায়। পাশতুনদের অনেক সম্প্রদায়। প্রধান দুটি, নাশাল আর দিয়ান। দিয়ান থেকে দেওয়ান। নাশালরা পাঠান। আর দেওয়ানরা, ধর্মান্তরিত রাজপুত ও ভূমিহার। ১৫২৬ সালে বাবরের হাত ধরে প্রথম মোগল সাম্রাজ্য তৈরি হলেও, তার পঞ্চাশ বছর পরে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন আফগান সুলতান দাউদ খান করবানিকে পরাজিত করে মোগল সাম্রাজ্য বাংলা-বিহার-ওড়িশায় তাদের রাজ্যপাট বিস্তার করে। যদিও পুরোপুরি মোগল আমল প্রতিষ্ঠা হতে কেটে গিয়েছিল আরও তিন দশকেরও বেশি সময়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তখন বারো ভুঁইঞাদের প্রতাপ প্রতিপত্তি। অবশেষে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি সারা বাংলাতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ১৬১২ সাল। ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাস্ত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবিভক্ত বাংলার দখল নেয়।
ইংরেজ এসেছে পরাক্রমশালী যোদ্ধা হয়ে নয়, বণিকের বেশে। ১৬১৮ সালে বার্ষিক এককালীন তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজরা সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্যের অনুমতি আদায় করে নেয়। এর কিছু বছর আগে ১৫৯৯ সালে কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ী মাত্র ৩০ হাজার পাউন্ডের ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তৎকালীন মুদ্রামান অনুযায়ী, ২৫ হাজার ভারতীয় মুদ্রার চেয়েও কম। এর পরের বছর রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভারতের সাথে তারা বাণিজ্য শুরু করে। ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে তৎকালীন ভারতের প্রধান সমুদ্র-বন্দর সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তারা। সুরাটে তখন আরও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের একেকজনের মূলধন পুরো ইংরেজ কোম্পানির চেয়েও অনেক অনেক বেশি। ইংরেজদের দৈন্যদশা দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং বিদেশী ইংরেজদের মোটেও গুরুত্ব দিতেন না। এই গুরুত্বহীন, করুণার পাত্র, নামমাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজ একসময় পুরো উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিল। অস্ত্র নয় ষড়যন্ত্র। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুরো ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে ইংরেজ। যুদ্ধ নয় প্রহসন। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানী প্রথম এলিজাবেথ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২১ বছর পর্যন্ত পূর্বভারতে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ দেয়। পরবর্তী সময়ে কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল স্বাধীন রাজা-বাদশাহদের শাসনাধীন। ইংরেজ শাসন শুরুর আগে ভারতভূমি কখনও পরাধীন ছিল না। আর্য, আরব, ইরানী, পাঠান, মুঘল, তুর্কি অর্থাৎ বহিরাগত যারাই এই ভূমিতে রাজনৈতিক কারণে পা রেখেছে, তারাই একে আপন করে নিয়েছে; ভারতের জল-আলো-বাতাসে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছে। এমনকি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণে আসেন, তখন তার বেশ কয়েকজন সেনানায়ক এ দেশের জলবায়ু ও ধনসম্পদে মুগ্ধ হয়ে এখানেই বসত করেছেন। ব্যতিক্রম, ইংরেজ বণিকেরা। এদেশ থেকে ধনসম্পদ লুঠ করে নিজ দেশে পাঠানোর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে শেষ দিন অব্দি। রাজত্বের একবারে শুরুতেই বাঙলার খাদ্যদ্রব্য লুঠ করে আর শিল্প-উৎপাদনকাঠামো ধ্বংস করে ১০ কোটি বাঙালির প্রাণ নিয়েছিল ১৭৭০-এ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে আর ব্রিটিশ-রাজ শেষের কালে ১৯৪৩-৪৪-এ ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণ নিয়ে। খাদ্য, ওষুধ সবকিছু এখান থেকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধরত ব্রিটিশ সেনাদের জন্য। অপ্রয়োজনেও। খাদদ্রব্য মজুত করে গুদামে নষ্ট হতে দিয়ে। এদেশ কোনোদিনই তার স্বদেশ হয়নি। কেবলই অবজ্ঞা আর উপহাস। ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষে অনেক অনেক মানুষ যখন অনাহারে মারা যাচ্ছেন, সে-সময়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল জানিয়েছিলেন, দুর্ভিক্ষ বা না দুর্ভিক্ষ, ভারতীয়রা ইঁদুরের মতো জন্ম দেবে।
তিন
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে বাংলা ভাষার বিশেষ কোন নাম ছিল না। সাধারণ শিক্ষিত লোকেরা দুটি ভাষার নাম জানতেন, সংস্কৃত (সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রচলিত) আর দেশি ভাষা (প্রাকৃত, লৌকিক)। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম প্রত্যন্তে সাঁওতাল প্রভৃতি অষ্ট্রিকভাষী জাতির বাস। বাংলার বাইরেও ছিল অষ্ট্রিকভাষী, খাসী জাতিগোষ্ঠী। তিব্বত-চীনীয়–ভাষী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কোঁচ, মেচ, রাজবংশী ইত্যাদি জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে। বাংলার মাঝবরাবর রাজমহল পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের মালতো-মালপাহাড়ি ভাষা, দ্রাবিড় ভাষা। হতে পারে প্রাক-আর্য সময়কালে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বসত ছিল। দ্রাবিড় ভাষার কিছু কিছু শব্দ বাংলায় আছে। বেশ কিছু গ্রাম-নাম এ দেশের প্রাচীনতম জনপদবাসী অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়-ভাষীদের কাছ থেকে এসেছে বলে অনুমান করা যায়।
বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ঠ ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু আগেই বিশেষ জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ। শুরু বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য-ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি ও অনার্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা হচ্ছে অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, গোবর্ধন, শরণ, ধোয়ী, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম, কবীন্দবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামের দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ঠ ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সব গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও এইসব রচনা সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। চর্যাপদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ়ার্থ সাংকেতিক রূপবন্ধে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তারা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের ধারাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই। অনেকের মতে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের (রাজত্বকাল ১১৭৮ – ১২০৬) সভাকবি বীরভূমের কেঁদুলি গ্রামের জয়দেব ১২ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচনা করলেন গীতগোবিন্দম্ কাব্য। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা। রাধা-কৃষ্ণের মিলন-বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, পুনর্মিলন। এবং কাব্যের শেষে ভগবানরূপী কৃষ্ণ ভক্ত-রাধার শ্রীচরণ নিজের মাথায় রাখার ইচ্ছাপ্রকাশ, ‘দেহি পদবল্লবমুদারম্’। কাব্য অনুপম সুললিত রচনাশৈলী সমৃদ্ধ।
পরের বেশ-অনেকটা সময়কাল জুড়েই তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের পরিচয় জানা যায় না। কিছু কিছু নিদর্শন নাকি আছে। প্রাকৃত ভাষায় গীতি কবিতার সংকলন, ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’, রামাই পণ্ডিতের গদ্যপদ্য মিশ্রিত ‘শূন্যপুরাণ’, হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’, ‘ডাক ও খনার বচন’ – এই সময়ের রচনা। হয়ত, ধর্মশিক্ষা, শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনেরা, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কেউই লোকভাষা বাংলাকে মান্যতা দেননি।
চৌদ্দ পনেরো শতকেও বাংলার লিখিত সাহিত্য, সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব-ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে। পুরাণ থেকে নিয়েছে বিষয় আর বর্ণনাভঙ্গি। রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত-প্রণয়োপাখ্যান-ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত-ফারসী-আরবী-হিন্দি থেকে অনূদিত হয়েছে বাংলায়। এভাবেই নাকি লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষাসাহিত্যের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। নদীয়া জেলার ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস (১৩৮১ – ১৪৬১) অনুবাদ করলেন রামায়ণ। মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানান অনুষঙ্গে সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ। রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্পও এই অনুবাদে জায়গা করে নিল। পরে বাংলায় অনূদিত হয়েছে আরও অসংখ্য গ্রন্থ।
পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি (আনুমানিক ১৩৭৪ – ১৪৬০)। গ্রাম বিসফি, মহকুমা সীতামারী। মিথিলারাজ দেবসিংহ ও শিবসিংহের সভাসদ। ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।।/ঝম্পি ঘন ঘন — জন্তি সন্ততি/ভুবন ভরি বরি খন্তিয়া।/কান্ত পাহুন কাম দারুন/সঘনে খন শর হন্তিয়া।।/কুলিশ শত শত পাত-মোদিত/ময়ূর নাচত মাতিয়া।/মও দাদুরী ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া।।/তিমির দিক ভরি ঘোর যামিনী/অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।/বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়াবি/হরি বিনে দিন রাতিয়া।।’
বিদ্যাপতি মূলত মৈথিলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেছেন। ভাষার বিশেষ মাধুর্যের জন্য এর নাম ব্রজবুলি। এই ভাষা-সুষমায় প্রভাবিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের কবিরাও। বিশেষভাবে গোবিন্দদাস। জ্ঞানদাসের কিছু কিছু পদও এই ব্রজবুলি ভাষাতেই রচিত। মধ্যযুগের বহু কবি এই ভাষাতেই পদরচনা করেছেন। এমনকি আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যখন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ লেখেন তখন তিনি লেখেন ব্রজবুলি ভাষাতেই।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও বাংলার বহুবিধ লৌকিক ধর্মবিশ্বাস নিয়েই এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলি এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সময়কালের সাহিত্যের মূল বিষয়। আনুমানিক চোদ্দ শতকের শেষার্ধে বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধে বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বনে লেখেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। কবি শাহ মুহম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতকে রচনা করলেন প্রণয়োপখ্যান, ‘ইউসুফ-জোলেখা’। এছাড়াও একাধিক অনুবাদসাহিত্য।
বাংলা সাহিত্যে তখন জোয়ার। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ছাড়াও জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস, যশোরাজ খান, চাঁদ কাজী, রামচন্দ্র বসু, বলরাম দাস, নরহরি দাস, বৃন্দাবন দাস, বংশীবদন, বাসুদেব, অনন্ত দাস, লোচন দাস, শেখ কবির, সৈয়দ সুলতান, হরহরি সরকার, ফতেহ পরমানন্দ, ঘনশ্যাম দাশ, গয়াস খান, আলাওল, দীন চণ্ডীদাস, চন্দ্রশেখর, হরিদাস, শিবরাম, করম আলী, পীর মহম্মদ, হীরামনি, ভবানন্দ প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য কবি। ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। জাতি-সংস্কৃতি সংপৃক্ততায় সবাই-ই বাঙালি।
বৈষ্ণব মতকে কেন্দ্র করে রচিত হ’ল বৈষ্ণব সাহিত্য। পঞ্চাদশ শতকে শ্রী চৈতন্যদেবের ভাব বিপ্লবকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব সাহিত্যের জন্ম। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬ – ১৫৩৪) কোন গ্রন্থ লিখে যাননি অথচ তাকে ঘিরেই জন্ম এই সাহিত্য-ধারার। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। ভাষা, ব্রজবুলি ও বাংলা। দৃষ্টিভঙ্গিতেও এক বড়সড় পার্থক্য। সংস্কৃত সাহিত্যে বিরহ প্রধানত পুরুষের। ঋক্ বেদে পুরুরবার বিরহ, রামায়ণে রামের বিরহ, মেঘদূতে যক্ষের বিরহ। আর এই বঙ্গদেশে, বৈষ্ণব গীতিকাব্যে বিরহ একান্তভাবে নারীরই। এই দেশ, বঙ্গদেশ বাঙালির মাতৃভূমি। উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে, ভারত, পিতৃভূমি।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলা সংস্কৃতিতে এনেছিল অভাবনীয় সব পরিবর্তন। মানবতার প্রতি গৌরববোধ বেড়েছিল। দৈবশক্তিতে মানুষের আস্থা কমে এসেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্যে ধরা পড়েছিল বাঙালির এই মানস পরিবর্তন। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মঙ্গলকাব্যের আন্তর্ধর্মে কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক দেবতায় সংশয় এবং অবিশ্বাসের সময়কাল। ব্রাহ্মণ সন্তানেরাও তাদের পূর্ব সংস্কার ও আভিজাত্য-গৌরব সরিয়ে, অন্তজ সম্প্রদায়ের দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তনে এগিয়ে এসেছেন। ধর্মমঙ্গলের কবি কাব্যরচনায় ধর্মঠাকুরের স্বপ্নাদেশের কথা নয়, গুণগান করেছেন বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের। ভারতচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্রের।
জ্ঞানমার্গের মানুষজন ছিলেন সাধারণভাবে বর্ণবিভাগের সমর্থক। শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা, প্রকৃতিগত কারণে বর্ণ-বিভাজন ছিল উচ্চশ্রেণিতেই সীমাবদ্ধ। চৈতন্য – শাস্ত্রজ্ঞ, নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ – কেটে দিলেন সেই বাঁধ। প্লাবন, মহাপ্লাবন।
বৈষ্ণব একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবেই প্রবর্তিত হয় এক বিশেষ সামাজিক বাস্তবতায় - শাস্ত্রীয় ধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়ায়। ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যেই মানুষে-মানুষে উঁচু-নিচু ভেদ, জাতি-পাতির বাছ-বিচার যখন মনুষ্যত্বের অবমাননায় লিপ্ত, তখন প্রেমের উদার বিচরণে সর্ববিধ সংস্কারমুক্ত মানুষের এক হওয়ার বাসনা থেকেই প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তনা। পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে ক্রমে চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং আরো পরে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্ভব। লালনের গানে এরই প্রতিফলন, ‘জাত দেয় সে অজাতের দৌড়ে গিয়ে’।
বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যিক গুণে অসামান্য। চণ্ডীদাস লিখছেন, ‘সই কেমনে ধরিব হিয়া।/আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/ আমার আঙিনা দিয়া।।/সে বধুঁ কালিয়া না চাহে ফিরিয়া/ এমতি করিল কে।/আমার অন্তর যেমন করিছে/তেমনি করুক সে।।/যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু/ লোকে অপযশ কয়।/সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি/আর যেন কার হয়।।/যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙাইয়া/এমত করিল কে।/আমার পরাণ যেমতি করিছে/তেমতি হউক সে।।’
এই সময়কালের বাংলা কাব্যধারার এক বিশিষ্ট শাখা হল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল মানে কল্যাণ। মধ্যযুগে বিভিন্ন দেব-দেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পৃথিবীতে তাদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী নিয়ে যেসব কাব্য রচিত হয়েছে সেগুলোই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত। দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক এই মঙ্গলকাব্যের সূত্রপাত পনের শতকে। তবে ষোল শতকে এর সর্বাধিক প্রসার হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধির পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়। এছাড়া শাক্ত পদাবলী, নাথসাহিত্য, বাউল ও অন্যান্য লোকসঙ্গীত, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা ইত্যাদি অমূল্য সাহিত্যও এই সময়কালের সৃষ্টি।
হিন্দু-বাঙালি ও মুসলমান-বাঙালি, এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষজনই মঙ্গলকাব্যের রচয়িতা। একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত। বাসও করতেন একই সঙ্গে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তার স্পষ্ট উল্লেখ। প্রধান চরিত্র দরিদ্র কালকেতু, দেবী চণ্ডীর বরে প্রভূত ধনসম্পদ লাভ করে যখন নগর পত্তন করেন, সেই নগর-পরিকল্পনায়,
বাম ভাগে দুর্গা মেলা, তার কাছে নাটশালা
সিংহদ্বার পূর্ব্বে জলাশয়।
খিড়কি উত্তর ভাগে, জলটুঙ্গি তার আগে,
প্রতি বাড়ী কূপের সঞ্চয়।।
পশ্চিমদিগেতে সেহ, তুলিল নমাজ-গৃহ,
দলিজ মসজিদ নানা ছান্দে।
সুধন্যা কোমল, তুলিল রন্ধনশালা,
বিবি চাখে বান্দী তথা রান্ধে।
এবং সেই নগর নির্মাণ করছেন বিশ্বকর্মা। রয়েছেন হনুমান মহাবীর।
মঙ্গলকাব্যের তিনটি প্রধান ঐতিহ্যের মধ্যে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল ছিল অন্যতম। প্রধান চরিত্র, মনসা, চণ্ডী ও ধর্মঠাকুর। এছাড়াও কিছু ছোট ছোট মঙ্গলকাব্য রয়েছে। শিবমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, রায়মঙ্গল, শশীমঙ্গল, শীতলামঙ্গল ও কমলামঙ্গল প্রভৃতি। মনসামঙ্গল ত্রয়োদশ শতকের শেষ থেকে চতুর্দশ শতকের প্রথমে রচনা করেন কানাহরি দত্ত। পরে ১৫ শতকে পদ্মাপুরাণ নাম দিয়ে বিজয় গুপ্ত। এছাড়াও লেখেন আরও কয়েকজন কবি। উল্লেখযোগ্য, কেতকাদাস।
বাংলা লোক সাহিত্যের অপরূপ সম্পদ হল, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলো একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন। সংগ্রহ করেছিলেন, বর্তমান বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা চন্দ্রকুমার দে।
পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্য একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা। ১৯২৬ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাহায্যে পালাগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৭১-১৯৭৫ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক সাত খণ্ডে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রকাশ করেন।
পূর্ব-ময়মনসিংহে সেনরাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের এবং সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রভাব বা আনুগত্য ছিল প্রায় অনুপস্থিত। এই অঞ্চল স্বীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে। রাজারা তাদের রাজত্ব চালাতেন হিন্দু ধর্মের প্রাচীন আদর্শে। সেই হিন্দু ধর্ম ছিল বৌদ্ধ কর্মবাদ ও হিন্দু নিষ্ঠার মিশ্রণ। ব্রাহ্মণের টোলে বেনে ধর্মশাস্ত্র পড়ছে, গন্ধবেনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। যজন যাজন ও যজ্ঞের সময়েই যজ্ঞোপবীতের প্রয়োজন হত, পৈতা ব্রাহ্মণের অপরিহার্য অঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়নি। কোথাও যাওয়ার সময় উত্তরীয় ও উপবীত উভয়ই পোশাকি দ্রব্যের মতো খুঁজে বের করে পরতে হত। কাব্যের নায়ক-নায়িকারা বেনে, বৈশ্য, ব্যাধ, এমনকি ডোম।
ময়মনসিংহ গীতিকায় গৌরীদান প্রথা নেই। এমনকি সতেরো বছর বয়সী মেয়েদের অবিবাহিত দেখা যেত। গীতিকায়, বাংলা ভাষা, সমাজের স্বরূপ। বহু শতাব্দী কাল পাশাপাশি বাস করার জন্য হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। জাতিভেদ নেই। লেখক হিন্দু, মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই। সাহিত্যেও হিন্দু নায়ক, মুসলমান নায়িকা; মুসলমান নায়ক, হিন্দু নায়িকা।
সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও প্রসার এতটাই সমাজ-সম্পৃক্ত হয়েছিল যে, ১৫৭৫-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে এই বাংলায় কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণের প্রচলিত কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে সীতার বয়ানে রচনা করেছেন রামায়ণ। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ। নায়ক সীতা। সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভেতর থেকেই এক নারী রামায়ণ পাঠ করার গোটা দৃষ্টিকোণ বদলে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
আমার দুঃখের কথা গো কহিতে কাহিনী।
কহিতে কহিতে উঠে গো জ্বলন্ত আগুনী।।
জনম-দুঃখিনী সীতা গো দুঃখে গেল কাল।
রামের মতন পতি পাইয়া গো দুঃখেরই কপাল।।
কবি চন্দ্রাবতী নিজেও হয়ে উঠেছিলেন এক কিংবদন্তি। তঁাকে নিয়েও ময়মনসিংহে বঁাধা হয়েছে পালাগান। সমাজ পরিবেশ উদার ও মুক্ত ছিল বলেই এমন কাব্যগাথা রচিত হতে পেরেছিল। ময়মনসিংহ গীতিকায় তাই দেখা মেলে মহুয়া মলুয়াদের।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে শিব-উপাসক সম্প্রদায়ও, যাঁদের ধর্ম ছিল নাথধর্ম। এই সম্প্রদায়ের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতবর্ষে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নাথ অর্থ প্রভু, দীক্ষালাভের পর নামের সাথে তারা ‘নাথ’ শব্দটি যোগ করত। বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের সমন্বয়ে এ ধর্ম গড়ে ওঠে। এই নাথপন্থা, বৌদ্ধ মহাযান আর শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবিদ্যা ও অজ্ঞান থেকে মুক্তির জন্য এবং মহাজ্ঞান লাভ করাই নাথগণের লক্ষ্য ছিল। নাথধর্মের অতীন্দ্রিয়তাবাদের প্রভাব দেখা যায় পরবর্তীকালে বাউল দেহতত্ত্বে।
আরাকান রাজসভার অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩)। কাব্য রচনা করেছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষায়। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। পারদর্শী ছিলেন প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা, প্রায় সবকিছুই। এই মানুষটি, আলাওল, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিল তঁার রচিত সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
বাউল মতবাদের উপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যই হল বাউল সাহিত্য। সহজিয়া সাধনার বাউল। ভিন্নধর্মী, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, বেশির ভাগই নিরক্ষর। তাদের কথায় সহজপন্থী। পিছনে কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চান না। নদীতে যখন স্রোত, সে তো কোনো দাগ রেখে যায় না। যারা নিজেদের ছোট ছোট প্রয়োজনে কাদার উপর দিয়ে নৌকো নিয়ে টানাটানি করে, তারাই লম্বা আঁচড় রেখে যায় পেছনে। এটা সহজ পথ নয়। ভক্তদের জীবনের মধ্য দিয়ে যে ভক্তিরসের স্রোত বয়ে চলেছে তাতে নিজের ভক্তিরসের ধারাকে মিশিয়ে দিয়ে চলাই আসল কাজ। বাউল ভক্তরা হিন্দু ও মুসলমান সমাজের নিম্নবর্গ থেকে আসা। দেহতত্ত্বের সাধনা।
বাউল সাধকদের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন জগন্মোহন গোসাঁই ও লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। এছাড়াও বাউল গীতিকারদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় প্রায় সব সম্প্রদায়ের মানুষজন - জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই, পাগলা কানাই, শীতলং সাঁই, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, আরকুন শাহ্, সিতালং ফকির, সৈয়দ শাহ্ নূর, শাহ আব্দুল করিম, চান খাঁ পাঠান প্রমুখ। তাদের মাধ্যমেই বাউল মতবাদ বা বাউল সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলার লোক সাহিত্য, লোক সাহিত্যের প্রচলিত সব শাখায় বিস্তৃত। গল্প, ছড়া, ডাক ও খনার বচন, সংগীত, ধাঁধা, প্রবাদ বাক্য, কুসংস্কার ও মিথ। লোকগীতি বাংলা লোক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলার সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। লোকগানে বিভিন্ন শাখা, বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান, ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।
বাংলার লোকসঙ্গীত ধারার বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ বাংলা সঙ্গীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। পরবর্তী দেড়শো বছরে শতাধিক কবি ও সঙ্গীতকার এই সুরে গান রচনা করেছিলেন। তার কাব্য ছিল ‘মধুর, আটপৌরে ও অসংস্কৃত’।
রামপ্রসাদের গান রামপ্রসাদী। তৎকালীন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে এই কালীভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তার গানেও এই সকল ঘটনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই কারণে, তার জীবদ্দশাতেই গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
শাক্তপদাবলী হল কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণির সঙ্গীত শাক্তপদাবলীর একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শাক্তপদাবলীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে। এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকুতি শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সমাজজীবন ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই পদাবলির অধ্যাত্মতত্ত্ব শেষাবধি পর্যবসিত হয়েছে এক জীবনমুখী কাব্যে।
শাক্তপদাবলী ধারাটি বিকাশলাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময় বাংলায় বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তার একটা কারণ দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সতীরূপের শক্তিপীঠগুলির অনেকগুলিই এই বাংলায়। সেই শক্তিপীঠগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে এসেছে শক্তিসাধনা। তারই ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত হয় শাক্তসাহিত্য। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং তার পরেই কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য হলেও পদকর্তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি একে ‘ধর্মেই ধর্মের শেষ’ বলে মনে করেননি। গবেষক ক্ষেত্রগুপ্তের কথায়, ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের চৌহদ্দীতে যে কবি-সম্প্রদায় গড়ে ওঠে তাঁদের সৃষ্টিতে রূপময় জগতের গন্ধ-রস-প্রাণ লেগেছিল, কারণ তাঁদের দর্শন জীবন আর জগৎকে নস্যাৎ করে দেয়নি; তাকে শাশ্বত না বললেও মায়া বলেনি, ভ্রান্তি বলেনি; …’। চর্যাকারগণ যেখানে জগৎ-জীবনকে মায়া-ভ্রান্তিরূপে চিত্রিত করেছেন, সেখানে পদাবলী সাহিত্যে, জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করার আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। বৈষ্ণবীয় প্রেমকথায় তারই আহ্বান;
পিরীতি পিরীতি সব জন কহে / পীরিতি সহজ কথা
বিরিখের ফল নহে পিরীতি / নাহি মিলে যথা তথা।।
পিরীতি অন্তরে পিরীতি মন্তরে, / পিরীতি সাধল যে।
পিরীতি রতন লভিল যে জন। / বড় ভাগ্যবান সে।।
পিরীতি লাগিয়া আপন ভুলিয়া / পরেতে মিশিতে পারে।
পরকে আপন করিতে পারিলে / পিরীতি মিলয়ে তারে।।
‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’ - জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষকে মনুষ্যত্বের উদারলোকে আহ্বান করেছিল বৈষ্ণবরা। তাদের সাধন-ভজন মানুষকে নিয়ে এবং মানুষেরই জন্য। মানবকেন্দ্রিকতা এর অনন্য গুণ। তাই পদাবলীতে বৈষ্ণবীয়তার আড়ালে মানুষ এবং মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের চিত্রই বারবার অঙ্কিত হয়েছে। মধ্যযুগের ধর্ম-সম্পৃক্ত মানস কাঠামোয় প্রতিফলিত মানব-মাহাত্ম্যই।
বাংলার এই ৬০০ বছরের গোটা পর্যায় জুড়ে জাতি বর্ণ ধর্ম সম্প্রদায় নিির্বশেষে এক সমন্বয়ী ধারার বিকাশ ও বিস্তৃতি। অনাহার, দারিদ্র্যর ঘরেও সুজলা সুফলা গ্রাম বাংলার যে শান্তির প্রতিচ্ছবি সেটিই আসল ‘সোনার বাংলা’।
চার
ইংরেজ এল ভারতে। পলাশীর যুদ্ধের পর লুঠ হ’ল মুর্শিদাবাদ রাজকোষ-রাজপ্রাসাদ। সরকার দেউলিয়া। নবাব হতে চেয়ে, ইংরেজদের দাবি অনুযায়ী ঘুষ জোগাড় করতে, মীরজাফর ও মীরকাসিম রাজস্ব বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণ। মুর্শিদকুলি খঁার আমলের চেয়ে বত্রিশগুণ বেশি কর ও খাজনা। মোগল শাসনে খাজনা ছিল কৃষিপণ্য উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের স্বত্ব নেওয়ার পর খাজনা বাড়ে ৫০ ভাগ। সঙ্গে সঙ্গে জমিদারেরাও, প্রান্তিক হিন্দু-মুসলিম প্রজা ও রায়তদের উপর বহুগুণে খাজনা বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত রাজস্ব ও খাজনার চাপে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে কৃষক-কারিগর। খাজনা আদায়ের ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্য ইংরেজরা পরগণা নিলামে চড়াতে শুরু করে। কিনতে থাকে নব্য বিত্তশালী মূলত হিন্দু-বাঙালি জমিদারেরা। ১৬৬০ পরগণার মধ্যে ১০০০ পরগণাই হিন্দু-বাঙালি ধনপতিদের হাতে চলে যায়।
সেসময় বাংলা থেকে কৃষিজ ও প্রাণিজ পণ্য বাদে শুধু মসলিন, রেশম, মোটা সুতি বস্ত্র, রেশমী বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানী করেই বছরে দশ-বারো হাজার কোটি টাকা আয় হ’ত। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, কিশোর মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হ’ত এই বস্ত্রশিল্পে। এছাড়া ইউরোপে সল্টপিটার, ইষ্ট ইণ্ডিজে চাল, চীন ও জাপানে আফিম, আরব, ইরাক ও ইরানে লাল চিনি, মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে মরিচ, আদা, দারুচিনি রপ্তানী হ’ত। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা শুধু বাংলা থেকেই হ’ত।
ক্ষমতায় এসে বৈদেশিক বাণিজ্যে অন্য বিদেশী বণিকদের বাংলা ছাড়া করে দেয় ইংরেজ। রেশম, মসলিন, সুতি কাপড়, চিনি, চাল, আফিম, সল্টপিটার প্রভৃতি পণ্যরপ্তানীর ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। একবার বাজার কুক্ষিগত করেই পণ্যের সংগ্রহ-মূল্য অস্বাভাবিক রকম কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ১৭৬৪-১৭৬৫ সালে বাজার চলতি রুপোর সিক্কা বাতিল ঘোষণা করে নতুন সিক্কার প্রচলন করে। সমস্ত স্থানীয় ব্যবসা কার্যত বন্ধ, বাজার অর্থশূন্য। এছাড়া খাদ্যশস্য উৎপাদন হ’ত যেসব জমিতে, সেখানে জোর করে অত্যধিক লাভজনক ব্যবসাপণ্য আফিম ও নীল চাষ করানোর কারণে অনেক জমি ঊর্বরতা হারিয়ে ফেলে। আফিম যেত চীন-জাপানে, আর ইউরোপে সেই সময় শিল্প বিপ্লব ঘটায় তুঙ্গে ছিল নীলের চাহিদা।
অত্যাচার-নিপীড়ন আর আর্থিক মন্দার কারণে চাষীরা এমনিই চাষ ছেড়ে দিয়েছিল, এর মধ্যে অনাবৃষ্টি আর খরায় ফসল এসেছিল কমে। দেশব্যাপী শুরু হয় অরাজকতা। স্বাভাবিক উৎপাদন হার কমে এলে জমিদারেরা গোমস্তা, দালাল ও ফড়িয়াদের দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে আড়ৎ-গদি খোলায়। অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে উৎপাদন বজায় রাখতে বাধ্য করে। দারোগা, শিকদার, পাইক নামিয়ে জোর করে প্রজাদের দাদন নিতে বাধ্য করত। বাধ্য করত, চাবুক মেরে কম দামে কাপড়, লবণ ও অন্যান্য উৎপাদন-সামগ্রী বিক্রি করতে। অবাধ ও প্রতিযোগিতামুলক একটি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ইংরেজরা এক দাসত্বমূলক নারকীয় যজ্ঞে পরিণত করে।
এমন অবস্থায় ১৭৭০ সালের মাঘ মাসে সারা দেশে ধান কিনে গুদামজাত করা শুরু হলে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) এই মহাদুর্ভিক্ষ ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। বলা ভাল ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৩ সময়কাল জুড়ে এই দুর্ভিক্ষে মারা যান অন্ততপক্ষে ১ কোটি মানুষ। সেই সময়ের বাংলার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ১৭৭১ সালে দুর্ভিক্ষ চলাকালীনও খাজনা বেড়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষকদের বাধ্য করেছিল নীল, পোস্ত ইত্যাদি ক্যাশ ক্রপ উৎপাদনে। ধান নয়। ঘরে, ক্ষেতে কোথাও অন্ন ছিল না। আর একটি বড়সড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সে দশকেই, ১৭৮৩-এ।
উইলিয়াম ডগবির হিসাব থেকে জানা যায়, ১৭৯৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ১০৭ বছরের সময়কালে সারা পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের কারণে মারা গেছে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ। আর ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষে মারা গেছে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ! ১৭৭০ থেকে ১৯০০ - এই ১৩০ বছরে মারা গেছে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। ১৮৬০ সাল থেকে মৃত্যু খাদ্যের অভাবজনিত কারণে নয়, খাদ্যের দাম ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ওড়িশায় ১৫ লক্ষ মানুষ যখন খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে,তখন এই ভারতের বন্দর থেকেই ২০ কোটি টন চাল ব্রিটেনের জন্য জাহাজ বোঝাই হচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত বড়মাপের দুর্ভিক্ষের তালিকা করা হলে রীতিমত চমকে উঠতে হয়। তবু ‘ভদ্র’, ‘সভ্য’ ‘সংস্কৃত’ নাগরিক বাঙালিসমাজ ‘মাস্টারমশায়, আপনি কিছু দেখেননি’তে প্রায় অবিচলিত থেকেছে। প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই সময়কালে প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে, কৃষক বিদ্রোহের স্বরূপ সন্ধান। সে ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ' (১৭৬০-১৮০০) হোক, বা ১৭৯৯ সালের ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’, বা ১৮৩১-৩২-এর ‘সঁাওতাল বিদ্রোহ’, এমনকি ১৮৫৭-র ‘সিপাহি অভ্যুত্থান’ যা পরবর্তীকালে চিহ্নিত ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’।
ব্রিটিশ-রাজ প্রতিটি বিদ্রোহ দমনে অমানবিক নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছিল। দাপট দেখিয়েছিল তার অস্ত্রসম্ভারের। আর দুর্ভিক্ষকালে মানুষজনের কোনো সুবিধা দেওয়ার বদলে জানিয়েছিল তত্ত্বকথা। মূলত তিনটি তত্ত্ব। প্রথমটি হচ্ছে, মুক্ত বাণিজ্য নীতি যেখানে বাজার ক্ষমতার উপরে সরকার কোনভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ম্যালথুসিয়ান নীতি – যেখানে ভূমির অনুপাতে জনসংখ্যা অতিরিক্ত হলে ‘প্রকৃতি’ অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে মৃত্যুপথে ঠেলে দেয় এবং ‘ভারসাম্য’ ফিরিয়ে আনে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, যে কাজের জন্য সরকার বাজেট করেনি, সে কাজে সরকার অর্থব্যয়ে প্রস্তুত নয়। অন্তর্বেদন-কথা, এই সময়কাল জুড়ে কলকাতাকেিন্দ্রক বাংলায় যে আলোড়নকারী সমাজ-সংস্কার মূলক বুদ্ধি-যুক্তি-চেতনা উন্মেষকারী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার অন্তর্নিহিতে এই বাস্তবতাজনিত প্রতিঘাত প্রায় অনুপস্থিত!
পাঁচ
প্রাক ব্রিটিশ পর্বেও বাংলায় বড় বড় দুর্ভিক্ষের প্রমাণ আছে। মহাস্থানগড়ের লিপিতে প্রাচীন এক দুর্ভিক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়, সেই দুর্ভিক্ষে পুণ্ড্রনগরের মহাজাতককে ত্রাণ সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে দেখা যায়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরের অস্থির সময়ে বাংলায় আরেকটি দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায় ইতিহােসর পাতায়। আর তৃতীয় আরেকটি দেখা যায় ১৬৬১ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে।
অন্যসময়েও বাংলায় খাদ্যাভাব ছিল না, এমন নয়। মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রধান কবি ছিলেন ভারতচন্দ্র। অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।
ময়মনসিংহ গীতিকার কবি চন্দ্রাবতী রচিত দস্যু কেনারাম পালায়, দুর্ভিক্ষের বিবরণের সঙ্গে আছে মানুষ কেনাবেচাও।
গরুবাছুর বেচিয়া খাইল খাইল হালিধান।
স্ত্রী পুত্র বেচে নাহি গো গণে কুলমান।
পরমাদ ভাবিল মাতুল কেমনে বাচে প্রাণ।
কেনারামে বেচল লইয়া পাঁচ কাঠা ধান।।
চর্যাপদেও অনাহারের নিদর্শন আছে,
‘টালিতে মোর ঘর নাই পড়িবেশি
হঁাড়িতে মোড় ভাত নাহি নিতি আবেশি’।
যার অর্থ দঁাড়ায় টিলাতে আমার ঘর, প্রতিবেশি নেই। হঁাড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত।
দুর্ভিক্ষের কথা আছে চৈতন্যমঙ্গলেও।
অনাহার আর দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি বাংলায় দাসপ্রথাও ছিল। বাবা-মা সন্তান বিক্রি করে দিচ্ছেন এমনও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ‘চৈতন্য চরণামৃতে’।
‘নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে
কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্রে জানে’।
দাসদের বিক্রয়মূল্যের দলিল দস্তাবেজের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের দামও তুলনামূলক কম। ইবনবতুতা নিজেই আড়াই দিনারে ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলেন, বাজারে কম দামে প্রচুর দাস-দাসী বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। অনাহার আর দুর্ভিক্ষ কিংবা ঋণের কারণে নিজেকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও পাওয়া যায় সেই সব রেকর্ডে। এবং বড়সড় দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে খাদ্য সংকটের ঘটনা খুব দুর্লভ ছিল না।
বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধ শিল্প মসলিনের কথায় যদি আসা যায় সেখানেও তঁাতিদের মজুরী ছিল অস্বাভাবিক রকমের কম। মজুরীর অর্থে জীবন নির্বাহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে শ্রমিকদের, পেটের দায়ে অন্য পেশায় চলে যায় অনেকেই। যে পণ্যের জন্য বাংলার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, সেই শিল্পে মজুরীর এমন দুর্দশা হলে অন্যান্য শিল্পে কী ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
তবু এই বাংলার নামের সাথেই জড়িয়ে আছে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ। সত্যিকার সোনার খনি না থাকলেও এখানে আছে নদী নালা বেষ্টিত নরম মাটি। এমন উর্বর মাটিতে বীজ পুঁতে দিলে মাটি প্রতিদান দেয় বুকভরে। তবে বাঙালির মাটিতে এমন জাদু থাকার পরেও অর্থনৈতিক দারিদ্র্য বাঙালির পিছু ছাড়েনি। বরং চাপা পড়ে থাকা পাতায় দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর খাদ্য সংকটের মতো সমস্যায় জর্জরিত বাংলার ইতিহাস। এতদসত্ত্বেও বাংলায় ছিল এক সদ্ভাব-সম্প্রীতি-বিশ্বাসের এক সমাজ-চিত্র। এমনকি সমৃদ্ধিরও।
ব্রিটিশ আসার আগে খাদ্য-সংকটের সময়ে ভারতীয় শাসকেরা করছাড়, খাদ্যের দাম বেঁধে দেওয়া বা মন্দা-পীড়িত অঞ্চল থেকে খাদ্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। স্থানীয় জমিদার ও অবস্থাসম্পন্ন বণিকেরা কাজের যোগান দিয়ে, লঙ্গরখানা বা ভর্তুকি দিয়ে কম দামে খাদ্য সরবরাহ করে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয়দের এমন দানের প্রথাকে বিরক্তির চোখে দেখত। তারা মনে করত, দান-খয়রাতের সংস্কৃতি দরিদ্রদের হাতপাতার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। ব্রিটিশ শাসকেরা সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যেও দুইটি ভিন্ন ক্যাটাগরি তৈরি করেন। একটি হচ্ছে ‘অভাবগ্রস্ত দরিদ্র’ এবং অন্যটি ‘ধর্মীয় ভিক্ষুক’। ভারতের মানুষ কখনই সাহায্যপ্রার্থীদের কোন ক্যাটাগরিতেতে ভাগ করেনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুষ্ঠিচাল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করা কিংবা ধনী অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দান-দক্ষিণা নিয়ে সাধু-ফকির-দরবেশদের জীবনযাপন এদেশে স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হ’ত। কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতীয় এই রীতিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। বহু ব্রিটিশ এই দেশ থেকে সারা জীবন নবাবের মত চলার সম্পদ সংগ্রহ করে গিয়েছিল, কিন্তু দাতব্য কিছু (যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ বা দীঘি-কূপ খনন) করার কথা ভাবেনি, যেটা এখানকার বিত্তশালীদের সহজাত ছিল।
একদা বাংলা ছিল ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অঞ্চল। রূপো ও অন্যান্য দামী ধাতুর বিনিময়ে পণ্য কিনতে হতো বিদেশীদের। বৃহত্তর বাংলার ত্রিহুত থেকে নাটোর পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫৫ হাজার গ্রামে প্রায় ১ লক্ষ পাঠশালা-মাদ্রাসা চালু ছিল। গ্রামের মানুষের সম্বল সহযোগিতায় চলত শিক্ষাব্যবস্থা। অভদ্র ছাত্র-শিক্ষক, উচ্চবর্ণের গুরু খুব বেশি হলেও শতকরা ১৫ জনের বেশি নয়, মেয়েদেরও পাঠশালা ছিল, জমিদারেরা ছিলেন কৃষক ও কারিগর পালক, অর্থনীতি ছিল বিকেন্দ্রীভূত। (দ্য গোেল্ডন ট্রি, তৃতীয় খণ্ড, ধর্মপাল)। Teresa Hayter, The Creation of World Poverty (Pluto 1990, 2nd edition) গ্রন্থে বলছেন, ১৭৭০-এ ব্রিটেনের মোট জাতীয় আয় ছিল ১২৫ মিলিয়ন ডলার মাত্র। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত সময়ে প্রথমে বাংলা পরে ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকেই সে লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে ১০০০ মিলিয়ন ডলার। সব থেকে বেশি ধনসম্বল লুঠ হয়েছে বাংলা-বিহারের। কোনও কোনও বছরে শুধু কোম্পানি ঘুষ নিয়েছে ১ মিলিয়ন ডলার। "The arrival of the Bengal loot in London soon after (the Battle of Plassey 1757) coincided with the beginning of the industrial revolution in Britain. It has been estimated that the total British plunder of India between 1757 and 1815 amounted to £1000 million; the national income of Britain in 1770 was about £125 million. Direct tribute payments alone through the EIC approximated £1 million in some years.
"The British subsequently proceeded to destroy the industrial economy of India itself. Between 1815 and 1832 the value of Indian cotton goods exported fell from £1.3 million to below £100,000. BY the middle of the 19th century, India was importing a quarter of all British cotton goods.
"The Indian weavers suffered great hardship. Sir Charles Trevelyan declared to a parliamentary inquiry in 1840: "Dacca which used to be the Manchester of India has fallen from a flourishing town to a very poor one. “A governor-general of the EIC wrote in 1835: "The bones of the weavers are bleaching the plains of India." (বিেশ্বন্দু নন্দ লিখিত পাঠ থেকে সংগৃহীত)।
ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের খ্যাতি ছড়িয়ে গেল বিশ্বজুড়ে। শুধু মানী-গুণী-সমাজতাত্ত্বিকদের ভাষ্যে প্রায় অনুল্লেখিত থেকে গেল যে শিল্পবিপ্লবের অন্যতম আর্থিক যোগান গেছে বাংলাকে লুঠ করে, বাংলাকে নিংড়ে নিয়ে, লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে। পলাশী পরবর্তী মাত্র প্রথম ১৩ বছর শাসনে পৃথিবীর তৎকালীন সমৃদ্ধ একটি জনপদ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যেভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তা নেহাতই ব্রিটিশ-শাসকের দস্যুবৃত্তির ফল।
ছয়
পশ্চিমী জ্ঞানচর্চার জগতে পঞ্চদশ শতাব্দী অব্দি দার্শনিক ভিত্তি ছিল জৈব বিশ্ববীক্ষা। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল এক জ্ঞান জগৎ। ভিত্তি ছিল, অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদ এবং খ্রিস্টীয় ধর্মচিন্তা ও নীতিবোধ। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এলেন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন। বিশ্বকে দেখার দুটি পদ্ধতি পাওয়া গেল সপ্তদশ শতাব্দীতে। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) পদ্ধতি হিসেবে আরোহী প্রণালী নির্ভর (Inductive method) নীচ থেকে ওপরে, পরীক্ষা – পর্যবেক্ষণ – সিদ্ধান্ত। অভিজ্ঞতা নির্ভর। সত্য সম্ভাব্য। দেকার্তে (১৬০০-১৬৫০) নিয়ে এলেন অবরোহী তাত্ত্বিক কাঠামো (Deductive method)। ওপর থেকে নীচে। সত্য সার্বিক, অভ্রান্ত। নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) দেখালেন দুইটি বলের (Force) সংঘাতে গতিশীল বস্তুর গতিপথ ও গতি অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করা যায়। প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। ইংল্যান্ডে বুদ্ধিচর্চার জগৎ তখন সমৃদ্ধ। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। প্রাকৃতিক নির্বাচন, যোগ্যতমের বেঁচে থাকা, আকস্মিক মিউটেশন। যন্ত্রের কাজকর্মের পদ্ধতি রৈখিক। কার্যকারণ সম্পর্ক জটিল। উন্নত কাঠামো জটিল ছাড়াও সর্বদা পরিবর্তনশীল। কান্ট আসছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে। ১৭৮১ সালে Critic of Pure Reason এ যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করছেন অভিজ্ঞতাবাদের বিপরীতে।
জ্ঞানচর্চার এই ইতিহাস বেয়ে অথবা মাড়িয়ে-পিষে কিংবা লুণ্ঠন-উপযোগী দক্ষ ব্যবহারিক প্রয়োগে বৃটিশ-শক্তির লাগাতার ভারত-লুঠ। নির্মিত হয়েছে অথবা নির্মাণ করা হয়েছে বৃটিশ-শক্তির দুটি ভিন্ন চরিত্র, নির্মম লুঠেরা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চাকারী। ব্যক্তি-চরিত্র, জাতি-চরিত্র। কখনো বিপরীতধর্মী কখনও সমন্বয়ী। আলো আঁধারী। এবং দুটি ভিন্ন অবস্থান একত্রে একইসঙ্গে।
ক্লাইভকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া আবার ভারতে পাঠানো, এই দ্বৈত সিদ্ধান্ত তারই সাক্ষ্য বহন করে। পলাশীর যুদ্ধশেষে নবাব হতে পারার দরুন মীরজাফর, ক্লাইভকে ঘুষ হিসাবে ৩০ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হয়। সঙ্গে ২৪ পরগনার জায়গীরদারি যার আয় বছরে ৩ লক্ষ টাকা। ক্লাইভের অনৈতিক ও দুর্বিনীত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ১৭৫৭ সালে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ক্লাইভের অনুপস্থিতিতে বিপর্যস্ত ইংরেজদের ডাকে তাকে আবার ভারতে পাঠানো হয় ১৭৬৫ সালে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। কোম্পানি এই বছরেই দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি আদায় করে। বাংলায় নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব আর রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজরা নিজেদের কাছে রাখে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে বাংলার দেওয়ান হন মুর্শিদকুলি খান। সে সময় বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। কিন্তু ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খান রাজধানী ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। ইংরেজ শাসন আমলে রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যায় কলকাতায়। রাজধানীর উপর নির্ভরশীল ভূস্বামী, ব্যবসায়ী সহ অনেকেই ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় যাওয়া শুরু করে। কৃষিভিত্তিক পূর্ব বাংলার জমিদাররা বেশিরভাগই স্থায়ী নিবাস গড়ে রাজধানী কলকাতায়। আর তাদের প্রতিনিধিরা খাজনার জন্য নির্যাতন চালাত বাংলার, বিশেষভাবে পূর্ববাংলার নিরীহ কৃষকদের উপরে। কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার মূল কেন্দ্র। কলকাতা শুধু বাংলা প্রদেশ নয় বরং পুরো ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী ছিল। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ব বাংলার কঁাচামাল দিয়ে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকে কলকাতা এবং আশপাশের অঞ্চলে। কলকাতা আহ্লাদিনী হ’ল। কলকাতা কল্লোলিনী হ’ল।
শিল্পবিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের বাজার তখন বাংলা। খাদ্য শস্য উৎপাদন কমিয়ে কৃষকদের বিভিন্নভাবে বাধ্য করা হ’ল ইংল্যান্ডের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে। কৃষিপণ্যের এই বাজার শুধু ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামালই যোগাল না, কলকাতার ব্রিটিশ-শাসন নির্ভর ‘বাবু’ শ্রেণির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও সূচনা করল। ‘ভদ্র’ শ্রেণির বঙ্গ-সংস্কৃতির এক নতুন নির্মাণেরও শুরু সেই সময়। শুরু সংস্কার আন্দোলনেরও। বাংলার সমাজ পুনর্গঠনে যার প্রভাব হ’ল সুদূরপ্রসারী।
মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ব্রিটিশ শক্তি/ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই সময় আইন-আদালত বা সরকারি অনেক দপ্তরেই কাজকর্ম ফার্সি ভাষাতেই চালু রেখেছিল। এমনকি হেস্টিংসের উদ্যোগে কোম্পানির আর্থিক আনুকুল্যে ১৭৮১ সালে আরবি-ফারসি ভাষা শেখার জন্য ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ও প্রতিষ্ঠা করেন। পরে হিন্দুদের জন্য ভারততত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি।
স্পেনের রানি ইসাবেলার কাছে কলম্বাসের মতই বা তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ছিলেন আন্তোনিও দ্য নেব্রিহা। তিনি জমা দিয়েছিলেন একটি ব্যাকরণ বইয়ের প্রকল্প। বই পড়ে প্রজারা যেন রানীর হুকুমের ভাষা বুঝতে পারে, উত্তর দিতে পারে সেই ভাষাতেই। একই প্রয়োজন কোম্পানির। কোম্পানির প্রয়োজন, ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের স্থানীয় এজেন্ট, যারা উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কোম্পানির যোগাযোগ রাখবে। এজেন্টদের জানা দরকার অন্তত কাজ চালানো ইংরেজি ভাষা। জানা দরকার কোম্পানির হুকুমের ভাষা। জানা দরকার এজেন্টদের ‘উত্তর দেওয়ার আদব-কায়দা’।
ব্রিটিশ বিশ্বাস করতে পারেনি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে। এক, দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে চলা জেরুজালেম দখলের ‘খ্রিস্টান-মুসলমান সংঘর্ষের’ ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড-স্মৃতি এবং দুই, মুসলমান শাসকদের হাত থেকে সদ্য সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ায় আহত ও ক্রুদ্ধ ধর্মীয় অনুগত মুসলমান সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান বিরোধিতা।
এজেন্ট দরকার হয়ে পড়ল মুখ্যত হিন্দু সমাজ থেকে। আবার হিন্দু সমাজ থেকেও দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ দেশীয় অভিজাতদেরও দাবি ছিল, ইংরাজি শেখার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ১৮১৭ সালে গড়ে উঠল হিন্দু সমাজপতিদের উদ্যোগে ‘হিন্দু কলেজ’। নিষিদ্ধ, ‘অ-হিন্দু’দের প্রবেশাধিকার।
কোম্পানির প্রয়োজন এক অনুকূল জনগোষ্ঠীর আনুগত্য। সুতরাং, ১৮২৪ সালে কোম্পানির উদ্যোগে বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য সমাজের সংস্কৃত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো, ‘সংস্কৃত কলেজ’। ১৮৩৫ সালে মেকলে জানালেন তাঁর পরিকল্পনা-কথা, শিক্ষার যাবতীয় উদ্দেশ্য-কথা, সার কথা। ‘We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern - a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.’
সে সময়কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট হওয়া ছিল অনেক লোভনীয়। সে দালাল আহ্লাদিনী। রোজগারের টাকায় কলকাতা তখন কল্লোলিনী।
‘এই সব বলিরেখা খুঁড়ে তুমি খোঁজো
সভ্যতার আলো।
এ যদি সভ্যতা হয় অসভ্যতা কাকে বলি বলো?’
সাত
শাসক, তার শাসনাধীন জনজাতিকে অধীনস্থ রাখার জন্যে, এক, একাধিক, যত পরিকল্পনাই গ্রহণ করুক না কেন, শাসিত মানুষজন তার মধ্য দিয়েও নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারার ব্যাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে বাংলায়ও দেখা যায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার। শুরু মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) সময় থেকে। গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ। একই সঙ্গে বাংলার শ্রীময়ী মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে, ভিন্ন এক নগরকেন্দ্রিক শিকড়বিহীন সংস্কৃতির সূচনা।
ব্রিটিশ প্রভাবিত জ্ঞানচর্চায় বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবন ও বিশ্বাসের নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক নগর-জীবনকে সবিশেষ প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং আরও উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু হয়। মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত ইউরোপীয় জ্ঞান (বিশেষ করে, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য)। এই নতুন ভাবাদর্শগত চেতনা রূপ পায় রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও তার অনুগামীবৃন্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুসারীরা, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গদের কর্মোদ্যমে। এঁরা ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭), জেরেমি বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯), অগুস্ত কোঁত (১৭৯৮-১৮৫৭), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) ও জন স্টুয়ার্ট মিল-এর (১৬০৬-৭৩) মতো পাশ্চাত্যের আরও অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ ও মনীষীর গুণগ্রাহী ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবোধ। বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল (প্রতিষ্ঠিত, ১৭৮৪), শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ (১৮৩৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৮৫৭) মতো প্রতিষ্ঠান।
বাংলার নতুন চিন্তাচেতনায় ওই সময়ে বহু সংখ্যক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সমিতি, সমাজ-সংগঠন। এরই ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত আধুনিক বাংলা গদ্যের সৌধ গড়ে তোলেন। কাব্য ও নাটকে প্রতিমা-পূজা বিরোধী এবং ভাবের দিক থেকে ডিরোজিওপন্থী মাইকেল মধুসূদন দত্ত রীতি ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দ, চতুর্দশপদী বা সনেট, ব্যক্তিবাদ, জড়পার্থিবতা, নাটকে তীক্ষ্ম, তীব্র সংঘাতের উপাদানের প্রবর্তন করেন। সাহিত্য পরিমণ্ডলের কথা ছেড়ে দিলেও বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন মধুসূদন গুপ্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার, জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রমেশচন্দ্র দত্ত , দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্য। মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন প্রথম হিন্দু যিনি শবব্যবচ্ছেদ করেন। মূল চালিকাশক্তি বা প্রেরণা ছিল যুক্তিবাদ আর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সংস্কার। পরবর্তী সময়কালে প্রাধান্য ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী জাতীয়তাবোধের।
হেনরি ডিরোজিও, তাঁর অনুসারীদের মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তানুশীলনে অনুপ্রাণিত করেন। এঁরা ছিলেন টমাস পেইন-এর এজ অব দ্য রিজনস ও রাইটস অব ম্যান-এর অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। এঁরা সম্মিলিতভাবে ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা কমপক্ষে ছয়টি সাময়িকীর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। পার্থিনন (১৮৩০), ইস্ট ইন্ডিয়া (১৮৩১), ইনকুয়্যারার (১৮৩১-৩৪), জ্ঞানাম্বেষণ (১৮৩১-৪০), হিন্দু পাইওনিয়ার (১৮৩৫-৪০) ও বেঙ্গল স্পেক্টেটর (১৮৪২-৪৩)। প্রথম কয়েক বছর তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সনাতন হিন্দুধর্মীয় মতবাদের অসার চিন্তাধারা। পরবর্তীকালে ইয়ং বেঙ্গল চিন্তাধারার অনুসারীরা ঔপনিবেশিক সরকারের নানা ব্যর্থতার দিকেই লক্ষ্য দেয়। রামমোহন ও তার অনুসারীদের আধ্যাত্মিকতা নয়, বিশুদ্ধ যুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন এঁরা। ১৮৪০-এর দশকের শেষ দিকে ব্রাহ্ম সমাজ এর অন্যতম নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিজ্ঞানপন্থী অক্ষয়কুমার দত্তের মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থের অভ্রান্ততা প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। বস্তুত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনের আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী হন, আর অক্ষয়কুমার দত্ত অনুপ্রাণিত হন রামমোহনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কতায়। ১৮৫০-এর দশকে এই সংঘাতে আর একটি মাত্রা যুক্ত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অংশগ্রহণে।
বাংলা গদ্য শুরু হয়েছিল সংস্কৃত গদ্যের চালে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ কথ্যরূপী গদ্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করেন। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হল মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের শিশুশিক্ষা, ১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়। মুদ্রিত হল এই দুই পণ্ডিত বন্ধুর যৌথ মালিকানায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ মুদ্রণাগারে। অপরিসীম ছিল এই পুস্তক ও মুদ্রণ যন্ত্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। শুরু শিশুশিক্ষায় বাঙালি-হিন্দুর জীবনবেদ, লেখাপড়া করে যেই/ গাড়িঘোড়া চড়ে সেই।
চ্যুতি ঘটল কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সঙ্গে, বিদ্যা-শিক্ষার। ভেদ বাড়ল গ্রাম-শহরের। উপেক্ষিত হল গ্রাম।
গুণের বিচার, অবস্থার বিচার, অবস্থানের বিচার সব কিছুই ‘গোপালে-রাখালে’ ঊর্দ্ধকমাবেষ্টিত হল। ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, সাদা-কালো। ‘চিহ্নক ও চিহ্নিত’ সবসময়ই ‘বাইনারি ডিভিশন’ আবদ্ধ। শিক্ষা-বিস্তারে, কোম্পানির অতি মনোযোগ মুসলমান-বাঙালি সমাজকে, কোম্পানি ও অভিজাত হিন্দু সমাজের সমীকরণ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলল। মুসলমান-বাঙালি সমাজের আপত্তি ছিল, ইংরেজি শিক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত হল, ‘হিন্দু কলেজ’ নামকরণে এবং সেখানে ‘অ-হিন্দু’দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণায়।
প্রাক-পলাশী সময়কালে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল নিছকই শিক্ষাকেন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ ও নেটিভ সাহেবসুবোদের ইসলাম-বিদ্বেষ, ইসলাম-ধর্মাবলম্বী শাসকদের শাসন-কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান সমাজ সমকালীন স্রোত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে। আত্মপরিচয় খোঁজে ধর্মে। মাদ্রাসা-শিক্ষা পরিবর্তিত হতে থাকল দ্বীনীশিক্ষায়, ধর্মশিক্ষায়। নতুন নতুন জ্ঞানের উন্মেষ থেকে বঞ্চিত হয়ে মসজিদ, ইমাম, মুয়াজ্জিনদের নির্দেশ-ফতোয়ায় পরিচালিত হতে থাকে বিশাল এক জনগোষ্ঠী।
১৯০৩ সালে মীর মসাররফ হোসেন প্রণীত ও ‘কলিকাতা-টালিগঞ্জ হইতে শ্রী মীর ইব্রাহিম হোসেন দ্বারা প্রকাশিত’ মুসলমানের বাংলা শিক্ষা প্রথম ভাগ বইটির আরম্ভ-পাঠে, আল্লা এক/ আল্লা সকলের বড় / আল্লার কোনও দোষ নাই। কোনো বদনাম নাই।
বর্ণপরিচয়ে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর অনুপস্থিত। শিশুশিক্ষায় সনাতন হিন্দু-ধর্মীয় অনুশাসন অনুপস্থিত, অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের পুস্তক শুরুই হচ্ছে আল্লার অস্তিত্ব বর্ণনে। সম্প্রদায়গত বিভাজন না স্বতন্ত্র অস্তিত্বের উদযাপন? কেমন ভাবে নিরূপণ করা হবে যখন বিষাদসিন্ধুর লেখক শ্রদ্ধেয় মীর মোসারফ হোসেন মুসলমানের বাংলা শিক্ষায় লিখবেন, ‘তোমার হাতে কি পুঁথি / আমার হাতে শিশুশিক্ষা’ অনুকরণে ‘তোমার হাতে কি কেতাব / উত্তর দেয় রমজান আমপারা’।
অন্যদিকে বঙ্কিমের সহজ রচনা শিক্ষায়, ‘ইহা স্মরণে রাখিতে হইবে যে ‘শ্রীযুক্ত বাবু’ শিরোনাম এখনকার দিনে কখনও পরিত্যাগ করা যায় না, আবার ‘মুসলমানকে বাবু লেখা নিষিদ্ধ, মুসলমানকে ‘মৌলবি বা মুন্সী’ লিখিতে হয়। নামের পর সাহেব লিখিতে হয়।’ ব্রাহ্মণ কন্যারা সকলেই নিজের নামের পর দেবী লিখিতে পারেন, শূদ্র কন্যাদিগকে দাসী লিখিতে হয়। পত্র রচনায় চিঠির একেবারে ওপরে মঙ্গলাচরণ বা স্বস্তিবাচন, হিন্দু হলে শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়, ওঁ, শ্রী, শুভম্ ইত্যাদি আর মুসলমান হলে ‘এলাহি খোদা হাফেজ, এলাহি ভরসা।’ পাঠাভ্যাসে শিশু শিখতে থাকবে তার ধর্মীয় পরিচয়। সনাতন হিন্দু ধর্মীয় শিশুশিক্ষায়, ‘উঠ শিশু মুখ ধোও/ পর নিজ বেশ’ হয়ে উঠবে মুসলমানের বাংলা শিক্ষায়, ‘আল্লার নাম করি সবে ফজরে উঠিবে/ মুখ ধুয়ে ওজু করে নামাজ পড়িবে।’
ভাষাতেও তার প্রতিফলন। বাংলা ভাষা ছিল প্রাকৃতের রূপভেদ। গীতিকাগুলি থেকে বোঝা যায় বাংলা ভাষা সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত হতেই তার উদ্ভব। খাজনা, ইজ্জত, জবরদস্তি, শাওন, আশমান এমন সব বহু বহু আরবী-ফারসী শব্দ দেশীয় রূপ ধারণ করেছিল। টোলের পণ্ডিতেরা অপর্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে ভাষার রূপটিই বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৌলবীরাও বেশি বেশি আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার শুরু করলেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় কথ্য ও লিখিত রূপে বড় ধরনের পার্থক্য এসে গেল। পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক বিভাজন, প্রাতিষ্ঠানিক-ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভাষাগত এই ভিন্নতাও খুব সম্ভব প্রভাব ফেলেছিল। বিভাজন অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে স্পষ্টতর হতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ শাসনকালে।
আট
ইতিমধ্যে ১৮৫৩ সালে রেলগাড়ি। ১৮৫৭’য় (২৪ জানুয়ারি) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ট কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পশ্চিমী ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার কাজের বিস্তৃতি ছিল লাহোর থেকে রেঙ্গুন সিংহল। প্রথম আচার্য, লর্ড ক্যানিং ও উপাচার্য, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল। ১৮৫৮ সালের প্রথম দু’জন স্নাতক, যদুনাথ বোস ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘বেথুন স্কুল’ (ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল) স্থাপিত হয়েছে আগেই, ১৮৪৯। বছর ২০-র মধ্যেই স্কুলে ছাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। অভিভাবকদের উদ্দীপনা িস্তমিত। অথচ ১৮৯৩ সালে ৩০ জন ছাত্রীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মহাকালী পাঠশালার ছাত্রীসংখ্যা ১৯০৩ সালে ৪৫০। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাত্রী মাতাজী মহারাণী তপস্বিনীর শিক্ষাদর্শে পাঠ্যসূচিতে সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি, ইত্যাদি। এই শিক্ষাদর্শ কলকাতা সমাজে যথেষ্ট আদৃত। নারী শিক্ষা প্রয়োজনীয় বোধ করেও পশ্চিমী ভাবাদর্শে গঠিত বেথুন স্কুল হারাচ্ছে শিক্ষার্থী আর অন্যদিকে পাঠ্যসূচিতে সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি, ইত্যাদি যুক্ত থাকার কারণে অভিভাবকেরা পছন্দ করছেন মহাকালী পাঠশালা। জাতীয়তাবোধ হিন্দু-জাতীয়তাবোধে নবনির্মিত।
অক্ষয়কুমার দত্ত যুক্তিবাদ, বস্তুনিষ্ঠতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস বিশ্লেষণে উদ্যোগী হন। বিদ্যাসাগর অজ্ঞেয়তাবাদী থেকে যান এবং তার সফল হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলনের (১৮৫৫-৫৬) ফলে ১৮৫৬ সালে প্রণীত আইনের (যা হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহকে বৈধ করে) পরে তিনি ষাটের দশকে কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আরও একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ ক্ষেত্রে এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও তাঁর প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। এই পর্যায়ে অসহযোগিতা ছিল ইংরেজ সরকারেরও। যুক্তিবাদীরা তখন থেকে পরাধীনতা ও আধিপত্যের বিষয়টির প্রতি নীরব থাকতে পারেন নি। কালো আইন পাস (আদালতের ভারতীয় বিচারকগণ, শ্বেতাঙ্গ বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে পারতেন না, এ বৈষম্যমূলক রীতি অবসানের জন্য ওই সময়ে এক আইনের প্রস্তাব করা হয়) সংক্রান্ত বিতর্ক, সিপাহি বিপ্লব (১৮৫৭-৫৮) ও নীলবিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) মতো ঘটনাপ্রবাহ চিন্তাশীল বাঙালি মানসকে জাতীয়তাবাদী পথে পরিচালিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় হরিশচন্দ্র মুখার্জির নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ বা নীলবিদ্রোহ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক (১৮৬০) ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের নীলদর্পনের ইংরেজি অনুবাদ, ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত পাবনার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে রমেশচন্দ্র সেনের ‘বাংলার কৃষক বিদ্রোহ’, ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’-র পটভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীরের (১৭৮২ – ১৮৩১) ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন নিয়ে ১৮৩১-এর ১৩ নভেম্বরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘বঁাশের কেল্লা’র স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠা বা এই ধরনের আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী।
ষাটের দশকে হিন্দু মেলা (১৮৬৭-৮১) ও ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ (১৮৭২) শীর্ষক আলোচনাসভার মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবোধ নতুন মাত্রা পায়। চিরায়ত হিন্দু রচনাগুলির আলোচনা-পর্যালোচনা-মূল্যায়ণ এবং সেই সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজ-দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়ে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন শুরু হয়। এই হিন্দু জাতীয়তাবোধ পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের পথ প্রশস্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়া লীগ (১৮৫৭), ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬), ন্যাশনাল কনফারেন্স (১৮৮৩) ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫)।
নব্যহিন্দু ও জাতীয়তাবাদী আবেগের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সমাজ সংস্কারের এই প্রেরণা শিক্ষিত, অভিজাত মুসলমান সমাজেরও মনোযোগ কাড়ে। এগিয়ে আসেন মুসলিম আর্থ-সামাজিক সমস্যার বিষয়ে যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার দেলোয়ার হোসায়েন, সামাজিক বিষয়ের সমালোচক এবং সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন এবং লেখক, শিক্ষাবিদ ও মুসলিম নারীমুক্তির জন্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর মতো মনীষী মানুষজন।
নারী সমাজের নিজস্ব যাপনকথা, প্রথম লেখেন রাসসুন্দরী দেবী (১৮১০ সালে জন্ম পাবনার এক অজ পাড়াগাঁয়, দশ বছরেই বিয়ে), ‘আমার জীবন’। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকের মেয়েদের জীবন-ছবির এক বিশ্বস্ত দলিল। তারপর উল্লেখজনক রচনা কৈলাসবাসিনী দেবীর ( জন্ম ১৮৩৭)। বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। মহিলা হিসেবে প্রথম প্রবন্ধের সঙ্কলন, ‘হিন্দু মহিলাগণের হীন অবস্থা’। সেই প্রথম এক মহিলা হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে প্রতিবাদ করলেন। আলোচনা করলেন, ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাদের সমস্যা, স্ত্রীশিক্ষা ও স্বাধীনতার অভাব নিয়ে। দাবি করলেন মেয়েদের শিক্ষার, বিবাহপরবর্তী জীবন প্রসঙ্গে সংস্কার। মেয়েদের সামাজিক অর্থনৈতিক ভূমিকা পালনের কথা জানালেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ বলা যায়। কৃষ্ণভাবিনী দেবীর লেখা ‘ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা’ বাংলা ভাষায় লেখা কোন নারীর প্রথম ভ্রমণবৃত্তান্ত।
সে সময় মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষও সন্দিহান ছিলেন। মনে করা হত, মেয়েদের নারীসুলভ কোমল গুণগুলি এতে নষ্ট হবে। কৃষ্ণভাবিনী এই মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। রোকেয়া নারীদের আরও ভাল মা বা স্ত্রী হওয়া, নারী-জীবনের এই সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সমকালীন অন্য নারী সমাজ-সংস্কারকদের থেকে তাঁর পার্থক্য এখানেই। তঁার কাছে নারীমুক্তির অর্থ ছিল পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন। নারী পুরুষের সহকর্মী সহধর্মিণী হবেন, এটাই ছিল তাঁর আশা। তিনি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারীর মুক্তি অসম্ভব। রোকেয়া দাবি করেছিলেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার। নারী যে পুরুষ দ্বারা শোষিত — এই চেতনা প্রথম নারী হিসেবে তিনি তুলে ধরেছিলেন।
বাংলার এই সময়কালীন জ্ঞানচর্চা ও সংস্কার আন্দোলন আখ্যায়িত হয় বাংলার প্রেক্ষাপটে ‘নবজাগরণ’। কিন্তু নতুন এই জাগরণ সমাজ-মানসের ধারাবাহিক উন্মেষের প্রক্ষিতে এল না। বরং বলা ভাল সেই সময়ের ঔপনিবেশিক সরকারের প্রশাসনিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলস্বরূপ এর উদ্ভব। এমনভাবেও ভাবা হয়ত খুব একটা অসঙ্গত হবে না, যদি বলা হয় গৃহীত অনেকানেক ব্যবস্থা অত্যন্ত সচেতন ও পরিকল্পিতভাবেই নেওয়া হয়েছিল যাতে এক বিশেষ সমাজ গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই।
বস্তুত এই শিক্ষিত শ্রেণির আকার-আয়তন ছিল খুবই ছোট আর তা ছিল শহুরে উঁচুতলার ‘ভদ্র’ হিন্দুদের মধ্যেই সীমিত। এই শ্রেণির চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপ বাংলার বৃহত্তর জনসমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি, এমনকি বলতে গেলে কোন প্রভাবই পড়েনি। মুসলিম সমাজ এর প্রভাব থেকে প্রায় বাইরেই থেকে যায়। আর পল্লীজনপদের হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলা চলে।
‘কু’প্রথার, ‘কু’কথার বিরুদ্ধতায় যুক্ত করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল আপামর বঙ্গবাসীকে, সম্প্রদায়গত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেই, তেমন কোনও চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটল না। মূলত, ‘রাষ্ট্র’ বা ‘শাসক’ নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত বোধ করলেন সজ্জন-সম্ভ্রান্তেরা। মধ্যযুগের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উদারতাকে প্রান্তিক করে দিয়ে, বিপন্ন করে দিয়ে, সুদীর্ঘকালের অর্জিত জ্ঞনচর্চার ইতিহাস নস্যাৎ করে দিয়ে এই দেশ যারা দখল করল, লুট করল, তাদেরকেই পরিত্রাতা ভেবে, তাদের কাছেই নিজেদের কার্যত সমর্পণ করলেন বিদ্দজনেরা। সেদিন, নিজেদের উদ্যোগে বাংলার নিজস্ব কৃষ্টির সংস্কৃতায়নে তৎপর হতেন যদি, জাত-ধর্ম-বর্ণের উর্ধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একদা প্রয়াসী বাঙালি সমাজ, এমনভাবে জাতপাত ধর্মে বিভক্ত হয়ে যেত না।
উপেক্ষিত হ’ল বাংলার বৈচিত্র্যের সম্মিলন। এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক ভৌগোলিক অখণ্ডতার ইউরোপীয় রাষ্ট্রনির্মাণের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন বাংলার শিক্ষিত, ভদ্র, পরিশীলিত নগরমনস্ক সমাজ! অনুকরণের মানসিকতা! ইংরাজ বর্ণিত উদ্দেশ্যমূলক নির্মিত ইতিহাস-বিশ্বাস! নিজস্ব ঐতিহ্যের বিস্মরণ! ধর্মীয় বিভাজনকে জাতিতত্ত্বের নির্মাণে বিন্যাস! নব্য বিত্তশালীদের অর্থকৌলিন্য! যুক্তি ও বুদ্ধিতে শানিত কলকাতার সমাজ-বিন্যাসের স্তরে স্তরে ‘চিড়’ হয়েছিল ফাটল। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যে, বৈশ্যে, শূদ্রে; উচ্চবর্ণে, দলিতে; হিন্দু, মুসলমানে। শিক্ষিতে, অশিক্ষিতে; প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে।
‘সপ্তকোটিকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে’ উচ্চারণকালে বঙ্কিমের বাংলা তখন বেঙ্গল - সুবা বাঙ্গালা, সুবা ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড - ওই সাত কোটির মধ্যে কমবেশি অর্ধেক ছিল মুসলমান। এছাড়াও ছিল বিহাির, ওড়িশা ও অন্যান্যরা। হিন্দু-বাঙালি মেরেকেটে দু কোটি। এই হিন্দু-বাঙালিরা মনে করতেন, তারাই একমাত্র বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠতে লাগল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। শহরকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’ বর্ণহিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক কৌলিন্য, সমাজের নমশূদ্র বাঙালী, মূলবাসী জনগোষ্ঠী, দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল। বিচ্ছেদ ঘটল হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর।
বাংলায় মানুষ বেড়ে উঠেছে অনেক বেশি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে। বৈচিত্র্য তাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নানানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ধর্ম পরিচয়েও বহুবিধ ভিন্নতা। ফলত হিন্দু ধর্ম এখানে কোন জাতি পরিচয়ে পূর্ণতা পায়নি। পূর্ণতা পাওয়ার কথাও নয়।
শতেক ধর্মাচরণেও একদা বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। সম্পর্কে বিশ্বাস, যাপনে-উৎসবে বিশ্বাস। উদার ধর্মমতে বিশ্বাস। ধর্মমতের উদারত্বে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসবোধ থেকেই গড়ে ওঠে সহনশীলতার পাঠ। ন্যায়-নৈতিকতাবোধ বহুত্বে বিশ্বাস। এমনই মনে হয় শুধু বাংলা কেন প্রাচ্যের বিশ্বাসী মনোজগৎ। তরল পদার্থের মতো আধারের আকারে ধর্মীয় বহুত্ববাদ।
গোটা গ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সর্বজনীন শীতলা পুজো, শীতলার গান, মনসার ভাসান। মাঘই ছিল গ্রামবাংলার প্রকৃত উৎসবকাল। অগ্রহায়ণে ধান, পৌষ কলাই, আখের নতুন গুড়, লোকের হাতে পয়সা-কড়ি, পিঠে-পুলি, নতুন জামা-কাপড়, তখনই তো উৎসব। গ্রাম-সমাজ বিচ্ছিন্ন নগর-মানুষ নির্মাণ করল নিজস্ব উৎসব, দুর্গাপুজো।
নগর সমৃদ্ধ হ’ল না উৎসভূমির আর্দ্রতায়, বিযুক্ত হল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ লোক-সমাজ থেকে। বরং নগর-চলন বিস্তৃত হল ভিন্ন অর্থনীতির গ্রাম-বাংলায়। অ-সমৃদ্ধ হল নগর, নিরক্ত হল গ্রাম। সভ্যতা সংজ্ঞায়িত হল নগর-বিত্তের ধ্যান-ধারণায়। সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য হল একমাত্রিক, একমুখী ধনসম্পদ আহরণ। মুখে মুখে প্রবাহিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে গেল অজ্ঞ-অশিক্ষিত-সংকীর্ণমনাদের সংস্কৃতি।
গ্রামবাংলা গোচরে-অগোচরে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, পরিকল্পনায়-অপরিকল্পনায় অসমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বহুত্বে, ধর্ম-বিশ্বাসী গ্রামসমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় ভাবাদর্শ, বিশ্বাসী ধর্ম নয়। রাজনৈতিক বা সমাজ অর্থনৈতিক স্বার্থে গ্রন্থিত, সুসংবদ্ধ এক রাষ্টীয় মতাদর্শ। 'বিশ্বাসী-ধর্মের' বিপরীতার্থক এক ভাবাদর্শ, আধুনিক পশ্চিমী রাষ্ট্রব্যবস্থা।
নয়
১৯০৫ সালে এল কার্জনের বঙ্গভঙ্গ। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, ত্রিপুরা, মালদহ নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশ, রাজধানী ঢাকা। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে বাংলা প্রদেশ, রাজধানী কলকাতাতেই থেকে যায়।
বাঙলাকে ভাগ করার চিন্তা, ইংরেজদের অনেক আগে থেকেই। ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, ওড়িশা ও আসাম নিয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে গঠিত হয়েছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি। ১৮৭৪-এ আসামকে বাংলা থেকে আলাদা করা হয়। আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় বাংলাভাষী তিনটি জেলা – সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া। অনেক পরে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারত বিভাজনকালে সিলেট পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাঙালি অধ্যুষিত কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলা আর বাংলায় ফিরে আসে না।
১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলা প্রদেশের সীমানা নতুন করে নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। ১৯০৩-এ স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলে আসামের চিফ কমিশনারের অধীনে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। বাঙালিদের সরব বিরোধিতায় সফল হন না।
এরপর ১৯০৪ সালে বড়লাট নিজেই পূর্ব-বাংলার মানুষজনকে নিজেদের পক্ষে টানতে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফর করেন। পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মানুষজনকে নিজের পক্ষে টানতে লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করে মুসলিমদের নানান সুযোগ সুবিধার কথা বলেন। একই সঙ্গে একজন লেফট্যানেন্ট গভর্নর, পৃথক আইন পরিষদ ও রাজস্ব বোর্ডের ঘোষণা করেন।
পূর্ব-বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও লর্ড কার্জন তার পূর্ব-বাংলা সফরে মুসলমানদের ঐক্যের উপরেই জোর দেন বেশি। ধর্মকে সরাসরি ব্যবহার করা হয়। পূর্ব-বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু-বিদ্বেষী মনোভাব বাড়তে থাকে। এছাড়া পূর্ব-বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিচু বর্ণের হিন্দু। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের মতো উঁচু বর্ণের হিন্দুরা থাকতেন কলকাতায়। ফলে মুসলমানদের সাথে সাথে পূর্ব-বাংলার হিন্দুরাও নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই অবস্থান নেন।
সে-সময় অমানুষিক শ্রম দিতেন গ্রাম-বাংলার কৃষক আর ফল ভোগ করত কলকাতার জমিদার। অর্থনৈতিক সংকটে গ্রামের মানুষ শিক্ষাতেও এগোতে পারত না। ফলে কলকাতার লোকেরা সহজে চাকরি পেলেও অবহেলিত গ্রাম-বাংলার লোকেরা চাকরি পেত না সহজে। সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত ছি’ল পূর্ববাংলা। ঢাকা থেকে কর আদায় করে সে কর দিয়ে উন্নয়ন হ’ত কলকাতা, ওড়িশা আর বিহারে। রেল ব্যবস্থার উন্নয়নও ছিল পশ্চিমকেন্দ্রিক। ঢাকার মতো প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের সাথে ছিল না রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে বঙ্গভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় বাংলার হিন্দু, মুসলমান আর ব্রিটিশ শাসকদের ত্রিমুখী এক দ্বন্দ্ব।
শিক্ষিত হিন্দু-বাঙালিরা অনুভব করে, বঙ্গভঙ্গ বাংলা-ভাষাভাষী মানুষজনের মধ্যে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের ওপর কার্জনের সুচিন্তিত আঘাত এবং আসল লক্ষ্য, শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্রুত উত্থানের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব-বাংলার মুসলিম প্রভাব বাড়ানো। সম্পূর্ণ বিহার ও ওড়িশা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাপ্রদেশেও হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। তাই বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্রতর হয়। বাংলার ছাত্র সম্প্রদায়ও জাতীয়তাবাদের ডাকে প্রবলভাবে সাড়া দেয়। নেমে আসে ব্যাপক দমনপীড়ন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। প্রতিবাদ ছিল প্রায় সর্বজনীন।
ওই সময়ের অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো এটিও ছিল ধর্মীয় ভাবধারায় পুষ্ট। সমারোহপূর্ণ পূজা-অর্চনার প্রচলন করা হয়। কালীকে মাতৃভূমির প্রতীক হিসেবে পুরোহিত স্বদেশী ব্রত পাঠ করাতেন। এ রকম ধর্মীয় উদ্দীপনা সাধারণ হিন্দু জনতাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিত। কিন্তু এর বিপরীতে ঐ উন্মাদনা সাধারণ মুসলমানদের চেতনায় প্রতিকূল মনোভাব জাগিয়ে তুলত। মুসলিম মানসকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে।
মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি ১৯০৫ সালে সাতজন নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিত্ব সাক্ষরিত ঘোষণার মাধ্যমে বিভক্তির পক্ষে অবস্থান নিতে মুসলমানদের অনুরোধ জানান। ব্যবসায় ও শিল্পক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকায় মুসলিম সমাজ-মানসে চিন্তা-ভাবনার প্রবণতা ছিল বিভক্তির পক্ষে। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ফাটল বেড়ে যায়। বিভাজনের আরও বড় কারণ ছিল বাংলায় ভূমি ব্যবস্থার প্যাটার্ন। নিজেদের জমিদারি থেকে অনুপস্থিত হিন্দু জমিদারেরা রায়তদের - যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান – আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির কথা প্রায় ভাবতেনই না।
শুরু থেকেই ভারতীয়, বিশেষত বাংলার, প্রচারযন্ত্র বিভক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভায় বিভক্তির প্রস্তাব যতদিন না প্রত্যাহার করা হবে ততদিন ব্রিটিশ দ্রব্যাদি ক্রয় না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। রাখীবন্ধনের দিনটিকে স্মরণ করে রচনা করেন,
বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
জাতীয় চেতনা ডি.এল রায়, রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর দেশাত্মবোধক গানে পুষ্ট হয়।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ রচিত, ‘ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির প্রথম ১০ লাইন পরবর্তীকালে নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠক, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারিতে সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি অর্জন করে।
এই কালসীমাতেই ১৯০৭ সালে সুরাট অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মধ্যপন্থী এবং চরমপন্থী ও বিপ্লবী। চরমপন্থী ভাগের যুবকেরা সশস্ত্র সংগ্রামকে সমর্থন করলেও এর সঙ্গে ধর্মীয় চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য যোগ করায় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বড় অংশই এই আন্দোলনের প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। এছাড়াও ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নেওয়া বা জাতীয় বীর হিসেবে শিবাজীর পূজা প্রচলনের মতো ঘটনা মুসলমানদের আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফল হ’ল, ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লায় সংঘটিত দাঙ্গা এবং এর পরপরই ঐ বছরের এপ্রিল মাসে জামালপুরের দাঙ্গা পরিস্থিতি। হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির মধ্যকার বিরোধ তীব্রতর হয়। এই অবস্থায় ১৯০৭ সালের ১৫ মার্চ তারিখে দুই সম্প্রদায়ের একদল বিশিষ্ট সদস্য ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা অবসানের জন্যে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন। ব্রটিশ-রাজ নিজ স্বার্থেই উদাসীন রয়ে যায়।
ইতিমধ্যে পূর্ববঙ্গ আর আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশে, ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তা সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রথম বৈঠকে প্রস্তাব নেয়, বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর এবং সরকার বিরোধী যে কোন বিক্ষোভ আন্দোলন নিন্দনীয়। অন্যদিকে বাঙালি হিন্দুদের অসন্তোষ নিরসনে রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে বঙ্গভঙ্গ রদ সহ প্রশাসনে নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তন ঘোষণা করেন। এক, ভারত সরকারের রাজধানী কলকাতার পরিবর্তে দিল্লিতে হওয়া উচিত। (দিল্লি ছিল মুসলমানদের একদা গৌরব নগরী। রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে ইংরেজ পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা হারানোর দুঃখে কাতর মুসলমান সম্প্রদায়কে শান্ত করার আশা করছিল)। দুই, প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম – এই পঁাচটি বাংলাভাষী বিভাগ একত্রিত করে একটি প্রেসিডেন্সিতে সংগঠিত করা হবে। তিন, বিহার, ছোটনাগপুর ও ওডিশাকে নিয়ে গঠিত প্রদেশটি শাসনকার্য পরিচালনা করবেন আইন পরিষদসহ লেফটেন্যান্ট গভর্নর। চার, আসাম চিফ কমিশনারের শাসনে প্রত্যাবর্তন করবে। বাংলার পুনরায় একীকরণের দিন ঠিক করা হয় ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল।
বঙ্গভঙ্গ-রদ হিন্দু-বাঙালিদের ক্রোধ কিছুটা সংযত করে বটে, কিন্তু সরকার সমর্থ হয় বাংলার বিক্ষুব্ধ পারিবার্শ্বিক অবস্থা থেকে রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায়। কলকাতাকে কেবল প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় নামিয়ে আনায় কলকাতার ভূ-সম্পত্তিগত মূল্য কমে যায়। রাজনৈতিক কাজকর্মের স্নায়ুকেন্দ্র সরে যাওয়ায় অবধারিতভাবে হিন্দু বাঙালিদের প্রভাব দুর্বল হয়ে যায়। বর্ণ হিন্দু বাঙালি সমাজ-চেতনা সর্বভারতীয় প্রাধান্য বজায় রাখতে নৈকট্য অনুভব করে উত্তর-ভারতীয় হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে।
উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে বাঙালি ছিল ‘অকুলীন, অধঃপতিত’ জাতি-সম্প্রদায়। ইংরেজ আনুকূল্যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে, ‘ইংরেজি’ জানা ও শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ভদ্র’ হিন্দু বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে। ‘প্রশাসনিক উচ্চপদ’ বাঙালির মান্যতা তৈরি করেছিল। এই মান্যতা প্রাচীন হিন্দু-সমাজ তাকে দেয়নি। ‘বাঙালি উচ্চবর্ণীয় হিন্দু-সমাজ’, বৃটিশ শক্তির ‘কৃতজ্ঞতাপাশে’ আবদ্ধ রইল। ইংরেজদের মুসলমান-সংস্কৃতির বিরোধিতায় নিষিক্ত হ’ল, জারিত হ’ল।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব রেখেছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থাটি হিন্দু-মুসলিম মতভেদকে জোরদার করেছে। হিন্দু এবং মুসলমান - এই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। একদিকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেমন হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিস্তৃত হয়েছে, তেমনই বিভক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এক মুসলিম জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত ঘটায় ও তাদেরকে স্বতন্ত্রবাদী রাজনীতিতে যোগদান করতে প্রাণিত করে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯০৯ সালে হিন্দু মহাসভার।
দশ
মধ্যযুগে বাংলার মাটিতে যে সর্বধর্মীয় সম্মিলন গড়ে উঠেছিল তাতে ভাঙন ধরাতে সফল হ’ল ইংরেজ শক্তি। ইংরেজ বিদ্বেষ, হিন্দু অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ মুসলমান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব কুঠুরীতে ঢুকিয়ে দিল। বিচ্ছেদ ঘটলো, হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর। কলকাতাকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’, বর্ণহিন্দু সমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক কৌলিন্য সমাজের নমশূদ্র বাঙালি, মূলবাসী জনগোষ্ঠী, দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ হিন্দু বাঙালিদের আবেগে যতখানি আঘাত হেনেছিল, মুসলমান বাঙালি সেভাবে তাড়িত হয়নি। হিন্দু জমিদারের কাছে বাংলা ভাগের পরিণাম ছিল পূর্ববঙ্গে তার আধিপত্য চলে যাওয়া, অন্যদিকে মুসলমান মধ্যবিত্তের কাছে বঙ্গভঙ্গ মানে পূর্ববঙ্গে মুসলমান-প্রধান একটি প্রদেশের প্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রভেদই হিন্দু-মুসলমানকে এক হতে দেয়নি স্বদেশী পতাকার নিচে। পরে অবশ্য বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির সঙ্কটের বাস্তব দিকগুলি বুঝে নেওয়া ও তার ভিত্তিতে আন্তরিকভাবে কাছাকাছি আসার তাগিদও তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় হিন্দু জমিদার বনাম মুসলমান চাষি – ভূমি-সম্পর্কের এই দ্বন্দ্বই নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের একটা বড় কারণ, তবে মুসলমান-সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে এই বিভাজনে। মুসলমান মধ্যবিত্তের এই দাবিকে মর্যাদা দিয়ে বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে তাদের সংখ্যানুপতিক প্রতিনিধিত্ব দিতে চেয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, বাধা দিয়েছিল হিন্দু কায়েমি স্বার্থ। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের অকাল-প্রয়াণের পর সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯২৫ সালেই গঠিত হয় আরএসএস। ১৯২৮-এর শেষে কংগ্রেস-লিগের সম্পর্ক প্রায় ভেঙে পড়ল মতিলাল নেহরুর বিতর্কের সময়ে। হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু কায়েমী স্বার্থের চাপে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলমানদের ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এবং বাংলা ও পাঞ্জাবে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দাবি নাকচ করে দিল কংগ্রেস। জিন্না ঘোষণা করলেন, শেষ হয়ে গেল কংগ্রেস-লিগ সম্পর্ক। ১৯২৯ মার্চে লিগ পেশ করে তাদের ১৪-দফা দাবি, সে দাবিও মেনে নিল না কংগ্রেস। এরপর লিগ ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি আদায় করে নিলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন একরকম আইনসিদ্ধই হয়ে যায়। বিশের দশকের গোড়ায় অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের (১৯১৯ – ১৯২৪) সুবাদে হিন্দু-মুসলমানের যে সাময়িক মিলন, ভিত তার শক্ত ছিল না, আর তাই আন্দোলনের অকাল পরিসমাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যেই মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো নিয়ে বিরোধ আর তা থেকেই শোচনীয় দাঙ্গা ঘটে যায় কলকাতা ও পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায়।
আইনগত সংরক্ষণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৯৩৭-এ বাঙলার আইন পরিষদে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনে ক্ষমতায় আসে লিগ। কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হকের প্রচার ছিল, দুবলা ডাল ভাত, জমিদারী উচ্ছেদ আর অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯৩৯-এ হিন্দু মহাসভা দাবি তুলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে সামরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। হিন্দুত্বকে একটা জঙ্গি রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। ইতিমধ্যে ১৯৪০ সালের মার্চে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়। বাংলার মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের কথায় তখন পাকিস্তান মানে, হিন্দু নিপীড়ন থেকে মুক্তি। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। ১৯৪২-এ হিন্দু মহাসভার কানপুর অদিবেশনে সাভারকর দাবি তোলেন Hinduise all Politics and Militarise Hindudom. পরের বছর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দাবি তোলেন একটি শক্তিশালী ও বলশালী হিন্দু আন্দোলনের (A strong and virile Hindu movement)। ১৯৪৩-এ এককভাবে বাংলায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করে লিগ। চল্লিশের মাঝামাঝি আরএসএসের সদস্য সংখ্যা দঁাড়ায় সারা ভারতে ৭৬,০০০।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৯ আগস্ট ভোরে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করে। কারারুদ্ধ হন কংগ্রেসের বহু প্রথম সারির নেতা। কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন ঘোষণা করা হয়। কারারুদ্ধ হন কংগ্রেস কর্মীরা। প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের হিন্দু-মুসলিম আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং। সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বেরিয়ে আসা, অফিস-আদালতে আগুন লাগানো, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ কেটে দেওয়া, থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি সব কর্মসূচি।
মেদিনীপুর জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয়ে ওঠে এক গণবিদ্রোহ। তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এর গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল ব্যাপক। মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন। ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত-শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচণ্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে ।
’৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যখন মাতঙ্গিনী হাজরা গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন, তমলুকে স্বাধীন সরকার গঠিত হচ্ছে, তখন বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আন্দোলনকে বলছেন ‘অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা’। তঁার রাজনীতি ছিল এক দিকে মুসলিম-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক। পরবর্তী সময়ে যখন সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতে প্রবেশ করছে, দেশজুড়ে প্রবল উত্তেজনা, তখন শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য হিন্দু যুবকদের আহ্বান করছেন। ২৬ জুলাই, ১৯৪২-এ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন, ‘কংগ্রেস খুব শীঘ্রই যে ব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিতে চলেছে এই যুদ্ধের সময়, তা প্রতিরোধের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। যুদ্ধের জন্য হয়তো তা একটু সীমাবদ্ধ, কিন্তু জনসাধারণের ভোটেই তো আমরা মন্ত্রী হয়েছি। আমরা মন্ত্রীরা মানুষকে বোঝাব যে ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ভারতের জনসাধারণের স্বার্থেই আমাদের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে।’ শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ছিল নীতিগত বিরোধ। এমনকি সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় কংগ্রেস সদস্যদের হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের সদস্য হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অন্য দিকে, শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু মানসিকতার ভিতরে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ও সেই চেতনাকে মুসলিম বিদ্বেষে পরিণত করা। এই বিদ্বেষকে তিনি রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের ক্ষতি করবে। ফলে শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তিনি বিরোধিতা করেন। সেটা এতই আপসহীন ছিল যে, শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘সুভাষচন্দ্র আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন, হিন্দু মহাসভা যদি বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন হিসবে মাথাচাড়া দিতে চায়, তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, তা হলে সেটাই করব।’
একদিকে যখন ইংরেজ-বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত শক্তির গণজোয়ার অন্যদিকে মুসলিম লিগ ক্ষমতায় আসায় মুসলমান আধিপত্যের আতঙ্ক ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে হিন্দুদের মধ্যে। ১৯৪১ সালের জনগণনায় অবিভক্ত বাঙলায় মুসলমান বাঙালির জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ আর হিন্দু বাঙালি ৪৪ ভাগ। মুসলমানেরা বাংলা গ্রাস করে ফেলছে, বাঙলার শিক্ষা-সস্কৃতি ইসলামীকরণ করা হচ্ছে, বাংলার কৃষ্টি নষ্ট হতে বসেছে ইত্যাদি অভিযোগে বাংলার হিন্দু সমাজ আলোড়িত। ‘বঙ্গীয় মধ্য শিক্ষা বিল’ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ অস্বাভাবিক রূপ নেয়। সাম্প্রদায়িক প্রচার ওঠে তুঙ্গে। ১৯৪১-এ ঢাকায় একটা দাঙ্গাও হয়ে যায়। ১৯৪৬-এর মার্চ মাসের নির্বাচনে শুধুমাত্র ‘পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়ে ১১৯টি মুসলিম আসনের ১১৪টা আসন পায় লিগ। বাঙালির পোশাকেও তখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। মুসলমানী পোশাকে ধুতি ছেড়ে কুর্তা পাজামার চল।
প্রসঙ্গত, ভারত-শাসন আইন প্রণয়নের পর থেকে ভারত-ভাগ আইন পর্যন্ত অবিভক্ত বাঙলায় চারটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। প্রথম মন্ত্রিসভা, ১ এপ্রিল ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। ফলে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি), মুসলিম লিগ, সংখালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং নিম্ন বর্ণের হিন্দু প্রতিনিধিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে, ফজলুল হক হন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ওই মন্ত্রিসভায় ফজলুল হক ছাড়া আরও দশজন মন্ত্রী ছিলেন এর মধ্যে ৫ জন হিন্দু এবং ৫ জন মুসলিম। পরবর্তীতে মুসলিম লিগের সাথে বিরোধ এবং কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যকার বিরোধে ২ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে ফজলুল হক প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং কৃষক প্রজা পার্টির সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) অংশ এবং কংগ্রেসের হিন্দু সদস্যদের নিয়ে আবার মন্ত্রিসভা গঠিত হয় যা ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা নামে খ্যাত। এই মন্ত্রিসভা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে ফজলুল হক আবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারপর ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লিগের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দিন অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় মন্ত্রিসভা মন্ত্রিসভা গঠন করেন। লিগ নেতৃত্বের মতবিরোধে ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে নাজিমুদ্দিন তার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে সুহরাওয়ারদি বাংলার চতুর্থ মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া পর্যন্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
সুহরাওয়ারদি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই ঘটে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০)। বাংলার প্রায় সাত লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হন। যাবতীয় সম্পত্তি - ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গয়নাগাটি, বাসন-কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। পরের বছরও তাই। এর কারণ ছিল কলেরা, বসন্ত-রোগ ও ম্যালেরিয়া মহামারির প্রার্দুভাব। প্রকৃত পক্ষে,বাঙলায় ১৭৭০ সালের পর সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ।
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘বিনিময় অধিকারদান’ (exchange entitlement)-এ দেখান ১৯৪৩ সালে বাংলায় তেমন বড় রকমের খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কারণ, জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে বিনিময় অধিকারদানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে, কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি এবং অ-কৃষিজীবী শ্রেণি যে মূল্যে তাদের জিনিসপত্র ও শ্রম বিক্রি করেছে তার চেয়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল। বস্তুত কলকাতায় ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিমণ মোটা চাল ৬ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছিল। সেই চালের দাম ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ প্রতিমণ ১৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ মে তা প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়ায়। সঙ্কট তীব্র হলে কোনো কোনো জেলায় প্রতিমণ চাল ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়।
ইংরেজ সরকার এই দুর্ভিক্ষের দায় যথারীতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার - (অক্টোবর মাসে উপকূলীয় জেলাসমূহে ৩২০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষেতের আমন ধানের বিপুল ক্ষতি, এছাড়া ২০, ২২ ও ২৪ ডিসেম্বর কলকাতায় জাপানি বিমান হানা, অসহযোগ আন্দোলনের ভারতব্যাপী বিস্তার ইত্যাদি) – অজুহাত দেয়। সাম্প্রতিক কালে মধুশ্রী মুখার্জি, তঁার বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে চার্চিলের বাংলা তথা ভারত বিদ্বেষী নির্মম আচরণ ও গৃহীত নীতিপদ্ধতি এই মন্বন্তরের প্রধান কারণ ছিল। বাঙালি শিখল নতুন সব শব্দ —পোড়ামাটি নীতি, ব্ল্যাকআউট, কালোবাজার, টমি, মা-ফ্যান-দ্যাও, দেশভাগ। ১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর চার্চিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘পোড়ামাটি নীতি’ অর্থাৎ যেসব অঞ্চল ইংরেজরা ছেড়ে চলে যাবে, তা নির্মমভাবে ধ্বংস করতে হবে। অবশ্য এই নীতির একটা ভদ্রস্থ নাম দেওয়া হয়েছিল—‘ডিনায়াল পলিসি’। জাপানিরা সাগরপথে উপকূলে এসে নামতে পারে—এই আশঙ্কায় কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে টানা লাইন টেনে উপকূলীয় এলাকার সব নৌকা ধ্বংস করা হ’ল। ফলে যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হ’ল, পাশের উদ্বৃত্ত জেলা থেকে ধান-চাল আনার কোনো উপায়ই আর রইল না। নৌকা কেড়ে নেওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল জেলে সম্প্রদায়। উপকূলীয় এলাকাগুলো থেকে চাল কেনার জন্য সরকার ২০ লাখ রুপি অগ্রিম দিল মির্জা আহমেদ ইস্পাহানিকে। ইস্পাহানি ছিলেন মুসলিম লিগের অন্যতম বড় আর্থিক যোগানদার ও ব্রিটিশদের বিশেষ তোষামোদকারী। যেহেতু সরকারের পক্ষে কাজ করছে, ফলে ইস্পাহানির ক্ষমতা ছিল কেউ তার দেওয়া দামে চাল বেচতে রাজি না হলে সে চাল জোর করে নেওয়ার। দুর্ভিক্ষের সে দিনগুলোতে মানুষ কচুঘেঁচু, পাতা-লতা এমনকি দূর্বাঘাস খেয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। ক্ষুধার্ত মানুষেরা সে সবও শেষ করে ফেলেছিল! রিলিফ কেন্দ্র থেকে দেওয়া খিচুড়ির পরিমাণও ক্রমেই কমে এসেছিল।
ফজলুল হক ১৯৪২ সালেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে’। কিন্তু চার্চিল বা ইংরেজ সরকারের সেসবে কান দেয়নি। অস্ট্রেলিয়ানরা চেয়েছিল ক্ষুধার্ত বাঙলার জন্য যতটা প্রয়োজন গম পাঠাতে। কানাডাও চেয়েছিল অন্তত একটা জাহাজভরা গম ভারতে পাঠাতে। কিন্তু চার্চিল এ কাজে কোনো জাহাজ দিতে রাজি হননি। অস্ট্রেলিয়া থেকে খাদ্যভরা জাহাজ শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পাঠানো হ’ল, কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার কোনো বন্দরে সে জাহাজ ভিড়ল না! সময়মতো অস্ট্রেলীয় বা কানাডার গম এলে প্রায় ২০ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত।
সে-সময় ক্ষুধায় উন্মাদ দরিদ্র এক কৃষক নিজের বাবা, মা, বউ ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ক্ষুধার্ত অসহায় বাবা, কোলের বাচ্চাটিকে যেমন করে হোক বিক্রি করতে চাইছেন। বিক্রি না করতে পেরে শিশুটিকে একটা কুয়ার মধ্যে ছুড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান! মৃত মায়ের স্তন থেকে দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে শীর্ণকায় শিশু—এ দৃশ্য কলকাতার রাজপথে প্রায়ই দেখা গেছে। কলকাতার ফুটপাতের মৃত্যু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিছু প্রচার পেলেও গ্রামের মৃত্যু নীরবে ঘটেছে এবং অন্ধকারেই রয়ে গেছে। শিয়াল-কুকুরেরা মৃতদেহ টেনে নিয়ে গেছে।
কোথায় গেল বাঙলার খাদ্যশস্য? উধাও হয়ে সব গেল কোথায়? বাংলা সরকার পাঁচ হাজার লাইসেন্স দিয়েছিল খাদ্য সংগ্রহের। ইস্পাহানি ছাড়াও লাইসেন্স পেয়েছিল কিছু ইংরেজ ব্যবসায়ী এবং মুসলিম লিগ সরকারের কাছের সব লোকজন। তারা খাদ্য মজুদ করেছিল, ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে চলছিল এবং অঢেল অর্থ পকেটে ভরছিল। সরকারি অফিসাররাও কম দায়ী ছিলেন না। যেমন যশোর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল কিনে রেলওয়ে প্লাটফর্মে রেখে দিয়েছিলেন। চরম দুর্ভিক্ষের দিনেও সে চাল বাইরে যেতে দেননি। তেমনি ৯০ হাজার টন চাল কলকাতার কাছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে মজুত করে রাখা ছিল। সেসব চাল পরে পচে যায়।
চার্চিলের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই প্রভাবিত ছিল ডারউইনের প্রতিযোগিতাবাদ ও ম্যালথাসের জীবন-মৃত্যুর অনিবার্যতার তত্ত্বে। দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু চার্চিলের বিবেককে নাড়া দেয়নি। ওয়ার ক্যাবিনেটের যে কোনো সভায় বাংলার দুর্ভিক্ষ বা ভারত প্রসঙ্গ এলেই চার্চিল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। এ ক্ষিপ্ততার একাধিক কারণ ছিল। ইতিহাসের দেয়াললিখন তত দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সিংহের থাবা থেকে বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া বাঙালিদের প্রতি চার্চিলের বিদ্বেষ ছিল। বাঙালিরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে। দরিদ্র, অযোগ্য বাঙালি তো মরবেই! আর তা ছাড়া যুদ্ধের কারণে ভারতের কাছে সৃষ্ট ব্রিটেনের বিশাল অঙ্কের ‘স্টার্লিং ঋণ’ শোধ করার দায়টা চার্চিল সহ্যই করতে পারতেন না। আর সে ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছিল! ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের যখন প্রায় শেষ পর্যায়, তখনো খাদ্য চেয়ে ওয়াভেলের টেলিগ্রামের কোনো জবাব দিলেন না চার্চিল; বরং এক টেলিগ্রামে জানতে চাইলেন, ‘গান্ধী এখনো মরছে না কেন!’ চার্চিল বিশ্বাস করতেন এবং বক্তৃতাতেও বলতেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যুগটাই ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’ হয়ে থাকবে। কার স্বর্ণযুগ? অবশ্যই ভারতবর্ষবাসীর জন্য নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। স্বর্ণযুগই বটে!
এগার
বাঙলায় সুহরাওয়ারদি সরকারের সময়কালেই, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ও তার পরের দিনগুলোয় ঘটে যায় কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব, কংগ্রেস (নেহরু) যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছিল, সেই ব্যাখ্যায় মুসলিম লিগ (জিন্না) মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপক স্বার্থহানির আশঙ্কায় ওইদিন Direct Action-এর ডাক দেয়। কলকাতায় বাংলার মুসলিম লিগ নেতারা মনুমেন্টের পাদদেশে বিরাট মিটিং-এর আয়োজন করে। মুসলমান ছাড়াও অন্য সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীদেরও সেই জমায়েতে সামিল করার চেষ্টা হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা এই কর্মসূচিকে তাঁদের বিরুদ্ধে বলে মনে করে। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়৷ জাতীয় রাজনীতির আবর্তেই সংঘাতের বীজ উপ্ত ছিল৷ ঘটে যায় দাঙ্গাও। দাঙ্গা দমনে প্রশাসনের ব্যর্থতা (অনীহা!) বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। জেলায় জেলায় এই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নোয়াখালিতে অক্টোবর মাসে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷
তলে তলে জমে ওঠা হিংসা দ্বেষ একটা বিরাট বিস্ফোরণ হয়ে ফেটে পড়েছিল ছেচল্লিশের ১৬ আগস্ট। অমানুষিক নৃশংসতার এক ধারাবাহিক অভিযান। লাশ কঁাধে লোক চলে গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে। ১৯৪৬’র কলকাতাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় খুন হয়েছিলেন ১০,০০০ মানুষ। অথচ এই ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই রশিদ আলি দিবসে হিন্দু-মুসলমান ছাত্র-যুবকদের কলকাতায় বিশাল মিছিল বের হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহের সমর্থনে জাহাজীরা ধর্মঘট করেছিলেন। ২৯ জুলাই ভারতব্যাপী ডাক ও তার সাধারণ ধর্মঘটে কলকাতায় অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছিল। যোগ দিয়েছিল হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ১৬ লক্ষ কারখানা-শ্রমিক, অফিস-কর্মচারি, ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক। সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে পরের দিন ৩০ জুলাই কোন দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি।
দাঙ্গার জন্যে লিগ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন মৌলানা আজাদ। পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার সমালোচনা করেন ফজলুল হকও। ছাত্রনেতা আনিসুজ্জমানের কথায়, ‘আমরা দেখিয়াছি ময়দানের সভায় যাইবার জন্য মিছিলকারী ও লিগওয়ালারা ছোরা ও লাঠিসহ সশস্ত্র হইয়া অবলীলাক্রমে রাস্তায় উভয় পার্শ্বস্থ দোকানসমূহ হিন্দুর দোকানসমূহ লুণ্ঠন করিতে করিতে যাইতেছে। আমরা আরও দেখিয়াছি,সশস্ত্র পুলিশ ইহা দঁাড়াইয়া দঁাড়াইয়া দঁাড়াইয়া দেখিয়াছে আর মনের আনন্দে হাসিয়াছে’। বাঙলার প্রধানমন্ত্রী তখন সুহরাওয়ারদি। নির্বিচার হত্যা লুণ্ঠন ও গৃহদাহ চলতে থাকার সময়ও কোন ব্যবস্থা তিনি নেননি, যদিও সেই ১৬ তারিখের অনেকটা সময়ই তিনি নিজে লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত ছিলেন। মিলিটারি নামে ১৭ তারিখ রাতে কলকাতা তখন রণক্ষেত্র।
বাঙলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যে আজও স্বাভাবিক হতে পারল না, তার একটি প্রধান কারণ এই পর্বের দাঙ্গা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দাঙ্গার রূপ যারা দেখেছেন, ভুলতে পারেন না তঁারা সেই বিভীষিকার কথা, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস। প্রবঞ্চনার বোধ, হিংসার উগ্র প্রকাশ – সহজে মুছে যাওয়ার নয় সেই সব স্মৃতি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার কিংবা নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য দেখা গিয়েছিল, কলকাতা-নোয়াখালি-বিহার-এর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এক লহমায় তাকে নষ্ট করে দিল। চতুর ইংরেজের বিভাজন নীতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান-হিন্দু দুই রাজনৈতিক পক্ষও এর জন্যে সমান ভাবে দায়ী। দাঙ্গার ভাগাভাগি আর উন্মত্ততায় হিন্দু-মুসলমান হারিয়েছিল ‘পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ও দায়বোধ’৷ দাঙ্গা অসাম্প্রদায়িক মানুষকেও কিছু সময়ের জন্যে হলেও সাম্প্রদায়িক করে তুলেছিল৷ আর দাঙ্গার ফলে কলকাতার পাড়াভাগের মধ্যে দিয়ে আভাস পাওয়া গেল ‘বাংলাভাগের ভবিষ্যৎ ছবি’৷
রবীন্দ্রনাথ একদা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে৷ আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই।’ সেই অমোঘ সত্যকথন আজও ভারতকে তাড়া করে চলেছে৷
(পরের অংশ পরবর্তী সংখ্যায়)
যেসব বই, পত্র-পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়েছেঃ
সুকুমার সেন : বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)
দীনেশচন্দ্র সেন : মৈমনসিংহ-গীতিকা
Shashi Tharoor : An Era of Darkness এর The Myth of Enlightened Despotism
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় : ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা
Madhusree Mukherjee : The British Empire and the Ravaging of India during World War II (2010)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ : প্রথম আলো১১ আগস্ট ২০১৭
অবভাষ, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৪
http://roar.media/bangla/main/history/partition-of-bengal-the-background-story
রুবায়েত আমিন : যেভাবে ইংরেজরা খুবলে খেয়েছিল উপমহাদেশ ও বাংলার অর্থনীতি (https://roar.media/bangla/ main/history/how-the-british-destroyed-the-economy-of-the-subcontinent-and-bengal)
মন খারাপ হলে খবর্দার শোপেনহাওয়ার পড়তে বসবেন না। এটি, যাকে বলে, একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। সুগার হলে রসগোল্লার ওপর নিষেধাজ্ঞার মতো। কেন পড়বেন না, সে অনেক গল্প। কিন্তু কথা হল, মার্কামারা হতাশাবাদী বলে শোপেনহাওয়ারের এমনই বদনাম যে মন খারাপ না থাকলেও ওঁকে সাবধানে হ্যান্ডেল করবেন।
শোনা যায় তলস্তয় একবার শোপেনহাওয়ার পড়তে বসেছিলেন। তখন তাঁর বিশেষ মন-টন খারাপ ছিল এমন শোনা যায় না। আঠের’শ ষাটের দশকের শেষ দিক সেটা। মধ্য চল্লিশের কাউন্ট তলস্তয় সৃজন শক্তির মধ্য গগনে। War and Peace এর শেষ খণ্ডও প্রকাশিত হয়েছে। অসামান্য ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রুশ দেশের বাইরেও। তখনও পর্যন্ত সুখী সাংসারিক জীবন কাটাচ্ছেন। এমন সময় শোপেনহাওয়ার পড়তে বসে অনুভূতিপ্রবণ মানুষটির চেতন অবচেতনে আঁধার ঘনিয়ে এল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে থাকল হতাশ আতঙ্কে। শেষে এমনকি অমন যে উত্তুঙ্গ প্রতিভাধর, শক্তিশালী স্রষ্টা তাঁরও নাকি ‘মরিবার হলো সাধ’। আমাদের সৌভাগ্য তলস্তয় নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলেন। তবে পুরোপুরি নয়। আন্না কারেনিনাকে আত্মহত্যা করতেই হয়েছিল।
সেই জন্যেই বলছিলাম, আর্থার শোপেনহাওয়ার হইতে সাবধান। যা দিনকাল, অসতর্ক হলেই খিটখিটে মেজাজের এই ঠোঁটকাটা জার্মান দার্শনিক মনের আনাচে কানাচে উঁকি-ঝুঁকি দিতে পারেন। আপনার দর্শন চর্চার বাতিক নেই বলছেন? তাতে কি, বাজারে তো যান। রোববার সকালে ভালোমানুষের মতো থলি হাতে বাজারেই তো গিয়েছিলেন, দার্শনিক সন্দর্ভ নিয়ে তো আর বসেন নি। কিন্তু ফিরে এসে মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে না? ‘এই বেআক্কেলে মানুষ জাতটা ...’ বলে মোক্ষম একটা গালি দিতে ইছে করছে না? সাবধান! মাথাটা ঠাণ্ডা করুন। মাথার ওপর ফ্যানের স্পিডটা না হয় শেষ ধাপ অব্দি বাড়িয়ে দিন। প্রাজ্ঞ ভালোমানুষরা বলেন এই তিতকুটে মনের অবস্থা, এই ক্ষিপ্ত মেজাজ নাকি একটি বিষম ব্যাধি। এমতাবস্থায় শুধু শোপেনহাওয়ার কেন, তস্য চেলা নিটশে অব্দি হাজির হতে পারেন আর আপনি হেন ভালো মানুষও ‘সব ব্যাটাকে চাবকে সিধে করা উচিত’ বলে রাম নবমীর মিছিলে বেরিয়ে পড়তে পারেন!
কই, সকাল বেলা তো দিব্যি ভালো মুডেই বাজারে বেরিয়েছিলেন। অবিশ্যি শোপেনহাওয়ারের কথা একটিবার মনে হয়েছিল ঠিকই। সেটা ওই বাজারে ঢোকার মুখে চলচ্চিত্র তারকার পোস্টার দেখে। ছেলেটার হাসি হাসি সুন্দর মুখের ওপর একটা বিচ্ছিরি শুকনো গ্যাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। এই হিড়িক আবার এখানে কবে থেকে শুরু হল? এরা পারেও বটে। কিছু না কিছু একটা হুজ্জুতি ছাড়া চলে না। আচ্ছা, এরা কেন ধরেই নিচ্ছে যে ওদের হিরো আত্মহত্যা করতে পারে না? ছবি দেখে তো মনে হয় সেনসিটিভ ছেলে ছিল (আপনি আবার এই বাজারে ফস করে বলে বসবেন না যেন যে ওর কোন সিনেমা দেখা তো দূরস্থান, মারা যাওয়ার আগে নামটার সাথে অব্দি পরিচিত ছিলেন না) আর নরম মনের মানুষ আঘাত পেলে কখন যে কী করে বসে। শোনা যাচ্ছে, পড়ুয়া ছেলে ছিল। আরে! ও আবার শোপেনহাওয়ার পড়তে যায় নি তো! বলা যায় না, যে ছেলে কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে মেতে থাকতো বলে শোনা যাচ্ছে তার শোপেনহাওয়ার পড়ার দুর্মতি হওয়া আশ্চর্যের নয়। আর শোপেনহাওয়ার ভর করলে গলায় দড়ি দেওয়ার সাধ হওয়া আশ্চর্যের কী? সবাই তো তলস্তয় নয় যে চল্লিশ বছর বয়সে হতাশার তেতো দর্শন পান করে আশি বছর অব্দি নীলকণ্ঠ হয়ে অমৃত সৃজন করবে।
মেজাজটা খিঁচড়ে যাওয়া শুরু হল পটল কেনার সময় থেকে। না, এখন আর পটলে রঙ দেওয়া নিয়ে সব্জিওলার সাথে খিটমিট করেন না। চাষি বেচারাকে দোষ দিয়ে কী হবে? পটলের রঙটা ফ্যাকাসে দেখালে, বোঁদের মাঝে টুকটুকে লাল দানা উঁকি না দিলে আমাদের মুখে যদি না রোচে তাহলে বিষই খেতে হবে। কিন্তু রাগ যেয়ে পড়লো ওই ফ্যান ছোঁড়াগুলোর ওপর। রাগ হবে না? তোরা সব কি রে! মানলুম না হয় যে হিরো অসময়ে মারা যাওয়ায় তোদের যারপরনাই দুঃখ হয়েছে। হওয়ারই কথা। কিন্তু এই সব্জিবাজারে হিরোর ফ্লেক্সটা লাগানোর সময় তোদের একবারও চাষিদের কথা মনে হয় নি? যে চাষিরা এই বাজারে সবজি নিয়ে বসেন, সবজি পাঠান তাঁদের কথা? তোরা তো সব খবর রাখিস। হিরো কতটা লম্বা, পাঁচ আট নাকি ছয় সে নিয়ে থিসিস অব্দি লিখতে পারিস। তা, শুনিস নি প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে চাষি আত্মহত্যা করে চলেছেন? এক-দু’ জন ঝোঁকের মাথায় বিষ খাচ্ছেন না? গত দশ-পনের বছর বা তারও আগে থেকে দেশজুড়ে চাষিদের মৃত্যুর মিছিল চলছে? কই, তাঁদের দু-এক জনের ছবি টানাতে পারিস না? তোদের হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটি তাঁদের খবর দেয় না বুঝি? নাকি দিলেও তোদের তাতে কিছু যায় আসে না? ওরে অলম্বুষের দল, হিরো হিরোইনদের নাচন-কোঁদন না দেখলেও মরে যাবি না - বরং একটু সুস্থভাবে বাঁচবি - কিন্তু চাষি চাষ করা ছেড়ে দিলে যে সব না খেয়ে মরবি হতচ্ছাড়ারা।
মাথাটা আরো বিগড়ে দিল ওই ব্যাটা নগেন পাল। নাঃ, আপনারই ভুল হয়েছিল ও’রম গাম্বাট লোকের সাথে ভরা বাজারে তক্ক করতে যাওয়া। বাজার করতে এসে অকারণে পলিথিনের প্যাকেট চাওয়া নিয়ে তো এর আগেও এর তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, লাভ হয়েছে কিছু? এমন কি সেনবাবুর সরু ফ্রেমের চশমার পেছনে সদয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখের ওপর ভরসা করে একদিন সন্ধে বেলা বাড়ি বয়ে গপ্পো করতেও তো গেছলেন। কায়দা করে পেড়েছিলেন শুধু শুধু গুচ্ছের পলিথিন ব্যবহার করে সর্বনাশ ডেকে আনার কথা। যুক্তির মাঝখানে এট্টু আবেগের সঞ্চার করার জন্য গরুদের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন, বেচারারা বাছবিচার না করে সব খেয়ে ফেলে ...। কিন্তু সেনবাবু কথাটাকে আর বাড়তে দেন নি। কপালের ওপর ঝুঁকে আসা পাতলা কাঁচাপাকা চুলের গোছা আলতো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে বলেছিলেন, ‘সে শুধু আমি-আপনি ব্যবহার না করলে কি আর হবে বলুন? নিন চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তারপর, ছেলের কোন ক্লাস হলো’।
এই সব অভিজ্ঞতার পর বাজারের মাঝখানে নগেন পালের থলির মধ্যে উঁকি দিয়ে ‘ও মশাই, আপনার থলিতে তো দেখছি যতগুলো সবজি ততগুলোই প্যাকেট’ বলে খোঁচা দিয়ে পরিবেশ চেতনা জাগ্রত করার প্রচেষ্টাটা যে সুবিবেচকের কাজ হয় নি সে নিশ্চই মানবেন। তবে নগেনের অমন তেড়িয়া হয়ে ওঠারই বা কি হ’লো? খোঁচা খোঁচা চুলের নীচে চোখদুটো পাকিয়ে গাঁক গাঁক ক’রে চেঁচাতে লাগলো, ‘আপনার তাতে কি মশাই! নিজের চরকায় তেল দিন গে যান। এই বয়সে আর আঁতলামো করতে হবে না’। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমন অসভ্য লোকের পাল্লায় পড়ে বাজার তো মাথায় উঠলো। রাস্তা পেরিয়ে দুধের প্যাকেট কিনে বাড়ি ফিরবেন ভাবছিলেন কিন্তু সেখানেও এক বখেড়া। সহেলী দিদিমণি, ইস্কুলে পড়ান, সকালে খুব তাড়া, পিঙ্ক রঙের স্কুটি একপাশে কাত করে এক পা মাটিতে রেখে শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থাতেই আমুল কোম্পানির দই-এর ছোট ছোট বাটি কিনছেন। সেও সব ‘প্ল্যাস্টিক’এর বাটি। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল, হেলমেটের ভেতর থেকেই দিদিমণি কোন কারণে বিদ্যাসাগরকে - হ্যাঁ, সকালে দুধ-দই নিয়ে যে ছেলেটি রাস্তার ধারে বসে তার বাবা-মা তাকে বিদ্যাসাগর নামই দিয়েছেন - বকুনি দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু সে বেচারা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, অল্প বিস্ময় মুখে বোঝানোর চেষ্টা করছে দাম সে ঠিকই নিয়েছে, ‘এক্সপায়ারি ডেট’ও দেখে নিয়েছে তাহলে তার অপরাধটা কী? দিদিমণির ইস্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে, হেলমেটটা যে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা আছে সে কথা ভুলে এক ঝটকায় খুলতে যেয়ে আরো রাগত হয়ে স্কুটি থেকে নেমে শিরস্ত্রাণ যখন খুললেন তখন তাঁর মুখমণ্ডল তাঁর বাহনের মতই বর্ণ ধারণ করেছে। ‘ব্যাটা শুনতে পাও না? তখন থেকে বলছি দইয়ের কাপের সাথে প্ল্যাস্টিকের যে চামচগুলো থাকে সেগুলো দে, কথা কানে যায় না, না?’ দোষ স্বীকার করে, এই নিন দিদি বলে, একগুচ্ছ খুদে খুদে প্ল্যাস্টিকের চামচ করকমলে সমর্পণ করে বিদ্যাসাগর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে চামচগুলোও একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের মোড়কে সুরক্ষিত।
রোদ চড়চড়ে হয়ে উঠছে, মাথাও ঝাঁ ঝাঁ করছে। না, না, ঢের শিক্ষা হয়েছে। বিদ্যায়তনে শিক্ষাদান লগ্ন বয়ে যাওয়ার মুখেও প্ল্যাস্টিকের চামচ সংগ্রহ করা কেন জরুরী বিবেচিত হয়েছিল সে নিয়ে দিদিমণির সাথে যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার দুর্মতি আর আপনার হবে না। কিন্তু এ তো বেশ গেরো। আপনার কাছে যেটা জলের মতো সোজা যুক্তি লোকে সেটা মানা তো দূরের কথা শুনতেই চায় না কেন? উলটে তেড়ে আসে। দেশসুদ্ধ লোকের মাথা খারাপ হয়ে গেল, নাকি, আপনার নিজের মাথাটাই বিগড়েছে? ভারি ফ্যাসাদে পড়া গেল!
ফ্যাসাদটা যে কী, গেরো যে কত গুরুতর সেটা টের পাবেন বাজার সেরে বাড়ি ফিরে। বেরোনোর সময় অর্ডার ছিল শুক্তোর সব উপকরণ নিয়ে আসার। সেই মতো নিখুঁত হিসেব করে কাঁচকলা, পেঁপে, বেগুন কিনেছেন কিন্তু তারপরই এই সব যুক্তিতর্কে মাথা গুবলেট হয়ে শুক্তোর মধ্যমণি উচ্ছে ব্যাটাই স্রেফ গপ্পো হয়ে গেছে। ব্যাস। এর পরের চিত্রনাট্য আপনার জানা। অপরাধ ধরা পড়া, ম্যাডামের চার্জশীট দাখিল, ম্যাডামের আদালতেই বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া আর তাঁরই হাতে ফাঁসির পদ্ধতিগুলো আপনার বহু পরিচিত। ‘জানতাম এটাই হবে! একটা কাজের কথাও কি কানে ঢোকে না? কোন জগতে থাকো? কই, অফিসের কাজে তো ভুল হয় না? ...’
কোন শালা বলে, মানুষ নাকি rational animal! না, না, ঠিক আছে, আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু হয় নি। মুখ ফস্কে বলে ফেললেও শালা শব্দটা ঠিক গালাগালির মধ্যে ধর্তব্য নয়। কথামৃতের পাতায় পাতায় ঠাকুর ওটাকে শুদ্ধ করে দিয়েছেন। আর শোপেনহাওয়ারও ওই কথাই বলতেন। জার্মান ভাষায় শালা বলতেন কিনা সে কথা হচ্ছে না, তবে বলতেন আপনি যে ভুলটা করছেন ঠিক সেই ভুলটাই আজ অব্দি সব দার্শনিকরা করে এসেছেন। এ্যদ্দিন অব্দি সবাই মানুষকে চিন্তাশীল, বুদ্ধিমান প্রাণী বলে এসেছেন। সব্বাই মানুষকে যুক্তিশীল প্রাণী rational animal বলে ঠাউরেছেন। এই সনাতনী গোড়ার গলদের জন্যেই লোকে যুক্তি দিয়ে, তর্ক করে অন্যকে সহমত করার বৃথা চেষ্টা করে। আপনার মনমেজাজের যা হাল তাতে শুনতে ভালোই লাগবে যে শোপেনহাওয়ার বলছেন, যুক্তি দিয়ে আজ অব্দি কেউ কাউকে কোন ব্যাপারে একমত করতে পারে নি। কারণ মানুষ আদপেই যুক্তির ধার ধারে না। মুখে যে যাই ভড়ং করুক লোকে আসলে নিজের তালে, নিজের ধান্দাতেই চলে আর সেই মতো যুক্তি সাজায়। নৈয়ায়িকরা যুক্তিবিদ্যার চর্চা করে বটে কিন্তু সে তো ওদের পেশা, ওই দিয়েই ওদের রোজগার।
হ্যাঁ, কটু চাঁছাছোলা কথা বলতে শোপেনহাওয়ারের সঙ্কোচ ছিল না। আর মজার কথা হল, মানুষ যুক্তিশীল নয় এই কথাটা বলতে যেয়ে ওঁর ক্ষুরধার প্রতিভা শাণিত যুক্তিতে ঝকঝক করে। মেনে নিতে পারুন বা না পারুন, শোপেনহাওয়ারের বক্তব্যটি ঋজু। আমরা যাকে সচেতনতা বলি সেটা আসলে আমাদের মনের স্রেফ ওপরের স্তরটুকু মাত্র। পৃথিবীর ওপরের স্তরে মাটির আবরণের মতো। মাটির নীচে বিপুল গভীর স্তরগুলো নিয়ে আমরা যেমন কমই জানি তেমনি চেতন স্তরের নীচে মনের পরিচয় দুর্জ্ঞেয়। শোপেনহাওয়ার অবিশ্যি বলবেন তিনি জানেন। সচেতন বুদ্ধির নীচে নিরন্তর জেগে আছে প্রাণচঞ্চল ‘ইচ্ছে’, চেতন বা অচেতন বাসনা। এই ‘ইচ্ছে’, ‘বাসনা’রাই নিয়ত ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নগেন পাল, সেনবাবু, সহেলী দিদিমনির মন। এই জন্যেই যুক্তি দিয়ে আপনি কাউকে স্পর্শ করতে পারছেন না। তবে শোপেনহাওয়ার আপনার যুক্তিবাদী চেতনার গর্বকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন। বলবেন, তোমার যুক্তিবাদী বন্ধুরা যতই চেঁচাক তোমাদের সবাইকেও পেছন থেকে চালায় তোমাদের ‘ইচ্ছে’, ‘বাসনা’। যুক্তি শুধু রাস্তা দেখিয়ে দেয়।
আপনি মানতে পারবেন না। শোপেনহাওয়ারের তাতে ভারি বয়েই গেল। ভারি অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। দার্শনিক বললে যে আপনভোলা, অমায়িক, শান্তস্বভাব মানুষটির ছবি দেখেন তার সাথে মেলাতে পারবেন না। রূঢ়প্রকৃতি, আত্মকেন্দ্রিক, বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ শোপেনহাওয়ার সঞ্চিত অর্থ বাজারে খাটাতেন ঝানু বিনিয়োগকারীর দক্ষতায়। নিজের প্রতিভা নিয়ে তুমুল আত্মবিশ্বাসী আর সে ব্যাপারে বিনয়ের ধার ধারতেন না। অক্লেশে বলতে পারতেন, কান্ট আর তাঁর মধ্যবর্তী সময়ে নাকি দর্শন নিয়ে বলার মতো কাজ কিছুই হয় নি। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই “The World as Will and Idea” এর মুখবন্ধে ঘোষণা করলেন এর পর এই বই শত শত নতুন বই আর গবেষণার উৎস হবে।
দুঃখের কথা, নেপোলিয়ন পরবর্তী যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অবসন্ন ইউরোপের মন মেজাজ দর্শন চিন্তার অনুকূল ছিল না। অসামান্য এই গ্রন্থটি প্রকাশের ষোল বছর পর প্রকাশক জানালেন অধিকাংশ বই বাজে কাগজ হিসেবে ওজন দরে বিক্রি হয়েছে! শোপেনহাওয়ার অবশ্য তাতে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। বললেন, বই আর মাথার ঠোকাঠুকিতে ফাঁপা শব্দ হলে দোষটা কি সব সময় বইয়ের? বইয়ের শুরুর বাক্য ছিল, ‘দুনিয়াটা আসলে আমার ভাবনা’। ইংরেজী অনুবাদে, “The world is my idea.” তা, লোকে নাকি জানতে চাইত, ওর বউ এটা শুনে কী বলেছে? কথাটা শোপেনহাওয়ারের কান অব্দি পৌঁছেছিল কিনা জানা নেই, পৌঁছলেও উত্তর দেওয়ার দায় ছিল না। কারণ তাঁর কোন স্ত্রী ছিলেন না। সংসার ছিল না। জীবনের শেষ তিরিশ বছর থেকেছেন একটা বোর্ডিং-এর দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে। একমাত্র সঙ্গী তাঁর কুকুর। নাম রেখেছিলেন, ‘আত্মা’। হ্যাঁ, সংস্কৃত শব্দ আত্মা, যদিও দুষ্টু লোকে বলতো, বাচ্চা শোপেনহাওয়ার। রাতের খাওয়ার জন্য প্রায়ই যেতেন এক ইংলিশ রেস্তোঁরায়। খেতে বসার আগে টেবিলের ওপর একটা সোনার গিনি রাখতেন আর খাওয়া হয়ে গেলে সেটা তুলে পকেটে পুরে ফিরে যেতেন। দিনের পর দিন এই কাণ্ড দেখে রেস্তোঁরার ওয়েটার একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, এই কাণ্ডটার মানে কী? শোপেনহাওয়ার বললেন, যে দিন দেখব ওই ইংরেজ অফিসারগুলো খাওয়ার টেবিলে বসে ঘোড়া, মেয়েমানুষ বা কুকুর ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা বলছে সেদিন এটা তোকে দিয়ে যাবো।
সে না হয় হল। কিন্তু কুকুরের নাম আত্মা কেন? সে গল্পের জন্য শোপেনহাওয়ারের দর্শনের একটু খোঁজ নিতে হবে। গোদা ভাবে বললে, শোপেনহাওয়ারের ধারণা সহেলীর বাজার করা থেকে বিশ্ব প্রপঞ্চের সব কিছুর মূলে ইচ্ছে বা বাসনা। “ইচ্ছেই মনের একমাত্র স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় উপাদান ... ইচ্ছেই চেতনাকে ধরে রাখে, তার সমস্ত ভাবনা চিন্তার মধ্যে সমন্বয় করে”। খুদে খুদে প্ল্যাস্টিকের চামচগুলো সংগ্রহ করার কোন কারণ ছিল বলে দিদিমণি ওগুলো চাইছিলেন তা নয় ওগুলো চাইছিলেন বলেই নানা কারণ দেখিয়ে বিদ্যাসাগরকে ধমক-ধামক দিচ্ছিলেন। বুদ্ধি বা মেধা বাসনার ভৃত্য বই নয়, ইচ্ছে চরিতার্থ করার জন্যই প্রকৃতি মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন। কিন্তু সহেলী দিদিমণি চামচগুলো চাইছিলেনই বা কেন? প্রশ্ন করতে পারেন, ইচ্ছেরও তো একটা কারণ আছে, তারও তো যুক্তি থাকতে পারে? শোপেনহাওয়ার বিশেষ পাত্তা দেবেন না, বলবেন ইচ্ছে ওসব যুক্তি-টুক্তির ধার ধারে না। বাসনা অন্ধ। নাঃ, এ লোকের সাথে পারা যাবে না। এই পাগলামো নিয়ে একটা কমপ্লেন করলে হয় না? আচ্ছা, আইনস্টাইন শুনেছিলেন এই সব অদ্ভুতুড়ে কথা? শুনেছিলেন। আর আপনার অভিযোগ শুনলে মুচকি হেসে বলতেন, হের দার্শনিক বলছেন আপনার যেটা ইচ্ছে হয় আপনি তাই করেন কিন্তু আপনি ইচ্ছে অনুযায়ী ইচ্ছে করতে পারেন না!
অর্থাৎ কিনা, ইচ্ছে বা বাসনা স্বয়ম্ভূ। ইচ্ছেই মানুষের সত্তা, তাকে আপনি কখনোই সম্পূর্ণ জানতে পারবেন না। মানুষের মন, তার সত্তা দুর্জ্ঞেয়। কেন, মন দুর্জ্ঞেয় হতে যাবে কেন? তাকে জানা যাবে না কেন? আরে মশাই, জানবেন কী দিয়ে? বুদ্ধি দিয়ে? বললাম না বুদ্ধি হল ইচ্ছের চাকর! বুদ্ধি মনের একটা প্রকাশ মাত্র, ওর কাজ ইচ্ছের হুকুম পালন করা, ওই কাজের জন্যেই ওর সৃষ্টি, ও শুধু ওটুকুই পারবে কিন্তু যার আজ্ঞা বহন করছে তার নাগাল পাবে কী করে? শুধু আপনার বুদ্ধি কেন, আপনার শরীর, তার শারীরবৃত্তীয় কাণ্ডকারখানা সবই এই ইচ্ছে-স্বরূপ সত্তার প্রকাশ। ভোজনেচ্ছার জন্য পরিপাকতন্ত্র ... ইত্যাদি ইত্যাদি। মা বলেছিলেন না খোকাকে, ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। এর মানে দাঁড়াল, আপনি যে আপনি সেই আস্ত মানুষটাই ইচ্ছের প্রকাশ। শুধু আপনি নন সেনবাবু, নগেন পাল, সহেলীদিদিমনি, তলস্তয়, অকালপ্রয়াত চিত্রতারকা সব্বাই। শুধু আমরা নই, আপনার নেওটা কুকুর লালু, বজ্জাত হুলো ভজা এরাও সব ইচ্ছের প্রকাশ। ওই যে শিরীষ গাছ ওর ডালগুলো নীচু করে পাঁচ আঙুল ছড়ানো হাতের মতো দোলাতে দোলাতে ‘সে কি এল, সে কি এল’ ভাবছে, সেও। গাছের নীচে লাল কাঁকুরে মাটি, মাটি থেকে অল্প একটু মাথা তুলে উঁকি দেওয়া পাথর ওরাও। আর্থার শোপেনহাওয়ার বলবেন জগতের সব প্রাণ এবং অপ্রাণ এক অখণ্ড সত্তার বিশেষ বিশেষ প্রকাশ।
চেনা চেনা লাগছে না তত্ত্বটি? ঠিক ধরেছেন। বিশ্ব চরাচর জুড়ে সর্বত্র অখণ্ড সত্তার বিচিত্র প্রকাশের ধারণার কথা শুনলে উপনিষদের কথাই মনে পড়বে। শোপেনহাওয়ার ছিলেন উপনিষদের একনিষ্ঠ পাঠক, উপনিষদের প্রজ্ঞার উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সরব। তবে কিনা উপনিষদে এই সত্তার পরিচয় নির্গুণ আত্মা আর শোপেনহাওয়ার দাবী করতেন এই সত্তা আসলে বদগুণ ইচ্ছে। আর কুকুরের নাম রেখেছিলেন আত্মা! তো সে যাই হোক, শোপেনহাওয়ার বলতেন তাঁর প্রেরণা প্লেটো, কান্ট আর উপনিষদ। প্লেটোকে কেন গুরু বলে ঠাউরালেন ঈশ্বর জানেন - প্লেটোর চিন্তার প্রভাব তাঁর দর্শনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল - কিন্তু ইমানুয়েল কান্টের যে তিনি চ্যালা সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এসব বখেড়ায় আপনার কোন ইন্টারেস্ট নেই বলছেন? তা না-ই থাকতে পারে। কার যে কিসে ইন্টারেস্ট কে বলতে পারে? তবে, দু’ পাতা শোপেনহাওয়ার পড়ে বলতে পারি আপনিই কি জানেন কিসে আপনার ইন্টারেস্ট? জানবেন কি করে? ইন্টারেস্ট তো আপনার নয়, আপনিই ইন্টারেস্টের। আপনি তো আপনার ইন্টারেস্টের দাস মশাই!
রেগে গেলেন নাকি? এই দ্যাখো! স্রেফ এট্টু লেগ পুলিং করছিলাম। তাও আপনার নয়, শোপেনহাওয়ারের। ওসব ছাড়ুন, বলছিলাম, আপনার একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে না, ‘পরিপ্রেক্ষিত’ পত্রিকায়? হিন্দু ধর্মের উৎস সন্ধানে, বা ওই রকম কিছু একটা? হেব্বি লিখেছেন কিন্তু। কখন পড়েন এত সব! তবে, ইন্টারেস্টের কথা যখন উঠলই তখন একটা কথা শুধোই। এত খেটেখুটে দাঁতভাঙা সব রচনা লেখেন কেন বলুন দিকিনি। হিন্দু কথাটা সিন্ধুনদ থেকে এসেছে নাকি গঙ্গায় ভেসে উঠেছে তাই নিয়ে কার মাথাব্যথা? হ্যাঁ, যে সাড়ে তের জন আপনাদের ওই পত্রিকা পড়েন তাঁদের অবিশ্যি সব কিছু নিয়েই মাথাব্যথা, ত্রিভুবনে হেন জিনিস নেই এঁরা জানেন না। ওঁদের আর নতুন করে কী শোনাবেন? নাকি আশা করেন মাথায় ফেট্টি বেঁধে যে মস্তানগুলো রামমন্দির নিয়ে চেঁচাচ্ছে তারা আপনার প্রবন্ধ পড়ে ভুল বুঝতে পেরে হিন্দু ধর্মের উৎস সন্ধানে উপনিষদ খুলে বসবে? ধন্যি আশা মশাই আপনাদের! আপনারা কি ভাবেন যে একদল অসভ্য ভুলভাল বকে লোক তাতাচ্ছে আর লোকেও নাচছে সে শুধু কয়েকটা তথ্য জানে না বলে? আচ্ছা নাহয় মানলাম, লোকে ইতিহাস ঠিকঠাক জানে না। কিন্তু চারপাশটা তো দেখতে পায়? সবাই তো দেখতে পাচ্ছে হিন্দুত্ব-অলারা মাসল ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় একজন মুসলমানকে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে মারলেও পেয়াদা দেখতে পাবে না। নেহাত যদি হলফনামা দাখিল করে কেউ না বলে যে আমি অমুকচন্দ্রের গুণধর পুত্র তমুক সাঙ্গোপাঙ্গো সমভিব্যাহারে শেখ তমুককে পিটাইয়া হত্যা করিয়াছি তাহলে প্রমাণ অভাবে মামলা খারিজ হয়ে যাবে। এসব দেখেশুনেও লোকে কি করে বলে বেড়ায় বলুন তো যে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়? আপনি কী করবেন? কী আর করবেন, আরেকটা প্রবন্ধ লিখতে বসে যান। এক দুই তিন চার যুক্তি আর তথ্য সাজান। কারণ আপনি বিশ্বাস করেন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে। মানুষ যা দেখবে জানবে তাই তো বিশ্বাস করবে।
আপনার মুণ্ডু! লোকে যা বিশ্বাস করে তাই দেখতে পায়। সংস্কৃতিবান উচ্চশিক্ষিতও অফিস এসে গলা বাজিয়ে বলতে পারেন আগের দিন সন্ধেবেলা শপিং মলে একদল বোরখাপরা মহিলাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন - ভাবুন, দিনে দিনে কী হল, এরপর তো ‘আমরা’ই সংখ্যালঘু হয়ে যাবো। আপনি আপনার চারপাশে এইসব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছেন না? এর পরও বলবেন, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। আপনার মুশকিল কি জানেন, সেই যে ক্লাস এইটে বিজ্ঞান ক্লাসে মদনবাবু পড়িয়েছিলেন, প্রথমে পরীক্ষা তারপর পর্যবেক্ষণ আর তারপর সিদ্ধান্ত ওইটেই মাথায় গেঁথে আছে। কাঁচা আমের রঙ সবুজ। কী করে জানলাম। আমে কামড় দিয়ে দেখলাম টক আর দেখতেই তো পাচ্ছি রঙটা সবুজ। অতএব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নির্ভুল সিদ্ধান্ত। মদনবাবু বোধহয় কান্ট পড়েন নি। তা নইলে এও বলে রাখতেন, তোর চোখে রঙটা সবুজই লাগছে বটে কিন্তু তাই বলে নিশ্চিন্ত হতে পারিস না যে আমটা সবুজই। কোন রঙ দেখবি সেটা নির্ভর করছে তোর ওপর, আমটার ওপর নয়। তুই কালার ব্লাইন্ড হলে সবুজ নাও দেখতে পারিস। ওই যে কাঠবেড়ালিটা লেজে ভর দিয়ে ডালের ওপর সোজা হয়ে বসে সামনের পা দুটোয় কী একটা জাপটে ধরে টুকটুক করে খেয়ে যাচ্ছে ও আমটার রঙ কী দেখছে সেটা জানারও কোন উপায় নেই।
মদনবাবু এসব কিছুই বলেন নি বটে তবে তপনবাবু কিন্তু ক্লাসে পড়িয়েছিলেন, আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে ... । সাঙ্ঘাতিক কথা মশাই! চুনি রাঙা হয়ে ‘উঠল’। ওর নিজের নয়, আমার চেতনার রঙে! তবে বাঙলা ক্লাসে কী পড়া হল সে আর কে পাত্তা দেয়। ভালো ছেলেরা মুখ নামিয়ে হাসে, এসব ন্যাকা ন্যাকা ব্যাপার ওদের পোষায় না। আপনিও নির্ঘাত সেই দলে ছিলেন, সায়েন্স ক্লাসের জন্যে মুখিয়ে থাকতেন। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত। খাঁটি জ্ঞান হল অভিজ্ঞতা লব্ধ। বাস্তবের কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেওয়া। ওই যে আমপাতাটা ভেসে ভেসে দুলে দুলে মাটিতে এসে পড়ল, সেটা যে মাধ্যাকর্ষণের জন্যে সে তো স্পষ্ট চোখে দেখা। পাথর হলে ধাঁই করে এসে পড়ত। তার মানে বায়ুস্তরে যে পাতাটা বাধা পাচ্ছে সেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
বটে! কান্ট বলবেন পাতাটা পড়ছে এটা দেখতে পাচ্ছো কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের জন্যেই পড়ছে এটা আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল কীভাবে? কান্ট অবিশ্যি ঠিক এভাবে বলেন নি কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে যে মা ধরিত্রীকে মাধ্যাকর্ষণের হাত বাড়িয়ে আমপাতা পাড়তে আপনি দেখেন নি। সত্যি বলতে কি, আমরা যাকে কার্য-কারণ সম্পর্ক বলি, মানে এই ঘটনার জন্য ওই ঘটনাটা ঘটল বলে ব্যাখ্যা করি, তাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি বলে দাবী করতে পারি না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে এইসব উষ্টুম ধুষ্টুম ভাবছেন এমন সময় তপনবাবু এসে ‘হাঁ করে মাঠের দিকে তাকিয়ে কী দেখা হচ্ছে’ বলে কষে কানটি দিলেন মলে। এমতাবস্থায় ইমানুয়েল কান্ট যদি এসে কূট তর্ক জুড়ে দেন যে তপনবাবুকে তুমি কান মলতে দেখেছো এটা তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, কানটি যে লাল হয়ে আছে সেও দেখাই যাচ্ছে কিন্তু তপনবাবুর কান মলে দেওয়াই কান লাল হওয়ার কারণ এটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত তাহলে কানের সাথে মাথাটাও আপনার এমনি গরম হবে যে বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিককেই হয়তো এক ঘা লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখুন, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। গেল বিষ্যুদবার সেভেন বি’র ক্লাস নিয়ে তপনবাবু যখন করিডোর দিয়ে ফিরছিলেন তখন আপনি থামের আড়াল থেকে ওনার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বানানো নিকনেম “তকুভ!” বলে ডেকেছিলেন না? স্যার নির্ঘাত শুনতে পেয়েছিল আর আজ তাই সুযোগ বুঝে কষে কানটা মলে বদলা নিয়ে নিল। আপনার সিদ্ধান্ত হয়তো নির্ভুল। আপনি বলবেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত। তর্ক করবো না, আপনার মন মেজাজ ভাল নেই, শুধু বলতে হবে একে যদি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলেন তাহলে মানতেই হবে সেটা শুধু আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা নয়। ওতে অনেকখানি আমাদের মনের মাধুরী - কিম্বা বিষ - মেশানো থাকে। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে তো আপনি এই সিদ্ধান্তও করতে পারতেন যে তপনবাবুর পুরো ক্লাসটাতেই আপনি অমনোযোগী ছিলেন তাই কান মলা খাওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তা কিন্তু করলেন না। প্রতিশোধ বলেই মনে করলেন। কী করে অস্বীকার করবেন তাহলে যে এই কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজাটা আপনার মন গড়া।
কান্ট বলেন কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজা সব সময়ই আমাদের মন গড়া। শুনে আপনার হাড় পিত্তি জ্বলে যাবে। আপনি শুনেছেন কান্ট ছিলেন ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের পুরোধা। আর মার্কস তো সেই কবেই চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান ঘোষণা করে দিয়েছেন। তাহলে আর এসব পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটার মানে কী? তা, মন্দ বলেন নি। যদিও কান্টের জ্ঞানতত্ত্ব মার্কস কীভাবে যুক্তি দিয়ে খারিজ করেছিলেন সে মনে করতে পারবেন না। বইপত্তরগুলো নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে দেখবেন নাকি একবার? এই জন্যে বলছিলাম যে, ‘তকুভ’ যে আসলে আপনার ওপর প্রতিশোধই নিচ্ছিলেন এই তত্ত্বটি প্রমাণ করতে হলে কান্ট ছাড়া আপনার গতি নেই। সব কিছু আপনি চোখে দেখেন নি তো কী হয়েছে, যেটুকু দেখেছেন তার থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার করলে এটাই হয়। এইবার কান্ট আপনার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবেন, জ্ঞানতত্ত্বের এটাই গোড়ার কথা। ইন্দ্রিয় অনুভূতিজাত অভিজ্ঞতা জ্ঞানের একটা উৎস, একমাত্র উৎস নয়। অন্য উৎসটা আছে আপনার ভেতরে। কান্ট বলবেন, পূর্বজ্ঞান, a priori. কাঁচা আমের রঙ সবুজ আপনার এই জ্ঞানের একটা উৎস আমের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে আসা সূর্যের আলো কিন্তু ওই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে যে আপনি সবুজ বলেই চিনবেন এটা আপনার মধ্যে পূর্বনির্ধারিত, a priori. আপনি তো ততদিনে ক্লাসে পড়েছেন যে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আপনার মধ্যে বিভিন্ন রঙের অনুভূতি তৈরি করে আর তারও একটা সীমা আছে। ওই সীমার চেয়ে কম বা বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আপনার চোখে পড়লেও আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। এসব তো আপনি জানেন। তাই কান্ট যদি বলেন, বাইরের জগত ইন্দ্রিয়ানুভূতির ভেতর দিয়ে কীভাবে আমার কাছে ধরা দেবে সেটা পূর্বনির্ধারিত, এই পূর্বনির্ধারিত ছন্দের সীমার মধ্যেই তাকে ধরা দিতে হবে তাহলে অত খাপ্পা হয়ে ওঠার কি আছে! কবিও তো বলেন সীমার মাঝেই অসীম সুর বাজিয়ে চলেছে। আপনার আবার কবিতা-টবিতা বিশেষ পোষায় না। তা বেশ তো, ওই যে দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার কথা বললেন ওখানেও গল্প আছে। কোত্থেকে জানলেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা? অ, ছোট্টবেলায় মা মার্বেল দিয়ে শিখিয়েছিলেন বলছেন? ভালো কথা। তা, এই যোগফলটা কষে ফেলুন তো। ৩৩+৪৩+৫৩। বাঃ, দিব্যি তো ঝপ করে করে ফেললেন। মাসিমা কি এটাও মার্বেল দিয়ে শিখিয়েছিলেন নাকি! নাকি সুধন্যবাবুর অঙ্ক ক্লাস থাকলে বস্তা করে মার্বেল নিয়ে আসেন? তখন তো দেখি কোন দিকে না তাকিয়ে খাতার ওপর ঝুঁকে ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাসও কষে ফেলছেন। কোন অভিজ্ঞতা থেকে? কোথায় তখন আপনার পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত?
যদি রাগ না করেন, একটা কথা বলি? ছাত্রজীবনে আমরা যে শুধু সুশিক্ষাই পেয়েছি এমন বলা যায় না। ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক তর্ক, সন্ধেবেলায় শ্রমিক মহল্লায় পড়ানো এগুলো মূল্যবান শিক্ষা। কিন্তু সব কিছুর ভেতরেই ‘দল’ এর উত্তেজনা ছিল। ‘কোন দিক সাথী কোন দিক বল/ কোনদিক বেছে নিবি তুই!’ দুরন্ত এর আবেদন। তীব্র নেশা এই উত্তেজনার। এই নেশার ঘোরে মানুষ, সমাজ, চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি সবকিছুকেই শিবির ভাগাভাগির দাগ টেনে দেখাটাই কর্তব্য জ্ঞান করেছি। দর্শনের দুটো শিবির। বস্তুবাদী আর ভাববাদী। বস্তুবাদী দর্শনটাই ঠিক আমরা তাই ওই শিবিরে - কিম্বা আমরা বস্তুবাদী শিবিরে বলেই ওটা ঠিক। ব্যস। লক্ষণের গণ্ডি কেটে দেওয়া হল। খবরদার এর বাইরে পা বাড়াবি না! ভাববাদী রাবণ মায়াবী রূপ ধরে ধরে নিয়ে যাবে। সেই নেশা, উত্তেজনা কবে কেটে গেছে। দলও ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিন্তু কর্তা গঙ্গালাভ করলেও কর্তার ভূত তো যেতে চায় না। শিবির কবে ডেরাডাণ্ডা উঠিয়ে নিয়েছে, আমার আপনার মতো লোকে সমাজ অর্থনীতির প্রচলিত প্রবাহেই নেমে পড়েছে। শুধু হৃতগৌরব বনেদিয়ানার নির্বোধ অহঙ্কারের মতো মাথার মধ্যে শিবির থেকে গেছে। আর কারুর তাতে কোন ক্ষতি হয় নি। আমার আপনার হয়েছে। কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য, দর্শন চর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। হস্টেলের ভাষায় একে বলে গাঁটামো।
তা নইলে, কান্টের সাথে একমত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল যে গণিতের ধারণাগুলো অভিজ্ঞতা থেকে আসে নি। কোত্থেকে এসেছে তাহলে? কান্ট হয়তো প্রশ্নটাকে পাত্তাই দেবেন না। কোত্থেকে এসেছে আবার কি! মানুষের মন কি স্রেফ সাদা কাগজ? পরিষ্কার স্লেট? লকের দাবী মতো tabula rasa? ইন্দ্রিয় অনুভূতি বাইরে থেকে যা এঁকে দেবে ওইটুকুই কি মানুষের মন? মন, তোমার মন নাই? আছে বই কি। বাইরের দিকে তাকিয়ে সে যা দেখে, শোনে সেসব কিছু নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েই তৈরি করে ধারণা, জ্ঞান, সত্য। যা রচিবে তাই তোমার সত্য। এই রচনার ভাষা তার একান্ত নিজের, বাইরে থেকে শেখা নয়। ভোরের অস্ফুট আলোটুকুই সে চোখে দেখে কিন্তু ওই আলো দেখার আনন্দটা তার। সেই আনন্দ থেকে উৎসারিত ভৈরবী রাগিণী তার একান্ত আপনার। প্রকৃতির বিচিত্র ছন্দকে যে গণিতের ভাষায় সে ‘ব্যাখ্যা’ করে সে ভাষায়ও তার জন্মগত, বাইরে থেকে শেখে নি। কার্য-কারণ নিয়ে ধারণাটাও তার নিজের। অভিজ্ঞতা থেকে সে দুটো আলাদা ঘটনা জানে কিন্তু ঘটনা দুটোর মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক সে অভিজ্ঞতা থেকে শেখে না। এমন কি আপনি যে তন্ময় হয়ে আম পাতাটাকে ওপর থেকে নীচে, এদিক থেকে ওদিকে দুলে দুলে পড়তে দেখে কান মলা খেলেন কান্ট বলবেন আপনি বিভিন্ন বিন্দু থেকে আসা আলো দেখছিলেন কিন্তু ওপর, নীচ এসব তো দেখেন না। স্পেসের ধারণাও অভিজ্ঞতা থেকে পান নি, ওটাও আপনার মাথার মধ্যেই ছিল, আছে। যা দেখেন তাকে ওই স্পেসে সাজিয়ে নেন।
এইটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এই তো দাঁড়িয়ে আছি করোনেশন সেতুর ওপর, পায়ের নীচে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে তিস্তা ছুটে যাচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি মাথার ওপর সেবক পাহাড়। এই সব কিছুকে বিভ্রম বলে মানতে হবে নাকি! প্রশ্ন করতেই পারেন। তবে স্পেসের প্রশ্নটা বিচার করার সময় গুরুর তত্ত্বের সমর্থনে শোপেনহাওয়ার যে উদাহরণ দিয়েছিলেন সেটাও খেয়াল রাখবেন। যষ্টি হাতে অন্ধের পথ হাঁটার উদাহরণ। আপনিও প্রতিদিন স্টেশনে দেখেন না, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম ..’ গাইতে গাইতে লাঠি হাতে টুক টুক করে অন্ধ মানুষটিকে ঘুরে বেড়াতে? ওঁর সিঁড়ি ওঠার পদ্ধতিটা লক্ষ্য করেছেন? লাঠিটা একবার ঠেকাচ্ছেন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেই ধাপে, তারপর একটু তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে, একবার বাঁদিকে লোহার রেলিঙটাও লাঠি দিয়ে স্পর্শ করে নিচ্ছেন। এইভাবে লাঠি দিয়ে স্পর্শ করে করেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, নামছেন, বাঁ দিকে ডান দিকে ঘুরছেন। শোপেনহাওয়ারের মোক্ষম প্রশ্ন সিঁড়ির ধাপের সাথে লাঠির যে স্পর্শ তিনি হাতের তালুতে অনুভব করছেন সেই স্পর্শের অনুভূতি তো ওপরের ধাপ বা নীচের ধাপে একই। রেলিঙের লোহার সাথে স্পর্শও ডানদিকে বাঁদিকে একই। জন্মাবধি তিনি কখনো ওপর নীচ ডান বাম এসব ‘দেখেন’ নি। তাহলে এই স্পর্শ দিয়েই ‘মানস চক্ষে’ স্পেস তিনি ‘দেখতে’ পাচ্ছেন কি করে যদি না স্পেস তাঁর মানসেই থাকতো?
যাই হোক, স্থান-কাল-পাত্রের এ সব কূটকচাল নিয়ে আপনার হয়তো মাথাব্যথা নেই। তবুও, একই সাথে কান্ট আর উপনিষদের কাছে শোপেনহাওয়ারের নাড়া বাঁধার গপ্পের খাতিরেই কথাগুলো উঠছে। ফিল্মের গপ্পো একেবারে বাদ দিয়ে তো হিরো-হিরোইনদের কেচ্ছা জমবে না! কান্টের মতিগতি দেখে আপনার সন্দেহ হতে পারে এই ভদ্রলোকও বোধহয় শেষমেশ ‘জগত মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য’-এ যেয়ে ভিড়বেন। তা কিন্তু নয়। কান্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অলীক বা বিভ্রম বলে সন্দেহ করেন নি। মনে করতেন, জগতের স্বরূপ দেখার বেলায় আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের মনের সীমার মধ্যেই জগত আমাদের বোধে ধরা দেবে। জগতের সমগ্র রূপ আমাদের বোধে ধরা পড়বে না। বলতেন, জগতের এই বস্তু সত্তা - thing-in-itself - এক অখণ্ড, অভিন্ন সত্তা। আমরা স্থান আর কালের ধারণার মধ্যে দিয়ে এই অখণ্ড সত্তাকে নির্দিষ্ট, খণ্ড চেহারায় দেখি।
আপনার নির্ঘাত ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’র খণ্ডাখণ্ড তত্ত্বের কথা মনে পড়ছে। আর এই তত্ত্বের ব্যাপারে শোপেনহাওয়ার এক্কেবারে গুরুর চেলা। ঘটনাকে আমরা যেভাবে দেখি স্থান আর কাল তার-ই অঙ্গ, thing-in-itself এর নয়। স্থান আর কাল-ই অখণ্ড অস্তিত্বকে খণ্ড অস্তিত্বে ভাগ করে রাখে। আমাদের এই দেখাকে শোপেনহাওয়ার বলবেন মায়া। স্থান-কালের এই মায়ার আবরণ সরিয়ে নিতে পারলে সব খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড, সব বিশেষের মধ্যে অবিশেষ আমাদের চোখে ধরা পড়তো। হ্যাঁ। মায়া শব্দটাই ব্যবহার করতেন। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? আমরা কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানি শোপেনহাওয়ারের পড়ার টেবিলে রাখা ছিল কান্ট এবং বুদ্ধের আবক্ষ মুর্তি আর টেবিলে প্রায় সব সময় খোলা পড়ে থাকতো উপনিষদের একটা খণ্ড। রাত্রে নাকি উপনিষদ হাতে নিয়েই শুতে যেতেন। বলতেন, বহুত্ব বা বৈচিত্র্য যে অখণ্ড সত্তার আপাত রূপ মাত্র এই ধারণার কথা কান্টের বহু আগে বেদ এবং উপনিষদে নানাভাবে বলা হয়েছে। মনে করতেন তাঁর শতাব্দীর “মহত্তম উপহার” হল ইউরোপের কাছে সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার খুলে যাওয়া।
শোপেনহাওয়ার অবশ্য সংস্কৃত জানতেন না। সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার তাহলে ওঁর কাছে খুলে গেল কীভাবে? সে গল্পটাও শুনে রাখুন। শোপেনহাওয়ার উপনিষদ পড়েছিলেন ল্যাটিন অনুবাদে। অনুবাদ করেছিলেন ফরাসী পণ্ডিত অ্যানকুতিল দ্য পেরন। সেও কিন্তু মূল সংস্কৃত থেকে নয়, ফারসি অনুবাদ থেকে। কী বললেন, উপনিষদের আবার ফারসি অনুবাদ কবে হল? ঠিকই, আপনার অবাক হওয়ারই কথা। দারা শিকো, সম্রাট শাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র, সংস্কৃত থেকে উপনিষদের ফারসি অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদই ফরাসী পণ্ডিতের হাতে ল্যাটিনে অনূদিত হয়ে শোপেনহাওয়ারের পড়ার টেবিলে পৌঁছেছিল।
সে তো হল, কিন্তু এ হেন উপনিষদে মগ্ন দার্শনিককে পড়ে তলস্তয়ের গলায় দড়ি দেওয়ার সাধ জেগেছিল কেন?
মুশকিল ওখানেই। শোপেনহাওয়ার কেন হতাশাবাদী সে নিয়ে দু’ চারটে বই ঘেঁটে আপনি একখানি প্রবন্ধ নামিয়ে দিতে পারেন। লিখবেন নাকি, পরের সংখ্যায়? নাঃ, থাক। ওই যে বলছিলাম, এঁকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাটি না করাই ভালো। একে তো বাজারে আপনার বদনাম হবে। প্রগতিবাদী তত্ত্বালোচনার অলিখিত নিয়ম হল রূপকথার গপ্পের মতো হ্যাপি এনডিং হতে হবে। আর এই ভদ্রলোক কিনা রাজ্যের যত জ্ঞান ভাণ্ডার ঘেঁটে, তত্ত্বের বিপুল কাঠামো বানিয়ে বলবেন, দেখেছেন তো শেষ অব্দি আপনার গলায় দড়ি দেওয়াই ভালো!
বিশ্বাস হচ্ছে না তো? সেই ভালো, বিশ্বাস করে কাজ নেই। এমনিতেই আপনার মন মেজাজ ভালো না। কিছুই ভালো লাগে না। হস্টেলের কৌশিককে মনে পড়ে? ভারি সুন্দর পোস্টার লিখতো। একদিন দেখা গেল বারান্দার দেওয়াল জুড়ে এ্যত্ত বড়ো বড়ো হরফে লিখে রেখেছে, ‘আর ভাই!’ রোজ সকালে চোখটা খুলে ওই কথাই মনে হয়। তবু প্রবন্ধ লেখেন। ভালো ভালো কথাই লেখেন। লিখতে ভালো লাগে। মনটা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভালো থাকে। ছেপে বেরোনর পর জনা তিনেক বন্ধুও দুটো ভালো কথা বললে দিনটা ভালো যায়। সে ঠিক আছে। কিন্তু, যা বলছেন সেটা বিশ্বাস করেন? না, না, ব্যাপারটাকে পারসোনালি নেবেন না। আমার আপনার মতো লোকের জেনেরিক সমস্যা হিসেবে বলছি। আমরা সমাধান জানি না এমন সমস্যা তো বোধহয় ভূভারতে নেই! তাই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করতে অসুবিধে হয় না। নাগরিক পঞ্জি থেকে জৈব চাষ, জলের আকাল থেকে ট্রাম্পের বিদেশ নীতি। এত কনফিডেন্স কোত্থেকে আসে মশাই? সমাজে যা যা হবে বলে সেই কবে থেকে বলে আসছি সব তো তার উল্টো উল্টো হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে ইদানীং যা বলা শুরু করেছি সেগুলো অবশ্য শুনতে ভালোই লাগছে। কারণ আমরা তো আর কোদাল কুপিয়ে চাষ করতে বা জল ধরে রাখতে যাচ্ছি না।
যাক গে। যে কোন কথাতেই দুই বুড়োকে টেনে আনা একটা বাতিক হয়ে যাচ্ছে, তবু তত্ত্বালোচনার চেয়ে ওই বুড়োদের গল্প করাই বরং ভালো। সবাই জানে, দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনটাতে গান্ধী বেলেঘাটায় ছিলেন। সারা দিন কাটিয়েছেন উপবাস আর প্রার্থনায়। যে দিনটার জন্য দীর্ঘ দীর্ঘ বছর নিরলস পথ হেঁটেছেন সেই দিনে পৌঁছে কী বলেছিলেন শুনেছেন? শোনেন নি। কেন, পণ্ডিত নেহরুর tryst with destiny তো মুখস্থ বলে দিতে পারবেন। না, দোষ আপনার নয়। বলি শুনুন, আরো কয়েক বছর পিছিয়ে যান। ভয়াবহ দাঙ্গার খবর পেয়ে নোয়াখালি যাচ্ছেন গান্ধী। যাওয়ার পথে বলছেন, এখন দেশের আর কোথাও আমার অন্য কোন কাজ নেই। এখন শুধু ওই গ্রামগুলোতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। কারণ, পথ দেখতে পাচ্ছি না। চল্লিশ বছর ধরে যে সত্য আর অহিংসার ওপর ভরসা করেছি এখন সেটা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। তারপর জীবনের বাকি বছরগুলো এই আত্মহননের আগুন নেভানোর জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন নোয়াখালি থেকে বিহার, কলকাতা, দিল্লী, পাঞ্জাব। প্রার্থনা করেছেন, শান্ত হতে বলেছেন, অনুতপ্ত হতে বলেছেন, ভালোবাসতে বলেছেন কিন্তু মিছে আশা দিয়ে বলেন নি যে এই পথেই মুক্তি। স্বীকার করেছেন, তিনিও পথ খুঁজছেন, তাই ১২৫ বছর বাঁচতে হবে ওঁকে। বেলেঘাটার রাস্তায় চোখের সামনে সন্তানকে হত হতে দেখলেন যে মা, তাঁকেও সান্ত্বনা দেন নি। বলেছেন, যিনি তোমাকে সন্তান দিয়েছেন তিনিই ফিরিয়ে নিয়েছেন, কাঁদছো কেন। আর তো কিছু বলার ছিল না। সেদিনও কিছু বলার ছিল না যেদিন বড়ো বেদনার মতো এলো তাঁর স্বরাজ। দুদিন ধরে বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেশ বিদেশের যতো সংবাদ মাধ্যম। বহু কাঙ্ক্ষিত স্বরাজ লাভের ঐতিহাসিক দিনে মিস্টার গ্যান্ডি কী বলেন শোনার জন্য। মিস্টার গান্ধী বলছেন একটাই কথা। ওঁর কিছুই বলার নেই। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকের দল সে কথা শুনবে কেন। ওদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নির্মল কুমার বসু। বি বি সি’র সাংবাদিক এত জ্বালাচ্ছিল যে নির্মল কুমার বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতর এসে বললেন, আর তো পারা যাচ্ছে না, আপনি না হয় কিছু একটা বলেই দিন। বাপু বললেন, ওদের বলো, আমি যে ইংরেজি বলতে পারি সে কথা ভুলে যেতে।
বুঝেছেন, একে বলে সততা। আপনার ব্লগবিহারী ফেসবুক বিপ্লবীরা আর কিছু না হোক বাপুর কাছ থেকে এই সৎ আত্মঅনুসন্ধানটুকুও শিখলে দেখতে পেতেন সমাজকে দেখায়, মানুষকে দেখায় কত কিছুই শিখতে বাকি। বস্তুত, মানুষকে তো ওঁরা দেখতেই চান নি, উৎপাদন সম্পর্ক আর শ্রেণী সংগ্রামের বাই প্রোডাক্ট ধরে নিয়ে রণনীতি আর রণকৌশলের অঙ্ক কষা নিয়ে মেতে থেকেছেন। যাই হোক, বিপ্লবীদের ব্যাপার স্যাপার ওঁরাই বুঝুন। তবে আপনি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখতে পারেন। আমরা জানি, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এখানের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে গান্ধী ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনের আর কংগ্রেস সংগঠনের মেজাজ, চরিত্র পালটে ফেলছিলেন। লক্ষ্য করুন, এই পালটে ফেলার গোড়ার ধারণাটা ছিল স্বরাজ মানে শুধু যেনতেন প্রকারেণ ব্রিটিশদের বিদায় করা নয়। বাকি সব বন্ধনগুলো থেকেও মুক্তি। উচ্চবর্ণের হাতে অবমাননা থেকে, সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ থেকে, ব্যক্তিজীবনে লোভ আর বাসনা থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় বেশ কয়েকবার ওঁকে ইংল্যান্ড যেতে হয়েছিল আর সেই সময় পরিচিত হন তলস্তয়ের ভাবনার সাথে। তলস্তয়ও তখন সাহিত্য সৃষ্টি থেকে দার্শনিক, রাজনৈতিক ভাবনায়, লেখালেখিতে বেশি সময় দিচ্ছেন। লিখছিলেন, কুসংস্কারমুক্ত কোন লোককে বলে দেখুন একটা সওদাগর সংস্থা দু’ কোটি মানুষের একটা জাতিকে পরাধীন করে রেখেছে, লোকটা বুঝতেই পারবে না কথাটার মানে কী? তিরিশ হাজার লোক, কেউ তারা মোটেই ব্যায়ামবীর নয়, বরং রুগ্ন সাধারণ লোকজন, তারা দু’ কোটি প্রাণবন্ত, চতুর, দক্ষ, স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষকে পরাধীন করে রেখেছে - কী অর্থ হতে পারে কথাটার? এটাই বোঝা যাচ্ছে না কি যে ইংরেজরা নয়, ভারতীয়রাই নিজেদের পরাধীন করে রেখেছে? কথাটা মনে ধরেছিল তরুণ মোহনদাসের। তারপর সারা জীবন ধরে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করেছেন পরাধীনতার এই বাঁধনগুলো, খুঁজেছেন বন্ধন থেকে উত্তরণের পথ। নিরলস বলার চেষ্টা করেছেন অস্পৃশ্যতা দূর করা, গ্রাম অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, হিন্দু মুসলিম ঐক্য, মদ্যপান নিবারণ এইসব কর্মসুচীর কোনটাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার কর্মসূচী থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোলটেবিল বৈঠকের সময় লন্ডন থেকে একবার যুক্তরাষ্ট্রে বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন। তার আগে এ রকম অভিজ্ঞতা ছিল না, যন্ত্রপাতিগুলোও অচেনা, তাই ভাষণ শুরুর আগে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কথা বলতে হবে গো, এখানে বুঝি? জানতেন না যে ততক্ষণে ‘অন’ হয়ে গেছেন, তাই মহাসাগরের ওপারের শ্রোতারাও শুনলেন সে কথা। আর তারপর শুনলেন, এই অদ্ভুত মানুষটি বলছেন ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলন এযাবৎ অন্য সব জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ের থেকে আলাদা। কারণ আমরা শুধু আমাদের মুক্তির জন্য লড়ছি না, মানুষের মুক্তির জন্য লড়ছি। কাউকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, সবাইকে আপন করে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য।
অবিশ্যি এও ঠিক যে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুগামীরা ঠিক এরকম ভাবে দেখতেন না। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে কুমারাপ্পার মতো কয়েকজন সহকর্মীর কথা বাদ দিলে বাকিরা বাপু বলছেন বলেই মেনে নিতেন। পণ্ডিত নেহরু যেমন হিন্দু-মুসলিম সমস্যাকে ব্রিটিশের divide and rule এজেন্ডার বাইরে দেখতে চাইতেন না। ভরসা করতেন মানুষের শ্রেণীচেতনার ওপর। মুসলিম লীগ আর হিন্দু মহাসভার নেতারা যতোই উস্কানি দিক শেষ পর্যন্ত সাধারণ দরিদ্র কৃষক তাঁদের শ্রেণীশত্রুদের চিনতে পারবেন। আশা করতেন দেশ স্বাধীন হলে, আধুনিক শিল্প অর্থনীতির প্রসার হলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভেদাভেদ এমনিই মুছে যাবে। কী হয়েছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কথা হল, পণ্ডিতজী শোপেনহাওয়ার পড়েন নি? মানুষের মধ্যে নিহিত অদম্য বাসনার তত্ত্বের কথা শোনেন নি। শুনেছিলেন। শোপেনহাওয়ারের গুণগ্রাহীও ছিলেন। কিন্তু মেজাজের দিক থেকে দুজন ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর। গত শতাব্দী যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশা নিয়ে এসেছিল নেহরু ছিলেন সেই আশার আলোয় স্নাত। আধুনিক প্রযুক্তি আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের সব কালো সব অন্ধকার মুছে ফেলবে এই উদ্দীপনার মেজাজ শুনতেই চাইবে না যে অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে মানুষের নিজের মধ্যেও। নবযুগ আনার ব্যস্ততার মুখে ‘বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়’ সে কূট আলোচনাও যে পাপ।
উল্টোদিকে শোপেনহাওয়ারকে আচ্ছন্ন করেছিল বিপ্লব পরবর্তী যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপের বিষণ্ণতা। অসামান্য প্রতিভাধর হলে কি হবে, ওঁরও ছিল আমার আপনার মতোই মন খারাপের ব্যামো। ব্যক্তিগত জীবনেও নিঃসঙ্গতা। সেই জন্যেই হয়তো উপনিষদ নিত্য পাঠ্য হলেও উপনিষদের শান্ত, উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিস্ময়মুগ্ধ মেজাজ ওঁকে স্পর্শ করে নি। জগতময় অখণ্ড সত্তার ধারণা গ্রহণ করলেও ঈশোপনিষদের সর্বব্যাপি, জ্যোতির্ময়, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ সত্তাকে খুঁজে পান নি। দেখতে পেয়েছেন জগতব্যাপী অশুভ বাসনার ঘন অন্ধকার। যে বাসনার করাল গ্রাস থেকে মানুষের রেহাই নেই। থাকবে কি করে। বাসনাই তো মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বাসনা তৃপ্তির নিরন্তর চেষ্টার পরেও বাসনা অতৃপ্তই থাকবে। ভিক্ষা যেমন ভিক্ষুকের ক্ষুধার নিবৃত্তি করে না শুধু আরো ভিক্ষা চাওয়ার জন্যে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যু ছাড়া তো এই খিদের অবসান নেই। শোপেনহাওয়ার বলবেন, মৃত্যুতেও নেই। ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাসনার অপ্রতিহত যাত্রা। তাহলে, হের দার্শনিক, আমাদের কি কোন গতিই নেই? জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। শোপেনহাওয়ার কিন্তু বলবেন না, যে, না কোন গতিই নেই। হাজার হোক, জার্মান তো। কৌশিকের মতো ‘আর ভাই!’ বলে বসে থাকতে পারেন না। বলবেন, আছে, সচেতন বুদ্ধির একটাই উপায় আছে অচেতন বাসনাকে হারিয়ে দেওয়ার। আত্মহত্যা! ব্যাস, বাসনার সব জারিজুরি বন্ধ। বুদ্ধির নিরঙ্কুশ জয়।
তাই বলছিলাম, শোপেনহাওয়ারকে বেশি ঘাঁটাবেন না। আপনি দুর্বল চিত্ত মানুষ। প্রবন্ধ লিখছেন লিখুন। সাবজেক্টের কি অভাব নাকি মশাই। নাগরিক পঞ্জি, জৈব চাষ এসব একঘেয়ে হয়ে গেলে গ্রেটা থুনবার্গ, বিল গেটস এবং করোনা চক্রান্ত, বিশ্বভারতীর পাঁচিল। ইস্যু আসতেই থাকবে। শুধু যাই বলুন না কেন শেষে একটু আশা ছুঁইয়ে রাখবেন। তা না হলে বাজারে দুর্নাম হবে আর একলা পড়ার টেবিলের আশেপাশে শোপেনহাওয়ার ঘুরঘুর করতে পারেন। সব ব্যাপারে সমাধান বাতলানো চাপের ব্যাপার বলছেন। আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কায়দাটা শিখলেন না এখনো? শুনুন, যে ইস্যু নিয়ে লিখবেন - করোনা ভাইরাস, রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত কিনা, অনলাইন ক্লাস বাঞ্ছনীয় কিনা, যাই হোক - প্রথমে বেশ খানিক বিশ্লেষণ করে আপনাকে দেখাতে হবে সমস্যাটি একচেটিয়া পুঁজির দাপটের ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাস। হয়ে গেল। আপনার কাজ মোটামুটি শেষ। কারণ পুঁজির মোকাবিলা কী করে করতে হবে সে আবার আপনাকে বলে দিতে হবে নাকি। আর্কাইভ ভর্তি বই আছে, যার দরকার দেখে নিতে পারে। আর তাছাড়া আমাকে আপনাকে তার জন্যে বিশেষ কিছু করতেও হবে না। পুঁজির এই হয়ে এল বলে। বিপ্লবীরা তো তাই বলেন। সঙ্কট ঘনায়মান। বিশ্বাস হয় না বলছেন? এই দ্যাখো! বিশ্বাস করতে কে বলেছে। আশা করতে হবে আপনাকে। আর আশাবাদী হওয়ার এই হলো খাঁটি যুক্তিবাদী পদ্ধতি।
দারা শিকো মহাভারতেরও একটা অনুবাদ করলেন না কেন? সাইজ দেখে ঘাবড়ে গেছলেন? রাজশেখর বসুর মতো কাটছাঁট করে নিতে পারতেন। তাহলে হয়তো শোপেনহাওয়ার মহাভারত পড়ারও সুযোগ পেতেন। ভারি খুশি হতেন বক আর যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তর শুনে। বার্তা কী? এই মহামোহরূপ কটাহে কাল প্রাণিসমূহকে পাক করছে। মাস-ঋতু তার আলোড়নের দর্বি। এই বার্তা। সাধু, সাধু, শোপেনহাওয়ার বলতে পারতেন, কান্টও বলেছেন টাইম আর স্পেস ফেনোমেনানের হাতা খুন্তি বই নয়। আশ্চর্য কী? প্রাণিগণ প্রত্যহ যমালয়ে যাচ্ছে, তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবী হতে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য কি আছে? নাঃ, এইটা কেমন উত্তর হল। নেহাত বকের রূপ ধরে ধর্ম প্রশ্নগুলো করছিলেন তাই যুধিষ্ঠির পার পেয়ে গেলেন। শোপেনহাওয়ার প্রশ্নকর্তা হলে ধর্মপুত্র পাশ করতেন না। এতে আশ্চর্যের কি দেখলে হে? প্রাণিগণকে এর চেয়ে যুক্তিশীল আচরণ করতে আবার কবে দেখলে। চাকরিবাকরি নেই, যাদের ছিল তাদেরও হয় তিরিশ শতাংশ মাইনে ধরিয়ে দিচ্ছে কিম্বা তাড়িয়ে দিয়েছে অথচ ব্যাটাদের রাত্তিরে ঘুম হচ্ছে না ফিল্মের হিরো কেন মরল তাই নিয়ে। বাসনা, বুঝেছ হে, অন্ধ বাসনা। হাতের কাছে কাউকে একটা চাই সবাই মিলে কিল মারার জন্য, ট্রোল করার জন্য, রাস্তায় থেঁতলে দেওয়ার জন্য। রামলালার পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হয়ে গেল কিন্তু মুসলিমগুলো চুপ মেরে গেছে। তাহলে আর ওহি বানায়েঙ্গে বলে লাভ কি হল? নতুন কিছু চাই। হিরোর একটা বাঙালি গার্ল ফ্রেন্ড ছিল না? ওই নিশ্চই কিছু করেছে। হে ধর্মপুত্র, আপনি শুনেছেন আপনার আর্যাবর্তের উচ্চশিক্ষাবিদ্যালয়ে যুবক যুবতীরা এখন বিশ্বাস করছে বাঙ্গালী মেয়েরা কালা যাদু জানে। বাঙ্গালীরা তো সব মুসলমান। কেন নয়? ওরা তো বাঙ্গলাদেশী, হিন্দিও বলে না, দাড়িওলা কবির ছবি দেওয়া টিশার্ট পরে, ওই কবিটাও তো হিন্দু ছিল না।
আশ্চর্য নয়? মানুষকে যুক্তিশীল বলে আশা করেছিলেন, ধর্মপুত্র? হ্যাঁ, যুক্তির চর্চাও করেন কেউ কেউ। আপনি ফেসবুক করেন নি, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব? সঞ্জয় তো করতেন। ওই দেখেই তো অন্ধ কুরুপতিকে যুদ্ধের বর্ণনা দিতেন। আপনিও ফেসবুকে যেয়ে দেখুন যুক্তিশীলরা এসব দেখে শুনে আশায় উল্লসিত। সঙ্কট পেকে উঠেছে। এই তো বিপ্লবের মহালগ্ন। বন্ধুগণ, আমি আগেই বলেছিলাম। জার্মানদেশীয় পণ্ডিতের আর কি দোষ বলুন? নিজের গলায় নিজেই এমন জয়মাল্য পরানোর চেয়ে এক গাছা দড়ি ...।
আট
আড়মোড়া ভাঙতেই পুরোনো কফিন চৌচির। বাঁচতে চায় বলে মৃতরা যে যার লাশ আর লাশ গুলো মাপ মত পায়জামা খুঁজে ঢুকে পড়ল তার ভিতরে।এতদিনের ঠান্ডা শরীরে উত্তাপ ফিরছে দেখে মমি রক্ষনাবেক্ষনে যারা ছিল তাদের অনির্দিষ্ট কাল ছুটি ও ব্যাজার মুখ।
কতকাল পরে এরা বাঁচতে শিখছে দেখে পলাশ আরো লাল হল। কেউ দেখেনি। পাখি’রা বহুদিন বাদে গানে ফিরলো। কেউ শোনেনি। আকাশ আরো নীল, উঁকি দিল কৃত্তিকা। বাঁচবে বলে এ শহর ভুল উল্লাস ছেড়ে উড়াল দিয়েছে ছায়াপথে। আকাশগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে পুরোনো পালক।
নয়
এ একটা ভাঙাচোরা ক্যারাভান অথবা নূহের নৌকো। মরুসমুদ্রে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই। উথালি পাথালি নাও বুক চেপে উগরে দিচ্ছে ভয় আর শ্বাসকষ্ট। অকরুণ আগুন পুড়িয়ে দিচ্ছে চোখ, চুল, পায়ের পাতা আর হিমস্রোতে কুঁকড়ে যাচ্ছে কেউ। ক্লান্তিহীন উজানে চোখে জুড়ে ইঁদুরের মৃত্যু ভয় অথবা আরারাত পাহাড়। ফ্যাসফ্যাসে শুকনো গলায় ঈশ্বর ও তার দালালদের অভিশাপ দিযে লুটিয়ে পড়লো কেউ। ওরা হাঁটছে। পায়ে পায়ে ধুলোমেঘ। কতকগুলো চলমান ধুলোমেঘ আরারাত পাহাড়ের খোঁজে সারারাত্রি হেঁটেছে। নষ্ট বলতে কয়েকটা ইঁদুর।
প্রবন্ধটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখকের The Concept of Bharatavarsha and other Essays বইয়ের প্রথম অংশ। এই বইয়ের প্রকাশক Permanent Black, Ranikhet।
এই প্রবন্ধের থিম হিসেবে ‘ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় ধারণা’ – বিষয়টি আলোচিত হওয়ার নানান কারণ আছে। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ - পোশাকী নাম INDIA। এর একটা মানচিত্র আছে, সেই মানচিত্রে নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে, যা এই দেশকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করেছে। ১৯৪৭এর দেশভাগ এই মানচিত্রে বদল ঘটিয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষ নাম, ও তার ধারণা একই রয়ে গেছে। ম্যাপে যে বদলই হোক না কেন, ‘দেশ’ সম্পর্কে তৈরি হওয়া ধারণাটা, পূর্বজদের থেকে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত একই। অথচ ঐতিহাসিক পরিবর্তনের নিরিখে ভারতবর্ষ বা INDIA, ধারণাটিরও কালোচিত পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের দিকটিকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। অন্য কথায়, একটা ধারণা, বা তার দ্বারা ভৌগোলিক ভাবে সীমায়িত একটা রূপ, এবং তার ঐতিহাসিক সঞ্চারপথ, - এই দুইয়ের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক মূল্যায়নের দাবি রাখে। কেননা এখন আমরা যেটাকে ‘মান্য’ হিসেবে গ্রহণ করছি, সেটা কতগুলো ‘অনুমানের’ সমাহার মাত্র! আমার তথ্যসূত্রের মধ্যে একই কথার যথেষ্ট অর্থগত পার্থক্যকে আত্মীকরণ না করেই এই অনুমানের জন্ম, এবং তা ভারতের ইতিহাসের, বিশেষত প্রথম দিককার অংশের সাধারণীকরণে যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের সবচেয়ে বড় অনুমান—ভারতবর্ষ ও INDIA-র অভিজ্ঞান (identity) গত ধারণা। এই ধারণার একীভূতকরণের ধারাটিকে ঐতিহাসিক ভাবে ব্যাখ্যা করা এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়।কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, উনবিংশ শতাব্দীতেই, কী ইতিহাস রচনায়, কী সাধারণ চিন্তায়, এই অভিজ্ঞানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাঁরা INDIA- র ওপর বা এই ধারণাটির ওপর লেখালেখি করেন, তাঁরা ধরে নেন, তাঁরা যে ভাবে এই ধারণাটিকে দেখাতে চাইছেন সেটাই ‘ভারতবর্ষ’। এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা দেশের অতীত বা ইতিহাস থেকে পাওয়া ধারণাটিকেই বহন করছেন। এমনকি ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার শুরুর দিকে এ ধরনের ইতিহাসের কথা ভাবা যেত। সেই মৌলিক ধারাপথে সৃজিত হতে পেরেছিল ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ এর মতো গ্রন্থ। ভারতবর্ষ ও INDIA-র চিহ্নিতকরণের এক ইতিবাচক বিবৃতি আমরা পাই, পৌরানিক ভূ-বিবরণের (Puranic cosmography) এক প্রখ্যাত গবেষকের লেখায়। তিনি লিখছেন - “সুদূরতম দক্ষিণের ‘বর্ষ’ ‘ভারত’ হিমবাত এবং সমুদ্রের মধ্যে শায়িত, সেটাই নিশ্চিতরূপে ‘INDIA’ “ (নিম্নরেখা লেখকের)।
INDIA ও ভারতবর্ষের এই পরিচয়ের দ্বিধাহীন পরিগ্রহণ আরও সুসংহত রূপ পায় আমাদের সংবিধানের এই সুমহান ঘোষণায়—
“ india that is Bharat shall be a union of states.” এই ঘোষণা, আমাদের দেশ-পরিচয়ে তথা জাতীয়তাবাদে ঐতিহাসিক সীলমোহর দিলেও, ইতিহাসে তার কোনো মান্যতা থাকে না, স্বভাবতই। মনে রাখতে হবে, এই নামের অনেকগুলি উৎসমুখ আছে। একদিকে ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা নির্দেশিত একটি দেশ, যার নাম ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করেছে, অপরদিকে ‘ভারতবর্ষ’ এই নামটি চিরকালীন না হলেও ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন প্রাচীন লেখায় নানাভাবে, সম্পূর্ণ বিপরীত ভূ-বিবরণগত গঠনের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং ‘ভারতবর্ষ’ এই নামটি একটি সম্পূর্ণ পৃথক অর্থমাত্রা বহন করে। বিভিন্ন লেখার মধ্যে এটাই উপস্থাপিত হয়, কীভাবে ‘ভারতবর্ষে’র এই ধারণা নানা বিভিন্নতাকে একসঙ্গে ধারণ করে। এই ‘নাম’এর পূর্ব ইতিহাস, এবং সম্ভাব্য স্বাধীন সূত্রগুলি অনুসরণ করে এবং যে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ কথাটি উঠে এসেছে, সেই প্রসঙ্গ বিচার করলে তা অভূতপূর্ব এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। এই ইস্যুগুলিকে সংযোগ করা ইতিহাস রচনার বৈশিষ্ট্যও বটে! ভারতবর্ষ সংক্রান্ত ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম চর্চার প্রয়াস সত্ত্বেও আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধারণাকেই মান্যতা দিয়ে এসেছি যে, যে দেশে আমরা বাস করি, তার সংজ্ঞা বরাবরই একই রয়ে গেছে। আমরা দেশকে যে ভাবে ভাবছি, তা অতীতেও একই ভাবে ভাবা হয়েছে। একই সময়ে এটা সাধারণ বোধের বিষয়ে যে, ভারতবর্ষের ভৌগোলিক স্থান ও তত্ত্বগত ধারণা বারবারই সংজ্ঞায়িত ও পুনর্সংজ্ঞায়িত হয়েছে। একটি স্থানের ইতিহাস ও মানুষজনকে বুঝতে হলে এই সংজ্ঞাকরণ ও পুনর্সংজ্ঞাকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে সচেতন হতে হয়। দ্বিতীয়ত একটি নির্দিষ্ট যৌথ সংবেদনশীলতা, যাকে সাধারণভাবে ‘জাতীয়তাবোধ’ বলা যায়, তার চিহ্নিতকরণে এই সামাজিক-ভৌগোলিক পরিসর বা সেখানে বসবাসকারী জনজাতির উৎকর্ষের দিকটি মর্যাদা পায় না। এটা এমন এক সংবেদনশীলতা, যা ঐতিহাসিকভাবে আহৃত, এবং তা নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। একটি দেশ বা সেই দেশের ধারণা স্বাধীন ভাবে সেই যৌথ সংবেদনশীলতায় বিরাজ করতে পারে, যদি না সেই ঐতিহাসিক ভাবে অর্জিত সচেতনতা নানা ধরনের স্পষ্ট ভাষ্যের মধ্যে দিয়ে প্রদর্শিত হয়।
এখন, যখন আমরা ভৌগোলিক ভাবে সীমাবদ্ধ (তা সে যে ভাবেই হোক না কেন) এবং সাংবিধানিকভাবে সংজ্ঞায়িত একটি বিশেষ ভূ-খণ্ডকে আমাদের দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছি, যেখানে আমরা বসবাস করি, সেই ‘দেশ’ কথাটির মানে কী, তার কোন্ অতীত আমার কাছে ধরা দিচ্ছে, তা নিয়ে জরুরী আলোচনার দরকার হয়ে পড়ে নানা কারণেই। ইতিহাস রচনার দিক থেকে আমরা এই অর্থ সম্যকভাবে বোঝার একটি নির্দিষ্ট বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি। বিশেষত INDIA ও ভারতবর্ষের ধারণা সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন আছে। বিশদে না গেলেও বর্তমান লেখালেখি বা চর্চার মধ্যে একজন তিন-তিনটি বড় অবস্থানগত ভিন্নতা লক্ষ্য করতে পারবেন। এক, ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক গঠন থেকে সৃষ্টি হয়েছে, এটি আঞ্চলিক শাসনযোগ্য ইউনিট হিসেবেই সৃষ্ট। অন্য অংশ থেকে পৃথক হচ্ছে প্রশাসনিক কারণে। এই অংশটি INDIA তথা ভারতবর্ষের ধারণাটিকে সূদুর অতীতের জাতীয় ঐক্যের ধারণা দিয়ে দেখার পক্ষে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত The fundamental unity of India র মত গ্রন্থ এই ঐক্যের ধারণাটিকে জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করে। এই ধারণায় ‘ঐক্য’ একটি দেশের মৌলিক গুণ, যার সাক্ষ্য পাওয়া যেতে পারে ভারতের ভৌগোলিক ধারণায়, পর্যটনকেন্দ্রগুলির কার্যকারিতায়, ভারতের সাম্রাজ্য জয় বা ঔপনিবেশিকতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য-আহ্বান প্রকাশিত, তার মধ্যে। ভারতের ঐক্যবদ্ধ চেহারার বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভারতের ইতিহাসের কিছু বইতে ছড়িয়ে আছে। অন্য অঞ্চলগুলির স্বকীয়তা সত্ত্বেও ভারতের এই ‘নেশনের’ ধারণাটি ‘ভারতবর্ষের’ ভূগোলের আলোচনায় বারবার আসছে, এখনও। ভারতবর্ষ তথা INDIA একটি প্রাচীন নেশন হিসেবে The fundamental unity of India নামক গ্রন্থে যেমনভাবে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনভাবেই পাওয়া যাচ্ছে The concept of India নামক সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থে। এই গ্রন্থে জানানো হচ্ছে-
“ অবশ্যই এই উপমহাদেশের ( যে দেশটি উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত) বাসিন্দারা পৌরাণিক লেখকদের বিবরণ অনুযায়ী, ভৌগোলিক , সাংস্কৃতিক ভাবে একটি ‘নেশন’ হিসেবে উল্লিখিত। এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই প্রতীতি আছে যে, এই সমগ্র উপমহাদেশে ( অথবা এর একটা বড় অংশে) বসবাসকারীদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সেতু আছে, অথবা তারা একই সাংস্কৃতিক ছাতার নিচে , সাধারণ বৈশিষ্ট্যসহ বসবাস করে। সেটা এতটা গভীর, যে তাদের একটা সাধারণ নামে অভিহিত করা যায়—‘ভারতী’। সুতরাং রাজনৈতিক এবং জাতিগত ভাবে না হলেও, ভৌগোলিক এবং সংস্কৃতিগত ভাবে, ‘ভারতী’ একটি নেশন।“
Imaginary Institutoion of India প্রবন্ধটি, যা Subaltern studies সিরিজের একটি ভল্যুমে প্রকাশিত, সেই প্রবন্ধে ঠিক উল্টো অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে যথেষ্ট জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে—
“আজকের ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা সেটাই, যে নৈর্ব্যক্তিকতা ভারতবর্ষের মানুষদের স্পষ্টভাবে জানায়, স্বীকৃত বাস্তবতা হল, একে রক্ষা করা, ধ্বংস করা, তুলে ধরা, গঠন বা বিচ্ছিন্ন করা — সবই, পক্ষে বা বিপক্ষে সমস্ত ক্ষেত্রেই, বিষয়টি আবিষ্কারের নয়, উদ্ভাবনের । এটা উনবিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদী কল্পনার দ্বারা ঐতিহাসিক ভাবে নির্মিত।“ ( নিম্নরেখা লেখকের )
এই বিবৃতিটি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য-নির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে কী নেই, সেই বিচার বাদ দিয়েও বলা যায়, এখানে কিছু নিহিত ধারণার কথা আছে, যা কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক করে।
১. এখানে জাতীয়তাবাদের ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতা’ ও ভারতবর্ষের ধারণার মধ্যে যে আবশ্যিক সমীকরণ স্থাপিত হয়েছে সে বিষয়ে
২. ‘উদ্ভাবন’ কোনো পূর্ব ধারণাসঞ্জাত নয়, বরং শূন্য-উদ্ভূত বা ভিন্ন ধরনের ‘নৈর্ব্যক্তিক ঠবাস্তবতা’ হলেও হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই জাতীয়তাকে চিহ্নিত করে না
৩ .ভারতের ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে আধুনিক ধারণার উত্থানের সম্ভাবনাকে এবং সেই উত্থানের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সম্পর্কের নির্মাণকে উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী কল্পনার ওপর ‘উদ্ভাবন’কে আরোপ করা।
একটি পূর্বজাতীয়তাবাদী অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, এই প্রবন্ধ একই সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান আদতে কী, তার সংজ্ঞা এবং ভারতবর্ষের ধারণা - উভয়কেই অস্বীকার করে। কেননা এটা ভারতবর্ষের ‘নৈবর্ক্তিক বাস্তবতা’ ও ভারতের জাতীয়তাবাদ, যা কি না আধুনিক, তাকে এক করে দেখে। এই অস্বীকরণ C.A.Bailey-র Empire and Information গ্রন্থেও দেখা যায়। এখানে ভারতবর্ষের ধারণাকে ‘জাতীয়তাবাদী সচেতনতা উন্মেষের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। একটা সময়ে ভূগোলকে ‘ব্রিটিশ উপনিবেশের তথ্য সংগ্রহের জন্য হৃদয়ের কাছাকাছি’ একটি সমাজ-বিজ্ঞান হিসেবে দেখানো হয়েছে। বেইলি ইউরোপিয়ান এবং তিনি ‘ভূগোলের হিন্দু ধারণাকরণে’র স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেন, এবং এই বৈপরীত্যের আলোতে তিনি ভারতবর্ষকে হিন্দুর ‘পবিত্র’ স্থানের প্রতিফল হিসেবে চরিত্রায়িত করেন। ম্যাথু এডনির দৃষ্টিতে ভারতের মানচিত্রকরণে প্রথম ‘একটি অবোধ্য দৃশ্যপটের (নিম্ন রেখা লেখকের) ভূমিকে জ্ঞানের সাম্রাজ্যে পরিণত করার একটি প্রবল বৌদ্ধিক প্রচার চালানো হয়... ভূগোলকারেরা কোম্পানির সাম্রাজ্যের স্থানিক গতিকে সৃষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত করেন’। একই সঙ্গে এর আঞ্চলিক সংহতি ও মূলগত অস্তিত্বকেও সংজ্ঞায়িত করেন। এডনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, এটি কোনো মূল্যবোধহীন স্থান ছিল না, যেভাবে ব্রিটিশদের ‘উপস্থাপিত ভারত’ তাদের ‘ভারত’কে নির্মাণ করেছিল। এটাই ছিল সেই ‘ব্রিটিশ ভারত’, যেটুকু তারা বুঝেছিল, বা শাসন করেছিল।
তাহলে উপনিবেশ-পূর্ব সময়ের কী হল? আপাতভাবে পূর্বোক্ত দুটি ধারণার মাঝামাঝি এর কোনো অবস্থান ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরফান হাবিব দৃঢ়তার সঙ্গে এক সত্যের পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছেন যে, ভারতবর্ষ শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান মাত্র ছিল না, এর নির্দিষ্ট সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও ছিল যা চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ভারতবর্ষকে অভিহিত করে। এটাই তার অন্যান্য দেশগুলির থেকে স্বাতন্ত্র্য বোধক চিহ্ন। হাবিবের মতে আল বিরুণির ভারত-বোধের মধ্যে যে ‘সাংস্কৃতিক ঐক্যের’ কথা পাওয়া যায়, তার ভিত্তি এই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা। একই সঙ্গে তা পারস্পরিক মত বিনিময় ও সমঝোতার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার দ্বারা দৃঢ় হয়। ‘জাতীয়তাবোধের কিছু পূর্ব ধারণা … ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জয়ের সময় অধিগত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে … ভারত শুধু একটি ভৌগোলিক প্রকাশ মাত্র ছিল না, এটির একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি ছিল।
হাবিবের নিজস্ব অবস্থান অনুসরণ করে যদি এ বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করা হয় যে, তাহলে কেন এরকম একটি সংপৃক্ত ক্ষেত্রকে পরিণত জাতীয়তাবোধের জন্য ঔপনিবেশিক মধ্যস্থতার অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তখন একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় দেখা যায়, তা হল, ভারতবর্ষ বা India-র সমস্ত না হলেও বেশিরভাগ আলোচনায় nation অথবা
nationalism এর ইস্যুটি যে করে হোক ঢুকে পড়েছিল।
এই মিশ্রণের কারণটি বোঝা গেলেও তা অপরিহার্য ছিল না। ‘ভারতবর্ষ’ বিষয়ে এই লেখার সময়ে আমি ঐতিহাসিকভাবেই এর ধারণাকে বুঝতে চেয়েছি। ‘ভারতবর্ষের ধারণা’ বিভিন্ন প্রেক্ষিতে যে ভাবে নির্দেশিত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছি। এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আদি ভারতের যে সম্ভাব্য ধারণাটি ইতিহাস রচনায় নিহিত হয়ে আছে, তার স্বরূপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছি।
‘জন’ থেকে ‘জনপদ’
‘ভারতবর্ষের’ এই ধারণাটিকে নানা বৈচিত্র্যময় উৎসের দিক থেকে বিচার করলে, একজনের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, আদি কালে ‘ভারতবর্ষ’ নামটি, এমনকি ভৌগোলিক অর্থেও লিখিত ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। যেটা পাওয়া যায়, তা হল ‘জন’—লোকসম্প্রদায় অর্থে। সেই সঙ্গে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কোনো নদী বা এরকম কিছুর নাম, যার পাশে ‘জন’টি অবস্থিত। এই ভাবেই ঋগ্বেদে ‘ভারত’ নামটি অন্য অনেক ‘জন’র সঙ্গেই এসেছে। এগুলোর কোনোটাই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করে না। বৈদিক গ্রন্থগুলিতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম স্থানিক দিকচিহ্ন হিসেবে কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা ওই ধরনের কথাগুলি আসে। ‘জন’ যেখানে থাকে, সেই স্থানকে ‘জনপদ’ বা একটি ‘বাসদেশ’ হিসেবে প্রথম চিহ্নিত হতে দেখা যায় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, সৎপথ ব্রাহ্মণ ও আরও এই ধরনের গ্রন্থে। এই অভিমুখের তাৎপর্য, এটি ‘জনপদের’ সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটি দেখায় যে ‘জনপদগুলি’ কীভাবে অবস্থিত হওয়ার কথা ছিল। এই নিয়ে আমি পরে আলোচনা করব। এভাবেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা আছে আলাদা অঞ্চলের কথা, সেখানকার বাসিন্দা ও তাদের যারা শাসন করেছে তাদের কথা।এই অন্তর্ভূক্তি ইন্দ্রের মহাভিষেকে দেখা যায়। ‘...এই পূর্বাংশে (প্রাচ্যনম দিশি) রাজা যে-ই হোন, ‘প্রাচ্যনম রাজন্য’ই প্রভূত্বের জন্য নিযুক্ত।.... সেই জন্য দক্ষিণাংশে রাজা যে-ই হোন, ‘সতবন্ত’রাই (দক্ষিণশ্যাম দিশি) চূড়ান্ত শাসনের অধিকারী। পশ্চিমাংশে (প্রতীচ্যম দিশি) রাজা যে-ই হোন, দক্ষিণ ও পশ্চিমের মানুষ স্ব-শাসনের জন্য নিযুক্ত। উত্তরাংশে (উদীচ্যমান দিশি) হিমবাতের বাইরে উত্তরা কুরু, বা উত্তরা মাদ্রাজের জনপদ, তাদের রাজা সার্বভৌম শাসনের জন্য নিযুক্ত। ....এই নির্দিষ্ট মধ্যাংশে ( ধ্রুবয়ম/ মধ্যমায়ম/ প্রতিস্থায়ম দিশি) ভাসাস, উর্মি নায়াম, কুরি পাঞ্চালদের যে-ই হোন তাঁর নিযুক্তি রাজত্ব চালনার জন্যই।
বাস্তবের রাজাদের বিভিন্ন অভিমুখগুলির সম্মিলিত ফলে দেখা যায় ভগবান ইন্দ্রের দেবত্ব প্রাপ্তির নিরিখে ব্রাহ্মণের রচয়িতা দৃঢ় ভাবে দেখিয়েছেন জনপদগুলির সঙ্গে অন্যান্য অংশের তুলনায় পশ্চিমাংশের অধিক নৈকট্যের কথা। ব্রাহ্মণ্যবাদের পরবর্তী আলোচনায় বিভিন্ন জনপদের গঠনের ক্ষেত্রে মধ্যাঞ্চলই অন্য অংশগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একটি দেশ, বা পৃথিবীর একটি স্থানিক অঞ্চলের ধারণা, যা বিভিন্ন অভিমুখের জনপদগুলিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে, তা এই প্রথমবার জম্বুদ্বীপ নাম নিয়ে বৌদ্ধ রচনাগুলিতে উঠে এসেছে। চারটি বৃহৎ দ্বীপের বা চারটি মহাদ্বীপের একটি—যা মাউন্ট সিনেরু পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটি কাক্কাভাত্তি নামে এক শাসক দ্বারা শাসিত। বস্তুত এই রচনাগুলি অনুযায়ী বুদ্ধ, কাক্কাভাত্তিরেয়া সবাই এই জম্বুদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মৈত্রেয় বুদ্ধ যখন আবির্ভূত হলেন, তখন এই দ্বীপের জনসংখ্যা যথেষ্টই ঘন, এবং এখানে তখন চুরাশি হাজার নগর ছিল। Dictionary of pali proper names গ্রন্থের রচয়িতা মালালাশেখরের মতে শিহালাদ্বীপ এবং তাম্বপান্নি দ্বীপকে আলাদা করে দেখলে ‘জম্বুদ্বীপ স্পষ্টভাবে ভারতীয় মহাদেশের ইঙ্গিত দেয়।’
আবার কেউ যদি অঙ্গুত্তারা-নিকারার সূত্র ধরে তাহলে প্রতি ‘কাকরাভালা’ বা দিগন্তে একটি করে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যাবে, যা থেকে ভারতবর্ষ নামে একটি নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে জম্বুদ্বীপের ভৌগোলিক কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এই দ্বৈততা সত্ত্বেও জম্বুদ্বীপের ধারণাটি বিদ্যমান ছিল এবং এটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ব্রাহ্মণ্য ধারণার অংশও ছিল। কখনও মনে করা হত জম্বুদ্বীপের অংশ ছিল ভারতবর্ষ, কখনও ভাবা হত, জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষ সমার্থক। এই টার্মটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য শাসক অশোকের আমলে একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক স্থানের নির্দেশ-চিহ্ন (point of reference) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে জম্বুদ্বীপ এমন একটি স্থান, “যেখানে ঈশ্বরেরা আগে মানুষের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না; কিন্তু তাঁরা এখন তাঁদের সঙ্গে একাত্ম।” যে জম্বুদ্বীপ সম্রাট অশোক শাসন করেছিলেন, তার ভৌগোলিক অংশ আফগানিস্তান থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণাংশ বাদে বাকি অংশের বাইরের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। জম্বুদ্বীপ, এই বৃহৎ বিশ্ব পরিবারের অংশ , যা অনেকগুলি দ্বীপের সমাবেশ, এবং এখানে একটি বাস্তবিক দেশের ধারণাও গড়ে উঠছে, যেখানে পরিচিত জনপদগুলির অস্তিত্ব আছে। ভারতবর্ষও এই বিস্তৃত বিশ্ব-ধারণার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু এই ধারণার যে স্পষ্ট সীমারেখা আমরা আগামীদিনে পাব তার মধ্যে সময়ের নিরিখে অনেকগুলি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যে ‘ভারতবর্ষ’ নামটি আগে কোনো অর্থই
বহন করত না, আর এখন সেটি একটি অস্পষ্ট যোগসূত্র তৈরী করে।
এই শব্দার্থের বিবর্ধনের ঐতিহাসিক ধাপগুলি যদিও পরিষ্কার নয়। কলিঙ্গ অথবা উড়িষ্যা উপকূলের রাজা খারাভেলা, খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে তাঁর শেষ লেখায় দাবি করেছেন, তিনি ভারতবর্ষ জয় করতে গিয়েছিলেন তাঁর রাজত্বের দশম বছরে। এটি তাঁর অন্যতম অভিযান ছিল। স্পষ্টতঃ, কলিঙ্গের শাসনকালে তাকে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। বস্তুত, পুরাণ রচনার সময়েই, ভারতবর্ষকে এই বিশ্বজনীন ধারণার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দেশ হিসেবে উল্লেখ করা শুরু হয়। এটা সেই ধরনের লেখ্য প্রমাণ, যা আমাদের কাছে এই টার্মটি (ভারতবর্ষ) যে ভাবে বাহিত হয়ে আসে, সেভাবেই এই স্থান, ও সহযোগী পাত্রপাত্রীকে বুঝে নিতে হয়। যে বিশ্বজনীন তত্ত্বের ‘ভারতবর্ষ’ একটি অংশ, তা নানাবিধ পুরাণগুলিতে প্রায় একইরকম ভাবে পাওয়া যায়। কিছু এদিক ওদিক হয়ত আছেই। দিগ্বিজয়ী মহাভারতের বর্ণনাতেও প্রথমবারের জন্য এটি পাওয়া যায়। এখানে একজন প্রথমবারের জন্য ভারতবর্ষের পূর্ণ উন্নত ধারণা বা তার স্থানিক অংশগুলির সঙ্গে পরিচিত হন। পুরাণ গ্রন্থগুলি বিপুল কলেবরের। এগুলোর মধ্যেকার বস্তুগত বিষয়গুলি নিয়ে, পুরাণগুলিকে ধরে ধরে আলাদা আলাদা আলোচনা করা অর্থহীন। তাই আমি শুধু বিষ্ণুপুরাণের আলোচনাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব। সত্যিকারের ভৌগোলিক স্থানটির ধারণার নিশ্চিতকরণ ও প্রসারণের জন্য আমি আর দু’টি গ্রন্থের সাহায্য নেব। কালিদাসের রঘুবংশম, এবং রাজশেখর প্রণীত দশম শতকের গ্রন্থ কাব্যমীমাংসা। এই গ্রন্থগুলি বৃহত্তর সময়ের আধারে দেখায়, পুরাণ-ধৃত তত্ত্ব বিভিন্ন গ্রন্থে কতটা এক ধাঁচের এবং এখানে উল্লেখিত একই বিবরণে কতটাই ভিন্নতা!
পুরাণ গ্রন্থসমূহে ভারতবর্ষ
বিষ্ণুপুরাণের বিসয়ণবস্তুতে ঢোকার আগে পুরাণের সাক্ষ্যপ্রমাণের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করা যেতে পারে। পুরাণে যা ভৌগোলিক বিবরণ হিসেবে চিত্রিত, তা ভারতবর্ষের প্রকৃত বিবরণের অংশ নয়। পুরাণে একটা প্রাসঙ্গিক অংশ ‘ভারতবর্ষ-বর্ণনম’ নামে উল্লিখিত। কিন্তু সেটাও মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে চিত্রিত, এর সঙ্গে সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনীও জড়িত। বিস্তারিত বংশেতিহাসের আলোচনা দেখায়, বংশেতিহাস ও স্পেসের আবশ্যিক সম্পর্ক। দেখায় পৃথিবীর বৃহত্তরে বিভাজন, বিশ্বমাঝে ভারতবর্ষের অবস্থান। এটা ভূ মধ্যেকার সবধরনের বিভাজনের মূল্যায়নও বটে! তাই ভারতবর্ষকে তার ভৌগোলিক অবস্থানের জায়গা থেকে বিচার করার আগে একে এর নির্দিষ্ট অবস্থানের নিরিখে বিচার করতে হবে। তা না হলে নানা বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যায়। বিভিন্ন পুরাণে বর্ণনাগুলির মধ্যে পার্থক্য আছে। একেকটি পুরাণের ভেতরে স্ববিরোধিতাও প্রচুর। সব পুরাণ পারস্পরিক আপসে মীমাংসার যোগ্যও নয়। এসব ছাড়াও পুরাণই হল সেই গ্রন্থ যা, মহাভারত থেকে পৃথকভাবে ভারতবর্ষের একটি সামগ্রিক ধাঁচাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসের নিরিখে ‘ভারতবর্ষ’ সংক্রান্ত ধারণার সন্ধান করতে হলে পুরাণের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করাই অধিকতর সমীচীন।
বিষ্ণু-পুরাণের দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ভারতবর্ষকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এর নাম জগৎ-সৃষ্টি-সম্বন্ধ-ভরত-বংশ-কথনম (বিশ্ব সৃষ্টির যোগে ভরত বংশের কাহিনী)।এখানে ভরত-বংশ স্বয়ম্ভূ বংশের সঙ্গে পরিবর্তনীয়, কেননা বংশধারাটি শুরু হয়েছে স্বয়ম্ভূ মনুকে দিয়ে। এই বংশেতিহাসে মনুর সাতটি পুত্রসন্তান সাতটি দ্বীপের দায়িত্বপ্রাপ্ত (জম্বু, প্লক্ষ্য, শাল্মলী, ক্রৌঞ্চ, কুশ, শক ,পুষ্কর)। এগুলির সমন্বয় হল এই বসুন্ধরা। বিষ্ণু-পুরাণের ভরত-বংশ-কথনম জম্বুদ্বীপ-বর্ণনমের অনুসারী।এরই সূত্র ধরে এল ভারতবর্ষ-বর্ণনম। পরবর্তী সময়ে ষটদ্বীপ-বর্ণনমকেও অনুসরণ করা হয়েছে।
প্রিয়ব্রতর পুত্রা অগ্নিধ্র শাসক হয়ে জম্বুদ্বীপকে ন’টি ভাগে ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে হিমবর্ষ, পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষ নভির দ্বারা শাসিত হয়। ঋষভের পুত্র ভরত এই বংশধারার বাহক এবং ‘এই দেশটি ভারত হিসেবে চিহ্নিত হয়, যখন ভরতকে তার পিতা ত্যাগ করেন...’। ভরতের পর এই বংশেতিহাস প্রবাহিত হয়, এবং ভারতবর্ষ নয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ‘এটি স্বয়ম্ভূ মনুর সৃষ্টি। তাঁর দ্বারাই পৃথিবীতে মনুষ্য সৃষ্টি হয়েছে, যখন তিনি প্রথম মন্বন্তর পরিচালনা করেন।
বিষ্ণুপুরাণের দ্বিতীয় পুস্তিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে বিশ্বলোকের বিবরণ বর্তমান এবং তৃতীয় অধ্যায় শুরু হচ্ছে এই চরণদুটি দিয়ে—
উত্তরম ইয়াৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেক্ষীয় দক্ষিণম
ভর্ষম তাদ ভারতম নাম ভারতী যাত্রা সান্তাতিহ
এর আক্ষরিক অনুবাদ এরকম—
এই বর্ষ যা সমুদ্রের উত্তরে, এবং তুষারাবৃত পর্বতের দক্ষিণে,
তাকেই বলে ভারত, এর সন্তানকে বলা হয় ভারতী।
উদ্ধৃত পংক্তিদ্বয়ে যে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সম্ভাব্য অর্থকে বিচার করলে এটা মনে রাখা দরকার এখানে যে অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে তা কঠোর ও সঠিকভাবে চিহ্নিত নয়। এর ভৌগোলিক ও ভূ-বিবরণগত বর্ণনায় যে পর্বত ও নদীসমূহের কথা উল্লিখিত সেগুলি ভারত নামে চিহ্নিত এবং অন্য বর্ষ ও দ্বীপসমূহ থেকে পৃথকীকৃত, এবং একটি ভৌগোলিক অর্থে দীপিত। এই পর্বতমালার প্রতিটি কূল-পর্বতের নাম হল—মহেন্দ্র, মলয়, সহ্য, সুক্তিমত, রক্ষ্য, বিন্ধ্য এবং পরিপত্র। এদের থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন নদীগুলি নানা দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
এটা হল সেই দিকনির্দেশেরই কথা, যা মধ্য ভাগ বা মধ্যদেশের সঙ্গে যুক্ত, এবং যা ভারতবর্ষ গঠনের কথা বলেছে। এই ভাবে ভারতবর্ষ যে ন’টি ভাগে বিভক্ত বলে উল্লিখিত, তার সবকটি আবার আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত। এই ‘দিক’ নির্দেশ করে—কত বিভিন্ন জনপদ থেকে কত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ ‘ভারতবর্ষে’ এসেছে। বিষ্ণুপুরাণ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যায়ঃ-
“ ভারতের পূর্বদিকে কিরাতরা বাস করে.......পশ্চিমে যবনেরা, মধ্যে (মধ্যভাগম) ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য এবং শূদ্ররা ……যারা তাঁদের কাজ অনুযায়ী ( ত্যাগ, অস্ত্রধারণ, বাণিজ্য ও সেবা) বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন”।
এখানে ‘দিক’ কথাটি মধ্যাঞ্চলের কেন্দ্রিকতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা খুব ভৌগোলিক কারণে নয়, বরং পূর্ব-পশ্চিমের বৈপরীত্যের কথা বোঝাতে, যেমনটি উল্লিখিত আছে বিষ্ণু-পুরাণে বা অন্যান্য পুরাণে। এই কেন্দ্রিকতার ধারণাটি বাহিত হয়েছে, ‘জনপদ’গুলির ভৌগোলিক অবস্থান বোঝাতে।এই ভাবেই কুরু এবং পাঞ্চালিরা মধ্য দেশের অন্তর্গত, কামরূপেরা ‘পূর্ব-দেশদিকের’, সৌরাষ্ট্র এবং ‘অভীরা’ অপরান্তের (পশ্চিম)।
বিষ্ণু-পুরাণে ‘ভারতবর্ষ’ বিষয়টা চারটি অধ্যায়ে বিধৃত।( অন্য পুরাণগুলিতেও এটি অনেক সময় বিস্তারে উপস্থাপিত)। এটি এসেছে ভূ-বিবরণের অংশ হিসেবেই। এই উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্য হিসেবে নানা কথাই যেন উঠে এসেছে। প্রথমতঃ ‘ভারতবর্ষ’ স্পষ্টভাবেই এক বৃহৎ নকশার একটি অংশ। পদ্ধতিগতভাবে এর একেকটি অংশ সুনির্দিষ্টভাবে একেকটি ভৌগোলিক বাস্তবতার কথা বলে। একই সঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ গঠনের যে ভৌগোলিকতা ও সাংস্কৃতিক লক্ষণের কথা আমরা শুনি, তা পুরাণকারদের নির্মাণ। এই ভাবেই ‘ভারতবর্ষের’ রূপদানের ক্ষেত্রে প্রথমে চারটি অঞ্চল ও একটি কেন্দ্রাঞ্চলে বিভক্ত ক্ষেত্রর কথা ভাবা হয়েছে, পরে তা সাত কিংবা ন’টি ক্ষেত্রে বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে এর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলি পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ অনুযায়ী আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়েছে।এই সব পুরাণ গ্রন্থসমূহ থেকে পাওয়া ভৌগোলিক জ্ঞান অনেক সময়ই অন্য সূত্রের সঙ্গে মেলে না। এভাবেই পুণ্ড্র, কলিঙ্গ, এবং মগধ—সবই বিষ্ণুপুরাণে একত্রিত হয়ে গেছে দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে। এবং এই তালিকা পশ্চিমাঞ্চলের (অপরান্ত) মধ্যেই কোনো সূত্র ছাড়াই উত্তরদিকের সাকালাভাসিন, সালভা, মদ্র, হুন, সৈন্দব ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এভাবেই পুরোনো গ্রন্থগুলিতে ভারতীয় ইতিহাসের নিরিখে দেখা যায়, এগুলিতে ভারতবর্ষের বিবরণ তার আনুপূর্বিক বিস্তারকে গুরুত্ব দেয় নি। ভারতবর্ষের সামগ্রিক গঠন এবং যে ভাবে এটা ভূবিবরণগত ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়েছে। তাকেই গুরুত্ব দিয়েছে, যেটা বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল। দ্বিতীয়ত পুরাণগুলিতে ভারতবর্ষের যে বর্ণনা রয়েছে তা অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত বংশেতিহাসের বিস্তৃত বিবরণের সঙ্গে, যা এই বিশ্বচরাচরের নকশাকে নানা স্তরে ধরে রেখেছে। মনুর সন্তানদের মধ্যে দিয়ে যার শুরু, এবং সাতটি সন্তানের মধ্যে আদি বিভাজন এখানে প্রকাশিত। তাই বিষ্ণুপুরাণের ভারতবর্ষের বর্ণনায় ‘ভারতী-সন্ততি’ বলতে, ভরতের সন্তানসমূহ না বুঝে, তাকে ভরতের বংশলতিকার সন্তানসমূহ হিসেবে গ্রহণ করাই সমীচীন। এই ভাবধারাটি সমান্তরালভাবে প্রকাশিত হয়েছে বায়ুপুরাণে।
তইর= ইদম ভারতম বর্ষম নব ভগাইর অলমক্রিতম
তেসম বংশ প্রসূতিয়াস = কা ভুক্তয়ম ভারতী পুরা।।
তৃতীয়ত জম্বুদ্বীপের অন্যান্য ভার্ষার মধ্যে ভারতবর্ষ শব্দটির অর্থ এর ভৌগোলিক অর্থকে ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবেই ভার্ষাগুলিতে বিপর্যয়, বৃদ্ধত্বপ্রাপ্তি, ধর্ম, অধর্ম, উচ্চ, নীচ, যুগ-বিভাজন কোনো কিছুই ছিল না। ভারতবর্ষ বিভিন্ন যুগ অতিক্রম করেছে। এই ক্ষেত্রে কর্মা সক্রিয় ছিল, বর্ণ চর্চার মধ্যে দিয়ে তা চরিত্রায়িত হয়েছে। অন্যান্য ভার্ষাগুলি হল ভোগভূমি, যদিও কর্মভূমি হিসেবেই তা উঠে এসেছে। ভারতবর্ষ অন্যান্য ভার্ষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভার্ষার পৌরাণিক প্রক্ষেপণ শাসকদের বংশেতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। এটি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রের সঙ্গে মাত্রাগত ভাবে যুক্ত, অথবা হতে পারে সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন দেখা হয়েছে। ‘দিগ্বিজয়’ ধারণা দিয়ে এই তত্ত্বকে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এখন আমরা ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটি অন্য কী অন্তর্গত অর্থের দিকে যেতে পারে, সেই খোঁজে যাত্রা করতে পারি। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা রঘুর দিগজিগীষা বা ক্ষেত্রবিজয়ের ধারণা দিয়ে এটা ধরা যেতে পারে। এটি বিশেষভাবে কালিদাসের বংশেতিহাসের কাব্য ‘রঘুবংশম’এ চিত্রিত হয়েছে।
ক্ষেত্রবিজয় (দিগজিগীষা)
কালিদাসের বর্ণনা অনুযায়ী রঘুর বিজয়যাত্রা শুরু হয় পূর্ব ( প্রাচী ) থেকে। ক্রমশঃ এই দিক থেকে সে সমুদ্র উপকূলে এসে পৌঁছায়, যা তালবনবীথিকায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। এখানেই নৌ-বহরসহ বঙ্গীয় রাজকুমার সুমার মুখোমুখি হয়। কপিশা নদী পার হয়ে সে উৎকলের দিকে যায়। আরও এগিয়ে সে মহেন্দ্র পর্বতমালা পেরিয়ে কলিঙ্গদের পরাজিত করে। সমুদ্র উপকূল ধরে সেনাবাহিনী দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়, এরপরে তারা কাবেরী নদীর তীর ধরে মলয় পর্বতের কাছে গিয়ে পৌঁছোয়। এখানে অন্য যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির কথা বলা হয়েছে তা হল, তাম্রপানি নদী এবং সমুদ্র, যা কী না ‘এই অঞ্চলের স্তনযুগলের মতো’ (দিশাস্তস্বা)।সেখান থেকে আরও এগিয়ে রঘু যায় সহ্যা পর্বতে। অপরান্ত অধীনস্থ স্থান এবং কেরল ছাড়াও রঘুর লক্ষ্য ছিল ত্রিকূট যেখন থেকে স্থলপথে ( স্থল-বর্তমান) পারসিকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এই প্রসঙ্গেই যবনদের কথা উল্লেখিত। পশ্চিমী জনগণের সঙ্গে রঘুর তীব্র সংঘাত হয়। একজন সুদক্ষ অশ্বারোহী হিসেবে এর পরিণতি হয়—
“ সে ভল্ল দিয়ে দাড়িওয়ালা মাথাগুলো আলাদা করে মাটিতে ছড়িয়ে দিল, ঠিক যেভাবে মৌমাছি চাক ঢেকে রাখে। বাকিরা নিজেদের শিরস্ত্রাণ খুলে তার শরণাপন্ন হল”।
রঘুর উত্তরমুখী যাত্রা (উদিচ্যী), যার ক্ষেত্রপ্রধান ছিলেন কুবের, তাকে হুনদের এবং কম্বোজদের বিরোধী করে তোলে। তার উত্তরমুখী যাত্রা তাকে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ও গঙ্গার উৎসস্থলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তার সঙ্গে কিরাত এবং অন্যান্য পার্বত্য উপজাতিদের লড়াই হয়। কৈলাস পর্বত এবং লাউটিয়া নদী পেরিয়ে রঘু প্রাগজ্যোতিষ এবং কামরূপের রাজধানীতে এসে পৌঁছোয়, তাদের অধীনতা স্বীকারের পর রঘুর ক্ষেত্রবিজয় শেষ হয়, ‘বিশ্বজিত’ হবার বাসনাত্যাগের শুরুও বলা যায়। রঘুর এই ‘দিস’ জয় ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে তার সার্বভৌম শাসকের খেতাবপ্রাপ্তি সম্পন্ন হয়, যা কি না সব জিগীষু শাসকেরই চরম সাধ।
‘রঘুবংশম’এর যে প্রাসঙ্গিকতার প্রতি আমরা নজর দিয়েছি, তা হল, এই চারটি ‘দিসের’ মধ্যে দিয়ে যে ভৌগোলিক ক্ষেত্রের কথা উঠে এসেছে, যেখানে এক প্রাচীন রাজা অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্বের স্বপ্ন দেখেছে, এর ভাবটুকু আরেকটা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, তা হল, ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’। যাই হোক, সম্পূর্ণ ‘ভৌগোলিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে যা আমাদের নজর কাড়ে তা হল—ভিন্ন গোষ্ঠী, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রস্তম্ভ, তার গাছপালা-ভূপ্রকৃতি সবই শেষ পর্যন্ত চারটে ‘দিস’কে একই সূত্রে গ্রথিত করে, হতে পারে উপাদান গুলো আলাদা আলাদা।
রঘুবংশমের এই সূত্র নির্দেশ আমাদের ভারতবর্ষের কাঠামো সম্পর্কে কোনো অর্থপূর্ণ ধারণা দেয় না। যদিও ক্ষেত্রধারণার চাবিকাঠিটি একই। কালিদাস কট্টর ভাবে নিখুঁত কোনো ভৌগোলিক ধারণার কথা বলেন নি, কিন্তু নির্দিষ্ট বিন্যাসকে ব্যবহার করে একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে তা সাহায্য করে। একজন সহজেই কিছু অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। কলিঙ্গের পরেই দক্ষিণাংশের কথা এসেছে, কেরালা এসেছে সহ্যের পর। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কথা মলয়ের প্রসঙ্গ ছাড়াই এসেছে। কামরুপের প্রাগজ্যোতিষের থেকে পৃথকীকরণ এবং তার আরোপিত অঞ্চল রঘুর উদীচ্যার বিস্তৃত অভিযানের প্রসঙ্গেই এসেছে।
কালিদাস রঘুর ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন, সেই প্রসঙ্গেই চারটে ক্ষেত্রের কথা এসেছে, ভৌগোলিক যাথার্থ্যের কথা পরে। বস্তুত এই ‘দিস’ ব্যবহার করে, পূর্বদিক থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত শুরু এবং প্রাগজ্যোতিষ ও কামরূপ দিয়ে শেষ করে কালিদাস একজন স্বাধীন শাসকের যাত্রার বৃত্তীয় পূর্ণতার কথা বলতে চেয়েছেন। ‘রঘুবংশম’এ চারটি দিকের ভৌগোলিক ধারণা ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানকার প্রধান ভৌগোলিক ক্ষেত্রগুলি (সমুদ্র, পর্বত, নদী ) এবং তার সূত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কথা এখানে আছে। ‘রঘুবংশম’এর আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য—এখানে নির্দিষ্ট স্থানের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের পরিচিতি আছে। স্থানভেদে অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের কথাও বলা আছে যা কিনা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরে। কালিদাসের ব্যবহৃত উপাদানের তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা আবার আলোচিত হবে, যখন আমরা ‘ভারতবর্ষের’ ধারণাটিকে একত্রে গুছিয়ে আনব।
এখন আমরা নবম-দশম শতকের একটি রচনার কথা বলব, যেখানে এক একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গের কথা এসেছে। কিন্তু সেখানেও ‘ ভারতবর্ষের’ আদি ধারণাটি ব্যক্ত হয়েছে। ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’ অর্থাৎ ‘ বিরামহীন গতিশীলের ক্ষেত্র’ হিসেবে যা সম্পর্কায়িত।
রাজশেখরের কাব্যমীমাংসাঃ
একটি সংশ্লেষণের (synthesis) অনুশীলন?
পুরাণে ভারতবর্ষের ধারণা দেওয়া আছে, বিবিধ গোষ্ঠী ও জনপদের মিলনস্থল হিসেবে। কালিদাস ‘ভারতবর্ষ’ কথাটি ব্যবহার না করে চারটি ক্ষেত্রের বিজয়-বিবরণ দিয়েছেন, যা ক্রমশঃ ক্ষেত্রগুলির একীকরণের দিকে এগিয়েছে। আলাদা আলাদা রচনায় সেগুলি আলাদা ভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য় দেশ বিভাগের প্রসঙ্গটি এল। ‘জগৎ’(universe) এবং ভূবন(world) কাকে বলে, এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে — ১) পুরো জগৎ অথবা ভূবনের একটা অংশ হল দেশ এবং ২) দেশ কাল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কবি ‘অর্থ-দারিদ্র্য’কে প্রকাশ করতে চাননি। এই দেশ প্রসঙ্গে আলোচনায় রাজশেখর ভারতবর্ষকে চিহ্নিত করেছেন, বহু ‘ভূবনে’র অস্তিত্বের কথা বলেছেন, ‘ভ্যূলোক’ বলতে ‘পৃথ্বী’র কথা বলেছেন, যেখানে সাতটা দ্বীপ আছে। নানা মতের উল্লেখ করলেও রাজশেখর ‘ভারতবর্ষে’র পুরাণ-বর্ণিত কাঠামোকেই ব্যবহার করেছেন। বিশেষত বায়ুপুরাণে এটি বিস্তারিতভাবে আছে। রাজশেখরও ভারতবর্ষকে ন’টি অংশে ভাগ করেছেন। তিনি বিভিন্ন জনপদকে গোষ্ঠীভিত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে সাজিয়েছেন। যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, রাজশেখর একেকটি ক্ষেত্রকে তাদের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। তার কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি চিহ্নিত হয়েছে আর্যাবর্ত নামে, যা মধ্যদেশের সমার্থক। ভৌগোলিকভাবে যা, পূর্ব ও পশ্চিম সাগরের হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অংশ।
আর্যাবর্তের নিরিখে রাজশেখরের লক্ষ্য, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের সূচনাকে নির্দিষ্ট করা। এতে অধিক্রমণ (overlaps) অনিবার্য, বিশেষতঃ রাজশেখর যখন ‘দিকে’র বিভাজনের কথা বলেন। কোনো কোনো চিন্তকের কাছে এটা নড়বড়ে মনে হতে পারে, তবে ‘অন্তর্ভেদী’ থেকে কন্যাকুব্জ (কনৌজ)এর ধারণা দ্রাঘিমা রেখার মতো কিছুর কথাই বলে। আর্যাবর্ত এবং অন্তর্ভেদী (গঙ্গা-যমুনার মধবর্তী অঞ্চল) উভয়কেই মৌলিক দিকনির্দেশের জন্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই ভাবে আর্যাবর্ত যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম সাগর, হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনই রাজশেখরের মতানুযায়ী, বারাণসী পূর্ব থেকে পূর্বদেশের শুরু। ‘দেবসভা’ থেকে পশ্চাৎদেশের(পশ্চিমদেশ) শুরু। ‘দক্ষিণাপথ’ মহিশমতি এবং উত্তরাঞ্চল প্রুদাকা থেকে শুরু।
ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও রাজশেখরের লক্ষ্য হল ‘ক্ষেত্র’র (‘দিশ’ দিক) কাঠামোকে বর্ণনা করা, তাদের প্রকৃত ভৌগোলিক অবস্থান থেকে। (যেমন বারানসী, মহিশমতি, প্রুদাকা ইত্যাদি)। এভাবেই এই অবস্থানকে ক্ষেত্রর সংজ্ঞা নির্ধারণের উপাদান হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করা হল।
পৃথক ক্ষেত্রের কাঠামো নিয়ে রাজশেখরের বিস্তৃত আলোচনায়, একজন তিনটি প্রধান পৌরাণিক উপাদান লক্ষ্য করতে পারবেন। জনপদের সংখ্যা, ক্ষেত্র’র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পর্বতমালার সংখ্যা, এবং তা থেকে উৎসারিত নদীর সংখ্যা—এটা হল একটা ধাঁচা, যা প্রত্যাশিত বৈচিত্রসহ সব ‘দিস’য়েই বিদ্যমান। রাজশেখর যেটা অতিরিক্ত করেছেন, কালিদাসীয় ভঙ্গীতে, প্রাকৃতিক উপাদানের তালিকা তৈরী করেছেন, যা একেকটি ক্ষেত্রর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, উত্তরাপথে, এর গোষ্ঠীসমূহ ছাড়াও একে বর্ণিত করা হয়েছে এর উৎপাদিত সামগ্রীর দ্বারা। সরলা, দেবদারু, আঙুর, জাফরানি, কামরাঙা ইত্যাদি গাছ দিয়ে। মৃগচর্ম, সৈন্ধব লবণ, সৌধীরা, স্রতঞ্জনা,বৈদূর্য ও তুরঙ্গ। এই তালিকা যে খুব সুসংহত বা সঠিক, তা না ও হতে পারে, কিন্তু একেকটি ক্ষেত্রকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার পক্ষে যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে রাজশেখর নিয়ে আসেন ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’র ধারা। এটা তিনি জম্বুদ্বীপ, ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের চারটি বিভাগ—ইত্যাদি আলোচনা প্রসঙ্গে এনেছেন। রাজশেখরের মত অনুযায়ী ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’র প্রসার কুমারীপুরা থেকে বিন্দুসরোবর পর্যন্ত। এর সহস্রযোজন বিস্তার ভূগোলের নিরিখে পরিমেয় নয়। এর তাৎপর্য ভারতবর্ষের স্থানিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত।
রাজশেখরের ক্ষেত্র বিভাজনের ধারণার আরও অনেক মাত্রা আছে, যা এই প্রসঙ্গে আলোচ্য নয়। যা রাজশেখরের লক্ষ্য ছিল, তা হল ‘ভারতবর্ষে’র রুপরেখা স্থির করতে পুরাণের উপাদানগুলিকে সংক্ষিপ্তকরণ করা, এমনভাবে যাতে সেখানে পুরাণের উপাদান আছে, তবে তা বংশগত যোগাযোগের বিষয়টি কর্তিতভাবে উপস্থাপিত। ভবিষ্যত রচয়িতাদের ক্ষেত্রে এই নকশা উপযোগী হয়েছে হয়ত।
ভারতবর্ষের অর্থ
ভারতবর্ষের বিস্তারিত বিবরণ তিনটি সময়ানুক্রমিক রচনায় এসেছে, তাতে এটা বোঝা যায়, এই সব রচনার রচনার রচয়িতারা কিভাবে ভারতবর্ষকে গ্রহণ করেছেন, এবং কিভাবে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, ভারতবর্ষ এক সুসংজ্ঞায়িত ভৌগোলিক অংশ হিসেবে তাদের কাছে ধরা দেয় নি। প্রথম দিকের ‘ভারতবর্ষ’ যেভাবে তাদের রচনায় এসেছে, তা পরবর্তী ‘ভারতবর্ষের’ অংশমাত্র। সেই ‘ভারতবর্ষ’ কুরু, কৌশল, মগধ, বৎস, এবং অন্যান্য জনপদের সূত্রেই এসেছে।
বস্তুত ‘ভারতবর্ষ’ নয়, ‘জনপদ’—এই শব্দবন্ধটির মধ্যে দিয়েই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে অভিহিত করা হত। এর পরে ভিন্ন ভিন্ন জনপদের নানা স্থানিক-সামাজিক উপাদানগুলি একত্রিত হয়ে ‘ভারতবর্ষ’—এই শব্দটির অর্থপ্রসারণ ঘটে। তবে অঞ্চলগুলি মধ্যাঞ্চলের নিরিখে বিভিন্ন ‘দিস’এ প্রসার লাভ করে।
‘দিসের’ মূল ভাবনার ওপর নির্ভর করে ‘ভারতবর্ষের’ ধারণা একটি ‘দেশের’ ধারণা হিসেবে উন্নীত হয়। ‘দেশ’¬—এই ‘দিস’ শব্দ থেকেই এসেছে। যদিও এই ‘দেশ’ সীমামুক্ত। ভৌগোলিকভাবে সীমায়িত কোনো ধারণা নয়। পুরাণে দেখা যায়, হিমবাত এবং সমুদ্রের মধ্যে বিরাজমান ‘বর্ষ’ই ‘ভারতবর্ষ’কে ভৌগোলিক আদল দিতে চেয়েছে, কিন্তু জনপদগুলির নানা গোষ্ঠী কখনই এ ধরনের কোনো সীমাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজশেখরের উত্তরাপথ প্রুদাকা ( আধুনিক হরিয়ানা) ছাড়িয়ে যার শুরু, সেখানে শক, কৈকেয়, বোক্কানা, হুন, বানায়ুজ, কম্বোজ, লিম্পক তানজানা, তুরস্ক, তুষার এবং আরও অনেক স্থানের কথা এসেছে। অবশ্য ‘দিস’এর ধারণা ভৌগোলিক নয়, একটি আধারাকৃতি ধারণা। সেখানে কোনো দৃঢ় সীমার কথা বলা নেই, যদিও জমি হস্তান্তরের প্রসঙ্গে জমির সীমা বা মর্যাদার কথা এখানে অনেকবারই এসেছে। একইরকমভাবে সিংহল বা শ্রীলঙ্কা দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত, এই তথ্য রাজশেখরের লেখায় বা অন্যান্য সূত্রে আছে। অন্যান্য রচনা থেকেও এরকম আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়। এই সূত্রে বলা যায়, অতীতে ‘ভারতবর্ষ’ নামে কোনো নির্দিষ্ট, দৃঢ়ভাবে সংজ্ঞায়িত দেশের কথা পাওয়া যায় না, যেখানকার মানুষরা সেই ‘দেশবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
এরপর ‘ভারতবর্ষ’ এক মুক্তসীমা অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়, যা এতক্ষণ আলোচিত হয়েছে। এটি পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব বা বিশ্ববীক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিভাত। একটি রাজ-বংশ সৃষ্টির কাহিনী এখানে গ্রথিত (ভরত বংশ যার একটি অংশ)। একই সঙ্গে ‘ভারতবর্ষে’র ধারণা কোনো স্থবির ধারণা নয়। পুরাণে ভারতবর্ষের গঠনগত ক্ষেত্রের ধারণা পাওয়া যায়। তার পাহাড়, নদী ইত্যাদির বর্ণনা। অপরদিকে কালিদাসের রচনায় পাওয়া যায়, স্থানীয় জীবনযাপন, সম্পদের বৈচিত্র্য ইত্যাদি। রাজশেখরের রচনায় ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে, তার ‘দেশ পরিচয়’ অধ্যায়ে। সময়ের সঙ্গে ভৌগোলিক জ্ঞানের বৃদ্ধি, নদী, পর্বত অঞ্চলের নির্দিষ্টকরণ সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের ধারণাটি পুষ্ট হয়েছে। সময়ানুক্রমিক সাক্ষ্যের মধ্যে দিয়ে গেলে একজন জন থেকে জনপদ, জনপদ থেকে বর্ষ, বর্ষ থেকে দেশ—এই ধারণার ক্রমবিকাশ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
‘ভারতবর্ষে’ কোনো ‘পবিত্র স্থান’ ছিল না, ছিল না ‘an incomprehensible spectacle’ যেমনটা Edney বলেছেন। কর্মার নীতি অনুযায়ী শাসিত জম্বুদ্বীপের ‘বর্ষ’র ধারণার মধ্যে থেকেও ভারতবর্ষের ধারণাটি উঠে আসতে পারে। এটা হল সেই স্থান, যেখানকার বাসিন্দারা চারটি অংশে বিভক্ত ছিল( চতুর্বিধা)। অথবা চারটি বর্গ। এটা ‘দিসে’র ধারণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সেটা ছিল কেন্দ্রীয় অঞ্চল (মধ্যদেশ, অথবা আর্যাবর্ত , যা আদর্শ (মডেল) হিসেবে ছিল। রাজশেখর যেভাবে বলেছেন —‘ এর চতুর্বর্ণ এবং চতুরাশ্রমের শৃঙ্খলা রয়েছে। সেটাই সু-আচরণের শিকড়’।
আর্যাবর্তের নৈকট্য বা দূরত্ব ছিল এই মডেলের প্রতি আনুগত্যের পরিমাপক। আর্যাবর্তের বাইরের জাতিগোষ্ঠীকে মনু চিহ্নিত করেছেন ‘ম্লেচ্ছ’ বলে।
অতএব, ভারতবর্ষ, একটি কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র ও চারটি (পরে সেটা সাতটি বা নয়টি) প্রান্তীয় ক্ষেত্র নিয়ে বিরাজিত ছিল। এগুলিতে নানা ধরনের ‘জনপদ’ থাকত। নিজেদের জনপদ অনুযায়ী এই মানবগোষ্ঠীগুলির স্বাভিজ্ঞান চিহ্নিত হত। ‘এরা ভারতবর্ষের মানুষ’ এভাবে চিহ্নিত হত না। একজন ব্যক্তি নিজেকে ঘোষণা করতেন, আমি মগধ, কোশল, দ্রাবিড়, কঙ্কণ বা অবন্তীর; অথবা গান্ধার কুরু বা মদ্র থেকে আসছি, কিন্তু কেউই বলতেন না — আমি ভারতবর্ষ থেকে আসছি। এই জন্যই তার জনপদ ছাড়া ‘ভারতবর্ষ’ কথাটা সেভাবে কোনো অর্থ বহন করত না। তাই ভারতবর্ষ আমাদের প্রথম দিকের জাতীয় সচেতনতার ক্ষেত্র ছিল কিনা; হয় সম্পূর্ণ অঙ্কুরিত বা সদা-অঙ্কুরিত বৈচিত্র্য হিসাবে, এ প্রশ্নটাই অপ্রাসঙ্গিক। ‘ভারতবর্ষে’র ধারণার সঙ্গে ‘স্বদেশ’ বা ‘বিদেশ’ শব্দগুলির কোনো প্রাসঙ্গিক যোগ নেই। সুতরাং ‘ভারতবর্ষের’ আদি ধারণা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আলোচ্য বা অনুধাবনযোগ্য। তাই ‘সীমা (border)’, ‘সীমান্ত (frontier)’, ‘বিদেশী (foreigner)’ এই শব্দগুলোর ধারণা ‘ভারতবর্ষ’ শব্দব্যঞ্জনায় অপ্রাসঙ্গিক।
যদিও প্রথমদিকের তথ্যসূত্রগুলিতে বারংবার ‘বিদেশী’,‘বিদেশী অনুপ্রবেশ’ ও হানাদারির সামাজিক-রাজনৈতিক কুফলের কথাই বলা আছে, ভারতীয় সমাজে গভীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে এই বিদেশী আক্রমণকারী দলগুলি সাঙ্ঘাতিক এক অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল; এমন ধারণা কিন্তু ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে পুরাকালের ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মানানসই নয়।
কোনো বহিরাক্রমণ একজনকে অন্যদের থেকে আলাদা করেনি, ভারতের সমাজে প্রধান বিভাজন ঘটিয়েছে বর্ণ। এটা ঘরে, বাইরে সব ধরনের পার্থক্য ঘটানর মুলে।
যেভাবে India ও ভারতবর্ষের রূপরেখা ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে তৈরী হয়েছে, সেখানে পূর্বতন ধারণা অনেকটাই সরে এসে একটা সুগঠিত, মানচিত্রায়নযোগ্য, সংহত অঞ্চলের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। যা ছিল একটা মুক্তসীমা অঞ্চলের ধারণা, তা হল সীমায়িত, প্রশাসনিক ভাবে সংজ্ঞায়িত এক দেশ। স্থানিক অংশ, ইতিহাসের নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে চিহ্নিত হল, যা আগে ছিল না। এই ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে, ‘বিদেশী’, বৈদেশিক আগ্রাসন’, ‘অন্ধকার যুগ’ এই সব শব্দগুলি। অতীতের বিরাট অংশের ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে এই একই রকম পূর্বাভাস প্রবেশ করেছে।
এই নবরূপে সীমায়িত ভারতবর্ষ শুধুমাত্র একমাত্রিক ঐতিহাসিক আখ্যানের ক্ষেত্র হিসেবেই চিহ্নিত হল না, এটা অনেক ইচ্ছুকদের কাছে অচেতনভাবে কালানৌচিত্যের শিকার হল। তৈরী হল ভারতীয় জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা। এইভাবে একজন সহজেই বুঝতে পারে, রাজনৈতিক একীকরণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও অনৈক্যের ভাবনা, কিভাবে আমাদের সহজে অর্থোদ্ধারযোগ্য ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের ওপর চাপ তৈরী করে।
ভারতবর্ষের উপনিবেশ-পূর্ব অতীতের কালগত বিভাজন ‘হিন্দু’, ‘মুসলিম’—এই দুই ভাবে খোদিত হয়ে রইল, যা আজও নির্মূল হয় নি। এটা ভারতীয় চিন্তাধারার অতীতের সম্পর্কে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী করল, যা আগে ছিল না। এটা হিন্দু শাসন ও মুসলিম শাসনের মধ্যবর্তী প্রক্ষেপণের পরিসরটুকু মুছে ফেলল। রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ এক জাতির থেকে আরেক জাতির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকল। এটা, বোঝাই যায়, ‘ভারতবর্ষ বা India’ গঠনের এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নারকীয় অপচেষ্টা। অতীতের ভারতবর্ষ অনেক ধরনের পরিসর, নানান সামাজিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখত।
ঔপনিবেশিক পর্বে সৃষ্ট India-র ধারণা ‘ভারতবর্ষ’র অভিজ্ঞানে চিহ্নিত হয়ে একটি দায় তৈরী করল, যা বাধ্য করল এক নব্য জাতীয়তাবাদের যুগের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে, এবং সম্ভবত তাকে গৌরবান্বিত করে তুলতে।
এক কথায়
এবারে ‘ভারতবর্ষের’ ধারণা সম্পর্কে আমি আমার উপসংহারীয় বক্তব্য পেশ করতে চেষ্টা করব, অন্য একটি প্রামাণ্যের কথা উল্লেখ করে, তা হল লিপি। লিপিকে ঐতিহাসিকরা অতীত সম্পর্কে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে মান্যতা দিয়েছেন। মোটামুটি দশম থেকে চতুর্দশ শতকের সময়কালকে চূড়ান্ত করার জন্য লিপিগুলি নির্বাচিত হয়েছে। এই কালখণ্ডের বিস্তারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেন না, এটা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের একত্রীকরণের চরম কালপর্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
মর্জিমাফিক এই লিপিগুলিকে বাছাই করলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট এলাকা, অঞ্চল বা স্থানকেন্দ্র অসমরূপে অন্যগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এবং মূল ‘ভারতবর্ষে’র ধারণাটিকে নির্মাণ করেছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। উত্তর কর্ণাটকের রাষ্ট্রকূট লিপি (৯২৯-৩০) থেকে পুরিকারা নামে একটি জনপদের কথা জানা যাচ্ছে। এটি ভারতমহিমামণ্ডলের অলঙ্কার হিসেবে বর্ণিত। ভারতমহিমামণ্ডল একটি ছোট্ট অঞ্চল হিসেবে নির্দেশিত। এটা বিভিন্ন সূত্রের উদ্ভব ও তার প্রয়োজনীয় নিয়মতান্ত্রিকতাকে নির্দেশ করে। কর্ণাটকের বেলারি জেলার কুরগদ-এর দ্বাদশ শতকীয় লিপি থেকে জানা যায় (AD 1181) কুন্তলার দেশের কথা , যা ভারত-ক্ষেত্রে অবস্থিত। এটা জম্বুদ্বীপের অংশ, যা গভীর সমুদ্র-বেষ্টিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ও চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অন্ধ্রের পূর্ব গোদাবরী জেলার পিথাপুরম অঞ্চলের কিছু লিপি থেকে জানা যায়, দক্ষিণ সমুদ্র থেকে পর্বতরাজ হিমালয় পর্যন্ত যে ভূমি প্রসারিত, তা-ই ভারতবর্ষ। অন্ধ্র সেখানেই অবস্থিত, যাকে বলা হত ত্রিলিঙ্গ ভূমি। এই তিনটি লিঙ্গ (shrines) দ্বারা অভিহিত শ্রীশৈল, কালেশ্বর, এবং দ্রাক্ষর্মা.....এখানে পাঁচটি বাগানের নাম দক্ষ, অমর, ক্ষীর, কুমার এবং প্রাচ্য। শিবের ক্রীড়া ক্ষেত্র এবং পবিত্র নদী হিসেবে নাম আছে গৌতমী, কৃষ্ণবেণী, মালপ্রভা, ভীমারথি এবং তুঙ্গভদ্রার। কৃষ্ণা নদীর তীরে শ্রীকাকুলা, বিষ্ণুর বাসস্থান। তিনি ত্রি-জগৎকে রক্ষা করেন। বোঝা যায়, মহাকাব্য-পুরাণে ভারতবর্ষের যে ধারণা উচ্চারিত হয়, তা স্থানিক ভাবে উদ্ভূত অঞ্চলবিন্যাসের এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রের কথাই বলে। এটাই সার্বিকভাবে স্বীকৃত মহাবৌদ্ধিক ধারণাকে উন্নীত করেছিল। এভাবেই একটি নব্য রাজবংশ নিজেদের পুরাণের বংশেতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে থাকে। এই একই ব্যাপার দেখা যায় একটি চতুর্দশ শতাব্দীর লিপিতে। একই অঞ্চল থেকে উদ্ভূত কোনো ভূ-ক্ষেত্র , ন’টি খণ্ডে ভাগ হয়ে জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষ পর্যন্ত গেছে। এ হল সেই স্থান যেখানে কর্মফল পাওয়া যায়। নানা ভাষা ও প্রথা বিরাজ করে। এই ক্ষেত্রটি কিন্তু বহু দেশে বিভক্ত। তাদের একটির নাম ত্রিলিঙ্গ—এর মধ্যে দিয়ে অনেক নদী প্রবাহিত হয়েছে। এখানে অনেক উন্নত শহর, সুন্দর পর্বত, গহন বন, গভীর নদীখাত, ও দুর্ভেদ্য দুর্গ আছে। স্পষ্টতই এই সময়ে ভারতবর্ষ তার মহাকাব্যিক-পৌরাণিক ইমেজসহ একট প্রসরমান ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কোনো স্থান হিসেবে হয়ত নথিবদ্ধ আছে।
(ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। পরে কেমব্রিজ থেকে পি.এইচ.ডি. করেন। ২০০৪ সাল অব্দি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। ২০১৭ সাল নাগাদ সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পড়িয়েছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর প্রকাশিত বহু বইয়ের কয়েকটির নাম দেওয়া গেলঃ Coins and Currency System in South India (1977); Aspects of Rural Settlements and Rural Society in Early Medieval India (1990); The Making of Early Medieval India (1994); Representing the Other Sanskrit Sources and the Muslims (1998)Studying Early India: Archaeology, Texts and Historical Issues (2003)। তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে D. D. Kosambi, Combined Methods in Indology and Other Writings (2002, 2009) এবং A Social History of Early India (2008)। ১৯৭৮ সালে তাঁর Coins and Currency System in South India ইন্সটিটিউট দে ফ্রান্সের পুরস্কার পেয়েছিল। ২০০২ সালে কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য পান হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী জন্মশতবার্ষিকী স্বর্ণ পদক। ৭৮ বছর বয়সী শারীরিকভাবে অসুস্থ এই ঐতিহাসিক বর্তমানে বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির বাসিন্দা।)
সূচনা
প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাসচর্চায় একটি অবহেলিত অধ্যায়। ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাস যে দিকপাল নৃতত্ত্ববিদরা রচনা করেছেন, যেমন বিরজাশঙ্কর গুহ, ধীরেন্দ্রনারায়ন মজুমদার, নির্মলকুমার বসু এবং এল.পি. বিদ্যার্থী, এঁরা কেউই জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের উপর আলোকপাত করেন নি। ভারতে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনা যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়
কিংবা সাম্প্রতিককালে রোমিলা থাপারের অবদানে যেমন একটি সুনির্দিষ্ট ধারায় প্রবাহিত সেরকমটা নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রে ঘটেনি। অথচ দেশ গঠনের কাজে নৃতত্ত্বের অবদান অনস্বীকার্য। আজও ভারতীয় নৃতত্ত্ব যেন পশ্চিমী নৃতত্ত্ব দ্বারাই প্রতিনিয়ত পরিচালিত হয়ে চলেছে। দ্বিতীয় যে কথাটা বলতে চাই সেটা হল জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব বলতে আমি উগ্র স্বাদেশিকতা সম্পৃক্ত, ধর্মীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ একদেশদর্শী কোন নৃতত্ত্বের কথা বলতে চাইছি না। আমার ব্যাখ্যায় জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব হল দেশ গঠনের কাজে নিযুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্বলিত নৃতাত্ত্বিক গবেষণার একটি নতুন ধারা যার পর্যালোচনা ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাস রচনায় এযাবৎকাল অনুল্লিখিত। এরকম একটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমি ভারতীয় নৃতত্ত্বের উপর সমালোচনামূলক ভাষ্যগুলির একটি ধারাবিবরণী উপস্থাপনের মাধ্যমে শুরু করব।
ভারতীয় নৃতত্ত্ব কি আসলে ঔপনিবেশিক?
বিগত বেশ কয়েক দশক যাবৎ ভারতীয় নৃতত্ত্বকে পশ্চিমী নৃতত্ত্বের অন্ধ অনুগামী একটি ধারা হিসেবে দেখার প্রবণতা গড়ে উঠেছিল। ভারতে নৃতত্ত্বচর্চার প্রতিষ্ঠাতা নিঃসন্দেহে
ব্রিট্রিশ প্রশাসক ও পণ্ডিতবর্গ। সমালোচকদের বক্তব্য ছিল এরকম। ব্রিটিশ প্রশাসক পণ্ডিতরা ভারতে নৃতত্ত্বচর্চার যে ঐতিহ্য তৈরি করেছিলেন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা সেই ঔপনিবেশিক ধারা অতিক্রম করে নৃতত্ত্বকে সত্যিকারের ভারতীয় করে তুলতে পারেননি। যদিও বিষয়টির গবেষণা ও পাঠের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। যাঁরা ভারতীয় নৃতত্ত্বের এই সমালোচনা করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই নৃতাত্ত্বিক এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত। সমালোচনার এইধারায় প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন সুরজিৎ সিংহের নাম। ভারতীয় নৃতত্ত্বে সুরজিৎ সিংহ একটি উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ভারত সভ্যতার নির্মাণে আদিবাসী ও জাতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ও ধারাবাহিকতার ক্রমান্বয় সম্পর্কিত মৌলিক গবেষণায় সুরজিৎ সিংহের অবদান আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। সুরজিৎ সিংহ ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৃ-বিজ্ঞান সমাজের বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। উক্ত প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘Is There an Indian Tradition in Social/Cultural Anthropology : Retrospect or Prospect?’ এই প্রবন্ধে সুরজিৎবাবুর প্রধান
বক্তব্য ছিল বিগত ১০০ বছরে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা পশ্চিমী এবং ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্বের উপরেই প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এরপর ১৯৭৪ সালে সুরজিৎবাবু একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকের ভূমিকায় প্রায় একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেন। লেখকের ভাষায়ঃ “ভারতীয়
গবেষকদের মধ্যে অগ্রণী পূর্বসূরী ও সমকালীন নৃতাত্ত্বিকদের প্রকাশিত গবেষণাগুলির সম্পর্কে একটি অনীহা দেখা যায়। এর ফলে উক্ত গবেষকবৃন্দের প্রচেষ্টাগুলি মৌলিকত্বের অভাবে দুষ্ট। আর সেকারণেই নতুন চিন্তাভাবনার সমস্ত দায়িত্ব তারা ছেড়ে দেন পশ্চিমী গবেষকদের উপর (সিংহ ১৯৭৪)।”
সুরজিৎ সিংহের পর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের দুই অধ্যাপক অমিতাভ বসু ও সুহাস বিশ্বাস ১৯৮০ সালে তাঁদের বিতর্কিত প্রবন্ধ ‘Is Indian Anthropology Dead/Dying?’ লেখেন। বসু এবং বিশ্বাস ভারতীয় নৃতত্ত্বকে সামাজিক দায়িত্ব বিবর্জিত ও মৃতপ্রায় একটি বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। বেশ কয়েক জন নৃতাত্ত্বিক ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সমাজের গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত উক্ত প্রবন্ধের উপর তাঁদের মন্তব্যে আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন যে বসু ও বিশ্বাসের পর্যবেক্ষণ মেনে নেওয়া যায় না। কারণ ভারতীয় নৃতত্ত্ব কারুর কাজে লাগেনি এটা বলা যায় না। ভারতীয় নৃতত্ত্ব এযাবৎ কালশাসক শ্রেণী ও সমাজের সুবিধা ভোগী গোষ্ঠীর উপকারে নিয়োজিত। আপামর জনসাধারণের জন্য বিষয়টির প্রায় কোন অবদান নেই (বসু ও বিশ্বাস ১৯৮০)। এরপর প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রেঁ বেতে তাঁর এক গবেষণাপত্রে আমাদের জানানঃ ‘‘ভারতবর্ষে সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রতিটি প্রজন্মই নতুনভাবে শুরু করতে আগ্রহী। পূর্বসূরীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে ওদের প্রায় কোন রকম আকর্ষণ নেই। পূর্বসূরীদের গবেষণা সম্পর্কে বিস্মৃত ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের এই বৈশিষ্ট্য নতুন কিছু খুঁজে বের করার ব্যাপারে তাদের অকৃতকার্যতা থেকে কোন অংশে কম নয় (বেতে ১৯৯৭)।’’
বলাবাহুল্য যে বেতের বক্তব্যের সঙ্গে সুরজিৎ সিংহের পর্যবেক্ষণ মিলে যায়। সিংহের প্রকাশিত প্রবন্ধের পর সুবিখ্যাত ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় বিশ্বনাথ দেবনাথ ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের তীব্র সমালোচনা করেন এই বলে যে তাঁরা আজ পর্যন্ত নিজেদের মত করে দেশের উপযোগী একটি নৃতত্ত্ববিদ্যা গড়ে তুলতে পারলেন না। ওরা শুধুই পশ্চিমী প্রভুদের অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছেন। দেবনাথের পথ অনুসরণ করে জে. জে. রায়বর্মণ তাঁর ২০১১ সালের প্রবন্ধে ভারতীয় নৃতত্ত্বের মধ্যে নয়া-উপনিবেশবাদী চিন্তাধারার প্রভাব সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন (দেবনাথ ১৯৯৯ এবং রায়বর্মণ ২০১১)।
হিন্দু নৃতত্ত্ব
ভারতীয় নৃতত্ত্ব ঔপনিবেশিক প্রভুদের অন্ধ অনুগামী, সামাজিক দায়িত্বজ্ঞান বিবর্জিত ও পূর্বসূরীদের মৌলিক গবেষণা সম্পর্কে বিস্মৃত একটি বিষয় এরকম ধারণার ঠিক উল্টোপিঠে আর একটি চিন্তার সন্ধান পাওয়া যায়। আমি ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাস রচনায় এই ধারার নাম দিয়েছি হিন্দু নৃতত্ত্ব। বর্তমান রাজনীতির জগতে হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে এর মিল খুঁজে বের করা আমার গবেষণার উদ্দেশ্য নয়। নৃতত্ত্ব বিষয়ে উক্ত মতবাদের অনুগামীরা বিশ্বাস করেন যে ভারতে ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্ব শুরু হবার অনেককাল পূর্বেই বেশ কয়েকটি প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে নানা নৃতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত এনথ্রোপলজিক্যাল পেপারস নামে গবেষণা পত্রিকায় যোগেশচন্দ্র ঘোষ লিখিত একটি আকর্ষণীয় প্রবন্ধের শিরোনাম Hindu Anthropology। এই প্রবন্ধের লেখক বলেছেন খ্রীঃপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগেই তৎকালীন হিন্দুরা মানবদেহের উপর নানা রকমের মাপজোক আবিষ্কার করেছিলেন যা কিনা পরবর্তীকালে ইউরোপে আবিষ্কৃত শারিরীক নৃবিজ্ঞানের (Physical Anthropology) গুরুত্বপূর্ণ প্রশাখা নৃমিতির (Anthrometry) সমতুল্য। প্রবন্ধের শুরুতেই ঘোষ বলেছেনঃ ‘‘নৃতত্ত্ব আধুনিক উন্নত বিজ্ঞানগুলির মধ্যে অন্যতম। নৃমিতি এবং মানবজাতি তত্ত্ব এই বিজ্ঞানটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই প্রবন্ধে আমরা তথ্য সহযোগে দেখাব যে হিন্দুরা বহু প্রাচীনকাল থেকেই তাদের নিজস্ব নৃমিতি ও মানবজাতি তত্ত্ব চর্চা করতেন (ঘোষ ১৯৩৮)।’’
এরপর উক্ত প্রবন্ধে ঘোষ বলেন যে প্রাচীন হিন্দু-চিকিৎসা বিজ্ঞানগ্রন্থ ‘শুশ্রুতসংহিতায়’ মানবদেহের উপর বিভিন্ন নৃমিতি সংক্রান্ত মাপজোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন যে ঋকবেদেই প্রথম মানুষের দেহের চামড়ার রঙ অনুযায়ী মানব জাতিসমূহের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে ঘোষের মত অনুযায়ী প্রাচীন হিন্দু মানবজাতি তত্ত্ব (Ethmology) ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানের পূর্বসূরী।
হিন্দু নৃতত্ত্বের আর একজন প্রভাবশালী নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বসু (১৯০১–১৯৭২) যিনি এক সময় মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। বসু ১৯২৯ সালে Cultural Anthropology শিরোনামে একটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। এই বইতে বসু বলেন যে হিন্দুশাস্ত্রে মানবজাতির জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু ও ক্রিয়াগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভাজিত করা হয়েছিল। এই বিভাগগুলি হল অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। নির্মলবাবুর মতে উক্ত শ্রেণীবিভাজন যেন অনেকটাই বিংশ শতকের উপযোগিতামূলক ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে মিলে যায়।অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্রকাররা পশ্চিমী উপযোগিতামূলক নৃতত্ত্বের (Functional Anthropology) অনেক আগেই উপযোগিতার তত্ত্বের সন্ধান পেয়ে গেছিলেন। পরবর্তীকালে বসু আদিবাসী আত্তীকরণের হিন্দুপদ্ধতি (Hindu Method of Tribal Absorption) নামে একটি তত্ত্বের অবতারণা করেন। ১৯৪১ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে নির্মলবাবু তাঁর একটি গবেষণা পত্রে এই তত্ত্বটি লিখিত আকারে পেশ করেন। উড়িষ্যার পাললাহারা অঞ্চলে জুয়াং নামে আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত স্বল্পকালীন ক্ষেত্রসমীক্ষা লব্ধ যে তথ্য বসু সংগ্রহ করেছিলেন তার উপর ভিত্তি করেই আদিবাসী আত্তীকরণের হিন্দুপদ্ধতি নামে তত্ত্বটিকে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। এই তত্ত্বটি ভারতীয় নৃতত্ত্বে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং প্রভাবশালী। আজও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠ্যক্রমে নৃতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীদের এই তত্ত্বটি অধ্যয়ন করতে হয়। তত্ত্বটির মূল কথা হল যে সমস্ত আদিবাসীগোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী বর্ণহিন্দু সমাজের সংস্পর্শে আসে তারা ক্রমশ নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বা হারিয়ে হিন্দু সমাজের নিম্নজাতিভুক্ত সম্প্রদায়ে পরিণতহয়। এটাই ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাস। বসুর এই তত্ত্বের বাস্তব ভিত্তি ক্ষেত্রসমীক্ষা দ্বারা যাচাই করার বিশেষ কোন প্রচেষ্টা ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। আদিবাসী সমাজের হিন্দু আত্তীকরণের এই বৃহত্তর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই নির্মলবাবুর জাতীয়তাবাদী ধারণা গড়ে ওঠে। সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসু নির্মলবাবুর জাতীয়তাবাদী ধারণা সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধে চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ ‘‘(নির্মল) বসুর বর্ণনায় হিন্দুধর্ম মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী একটি আদর্শ যা কিনা সমাজের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলিকে অসাম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থার মধ্যে একত্রিত করে ফেলে। হিন্দুধর্মের এই আত্তীকরণের ক্ষমতা সম্পর্কে বসুর ধারণা থেকেই আদিবাসীগোষ্ঠীগুলি যে শেষ পর্যন্ত জাতিব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিলএই তত্ত্বের ব্যাখ্যা মেলে। এইদিক থেকে দেখতে গেলে বসু অন্যান্য প্রাচ্যবাদী লেখকদের মতই ভারতীয় সমাজের ইতিহাসকে মূলত একটি হিন্দু ইতিহাস হিসেবেই দেখেছেন। এই ইতিহাস অ-হিন্দুদের হিন্দু হয়ে যাবার ইতিহাস (বসু ২০০৭)।’’
হিন্দু নৃতত্ত্বের ধ্যান-ধারণাগুলি আজও বর্তমান ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের আকর্ষণ করে চলেছে। সম্প্রতি ভারতীয় নৃ-বিজ্ঞানসর্বেক্ষণের (Anthrpological Survey of India) একদা পরিচালক (Director) অজিতকুমার দণ্ড তাঁর সাম্প্রতিক প্রবন্ধে বলেছেনঃ
‘‘আনুমানিক ১৩৫০ খ্রীঃপূর্বে রচিত মানব ধর্ম শাস্ত্র নামক স্মৃতিগ্রন্থ (আক্ষরিক অর্থে মানবসম্পর্কিত বিজ্ঞান) সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম নৃবৈজ্ঞানিক পুঁথি। এরকম দাবী করাই সঙ্গত যে উক্ত গ্রন্থটি অ্যারিস্টটল নামাঙ্কিত এনথ্রোপলজি শব্দটি ব্যবহারের অন্তত ১০০০ বছর পূর্বেই নৃবিজ্ঞানের প্রকৃত প্রয়োগে নিয়োজিত হয়েছিল।’’ (দণ্ড ২০১৭)
অধ্যাপক দণ্ড অবশ্য তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধের কোথাও তথাকথিত ‘হিন্দু-নৃতত্ত্বের’ পূর্বসূরী বস্তুতান্ত্রিক চার্বাক দর্শনের উল্লেখ করেননি। দণ্ডের আলোচনায় লোকায়ত, আদিবাসী কিংবা দলিত সম্প্রদায়ের চিন্তাভাবনার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানের কোন সন্ধানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দণ্ডের ভারতীয় নৃতত্ত্ব আসলে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুশাস্ত্রের আলোচনায় নিয়োজিত। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সুবিখ্যাত ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থের কোন উল্লেখ দণ্ডের লেখায় পাওয়া যায় না। যদিও অজিতবাবুর পূর্বসূরী যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের মত ‘হিন্দু নৃতত্ত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু ওঁর উদ্দেশ্য যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত উচ্চবর্ণীয় শাস্ত্রগুলির মধ্যেই বিশ্বের প্রাচীনতম নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানভাণ্ডার লুকিয়ে আছে এই তত্ত্বটি প্রচার করা এটা পরিষ্কার।
জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব
সাম্প্রতিককালে Anthropology in the East শিরোনামে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে প্যাট্রিশিয়া উবেরয়, নন্দিনী সুন্দর এবং সতীশ দেশপাণ্ডে মুখবন্ধের ‘জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্র’ শীর্ষক অংশে লিখেছেনঃ
‘‘আমরা এখনও ভারতীয় সমাজতত্ত্ব ও সামাজিক নৃতত্ত্বের উপর জাতীয়তাবাদ ঠিক কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করে ছিল তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে পারিনি। এটা নিশ্চিত যে উক্ত বিষয় দুটির ব্যক্তিসংক্রান্ত বা প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস রচনায় জাতীয়তাবাদ একটি উপাদান হিসেবে উল্লিখিত।’’ (উবেরয়, সুন্দর, দেশপাণ্ডে ২০০৭)
উল্লিখিত মন্তব্যটির পরবর্তী আলোচনায় লেখকরা স্বীকার করেছেন যে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি বিশাল এক বর্ণালীর মত এবং কোন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক অথবা সমাজতাত্ত্বিকই জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন নি। আমি এই প্রবন্ধে ভারতীয় নৃতত্ত্বে জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরতে পারব এরকম দাবী করছি না। বেশ কিছুদিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার ফলে আমার কাছে যে সমস্ত তথ্য এসেছে সেগুলিকে পাঠকবর্গের সামনে হাজির করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। উক্ত তথ্যাবলীর মাধ্যমে যা আমার নজরে এসেছে তাহল ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্বচর্চার পাশাপাশি ভারতে বেশ কিছুকাল ধরেই (স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে) কয়েকজন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক দেশের উপযোগী একটি জাতীয় তথা ভারতীয় নৃতত্ত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব (Nationalist Anthropology) কখনই হিন্দু নৃতত্ত্ব বা উগ্র স্বাদেশিকতাসম্পৃক্ত কোন নৃতত্ত্ব নয়। এই নৃতত্ত্বচর্চায় নিয়োজিত নৃতাত্ত্বিকরা পশ্চিমী নৃতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাগুলিকে যথেষ্ট পরিমাণে আয়ত্ত করেছিলেন, পদ্ধতিগুলিকে শিখেছিলেন এবং তারপর দেশগঠনের কাজে নৃতত্ত্ববিদ্যাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। এরকম কয়েকজন নৃতাত্ত্বিকের গবেষণার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। এ নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এই জাতীয়তাবাদী নৃতাত্ত্বিকরা পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করেননি আবার হিন্দু সংস্কৃত শাস্ত্রের মধ্যেই নৃতত্ত্বের প্রাচীনতম জ্ঞানভাণ্ডার লুকিয়ে আছে এমনটাও মনে করতেন না। বরং দেশগঠনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে নৃতত্ত্বকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এটাই ছিল ওদের চিন্তা। জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের এই প্রচেষ্টার বীজ বপন হয়েছিল মাত্র। বিশাল মহীরুহ দূরের কথা ছোটখাটো বৃক্ষও আমরা দেখতে পেলাম না। হয়ত সেকারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে সুরজিৎ সিংহের মত নৃতাত্ত্বিক ভারতীয় নৃতত্ত্বকে পশ্চিমী নৃতত্ত্বের অন্ধ অনুসরণকারী একটি বিদ্যা হিসেবেই দেখেছেন। এবার জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের কাহিনী শুরু করা যাক।
ঠিক যে বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ হিন্দু নৃতত্ত্ব প্রবন্ধটি লেখেন সেই বছরই ভারতীয় নৃতত্ত্বের এক পথিকৃৎ শরৎচন্দ্র রায় ইংল্যান্ডের সুবিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পত্রিকা Man-এ নৃতত্ত্বের একটি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধটিকে জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের প্রথম প্রতিনিধি বলা যায়। উক্ত প্রবন্ধে রায় তদানীন্তন পশ্চিমী তত্ত্বগুলিকে অত্যন্ত খুঁটিয়ে সমালোচনা করেন এবং একইসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মূল ভাবনার সঙ্গে পশ্চিমী ভাবধারার সম্মিলন ঘটাবার চেষ্টা করেন। নিঃসন্দেহে শরৎচন্দ্র রায়ের এই প্রচেষ্টা আজও আধুনিক। রায়ের মতে ভারতীয় দর্শনের মূল কথা হল আত্মানুসন্ধানী মনন প্রক্রিয়ার সাহায্যে ‘অন্য সংস্কৃতির’ (Other Culture) অন্তরেপ্রবেশ। এর সঙ্গে পশ্চিমী বস্তুবাদী পদ্ধতির মিলন ঘটানোই হল আসল কথা। রায়ের নিজস্ব ভাষায় শোনা যাকঃ
“আজ ভারতের অধিকতর বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তকরা বিশ্বজনীন আত্মসন্ধানে প্রাচীন ও আদর্শ সংস্কৃতির কাছেই ফিরতে চাইছেন। এই আত্মানুসন্ধানে ব্যক্তি ও সামাজিক সম্মিলনের মাধ্যমে উন্নততর জাতীয় চরিত্রের পুনর্গঠন সম্ভব। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রত্যেক সংস্কৃতি ও দেশের মধ্যে সর্বজনীন আত্মার সন্ধান মেলে বটে কিন্তু সকল জাতি ও সংস্কৃতিগুলিকে একই ছাঁচে ঢালাই করা সম্ভব নয়। অতীত ও বর্তমান, নব্য ও পুরাতন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রকৃত সম্মিলনই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।“ (রায় ১৯৩৮)
শরৎচন্দ্র রায়ের কাছে ভারতীয় নৃতত্ত্ব গড়ে তোলা শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উনিই প্রথম ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক যিনি ১৯২১ সালে Man in India নামে বৈজ্ঞানিক পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেন। আজও নৃতত্ত্বের এই পত্রিকাটি সগৌরবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। রায়ের মূল লক্ষ্য ছিল নৃতত্ত্বের একটি ভারতীয় ধারা গড়ে তোলা। Man in India পত্রিকার ১৯৮৫ সালের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সুরজিৎ সিংহের মন্তব্য এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়ঃ “Man in India পত্রিকায় শরৎচন্দ্র রায়ের উদ্যোগের পিছনে ছিল তদানীন্তন জাতীয় চাহিদা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রায়ের ব্যক্তিগত গর্ব। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিষয়ে রায় ভারতীয় গবেষকদের পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের উপদেশ দিয়েছেন। ফলত এই বৈজ্ঞানিক পত্রিকাটিতে ভারতীয় নৃতত্ত্বের পথপ্রদর্শক প্রায় সমস্ত পশ্চিমী এবং ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের প্রবন্ধ দেখতে পাওয়া যায়” (সিংহ ১৯৮৫)।
একথা বলাই যথেষ্ট যে শরৎচন্দ্র রায় একজন অন্ধ জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। Man in India পত্রিকায় বহু পশ্চিমী নৃতাত্ত্বিক ভারত সম্পর্কে তাঁদের মৌলিক গবেষণাপত্রগুলি লেখেন। এ বিষয়ে সঙ্গীতা দাশগুপ্তের শরৎচন্দ্র রায়ের উপর রচিত মূল্যবান প্রবন্ধের একটি অংশ উদ্ধৃত করলামঃ “রায় তাঁর দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় জীবনে বিবর্তনবাদ ও পরিচালনবাদের উত্থান এবং পতন দুই-ই দেখেছিলেন। একইসঙ্গে উনি দেখেছিলেন উপযোগিতামূলক ক্রিয়াবাদের উত্থান। বিভিন্ন সময়ে উক্ত ইউরোপীয় তত্ত্বগুলিকে উনি ভারতীয় ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেছিলেন। একই সঙ্গে রায় ছিলেন হিন্দু ও জাতীয়তাবাদী। জীবনের শেষ প্রান্তে রায় নৃতত্ত্বে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন। রায়ের বিশ্বাস ছিল যে নৃতত্ত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে বিভিন্ন উপাদানের মিলন ঘটিয়ে একীকরণ ঘটাতে সক্ষম” (দাশগুপ্ত ২০০৭)।
শরৎচন্দ্র রায়ের জাতীয়তাবাদী নৃতাত্ত্বিক চেতনা কখনই অন্ধ হিন্দুত্ববাদ কিংবা পশ্চিমী নৃতত্ত্বের অনুগামী ছিল না। রায়ের জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব ছিল একান্তই ভারতীয়।
এরপর আমরা সংক্ষেপে তিনজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নৃতাত্ত্বিকের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করব। এই তিনজন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক হলেন, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১), বিরজাশঙ্কর গুহ (১৮৯৪-১৯৬১) এবং তারকচন্দ্র দাশ (১৮৯৮-১৯৬৪)।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। কিশোর বয়সেই ভূপেন্দ্রনাথ তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেন এবং কারাদণ্ড ভোগ করেন। এরপর তিনি ছদ্মবেশে আমেরিকা যাত্রা করেন ও ১৯৪২ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি ও ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি বার্লিনে আসেন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি ভূপেন্দ্রনাথ সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান এবং ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে নৃতত্ত্বে জার্মানীর হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দত্তের গবেষণা ছিল সবসময়ই ভারতবিষয়ক। তিনি বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন ও বহু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখেন। শরৎচন্দ্র রায়ের প্রখ্যাত Man in India পত্রিকায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ভারতীয় সমাজপদ্ধতি (১৯৫৬), বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব (১৯৪৫), বাংলার ইতিহাস (১৯৬৩), Dialectics of Hindu Ritualism(1950), Hindu Law of Inheritance (1957), Swami Vivekananda: Patriot-Prophet-A Study (1954 ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভূপেন্দ্রনাথের Man in India পত্রিকায় ১০টি প্রবন্ধের মধ্যে ভারতে বর্ণজাতি ব্যবস্থা ও পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জাতি সম্পর্কিত প্রবন্ধদুটি উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের জাতিবিষয়ক প্রবন্ধটি ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। ওই সময় ভারতীয় নৃতত্ত্বে গবেষণার মূল বিষয় ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈহিক ও সমাজ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বিবর্তন। ভূপেন্দ্রনাথ উক্ত প্রবন্ধে আদিবাসী সমাজের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতিগোষ্ঠীগুলির বিষয়ে গবেষণা করেছেন অবলীলায়। তুলে ধরেছেন জাতিগুলির সামাজিক পরিবর্তনের কাহিনী। ভূপেন্দ্রনাথ লিখিত দুষ্প্রাপ্যগ্রন্থ Dialectics of Hindu Ritualism প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। প্রকাশক গুপ্তপ্রেস। শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন বইটির উদ্দেশ্য এবং স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন ভারত পুনর্গঠনের জন্যই যে এর প্রয়োজন গ্রন্থের ভূমিকাতেই লেখক সেকথা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। এরপরই বলা প্রয়োজন ভূপেন্দ্রনাথের ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ Hindu Law of Inheritance (An Anthropological Study)-র কথা। এই বইটিতে লেখক হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মার্কসীয় ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলা বাহুল্য যে ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাসে কিংবা পাঠক্রমে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্বন্ধে বিদেশী নৃতাত্ত্বিকদের তত্ত্ব আলোচিত অথচ আগাগোড়া ভারতীয় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় সম্পৃক্ত ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান আজও উপেক্ষিত। নৃতত্ত্বের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর অবদান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হোক এটাই কামনা।
বিরজাশঙ্কর গুহ
বিরজাশঙ্কর গুহ আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে। ভারতে ফিরে এসে ১৯২৭ সালে গুহ ভারতীয় প্রাণীবিজ্ঞান সর্বেক্ষণ (Zoological Survey of India) সংস্থায় নৃবিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন। প্রাণীবিজ্ঞান সংস্থায় যোগদান করার পর থেকেই বিরজাশঙ্করের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতে একটি নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণ প্রতিষ্ঠা করা। বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় ১৯৪৫ সালে গুহ অবশেষে ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণ (Anthropological Survey of India) প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংস্থার প্রধান পরিচালক (Director) হিসেবে যোগদান করেন। ওই সময় ভারতীয় নৃবিজ্ঞানের সহ-পরিচালক (Deputy Director) ছিলেন প্রবাদপ্রতিম নৃতাত্ত্বিক ভেরিয়ার এলউইন। গুহ শুধু একজন শারিরীক নৃবিজ্ঞানী ছিলেন না, উনি একই সঙ্গে ছিলেন একজন সমাজ সচেতন সমাজবিজ্ঞানী। ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের গবেষণা যাতে নৃতত্ত্ব ও নতুন ভারত গঠনে কাজে লাগে এবং একই সঙ্গে নৃতত্ত্ব যেন একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এগুলিই ছিল বিরজাশঙ্কর গুহর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। পঞ্চাশের দশকে গুহ একটি গবেষক দলের প্রধান হিসেবে তদানীন্তন উদ্বাস্তু সমস্যার উপর একটি সর্বাঙ্গীন সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের দুটি উদ্বাস্তু কলোনীর উপর গুহর নেতৃত্বে যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তার শিরোনাম ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে সামাজিক উত্তেজনা বিষয়ক অধ্যয়ন’ (১৯৫৯)। এই বইটি বিরজাশঙ্করের সম্পাদনায় ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণ থেকে প্রকাশিত হয়। উক্ত সমীক্ষায় গুহ ব্রিটিশ সরকারের বিভাজনের মাধ্যমে শাসনের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলেই যে উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরী হয়েছিল সেকথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেন। এই সমীক্ষায় যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তাহল উদ্বাস্তুদের সামাজিক উত্তেজনা সম্পর্কিত বিপুল পরিমাণ তথ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গুহ কখনই পশ্চিমী কোন তাত্ত্বিকদের দ্বারস্থ হননি, নিজেদের সংগৃহীত তথ্যাবলীর বাইরে গিয়ে তত্ত্বনির্মাণের চেষ্টা করেন নি। উদ্বাস্তুদের মধ্যে সামাজিক উত্তেজনার কারণ খুঁজতে গিয়ে গুহ দেখেছিলেন যে সরকারী ব্যবস্থাই গৃহহীন মানুষগুলিকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। ওঁর পরামর্শ ছিল উদ্বাস্তুদের ক্ষমতায়ন করতে হবে, ওদের সঙ্গে বসে পুনর্বাসন প্রকল্প বানাতে হবে, দেশ গঠনের কাজে উদ্বাস্তুদের অংশগ্রহণই হবে নতুন ভারত তৈরির মূলমন্ত্র। স্বাধীনতার অব্যবহিত কালে একমাত্র সুরজিৎ সিংহ ছাড়া আর কোন নৃতাত্ত্বিক উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে এরকম মানবিক এবং নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষালব্ধ তথ্য সহযোগে পরামর্শ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। প্রায় একই সময়ে ১৯৫৮ সালে বিরজাশঙ্কর গুহ প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞান পত্রিকা Sociological Bulletin-এ একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটির নাম ‘জাতি গঠনে সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা’। এটি গুহ-র একটি দৃষ্টান্তমূলক রচনা, যা আজও পণ্ডিতমহলে উপেক্ষিত। উক্ত প্রবন্ধে গুহ নানা তথ্য ও যুক্তি সহযোগে বলেন যে, যদি আমরা বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক বৈচিত্র্যপূর্ণ মানবগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঐক্য বুঝতে না পারি তাহলে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ শুধুই একটি পল্লবগ্রাহী আহবানেই পর্যবসিত হবে। ওই প্রবন্ধেই গুহ নৃবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস কিংবা কেশবিন্যাসের বৈচিত্র্যের উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদানের (Undue Weightage) সমালোচনা করেন। গুহর মতে ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক একাত্মতাকে যেমন অধ্যয়ন করতে হবে, তেমনি একই সঙ্গে বুঝতে হবে তাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের পদ্ধতি ও কারণাবলী। আর এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রবন্ধের শেষভাগে গুহর পরামর্শ ছিল যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির সমাজবিজ্ঞানের প্রসার ও উন্নতি কল্পে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা উচিত। দেশ ও জাতি গঠনে নৃতাত্ত্বিক বিরজাশঙ্কর গুহর অবদান তাই আজও প্রাসঙ্গিক।
তারকচন্দ্র দাশ
স্বাধীনতা প্রাপ্তির সন্ধিক্ষণে যে সমস্যাগুলি তদানীন্তন ভারতবাসীর সামনে তাদের ভয়ংকর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৪৩-৪৪ এর বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ নিঃসন্দেহে অন্যতম। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু পুনর্বাসন যেমন স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের প্রধান সমস্যাবলী, তেমনই ১৯৪৩-র বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ ছিল এমনই এক সমস্যা যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা যান এবং গৃহহারা হন। অথচ দেশের এইরকম একটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও সমাজ সাংস্কৃতিক সমস্যা নিয়ে তদানীন্তন সমাজবিজ্ঞানীরা সে রকম কোন সমীক্ষা চালাননি। যে কয়েকজন ব্যতিক্রমী সমাজবিজ্ঞানী বঙ্গদেশের দুর্ভিক্ষ ও পুনর্বাসন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তারকচন্দ্র দাশ। ভারতে জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব তথা দেশগঠনের কাজে নৃতত্ত্বের প্রয়োগ সম্বন্ধে তারকচন্দ্র দাশের অবদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তারকচন্দ্র দাশ দেশ ও বিদেশের নৃতাত্ত্বিক মহলে উত্তর-পূর্ব ভারতের পুরুম কুকিদের উপর তাঁর লেখা The Purums: An Old Kuki Tribe of Manipur (১৯৪৫) বইটির জন্যই খ্যাতি অর্জন করেন। তারকবাবুর যে কাজটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটির শিরোনাম Bengal Famine (1943): As revealed in a Survey of the Destitutes of Calcutta (১৯৪৯)। যে সময় ভারতীয় এবং বিদেশী নৃতাত্ত্বিকরা আদিবাসী সমাজ ও হিন্দুবর্ণ-জাতিব্যবস্থার অধ্যয়নে নিবিষ্ট সেই সময় তদানীন্তন রাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের সামনে বাংলার দুর্ভিক্ষ ছিল এক চ্যালেঞ্জ। তারকচন্দ্র দাশ তার অত্যন্ত সীমিত অর্থ ও লোকবল নিয়েই মহাদুর্ভিক্ষের মত জটিল ও বৃহৎ একসামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলায় নেমে পড়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগের কিছুছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-গবেষকদের নিয়ে কলকাতায় আগত দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের উপর পুরোদস্তুর নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমীক্ষা চালান দাশ। একই সঙ্গে উনি দক্ষিণ কলকাতার একটি লঙ্গরখানাও চালাতেন দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের জন্য। দাশের মহামূল্যবান পুস্তকটির ক্ষুদ্রতর সংস্করণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচিত হয়। তদানীন্তন দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধানকারী কমিশন দাশের বেশ কিছু পরামর্শ গ্রহণ করে। জহরলাল নেহরু উক্ত সমীক্ষার কথা তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ The Discovery of India তে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলার মহাদুর্ভিক্ষের উপর তাঁর লেখায় দাশের বহু তথ্যের উল্লেখ করেন। এক কথায় দেশগঠনের কাজে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের পুনর্বাসন পরিকল্পনা সম্পর্কিত দাশের এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদী ও প্রায়োগিক নৃতত্ত্বের সুযোগ্য ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পাবার অধিকারী।
উপসংহার
ভারতে জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের উৎস ও তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরাটাই ছিল বর্তমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাস রচনায় জাতীয়তাবাদী তথা দেশগঠনের কাজে নৃতত্ত্বের ভূমিকার কথা আজ পর্যন্ত গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠেনি। যে সমস্ত নৃতাত্ত্বিকরা ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা হয় ভারতে নৃতত্ত্ব চর্চাকে পশ্চিমীধারার অনুকরণ হিসেবে দেখেছেন, যেমন সুরজিৎ সিংহ; অথবা প্রাচীন ভারতে নৃবিজ্ঞান অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল এমনভাবে ভেবেছেন যেমননির্মলবসু, যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ও অজিত দণ্ড। বর্তমান প্রবন্ধের সাহায্যে আমি এটাই দেখেতে চেয়েছি যে উপনিবেশিক ধারায় নৃতত্ত্বচর্চার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক (যেমন শরৎচন্দ্র রায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিরজাশঙ্কর গুহ ও তারকচন্দ্র দাশ) দেশেরউপযোগী, বৈজ্ঞানিক ও জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বচর্চার একটি ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। নৃতত্ত্বচর্চার এই জাতীয়তাবাদী ধারা কেন পরবর্তীকালে যথেষ্ট পরিপুষ্ট হয়ে উঠল না সেটাই ভবিষ্যতের গবেষণার বিষয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এই লেখা তৈরির জন্য সবসময় উৎসাহ যুগিয়েছে আমার বন্ধু ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের অম্লান বিশ্বাস। অম্লানের তাগাদা এবং উৎসাহ না থাকলে এ লেখা তৈরিই হতনা। এছাড়া আমি কৃতজ্ঞ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোস্যাল সায়েন্স রিসার্চের কাছে। ওই সংস্থার সিনিয়র ফেলো হিসেবে ভারতীয় নৃতত্ত্বের জাতীয়তাবাদী উৎস নিয়ে গবেষণা করার সুবাদেই এই প্রবন্ধ লেখার রসদ সংগ্রহ করি। কলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস ও ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ওই সংস্থাদুটির গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ দেবার জন্য।
তথ্যসূত্র
Basu, A and Biswas, S.K. (1980). Is Indian Anthropology Dead/Dying? Journal of the Indian Anthropological Society. Vol.15; PP. 1-14.
Be’teille, A. (1997). Newness in Sociological Enquiry, Sociological Bulletin. Vol. 46, PP. 97-110.
Bose, N.K. (1953). Cultural Anthropology and Other Essays. Calcutta: Indian Associated Publishing Company Ltd.
Chattopadhyaya, D. (1959). Lokayata: A Study of Ancient Indian Materialism. New Delhi: People’s Publishing House.
Danda, A. (2017). Anthropology in Contemporary India. Journal of the Indian Anthropological Society. Vol.52, PP. 4-16
Bose, P. (2007). The Anthropologist as ‘Scientist’? Nirmal Kumar Basu. In P. Uberoi, N.Sundar, and S. Deshpande (Eds). Anthropoloy in the east : founders of Indian Sociology and anthropology (pp. 290-329). Ranikhrt : Permanent Block
Nirmal Kumar Bose. In P. Uberoi, N. Sundar and S. Deshpande (Eds.). Anthropology in the east: founders of Indian sociology and anthropology (PP. 290-329). Ranikhet: Permanent Block.
Dasgupta, S (2007). Recasting theOraons and the ‘Tribe’ Sarat Chandra Roy’s Anthropology.
In P. Oberoi, N. Sundar and S. Deshpande (Eds.).
Anthropology in the East: Founders of Indian Sociology and Anthropology (PP. 132-171). Ranikhet: Permanent Block.
Debnath, B. (1949). Crisis of Indian Anthropology. Economic and Political Weekly. Vol 34: 3110-3114.
Ghosh, J.C. (1938). Hindu Anthropology [Anthropological Papers (New Series)]. Calcutta: Calcutta University Press.
Guha, A. (2011). Tarak Chandra Das: A Marginalised Anthropologist. Sociological Bulletin. Vol. 60, PP. 245-265.
Guha, A. (2018). Nationalist Anthropology. The Statesman, 24th February, 2018, P. 8.
Guha, A. (2018). Scrutinising the Hindu Method of Tribal Absorption. Economic and Political Weekly. Vol. 53, PP. 105-110
Guha, A. (2019). Colonial, Hindu and Nationalist Anthropology in India. Sociological Bulletin, Vol. 68, PP. 154-168.
Guha, B.S. (1958). The Role of Social Sciences in Nation Building. Sociological Bulletin, Vol. 7, PP. 148-151.
Guha, B.S. (1959). Social Tensions Among the Refugees from Eastern Pakistan. Calcutta: Govt. of India.
Ray, S.K. (1974). Bibliographies of Eminent Indian Anthropologists (with life-sketches). Calcutta: Anthropological Survey of India, Govt. of India, Indian Museum.
Roy, S.C. (1938). An Indian Outlook on Anthropology. Man, Vol. 38; PP. 146-150
Roy Burman, J.J. (2011). Tragedy of Culture in Indian Anthropology. Mainstream 69 (12): 1-2
Sinha, S. (1971). Is There an Indian Tradition in Social/Cultural Anthropology: Retrospect and Prospect? Journal of the Indian Anthropological Society. Vol. 6, PP. 1-14.
Sinha, S. (1974). Foreword. In S.K. Ray (Ed.) Bibliographies of Eminent Indian Anthropologists (with life-sketches). Calcutta: Anthropological Survey of India, Govt. of India, Indian Museum.
Sinha, S.C. (1985). Editorial. Man in India. Vol. 65, PP. III-V.
Uberoi, P. Sundar, N. and S. Deshpande (2007). Introduction. In P. Uberoi, N. Sundar, and S. Deshpande (Eds.).
Anthropology in the east: founders of Indian sociology and anthropology (PP. 1-63). Ranikhet: Permanent Block.
নন্দীগ্রামের ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমার এক প্রিয় আমেরিকাবাসী বাঙালি অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্বাধীন দেশে এসব কী ঘটছে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, শিশুরাষ্ট্র তো। তাঁর কথা আমি বুঝতে পারিনি। ভুরু কুঁচকে বলেছিলাম, শিশুরাষ্ট্রেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে এর বয়স হলে কী হবে! তিনি হেসে বলেছিলেন, রাগ কোরোনা, আসলে উপনিবেশিক শাসকরা আমাদের ছেড়ে গেছে, উপনিবেশিকতা এখনো খোঁয়াড়ি কাটছে। কথাটা যে কতটা সত্যি প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করি। আমরা যতই ভাবি আমরা খুব স্বাধীনভাবে ভাবছি, আসলে সেসব ভাবনার সিংহভাগ জুড়ে আছে আমাদের উপনিবেশিক শাসকদের শেখানো ভাবনার বিন্যাস, আমাদের চেতনার গভীরে চারিয়ে যাওয়া তার শেকড়। যেমন সিঙ্গুর খুঁড়তে খুঁড়তে বেরিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশের তৈরি ১৮৯৪ সালের জমি আইন, ষাট বছরেও যা নিয়ে বিব্রত বোধ করেননি এমনকি কৃষক-শ্রমিকের বন্ধুরাও। উল্টে সেই আইনকেই ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন শিল্পপ্রসারের স্বার্থে। তাও আবার শিল্পটি কি, না, মোটরগাড়ি শিল্প, তার জন্যে হাজার একর চাষের জমি নষ্ট করতেও কুছ পরোয়া নেই।
উপনিবেশিকতা কী? নেলসন ম্যালডোনাল্ডো-টোরেস১ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের লোক। ২০০৭ সালে উপনিবেশিকতার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, উপনিবেশবাদ (Colonialism) আর উপনিবেশিকতা (Coloniality) দুটো আলাদা জিনিস। উপনিবেশবাদ হচ্ছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে যখন একটা দেশের সার্বভৌমত্ব আর একটা দেশের ক্ষমতার কাছে বাঁধা পড়ে, তখন তাকে বলে উপনিবেশবাদ। এই বন্ধকটাই হয়ে দাঁড়ায় সার্বভৌমত্ব হরণকারী সেই দেশটার সাম্রাজ্যে পরিণত হবার চাবিকাঠি। আর উপনিবেশিকতা হচ্ছে ঐসব দেশ তাদের উপনিবেশগুলোতে দীর্ঘ দিনের শাসনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতার নয়, ধ্যানধারণার যে বিন্যাস তৈরি করে তার বহমানতার নাম। বাঁধা পড়া দেশগুলো হয়ত একদিন মোটের ওপর সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়, চলতি অর্থে যাকে আমরা বলি স্বাধীন হয়ে যাওয়া, কিন্তু উপনিবেশিক শাসকের তৈরি সেই ক্ষমতার সেই ধ্যানধারণার বিন্যাসের বহমানতা সহজে নষ্ট হয় না। সেগুলো সে দেশের লোক বহন করে চলে প্রতিদিনকার অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রনৈতিক রাজনৈতিক যাপনে। শুধু শাসক গোষ্ঠী নয়, সবাই। তাই সাধারণ মানুষকেও আমরা কখনো কখনো বলতে শুনি, এর থেকে ব্রিটিশ আমল ভালো ছিল।
স্বাধীন ভারতে আজ আমরা সর্বক্ষেত্রে যে ক্ষমতার এবং ধ্যানধারণার বাহুবিস্তার দেখছি তার মূলে আছে সেই উপনিবেশিকতা, যে উপনিবেশিকতা ইংরেজরা আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। তার কিছু কিছুর যেমন আমরা প্রতিরোধ করতে পেরেছি, তেমনি বহু কিছুর আবার শিকারও হয়েছি। এই দুটো নিয়েই আমাদের ইতিহাস। যেসব উপনিবেশিকতা আমাদের রক্তের মধ্যে এখনো থেকে গেছে সেসবের মাশুলই আমরা এখনো গুনছি। শুধু যে এই স্বাধীন ভারতেই গুনছি তা নয়, যখন থেকে আমরা বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তির লড়াই লড়ছিলাম, তখন থেকেই গুনছি। তার পরিণামেই দেশভাগ, তার পরিণামেই প্রকৃতির ধ্বংস, তার পরিণামেই ক্ষমতার এই খেয়োখেয়ি, তার পরিণামেই আজকের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, তার পরিণামেই সাধারণ মানুষের প্রতি এই নিদারুণ অবহেলা। অতএব উপনিবেশিকতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত এবং অনুধাবন করতে না পারলে এবং ঠিকঠাক বিচার করে তার বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের সমস্ত লড়াই সমস্ত প্রগতিশীলতা শেষপর্যন্ত পরিণত হবে লম্ফঝম্ফে, কিংবা আমার আর এক প্রিয় অধ্যাপক তথা প্রশাসকের ভাষায় ‘হল্লা’য় এবং তার গুণাগার দিতে হচ্ছে এবং হবে সাধারণ মানুষকে।
এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে বাংলাকেই উপনিবেশিকতার সমীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ধরার কারণ হল বাংলা দিয়েই ব্রিটিশের ভারত জয়ের শুরু। সে হিসেবে বাংলাতেই উপনিবেশিকতার প্রথম শেকড় গাড়তে শুরু করার কথা। কিন্তু বাংলায় উপনিবেশিকতার আলোচনাকালে জায়গাটার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বাঙালি চরিত্রের গঠন ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার তুলনায় বেজায় আলাদা। ভৌগোলিক কারণে তার চরিত্রে যে মানসিক সংস্কারমুক্ততা, মানসিক স্বাধীনতা, বিচারশীলতা ইত্যাদি দেখা যায় সেগুলো আবার অন্য জায়গায় সেভাবে দেখা যায় না। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবিষয়ে নাতিবিস্তর আলোচনা করেছেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের গোড়ার দিককার কথা’ প্রবন্ধে। নদীর নিত্য ভাঙাগড়ার খেলাই বাংলার মানুষকে মানসিকভাবে সংস্কারমুক্ত ও স্বাধীন করে তুলেছে। প্রকৃতির হাতে মানব কীর্তির অহরহ ধ্বংস দেখে বাঙালির ভাবজগতেও পরিবর্তন সম্বন্ধে একটা সহনশীলতা এসে গেছে। তাই সে “ধর্ম চিন্তা বা সামাজিক জগতে পরিবর্তনের বিরোধী নয়, tradition বা চিরাচরিত রীতির চাপ থেকে তার মন অনেকটা মুক্ত।”২ ধর্মের দিক থেকে অনার্য বাংলা প্রধানত তন্ত্র ও মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের দেশও। এখানকার উচ্চতর শ্রেণিটির সঙ্গে আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আত্মিক সম্পর্কও অতি ক্ষীণ। এসব কারণেই বাংলার যে সংস্কৃতি তা আসলে অনেকটাই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধের সংস্কৃতি। সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধের সংস্কৃতির সঙ্গে পরে ইসলামি সাম্যবাদের ধারণাও যুক্ত হয়ে যায় এবং সমন্বয় ও আত্মীকরণের ফলে উদ্ভব হয় উচ্চতর এক সংস্কৃতির। প্রশ্ন হল বাঙালির সমন্বয় ও আত্মীকরণের সেই সংস্কৃতি উপনিবেশিকতার কতটা প্রতিরোধ করতে পেরেছে অথবা সেই সংস্কৃতি কতটা উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছে।
আসা যাক উপনিবেশিকতার আলোচনায়। পুরোনো জানা কথাগুলোই একবার ঝালাই করে দেখা যাক প্রাক-উপনিবেশিক পর্বে আমরা কেমন ছিলাম এবং উপনিবেশিক শাসন পর্বে আমরা কেমন দাঁড়ালাম।
ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসকের অর্থাৎ ব্রিটিশের প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্যের সূত্রপাত হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলার ক্ষেত্রে লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে। জমি পণ্য হয়ে গেল। মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব মুঘল যুগেও ছিল, তাদের কিছু কিছু অত্যাচারও ছিল, কিন্তু ছিল না জমির মালিকানা। জমির মালিকানা থাকত কৃষকের হাতেই, যদিও সীমাবদ্ধ। রাজার ক্ষমতা ছিল না কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করার, কৃষকের ক্ষমতা ছিল না জমি হস্তান্তর করার। অনেকে একে দ্বৈত মালিকানা বলেছেন।
সত্যের খাতিরে বলতে হবে ব্রিটিশ আমলে যেসব মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপত্তি হল, তাদের সিংহভাগই ছিল হিন্দু। কেন সেকথায় পরে আসছি। এই মধ্যস্বত্বভোগী স্তরটি হলুম আমরা, ভদ্রলোকরা। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে ‘ভদ্রলোক’ শব্দটার কোনো অস্তিত্ব নেই। আগে আমরা ছিলাম কেউ বামুন, কেউ কায়েত, কেউ বদ্যি--উঁচু জাত, কিন্তু কেউ ভদ্রলোক ছিলাম না। আমরা ভদ্রলোক হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা, আগে যারা নিচু জাত হিসেবে অভিহিত হত, তারা হয়ে গেল ছোটলোক। এ এক নতুন অভিধা।
সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজকে ভদ্রলোক-ছোটলোকে এবং হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে দিতে পারাটা ছিল ব্রিটিশের দিক থেকে দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। জাত কী? মার্কসীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত বন্টনের অসাম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে যে সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রচলিত ছিল, তাকে আমরা জাত বলি। সমাজ যখন পুঁজিবাদের পথে হাঁটা দিল, তখন সেই পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার প্রয়োজনে প্রচলিত নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ওপরের স্তরের জাতগুলো নতুন সংহত রূপ ধারণ করে ‘ভদ্রলোক’ হয়ে উঠল (নিচের স্তরের কেউ কেউ যে সে সৌভাগ্য অর্জন করেনি তাও নয়। রামপ্রসাদের গানে আছে—‘পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি, তারেও দিলি জমিদারি’। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম)। জে এচ ব্রুমফিল্ড (১৯৬৩)৩ বঙ্গ বিধানসভার ১৯২১ থেকে ১৯২৬ সালের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে বসে সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলেন, বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্রের নেতৃত্বে একটি বিশেষ স্তরের লোকজনের সর্বগ্রাসী উপস্থিতি, যাদের ‘ভদ্রলোক’ বলা হয়। জনসংখ্যার তারা মাত্র ৫ শতাংশ এবং তাদের প্রায় সকলেই ছোটবড় জমিদার।
এ গেল জাত থেকে আমাদের যথাক্রমে একদলের ভদ্রলোকে উন্নীত এবং বাকিদের ছোটলোকে অবনত হয়ে যাবার গল্প। এই গল্পেরই আর এক পিঠে আছে আমাদের হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে যাবার গল্প। এই গল্পের ধরতাইটাও ইংরেজরাই সঙ্গে করে এনেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত ইয়োরোপের ইতিহাস ছিল মূলত খ্রিস্টানদের ইতিহাস। অটোমান সাম্রাজ্যের বাহুবিস্তারের পর থেকে ইয়োরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে, যে বিষবাষ্প তারা উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে দিয়েছিল।
পলাশী যুদ্ধের আগে পর্যন্ত সামরিক এবং অসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের একটা প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি পাবার পরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলমান সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়। এর ফলে শুধু ওপরতলার কিছু কর্মচারীই বেকার হয়ে যায়নি, প্রচুর নিচুতলার কর্মচারীও বেকার হয়ে দারিদ্রের মধ্যে গিয়ে পড়ে। এর পর রাজস্ব বিভাগকেও তারা নিজেদের ধ্যানধারণা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর সময় প্রচুর মুসলমান কর্মচারীর কাজ যায়। সবথেকে বড় আঘাত আসে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে। বহু মুসলমান জমিদার তাদের জমিদারি থেকে উচ্ছেদ হয়। বলা বাহুল্য এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল হিন্দুরা। ইংরেজরা এদেশে আসার প্রায় শুরু থেকেই মুসলমানদের অনুপস্থিতিতে একদল হিন্দু তাদের গোমস্তাগিরির দেওয়ানিগিরির মুৎসুদ্দিগিরির সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে যথেষ্ট অর্থের মালিক হয়ে গিয়েছিল। সেই অর্থই তারা জমিতে ঢালে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই বাংলায় শুধু আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করেনি, হিন্দু মুসলমানে বিভেদের বীজও প্রথম বপন করেছিল। ঐ বছরই গ্রাম্য পুলিশ প্রথা তুলে দেওয়ার কারণে ঐ পেশায় বহাল থাকা প্রচুর মুসলমান আরো এক দফা বেকার হয়। মুসলমানদের আয়ের উৎস এবং সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ নীতি। আর, নিচু তলার লোকজনের যে দুটো প্রধান সম্বল ছিল অর্থাৎ কৃষি ও তাঁত, সেগুলো ইংরেজরা কীভাবে ধ্বংস করেছিল সে গল্প আমাদের সকলেরই জানা, তাই তার পুনরুক্তি এখানে করছি না। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে এইসব কৃষক ও তাঁতিদের বড় অংশটাই ছিল মুসলমান। খেয়াল করলে দেখা যাবে মুঘল শাসনের বিরোধিতা করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অছিলায় মুসলমানদের বিরোধী হয়ে উঠতে গোড়ার দিকে হিন্দুদের তারা যথেষ্ট তাতিয়েও ছিল, যার পরিণামে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি আমাদের একদল জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকও আমাদের ইতিহাসের মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। ১৮৭০ সালের আগে পর্যন্ত ইংরেজরা মুসলমানদের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব টানা বজায় রেখেছিল, তার পর তাদের গুরুত্ব দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, সে কেবল তাদের ভাগ কর শাসন কর নীতির স্বার্থে, হিন্দুদের অপ্রতিহত গতিকে রোখার জন্যে, যেহেতু তা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের পক্ষে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল।
সামাজিক ক্ষেত্রে আরো দুটো বড় পরিবর্তন ঘটল। এক, বৃহত্তর সমাজের থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকায় এবং পশ্চিমী ধারার প্রাবল্যে আমরা ভুলে গেলাম যে আমাদের দেশে সমাজ আগে, ব্যক্তি পরে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বর্ণাশ্রম প্রথা তৈরি করার সময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জায়গাও তৈরি করেছিল, সে জায়গাটা হল সন্ন্যাস। কিন্তু আমাদের সামাজিক ভাবনাচিন্তায় এবং কাজেকর্মে যে উগ্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, তার চেহারাটা সন্ন্যাসীর নয়। দুই, আমরা ভুলে গেলাম যে আমাদের দেশে ‘সমাজকে যা ধারণ করে তাহাই ধর্ম’, মূলত সমাজপদ্ধতি বা জীবনধারা। খ্রিস্টধর্মের মত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয় যে ব্যবহারিক জীবন ও ধর্মীয় জীবন দুটো আলাদা খাতে বয়ে যাবে। এবং যদিও ইসলাম বাদে বাকি সব ধর্মেরই জন্ম বৈদিক ধর্মের বিরোধিতা থেকে এবং তাদের প্রতিষ্ঠাতা আছে, এদেশে তাদের পুষ্টি কিন্তু সমাজপদ্ধতি হিসেবেই। এমনকি প্রতিষ্ঠাতা থাকলেও ইসলামও এদেশে সমাজপদ্ধতি হিসেবেই বিকশিত হয়েছিল। ধর্মগুলির পারস্পরিক সমন্বয় ও আত্মীকরণের ওপর দাঁড়িয়েই এই সমাজপদ্ধতিগুলি গড়ে ওঠে। আরো বড় কথা, এইসব ধর্মের সমন্বয় ও আত্মীকরণের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় জনজীবন ও সংস্কৃতি। পশ্চিমী ভাবধারার অনুকরণে ধর্মনিরপেক্ষতা যে আমাদের দেশে অচল, আশিস নন্দী (২০০৭)৪ সেটা যথেষ্ট যুক্তিসহকারে প্রমাণ করেছেন।
ধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনার ক্ষেত্র সাম্প্রতিক বাংলায় খুবই সংকীর্ণ। বেশির ভাগ পাঠকই এ ধরনের আলোচনা শুনতে চান না বা এসব বিষয়ে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারেন না। আনুষ্ঠানিক ধর্মের ক্রিয়াকলাপ এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিকৃতি দেখে তাঁরা এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন যে ধর্মকেই তাঁরা জীবন থেকে বাদ দিয়ে ভাবতে চান। তাঁরা ঢাকিশুদ্ধু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। তাঁদের পশ্চিম-জারিত ধারণা হল ধর্ম অশিক্ষিত মূর্খ বোধবুদ্ধিহীন গেঁয়ো লোকেদের ব্যাপার। তাঁদের মধ্যে এ বোধ তৈরি হয়নি যে “নানা ব্যবহারিক কারণে আমাদের সামাজিক জীবনে যে জিনিসটি একটি বহুমূল্য লাভ করে তাহা আস্তে আস্তে একটা ধর্মমূল্য অর্জন করিয়া বসে। দেখা যায়, যাহাকে অবলম্বন করিয়া আমাদের সমাজচিত্তের কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন তাহারই ধীরে ধীরে আমাদের ধর্মবস্তু বা ধর্মানুষ্ঠানে রূপান্তর।” (শশীভূষণ দাশগুপ্ত; ১৩৯৯ বাং)৫ কোটি কোটি মানুষের ধর্মপ্রাণতাকে এই যে কতিপয় লোক মিলে নস্যাৎ করে দিতে চান এই প্রতিক্রিয়াটা অনেকটা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইয়ং বেঙ্গলি প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ। কায়েমি স্বার্থের হাতিয়ার ধর্মের বিপরীতে জনগণের লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও যে ধর্মের বড় ভূমিকা ছিল সে ইতিহাসে তাই তাঁরা কখনো মনোনিবেশ করেননি। এলিট শ্রেণির মধ্যে এই বীতশ্রদ্ধা ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে উপনিবেশিকতার কি কোনো ভূমিকা আছে? বোধহয় আছে। বাপকাকাদের কাছে শুনেছি স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে ছেলেদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে ব্রিটিশরাই সেই সময় জেলের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারার বই চালান করেছিল। এবং অনেকেই জেল থেকেই বামপন্থী হয়ে ওঠেন। নিপীড়িত জনগণের হাতিয়ার হিসেবে বামপন্থার তুলনা নেই, কিন্তু বদহজম হওয়া সেই বামপন্থা থেকেই নিজের দেশ ও তার ধর্ম-সংস্কৃতি সম্বন্ধে এই বীতশ্রদ্ধার ও অজ্ঞতার যে উৎপত্তি তাও অস্বীকার করার নয়।
ব্রিটিশের তৃতীয় তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মধ্য বা এই ভদ্রলোক শ্রেণিটির পোষণ। এই ভদ্রলোক শ্রেণিটিকে অতঃপর নিজেদের প্রয়োজনমত গড়েপিটে নেওয়ার কৌশলের রূপরেখা তৈরি করলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, যিনি বলেছিলেন যে ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান আর যাঁর সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, “systematic falsifier of history”৬। তিনি আমাদের বশংবদ শ্রেণি হিসেবে গড়ে তোলার উপায়স্বরূপ প্রথমত ইংরেজি ভাষা শেখানোর ওপর জোর দিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের অন্যান্য আদতগুলোও আমাদের গ্রাস করতে শুরু করল। পরিণামস্বরূপ সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আমরা দেশের বাকি লোকজনের থেকে আলাদা হতে শুরু করলাম। বাংলা সাহিত্যের দাদামশাই কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৭) লিখেছিলেন, “কেরাণীদের নিত্য কলিকাতায় যাতায়াতের সঙ্গে সঙ্গে, পল্লীগ্রামে নব নব ভাবের অভ্যুদয় আরম্ভ হইয়া,--অশিক্ষিত ইতর সাধারণের সখ্য-বন্ধন হইতে ক্রমেই আমাদের স্বতন্ত্র করিয়া দিতেছিল, এবং তাহারা ‘ছোটলোক’ আখ্যা পাইতেছিল।”৭ আমাদের চোখে মুসলমানরাও গিয়ে পড়ল ছোটলোকদেরই দলে, কারণ ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষের কারণে তখন তারা ইংরেজের সমস্ত কিছুকেই এড়িয়ে চলত, এমনকি ইংরেজি ভাষা শিখতে চাওয়াটাও। আর ভদ্রলোক মানেই ইংরেজনবিশী।
সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইংরেজরা বাঙালিদের আরো একটা বড় ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। বিশেষ করে ১৮৬০ সালের পর থেকে ইংরেজদের নজরে বিষ হয়ে উঠতে শুরু করে বাঙালিরা। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে তারা ক্রমশই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছিল এবং সিভিল সার্ভিসে তাদের যোগদানকে ঠেকানোটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল। অতএব এই সময় থেকে তারা এ কথা প্রচারে আনতে শুরু করল যে “পরীক্ষা পাশ করার ব্যাপারে খুবই দক্ষ ও মেধাবী হলেও সুশাসক হবার কোনও গুণই তাদের নেই। সাহস, ক্ষিপ্রতা, কর্মনৈপুণ্য ও আত্মনির্ভরতা ইত্যাদি যে সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য অসংখ্য ইংরেজ সুদক্ষ প্রশাসক হতে পেরেছেন, বাঙালীদের মধ্যে তার একান্ত অভাব।”—লিখেছেন স্বয়ং বড়লাট জন লরেন্স। এই উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে অমলেশ ত্রিপাঠী (১৯৮০) লিখেছেন, “....যথেষ্ট যত্ন সহকারে পঞ্জাবী ও পাঠানদের মতো ‘বলিষ্ঠ জাতি’, ‘পরিশ্রমী জাতিগুলিকে’ ‘রমণী-সুলভ কোমল-স্বভাব’ বাঙালীদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছিল, এমন কি বুদ্ধিমান বাঙালীদের ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে বিদেশী বলে বর্ণনা করা হচ্ছিল। বাঙালীর গুণগ্রাহী চার্লস ট্রেভেলিয়ানের পুত্র জি. ও. ট্রেভেলিয়ান বাঙালীদের মিথ্যুক বলতেও দ্বিধা করলেন না।”৮ বুঝতে অসুবিধে হয় না স্বাধীন ভারতে সর্বভারতীয় স্তরে এই যে বাঙালি-বিদ্বেষ বা বাঙালিকে অবহেলা করার একটা প্রবণতা আমরা দেখছি, তার উৎস কোথায়।
তবে এই সঙ্গে এটাও বলতে হয় যে বাঙালি হিন্দুরাও খুব ধোয়া তুলসিপাতা নয়। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের উন্নাসিকতার অনুকরণ করে তাদের সঙ্গে সমমর্যাদার আসন পাবার লোভে অন্যান্য জাত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের মনোভাব থেকে আমরাও নিজেদের মুক্ত করতে পারিনি। আমাদের শব্দভাণ্ডারে ‘উড়ে-মেরো-খোট্টা’ বা মুসলমানদের সম্পর্কে ‘কাটা বা কাটুয়া’ শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার তার প্রমাণ। সাহেবদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারেও আমরা কিছু কম যাইনি। এই তাচ্ছিল্য ও অত্যাচারের ফল হয়েছিল এই যে একটা সময় বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি সত্তা থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়েছিল। জীবনতারা হালদার ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা’য় (১৯৮৯)৯ অভিযোগ করেছিলেন যে তখন মুসলমানরা বাঙালি বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের বুঝত এবং নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে ভাগের এই ষড়যন্ত্র শেকড়ে পৌঁছতে পারেনি। গত পঞ্চাশ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিক দিক থেকে যদি কোনো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে থাকে তা হল বাংলাদেশের স্বাধীন হয়ে যাওয়া--হিন্দু-মুসলমান ভিত্তিতে নয়, বাঙালি সত্তার পরিচয়ে। এর জন্যে অবশ্যই আমাদের ওপার বাংলার মানুষগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
সাধারণভাবে দেখলে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রদেশগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে পারস্পরিক অসম্মানসূচক কিছু শব্দের চল ছিল, যেমন উত্তর ভারতে খুব প্রচলিত ছিল একটা কথা—‘বঙ্গালি জেঞ্জালি, কাশ্মিরী বিপীরী’ অর্থাৎ বাঙালিরা হল ঝঞ্ঝাটে জাত আর কাশ্মিরীরা বিধর্মী। কিন্তু সেসব বাচালতার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। এসব মনোভাবকে ইংরেজরাই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা হয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার অধিবাসী এবং প্রায় ভুলতেই বসলাম যে আমরা আসলে যে দেশটার লোক ছিলাম, তার নাম ছিল ভারতবর্ষ, ব্রিটিশের হাতে গড়া ইন্ডিয়া নয়। তার আদলটা যেরকম ব্রিটিশের তৈরি আদলের থেকে আমূল আলাদা ছিল, তেমনি তার ইতিহাসের চলনটাও ব্রিটিশের তৈরি ইতিহাসের চলনের থেকে আমূল আলাদা ছিল। ভারতবর্ষ কোনো দেশ ছিল না, এটা ছিল একটা ধারণা, একটা সংস্কৃতির ধারা, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে সেই ধারণার সেই সংস্কৃতির ধারার বশবর্তী হয়ে পথ চলতে আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামে পাই—“জেই জন চন্দনে করে হরিসঙ্কীর্তন/ভারথমণ্ডলে তার সফল জীবন।”১০
ভারতবর্ষ অন্তত তিনটি বিষয়ে পশ্চিমী দেশগুলোর থেকে আলাদা ছিল। এক, এটা ছিল একটা মূল্যবোধকেন্দ্রিক সভ্যতা, ক্ষমতা ও বিত্তকেন্দ্রিক নয়। দুই, এটা ছিল একটা সমাজকেন্দ্রিক সভ্যতা, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়। তিন, এটা ছিল একটা কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা, শিল্পকেন্দ্রিক নয়। ইংরেজদের হাতে পড়ে এই তিনটে বৈশিষ্ট্যই চুলোয় গেল। আমরা ক্রমশ ভোগবাদে ঢুকে পড়লাম। সমাজকে কমজোরি করে ক্রমশ রাষ্ট্রনির্ভর হয়ে উঠতে লাগলাম। এবং যদিও সভ্যতাটা এখনো কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা, তথাপি এটাকে শিল্পকেন্দ্রিক করতে উঠে পড়ে লাগলাম। ১৯২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতে গ্রাম ছিল ৬,৮৫,৬৬৫ ১১ যখন নাকি বাংলা ও পঞ্জাব দুইই অখণ্ড ছিল। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী খণ্ডিত বাংলা ও পঞ্জাব সমেত স্বাধীন ভারতের গ্রাম ৬,০০,০০০ ১২ যেসব গ্রামের মূল নির্ভর এখনো কৃষি এবং শিল্প এখনো কৃষির সঙ্গে হাত মিলিয়েই পথ চলা দাবি করে। অর্থাৎ গত পৌনে একশ বছরে সেই কাঠামোর বিশেষ বদল ঘটেনি। বদলে গেছে আমাদের এলিট শ্রেণির চাওয়াটা।
তার ওপর ইংরেজরা ভারতবর্ষকে একটা নির্দিষ্ট পরিধির গণ্ডিতে বেঁধে দেশটাকে রাজনৈতিকভাবে একটা রাষ্ট্রে পরিণত করল, আর আমরা তাকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করতে উঠে পড়ে লাগলাম। অথচ যে দেশে বহু ভাষা বহু ধর্ম বহু জাতের লোকের বাস, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা সে দেশে খাটে না। রাষ্ট্র বলতে যদি রাজ্যশাসন প্রণালী বোঝায়, সেটা ভারতবর্ষে সবসময়ই ছিল, ছিল না গণ্ডিবদ্ধ রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ধারণা। দেশটা যখন গণ্ডিবদ্ধ রাজনৈতিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেল, তখন পশ্চিমী ধারণার অনুবর্তন করে আমরা জাতীয়তাবাদের যাঁতাকলে পা দিলাম। এবং জাতিরাষ্ট্র গঠনের অভীপ্সায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম হল। বিজ্ঞরা জানেন জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা মোটেই ভালো ছিল না। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “এক মস্ত বড় আপদ।”১৩ গান্ধীজির স্বরাজের সঙ্গেও জাতীয়তাবাদের ধারণার মৌলিক পার্থক্য আছে।১৪
আমরা কখনো খুঁটিয়ে দেখিনি পশ্চিমের সঙ্গে প্রাচ্যের আমাদের মূল তফাতগুলো কী কী? ভারতীয় সমাজসাধনার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর পশ্চিমের রাষ্ট্রসাধনার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। আমাদের দেশে যেসব চিন্তানায়করা নিয়ত পূব-পশ্চিমকে মেলানোর সাধনা করে গেছেন, উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার কারণে তাঁরা অনেক সময়ই এই তফাতগুলোর দিকে সম্যক দৃষ্টি রাখতে পারেন নি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিলিতি হুইগ ধারার রাজনীতিই হয়ে উঠল আমাদের আদর্শ, যে কারণে বিখ্যাত হুইগ এডমন্ড বার্ক ভারতীয় রাজনীতিতে অভাবিতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির ‘A Nation in Making’ পড়লেই এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে। মনে রাখতে হবে লর্ড কর্ণওয়ালিশ, লর্ড মেকলে, লর্ড বেন্টিংক এঁরা সবাই ছিলেন হুইগ।
বিশেষ করে তরুণ পাঠকের জন্যে এখানে ছোট্ট করে বলে নেওয়া উচিত হুইগ কি। এককথায় হুইগ হচ্ছে নরমপন্থী উদারতাবাদ। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এটা ছিল রাজার সর্বময় কর্তৃত্বের জায়গায় সংসদের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, নিজেরাও যেহেতু প্রোটেস্টান্ট, তাই বিরোধী প্রোটেস্টান্টদের প্রতি নরম মনোভাব গ্রহণ দেখানো এবং পোপতন্ত্রবাদী পৌত্তলিক রোমান ক্যাথলিকদের বিরোধিতা করা। পোপতন্ত্রবাদীদের বিরোধিতা করার বড় কারণ ছিল পোপতন্ত্র মানেই ছিল সৈন্যশাসন ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা। আমাদের দেশে হুইগ আদর্শ এসে পৌঁছেছিল এডমন্ড বার্কের লেখালেখির মাধ্যমে। বার্ক ছিলেন হুইগ ধারার এক রক্ষণশীল উদারতাবাদী চিন্তাবিদ। তিনি এলিটদের স্বাভাবিক নেতৃত্বের পক্ষে জোর ওকালতি করেছিলেন, জনগণের রাজনৈতিক অক্ষমতার কথা বলেছিলেন, বাসিন্দাদের যে এলিট অংশটিকে নাগরিক সমাজ বোঝায় সেই নাগরিক সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং সর্বোপরি সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আদর্শ রাষ্ট্রের ছাঁচে ঢেলে সামাজিক প্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন।
দুটো কারণে বার্ক ভদ্রলোকদের বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের কাজকর্ম (Speeches of Edmund Burke on the Impeachment of Warren Hastings) নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি আগেই ভদ্রলোকদের মন জয় করেছিলেন। বিজেতাদের (মানে শাসক ইংরেজদের) সমালোচক আমাদের বন্ধু--এই ছিল বার্কপ্রিয়তার যুক্তি। তার ওপর এলিটদের স্বাভাবিক নেতৃত্বের পক্ষে বার্কের ওকালতি বার্কপ্রিয়তাকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৮৯৫ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে জনগণের নয়, শিক্ষিত শ্রেণির একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তাতে সেইসব শিক্ষিতদের নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন, “who by reason of their culture and enlightenment, their association with English ideas and their familiarity with the English model of government might be presumed to be qualified for such a boon.”১৫
মূলগতভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিশ্বস্ত আবেদন নিবেদনের এই নরমপন্থী রাজনীতি কিন্তু বাংলায় বেশিদিন ধোপে টেঁকেনি। বাংলায় আগাগোড়াই প্রচ্ছন্নভাবে একটা চরমপন্থী আবহাওয়া ছিল। এই চরমপন্থী আবহাওয়ার ধারকবাহক ছিল রাজনীতি নয়, ধর্ম--শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের মনন ধর্মকে আশ্রয় করেই ক্রিয়াশীল ছিল। ‘প্রবুদ্ধ ভারত’এ বিবেকানন্দ স্মৃতিচারণে কামাখ্যানাথ মিত্র লিখেছিলেন, “এখন যেমন সবাই খুব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়, আমাদের সময় সবাই খুব ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাত।”১৬
তন্ত্রচর্চা দেবীকেন্দ্রিক। তন্ত্রচর্চার উদ্ভব সম্ভবত হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে যেসব দেশ সেইসব দেশে—কাশ্মীর থেকে বাংলার প্রাগার্য সমাজের মধ্যে, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। শাক্ত ধর্মের উত্থান খুব সম্ভবত মধ্যযুগে, অন্তত এ এল ব্যাসাম (১৯৮৬)১৭ সেরকমই অনুমান করেছেন। ভারতেতিহাসের গোড়া থেকেই দেবীরা ছিলেন, কিন্তু ছিলেন প্রধানত পুরুষ দেবতাদের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে। কিন্তু মধ্যযুগে যখন বড় বড় সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করল এবং তাদের জায়গায় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হল, তখন থেকেই সম্ভবত শক্তির দেবী হিসেবে আলাদা করে তাঁদের অর্চনা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এই শক্তিসাধনায় সন্তান ভাবের মধ্যে বীরভাবে সাধনাও ক্রমশ মিলেমিশে যেতে শুরু করে। সন্তানভাবে সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল বিপদের রক্ষয়িত্রী হিসেবে দেবীর সাধনা, বীরভাবে সাধনায় লক্ষ্য হয়ে উঠল বলদায়িনী রূপে দেবীর সাধনা।
শশীভূষণ দাশগুপ্তের (ঐ)১৮ মতে, শক্তিসাধনা বাংলায় অনেক আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই নবরূপ লাভ করেছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। তার আগে অব্দি এখানে ছিল চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ বাংলায় মূল ধারার বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব কমতে শুরু করে এবং এর সারবস্তু বাংলার তন্ত্র এবং ইসলামের সঙ্গে মিলেমিশে লৌকিক সমাজে নানা ধারায় ছড়িয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষে করার চেষ্টা করে। মুঘল আমলের পতন এবং ইংরেজ শক্তির উত্থানের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধিক্ষণে মূল বৈষ্ণব ধর্মের অনুপস্থিতিতে শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম আবার মাথা চাড়া দেয় এবং সম্ভবত এসময় থেকেই সন্তানভাবে শক্তিসাধনার পাশাপাশি বীরভাবে শক্তিসাধনাও সমধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এখানে একটা কথা অবশ্যই বলা দরকার। বৈষ্ণব ধর্মের সারবস্তু লোকসমাজে নানা সমন্বয় ও আত্মীকরণের মধ্যে দিয়ে বিচিত্র বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করে নিজেকে রক্ষে করার যেসব চেষ্টা করছিল সেসব চেষ্টার মধ্যে অনেক পথের খোঁজ ছিল, কিন্তু একথা ঠিক যে দীন ও দাস্যভাবের সেই সাধনা মানুষে মানুষে ঐক্যের ভিত মজবুত করলেও সমাজটা যেন কিছুটা এলিয়ে পড়েছিল বা বলা যায় প্রাণশক্তির একটা অভাব ঘটেছিল। সম্ভবত সমাজে প্রাণশক্তির সঞ্চারে বীরভাবে শক্তিসাধনা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। তাই দেখি একদিকে ইংরেজদের স্তাবক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রজাদের কালীর আরাধনায় উৎসাহ যোগান, অপরদিকে চুয়াড় বিদ্রোহীরাও সেই একই কালীর আরাধনা করে।১৯
বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিবিষ্টভাবে চোখ রাখলে দেখব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তার ইতিহাস টানা ধর্মের মাধ্যমে লড়াইয়ের ইতিহাস। এই উপাদান সম্পূর্ণ দেশজ উপাদান। শুরু থেকে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম ও পরে তারই উপজ সহজযানের হাত ধরে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধকল্পে, তারপর শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে বৈষ্ণব ধর্মের মাধ্যমে—সেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধকল্পে, এবং শেষে শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্মের মাধ্যমে একাধারে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও বিদেশী শাসনের প্রতিরোধকল্পে। এই শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম থেকে কিভাবে ‘মা’ শব্দটাকে গ্রহণ করা হল এবং দেশের সঙ্গে তাঁকে একাকার করে দিয়ে দেশমাতৃকার মূর্তি বানানো হল তার ইতিহাসে যথাসময়ে আসা যাবে। আপাতত ‘বিদেশী’ শব্দটা নিয়ে দুচার কথা বলে আমরা রামমোহন প্রসঙ্গে ঢুকি।
সম্প্রতি ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়২০ দেখিয়েছেন, যে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ‘স্বদেশী-বিদেশী’ বলে কিছু ছিল না। কথাটা ঠিকই। এই ভাগগুলো এসেছে জাতীয়তাবাদের সূত্র ধরে। অর্থাৎ এটাও উপনিবেশিকতার অবদান। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতবর্ষে মানুষে মানুষে ভাগের বিচার হত চতুর্বর্ণের ভিত্তিতে, স্বদেশী-বিদেশী নয়। স্বদেশী-বিদেশী হিসেবে দেখলে তো বাংলাও বিদেশ, কারণ যেসব দেশ আর্যাবর্তের চতুর্বর্ণের অনুসারী নয়, তারাই ছিল ম্নেচ্ছদেশ। ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দের হরিচরণ-কৃত অর্থ হল—“অব্যক্তভাষী, যে সংস্কৃতে কথা বলে না; অনার্যজাতি, বৈদেশিকজাতি।”২১ তবে মধ্যযুগে বিদেশী শব্দটা আমাদের এখানে যে চালু ছিল, স্বদেশী-বিদেশী অর্থে নয়, নিতান্তই বাণিজ্যসূত্রে যাতায়াতের অর্থে, কেননা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামে পাই—“দিসী সাধু হইল বধূ/না আইল বৈদিসী সাধু/দেখিতে দুর্লভ হইল গুয়া।”২২ সাধু এখানে সওদাগর অর্থে। এক জনপদের লোকের কাছে তার নিজের জনপদটা ছিল দেশ (‘স্বদেশ’ নয় কিন্তু), অন্য জনপদ ছিল বিদেশ। সহজেই অনুমেয় কেন বাঙালি বণিকের মানদণ্ডের মধ্যে অন্যায় কিছু দেখেনি।
অতএব বণিকের মানদণ্ডের মধ্যে রামমোহনও যে অন্যায় দেখেন নি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু রামমোহন চোখের সামনে বণিকের সেই মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হতে দেখেছিলেন। এবং সে শাসনের চেহারা তাঁর ভালো লাগে নি। তাঁর স্বলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনীতেই আছে, “পরিশেষে বৃটিস্ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশতঃ আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করিয়াছিলাম।”২৩ তবু তাকে তিনি স্বাগত জানালেন কেন? ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে রামমোহনের মত বিতর্কিত চিন্তানায়ক বোধহয় দুটি নেই। গত দেড়শ বছর ধরে তাঁকে ডান-বাম সব ধরনের কঠোর সমালোচনার সামনে পড়তে হয়েছে। একদিকে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯৮৪)২৪ রামমোহন নামক কিংবদন্তীর গোড়ায় আঘাত করে বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীকে যেসব কারণে নবযুগ বা নবজাগরণের কাল বলা হয়, সেই রাজনৈতিক নবজন্ম, জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং দেশাত্মবোধের পুষ্টি, কোনোটারই উৎসমুখ হিসেবে রামমোহনকে গণ্য করা যায় না, বরঞ্চ সে সম্মান অনেক বেশি প্রাপ্য ডিরোজিওর। যে লোক ফরাসি বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন, যে লোক দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশগুলির মুক্তিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, সেই একই লোক কী করে নিজের দেশের উপনিবেশ থাকা আন্তরিকভাবে চাইতে পারেন, এ প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। অপরদিকে গত শতাব্দীর সত্তরের ধারার একদল বামপন্থী ঐতিহাসিকের অভিমত এই যে “ব্রিটিশ-শক্তিনির্ভর দেশীয় বণিক-জমিদারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে রাজার চিন্তায় ও কর্মে। সামন্ত-স্বার্থ ও বণিক-স্বার্থের প্রতিনিধি রাজা রামমোহনের চিন্তাধারায় ও কর্মকাণ্ডে ছিল স্ববিরোধিতা এবং সে কারণেই উনিশ শতকের হিন্দুসমাজ-সংস্কার আন্দোলন সার্বিক পরিবর্তনের জন্য বাংলার গ্রামগুলিকে উদ্দীপিত করতে পারেনি।” (কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, ১৯৮৬)২৫।
রামমোহনকে ঘিরে ইতিহাসে যে জট পাকিয়ে আছে সেই জট খোলা এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। আমরা বরং উপনিবেশিকতার দিক থেকে রামমোহনের কাজকর্মের অসংগতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের রচনায়২৬ পাই, রামমোহন ছিলেন তুলনামূলক ধর্মের এক অতুলনীয় ছাত্র। ইসলাম, আর্য–ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের তুলনামূলক গভীর অধ্যয়ন এবং ভ্রমণকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সঙ্গে সম্যক পরিচিতির মধ্যে দিয়েই তিনি বিশ্বজনীনবাদে পৌঁছেছিলেন। তাঁর ছিল এক সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি। আচার্য শীলের মতে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি এই সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছিলেন। কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সামাজিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, কী রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। দিলীপ কুমার বিশ্বাসের২৭ মতে, একমাত্র ব্রজেন্দ্রনাথ শীলই তাঁকে ঠিকঠাক ধরতে পেরেছিলেন। তিনি আফশোষ করেছেন যে আচার্য শীল এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে কিছু লেখেননি। সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থই ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি। অতএব আচার্য শীলের ইঙ্গিতকে শিরোধার্য করে আমরা বিশ্লেষণের পথে এগিয়ে দেখতে পারি কোথায় পৌঁছই। কিন্তু রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি কি শুধুই সমন্বয়মূলক ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে এবং কিসের কিসের সমন্বয়? আচার্য শীল অবশ্য তার উত্তরও দেবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণে রামমোহন নিছক তত্ত্ববিদ ছিলেন না, ছিলেন একাধারে তত্ত্ববিদ এবং প্রখর বাস্তববাদীও। তাই জন ডিগবিকে তিনি লিখতে পারেন, হিন্দু ধর্ম বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা দিয়ে জনগণের পক্ষে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষে করা সম্ভব নয় এবং তাদের সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য আসাও সম্ভব নয়। অরবিন্দ পোদ্দার২৮ দেখিয়েছেন যে রামমোহন শুধু সমন্বয়বাদী ছিলেন না, ছিলেন উপযোগবাদী এবং শ্রেয়োবাদীও। ঘটনা হচ্ছে ভারতীয় জীবনধারায় উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদের অস্তিত্ব (চার্বাক) ছিল না তা নয়, কিন্তু তা কখনো জীবনের আদর্শ লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়নি। চার্বাক দর্শন সম্ভবত মূলগতরূপে খুবই উজ্জ্বল ছিল, এবং সেই অবিকৃত মূল দর্শনের সঙ্গে আমাদের সম্যক পরিচয় না থাকার ফলে এ নিয়ে কেউই খুব বেশি কিছু বলতে পারেন না, তবে মোটামুটিভাবে আন্দাজ করা হয় সমাজ শৃঙ্খলা এবং নৈতিক দায়িত্বকে খাটো করে দেখার কারণেই চার্বাক দর্শন গৃহীত হয়নি।২৯ চার্বাক দর্শন সম্ভবত দর্শনের সেই প্রারম্ভিক যুগেই ব্যক্তিকে সমাজের ওপরে ঠাঁই দেবার চেষ্টা।
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সবাই রামমোহন নন। কুমুদ কুমার ভট্টাচার্যের কথার খেই ধরে বলা যায় যে সামন্ত-স্বার্থ বা বণিক-স্বার্থ সেসময় আরো অনেকের ছিল, কিন্তু তাঁরা কেউ রামমোহন হয়ে ওঠেননি। একটা বৃহত্তর কিছুর প্রেরণাই রামমোহনকে রামমোহন করেছিল। হতে পারে সামন্ত-স্বার্থ বা বণিক-স্বার্থ তাঁর দৃষ্টিকে কিছুটা আচ্ছন্ন করেছিল, কিন্তু তাঁর স্ববিরোধিতাগুলির বিচারের ক্ষেত্রে সেগুলিকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
একটা আধটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে ছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল এতে করে রাজ্যের উপকার হয়েছে। এক, পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিগুলোতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে যে আয়বৃদ্ধি হবে তার জন্যে রাজস্ব বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যেসব জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছে সেসব জায়গায় জমির আয় অনেক বেড়েছে। তার ফলে পণ্যদ্রব্যের ওপর আমদানি রপ্তানি শুল্কও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। তাতে সরকারেরও আয় বৃদ্ধি হয়েছে। রাজস্ব নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতে জমি ব্যক্তিগত, পরিবারগত বা গ্রাম্য সম্পত্তি ছিল, রাজা স্বত্বাধিকারী ছিলেন না। মুসলমান আমলে তাঁরা বিজয়ী বলে জমির ওপর স্বত্ব স্থাপন করেছিলেন। তখন জমির ওপর চাষী এবং রাজা উভয়েরই স্বত্ব ছিল। এবং মোঘল আমলে জমির ওপর চাষী, জমিদার এবং রাজা তিনেরই স্বত্ব ছিল। চাষীদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্যে জমিদাররা শতকরা দশ কিংবা এগারো টাকা পেতেন। ইংরেজ আমল সম্পর্কে রামমোহনের অভিমত এই যে, তাঁরাও যেহেতু বিজয়ী, জমির ওপর তাঁদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। তাঁর মতে, লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেকটাই মুঘল আমলের সদৃশ। তফাতের মধ্যে শুধু এই যে রাজার স্বত্ব আরো স্পষ্ট হয়েছে এবং জমিদারদের স্বত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়, প্রজাদের জমিদারদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়। জমির ওপর তাদের স্বত্ব নেই। এটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যাপারে রামমোহন চেয়েছিলেন, এক, জমির ওপর প্রজার দখলীস্বত্ব থাকা দরকার (বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন তাঁর এই চাওয়া খানিকটা পূরণ করেছিল)। দুই, শুধু সরকারের সঙ্গে জমিদারদের নয়, কৃষকের সঙ্গেও জমিদারদের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থাকা দরকার। অর্থাৎ খাজনার ঊর্ধ্বসীমাটা চিরস্থায়ী হওয়া দরকার। এইজন্যে দরকার যে জমির বা চাষের উন্নতি করলেই জমিদার যদি খাজনা বাড়িয়ে চলেন, তাহলে জমির বা চাষের উন্নতিতে চাষীর কোনো আগ্রহ থাকবে না। ৩০
আগে রামমোহনের ইতিহাসপাঠের ভুলগুলো দেখে নেওয়া যাক। ইংরেজ আমলেই প্রথম পতিত, জংলা এবং অনাবাদী জমিতে চাষবাস আরম্ভ হয়েছে রামমোহনের এ বক্তব্য অনৈতিহাসিক। ইটন ৩১ (১৯৯৭) দেখিয়েছেন, ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল আমলে গঙ্গার মূল স্রোতের পদ্মার দিকে চলে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের দিকের জমি অনেক বেশি উর্বরতা পায় এবং ক্রমে জঙ্গলে ভরে ওঠে। সেইসব পতিত, জংলা ও অনাবাদী জমিকে আবাদী করতে স্থানীয় মানুষদের উৎসাহিত করেছিলেন একদল পিরগাজী। তাঁদের অনুগামী হয়ে যাওয়া ঐসব জায়গার লৌকিক সমাজই পরবর্তীকালে বাঙালির মুসলমান অংশের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। স্বত্বের ব্যাপারেও রামমোহনের বক্তব্য ঠিক নয়। প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে কোনো একটা সময় চাষী এবং রাজার দ্বৈতস্বত্বের উদ্ভব হলেও মুঘল আমল পর্যন্ত সেটা ছিল মালিকানা-স্বত্ব। দুপক্ষের দিক থেকেই সীমায়িত সেই মালিকানা-স্বত্বের বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে রাজা যেমন চাষীকে কখনো জমি থেকে উৎখাত করতে পারবেন না, তেমনি চাষীও কখনো জমি হস্তান্তর করতে পারবে না। জমিদারদের কোনো স্বত্ব ছিল না। রামমোহন নিজেই বলেছেন, তারা কর আদায়ের জন্যে শতকরা দশ কিংবা এগারো টাকা পেত। সেটা কোনো স্বত্বের ব্যাপার নয়। তাঁর নিজেরই বক্তব্য অনুযায়ী, ইংরেজ আমলে জমিদারদের স্বত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই স্বীকৃতি আগে ছিল না। এবং তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে চাষীদের কোনো স্বত্ব অবশিষ্ট নেই, তাই তিনি তাদের দখলী-স্বত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রামমোহনের বক্তব্যে প্রথমেই যেটা পীড়া দেয় সেটা হল রামমোহনের ভাবনায় কৃষকের ঠাঁই সবার নিচে। আরো একটা কথা পীড়া দেয়, বিজয়ী রাজার স্বত্বাধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। এখানে যে তাঁর ভাবনা সামন্ততান্ত্রিক যুগের ভাবনা দ্বারা সীমায়িত তা অস্বীকার করার নয়। আরো বেশি সীমায়িত এই কারণে যে তিনি নিজে এবং তাঁর পরিবার ছিল সেই সামন্ততন্ত্রেরই অংশ। কিন্তু তিনি যেমন সামন্ত যুগের অন্তিম লগ্নের লোক, তেমনি ইংরেজ যুগের প্রারম্ভিক লগ্নের লোকও। ইংরেজ আমলকে তিনি খোয়াতে চান না, আবার দেশের লোককে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতেও চান। অতএব তিনি সেইমত সমাধানসূত্র খুঁজেছেন। সেই সমাধানসূত্র হল তাঁর বিবেচনায় কৃষকদের দখলীস্বত্ব এবং কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে অনুরূপ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এটা হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কথিত রামমোহনের সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির একটা নমুনা। একটু খেয়াল করলেই দেখব সামন্ত-স্বার্থ এবং বণিক-স্বার্থ দ্বারা রামমোহনের দৃষ্টি আচ্ছন্ন থাকার কারণে একেবারে নিচের তলার মানুষদের ব্যাপারে রামমোহনের ভাবনাচিন্তা খানিকটা ওষ্ঠ-সেবা বা মৌখিক সহানুভূতির স্তরে থেকে গেছে। কিন্তু মূল ব্যাপারটা হচ্ছে মালিকানা-স্বত্ব আর দখলী-স্বত্বে যে মৌলিক তফাত আছে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই প্রথম যে আমাদের দেশের জমি পণ্য হয়ে গেল, উপনিবেশিকতার শিকার হয়ে যাবার ফলেই তিনি তা বুঝতে পারলেন না।
রামমোহন ইংরেজ শাসনের সম্পূর্ণ পক্ষে ছিলেন। পশ্চিমী সভ্যতাকে তিনি মনে করতেন আমাদের থেকেও উন্নতমানের এক সভ্যতা এবং আমাদের বহু দিন তার অধীনে থাকার দরকার আছে। অস্পষ্টভাবে জাতীয় চেতনার বিকাশ তাঁর সময়েই ঘটতে শুরু করেছিল। এই প্রশ্নে তিনি ভিক্টর জাকমোঁকে বলেছিলেন, “এই যে জাতীয় চেতনার তীব্র আকাঙ্খা একি লাগামছাড়া কল্পনা নয়? বিজিতের থেকে বিজয়ীরা যখন বেশি সভ্য হয়, বিজয়টা তখন আর খুব মন্দ জিনিস থাকে না, কারণ বিজয়ীরা বিজিতদের জন্যে নিয়ে আসে সভ্যতার নানা সুফল। ভারতের এখনো অনেক অনেক দিন ইংরেজদের অধীনে থাকা দরকার যাতে সে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে চাইবে তখন তাকে বহু কিছু হারাতে না হয়।”৩২ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের) তাঁর মতে, “ভারতীয় জাতীয়তাবাদ একমাত্র তখনই উন্নতি করবে যখন পশ্চিমী জগতের দেশগুলো মুক্ত হয়ে যাবে। তখন বিশ্বের সেইসব মুক্ত দেশ সর্বত্র একই নীতিগত সরকারের ব্যাপারে একটা সার্বিক মতৈক্যে পৌঁছবে।”৩৩ (বিমানবিহারী মজুমদার, ১৯৯৬;স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের) অধীনতা-স্বাধীনতা শব্দ দুটির তফাত বোঝাতে অতঃপর তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় স্বাধীনতা পরম কল্যাণকর কিছু নয়। যদি সমাজের লক্ষ্য হয় সবচাইতে বেশি লোককে ভালো রাখা এবং যখন একটা দেশ একা একা সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর অবস্থায় থাকে না, তখন ভবিষ্যৎ প্রগতির স্বার্থে তার উচিত হচ্ছে অধিকতর সভ্য কোনো দেশের অধীনে থাকা, যদি সেটা বিজয়ী কোনো দেশ হয়ও।”৩৪ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, সমাজে একজন লোক যখন আর একজন লোকের সাহায্য চায় তখন সেটা সে চায় এই জন্যেই যে সাহায্যকারী লোকটি তার থেকে বেশি শক্তিশালী। দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এই সাধারণ সত্যটা প্রযোজ্য হবে না কেন? ‘মুক্তি’ শব্দটা রামমোহনের লেখায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, অতএব এটা জেনে নেওয়া দরকার যে মুক্তি বলতে রামমোহন বুঝতেন ‘সাংবিধানিক সরকার’। যদিও তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁর বিশ্বাস ছিল সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে। নেপলসে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যখন বৃথা যায়, তখন রামমোহন খুব দুঃখ পেয়েছিলেন এবং বাকিংহামকে একটা চিঠিতে তিনি তা জানিয়েওছিলেন।
তাঁর এসব কথায় যে যথেষ্ট যুক্তি আছে তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যদি তাই হয়, ১৮২০ সাল নাগাদ যখন তিনি দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় কলোনিগুলির মুক্তির খবর পান, তখন অত খুশি হয়ে উঠেছিলেন কেন? সেকি এইজন্যে যে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিকে তিনি মনে করতেন পশ্চিমী সভ্যতার অংশ, যে সভ্যতাকে তিনি আমাদের তুলনায় উন্নতমানের সভ্যতা বলে মনে করতেন? কিন্তু তখনকার দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে কি পশ্চিমী সভ্যতার অংশ হিসেবে গণ্য করা যেত? তাদের কি সম্পূর্ণ নিজস্ব এক সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারা বহমান ছিল না? নাকি রামমোহনের ধারণায় এইসব স্পেনীয় উপনিবেশের লোকজন অন্তত আমাদের থেকে বেশি সভ্য ছিল? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। প্রচ্ছন্নভাবে যে ধারণাটা আমাদের মধ্যে থেকে যায় সেটা হল তাঁর ও তাঁর সময়কার আরো বহু ভদ্রলোকের সামন্ত-স্বার্থ এবং বণিক-স্বার্থই ব্রিটিশ শাসনকে আঁকড়ে থাকতে তদনুযায়ী যুক্তির হেরফের করতে বাধ্য করেছিল। তবে রামমোহন-গবেষকদের জন্যে কৌতুহলজনক একটা তথ্য এ প্রসঙ্গে যোগ করা যায়। ঐ ১৮২০ সালেই রামমোহনের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু জেরেমি বেন্থাম স্পেনীয়দের তাদের উপনিবেশগুলোকে মুক্ত করার ডাক দিয়ে কিছু চটজলদি নোট তৈরি করেছিলেন, যার থেকে তিনি পরে ১৮২১-২২ সাল নাগাদ Rid Yourselves of Ultramaria নামে একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন, যদিও সে পাণ্ডুলিপি শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল বা ছেপে বেরিয়েছিল কিনা ঠিক জানা যায় না। (R. N. Ghosh, 1963)৩৫
এহো বাহ্য। রামমোহনের মধ্যে বেশি সভ্য-কম সভ্য সম্পর্কে এসব ধারণা এল কোত্থেকে? সেকি নিজের দেশের সামান্য কিছু বর্ণ হিন্দুর চেহারা দেখেই? অথচ এই রামমোহনই তো ভারতের অবস্থার ওপর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষের সহজ সরল চরিত্রের উচ্চ নৈতিকতার ধর্মপ্রাণতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ধর্মদর্শনের এবং পৃথিবীর ইতিহাসের অত একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখানে উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে ব্রিটিশরা যে আমাদের থেকে অনেক বেশি সভ্য এই বিশ্বাস তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন তাঁর ইংরেজ গুরুরা। রামমোহনের দুই গুরু– এক, ফ্রান্সিস বেকন, দুই, জেরেমি বেন্থাম। বেকনের কাছ থেকে তিনি নিয়েছিলেন শ্রেয়োবাদ বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে Hedonism। এই শ্রেয়োবাদই তাঁকে বিজ্ঞানকে খোলা মনে আহ্বান করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বেন্থাম মনে করতেন উপনিবেশ স্থাপনের সুফল শুধু যে উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশই পেয়েছে তা নয়, কম মাত্রায় হলেও উপনিবেশের লোকজনও পেয়েছে। ব্রিটেনের হাতে নিজেদের সমর্পণ করে তারা নিশ্চিত করেছে তাদের রাজনৈতিক সুস্থিরতা, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতি। এটা উপনিবেশের লোকজনের দিক থেকে সর্বদাই লাভ যে তারা ব্রিটেনের মত রাজনৈতিকভাবে উদার এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রগতিশীল একটি দেশের শাসনে আছে। (R. N. Ghosh, ঐ)৩৬ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ধারণাও তিনি নিয়েছিলেন বেন্থামের কাছ থেকেই। শুধু তাই নয়, উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার ফলে মুসলমান আমলকে তিনিও স্বৈরতান্ত্রিক আমল বলে চিহ্নিত করে দিলেন। অথচ এই রামমোহনই Appeal to the King in Councilএ ৩৭ লেখেন যে মুসলমান আমলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এদেশের লোক সবরকম রাজনৈতিক সুবিধা পেত, যা ব্রিটিশ আমলে পাওয়া যাচ্ছে না।
রামমোহনকে পেরিয়ে যাবার আগে যে কথাগুলো অবশ্যই বলা দরকার সেটা হল উপরের কোনো কারণই সামাজিক ক্ষেত্রে বা ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকাকে নস্যাৎ করে না। আর শিক্ষাক্ষেত্রে তো নয় বটেই। তিনি যদি ইংরেজি ভাষার সিংহদুয়ারটি না খুলে দিতেন, এই বিশ্বদৃষ্টি আমাদের স্বপ্নের অগোচর থেকে যেত। নস্যাৎ করে না রামমোহনের বিশ্বজনীনবাদ বা আন্তর্জাতিকতাবাদকেও। সেই সঙ্গে আমরা টেরেল কার্ভারের কথাগুলোকেও স্মরণে রাখতে পারি, “এমন কোনো বর্তমানের জ্ঞানই নেই যা অতীতে উদ্ভূত ধ্যানধারণা থেকে গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু সেগুলি বিশেষভাবে কোনো এক ব্যক্তিবিশেষের অতীতে উদ্ভূত নয়, আমাদের সমাজজীবনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধ্যানধারণার পারস্পরিক আদানপ্রদান থেকে গড়ে ওঠা এবং [আমাদের ভাবনার মধ্যে] ঠাঁই পাওয়া।”৩৮ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের)
কিন্তু বিশ্বজনীনতা বা আন্তর্জাতিকতা একমাত্র তখনই সত্য হয়ে উঠবে যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশ পরস্পরের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে বিবেচনা করতে শিখবে এবং তার সারবস্তু গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। কিন্তু অবশ্যই তা বেশি সভ্য-কম সভ্যের ভিত্তিতে নয়। পশ্চিমী সভ্যতায় এখনো বেশি সভ্য-কম সভ্যের মাপকাঠি হচ্ছে বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেশিকম। বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেশিকম কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতির মানের মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আদানপ্রদানযোগ্য হতেই পারে, কিন্তু সেটা সেইসব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের শিক্ষাদাতা বা গ্রহীতা দেশকে এককে অপরের থেকে বড় ছোট করে ফেলার কথা নয়। এখনো পর্যন্ত আমরা যে আন্তর্জাতিকতার চর্চা করি তা প্রধানত বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যজারিত আন্তর্জাতিকতার একপেশে পশ্চিমী ধারণা। এই ধারণাকে আঁকড়ে থাকাটাও উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার ফল।
রামমোহন মুক্তির প্রশ্নে খুবই ভাবালু ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে তিনি এতটাই উদ্বেলিত বোধ করেছিলেন যে ইংল্যান্ডে যাবার পথে অসুস্থ অবস্থায় ফরাসি ফ্রিগেটে উঠে গিয়ে তিনি তাঁদের আনন্দের ভাগ নিয়েছিলেন। ‘মুক্তি’ শব্দটা প্রথম দানা বাঁধতে শুরু করে ইংল্যান্ডে। মহাকবি মিল্টনের লেখায় প্রথম মুক্তির আকুতি স্পষ্ট করে ফুটে উঠতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে অভূতপূর্ব এক আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয় যে আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে অস্পষ্টভাবে জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়। তারা নিজেদের জাতি হিসেবে মুক্ত অনুভব করতে শুরু করে এবং আশা করতে শুরু করে যে সব দেশের মানুষই একদিন এইভাবে নিজেদের মুক্ত অনুভব করবে। তাদের এই মুক্তির অনুভবের চালিকাশক্তি ছিল প্রোটেস্টান্ট ধর্ম এবং মনে রাখতে হবে এই জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যপ্রয়াসী মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও, যাদের কাজকর্মের থেকেই পুঁজিবাদের জন্ম হয়। মুক্তির এই ধারণা যখন ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছয়, তখন তিনটি প্রধান পরিবর্তন ঘটে। এক, ‘মুক্তি’ শব্দটার সঙ্গে যোগ হয় আরো দুটি শব্দ—‘সাম্য’ ও ‘ভ্রাতৃত্ব’। দুই, এই ফরাসি জাতীয়তাবাদ নিজেকে ধর্মের অধীনতা থেকে মুক্ত করে হয়ে দাঁড়ায় ধর্মনিরপেক্ষ। তিন, ফরাসি বিপ্লবের ফলে কৃষক–মজদুররাও এই জাতীয়তাবাদের অংশীদার হয়ে যায়। বিপ্লবের পরে নেপোলিয়ন প্রজাতন্ত্রের পতাকা নিয়ে দেশে দেশে যান এবং যুদ্ধ করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে সেসব দেশকে মুক্ত করেন এবং গণভোটের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত করেন। আদর্শগত দিক থেকে নেপোলিয়ন নাকি এরকমই চেয়েছিলেন, তাঁর বাসনা ছিল দেশে দেশে প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির মাধ্যমে গোটা ইয়োরোপকে এক জাতিতে পরিণত করার। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বিপ্লবের আগেকার ফ্রান্সের যেসব উপনিবেশ ছিল এবং বিপ্লবের পরে নেপোলিয়ন যেসব দেশ জয় করে সেসব দেশে প্রজাতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবেছিলেন, সেসব দেশে সত্যিই কী মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? ইতিহাস বলছে হয়নি।
The nationalist rhetoric of assimilation and integration was also brutally contradicted by the actual treatment of the newly annexed territories. In theory, after all, the former Jacobins were promising to Italians, Germans, Dutch and Belgians precisely what they were promising to Gascons and Bretons and Alsatians: namely, in return for integration, the full benefits of French citizenship and civilisation. But in practice, the French regime was far more concerned with extracting resources from these territories to feed the war effort, and with crushing all possible resistance. Certainly Napoleon himself, on the evidence of his correspondence, paid far more attention to questions of resources and resistance than to questions of cultural integration. For this reason, many historians are still ready to endorse Paul Schroeder’s view of the Napoleonic Empire as an enterprise driven almost entirely by practical military considerations – Schroeder himself called it a ‘criminal enterprise’ – because of its supposed violations of international norms.৩৯
মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের ধারণা থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে নেপোলিয়ন নতুনভাবে এক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করে বসেন। ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তা নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও উপনিবেশের বাইরের দেশগুলোর কারো কারো এই অভিপ্রায় পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে জার্মানি নেপোলিয়নের আদর্শের বিরোধিতায় এমন এক আদর্শ গড়ে তোলে শেষপর্যন্ত যার ফলশ্রুতি হয় বিসমার্ক হয়ে হিটলার।
ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এইসব আদর্শগুলো ফ্রান্সের নিজের লোকজনের জন্যে অনুসরণীয়, কিন্তু উপনিবেশ বা সদস্য হওয়া নতুন দেশগুলির জন্যে নয়। ফ্রান্সের অবস্থাই যেখানে এই, ব্রিটেনের কথা সেখানে না তোলাই ভালো। তারা ফ্রান্সের আদর্শের অনুসরণও করেনি। অতএব উপনিবেশের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান সহজেই অনুমেয়। এর পরের জাতীয়তাবাদের ইতিহাস আরো মারাত্মক। যার যার ভূখণ্ডের অধিকারকে কেন্দ্র করে এবং প্রত্যেকের নিজেকে অপরের তুলনায় অধিক বলশালী প্রমাণ করতে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেল। অবশ্যই নেপথ্যের কারণটা ছিল বাজার দখলের প্রতিযোগিতা। এই প্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
এই জাতীয়তাবাদের কারণেই নিজেদের বেলায় যারা স্বাধীনতাপ্রিয়, বিশ্বের বড় অংশে দাসত্বকে চিরস্থায়ী করতে তারা দ্বিধা করে না এবং সে কাজ তারা করে কর্তব্যসাধনের গর্বের সঙ্গে। যারা এমনিতে ন্যায়পরায়ণ, নিষ্ঠুর অন্যায় করতে তারা দ্বিধা করে না এবং মনে করে কুকর্মের প্রতিফল দিয়েছে। যারা এমনিতে সৎ, নিজেদের শক্তি বাড়াতে অন্যদের মানবিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে তারা দ্বিধা করে না এবং মনে করে সেইসব হতভাগ্যরা এর বেশি অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত নয়। ৪০ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের)
রবীন্দ্রনাথের এই ব্যাখ্যায় আরো একটা বিপজ্জনক ইঙ্গিত উপ্ত আছে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপনিবেশ তৈরির একটা ঝোঁক থেকে যায়। অন্তত নাম কে ওয়াস্তে নিজের দেশকে আরো ভালো রাখার জন্যে বা বলা যায় আরো বেশি মুক্ত করার নামে জাতীয়তাবাদীরা উপনিবেশ বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। নয়া-উপনিবেশবাদের আলোচনায় বেশ কিছুদিন ধরে এই কথাগুলো উঠে আসছে। চে গ্যেভারা বলেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশ কথাটা ভদ্রভাবে দেওয়া একটা নাম। আসলে এটা আধা উপনিবেশ বানিয়ে রাখার একটা কৌশল।৪১ নয়া-উপনিবেশবাদ হল আগেকার মত সাম্রাজ্যবাদী পদ্ধতিতে কোনো একটা দেশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ না রেখে বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না রেখে অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদিকে ব্যবহার করে বা শর্তসাপেক্ষ অনুদানের মাধ্যমে সেই দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এবং এক্ষেত্রে এই পদ্ধতির ব্যবহারকারী হিসেবে যেসব দেশের নাম উঠে আসে তারা সবাই এককালের প্রসিদ্ধ জাতীয়তাবাদী দেশ।
উপনিবেশের ব্যাপারটাকে বাদ দিলেও জাতীয়তাবাদের সবথেকে বড় সমস্যা হল এর মূল ভিত দাঁড়িয়ে আছে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতির ধারণার ওপরে। এই সমস্যার কারণেই বহু ধর্মের বহু ভাষার বহু জাতের দেশ ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের ধারণার শেকড় গাড়া সম্ভব নয়।
(পরের অধ্যায় আগামী সংখ্যায়)
তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যেকার শব্দগুচ্ছ সর্বদাই লেখকের সংযোজন।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. Nelson Maldonaldo-Torres quoted from Colonialism: Why Write Back?, George Sefa Dei & Chizoba Imoka, 2018. p. 3. https.//www.e-ir.info/...
২. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্বাচিত রচনা সংকলন, ১৪১৭ বাং., সংকলন ও সম্পাদনা. বারিদবরণ ঘোষ, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, প্রবন্ধ ‘বাঙলা সাহিত্যের গোড়ার দিককার কথা’, পৃ. ১১৬
৩. J. H. Broomfield, Politics and the Bengal Legislative Council 1912-1926, Thesis, 1963. p. V, openresearch-repository.anu.edu.au.
৪. Ashis Nandy, The Romance of the State and the Fate of Dissent in the Tropics, 2007, Oxford University Press, New Delhi, ‘An Anti-Secularist Manifesto’, p. 34-60.,
৫. শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, ১৩৯৯ বাং, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, পৃ. ৯
৬. Karl Marx, Capital vol 1. 1986 সংস্করণ, Progress Publishers, Moscow, p. 260
৭. কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেদার রচনাবলী ১ম খণ্ড, ১৯৮৭, বিহার বাঙলা আকাডেমি, পাটনা. ১ম সংস্করণ, প্রবন্ধ ‘আমরা কি ও কে’, পৃ. ৮৫
৮. অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, ১৩৮৭ বাং, লেখাপড়া, কলকাতা, পৃ. ৯৬
৯. জীবনতারা হালদার, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা, ১৯৮৯, প্রকাশক, কলকাতা, পৃ. ১০১
১০. কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল, সম্পাদনা সুকুমার সেন, ১৩৯২ বাং, সাহিত্য অকাদেমি, পৃ. ১৯১
১১. Census of India 1921, General Report
১২. Census of India 2011, General Report
১৩. Rabindranath Tagore, Nationalism, rptd edn 1918, Macmillan & Co., London, p. 111, ‘Nationalism in India’
১৪. পড়ুন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’
১৫. Ganesh Prasad, Whiggism in India, published in Political Science Quarterly, vol 81, no. 3 (Sep 1966), pp. 412-431, Academy of Political Science, https://www.jstor.org/stable/2147642
১৬.Kamakshyanath Mitra, Reminiscences of Swami Vivekananda, https://www.ramakrishnavivekananda.info/reminsciences/333_knm.htm
১৭. A. L. Basham, The Wonder that was India, 1986, Rupa & Co., Calcutta, p. 313
১৮. শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ঐ, পৃ. ৮
১৯. Narendranath Bhattacharya, History of the Sakta Religion, 1974, Munishiram Monoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, p. 153
২০. Brajadulal Chattopadhyaya, The Concept of Bharatavarsha and Other Essays, 2017, Permanent Black, Ranikhet, p. 22
২১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ ২য় খণ্ড, ১৯৮৮, সাহিত্য অকাদেমি, পৃ. ১৮৩৯
২২. কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল, ঐ, পৃ. ১৯২
২৩. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ১৩৯৭ বাং, পৃ. ৪
২৪. Ramesh Chandra Majumdar, On Rammohan Roy, 1984, The Asiatic Society, pp. 47-49
২৫. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়ঃ বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, ১৯৮৬, বর্ণপরিচয়, কলকাতা, পৃ. ২০১
২৬. Brajendranath Seal, Rammohun Roy– The Universal Man, pp. 93-112, published in ‘Rammohun Roy – The Man and His Work’, Centenary Publicity Booklet No. 1, June 1933, compiled and edited by Amal Home, Editor The Calcutta Municipal Gazette
২৭. দিলীপ কুমার বিশ্বাস, সম্পাদনা রামমোহন সমীক্ষা, ১৯৭৩, সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা, পৃ. ১১
২৮. Arabinda Poddar, Renaissance in Bengal– Quests and Confrontations 1800-1860, 1970, Indian Institute of Advanced Study, Simla, pp. 47-74
২৯. পড়ুন Mysore Hiriyanna, Outlines of Indian Philosophy, 2005, Motilal Banarasidass Publishers Pvt. Ltd., Delhi, Part 2, Chapter VIII, Materialism, pp. 187-195
৩০. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কৃত মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ঐ, থেকে ঊনবিংশ অধ্যায়ের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রসঙ্গে রামমোহনের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ
৩১. পড়ুন Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760, 1997, Oxford University Press, Delhi, Part 2, Bengal under the Mughals, pp. 137-304
৩২. Arabinda Poddar, ঐ, p. 62
৩৩. Biman Behari Majumdar, History of Indian Social and Political Ideas, 1996, Firma KLM, Calcutta, p. 43
৩৪. Arabinda Poddar, ঐ, p. 61
৩৫. R. N. Ghosh, Bentham on Colonies and Colonization, published in Indian Economic Review, vol 6, no. 4, (August 1963), pp. 64-80, Department of Economics, Delhi School of Economics, University of Delhi; Springer, https://www.jstor.org/stable/42656474
৩৬. R. N. Ghosh, ঐ, p. 76
৩৭. English Works of Raja Rammohun Roy, ed. Jogendra Chunder Ghose, 1906, Panini Office, Allahabad, p. Xxi
৩৮. Terrell Carver, The Cambridge Companion to Marx, 1999, Cambridge University Press, UK, p. 1-2
৩৯. Lotte Jensen, ed. Roots of Nationalism, 2016, Amsterdam University Press, Amsterdam, দেখুন ‘Revolutionary France and Origins of Nationalism – An Old Problem Revisited’, David A Bell, p. 77
৪০. Rabindranath Tagore, Nationalism, rptd edn 1918, Macmillan & Co., London, p. 111, ‘Nationalism in India’, p. 110-111
৪১. Che Guevara, Cuba: Historical exception or vanguard in the anticolonial struggle? 1961 সালের April 9 তারিখে দেওয়া একটি বক্তৃতা, www.marxists.org
এখন সারা বিশ্বের মানুষ একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। বলা ভালো নাক-মুখ-চোখ চাপা দিয়ে প্রায় দমবন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে আমরা এখন দূরত্ব বজায় রেখে প্রায় ঘরবন্দি। ওদিকে প্রায় ১০০টা দেশ কোটি ডলারের বাজি ধরে ‘কোভ্যাক্স’ তৈরিতে ব্যস্ত। এ যুদ্ধের স্লোগান ‘ভাইরাসের বদলা ভ্যাকসিন’। মাত্র সাত-আট মাসের জীবনকালে এই নবতম করোনা ভাইরাসের অবতারটি মানবসভ্যতার অনেক কিছুই ওলটপালট করে দিয়েছে। আর আমরা বুঝেছি বিশ্ব-মহামারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভ্যাকসিন গবেষণার দৌড় এক অসম লড়াই। ধরা যাক আর কটা দিন পরেই আমরা কোভিড-১৯কে ভ্যাকসিন দিয়ে একদম ভাগিয়ে দেব। অবশ্যই তত্ত্ব ও প্রয়োগের ফাঁক-ফোকর ধরে নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে লকডাউনে অর্থনীতির মহাবিপর্যয় আর যাদের পায়ের তলার চামড়া খসে পড়ল রাস্তায়, তার কি হবে? তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন কোভিড-২০ কিংবা কোভিড-২১ এর জন্য আমরা কোন ভগবানে ভরসা রেখে ঘুমোতে যাবো? কোনরকমে জানটা বাঁচলেও জীবিকাটা বাঁচবে তো?
অথচ সেই খ্রীষ্টপূর্ব চার শতকে চিকিৎসার জনক বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস প্রথম বলেছিলেন মানুষের রোগ জ্বালা আসলে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর যে জীবজগত তার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য রোগজীবাণু আর সেই জীবাণুবাহক প্রাণীরাও। ঐ সব হাজার জীবাণু আর প্রাণীরা অনেকেই মানুষের উপকারী আর বেশ কিছু দুর্জন বা শত্রু। কিন্তু একটা কথা তো মানতেই হবে, পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনের একদম প্রথমেই এইসব অনুজীবদের উদ্ভব। মেরুদন্ডী এবং চতুষ্পদ জীবদের আবির্ভাবের অনেক যুগ আগে থেকেই জীবাণুদের অস্তিত্ত্ব ছিলো।
স্বাস্থ্যের পরিবেশ
মানুষের সংক্রামক ব্যাধির উৎস খুজতে গিয়ে একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন যে বেশ কয়েকটি একই প্রজাতির পরজীবী রোগজীবাণু পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকার বিভিন্ন বন্য প্রাণীর মধ্যে। সবরকম সম্ভাব্য সূত্র যাচাই করে বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। চল্লিশ থেকে তিরিশ লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট-এর ফলে মহাদেশগুলো আলাদা হয়ে যাবার আগে থেকেই সেই আদিসংযুক্ত-মহাদেশ বা প্যাঞ্জিয়াতে এই পরজীবীরা ছিল। মানেটা পরিষ্কার যে আফ্রিকায় প্রথম হোমোস্যাপিয়েন্স জন্ম নেবার (৮০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে) অনেক আগে থেকেই তাকে কাবু করার জন্য রোগজীবাণু তৈরি হয়েই ছিল। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ‘লেইস্ম্যানিয়াস্’ এবং ‘ট্রাইপ্যানোসোমস্’ পরজীবী দুটিকে। বর্তমান বিশ্বে ২০ প্রজাতির লেইস্ম্যানিয়াস্ প্রায় ৯০ প্রজাতির বালি-মাছিদের দ্বারা বাহিত হয়ে মূলতঃ তিন ধরণের রোগ ছড়ায়। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম কালাজ্বর। আর খুব কম হলেও আফ্রিকার স্লিপিং সিক্নেস বা ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস্ এখনও মানুষকে আক্রান্ত করে। এই মারাত্মক রোগটি ছড়ায় বাহক সেট্সি মাছির কামড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় আজও এই রোগ ঘোড়া ও গবাদিপশুদের সংক্রামিত করে।
এছাড়াও দেখা যাচ্ছে মানববিবর্তনের ধারায় বানর, বনমানুষ হয়ে মানুষের পাকস্থলীতে প্রবাহিত হয়েছে মোট ১১টি প্রোটোজোয়া। পীতজ্বর আর ম্যালেরিয়াও মানুষ ও তার নিকট প্রজাতিদের মধ্যেই রয়ে গেছে হাজার হাজার বছর ধরে। এর কারণ মানুষের দেহই এদের মূল আশ্রয়দাতা বা হোস্ট। যদিও এই রোগদুটির পরজীবী শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতেই বাঁচতে পারে।
ইতিহাসের নিরিখে সংক্রামক ব্যাধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌছায় শেষতম হিম যুগের শেষে। উপযুক্ত উষ্ণ আবহাওয়া আর প্রচুর জলসিক্ত মাটির সহজলভ্যতায় আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা ক্রমশ কৃষিকাজ আর পশুপালন শুরু করেন। আর সেজন্যই মানুষ ক্রমশ নির্দিষ্ট জায়গায় স্থায়ী বাসস্থান বানাতে বাধ্য হয়। বন্যপশুকে পোষ মানিয়ে মানুষের নতুন নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে কুকুর, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী, শুকর আর স্থায়ী বসবাসের ফলে একই জায়গায় গাছপালা পশুপাখির সঙ্গেও মানুষের অনেক বেশি নিয়মিত সংযোগ ও মিথস্ক্রিয়া (Interaction) ঘটতে লাগল। আর সেই সুযোগে মানুষের অজান্তেই ঘটে চলল অনুজৈবিক কর্মকাণ্ড। পশুপাখির শরীরের অসংখ্য রোগজীবাণু বারবার মানুষের শরীরের সংস্পর্শে আসার সুযোগে বিবর্তিত হয়ে ঠাঁই করে নিল মানুষের চামড়ায়, পাকস্থলীতে কিংবা রক্তে। তারপর আর এক ধাপ এগিয়ে ঐসব রোগজীবাণু মানুষ থেকে সরাসরি মানুষে ছড়াতে বিভিন্ন মাধ্যম আশ্রয় করল যেমন মশা, মাছি, কৃমি, লালা, রক্ত, প্রভৃতি।
একইভাবে জীবিকা আর আবিষ্কারের প্রয়োজনে মানুষের জগৎ জোড়া পরিযানের অভ্যাসও তাকে পৌঁছে দিল নানা বিচিত্র জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অঞ্চলে। সেখানেও দেখা হল নতুন জীবজন্তু, গাছপালা আর জীবাণুদের সঙ্গে। তার মধ্যে কিছু কিছু মানুষকে সংক্রামিত করল, বাসা বাঁধল শরীরে। অবশ্য ফেলে আসা অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা কিছু রোগ জীবাণু স্বাভাবিক কারণে নির্মূল হল নতুন পরিবেশে। এভাবেই ক্রমশ প্রতিটি প্রাকৃতিক অঞ্চলভিত্তিক কিছু স্থানীয় বা দেশগত (endemic) রোগ চিহ্নিত হল যেগুলোর বিস্তার একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে মানুষ তার মেধা আর পর্যবেক্ষণের সাহায্যে প্রত্যেক অঞ্চলের প্রকৃতি থেকে রোগনিরাময়ের ওষুধও আবিষ্কার করতে থাকল। অতএব একই অরণ্য-প্রকৃতি তাকে দিল খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান আবার রোগব্যাধি ও তার নিরাময়ও। এক অনন্য ঐকতান গড়ে উঠল মানুষ আর তার আবাসস্থলের প্রকৃতির মধ্যে। আর সেই কারণেই আদিকাল থেকে এত রোগজীবাণুর মধ্যেও মানুষজাতির সফল বিবর্তন ঘটেছে। এটাই হল মানুষের অসাধারণ মানিয়ে নেবার ক্ষমতা (adaptive habit) বা অভিযোজন প্রবণতা। এখন প্রশ্ন হল আদি মানুষ ভয়ঙ্কর সব দ্রুত সংক্রামিত ব্যাধি এবং মহামারী থেকে নিজেকে এত হাজার বছর বাঁচাল কিভাবে? আসলে সব রোগই সংক্রামক নয় আর যে কোন সংক্রামক রোগের মহামারী রূপ নেবার জন্য কিছু বিশেষ অবস্থা বা কার্যকারণ থাকতে হয়।
সেইসব রোগ-মহামারীর সম্বন্ধে প্রাথমিক বিস্ময় আর অপদেবতা, দানব, পিশাচ, ডাইনীর মতবাদ ডিঙিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা করে যে বিদ্যার সূত্রপাত করেছিলেন সেই হিপোক্রেটিস, আজ তারই নাম মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যা বা এপিডেমিওলজি। প্রধানত সংক্রামক রোগের উৎস, কারণ ও বিস্তারকে সহজবোদ্ধভাবে দেখানো হয় এপিডেমিওলজিক্যাল ত্রিভুজের মাধ্যমে।
আমি একে প্ল্যানডেমিক বলছি এবং না, ‘ল’টি মোটেই উহ্য নেই, বরং আমি যতটা বলতে চাইছি ততটাই উচ্চকিত, স্পষ্ট।
বিগত ছয়মাসকাল যাবৎ কিছু মিথ্যা বা কল্পসত্য ফোঁটায় ফোঁটায় অবিরাম ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের চেতনায়, কেননা আমরাই আমাদের ভয়কে ওদের সিদ্ধির রসদ বানাতে দিয়েছি। মাদ্রিদে ২৫শে জুলাই একটি সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৪০০’র বেশি কৃতবিদ্য মানুষ, ছিলেন সারা পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে পেশাগতভাবে যুক্ত ১০০’র বেশী মানুষ। সেখানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘Doctors for the Truth’ সংগঠনের ডাক্তাররা। সেখানে তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনায় একটি বিশেষ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন - ‘world dictatorship with a sanitary excuse’, অর্থাৎ স্বাস্থ্যকে শিখণ্ডী খাড়া-করে রচিত বিশ্ব-স্বৈরতন্ত্র। বর্তমানে আমরা এমনই এক স্বৈরতান্ত্রিক বিশ্বের বাসিন্দা।
আপনি নিশ্চয়ই বিস্মিত হচ্ছেন, কিসের তাগিদে এই চিকিৎসা-বিশারদরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা এবং জীবিকার ঝুঁকি নিয়েও প্রকাশ্যে এই দানবীয়তাকে তার প্রকৃত পরিচয়ে, রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য-সাধনের মিথ্যে প্যানডেমিক নামে, অভিহিত করলেন? করলেন, কেননা পুরো মানবজাতির ভাগ্য এখন বিপন্ন, আমরা তাকিয়ে আছি এক অন্ধকার, আশঙ্কাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে। নাটকীয় শোনাচ্ছে কি? আমি নিশ্চিত, আদতে তা নয়।
চলুন একটু সময়পথে পিছিয়ে যাই এবং দেখি ওরা এটা ঘটাল কিভাবে। আপনি নিশ্চই ভাবছেন, ‘ওরা’ কারা? ধৈর্য্য ধরুন, একটু পরেই ওদের পরিচয় দিচ্ছি। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা অনুভব করে আসছি একটা অলক্ষ্য হাতের অস্তিত্ব - প্রতাপশালী, আবছায়া শক্তি যা পর্দার আড়ালে থেকেই পরস্পর-সংবদ্ধ ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তারা অপরিসীম বিত্তশালী এবং শক্তিমান। বিল গেটস, জেফ বেজোস, মুকেশ আম্বানীদের মতো বিত্তশালী নয়, তারা এমন বিত্তশালী যে, আপনি চারপাশে যা কিছু দেখছেন তারই প্রকৃত মালিকানা তাদের।
প্রাককথন
বর্তমান আলোচনার বিষয় তথাকথিত কোভিড-১৯ অতিমারী (Pandemic), তাই আমরা লক্ষ্যস্থির রাখবো সেখানেই। ২০১০ সালে রকেফেলার ফাউণ্ডেশন (Rockefeller Foundation) ‘প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ভবিষ্যত রূপরেখা’ (Scenarios for the Future of Technology and International Development) নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বিম্বিত ছিল আগামী পৃথিবী কিভাবে প্রভাবিত হতে চলেছে। সেখানে ‘লক স্টেপ’(Lock step) নামে একটি অধ্যায়ে বলা আছে একটি অতিমারী এবং তার ফলে উদ্ভূত এক স্বৈরতান্ত্রিক সরকার নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীর কথা। সে পৃথিবী হবে এক প্রভুত্বকামী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত, সীমিত উদ্ভাবন-পরিসর সমন্বিত এবং নাগরিকদের উত্তরোত্তর অবদমন হবে তার রাষ্ট্রীয় অবস্থান। আমরা এখন যা দেখছি তার বিশ্লেষণেও এটি ভীতিপ্রদভাবে নিখুঁত।
অবশ্য এমনটাই যে আসতে চলেছে সে সতর্কবার্তাও আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৪৯ সালে জর্জ অরওয়েল ‘1984’ নামক তাঁর দিকদর্শী উপন্যাসে আজকের এই অবদমিত পৃথিবীর পূর্বাভাস রেখে গেছেন। পুলিশরাষ্ট্র, ২৪/৭ নজরদারি সবকিছুরই বাস্তবায়ন ঘটে চলেছিল, আমরা বুঝে উঠতে পারিনি শুধু।
কিন্তু এই ওস্তাগরি – আমি এই অভিধা ব্যবহার করছি আরো ভালো কোনও শব্দের অভাবে – যে ব্যাপারে বিস্ময় জাগায় তা হল এর আতঙ্ক তৈরীর ক্ষমতা। এই আতঙ্কই নিশ্চিত করেছে এক অজানা, অদৃশ্য শত্রুর কাছে আমাদের বশ্যতা, যে শত্রুর নিছক অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। গুলির আঘাতে মৃত্যু হবার আগে জন এফ. কেনেডি যে ছায়াবৃত অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন, সে-ই ৯/১১’র পরে পৃথিবীকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে ওসামা বিন লাদেন, আফগানিস্তানের কোনো এক গুহায় বসে ছুরি এবং বাক্স-কাটার যন্ত্রধারী আতঙ্কবাদীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন দুটি ড্রোন দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের বুকে তিনটি টাওয়ার ধ্বংস করতে, আর একটি প্লেনকে পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কসভিলে একটি মাঠের মধ্যে আছড়ে চুরমার করে দিতে – প্রায় কোনও যন্ত্রাংশ অক্ষত না রেখে – এবং আর একটি প্লেনকে পেন্টাগনের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দিতে তার দেওয়ালে একটিমাত্র ফুটো করে! বিভিন্ন ঘটনার সাপেক্ষে আমাদের এভাবে প্রতারিত হওয়ার ইতিহাস যতই দীর্ঘ হোক, এবং তার অনুধাবন যতই আকর্ষণীয় হোক, বর্তমান পরিসরে আমি সে-বিবরণে যাচ্ছি না।
২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘Contagion’ নামের সিনেমাটি দেখলে মনে হবে গত ছ’মাসের ঘটনাপ্রবাহ দেখছি ঐ ১ ঘন্টা ৪৬ মিনিট সময়কালে। এরপর ২০১৫ সালে অননুকরণীয় বিল গেটস, একজন সফটওয়্যার-নির্মাতা যিনি হঠাৎই এক অগ্রণী প্রতিষেধক-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, একটি ‘টেড টক’(Ted Talk)-এ উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে উনি জানিয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন কোনো আসন্ন অতিমারীর মোকাবিলার ব্যাপারে আমরা কেমন প্রস্তুতিহীন হয়ে আছি! আপাতভাবে অসংবদ্ধ এই ঘটনাবলীর অনুসন্ধানে আমি যদি কিছুমাত্র শিখে থাকি তা হল, কাকতালীয় বলে কিছু নেই।
২০১৯-এর ১৮ই অক্টোবর, উহানে যখন মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমস চলছিল, ‘কাকতালীয়ভাবে’ নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল অতিমারী-অনুরূপ পরিস্থিতির মহড়া (Pandemic simulation)। ইভেন্ট ২০১ নামে অভিহিত এই কর্মসূচীর পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে ছিলেন জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এবং বিল ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। অতিমারীকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলির অনুরূপ-নির্মাণ ও তার পর্যালোচনা ছিল এর উদ্দেশ্য।
জর্জ ওয়েব, একজন তদন্তকারী আমেরিকান সাংবাদিক যাঁর ইউটিউবে অনুগামী-সংখ্যা লক্ষাধিক, দাবী করেছেন, এই নভেল করোনাভাইরাস ইউএস-এর সামরিক পরীক্ষাগারে সৃষ্ট এবং উল্লিখিত গেমস চলাকালীন মাজ বেনাসি নামে এক মিলিটারি সাইক্লিষ্ট এটি চীনে নিয়ে আসেন। এমনকি চৈনিক মিডিয়া ও চীনের সামরিক মুখপাত্ররাও ভাইরাসটির উৎস সম্পর্কে ওয়েব-এর মতকে সমর্থন করে। কিন্তু সম্যকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় বলে এই তত্ত্ব মত নিয়ে আমরা আর এগোবো না, বিশেষত যখন ওয়েব-এর স্বর পুরোপুরিভাবে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, যেমন ঘটেছে ডক্টর জুডি মাইকোভিৎসের ক্ষেত্রে, যিনি এই ধাপ্পাবাজির চক্রান্ত ফাঁস করতে প্রথম এগিয়ে আসা মানুষদের একজন, এবং সুইস জীববিদ্যাবিশারদ বিডা এম. স্ট্যাডলারের ক্ষেত্রে, যিনি উপসর্গহীন বাহকদের নিয়ে ওঠা ধারণাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাচ্ছিল্য করে।
বিনির্মাণের নির্মাণ
নিশ্চিতভাবে স্পষ্ট তথ্য হল, এবছর ১১ই মার্চ যখন বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০০০, তখন WHO রোগটিকে অতিমারী ঘোষণা করল। তারপর থেকে অনেক স্বনামধন্য ডাক্তার এবং মেডিক্যাল হুইসলব্লোয়ারস এগিয়ে এসেছেন এই ধাপ্পাবাজির উন্মোচনে। তাঁরা বলেছেন কিভাবে একে একটা মারাত্মক সংক্রামক রোগ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংখ্যাগুলিকে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। যাদুবলেই যেন-বা পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর অন্যসব কারণগুলিকে, যাদের মধ্যে কিছু এই ‘ঘাতক’ ভাইরাসের থেকে বেশীমাত্রায় হন্তারক। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, Parliamentary Assembly of the Council of Europe (PACE) ২০১০ সালে WHO-ঘোষিত সোয়াইন ফ্লু অতিমারীকে মিথ্যে-অতিমারি আখ্যা দেয় এবং ওই ঘোষণাকে বর্তমান শতকের ব্যাপকতম স্বাস্থ্য-কেলেঙ্কারীগুলির মধ্যে একটি বলে অভিহিত করে। WHO-এর মুন্সটার (জার্মানী)-প্রতিনিধি ডক্টর উলরিখ PACE-এর মতকে সমর্থন করে এই প্রতারণার বিরুদ্ধাচরণ করেন।
এখন আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংখ্যাবিচার সেরে নিই। বর্তমান লেখাটির রচনাকাল অবধি এ বছর সংক্রামক অসুখে মৃত্যু হয়েছে ৭,৮৮২,৭৩৭ জন মানুষের, মরশুমি ফ্লুয়ের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২৯৬,৩৩৫, HIV/AIDS-এ মৃত্যু ১,০২০,৭৭৬, ক্যানসারে মৃত্যু হয়েছে ৪,৯৮৭,০৬১ জন মানুষের, ম্যালেরিয়ায় ৫৯৬,৬১৫ জনের। কোভিড-১৯ জনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা, খেয়াল করুন, এখনও অবধি ৭২৯,৯৮৭; এবং প্রশ্ন উঠছে রোগনির্ণয়ের পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে, যার ভুয়ো-পজিটিভ (false positive) নিরুপণ-প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে নিখুঁত – ইউএস CDC ওয়েবসাইট স্পষ্ট জানাচ্ছে, একজন কোভিড-১৯ পজিটিভ প্রমাণিত হবার অর্থ এটাও হতে পারে যে, তিনি ঐ গোত্রের ভাইরাসগুলির (যাদের গোত্রনাম করোনাভাইরাস) যে-কোন একটির প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি শরীরে ধারণ করছেন। এছাড়াও, এই রোগে প্রাণ-হারানো একটি বড় সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ তাঁদের শরীরে অন্য প্রাণঘাতী অসুখের উপস্থিতি (co-morbidity) কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা স্বচ্ছন্দে এই তথ্যটি উপেক্ষা করলেন যে এই রোগে আক্রান্ত বলে প্রমাণিত ব্যক্তিদের বর্তমান মৃত্যুহার ৫% - লক্ষ্যণীয়ভাবে কম যদি এই বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হয়, এই তথাকথিত ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বলে নির্ণীত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশের শরীরে পূর্বস্থিত অন্য এক-বা-একাধিক মারণ-রোগের ক্ষয়িষ্ণুতা ছিল; অথবা, যাঁরা আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হয়েছেন তাঁদের ৯৯% সংক্রমণ-চিহ্নহীন, বা মৃদুভাবে সংক্রামিত।
আসলে, আপনার যদি সুনির্দিষ্ট অভিসন্ধি থাকে তাহলে আপনি আখ্যানটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্মাণ করতেও পারবেন। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ওপর বর্ষিত হতে শুরু করলো কিছু শব্দবন্ধ – নিউ নর্মাল, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, বিচ্ছিন্নতা। বলা হলো, সংক্রমণ আটকাতে আমাদের মুখোশ পরা জরুরী। এখানেও, অভিসন্ধিটা ছিল বিভ্রান্তি রোপণ করা। প্রথম পর্যায়ে, সংক্রামক রোগের দক্ষতম বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত ডক্টর আন্থনি ফাউচি বললেন, মুখোশ পরা জরুরী নয়। ধারণাটা পালটে দাঁড়ালো, শ্বাসপরিবাহীযুক্ত এন-৯৫ মাস্ক সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বোৎকৃষ্ট অস্ত্র। তারপর আবার উনি বললেন, এই শ্বাসপরিবাহীযুক্ত এন-৯৫ মাস্ক না-পরাই ভালো, কারণ এর কোনো উপযোগিতা নেই। এই অলীক নাট্যরঙ্গে তাঁর পরবর্তী সংযোজন, চোখের মধ্যে দিয়ে ভাইরাসটির প্রবেশ আটকাতে গগলস্ পরা ভালো। অতি-সম্প্রতি CDC (Centres for Disease Control and Prevention) এই সার্কাসে যোগ দিয়ে বলেছে যে সুস্থ, উপসর্গহীন ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ রুগীর সংস্পর্শে এলেও তাদের পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই, যদিও আগে তাদের প্রত্যয় ছিল উপসর্গহীন ব্যক্তিরাও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। এভাবে চললে অচিরে ভাইরাসটি নিজেই অস্তিত্ব-সংকটে পড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
সত্যিটা হল, এমন কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে বলা যায় মাস্ক এই ভাইরাসের চলাচল রোধে সক্ষম। পক্ষান্তরে, এর একটানা ব্যবহার উপকারের চেয়ে ক্ষতি করে বেশী। একই কথা প্রযোজ্য ড্রাকোনিয়ান লকডাউন পদ্ধতি সম্পর্কেও, স্বল্পপুঁজির ব্যবসা তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে যার ভূমিকা নগণ্য বললেই চলে। তাই আশ্চর্য্যের কিছু নেই যে কয়েকটি ইওরোপীয় দেশ যেমন সুইডেন – যে-দেশের অগ্রণী ভাইরাস-বিশেষজ্ঞ, আন্দার্স টেগনেল, বলেছেন মাস্ক বা লকডাউন কোনটারই কোনও উপযোগিতা তাঁর চোখে নেই - ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস এবং আমেরিকার কিছু শহর স্বাভাবিক চলমানতা বজায় রেখেছে; এবং সম্প্রতি লন্ডন, বার্মিংহাম ও বার্লিনে বেশ কয়েক হাজার মানুষ পথে নেমেছিলেন এই ভুয়ো অতিমারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।
কিন্তু অন্য অধিকাংশ দেশেই বিহ্বল, আতঙ্কিত জনগণের বর্তমান যাপন মানে শুধু যা-কিছু বলা হচ্ছে তার নিষ্প্রশ্ন অনুসরণ আর মাস্ক না-পরা মানুষদের সন্দেহ ও বিরূপতার দৃষ্টিতে দেখা। বিভাজন এবং বিজয়ের নীতি মসৃণভাবে প্রশস্ত করে চলেছে এক-বিশ্ব-সরকার গঠনের পথ।
ছায়াবৃত কুশীলবেরা
এখন দেখা যাক ‘ওরা’ কারা। ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি রকেফেলার পরিবারের নাম, যারা আমেরিকার তৈল-ব্যবসায় বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে; বলেছি ইওরোপীয়ান-ইহুদি ব্যাঙ্কার রথসচাইল্ড পরিবারের কথা, জনশ্রুতি অনুযায়ী যারা বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রক। আছে আরো কিছু খেলোয়াড়, কোখ ব্রাদার্স (Koch Brothers) এবং জর্জ সরোস, যারা বিপুল রাজনৈতিক প্রতিপত্তির অধিকারী। এরা সবাই অপরিসীম ক্ষমতাশালী ও অমিত বিত্তশালী মানুষ, যারা তাদের আর্থিক মদতপুষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা নেন। এছাড়াও আছে তাদের আর্থিক মদতপুষ্ট মিডিয়া হাউসগুলি, যারা তাদের নির্মিত আখ্যানগুলো আমাদের মগজে গেঁথে দিতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। অবশ্যই অন্যদেরও উপস্থিতি আছে – বৃটিশ রাজপরিবার এবং ভ্যাটিকান দুটি মাত্র উদাহরণ; এবং ইহুদীবিদ্বেষী না-হয়েও বলা যায় একটা ইহুদী প্রভাব এই সমস্ত সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের নেপথ্যে সর্বদাই ক্রিয়াশীল থাকে। সম্প্রতি বেইরুটে যে বিস্ফোরণে প্রায় অর্ধেক শহর ধ্বংস হয়ে গেছে তার তদন্ত এখনো চলছে এবং ইতিমধ্যেই লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল অ্যাওন বলেছেন, ‘বিস্ফোরণের পেছনে রকেট, বোমা বা অন্য কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা যথেষ্ট’। উল্লেখযোগ্য যে, লেবাননের রেসিস্ট্যান্স গোষ্ঠী হেজবুল্লা এবং ইজ্রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (IDF)-এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধের প্রকাশ্য রূপ আমরা শেষ দেখেছি ২০০৬ সালের যুদ্ধ চলাকালীন; এবং লক্ষ্যণীয় যে, ৪ঠা আগস্ট, বেইরুট বিস্ফোরণের সকালে, ইজরায়েলি সংবাদপত্রগুলিতে এক-সুরে বাঁধা শিরোনামগুলির মধ্যে একটি হল “প্রয়োজন হলে, হেজবুল্লা, লেবাননকে খেসারত দিতে হবে” (“If need be, Hezbollah, Lebanon will be made to pay”)
এমনই সব আধিপত্যকামী ভূ-রাজনৈতিক প্রকৌশল ক্রিয়াশীল থাকে এইসব দুনিয়া-কাঁপানো পরিবর্তন রূপায়ণের মধ্যে। বর্তমানে এমনই একটি পরিবর্তনের জায়মান কালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চলছে সমগ্র বিশ্বের কর্মপদ্ধতির পুনর্বিন্যাস, পরিভাষায় ‘রিবুট’। ওয়র্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনির্বাহী সভাপতি প্রফেসর ক্লাউস শোয়াব-এর মতে, “এই অতিমারী আসলে আমাদের একটি দুর্লভ এবং সীমায়িত পরিসরের আনুকূল্য দিচ্ছে ভাবার, আমাদের জগৎটাকে নতুন করে দেখার ও তার পুনর্বিন্যাসের”(“The pandemic represents a rare but narrow window of opportunity to reflect, re-imagine and reset our world”)। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রপুঞ্জের অ্যাজেন্ডা ২১, যার নবতম সংস্করণ অ্যাজেন্ডা ২০৩০ – এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এই কর্মসূচী প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সুস্থায়ী উন্নয়ন (sustainable development)-এর উদ্দেশ্য ও অভিষ্টের নীল নকশা, যা মানবজাতি এবং পৃথিবীর পক্ষে মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ন ক্ষেত্রগুলিতে আগামী দশ বছরে গ্রহণীয় প্রকল্পগুলির স্বরূপ ও অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দেবে।
কয়েকজন বলছেন, এই ‘গ্রেট রিসেট’ রূপায়িত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা হ্রাসের এবং কার্বন-নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে। আমরা, যারা এক দশকেরও বেশী সময়-ব্যাপী চলমান এক-বিশ্ব-সরকার কর্মসূচী সম্পর্কে সচেতন, বিশ্বাস করি, উপরের কারণ দুটি ওদের আমাদের ঘাড়ে চেপে বসার প্রেরণা দিলেও, ওদের চূড়ান্ত লক্ষ্য আমাদের জীবনের ওপর সর্বাঙ্গীন নিয়ন্ত্রণ কায়েম। সেইজন্যই এই ভয়ের বেসাতি জারি রাখাটা ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্ল্যান্ডেমিক ইতিমধ্যেই সব মহাদেশের বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদ মিছিলগুলিকে থামিয়ে দিয়েছে, নাগরিকদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণকে মজবুত করেছে এবং যা-কিছু স্বাধীনতা আমাদের প্রথম থেকে ছিল তা কার্যকরীভাবে বাতিল করে দিয়েছে।
তাহলে করণীয় কি?
শুরু হয়ে গেছে প্রতিষেধক তৈরীর প্রতিযোগিতা। যে গতিতে ভাইরাসটি জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম, তা বিচার করলে বোঝাই যায় প্রতিষেধকগুলি ভাইরাস মোকাবিলায় মাস্কের মত কার্যকরী হবে। অবশ্যই প্রতিষেধক নেওয়া বাধ্যতামূলক হবে, কারণ রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইমিউনাইজেশন অ্যাজেন্ডা ২০৩০’-এর লক্ষ্যই হল সবাইকে প্রতিষেধকের আওতায় নিয়ে আসা। শোনা যাচ্ছে মেডিক্যাল ট্র্যাকিং চিপ ব্যবহারের কথা; চিপ না- হলেও ডিজিটাল হেলথ কার্ড তো হবেই। প্রচুর সংখ্যক মানুষ বাড়িতে থেকে অনলাইনে কাজ করলে ৫জি প্রযুক্তি প্রচলনের সুবিধা হবে, যদিও এই প্রযুক্তির বিকীরণজনিত বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক চলছে এখনও। কর্মীদের একটা বিশাল অংশ ইতিমধ্যেই বাতিল প্রতিপন্ন, কোম্পানিগুলি উত্তরোত্তর স্বয়ংক্রিয়তা-নির্ভর হয়ে উঠলে আরও কর্মী-ছাঁটাইয়ের অশনিসংকেত স্পষ্ট।
যদি সামাজিক দূরত্বের মন্ত্রগুপ্তি ভুলে মানুষজন আবার কাছাকাছি আসতে শুরু করেন, তাহলে ওরা বর্তমান ভাইরাস এবং অন্য নানা ভাইরাসের একাধিক সংক্রমণ-তরঙ্গ সুনিশ্চিত করবেই যাতে আবার লকডাউন-বিধি চাপিয়ে দেওয়া যায়। সমস্যা, প্রতিক্রিয়া এবং সমাধানের হেগেলীয় ভাষ্যের বর্তমান প্রয়োগ আশ্চর্য্যজনকভাবে সফল হয়েছে। আমরা আত্মসমর্পণ করেছি; এবং এরপর ওরা এমনই অজানা অদেখা কিছুর আতঙ্ক বারংবার আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকবে যতক্ষণ-না আমরা পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করি। আমি ভয় পাই সেই দিনটাকে যেদিন আমার সন্তান ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে, ‘তুমি তখন কী করছিলে যখন ওরা আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছিল?”
খুব বেশী দেরী হবার আগে আমাদের জেগে উঠতে হবে।
(তথ্যসূত্র সম্বলিত মূল ইংরেজি লেখাটি
কালধ্বনির ওয়েবসাইটে আপলোড করা থাকবে)
দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেল এই অতিমারীর তান্ডব আমরা দেখছি, অনুভব করছি, এই তান্ডবের বলি হচ্ছি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে।ভয়, আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তা পরতে পরতে জড়িয়ে রেখেছে আমাদের, বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় সামলাচ্ছি আর মাঝে মাঝেই ভাবছি এই বুঝি ‘সে’ এলো- এই ঝড়ের হাত থেকে আমাদের সরিয়ে নিতে। চেতনে বা অবচেতনে আমরা কেউ এই ‘সে’র জায়গায় ভাবতে চাইছি ‘ঈশ্বর’ কে কেউ বা ‘রাষ্ট্র’-এর কথা ভাবছি। না, ভুল হল, রাষ্ট্র আমাদের কাছে বিমূর্ত ‘ইমেজ’; তাকে আমরা ধরতে পারি না, আমরা চিনি সরকার। আবার সরকারও অনেক বড়ো ব্যাপার, আমাদের কাছে সহজ হয়ে যায় নেতা বা নেত্রী। কখনও ভুল ভাঙ্গে, তখন সঁপে দিই ভাগ্যকে বিচারব্যবস্থার ওপর, কখনও বা মিডিয়ার কাছে ছুটে যাই - সত্যিটা সকলে জানুক! জানলে হয়ত সুবিচার আসবে!
সব আলাদা আলাদা ইমেজ নিয়ে আমাদের সামনে - সরকার, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, শিক্ষা। এগুলো দিয়ে কোলাজ বানাতে পারি না। কিন্তু ধাক্কা লাগে যখন দেখি এই ইমেজগুলোর মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে যায়, কোন একটা যখন সর্বেসর্বা হয়ে বাকী কটাকে চোখ রাঙায়, রাজনীতির নিপুণ ছকে, সুতোর টানে সব ইমেজগুলো যখন পুতুলের মত নাচে, প্রমাদ গুনতে হয়। দিশেহারা আমরা আশ্রয় খুঁজি, তাত্ত্বিকেরা বলেন পলিটিক্যাল ইকনমির কথা।পলিটিক্যাল ইকনমির ছকে দেখতে চান রাষ্ট্রের স্বরূপ। রাষ্ট্র এমন একটা সেট যার অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে সরকার, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, শিক্ষা, জনগণ, ভৌগোলিক সীমানা এবং তার সার্বভৌমত্ব।
পলিটিক্যাল ইকনমি কী?
বিগত তিন’শ বছর ধরে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে চলেছে এই পলিটিক্যাল ইকনমি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে চাহিদার প্রকৃতি এবং দ্রব্যের উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে চলাটাই ছিল পলিটিক্যাল ইকনমির কাজ। অর্থনীতির ব্যুৎপত্তিগত অভিধায় যেখানে তাকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছিল পরিবারের ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞান হিসাবে, পলিটিক্যাল ইকনমি সেখানে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাজকর্মের ব্যবস্থাপনার দিকটা নিয়ে পড়ল। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টা?
এই যে মানুষের চাহিদা মেটানোর কাজ, সেটা তো একাকী কারুর পক্ষে সম্ভব নয়, পরস্পর আদান-প্রদানের মাধ্যমেই তো তা সম্ভব। আবার সেই পারস্পরিক লেনদেনও ঘটে থাকে একটা রাজনৈতিক সীমানার চৌহদ্দিতে যেখানে চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব আর পরিবারের হাতে থাকে না তা ন্যস্ত হয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ওপর আর সেটা হল রাষ্ট্রের আর এক শরিক-সরকার। একটা সময় ছিল যখন পলিটিক্যাল ইকনমির দায়িত্বর মধ্যে পড়ত রাষ্ট্রনায়কদের পরামর্শ দেওয়া, কী উপায়ে সুষ্ঠুভাবে সরকার তার নাগরিকদের প্রয়োজন মেটানোর কাজটা সম্পন্ন করতে পারে।
পরবর্তীকালে কোন সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের চরিত্র ও সেই বিন্যাস কীভাবে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে সেটাই পলিটিক্যাল ইকনমির বিষয় হয়ে ওঠে।
পুঁজিবাদকে সচল রাখার সাংগঠনিক প্রয়াস
কয়েক’শ বছর ধরে সামাজিক পর্বান্তর-এর বিভিন্ন্ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার জন্ম্।এর আস্ফালনের কাছে হার মেনেছে সমাজতন্ত্রের আশা। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, তৃপ্তি, অতৃপ্তি, বৈভব, বঞ্চনা - সব নিয়ে পুঁজিবাদের যাত্রা, কখনও ঠোক্কর খেতে খেতে, কখনও বা অবাধ। নানান সময়ে নানান সঙ্কট কম নাজেহাল করে না। উৎপাদনের বিভিন্ন্ শাখায় অসম্পূর্ণতা (disproportionality in different lines of production), কখনো ভোগের ঘাটতি (under-consumption), মুনাফার হার কমে যাওয়ার প্রবণতা, মন্দা- এইরকম নানা সংকট ব্যতিব্যস্ত করে পুঁজিবাদকে, আর তাই কালানুক্রমে জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন প্রচেষ্টা পুঁজিবাদের গতিকে সচল রাখতে, যেমন উদারনীতিবাদ (Liberalism), Dirgiste রাষ্ট্র এবং নয়া-উদারনীতিবাদ বা Neo-liberalism.
উদারনীতিবাদ একরকমের ইউটোপীয় দর্শন যা দাঁড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, স্ব-নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা এবং অবাধ বাণিজ্যের নীতির উপর; কারণ তাতেই ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের বিশ্ব দেখেছে উদারনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের আর একরকম ভাষ্য হল রাষ্ট্রের সদর্থক হস্তক্ষেপ বা dirgisme অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ। বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে এই ধারণার জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রান্সে এই মতবাদ গ্রহণ করা হয় শিল্পায়নের তাগিদে এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার হাত থেকে বাঁচতে। পরবর্তী কালে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও এর অনুকরণ করা হয়। রাষ্ট্রের এই ইতিবাচক ভূমিকার অংশ হিসেবে বিবেচ্য হয় কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, রাষ্ট্র কর্তৃক বিনিয়োগের পরিচালনা, দাম ও মজুরীর নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমের বাজারের তত্ত্বাবধান।
নয়া-উদারনীতিবাদের জন্ম ১৯৭০ এর দশকে মার্গারেট থ্যাচার, রোনাল্ড রেগন এবং পিনোচেত-এর মস্তিষ্ক প্রসূত এবং প্রবর্তিত নীতির পরম্পরায়।এর প্রধান কথা হল বাজারের কাজকর্ম চলতে হবে দক্ষতার সঙ্গে যাতে দেশী-বিদেশী ব্যক্তিগত পুঁজির অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও কাজকর্মে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। এই মতবাদে রাষ্ট্রের উন্নয়নের ভাষ্য চাপা পড়ে যায় বরং তার কাছে বড় হয়ে ওঠে আদিম আহরণের (Primitive Accumulation) প্রচেষ্টাগুলো ঢেকে রাখা এবং আহরণের সেই রাজকে কায়েম করা যেখানে দেশীয় বাজার ও ঘাটতি-ব্যয়কারী রাষ্ট্রের পরিবর্তে আর্থিক বৃদ্ধির প্রধান উদ্দীপক হিসেবে রপ্তানী ও ঘাটতি ব্যয়কারী বেসরকারী ব্যয় মুখ্য হয়।
ভারতে কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীকালে প্রায় দুই দশক ধরে ছিল dirgiste রাষ্ট্রের প্রভাব। দ্রুত শিল্পায়ণের তাগিদে নিয়ন্ত্রণের বজ্র আঁটুনির ঘেরাটোপে গজিয়ে ওঠে লাইসেন্স রাজ আর আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
১৯৬০-এর মাঝামাঝি থেকে এটা অনুভূত হতে থাকে যে নিয়ন্ত্রণের রূপায়ণ যেভাবে হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি, অনেক লক্ষ্য-পূরণ অধুরা থেকে গেছে আর তখন থেকেই নিয়ন্ত্রণের দর্শন তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে।১৯৮০-র দশকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও ধীর গতিতে উদারীকরণের দিকে প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
১৯৯০-এর দশক থেকে মূলত লেনদেন ব্যালেন্স-এর ঘাটতি সামলাতে সার্বিক উদারীকরণের জোয়ার আসে এবং রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে উঠে সরকারের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়া-উদারনীতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে।স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনকল্যাণ, শ্রমিকের স্বার্থ, নাগরিকের নিরাপত্তা – কোন কিছুই আর রাষ্ট্রকে আলোড়িত করে না। উন্নয়নের নামে অগণিত মানুষ ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এর ভয়াল রূপ লুকিয়ে রাখতে জাতীয়তাবাদের জিগির খাড়া করা হয় আর এসবের অন্তরালে কখন থাবা বসায় অতিমারী।
দি ইকনমিস্ট ১৪ মে ২০২০-র সংখ্যায় জানান দিল এতদিন
পারস্পরিক আদান-প্রদান-এর ওপর নির্ভর করে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, জ্ঞান-এর যে অবাধ চলাচল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে চালু ছিল তার দিন শেষ হল বলে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১২ মে-র ঘোষণাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকা আভাস দিল বিশ্বের দেশগুলো আবার Dirgiste রাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবছে আর আত্মনির্ভর হওয়ার সেটাই প্রথম পদক্ষেপ।
এই দেশের প্রেক্ষিতে তো বটেই অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেও এটা বুঝতে না পারার কারণ নেই যে ইতিহাসের এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট। একদিকে এই মারণ ভাইরাস-এর সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের বাঁচান অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাজ কে সুস্থির রাখা।এর জন্য আইনের অনুশাসন কঠোর করার সাথে সাথে রাষ্ট্রের নজরদারী সার্বিক করে তোলার পাশাপাশি ‘আলোচনার দ্বারা সরকার’(government by discussion)-এর স্বরূপ উন্মোচিত হওয়ার কথা ছিল।অথচ এক্ষেত্রেও সেই সরকারের তর্জন গর্জনে রাষ্ট্র কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
কোন আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই পরিকল্পনা কমিশন বাতিল করে নীতি আয়োগের প্রতিষ্ঠা, রাতারাতি বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দ্রব্য ও সেবার ওপর করের প্রবর্তন, অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের সময় রাজ্যগুলিকে প্রস্তুত হবার সু্যোগ ও সময় না দিয়ে লকডাউনের ঘোষণা এবং এই বিপর্যয়ের মুহূর্তেও ওপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা একটা বিষয়কে সুনিশ্চিত করে, সরকারের স্বশাসনের (Autonomy) ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়ছে আর সেইদিন হয়ত বেশি দূরে নয় যখন আমরা বুঝতে শিখব সরকার মানেই রাষ্ট্র, রাষ্ট্র মানে সরকার বৈ আর কিছু নয়।
এইখানটায় দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেওয়া যাক Dirgiste রাষ্ট্রের কথা ভাবার আগের ছবিটা।
প্রাক-অতিমারী রাষ্ট্র
সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি এক একরকম এবং নিজ নিজ কাঠামোগত অবস্থানে থেকে তারা সেই ২০০০ সাল থেকে, SARS সংকটের সময় থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করেছে।আবার চীন, ভারত, মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্র-এর ছবিটা আলাদা।
চীন সেই SARS সংকটের সময় থেকেই আগাম-সতর্কীকরণ এর সংকেত দেওয়ার যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তাতে কোন এক প্রান্তে কোভিদ-১৯ এর আক্রমণের কথা জানা গেলেও জনসমক্ষে তা আনতে চায় নি, ফলে জনগণের মধ্যেও সচেতনতা আসে নি। কিন্তু যখন অতিমারীর দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো তখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন, হাসপাতাল তৈরীর মধ্যে দিয়ে অবস্থা সামাল দিয়েছে।
ভারতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়, ২০১৭-১৮তে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপি-র ১.২৮ শতাংশ। সেন্টার ফর ডিজিজ, ডায়নামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি (CDDEP) ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ের যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায় যে ১৫ এপ্রিল,২০২০ পর্যন্ত এইদেশে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ, আই সি এউ ৯৫ হাজার এবং ভেন্টিলেটর এর সংখ্যা ৪৮,০০০। হাসপাতালের শয্যা ও ভেন্টিলেটারেরও বেশির ভাগ রয়েছে সাতটা রাজ্যে – উত্তরপ্রদেশ (১৪.৮%), কর্ণাটক (১৩.৮%), মহারাষ্ট্র (১২.২%), তামিলনাড়ু (৮.১%), পশ্চিমবঙ্গ (৫.৯%), তেলেঙ্গানা (৫.২%) এবং কেরালা (৫.২%)।
অতিমারীর মোকাবিলায় বিফলতার একটা বড়ো কারণ হল কিছু কিছু দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। ইতালীতে ২০০৯ থেকে ২০১৭ - এই সময়ে স্বাস্থ্যপরিষেবায় চাকরী কমেছে ৪৬৫০০, কমেছে ৭০০০০ হাসপাতালের শয্যা। ইতালীতে ১৯৭৫ সালে প্রতি হাজারে হাসপাতালের শয্যা ছিল ১০.৬, বর্তমানে তা হয়েছে ২.৬।ব্রিটেনে ১৯৬০ সালে সেটা ছিল ১০.7, ২০১৩ তে তা কমে হয়েছে ২.৮।পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলোতে অবস্থা প্রায় একইরকম।ফলে যত বেশি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় সমস্যা হয়েছে।সমাজের উচ্চবিত্ত এবং সরকারের উঁচু পদে থাকা মানুষের পক্ষে করোনার চিকিৎসায় যে-পরিষেবা লাভের সুযোগ হয়েছে, সাধারণ ও দুঃস্থদের সেটা না থাকায় তাঁরা যে অকূল পাথারে পড়বেন তাতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যবীমার অপ্রতুলতা একটা বড়ো কারণ যার জন্য এই অতিমারীর ঝড় সামলাতে সরকার নাজেহাল। তার ওপর আছে ওষুধ কোম্পানী গুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া, তাদের পকেট ভারী করার অক্লান্ত প্রয়াস ((https://www.marxist.com/coronavirus-pandemic-opens-a-new-stage-in-world-history.htm).
নিও-লিবারালিজম এর সবচেয়ে বড়ো সাফল্য এই যে পুঁজিবাদের এই নতুন প্রজাতির বীজটিকে সুচারু ভাবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার চারণভূমিতে বপন করতে পেরেছে যার ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের পানসি চালাবার ঠিকে পেয়েছে সেগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হিসেবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীকে পুঁজির আজ্ঞাবাহক করতে পেরেছে।এদের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হল একটা বিরাট সংখ্যক সর্বহারা শ্রেণীকে শ্রমের রিজার্ভ আর্মিতে পরিণত করে পুঁজির বাজারের নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করতে পারা।
পুঁজিবাদের এই পর্যায়ে এসে বিশ্বে মোট ধনসম্পদের কিরকম পরিবর্তন ঘটেছে দেখা যাক। ২০১৫ সালে বিশ্বের ৬২ জনের মোট আয়ের পরিমাণ বিশ্বের ৩.৬ বিলিয়ন লোকের আয়ের সমান। ২০১০ থেকে ২০১৫- এই পাঁচ বছরে বিশ্বের ৬২ জন ধনীর আয় বেড়েছে ৪৪% আর বিশ্বের জনসংখ্যার একেবারে নীচের তলার ৫৫% মানুষের আয় কমেছে ৩৮%। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে জনসংখ্যার বিরাট অংশ কৃষির অধিকার হারিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন সারা বিশ্বে। আবার অসংগঠিত ক্ষেত্রে ভিড় বাড়ছে শ্রমজীবী মানুষের তার কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে যত দিন যাচ্ছে কাজের সংকোচন ঘটছে আর যেখানে সুযোগ আছে সেখানে বাড়ছে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। এতো একরকম; পুঁজিবাদের স্বয়ংক্রিয়তা চালু রাখতে নিও-লিবারালদের দাবী মেনে শ্রম-বাজারের নমনীয়তার রব উঠেছে যার মূল কথা হল শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াই আর সংগঠনের ছাতার তলায় হবে না কিন্তু উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটাতে শ্রম-ঘন্টার বৃদ্ধি অবশ্যই করতে হবে।
তবে প্রতিবাদের সুর চাপা নেই।১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রাজিলে আন্দোলনের ফলে জমির অধিকার হারানো শ্রমিকদের ৩,৫০,০০০ পরিবার ফিরে পায় জমির অধিকার। ভারতেও বিগত তিরিশ বছর ধরে বিহারে মহিলা কৃষি শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরীর, জমির পুনর্বন্টনের, জাত-পাতের ভেদাভেদ অবলুপ্তির দাবীতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। আর্জেন্টিনায় সহস্রাব্দের শুরুতে ছাঁটাই হওয়া এবং কাজ হারাবার হুমকিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া শ্রমিকের আন্দোলনের ফলে ২০০০ সালের মাঝামাঝি কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব অর্জন করেন ১৫০০০ শ্রমিক যাঁরা পরবর্তীকালে গোটা দেশ জুড়ে ২০০ টারও বেশি সংস্থা চালাচ্ছেন সফলভাবে। পুঁজিবাদের সমর্থকরা এগুলোকে মনে করেন মূলধন- আহরণ ব্যবস্থার ক্ষত। শ্রম নির্ভর উন্নয়নের প্রবক্তারা (Labour Led Development) একে দেখেন শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির এবং সংহতির এক নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে।তবে ২০১৮-র ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট এবং ২০২০-র গ্লোবাল সোশ্যাল মোবিলিটি রিপোর্ট জুড়ে নয়া-উদারতন্ত্রের হামলার ছবি ভয় দেখায়, মনে করায় একবিংশ শতাব্দী তে মূলধনের চরিত্র ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে থমাস পিকেটি-র পর্যবেক্ষণ - বিশ্ব জুড়ে মূলধন থেকে আয়ের পরিমাণ পেছনে ফেলছে শ্রমোদ্ভূত আয় কে; ফলে আগামীদিনে বাড়তে চলেছে আয়ের অসাম্য, সামাজিক সচলতা(social mobility) স্থবির হওয়ার আশংকা।
অতিমারী সভ্যতার কাছে রাখতে চলেছে এক বড়ো প্রশ্ন – অতিমারী কী নিয়ে আসবে সামাজিক পর্বান্তরের আর এক অধ্যায় যেখানে সব-হারানো মানুষ ফিরে পাবে বাঁচার অবলম্বন, দারিদ্রের করাল ছায়া মুছে গিয়ে দারিদ্র-মুক্ত নতুন জীবনের আশা সঞ্চারিত হবে, মুমূর্ষুপ্রায় সভ্যতা শুনবে সঞ্জীবনের গান?
আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে প্রথম আন্তর্জাতিক-এর উদ্বোধনী ভাষণে মার্ক্স ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া শ্রমিকের ১০ ঘণ্টা কাজের আইনকে দেখেছিলেন শ্রমের পলিটিক্যাল ইকনমির কাছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পলিটিক্যাল ইকনমির আত্মসমর্পণ হিসেবে।
এই যে দুর্দশা ডেকে আনল এক ভাইরাস, বিপর্যস্ত হয়ে গেল মানবসমাজ, এইখানটায় পলিটিক্যাল ইকনমির দায় থেকে যায় নিও-লিবারাল অভ্যেস থেকে dirgiste ভূমিকায় রাষ্ট্রের উত্তরণের দিকটা বুঝে নেওয়ার। কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
দক্ষিণের বারন্দার সামনে একটা বড় ঝাঁকড়া নিম গাছ, তারপর চওড়া রাস্তা। রাস্তার ওপাশের জমি এখনো ফাঁকা। বারান্দাটা সুদীপ্ত আর নীলিমার খুব প্রিয় জায়গা। বেতের চেয়ার টেবিল কিনে সাজিয়েছিল এখানে গুছিয়ে সকালের চা খাবে বলে। এমনি দিনে একজনের অফিস আর অন্যজনার স্কুলের তাড়ায় তা আর হয়ে ওঠে না। এখন অবসরই, অবসর। এমনকি বাজার বা সামজিকতাও বন্ধ। ভোরে দুজনের অনেকটা সময়ই, এই বারান্দায় কাটে। বিকালের চা’ও। মাঝেমধ্যে চায়ের ফাঁকে দুচারটে কথা আর বাকিটা নীরবতা।
এদিন সকালে নীলিমা চায়ের ট্রে-টা টেবিলের কাঁচের উপর রাখতে রাখতে শুনতে পেল, সুদীপ্ত চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে আপন মনে গুনগুন করছে। কাপে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞাসা করে কি বলছ? সুদীপ্ত বলে একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। নীলিমা নিজের চায়ের কাপটা তুলে বলে আমাকেও শোনাও। সুদীপ্ত ওর গরম চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে ওর ভারি গলায় আবৃত্তি করে;
ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি
চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে
কামনার আবর্জনা যত, ক্ষুধিত অহমিকার
উঞ্ছবৃত্তি-সঞ্চিত জঞ্জালরাশি দগ্ধ হয়ে গিয়ে
ধন্য হোক আলোকের দানে, এ মর্ত্যের প্রান্ত-পথ
দীপ্ত করে দিক, অবশেষে নিঃশেষে মিলায়ে যাক
পূর্ব সমুদ্রের পাড়ে অপূর্ব উদয়াচল চূড়ে
অরুণ কিরণ তলে একদিন অমর্ত্য প্রভাতে।
নীলিমা একাগ্রে কবিতার প্রত্যেকটা শব্দকে অনুভব করতে থাকে। কবিতা শেষ হতে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সুদীপ্ত বলে - জীবনে মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত, অবধারিত, তাই না? নীলিমা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল, সে থমকে বলে ওঠে – তা ঠিক, কিন্তু এত সুন্দর কবিতার পর হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে পড়লে কেন? সুদীপ্ত সামনে তাকিয়ে বলে – আসলে কবিতাটা তো মৃত্যুরই কবিতা, তাই না? নীলিমা কিছুটা বিস্ময় মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করে রবীন্দ্রনাথের? সুদীপ্ত অল্প হেসে জানায়, হ্যাঁ, সেই এক এবং অদ্বিতীয় রবি ঠাকুর। নীলিমা হেসে বলে - আমি রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ‘মরণরে তুহুঁ মম শ্যামও সমান’কেই মৃত্যুর গান বলে জানতাম কিন্তু তার মৃত্যুকে নিয়ে এরকম কবিতা আছে জানতাম না তো। সুদীপ্ত একটু অবাক হয়ে বলে ওঠে, তা কেন পুরো একটা কবিতার বই ‘প্রান্তিক’ই লিখেছেন মৃত্যুকে নিয়ে। যে কবিতাটা আবৃত্তি করলাম এটাতো প্রান্তিকেরই কবিতা। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছিলেন এবং অনেকে মনে করেন যে তিনি খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছিলেন।
নীলিমা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে কিরকম? সে বলে - ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বয়স সাতাত্তর। প্রায় ষাট ঘণ্টার মতো কোমায় ছিলেন। শান্তিনিকেতনে তখন টেলিফোন ছিল না। কাজেই সেখান থেকে কলকাতায় খবর পাঠিয়ে মেডিকেল টিম আসতে এতোটাই সময় লেগে যায় এবং চিকিৎসায় ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসার পর, যখন তিনি প্রথম বালিশে ভর দিয়ে বসেন তখন প্রথমে তুলি আর কিছু রং নিয়ে, ঘরে থাকা একটা প্লাইউডের উপর এক নিসর্গ দৃশ্য আঁকেন; আঁধারঘন বনানীর বিষাদের মধ্যে এক চিলতে হলুদ আলোর রশ্মি। এরই কিছুদিন পর মৃত্যু নিয়ে তার কবিতা সঙ্কলন ‘প্রান্তিক’ বেরোয়, মৃত্যুকে নিয়ে কোন ভাষাতেই এত অপূর্ব কবিতা খুব কম দেখা যায়।
তারপর সুদীপ্ত একটু ভেবে বলে - এই একটা ব্যাপার, মানে মৃত্যুটা, জন্ম থেকেই নিশ্চিত অথচ কি আশ্চর্য দেখ আমরা তাকে নিয়ে কখনো ভাবতে চাই না। সারা জীবন এমন ভান করি যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই।
- তোমার কি হয়েছে বল তো? শুধু শুধু লোকে মরার কথা ভাবতে যাবে কেন?
- দেখ আজ চার মাস আমরা ঘরে বসে আছি করোনার ভয়ে, আর সারা বিশ্বের মানুষও আমাদের মতো মৃত্যুর ভয়ে কত কি করছে অথচ তাকে নিয়ে কোথাও কোন পরিষ্কার চিন্তা ভাবনা বা আলোচনা নেই, তাই না।
- মোটেই না, চারিদিকে মানুষ করোনার হাত থেকে কি করে বাঁচা যায় তার কথা ভাবছে।
সুদীপ্ত শান্ত গলায় বলে – না মৃত্যুর হাত থেকে কি করে বাঁচা যায় সেই কথা ভাবছে। কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে সে মৃত্যুকে সামনে আনে না, করোনাকে সামনে আনে। দেখ করোনা হলেই মৃত্যু আসবে এমন কথা নেই, কিন্তু মৃত্যু একদিন আসবেই। তারপর একটু নীরব থেকে, হেসে বলে - কবি যতই বলুন “মরণ রে তুহুঁ মম শ্যামও সমান...”, আমরা কিন্তু প্রাণপণে চেষ্টা করি সেই শ্যামের থেকে দূরে থাকতে, মৃত্যুর চিন্তাকে দূরে রাখতে। আমার এই বাহান্ন বছরের জীবনে কখনো এই নিয়ে কোন স্বাভাবিক কথা, আলোচনা বা আড্ডা শুনিনি।
- কি যে বলো! এই তো ফেব্রুয়ারি মাসে বড় জ্যেঠিমার মারা যাওয়ার আগে দু মাস তো বাড়ির লোকে সেই নিয়েই সারাক্ষণ কথা বলে গেল, মাঝে মাঝে আমার বিরক্ত লাগছিল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বাড়িতে বয়স্ক, খুব অসুস্থ কোন মানুষ থাকলে তো বারবার সেই আলোচনাই হয়।
সুদীপ্ত বারন্দার সামনের নিম গাছটার ডালে বসে থাকা কাকটার দিকে তাকিয়ে বলে - তখনো কি সত্যি করে মৃত্যুকে নিয়ে আলোচনা হয়? যিনি মারা যাচ্ছেন তার অবস্থা কেমন, তিনি কেমন ছিলেন, তিনি গেলে কি হবে? এই সব নিয়েই লোকে কথা বলে। সে সব কথা নয়, সাধারণ অবস্থায় তো আমরা কত গল্প, আলোচনাই করে থাকি এমনকি সম্পূর্ণ উড়ো গল্প আর নানা রকম বাজে ব্যাপার নিয়েও আমরা আলোচনা করি, কিন্তু কখনো কাউকে বলতে শুনেছ চল আজ আমরা মৃত্যু কেমন তাই নিয়ে আলোচনা করি। অথচ আমাদের জীবনে এটা তো অবশ্যম্ভাবী, অথচ তাকে নিয়ে মানুষ কি অদ্ভুত রকমের উদাসীন থাকার চেষ্টা করে। তাই না?
নীলিমা হাল ছেড়ে দিয়ে সুদীপ্তর কথা শুনতে থাকে, তার কৌতূহল হয়, শান্ত, কম কথা বলা সুদীপ্ত কি বলতে চাইছে আজ!
সুদীপ্ত চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিয়ে বলে চলে - দেখ যে সব জিনিস আমাদের জীবনে জন্মের পর থেকে আসবেই আসবে আমরা সেই সব নিয়ে কত অনুষ্ঠান, কত চিন্তা, ভাবনা, আলোচনা করে থাকি। বিয়ে নিয়েই ভাবো মানুষের কত স্বপ্ন, চিন্তা, লোকজন নানা রকমের সাজসজ্জা। বাচ্চা হবে তাই নিয়ে কত কল্পনা, এমনকি দুর্গা পুজো আসছে তাই নিয়েও মানুষের কত ভাবনা অথচ মৃত্যু যা এই সবের থেকেও নিশ্চিত, যা সবার জীবনে একদিন আসবেই তাকে যেন জীবন থেকে আমরা কিছুটা জোর করে দূরে সরিয়ে রাখি। তাই না?
নীলিমা একটু অস্থির হয়ে বলে – তার কারণ অন্য সব অনুষ্ঠান মিলনের, কিন্তু মৃত্যু, সে তো কেবল বিচ্ছেদের কথা বলে, তাই আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। তার থেকে দূরে থাকতে চাই তাই।
দুজনের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে, সুদীপ্ত তার চায়ের কাপটা আবার তুলে শেষ চুমুক দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। তারপর ধীরে সুদীপ্ত বলে – সেটা ঠিক, কিন্তু কেন? আর তাকে দূরে সরিয়ে রাখলেই কি সে দূরে থাকে?
– কারণ আমরা তার সম্পর্কে কিছু জানিনা, যেখান থেকে কখনো এই জীবনে আর ফিরে আসা যায় না তাই।
- কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানিনা বলেই কি তাকে এত ভয়? জন্মের আগে তো এই জীবন সম্পর্কেও কেউ কিছু জানত না। অর্থাৎ একটা সীমিত অস্তিত্ব যার শুরু আর শেষ আছে তার শেষটা ভাবলেই ভয় হচ্ছে, যা অবধারিত যার হাত থেকে পালানোর কোন রাস্তা নেই তাকে চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এই মিথ্যা চেষ্টা কেন? এবং এটা একজন বা দুজন ভীতু মানুষের কথা নয়, এটার থেকে বেশিরভাগ মানুষ বা পুরো মানবসমাজই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার থেকে দূরে রাখতে চায়। একটু চুপ থেকে বলে - এই দুর্গা পুজোর কথাই ভাবো দশমীতে মায়ের বিসর্জন, দুঃখের অনুষ্ঠান কিন্তু তা নিয়ে কি আমরা ভাবি না? সিঁদুর খেলা, কোলাকুলি, বিজয়ার শুভেচ্ছা সবই তো দেবীর বিসর্জনকে ঘিরে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা আমাদের কাছে মিলনের উৎসবও। অথচ নিজেদের জীবনে সেই বিসর্জন নিয়ে এতো ভয় কেন? নীলিমা গম্ভীর হয়ে বসে থাকে, এই আলোচনাটা সে যে খুব উপভোগ করছে তা নয়, কিন্তু এই দিনের পর দিন লকডাউনে বাড়িতে এরকম বসে থাকতে থাকতে একটা বিরক্তি, তার মধ্যে এটা যেন নতুন কিছু কথা।
সুদীপ্ত একটু আনমনা হয়ে বলে - অথচ মৃত্যু যতটা নিশ্চিত ততই অনিশ্চিত মৃত্যুর আসার সময়, সে যে কখন আসবে কেউ জানেনা। মিঃ দেশাই এর কথাই ধরো, সুস্থ্ মানুষ অফিসে বসে বসে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ, দুদিন আগেই প্রমোশনের দিন প্ল্যান করছিলেন ইউরোপ যাবার। তাই মনে হয় জীবনের সব থেকে নিশ্চিত ঘটনা মৃত্যু একটা চূড়ান্ত অনিশ্চিত সময়ে প্রবেশ করে।
সুদীপ্তর শেষের কথাটা শুনে নীলিমা আস্তে বলে ওঠে - তা ঠিক, আহা বিহারীদার বাইশ বছরের অমন জোয়ান তরতাজা ছেলেটা হঠাৎ চলে গেল বাপু। অত ভালো ছেলে কেন যে সেদিন বন্ধুদের সাথে মরতে মোটরসাইকেলে গেল ভগবান জানে। সীমাদির দিকে তাকানো যায় না। অন্যদিকে শ্যাওড়াফুলির মাসীমাকে দেখো, আজ দেড় বছর হল ডাক্তার বলে গেছে আশা ছেড়ে দিতে কিন্তু তিনি কোমার মধ্যেও এখনো বেঁচে। ছেলেগুলো ওদের এই অবস্থাতেও ডাক্তার, আয়া, ওষুধ এসব করছে, অথচ মায়ের কোন সাড়া নেই কিন্তু তিনি এখনো রয়েছেন।
– আর মৃত্যুর আসার সময় অনিশ্চিত বলেই আমরা এমন ভান করি যে সে যেন কখনোই আসবে না। ভাবি হয়ত এই সময় নয় অন্য কোন সময় কিন্তু ভাবটা এমন, যেন কখনই নয়।
তারপর নীলিমা একটু থমকে রেগে গিয়ে সুদীপ্তকে একটু ধমকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কি বলতে চাইছ বলতো? সকালবেলায় চা খেতে খেতে হঠাৎ মরা নিয়ে পড়লে কেন?
সুদীপ্ত দেখে নিম গাছে বসা কাকটা কখন উড়ে গেছে, সে নীরবে ভেবে চলে। নীলিমা তার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ আর টি-পট নিয়ে উঠে যায়। সে বসে বসে ভাবে জীবনে কত মৃত্যুই সে দেখল, বুক চাপড়ে কান্না, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস এবং শ্মশানে কিছু মৃত্যু নিয়ে টুকরো কথা যা চিতার আগুন নেবার আগেই হারিয়ে যায়। সুদীপ্ত সামনের ঝাঁকড়া নিম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে এক টুকরো হাসি আর ওর পায়ের কাছে গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে সকালের সূর্যের এক চিলতে আলো। নীলিমা রান্নাঘর থেকে ফের ঘুরে এসে সুদীপ্তর পাশের বেতের চেয়ারে বসে।
সুদীপ্ত বলে - সত্যি করে দেখলে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় মৃত্যু যেন এক বিপদ, এক অস্বাভাবিক ঘটনা, কোন রকমে আমাদের এর থেকে বাঁচতে হবে। টাকা পয়সা, ডাক্তার, হসপিটাল সমস্ত কিছুর বিনিময়ে এর হাত থেকে পালাতে হবে, অথচ তা অসম্ভব। আর এই দূরে সরিয়ে রেখে, তার থেকে পালাতে গিয়ে আমরা আমাদের জীবনের সব থেকে স্বাভাবিক ঘটনাকে অস্বাভাবিক ভয়াবহ করে তুলেছি।
- তা বলে মৃত্যু আসছে বলে তো হাত গুটিয়ে মানুষ বসে থাকবে না। তাকে তো বাঁচার চেষ্টা করতেই হবে।
- নিশ্চয় আমাদের মধ্যে বাঁচার যে জৈবিক তাগিদ আছে তাকে অস্বীকার করার কোন কারণ নেই, মৃত্যু আছে বলেই বাঁচার চেষ্টা থাকবে। কিন্তু মানুষের মতো উন্নত চিন্তাশীল প্রাণী, যা অবধারিত, স্বাভাবিক তাকে এরকম অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক ভাবে ভয় পেতে থাকবে? যত আধুনিক মানব সভ্যতা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির রথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তত যেন আমাদের মৃত্যুর প্রতি ভয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
নীলিমা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করার দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে তাকায়। এই বিষয়ের প্রতি সব মানুষের মতো তার স্বাভাবিক বিরাগ থাকলেও, ধীর, স্থির সুদীপ্তর খুব স্বাভাবিক কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে তাতে তার অভিজ্ঞ শিক্ষিকার দৃষ্টি এড়ায় না। সেও কিছুটা যেন কৌতূহল অনুভব করে।
- যত অত্যাধুনিক চিকিৎসা আসছে, নতুন নতুন ওষুধ আর যন্ত্র বেরোচ্ছে মানুষ যেন তত বেশি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে। ভিতরে হয়ত একটা আশা যে বোধহয় মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে গেলেও যেতে পারি। কিছু দিন আগেও মানুষ বাঁচার জন্য এতটাও বোধহয় হ্যাংলামো করতো না, তখন বোধহয় মৃত্যু অনেক স্বাভাবিক ছিল। অনেক মানুষের মধ্যেই মৃত্যুর বিষয়ে কিছুটা যেন আত্মসম্মান দেখা যেত। তাই না?
নীলিমা ভুরু কুঁচকে একটু হেসে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কি রকম?
- জানো আমার বাবার ঠাকুমা শেষ বয়েসে মারা যাবেন বলে সব কিছু গুছিয়ে কাশী চলে যান। আগে অনেক সময় লোকে গঙ্গার ধারে অন্তর্জলী যাত্রা করত, অর্থাৎ কিনা নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য ভয়ে পালানো নয় অপেক্ষা করা। আগে বাড়িতেও শেষ সময়ে লোকে হরিনাম করত, মুখে গঙ্গাজল দিত, এখনকার মতো ভেন্টিলেটারের নল গুঁজে দিত না।
- তুমি বলতে কি চাইছ? যে মানুষের শেষ সময়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে হরিনাম করবে, সে যাতে মারা গেলে স্বর্গে যায়।
সুদীপ্ত জানায়, সে তেমন কিছু বলতে চাইছে না। বলে, কিন্তু এটা মানাও কষ্টকর যে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আর নল লাগিয়ে ভাবা যে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যাবে। বহুক্ষত্রে তো বাড়ির লোক বুঝতে পারে আর কোন আশা নেই তবুও ভেন্টিলেটারে মানুষটাকে দেওয়া হয়, এই ভয়ে যে লোকে বা আত্মীয়স্বজনে কি বলবে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে তো শেষ সময়ের বয়স্ক মানুষদের ভেন্টিলেটারে দেওয়াটা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর একটু নীরব থেকে বলে, আমেরিকার এক সার্ভেতে দেখা গেছে ৭৫% মানুষ নিজের ঘরে মারা যেতে চান কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয় মাত্র ২৫% মানুষের। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও শেষ মুহূর্তে মানুষকে তার প্রকৃত জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চনা করে এক মরীচিকার মধ্যে দিয়ে অহেতুক আরো মৃত্যুভয়ে ঠেলে দেওয়া কি ঠিক?
- তা সত্যি, নার্সিং হোমে শেষ সাতটা দিন মা মারা যাবার আগে কতবার বলেছিল আমায় ‘আমায় ঘরে নিয়ে চ, আমি বাড়ি যাব’। কিন্তু বেঁচে ফিরবে এই মিথ্যা আশায় মা সেই আইসিইউতেই মারা গেল। একটু চুপ থেকে বলে কেন জানি আমার মনও বলছিল যে মায়ের আর বেশিদিন নেই কিন্তু মনে হচ্ছিল হয়ত আমি ভুল, ডাক্তার যখন বলছে তখন মা বেঁচে যেতেও পারে। সত্যিই তো মা তো চিরকাল বাঁচত না কিন্তু শেষের কটা দিন বাড়িতে থাকলে মার শেষ সময়টা শান্তিতে কাটত। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি।
তারপর সে বলে - বয়স্ক মানুষদের কথা ছেড়ে দাও কিন্তু বড়দার মতো মানুষের কথা ভাবো, মাত্র ৪৪ বছর বয়েসে হার্ট অ্যাটাক হ’ল, কিংবা বিহারীদার ছেলে দীপ্তেন্দুর অ্যাকসিডেন্ট। এদের জন্যও কি তুমি একই কথা বলবে? শেষ মুহূর্ত ভেবে এদের মতো তরতাজা প্রাণকে বাঁচানোর চেষ্টা হবে না, এইসব হাসপাতালে এদের মতো কত প্রাণ বেঁচে ফিরে আসে। তুমি তো জানো আমাদের স্কুলের বড়বাবুর মেয়ের বুকে ক্যান্সার হয়েছিল, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু এখন তো সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
- আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে মানুষকে বাঁচানোর জন্য আইসিইউ, ভেন্টিলেটার বা আধুনিক চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কিংবা বড়দা বা দীপ্তেন্দুকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। কিন্তু তার সঙ্গে মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ না করার তো কোন সম্বন্ধ নেই। মৃত্যু তো জীবনের বিপরীত নয় এতো জীবনের অংশ তারই পরিণতি, তাই না?
তারপর সে নীলিমাকে যেন কিছুটা শান্ত করার জন্য বলে, দ্যাখো আমরা মোটামুটি চার রকমের মৃত্যুকে দেখি; এক, হঠাৎ কম বয়েসে অ্যাকসিডেন্ট বা হার্ট অ্যাটাক; দুই, টার্মিনাল রোগ যেমন ক্যান্সার; তিন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের বিকল হওয়া ফুসফুস, কিডনি বা লিভার; এবং সব শেষে বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত, দুর্বল হয়ে মৃত্যু। এখন রোগীর গড় বয়স প্রথম দুই ক্ষেত্রে কম হলেও কিন্তু পরের দুই ক্ষেত্রে বেশি এবং বাঁচানোর চেষ্টাও আলাদা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুকে একই রকম ভাবে অজানা এক ভীতির সঙ্গে দূরে ঠেলে ফেলা হয়। এর সঙ্গে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টার কোন সম্পর্ক নেই। একজন যুবককের অ্যাকসিডেন্ট বা একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের কিডনির কাজ না করা, বা একজন নব্বই বছর বয়সী মানুষের নিউমোনিয়া - এই সব মৃত্যুকেই আমরা একই রকম ভাবে কেন দেখবো? তাকে তো কখনো না কখনো সহজ ভাবে নিতে হবে, যদি তা না নি তাহলে আমরা অসুখের যন্ত্রণার সাথে, মৃত্যুভয়ের যন্ত্রণাকে যোগ করব।
দুজনেই চুপ করে বসে থাকে, কারোরই এখন আর কোন তাড়া নেই। নীলিমা ব্যাপারটাকে কিছুটা হালকা করার জন্য বলে কিন্তু তুমি যে বলছ আমাদের মধ্যে মৃত্যু নিয়ে কোন আলোচনা বা গল্প হয় না সেটা হয়ত ঠিক কিন্তু যদি হত তাহলে কি আলোচনা হত? সেখানে তোমার বক্তব্য কি হত? সুদীপ্তর মুখে মৃদু হাসির ছোঁয়া, সে বলে - প্রথম তো আমার এটা প্রশ্ন হত যে মৃত্যু কি? মৃত্যু কাকে বলে? নীলিমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে সত্যি তো মৃত্যু কাকে বলে? সে একটু হেসে উত্তর দেয় - হাজার হাজার বছর ধরে এটা একটা বড় প্রশ্ন মানুষের কাছে। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে অন্য অনেক দেশের মতোই প্রথাগত মৃত্যুর সংজ্ঞা হচ্ছে অনেকটা এরকম; শ্বাস ও রক্ত চলাচলের অপরিবর্তনীয় সমাপ্তি। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যু ঘটে মস্তিষ্কে যখন সেখানকার স্নায়ুকোষেরা একবার মারা গিয়ে আর পুনর্জীবন পায় না বা নূতন করে ফিরে আসে না বা কাজ করে না। এখনো প্রকৃত মৃত্যু নিয়ে নানা দেশে নানা রকমের আইনি সংজ্ঞা আছে, অর্থাৎ কিনা সেখানেও একটা বিভ্রান্তি রয়েছে।
এটা শুনে নীলিমা হেসে বলে তা তোমার আর কি কি প্রশ্ন আছে এর সম্পর্কে? সে বলে - তা সে হৃদয় বা মস্তিষ্ক যাই হোক, এই দেহের শেষই কি মৃত্যু? আর তা যদি হয় তাহলে জীবন মানে কি কেবল এই দেহই? এই যে আমাদের চেতনা যা মনকে চালায় তার অবস্থান মৃত্যুর সাথে কি? যখন এই জীবনের শেষে আমাদের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হবে তখন এই চেতনা, মন আর দেহের যে সম্পর্ক, তার কি হবে? চেতনা আর মন কোথায় যাবে? এই সব আর কি। নীলিমাও হেসে ফেলল বলল - বাবা! এতে তো মৃত্যুর থেকে জীবনকে নিয়ে বেশি ভাবতে হবে।
সুদীপ্ত বলে তোমার তাই মনে হচ্ছে? তারপর ওর স্বভাব বিরুদ্ধ কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে ও বলে ওঠে; “আমরা আপনার কাছে মৃত্যুকে জানতে চাই” এবং তিনি বললেন “তোমরা মৃত্যুর রহস্য জানিবে। কিন্তু তোমরা তাহাকে পাইবে কি করিয়া যদি না তাহাকে তোমরা জীবনের গভীরে সন্ধান করো? যে নিশাচর পেচকের চক্ষু দিনের আলোক রশ্মির সামনে অন্ধ, সে আলোকের রহস্যকে কেমন করিয়া উন্মোচন করিবে? যদি তোমরা সত্যই মৃত্যুর আত্মাকে উপলব্ধি করিতে চাও তাহলে তোমাদের হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দাও জীবনের সন্মুখে। জীবন ও মৃত্যু অভিন্ন, যেমন নদী এবং সাগর এক”।
নীলিমা অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করে - কার লেখা ? তোমার নাকি? সুদীপ্ত জোরে হেসে ফেলে বলে না খালিল জিব্রান, তবে অনুবাদ আমার।
নীলিমা বলে ও ‘প্রফেট’ থেকে বললে - বাঃ তোমার বেশ মনে থাকে তো। তারপর একটু ভাবতে ভাবতে বলে জীবনের গভীরেই মৃত্যুর উপলব্ধি! বেশ নতুন চিন্তা তো।
- হ্যাঁ। এক গভীর উপলব্ধি। আসলে মৃত্যু আমাদের মনে করায় আমাদের অনিত্যতাকে তাই হয়ত আমরা ভুলে থাকতে চাই মৃত্যুকে। কিন্তু যারা ভয় না পেয়ে তার মুখোমুখি হতে পেরেছে তারাই উপলব্ধি করেছে জীবনের অসীম গুরুত্বকে। আমরা মৃত্যুকে ভুলে যখনই ভাবি জীবন নিত্য, এর যেন শেষ নেই, তখনই হয়ত আমরা যেমন তেমন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঁচি, অপচয় করি জীবনকে, বাঁচার প্রতি মুহূর্তকে। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসবে তাই জীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত দামী, তাই মৃত্যু থেকে ভয়ে পালানো নয়, এতো আমাদের জীবনের তটরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা লাইটহাউস। দশমীর বিসর্জনের জন্যই আমরা সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর প্রতি মুহূর্তকে উপভোগ করতে চাই।
দুজনেই চুপ করে সামনের গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিমের ছোট ছোট সবুজ কচি পাতারা হাওয়া নাচতে থাকে। নীলিমা ধীরে ধীরে বলে, সত্যি কি কেউ আছে যে মৃত্যু ভয়ে ভীত নয়। অন্যদিক থেকে উত্তর আসে – কেন নচিকেতা।
নীলিমা ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে সত্যিই অনেক আগে পড়েছিলাম যম আর নচিকেতার গল্প। মৃত্যু নিয়েই তো যমের কাছে ছিল নচিকেতার প্রশ্ন, কিন্তু কি বলেছিল তা আর মনে নেই। বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে তাকায় সুদীপ্তর দিকে।
সুদীপ্ত স্ত্রীর কথায় হেসে বলে - তুমি নয় খুব কম লোকেরই মনে থাকে যম ও নচিকেতার সেই বিখ্যাত কথোপকথন যদিও অনেকেই গল্পের ঘটনাকে মনে রাখে। আসলে ঐ গল্প কঠোপনিষদের অবতারণা মাত্র, কথোপকথনটাই উপনিষদের মূল কথা। সেখানে যমের তৃতীয় বরের বিনিময়ে কিশোর নচিকেতা জানতে চায় “কেউ কেউ বলে মৃত্যুর পরেও অন্য জীবন শুরু হয় আবার কেউ কেউ বলে তা সত্য নয় এই জীবনই একমাত্র জীবন যা মৃত্যুর সাথে শেষ হয়। আমাকে প্রকৃত সত্য কি তা বলুন”।
নীলিমা থাকতে না পরে বলে ওঠে - বাঃ বুদ্ধিমান ছেলে, এর উত্তর তো যমের কাছেই থাকবে। সুদীপ্ত বলে - তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যমের তৃতীয় বরে সে অনেক কিছু চাইতে পারত কিন্তু সেই কিশোর যার সামনে সমগ্র জীবন, যৌবন পড়ে আছে, সে ধন, মান, সম্পদ, রূপ কোন কিছু না চেয়ে মৃত্যু কি জানতে চাইলো, যখন কিনা আমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবতেও ভয় পাই, আমাদের জীবনের সেই গভীর বাস্তবকে আমরা জোর করে ভুলে থাকতে চাই। তাই না? নচিকেতা সত্যই বুদ্ধিমান কারণ সে জানত সামনে মৃত্যুই একমাত্র বাস্তব যাকে কিছুতেই এড়ানো যাবে না, বাকি সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, আসবে চলে যাবে। কাজেই তাকে জানাই সব থেকে প্রয়োজনীয় এই জীবনে। আর ঠিকই বলেছ, মৃত্যুর দেবতা যমই এর সঠিক উত্তর জানবে।
- যম কি বলেছিল?
- সে অনেক কথা, প্রথমে যম নচিকেতাকে ছোটছেলে ভেবে তাকে নানান চেষ্টা করে যাতে সে এই প্রশ্ন ভুলে যায়। কিন্তু নচিকেতা ভোলে না। সে পরম সত্যকে জানার এই সুবর্ণ সুযোগ ছাড়তে চায় না। আসলে নচিকেতা আছে আমাদেরই অন্তরের গভীরে, যখন তাকে অস্বীকার করি, তখনই মৃত্যু দেবতা ভয়ানক হয়ে ওঠেন।
তারপর একটু ভেবে সে বলে - এক কথায় বললে যম যা বলেছিল তা আমি যে খুব বুঝেছি তা বলব না, তবে তা অনেকটা এরকম; প্রকৃত আমি বা আত্মা অমর, তার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই, সে শাশ্বত, অবিনাশী, এর কোন শুরু বা শেষ নেই। কেবল দেহের মৃত্যু হয় কিন্তু আত্মা অমর অজর। যে ভাবে সে হত্যাকারী বা যে ভাবে সে হত, দুজনেই অজ্ঞানী। আত্মা হত্যা করেও না বা তাকে হত্যা করাও যায় না। দ্যাখো, কি আশ্চর্য! মৃত্যুর দেবতাই অমরত্বের সন্ধান দিচ্ছেন। জীবন ও মৃত্যুকে অতিক্রম করার কথা বলছেন। জানিনা তা সত্যি সম্ভব কিনা, কিন্তু নচিকেতার উত্তরসূরি হিসাবে মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমরত্ব খোঁজায় দোষ কোথায়? আর তাকে দূরে সরিয়েও তো আমরা তাকে জয় করি না কেবল ভয় পেতে থাকি, ভুলতে চেষ্টা করি।
নীলিমা একটু চিন্তিত হয়ে বলে এই কথার সাথে গীতার কোন কোন শ্লোকের বেশ মিল আছে বলে মনে হয় না? উল্টোদিকে কিছু নীরব সম্মতির ঘাড় নাড়া দেখে সে কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বলে যম নিশ্চয়ই এই আত্মার ব্যপারে কিছু বলে ছিল।
- হাঁ, এখানে মৃত্যুর প্রসঙ্গে এমন এক ‘আমি’ বা ‘আত্মাকে’ নিয়ে আসা হয় যা অমর, অজর, যার ব্যপারে আমাদের শাস্ত্রে নানা কথা লেখা থাকলেও আমাদের জীবনে, চিন্তায় মননে তার কোন উপস্থিতিই নেই। কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই তা এক বড় ধোঁয়াশা, একই রকমের জটিল।
সেটা শুনে নীলিমা প্রশ্ন করে কি রকম?
- যম বলেন, আত্মা ক্ষুদ্রতম বস্তুর থেকেও ক্ষুদ্র একই সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের বৃহত্তম বস্তুর থেকেও বৃহৎ। তাকে বুদ্ধি দিয়ে বা আলোচনা করে বা শিক্ষার মাধ্যমে জানা যায় না তা প্রকৃত জিজ্ঞাসুর সামনে স্বপ্রকাশিত। তাকে উপলব্ধির রাস্তা অন্ধকার রাত্রে ধারালো ক্ষুরের উপর দিয়ে হাঁটার মতোই ভীষণ কঠিন, তাই সময় নষ্ট কোর না, তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানর জন্য ওঠো, জাগো এগিয়ে চলো।
- তার মানে উপনিষদের ঋষি থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই মৃত্যু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছেন?
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সুদীপ্ত বলে ওঠে, আসলে উপনিষদের কবি, রবি ঠাকুর বা খালিল জিব্রানের মতো মানুষদের কাছে জীবন এক মহার্ঘ, অনির্বচনীয় আনন্দ আর তাই এরা সকলেই মৃত্যুকে জীবনের দিগন্ত হিসাবে দেখেছেন, সেই দিগন্ত যা জগতের আনন্দ যজ্ঞের এক মাত্রা।
বেলা বাড়ছে নিম গাছটা রোদে আরো ঝলমল করছে।
সুদীপ্তর আবদারে নীলিমা ধীরে ধীরে গান ধরে -
বেলা যে ফুরায়ে যায়, খেলা কি ভাঙে না হায়
অবোধ জীবনপথ যাত্রী।
কে ভুলায়ে বসাইল কপট-পাশায়
সকলি হারিলি তায়, তবু খেলা না ফুরায়।
পথের সম্বল গৃহের দান
বিবেক-উজ্জ্বল সুন্দর প্রাণ,
তা কি পণে রাখা যায়
খেলায় তাকে হারায়।
আসিছে রাত্রি কত রবি মাতি,
সাথীরা যে চলে যায়, খেলা ফেলে চলে আয়।
দ্য গার্ডিয়ান আগস্ট ৫, ২০২০
নরেন্দ্র মোদী এখন রাম মন্দিরের শিলান্যাসের সংকল্প করলেন কেন?
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট কাশ্মীরের সব ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেটে দেওয়া হয়েছিল অন্তর্জাল পরিষেবা। ঠিক এক বছর আগে এই দিনটিতে, অর্থাৎ ৫ আগস্ট দুর্ভেদ্য সামরিক কার্ফুতে নিজ গৃহে বন্দী হলেন ৭০ লক্ষ মানুষ (৭ মিলিয়ন)। শিশু ও কিশোর সমেত ১০,০০০ মানুষ পূর্বতন সব মুখ্যমন্ত্রী ও ভারত সমর্থনকারী প্রধান রাজনীতিকদের দিকে পাথর ছোঁড়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হলেন, তাঁদের হাজতে পাঠানো হল, এখনও তাঁরা অনেকেই সেখানেই আটক আছেন। ৬ আগস্ট লোকসভায় (পার্লামেন্টে) একটা বিশেষ বিল পাস হল। ছেঁটে ফেলা হল সংবিধান প্রদত্ত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন। খর্ব হ’ল এমনকি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদাও। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ - এই দুই ইউনিয়ন টেরিটরি (কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে) ভাগ করে দেওয়া হল। লাদাখের জন্য কোন বিধানসভা রইল না। সোজা দিল্লি থেকেই চালানো হবে শাসন।
আমাদের বলা হল, কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়ে গেল। অন্য কথায় বলতে গেলে, কাশ্মীরে দশক ধরে চলা আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, যার জন্য প্রাণ গিয়েছে হাজার হাজার সেনার, মিলিটারি ও অসামরিক মানুষজনের, নিখোঁজ হয়েছেন, নিখোঁজ করে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, নৃশংসভাবে অত্যাচারিত দেহের অগুনতি দৃশ্য - সব শেষ।
লকডাউন, বা না-লক ডাউন, যখন আমি লিখছি, নিশ্বাসে অনুভব করছি ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তের পূর্বাভাস।
ভারতের লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আর একটু এগোলেন। তিনি বললেন, পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিটস্তানের সম্মুখবর্তী অঞ্চল উদ্ধারের জন্য তিনি জীবন দিতেও রাজী। আকসাই চিনের কথাও জানালেন তিনি। একসময় তা জম্মু কাশ্মীরেরই ছিল, এখন চিনের অন্তর্গত। আক্ষরিক ও প্রতীকী এই দুই অর্থেই, বিপজ্জনক অঞ্চল দিয়ে হাঁটছেন তিনি। যে সীমানাগুলির কথা তিনি বলছেন তা তিন পারমাণবিক শক্তির আওতার মধ্যে। কাশ্মীরের অসংখ্য মানুষের ওপর নামিয়ে আনা অমানবিক আচরণের মধ্যে ভারতের রাজপথে রাজপথে অবোধ্য অভূতপূর্ব উল্লাস, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইতিমধ্যেই লালিত ঈশ্বর সদৃশ ভাবমূর্তিকে আলাদা ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। প্ররোচিত হয়ে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর দেশের আবহাওয়া বার্তায়, গিলগিট বালটিস্তানের আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যাদিও পেশ করতে শুরু করে দিয়েছে। ভারতে খুব কম সংখ্যক মানুষজনই গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করেছেন, সেই সময় চিন সরকার ভারতকে সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তা ও কাজকর্মে সতর্ক থাকতে বলছে।
যে বছরটি চলে গেল, সেই বছরে কাশ্মীরের মানুষজনের লড়াই কোন অর্থেই শেষ হয়ে যায়নি। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে গত কয়েক মাসে কাশ্মীরে ৩৪ জন সেনা, ১৫৪ জন জঙ্গী ও ১৭ জন অসামরিক (সাধারণ) মানুষ মারা গিয়েছেন। ‘করোনা ভাইরাস’ এই শব্দবন্ধের আতঙ্কে ভারত সরকার কাশ্মীরের মানুষজনকে কি করছেন তাতে কেউ মনোযোগ দিচ্ছেন না। কার্ফু ও যোগাযোগবিহীনতার সঙ্গে কয়েকমাস ধরে অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলল বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগহীনতা - ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা, হাসপাতালে কাজকর্ম ব্যাহত হওয়া, ব্যবসা নেই, স্কুল কলেজ বন্ধ, প্রিয়জন, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই - সর্বত্রই অবরোধ। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ও আমেরিকা এমন করেনি।
কোভিড লক ডাউনের কয়েক মাস, মিলিটারি কার্ফু ও যোগাযোগবিহীনতা ছাড়াই পৃথিবীকে প্রায় ধ্বসিয়ে দিয়েছে। শত শত, লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ তাঁদের সহ্যসীমা ও স্বাভাবিকতার প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছেন। এবার পৃথিবীর সব চাইতে বেশি মিলিটারি নিযুক্ত কাশ্মীরের কথা ভাবুন। করোনা ভাইরাস আপনার জীবনে যে যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে যোগ করুন কাঁটাতারের গোলকধাঁধা, সেনারা আপনার ঘর ভাঙছে, লোকজনকে মারছে, মহিলাদের প্রতি অশালীন আচরণ করছে। নষ্ট করে দিচ্ছে আপনার মজুত করা খাবার, গণমাধ্যমের যাবতীয় কন্ঠ ব্যবহার করে অত্যাচারিত মানুষজনের আর্তনাদ শুনিয়ে যাচ্ছে, শুনিয়েই চলেছে।
এর সঙ্গে যোগ করুন বিচার ব্যবস্থাকে - ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সহ যারা সারা বছর ধরে এই অন্তর্জাল অবরোধ চলতে দিয়েছে, গ্রাহ্যই করেনি নিজেদের পরিবার পরিজনদের প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া ৬০০০ মানুষের ‘হেবিয়াস কর্পাসের’ আবেদন। আরও যোগ করুন বসবাসের আইনের কথা (domicile law), যার ফলে সমস্ত ভারতীয়দের জন্য কাশ্মীরের বসবাসের পথ উন্মুক্ত করা হল। কাশ্মীরের আদি বাসিন্দাদের অমূল্য শংসাপত্রগুলি এখন আইনগতভাবে মূল্যহীন। এখন নিজ মাতৃভূমিতে বসবাসের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদনে এগুলো হয়তো কিছু প্রমাণ দেবে। এঁদের মধ্যে যাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবে তাঁদের নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজ কাশ্মীর সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন।
কাশ্মীরে নতুন বসবাসের আইন (domicile law) ভারতের মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (CAA) নিকটাত্মীয়। ২০১৯ সালে এই বিলের সঙ্গে পাস হওয়া আরও আছে NRC (National Register for Citizens বা নাগরিক পঞ্জীকরণ) - যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের (অবশ্যই মুসলিম) ধরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় তারা ‘উইপোকা’। আসামে নাগরিক পঞ্জীকরণ চলাকালীন প্রভূত প্রতিহিংসা প্রতিফলিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোকের নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ গেছে। অনেক দেশই যেখানে ঊদ্বাস্তু সমস্যার সংকটে জেরবার, সেই সময়ে ভারতরাষ্ট্র তার নাগরিকদের উদ্বাস্তু বানাচ্ছে। অকল্পনীয়ভাবেই এক রাষ্ট্রহীনতার সমস্যায় ইন্ধন যোগাচ্ছে।
CAA, NRC ও কাশ্মীরের নতুন Domicile Law বৈধ নাগরিকদের কাছেও রাষ্ট্রের নির্দেশ ও সম্মতিপ্রদত্ত তথ্যাদি চাইছে। (১৯৩৫ সালে নাজি পার্টির ন্যুরেমবার্গ আইন ডিক্রী জারি করেছিল যাদের থার্ডরাইখের সম্মতি সহ আইনানুগ কাগজপত্র আছে একমাত্র তারাই জার্মান নাগরিক)। এসবকে কি বলা যায়? যুদ্ধ অপরাধ! না মনুষ্যত্বের প্রতি অপরাধ!
লুন্ঠিত হয়েছে আমাদের পরিচিতি ঃ এক বছর সমস্যার পর কাশ্মীরের জীবন
ষড়যন্ত্রে সহায়তা করা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ভারতরােষ্ট্রর রাস্তায় রাস্তায় উল্লসিত সাড়ম্বর উদ্যাপনগুলিকে কি বলা যাবে? গণতন্ত্র?
এক বছর পর, কাশ্মীরের ওপর এই উদ্যাপনগুলি স্পষ্টতই নির্বাক। কারণটি অবশ্য অন্য। আমাদের সদর দরজায় ড্রাগন - তাই সে অসুখী। ২০২০ সালের ১৭ জুন আমরা চোখ খুললাম একটা ভয়ঙ্কর খবরে - চিনের সেনা, People Liberation Army-র হাতে একজন কর্নেল সহ ২০ জন ভারতীয় সৈনিক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে দুর্গম তুষারাবৃত গালওয়ান উপত্যকায়। পরবর্তী কয়েকদিনে ভারতীয় কয়েকটি সংবাদ সংস্থার বার্তায় প্রবেশের বিষয়ে কতকগুলি জিনিস জানা গেল। অভিজ্ঞ সামরিক মানুষজন ও প্রতিরক্ষা সংবাদদাতারা জানালেন ভারত-ভূখণ্ডের একশ কিলোমিটার PLA অধিকার করেছে। ‘ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারে’ এই ঘটনাকে যেভাবে নগ্ন আগ্রাসন বলে চিত্রিত করা এটা শুধুমাত্র কি তাই? না কি এই প্রবেশের সঙ্গে চিনের মূলগত কিছু স্বার্থ জড়িত – আকসাই চিনের সুউচ্চ পর্বতমালার উপর দিয়ে নির্মিত রাস্তা ও পাক অধিকৃত/আজাদ কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য সড়ক? দুটোই হুমকির মুখে, যদি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বসহকারে বিচার করা হয়, এবং সেটা করা হবেই বা না কেন?
আমাদের মত ভয়ঙ্কর জাতীয়তাবাদী সরকারের কাছে সে যে সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা দুঃস্বপ্ন। এ বিষয়টি গোপন করা যাবে না, কিন্তু কি ই বা করা যাবে? একটা সাধারণ সমাধান পাওয়া গেছে। গালওয়ান ট্র্যাজেডির কয়েকদিন পর মোদী জনতার সামনে ভাষণ দিলেন, ‘কেউ এক ইঞ্চি জমিও আমাদের নিতে পারে নি।’ বললেন আমাদের সীমানায় কেউ ঢুকতে পারে নি ও কোন ঘাঁটিই দখল করতে পারে নি। মোদীর বিরোধীরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। চিন সরকার তাই বলছিল, তারা মোদীর ভাষণ কে স্বভাবতই স্বাগত জানাল। তবে মোদীর বক্তব্য যেমনটি মনে হচ্ছে, ততটা নির্বোধ নয়। যখন দুই দেশের সেনা নায়কেরা প্রত্যাহারের কথা বলছেন, বলছেন সেনাদলের ‘disengagement’ বা বিরত থাকার কথা, স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনা যখন ঢোকেনি তখন প্রত্যাহার কি ভাবে হয় তা নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলছে, যখন চিন নিজ সীমানার দাবী রাখছে, সেসময় ভারতের বিপুল অবিজ্ঞাত সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে মোদীই জিতে গেছেন। দূরদর্শনে চলছে মোদীর জয়। কে বলবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ - দূরদর্শন না রাষ্ট্র?
যেভাবেই এটাকে ভাবা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত ভারতের দুদিকেই, পশ্চিমে পাকিস্তান ও পূর্বে চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত সেনাদল থাকতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের ঔদ্ধত্যে প্রতিবেশী নেপাল ও বাংলাদেশের ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ। যুদ্ধের মুহূর্তে আমেরিকা এখন তার নিজের সংকটেই আবর্তিত হচ্ছে সে কি পারবে ভারত কে উদ্ধার করতে? সত্যি? আমেরিকা যেমন ভাবে সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দদের রক্ষা করেছিল, সত্যি কি সেভাবে ভারত কে সাহায্য করতে পারবে? পারবে কি যেমন সোভিয়েতের থেকে আফগানদের রক্ষা করেছিল বা উত্তর ভিয়েতনামীদের থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের - সেভাবে ভারতকে বাঁচাতে?
কাল রাতে আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু আমাকে মেসেজ করেছিলেন, ভারত, চিন ও পাকিস্তান কি কাশ্মীরের আকাশে আমাদের না দেখেই যুদ্ধ করবে? না হওয়ার মত কিছু নয়। এই তিনটি দেশের কোনটিই না নৈতিক না মানবিকভাবে একে অপরের থেকে ওপরে। এরা কেউই মনুষ্যত্বের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য ভাবিত নয়।
সরকারিভাবে যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও ভারতকে লাদাখ সীমানায় উচ্চতায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ও সজ্জিত সেনাদল রাখতে হবে, দূরতম প্রান্তেও চিনের অস্ত্রভাণ্ডারের সঙ্গে খাপ খায় এমন কিছু সঙ্গে রাখতে হবে। স্বভাবতই ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দুগুন কি তিনগুন বাড়বে। শুধুমাত্র এই নয়, ভারতের বর্তমান অর্থনীতি এখন ক্রমাগত নিম্নমুখী তার ওপর গভীর আঘাত নেমে আসবে, (৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব)। এই চিত্র, কোভিড-১৯ লক ডাউনের আগেই। আর এখন অর্থনীতি ৩.২ ও ৯.৫এ সঙ্কুচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। চাইনিজ চেকারের প্রথম রাউন্ডগুলিতে মোদী খুব একটা ভাল ফল করছেন না।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমরা দেখলাম আরো কিছু মাইল ফলক। পরিকল্পনাহীন, নির্মম, শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া লক ডাউন ছাড়াও, অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা সত্ত্বেও ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য দেশগুলির তুলনায় সম্ভবত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে আছেন আমাদের যুদ্ধপ্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করছেন হাসপাতালের বিছানায়। তাঁর জন্য নিরাময়ের নিদান হাতুড়ে ডাক্তাররা দিচ্ছেন না, দলের লোকসভার সাংসদ বা ‘গুরু’রাও নয়, যাঁরা গোমূত্র পান করেছেন, ‘যাদুকরী’ ‘করোনিল’-এর কথা বলছেন তাঁরা নন, শাঁখ বা থালা বাজিয়ে ‘যাও করোনা যাও’ বলে সংস্কৃত ধাঁচে ‘হনুমান চালিশা’ পাঠ করে চলেছেন তাঁরাও নন। তাঁর জন্য বিলাসবহুল বেসরকারি ব্যবস্থা, সরকারি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা।
এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোথায় থাকবেন?
যদি কাশ্মীর সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান হয়ে গিয়ে থাকে, সেখানে তিনি থাকতেন সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা ভীড়ের সঙ্গে পর্ব উদ্যাপনে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসা হয়নি। আবার সব আবদ্ধ। লাদাখ প্রায় যুদ্ধক্ষেত্র। বিজ্ঞজনোচিতভাবেই মোদী স্থির করলেন এ সমস্ত উপদ্রুত অঞ্চলগুলি থেকে সরে গিয়ে একেবারে নিরাপদ জায়গায় আর একটা দীর্ঘ মেয়াদী ভোট প্রতিশ্রুতি দিতে। এই লেখাটা আপনারা যখন পড়বেন তার মধ্যে মোদী পুরোহিত এমন কি সুপ্রীম কোর্টেরও আশীর্বাদধন্য হয়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষে ৪০ কেজি রূপোর ইঁট দিয়ে রাম মন্দির নির্মাণের ভূমি পূজন করেছেন – বাবরি মসজিদ যা ১৯৯২ সালে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যদের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু মানুষের হাতুড়ির ঘায়ে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে উঠবে এই মন্দির। দীর্ঘ যাত্রা নিঃসন্দেহে। আমরা বরং বলি, ‘ইচ্ছার জয়’।
কাশ্মীরে আবারো কার্ফু ফিরিয়ে আনতে হল কেন, বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের বছর পূর্ণ হওয়ার পরেও?
লক ডাউন বা না লক ডাউন যখন লিখছি, নিঃশ্বাসে তখন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকা বাতাসের কম্পন। এখনও কিছু সরল ও গোঁড়া আদর্শবাদীরা বিশ্বাস করেন ক্ষুধা ও কর্মহীনতা বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করে - মন্দির বা মনুমেন্ট মানুষকে অন্ন দিতে পারে না।। রাম মন্দির লক্ষাধিক ক্ষুধার্ত হিন্দু আত্মার খাদ্য। ইতিমধ্যে লাঞ্ছিত মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ক্রমিক লাঞ্ছনা বিজয়ের রসনা আরো সুস্বাদু করে। রুটি কি তা দিতে পারে?
গত আগস্ট থেকে আজ অব্দি, এই ৩৬৫ দিন এখন ফিরে দেখাটা সহজ হবে - ভারতের কাশ্মীরের চূড়ান্ত অন্তর্ভূক্তি, CAA ও NRC বিল পাস ও রাম মন্দিরের শিলান্যাস – এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, এই সময়কালে মোদীর নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠেছে এক হিন্দুরাষ্ট্র, নতুন যুগের ভোর। এই আপাত ঘোষণার পিছনে আছে না-মেনে নেওয়া এক পরাজয়। এবং শুরুর ঔজ্জ্বল্যে সন্তুষ্ট অনাগত নিষ্পত্তি। মনে রাখা ভাল যে মোদীর জীবনের চেয়েও উজ্জ্বল উপস্থিতি ও বিজেপির লোকসভায় বিরাট জয় সত্ত্বেও ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ১৭.২% তাঁদের ভোট দিয়েছিলেন।
মনে হয়, চিনের বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের সতর্কতা নিয়ে এগোতে হবে। এক মুহূর্ত ভেবে দেখুন। মোদী এখন কেন রাম মন্দিরের ভূমিপূজা করতে গেলেন? এখন অন্তত দশেরা বা দিওয়ালি নয়, তারিখটিরও রামায়ণ বা হিন্দু ক্যালেন্ডারে কোন অস্তিত্ব নেই। ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই এখন আংশিক লক ডাউন, রামমন্দির ক্ষেত্র প্রস্তুত ও নিরাপত্তায় নিযুক্ত পুরোহিত ও পুলিশদের অনেকেই করোনাক্রান্ত। তা হলে এখন কেন? কাশ্মীরের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে? না ভারতের ক্ষতে মলম লাগাতে? দূরদর্শন অবশ্য আমাদের যা বলছে তাতে শুনছি এখন বর্ডার বা সীমানায় টেকটনিক (ভূত্বকীয়পাত) প্লেটের নড়াচড়া হবে, বড় বড় প্লেটগুলি বা ভূত্বকীয়পাতগুলি এখন নড়ছে। পৃথিবীর ধরন বদলে যাচ্ছে। মানুষকে এখন আর দাবিয়ে রাখা যাবে না, নিজে প্রভু না হয়েও প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রভুর মত আচরণ করা যায় না। এটা চিনা প্রবাদ নয় - সাধারণ জ্ঞান।
তা হলে কি এই আগস্টে বর্ষপূর্তি যা ভাবা হয়েছিল তা নয়? গৌরবের ক্রমবর্দ্ধমান চূড়ায় কি এই কলঙ্ক এঁটুলির মত লেগে থাকবে না?
কাশ্মীরের আকাশ নিয়ে যখন চিন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ চলে, আমরা, বাকিরা তখন যা করতে পারি তা হল কাশ্মীরের মানুষদের দিকে চোখ রাখা।
এক
গোটা ভারতের মানুষ গত কয়েক মাস ধরে ‘লক ডাউন’-এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আর কাশ্মীর এই বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করছে ২০১৯-এর ৫-আগস্ট থেকে। সেদিন থেকেই টানা ‘লক ডাউন’। তারই সঙ্গে চলছে Cordon and Search Operation (CASO) । ভারতীয় সেনারা একটা গোটা অঞ্চল ঘিরে ফেলে। তারপর চলে ঘরে ঘরে তল্লাসি। সেনারা যাকে খুশি তুলে নিয়ে যায়, মেয়েরা যৌন নিগ্রহের শিকার হন। সাদামাটা ভাবে এটাই Cordon and Search Operation-এর বৈশিষ্ট্য। কাশ্মীরের মানুষ এই অপারেশনের ভয়ঙ্করতা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।
২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে জুলাই-এর মধ্যে ১৮৯টি এই অপারেশন চলে। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা ঘটনার পর দক্ষিণ কাশ্মীরের জেলাগুলোতে CASO চালিয়ে কয়েকশ তরুণকে বেআইনি ভাবে আটক করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে এই অপারেশনের খবর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ৫ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর প্রথম পর্যন্ত উত্তর কাশ্মীরে বারমুলা জেলায় নিয়ন্ত্রণ রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৪০০ বার CASO চালানো হয়। গান্ডেরবাল জেলায় গাঙবাল অরণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত CASO চালানো হয়। অপারেশন চলাকালীন সামরিক বাহিনী চপারও ব্যবহার করে ।
২০১৯-এ জম্মু-কাশ্মীরে আশি জন সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে উনিশ জন সশস্ত্র বাহিনীর হাতে মারা গেছেন। নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারত-পাকিস্তান সৈন্যদের গুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে সতেরো জন প্রাণ দিয়েছেন। অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা তেত্রিশ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। (সশস্ত্র অবস্থায় মারা গিয়েছেন ছয় জন।) বিস্ফোরণের ফলে তিন জনের মৃত্যু ঘটেছে। পাথরের আঘাতে এক জন এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর বন্দুকের লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে এক জন প্রাণ দিয়েছেন। এই আশি জনের মধ্যে বারো জন মহিলা। এদের অধিকাংশই মারা গেছেন নিয়ন্ত্রণ রেখা অঞ্চলে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে। শিশু মৃত্যুর সংখ্যা আট।
২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ২৫ জন রাজনৈতিক কর্মীকে জন নিরাপত্তা আইনে (PSA) আটক করা হয়। বছরের শুরুতে জামাত-ই-ইসলামি ও জে-কে-এল-এফ’কে ভারত সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী অবন্তীপুরা, পামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে তল্লাসি চালিয়ে ২ জন নাবালক সহ ৩৫ জনকে আটক করে। ৫ আগস্টের পর গোটা উপত্যকা জুড়ে কয়েক হাজার মানুষকে আটক করা হয়। বিজেপির মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি ৫ ডিসেম্বর সংসদে এক বিবৃতিতে বলেন, এই বন্দীদের মধ্যে ২৩৪ জনকে উত্তরপ্রদেশ ও ২৭ জনকে হরিয়ানা জেলে রাখা হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর এলাহাবাদের নৈনি সেন্ট্রাল জেলে জামাত-ই-ইসলামির একজন কর্মী মারা যান। জেলে কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়, অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ থাকাকালীন তার পরিবারের লোকজনদের এই বিষয়ে জানানো হয়নি। মৃত্যুর পরই তার পরিবারের লোকজনদের খবর দেওয়া হয়।
কুলগাম জেলার মতিবাগ গ্রামের বাসিন্দা পারভেজ আহমদ পালা। বয়স ৩৩। গত পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছেন। ৬ আগস্ট রাতে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে PSA-তে আটক করা হয়। বর্তমানে তিনি উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে জেলবন্দী। আত্মীয়-স্বজন ওষুধ ও জামাকাপড় নিয়ে জেলে তার সাথে দেখা করতে গেলে দেখা করার অনুমতি পাননি। আর্থিক অনটনে তার পরিবারের পক্ষে আবার কাশ্মীর থেকে উত্তরপ্রদেশে যাওয়া সম্ভব নয়।
শ্রীনগরের ২৭ বছর বয়সী এক যুবককে PSA-তে আটক করে সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়েছে। ২০১৫-তে তার বাম চোখ পেলেটের আঘাতে শতকরা আশি ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে PSA-তে আগ্রা ডিস্ট্রিক্ট জেলে আটক রাখা হয়েছে। শারীরিক ভাবে অক্ষম বা ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও PSA প্রয়োগ করা হয়। সংসদে সরকারের বিবৃতি অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর ৫১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশকেই সি-আর-পি-সি’র ১০৭ ও ১৫১ ধারায় আটক রাখা হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে আটক করে কয়েকদিন পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। বেআইনি ভাবে তাদের কয়েকদিন আটক রাখা হয়।
১৯৯০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে কাশ্মীরে ৮০০০-এর বেশি মানুষ নিখোঁজ। ভারত সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, এরা প্রত্যেকেই পাক-কাশ্মীরে চলে গেছেন এবং সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এই ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অনেকেরই মৃতদেহ পরবর্তীতে তাদের বাসস্থানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পাওয়া গেছে। ভারত সরকার ২০০৭ সালে International Convention for Protection of All Persons from Disappearance-এ সই করেছে। কিন্তু এখনও অনুমোদন (ratify) দেয়নি। রাজ্য মানব অধিকার কমিশনের কাছে বানিহাল ও ব্রাসবান থেকে ১৩২ জনের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১২৯ জন ‘নিখোঁজ’ ও ৩ জন বেঁচে আছেন। বারামুল্লা থেকে ৩৬৯ জন ও বান্দিপোরা থেকে ১৩৮ জনের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ কমিশনে দায়ের করা হয়। সরকার ১৮৬ জনের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেছে। রাষ্ট্রসংঘের Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances-এর পক্ষ থেকে ভারতে আসতে চাইলে ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি।
জম্মু-কাশ্মীরের সাতটা জেলায় - বারামুল্লা, বান্দিপোরা, কুপওয়ারা, পুঞ্চ, রাজৌরি, শ্রীনগর ও বাদগামে ৭০০০-এরও বেশি গণকবর পাওয়া গেছে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে - Facts Underground and Buried Evidence। ২০১১-এর এপ্রিল এক বিবৃতিতে ২৭৩০টি গণকবরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। কমিশন মৃতদেহগুলোর ফরেন্সিক পরীক্ষা ও ডি-এন-এ পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করে। একটা তদন্ত কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করে। সরকার কোন সুপারিশই কার্যকর করেনি।
২০১৭-তে পুঞ্চ জেলায় ২৭১৭ ও রাজৌরি জেলায় ১৭২৭টি গণকবর পাওয়া যায়। দুই জেলারই ডেপুটি কমিশনাররা স্বীকার করেন যে, ২০৮০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কবর উদ্ধার হয়েছে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ডি-এন-এ পরীক্ষা, কার্বন ডেটিং ও অন্যান্য ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করে। সরকার এবারও কমিশনের সুপারিশে কর্ণপাত করেনি।
৫ আগস্টের (২০১৯) পর সরকার কাশ্মীরে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। ১২ নভেম্বর শ্রীনগর থেকে বারামুল্লা ও ১৭ নভেম্বর শ্রীনগর থেকে বানিহাল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এর আগে ২০১৬-তে ১৩৫ দিন, ২০১৭-তে ২৫ দিন ও ২০১৮-তে ৯২ দিন ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।
১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা ঘটনার পর সামরিক কনভয় যাওয়ার সময় রাস্তা দিয়ে অসামরিক যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২ এপ্রিল একটা স্কুলবাসকে সামরিক কনভয় যাওয়ার সময় আটকে দেওয়া হয়। বাসের ছাত্র-ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়। ৩ এপ্রিল এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে রবিবার ও বুধবার, বারামুল্লা থেকে উধমপুর পর্যন্ত জাতীয় সড়ক দিয়ে সামরিক বাহিনীর কনভয় যাবে। ভোর ৪টে থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অসামরিক যানবাহন জাতীয় সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। এই ব্যবস্থা ৩১ মে পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামা মসজিদ লকডাউন করে দেওয়া হয়। ঈদের দিনে বিভিন্ন মসজিদে বড় সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টের পর কাশ্মীরের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে বাড়ি বাড়ি তল্লাসি চলে। এই তল্লাসি চলাকালীন বাসিন্দাদের মারধোর, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, জিনিসপত্র লুটপাটও চলতে থাকে। এমনকি কুঠার, কোদাল, হাতুড়ি এই সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। খাদ্যসামগ্রী মাটিতে ফেলে দিয়ে যায়।
দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার পরিগাম অঞ্চলে ১২ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে রাস্তায় নগ্ন অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখে। এদের যৌনাঙ্গে শক দেওয়া হয়। তারপর উপুড় অবস্থায় একজনের ওপর একজন এইভাবে বারোজনকে একসাথে শুইয়ে রাখা হয়। তল্লাসি চলাকালীন মেয়েরা বাড়ির মধ্যেই সশস্ত্র বাহিনীর হাতে যৌন হেনস্তার শিকার হন।
২০১০ থেকে কাশ্মীরে পেলেটগান চলছে। ১১ এপ্রিল ১৩ বছর বয়সী ওয়াইস আহমদমীর পেলেটগানের আঘাতে মারা যায়। ১৫ নভেম্বর আহমদ দারের মৃত্যু হয় পেলেটগানের আঘাতে। ৬ আগস্ট আসারার আহমদ খান বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলার সময় পেলেটগানে আহত হন। ৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। সি আর পি নির্বিচারে টিয়ার গ্যাস ও পেপার গ্যাস ব্যবহার করে। এর ফলে মানুষের মৃত্যু ঘটে। ৯ আগস্ট ৩৪ বছর বয়সী দুই শিশু সন্তানের মা ফেহমিদা, ১৭ আগস্ট ৫৭ বছর বয়সী মহম্মদ আয়ুব খান ও ২২ আগস্ট ৬৫ বছর বয়সী আব্দুল গফ্ফর ওয়ানি (১৯ আগস্ট আক্রান্ত হন) সি আর পি-র আক্রমণে মারা যান।
পেলেটগানের আঘাতে অনেকে চোখ হারিয়েছেন। ১৪ বছর বয়সী আসিফ আহমদ প্যারীর একটা চোখ বাদ দিতে হয়েছে। আসিফ ২০ মে পেলেটগানে আহত হয়। সোহান জিৎ নামে এক বিহারী শ্রমিক পেলেটগানে আহত হয়ে দুটি চোখই হারিয়েছেন। সেপ্টেম্বরের ১ থেকে ১০ তারিখ জাদিবালে মহরমের বিভিন্ন মিছিলে পেলেটগান ও টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয়। এতে ১০০র বেশি লোক আহত হন। ৯ আগস্ট, ৩ অক্টোবর ও ১৫ অক্টোবর ৩ জন পেলেটগানে আহত হন। জুন মাস থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী Long Range Acoustic Device (শব্দ কামান) ব্যবহার করছে। এই কামানের শব্দে কানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়।
ভারতীয় সেনারা যখন তখন যে কোন ব্যক্তিকে তাদের শিবিরে ডেকে পাঠায়। তারপর সেই ব্যক্তির ওপর চলে অত্যাচার। এটা কাশ্মীরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ৫ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার তৌসিফ আহমদকে ৪৪ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর শিবিরে ডেকে পাঠানো হয়। শিবিরে তাকে নগ্ন করে পেটানো হয় এবং পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। মহম্মদ ইশাক লোন’কে নাগিশরণ-এ ৩৪ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এ ডেকে পাঠিয়ে নগ্ন করে পেটানো হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শোপিয়ানে তল্লাসি চালাবার সময় ইমাম মুফতি সিরাজ ও তার শ্বশুর মহম্মদ আসানকে ভারতীয় সেনারা তুলে নিয়ে আসে। সেনাদের অত্যাচারের ফলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
১৯ মার্চ বান্দিপোরার একজন শিক্ষক রিজওয়ান আসাদ পণ্ডিত (২৯) জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের Special Operation Group-এর শিবিরে অত্যাচারের ফলে মারা যান। শ্রীনগরের এই শিবিরটার নাম Air Cargo SOG Camp। এই শিবির থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসাটা এক অভাবনীয় ঘটনা। কুপওয়ারা জেলার বান্দি নন্দপোরার বাসিন্দা রিয়াজ আহমদ তিকরে (৩০) ৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতে মারা যান। পুলিশের দাবি ছিল রিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। রিয়াজের পরিবারের লোকজন এটা মেনে নেননি। ৭ তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোন তদন্তের খবর জানা যায়নি। ২৬ মে বাদগাম জেলার বাসিন্দা ১৪ বছর বয়সী ফাজিল আহমদ মালিককে ২ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর দাহারমুনা শিবিরে লোহার রড ও বন্দুকের বাট দিয়ে পেটানো হয়। হাসপাতালে চিকিৎসার পর মালিক এখন সুস্থ। ১১ আগস্ট শোপিয়ান জেলার বাসিন্দা বসির আহমদ দার ও আরও দুজন ব্যক্তিকে ৪৪ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস-এর চিলিপোরা শিবিরে অত্যাচার চালানোর সময় লাউড স্পিকারে তাদের চিৎকার শিবিরের আশেপাশের লোকজনদের শোনানো হয়। ৩ ডিসেম্বর পুলওয়ামাতে বিমানবাহিনীর ঘাঁটির কাছে ঘোরাঘুরি করার অভিযোগে বসির আহমদ গনি নামে এক মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিকে ভারতীয় সেনারা গুলি করে। গুলিতে তিনি আহত হন।
৫ আগস্টের পর ১৪ জন বহিরাগত শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। ১১ জন অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান, ২ জন গ্রেনেড বিস্ফোরণে ও ১ জন গুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়ে মারা যান। কোন সশস্ত্র গোষ্ঠী এই হত্যার দায় নেয়নি বা হত্যার দায় স্বীকার করেনি।
জম্মু-কাশ্মীরে এখন ৭,০০,০০০ ভারতীয় সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সেনা (CRPS, BSF, SSB, ও ITBP) অবস্থান করছে। ৫৬৬১৫.৫৪ একর জমি ভারতীয় প্রতিরক্ষা দপ্তর দখল করে আছে। ১৬ মে জম্মু-কাশ্মীরের Horticulture Produce Marketing Corporation-এর ৭.৫ একর জমি ৪০ বছরের জন্য সি আর পি-কে ইজারা দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা ৯৯ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
Jammu Kashmir Coalition of Civil Society ও Association of Parents of Disappeared Persons - জম্মু-কাশ্মীরের এই দুটি সংগঠন যৌথভাবে প্রকাশ করে (৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯) Annual Review of Human Rights Situations in Indian Administered Jammu and Kashmir। ১০০ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে ৬৩৫ জনের নামের একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে, যাদের ৫ আগস্টের পর জম্মু-কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইন, ১৯৭৮-এ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দুই
কাশ্মীরে লক ডাউনের বর্ষপূর্তি
কেমন কাটল এই এক বছর কাশ্মীরিদের! কাশ্মীরের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে The Forum for Human Rights in Jammu Kashmir-এর প্রকাশিত রিপোর্টে – Jammu and Kashmir/ The Impact on Lockdowns on Human Rights/ August 2019 – July 2020।
২০১৯-এর ৫ আগস্টের আগেই কার্ফু, হরতাল, এলাকা জুড়ে সামরিক বাহিনীর তল্লাসি – এই সমস্ত কিছুই কাশ্মীরিদের জীবন-যাপনের অঙ্গ ছিল। কিন্তু ৩৭০ ও ৩৫ক ধারা বাতিলের পর তারা যে জীবনের মুখোমুখি হলেন, তা তাদের হতভম্ব করে দেয়। জম্মু-কাশ্মীর জুড়ে সার্বিক লক ডাউন। মানুষের জীবন যাপনে এক অচলাবস্থা দেখা দিল। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ কারারুদ্ধ হলেন। মানুষকে শুধু গৃহবন্দী করে রাখা নয়, তারা যাতে ফোনে কথা না বলতে পারেন, সেজন্য সমস্ত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও অচল করে দেওয়া হ’ল। দোকান-বাজার বন্ধ, সমস্ত কর্মস্থল বন্ধ, শিল্প-বাণিজ্য বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ। শুধু বন্ধ নেই, রাজপথ জুড়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ।
বছরের শেষদিকে সাবেকি টেলিফোন (Landline) চালু হলেও মুঠোফোন পরিষেবা (২জি-তে সীমিত) চালু হয় ২০২০-র জানুয়ারিতে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে। এই বছর মে মাসে সুপ্রীম কোর্ট জম্মু-কাশ্মীর সরকারকে নির্দেশ দেয় যে, ৪জি পরিষেবা আবার চালু করা যায় কিনা, খতিয়ে দেখতে একটা বিশেষ কমিটি তৈরি করতে হবে। সরকার একটা কমিটি তৈরি করে। সরকারের লোকজনেরাই সেই কমিটির সদস্য। এই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত ২জি পরিষেবাই চালু আছে।
ভারত রাষ্ট্র কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে কোনদিনই আন্তরিকভাবে আগ্রহী নয়। বরাবরই সামরিক শক্তির সাহায্যে নৃশংসভাবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘোলাজলে মাছ ধরার অভিযোগ এনেছে। এর মধ্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও ভারত সরকারের নীতি কাশ্মীরি জনসাধারণ বিশেষত যুব সম্প্রদায়কে ভারত বিদ্বেষী করে তুলেছে। ২০১৯-এ কাশ্মীরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর ১৫২ জন সদস্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ১২০ জনই স্থানীয় বাসিন্দা।
দীর্ঘস্থায়ী লক ডাউন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক, সংবাদ মাধ্যম ও ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ যুব সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরিরা সামরিক বাহিনীর তল্লাশির মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০২০-র জুনের গোড়া থেকে মধ্য-জুলাই পর্যন্ত ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যেকদিন এলাকা ঘিরে তল্লাশি (Cordon and Search Operation) চালিয়েছে। এই মাত্রাহীন তল্লাশি কাশ্মীরিদের যন্ত্রণা ও কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০১৯-এর ৪ আগস্টের পর ব্যাপক মানুষকে আটক করা হয়। পরে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০২০-এর মার্চ পর্যন্ত ৪৩৭ জন আটক আছেন। এর মধ্যে ৩৮৯ জন জননিরাপত্তা আইনে (১৯৭৮) আটক আছেন। জননিরাপত্তা আইনে কোন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে দুই বছর পর্যন্ত আটক করে রাখা যায়। জম্মু কাশ্মীর বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিয়া আব্দুল কায়ুম জননিরাপত্তা আইনে বন্দী আছেন। গত মে মাসে জম্মু কাশ্মীর হাইকোর্টের এক ডিভিশন বেঞ্চ তার জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয়। ২০১৯-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৪ জন নাবালককে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৭৫ জনকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়েছে।
২০১৯-এর ৪ আগস্ট লক ডাউনের সাথে সাথে ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়। এই ১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে একটা মামলা দায়ের করা হয়। ২০২০-এর ১০ জানুয়ারী সুপ্রীম কোর্ট তার রায়ে জানায় নির্বিচারে ১৪৪ ধারা জারি করাটা গ্রহণযোগ্য নয়।
২০১৯-এর ১৫ অক্টোবর ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখানোর সময় ১৩ জন মহিলাকে আটক করা হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শান্তি বিঘ্নিত করছিলেন, এই অভিযোগে তাদের প্রত্যেককে ১০,০০০ টাকার ব্যক্তিগত বন্ড ও ৪০,০০০ টাকার জামিনে ৩০ ঘণ্টার পর ছাড়া পান। তাদের এই মুচলেকাও দিতে হয় যে, ভবিষ্যতে তারা কখনও শান্তি ভঙ্গ করবেন না।
১৯ মে ২০২০, শ্রীনগরের নবকাদাল অঞ্চলের একটা বাড়ি সেনা বাহিনী বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দেয়। তাদের অভিযোগ ওই বাড়িতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৫ জন সাধারণ মানুষ ওই বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে ৩ জন পরে হাসপাতালে মারা যান। ১৩ মে একটা চেক পয়েন্টে গাড়ি না থামিয়ে চলে যাবার জন্য পরের চেক পয়েন্টে ২৫ বছর বয়সী পীর মেহরাজুদ্দিন সি-আর-পি’র গুলিতে প্রাণ হারান। গাড়িতে তার সাথে ছিলেন তার কাকা গুলাম শাহ, যিনি জম্মু কাশ্মীর পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাবইন্সপেকটর। ৬ মে ৩২ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর ইউসুফ ওয়ানি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে বুলেটে আঘাতে মারা যান।
রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবের রিপোর্টে (১৫ জুন, ২০২০) বলা হয়েছে, ৮ জন শিশু বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে ও ৭ জন পঙ্গু হয়ে গেছে, এদের বয়স ১ থেকে ১৭’র মধ্যে। এই ১৫ জনের ১০ জন আহত বা নিহত হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। ৩ জন নিয়ন্ত্রণ রেখার দুপাশে গুলি বিনিময়ের মাঝে পড়ে গিয়ে, ১ জন লস্কর-ই-তৈবার গুলিতে ও বাকি ১ জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির গুলিতে। ২০২০-র ৪ থেকে ৬ মে অবন্তীপুরাতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও হিজবুল মুজাহিদিনের মধ্যে ৪২ ঘণ্টা ধরে বন্দুকের লড়াই চলে। সশস্ত্র বাহিনী ১৮টা বাড়ি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা স্থানীয় যুবকদের বিস্ফোরক বসাতে বাধ্য করে। তাদের সামনে রেখেই সশস্ত্র বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে ঢোকে।
৭ আগস্ট, ২০১৯ অনাবাসী কাশ্মীরি ব্যবসায়ী মুবিন শাহের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। কারণ তিনি যেসব অকাশ্মীরি মানুষ, সরকার প্রদত্ত ডোমিসাইল সার্টিফিকেটে কাশ্মীরে জমি কিনতে চাইবে তাদের বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন।
সোশাল মিডিয়ায় আরিফা জানের কাহিনী পোস্ট করার জন্য চিত্র-সাংবাদিক মাথরাট জারাকে ১৮ এপ্রিল ২০২০-তে ইউ-এ-পি-এ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরিফার স্বামী ২০০০ সালে আরিফার সামনেই ভারতীয় সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। আরিফা এখনও গুলির শব্দ শুনতে পান। একটা আতঙ্ক তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়।
সি-এ-এ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে কাশ্মীরি ছাত্রী সাফুরা জারগারকে ২০ এপ্রিল ইউ-এ-পি-এ’তে গ্রেপ্তার করা হয়। জারগার গর্ভবতী থাকায় দিল্লি হাইকোর্ট ১৯ জুন তার জামিন মঞ্জুর করে।
৩ জুন ডঃ মুজফ্ফর জান্নিজের গাড়িতে করে হাসপাতালে যাবার পথে সি-আর-পি’র হাতে নিগৃহীত হন। ২৩ মে ডঃ সৈয়দ মকবুল শ্রীনগরে পুলিশের হাতে নিহত হন। জম্মু কাশ্মীরের চিকিৎসকেরা এখন সরকারি গাড়িতে হাসপাতালে যান।
২০১৯-এর আগস্টে লক ডাউনের পর অবসাদ আর উদ্বেগ সাধারণ মানুষকে গ্রাস করতে থাকে। প্রত্যেকেই নিজের জীবিকা ও শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। Kashmir Chamber of Commerce and Industry (KCCI) এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-এর আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ৪,৯৭,০০০ জন। শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১৭,৮৭৮.১৮ কোটি টাকা। ২০২০’র জানুয়ারি থেকে জুলাই-এর মধ্যে শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ২২,০০০ কোটি টাকা। ২০১৯-এর আগস্ট থেকে ২০২০’র জুলাই এই এক বছরে শিল্পে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা। কৃষি, ফলচাষ, নির্মাণ শিল্প, হস্তশিল্প, পরিবহণ, পর্যটন – সমস্ত ক্ষেত্রেই সংকট দেখা দিয়েছে। এক বছর ধরে চলা লক ডাউনের (করোনার জন্য লক ডাউন সহ) পাশাপাশি অকাশ্মীরিদের অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ায় কাশ্মীরিদের শিল্প ব্যবসা আরও সংকটের সম্মুখীন। কাশ্মীর থেকে গোটা ভারতে আপেল রপ্তানি করা হয়। কিন্তু যান চলাচলের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় আপেল রপ্তানি করা যায়নি। পর্যটন শিল্প ধাক্কা খায়। শিল্পের সাথে জড়িত কর্মীরা কাজ হারিয়েছেন। পর্যটক না আসায় হস্তশিল্পও চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। KCCI-এর তথ্য অনুযায়ী ট্রাক পরিবহণ ও যাত্রিবাহী বাস পরিবহণ বন্ধ থাকায় ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর এই ৫ মাসে ২২৬৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
লক ডাউনের শিকার সংবাদ মাধ্যমও। আগস্টে লক ডাউন জারি হওয়ায় প্রথম ২ মাস কোনও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি, অনলাইনেও নয়। পরে সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে সরকার বিরোধী কোনও লেখা ছাপা হয় না। কয়েকজন সাংবাদিক চাকরিও হারান। সাংবাদিকদের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
ভারতে এখন আনলক পর্ব চলছে। কাশ্মীরে ২০১৯-এর ৪ আগস্ট যে লক ডাউন জারি হয়েছিল, তার অবসান কবে হবে সে সম্পর্কে ভারত সরকার নীরব। কাশ্মীরে সামরিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অব্যাহত। লক ডাউন জারি করে, মানুষকে গৃহবন্দী করে এই প্রতিরোধ আন্দোলন দমন করা যায়নি। ২২ আগস্টের আনন্দবাজার পত্রিকা লিখছে, ‘এক বছরের বেশি কেটে যাওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের নথিই বলছে, আদৌ সব ঠিক নেই কাশ্মীরে। যতই উপত্যকার ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার কথা বলা হোক, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মারা পড়ুক জঙ্গিরা – সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ানো তরুণের সংখ্যা আদৌ কমছে না উপত্যকায়। কেন্দ্রের খাতাই বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশে অন্তত ৯০ জন তরুণ বিভিন্ন জঙ্গি দলে নাম লিখিয়েছে। বাস্তব সংখ্যাটা তার বেশি হওয়ার সম্ভবনাই বেশি, সরকারি কর্তারাই তা মানছেন। নিরাপত্তা বাহিনীকেও এটা উদ্বেগে রেখেছে।
‘আগে পাক জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও তাদের নাশকতার কথা বলা হত। নর্থ ব্লকের এক কর্তাই জানাচ্ছেন, এমনিই দেখা যাচ্ছে, সংঘর্ষে যেসব জঙ্গি মারা পড়ছে তাদের বেশির ভাগই স্থানীয়। ২০২০’র প্রথম ৭ মাসে নিহত ১৩১ জঙ্গির মধ্যে ১২১ জনই ছিল স্থানীয়। বিদেশি মাত্র ১৫ জন। ২০১৯-এ নিহত ১৫২ জন জঙ্গির মধ্যে ১১৯ জনই ছিল কাশ্মীরের।’