সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
শক্ত হাট্টাকাট্টা মানুষটা তিন মাসে কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে গেল। ধনঞ্জয়ের চোখগুলো পর্যন্ত বসে যাওয়া গালের পিছনের কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে। চোখ বুজলেই ও দেখে বাতাসে ভারী ধুলো ভাসছে, চারপাশে বুড়ো কুকুরের পিঠের ঘায়ের মতো গোলাপি ধুসর এবড়ো খেবড়ো পাথর খাদানের গর্ত থেকে পোকার মতো সাদা সাদা ধুলো মাখা মানুষ বেরিয়ে আসছে। ঘড় ঘড় করে বিশ্রী আওয়াজে বড় বড় দানোর মতো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক দল ক্রাশার বড় বড় পাথর চিবিয়ে ছোট করছে। কখনো শুনতে পায় ঘরের ভিতর কেউ হাপরের মতো শোঁ শোঁ আওয়াজে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে মঝে মাঝে ঘং ঘং কাশির আওয়াজ। ভয়ে ও ঘুম থেকে উঠে বসে।
গোলাপি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, পুরুলিয়ার বড় ডাক্তারও অনেক পরীক্ষা করে দেখেছে কোন রোগ নাই অথচ এমন শক্ত মানুষ ঘরে বসে বসে শুকিয়ে যাচ্ছে। যে লোকটা মাঠ আর চাষ ছাড়া কিছু জানত না আজকাল সে মাঠে যেতে পর্যন্ত চায় না। পাশের বাড়ির কানু যে ধনঞ্জয়ের ভরসায় চাষ করত সে পর্যন্ত সেদিন নিজে এসে ওকে ডাকল, বলল- এবার তো সর্ষে ফেলার সময় হয়েছে চল ধনঞ্জয় দুজনে সর্ষেটা লাগিয়ে আসি, ধনঞ্জয় বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল – না আমি এবার আর সর্ষে দেবো না। ইচ্ছা করছে না।
গোপালির কানে একথা যেতেই সে ভিতর থেকে রেগে দৌড়ে এসে বলল –তাহলে তুমি কি করবে? চুপ মেরে বসে থাকবে? কি হয়েছে কি তোমার? তোমার এমন মরন ক্যানে?
ধনঞ্জয় শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গোপালির দিকে।
২
রাস্তার ধারের উঁচু পাথুরে ডাঙা জমিটার নীচে বড় ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটার পর থেকে বড় ধান জমিটা হঠাৎ শুরু হয়েছে, চারিদিকে এক অদ্ভুত শান্তি। গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে, সকালের হাওয়ায় ধনঞ্জয় মাঠের কচি সবুজ ধান গাছগুলোর দোলা দেখতে দেখতে ভাবছিল, বছর চারেক আগেও এই টাঁড় জমিটার কি হাল ছিল? জমিটাকে ঠিক করতে কটা বছর ওকে কি খাটনিই না খাটতে হয়েছে! তার শ্বশুর দিনু মানকি কোনদিন ভাবেনি তার পাথুরে ডাঙার ধারের এই পতিত টাঁড় জমিতে কোনদিন ধান হবে।
হঠাৎই সকালের শান্ত নির্জনতাকে খান খান করে কর্কশ ঘড়ঘড় আওয়াজে রাস্তার উপর ধুলো উড়িয়ে বড় কালো গাড়িটা এসে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে দেখতে ও ভাবল গাঁয়ে কোথাও শান্তিতে বসার জো নেই। বছর পাঁচেক ধরে ও দেখছে বান্ধাডিহ আর আশপাশের গ্রামে গাড়ি আর মোটর সাইকেলের দৌরাত্মে টেঁকা দায়। ভাবে বছর দশ আগেও গাঁয়ে সবার বাড়িতে সাইকেলও ছিল না।
গাড়ি থেকে জনা তিনেক ছেলের সঙ্গে নামল চোখে কালো চশমা পড়া ওর বয়েসী একটা লোক। কালো লোকটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, পড়নে তার সাদা প্যান্ট আর বুকের বোতাম খোলা লাল সবুজ জামার ভিতর দুর থেকে ধনঞ্জয় মোটা সোনার হারটা দেখতে পেল। তিনটে মস্তানের মতো ছেলে ওর দিকে কিছুটা হেঁটে এসে ওকে হাত নেড়ে ডাকল, ও লুঙ্গিটা হাতে ধরে হাঁটা দিল ওদের কছে এলে, একটা ছেলে ওকে বলল- এই ডাঙ্গা জমিটা কার বটে?
ও বুঝল বয়েসে ওর থেকে ছোট এই ছেলেগুলো সব আদিবাসী ছেলে, এরকম আদিবাসী ছেলে দেখলেই ওর এখন রাগ হয়। ও একটু ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করল- ক্যানে?
একটা ছেলে একটু খেঁকিয়ে ওঠে– তাতে তোমার কি? জমিটা কার বটে?
ধনঞ্জয় একটু রেগে বলে- জমিটা আমার বটে, ক্যানে?
ডাঙ্গাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা ওদিকে একটা সিগারেট বার করে ধরাল। এই এক হয়েছে, আদিবাসীর ব্যাটা সব সাহেব হ্যইছে। সাহেব না দালাল।
-ইদিকে এসো, দাদা, তোমার লগে কথা কইবে।
ও রেগে বলে ওঠে-কি কথা বলো না।
ওদিক থেকে আওয়াজ এলো – কি বলছে রে? খবর পেলিক?
-এই মালিক বটে।
ওকে নিয়ে ছেলেগুলো দাদার দিকে এগোয়।
লোকটা বলে- কি নাম?
ধনঞ্জয়ের চোয়াল শক্ত হয়, বলে- ধনঞ্জয় মুড়া।
-বান্ধাডিহ বাড়ি? সে মাথা নেড়ে বলে –হাঁ।
লোকটা মুখটা ওর কাছে নিয়ে এসে বলে- জমিটা বেচবে?
ভালো দাম পাবেক।
ধনঞ্জয় বলে কোন জমিটা বটে?
লোকটা আঙ্গুল তুলে বড় পাথুরে ডাঙ্গা জমিটা দেখায়। ধনঞ্জয়
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে –তোমারা কারা? কোথা হতে আসছ বটে?
ছেলেগুলো বলে দাদা বান্দোয়ানের মা দুর্গা ক্রাশার কোম্পানির
মালিক। ধনঞ্জয়ের বুক ছ্যাঁত করে ওঠে, ও বুঝে গেছে, পাথর খাদানের লোক। সে জানে এই ডাঙ্গার সিকি ভাগ কানুদের, তবু গম্ভীর গলায় বলে ওঠে এ জমি বিক্রি নেই।
লোকটা চোখ নাচিয়ে বলে ওঠে এই পতিত পাথুরে ডাঙ্গা জমির অনেক দাম পাবে।
ও শক্ত স্বরে বলে – শোন নাই নাকি, এ জমি বিক্রি নাই বটে,
বলে ওদের মুখের উপর হাঁটা দেয়। লোকটা ভ্রু কুঁচকে ওকে একটু দেখে গাড়িতে উঠতে উঠেতে বলে। লোকটা কে বটে?
একটা ছোঁড়া বলে- ইটা বান্ধাডিহর দিনু মানকির ঘরজামাই গো
দাদা। ধুলো উড়িয়ে কালো গাড়িটা হুশ করে চলে যায়।
ধনঞ্জয় ভাবে আপদ গেছে তবে কানুকে নিয়েই যা একটু ভয়,
ও খবর পেলে হয়ত লোভে পরে ওর ভাগটা বেচে দেবে। ও চিন্তিত মুখে ভাবতে ভাবতে ও ফেরার পথ ধরে। ঝোড়ার ধারের কানুর ধান জমিতে জল নেই দেখে, ও দাঁড়াল। কানুটার এতো ভালো জমি অথচ দিন রাত হাঁড়িয়া খেয়ে পরে আছে, মাঠের দিকে হাঁটেই না। হঠাৎ ওর চোখ পরে আলের পাশের ধান গাছের পোকাটার দিকে, সব্বোনাশ মাজরা পোকা লেগেছে, কানুকে খবর দিতে হবে। একবার গাছের ভিতরের মাজায় চলে গেলে দাঁড়ানো ধানগাছ শেষে, একেবারে মাঝের থেকে খেয়ে গাছটার মাজা ভেঙ্গে দেয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফলন্ত গাছ শুকিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি এর বিহিত না করলে সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়বে।
৩
একটু পর মনটা একটু হালকা হতেই লতিকার মুখটা মনে পড়ে গেল, মেয়েটা বড় হচ্ছে এবার ক্লাস নাইনে উঠবে। একটাই মেয়ে, গোপালিতো মেয়ে বলতে পাগল, বাবুদের মেয়েদের মত সে মেয়েকে বাড়ির কোন কাজ করতে দেয় না, সে কেবল পড়াশোনা করে, ধনঞ্জয়ও খুশী। আদিবাসী মেয়ে বাড়ির কাজ না করে পড়ছে এমন এ তল্লাটে কটা আছে? প্রথম ছেলে মারা যাবে বছর তিন পর লতিকা হয়। তার স্বপ্ন মেয়ে বড় হয়ে ইস্কুলের দিদিমনি হবে, তার কাছেই থাকবে আর সেও একটা খাটিয়ে চাষিঘর মুন্ডা ছেলে দেখে বিয়া দিবে। কত খেটে আজ ও এখানে এসেছে, ওর বাপ মা মরেছে কোন ছোটবেলায়। মামার বাড়ীতে মানুষ, তাই মেয়েকে ছাড়ার কথা ও ভাবতে পারে না।
পনের বছর আগে দিনু যখন গোপালির সাথে বিয়ে দিয়ে ওকে
নিয়ে আসে তখন গ্রামের সবাই ঘর জামাই বলে পিছনে হাসত, পাহাড়িটোলার রতনকে নিয়েও কানাঘুষো ও শুনেছে। এখনো ঈর্ষায় আড়ালে আবডালে ওকে নিয়ে নানা কথা হয়। তবে সেদিনও গাঁয়ের লোকের কথা গায়ে মাখে নি আর আজ তো ওর গোলা ভরা ধান, কেন্দু পাতার ব্যবসা, এখন সবাই ওকে সমীহ করে।
আজকাল রাত পর্যন্ত গোপালির আর মেয়ের অনেক টিভি
দেখার বাতিক হয়েছে দেখে ধনঞ্জয় একটু বিরক্ত হয়। দুজনেই আর আগের আগের মতো আর সকালে উঠতে পারে না। গোপালি তখন মেয়েকে ইস্কুলে পাঠিয়ে গোয়ালের গরু কটাকে বাইরের সজনে গাছ তলায় বাঁধতে গিয়ে দেখল পাশের বাড়ির মালতি কঠিন মুখে হাঁসগুলোকে বাসী পান্তা দিচ্ছে।
ও জিজ্ঞাসা করে- কিরে কানু ফিরেছে?
মালতি বিরক্ত স্বরে বলে- সারাদিন হাঁড়িয়া খাচ্ছে আর
ঘুমুচ্ছে, এদিকে বাড়িতে আনাজ নাই, চাল, ডাল নাই, ছেলে মেয়েগুলোর মুখে কি যে দেবো? বলে গজ গজ করতে করতে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
আগে মালতি আর গোপালি খুব বন্ধু ছিল, কিন্তু এখন দুজনের
আর তত ভাব নাই। গোপালির মনে পরে ধরণী মুড়া আর ওর বাপ দিনু মানকি খুব বন্ধু ছিল। সেই সময় কানুদের কি অবস্থা খুব ভালো ছিল! কুড়ি বিঘে ঝোরার ধারের ধানের জমি, বাড়িতে তিনটে হাল, গাই,বলদ, ছাগল, ধানের গোলা, জমজমাট অবস্থা। সেই সময় বরং ওদের অবস্থা তত ভালো ছিল না, বিঘে বারো জমির অনেকটাই ট্যাঁড় ডাঙ্গা জমি, দিনু চাষবাস করত কিন্তু যতটা না করলে নয় ততটা।
ওর বাবা দিনু আর তার বৌও মারা গেছে বছর পাঁচেক হলো। দিনু খুব ভালো মানুষ ছিল, গাঁয়ের সবাই খুব মানত, ভালো বাঁশি বাজাত, জঙ্গলের অনেক জড়ি বুটি চিনত, গাঁয়ের লোকের নানা রোগ সারাত সে, জঙ্গলের জড়ি বুটি দিয়ে হাঁড়িয়া বানাত, সেই হাঁড়িয়ার জন্য এদিককার লোকে সব পাগল ছিল। চার ছেলেমেয়ে মারা যাবার পর গোপালি হয়, লতিকার মতো সেও বাপ মায়ের খুব আদরের মেয়ে ছিল। দিনু ওকে বান্দোয়ানের কাছে চিরকুন্দায় ওর মামার বাড়ির গ্রামে পাঠিয়ে দেয় ইস্কুলে ভর্তি করার জন্য। দিনু তখন অন্য স্বপ্ন দেখত। গোপালি সেখানকার হাই স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে।
বাড়িতে ঢুকে উঠোনের রোদে ধানগুলো শুকতে দিতে দিতে
ভাবছিল, ধরণী মারা যাবার চার বছরের মধ্যে সব কেমন শেষ হয়ে গেল। বড় দুই ভাই জমি ভাগ নিয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেছে আর কানু বাড়ি আগলে মালতি আর ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে পড়ে আছে। এখন গোপালিদের অবস্থা অনেক ভালো, লোকটাও খাটতে পারে! সারাদিন মাঠে ঘুরছে, চাষ বলতে পাগল, জঙ্গলের কেন্দু পাতা আর বাবুই ঘাসে কারবারও করে। ধনঞ্জয় খুব হিসেবি লোক ওর শ্বশুর দিনুর মতো নয়। এদিকে গোপালি ওদের পাড়ার মা সারদা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সভাপতি। হিসাব পত্র, খাতা লেখা ব্যাঙ্কে যাওয়া সব তাকেই করতে হয়, পাড়ার সব মেয়েরাও ওকে মান্য করে। সবাই বলে গোপালির খুব দেমাক হয়েছে, সে ভাবে, হবে না কেন? কি নেই ওদের? এই সেদিন গাঁয়ের প্রথম টিভি কিনলো ওরা।
৪
রান্না করে ছাগলগুলোকে ঘাস দিতে দিতে ও দুর থেকে দেখে
জমির আল ধরে ধনঞ্জয় ফিরছে। ধনঞ্জয় পাড়ার পুকুরে চান করে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখে কানু মাথা নিচু করে বসে আছে তার বাড়ির সামনে, তাকে দেখে একটু নরম সুরে বলে – কানু তোদের ঝোরার পশ্চিমের জমিতে মাজরা পোকা লেগেছে, তাড়াতাড়ি ওষুধ দে না হলে সব ধান শেষ করে দেবে। কানু চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে থাকে।
ধনঞ্জয় বাড়ি ঢুকে গোপালিকে বলল– ভাত দে, বান্দোয়ান যাব।
দুলালি ভাত বাড়তে বাড়তে বলল– বান্দোয়ান কেন যাবে আজ?
সে বলল – ডিলারের থেকে সার আর ওষুধ নিয়ে আসবো। বলে সে খেতে শুরু করল।
এমন সময় ওদের কানে এলো পাশের বাড়ি থেকে মালতি আর কানুর ঝগড়ার আওয়াজ। ধনঞ্জয় ভাতের গ্রাসটা নামিয়ে রেখে গোপালির দিকে তাকায়। দুজনে দুজনকে দেখে তারপর ধনঞ্জয় আবার খেতে শুরু করে। ঝগড়া কমে আসে, মালতির ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে।
ধনঞ্জয় খেয়ে বেরিয়ে গেছে, লতিকা একটু পরে ইস্কুল থেকে ফিরবে। সামনের সজনে গাছটায় দুটো শালিক এসে একে ওপরের গা ঘেঁষে বসেছে। গোপালির ছোট বেলার নানা কথা মনে পরতে থাকে, ধরণী আর দিনু দুই বন্ধু মিলে বড়শালঘাটির জঙ্গল থেকে বরা শিকার করে নিয়ে এলে, ওদের গোটা পাড়ায় পরব লেগে যেত। পাহাড়ি টোলার রতনের কথা ভেবে গোপালির মনটা খারাপ হয়ে যায়, কতই বা বয়েস ছিল তখন? আজকের লতিকার মতই উটতি বয়স। যেদিন জঙ্গলে ছেলেটা ওকে বলেছিল- তোর চোখদুটো খুব সোন্দর। তুই যখন চুল বেঁধে তোর মায়ের সাথে যাস তখন কি যে লাগে তোকে। সেদিন ও লজ্জায় হেসেছিল, আজও ভাবলে ওর গা শিরশির করে ওঠে।
ছেলেটা ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল লতিকারও ইচ্ছা ছিল বিয়ে করার। কিন্তু রতনরা ভুমিজ বলে তার বাবা রাজি হয় নি মুন্ডা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে। ওদের মেলা মেশা বন্ধ হয়ে যায়, রতনের বাবা জোড় করে ওর বিয়ে দেয়।
দিনুও এর কিছু দিন পর দিনু শিলদায় কুটুমবাড়ি গিয়ে মা বাপ মরা ধনঞ্জয়কে দেখে। ছেলেটার বাবা মা লাতপাড়ার পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে অল্প বয়েসে মারা যায়। বাপ মা মরা ছেলেটাকে ওর মামা শিলদায় নিয়ে আসে। ছেলেটাকে দিনুর ভালো লাগে ওদের জাতের, মামার চাষ সেই দেখে, ঝাঁকাল শাল গাছের মতো সুন্দর পেটানো চেহারা। দিনু ওর মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে ওকে ঘর জামাই করে নিয়ে আসে। সেই থেকে ধনঞ্জয় বান্ধাডিহতে। ছোটবেলায় পাথর খাদানে বাবা মায়ের মৃত্যু, তারপর মামার বাড়ীতে অনাথের মতো বড় কোন রকমে হওয়ার পর ও এখানে গোপালির প্রেম আর দিনুদের স্নেহ ভালবাসায় এক স্বপ্নের জীবন পায়।
গোপালি পরে শুনেছিল রতন বাড়ি ছেড়ে বান্দোয়ানে গিয়ে পার্টির নেতা শীতল কুণ্ডুর ঠিকেদারি কাজের দেখভাল শুরু করে। এখন নাকি সে নাকি অনেক বড়লোক, বড় বাড়ি করেছে সিমলাপানিতে।
লতিকা পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাসি হাসি মুখে বাড়ি ঢোকে। গোপালি বলে যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আয় খেতে বসব। লতিকা কলতলায় যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করে – তুমি এখনো খাও নি?
উত্তর আসে না, তুই তাড়াতাড়ি আয় আমি ভাত বাড়ছি দুজনের।
কিশোরী লতিকার তখন চোখে ভাসছে সিনেমার হিরোর মতো ছেলেটার কথা। কি দারুন মোটর সাইকেল, তেমনি জামা প্যান্ট, চোখে কালো চশমা, গাঁয়ের ছেলেদের থেকে একদম আলাদা। টিভির সিরিয়ালের হিরোদের মতো। ছেলেটা স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় মোটর সাইকেলে হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আড়চোখে দেখে ও ভীষণ খুশী হয়েছিল। ভাবতে ভাবতেই ফিক হেসে গামছায় নিজের মুখ মুছতে শুরু করে। ভাবে ছেলেটার নাম কি? কাল স্কুলে খবর নিতে হবে। ওদিক থেকে গোপালির আওয়াজ আসে কি রে হোল?
বেলা পড়ে আসছে পুকুর পাড়ের তাল গাছের ছাওয়াটা ধান খেতের অনেক দুর পর্যন্ত চলে গেছে। সজনে গাছে বসে ঘুঘুটা একটানা ঘুউউউ ঘুউউউ করে ডাকছে।
ছেলেটা তখন ওদের পাকা বাড়ির দোতলায় তার ঘরে নতুন দামি মোবাইলে ওর বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞাসা করছে - মেয়েটা কে রে?
ওর মা নীচে থেকে চেঁচায় - বাবা মিহির খাবি আয়। বেলা হোল।
সে কথা বলে চলে বন্ধুর সঙ্গে।
৫
খবরটা যখন ধনঞ্জয় জানে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ও মাঠ থেকে ফিরছিল রাস্তায় কানুর সাথে ওর দেখা। ওকে দেখে কানু বলল- কিরে, ব্যাপারটা কি বটে? তোর বিটিকে তো বড়লোকের এর ব্যাটার ভটভটির পিছনে বড়শালঘাটির জঙ্গলের রাস্তায় ঘুরতে দেখলাম।
ধনঞ্জয় প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কানু মদ খেয়ে উল্টো পাল্টা বলছে না তো? ওর অন্য কোন মতলব নেই তো? সে ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলে– বাজে বকছিস ক্যানে?
কানু সরল ভাবে বলে- নারে সত্যি বলছি আমি বান্দোয়ান যাবার সময় দেখলাম একটা বড় লোকের ব্যাটার সাথে লতিকা ভটভটিতে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি তো ছ্যালেটারে চিনি নাই। আমার সাথে সিমলাপানির গদাই ছিল ও বললে ওটা রতন সিং এর ব্যাটা মিহির।
তারপর খুব হতাশ গলায় বলে- শুনলাম ঠিকাদার বাপের মতো ছেলেটাও নাকি সুবিধের নয় রে। সে কানুকে অনেক বছর চেনে ও বোঝে কানু মিথ্যা বলছে না। এক অজানা ভয়ে ধনঞ্জয়ের হাত পা কাঁপতে থাকে। আর একটু হলে সে পড়ে যেত কানু ওকে ধরে ফেলে বলে- কি হোল রে ধনঞ্জয়, এমন করছিস ক্যানে? চ বাড়ি।
ধনঞ্জয় কোন রকমে কানুকে ধরে এসে বাড়ির দাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ধনঞ্জয়ের সাথে এত বছরে একবারও গোপালির ঝগড়া হয় নি। আজ প্রথম সে তাকে চিৎকার করে বলে- ঘরে বসে করিস কি একটা বিটি ছেলে তাও সামলাতে পারিস না? বলতে বলতে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় গোপালি অবাক, নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করে- কি হয়েছে?
ততক্ষণে দু হাতে মুখ ঢেকে ধনঞ্জয় কানুর কথাগুলো তাকে বলে। শুনে গোপালি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। সেও কিছুদিন ধরে দেখছিল লতিকার চাল চলন বদলে যাচ্ছে। ইস্কুল থেকে এখন রোজ দেরি করে ফেরে বলে টিউশন ছিল। ওর ভয় হচ্ছিল উটতি বয়েসের মেয়ে তার মতো কারো সঙ্গে জড়িয়ে গেলে কি হবে? তা বলে রতনের ছেলে! তার বুকের ভিতর ভয়, রাগ, বিদ্বেষ সব কিছুর মিলে মিশে ঝড় বইতে থাকে। গোপালি আর ধনঞ্জয় থম মেরে মুখোমুখি বসে রইল।
সেদিন লতিকা ফিরেছিল অনেক দেরি করে, দুজনে ওকে চেপে ধরতেই সে মিহিরকেই বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে। ওরা কেঁদে, ভালবেসে ভয় দেখিয়ে মেয়েকে কত বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়ের এক গোঁ। গোপালির ভিতর একটা চাপা কষ্ট গুমরে ওঠে, আর কেউ নয় রতনের ছেলে, কি হবে এখন? ধনঞ্জয়ের বুকটা হু হু করে ওঠে। লতিকাকে ওরা ঘরে বন্ধ করে রাখল, বাড়ীতে সবার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে।
তৃতীয়দিন সাঁঝের সময় বাড়ির সামনে পাড়া কাঁপিয়ে তিনটে মোটর সাইকেল ধনঞ্জয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মিহিরের সঙ্গে সেই তিনটে মস্তান ছেলে, দুর থেকে দেখেই ধনঞ্জয় তাদের চিনতে পারে। তাদের সাথে মিহির ধনঞ্জয়ের বাড়ি ঢুকে জোড় গলায় হাঁক দিল – লতিকাআ-
ধনঞ্জয়ের মাথায় রাগ চড়ে গেছে দৌড়ে তার সামনে এসে বলল- কি হয়েছে? লতিকাকে কি দরকার?
মিহির একই রকম বেপরোয়া গলায় উত্তর দিল- ওকে বিয়ে করব, তোমরা রাজি হলে ভালো, না হলে ওকে তুলে নিয়ে যাবো ।
ধনঞ্জয় রেগে মিহিরেকে মারতে এগোতেই, হঠাৎই পকেট থেকে একটা দিশি পিস্তল বার করে মিহির ধরল ধনঞ্জয়ের বুকে, হিসহিস করে বলে- জোর করে কোন লাভ নাই। বিয়ে আমি লতিকাকে করবোই, তোমরা বিয়ে না দিলে অরে তুলে নিয়ে যাব। কে আটকায় দেখি?
ঘটনার আকস্মিকতায় ধনঞ্জয়, গোপালি আর লতিকা হতবাক। ধনঞ্জয় বিশ্বাস করতে পারছিল না, পিস্তল দেখে শরীর মাথা কেমন পঙ্গু হয়ে গেল।
ঘটনা দ্রুত এগোতে থাকে। খবর পেয়ে পরের দিন মা দুর্গা ক্রাশার কোম্পানির মালিক রতন সিং সেই বড় কালো গাড়ি নিয়ে এসে হাজির ওদের বাড়ি। হাসি হাসি মুখে ছেলের বেয়াদপির কথা ভুলে যেতে বলে, বিয়ের কথা পাড়ে, এমন ভাব যেন গোপালিকে প্রথম দেখছে। আদর করে ওদেরকে সিমলাপানির বাড়ি নিয়ে যায়, খুব খাওয়া দাওয়া হয়। গোপালিও রতনের দোতলা পাকা বাড়ি, গাড়ি, বড় টিভি দেখে খুব খুশী লতিকার মতই, তার মনে হয় যাই হোক, বান্ধাডিহতে কার বিটির এমন বড়লোকের ঘরে বিয়ে হইছে!
কেবল ধনঞ্জয়ের মুখে কোন কথা নেই, তার বুকের ভিতর তখন হাজার মাজরা পোকা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে দেখে পোকা গুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারি দিকে।
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার পূর্বতন রাজধানী মুর্শিদাবাদে আপনাকে স্বাগত”, স্পষ্ট, কাটা কাটা করে বলা কথাগুলো কানে এলো প্রিয়মের। স্বর যদিও কিছুটা স্তিমিত। কে ওকে স্বাগত জানালো, প্রিয়ম বুঝতে পারল না। ও আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল্ না। এই জায়গাটা, মানে মুর্শিদাবাদ স্টেশনের লাগোয়া চত্বরটা এখন বেশ ফাঁকা। প্রিয়ম একাই একটা সিমেন্ট-বাঁধানো চাতালে বসে আছে। শীতের সকালের নরম রোদের ওম উপভোগ করছে। ওঠার তাড়া নেই। বিকেল পর্যন্ত সময় হাতে আছে। ফিরতি ট্রেনের আগে।
নির্দিষ্ট কোনো কাজ বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রিয়ম মুর্শিদাবাদে আসেনি। খানিকটা খেয়ালের বশে ভোরের প্রথম লালগোলায় চেপে বসেছিল। সকাল সাড়ে আটটায় নেমেছে এখানে। ইউনিভার্সিটির পাট শেষ করে প্রিয়ম এখন খবরের কাগজে ফ্রি ল্যান্সিং করে। এই বাংলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে একটা কলাম লিখছে ওর কাগজে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। সেই কাজে গত মাসেই ও মুর্শিদাবাদে ঘুরে গেছে। কিন্তু পেশাগত প্রয়োজনের বাইরে ওর আবার এখানে আসার ইচ্ছেটা পেয়ে বসেছিল। তার একটা কারণও ছিল অবশ্য। সে কথা ভাবলে ওর এখানে আসাটা একেবার উদ্দেশ্যহীন বলা যায় না।
প্রিয়ম আগেরবারই দেখেছিল, এখানে টাঙ্গার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। টাঙ্গার প্রতি ওর আকর্ষণ ছোটবেলা থেকে। যখনই এখানে বেড়াতে এসেছে , টাঙ্গায় চড়ে ঘুরেছে। সেই টাঙ্গার অনুপস্থিতি ওর কাছে মুর্শিদাবাদের মহিমা যেন একটু খাটো করে দিয়েছে। এবার তাই প্রিয়ম ভেবেছে, বিষয়টা নিয়ে খোঁজ খবর করবে।
ছোটবেলা থেকে দেখা মুর্শিদাবাদ স্টেশনের চেহারার বদল ঘটেছে অনেকটাই। উন্নয়নের রূপটান লেগেছে এর গায়ে। ভিড় বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই ভিড় যথেষ্ট ভীতিপ্রদ, ট্রেনে বসেই টের পেয়েছে প্রিয়ম। সেই ভিড়ের ধাক্কা এড়িয়ে চলতেই প্রিয়ম বেশ খানিকক্ষণ হল এখানে বসে আছে। ট্রেন থেকে নামা শেষ মানুষটিও চলে গেছেন খানিক আগে। থেমে গেছে রিকশা, টোটোর হাঁকাহাঁকি। পুরো চত্বর শুনশান হয়ে এলে প্রিয়ম মন্থর পদে স্টেশনের বাইরে আসে। কয়েক পা এগিয়ে বাঁ দিকে দেখতে পায় লেখা, টাঙ্গা স্ট্যান্ড। কিন্তু সেখানে না আছে টাঙ্গা, না আছে কোনো মানুষ ! ওর কাছাকাছি একটা সিমেন্টের চাতালে এসে প্রিয়ম বসে পড়ে। স্ট্যাণ্ড যখন, এখানে খানিক বাদে হলেও টাঙ্গার দেখা মিলবে নিশ্চয়ই! প্রিয়ম অপেক্ষা করে। সকালের মিঠে রোদে বসে থাকতে মন্দ লাগছে না!
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার পূর্বতন রাজধানী মুর্শিদাবাদে আপনাকে স্বাগত”, কথাটা আবার একই স্বরে ভেসে আসে! উচ্চারণের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রিয়ম এদিক ওদিক তাকায়। নাঃ, কেউ কোত্থাও নেই! আশে পাশের গুমটি দোকানগুলো থেকে নিশ্চয়ই কথাটা আসছে না! ও তো সেখান থেকে খানিক দূরেই বসে আছে! তবে কী এই বিজন স্টেশনে ভূতের পাল্লায় পড়ল সক্কাল সক্কাল! কথাটা ভেবে নিজেই হেসে ফেলে প্রিয়ম। আলগোছে পেছন ঘুরে ও কোনাকুনি একটা সাদা ঘোড়া দেখতে পায়। স্ট্যাণ্ডের একেবারে কোনার দিকে একটা ভাঙা শেডের তলায় ঘোড়াটা কিছু একটা চিবোচ্ছে। সূর্যের আলো ওর ঠিক আগে এসে থমকে গেছে। ফলে ওর শরীরের সাদা রঙে আঁধারের প্রলেপ পড়েছে। খানিকটা তফাতে থেকেও প্রিয়ম ওর পাঁজরের হাড়গুলোকে গুনতে পারছে। মুখে লাগাম পরানো না থাকলেও তার স্মৃতি আছে। প্রিয়মের কানে বিলীয়মান স্মৃতির টগবগ টগবগ শব্দ ঘোড়াটার খাদ্যবস্তু চিবোনোর শব্দে এসে থিতু হয়। প্রিয়মের মনে হয়, ভেসে আসা এই স্বাগত বাণী এই ঘোটকের মুখনিঃসৃত। ও আস্তে আস্তে ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে যায়। ওর গায়ে হাত রাখে। ঘোড়াটি ওর চর্বণক্রিয়া বন্ধ রাখে। প্রিয়মের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করে হয়ত! প্রিয়ম জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম?
নবাব।
প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে ওকে অভিবাদন জানায়!
অদ্ভূত এই মুর্শিদাবাদ শহরটা! শহুরে সমস্ত লক্ষণ ট্রেনে চড়ে এখানে এসে পড়ে, ট্রেন বেরিয়ে যাবার পর সেসবও বিদায় নেয়, শহর তার আড়ষ্ট ভাব ঝেড়ে ফেলে পল্লীপ্রকৃতির নকশীকাঁথায় নিজেকে প্রসন্ন উদারতায় মেলে ধরে! সকাল সাড়ে ন’টার মুর্শিদাবাদ শহরের দিকে তাকিয়ে প্রিয়মের সে কথাই মনে হল। নবাবের সঙ্গে আলাপ জমার পর ওর নিশ্চিত ভাবেই মনে হয়, নবলব্ধ এই সখাই ওকে দোরে দোরে নিয়ে যাবে, পরিচয় করাবে সকলের সঙ্গে।
প্রিয়ম নবাবের সাথে চলতে শুরু করে। দুজনেই দুজনের গতির সঙ্গে তাল মেলায়। এক মন্থর, ছন্দোবদ্ধ চালে ওরা স্টেশন এলাকা ছাড়িয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে।
স্টেশনের ধারে কাছের হোটেল, দোকানপাট ছাড়িয়ে এলে চাষের ক্ষেত চোখে পড়ে। তার ওপর দিয়ে রেললাইন দেখা যায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখে প্রিয়মের মন অনেকদিন পর ভালোলাগায় ভরে ওঠে। রাস্তার ওপর লাফাতে থাকা ছাগলছানার মতো ওর মনও নেচে ওঠে!
তোমার মালিকের নাম?
নবাবের মালিক আবার কে হবে, খোদাতাল্লা ছাড়া? ঘোড়াটার চিঁহি চিঁহি শব্দে প্রিয়ম যেন হাসির আভাস পায়। ও অপ্রস্তুতে পড়ে! নবাব সেটা টের পেয়েই যেন বলে, সাদিকুর। সাদিকুর শেখ। চলো তোমায় আলাপ করাবো সাদিকুরের সঙ্গে। যাবে? প্রিয়ম সম্মতিতে মাথা নাড়ে।
একটু দূর থেকে নবাব দেখিয়ে দেয় সাদিকুরের বাসা। তুমি যাবে না? প্রিয়মের এই প্রশ্নের উত্তরে নবাব জানায়, না। আমায় দেখলে সাদিকুর অস্থির হয়ে পড়বে। কী দরকার বুড়োটাকে ঝামেলায় ফেলে!
ক্ষয়াটে চেহারা। কালচে বাদামী গায়ের রঙ। থুতনিতে সামান্য এলোমেলো দাড়ি ঝুলছে। কোটরগত চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা সাদা ফতুয়া আর নীল চেক লুঙ্গি পরে ঘরের বাইরে বসে আছে সাদিকুর। ঠোঁটে ঝুলছে নিভে যাওয়া বিড়ি। কাজে যাওনি চাচা? প্রিয়মের এই প্রশ্নে সাদিকুর দুনিয়ার বিস্ময় মুখে জড়ো করে ওর দিকে তাকায়। অপরিচিত আগন্তুককে দেখে ও যতটা না অবাক হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হয়েছে ওর কাণ্ডজ্ঞানহীন রসিকতার প্রশ্ন শুনে! কিন্তু প্রিয়ম আলাপে ওস্তাদ। ঝুলন্ত বিড়িতে আগুন দিয়ে ও সাদিকুরের পাশে বসে পড়ে। কথায় কথায় সাদিকুরেরও মনে হয়, এতদিনের পাক খেয়ে মরা কথাগুলো একে তো বলাই যায়!
কোথা থেকে টাঙ্গা দেখবে বাপ? টাঙ্গাও্য়ালাদের দিন শেষ! এখন টুকটুকির সময়! যারা ঘুরতে আসে, তাদেরও ঘড়িতে দম লাগানো থাকে! যত জলদি যত বেশি জায়গায় ঘুরা যায়! সময় শুধু আমাদের হাতেই মেলা পড়ে আছে। পার করবার যো নাই!
তুমি তো দেখছ টুকটুকিগুলা। ওই মিনমিন করে চলা টুকটুকিকে আমরা বয়সকালে পায়ে হেঁটে পার হয়ে যাবার পারতাম! ওগুলার সঙ্গে ঘোড়ার তুলনা? একটানা কথা বলার জন্যই হোক, বা ঘেন্নায়, সাদিকুর একদলা থুতু ফেলে একটু দম নেয়!
প্রিয়ম এদিক ওদিক চোখ ঘোরায়। চাচা কি একা মানুষ, না পরিবার আছে! ছেলেমেয়ে? এক লপ্তে এত কথা জিজ্ঞেস করা শোভা পায় না। কিন্তু প্রিয়মের জিজ্ঞাসা সাদিকুরের চোখ এড়ায় না সম্ভবত। সাদিকুর হাঁক দেয়, টুলুর মা, বাপজানেরে এট্টু জল দাও। কলকেতা থেকে আসেছে। কিছুক্ষণ পরে একটা ঝকঝকে স্টিলের ঘটি ভর্তি জল, আর একটা সস্তা রেকাবিতে এক খণ্ড গুড় নিয়ে আসে টুলুর মা। পরনে ছাপা শাড়ি। মাথার ঘোমটা আলগোছে টানা। প্রিয়ম এতক্ষণে টের পায়, ওর অসম্ভব তেষ্টা পেয়েছিল!
টুলুর মা ওদের সামনে এলে সাদিকুর দু’পর্দা স্বর নামিয়ে বলে, সে ছোঁড়ারে কটা ছোলা-গুড় দিয়ো টুলুর মা। ইধারেই সে ঘাপটি মেরে আছে! সে কথা শুনে চমকে ওঠে প্রিয়ম! ওর অভিব্যক্তি দেখে করুণ হাসি হাসে সাদিকুর! বলে, শুধু শুধু ঘরে রেখে খাওয়ানো আমাগোর চলে, বলো! ছেলেরা চায় না। বলে, টাঙ্গা চলে না, নবাবের বয়সও হয়েছে। চরে খাক। আমি বলি, এই ভিটেটা আমারে বাঁচায়ে দিল রে বাপ! না হলে.. কথা শেষ করে না সাদিকুর। বিড়িতে ব্যর্থ টান দেয়। প্রিয়ম আবার আগুন যোগান দেয়।
একটা বাইক ঘরঘর শব্দে এসে দাঁড়ায়। সাদা জামা, সাদা প্যাণ্ট, চোখে নীল রঙের সানগ্লাস পরে একটা ছেলে এসে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোক। আবার বাইক উড়িয়ে বেরিয়েও যায়। সাদিকুর জানায়, আমার ছোট পোলা। বড়টা যোগানের কাজ করে। শাদি করে পাশেই ভেন্ন থাকে। এই ছোঁড়া নেকাপড়া করে পাস দিল। কোথায় ইস্কুলে চাকরি হবে বলে আফজলেরে টাকা দিছিল। আমি জমি বেচে সে টাকা ধরে দিলাম। কোথায় চাকরি! কোথায় আফজল! আমি কিন্তু বলেছিলাম, ওই আফজল পাটির চক্করে ঘোরে, ফেউয়া মাল! ওরে ট্যাহা দিস না! তা মুখ্যু বাপের কথা শুনবে কেডা! বলে, সবাই দেছে! সবাইরে ঠকাবে, এতবড় বাপের ব্যাটা সে! তা হল তো! তাগোর কেউ এখন বাপের হাল চষে, কেউ টুকটুকি চালায়। এক পোলা তো হুনি, লাইনে গলা দেছে! মেলা দ্যানা হয়েছিল। কী করবার পারলি তোরা, ছ্যামড়ার দল! আফজল তো ট্যাহা নিয়ে ভোঁ ভাঁ! ওর বাপে আবার চোপা দেখায়ে কয়, যে টাকার রঙ দ্যাখলাম না চোখে, তার জিম্মাদার আমি হব ক্যানে! সাদিকুরের বোধহয় আরেকবার থুতু ফেলার ইচ্ছে হয়, কিন্তু ও একটা ঢোক গিলে হাসে! শীতের রোদ্দূরও প্রিয়মের গায়ে চড়া হয়ে লাগে। ও উঠে পড়ে। ওর সঙ্গে সঙ্গে সাদিকুরও ওঠে। তারপর খুব গোপন কোনো কথা জিজ্ঞেস করছে, এমন ভাবে প্রিয়মের কানের কাছে মুখ এনে বলে, কিছু শুনলা? তুমরা তো কাগজের লোক। আমাগো কি ভাগায়েই ছাড়বে? কত নকশার কাগজ তো চাইতেই আছে এরা! টুলু আসে খবর দেয়! প্রিয়ম মৌন থেকে এগিয়ে যায়!
নবাব খানিকটা রসিকতার ঢঙে ওকে বলে, আমাদের অন্তত এই একটা বাঁচোয়া। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের চক্কর আমাদের নাই। প্রিয়ম হাসে। সাদিকুরের ঘর ছেড়ে ওরা একটা মোড়ের মাথা থেকে ডান হাতের রাস্তা ধরে। বাঁ দিকে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নামে কলেজ। বড় ক্যাম্পাস। আরেকটু এগোলে মহকুমা হাসপাতাল, কোর্ট। এইখানে ভিড়ভাট্টা খুব বেশি। চিকিৎসাপ্রার্থী, এবং বিচারপ্রার্থী সকলকেই এক ঝটকায় দেখলে কেমন সাদিকুরের মতো মনে হয়! এক চেহারা, এক দৃষ্টি! প্রিয়ম এলাকাটা তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে। নবাব এগিয়ে গেছে। প্রিয়ম দেখে রাস্তার মোড়ের সিভিক ভলান্টিয়ার আলতো চাপড়ে নবাবকে মাঝ রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
ট্র্যাফিক মোড় পার করে নবাব ডানদিকে ঘুরে যায়, ওর দেখাদেখি প্রিয়মও। একটা বড়, ঘেরা জায়গায় ঢুকে নবাব বলে, এটা হল নবাবী আমলের আস্তাবল। জায়গাটার নামও আস্তাবল মোড়। আমাদের কত পূর্বপুরুষের থাকার যায়গা ছিল। এখন দেখে কিছু মনে হয়? দেখ, কেমন সুন্দর রোদ পড়েছে! কী নির্লজ্জ, ফ্যটফ্যাটে বাহার! শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু যায় আসে না! একটা জ্যয়গার নাম আস্তাবল, অথচ সেখানে একটাও ঘোড়া নেই, কতদিন ধরে নেই, তাকেই সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়েছে! ভাবো একবার! সাদিকুরেরা এমনি এমনি ভয় পায় না! একটানা কথা গুলো বলে নবাব বেশ হাঁপিয়ে ওঠে। খানিক্ষণ জিরিয়ে প্রিয়মকে বলে, এর পেছনের অংশে বাজার হয়েছে। সবজি, মাছের বাজার। চলো, তোমায় দেখাবো!
বাজারের দিকে আসার পর নবাব থেমে যায়! বলে, যাও, দেখে এসো সবটা। আমাকে দেখলেই খেদাবে!
বাজারটা দেখে প্রিয়ম বেশ অবাক হয়। বড় একটা অংশ জুড়ে দু’পাশে বাজার বসেছে। মাথার অনেক উঁচুতে নবাবী আমলের ছাদ। এখন বেশিরভাগটাই ভাঙা। নীচ থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে! পুরোনো কাঠের খিলানগুলো অসহায় ইতিহাস হয়ে ঝুলছে! যে সব দোকানদারেরা বসে আছে, বা ক্রেতারা, সকলেই সেই ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন বলেই ওর মনে হয়।
হাজারদুয়ারীর সামনের প্রান্তরে এসে প্রিয়ম একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে! নবাবও যেন একটু উত্তেজিত। বেশ কয়েকটা ঘোড়া এখানে নিজের মতো চরে বেড়াচ্ছে। একটা দুটো টাঙ্গাও আছে। নবাব যথারীতি একটা কোণা বেছে নিয়েছে। অপেক্ষকৃত নির্জন। দূর থেকে নজর রাখছে প্রিয়মকে, প্রিয়মের এরকমই মনে হয়।
এখানে বেশ ভালো ভিড় আছে। টিকিট কাটার লম্বা লাইন। বাইরেও প্রচুর লোকের ঘোরাফেরা। এটাসেটা কিনছে, খাচ্ছে, ঘন ঘন সেলফি তুলছে। পেশাদার ক্যামেরাওয়ালা ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার অনুরোধ জানাচ্ছে সবাইকে। প্রিয়মকেও জানালো। এখন সকলের হাতে মোবাইল হওয়াতে এই ফটোওয়ালাদের দলও আস্তে আস্তে মুছে আসছে। প্রিয়মের এই সামান্য বয়সের দেখার মধ্যেই ও কত কিছুকেই হারিয়ে যেতে দেখছে, ভাবতে বসলে অবাক হতে হয়! একটাকে হটিয়ে দিতে না পারলে বাকিদের এগোনো থমকে যায়, এ এক আজব কল!
কতগুলো বাচ্চা বল খেলছিল। প্রিয়মের দিকে বল গড়িয়ে এলে ও বলটা তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কিছুক্ষণ বাদে আবার সেই বল ওর দিকে উড়ে আসে। ও লুফে নেয়! খেলুড়ের দল হাততালি দিয়ে ওঠে! একজন দৌড়ে আসে ওর দিকে। বলে, খেলবে আমাদের সঙ্গে? প্রিয়ম হেসে, হাত নেড়ে ওদের ‘না’ বলে। ছেলের দল মুষড়ে পড়ে। বলে, দেখো না, সবাই একদলে থাকতে চায়! দল ভাগ না হলে ম্যাচ খেলব কি করে? প্রিয়ম কিছু না বলে, হেসে নবাবের কাছে এগিয়ে যায়।
নবাব ওকে বলে, সবাই বিপক্ষ চায়। বিপক্ষকে হারাতে না পারলে আরেকজন জিতবে কীকরে? আর না জিততে পারলে সুখ কোথায়, বলো? তাই একজন প্রতিপক্ষ দরকার। সবসময়। সব কালে।
দিনের আলো মরে আসে ক্রমশ। ঠাণ্ডাটা বেশ লাগছে গায়ে। প্রিয়মের ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে এল। প্রিয়ম নবাবের গায়ে হাত বুলিয়ে নীরবে ওর কাছে বিদায় চায়। নবাবের নীরব দৃষ্টি বাঙ্ময় হয়ে ওকে কিছু বলতে চায়। প্রিয়ম সে জন্য অপেক্ষ করে। খানিক্ষণ পরে নিজেকে যেন খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে নবাব বলে, আবার দখা হবে বন্ধু।
প্রিয়ম বলে, হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। ঘোড়ারা শুয়ে পড়ে কখন জানো তো? মরণকালে। তাই দাঁড়ানো, ছুটে চলা আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই জরুরী। বাঁচতে তো হবে। তাই ছুটতেও হবে। প্রিয়ম বিকেলের আলো-মাখা হাসি হাসে।
প্ল্যাটফর্মে প্রিয়ম এসে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসার খবর হয় মাইকে। প্রিয়ম প্ল্যাটফর্মের বাইরে তাকিয়ে ফেলে আসা দিনটাকে দেখতে চায় যেন! একসময় ঝমাঝম শব্দে ট্রেন ঢুকে পড়লে প্রিয়মের কানে সেই শব্দ ছাপিয়ে উঠে আসে এক দৃপ্ত টগবগ টগবগ শব্দ!
ভোরের প্রথম আলো ফোটার সাথে সাথে মেসেঞ্জারের টুং শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তনুজার। রোজই। কয়েকমাস হোল এই রুটিন হয়েছে। যবে থেকে অতনুর সাথে ফেসবুকে আবার যোগাযোগ হয়েছে দুদশক পরে। পরিমল পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমায় তখন। মোবাইল নিয়ে আস্তে করে বাইরে বেরিয়ে আসে তনুজা। গুড মর্ণিং মেসেজ। তারপর টুকটাক আলাপচারিতা চলে। বেশিরভাগ দিনই ফেলে আসা কলেজের দিনের স্মৃতি নিয়ে আলোচনা চলে। কেবির ক্লাসে পরেশ কেমন ঘুমাত আর বকা খেত, কিম্বা অতসী কেমন অরুণকে কাটিয়ে দোজবরে বড়লোক বরকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেল…… এইসব! সবশেষে অতনুর আক্ষেপ থাকবেই, “তুই তো হাত ধরলি না! ধরলে জীবনটা অন্যরকম হত!” তখনই তনুজার বুকের ভেতর হাড় পাঁজরগুলো গলতে শুরু করে, গলতে গলতে পুরোপুরি দ্রব হয়ে যেতে যেতে উত্তর দেয়, “আচ্ছা, এখন তো ধরলাম!” কলেজে পড়তে অতনু প্রপোজ করলে তনুজা বলেছিল, “তোকে বন্ধুর মত দেখি।“ তারপর কত কত দিন কেটে গেছে। চব্বিশ বছর প্রায়।
দুপুরের দিকেও একবার অনলাইনে আসে অতনু। বেশিরভাগ দিনই একটা দুটো কথার পরই বলে, “তোকে চাই। নিজের করে। কবে পাব?” দ্বিধায় পড়ে তনুজা। একদিকে দীর্ঘদিনের সংস্কার, পরিমলের প্রতি কমিটমেন্ট, অন্যদিকে অতনুর ডাক যেন নিশির মত টানতে থাকে। এটা ওটা বলে কাটিয়ে দেয় তনুজা। অতনুর বৌ ওকে ছেড়ে গেছে। যে কদিন ছিল, ভালও নাকি বাসে নি। অতনু একথা বললেই বড় মায়া হয় তনুজার। মনে হয় দুহাতে আগলে রাখে, সব বেদনাগুলো মুছে নেয়। জিজ্ঞেস করেছিল তনুজা, “আবার বিয়ে করলেই পারতিস!” অতনু বলেছিল, “আবার! যা সব চার্জ দিয়ে কেটে পড়েছিল! আরেকটা কেমন আসত কে জানে!” মায়া আরো বাড়ে তনুজার। তনুজা পরিমলের একমাত্র মেয়ে পুনেতে থেকে ম্যানেজমেন্ট পড়ে। বাড়িতে তাই পরিমল আর তনুজাই। পরিমল অফিস চলে গেলে তনুজার হাতে অঢেল সময়।
অতনু বলে, “একদিন দুপুরে আসতে পারিস তো আমার ফ্ল্যাটে। কেউ তো থাকে না। তোকে আদর করব আর আদর খাব।“ তনুজা শুনে কেমন যেন হয়ে যায়। মাঝবয়সী হরমোনের প্রভাবে? পরিমল তো সেভাবে কোনকিছুরই অভাব রাখে নি! তাহলে এমন হচ্ছে কেন? নাকি দীর্ঘদিন পরিমল ওকে আলাদা করে দেখা, আরো ভালো করে বললে আবিষ্কার করে নি বলে? আর কারো চোখে আবিষ্কৃত হচ্ছে ভেবে রোমাঞ্চ হচ্ছে? কুড়ি বছরের পুরোনো বিবাহিত সম্পর্কে প্রতিদিন নতুন আবিষ্কার আসবে কোথা থেকে? স্বাভাবিক, জানে তনুজা। কিন্তু অতনু যখন বলে, “তোকে আমি কি চোখে দেখেছি প্রথম দিন থেকেই তুই জানিস! এতদিন তো আমায় মেরে রেখেছিলি, এবার তো আয়!” পারলে তখনই ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে তনুজার। কিন্তু পিছু টেনে ধরে সংস্কার। দীর্ঘদিনের মধ্যবিত্ত মনে লালিত সংস্কার। সতীত্ব নারীজীবনে সবচেয়ে বড়, এই শিক্ষাই বাড়ির বড়রা দিয়ে এসেছেন। এখন চাইলেই সেসব ঠেলে ফেলে চলে যাওয়া যায়? তনুজা অতনুকে বোঝায়। অতনু বলে, “ওসব মানি না। দুজন নরনারীর পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক মিলনে বাধা কোথায়?“ মানতে পারে না তনুজা। পরিমল কি দোষ করেছে? তাকে ঠকাবে কি করে? পরিমল জানলে কতটা কষ্ট পাবে! এটা ঠিকই বরাবরই পরিমল কেমন থেকেও নেই হয়ে থেকেছে…… তবু, পরিমল জানলে তাদের সম্পর্ক আর জোড়া লাগবে? তাছাড়া মেয়ে বড় হয়েছে। যদি বুঝতে পারে? তাহলে মেয়েকে আর কিছু বলার অধিকার থাকবে তনুজার? ভেবে কুল পায় না তনুজা। তাছাড়া সমাজ বলেও তো একটা বিষয় আছে! অতনু শুনে বলে, “ধুর! ছাড় সমাজ! সমাজ আমাদের ভালো রাখে? তাহলে আমরা নিজেদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে নেব না কেন? কেউ না জানলেই তো হচ্ছে! “ মানতে পারে না তনুজা। কেউ না জানলেই হচ্ছে? নিজের কাছে কি জবাবদিহি করবে?
কিন্তু অতনু বলেই চলে প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু। “তোর গালের টোলটা কাছ থেকে দেখব। তুই আমার ফ্ল্যাটে না যাস, তোর ফ্ল্যাটে আমাকে ডেকে নিস পরিমলদা না থাকলে। সেই কবে থেকে তোকে চেয়ে আসছি বলত! তুই হাতটা ধরলে জীবনটা অন্যরকম হত!” তনুজা আবার চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। কিন্তু ডাকতে পারে না! কি করে ডাকবে! ফ্ল্যটের দারোয়ান আছে, লিফটম্যান আছে, কি ভাববে! এতদিন ধরে তারা তনুজাকে চেনে! শেষে অতনু বায়না শুরু করে, “তাহলে চল, পুরী ঘুরে আসি। নিয়ে চল, প্লীজ, অনেক আবদার করব……” তনুজা ডুবতে থাকে! পুরী! পরিমল যাবে না, ও একা? তা আবার হয় নাকি? কিন্তু অতনুর আহ্বানে মনে মনে পুরীর সি বিচে দৌড়াতে থাকে কিশোরীবেলার মত! পরিমল আর তনুজা বেড়াতে যায় না কোথাও তেমন একটা। পুরীও নয়। মনে হতে থাকে, এটুকু যদি দেওয়া যেত অতনুকে! ও যে সারাজীবনে কিছুই পেল না! লুকিয়ে কাঁদে তনুজা।
এইরকমই চলছিল। প্রায়ই গল্প হত, কোন কোন মহাপুরুষ পরকীয়া করেছেন। অতনু বলত, পরকীয়া, আবার নিরামিষ! সে আবার পরকীয়া নাকি! তনুজা গান্ধীজীর রেফারেন্স দিতে গেলে বলত, “ওসব গান্ধী ফান্ধী ছাড়, আমি বাপু সিংহ, আমার মাংস চাই বুঝলি!” অতনুর পদবী সিংহ। এতটা কাঁচা রসিকতা তনুজা একেবারেই পছন্দ করে না, কিন্তু তনুজার যে কি হয়েছে, অতনুর কোনকিছুতেই অসুবিধা খুঁজে পায় না। শুধু মনে হয় আহা! এতদিন ধরে একটা মানুষ কিছুই না পেয়ে একটা মেয়েকে এভাবে চাইতে পারে তা তনুজার ধারণার বাইরে ছিল। নিজেকে এলেবেলে ভাবতে অভ্যস্ত তনুজার নিজেকে হিরের চেয়েও দামী মনে হয়। যৌবন প্রান্তে এসে রূপ কি আর প্রথম যৌবনের মত আছে? তবু যাই যাই করেও বসন্ত যেটুকু আছে, চুপিচুপি আয়নার সামনে সেটুকু দেখে তনুজা। এটুকুতে কেউ মুগ্ধ হচ্ছে ভাবলে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায় তনুজা। পরিমল কোনওদিন এভাবে মুগ্ধ হয়েছে? ডালভাতের জীবনে আলাদা করে মনে পড়ে না তনুজার। মাঝে মাঝে কল্পনা করে সেই সময় অতনুর হাত ধরলে কি হত…… আর যাইহোক, ডিভোর্স হত না। বিয়ে করলে তনুজা আগলে রাখত ঠিক। অতনুর জীবনটা মাঝবয়সে এমন চালচুলোহীন হয়ে যেত না। চাকরিবাকরি তো ভালোই করে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে বড় পোস্টে চাকরি। প্রচুর বেতন, সুযোগ, সুবিধা। একদিন বলতে এসেছিল তনুজাকে, তনুজা বলেছিল, “আমাকে এসব বলে কি লাভ, বল! তোর পে স্কেল শুনে কি করব, তোর সম্পত্তি জেনেই বা কি করব!” তনুজা তো সম্পত্তি টম্পত্তির ধার ধারে না! তনুজা শুধু এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বসবাস করছে ইদানীং। না, তনুজা পরিমলকে ডিভোর্স করে অতনুর হাত ধরার কথাও ভাবতে পারে না। তনুজা পরিমলের সাথে কাটানো নিতান্ত ডালভাতের জীবনে স্বচ্ছন্দ। সেকথাও অতনুকে বলে দিয়েছে তনুজা। তাহলে কি চায় তনুজা অতনুর থেকে? বন্ধুত্ব? প্রেম? ভালবাসা? মুগ্ধতা? তনুজা সঠিক বুঝতে পারে না। অতনু কি চায় তনুজা জানে। শুধু তনুজাকে। চব্বিশ বছর ধরে শুধু তনুজাকেই চেয়ে এসেছে। এইখানটায় বড্ড মোহ তনুজার।
পথ চলতে চলতে কোথায় বাঁক নেয়, কেউ বলত পারে না। সকালে গুড মর্নিং মেসেজ আসতে বেলা আটটা বেজে যেতে লাগল। প্রথম প্রথম সেভাবে খেয়াল করে নি তনুজা। পরের দিকে তনুজা অনুযোগ করতে লাগল, “কি রে, সকালে গুড মর্ণিং এত দেরিতে হচ্ছে আজকাল! মর্ণিং গুলো কি আর গুড নেই? অতনু বলে, “ম্যাডাম, আপনি তো দেখলেন না! আর গুড থাকে কি করে! উঠতেই ইচ্ছে করে না!” তনুজা ভাবল, আহা, উঠতে ইচ্ছে করে না, রাত জেগে অফিসের কাজও তো করে! তনুজা বলল, “আচ্ছা, তোকে পাঠাতে হবে না, আমিই পাঠাব। একটু কথাও লিখে দেব, তাহলে কি লিখেছি তোর দেখার ইন্টারেস্ট হবে!” অতনু বলল, “জ্যায়সা ম্যাডাম কি মর্জি! আপনিই তো আমার বিশ্ব!” সকালে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে তনুজা দেখে অতনু মেসেঞ্জারে অনলাইন। তনুজা মেসেঞ্জারে ঢুকেই বলে, “কি? বাবু? আমি মেসেজ পাঠাব শুনেই হাজির? ফার্স্ট হবার নেশাটা তোর গেল না!” পরেরদিন অতনুকে হারাবার ছেলেমানুষি ইচ্ছায় চারটের সময় উঠল তনুজা। মেসেঞ্জারে ঢুকেই অতনু অনলাইন। হেসে ফেলে তনুজা। লেখে, “নাঃ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না! ভাবলাম আজ তোকে হারাবই! কিন্তু তুই তা হতে দিবি না, তাই না? সোনাছেলে!” এবার তনুজা ভাবল রাত্রে অতনুকে মেসেজ করে চমকে দিতে হবে। বলবে, “এই! এবার যাব তোর ফ্ল্যাটে! আর কষ্ট দেব না!” তনুজা জানে অতনুর কষ্টের কারণ সে, কষ্ট কমাবার ভার তাই তারই। রাত বারোটায় মেসেঞ্জারে ঢুকেই দেখে অতনু অনলাইন। তনুজা লেখে, “কি ব্যাপার? এত রাত্রে কার অভিসারে, শুনি? ওপাশ থেকে উত্তর আসে, “ কি মুশকিল, আমি কি মেসেঞ্জারে থাকতে পারব না?” ধাক্কা খায় তনুজা। বলে, “না, না তা কেন! দেখি নি তো কখনও! তাই মজা করলাম।“ বেরিয়ে আসে মেসেঞ্জার থেকে। বলা হয় না যে তনুজা অতনুর ফ্ল্যাটে যাবে ভাবতে পেরেছে।
পরেরদিন রাত্রে শুয়ে পড়ল তনুজা। কিন্তু কি যেন অস্বস্তি মনটা ছেয়ে আছে! ঘুমাতে পারল না। রাত আরো বাড়লে তনুজার কেমন কৌতুহল হোল। অতনু কি করছে, দেখি। মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখে, হ্যাঁ অতনু অন। রাত দুটো। তনুজা ঢুকে বলল, “হাই! ক্যান আই চ্যাট উইথ ইউ, ম্যান! নাইট ইজ টু ইয়ং!” অতনু খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, তো? তোর আর কাজ নেই?” তারপরই বলে, “আরে, ম্যাডাম, কর, কর, চ্যাট কর। তোর জন্যই তো বসে আছি!” প্রথম একটা ধাক্কা খাবার অনুভূতি হোল তনুজার। কেমন মনে হল ঠিক বলছে না। দিনের মধ্যে অসংখ্যবার মেসেজ করা অভ্যাস হয়ে গেছিল। এখন মেসেজ করলেও উত্তর আসে না সময়মত। তনুজা অনুযোগ করে, “কি রে! মেসেজ দেখছিস না?” অতনু বলে, “মিটিং ছিল।“ মিটিং আগেও থাকত, তনুজা জানে, কিন্তু মেসেজের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। কি যেন নেই, কি যেন নেই অনুভূতিতে ডুবল তনুজা। কেমন বদলে যাচ্ছে অতনু। তনুজার মনে পড়তে লাগল অতনু কি কি বলত…… তার দাবী নিয়ে তনুজার কনফিউশন থাকলে বলত, “দূর! ঠাকুর প্রণাম করে নিবি, তাহলেই পাপ কেটে যাবে। আর দান ধ্যান, পুণ্যকাজ করলেই তো হয়! পুণ্যের ভাগে বেশি পড়লেই হোল!” তনুজার মনে হত, এত সহজ! মানুষ যে কোন অন্যায় করে পুণ্যকাজ করে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যাবে!
অতনুর ব্যবহারে তনুজা কেমন যেন অনুভব করতে লাগল কি যেন নেই, কি যেন নেই। অথচ সেরকম নয়। অন্যকেউ দেখলে দেখবে তাতে তনুজার আদরের নামেই সম্বোধন করা আছে, তীরবিদ্ধ হৃদয় আছে, তবু তনুজার মনে হচ্ছে হৃদয়টা নেই! তনুজা মনকে বোঝাতে বসে। বসেই ইচ্ছে হয় মেসেঞ্জার চেক করতে। হ্যাঁ মেসেঞ্জারে অতনু অন। কেমন রোখ চেপে যায় তনুজার। অতনুকে বলে, “তুই কার সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করিস?” অতনু বলে, “বিধান, অরূপ, শাশ্বত, বিকাশ…… কেন? তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে?” তনুজা উত্তর করে না, কিন্তু অতনুর ফেসবুকে ঢুকে দেখে ওদের মধ্যে তিনজনের নামই ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। অতনু মিথ্যে বলল? কেন? আর অতনুর বন্ধু সংখ্যা বেড়েছে। অতনুর বন্ধু খুব বেশি নয়, তবে নতুন বন্ধু কে, এটা বোঝাও খুব সহজ কাজ নয়। তনুজা ফেসবুক আর মেসেঞ্জার ঘেঁটে অস্থির করে ফেলল। তনুজা খুব টেক স্যাভি তাও নয়। কিন্তু গুগল সার্চ দিয়ে অতনুর ফ্রেন্ডলিস্ট বার করে তাতে অ্যাভারেজ ইন্ট্যার্যাকশন টাইম অনুযায়ী প্রথমেই তনুজার নাম, তারপরই আর একটা নাম। কেমন জ্বালা ধরে তনুজার শরীরে! “কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে?”
সেই নতুন বন্ধুর টাইমলাইন চষে ফেলে তনুজা। খুব সুন্দরী। হরিণের মত চোখ। খুব গুণী। খুব ভালো গান গায়। খুব আলগা লাগে পায়ের তলার মাটি। বারবার মনে করতে থাকে অতনু কবে কবে কি কি ভাবে বিরক্ত হয়েছিল। একদিন তো মেসেঞ্জারে কথা হতে হতে মাঝপথেই কিছু না বলে চলে গেল, আর ফিরে এল না। পরেরদিনও কিছু বলল না। তারমানে অতনু এড়াতে চাইছে? অতনু ঠকাল? এটা ভাবলেই সারা শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে তনুজার। বলে দিলেই পারত! তনুজা কি কিছু বলত? তনুজা রাগের মাথায় বলেছিল, “কোথাও যাব না আমি, হয়েছে?” তাহলে এরকম বলেছিল বলে? অতনুও বলেছিল, “জানি। কিন্তু এই বয়সে আমি কোথায় যাব?” তাই খুঁজে নিল অন্য ঠিকানা? ঐসব ভালবাসা টাসা কিছু নয়? তুইই আমার বিশ্ব, কিছু নয়! “চব্বিশ বছর ধরে প্রতীক্ষা করে আছি” ছেলে ভোলানো কথা! তারপরই তনুজার মনে হয় ওই আভারেজ ইন্টার্যাকশন টাইম দিয়ে কি প্রমাণিত হয়? কিচ্ছু না! কিন্তু তনুজা ভুলতে পারছে না! তনুজা প্রকাশ করে ফেলে তার অনুভূতি। অতনু বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না! বলে, আমি মেসেঞ্জারে কতক্ষণ থাকব, তাও তুই ঠিক করে দিবি?” আর ওরকম কোন ব্যাপার হয় নি। তুই ভুল ভাবছিস।ওভার থিঙ্ক করিস কেন এত? তনুজা ভাবে তাই হবে হয়ত! ওভার পজেসিভ হয়ে যাচ্ছি!
তারপর থেকে অতনুর প্রতি কথায় তনুজার মনে হতে থাকে তাকে ভোলানোর জন্য বলছে। আদরের ডাকে মনে হয় মেকি সুর… তনুজা খুব ক্লান্ত বোধ করে। ঘুমিয়ে পড়তে চায়। গভীর ঘুম। যুগান্তের অভিমান বুকে নিয়ে যেমন গভীর ঘুমানো যায়! তনুজার মনে হতে থাকে তাহলে সত্যিই আটচল্লিশ বছর হেরে যায় ছাব্বিশের কাছে! হবেই তো শেষ সূর্যের আলোর থেকে প্রভাতী সূর্যের আলো ও উত্তাপ দুইই বেশি! নাকি জাগতিক দেওয়া নেওয়ার একটা অলিখিত শর্ত মনের গোপনে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে? মেসেজে উচ্ছ্বাসের ফানুষ ছাড়া আর কিছুই দেওয়া নেওয়া হয় নি তাদের। তনুজা ভাবে, কমপ্লেক্স নয়ত? অতনু বারবার বলেছে, “তুই তো আমাকে সেই কলেজের ব্যাক বেঞ্চার ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিস না! আমি কিন্তু এখন একটা কোম্পানীর প্রায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! অনেক ক্ষমতা রাখি! কতজনকে চাকরি দিয়েছি, জানিস?” হয়ত নতুন বান্ধবী মেয়েটার কাছে অতনু ভগবানের মত হয়ে উঠছে! তাছাড়া মেয়েটি যা সুন্দরী! যে কোন পুরুষ মানুষের মাথা খারাপ হতে বাধ্য! তনুজারই মনে হচ্ছে আদর করে দেয়!
পরেরদিন সকাল থেকে নিজের মধ্যে অস্থির উথালপাথাল চলতে থাকে তনুজার। পরিমল বেরিয়ে গেলে খুব যত্ন করে সাজে তনুজা। আয়নায় বারবার নিজেকে দেখে। মন খুঁত খুঁত করতে থাকে! কি যেন নেই, তার কি যেন নেই মনে হতে থাকে। অথচ জানে যা নেই, বিস্তর সেজেও তাকে আনা যাবে না। তারুণ্য। সমস্ত শক্তি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে। দুম করে আওয়াজ হয়। সেকেন্ড ফ্লোরের সিকিউরিটি অবাক হয়ে তাকায়। একটা ওলা ডেকে রওনা হয়। অতনুর ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেল বাজায়। তনুজা জানে অতনুর এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। অতনুকে বিরাট সারপ্রাইজ দেবে তনুজা। দরজা খুললেই অতনুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে থির থির করে কাঁপছে তনুজা। দরজা খুলল না। আবার বেল। আবার অপেক্ষা। দরজা খুলল না। পরপর তিনবার বেল দিয়েও দরজা যখন খুলল না, তনুজা পাগলের মত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নামতে নামতে ভাবতে থাকল যদি এভাবেই পাতালে পৌঁছে যাওয়া যায়! কোনওরকমে বাড়ি এসে বিছানায় ছুঁড়ে দিল নিজেকে। যতবার চোখ বোঁজে, ততবার কল্পনায় ভেসে উঠতে থাকে এক আদিম অরণ্য, যেখানে সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টই শেষ কথা! একটা সুন্দর সাজানো ঘর তনুজার কল্পনায় ক্রমেই আদিম অরণ্য হয়ে ওঠে। সবুজ ঘাসের গালিচায় একটা ছোট্ট নরম হরিণশিশু ক্রমেই সিংহের খাদ্য হয়ে উঠছে। তৃপ্ত সিংহ আস্তে আস্তে থাবা চাটছে। তনুজা আগ্নেয়গিরির গরম লাভাস্রোতে যেন পুড়ে যেতে থাকে। প্রতিটি কোষ দগ্ধ হতে থাকে…
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না তনুজা। তনুজার মনে আদিম অরণ্যের দৃশ্য সর্বশক্তিমান হয়ে কোনও যুক্তিবোধকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। পরিমল টুরে গেছে, তনুজা একাই থাকবে বাড়িতে। অনেক রাত্রে তনুজা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। খোলা চুল, বিস্রস্ত সাজের তনুজাকে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে প্রেতিনীর মত মনে হয়। তনুজারও নিজেকে প্রেতিনীই মনে হয়। যার একটা ধারণার সদ্যমৃত্যু হয়েছে। চব্বিশ বছর ধরে তাকে ভেবে বেঁচে আছে কেউ, এই ধারণার মৃত্যু। ফ্ল্যাটের ওধারের জলা থেকে জোনাকিরা উঁকি দিয়ে যায়, নাইটগার্ডের বাঁশি রাত্রের নিস্তব্ধতা এ ফোঁড়, ও ফোঁড় করে দেয় তনুজার হৃদয়ের মত। তনুজা পুড়তে থাকে। শিকড় উপড়ে যাওয়া গাছের মত অনায়াসে পুড়তে থাকে। ভোরের দিকে ঠান্ডা বাতাস যখন দগ্ধ ক্ষতে হাত বুলিয়ে দেয়, তখন তনুজার মনে হয়, পুরোটাই ভুল নয়ত? তনুজার ভাবার ভুল! দরজা খোলেনি মানেই তনুজা যেমন ভেবে নিল তেমন নাও হতে পারে। অতনু হয়ত ফ্ল্যাটে ছিল না। তনুজা বলে যায় নি তো! হয়ত ভুল! কিন্তু ভুল হলেও তনুজার মন থেকে সব ছবি মোছে না। অতনু যে শেষদিকে তনুজাকে চাইছিল না, সেই ছবি মোছে না।
আরো কিছুক্ষণ পরে সূর্যের নরম আলো তনুজার কপালে ঠোঁট রাখলে তনুজার দুগাল বেয়ে শ্রান্ত বর্ষণ শুরু হয়। বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! তনুজা স্নিগ্ধ হতে থাকে, স্নিগ্ধ হতে থাকে। তনুজার মনে হয়, বেশ তো, যদি হয়ই, ক্ষতি কি! দেয়ার ইজ নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার! যদি সত্যিই ওকে নিয়ে অতনু সুখী হয়, তবে ক্ষতি কি? সারাজীবন একটু ভালবাসার আশায় ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাওয়া ছেলেটা যদি একটু আশ্রয় পায় তবে তার থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তনুজার পোড়া গাছের শরীর থেকে বাকল খসে পড়ে। দাবানলে দগ্ধ অরণ্যে উঁকি মারে নতুন কচি পাতা। ভালবাসার নিবিড়তায় সবুজ।
তুমি শুনেছ ?
হ্যাঁ, পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছিলো জীবনে একবার। সে গল্প তোমাকে তো বলেছিলাম।
বাব্বা, বেশ মনে পড়ে আমি তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছি। একদিন দেখলাম একটা চাকু নিয়ে ঘুরছে। আমাকে বলল - সাবধানে চলাফেরা করবি ; তোদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। অথচ জানো একদম ভয় পাইনি। তুমি তখন কোথায় ?
কোথায়? মনে নেই। হয়ত কোনো গ্রামে। শেষের কয়েকমাস আমরা একই সেলে ছিলাম।
কিছু ভাবছ?
তিনদিন বৃষ্টির পর, গতরাত্রে বৃষ্টি হয়নি। অথচ হতে পারত। তাই সমস্ত বাড়ির জানালা বন্ধ ছিলো। ছিলো ঠাণ্ডা বাতাস। যারা বাড়ির বাইরে ছিলো, সে সময় তারা অবশ্যই আশেপাশের বাড়ীর কোন শিশু হঠাৎ কেঁদেছিলো কিনা শুনতে পায়নি। এবং ঘরের ভিতরে যারা ছিলো তারা কেউই সম্ভবত জানতো না, বাইরে তিনজন মানুষ একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা শুরু হয়েছিলো রাত্রি দশটা থেকে।
সাধারণ নিয়মে শহরতলির এই অঞ্চলে রাত্রি হয় আরো দেরিতে। অন্তত বারোটা। যদিও এখনও শীত আসতে অনেক দেরী। তবু বারোটার পর রাস্তায় কাউকে প্রায় দেখা যায় না।
কিন্তু তিনদিন বৃষ্টিতে সমস্ত রাস্তা ডুবে গেছে। বেশির ভাগ মানুষ অফিসে যেতে পারেনি। শহরে স্টেশনের কাছে যাদের দোকান আছে তারাও অনেকেই দোকান খোলেনি এবং যারা খুলেছিলো, তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায়, দরজা জানালা বন্ধ ঘরে চাদরের তলায় উষ্ণতা ছিলো।
এরই মধ্যে দ্বীপের মতো ছোট একটা জায়গা, তিন রাস্তার মোড়ে জল জমেনি। পাকা রাস্তা বৃষ্টির জলে ধোয়া। স্টেশন থেকে জায়গাটা প্রায় দশ মিনিটের পথ। অবশ্য কে কেমন জোরে হাঁটে বা কত রাতে বাড়ী ফিরবে তার উপর সময় অনেকখানি নির্ভর করে। এখানে একটা কালভার্ট আছে। তলায় নর্দমা। পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছের ছায়া পড়েছে। উল্টো দিকের বাড়ীর বাইরের আলোটা সারারাত জ্বলে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন। সে কোনো সন্দেহ না-রেখেই একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। অন্য দুজন তখন পরখ করছিল তাদের হাতের শক্তি। কালভার্টের উপর হাত রেখে পাঞ্জা লড়ছিলো, নিঃশব্দে। যে হারছিলো সে ভীষণ রেগে যাচ্ছিল। আর জিতছিল যে সে ও রাগে ভিতর থেকে একটা গরগর আওয়াজ করছিলো। তার একটা কারণ হতে পারে তারা অনেকক্ষণ ধরে, প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করছে।
অপেক্ষা করছে। স্টেশন চত্বরে যে বাজার, সেখান থেকে একজন ফুলওয়ালা, ফুলের দোকানদার ফিরবে এই রাস্তায়। এটাই তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা। খবর আছে। বর্ষার বৃষ্টি নয়। তিন দিনের পর এখন বৃষ্টিও থেমে গেছে। যে সব বস্তি ও নীচু জমির মানুষদের বাড়ি ডুবে গেছে, তারা তিনতলা স্কুলের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সম্ভবত তারা সন্ধ্যায় যে চিঁড়ে ও গুড় পেয়েছিল তাই খেয়ে এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। জায়গাটা কালভার্ট থেকে মিনিট তিনেকের রাস্তা। স্কুল বাড়ির তলায় গেটের গায়ে দুটো ল্যাজ ঝোলা লাল পতাকা কোনাকুনি বাঁধা।
তবে এইমাত্র একটা মালগাড়ি যাওয়ার শব্দ থেমে গেল। অর্থাৎ ঐ অঞ্চলে কয়েকজন মানুষের সকাল হয়েছে।
আজ কি খাবে ?
সেবার বর্ষায় দীঘার সমুদ্র, মনে পড়ে? কিন্তু এবার তেমন রাত নেই। সেই, তুমি প্রশ্ন করেছিলে দিগবসনা, মানে কী।
মনে পড়ে। আজ কি রান্না হবে তাড়াতাড়ি বলো।
বৃষ্টি পড়ছে, তাহলে খিচুড়ি।
খিচুড়ি-খিচুড়ি বেগুনভাজা-- বেগুনভাজা ডিমভাজা-- ডিমভাজা ডিম নেই, ব্যাস।
এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। কিন্তু আবার মেঘ উঠছে। মেঘ প্রায় চাঁদের কাছাকাছি এসে গেছে। যে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে ছিলো সে লক্ষ করছিলো মেঘের এগিয়ে আসা। আর ভাবছিলো - প্রথমার চাঁদ? দ্বিতীয়া? তৃতীয়া? চতুর্থী? পঞ্চমী? ষষ্ঠী? সপ্তমী? অষ্টমী? নবমী? দশমী? তারপর তার মানে হলো বিসর্জন, প্রণাম করলেই নাড়ু। এই ভেবে শব্দ করে হেসে ফেললো। রাত বেড়ে গেছে অনেক। রুলিং পার্টির পেমেন্ট ভালো। হতে পারে খবরটা ভুল ছিলো।
হাসির শব্দে অন্য দুজন চমকে তাকালো। স্টেশনের দিকের রাস্তাটা ভালো করে দেখে নিলো। আকাশের দিকে তাকালো। পাঞ্জা লড়তে লড়তে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে। একজন কোমর থেকে হাত তিনেক একটা মোমে পাকানো দড়ি বার করলো। মোটা দড়ি। দড়িটাকে দু'জন দু'দিক থেকে টানতে শুরু করলো। যদিও তারা জানতো ভীষণ শক্ত। আগে একবার এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলো। ঝামেলা কম। একজন বাঁ হাত দিয়ে পকেটের ক্ষুরধার অস্তিত্ব পরখ করে নিলো।
কিন্তু এই দু'জন ক্রমশ আরো বিরক্ত হচ্ছে। তাদের সহ্য হচ্ছে না, আরো অপেক্ষা করা, আজ তো দোকান বন্ধ ছিলো। লাইনের ওপারের মদের আড্ডা থেকে ফেরার কথা। বাড়ীতে একমাত্র বুড়ি মা। এত রাত করা উচিত নয়। তবু অপেক্ষা করতেই হবে। মোট ষোল আনা, তার মধ্যে এরা দু'জন পাবে আট আনার আট আনা করে। সাব কনট্রাকটর।
তুমি কি দেখতে যাবে?
গেলে খুশি হবে?
জানি না।
না গেলে?
জানি না।
কয়েকমাস আগে একদিন দেখা হয়েছিলো। বলেছিলো চারু মজুমদার বেঁচে আছেন। মাও সেতুং বেঁচে আছেন। ওকে নাকি কারা ঝুলিয়ে গেছে। আমারও হঠাৎ মনে হলো সকলেই বেঁচে আছেন। সরোজ দত্ত ময়দানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাইকে একটা করে তারা উপহার দিচ্ছেন। ঝকঝকে হেমন্তের রাত্রি। আমাকে কেবল দিলেন না। যাঃ বড্ড ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। এক কাপ না খাওয়াবে? তোমার খিচুড়ি বসিয়েছ?
যাই হোক ছেলেটা ভালো ছিলো, তবে মাথাটা একেবারে ইঁট।
আস্তে আস্তে চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে গেলো। বাড়ীর বাইরের আলোটা জ্বলছে। সারা আকাশটা জুড়েই কালো মেঘ। ঠাণ্ডা বাতাস এখন আর নেই। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা নড়ছে না। ফুল ফুটতে এখনও ঢের দেরি।
তিনজন খেয়াল করল একটা শব্দ থেমে গেলো। এতক্ষণ ব্যাঙ ডাকছিলো। শুধু কালভার্টের তলা দিয়ে মৃদু শব্দে জল যাচ্ছে। এই নোংরা জল একটা মজা খালে গিয়ে মিশবে।
মালগাড়িটা অনেকক্ষণ চলে গেছে। দু'একটা কাক ডাকছে সকাল হয়েছে, মনে করে। অথচ সেটা নিতান্তই ভুল করে। কারণ কালো মেঘে রাত্রি আরো অন্ধকার হয়েছে। যদিও সময়টা প্রায় কাক ভোর।
দূরে একজন মানুষকে দেখা গেলো। তিনজন পরস্পরের দিকে একবার তাকালো। কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে যে ছিলো তার হাঁ করে দুই ঠোঁটের কোণায় চুলকানো বন্ধ হতেই অন্য দু'জন নিশ্চিন্ত হলো। একজন পকেট থেকে বোতলটা বার করে দু'জনে খুব দ্রুত ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। অন্যজন এখন আগের চাইতেও নির্বিকার। এই মদ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণ করল না।
দূরের মানুষটা কাছাকাছি এসে গেছে। একেবারে কালভার্টের কাছে। বোধ হয় মৃদুস্বরে কোনো গান গাইছিলো।
একটু পরেই জোরে বৃষ্টি নামল।
কি বুঝলি?
কিছু না স্যার।
কিছুই না?
ইলেকশন আসছে স্যার।
আর? কত বছর চাকরি করছি জানিস ?
না, স্যার।
ছাব্বিশ বছর। তার মানে বুঝিস ?
না, স্যার।
তার মানে, ছাব্বিশ বছর রাজনীতি করছি।
হ্যাঁ স্যার।
কি রাজনীতি বলত ?
বলুন স্যার।
খিচুড়ি রাজনীতি। বুঝিস ?
না, স্যার।
পুলিশকে করতে হয়। তোদের সময় তোরা করতিস, তখনও আমি ছিলাম। এদের সময় এরা করে, তখনও আমি আছি। তোরা এখন গোপনে করবি। যাক যাক কোনোটাতেই ঝামেলা নেই। শুধু নকশাল তাড়া করলে তোরাও আছিস ওরাও আছে - এ ভরসায় বউকে সান্ত্বনা দেই, বুঝলি ?
হ্যাঁ স্যার। আমি এখন সংসার করছি।
বাধা তো নেই।
হ্যাঁ স্যার না স্যার।
ভোরের আগে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো, মাঝে একটু কমেছিলো মাত্র। আবার জোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জলে সমস্ত রক্ত ধুয়ে গেছে। বৃষ্টির কয়েকদিন ফুলের দোকান বন্ধ ছিলো। আজও আছে।
ভোটের আর বেশি দেরি নেই। কালভার্টের আশেপাশে জল জমতে শুরু করেছে। কয়েকজন মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে পরিচিতদের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। কারণ - পাশেই পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে। আশে পাশের বাড়ির জানালা মাঝে মাঝে খুলছে, আবার বন্ধ হচ্ছে।
জলের উপর কিছু হতভাগ্য লটারির টিকিট, সিনেমা সুন্দরসুন্দরীদের পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা ছবি মার্কা ঠোঙা ভাসছে। একটা ঠোঙার ভিতর একটা, সম্ভবত কই মাছ ঢুকে গিয়েছিলো। সেটা ঠোঙা শুদ্ধ জলের এদিক ওদিক ও উপর নীচে ওঠা নামা করছিলো। জনৈক দর্শক সরষের তেলে নিজের হাতে ধরা মাছ ভাজার গন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। না। বেশ কয়েকজনই চেষ্টা করছেন।
বড় দারোগাবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন গামবুট পরে। চোখে চশমা। রোদ উঠলে কালো হবে। এখন তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছে। যদিও এখন তিনি রুলিং পার্টির হাফ উচ্চস্তরের স্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলছেন। নেতার সহযোগী আত্মার আত্মীয়রা উচ্চস্বরে সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটা মিছিল বার করা নিয়ে আলোচনা করছেন। যদিও সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিলো।
স্যার লাশ এবার গাড়ীতে তুললে হয়?
হুঁ।
একটা কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছেন, স্যার? বোধহয় লোকজন আসছে, শুনছেন?
তোমাকে দেখলে আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিককার কথা মনে পড়ে। ক’টা বাজলো?
দশ’টা, স্যার।
চলো।
ওই যে দেখা যাচ্ছে, হাড্ডি চর্মসার এক মানব অবয়ব ধীর গতিতে হেঁটে আসছে..
দরজা খোলাই ছিল, ভিজে ছাতাটা গেটের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে দু'ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ডাইনিংএ।
—"পুরো ভিজে গেলাম।" সে বলল।
—"ওঃ এই বৃষ্টির মধ্যে তুমি তো আজকে না আসতে পারতে!" বললাম।
—"না গো বৌদি, বাইরে থাকলেই বরং ভালো থাকি। কাল আবার মদ খেয়ে ঢ্যামনাটা সারা রাত নেত্য করেচে। কাল একশ টাকার কাজ করেচে, পুরোটাই মদ গিলে এয়েচে। দিইচি ঘা কতক মনের ঝাল মিটিয়ে "।
—"দূর করে দাওনা কেন ওই রকম কুলাঙ্গারকে।"
—"তবে কি জানো বৌদি, মন্টে আমার এমনিতে যাই হোক, আমায় মান্নি করে খুব, কোনদিন গায়ে হাত তো তোলেই নি, খারাপ কতাও কোনদিন বলে নি। দোষের মদ্যে ওই এট্টু মদ খায় আর এর-তার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়।"
যার কথা বলছিলাম, ইনি হচ্ছেন আমাদের কাজের দিদি। আমরা এপাড়ায় আসা থেকে, মানে এই দীর্ঘ কুড়ি বছর এই দিদি আমাদের সংসারের গৃহকর্মে সাহায্যকারী হিসাবে রয়েছেন। আমাদের আশেপাশে আরও অন্তত ছয় সাত বাড়িতে কাজ করেন। কোন কোন বাড়িতে পঁচিশ ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন।
এই বাড়ির বৌদি খুব 'ছুঁচিবাই', ওই বৌদির হাত দিয়ে জল গলে না, সেই বৌদির 'বড্ড মুখ ', অমুক দাদার 'চাউনি' ভালো না, এই রকম শতেক অভিযোগ। কোন বাড়ি পুজোর পরেই ছেড়ে দিতে চায় তো কোন বাড়ি এ-মাসটা করেই ছেড়ে দেবে এই তার ইচ্ছে। এইভাবে মাস গড়িয়ে বছর গড়ায়, অভিযোগের সঙ্গে দিদিও টিঁকে থাকে। নেহাত শয্যাশায়ী না হলে আর ছুটির বালাই নেই। তবে বছরে আড়াইটে দিন ছুটি চাই-ই। বলি- "ও দিদি, কদিন ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে এসো।" কিন্তু যার কাঁধে সাতটা বাড়ির কাজের দায়িত্ব সে কি করে যায়!
—"না বৌদি পরে যাব’খন"।
ছোটবেলায় হাঁটতে হাঁটতে এই পাড়ার রাস্তা দিয়ে রেললাইনের ওপারে মামার বাড়ি যাওয়ার গল্প বলে, তাই না হয় একদিন যাও। তাও হবে না, কারণ মামা, মামি অনেক কাল আগে মরে গেছে, মামাতো ভাইয়েরা সব ভিন্ন হয়েছে, এখন ওখানে গেলে সম্মানটুকু যদি না পাওয়া যায়! তাহলে আড়াইটা দিন ছুটি কিসের!?
হ্যাঁ,ওই আধখানা ছুটিটা হল রান্নাপূজোর দিন। যেহেতু পুজোর পরের দিনের রান্না আগের দিন রাত্রে করে রাখতে হয় তাই সকালটা ছুটি না নিলেও চলে যায়। দ্বিতীয় ছুটি আষাঢ় মাসের অম্বুবাচি তিথির শেষ দিনটা।
তিনদিন উপবাসের পর ওইদিন শুদ্ধ হওয়ার দিন। ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, মাথা ঘষে সাবান মেখে স্নান তারপর শুদ্ধ দেহে শুদ্ধ বসনে অন্ন গ্রহণ। তৃতীয় ছুটি ভাই ফোঁটার দিন। দিদির কথায় "ছোট বোন ভাইদের ফোঁটা দিতে আসে না, আমি বড় দিদি, আমার তো একটা কত্যব্য আচে, কিচুই তো করতে পারিনি ওদের জন্য"। দিদি বলে " দুভাইয়ের জন্য দুটো গেঞ্জি কিনেচি, আর খাসির মাংসোর দাম দেব বলেচি"।
আমি বলি, "ভাইফোঁটায় ভাইয়েরা তোমাকে কিছু দেয় না?"
` —"না না ওরা কোতায় পাবে!? ওদের সংসার আছে, রোজগারও কম।"
প্রশ্নটা করে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি দিদির বলার ভঙ্গিতে সেটাই মনে হল। ভাইয়েরা তাকে একচিলতে জমি দিয়েছে ঘর বাঁধতে, যদিও সে জমি বাবার, ভাইয়েরা তো নাও দিতে পারতো! সেই কারণে ভাইয়েদের কাছে সে ঋণী। বাবার কাছেও সে ঋণী, এই ভূষুন্ডি কালো মেয়েকে সে তো পাত্রস্থ করেছিল। জামাই পাগল তা সে বুঝবে কেমন করে? পাগল বর কাজকর্ম করে না, মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়।
তোমার বর বেকার অতএব তার দায় তোমাকেই নিতে হবে। রাতদিন সংসারে গাধার খাটুনি। বিয়ের পরের বছরই মন্টে জন্মাল। মন্টে যখন সবে দুই, জন্ম হল পার্বতীর। চার বছর বয়সে বাহ্যেবমি হয়ে পার্বতী মারা যায়।
আছাড়িপিছাড়ি কাঁদে মন্টের মা। সকলে সান্ত্বনা দেয়, "তোমার একটা গেছে আর একটা তো আছে, তার মুখের দিকে চেয়ে মনটাকে শক্ত কর।" ছোট ছেলেটা যখন পেটে, পাগল গেল মরে। অগত্যা বাপের ঘরে এসে ওঠা। বাবা ওই চিলতে জমি খানা দিয়ে বলল, "নে খেটে খা ছেলে মানুষ কর"।
"বাবার জন্য খুব কষ্ট হয় গো বৌদি। আমি বড় মেয়ে হয়ে বাবার জন্যে কিছুই করতে পারিনি। বাবার শেষ সময়ে কাছে থেকে এট্টু সেবা যত্ন করারও সময় পাইনি।" -দিদির আক্ষেপ।
বাবাই বলে ক'য়ে টালির কারখানায় কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কাদা মেখে, তাকে ছাঁচে ফেলে, রোদে শুকিয়ে গুনতি করে সাজিয়ে রাখতে হবে। সকাল থেকে সন্ধে কাজ। কারখানার কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় কাজের ফাঁকে দুপুরে বাড়ি গিয়ে দুমুঠো ভাত খেয়ে আসা। এরমধ্যে বৃষ্টি এলে মাখা ভাত ফেলে দৌড়ে গিয়ে টালি তোলা। ইতিমধ্যে বড় ছেলে একদিন বউ নিয়ে বাড়ি ঢোকে। দিদির মুখে ছদ্ম রাগ "বউ এনেছিস খাওয়াবি কি"? আবার ওই রকম কুঁড়ে মাতাল ছেলেকে যে বিয়ে করেছে তাই ভেবে মনে মনে সে বউমার প্রতি কৃতজ্ঞ। বড় ছেলে বউমাকে ঘর ছেড়ে দিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে ঠাঁই হয় বারান্দায়।
বউমাকে ঘরের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজে যায় কারখানায়। বউমার জন্য বড় খারাপ লাগে, বেচারা বাপের ঘর থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করল তাকে একটু ভালো খেতে পরতে দিতে পারলুম না। ছোট ছেলে বাস কন্ডাকটরের চাকরি পেয়েছে। বড় সারাদিন ঘুরেফিরে রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। কাঁহাতক কত সহ্য করবে, তাই পোয়াতি বউ একদিন নিজের রাস্তা দেখে নেয়। ছোট ছেলেটার কাজে মন আছে। এবার দেখেশুনে ওর একটা বিয়ে দিতে হবে। বাচ্চা কাচ্চা না থাকলে ঘরের মানান হয় না। টালির বাজারে মন্দা দেখা দেওয়ায় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই দিদির এ পাড়ায় আসা। এক বাড়ির কাজ থেকে দু বাড়ি। এই ভাবে বতর্মানে সাত বাড়ি।
ঝুলি ভরে নিয়ে আসত নিত্য নতুন গল্প। "জান বৌদি, কাল রাতে ভোম্বলটা গলায় দড়ি দিয়েছে।"
—"কে ভোম্বল?"
—"আরে শেফালীর ভাই।"
—"কে শেফালী?"
—"স্বপনের বৌ শেফালি গো।"
—"ও আচ্ছা.." -বলে চিনতে পারার ভান করেছি।
দিদির ধারণা ছিল ওদের পাড়ার প্রত্যেককে আমি চিনি। তবে বহুবার শুনে শুনে দিদিদের পরিবারের একটা ছক আমি মনে মনে তৈরি করে ফেলে ছিলাম। একদিন এসে বলল "আজকে ভোরবেলা দেখি খালপাড়ের দিকে কি ধোঁয়া, তারপর জানতে পারলুম রমেশদের গোয়ালে আগুন ধরে গেছে।" দিদির মুখ থেকে দিদির ছোট বেলার গল্প শুনতে খুব ভালো লাগত। আন্দুলের পুরানো বাসিন্দা হওয়ায় আন্দুল রাজবাড়ির অনেক গল্প দিদির কাছে শুনেছি। দিদির ছেলে ছোট বেলায় একটা দামি ঘড়ি কুড়িয়ে পেয়েছিল সে গল্পও দিদি করেছে। কি সে দামি ঘড়ি? "সেই চিমটি ঘড়ি (HMT) গো!" তবে দিদির যে কথাটা শুনে সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম সেটা হল, একদিন এসে বলল- "কাল আমার ভাইপো বউ এর বাপের বাড়ির কাছে খুব ঝামেলা হয়েছে, ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে ওই তিন আঙুল না চার আঙুল বলে ওই পাটির ছেলেদের।"
—"আরে দিদি ওটা তৃণমূলের ছেলেরা!
—"ওই একই হল, নাও তো।"
যাইহোক এইভাবেই দিন কাটছিল। কখনো সখনো পুরনো শোকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতো, আবার পরক্ষণে ভুলেও যেত। আর একদিনের কথা না বললে দিদির গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়। একদিন দিদি ঘর মুছছে আর ক্ষণে ক্ষণে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। কাঁদছে কেন জিজ্ঞেস করাতে বলে "আজ শিখা বৌদির বাড়িতে মুসুরির ডাল দিয়ে মুড়ি খেয়ে ফেলেছি। আমি বলি তাতে হয়েছে’টা কি? দিদি বলে "আজ একাদশী তো!" বলি, না জেনে খেলে কোন দোষ নেই। "আজ তোমার জামাইবাবুর খাওয়া হবে না যে! "দিদির ভুলে মৃত জামাইবাবুর খাওয়া হবে না তাই দিদি নাকের জলে চোখের জলে।
তবে দিদির জীবনের মোক্ষম আঘাতটা আসে এইবার। ঘরগুছিয়ে সবে কাজে বেরুতে যাবে আচমকা বজ্রপাতের মতো কে যেন বলে গেল "মন্টের মা তোমার ছোট ছেলে আন্দুল রোডে গাড়ি চাপা পড়েছে.."
ওইটুকুই আর কোন কথা কানে যায়নি। এবার আর আছাড়িপিছাড়ি নয়, একেবারে নিঃশ্চুপ নিঃশ্চল। যেন রামকিঙ্করের তৈরি কোন আদিবাসী রমণীর ভাস্কর্য। "ওরে ওকে কাঁদা, তা নাহলে মরে যাবে যে"। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল। "লাশটাকে নিয়ে আয়, ওর মাকে দেখা"। লাশ আনা হল মায়ের সামনে লাশের মুখের কাপড় খোলা হল। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে যুগোপৎ উত্তেজনা না জানি লাশের মুখ কতটা বিকৃত হয়েছে, দ্বিতীয়ত তা দেখে মায়ের প্রতিক্রিয়া কি হয়! কিন্তু মা তো ছেলেকে স্বীকারই করতে চায় না। বলে না তুই আমার ছেলে হতেই পারিস না। এইতো বলে গেলি মা আমি দর্জির দোকানে যাচ্ছি পুজোর জামাটা তৈরি করতে দিয়ে আসি। খাবার চাপা দিয়ে রাখতে বললি, ফিরে এসে খাবি। তারপর-ই "খোকারে..!" বলে আর্ত চিৎকার। আর কারো মুখে কোন কথা নেই, ভিড়ের মধ্যে থেকে শুধু মহিলাদের গোঙানির শব্দ, পুরুষেরা মাথা নোয়ালো। নিজেকে সামলে নিয়ে এক মধ্য বয়সি এগিয়ে গেল "ওঠ্ মন্টের মা, মন শক্ত কর, ভেঙে পরিস নে, তোর তো মন্টে আছে, ওর জন্য তোকে বাঁচতে হবে "।
হ্যাঁ, বেঁচেছিল মন্টের মা, 2022 সাল পর্যন্ত বেঁচেছিল তার সবেধন নীলমণি মাতাল অলস ছেলে মন্টেকে বুকে আগলে। সে যেমনই হোক তাকে তো মা বলে ডাকে!
মা বলে’কয়ে ছেলেকে কাজে লাগায়, কখনো মাছের দোকানে, কখনো আলুর দোকানে কখনোবা সাইকেলের দোকানে। ছেলে কোথাও দু মাসের বেশি টেকে না। সব জায়গায় ছেলেকে বড্ড বেশি খাটায় তাই কাজ ছেড়ে দিলেও মায়ের তেমন আক্ষেপ থাকে না। মায়ের আক্ষেপ ছেলে মদ খেয়ে লিভারটা নষ্ট করে ফেলছে, মা হয়ে তাকে একটু ভালো মন্দ খাওয়াতে পারে না। কাজের বাড়ি থেকে যেটুকু ভালো মন্দ খাবার পায় নিজের পেট ভারের অজুহাত দেখিয়ে আঁচলে বাঁধে। বেশ কিছুদিন হল ছেলের কাশি হয়েছে। থুতুর সঙ্গে রক্ত। ডাক্তার বলেছে টিবি। কাজের বাড়িতে মাংস রান্না হয়। ছেলেটার জন্যে কি একটু দিতে পারে না মায়ের মন কাঁদে। পুজোয় সবার নতুন জামা কাপড় হয় ছেলেকে কিছু না দিলে হয় না। মা এক বাড়ির মাইনে ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে- "একটা লুঙ্গি কিনে আনিস"। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখে ছেলে ওই পয়সায় মদের আসর বসিয়েছে। সেই রাতে এই ঘটনা দিদির মনে কতটা জোরে বেজেছিল জানিনা, তবে কুন্ডু বাড়ির সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লাঠালাঠির পর পরিণতি কি হল গতকালের সেই অর্ধ সমাপ্ত কাহিনী আজ শোনায় নি। বড় বেশি রকম চুপ ছিল। দিনের শেষে শুধু বলেছিল, বৌদি এবার পুজোয় কাপড় খেতে দিতে হবে না, টাকা দিও। হঠাৎই বেশ কিছুদিন হল দিদি কাজে আসছে না দেখে খবর নিতে যাই। বলি,
—"কি গো কাজে যাচ্ছ আসছ না কেন?"
—"শরীলটা একদম ভালো নেই গো, উঠলেই মাথা ঘুরচে,একদম বল পাচ্ছি না।"
—"তা ডাক্তার দেখাও নি কেন?
—"ডাক্তার কি দেখাব বলত, ডাক্তারের বিচুটি তো (ভিজিট-ই তো) দুশো টাকা, তাপ্পর ওষুধ।"
কাছের দোকান থেকে এক প্যাকেট দুধ আর গোটা ছয়েক ডিম কিনে দিয়ে আসি। সপ্তাহখানেক পর আবার খোঁজ নিতে যাই, সঙ্গে এক প্যাকেট দুধ, ছটা ডিম,এক প্যাকেট বিস্কুট। —"কিগো দিদি কেমন আছ?"
—"ভাল নয় গো, পা দুটো ফুলেছে, হাঁটা চলা করতে খুব কষ্ট হচ্ছে"।
খাবারের থলিটা হাতে দিয়ে বলি এই নাও এটা রাখ। দিদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে- "মন্টে তাই বলছিল দুধটা খুব সুন্দর খেতে, ওই দিয়ে দুদিন ধরে ও তিপ্তি করে দুটো ভাত খেয়েছে আর প্রতিদিন ওকে একটা করে ডিম সেদ্ধ করে দিয়েছি"।
আমি দাঁত কিড়মিড় করতে থাকি, মনে মনে বলি, আমি তো তোমাকে খেতে দিয়েছি। তোমাকে আমার প্রয়োজন। ফেরার সময় বলে আসি, "কাজ করতে না পারো, পারলে মাঝে মধ্যে গিয়ে এমনি ঘুরে এস।"
কয়েক দিন পর মন্টে এসে মায়ের মৃত্যু সংবাদ দেয়। গত রাতে টুল থেকে পড়ে গিয়ে মা আর কথা বলে নি। মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে চলে গেল মন্টের মা, আমাদের কাজের দিদি। পরিবারের কারোর জন্য সে কিছু করে উঠতে পারেনি, না ভাই, না বাপ, না পাগল বর না নিজের ছেলে মেয়ের কারুর জন্য না। এই কথাগুলো ওর নিজেরই কথা। দিদির দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আমার এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে নিজের হিসেবের খাতা খুলে বসি, কিছু ঋণ আছে কিনা দেখার জন্য। দেখি খাতা উপচিয়ে পড়েছে প্রাপ্তিতে।
অলঙ্করণ : সংহিতা পাল
জষ্ঠির এই দুপুরে সূয্যি যেন একহাত নীচে নেমে এসেছে! এত তাতে চাঁদি ফাটা তো সাধারণ কথা, লোহার রেল লাইনও যে গলে আলকাতরা হয়ে এদিক ওদিক গড়িয়ে আসছে না, একথা ভেবে রেবতী অবাক মানে! ওরে রোদ্দূর রে রোদ্দূর! আর এই ব্রহ্মতালু-তাতানো রোদে মাকড়াগুলোকে দেখো, হর্ন বাজিয়েই চলেছে! যেন বাবার বিয়ে লেগেছে! হাসিও পায় ওর! বাজা তোরা যত ইচ্ছে বাজা তোদের হর্ন, তাতে কার কী, রেবতী মণ্ডলের আঙুল উঠবে না তোদের কথায়! ও জানে, কখন স্যুইচে আঙুল রাখতে হয়, কখন তুলতে হয়! চাকরির বয়স এই শ্রাবণেই দুই বছর পুরো হবে ওর! বাইরে থেকে ভেসে আসা খিস্তি এই দু’বছরে অনেক শুনেছে ও! তাতে ওর কিচ্ছুটি যায় আসে না! ওদের মতো সক্কাল সক্কাল সে নিজে মুখখারাপ করবে না!
আজ নিয়ে চারদিন হল, মর্ণিং শিফট করছে রেবতী। মানে আর দুদিন। তারপর দুটো-দশটায় আসবে। মেয়েছেলে বলে ওকে নাইট দেয় না। কিন্তু নাইটেই আরাম ডিউটি করে, বিশেষ করে এই গরমের দিনে। সারারাতে এই লাইনে একটাও প্যাসেঞ্জার ট্রেন যায় না, কখনো সখনো একটা মালগাড়ি হয়ত টানল এই লাইনে। নাহলে তেইশটা বত্রিশের শেষ আপ ট্রেনকে পার করিয়ে হারান দা বা সাদিকুলরা ক্রশিং এর বার তুলে শুয়ে পড়ে ক্যাম্প খাটে! মোবাইলে মুভি চালিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেরাই টের পায় না, ঘুম ভাঙে সেই ফার্স্ট ট্রেনের খবর নিয়ে টেলিফোনটা ঝনরঝন করে মাথায় বাড়ি মারলে! ক্রশিং বার নামিয়ে ওরা রেললাইনের ধারে পেচ্ছাপ করতে দাঁড়ায়, যদিও লেভেল ক্রশিং এর গুমটি ঘরে টয়লেট আছে, রেবতী সেটাতেই যায়।
রেবতী মণ্ডল। সাকিন মনসাতলা, জিলা উত্তর চব্বিশ পরগণা। পিতা ঈশ্বরীয় গোপাল মণ্ডল। মাতা সবিতা মণ্ডল। গোপালের এক ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে রেবতীই বড়। ভাই নেপাল মণ্ডল ওর চেয়ে তিন বছরের ছোট। ওর বউ সোনা মণ্ডলকে রেবতী সেই বাচ্চাবেলা থেকে চেনে। বা, চেনে না, চিনল না! বুঝল না সেই মেয়ের পেটে পেটে এত! ভাইয়ের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা চলেছে কতদিন ধরে ভগবান জানে, হঠাৎ একদিন ভাইয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে একেবারে বউ হয়ে হাজির! ধ্যাবড়া করে কপালে, সিঁথিতে সিঁদূর ল্যাপটানো , আনকোরা একটা শাড়ি গায়ে লেপটানো! ওদের বাড়ির দরজায় তখন যাত্রা দেখার ভিড়! বেরো ঘর থেকে, মায়ের আগে রেবতীই বলেছিল। বলবে না কেন? ন্যায্য কথা বলতে রেবতীর কোনোদিনই বুক কাঁপেনি। আর এ তো মায়ের পেটের ভাই। বাবার মৃত্যুর একবছর পেরিয়েছে তখন সবে, কোন আক্কেলে তুই বলা নেই, কওয়া নেই, একেবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘরে ঢোকার সাহস করিস! এক বছরেই বাপকে ভুলে মেরে দিলি! মায়ের চোখে, দিদির চোখে জল তখনও ভালো করে শুকোলো না, ওই ধিঙ্গি মেয়েটার জন্যে হেদিয়ে গেলি! রেবতীর চণ্ডালে রূপ দেখে সেদিন সোনার কী কান্না! সত্যি কথা বলতে কী, মায়ের দিব্যি, ভাইয়ের জন্য নয়, ওই পুঁটুলি বাঁধা মেয়েটার দিকে তাকিয়েই সেদিন রেবতীর মন গলেছিল। দিয়েছিল ওদের ঢুকতে। কিন্তু ঢুকলেই তো হল না, ঘর তো সেই কুললে একটা। সামনের একফালি জায়গাটাকে যদি বারান্দা বলো তো বারান্দা। একটা সিঙ্গেল ক্যাম্প খাট কোনোরকমে পাতা। পিলু, মানে রেবতীর ভাই নেপাল মণ্ডল, ওখানেই শোয়। এখন ওরা দ্যাবা দেবী কোথায় শোবে, সে হুঁশ আছে! বাধ্য হয়ে মা-মেয়েতে ওই ক্যাম্প খাটে জড়ামড়ি করে শোয়। গরমের দিনে এ ভাবে ঘুম হয়! রেবতী তাই মেঝেতে নেমে আসে।
অথচ রেলের কোয়ার্টারে থাকতে কত হাত পা ছড়িয়ে থেকেছে ওরা! হলই বা সিঙ্গেল কোয়ার্টার। সামনে পেছনে বারান্দা, আর যে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম পায়খানা যেতে হত, সেই উঠোন-- সব মিলিয়ে সে তো জমিদারি! দিনে রাতে মিলিয়ে চার পাঁচ বার জল আসে। উঠোনের জামগাছটার কথা তো পিলু আজও বলে! রসগোল্লার মত বড়, কুচকুচে কালো জাম, খেতে খেতে জিভ ভারী হয়ে যেত, তাও আশ মিটত না! আশেপাশের কোয়ার্টারে বাটি ভরে মা জাম পাঠাতো! কতজন বলেছে, এত সুন্দর জাম, বাজারে ভালো দাম পেতে! মা জিভ কাটত! ‘গাছ কি আমাদের দিদি, যে বাজারে বেচব! ছেলেপুলে আনন্দ করে খায়, এতেই আমার দাম পাওয়া হয়!’ তখন বাবা সন্ধে হব হব সময়ে ঘরে ফিরত, সাইকেলটা কোয়ার্টারের পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে ঘরে ঢুকত। মা বলত, সাইকেল ভেতরে ঢোকালে না কেন! সন্ধের দিকে কিন্তু প্রায়ই চোর ঘুরছে, এই তো… মা বেত্তান্ত শুরু করার আগেই বাবা সাইকেল ভেতরে টেনে নিত, আর উল্টোদিকের পোস্টের আলোয় দেখা যেত, ওদের পাঁচিলের দেওয়ালে কালো আলকাতরার ওপর সাদা দিয়ে লেখা, জি. মণ্ডল। বি বাই ইলেভেন।
একটা সিলিং, একটা টেবিল, দুটো ফ্যান চালিয়ে বাবা টান হয়ে শুয়ে পড়ত বিছানায়, আর রেবতীকে বলত, টিভি টা ছাড় তো মা। খবরটা শুনি। রান্নাঘর থেকে মা বলত, আটটায় আমি কিন্তু সিরিয়াল দেখব! বাবা বলবে, কি এক সিরিয়াল দেখো রোজ রোজ! বলত বটে, কিন্তু সিরিয়াল শুরু হলে সময়ে সময়ে বলে উঠত, এ কি! ওদের ডাইভোর্স হয়ে গেছে নাকি! রেবতী হেসে উঠত, এই তো নাক ডাকাচ্ছিলে, হঠাৎ আবার কার ডিভোর্স দিয়ে দিলে! বাবা বলত, আজকালকার কারবার বুঝি না সব! ভাব হতেও দেরী নেই, ছাড়াছাড়ি হতেও দেরী নেই! মা বিরক্ত হয়ে বলত, থামো না বাপু! একটা সিরিয়াল দেখব, তখনই তোমাদের বাপবেটিতে যত বকরবকর শুরু হয়! রেবা, গ্যাসটা ছোট করে দে মা! তরকারিটা লেগে যাবে!
মা আসলে ওই ছাড়াছাড়ির কথাটা এগোতে দিত না। জানত, কথাটা কোথায় গিয়ে লাগবে। গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে, আগুনের তাতে কি না কে জানে, রেবতীর চোখ দুটো জ্বলে উঠত! আজও ও ভাবে, সত্যিই কি ও মানুষ চিনতে চিরটা কাল ভুল করে এল! নাকি ও নিজেকেই চিনতে পারল না আজও।
সোমনাথকে এতটা ভুল ভাবল! পরেও একবার দেখা হয়েছিল ওর সাথে। রেবতী লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল! লজ্জা পাওয়ার কথা তো ছিল সোমনাথের। রেবতীর যেটা হওয়ার কথা তা তো, ঘৃণা! কেন ও সোমনাথকে ঘেন্না করতে পারল না তারপরেও, ভাবলে নিজের ওপরেই ঘেন্না হয় ওর! যে ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল পরপর, তাকেই তো নিয়তি বলে! কপালের লিখন আর কী!
এমনিতে বিয়েবাড়ি টাড়ি কোনোদিনই খুব একটা যেতে পছন্দ করে না রেবতী। বান্ধবী বলতে সেই ইস্কুলের মুনমুন। রেবতী মুখরা বলেই সম্ভবত, সবাই ওকে এড়িয়ে চলত। এখন তো আরও! তো সেই মুনমুনের বিয়েতে যেতেই হবে। না বলা যাবে না! মা আগেই গেয়ে রেখেছিল, ওসব অসভ্যতা একদম করবে না! আমরা যাব, আর তুমি যাবে না, তা তো হয় না! আর তাছাড়া তুমি কোথাও না গেলে তোমার বিয়েতেই বা অন্যরা আসবে কেন! মোট কথা, ও মুনমুনের বিয়েতে গিয়েছিল। শুধু যায়নি, মুনমুনের ঝুলোঝুলিতে ওকে সকাল থেকেই থাকতে হয়েছিল। বাসরে ছিল। সেখানেই দেখা হল সোমনাথের সঙ্গে। তখন সোমনাথ দা। বিধাতার লিখন সেই রাত্রেই লেখা হয়ে গেল রেবতী মণ্ডলের! সোমনাথ দা মুনমুনের বরের বন্ধু। একাই বাসর জমিয়ে দিল! কাউকে দু”চোখের পাতা এক করতে দিল না সারারাত! রূপকথার সেই নায়কের দিকে তাকিয়ে রেবতী মণ্ডল ভুলে গেল, ও রেলের ডি গ্রুপ স্টাফ গোপাল মণ্ডলের মেয়ে, পাড়ার মোড়ে ছোট্ট মুদির দোকান চালানো নেপাল মণ্ডলের দিদি!
নিমন্ত্রিতরা সব চলে গেছে, বিয়েবাড়ির আলোয়, পরিত্যক্ত ফুলের গন্ধে ভাড়া-করা বিরাট বিয়েবাড়ি হা হা করছে! রেবতীর কেমন মাথা ধরে যায়! সোমনাথ নামে ছেলেটা বারবার যেন ওর দিকেই অদ্ভূত ভাবে তাকাচ্ছিল! রেবতীর বিরক্ত লাগছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল, আবার কিছু সময় পরপর, কিসের টানে কে জানে, ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছিল, ছেলেটা ওর দিকে আর তাকাচ্ছে কি না! মুনমুনের বর, অলোক দা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার বন্ধু সোমনাথ। এরপর সোমনাথ নামে ছেলেটা বাসরে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। হাসি, ঠাট্টা, গানে। রেবতী স্রেফ উড়ে গিয়েছিল।
সোমনাথ দা সম্ভবত সিগারেট খেতে বাইরে এসেছিল। রেবতীও তখন কেমন ভুতে পাওয়ার মত বাসর ঘর ছেড়ে উঠে এসেছিল। খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল যেখানে, সেখানেই একটা চেয়ারে বসেছিল সোমনাথ। সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে লেপটে আছে। মুখটা চকচক করছে ঘামে। ও যেন জানত, রেবতী আসবে! অথচ রেবতীই জানত না! সোমনাথ একটা চেয়ার ওর দিকে আলতো ঠেলে দিয়ে বলল, বোসো! চেয়ারটা রেবতীকে টেনে নিল! সোমনাথ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বলল, তোমাকে একটা কথা বলবার চান্স পাচ্ছিলাম না! বলে, কথাটা না বলে ও লম্বা করে সিগারেটে টান দিল। রেবতী ওর দিকে তাকিয়েই রইল। রেবতীর কী জ্বর এসে গেল! ওর কাঁপুনিটা কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না কেন!
আজকে সেসব কথা মনে পড়লে রেবতীর মনে হয়, ও কী আদৌ সেই রাতে বেঁচে ছিল? সোমনাথ কী ওকে জোর করেছিল বিয়েবাড়ির ওই ছোট ঘরটাতে যে্তে? না ওর নিয়তিই ওকে টেনে নিয়ে গেছিল ওখানে? সন্ধে থেকে পরিবেশিত নানা খাবারের গন্ধ তখনও ঘরময় লেগেছিল। বড্ড গা- গোলানো সে গন্ধ! এখানে ওখানে ছড়ানো ফুলের গন্ধও মিশে ছিল তাতে! মুনমুন কি খোঁজ করেছিল ওর, কোথায় গেল রেবতী? কিছুই কি মাথায় এলো না ওর? কালই মুনমুন চলে যাবে ওর স্বামীর সঙ্গে। রেবতী আবার একা হয়ে যাবে! ইস্কুলের পাট শেষ হয়ে গেছে কবে, কলেজে যাওয়া হয়নি। এখন মায়ের সঙ্গে কুটনো কোটা, ভাতের ফ্যান গালা, বাপ, ভাইয়ের কাপড় কাচা আর সন্ধে হলে টিভি সিরিয়াল দেখা, এতেই আটকে গেছে ও। বাবা অফিস থেকে ফিরলে দুটো কথা হয়। মা ওকেই বলে, সময় নষ্ট না করে পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনগুলোতে দাগিয়ে রাখতে! হাত অবসর হলে মা ওগুলো নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলবে! এর মাঝে সোমনাথ এলো বিজ্ঞাপনের খুদি খুদি কালো অক্ষরগুলোকে ছড়িয়ে, ছিন্নভিন্ন করে! জ্বরে কাবু হয়ে গেল রেবতী মণ্ডল!
মনে ঠাঁই দেবে না দেবে না করেও সেই অভিশপ্ত রাতের কথাই নানাভাবে তাড়া করে বেড়ায় ওকে! ওর মনে হয়েছিল, ওর সারা শরীরের গ্লানি, সমস্ত ক্ষত সকলের সামনে বে-আব্রু হয়ে গেছে! এ কী হয়ে গেল! আর মুনমুনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি ছিল না রেবতীর! ও শরীর খারাপের কথা বলে রাত থাকতে কোয়ার্টারে ফিরে এল! ডান হাতের রক্ত-ভেজা তর্জনী মায়ের ঘুম জড়ানো চোখের আড়াল করতে সমস্যা হল না! যেন আঙুলের ডগায় ও সোমনাথের একটা দাঁতই তুলে নিয়ে এসেছে! ঝরতে থাকা নিজের রক্তকে রেবতী চিনতে পারছিল না! এ অসম্ভব! একই সঙ্গে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি, অপরাধবোধ, গ্লানি, যন্ত্রণা, আনন্দ বা আরো কতকিছু দলা পাকিয়ে ভার হয়ে রেবতীর চোখে চেপে বসেছিল। ভোরের দিকে এক গভীর ঘুমের মধ্যে রেবতী হারিয়ে গেল! মা যখন ডেকে তুলল, তখন গায়ে জ্বরের তাপ ওর নিজেকে লুকোনোর বর্ম হয়ে ওকে বাঁচিয়ে দিল! মা মুনমুনদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে খবর দিল, মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছিল। তুই একবার গেলে পারতিস!
মুনমুনের বাড়ি রেবতী গিয়েছিল ও অষ্টমঙ্গলায় বাসায় আসার পর। অভিমান হয়েছিল মুনমুনের। তাই নিজের আসার খবর রেবতীকে জানায়নি ও।
মা বলল, মুনমুন এসেছে?
জানি না।
ফোন করেনি?
না।
মা বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, এসেছে নিশ্চয়ই। তুই যা একবার। মেয়ের অভিমান হয়েছে। সেদিন তুই শরীর খারাপের পর চলে এলি। আর তো গেলি না! সেটা যে রেবতী বোঝেনি, তা নয়। তবু কেমন যেন এক জেদ চেপে বসে ওর! কেন ও নিজে থেকে যাবে! আবার ভাবে, মুনমুন এখন সোমনাথের দেশের মেয়ে। মুনমুনের সঙ্গে কথা মানে, সোমনাথের খবর পাওয়া। সে মানুষ কী করে, কোথায় থাকে, বাড়িতে কে কে আছে, কিছুই তো জানা হয়নি সেদিন! এইসব ভাবনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল মুনমুনের বাসায়।
মুনমুনকে দেখে রেবতী অবাক হয়ে গেল! মাঝখানে মোটে কয়েকটা দিন, মুনমুনটা কেমন দূরের মানুষ হয়ে গেছে! রেবতীর সঙ্গে ওর কথাবার্তা যেন দুই বন্ধুর কথা নয়, এক বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে এক অবিবাহিতা মেয়ের কথা! অথচ আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই! এই ব্যবধান যেন প্রাকৃতিক, অনিবার্য!
দুপুরে রেবতীকে কিছুতেই ছাড়ল না মুনমুন। সবাই একসঙ্গে খাবে ওরা! রেবতী আপত্তি করেছিল। অলোক দা বলল, আমরা এমন কিছু খারাপ লোক না! বিশ্বাস করতে পারেন! কথাগুলো হুবহু মনে আছে রেবতীর!
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মুনমুন আর রেবতী যেন বন্ধু হয়ে ফিরে এল! দুই সখী ভেতরের ঘরে কলকল করছিল। মুনমুনই বেশি! রেবতী কিছু কথা শুনছিল, কিছু কথা হারিয়ে ফেলছিল। ভাবছিল, একবারও সোমনাথের কথা উঠছে না তো! মরিয়া হয়ে রেবতীই তোলে কথাটা! হালকা পরিহাসে মুনমুনই বলে, খুব মনে ধরেছে যে! রেবতীকে তখন কথায় পেয়েছে! এখান থেকে একটু কিছু শুনে যাওয়ার পরে ও মা’কে বলবে, এবার বিজ্ঞাপন দেখা বন্ধ করো, মা!
সবটা কি বলতে পেরেছিল রেবতী? এখন সত্যিই মনে পড়ে না! বন্ধুর কাছে নাকি সব বলা যায়? সওওব? সত্যিই? রেবতী জানে না! তবে সদ্যবিবাহিত মুনমুনকে সবটা বলতে হয়নি! ও কয়েক মুহূর্ত কেমন ভাবে যেন তাকিয়েছিল রেবতীর দিকে, তারপর নিজেই কেঁদে ফেলেছিল ঝরঝর করে! রেবতীর সালোয়ার মুঠো করে ধরে ওকে টেনে তুলে বলেছিল, সোমনাথের একটা ছেলে আছে রে রাক্ষসী! তুই এ কী করলি! তোর অলোক দা শুনলে….
শুনতে পায়নি রেবতী আর কিছু! ওর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোয়নি, বেরোয়নি চোখ দিয়ে একফোঁটা জল! ও যেন কোথাও নেই! না মুনমুনের বাসায়, না নিজের ! ওর বাবা, মা, ভাই কেউ আছে? সোমনাথ? সোমনাথ বলে সত্যিই কেউ আছে পৃথিবীতে? রেবতী? রেবতী বলে কেউ আছে? ওর এখনও মরণ হচ্ছে না কেন? মুনমুনরা তো ওকে মারছে না! কেন? তাড়িয়ে দিচ্ছে না তো বাড়ি থেকে? অলোক দা বিশ্বাসের কথা বলেছিল, অলোক দা কি ওকে বিশ্বাস করতে পারবে? মুনমুন নিজে? কোথায় চলে গেল মুনমুন? আলোক দা’র কাছে? এ কি ওকে চলে যেতে বলা নয়?
চোরের মত সেদিন মুনমুনের বাসা থেকে চলে এসেছিল রেবতী। ফিরেওছিল নিজের বাসায়। জি. মণ্ডল, বি বাই ইলেভেন নামাঙ্কিত কোয়ার্টারে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল, এই আশৈশব আস্তানাতেও ও অনাহূত হয়ে পড়েছে। কেউ কিছু বলেনি, কাউকে কিছু বলতে হয়নি, বাড়ির অন্যদের এই নিস্পৃহ উদাসীনতা রেবতীকে আরও ভয়ের গর্তে ঠেলে দিয়েছে! হয় সকলে ওর বাইরে, বা ও সকলের সামনে একটা পাঁচিল তুলে দিয়েছে। রেবতী এখন একা! এই অসহ্য একাকীত্বই ওর কাঙ্ক্ষিত ছিল কি না, রেবতী বুঝতে পারে না!
আরেকটা বড় ঝড় না এলে আগের ঝড়ের স্মৃতি মানুষ ভুলতে পারে না। কথাটা বলেছিলেন রেবতীর ইস্কুলের বাংলার দিদিমণি। সেই দিদিমণি, যিনি ভালো মুখ করে রেবতীকে বলতেন, প্রায়ই বলতেন, পড়াশোনাটা একটু ভালো করে কর। তোরা তো রিজার্ভড। চাকরির পরীক্ষায় টেনেটুনে দশ পেলেই তোরা পাস! কথাটা কতবার, কতরকম করে যে রেবতীকে বলেছেন চৈতালি ম্যাম! ব্রাহ্মণ বাড়ির বউ চৈতালি মুখোপাধ্য্যায় এরপরই সকলের সামনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতেন, আমাদেরগুলোর যে কী হবে, কে জানে!
আজ, এতদিন পরে, সেই চৈতালি ম্যামের কথাগুলো মনে পড়ল। এই ঝড় কি ও চেয়েছিল? নাকি ঝড় ঘনিয়ে এনেছিল ও নিজেই?
বাবা গোপাল মণ্ডল ছিল গ্যাংম্যান। বড্ড পরিশ্রমের চাকরি। সারাবছর, রোদে জলে লাইনের ওপর কাজ। সবিতা, রেবতী দুজনেই মনে করিয়ে দিত, সাবধান হওয়ার কথা। দুদিকে ভালো করে দেখে নিতে হবে, ট্রেন আসছে কি না! গোপাল হাসত, ওদের ছেলেমানুষী উদ্বেগ দেখে! একটা লাইনের কাজ কত লোকের নজরদারিতে হয়, জানিস? সবই জানে রেবতীরা। তবু এসব কথা বলা। একসময় এসব নিয়ে আর কথা হত না। হত অফিসের অন্য কলিগদের নিয়ে, সাহেবদের নিয়ে গল্প। ছেলে দোকান আগলিয়ে এসব শোনার সময় পায় না। অথচ ছেলের জন্য কোন সাহেবের কাছে তদবির করা হয়েছে, তার কথাই বেশি করে বলত গোপাল। সবিতা বলত, ছেলেটা তো তবু যা হোক, একটা দোকান করছে। ঠাকুরের আশীর্বাদে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পারছে। তুমি রেবার কথাটা ভাবো। চাকরি থাকতে থাকতে ওর একটা কিছু নাহলে, রিটায়ার করার পর সে দম থাকবে! রেবতী শক্ত মুখে প্রতিক্রিয়া দিত, আমার কথা ভাবতে হবে না, মা। এক কথা বারবার বলবে না! এরপর এক কথা, দু’কথায় মা- মেয়ের তুমুল লেগে যেত! সবিতা লড়াইয়ের শেষ অস্ত্র হিসেবে ঠারে ঠারে ওর কপালের কথা, ওদের কপালের কথা তুলত। সেই এক কথাতেই জোঁকের মুখে নুন পড়ত। গোপাল আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে যেত! এক ভারী নৈঃশব্দ্যের চাদর মুড়িয়ে বি বাই ইলেভেন রেল কোয়ার্টারে সন্ধে নেমে আসত। অনেক পরে সবিতা তিনবার শঙ্খে ফুঁ দিয়ে সেই নীরবতাকে খানখান করে দিতে চাইত!
এরকমই এক সন্ধেয়, ফোনে নয়, এক রেলকর্মচারী মারফৎ গোপালের অ্যাকসিডেন্টের খবর এসেছিল। বলা হয়েছিল, সিরিয়াস! ওদের জানানো না হলেও গোপাল তখনই সমস্ত ঘটন-অঘটনের ওপরে চলে গেছে! সমস্ত কিছু মিটিয়ে গোপালের নিথর, দলা পাকানো দেহ যখন কোয়ার্টারের বারান্দায় আনা হল, তখন একমাত্র রেবতী এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি! হাজার বার বলা সত্ত্বেও একবারের জন্যও বাবাকে দেখতে বাইরে এসে দাঁড়ায়নি! পারোলৌকিক কাজে সারাক্ষণ পিলুর পাশে বসে থেকেছে। ওড়না দিয়ে বাবার ছবি মুছে দিয়েছে মাঝে মধ্যেই, যেন বাবার চোখের জল কেউ না দেখে ফেলে!
গোপালের অফিসের লোকেদের, ইউনিয়নের উদ্যোগে রেবতীর চাকরি হল রেল দপ্তরে। গেটম্যানের কাজ। সোজা কথায় লেভেল ক্রশিং তোলা নামানো। সময় লেগেছে অনেক, ছোটাছুটি হয়েছে বিস্তর। কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হয়েছে এর মধ্যে। হাত পা ছড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত পরিবারটির ঠাঁই হয়েছে এক কামরার অপরিসর ভাড়া বাসায়। গুটিয়ে ছোটো হয়ে গেছে গোটা পরিবারটাই। সবিতা থম মেরে গেছে, পিলু দোকানের কাজে বা অন্য অকাজে বাইরেই কাটায় বেশি সময়। ঘরের সঙ্গে তার সম্পর্ক খাওয়া আর ঘুমের! এ যেন বাকিদেরও স্বস্তির! কী কথা বলবে, ওরা নিজেরা? তার চেয়ে যে যার মত সময়গুলো পার করে যাচ্ছে, এই ভালো! বিয়ে করে আনার পর ছেলে ঘরমুখী হয়েছে তাও।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে রেবতীর। চাকরি পেয়ে আর্থিক সুবিধা হয়েছে গোটা পরিবারের, কিন্তু এই চাকরি রেবতীকে যেন প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, এ ওর বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহের বিনিময়ে পাওয়া! আর সেই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী রেবতী মণ্ডল! এ চাকরি ও নিজের যোগ্যতায় পায়নি, এমনকি চৈতালি ম্যাম ওকে যে কারণে খোঁটা দিয়ে গেছে তার জন্যও পায়নি! এ চাকরি ওর নিজের অভিশপ্ত জীবনের শাস্তি! এই চাকরির ভার ওকে বহন করে যেতে হবে সারাজীবন!
আজ, এতদিন পরে, বন্ধ লেভেল ক্রশিং এর দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের অস্থির অপেক্ষাতে রেবতী এক অদ্ভূত আমোদ অনুভব করে! এদের প্রত্যেকের নিয়তি এখন বাঁধা পড়ে আছে রেবতী মণ্ডলের তর্জনীর ওপর! কারা আছে বাইরে, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে, অপেক্ষায়? সোমনাথ, অলোক দা, মুনমুন, চৈতালি ম্যাম, পিলু, সোনা, এরা? আর কারা? রেবতী ওর দষ্ট আঙুলের দিকে যত্ন করে তাকায়! তাকিয়েই থাকে! ও পারে, এই আঙুলের চাপে এতগুলো আটকে থাকা লোককে শাস্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে! আবার এই আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওর পুরোনো ব্যথাটা যেন জেগে ওঠে! ব্যথাটা ওই আঙুল থেকে পুরো শরীরে চারিয়ে যায়! সেই ব্যথাই রেবতীর সামনে গোপাল মণ্ডলকে এনে দাঁড় করায়! এই আঙুল কি গোপাল মণ্ডলের মরণচিহ্ন হয়ে থাকেনি ওর শরীরে? রেবতীর চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়! ওর দু’চোখে প্লাবন নামে। রেবতী আস্তে আস্তে স্যুইচে ওর আঙুল ছোঁয়ায়। দুই ধারের লেভেল ক্রশিং এর লোহার দণ্ড ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে আস্তে আস্তে। যেন রেবতী মণ্ডলের দুই হাত আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলতে চায়। অদৃশ্য, অথচ রেবতীর কাছে দৃশ্যমান কাউকে!
রেবতী সকলকে মুক্তি দেয়!
গল্পের পাতা থেকে , শব্দটি ছাপার পোষাক বদলে ,আমার বুকের অতলে ঢুকে গেল।
বইটা রেখে, জানলা ধরে তাকিয়ে রইলাম। তা-কি-য়ে-ই রইলাম। আমার নাকের রন্ধ্রপথে স্মৃতির নিঃশ্বাস।
বিস্ময় হল, কত যুগ পর একটা পরিচিত, মুখে মুখে ঘোরা শব্দ, বইয়ের পাতায় হঠাৎ আমার নজরে এল। একটা নাম।
ব্যথায়, শিহরণে, রহস্যে, ভেতরটা ক্রমাগত মোচড়াতে থাকে।
একটি নদীর নাম। কালিজিরা।
গল্পটির লেখক একজন প্রবীন। ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এক কি দেড় দশক আগে গত হয়েছেন। কোনো ‘স্টার’ লেখক কিংবা মিডিয়ানন্দিত ছিলেন না। হতেও চাননি, কোনো আপশোস ছিল না। খোলামেলা, দৃঢ়চেতা দায়বদ্ধ মানুষ একজন। তরুণ লেখকদের গভীর মমতায় দেখতেন। তাঁরাও কাছে বসে থাকলে বটের ছায়ার মতো স্নিগ্ধ শান্তি বোধ করত।
গল্পটি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম,অদ্ভূত! তালে তিনিও নদীটিকে চিনতেন? তাহলে পূরাণ কিংবা রূপকথার নদী নয় কালিজিরা! খাঁটি বাস্তবের!
আখ্যানটি শেষ করে বুঝলাম, তিনিও জীবনের কোনো পর্বে কালিজিরার তীরের কোনো গ্রামে ছিলেন। অবশ্যই আমাদের ভিটে গ্রাম নয়। গল্পে যে-গাঁ-গুলোর উল্লেখ পেলাম, আমাদেরটি ছিল না। লেখক নাকি কালিজিরার স্মৃতিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপন কান্নায় দেশ ত্যাগ করেছিলেন। নিজদেশে পরবাসী হয়ে পড়ার সাথে সাথেই। সেইসব স্মৃতি ও চাপা অভিমানের গল্প এটি। যেমন, ‘...তোমাদিগের মন এবং দেহের যাবতীয় দুষিত বর্জ্য পদার্থ আমি পূর্বের ন্যায় এখনও বহিয়া লইয়া যাইতেছি কালিজিরা নদীতে, যে তাহা লইয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে, কীর্তনখোলা সে-সব তুলিয়া দিতেছে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
গল্পটির বিষয় একটি নদীর আত্মকথা। সন্ধ্যা নামের নদী। এ নামটি আমার পরিচিত নয়। বুঝতে পারলাম, শৈশবে ছেড়ে আসা আমার জন্মভিটার আশপাশ দিয়ে অনেক নদী ছিল। জটাজালের মতো। সন্ধ্যা, কালিজিরা বা কীর্তনখোলা-রা স্নায়ুজালে জড়িত স্বচ্ছ পানিবহা আত্মীয় নদী। যেমন পারিবারিক ভিটায় জ্ঞাতিসহ পিতামহ, প্রপিতামহদের দিনগুলো বয়ে গেছে।
বইটির পাতা আবার খুললাম, চোখ বোলালাম, বন্ধ করলাম ফের। ততক্ষণে বুকের তলায় ‘কালিজিরা’ শব্দটি চোরাডুব দিতে দিতে আমার চোখের ঢাকনা দুটি ভিজিয়ে দিল। জীবনের দীর্ঘ বছরে যা শুখা, খরখরে হয়ে আছে।
দেশ ছেড়েছিলাম তিন কি সাড়ে তিন বছরে—সেসবের স্মৃতি ঝাপসা। ঝাপসাটুকুও এখন উই-য়ে কেটে রেখেছে।
এ দেশে ভাসতে ভাসতে এসে টিপ টিপ মনে পড়ছে, বাপ মায়ের সঙ্গে ভুখা সংসারে, আমার যখন উপোসী কৈশোর, মা একদিন ম্লান হেসে আমার মাথায় হাত রেখে, স্নেহের ছোঁয়ায় বুঝিয়েছিলেন, কি করবি আর বল? কালিজিরা নদীই আমাদের সংসারের বিপর্যয়ের মূল!
সেদিনও টের পাইনি, মায়ের চোখমুখে একটু বাঁকা হাসির অভিনয় থাকলেও, আমার মাথায় স্নেহের আড়াল দিয়ে, কেন চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করেছিল।
কালিজিরা! কালিজিরা!
সেদিন নদীর নামটিকে নিছক রূপকথার মনে হয়েছিল।
পার্টিশনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাকি প্রাণ হাতে, রাতারাতি এক-কাপড়ে কালিজিরা বেয়েই, কীর্তনখোলায় পড়ে, লুকিয়ে বরশাল শহরে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। য়াজ অত গভীর স্মৃতি ভেদ করার ক্ষমতা মরে গেছে। তবে ঐ অতিসুদূর অস্পষ্ট, উইয়ে কাটা দু-চারটে টুকরো খুঁজে পেতে পারি।
একটা স্যাঁতস্যাঁতে, ছায়াছায়া বাসার একতলায় আমরা ঠাসাঠাসি। কীর্তনখোলার তীর। দরজায় দাঁড়ালেই নদী, এবং ওপারটায় দাউদাউ আগুন। শ্মশান। দেশের বুলিতে সরকখোলা।
অতিসুন্দরী, আমার জ্ঞাতিবৌদিটির একটুকরো হাসির ঝিলিক, চোখ বুজলে, সরকখোলার আগুনের মতো চোখে ভাসে। রাস্তার কাকে যেন ত্যাগের হাসি দিয়ে বলছে, আজ আমাদের অরন্ধন!
...গান্ধীজি খুন হয়েছেন যে!
ঐ বউদিটিকে সেদিন খুবই সুন্দরী লাগছিল। কথা বললেই চোখদুটি কেমন ঝলমল করে!
এ-দেশে জ্ঞাতিবন্ধন ছিঁড়ে যে-যার ছিটকে গেলেও, বিচ্ছিন্নতা ও বোধবুদ্ধি জন্মানোর পর মুখটা মনে ভাসলে একটু লজ্জা লজ্জা লাগত ভেতরে। গোপনে কল্পনা করতাম, আমার ওরকমই একজন আসবে হয়তো!
বিচ্ছিন্নতার পর, কৈশোর-যৌবনের সন্ধিজুড়ে একটানা অভাব ও ব্যর্থতার দিনগুলোয়, আমাদের ঝমঝমে এক বৃষ্টির বিকেলে, আমার অবিবাহিতা আঠাশ বছরের দিদি, মা-কে বেআব্রু থ্রেট দিয়ে বলে উঠেছিল, যে-দিকে দুচোখ যায়, চইল্যা যামু!
ছিঃ! ছিঃ! মা দাঁত ঘষে বলেছিল, লজ্জার মাথা খাইছ!
আমার বুঝি শরীর নাই?
ততোধিক চাপা হুঙ্কারে মা, এ সন্তানরে ক্যান আঁতুরঘরে মুখে লবণ দিলাম না!
দিদি দৌড়ে দা-খানা মা-র হাতে দিতে দিতে ফুঁসেছিল, মারো! মারো!
গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ফের, এখন কোপ দিয়া শান্তি পাও!
পরমুহূর্তেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে আকুল কান্না! ফোঁপানি। আমি স্তম্ভিত।
কালে খাঁ নামের মুসলমান অনুচরটি আমাদের----বাবার একান্ত অনুগত----ঝুকঝুকে ভোরের কুয়াশায় একদিন আমাদের শৌখিন কাঠের দোতলা বাড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে অশুভ কণ্ঠে ডেকে উঠেছিল, ওঠেন কত্তা! ওঠেন! সব্বোনাশ হইয়া গ্যাছে!
বিপর্যয়ের নাকি শেই শুরু।
বাবার মালিকানায় গড়ে তোলা কন্ট্রোল দোকানটির চাল-চিনি-কাপড়-কেরোসিন বোঝাই দুটি নৌকোর জলসমাধি হয়েছে কালিজিরায়। অন্তর্ঘাত। বাবার তখন হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ। গ্রামের অনেক হিন্দু প্রতিবেশীর ঈর্ষা। উপরন্তু আগের বছর শ্রাবণে কলকাতায় মহাদাঙ্গা ঘটে গেছিল।।
শুনেছি, যুদ্ধের পিরিয়ডে বাবা ছিলেন এ-পারে। বর্ধমান জিলায়। বাঁকুড়াতেও থাকতেন মাঝে মাঝে। দু হাতে অর্থ কামিয়েছিলেন। সিভিল কনট্রাক্টরির কাজ। বর্ধমানের জনৈক জোতদার বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে।
হঠাৎ যুদ্ধ থেমে গেলে , জোতদার বন্ধুটি নাম আজও ভুলিনি, শিবশঙ্কর গড়াই, নাকি পরামর্শ দিয়েছিলেন, মিতা, কি হবে দেশে গিয়ে? এ-পারে থেকে যাও!...জমিজিরেত, পুকুর-বাগান সস্তায় কিনিয়ে দেবখন… বাকি জীবন লপচপিয়ে কেটে যাবে… যা সব খবর আসছে, কালনেমির লঙ্কা ভাগ হবেই!
বাবা হাসতে হাসতে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেজাজি মানুষ ছিলেন তো!
মিতা, তোমার এ-দেশে পোস্ত আর বিউলির ডাল খেতে? আমার ছ’পুরুষের ভিটে!... একবার তো দেখে এসছ!
বুঝলুম ভাই!...দেশটা ভাংলে? পার্টিশন হয় যদি, যা শুনছি?
এ-সব বড় হয়ে আমার মায়ের কাছে শোনা। বাবা ফিরে এসে জমির পর জমি, পুকুর, কন্ট্রোল কিনলেন।
এর কিছু পরই শেষ রাতে একদিন ঝুপসি ভোরের কুয়াশায় কালে খাঁ-র কণ্ঠ । সারাদিন ঘরে লুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে, কালে খাঁর নির্দেশিত পথে কালিজিরার ঘাটে আসা। কপর্দখীন, এক- কাপড়ে সব কিছু পিছনে ফেলে বাবার প্রাণটুকু রক্ষা করতে কালে খাঁ মরিয়া। ভাগ্যবিপর্যয়ের ছিল ওটাই শুরু।
আজ বার্ধক্যে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাই। মনে পড়ে, সব খুইয়ে এ পারে মাথা গুঁজলেও, বাবার রুক্ষ বেপরোয়া মেজাজে ঘাটতি ছিল না। আমাকে অকারণে শাসন করত। হুকুমের পানটি থেকে একটূ চুন খসলেই কান ধরে একপায়ে রোদে আধঘন্টা। কৈশোরের সামান্য চপলতা দেখলেই হল! ভাঙা কাঠের চ্যাপ্টা ছোট্ট একটি ব্যাট বানিয়ে পাড়ায় আমি গাম্বিল বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। আমার প্রিয় খেলা। একদিন শীতের খুব সকালে উঠিয়ে, ঘরের দা খানা তুলে দিয়ে হুকুম দিলেন, নিজের ব্যাট নিজেকেই ফালাফালা করতে হবে। শেষে কাঠগুলো উনুনে গুঁজে দিলেন। আগের রাতে, কিছু জোটাতে পারেনি বলেই নির্জলা উপোস।
শেষে আমার বয়ঃসন্ধিতে, স্বপ্নদোষের ভয় কেটে যাওয়ার পর যখন জ্ঞান হল, দারিদ্র ও ক্ষুধার হাত থেকে সংসার বাঁচাতে উনি অক্ষম, আমি প্রবল জেদে বাবাকে উপেক্ষা করতে শিখলাম। তত বেশি তিনি আমাকে অভিশাপ দিতে থাকলেন। গায়ে হাত কিংবা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার হুকুম দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাঁর প্রতি আমারও কোনো সহানুভূতি ছিল না, উপরন্তু অসমর্থ শরীরে বাবার নখদন্তহীন স্তিমিত গর্জনকে আমি ব্যঙ্গ করতে শিখলাম।
মনে আছে, একবার সংসারের ঘটি-বাটি এটা-ওটা বিক্রিবাট্টার পরও, টানা দুদিন উপবাসে। দিদির ঐ সংসারত্যাগের অবুঝ হুমকির কিছুপর, বাবা একদিন ভিক্ষে করতে নামলেন। যথাযথ ভিক্ষে যাকে বলে। খাড়া দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরতে , বাবার ম্লান শুকনো মুখটা দেখেমজা হয়েছিল আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে ঝুলিটা তুলে দিতে, মা নাকের আড়ালে শাড়িটা তুলে, থলিটা নিল। তখন উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মার মুখটা দেখতে চাইনি। পরে, সবাই গোল হয়ে বসলে, বাবাকে শুনিয়ে বলেছিলাম,ভিক্ষের ভাত আমি খাই না। মর! মর তুই! বাবা দুর্বলভাবে রুখে উঠলেও, ভাতের থালা ছেড়ে গেলেন না। দেহের শক্তি , মনের জোর হারিয়ে গেছে। সেদিন আর কি কি বলেছিলাম,এতদিনে কিছু মনে নেই। তবে, পেট ভরে খেয়ে, লুকিয়ে লক্ষ করেছিলাম, বাবা গোপনে কাঁদছেন। দাপুটে, স্বৈরাচারী মানুষের চোখের জল তৃপ্তি এনেছিল।
বাবা বিদায় নেবার আগেই সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছিল। তবে অভাব আমার ভেতর যে-দাগ টেনে দিয়েছিল, স্বাচ্ছল্যে বেপরোয়া হতে দেয়নি। মিতব্যয়ী ছিলাম। তবে দরজায় এসে কেউ হাত পাতলে ভিক্ষে দিতে ছুটে যেতাম, বুকটা গুরুগম্ভীর হয়ে যেত। বাবা কিছুটা অথর্ব, কিন্তু স্বমেজাজটুকু শেষদিকে উগ্র হয়েছিল কেবল মায়ের ওপর। মাকে সইতে হত। আমিও জীবনের কোনো গভীর সত্যের কথা ভেবে , বিচারক সাজতে যেতাম না।
বিয়ে করিনি তখনও কল্পনায় তবে, সুন্দরী জ্ঞাতিবৌদির মতো আমার বউ জোটার য়াত্মরতি অনেক আগেই মিলিয়ে গেছল। সাংসারিক বুদ্ধিতে শান পড়ছিল প্রচুর। রাষ্ট্রের কাছে রিফিউজি বনবার অধিকার ফলাতে পোক্ত হয়ে গেছলাম। নতুন কোনো ইতিহাস তৈরি হবে , এই সব সংকল্প ধারালো হয়ে উঠছিল। তবু আচমকা কখনো পশ্চিম আকাশে চোখ গেলে, ডগডগে ঢলন্ত সূর্যটাকে দেখে মুগ্ধ চোখে স্থির থাকতাম। আহাঃ! একটা মোচড় হৃৎপিণ্ডে অনির্বচনীয় হত।
এক ছুটির বিকেলে মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ থেকে বাবার রক্ত-পাইখানার খবর এল। স্বাভাবিক উঁকি দিয়ে দেখি, বাবার মুখটা নীচে। মেঝেমুখীন। আগের মতো ভাঙা ঘরে জল পড়ে না। আমি ঝকঝকে, তকতকে করে দিয়েছি। অনিচ্ছাতেই, কারণ মা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে থাকত।
অ্যাম্বুলেন্স জুটিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতার বড় একটা হাসপাতালে নিয়ে গেছলাম। সেকালে তখনও নার্সিং হোম গজিয়ে ওঠেনি। সাধারণের জন্য হাসপাতালের সুযোগ মিলতে কথায় কথায় মন্ত্রী-সান্ত্রীদের পাকড়াও করতে হত না, কিংবা দালালরাজ! হাসপাতালে কারও হয়ে রাত কাটানো ছিল যৌবনের ধর্ম।
বাবাকে ভর্তি করিয়ে আমরা ফিরে এলাম। কেউ আমাদের জানায়নি, সেখানে রাতকাটানো প্রয়োজন। পরদিন দুপুরে স্থানীয় থানার একটা কনস্টেবল খবর দিয়ে গেল। গিয়ে দেখি, বেড ফাঁকা। সাদা চাদরে ঢেকে বাবাকে পর্দার ঘেরে শুইয়ে রাখা। উঁচু পেটটা অস্বাভাবিক ফোলা। একজন মাঝবয়সী পেসেন্ট আমাদের বলল, আপনাদের মধ্যে পুটু কে? বললাম, আমি! পেসেন্টটি বলল, মাঝরাতে পুটু! পুটু! বলে খুব নাকি ছটপট করেছিল।
দিদির প্রসঙ্গ তুলব না আর; আত্মগ্লানির হাতুড়ি হৃৎপিণ্ডে আমার ঘা মারতে থাকবে। এইসব ঘটনার দু’দশক পর মা গত হল। কোমরের হাড় ভেঙে দু”দুটি বছর শয্যাগত কাটিয়ে, বেডপ্যান এবং আমার স্ত্রীর সেবাযত্নের ধমক-ধামক শুনে, আয়া রেখে দিলেও বা কী হয়, একদিন সকালে চাক্ষুষ দেখলাম প্রাণবায়ু কীভাবে উড়ে যায়। রেডিওতে তখন ফিরোজা বেগমের পরিচিত একটি নজরুলগীতি বাজছিল। অসুস্থতার শেষ দিকে মার কোনো বিবেচনাবোধ ছিল না। বাড়ির সকলের কাছে হাত পাতত খাওয়ার জন্য। ভেতরে একটা ধিকিধিকি ধারণা জেগে থাকত, তাকে খেতে দেয়া হয়নি। অথচ, ঘনঘন বিছানা ময়লা হোত। মনে আছে, তিন বছরের নাতনিটাকে দেখে হাত পাততে, সে লূডোর ছক্কাটা দিয়েছিল, অমনি মা টপ করে মুখে। ভেবেছিলাম ঐ-ছক্কার কারণেই হয়ত মা মরে যাবে, কিন্তু দিব্যি বেঁচে ছিল। অথচ ফিরোজার গানের সকালে তার মরণে কোনো ইঙ্গিতই ছিল না।
সব কিছুরই জন্মের চেয়ে মৃত্যুর কারণ অধিক অজানা। তা প্রাণবায়ু হোক, কালিজিরায় কোনো কিছুর জলসমাধি, কেবিনেট মিশন, কিংবা ইতিহাসের কোনো সম্ভাবনাময় মৃত্যুর। তা জন্মভিটাও হতে পারে।
আখ্যান ছেড়ে, কালিজিরা শব্দটি উঠে এসে আমার বুকের অতলে সাঁতরাতেই থাকল, ওটি কোনো বাস্তবের নদী ছিল কি না!
‘দি টিউলিপ বার’, সাইনবোর্ডে ঝোলানো নামে ফুলের বাহার থাকলেও বারের ভিতরের চেহারাটা প্রায় নরকতুল্য। তাই বলে খদ্দেরের অভাব আছে তেমনটা নয়। ‘গুলজার’ শব্দটা নরকের পাশেই বেশি মানায়, তাই মাঝ রাতেও ‘দি টিউলিপ বার’ থেকে ভেসে আসে উন্মত্ত উল্লাস…
সেই উল্লাসে কতটা কান্না আর কতটা হা-হুতাশ মিশে থাকে তা অবশ্য মেপে দেখা হয়নি। এখন রাত প্রায় বারোটা। গোটা ছয়েক টেবিলের প্রায় সব কটাই ভর্তি। প্রতিটা টেবিলের মাথায় ঝুলছে নিভন্ত হলুদ বাতি। বারের বাকী অংশ অস্পষ্ট অন্ধকারে ঢাকা। আনাচ কানাচে জমে থাকা দারিদ্র্য আর অযত্ন যে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বাঁচে।
একদল ঝাঁঝালো দেশি আর নরম বিলিতি মুখোমুখি বসে মদ খাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেশী-বিলিতির গেলাস বদল হচ্ছে। চড়া পেটে বিলিতি আর ভরা পেটে দেশী পড়লে মৌতাত জমছে দ্বিগুণ…
স্টেজের ঠিক সামনে লম্বাটে টেবিলটায় এখন যারা বসে আছে, তাদের বিত্তে মিল না থাকলেও তারা এক গেলাসের ইয়ার। একমাত্র মাতালরাই অনায়াসে ‘বিত্তের কাঁটাতার’ পেরিয়ে যেতে পারে। এদের মধ্যে একজন হল সেলস এক্সিকিউটিভ বিমান গাঙ্গুলী। কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। তাতে যে বিশেষ দুঃখ হয়েছে তেমন নয়, কিন্তু পেটে মদ পড়লেই বিমানের শোক উথলে ওঠে। ইদানীং বেশ্যাবাড়ি যাচ্ছে, বেশ কিছু বাড়তি পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে। শোকটা বোধহয় বেশ্যার খুঁটে বাঁধা। চোখের জলটা সেই কারণেই…
আজ বিমান গাঙ্গুলী কিছুতেই থামতে পারছে না। টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিস রুপালির ঘষা গলার গান ওকে এতটুকুও উত্তেজিত করতে পারেনি। নেশা আর কান্নার বেগ সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সেই সুযোগে বিমান গাঙ্গুলীর রামের বোতল ফাঁকা করে দিয়ে গজা ঝিম মেরে বসে আছে। এই গজা আদতে চোর। যদিও টেবিলের বাকী মানুষ তা জানে না। তার পরিচয় টিকিট ব্ল্যাকার। ইদানীং ব্যাঙের ছাতার মতো সিনেমাহল গজিয়েছে। কোনো হলই হাউসফুল হয় না। কিন্তু তাই বলে গজার ব্ল্যাকার উপাধি কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। চুরিটা পেটের দায়েই করে, যদিও এই নিয়ে ওর অনুশোচনার শেষ নেই। বিমান গাঙ্গুলীর পিঠে বার কতক হাত বুলিয়ে জড়ানো গলায় গজা বলল, “একটু চোলাই খাও ভাই, জ্বালাটা জুড়োবে। এই কারণে আমি কোনো লেডিসের চক্করে পড়ি না।”
জ্বালাটা যে আসলে কীসের সেটাই বিমান গাঙ্গুলী নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি। আজ বেহালাটা শোনার পর থেকেই...
বিমানের ঠিক উল্টোদিকে বেজার মুখে বসে আছে এক্স ক্রাইম রিপোর্টার অজয় তরফদার। কান্না ভুলতে বারে আসে, সেখানেও রেহাই নেই। নেশাটা ছুটে গিয়েছে। মেজাজটা খিঁচড়েই ছিল, টেবিলের উপর এক চাপড় মেরে বলল “সব দোষ ওই পালের। শালা! বারে কেউ পিড়িং পিড়িং করে বেহালা বাজায়? গিটারখানা বেচে খেয়েছ নাকি?”
পাল বলে যাকে সম্বোধন করা হল তার আসল নাম পল এডওয়ার্ড। বো ব্যারাকের এক চিলতে ঘরে বউ, মেয়ে আর অভাব নিয়ে থাকে। চোখের নীলচে রঙ ছাড়া পূর্বপুরুষ আর কিছুই রেখে যায়নি। সে মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। বলল “বউ বেচে দিয়েছে। মেয়েটার স্কুলের ফিজ...“শালা পৃথিবীর কোথাও কি একটু সুখ নেই? শান্তি নেই?” অজয় তরফদারের গলায় আকুতি।
“শান্তি শ্মশানে” বলল গজা।
“একথা বিশ্বাস করি না। এই যে আমার চব্বিশ বছরের ছেলেটা খুন হয়ে গেল। নিজে হাতে শ্মশানে দাহ করে এলাম, সে মরে গিয়ে সুখে আছে বলছিস? এক সময় ক্রাইম রিপোর্টার ছিলাম। খুন দেখা ছিল জলভাত। যেদিন ছেলেটা গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল আর কুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে খবর খুঁজছিল রিপোর্টারের দল সেদিন ওদের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজছিলাম। শুধু ক্রাইম রিপোর্ট লিখে পাতা ভরিয়েছি। যারা খুন হয়েছে তাদের বাপ-মায়ের দুঃখ ছুঁতে পারিনি। শালা, সেই শাস্তিই পাচ্ছি…”
“মরেও সুখ নেই আর এই জীবন বেঁচেও সুখ নেই। সুখ কোথায় জানো, ত্যাগে… মোহ-মায়া মুক্ত জীবনই একমাত্র সুখের। তোমরা তথাগতর গল্প জানো?” পল ধীরে গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“জানি, শালা, মহা হারামি মাল। আমার সঙ্গে পড়ত, নেতার জুতো চেটে একটা ইস্কুলের চাকরি বাগিয়ে ছিল। এখন তো সে চাকরি গেছে। বেশ হয়েছে।” গজার ক্ষোভে ফেটে পড়ল।
হালকা হেসে পল বলল , “না না সে নয়। আমি ভগবান বুদ্ধের কথা বলছি। তখনো তিনি বোধি লাভ করেননি। কঠোর তপস্যা করছেন, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর। প্রায় মৃতপ্রায় দশা, একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন এক দেবপুরুষ তিন তারের সুরেলা যন্ত্র বাজাচ্ছে। যার একখানি বেশ টান করে বাঁধা, একটি ঢিলা আর একটি না ঢিলা না টান…”
কথা বলতে বলতেই পল নিজের চার তারের বেহালাখানা হাতে নিল। দ্বিতীয় তারে ছড় বুলিয়ে মধুর সুর তুলল। তারপর আবার গল্প শুরু করল। “তথাগত বুঝলেন দেহকে কষ্ট দিয়ে নয়, আবার আয়েসে থেকেও নয়, এই মর্ত্যে শান্তি পেতে হলে ওই মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেদিনের পর সুজাতার হাতে পায়েস খেলেন। তারপর তপস্যা করে বোধি লাভ করলেন। সে এক পরম সুখ। ত্যাগের সুখ, সাধনার সুখ। সংসারে সেই সুখ কোথা?”
পলের কথা শুনে হা হা শব্দে হেসে উঠল অজয় তরফদার। “শালা অ্যাংলোর বাচ্চা আমাদের বুদ্ধের গপ্পো শোনাচ্ছে। তোকে কি আর সাধে পাল বলে ডাকি! তবু যীশু-টীশুর কথা হলেও হত। এ একেবারে বোধি, সন্ন্যাস, ত্যাগ! অত সোজা নাকি? বললেই সব ছাড়া যায়?”
বিমান এখন হাফ মাতাল। চোখের জল অনেকক্ষণ আগেই বন্ধ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করল - “পাল’দা, সন্ন্যাস নিলে মেয়েদের সঙ্গে শোয়া যায়? মানে ওই সাধন সঙ্গিনী? পাব না ?”
“কার মতো লাগবে? মিস রুপালি?” গজা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।
“স্টেজে তখনও গান গাইছিল মিস রুপালি। সেদিকে তাকিয়ে বিমান গাঙ্গুলী মুখটা কুঁচকে বলল, “ও তো বুড়ি।”
অজয় তরফদার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, “ছুড়ি সাধন সঙ্গিনী চাই ? এই পাল, শুনছ? কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দাও দেখি।” বারের টেবিলে সুখ আর দুঃখ সর্বক্ষণ কানামাছি খেলে বেড়ায়। কখন কাকে ছুঁয়ে দেয় কে জানে…
পল বেহালার বাক্সটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টে সেটার দিকেই তাকিয়েছিল। যার গায়ে সোনালী অক্ষরে Peace Of Lord লেখা। চারটে তার আর এই শব্দগুলো কিছুতেই ওকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। অজয় তরফদারের কথাগুলো পলের কানে যায়নি, বলল “আজ উঠি।” পকেটে থাকা একশোটা টাকা কিছুতেই খরচা করা যাবে না। মেয়েটার জুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এখানে বসলে টাকাটা মদে উড়বে। বেহালার বাক্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল পল, ফিরে এল। গজার দিকে একশো টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একশো কুড়ি পেতিস তো? এইটা এখন রাখ।
বারের আলো আঁধারি মাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। মিস রুপালি টেনে টেনে গাইছে, “আভি না যাও ছোড়কে, কে দিল আভি ভরা নেহি...”
২
ওরা তিনজন এক সঙ্গেই গিয়েছিল। বেশ সঙ্কোচ ভরে কড়া নেড়েছিল বো ব্যারাকের একটা লড়ঝরে বাড়ির দরজায়। গম্ভীর মুখে দরজা খুলে বসতে দিয়েছিল প্রতিমা। যার নামের পাশে এডওয়ার্ড পদবীটা কোনোভাবেই মানায় না। একসময় চেহারায় একটা আলগা শ্রী ছিল ঠিকই, কিন্তু অভাবের সঙ্গে ঝুঝতে ঝুঝতে সেটা এখন মলিন। ঘরের অবস্থা অবশ্য আরও খারাপ। প্লাস্টার খসা দেয়ালে দারিদ্রের সাক্ষী হয়ে যীশু আর মা কালী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। একটা বছর চারেকের মেয়ে খাতায় রঙ ঘষছে। আসেপাশে বই খাতা, ভাঙা পুতুল ছড়িয়ে আছে। মেয়েটা একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার আঁকায় মন দিল। দেখা গেল ওর চোখ পলের মতোই নীলচে…
এই একটা ঘরেই রাঁধা-শোয়া-খাওয়া-বসা। তিনকাপ চায়ের জল বসালো প্রতিমা। দুধ চায়ের বিলাসিতা এ’ঘরে নেই। মেপে মেপে গুঁড়ো চা দিল। চুপ করেই আছে, নিঁখোজ স্বামীর জন্য ঠিক কতটা শোক করা উচিত বুঝতে পারছে না। পল থাকা আর না থাকার ফারাক কতটুকু? ইদানীং বিছানাও সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। কেবল মেয়েটা থেকে থেকে বাবা কই ? বাবা কই ? বলছে…
“যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি? মানে চিঠি-টিঠি, দিন কয়েক পরে ফিরে আসবে এমনও তো হতে পারে।” অজয় তরফদার প্রতিমাকে স্বান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।
“বেহালাটা ফেলে গেছে। মাস খানেক ধরে ওটাই তো প্রাণ হয়েছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত আছাড় মেরে ভেঙে দিই। সংসারে ক্ষিধের আগুন জ্বলছে আর সে নিরোর মতো বেহালা বাজিয়েছে। আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, একরত্তি মেয়েটার কথা ভাবল না? অজয়দা, পল বেঁচে আছে তো? শক্ত প্রতিমাকে দিশেহারা দেখাচ্ছে। যেন কেউ ওকে জলে ফেলে দিয়েছে। মনের মাটি গলছে…
প্রশ্নটা যে বাকী তিনজনের মনে উদয় হয়নি তা নয়। বিমান বলল “থানায় তো ডায়েরী করা হয়েছে। কিছু হলে এতদিনে খবর পাওয়া যেত না?”
গজা চুপ করে থাকে। ভাবে, চলে যাবে বলেই কি পাল’দা টাকাটা শোধ করে দিয়েছিল? পকেট থেকে দুশো টাকা বার করে প্রতিমার হাতে দিয়ে বলল “বৌদি মেয়েটার জন্য কিছু আনা হয়নি। কিছু কিনে দেবেন।”
চোখের জলটা সামলে রেখেছিল প্রতিমা। যাদের সঙ্গে গেলাসের সম্পর্ক অন্তত তাদের সামনে সে ভেঙে পড়তে চায়নি। এই লোকগুলোকে উঠতে বসতে শাপশাপান্ত করেছে। এদের কাছে হাত পেতে টাকা নেওয়ার সময় জলটা আর আটকাতে পারল না। দুশো টাকায় চারটে দিন সে চালিয়ে নেবে, তারপর?
“দাদার বেহালাটা?” গজা অস্ফুটে প্রশ্ন করে।
“গতকাল বেচে দিয়ে এসেছি। লি রোডে একটা অ্যান্টিক শপ আছে, খুব বেশি দাম দেয়নি। আসলে বেহালাটাকে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। গিটারটা বেচে দেবার পর ওর মামার বাড়ি থেকে বেহালাটা নিয়ে হাজির হল, সেই কোন যুগ থেকে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। নিজেই সারিয়ে নিল। তারযন্ত্রের প্রতি ওর মায়াটাকে আমি হিংসে করতাম…”
“বেহালাটা কার?” অজয় তরফদার প্রশ্ন করে। রিপোর্টারের স্বভাব যাবে কোথা।
প্রতিমা বোধহয় বিরিক্ত হল। বলল “খুব বেশি জানি না। বেহালাটা নাকি সম্পর্কে কোনো এক দাদুর ছিল। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিঁখোজ হয়ে যান। তারপর থেকে বেহালাটা কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। গল্পটা আমি পলের কাছ থেকেই শুনেছি। গল্পই বলছি কারণ এর সত্যি মিথ্যে জানা নেই। রাত হল, মেয়েটাকে খাওয়াবো…”
এরপর আর বসা চলে না। বিমান গাঙ্গুলী একটা চকোলেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল, সেটা মেয়েটার হাতে দিয়ে উঠে পড়ল। মেয়েটা মিষ্টি করে ‘থ্যাঙ্কিউ’ বলল। বিমানের বিয়েটা টিঁকে গেলে এইরকম একটা মেয়ে আসতে পারত। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অজয় তরফদার একটা তেলচিটে কার্ড টেবিলে নামিয়ে রাখল, - “দরকার হলে ফোন কোরো।”
তিনজনেরই মনটা ভার। টিউলিপ বারে বসলেই পল’কে মনে পড়ছে। নেশা আর আড্ডা কোনোটাই ঠিক জমছে না। পলের বলে যাওয়া কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। ওরা পার্কে এসে বসল, মুখোমুখি। নামেই পার্ক, এক চিলতে রেলিং ঘেরা জমিকে পার্কের জাতে তুলতে দুটো দোলনা একটা স্লিপ বসানো হলেও সবগুলোই অচল। বেঞ্চের অবস্থাও তথৈবচ। বাহারি বাতি ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পথবাতি আর হেড লাইটের আলো ভরসা। সন্ধ্যা হলে নেশাখোর মানুষ এসে গাঁজা টানে, প্লাস্টিক পেতে বসে তাস পেটায়। স্লিপের নীচে, ঝোপের পিছনে দু একটা প্রেমিক প্রেমিকারও দেখা মেলে। যাদের গায়ে চাঁদের আলোতেও ফোসকা পড়ে, তাই ছাতা খুলে রাখে।
আজকেও একদল লোক জুয়ো খেলছে। তাদের সঙ্গে আনা রেডিওতে বেশ জোরেই হিন্দি গান বাজছে। একদিকে পচা খাল অন্যদিকে কর্মব্যস্ত রাস্তা, মাঝের জমিতে বসে বোধি, মায়া আর ত্যাগ নিয়ে বেশ উচ্চস্বরেই আলোচনা করছে তিনজন।
“যারা সাধু হবার জন্য ঘর ছাড়ে তারা সব থেকে বড় ধান্দাবাজ। এসব সংসারের দায় এড়ানোর ধান্দা। একটা ছোট মেয়েকে ফেলে চলে গেল? অজয় তরফদার শূন্যে নিস্ফল ঘুঁষি চালালো। ছেলের মুখটা মনে পড়ছে বোধহয়।
“সে তো বুদ্ধদেবও গিয়েছিলেন।” কোল্ড ড্রিংকের বোতলে ঢালা মদ গলায় উপুড় করে বিমান গাঙ্গুলী বলল।
“তিনি শাক্য বংশের রাজার ছেলে। রাজার ঘরে খাওয়া পরার অভাব আছে? মেয়েটা কী খেয়ে বাঁচবে পাল ভেবেছে একবারও?” অজয় প্রতিবাদ করে।
“কারো জন্য কিছু আটকায় দাদা? পাল’দা যদি মরে যেত? মেয়েটা বাঁচতো না ? প্রতিমা বৌদি শক্ত মানুষ। ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে।” গজা বেশ নির্লিপ্ত গলায় কথাগুলো বলল।
“ খুব তো বড় বড় বাত ঝাড়ছিস। তুই মরে গেলে তোর মায়ের চলবে?” খিঁচিয়ে ওঠে অজয়।
গজার মনে পড়ল কটা ওষুধ আর একটা মলম কিনতে হবে। পা আর পিঠ’ময় দগদগে ঘা থেকে আজকাল গন্ধ ছাড়ে। বুড়ির অবশ্য হুঁশ নেই। অসাড় শরীরের এই এক সুবিধে। নিজে টের পায় না, অন্যদের ভুগিয়ে মারে। যাই হোক মা তো, গজা ফেলে দিতে পারে না। দুশোটাকা দিয়ে দিল, হাত খালি। আজ একটা ধান্দা না হলে, কটা সাইকেল পার্কের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো, গজা সুযোগের অপেক্ষায় আরো কিছুক্ষণ বসে রইল ...
পাশে যারা তাস খেলছিল তারা এখনো রেডিও বন্ধ করেনি। সেখান থেকে ভেসে আসছে- “জিন্দেগি কা সফর হ্যায় ইয়ে ক্যায়সা সফর,কোই সামঝা নেহি, কোই জানা নেহি…”
৩
অতীতের গন্ধ ঠিক কেমন হয় সেটা অ্যান্টিক শপে গেলেই মালুম পড়ে। লি রোডের এই দোকানটায় কী নেই! যেন স্মৃতির কবরখানা। দোকানের ঠিক মাঝে শ্বেতপাথর বসানো বার্মাটিকের কাউন্টারে বসে আছেন দোরাব’জি। পুরু কাচের চশমাটা নাকের উপর ঝুলছে, উনি মন দিয়ে ডায়েরির পাতায় মিঃ বোসের ফোন নম্বর খুঁজে চলেছেন। এখনো আধুনিক যন্ত্র নির্ভর হতে পারেননি, নাম্বারটা পেয়ে ল্যান্ড ফোন থেকেই ডায়াল করলেন। অ্যান্টিক জিনিসের কদর জানেন এমন মানুষ এখন হাতে গোনা। মিঃ বোসের নজর আছে, আর পয়সাও…
দিন কয়েক হল জিনিসটা যৎসামান্য মূল্যে হাতে পেয়েছেন দোরাব’জি। ‘অ্যামেটি’ কোম্পানীর ভায়োলিন। আজকাল এমনটা আর পাওয়া যায় না। সব থেকে বড় কথা ভালো অবস্থায় আছে। বাক্সটার গায়ে সোনার জল দিয়ে Peace Of Lord লেখা। লাখ পাঁচেক পেলেও কম পাবেন। ফোনটা লেগেছে, ওপারে মিঃ বোস।
“বলুন দোরাব’জি, কিছু খবর আছে ? নাতিটার জন্মদিন…”
“স্যার একটা ভায়োলিন পেয়েছি, উনিশশো চার।”
“রাখুন আসছি। তবে দরটা আপনি বড্ড বেশী হাঁকেন।”
কথার পিঠে কথাটা আর বলা হল না দোরাব’জির। “এসে দেখুন” বলে ফোনটা কাটলেন। একটা সিড়িঙ্গে মতো লোক দোকানে ঘুর ঘুর করছে। দোরাব’জির পাঁচ পুরুষ কলকাতায় বাস করেছেন, বাংলাটা উনি আধুনিক বাঙালীদের থেকেও ভালো বলেন। মানুষ চিনতেও তার বিশেষ ভুল হয় না। লোকটা সন্দেহজনক। দোকান ভর্তি দামী জিনিস। লোকটা কি চোরাই কারবার করে? আগে কখনো এ চত্বরে দেখা যায়নি। যদিও চুরির মাল দোরাব’জি ঠেকায় না পড়লে কেনেন না। তাই বেশ কড়া গলাতেই বললেয়া, “কী ব্যাপার? কোনো দরকারে এসেছেন?”
গজা চারধারে চোখ বুলিয়ে বেহালাটা খুঁজছিল। বলল “একটা বেহালা…”
“আপনি কিনবেন?”
“হ্যাঁ, যদি দরে পোষায়…”
“আছে, সাড়ে পাঁচলাখ।” দামটা ইচ্ছে করেই পঞ্চাশ হাজার বাড়িয়ে বললেন।
“সাড়ে পাঁআআচ লাআআখ?” প্রতিমা বৌদি হাজার পাঁচেক পেয়েছে কিনা সন্দেহ। “জিনিসটা দেখা যায়?”
দোরাব’জির ইচ্ছে ছিল না, তবু বাক্সটা খুলে কাউন্টারে রাখলেন। গজা বাক্সটার গায়ে হাত বোলালো। বেহালার চারটে তার আলতো ছুঁলো। পাল’দা বলত “এই তারগুলো কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।” বেহালাটা তো গজার নয়। তবু তার ছুঁয়ে এমন কেন মনে হচ্ছে। ঘোরটা ভেঙে গেল। একজন হোমরা-চোমরা লোককে দোকানে ঢুকতে দেখে বেহালার বাক্সটা বন্ধ করে দিলেন দোরাব’জি। গজাকে বেশ অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, “এবার আপনি আসুন।”
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরালো গজা। এই অঞ্চলে যারা ঘোরাফেরা করে তাদের অনেক পয়সা। ফুটপাতে দামী দামী ফল, সবজি বিক্রি হচ্ছে। গজার মাকে ডাক্তার আপেল খেতে বলেছিল। পুরুষ্ট আপেল গুলো দেখে ওর সেই কথা মনে এল। এখন ওর মায়ের যা অবস্থা তাতে থাকা না থাকা সমান। গজার মনটা অকারণেই অস্থির হল। পাশেই একটা পুরনো রেকর্ডের দোকান। তার পাশে বিক্রি হচ্ছে পান সিগারেট চকলেট। অন্যদিন হলে গজা দু একটা জিনিস সরিয়ে ফেলত, আজ ইচ্ছে করছে না। অথচ পকেটে মাত্র বিশটা টাকা পড়ে আছে। লোকটা অনেকক্ষণ দোকানে ঢুকেছে। গজা উঁকি দিল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে লোকটা বেহালাটাই নেবে। একবার যদি হাতাতে পারে, সাড়ে পাঁচ না হোক দু’লাখ পাওয়া যাবে না? গজার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বহুদিন পর একটা বড় দাঁও…
ফুটপাত ঘেষে একটা সাদা মার্সিটিজ দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাকের ড্রাইভার পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে মৌজ করে দামী সিগরেট ফুঁকছে। লোকটা বেরোচ্ছে, হাতে ভায়োলিনের বাক্স। কাচের দরজার সামনে দোরাব’জির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ড্রাইভার সিগারেট ফেলে তড়িঘড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিল। বাঁদিকের সরু রাস্তাটা এ’সময় ওয়ান ওয়ে থাকে, এই সুযোগ। গজা ছোঁ মেরে ভায়োলিনের বাক্স নিয়ে দৌড় দিল। সরু রাস্তাটা ধরে একটু অলিগলি পেরোলেই বাস রাস্তা...
এর আগেও বহু দামী জিনিস কিনেছেন মিঃ বোস। এমনটা কখনো হয়নি। উনি দিশেহারা হয়ে থানায় ফোন করলেন। দোরাবজি হায় হায় করছেন। গজা ছুটছে, ছুটছে ছুটছে…
পিছনে পড়ে থাকছে চেনা অচেনা অসংখ্য মুখ। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কাকে ভায়োলিন বেচবে কিচ্ছু জানে না। গজাকে পালাতে হবে, মায়া ছেড়ে অনেক অনেক দূরে। চারটে তার আর ঐ কথাটা গজাকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।
পুরনো রেকর্ডের দোকানে চোঙ লাগানো গ্রামাফোনে টানা টানা সুরে গান বাজছে- “ও যানেওয়ালে হো সকে তো লওট কে আনা...”
কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাঁদ, তাকে ঘিরে বলয়ের হালকা আভা, পাশে একটা উজ্জ্বল তারা আর এই সবকিছুকে স্বচ্ছ ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখার মতো ছেয়ে আছে বর্ষার মেঘ। অনুপমা উবু হয়ে বসে একটা তোলা উনুনে ঘুঁটে সাজাচ্ছে আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে আবছায়া চাঁদ ও তার পাশের তারাটিকে। খুব বেশি সময় তার হাতে নেই। একটা উনুন ধরাতে কতক্ষণই বা দেরি করা যায়। দুটো ঘুঁটে আধখানা করে চারদিকে দাঁড় করিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা ঘুঁটের টুকরো দিয়ে ভরিয়ে দিল মাঝখানের ফাঁকটা। তখন একবার বাতাস বইল। সে দেখল কাঁঠাল পাতার ফাঁক সরে গিয়ে চাঁদটা আরও বেশি প্রকাশিত হয়েছে। ও ঘুঁটের উপর একটু কেরোসিন তেল ঢেলে তার উপর কয়লা রাখছে একটা একটা করে। ততক্ষণে বাতাসে উড়ে গেছে মেঘ, চাঁদের আলোর পাশে তারাটা যেন একটু ম্লান। পায়ের কাছে রাখা তেলের কুপি থেকে আগুন ধরালো উনুনে। আর সামান্য সময় আছে হাতে। উনুন ধরে গেলেই রান্নাঘরে চলে যেতে হবে। উনুনের ধোঁয়া তখন ক্রমশ উঁচুতে উঠতে উঠতে কাঁঠাল গাছের ডাল পেরিয়ে আরও উপরে উঠে বিছিয়ে যাচ্ছে চাঁদের বলয়ের ধার বরাবর। চাঁদটাকে এখন যেন অনেক বড় মনে হচ্ছে। সামনে পূর্ণিমা না অমাবস্যা? চিনেপুকুরের আকাশেও তো এই চাঁদটাই এখন দেখা যাচ্ছে! এ কথা মনে হতেই আরও অনেকক্ষণ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হল। এরকমই সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে ছাদে শুয়ে থাকত আর মাথার উপর দিয়ে অনেক বাদুড় উড়ে যেত গাব ফল খেতে। কটা বাদুড় যাচ্ছে তা গুনতে নেই, দিদিমা বলত, যে বাদুড়গুলোকে গোনা হবে সেগুলো গাবফলে মুখ দেওয়া মাত্র মরে যাবে। তাও অনিচ্ছাতেও একটা-দুটো আপনা থেকেই গুনে ফেলত, আর মন খারাপ হত ওই বাদুড়গুলো মরে যাবে বলে। সত্যি কি গুনলে বাদুড় মরে যায়? এখানে আকাশ দিয়ে কোনও বাদুড় উড়ে যায় না। ও খেয়াল করে দেখেছে এই বাড়ির চারপাশে কোনও পাখি আসে না। কতদিন যেন সে চড়াই দেখেনি, শালিখ দেখেনি। একটা ফিঙেও কোথাও এসে বসে না। উনুন ধরে এসেছে, ভাত বসাতে হবে, ছোট ঠাকুরজামাই এসেছে, সে খেয়ে যাবে।
চাল ধুচ্ছে যখন বড় ননদ এসে একবাটি মটর ডাল দিয়ে গেল। আলু আর ডালভাতে, শুধু এই দিয়ে কি জামাইকে ভাত দেওয়া যায়? ননদ বিধবা হওয়ার পর থেকে এখানেই থাকে, এ-সংসারের চাবিকাঠি এখন তার হাতে। সে বলল, যে জামাই ভিক্ষে করতে এসেছে তার জন্য এই যথেষ্ট। তার নিজের স্বামী বড়লোক ছিল; মরার পরেও যা রেখে গেছে তা এক নিঃসন্তান বিধবার পক্ষে অফুরন্ত। তাই ছোট বোনের নিষ্কর্মা স্বামীকে সে মানুষ জ্ঞান করে না। অনুপমার এতে কিছু বলার নেই, ভাত হওয়া পর্যন্ত করারও কিছু নেই। কিন্তু রান্নাঘর থেকে বেরোন যাবে না। বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেই বড় ননদ এসে জিজ্ঞাসা করবে ওখানে কি করছে সে। তাকে তো আর বলা যাবে না আকাশ দেখছি। বাতাস মেঘ উড়িয়ে দিয়ে চাঁদের ঘোমটা কেমন করে খুলে দিচ্ছে তাই দেখছি। তার চেয়ে ওখানেই বসে থাকা ভালো। আরও ভালো এই কারণে যে রান্নাঘরে এখন কেউ আসবে না আর এই সুযোগে সে ভাবতে থাকবে এমন বর্ষায় চিনেপুকুরে কত কামিনী ফুল ফুটত। সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টি হলেই সে কামিনীর গন্ধ পায়, অথচ আশেপাশে কোথাও সে গাছ নেই, সে জানে। এখন ভাতের গন্ধের সঙ্গে ও সেই গন্ধটা আবার পাচ্ছে আর তাকিয়ে রয়েছে বাইরে, দাওয়ার উপর বাঁশের চালার যে ফাঁকটা দিয়ে আকাশের একটা ছোট্ট টুকরো দেখা যায়, সেই দিকে। কিছুক্ষণ পরে কামিনীর গন্ধ তাকে এত বেশি ঘিরে ধরল যে ভাতের গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে ভাবছে, কামিনী গাছের গোড়ায় অপরাজিতা ফুলের যে চারা বেরিয়েছিল সেগুলো কত বড় হল। ওর চিন্তা হল, কে ওদেরকে কামিনী গাছের সঙ্গে বেঁধে দেবে যাতে লতিয়ে উঠে যেতে পারে। ঠাকুমা কি চারাগুলোর খেয়াল রাখবে? আসার সময় যে সে কথাটা বলে আসতে ভুলে গেছে। আর ঠিক তখনই কামিনীর গন্ধ চলে গিয়ে ভাতের গন্ধ ফিরে এল। সে ত্বরিতে এক ঘটি জল ঢেলে দিল ভাতে। ভাগ্যিস ধরে যায়নি, না হলে কি কেলেঙ্কারিটাই না হত। সে কথা ভাবতে ওর বুক ধরাস ধরাস করছে। তখন বড় ননদ আবার রান্নাঘরে ঢুকল, ভাত হয়েছে কিনা দেখতে। তার হাতে একটা চটের থলি ভর্তি চাল, তার উপরে দুটো গোপলাধোপা আম। সে অনুপমাকে বলল উনুনে হাওয়া দিতে, যাতে তাড়াতাড়ি ভাত রান্না হয়, যাতে তার ভাই বাড়ি আসার আগেই জামাইকে বিদায় করা যায়।
অনুপমা হাঁড়ি থেকে একটা চাল তুলে টিপে দেখল আরেকটু বাকি আছে। সে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগল। তখন শাশুড়ির গলা শোনা গেল, ভাত হয়েছে কিনা জানতে চাইছে। ননদ উত্তর দিল, আর কিছুক্ষণ। অনুপমা বুঝতে পারল, শাশুড়িও চাইছে ছেলে বাড়ি ফেরার আগেই জামাই চলে যাক। ননদ তখন থলিসুদ্ধ চাল নিয়ে বাইরের দিকে গেল, জামাইকে দিতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবসুদ্ধ নিয়ে ফিরে এল রান্নাঘরে। থলিটা ঘরের কোণায় রেখে অনুপমাকে বলল, এখন এখানে থাক, খাওয়া হয়ে গেলে তারপর দিলেই হবে। সদরের ঘরে জামাই যেখানে বসে আছে সেখানে থলিটা রাখল না, যাতে ভাই আগে ফিরে এলেও ঢুকেই যেন থলিটা দেখতে না পায়। চালের নাকি এখন আক্রা চলছে, সে শুনেছিল স্বামীর কাছে। তাই এক থলি কেন, এক মুঠো চালেরও অনেক দাম। কিন্তু দু’ গোলা ভর্তি চাল, তাতেও আক্রা? প্রশ্নটা সেদিন তার মনে এসেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। কি জানি কি কথা থেকে কি কথা এসে পড়বে, তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভালো। এই এখন যেমন সে চুপ করে ভাতের হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে বসে আছে, অপেক্ষা কখন ভাত সেদ্ধ হবে, ডালভাতেটা আগে বের করে নিয়ে ফেন উপুড় দেবে, তারও পরে সাদা ধবধবে গরম ভাত বেড়ে দেবে থালায়। এই সেদিনও ভাত গরম বলায় ঠাকুমা এসে গরাস করে করে তাকে খাইয়ে দিল। ঠাকুমার মতো সে ভাত মাখতে পারে না, তাই খেয়েও যেন আর ঠিক তৃপ্তি হয় না। আজকাল কত কম খেয়ে সে উঠে পড়ে, ঠাকুমার সামনে সেটি হবার জো ছিল না। কিন্তু ঠাকুমা কি জানে চাল এখন আক্রা? জানলে হয়তো যে চাইত তাকেই অমন চাল বিলিয়ে দিত না। এই এক স্বভাব ঠাকুমার, তার কাছে কোনও জিনিস কেউ চাইলে তাকে সেটা না দেওয়া অবধি যেন তার শান্তি নেই। সে নিজেও ওইরকম ছিল। তবে এখন তার স্বভাব পালটে গেছে। তাছাড়া তার নিজের আছেটাই বা কি যে দেবে।
সদরের ঘর থেকে ঠাকুরজামাইয়ের গলার স্বর ভেসে আসছে। খুব জোরে জোরে কথা বলে মানুষটা আর বেশ সরল-সাধাসিধে। খুব খেতে ভালোবাসে, কিন্তু নিজের বাচ্চাদেরই খেতে দিতে পারে না তো নিজে কি খাবে। বেচারা, মনে মনে ভাবল অনুপমা। তার শাশুড়ি একবার কয়েক বিঘে জমি দিতে চেয়েছিল জামাইকে, কিন্তু ছেলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল ওসব দান-ধ্যান করা আর চলবে না। তারপর থেকে মাঝে মধ্যে ছেলেকে লুকিয়ে কিছু চাল আর গাছের ফল-পাকড় দু’-চারটে দেয়। তাতেও তো কিছুটা সুরাহা হয় আর ওইটুকু জিনিষ কমে গেলে ছেলে ধরতে পারে না, এই যা রক্ষে। কিন্তু আজ সে রক্ষা হবে কিনা সন্দেহ। বড় ননদ আবার এসে তাগাদা দিল। এবার ভাত হয়ে গেছে। অনুপমা ডালের পুঁটুলিটা তুলে নিয়ে সবে ফেন গালতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সাইকেলের ঘন্টির শব্দ শোনা গেল।
কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অনুপমার ফেন গালা হয়ে গেছে। ডালভাতেও মাখা হয়ে গেছে। নির্দেশ আসলেই সে ভাত বাড়বে। কিন্তু আর সবাই তখন সদরের ঘরে। রান্নাঘর থেকে সে ঘরখানা এত দূরে যে কিছুই শোনা যায়না। সেখানে তারা কি করছে, কি বলছে এখান থেকে তা জানার উপায় নেই। ও ভাবছে ননদ আসলে ভাতের পাতে একটু ঘি দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করবে, সত্যিই কি আর ডাল-আলু ভাতে দিয়ে ভাত জামাইকে ধরে দেওয়া যায়! কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এদিকে কেউ আসা তো দূরস্থান, কারুর গলার স্বরও পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক তখনই ননদের চিৎকার শোনা গেল, এ কি করছিস তুই? তারপর আবার সব চুপচাপ। অনুপমা ভাবছে একবার ওঘরের দিকে যাবে কিনা, কিন্তু স্বামীর উপস্থিতিতে বাড়ির বাইরের দিকে যাওয়ার সাহস তার নেই। আবার চুপ করে যেন বসেও থাকতে পারছে না। বুঝতে পারছে, কিছু একটা ঘটেছে। আস্তে আস্তে রান্নাঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল সে। কলতলার দিকে গিয়ে একবার দেখবে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে কিনা? কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে কলে যাচ্ছি, সে ভাবল। তখনই দেখল ননদ আসছে। সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ননদকে দেখে মনে হল বেশ বিভ্রান্ত। কি হয়েছে? সে কিছু প্রশ্ন করার আগেই বড় ননদ বলল কি ঘটেছে। তার স্বামী জামাইকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আর বলেছে কখনও যেন এমুখো হওয়ার চেষ্টা না করে। জামাইয়ের মতো নিপাট ভালোমানুষেরও এতটা মানে লেগেছে যে সদরের বাইরে রোয়াকের উপর বসে কাঁদছে। কথা কটা বলেই ননদ আবার চলে গেল। অনুপমা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, ভাবল, তার কি কিছু করার আছে? সত্যিই কি সে কিছু করতে পারে?
তারপর মনের সমস্ত সাহসকে জড়ো করে সে হাতে তুলে নিল চালের থলি। তারপর দ্রুতপদে কিন্তু নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল খিড়কির দরজার দিকে। সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে খিড়কির পুকুরের পাশ দিয়ে গিয়ে পড়ল বাঁশবনের গভীর অন্ধকারের মধ্যে। এই বাঁশবনে সে দিনের বেলাতেও আসে না। কিন্তু এখন সে নিঃশঙ্ক, তাই অবলীলায় সে বন পেরিয়ে পা দিল সদরের রাস্তায়। আর একটু, আর একটু এগিয়েই সে দেখতে পেল চাতালের এক কোণে ঠাকুর জামাই দুটো হাত মাথায় দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। সে নিঃশব্দে তার পায়ের কাছে থলিটা নামিয়ে রাখল। ভেবেছিল, ঠাকুরজামাই তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু থলিটা রাখামাত্র সে চমকে তার দিকে তাকাল। তারপরেই চাতাল থেকে উঠে হন হন করে রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে গেল। অনুপমা তাকে বলতে গেল, ঠাকুরজামাই, চাল কটা নিয়ে যান। কিন্তু তার আগেই সে দেখল মানুষটা পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর পেছনে ফিরল। এক-পা দু-পা করে ফিরে এল ওরই কাছে। তারপর থলিটা তুলে নিয়ে আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেল স্টেশনমুখো সেই রাস্তা দিয়ে, যে রাস্তা দিয়ে সে একটু আগে এগিয়ে গিয়েছিল খালি হাতে এবং এখন সে যাচ্ছে চালের থলি হাতে নিয়ে।
অনুপমা আবারও বাঁশবন পেরিয়ে খিড়কি পুকুরের ধার দিয়ে খিড়কির দরজায় যখন এসে পৌঁছাল, বাড়ি তখনও নিস্তব্ধ। সে গেল রান্নাঘরে, না, সেখানে কেউ নেই, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। এবার উনুনটা হাতে নিয়ে বাইরে গেল, ছাই বের করে নিকিয়ে রেখে দেবে। আসলে সে গেল চাঁদ দেখতে। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে শুধু জমাট বাঁধা রক্তবর্ণ মেঘের দল, কৃষ্ণপক্ষের স্বল্পায়ু চাঁদ অনেক আগেই অস্ত গিয়েছে।
তিনটে পরিবারের মিল অনেকটাই, চালচলন, জীবনযাপন সবই। হয়ত সেই কারণেই ওদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশাটা বেশি। এক জায়গায় চাকরি করলে রেষারেষির যে চালু গল্পটা শোনা যায়, তা এদের এখনো পর্যন্ত ছোঁয়নি। তিনজনেই ‘হাম দো, হামারা এক’, তবু তফাৎ যদি করতেই হয়, তা এখানেই। চয়নের মেয়ে বাকি দুজনের থেকে অনেকটাই ছোট, তিন্নি পাঁচ পূর্ণ করল সবে। সেখানে নিখিল আর অরুণাংশুর দুটো পিঠোপিঠি, নিখিলের মেয়ে মৌলি আইসিএসসি পার করেছে গতবার, অরুণাংশুর ছেলে রেহান সামনের বার দেবে।
কথাটা তুলেছিল অরুণাংশুর বউ শুভ্রা, তিন্নির পাঁচ বছরের পার্টিটা রেস্টুরেন্টে দাও চয়নদা। বাড়িতে আ্যরেঞ্জ করতে গেলে ঋতুর ওপর অহেতুক প্রেশার হবে। কথাটা লুফে নিয়েছিল ঋতুপর্ণা! সত্যি কথা বলতে ও এই কথাটা চয়নকে আগেই বলেছিল। এইটুকু ফ্ল্যাটে দুটো লোক বেশি এলে ঠাসাঠাসি লাগে। কোথায় বসাবে, কোথায় কী করবে, ঋতুপর্ণার পাগল পাগল অবস্থা হয়! হোক না ফেব্রুয়ারির থার্ড উইক, গরম কিন্তু ভালোই পড়ে যায় তখন। আর তাছাড়া, ঋতুপর্ণা চয়নকে বুঝিয়েছিল, রেস্টুরেন্টে সেরে ফেলতে পারলে আ্যপার্টমেন্টের কাকে বলব, কাকে না, এসব ঝক্কি থাকে না! নিজেরা নিজেরা চলো, আনন্দ ফুর্তি করো, কড়ি ফেলো, তারপর তেল মাখো, কী ছড়িয়ে ফেলো, ব্যাপারটা ওখানেই শেষ, তার রেশ বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনতে হচ্ছে না!
এরপর খুব ঝটপট গুগল খুলে দেখে নেওয়া হল কয়েক গণ্ডা রেস্টুরেন্টের নাম, তাদের স্পেশাল অফার কী চলছে, বিডে স্পেশাল কিছু আছে কী না, সমস্ত কিছু। তিন্নির জন্মদিনটা ফেব্রুয়ারির তেইশে, ওরা দুদিন পরে রোববার দেখে প্রোগ্রামটা ঠিক করল, সবক্ষেত্রে এটাই করা হয়। ওদের শহর থেকে একটু দূরে, গঙ্গা পেরিয়ে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে, নাম ভোজবাজি, সেটাকেই চুজ করল ওরা। এদের অফার টফারগুলো্র মধ্যে নতুনত্ব আছে! নিখিল বলেছিল, আগে থেকে টেবিল বুক করার কথা, কিন্তু বাকিরা বাধা দিল। ওখানে পৌঁছেই দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
শেষ ফেব্রুয়ারির এক রোববারের দুপুরে তিন পরিবারের ন’টি প্রাণী একটা ভাড়া করা স্করপিওয় চেপে , বহুবার নিজেদের মধ্যে করা রসিকতা, খুনসুটিগুলোকে ঝালিয়ে নিতে নিতে, ভোজবাজির উদ্দেশ্যে চলল। নতুন বলতে, প্রত্যেকে তিন্নিকে একবার করে ‘হ্যাপি বার্থ ডে বেটা’ বলে উইশ করল, আর প্রত্যেকবার ঋতুপর্ণা মেয়েকে মনে করিয়ে দিল, থ্যাংকু বলে দাও! মূল জন্মদিনেও এই অনুশীলন একবার হয়ে গেছিল যদিও!
ভোজবাজির সামনে এসে ওরা প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেল! বাইরে এত ভীড় কেন! রেস্টুরেন্ট বন্ধ নাকি! জানা গেল, আজ রোববার, চাপ বেশি, ভেতরে সিট সব ফুল, এরা বাইরে অপেক্ষা করছে! চয়নরাও এখন এই অপেক্ষমানদের দলে। নিখিল বলল, ডিসগাস্টিং! পয়সা দিয়ে খাবো, তাও লাইন দিতে হবে! এর চেয়ে অনলাইনে আনিয়ে নিলে ঝামেলা চুকে যেত! শুভ্রা ফোড়ন কাটল, দুয়ারে লাঞ্চ? এই রসিকতা পাকিয়ে ওঠার আগেই রিমি, নিখিলের স্ত্রী, নিখিলের দিকে চোখ পাকায়! আজকে ট্রিট দিচ্ছে চয়ন-ঋতুপর্ণা, ওদের সামনে এরকম বিরক্তি দেখালে সেটা মোটেই ভালো দেখায় না! নিখিল বউএর এই নীরব বার্তা আদৌ পড়তে পারল কী না, পারলেও কতটা পাত্তা দিল, সে সন্দেহ থেকেই গেল!
বাইরে কোথাও বসার ব্যবস্থাও নেই। রোদটাও এই সময় বেশ চড়া। ওরা প্রত্যেকেই উশখুশ করতে লাগল। ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক পরে, এই ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে প্রত্যেকেরই বাধো বাধো ঠেকে! রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া লোকজন কেউ কেউ এই জটলার দিকে তাকায়! এতে ওদের আরও অস্বস্তি বাড়ে! ওরা নিজেদের মতো করে সময় কাটিয়ে পরিস্থিতি এবং নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে চায়।
নিখিল আর অরুণাংশু একটু তফাতে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। শুভ্রা আর রিমি প্লাস টু তে কোন কোন টিচারের টিউশন বেশি কার্যকরী হতে পারে, সেই নিয়ে নিবিড় আলোচনায় মত্ত। রেহানের চোখে ভারী চশমা। সেই চশমার ওজন ওকে সকলের থেকে বরাবরই আলাদা করে রাখে। সে মুখে কথা বলে কম, আর তার চশমার ওপারে চোখের ভাষা পড়া যায় না! হয়ত সে জন্যেই ওকে তফাতে রেখেই মৌলি আর তিন্নি মোবাইলে গেম নিয়ে মত্ত থাকে। তিনজনেরই মা , আপন আপন সন্তানকে ‘রোদ থেকে সরে এসো না’ পরামর্শ দিলেও এই একটা জায়গায় তিনজনের আচরণে মিল পাওয়া যায়। তিনজনই নিজেদের অবস্থান থেকে একটু নড়ে ওঠে, কিন্তু তাকে পূর্বোক্ত পরামর্শের প্রতি সুবিচার বলা যায় না!
বেশ কিছুক্ষণ পরে শুভ্রার গলা পাওয়া যায়। অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে বলে, কী গো, তিন্নিটা তো ছোট, নাকি! কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে! দেখো না অন্য কোথাও যাওয়া যায় কী না! শুধু সিগারেট ফুঁকলে হবে এই গরমে! গা জ্বলে যায় একেবারে! এই উদ্বেগ এবং গাত্রদাহ সকলকেই স্পর্শ করে, ঋতুপর্ণাকে তো করেই! ও চয়নকে ঠেলা দেয়, একবার দেখো না, কতক্ষণ লাগবে আর! বাচ্চাগুলোর তো খিদে পেয়ে গেছে! চয়ন গম্ভীর গলায় বলে, মিনিমাম এক ঘন্টা! আমাদের সিরিয়াল একত্রিশ!
সিরিয়াল! নাম লেখাতে হয়েছে নাকি! ঋতুপর্ণার বিস্ময়ের উত্তরে চয়ন চুপ করে থাকে।
রেস্টুরেন্টটা রাস্তার যে ধারে, ওরা তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষারত সকলেই তাই। কত লোক অপেক্ষায় আছে , চয়ন আন্দাজ করার চেষ্টা করে। জনা চল্লিশ তো হবেই! আজকাল মানুষ বাড়িতে রান্নাবান্না করে না নাকি! নাকি এদের সবারই বার্থ ডে পার্টি আজ এখানে হবে! ভারতবর্ষে একদিনে কত শিশুর জন্ম হয়? চাকরি পাওয়ার আগে এরকম কিছু তথ্য ওকে মনে রাখতে হয়েছিল, এখন সেসব পাট চুকেছে। এখন ওদের সমস্ত সাধারণ জ্ঞানের আহরণ একটি শিশুকে ঘিরেই! এই ভিড়টায় ছোট ছেলেমেয়ে সংখ্যায় কম নেই, তাদের সকলেরই খিদে পেয়েছে ভেবে চয়নের অবশ্য সেই গুণিতকে উদ্বেগ বাড়ে না! চয়ন দেখে, পাশেই একটা নির্মীয়মান বহুতলে কর্মরত শ্রমিকদের একটা দল ওদের একটু দূরেই বাড়ি থেকে আনা টিফিন বাক্সো খুলে বসে। দূর থেকে ভাত আর নধর কাঁচালঙ্কা দেখা যায়। একটা বাটিতে তরকারি গোছের কিছু একটা! দলটির এই স্বাধীনতা-উদযাপন দেখে চয়নের সম্বিত ফেরে, ওর মনে হয়, রেস্টুরেন্ট-কর্তৃপক্ষকে একবার তাড়া দেওয়া দরকার। ও রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে যায়।
কাঠের পেল্লাই দরজা ঠেসে বন্ধ করা। ভেতরে কী হচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বিশাল চকচকে , মসৃণ দরজার ওপর চারটে বাক্স-কাটা ডিজাইন। সেই বাক্সের মধ্যে একটা করে ঢাল উঁচু করে বসানো, যার মধ্যে আবার কোণাকুণি দুটো করে তরোয়াল! সবই দামি কাঠের। চয়নের একঝলক দেখে মনে হয়, রেস্টুরেন্ট তো নয়, একটা দুর্গ যেন ! অথবা কোনো সম্ভ্রমমাখা সরকারী অফিস, যার সব কাজকর্মই দরজার ওপারে হয়, বাইরের মানুষদের জন্য থাকে শুধু বিমূঢ় বিস্ময়! বাইরে একজন সিকিউরিটির লোক দাঁড়িয়ে। এই লোকটাই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। হাত খাদ্যপ্রত্যাশী মানুষের তালিকা। একে একে ডাকছেন, যেমন যেমন ফাঁকা হচ্ছে ভেতরে। লোকটার পরনে জলপাই রঙের পোশাক। মাথায় টুপি। ম্যাজিশিয়ানের হাতের ওপর ছড়িয়ে থাকা তাসের মতো একরাশ পালক সেই টুপির ওপর সাজানো। মুখ ভাবলেশহীন। লোকটাকে দেখে চয়নের কয়েক বছর আগে ঘুরে আসা ওয়াঘা সীমান্তের সেই সেনা জওয়ানদের কথা মনে পড়ল, যাঁরা সীমান্তের অনেক ভেতরে, নিজেদের বসতভিটায় অনেকটা মায়া ছেড়ে রেখে এসে ওখানে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেছিল!
চয়ন ‘আর কত দেরী’ জিজ্ঞাসা করার পরিবর্তে লোকটাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘আপনার খিদে পায়নি?’ রোদতপ্ত দুপুরে, এই কার্যকারণ সম্পর্কহীন প্রশ্নে নিরাপত্তা আধিকারিকটি কতটা ঘাবড়ে গেলেন বোঝা গেল না ওর নির্লি্প্ত মুখ দেখে, কিন্তু ভদ্রলোক অতিরিক্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর করলেন, আপনাদের সময় হয়ে এসেছে স্যার! আর একটু ওয়েট করুন প্লিজ! অগত্যা চয়ন ওর প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে উল্টোমুখে ফিরল!
মুখ ঘুরিয়ে চয়ন দেখল, ঋতুপর্ণা কতগুলো চিপসের প্যাকেট কিনে প্রত্যেকের হাতে দিচ্ছে, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। একটা আইসক্রিমের ঠেলাগাড়ি ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে। জড়ো হওয়া লোকজনের কেউ কেউ কিনছেনও । লেবু লজেন্স নিয়ে একটা ছেলে ওদের পাশ দিয়ে হাঁক পেড়ে চলে গেল। চয়ন ভাবতে চেষ্টা করল, একেই কী অনুসারী শিল্প বলে! এই রেস্টুরেন্ট না থাকলে কী এদের এখানে দেখা যেত! ও আবার এও ভাবল, সকলে যদি ঠিক ঠিক সময়ে এসেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়তে পারত, তাহলে কী এরা আদৌ এখানে আসত! সত্যিই অর্থনীতি বড়ই জটিল বিষয়!
চয়ন রাস্তা পেরোনোর উদ্যোগ করল। যাঁরা খেতে দেবেন, তাঁদের প্রান্ত থেকে, যাঁরা খেতে পাবেন, তাঁদের কাছে এসে পৌঁছোতে যে চব্বিশ ফুট রাস্তাটা পেরোতে হবে, সে রাস্তা চয়নের অনন্ত বলে মনে হল! উল্টোদিকের ভিড়ে যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, তা আর চাপা নেই, বেশ কোলাহলের রূপ নিয়েছে। চয়ন দেখল, উল্টো প্রান্ত থেকে অরুণাংশু এদিকে আসছে। সকলেই অস্থির হয়ে পড়েছে। শুধু যাঁদের কাছে ভেতরের ডাক এসে পৌঁছোচ্ছে, তাঁদের ক্ষোভের উদ্গতপ্রায় আগুনে মুহূর্তে বারিসিঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে, ওঁরা ওই প্রান্তের শিবিরভূক্ত হয়ে পড়ছেন! পদ্ধতিটি চলমান, তাই আলাদা আলাদা করে কাউকে নির্দিষ্ট শিবিরের বলে চিহ্নিত করাও অসম্ভব! চয়ন ভাবে, আচ্ছা, যাঁরা এখনও পর্যন্ত খাবার না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছেন, তাঁরা কী সত্যিই এতটা ক্ষুধার্ত, যে একটা ভাঙচুরের সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে! ওরা নিজেরা যেমন যথেষ্ট ভারী জলখাবার খেয়ে এসেছে, এবং চয়ন অনুমান করতে পারে, ওর দলের তো বটেই, এমনকি এই জমায়েতের কেউই সেই মাত্রায় বুভুক্ষু নয়, যাতে এই মুহূর্তে কোনো অভাবিতপূর্ব ঘটনা ঘটে যেতে পারে! অথচ সবার ক্ষোভটাও সৎ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আচ্ছা, ওই বহুতলের যে শ্রমিকরা একটু আগে পেট ভরে ভাত খেয়ে আবার কাজে ফিরে গেছে, তারা এই অবস্থায় পড়লে কী করত! এইসব আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতে চয়ন রাস্তা পেরোচ্ছে, এই সময় অরুণাংশু ওকে ক্রশ করতে করতে বলে গেল, দেখি সিকিওরিটির মালটাকে ম্যানেজ করি গে!
ম্যানেজ! মানে সিকিওরিটির লোকটাকে ঘুষ দেবার কথা ভাবছে অরুণাংশু! বেশ খানিকটা অবাক হল চয়ন! তারপর ভাবল, সত্যিই তো, ভেতরে ঢুকে পড়া কেউ কেউ যে এ পন্থা অবলম্বন করেনি, তাই বা কে জানে! এভাবে ভাবতে পেরে চয়নের মনের অস্বস্তি ভাব খানিকটা কমে এলো! ইতিমধ্যে ও ওর দলের কাছে চলে আসতে পেরেছে। ওর আশঙ্কা ছিল, নিখিল হয়ত ইতিমধ্যে রেগে টং হয়ে আছে! কিন্তু ও দেখল, নিখিল বেশ শান্ত হয়েই বাকিদের সঙ্গে কথা বলছে! চয়ন ওদের মাঝে গিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলল, এক্ষুণি ডাকবে বলল। ঋতুপর্ণা বলল, কখন থেকে তো এক্ষুণি এক্ষুণি শুনছি! এরপর তো একবারে ডিনার সেরে গেলেই চলে। বাকিরা এ কথায় হাসল। চয়ন লক্ষ করল, ঋতুর মন্তব্য বা বাকিদের হাসিতে একধরনের নিস্তেজ ভাব! ঠিক এই সময়েই শুভ্রা বলল, সবাই মিলে গিয়ে প্রোটেস্ট করা উচিত! এ কী ধরনের অসভ্যতা রে বাবা! পয়সা দিয়ে খাব, তার জন্য এইভাবে কাউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে! সকলে এই কথাতেও সায় দিল। নিখিল বলল, দাঁড়াও,অরুণ গেছে তো সিকিওরিটিকে পটাতে। ও আসুক। চয়ন জিগ্যেস করল, ছেলেমেয়েগুলো কোথায় গেল! যে কোনো সময় ডাকবে তো! তখন দেরী করলে লাইন ফস্কে যাবে! রিমি হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল, তিনটেতে মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। কাছাকাছিই আছে। কোথায় আর যাবে! ঋতুপর্ণা সমর্থন করল, তাই তো! আমরা, বড়রাই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। ওদের কাঁহাতক ধৈর্য থাকে!
চয়ন দেখল, সামনের রাস্তায় লোকজন বা যান চলাচল বেশ কমে এসেছে। রোদও মরে এসেছে অনেকটা। অপেক্ষমানদের ভিড়ও ছোট হয়ে গেছে। রাস্তার ওপারে ঢাল-তরোয়াল খচিত বন্ধ দরজাটাকে আরও বড়, আরও চকচকে দেখাচ্ছে! দরজাটা বড় হতে হতে ওপারের অনেকটা ঢেকে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ঢেকে গেল সেই সিকিওরিটির মানুষটা! এরপর ওটা প্রসারিত হতে হতে সেই নির্মীয়মান বহুতল, ওখানে কর্মরত শ্রমিক সবাইকেই ঢেকে দেবে আস্তে আস্তে! তারপর দরজাটা কী এদিকে চলে আসবে! ঢেকে দিতে চাইবে ওদের সবাইকে! আজকের দিনে যার জন্ম হয়েছে, সেই পাঁচ বছরের পৃথিবী দেখা মেয়েটাকেও! চয়ন অস্থি্র হয়ে পড়ে! কেমন যেন অসহায় বোধ করে ও! অবিশ্বাস্য জোরে ডাক দেয়, তি…ন্নি! ঋতুপর্ণা ওর হাত ধরে টান দেয়, আরে, এই তো! তিন্নি তো আমার সঙ্গে ! ওরা তো চলে গেল! কখন থেকে ডাকছে, চয়ন মিত্র এণ্ড ফ্যামিলি চলে আসুন। শুনতে পারছ না! তোমার শরীর খারাপ করছে নাকি!
চয়ন ধাতস্থ হয়ে বলে, না না ঠিক আছে। চলো। ও মেয়ে আর বউয়ের হাত ধরে হাঁটতে থাকে ধীর গতিতে। বাকিরা সেই গিলে খেতে আসা দরজা দিয়ে একে একে ভেতরে ঢুকছে। একটু দূর থেকে, দরজার ফাঁকে ভেতরের মায়াবী আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তা কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছে চয়নের! এখানে তিন্নির জন্মদিন পালিত হবে ভেবে, কেন কে জানে ওর মধ্যে এক গোপন বিমর্ষতার জন্ম হয়!
ঠিক এই সময়েই চয়ন ওর হাতে ঋতুপর্ণার চাপ টের পায়। ঋতুর দিকে তাকালে ও ওর বাঙ্ময় দৃষ্টি বিনিময় করে চয়নের সঙ্গে। তিন্নি মুখ উঁচু করে এই দৃষ্টিবিনিময় প্রত্যক্ষ করে।
ওরা দুজন তিন্নির হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে, এ ভাবনা চয়নকে তিন্নির প্রথম পৃথিবীর আলো দেখা দিনটির কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়! চয়ন রাস্তা পার হওয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়!
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল শিবার। ঘুম ভাঙ্গার কারণ, অবচেতন মনে স্বপ্ন যখন রঙিন থেকে রঙিনতর হচ্ছিল তখনই হঠাৎ পেটে কামর। চোখ বুজে মটকা মেরে থাকল কিছুসময়। সারাদিনের গতর খাটান শরীরটা একটু বিশ্রাম চায় এই সময়ে। রাতের এই কয়েক ঘন্টাই বিশ্রাম। পরদিন সকাল হলেই সাইকেল নিয়ে ছুটতে হবে কাটাবেলে। মাটি কাটার কাজ। দু’মাস ধরে করছে। ডাকাবুকো চওড়া শরীরটা তাকে এই কাজ পাইয়ে দিয়েছে। নাহলে এই বাজারে কাজ কোথায়? বেশিরভাগই পার্টির লোক। তার মত কয়েকটা তাগড়া জোয়ানকে কন্ট্রাক্টর আলাদা বেছে নিয়েছে তাই! তা-নাহলে নেতাদের পিছনে ঘুরে মরতে হতো।
পেট চেপে শুয়েও স্বস্তি পাচ্ছেনা কিছুতেই। লুকানো মেঘের মতো গুড় গুড় করেই চলেছে পেটটা। শেষে বাধ্য হয়ে চোখ মেলে। চোখ কচলে দেখে সারাঘরে সাদা টুনি লাইটের আলো। দড়মার বেড়ার একচালা ঘরে চাঁদ যেন ফুলশয্যার আসর বসিয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এসে আরো অবাক। মাথার উপর ফোকাস মেরে আধখানা চাঁদ ফটফটে সাদা চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সিসি টিভির ক্যামেরা। কড়া নজর চারপাশে। কিন্তু শিবার ওসব দেখার সময় কোথায়? এক দৌড়ে সোজা চলে গেল মাস্টারদার সর্ষে ক্ষেতের আলে। আলের দু’ধারে কোমর সমান গাছ। হালকা বাতাসে দুলছে সর্ষে ফুল। রূপালি আলোয় সোনালি ঢেউ। শিবা কোনদিকে না তাকিয়ে লুঙ্গি তুলে পা ফাঁক করে বসে পড়ল আলের মাঝে।
শরীরের নিচ দিয়ে গরম বেরিয়ে যেতেই ফুরফুরে হালকা বোধ করে শিবা। কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নটাকে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। কোন দিনই পারেনা। রাতের সব স্বপ্নই সর্ষে ফুলের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! তারপর ঘুম চটকালেই ভোকাট্টা। কোথায় যে ভেসে যায়!
কাজ হয়ে গেলে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে শিবা। শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস শরীর ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে। এক টুকরো মেঘ চাঁদের গা ঘেঁষে চলে যেতেই জ্যোৎস্নার আলো আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ রাতকে সঙ্গে নিয়ে একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকা। ফিরতি পথে পা বাড়াতেই দূরে একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ল শিবার। হেঁটে বেড়াচ্ছে আলোর বিন্দুটা। প্রথমে ভাবল আলেয়া হবে হয়তো। কপালের উপর চার আঙ্গুল দিয়ে চাঁদকে আড়াল করে দেখে, আলোর বিন্দুটা ডানে-বাঁয়ে বাঁক নিচ্ছে বারবার। তবে কি আল পথ ধরে এগিয়ে আসছে। কীসের আলো?
মাস কয়েক আগে মায়ের দাহ কাজ সেরে শ্মশান থেকে ফেরার সময় এমনি একটা আলোর বিন্দু দূরে, ক্রমশ আরো দূরে সরে যাচ্ছিল। সেদিন পেছন ফিরে তাকায়নি। তাকাতে নেই। মাঘ-শীতের ঠান্ডায় আদুল গায়ে কাঁপতে কাঁপতে বুঝতে পারছিল, আলো থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সে। তখন মনে হল মায়ের কথাই ঠিক। প্রায় সময়ই বলত, “আমি বিদেয় নেব যেদিন, দুনিয়ার হাজার আলোও মিথ্যে হবে সেদিন, দেখবি! চোখে আলো পড়লিই দুনিয়ার সব রং সাদা। চেনা জিনিসও তখন অচেনা হবে।“
এসব বলার কারণ, শিবা তার মাকে সন্দেহের চোখে দেখত। নিজের জন্ম নিয়েই সন্দেহ। কে তার আসল বাপ? একদিন সরাসরি প্রশ্ন করে যমুনাকে,“আমার জন্মবাপ কে? কার দায় হব আমি?”
কিছু সময় অসহায় চোখে শিবার দিকে তাকিয়ে যমুনা বলে,“এমন কথা কেমন করে মুখে আনিস তুই, জানিনে। উপরে থুথু ফেললি নিজের মাথায়ই পড়ে। আমাকে অবিশ্বাস করিস করিস, নিজের বাপকে অস্বীকার করিস নে। সে বড় ভোলা ভালা মানুষ ছিল।”
“বাবাঃ দরদ যে উথলে উঠছে! তা অমন সোয়ামীর পিরিতের দু’চারখান চিহ্ন পিঠের কাপড় সরালি যে এখনো মিলবে। সে কি আমাকেও রেয়াত করেছে? করেনি। হেঁসো ছুঁড়ে মেরেছিল।”
শিবা তখন সাত কি আট। অচিন একদিন রাগে হাতের হেঁসো ছুঁড়ে মারল। সেই উড়ন্ত হেঁসোর কোপে শিবার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল উড়ে গিয়ে পড়ল যমুনার পায়ের কাছে। যমুনা তখন দাওয়ায় বসে লাউডাটা কাটছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হাউ-হাউ করে কান্নাকাটি করার কথা ভুলে গেল। রক্তাক্ত শিবা তখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে। যমুনা তাকে পাঁজাকোলা করে ছুটল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ফিরে এসে আঙ্গুল হারানো শিবাকে দাওয়ায় শুইয়ে জলভরা চোখে অচিনের উদ্দেশ্যে শুধু একটা কথাই বলল,“নিজের সন্তানের এমন একটা ক্ষেতি করতে পারলে?”
অচিন সেইদিনই প্রথম প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলল,“উ আমার ছেলি না। তোর কলঙ্ক।”
“না না…” বলে বুক ভাঙ্গা কান্নায় আছড়ে পড়ল যমুনা।
অচিন মন্ডল মানুষটা সহজ সরল হলেও যমুনাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তাদের প্রথম সন্তান জন্মানোর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়। এরপর অনেক বছর যমুনার পেটে আর সন্তান আসেনি। ওদিকে সংসারের অভাবের সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ল অঞ্চল প্রধান মাস্টারদা। ন্যায্য পাওনার থেকেও বেশি করে চাল দিত, গম দিত, ঘর ছাউনির ত্রিপল দিত। অচিনকে ডবল রোজ দিয়ে তার আম বাগানে রাত পাহারার কাজেও লাগাত। সেই সময়ই শিবার জন্ম হলে অচিন তাকে মানতে চায় নি। এত বছর বাদে পেট বাঁধল কী করে? পঞ্চায়েতির প্রধান মাস্টারদা কেন তার ঘরে আসে? যমুনা অনেক কেঁদে কেটে বোঝাতে চেয়েছে, বাপের বাড়ি থাকতে মাস্টারদা তার চার কেলাসের মাস্টার ছিল। যমুনা একদিন পঞ্চায়েত অফিসে গেলে হঠাৎ মাস্টারদার দেখা পায়। সেই থেকে মাস্টারদা মাঝে মধ্যে তাদের বাড়ি আসে। তাদের অভাবের কথা জেনে পঞ্চায়েত থেকে এটা ওটা সাহায্য করে। অভাবের কারণেই সাহায্য নেওয়াটা মেনে নেয় অচিন। কিন্তু মাস্টারের বাড়ি বয়ে আসাটা মানতে পারে না।
কাটা আঙ্গুল নিয়েও অনেক কথা শুনতে হত শিবাকে। গাঁয়ের লোক পথ আটকে তার ডান হাতটা তুলে বলত,“ বাপ তোর কীসের দক্ষিণা নিল রে?”
এই কথার অর্থ সে বুঝত না। কিন্তু তখন থেকেই মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তবে কি বাপের উড়ন্ত হেঁসোয় তার আঙ্গুল উড়ে যাবার পেছনে মাস্টারদার কোন হাত আছে? এই সব ভেবে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একদিন সুযোগ বুঝে মাস্টারদার বাড়ির উঠোন হেগে ভরিয়ে আসে। মনে মনে গালও দেয়,“ শালার মাস্টার। তোর মুখে…।”
ষোল বছর বয়স থেকেই লায়েক লায়েক ভাব, বাপকেও আর রেয়াত করত না। যমুনা বলত,“ নিজের বাপকে শ্রেদ্ধা ভক্তি করতে শেখ।”
শিবা মাটিতে থুতু ছুঁড়ে বলত, “বাপ না ছাই। নিজের কলঙ্ক ঢাকতে আমারে ঢাল বানাচ্ছ? গাঁয়ের লোক যে পাঁচ কথা বলে, পারবে তাদের মুখ বন্ধ করতে?”
“গাঁয়ের লোক সত্যিটা জানেনা, তাই…। তা-বলে তুইও! পেটের সন্তান হয়ে…” বলতে বলতে অভিমানে চোখ ছেপে জল আসত যমুনার।
এখন নিরিবিলি, মায়াময় চাঁদের আলোয় অনেক দূরের একটা আলোর বিন্দু দেখে শিবার মনে সংশয় জাগে— মা কি সত্যিই…!
মাথার উপর সাদা আকাশ আর চারপাশে আদিগন্ত বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেতে যেন খই ফোঁটা সাদা আলোর নদী বয়ে যাচ্ছে। আর সেই নদীতে পালতোলা নৌকার মত দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে একাকী নিঃসঙ্গ একটি আলোর বিন্দু। আলপথে, ডানে বামে, ঘুরে ঘুরে। শিবার ইচ্ছে করছে এই আলপথে শুয়েই বাকি রাতটা কাটিয়ে দিতে। বেড়ার ঘর কিংবা এই জ্যোৎস্না মাখা ক্ষেতের আল, চোখ বুজলে কী আর তফাৎ! ওই আলোর বিন্দুর মতো তারও যে নিঃসঙ্গ জীবন।
অচিন মন্ডল তার বাপ কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় শিবা। দক্ষিণ দিঘির পাড়ে আম বাগানে গলায় দড়ি দেওয়াটাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয় তার কাছে। আত্মহত্যার জন্য নিজের ভিটেয় গাছ থাকতে অত দূরে মাস্টারদার বাগানে কেন? গাঁয়ের লোক জানল, অচিন মন্ডল অভাবের জ্বালায় গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু গাঁয়ে কার ঘরে অভাব নাই? এসব তলিয়ে ভাবেনি এতদিন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে নিরিবিলি, নিরুপদ্রব হলেই পেছনের অশান্ত এলোমেলো জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া করে শিবা। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।
আলোর বিন্দু যখন আরও কাছে চলে এল, শিবা হঠাৎ পিছন ফাঁকা করে মাথার উপর লুঙ্গি তুলে ঘোমটা টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াল আলো। শিবা নিশ্চিত হল, আলো হাতে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোয়াল শক্ত করে মাথা থেকে লুঙ্গি নামিয়ে কষে বেঁধে নেয় কোমরে।
আগন্তুক এবার সরাসরি মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আলোটাকে মাথার উপর তুলে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলে,“মাঝরাতে আলোকিত জ্যোৎস্নায় আমার সর্ষে ক্ষেতের আলে বাহ্যত্যাগ?”
মাস্টারদাকে দেখে অবাক হলেও বিস্মিত হল না শিবা। এখন বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে পঞ্চায়েত। পাছে কেউ শত্রুতা করে ফসল নষ্ট করে, সেই ভয়ে কী নিজেই পাহারায় বেরয়! তা’বলে এই মাঝরাতে, একা!
“আপনি কেনে মাঝরাতে মাঠেঘাটে…। হুরী-ফুরী নামে। আলো ঘোরে শ্মশানে। ক্ষেত-খামারে হায়না চরে। ভয় ডর নাই? আমরা অভাবী মানুষ। সরকারি মাগনার চালে বদ হজম হয়, প্যাট গুড়্ গুড়্ করে…।”
“ খাইয়ে-দাইয়ে তোদের পুষে সরকারের কী যে লাভ! যে পাতে খাস সে পাতেই হেগে রাখিস।”
শিবা মাস্টারের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না। আপনা হতে কোদালের মত সামনের দু’খানা দাঁত বেরিয়ে আসে তার। সেটা মাস্টারের নজরে পড়ার কথা নয়। এ যেন শিকার নিজেই গুটি গুটি পায়ে এসে বাঘের খাঁচায় গা চুলকাচ্ছে। এই মাস্টার তার পরিচয়কে অনিশ্চিত করেছে। এই মাস্টারের কারণেই সে হাতের আঙ্গুল হারিয়েছে। আজ তাকে বাগে পেয়েছে। বুঝে শুনে এগোতে হবে। মুখে হালকা হাসি রেখে বলল,“ তা মাস্টারদা, আমাগরে নিয়ে এত চিন্তা কীসের আপনাদের? দিনে মাস্টারি করেন, আর রাতের বেলা? দুই সময়ে দুই মানুষ। কিন্তু আমাগ কাছে এই সর্ষে ক্ষেত, তিসি ক্ষেত, ক্ষেতের আল, দিনে যা রাতেও তাই। ফুরফুরা বাতাস, চান্দের জোছনা, রোদ-বৃষ্টি, আন্ধার— এইসব আপনারা থাকলেও আছে, না থাকলেও আছে। তা মাস্টারদা, এবার ভোট নিতে আলা না?”
মাস্টার আলো থেকে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে বলে,“ভোটের খবরে তোদের এত মজা কীসের রে?”
মাঝরাতে মাস্টারকে একা পেয়ে শিবা বেশ মজাই পেয়েছে। মাস্টারের বিরুদ্ধে অনেক দিনের পুষে রাখা রাগ ঢেউ খেলছে মনে। আধখানা হেসে বলল, “আমাগ সবেতেই মজা। মাসে তিন কিলো পেলে মজা, আবার পাঁচ কিলো পেলেও মজা। আপনি ছিলেন পেইছি। এখন কেষ্টবাবু, তিনিও দেচ্ছেন। পেলেই হল!”
মাস্টার দেখছে শিবার কথার ভাঁজ তো যেমন তেমন না। খুব সাহস যে! নিজের পুরানো পঞ্চায়েতি ঝাঁজ এনে বলল,“পেয়ে পেয়ে তোদের নোলা বেড়ে গেছে।”
“ সে মাস্টার, আপনাদিগের দয়া আর ভোট ঠাকুরের কৃপা। ভোট ঠাকুর আছে বলেই না আমরা পাই।” মাস্টারের দিকে দু’পা এগিয়ে বলে, “ আচ্ছা মাস্টারদা! আপনে গাঁয়ের মান্য গন্য মানুষ। তা অচিন মন্ডল আপনের আম বাগানেই মরতে গেল কেন? কায়দা করে রটালেন গলায় দড়ি দ্যাছে। পাড়া গাঁয়ের মানুষ যে অন্য কথা বলে! ”
মাস্টারের হাতের আলো বেমক্কা নেচে উঠল যেন। নিজেকে সামলে-সুমলে বলল, “জীবতকালে কোনদিন ইস্কুলে পা দিস নি, অথচ কথা শুনলে মনে হয় যেন পেটে কথার জাহাজ নিয়ে ঘুরছিস। দু’পাতার বিদ্যে পেলে তোকে আর দেখতে হত না।”
সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে শিবা বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অসংখ্য আলোর বিন্দু এদিকেই এগিয়ে আসছে। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আলোর মিছিল দেখে মাস্টার ঘাবড়ে যায়। বিস্ময় না লুকিয়ে বলে, “ এই মাঝরাতে…!”
“কারা মাস্টার?” শিবা জানতে চায়।
মাস্টার দৃষ্টি না সরিয়ে বলে,“ সেটাই তো ভাবছি!”
হাতের আলো নিভিয়ে স্থির হবার চেষ্টা করে মাস্টার। চাঁদের রুপালি আলোয় শিবা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মাস্টারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন। আলোর মিছিল ক্রমশ এগিয়ে আসছে আলপথ ধরে। মাস্টার হঠাৎ মাথা নিচু করে বসে পড়ল। শিবা নিশ্চিত হল, মাস্টার ভয় পেয়েছে।
“মাস্টার, আপনে ভয় পাচ্ছেন?”
মচকায় তবু ভাঙ্গে না মাস্টার। বলে,“ কেন, ভয় পাব কেন? তুই জানিস ওরা কারা?”
আগুয়ান আলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিবা বলল,“জানিনে। আবার জানিও বটে। ওরা রোজ রাতে বেরয়। তবে এদিকপানে কখনো আসে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনেরে দেখে…!”
“শিবা! মজা মারিসনে! ওরা দেখতে পেলে আমাকে মেরে ফেলবে।”
মাস্টারের গলায় আর্তনাদ। ভয়ে ঢুকে পড়ল সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে। শিবা দেখে এক গোছা সর্ষে গাছ খামোখা নুয়ে পড়ল মাটিতে। মাস্টার হামাগুড়ি দিচ্ছে তাতে।
“ কেন, মাস্টারকে মারবে কেন?” শিবার মুখে চাপা বিদ্রুপ।
“জানিনে। তুই কিন্তু আমাকে দেখিস নি। না না, তুইও পালা এখান থেকে। ওরা তোকেও মারবে। আমার কাছে থাকিস নে, যা পালা!”
শিবা মাস্টারের কথায় আমল দেয় না। চোয়াল শক্ত করে ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে একেবারে মুখোমুখি বসে বলে,“ ওরা কী বলছে জানেন?”
মাস্টার গলা নামিয়ে বলে,“ না, আমি শুনতে চাইনে। তুই অন্যদিকে ভাগ। আমার সঙ্গে আসিস নে। দু’জনাই বিপদে পড়ব।”
মাস্টারের কথা শুনে শিবার হাসি পায়। তার বিপদের কথা ভেবে মাস্টার চিন্তিত! গলাটাকে মোলায়েম করে বলল, “ মাস্টার, আজ এই সুন্দর জোছনা রাতে চাঁদ পানে চেয়ে একটা সত্যি কথা বলেন দেখি।”
“ কী, কী সত্যি কথা!” তোতলাতে থাকে মাস্টার।
শিবা মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। চারপাশের ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম কর্নসার্ট ছাপিয়ে চিৎকার করে জানতে চায়,“আমি কে?”
সেই চিৎকারে কয়েক মুহূর্ত থেমে যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। বাতাসের আচমকা ঝাপটে উড়তে থাকে ফুল, যেন সারা মাঠ জুড়ে কাঁপছে জ্যোৎস্না ফুল। অনেকটা কাছে এসেও থমকে দাঁড়ায় আগুয়ান আলোর বিন্দুগুলো।
শিবার রুদ্রমূর্তি আন্দাজ করে মাস্টার ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। সর্ষে ক্ষেতের ভেতরে বুক দিয়ে হেঁটে পালানোর চেষ্টা করে। শিবাও ছাড়ে না। পিছু নেয়।
মাস্টার বাধা দেবার চেষ্টা করে,“ হারামখোর, তুই আমার পেছু নিচ্ছিস! নিজে মরবি আমাকেও মারবি?”
“ না মাস্টার, ওরা আমাকে মারার সুযোগ পাবে না। শুধু আপনাকে…”
শিবার কথায় থমকে পিছনে তাকায় মাস্টার। চোখে মুখে আতংক। ক্ষেতের ভিতর স্থির বসে থাকলেও তার শরীরের কাঁপুনিতে দোলা লাগে সর্ষে ফুলে। শিবা মাথা তুলে দেখে, আলোর মিছিল দাঁড়িয়ে আছে সেই আলের উপর যেখানে কিছুক্ষণ আগেই নিজেকে হালকা করেছে। তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হঠাৎ দু’হাতে গলা চেপে ধরলো মাস্টার।
“ সব তোর চক্রান্ত। তুই ইচ্ছা করে আমাকে এখানে টেনে এনেছিস। ভাবছিস আমি কিছু বুঝিনে? জানিনে? সব জানি। আমার বাড়ির উঠোনে তুই-ই হেগেছিলি। তখন কিছু বলিনি। লোক জানাজানি হলে আমারই সম্মান হানি হবে বলে চুপচাপ ছিলুম। পঞ্চায়েতির কোন সাহায্য তোদের দিইনি? এখন আমাকে মারার চক্রান্ত? নেমকহারাম!”বলে ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয় শিবাকে।
শিবা গলায় ধারালো সুর মিশিয়ে বলে, “আপনে ভুল ভাবছেন মাস্টার। আমি মারব কেন? আপনে নিজেই মরে আছেন।”
“ ইস্কুলে না যেয়েই দেখছি কথার দিগ্ -গজ হয়েছিস। এত কথা শিখলি কোথায় বলতো?”
“ অচিন মন্ডল ইস্কুলে না পাঠালিও যে রক্ত শরীলে সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে, তা লেখাপড়া জানা রক্ত। সবসময় টগবগ করে ফুটছে। আমায় দেখে বুঝতে পাচ্ছেন না? আলোটা আবার জ্বালি?”
“না…আ আ” বলে শিবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাস্টার,“শালা, বেজন্মা! আমার দেয়া ধান চাল খেয়ে শেষে কিনা আমাকেই…”
সাতাশ বছরের যোয়ান ছেলে শিবা সর্বশক্তি দিয়ে মাস্টারকে উল্টে ফেলে চেপে ধরে,“ আমাকে বেজন্মা বানাল কে, বেজন্মার বাপ? আপনের জন্য আমার হাতের একখান আঙ্গুল উড়ে গেছে। এই আপনের জন্য অচিন মন্ডল আমারে নিজের ছেলি বলে মানেনি কোনদিন। আপনের জন্য আমার মায়ের সংসার ভেঙ্গিছে। অচিন মন্ডল যেমন তাকে কোনদিন সুখ দেয়নি, আমিও তেমনি কম দুঃখ দিইনি তাকে। এ সব কিছুর দায় আপনের। এখন আপনের হাতে কোন ক্ষমতা নাই। ভোট নাই যার, ক্ষমতাও নাই তার। আজ সব হিসাব চুকাতি হবে”
একগোছা সর্ষে গাছ তুলে মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। হাত পা-ও কষে বেঁধে টেনে আনল আলের উপর। ততক্ষণে আলোর বিন্দুগুলো আরও কাছাকাছি এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের।
মাস্টার গোঙাতে গোঙাতে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল,“ শিবা, বাপ আমার! আমার কথাটা শোন। আমাকে ছেড়ে দে। অকারণ এই মাস্টারকে মেরে কেন জেলের ঘানি টানবি? তুই কী চাস বল, আমি তোকে সব দেব। আমাকে এভাবে ফেলে রাখিস নে। ঐ এত আলোয় আমার বড় ভয়। আমাকে এই অবস্থায় লোকে দেখলে…”
“ ভয় নাই মাস্টার! আপনেকে কেউ আর দেখতি পাবে না। যে ক’খান হাড়-গোড় পড়ি থাকবে, তাতে কেউ চিনতিই পারবেনা। ঐ যি দেখছেন একপাল আলো, জোছনার মধ্যিও কেমন জ্বলজ্বল করছে। হাতের আলোখান দেখে কাছে আসতি সাহস পাচ্ছে না। আমি সরে পড়লেই ওরা ভোজন উৎসবে মেতি উঠবে। ওদের পেটে বড় খিদা।”
শিবা খুশি মনে আলো নিয়ে ঘরের পানে হাঁটতে থাকে। আর পিছন ফিরে তাকায় না।
ঘন অন্ধকারের গভীরে লাল আলোর বলয় একবার উগ্র হয়ে ওঠে নরশুয়ার মুখের কাছে, আবার মিলিয়ে যায়। তোবড়ানো মুখের ওপর থেকে আলো গুটিয়ে পুনরায় জেগে ওঠে টিকনার মুখে। টিকনা সোঁ শব্দে টান দেয়। মন্দির লাগোয়া শুনশান চত্তরে নরশুয়া আর টিকনার টানের শব্দে কৃত্রিম ঝড়ের স্বর যেন নিস্তব্ধ রাতে একবার ওঠে আর একবার নামে। শীতের রাত। খাটো কম্বলের নীচে গুটিয়ে থাকতে চায় দুটি শীতার্ত মানুষ। একটি কুকুর পায়ের কাছে যতটা সম্ভব কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসতে চায় কম্বলের ওপর।
নরশুয়ার মৌতাত হতে সময় লাগে। সে পাকা নেশাখোর। টিকনার হাতে কলকে ফটফট শব্দ করছে। নরশুয়া অভ্যস্ত কায়দায় হাত বাড়িয়ে বলে, আমাকে দে, তোর হাত কাঁপছে, বিছানায় আগুন পড়লে সর্বনাশ। টিকনা ছোট শ্বাসে ধোঁয়া টেনে কলকেটা নরশুয়ার হাতে এগিয়ে দেয়। নরশুয়া উঠে বসে আধশোয়া অবস্থা থেকে। কলকেটা দুহাতে ধরে টান দেয় কলজের শেষমাথা পর্যন্ত । আংরার লাল আলো মন্দিরের ছাউনি ভরিয়ে সিঁড়ির কাছ বরাবর পৌঁছলে নরশুয়া হঠাৎ লক্ষ্য করে ছায়ামূর্তির মতো কেউ যেন দাঁড়িয়ে।
কিছু ভুল দেখল নরশুয়া! বাইরে চেন দিয়ে বাঁধা রিক্সা। চোর ? চোর হলে এভাবে মন্দিরমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? ভক্ত কেউ? এত রাতে! নরশুয়া ভাবতে ভাবতে কুকুরটাকে পা দিয়ে ঠেলা দেয়। কিন্তু সে নড়ে না। নেশা তার হয়নি। নিশ্চিত হবার জন্য আর একবার কলকেতে টান দেয় দ্বিগুণ শ্বাসে। ঠিক তাই! টান দেবার সাথে সাথেই রাঙা আলোয় দেখা গেল চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন ঠায় দাঁড়িয়ে।
নরশুয়া বসে বসেই হাঁক দেয়- হেই কে’রে? কে ওখানে? আচমকা কথা বোবা রাতকে যেন আছাড় মেরে জাগায়। কুকুরটা ধড়মড় করে উঠে বসে নরশুয়ার বলা কথারই যেন অন্য তর্জমা করে ঘেউ ঘেউ শব্দে। ছায়া মুর্তি এবারে যেন একটু এগিয়ে আসে, বলে, আমি রে নরেশ, তোর বাপ।
তা এখানে কি চাই? যা শুগে যাহ্। এইটুকু বলে বাকিটা সে বিড়বিড় করে, বাড়িতে নতুন বউ রেখে এসে এখানে সোহাগ লাগাচ্ছে। আবার গলা তুলে বলে, যা এখান থেকে! টিকনা চাদরের নীচ থেকে সব শুনেও ঘাপটি হয়ে থাকে। তাঁর কান-মাথা দুটো টান দেওয়া ইস্তক ভোঁ ভোঁ করছে। শরীর তুলতে সাড় হয়না। মনে মনে ভাবে, মরুক শালা বাপ-ব্যাটা কিচাইন করে। কিছু একটা এসপার ওসপার হোক। আজ তিনদিন ধরে, ওর বিছানায় ভাগ বসিয়েছে। কিছুতেই বাড়ি যাচ্ছেনা শালা!
ছায়ামূর্তি দু’পা উঠে আসে, চল, গুস্যা উস্যা বাদ মে হবে, এখন চল। তোর লতুন মা মন খারাব করছে, চল ঘর চল। অন্ধকারে নরশুয়া যেন নেভা আগুন! সে বাপের কথার উওর না দিয়ে হাতের কলকেটা আগুন সমেত ছুঁড়ে মারে ছায়ামূর্তিকে উদ্দেশ্য করে। ফসকে যায় লক্ষ্য। আগুনের ফুলকি ছিটকে কলকেটা ভেঙে গেলে কুকুরটা দৌড়ে মন্দিরের বাইরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। তার সাথে আরও কুকুরের সমবেত শব্দে রাতের নৈঃশব্দ্য খানখান হয়ে যায় কলকের মতো।
টিকনা কম্বলের ভেতর থেকে বলে, যা মিলমিশ করে লে, ঘর যাহ্। অচেনা কণ্ঠস্বরের প্রশ্রয়ে ছায়ামূর্তি খানিক এগিয়ে এসে নরশুয়ার হাত ধরতে চায় বুঝি। বলে, চল বেটা চল, হামি সব ...। কথা শেষ করতে দেয়না নরশুয়া। কলকের আগুনের মতো গনগন করছে সে। অন্ধকারে আন্দাজ মাফিক হাত ছুঁড়ে সে বলে, হাট বে, হাট ! ছায়ামূর্তি সরে দাঁড়ায় । হনহন করে মন্দির চাতাল থেকে নেমে কুকুরের ভিড় কাটিয়ে সে নিজের রিক্সার চেন খুলে,চড়ে বসে তাতে। তারপর ধুধু ফাঁকা রাস্তা দিয়ে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। কুকুরগুলো কিছুদূর এগিয়ে থমকে যায়। চিৎকার করে শুধু।
#
শীতের নৈঃশব্দ একটু বেশি মাত্রায় নিস্তেজ করে রাখে মফস্বল। আলোজ্বলা বাড়িগুলো দ্রুত জনমানবহীন অস্তিত্ব হয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থকে শুধু। এই সময় রিক্সা নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে যাওয়াটা নরশুয়ার অনেকদিনের নেশা। নিজেকে শহরের ডন বলে মনে হয় তখন। সে ডনের মতোই বাঁচতে চায়। সামনের ইলেকশনে তার হাতে দুটো বুথ। এলাকার পার্টি অফিস থেকে দুবেলা ডাক আসে। কৃষ্ণবর্ণের পেশিবহুল বেঁটেখাটো চেহারার নরশুয়া যখন নেতাদের দেওয়া শার্ট-প্যান্ট পড়ে অ্যাকশনে নামে তখন তাকে চেনা যায়না। প্রথম মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে তার হাতেখড়ি। সেবার তিনটে বুথে ভোট করার পর কাউন্সিলর তাকে রিক্সাটা দিয়ে বলেছিল, তোকে চাকরি দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। মিউনিসিপ্যালিটিতে মজদুরের কাজ। যতদিন না হয় এই রিক্সাটা চালিয়ে যা। কিন্তু হ্যাঁ, পার্টির কাজে ডাকলেই রিক্সাটা নিয়ে চলে আসবি। অবশ্যই পয়সা পাবি তার জন্য। সেই থেকে নরশুয়া রিক্সা চালায়। নিজের রিক্সা , নিজের রোজগার, আর পার্টির দরকারে অ্যাকশনে লেগে যাওয়া।
কিন্তু আজ? আজ এই জনশূন্য রাস্তায় নিজেকে ডন বলে ভাবতে পারছেনা নরশুয়া। খালি রিক্সার ঝনঝন শব্দ নিজের কানে আগে বেশ সুরেলা ঠেকত। কিন্তু আজ বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে একলাথি মেরে শালার ঝনঝনানি লোপাট করে দেয়! ক’দিন বাদে ইলেকশন। ভেবেছিল মাথা গরম করবে না নরশুয়া। তবু শালার বাপটা সব বিগড়ে দিল! লোকাল কমিটি থেকে জানিয়েছে, কটা’দিন একটু মাথা ঠান্ডা রেখে পার্টির কাজটা করে দে তারপর তোর ফ্যামিলি ম্যাটারটা নিয়ে আমরা আলোচোনায় বসব। লোকাল কমিটি মাথা না গলালে নরশুয়া নিজেই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলত এতদিনে। কমিটির বাচ্চুদা খবর পেয়েছিল সবার আগে। নরশুয়ার মনে হয় এটা নির্ঘাত টিকনার কাজ। এখন নরশুয়ার হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
নরশুয়ার রিক্সা ছোটে অন্ধকার রাতের শহরে। তার চোদ্দপুরুষ বিহার থেকে কবে এসেছিল সে জানেনা। তার জন্ম এখানেই। এই শহর, শহরের মানুষ, মানুষের ভাষা সবই সে জন্ম থেকে এখানেই পেয়েছে। শুধু মা ছাড়া। শুনেছে তার মা নাকি এখানকারই মেয়ে। নরশুয়া তাকে চোখেই দেখেনি।
চার নম্বর পোলের তলা দিয়ে ইটভাটায় যাবার পথ। দিনের আলোয় দেখা যায় নতুন ইটের ধুলোয় লাল হয়ে আছে টানা পথ। নরশুয়া সকাল সাড়ে দশটায় একবার আর বিকেলে সুয্যি ডোবার মুখে এই ইটভাটায় আসে। কদিন আগেও ঘুরে গেছে নিয়ম করে। নরশুয়ার শেষবার আসা সূর্য ডোবার সময়টা মনে পরে। আকাশের লাল রঙে ইটভাটার চারপাশ যেন হারিয়ে গেছে। কেবল হলুদ রঙের শাড়ি পড়া মইনার পাখির মতো শরীরটা জেগে ছিল। চারিদিকে লাল রঙের মাঝখানে হলুদ রঙটা হারাবার পথ পায়না। এলোমেলো হাওয়ায় ধুলো ওড়ে। নরশুয়া দূর থেকে দেখতে পায় মইনা থাক দিয়ে সাজানো ইটের লম্বা প্রাচীর ভেদ করে যায় আসে, মনে হয় রাজার কেল্লায় এক রাজকুমারী। রিক্সার হ্যান্ডেলে একটা মোচড় দিয়ে নরশুয়া রথারোহী যুবরাজের মতো সিটে আসীন থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় এবং হর্ণ টিপে দুবার পঁকপঁক শব্দে চারপাশের পাখপাখালি আর গাছপালায় ঝিরঝির একটা শব্দতুলে মইনার দৃষ্টি টেনে আনে ছোঁ মেরে। মইনা হাসে। নরশুয়া রিক্সায় বসে দু’হাত মাথার ওপর তুলে পাখির ডানার মতো নাড়িয়ে ইশারা জানায় হাসি মুখের মইনাকে। ইশারার মানে আশপাশের কেউ না বুঝলেও মইনা বোঝে। এরমানে হল বাপের সাথে পাকা কথা হয়েছে তার মরদের।
ইটভাটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার ওপর নরশুয়ার রিক্সা থামে। শুনশান অন্ধকারে চত্তরটা পুরনো কেল্লার মতো মনে হয়। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসা নরশুয়া তাকিয়ে দেখে, কবেকার এক রাজকুমারীর ভাঙা প্রাসাদের মাথায় চাঁদ উঠেছে। প্রাসাদের ওই পারে গঙ্গার দিক থেকে ধুলো উড়িয়ে আনছে হাওয়া। মিনারের মতো নেভা চুল্লির মাথায় নিকিয়ে রাখা আকাশের গায়ে থালার মতো চাঁদ। মইনার মুখের মতো উজ্জ্বল। নরশুয়া রাতের নির্জনতা ভেঙে আচমকা হর্ণ বাজায়। ঘুম ভাঙা পাখিদের ডানার ভৌতিক শব্দে নরশুয়া দেখে কেল্লার মাঠ দুলছে হাওয়ায়। রিক্সা থেকে নেশায় হালকা হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সে নামিয়ে আনে মাঠে। পা টলছে তার। দাঁড়াতে পারেনা। মাঠের মাঝ বরাবর এসে শরীর এলিয়ে সে শুয়ে পরে। দুহাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ওঠে সে, মইনা, মইনারে।
ভোরের ফুটি ফুটি আলো আর হাওয়ায় গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে। দূরে মাঠের প্রান্তে দুএকটা মেয়েলি কন্ঠস্বর কানে আসতেই লাফ দিয়ে ওঠে নরশুয়া। তার পরনের লুঙ্গি কোমড় ছাড়িয়ে বুকের ওপর জড়ো হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। রাস্তার ওপর কুয়াশার চাদরে ঢাকা রিক্সাটা দেখা যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে সেদিকে হাঁটা দেয় নরশুয়া। বুঝতে পারে দূরে মেয়েমানুষগুলো নিজেদের মধ্যে তাকে নিয়ে গা ঠেলাঠেলি করে হাসছে।
শিশির ভেজা রিক্সায় উঠে নরশুয়া প্যাডেলে পা রাখে। মইনাকে তার বাপ ঘুটিয়া নতুন বউ করে ঘরে নিয়ে গেছে তিনদিন হল। মইনা এখন তার নতুন মা। নরশুয়া মইনার মুখ দেখেনি তারপর থেকে। টিকনার সাথে মন্দিরে শুয়ে থাকার নামে রাত জাগে সে। চোখ বুজে এলেই মইনা তার স্বপ্নে নেমে আসে ইটভাটার মাটির ঢিবি থেকে। এই গলদ স্বপ্ন দেখা পাপ। চোখ টান করে থাকে সে।
#
রিক্সায় ঊঠে নরশুয়ার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে একবার। তার মনে পরে সিটের নিচে রাখা রিভাল্ভারের কথা। এভাবে রিক্সাটা ফেলে রেখে যাওয়া তার উচিত হয়নি। তাড়াতাড়ি সিটের নীচে হাত ঢূকিয়ে ঠান্ডা হয়ে থাকা বস্তুটা একবার আন্দাজ করে নেয় সে। এই প্রথম তার মনে হল অস্ত্রটা যেন বড় বেশি ঠান্ডা হয়ে আছে। কোনদিন এমনটা মনে হয়নি তার। সে নিজেও যেন কেমন ঠান্ডা অনুভব করছে। চারদিকে একবার তাকিয়ে সে অস্ত্রটা বার করে সিটের নীচ থেকে। লোকাল কমিটি থেকে ভোটের কিছুদিন আগে বাচ্চুদা তার হাতে দিয়ে বলেছিল, দরকার হলে চমকাবি, তাতেই কাজ হবে। নরশুয়ার হাত কাঁপছিল তখন। বাচ্চুদা ধমক দিয়েছিল, ন্যাকামো করিস না! নরশুয়া যন্ত্রটা নিজের কোমড়ে গুঁজে নেয় সাবধানে।
বাচ্চুদার মুখের ওপর কথা চলেনা। নরশুয়া বলতে চাইছিল অন্যকথা। মইনাকে বিয়ে করার কথা। মইনার টিয়ারঙ শাড়ির গায়ে ঝলমল করছিল রোদ। নরশুয়ার গায়ের ঘামে তখন চোলাইয়ের গন্ধ। খানিকটা তফাতে রিক্সা থেকে নেমে সে হাত নাড়িয়ে মইনাকে ইশারা করে জানিয়েছিল তার বাপ আসবে বিয়ের কথা কইতে। মইনা বুক সমান ইটের পাঁজায় ঠেসান দিয়ে হাসছিল। নরশুয়ার ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে মইনার নাকে দুলে ওঠা নোলকের ছিলায় ঠিকরে ওঠা আলো ছুঁয়ে দেখে। কিন্তু ইটভাটার মালিকের কড়া হুকুম, কাজের সময় বাইরের লোকের সাথে কথা বললে কাজ চলে যাবে।
নরশুয়াকে বিমনা লাগে বাচ্চুদার। সে আচমকা নরশুয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, কিছু বলবি, পকেট থেকে একশটা টাকা বার করে এগিয়ে দেয়, এটা রাখ, লাগলে বলবি আবার দেব, কাজটা ঠিক করে কর, এবারের ভোটটা খুব ইমপর্টেন্ট।
একটা কথা ছিল।
কী?
আমার বিয়ে।
তাতে কী হয়েছে? ভোট মিটে গেলে বিয়ের দিন দেখে টোপর পড়ে নিবি। মেয়েটা কে?
ইটভাটার মইনা। বাপ গেছে কথা কইতে।
আচ্ছা! ওই কারণে তোকে মাঝে মাঝেই ইটভাটার ওখানে দেখা যেত।
নরশুয়া মাথা নামিয়ে হাসে।
তা তোর বউ তো রোজগেরে । বিয়ের পর কী করবে?
ওকে আর কাম কাজ করতে দেবনা।
কেন? দু-পয়সা ঘরে আনলে তোরই তো ভাল।
নরশুয়া চুপ করে থাকে।
নরশুয়ার রিক্সায় আজ কোন আওয়াজ নেই। কুয়াশায় ভিজে সেও চুপ করে থাকে। নরশুয়ার ভাবতে সুবিধে হয় পেছনের কথাগুলো। তার মনে হয় এই রিক্সা চালিয়ে যদি সে নগর প্রান্তর পার হয়ে চলে যায় ভিনদেশে! সেখানে তাকে কেউ চিনবেনা। ভোটের কাজে তার উৎসাহ নেই আর। একবার একবার মন করছে বাড়ি যায় সে। মাকে সে কোনদিন চোখেই দেখেনি। এমনকি ছবিও দেখেনি। মায়ের নামটাও শুনেছে বলে মনে পড়ে না। মনে মনে মইনাকে মায়ের মতো ভাবতে গিয়ে তার কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। রাগ গিয়ে পরে বাপের ওপর। বাচ্চুদার সেদিনের কথাও নরশুয়ার ভাল লাগেনি। বলেছিল বিয়ের পর মইনাকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিবি, আমি কাজ দেব। কমিটির সবাই কথাটা শুনে খুব হাসছিল। নরশুয়ার এই তামাশা ভাল লাগছিল না। যদিও চুপ করে ছিল সে।
নেশার আচ্ছন্নতা কাটলে নরশুয়া ক্লান্ত বোধ করে। সে কতক্ষণ রিক্সা চালিয়ে চলেছে সে নিজেই জানে না। ততক্ষণে রোদ উঠেছে , শীতের সকালে হালকা রোদে তার শরীরে বিনবিন করে ফুটে উঠেছে স্বেদবিন্দু। চারপাশে তাকালে সে চিনতে পারেনা জায়গাটা। কোনোদিন এসেছিল বলে মনে হয়না তার। যেমন খুশি চালাতে চালাতে এ কোথায় এল সে! এটাই কী তবে ভিনদেশ, যেখানে সে আসতে চাইছিল? তবে সে যদি আর ফিরে না যায়! পার্টি অফিসের বাচ্চুদা তাকে ভোটের কাজে ব্যবহার করার জন্য খোঁজ নেবে। থানায় খবর যাবে নিশ্চয়। আর মইনা? মইনার কথা মনে হতে একবার নরশুয়ার মনে হয় বাড়ি ফিরে যাবে সে। বড় ইচ্ছে করে মইনাকে বুক চিরে দেখাতে তার কষ্ট।
একটা ভাঙা একতলা বাড়ি। নরশুয়া বাড়িটার সামনে রিক্সা থামায়। জায়গাটা সুনসান। বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে তার। পরিত্যক্ত ইটভাটার মতোই বাড়িটার চারপাশে মাটির ঢিবি আর ইটের পাঁজা। নরশুয়া আগাছা সরিয়ে সামনের ভাঙা বারান্দায় বসে। বারান্দার সামনে একটা নিমগাছ। গাছের গায়ে হেলান দেওয়া একটা টিনের ছাউনি। পেছনে ঘরে ঢোকার মুখটা হাঁ হয়ে আছে, দরজা নেই। ভেতরে একটা ভাঙা জানলা থেকে রোদ এসেছে শুকনো পাতা আর জঞ্জালে ভরা মেঝের ওপর। নরশুয়া চারপাশ দেখতে দেখতে বারান্দাতেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়তেই খিদে তেষ্টা আর ক্লান্তিতে তার দুচোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।অদ্ভুত একটা শীতলতা অনুভব করে সে। স্যাঁতস্যেঁতে ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে তার। তার যে সত্যিই কোন মা ছিল এককালে, সেকথা এই প্রথম তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। এখন তার খুব ইচ্ছে করছে মইনাকে মা বলে ডাকতে। মুখটা মনে করে একবার সে অস্ফুটে উচ্চারণ করল’ আহ্’ শব্দটা। একটা স্বস্তির নিশ্বাস এল ভেতর থেকে। তারপর নিজের কোমড়ে গুঁজে রাখা যন্ত্রটা বার করে নিজের কপালে ঠেকাল পরম শান্তিতে।
এইমাত্র এক ধাতব শীতলতা তার কপালে যেন অলৌকিক চুম্বন এঁকে দিল।
স্কুল থেকে ফিরে এসেই আমি চিৎকার করতাম - মা খেতে দাও। মা হয়তো তখন গেছে বারান্দায় বা ছাদে, সেখানে মেলে রাখা শুকনো জামাকাপড় তুলে আনতে। আমার চিৎকার শুনে মা হয়তো বলেছিল যে - আগে একটু ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে আয়, তারপর দিচ্ছি। তাতে আমি নিশ্চয়ই জবাব দিয়েছিলাম যে - এখন হাত-পা ধুয়ে কী হবে? খেলতে যাবো তো। তারপর জামা-প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে হয়তো বলেছিলাম - বেশি কিছু দিও না, খাওয়া বেশি হয়ে গেলে, দৌড়াদৌড়ি করতে গেলে পেটে ব্যাথা করে।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মোটামুটি একই কথাবার্তা সামান্য একটু অদল-বদল করে আমরা বলতাম। খেতে খেতে সেদিন স্কুলে নতুন কী ঘটেছিল, সেটাও ওই খেতে খেতেই বলতে চাইতাম। মা বলতো - খেতে খেতে কথা বলতে নেই। গলায় আটকে যাবে। কে জানে, আমার তো কোনো দিন আটকেছে বলে মনে পড়ে না।
খেয়ে উঠে কোনোরকমে হাত-মুখ ধুয়ে আমি ছিটকে বেরিয়ে আসতাম বারান্দায় আর তারপর লাফিয়ে আমার সাইকেলের ওপর চেপে বসে, বলে উঠতাম - চল মেরে ঘোঁড়ে! মা পেছন থেকে বলতো - ঘোঁড়ে নয়, ওটা হবে ঘোড়ে, চন্দ্রবিন্দু নেই। সেটা আমি জানতাম, কিন্তু ঠিক ওইসময় কেন যে মুখ থেকে চন্দ্রবিন্দু দিয়েই শব্দের উচ্চারণ হতো, সেটা আজও রহস্য!
কিন্তু একদিন এই বাঁধা রুটিনে ঘটলো গন্ডগোল। খেয়ে উঠে এসে আমি দেখলাম বারান্দায় আমার সাইকেলের চিহ্ন মাত্র নেই। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চুরি হয়ে গেল নাকি? গেট লাগানো থাকে বলে সাইকেলে আর তালা দিয়ে রাখিনি। কিন্তু এর মধ্যেই?
ছুটে ফিরে এলাম ঘরের মধ্যে। মাকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম - মা সাইকেলটা...
মায়ের মুখে কিন্তু খুব একটা ভাবান্তর দেখলাম না। বেশ শান্ত হয়ে মা বললো - হ্যাঁ, ঋজু এসেছিল একটু আগে। ওর নাকি সাইকেল লিক হয়ে গেছে। আজকে নাকি ওর খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলা। তাই, তোর সাইকেলটা চাইলো।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম - ও চাইলো, আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করেই দিয়ে দিলে? ওর খেলা আছে, আর আমার নেই?
- তুই কি আজকের ম্যাচে খেলছিস? মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।
আমি মুখ নামিয়ে বললাম, শুরু থেকেই হয়তো নয়, কিন্তু যদি তারপরও দীপকদা মনে করে, হয়তো শেষের দিকে নামাতেও পারে।
মা বললো - তাহলে যা, দশটা টাকা নিয়ে, মতিগঞ্জের মোড় থেকে একটা টোটো নিয়ে বেরিয়ে যাবি। অনেক দিন ও তোকে পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করেছে। একদিন একটুখানি সাইকেল চাইতে এলে না বলা যায়?
রাগে গজগজ করতে করতে কিটব্যাগ আর বুকজোড়া দুই কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সেদিন মতিগঞ্জের মোড় থেকে টোটো পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে যখন মাঠে পৌঁছালাম, তখন খেলা প্রায় শুরু হতে যাচ্ছে। দীপকদা রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
খেলা শুরু হতেই আমি ক্লাবঘরে ঢুকে দেখি দেয়ালের একপাশে হেলান দিয়ে রাখা আছে আমার সাইকেল। তালা লাগানো নেই। আমি তালাটা লাগিয়ে চাবিটা আমার ব্যাগের সাইড পকেটে রাখলাম।
সেদিনের ম্যাচ আমরা জিততে পারিনি। আমাকেও সামান্য সময়ের জন্যেও নামানো হয় নি। ম্যাচ শেষে দীপকদার ধরে ধরে ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণের শেষে আমি সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে সাইকেলের তালা খুলে বেরিয়ে এলাম। কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না।
যদিও আমি চাইছিলাম যে, কেউ কিছু বলুক। একটু চিৎকার-চেঁচামিচি হোক। কিন্তু কিছুই হলোনা দেখে, সরাসরি বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হলোনা। সাইকেল ঘুরিয়ে চললাম তিষ্টিদের বাড়ির দিকে। মন ভালো থাকলেও কি, আর অস্হির হলেও কি - ওই বাড়িটাই আমাকে টানে।
আসলে এইটা হয়তো কোনো ঘটনাই নয়। হয়তো বা এটা আমি রোজকার সাধারণ আর পাঁচটা ঘটনায় জড়িয়ে-মিশিয়ে কবেই হারিয়ে ফেলতাম। তাছাড়া ঋজুদা আমার চেয়ে তিনটে ক্লাস সিনিয়র, পড়াশোনা করে আর সবচেয়ে বড়ো কথা, কম্পিউটার বিষয়ে কোনো কিছু সমস্যায় পড়লে, ওর কাছেই পরামর্শ নিতে যেতাম আমি। তবে, সে সবই গতবছর বা তার আগের কথা।
তিষ্টি আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা এক ক্লাসেই পড়ি। এর সঙ্গে কয়েকটা টিউশনিতেও আমরা একসাথে যাই। তাই, সকাল সাতটা বা রাত দশটার সময়েও যদি আমরা একে অপরকে ফোন করি, আমাদের বাড়ির লোকেরা তাতে কিছু মনে করে না।
ক্লাস ইলেভেন-এ পড়ি বলে, স্কুলে সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব সেবার আমাদের ওপর। সকাল সাতটায় আমরা সবাই ঠিক পৌঁছে গেছি। কাজকর্ম, হৈ-হল্লা, এর-ওর পেছনে লাগা - সবটাই চলছে পুরোদমে। তিষ্টি আলপনা দিচ্ছিলো দোতলায় ওঠার সিঁড়ির সামনে। হঠাৎই আমার মনে যে কিসের পুলক জাগলো - আমি ঠিক করে ফেললাম, হয় আজকেই আর না হলে কখনোই নয়। ওর আশেপাশে তখন কেউ নেই দেখে আমি বলে উঠলাম - তিষ্টি, আজকে তোকে আমি একটা কথা বলবো।
তিষ্টি উঠে দাঁড়ালো আমার কথার ধাক্কায়। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, সামান্য একটু সময়। তারপর বললো - বেশ, তবে কিছু দিন আগে ঋজুদা যেটা বললো, তুই নিশ্চয়ই সেটা আবার বলবি না।
এবার ওর থেকেও বড়ো ধাক্কা খেলাম আমি। কিন্তু প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে গলায় খুব উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম - কী বলেছে তোকে রে ঋজুদা? কখন দেখা হলো, তোর সঙ্গে?
তিষ্টি আবার বসে পড়লো, আলপনার কাছে। তারপর আঁকতে আঁকতেই বললো - এই তো, স্কুলে আসার সময়। আমার মুখে এসে গেছিলো যে, কিন্তু ও তো তোর থেকে অনেকটা সিনিয়র। কিন্তু অনেক কষ্টে সেটা চেপে গেলাম। এটুকুই বুঝলাম যে, এবার আমি যাই বলি না কেন, আরো বেশি করে ধরা পড়ে যাবো। তাই মুখে শুধু বললাম - গুড! তারপর ফিরে এসে মিশে গেলাম আমার বন্ধুদের দঙ্গলে।
অন্যদের সঙ্গে মিশতে কোনো অসুবিধা না হলেও আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ঋজুদার সঙ্গে মিশতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকছে।
আর, তার দিন পনেরো পরেই সেই ঘটনাটা ঘটেছিল। নেহাতই একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ। বিপক্ষের একজন কেউ কর্নারের কাছ থেকে ব্যাক-সেন্টার করেছিল আমাদের পেনাল্টি বক্সের মাথায়। মরিয়া হয়ে আমি ভলি করে সেটা ফেরত পাঠাতে চেষ্টা করেছিলাম মাঝমাঠে। ওমনি কোথা থেকে ছুটে এসেছিল ঋজুদা। ট্যাপ করতে নয়, সরাসরি হিল করেছিল আমার পায়ের চেটোতে। যন্ত্রনায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম, তাহলে কি তিষ্টি আমাকে যেমন বলেছিল, তেমনি ঋজুদাকেও কি বলেছিল আমার বলতে চাওয়ার ইচ্ছা?
তিনদিন স্কুলে যেতে পারিনি, টিউশনিতেও না। তিষ্টি এসেছিল আমাদের বাড়িতে, আমাকে দেখতে। আমাকে বললো - কীভাবে হলো? আমি সরাসরি বলতে পারি নি। বলেছিলাম - রংফুটিং হয়ে গেছিলো, মচকে গেছে। খেলতে গিয়ে ওরকম হয়।
সেদিন দুপুরে অনেকটা সময় আমার বিছানার পাশে বসেছিল তিষ্টি। অবশ্যই তার একটা কারণ এটা হতে পারে যে, সেই দুপুরে ও আসার পর আচমকাই আকাশ ঢেকে গেছিল কালো মেঘে। কিন্তু সেকথা না ভেবে, আমার মনটা ভরে উঠছিল শুধু এই কথাটাই ভেবে যে, সে এসেছে। আমি ভেতরে ভেতরে এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে, পা-টা যদি আমাকে সাহায্য করতো, তাহলে আমি হয়তো নেচেও উঠতে পারতাম।
তারপর আমাদের চারপাশে অনেক দিন কেটে গেছে। পড়ার ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত গন্যমান্য মানুষের সামনে তিষ্টি রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আমরা দর্শকদের পেছনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছি। রূপকথার গল্পের ওপর নির্ভর করে তৈরি বিদেশি সিনেমা দেখতে গিয়ে রাজকন্যার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটার মধ্যে নিজের ভাবনায় আমি ওরই মুখের আদল দেখে উল্লাস প্রকাশ করেছি। ভোরবেলায় রাস্তা ধরে দৌড়তে দৌড়তে ওদের বাড়ির পাশেই বকুলতলায় ফুল পড়ে থাকতে দেখে, আশা করেছি, আর একটু অপেক্ষা করলেই হয়তো সাজি হাতে সে বেরিয়ে আসতে পারে, ফুল কুড়োতে।
কিন্তু দৌড় শুরু করলে, যখন-তখন সেটা থামানো যায় না। এভাবেই দৌড়তে দৌড়তে আমি স্কুল থেকে কলেজ হয়ে একসময় ইউনিভার্সিটি পৌঁছে যাই। সময়- সুযোগ পেলে সকালের দৌড় আর বিকেলের খেলা চলতেই থাকে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় ওদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই ফিরি। কোনো কোনো দিন ওকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আবার কোনো দিন ফাঁকা বারান্দায় একা একাই একটা নীল রঙের আলো জ্বলে।
তারপর একদিন দেশে এক ভাইরাস হানা দেয়। প্রথমে সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমার দৌড় আবার শুরু করি। কিন্তু ক্লাবের দরজা বন্ধ-ই থাকে। বাড়ির ছাদে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই, ফাঁকা রাস্তা ধরে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলে যায়, ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের দল। ঋজুদাও ভালো একটা চাকরি পেয়ে চলে গেছিল বিলাসপুরের কাছে একটা কোথাও। একদিন খবর পাই, সেও নাকি ফিরে এসেছে অনেক খরচাপাতি করে। একদিন রাস্তায় দৌড়াতে গিয়ে দেখা হয়। ঋজুদাই এগিয়ে এসে কথা বলে। আমি বলি - কেমন আছো? ও বলে - বলবো একদিন সবকিছু। তুই থামিস না, দৌড়ে যা।
আরো খবর পাই, এবছর নাকি কলুষতা মুক্ত হয়েছে অনেক নদীর জল। অস্ট্রেলিয়ার হাইওয়েতে নাকি দৌড়ে বেরাচ্ছে ক্যাঙারুর পাল। ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে নাকি আবার ফিরে এসেছে তিমি-ডলফিনের দল। আমাদের এখানেও গাছে গাছে দেখতে পাই, অনেক পাখি আর কাঠবিড়ালি। নিশ্চিত করে অবশ্য বলতে পারি না, আগের থেকে অনেক বেশি কিনা। কেননা, আগে তো এদের দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসৎ-ই পাইনি।
এখন তো কেউ কারোর বাড়িতে যাই না। আশেপাশের বন্ধুদেরকেও পাড়ার মোড়ে নয়, ফোনে ফোনেই কথা বলে, মেসেজ করে খোঁজ খবর নিই। ফোনে ফোনেই এটা-সেটা খবর ছড়ায়। চেনা অচেনা কতো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দেয় অজানা দেশে। আবার, এরমধ্যেই জন্ম নেয় কতো নবজাতক, কতো জনের বিয়েও হয় - তারা ঘর বাঁধে। আমি মনে মনে ঋজুদাকে ক্ষমা করে দিই।
আর একটা বদ-অভ্যাস হয়েছে এখন। দুপুর বেলায় খাবার খেয়ে উঠেই বড্ড ঘুম পায়। খুব বেশি নয়, হয়তো আধঘন্টা বা চল্লিশ মিনিটের মতো সময় পেলেও একটু শুয়ে পড়ি। যেদিন খাওয়া একটু বেশি হয়ে যায়, সেদিন ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্ন দেখি। অদ্ভুত সব স্বপ্ন।
পঞ্চাশ জন মাত্র আমন্ত্রিত। এর মধ্যে আমি যে ডাক পাবো, ভাবিনি। গিয়ে দেখি ঋজুদাও আছে সেখানে। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়ে খুব বেশি নেই। এখন কনের পিঁড়ি ধরবে কে? এ ওকে ডাকছে। ঋজুদাই এগিয়ে গেল প্রথমে, আমি এড়িয়ে গেলাম।
মুখের সামনে একটা পানপাতা ধরে নিয়ে সাতপাকে ঘুরছিল তিষ্টি । আর একটা হাত ঋজুদার কাঁধে । তিষ্টিকে বিয়ে করতে আসা বরটা মাটির দিকে তাকিয়েই একমনে কী যেন ভাবছিল ।
নতুন কেনা শেরওয়ানির পকেট থেকে ঠিক এইসময় একটা মোবাইল ফোন বের করে দৃশ্যটা তুলে রাখার কথা ভাবলাম আমি। ঠিক তখনই ঋজুদার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল ।
আমি এতোক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করছিলাম ঋজুদা কী ভাবছে! এখন ঋজুদাও বোধহয় বুঝতে চাইল - আমি সেটা ধরতে পেরেছি কিনা । তিষ্টিদের বাড়ির পাশের জুড়িপুকুরের ধারের বকুলগাছটা থেকে তখন বকুল ফুলের মাতাল করা গন্ধটা ভেসে আসছিল।
আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আমার মা’কে চলে যেতে দেখছিলাম।
সেদিন ষষ্ঠী। আমাদের পাড়ার মণ্ডপে ঠাকুর এসে গেছে। আমার ছাদ থেকেই পাড়ার পুজো মণ্ডপ দেখা যায়। কেউই প্রায় নেই সেখানে। মণ্ডপ খাঁ খাঁ করছে। বোধন কখন হবে কে জানে! একে অকালবোধন বলে। তার সময় হয়নি এখনও।
এবারে জাঁকজমক কম, সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। আশে পাশে ডাইনে বাঁয়ে সন্দেহ নিয়ে তাকায়, কোথায় করোনা-রুগী ঘাপটি মেরে দিব্যি ভালোমানুষটি সেজে বসে আছে, কে জানে! আমি ঘোষিত করোনা রুগী। দো-তলার ঘরে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত। কতটা স্বেচ্ছা কে জানে! সবাই মিলে কতরকম ইচ্ছে তৈরী করে ফেলে একেক সময়, যখন মনে হয়, ওই ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে। সেভাবেই আমি আমার এই বন্দীত্বকে, আমার অসুখকে, আমার অসহয়তাকে মেনে নিয়েছিলাম। মেনে নেওয়াও নয় হয়ত, এই নির্বাসনকে আমি আমার সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখতে স্বস্তিবোধ করেছিলাম। সেই সিদ্ধান্তের একটা অংশ হল আমার মা’কে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া। তাঁরই ভালোর জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সেখানে তাঁর মতামত বাহুল্য এবং অবাঞ্ছিত। তাই হাতের ছোট ব্যাগটা বুকের কাছে নিয়ে মা রওনা দিলেন সুস্থ কোনো নিকেতনের ঠিকানায়।
আমি তখন আমাদের ছাদে। সকালের রোদ তখন মোলায়েম, আমাদের পাড়া জুড়ে ছুটির মেজাজ আর আলস্য। আমি ছাদ থেকে দেখলাম পুজোর জোগাড় দেবার জন্য সদ্য-কিশোরী দু’জন চান-টান সেরে মণ্ডপে এল, পুরোহিত মশায় আসেননি তখনও। আমাদের গলিটার ধার ঘেঁষে ছোট্ট ছোট্ট ফুল ধরেছে চোখে না -পড়া গাছে। রাস্তার ধুলোয় তখনও ভিজে ভাব। বড় রাস্তা দিয়ে দু’একজন লোক হেঁটে, সাইকেলে পার হয়ে যাচ্ছে। সকলের মুখ ঢাকা অজানা যুদ্ধের মোকাবিলায়। আমি দেখলাম, রওনা হবার পর মা গলিটার মুখে গিয়ে একবার দাঁড়ালেন, পেছন ঘুরে তাকালেন, আমাদের বাড়িটাকে একবার দেখলেন, তারপর আবার হেঁটে গলির বাঁক ছাড়িয়ে গেলেন।
প্রথম যখন খবর এল, আমার রিপোর্ট পজিটিভ, আমার ভয় করেছিল। কিন্তু ভয় পেয়ে আমি কী ভেবেছিলাম, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না! আমি কী মরে যাব ভেবেছিলাম! মৃত্যুভয় কাকে বলে, আমি জানি না! প্রথমটায় একটু নার্ভাস হয়েছিলাম হয়ত, তারপর তো বেশ জাঁক করেই সবাইকে ফোন করে দিলাম, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে দিলাম, আমি ভাই করোনা রুগী, একজন সচেতন নাগরিক। এই বার্তা প্রেরণ এক মহান সামাজিক কর্তব্য বলে আমি মনে করি। একটা চিনচিনে দু;খ ভেতরে কাজ করছিল, এ এমন এক পোড়ামুখো রোগ, যে কেউ দেখতেও আসবে না। ফোন করেই দায় সারবে! হলও তাই! ফোনের বন্যা বয়ে গেল! সকলেই একই কথা জানতে চায়, কী করে কী হল! আমি মুখস্থের মত সকলকে একই কথা বলে যাই। শুধু মা’য়ের চলে যাওয়ার খবরটা আমার বিবরণে থাকে না, কেন না, ওটা রোগ-সংক্রান্ত কোনো খবর নয় বলেই আমার মনে হয়। না লক্ষণ, না ফলাফল!
ছাদের মিঠে রোদে বসে কথাগুলো যখন মনে পড়ছিল, তখন হঠাৎই যেন মনে হল, গলির শেষপ্রান্তে মায়ের ছায়াটা এতক্ষণে বাঁক নিল! এমনটা তো হও্যার কথা নয়! শুনেছি রোগটা সবাইকে খুব দুর্বল করে দিচ্ছে। আমি কী সেই দুর্বলতার শিকার!
আমার নির্বাসনের পঞ্চম দিনে আমি খবর পেলাম, সুমিতা মারা গেছে! আশ্চর্যের ব্যাপার,এ খবরে আমার যতখানি প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, তা হল না! সুমিতা আমার পাড়ার মেয়ে। মেয়ে, আমাদের খান তিনেক বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। ও আমার বউ মিত্রার কাছে প্রায়ই আসে বলে শুধু নয়, পাড়ার সমস্ত ব্যাপারে ও খুবই উদ্যোগী। দুর্গাপুজোর চারটে দিন ওই সবচেয়ে বেশি হই হই করে। আমার মা’কে ও ঠাকুমা বলে ডাকে। সেই সুমিতাকে ক’দিন ধরে যে মণ্ডপের ধারে কাছেই দেখলাম না, এই নিয়ে আমার কিছু মনে হয়নি তো! আলাদা করে মনেই পড়েনি ওর কথা! আসলে, দিনগুলো এমন হুড়মুড় করে ছুটতে থাকে সারা বছর, যে নিজের অসুখবিসুখ না করলে কাউকে নিয়ে দু’দণ্ড ভাবার অবসর হয় না! মিত্রাকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, শুনেছিলাম, মেয়েটা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে, তা বলে.. মিত্রা কথা শেষ করে না ,বা করতে পারে না! চুপ করে আমার জন্য নির্ধারিত পুষ্টিকর খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখে। আমি দুরত্ব বজায় রেখে উষ্মা জানাই, কই, আমাকে তো কিছু বলোনি! মিত্রা আমার দিকে সোজা তাকায়। এটা আমার অপ্রয়োজনীয় ব্যাগ্রতা বলে ওর মনে হচ্ছে, এরকম কিছু ওর চোখ দেখে মনে হয় না!
তবু আমি ‘এত কিছু একবারে খাওয়া যায়’ বলে প্রসঙ্গ পাল্টাই। সেটা দশমীর দিনের কথা। মা দুর্গাকে সেদিন বিসর্জন দেওয়া হবে। বিলিতি লিকারের প্রভাবে পাড়ার ছেলেদের মুখ গর্জন তেলের মত চকচক করছে। সুমিতার বডি আসার আগে ঠাকুর বেরিয়ে যাবে। এবার নাচানাচি, হুল্লোড় এমনিই বন্ধ, আর পাড়ার মধ্যে এরকম একটা ঘটনায় তো সকলে আরও মুষড়ে পড়েছে। অনেকেই বলছে, সত্যি, পুজোগণ্ডার দিন কী সব খবর গো!
আমার মা’য়ের ফিরে তাকানোটা অনেকদুর পর্যন্ত গেল বলে আমার মনে হল। আমি সেই দৃষ্টিপথ ধরে তাকা্নোর চেষ্টা করলাম। বিশুদার বাড়ির সজনে গাছে চোখ আটকে যায় আমার। বিশুদার ছেলেটা বাইরে আছে। মুম্বাই না পুনে, কোথায় যেন! এমনকি ওর নামও মনে পড়ে না আমার! এরকম তো হওয়ার কথা নয়! এই রোগে স্মৃতিও লোপ পায় নাকি! মিত্রাকে কথাটা বলতে ও বলে, ‘আমারও ছাই মনে আছে নাকি, ওসব!’ আমি আশ্বস্ত হই!
বিশুদাদের সজনে গাছের পাতাগুলো কেমন আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে নত হয়ে আছে। ঘন পাতা ভেদ করে বিশুদার ঘর সংসার চোখে পড়ে না আমার। সে কী আমি এতটা উঁচুতে আটকে বলে! মা হয়ত দেখতে পেয়েছে ওদের গেরস্থালির ছবি। বিশুদার বউয়ের নামটাও মনে পড়ে না আমার! তবে এবার আর মিত্রার শরণাপন্ন হই না আমি!
দোতলায় থাকি বলে টি ভি দেখা হয় না আমার। মিত্রা খবরের কাগজটা ওপরে দিয়ে যায়। আমি বাইরে আটকে পড়া লোকগুলোর কথা পড়ি। পড়ি ওদের দুর্দশার কথা। বিশুদার ছেলের কথা মনে হয় আমার, একটু উদ্বেগও হয়। কিন্তু ছাদের কার্ণিশের কাছাকাছি এসেও আমি সজনে গাছ টপকে ওদের সংসারে ঢুকতে পারি না!
মণ্ডপে লোক বাড়লে আমি ঘরে চলে আসি। মণ্ডপের থেকে ঘুরে তাকালেই সবাই আমাকে দেখতে পাবে। হয়ত ভয় পাবে। আমি সেটা চাই না। আজকাল এই রোগের দৌলতে চারিদিকে খুব গণ্ডী কাটাকাটি হচ্ছে, স্টেশনে , বাজারে, রাস্তায়।এই গণ্ডীটাকে ঠিকঠাক চিনে নিতে পারি বলেই তো আমরা সভ্য। গণ্ডী টানতে টানতেই তো এগিয়ে চলে সবটা। আমি ঘরে চলে যাই।
সেই যে ষষ্ঠীর সকালে আমার মা চলে গেল নিরাপদ আশ্রয়ে, তারপর থেকে মা রোজই ফোন করে জানতে চায় আমার খবর। আমার বেশ তৃপ্তি হয়, আমি এক মহান কর্তব্য করেছি ভেবে। অন্যের ভালো করতে পারার মধ্যে একটা মানসিক তৃপ্তি আছে। কত জায়গায় কতজনের কতরকমের ভালো করার আয়োজন প্রতি মুহূর্তে আছড়ে পড়ে আমাদের বেঁচে থাকায়, ভাবলেও আমার অসুস্থ শরীরে শিহরণ হয়! যারা করছেন, তারা তো আমাদের ভালো হবে বলেই করছেন এ সব। আর অতো বড় করে ভাবতে পারেন বলেই তারা বড় মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকে না আমার! সে ভাবেই গড়ে ওঠে নগর, সড়ক পথ, বিমানবন্দর, বা অতিথিশালা। ইতিহাসেও তো এ সব কথাই লেখা আছে। সুমিতার কথা আলাদা ভাবে ইতিহাসে লেখা হয় না বলে আমার এই সময়ে মনে হয়, সেটা আমার দুর্বল মনের বিকার কিনা কে জানে! সুমিতার নাকি একটা বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ঠিক ঠিক ক’দিন ও শ্বশুরবাড়ির ঘর করেছিল, আমি জানি না। মিত্রা বা মা জানতে পারে। আমরা, পুরুষমানুষরা একটু উদাসীন থাকতে অভ্যস্ত। উদাসীনতাটা আমাদের সঙ্গে যায় ভালো! সুমিতাদের ঠিক পাশের বাড়ির দেবাঞ্জন বাবু, যার সঙ্গে আমার একটা মাপা ‘ হ্যালো হাই’এর সম্পর্ক, তিনি ওই দশমীর পড়ন্ত বিকেলে ছাদে উঠে আমার মুখোমুখি হয়েছিলেন, আর আমার শ্রবণগ্রাহ্য হতে পারে এমন চিৎকারে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘কীসে মরল, জানলেন?’ দেবাঞ্জন বাবুর এই প্রশ্ন আমার কানে, মগজে লেগে থাকে অনেকক্ষণ! এরপর মা দুর্গাকে বাইরে আনার তোড়জোড় শুরু হয় মণ্ডপে। ঢাকের আওয়াজ উত্তরোত্তর বেড়ে চলে, ছোটবেলা থেকে আমরা ঢাক বাজলেই মিলিয়ে বলতাম, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন!’ সেদিন বার বার ঢাকের আওয়াজে বেজে উঠছিল, ‘মরল কীসে! মরল কীসে!’ তালে তাল মিলছিল না, কিন্তু তার সময়ও নয় এখন। পরে ভেবেছি, অসুখটা আমাকে ভালোই পেড়ে ফেলেছিল!
সন্ধে গড়িয়ে গেলেও আমি ছাদে বসে থাকি।
বিসর্জনের পরে পুজো মণ্ডপ জুড়ে বিষাদ ছড়িয়ে থাকে। প্যাণ্ডেলের কাপড় কোথাও খোলা, কোথাও ছিঁড়ে ফেটে গেছে। চারিদিকে থার্মোকলের বাটি, দোমড়ানো জলের বোতল, শুকনো ফুল, আধপোড়া মোমবাতি, বাঁশের টুকরো পড়ে আছে। একটা লাইট টিমটিম করে জ্বলছে, বাকি আলো খুলে ফেলা হয়েছে। মণ্ডপের মাঝখানে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ওর আলোর চারদিকে শূন্যতা যেন আরো বেশি হা হা করছে। আমি দেখি, সেই বিষন্ন সন্ধ্যায় বিজন মণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিশুদার বউ। হাত দূটো বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গীতে জড়ো করা। খানিকটা শিথিল সেই করজোড়। যেন কপাল পর্যন্ত হাত দুটো তোলার জোর পাচ্ছে না বউটা। ওর কী দেরী হয়ে গেল? দুগ্গাঠাকুর বিদায় নেবার পর ওকে এসে দাঁড়াতে হল শূন্য মণ্ডপে? আমার এসব কথা ভাবার মধ্যেই বউটা খুব ধীর পায়ে ওখান থেকে চলে যায়। যাবার আগে আমাদের দরজার দিকে একবার তাকায়। সম্ভবত আমার মা’কে দেখার প্রত্যাশা করে। কিন্তু ডাক দেয় না। আমি ছাদের ওপর থেকে সবই লক্ষ্য করি। কোনো আও্য়াজ দিই না। আমার কী মিত্রাকে ডেকে দেওয়া উচিত ছিল! হয়তো তাই! কিন্তু আমি নড়াচড়ার উদ্যোগ নিই না! এই অসুখ কী আমাকে সিদ্ধান্তহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
অষ্টমীর সকালে আমাদের মণ্ডপ জমে উঠেছিল। মেয়ে বউরা স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে একপ্রকার মণ্ডপের দখল নিয়েছে। নানা বয়সের পুরুষেরা পাঞ্জাবি-পাজামা, ইস্তিরি করা জামা-প্যাণ্ট পরে একটু দূরে তৃপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে। আমি ছাদে থাকা দূরের দর্শক, তাই একটু উঁচু আর দূর থেকে সবটা দেখতে পাই। বিশুদাদের সজনে গাছের ওপর একটা বিজ্ঞাপনের ব্যানার ঝোলানো হয়েছে। ফলে এখান থেকে ওদের ইতিউতি দেখার সম্ভাবনাটুকুও গেছে। পুরোহিত মশায় ছোকরা ছেলে, গলার জোর আছে এমনিতেই। তার ওপর লাউডস্পিকারে মন্ত্র পড়ছে, যাতে অঞ্জলিদাতাদের কানে সবটুকু স্পষ্ট পৌঁছায়। এ সব ব্যবস্থা সব বারেই থাকে। মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ পাড়া ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত যায়। তখন অবশ্য সুমিতাদের বাড়ির খবর আমরা কেউ জানতাম না। সকলে হাতের মুঠোয় অঞ্জলির ফুল নিয়ে, পাশের জন ও বিগ্রহের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছিল ঠাকুরমশায়ের কথা মতো। তারই ফাঁকে ওরা আমাদের বাড়ির এদিক ওদিক তাকিয়ে জরিপ করছিল, আমি ঠিক কোথায় আছি!
মাতৃ-বন্দনার এ সময় অন্য বছর আমার মা থাকে। এবার আমার অসুখের জন্য মা ভীড়, কোলাহল থেকে দূরে সুস্থযাপনের জন্য অন্যত্র, একা। মাইকে শোনা যাচ্ছে, “….নমঃ শরণাগতদীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে/ সর্বস্যাতিহরে দেবী…..” বিশুদাদের সজনে গাছের ওপর ঝোলা ব্যানার আশ্বিনের বাতাসে দুলছে, কিন্তু তার ফাঁকফোকরে তেজী রোদ পড়লেও গাছের আড় ভাঙছে না, আমার দৃষ্টি ওদের উঠোনে পৌঁছতে পারছে না। এবার মিত্রাও যায়নি অঞ্জলি দিতে। এ কটা দিন ও মণ্ডপমুখোই হচ্ছে না। আমাদের এই সচেতনতা সবার তারিফ পেয়েছে। তবু সকলের তাকানো দেখে আমি বুঝতে পারি, নিজের চোখই সকলকে একশো শতাংশ নিশ্চিন্তি দেয়, বিশেষ করে এটা যখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন!
আমাদের পাড়া শুনশান হয়ে গেছে। দূর থেকে বিসর্জনের ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। মিত্রা নীচ থেকে চেঁচায়, তুমি এখনও ছাদে? ওর গলায় বিরক্তি, উষ্মা, উদ্বেগ! আমি শরীরে কোনো অসুস্থতা অনুভব করছি না। বন্দী থাকার জন্যই মাথায় নানা চিন্তা ঘুরঘুর করছে। সেটা বয়স হলে সকলেরই হয়। তবু আমি ছাদ থেকে ঘরে চলে আসি। আশ্বিনের হিম আমাকে নতুন করে অসুস্থ করতে পারে, এটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে। একটা ভয়ও কাজ করে। শরীরটা বেশি খারাপ হলে কাউকেই তো পাশে পাব না! এই ভয় কী মিত্রারও নেই! সুমিতার বাড়ির লোকও কী এই একই ভয় পেয়েছিল! তাই আমরা কিছু জানতে পারলাম না! অথচ আমাদের নাকের ডগায় এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল! আচ্ছা, কীভাবে একজন মানুষ অন্যের বিপন্নতার খবর জানতে পারে! আমিই কী খুব বেশি অসুস্থ হলে অন্যকে জানাবার মতো অবস্থায় থাকতাম! সে ক্ষেত্রে মিত্রাকে খুব হইচই করতে হত! সুমিতার মা-বাবারা কী সেটা করতে চাননি! কোনো বুক-চাপা কষ্টের কথা তেমন ভাবে না জানালে কেউ জানতেই পারবে না, একথা ভাবতে গিয়ে এবার আমার ভয়ই হয়! ঘরে সেঁধিয়ে যাবার আগে আমি একবার বিশুদার সজনে গাছে ঝোলা ব্যানারটার দিকে তাকাই। বিজ্ঞাপন তো আড়ালও করে!
নবমীতে পুজো-কমিটি থেকে প্রত্যেকবার খাওয়ানো হয়। ফ্রায়েড-রাইস, চিলি-চিকেন এই সব কত কী! এবার জমায়েত বারণ, তাই সেটাও বন্ধ রাখতে হয়েছে। অল্প বয়সীদের মন খারাপ। সবাই এদিক ওদিক ঘুরবে, বাইরে খাবে। বেশ কিছু রেস্টুরেণ্ট খুলেছে। নবমীর দুপুরে মণ্ডপ ফাঁকাই। পেতে রাখা চেয়ারগুলো মানুষের অপেক্ষায়। মণ্ডপের সামনের রাস্তার ধারে যে ছোট ছোট ফুলগুলো ষষ্ঠীর দিন ফুটে থাকতে দেখেছিলাম, আজকে দেখি, তার বেশির ভাগটাই পায়ের চাপে দলে মচড়ে গেছে! অন্য সময় তো এতো লোকের আনাগোনা এই গলিতে হয় না। চেনা পায়ের ছাপ ওদের বাঁচিয়ে রেখে চলে। মা যেদিন এই ঘর থেকে বেরোল, সেদিনও গলির বাঁক পার হবার আগে মা ওদের দেখে গেল! আমি তেমনটাই দেখেছিলাম। এটা তো ঠিকই, ফুল টবে বা বাগানে থাকলে যত্ন পায়, রাস্তার ধারে থাকলে তাকে নিজের জোরে বেঁচে থাকতে হয়। তবু তো এখানে ওখানে ফুল ফোটে, যত্নের তোয়াক্কা না করেই! মরে ঠিকই, আবার বেঁচেও তো যায়! দূরের কোনো মণ্ডপে ‘যেও না নবমী রজনী’ গান বাজছে। তবু নবমী রজনিকে যেতে হয়, উমাকেও!
দশমীর রাতের দিকে আমার আবার একটু জ্বর জ্বর ভাব হল। মিত্রাকে কিছু বলি না। সম্ভবত ছাদে বেশি সময় কাটানোতেই হয়েছে। রাতের খাবার মুখে ভালো লাগল না। আমি গায়ে হাল্কা চাদর টেনে শুয়ে পড়ি। সারা শরীরে ক্লান্তি, অবসাদ! আগুন! স্বপ্নে দেখি, দাউদাউ আগুন জ্বলছে! প্রচণ্ড আওয়াজে ঢাক বাজছে। আগুনের মধ্যে সুমিতার মুখটা আবছা দেখতে পাই। আমি আগুনের থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে আশে পাশে তাকানোর চেষ্টা করি। আগুনের লালচে আভা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোতে রাস্তার যতটা দেখা যায়, সব ফাঁকা! বিশুদার ছেলেকে আমি কোথাও দেখতে পেলাম না! আমি ওর নাম ধরে যে ডাকব, তাও পারছি না! আমার তো ওর নামই মনে নেই! ছেলেটা কী পথ হারিয়ে ফেলল! আগুনের হল্কায় আমার সারা শরীর গরম হয়ে উঠেছে। গলা, বুক শুকিয়ে গেছে! অস্থির হয়ে আমি উঠে বসি। গা থেকে ঢাকা সরে গেছে। আমার সত্যি সত্যি গরম লাগছে। কপালে ঘাম হচ্ছে, টের পাই। জ্বরটাও ছেড়ে গেছে।
ক’টা দিন কাটলে একটু ঝরঝরে লাগে আমার। মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসছে ভেবে আহ্লাদ হয়। অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে লিস্টি বানাই, কতজনের কাছে যেতে হবে আমায়, ঢুকে পড়তে হবে কতরকমের কাজে!
মিত্রা খবর দেয়, মায়ের ঘর ঝাড়পোছ হচ্ছে।
মা আসছেন।
গাড়িটা বিদ্যুৎচালিত। কোনো আওয়াজ নেই। সাধারণ টোটো গাড়ির চেয়ে একটু বড় কী, দিয়ার তেমনই মনে হয়। এটা কী ব্যাটারিতে চলছে? দিয়ার প্রশ্নের উত্তরে গাড়ির চালক একটা ‘হুম’ শব্দ করে মুখে। ওর মুখাবরণী ভেদ করে সেই শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কোনো শব্দ নেই। দিয়া ঘাড়টা একটু পেছনের দিকে হেলিয়ে বসে, চোখদুটো আধবোজা। ক্লান্ত লাগছে ওর, খুব অবসন্ন। কার কাছে হারল দিয়া? ওর নিজের কাছে? নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ওর নিজের কাছে জোরালো ঠেকে!
এ সময় প্রাণীটা একটু নড়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ও নিজের শরীরের ওমেই আরাম বোধ করছিল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন আরামে বোধহয় ক্লান্তির প্ররোচনা থাকে! তাই নড়ে চড়ে নিজেকে সুসহ করে নেওয়া। দিয়া অবশ্য তাকায় না ওর দিকে। এ যেন নিজের সঙ্গে লড়াই! দেখব না ওকে, যতক্ষণ সম্ভব! ও ও তো দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে নেই। ‘তুমি আছো, আমি আছি’ এই বিশ্বাসের চাদর ওদের দুজনের গায়েই লেপ্টে আছে, কুকুরটা তো সেই বিশ্বাসেই থিতু হয়ে আছে! দিয়ার চাদরের অংশটা জ্যালজ্যালে হয়ে এসেছে, দিয়া টের পায়! এখন প্রবল শীতবোধ হয় ওর!
ঠাণ্ডাটা সত্যি খুব জবর পড়েছে! কতটা জবর, দিয়া বাইরে না বেরোলে টের পেত না। ঘরের মধ্যে নানা উষ্ণতার আয়োজন যেমন আমদের উদাসীন করে রাখে শৈত্যের প্রবল থেকে, তেমন আর কী! কিন্তু শীতের কিছু স্বধর্ম থাকে, সে তো আবহাওয়া বিজ্ঞানের নানা কার্যকারণের ফলাফল মাত্র, উত্তুরে হাওয়ার কাঁধে চড়ে বসা তার নিয়তি নয়, স্বাধর্ম্য! দিয়ার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে থাকা কুকুরটা এর সবটুকুই মেনে নিয়ে ওর বেঁচে থাকা জারি রাখে! কোন আদাড়ে বাদাড়ে জন্ম হয়েছিল ওর। রাস্তায় ফেলে দেওয়া খাবারের ভাগ নিয়ে রক্তারক্তি করা, লোমওঠা ঘেয়ো কুকুরটাই ওর গর্ভধারিণী। প্রকৃতিরই এরকম কোনো স্বাধর্ম্যে সেই ঘেয়োচর্মসার সারমেয় নিজের শরীরে আহ্বান করেছিল কোনো সারমেয়-পুরুষের বীজ! আশ্লেষে জিভ ঝুলে পড়েছিল! গর্ভসঞ্চারও হল একই নিয়মে। তারপর এক জল ঝড়ের রাতে, সজীব জংলার মাঝে, গুপ্ত হয়ে থাকা যে অন্ধকারে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল আনত হয়ে পড়ে, তার আড়ালে, আদিম মাটিতে খালাস হল সে! সে এবং কয়েকজন। ওরা ওর সহোদর। এ ওর ঘাড়ে লিপ্ত হয়ে মায়ের স্তনের বোঁটা খুঁজে নিতে চাইত। উদাসীন জননীর মধ্যে আগামী দিনের খাবারের ভাগ বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত কোনো দুরভিসন্ধি তখনও ওদের চোখে পড়েনি, কেন না চোখই ফোটেনি ওদের তখন!
তারপর যেমন হয়। জগতের সমস্ত প্রতিকূলতা, অসঙ্গতি, অন্যায় অথবা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে ওই ছোট্ট, তুলতুলে শরীরের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসে শব্দ, তাকে কান্না বলা হয়। অশ্রু থাকে না তাতে, একটানা একটা আওয়াজ—ক্ষীণ, তীক্ষ্ণ! সুর্য-চন্দ্র উঠে পড়ে, বৃষ্টির দাগ শুকিয়ে আসে, এলোমেলো হাওয়া বয় কখনও, সেই শব্দটা ভেসে বেড়াতে থাকে দশদিক জুড়ে।
আলোড়ন তৈরি হয়। যে অস্বস্তি আমাদের বেঁচে থাকাকে এখনও নানাভাবে অর্থবহ করে রাখে, সেই অস্বস্তি বুড়বুড়ি কাটে। ইতিমধ্যে সহোদরগুলো অন্য কোনো উপায়হীন হয়ে মরে গেছে! মা-কুকুর পরবর্তী আশ্লেষের হাতছানিতে পুর্বকৃতির দায় ঝেড়ে ফেলেছে! এই সঙ্গতিহীন বাস্তবতার আবহ হয়ে ভেসে বেড়ায় সেই একটানা, তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ। সে আওয়াজ আকাশে, বাতাসে, নভোমণ্ডলে, মেট্রোপলিটনে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এসে ঢোকে এক ছিমছাম আবাসনে, এবং শেষমেশ দিয়ার কানে। দিয়া বিচলিত হয়। বিচলিত হওয়ার জন্য জগতসংসারে আরও নানা বিষয় ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও ওই একটানা , একঘেয়ে কান্নার সুরটাই অস্থির করে তোলে দিয়াকে।
সেই রাত্তিরে আকাশে চাঁদ ছিল না, ছিল শীতের রাত্রের নির্মোহ একাকীত্ব! দিয়া বেরিয়ে এল; পেছনে রয়ে গেল ওদের নিরুপদ্রব আবাসন, সন্ধের টি.ভিতে নানা খবরের জমকালো আয়োজন, মা-বাবা-পরিজনদের নিত্য বিমূঢ়তা, আর অপরাপর জগৎ সংসারের নিস্পৃহ বহমানতা!
জঙ্গল নয়,জঙ্গলের মতো। দুটো-চারটে বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলো, পড়ে থাকা ঝোপঝাড়কে চিকচিকে ঝলক দেয়। দিয়া সহজেই ঠাহর করতে পারে কান্নার উৎস। কান্নাটুকু কোলের মধ্যে জড়ো করে দিয়া ঘরমুখো হয়।
বিজয়ী দিয়া নিশ্চিত, তৃপ্ত পদক্ষেপে রাস্তাটুকু পার হয়ে আসে। জীবন বিমার বিজ্ঞাপনে দু’হাতে আগলে রাখা আলোকশিখার মতো দিয়া সেই জীবনকে আগলে রাখে। কম্পমান সেই শিখাজীবন কোথাও হয়ত নিশ্চিত আশ্রয়ের বার্তা পায়! ওর উদ্গত কান্না থেমে যায়।
কিন্তু জীবন তো শুধুই দু’হাতের বেড়ে আগলে রাখা বিজ্ঞাপনের বিষয়মাত্র নয়। তার নিজস্ব ছক আছে। সে ছক, ভেবে রাখা অন্যান্য যাবতীয় ছককে ওলটপালট করে দেওয়ার ছক! কতরকমভাবে তার নকশিকাঁথা বোনা হয়! দিয়া শুধু সেই জীবনকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অগণিত জীবের প্রবহমান ধারায়। সেটুকু উজ্জীবনে ভর করে সেই সারমেয়শিশু খায়, ঘুমোয়, হয়ত স্বপ্নও দেখে! এভাবেই পার হয় আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি। সুতরাং কালের নিয়মে সেই শিশু দাবি জানাতে শেখে। সোচ্চার দাবি। আর এখানেই তার জীবনছকের বাঁক বদল হয়। ওর উৎকট, কর্কশ, অপরিচিত তীব্র চিৎকার নাগরিক যাপনের ছেয়ে থাকা জালকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফ্যালে! অস্বস্তি, অসহায়তা ঢুকে পড়ে স্থির, নিস্তরঙ্গ, মজে যাওয়া জীবনে!
দিয়া এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। বাঁধানো শানে প্রাণীটা আদুরে ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। সামনের দিকে দুটো পা ছড়ানো। দুটো পায়ের মাঝখানে মুখটাকে রেখে ও জুলজুল করে তাকিয়ে আছে দিয়ার দিকে। দুজনে চুপ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেরই প্রতীক্ষা-- কে আগে পলক ফ্যালে! লেজের প্রবল আন্দোলনে প্রাণীটি দিয়াকে প্ররোচিত করে আগে প্রতিক্রিয়া দিতে! দিয়া দু’আঙুল নাচিয়ে হাতছানি দেয়! প্রাণীটা ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে দিয়ার গায়ে। ঢেউ ওঠে দুটি হৃৎযন্ত্রে! লাবডুব দ্রুত হয়! অহৈতুকী আদিখ্যেতার নিরবচ্ছিন্নতা বাধা পায় কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দে। কলিং বেল সেই আশ্চর্য যন্ত্র, যার বেজে যাওয়া সুর অনেকক্ষণ বেজে যাবার পরেও শ্রোতাকে মোহিত করে না, সচকিত করে! এবারও দিয়ার লাবডুব বেড়ে যায়, তবে তা কোনো অজানা আশঙ্কায়!
ভদ্রলোক কথা বলছিলেন দিয়ার বাবার সঙ্গে। সে কথা বিজ্ঞপ্তি জারির মতো, একতরফা। মুহ্যমান বাবাকে দেখে দিয়া বুঝতে পেরেছিল, সে বিজ্ঞপ্তি দিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছেন না তিনি। ওর বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোথায় লাগছে বাবার! পক্ষ নেবার আহ্বান এসেছে। হয় অভ্যস্ত সামাজিক জীবনের তরঙ্গে যেমন ভেসে আছো, থাকো; নয়তো এক প্রাণকে সেখানে জড়িয়ে নিতে গিয়ে সম্ভাব্য ওলটপালটগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকো। সে প্রাণ এত তুচ্ছ, এত অগণ্য যে, উপদ্রব হয়ে দেখা না দিলে তার কথা কেউ মনেও আনবে না! এখন সেই প্রাণ যখন নিজের যাবতীয় অনুভূতিকে একটা মাত্র আওয়াজেই ব্যক্ত করতে জানে, সে আওয়াজ, হয়ত কান্না, বা কান্না নয়, বোধের অগম্য কোনো সঙ্কেত, তা অস্থির করে তোলে চেনা সমস্ত যাপনকে। এ থেকে মুক্তি চান ভদ্রলোক। নিজের ভেতরকার সমস্ত দাঁত-নখ-জিঘাংসাকে দাম হিসেবে দিতে প্রস্তুত তিনি। এখন যেন দিয়ার বাবাকে যুদ্ধ শুরুর একটা নোটিশমাত্র দিয়ে গেলেন তিনি। সেই অবলা জীবের সামান্যতম বলার চেষ্টা, তার ক্ষোভ-দুঃখ-ক্রোধ-রিরংসা-আহ্লাদকে সমূলে নিকেশ করাই একমাত্র পন্থা, যার মধ্যে দিয়ে তিনি পৌঁছতে পারেন চেনা তরঙ্গে। সে কথাই বলতে আসা ওঁর। দিয়ার বাবা সেই অনিবার্য প্রস্তাব পেয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন! অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে দেখেন দিয়াকে! তার বীজের পূর্ণতার রূপ! মনে পড়ে ওর জন্মের প্রথম দিন থেকে নানা টুকরো টুকরো কথা! একটা জীবনের মধ্যে কিছু ক্রোমোজম, জিন, ডি এন এ’র বাইরেও কত পলস্তরা পড়তে থাকে! সে কথা ভেবে নতুন করে আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ হয় ওঁর! প্রতিবেশি ভদ্রলোকের পাঠানো সমন যেন এ সবের বিরুদ্ধেই এক চ্যালেঞ্জ!
ক্রমশঃ সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমে আসে। বাবা-মেয়ের মধ্যেখানে একটা অস্বস্তির পর্দা ঝুলতে থাকে। বাবা-মেয়ে-মা সবাই থম মেরে অপেক্ষা করতে থাকে, আবার কখন ডেকে উঠবে কুকুরটা ওই বিচিত্র স্বরে! আবার কখন অস্থির হয়ে উঠবে অবশিষ্ট পৃথিবীর দাঁত-নখ-থাবা!
ঘড়ির কাঁটার শব্দ চড়া হয়ে কানে বাজে। চরাচর ঘুমিয়ে পড়ে। এ বাড়ির তিনজন মানুষের বোধ অবশ হয়ে আসে। বাইরে ধাবমান মোটরসাইকেল একরাশ আওয়াজ ছড়িয়েই মিলিয়ে যায়। পাহারাওয়ালার ফুকারিত বাঁশিতে কর্তব্যের ক্লান্তি ধরা পড়ে! ঠিক তখনই ছেয়ে থাকা নৈশঃব্দ্যকে খানখান করে দিয়ে দিয়ার বাবার মোবাইল বেজে ওঠে! রিংটোনে ধরে রাখা গানের সুর অসহ্য হয়ে হাতুড়ি পেটাতে থাকে তিনজনের মাথায়! ‘কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন?’ শুধু এটুকু শোনার পর দিয়ার বাবার ফোন-ধরা হাত শিথিল হয়ে পড়ে! ফোন কেটে যাবার পর দিয়া ওর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, ‘দিয়ে এসো ওকে কোনো বাজার বা জঙ্গলে’।
কিন্তু এত শলা, পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা-উদ্বেগ---- কোনো কিছুই সেই প্রাণীর হেলদোল ঘটায় না! শুধু খাওয়া পরার অধিকারই অধিকার নয়, মনোজগতে স্থান করে নেওয়াও অর্জিত অধিকারের মধ্যে পরে, সেই বিশ্বাসেই সে বড় হয়েছে। আজ সে অধিকার ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! এই বার্তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ওকে নিতে আসা পেশাদার দলের সঙ্গে ওর প্রবল টানা হ্যাঁচড়া শুরু হয়। চোকাতে হয় বেশ কিছু নগদ মূল্যও! অবশেষে হস্তক্ষেপ করে দিয়া।
গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়া ওর চেনা উষ্ণতা ফিরিয়ে দেয়। আগন্তুকের দল ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। দিয়া ওর নির্ভরতা দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে, একবুক ভালোবাসা দিয়ে জীবনের প্রথম খুনটা সংঘটিত করে ফ্যালে! দিয়ার এক ডাকেই সে নির্ধারিত টোটোতে গিয়ে বসে পড়ে। চেনা পৃথিবী দিয়ার কাছে আবছা জলছবি হয়ে যায়! ওর মনোজগতের সেই ভাঙন প্রাণীটির কাছে হয়ত পৌঁছায়, হয়ত না!
এক সাদা, পাঁশুটে শীতের ভেতর দিয়ে শূন্য টোটো ভাঙাচোরা দিয়াকে নিয়ে ফিরে আসে! দিয়া এলোমেলো কল্পনা করে, সেই চিরনির্বাসনভূমিতে অনাবিল বিশ্বাসী এক প্রাণী ওর জন্য, শুধু ওরই জন্য প্রতীক্ষা করে থাকবে আমৃত্যু!
রিক্ত দিয়া বুঝে উঠতে পারে না, বধ্যভূমির মাটি সত্যিই ও এতদিন চিনে উঠতে পারেনি কেন!
শহরটা এখানে এসে অাচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। অচল ফেরিঘাট। লোকজনের চলাচল, আনাগোনা,হৈ চৈ নেই। চারিদিক চুপচাপ, নীরবতা, শোকসভার নিস্তব্ধতা। শুধু কিউই, কিউই সুরে কয়েকটা নাম-না-জানা পাখির ডাক উঁচু পাড়ের ঝুঁকে পড়া গাছের পাতার আড়াল থেকে কানে আসছে। শুকনো নদী খাতের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছের সারির মাথা থেকে কুবু...কুবু...কুবু...স্বরে আর্তনাদ করতে করতে ঘুঘু জাতের পাখি নিস্তব্ধতার ওপর সপাটে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে গাছের আড়াল ছেড়ে উড়ে গেল শূন্য আকাশের টানে। পাড়ের উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো ভূমির দিকে তাকালে বহুদূর পর্যন্ত আড়ালহীন আকাশ।
পাড় থেকে ফেরি নৌকায় যাওয়ার জন্য বাঁশের মাচার যে সাঁকো ছিল, সেটা শীর্ণকায়, কঙ্কালসার হয়ে জলের ধার পর্যন্ত পৌঁছানোর বহু আগেই মাটির ওপর ঘাড়-মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে। ছবিতে দেখা বিশালাকায় ডায়ানাসোরের কঙ্কালের মতো।
লোকজন, জনপদ, হৈহৈ রবের মানুষজনের সাড়া না-পেয়ে নদীও কী মুখ ফিরিয়ে নেয়! কখন, কবে থেকে মানুষের সঙ্গে এই দূরত্ব তৈরি হয় তা’কি বুঝতে পারে মানুষ। না-হলে সরতে সরতে কোথায় হারিয়ে গেল নদীর জলরাশি। কে শুষে নিল এত বিপুল জল। একটা বিচলিত বোধ কাজ করে মৈনাকের।
হা-হোসেন, হা-হোসেন করে বুক চাপড়ানো হাওয়া বইছে এই জনমানব শূন্য অঞ্চলে। উঁচু পাড় থেকে ঢালু পথ বেয়ে নদীর মরা খাতে হাঁটতে শুরু করে মৈনাক। শুকনো নদী খাতে নিস্প্রাণ করোটির মতো সাদা বালি যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ হয়ে রয়েছে। আকাশের নীচে কাফনের সাদা কাপড় কে যেন যত্ন করে বিছিয়ে রেখেছে।
নদীর করুণ চেহারা দেখে বুকে ভার বোধ হয়। একটা অব্যক্ত বেদনা কেমন বাইরে বেরোনের পথ খুঁজে না-পেয়ে বুকে চেপে ধরে। নদীর এই মরা চেহারা দেখতে চোখ আটকে যায় মৈনাকের। মৃত এক পশু অপলক চেয়ে রয়েছে। আর তার শরীরের পেছনের দাবনা থেকে খুবলে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে কুকুরের দল। কিছুটা তফাতে অপেক্ষা করছে শকুনের দল। মৃত পশুর নিস্পলক চাউনি মৈনাকের পা-দুটোকে নিশ্চল করে দেয়। নদীর মরা খাত থেকে উঁচু পাড়ের দিকে উঠে আসে সে। দীপ্তেন এই জলটুঙ্গি’র কথা বলেছিল চিঠিতে। চিঠি পেয়ে আসার ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু দীপ্তেনের চিঠিতে যে জলটুঙ্গি’র কথা ছিল এখন নিজের চোখে দেখে কেমন অন্যরকম মনে হয় তার। অন্তত এই রকম শুকিয়ে যাওয়া, মরা একটা মলিন চেহারার কথা লিখে কাউকে আসতে বলে না। তবে কী অন্য একটা চেহারা ছিল। দীপ্তেনের চিঠির পৌঁছানো নয়, নয় করে বছর তিন হয়ে গেল। দীপ্তেনের সঙ্গে এর মধ্যে আর কোন বাক্যালাপ হয়নি। বাক্যালাপ হওয়ার জন্য কোন সংযোগের চিহ্ন দীপ্তেনের নেই। কোন মোবাইল নেই। আবার একটা অভিমান থাকতে পারে। চিঠি পাওয়ার পর পর মৈনাকের কাছ থেকে কোন জবাব না-পেয়ে দীপ্তেন হয়তো ভেবে নিয়েছে মৈনাক আসবে না। আসারও একটা সময় থাকে তারপর সেই সময়ও পেরিয়ে যায় আস্তে আস্তে। মৈনাক সেই সময়টাতে এল যখন দীপ্তেন এখানে ওর আসার ওপর সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।
শীত যাই যাই করছে। গরম নেই। হালকা চাদরের মতো একটা শীত বোধ জড়িয়ে থাকে। দিনের আলো চলে যাচ্ছে একটু একটু করে। একটা শ্রী-হীন চেহারা নিয়ে জলঢুঙ্গির ওপর আধাঁরের চাদর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে আসার কথা জানানো হয়নি দীপ্তেনকে। জলটুঙ্গি নামের মধ্যে কেমন একটা টান রয়েছে, তাই পুবের এই স্টেশনে প্রায় কোন প্রস্তুতি ছাড়াই যখন নেমে পড়লো সূর্য তখন মাথায় ওপর দিন শাসন করছে। তাকে নিয়ে আর যারা স্টেশানে নেমেছিল অল্পকয়েক জন। তারা হনহনিয়ে স্টেশন চত্বর ছেড়ে যেতেই এতক্ষণ সওয়ারিদের ভার বহন হালকা করে ট্রেনটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলতে শুরু করে। মৈনাকের কোন তাড়া নেই। ট্রেন গতি বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যেতেই প্রান্তিক স্টেশনটা মুখ বুজে ফেলল। মৈনাক ধীরপায়ে ওভার ব্রীজ পেরিয়ে স্টেশনের মূল গেট অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালো দীর্ঘ লম্বা বাতিস্তম্ভের নীচে। স্টেশনের রূপ বদলে গেছে অনেকটাই। লম্বা বাতিস্তম্ভ ঘিরে বৃত্তাকারে বাগান। অল্প কয়েকটা সওয়ারি বহন করে নেবার জন্য রিকশা, টোটো দাঁড়িেয়। মৈনাকের চোখ খুঁজছিল অনেক আগে আসার সেই ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়ি। নগরায়নের একমুখী ধাক্কায় এক্কা গাড়ীকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে এই সাজানো চত্বর থেকে।
বাঁক ঘুরে একটু হাঁটতেই মৈনাকের চোখে পড়লো হারিয়ে যাওয়া রূপটান, আভিজাত্যকে জোর করে ধরে রাখার এক প্রবল চেষ্টায় এখনও ঘোড়ায় টানা এক্কা-টাঙা দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে ওঠার রেকাবে পা দিয়ে গাড়িতে উঠে মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে এল, জলটুঙ্গি যাবো।
মাথায় ফেজ, ছুঁটলো দাড়ি, পরনে ঢিলে পা-জামা পরিহিত মাঝ বয়সী মানুষটি ভাঙা গলায় বলল, সে’তো বহুদূর। বেলা পেরিয়ে যাবে।
যাকগে, তুমি কী যাবে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় টাঙার মালিক ঘাড় নেড়ে বলল, যাবো, কিন্তু ভাড়া বেশি লাগবে। একশো টাকা।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাগাম হাতে নিয়ে মুখে একটা শব্দ করতেই টাঙা চলতে শুরু করলো। ঘোড়ার পায়ের নালের ছন্দে শব্দ তুলে টাঙা প্রায় দৌড়তে শুরু করলো। আস্তে আস্তে মুছে যেতে শুরু করলো চেনা দৃশ্যগুলো। যেগুলো প্রায় সব শহরেই রয়ে যায়।
জলটুঙ্গিকে এখনকার জামানা কেউ চেনে না। পচা খাল রাস্তার দিকে মুখ রেখে কোচোয়ান বলল।
তন্ময়তা ভাঙলো মাইক্রোফোনের তীব্র আওয়াজে। মৈনাক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর ঢেউ খেলানো পাড়ের ভূমির ওপর। একটু দূরেই একটা নৌকা শুকনো নদী খাতে পাটাতন, ভাঙা-ছৈ নিয়ে খোলা আকাশের নীচে হাড় জিরেজিরে শরীরে করুণ ভাবে পড়ে রয়েছে।
মাইকের তীব্র আওয়াজ কানের ভেতর শব্দগুলো গুলির মতো বিঁধলো। আশ্চর্য দু’মুখো মানুষ দেখুন। একটা শরীরে দু’মাথা ওলা মানুষ আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আপনার এলাকায় থাকবে। এই সুযোগ আর পাবেন না। আমাদের তাঁবুতেই দেখতে পাবেন পৃথিবীর আশ্চর্য দু’মাথাওলা মানুষ।
মৈনাক আর দাঁড়ালো না। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার ছাওয়া জলটুঙ্গিকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করলো লম্বা পা ফেলে শহরের দিকে। এলোমেলো ঝোপ-জঙ্গল থেকে ঝিঁ-ঝিঁ-র ডাক আসছে। আকাশের এক কোণে ইঁদুরে কাটা চাঁদ। মাইকের শব্দের তীব্রতা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। একটা ধোবিখানা চোখে পড়লো। সার সার সিমেন্টের পাটাতনের পাশেই জল ধরার ছোট ছোট চৌবাচ্চা। কাপড় আছাড় দেওয়ার শব্দ নেই। ধোপাহীন একটা ফাঁকা জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা-দু’টো শ্রীহীন, ছাড়া ছাড়া ঘর-বাড়ি চোখে পড়ছে মৈনাকের। এখনো অন্ধকার জমাট নয়। অচেনা পথে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে বেশ। ঘণ্টা কয়েক আগে টাঙা করে যাবার সময় যেটুকু চোখে পড়ছিল সেটুকু সমুল করেই হাঁটছে সে। এভাবেই এসে পড়লো ভাঙাচোরা রেলিং, শ্রী-হীন একটা পার্কের কাছে। দোলনার বসার বেঞ্চগুলোর কাঠের পাটাতন নেই। পড়ে অাছে দুই প্রান্তের লোহার পায়া। আচমকা চোখের ওপর ঝুপ করে অন্ধকার নামতে মৈনাক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নতুন, অচেনা জায়গায় এই আচমকা আঁধার নামা তাকে স্থবির করে দিল। ধাতস্থ হবার জন্য দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে সিগারেট লাইটার দিয়ে অগ্নি সংযোগ করলো। অন্ধকারের মধ্যে সিগারেটের লালাভ বিন্দুটুকুই মৈনাক হয়ে জ্বলতে লাগলো।
আচমকা অন্ধকারের মধ্যে মৈনাকের মনে হল কে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনুমানে ভুল নয়। তার কানের পাশে আঁধার মাখা মুখ নিয়ে কেউ একজন ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো, চলবে নাকি! পাউচ প্যাকেটে টেম্পার দেওয়া মাল।
মৈনাক ঘাড় ঘুিরয়ে দেখার চেষ্টা করলো অচেনা স্বরের মানুষটাকে। চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে এল না। এরকম অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে মৈনাকের নাকে তীব্র ঝাঁঝাঁলো, মাথা ঝিম ঝিম করা একটা গন্ধ এল। গন্ধের মধ্যে থাকা জিনিসটাকে চিনতে চাইছিল। তার মনে হল খুব চেনা গন্ধ। গন্ধের পরিচয় তাকে পৌঁছে দিল এক সচেতনতায়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ডেনড্রাইটের তীব্র গন্ধ টানা নেশুরেদের এখন নেশার নতুন সামগ্রী। জায়গাটা খুব সুবিধেজনক নয়। মুহূর্তের মধ্যে মৈনাককে চমকে দিয়ে সাদা আলোয় ভরে গেল অঞ্চলটা। রেলিং ভাঙ্গা পার্কটার মধ্যে সিমেন্টের হাতির মাথায় বসে আছে কেউ। দূরে রিকশা স্ট্যান্ডের জটলা। মৈনাক পা-বাড়ালো রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে। গান ভেসে আসছিল ঐদিক থেকে, বাবুজি ধীরে চলনা, যারা সামাহলনা।
রিকশাওলা প্যাডেলে চাপ দিয়ে রিকশায় গতি এনে বলল, গাঙহাটিতে নতুন এসেছেন?
মৈনাক বলল, না, না। আগেও এসেছিলাম একবার। কিন্তু এদিকটায় আসিনি।
এদিকটায় আসার আগে কাউকে জানপুছ করবেন তো।
আমি জলটুঙ্গি দেখতে এসেছিলাম, মৈনাকের জবাবে রিকশা চালাতে চালাতে রিকশাওলা বলল, নামেই জলটুঙ্গি। এরকম মরা নদী কেউ শখ করে দেখতে আসে। আগে শীত কালের দিকে প্রচুর বিদেশী পাখি আসতো এখন শিয়াল-কুকুর আর হাড়গিলেদের চারণভূমি। আর যত রাজ্যের পাতাখোর, মাতাল, আর নেশুরেদের আস্তানা। হ'! কী হয়ে গেল জায়গাটা!
ফেরিঘাট ছিল তো, মৈনাক বলল,
সে অন্যযুগের কথা, ছবি হয়ে গেছে। জল নেই তো! ফেরিঘাট।
নদী এরকম শুকিয়ে যায়! মৈনাকের বিস্ময়ে রিকশাওয়ালা বলল, নিজের চোখেই তো দেখলেন। তবে আপনার মতো আমারও মনে হয় নিজে থেকে নদী শুকিয়ে যায় না। শুকিয়ে দেওয়া হয়। এসব একদিনের ব্যাপার নয়। খুব পরিকল্পনা করে প্রতিদিন একটু একটু করে নদীটাকে শুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড্রিঙ্কস ফ্যাক্টরি দেখেছেন?
ড্রিঙ্কস ফ্যাক্টরি, স্ট্রেঞ্জ! মৈনাক বলল।
কত জল টানতো জানেন। গ্যালন, গ্যালন, এ খবর সবই বাতাসে এখন ঘুরে বেড়ায়। জায়গাটাই কেমন দীন দরিদ্রের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। লোকজন-ই সব ছেড়ে ছুড়ে কোথায় চলে গেল। এখন তো শ্মশানের দশা। আপন মনেই রিকশাওলা বলতে থাকে।
রিকশাওয়ালার সবটা বোঝা যায় না। মৈনাক একবার স্মরণ করিয়ে দিল, কংসবণিক পাড়ায় যাবে।
আরে, আমার খেয়াল আছে। ঐ ফেরিঘাটের সঙ্গে আমার জীবনটাই হারিয়ে গেছে।
কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় রিকশাওলা বলল, ফেরিঘাট চালু থাকলে রিকশা টেনে জীবন কাটতে হত না।
কংসবণিক পাড়ায় এসে রিকশা থেকে নেমে দাম মিটিয়ে মৈনাক বলল, নামটাই তো জানা হল না তোমার।
স্বপন ধর। স্বপন ধর বললেই হবে।
দুই
বহুদিন আগে বন্ধুবান্ধব নিয়ে দীপ্তেনের এখানে এসেছিল একবার-ই। রাত কাটিয়ে ছিল হুল্লোরের মধ্যে। আজ বহুদিন পর প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালো মৈনাক। আর্চ করা লোহার শৌখিন গেট। বহুদিন সংস্কারের অভাবে জীর্ণ, ভেঙে পড়ার উপক্রম। পুরোনো আমলের খড়খড়ি জানালাগুলো বন্ধ। দোতালার কোথাও কোন আলোর চিহ্ন নেই। আশপাশের সাজানো ঘরবাড়ির মাঝে, পুরোনো বয়স্ক চেহারা নিয়ে দীপ্তেনের বাড়িটা বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গলা ছেড়ে মৈনাক ডাকলো, দীপ্তেন, দীপ্তেন -
অন্ধকার বাড়ি, বাইরের আলোয় যেটুকু চোখে পড়ছে তাতে ধারনা হয় বাড়ির ভেতরে কেউ থাকে না। এই ভাবনা মাথায় আসতেই মৈনাকের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হল। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেই অনিশ্চিয়তায় পুনরায় গলা দিয়ে উচ্চস্বরে বেরিয়ে এল, দীপ্তেন, আমি মৈনাক।
মৈনাক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুটা তফাতে একটা ছোট দরজা খুলে একজন অপরিচিতা মহিলা বেরিয়ে মৈনাকের সামনে এসে বলল, এদিক দিয়ে আসুন। ওখান দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।
অবাক হ’ল মৈনাক। বিস্ময় নিয়ে মহিলাকে অনুসরণ করে ছোট দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। মৈনাকের মনে হল বাড়ির পেছন দিকে চলে এল। এদিকটাতে বড় বড় গাছ তাদের পাতার ছাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছে জায়গাটা। কোন কালে বাগান ছিল। এখন সবটাই ঝোপঝাড়। আম, জাম, নিম, কাঁঠাল গাছের নীচে বুনো আকন্দের ঝাড়, ক্যাসিয়ার জঙ্গল। খুব হালকা একটা আলোর রেশ তার চোখের সামনে অপরিচিত মহিলার হাতের থেকে বেরিয়ে এটুকু দৃশ্যমান।
বাগানের কাঁচা পথ পেরিয়ে পুরোনো আমলের টানা বারন্দায় ওঠার জন্য সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে কড়ি-বরগার টানা লম্বা বারান্দায় দাঁড়ালো মৈনাক। আগে মহিলা। তার ঠিক মাথার ওপর লম্বা লোহার শিকল দিয়ে ঝোলানো পুরোনো আমলের শৌখিন কাঁচের বাতিধার কড়ি-বরগার ছাদ থেকে নিষ্প্রদীপ হয়ে ঝুলে রয়েছে।
নীরবতা ভেঙে মৈনাক বলল, দীপ্তেন নেই, আমি মৈনাক, দীপ্তেনের বন্ধু। বহুদিন আগে এই বাড়িতে একবার এসেছিলাম।
কমজোরের বিজলি বাতির আলোয় অন্ধকার মাখা আগে চলা অচেনা মহিলা ঘাড় ফিরিয়ে মৈনাকের দিকে মুখ রেখে বলল, অনেক দিন এই বাড়ির দরজায় দীপ্তেনের নাম ধরে ডাকেনি কেউ। আপনি আসুন।
মৈনাক বিস্ময় চেপে রেখে অনুসরণ করলো। টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে প্রায় পুরোনো কালের সিঁড়ি ওপরে ওঠার। দু’দিকে খাড়া উঁচু দেওয়ালের মাঝ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে। যেন সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে এই আরোহন।
দোতলায় এসে অন্ধকার কিছুটা কাটে। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। মনে হয় থাকে না কেউ। একটা ঘরের সামনে মৈনাক-কে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বালতে দীপ্তেন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে মৈনাকের চোখের সামনে। দেওয়ালে দীপ্তেনের বড় ছবি, আলনায় ঝোলানো পরনের পোশাক। টেবিলে, বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দীপ্তেনের ব্যবহৃত কাগজ পত্র, পাতা ওল্টানো বই, ডায়েরি, কলম। যেন কাজ করতে করতে বাইরে কারুর ডাক পেয়ে বেরিয়ে গেছে হঠাৎ।
মৈনাক প্রশ্নচিহ্ন মুখ নিয়ে তাকালো অচেনা মহিলার দিকে। শ্যামলা রঙের, লম্বাটে গড়নের মহিলা মৈনাকের দিকে চোখ রেখে বলল, দ্বিধাহীন স্বরে, আমি মলিনা, দীপ্তেন বাবু’র মা’কে দেখাশুনো করি। কিন্তু এখন এই ঘর-দোর আমাকে আগলে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
মৈনাক মুখ তুলে বলল, কেন, দীপ্তেন?
আপনি জানেন না? মলিনার স্বরের মধ্যে বিপন্নতা টের পেল মৈনাক।
আমি! না’তো।
দীপ্তেনবাবু আজ প্রায় মাস ছয়েক উধাও। কোন খবর নেই। একদম অদৃশ্য। ওর মাকে নিয়ে আমি পড়েছি জলে। কাউকে চিনি না, কী করবো বুঝতে পারছি না। অনেক দিন পর আপনার মতো চেনা কেউ এই বাড়িতে পা রাখলো।
মলিনার কথা মৈনাককে যেন সজোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু তার পা’ দু’টো পেরেক দিয়ে গাঁথা। এ রকমের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের মাঝখানে ফাঁকামাথা আর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে। এই রকম পরিস্থিতে যে তাকে পড়তে হবে কিছুক্ষণ আগেও ওর ভাবনার মধ্যেও ছিলনা। ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি এরকম একটা কঠিন বাস্তব তার জন্য অপেক্ষা করছে। নিজেকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলো না। সামনে বিছানায় নিজের শরীরের ভারটা ছেড়ে দিল।
মাসীমাকে নিয়ে কোথাও খোঁজ-খবর করেন নি? মৈনাকে’র উদ্বিগ্ন স্বরে মলিনা বলল, করেছি, থানায় মিসিং ডায়রি করেছি। সবই আমার সাধ্যমতো।
দীপ্তেনের না-থাকা মৈনাককে গভীর জলে ফেলে দিয়েছে। ভাবার জন্য তার একটু সময় দরকার। মাথায় কোন শব্দই অর্থবোধ নিয়ে আসছে না। বাকরুদ্ধ অবস্থায় বিছানায় বসে রইল।
মৈনাকের কাছ থেকে কোন রকম সাড়া না-পেয়ে মলিনা আপন মনেই বলল, মাসিমাকে খবর দিই আর আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি।
মলিনা ঘর ছেড়ে যেতে, মৈনাক বিছানা ছেড়ে দেওয়ালে টাঙানো দীপ্তেনের হাসি মুখের ছবির দিকে এগিয়ে গভীর ভাবে দেখতে থাকলো। নিমগ্নতা গ্রাস করলো মৈনাককে।
এনিথিং রং দীপ্তেন। তুই আমাকে ভীষণ মুশকিলে ফেললি। তুই আসতে লিখেছিলি। দেরী হল কিন্তু এলাম আর তুই লুকিয়ে রয়েছিস ইডিয়েট্। বেরিয়ে আয়।
আপনার চা। মলিনার কথায় তন্ময়তা ভাঙে মৈনাকের। পায়ে পায়ে ফিরে আসে বিছানায়। চা’য়ে চুমুক দেয়। এখুনি দীপ্তেনের মা’র মুখোমুখি হতে মন চাইছিল না। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। মলিনার কথায় মৈনাক মুখ তুলে বলল, আমাকে একটু সময় দিতে হবে। তারপর না হয়...
মৈনাকের কথা শেষ করতে না দিয়ে মলিনা বলল, মাসীমা, বাড়ি-ঘর, আর টাকা পয়সা।
মাসীমা! মৈনাকের বিস্ময় বোধ।
রাতের বেলা কোন কিছুই দেখতে পায় না। এমন কি দিনের বেলায় অসুবিধে হয় দেখার। অনুমান করে বসে বসে ঘোরা ফেরা করে। আচ্ছা, দীপ্তেনবাবু কী ফিরবেন না? কী এমন হ’ল যে বাড়ির পথ ভুলে গেল।
মৈনাক জবাব দেবার মতো কোন কথা খুঁজে পেল না। শুধু শুনে গেল চুপ করে।
মলিনা দেখলো মৈনাককে। তারপর চা-য়ের কাপ নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল নীরবে।
বিছানা ছেড়ে দীপ্তেনের ছোট টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। টেবিল জুড়ে কাগজ, পেনদানি, অ্যাসট্রে’র মধ্যে ডায়রিটা পড়ে রয়েছে। কৌতূহলী মন নিয়ে বড় ডায়রিটা হাতে তুলে বিছানায় বসে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো মৈনাক। হালকা একটা ধুলোর স্তর রয়েছে ডায়রির পাতায়। ধারাবাহিকভাবে দিন ধরে কোন লেখা নেই। চোখ আটকে গেল পাতা জুড়ে বড় বড় করে লেখা ‘ডু নট ওয়েস্ট ইয়োর টাইম।’ ঠিক তার নীচে ছোট ছোট করে লেখা, টাইম ওয়েস্ট আস। মজা পেল মৈনাক। কিন্তু ও’র চোখ খুঁজছে প্রয়োজনীয় কিছু কথা। যা দিয়ে অন্তত পরবর্তী পা ফেলার মতো একটা জায়গা পাওয়া যাবে।
হঠাৎ-ই আটকে গেল মৈনাকের চোখ। গোবিন্দ সেই যে মলিনাকে রেখে উধাও হ’ল। তারপর আর কোথাও চিহ্ন নেই। একে নিয়ে কী করি। মনে হয় নিরুপায় হয়ে গোবিন্দ’র হাত ধরে ছিল। না, হলে ভবঘুরে গোবিন্দ’র হাত কোন চালাক মেয়ে ধরে। না, মেয়েটা ভালো, ঘর-বাড়ির দেখভাল করছে নিজে থেকেই। বাড়িতে মেয়েরা থাকলে বোঝা যায় বাড়িতে একটা গোছানো ব্যাপার থাকে। তা’না হলে কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব। কিন্তু গোবিন্দ গেল কোথায়!
এরপর আর কোন লেখা নেই ডায়রির পাতায়। কিছু হিসেবপত্তর। দীপ্তেন বোধহয় ব্যাঙ্কে একটা টাকা ফিক্সড করে ছিল। সেই সমস্ত সার্টিফিকেটের নম্বরগুলো পরপর রয়েছে।
মৈনাক পাতা ওল্টাতে শুরু করল। পাতা ওল্টাতে গিয়ে তার মনে হ’ল ডায়রির পাতায় হদিশ মিলতে পারে দীপ্তেনের।
অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি এখনও বৃষ্টির কোন দেখা নেই। হাওয়া অফিস বলছে এবার ‘এল নিনো’। কিন্তু মাথায় সূর্যের তাপে দেহ-মন কাহিল। জিভ বের করা কুকুরের হাল। আকাশে কোথাও এক কণা মেঘ নেই। যাও বা বিকেলের শেষে একটু কালো মেঘের চিহ্ন দেখে মনে একটু আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, এই মেঘে কোন আশা নেই। আশা করার মতো জীবনে কিছু ঘটবে না বোধহয়। গ্রামে ঘুরে ঘুরে বীজ কোম্পানীর হয়ে ক্যানভাসিং করা, সম্পন্ন চাষীদের একত্র করে বীজের গুনাগুণ ব্যাখা করা, ছোট ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই বিষয়ে আলোচনা সভা বসানো। ওদের মধ্যে কাউকে দিয়ে এই সমস্ত কিছু বলালে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয়। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি এরাও সুবিধা চাইছে। ফ্রি সার্ভিস বলে কিছু হয়না। অফিসে রাধিকা গুপ্ত’র সঙ্গে কথা বলতে হবে। ও তো ব্যাঙ্কের বিষয় দেখাশুনো করে। রাধিকা বলে ছিল, পার্স খুলতে দেরী করবেন না। এখন সব সর্ট স্প্রিন্টার। আপনি দেরী করলে দেখবেন কালকে আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের বিশাল প্রজেক্ট। এই গাঙহাটিতে আমরা গ্রীন রেভিলিউশ্যান এনে দেবো। রেভিলিউশ্যানের জন্য আর অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে না। গ্রামের সবার পকেটে টাকা আসবে। আপনার ফিল্ডওয়ার্ক যত ভালো হবে, কোম্পানীর গাড়ি তত মসৃণ ভাবে চলবে। ঘরের কোণে মাকড়সার জাল পেতে চুপ করে বসে শিকারের অপেক্ষায় থাকে অর্থোডক্সরা। শিকারের সন্ধানে আপনাকেই টার্গেট করতে হবে তবেই আপনার পেছনে কোম্পানী থাকবে। শুধু মাথায় রাখুন, এভরিথিং ফর সেল। নিজেকে বিক্রী করার কায়দা রপ্ত করতে হয়।
একটানা ডায়রির পাতায় দীপ্তেনের লেখা পড়তে গিয়ে দীপ্তেনকে অনুভব করতে পারলো মৈনাক। যেন এই ঘরের মধ্যেই রয়েছে। মলিনা কখন রাতের খাবার দিয়ে গেছে খেয়াল করেনি। সমস্ত বাড়িটায় কোন সাড়া শব্দ নেই। আশপাশ রাতের নৈঃশব্দে চুপ করে রয়েছে। উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে শেষ শীতের একটা হালকা ঠাণ্ডা ঢুকছে চুপিসারে। চোখ তুলে মৈনাক খোলা জানালা দিয়ে দেখলো গাছপালারা মাথায় একটা কুয়াশার চাদর টেনে নিদ্রা যাবার তোড়জোর করছে। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে নীচতলা থেকে। ঘরের মধ্যে আলোর রেশ থাকায় অন্ধকার যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে কালো আলখাল্লা পরে প্রহরীর মতো। দরজা খোলা পেয়ে একটা বিড়াল নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। অবাক চোখে মুখ তুলে মৈনাকের দিকে তাকালো। গলায় শব্দ করলো মিয়াউ, মিয়াউ করে। তারপর উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে লাফ মারলো অন্ধকারের মধ্যে। ক্যা, ক্যা করাত চেরা গলায় রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে কোন নিশাচর পাখি ডেকে উঠলো।
মৈনাক ঢাকা দেওয়া খাবার খেতে শুরু করলো। ডায়রিটা বিছানার ওপর রেখে দিল। যে ভাবনা মাথায় নিয়ে এখানে এসেছিল তার সবটাই উলটে গেছে। এখন ওর হাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কিছু নেই। ঘটনা যে দিকে বাঁক নেবে সে দিকে হেলতে হবে। তারই একটা ধারনা পাবার চেষ্টা করছিল ডায়রির পাতায়, এখনও সেরকম সূত্র খুঁজে পায়নি। এই বুঝতে না-পারা মৈনাকের শরীর-মনে এক ধরনের অস্বস্তি চোরা গোপ্তার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। অস্বস্তি কাটাতে মৈনাক সিগারেট ধরালো। একটা দীর্ঘটান দিয়ে উত্তরের জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
ফেরারি পাখিদের মতো হু হু করে দিনগুলো চোখের ওপর ভেসে উঠলো। দীপ্তেন সাইকেলের রডে ওর বাবাকে বসিয়ে অফিসে নিয়ে আসতো। ওর বাবা পাবলিক হেল্থ ডিপার্টমেন্টের কোন এক পদে চাকরি করতো। ওর বাবা হ্যান্ডিক্যাপড ছিল। পা ছোট-বড় ছিল। হাঁটতে অসুবিধে হতো। রোগাটে গড়নের, চাপা গায়ের রঙ, ধুতি-পরা দীপ্তেনের বাবা এলাকায় টিকে বাবু নামে পরিচিত ছিল। বরফকলের পাশ দিয়ে গাড়ি যাবার রাস্তার ধারে যে মেস বাড়ি বড় পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে শ্রীপুর অার রাজপুরের মাঝে আদ্যিকাল থেকে সীমান্তরক্ষী হয়ে পাহারা দিত, সেই মেসবাড়িতে দীপ্তেন ওর বাবাকে নিয়ে থাকতো। সেনানিবাস ছিল একসময়। পায়রার খোপের মতো ঘরগুলোতে রাজপুরে কাজের সন্ধানে আসা মানুষদের মেসবাড়ি ছিল ঐ সেনানিবাস। সেনা নিবাসের পেছনে অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ক্যাসিয়া, আকন্দ, ফনিমনসা, পার্থেনিয়াম, শিয়াল কাঁটা, কচু আরও নাম-না-জানা বুনো ঝোপ জঙ্গলে ভরা অংশের মাঝে মাথা তুলে খেঁজুর, আতা, কুল গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো। জন বসতিহীন নির্জন ঐ ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে পায়ে চলা পথ দিয়ে অনেকটা হেঁটে গেলে শ্রীপুর পৌঁছানোর ঠিক আগে একটা টাওয়ার ছিল। বুনো জঙ্গলের মধ্যে রেলের লাইন পাতা ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। কবে কী প্রয়োজনে এই রেল লাইন পাতা হয়েছিল জানা নেই। কোনদিন রেলগাড়িও বোধ হয় এই রেল লাইন দিয়ে চলেনি। আমরা বন্ধুরা দীপ্তেনের কাছে যেতাম এই জায়গাটার টানে। দীপ্তেন বলতেই সেই খাঁড়া পাঁচিলের দূর্গের মতো বাড়ির ছবিটা ফুটে উঠলো মৈনাকের চোখের সামনে।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে জ্বলন্ত অংশটুকু জানালা থেকে সরে এসে অ্যাসট্রের মধ্যে গুঁজে বিছানায় টান টান হয়ে নিজেকে ছেড়ে দিল মৈনাক। ঘরের বিজলি বাতি জ্বলতে থাকলো। সারাদিনের পেরিয়ে আসা ঘটনাগুলো ঘুম না আসা চোখে বিচ্ছিন্নভাবে আসতে লাগলো।
কোচোয়ানের মাথায় ফেজ, ছুঁচলো দাড়ি, টাঙাওয়ালার বাতাসে চাবুক হিসহিস শব্দ করে উঠলো। মৈনাক দুলে উঠলো যেন জলের ঢেউয়ের ওপর দুলতে দুলতে ভেসে চলে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারের পাড় ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। খালি জল আর জল। এক অনন্ত জলরাশি। আচমকা চোখের অদূরেই দেখতে পেল দীপ্তেন ওর দিকে বড় দু’টো চোখ নিয়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখ দু’টো স্থির। ওর শরীর ঘিরে রয়েছে বড় ডানাওয়ালা হাড়গিলে, শকুন। মৈনাকের গলা বুজে এল। কে যেন দু’হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেছে। মৈনাক গলা দিয় স্বর বার করার চেষ্টা করছিল। দীপ্তেনকে ডাকতে চাইছিল। দীপ্তেনের বড় স্থির চোখ আর ওকে ঘিরে থাকা বড় ডানাওয়ালা পাখি জলে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে...।
তিন
সকালের আলোয় মৈনাক বাড়ির ভগ্নদশা দেখছিল। মনের মধ্যে লেপ্টে থাকা উদ্বেগ ঘুমের রেশ কাটিয়ে ক্লান্তি এনেছে শরীরে। মৈনাক ঘর ছেড়ে বাইরে এল। বাইরে খোলা চত্বর। উঁচু পাঁচিলের আলসে তুলে আশপাশের বাড়ি থেকে একটা আড়াল তোলার চেষ্টা ছিল। কিন্তু এ বাড়িতে দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে একটা ক্ষয় রোগ বাসা বেঁধেছে। দীপ্তেনের তাকানোর সময় হয়নি কিংবা হয়তো উদাসীন ছিল। বাগানের অামগাছের মোটা ডাল আলসের পাঁচিলের ওপর পড়ে বেশ কিছুটা অংশ ভেঙেছে। ডালটা শুকিয়ে গেছে। মনে তো হয় এটাও অনেকদিন। কেউ খেয়াল করলেও উদ্যোগী হয়নি। মৈনাক ঐ ভাঙা অংশের দিকে এগিয়ে গেল। ভাঙা অংশ দিয়ে নীচে দীপ্তেনদের এজমালি রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে। চাল নেই কিন্তু কঙ্কালের মতো চালের নীচে বাঁশের অস্থিকাঠামোটা এখনও পর্যন্তু টিঁকে রয়েছে। রয়েছে একটা বড় উনুন। আরও টুকিটাকি কিছু গৃহস্থালীর জিনিস। দীপ্তেনের যৌথ পরিবারের চিহ্নগুলো গতবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছিল। আরও একজনকে মৈনাক এখনও পর্যন্ত দেখেনি। ঝাঁকড়া চুলের ব্যনিয়ান পরা, আলুথালু বেশের মাঝ বয়সি সেই রাঙা কাকাকে। প্রথম দেখাতেই সে বলেছিল, আমার সাজানো বাগান, শুকিয়ে গেল। দীপ্তেন বলেছিল মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। নীচের তলায় থাকতো। আর মাঝে মাঝে উদাত্ত কণ্ঠে থিয়েটারের কোন সংলাপ বেরিয়ে আসতো। মধ্য দুপুরের নির্জনতা ভেঙে বুকফাটা আর্তনাদের মতো, দীপ্তেনের রাঙা কাকার সংলাপ, জাহানারা, জাহানারা কোথা গেলি মা। দেখছিস না চারদিক কালো করে আঁধার নামছে কেমন চারিধারে। এখন-ই দীয়া জ্বালাও। অন্ধেরা, যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে। এখনই অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা...
ঘর বাড়ি দেখছেন? মলিনার সাড়া পেয়ে মৈনাক বলল, মিলিয়ে দেখছিলাম পূর্বের দেখার সঙ্গে।
মিললো কিছু? মলিনার ছোট্ট কথার জবাবে মৈনাক বলল, মেলে না’কি। সময় অনেক কিছুই ক্ষইয়ে দেয়। এই আমাকে আসতে লিখে দীপ্তেন-ই বাড়িতে নেই। এটাই তো মিলছেনা। আচ্ছা, গোবিন্দ কোথায়?
মৈনাকের জিজ্ঞাসায় মলিনা চমকে উঠলো। তারপর বলল, আপনার চা-খাবার ঘরে রেখে এসেছি।
মৈনাক ঘরের দিকে ফিরতে মলিনা বলল, গোবিন্দ দা’কে আপনি চেনেন?
ঘাড় নাড়লো মৈনাক।
তবে? মলিনা’র ছোট্ট জিজ্ঞাসায় মৈনাক বলল। আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না ওকে পেলে সুবিধে হত।
পাবেন বলে মনে হয় না। মলিনার উত্তরে মৈনাক বলল, পাবো না কেন?
ঘরের দরজা পেরিয়ে বিছানায় বসতে গিয়ে মৈনাক লক্ষ্য করলো বিছানা পরিস্কার। চা’য়ে চুমুক দিয়ে দেখলো মলিনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। মৈনাক বলল, তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে গোবিন্দর?
মলিনা মাথা নাড়লো। তারপর বলল, অনুমান করতে পারি।
মৈনাক বলল, সেই অনুমানটা শুনি।
জেলে। মলিনার জবাবে বিষম খেলো মৈনাক। এরকম উত্তর আশা করেনি। কোনরকমে সামলে অবাক স্বরে বলল, জেলে!
এরকম টানা মালের কারবার করলে দু’চারবার জেলে যেতে হয়। আমাদের পাড়ায় এটা কোন অবাক করা ঘটনা নয়। ওখানে সবাই কম বেশি জেলে যায়। মলিনা কথা থামাতে মৈনাক বলল, তোমার পাড়ার নাম কি?
মলিনা বলল, চৈতল পাড়া।
চার
অচেনা জায়গায় চলাফেরা করার সময় নিজেকে যতটা সম্ভব খোলামেলা রাখতে হয়। মনে অযথা উৎকন্ঠা থাকলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া সেটাই পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়। মৈনাক গুমটির দোকান থেকে সিগারেট কিনে আগুন ধরিয়ে মুখের ধোঁয়া ছেড়ে দোকানির উদ্দেশে বলল, চৈতল পাড়া যেতে কোন রাস্তায় গেলে সুবিধে হবে।
দোকানি খুচরো পয়সা ফেরৎ দিয়ে বলল, আপনি জেলে পাড়ায় যাবেন কেন?
জেলেপাড়া! মৈনাক বলল।
তুড়ি মারার ভঙ্গিতে দোকানি বলল, চৈতল পাড়া তো এই সেদিন হ’ল। দিন দিন কত কী দেখবো। কেওড়া পাড়া, জেলে পাড়ার গায়ে সাজ পোশাক পরিয়ে দিলেই বাবুলোক হয়ে গেলি। যাকগে ঐ সামনের মোড় থেকে যে কোন লোককে বলবেন, সেই পথ বাতলে দেবে। তবে সাবধান ওরা কিন্তু খতরনাক, মারকুটে।
দোকানির কাছ থেকে সরে মৈনাক চৈতলপাড়া যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
চৈতলপাড়ায় কার কাছে যাবেন? রিকশাওলা জিজ্ঞাসা করতে মৈনাক বলল, গোবিন্দ’র কাছে কয়েকটা জিনিস পাবার কথা ছিল।
ও, টানা মালের গোবিন্দ। রিকশাওলার কথা শুনে মৈনাক বলল, গোবিন্দ তো খুব ফেমাস।
ফেমাস আর কী আমাদের কপালে জোটে বাবু। ও সব বড়লোকদের ব্যাপার। আমরা দাগী হয়ে যাই।
প্রসঙ্গ বদল করে মৈনাক বলল, কতটা দূর হবে?
তা’, ২ কিলোমিটার হবে।
চৈতলপাড়ার কাছে আসতে একটা পচা বোঁটকা গন্ধ নাকের মধ্যে দিয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায় মৈনাকের। সবুজ জলের একটা বড় জলাশয় দেখলে শরীর গুলিয়ে ওঠে। চারদিকে তাকালে মনে হয় একটা বড় জ্যালজ্যালে নোংরা মশারি দিয়ে গোটা অঞ্চলকে ঢেকে রাখা হয়েছে। লোম ওঠা কুকুরের দল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এলাকা দখলে মত্ত। কতগুলো হোৎকা শুয়োর জলাশয়ের ধারে রাখা টিনের পাত্র থেকে খাবার খাচ্ছে শব্দ করে। তাদের মুখ থেকে তরল খাবার গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে জলাশয়ের সবুজ জলে। একটা ঘোড়া টানা গাড়ি একদিক হেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক তার পাশে কাঁধের ওপর একটা দগদগে ঘা নিয়ে শীর্ণকায় ঘোড়া দীর্ঘ সফর শেষে পরম আরামে চোখ বুজে তার ঘাড়ে ঝোলানো ঝোলা থেকে খাবার চিবোচ্ছে।
রিকশা চৈতলপাড়া ঢোকার মুখেই নামিয়ে দিয়েছিল মৈনাককে। মাথা ঝিম করা দুর্গন্ধ সয়ে সাবধানে পা ফেলে সে। ভুল পদক্ষেপে যে কোন সময় রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষ্টা লেগে যেতে পারে জুতোতে।
যতরাজ্যের বাতিল, ফেলে দেওয়া, নোংরা মাখা প্লাস্টিক বোতল, খেলনা, ক্যারিব্যাগ, গাড়ি, হাতল ভাঙা চেয়ার, ফালতু জিনিসের স্তূপ করা পাহাড়ের পেছনেই টালির চালায় মৈনাক দেখা পেল গোবিন্দর।
মৈনাকের সঙ্গে প্রথমে দেখায় কথা না বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণ মনের ভেতর যে কথাগুলো জমিয়ে নিয়ে আসছিল সেটা বলতে না পারা মৈনাককে হতভম্ব করে দিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেঁচিয়ে বলল, মলিনা আমাকে পাঠিয়েছে।
মলিনার নাম শুনে দরজার পাল্লা খুললো গোবিন্দ। বেরিয়ে বলল, মলিনা পাঠিয়েছে। কিন্তু আপনি কে?
সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে গোবিন্দ’র দিকে এগিয়ে মৈনাক বলল, চলে।
হাত দিয়ে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে গোবিন্দ বলল, নরক দর্শন করলেন। চলুন আপনাকে নদীর দিকে নিয়ে যাই। এখানে থাকা আপনার পক্ষে খুব সুখের হবেনা।
ভাঙাচোরা, সরু, সংকীর্ণ, দুটো চালা ঠেকা ঠেকি করা ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মৈনাকের নাকে পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধ এল। গোবিন্দকে অনুসরণ করে বস্তি ছেড়ে বেরিয়ে এল। সামনে সান বাঁধানো একটা ঘাট। ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে একটা সবুজ প্রান্তরের মধ্যে। বোঝা যায় বহুকাল আগে জলের প্রবাহ ছিল। জল ছেড়ে দেওয়া মাটিতে এখন গরু, ছাগল চরছে।
এতক্ষণের দমবন্ধ করা পরিবেশ ছেড়ে এসে বড় করে মুখ খুলে শ্বাস নিল মৈনাক। গোবিন্দর দিকে তাকাতে বলল, আমি জানি আপনি কী জিজ্ঞাসা করবেন। তবে আমি যতদূর জানি দীপ্তেনবাবু একটা বড় চক্করে পড়েছে। সহজে নিস্তার পাবেনা। আপনি বারপুরে ধরনীধর মিত্র, নাম করা মানুষ, ওর সঙ্গে কথা বলে কিছু আভাস পেতে পারেন। আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। অামি দীপ্তেনবাবুর নীচের তলার সঙ্গী ছিলাম। ঝড়ের সংকেতের কথা বলেছিলাম। কানে তুলেছিল কিনা কে জানে! যাক গে, আপনাকে বড় রাস্তা দেখিয়ে দিই। চলুন।
কীসের ঝড়! মৈনাকের জিজ্ঞাসায় গোবিন্দ হেসে বলল, আপনি তো দেখছি অ, আ, ক, খ না জেনেই মাঠে নেমে পড়েছেন।
আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে তো! মৈনাকের কথায় গোবিন্দ বলল, হবে। আপনি দীপ্তেনবাবুর লোক। আপনাকে সাহায্য না-করলে অর্ধম হবে। হ্যাঁ, মলিনা কিন্তু খুব ভালো, পড়ালিখা জানে, এখানে থাকলে কখন কে ছোবল মারতো।
কেন ওর বাবা-মা? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় গোবিন্দ বলল, মা’টাতো গা’য়ে আগুন দিয়েছিল বহুদিন আগে, বাপটা জেলে।
আর কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে চলমান একটা রিকশাকে দাঁড় করিয়ে গোবিন্দ বলল, কোন রকম খবর থাকলে আমি নিজেই পৌঁছে যাবো আপনাকে এখানে আসতে হবে না। এ জায়গা আপনার কাছে সুবিধের নয়।
শহরের পেটের ভেতর সে এ রকম অচেনা জায়গা থাকতে পারে মৈনাকের ধারনায় ছিল না। এখন নীল আকাশের নীচে ঝকঝকে রাস্তায় যেতে যেতে মৈনাকের মনে হ’ল দীপ্তেনের মতো একজন অ্যাভারেজ লোকের পক্ষে সম্ভব নয় কোন জটিল আর্বতে জড়িয়ে পড়া। যদি না কেউ ওকে ঠেলে ঐ ঘুর্ণিপাকের মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু কে?
পাঁচ
দুপুর মাথায় নিয়ে যখন মৈনাক দীপ্তেনের বাড়িতে ফিরলো ওর মাথা জুড়ে যন্ত্রণা। মাথার দু’পাশ দপ দপ করছে। চোখের পাতা ভারী। কোনরকমে ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দিল। এই মাইগ্রেন ওর পরিচিত। এখন ওর কী কী করণীয় ও সেগুলো জানে। কিন্তু এখুনি সেগুলো করার জন্য শরীর সায় দিচ্ছিল না। চোখের পাতা বন্ধ করে ও পড়ে রইল।
আলকাতরার মতো কালো, ঘন, ভারী একটা যন্ত্রণা ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দখল নিয়ে নিল। ক্রমশ চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে দুহাত-পা-ওলা হিংস্র পশুর মতো যন্ত্রণা ঝাঁপিয়ে পড়লো দাঁত-নখ বার করে। মৈনাকের চোখ, মুখ, মাথা জুড়ে দাপাদাপি করতে লাগলো।
ঘরে ঢুকে মলিনা দেখলো বাইরের পোশাক না ছেড়েই বিছানায় শুয়ে আছে মৈনাক। ডাকার সাহস হ’ল না তার। খাবার থালা টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে দরজার পাল্লা দু’টো টেনে ভেজিয়ে দিল বাইরে থেকে। দিনের শেষ আলো ঢুকতে না পেরে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।
একটা বরফের মতো হিমশীতল ছোঁয়া মৈনাক কপালের ওপর স্পর্শ পেল। সেই হিমশীতলতার স্পর্শে কালো, ভারী যন্ত্রণাটা সরে গিয়ে সকালবেলার আলোর মতো নির্মল লাগছিল। মৈনাক আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটোর পাতা খুলল। খুলেই বুঝতে পারলো ঘরটা অন্ধকার। এবং একটা হাত ওর গায়ের থেকে সরে গেল দ্রুত। বিছানা থেকে নেমে ঘরের সুইচ অন করতে আলোয় ভরে গেল মুহূর্তের মধ্যে। দেখলো দীপ্তেনের মা ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু চাউনিটা কেমন। হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝতে চাইছিল হয়তো দীপ্তেনকে। মৈনাক কথা বলার উদ্যোগ নিতেই হাত এবং পা দিয়ে ঘষটে ঘষটে দীপ্তেনের মা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মন্থর ভাবে।
যন্ত্রণাটা একদম নেই। জল খেল অনেকটা। শরীরটা পালকের মতো হালকা লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে উত্তরের জানালার পাল্লাটা দু’হাট করে খুলে দিল। এক ঝলক তাজা বাতাস গায়ে-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘড়ি না দেখলেও বুঝতে পারলো রাত শেষ হবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। একটা দু’টো করে পাখি ডাকছে। রাতের আকাশের রং ফিকে হতে শুরু করেছে। শুকতারাটা এখনও জ্বলজ্বল করছে। উষাকাল অনেক, অনেক দিন পর মৈনাক দেখার মতো সময় পেল। এই মুহূর্তকে অনুভব করতে ঘরের আলো নিভিয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে রইল। একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে প্রকৃতিতে।
আপনি তো মুখে কিছুই তোলেন নি দেখছি, মলিনার কথায় মৈনাক হাসলো নীরবে। কাল রাতে খাবার মতো অবস্থা ছিল না আমার। আর খেলেও বমি হয়ে যেত। আচ্ছা, মাসীমা রাতে ঘুমোয় না?
মৈনাক জিজ্ঞাসা করায় মলিনা বলল, না, চোখের দৃষ্টি কমে আসার পর থেকেই এই উপসর্গ দেখছি। রাতের বেলা না ঘুমিয়ে বাড়ির সব কিছুই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বোধহয়। মাঝখানে তো সিঁড়ির দরজা খোলা পেয়ে নীচের বাগানে হাত দিয়ে গাছগুলোর দেহ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতো রাতের বেলায়। এখন দেখুন গভীর ঘুমে মাসীমা।
তাই দিনের বেলা দেখছি না। ডাক্তার বাবুকে বলেছিলেন? মৈনাকের প্রশ্নের জবাবে মলিনা বলল, দীপ্তেনবাবু থাকতে ডাক্তারবাবু বলেছিল, একটা চোখে গ্লুকোমা। অন্যটাতে অপরেশান করা হয়েছিল। সেটাও ক্ষীণ দৃষ্টি।
আচ্ছা, আপনি জানেন বারপুর এখান থেকে কতটা দূর? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় মলিনা বলল, আপনি কী যাবেন?
ইচ্ছে আছে। ছোট করে বলল মৈনাক।
আপনি কী দীপ্তেনবাবুর খোঁজ পেয়েছেন? মলিনার প্রশ্নের জবাবে মৈনাক বলল, না, না, তবে চেষ্টা করে দেখছি কী এমন হ’ল যে, দীপ্তেন আচমকা অর্ন্তধান হ’ল। দীপ্তেনের মতো সাদামাটা ছেলের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
ছয়
রাধিকা গুপ্তের মুখ গোল। ঘাড় পর্যন্ত চুল। ঠোঁটে চড়া বাদামি রঙের লিপস্টিক। মোমপালিশ করা মুখ। প্লাক করা ভুরু ধনুকের মতো বাঁকা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। কানের নীচের গ্রীবায় ড্রাগনের ট্যাটু। ডান হাতের কবজিতে বড় ডায়ালের ঘড়ি। জাপানী মেয়ের মতো ঠোঁটে হাসি এনে বলল, বলুন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ।
মৈনাক রাধিকা গুপ্তর ব্যক্তিগত কক্ষে বসে ফালি চাঁদের মতো টেবিলের উল্টো দিকের থেকে রাধিকার প্রশ্নে বলল, আমি একজনের খোঁজ পাবার জন্য এসেছি।
রাধিকা গুপ্তের ধনুকের মত বাঁকা ভুরু একটু কুঁচকে গেল। মুখে বিরক্তি এনে বলল, এটা তো ইনভেস্টিগেশন অফিস নয়।
আই নো ইট ভেরি ওয়েল বাট্ দীপ্তেন বসু আজ ছয় মাস বাড়ি ফেরেনি। আপনাদের স্টাফ্ ছিল। মৈনাকের উত্তেজিত স্বরে রাধিকা গুপ্তের কোন ভাবান্তর হল না।
ইটস ভেরি স্যাড বাট্ আমি এরকম তিনশো স্টাফ নিয়ে কাজ করি। অফিসের কাজের বাইরে কে, কী করছে সেটা দেখা আমার কাজ নয়। ইট ইস বেটার টু গো পুলিশ স্টেশন। থ্যাঙ্ক ইউ, রাধিকা গুপ্ত দু হাত করজোর করতে মৈনাকের আর কিছু বলার রইল না। ঠাণ্ডা ঘর থেকে বের হতে বুঝতে পারলো ওর কান দুটো গরম লাগছে।
ওভাল শেপ্ড ফাইবার গ্লাসে মোড়া সুদৃশ্য অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে সামনে চা’য়ের দোকানের চেয়ারে বসলো মৈনাক। হাতের তাস সবটাই বেরিয়ে গেল। ভীষণ আশা নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু কোন লাভ হল না। দীপ্তেনের ব্যাপারে বোধ হয় কিছুই করা যাবে না। এ বোধহয় বুনো হাঁসের পালক খোঁজা।
চা-য়ের দোকানের বয় সামনে দাঁড়াতে মৈনাক চা-টোস্টের অর্ডার দিল। এখন মাঝ দুপুরে চা-য়ের দোকানের টেবিলগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন বসে আছে। বেশ কয়েকটা টেবিল ছাড়িয়ে গাঢ় হলুদ রঙের আলখাল্লা, গলায় চাপানো নানা রঙের পুঁতির মালা, কপালে লাল তিলক টানা লোকটা চা-য়ের দোকানে ঝলমল করছে।
চা-টোস্ট দিতে মৈনাক খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে মনে হল দুরের আলখাল্লা পরা লোকটা ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে। মৈনাক ওর চোখে চোখ রাখতে হলুদ বসন পরা লোকটা হাসলো। মৈনাক আবার ওর খাওয়ায় মন দিল। চা-য়ে চুমুক দিল। শেষ করে একটা সিগারেট ধরালো। ধোঁয়া ছাড়তে দেখলো হলুদ বসন পরা লোকটা একদম ওর উল্টো দিকে এসে বলল, কিছু মনে না করলে কয়েকটা কথা বলবো স্যার।
মজা লাগলো মৈনাকের। এই ধরনের লোকেরা একটু গা’য়ে পড়া হয়। অযাচিত কিছু উপদেশ বিলিয়ে অর্থ দাবী করে। মৈনাক ঘাড় নাড়লো।
লোকটা বলল, আমি ফোরটেলিং করি।
আপনার কেন মনে হল আমি আমার ভবিষ্যৎ জানতে চাইছি!
আপনার চোখ বলছে আপনি গভীর দুশ্চিন্তায় আছেন। লোকটার কথায় মৈনাক বলল, বলুন তো কীসের দুশ্চিন্তা।
অর্থের সুরাহা হওয়ার কোন রাস্তা নেই স্যার। অর্থ আপনার কপালে নেই।
মৈনাক টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোন স্কুলে পড়েছেন।
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, বলার মতো নয়। তবে আপনাকে বলছি আজ প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হবে।
গনগন করছে দুপুরের রোদ। এর মধ্যে বলে কিনা ঝড়-বৃষ্টি হবে। তবে নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে লোকে এক সপ্তাহ আগে জেনে যায়। এ হয়তো সে রকম। মৈনাক কথা না বাড়িয়ে চা-য়ের দোকানের দাম মিটিয়ে বাস টার্মিনাসের দিকে পা চালালো।
আলখাল্লা পরা লোকটা দ্রুত পা চালিয়ে ওর পিছনে এসে বলল, আর একটা কথা স্যার, আপনি দিয়ে কোন লোকের কাছ থেকে সাহায্য পাবেন।
মৈনাক দশটা টাকা লোকটার হাতে দিয়ে বলল, আর কিছু হবে না। এবার অন্য কাউকে ধরুন।
মাথার ওপর তাপ বর্ষণ হচ্ছে। ২টোর বাসটা পেতেই হবে। না হলে গাঙহাটিতে পৌঁছতে দেরী হবে। যখন বেরিয়েছিল, ভেবেছিল কিছু একটা সূত্র পাবে। কিন্তু উলটে কপালে জুটলো কিছু অপমান। দীপ্তেনের ডায়রিতে এই রাধিকা গুপ্ত সম্পর্কে লেখা ছিল। দীপ্তেনের না-থাকা এদের কোনরকম মাথাব্যাথা নেই। হাত ধুয়ে ফেলেছে। মৈনাকের রাগ হল। কিন্তু সেই রাগ বেরোতে না পেরে পা দু’টোকে জোরে জোরে ফেলতে লাগলো।
বাসে উঠে শরীর জুড়ে ঘামের স্রোত নামলো। একটা ক্লান্তি দু’চোখের পাতায় এসে ভর করলো। বাস অল্প সময় পরেই গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করলো। মৈনাকের চোখ বুজে এল।
গাঙহাটিতে যখন নামলো হাত ঘড়িতে তখন সাড়ে চার বেজে গেছে। রোদের এখন সেই প্রখরতা নেই। চারিদিক কেমন থম মেরে আছে। মৈনাক পা চালালো দ্রুত। যখন দীপ্তেনের বাড়ির দরজায় পৌঁছালো তখন আকাশ কাঁপিয়ে বাজের শব্দ আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে বড় ড্রামের গড়িয়ে চলার মতো গুম গুম করে চলে গেল। মৈনাক সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ওপর উঠতে বুঝতে পারলো মত্ত ষাড়ের মতো গোঁ-গোঁ করতে করতে প্রলয় ঝড় শুরু হল। দুমদুম করে শিল পড়তে লাগলো ছাদে। যেন রণমত্ত হিংস্র দুটো পশু মুখোমুখি হয়ে প্রবল বিক্রমে পরস্পরের ওপর সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের মুখ নিঃসৃত জান্তব শব্দ আকাশ, বাতাস বন-জঙ্গল প্রাণ ভয়ে আলোড়ন করতে করতে ওলোট পালোট শুরু করে দিল। ঘন ঘন বজ্র পাতে মনে হল পৃথিবী বোধহয় শেষ লড়াইতে নেমেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা বর্শার ফলকের মতো দরজা-জানালার ওপর পড়তে থাকলো সশব্দে। অন্ধকারের মধ্যে মৈনাক ঘরের মধ্যে বসে ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য শুনতে লাগলো।
সাত
বাস টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে মৈনাক বারপুর যাবার বাসের সময় দেখছিল। প্রথম বাস ছেড়ে গেছে ভোর বেলা। দ্বিতীয় বাস ছাড়তে এখনও একঘন্টা দেরী। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। টার্মিনাসের থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানগুলো পেরিয়ে লোকসমাগম একটু হালকা দেখে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্টের এখনই একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ। বাইরের সকাল দশটার আলো ঝলমলের বদলে কেমন একটা মায়াবি মোহময় হালকা-আলো। বাইরের থেকে পৃথক হওয়ার জন্য এই কৃত্রিমতা একটা সাময়িক ভালোলাগা তৈরি করে। কোণের একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। যতটা ফাঁকা মনে হচ্ছিল ততটা ফাঁকা নয়। তবে কলেজ পড়ুয়াদের সংখ্যাটা চোখে পড়ার মতো। নিছক সময় কাটানো এবং কৌতূহল বশে এখানে ঢুকে পড়া। কোলাহল নেই তবে মৃদু গুঞ্জন বিদেশী মিউজিকের সঙ্গে মিশে আছে। খাবারের তালিকায় চোখ বোলালো মৈনাক। খাবারগুলোর মধ্যে পরিচিত খাবার খুঁজছিল। আচমকা কাঁধে হাত পড়তেই মুখ তুলতে যেটা দেখলো সেটা মৈনাকের কাছে বিস্ময়কর বললে কম বলা হবে। পরিবেশ, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মুখ থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এল, তুই!
মাথায় বিদেশী হ্যাট পরা অত্রি বলল একদমে, তোকে এখানে দেখবো এটা ভাবনার মধ্যে ছিল না। তুই এখানে, নিশ্চয় প্লটের ব্যাপার।
মৃদু হাসি দিয়ে মৈনাক বলল, আর তুই ফিরলি কবে। অত্রি বলল, উত্তর পরে। এতদিন পর যখন দেখা হল চল তোকে একটা অসাধারণ জিনিস দেখাবো।
মৈনাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মধ্যে ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার নিল।
তোকে এখানে দেখতে পাবো একদম ভাবিনি। এতো মিরাকেল। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, তুই দীপ্তেনকে চিনতিস।
দীপ্তেন! অত্রির মধ্যে দ্বিধা দেখে মৈনাক বলল, সেই যে দুর্গবাড়ি, ওয়াচ টাওয়ার।
ওহ! দ্যাট ফানি ডেইজস। হ্যাঁ, হ্যাঁ, টিকে বাবু। মনে পড়েছে। অত্রি’র কথায় মধ্যে খাবার সার্ভ করে গেল।
ওই দীপ্তেনের বাড়িতে আমি এসেছি কিন্তু দীপ্তেন নেই। মৈনাকের কথা শেষ করতে না দিয়ে অত্রি বলল, ও নেই তো কী আছে আমি আছি। চ. আজ তোকে দেখাবো আমি কোথায় থাকি। একে বারে হাওয়া মহল।
খাওয়া শেষ করে দু’জনেই বেরিয়ে এল রেস্টুরেন্ট থেকে। মৈনাককে দাঁড় করিয়ে অত্রি গাড়ির স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে রোদ এখন বেশ চড়া। মোটর বাইকে শব্দ তুলে মৈনাকের কাছে এসে বলল, নে উঠে পড়। ওহ, কতদিন পর দু’জনে একসঙ্গে।
মোটর বাইক গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করলো। ক্রমশ শহর ছাড়িয়ে যেখানে দাঁড় করালো অত্রি সেটা একটা ফ্যাক্টারির সামনে। জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির প্রধান গেটের সামনে অত্রির মোটর বাইকটার স্টার্ট বন্ধ হতে ফ্যাক্টরির প্রধান ফটক খুলে গেল।
কিছুটা অবাক চোখ নিয়ে মৈনাক ঢুকলো অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরির মধ্যেটা দেখে মনে হচ্ছে একটা ঝড় এসে সব কিছু ওলোট পালোট করে দিয়েছে। ভাঙাচোরা, পোড়া জিনিস ছত্রখান হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা চার চাকার গাড়ি ঝলসানো, হেডলাইট দু’টো খুবলে নিয়েছে কেউ। প্রসেসিং ইউনিটের টিনের চাল তোবড়ানো, অ্যাসবেস্টসের একটাও আস্ত নেই।
অত্রি দাঁড়িয়ে থাকা মৈনাককে ধাক্কা দিয়ে বলল, ধ্বংসস্তুপ দেখছিস।
মৈনাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অত্রির দিকে মুখ ফেরাতে অত্রি বলল, ম্যানমেড ডিজাস্টার। জনরোষ ও বলতে পারিস।
কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় অত্রি বলল, সে অনেক ইতিহাস। তোকে বলবো পরে। তবে এটা একটা সময়ের সাক্ষী, এটা থাকবেনা আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। রেজারেকশান। ধ্বংসস্তুূপ থেকে মাথা তুলবে এই জলটুঙ্গির অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি। আমি সেই দায়িত্ব নিয়েই এখানে এসেছি। তোকে তার একটা নমুনা দেখাবো চল।
ফ্যাক্টরির কোম্পাউন্ডের এই অংশটা অনেকটা রানওয়ের মতো। ছোট চাটার্ড প্লেন অনায়াসে নামা-ওঠা করতে পারে। কথাটা অত্রিকে বলতে, অত্রি বলল, আগে তো এইটা রানওয়ে ছিল। তারপর রানওয়েটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফ্যাক্টরি তৈরি হয়।
তুই এত কথা জানলি কী করে? মৈনাক বলাতে অত্রি বলল, ফিল্ড ওয়ার্ক করে তবে এখানে এসেছি। বিগত দশবছর এখানে কী হয়েছিল তা সব কিছু আমার নখদর্পনে, চাইলে এক্ষুনি বলতে পারি। কিন্তু তুই বোরড হবি। তার চেয়ে তোকে যেটা দেখাতে এনেছি সেটা দেখে তোর দারুন লাগবে।
অত্রির কথা শুনে মৈনাক বলল, আমার বোরিং লাগবে না। তুই বলতে পারিস।
আমার লাগবে বস ঐ মৃতদের কথা বলতে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, এখানে মৃতদের কথা আসছে কোথায়!
ইতিহাস তো মৃতদেরই হয়। যাক এটা নিয়ে কথা পরে হবে। আপাতত তোলা থাক। তোকে ঐ লিফটে চড়িয়ে একদম আকাশের কাছে নিয়ে যাব। চাইলে পেয়েও যেতে পারিস আকাশের চাবি।
বড় বড় কনস্ট্রাকশনে হাইরাইজ ওঠার জন্য শ্রমিক-মজুরেরা সেরকম খোলা লোহার খাঁচা ব্যবহার করে। এটাও সেরকম লিফট, আস্তে আস্তে নেমে আসছিল মাটির দিকে।
দুজনে ঐ লোহার খাঁচায় উঠতে ওটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। মৈনাক দেখলো মাটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সরতে সরতে ক্রমশ চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। মাটির ওপর জিনিসগুলো এত ছোট হয়ে যাচ্ছে যেন লিলিপুটের আকার নিতে নিতে ক্রমশ বিন্দু বিন্দু হয়ে গেল। সবটা কেবল যেন অলীক বস্তু হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেও যেগুলো একটা আকৃতি নিয়ে নিজেদের জাহির করছিল। এখন সেগুলো এত ক্ষুদ্র যেন মনে হয় তুচ্ছ, নগন্য। এখন ভূমির ওপর থাকা সবই অলীক। লিফট শেষ পর্যন্ত যখন থামলো তখন মনে হল লোহার ট্যাঙ্কের ছাদের ওপর। প্রথম অভিজ্ঞতায় মৈনাকের কাছে একটা অ্যাডভেঞ্চার। ওর শরীর জুড়ে একটা রোমাঞ্চ সেতারের তারগুলোর মতো রিন রিন করে সুর তুলছিল। ওর মনে হ’ল ও দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী থেকে দূরে এক বিশালাকার লোহার স্টেডিয়ামের মধ্যে। স্টেডিয়ামের ঘাসের বদলে এখানে রয়েছে লোহার পাত। অনেক দূরে একটা ব্রীজ আকাশে আলপনার মতো আবছা একটা রেখা। বাকী শহর-গ্রাম, সবুজ-গাছ পালা সব নীচে বৃত্তকারে সাজানো রয়েছে। হাওয়া বইছে জোরে।
কী বলেছিলাম না হাওয়া মহল। এবার বিশ্বাস হচ্ছে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, সত্যিই অসাধারণ। ইউনিক, এত উঁচুতে আমি উঠিনি কোন দিন। কিন্তু এটা তো একটা বিশাল জলাধার।
২১৫টা লোহার স্তম্ভের ওপর ৮৫০০ টন এই লোহার কাঠামোর এখন মেরামতির সঙ্গে মজবুত করার কাজ চলছে। একসঙ্গে জলাধার থেকে পানীয় জল আর সেচ দুটোই হবে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, জল কোথায় জলটুঙ্গি তো এখন শুকনো নদী খাত।
মুচকি হেসে অত্রি বলল, জল আছে বলেই ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করছে সরকার আর আমার কোম্পানী। ড্রিঙ্কিং ওয়াটারটা আমাদের আর সেচ সরকারের। মৌ স্বাক্ষর হয়ে গেছে।
কিন্তু গতবারের জনরোষ যদি আবার আছড়ে পড়ে। মৈনাকের কথায় অত্রি বলল, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু এবার ট্র্যাজিক এন্ড হবে না। গতবার মূল কালপ্রিট্ ছিল বিদেশী বীজ কোম্পানী। যাদের জন্য এই তল্লাট জলশূন্য হয়ে গেছে। কোথাও ডাস্ট অব্ বোল। শুধু ধুলো। কিন্তু ওরা সেটা মানতে চায়নি। ওদের উচ্চ ফলনশীল বীজ প্রচুর জল খায়। আর ওদের সঙ্গে গ্রামের চাষীরা ছিল।
অত্রির কথা শেষ হতে মৈনাক বলল, কিন্তু তোদের ওপর আক্রমন হ’ল কেন? তোরা তো চাষ করিস না কিংবা ঐ বিদেশী কোম্পানীর প্রতিযোগী নস।
খোলা চোখে দেখলে সেটা মনে হতেই পারে। কিন্তু এই জলঢুঙ্গির জল ধারণ ক্ষমতা কমছিল কিন্তু বীজ কোম্পানী এই বেসিন এরিয়ায় শস্য চাষের জমি বাড়িয়ে যাচ্ছে। চাষীদেরও হাতে পৌঁছে যাচ্ছিল টাকার থলি। কে আর লাভের কড়ি গোনার সময় খেয়াল রাখে টাকার রং কি? কীসের বিনিময়ে এল এই অর্থ। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, তোদের জল নেওয়াটা ওদের সহ্য হ’ল না।
ঠিক তাই। ১৯৬০ সালে জলটুঙ্গি যেখানে ৫৫ বিলিয়ন ঘন মিটার জলের যোগান দিত, ২০০০ সালে সেই জলের যোগান ৫ বিলিয়নে। এখন সেটা ১-য়ের নীচে। যারা লাভের কড়ি গুনছিল তাদের শিরে সংক্রান্তি। আর এই লাভ না পাওয়া লোকগুলোকে মারমুখী করে ঘুরিয়ে দেওয়া হ’ল জলঢুঙ্গির অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরি’র দিকে।
হুঁ বুঝলাম। মৈনাক বলল, কিন্তু তারপরে তোর কোম্পানী ১৫০০ কোটি টাকা ঢেলে প্রকল্প গড়ছে কেন সেটা মালুম হ’ল না।
মৈনাকের কথা শেষ হতে অত্রি হো, হো করে থাকলো। হাসি থামিয়ে বলল, সোলারিস ফিল্ম দেখেছিস তুই।
মৈনাক বলল, আন্দ্রেই তারকোভক্সি। রাশিয়ান ছবি।
ব্যাস, তা হলে তোকে আর ডিটেলস বলতে হবে না। সেই কৃত্রিম স্পেস বা স্টেশনে যখন নায়ক গেল, দেখল তার মৃত স্ত্রী রয়েছে। তার ছেড়ে যাওয়া স্ত্রী’কে পেয়ে .... অত্রিকে থামিয়ে মৈনাক বলল, তুই সিরিয়াস বিষয় থেকে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাইছিস কেন?
অত্রি বলল কিছুক্ষণ আগেও এই হাওয়া মহলকে দেখে তুই কেমন বিহ্বল হয়ে গেছিলিস। আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে বললি এ-তো পৃথিবীর বাইরে রয়েছি। সেই সমস্ত ভুলে গিয়ে নীচের তলার যাবতীয় কথা, প্রসঙ্গ এনে দেখার আনন্দটায় একদম জল ঢেলে দিলি।
না, না, সত্যিই ইউনিক অত্রি। রিয়েলি অনেক দিন স্মৃতিতে থাকবে। তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মৈনাক থামতে অত্রি বলল, চাইলে আবার আসবো। এখন চল ধরাধামে যাই।
আট
দরজায় ধাক্কা দিতে মৈনাকের ঘুম ভেঙে গেল। চোখের পাতা খুলতে বুঝতে পারলো সকাল এখন ক্রমশ দিনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে মলিনা বলল, এই নিয়ে দু’বার ডাকলাম। গোবিন্দদা এসেছে, সঙ্গে এনেছে আর একজন কে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
মৈনাক বলল, কোথায় ওরা?
নীচে দাঁড়িয়ে আছে। মলিনা বলতে মৈনাক বলল, যাও, এই ঘরে নিয়ে এসো। আর ওদের জন্য চা-আন।
গোবিন্দর পেছনে পেছন কালো রঙের, লম্বা, সাদা কাঁধ থেকে হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া ক্লোক পরা মানুষকে দেখে মৈনাক হাত জোড় করে নমস্কার করতে অচেনা মানুষ হাসলো। গোবিন্দ চেয়ার টেনে বসতে বলে, মৈনাককে বলল, ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস। আপনাকে কিছু বলতে চায়।
মৈনাক অবাক হয়ে গোবিন্দ’র দিকে তাকাতে বলল, উনি দীপ্তেনবাবু সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। কিন্তু আমাকে ঠিক বিশ্বাস করে বলতে অসুবিধে আছে। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম। ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের চোখে-মুখে-চেহারার মধ্যে এক ধরনের শান্ত, গাম্ভীর্য রয়েছে। সেই গাম্ভীর্য ভেঙে বলল, গোবিন্দ আমাকে বলেছে আপনার কথা। আমি আপনাকে বিশেষ কিছু গোপনীয় কথা বলতে চাই। এটা না বলতে পারলে আমার অধর্ম হবে। আর তাছাড়া, আমার কাছে কিছু জিনিস আছে সেগুলি আপনার হাতে তুলে দিতে পারলে শান্তি। আমি অনেকদিন ধরে এগুলি নিজের কাছে রেখেছি। এবার উপযুক্ত মানুষের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি দায়মুক্ত হব।
হ্যাঁ, আপনার গোপন কথা বলুন। মৈনাক বলতে গোবিন্দ উঠে ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
দেখুন বিষয়টা আমি পাঁচকান করতে চাইনা। দীপ্তেনবাবু আপনার বন্ধু তো প্রথমে আপনিই জানুন। মালোপাড়া চার্চের যে ছোট সিমেট্রি আছে। মাস ছয় আগে গভীর রাতে একজনকে কবরস্থ করা হয়। খ্রীস্টান আচার মেনেই। অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ। নাম ম্যাথুজ উইলিয়াম। এবং সেই মৃতের কিছু জিনিসপত্র আমার কাছে রেখে দেওয়া হয়। পরে আমি জানতে পারি কবরে যে মানুষটিকে শোয়নো হয়েছিল সে ম্যাথুজ নয়।
ম্যাথুজ নয় কেন আপনার মনে হল? মৈনাকের জিজ্ঞাসার মধ্যেই গোবিন্দ চা ও কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলো। খুব দ্রুত হাতে সেগুলো রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চা-য়ের কাপে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস বলল, ম্যাথুজ ইঞ্জিনের ড্রাইভার। ড্রাঙ্কড্। মাথার সামনে টাক। গাল পর্যন্ত চওড়া জুলপি। জিন্স আর কলারতোলা গেঞ্জি পরতো। এই পোশাক পরতোই না। বলে, জোব্বার পকেট থেকে ট্রাউজার-শার্ট বের করে মৈনাকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
মৈনাক হাত বাড়িয়ে নিল। এগুলো, বলে অবাক নয়নে তাকালো।
কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস পুনরায় বলল, ট্রাউজারের ভেতর দিকে দেখুন দর্জিঘর স্টিকার পাবেন। আর একটা কথা এখন আমি নিশ্চিত ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ নয়, মার্ডার।
কিন্তু এতদিন অাপনি মুখ বুজে ছিলেন। আর এটা যে হারিয়ে যাওয়া দীপ্তেনের এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে। মৈনাকের দ্বিধা জড়িত প্রশ্নে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস বলল, আমি মালোপাড়া চার্চের ফাদার। আমার জানার অনেকগুলো জায়গা আছে। আর একটা কথা, আপনার যদি মনে হয় তবে ঐ সিমেট্রিতে আসলে আপনাকে আমি দেখিয়ে দেবো। হ্যাঁ, আমার এই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ গোপনীয়। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি তো।
দীর্ঘ কথায় শেষে ফাদারের ইচ্ছায় মাথা নাড়ালো। প্রতি নমস্কার জানালো মৈনাক। এবং ফাদারের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া দেখলো। গোবিন্দ ফাদারকে নিয়ে নীচে নামছে। মলিনা ঘরে ঢুকলো। চা-য়ের কাপ, থালা নিয়ে যাবার সময় মৈনাকের নিশ্চল অবস্থা দেখলো। মলিনা ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর খেয়াল হ’ল মৈনাকের ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস যে জামা-প্যান্ট দিয়ে গেছে সেগুলো একবার মলিনাকে দেখালে হয়।
মৈনাক ডাকলো মলিনাকে। মৈনাক জামাটা দেখাতে মলিনা জামাটা হাতে নিল তারপর বলল, এটা আপনি পেলেন কোথায়?
মৈনাক বলল, দর্জি ঘরে গিয়েছিলাম দীপ্তেনের খোঁজ করতে ওরা এটা দিয়েছে।
মলিনা মাথা নেড়ে বলল, না, না, এটা তো দীপ্তেনবাবু পরে বেরিয়েছিল। এটা দর্জি ঘরে থাকবে কী করে।
মৈনাকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল কথাটা কিন্তু সংবরণ করলো নিজেকে। কী হবে। তার চেয়ে বরং যে রকম চলছিল সেরকম চলুক। দীপ্তেনের না থাকা এ বাড়িতে সয়ে গেছে। নতুন করে আর ইন্ধন জুগিয়ে লাভ নেই। কিন্তু চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারলো না। না’কি জানা ছিল না বেরোনোর রাস্তা। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মৈনাক বলল, তুমি যাও।
মৈনাকের কথা শুনে মলিনা চলে গেল। দেওয়ালে দীপ্তেনের টাঙানো ফটোর দিকে এগিয়ে গেল মৈনাক। গাল পর্যন্ত টানা জুলপি, টিকালো নাক, চোখের মনি দু’টো বিড়ালের মতো কটা, মাথার সামনে অল্প চুল, ম্যাথুজ উইলিয়াম!
নয়
বারপুরে এসে ধরনীধর মিত্র বলতে ঘুরতে হ’ল মৈনাককে। সাজানো গোছানো ছোট মফঃস্বল শহর এখনও পর্যন্ত মহানগরের আদব কায়দা রপ্ত করে উঠতে পারিনি। মহানগরগুলোতে ব্যক্তি যতই জনপ্রিয় হোকনা কেন। আসলে সে একটা সংখ্যা। তাঁর বাড়ির নম্বর ও রাস্তার নামের মধ্যেই তার পরিচয়। মফঃস্বলগুলোতে এখনও ব্যাক্তি সংখ্যার ভিড়ে হারিয়ে যায়নি। প্রথমে রিকশাওলা যে ধরনীধরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তিনি ডাক্তারবাবু। তিনি মৈনাকের কাছ থেকে শুনে বলল, হ্যাঁ সার্ভেয়ার ধরনীধর মিত্র। তারপর রিকশাওয়ালাকে বলল, তুমি সুভাষ এভিনিউ-য়ে নিয়ে যাও। ওখানেই পেয়ে যাবে।
ডাক্তার বাবুর নির্দেশ মত রিকশাওলা রিকশা ঘুরিয়ে সুভাষ এভিনিউ-য়ের দিকে যাওয়ার জন্য প্যাডেলে চাপ দিল। রাস্তার দু-ধারে গাছের সারি। এখনও কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল রয়েছে। শিমুল গাছগুলোতে ফুলের বান ডেকেছে। রোদ চড়া হচ্ছে। রিকশাওলা ধরনীধর মিত্র’র বাড়ির সামনে মৈনাককে নামিয়ে দাম নিয়ে রাস্তার বাঁকে হারিয়ে গেল। এখন অনেক দূর পর্যন্ত গাছে ঢাকা চওড়া রাস্তা লোকজনহীন। রাস্তা থেকে সরে এসে কলিং বেলে আঙ্গুল ছোঁয়ালো মৈনাক। বাইরের শ্বেতপাথরের নেমপ্লেটে ধরনীধর মিত্র। গর্ভনমেন্ট সার্ভেয়র।
ঘরের দরজা খুলে বারান্দার ছোট, গ্রীলের দরজা খুলে মাথাভর্তি সাদা চুল, সুঠাম চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক মৈনাকের সামনে এসে দাঁড়াতে মৈনাক দু’হাত জড়ো করে বলল, আমি গাঙহাটি থেকে আসছি। দীপ্তেন আমার বন্ধু। ওর ব্যাপারে কিছু খোঁজ-খবরের জন্য এসেছি।
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি ভেতরে আসুন। ধরনীধরের কথায় মৈনাক বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বসার ঘরে ঢুকে বলল, চা খান তো?
মৈনাক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে ধরনীধর বাবু বসার ঘরের জানালার দিকে গিয়ে ফ্লাক্স এনে দু’টো কাপে চা ঢেলে একটা মৈনাকের দিকে এগিয়ে দিয়ে সোফায় আরাম করে বসলেন।
মৈনাকও উল্টো দিকের সোফায় বসে বলল, আমার বন্ধু দীপ্তেন বীজ কোম্পানীর হয়ে....।
মৈনাককে কথার মাঝে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ধরনীধর মিত্র বলল, এখন সে কোথায়?
মৈনাক বলল, আমি ঠিক বলতে পারবো না।
আমার কাছে এসেছিল বহুদিন আগে। খুব জরুরী কিছু প্রশ্ন নিয়ে। ওই গ্রামগুলোতে কোম্পানীর হয়ে কাজ করতে গিয়ে ও লক্ষ্য করেছিল। যেগুলো আমার জানা ছিল না। ওর এই পয়েন্টগুলো গ্রাউন্ড লেভেলের অভিজ্ঞতা বিশেষত জলস্তর, পরিবেশ নিয়ে, আর কৃষিজমিতে পূর্বের মতো ফসল হচ্ছে না, ক্রমশ বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অ্যাফেক্টজোন হ’ল জেলেপাড়া। যারা জলঢুঙ্গিতে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করতো তারা দেখলো মাছ তো হচ্ছে না।
এসবের জন্য কী ক্ষোভ জমেছিল। যা একদিন আছড়ে পড়েছিল জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরির ওপর। মৈনাকের মুখ থেকে একথা শুনে ধরনীধর মিত্র বলল, একটা আই ওয়াশ করার চেষ্টা।
কিন্তু দীপ্তেনের এখানে ভূমিকা কী? মৈনাকের কথায় ধরনীধর বাবু বলল, দীপ্তেনরা স্কেপগোট হয় চিরকাল। কারণ ওরা ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধটা করে।
আপনার কাছে দীপ্তেন এসেছিল কেন? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ধরনীধর বলল, একটা সার্ভে করার জন্য ওকে ডেকেছিলাম। যোগ দেবে বলেছিল পরে ও পিছিয়ে যায়। হয়তো বুঝতে পেরেই পিছিয়ে যায়। ওর কাজের বিপক্ষে ছিল আমাদের সমীক্ষা।
আর আপনাদের সার্ভে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ধরনীধর বলল, আমরা একটা নদীর মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে আর একটা বিস্ময়কর জিনিস আবিস্কার করেছি। তবে রিটায়ার্ড জিওলজিস্ট রঞ্জন দে’র জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে, ও মাটির চরিত্র বোঝে। সেই আবিস্কার যদি বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে আবার মরা গাঙে জোয়ার আসবে।
ধরনীধরের গলা কথার শেষের দিকে আবেগে থর থর করে কাঁপছিল।
বলেন কি! জলটুঙ্গি আবার জলে ভরে যাবে? মৈনাকের প্রশ্নে ধরনীধর বাবু বললেন, তা হয়ত হবে না। তবে এই নদী খাতটা পাইপ লাইনের কাজে ব্যবহার হবে। নদীর দু’ধারে সে ক্ষেতগুলো দাবানলের পরের চেহারা নিয়েছে সেটা আবার শস্য শ্যামলা হয়ে উঠবে।
এ’তো আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, না ম্যানড্রেকের সম্মোহন। মৈনাকের কথা ধরে ধরনীধরবাবু বলে ফেললেন, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। তারপর সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ বদল করে বলল, আজ অনেক বেলা হ’ল।
মৈনাক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে এল ধরনীধর মিত্রের বাড়ি থেকে। গাছের ছায়া ঢাকা, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট ধরালো। আচমকা অত্রির কথার সঙ্গে ধরনীধর বাবুর কথার মধ্যে কোথায় একটা সংযোগ রয়েছে বলে মনে হল তার। অত্রির সঙ্গে একবার এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে হ’ল কিন্তু স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল বলে যদি এড়িয়ে যায়। যা হয় হবে, একবার নিজের কৌতূহল মেটাবার জন্য মোবাইল বের করে অত্রির নম্বরে ফোন করলো। রিং হচ্ছে মোবাইলের অন্য প্রান্তে।
হ্যাঁ, বলছি। অত্রির সাড়া দেবার পর মৈনাক বলল, তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তোর সময় আছে?
তোর জন্য সময় আছে। এই সন্ধের দিকে হলে ভালো হয়। চলে আয় সেই বাস টার্মিনাসের রেস্টুরেন্টে। পানাহার আর কথা দুই-ই চলবে। ও প্রান্তে হাসির শব্দ শোনার পর মৈনাক বলল, তা’হলে ছ’টা নাগাদ তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
দশ
হাতে একটু সময় নিয়ে মৈনাক বাস টার্মিনাসের কাছে রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকলো। আজ লক্ষ্য করলো, রেস্টুরেন্টের নাম জ্বলজ্বল করছে বৈদ্যুতিন আলোয়, ‘পারিজাত-ইন’। রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে একদম কোণের দিকের নিরিবিলি টেবিলটার কাছে গিয়ে বসলো। এখান থেকে মোহময়, মায়াবি আলোর ছায়াময় অস্তিত্বের মধ্যে কাচের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলে বোঝা যায়। মৃদু লয়ে বিদেশী মিউজিক বাজছে। সাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়ালে সমুদ্রের ঢেউ তট রেখায় আছড়ে পড়লে যেমন সুরের ঐকতান তৈরি হয়। এই পারিজাত ইনে’র মধ্যে বসে মৈনাক অনুভব করলো জলোচ্ছাসের সেই সিমফনি।
কাঁধে হাতের ছোঁয়া পড়তে মৈনাক দেখলো অত্রি বসেছে ঠিক টেবিলের উল্টো দিকে।
কিউ মুঝে বুলায়া? অত্রির কথায় মৈনাক বলল, আজ দুপুরের দিকে বারপুরে ধরনীধর মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।
দ্যাট ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী, এনারজেটিক। কেন? অত্রি জিজ্ঞাসা করতে মৈনাক বলল দীপ্তেনের ডায়রিতে ওর নাম ছিল।
তুই দীপ্তেনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস, তাই না, অত্রির কথায় মৈনাক বলল, হুঁ। যাকগে, ধরনীধরবাবুকে তোর চেনা কী এখানে কর্মসূত্রে।
হ্যাঁ, শুধু উনি নন। ওনার দলের সবাইকে আমি চিনি। অত্রির জবাবে মৈনাক বলল, আজ কথায় কথায় ধরনীধর বাবু বলছিলেন এক আবিস্কার, ডিসকভারির কথা।
কথার মাঝখানে ওয়েটার বিয়ারের ছোট দু’টো ক্যান আর এক প্লেট ফিসফিঙ্গার দিয়ে গেল। মুচকি হেসে অত্রি বিয়ারের ক্যানের সিল ভেঙে মুখে ঢেলে বলল, গরমের মোস্টপ্রিভেন্টিভ মেসারড।
বলছিস, মৈনাক বলল।
শুধু বলছিনা, টেস্ট নিতে বলছি। আর হ্যাঁ, দ্যাট ওল্ড ম্যান আর কি কি বলল তোকে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, ওর এই আবিস্কার যদি সত্যি হয় তাহলে ভোল পাল্টে যাবে জলটুঙ্গির। ওহ, তাহলে তো সবটাই বলে দিয়েছে। অত্রির কথায় মৈনাক বলল, না, আমি আবিস্কারের কথা শুনতে চাই না। এই ভোল পাল্টাবে কী ভাবে সেটাই তোর কাছ থেকে শুনতে চাইছি। শোনাটা তোর খুব জরুরী। অত্রির এই কথায় মৈনাক কিছু না বলে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিল।
শোন তাহলে। মালোপাড়া খ্রীষ্টানদের চার্চের আরও উত্তরে গ্রামগুলো ছাড়িয়ে বন-জঙ্গলের মধ্যে যে টিলা আছে। ঐ টিলার পাঁচশো মিটার নীচে এক জলের ভাণ্ডার অাছে। এই জল ভাণ্ডারের জন্ম হয়েছিল গত তুষার যুগে। বিশাল শিলীভূত জল ভাণ্ডার ঠিক মতো যদি ব্যবহার করা যায় তবে এই অফুরন্ত জল আগামী এক হাজার বছর ধরে চলবে। পাইপ লাইনের মধ্যে দিয়ে এই জলকে দূরদূরান্তে পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করার জন্যই জলটুঙ্গি অ্যাকোয়া ফ্যাক্টরিতে আমাদের আগমন। অত্রির মুখের থেকে এই কথা রূপকথার গল্পের মতো বেরিয়ে আসছিল।
দীর্ঘক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে মৈনাক বলল, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য!
অত্রি বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিয়ে বলল, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া তো পূর্বে মরুভূমির মতো ছিল। স্যান জোয়াকিন ভ্যালি এই রকম জলের প্রাপ্তি জোরে দুনিয়ায় খাদ্য আর তুলো উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
সত্যি ধরনীধরবাবু তো দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী, মৈনাকের কথায় অত্রি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
‘পারিজাত ইন’ এখন জমজমাট। সমস্ত টেবিলগুলো ভরে গেছে, রসিক মানুষের ভিড়ে। এক জন জোকারের মতো সেজে ম্যাজিক দেখাচ্ছে।
আর এক রাউন্ড হয়ে যাক অত্রি মৈনাকের দিকে চেয়ে বলল। মৈনাক উঠে পড়লো টেবিল ছেড়ে। আরে বাবা, বোস না। অত্রির জেদাজেদিতে বসে পড়লো। বিদেশী মিউজিকের রেশ আছড়ে পড়ছিল। মৈনাকের মনে হল একটা জাহাজের ডেকের ওপর সবাই রয়েছে। পারিজাত ইন ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে।
এগারো
গোবিন্দ এসে পড়েছিল সময়ের একটু আগেই। মৈনাক নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিচ্ছিল। এসে অবধি দীপ্তেনের মা’র সঙ্গে কথা হয়নি। আজ মলিনাকে ডেকে দীপ্তেনের মা’র ঘরে ঢুকলো কিন্তু দেখলো মাসীমা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কী ভেবে মৈনাক বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত মাসীমা’র হাতের সঙ্গে নিজের হাত স্পর্শ করলো। তারপর মলিনা’র দিকে ফিরে বলল, আজ ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।
গোবিন্দ ঘরের বাইরে থেকে বলল মৈনাকের উদ্দেশে, এখনও রওনা না হলে সাড়ে-নটা’র বাসটা বেরিয়ে যাবে। মালোপাড়ায় যেতে কিন্তু দু-আড়াই ঘন্টা লাগবে।
মৈনাক আর দেরী না-করে গোবিন্দকে সঙ্গে করে বেরিয়ে এল রাস্তায়।
বাস ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর থামতে গোবিন্দ ও মৈনাক নেমে পড়ল। বাস ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর দিয়ে যাবে না। পূর্ব দিকে যাবে। ন্যাশনাল হাইওয়ে উত্তরের থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। এবার ওদের উত্তর দিকে যেতে হবে। অন্তত দুই কিলোমিটার যেতে হবে এখনও। ভ্যান রিকশা ছাড়া গতি নেই। অগত্যা গোবিন্দ-মৈনাক তাতে চেপে বসলো। জাতীয় রাজপথের ওপর দিয়ে হা-হা করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে মালবাহী ট্রাক, দুরপাল্লার বাস, ম্যাটাডোর চলে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। দু-পাশে ক্ষেত জমি বুক চিতিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। দু-পাশের বিস্তীর্ণ জমি রুক্ষ। কোন মানুষ জন কিংবা পশু নেই। শুধু আকাশের অনেক উঁচুতে চিল তার ডানা ছড়িয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভ্যান রিকশা হাইওয়ের পাশে লোকজনের পায়ে চলা পথ ধরে বাঁ-দিকের খোয়া ওঠা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় নেমে এল নাচতে নাচতে।
এ ভাবে কতদূর আর যেতে হবে? মৈনাকের প্রশ্নে ভ্যানচালক বলল, তা হাফ কিলোমিটার হবে। মালোপাড়ার পেছন দিকে বিলের কাছে আপনাদের নামিয়ে দেবো। ওখানে থেকেই চার্চের চূড়া দেখতে পাবেন। বাকী পথটুকু আপনাদের হেঁটে যেতে হবে। ঘুর পথে গেলে আরও সময় লাগতো। হাঁটতে হত না একদম চার্চের মুখে পৌঁছে যেতেন। কিন্তু আপনারা তাড়া লাগালেন। তাই...।
ভ্যান চালক কে কথা শেষ করতে না দিয়েই মৈনাক বলল, মোক্তার বিল কেন?
আরে এই মোক্তার-ই এখানে প্রথম চার্চ তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। স্কুল করে। সেই থেকে মালোপাড়ার সবাই খেস্টান হয়ে গেল। সে বহুকাল আগের কথা। আশপাশের গাঁ-গঞ্জের মানুষজনের মধ্যে তখন না’কি খেস্টান হওয়ার ঢল নেমেছিল। এখন এসব নেই তবে মাঝে মধ্যে সাহেব-মেমরা আসে।
তুমি এতসব জানলে কী করে? মৈনাকের জিজ্ঞাসায় ভ্যানচালক বলল, আমিও খেস্টান। সদা প্রভুর অনুগামী।
কালো আবলুস কাঠের মতো দেহের কাঠামোয় বয়েসের ভার নেমেছে ভ্যানচালকের। ফতুয়ার মতো জামার আড়ালে থাকা গলায় ঝোলা চেনের ক্রশকে বাইরে এনে একবার ঠোঁট ছোঁয়ালো ভ্যানরিকশা থামিয়ে। তারপর আঙ্গুল তুলে বলল, ঐ যে শরবনের ভেতর দিকে তাকান।
ভ্যান চালকের আঙ্গুল তোলার দিকে চোখ রাখতে মৈনাক দেখলো শরবনের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে চার্চ।
দাম মেটানোর সময় মৈনাক দেখলো ঘামে ভিজে গেছে ওর পরনের ফতুয়া। দাম নিয়ে সৌজন্য বশত হাসলো। তারপর ভ্যানরিকশা নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে গেল।
চুপ থাকা গোবিন্দ বলল, এ রাস্তা অামার চেনা। আসুন। মৈনাক গোবিন্দর পিছন পিছন চলতে লাগলো। রাস্তার দু’ধারে ঘন শরবন মাথা উঁচু করে চলার পথটুকু একদম ঢেকে দিয়েছে। নীচু জমিতে জল জমে আছে। কোথাও বকের দল মানুষের সাড়া পেয়ে ঝাঁক বেধে পাখা মেলে শরবনের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। দূরের গীর্জা ক্রমশ চোখের সামনে স্পষ্ট হতে লাগলো। কিছুটা এগিয়ে গোবিন্দ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, যাহ! গেল কোথায়?
পেছনে আসা মৈনাক গোবিন্দ’র থেকে যাওয়ায়, বলল, কী’হল?
রাস্তাটা নেই। মোক্তার বিলের জলে হারিয়ে গেছে। গোবিন্দর কথা শুনে মৈনাক অবাক হ’ল। আর চল্লিশ ফুটের যত দূরে গীর্জা। এটা বোধহয় গীর্জার পেছনদিক। হাওয়ায় শরবনে ঢেউ উঠেছে।
জল বেশি হবে না। গোবিন্দর দেখা দেখি মৈনাক হাঁটু পর্যন্ত প্যান্টের ফোল্ড গুটিয়ে নিল। জুতো হাতে নিয়ে জলাভূমিতে নেমে পড়লো। গোবিন্দর পিছনে পা ফেলল। জল হাঁটুর কিছুটা আগে পর্যন্ত উঠে স্থির হয়ে রয়েছে। পা ফেলার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হচ্ছে। অবশেষে উঁচু ভূমিতে উঠে মৈনাকের চোখ স্থির হয়ে গেল গীর্জার দেওয়ালে আঁকা চিত্রে। কাঁটার মুকুট পরা যীশুখ্রীষ্টের রক্তের ধারা নেমেছে মুখ বেয়ে। পৃথিবীর যাবতীয় যন্ত্রণা সহ্য করেও চোখ দু’টোয় ফুটে উঠেছে প্রেম, ভালোবাসা।
প্যান্টের ফোল্ড আবার পায়ের পাতা পর্যন্ত নামিয়ে গোবিন্দ বলল, এবার চলুন ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের খোঁজ করি।
মূল চার্চ খুব বড় নয়। চার্চের সামনে অনেকটা প্রান্তর। চার্চের সংলগ্ন সমাধি ক্ষেত্রের প্রবেশ পথের মুখটাতে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখা হতে মৈনাক কে ডেকে নিয়ে গেল নিজস্ব ঘরে। এখানে যে অাসবেন সেটা অামি জানতাম। এখানে এত মানুষ শুয়ে অাছে তাদের কেউ না কেউ বছরের কোন সময় অাসে। ফুল দেয়, ক্যান্ডেল জ্বালায়। কৃষ্ণ কিশোর কথা শেষ করে মৈনাকের দিকে ইঙ্গিত করলো ওকে অনুসরণ করতে।
মৈনাক কৃষ্ণকিশোর কে অনুসরণ করলো। পায়ে পায়ে কবর খানায় ঢুকলো। পেছন পেছন গোবিন্দ। গাছে গাছে সমাধিক্ষেত্র ছায়ায় ঢাকা এক শান্ত, নীরব। যেন ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়। মাটির নীচে চির ঘুমে থাকা মানুষগুলো কোন কোলাহল পছন্দ করেনা। শুধু গাছের পাতার ছাতার আড়াল থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে টিউই স্বরে, টিউই স্বরে।
নীরবতা ভেঙে কৃষ্ণকিশোর বলল, আশপাশের পাঁচ ছয় গ্রাম, মফস্বলের এটাই একমাত্র কবরখানা। বড়দিনে মেলা বসে। লোকজন আসে, প্রার্থনা হয়, প্রভু যীশুর জীবন বাণী নিয়ে প্রদর্শনী হয়। ঐ যে দেখুন ঐ সমাধি ফলকটা মোক্তার সাহেবের।
কৃষ্ণকিশোরের হাতের ইঙ্গিতে মৈনাক দেখলো চার কোণা পিরামিড অাকৃতির সিমেন্টের স্মৃতি ফলক। কয়েক পা এগিয়ে স্মৃতি ফলকে লেখা পড়লো, No more noisy I loud word from me. Such is my master's will.
হাঁটা পথের দু’ধারে ছোট ছোট সমাধিফলক মাটিতে গাঁথা। এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা ছাতিম গাছের নীচে ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। কবরখানার গাছগুলো হাওয়ায় দুলে উঠলো। মুখে কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে ছাতিমগাছের নীচের দিকটাতে দেখালো।
মৈনাক বসে পড়ল ঘাসে ঢাকা শুকনো পাতার ওপর। তারপর হাত দিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করলো। গোবিন্দ এগিয়ে গেল আরও কয়েক পা। সেখানে নাম-না-জানা বুনো সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। সেই সাদা ফুল তুলে এনে মৈনাকের পরিষ্কার করা জায়গাটাতে ছড়িয়ে দিল। এই সময় মৈনাকের কী যেন হল, দীপ্তেনের টানে এখানে এসে পৌঁছালো। সেই মানুষটাই চিরকালের মতন চুপ করে গেছে। তাকে যে এখানে পাবে না, সে যে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে এই ভাবনাটা মাথায় ছিল না তার। ঘুনাক্ষরে এই চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এখন নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। সম্বলহীন মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত রকমের নিঃসঙ্গ, শূন্য, ফাঁকা লাগছিল তার। দীপ্তেনের না-থাকার বেদনা মৈনাকের ভেতরে জমাট হয়ে ছিল বরফের মত। এখন সেই জমাট হওয়া বরফ গলে জল হয়ে দু’চোখের কোল উপচে ঝরে পড়ল টপ টপ করে গোবিন্দ’র ছড়িয়ে রাখা ফুলের ওপর।
অনেকক্ষণ কেটে যাবারপর ফাদার কৃষ্ণকিশোর বিশ্বাস মৈনাকের মাথার ওপর হাত রাখলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল, সাচ ইস লাইফ। তুমি কোথাও কিছু হারাবে আবার কোথাও কিছু পাবে।
সে লোকটা সবুজ স্বপ্নের থেকে জেগে উঠেছিল। তার সদ্য খোলা চোখে সবুজাভ ঘরের দেওয়ালের সবুজ রঙ প্রতিফলিত হচ্ছিল। সে হাত ছড়িয়ে আড়োমোড়া ভেঙে, বিকট শব্দে হাই তুলল এমন, যেন ভিঁত কেঁপে উঠল, যেন কারো মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে, যদিও আর কেউ সেখানে ছিল না। সে পেচ্ছাপ করতে করতে খেয়াল করছিল তার সিগারেটের গন্ধ ছড়ানো মুখটায় বেকারত্বের কালচে ছোপ পড়েছে, গাল আর তিন দিনের বাসি দাড়ির থুতনি টানছিল সবুজ লোকটা, দিনের বেলার খর তাপে ছাদের ট্যাঙ্কের ধাতব পাইপে সেদ্ধ হয়ে সিধে নেমেছে এমন টগবগে গরম জলে মুখে ঝাপটা দিল। তারপর ফ্রিজটা খুলে দু-গ্লাস সবজে দুধ খেল (তার পক্ষে ঠিক স্বাভাবিক নয়)। দুধটুকু এক ঢোকে গলাধঃকরণ করে ভাবছিল, পরদিন এমন করেই এক ঢোকে সবুজ দুধ গেলার খরচ কি করে জোটাবে।
যদিও স্থায়ী ছিল না এই ভাবনা। কয়েক ঘন্টায় কী আর ঘটবে, বরং সে উদ্বিগ্ন ছিল বেশি এই ভেবে যে, সূর্য অস্তাচলের দিকে আর ভূমি ঝলসে যাবে অন্য আগুনে। সে আগত সময়ের মোকাবিলার কথা ভাবছিল।
****
সে লোকটা নীল স্বপ্নের থেকে জেগে উঠেছিল। তার সদ্য খোলা চোখে নীলচে ঘরের দেওয়ালের নীল রঙ প্রতিফলিত হচ্ছিল। সে হাত ছড়িয়ে আড়োমোড়া ভেঙে, বিকট শব্দে হাই তুলল এমন ভাবে যেন ভিত কেঁপে উঠল, যেন কারো মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে, যদিও আর কেউ সেখানে ছিল না। সে পেচ্ছাপ করতে করতে আয়নায় নিজের মুখের দিকে চেয়ে রক্তের নালী আর বিস্ফারিত কৈশিক নাড়ির আরক্ত চোখ দেখে বিষম ঘা খেল, চোখের কোলে কালচে থলথলে ব্যাগস। দিনের বেলার খর তাপে ছাদের ট্যাঙ্কের ধাতব পাইপে সেদ্ধ হয়ে সিধে নেমেছে এমন টগবগে গরম জলে মুখে ঝাপটা দিল, তারপর ফ্রিজটা খুলে দু-গ্লাস নীলচে দুধ খেল (তার পক্ষে ঠিক স্বাভাবিক নয়)। দুধটুকু এক ঢোকে গলাধঃকরণ করে ভাবছিল, পরদিন এমন করেই এক ঢোকে নীল দুধ গেলার খরচ কি করে জোটাবে।
যদিও বেশিক্ষণ ছিলনা এই ভাবনা। সেও আগত সময়ের মোকাবিলার কথা ভাবছিল।
সবুজ লোকটা ধুলোর মধ্য দিয়ে অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাদের ফুলো ফুলো মুখ আর বেকার যুবক দলের রিফুইজি ক্যাম্পের গলিটা দিয়ে হাঁটছিল। তার গ্রামটা ছিল নদীর ওই পাড়ে, যেন স্বপ্নের এক দৃশ্য, একবারই গেছিল সেখানে, কিন্তু বাপ-ঠাকুর্দারা যেহেতু ক্লান্তিহীনভাবে আর বিশদে বর্ণনা করতো গ্রামখানার, একটা ক্যাম্পের মতো, সে জেনে ফেলেছিল, সেখানের সব কটা বাড়ি আর পাথরের খুঁটিনাটি পরিচয়। ‘ঐটা আমাদের স্বদেশ, আর কখনো ভুলো না তা,’ নির্বাসন, সংহার আর বেইমানি, মানে আরবদের বেইনামির ঘটনা ইনিয়ে বিনিয়ে তারা বলতো তাকে। একদিন সন্ধেবেলা বাবা বলেছিল, ‘আরবরা আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে, আমাদের যে কি হল, সেসব খোঁজ করার প্রয়োজনই বোধ করেনি, আর এখন পীড়ন করছে, যদি না খুব নিকৃষ্ট হয়, ঐ ইহুদের মতো।’ ওর বন্ধু আর পড়শিদের ছেলেরাও একই জিনিস শুনেছিল।
‘ইয়া ওয়াধানা’ (ওহ কী নিঃসঙ্গ আমরা)। বিপ্লবকে, উম্মাকে (ধর্মের জিগিরে সমগ্র ইসলামী সমাজকে একাট্টা করা), সব কারণ আর শ্রেণি সংগ্রামকে বিদ্রুপ করে আর তিরিশের দশকের লেবাননের জাতীয়তাবাদী নেতা আল-কাত্তুকজি, প্যালেস্তাইনের হামাজদের মিলিটারি দল আল-কাসসাম, জর্ডনের আরব আর্মির প্রথম শহীদ খায়েদ আল-অবেদাত, মুহম্মদ হামাদ আল-হুনাইতি আর সুলাতান আজলউনি, আর হাজারো শহীদ, সংগ্রামী আর মিলিট্যান্টকে, যারা লড়াইয়ের আগুনে ঝলসে অবিনশ্বর হয়েছে, উপহাস করে বিপ্লবী মুলাকাতের কবি, মাহুদ দরবেশ, গেয়েছিলেন এই গান।
কবির হৃদয়বিদারী কান্না ‘ইয়া ওয়াধানা’-র প্রতি সহমত পোষণকারী সবুজ লোকটা, দক্ষিণ বাম কোনো কিছুর তফাৎ না করে, অগুন্তি মুখের সাগরে থুথু ফেলল। ক্লাবহাউসের কাছে পৌছে লোকটা মোকাবিলা করতে বেরোনো প্লাবিত সবুজ মানুষের স্রোতে হারিয়ে গেল।
নীল লোকটা কাছেপিঠের গলি দিয়ে হাঁটছিল, মনে পড়ছিল, দক্ষিণ কি উত্তরের তার শান্ত গ্রামের কথা। বছরে একবার কী দু’বারের বেশি সে যায়নি কোনোদিন সেখানে, আর সেখানে যাওয়াটাও বেশ কঠিন ছিল, কেননা আকাট মনিবটা তাকে কাজের ঘোড়ার মতো তাড়িয়ে বেড়াতো এমনভাবে যে রাতে যখন সে ঘরে পৌঁছাত ততক্ষণে সে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। সে হাড়জিরজিরে বাচ্চাগুলোকে আর তাদের পিছনের কানাগলি দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোনো বেকার যুবকের ঝাঁকটার দিকে তাকালো। ‘ওরা আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে, দেশের সব সম্পদ লুটেছে’, ঘনিষ্ঠ মোলাকাতে লোকগুলো তাকে বলেছিল, ‘ওদের খিদমত করতে আমরা সরকারি দপ্তরে আর সিকুরিটি ডিপার্টমেন্টে খাটুনি খেটে মরছি, মুখ্যত এই কারণে, যাতে ওরা আরো বিলাস বহুল গাড়ি চড়ে, বাড়ি পায়, আরামে সাঁতার কাটতে পারে পুলে, আরো ভালো বিদ্যে আর কাজের সুযোগ পায়, আচ্ছা আমরা কী এদেশের রেড ইন্ডিয়ান?’ প্রশ্নটা নীল লোকটার মুখে থাপ্পড়ের মতো পড়েছিল।
এটা কোন দেশ ? লোকটা ভুলে গেছিল যে তার পূর্বপুরুষেরা নিজেরা ও তাদের সন্তানদের ধনেপ্রাণে বাঁচাতে, উপনিবেশবাদ বর্ডারের সীমারেখা টানার আগে সেখান থেকে পালিয়েছিল। সে ভুলে গেছিল যে তার নিজের ঠাকুর্দা ও তার সঙ্গী সাথীরা ফেরত যাবার হুকুম অস্বীকার করার জন্যে ট্রেঞ্চেই মারা পড়েছিল। আর ষাট বছর পর এখানকার একটা বাগানবাড়ির তলা থেকে খুঁজে পাওয়ার আগ অব্দি তাঁর দেহাবশেষও পাওয়া যায়নি, এখন তাঁদের রক্তের শপথ স্মরণ করে ঠাকুর্দার সমাধিতে গোলাপের আতর ছড়ানো হয় প্রতিদিন।
‘রেড ইন্ডিয়ান’, নীল লোকটা এটার সাক্ষী দিতে পারে, সে ইতিহাসের মুখে থুতু ছেটায় আর এর রক্ত ভেজা অভিশাপ, এই নোংরা ধূলিধূসর গলি আর এর বাসিন্দাদের ধূলিমলিন মুখের মানুষের মধ্যে তারই সমগোত্রের শিশুদের ওপর স্তূপীকৃত অভিশাপ।
ক্লাবহাউসের কাছে পৌছে লোকটা মোকাবিলা করতে বেরোনো প্লাবিত নীল মানুষের স্রোতে হারিয়ে গেল ।
(লাইভ ব্রডকাস্ট)
বাঁশি বাজতেই দুপক্ষের ঢেউ সামনের দিকে এগুতে থাকলো। বাতাস মন্ত্রে আর প্রার্থনা সংগীতে ভরপুর, আর পিছনে, যেন স্বপ্নের মধ্যে তারস্বরে বাজছে, মুহম্মদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামা প্রাচীন মক্কার যোদ্ধা নারী হিন্দ-বিন-উদবাহ’এর গাওয়া সেই মেয়েলি লোকগাথা, ‘যদি তোমরা আগুয়ান হও, তবে আমরা আলিঙ্গন করবো, তাকিয়া পেতে দেবো। যদি পালাও তবে ছেড়ে যাবো, আর আমাদের বিচ্ছেদ হবে বরাবরের, শীতল-হৃদয়ে।’
প্রথমদিকে ছিল শুধু জিভে জিভে দাঙ্গা, কিন্তু অচিরেই মুষ্টিগুলো আকাশের দিকে উঠল, প্রতিটা গোষ্ঠীর নিজস্ব নিশান আছে, তাই কাফিয়াগুলোও উড়তে লাগলো। দুটো স্রোতই, সামনের দিকে ঝুঁকে গর্জন করতে করতে এগোতে লাগলো আর যখন দ্বিতীয়বার হুইসেল বেজে উঠল দুপক্ষই টক্কর নিতে শুরু করল একে অপরের আর অস্ত্রশস্ত্র, তরবারি, ধাতব পাইপ, চেন সব ঝলসে উঠল, অচিরেই রক্তের নালা বইতে শুরু করল। দুপক্ষেরই, বুড়ো, ছোকরা এমনকি বাচ্চারাও সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল। রক্তে মিশে গেল রক্ত, আর একটার পর একটা লাশ পড়ল মাটিতে।
একমাত্র তখন, (না, তার আগে নয়) সৈন্যবাহিনী মুখোশ পরে হাতে ঢাল নিয়ে, ডান্ডা নিয়ে, টিয়ার গ্যাস ফাটিয়ে আর গ্রেনেড নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে এল। ডাণ্ডা আর টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে ওরা একটা দাগ টেনে দুটো স্রোতকে বিভাজিত করল আর ধীরে ধীরে সবুজ আর নীল লোকেরা পালাতে শুরু করল - একদল পুবদিকে আর অন্যেরা পশ্চিমে যতক্ষণ না সবকটা চোখের আড়ালে না চলে গেল।
যখন সবুজ আর নীল বাহিনীর লোকেরা নিজের নিজের দলের লাশ ফেরাতে এল, দেখল চারিদিকে শুধু লাশের স্তূপ। তারকা খচিত ইউনিফর্ম পরা বিশাল বপুর লোকটা বুটের ডগা দিয়ে লাশগুলো উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছিল। তারা সব রঙহীন, ওদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই - ধুলোটে ক্লান্ত ম্লান মুখগুলোর, খিদে, লাঞ্ছনা আগ্রাসন আর অবিচারে ভূপতিত মুখগুলোর ।
দুই ভিন্ন স্রোত একে অপেরর লাশ শনাক্ত করার সময় ক্ষমতার রোমাঞ্চে জ্বলজ্বল করা চোখের বিশাল বপুর লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল।
(সালভাদোর দালির নতুন ছবি)
পাহাড়ের ওপর চৌকোণা কেল্লাটা হল রইসদের জায়গা, ৫২ ইঞ্চি প্লাসমা টিভির পর্দা রিমোট টিপে বন্ধ করতে, গ্লাসগুলো ঠুং ঠাং করছে, কেননা আটটা লোক ‘সহনশীলতা’য় চুমুক দিল।
তীক্ষ্ণ স্বরের ইংরেজি বলা লোকটার এখন এটাই ছিল আসল খেলা, আমরা যেমনটা ওদের শিখিয়েছি খেলতে। আগুন লাগাবার এই আমার ধান্দা যাতে ওরা একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে নিজেদের বলি চড়ায়। দূর থেকে দোলা দেওয়া, এটাই আমার জগতের পন্থা ।
সাতটা মোমের বাতিদান যার হাতে সেই ইহুদি লোকটা বলল, আর এখানে, তোমার প্রজ্জ্বলন থেকে আমার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ শুকনো জঙ্গলে অলক্ষ্যে একদিন ভয়ঙ্কর দাবানল ঘটাবে। এটাই আমার জমিন আর এই বাধ্যকতা উঠে আসছে প্রাচীন পুঁথির গহ্বর থেকে ।
সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহামান্য ব্যক্তিটি বলল, তোমাদের জ্বালানোর জন্য এইতো আমার জ্বলন্ত কাঠ মজুত। আমি কেটে টুকরো করে আর বেছে আলাদা আলাদা করে ঢিবি বানাবো কারো কারো নিমিত্তে ততক্ষণ ধরে যতক্ষণ না তারা আমার দোরে এসে হত্যে দেয়। এমনটাই আমার রাজপাট, কাঠের গুদামের মতো।
যে লোকটা দেশ গেছে, সে বলল এখানে তাদের স্মৃতি, রক্ত আর ভূমি। আমি বাঁজা সমভূমির মতো এটাকে সমান করে লেপে দেব যাতে কাঠের টুকরো কিংবা অঙ্গার ছাড়া কিছু না থাকে সেখানে আর ছেঁড়া জামার নিশান উড়বে তার ওপর, বিজয় আর স্বাধীনতার পতাকা। কবরের মতো, এমনটাই আমার রাজত্ব। মেডেল আর বেল্ট শোভিত লোকটা বলল, এই আমার সব অস্ত্র আর এই আমার গাম্বুট পরা পা, কর্তৃত্বের দণ্ড, আর ধাতব রুল আর সুইচ টিপলেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরী এই আমার মস্তিস্ক।
নীল দলের পাণ্ডা বলল, আমি আপনার অনুগত ভৃত্য জাহাপনা, দিবা রাত্রি আপনাদের গুণকীর্তন করি, আমি জ্বলন্ত কাঠের টুকরোগুলো জড়ো করব আমার ব্যাগে আর প্রত্যেক দিন সকালে আপনার দরজায় গিয়ে অর্পণ করব।
সবুজ দলের পাণ্ডা বলল, আমি আপনার অনুগত ভৃত্য জাহাপনা, দিবা রাত্রি আপনাদের গুণকীর্তন করি, আমি জ্বলন্ত কাঠের টুকরোগুলো জড়ো করব আমার ব্যাগে আর প্রত্যেক দিন সকালে আপনার দরজায় গিয়ে অর্পণ করব।
উপসাগরীয় অঞ্চলের একছত্র চালানো সেলফোন কোম্পানির মালিক বলল, এ হল আমার বিস্তর খোলা পকেট, যার ধারটায় আগুনে ঝলসানো কাঠের টুকরোর ওড়া ছাই লেগে আছে। আমার খেলাটা এমনই।
কণ্ঠস্বর চড়ছে, হৈচৈ ফুলেফেঁপে উঠছে, গ্লাসগুলো ঠুং ঠাং করছে ।
সবুজ লোকটা যখন সব দৌড় আর দাঙ্গা থেকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ফিরে তার সবুজ ঘরের দরজা খুললো, সে বিস্মিত হয়ে দেখলো নীল লোকটাও ঊর্দ্ধশ্বাসে রাস্তার আড়াআড়ি গিয়ে তার নীল ঘরের দরজা খুললো। নীচের রাস্তার পাশের নর্দমার দুর্গন্ধটা অসহনীয়, আর অস্থিসার বাচ্চা ও বেকার যুবকেদের খিস্তি জানলায় অলক্ষিতভাবে এল,
“মাদারচোদ”
“কুত্তির বাচ্চা”
নীল লোকটা সবুজ লোকটায় মাথায় একটা লোহার রড দিয়ে মারলো, আর সেই মুহূর্তেই সবুজ লোকটা একটা ছোরা বের করে নীল লোকটার গলায় আমূল বসিয়ে দিল। দুটো লোকের দেহ জড়ামড়ি করে যেন একটাই লাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
যখন ঘর থেকে পচা গন্ধ ছড়াতে লাগলো, পড়শিরা দরজা ভাঙল। ঘরের সর্বত্র হানাহানির চিহ্ন, টেবিল ওলটানো, ডিসগুলো ভাঙা, দেওয়াল বেয়ে গড়িয়ে নামা অস্পষ্ট সবুজ-নীল জমাট রক্তের রেখা। মেঝেতে পড়ে একটা রড ধরা হাতের লাশ, পাশে পড়ে থাকা অন্য লাশটার হাতে ধরা ছোরা। এর আবছায়া চূর্ণিত, ওর মুণ্ডুটা দু-ফাঁক আর নাকের পাশ থেকে ডান চোখের ধার অবধি চেরা আঠালো ক্ষত।
হিসাম বুস্তানি (১৯৭৫- ) জর্ডনের লেখক, কবি, অ্যাক্টিভিস্ট, এ-পর্যন্ত পাঁচটি গল্পের ও কবিতার সংকলন বেরিয়েছে। আরব দুনিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী তাঁর লেখায় উঠে আসে বারে বারে। বুস্তানির আখ্যানগুলো, নানা লৌকিক উপকথা আর লোকগান ও কবিতার ব্যবহারে ঋদ্ধ, আর সেসব দশকের পর দশক ধরে চলা নির্মম হিংসার পরিবেশ আর উপনিবেশ-উত্তর আরব দুনিয়াকে চেনায় অন্য এক রহস্যময় আলোআঁধারি মিশিয়ে।